চুয়াল্লিশ
গুপ্তচর হিসেবে দেশ-বিদেশে গোপনে ঘুরে বেড়িয়েছে একাকী রানা। আগে ছিল কমাণ্ডো মেজর। জীবনে যেসব ট্রেইনিং নিয়েছে, তার ভেতর রয়েছে কিডন্যাপড্ মানুষকে উদ্ধার করা। পৃথিবীতে মস্তবড় ব্যবসা এখন কে অ্যাণ্ড আর। শুনলে মনে হতে পারে ওটা কোনও শিপিং লাইনের কোম্পানি বুঝি। তা নয়। কিডন্যাপ অ্যাণ্ড র্যানসম আজকালকার ক্রিমিনালদের সবচেয়ে লোভনীয় ব্যবসা। তাতে সহজেই মেলে অঢেল টাকা। বিবেকটাকে বিসর্জন দিলেই হলো। এ খেলায় যোগ দেয়ার মত উৎসাহী অপরাধীর অভাব নেই। টাকার গন্ধ পেয়ে নিরপরাধ মানুষকে নানাভাবে ফাঁদে ফেলছে তারা। তবে তাদের বিরুদ্ধে লড়তে কখনও দ্বিধা করেনি রানা। বহুবার হানা দিয়েছে কিডন্যাপারদের আস্তানায়। অপরাধীদের হাত থেকে ছুটিয়ে এনেছে অসহায় মানুষকে। তাদের বেশিরভাগই ছিল শিশু বা কিশোর বয়সী। মুক্তিপণ পেয়েও বেশিরভাগ সময় তাদেরকে মেরে ফেলতে চেয়েছে অপরাধীরা। সুতরাং, এসব অপরাধীদের প্রতি রানার হৃদয়ে বিন্দুমাত্র দয়া নেই। ওর হাতে মরেছে অন্তত দশজন কিডন্যাপার।
রানা ভাবছে, প্রথম সুযোগে এলিসা ও বাচ্চাদেরকে সরিয়ে নিয়ে কিডন্যাপারদের মুখোমুখি হবে। জোসেফ যখন বাড়ির দিকে ফিরছে, তার আগেই গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হয়েছে রানা। ভাল করেই বুঝিয়ে বলেছে জোসেফকে, যেন বাধা না দিয়ে পুলিশের হাতে নিজেকে তুলে দেয় সে। আর কাউকে বলবে না, কোথায় আছে এলিসা আর বাচ্চারা। বদলে জানাবে, রিচিরা হুমকি দিয়েছে, যেন মাসুদ রানাকে তুলে দেয়া হয় তাদের হাতে। গুডরিচদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে পাহাড়ি ওই খামারে বসে নোভাকদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্ল্যান করছিল রানা। আর আজই বিকেলের আগে আবারও খামারে ফিরবে সে।
রানা জানে, জোসেফের কথা শোনার পর ওই খামারে চোখ রাখবে পুলিশের লোক। তাদের কেউ কেউ স্নাইপার। ওর জন্যে লুকিয়ে থাকবে জঙ্গলে। রোটর আর ইঞ্জিনের আওয়াজে রানা পালিয়ে যেতে পারে ভেবে হেলিকপ্টার ব্যবহার করবে না পুলিশ। একই কারণে সঙ্গে রাখবে না কে নাইন ইউনিট। এত বড় সুযোগ হাতছাড়া করবে না শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। নিশ্চয়ই চাইবে খামারে উপস্থিত থেকে নেতৃত্ব দিতে। তার জীবনের সেরা দুর্ধর্ষ অপরাধী মাসুদ রানাকে গ্রেফতার করতে পারলে বাকি জীবন নিজের পিঠ চাপড়াবে সে। হয়তো খুশিতে আগামীকালই অবসর নেবে… কম তো করেনি জীবনে!
এসব ভেবেছে রানা। তবে বিপক্ষ জানে না, কী করতে চলেছে ও।
দুপুরে গুডরিচদের খামার অর্থাৎ গন্তব্যের কাছে পৌঁছে আরও সতর্ক হলো রানা। চোখ রাখল চারপাশে। একটু পর বুঝল, এদিকে নেই পুলিশের লোক। সম্ভবত খামারে ফাঁদ পেতে অপেক্ষা করছে তারা।
খামারের মাইলখানেক আগে জঙ্গলে টরাস গাড়িটা রেখে নেমে পড়ল রানা। চাকার দাগ মোছার চেষ্টা করল না। এবার যেটা করবে, সেজন্যে গোপনীয়তার প্রয়োজন নেই। ব্যাগ আর ধনুক হাতে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকল রানা। জঙ্গলে পাখির কলকাকলি ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই।
রানার হিসাব ঠিক হলে পৌনে এক মাইল দূরে জঙ্গলের মাঝে গুডরিচদের খামার। পশ্চিমে। অর্থাৎ টার্গেট মাত্র তেরো শত গজ দূরে। খামারবাড়ির বাইরে এক শ’ গজ এলাকায় বৃত্তাকারভাবে ফাঁদ পেতে ঘন জঙ্গলে লুকিয়ে থাকবে পুলিশের স্নাইপার। ধরে নেয়া যায়, বারো শ’ গজ যাওয়ার পর তাদের বৃত্তাকার কর্ডনের কাছে পৌঁছবে রানা।
পশ্চিমে চলল রানা। জঙ্গলে নানান স্বাভাবিক আওয়াজ। কোথাও কোথাও ঘন সবুজ গাছের ছাউনি ভেদ করে মাটিতে পড়ে দুলছে সোনালি রোদ। বাতাসের আর্দ্রতা আরও বাড়লে মনে হবে, হাঁটছে ও পানির ভেতর। ভিজে গেছে মাথার চুল ও ভুরু। নীরবে গাছপালার মাঝ দিয়ে এগিয়ে চলল। খেয়াল করছে চারপাশের প্রতিটা ছায়া ও নড়াচড়া। সাবধানে এড়িয়ে গেল ছোট একটা জলা এবং উপড়ে পড়া কয়েকটা গাছের কাও।
নিখুঁত হিসেব কষে জঙ্গলে বারো শ’ গজ যাওয়ার পর থামল রানা। সাবধানে বড় করে শ্বাস নিল। বাতাসে কটু গন্ধ। অথচ, লুইযিয়ানা স্টেট পুলিশের সোয়াট স্কুলের শিক্ষার্থীদেরকে ধোঁয়ার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়। ক্লাসে মনোযোগী ছিল না এই লোক।
সামনে ডানদিক থেকে আসছে পোড়া গন্ধ।
নিঃশব্দে আরও ক’পা এগিয়ে দূরে গুডরিচদের বাড়িটা দেখল রানা। ওটা বড়জোর এক শ গজ দূরে। তবে আপাতত ওদিকে না গিয়ে অন্যকিছু খুঁজতে লাগল রানা। কয়েক মিনিটে পেয়ে গেল ওর প্রথম টার্গেট।
ধুলোবালি মেখে সবুজ ক্যামোফ্লেজ ড্রেস পরে জঙ্গলে বসে আছে লোকটা। সামনেই বাইপডে কালো রাইফেল। আরাম করে সিগারেট ফুঁকছে শাইপার।
তুমিই প্রথম টার্গেট, স্নাইপার সাহেব! মৃদু হেসে মনে মনে বলল রানা।