আটত্রিশ
বাইয়ু থেকে দশ গজ দূরে আইভি ও লতাগুল্ম দিয়ে ঘেরা জীর্ণ কুটির। জানালার ফাটল দিয়ে আসছে লণ্ঠনের হলদে আলো। রানা টের পেল, কাছেই কোথাও পচে গেছে মাংস। কুটিরের সামনে যেতেই দেখল, টি-ফ্রেমের কাঠের স্ট্রাকচারে ঝুলছে অর্ধেক ছেলা কুৎসিতদর্শন মস্ত দুই মাছ— চোয়াল অ্যালিগেটরের চোয়ালের মত। জঙ্গলে এ ধরনের স্ট্রাকচারে হরিণের চর্বি, নাড়িভুঁড়ি ও চামড়া শুকিয়ে নেয় শিকারিরা। টি- ফ্রেমের পাশে বালতির ভেতর কমপ্রেসর লাইন, আর কয়েকটা ছোরা ও হ্যাচেট। দুর্গন্ধ এতই বেশি যে দ্বিতীয় বালতির ভেতর উঁকি দিতে গেল না রানা।
জঙ্গলে এঁকেবেঁকে গেছে কাঁচা রাস্তা। একটু দূরেই বাইয়ুর তীরে কাঠের নড়বড়ে জেটি। ওটার ওপর রানা উঠতেই মচমচ করে উঠল কাঠের তক্তা। এখানে ওখানে লবস্টার ধরার ফাঁদ, ব্যারেল আর কয়েল করা দড়ি। আনমনে ভাবল রানা, এবার যে-কোনও সময়ে ঘেউ-ঘেউ করে উঠবে কুকুর। কর্কশ গলায় চিৎকার ছাড়বে কেউ: ‘কোন্ শালা রে!’ পরক্ষণে জঙ্গলে বন্দুক দাগবে লোকটা।
চাঁদের আলোয় জেটিতে বাঁধা দুটো নৌকা দেখল রানা। হালকা জোয়ারে তিরতির করে কাঁপছে ওগুলো। হাঁটু গেড়ে বসে ওদিকে মনোযোগ দিল ও। দুটোর একটা ফাইবার গ্লাসের মোটর বোট। অন্যটা কাঠের ক্যানু। আউটবোর্ড মোটর চালু করলে ছুটে এসে রানার পেছনে বন্দুকের নল খালি করবে গেটর শিকারি। অথচ, আওয়াজ না করেই ক্যানু নিয়ে উধাও হলে কে ঠেকাচ্ছে ওকে!
ভেজা মানিব্যাগ থেকে নেতিয়ে পড়া দুটো এক শত ডলারের নোট নিয়ে জেটির একটা ফাটলে গুঁজল রানা। আশা করল, ক্যানু নিয়ে গেলেও নগদ প্রাপ্তির কারণে খুশিই হবে শিকারি।
নিজের ব্যাগ ও টুকটাক জিনিস ক্যানুর ওপর রেখে নিজেও ক্যানুতে চেপে বসল রানা। নীরবে বৈঠা মেরে চলল – ভাটির দিকে।
ধীরে ধীরে গভীর হয়ে উঠছে রাত।
বাইয়ুর জলপথের ওপর গাছের পাতার ছাউনি। মাঝে মাঝে তার ফাঁক দিয়ে এসে মিষ্টি হাসি দিয়ে যাচ্ছে রুপালি জ্যোৎস্না। মাঝ আকাশে ঝলমল করছে চাঁদ। রাতের পাখি, ঝিঁঝি পোকা, কোলাব্যাঙের ক্রো-ক্রা বাদ দিলে রয়েছে শুধু বৈঠা বাওয়ার ছন্দোবদ্ধ ছপাৎ-ছপাৎ আওয়াজ।
বিশাল এই জঙ্গুলে জলাভূমিতে হারিয়ে গেলে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবে না সাধারণ মানুষ। তবে বিপদ দেখলে সপ্তাহের পর সপ্তাহ এখানে লুকিয়ে থাকতে পারবে রানা।
মাঝে মাঝে সরু হয়ে আবারও চওড়া হচ্ছে বাইয়ু। একটু পরেই হয়ে উঠছে নালার মত। গেটর শিকারির কেবিনের বাজে বদবুর চেয়ে কম যাচ্ছে না পচা পানির দুর্গন্ধ। পাতা পড়ে কোথাও কোথাও থকথক করছে বাইয়ু। এগিয়ে চলা কঠিন। কখনও গাছ ঘন হয়ে জন্মালে বৈঠার গুঁতো মেরে ডাল ভেঙে এগোতে হচ্ছে রানাকে। বেশিরভাগ সময় দু’দিকের সাইপ্রেস গাছের মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে গেছে বাইয়ু। গাছগুলো জলাভূমির অতন্দ্র প্রহরী- ভুতুড়ে, কালো ও নীরব। কোনও কোনও গাছ বুড়ো মানুষের মত। মুখে লম্বা দাড়ি তৈরি করেছে স্প্যানিশ মস। এগোবার পথে খসখস করে লাগছে রানার মুখ ও কাঁধে। একটু পর পর বাইয়ুতে নেমে আসা গাছের শেকড়ে ঘ্যাস শব্দে আটকে যাচ্ছে ক্যানুর তলী।
অস্বাভাবিক আলোড়ন চারপাশের পানিতে। একবার টর্চ জ্বেলে রানা দেখল, কালো, চকচকে কী যেন আস্তে করে তলিয়ে গেল। প্রথমে রানা ভেবেছিল, ওগুলো বুঝি সাপ বা কাছিম, কিন্তু আবারও আলো জ্বেলে দেখল, পানির ওপর জেগে উঠেছে লাল চোখের মত হাজার হাজার ওই জিনিস। ঠিক যেন অ্যালজি আর পদ্ম ফুলের ভেতর চাইনি লণ্ঠন চোখে টর্চের আলো পড়লেই টুপ করে ডুবে যাচ্ছে প্রাণীগুলো। ক’মুহূর্ত পর বুঝল রানা, ওই চোখের মালিক অ্যালিগেটররা! সারাদিন আলো এড়িয়ে লুকিয়ে থাকার পর রাতের আঁধারে শিকার ধরতে বেরিয়েছে জন্তুগুলো! ডিসটার্ব হচ্ছে ওদের।
আমারও শিকার চাই, ভাবল রানা।
অ্যালিগেটরের চেয়ে কম নয় ওর খিদে।
আজ অ্যালিগেটরের চেয়েও দক্ষ শিকারি এসেছে এদিকের অন্ধকার বাইয়ুতে।
আরও মাইলখানেক যাওয়ার পর ডানদিকের তীরে ক্যানু ভিড়াল রানা। শুকনো ডাঙা দেখে উঠে গেল জঙ্গলের ভেতর। খুঁজছে ক্যাম্পের উপযুক্ত জায়গা। বড় এক গাছের গোড়ায় রাখল নিজের জিনিসপত্র। ধনুক হাতে রওনা হলো শিকারের খোঁজে। সতর্ক, যেন পথ হারিয়ে না যায়।
প্রায় একঘণ্টা পর পাতায় পাতায় চাঁদের আলো ঝিলিক দিচ্ছে, এমন এক গাছের নিচে মাঝারি আকারের একটা হরিণ দেখল রানা। খুব সতর্ক পায়ে ওটার কাছে পৌঁছুল ও। খেয়াল রেখেছে, বাতাসে যেন ওর গায়ের গন্ধ না পায় হরিণটা।
সন্দেহজনক কিছু না দেখে আনমনে ঘাস চিবুচ্ছে জন্তুটা।
নীরবে তূণ থেকে তীর নিয়ে ছিলায় জুড়ল রানা। কানের কাছে টেনে নিল ছিলা। আস্তে করে ছেড়ে দিল তীর। স্যাৎ করে আওয়াজ তুলে হৃৎপিণ্ডে তীর ঢুকতেই লাফিয়ে উঠে ধুপ করে মাটিতে পড়ল হরিণটা। মাত্র দু’বার পা ছুঁড়ে স্থির হয়ে গেল।
খাবার পেয়েছে রানা। মাঝরাতে গাছের নিচে আগুনের পাশে বসে ঝলসানো হরিণের মাংস খেল। আগুনের তাপে শুকিয়ে নিচ্ছে ভেজা ওয়ালেট, টাকা, ফোন আর গায়ের পোশাক। চুপচাপ মাংস চিবুতে চিবুতে ভাবছে, এবার কী করবে। আপাতত নিজেকে নিরাপদ লাগলেও কতক্ষণ এই স্বস্তি বজায় থাকবে, তার নিশ্চয়তা নেই। ওদিকে লুকিয়ে পড়েছে দুই নোভাক। চট্ করে আর তাদেরকে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। ফিরে গিয়ে বা ফোন করে আরও লোক নিয়ে আসবে? নাহ্! এখন লুইযিয়ানায় ঢোকা বা এখান থেকে বের হওয়া প্রায় অসম্ভব। যা করার ওকে একাই করতে হবে।
রাত দেড়টা পর্যন্ত ঝিমিয়ে পড়া লাল আগুনের দিকে চেয়ে ভাবল রানা। শুয়ে পড়তে যাবে, এমন সময় বেজে উঠল ওর বার্নার মোবাইল ফোন। আগে ওটার রিং টোন শোনেনি রানা। গভীর জঙ্গলের ভেতর ব্যাঙের বিশ্রী ডাক শুনে চমকে গেল। পরক্ষণে টের পেল, পানিতে পড়েও দিব্যি কাজ করছে সস্তা জিনিসটা
তুলে নিয়ে রিপ্লাই বাটন টিপে মোবাইল ফোন কানে ঠেকাল রানা। ‘কে বলছেন?’
ওদিক থেকে এল ঘড়ঘড়ে, ভারী পুরুষালী কণ্ঠ : ‘আমি বড়মা এবি পামবোর দেহরক্ষী দলের প্রধান চার্লস।’
‘ও। হ্যালো, চার্লস,’ বলল রানা। ‘বলুন, কেন ফোন করেছেন?’
‘বড়মা আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।’
‘কী কারণে?’ জানতে চাইল রানা।
‘উনিই জানেন। আমি জানলে তো বলেই দিতাম!’
‘ঠিক আছে, তাঁকে দিন,’ বলল রানা।
‘না, তা হবে না, আগেই তো বলেছি, মা কখনও ফোন ব্যবহার করেন না। উনি সামনা-সামনি কথা বলবেন।’
পুরো একমিনিট চুপ করে ভাবল রানা। তারপর বলল, ‘ঠিক আছে, বলুন কোথায় পাব তাঁকে।’
‘তা হলে মন দিয়ে শুনুন।’