1 of 2

স্ট্রেঞ্জার – ১০

দশ

সিঁড়িতে ঘুটঘুটে আঁধার। নিচতলায় কোনও আওয়াজ নেই।

দোতলায় নেমে ডাক দিল রানা, ‘লিয?’

কোনও জবাব এল না।

বাড়িটা বেশ বড়। কে জানে, কোন্ দিক থেকে এসেছে আর্তনাদের আওয়াজ।

লিযের বেডরুমের দরজার তলা দিয়ে আসছে সরু আলোর রেখা। কবাট খুলে উঁকি দিল রানা। ডাবল বেডের চাদর কোঁচকানো। পাশের টেবিলে জ্বলছে কম ওয়াটের নীল বার্। তবে ঘরে কেউ নেই।

সরে এসে নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল রানা। একবার দেখল হাতঘড়ির লিউমিনাস কাঁটাগুলো।

রাত এখন চারটে বাইশ।

থমথম করছে চারপাশ।

বাড়ির ভেতর কোনও আওয়াজ নেই।

কিন্তু রানার মন বলছে, খুব খারাপ কিছু ঘটেছে লিষের।

বাতি জ্বলছে নিচতলার হলওয়েতে। সে আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ঘুরে উঠে আসা স্টেয়ারকেস।

হয়তো পিপাসা লেগেছিল লিষের, ভাবল রানা। তাই নিচতলায় নেমেছে। তখন হয়তো পা পিছলে গেছে। বা পতনটা হয়েছে বাথরুমে। আহত হয়েছে বাজেভাবে।

একটু আগে কাঁচ ভাঙার যে শব্দ হলো, তা হয়তো গ্লাস বা বালব ভাঙার আওয়াজ।

আবারও লিযের নাম ধরে ডাকতে গিয়েও থেমে গেল রানা। অন্যভাবে ব্যাখ্যা করা যায় আওয়াজগুলোকে। ভীষণ ব্যথা না পেলে এভাবে কাতরে ওঠে না কেউ!

সিঁড়ির শেষ কয়েক ধাপ দৌড়ে নামল রানা। হলওয়ে ফাঁকা নয়। মেঝেতে পড়ে আছে ভারী দেহের কেউ।

নারীদেহটা লিষের! পরনে লাল টাওয়েল বাথরোব। তার ওপরে পরেছে স্যাটিনের নাইট ড্রেস। পেটের ওপর দড়ির বেল্ট। দু’হাত ছড়িয়ে চিত হয়ে পড়ে আছে বেচারি। মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে বলে চেহারা দেখতে পেল না রানা।

একদম নড়ছে না লিখ। লাল বাথরোব ও নাইট ড্রেসের বুক-পেট ভেসে যাচ্ছে রক্তের স্রোতে। ভিজে গেছে মেঝের কার্পেট। ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে রক্তের কালচে দাগ।

ওদিকে চেয়ে নেই রানা। চোখ লিষের পেটের ওপর। পাঁজরের নিচে পেটে গেঁথে দেয়া হয়েছে চওড়া ফলার ভয়ঙ্করদর্শন এক তলোয়ার। ওটার ডগা গেঁথে গেছে কাঠের মেঝেতে।

প্রায় ছুটে লিযের পাশে পৌঁছুল রানা। নাম ধরে ডাকল। নিজের কণ্ঠস্বর বড় অচেনা লাগছে ওর কাছে। বুঝে গেছে, জখমটা মারাত্মক। চাইলেও বাঁচাতে পারবে না লিযকে।

এবার কী করবে ভাবছে রানা, এমনসময় ওর চোখ পড়ল হলওয়ের ওদিকে দরজার ওপর। কবাট কয়েক ইঞ্চি খোলা। স্ক্রিন ডোর পুরো হাট করা। দরজার বুকে ছোট জানালার মত কাঁচের প্যানেল ছিল। ওটা দিয়ে দেখা যেত কে এসেছে। সেই প্যানেলটা এখন চুরচুর হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। ঘুষি মেরে ওটা চুরমার করে সিকিউরিটি চেইন লক খুলেছে কেউ। এরপর বিনা বাধায় ঢুকেছে আততায়ী।

দরজার কাঁচের প্যানেল ভাঙার আওয়াজ শুনে দোতলার বেডরুম থেকে নেমেছে লিয। বাতি জ্বেলেছে। আর তখনই চেঁচিয়ে উঠেছে হামলাকারীকে দেখে। সেসময়ে লিষের কণ্ঠ শুনেছে রানা। এরপর তলোয়ার হাতে বেচারির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে খুনি। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে মেঝেতে। তলোয়ার গেঁথে দিয়েছে অসহায় মানুষটার পেটে। সেসময়ে প্রচণ্ড ব্যথায় কাতরে ওঠে লিখ।

এসব হয়েছে মাত্র কয়েক মুহূর্তের ভেতর।

তার মানে, বেশি দূরে যেতে পারেনি আততায়ী।

কথাটা ভাবতে না ভাবতেই বাইরে গাড়ির ইঞ্জিন গর্জে ওঠার আওয়াজ পেল রানা।

খুব তাড়া আছে কারও।

লিষকে গুরুতরভাবে আহত করে পালিয়ে যাচ্ছে লোকটা!

দ্বিধায় পড়ল রানা। লিয়ের পাশে থাকবে, না ধরতে যাবে খুনিকে?

পরমুহূর্তে লিযের দেহ পাশ কাটিয়ে আধখোলা দরজায় পৌছুল রানা। কবাট সরিয়ে কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে নেমে ছিটকে বেরোল মেইন গেট দিয়ে। আশপাশের বাড়িতে আলো নেই। এইমাত্র ওর মার্সিডিষের পাশ থেকে রওনা হয়েছে পুরনো আমলের লম্বাটে এক আমেরিকান গাড়ি। কোম্পানির লোগো বা নাম দেখতে পেল না রানা। গর্জনটা ভারী ভিএইট ইঞ্জিনের। গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়েছে ড্রাইভার। এইমাত্র ধুপ্ শব্দে বন্ধ হয়েছে প্যাসেঞ্জার ডোর। ড্রাইভারকে গাড়িতে রেখে লিয বাউয়ারকে খুন করতে এসেছিল খুনি। দৌড়ে গাড়ির দশ ফুটের ভেতর পৌঁছে গেল রানা। কিন্তু তখনই চাকা হড়কে রওনা হলো ড্রাইভার।

আবছাভাবে তার পাশের লোকটাকে দেখল রানা। দু’জনই শ্বেতাঙ্গ। বয়স তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ। বেণী করে লালচে চুল বেঁধেছে ড্রাইভার। ওর সঙ্গীর চুল খাটো করে ছাঁটা। পরনে সাদা টি-শার্টের ওপর কালচে জ্যাকেট।

গাড়িটা চলে যাওয়ার আগেই কিছু করতে হবে। রানার প্যান্টের পকেটে আছে মার্সিডিযের চাবি। তবে গাড়ির ইঞ্জিন চালু করার আগেই বহু দূরে চলে যাবে খুনির গাড়ি। ছোটার গতি আরও বাড়ল রানার। প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে ও। ভাবছে, লোকদু’জন নিশ্চয়ই সশস্ত্র। কাজেই কোনভাবে গাড়িতে উঠতে পারলেও কঠিন হবে তাদেরকে কাবু করা। ওর নিজের কাছে পিস্তল নেই।

শেষ ক’পা ছুটে গাড়ির রিয়ার উইং ধরতে ডানহাত বাড়াল রানা। খপ্ করে ধরেও ফেলল ওটা। দ্রুতগামী গাড়ির হ্যাঁচকা টান খেয়ে ভাবল, ছিঁড়েই গেছে হাত দুটো। পেছনে ছেঁচড়ে এল দুই পা। নাকের কাছে মাস্ট্যাং লোগো।

মাত্র নয় সেকেণ্ডে চল্লিশ মাইল গতি তুলল গাড়িটা। দুই সাইলেন্সার পাইপের উত্তপ্ত ধোঁয়ায় পুড়ছে রানার উরুর ত্বক ও মাংস। মারাত্মক জ্বলুনি আর তীব্র ব্যথা সহ্য করে ভাবল, একবার ছাতে উঠতে পারলে ওখান থেকে জানালা দিয়ে গাড়ির ভেতর ঢুকবে। তবে তখনই ঝট্ করে ঘুরে তাকাল প্যাসেঞ্জার। কী যেন বলল ড্রাইভারকে। পরক্ষণে জানালা দিয়ে বের করল বামহাত। মুঠোয় পিস্তল!

বিকট আওয়াজে দু’বার গর্জে উঠল অস্ত্রটা।

গতি আরও বাড়ছে বলে মৃদু দুলছে গাড়িটা।

রানার মাথার পাশে লোহার উইঙে ঠক্ঠক্ আওয়াজে বিধল দুই বুলেট। বাঁচতে হলে উইং থেকে হাত সরাতে হবে, বুঝে গেল রানা। তবে সেক্ষেত্রে প্রচণ্ড বেগে রাস্তার ওপর হুড়মুড় করে পড়বে ও!

গাড়িটা চলেছে পঞ্চাশ বা ষাট মাইল বেগে।

রুক্ষ রাস্তার ঘষা খেয়ে ছিঁড়ছে রানার বুটের ডগা। যে- কোনও সময়ে কয়েকটা আঙুল হারিয়ে পঙ্গু হবে। তবে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে হলো না ওকে। ডানের রাস্তায় তীরবেগে বাঁক নিল গাড়িটা। উইং থেকে হাত ছুটে যেতেই ছিটকে রাস্তায় পড়ল রানা। গড়াতে গড়াতে গিয়ে থামল বিশ ফুট দূরে ফুটপাথের পাশে। পিঠে আঘাত পেয়ে ভুস্ করে বুক থেকে বেরিয়ে গেছে শ্বাস। কেমন যেন অবশ লাগছে শরীর-মন।

কয়েক মুহূর্ত পর চোখ মেলতেই রানা দেখল, দূরে চলে গেছে অন্ধকারের ভেতর খুদে দুটো লাল আলো।

তিক্ত মনে নিজেকে দেখল রানা। শরীরে শতখানেক ছড়ে যাওয়ার দাগ। দরদর করে রক্ত পড়ছে হাঁটু ও কনুই বেয়ে। ফুটপাথের পাশ থেকে উঠে লিষের বাড়ির দিকে চলল রানা। বুঝে গেছে, জড়িয়ে গেছে বাজে পুলিশী ঝামেলায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *