সাবাইস বুদ্ধি
(অর্থাৎ একটি স্ত্রীলোকের অদ্ভূত জুয়াচুরি রহস্য!)
প্রথম পরিচ্ছেদ
আজকাল এদেশে পাশ্চাত্যশিক্ষার বহুল প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে কোন কোন সম্প্রদায়ের স্ত্রীলোকদিগের স্বাধীনতাও খুব বাড়িয়া, প্রায় ইংরাজ-রমণীগণের ন্যায় হইয়া উঠিয়াছে ও উঠিতেছে। হিন্দু বলুন, মুসলমান বলুন, কোন সম্ভ্রান্তবংশীয় স্ত্রীলোকগণ ইহার পূর্ব্বে ঘরের বাহির হইতেন না, পর-পুরুষের সম্মুখীন হইতেন না, ইহা আমাদিগের জীবনের এক সময় দেখিয়াছি। এমন কি, বারবনিতাগণকেও যে কখন একাকী প্রকাশ্যভাবে কেবলমাত্র পুরুষ-মানুষ সমাবৃত সভাসমিতি, কি অন্য কোন স্থানে বা কোন দোকান প্রভৃতি প্রকাশ্য স্থানে দেখিয়াছি, তাহাও মনে হয় না; সময় সময় তাহারা কোন দ্রব্যাদি খরিদ করিবার নিমিত্ত দোকানাদিতে গমন করিত সত্য, কিন্তু হয় কোন পুরুষ- মানুষ তাহাদিগের সঙ্গে গমন করিত, অথবা তাহার সমব্যবসায়ী অপর ২।৪ জন স্ত্রীলোককে সঙ্গে লইয়া সে তাহার বাড়ীর বাহির হইত। আজকালও তাহাদিগের মধ্যে অনেকটা সেইরূপ পদ্ধতি প্রবর্তিত আছে; কিন্তু সম্প্রদায় বিশেষের মধ্যে ভদ্র স্ত্রীলোকদিগের স্বাধীনতা এতদূর বাড়িয়া উঠিয়াছে যে, কোন স্থানে গমনাগমন করিতে হইলে কাহাকেও আর সঙ্গে লইবার তাহাদিগের প্রয়োজন হয় না; সভা-সমিতিতে একাকীই গমন করিয়া সহস্রাধিক পুরুষের মধ্যে অনায়াসেই গিয়া উপবেশন করেন। গড়ের মাঠে শত শত ইংরাজ বাঙ্গালীর ও অপরাপর দেশীয় পুরুষবর্গের মধ্যে একাকীই বায়ু সেবন করিয়া থাকেন। দেশীয় ও বিদেশীয়গণের বড় বড় দোকানে একাকিনী গমন করিয়া দ্রব্যাদি খরিদ বিক্রয় করিতেও কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হন না।
সকল সম্প্রদায়ের স্ত্রীলোকমাত্রেই পুরুষ অপেক্ষা মাননীয়া, সুতরাং যে স্থানেই তাঁহারা গমন করুন না কেন, পুরুষ অপেক্ষা সকলেই তাহাদিগকে একটু মান্য করিয়া থাকে। তাহাদিগের কার্য্য অগ্রেই সম্পাদিত হয় ও তাহাদিগের কথায় অনেকেই স্বভাবতঃ বিশ্বাস করিয়া থাকেন। কারণ, আপনি দেখিবেন যে, পুরুষগণ যেরূপ মিথ্যা কথা কহিয়া থাকেন, স্ত্রীলোকগণ তাহা অপেক্ষা অনেক অল্প পরিমাণে মিথ্যা কথা বলিয়া থাকেন। সুতরাং পূর্ব্বকথিত নবঅবগুণ্ঠন উদ্ঘাটিতা স্ত্রীলোকগণ যে কার্য্যের নিমিত্ত যে স্থানে গমন করেন, তাহাদিগের সেই কাৰ্য্য সর্ব্বাগ্রেই সংসাধিত হইয়া থাকে।
যে স্থানে ভাল আছে, মন্দও সেইস্থানে আছে। যে স্থানে প্রকৃত দ্রব্য পাওয়া যায়, সেই স্থানেই অপ্রকৃত দ্রব্যের অভাব থাকে না। স্থূলকথায়, যে স্থানে আসল— সেই স্থানেই নকল দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু আসল নকল চিনিয়া লইতে পারে, এরূপ জহুরি কয়জন আছে? মনুষ্য দেখিয়া তাহার হৃদয়ের উপাদান বাছিয়া লইতে সমর্থ হয়, এরূপ লোক সহজে কয়জন দেখিতে পাওয়া যায়।
রাত্রি ১২টার পর আমি বড়বাজারের ভিতর দিয়া আসিতেছি। দেখিলাম, একখানি জহুরির দোকান সেই সময় ভিতর হইতে বন্ধ, কিন্তু দোকানের ভিতর আলো জ্বলিতেছে। ঐ দোকানখানি আমি পূৰ্ব্ব হইতেই জানিতাম, ও ঐ দোকানের অধিকারীর সহিত আমার পরিচয়ও ছিল। ইতিপূর্ব্বে ঐ দোকান হইতে কয়েক সহস্রমুদ্রা মূল্যের জহরত চুরি হইয়াছিল। ঐ চুরি মোকদ্দমার অনুসন্ধান আমি করিয়াছিলাম, চোর ধৃত ও অপহৃত জহরতের পুনরুদ্ধারও হইয়াছিল। সেই সময় হইতে আমি ঐ জহুরির সহিত পরিচিত। রাত্রি ৯টার পর ঐ দোকান খোলা থাকে না, দোকানের একটি ব্যতীত সমস্ত দরজা ভিতর হইতে বন্ধ করিয়া দেওয়া হয়। অবশিষ্ট দরজাটিতে কেবল কয়েকটি তালা বাহির হইতে বদ্ধ থাকে। দোকানের ভিতর লোকজন কেহই থাকে না, পুলিসের অনুকম্পার উপর ঐ দোকান সমস্ত রাত্রি রক্ষিত হয়। আজ ঐ দরজাটি পর্যন্ত ভিতর হইতে বদ্ধ দেখিয়া ও উহার মধ্যে আলো জ্বলিতেছে দেখিয়া, আমার সম্পূর্ণরূপ বিশ্বাস হইল যে, ঐ দোকানের ভিতর চোর প্রবেশ করিয়াছে, ও আলো জ্বালিয়া নিশ্চয়ই মূল্যবান জহরতাদি অপহরণ করিতেছে। দরজার ফাঁক দিয়া ঐ দোকানের আভ্যন্তরীণ অবস্থা দর্শন করিবার বিশেষরূপে চেষ্টা করিলাম, কিন্তু কিছুই দেখিতে পাইলাম না। নিকটে কোন প্রহরীকেও দেখিতে পাইলাম না, অথচ সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়া স্থানান্তরে গমন করিয়া কোনরূপ বন্দোবস্ত করিতেও সাহসী হইলাম না।
এইরূপ অবস্থা দেখিয়া সেই সময় কি করা কর্ত্তব্য, সেই স্থানে দাঁড়াইয়া মনে মনে ইহা ভাবিতেছি, এরূপ সময় হঠাৎ ভিতর হইতে বদ্ধ দরজার একটা খুলিয়া একজন লোক সেই দোকান হইতে বহির্গত হইল। উহাকেই দেখিয়া চোর বিবেচনায় আমি দ্রুতপদে উহার নিকট গমন করিয়া তাহাকে ধরিলাম। হঠাৎ ধৃত হওয়ায় সে অতিশয় বিস্মিত হইল এবং আমাকে কহিল, “কেন মহাশয় আমাকে ধরিতেছেন?”
উত্তরে আমি কহিলাম, “তুমি কে?” আমার কথা শুনিয়া সে কহিল, “আমি এই দোকানের একজন কর্ম্মচারী, বিশেষ কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে আমি বাহিরে যাইতেছি।”
আমি। আপনি যে এই দোকানের কর্মচারী, তাহা কে জানে?
কর্ম্মচারী। দোকানের ভিতর আমার মনিব আছেন, তিনিই বলিবেন যে, আমি তাঁহার দোকানের কর্ম্মচারী কি না?
আমি। আচ্ছা আসুন, আপনার মনিবের নিকট।
এই বলিয়া ঐ ব্যক্তিকে সঙ্গে লইয়া আমি ঐ দোকানের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম বাস্তবিকই সেই দোকানের স্বত্ত্বাধিকারী সেই স্থানেই বসিয়া আছেন, তাঁহার সহিত আরও দুইচারিজন লোক সেই স্থানে বসিয়া আছেন। আমাকে দেখিয়াই তিনি চিনিলেন ও বিশেষ অভ্যর্থনার সহিত আমাকে সেইস্থানে বসাইলেন। তাঁহার লোককে আমি ঐরূপে দোকানের মধ্যে লইয়া যাওয়ার নিমিত্ত আমি বিশেষরূপে লজ্জিত হইলাম। কি সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া আমি তাহাকে ঐরূপে দোকানে লইয়া গিয়াছি, তাহা তাঁহাকে সমস্ত কহিলাম। তিনি আমার কথা শ্রবণ করিয়া বিশেষরূপে সন্তুষ্ট হইলেন। পরিশেষে কহিলেন, আপনি এই সময় এখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন, ইহাতে আমার বোধ হইতেছে, আমার যে সৰ্ব্বনাশ হইয়াছে, তাহার প্রতিকার আপনার দ্বারাই সম্পন্ন হইবে। এই নিমিত্তই ভগবান দয়া করিয়া এই অসময়ে আপনাকে এখানে আনিয়া উপস্থিত করিয়াছেন।”
উহার কথা শুনিয়া আমি কিছুই অনুমান করিয়া উঠিতে পারিলাম না। সুতরাং আমাকে জিজ্ঞাসা করিতে হইল, “আপনার আবার কি সর্ব্বনাশ হইল?”
জহুরি। আমার প্রায় দশসহস্র টাকা অপহৃত হইয়াছে। তাহার উপর বোধ হয়, একটি জীবনও নষ্ট হইয়া গিয়াছে।
আমি। এ কিরূপ কথা, ইহার কিছুই আমি বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। কবে এরূপ ঘটনা ঘটিয়াছে?
জহুরি। ইহা আজ সন্ধ্যার সময়ের ঘটনা।
আমি। জীবন নষ্ট হইয়াছে, কথাটি কি?
জহুরি। আমি সমস্ত অবস্থা আপনার নিকট বলিতেছি, শুনিয়া যাহাতে ইহার প্রতিবিধান হয়, তাহার চেষ্টা আপনাকে করিতে হইবে। এক সময় আপনি আমার বিশেষরূপ উপকার করিয়াছেন। এবারও আমাকে এই ঘোরবিপদ হইতে উদ্ধার করুন।
আমি। কি ঘটিয়াছে বলুন দেখি।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
আমার কথার উত্তরে সেই জহুরি কহিলেন, “আজ সন্ধ্যার পর আমি আমার দোকানে বসিয়া আছি, এরূপ সময়ে একটি এদেশীয় স্ত্রীলোক দোকানের ভিতর প্রবেশ করিল। ইনি একখানি ক্রহাম গাড়ীতে করিয়া আগমন করেন। রুহামখানি নূতন বলিয়া অনুমান হয়, ঘোড়াটিও বিশেষ মূল্যবান ওয়েলার। তিনি ঐ গাড়ীতে একাকীই আসিয়াছিলেন, আজকাল এদেশীয় বিলাত ফেরত যুবকগণের শিক্ষিতা মহিষীগণ বা ব্রাহ্মিকাগণ, যেরূপভাবে বস্ত্রাদি পরিধান করিয়া থাকেন, উনিও সেইরূপ ভাবে সজ্জিতা ছিলেন। তিনি গাড়ী হইতে অবতরণ করিয়া, পুরুষের ন্যায় অথবা মেমসাহেবদিগের ন্যায় একাকী আমার দোকানের ভিতর প্রবেশ করিয়া আমাকে কহিলেন, ‘আপনি আমাকে চিনেন কি!’ উত্তরে আমি কহিলাম, ‘না, আমি আপনাকে ইতিপূর্ব্বে আগে কখন দেখিয়াছি বলিয়া অনুমান হয় না।’ ‘পরিচয় পরে হইবে এখন আমার দুইটি জিনিষের আবশ্যক আছে, যদি আপনার দোকানে থাকে, তাহা হইলে দেখান দেখি।”
আমি। কি কি দ্রব্যের আবশ্যক?
স্ত্রীলোক। একজোড়া উৎকৃষ্ট হীরক-বলয় ও একছড়া মতির মালা।
তাঁহার কথা শুনিয়া আমার দোকানে যে সকল হীরকবলয় প্রস্তুত ছিল, তাহা এক এক করিয়া তাঁহাকে দেখাইলাম, ও কয়েক ছড়া মতির মালাও তাঁহাকে দেখাইলাম। দেখিয়া দেখিয়া তিনি উহার মধ্য হইতে একজোড়া বলয় ও একছড়া মালা পছন্দ করিলেন। সেই সঙ্গে দুইটি হীরার ও একটি মাণিকের আংটীও তাঁহার পছন্দ হইল। তিনি ঐ সমস্ত দ্রব্যের মূল্য আমাকে জিজ্ঞাসা করিলে আমি কহিলাম, উহার মূল্য পনর সহস্র টাকা হইবে। ঐ সকল দ্রব্যের প্রকৃতমূল্য দশ হাজার টাকা; কিন্তু তাঁহার সহিত অনেক কসা মাজা করিয়া বার হাজার টাকা উহার মূল্য অবধারিত হইল। তখন তিনি তাঁহার পকেট হইতে একটা রূপার কার্ডকেস বাহির করিয়া তাহার মধ্য হইতে একখানি কার্ড বাহির করিয়া আমার হস্তে অর্পণ করিলেন। কার্ডে যে নাম মুদ্রিত ছিল, তাহা দেখিয়া আমি বুঝিলাম যে, উনি কলিকাতা হাইকোর্টের একজন বিখ্যাত কৌন্সলির স্ত্রী। বার হাজার কেন, সেই কৌন্সলি সাহেব যদি বিশ হাজার টাকার অলঙ্কার দেনায় চাহেন, তাহা আমি অনায়াসেই দিতে পারি।
ঐ স্ত্রীলোকের পরিচয় পাইয়া আমি কহিলাম, “এই অলঙ্কারগুলি কি আপনি নিজে লইয়া যাইবেন, কি আমি উহা আপনার বাড়ীতে পাঠাইয়া দিব।” আরও জিজ্ঞাসা করিলাম, “ইহার মূল্য এখন আপনি প্রদান করিবেন, না বাকী থাকিবে, পরে ইহার বিল পাঠাইয়া দিব।”
“ইহার মূল্য আপনি নগদ পাইবেন, কিন্তু এত টাকার অলঙ্কার আমার স্বামীকে একবার না দেখাইয়া লওয়া কৰ্ত্তব্য নহে, অদ্যই রাত্রির গাড়ীতে কোন একটি মোকদ্দমা উপলক্ষে তাঁহাকে বাহিরে যাইতে হইবে। তিনি তাঁহার নিমিত্ত একটু ব্যস্ত আছেন বলিয়া, আমার সহিত আসিতে পারিলেন না। আপনি গহনাগুলি আমার সহিত লইয়া আসুন, আমার স্বামীকে দেখাইয়া ইহার মূল্য লইয়া আসিবেন।”
উহার কথায় আমার অবিশ্বাস করিবার কিছুমাত্র কারণ ছিল না, একে তিনি যাঁহার স্ত্রী বলিয়া পরিচয় প্রদান করিতেছেন, তিনি আমার উত্তমরূপ পরিচিত— তাহার উপর নিয়মিত লাভের উপর দুই সহস্রমুদ্রা অধিক লাভের প্রলোভন ছাড়িয়া দেওয়া ব্যবসায়ীর পক্ষে অসম্ভব। সুতরাং ঐ সকল অলঙ্কার তাঁহার স্বামীর নিকট পাঠাইয়া দিতে প্রস্তুত হইলাম। আমার দোকানের বিশেষ বিশ্বাসী ও সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারী যিনি ছিলেন, তাঁহাকেই ঐ অলঙ্কারগুলি লইয়া তাঁহার সহিত পাঠাইয়া দিলাম। গাড়ীতে উঠিবার সময় আমার কর্ম্মচারী একটু ইতস্ততঃ করিতে লাগিলেন। কারণ, ব্রুহায় গাড়ীতে কেবল একপার্শ্বে ভিন্ন বসিবার স্থান নাই, সেইস্থানে ঐ স্ত্রীলোকটি উপবেশন করিবেন, সুতরাং তাঁহার পার্শ্বে তিনি কিরূপে বসেন, এইরূপ একটু ইতস্ততঃ করিয়া ঐ কর্ম্মচারী আমার দ্বারবানকে একখানি গাড়ী আনিতে কহিলেন। ইহা শুনিয়া ঐ স্ত্রীলোকটি কহিলেন, আর গাড়ী আনিবার প্রয়োজন নাই। আমার গাড়ীতেই আইস, আমার পার্শ্বে বসিয়া গমন করিলে, তাহাতে আমি অবমাননা বোধ করিব না। উহার কথা শুনিয়া আমার কর্ম্মচারী কি একটু ভাবিলেন ও পরিশেষে তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া ঐ গাড়ীতেই আরোহণ করিয়া। তাঁহার পার্শ্বে উপবেশন করিয়া গমন করিলেন। বলা বাহুল্য অলঙ্কারগুলি তাঁহার সঙ্গে রহিল।
এক ঘন্টার মধ্যে তাঁহার প্রত্যাগমন করিবার কথা ছিল কিন্তু ক্রমে দুই ঘন্টা কাল অতিবাহিত হইয়া গেল, তিনি প্রত্যাগমন করিলেন না বা কোনরূপ সংবাদও প্রদান করিলেন না। সুতরাং আমার মনটা একটু ব্যস্ত হইয়া পড়িল। বাসায় যাইবার নিমিত্ত আমার গাড়ী প্রস্তুত ছিল, ঐ গাড়ীতে আরোহণ করিয়া আমি সেই কৌন্সলি সাহেবের বাড়ীতে গমন করিলাম। তাঁহার সহিত সাক্ষাৎও হইল, কিন্তু তাঁহার নিকট জানিতে পারিলাম যে, তাঁহার স্ত্রী এখন কলিকাতায় নাই, তিনি এখন দার্জ্জিলিংয়ে আছেন ও অপর কোন স্ত্রীলোককে তিনি কোন অলঙ্কারাদি খরিদ করিবার নিমিত্ত কোন স্থানে প্রেরণ করেন নাই, ও ঐরূপের কোন স্ত্রীলোককে তিনি জানেন না, অথবা অলঙ্কারাদি লইয়া কেহ তাঁহার বাড়ীতে আগমনও করে নাই।
কৌন্সলি সাহেবের কথা শ্রবণ করিয়া আমার বুদ্ধি লোপ পাইয়া গেল, কিছুক্ষণের নিমিত্ত আমি হিতাহিতজ্ঞান- বিবর্জ্জিত হইয়া পড়িলাম। সেই সময় কি করা কর্তব্য, তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, আমি আমার দোকানে ফিরিয়া আসিলাম। দোকানের অপরাপর কর্ম্মচারীগণের সহিত পরামর্শ করিয়া ইহাই স্থির হইল যে, আর কালবিলম্ব না করিয়া থানায় গিয়া এই সংবাদ প্রদান করা হউক। ঐ সংবাদ লইয়া থানায় যে লোক গমন করিতেছিল, আপনি তাহাকেই ধৃত করিয়া এখানে আনিয়াছেন।
আমি। তাহা হইলে এখনও থানায় সংবাদ দেওয়া হয় নাই?
জহুরি। না।
আমি। শীঘ্র সংবাদ পাঠাইয়া দিন।
আমার কথা শুনিয়া সেই ব্যক্তি থানায় সংবাদ দিতে দ্রুতপদে গমন করিল।
আমি। আপনি এত বড় চতুর লোক হইয়া একটা স্ত্রীলোকের নিকট এইরূপে প্রবঞ্চিত হইলেন?
জহুরি। স্ত্রীলোক বলিয়াই তাহার নিকট আমি প্রবঞ্চিত হইয়াছি, পুরুষ হইলে বোধ হয়, আমাকে এইরূপ প্রতারিত করিতে পারিত না। সে যাহা হউক, আমার অর্থের অদৃষ্টে যাহা হয় হউক, অর্থ পুনরায় উপার্জ্জিত হইবে। কিন্তু আমার বিশ্বস্ত প্রধান কর্মচারীর যদি কোনরূপে জীবন নষ্ট করিয়া ফেলে, তাহা হইলে কি সৰ্ব্বনাশ হইবে বলুন দেখি?
আমি। আপনার সেই বিশ্বস্ত কর্ম্মচারী তো ঐ স্ত্রীলোকটির সহিত মিলিত হইয়া, এইরূপ কার্য্যে হস্তক্ষেপ করে নাই?
জহুরি। না মহাশয়, তাহা কোনরূপেই হইতে পারে না। তাঁহার দ্বারা এরূপ কার্য্য কিছুতেই সম্পন্ন হইবে না।
আমি। তাঁহার বাসা কোথায়? সেই স্থানের সংবাদ লইয়াছেন কি, তিনি ত বাসায় প্রত্যাগমন করেন নাই?
জহুরি। তিনি তাঁহার বাসায় যাইবেন না। কারণ তিনি অবগত আছেন যে, তাঁহার অপেক্ষায় আমি এখানে বসিয়া আছি। তদ্ব্যতীত তাঁহার বাসার সংবাদও লওয়া হইয়াছে, তিনি বাসায় আসেন নাই। জীবিত থাকিলে ত বাসায় প্রত্যাগমন করিবেন।
আমি। তাহার জীবন সম্বন্ধে কোন ভাবনা নাই। যাহার দ্বারা এই কার্য্য হইয়াছে, সে কাহাকেও হত্যা করিবার জন্য এই কার্য্য করে নাই। সে অর্থ অপহরণ করিবার মানসেই এই কার্য্য করিয়াছে।
জহুরি। তাহা হইলেই ভাল, উহাকে জীবিত অবস্থায় প্রাপ্ত হইলেই আমি সন্তুষ্ট। অলঙ্কারের ভাগ্যে যাহা হয় হউক।
আমি। আপনার কর্ম্মচারীকেও প্রাপ্ত হইবেন, অলঙ্কারও পাইবেন। তবে আমাদিগের অদৃষ্টে যে কষ্ট আছে, সেই কষ্ট আমাদিগকে সহ্য করিতে হইবে।
আমাদিগের মধ্যে এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এরূপ সময়ে থানা হইতে কর্ম্মচারীগণ আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
থানা হইতে যে সকল পুলিস কর্ম্মচারীগণ আসিয়া উপস্থিত হইলেন, তাহাদিগের মধ্যে সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারী ছিলেন একজন ইংরাজ। তিনিও ঐ জহুরির নিকট সমস্ত অবস্থা অবগত হইয়া পরিশেষে আমাকে কহিলেন, “এখন আমাদিগের কি কর্তব্য? আমি যতদূর শুনিতে পাইলাম, তাহাতে বেশ বুঝিতে পারিতেছি, এই মোকদ্দমার সহিত আমাদিগের কোনরূপ সংস্রব নাই, ইহা সম্পূর্ণরূপ দেনা পাওনা ঘটিত মোকদ্দমা। সেই ভদ্র স্ত্রীলোকটি অলঙ্কারের মূল্য স্থির করিয়া খরিদ করিয়া লইয়া গিয়াছে; এখন যদি, সে তাহার মূল্য না দেয়, তাহা হইলে দেওয়ানি আদালত আছে, – দেওয়ানি মোকদ্দমায় আমরা হস্তক্ষেপ করিব কেন?”
ইংরাজ-কর্মচারীর কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, “আমার মতে ইহা দেনা পাওনার মোকদ্দমা নহে; সেই ভদ্র স্ত্রীলোকটি যে বঞ্চনার অপরাধ করিয়াছেন, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। তাহার উপর যে ব্যক্তি ঐ অলঙ্কার বহন করিয়া লইয়া গিয়াছে, তাহারও আর কোন সন্ধান পাওয়া যাইতেছে না। পরিশেষে যদি তাহার মৃতদেহ পাওয়া যায়, তাহা হইলেও কি দেওয়ানি আদালতে ঐ মোকদ্দমা চলিবে?”
ইংরাজ-কৰ্ম্মচারী। তাহাকে যদি জীবিত অবস্থায় পাওয়া যায়? যাহা হউক, যখন আমরা এখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি, তখন ইহার অনুসন্ধান হউক। আমার সহিত যে সকল কর্ম্মচারী আসিয়াছে, তাহারা রহিল, আপনিও আছেন। যে যে অনুসন্ধান করার প্রয়োজন বিবেচনা করেন, তাহা আপনারা করুন, আমি এখন চলিলাম। আমার হস্তে আরও কতকগুলি বিশেষ কাৰ্য্য আছে।
এই বলিয়া ইংরাজ কর্মচারী সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। তাঁহার সহিত যে কয়েকজন কৰ্ম্মচারী আসিয়াছিলেন, তাহার মধ্যে একজন পশ্চিম দেশবাসী বহু পুরাতন কৰ্ম্মচারী ছিলেন; কলিকাতা সহরের অনেক অবস্থা তিনি উত্তমরূপে জানিতেন। তাঁহার ঊর্দ্ধর্তন ইংরাজ কর্মচারী সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলে তিনি কহিলেন, “উঁহার গতিকই ঐরূপ, মামলা মোকদ্দমা উনি ঐরূপ ভাবেই অনুসন্ধান করিয়া থাকেন, আর অনুসন্ধানের উনি জানেনই বা কি? উনি উপস্থিত থাকিলে কার্য্য আরও নষ্ট হইত, প্রস্থান করিয়াছেন ভালই হইয়াছে। এখন কোন পন্থা অবলম্বন করিয়া এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইতে হইবে, তাহাই বলুন, সেই পন্থা অবলম্বন করিয়া আমরা ক্রমেই অগ্রসর হই।”
ঐ কর্ম্মচারীর কথা শুনিয়া আমি অতিশয় সন্তোষ হইলাম ও তাঁহাকে কহিলাম, “যাঁহার দ্বারা এই কার্য সম্পন্ন হইয়াছে, তাহা আমি বুঝিতে পারিয়াছি, অনুসন্ধান করিয়া এখন তাহাকে বাহির করিতে পারিলেই আমাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে।”
কর্ম্ম। কাহার দ্বারা এই কার্য্য সম্পন্ন হইয়াছে?
আমি। তুমি সুশীলাকে চিন?
কৰ্ম্ম। কোন সুশীলা?
আমি। যে সুশীলা পূর্ব্বে মেহিদীবাগানে বাস করিত। সে বেশ্যার কন্যা, প্রথমে কোন নূতন সম্প্রদায় বিশেষের মতে বিবাহ করিয়া কিছুদিবস দিনযাপন করে, পরে আপন স্বামীকে পরিত্যাগ করিয়া একজন কৌশলির প্রণয়ে কিছুদিবস মুগ্ধ থাকে, পরিশেষে নানারূপ জুয়াচুরি ব্যবসা অবলম্বন করিয়া দিনপাত করিতে আরম্ভ করে। সে শিক্ষিতা, ইংরাজি বালা বেশ জানে, ও প্রায়ই বড় বাড়ীতে বড়মানুষি ধরণে বাস করিয়া থাকে। সৰ্ব্বশেষে যখন সে একটি জুয়াচুরি
কার্যে লিপ্ত থাকার অপরাধে ধৃত হয়, সেই সময় সে মেহেদীবাগানে একখানি সাহেবি ধরণের পাকা বাড়ীতে বাস করিত। ঐ মোকদ্দমায় সে অব্যাহতি পায়। তাহার পর আমি শুনিয়াছি যে, সে ঐ বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া অপর কোন স্থানে বাস করিতেছে। যদি অনুসন্ধান করিয়া উহাকে বাহির করিতে পারেন, তাহা হইলে এই মোকদ্দমার কিনারা হইতে আর ক্ষণমাত্রও বিলম্ব হয় না। আমি শপথ করিয়া বলিতে পারি, এ কার্য্য সুশীলা ভিন্ন অপর আর কাহার দ্বারা সম্পন্ন হয় নাই।
কৰ্ম্ম। না মহাশয়, আমি তো তাহাকে চিনি না বা তাহার অবস্থা আমি পূর্ব্বে জানিতাম না, কিন্তু আপনি আমাকে তাহার সেই মেহিদীবাগানের বাড়ী দেখাইয়া দিন, আমি অনুসন্ধান করিয়া সে এখন যেখানে আছে, তাহা নিশ্চয় বাহির করিয়া দিব।
কর্ম্মচারীর এই কথা শুনিয়া আমি তাঁহাকে সঙ্গে লইয়া তখনই মেহিদীবাগান অভিমুখে গমন করিলাম, দোকানের অধিকারী সেই জহুরিও আমাদিগের সঙ্গে গমন করিলেন।
মেহেদীবাগান গমন করিবার পূর্ব্বে ভাবিলাম, যে কর্ম্মচারীর দ্বারা সুশীলা ইতিপূৰ্ব্বে ধৃতা হইয়াছিল, একবার তাঁহার সহিত প্রথম দেখা করা আবশ্যক। মনে মনে ইহা স্থির করিয়া সেই কৰ্ম্মচারী এখন যে থানায় আছেন, সেই থানায় গমন করিলাম। সেইস্থানে গিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইল না, কিন্তু জানিতে পারিলাম, হাসপাতালে এক ব্যক্তি জখম হইয়া ভর্তি হইয়াছে। এই সংবাদ পাইয়া তাহার অনুসন্ধানার্থ তিনি সেই হাসপাতালে গমন করিয়াছেন। ঐ স্থান হইতে মেহেদীবাগান গমন করিতে হইলে ঐ হাসপাতাল প্রায় আমাদিগের রাস্তাতেই পড়ে, সুতরাং ঐ হাসপাতালে ঐ কর্ম্মচারীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া মেহেদীবাগান গমন করাই স্থির করিলাম।
হাসপাতালে গমন করিয়া দেখিলাম, সেই কৰ্ম্মচারী সেই স্থানেই আছেন। তাঁহার নিকট হইতে অবগত হইলাম, একব্যক্তি মস্তকে অতিশয় জখম পাইয়া বেহুস অবস্থায় ময়দানে পড়িয়াছিল, একজন প্রহরী তাহাকে ঐরূপ অবস্থায় পাইয়া হাসপাতালে আনয়ন করে, কিন্তু ঐ ব্যক্তি যে কে, কোথা হইতে সে ময়দানে আসিল ও কিরূপেই বা সে মস্তকে আঘাত প্রাপ্ত হইল, তাহার কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। সে এখনও অচৈতন্য অবস্থায় রহিয়াছে, চৈতন্য হইবে কি না, জানি না। যদি চৈতন্য হয়, তাহা হইলেই উহার নিকট হইতে সমস্ত অবস্থা অবগত হইতে পারিব, নতুবা কোন উপায় যে অবলম্বন করিতে হইবে, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না।
কৌতূহলের বশবর্তী হইয়া আমরাও উহাকে দেখিবার নিমিত্ত গমন করিলাম, আমাদিগের সমভিব্যাহারী জহুরিও আমাদিগের সহিত গমন করিলেন। উহাকে দেখিবামাত্র জহুরি চীৎকার করিয়া উঠিলেন ও কহিলেন, “আমরা যাহার অনুসন্ধান করিতেছি, ইনিই আমার সেই কর্মচারী, কে ইহার এইরূপ সর্ব্বনাশ করিল?”
জহুরির কথা শুনিয়া আমরাও অতিশয় বিস্মিত হইলাম ও মনে করিলাম, সেই স্ত্রীলোকটি কি ইহাকে এইরূপে আহত করিয়া হতজ্ঞানে ময়দানে নিক্ষেপ করিয়া চলিয়া গিয়াছে? স্ত্রীলোকের দ্বারা কি এইরূপে হত্যাকাৰ্য সম্পাদিত হইতে পারে? কি দস্যুগণ এইরূপ একটি দল সৃষ্টি করিয়া কার্যক্ষেত্রে পদবিক্ষেপ করিয়াছে? ঐ স্ত্রীলোকটিও কি তাহাদিগের দলের একজন। ঈশ্বর করুন, ইহার শীঘ্র চৈতন্যলাভ হউক, ইহার নিকট সমস্ত অবস্থা শুনিতে পাইলেও আমরা অনেক বিষয় অবগত হইতে পারিব।
আমাদিগের যেমন অনেকটা কাৰ্য সম্পন্ন হইল, যে কর্মচারীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলাম, তাঁহারও সেইরূপ অনেকটা কাৰ্য সম্পন্ন হইল। তিনি অকূল পাথারে পড়িয়া ভাবিতে ছিলেন, এখন আমাদিগের ন্যায় তাঁহারও কূল পাইবার অনেকটা সম্ভাবনা হইল। এখন আমরা কি অনুসন্ধানে নিযুক্ত ও কি নিমিত্তই বা তাঁহার নিকট আগমন করিয়াছি, তাহার সমস্ত অবস্থা তাঁহাকে কহিলাম। তিনিও এখন হৃষ্টান্তঃকরণে সুশীলাকে খুঁজিয়া বাহির করিবার নিমিত্ত আমাদিগকে সম্যরূপে সাহায্য প্রদানে সম্মত হইয়া আমাদিগের গাড়ীতে আসিয়া আরোহণ করিলেন।
সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিবার সময় সেই হাসপাতালের ডাক্তারকে বিশেষ করিয়া বলিয়া গেলাম, যেন ঐ ব্যক্তির কোনরূপে সেবা শুশ্রূষার ত্রুটি না হয় ও যাহাতে উহার শীঘ্র জ্ঞানের উদয় হয়, তদ্বিষয়ে যেন বিশেষরূপ লক্ষ্য রাখা হয়। ডাক্তারবাবু আমাদিগের কথা শুনিয়া আমাদিগের অনুরোধ রক্ষা করিতে প্রবৃত্ত হইলেন।
আমরা মেহেদীবাগানে গমন করিলাম, সেইস্থানের যে গৃহে সুশীলা বাস করিত, এখন সেই গৃহে একজন সাহেব বাস করিতেছেন, তিনি সুশীলা সম্বন্ধে কোন কথাই বলিতে পারিলেন না, কিন্তু প্রতিবেশীগণের নিকট হইতে অবগত হইতে পারিলাম যে, প্রায় এক বৎসর হইল, সে ঐগৃহ পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে, কিন্তু এখন যে কোথায় বাস করিতেছে, তাহা কেহ বলিতে পারে না। তবে প্রায় ৬ মাস হইল, সুশীলার একটি চাকরের সহিত এক ব্যক্তির সাক্ষাৎ হইয়াছিল, তাহার নিকট হইতে অবগত হন, যে সুশীলা এখন চন্দননগরে বাস করিতেছে, কিন্তু চন্দননগরের কোন্ স্থানে সে বাস করিতেছে, তাহা কিন্তু তিনি ঐ চাকরকে জিজ্ঞাসা করেন নাই।
যাহা অবগত হইলাম, তাহাতে চন্দননগরে গিয়া উহার অনুসন্ধান করাই সাব্যস্ত হইল।
চন্দননগর ফরাসী রাজ্যের অন্তর্ভূত, সুতরাং সেইস্থানে গিয়া কোনরূপ অনুসন্ধান করিতে হইলে ফরাসী গবর্ণমেন্টের আদেশ অগ্রে গ্রহণ করিতে হয় ও তাহাদিগের কর্মচারীর সাহায্য ব্যতীত কোনরূপ অনুসন্ধান করিবার উপায় নাই। এদিকে প্রকাশ্যভাবে ফরাসী রাজ্যের কর্মচারীগণের সাহায্য লইতে গেলে প্রায়ই নানারূপ গোলযোগ ঘটে, সুতরাং অনুসন্ধান করিবার সময় প্রায়ই বিপরীত ফল হইয়া থাকে, ইহা আমি অনেকবার নিজেই দেখিয়াছি। এরূপ অবস্থায় প্রকাশ্য অনুসন্ধান না করিয়া যদি ছদ্মবেশে অনুসন্ধান করিয়া সুশীলার কোনরূপ সন্ধান পাওয়া যায়, তাহার নিমিত্ত পূর্ব্বকথিত সেই পশ্চিম দেশীয় কর্ম্মচারীকে প্রেরণ করিলাম। তাঁহাকে বিশেষ করিয়া বলিয়া দিলাম, যে কার্য্যের নিমিত্ত তিনি গমন করিতেছেন, সেই কাৰ্য্য তিনি যত করিতে পারুন বা না পারুন, তিনি যে ইংরাজ- রাজকর্ম্মচারী, তাহা যেন তাহারা কোনরূপে অবগত হইতে না পারে। আর তাঁহার দোষে যদি তাহার কথা প্রকাশিত হইয়া পড়ে, তাহা হইলে তাহার জন্য তাঁহাকে দণ্ড গ্রহণ করিতে হইবে, অথচ ইংরাজরাজ হইতে তিনি কোনরূপ সাহায্য প্রাপ্ত হইবেন না। ইতিপূর্ব্বে একবার আমরা ঐ স্থানে গুপ্ত অনুসন্ধান করিতে যাওয়ায় আমাদিগের মধ্যস্থিত একজন কৰ্ম্মচারী যেরূপ বিপদগ্রস্ত হইয়াছিলেন, তাহাও তাঁহাকে কহিলাম। কহিলাম, “কয়েক বৎসর পূর্ব্বে আমি, একজন মুসলমান কৰ্ম্মচারী ও একজন পশ্চিমদেশীয় কর্ম্মচারী একটী খুনী মোকদ্দমায় আসামীর অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত ঐ স্থানে গমন করি। কারণ, আমরা এইরূপ সংবাদ পাইয়াছিলাম যে ঐ হত্যাকারী গোপনভাবে ঐ স্থানে বাস করিতেছে ও ঐ স্থানের কয়েকজন নিম্নপদস্থ কর্মচারী এই অবস্থা অবগত আছেন। এই সংবাদ জানিতে পারিয়া, আমরা তিনজনে উহার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত সেইস্থানে গমন করি। সেইস্থানে যখন আমরা গুপ্ত অনুসন্ধানে নিযুক্ত ছিলাম, সেই সময় সেই স্থানের পুলিস কি প্রকারে ইহা জানিতে পারে, ও আমাদিগকে ধৃত করিয়া লইয়া যাইবার নিমিত্ত কয়েকজন বরকন্দাজ প্রেরণ করেন। আমরাও এই সংবাদ জানিতে পারিয়া ঊর্দ্ধশ্বাসে সেইস্থান হইতে পলায়ন করিতে আরম্ভ করি। ইংরাজ রাজত্বের ভিতর উপস্থিত হইয়া দেখি, যে মুসলমান কৰ্ম্মচারীও আমার সহিত সেইস্থানে উপস্থিত হইয়াছেন, কিন্তু পশ্চিমদেশীয় সেই হিন্দু কর্ম্মচারী আসিয়া উপস্থিত হইতে পারেন নাই। পরে সংবাদ লইয়া জানিতে পারিলাম, যে তিনি বরকন্দাজদিগের হস্তে পতিত হইয়াছেন ও তাঁহাকে থানায় ধরিয়া লইয়া গিয়াছে। আরও জানিতে পারিলাম, যে তাঁহাকে “তোরং” দ্বারা আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে। এই অবস্থা জানিতে পারিয়া আমরা কলিকাতা প্রত্যাগমন করি ও আমাদিগের প্রধান কর্মচারীর নিকট এই সকল কথা জ্ঞাপন করিয়া তিনি লাট সাহেবের সহায়তায় ঐ কর্ম্মচারীকে ঐ স্থান হইতে খোলসা করিয়া আনিতে সমর্থ হন। বলা বাহুল্য, যে কয়দিবস তিনি ঐ স্থানে আবদ্ধ ছিলেন, সেই কয়দিবস তাঁহার কষ্টের পরিসীমা ছিল না।
আমার কথা শুনিয়াও ঐ কর্ম্মচারী ঐ স্থানে গমন করিয়া গোপন অনুসন্ধানে সুশীলাকে বাহির করিবার চেষ্টা করিতে সম্মত হইলেন। সুতরাং তখনই তাঁহাকে চন্দননগরে প্রেরণ করিলাম। দুই দিবস পরে তিনি সেইস্থান হইতে প্রত্যাগমন করিলেন ও কহিলেন, “সুশীলা নাম্নী একটি স্ত্রীলোক ঐ স্থানে বাস করেন সত্য, কিন্তু যে তারিখে এই জুয়াচুরির কার্য সম্পন্ন হইয়াছে, সেইদিন হইতে তিনি ঐ স্থানে গমন করেন নাই; তাহার লোকজন ও পরিচারক প্রভৃতি সকলেই সেইস্থানে আছে, কেবল তিনিই নাই ও তিনি যে কোথায় গমন করিয়াছেন, তাহাও তাহাদিগের মধ্যে কেহই বলিতে পারে না।”
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
সুশীলার দ্বারা এই কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়াছে, অনুমানে ইহাই মনে করিয়া, আমরা তাহার অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম, কিন্তু সেই যে এই কার্য্যের প্রকৃত নায়িকা, তাহারই বা নিশ্চয়তা কি? যে পর্য্যন্ত তাহাকে ঐ জহুরি বা তাঁহার অপর কোন কর্ম্মচারী দেখিতে না পান, সেই পৰ্য্যন্ত কোন কথা নিশ্চয়রূপে বলা যাইতে পারে না।
জহুরির সেই প্রধান কর্মচারীর চিকিৎসা সেই হাসপাতালেই উত্তমরূপে হইতে লাগিল। ঐ স্থানের ডাক্তারগণের বিশেষ যত্নে তিনি ক্রমেই আরোগ্যলাভ করিতে লাগিলেন। চারি দিবস পরে তাঁহার হুস্ হইল, সেই সময় হইতে আস্তে আস্তে তিনি তাঁহার নিজের অবস্থা বিবৃত করিতে সমর্থ হইলেন। তাঁহার নিকট হইতে ক্রমে আমরা নিম্নলিখিত বিষয়গুলি অবগত হইতে পারিলাম। তিনি আমাদিগের নিকট ক্রমে যাহা যাহা বলিয়াছিলেন, তাহার কতক অংশ এইস্থানে বর্ণিত হইলেই পাঠকগণ জানিতে পারিবেন যে, তিনি কিরূপ অবস্থায় পতিত হইয়া এইরূপ সাঙ্ঘাতিক আঘাত প্রাপ্ত হন, ও কিরূপেই বা তাঁহার নিকট হইতে অলঙ্কারগুলি অপহৃত হয়।
তিনি বলিয়াছিলেন,—আমি তাঁহাকে নিতান্ত সম্ভ্রান্ত স্ত্রীলোক মনে করিয়াই প্রথমতঃ তাঁহার সহিত তাঁহার ব্রুহেম গাড়ীর একাসনে উপবেশন করিতে অসম্মত হই, কিন্তু পরিশেষে তাঁহারই ইচ্ছা অনুসারে সেই রুহেম গাড়ীতে আরোহণ করিয়া তাঁহারই পার্শ্বে উপবেশন করি। গাড়ী চলিতে থাকে। গাড়ী চলিবার সময় তাঁহার বসিবার ভাব ভঙ্গি ও আমার সহিত যেরূপ ভাবে কথাবার্তা করিতে আরম্ভ করেন, তাহাতে তাঁহাকে চরিত্রবতী স্ত্রীলোক বলিয়া আমার বোধ হয় না। আমার সেই সময়ে মনে হয় যে, ইনি যদি সেই কৌন্সলির প্রকৃতই স্ত্রী হন, তাহা হইলে তিনি ইঁহাকে লইয়া কখনই সুখী নহেন। আমার মনে এইরূপ নানাপ্রকার তর্ক আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল, আমি আমার মনের ভাব অনেক কষ্টে গোপন করিয়া তাহার সহিত গমন করিতে লাগিলাম। গাড়ী যে কোথা দিয়া কোথায় গমন করিতে লাগিল, রাত্রিকালে তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। গাড়ী ক্রমশই গমন করিতে লাগিল, ক্রমে অন্ধকারের মধ্যে একটি বাড়ীর সম্মুখে আসিয়া ঐ গাড়ী থামিল। গাড়ী থামিবামাত্র তিনি আমাকে সেইস্থানে অবতরণ করিতে কহিলেন। সহিস গাড়ীর দরজা খুলিয়া দিল, আমি গাড়ী হইতে বহির্গত হইলাম। আমি যেমন গাড়ী হইতে অবতরণ করিলাম, সহিস ঐ দরজা অমনি বন্ধ করিয়া দিল, স্ত্রীলোকটি কিন্তু গাড়ী হইতে অবতরণ করিলেন না। আমি গাড়ী হইতে অবতরণ করিবামাত্র কোচমান ঘোড়াকে কষাঘাত করিল, চাবুক খাইয়া ঘোড়া ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটিল, দেখিতে দেখিতে স্ত্রীলোকটির সহিত ঐ গাড়ী নয়নপথের বহির্গত হইয়া পড়িল। আমি বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি, যে সময় আমি গাড়ীতে ঐ স্ত্রীলোকটির সহিত গমন করিয়াছিলাম, সেই সময় তিনি ঐ অলঙ্কারগুলি আমার নিকট হইতে কোনরূপে হস্তগত করিবার মানসে নানারূপ উপায় অবলম্বন করেন, কিন্তু আমি কোনরূপেই তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত না হইয়া, নানা ওজর আপত্তি করিয়া কিছুতেই ঐ সমস্ত অলঙ্কার তাঁহার হস্তে প্রদান করি না। যে সময় আমি গাড়ী হইতে অবতরণ করি, সেই সময় সমস্ত অলঙ্কারগুলিই আমার নিকট রহিল।
গাড়ী হইতে অবতরণ করিবার পর আমি যে কোন্ স্থানে আসিয়াছি, তাহার কিছুমাত্র স্থির করিতে পারিলাম না, কিন্তু ঐ স্থান যে সহরের মধ্যে নহে, তাহা বেশ বুঝিতে পারিলাম। ঐ স্থানে গ্যাসের আলোকমাত্র নাই, বহু দূরে দূরে একটি একটি তেলের আলো মিট্ মিট্ করিয়া জ্বলিতেছে, ঐ আলোকে রাস্তা আলোকিত হওয়া দূরে থাকুক, আরও যেন কেমন একরূপ চক্ষে ঝাপসা ঝাপসা বোধ হইতে লাগিল। যে বাড়ীর সম্মুখে আমি অবতরণ করিয়াছিলাম, তাহাও অন্ধকারময়, উহার কোন স্থান হইতে একটি আলোকও দৃষ্টিগোচর হইতেছে না, অনুমান হয় ঐ স্থান একেবারে জনশূন্য। রাস্তার উপর একটি লোককেও যাতায়াত করিতে দেখিতে পাইলাম না। আমি এইরূপ অবস্থায় পতিত হইয়া কি করিব বা কোথায় যাইব তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। যেন অনন্যোপায় হইয়া একদিক অবলম্বন করিয়া চলিতে লাগিলাম, কোথায় যাইতেছি, তাহা জানি না; কোন্ স্থানে আসিয়াছি, তাহা জানি না ও কোন দিকে গমন করিতেছি, তাহা জানিতে পারিতেছি না, অথচচলিতে লাগিলাম, কিন্তু একটিজনমানবকে দেখিতে পাইলাম না। এইরূপ অবস্থায় আমি কিয়ৎদূর গমন করিয়াছি, এরূপ সময়ে হঠাৎ পশ্চাৎদিক হইতে কে আসিয়া আমার মস্তকে এক আঘাত করিল। কে যে আঘাত করিল বা কিসের দ্বারা আঘাত করিল, তাহার কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। আমি অজ্ঞান অবস্থায় সেইস্থানে পড়িয়া গেলাম তাহার পর আমার যে কি দশা ঘটিয়াছে, তাহার কিছুই আমি অবগত নহি। আমি বেশ বলিতে পারি যে, যে সময় আমি অজ্ঞান হইয়া পড়ি, সেই সময় অলঙ্কারগুলি আমার নিকটেই ছিল। যখন আমার হুঁস হইল, তখন আমি দেখিলাম যে, আমি এই হাসপাতালের মধ্যে অবস্থান করিতেছি।
ইহার কথা শুনিয়া আমরা বিশেষ কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। সুশীলাই হউক বা অপর কোন স্ত্রীলোকই হউক, যে অলঙ্কারের সহিত ইহাকে সেই জহুরির দোকান হইতে নিজের গাড়ীতে করিয়া আনিয়াছিল, সে উহার নিকট হইতে সকল অলঙ্কার গ্রহণ না করিয়া, উহাকে ঐরূপ অবস্থায় অন্ধকারের মধ্যে একটিঅপরিচিত স্থানে পরিত্যাগ করিয়া যাইবে কেন? ইহার এরূপ কার্য্যের ত কোনরূপ কারণ বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। আর যেরূপ স্থানে ঐ ব্যক্তি আঘাতিত হইয়া পড়িয়াছিল বলিতেছে, সেইরূপ স্থানে ত উহাকে প্রাপ্ত হওয়া যায় নাই, সে স্থানই বা কোথায়? তাহার জ্ঞান হইলে সে আমাদিগকে যাহা বলিয়াছিল, তদ্ব্যতীত আমাদিগের সন্দেহ দূর করিবার মানসে তাহাকে নিম্নলিখিত আরও কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করিলাম।
আমি। যে স্ত্রীলোকটির সহিত তুমি গমন করিয়াছিলে, ইহার পূর্ব্বে তাহাকে আর কখন দেখিয়াছ কি?
কর্ম্মচারী। না, ইতিপূর্ব্বে তাহাকে আমি আর কখন দেখি নাই।
আমি। যে স্থানে তিনি তোমাকে তাহার গাড়ী হইতে নামাইয়া দিয়াছিলেন, ইতিপূর্ব্বে তুমি আর কখন সেইস্থানে গমন কর নাই?
কৰ্ম্মচারী। না, সেইস্থান ইতিপূর্ব্বে আমার জীবনে আর কখন দেখি নাই।
আমি। ঐ স্থান দেখিলে পুনরায় চিনিতে পারিবে কি?
কৰ্ম্মচারী। তাহাও আমি ঠিক বলিতে পারিতেছি না।
আমি। গড়ের মাঠ তুমি চেন?
কৰ্ম্মচারী। খুব চিনি। গড়ের মাঠ দিয়া প্রায়ই আমাকে যাতায়াত করিতে হয়।
আমি। যে স্থানে তুমি আঘাত প্রাপ্ত হও, সেইস্থানটি গড়ের মাঠের মধ্যস্থিত কোন স্থান, কি তাহার নিকটবর্ত্তী কোন স্থান নয় তো?
কর্ম্মচারী। না। উহা গড়ের মাঠও নহে বা তাহার নিকটবর্তী কোন স্থানও নহে।
আমি। যে তোমার মস্তকে আঘাত করে, তাহাকে দেখিলে চিনিতে পারিবে?
কর্ম্মচারী। না, তাহা পারিব না। তাহাকে তো আমি ভাল করিয়া দেখিতে সমর্থ হই নাই!
আমি। তাহারা কয়জন ছিল, তাহা তুমি বলিতে পার?
কর্ম্মচারী। না, তাহাও আমি বলিতে পারি না। সেই গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে আমি কাহাকেও দেখিতে পাই নাই।
আমি। যে সময় তুমি আঘাতিত হইয়া অচৈতন্য অবস্থায় পতিত হও, সেই সময় সমস্ত অলঙ্কারগুলি তোমার নিকটেই ছিল, ইহা তোমার বেশ মনে আছে?
কর্ম্মচারী। তাহা আমার ঠিক স্মরণ আছে, গাড়ীতে উঠিবার পর হইতেই ঐ অলঙ্কার আমি কাহারও হস্তে প্রদান করি নাই।
আমি। তুমি কি করিয়া বলিতে পার যে, তোমাকে গাড়ী হইতে নামাইয়া দিবার পূর্ব্বে অলঙ্কারগুলি সেই স্ত্রীলোকটি আত্মসাৎ করে নাই?
কর্ম্মচারী। তাহা আমি বেশ বলিতে পারি। কারণ, অলঙ্কারগুলি আমি গাড়ীর ভিতর রাখিয়া দেই নাই। উহা আমার চাদরে বাঁধিয়া আমার বগলের নীচে করিয়া রাখিয়াছিলাম ও সেইরূপ অবস্থাতেই আমি গাড়ী হইতে অবতরণ করি। যখন আমি চলিতে আরম্ভ করি, সেই সময়ও আমি উহা আমার বগলের নীচে ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলাম, ইহা আমার বেশ মনে আছে।
এরূপ অবস্থায় ঐ ব্যক্তিকে আর অধিক কথা জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন হইল না। কিন্তু এখন বিশেষরূপ চিন্তা করিয়া দেখা উচিত যে, কি কারণে বা কিরূপ ষড়যন্ত্রের বশবর্তী হইয়া ঐরূপ অবস্থায় সেই স্ত্রীলোকটি উহাকে তাহার গাড়ী হইতে নামাইয়া দিল। আরও আমাদিগের স্থির করা কর্তব্য যে, যে ময়দানে উহাকে আঘাতিত অবস্থায় প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছিল, সেই ময়দান কি অপর কোন স্থানে এইরূপ ঘটনা ঘটিয়াছে। আর যদি অপর কোন স্থানে তিনি আঘাতিত হইয়া থাকেন, তাহা হইলে সেই স্থানটিই বা কোথায়, এবং কাহাদিগের দ্বারা এই কার্য্য সাধিত হইল ও অলঙ্কারগুলিই বা কোথায় গেল?
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
সেই আঘাতপ্রাপ্ত লোকটির নিকট হইতে যাহা অবগত হইলাম, তাহাতে বেশ অনুমান হইল যে, এই মোকদ্দমা কিনারা হইবার কোনরূপ উপায়ই নাই। কাহার দ্বারা তিনি আঘাতিত হইয়াছেন, কাহার দ্বারা তাঁহার অলঙ্কারগুলি অপহৃত হইয়াছে, তাহার কিছুই তিনি বলিতে পারেন না। কেবলমাত্র সেই স্ত্রীলোকটিকে তিনি দেখিলে চিনিতে পারিবেন সত্য, কিন্তু যদি তাহাকে পাওয়া যায়, তাহা হইলেই বা এই মোকদ্দমা তাহার উপায় কি প্রকারে প্রমাণ করিতে সমর্থ হইব? তিনি অলঙ্কারগুলির সহিত উহাকে তাঁহার গাড়ীতে করিয়া আনিয়াছেন সত্য, কিন্তু অলঙ্কারগুলি তাহার নিকট হইতে না লইয়াই তিনি উহাকে তাঁহার গাড়ী হইতে নামাইয়া দিয়া চলিয়া গিয়াছেন; এবং যদি তাঁহার নিকট অলঙ্কারগুলি প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহা হইলেই যদি তাঁহার দণ্ড হয়, নতুবা তাঁহাকে দণ্ডিত করা নিতান্ত সহজ হইবে না। সে যাহা হউক, এখন দুইটি বিষয়ের উপর লক্ষ্য রাখিয়া আমাদিগকে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে হইবে। প্রথম সেই স্ত্রীলোকটি কে, ও দ্বিতীয় অলঙ্কারগুলি কোথায় গেল।
মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া সর্ব্বপ্রথমেই আমার মনে যে সন্দেহ আসিয়া উদিত হইয়াছিল, সেই সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া সুশীলার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলাম। যে কৰ্ম্মচারীকে তাহার অনুসন্ধানের নিমিত্ত ইতিপূর্ব্বে চন্দননগরে প্রেরণ করিয়াছিলাম, তাহাকে সঙ্গে লইয়াই আমি পুনরায় চন্দননগরে গমন করিলাম।
ঐ স্থানে গমন করিয়া সেই কৰ্ম্মচারী আমাকে ঐ স্ত্রীলোকটির বাড়ী দেখাইয়া দিল। ঐ বাড়ীতে কেবল দুইজান মাত্র চাকরকে দেখিতে পাইলাম, কিন্তু তাহাদিগের মনিবকে সেইস্থানে দেখিতে পাইলাম না বা ব্রুহেম বা অপর কোন প্রকার গাড়ী বা ঘোড়া থাকিবার স্থানও সেই বাড়ীতে খুঁজিয়া পাইলাম না। অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম, তাহার গাড়ী গোড়া কিছুই নাই। কোন স্থানে যাতায়াত করিতে হইলে ভাড়াটিয়া গাড়ীর আশ্রয় অবলম্বন করিতে হয়। ঐ বাড়ীর চাকরদ্বয় বা সেই স্থানের অপর কোন লোক ঐ স্ত্রীলোকটির নাম বলিতে পারিল না। সকলেই কহিল, উনি ঐ স্থানে মেমসাহেব নামে পরিচিত, তিনি বাঙ্গালীর কন্যা, কিন্তু থাকেন মেমসাহেবের ধরণে,—কোনরূপ জাতি বিচার নাই। তিনি হিন্দু, কি মুসলমান, কি খ্রীষ্টান, তাহা এ পর্যন্ত কেহই স্থির করিয়া উঠিতে পারে নাই। যখন বাড়ীর ভিতর থাকেন, তখন তিনি হিন্দু স্ত্রীলোকদিগের ন্যায় পোষাক পরিধান করেন। বাহিরে যাইবার সময় সেই পোষাক রূপান্তর ধারণ করে। আহারীয় প্রস্তুত করিবার নিমিত্ত মুসলমান বাবুরচি নিযুক্ত আছে, অথচ যে সকল খাদ্য মুসলমানও স্পর্শ করে না, সেই সকল দ্রব্য ভিন্ন তাহার আহার হয় না। তিনি প্রায়ই ঘরে বসিয়া থাকেন না, প্রায়ই বাহিরে গমন করেন, কিন্তু কোথায় যে গমন করেন, তাহা কেহ বলিতে পারে না, এবং সময় সময় একাদিক্রমে দশ পনের দিবস পৰ্য্যন্ত প্রত্যাগমনও করেন না। এ পর্যন্ত কেহ তাঁহাকে কোনরূপ কার্য্য করিতে দেখে নাই, ও কিরূপে যে তিনি তাঁহার খরচপত্র নির্ব্বাহ করেন, তাহাও কেহ বলিতে পারে না, এবং এখন যে তিনি কোথায়, তাহাও কেহ অবগত নহে। তিনি যে দিবস হইতে ঐ স্থানে প্রত্যাগমন করেন নাই, তাহা জানিতে পারিলাম, ও হিসাব করিয়া বুঝিতে পারিলাম, যে দিবস হইতে বড়বাজারের সেই জহুরি প্রতারিত হইয়াছে, সেইদিবস হইতে তিনিও চন্দননগরে পদার্পণ করেন নাই। আরও জানিতে পারিলাম, তাঁহার ঐ বাটীতে ভদ্রলোকের প্রায় সমাগম হইত না। যাহারা সময় সময় আসিত, তাহাদিগকে দেখিয়া অনুমান হয়, তাহারা নিতান্ত নীচবংশসম্ভূত সামান্য লোক। তাহারা যে কেনরূপ ভাল কার্য্য করিয়া দিনযাপন করিয়া থাকে, তাহাও তাহাদিগকে দেখিয়া অনুমান হয় না। উহাদিগের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোকদিগকেই দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু তাহারা যে কে বা তাহাদিগের বাসস্থানই বা কোথায়, তাহা কিছুই জানিতে পারা গেল না। এই সমস্ত অবস্থা অবগত হইয়া আমরা সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিতেছি, এরূপ সময় দেখিলাম, দুইজন মুসলমান সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। উহাদিগকে দেখিয়া আমরাও সেইস্থানে একটু স্থিরভাবে দাঁড়াইলাম। আমাদিগের ইচ্ছা যদি কোন প্রকারে অবগত হইতে পারি, যে উহারা কাহারা, কোথায় উহাদিগের বাসস্থান ও কি কার্য্যের নিমিত্তই বা উহারা এই স্থানে আগমন করিয়াছে।
ঐ বাড়ীতে যে একটি মুসলমান চাকরের সহিত আমাদিগের কথাবার্তা হইয়াছিল, দেখিলাম, ঐ মুসলমানদ্বয় ঐ বাটীর ভিতর প্রবেশ করিয়া তাহারই সহিত কথা আরম্ভ করিল। উহাদিগের মধ্যে যে সকল কথাবার্তা হইল, তাহা সমস্তই হিন্দিতে। উহার মর্ম্ম এইস্থানে প্রদত্ত হইল।
মুসলমান। মেমসাহেব আসিয়াছেন?
চাকর। না, আজ পর্যন্ত ফিরিয়া আসেন নাই, কোথায় তিনি গমন করিয়াছেন?
মুসল। তিনি কোথায় গিয়াছেন, তাহা তোমরা জান না?
চাকর। তাহা ত আমরা জানি না।
মুসল। কেন, যাইবার সময় তিনি কিছু বলিয়া যান নাই?
চাকর। না।
মুসল। কবে আসিবেন, তাহা কিছু বলিয়া গিয়াছেন?
চাকর। না, যেমন প্রত্যহ বাহির হইয়া যান, সেইরূপ বাহির হইয়া গিয়াছেন; কিন্তু আজ পর্য্যন্ত আর প্রত্যাগমন করেন নাই। তিনি যে স্থানে গমন করিয়াছেন, তাহা ত তুমি অবগত আছ। এইরূপে তিনি যখন বাহিরে গমন করিয়া থাকেন, তখন তো তুমি প্রায়ই তাঁহার সহিত গমন করিয়া থাক।
মুসল। আমি সকল সময় তাঁহার সহিত বাহিরে গমন করি না, কেবল একবারমাত্র গমন করিয়াছিলাম।
চাকর। সেবার কোথায় কোথায় গমন করিয়াছিলে?
মুসল। সেবার কেবলমাত্র বেনারসেই গমন করি। সেইস্থানে ৭/৮ দিবস থাকিয়াই পুনরায় প্রত্যাগমন করি।
চাকর। বাহিরে যাইবার সময় আমাদিগের মধ্যস্থিত কোন চাকরই তো তাঁহার সহিত গমন করে না, ইহাতে তাঁহার কোনরূপ কষ্ট হয় না?
মুসল। হাতে টাকা থাকিলে কি আর কখন কাহার কষ্ট হয়। যখন যে হোটেলে গমন করেন, তখন সেই হোটেলেই রাজার ন্যায় অবস্থান করেন।
চাকর। বাহিরে গিয়া তবে ইনি হোটেলেই থাকেন?
মুসল। হাঁ, হোটেল ভিন্ন অন্য দেশে অপরিচিতের থাকিবার সুবিধা আর কোথা হইতে পারে।
চাকর। আমার মনিব মধ্যে মধ্যে বাহিরে যান কেন, বাহিরে কোনরূপ কারবার আছে কি? এখানে তো আমরা তাহার কিছুই বুঝিতে পারি না।
মুসল। কাৰ্য্য না থাকিলে কি আর কেহ আপন ঘরবাড়ী ছাড়িয়া কষ্ট সহ্য করিতে বাহিরে গমন করিয়া থাকেন? অবশ্য কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে গমন করিয়া থাকেন।
চাকর। বাহিরে আমার মনিবের কি কাৰ্য্য আছে?
মুসল। ঠিক কি কাৰ্য্য, তাহা আমি বলিতে পারি না। তবে এইমাত্র বলিতে পারি যে, বিনাকার্য্যে কি কেহ কখন বাহিরে গমন করিয়া থাকেন।
চাকর। সে যাহা হউক, আমার মনিব কবে প্রত্যাগমন করিবেন, তাহার কিছু বলিতে পার কি?
মুসল। আজি কালি আসিবার কথা আছে, আমি ভাবিয়াছিলাম, তিনি আসিয়াছেন, তাই তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিলাম।
চাকর। আজি কালি তিনি আসিবেন, একথা তুমি জানিলে কি প্রকারে? তিনি কি তোমাকে কোনরূপ পত্রাদি লিখিয়াছেন?
মুসল। তিনি আমাকে পত্রাদি লেখেন নাই, তবে আমি জানি, যাইবার সময় তিনি আমাকে বলিয়া গিয়াছিলেন।
চাকর। তাহা হইলে তিনি যে কোথায় গমন করিয়াছেন, তাহাও তুমি অবগত আছে?
মুসল। তাহা আমি অবগত নহি। তবে এই মাত্র জানি যে, তিনি পশ্চিমে গমন করিয়াছেন, এবং আজ কালের মধ্যে তিনি প্রত্যাগমন করিবেন।
চাকর। এবার তুমি তাঁহার সহিত গমন কর নাই, তিনি একাকী গিয়াছেন, কি অপর আর কোন ব্যক্তি তাঁহার সহিত গমন করিয়াছেন?
মুসল। তাহা আমি বলিতে পারি না। কিন্তু তিনি যে একাকী গমন করিবেন, তাহা আমার বোধ হয় না, কেহ না কেহ তাঁহার সহিত গমন করিয়া থাকিবে। সে যাহা হউক, আজ আমি চলিলাম, তিনি প্রত্যাগমন করিলে দুই এক দিবস পরে আসিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিব।
এই বলিয়া উহারা সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল। উহারা কে, কোথা হইতে উহারা এইস্থানে আগমন করিয়াছে ও মেমসাহেবের সহিত উহাদিগের সংশ্রবই বা কি আছে, তাহা গোপন ভাবে অনুসন্ধান করিবার মানসে আমার সমভিব্যাহারী সেই পশ্চিমদেশীয় কৰ্ম্মচারীকে তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ প্রেরণ করিলাম।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
পূৰ্ব্ববর্ণিত মুসলমানদিগের কথা শুনিয়া আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম, মেমসাহেবের সহিত উহাদিগের বেশ পরিচয় আছে, আর যদি তিনিই ঐ কাজের কাজি হন, তাহা হইলে এই সকল ব্যক্তিই তাঁহার পারিষদ। আরও বুঝিতে পারিলাম, তিনি পশ্চিম প্রদেশে গমন করিয়াছেন। যদি তাঁহার দ্বারাই ঐ কার্য্য হইয়া থাকে, তাহা হইলে এই সময় তাঁহার হঠাৎ পশ্চিম প্রদেশে গমন করার উদ্দেশ্য ঐ সকল অলঙ্কার বিক্রয় ভিন্ন আর কি হইতে পারে? দুই এক দিবসের মধ্যেই তাঁহার প্রত্যাগমনের কথা আছে। যদি তিনি ঐ সকল অলঙ্কার বিক্রয় করিবার মানসে পশ্চিম গমন করিয়া থাকেন, তাহা হইলে ঐ সকল অলঙ্কার বিক্রয় করিয়া যে টাকা পাইবেন, তাহা লইয়া যে প্রত্যাগমন করিবেন, তদ্বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। এরূপ অবস্থায় চন্দননগরের বাহিরে যদি তাঁহাকে ধরিতে পারি, তাহা হইলেই সুবিধা হয়। কারণ, চন্দনগরের মধ্যে তাঁহাকে ধৃত করিতে হইলে প্রথমতঃ ইংরাজ গবর্ণমেন্টের পৃথক আদেশ লইয়া চন্দনননগরের পুলিসের সাহায্য গ্রহণ করিতে হইবে এবং তাহাদিগের রাজত্বের ভিতর উহাকে ধরিতে হইলে ওয়ারেন্টের প্রয়োজন। সেই ওয়ারেন্টই বা কোথায় পাইব? প্রমাণাদির দ্বারা উহাকে দোষী সাব্যস্ত করিতে না পারিলে, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব উহার বিপক্ষে আইন অনুসারে ওয়ারেন্ট বাহির করিতে পারিবেন না। অথচ যে পৰ্য্যন্ত উহাকে দেখিতে পাওয়া না যায়, সেই পর্য্যন্তই বা কিরূপে বলিতে পারিব যে, এই মেমসাহেবের দ্বারা ঐ কার্য্য সম্পন্ন হইয়াছে। তাঁহাকে দেখিয়া ঐ জহুরি বা তাঁহার কর্ম্মচারীগণ যদি চিনিতে পারে, তাহার পর তাহাদিগের সাক্ষ্য দ্বারা উহার নামে ওয়ারেন্ট বাহির হইতে পারে। কিন্তু এত সময় পাইলে তাহার নিকট কি কোনরূপে অপহৃত দ্রব্য না নগদ অর্থ প্রাপ্ত হইবার সম্ভাবনা থাকে, কখনই নহে। মনে মনে এইরূপ নানাপ্রকার ভাবিয়া যাহাতে তাহাকে চন্দননগরের বাহিরে ইংরাজ রাজত্বের মধ্যে ধৃত করিতে পারি, তাহারই উপায় চিন্তা করিতে লাগিলাম। পশ্চিম হইতে বা কলিকাতা হইতে রেলগাড়ীতে আসিতে হইলে চন্দননগর রেলওয়ে স্টেসনে গাড়ী হইতে অবতরণ করিতে হয়, ইহা সকলেই অবগত আছেন। আরও বোধ হয়, সকলেই অবগত আছেন যে, ঐ চন্দননগর রেলওয়ে ষ্টেসন ইংরাজ রাজত্বের অন্তর্ভূত। সুতরাং ইহাই স্থির করিলাম যে, তাহাকে যদি ধরিবার প্রয়োজন হয়, তাহা হইলে রেলওয়ে ষ্টেশনের মধ্যে তাহাকে ধরিতে পারিলেই চন্দননগরের ভিতর ধৃত করিবার গোলযোগ হইতে নিষ্কৃতি লাভ করা যাইতে পারে। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সেই স্ত্রীলোকটিকে যাহারা সেই জহুরির দোকানে দেখিয়াছিল, তাহাদিগের একজনকে সঙ্গে লইয়া ঐ রেলওয়ে ষ্টেসনে অবস্থিতি করিতে লাগিলাম। উভয়দিক হইতে যে সকল গাড়ী থামিতে লাগিল, তাহা দেখিতে লাগিলাম। দেখিতে লাগিলাম যে, ঐ সকল গাড়ী হইতে পূৰ্ব্বকথিত মেমসাহেব ঐ স্থানে অবতরণ করেন কি না?
এইরূপে দুইদিবসকাল ঐ চন্দননগর রেলওয়ে ষ্টেসনে অবস্থিতি করিবার পর পশ্চিমের মেলগাড়ীতে ঐ মেমসাহেব আসিয়া সেই ষ্টেসনে অবতরণ করিলেন। আমার সহিত জহুরির যে লোক ছিল, সে ঐ মেমসাহেবকে দেখিবামাত্রই কহিল, এই স্ত্রীলোকটিই তাহাদিগের দোকানে গমন করিয়াছিল, এবং তাহারই সহিত তাহাদিগের দোকানের প্রধান কর্মচারী অলঙ্কার লইয়া গমন করিয়াছিল।
এই কথা বলিবামাত্র আমি তাহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়াই একেবারে তাহাকে সেই রেলওয়ে ষ্টেসনের প্লাটফারমের উপর ধরিয়া ফেলিলাম। এইস্থানে অনেক পাঠক মনে করিতে পারেন যে, তাহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া একেবারে তাহাকে গ্রেপ্তার করার উদ্দেশ্য কি? রেলওয়ে ষ্টেসনের বাহির হইতেই ফরাসীদিগের রাজত্ব আরম্ভ হইয়াছে, উহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলেই যদি তাহার মনে কোনরূপ সন্দেহের উদয় হয় ও যদি তিনি ধৃত হইবার পূর্ব্বে ষ্টেসনের বাহির হইয়া ফরাসী রাজত্বের মধ্যে পদার্পণ করেন, তাহা হইলে তাঁহাকে ধৃত করা নিতান্ত সহজ হইবে না। অথচ সময় পাইলে তাঁহার নিকট যদি কিছু থাকে, তাহা তিনি অনায়াসেই হস্তান্তর করিতে সমর্থ হইবেন। সুতরাং তাঁহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া বা তাঁহাকে রেলওয়ে ষ্টেসনের বাহিরে গমন করিবার কোনরূপ সুযোগ প্রদান না করিয়া, তাঁহাকে সেইস্থানে ধৃত করিলাম। তাঁহাকে ধরিবার সময় তিনি ভয়ানক গোলযোগ করিয়া উঠিলেন, কিন্তু তাঁহার দিকে আমরা কিছুমাত্র দৃষ্টিপাত না করিয়া যাহাতে তিনি কোনরূপে ষ্টেসনের বাহিরে গমন করিতে সমর্থ না হন, তাহার উত্তমরূপ বন্দোবস্ত করিয়া পরিশেষে তাঁহাকে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার নাম কি মেমসাহেব?”
স্ত্রীলোক। আমার নামে আপনার প্রয়োজন কি? সম্ভ্রান্ত স্ত্রীলোককে এইরূপে অবমাননা করিলে, পরিশেষে তাহার পরিণাম কি হইবে, তাহা আপনি জানেন কি?
আমি। খুব জানি। বিশেষ আপনি যেরূপ সম্ভ্রান্ত স্ত্রীলোক, তাহাও আমি উত্তমরূপে অবগত আছি। এখন আপনি আমার কথার উত্তর প্রদান করিবেন কি না, অনুগ্রহ করিয়া তাহাই বলুন? আপনার কথার উত্তর পাইলেই আমার বিবেচনা মত কাৰ্য্য করিব।
স্ত্রীলোক। আপনি আমাকে কি কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন?
আমি। প্রথমতই ত আমি আপনার নাম জিজ্ঞাসা করিয়াছি, কিন্তু এখন পর্যন্ত তাহার কোনরূপ উত্তর পাই নাই। পুনরায় জিজ্ঞাসা করিতেছি, আপনার নাম কি?
স্ত্রীলোক। আমার নাম মিস্ সুশীলা।
আমি। পূর্ব্বে আপনি মেহেদিবাগানে থাকিতেন না?
স্ত্রীলোক। সেইস্থানে কিছুদিবস ছিলাম।
আমি। এখন আপনি চন্দননগরে বাস করিতেছেন?
স্ত্রীলোক। হাঁ, এখন আমি চন্দননগরেই থাকি।
আমি। আপনি যে সে দিবস বড়বাজারের একজন জহুরির দোকানে কতকগুলি গহনা খরিদ করিতে গিয়াছিলেন, তাহা কাহার জন্য?
স্ত্রীলোক। কিসের গহনা, আমি ইহার মধ্যে কাহারও দোকানে কোন গহনা খরিদ করিতে যাই নাই। গত এক বৎসরের মধ্যে আমার কোনরূপ অলঙ্কারের প্রয়োজন হয় নাই।
আমি। আপনি কোন জহুরির দোকানে কোন অলঙ্কার খরিদ করিতে গিয়াছিলেন কি না, বা আপনার কোনরূপ অলঙ্কারের প্রয়োজন হইয়াছিল কি না, সেই সকল বিষয় পরে দেখা যাইবে। এখন বলুন দেখি, আজ কয়েক দিবস হইতে আপনি আপনার বাড়ী ছাড়িয়া কোথায় গমন করিয়াছিলেন, এবং কি নিমিত্তই বা গমন করিয়াছিলেন?
স্ত্রীলোক। আমি আমার নিজের কোন কার্য্যের নিমিত্ত কোন স্থানে গমন করিয়াছিলাম। কি কার্য্যের নিমিত্ত যে কোথায় গমন করিয়াছিলাম, তাহা আপনাকে বলিবার আমি কোনরূপ প্রয়োজন দেখি না।
আমি। তাহা হইলে আপনি যে কোথায় এবং কি নিমিত্ত গমন করিয়াছিলেন, তাহা আমাকে বলিতে ইচ্ছা করেন না?
স্ত্রীলোক। না।
আমি। ইচ্ছা করুন বা না করুন, তাহা কিন্তু আপনাকে বলিতে হইবে। এখন না বলুন, সেই সকল কথা বলিবার যখন সময় আসিয়া উপস্থিত হইবে, তখন না বলিয়া আপনি কোনক্রমেই থাকিতে পারিবেন না।
স্ত্রীলোক। কি সময় আসিয়া উপস্থিত হইবে?
আমি। তাহা আপনি পরে জানিতে পারিবেন। এখন বলুন দেখি, আপনার কাছে কি কি অলঙ্কার আছে?
স্ত্রীলোক। কিসের অলঙ্কার?
আমি। সোণার অলঙ্কার, হীরামতি বসান অলঙ্কার।
স্ত্রীলোক। না, আমার নিকট কোন অলঙ্কার নাই।
আমি। নগদ টাকা কতগুলি আছে?
স্ত্রীলোক। আমার নগদ টাকা কি আছে না আছে, তাহার হিসাব আমি দিতে ইচ্ছা করি না।
আমি। তোমার নগদ টাকা কত আছে, সে হিসাব আমি চাহিতেছি না। আমি জানিতে চাহি, তোমার নিকট এখন নগদ টাকা কি আছে?
স্ত্রীলোক। আমি তাহা বলিতে চাহি না।
আমি। এখন আমি তোমাকে যাহাই জিজ্ঞাসা করিতেছি, তাহাই তুমি বলিতে চাহিতেছ না। তুমি এখনও বুঝিতে পার নাই যে, তুমি এখন কিরূপ অবস্থায় পতিত হইয়াছ, এবং ইহার পরিণামই বা কি দাঁড়াইবে?
স্ত্রীলোক। আমি এমন কোন অপরাধ করি নাই, যাহাতে আপনাদিগকে ভয় করিয়া চলিতে হইবে।
ঐ স্ত্রীলোকের নিকট হইতে ঐরূপ উত্তর প্রাপ্ত হইয়া সেই সময় উহাকে আর কোনরূপ কথা জিজ্ঞাসা করা অনাবশ্যক বিবেচনা করিলাম। যখন সে গাড়ী হইতে অবতরণ করে, সেই সময় তাহার নিকট একটি চামড়ার পোর্টমেন্ট, একটি গ্লাডষ্টোন ব্যাগ ও একটি বিছানা ছিল মাত্র। ঐ পোর্টমেন্ট ও বাগের চাবি চাহিলে, সে উহা আমাকে প্রদান করিল না ও কহিল, আমি চাবি দিব না। তবে চাবি ভাঙ্গিয়া উহা দেখিতে ইচ্ছা করিলে, অনায়াসেই করিতে পারেন।
উহার কথা শুনিয়া, উহার উপর একটু ক্রোধের উদয় হইল। তখন তাহাকে ষ্টেসনের মধ্যে যে ঘরে সম্ভ্রান্ত স্ত্রীলোকগণ আসিয়া উপবেশন করে, সেই ঘরের মধ্যে লইয়া গেলাম। ঐ ঘরের স্ত্রীলোকদিগের কার্য্যের নিমিত্ত প্রায়ই একটি মেথরাণী স্ত্রীলোক রেলওয়ে কোম্পানি কর্তৃক নিযুক্ত থাকে। ঐ মেথরাণী স্ত্রীলোকটিকে উহার অঙ্গের কাপড় খুলিয়া উত্তমরূপে তল্লাসি করিয়া দেখিতে কহিলাম। সে প্রথমতঃ ঐ কার্য্য সম্পন্ন করিতে একটু ইতস্ততঃ করিতে লাগিল। কিন্তু পরিশেষে আমি ও সেই ষ্টেসনের ষ্টেসনমাষ্টার তাহাকে বিশেষ করিয়া বুঝাইয়া দিলাম, ইহাতে তাহার কোনরূপ অপরাধ হইবে না; আসামী স্ত্রীলোক না হইলে ঐ কাৰ্য্য আমি আপন হস্তেই সম্পন্ন করিতাম, কিন্তু স্ত্রীলোক বলিয়া সেই কাৰ্য্য আমি স্বহস্তে সম্পন্ন করিতে সমর্থ নহি, তাই অপর স্ত্রীলোক দ্বারা ঐ কার্য্য সম্পন্ন করাইতে হইতেছে। এই কার্য্যও আমাদিগের নিজের কার্য্য নহে, সরকারি কার্য্য; সেও একরূপ সরকারি চাকর, সুতরাং ঐ কার্য্যসম্পন্ন করাও তাহার একরূপ কর্ত্তব্য কর্ম্মের মধ্যে পরিগণিত। এইরূপভাবে উহাকে বুঝাইবার পর, পরিশেষে সে ঐ কাৰ্য্য সম্পন্ন করিতে সম্মত হইল ও সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া উহার বস্ত্রাদির অভ্যন্তরে অনুসন্ধান করিয়া কেবলমাত্র এক গোছা চাবি ও কয়েকটি মুদ্রা আনিয়া আমাদিগের হস্তে প্রদান করিয়া কহিল, ইহা ব্যতীত উহার নিকট আর কিছুই নাই।
সে চাবিগুচ্ছ আনিয়া আমাদিগের হস্তে প্রদান করিলে দেখিলাম, উহার মধ্যে তাহার নিকট যে পোর্টমেণ্ট ও বাগ ছিল, তাহাদের চাবি ইহার মধ্যে আছে। তখন স্ত্রীলোকটিকে সেই ঘরের মধ্য হইতে বাহির করিয়া, ষ্টেসনমাষ্টার ও অপরাপর লোকের সম্মুখে ঐ পোর্টমেন্ট ও ব্যাগ খুলিয়া তাহার ভিতর অনুসন্ধান করিলাম। উহার মধ্যে প্রায় তিন সহস্র টাকার ১০ টাকা হিসাবের নোট ও একখানি গহনা পাওয়া গেল। সেই জহুরির দোকানের যে কর্মচারী আমার নিকট ছিল, ঐ গহনাখানি দেখিবামাত্রই সে কহিল, ইনি যে সকল গহনা লইয়া গিয়াছিলেন, এই গহনাখানি তাহারই একখানি। এরূপ অবস্থায় তাহার উপর আর কোনরূপ সন্দেহই থাকিল না, প্রথমেই যে ট্রেণ পাইলাম, সেই ট্রেণেই উহাকে লইয়া কলিকাতায় গমন করিলাম।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
যে জহুরির দোকান হইতে তিনি অলঙ্কারগুলি লইয়া গিয়াছিলেন, প্রথমেই তাহাকে সেই দোকানে লইয়া গেলাম। জহুরি নিজে ও তাঁহার দোকানের কর্ম্মচারীগণের মধ্যে যে যে ব্যক্তি সেই স্ত্রীলোকটিকে দেখিয়াছিল, তাহারা সকলেই একবাক্যে কহিল যে, ঐ স্ত্রীলোকটিই কোন সম্ভ্রান্ত কৌন্সিলের বনিতা পরিচয়ে ঐ দোকান হইতে অলঙ্কারগুলি লইয়া গিয়াছিল, তাহার নিকট যে একখানি অলঙ্কার পাওয়া গিয়াছিল, তাহা দেখিয়া সকলেই উহা চিনিতে পারিল ও একবাক্যে কহিল, যে সমস্ত অলঙ্কার সে লইয়া গিয়াছিল, ঐ অলঙ্কারখানিও তাহারই মধ্যস্থিত একখানি। ঐ দোকানের প্রধান কর্ম্মচারী যিনি ইহার সহিত ব্রুহেম গাড়ীতে আরোহণ করিয়া অলঙ্কার সহ গমন করিয়াছিলেন, তিনিও উহাকে দেখিবামাত্র চিনিতে পারিলেন, ও উহার নিকট প্রাপ্ত অলঙ্কারখানিও চিনিতে পারিলেন এবং কহিলেন, ইনি যে সকল অলঙ্কার পছন্দ করিয়া লইয়াছিলেন, এই গহনাখানি তাহারই মধ্যস্থিত একখানি।
এই স্ত্রীলোকটি ইহাদিগের সকলের কথা বিশেষ মনোযোগ পূৰ্ব্বক শ্রবণ করিয়াও প্রথমতঃ তিনি যে সেই স্ত্রীলোক নহেন, তিনি কখন গহনা খরিদ করিবার নিমিত্ত ঐ দোকানে আগমন করেন নাই, তাহাই আমাদিগকে বুঝাইবার নিমিত্ত বিশেষরূপ চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কিন্তু যখন দেখিলেন যে, আমরা কিছুতেই তাঁহার কথা বিশ্বাস করিতে পারিলাম না, অথচ বুঝিতে পারিলেন যে, তাঁহার উপর যেরূপ প্রমাণ হইতে লাগিল, তাহাতে দীর্ঘ কারাদণ্ড হইতে কিছুতেই তাঁহার রক্ষা নাই, তখন তিনি প্রকৃত কথা ব্যক্ত করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। কিন্তু তিনি আমাদিগকে কহিলেন যে, যদি আমরা তাঁহাকে এই বিষম অবমাননা হইতে রক্ষা করিতে যত্নবান হইয়া তাঁহাকে ছাড়িয়া দিতে সমর্থ হই, তাহা হইলে প্রকৃত কথা বলিয়া তিনি যে আমাদিগকে সম্পূর্ণরূপে সাহায্য করিতে প্রস্তুত তাহা নহে; যেরূপভাবে ও যাহাদিগের দ্বারা এই কার্য হইয়াছে, তিনি তাহার সমস্ত কথা প্রকাশ করিয়া ও তাহাদিগকে ধরাইয়া দিতে প্রস্তুত আছেন।
আমরা তাঁহার উপর যতদূর প্রমাণ সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়াছি, তাহাতে তিনি যে কোনরূপে নিষ্কৃতিলাভ করিতে সমর্থ হইবেন, তাহা আমাদিগের অনুমান হয় না। সুতরাং তাঁহার এই বিপদ হইতে যে আমরা তাঁহাকে উদ্ধার করিতে সমর্থ হইব তাহারও কোনরূপ সম্ভাবনা নাই; অথচ এই ঘটনার সমস্ত অবস্থা জানিয়া লওয়াও আমাদিগের কর্তব্যকর্ম্মের একটি প্রধান কার্য্য। এরূপ অবস্থায় কি করা যাইতে পারে, তাহা আমাকে বিশেষরূপ চিন্তা করিতে হইল। পরিশেষে আমি তাহাকে কহিলাম, “তোমার তো কারাবাস নিশ্চয়ই। তবে যদি তুমি আমাদিগকে বিশেষরূপ সাহায্য করিতে প্রস্তুত হইয়া সমস্ত অবস্থা আমাদিগের নিকট বিবৃত কর, এবং ঐ দলস্থিত সমস্ত লোককে ধরাইয়া দিতে সমর্থ হও, তোমাকে এই মোকদ্দমায় রাজার পক্ষীয় প্রধান সাক্ষীতে পরিণত করিয়া এ যাত্রা যদি তোমাকে অব্যাহতি দিতে সমর্থ হই, তাহার চেষ্টা করিব। কিন্তু তোমার কর্তব্য কার্য্য—এখন সমস্ত অবস্থা আমাদিগের নিকট প্রকাশ করা। সুশীলা অনেক দিবস হইতে কোন কৌন্সিলের অন্নে প্রতিপালিত হইয়াছিল, সুতরাং সময় সময় অনেক মাম্লা মোকদ্দমার কথা তাঁহার নিকট শুনিতে পাইত। আরও শুনিতে পাইত, দুইজনে হত্যা করিয়া তাহাদিগের মধ্যে একজন সমস্ত কথা স্বীকার করতঃ রাজার পক্ষ হইতে সাক্ষী হইয়া নিজের জীবন রক্ষা করিয়াছে। বহুজনে মিলিত হইয়া ডাকাতি করিয়া পরিশেষে যে ডাকাতের সর্দ্দার, সেই সমস্ত কথা বলিয়া দিয়া তাহার দলস্থিত ডাকাইতকে ধরাইয়া দিয়া নিজে নিষ্কৃতিলাভ করিয়াছে। এই সকল কথা তাহার মনে উদিত হওয়ায় অনেক চিন্তা করিয়া, পরিশেষে সে আমাদিগের প্রস্তাবে সম্মত হইল এবং কহিল, যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, তাহার সমস্তই আমি আপনাদিগকে বলিতেছি ও যাহার যাহার দ্বারা এই সকল কার্য্য হইয়াছে, তাহাদিগকেও যেরূপে হউক, আমি ধরাইয়া দিয়া আপনাদিগকে সম্যকরূপে সাহায্য করিব, ইহাতে আপনাদিগের বিবেচনায় পরিশেষে যাহাই হয়, তাহাই করিবেন। এই কথা বলিয়া সে বলিতে আরম্ভ করিল-
“আমি যে সময়ে মেহেদিবাগানে বাস করিতাম, সেই সময় হইতে চারি পাঁচজন নিম্নশ্রেণীর লোকের সহিত আমার জানা শুনা হয়। সেই সময় আমার অবস্থা ভাল ছিল, কোন উচ্চ পদস্থ ব্যক্তির দ্বারা আমি প্রতিপালিত হইতাম, তাঁহারই সহিত ঐ সকল ব্যক্তি সময় সময় আমার বাড়ীতে আসিত। সেই সময় হইতেই তাহাদিগের সহিত আমার জানা শুনা হয় মাত্র; কিন্তু তাহাদিগের সহিত আমি কোনরূপে মিলিত হই না। ইহার পরই আমার অবস্থার পরিবর্তন ঘটে, আমিও মেহেদিবাগানের বাসা পরিত্যাগ করিয়া, চন্দননগরে আমার বাসস্থান স্থাপিত করি। ইহার কিছুদিবস পরেই উহারা আমার নিকট সেইস্থানে গমন করিয়া আমাকে নানারূপ প্রলোভিত করিতে আরম্ভ করে। প্রথমতঃ আমি তাহাদিগের প্রস্তাবে কোনরূপেই সম্মত হই নাই, কিন্তু ক্রমে তাঁহারা আমাকে নানারূপ প্রলোভন দেখাইতে আরম্ভ করে। আমার অবস্থা সেই সময় ভাল ছিল না, আর্থিক কষ্ট আমাকে বিশেষরূপে সহ্য করিতে হইতেছিল, সুতরাং আমার নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমি তাহাদিগের প্রস্তাবে ক্রমে সম্মত হই। তাহাদিগের পরামর্শমতে আমি বড়বাজারের জহুরির দোকানে গমন করি, এবং কোন একজন এদেশীয় প্রধান কৌন্সিলের বনিতা বলিয়া পরিচয় প্রদান পূর্ব্বক তাহার দোকান হইতে বাছিয়া বাছিয়া কতকগুলি বহুমূল্য অলঙ্কার গ্রহণ করিয়া, আমার স্বামীকে দেখাইয়া তাহার মূল্য প্রদান করিব বলিয়া উহা গ্রহণ করি। আমার বিশ্বাস ছিল, যাঁহাকে আমার স্বামী বলিয়া পরিচয় প্রদান করিয়াছিলাম, তাঁহার নাম শুনিয়া উহারা ঐ সকল অলঙ্কার অনায়াসেই আমার হস্তে প্রদান করিবে, কিন্তু দেখিলাম, আমার সেই অভিসন্ধি কোনরূপেই কার্য্যে পরিণত হইল না। ঐ জহুরি বিশ্বাস করিয়া ঐ সকল অলঙ্কার কিছুতেই আমার হস্তে প্রদান করিল না। সে ঐ সকল অলঙ্কার তাহার একজন বিশ্বাসী কর্ম্মচারীর হস্তে প্রদান করিয়া তাঁহাকে আমার সহিত পাঠাইয়া দিল। আমি ব্রুহেম গাড়ীতে করিয়া ঐ দোকানে গমন করিয়াছিলাম, ভাবিয়াছিলাম, যে ব্যক্তি গহনা লইয়া আমার সহিত গমন করিতেছে, তাহাকে আমার গাড়ীতে আমার পার্শ্বে বসাইয়া লইব, এবং আমাদিগের ঈশ্বরদত্ত বাণ তাহার উপর নিক্ষেপ করিয়া তাহার হস্ত হইতে অলঙ্কারগুলি কোন গতিকে আত্মসাৎপূর্ব্বক তাহাকে গাড়ী হইতে নামাইয়া দিব, এই ভাবিয়া তাহাকে অপর গাড়ীতে আরোহণ করিতে না দিয়া আমার নিজের গাড়ীতে আমার পার্শ্বে বসাইয়া লইলাম। যাইবার সময় তাহাকে অনেক রূপে চেষ্টা করিয়া দেখিলাম, কিন্তু কোনরূপ প্রলোভনেই তাহাকে ভুলাইয়া অলঙ্কারগুলি হস্তগত করিতে সমর্থ হইলাম না। এখন অনন্যোপায় হইয়া সেই সকল লোক যেখানে আমার অপেক্ষায় বসিয়াছিল, সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম।
আমি। সেই স্থানটি কোথায়?
স্ত্রীলোক। আলিপুরের জজসাহেবের কাছারির পূর্ব্বদিকে যে স্থানে হেষ্টিংস হাউস নামক একটি প্রকাণ্ড বাড়ী জঙ্গলের ভিতর খালি অবস্থায় পড়িয়াছিল, সেইস্থানে। আজকাল ঐ স্থানের যেরূপ অবস্থা দেখিতেছেন, তখন ঐ স্থানের অবস্থা সেই রূপ ছিল না। এখন যে একটি নূতন রাস্তা বাহির হইয়া ঐ স্থানের অবস্থা পরিবর্তন করিয়া দিয়া বড় বড় ইংরাজদিগের বাসস্থান হইয়াছে, তখন ঐ স্থানের অবস্থা এইরূপ ছিল না। রাত্রিকালের কথা দূরে থাকুক, দিবাভাগেও ঐ স্থানে কাহারও একাকী যাইতে সাহস হইত না। ঐ হেষ্টিংস হাউসের প্রকাণ্ড ময়দানেই ঐ সমস্ত লোক প্রায়ই বসিত, কোনরূপ দুষ্কার্য্য করিতে হইলে ঐ স্থানেই তাহার মন্ত্রণাদি সম্পন্ন হইত।
আমি। ঐ স্থানে যাইবার পর কি হইল?
স্ত্রীলোক। ঐ স্থানে গমন করিয়া আমার গাড়ী থামাইয়া জহুরির কর্ম্মচারীকে ঐ স্থানে নামাইয়া দিলাম। অলঙ্কারগুলি তাহার নিকটেই রহিল, আমার গাড়ীর সহিস ও কোচমানও আমাদিগের দলস্থিত লোক ছিল। উহারা সমস্তই পূৰ্ব্ব হইতে দেখিয়াছিল, এবং সমস্তই জানিত, তথাপি সহিসকে একটু টিপিয়া দিয়া কোচমানের দিকে ইঙ্গিত করিবামাত্রই সে আমার গাড়ী লইয়া, একটু দূরে গমন করিল। সহিস সেই স্থানেই থাকিয়া তাহার দলস্থিত অপর ব্যক্তিগণ যাহারা সেইস্থানে অপেক্ষা করিতেছিল, তাহাদিগকে এই সংবাদ প্রদান করিল ও কহিল, অলঙ্কারগুলির সহিত ঐ ব্যক্তিকে ঐ স্থানে গাড়ী হইতে নামাইয়া দেওয়া হইয়াছে। এই সংবাদ পাইবামাত্র উহারা আসিয়া পথিমধ্যে তাহাকে আক্রমণ করিল ও উহাদিগের মধ্যে কোন ব্যক্তি উহাকে প্রহার করিবামাত্র সে অচৈতন্য অবস্থায় সেইস্থানে পড়িয়া গেল। সেই সময় তাহার নিকট হইতে সমস্ত অলঙ্কারগুলি অপহরণ করা হইল, আমিও পুনরায় সেইস্থানে ফিরিয়া আসিলাম ও দেখিলাম, ঐ ব্যক্তি নিতান্ত আঘাতিত হইয়া অচৈতন্য অবস্থায় রহিয়াছে। তখন আমরা মনে করিলাম, ঐ ব্যক্তি যদি এইস্থানে মরিয়াই যায়, তাহা হইলে এই স্থানেই পুলিস আসিয়া অনুসন্ধান করিবে। আর এইস্থানের কোন লোক যদি কোন গতিকে আমাদিগকে দেখিয়াই থাকে, তাহা হইলে সেই কথা প্রকাশ পাইলেও পাইতে পারে। সুতরাং এইস্থান হইতে উহাকে স্থানান্তরিত করা নিতান্ত প্রয়োজন। কারণ, যে স্থানে উহাকে পাওয়া যাইবে, সেই স্থানেই পুলিস তাহার অনুসন্ধান করিবে, তাহা হইলে পুলিস এইস্থানের আভাস মাত্রও প্রাপ্ত হইবে না। মনে মনে এইরূপ চিন্তা করিয়া আমরা তাহাকে আমার সেই গাড়ীতে উঠাইয়া লইয়া গড়ের মাঠের একস্থানে ফেলিয়া দিলাম। পরিশেষে গহনাগুলি আমি গ্রহণ করিয়া একেবারে আগ্রায় গমন করিলাম। কারণ, আমি জানিতাম, ঐ স্থানে অপহৃত দ্রব্য বিক্রয় করিবার যেরূপ সুবিধা হইবে, সেইরূপ সুবিধা কলিকাতার মধ্যে কোন রকমেই হইবার সম্ভাবনা নাই। সুতরাং আমি আর চন্দননগরে গমন না করিয়া একেবারেই আগ্রায় গমন করিলাম। সেইস্থানে হোটেলে অবস্থান করিয়া ক্রমে ক্রমে সমস্ত অলঙ্কারগুলি বিক্রয় করিয়া ফেলিলাম, কেবলমাত্র একখানি গহনা আমার নিকট রহিয়া গেল। ঐ অলঙ্কারখানি বিক্রয় করা সম্পূর্ণরূপ আমার ইচ্ছা ছিল না। ইচ্ছা করিয়াছিলাম, যদি কোনরূপে গোলযোগ না ঘটে, তবে আমার দলস্থিত সমস্ত লোককে ফাঁকি দিয়া ঐ অলঙ্কারখানি আমি নিজে ব্যবহার করিব। এইরূপে অলঙ্কারগুলি বিক্রয় করিয়া আমি যেমন প্রত্যাগমন করিলাম, অমনি আপনা কর্তৃক ধৃত হইলাম। আমার নিকট যে সকল অর্থ পাওয়া গিয়াছে, তাহার সমস্ত ঐ সকল অলঙ্কার বিক্রয়ের টাকা। ঐ সকল টাকা এখনও পর্যন্ত আমাদিগের মধ্যে বিভাগিত হয় নাই।
আমি। তুমি যাহা বলিলে তাহার সমস্তই প্রকৃত সত্য বোধ হইতেছে। গাড়ীখানি কোথা হইতে সংগ্রহ হইয়াছিল?
স্ত্রীলোক। উহা আমি ঠিক জানি না। উহাদিগের মধ্যে একজন যে ঐ গাড়ীতে কোচমানের কার্য্যে নিযুক্ত ছিল, সেই বলিয়াছিল যে, উহা তাহার নিজের গাড়ী। সেই এই কাৰ্য্যসাধন করিবার মানসে ঐ গাড়ী আনয়ন করিয়াছিল। ঐ গাড়ী ও ঘোড়া সম্বন্ধে পরিশেষে আমরা অনুসন্ধান করিয়াছিলাম, এবং জানিতে পারিয়াছিলাম। যে কোচমান হইয়াছিল, সে প্রকৃতই কোচমান। কোন একজন ডাক্তারের নিকট সে কোচমানি করিত, ও সেই গাড়ী সেই হাঁকাইত। ডাক্তারবাবুটি এই সময় কলিকাতায় ছিলেন না, তিনি হাওয়া পরিবর্তন করিবার জন্য দার্জ্জিলিঙে গমন করিয়াছিলেন, গাড়ী ঘোড়া উহার জিম্মায় ছিল। সুতরাং সে তাহার নিজের ইচ্ছামত গাড়ী ঘোড়া ব্যবহার করিলে তাহা দেখিবার লোক ছিল না। সুশীলার নির্দেশমত ঐ দলের সমস্ত লোক ধৃত হইল, এবং পরিশেষে সকলেই উপযুক্ত দণ্ড গ্রহণ করিল। সুশীলাও নিষ্কৃতিলাভ করিতে পারিল না।
[কাৰ্ত্তিক, ১৩১১]