কি না হয়?

কি না হয়? 

(অর্থাৎ ঘোড়দৌড়ের কাণ্ড কারখানা!) 

প্রথম পরিচ্ছেদ

পাঠক-পাঠিকাগণ! আপনারা দারোগার দপ্তর পাঠ করিয়া, এ পর্য্যন্ত যে অনেকরূপ জুয়াচুরির বিষয় অবগত হইতে পারিয়াছেন, সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। আপনারা যে সকল জুয়াচোরের কথা শ্রবণ করিয়াছেন, তাহাদিগের মধ্যে অনেকেই অশিক্ষিত, নীচ-বংশ-সম্ভূত ও নীচ প্রকৃতি। জুয়াচুরি, অতি ঘৃণীত ব্যবসা; জুয়াচোরগণকে সকলেই বিশেষ ঘৃণার চক্ষে দেখিয়া থাকেন, জুয়াচোরকে কেহ কখনও বিশ্বাস করেন না। যে ব্যক্তি জুয়াচোর বলিয়া প্রকাশিত হইয়া পড়ে, কোন ব্যক্তি তাহার সহিত কোনরূপ সংশ্রব রাখিতে চাহেন না, “ও বেটা জুয়াচোর” এই বলিয়া সকলেই ঘৃণার সহিত তাহার সঙ্গ পরিত্যাগ করিয়া থাকেন। 

আমি যে জুয়াচোরের চরিত্র আজ পাঠক-পাঠিকাগণের সম্মুখে উপস্থিত করিতেছি, তাহা কল্পিত বা অতিরঞ্জিত নহে, বরং উহা অসম্পূর্ণ চিত্র। কারণ, ইহার প্রকৃত চরিত্র অঙ্কিত করিতে হইলে যে সকল উপাদানের প্রয়োজন, তৎসমস্ত সম্পূর্ণরূপে সংগ্রহ করা আমার সদৃশ একজন সামান্য কাৰ্য্য নহে। এ সম্বন্ধে আমি যতদূর কার্য্যগতিকে অবগত হইতে পারিয়াছি, কেবলমাত্র তাহাই অবলম্বন করিয়া, এই চরিত্র অঙ্কিত করিতেছি। 

যে সকল সামান্য ব্যক্তি জুয়াচুরি কার্য্য করিয়া, জুয়াচোর আখ্যায় আখ্যাত হইয়া থাকে, আজ আমি সেইরূপ ব্যক্তিগণের চিত্র অঙ্কিত করিতে প্রবৃত্ত হই নাই। যে শ্রেণীর লোকদিগের কার্য্য-কলাপ আজ আমি বর্ণন করিতে প্রবৃত্ত হইতেছি, সেই সমস্ত লোক এই সহরের প্রধান পদবীস্থ। যাঁহারা আপন আপন সমাজে উচ্চ আসন পাইয়া থাকেন; বিদ্যা, বুদ্ধি ও জ্ঞানে যাঁহারা সমস্ত লোকের আদর্শ স্বরূপ, এবং অর্থবল যাঁহাদিগের অগাধ আছে, তাঁহাদিগের মধ্যে কয়েকজন লোকের চরিত্র, আজ আমি এইস্থানে চিত্রিত করিতেছি; আমার ইচ্ছা ছিল, তাঁহাদিগের প্রকৃত নাম ও ঠিকানা দিয়া জনসমাজে অন্যভাবে প্রকাশিত করিব; কিন্তু সাহসে তাহা কুলাইতেছে না। তাঁহাদিগের বিপক্ষে দাঁড়াইতে হইলে, লোকবল, অর্থবল, বা অপর যে কোন বলের আবশ্যক, তাহার কিছুই আমার নাই। সুতরাং তাঁহাদিগের নাম যথাযথ প্রকাশ না করিয়া তাঁহাদিগের কার্য্য-কলাপ প্রকাশ করিলেই, আমার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণরূপে সফল হইবে, অথচ “ভদ্রবেশ ধারী” জুয়াচোরকে, জুয়াচোর বলিয়া, আমাকে কোনরূপ বিপদ্‌গ্রস্থ হইতে হইবে না; কিন্তু আমি যে সকল লোকের চরিত্র এই স্থানে চিত্রিত করিতে প্রবৃত্ত হইলাম, তাঁহাদিগের প্রকৃত নাম প্রকাশ না করিলেও যে, কেহ বুঝিয়া উঠিতে পারিবেন না, তাহা নহে। মফঃস্বলের পাঠকগণের মধ্যে অনেকে তাহাদিগকে চিনিতে না পারিলেও, এই স্থানের অনেক পাঠকই, তাঁহাদিগকে চিনিতে পারিবেন। 

কলিকাতার ঘোড়দৌড় সৰ্ব্ববিদিত; গড়ের মাঠে, ওই ঘোড়দৌড় হইয়া থাকে। যে স্থান দিয়া ঘোড়া সকল দৌড়িয়া থাকে, যে স্থানে ঘোড়া সকলকে রাখা হয়, যে স্থানে অর্থশালী দর্শকগণ বসিয়া, ঘোড়ার দৌড় দেখিয়া থাকেন, সেই সকল স্থান প্রস্তুত করিতে বা মেরামত করিতে, বৎসর বৎসর যে কত টাকা ব্যয় হইয়া থাকে, তাহার হিসাব দেওয়া আমাদিগের পক্ষে একবারে অসম্ভব। তবে এইমাত্র বলিতে পারি, সেই সকল কার্য্যের নিমিত্ত, বৎসর বৎসর সহস্র সহস্র টাকা ব্যয় হইয়া যায়। 

সহরের পাঠকগণের মধ্যে অনেকেই অবগত আছেন, এই ঘোড়দৌড় ব্যাপারটা কি? কিন্তু মফঃস্বলস্থ পাঠকগণের মধ্যে অনেকেই অবগত নহেন যে, ইহার মধ্যে কিরূপ ভয়ানক ভয়ানক ব্যাপার ও অর্থের শ্রাদ্ধ হইরা থাকে। কোন পৰ্ব্ব বা মেলা উপলক্ষে পল্লীগ্রামে যেরূপভাবে ঘোড়দৌড় হইয়া থাকে, ইহা সেইরূপের ঘোড়দৌড় নহে। পল্লীগ্রামে আট দশটি ঘোড়া একবারে দৌড়িয়া যায়; উহার মধ্যে কোন ঘোড়া অগ্রে গমন করিতে পারে, ইহাই দেখিবার নিমিত্ত সকলে সোৎসুকনেত্রে সেইস্থানে উপস্থিত হইয়া ক্ষণিক আমোদ উপভোগ করেন। পরিশেষে উহার সমালোচনা লইয়া, দুই একদিবস অতিবাহিত হইয়া যায়। পল্লীগ্রামে এইরূপ ভাবেই ঘোড়দৌড় হইয়া থাকে; কিন্তু এই সহরের ঘোড়দৌড় অন্যরূপ, এইস্থানে কেবল ঘোড়ার হারজিত দেখিয়া, কেহই ফিরিয়া আসেন না, এখানে ঘোড়ার হারজিতের উপর দর্শকগণের আর্থিক বিষয়, অনেক নির্ভর করে। এই স্থানের ঘোড়দৌড় কেবল ঘোড়দৌড় নহে, উহা একটি খুব প্রকাণ্ডগোছের জুয়া, ঘোড়দৌড়ের দিবস সেই স্থানে যে কত লোক, বড় মানুষ হয়, এবং কত লোক স্বোপার্জিত হারাইয়া পরিশেষে পূর্ব্ব পুরুষের পরিত্যক্ত বিষয় সকল নষ্ট করেন, তাহার সংখ্যা করা নিতান্ত সহজ নহে। 

ঘোড়দৌড়ে বড় মানুষ হওয়ার সংখ্যা, অতি অল্পই দেখিতে পাওয়া যায়; কিন্তু সেইস্থানে গিয়া রাশি রাশি অর্থ নষ্ট করিয়াছেন, এবং প্রত্যেক ঘোড়দৌড়ের দিবসই সেইরূপ অর্থ নষ্ট করিতেছেন, এইরূপ লোকের সংখ্যাই অধিক পরিমাণে দেখিতে পাওয়া যায়। 

যে সকল ব্যক্তি ঘোড়দৌড় দেখিতে যান, তাঁহাদিগের হাজারের মধ্যে নয়শত নিরানব্বুই জন, ঘর হইতে অর্থ লইয়া, পরের অর্থ ঘরে আনিবেন মনে করিয়া, সেই স্থানে গমন করিয়া থাকেন। যাঁহার যেরূপ সামর্থ, তিনি সেইরূপ অর্থই লইয়া যান; আমরা দেখিয়াছি, যাঁহারা নিতান্ত দরিদ্র, তাঁহারও অন্ততঃ একটি টাকা লইয়া, ঘোড়দৌড় দেখিতে গিয়াছেন, এবং যিনি বড় মানুষ তিনি দুই তিন লক্ষ বা ততোধিক মুদ্রা লইয়াও, ঘোড়দৌড় লালসা নিবৃত্তি করিবার মানসে সেই স্থানে গমন করিয়াছেন। ইঁহাদিগের মধ্যে অনেককেই প্রায় ঘরের অর্থ সেই স্থানে রাখিয়া আসিতে হয়, কেহ কেহবা কিছু লইয়াও আসেন; কিন্তু সেইরূপ লোকের সংখ্যা নিতান্ত অল্প। 

আমার বেশ বোধ হইতেছে যে, পাঠক-পাঠিকাগণের মধ্যে অনেকে, আমাকে এই স্থানে একটি প্রশ্ন করিতে প্রবৃত্ত হইবেন। সেই প্রশ্নটি এই—“অনেকেই যদি ঘোড়দৌড়ে গিয়া আপন আপন অর্থ নষ্ট করিয়া আসেন, তাহা হইলে সেই সকল অর্থ যায় কোথায়? কেহ কিছু আপন অর্থ জলে নিক্ষেপ করিয়া প্রত্যাবর্তন করেন মা, নিশ্চয়ই একজনের অর্থ অপরের নিকট গমন করে। সুতরাং কোন ব্যক্তি যেমন অর্থ’ নষ্ট করেন, অপর ব্যক্তি সেইরূপ সেই অর্থ উপার্জ্জন করেন?”

পাঠক-পাঠিকাগণের এই প্রশ্নে উত্তর দেওয়ার নিমিত্তই এই প্রবন্ধের অবতারণা। ইহার আদ্যোপান্ত পাঠ করিলেই, সকলেই বুঝিতে পারিবেন যে, কত লোক কিরূপ ভাবে তাহাদিগের অর্থ অযথারূপে নষ্ট করিতেছেন, ও কয়জন লোক সেই সমস্ত লোকের অর্থ অযথারূপে আত্মসাৎ করিতেছেন। 

ঘোড়দৌড় যে কেবলমাত্র একটি প্রধান জুয়াখেলা, তাহা নহে, ইহাতে যেরূপ ভয়ানক ভয়ানক জুয়াচুরি সকল হইয়া থাকে, তাহাই আজ পাঠকগণের নিকট বর্ণন করাই, এই প্রবন্ধের প্রধান উদ্দেশ্য। এইরূপ উপায়ে যত প্রকার জুয়াচুরি সেইস্থানে হইয়া থাকে, একজনকে উপলক্ষ্য করিয়া, তাহাই নিম্নে বিবৃত হইল। 

গেভিন সাহেব যখন সৰ্ব্বপ্রথমে কলিকাতায় আগমন করেন, তখন তাঁহার অবস্থা নিতান্ত শোচনীয়া। ইহা একজন বিলাতী সাহেব কিন্তু বিলাতের কিরূপ বংশ সম্ভূত, তাহা আমরা অবগত নহি। বিলাত হইতে ভারতে আগমন করিতে হইলে, যেরূপ অর্থের প্রয়োজন হয়, সেইরূপ অর্থ তাঁহার ছিল না, ইহা কিন্তু নিশ্চয় বলিতে পারি। কারণ, যখন তিনি এদেশে আগমন করেন, সেই সময় কোন একখানি জাহাজে একটি সামান্য খালাসীর কার্য্য গ্রহণ করিয়া, বিনা অর্থ ব্যয়ে তিনি এদেশে আসিয়া উপস্থিত হন। 

কলিকাতায় গোরা খালাসিদিগের থাকিবার যে স্থান আছে, সেই স্থানে তিনি কিছুদিবস কালাতিপাত করিয়া দিবাভাগে সহরের নানাস্থানে ঘুরিয়া বেড়াইতেন, এবং সহরের কোন স্থানের কিরূপ অবস্থা তাঁহা জানিয়া লইতেন। 

গোরা খালাসিগণ যেমন স্বভাবতই অত্যধিক সুরাপায়ী হইয়া থাকে, গেভিন্স সাহেব কিন্তু সেরূপ ছিলেন না। তিনি মধ্যে মধ্যে সুরাপান করিতেন বটে; কিন্তু অনিয়মিতরূপ সুরাপান করিয়া সদা সৰ্ব্বদা উন্মত্ত থাকিতেন না। 

তিনি যে সময় কলিকাতায় প্রথম আগমন করেন, সেই সময় শীতকাল সমাগত ও গড়ের মাঠে ঘোড়দৌড় হইতে কেবল আরম্ভ হইয়াছে মাত্র। গেভিন সাহেব ঘোড়দৌড় দেখিবার মানসে সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলেন। ভিতরে যাইতে হইলে টিকিট খরিদ করিয়া যাইতে হয়। গেভিন সাহেবের সে ক্ষমতা নাই, সুতরাং তাঁহার ভিতরে যাওয়া হইল না। তিনি বাহিরের বুকমেকারদিগের নিকট দাঁড়াইয়া তামাসা দেখিতে লাগিলেন। 

পল্লীগ্রামের পাঠক-পাঠিকাগণকে এই স্থানে বলিয়া দেওয়া আবশ্যক যে, “বুকমেকার” কাহাকে কহে, এবং ঘোড়দৌড় উপলক্ষে তাহাদিগের কার্য্যই বা কি? 

যে দিবস ঘোড়দৌড় হইবে, তাহার একদিবস পূর্ব্বে ঘোড়দৌড় সভার কর্তৃপক্ষীয়গণ একখানি পুস্তক মুদ্রিত করিয়া প্রচারিত করিয়া থাকেন। সেই পুস্তক, বিক্রীতও হইয়া থাকে, ইচ্ছা করিলে মূল্য দিয়া যে কোন ব্যক্তি, সেই পুস্তক ক্রয় করিতে সমর্থ হন। যে তারিখের নিমিত্ত ঘোড়দৌড়ের ওই পুস্তক মুদ্রিত হয়, সেই তারিখের ঘোড়দৌড় সম্বন্ধীয় সমস্ত কথা, উহাতে লিখিত থাকে, অর্থাৎ- 

ক। কোন্ তারিখে ঘোড়দৌড় হইবে। 

খ। সেইদিবস কয়বার ঘোড়দৌড় হইবে। 

গ। প্রত্যেকবার কোন্ কোন্ সময়ে ঘোড়া দৌড়িতে আরম্ভ করিবে। 

ঘ। প্রত্যেকবারের দৌড়ে কয়টি করিয়া ঘোড়া থাকিবে। 

ঙ। কতদূর দৌড়িবে। 

চ। কোন্ কোন্ ঘোড়া থাকিবে, তাহার নাম। 

ছ। প্রত্যেক ঘোড়ার ওজন। 

জ। প্রত্যেক ঘোড়ার মালিকের নাম। 

ঝ। প্রত্যেক ঘোড়ার উপর যে সোয়ার থাকিবে, তাহার নাম। 

প্রভৃতি অনেক সংবাদ উহাতে লিখিত থাকে। 

এই সকল ঘোড়ার উপর যাহাদিগের নিকট বাজি লাগাইতে পারা যায়, তাহাদিগকে বুকমেকার কহে। 

যে স্থানে ঘোড়দৌড় হইয়া থাকে, সেই স্থানে তিন শ্রেণীর বুকমেকার দেখিতে পাওয়া যায়। 

প্রথম শ্রেণীর বুকমেকারগণের কার্য্যস্থল যে স্থানে, সেই স্থানে যাহার ইচ্ছা তাহার প্রবেশ করিবার উপায় নাই, সেই স্থানে প্রবেশ করিতে হইলে, টিকিট খরিদ করিতে হয়, সেই টিকিটের মূল্য সময় সময় পাঁচ টাকা হইতে দশ টাকা পর্যন্ত। বিনা-টিকিটে কেহই সেই স্থানে গমন করিতে সমর্থ হন না। তদ্ব্যতীত সেই স্থানে যে সকল বুকমেকার থাকেন, তাঁহাদিগের নিকট বাজি রাখিতে হইলে, দশ টাকার কম হয়না। দশ টাকা হইতে আরম্ভ করিয়া, যত ইচ্ছা তত টাকা পৰ্য্যন্ত আপনি বাজি রাখিতে পারেন। যে সকল বুকমেকার সেই স্থানে আগমন করেন, তাঁহাদের মধ্যে দরিদ্র কেহই নাই। দরিদ্র ব্যক্তিগণকে সেই স্থানে স্থান প্রদান করা হয় না। কারণ, ঘোড়দৌড় সভার নিকট পঁচিশ হাজার, পঞ্চাশ হাজার বা সময় সময় লক্ষ টাকা পর্য্যন্ত জমা না রাখিলে, তাঁহাদিগকে সেইস্থানের বুকমেকারের কার্য্যে নিযুক্ত করা হয় না। সেই সকল বুকমেকারদিগের নিকট হইতে অত টাকা জমা লইবার কারণ এই যে, যে সকল ব্যক্তি বাজি প্রাপ্ত হন, অর্থাৎ যে ঘোড়ার উপর, যে বুকমেকারের নিকট যাঁহারা বাজি রাখেন, সেই ঘোড়া যদি প্রথম বা দ্বিতীয় হয়, তাহা হইলে যতগুণ মূল্যে তাঁহারা বাজি রাখিয়াছিলেন, সেই টাকা, সেই বুকমেকারের নিকট হইতে তাঁহাদিগের প্রাপ্য হয়। আর সেই বুকমেকার যদি সেই সময় সেই টাকা তাঁহাদিগকে প্রদান করিতে সমর্থ না হন, তাহা হইলে পূর্ব্ব-বর্ণিত ডিপজিটের টাকা হইতে সেই টাকা সেই ব্যক্তিগণকে প্রদান করা হয়। অবশিষ্ট ডিপজিটের টাকা আর সেই বুকমেকারকে ফেরত দেওয়া হয় না। অধিকন্তু তাঁহাকে সেই স্থান হইতে দূর করিয়া দেওয়া হয়। 

দ্বিতীয় শ্রেণীর বুকমেকারগণ যে স্থানে আপনাপন কার্য্য করিতে প্রবৃত্ত হন, সেইস্থানে প্রবেশ করিতে হইলেও টিকিট খরিদ করিয়া যাইতে হয়। সেই স্থানে প্রবেশ করিবার নিমিত্ত যে টিকিটের আবশ্যক হয়, তাহার মূল্য এক টাকা মাত্র। যাঁহারা অল্প টাকা লইয়া ঘোড়দৌড়ে বাজি রাখিতে ইচ্ছা করেন, তাঁহারাই সেইস্থানে গমন করেন। কারণ, সেই স্থানের বুকমেকারগণের নিকট এক টাকা পর্য্যন্ত বাজিও রাখা যাইতে পারে। ঘোড়দৌড় সভার সভ্যদিগের নিকট ইহাদিগকেও টাকা জমা রাখিতে হয়; কিন্তু অধিক টাকা নহে, সহস্র মুদ্রার অধিক প্রায়ই জমা দিতে হয় না। ইহাদিগের নিকট হইতে টিকিট খরিদ করিয়া যদি কেহ বাজি জিতিয়া থাকেন, এবং উহাদিগের টাকা যদি সেই বুকমেকারগণ সেই সময় প্রদান করিতে সমর্থ না হন, তাহা হইলে উহাদিগের অবস্থাও পূর্ব্ব বর্ণিত প্রথম শ্রেণীর বুকমেকারগণের ন্যায় হইয়া থাকে। 

তৃতীয় শ্রেণীর বুকমেকারদিগের অবস্থা অতিশয় ভয়ানক, তাঁহারা যে স্থানে থাকিয়া আপনাপন কার্য্য করিতে প্রবৃত্ত হন, সেই স্থানে যাঁহার ইচ্ছা, তিনি অনায়াসেই গমন করিতে পারেন। সেই স্থানে প্রবেশ করিতে হইলে অর্থ ব্যয় করিয়া কাহাকেও কোনরূপ টিকিট খরিদ করিতে হয় না। ইহাদিগের কার্য্য স্থানে প্রবেশ করিতে হইলে যেমন কাহার কোনরূপ অর্থের প্রয়োজন হয় না; সেইরূপ ঘোড়দৌড় সভার সভ্যগণের নিকট ইহাদিগকেও কোনরূপ অর্থ জমা রাখিতে হয় না। ইহাদিগের কাহারও নিকট হইতেটিকিট খরিদ করিয়া যদি কেহ কোন বাজি জিততে পারেন, এবং সেই বাজির প্রাপ্য টাকা যদি ইহারা প্রদান না করেন, তাহা হইলে ঘোড়দৌড় সভার সভ্যগণ সেই অর্থের নিমিত্ত দায়ী হয়েন না। মনে করিলে ইহারা অনায়াসেই যাহাকে তাহাকে প্রতারিত করিতে পারেন। 

এই ত গেল বুকমেকারদিগের শ্রেণীবিভাগ; এখন দেখা যাউক, উহারা কিরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া আপনাপন কার্য্য নির্ব্বাহ করিয়া থাকেন, কিরূপে সর্ব্ব সাধারণে ডাঁহাদিগের নিকট ঘোড়ার উপর বাজি রাখিয়া থাকেন, কিরূপে, ও কিরূপ মূল্যে উঁহারা সাধারণের নিকট টিকিট বিক্রিয় খরিয়া থাকেন, এবং এই কার্য্য করিয়া তাঁহারা কিরূপে অর্থ উপার্জ্জন করিতে সমর্থ হন। 

এই সকল বিষয় পাঠকগণকে একটু বিশদরূপে বুঝাইয়া না দিলে তাঁহারা সহজে কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিবেন না। অথচ এই অংশটি পাঠ করিতেও তাহাদিগের একটু নীরস বোধ হইবে। 

এই তিন শ্রেণীর বুকমেকারদিগের আর্থিক ব্যাপার সমান না হইলেও, প্রায় এক ধরণেই সকলেই কার্য্য করিয়া থাকেন। সুতরাং ইঁহাদিগের কার্য্য প্রণালী পৃথক পৃথকরূপে বর্ণন না করিয়া, মোটের উপর বলিয়া দিলেই পাঠক- পাঠিকাগণ ইহার অবস্থা অনায়াসেই বুঝিয়া লইতে পারিবেন। 

বুকমেকারগণ যে স্থানে উপস্থিত হইয়া টিকিট বিক্রয় করেন, সেই স্থানেই তাঁহাদিগের বসিবার বা দাঁড়াইবার উপযোগি এক একটি স্থান স্থির করিয়া লন। এ স্থানে একখানি “বোর্ড” বা তক্তা এরূপ ভাবে উচ্চ করিয়া রাখা হয় যে, একটু দূর হইতেও যাহাতে সহজে তাহার উপর দৃষ্টি পতিত হয়। 

এই বোর্ডে বুকমেকারগণ প্রায়ই আপনার নিজের নাম ব্যবহার করেন না, একটি একটি কোম্পানী ধরণের নাম বাহির করিয়া, সেই নামে কার্য্য করিতে প্রবৃত্ত হন। যে নামে যে বুকমেকার আপন আপন কার্য্য করিতে চাহেন, তিনি সেই নাম বেশ স্পষ্টরূপে মুদ্রিত অক্ষরে সেই বোর্ড বা তক্তা খণ্ডের উপরিভাগে লিখিয়া দেন, উহা দেখিলে সকলে জানিতে পারেন যে কোন্ বোর্ড কাহার।

যে বাজিতে যে সকল ঘোড়া দৌড়াইবে, সেই সকল ঘোড়ার নাম কেহবা কাগজের উপর লিখিয়া, সেই বোর্ডের উপর লাগাইয়া দেন, কেহবা সেই বোর্ডের উপরই ঘোড়াগুলির নাম খড়ি বা অপর কোন দ্রব্যদ্বারা লিখিয়া দেন। প্রত্যেক ঘোড়ার নামের বিপরীতে একটি করিয়া অঙ্কপাত করিয়া দেন। এই অঙ্কপাতের উদ্দেশ্য এই যে, যিনি যে ঘোড়ার নামীয় টিকিট, এক টাকা দিয়া সেই বুকমেকারের নিকট হইতে খরিদ করিবেন, এবং দৌড়ে সেই ঘোড়া যদি প্রথম হয়, তাহা হইলে সেই ঘোড়ার নামের বিপরীতে যত টাকার অঙ্কপাত থাকে, তিনি তত টাকা প্রাপ্ত হইবেন। অর্থাৎ একটি ঘোড়ার নাম ‘বিজলী” সেই ঘোড়ার নামের বিপরীতে পাঁচ টাকার অঙ্কপাত আছে, যিনি এক টাকা দিয়া বিজলী ঘোড়ার নামীয় একখানি টিকিট খরিদ করিবেন দৌড়ে বিজলী ঘোড়া প্রথম হইলে তিনি পাঁচ টাকা পাইবেন। 

২ টাকা দিয়া খরিদ করিলে ১০ টাকা,

৫ টাকা দিয়া খরিদ করিলে ২৫ টাকা, 

১০ টাকা দিয়া খরিদ করিলে ৫০ টাকা, 

১০০ টাকা দিয়া খরিদ করিলে ৫০০ টাকা পাইবেন, ইত্যাদি। 

তদ্ব্যতীত নিজের টাকাটি ফেরত পাইবেন। আর যদি সেই ঘোড়া প্রথম না হয়, তাহা হইলে যে টাকা দিয়া, তিনি টিকিট খরিদ করিয়াছেন, সেই টাকা তাঁহার লোসান হইবে, এবং তাহাই সেই বুকমেকারের লাভ হইবে। 

প্রত্যেক বাজিতে আটটি দশটি করিয়া ঘোড়া থাকে, ও প্রত্যেক ঘোড়ার নামের বিপরীতে সেইরূপ ভাবে অঙ্কপাত থাকে, পূর্ব্ব-বর্ণিত ভাবে যাঁহার যেরূপ ইচ্ছা, তিনি সেই ঘোড়ার নামীয় টিকিট খরিদ করিতে পারেন। প্রত্যেক ঘোড়ার নামের বিপরীতে যে অঙ্কপাত থাকে, তাহা যে একরূপ তাহা নহে; সেই দর, ঘোড়া ও সোয়ারের তারতম্যের উপর অধিক পরিমাণে নির্ভর করে। অর্থাৎ যে ঘোড়া উৎকৃষ্ট, ও যাহার উপর দক্ষ সোয়ার আরোহণ করিবে, তাহার দর সময় সময় চারি আনা পর্য্যন্তও হইয়া থাকে। অর্থাৎ এক টাকা বা একশত টাকা দিয়া, সেই ঘোড়ার টিকিট খরিদ করিলে যদি সেই ঘোড়া সৰ্ব্বপ্রথম হয়, তাহ হইলে নিজের টাকা বাদে চারি আনা বা ২৫ টাকা পাওয়া যাইতে পারে। আর যে ঘোড়া তত উৎকৃষ্ট বলিয়া লোকে অবগত নহে সেই ঘোড়ার টিকিটের দাম সময় সময় ৫০ টাকা পর্যন্ত হইয়া থাকে, অর্থাৎ এক বা একশত টাকা দিয়া সেই ঘোড়ার টিকিট খরিদ করিলে, যদি দৌড়ে সেই ঘোড়া সৰ্ব্বপ্রথম হয়, তাহা হইলে নিজের টাকা বাদে পঞ্চাশ টাকা, বা পাঁচ হাজার টাকা পর্য্যন্ত পাওয়া যায়। 

এক ঘোড়ার টিকিটের দর, সকল সময় বা সকল বুকমেকারের টিকিট যে সমান, তাহা নহে; সময় সময়, মিনিটে মিনিটে দর পরিবর্তন হইতেছে, এবং বুকমেকারগণ এক ঘোড়ার দর আপন আপন ইচ্ছামত দিতেছেন, অর্থাৎ একজন বুকমেকারের নিকট বিজলী ঘোড়ার টিকিটের দর এখন দেখিলাম, দুই টাকা, দুই মিনিট পরে দেখিলাম, তিনি সেই দর পরিবর্তন করিয়া, এক টাকা করিয়াছেন। আবার আর একজন বুকমেকার সেই সময়ে সেই ঘোড়ার টিকিটের দর পাঁচ টাকা দিয়াছেন। 

যে ব্যক্তি যে সময় যে ঘোড়ার টিকিট যে বুকমেকারের নিকট খরিদ করেন, সেই বুকমেকার, তাঁহার বোর্ড বা তক্তায় যে নাম লেখা আছে, সেই নাম মুদ্রিত একখানি টিকিটও তাঁহাকে প্রদান করেন। সেই টিকিট প্রদান করিবার সময় কোন ঘোড়ায় নামীর টিকিট কত মূল্যের ও কত টাকা দিয়া, তিনি খরিদ করিলেন, তাহা তাহাতে লিখিয়া দেন। যে বাজিতে যে সকল ঘোড়া দৌড়িবে, সেই বাজির ঘোড়ার নামীয় টিকিট এইরূপে বিক্রয় ইহবার পর, সেই সকল ঘোড়া দৌড়িবার যেমন সময় হইয়া আসিল, অমনি সেই সকল ঘোড়া ছাড়িয়া দেওয়া হইল। ঘোড়া ছুটিবার সঙ্গে সঙ্গে সেই সকল ঘোড়ার নামীয় টিকিট বিক্রয় বন্ধ হইয়া গেল। সকলেই সেই স্থানে দাঁড়াইয়া সোৎসুকনেত্রে দেখিতে লাগিলেন, কোন ঘোড়া অগ্রগামী হয়। 

ক্রমে ঘোড়া সকল দৌড়িতে দৌড়িতে আসিয়া, নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হইল, সে বাজি শেষ হইয়া গেল। ঘোড়াদৌড় সভার সভ্যগণ কর্তৃক কোন্ ঘোড়া প্রথম, কোন্ ঘোড়া দ্বিতীয়, কোন্ ঘোড়া তৃতীয় প্রভৃতি হইয়াছে, তাহা ঘোষিত হইয়া গেল। তাহার পরই বুকমেকারগণ বাজির টাকা প্রদান করিতে আরম্ভ করিলেন। অর্থাৎ যে সকল ঘোড়া প্রথম হইয়াছে, বা যে সকল ঘোড়া দ্বিতীয় হইয়াছে, সেই সকল ঘোড়ার নামীয় টিকিট যাঁহারা যেরূপ মূল্যে খরিদ করিয়াছিলেন, তাঁহারা পূর্ব্ব-বর্ণিত টিকিট লইয়া যেমন তাঁহাদিগের নিকট উপস্থিত হইতে লাগিলেন, অমনি তাঁহারা সেই সকল টিকিট গ্রহণ পূর্ব্বক তাহাতে লিখিতমত টাকা তৎক্ষণাৎ প্রদান করিতে লাগিলেন। 

যে সকল ঘোড়া প্রথম বা দ্বিতীয় হইতে পারে নাই, তাঁহারা যে মূল্য দিয়া, সেই সকল ঘোড়ার নামীয় টিকিট খরিদ করিয়াছিলেন, তাঁহাদিগের সেই অর্থ লোকসান, এবং বুকমেকারদিগের সেই সকল টাকা লাভ হইতে লাগিল। কিন্তু বুকমেকারদিগের সেই লাভের টাকা হইতে, যাঁহারা বাজি জিতিয়াছে, তাঁহাদিগকে তাঁহাদিগের প্রাপ্য টাকা প্রদান করিতে হইল। মোটের উপর কোন বুকমেকার লাভ করিলেন, কেহবা লোকসান দিলেন। 

এইরূপে এক বাজি শেষ হইয়া গেল, পুনরায় অপর বাজির উদ্যোগ আরম্ভ হইল। পূর্ব্ব-বর্ণিতরূপে ঘোড়ার নাম সকল বোর্ডে লেখা হইল, তাহার পার্শ্বে অঙ্কপাত হইল, পুনরায় সেইরূপ উপায়ে টিকিট বিক্রয় আরম্ভ হইল। সময় হইলে সেই বাজির ঘোড়া পুনরায় দৌড়িল, পুনরায় হারজিত স্থির হইয়া গেল, এবং পুনরায় টাকাকড়ির আদান-প্রদান আরম্ভ হইল। এইরূপে কত লোক কত অর্থ সেই স্থানে রাখিয়া আসিলেন, এবং কত লোক পরের অর্থ ঘরে আনিলেন। 

এইরূপে একদিবসের ঘোড়দৌড়ে যিনি কিছু জিতিয়া আসিলেন, অপর আর একদিবসের ঘোড়দৌড়ে তিনি আবার সেই অর্থ হারিয়া পুনরায় ঘর হইতে আরও কিছু দিয়া আসিলেন। আবার যে ব্যক্তি প্রথম দিবসে ঘরের অর্থ পরকে দিয়া আসিয়াছিলেন, অপর দিবস তিনি আবার কিছু লাভ করিলেন। 

এই ত ঘোড়দৌড়ের ব্যবসা, এখন দেখা যাউক, ইহার ভিতর কিরূপে জুয়াচুরি হইতে পারে। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

গেভিন সাহেব প্রথম দিবস ঘোড়দৌড় দেখিতে গিয়া, যেস্থানে টিকিট না লইয়া, বুকমেকারগণ আপন আপন টিকিট বিক্রয় করিয়া থাকেন, সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলেন। সেইদিবস তথায় উপস্থিত থাকিয়া, বুকমেকারগণ কিরূপে স্ব স্ব কার্য্য নির্ব্বাহ করিতেছেন, তাহা বিশেষ মনোযোগের সহিত দেখিতে লাগিলেন; এবং তাহার আভ্যন্তরিক অবস্থা বিশেষরূপে বুঝিতে লাগিলেন। 

গেভিন সাহেব বেশ বুদ্ধিমান লোক; বুকমেকারদিগের এই অবস্থা দেখিয়া, তিনি মনে মনে স্থির করিলেন, এইস্থানে বুকমেকাররূপে কার্য্য করা, নিতান্ত মন্দ দেখিতেছি না। প্রকৃত প্রস্তাবে কার্য্য করিতে পারিলেন, ইহাতে কোনরূপেই লোকসান হইবার সম্ভাবনা নাই। কারণ, প্রকৃত কার্য্য করিয়া, যে সকল ঘোড়ার নামীয় টিকিট বিক্রীত হইবে, সেই সকল টাকা হইতে যে ঘোড়ার টিকিটের মূল্য প্রদান করিতে হইবে, তাহা বাদে যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে, তাহাই লাভ। আর যদি অপর ঘোড়ার টিকিটের নিমিত্ত যে টাকা পাওয়া যাইবে, সেই টাকা হইতে যে টাকা দিতে হইবে, তাহা যদি না কুলাইয়া উঠে, এরূপ জানিতে পারা যায়, তাহা হইলে টাকা প্রদান করিবার পূর্ব্বেই সেই স্থানের সেই গোলোযোগের মধ্যে হইতে আস্তে আস্তে প্রদান করিতে পারিলে সমস্তই লাভ। 

মনে মনে এরূপ স্থির করিয়া, গেভিন সাহেব আপন স্থানে প্রস্থান করিলেন, এবং ইহার পর যেদিবস পুনরায় ঘোড়দৌড় হইবে, সেইদিবসের অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। ইত্যবসরে অপরাপর গোরাদিগের নিকট হইতে কিছু কিছু গ্রহণ করিয়া, দুইটি টাকার সংস্থান করিয়া লইলেন। সেই টাকা হইতে আট আনা খরচ করিয়া, দেড় ফুট লম্বা ও দেড়ফুট চওড়া, একখানি তক্তা ও সাতফুট লম্বা একখানি চিকণ বাঁশ সংগ্রহ করিয়া, সেই বাঁশের এক প্রান্তে সেই তক্তাখানির মধ্যভাগ এরূপ ভাবে আবদ্ধ করিয়া লইলেন যে, সেই বাঁশখানি খাড়া করিয়া দাঁড় করাইলে, তাহার উপরিভাগে সেই তক্তাখানি সাইনবোর্ডরূপে সকলের নজরে পড়ে। 

এইরূপে সাইনবোর্ডের বন্দোবস্ত করিয়া তাহার উপর বেশ মোটা মোটা অক্ষরে লিখিয়া দিলেন, “কোরেন এণ্ড কোং।” মোটা গোছের কিছু কাগজ খরিদ করিয়া, তাহা টিকিটের আকারে কাটিয়া তাহার উপরেও লিখিয়া রাখিলেন, “কোরেন এণ্ড কোং।” 

আট আনা পয়সা দিয়া, সেইদিবসের একখানি ঘোড়দৌড়ের পুস্তকও খরিদ করিয়া লইলেন। 

এইরূপ বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া ঘোড়দৌড়ের দিবস সেই সকল দ্রব্যাদি লইয়া, অপরাপর বুকমেকারগণ সেইস্থানে উপস্থিত হইবার পূর্ব্বে তিনি গিয়া, উপস্থিত হইলেন। 

তৃতীয় শ্রেণীর বুকমেকারগণ যেস্থানে গিয়া, টিকিট বিক্রয় করিয়া থাকে, সেইস্থানে গমন করিয়া, নিজের ইচ্ছানুযায়ী একটি স্থান স্থির করিয়া লইলেন। সেই স্থানে পূৰ্ব্ব-বর্ণিত সেই সাইনবোর্ডখানি সেই বংশখণ্ডের উপর স্থাপিত করিয়া, প্রথমবারে যে কয়েকটি ঘোড়া দৌড়াইবে, তাহাদের নাম খড়িদ্বারা সেই বোর্ডের উপর লিখিয়া দিলেন, এবং প্রত্যেক ঘোড়ার নামের বিপক্ষে একটি একটি অঙ্কপাত করিয়া, সেই স্থানে দাঁড়াইয়া রহিলেন। 

ঘোড়দৌড়ের প্রথম বাজিতে তিনি একটু বেশ সতর্কতার সহিত কার্য করিলেন। অর্থাৎ যে সকল ঘোড়া ভাল, অর্থাৎ দৌড়ে যাহাদিগের প্রথম হওয়াই সম্ভব, সেই সকল ঘোড়ার নামের বিপক্ষে তিনি যেরূপ ভাবে অঙ্কপাত করিতে লাগিলেন, তাহাতে কেহই তাঁহার নিকট হইতে সেই সকল ঘোড়ার নামীয় টিকিট খরিদ করিল না। কারণ, যে সকল ঘোড়ার টিকিটের নিমিত্ত অপর বুকমেকারগণ দুই টাকা দর দিলেন, গেভিন সাহেব তাহার দাম এক টাকা মাত্র, লিখিয়া দিলেন। সুতরাং সেই সকল ঘোড়ার নামীয় টিকিটের একখানিও বিক্রীত হইবার সম্ভাবনা রহিল না। কিন্তু যে সকল ঘোড়া কোনরূপেই প্রথম হইবার সম্ভাবনা নাই, সেই সকল ঘোড়ার টিকিটের নিমিত্ত তিনি অধিক মূল্য প্রদান করিতে সম্মত হইলেন। সেই প্রকারের যে সকল ঘোড়ার টিকিটের দাম, অপর বুকমেকারগণ টাকায় দশ টাকা, কি পনর টাকা প্রদান করিতে লাগিলেন, তিনি তাহার নিমিত্ত কুড়ি ও পঁচিশ টাকা প্রদান করিলেন। 

সেই বাজিতে যে সকল ঘোড়ার দৌড়াইবার কথা ছিল, তাহার মধ্যে কোন কারণবশতঃ একটি ঘোড়ার দৌড়ান বন্ধ হইয়া গেল। একথা ঘোড়দৌড় সভা হইতে প্রচারিত হইবার পরই, অপরাপর বুকমেকারগণ সেই ঘোড়ার নাম আপন আপন বোর্ডের উপর হইতে উঠাইয়া দিলেন; কিন্তু গেভিন সাহেব তাহা না করিয়া, সেই ঘোড়ার দাম এক টাকায় পঁচিশ টাকা লিখিয়া রাখিলেন। সেই ঘোড়াটি নিতান্ত মন্দ ঘোড়া ছিল না, উহার বাজি জিতিবার সম্ভাবনাও ছিল। যে সকল লোক সেই ঘোড়ার উপর বাজি রাখিবার নিমিত্ত মনে মনে স্থির করিয়া আসিয়াছিলেন, তাঁহারা হঠাৎ আসিয়াই সেই ঘোড়ার দাম কোরেন এণ্ড কোংর বোর্ডে পঁচিশ টাকা দেখিয়া, আর কাহাকেও কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া, এক টাকার টিকিট খরিদ করিলেন। গেভিন সাহেব তাঁহার আনীত একখানি টিকিটে ঘোড়ার নাম ও এক টাকায় পঁচিশ টাকা লিখিয়া, তাহা তাঁহাকে প্রদান করিলেন। 

এইরূপে না জানিয়া-শুনিয়া, আরও দুই তিনজন এক এক টাকা দিয়া, সেই ঘোড়ার টিকিট খরিদ করিলেন। তদ্ব্যতীত যে সকল ঘোড়ার নামের বিপক্ষে কুড়ি পঁচিশ টাকার অঙ্কপাত ছিল, সেই সকল ঘোড়ার টিকিটও, তাঁহার দুইখানি বিক্রয় হইল। যে সকল ব্যক্তি এইরূপে ঘোড়দৌড়ের খেলা খেলিতে গমন করেন, তাঁহাদিগের মধ্যে দুই একজনের প্রকৃতি, তাঁহারা ঘোড়ার ভালমন্দর দিকে, বা কোন্ ঘোড়ার বাজি জিতিবার সম্ভাবনা, তাহার দিকে লক্ষ্য করেন না, তাঁহাদিগের লক্ষ্য থাকে, মূল্যের দিকে। অর্থাৎ যে ঘোড়ার নিমিত্ত এক টাকা প্রদান করিলে, অধিক অর্থ পাওয়া যায়, তাঁহারা প্রায়ই সেই সকল ঘোড়ার নামীয় টিকিট খরিদ করিয়া থাকেন। কারণ, তাঁহাদিগের বিশ্বাস, যে সকল ঘোড়া ঘোড়দৌড়ে দৌড়ায়, সেই সকল ঘোড়ার মধ্যে নিতান্ত মন্দ ঘোড়া থাকে না, একটু কম-বেশ থাকিতে পারে বটে; কিন্তু দৌড়কালীন যে কোন ঘোড়া অগ্রে উঠিবে, তাহা বলা নিতান্ত শক্ত। বাস্তবিক সময় সময় দেখাও গিয়া থাকেন, যে ঘোড়াকে অবহেলা করিয়া, কেহই তাহার নামীয় টিকিট খরিদ করেন না, সেই ঘোড়াও কখন কখন বাজি জিতিয়া থাকে। এই সকল কারণে কেহ কেহ মনে মনে স্থির করিয়া রাখেন, যে ঘোড়ার টিকিট এক টাকা দিয়া, খরিদ করিলে, অধিক টাকা পাওয়া যাইতে পারে, তাঁহারা সেই সকল ঘোড়ার টিকিটই খরিদ করিয়া থাকেন। 

এইরূপ উপায়ে গেভিন সাহেব প্রথম বাজিতে চারি পাঁচ টাকার টিকিট বিক্রয় করিলেন; কিন্তু সেইরূপ টিকিট বিক্রয়ের সময় একবারও ভাবিলেন কি না, বলিতে পারি না যে, সেই সকল ঘোড়ার মধ্যে যদি কোন ঘোড়া প্ৰথম হয়, তাহা হইলে তিনি তাহার বিক্রীত টিকিটে লিখিত অর্থ কোথা হইতে প্রদান করিবেন। 

যাহা হউক, তাঁহার ভাগ্যবশতঃ তিনি যে সকল ঘোড়ার নামীয় যে কয়েকখানি টিকিট বিক্রয় করিয়াছিলেন, তাহার একটি ঘোড়াও সেই বাজিতে প্রথম হইতে পারিল না। সুতরাং কাহাকেও তাঁহার আর একটি পয়সাও দিতে হইল না। এইরূপে তিনি যে চারি পাঁচ টাকার টিকিট বিক্রয় করিয়াছিলেন, সেই চারি পাঁচ টাকাই তাঁহার লাভ হইল। তিনি মনে মনে নিজের বুদ্ধির বিস্তর প্রশংসা করিয়া, দ্বিতীয় বাজির টিকিট বিক্রয়ের উদ্যোগ করিতে আরম্ভ করিলেন। 

পূর্ব্বোক্তরূপ উপায় এবারও তিনি টিকিট বিক্রয় করিতে লাগিলেন, এবার তাঁহার সাহসও আরও একটু বৃদ্ধি হইল। দ্বিতীয় বাজিতে তিনি প্রায় দশ টাকা পাইলেন। 

এইরূপে ক্রমে পাঁচ বাজি ঘোড়দৌড় হইয়া গেল। পাঁচবাজিতেই গেভিন সাহেব লাভ করিলেন, প্রায় পঞ্চাশ সাইট টাকা। সুতরাং তাঁহার মন একবারে গরম হইয়া গেল। যষ্ঠ বা শেষ বাজিতে তিনি আর তাঁহার পূর্ব্ব পূর্ব্বরূপ প্রথা রাখিতে পারিলেন না, অপরাপর বুকমেকারগণের ন্যায় তিনি এবার তাঁহার কার্য্যে প্রবৃত্ত হইলেন; কিন্তু এবার তাঁহার চেষ্টা হইল, যাহাতে তিনি অধিক পরিমাণে টিকিট বিক্রয় করিতে পারেন। 

অপরাপর বুকমেকারগণ যে সকল ঘোড়ার টিকিটের দর যেরূপ প্রদান করিতে লাগিলেন, তিনি তাহা অপেক্ষা অধিক দর দিতে লাগিলেন, অর্থাৎ যে ঘোড়ার টিকিটের দাম অপর বুকমেকারগণ এক টাকা প্রদান করিলেন, তিনি সেই স্থানে দুই টাকা প্রদান করিলেন। তাঁহারা যে ঘোড়া জিতিলে এক টাকার পরিবর্ত্তে তিন টাকা দিতে চাহিলেন, গেভিন সাহেব সেইস্থলে পাঁচ টাকা দিতে সম্মত হইলেন। 

এইরূপ উপায়ে এবার তাহার বিস্তর টিকিট বিক্রীত হইল, তিনি প্রায় পাঁচশত টাকার টিকিট বিক্রয় করিয়া ফেলিলেন। যে ঘোড়ার সেইবার বাজি জিতিবার সম্ভাবনা, সেই ঘোড়ার নামীয় টিকিট অনেকে বিক্রয় করিলেন, অনেকে এক টাকারস্থলে আর আট আনা, কেহবা একটা দিতে সম্মত হইলেন; কিন্তু গেভিন সাহেব সেই ঘোড়ার টিকিট এক টাকার পরিবর্তে তিন টাকা মূল্যে বিস্তর বেচিয়া ফেলিলেন। এইরূপে প্রায় পাঁচশত টাকার টিকিট বিক্রয় করিবার পর, শেষ বাজির ঘোড়া সকল ছুটিল, তিনি টাকাগুলি কোরিয়ার ব্যাগে, রাখিয়া, কোন্ ঘোড়া অগ্রে গমন করে, তাহা দেখিবার বান করিয়া, ভিড়ের ভিতর প্রবেশ করিলেন, এবং সেই গোলমালের ভিতর হইতে বহির্গত হইয়া, বাহিরে আসিলেন, রাস্তায় যে সকল ভাড়াটিয়া গাড়ি দাঁড়াইয়াছিল, তাহার একখানি গাড়ি ভাড়া করিয়া, তিনি দ্রুতবেগে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। তাঁহার সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার প্রধান উদ্দেশ্য এই যে, তিনি যে ঘোড়ার টিকিট বিক্রয় করিয়াছেন, সেই ঘোড়া যদি বাজি জিততে পারে, তাহা হইলে তাঁহাকে সেই পাঁচশত টাকা ব্যতীত আরও পনরশত টাকা প্রদান করিতে হইবে। কিন্তু তাঁহার সেই সময়ের সংস্থানের মধ্যে পাঁচশত পঞ্চাশ টাকামাত্র। কার্যেই তাঁহার সেই স্থানে হইতে পলায়ন করাই কৰ্ত্তব্য, মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, তিনি দ্রুতবেগে সেই স্থান পরিত্যাগ করিলেন। তাঁহার সাইনবোর্ড প্রভৃতি যেস্থানে স্থাপিত ছিল, সেইস্থানেই রহিয়া গেল। 

বাজি শেষ হইয়া গেল, গেভিন সাহেব যে ঘোড়ার এত টিকিট বিক্রয় করিয়াছিলেন, সেই ঘোড়াই প্রথম হইল। যাঁহারা কোরেন কোম্পানীর নিকট হইতে টিকিট খরিদ করিয়াছিলেন, তাঁহারা টাকা পাইবার প্রত্যাশায় সেই কোরেন কোম্পানীর সাইনবোর্ড ঘিরিয়া, সেইস্থানে সেই গেভিন সাহেবের অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। কিন্তু গেভিন সাহেবকে আর সে দিবস কেহ দেখিতে পাইল না, ঘোড়দৌড় শেষ হইয়া যাইবার পর, অপরাপর বুকমেকারগণ আপন আপন দেনাপাওনা মিটাইয়া দিলেন, ক্রমে ক্রমে সকলে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিতে লাগিলেন। ক্রমে রাত্রি হইয়া পড়িল, কিন্তু কোরেন কোম্পানীর কোন লোক আসিয়া, আর কাহাকেও তাঁহাদের প্রাপ্য টাকা প্রদান করিল না। তখন তাঁহারা জানিতে পারিলেন যে, তাঁহারা অদ্য জুয়াচোরের হস্তে পতিত হইয়াছেন। এইরূপ ভাবিয়া, কোরেন্ কোম্পানীর উদ্দেশে সহস্র সহস্র গালি বর্ষণ করিতে করিতে ও আপনাদিগের অদৃষ্টকে ধিক্কার দিতে দিতে, ক্রমে সকলে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। ঘোড়াদৌড় সভার একজন চাপরাশী এই অবস্থা দেখিতে পাইয়া, সেই সাইনবোর্ডখানি সেই স্থান হইতে উঠাইয়া লইয়া গিয়া, তাহার আফিসে জমা করিয়া দিল। 

গেভিন সাহেব এইরূপে একদিবসেই প্রায় সাড়ে পাঁচশত টাকা হস্তগত করিয়া, তাঁহার থাকিবার স্থান পরিত্যাগ করিলেন। সহরের যে সকল বাড়ী মধ্যম অবস্থার সাহেবদিগের দ্বারা অধিকৃত, সেইরূপ একখানি বাড়ীর ভিতর একটি ঘর লইয়া, আপাততঃ তিনি তাহাতেই বাসস্থান স্থাপন করিলেন। জুয়াচুরি লব্ধ টাকা হইতে প্রায় দুইশত টাকা খরচ করিয়া, নিজের কিছু কাপড়, নিতান্ত প্রয়োজনীয় কিছু কিছু আসবাব-পত্র খরিদ করিয়া, ভদ্রভাবে সেই স্থানে বাস করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

যে দিবসের ঘোড়দৌড়ে গেভিন সাহেব এইরূপ জুয়াচুরি করিয়া, কিছু অর্থের সংস্থান করিয়াছিলেন, তাহার পর পুনরায় যে দিবস ঘোড়দৌড় হইবে, সেইদিবসের নিমিত্ত তিনি পুনরায় প্রস্তুত হইতে লাগিলেন। পূর্ব্ব-বর্ণিতরূপে পুনরায় আর একখানি সাইনবোর্ড প্রস্তুত হইল, তাহাতে পূৰ্ব্ববৎ নাম লেখা হইল। এবার আর সেই সাইনবোর্ডে কোরেন কোম্পানীর নাম ব্যবহার না করিয়া, “হবসন কোম্পানী বলিয়া আপনার পরিচয় প্রদান করিলেন। এবার আর হাতের লেখা টিকিট নহে, হবসন্ কোম্পানীর নাম এবার টিকিটের উপর মুদ্রিত হইল। 

ঘোড়দৌড়ের দিবস তিনি সর্ব্বপ্রথমে সাইনবোর্ড প্রভৃতি লইয়া, সেই স্থানে গিয়া, উপস্থিত হইলেন। পূৰ্ব্বে যে স্থানে তিনি আপন বোর্ড স্থাপিত করিয়াছিলেন, এবার সেই স্থান পরিত্যাগ করিয়া, তাঁহার ইচ্ছানুযায়ি আর একটি স্থানে গিয়া, তিনি তাঁহার সাইনবোর্ড স্থাপিত করিলেন। গতবারে তাঁহার যেরূপ পোষাক- পরিচ্ছদ ছিল, এবার কিন্তু তাঁহার সেই পোষাকের পরিবর্তন করিয়া, তিনি সেই স্থানে আগমন করিয়াছিলেন। 

ক্রমে ক্রমে অপরাপর বুকমেকারগণ আসিয়া উপস্থিত হইলেন, সেই সকল স্থান ক্রমে লোকে লোকারণ্য হইয়া পড়িল। ঘোড়দৌড় আরম্ভ হইবার বন্দোবস্ত হইতে লাগিল। বুকমেকারগণ আপন আপন টিকিট বিক্রয়ের নিমিত্ত বিশেষ চেষ্টা করিতে লাগিলেন। যাঁহারা ঘোড়দৌড়ে বাজি রাখিতে আসিয়াছিলেন, তাঁহারা প্রত্যেক বুকমেকারের বোর্ডের উপর দৃষ্টি রাখিয়া, তাঁহার মনোনীত ঘোড়ার উপর, যিনি অধিক মূল্য দিতে প্রস্তুত আছেন, তাঁহারই নিকট টিকিট খরিদ করিতে লাগিলেন। 

গেভিন সাহেব হবসন্ কোম্পানীর নামে কার্য্যক্ষেত্রে প্রবিষ্ট হইয়া, পূৰ্ব্ব-বর্ণিতরূপ অপরাপর বুকমেকারগণের ন্যায় আপনার টিকিটও বিক্রয় করিতে লাগিলেন। এবারকার তাঁহার কার্য্যের গতিক, অপরাপর সকলের ন্যায়। এবার তাঁহার নিকট পূৰ্ব্ব উপার্জ্জিত কিছু অর্থ ছিল বলিয়া, তিনি চারি পাঁচটি বাজিতে টিকিট বিক্রয় প্রভৃতি সৎভাবেই সম্পন্ন করিলেন। যে সকল ঘোড়ার নিমিত্ত তাঁহাকে টাকা দিতে হইবে, তাহা তিনি বিনা বাক্য ব্যয়ে প্রদান করিলেন। পরিশেষে হিসাব করিয়া দেখিলেন যে সেইদিবসের চারি পাঁচ বাজি খেলায়, তাঁহার মোটের উপর একশত টাকা লোকসান হইয়াছে। যে চারি পাঁচ বাজি ঘোড়দৌড়ে তিনি যেরূপে কার্য্য করিয়াছিলেন, তাহাতে সকলেই অনুমান করিয়াছিলেন যে, হবসন্ কোম্পানী অনেক টাকা লইয়া, সেই স্থানে আগমন করিয়াছেন। কারণ, বাহিরে একশত বুকমেকারের অধিকও ছিল বলিয়া অনুমান হয়, উহারা প্রত্যেকে, যে ঘোড়ার যে দাম দিয়া টিকিট বিক্রয় করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন, তাঁহাদিগের প্রত্যেকের দাম অপেক্ষা ইহার দাম অধিক ছিল। সুতরাং অধিকাংশ লোকই ইহার নিকট টিকিট খরিদ করিয়াছিলেন, এবং যাঁহারা বাজি জিতিয়াছিলেন, তাঁহারাও তাঁহাদিগের প্রাপ্য টাকা তৎক্ষণাৎ তাঁহার নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। 

গেভিন সাহেব যে গতবারে জুয়াচুরি করিয়া গিয়াছিলেন, একথা অনেকে অবগত থাকিলেও, ইনিই যে সেই গেভিন সাহেব, তাহা কেহই চিনিয়া উঠিতে পারিলেন না। ঘোড়দৌড়ে যেরূপ ভিড় হয়, তাহাতে কাহার নিকট হইতে টিকিট খরিদ করা হইয়াছে, তাহাকে পরক্ষণেই চিনিয়া লওয়া বড় সহজ হয় না। কাৰ্য্য চলিয়া যায়, সাইনবোর্ড দেখিয়া; যিনি যে ঘোড়ার টিকিট খরিদ করিয়াছেন, তাঁহার সেই ঘোড়া যদি বাজি জিতিয়া থাকে, তাহা হইলে তাঁহার খরিদ করা টিকিটখানি, তিনি দেখিলে জানিতে পারেন যে, উহা কোন্ কোম্পানীর নিকট হইতে খরিদ করিয়াছেন। কারণ, সেই টিকিটে সেই কোম্পানীর নাম লেখা থাকে। পরিশেষে যে সাইনবোর্ডে সেই কোম্পানীর নাম লেখা থাকে, সেই স্থানে গমন করিয়া, সেই দলের উপস্থিত মত যে কোন ব্যক্তির হস্তে সেই টিকিটখানি প্ৰদান করিলে, তিনি সেই টিকিটখানি গ্রহণ করিয়া, তাহাতে যে টাকা লেখা থাকে, তাহা তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে প্রদান করিয়া থাকেন। এই নিমিত্ত প্রায়ই কেহ, কোন লোককে বিশেষ মনোযোগের সহিত দেখিয়া চিনিয়া রাখেন না। 

এই নিমিত্তই গেভিন সাহেব, যে সেই কোরেন কোম্পানী, তাহা কেহ জানিতে পারিলেন না। কিন্তু সকলেই জানিতে পারিয়াছিলেন যে, গতবারের ঘোড়দৌড়ে কোরেন কোম্পানী অনেককে প্রতারিত করিয়াছেন। কোরেন কোম্পানীর এই অবস্থা দেখিয়া, সকলের আরও একটু জ্ঞান জন্মিয়াছিল যে, সর্ব্বশেষের বাজিতে যে সে বুকমেকারের নিকট আর টিকিট খরিদ করা হইবে না। কারণ, সেই বাজির পর, আর টিকিট বিক্রয়ের আশা থাকে না; সুতরাং ইচ্ছা করিলে, অনেকেই সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিতে পারেন। 

একথা যেমন সকলে বুঝিতে পারিয়াছিলেন, গেভিন সাহেব ও তাহা জানিতে পারিয়াছিলেন। সেইদিবস সাতবার ঘোড়দৌড় হইবার ব্যবস্থা ছিল, পাঁচবার হইয়া গেলে, গেভিন সাহেব আপনার জুয়াচুরি প্রকাশ করিবার মানস করিলেন। ইচ্ছা করিলেন, এবার ঘোড়দৌড়ের এক বাজি অবশিষ্ট থাকিতেই তিনি যাহা কিছু সংগ্রহ করিতে পারেন, লইয়া প্রস্থান করিবেন। 

মনে মনে যেরূপ ভাবিলেন, কার্য্যেও সেইরূপ করিলেন। তিনি গত পাঁচবার যেরূপভাবে কার্য্য করিয়া আসিতেছিলেন, এবার তাহা অপেক্ষা আরও সাহসের সহিত কার্য্য করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। 

এবার যে ঘোড়ার টিকিটের যে মূল্য অপর বুকমেকারগণ প্রদান করিতে লাগিলেন, তিনি তাঁহাদিগের অপেক্ষা দুই টাকা, তিন টাকা অধিক দাম দিতে লাগিলেন। অর্থাৎ অপরের নিকট একটি ঘোড়ার টিকিট এক টাকা দিয়া খরিদ করিলে, যদি তিন টাকা পাওয়ার আশা থাকে, তাঁহার নিকট এক টাকা দিয়া, সেই ঘোড়ার টিকিট খরিদ করিলে, পাঁচ কি ছয় টাকা পৰ্য্যন্ত পাওয়া যাইবে, এরূপ ভাবে তিনি টিকিটের মূল্য সাইনবোর্ডে লিখিয়া দিতে লাগিলেন। 

ইহার পূর্ব্বেই পাঁচবার তিনি বিশেষ সতর্কতার সহিত কার্য্য করিয়াছিলেন। সুতরাং তাঁহার উপর অনেকেই বিশ্বাস করিয়া, এক টাকার পরিবর্ত্তে, অধিক টাকা পাইবার আশায়, টিকিট খরিদ করিতে লাগিলেন। কেহ এক টাকা, কেহ দুই টাকা, কেহবা দশ টাকা পৰ্য্যন্ত জমা দিয়া, এক একখানি টিকিট খরিদ করিতে লাগিলেন। 

দেখিতে দেখিতে গেভিন সাহেব প্রায় দুই সহস্র টাকার টিকিট বিক্রয় করিয়া ফেলিলেন। ষষ্ঠ বাজির ঘোড়া ছুটিল, টিকিট বিক্রয়ও বন্ধ হইল, সকলে ঘোড়দৌড় দেখিতে ব্যগ্র হইয়া, যেদিকে ঘোড়া দৌড়াইবে, সেই দিকে গমন করিলেন। এদিকে গেভিন সাহেবও সেই গোলযোগের ভিতর সেই স্থান হইতে বহির্গত হইয়া, বাহিরে আসিলেন, এবং সেইস্থানে একখানি দণ্ডায়মান দ্বিতীয় শ্রেণী ঘোড়ার গাড়ির ভিতর উপবেশন করিবামাত্রই গাড়িখানি দ্রুতগতিতে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। 

যে সময় গেভিন সাহেব আপনার বাসা হইতে আগমন করিয়াছিলেন, সেই সময় তিনি সেই গাড়িতেই আসিয়াছিলেন, ও তাঁহারই আদেশ মত গাড়িখানি সেই স্থানে হাজির ছিল, এবং গাড়িবানকে এইরূপ আদেশ দেওয়া ছিল যে, যেমন তিনি গাড়িতে আরোহণ করিবেন, অমনি গাড়িবান্ গাড়ি সেই স্থান হইতে চালাইয়া, তাঁহার বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইবে। 

যষ্ঠ বাজি শেষ হইবামাত্রই যাঁহারা দেখিলেন যে, তাঁহারা যে ঘোড়ার টিকিট খরিদ করিয়াছিলেন, সেই ঘোড়াই বাজি মারিয়াছে, তখন তাঁহারা নিতান্ত আনন্দিত অন্তঃকরণে হবসন্ কোম্পানীর সাইনবোর্ডের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, হবসন কোম্পানীর সাইনবোর্ড রহিয়াছে, কিন্তু সেইস্থানে লোকজন কেহই নাই! তাঁহারা অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত সেই স্থানে অপেক্ষা করিয়া, হবসন্ কোম্পানীর লোকের অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন; কিন্তু আর কেহই টিকিট বিক্রয় করিতে, বা বাজির টাকা দিতে, সেইস্থানে উপস্থিত হইল না। অপরাপর বুকমেকারগণ সপ্তম বাজির টিকিট সকল বিক্রয় করিতে আরম্ভ করিলেন। ক্রমে সপ্তম বাজিও শেষ হইয়া গেল। কিন্তু হবসন্ কোম্পানীর আর কেহই, সেই স্থানে আগমন করিল না। সকলেই তখন বেশ বুঝিতে পারিলেন যে, তাঁহারা জুয়াচোরের হস্তে পড়িয়া, বিশেষরূপ প্রতারিত হইয়াছেন। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

এইরূপ জুয়াচুরি ব্যবসা অবলম্বন করিয়া, গেভিন সাহেব একবারে দুই সহস্র মুদ্রা একদিবসে হস্তগত করিলেন। এবার তাঁহার আশা আরও উচ্চ হইয়া পড়িল, যাহাতে আরও অধিক পরিমাণে অর্থ কোনরূপে হস্তগত করিতে পারেন, ক্রমে সেই চিন্তাতেই দিন অতিবাহিত করিতে লাগিলেন। এক্ষণে তাঁহার মনের গতি যে কত দিকে চলিতে লাগিল, তাহা কে বলিতে পারে? 

পুনরায় ঘোড়দৌড়ের দিন আসিয়া উপস্থিত হইল, পুনরায় তিনি আবশ্যক দ্রব্য সকল প্রস্তুত করাইয়া, পুনরায় ঘোড়দৌড়ে যাইবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইলেন। যে স্থানে সাইনবোর্ড স্থাপিত করিয়া, ইতিপূর্ব্বে তিনি বুকমেকারের কার্য্য করিয়াছিলেন, এবার আর সেই স্থানে গমন করিলেন না। এবার তাহা অপেক্ষা আরও উচ্চ স্থানে অর্থাৎ যে স্থানে দ্বিতীয় শ্রেণীর বুকমেকারগণ টিকিট বিক্রয় করিয়া থাকেন, তিনি সেই স্থানে গমন করিলেন। সেই স্থানে বুকমেকারের কার্য্য করিতে হইলে, ঘোড়দৌড় সভাতে যে পরিমিত টাকা জমা রাখিতে হয়, এবার তিনি সেই টাকা, জমা করিয়া দিলেন। তাঁহার হস্তে সেই সময় দুই সহস্র মুদ্রারও অধিক ছিল; সুতরাং অনায়াসেই তিনি টাকা জমা দিতে সমর্থ হইলেন। 

দ্বিতীয় শ্রেণীর বুকমেকারগণ যে স্থানে আপন আপন সাইনবোর্ডের সহিত দণ্ডায়মান হইয়া, টিকিট বিক্রয় করিয়া থাকেন, এবার সেইস্থানে তিনি আপন নাম পরিবর্ত্তন করিয়া, রবার্ট কোম্পানী নামে আপনার পরিচয় প্রদান করিলেন! এবার তিনি যে নূতন সাইনবোর্ড প্রস্তুত করাইয়াছিলেন, তাহাতে রবার্ট কোম্পানীর নাম লিখিত হইয়াছিল, ও টিকিট সকল সেই নামে মুদ্রিত হইয়াছিল। 

যে সকল ব্যক্তি, বাজি রাখিবার উদ্দেশে টিকিট খরিদ করিয়া, দ্বিতীয় শ্রেণীর বুকমেকারদিগের স্থানে গমন করেন, তাঁহারা ইচ্ছা করিলে, বাহিরে অর্থাৎ যে স্থানে তৃতীয় শ্রেণীর বুকমেকারগণ থাকেন, সেই স্থানে আসিতে পারেন। কিন্তু যে স্থানে প্রথম শ্রেণীর বুকমেকারগণের কার্য্যস্থান, সেই স্থানের স্বতন্ত্র টিকিট খরিদ না করিলে, আর তাঁহারা সেই স্থানে গমন করিতে পারেন না। কিন্তু প্রথম শ্রেণীর বুকমেকারগণের কার্য্যস্থানে যাহারা টিকিট খরিদ করিয়া, গমন করেন, তাঁহারা ইচ্ছা করিলেই, দ্বিতীয় শ্রেণীর বুকমেকারদিগের নিকট আসিয়া থাকেন। আর তৃতীয় শ্রেণীর বুকমেকারদিগের নিকট গমন করিতেও তাঁহাদিগের কোনরূপ বাধা থাকে না। 

দ্বিতীয় শ্রেণীর বুকমেকারদিগের স্থানে যাঁহারা গমন করেন, তাঁহারা প্রায়ই মধ্যমাবস্থার লোক ও তাঁহাদিগের মধ্যে দুই চারিশত টাকার অধিক প্রায় কেহই বাজি রাখেন না। কিন্তু প্রথম শ্রেণীতে যাঁহারা গমন করেন, তাঁহাদিগের মধ্যে সকলেই প্রায় প্রধান লোক, এবং তাঁহাদিগের মধ্যে অনেকেই দুই দশ হাজার টাকার বাজি রাখিয়া, ঘোড়ার নামীয় টিকিট খরিদ করেন। প্রথম শ্রেণীর বুকমেকারদিগের নিকট যে ঘোড়ার নামীয় টিকিটের যে দাম দেওয়া হয়, সময় সময় দ্বিতীয় শ্রেণীর বুকমেকারগণ ওই ঘোড়ার নামীয় টিকিটের দর অধিক দেন। এরূপ অবস্থায় প্রথম শ্রেণীর লোক আসিয়াও সময় সময় দ্বিতীয় শ্রেণীর বুকমেকারদিগের নিকট টিকিট খরিদ করিয়া থাকেন। 

প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর বুকমেকারগণের কাৰ্য্য এত অধিক হইয়া পড়ে যে, তাঁহারা টিকিটের উপর ঘোড়ার নাম পৰ্য্যন্ত বেশ স্পষ্ট করিয়া, লিখিয়া দিতে সমর্থ হন না। প্রায় ঘোড়ার নামের আদ্য অক্ষর লিখিয়া, অস্পষ্ট ভাবে নামের অবশিষ্ট লিখিয়া দেন। এই দুই স্থানের ক্রেতা ও বিক্রেতা, প্রায়ই সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি; সুতরাং কেহ কাহাকেও অবিশ্বাস করেন না, এবং প্রায়ই কোনরূপ গোলোযোগ ঘটে না। 

এই অবস্থা জানিতে পারিয়া, গেভিন সাহেব একটিবিশেষরূপ সুযোগের অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। অপরাপর বুকমেকারগণ সেইস্থানে যেরূপভাবে কার্য্য করিয়া থাকেন, তিনিও প্রত্যেক বাজিতেই বিশেষ ভদ্রতার সহিত দেনা- পাওনা মিটাইতে লাগিলেন। এইরূপে চারি বাজি ঘোড়দৌড় হইয়া গেল। পঞ্চম বাজিতে এগারটা ঘোড়া দৌড়াইবে। নিয়মিতরূপ সেই সকল ঘোড়ার টিকিট সকল বিক্রয় হইতে লাগিল। সেই এগারটা ঘোড়ার মধ্যে সর্ট (Short) এবং সাউট (Shout) নামীয় দুইটি ঘোড়া ছিল, সর্টের নামীয় টিকিট প্রথমাবধিই তিন টাকা হইতে চারি টাকাতেই বিক্রীত হইতেছিল, এবং সাউটের টিকিট দুই টাকা হইতে তিন টাকার মধ্যেই ছিল। সেই সকল ঘোড়া দৌড়িবার, আন্দাজ দশ মিনিট পূর্ব্ব হইতেই সর্টের টিকিটের দাম একবারে কমিয়া গেল, কি প্রথম শ্রেণীর বুকমেকারগণ কি দ্বিতীয় শ্রেণীর বুকমেকারগণ সকলেই সেই ঘোড়ার টিকিট বিক্রয় একেবারে বন্ধ করিয়া দিলেন। যদি কেহ বিক্রয় করিতে লাগিলেন, তিনি টাকায় চারি হইতে আট আনার অধিক দাম দিতে সম্মত হইলেন না। অর্থাৎ যিনি একশত টাকা দিয়া, টিকিট খরিদ করিবেন, সেই ঘোড়া জিতিলে, তিনি তাঁহার নিজের টাকা ও অধিক পঁচিশ বা পঞ্চাশ টাকা প্রাপ্ত হইবেন। 

সর্টের টিকিটের মূল্য এত কমিয়া যাওয়ায়, সকলেই অনুমান করিলেন যে, ভিতরের কথা বোধ হয়, প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে; সর্ট এবার নিশ্চয়ই বাজি মারিবে। 

গেভিন সাহেব এই অবস্থা জানিতে পারিয়াও, তিনি কিন্তু সেই ঘোড়ার নামীয় টিকিটের দর কমাইলেন না। তাঁহার দাম সেই দশ মিনিটের নিমিত্তই চারি টাকা রহিল। এই সংবাদ প্রথম শ্রেণীর স্থানের সম্ভ্রান্ত লোকগণ যেমন জানিতে পারিলেন, অমনি অনেকেই সেই স্থানে আসিয়া, গেভিন সাহেবের নিকট হইতে সর্ট ঘোড়ার টিকিট খরিদ করিতে আরম্ভ করিলেন। কেহ একশত, কেহ দুই শত, কেহ এক হাজার, কেহ পাঁচ হাজার টাকার টিকিট খরিদ করিবার নিমিত্ত গেভিন সাহেবের হস্তে টাকা প্রদান করিতে লাগিলেন। গেভিন সাহেবও সেই সকল টাকা লইয়া, নিয়মিতরূপ টিকিট প্রদান করিতে লাগিলেন। সেই দশ মিনিটের মধ্যে অনুমান পঁচিশ হাজার টাকার টিকিট গেভিন সাহেব বিক্রয় করিলেন। 

সকলে যেরূপ অনুমান করিয়াছিল, ঘটিলও ঠিক সেই প্রকার; দৌড়ে সর্ট ঘোড়াই সর্ব্বপ্রথম স্থান অধিকার করিল। 

এবার কিন্তু গেভিন সাহেব সেই স্থান পরিত্যাগ করিয়া, প্রস্থান করিলেন না। অপরাপর বুকমেকারগণের ন্যায় তিনি আপন স্থানে দণ্ডায়মান হইয়া, যাঁহার যে প্রাপ্য টাকা তাহা প্রদান করিতে লাগিলেন। যে সকল ব্যক্তি তাঁহার নিকট হইতে সর্ট ঘোড়ার টিকিট খরিদ করিয়াছিলেন, তাঁহারা সকলে আসিয়া, আপন আপন টাকা পাইবার প্রত্যাশায় তাঁহার নিকট উপস্থিত হইলেন। তিনি তাঁহাদিগের দুই একজনের নিকট হইতে তাঁহার বিক্রীত টিকিট গ্রহণ করিয়া কহিলেন, “কি মহাশয়! আপনি এত বড় সম্ভ্রান্তশালী ব্যক্তি হইয়া, এইরূপ অকপট ক্ষুদ্র বুকমেকারকে প্রতারিত করিতে আসিয়াছেন।” 

গেভিন সাহেবের কথা শুনিয়া, তিনি মনে মনে একটু ক্রুদ্ধ হইলেন, ও কহিলেন, “আমি আপনাকে প্রতারিত করিতে আসিয়াছি, একথা আপনি কিরূপে বলিতেছেন? আমি অর্থ দিয়া, যে ঘোড়ার টিকিট আপনার নিকট ইহতে খরিদ করিয়াছি, তাহার প্রাপ্য টাকা কোথায় আপনি আমাকে প্রদান করিবেন, না আপনি আমাকেই জুয়াচোর বলিতেছেন; ইহা আপনার পক্ষে নিতান্ত অন্যায়।” 

গেভিন। আমি কি অন্যায় কথা বলিয়াছি, আপনি কোন্ ঘোড়ার নামীয় টিকিট আমার নিকট হইতে খরিদ করিয়াছিলেন, ও কোন্ ঘোড়ার নিমিত্ত অর্থ প্রার্থনা করিতেছেন? 

ভদ্রলোক। কেন, আমি সর্ট নামক ঘোড়ার টিকিট খরিদ করিয়াছি। 

গেভিন। না, আপনি সর্ট নামক ঘোড়ার টিকিট খরিদ করে নাই, আপনি খরিদ করিয়াছেন (Shout) নামক ঘোড়ার টিকিট। আপনার টিকিট ত এখনও বর্তমান, একবার ভাল করিয়া দেখুন না কেন, তাহা হইলেই আর গোলযোগ থাকিবে না। 

এই বলিয়া, গেভিন সাহেব সেই টিকিট খানি সেই সম্ভ্রান্ত লোকের হস্তে প্রদান করিলেন। তিনি সেই টিকিটখানি উত্তমরূপে দেখিয়া কহিলেন, “আপনি যেরূপ অস্পষ্টভাবে লিখিয়া দিয়াছেন, তাহাতে সর্টও পড়া যায়, সাউটও পড়া যায়। যাহা হউক, যখন আমি সেই সময় স্পষ্ট করিয়া, আপনার নিকট হইতে লিখাইয়া লই নাই, তখন আপনার সহিত অনর্থক বাক্‌বিতণ্ডা করিয়া, আমি আর কি করিব? ঘোড়দৌড় সভার সভ্যগণের হস্তে উহা অর্পণ করিব, তাঁহারা ইহার যেরূপ বিচার করিবেন, সেইরূপই হইবে। 

উহাদিগের উভয়ের মধ্যে যে সকল কথাবার্তা হইল, তাহা শুনিয়া, অপরাপর সম্ভ্রান্ত লোকগণ যাঁহারা তাঁহাদিগের টাকার নিমিত্ত আগমন করিয়াছিলেন, তাঁহারাও আপন আপন টিকিট একবার পড়িয়া দেখিলেন। দেখিলেন, তাঁহাদিগের টিকিটও সেইরূপ অস্পষ্ট ভাবে লেখা, সর্টও পড়া যায়, সাউটও পড়া যায়। তথাপি তাঁহারা একবার গেভিন সাহেবকে কহিলেন, “দেখুন দেখি মহাশয়! আমাদিগের এ কোন্ ঘোড়ার নামীয় টিকিট।” 

গেভিন সাহেব তাঁহাদিগের হস্ত হইতে এক একখানি টিকিট গ্রহণ করিয়া, দেখিতে লাগিলেন, ও উহা ফিরাইয়া দিতে দিতে কহিলেন, “আপনাদেরও সাউট ঘোড়ার টিকিট।” 

এবার তাঁহাদিগের সকলের মনে বেশ বিশ্বাস হইল যে, রবার্ট কোম্পানী যিনিই হউক না কেন, তিনি একজন মহা জুয়াচোর। 

আমরা ইহাও জানিতে পারিয়াছিলাম যে, সেই সকল সম্ভ্রান্ত লোক তাঁহাদিগের সেই সকল টিকিট ঘোড়দৌড় সভার সভ্যগণের নিকট প্রদান করিয়াছিলেন, এবং তাঁহারাও ইহার বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিয়াছিলেন; কিন্তু রবার্ট কোম্পানীকে কোনরূপে দায়িক করিতে পারেন নাই। 

পাঠকগণ, দেখুন দেখি, কি ভয়ানক জুয়াচুরি। একদিবস কতকগুলি লোকের সর্ব্বনাশ করিয়া, গেভিন সাহেব বিশ ত্রিশ হাজার টাকা লাভ করিলেন। 

ইহার পর আর যে কয়দিবস ঘোড়দৌড় হইয়াছিল, গেভিন সাহেব আর কোনরূপ জুয়াচুরি করিলেন না। বিশেষরূপ বিবেচনার ও সতর্কতার সহিত টিকিট বিক্রয়-পূর্ব্বক অপরাপর বুকমেকারদিগের ন্যায় কিছু কিছু লাভই করিতে লাগিলেন। 

এইরূপে সেই বৎসর অতীত হইয়া গেল। সেই বৎসরের ঘোড়দৌড় ব্যাপার শেষ হইয়া গেলে, গেবিন সাহেব হিসাব করিয়া দেখিলেন, দুই টাকামাত্র মূলধন লইয়া, তিনি যে কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন, সেই কার্য্যের নিমিত্ত এখন তাঁহার পঞ্চাশ হাজার টাকার সংস্থান হইয়াছে। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পর বৎসর পুনরায় ঘোড়দৌড়ের সময় আসিয়া উপস্থিত হইল, এবার রবার্ট কোম্পানী জনসাধারণে বাহির হইল না। এবার সেমুয়েল কোম্পানী নামীয় আর একটি নূতন ফারম প্রথম শ্রেণীর বুকমেকারদিগের নিকট একটি স্থান অধিকার করিল। পাঠক পাঠিকাগণকে বোধ হয়, বলিয়া দিতে হইবে না; সেমুয়েল কোম্পানী আমাদিগের পূর্ব্ব-পরিচিত সেই মহাত্মা গেভিন সাহেব। এবার গেভিন সাহেব একাকী সেই কার্য্যে প্রবৃত্ত হইলেন না, বেতন দিয়া, সেই কার্যদক্ষ এরূপ আর একজন ইংরাজকে নিযুক্ত করিলেন, ও কার্য্য পরিচালনের ভার এবার তাঁহার হস্তে প্রদান করিলেন। তিনি এবার বুকমেকারের কার্য্য করিতে লাগিলেন। গেভিন সাহেব সদাসৰ্ব্বদা সেই স্থানে উপস্থিত থাকিতেন বটে; কিন্তু নিজ হস্তে আর টিকিট প্রভৃতি বিক্রয় করিতেন না। 

যেস্থানে প্রথম শ্রেণীর বুকমেকারগণের টিকিট বিক্রয় করিয়া থাকেন, সেই স্থানে প্রবেশের জন্য যে সকল সম্ভ্রান্ত লোক টিকিট খরিদ করিয়া, সেই স্থানে গমন করিতে পারেন; ইচ্ছা করিলে, তাঁহারা আর একটি স্থানে গমন করিতেও সমর্থ হন। অর্থাৎ যে স্থানে ঘোড়দৌড়ের ঘোড়া সকল প্রস্তুত হয়, যে স্থানে ঘোড়া সকলকে ওজন করান হয়, যে স্থানে আরোহিগণ আপন আপন নির্দ্দিষ্ট ঘোড়ার উপর সোয়ার হইবার নিমিত্ত প্রস্তুত হন, সেই স্থানে যদি সেই সমস্ত সম্ভ্রান্ত লোকের মধ্যে কেহ গমন করিতে ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে সেই স্থানে প্রবেশের নিমিত্ত নির্দ্দিষ্ট মূল্যের যে টিকিট আছে, তাহা খরিদ করিলে, তাঁহার সেই স্থানে গমন করিবার অধিকার জন্মে। 

এ সুযোগ গেভিন সাহেব সহজে পরিত্যাগ করিবেন কেন? নিয়মিত মূল্যে টিকিট খরিদ করিয়া, তিনি সেই স্থানে প্রবেশ করিলেন। 

যে সকল ব্যবসায়ী—আরোহীগণ ঘোড়দৌড়ের সময় ঘোড়দৌড়ের ঘোড়ায় চড়িয়া, ঘোড়া দৌড় করাইয়া থাকেন, সেই সকল আরোহি (Jockey) দিগের সহিত তিনি দুই চারিদিবসের মধ্যেই বিশেষরূপ বন্ধুত্ব করিয়া ফেলিলেন। উহাদিগের কাহারও সহিত সদ্ব্যবহার করিয়া, কাহাকেও মদ্যপান করাইয়া, কাহাকেও হোটেলে লইয়া গিয়া, এবং কাহাকেও বা নগদ কিছু অর্থ দিয়া, ক্রমে সকলকে বশীভূত করিয়া লইলেন। যে ঘোড়া যেরূপ, কোন্ ঘোড়ার কিরূপ দোষগুণ আছে, কোন্ ঘোড়া কোন বাজি মারিতে সম্পূর্ণরূপে পারক, তাহা এইরূপ উপায়ে তিনি তাঁহাদিগের নিকট হইতে ক্রমে অবগত হইয়া, সেই সকল ঘোড়ার নামীয় টিকিট তিনি অপর বুকমেকারের নিকট হইতে খরিদ করিয়া লইতে আরম্ভ করিলেন, ও সেই সকল ঘোড়া বাজি জিততে পারিলে, তাহার লাভের মধ্য হইতে কিয়দংশ যে জকী সেই ঘোড়ার কথা তাঁহাকে বলিয়া দিয়াছিল, তাঁহাকে প্রদান করিতে লাগিলেন। এইরূপ উপায়ে তিনি প্রায় বাজি জিতিয়া দিন দিন অর্থের সংস্থান করিতে লাগিলেন। 

তাঁহার এই সকল কাৰ্য্য দেখিয়া, অনেকেই অনুমান করিতে লাগিলেন যে, গেভিন সাহেব যে সকল ঘোড়ার টিকিট খরিদ করেন, সেই সকল ঘোড়া নিশ্চয়ই বাজি জিতিবে। এই বিশ্বাসের উপর নির্ভর করিয়া, তাঁহার টিকিট খরিদ করিবার সময় অনেকেই তাঁহার পশ্চাদগামী হইতে লাগিলেন; এবং সময় সময় তাঁহার দৃষ্টান্তের উপর নির্ভর করিয়া, অনেকে দুই একটি বাজিও জিতিতে লাগিলেন। 

গেভিন সাহেব এইরূপে আর এক সুযোগ পাইয়া, একটু জুয়াচুরি করিতে আরম্ভ করিলেন। তাহার দৃষ্টান্ত এই স্থানে একটি প্রদান করিতেছি। 

মনে করুন, এক বাজিতে সাতটি ঘোড়া দৌড়াইবে। তাহার মধ্যে ডায়মণ্ড (Diamond) নামক একটি ঘোড়া আছে। তাহার বাজি জিতিবার কোনরূপ সম্ভাবনা নাই। গেভিন সাহেব জকীদিগের নিকট হইতে দ্রুতবেগে চলিয়া আসিলেন। পূর্ব্বে যে সময় তিনি জকীদিগের নিকট গমন করেন, সেই সময় তিনি তাঁহার বুকমেকার কর্ম্মচারীকে কিছু উপদেশ দিয়া গিয়াছিলেন। যে সময় গেভিন সাহেব দ্রুতগতি বাহির হইয়া আসিয়াছিলেন, সেই সময় সকলের বোর্ডেই ডায়মণ্ড ঘোড়ার দাম লেখা ছিল, চারি টাকা হইতে পাঁচ টাকা। গেভিন সাহেবকে বাহিরে আসিতে দেখিয়া, তাঁহার বুকমেকার, ডায়মণ্ড ঘোড়ার টিকিটের দাম একবারে সকলের দাম অপেক্ষা চড়াইয়া দিলেন। অর্থাৎ উহার দাম লিখিয়া দিলেন, একবারে ছয় টাকা। 

গেভিন সাহেব বাহিরে আসিয়াই, তাঁহার পকেট হইতে একবারে সহস্র মুদ্রার একখানি নোট বাহির করিয়া, তাঁহারই সেই কর্মচারীর হস্তে প্রদান পূর্ব্বক ডায়মণ্ড ঘোড়ার টিকিট খরিদ করিলেন। গেভিন সাহেব যেরূপ ভাবে জকিদিগের স্থান হইতে বাহিরে আগমন করিলেন, তাহা দেখিয়া, সেই স্থানে যাঁহারা উপস্থিত ছিলেন, তাঁহারা সকলেই ভাবিলেন, গেভিন সাহেব নিশ্চয়ই কোন না কোন প্রকারের গুপ্ত সংবাদ জানিতে পারিয়াছেন। এই ভাবিয়া, তাঁহারও গেভিন সাহেবের পশ্চাৎ পশ্চৎ আগমন করিলেন, এবং যখন দেখিতে পাইলেন যে, তিনি একবার সহস্র মুদ্রায় ডায়মণ্ড ঘোড়ার টিকিট খরিদ করিলে, তখন তাঁহারাও একটু ব্যস্ত হইয়া, সেই ঘোড়ার টিকিট খরিদ করিতে অগ্রবর্তী হইলেন, এবং দেখিতে দেখিতে অনেকেই গেভিন সাহেবের অনুবর্ত্তী হইয়া, সে ঘোড়ার টিকিট খরিদ করিতে আরম্ভ করিলেন। যাঁহার এইরূপে ডায়মণ্ড ঘোড়ার টিকিট খরিদ করিয়াছিলেন, তাঁহাদিগের মনে বেশ প্রতীতি জন্মিয়াছিল যে, ডায়মণ্ড ঘোড়া নিশ্চয়ই সেই বাজি জিতিবে; কিন্তু কার্য্যে তাহা ঘটিল না। দৌড়কালীন ডায়মণ্ড ঘোড়া প্রথম হওয়া দূরে থাকুক, দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থানেও তাহার নাম দেখিতে পাওয়া গেল না। 

ডায়মণ্ড ঘোড়া প্রথম হইলেও হইতে পারে, ইহা জানিতে পারিয়া গেভিন সাহেব যে হাজার টাকার টিকিট খরিদ করিয়াছিলেন, তাহা নহে; তিনি বেশ জানিতেন যে, সেই ঘোড়া কোনরূপেই বাজি জিতিতে পারিবে না। অথচ তিনি যখন তাঁহার নিজের টিকিট বিক্রয়ের স্থান হইতে টিকিট খরিদ করিতেছেন, তখন সেই ঘোড়া প্রথম না হইলেও, সেই হাজার টাকা লোকসান হইবার কোনরূপ সম্ভাবনা নাই। অথচ তাঁহার পথ অবলম্বন করিয়া অপর যে কোন ব্যক্তি তাঁহার টিকিট বিক্রয়ের স্থান হইতে যত টাকার টিকিট খরিদ করিবেন, সেই টাকা তাঁহারই লাভ হইবে। তিনি আরও বেশ জানিতেন যে, যে সকল ব্যক্তি ডায়মণ্ড ঘোড়ার টিকিট খরিদ করিবেন, তাঁহাদিগকে তাঁহারই টিকিট বিক্রয়ের স্থান হইতে টিকিট খরিদ করিতে হইবে। কারণ, তাঁহারই বিক্রয়ের দর অপরাপর সকল টিকিট বিক্রয়কারীর দর অপেক্ষা অধিক। 

বলা বাহুল্য যে, এইরূপে ডায়মণ্ড ঘোড়ার টিকিট বিক্রয় করিয়া, দশ বার মিনিটের মধ্যে গেভিন সাহেব অনেকগুলি অর্থের সংস্থান করিয়া লইলেন। 

এইরূপ উপায়ে কতক টাকার টিকিট, যে তাঁহার টিকিট বিক্রয়ের স্থান হইতে বিক্রীত হইবে, তাহা তিনি বেশ জানিতেন; কিন্তু এত অল্প সময়ের মধ্যে তিনি যে এতগুলি টাকা লাভ করিতে পারিবেন, তাহা কিন্তু তিনি একবারের নিমিত্তও ভাবিয়াছিলেন না। 

ঘোড়দৌড়ে গেভিন সাহেবের অর্থ উপার্জ্জনের আর একটি উপায় এইরূপ। যে সকল ঘোড়ার বাজি জিতিবার সম্ভাবনা, তাহার অধিকাংশ সংবাদ তিনি পূর্ব্ব হইতেই জানিতে পারিতেন। যে সকল “জকী” সেই সকল ঘোড়ায় অরোহণ করিত, বা সেই সকল ঘোড়ার ফেরি করিত, সেই সকল জকীদিগের নিকট হইতে তিনি অনেক সংবাদ পূৰ্ব্ব হইতেই অবগত হইতে পারিতেন। যে উপায়ে তিনি এই সংবাদ অবগত হইতে পারিতেন, তাহা অনেকেই অবগত ছিলেন না। কোন্ ঘোড়া প্রথম বা দ্বিতীয় হইবার সম্ভাবনা, এই সংবাদ যেমন তিনি জানিতে পারিতেন, অমনি সেই সকল ঘোড়ার টিকিটের মূল্য তাঁহার বোর্ডে সকলের নিম্নলিখিত মূল্য অপেক্ষা কম করিয়া দিতেন। সুতরাং সেই ঘোড়ার টিকিট তাঁহাকে প্রায় বিক্রয় করিতে হইতে না। কারণ, যে বুকমেকারগণের নিকট অধিকমূল্যে সেই টিকিট বিক্রীত হইত, সকলে তাঁহাদিগের নিকট হইতে উহা খরিদ করিতেন। সেই ঘোড়া প্রথম ইহলে, তাঁহাকে প্রায় কাহাকেও কিছু প্রদান করিতে হইত না। অথচ অপরাপর যে সকল ঘোড়ার টিকিট যে মূল্যে বিক্রীত হইত, তাহা তাঁহার লাভ হইত। 

এইরূপ উপায়ে তিনি যে অর্থ উপার্জ্জন করিতে পারিতেন, তাহার সমস্তই যে তিনি একাকী গ্রহণ করিতেন, তাহা নহে; যে সকল জকীদিগের নিকট তিনি যেরূপ সংবাদ প্রাপ্ত হইতেন, এবং কার্য্যে যদি সেইরূপ ফল ফলিত, তাহা হইলে সেই উপার্জিত অর্থ হইতে কিয়দংশ সেই সকল জকীকে প্রদান করিতেন। অর্থ পাইয়া জকীগণ ও তাঁহার উপর বিশেষরূপে সন্তুষ্ট হইত, ও যে সকল জকী যে কোন সংবাদ জানিতে পারিত, তখনই সে তাহা গেভিন সাহেবকে প্রদান করিত। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

এইরূপে কার্য্য করিতে করিতে, সেমুয়েল কোম্পানীর প্রতিপত্তি বিশেষরূপ বাড়িতে লাগিল। এদিকে গেভিন সাহেব, ঘোড়দৌড়ের ঘোড়া চিনিতে যে একজন অদ্বিতীয় ব্যক্তি, তাহাও লোকমুখে চারিদিকে প্রচারিত হইয়া পড়িতে লাগিল। ঘোড়দৌড়ের ঘোড়ার স্বত্বাধিকারিগণ ক্রমে তাঁহাকে বিশেষরূপ খাতির করিতে লাগিলেন, জকীগণ তাঁহাকে বিশেষরূপ মান্য করিতে লাগিলেন। আপামর সাধারণ সকলে তাঁহার অনুকরণে চলিতে আরম্ভ করিল, ঘোড়দৌড় সম্বন্ধীয় তাঁহার কথা, সকলে যেন বেদবাক্য বলিয়া বিশ্বাস করিতে লাগিল। 

গেভিন সাহেবও এই সকল সুযোগ পাইয়া, মধ্যে মধ্যে এক একবার এরূপ ভাবে জুয়াচুরি করিতে লাগিলেন যে, তাঁহার জুয়াচুরির ভিতর সহজে কেহই দত্তস্ফুট করিতে পারিলেন না। এখন কিন্তু গেভিন সাহেব সামান্য সামান্য জুয়াচুরির দিকে দৃষ্টিপাত করিতেন না, যে কার্য্য করিলে, তিনি একবারে অধিক টাকা পাইতে পারেন, মধ্যে মধ্যে এইরূপ জুয়াচুরি করিতেন, এবং এক একবারে বিস্তর অর্থও উপার্জ্জন করিতেন। একদিবসের একটি ঘটনার কথা এই স্থানে বলি, তাহা হইলে পাঠক-পাঠিকাগণ ইহার উচ্চদরের জুয়াচুরির বিষয় কিয়ৎ পরিমাণে অবগত হইতে পারিবেন। 

এক বাজিতে সাতটি ঘোড়া দৌড়াইবে। তাহার ভিতর একটি ঘোড়া সর্ব্বোৎকৃষ্ট আছে। সেই ঘোড়া যখন দৌড়াইয়াছে, তখনই উহা অপরাপর সকল ঘোড়াকে পরাজয় করিয়াছে; কারণ, একে ত ঘোড়া যতদূর ভাল হইতে হয়, তাহার উপর সেই ঘোড়াতে যে জকী আরোহণ করিবে, তাহার মত উৎকৃষ্ট জকী প্রায়ই নাই। এরূপ অবস্থায় একরূপ স্থিরই হইয়া গেল যে, সেই ঘোড়া নিশ্চয়ই বাজি জিতিবে। সেই ঘোড়ার টিকিটের দর প্রথম হইতে আর বাড়িল না। প্রথমতঃ কোন কোন বুকমেকারগণ সেই ঘোড়ার টিকিট এক টাকা মূল্যে বিক্রয় করিতেছিলেন, অর্থাৎ একশত টাকার টিকিট খরিদ করিলে, যদি সেই ঘোড়া জিতিতে পারে, তাহা হইলে তিনি নিজের একশত টাকা, ও বাজির একশত টাকা পাইবেন; কিন্তু সেই দর ক্রমে কমিতে আরম্ভ হইল, এক টাকারস্থলে বার আনা, পরে আট আনা, পরিশেষে চারি আনায় উপস্থিত হইল। অর্থাৎ একশত টাকার টিকিট খরিদ করিলে, তিনি নিজের টাকার সহিত একশত পঁচিশ টাকা পাইবেন মাত্র। 

অপরাপর বুকমেকারগণ যেমন সেই ঘোড়ার টিকিটের দাম কমাইয়া দিয়া, চারি আনা করিলেন, সেমুয়েল কোম্পানীও তাহাই করিলেন। 

সেই সময় গেভিন সাহেব ঘোড়া ও জকীদিগের নিকট হইতে বাহিরে আসিয়া, সেমুয়েল কোম্পানীর নিকট গিয়া উপস্থিত হইলেন, এবং অপরাপর অনেক ব্যক্তি সমক্ষে কহিলেন, “সেই ঘোড়ার টিকিটের মূল্য যদি কিছু বাড়াইয়া দেন, তাহা হইলে তিনি কিছু টিকিট খরিদ করেন। 

সেমুয়েল কোং। আপনি কত টাকার টিকিট খরিদ করিবেন? 

গেভিন। এক সহস্র টাকার। 

সেমুয়েল কোং। আপনি কত দাম দিতে চাহেন? 

গেভিন। বার আনা। 

সেমুয়েল কোং। তাহা কিছুতেই হইতে পারে না? 

গেভিন। আচ্ছা, আট আনা। 

সেমুয়েল কোং। আট আনায় আমি বিক্রয় করিতে পারিব না। কারণ, সেই ঘোড়া যে, বাজি জিতিবে, তাহা একরূপ প্রায় স্থিরই হইয়া গিয়াছে। আপনি যদি অধিক টাকার টিকিট খরিদ করেন, তাহা হইলে কিছু বাড়াইয়া দিতে পারি। 

গেভিন। অধিক টাকা? 

সেমুয়েল কোং। হাঁ মহাশয়! 

গেভিন। কত টাকা? 

সেমুয়েল কোং। পাঁচ হাজার টাকার কম নহে। 

গেভিন। তাহা ইহলে আপনি কি দর দিতে প্রস্তুত? 

সেমুয়েল কোং। আমি ছয় আনা পৰ্য্যন্ত দিতে পারি। 

গেভিন। কিছু অধিক? 

সেমুয়েল কোং। না মহাশয়! ইহা অপেক্ষা অধিক দাম দিতে, আমি কোনরূপেই সমৰ্থ নহি। 

গেভিন। আচ্ছা তাহাই দিন। 

এই বলিয়া, গেভিন সাহেব হাজার টাকা করিয়া, পাঁচখানি পাঁচ হাজার টাকার নোট বাহির করিয়া, প্রদান করিলেন, এবং টাকার ছয় আনা মূল্যে একখানি পাঁচ হাজার টাকার টিকিট খরিদ করিয়া, স্থানান্তরে গমন করিলেন। 

উহার পরই রাশি রাশি টাকা আসিয়া, সেমুয়েল কোম্পানীর নিকট উপস্থিত হইল। যে সকল ব্যক্তি গেভিন সাহেবের পশ্চাৎ পশ্চাৎ আগমন করিয়াছিলেন, তাঁহাদিগের মধ্যে কেহ পাঁচ হাজার, কেহ সাত হাজার, কেহ দশ হাজার, এইরূপে যাহার, যাহা মনে আসিতে লাগিল, তিনি সেইরূপ অর্থ প্রদান করিয়া ছয় আনা মূল্যে সেই ঘোড়ার নামীয় টিকিট খরিদ করিতে লাগিলেন। 

এইরূপে পনর মিনিটের মধ্যে সেমুয়েল কোম্পানী গেভিন সাহেবের পাঁচ সহস্র মুদ্রা ব্যতিরেকে প্রায় পঁচাত্তর হাজার টাকার টিকিট বিক্রয় করিয়া ফেলিলেন। সেই ঘোড়া প্রথম হইলে সেমুয়েল কোম্পানী বিস্তর টাকার দায়ী হইবেন। 

বাজি আরম্ভ হইল, ঘোড়া দৌড়াইল, সেই ঘোড়া প্রথম হইতে আরম্ভ করিয়া, প্রায় শেষ পর্য্যন্ত অগ্রে অগ্রে আসিতে লাগিল, কিন্তু বাজি মারিবার একশত গজ মাত্র বাকি থাকিতেই অপর আর একটি ঘোড়া ক্রমে তাহাকে অতিক্রম করিতে আরম্ভ করিল, এবং দেখিতে দেখিতে দ্বিতীয় ঘোড়াই বাজি মারিয়া দিল। সেই ঘোড়া যে নিতান্ত মন্দ ঘোড়া, তাহা নহে; কিন্তু সেই ঘোড়া প্রথম ঘোড়া অপেক্ষা উৎকৃষ্ট ছিল না। যাহা হউক, প্রথম ঘোড়া হটিয়া গেল, দ্বিতীয় ঘোড়া জিতিয়া গেল। একা এই বাজিতে গেভিন সাহেব পঁচাত্তর হাজার টাকা লাভ করিলেন। 

পরে জানিতে পারিয়াছিলাম, ইহার মধ্যে গেভিন সাহেবের সম্পূর্ণরূপ জুয়াচুরি ছিল। তিনি উভয় ঘোড়ার উভয় জকীকেই পূৰ্ব্ব হইতে হাত করিয়াছিলেন। প্রথম ঘোড়ার জকীকে তিনি একবারে পাঁচ সহস্র মুদ্রা ঘুস প্রদান করেন, সেই ঘুস প্রদানের অর্থ এই যে, তিনি যখন দেখিলেন যে, তাঁহার ঘোড়া বাজি মারিবার উপক্রম করিবে, সেই সময় তিনি সেই ঘোড়ার লাগাম একটু টানিয়া রাখিবেন, তাহা হইলে সেই ঘোড়া আর অগ্রগামী হইতে পারিবে না, তাহার পশ্চাদ্বর্তী ঘোড়া তাহার অগ্রে বাহির হইয়া পড়িবে। কেবলমাত্র পাঁচ সহস্র মুদ্রা তিনি সর্ব্বোৎকৃষ্ট জকীকে দিয়াই যে ক্ষান্ত ছিলেন, তাহা নহে; দ্বিতীয় জকীকেও সহস্র মুদ্রা প্রদান করিয়াছিলেন। সেই অর্থ প্রদানের উদ্দেশ্য এই ছিল যে, প্রথম জকী যেমন তাহার ঘোড়ার লাগাম একটু টানিয়া ধরিবে, অমনি দ্বিতীয় জকী তাহার ঘোড়াকে জোরে কশাঘাত করিয়া, প্রথম ঘোড়ার অগ্রগামী হইয়া পড়িবে। 

পাঠকগণ ভাবিয়া দেখুন দেখি, এ কিরূপ ভয়ানক জুয়াচুরি! ছয় হাজার টাকা ঘুস দিয়া, ঊনসত্তর হাজার টাকা পনর মিনিটের মধ্যে উপার্জ্জন; অথচ কাহারও কিছু বলিবার উপায় নাই। 

গেভিন সাহেব যে কেবল এইরূপ ভাবে জুয়াচুরি করিয়াই ক্ষান্ত ছিলেন তাহা নহে; ইহা ব্যতীত তিনি আরও যে সকল কার্য্য করিতেন, তাহারও দুই একটি দৃষ্টান্ত নিম্নে প্রদাত্ত হইল। 

যে স্থলে বুকমেকারগণ টিকিট বিক্রয় করিয়া থাকেন, সেইস্থানে নোটের যেরূপ ভাবে প্রচলন, তাহা যিনি দেখিয়াছেন, তিনিই বিশ্বাস করিবেন। আর যাঁহারা কখনও উহা দেখেন নাই, তাঁহারা আমার কথা সহজে বিশ্বাস করিতে চাহিবেন না। পঞ্চাশ টাকা, একশত টাকা, পাঁচশত টাকা ও হাজার টাকার নোট সেই স্থানে দেখিয়া লইবার সাবকাশ কাহারও নাই। প্রথম শ্রেণীর বুকমেকারগণ যে স্থানে টিকিট বিক্রয় করিয়া থাকেন, সেই স্থানে একখানি নোট পরীক্ষা করিয়া দেখিয়া লইতে বোধ হয়, এক সেকেণ্ড সময়ও প্রাপ্ত হন না, কেবল নোটের উপর অঙ্কপাতটি দেখিয়া লন মাত্র। 

এই প্রদেশে প্রচলিত নিয়ম আছে যে, যাঁহার হস্তে যে কোন নম্বরী নোট কার্য্য গতিকে পতিত হয়, তিনি সেই নোটের নম্বর, উহা কোথা হইতে প্রাপ্ত হইলেন, এবং কাহাকেই বা প্রদান করিলেন, তাহার রীতিমত হিসাব রাখিয়া থাকেন; কিন্তু সেই স্থানে সেই নিয়ম একবারেই প্রচলিত নাই। কোন্ বুকমেকার কোন্ নোট কাহার নিকট হইতে প্রাপ্ত হইলেন, এবং কাহাকেই বা প্রদান করিলেন, তাহার কিছুমাত্র হিসাব রাখেন না, বা বলিতেও পারেন না। কাহার, তথায় এরূপ গোলযোগ হয় যে, নোটের নম্বর রাখা দূরে যাউক, সময় সময় টাকার সংখ্যাও দেখিয়া উঠিতে পারা যায় না। 

গেভিন সাহেব এই সুযোগ অনেকদিবস পর্য্যন্ত লক্ষ্য করিয়া আসিতেছিলেন, কিন্তু এ পর্যন্ত সুবিধাজনক কিছুই করিয়া উঠিতে পারিতেছিলেন না। সেই সময় তাঁহার কোন এক পরিচিত ব্যক্তি তাঁহাকে কহিলেন, “একস্থানে অনেকগুলি চোরা নম্বরী নোট আছে, কিন্তু তিনি কোনরূপেই তাহা ভাঙ্গাইতে পারিতেছেন না।” 

বন্ধুর এই কথা শুনিয়া, গেভিন সাহেব কহিলেন, যত টাকার নম্বরী নোট থাকুক না কেন, তিনি অর্দ্ধেক মূল্যে পাইলে, তাহার সমস্তই গ্রহণ করিতে প্রস্তুত আছেন। 

উত্তরে তাঁহার সেই বন্ধু কহিলেন, আচ্ছা, তিনি তাহার যোগাড় দেখিতেছেন। 

উভয়ের মধ্যে এইরূপ কথাবার্তা হইবার পর, প্রায় পনরদিবসের মধ্যেই গেভিন সাহেব পঞ্চাশ হাজার টাকা প্রদান করিয়া, এক লক্ষ টাকার নম্বরী নোট খরিদ করিলেন। খরিদ করিবার সময় তাঁহার বন্ধু তাঁহাকে বলিয়াছিলেন, এই সকল নোটের নম্বর করেসি আফিসে ও সমস্ত কালেক্টরি আফিসে “স্টপ” করা আছে। 

গেভিন সাহেব সেই কথায় একবারের নিমিত্ত দৃপাত না করিয়াই, পঞ্চাশ হাজার টাকার পরিবর্তে, সেইসকল নোট গ্রহণ করিলেন। 

বলা বাহুল্য, সেই সকল নোট তিনি ঘোড়দৌড়ের স্থানেই এক একখানি করিয়া, চালাইয়া ফেলিবেন। ঘোড়দৌড়ের সময় যে সকল টিকিটের মূল্য তাঁহাকে প্রদান করিতে হইত, তাঁহাদিগকে তিনি সেই সকল নোটই প্রদান করিতেন। ঘোড়দৌড় হইতে যিনি নোট প্রাপ্ত হইতেন, তিনি জানিতেন না যে, উহা চোরা নোট; সুতরাং তিনি আবার সেই সকল নোট অপরকে প্রদান করিতেন, এইরূপে ক্রমে উহা করেসি আফিসে গিয়া উপস্থিত হইত, সেইস্থানে জানিতে পারা যাইত যে, উহা চোরা নোট। সেই সময় সেই সকল নোটের অনুসন্ধানের ভার পুলিসের হস্তে পতিত হইত। এইরূপ অনেক নোটের অনুসন্ধানের ভার আমার হস্তেও পতিত হইয়াছিল। করেসি আফিসে সেই নোট কে প্রদান করিয়াছে, এবং তিনিই বা উহা কাহার নিকট হইতে পাইয়াছেন, এইরূপ অনুসন্ধান করিতে করিতে, পরিশেষে যাহার নিকট আসিয়া উহার অনুসন্ধান শেষ হইত, তিনি গেভিন সাহেবের নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়াছেন, এই কথা বলিয়া দিতেন। গেভিন সাহেবকে জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি নির্ভয়চিত্তে বলিতেন যে, ‘আমি বলিতে পারি না যে, এই নোট ওই ব্যক্তিকে প্রদান করিয়াছি, কি না; আর যদি দিয়াই থাকি, তাহা হইলেও বলিতে পারি না যে এই নোট কোথা হইতে পাইয়াছি। কারণ, ঘোড়দৌড় স্থানে যে সকল নোট প্রাপ্ত হই, বা যে সকল নোট অপরকে প্রদান করি, তাহার কোনরূপ হিসাবই রাখি না।” 

গেভিন সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ হইলে তিনি এইরূপ কহিতেন, কিন্তু অনুসন্ধানের সকল সময় প্রায় তাহাকে পাওয়া যাইত না। কারণ, ঘোড়দৌড়ের সময় অতিবাহিত হইয়া গেলেই তিনি বিলাতে গমন করিতেন, ও পর বৎসর ঘোড়দৌড়ের সময় পুনরায় এ প্রদেশে আসিয়া উপস্থিত হইতেন। 

 এইরূপ উপায় অবলম্বনে গেভিন সাহেব অনেক টাকার চোরা নোট চালাইয়া দিলেন, কিন্তু তাঁহার কিছুই হইল না।

এইরূপ উপায়ে গেভিন সাহেব যে কেবলমাত্র চোরা নোট চালাইয়াই নিবৃত্ত থাকিতেন, তাহা নহে; যে সময় তাহার নিকট চোরানোট থাকিত না, সেই সময় তিনি জাল নোটের উপর দৃষ্টি করিতেন। হাজার হাজার টাকার এক এক কেতা জাল নোট তিনি পূর্ব্বোক্তরূপ উপায়ে অনায়াসেই সেই স্থানে চালাইয়া দিতেন। সেই সকল জাল নোট গেভিন সাহেব যে কোথা হইতে প্রাপ্ত হইতেন, তাহা কেহ জানিত না। পুলিস এ সম্বন্ধে বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিয়া, এ পর্যন্ত কিছুই বাহির করিয়া, উঠিতে সমর্থ হন নাই। অনেকেই অনুমান করিতেন যে, গেভিন সাহেব নিজেই জাল নোট প্রস্তুত করিয়া থাকেন। এই সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া, আমরা অনেকরূপ তাহার ভিতরের অবস্থা সকল জানিতে প্রাণপণে চেষ্টা করিয়াছি কিন্তু কিছুতেই কৃতকাৰ্য্য হই নাই। 

এ সম্বন্ধে আমাদিগের অনেকেরই ধারণা এই যে, গেভিন সাহেব এই স্থানে বসিয়া, সেই সকল নোট প্ৰস্তুত করিতেন না। যে সময় তিনি তাঁহার স্বদেশে অবস্থান করিতেন, সেই সময় সেইস্থানে বসিয়া, তিনি উহা প্রস্তুত করিতেন, বা সেইস্থানের অপর কাহাদ্বারা প্রস্তুত করাইয়া যে সময় এ প্রদেশে আগমন করিতেন, সেই সময় উহা লইয়া আসিতেন, এবং ঘোড়দৌড়ের সময় এক একখানি করিয়া সেই সকল নোট চালাইয়া দিতেন। 

পাঠক, এখন বুঝিতে পারিলেন কি যে, ঘোড়দৌড়ে কি না হয়? 

গেভিন সাহেবের নাম অবলম্বন করিয়া, যে চিত্র আজ আমি পাঠক-পাঠিকাগণের সম্মুখে উপস্থিত করিলাম, তাহা যে কেবল গেভিন নামক জনৈক সাহেবের চিত্র, তাহা নহে। যে সকল ব্যক্তি দেশের মধ্যে বিশেষরূপ গণ্যমান্য, যাঁহাদিগের মধ্যে অনেকেই এই দেশের মুখপাত্র বলিয়া, জনসমাজে প্রচারিত; ইহার ভিতর অনুসন্ধান করিলে, তাঁহাদিগের অনেকের চিত্রই আপনারা প্রাপ্ত হইবেন। তখন আপনারা বুঝিতে পারিবেন যে, যে সকল ব্যক্তিকে আপনারা সাধু জ্ঞানে দেশপূজ্য বলিয়া, মনে করিয়া থাকেন, তাঁহাদিগের কাহারও কাহারও চরিত্র ইহার ভিতর প্রদত্ত আছে। যে সকলবড় বড় ধনকুবের জমিদার বা রাজকর্মচারীগণকে আপনার বিশেষ ভক্তির চক্ষে দেখিয়া থাকেন, এই চিত্রের মধ্যে অনুসন্ধান করিয়া দেখুন, তাঁহাদিগের কাহারও কাহারও চরিত্র ইহার ভিতর দেখিতে পাইবেন। ঘোড়দৌড়ের ভিতর যে কি ভয়ানক কাণ্ড হইয়া থাকে, কিরূপে লোক সকল প্রতারিত হয়, তাহার যথাযথ বর্ণন করা আমার সাধ্যাতীত, এবং সমস্ত অবস্থা অবগত হইতে পারাও আমার পক্ষে একবারে অসম্ভব। তথাপি স্বচক্ষে দেখিয়া ও অনুসন্ধান করিয়া, যতদূর আমি অবগত হইতে পারিয়াছি, তাহাই আমি এই স্থানে বর্ণন করিতে সমর্থ হইলাম ও ইহাতেই আমার আশা আছে যে, এই প্রবন্ধ পাঠ করিয়া, ভবিষ্যতের জন্য অনেকেই সতর্ক হইবেন, এবং একটু দেখিয়া-শুনিয়া, ঘোড়দৌড়ে বাজি রাখিবেন। 

এই স্থানে আমার ইহা বলাও নিতান্ত আবশ্যক যে, ঘোড়দৌড় সভার সভ্যগণ যাহাতে এইরূপ জুয়াচুরি না হইতে পারে, তাহার নিমিত্ত সদাসর্বদা বিশেষ দৃষ্টি রাখেন, এবং প্রাণপণে সেই সকল জুয়াচুরি বন্ধ করিতে চেষ্টা করেন; 

কিন্তু সময় সময় তাঁহাদিগকেও জুয়াচোরগণের নিকট পরাজয় স্বীকার করিতে হয়। একরূপ জুয়াচুরির বিষয় অবগত হইয়া, যেমন তাঁহারা উহার প্রতিবিধানের চেষ্টা করিতে প্রবৃত্ত হইলেন, ভদ্রবেশধারী জুয়াচোরগণ কর্তৃক অমনি আর একটি নূতন উপায় বাহির হইয়া পড়িল। 

[ভাদ্র, ১৩০৬] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *