কামতাপ্রসাদ
(অর্থাৎ যেমন দস্যু, তেমনই জীবনী!)
প্রথম পরিচ্ছেদ
কামতাপ্রসাদ একজন অদ্ভুত লোক বলিয়া জন-সাধারণের নিকট পরিচিত। ‘অদ্ভুত লোক’ পাঠকগণের মধ্যে অনেকেই এই কথার অনেকরূপ অর্থ করিতে পারেন। কেহ ভাবিবেন, দয়া দাক্ষিণ্যে ও পরোপকার রতে কামতাপ্রসাদ সদাসৰ্ব্বদা লিপ্ত থাকেন বলিয়া, তাঁহাকে অদ্ভুত লোক আখ্যায় আখ্যাপিত করা হইয়াছে। কেহ মনে করিবেন, কামতাপ্রসাদ জাতীয় উন্নতিকল্পে আপন জীবন ও নিজ কার্য্য বিসর্জ্জন দিয়া, সর্ব্বসাধারণের কার্য্যে আপন জীবন অতিবাহিত করিতেছেন বলিয়াই অনেকে তাঁহাকে অদ্ভুত লোক বলিয়া থাকে। কেহ ভাবিবেন কামতাপ্রসাদ দৈবশক্তি- সম্পন্ন মহাপুরুষ, তাহাই সকলে তাঁহাকে অদ্ভুত লোক পরিচয়ে পরিচয় প্রদান করিয়া থাকেন। কিন্তু আমি তাঁহাকে অন্যচক্ষে দেখিয়া থাকি, দয়া-দাক্ষিণ্য ও পরোপকার তাঁহার মধ্যে আছে কি না, তাহা বলিতে পারি না –বুঝিতেও পারি নাই। জাতীয় উন্নতিকল্পে আপন জীবন, নিজ কার্য্য বিসর্জ্জন দিবার চেষ্টা তিনি কখন করিয়াছেন কি না, সে সংবাদও আমরা এ পর্যন্ত পাই নাই; তাঁহার দৈবশক্তিও কখন নয়নগোচর হয় নাই।
যে সকল কাৰ্য্যকে লোকে কুকাৰ্য্য বলিয়া থাকে, যে কার্য্যের নিমিত্ত জন-সমাজে সতত লাঞ্ছনীয় হইতে হয়, যে কার্য্যের ফল সর্ব্বদাই বিষময়, কামতাপ্রসাদকে সততই সেই কার্যে লিপ্ত থাকিতে দেখা যায়। বুঝিতে না পারিয়া বা ভ্রমবশতঃ যে কাৰ্য্য হঠাৎ করিয়া ফেলিলে জন-সমাজে যাহার নিমিত্ত মুখ দেখান ভার হইয়া পড়ে, কামতাপ্রসাদ সৰ্ব্বদাই সেইরূপ কাৰ্য্য লইয়া দিনযাপন করিয়া থাকে; তাহাতে তাহার কিছুমাত্র লজ্জা, ঘৃণা বা অপমান নাই। যে কুকাৰ্য্য করিবে বলিয়া সে মনে করে, সে কার্য্য তাহাকে করিতেই হইবে। শতবার নিষেধ করিলে, বা সহস্র বার প্রতিবন্ধক প্রাপ্ত হইলেও সে সেই কার্য্য করিতে কখন পরাম্মুখ হইবে না, ভীষণ প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হইয়া তাহাকে সেই কার্য্য করিতেই হইবে। ইহাতে সে লাঞ্ছিত, তিরস্কৃত, অপমানিত বা দণ্ডিত হইলেও সে তাহার সংকল্পিত কার্য্য কখনই পরিত্যাগ করিবে না। এই জগতে এমন কোন পাপকার্য্য নাই, যাহা কামতা প্রসাদ না করিয়াছে; এমন কোন নিন্দনীয় কাৰ্য্য নাই, যাহাতে তাহার হস্ত স্পর্শ করে নাই, এবং এমন কোন নৃশংস বা শোচনীয় কাৰ্য্য দেখিতে পাই না, যাহাতে কামতাপ্রসাদ কোন না কোন প্রকারে সম্মিলিত থাকে না।
কামতাপ্রসাদ অনেকবার রাজদ্বারে অভিযুক্ত হইয়াছে। কখন বা অব্যাহতি পাইয়াছে, কখন বা কারাদণ্ড ভোগ করিয়া হাসিতে হাসিতে বাহির হইয়া আসিয়াছে। এরূপ অবস্থায় কামতাপ্রসাদকে অদ্ভুত লোক না বলিয়া আর কি বলা যাইতে পারে? যাহার লোকনিন্দার ভয় নাই, সে অদ্ভুত লোক নয়তো কি?
এই অদ্ভুত কামতাপ্রসাদের যতই কেন দোষ থাকুক না, সে যেরূপই দুর্দান্ত হউক না কেন, কিন্তু তাহার একটি মহৎ ক্ষমতা আছে। তাহার বুদ্ধি অতিশয় তীক্ষ্ণ। এই বুদ্ধি যদি সে অন্যদিকে পরিচালিত করিত, তাহা হইলে বাস্তবিকই অদ্ভুত লোক বলিয়া তাহাকে উচ্চ আসন প্রদান করিতাম, ও জন-সাধারণের নিকট বাস্তবিকই সে অতিশয় পূজনীয় হইত।
কামতাপ্রসাদের বিস্তৃত বিবরণ এইস্থানে লিপিবদ্ধ করিয়া তাহার সম্পূর্ণ চিত্র পাঠকগণের সম্মুখে উপস্থিত করা আমার পক্ষে একেবারে অসম্ভব। কেবলমাত্র একটি মোকদ্দমায় আমি কামতাপ্রসাদের উপস্থিত কুবুদ্ধির যেরূপ পরিচয় পাইয়াছিলাম, তাহারই কিছু পরিচয় আমি এইস্থানে পাঠকগণের সম্মুখে উপস্থিত করিতেছি। ইহাতে পাঠকগণ তাহার কিঞ্চিৎ আভাস প্রাপ্ত হইবেন।
দশ বার বৎসর অতীত হইল, কামতাপ্রসাদ বড়বাজারের মাড়োয়ারি -পটিতে বাস করিত। যেস্থানে বাস করিত, তাহার সন্নিকটে এক ঘর এদেশীয় হতভাগিনীগণের বাস ছিল। ঐ বাড়ীর একটি স্ত্রীলোকের নিকট কামতা প্রসাদের যাতায়াত ছিল। ঐ স্ত্রীলোকটির অনেকগুলি অলঙ্কার ছিল। ঐ অলঙ্কারই পরিশেষে তাহার কাল হয়। ঐ অলঙ্কারের নিমিত্তই অপমৃত্যুতে তাহাকে ইহজগৎ পরিত্যাগ করিতে হয়। এক দিবস অতি প্রত্যূষে তাহার ঘরের মধ্যে তাহার মৃতদেহ পাওয়া যায়। গলায় কাপড় জড়াইয়া তাহাকে হত্যা করা হইয়াছিল। তাহাকে হত্যা করিয়া হত্যাকারী তাহার অলঙ্কারগুলি অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে। এই হত্যা-সংবাদ থানায় গিয়া কামতাপ্রসাদই প্রথম প্রদান করে। তাহারই সংবাদমত এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান আরম্ভ হয় ও নামজাদা পুলিস কর্মচারীগণের মধ্যে প্রায় সকলেই আসিয়া এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হন। কয়েক দিবস পর্য্যন্ত ইহার বিশেষরূপ অনুসন্ধান চলে, কিন্তু কোনরূপ ফলই হয় না। যত দিবস পর্য্যন্ত এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান হয়, কামতাপ্রসাদ অনুসন্ধান উপলক্ষে পুলিসকে বিশেষরূপ সাহায্য করিয়াছিল। যেরূপ প্রকারে কামতাপ্রসাদ আমাদিগকে সাহায্য করিয়াছিল, তাহাতে আমাদিগের কাহার মনে কোনরূপ সন্দেহ হয় না যে, এই মোকদ্দমার সহিত তাহার অপর কোনরূপ সংস্রব আছে। যে স্ত্রীলোকটি হত হইয়াছিল, তাহার নিকট কামতার যাতায়াত ছিল, ও সকল জানিতে যে, কামতা তাহাকে ভালবাসে, সুতরাং হত্যাকারী যে কে, তাহাই জানিবার নিমিত্ত কামতাপ্রসাদের বিশেষরূপ চেষ্টা ছিল বলিয়াই সে সৰ্ব্বদাই এই মোকদ্দমায় পুলিসকে বিশেষরূপ সাহায্য করিত। প্রায় ১৫ দিবস কাল এই মোকদ্দমার প্রকাশ্যরূপে তদারক হয়। এই ১৫ দিবস কাল রাত্রিদিবস কামতাপ্রসাদ আমাদিগের নিকটেই থাকিত। ১৫ দিবস অনুসন্ধানের পর প্রকাশ্য তদারক বন্ধ হইল, কর্ম্মচারীগণের মধ্যে অনেকেই অপরাপর মোকদ্দমার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলেন। কেবল দুই একজন কর্ম্মচারী এই মোকদ্দমার গুপ্ত অনুসন্ধানে নিযুক্ত রহিলেন। বলা বাহুল্য, আমিও তাহার মধ্যে একজন ছিলাম। যত দিবস আমরা প্রকাশ্য অনুসন্ধানে নিযুক্ত ছিলাম, তত দিবস পর্য্যন্ত কামতাপ্রসাদের উপর আমাদিগের কোনরূপ সন্দেহ হয় না, সুতরাং তাহার সম্বন্ধে আমরা কোনরূপ অনুসন্ধানও করি না। তাহার সম্বন্ধে সে নিজে আমাদিগকে যেরূপ পরিচয় প্রদান করিয়াছিল, আমরা তাহাই বিশ্বাস করিয়া লইয়াছিলাম।
বিশ্বাস করিয়া লইয়াছিলাম যে, কামতাপ্রসাদ আজিমগড় জেলার অন্তর্গত কোন একটি পল্লীগ্রামের জনৈক জমিদার- সন্তান। বিশ্বাস করিয়াছিলাম যে, বিষয় কার্য্য উপলক্ষে সে কলিকাতায় বাস করিয়া থাকে। তাহাদিগের দেশে যে সকল দ্রব্যাদি উৎপন্ন হয়, তাহাই সেই স্থান হইতে গাড়ি করিয়া তাহার কর্ম্মচারীগণ কলিকাতায় পাঠাইয়া দেয়, ও কামতাপ্রসাদ নিজে এই স্থানে উপস্থিত থাকিয়া ঐ সকল দ্রব্যাদি বিক্রয় করিয়া থাকে।
বিশ্বাস করিয়াছিলাম, কামতাপ্রসাদ ভদ্রসন্তান, ভদ্র ব্যবসা অবলম্বন করিয়া দিন অতিবাহিত করিয়া থাকে।
বিশ্বাস করিয়াছিলাম, তাহার স্বভাব-চরিত্র ভাল, কুকার্য্যে বা কুসংসর্গে সে কখন মিলিত হয় না, চরিত্রবান ও ভাল ভাল লোকের সহিতই তাহার বসা উঠা, আহার বিহার ও শয়ন উপবেশন।
বিশ্বাস করিয়াছিলাম, ভদ্র ও সম্ভ্রান্তশালী লোক যেরূপ উপায়ে সময় বা জীবন অতিবাহিত করিয়া থাকে, কামতাপ্রসাদও সেইরূপে আপন জীবন অতিবাহিত করিয়া থাকে।
আরও ভাবিয়াছিলাম, স্ত্রীর নিকট হইতে বহুদূরে অবস্থিতি করিবার নিমিত্ত সময় সময় নিতান্ত গুপ্তভাবে সে কখন কখন ঐ স্ত্রীলোকটির নিকট গমন করিত, এবং তাহাকে অন্তরের সহিত একটু ভালও বাসিত। ঐ একমাত্র স্ত্রীলোক ভিন্ন অপর আর কোন স্ত্রীলোকের নিকট তাহার গতিবিধি ছিল না।
মনে মনে আমরা এইরূপ বিশ্বাস করিয়াছিলাম বলিয়া কামতা প্রসাদ সম্বন্ধে আমরা কোনরূপ অনুসন্ধানই করি না; বরং তাহারই কথিতমত পন্থা অবলম্বন করিয়া, তাহারই সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া অনেক সময় বলিয়াছিলাম, যে সকল ব্যক্তির উপর সন্দেহ হয় বলিয়া সে আমাদিগের নিকট তাহার মনের ভাব প্রকাশ করিয়াছিল, আমরা তাহাদিগের বিপক্ষে উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিতে কিছুমাত্র ত্রুটী করি নাই।
প্রথম হইতেই আমরা তাহার নিকট যেরূপে প্রবঞ্চিত হইয়াছিলাম, সেইরূপে তাহার নিকট হইতে শেষ পর্য্যন্তই যে প্রবঞ্চিত হই নাই, ইহাই আশ্চৰ্য্য।
গুপ্ত অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইবার কয়েক দিবস পরে, হঠাৎ এক দিবস আমার মনে উদয় হইল যে, কামতাপ্রসাদের সহিত মৃতার এতদূর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল যে, তাহার নিমিত্ত কামতা তাহার নিজের কার্য্য পরিত্যাগ করিয়া রাত্রিদিবস কেবল আমাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ঘুরিয়া আমাদিগের আদেশ সর্ব্বদাই প্রতিপালন করিতেছে, ও যে আদেশ প্রতিপালন করিতে সময় সময় তাহাকে নিরর্থক অনেক সময় ও অর্থ নষ্ট করিতে হইয়াছে, তাহার সম্বন্ধে আমরা এ পর্য্যন্ত কিছুমাত্র অনুসন্ধান করি নাই কেন? তাহার চরিত্র যতই কেন ভাল হউক না, সে যতই কেন ভদ্রবংশ-সম্ভূত হউক না, সে নিঃস্বার্থভাবে যতই কেন আমাদিগকে সাহায্য করুক না, তথাপি ঐ স্ত্রীলোকটির সহিত যখন তাহার বিশেষরূপ সংস্রব ছিল, তখন তাহার সম্বন্ধে আমাদিগের বিশেষরূপ একটি অনুসন্ধান করা নিতান্ত আবশ্যক কিন্তু প্রকাশ্য অনুসন্ধান করিয়া যদি তিনি প্রকৃতই সম্ভ্রান্তশালী লোক হয়েন, তাহা হইলে তাহাকে কোনরূপ অবমানিত করা আমাদিগের কর্তব্য নহে। সুতরাং গুপ্ত অনুসন্ধান করিয়া তাহার সম্বন্ধে যতদূর জানিতে পারা যায়, তাহাই জানিবার চেষ্টা করা কর্তব্য।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
কামতাপ্রসাদ সম্বন্ধে গুপ্ত অনুসন্ধান করাই কর্তব্য, মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইলাম। কিন্তু অনুসন্ধান করিতে করিতে যতই অগ্রসর হইতে লাগিলাম কামতাপ্রসাদ সম্বন্ধে আমাদিগের যেরূপ অটলবিশ্বাস ছিল, ক্রমে তাহা তিরোহিত হইতে লাগিল। ক্রমে জানিতে পারিলাম, কামতাপ্রসাদের বাসস্থান আজিমগড় জেলার অন্তর্গত কোন পল্লীগ্রামে নহে, বা সেইস্থানের কোন ভদ্রবংশে তাহার জন্ম হয় নাই, ও আজিমগড় জেলার সহিত তাহার কোনরূপ সংস্রব নাই! আরও জানিতে পারিলাম, তাহার জন্মস্থান আগ্রা সহরের মধ্যে চৌ-ফাটকা নামক স্থানে, কিন্তু সেইস্থানে তাহার কেহই নাই। যখন তাহার বয়ঃক্রম ১৫।১৬ বৎসর, সেই সময় তাহার পিতা মাতার মৃত্যু হওয়ায়, সেই স্থানের একটি প্রসিদ্ধ জুয়াচোরের সহিত মিলিত হইয়া, ঐস্থান পরিত্যাগপূর্ব্বক কিছু দিবস লক্ষ্ণৌ সহরে গিয়া অবস্থিতি করে। ও সময় সময় আগ্রায় আসিয়া ও দুই একটি চুরি ও জুয়াচুরি কার্য্য সম্পন্ন করিতেও পশ্চাৎপদ হয় না। দুই একবার লক্ষ্ণৌ ও দুই একবার আগ্রায় ধৃত হইয়া কারাগার ভোগ করিতে হয়। আগ্রা ও লক্ষ্ণৌ নগরীতে সে উত্তমরূপে পুলিসের পরিচিত হইয়া পড়িলে, ঐ স্থান পরিত্যাগ পূর্ব্বক সে বোম্বাই সহরে গিয়া তাহার বাসস্থান সংস্থাপিত করে। এবং সেই স্থানে সে নিজের ব্যবসা গুপ্তভাবে চালাইতে আরম্ভ করে। বিনা গোলযোগে কিছু দিবস অতিবাহিত হইয়া যায়। সে যে সময় বোম্বাই সহরে অবস্থিতি করিয়াছিল, সেই সময় কয়েকটি বড় বড় চুরি তাহার দ্বারা সম্পন্ন হয়, এবং ঐ সকল অপহৃত দ্রব্য, বেনারস ও কলিকাতায় আনিয়া বিক্রয় করিয়া যায়। ক্রমে বোম্বাই পুলিস তাহার উপর সন্দেহ করে, ও একটি মোকদ্দমার অপহৃত মালের সহিত তাহাকে ধৃত করিয়া পাঁচ বৎসরের নিমিত্ত কারাগারের মধ্যে তাহার বাসস্থান নির্দ্দেশ করিয়া দেয়।
জেল হইতে বহির্গত হইবার পর, কিছুদিবস কামতাপ্রসাদের বাসস্থানের স্থিরতা থাকে না। অদ্য কাশীতে, কল্য বোম্বাই সহরে, তাহার পরই কলিকাতায়, এইরূপে নানা স্থানে থাকিয়া সে দিন অতিবাহিত করিতে আরম্ভ করে। সেই সময়েও যে সে তাহার ব্যবসা পরিত্যাগ করিয়াছিল, তাহা নহে; বরং আরও প্রবলরূপে তাহার ব্যবসা চালাইতে আরম্ভ করে। কামতাপ্রসাদ যেস্থানে বাস করিত, তাহার চাল চলন দেখিয়া কেহ তাহাকে চোর বা জুয়াচোর অথবা হত্যাকারী বলিয়া সন্দেহ করিত পারিত না। কারণ, সে বড়মানুষের ন্যায় বাস করিত, বড় বাড়ী ভিন্ন সে কখনই বাস করিত না, চাকর চাকরাণীতে সেই বাড়ী প্রায়ই পূর্ণ থাকিত। যখন যেখানে সে বাস করিত, সেই স্থানে জমিদার অথবা ব্যবসায়ী বা সওদাগর পরিচয়ে বাস করিত। কেবল যে সে বড়মানুষ পরিচয়ে বাস করিত, তাহা নহে; তাহার খরচ- পত্রও সেইরূপ বড়মানুষী ধরণে সম্পন্ন হইত। যাহার উপার্জ্জনের সীমা নাই, তাহার কিসে খরচ-পত্রের অভাব হইবে? যাহাকে দিবারাত্রি পরিশ্রম করিয়া উপার্জ্জন করিতে হয়, পরের দাস্যবৃত্তি অবলম্বন করিয়া যাহাকে উদবান্নের সংস্থান করিতে হয়, অন্যান্য খরচ তাহাদিগের পক্ষে কষ্টকর হয় বটে, কিন্তু কামতাপ্রসাদ যে উপায়ে অর্থ উপার্জ্জন করিয়া থাকে, ঐ অর্থ জলের ন্যায় খরচ করা তাহার পক্ষে কিছুমাত্র অসম্ভব নহে। যেরূপ উপায়ে তাহার অর্থ উপার্জ্জন হয়, ব্যয়ও প্রায় সেইরূপ উপায়েই হইয়া থাকে। সুতরাং কামতাপ্রসাদ বড়মানুষী ধরণে বড়মানুষ পরিচয়ে দিনযাপন করিবে না কেন?
কামতাপ্রসাদের ন্যায় অনেক বড়মানুষ এ পর্যন্ত দেখিয়াছি, তাহার ন্যায় অনেক বড়মানুষের জ্বালায় অস্থির হইয়াছি, কিন্তু স্থায়ীরূপে বড়মানুষী করিতে কাহাকেও দেখিতে পাই নাই। জলবিম্বের ন্যায় যেমন তাহাদিগের উৎপত্তি হইয়াছে, দেখিতে দেখিতে ঐ জলবিম্ব অগাধ জলে মিশাইয়া গিয়াছে। অনুসন্ধান করিয়া আর তাহাদিগের অনেকের চিহ্নমাত্রও দেখিতে পাই নাই। যাহাদিগকে পরে দেখিতে পাইয়াছি, তাহাদিগের অবস্থা নিতান্ত শোচনীয়ই দেখিয়াছি, উদরান্নের জন্য তাহাদিগকে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করিতে দেখিয়াছি। স্থানাভাবে রাজবর্থের পার্শ্বে অথবা নদীতীরে, তাহাদিগকে শয়ন করিয়া প্রচণ্ড শীতে রাত্রি অতিবাহিত করিতে হইয়াছে। কিন্তু যাঁহারা সৎপথ অবলম্বন করিয়া যাহা কিছু উপার্জ্জন করিয়াছেন, তাহাতেই তাঁহারা মনের সুখে দিনযাপন করিতে সমর্থ হইতেছেন, ইহা সৰ্ব্বদাই দেখিতে পাইতেছি।
কামতাপ্রসাদ সম্বন্ধে গোপনে যতই অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম, তাহার চরিত্র সম্বন্ধে ততই রহস্য বাহির হইয়া পড়িতে লাগিল। জানিতে পারিলাম, কামতাপ্রসাদ একজন নামজাদা দস্য। কলিকাতা নগরীর মধ্যে সে অপরিচিত থাকিলেও তাহার ন্যায় প্রসিদ্ধ দস্যু এইস্থানে অতি অল্পই দেখিতে পাওয়া যায়। এত দিবস পর্য্যন্ত কামতাপ্রসাদ যে সকলের নিকট অপরিচিত ছিল, তাহার প্রধান কারণ এই যে, এই স্থানের কোন দস্যুর সহিত সে কোন রূপে মিলিত হইত না, কাহার সহিত কখন সে তাহার কার্যক্ষেত্রে পদবিক্ষেপ করিত না; যাহা করিবার প্রয়োজন হইত, অপর কাহার সাহায্য না লইয়া একাকীই সেই কার্য্য সম্পন্ন করিত। সুতরাং স্থানীয় দস্যুগণের নিকট সে পরিচিত ছিল না বলিয়াই এত দিবস পর্য্যন্ত তাহার নাম কেহই জানিতে পারে নাই, বা সে যে কি চরিত্রের লোক, তাহাও কেহ অবগত হইতে পারে নাই। কামতাপ্রসাদ যাহা বলিত, সকলেই তাকে বিশ্বাস করিত।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
কামতাপ্রসাদের চরিত্র যখন আমরা উত্তমরূপে অবগত হইতে পারিলাম, তখন আমাদিগের বেশ অনুমান হইল, এই হত্যা কামতাপ্রসাদ ভিন্ন অপর আর কাহারও দ্বারা হয় নাই। আমি পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, কামতাপ্রসাদ অতিশয় চতুর লোক। আমরা যখন তাহার বিপক্ষে গুপ্ত অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছিলাম, কামতাপ্রসাদ অনুমান করিয়া তাহার অনেকটা জানিতে পারিতেছিল ও আমরা কি করি, না করি, তাহার দিকে কামতাপ্রসাদ বিশেষরূপ লক্ষ্যও রাখিয়াছিল। তাহার বিপক্ষে আমরা কি করিতেছি, না করিতেছি, তাহা যেমন আমরা তাহাকে বলিতাম না, সেও আমাদিগের গতিবিধি সম্বন্ধে যতদূর অবগত হইতে পারিত, তাহারও কিছুমাত্র আভাষ আমাদিগকে প্রদান করিত না। এইরূপে কিছু দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। যে সময়ে আমাদিগের প্রকাশ্য অনুসন্ধান বন্ধ হইয়া গিয়াছিল, তাহার ৩।৪ দিবস পরে কামতাপ্রসাদ একবার ৩।৪ দিবসের নিমিত্ত কলিকাতা হইতে স্থানান্তরে গমন করিয়াছিল, কিন্তু সেই অল্প সময়ের নিমিত্ত সে যে কোথায় গিয়াছিল, তাহা আমরা সেই সময় কিছুমাত্র অবগত হইতে পারি না; পরন্তু এখন বিশেষরূপ অনুসন্ধান করায় তাহাও জানিতে পারিলাম। জানিতে পারিলাম, পাটনা সহরে তাহার একটি আড্ডা আছে। লক্ষ্ণৌ হইতে একটি স্ত্রীলোককে আনিয়া একটি ঘর ভাড়া করিয়া তাহাকে পাটনায় রাখিয়া দিয়াছে। কিন্তু কামতাপ্রসাদ নিজে কখন পাটনায় থাকে না, সময় সময় সেই স্থানে গমন করিয়া দুই চারি দিবস অতিবাহিত করে মাত্র। ইতিপূর্ব্বে কামতাপ্রসাদ কলিকাতা হইতে ২।৪ দিবসের নিমিত্ত যে স্থানান্তরে গমন করিয়াছিল, এখন জানিতে পারিলাম, যে পাটনায় গমন করিয়াছিল; কিন্তু কেন যে সেই স্থানে গমন করিয়াছিল, তাহার নিশ্চিৎ সংবাদ জানিতে পারিলাম না। তাহার রক্ষিতা সেই স্ত্রীলোকটির নিকট যেমন সে সময় সময় গমন করিয়া থাকে, সেইরূপ গিয়াছিল, কি এই খুনি মোকদ্দমায় অপহৃত অলঙ্কারগুলির কোনরূপ বন্দোবস্ত করিবার নিমিত্র গমন করিয়াছিল, তাহার কিছুমাত্র বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। কিন্তু সে যে পাটনায় গমন করিয়াছিল, ইহার নিশ্চয়ই সংবাদ আমরা প্রাপ্ত হইলাম।
এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া আমি একবার মনে করিলাম কামতা প্রসাদ সম্বন্ধে আমি যাহা কিছু অবগত হইতে পারিয়াছি, তাহার সমস্ত অবস্থা তাহাকে বলি ও দেখি, উহাতে সে কিরূপ উত্তর প্রদান করে। আরও পাটনায় গমন করিবার সম্বন্ধেই বা সে কি বলে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হইল, কামতাপ্রসাদ যেরূপ চতুর, তাহাতে যদি সে আমাদিগের উদ্দেশ্য জানিতে পারে, ও এই কার্য্য যদি তাহার দ্বারা সম্পন্ন হইয়া থাকে, তাহা হইলে তাহার উপর এই মোকদ্দমা প্রমাণ করা একরূপ অসম্ভব হইয়া পড়িবে; এমন কি তাহাকে হয়তো পরিশেষে খুঁজিয়াই পাইব না ও আমাদিগের সমস্ত আশাই ব্যর্থ হইয়া যাইবে। সুতরাং তাহাকে এখন কোন কথা বলা হইবে না। যে পৰ্য্যন্ত তাহাকে গ্রেপ্তার করিবার সময় আসিয়া উপস্থিত না হইবে, সে পর্যন্ত তাহার বিষয়ে কোন কথা প্রকাশ বা তাহাকে কোন কথা জানিতে দেওয়া হইবে না।
মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া, আমি প্রথমতঃ পাটনায় গমন করাই স্থির করিলাম। সেই স্থানে কামতাপ্রসাদের যে স্ত্রীলোকটি আছে, তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, তাহার নিকট হইতে যদি কোন কথা প্রাপ্ত হওয়া যায়, এই আশার বশবর্তী হইয়া আর কাল বিলম্ব না করিয়া পাটনা অভিমুখে রওনা হইলাম।
পাটনা সহর পশ্চিম প্রদেশে স্থাপিত হইলেও, উহা বাঙ্গালা হাতার সামিল ও কলিকাতা হইতে বহুদূরেও নহে, ইহা পাঠকগণের মধ্যে প্রায় সকলেই অবগত আছেন। সরকারি কার্য্য উপলক্ষে ইতিপূর্ব্বে আমি দুই একবার পাটনায় গমন করিলেও ঐ স্থানের বিশেষ অবস্থা আমি উত্তমরূপে অবগত ছিলাম না, বা উহার অন্তর্গত সমস্ত স্থানই আমার নিকট উত্তমরূপে পরিচিত ছিল না। এই স্থানের বাসগৃহ সকল প্রায় খাপরেলের, ও নিতান্ত সংমিলিতরূপে সংস্থাপিত ও দেখিতে প্রায় একই প্রকার। ঐ স্থানটি নিতান্ত সামান্যরূপ পরিচিত থাকিলে কাহার গৃহ অনুসন্ধান করিয়া বাহির করা নিতান্ত সহজ হয় না। আমার পক্ষেও ঠিক সেইরূপ হইয়াছিল। পাটনায় উপস্থিত হইয়া সেই স্থানের স্থানীয় পুলিসের সাহায্য আমাকে গ্রহণ করিতে হয়, ও তাহাদিগের সাহায্যে অনেক অনুসন্ধানের পর পরিশেষে আমরা ঐ স্ত্রীলোকটির বাসস্থানটি বাহির করিতে সমর্থ হই। উহাও একখানি খাপরেলের ঘর, কিন্তু দ্বিতল; ঐ বাড়ীতে আরও দুই একজন গৃহস্থের বাস। ঐ স্ত্রীলোকটিও গৃহস্থ পরিচয়ে সেইস্থানে বাস করিয়া থাকে।
আমরা যখন ঐ স্ত্রীলোকটির বাটীর সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইলাম, সেই সময়ে দেখিলাম, এক টেলিগ্রাফ-পিয়ন একখানি টেলিগ্রাফ হস্তে ঐ বাড়ীর অনুসন্ধান করিতেছে। ইহা দেখিয়াই আমি বুঝিতে পারিলাম যে, ইহাও কামতাপ্রসাদের একটি কার্য্য। আমাদিগের অভিসন্ধির বিষয় বুঝিতে পারিয়া পূর্ব্ব হইতেই সে ঐ স্ত্রীলোকটিকে সতর্ক করিয়া দিতেছে। মনে মনে এইরূপ বুঝিতে পারিয়া, ঐ টেলিগ্রাফখানি আমি রসিদ দিয়া গ্রহণ করিলাম ও উহা পাঠ করিয়াই জানিতে পারিলাম যে, আমি পূর্ব্বেই যে অনুমান করিয়াছিলাম, তাহা সত্য। উহাতে লেখা ছিল- “তোমার বাসায় বোধ হয় কোন লোক আমার নাম করিয়া যাইবে, কিন্তু সাবধান, কাহার কোন কথায় বিশ্বাস করিয়া কোন কথা বলিও না। আমিও পরে যাইতেছি।” ঐ টেলিগ্রাফে এইরূপ লেখা ছিল, কিন্তু কে যে উহা পাঠাইতেছে, তাহার নাম উহাতে ছিল না। প্রেরণকারীর নাম উহাতে না থাকিলেও বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, উহা কামতাপ্রসাদের কার্য্য। ঐ টেলিগ্রাফ সম্বন্ধে কোন কথা আমরা সেই স্ত্রীলোকটিকে বলিলাম না, উহা আমার নিকট রাখিয়া দিলাম।
ঐ স্ত্রীলোকটিকে কামতাপ্রসাদ সম্বন্ধে দুই চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করায় সে প্রথমতঃ আমাদিগের কথায় কোনরূপ উত্তর প্রদান করিল না, কিন্তু পরিশেষে অন্তরাল হইতে কহিল, “কামতাপ্রসাদ তাহার স্বামী, তিনি কলিকাতায় থাকিয়া সওদাগরি কার্য্য করিয়া থাকেন, ও সময় সময় এখানে আসেন। সম্প্রতি কোনরূপ অলঙ্কার-পত্র তিনি আনেন নাই, বা তাহাকে কেবলমাত্র খরচের টাকা ভিন্ন আর কিছুই দিয়া যান নাই।”
ঐ স্ত্রীলোকটির এই কথা শুনিয়া তাহার ঘরের খানাতল্লাসি করাই স্থির করিলাম, ও সেই স্থানের দুই তিনজন প্রতিবেশীকে ডাকাইয়া তাহাদিগের সম্মুখে তখনই আমার মনোভিলাষ পূর্ণ করিলাম। ঘর খানাতল্লাসি করিবার সময় *ঐ স্ত্রীলোকটি অনেকরূপ আপত্তি ও পরিশেষে নানারূপ ভয় প্রদর্শন করিতে আরম্ভ করিল, কিন্তু কিছুতেই আমি তাহার কথায় কর্ণপাত না করিয়া আমাদিগের কার্য্য শেষ করিয়া ফেলিলাম। উহার ঘরে একটি লোহার সিন্ধুক ছিল। ঐ সিন্ধুকের চাবি ঐ স্ত্রীলোকটি কোনরূপেই আমাদিগকে প্রদান করিল না ও কহিল যে, চাবি তাহার নিকট নাই, কামতাপ্রসাদের নিকট আছে। কিন্তু অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম, উহার কথা মিথ্যা; কারণ কামতাপ্রসাদের অবর্তমানে, ঐ সিন্ধুক তাহাকে খুলিতে সেই বাড়ীর কেহ কেহ দেখিয়াছে। সিন্ধুকের চাবি না পাওয়ায় অনন্যোপায় হইয়া ঐ সিন্ধুকের চাবি আমাদিগকে ভাঙ্গিয়া ফেলিতে হইল। দেখিলাম, উহার মধ্যে প্রায় পাঁচ সহস্ৰ নগদ মুদ্রা ও একটি টিনের বাক্স সুবর্ণ অলঙ্কারে পূর্ণ। ঐ অলঙ্কারগুলি কাহার, তাহা ঐ স্ত্রীলোকটিকে জিজ্ঞাসা করায় সে কহিল, সে তাহার কিছুই বলিতে পারে না।
সেই হত স্ত্রীলোকটির যে সকল অলঙ্কার অপহৃত হইয়াছিল, সেই সকল অলঙ্কারের সদৃশ অনেক অলঙ্কার ঐ বাক্সের ভিতর দেখিতে পাইলাম, তদ্ব্যতীত আরও বিস্তর অলঙ্কার ঐ বাক্সের মধ্যে ছিল। ঐ সকল অলঙ্কারের একটি তালিকা প্রস্তুত করিয়া উহার সমস্তই আমাদিগের অধিকারে লইলাম, এবং ঐ স্ত্রীলোকটিকেও গ্রেপ্তার করিয়া থানায় লইয়া গেলাম। যে ঘরে সে বাস করিত, তাহাতে তালাবদ্ধ করিয়া ঐ স্থানে একটি প্রহরীর পাহারা রাখিয়া দিলাম।
এই সকল কাৰ্য্য শেষ করিবার পূর্ব্বেই সর্ব্বপ্রধান পুলিস কর্ম্মচারীর নিকট একখানি বিশেষ জরুরি টেলিগ্রাফ পাঠাইয়া দিলাম। ঐ টেলিগ্রাফের মর্ম্ম এইরূপ “কামতাপ্রসাদের স্ত্রী-লোকের ঘরে বিস্তর অলঙ্কার পাওয়া গিয়াছে, খুনি মোকদ্দমায় অনেক গহনা ইহার ভিতর আছে বলিয়া অনুমান হইতেছে, স্ত্রীলোকটিকে ধৃত করিয়াছি। হত্যা কামতাপ্রসাদের দ্বারা হইয়াছে বলিয়া অনুমান হইতেছে। কামতাপ্রসাদ এখন কলিকাতায়; যত শীঘ্র হয়, কামতাপ্রসাদকে ধৃত করা আবশ্যক।”
আমি যখন কলিকাতা হইতে পাটনায় আগমন করি, সেই সময় কামতা প্রসাদকে কলিকাতায় দেখিয়া আসিয়াছিলাম। তাহার পর যে টেলিগ্রাফ আমার হস্তগত হয়, তাহাতে জানিতে পারিয়াছিলাম যে, কামতাপ্রসাদ কলিকাতায় আছে। কিন্তু আমি কলিকাতার সর্ব্বপ্রধান পুলিস কর্ম্মচারীর নিকট যে টেলিগ্রাফ করিলাম, তাহার উত্তর পাইয়া বুঝিতে পারিলাম যে, কামতাপ্রসাদ আমাদিগের অভিসন্ধির বিষয় সমস্তই অবগত হইতে পারিয়াছে, ও পুলিসের চক্ষে ধূলিমুষ্টি প্রদান করিয়া তাহাদিগের হস্তের বহির্দেশে গমন করিয়াছে। আমার নিকট হইতে টেলিগ্রাফ প্রাপ্ত হইবার পূর্ব্বেই সে তাহার থাকিবার স্থান পরিত্যাগ করিয়া কোথায় প্রস্থান করিয়াছে। অনুমান হইতেছে যে, সে কলিকাতায় নাই, কলিকাতা পরিত্যাগ পূর্ব্বক পলায়ন করিয়াছে। যে এরূপভাবে পুলিসের চক্ষের উপর হইতে পলায়ন করিতে পারে, তাহাকে পুনরায় প্রাপ্ত হওয়া বা তাহাকে ধৃত করা নিতান্ত সহজ হইবে না। ভারতবর্ষের সমস্ত প্রধান নগরই যাহার নিকট উত্তমরূপে পরিচিত, সকল স্থানে গতিবিধি করিবার উপায় যাহাকে কাহার নিকট জিজ্ঞাসা করিতে হয় না, সে একবার পলায়ন করিলে তাহার অনুসন্ধান ও তাহাকে ধৃত করা যে কিরূপ দুরূহ, তাহা ভূক্তভোগী ভিন্ন আর কেহই অবগত নহেন।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
কামতাপ্রসাদের পলায়নের সংবাদ পাইয়া আমার মন নিতান্ত খারাপ হইয়া গেল। ভাবিলাম, এত পরিশ্রমের পর এই হত্যা মোকদ্দমার কিনারা হইবার সম্ভাবনা হইল, কিন্তু যাহাকে লইয়া এই মোকদ্দমার কিনারা, সে-ই আমাদিগকে তাহার বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করিল। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, এখন কোন্ উপায় অবলম্বন করা কৰ্ত্তব্য, তাহাই ভাবিতে ভাবিতে পাটনার রেলওয়ে ষ্টেশনে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। রেলওয়ে ষ্টেসনে যে কেন আসিয়া উপস্থিত হইলাম, তাহা জানি না; বিনা কাৰ্য্যেই সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি, এরূপ সময়ে কলিকাতা হইতে একখানি গাড়ি আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল। এই ষ্টেসনে গাড়ি অনেকক্ষণ থাকে না, সুতরাং অল্প সময় পরে ঐ গাড়ি ছাড়িয়া দিল। যে পৰ্য্যন্ত গাড়ি সেই স্থানে দাঁড়াইয়া ছিল, সেই পৰ্য্যন্ত কিছুই দেখিতে পাইলাম না; কিন্তু গাড়ি ছাড়িবার যেমন বাঁশী হইয়াছে, অমনি দেখিলাম, এঞ্জিনের পরবর্তী একখানি গাড়ি হইতে কামতাপ্রসাদ নামিল। আমি সেই সময় গাড়ির প্রায় শেষ ভাগে ছিলাম; সেই স্থান হইতে যে স্থানে কামতাপ্রসাদ নামিয়াছিল, তাহার ব্যবধান অনেকটা হইবে। কামতাপ্রসাদকে দেখিবামাত্র আমি সেই দিকে গমন করিতে লাগিলাম, কামতাও আমাকে দেখিতে পাইল: সেই সময় গাড়ি কেবল চলিতে আরম্ভ করিয়াছে। আমাকে দেখিবামাত্র কামতাপ্রসাদ সেই চলিত গাড়িতে পুনরায় দ্রুতবেগে আরোহণ করিল। আমিও অনন্যোপায় হইয়া আমার নিকটবর্ত্তী একখানি গাড়ির হাতোল ধরিয়া অঙ্গঝুলিত অবস্থায় একখানি তক্তার উপর পা দিয়া কোন গতিকে দাঁড়াইলাম। ষ্টেসন হইতে সেই সময় আমাকে লক্ষ্য করিয়া মহা চীৎকার আরম্ভ করিল, ও যাহাতে আমি নামিয়া যাই, তাহার নিমিত্ত উচ্চকণ্ঠে সকলে আমাকে বলিতে লাগিল। সেই সময় গাড়ি ষ্টেসনের বাহিরে আসিয়া পড়িয়াছিল। আমি কাহার কথার উপর লক্ষ্য না করিয়া সেই গাড়ির ভিতর প্রবেশ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। আমার অবস্থা দেখিয়া ঐ গাড়ির ভিতর হইতে এক ব্যক্তি আমার নিকটবর্ত্তী দরজাটি খুলিয়া দিল, আমি তাহাকে শত ধন্যবাদ দিয়া ঐ গাড়ির ভিতর প্রবেশ করিলাম।
আমি ঐ গাড়ির ভিতর প্রবেশ করিবার বোধ হয় ৫ মিনিট পরেই ঐ গাড়ির ইংরাজ গার্ডসাহেব আসিয়া ঐ গাড়িতে প্রবেশ করিলেন, ও জিজ্ঞাসা করিলেন “গাড়ি ছাড়িবার পর কোন্ ব্যক্তি এই গাড়ির ভিতর প্রবেশ করিয়াছে?” উত্তরে “আমি কহিলাম আমি প্রবেশ করিয়াছি।” তাঁহাকে আমি আরও কহিলাম, আমি কে, কি নিমিত্ত আমি এরূপভাবে গাড়ির ভিতর প্রবেশ করিয়াছি, ও আমি চাহিই বা কি। কামতা প্রসাদ যে গাড়িতে উঠিয়াছে, তাহাও তাঁহাকে কহিলাম, সে খুনি মোকদ্দমার আসামী, তাহাকে সেই সময় গ্রেপ্তার করিবার নিমিত্ত গার্ড সাহেবকে বিশেষরূপ অনুরোধও করিলাম, কিন্তু তিনি আমার কোন কথাতেই কর্ণপাত করিলেন না। তিনি সাহেব, আমি বাঙ্গালি। তিনি গার্ডের পোষাকে সজ্জিত, আর আমার পরিধানে ধুতি চাদর, সুতরাং তিনি আমার কথায় বিশ্বাস করিবেন কেন? বিশেষ আমার নিকট টিকিট নাই, তাঁহার উপর সঙ্গে দুই চারিটি পয়সা ভিন্ন অর্থাদি কিছুই নাই। কাজেই তিনি আমার কথায় বিশ্বাস করিয়া কামতাপ্রসাদকে ধরিবার কোনরূপ সাহায্যই করিলেন না। আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম, সেই সময় যদি আমার পরিধানে ছিন্নভিন্ন ও নিতান্ত মলিন কোট পেন্টুলন থাকিত, তাহা হইলে আমার এরূপ অবস্থা কোন প্রকারেই ঘটিত না।
সে যাহা হউক, আমাকে কোনরূপে সাহায্য করা দূরে থাকুক, দেখিলাম, গার্ড সাহেবের ইচ্ছা যে, আমি বিনা টিকিটে গতিমান গাড়িতে আরোহণ করিয়াছি, এই অপরাধে আমার উপর একটি মোকদ্দমা রুজু করেন। যে গাড়িতে আমি ছিলাম, গার্ড সাহেব সেই গাড়ি হইতে আর অবতরণ করিলেন না। ক্রমে গাড়ি একটি ষ্টেসন বাদ দিয়া বাঁকিপুর ষ্টেসনে আসিয়া উপস্থিত হইল।
গার্ড সাহেব ষ্টেসনে আসিয়াই আমার কথা ষ্টেসন মাষ্টারকে কহিলেন। তিনিও সাহেব; তিনি আমাকে একজন রেলওয়ে কর্ম্মচারীর জিম্বায় রাখিবার আদেশ করিলেন। আমি কে, কি নিমিত্ত আমি ঐরূপ দুঃসাহসিক কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছি, তাহা তাঁহাকে কহিলাম। তাঁহাকে আরও কহিলাম, “আমার উপর তাঁহারা যেরূপ মোকদ্দমা চালাইতে ইচ্ছা করেন, তাহা অনায়াসেই চালাইতে পারিবেন; কিন্তু অগ্রে খুনি মোকদ্দমার আসামীকে তাঁহারা হয় গ্রেপ্তার করুন, না হয় গ্রেপ্তার করিতে আমাকে সাহায্য করুন। সে অতিশয় চতুর লোক, একবার পুলিশের হস্ত হইতে পলায়ন করিয়াছে, তাহাতে এবার যদি সে পুনরায় পলায়ন করে, তাহা হইলে তাহাকে আর কোনরূপেই পাওয়া যাইবে না। এই সমস্ত কথাই আমি ষ্টেসন-মাষ্টারকে কহিলাম, কিন্তু তিনিও আমার কথায় কর্ণপাত না করিয়া অপরের জিম্বায় আমাকে রাখিয়া দিয়া, তিনি তাঁহার নিজ কার্য্যে প্রস্থান করিলেন।
আমি যাঁহার জিম্বায় রহিলাম, তিনি একটু দূরে প্লাটফরমের উপরই আমাকে রাখিয়া দিলেন। এইরূপ গোলযোগে প্রায় ৫।৬ মিনিট অতিবাহিত হইয়া গেল। আরোহীগণের মধ্যে অনেকে গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া চলিয়া গেল, অনেক আরোহী গাড়িতে আরোহণ করিল। আমি সেই স্থানে দাঁড়াইয়া সমস্ত দেখিতে লাগিলাম। রেলওয়ে পুলিসের জনৈক এদেশীয় কৰ্ম্মচারী সেই সময় একটু দূরে দাঁড়াইয়া ছিল। তাঁহাকে ডাকিয়া দিবার নিমিত্ত আমি একটি লোককে কহিলাম, তিনি তাঁহাকে ডাকিয়া দিলেন। ঐ কর্ম্মচারী আমার নিকট আসিলে আমি সংক্ষেপে আমার সমস্ত কথা তাঁহাকে কহিলাম ও যাহাতে তিনি কামতাপ্রসাদকে ধরিতে পারেন, তাহার নিমিত্ত তাঁহাকে বিশেষরূপ অনুরোধ করিলাম। জানিনা, কি ভাবিয়া তিনি আমার কথায় কর্ণপাত করিলেন, ও আমাকে সঙ্গে লইয়া ঐ গাড়িতে তিনি কামতাপ্রসাদের অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন, কিন্তু কোন গাড়িতেই বা কোন স্থানেই কামতাপ্রসাদকে আর দেখিতে পাইলাম না।
কামতাপ্রসাদকে আমি পাটনা ষ্টেসনে যে দেখিয়াছিলাম, সে সম্বন্ধে আর কিছুমাত্র ভুল ছিল না। সে যে আমার সম্মুখে পুনরায় গাড়িতে উঠিয়াছিল, তাহাতেও কিছুমাত্র সন্দেহ ছিল না; কিন্তু এক ষ্টেসনের মধ্যে কামতাপ্রসাদ যে কোথায় গেল, তাহার কিছুমাত্র অনুভব করিয়া উঠিতে পারিলাম না। তবে সকলেই অনুমান করিলেন যে, যে সময় গাড়ি আসিয়া ঐ ষ্টেসনে দণ্ডায়মান হয়, তাহার পরই সে কোন না কোন প্রকারে গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া ষ্টেশন হইতে বহির্গত হইয়া গিয়াছে।
রেলওয়ে পুলিসের কর্মচারী আমাকে সেই ইংরাজ ষ্টেসনমাষ্টারের বিনা আদেশে স্থানান্তরে লইয়া যাইবার নিমিত্ত উভয়ের মধ্যে বিশেষরূপ বচসা হইয়া গেল। কিন্তু ঐ বচসাই আমার পক্ষে মঙ্গলদায়ক হইল। তিনি ষ্টেশন মাষ্টারের উপর রাগ করিয়া আমার সমস্ত অবস্থা বিবৃত করিয়া, কলিকাতার সর্ব্বপ্রধান পুলিস কর্ম্মচারীর নিকট এক টেলিগ্রাফ পাঠাইলেন, ও তাঁহাকে আরও লিখিলেন যে, গার্ড ও ষ্টেসন মাষ্টারের দোষে কামতাপ্রসাদ পলায়ন করিতে সমর্থ হইয়াছে। ঐ টেলিগ্রাফ পাইয়া প্ৰধান কৰ্ম্মচারী মহাশয় যে কি পন্থা অবলম্বন করিলেন, তাহা আমি কিন্তু তখন কিছুমাত্র অবগত হইতে পারিলাম না, কিন্তু রেলওয়ে বিভাগের সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারীর নিকট হইতে একখানি টেলিগ্রাফ পাইয়া ষ্টেসন-মাষ্টার সাহেব আমাকে তখনই অব্যাহতি প্রদান করিলেন। ও পরে শুনিয়াছিলাম যে, ষ্টেশন মাষ্টার ও গার্ড উভয়েই তাঁহাদিগের প্রধান কর্মচারীর নিকট হইতে বিশেষরূপে দণ্ডপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন।
আমি ঐস্থান হইতে অব্যাহতি পাইয়া কি করিব, তাহার বিশেষ কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না; কিন্তু একবার মনে ভাবিলাম, যখন সে এই স্থান হইতে প্রস্থান করিয়াছে, তখন সে একবার পাটনায় গমন করিয়া তাহার বিপক্ষে কতদূর কি পাওয়া গিয়াছে, তাহা জানিবার চেষ্টা করিবে ও যদি কোনরূপে সুযোগ করিতে পারে, তাহা হইলে তাহার সেই স্ত্রীলোকটির সহিত একবার দেখা করিবার বা তাহার নিমিত্ত কোনরূপ বন্দোবস্ত করিবার চেষ্টা করিলেও করিতে পারে। ঐরূপ অবস্থায় আমার পুনরায় পাটনায় প্রত্যাগমন করা কর্তব্য; বিশেষ পাটনায় আমার পরিধেয় ও অর্থাদি সমস্তই পড়িয়া আছে। সেই স্থান হইতে উহা গ্রহণ না করিলে, অপর কোন স্থানে গমন করারও সম্ভাবনা নাই। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া, এ পর্যন্ত যে সকল অবস্থা ঘটিয়াছিল, তাহার সমস্ত অবস্থা আমার প্রধান কর্মচারীকে লিখিয়া আমি পাটনায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম।
আমি পাটনায় আসিয়া উপস্থিত হইয়া আমার বস্ত্রাদি সমস্ত ঠিক করিয়া লইয়া, সেই স্ত্রীলোকটির সহিত পুনরায় সাক্ষাৎ করিলাম। সে তখন পর্যন্ত সেই স্থানের মাজিষ্ট্রেটের আদেশ অনুযায়ী থানার হাজতেই বদ্ধ ছিল। এবার উহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার উদ্দেশ্য এই ছিল যে, যদি তাহার নিকট হইতে জানিতে পারি যে, কামতাপ্রসাদের কোন্ কোন্ স্থানে অধিক পরিমাণে যাতায়াত আছে, ও যদি সে কলিকাতায় প্রত্যাগমন করে, তাহা হইলে, কোথায় তাহার সহিত সাক্ষাৎ হইবার সম্ভাবনা? কিন্তু ঐ স্ত্রীলোকটির নিকট হইতে কোনরূপ সন্ধানই প্রাপ্ত হইলাম না; বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, তাহার পেটের কোন কথা বাহির করা আমাদিগের কৰ্ম্ম নহে।
ঐ স্ত্রীলোকটির সহিত সাক্ষাৎ করিয়া নিতান্ত নিরাশ হৃদয়ে থানায় বসিয়া আছি, এরূপ সময় দেখিতে পাইলাম, আমাকে সাহায্য করিবার নিমিত্ত কলিকাতা হইতে অপর আর একজন কর্ম্মচারী সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কামতাপ্রসাদ ইহার নিকটও উত্তমরূপে পরিচিত, ইনিও পূর্ব্বে আমাদিগের সহিত এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত ছিলেন। আমার সাহায্যের নিমিত্ত ইনি আসিয়া উপস্থিত হওয়ায় আমার অনেকটা সাহস হইল। ভাবিলাম, এখন যাহা করিব, দুইজনে পরামর্শ করিয়া সেই কার্য্য নির্ব্বাহ করিতে পারিব।
তিনি আমার নিকট সমস্ত কথা অবগত হইয়া ঐ স্ত্রীলোকটির সহিত একবার সাক্ষাৎ করিতে চাহিলেন, কিন্তু আমি তাহাকে কহিলাম, উহার সহিত দেখা করিয়া কোন লাভ নাই, তাহার নিকট হইতে কোন কথা পাইবার কিছুমাত্র উপায় নাই। আমার কথা শুনিয়াও তিনি তাহার সহিত দুই চারিটি কথা কহিতে চাহিলেন। আমি তাঁহার কথায় আর কোনরূপ প্রতিবাদ না করিয়া, যে স্থানে ঐ স্ত্রীলোকটি আবদ্ধ ছিল, তাহা তাঁহাকে দেখাইয়া দিলাম। তিনি সেই স্থানে গমন করিলেন। সেই সময় সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে, অন্ধকারে মেদিনী আবৃত হইয়া পড়িয়াছে।
ঐ কর্ম্মচারী আমার নিকট হইতে গমন করিবার কিয়ৎক্ষণ পরেই প্রত্যাগমন পূর্ব্বক কহিলেন, “স্ত্রীলোকটির সহিত আমার সাক্ষাৎ হইল না; যে প্রহরীর পাহারায় তাহাকে রাখা হইয়াছিল, তাহার নিকট হইতে অবগত হইতে পারিলাম যে, সে পলায়ন করিয়াছে।”
আমি। কি, সেই স্ত্রীলোকটি পলায়ন করিয়াছে?
কৰ্ম্মচারী। তাহাই তো শুনিলাম।
আমি। কখন পলায়ন করিয়াছে?
কৰ্ম্ম। আমি সেই স্থানে যাইবার কিছুক্ষণ পূর্ব্বে?
আমি। সে যে এখন একজন প্রধান আসামী। তাহার নিকট হইতেই যে সমস্ত অলঙ্কার পাওয়া গিয়াছে। সে কিরূপে পলায়ন করিল?
কর্ম্ম। সেই প্রহরীর প্রমুখাৎ আমি যাহা অবগত হইলাম তাহাতে এই মাত্র বুঝিতে পারিলাম যে, সেই স্ত্রীলোকটি মলমূত্র পরিত্যাগ করিবার নিমিত্ত বাহিরে যাইতে চাহে, ও প্রহরীকে ফটক খুলিয়া দিতে অনুরোধ করে। তাহার কথায় বিশ্বাস করিয়া প্রহরী তাহার কারাগারের দ্বার মুক্ত করিয়া দেয়। সে বাহিরে আসিয়া মল-ত্যাগের ভানে একটু দূরে গমন করে ও ক্রমে অন্ধকারের ভিতর বিলীন হইয়া যায়। সে কহে যে, অনেক অনুসন্ধান করিয়া আর তাহাকে পাওয়া যায় না।
আমি। আমার বিবেচনায় ও মিথ্যা কথা, ইহা চতুর কামতাপ্রসাদের একটি চাতুরী। সে-ই কোনরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া প্রহরীকে হস্তগত করিয়া ঐ স্ত্রীলোকটিকে লইয়া প্রস্থান করিয়াছে।
ঐ কৰ্ম্মচারীকে এই কথা বলিয়া আমি তখন গাত্রোত্থান করিলাম, ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীকে সংবাদ প্রদান করিয়া, যে স্থানে ঐ স্ত্রীলোকটিকে আবদ্ধ করিয়া রাখা হইয়াছিল, সেই স্থানে গমন করিলাম। আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীও সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। প্রহরীকে জিজ্ঞাসা করায় পূর্ব্বে সে যেরূপ বলিয়াছিল, এখনও সেইরূপ কহিল; কিন্তু তাহার কথায় আমরা কোনরূপেই বিশ্বাস করিতে পারিলাম না। ঐ প্রহরীর উপরই আমাদিগের সন্দেহ হইল, আসামীর অনুসন্ধান পরিত্যাগ করিয়া ঐ প্রহরীর বাক্স অনুসন্ধান করিলাম। তাহার বাক্সের ভিতর হইতে নগদ ২০০ শত টাকা বাহির হইল। ঐ টাকা সে কোথা হইতে প্রাপ্ত হইয়াছে, তাহা তাহাকে জিজ্ঞাসা করায় সে তাহার সন্তোষজনক উত্তর প্রদান করিতে পারিল না। কহিল, সে অনেক দিবস হইতে এই অর্থ ক্রমে ক্রমে সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াছে।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
সেই স্ত্রীলোকটি কিরূপে পলাইয়া গেল, ও কোন দিক দিয়াই যে গমন করিল, আমরা তাহার বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করিলাম। অনুসন্ধান করিয়া ঐ স্ত্রীলোকটির সম্বন্ধে কোনরূপ সন্ধানই পাওয়া গেল না, কিন্তু এই মাত্র জানিতে পারিলাম যে, যে সময়ে ঐ স্ত্রীলোকটি পলায়ন করে, তাহার কিয়ৎক্ষণ পূর্ব্ব হইতে একখানি এক্কা থানার নিকটবর্ত্তী একস্থানে দাঁড়াইয়া ছিল, ও অনুমান হয়, তাহার ভিতর একটি পুরুষ মানুষও বসিয়া ছিল। এই সংবাদ জানিতে পারিয়া আমাদের মনে যে একটু সন্দেহ ছিল, তাহা সম্যরূপে দূর হইল। তখন বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, এক্কার মধ্যে যে পুরুষটি বসিয়া ছিল, সে কামতাপ্রসাদ ভিন্ন অপর আর কেহই হে। আরও বুঝিতে পারিলাম, কামতাপ্রসাদই ঐ প্রহরীকে হস্তগত করিয়া, ঐ স্ত্রীলোটিকে সঙ্গে লইয়া ঐ এক্কায় করিয়া প্রস্থান করিয়াছে; সুতরাং সেই স্থানে ঐ স্ত্রীলোটির অনুসন্ধান করা একেবারেই অনাবশ্যক।
মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া ঐ স্ত্রীলোকটি যে বাড়ীতে বাস করিত, একবার সেই স্থানে গমন করিলাম। সেই সময় পর্যন্ত ঐ বাড়ীতে পাহারা ছিল। তাহার ও অপরাপর ব্যক্তিগণের নিকট হইতে জানিতে পারিলাম যে, সেই স্ত্রীলোকটি ঐ বাড়ীতে আর যায় নাই, বা কামতাপ্রসাদকেও সেই স্থানে কেহ দেখে নাই।
এখন আমাদিগের প্রধান কাৰ্য্য হইল, যদি কোনরূপে সেই এক্কার অনুসন্ধান করিয়া উঠিতে পারি। ঐ উদ্দেশ্যের উপর লক্ষ্য রাখিয়া যখন আমরা অপরাপর একাওয়ালার নিকট অনুসন্ধান করিতেছি, সেই সময় একজন এক্কাওয়ালার নিকট হইতে অবগত হইতে পারিলাম যে, একখানি এক্কা করিয়া একটি স্ত্রীলোক ও একজন পুরুষকে সে ফতোয়া ষ্টেসন অভিমুখে গমন করিতে দেখিয়াছে। সে আরও কহিল, ঐ এক্কাখানি পাটনা সহরের নহে, কিছু দিবস পূর্ব্বে সে ঐ এক্কাওয়ালাকে একবার বাঁকিপুর রেলওয়ে ষ্টেসনে এক্কা লইয়া দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়াছে। ঐ এক্কাওয়ালার নিকট হইতে এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া তাহারই এক্কা ভাড়া করিয়া ফতোয়া ষ্টেসন অভিমুখে গমন করিতে লাগিলাম। ঐ স্থান হইতে ফতোয়া চারি ক্রোশের কম নহে। আমরা দুই ক্রোশ আন্দাজ গমন করিয়াছি, এরূপ সময়ে দেখিলাম, একখানি এক্কা আস্তে আস্তে পাটনা অভিমুখে আগমন করিতেছে। উহাতে আরোহী নাই। ঐ এক্কাখানি দেখিয়াই আমাদিগের এক্কাচালক কহিল, সে যে এক্কার কথা বলিয়াছিল, ঐ সেই এক্কা আসিতেছে। এক্কা-চালকের কথা শুনিয়া তাহার এক্কা হইতে আমরা অবতরণ করিলাম। দেখিতে দেখিতে সেই এক্কাখানি আসিয়া আমাদিগের নিকট উপস্থিত হইল ও আমাদিগের নির্দেশমত সেও তাহার এক্কা হইতে অবতরণ করিয়া আমাদিগের সম্মুখে আসিয়া দণ্ডায়মান হইল। আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম “তুমি যে দুইজন আরোহীকে লইয়া গিয়াছিলে, তাহাদিগকে কোথায় রাখিয়া আসিলে?”
আমার কথার উত্তর প্রদানে সে প্রথমত ইতস্তত করিতে লাগিল; কিন্তু আমাদিগের এক্কা-চালক তাহাকে ভয় প্রদর্শন করিয়া বুঝাইয়া বলিবার পর সে কহিল “আমি তাহাদিগকে রেলওয়ে ষ্টেসনে ছাড়িয়া দিয়াছিলাম।”
আমি। তোমার এক্কা উহারা কোথায় ভাড়া করিয়াছিল। কেইবা প্রথমে ভাড়া করে?
এক্কা-চালক। যে পুরুষটি আমার গাড়িতে ছিল, সে-ই বাঁকিপুর রেলওয়ে ষ্টেসনের নিকট আমার এক্কা ভাড়া করিয়াছিল।
আমি। সেই সময় ঐ স্ত্রীলোকটি তাহার সহিত ছিল?
এক্কা-চা। ঐ স্ত্রীলোকটি সেই সময় তাহার সহিত ছিল না।
আমি। তোমার এক্কা ভাড়া করিয়া সে কোথায় যায়?
এক্কা-চা। প্রথমতঃ সে পাটনা সহরে গমন করে ও আমাকে ভাড়া দিয়া সে কোথায় চলিয়া যায়। যাইবার সময় আমাকে অগ্রিম আরও একটি টাকা দিয়া আমার এক্কা হাজির রাখিতে কহেন আরও কহেন যে, তিনি আমার এক্কাতেই পুনরায় বাঁকিপুর প্রত্যাগমন করিবেন। আমি প্রায় দুই দিবস কাল সেই স্থানে অপেক্ষা করি। তাহার পর গত কল্য সন্ধ্যার পর তিনি আমার এক্কায় আরোহণ করিয়া এক স্থানে প্রায় অৰ্দ্ধঘণ্টাকাল অপেক্ষা করেন। তাহার পর ঐ স্ত্রীলোকটি কোথা হইতে আসিয়া উহাকে আরোহণ করিলে বাঁকিপুরের পরিবর্ত্তে, তিনি আমাকে ফতোয়া রেলওয়ে ষ্টেসনে লইয়া যান, ও সেই স্থানে রেলওয়ে ষ্টেসনে অবতরণ করিয়া আমাকে বিদায় দেন। তাহার পর আমি সেই স্থানের আর একটি ভাড়া পাই, এবং এখন আমি নিজস্থানে ফিরিয়া যাইতেছি।
ঐ এক্কা-চালকের সমস্ত কথাই আমরা বিশ্বাস করিলাম। ঐ পুরুষ ও স্ত্রীলোটির যেরূপ চেহারা আমাদিগের নিকট বলিয়াছিল, তাহাতে আমরা বেশ বুঝিতে পারিয়াছিলাম যে, আরোহীদ্বয় কামতাপ্রসাদ ও তাহার সেই স্ত্রীলোকটি ভিন্ন অপর আর কেহই নহে। আরও বেশ বুঝিতে পারিয়াছিলাম যে, কামতাপ্রসাদ কোন গতিকে রেলগাড়ি হইতে বাহিরে আসিয়া বাঁকিপুরে তাহার এক্কা ভাড়া করে ও তাহার স্ত্রীলোকটি উদ্ধার করিবার মানসেই সে পুনরায় পাটনায় আগমন করে, ও তাহার মনবাঞ্ছা পূর্ণ করিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করে।
মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া আমি তাহাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম “যে তোমার এক্কা ভাড়া করিয়াছিল, সে পাটনা সহরে আসিয়া কোথায় ছিল, তাহার কিছু তুমি বলিতে পার?” উত্তরে সেই এক্কাচালক কহিল, সে সহরের মধ্যে গিয়াছিল, কিন্তু সে কোথায় ছিল, তাহা কিন্তু সে অবগত ছিল না।
ঐ এক্কা-চালকের নিকট এই সমস্ত বিষয় অবগত হইয়া তাহাকেও সঙ্গে লইয়া ফতোয়া ষ্টেসনে গিয়া উপস্থিত হইলাম। যে স্থানে সে উহাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া আসিয়াছিল, তাহা আমাদিগকে দেখাইয়া দিল। আমরা সেই স্থানে অনুসন্ধান করিয়া অবগত হইতে পারিলাম যে, সে যাহা বলিয়াছিল, তাহা প্রকৃত। আরও জানিতে পারিলাম, উহারা মোকামা ষ্টেসনের দুইখানি মধ্য শ্রেণীর টিকিট লইয়া গমন করিয়াছে।
আমাদিগের সমভিব্যাহারী এক্কা দুইখানিকে সেই স্থানে ছাড়িয়া দিয়া, আমারও মোকামা ষ্টেসনের টিকিট লইয়া সেই স্থানে গমন করিলাম। সেই স্থানে অনুসন্ধান করিয়া উহাদিগের কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিলাম না। রেলওয়ে বুকিং আফিসে অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম যে, ফতোয়া ষ্টেসনের কোন টিকিট সেই দিবস কোন আরোহী মোকামা ষ্টেসনে প্রদান করে নাই। বুকিং আফিসে এই অবস্থা অবগত হইয়া বেশ বুঝিতে পারিলাম, হয় কামতাপ্রসাদ এই স্থানে অবতরণ করিয়া টিকিট না দিয়া আস্তে আস্তে বাহির হইয়া গিয়াছে, না হয়, পথিমধ্যে অপর কোন ষ্টেসনে অবতরণ করিয়া প্রস্থান করিয়াছে।
ঐ স্থানে যখন কামতাপ্রসাদের কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিলাম না, তখন আমরা কোন্ স্থানে গমন করিব, তাহারই চিন্তা করিতে লাগিলাম। পরিশেষে ইহাই সাব্যস্ত হইল যে, একবার কলিকাতায় গমন করিয়া কামতাপ্রসাদের স্ত্রীলোকের ঘরে যে সকল অলঙ্কার পাওয়া গিয়াছে, তাহা সেই স্থানে রাখিয়া দিয়া ও প্রধান কর্মচারীকে সমস্ত অবস্থা বলিয়া পরিশেষে উহাদিগের অনুসন্ধানে বহির্গত হইব।
মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া পুনরায় পাটনায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। কারণ, যে সকল অলঙ্কার ঐ স্ত্রীলোকটির ঘর হইতে পাওয়া গিয়াছিল, তাহা সেই স্থানেই রক্ষিত ছিল। ঐ স্থানে আগমন পূর্ব্বক ঐ সকল অলঙ্কার লইয়া আমরা উভয়েই কলিকাতায় গমন করিলাম। সেই স্থানে ঐ সকল অলঙ্কার যে থানায় মোকদ্দমা সেই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্ম্মচারীর জিম্বায় রাখিয়া দিয়া, প্রধান কর্ম্মচারীর সহিত সাক্ষাৎ পূৰ্ব্বক কামতাপ্রসাদের অনুসন্ধানে বহির্গত হইবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইলাম ও পরদিবস অতি প্রত্যূষে হাবড়া ষ্টেসনে আসিয়া পশ্চিমের গাড়িতে আরোহণ করিলাম। আমাদিগের প্রধান উদ্দেশ্য, সৰ্ব্ব প্রথমে মোকমায় অবতরণ করিব ও সেইস্থান হইতে যে দিকে গমন করা বিবেচনা করিব, পরিশেষে সেই দিকেই গমন করিব।
আমরা হাবড়া ষ্টেসনে আসিয়া গাড়িতে উঠিলাম। গাড়ি পশ্চিম অভিমুখে যাত্রা করিল। হুগলিতে ঐ গাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইলে, একজন আরোহী অনেকক্ষণ ঘুরিয়া সমস্ত গাড়ি দেখিয়া পরিশেষে আমরা যে গাড়িতে ছিলাম, সেই গাড়িতে আরোহণ করিল। নৈহাটী হইতে যে গাড়ি গঙ্গাপার হইয়া হুগলি ষ্টেসনে আগমন করে, সেই ব্যক্তিও ঐ গাড়িতে আসিয়া হুগলিতে উপস্থিত হন। তিনি যে সময় আসিয়া ঐ গাড়ির ভিতর প্রবেশ করেন, সেই সময় আমাদিগের গাড়ি প্রায় ছাড়িয়া দিয়াছিল, তাহার পর ঐ গাড়িতে আর কেহই উঠিতে পান না।
ঐ ব্যক্তিকে দেখিয়া বোধ হইল, উহাকে আমি ইতিপূৰ্ব্বে কোথায় দেখিয়াছি। কিন্তু কোথায় যে দেখিয়াছি, তাহা অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত ভাবিয়াও কিছুমাত্র স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। পরিশেষে আমি কিন্তু তাহাকে কহিলাম “মহাশয়কে কোথায় যেন দেখিয়াছি বলিয়া বোধ হইতেছে, কিন্তু ঠিক মনে করিয়া উঠিতে পারিতেছি না।”
আরোহী। আমারও বোধ হইতেছে যে, আমিও আপনাকে কোথায় দেখিয়াছি।
আমি। আপনি কোথায় থাকেন?
আরোহী। কলিকাতায় অনেক সময় থাকি, কিন্তু আমার বাসস্থান কলিকাতায় নহে— দিল্লীতে।
আমি। কলিকাতায় আপনি কি করিয়া থাকেন?
আরোহী। সেই স্থানে আমার একখানি দোকান আছে।
আমি। আপনার দোকান মুর্গিহাটায় নহে?
আরোহী। হাঁ।
আমি। এখন আমার মনে হইতেছে, আপনাকে এক দিবস আমি কামতাপ্রসাদের বাসায় দেখিয়াছিলাম না?
আরোহী। বোধ হয় দেখিয়া থাকিবেন।
আমি। কামতাপ্রসাদ এখন কোথায়?
আরোহী। এখন তিনি কোথায়, তাহা এখন আমি ঠিক বলিতে পারিতেছি না। এই গাড়িতেই তাঁহার কলিকাতা হইতে আসিবার কথা ছিল, কিন্তু অনুসন্ধান করিয়া তাঁহাকে এই গাড়িতে দেখিতে পাইলাম না। গাড়ি ছাড়িবার ঘণ্টা হইয়া গেল, কাজেই আমাকে এই গাড়িতে উঠিতে হইল।
আমি। কামতাপ্রসাদের সহিত আপনার ছাড়াছাড়ি কখন ও কোথায় হইয়াছে?
আরোহী। আজ প্রত্যূষে সিয়ালদহ ষ্টেসনে আমার সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হয়। আমাকে দেখিয়াই তিনি কহিলেন, আপনি দেখিতেছি দেশে যাইতেছেন, আপনার সহিত সাক্ষাৎ হইল ভালই হইল, আমিও পশ্চিমে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া আসিয়াছি, কিন্তু এখন দেখিতেছি, একটি বাক্স যাহাতে কতকগুলি মূল্যবান্ দ্রব্য আছে, তাহা আমি বাসায় ফেলিয়া আসিয়াছি। আমি সেই গুলি লইয়া ইহার পরে যে পশ্চিমের গাড়ি হাবড়া ষ্টেসন হইতে ছাড়িবে, সেই গাড়িতে গিয়া হুগলি ষ্টেসনে আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব। আপনাকেও ঐ গাড়িতে গমন করিতে হইবে। কারণ, নৈহাটীতে আপনার যে কার্য্য আছে, তাহা শেষ করিয়া ও তৎপরে পশ্চিম যাইতে হইলে আপনাকেও ঐ গাড়ি অবলম্বন করিতে হইবে। আর যদি কোন গতিকে গাড়ি ফেল হইয়া আপনার সহিত সাক্ষাৎ নাই হয়, তাহা হইলে আমি অমন করিবার সময় আপনার বাড়ীতে গিয়া আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব, ও সেই স্থান হইতে আমার এই বাক্সটি আপনার নিকট হইতে লইয়া যাইব। ইহার মধ্যেও আমার কিছু মূল্যবান দ্রব্য আছে, অপর আর কাহাকেও বিশ্বাস করিয়া আমি কাহারও হস্তে উহা প্রদান করিয়া যাইতে পারি না, অথচ ইহা সঙ্গে করিয়া পুনরায় বাসায় লইয়া যাইতে চাহি না।” এই বলিয়া কামতাপ্রসাদ একটি বাক্স আমাকে প্রদান করিলেন। উহা লইতে আমি প্রথমতঃ অসম্মত হইলাম, কিন্তু যাঁহার নিকট হইতে অনেক সময় অনেক উপকার প্রাপ্ত হইয়াছি, তাঁহার অনুরোধ কিছুতেই লঙ্ঘন করিতে পারিলাম না। কাজেই ঐ বাক্স আমাকে লইয়া আসিতে হইল।
আমি। কামতাপ্রসাদের নিকট হইতে আপনি কিরূপ উপকার প্রাপ্ত হইতেন?
আরোহী। কামতাপ্রসাদ বিশেষ ভদ্র এবং বড়লোক। তিনি বিস্তর অর্থ লইয়া কারবার করিয়া থাকেন। আমরা সামান্য দোকানদার, সামান্য মূলধনে আমরা ব্যবসা চালাইয়া থাকি, কিন্তু তাঁহার অনুগ্রহে আমার কোন মহাজনই বুঝিতে পারেন না যে, আমার মূলধন কম। কারণ, আমার যখন যত টাকার প্রয়োজন হয়, কামতাপ্রসাদ নিতান্ত সামান্য সুদে আমাকে সেই অর্থ দিয়া বিশেষরূপ উপকার করিয়া থাকেন।
আমি। আপনি জানেন কি যে, কামতাপ্রসাদের বাসস্থান কোথায়, ও তিনি কি কার্য্য করিয়া থাকেন? আরোহী। তাহা আমি বিশেষরূপ অবগত নহি। শুনিয়াছি, তিনি একজন খুব বড় সওদাগর; বোম্বাই, মাদ্ৰাজ, রেঙ্গুন প্রভৃতি বড় বড় স্থানে তাঁহার কারবার আছে। তিনি কলিকাতায় থাকিয়া বিলাতে সওদাগরদিগের সহিত কার্য্যের বন্দোবস্ত প্রভৃতি করিয়া থাকেন, ও সময় সময় নিজের কারবার স্থানে গমন করিয়া দেখিয়া আসেন। একবার কোন সওদাগর সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত তাঁহাকে সিমলা পাহাড়ে গমন করিতে হয়। সেই সময় অনুগ্রহ করিয়া তিনি একবার দিল্লীতে অবতরণ করেন, ও এই দরিদ্রের গৃহে পদধূলিও প্রদান করিয়াছিলেন।
আমি। তাঁহার সম্বন্ধে এ সমস্ত কথা আপনি কিরূপে জানিতে পারিলেন?
আরোহী। আমি তাহার মুখেই এই সব কথা শুনিয়াছি। তিনি আমাকে বিশেষ অনুগ্রহ করেন বলিয়া এই সকল কথা আমাকে বলিয়াছেন।
আমি। আপনি আমাকে চিনিতে পারিয়াছেন কি?
আরোহী। ঠিক চিনিয়া উঠিতে পারি নাই, তবে যতদূর আমার মনে হইতেছে, তাহাতে বোধ হয়, আপনি পুলিস-
কৰ্ম্মচারী। কামতাপ্রসাদের আশ্রিতা একটি স্ত্রীলোক হত হইবার পর, সেই অনুসন্ধানের সময় কামতাপ্রসাদের সহিত আপনাকে দেখিয়াছি বলিয়া অনুমান হইতেছে।
আমি। আপনার অনুমান সত্য। আমি একজন পুলিস
কর্ম্মচারী। ঐ হত্যা মোকদ্দমার অনুসন্ধান আমি করিয়াছিলাম। কামতাপ্রসাদ ঐ মোদ্দমার অনুসন্ধানে আমাদিগকে বিশেষরূপ সাহায্য করিয়াছিলেন।
আরোহী। ঐ মোকদ্দমার কোনরূপ কিনারা হইয়াছে কি?
আমি। কিছুই করিয়া উঠিতে পারি নাই, পারিব বলিয়াও অনুমান হইতেছে না।
ঐ আরোহীর কথা শুনিয়া বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, কামতাপ্রসাদ পুনরায় কলিকাতায় গমন করিয়াছে, ও সেই স্থানেই লুক্কায়িত ভাবে সে তাহার সেই স্ত্রীলোকটির সহিত অবস্থান করিতেছে।
আমি তাহাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, কামতা প্রসাদ আপনার নিকট যে বাক্সটি রাখিতে দিয়াছে, তাহা আপনি কোথায় রাখিয়াছেন?
আরোহী। আমার এই পোর্টমেন্টের ভিতর উহা আছে।
আমি। ঐ বাক্সের মধ্যে কামতাপ্রসাদের কি মূল্যবান দ্রব্য আছে, তাহা আপনি বলিতে পারেন?
আরোহী। তাহা আমি অবগত নহি; কারণ, উহা আমি খুলিয়া দেখি নাই।
আমি। উহাতে কি আছে না আছে, খুলিয়া একবার দেখা উচিত নহে কি?
আরোহী। দেখিয়া আর কি করিব। যাহা আছে, তাহা উহার মধ্যেই আছে।
আমি। কামতাপ্রসাদ কেবল আপনার নহে, আমারও একজন বন্ধু, সুতরাং উহার ভিতর তাহার কি মূল্যবান দ্রব্য আছে, একবার দেখা যাউক; বাক্সটি বাহির করুন দেখি।
আরোহী। উহার চাবি তো আমার নিকটে নাই। উহা খুলিব কি প্রকারে?
আমি। বাক্সটিই বাহির করুন না কেন; দেখা যাউক্, উহা কিরূপ বাক্স। আপনি জানেন, দুই কারণে আমার ঐ বাক্স খুলিয়া দেখিবার অধিকার আছে। ১ম– কামতাপ্রসাদ আমার বন্ধু; ২য়— আমি পুলিস
কর্ম্মচারী। আপনি কলিকাতা হইতে কোন দ্রব্য অপহরণ করিয়া পলায়ন করিতেছেন কি না, তাহাও আমার দেখা কর্তব্য। এই জন্যই বলিতেছি, অনুগ্রহপূর্ব্বক বাক্সটি বাহির করুন; উহার ভিতর কি কি মূল্যবান দ্রব্যাদি আছে, একবার দেখিয়া লই। বিশেষ আমার সম্মুখে ঐ বাক্স প্রথমে খুলিলে পরিশেষে আর কেহ বলিতে পারিবে না যে, ঐ সকল দ্রব্য ভিন্ন অপর আর কোন দ্রব্য উহার ভিতর ছিল।
আমার কথা শুনিয়া ঐ আরোহী অনেকক্ষণ পৰ্য্যন্ত মনে মনে কি ভাবিয়া, পরিশেষে তাহার পোর্টমেন্টের ভিতর হইতে ঐ বাক্সটি বাহির করিয়া বেঞ্চের উপর রাখিয়া দিল। দেখিলাম, বাক্সটি টিনের ও প্রকৃতই বন্ধ। আমার নিকট যে কয়েকটি আমার নিজের চাবি ছিল, তাহা দিয়া ঐ বাক্সটি খুলিবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। একটি চাবি উহাতে লাগিয়া গেল। বাক্সটি সৰ্ব্বসমক্ষে খুলিয়া ফেলিলাম। দেখিলাম, উহা কতকগুলি সুবর্ণ অলঙ্কারে পূর্ণ। ঐ অলঙ্কারগুলি দেখিবামাত্রই আমরা বিস্মিত হইয়া পড়িলাম। ও ক্রমে যখন উহা এক একখানি করিয়া বাহির করিতে লাগিলাম, আমার বিস্বস্ময় ততই বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। দেখিলাম, যে সকল অলঙ্কার আমি ইতিপূর্ব্বে পাটনায় কামতাপ্রসাদের সেই স্ত্রীলোকের ঘরস্থিত লোহার সিন্ধুকের মধ্য হইতে প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, ইহা সেই সকল অলঙ্কার। যে সকল অলঙ্কার আমি পরিশেষে পাটনার থানায় জমা রাখিয়াছিলাম, ও তাহা সেই স্থান হইতে গ্রহণ করিয়া কলিকাতায় লইয়া গিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্ম্মচারীকে প্রদান করিয়া পূর্ব্বদিবস যাহার রসিদ লইয়া আসিয়াছি, এই সকল অলঙ্কার তাহারই অংশ। এই অবস্থা দৃষ্টে আমার মনে নিতান্ত বিস্ময়সূচক ভাবনা আসিয়া উপস্থিত হইল। আমিও আমার পোর্টমেন্টটি খুলিয়া উহার মধ্য হইতে পাটনায় প্রাপ্ত অলঙ্কারগুলির তালিকার একটি নকল বাহির করিয়া, উহার সহিত ঐ অলঙ্কারগুলি মিলাইয়া দেখিতে লাগিলাম। দেখিলাম, যে সকল অলঙ্কার সেই হত স্ত্রীলোকের বলিয়া আমরা সন্দেহ করিয়াছিলাম, সেই সকল অলঙ্কার উহার ভিতর নাই। তদ্ব্যতীত আরও অনেকগুলি গহনা দেখিতে পাইলাম না, অবশিষ্ট সমস্তই তালিকার সহিত মিলিয়া গেল। কিন্তু এ রহস্যের কোনরূপ অর্থই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। যে সকল অলঙ্কার পুলিসের হস্তে — পুলিসের পাহারায় পুলিস মালখানার ভিতর আছে, তাহা কিরূপে একজন মুর্গিহাটার দোকানদারের হস্তে আসিয়া পড়িল? আর যদি তাহার কথাই প্রকৃত হয়, তাহা হইলে কামতাপ্রসাদই বা কিরূপে সেই সকল অলঙ্কার সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইল? পুনরায় ভাবিলাম, যে কামতাপ্রসাদ পাটনার পুলিস-গারদের মধ্য হইতে ও পুলিস প্রহরীর পাহারার মধ্য হইতে একটি স্ত্রীলোককে স্থানান্তরিত করিতে পারে, সে কলিকাতা পুলিস মালখানা ও প্রহরীর পাহারার মধ্য হইতে অলঙ্কারগুলিই যে স্থানান্তরিতনা করিতে পারিবে, তাহাই বা বলি কি প্রকারে? সে যাহা হউক, ক্রমে সমস্ত কথা জানিতে পারিব।
গহনাগুলি আমার নিকটস্থিত তালিকার সহিত মিলিয়া যাওয়ায়, আর উহা সেই আরোহীকে প্রত্যর্পণ করিলাম না বা তাহাকেও আর আমার নজরের বাহির হইতে দিলাম না। আমার সহিত অপর যে একজন কর্মচারী ছিলেন, ঐ আরোহীর অলঙ্কার তাহার জিম্বায় রহিল। ক্রমে গাড়ি গিয়া বৰ্দ্ধমান ষ্টেসনে উপস্থিত হইল। সেই স্থানে আমরা গাড়ি হইতে অবতরণ করিলাম, ঐ আরোহীকেও আমাদিগের সহিত নামাইয়া লইলাম। সেই স্থান হইতে কলিকাতার প্রধান পুলিস কর্ম্মচারীর নিকট একখানি টেলিগ্রাফ করিলাম, উহার মর্ম্ম এইরূপ; “সঠিক সংবাদ পাইয়াছি, কামতা প্রসাদ এখনও কলিকাতায় আছে। অদ্য প্রাতে সিয়ালদহ ষ্টেসন হইতে একখানি ঠিকা গাড়িতে সে বড়বাজার অভিমুখে গিয়াছে। তাহার সঙ্গি একজন লোককে আমরা ধরিয়াছি। যে সকল অলঙ্কার আমি পাটনা হইতে কলিকাতায় লইয়া গিয়া থানায় রাখিয়া আসিয়াছি, তাহার মধ্যে অনেকগুলি অলঙ্কার ঐ ব্যক্তির নিকট পাইয়াছি। কেবল হত স্ত্রীলোকটির অলঙ্কারগুলি উহার সহিত নাই। ইহার রহস্য কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। উত্তরে অপেক্ষায় বর্দ্ধমান ষ্টেসনে রহিলাম।”
তিন ঘণ্টার মধ্যেই আমার প্রেরিত টেলিগ্রাফের উত্তর আসিল। উত্তর প্রাপ্তে জানিতে পারিলাম যে, যে থানার মালখানায় ঐ সকল অলঙ্কার রক্ষিত ছিল, সেই স্থান হইতে এইসকল অলঙ্কার অপহৃত হইয়া গিয়াছে। সিন্ধুকের তালা যেমন ছিল তেমনি আছে, উহার উপর প্রহরীর যেরূপ পাহারা ছিল, তাহা সেইরূপই আছে, কেবল মধ্যে মধ্যে বদলি হইয়াছে মাত্র, অথচ তাহার মধ্য হইতে সমস্তই অপহৃত হইয়া গিয়াছে। কিন্তু কখন যে অপহৃত হইয়াছে, ও সেই সময় যে কাহার পাহারা ছিল, তাহা এ পর্যন্ত কিছুই স্থির হয় নাই, ও আমার নিকট হইতে টেলিগ্রাফ পাইবার অগ্রে কেহ অবগত হইতেও পারেন নাই যে, থানার মধ্যে এইরূপ ভয়ানক ব্যাপার সংসাধিত হইয়াছে। ঐ টেলিগ্রাফে আমাদিগের উপর কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিবার আদেশ হইল। এই সংবাদ প্রাপ্ত হইবার পরই যে গাড়ি প্রাপ্ত হইলাম, তাহাতেই কলিকাতায় গমন করিলাম। বলা বাহুল্য, পূর্ব্বকথিত আরোহী ও তাহার নিকট হইতে প্রাপ্ত অলঙ্কারগুলিও লইয়া গেলাম।
আমি কলিকাতায় গিয়া উপস্থিত হইবার পূর্ব্বেই কামতাপ্রসাদের নিমিত্ত বিশেষরূপ অনুসন্ধান আরম্ভ হইয়াছিল। সহর ও সহরতলীর ছোটবড় সমস্ত কর্ম্মচারী এই উপলক্ষে একত্রিত হন। এই অনুসন্ধানে শ্বেত ও কৃষ্ণকায় কর্ম্মচারীর কিছুমাত্র প্রভেদ বুঝিতে পারা যায় না, বা প্রত্যেকের দায়িত্ব বিষয়েও কিছুমাত্র তারতম্য পরিলক্ষিত হয় না। সহর ও সহরতলীর সমস্ত স্থান ভিন্ন ভিন্ন বিভাগে বিভক্ত করা হয়, ও প্রত্যেক বিভাগের অনুসন্ধানের ভার এক একজন কর্ম্মচারীর হস্তে ন্যস্ত হয়, ও ঐ সকল কর্ম্মচারীগণের উপর দৃষ্টি রাখিবার জন্য প্রধান প্রধান কয়েকজন কর্ম্মচারীও বিভাজিতরূপে নিযুক্ত হন। ইহাদিগের প্রত্যেকের উপর এইরূপ কঠিন আদেশ প্রদত্ত হয় যে, যখন জানিতে পারা যাইবে, কামতাপ্রসাদ যে যে স্থানে গমন করিয়াছে, বা যে যে স্থানে লুক্কায়িত ভাবে অবস্থিতি করিয়াছে, সেই সেই স্থানের মধ্যে অনুসন্ধানে যে যে কর্ম্মচারী নিযুক্ত ছিলেন, তাহাদিগের কোনরূপ ওজর আপত্য না শুনিয়া সরকারি কৰ্ম্ম হইতে তাহাদিগকে বিতাড়িত ও তাহাদিগের প্রাপ্য বেতন বাজেয়াপ্ত করা যাইবে।
যাহারা চাকরি করিয়া নিজব্যয় সম্পাদন ও পরিবার প্রতিপালন করিয়া থাকেন, তাহাদিগের পক্ষে এইরূপ আদেশ যে কিরূপ ভয়ানক, তাহা চাকুরে মাত্রেই অনুমান করিতে পারিবেন।
বলা বাহুল্য, নিতান্ত ভীতিবিহ্বল চিত্তে সকলেই আপনাপন নির্দ্দিষ্ট স্থানে ঘর ঘর অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত গমন করিলেন। কেহ ঘাটে ঘাটে, কেহ ষ্টেসনে ষ্টেসনে, কেহ পথে পথে, কেহ বাগানে বাগানে, তাহার অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। যাঁহার যাঁহার উপর ঘোড়ার গাড়ির কোচমান দিগের নিকট অনুসন্ধানের ভার ছিল, তাঁহারা আস্তাবলে আস্তাবলে ছুটিতে লাগিলেন। যাঁহারা নৌকায় নৌকায় অনুসন্ধান করিতেছিলেন, তাঁহাদিগকে ঘাটমাঝির স্মরণ লইতে হইল। এই রূপে কৰ্ম্মচারীমাত্রই আপনাপন নির্দ্দিষ্ট কার্য্যে নিযুক্ত হইলেন। থানার যে সকল নূতন নালিস বা অপর যে সকল কাৰ্য্য আসিতে লাগিল, তাহার অনুসন্ধান প্রভৃতি সেই সময়ের নিমিত্ত স্থগিত রহিল। পুলিস-কর্মচারীগণের এইরূপ অবস্থা দৃষ্টে অনেক অধিবাসীও পুলিসকে বিশেষরূপে সাহায্য করিতে আরম্ভ করিলেন।
এদিকে কামতাপ্রসাদকে ধৃত করিবার নিমিত্ত ৫০০শত টাকা পুরস্কার বিজ্ঞাপিত হইল। ঐ বিজ্ঞাপন ছাপা হইয়া প্রত্যেকের গৃহে গৃহে প্রদত্ত হইতে লাগিল।
এইরূপে অনুসন্ধান করিতে করিতে কোন কোন কর্মচারী কামতাপ্রসাদের কোন কোন সংবাদ প্রাপ্ত হইতে লাগিলেন, কেহ বা তাহার সেই স্ত্রীলোকটির সন্ধানও আনিতে লাগিলেন, কিন্তু উহাদিগকে কেহই সহজে আনিতে সমর্থ হইলেন না। তবে ইহা বেশ অনুমান হইতে লাগিল যে, কামতাপ্রসাদ এখন পর্যন্ত কলিকাতা সহর পরিত্যাগ করিয়া বাহিরে গমন করেন নাই।
এইরূপে অনুসন্ধান করিতে করিতে এক দিবস একজন কৰ্ম্মচারী যিনি কামতাপ্রসাদকে চিনিতেন না, তিনি কামতাপ্রসাদকে তাঁহার সেই স্ত্রীলোকটির সহিত একখানি ক্ষুদ্র নৌকার মধ্যে দেখিতে পাইলেন। ঐ নৌকাখানি সেই সময় সহর পরিত্যাগ করিয়া দক্ষিণদিকে গমন করিতেছিল। অনুমান করিয়া উহাদিগকে ধরিতে সেই কর্ম্মচারীর সাহসে কুলাইল না, কিন্তু তিনি তৎক্ষণাৎ এই সংবাদ তাঁহার উপরিতন কর্মচারীকে প্রদান করিলেন। তিনি কালবিলম্ব না করিয়া যে যে কৰ্ম্মচারী কামতা-প্রসাদকে চিনিত, তাহাদিগকে দুইখানি ষ্টিম-লঞ্চে দুই দিকে প্রেরণ করিলেন। তাঁহারা প্রত্যেক নৌকা দেখিতে দেখিতে ক্রমে অগ্রবর্ত্তী হইতে লাগিলেন। যিনি দক্ষিণদিকে গমন করিয়াছিলেন, তিনি মেটিয়াব্রুজের নিকট উপস্থিত হইয়া সেই নৌকাখানি দেখিতে পাইলেন ও উহার মধ্যে কামতাপ্রসাদ ও সেই স্ত্রীলোকটিকে প্রাপ্ত হইলেন। উহাদিগের সহিত দুই তিন সহস্র নগদ টাকা ভিন্ন আর কিছুই ছিল না। কামতাপ্রসাদ ও তাহার সেই স্ত্রীলোকটিকে ধরিয়া আনিবার সময় কামতা প্রসাদ আর এক খেলা খেলিয়া তাহার ধৃতকারী কর্ম্মচারীর চক্ষে ধূলি মুষ্টি প্রদান করিবার উদযোগ করিয়াছিল, কিন্তু তাহাতেও সে কৃতকাৰ্য্য হইতে পারে নাই। কর্ম্মচারী উহাদিগকে ধৃত করিয়া উভয়কেই আপনার ষ্টিম-লঞ্চের উপর উঠাইয়া লন, ও যে নৌকায় উহারা গমন করিতেছিল, সেই নৌকাখানি তাহার সেই ষ্টিম-লঞ্চের সহিত বাঁধিয়া লইয়া কলিকাতা অভিমুখে আগমন করিতে থাকেন। কামতাপ্রসাদের হাত হাতকড়ির দ্বারা আবদ্ধ করিয়া দিয়াছিলেন, কিন্তু স্ত্রী লোকটিকে কোনরূপে আবদ্ধ করিয়াছিলেন না। মেটিয়াব্রুজ হইতে কিছুদূর আসিবার পরই ঐ ষ্টিমলঞ্চের উপরই ঐ স্ত্রীলোকটির হঠাৎ মূৰ্চ্ছা হয়। তিনি একেবারে অজ্ঞান হইয়া সেই স্থানে ষ্টিমলঞ্চের উপরই পড়িয়া যান। তাঁহার মূৰ্চ্ছা অপনোদনের নিমিত্ত প্রথমতঃ চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তাঁহার মূর্ছা অপনোদিত না হওয়ায়, যাহাতে তাঁহার ভালরূপ শুশ্রূষা হয়, তাহার নিমিত্ত কামতাপ্রসাদের হাতের হাতকড়ি খুলিয়া দিয়া তাহাকে উহার শুশ্রুষা কার্য্যে নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু কামতাপ্রসাদ তাহাব করিবার পরিবর্তে বন্ধনোন্মুক্ত হইবামাত্রই সেই ষ্টিমলঞ্চ হইতে গঙ্গাগর্ভে ঝম্ফ প্রদান করে। তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ষ্টিমলঞ্চের দুই একজন খালাসীও তাহাকে ধরিবার নিমিত্ত গঙ্গাগর্ভে পতিত হন, কিন্তু অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত কামতাপ্রসাদকে দেখিতে পাওয়া যায় না। পরিশেষে দেখিতে পাওয়া যায় যে, দূরে একটি লোক গঙ্গা-তরঙ্গের মধ্যে সন্তরণ প্রদান করিয়া ধীরে ধীরে গমন করিতেছে, ইহা দেখিয়াই ষ্টিমলঞ্চের সারঙ্গ সেই দিকে তাহার লঞ্চ লইয়া গিয়া অনেক কষ্টে তাহাকে জল হইতে উত্তোলন করেন। কামতাপ্রসাদ সন্তরণ জানিলেও সেই সময় তিনি অতিশয় ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন বলিয়াই কষ্ট করিয়াও পুনরায় তাঁহাকে ধৃত করিতে পারা যায়। যে সময় কামতা প্রসাদ গঙ্গাবক্ষে ঝম্ফ প্রদান করিয়াছিলেন, সেই সময় ঐ স্ত্রীলোকটির প্রতি বিশেষ কাহারও লক্ষ্য ছিল না। কেবলমাত্র তাহার উপর এই মাত্র লক্ষ্য ছিল যে, সেও যেন কামতাপ্রসাদের অনুসরণ না করে। সেই সময় জানিতে পারা যায়, তাহার যে মূৰ্চ্ছা হইয়াছিল, তাহা প্রকৃত মূৰ্চ্ছা নহে, মূৰ্চ্ছার ভান মাত্র। এইরূপ উপায় অবলম্বন করিলে যদি কামতাপ্রসাদ কোনরূপে পুলিসের হস্ত হইতে উদ্ধার হইতে পারে, এই নিমিত্তই সে মূৰ্চ্ছার ভানে অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিল। তাহার আরও ইচ্ছা ছিল, কামতাপ্রসাদকে ধৃত করিবার মানসে সকলে যখন বিশেষরূপে ব্যস্ত থাকিবে, সেই সময় যদি সুযোগ পায়, তাহা হইলে সেও পলায়নের চেষ্টা করিবে। কিন্তু তাহার ইচ্ছাও কার্য্যে পরিণত হইতে পারিল না। কামতাপ্রসাদও পুনরায় ধৃত হইল।
উহাদিগকে ধরিয়া কলিকাতায় আনা হইল, কিন্তু তাহারা কোন কথা স্বীকার করিল না। সেই স্ত্রীলোকটিকে হত্যা করার কথা দূরে থাকুক, কিরূপ উপায়ে কামতা রেলগাড়ি হইতে অন্তর্হিত হন, কিরূপ উপায়ে তিনি পুলিস-হাজত ও পুলিস-প্রহরীর পাহারা হইতে তাঁহার সেই স্ত্রীলোকটিকে উদ্ধার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, ও কিরূপেই বা তিনি কলিকাতার থানার ভিতরস্থিত মালখানার বাক্সের ভিতর হইতে অলঙ্কারগুলি পুনরায় অপহরণ করিয়াছিলেন, তাহা কোনরূপেই কহিলেন না ও পুলিস প্রহরীগণকে কিরূপে বশীভূত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, তাহার আভাসও আমাদিগকে প্রদান করিলেন না। কিন্তু কলিকাতার থানার ভিতর হইতে অলঙ্কারগুলি অপহৃত হইবার পর তাহার কিয়দংশ তিনি যে তাঁহার সেই সব বন্ধুকে প্রদান করিয়াছিলেন, কেবল তাহাই স্বীকার করিলেন। ঐ সকল অলঙ্কারের মধ্যে খুনি মোকদ্দমা সম্বন্ধীয় অলঙ্কার একখানিও ছিল না। ঐ অলঙ্কারগুলি কি করিয়াছেন, তাহা জিজ্ঞাসা করায় তিনি স্পষ্ট করিয়া কোন কথা কহিলেন না, কিন্তু ভাব ভঙ্গিতে যাহা কহিলেন, তাহাতে আমরা ইহা বুঝিতে পারিলাম যে তাঁহার উপর যখন খুনি মোকদ্দমা চাপান হইয়াছে তখন তাঁহাকে তাহার জীবন রক্ষার উপায় দেখিতে হইবে। তিনি যে হত্যা করিয়াছেন, এ কথা কেহ বলিতে পারিবে না; কারণ হত্যা করিতে কেহ কাহাকেও দেখে নাই। এ অবস্থায় হত্যা মোকদ্দমার প্রমাণ করিতে হইলে অপহৃত অলঙ্কারের উদ্ধার ভিন্ন আর কোন উপায় নাই। বিচারকের নিকট যদি সকল অলঙ্কার উপস্থিত করিতে না পারা যায়, তাহা হইলে কোন বিচারকই কোন ব্যক্তিকে হত্যা মোকদ্দমায় দণ্ড করিতে পারেন না।
কামতাপ্রসাদের কথা শুনিয়া সকলেই বুঝিতে পারিলেন যে, থানার ভিতর হইতে কামতাপ্রসাদ কেন অলঙ্কার অপহরণ করিয়াছিল, ও হত স্ত্রীলোকটির অলঙ্কারগুলি বিশ্বাস করিয়া সে কেন কাহার হস্তে অর্পণ করে নাই।
ঐ সমস্ত অলঙ্কার কামতাপ্রসাদ কি করিল, তাহার নিমিত্ত বিস্তর অনুসন্ধান হইল, কিন্তু ফলে কিছু দাঁড়াইল না। সমস্ত অলঙ্কার সম্বন্ধে কামতাপ্রসাদ বিশেষ কিছুই বলিল না। ঐ স্ত্রীলোকটির নিকট হইতে যদি কোন কথা পাওয়া যায়, তাহার নিমিত্ত অনেকরূপ চেষ্টা করা হইল, কিন্তু সে কোন রূপে কাহার নিকট কোন কথার উত্তরই প্রদান করিল না। সে স্পষ্টই কহিল, তাহাকে যতই পীড়াপীড়ি করুন, ভাল হউক আর মন্দ হউক, সে কোনরূপে কোন কথার উত্তর প্রদান করিবে না।
উহারা ধৃত হইবার পর উহাদিগকে লইয়া ১৫ দিবস অনুসন্ধান হইল, কিন্তু কাৰ্য্যে কিছুই হইল না। তখন অনন্যোপায় হইয়া কর্তৃপক্ষীয়গণ উহাকে খুনি মোকদ্দমা হইতে অব্যাহতি প্রদান করিয়া উহার উপর চুরি মোকদ্দমা উপস্থিত করিলেন। থানার ভিতর হইতে যে সকল অলঙ্কার অপহৃত হইয়াছিল, তাহাই অপহরণ করা অপরাধে তাহাকে ও তাহার
স্ত্রীলোকটিকে বিচারকের নিকট প্রেরণ করা হইল। পূর্ব্বে তিনি যে যে স্থান হইতে কারারুদ্ধ হইয়াছিলেন, সেই কাগজ পত্র ও প্রমাণ-প্রয়োগ বিচারকের নিকট উপস্থিত হইল। বিচারকালে খুনি মোকদ্দমা প্রভৃতি সমস্ত অবস্থা জানিতে পারিলেন। কিরূপে হত্যা মোকদ্দমার অলঙ্কার তাহার সেই স্ত্রীলোকের নিকট হইতে প্রাপ্ত হওয়া যায়, কিরূপে তিনি আসামীকে পুলিসের হাজত হইতে পলায়নের সহায়তা করেন, ও পরিশেষে কিরূপে তিনি থানার মালখানা থেকে ঐ সকল অলঙ্কার পুনরায় অপহরণ করিয়া, হত্যাপরাধের আসামী হইতে আপনাদিগকে রক্ষা করেন, তাহার সমস্ত অবস্থা বিচারকালে বিচারকের জানিতে বাকী রহিল না।
বিচারে সেই স্ত্রীলোকটি চুরি অপরাধে অব্যাহতি পাইল, কিন্তু পুলিসের হাজত-গৃহ হইতে পলায়ন করা অপরাধে তিন মাসের কারারুদ্ধ হইল। কামতাপ্রসাদ ১০ বৎসরের জন্য নিৰ্ব্বাসিত হইলেন।
[আশ্বিন, ১৩১১]