ছবি

ছবি 

প্রথম পরিচ্ছেদ

মাঘ মাস। দারুণ শীত। তাহার উপর সমস্ত দিন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। উত্তরে বাতাস হু হু করিয়া প্রবাহিত হইতেছে। পথ জ্ঞানশূন্য; নিতান্ত প্রয়োজন না হইলে কেহ রাস্তায় বাহির হইতেছে না। 

আমার হাতে সেদিন বিশেষ কোন কাজ না থাকায়, বহুবাজারে আমার অফিসের একটি নির্জ্জন গৃহে বসিয়া সংবাদ-পত্র পাঠ করিতেছিলাম, এমন সময়ে আমার ভৃত্য একখানি পত্র আনিয়া আমার হস্তে দিল। 

সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে, গৃহে গৃহে আলোক প্রজ্জ্বলিত হইয়াছে। মনে করিয়াছিলাম, এই দারুণ শীতে আর কোন কার্য্য করিব না; শীঘ্র বাড়ী গিয়া, আহারাদি সমাপন করিয়া, নিদ্রার আশ্রয় গ্রহণ করিব। কিন্তু মানুষের ইচ্ছায় কাৰ্য্য হয় না। মানুষ মনে মনে অনেক আশা করে, কিন্তু সকল সময়েই তাহার আশা ফলবতী হয় না। 

সে যাহা হউক, আশাভঙ্গ হওয়ার মনটা কেমন খারাপ হইয়া গেল। চিঠিখানি খুলিলাম এবং দুই-তিনবার পাঠ করিলাম। পত্রখানি কোথা হইতে আসিয়াছে, তাহা জানিবার উপায় নাই, কারণ উহাতে পত্র-লেখকের স্বাক্ষর ছিল না। তিনি লিখিতেছেন : – 

“আজ রাত্রি আটার সময় আপনার অফিসে থাকিবেন। কোন জমীদার-পুত্র ঐ সময়ে আপনার নিকট গমন করিয়া এক গুরুতর বিষয়ে পরামর্শ গ্রহণ করিবেন। সম্প্রতি কোন জমীদার বাড়ীতে আপনি যে কার্য্য করিয়াছেন, তাহাতে আমার দৃঢ় বিশাস হইয়াছে যে, আপনিই জমীদার-পুত্রকে আসন্ন বিপদ হইতে রক্ষা করিতে পারিবেন। জমীদার- পুত্র স্বয়ং আপনার নিকটে না যাইতে পারেন। হয়ত তাঁহার কোন বন্ধুর উপরেই এই কার্য্যের ভার পড়িবে। কিন্তু আপনার নিকট আমার বিনীত অনুরোধ এই যে, আপনি তাঁহাকে কোনরূপ পরিচয় জিজ্ঞাসা করিবেন না। যদি ঈশ্বর দিন দেন, যদি আপনি জমীদার-পুত্রকে এই বিপদ হইতে রক্ষা করিতে পারেন, তাহা হইলে পরে সমস্তই জানিতে পারিবেন। আপনি চেষ্টা করিলে সকলই জানিতে পারিবেন বটে, কিন্তু আমার একান্ত অনুরোধ যে, আপাততঃ সেরূপ কোন চেষ্টা করিবেন না।” 

পত্রখানি তৃতীয়বার পাঠ করিলাম, কিন্তু কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। চিঠির কাগজখানি সাধারণ বাজারে কাগজ নহে, সাধারণ লোকে সে কাগজ ব্যবহার করা দূরে থাকুক, কখনও দেখিয়াছে কি না বলা যায় না। কাগজখানি আলোকের দিকে ধরিলাম; দেখিলাম, জলের অক্ষরে কি একটা কোম্পানীর নাম লেখা রহিয়াছে। সম্ভবতঃ সেই কোম্পানিই ঐ প্রকারের চিঠির কাগজ প্রস্তুত করিয়া বিক্রয় করিয়া থাকে। কাগজখানি গোলাপের গন্ধে ভরভর করিতেছে। বুঝিলাম, পত্র-লেখক সামান্য ব্যক্তি ন’ন। খুব সম্ভব, তিনি স্বয়ংই জমীদার-পুত্র। 

শীতকালের রাত্রি সহজে যায় না। বেলা পাঁচটার পরই সন্ধ্যার আলোক প্রজ্জ্বলিত হইয়াছে। তাহার কিছু পরেই আমি পত্র পাইয়াছি। পত্রখানি এতবার পাঠ করিয়াছি, এতক্ষণ ধরিয়া পত্র-লেখকের নাম জানিবার জন্য চেষ্টা করিয়াছি, কিন্তু তখনও সাতটা বাজিল না। 

পত্রখানি সম্মুখে রাখিয়া, একখানি আরাম-চৌকিতে উপবেশন করিয়া, নানাপ্রকার চিন্তায় নিমগ্ন আছি, এমন সময়ে আমার গৃহদ্বারে করাঘাতের শব্দ শুনিতে পাইলাম। 

হাতের শব্দ শুনিয়াই বুঝিতে পারিলাম, আমার বন্ধু বলাই ডাক্তার আসিয়াছেন। দরজা বন্ধ ছিল,কিন্তু হুড়কো দেওয়া ছিল না। আমি চৌকী হইতে না উঠিয়াই বলিলাম, “ভিতরে এস ডাক্তার! আমার এখানে ত মেয়ে ছেলে নাই যে, তোমার আসিতে ভয় হইবে?” 

ডাক্তারকে আর কিছু বলিতে হইল না। তিনি হাসিতে হাসিতে গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন, এবং আমার নিকটস্থ একখানি চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন। 

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কেমন আছ ডাক্তার? এদিকে আর আস না কেন?” 

ডা। তুমিই যত নষ্টের মূল।

আ। সে কি! আমার অপরাধ কি?

ডা। তোমার কথাতেই বিবাহ করি। এখন আমায় ঘোর সংসারী হতে হয়েছে। 

আ। ভালই ত ডাক্তার! সকলেই যদি বিবাহ না করে, তাহা হইলে ঈশ্বরের সৃষ্টি লোপ হবে যে! 

ডা। তাই বুঝি আমার ঘাড়ে সংসার চাপিয়ে দিলে? 

আ। কেন ভাই, তোমার অসুখ কিসে? অমন স্ত্রী কার ভাগ্যে আছে? 

ডা। সে কথা আমি স্বীকার করি। সে সকল কষ্ট নাই, তবে অর্থের অভাব। 

আ। কেন? এখন তোমার কাজ কর্ম্ম ত বেশ চলিতেছে। 

ডা। সে কথা তোমায় কে বলিল? 

আ। কেহই নয়। যদি তোমার অবসর থাকিত, তাহা হইলে কি এতদিনের মধ্যে একটিবারও দেখা করিতে পারিতে না? আর এককথা, সম্প্রতি তুমি একদিন ভয়ানক বৃষ্টিতে ভিজিয়াছিলে, কেমন? আমার অনুমান সত্য কি না? 

ডা। সত্য। গত মঙ্গলবার রোগী দেখিয়া বাড়ী ফিরিবার সময় পথে ভয়ানক বৃষ্টি আ’সে, বাড়ীর নিকটে ছিলাম বলে, কোথাও না দাঁড়াইয়া, ভিজিতে ভিজিতে বাড়ী যাই। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, তাহার পর প্রায় চারিদিন কাটিয়া গিয়াছে অথচ তুমি সে কথা বলিলে কিরূপে? 

আ। আরও একটি কথা আছে, তোমার চাকর বড় দুষ্ট, সকল সময়ে সে তোমার কথানুযায়ী কাজ করে না।

ডা। যথার্থ বলিয়াছ। বেটাকে লইয়া আমি কি করিব স্থির করিতে পারিতেছি না। কিন্তু সে কথা যাউক, তুমি এ সকল কথা জানিলে কিরূপে? 

আ। ডাক্তার! তোমার জুতার অবস্থা ভাল করিয়া দেখ দেখি, তুমি নিজেই বলিতে পারিবে। জুতার উপরের কাদা দেখিয়া ঐ দুইটি মীমাংসা করিয়াছি। যদি তোমার চাকর ভাল করিয়া জুতা পরিষ্কার করিত, তাহা হইলে আমি এই দুইটি কথা বলিতে পারিতাম না। এখন বুঝিলে? বৃষ্টি আরম্ভের পর ভিজিয়া রাস্তায় চলিলে জুতায় ঐরূপ কাদা ও ময়লা জমে। 

ডা। বেশ বুঝিয়াছি; কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, যদিও তোমার সহিত এতকাল বাস করিতেছি, তথাপি তুমি না বুঝাইয়া দিলে, আমি কিছুই বুঝিতে পারি না। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

কিছুকাল এইরূপ আমোদে অতিবাহিত হইলে ডাক্তার জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার খবর কি? এর মধ্যে কতগুলো চোর ধরিলে বল?” 

আমি হাসিয়া বলিলাম, “সে কথা এমন নয়। আপাততঃ আজ আমি একটা গোলযোগে পড়িয়াছি। একখানা উড়ো চিঠি আসিয়াছে।” 

ডা। চিঠিখানা কোথায়? 

আ। এই নাও। পড়ে দেখ দেখি, তুমি কিছু করিতে পার কি না? 

ডা। যখন তুমি কিছু পার নাই, তখন আমি কোন্ ছার। 

আ। সে কথা বলা যায় না। 

ডাক্তার চিঠিখানি অনেকবার পড়িলেন। কিন্তু কোন কথা বলিতে পারিলেন না। তখন আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “ডাক্তার, তোমার বিশেষ কিছু কাজ আছে?” 

ডা। কই না। 

আ। খানিকক্ষণ এখানে থাকিতে পারিবে?

ডা। নিশ্চয়ই পারিব। 

আ। স্ত্রীর কাছে কৈফিয়ৎ দিতে হইবে না ত? 

ডা। বোধ হয়, না। 

আ। কেন? 

ডা। তুমি যখন মাঝে আছ, তখন আমি সে ভয় করি না। তোমার উপর আমার স্ত্রীর যথেষ্ট বিশ্বাস আছে।

আ। তবে ভালই হইয়াছে, রাত্রি সাড়ে সাতটা বাজিয়া গিয়াছে। ঠিক আটার সময় তিনি অসিবেন লিখিয়াছেন।

ডা। বেশ কথা। আমি অনেক দিন তোমার কাজ দেখি নাই। বড় সে: সৌভাগ্যবশতই আজ এখানে আসিয়াছি।

আ। তবে এই আধ ঘণ্টা কোন সংবাদ-পত্র পাঠ কর। তিনি এখনই আসিবেন। 

আটটা বাজিবার অব্যবহিত পরেই আমার ভৃত্য গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া বলিল, “একটি বাবু আপনার সহিত নির্জ্জনে দেখা করিতে চান। 

ভৃত্যের কথা শুনিয়া আমি বলিলাম, “বাবুকে এখানে আন।” 

ভৃ। তিনি এখানে আসিতে চান না। 

আ। কেন? 

ভৃ। আমি ডাক্তারবাবুর কথা তাঁহাকে বলিয়াছি। 

আ। কেন বলিলে? 

ভৃ। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনার নিকট কেহ আছে কি না? আমি তাঁহাকে সত্য কথাই বলিয়াছি।

আ। বেশ করিয়াছ। এখন আমার নাম করিয়া তাঁহাকে এখানে লইয়া আইস। 

ভৃত্য প্রস্থান করিল এবং অবিলম্বে একজন সুপরিচ্ছদধারী সম্ভ্রান্ত যুবককে সঙ্গে করিয়া আনিল। 

যুবককে দেখিতে অতি সুপুরুষ। বয়স পঁচিশের অধিক নহে। তিনি নীতিশীর্ণ, নাতিস্থূল; তাঁহার চক্ষুদ্বয় আয়ত, বর্ণ গৌর; তাঁহার পরিধানে একখানি সুন্দর ঢাকাই কাপড়, গায়ে ভাল বনাতের কোট, তাহার উপর একখানি বহুমূল্য শাল। পায়ে পম্-সু। হাতে স্বর্ণমণ্ডিত একগাছি ফ্যান্সি লাঠী। চক্ষে স্বর্ণের চশমা। 

গৃহে প্রবেশ করিয়া যুবক আমার বন্ধু ডাক্তারের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন এবং পরক্ষণেই মুখ বিকৃত করিয়া আমার দিকে চাহিলেন। আমি তাঁহার মনোভাব বুঝিতে পারিলাম এবং নিকটস্থ একখানি আরাম-চৌকিতে বসিতে বলিলাম। যুবক আমার কথামত চেয়ারে উপবেশন করিলেন। 

আমি তখন যুবককে ভাল করিয়া দেখিতে লাগিলাম, কিন্তু তাঁহাকে আর কোথাও দেখিয়াছি বলিয়া বোধ হইল না। যুবক কিন্তু গৃহে প্রবেশ করিয়াই আমাকে চিনিতে পারিয়াছিলেন। নতুবা তিনি ডাক্তারের দিকে এরূপ ভাবে চাহিবেন কেন? 

ক্ষণকাল পরে যুবক জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি আমার পত্র পাইয়াছেন?” 

আমি সহাস্যমুখে উত্তর করিলাম, “আপনার পত্র না পাইলে এতক্ষণ বাসায় ফিরিয়া যাইতাম। এই দারুণ শীতে আজ আমার কোন কাজ করিবার ইচ্ছা ছিল না।” 

যুবক। তবে ত আমি বড় অন্যায় করিয়াছি। 

আ। কিছু না। কাজ ছিল না বলিয়াই বাড়ী যাইতাম। আমি কাজ ফেলিয়া আমোদ করিতে ইচ্ছা করি না। আর এক কথা, ইনি আমার প্রিয় বন্ধু বলাইবাবু একজন বিখ্যাত ডাক্তার। সময়ে সময়ে আমি ইঁহার নিকট পরামর্শ গ্রহণ করিয়া থাকি। আমায় যে কথা বলিবেন, ইনিও সেই কথা জানিতে পারিবেন। সুতরাং ইহার সমক্ষে আপনি সকল কথাই বলিতে পারেন; তাহাতে আপনার কোন ক্ষতি-বৃদ্ধি হইবে না। 

যু। যে বিষয় বলিবার জন্য এখানে আসিয়াছি, তাহা বড়ই ভয়ানক। লোকে ঘুণাক্ষরে সে কথা জানিতে পারিলে আমার সর্ব্বনাশ হইবে। 

আ। আপনার কোন চিন্তা নাই। আমাদের নিকট যাহা বলিবেন, তাহা তৃতীয় ব্যক্তি জানিতে পারিবে না। কিন্তু আপনাকে কি বলিয়া সম্বোধন করিব? 

 যু। আপনার নিকট মিথ্যা বলিতে পারিব না। আপনি পত্রের কথামত এখন আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিবেন না।

এই বলিয়া যুবক ক্ষণকাল কি চিন্তা করিলেন। পরে যেন হতাশ হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “না মহাশয়! আমি ভুল বুঝিয়া ছিলাম। আপনাকে বিশ্বাস না করিলে আমি কোনরূপে কৃতকার্য হইতে পারিব না। আমি—রাজবাটীর একমাত্র বংশধর, নাম বিদ্যুৎপ্ৰকাশ। 

আমিও সেইরূপ অনুমান করিয়াছিলাম, সম্প্রতি এক সংবাদপত্রে তাঁহার বিবাহের বিজ্ঞাপন বাহির হইয়াছিল, তাহাও জানিতাম, সেই জন্য বলিলাম, “তবে আপনারাই বিবাহের কথা সেদিন সংবাদ পত্রে পাঠ করিয়াছি?” 

যুবক বিবাহের নাম শুনিয়া যেন বিমর্ষ হইলেন। বলিলেন, “এখন আর সে কথায় কাজ নাই। আপনি আমার বক্তব্য শুনুন; তাহার পর যেমন বুঝিবেন, সেইরূপ কার্য করিবেন।” 

আমি আগ্রহসহকারে বলিলাম, “ভাল, তাহাই হউক।” 

যু। প্রায় তিন বৎসর অতীত হইল, আমি কিছুদিন কলিকাতায় বাসা ভাড়া লইয়া বাস করিতাম। সেই সময়ে এক প্রসিদ্ধ অভিনেত্রীর সহিত আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। 

আমি সমস্ত কথা না শুনিয়াই ব্যাপার বুঝিতে পারিলাম। পরে বলিলাম, “সেই অভিনেত্রী এখন আপনাকে কোন ফাঁদে ফেলিবার পরামর্শ করিতেছে, কেমন?” 

যু। আজ্ঞা হাঁ। 

আ। সে বলে কি? 

যু। আমার বিবাহের সংবাদ পাইয়া সে আমার ভাবী শ্বশুরকে আমাদের সকল কথা বলিবার চেষ্টা করিতেছে। যদি আমার শ্বশুর মহাশয় আমার পূর্ব্ব চরিত্রের কথা জানিতে পারেন, তাহা হইলে তিনি কখনও আমাকে তাঁহার কন্যা সমর্পণ করিবেন না। ক্রমে আমার পিতাও আমার গুণ জানিতে পারিবেন, তাহা হইলে আমার আর মুখ দেখাইবার উপায় থাকিবে না। 

আমি তাঁহার কথায় আশ্চর্যান্বিত হইলাম। তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি বড় মানুষের ছেলে হইয়া এমন কি পাপ করিয়াছেন, যাহার জন্য এত ভাবিত হইতেছেন? সেই অভিনেত্রীকে কি আপনি বিবাহ করিয়াছিলেন?’ 

বিদ্যুৎপ্রকাশ হাসিয়া উত্তর করিলেন, “না, বিবাহ করি নাই।” 

আ। রেজেষ্ট্রী করা কোন দলিল আছে? 

বি। কি সম্বন্ধে? 

আ। আপনাদিগের উভয় নামে কোন দলিলাদি রেজিষ্ট্রির জন্য পাঠান হইয়াছিল কি? 

বি। না, সে ভয়ও নাই। 

আ। তবে কেবল ফাঁকা চিঠিতে সে আপনার কি করিবে? যদি কখনও সেরূপ চিঠি আপনার ভাবি শ্বশুর কিম্বা পিতার নিকট আনীত হয়, আপনি অনায়াসে উহা জাল বলিয়া প্রমাণ করিতে পারিবেন। 

বি। চিঠিতে আমার মোহর আছে। 

আ। মোহর চুরি যাইতে পারে, জাল হইতে পারে। 

বি। আমার মোহরাঙ্কিত চিঠির কাগজ আর কাহারও নাই। 

আ। আপনার বাক্স হইতে কাগজখানি চুরি গিয়াছিল, এ কথা অক্লেশে বলিতে পারিবেন। 

বি। কেবল চিঠি নহে, আমার ফটো তাহার কাছে আছে। 

আমি হাসিয়া উত্তর করিলাম, “আপনি যেখানে ফটোগ্রাফ উঠাইয়া ছিলেন, সেইখানে উহার “নেগেটিভ” আছে, কেহ ইচ্ছা করিলে তাহা হইতে যত ইচ্ছা আপনার ফটোগ্রাফ পাইতে পারে। 

বি। আজ্ঞা না, তদপেক্ষাও গুরুতর। সে ফটোতে আমাদের দুজনের আকৃতি আছে। 

আমি হতাশ হইয়া বলিয়া উঠিলাম, “কি ভয়ানক! এ যে সর্ব্বনাশ করিয়াছেন।” বিদ্যুৎপ্রকাশ লজ্জিত হইয়া বলিলেন, “তখন আমার হিতাহিতজ্ঞান লোপ পাইয়াছিল। অভিনেত্রী আমায় যাদু করিয়াছিল। জান না, কোন্ গুণে আমি তাহার এত বশীভূত। কিন্তু এখন উপায় কি? ছবিখানি আদায় করিতে হইবে।” 

আ। আপনি মিষ্ট কথায় আদায় করিতে পারিবেন না? 

বি। না, আমি অনেক চেষ্টা করিয়াছি। 

আ। অর্থলোভে সে উহা বিক্রয় করিতে পারে। 

বি। অনেক টাকা দিতে চাহিয়াছিলাম, সে কিছুতেই ছবি দিতে চায় না। 

আ। তবে চুরি করিবার চেষ্টা করুন। 

বি। সে চেষ্টাও করিয়াছি, কিন্তু কৃতকার্য হইতে পারি নাই। সর্ব্বশুদ্ধ পাঁচবার সেই অভিনেত্রী চোরের হস্তে পতিত হয়। দুইবার তাহার বাড়ীতে, একবার রেলে, আর দুইবার পথে। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, কেহই সেই ছবিখানি বাহির করিতে পারে নাই। 

আমি। হাসিয়া উত্তর করিলাম, “এ বড় বিষম সমস্যা! এতবার চুরি হইয়া গেল, কিন্তু ছবি বাহির হইল না! সে অভিনেত্রী যে সে রমণী নহে–একজন পাকা চোর।” 

বি। এখন উপায়? 

আ। সে অভিনেত্রী ছবিখানি রাখিয়া কি করিতে চায়? আপনি তাহার কোন পত্র পাইতেছেন? কিম্বা তাহার মুখে কোন কথা শুনিয়াছেন? 

বি। আজ্ঞা হাঁ! সেই ছবি আমার গুরুজনের নিকট পাঠাইয়া দিবে। যদি আমার ভাবী-পত্নী এ বিষয় জানিতে পারে, তাহা হইলে সে আমায় কি মনে করিবে, একবার ভাবিয়া দেখুন। উহা অপেক্ষা আমার মৃত্যু শ্রেয়ঃ। সে অভিনেত্রীকে আমার বেশ জানা আছে। সে কথায় যাহা বলে, কাজেও ঠিক সেইরূপ করিয়া থাকে। সে যখন বলিয়াছে, তখন সে নিশ্চয়ই ঐ ছবিখানি আমার গুরুজনের নিকট পাঠাইয়া আমার সর্ব্বনাশ করিবে। 

আ। আপনি নিশ্চয় জানেন যে, সে এখনও উহা পাঠায় নাই? 

বি। আজ্ঞা হাঁ, ছবিখানি এখনও পাঠান হয় নাই। 

আ। কেমন করিয়া জানিলেন? 

বি। বিবাহের দিন স্থির হইলেই সে ছবিখানি পাঠাইবে, এরূপ বলিয়াছে। 

আ। কবে দিন স্থির হইবে? 

বি। এই সোমবারে। 

আ। আজ বৃহস্পতিবার। এখন তবে তিনি দিন সময় আছে? 

বি। আজ্ঞা হাঁ, সময় আছে বটে, কিন্তু আমার মন অত্যন্ত অস্থির হইয়াছে। যদি এই সময়ের মধ্যে কিছু না করা যায়, তাহা হইলে আমার সর্ব্বনাশ হইবে। 

আ। আপনি কি এখন কলিকাতায় বাস করিতেছেন? 

বি। আজ্ঞে হাঁ। বৌ-বাজার স্ট্রীটে, নগেন্দ্রনাথ নাম ধারণ করিয়া, আপাততঃ বাস করিতেছি।। 

আ। তবে ভালই হইয়াছে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনার কোন চিন্তা নাই। কাল আমার হাতে এক গুরুতর কাজ আছে। সুতরাং কাল আপনার কিছু করিতে পারিব না। পরশ্ব আপনি আমার পত্র পাইবেন। 

বি। যত শীঘ্র পারেন, আমায় সকল ব্যাপারে জানাইবেন। আমি যে কিরূপ উদ্বিগ্ন অবস্থায় কাল কাটাইব, তাঁহা আপনি বেশ বুঝিতে পারিয়াছেন। 

আ। আপনার কোন চিন্তা নাই। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। 

আমার কথায় আশ্বাসিত হইয়া তিনি বিদায় গ্রহণ করিলেন। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

বিদ্যুৎপ্রকাশ প্রস্থান করিলে পর, আমি বলাইবাবুকে বলিলাম, “ডাক্তার! আর তোমার কষ্ট দিতে ইচ্ছা করি না। হয়ত এই বিলম্বের জন্য তোমার বাড়ী গিয়া অনেক কৈফিয়ৎ দিতে হইবে। যদি তোমার ইচ্ছা হয়, তাহা হইলে পরশ্ব বেলা তিনটার সময় আমার এখানে আসিও।” 

ডাক্তার প্রস্থান করিলেন। আমিও অফিস ঘর বন্ধ করিতে আদেশ করিয়া বাসায় প্রস্থান করিলাম। 

পরদিন জমীদার-পুত্রের কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে পারি নাই। যে কার্য্যের ভার সেদিন গ্রহণ করিয়াছিলাম, তাহাই যথাসম্ভব শেষ করিলাম 

পরদিন বেলা আটটার সময় এক কোচম্যানের ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া সেই অভিনেত্রীর বাড়ীর নিকট ঘুরিতে লাগিলাম। অভিনেত্রীর প্রকাণ্ড বাড়ী। বাড়ীর পার্শ্বেই তাহার আস্তাবল। আস্তাবলে একজন সহিস ঘোড়ার গাত্র মলিতেছিল। আমি কথায় কথায় তাহার নিকট গমন করিলাম এবং তাহার কার্য্যে সাহায্য করিলাম। সহিস আমার কাৰ্য্যে সন্তুষ্ট হইল। আমি তখন তাহার নিকট একটি কর্ম্মের প্রার্থনা করিলাম, সে সম্মত হইয়া বলিল যে, সুবিধা হইলেই সে আমার জন্য তাহার প্রভুকে বলিবে। 

আমি বাস্তবিক চাকরীর চেষ্টায় যাই নাই, সুতরাং সহিসকে অভিনেত্রী সংক্রান্ত অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলাম সহিস যে উত্তর করিল, তাহাতে সন্তুষ্ট না হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “ভাই সহিস! তোমার প্রভু কেমন?” 

সহিস উত্তর করিল, “অমন মনিব পাওয়া যায় না। তাঁহাকে দেখিতে যেমন সুন্দরী, তাঁহার গুণও ততোধিক। এখন অনেকেই তাঁহার জন্য পাগল।” 

আ। বটে! এমন সুন্দরী! আচ্ছা, তিনি কেন বিবাহ করেন না? 

আমার কথায় সহিস হাসিয়া উঠিল। বলিল, “এ কি মুসলমান যে নিকা করিবে? হিন্দুরমণী বিধবা হইলে কি আর বিবাহ করে?” 

আমিও হাসিয়া বলিলাম, “আজকাল ব্রাহ্মমতে অনেকের বিবাহ হইয়া থাকে। 

স। তা ত জানি না। 

আ। এখন ইঁহার প্রিয়পাত্র কে? 

স। আগে একজন বড় জমীদারই প্রিয়পাত্র ছিলেন। কিন্তু আজকাল আর তাঁহাকে দেখিতে পাই না। গণপত নামে এক মাড়োয়ারী ইঁহার প্রিয়পাত্র হইয়াছেন। বোধ হয়, ইনি তাঁহাকে বিবাহ করিবেন। 

এই সংবাদ পাইয়া গণপতের সহিত দেখা করিবার ইচ্ছা হইল। আমি তাঁহার ঠিকানা জানিবার জন্য প্রশ্ন করিতে উদ্যত হইব, এমন সময়ে একখানি প্রকাণ্ড ল্যাণ্ডো অট্টালিকা দ্বারে লাগিল। সহিস সেই গাড়ী দেখিয়াই বলিয়া উঠিল, “ঐ যে গণপতবাবু স্বয়ং উপস্থিত!” 

গাড়ীখানি স্থির হইলে উহার মধ্য হইতে একজন সু-পরিচ্ছদধারী মাড়োয়ারী অবতরণ করিলেন এবং অবিলম্বে বাটীর ভিতর প্রবেশ করিলেন। 

প্রায় অৰ্দ্ধঘণ্টা পরে তিনি সহাস্যবদনে পুনরায় দ্বারদেশে উপনীত হইলেন এবং সেই গাড়ীতে আরোহণ করিয়া চীৎকার করিয়া বলিলেন, “ব্রাহ্ম সমাজ। যত শীঘ্র পার যাও।” 

গণপতের মুখ হইতে কথা বাহির হইতে না হইতে কোচমান অশ্বে কশাঘাত করিল। গাড়ী সবেগে ব্রাহ্ম সমাজের দিকে আসিতে লাগিল। 

পাঁচ মিনিট অতীত হইতে না হইতে সেই অভিনেত্রীও অট্টালিকা হইতে বহির্গত হইল। এক ভৃত্য ঠিক সেই সময়ে একখানি ভাড়াটীয়া গাড়ি ডাকিয়া আনিল। অভিনেত্রী সেই গাড়ীতে উঠিয়া বলিল, “ব্রাহ্ম সমাজ। যদি দশ মিনিটের মধ্যে ঐ স্থানে লইয়া যাও, তাহা হইলে পাঁচ টাকা বক্‌সিস দিব।” 

গাড়োয়ান বেগে গাড়ী চালাইয়া দিল। আমি কি করিব, স্থির করিতে পারিলাম না। ঠিক সেই সময়ে আর একখানি খালি গাড়ী যাইতেছিল। আমি গাড়োয়ানের নিকট যাইয়া বলিলাম, “যদি আমায় ব্রাহ্ম সমাজে দশ মিনিটের মধ্যে পঁহুছাইয়া দিতে পার, তাহা হইলে দশ টাকা পুরস্কার দিব।” 

পুরস্কারের লোভে সে প্রাণপণে অশ্বচালনা করিল। আমি অনেক গাড়ী চড়িয়াছি, কিন্তু এই কোচম্যান যেমন দ্রুত গাড়ী চালাইয়াছিল, তত দ্রুত আমি এ পর্য্যন্ত আর কখনও গমন করি নাই। কিন্তু আমি যতই তাড়াতাড়ি করি না কেন, আমার গাড়ী যখন ব্রাহ্ম সমাজের দ্বারে আসিয়া লাগিল, তাহার পূর্ব্বে অপর দুইখানি গাড়ী আসিয়া পড়িয়াছে। 

গাড়োয়ানকে পুরস্কার দিয়া বিদায় করিয়া বাহিরে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। প্রায় অর্দ্ধঘণ্টা পরে তাঁহারা সমাজ হইতে বাহির হইয়া চলিয়া গেলেন। আমি তখন সমাজের ভিতর গিয়া সন্ধান লইলাম। 

আমি যাহা ভাবিয়াছিলাম, বাস্তবিক তাহাই ঘটিয়াছিল। গণপত অভিনেত্রীকে ব্রাহ্মমতে বিবাহ করিয়াছেন। এই সংবাদে আমি কিছু চিন্তিত হইলাম। ভাবিলাম, যদি আজই উভয়ে পলায়ন করে, তবে বিদ্যুৎ প্রকাশের ফটো আদায় হইল না। 

এই চিন্তা করিতে করিতে আমি আমার অফিসে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। বলা বাহুল্য, আমি তখনও ছদ্মবেশ পরিত্যাগ করি নাই। 

অফিসে আসিয়া দেখি, ডাক্তার আমার জন্য অপেক্ষা করিতেছেন। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, তিনিও প্রথমে আমায় চিনিতে পারিলেন না। অনেকক্ষণ আমার দিকে নির্নিমেষ-নয়নে নিরীক্ষণ করিয়া, তিনি হাসিয়া ফেলিলেন। বলিলেন, “এ আবার কি! সহিসের চাকরী করে হইতে করিতেছ?” 

আমি হাসিয়া একটি প্রকোষ্ঠে গমন করিলাম এবং তথায় ছদ্মবেশ ত্যাগ করতঃ পুনরায় ডাক্তারের নিকট আগমন করিলাম। বলিলাম, “ডাক্তার! বড় বিপদ। এখন তোমার সাহায্য চাই।” 

ব। আমিও সেইজন্য এখানে আসিয়াছি। 

আ। কিন্তু কোম্পানীর আইন ভঙ্গ করিতে পারিবে? 

ব। নিশ্চয় পারিব। 

আ। যদি পুলিসের হাতে পড়? 

ব। সৎকাৰ্য্য হইলে তাহাতেও আপত্তি নাই। 

আ। আমি অসৎ কাৰ্য্যে নাই, তুমি জান বোধ হয়? 

ব। নিশ্চয়ই জানি। 

আ। তবে আমায় সাহায্য করিতে অঙ্গীকার করিলে? 

ব। হাঁ, অঙ্গীকার করিলাম। এখন আমায় কি করিতে হইবে বল? 

আ। সেই অভিনেত্রী আজ সন্ধ্যা সাতটার পূর্ব্বে বাড়ী আসিবে জানি। সেই সময় আমরা উভয়েই তথায় হাজির থাকিব। 

ব। বেশ কথা। কিন্তু আমায় কি করিতে হইবে? 

আ। আমার যতই বিপদ হউক না কেন, তুমি কোনমতে ব্যস্ত হইবে না। 

ব। ভাল, তাহাই হইবে। কিন্তু তুমি কি করিতে বল? 

আ। সম্ভবতঃ আমাকে সেই অভিনেত্রীর বাড়ীর মধ্যে লইয়া যাইবে। একতলায় বাহিরের ঘরেই লোকজন যাতায়াত করে। খুব সম্ভব আমাকেও সেই ঘরে লইয়া যাইবে। তুমি বাহির হইতে আমায় লক্ষ্য করিবে এবং যখন দেখিবে যে, দুই হস্ত উত্তোলন করিয়াছি, তুমিও তখন এই দুই গোলা সেই ঘরের দেওয়ালে নিক্ষেপ করিবে এবং আগুন লাগিয়াছে বলিয়া চীৎকার করিবে। যখন দেখিবে, লোকজন সকলেই সেই অগ্নি নির্ব্বাপিত করিবার জন্য সেই বাড়ীতে প্রবেশ করিবে, তখনই তুমি তথা হইতে প্রস্থান করিয়া গোলদীঘিতে আসিয়া আমার জন্য অপেক্ষা করিবে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমি তোমার সহিত যোগ দিব। এখন বুঝিলে, তোমায় কি করিতে হইবে। 

ব। হাঁ। বেশ বুঝিয়াছি। 

আ। তবে তুমি কিছুকাল অপেক্ষা কর, আমি ছদ্মবেশ পরিয়া আসি। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

অর্দ্ধ ঘণ্টার মধ্যেই আমি ছদ্মবেশ পরিয়া আসিলাম। এবার আমায় দেখিয়া ডাক্তার হাস্য সম্বরণ করিতে পারিলেন না। আমি এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের বেশ ধারণ করিয়াছিলাম, কেবল বেশ পরিবর্তনই ছদ্মবেশ হয় না, পরিচ্ছদের সঙ্গে সঙ্গে মুখের ভাব, গতিবিধি, অঙ্গ সঞ্চালন এই সমস্তও পরিবর্তন করিতে হয়। আমার বন্ধু আমার এই নূতন সাজে বড়ই আনন্দিত হইলেন। আমরা যথাসময়ে সেই অভিনেত্রীর বাড়ীর নিকটে গমন করিলাম। 

অভিনেত্রী সাতটার পূর্ব্বে বাড়ী ফিরিবে না, এ সংবাদ জানিতাম। আমরা যখন তাহার বাড়ীর নিকট উপস্থিত হইলাম, তখন বেলা ছয়টা মাত্র। তখনও এক ঘণ্টা সময় ছিল জানিয়া, আমরা উভয়ে নিকটস্থ এক পানের দোকানে আড্ডা করিলাম। কথায় কথায় আমি ডাক্তারকে বলিলাম, “যখন অভিনেত্রী গণপতকে বিবাহ করিয়াছে, তখন ছবিখানি বোধ হয় আর তাহার প্রয়োজন হইবে না। কারণ গণপত যদি কখনও সে ছবি দেখিতে পায়, তাহা হইলে অভিনেত্রীর প্রতি তাহার স্নেহের হ্রাস হইবে।” 

ডাক্তার জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিন্তু ছবিখানি সে কোথায় রাখিয়াছে? ছবিখানি কত বড়, জানিয়াছ?” 

আ। ক্যাবিনেট আকার। নিতান্ত ছোট নয়। সুতরাং অভিনেত্রী যে উহাকে সঙ্গে করিয়া ফিরিবে, তাহা বোধ হয় না। 

ডা। না। সেটা অসম্ভব কিন্তু সে কোথায় রাখিয়াছে? 

আ। নিশ্চয়ই তার বাড়ীতে আছে। যেখানে রাখিলে সে ইচ্ছামত গ্রহণ করিতে পারিবে, সকল সময়ে দেখিতে পাইবে, এইরূপ স্থানে রাখাই সম্ভব। 

ডা। কিন্তু তাহার বাড়ীতে দুইবার চুরি হইয়া গিয়াছে। যদি তাহার বাড়ীতেই ছবিখানি থাকিত, তাহা হইলে নিশ্চয়ই পাওয়া যাইত। 

আ। পেশাদার চোরের দ্বারা এ কার্য সম্ভবে না। তাহারা কি খুঁজিতে জানে? 

ডা। তুমি কোথায় দেখিবে? 

আ। আমি দেখিব না। নিজে কোথাও সন্ধান করিতে চেষ্টা করিব না। 

ডা। তবে? 

আ। অভিনেত্রী আমায় দেখাইয়া দিবে? 

ডাক্তার হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “তোমার কথা মন্দ নয়। সে ছবিখানি প্রাণপণে লুকাইবার চেষ্টা করিতেছে, আর তুমি বলিতেছ যে, সে তোমায় ছবির সন্ধান বলিয়া দিবে।” 

আ। সে কি সহজে দেখাইবে? আমি তাহাকে দেখাইতে বাধ্য করিব। 

ডা। কিসে? 

আ। কৃতকাৰ্য্য হইলে সে কথা বলিব। এখন সাবধান, ঐ শোন গাড়ীর শব্দ পাওয়া যাইতেছে। বোধহয় অভিনেত্রী গৃহে ফিরিতেছে। সাবধান ডাক্তার, যেমন যেমন বলিয়াছি, ঠিক সেই মত কার্য্য করিও। নতুবা নিশ্চয়ই ঠকিতে হইবে। 

ডা। সে ভয় নাই গোয়েন্দা মহাশয়! আজ নূতন তোমার কাজ করিতেছি না। 

ডাক্তারের কথা শেষ হইবার ঠিক পরেই দেখিলাম, দূরে একখানি বড় ল্যাণ্ডো দুইটা প্রকাণ্ড তেজীয়ান ওয়েলার ঘোড়ায় অতিবেগে অভিনেত্রীর বাড়ীর দিকে টানিয়া আনিতেছে। আমি বুঝিলাম, কার্য্যের সময় উপস্থিত হইয়াছে। দেখিলাম, আমি যেমন যেমন বন্দোবস্ত করিয়াছিলাম, সমস্তই ঠিক আছে। 

কিছু পরেই গাড়ীখানি অভিনেত্রীর বাড়ীর দ্বারে থামিল। অভিনেত্রী গাড়ী হইতে অবতরণ করিবামাত্র একজন ভিখারী তাহার নিকট একটি পয়সা চাহিল। তাহার দেখাদেখি, আরও দশ বার জন অভিনেত্রীর চারিদিকে বেষ্টন করিয়া ভিক্ষা চাহিতে লাগিল। ক্রমে ঠেলাঠেলি আরম্ভ হইল। অনেকেই কোন না কোন পক্ষ অলম্বন করিয়া মহা কোলাহল ও মারামারি করিতে লাগিল। ইত্যবসরে আমি বেগে সেই ভিড়ের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। 

দুই একটা লোকের সহিত সামান্য দাঙ্গা হাঙ্গামা করিয়া অভিনেত্রীর অতি নিকটে গোঁ গোঁ শব্দ করিতে করিতে পড়িয়া গেলাম। তখন দাঙ্গা কমিয়া গেল, অনেকেই আমার চারিদিকে বেষ্টন করিল। 

আমার হাতে উৎকৃষ্ট আ-লতা ছিল। সেই আতা মুখে চিবাইয়া হাতে মুখে মাখিয়া আবার হাত দুটি মুখে ঢাকা দিলাম। যখন মুখ হইতে হাত নামাইল, আমার মুখে রক্ত ও আমাকে অজ্ঞানবৎ পড়িয়া থাকিতে দেখিয়া সকলেই বলিল, “বেচারা মারা গিয়াছে।” 

অভিনেত্রী চমকিত হইল। তাহার সম্মুখে একটি নরহত্যা হইল দেখিয়া মনে ভয় হইল। সে কাতরভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “ভদ্রলোকটি কি বাস্তবিক মরিয়া গিয়াছেন?” 

দুই একজন বলিল, “না, মরেন নাই। কিন্তু আর বড় বেশী দেরীও নাই।” 

অভিনেত্রী পুনরায় চমকিতা হইল। সে বলিল, “উহাকে আমার বৈঠকখানায় আনিতে পার?” 

তখন অনেকেই সে কার্য্যে সাহায্য করিল। আমি অনায়াসেই অভিনেত্রীর বৈঠকখানায় আনীত হইলাম। আমাকে রাখিয়া সকলে চলিয়া গেল, তখন আমি এরূপে হাত বাড়াইলাম, যাহাতে অভিনেত্রী বুঝিল, আমার বড় গরম হইতেছে। সে ঘরের জানালা খুলিয়া দিল। 

আমি যেখানে ছিলাম, সেখান হইতে বাহিরের অনেকটা দেখা যায়। আমি কৌশলে ঘাড় ফিরাইয়া ডাক্তারকে দেখিতে পাইলাম। দেখিলাম, ডাক্তারও আমার দিকে চাহিয়া আছে। 

যখন দেখিলাম, সমস্ত ঠিক হইয়াছে, তখন ডাক্তারকে সঙ্কেত করিলাম। ডাক্তার প্রস্তুত ছিল। সেও সেই দুইটি গোলা বাহির হইতে অতি বেগে গৃহ মধ্যে নিক্ষেপ করিল। দুইটি সামান্য শব্দ করিয়া অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হইল, চারিদিক ধূমে আচ্ছন্ন হইল। বাহির হইতে লোক সকল “আগুন লাগিয়াছে” “আগুন লাগিয়াছে” বলিয়া চীৎকার করিয়া উঠিল। 

অভিনেত্রীও ভয়ে, যেখানে ছবিখানি, তাহার প্রিয় অপেক্ষা প্রিয়তর বস্তু, লুকাইয়া রাখিয়াছিল, সেইখানে তাড়াতাড়ি গমন করিল। গৃহে আগুন লাগিয়াছে শুনিয়া, তাহার চিত্তের স্থিরতা ছিল না। আমি যে সেই ঘরে শুইয়া রহিয়াছি, তাহা সে ভুলিয়া গেল। সে তাড়াতাড়ি সেই ছবিখানি বাহির করিতে উদ্যত হইল। প্রায় অর্দ্ধেক তুলিলে পর আমি সাড়া দিলাম, যেন আমার জ্ঞান সঞ্চার হইল। অভিনেত্রী সেই শব্দে চমকিত হইয়া ছবিখানি যথাস্থানে রাখিতে বাধ্য হইল এবং আমার নিকটে আগমন করিল। 

আমাকে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া সে আনন্দিত হইল। কিন্তু তাড়াতাড়ি পলায়নের চেষ্টা করিল, বলিল, “ঘরে আগুন লাগিয়াছে।” 

আমি তখন অভিনেত্রীকে বুঝাইয়া দিলাম যে, বাস্তবিক তাহার গৃহে আগুন লাগে নাই; কোন শত্রু বাহির হইতে কোনরূপ আতস বাজী নিক্ষেপ করিয়া থাকিবে: সেই জন্যই এত ধূম নির্গত হইতেছে। 

আমার কথায় অভিনেত্রী আমার মুখের দিকে ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিল। পরে আমার কথার সত্যাসত্য নিরূপণ করিবার জন্য বাহিরে গমন করিল। আমিও সেই সুযোগে সেখান হইতে পলায়ন করিলাম। 

অনেক কষ্টে গোলদীঘিতে আসিয়া ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করিলাম। ডাক্তার ইতিপূর্ব্বেই একখানি গাড়ী ভাড়া করিয়া রাখিয়া ছিল; আমি আসিলে উভয়ে গাড়ীতে উঠিলাম এবং শীঘ্রই ডাক্তারের বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

যখন ডাক্তারের বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম, তখন রাত্রি নয়টা বাজিয়া গিয়াছিল। ডাক্তারের বাড়ী ফিরিতে যে এত বিলম্ব হইবে, তাহা তিনি নিজেই জানিতেন না। তাঁহার স্ত্রীকে সেইজন্য কোন কথা বলিয়া যাইতে পারেন নাই। বাড়ীতে উপস্থিত হইয়াই ডাক্তার আমাকে বৈঠকখানায় বসিতে বলিয়া অন্দরে গমন করিলেন। প্রায় এক কোয়াটারের মধ্যেই তিনি হাস্যমুখে ফিরিয়া আসিলেন। 

আমি দ্বার রুদ্ধ করিয়া ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি ডাক্তার, শাস্তি কি গুরুতর হইয়াছে?” 

ডাক্তার বলিলেন, “কিসের শাস্তি?” 

আ। কেন! বাড়ী আসিতে বিলম্ব হওয়ায়। 

ডা। শাস্তি দিবে কে? 

আ। তোমার মনিব। 

ডা। আমার মনিবের মেজাজ তোমার অজ্ঞাত নাই। সে তেমন নয়। 

আ। তা জানি, তবু বেচারাকে এত রাত্রি পর্য্যন্ত একা রেখে আমার সঙ্গে তোমার ঘোরা উচিত হয় নাই।

ডা। সে এখন আর একা নয়। আমি লোক রাখিয়া গিয়াছি। 

আ। কে সে? তোমার নবজাত পুত্ৰ? 

ডা। নিশ্চয়ই, আত্মবৈ জায়তে পুত্রঃ। এখন সে কথা যাক, আগে কিছু জলযোগ করিয়া লও, তাহার পর সমস্ত ব্যাপার আমার কাছে প্রকাশ কর। ছবিখানি পাইয়াছ ত? 

আ। পাই নাই বটে, কিন্তু দেখিয়া আসিয়াছি? সেই অভিনেত্রী ছবিখানি যেখানে লুকাইয়া রাখিয়াছিল, তাহা আমি জানিতে পারিয়াছি। 

ডা। তবে সঙ্গে করিয়া আনিলে না কেন? 

আ। কোন কাজ তাড়াতাড়ি করা ভাল নয়। যদি তখনই গ্রহণ করিতাম, তা হইলে নিশ্চয়ই কার্য্যোদ্ধার করিতে পারিতাম না। যখন গোপনীয় স্থান দেখিয়া আসিয়াছি, তখন আর যায় কোথা? 

ডা। অভিনেত্রী সেখান হইতে সরাইয়া আর কোথাও রাখিতে পারে। 

আ। যদি সে আমার উপর সন্দেহ করিত, তাহা হইলে সেইরূপই করিত। কিন্তু তাহার কথায় বোধ হইল যে, সে আমাকে কোনরূপ অবিশ্বাস করে নাই। 

ডা। কবে আনিতে যাইবে? 

আ। আজই। 

ডা। কখন? 

আ। রাত্রি তিন প্রহরের পর। 

ডা। একাই যাইবে? 

আ। ইচ্ছা সেইরূপ। তবে যদি জমীদারপুত্র, আমার সহিত যাইতে ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে তাহাকেও লইয়া যাইব। 

ডা। অত লোক কোথা হইতে আসিল? 

আ। পয়সা দিলে কিসের অভাব হয়? 

ডা। তবে কি ঝগড়া মারামারি সমস্তই মিথ্যা? 

আ। তা নয় ত কি? তুমি কি মনে কর, আমি সত্য সত্যই আহত হইয়াছিলাম? 

ডা। আমিত সেই রকমই ভাবিয়াছিলাম। কিন্তু যদি উহা মিথ্যাই হয়, তবে তোমার মুখ হইতে অত রক্ত বাহির হইল কিসে? 

আ। উহা রক্ত নহে—আতা। মুখে চিবাইলেই রক্তের মত দেখায়। 

ডা। তোমার অসাধ্য কিছুই নাই। এখন সেই অভিনেত্রী তোমার বাড়ী লইয়া গিয়া কি করিল বল? আমি ত বাড়ীর ভিতর যাই নাই, সুতরাং সে সকল বিষয় আমার কিছুই জানা নাই। 

আ। যেমন অনুমান করিয়াছিলাম, অভিনেত্রী আমায় তাহার বৈঠকখানায় লইয়া গেল। সকলে প্রস্থান করিলে আমি দেখিলাম, ঘরের জানালাগুলি সমস্ত বন্ধ। সুতরাং তুমি আমার সঙ্কেত দেখিতে পাইবে না বুঝিতে পারিয়া, এরূপভাবে হাত বাড়াইয়া দিলাম, যাহাতে অভিনেত্রী বুঝিল, আমার বড় গরম বোধ হইতেছে। সে সমস্ত জানালা খুলিয়া দিল। আমিও তোমায় দেখিতে পাইলাম। দেখিলাম, তুমিও আমার দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিয়াছ। এইরূপে যখন দেখিলাম সমস্ত ঠিক হইয়াছে, তখন তোমার ইঙ্গিত করিলাম। মুহূৰ্ত্ত মধ্যে সামান্য মাত্র শব্দ করিয়া ঘরখানি ধূমে পরিপূর্ণ হইল। চারিদিকে আগুন লাগিয়াছে, বলিয়া চীৎকারধ্বনি হইতে লাগিল। অভিনেত্রী ভয়ে যেখানে ছবিখানি লুকাইয়া রাখিয়াছিল, তথায় গমন করিল এবং আমার কথা ভুলিয়া গিয়াই হউক কিম্বা আমাকে অজ্ঞান মনে করিয়াই হউক, ছবিখানি বাহির করিতে লাগিল। আমি দেখিলাম শিকার হাতছাড়া হয়। কারণ অভিনেত্রী যদি ছবিখানি তথা হইতে গ্রহণ করিত, তাহা হইলে সে যে উহাকে আর কোথাও লুকাইয়া রাখিবে, তাহা বুঝিতে পারিলাম। অগত্যা ঠিক সেই সময়ে সাড়া দিলাম। অভিনেত্রী আমায় সচেতন দেখিয়া চমকিত হইল এবং ছবিখানি যথাস্থানে রাখিয়া আমার নিকট দৌড়িয়া আসিল। আমি তখন উঠিয়া বসিয়াছিলাম। অভিনেত্রীর অন্তরে যাহাই থাকুক, আমায় সুস্থ দেখিয়া মৌখিক আনন্দ প্রকাশ করিল। আমি তখন তাহাকে গোলযোগের কারণ জিজ্ঞাসা করিলাম। সে আমাকে ঘরে আগুন লাগিবার কথা বলিলে, আমি হাস্য করিয়া তাহার ভুল দেখাইয়া দিলাম। বলিলাম, ঘরে আগুন লাগে নাই। কোন শত্রু বাহির হইতে কোনরূপ আতস বাজী নিক্ষেপ করিয়াছে, তাহাতেই গৃহমধ্যে এত ধূম হইয়াছে। অভিনেত্রী বোধ হয় আমার কথা বিশ্বাস করিল না। সে একবার আমার দিকে তীব্র দৃষ্টি করিয়া আমার নিকট হইতে বেগে প্ৰস্থান করিল। আমি সেই সময় ছবিখানি গ্রহণ করিতে পারিতাম, কিন্তু একটা সহিস সে সময় আমার নিকটে ছিল বলিয়া সে কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে সাহস করিলাম না। ধীরে ধীরে গৃহ হইতে বহির্গত হইলাম এবং জনতার মধ্যে প্রবেশ করিয়া অদৃশ্য হইলাম। তাহার পর তোমার সহিত গোলদীঘিতে সাক্ষাৎ করিলাম। ক্রমে রাত্রি অধিক হইতেছে। এখন আমায় বিদায় দাও। তোমার চাকরকে একখানি গাড়ী ডাকিয়া আনিতে বল। 

ডাক্তার সহাস্যবদনে উত্তর করিলেন, “তিনি বলিতেছিলেন, যে প্রিয়বাবু যখন আমাদের বাড়ীতে আসিয়াছেন, তখন আহার না করিয়া তিনি যেন না যান।” 

আমিও হাসিয়া বলিলাম, “তোমার স্ত্রীর হাতের রন্ধন আমারও খাইবার ইচ্ছা হইয়াছে। অনেক দিন ও কাজ হয় নাই। কি করিব আজ আমায় মাপ কর। কাল তাঁহার অতিথি হইব। তিনি যে আমায় এখনও মনে রাখিয়াছেন, সেই আমার পরম সৌভাগ্য।” 

ডাক্তার আমার কথায় কিছু বিমর্ষ হইলেন। তিনি ভৃত্যকে আমার জন্য একখানা গাড়ী আনিতে বলিলেন। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

যখন আমি বাসার দ্বারে উপনীত হইলাম, তখন ঘড়ীতে দশটা বাজিল। গাড়োয়ানকে তাড়া দিয়া বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিতে উদ্যত হইব, এমন সময়ে কে যেন আমার পশ্চাতে আসিয়া বলিল, “মহাশয়! আচ্ছা খেলা খেলেছেন। কিন্তু আমায় ঠকাইতে পারিলেন না। ইচ্ছা করিলে যাহার জন্য আপনি এত চেষ্টা করিয়াছেন, তাহা লইয়াই পলায়ন করিতে পারিতাম।” 

কণ্ঠস্বর ও কথাগুলি শুনিয়া আমি চমকিত হইলাম। ফিরিয়া দেখি, একখানি গাড়ী আমার পার্শ্ব দিয়া বেগে চলিয়া গেল। আমি আর বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম না। যে গাড়ী করিয়া বাড়ী আসিয়াছিলাম, সেই গাড়ীর কোচমান তখনও যায় নাই। আমি তাহাকে অগ্রগামী গাড়ীখানি দেখাইয়া বলিলাম, “ঐ গাড়খানি ধরিতে পারিলে তোমায় পাঁচ টাকা পুরস্কার দিব।” 

পুরস্কার লোভে সে অতি বেগে অশ্ব চালন করিল এবং অতি অল্পকাল মধ্যেই গাড়ীখানির নিকটবর্ত্তী হইল। আমি গাড়ীর ভিতর হইতে অতি গম্ভীর ভাবে চীৎকার করিয়া বলিলাম, “গাড়ী থামাও।” 

আমার কথায় দুইখানি গাড়ীই স্থির হইল। আমি অভিনেত্রীকে দেখিতে পাইলাম। বলিলাম, “সুন্দরি! তোমায় বাধা দিয়া অন্যায় করিয়াছি। কিন্তু কি করিব, তোমায় আমার বিশেষ প্রয়োজন।” 

অভিনেত্রী হাস্য করিল; বলিল, “যাহার জন্য আপনি এত ব্যস্ত হইয়াছেন, তাহা রাখিয়া আসিয়াছি। ইচ্ছা করিলে লইয়া যাইতে পারিতাম, কিন্তু আপনার ন্যায় বিখ্যাত গোয়েন্দাকে পরাজিত করিবার ইচ্ছা নাই।” 

আ। আজ তুমি যে কার্য্য করিলে, এরূপ আর কখনও কোন লোকে করিতে পারে নাই। আমাকে পরাস্ত করে এমন লোক এ পর্যন্ত দেখি নাই। আমার বড় অহঙ্কার ছিল যে, আমায় কেহ পরাজিত করিতে পারিবে না। কিন্তু আজ আমার সে অহঙ্কার দূর হইল। যদি কখন আমার মনে আবার অহঙ্কার উদয় হয়, তোমার নাম স্মরণ করিব, তাহা হইলে আমি নিজের গুণ বুঝিতে পারিব। কিন্তু আমায় চিনিলে কিরূপে? 

অ। আমি ছবিখানি লইতে উদ্যত হইলে আপনি যখন সাড়া দিলেন, তখন আমার মনে কেমন এক প্রকার সন্দেহ হইল। আমার বোধ হইল, আপনি সেই ছবির জন্যই সেখানে গিয়াছেন। আপনার সাড়া পাইয়া আমিও আপনার নিকট যাইলাম। তখন আমি ভাল করিয়া আপনার মুখ নিরীক্ষণ করিলাম। দেখিলাম, আপনার মুখে বাস্তবিক রক্তের চিহ্ন নাই। লাল দাগগুলি আতা বা অন্য কোন পদার্থ সংযোগে হইয়াছে। তখন আর আপনার নিকট থাকিবার প্রয়োজন বুঝিলাম না এবং আপনাকে কোন কথা না বলিয়া তখনই পলায়নের বন্দোবস্ত করিলাম। 

আ। তোমার ন্যায় চতুরা রমণী আমি এ জীবনে আর কখনও দেখি নাই। কিন্তু তুমি একা কোথায় যাইতেছ? অ। আমি এখন একা নয়। আমার স্বামীও আমার সহিত যাইতেছেন। 

আ। তোমার স্বামী। তুমি ত একজন অভিনেত্রী? 

অ। হাঁ আমার স্বামী। তিনি আমায় ব্রাহ্মমতে বিবাহ করিয়াছেন। 

আ। তিনি কোথায়? 

অ। এতক্ষণ বোধ হয় হাওড়া ষ্টেসনে। 

আ। কোথায় যাইবে? 

অ। তাঁহার দেশে। 

আ। আপাততঃ কোথায় নামিবে? 

তা। বৈদ্যনাথে। 

আ। সেই ছবিখানির কি করিলে? 

অ। সেইখানেই আছে। আপনি যাইলেই পাইবেন। 

আ। বাড়ীখানির কি বন্দোবস্ত করিলে? 

অ। বাড়ী ভাড়া হইয়া গিয়াছে। 

আ। এত শীঘ্র অত বড় বাড়ী কে ভাড়া লইলেন? 

অ। বাড়ী পূৰ্ব্বেই ভাড়া হইয়াছিল। সে যাহা হউক, এবার হইতে যখন কোন স্ত্রীলোকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করিবেন, তখন কিছু সাবধান হইয়া করিবেন। পুরুষ অপেক্ষা স্ত্রীলোকের বুদ্ধি অনেক বিষয়ে ভাল। 

আ। তোমার কথায় সম্মত হইলাম। কিন্তু যদি ছবিখানি দিতেই তোমার ইচ্ছা, তবে তুমি পলায়ন করিতেছ কেন? অ। আজ না হয় আপনাকে পরাস্ত করিয়াছি, কিন্তু এমন দিন আসিতে পারে, যখন আমি স্বয়ং পরাজিত হইব। আপনার নামে দুর্দান্ত দস্যুগণ পৰ্য্যন্ত যখন ভয়ে সশঙ্কিত, তখন আমি কোন্ সাহসে কলিকাতার বিখ্যাত গোয়েন্দার বিপক্ষে কার্য্য করিব। আমার সে সাহস নাই বলিয়াই এখান হইতে পলায়ন করিতেছি। আর এক কথা, এখন আমি আমার স্বামীর বশীভূতা। তিনি আমায় যেমন বলিবেন, আমি নির্ব্বিবাদে তাহাই করিব। আর নয় মহাশয়! রাত্রি অধিক হইল; সাড়ে এগারটার ট্রেনে আমরা যাইব মনে করিয়াছি; ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ

অভিনেত্রী প্রস্থান করিলে আমিও বাসায় আগমন করিলাম। গাড়োয়ানকে প্রতিশ্রুত পুরস্কার দিয়া আমি আমার বৈঠকখানায় আসিলাম। দেখিলাম, বিদ্যুৎপ্রকাশ আমার অপেক্ষায় বসিয়া আছেন? আমাকে দেখিয়াই জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি খবর মহাশয়? বিলম্বে কাৰ্য্য সিদ্ধি হইয়াছে ত?” 

আ। হাঁ, একপ্রকার সেইরূপই বটে। 

বি। তবে দি’ন, ছবিখানির জন্য রাত্রে আমার ঘুম নাই, দিনে ক্ষুধা নাই, উহা না পাইলে আমায় পাগল হইতে হইবে। 

আ। ছবিখানি আনা হয় নাই! 

বি। কোথায় আছে? 

আ। সেই অভিনেত্রীর বাড়ীতেই।

বি। কোথায় আছে দেখিয়াছেন?

আ। আজ্ঞা হাঁ। 

বি। তবে সঙ্গে আনিলেন না কেন? 

আ। তখন সুবিধা পাই নাই। 

বি। কখন আনিবেন? 

আ। বলেন ত আজই যাওয়া যায়। 

বি। তবে তাই যান, আমি এখানে অপেক্ষা করিব। 

আ। আপনাকেও যাইতে হইবে। 

বি। সে কি! আমায় দেখিলে অভিনেত্রী কখনই ছবি দিবে না। 

আ। সে আপনাকে দেখিতে পাইবে না। 

বি। কেন? সে কোথায়? 

আ। সে আর সেখানে নাই। 

বি। কোথায় গিয়াছে? 

আ। বৈদ্যনাথ। 

বি। কবে? 

আ। আজ —এই মাত্র। 

বি। কেন? তাহার এরূপ মতি কেন হইল? 

আ। তাহার স্বামীর কথায়? 

বিদ্যুৎপ্রকাশ আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া চীৎকার করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাহার স্বামী!” 

আ। আজ্ঞা হাঁ। সে অপরের পরিণীতা। 

বি। সে কি! বিশ্বাস হয় না। 

আ। আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি। 

বি। কোথায়, কবে বিবাহ হইল? 

আ। ব্রাহ্ম সমাজে—আজই বিবাহ হইয়া গিয়াছে। 

বি। বিবাহ তবে ব্রাহ্মমতে হইয়াছে? 

আ। নতুবা আর কিসে হইতে পারে? 

বি। সে আমার প্রতি অত্যন্ত অনুরক্তা ছিল। সে অপরকে কিরূপে ভালবাসিবে বলিতে পারি না। 

আ। তাহার কথায় বোধ হইল, সে আপনাকে গ্রাহ্য করে না। যাহার সহিত তাহার বিবাহ হইয়াছে, সে তাহাকেই ভালবাসে। 

বি। যদি তাহাই হয়, তবে সে ছবিখানি লইয়াই পলায়ন করিয়াছে। 

আ। না, সে সেরূপ নির্ব্বোধ নয়। 

বি। কেন? 

আ। যদি কখনও সেই ছবি তাহার স্বামীর দৃষ্টিগোচর হয়, তাহা হইলে তাহারই অনিষ্ট হইবে। 

বি। সত্য বলিয়াছেন। ছবিখানি তবে সে রাখিয়া গিয়াছে? 

আ। আজ্ঞা হাঁ। 

বি। আপনি জানিলেন কিসে? 

আ। তাহার মুখে শুনিয়াছি। 

বি। তাহার সহিত আবার কোথায় দেখা হইল? সকল কথা আমায় বুঝাইয়া বলুন, আমার মন অত্যন্ত অস্থির হইয়াছে। 

আমি বিদ্যুতের কথায় হাস্য করিয়া সমস্ত আদ্যোপান্ত প্রকাশ করিলাম। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ

সমস্ত কথা শুনিয়া বিদ্যুৎপ্রকাশ দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন। বলিলেন, “মহাশয়! কি বলিব, সেই অভিনেত্রীকে বিবাহ করিতে পারিলাম না, যদি সে উচ্চ বংশে জন্মগ্রহণ করিত, যদি তাহাকে বিবাহ করিলে আমার মর্য্যাদার হানি না হইত, তাহা হইলে সে কি আজ অপরের হইতে পারে? এমন রমণী আমি ইতিপূর্ব্বে আর কোথাও দেখি নাই। আপনি স্বয়ং তাহাকে দেখিয়াছেন, সুতরাং সে যে অতি রূপসী, তাহা আমাকে আর নূতন করিয়া বলিতে হইবে না। আপনি যখন তাহার সহিত কথা কহিয়াছেন, যখন তাহার বুদ্ধিতে আশ্চর্য্য হইয়াছেন, তখন সে যে কিরূপ বুদ্ধিমতী, তাহাও আপনাকে বলিবার কোন প্রয়োজন দেখি না। বলুন দেখি, সে যদি আজ আমার স্ত্রী হইত এবং ভবিষ্যতে রাণী পদবাচ্য হইত, তাহা হইলে তাহা দ্বারা আমার কত উপকার হইত?” 

আমি বিদ্যুতের কথা স্বীকার করিলাম। বলিলাম, “আপনি যাহা বলিয়াছেন, তাহা সত্য। যে রমণী আমাকে পরাস্ত করিতে পারে, সে সামান্যা রমণী নহে। এ পৰ্য্যন্ত ভাতি অল্প লোকেই আমাকে পরাজিত করিয়াছে, কিন্তু তাহার মধ্যে কেহ রমণী ছিল না। সেই অভিনেত্রী যে সৰ্ব্বাপেক্ষা বুদ্ধিমতী, ইহাই তাহার জ্বলন্ত প্রমাণ।” 

বিদ্যুৎপ্রকাশ আমার কথায় সন্তুষ্ট হইলেন; বলিলেন, “তবে আর আমাদের বিলম্বের প্রয়োজন কি?” আ।। কিছুই নয়। আমি প্রস্তুত। 

বি। তবে আপনার ভৃত্যকে আমার গাড়ী আনিতে বলুন। 

আ। আপনার গাড়ী কোথায়? আমি যখন বাড়ীতে প্রবেশ করি, তখন দরজায় কোন গাড়ী দেখি নাই! 

বি। আপনার ভৃত্য জানে। 

আ। সে কি! 

বি। আমিই তাহাকে গাড়ীখানি গোপনে রাখিতে বলিয়া ছিলাম। 

আ। কেন? 

বি। শুনিতেছি, দেশ হইতে আমার সন্ধানে লোক আসিয়াছে। যদি তাহারা আমার গাড়ী দেখিতে পায়, এই জন্যই গোপনে রাখিতে বলিয়াছিলাম। 

আমি সহাস্যমুখে বলিলাম, “তবে চলুন, আপনি কাল প্রাতেই যাহাতে দেশে যাইতে পারেন, তাহার উপায় করা যাউক। বুঝিয়াছি, আপনার বিবাহের দিন নিকটবর্তী হইয়া আসিতেছে।” 

এই বলিয়া ভূতাকে গাড়ী আনিতে বলিলাম। কিছুক্ষণ পরেই ভৃত্য গাড়ী লইয়া আসিল। আমরা উভয়ে উহাতে আরোহণ করিলাম এবং সত্বর সেই অভিনেত্রীর বাড়ীর দ্বারে উপস্থিত হইলাম। 

বাড়ীতে প্রবেশ করিবামাত্র দ্বারবান হাস্য করিয়া সুদীর্ঘ সেলাম করিল। তাহার ভাবগতিক দেখিয়া আমি আশ্চৰ্য্য হইলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমাদের প্রভু কোথায়? হাসিতেছ কেন? ব্যাপার কি?” 

সে বলিল, “তিনি এখানে নাই। বোধ হয় আর আসিবেন না। যখন তিনি এ বাটী ত্যাগ করেন, তখন বলিয়া যান যে, আপনি এখানে আসিবেন। তাঁহার কথা এখন সত্য হইল দেখিয়া, হাসিয়াছিলাম।” 

“তিনি কেন বলিয়াছিলেন, বলিতে পার?” আমিও হাসিয়া এই কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। 

সে বলিল, “পারি! শুনিয়াছি, আপনার কি একখানি ছবির দরকার। সেই ছবির জন্য আপনাকে এখানে আসিতেই হইবে। আপনি সহরের একজন নামজাদা লোক, আমার পরম সৌভাগ্য যে, আপনার ন্যায় লোকের চরণ দর্শন করিতে পাইলাম।” 

আমি বলিলাম, “না, হে বাপু, অতটা ভাল নয়। ‘অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ’ হইয়া পড়িবে। এখন আমরা তোমার প্রভুর ঘরগুলি পরীক্ষা করিতে ইচ্ছা করি। তোমার কোন আপত্তি নাই ত?” 

দ্বা। আজ্ঞা না। 

আ। তবে তুমি আমাদের সঙ্গে চল। 

দ্বা। আমাকে আর কেন জড়ান মহাশয়। গরিবকে মাপ করুন। আপনি ত সকলকেই জানেন। 

আমি দ্বারবানের কথায় হাস্য করিলাম। পরে বিদ্যুৎপ্রকাশকে সঙ্গে লইয়া অভিনেত্রীর বৈঠকখানায় প্রবেশ করিলাম; যেখানে ছবিখানি লুক্কায়িত ছিল, সেই আলমারির ভিতর একখানি সামান্য আয়নার কাচ ও কাষ্ঠের মধ্যস্থল হইতে তাহা বাহির করিয়া ফেলিলাম। 

আয়নাখানি এরূপ নির্ম্মিত যে, উহার কাচ ও কাষ্ঠের মধ্যে সামান্য পরিমাণ স্থান ব্যবধান ছিল। অথচ এরূপভাবে গঠিত যে, সহজে কেহ তাহা জানিতে পারিবে না। ঐ ব্যবধানের মধ্যেই ছবিখানি লুক্কায়িত ছিল। আমি অভিনেত্রীকে ঐ স্থান হইতেই ছবিখানিকে অর্দ্ধেক বাহির করিতে দেখিয়াছিলাম। 

যাহা বাহির করিলাম, তাহা প্রথমতঃ দেখিলে ছবি বলিয়া বোধ হইল না, দেখিলাম, একটি কাগজের মোড়ক। শশব্যস্তে মোড়কটি খুলিয়া ফেলিলাম। দুইখানি ছবি ও একখানি পত্র বাহির হইল। পত্রখানি আমারই উদ্দেশে লেখা, পত্রের উপরে আমার নাম পরিষ্কাররূপে লিখিত ছিল। 

ছবি দুইখানির মধ্যে একখানিতে বিদ্যুৎপ্রকাশ ও অভিনেত্রী একত্রে, অপরখানিতে অভিনেত্রী স্বয়ং একাকিনী বিরাজমানা। প্রথমখানি, দেখিবামাত্র বিদ্যুৎ প্রকাশ চকিতের মত তুলিয়া লইলেন। দ্বিতীয়খানি পড়িয়া রহিল। বিদ্যুৎপ্রকাশ মনে করিয়াছিলেন, সেখানি পত্রের মর্ম জানিয়া পরে লইবেন। 

পত্র পাঠ করিবার জন্য আমারও কৌতূহল জন্মিল। আমি পাঠ করিলাম, 

“মহাশয়! 

“আমি ভাল লেখাপড়া জানি না। ভুলভ্রান্তি মাপ করবেন। কি খেলাই আজ খেলেছেন। প্রথমে আমি সত্যই মনে করেছিলাম, শেষে আপনার মুখ ভাল করে দেখে আমার সন্দেহ হয়। 

“আপনি যখন চলে যান, আপনার পশ্চাতে দরোয়ান পাঠাই। সে, আমার আপনার সন্ধান এনে দেয়। আমি আপনার মতলব বুঝতে পারি। ঐ দিনেই আমার স্বামীর দেশে যাবার কথা ছিল। কিন্তু ইচ্ছা আছে, আপনার সঙ্গে শেষ দেখা না ক’রে যাব না। 

“ইচ্ছা ছিল, ছবিখানি নিয়ে যাই। কিন্তু শেষে মনে করলাম না। যার জন্য কলিকাতার বিখ্যাত গোয়েন্দা আমার পিছু নিয়েছে, সেটা রেখে যাওয়াই উচিত। কিন্তু মনে করলে আপনাকে হতাশ করতে পারতাম। 

“আর এককথা। ঐ ছবিতে আর আমার কোন প্রয়োজন নাই। ও পাপ আমার গৃহে না থাকাই ভাল। যে আমায় ভালবাসে, আমি যাকে প্রাণ অপেক্ষা ভালবাসি, এখন তার রূপ চিন্তা করতেই সময় কুলাইবে না :— অন্য ছবি লইয়া কি করিব? আমার নিজের একখানি ছবি রাখিয়া যাইতেছি। যদি কুমার বিদ্যুৎপ্রকাশ ইচ্ছা করেন, গ্রহণ করিবেন, নচেৎ আগুনে পুড়াইয়া ফেলিবেন। ইতি— 

আশীৰ্ব্বাদাকাঙ্ক্ষী 

শ্রীমতী— 

পত্রের মা অবগত হইয়া কুমার বিদ্যুৎপ্রকাশ দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলেন, “যাহাই হউক, আপনারই জিত মহাশয়! আপনিই আজ আমায় বিপদ হইতে উদ্ধার করিলেন।” 

আ। আমার একটা অনুরোধ আছে। 

শশব্যস্তে বিদ্যুৎপ্রকাশ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি বলুন?” 

আমি হাসিয়া বলিলাম, “ঐ ছবিখানি।” 

বি। আপনার চাই? 

আ। আজ্ঞা হাঁ। 

বি। কেন? 

আ। যে রমণী বুদ্ধিতে আমায় পরাজিত করিয়াছে, তাহার চিত্র আমার নিকট রাখিতে চাই। 

“বেশ কথা, এই নিন।” এই বলিয়া বিদ্যুৎপ্রকাশ উহা আমার হস্তে প্রদান করিলেন। পরে গাড়ী করিয়া আমায় বাসায় পৌছাইয়া দিয়া তিনি চলিয়া গেলেন। 

বাসায় আসিয়া বিশ্রামের চেষ্টা করিলাম, কিন্তু আমার মন তখন এত অস্থির ছিল যে, অনেক চেষ্টা করিয়াও ঘুম আসিল না। পরদিন প্রাতে ডাক্তারের বাড়ী গেলাম। ডাক্তার তখন গৃহাগত রোগীর ব্যবস্থা দিতে ছিলেন; আমাকে দেখিয়া হাসিয়া বসিতে বলিলেন। আমি তাঁহার নিকট একখানি চেয়ারে বসিলাম। 

রোগী দেখা শেষ হইলে ডাক্তার জিজ্ঞাসা করিলেন, “ছবিখানি আদায় হইয়াছে?” আমি বলিলাম, “তা না হইলে আর নিশ্চিন্তভাবে তোমার নিকট বসিয়া আছি।” 

এই বলিয়া ডাক্তারকে সমস্ত কথা বলিলাম। সকল কথা শুনিয়া ডাক্তার জিজ্ঞাসা করিলেন—”এ ছবি লইয়া তুমি কি করিবে?” 

আমি হাসিয়া উত্তর করিলাম, “ইনি আমার শিক্ষাদাত্রী। ইঁহার নিকট হইতে আমার যথেষ্ট শিক্ষা লাভ হইয়াছে। ছবিখানি এক একবার দেখিলে যড়রিপুরমধ্যে একটির হাত হইতে অব্যাহতি পাওয়া যাইবে।” 

বলা বাহুল্য, এই ছবিখানি উদ্ধার করিতে যাহা কিছু খরচ হইয়াছিল, তাহার সমস্তই ও উপযুক্তরূপ পারিতোষিক বিদ্যুৎপ্রকাশ পরিশেষে প্রদান করিয়াছিলেন। 

[ অগ্রহায়ণ, ১৩১৩ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *