কয়েক রকম

কয়েক রকম 

(অর্থাৎ কয়েক প্রকার জুয়াচুরির অদ্ভুত রহস্য! ) 

চিঠিওজনে জুয়াচুরি 

রামসহায় দেখিল, অতি প্রত্যূষে একটি লোক তাহার মস্তকোপরি একটি মোট লইয়া দ্রুতপদে গমন করিতেছে। দেখিয়াই সে বুঝিতে পারিল, ঐ ব্যক্তি কলিকাতা হইতে আপন দেশে গমন করিবার মানসে দ্রুতগতি চলিতেছে; আরও বুঝিতে পারিল, প্রত্যূষে যে সকল স্টীমার বন্দর ছাড়িয়া চলিয়া যায়, ঐ ব্যক্তি তাহারই একখানিতে আপন দেশে গমন করিবে। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া রামসহায় দ্রুতপদে তাহার অনুসরণ করিল, ও কিয়ৎদূর গমন করিবার পরই তাহার নিকট উপস্থিত হইল। দেখিল, ঐ ব্যক্তি জাতিতে উড়িয়া। অনুমান করিয়া লইল যে, উহার বাসস্থান হয় কটক, না হয় বালেশ্বর জেলায়। 

রামসহায় তাহার সহিত কিয়ৎদূর গমন করিতে করিতে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “ভাই! তোমার বাসস্থান কোথায়?” 

উড়িয়া। আমার বাসস্থান বালেশ্বর জেলার মধ্যস্থিত একখানি ক্ষুদ্র গ্রামে। 

এই বলিয়া যে গ্রামে তাহার বাসস্থান, সেই গ্রামের নাম তাহাকে বলিল। 

রাম। তুমি কি এখন দেশে গমন করিতেছ? 

উড়িয়া। হাঁ। 

রাম। তুমি বালেশ্বর হইয়া যাইবে, না অপর কোন স্থান হইয়া গমন করিবে? 

উড়িয়া। বালেশ্বর পর্যন্তই জাহাজে যাইবার ইচ্ছা আছে! 

রাম। সেইস্থানে তোমার দুই এক দিবস বিলম্ব হইবে কি? 

উড়িয়া। না, সেইস্থানে অধিক বিলম্ব হইবার আশা নাই, জোর এক দিবস যদি সেইস্থানে থাকি। 

রাম। সেইস্থানে তোমার থাকিবার স্থানে আছে? 

উড়িয়া। থাকিবার বিশেষ কোন পরিচিত স্থান নাই, কিন্তু বাজারে অনায়াসেই থাকা যাইতে পারে। 

রাম। বাজারে যদি তোমার থাকিবার সুবিধা না হয়, তাহা হইলে আমার ভাই সেইস্থানে থাকে, তুমি তাহার নিকট থাকিতে পার। 

উড়িয়া। তোমার ভাইএর নাম কি? 

রাম। তাহার নাম গোপাল। 

উড়িয়া। গোপাল থাকে কোথায়? 

রাম। বালেশ্বরে বাজারে যে একটি “চটি” (অর্থাৎ পথিকগণ যেস্থানে এক দিবস অবস্থিতি করিয়া স্থানান্তরে গমন করে) আছে, সেই “চটিতে” সে চাকরি করে। ঐ “চটির” অধিকারী সদাশিব পাণ্ডা। সদাশিব প্রায় সেইস্থানে থাকে না, সমস্ত কার্য্য আমার ভাই নির্ব্বাহ করিয়া থাকে। 

উড়িয়া। দেখিব, অনুসন্ধান করিয়া যদি তাহাকে পাই, তাহা হইলে তাহার “চটিতেই” গমন করিব। 

রাম। অনুসন্ধান করিয়া সেইস্থান প্রাপ্ত হইতে আর বিলম্ব হইবে না। সদাশিব পাণ্ডা সেইস্থানের একজন পরিচিত লোক। তাহার কথা তুমি যাহাকে জিজ্ঞাসা করিবে, সেই তোমাকে তাহার “চটি” দেখাইয়া দিবে। তোমার সহিত আমার দেখা হইয়া ভালই হইল, বালেশ্বরে গমন করিবে এরূপ একটি লোকের আমি অনুসন্ধান করিতেছিলাম। 

উড়িয়া। কেন? 

রাম। আমার ভাই-এর নিকট একখানি চিঠি পাঠাইবার নিতান্ত প্রয়োজন হইয়াছে। উহার মধ্যে বিশেষ আবশ্যকীয় কতকগুলি কাগজ পত্র আছে। ঐ কাগজগুলি আমার ভাই-এর নিকট শীঘ্র পাঠাইয়া না দিলেই নহে। 

উড়িয়া। ডাকে পাঠাইয়া দিলেই তো হইত। 

রাম। ডাকে পাঠাইতে আমার সাহস হয় না, একে ডাকে ফি তোলা দুই আনা করিয়া মাসুল লইবে তাহাতে উহার ভিতর যে সকল কাগজ আছে, যাহা যদি কোনরূপে হারাইয়া যায়, তাহা হইলে আমার বিশেষ অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা। ডাকে কেবলমাত্র আমার ঐ পত্রখানি যাইবে না। অনেক পত্রের সহিত মিশ্রিত হইয়া গেলে হারাইয়া যাওয়ারই বিশেষ সম্ভাবনা, কারণ আজকাল ডাকঘরে চিঠি পত্র লইয়া বড়ই গোলযোগ হইয়া থাকে। এই নিমিত্ত আমি একটি লোকের অনুসন্ধান করিতেছি; তিনি যদি উহা লইয়া যান, তাহা হইলে ডাকঘরে আমায় যে মাসুল দিতে হইত তাহা আমি তাহাকে প্রদান করিব, অথচ আমার পত্র সেইস্থানে পৌঁছিতে কোনরূপ গোলযোগ হইবার সম্ভাবনা নাই। 

এইরূপে ডাকঘরের মিথ্যা দোষ দিয়া রামসহায় তাহার নিকট হইতে একখানি বৃহদাকার পত্র বাহির করিল। ঐ পত্রখানির আকার প্রায় ১ ফুট লম্বা, ৬ ইঞ্চি চেওড়া ও ৩/৪ ইঞ্চি ঊর্দ্ধ; ওজনে অর্দ্ধসেরের কম নহে। 

পত্রখানি উড়িয়ার হস্তে প্রদান করিয়া রামসহায় কহিল, “এই পত্রখানি যদি তুমি লইয়া গিয়া আমার ভাইকে প্রদান কর, তাহা হইলে ইহা ডাকে পাঠাইতে আমার যে খরচ হইত, তাহা আমি তোমাকে প্রদান করিতে পারি। ইহাতে তোমার রাস্তা খরচের অনেকটা সাহায্য হইবে, অথচ আমারও বিশেষ উপকার হইবে।” 

রামসহায়ের কথা শুনিয়া উড়িয়া ঐ পত্রখানি লইয়া যাইতে স্বীকৃত হইল। রামসহায়কে উপকৃত করিবার নিমিত্তই যে, সে তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইল, তাহা নহে; দেশে গমন করিবার সময় যাহা কিছু প্রাপ্ত হইতে পারে, এই আশায় এই পত্র বহন করিতে প্রস্তুত হইল। 

উড়িয়ার মনের ভাব জানিতে পারিয়া রামসহায় কহিল, “তাহা হইলে তুমি এই পত্রখানি লইয়া যাও, ইহার মাসুল বাবদে আমি তোমাকে ফি ভরি দুই আনার হিসাবে প্রদান করিতেছি।” এই বলিয়া তাহার নিকট হইতে ওজন করিবার একটি নিক্তি বাহির করিয়া, তাহার একপার্শ্বে ঐ চিঠিখানি চাপাইয়া দিল ও সেই উড়িয়াকে কহিল, “ভাই! আমার সহিত অধিক টাকা নাই, যে পরিমিত মাসুল তোমাকে প্রদান করিতে হইবে সেই পরিমিত টাকা আছে, তোমার নিকট হইতে গুটিকয়েক টাকা বাহির কর, ঐ টাকা দ্বারা চিঠিখানি ওজন করিয়া টাকা ও চিঠি তোমাকে প্রদান করি।” 

রামসহায়ের কথায় উড়িয়া বিশ্বাস করিল, ও তাহার নিকট যে সকল টাকা ছিল, তাহা ক্রমে ক্রমে সমস্তই বাহির করিল, তথাপি চিঠি ওজনের উপযুক্ত টাকা হইল না। উহা গুণিয়া হইল ৩টাকা। 

রামসহায় সেই উড়িয়াকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার নিকট আর টাকা নাই? আর কয়েকটি টাকা হইলেই আমাদিগের কার্য শেষ হইত।’ 

উড়িয়া অনেক অনুসন্ধান করিয়া তাহার নিকট হইতে আরও দুইটি টাকা বাহির করিয়া কহিল, “আমার নিকট আর কিছুই নাই।” 

রাম। আচ্ছা, আর টাকা না থাকে, এখন আন্দাজে একরূপ ঠিক করিয়া লইব। 

এই বলিয়া রামসহায় সেই বত্রিশটি টাকা সেই নিক্তির অপরপ্রান্তে উঠাইয়া দিল ও ওজনের ভাণ করিয়া কহিল, “আন্দাজ আরও তিন টাকা লাগিবে, অর্থাৎ ঐ চিঠিখানি ওজনে ৩৫ ভরি হইবে, তাহা হইলে তুমি আমার নিকট হইতে চার টাকা ছয় আনা পাইবে। ঐ টাকা আমি তোমাকে এখনই প্রদান করিতেছি।” 

এই বলিয়া টাকা ৩২ টি সেই উড়িয়ার হাতে এক এক করিয়া গণিয়া প্রদান করিল ও কহিল, “ তুমি দূরদেশে গমন করিতেছ, ওরূপ অবস্থায় এরূপ ভাবে টাকাগুলি লইয়াছ কেন? একটি “গেঁজের” ভিতর টাকাগুলি পুরিয়া নিজের কোমরে বাঁধিয়া রাখা উচিত। তাহা হইলে কেহই জানিতে পারিবে না যে তোমার নিকট টাকা আছে, — লওয়া তো দূরের কথা। 

উড়িয়া। আমি একটি গেঁজিয়ার চেষ্টা করিয়াছিলাম, কিন্তু তাহা তাড়াতাড়িতে কিনিবার সময় পাই নাই।

রাম। আমার নিকট একটি নূতন গেঁজিয়া আছে, আমি তাহা তোমাকে প্রদান করিতেছি, উহার ভিতর তুমি তোমার টাকাগুলি পুরিয়া রাখ। 

এই বলিয়া রামসহায় তাহার নিকট হইতে বেশ রঙ্গিণ একটি নতুন গেঁজিয়া বাহির করিয়া দিল, উড়িয়া ঐ গেঁজেটি পাইয়া বিশেষ সন্তুষ্ট হইল ও একটি একটি করিয়া তাহার টাকাগুলি সেই গেঁজিয়ার ভিতর পুরিল। 

টাকাগুলি গেঁজিয়ার ভিতর বদ্ধ হইলে রামসহায় চারিটি টাকা নিজের হস্তে গ্রহণ করিয়া কহিল “এই টাকা চারিটি তোমার ৩২ টাকার মধ্যের কি তোমাকে মাসুল বাবুদ দিবার নিমিত্ত আমি বাহির করিয়াছি, তাহা মনে করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। গেঁজিয়া হইতে টাকাগুলি বাহির করিয়া পুনরায় আর একবার গণিয়া দেখ।” 

রামসহায়ের কথা শুনিয়া উড়িয়ার মনে একটু সন্দেহ হইল, সেও তাহার টাকাগুলি পুনরায় গেঁজিয়া হইতে বাহির করিয়া গণিয়া দেখিল, তাহার ৩২ টাকা ঠিক্ আছে। তখন রামসহায় ঐ চারি টাকা সেই উড়িয়াকে দেখাইয়া কহিল, “এই লও তোমার পারিশ্রমিক।” 

এই বলিয়া রামসহায় ঐ গেঁজিয়াটি উড়িয়ার হস্ত হইতে গ্রহণ করিল। তাহার মধ্যে ঐ চারিটি টাকাও রাখিয়া দিয়া উহার মুখ উত্তমরূপে বাঁধিয়া দিল। অতি অল্প সময়ের নিমিত্ত উহা আপনার হস্তে রাখিয়া, তাহার সহিত দুই চারিটি অপরাপর কথা বলিতে আরম্ভ করিল; ও পরিশেষে গেঁজিয়া ও চিঠি তাহার হস্তে প্রদান করিল। অবশিষ্ট ছয় আনা আর তাহাকে প্রদান করিল না; কহিল, “আমার নিকট আর পয়সা নাই।” 

এই বলিয়া রামসহায় সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল, উড়িয়াও ঐ গেঁজিয়া কোমরে বাঁধিয়া, ও মোটটি আপন মস্তকের উপর উঠাইয়া লইয়া আপনার গন্তব্য স্থানাভিমুখে গমন করিতে লাগিল। 

জাহাজে গমন করিবার টিকিট সেই উড়িয়া পূর্ব্ব হইতেই সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিল, সুতরাং তাহাকে আর টিকিট খরিদ করিতে হইল না, কাজেই টাকা বাহির করিবার নিমিত্ত ঐ গেঁজিয়া খুলিবারও আর প্রয়োজন হইল না। সে জাহাজে উঠিলে সময়মত জাহাজ ছাড়িয়া দিল। কিছুদূর গমন করিবার পর উড়িয়া তাহার টাকাগুলি গুণিয়া গাথিয়া ঠিক করিয়া রাখিবার মানসে, গেঁজিয়াটি তাহার কোমর হইতে বাহির করিল, ও উহা খুলিয়াই দেখিল, তাহার সর্ব্বনাশ হইয়াছে। উহার ভিতর একটিমাত্রও টাকা নাই। টাকার পরিবর্তে কতকগুলি ডবল পয়সা রহিয়াছে। এই অবস্থা দেখিয়া সে তাহার কপালে করাঘাত করিয়া কাঁদিতে লাগিল, বুঝিতে পারিল, চারি টাকার লোভ সম্বরণ করিতে না পারিয়া সে তাহার সঞ্চিত সমস্ত অর্থই নষ্ট করিয়াছে; জুয়াচোরের জুয়াচুরি-বুদ্ধির মধ্যে প্রবেশ করিতে না পারিয়া সে সৰ্ব্বস্বান্ত হইয়াছে! 

পাঠকগণ অনায়াসেই বুঝিতে পারিলেন যে, জুয়াচোরগণ কিরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া আপনাপন মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিয়া থাকে। 

এই শ্রেণীর জুয়াচোরগণ প্রায়ই তিন চারিটি এক প্রকারের গেঁজিয়া খরিদ করিয়া তাহার অর্দ্ধেকগুলিতে ডবল পয়সা পুরিয়া রাখে, অবশিষ্টগুলি আপনাদিগের নিকট রাখিয়া দেয় ও সুযোগমত পূৰ্ব্ব বর্ণিতরূপে যাহাকে ঠকাইবে, তাহাকে খালি গেঁজিয়া প্রদান করে। ঐ গেঁজিয়ার ভিতর টাকা রাখা হইলে, কোন না কোন কৌশল অবলম্বন করিয়া টাকা সমেত গেঁজিয়াটি একবার আপন হস্তে গ্রহণ করিয়া, হাতের কৌশলে যে গেঁজিয়ার ডবল পয়সা থাকে, তাহা বদলাইয়া লইয়া আপনাপন উদ্দেশ্য সফল করিয়া লয়। উভয় গেঁজিয়াই দেখিতে একরূপ বলিয়া, এইরূপ অবস্থায় প্রায়ই মূর্খগণকে জুয়াচোরের হস্তে ঠকিতে হয়। 

এইরূপ ভাবে নিরীহ লোকগণ কলিকাতার মধ্যে যে কতই প্রতারিত হইতেছে, তাহার অনুমান করা নিতান্ত সহজ নহে। 

গিলটির দানা 

জুয়াচোরগণ সোণা বলিয়া পিতল দিয়া যেরূপভাবে সর্ব্বদা জুয়াচুরি করিয়া থাকে, সে সম্বন্ধে অনেক কথা অনেক সময়ে আমি পাঠকগণের নিকট বর্ণন করিয়াছি, কিন্তু তাহাতে অতি অল্প পরিমাণে শুভফল ফলিলেও, এখনও অনেক ব্যক্তি নিত্য নিত্য যে জুয়াচোরগণের হস্তে পড়িতেছেন, তাহা প্রায় প্রত্যহই দেখিতে পাই; কিন্তু কি উপায় অবলম্বন করিলে ঐ জুয়াচুরি একেবারে বন্ধ হইয়া যায়, তাহার কিছুই ভাবিয়া চিন্তিয়া ঠিক করিয়া উঠিতে পারি না। পূর্ব্বে জুয়াচুরি অপরাধ পুলিসের অধিকারের সাধ্য ছিল না, অর্থাৎ কোন ব্যক্তি অসদ উপায় অবলম্বন করিয়া কাহাকেও প্রতারিত করিলে তাহাদিগকে একায়েক ধৃত করিতে পুলিস পারিতেন না, সুতরাং কলিকাতার ভিতর জুয়াচুরিটা বড়ই প্রবল ছিল, জুয়াচোরগণ দলে দলে যে স্থানে ইচ্ছা সেই স্থানে গমন করিয়া যাহাকে ইচ্ছা তাহাকে প্রতারিত করিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হইত না, কিন্তু আজকাল গবর্ণমেণ্ট সেই আইনের পরিবর্ত্তন করিয়া দিয়াছেন, জুয়াচুরির নালিশ হইলে পুলিস প্রায়ই জুয়াচোরগণকে ধৃত করিতে আর কুণ্ঠিত হন না, তথাপি এই কলিকাতা হইতে জুয়াচুরি যে একবারে লোপ পাইয়াছে, তাহা আমি বলিতে পারি না; কিছু পরিমাণে অনেক কমিয়াছে বলিয়া অনুমান হয় সত্য, তথাপি এমন দিন প্রায়ই গত হয় না, যে দিবস কোন না কোন ব্যক্তি জুয়াচোরগণের হস্তে পতিত না হন। 

পুরাতন প্রথার গিল্টিদানার জুয়াচুরিতে এখনও নিরীহ ব্যক্তিগণ প্রায়ই পতিত হন। যে সকল ব্যক্তি পূর্ব্বে কখন কলিকাতায় আসেন নাই, বা দুই একবার আসিয়াও ভাগ্যক্রমে জুয়াচোরগণের হস্তে পতিত হন নাই, ঐ সকল লোকদিগকেই প্রায় জুয়াচোরগণের করায়ত্ত হইতে দেখিতে পাওয়া যায়। 

গিল্টিদানার জুয়াচুরি যেরূপভাবে হইয়া থাকে, তাহাতে জুয়াচোরগণ একটু চালাক চতুর লোকের নিকটে গমন করিতে প্রায়ই সাহসী হয় না। 

জুয়াচোরগণ কিরূপ উপায়ে নিরীহ লোকদিগকে প্রতারিত করিয়া থাকে, তাহাই এইস্থানে অতি সংক্ষেপে বিবৃত হইতেছে। 

দুই জন, কখন কখন বা তিন জন জুয়াচোর একত্রে মিলিত হইয়া, সিয়ালদহ ও হাওড়া ষ্টেশনের সন্নিকটে, কখন বা ষ্টীমার ঘাট, অথবা হাওড়া পুলের নিকটবর্ত্তী কোন স্থানে বসিয়া থাকে। যখন দেখিতে পায়, পল্লিগ্রামবাসী কোন লোক রেলওয়ে, জাহাজ প্রভৃতি হইতে অবতরণ করিয়া, অথবা হাওড়া পুল পার হইয়া একাকী আগমন করিতেছে, তখনই তাহারা গাত্রোত্থান করিয়া আপনাপন অভীষ্ট সিদ্ধ করিবার মানসে যত্নবান হয়। উহাদিগের মধ্যে একজন প্রায়ই ভদ্রবেশ ধারণ করিয়া থাকে। একজন সেই নবাগত ব্যক্তির অগ্রে অগ্রে গমন করিতে আরম্ভ করে, ও পরিশেষে যে স্থানে উপস্থিত হইল তাহার বুঝিতে পারে যে, ঐ স্থানে তাহাদিগের কার্য্য উদ্ধার হইবার কোনরূপ প্রতিবন্ধকের সম্ভাবনা নাই; সেই মানসে অগ্রগামী ব্যক্ত তাহার নিকটস্থিত গিল্টি দানা, (যাহা দেখিতে সোণার দানার ন্যায়) একখানি নীলবর্ণ কাগজে মোড়ক করিয়া আপনার নিকট রাখিয়াছিল, তাহা রাস্তার উপর আস্তে আস্তে ফেলিয়া রাখিয়া আরও অগ্রবর্তী হয়। নবাগত ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে একজন জুয়াচোর আসিতে আসিতে, যে স্থানে কাগজে মোড়া ঐ গিল্টির দানা পূর্বে ফেলিয়া রাখা হইয়াছে, সেইস্থানে উপস্থিত হইয়াই ঐ ব্যক্তি ঐ দানা এরূপ ভাবে উঠাইয়া লয় যে, আগন্তুক ব্যক্তি তাহা যেন দেখিতে পায়। কাগজে মোড়া দানা উঠাইয়া লইয়াই সে ধীরে ধীরে এরূপভাবে উহা খুলিয়া দেখে যে, আগন্তুকও তাহা যেন দেখিতে পায়। ঐ দানা দেখিয়াই সে উহা লুক্কায়িত করিবার ভাণে আপনার নিকট রাখিবার চেষ্টা করে। 

এই সময়ে সেই ভদ্রবেশী জুয়াচোর সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হয়, ও যে জুয়াচোর সেই দানা উঠাইয়া লইয়াছে, তাহার নিকট আসিয়া কহে, “তুমি যাহা পাইয়াছ, তাহা আমি দেখিয়াছি, তুমি মনে করিও না যে, আমাদিগকে একেবারে ইহার কিছুমাত্র অংশ না দিয়া, এতগুলি সোণার দানা তুমি একাকী আত্মসাৎ করিতে সমর্থ হইবে। যাহা সরকারি রাস্তার উপরে পাওয়া গিয়াছে, তাহাতে তোমার যেরূপ অধিকার, আমারও সেইরূপ অধিকার; আর এই যে ভদ্রলোকটি (সেই নবাগত ব্যক্তি) এখানে উপস্থিত আছেন, তাঁহারও সেইরূপ অধিকার। যদি ঐ দ্রব্য আমাদিগকে সমান অংশে বিভাগ করিয়া না দেও, তাহা হইলে আমি পুলিসে সংবাদ দিয়া এখনি তোমাকে ধরাইয়া দিব।” 

এইরূপ ভাবের কথা শুনিয়া যে জুয়াচোর ঐ দ্রব্য উঠাইয়া লইয়াছিল, সে এইরূপভাবে উত্তর করে, “যখন আপনারা দেখিতে পাইয়াছেন, তখন আর গোলযোগ করিবার প্রয়োজন কি? পুলিসের নিকট এই কথা প্রকাশ করিলে আপনার কোনরূপ লাভ নাই, অথচ আমাদিগের কিছুই পাইবার উপায় থাকিবে না, যখন আপনি দেখিতে পাইয়াছেন, তখন এইগুলি আপনি গ্রহণ করুন। আমি দরিদ্র লোক, এই সকল সোণার গহনা লইয়া আমি কি করিব? আপনি ভদ্রলোক, আপনার কার্য্যে লাগিতে পারে; আমার অংশের মূল্যবাবুদে আমাকে কিছু প্রদান করিলেই আমি সন্তুষ্ট।” এইরূপ বলিয়া ঐ জুয়াচোর, ভদ্রবেশী জুয়াচোরের হস্তে উহা প্রদান করিয়া থাকে। 

ভদ্রবেশী জুয়াচোর উহা আপনার হস্তে লইয়া সেই নবাগত ব্যক্তির সম্মুখে খুলিয়া ফেলে ও কহে, “ইহা দেখিতেছি উৎকৃষ্ট সোণার দানা।” 

জুয়াচোর। সোণার দানা কি না, তাহা আপনি চিনিয়া উঠিতে পারিতেছে না? 

ভদ্রবেশী জুয়াচোর। চিনিয়া উঠিতে পারিব না কেন? 

জুয়াচোর। তাহা হইলে ইহা কি প্রকৃতই সোণা? 

ভদ্রবেশী জুয়াচোর। সোণা বলিয়া সোণা, ইহা পাকা সোণার গহনা। 

জুয়াচোর। তাহা হইলে ইহার মূল্য কত হইতে পারে? 

ভদ্রবেশী জুয়াচোর। ওজনে বোধ হয়, ইহা তিন ভরির কমন হইবে না, যদি তিনি ভরি হয়, তাহা হইলে ইহার মূল্য প্রায় ৭০। ৭৫ টাকা হইতে পারে। কেমন মহাশয় আপনি কি বলেন? ইহার দাম ৭০।৭৫ টাকা হইবে না কি? 

এই বলিয়া সে উহা সেই আগন্তুকের হস্তে প্রদান করিয়া থাকে। 

ভদ্রবেশী জুয়াচোর। দেখুন দেখি ইহা সোণা কি না? 

আগন্তুক। সোণার ন্যায়ই বোধ হইতেছে, কিন্তু ইহা রাস্তার উপর আসিল কি প্রকারে? 

ভদ্রবেশী জুয়াচোর। দেখিতে পাইতেছেন না ইহা দোকানদারের প্রদত্ত নূতন নীলবর্ণের কাগজে এখন পৰ্য্যন্ত মোড়া রহিয়াছে। কোন ব্যক্তি দোকান হইতে লইয়া যাইবার সময় তাঁহার নিকট হইতে উহা কিরূপে রাস্তায় পড়িয়া গিয়াছে। সে যাহা হউক, এখন ইহা আমাদিগের। আসুন আমরা ইহার আপনাপন অংশ গ্রহণ করি। 

জুয়াচোর। আমি মহাশয় ইহার অংশ-টংশ জানি না, আমাকে যাহা হয় প্রদান করুন। 

ভদ্রবেশী জুয়াচোর। তোমার এক অংশ তুমি গ্রহণ কর। 

জুয়াচোর। আমি সোণা লইয়া কি করিব। আমি নগত টাকা চাহি! সোণা আমি গ্রহণ করিব না। 

ভদ্রবেশী জুয়াচোর। আমার নিকট নগত টাকা নাই। তোমাকে আমি নগত টাকা দিব কি প্রকারে। 

জুয়াচোর। বিক্রয় করিয়া ফেলুন, তাহ হইলেই নগত টাকা পাওয়া যাইবে। 

ভদ্রবেশী জুয়াচোর। আমি কোথায় ইহা বিক্রয় করিব। 

জুয়াচোর। ইহার নিকট বিক্রয় করুন। দাম একটু কম হইলে ইনি গ্রহণ করিতে পারেন। 

ভদ্রবেশী জুয়াচোর। সেই ভাল, আপনিই ইহা গ্রহণ করুন। 

আগন্তুক। আমার নিকট এরূপ টাকা নাই, যাহাতে আমি ইহা খরিদ করিতে সমর্থ হই। 

ভদ্রবেশী জুয়াচোর। আপনার নিকট কত টাকা আছে? 

আগন্তুক। কিছুই নাই বলিলে হয়। মোট পাঁচটি টাকা আছে। 

ভদ্রবেশী জুয়াচোর। পাঁচ টাকায় হইবে কি প্রকারে। ইহা যদি ওজনে তিন ভরি হয়, তাহা হইলে আপনার নিজ অংশ এক ভরি বাদে অবশিষ্ট যে দুই ভরি থাকে, তাহার মূল্য অভাবপক্ষে ৪০/৫০ টাকা হইতে পারিবে, আপনি তাহারও অর্দ্ধেক অর্থাৎ ২০/২৫ টাকা আমাদিগের উভয়কে প্রদান করিয়া, সমস্তই নিজে গ্রহণ করুন। 

আগন্তুক। টাকা না থাকিলে আমি আপনাদিগকে প্রদান করিব কিরূপে? আমি তো বলিয়াছি, আমার নিকট মোট পাঁচটি টাকা আছে, তাহাই যদি গ্রহণ করিয়া উহা আমাকে প্রদান করেন, তাহা হইলে আমি উহা গ্রহণ করিতে সম্মত আছি। 

ভদ্রবেশী জুয়াচোর আগন্তুকের কথা শুনিয়াই বুঝিতে পারিল যে, ঐ সোণার উপর তাঁহার লোভ পড়িয়াছে ও নিতান্ত অল্প মূল্যে তিনি উহা গ্রহণ করিতে প্রস্তুত হইয়াছেন। এই ভাবিয়া তিনি কহিলেন, এত অল্প মূল্যে আপনি এতগুলি সোণার দানা কিরূপে গ্রহণ করিতে পারেন? আমরা ইহা পড়িয়া পাইয়াছি বলিয়াই কি সমস্ত লাভই আপনি করিতে চাহেন, তাহা কিরূপে হইতে পরে? আপনি অধিক লাভ করুন, তাহাতে আমাদিগের কিছুমাত্র আপত্তি নাই, কিন্তু আমাদিগেরও কিছু পাওয়া আবশ্যক। 

আগন্তুক। তাহাতো নিশ্চয়, কিন্তু আমার নিকট তো আর অধিক টাকা নাই, বোধ হয়, খরচা পয়সা প্রভৃতিতে আর দুই টাকা হইতে পারে। 

ভদ্রবেশী জুয়াচোর। আপনার আঙ্গুলে উটি কি? 

আগন্তুক। একটি আংটি। 

ভদ্রবেশী জুয়াচোর। উহা কিসের প্রস্তুর? 

আগন্তুক। সোণার। 

ভদ্রবেশী জুয়াচোর। উহার মূল্য কত? 

আগন্তুক। উহা আমার দশ টাকায় খরিদ ছিল। 

ভদ্রবেশী জুয়াচোর। তাহা হইলে এখন উহার মূল্যও প্রায় ৭ টাকা হইতে পারে। 

আগন্তুক। সম্ভব। 

ভদ্রবেশী জুয়াচোর। তাহা হইলে ঐ আংটীটি আমাকে দিন, ও নগত যে ৭ সাত টাকা আছে, তাহা ইহাকে প্রদান করুন। আপনি সমস্ত সোণার দানাগুলি গ্রহণ করুন। আপনিই সকলের অপেক্ষা জিতিলেন। ১৪ টাকামাত্র প্রদান করিয়া ৭০/৭৫ টাকার উত্তম সুবর্ণ প্রাপ্ত হইলেন। 

আগন্তুক মনে মনে বুঝিতে পারিলেন, বাস্তবিকই তিনি বেশ দশ টাকা লাভ করিলেন, এই ভাবিয়া তাহার নিকট যাহা কিছু ছিল, তাহা একত্রিত করিয়া দেখিলেন, সাত টাকা কয়েক পয়সা হইল। উহা, ও আপনার অঙ্গুলী হইতে অঙ্গুরি উন্মোচিত করিয়া সেই ভদ্রবেশী জুয়াচোরের হস্তে প্রদানপূর্ব্বক সেই দানাগুলি গ্রহণ করিলেন। জুয়াচোরগণ যাহা পাইল, তাহাই লইয়া হৃষ্টমনে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল। আগন্তুকও অতগুলি টাকার দ্রব্য পাইয়া মহা আনন্দে সেইস্থান হইতে আপনার গন্তব্য স্থানে গমন করিলেন। 

পরিশেষে আপন বন্ধুবান্ধবগণকে ঐ সোণার দানা যখন দেখাইলেন, তখনই তিনি জানিতে পারিলেন যে, জুয়াচোরগণ কর্তৃক তিনি সম্পূর্ণরূপে প্রতারিত হইয়া তাঁহার নিকট যাহা কিছু ছিল, সমস্তই নষ্ট করিয়া ফেলিয়াছেন। মফঃস্বলের পাঠকগণ মনে করিয়া রাখিবেন যে, এইরূপে পিতলের উপর সোণার গিল্টিকরা দানা গ্রহণ করিয়া নিত্য নিত্য অনেক লোক এই রাজধানীতে প্রতারিত হইতেছেন ও ঐসকল জুয়াচোরগণ এরূপভাবে কলিকাতার মধ্যে পরিভ্রমণ করিয়া বেড়ায় যে, তাহাদিগকে দেখিয়া সহজে জুয়াচোর বলিয়া স্থির করাও নিতান্ত সহজ নহে। 

আড়ত খুলিয়া জুয়াচুরি 

কিশোরিলাল একজন পাকা জুয়াচোর। এ পর্যন্ত অনেক স্থানে ও অনেকরূপে জুয়াচুরি করিয়াছে; অনেকবার ধরাও পড়িয়াছে, এবং অনেকবার জেল ভ্রমণ করিয়াও আসিয়াছে, তথাপি কিন্তু সে জুয়াচুরি ব্যবসা পরিত্যাগ করিতে সমর্থ হয় নাই। 

জুয়াচুরি পরিত্যাগ করিতে পারিবে না, অথচ পুলিসের হস্তে যাহাতে আর পতিত হইতে না হয়, এরূপ একটি জুয়াচুরির পন্থা অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া পরিশেষে স্থির করিয়া লইল। ভাবিয়া চিন্তিয়া যেমন নূতন পন্থা বাহির করিল, অমনি সেই পন্থা কার্য্যে পরিণত করিতে আরম্ভ করিল। 

পাথুরিয়াঘাটায় ব্যবসায়ীগণ বিস্তর আড়ত খুলিয়া আপনাপন ব্যবসা চালাইয়া থাকেন, একথা কিশোরিলাল বেশ জানিত। খুজিয়া খুজিয়া উহার নিকটবর্তী স্থানে একটি ছোট গোছের বাটী ভাড়া করিয়া তাহাতে একটি নূতন আড়ত খুলিল। আড়ত খুলিবার সরঞ্জামের মধ্যে দুইটি বড় বড় মাদুর (যাহা একত্রিত করিয়া ঐ বাটীর একটি ঘর জুড়িয়া পাতা হইল।) তাহার উপর সারি সারি তিনটি কাষ্ঠের হাতবাক্স, তিনটি বড় বড় তাকিয়া, দুইটি বৈঠকের উপর দুইটি বাঁধান হুকা, এবং কতকগুলি লাল খেরুয়া বাঁধা কাগজপত্র। আড়তের কর্মচারীর মধ্যে কিশোরিলাল, ও তাহার একজন অনুচর চিনিবাস। 

চিনিবাস প্রায় সর্ব্বদাই সেইস্থানে সেই মাদুরের উপর তাকিয়া ঠেস দিয়া, একটি কাষ্ঠের হাতবাক্স সম্মুখে রাখিয়া বসিয়া থাকিত, ও মধ্যে মধ্যে পূর্ব্বকথিত লাল খেরুয়া বাঁধা একখানি খাতায় কি লিখিত। 

কিশোরিলাল প্রায়ই সেইস্থানে থাকিত না, বাজারে বাজারে ঘুরিয়া বেড়াইয়া দ্রব্য সামগ্রী সংগ্রহ করা তাহার কাৰ্য্য ছিল। 

সন্ধ্যার পর বাহির হইয়া এক দিবস কিশোরিলাল একটি নামজাদা পুরাতন আড়তদারের নিকট গমন করিল। সেই সময় তাঁহার ঘরে চাউলের বিস্তর আমদানী ছিল। কিশোরিলাল সেইস্থান হইতে কয়েক প্রকার চাউলের নমুনা সংগ্রহ করিল ও ঐ সকল চাউলের দাম জানিয়া আপন বাসায় প্রত্যাগমন করিল। সেই সময় একজন নাখোদা বিস্তর চাউল খরিদ করিতেছিলেন। কিশোরিলাল সেই নাখোদার নিকট গমন করিয়া, তাহার আনীত চাউলের নমুনা সকল দেখাইলেন, নাখোদা তাহার মধ্য হইতে এক প্রকার চাউল পছন্দ করিয়া, তাহার দাম জিজ্ঞাসা করিলেন ও কহিলেন, “আপনার এই চাউল কত আছে?” 

কিশোরি। অধিক নাই, এক হাজার মণ দিতে পারিব মাত্র। 

নাখোদা। কয়দিবসে হাজার মণ মাপিয়া দিতে পারিবেন? 

কিশোরি। তাহা আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন? আমার সমস্তই মজুত আছে, আপনি লোকজন লইয়া গিয়া একেবারেই মাপিয়া আনিতে পারেন। 

নাখোদা। ইহার মূল্য কত? 

কিশোরি। ২/১ আনা। 

বলা বাহুল্য এই দর কিশোরিলাল আড়ত হইতে প্রাপ্ত হইয়াছিল। 

নাখোদা। ও দরে আমি লইতে পারি না। 

কিশোরি। আপনি কি দরে লইতে পারেন। 

নাখোদা। তুমি টাকা লইবে কিরূপে? 

কিশোরি। টাকা নগদ। এমন কি আপনি যখন চাউল মাপ করিয়া লইবেন, সেই সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে টাকা মিটাইয়া দিতে হইবে। টাকা মিটাইয়া না দিলে আপনি চাউল স্থানান্তরিত করিতে পারিবেন না। 

নাখোদা। আর এক দিবসে যদি সমস্ত চাউল মাপ করিয়া লইতে না পারি? 

কিশোরি। তাহা হইলে যত পরিমাণে মাপ করিয়া লইতে সমর্থ হইবেন, তাহারই মূল্য প্রদান করিয়া আপনাকে উহা স্থানান্তরিত করিতে হইবে। 

নাখোদা। এরূপভাবে যদি টাকা লও, তাহা হইলে আমি ঐ দরে এই চাউল খরিদ করিতে পারি না। 

কিশোরি। আপনি কত দরে উহা গ্রহণ করিতে পারেন? 

নাখোদা। আমি পারি দু টাকা বারো আনায় গ্রহণ করিতে। 

কিশোরি। তাহা হইলে অনেক লোকসান দিতে হয়। 

নাখোদা। আমি আপনাকে লোকসান দিতে বলিতেছি না। আপনি আপনার দ্রব্য এখন বিক্রয় না করিয়া অনায়াসেই রাখিয়া দিতে পারেন। 

কিশোরি। এখন রাখিয়া দিবার আমার সম্পূর্ণরূপ ইচ্ছা ছিল, কিন্তু আপনাকে বলিতে কি, কতকগুলি টাকার হঠাৎ বিশেষ প্রয়োজন হওয়ায়, বাধ্য হইয়া আমাকে উহা বিক্রয় করিতে হইতেছে। আপনি আর কিছু দর বাড়াইয়া দিন। 

নাখোদা। উহার উপর আমি আর একটি পয়সাও অধিক দিতে পারিব না। 

কিশোরি। আচ্ছা, তাহাই হইল, কিন্তু আমার একটি অনুরোধ আপনাকে রক্ষা করিতে হইবে। 

নাখোদা। কি? 

কিশোরি। আপনি ঐ চাউল আমার নিকট হইতে যে কি দরে খরিদ করিবেন, তাহা কাহারও নিকট যাহাতে প্রকাশ না হয়, তাহা কিন্তু আপনাকে করিতে হইবে। 

নাখোদা। তাহা হইতে পারে, আমি কি দরে খরিদ করিতেছি, তাহা কাহাকেও কহিব না। 

কিশোরি। তাহা হইলে আমি আপনার দরে স্বীকার করিলাম। 

নাখোদা। কোন সময়ে আপনি চাউলের মাপ দিবেন? 

কিশোরি। কল্য দিবা ৯টার সময়। 

নাখোদা। তাহা হইলে আমাকে কোথায় গমন করিতে হইবে? 

কিশোরি। আমার আড়তে গমন করিলেই পাইবেন। না হয় কল্য প্রাতে আমি আসিয়া আপনাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইব। কারণ এ মাল আমার নিজের আড়তে নাই, স্থানাভাব বশতঃ অপর আর একটি আড়তে রাখিয়া দিয়াছি। 

নাখোদা। আচ্ছা, তাহাই হইবে। 

নাখোদার সহিত এইরূপ বন্দোবস্ত করিয়া পরদিবস অতি প্রত্যূষে কিশোরিলাল সেই চাউলের আড়তে গমন করিয়া, ফি মণ দু টাকা তেরো আনা দশ পয়সা মূল্যে সহস্ৰ মণ চাউল খরিদ করিবার সমস্ত বন্দোবস্ত করিয়া, সেই ‘নাখোদার নিকট গমন করিলে, ও তাঁহাকে ও তাঁহার লোকজনকে সঙ্গে আনিয়া ঐ চাউলের ওজন আরম্ভ করিয়া দিল। দিবা ৪টার মধ্যেই সহস্ৰ মণ চাউল মাপ শেষ হইয়া গেলে, নাখোদা কিশোরিলালকে ২৭৫০ টাকা প্রদানপূর্ব্বক সমস্ত চাউল লইয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। 

কিশোরিলাল ঐ ২৭৫০টাকা ও নিজ হইতে তিরানব্বই টাকা বারো আনা সেই চাউলের মহাজনকে দিয়া আসিল। স্থূলকথা এই হাজার মণ চাউল বিক্রয় করিয়া কিশোরিলালকে তিরানব্বই টাকা বারো আনা দণ্ড দিতে হইল। সে যে এতগুলি টাকা নিরর্থক কেন লোকসান করিল, তাহার কারণ পাঠকগণ পরিশেষে অবগত হইতে পারিবেন। 

যে আড়ত হইতে কিশোরিলাল চাউল খরিদ করিল, সেই আড়তদার কিশোরিলালের ব্যবহারে অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন। 

ইহার দুই দিবস পরে কিশোরিলাল আর একজন মহাজন স্থির করিয়া পূর্ব্বোক্তরূপ উপায়ে তাঁহার নিকট দুই সহস্ৰ মণ চাউল বিক্রয় করিল। এবার কিশোরিলাল ফি মণে দু আনা অর্থাৎ ২৫০ টাকা লোকসান দিল। যাহার নিকট কিশোরিলাল চাউল বিক্রয় করিল, তাহার নিকট হইতে চাউলের দাম আদায় করিয়া লইয়া সেই চাউল লইয়া যাইতে দিল, কিশোরি যে আড়ত হইতে চাউল লইয়াছিল, এবার কিন্তু তাঁহাকে সেই টাকা যথাস্থানে প্রদান না করিয়া, তাহার নব-প্রতিষ্ঠিত আড়তে পাঠাইয়া টাকা আনিতে কহিল। আড়তদার তাহার কথায় সম্মত হইয়া সেই দিবস সন্ধ্যার পর, তাহার আড়তে লোক পাঠাইয়া দিলেন। সেই লোক সেইস্থানে উপস্থিত হইবামাত্র কিশোরিলাল সমস্ত টাকা তাহাকে একেবারে প্রদান করিল। 

ইহার কয়েক দিবস পরে কিশোরিলাল পুনরায় সেই আড়তে গমন করিয়া একেবারে ৩০০০ তিন হাজার মণ চাউল বায়না করিল। সর্ব্বপ্রথমে যে নাখোদা তাহার নিকট হইতে চাউল খরিদ করিয়া লইয়াছিলেন, এবারও তাহার নিকট ঐ সকল চাউল চারি আনা কম মূল্যে বিক্রয় করিয়া ফেলিল। নাখোদা পূর্ব্বকথিতরূপে চাউল লইয়া সেই সময়েই তাহার সমস্ত মূল্য প্রদান করিল। কিশোরিলাল কি আড়তদারকে সেই টাকা না দিয়া, তাহার একখানি হাতচিঠায় ঐ সকল চাউল ও তাহার মূল্য তুলিয়া দিয়া সন্ধ্যার পর ঐ হাতচিঠার সহিত তাঁহার আড়তে লোক পাঠাইতে বলিল। 

ইতিপূর্ব্বে আড়তদার যেরূপভাবে লোক পাঠাইয়া দিয়াছিলেন, সেই দিবসও সেইরূপ ভাবে একজন লোক পাঠাইয়া দিলেন। কিন্তু কিশোরিলাল সেই দিবস একটি টাকাও তাহাকে প্রদান না করিয়া ঐ লোকের দ্বারা বলিয়া দিল, তাহার নিকট কত চাউলের দরুণ কত পাওনা আছে তাহার একটি দস্তুরমত ফদ প্রস্তুত করিয়া, ঐ ফৰ্দ্দে আড়তদার মহাশয়ের নাম সহি করিয়া যখন আগমন করিবে, তখনই সমস্ত পাওনা অর্থ প্রাপ্ত হইবে। 

কিশোরিলালের কথা শুনিয়া কাজেই সেই লোক সেই সময় সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল, ও তাহার কথিতমত একটি ফর্দ প্রস্তুত করিয়া আনিয়া পর দিবস তাহার হস্তে প্রদান করিল। 

কিশোরিলাল ফদখানি গ্রহণ করিল, কিন্তু সে দিবসও টাকা প্রদান করিল না। একটি ওজর করিয়া তাহাকে বিদায় করিয়া দিল। এরূপে ক্রমে দিন অতিবাহিত হইতে লাগিল। তাগাদায় লোক আসিলে প্রায়ই তাহার সহিত সাক্ষাৎ হইত না, যে দিবস সাক্ষাৎ হইত, সেই দিবসও কোন না কোন রূপ ওজর করিয়া উহাকে বিদায় করিয়া দিত। 

এইরূপে প্রায় একমাস কাটিয়া গেল। যখন আড়তদার বেশ বুঝিতে পারিলেন যে, সহজে তাঁহার টাকা প্রদান করিতে কিশোরিলালের ইচ্ছা নাই, তখন তিনি নিজে গিয়া এক দিবস তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। সেই দিবস কিশোরিলাল তাঁহাকে স্পষ্টই কহিল যে, নানারূপে তাহার অনেকগুলি টাকা লোকসান হইয়া গিয়াছে, সুতরাং এখন কোনরূপেই তাহাকে টাকা প্রদান করিতে পারিতেছে না। এরূপ অবস্থায় যদি তিনি ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে দেওয়ানি আদালতে তিনি অনায়াসেই তাহার নামে নালিশ করিতে পারেন। 

কিশোরিলালের এই কথা শুনিয়া আড়তদার একেবারে আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া পড়িলেন, দেওয়ানি আদালতে তাহার নামে নালিশ করিয়াই বা তিনি কি করিবেন। কারণ, কিশোরিলালের এরূপ কোন দ্রব্যই ছিল না, যাহা বিক্রয় করিয়া লইলে তাঁহার অত টাকা আদায় হইতে পারে। 

কিশোরিলালের এই জুয়াচুরির বিষয় তিনি প্রথম পুলিশে, ও পরিশেষে মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট গিয়া জানাইলেন, কিন্তু তাহার কিছুই করিয়া উঠিতে পারিলেন না। সকলেই কহিলেন, কিশোরিলাল যে জুয়াচুরি করিয়া এতগুলি টাকা হস্তগত করিয়াছে, সে সম্বন্ধে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই, কিন্তু ঐ জুয়াচুরি কার্য্য সে এরূপ চতুরতার সহিত সম্পন্ন করিয়াছে যে, দেওয়ানি আদালত ভিন্ন ফৌজদারি আদালতে তাহার কিছুই হইতে পারে না। 

এইরূপ উপায়ে জুয়াচুরি করিয়া কেবলমাত্র ঐ আড়তদারের নিকট হইতেই যে কিশোরিলাল এতগুলি টাকা সংগ্রহই করিয়া লইল, তাহ নহে। পরিশেষে জানিতে পারা গিয়াছিল, এইরূপ উপায়ে সে আরও কয়েকজন মহাজনের নিকট হইতে আরও অনেক টাকা সংগ্রহ করিয়াছিল। কোন কোন স্থানের দ্রব্য সকল খরিদ করিবার সঙ্গে সঙ্গে কম মূল্যে উহা বিক্রয় করিয়া ফেলে, ও কোন কোন মহাজনের নিকট হইতে ঐরূপ উপায়ে কাপড়, চিনি, মিছরি প্রভৃতি নানারূপ দ্রব্য গ্রহণ করিয়া, মিথ্যা নামে ঐ সকল দ্রব্য রেলযোগে অপর স্থানে প্রেরণ করে, ও পরিশেষে সেই সকল স্থানে গমন করিয়া, অল্প মূল্যে ঐ সকল দ্রব্য বিক্রয়পূর্ব্বক অর্থের সংস্থান করিয়া আপনার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে। 

কিশোরিলাল এইরূপ উপায়ে অনেক মহাজনকে ফাঁকি দিয়াছিল সত্য, কিন্তু একজন চিনি ব্যবসায়ীকে সে একেবারে ফাঁকি দিতে পারে নাই। ঐ চিনি ব্যবসায়ীর সহিত জনৈক প্রসিদ্ধ ডিটেকটিভ কর্মচারীর পরিচয় ছিল। তিনি আসিয়া তাঁহার সেই পরিচিত ডিটেকটিভ কৰ্ম্মচারীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তাঁহাকে কহিলেন, “মহাশয়! আপনার সহিত এত আলাপ থাকিতে আমি জুয়াচোর কর্তৃক প্রতারিত হইতে বসিয়াছি, ইহা কি কম দুঃখের বিষয়।”

ডিটেকটিভ কৰ্ম্মচারী। কেন, কি হইয়াছে? 

চিনি ব্যবসায়ী। আমি জুয়াচোরের হাতে পড়িয়াছি। 

ডিঃ ক। জুয়াচোরের হস্তে, কে সে জুয়াচোর? 

চি ব্যব। কিশোরিলাল নামক এক ব্যক্তি। 

ডিঃ ক। কোন কিশোরিলাল? সম্প্রতি যে কিশোরিলাল জুয়াচুরি আড়ত খুলিয়া অনেক মহাজনের সর্ব্বনাশ করিয়াছে? 

চি ব্যব। হাঁ সেই। 

ডিঃ ক। সে তোমাকে কি বলিয়া ঠকাইল, ও কত টাকা লইয়া গেল। 

চি ব্যা। আমাকে অধিক ঠকাইতে পারে নাই, আমার নিকট হইতে কেবলমাত্র ১ গাড়ি চিনি যাহার ওজন ২০ মোণ, তাহাই লইয়া গিয়াছে। 

ডিঃ ক। সেই এক গাড়ি চিনির মূল্য কত টাকা? 

চি ব্যব। অধিক নহে, প্রায় একশত টাকা হইবে। 

ডিঃ ক। তোমার নিকট হইতে সে কিরূপে ঐ চিনি লইয়া গেল? 

চি ব্যব। এক দিবস সে আমার নিকট আসিয়া এক গাড়ি চিনি খরিদ করে, কিন্তু সেই সময় চিনির টাকা আমাকে প্রদান করিয়া চিনি লইয়া যায় না। তাহার সহিত এই কথা থাকে, যে গাড়োয়ান চিনি বহন করিয়া লইয়া যাইবে, সেই গাড়োয়ান মারফতে সে ঐ চিনির দাম প্রদান করিবে। এই প্রস্তাবে আমি সম্মত হইয়া, আমার পরিচিত একজন গাড়োয়ানের সমভিব্যাহারে আমি ঐ চিনি পাঠাইয়া দিই, কিশোরিলালও সেই গাড়ির সহিত গমন করে। রথতলা ঘাটে যে ষ্টীমার ষ্টেশন আছে, সেইস্থানে ঐ চিনি রাখিয়া দিয়া, আমার গাড়োয়ানকে সঙ্গে করিয়া সে তাহার নিজের আড়তে লইয়া যায়, ও সেইস্থান হইতে আমার চিনির সমস্ত মূল্য সেই গাড়োয়ানের হস্তে প্রদান করে। 

এই ঘটনার দুই দিবস পরে পুনরায় কিশোরিলাল আমার দোকানে আগমন করে ও আর এক গাড়ি চিনি খরিদ করিয়া লইয়া যায়। এবার আর গাড়োয়ানের সমভিব্যাহারে ঐ চিনির মূল্য দিতে চাহে না; এবার বলিয়া যায়, সন্ধ্যারপরে, তাহার আড়তে লোক পাঠাইয়া দিয়া যেন ঐ চিনির মূল্য আনা হয়। সে একে আড়তদার, তাহার উপর তাহার আড়তও আমার লোক দেখিয়া আসিয়াছে, বিশেষ ইতিপূর্ব্বে একগাড়ি চিনির দাম সে গাড়োয়ান মারফতে প্রদানও করিয়াছিল, এই সকল নানা কারণে আমরা তাহার কথায় বিশ্বাস করিয়া, তাহার প্রস্তাবে সম্মত হই। কিশোরিলাল চিনি লইয়া প্রস্থান করে, এবং সন্ধ্যার পরে তাহার আড়তে লোক পাঠাইয়া দিই, কিন্তু তাহার সহিত আর সাক্ষাৎ হয় না এইরূপে দুই তিনি দিবস তাহার অনুসন্ধান করি, কিন্তু কোন স্থানেই আর তাহাকে দেখিতে পাই না। পরে জানিতে পারি, আমার নিকট হইতে সে যেরূপে একগাড়ি চিনি লইয়া গিয়াছিল, সেইরূপে আরও অনেক লোকের নিকট হইতে সে অনেক দ্রব্য গ্রহণ করিয়া, কাহাকেও কিছু না দিয়া কলিকাতা পরিত্যাগ পূর্ব্বক পলায়ন করিয়াছে। 

ডিঃ কে। যেরূপ উপায়ে কিশোরিলাল তোমার নিকট হইতে চিনি লইয়া গিয়াছে, তাহাতে তুমি তাহার উপর কোনরূপেই ফৌজদারী মকদ্দমা আনিতে পার না? তোমাকে দেওয়ানী আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করিতে হইবে। 

চি ব্যব। তাহাতো আমি অবগত আছি, কিন্তু আপনার নিকট আমি আসিলাম কেন? আমাকে এমন কোনরূপ পরামর্শ প্রদান করুন, যাহাতে আমি উহার উপর ফৌজদারী মকদ্দমা আনিতে পারি। সে এইরূপে জুয়াচুরি করিতে আরম্ভ করিয়াছে, তাহাকে কোন গতিকে ফৌজদারী মকদ্দমায় ফেলিতে না পারিলে, তাহাকে কোনরূপে জব্দ করিতে পারিব না। দেওয়ানী মকদ্দমায় উহার আর কি হইবে। 

ডিঃ ক। তুমি মিথ্যা হলপ করিতে পারিবে? 

চি ব্যব। দুষ্টকে দমন করিবার নিমিত্ত মিথ্যা বলিলে কোন পাপ নাই। 

ডিঃ ক। আর আমি মিথ্যা বলিবার নিমিত্ত যে পরামর্শ প্রদান করিব, তাহাতে আমার পাপ হইবে না? 

চি ব্যর। দুষ্টকে দমন করাই আপনাদিগের কার্য্য, সেই দুষ্ট দমন করিবার নিমিত্ত পরামর্শ দিলে আপনার পাপ হইবে কেন? 

ডিঃ ক। সে বিচার আমি এখন করিতে চাহি না, এখন তোমাকে কি প্রকৃতই মিথ্যা মকদ্দমার পরামর্শ দিতে হইবে? 

চি ব্যব। পরামর্শের নিমিত্তই আমি আপনার নিকট আগমন করিয়াছি। 

ডিঃ ক। আমা অপেক্ষা যাহারা ভাল পরামর্শ প্রদান করিতে পারেন, এরূপ কোন লোকের নিকট গমন করিলে না কেন? 

চি ব্যব। এরূপ লোক আর কে আছে? 

ডিঃ ক। যাহারা আইন ব্যবসায়ী উকিল। 

চি ব্যব। দুই তিন জন উকিলের নিকট আমি পরামর্শের নিমিত্ত গমন করিয়াছিলাম, তাঁহারা কহেন, কোনরূপেই কিশোরিলালের নামে ফৌজদারী মকদ্দমা হইতে পারে না, যেরূপ অবস্থায় সে চিনি লইয়া গিয়াছে, তাহাতে তাহার উপর কোনরূপ মিথ্যা মকদ্দমা সাজাইবারও উপায় নাই। 

ডিঃ ক। ইচ্ছা করিলে এজগতে না হইতে পারে, এমন কোন কাৰ্য্যই নাই। আচ্ছা, আমি তোমার এক উপায় বলিয়া দিতেছি, উকিলের সহিত পরামর্শ করিয়া দেখিও যে এখন তাঁহারা কি বলেন। 

চি ব্যব। কি উপায়? 

ডিঃ ক। আগে আমাকে সমস্ত কথা ভাল করিয়া শুনিতে দেও, তাহার পরে উপায় বলিয়া দিতেছি। 

চি ব্যব। কি জানিতে চাহেন? 

ডিঃ ক। যে এক গাড়ি চিনি কিশোরিলাল সৰ্ব্বশেষে লইয়া গিয়াছে, সেই চিনি তোমার পরিচিত কোন গাড়োয়ান বহন করিয়া লইয়া গিয়াছিল কি? 

চি ব্যব। আমার কারখানার একজন গাড়োয়ান ঐ চিনি বহন করিয়া লইয়া গিয়াছিল। 

ডিঃ ক। তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিয়াছ কি, সেই চিনি সে কোথায় রাখিয়া আসিয়াছে? 

চি ব্যব। পূর্ব্বে যেস্থানে রাখিয়া আসিয়াছিল, এবারও সেইস্থানে রাখিয়া আসিয়াছে। 

ডিঃ ক। রথতলার ঘাটের সেই ষ্টীমার ষ্টেসনে? 

চি ব্যব। হাঁ। 

ডিঃ ক। সেইস্থান হইতে ঐ চিনি কোথায় গেল। 

চি ব্যব। তাহাও আমি জানিতে পারিয়াছি, আমার ঐ চিনির সহিত আরও কতকগুলি দ্রব্য, সে ষ্টীমারে, বরিশাল জেলার অন্তর্গত একস্থানে প্রেরণ করিয়াছে। 

ডিঃ ক। তোমার ঐ চিনিই যে সে পাঠাইয়াছে, তাহা তুমি জানিলে কি প্রকারে? 

চি ব্যব। যে বস্তা সহিত আমার চিনি আসিয়াছিল, সেই বস্তা সহিত কিশোরিলাল উহা খরিদ করিয়া লইয়া যায়, ও সেই বস্তা সহিতই উহা বরিশালে পাঠাইয়া দিয়াছে। 

ডিঃ ক। সেই বস্তা দেখিলে তুমি চিনিতে পারিবে? 

চি ব্যব। কেন পারিব না, সেই বস্তার উপর আমার নাম লেখা আছে। 

ডিঃ ক। তোমার ঐ চিনি কোথা হইতে আসিয়াছে? 

চি ব্যব। আমি উহা রেলি ব্রাদারে আফিসে খরিদ করিয়াছি। 

ডিঃ ক। কোন তারিখে তুমি উহা খরিদ করিয়াছিলে? 

চি ব্যব। যে তারিখে কিশোরিলাল উহা আমার নিকট হইতে খরিদ করিয়া লইয়া যায়, সেই দিবসই আমি উহা খরিদ করিয়াছিলাম। 

ডিঃ ক। তুমিও কি এক গাড়ি চিনি খরিদ করিয়া আনিয়াছিলে? 

চি ব্যব। না। আমি একশত মণ খরিদ করি, ও পাঁচখানি গাড়ি করিয়া উহা আমার দোকানে লইয়া আসি। ডিঃ ক। ঐ পাঁচ গাড়ি মাল গাড়িতে কে বোঝাই দিয়াছিল? 

চি ব্যব। আমারই একজন বিশ্বাস। 

ডিঃ ক। সে তোমার বশীভূত লোক? 

চি ব্যব। খুব বশীভূত। 

ডিঃ ক। তাহাকে যাহা বলিতে বলিবে, সে তাহা বলিবে? 

চি ব্যব। কেন বলিবে না? আমি তাহাকে যাহা বলিতে বলিব, সে তাহাই বলিবে। 

ডিঃ ক। তাহা হইলে সে তোমার নিমিত্ত মিথ্যা কথা বলিতে প্রস্তুত আছে? 

চি ব্যব। আছে। 

ডিঃ ক। সে যে পাঁচখানি গাড়িতে করিয়া চিনি পাঠাইয়া দিয়াছিল, সেই সকল গাড়ির নম্বর সে রাখিয়াছিল কি? চি ব্যব। তাহা তাহার খাতায় লেখা আছে। 

ডিঃ ক। চিনি ও অপরাপর দ্রব্য যাহা বরিশালে পাঠান হইয়াছে, তাহা কে পাঠাইয়াছে? 

চি ব্যব। কিশোরিলাল নিজে পাঠাইয়াছে। 

ডিঃ ক। তাহার নিজ নামে পাঠাইয়াছে? 

চি ব্যব। হাঁ। 

ডিঃ ক। ইহা তুমি বেশ করিয়া জানিয়াছ? 

চি ব্যব। না জানিয়াই কি আপনাকে বলিতেছি। 

ডিঃ ক। যে পাঁচখানি গাড়িতে করিয়া তোমার বিশ্বাস তোমার দোকানে চিনি পাঠাইয়া দিয়াছিল, সেই সকল গাড়ির নম্বর সে তাহার খাতায় লিখিয়া রাখিয়াছে, এই কথা তুমি এখনই বলিলে না? 

চি ব্যব। হাঁ। 

ডিঃ ক। ঐ সকল গাড়োয়ানের নাম তাহার খাতায় লেখা আছে। 

চি ব্যব। না, নাম লেখা নাই, কেবল গাড়ির নম্বর লেখা আছে মাত্ৰ। 

ডিঃ ক। তাহা হইলে এক কার্য্য করিও, তোমার বিশ্বাসের খাতায় ঐ পাঁচ গাড়ির যে নম্বর লেখা আছে, তাহার একটি নম্বর একটু ইতর বিশেষ করিয়া দিও, অর্থাৎ যদি নম্বর থাকে ৭২৫, তাহা হইলে সুবিধা বুঝিয়া হয়, ১৭২৫, বা 2725, কিম্বা ৭২৫০, অথবা ৭২৫১ প্রভৃতি এইরূপে একটি হরপ যোগ করিয়া দিও। এইরূপ একখানি গাড়ির নম্বর এইরূপে পরিবর্তন করিয়া দিয়া, তুমি উকিলের নিকট গিয়া কহিও, “তোমার বিশ্বাস রেলি ব্রাদারের গুদাম হইতে পাঁচ গাড়ি চিনি তোমার দোকানে পাঠাইয়া দিয়াছিল, তাহার মধ্যে ৪ গাড়ি দোকানে পৌছিয়াছে, কিন্তু এক গাড়ি অর্থাৎ পরিবর্তিত নম্বরের ১ গাড়ি তোমার দোকানে আসিয়া উপস্থিত হয় নাই। অনুসন্ধানে ঐ গাড়ির গাড়োয়ান যে কে ছিল, তাহা জানিতে পারি নাই, কিন্তু ইহা জানিতে পারা গিয়াছে যে আমার ঐ এক গাড়ি চিনি কিশোরিলাল, রথতলা ঘাট হইতে ষ্টীমারযোগে বরিশালে পাঠাইয়া দিয়াছে। এখন আপনি বিবেচনা করিয়া দেখুন যে, কিরূপ মকদ্দমা এখন উপস্থিত হইতে পারে?” 

উকিলের নিকট এই কথা বলিলে তিনি কিরূপ পরামর্শ দেন তাহা যেন আমি জানিতে পারি। 

ডিটেক্‌টিভ পুলিস কর্মচারীর এই পরামর্শ শুনিয়া চিনি ব্যবসায়ী গমন করিলেন। তিন দিবস আর তাঁহার কোনরূপ সন্ধান পাওয়া গেল না, তিন দিবস পরে আসিয়া তিনি সেই ডিটেকটিভ কর্ম্মচারীর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। ডিটেকটিভ কৰ্ম্মচারী তাঁহাকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি তোমার উকিলের নিকট গমন করিয়াছিলে কি?” 

চি ব্যব। করিয়াছিলাম। 

ডিঃ ক। তাঁহাকে সমস্ত কথা বলিয়াছিলে? 

চি ব্যব। বলিয়াছিলাম। 

ডিঃ ক। তিনি সমস্ত কথা শুনিয়া কি বলিলেন? 

চি ব্যব। বিশেষ কিছুই বলিলেন না, একটু হাসিলেন মাত্র, ও পরিশেষে আমাকে সঙ্গে লইয়া একটি থানায় গমন করিলেন। 

ডঃ ক। থানায় গিয়া তিনি কি করিলেন? 

চি ব্যব। আমি তাঁহাকে যেরূপ বলিয়াছিলাম, তিনিও থানার কর্ম্মচারীর নিকট তাহাই বলিলেন। এই কথা শুনিয়া থানার কর্ম্মচারী আর কোন কথা কহিলেন না। একটি নালিস লিখিয়া তাহার অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। আমরা গাড়ির নম্বর দিয়াছিলাম ১৫২৫১, ঐ নম্বরের কোন গাড়িই পাওয়া গেল না। সকলে বুঝিতে পারিলেন, গাড়োযান মিথ্যা নম্বর লিখিয়া দিয়াছে; সুতরাং গাড়োয়ানের নামে আর কিছু হইল না। পুলিস কর্ম্মচারী দণ্ডবিধি আইনের ৪০৭ ও ৪১১ ধারা মতে এই মকদ্দমা মেজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট প্রেরণ করিলেন। সেইস্থান হইতে কিশোরীলালের নামে এক গ্রেপ্তারি ওয়ারেন্ট বাহির হইয়াছে, ও বরিশালের পুলিসের উপর এক আদেশ গিয়াছে যে, যে ষ্টীমারে ঐ চিনি পাঠাইয়া দেওয়া হইয়াছে, ঐ ষ্টীমার সেইস্থানে পৌঁছিলে, ঐ চিনি ক্রোক করিয়া কলিকাতায় যেন পাঠাইয়া দেওয়া হয়। 

ডিঃ ক। তাহা হইলে এখন তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইয়াছে। 

চি ব্যব। সে আপনার কৃপায়। 

ইহার পর বরিসালের পুলিস ঐ চিনি কলিকাতায় পাঠাইয়া দেন ও চিনি ব্যবসায়ী ফরিয়াদী ঐ চিনি হন; কিন্তু অদ্যাবধি কিশোরিলাল ধৃত হয় নাই, জেলে গমন করিবার ভয়ে সে এখন পর্যন্ত নিরুদ্দেশ। 

ফেল হইয়া জুয়াচুরি 

কলিকাতার দোকানদার, আড়তদার ও কলওয়ালাগণের মধ্যে এক ভয়ানক জুয়াচুরি চলিয়া আসিতেছে। এই জুয়াচুরির বিষয় অনেকেই অবগত আছেন। অনেকেই ঠকিতেছেন, তথাপি প্রতীকার হইতেছে না, কারণ উহার প্রতীকারের উপায় একরূপ নাই। অপরকে বিশ্বাস করিতে না পারিলে, ব্যবসা কার্য্য একেবারেই চলিতে পারে না, সুতরাং সকলকেই বিশ্বাস করিতে গিয়া, কাহার কাহার নিকট উত্তমরূপে প্রবঞ্চিত হইতে হয়। কিরূপ উপায়ে এই সকল জুয়াচুরি চলিয়া আসিতেছে, তাহার একটি দৃষ্টান্ত এইস্থানে বর্ণিত হইলেই পাঠকগণ ইহার অবস্থা একরূপ বুঝিতে পারিবেন। 

প্রায় দুই বৎসর অতীত হইল, যখন আমি বটতলা থানার ভারপ্রাপ্ত কৰ্ম্মচারী ছিলাম, সেই সময় এক রাত্রিতে আমি কেবল একজনমাত্র প্রহরী সঙ্গে লইযা রাউণ্ডে বাহির হইয়াছি, আপনার এলাকার অনেক স্থান ঘুরিয়া যখন কালিপ্রসাদ দত্তের গলির নিকটবর্ত্তী একটি স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলাম, তখন রাত্রি প্রায় ৩টা। সেই সময় দেখিতে পাইলাম, একটি বাড়ী যাহা অনেক দিবস হইতে খালি ছিল, ও যাহার সদর দরজায় সদাসাদা বাহির হইতে তালা বদ্ধ থাকিত, তাহা উন্মুক্ত অবস্থায় রহিয়াছে। ও ঐ বাড়ীর সম্মুখে প্রায় ১৫/২০ খানি গরুর গাড়ি রহিয়াছে; তাহার কোন গাড়ি খালি, কোন গাড়ি হইতে গম বোঝাই বস্তা সকল মুটিয়াগণ উঠাইয়া সেই বাড়ীর মধ্যে লইয়া যাইতেছে, কোন কোন গাড়িতে এখনও বস্তা সকল রহিয়াছে। 

এই অবস্থা দেখিয়া আমি গাড়োয়ানদিগকে জিজ্ঞাসা করিলাম, এই সকল গম কাহার? 

উত্তরে একজন কহিল, কাহার তাহা আমরা অবগত নহি। 

আমি। কোথা হইতে তোমরা এই সকল গম এখানে লইয়া আসিলে? 

গাড়োয়ান। একটি স্থান হইতে, ঐ স্থানের নাম আমার জানি না; কিন্তু যদি চাহেন, তাহা হইলে দেখাইয়া দিতে পারি। 

আমি। কাহার মাল তোমরা জান না বলিতেছ, কিন্তু তোমাদিগের গাড়ির ভাড়া তোমাদিগকে কে দিবে? 

গাড়োয়ান। তাহাও জানি না। আমরা আসিতেছি আমাদিগের চৌধুরীর নিকট হইতে। 

আমি। তোমাদিগের চৌধুরী কোথায়? 

গাড়োয়ান। সে এখানে নাই। 

আমি। এঘরের তালা তোমাদিগকে কে খুলিয়া দিল! 

গাড়োয়ান। তাহাও জানি না, আমরা যখন এখানে আসি। তখন এই ঘরের তালা খোলা ছিল। 

আমি। যে মুটিয়াগণ এই গমের বস্তা তুলিতেছে, তাহারা বলিতে পারিবে কি, এত দ্রব্য এখানে কে লইয়া আসিয়াছে? 

গাড়োয়ান। তাহা আমরা বলিতে পারি না, আপনি ইহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেই অবগত হইতে পারিবেন। এই বলিয়া সেই গাড়োয়ান একজন মুটিয়াকে আমার নিকট ডাকিয়া দিল। 

আমি। তোমরা কাহার গম এই বাড়ীতে উঠাইতেছ? 

মুটিয়া। জানি না। 

আমি। তোমাদিগকে এই বাড়ী দেখাইয়া দিয়াছে কে? 

মুটিয়া। একজন দরয়ান। 

আমি। সে দরয়ান কোথায়? 

মুটিয়া। সে এখনই চলিয়া গিয়াছে। 

আমি। কোথায় গিয়াছে? 

মুটিয়া তাহা জানি না। 

আমি। সেই দরয়ান আর এখানে আসিবে কি? 

মুটিয়া। তাহা কিছু বলিয়া যায় নাই। 

আমি। সে যদি না আসিবে, তাহা হইলে তোমাদিগের পারিশ্রমিক তোমাদিগকে কে দিবে? 

মুটিয়া। তাহা বলিতে পারি না। আমাদিগের পারিশ্রমিক আমাদিগের সর্দ্দারের নিকট হইতে আমরা পাইব।

আমি। তোমাদিগের সর্দ্দার কোথায়? 

মুটিয়া। সে এখানে নাই; সে আছে, তাহার নিজ বাড়ীতে। 

গাড়োয়ান ও মুটিয়াকে এই কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করিয়া, আমি সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। কিন্তু মনে মনে আমার একরূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল, এত রাত্রিতে গলির মধ্যস্থিত খালি বাড়ীতে এত গম কে রাখিতেছে? আর সেই বা এত গম কোথা হইতে পাইল? যদি ইহা তাহার নিজের মাল হইবে, তাহা হইলে সে এত রাত্রিতে, এরূপভাবে ঐ সকল গম আনিবে কেন? 

মনে মনে এইরূপ ইতস্ততঃ করিয়া, এক ঘণ্টা পরে পুনরায় আমি সেইস্থানে প্রত্যাগমন করিলাম। এবার কিন্তু সেইস্থানে কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না; না আছে গাড়ি, না আছে মুটিয়া। ঐ বাড়ীর সদর দরজায় যেরূপভাবে তালাবদ্ধ থাকিত, ঠিক সেইরূপ ভাবেই ঐ বাড়ীর তালাবদ্ধ রহিয়াছে। 

এইরূপ অবস্থা দেখিয়া, আমার মনে বেশ বিশ্বাস জন্মিল, যে ঐ সকল গম কোন স্থান হইতে অপহৃত হইয়া ঐ বাড়ীতে লুক্কায়িতভাবে রক্ষিত হইয়াছে। 

এই বিশ্বাসের উপর নির্ভর করিয়া, আমি সেই বাড়ীর দরজার উপর একটি পাহারা রাখিয়া দিলাম; তাহার উপর আদেশ রহিল, কোন ব্যক্তি ঐ বাড়ীর দরজা খুলিয়া ঐ সকল দ্রব্য আমার বিনা অনুমতিতে লইয়া প্রস্থান করিতে না পারে। আরও আদেশ রহিল, যে কোন ব্যক্তি ঐ বাড়ী হইতে দ্রব্য সকল বাহির করিয়া লইয়া যাইবার নিমিত্ত সেইস্থানে গমন করিবে, তাহাকে যেন তাহার নিকট লইয়া আসা হয়। 

প্রহরী সেই আদেশের উপর নির্ভর করিয়া সত্ত্বর সেইস্থানে পাহারা দিতে লাগিল। 

আমি যাহা দেখিয়াছিলাম, ও যেরূপ সন্দেহের আঁচ করিয়া আমি সেইস্থানে একজন প্রহরী নিযুক্ত করিলাম তাহার সমস্ত অবস্থা নিয়মিতরূপ ডায়রিতে লিখিয়া আমার ঊর্দ্ধর্তন কর্মচারীর নিকট প্রেরণ করিলাম। 

এক দিবস গত হইয়া গেল, কিন্তু আর কোন কথাই জানিতে পারিলাম না। 

দ্বিতীয় দিবস সন্ধ্যার পূর্ব্বে একজন উকিল আসিয়া আমার নিকট উপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে আমি পূৰ্ব্ব হইতে চিনিতাম, তিনিও আমাকে উত্তমরূপে জানিতেন। আমার সহিত তাঁহার দেখা হইলে, তিনি যেরূপভাবে কথাবাৰ্ত্তা কহিতেন, আজ কিন্তু প্রথমেই তাহার বিপরীতভাব দেখিতে পাইলাম। আমি আমার আফিসের বাহিরে বসিয়া আছি, তাহা তিনি দেখিয়াও যেন দেখিলেন না, দ্রুতপদবিক্ষেপে আফিসের ভিতর গমন করিলেন। আমিও তাঁহাকে কিছু বলিলাম না। আফিসের ভিতর একজন নিম্নপদস্থ কৰ্ম্মচারী সেই সময় বসিয়া কি লেখাপড়া করিতেছিল, সেই 

কর্মচারী বাঙ্গালী। উকিল বাবুটিও বাঙ্গালী ব্রাহ্মণ। সেই কৰ্ম্মচারীকে দেখিবামাত্রই কি কারণে জানি না, তিনি বাঙ্গলা কথা ভুলিয়া গিয়া, বাঙ্গলা মিশ্রিত হিন্দিভাষায় তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমাদিগের ইনস্পেক্টর কোথায়? কর্ম্মচারী তাঁহার কথায় কোনরূপ উত্তর প্রদান না করিয়া, আমি যেখানে বসিয়াছিলাম অঙ্গুলিনিৰ্দ্দেশপূর্ব্বক তাহাই তাঁহাকে দেখাইয়া দিল। 

উকিলবাবু আমার নিকট আগমন করিলেন। আমি আফিসের সম্মুখস্থিত রোয়াকের উপর একটি মাদুর বিছাইয়া বসিয়াছিলাম; তিনি আমার নিকট আগমন করিলে আমি তাঁহাকে বসিতে বলিলাম; কিন্তু তিনি রোয়াকে সেই মাদুরের উপর বসা অবমান বিবেচনা করিয়া, সেইস্থানে বসিলেন না; আমার সম্মুখে গিয়া দণ্ডায়মান হইলেন। আমি বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি যে, উকিল বাবুর পরিধানে কোনরূপ “উকিলী” পরিচ্ছদ ছিল না, ধুতি চাদর পরিয়াই তিনি আমার নিকট আগমন করিয়াছিলেন। 

উকিলবাবু আমার নিকট আসিয়াও বাঙ্গলা কথা কহিলেন না, এবার ইংরাজীভাষায় আমার সহিত কথা কহিতে আরম্ভ করিলেন। আমার নিকট হইতে তিনি যে উত্তরপ্রাপ্ত হইলেন, তাহা কিন্তু বাঙ্গলা ভাষায়। 

উকিল। আপনি বিশেষ অন্যায় কার্য্য করিয়াছেন। 

আমি। কি? 

উকিল। আপনি অবৈধরূপে আমার মক্কেলের কতকগুলি দ্রব্য আটক করিয়া রাখিয়াছেন; আপনি জানেন যে, ইহাতে আপনার উপর নালিশ করিতে পারি। 

আমি। কি জিনিস আমি অবৈধরূপে আটক করিয়া রাখিয়াছি? 

উকিল। কতকগুলি ময়দা, গম প্রভৃতি। 

আমি। কোথায় আমি উহা আটক করিয়াছি? 

উকিল। একটি গুদামে। 

আমি। গুদাম, না খালি বাড়ীতে? আমি কিরূপে উহা আটক করিয়াছি? 

উকিল। সেই বাড়ীর উপর পাহারা দিয়া। 

আমি। যদি আমি অবৈধরূপে আপনার মক্কেলের দ্রব্যাদি আটক করি তাহা হইলে তাঁহাকে আমার নামে নালিস করিতে কহিবেন। আপনার মক্কেল কে? কাহার জিনিস আমি আটক করিয়াছি? 

উকিল। আমি আমার মক্কেলের নাম আপনার নিকট বলিব না। 

আমি। তিনি চোর, সুতরাং চোরের নাম আপনি বলিবেন কিরূপে? এ সম্বন্ধে আমিও আপনাকে আর কোন কথা বলিতে ইচ্ছা করি না; এখন আপনি স্থানান্তরে গমন করিতে পারেন। 

এই বলিয়া আমি সেইস্থান হইতে উঠিয়া স্থানান্তরে গমন করিলাম। উকিল মহাশয় এখন বুঝিতে পারিলেন, তাঁহার নিজের ব্যবহারে তাঁহার নিজেরই ক্ষতি হইল; তিনি তখন সেই মাদুরের উপর উপবেশন করিয়া কিয়ৎক্ষণ কি ভাবিলেন, ও পরিশেষে সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়া একটু দূরে আসিয়া একখানি গাড়িতে আরোহণ করিলেন। ঐ গাড়ির ভিতর আর একজন লোক ছিল, তাঁহার সহিত কি কি কথা বলিলেন ও পরিশেষে উভয়েই সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। 

রাত্রি ১২টার সময় আমার একজন পরিচিত লোক আসিয়া থানায় উপস্থিত হইলেন, তাঁহার সহিত অপর আর এক ব্যক্তি ছিলেন। সেই পরিচিত ব্যক্তির সহিত সাক্ষাৎ হইলে, আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, এত রাত্রিতে আপনি কি মনে করিয়া আগমন করিয়াছেন? 

পরিচিত। আমার সমভিব্যাহারী এক ব্যক্তি একটু বিপদে পড়িয়াছেন, তাই আমি আপনার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। 

আমি। কিরূপ বিপদে পড়িয়াছেন? 

পরিচিত। আপনি ইহার অনেকগুলি দ্রব্য আটক করিয়া রাখিয়াছেন। 

আমি। গম-প্রভৃতি? 

পরিচিত। হাঁ। 

আমি। তাহা কি ইঁহার? 

পরিচিত। হাঁ। 

আমি। তাহা হইলে, এরূপভাবে উহা ঐ স্থানে রাখা হইল কেন?

পরিচিত। তাহার কারণ আছে। 

আমি। সমস্ত অবস্থা যদি আমাকে স্পষ্ট করিয়া বলেন, তাহা হইলে আমি ঐ সকল দ্রব্য ইহাকে প্রদান করিতে পারিব কি না, তাহা বলিতে পারি; সমস্ত অবস্থা না জানিয়া কোন কথা বলা যাইতে পারে না। 

পরিচিত। আমি সমস্ত কথা আপনাকে স্পষ্ট করিয়া বলিতেছি। ইহার একটি ময়দার কল আছে, গত দুই বৎসর পৰ্য্যন্ত ব্যবসায় সুবিধা না হওয়ায়, ইঁহার অনেকগুলি টাকা লোকসান হইয়াছে, ও অনেক মহাজনের নিকট ইনি ঋণগ্রস্ত হইয়াছেন। ইঁহার কলের মূল্য যত হইবে, তাহাতে সমস্ত দেনা পরিশোধ হইবার উপায় নাই। নিজের মূলধনের তো কথাই না। এরূপ অবস্থায় যদি ইনি ঐ কল বিক্রয় করিয়া দেন, তাহ হইলে, কল্য যে ইনি কি খাইবেন তাহার ঠিকানা নাই; সুতরাং দায়ে ঠেকিয়া মহাজনগণ গম প্রভৃতি দেনায় পরাঙ্মুখ নহে; গত কয়েক দিবস হইতে ইনি বিস্তর গম দেনায় খরিদ করিয়াছেন, কিন্তু তাহার সমস্ত বিক্রয় করিয়া উঠিতে পারেন নাই। ইঁহার ইচ্ছা এই গমগুলি আত্মসাৎ করিয়া, তাহার পর ফেল হইবেন। ফেল হইলে ইঁহার যত টাকা দেনা দাঁড়াইবে, তাহা পরিশোধ করিবার নিমিত্ত কল বিক্রয় হইয়া যাইবে; ও ঐ কল বিক্রয়ের টাকা হইতে অংশমত সমস্ত পাওনাদারকে দিয়া তিনি ঋণ হইতে মুক্তি পাইবেন। এদিকে গমগুলি গুপ্তভাবে বিক্রয় করিয়া ইনি যাহা পাইবেন, সেই অর্থ ইঁহার থাকিবে। গমগুলি বিক্রয় হইয়া যাইবার পূর্ব্বে মহাজনগণ যদি ঐ সকল গমের অনুসন্ধান পান, তাহা হইলে উহাও ঐ কলের সামিল হইয়া বিক্রয় হইয়া যাইবে। 

এই নিমিত্ত পূর্ব্বকথিতরূপে জুয়াচুরি করিবার আশায় ইনি যে সকল গম খরিদ করিয়াছিলেন; তাহার সমস্তই কল হইতে রাত্রিকালে স্থানান্তরিত করিয়া তিনটি বাড়ীতে লুকাইয়া রাখিয়াছেন; দুইস্থানে কোনরূপ গোলযোগ হয় নাই, কেবল আপনার এলাকার মধ্যে যে বাড়ীটি লওয়া হইয়াছিল, তাহাতে গম রাখিবার কালীন আপনি জানিতে পারিয়া, উহার উপর পাহারা দিয়াছেন। মহাজনগণ যদি এই সংবাদ জানিতে পারেন, তাহা হইলে ঐ সকল গমের একটিও ইঁহার হস্তগত হইবে না। এখন আপনি অনুগ্রহ করিয়া মহাজনদিগের জানিবার পূর্ব্বে যদি ঐ গমগুলি ছাড়িয়া দেন তাহা হইলে ইহাকে ক্ষতিগ্রস্ত হইতে হয় না। ইহার জিনিস এখন আপনার যাহ। ভাল বিবেচনা করেন তাহাই করুন। 

এই অবস্থা শুনিয়া আমি মনে জানিলাম, ইঁহারা যাহা বলিতেছেন, তাহা প্রকৃত বলিয়া বোধ হইতেছে। আর এরূপ অবস্থায় ঐ সকল দ্রব্য আটক করিয়া রাখা উচিত নহে, কারণ ইহা ফৌজদারীর মধ্যে কোনরূপেই আইসে না; ইহা দেওয়ানীর অন্তর্ভূত; — এই সমস্ত বিষয় আমার উপরিতন কর্মচারীর গোচর করিবামাত্রই তিনি ঐ স্থানের পাহারা উঠাইয়া লইতে যে অনুমতি প্রদান করিবেন, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমি তাঁহাকে কহিলাম, “আপনার উকিল আমার উপর যে নালিশ করিতে চাহিয়াছিলেন, তাহা না করিয়া ইঁহাকে সঙ্গে লইয়া পুনরায় আমার নিকট আগমন করিলেন কেন?” 

উত্তরে তিনি কহিলেন, “এই কাৰ্য্য আমি উকিলের দ্বারা সম্পন্ন করিয়া লইব বলিয়া তাঁহাকে আপনার নিকট প্রেরণ করিয়াছিলাম; কিন্তু তিনি এইরূপ ভাবে যে কার্য্য নষ্ট করিয়া দিবেন, তাহা আমার মনে ছিল না; সে যাহা হউক, সে সম্বন্ধে আপনি কোন কথা মনে করিবেন না। উকিল বাবু তাঁহার নিজের ব্যবহারে তিনি পরিশেষে পরিতাপ করিয়াছেন ও আপনার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিবার নিমিত্ত তিনি আমাদিগের সহিত আগমনও করিয়াছেন; তিনি আমাদিগের গাড়িতে বসিয়া আছেন, আমি এখনই তাঁহাকে সম্মুখে আনয়ন করিতেছি,” এই বলিয়া তিনি আবার গমন করিলেন, দেখিতে দেখিতে উকিল বাবু সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। এবার কিন্তু উকিল বাবুর সে উগ্রমূৰ্ত্তি পাইলাম না, তাঁহার সেই হিন্দি ও ইংরাজী কথাও আর শুনিতে পাইলাম না। তাঁহার অবস্থার কথা তিনি নিজেই উল্লেখ করিয়া সবিশেষ দুঃখপ্রকাশ করিলেন। 

উপরিতন কর্মচারীর আদেশ অনুসারে ঐ স্থানের পাহারা আমি উঠাইয়া লইলাম; তিনিও তাহার গম সকল পর রাত্রিতে সেইস্থান হইতে অপর আর একস্থানে উঠাইয়া লইয়া গেলেন। 

এইরূপভাবে ফেল হইয়া কলিকাতা সহরের মধ্যে যে কত জুয়াচুরি হইতেছে, তাহার সংখ্যা করা সহজ নহে। 

[ফাল্গুন, ১৩০৬] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *