শহুরে মেয়ে

সহুরে মেয়ে 

(অর্থাৎ কলিকাতা নিবাসী জনৈক বালিকার অদ্ভুত রহস্য!) 

প্রথম পরিচ্ছেদ

এক দিবস প্রত্যুষে সংবাদ পাইলাম, একটি ভদ্র পল্লীর অধিবাসী জনৈক বিশিষ্ট ভদ্রলোক, তাঁহার স্ত্রীকে হত্যা করিয়া ধৃত হইয়াছেন। এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের ভার আমার উপর অর্পিত না হইলেও, নিতান্ত কৌতূহলের বশবৰ্ত্তী হইয়া, আমি সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম! 

সেই স্থানে উপনীত হইয়া দেখিতে পাইলাম, হত্যাকারী পুলিসের হস্তে বন্দী। যিনি হত হইয়াছেন, তাঁহার মৃতদেহ রক্তাক্ত কলেবরে এখনও তাঁহার শয্যাগৃহের মধ্যে পতিত রহিয়াছে। তাঁহার নাম বিনোদিনী। বিনোদিনী যাঁহার স্ত্রী বা যাঁহা কর্তৃক তিনি হতা হইয়াছেন, তাঁহার প্রকৃত নাম গোপন করিয়া, আমরা তাঁহাকে রাসবিহারী নামে অভিহিত করিলাম। 

রাসবিহারী, এই মহানগরীর মধ্যে সুপরিচিত ও ধনগৌরবে গৌরবানন্বিত জনৈক বিশিষ্ট ব্যক্তির পুত্র। এদিকে রাসবিহারীও নিতান্ত অশিক্ষিত ছিলেন না, প্রেসিডেন্সি কলেজে বি-এ, পর্য্যন্ত লেখাপড়া শিখিয়াছিলেন। যে সময় রাসবিহারী বি-এ, ক্লাসে অধ্যয়ন করেন, সেই সময় পর্যন্ত তিনি অবিবাহিত ছিলেন। তাঁহার পিতার ইচ্ছা ছিল যে, বি-এ পাস না করিলে, তিনি পুত্রের বিবাহের সম্বন্ধ স্থির করিবেন না; কারণ একে বড় মানুষের পুত্রের লেখাপড়া হয় না, তাহার উপর পাঠাভ্যাসের সময় তাঁহাকে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করিয়া দিলে, লেখাপড়া শিখিবার সামান্য আশা থাকিলেও, সে আশা একবারে নির্মূল হইয়া যায়। এই প্রকার অনেক রূপ ভাবিয়া চিন্তিয়া, রাসবিহারীবাবুর পিতা তাঁহার বিবাহের কোন কথা একবারে উল্লেখই করেন না। কন্যা-ভার-পীড়িত কোন ব্যক্তি আসিয়া যদি তাঁহার নিকট রাসবিহারীর বিবাহের কথা পাড়িতেন, “বি-এ, পাস হইলে আপনি আসিবেন” এইরূপ বলিয়া তিনি তাঁহাকে বিদায় করিয়া দিতেন। পুত্রের বিবাহ দিতে রাসবিহারীর মাতার আন্তরিক ইচ্ছা থাকিলেও, স্বামীর ভয়ে তিনি সে কথা সম্পূর্ণ রূপে প্রকাশ করিয়া উঠিতে পারিতেন না। তথাপি পাকে-প্রকারে যদি তাঁহাকে কোন কথা বলিতেন, তিনি অন্য কথা পাড়িয়া সে কথা একেবারেই উড়াইয়া দিতেন। এইরূপে কিছু দিবস অতিবাহিত হইলে, রাসবিহারীর বি-এ, পরীক্ষা দিবার সময় আসিয়া উপস্থিত হইল; কিন্তু তিনি পরীক্ষা দিতে সমর্থ হইলেন না। পিতা জিজ্ঞাসা করিলে কহিলেন, “এবার আমি প্রস্তুত হইতে পারি নাই, আগামী বৎসর যাহাতে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইতে পারি, বৎসরের প্রথম হইতেই তাহার চেষ্টা করিব।” বলা বাহুল্য, রাসবিহারীর সে চেষ্টা আর করিতে হইল না, ক্রমে কলেজ পরিত্যাগ করিয়া তিনি বাড়ীতে আসিয়া বসিলেন। 

পিতা যখন দেখিলেন যে, তাঁহার পুত্রের লেখাপড়া শেষ হইয়াছে, তখন তাহাকে বিনা কার্য্যে বাড়ীতে স্থিরভাবে বসাইয়া রাখা কর্তব্য নহে; কারণ বিনা কার্য্যে অলসভাবে বসিয়া থাকিলে মনের গতি কুপথে ধাবিত হইবার সম্ভাবনা। এই ভাবিয়া তিনি পুত্রকে কোনরূপ বিষয় কার্য্যে নিযুক্ত করিতে মনস্থ করিলেন। অর্থ উপার্জ্জন করিয়া সংসারের সাহায্য করিবে, এই উদ্দেশে তিনি পুত্রের নিমিত্ত কোনরূপ কার্য্যের যে অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন, তাহা নহে। 

রাসবিহারীর পিতা যে সময়ে তাহার নিমিত্ত কোন একটি কার্য্যের অনুসন্ধান করিতেছিলেন, সেই সময়ে কোন সওদাগরি আফিসে ৫০ টাকা বেতনে একটি কর্ম্ম খালি হয়। রাসবিহারীবাবুর পিতার সওদাগরি মহলেও একটু নাম ছিল, তিনি পুত্রের নিমিত্ত সেই চাকরির চেষ্টা করিতেই তাঁহার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। রাসবিহারী সেই ৫০ টাকা বেতনে উক্ত সওদাগরি আফিসে কর্ম্ম করিতে প্রবৃত্ত হন। রাসবিহারী যেমন হউক একটু লেখা পড়া শিখিয়াছিলেন; নূতন 

কার্য্যে ব্রতী হইয়া তিনি বিশেষ মনোযোগের সহিত আপন কার্য্য নির্ব্বাহ করিতে থাকেন। হারাধন নামক এক ব্যক্তি রাসবিহারীর উপরিতন পদে নিযুক্ত ছিলেন, তাঁহার বেতন ছিল ৭৫ টাকা। হারাধন রাসবিহারীর উপরিতন কর্ম্মচারী হইলেও রাসবিহারীর সহিত তিনি বিশেষরূপ বন্ধুভাব প্রকাশ করিতে লাগিলেন। হারাধনের উপর আর একজন কৰ্ম্মচারী ছিলেন, তাঁহার বেতন ছিল ১০০ টাকা। হঠাৎ তাঁহার মৃত্যু হওয়ায় সেই পদ শূন্য হয়। হিসাব মত দেখিতে গেলে হারাধনের সেই পদ প্রাপ্ত হইবার আশা ছিল; কিন্তু কার্য্যে তাহা ঘটিল না। আফিসের সাহেবেরা 

রাসবিহারীকে একটু ভাল বাসিতেন বলিয়া, হারাধনকে অতিক্রম পূর্ব্বক রাসবিহারীকেই সেই কার্য্যে নিযুক্ত করিলেন। এই কার্য্যের নিমিত্ত হারাধন রাসবিহারীর উপর আন্তরিক চটিয়া গেলেন। কিসে তাঁহার সর্ব্বনাশ সাধন করিতে পারেন, মনে মনে কেবল তাহারই চিন্তা দেখিতে লাগিলেন। কিন্তু প্রকাশ্যে তাঁহার মনের ভাব কোনরূপ প্রকাশ না করিয়া, বাহিরে আরও বন্ধুত্বের ভান করিয়া, রাসবিহারীর সহিত সকল কার্য্যে মিলিতে লাগিলেন। 

যে সময় রাসবিহারী সওদাগরি আফিসে কার্য্য করিতেন, সেই সময় বিনোদিনীর সহিত রাসবিহারীর বিবাহ হয়। এই বিবাহে একটু বিশেষ গোলযোগও উপস্থিত হইয়াছিল। বিনোদিনীর পিতা এই বিবাহ প্রথমতঃ হারাধনের সহিত স্থির করেন। হারাধনের বয়ঃক্রম রাসবিহারীর অপেক্ষা যে নিতান্ত অধিক ছিল, তাহা নহে। বিনোদিনীর পিতা ও হারাধনের পিতা উভয়ে এই বিবাহ একরূপ স্থির করিয়া ফেলেন; দেনা পাওনার কথা সমস্ত মিটিয়া যায়, কেবল বাকী থাকে কন্যাটি দেখা। হারাধন তাঁহার বিবাহের কথা শুনিয়া, ইতিপূৰ্ব্বে কোন গতিকে তাঁহার পিতাকে বলিয়াছিলেন যে, তিনি নিজে না দেখিয়া বিবাহ করিবেন না। তাঁহার পিতাও ইহাতে সম্মত হইলে, প্রথমতঃ বিবাহের সমস্ত কথা স্থির করিয়া, পরিশেষে বিনোদিনীকে দেখিবার নিমিত্ত হারাধনকে বলিলেন; এবং একটি দিনও স্থির করিয়া দেন। ঐ স্থিরীকৃত দিবসে হারাধন তাঁহার কয়েকটি বন্ধু বান্ধবের সহিত বিনোদিনীকে দেখিতে যান। যে সকল বন্ধু তাঁহার সহিত গমন করিয়াছিলেন, তাহার মধ্যে রাসবিহারীও একজন ছিলেন। 

এদেশীয় প্রথা অনুসারে কন্যা দেখান হয়, বিনোদিনীর পিতা বিনোদিনীকে আনিয়া সর্ব্বসমক্ষে উপস্থিত করেন। হারাধন ও তাঁহার বন্ধুগণ সেই সময় বিনোদিনীকে উত্তম রূপে দেখিয়া লন। বিনোদিনী কুরূপা ছিলেন না, সুরূপাই ছিলেন; কিন্তু তাঁহার পিতার অবস্থা খুব ভাল না থাকায়, তিনি এ পর্যন্ত আপন কন্যার বিবাহ দিয়া উঠিতে পারেন নাই। সুতরাং বিনোদিনী বিবাহের বয়ঃক্রম অতিক্রম করিয়াছিলেন, এখন তাঁহার বয়ঃক্রম দ্বাদশ বৎসরের কম নহে। হিন্দুর ঘরে এত বড় কন্যা প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায় না; কিন্তু অর্থ না থাকিলে হিন্দু-ললনার আজকাল সহজে বিবাহ হওয়া যে কিরূপ কঠিন, তাহা হিন্দুমাত্রেই অবগত আছেন। হারাধনের পিতার অবস্থা নিতান্ত মন্দ ছিল না, অথচ হারাধনের বিবাহের বয়ঃক্রমও প্রায় অতীত হইতে বসিয়াছিল, তাহাতে কন্যাটি সুশ্রী ও তাঁহাদিগের স্বঘরের দেখিয়া তিনি অর্থের বিশেষ রূপ লাভ না করিয়াই এই বিবাহে সম্মতি প্রদান করিয়াছিলেন। 

বিনোদিনীকে দেখিয়া হারাধনেরও মন টলিল। উহার সহিত যাহাতে তাঁহার বিবাহ হয়, সেইরূপ ইচ্ছা তিনি প্রকাশ করিলেন; সুতরাং এ বিবাহে আর কাহারও অনভিমত রহিল না। বিবাহের দিন স্থির হইল, কন্যাকৰ্ত্তা, ও বরকর্তা উভয়েই বিবাহের উদ্যোগ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। 

রাসবিহারী অবিবাহিত। তিনি তাঁহার বন্ধুর নিমিত্ত কন্যা দেখিতে গিয়াছিলেন, কন্যাও তাঁহাকে দেখিয়াছিল। রাসবিহারীর পিতা ও বিনোদিনীর পিতা স্বজাতি হইলেও, সামাজিক নিয়মে রাসবিহারীর পিতা একটু হীন ছিলেন। কিন্তু তাঁহার অর্থ যথেষ্ট ছিল। হিন্দু-সমাজে কেবল অর্থ থাকিলেই হয় না, সামাজিক মান্যও চাই; এই কারণে রাসবিহারীর পিতা সাহস করিয়া বিনোদিনীর পিতাকে এই বিবাহের কথা কখন বলিতে সাহসী হন নাই। বিনোদিনী বয়ঃস্থা ও সুরূপা, ইহা জানিয়াও রাসবিহারীর পিতা অন্যস্থানে রাসবিহারীর বিবাহের সম্বন্ধ করিতেছিলেন। এদিকে রাসবিহারী বিনোদিনীকে দেখিয়া নিতান্ত যে মোহিত হইলেন; ভাবিলেন, বিনোদিনীর সহিত তাঁহার যদি বিবাহ হইত, তাহা হইলে তিনি সুখী হইতে পারিতেন। 

কলিকাতার স্ত্রীলোকগণ নিতান্ত বেহায়া, একথা পল্লীগ্রামবাসী মাত্রেই কহিয়া থাকেন। তাঁহাদিগের সেই কথা যে একবারে ভ্রমপূর্ণ, তাহা নহে। যাঁহারা কলিকাতাবাসীগণের সহিত কোনরূপ বিশেষ সম্বন্ধে মিলিত হইয়াছেন, তাঁহারাই একথা স্বীকার করিবেন। যে সকল বালিকা কলিকাতায় জন্মগ্রহণ করিয়াছে, ও লেখাপড়া শিখিবার নিমিত্ত যাহারা বাল্যকালে স্কুলে গমনাগমন করিয়াছে, সেই সকল বালিকার অবস্থা আরও ভয়ানক। যে সকল বিষয় পল্লীগ্রামের বালিকাগণের সম্মুখে উপস্থিত হইল, তাহারা লজ্জায় সেইস্থান পরিত্যাগ করে, সেই সকল বিষয় সহরের বালিকাগণের কর্ণগোচর হইলে তাহারা তাহা লইয়া আপন গুরুজনের সম্মুখে তাহার ভাল মন্দ বিচার করিতে আরম্ভ করে। এরূপ বালিকার দৃষ্টান্ত এই মহানগরীতে সহস্ৰ সহস্ৰ দেখিতে পাওয়া যায়। বিনোদিনীও তাহাদের একজন। 

হারাধনের সহিত বিনোদিনীর বিবাহ স্থির হইয়া গেলে, বিনোদিনী নিতান্ত লজ্জাহীনা হইয়া তাহার পিতাকে এক পত্র লিখিল। ঐ পত্র পাঠ করিয়া তাহার পিতার সর্ব্বশরীর জ্বলিতে লাগিল। ঐ পত্রে লেখা ছিল, “আমি জানিতে পারিলাম যে, হারাধন নামক জনৈক ব্যক্তির সহিত আমার পরিণয় হইবে। আমি এই বিবাহে সম্মত নহি। হারাধনের সহিত আমার বিবাহ স্থির করিবেন না। যদি আমার বিবাহ দিতে চাহেন, তাহা হইলে রাসবিহারীবাবুর সহিত যাহাতে আমার বিবাহ হইতে পারে, তাহার বন্দোবস্ত করুন। অপর কাহারও সহিত আমি বিবাহিত হইব না। অপরের সহিত যদি আপনি আমার বিবাহের স্থির করেন, তাহা হইলে হয় আমি আত্মহত্যা করিব, না হয় আপনার বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া অপর স্থানে চলিয়া যাইব। ইহাই বিবেচনা করিয়া আপনি যেরূপ ভাল বুঝিবেন, সেইরূপ করিবেন।” 

বিনোদিনীর পত্র পাঠ করিয়া তাহার পিতার সর্ব্বশরীর জ্বলিয়া গেল। পাশ্চাত্য সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু- বালিকাগণ যে চরম দশায় উপনীত হইয়াছে, তাহা এখন তিনি বেশ বুঝিতে পারিলেন। কিন্তু এখন যে তাঁহার কি করা কর্তব্য, তাহা তিনি ভাবিয়া চিন্তিয়া কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলেন না। মনে করিলেন, তাঁহার কন্যা যাহা বলে বলুক, তাহার কথায় কর্ণপাত করা কর্তব্য নহে। আবার ভাবিলেন, যে কন্যা লজ্জার মস্তকে পদাঘাত করিয়া তাঁহাকে অনায়াসে লিখিতে পারে যে, সে বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইবে, সে পাপীয়সী না পারে এমন কাৰ্য্যই নাই, সে অনায়াসেই কুল পরিত্যাগ করিতে পারে। ভদ্রঘরের কন্যা কুলের বাহির হইয়া যাওয়া অপেক্ষা একটু নীচ ঘরে বিবাহ দেওয়া ভাল। মনে মনে তিনি এইরূপ নানা প্রকার চিন্তা করিয়া তাঁহার সহধর্মিণীকে সমস্ত কথা কহিলেন। উত্তরে তিনি কহিলেন যে, হতভাগিনী লজ্জার মাথা খাইয়া একথা ইতিপূর্ব্বে তাঁহাকেও বলিয়াছিল, কিন্তু লোক-লজ্জা-ভয়ে একথা তিনি কাহারও নিকট প্রকাশ করেন নাই; অথচ বিনোদিনীকে তিনি এ সম্বন্ধে অনেক কথা বলিয়াছেন। সে যখন হিন্দুর ঘরে জন্মিয়াছে, তখন তাহার ইচ্ছায় কোন কৰ্ম্ম হইতে পারে না, একথা তাহাকে বার বার বলিয়াছেন। কিন্তু হতভাগিনী কিছুতেই তাঁহার কথায় সম্মত হয় নাই; অথচ তাহার মাতার মুখের উপর বলিয়াছে যে, যদি তাহার ইচ্ছামত কার্য্য করা না হয়, তাহা হইলে সে বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া বেশ্যাবৃত্তি করিতে প্রস্তুত, তথাপি সে অপর কাহাকেও বিবাহ করিবে না। 

স্ত্রীর কথা শুনিয়া বিনোদিনীর পিতা একবারে অন্ধকার দেখিলেন। ক্রোধে তাঁহার সর্ব্বশরীর কাঁপিতে লাগিল। কিন্তু কি করেন, বয়ঃস্থা কন্যাকে না পারেন বাড়ী হইতে বাহির করিয়া দিতে, না পারেন তাহার শরীরে হস্তপ্রদান করিতে। এরূপ অবস্থায় তিনি বিশেষ বিপদে পড়িলেন। বিনোদিনীকে তাঁহার সম্মুখে ডাকাইলেন, তাহাকে মিষ্ট কথায় অনেক করিয়া বুঝাইলেন ও পরিশেষে রাগভাব প্রকাশ করিয়া তাহাকে গালাগালি প্রভৃতি দিতেও ত্রুটি করিলেন না। কিন্তু বিনোদিনী কিছুতেই তাঁহার কথায় কর্ণপাত করিল না, অধিকন্তু সম্মুখে দাঁড়াইয়া অবলীলাক্রমে তাহার মনের ভাব তাহার পিতার নিকট বলিতে লাগিল। সেই সময় তাঁহার মুখে লজ্জার রেখামাত্রও দৃষ্টিগোচর হইল না। 

কন্যার এই অবস্থা দেখিয়া, পিতা তাহাকে আর কোন কথা কহিলেন না, সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। যাইবার সময় কেবল এইমাত্র বলিয়া গেলেন, “যদি আমি ব্রাহ্মণ হই, ব্রহ্ম অংশে যদি আমার জন্ম হইয়া থাকে, তাহা হইলে দেখিস্ আমার কথা অবহেলা করিবার নিমিত্ত তোর কিরূপ কষ্ট ও দুর্গতি হয়। তুই যাহার জন্য এখন এতদূর লালায়িত হইয়াছিস্, দেখিবি তাহাকে লইয়া তুই কখন সুখী হইতে পারিবি না। তোর পরিণাম আমিও দেখিব, অপরেও দেখিবে।” 

বিনোদিনী পিতার সমস্ত কথাগুলি স্থিরভাবে শ্রবণ করিল; কিন্তু কোনরূপ উত্তর না করিয়া সেইস্থান হইতে ধীরে ধীরে চলিয়া গেল। 

বিনোদিনীর পিতা তাঁহার স্ত্রীর সহিত পরামর্শ করিয়া, পরিশেষে রাসবিহারীর পিতার নিকট গমন করিলেন, ও আপন মনের ভাব তাঁহার নিকট প্রকাশ করিলেন। রাসবিহারীর পিতার এ সম্বন্ধে আন্তরিক ইচ্ছা ছিল, সুতরাং এই প্রস্তাব তাঁহার নিকট উত্থাপিত হইতে না হইতেই, তিনি বিশেষ আগ্রহের সহিত ইহাতে সম্মত হইলেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই দিবসই সমস্ত কথাবার্তা শেষ হইয়া গেল, বিবাহের দিন স্থির হইল। 

হারাধনের পিতা যখন এই সংবাদ অবগত হইতে পারিলেন, সেই সময় হইতে তাঁহার আর ক্ষোভের পরিসীমা রহিল না, তিনি নিতান্ত মর্মাহত হইলেন। হারাধন এই সংবাদে যে কেবল মাত্র দুঃখিত হইলেন, তাহা নহে; সেইদিন হইতে তিনি রাসবিহারীর প্রবল শত্রুরূপে আরও পরিগণিত হইলেন। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

রাসবিহারী কিন্তু হারাধনের মনের ভাব কিছুমাত্র অবগত হইতে পারিলেন না। তিনি পূর্ব্ব হইতে তাহার সহিত যেরূপ ব্যবহার করিয়া আসিতেছিলেন, সেইরূপ ভাবেই চলিতে লাগিলেন; অধিকন্তু, হারাধন তাহার নিম্নপদস্থ কৰ্ম্মচারী হইলেও যাহাতে তিনি সর্ব্বদা তাহার উপর সন্তুষ্ট থাকেন, সেইরূপ ভাবে হারাধনের সহিত ব্যবহার করিতে লাগিলেন। কারণ তিনি মনে জানিতেন যে, হারাধন যাহার সহিত পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হইতেছিলেন, তিনিই তাঁহার সেই পথে কণ্টক-ক্ষেপণ করিয়াছেন। তিনি যদি বিনোদিনীকে বিবাহ করিতে না চাহিতেন, তাহা হইলে বিনোদিনীর আন্তরিক ইচ্ছা সত্ত্বেও কি তিনি রাসবিহারীকে বিবাহ করিতে সমর্থ হইতেন? বিনোদিনী হিন্দুকন্যা। তাহার পিতা মাতা যদি জানিতে পারিতেন যে, রাসবিহারী এই বিবাহ করিতে কোনরূপেই প্রস্তুত নহেন, তাহা 

হইলে কি তাঁহারা এই বিবাহে হারাধনকে বঞ্চিত করিতে পারিতেন? বিনোদিনীও যখন জানিতে পারিতেন যে, রাসবিহারী তাহাকে বিবাহ করিতে সম্মত নহেন, তখন তাহাকেও তাহার পিতা মাতার মতে মত দিয়া হারাধনের সহিতই যাহাতে বিবাহ হয়, সেইভাবে অভিমত প্রদান করিতে হইত। এই প্রকার নানারূপ মনে মনে সৰ্ব্বদা চিন্তা করিয়া ক্রমে হারাধন রাসবিহারীর বিষম গুপ্তশত্রু রূপে পরিগণিত হইয়া পড়েন। সেই সময় হইতে তিনি প্রতিজ্ঞা করিলেন, যখনই পারেন, তিনি রাসবিহারী ও বিনোদিনীর সর্ব্বনাশ সাধন করিবেন। তিনি মনে মনে বেশ জানিতেন যে, প্রকাশ্য ভাবে শত্রুতা সাধন করিতে হইলে, তাঁহার মনোবাঞ্ছা কোন রূপেই পূর্ণ করিতে পারিবেন না; সুতরাং, সেই দিন হইতে প্রকাশ্যরূপে তিনি রাসবিহারীর সহিত বিশেষ বন্ধুত্ব দেখাইতে আরম্ভ করিলেন। কিন্তু তাহার অন্তরে প্রতিহিংসা প্রবল বেগে জ্বলিতে লাগিল। ইতিপূর্ব্বে হারাধন রাসবিহারীর বাড়ীতে প্রায়ই যাতায়াত করিতেন না; কিন্তু এখন হইতে তিনি সর্ব্বদা রাসবিহারীর বাড়ীতে যাতায়াত আরম্ভ করিলেন, ও দিবা রাত্রি প্রায় সেইস্থানেই অতিবাহিত করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। আফিসে যাইবার পূর্ব্বে তিনি সেইস্থানে গমন করিতেন ও আফিস হইতে আসিবার পরই সেইস্থানে গমন করিতেন ও আফিস হইতে আসিবার পরই সেইস্থানে গিয়া উপনীত হইতেন। কোন কোন দিবস রাসবিহারীর সহিত আফিস হইতেই তাঁহার বাড়ীতে গমন করিয়া রাত্রি নয়টা দশটা পৰ্য্যন্ত অতিবাহিত করিয়া আসিতেন। হারাধনের এই অবস্থা দেখিয়া সকলেই অনুমান করিতে লাগিলেন যে, রাসবিহারী তাঁহার ঊর্দ্ধতন কৰ্ম্মচারী, সেই নিমিত্তই রাসবিহারীকে সন্তুষ্ট রাখিবার মানসে তিনি সর্ব্বদা সেইস্থানে যাতায়াত করিয়া থাকেন। 

রাসবিহারীর বিবাহ হইবার এক মাস কি দুই মাস পরেই হারাধনের বিবাহ হয় : হারাধন যাঁহার সহিত পরিণয়- সূত্রে আবদ্ধ হইয়াছিলেন, তিনি ধনবান ব্যক্তির কন্যা না হইলেও রূপ-গৌরবে তিনি দরিদ্রা ছিলেন না। তাঁহার নাম ছিল গোলাপ; প্রকৃতই তিনি গোলাপ ফুলের ন্যায় মনোহারিণী ছিলেন। বিনোদিনী অপেক্ষা তিনি যে সৰ্ব্ব বিষয়ে সুন্দরী ইহা যে দেখিত, সেই কহিত। 

হারাধন ও গোলাপ পরিণয়-সূত্রে আবদ্ধ হইয়া সংসারধর্ম্মে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন সত্য, কিন্তু উভয়ের মধ্যে যে আস্তরিক মিল হইয়াছিল, তাহা কিন্তু অনুমান হয় না। কারণ হারাধনের প্রকৃতি ও গোলাপের প্রকৃতি সম্পূর্ণরূপে পৃথক্ উপাদানে নির্ম্মিত ছিল। হারাধন মুখে একরূপ বলিতেন, কার্য্যে অন্যরূপ করিতেন। অন্তরে যাহা স্থির করিতেন, প্রকাশ্যে তাহা বলিতেন না। গোলাপের অন্তর ও বাহির সমান ছিল। সে মুখে যাহা বলিত, কাৰ্য্যে তাহা করিত; সত্যকে গোপন করিয়া কখন মিথ্যা কথা কহিত না, সৰ্ব্বদা ধর্ম্মকে সম্মুখে রাখিয়া কাৰ্য্য-ক্ষেত্রে প্রবিষ্ট হইত। সুতরাং কোন বিষয়েই উভয়ে কখন একরূপ মতের অনুবর্ত্তী হইতে পারিতেন না, উভয়েই ভিন্ন ভিন্ন পথ আশ্রয় করিয়া সংসার-কার্য নির্ব্বাহ করিতেন। 

হারাধন যেমন সর্ব্বদা রাসবিহারীর বাড়ীতে গমন করিতেন, গোলাপ কিন্তু সর্ব্বদা সেইরূপ বিনোদিনীর নিকট গমন করিতেন না। তবে কোনরূপ প্রয়োজন হইলে বা সেই স্থানে আহারাদি করিবার নিমন্ত্রণ থাকিলে, তিনিও যেমন রাসবিহারীর বাড়ীতে গমন করিতেন, বিনোদিনীও সেইরূপ তাহার বাড়ীতে আগমন করিতেন। কিন্তু উভয়ের মধ্যে যে কিরূপ প্রণয় ছিল, তাহা কিন্তু আমরা অবগত নহি। 

রাসবিহারীর বাল্যকাল হইতে গোবর্দ্ধন নামক আর একটি বালক রাসবিহারীর পিতা কর্তৃক প্রতিপালিত হইত। রাসবিহারী যেমন লেখা পড়া শিক্ষা করিয়াছিলেন, গোবর্দ্ধন কিন্তু সেইরূপ কিছুই শিক্ষা করিতে পারেন নাই। গোবর্দ্ধনের বয়ঃক্রম রাসবিহারী হইতে ২।৩ বৎসর অল্প ছিল, এবং দেখিতে তিনি রাসবিহারী অপেক্ষা সুশ্রীও ছিলেন। রাসবিহারীর পিতার কোন আত্মীয় তাঁহার পুত্র গোবর্দ্ধনকে শৈশব অবস্থায় রাখিয়া পরলোক গমন করেন। সেই সময় হইতে গোবর্দ্ধন রাসবিহারীর পিতা কর্তৃক লালিত-পালিত হন। গোবৰ্দ্ধনকে লেখাপড়া শিক্ষা দিবার নিমিত্ত রাসবিহারীর পিতা বিশেষরূপ চেষ্টা করিয়াছিলেন; কিন্তু অল্প বয়স হইতেই কু-সংসর্গে পতিত হইয়া ও কুপথগামী বালকগণের পরামর্শ মত চলিয়া, পরিশেষে গোবর্দ্ধনও সেই পথ অবলম্বন করেন, ও ক্রমে লেখাপড়া পরিত্যাগ করিয়া বারবিলাসিনী মহলে রাত্রিদিন পরিভ্রমণ করিতে আরম্ভ করেন। রাসবিহারীর পিতা এই অবস্থা জানিতে পারিয়া পরিশেষে যে আফিসে রাসবিহারী কার্য্য করিতেন, সেইআফিসে ২০ বেতনে একটি কর্ম্ম করিয়া দেন, ও তাঁহাকেও পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ করিয়া দিয়া তাঁহার দায় হইতে নিষ্কৃতি লাভ করেন। ইহার পর হইতেই গোবর্দ্ধন তাহার শ্বশুর বাড়ীতে গিয়া বাস করিতে আরম্ভ করেন। কিন্তু প্রায় সর্ব্ব সময়েই তিনি রাসবিহারীর বাড়ীতে আসিতেন, বাড়ীর ভিতর যেস্থানে ইচ্ছা, সেই স্থানে গমন করিতেন ও যাহার সহিত ইচ্ছা, তাহার সহিত কথাবার্তা কহিতেন। ইহার নিকট বিনোদিনীর কোনরূপ কায়দা ছিল না। গোবর্দ্ধন অনায়াসেই বিনোদিনীর সম্মুখে গমন করিতেন, বিনোদিনীও তাঁহার সম্মুখে বাহির হইতেন, ও তাঁহার সহিত কথাবার্তা কহিতেন। গোবর্দ্ধনের চরিত্র নিতান্ত মন্দ, ইহা সকলে জানিয়াও তাঁহাকে কেহ কিছু কহিতেন না, সকলেই তাঁহাকে বাড়ীর ছেলের ন্যায় দেখিতেন। 

গোবর্দ্ধন ও রাসবিহারী এক আফিসেই কর্ম্ম করিতেন। রাসবিহারীর অধীনে গোবর্দ্ধনকে কর্ম্ম করিতে হইত ও তাঁহার আদেশ গোবর্দ্ধনকে সৰ্ব্বতোভাবে প্রতিপালন করিতে হইত। গোবর্দ্ধনের কার্য্যের দোষ গুণের নিমিত্ত আফিসের সাহেবের নিকট রাসবিহারীকেই দায়ী থাকিতে হইত; সুতরাং রাসবিহারীর ইচ্ছার উপরেই গোবর্দ্ধনের চাকরীও নির্ভর করিত। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

গোবর্দ্ধনের চরিত্র রাসবিহারীর অজ্ঞাত ছিল না। তাঁহার বিপক্ষে যাহা কিছু বলা যাইবে, তাহা রাসবিহারী অনায়াসেই বিশ্বাস করিবেন, এই ভাবিয়া হারাধন তাঁহার মনের অভিলাষ পূর্ণ করিবার পন্থা অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। এক দিন কথায় কথায় গোবর্দ্ধনের কথা পাড়িয়া তাঁহার চরিত্র সম্বন্ধে অনেক কথার আভাষ হারাধন রাসবিহারীর কর্ণগোচর করিলেন। ইহার ভিতর যে সমস্ত কথাই সত্য ছিল, তাহা নহে; একটু সত্যের উপর রাশি রাশি মিথ্যার সমাবেশ করিয়া অথচ স্পষ্ট কোন কথা না বলিয়া প্রকারে তাহার অনেক কথা কর্ণে উঠাইয়া দিলেন। রাসবিহারীর হিত-কামনা করিয়া হারাধন গোবর্দ্ধনের যে সকল কথা তাঁহার কর্ণগোচর করিলেন, তাহাতে রাসবিহারীর হৃদয়ে কেমন যেন একরূপ নূতন ভাবের ছায়া পড়িল। হারাধন পাকে প্রকারে অথচ উপদেশচ্ছলে ফের ফার করিয়া কেমন এক রূপ কহিলেন যে, তাহাতে গোবর্দ্ধনের বাড়ীর ভিতর যাওয়া কোনরূপেই কৰ্ত্তব্য নহে, ও বিনোদিনী যেরূপ ভাবে তাহার সহিত কথাবার্তা কহিয়া থাকেন, তাহাও কোনরূপে কৰ্ত্তব্য নহে, এইরূপ ঠিক হইয়া গেল। 

হারাধনকে রাসবিহারী বিশেষ হিতকারী বলিয়া জানিতেন; সুতরাং, তাঁহার কথাগুলি রাসবিহারীর হৃদয়ের অন্তঃস্থল পৰ্য্যন্ত ক্রমে স্পর্শ করিতে আরম্ভ করিল। সেই সময় তিনি হারাধনকে আর অধিক কোন কথা না বলিয়া আপন কার্য্যে মনঃসংযোগ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন; কিন্তু কার্য্যে আর তাঁহার মন বসিল না, হৃদয়ে নানারূপ চিন্তা আসিয়া ক্রমে তাঁহাকে পাগল করিয়া তুলিতে লাগিল। 

“হারাধন এত দিবস গোবর্দ্ধন সম্বন্ধে কোন কথা না বলিয়া আজ হঠাৎ আমাকে ঐরূপ কথা বলিল কেন? গোবর্দ্ধন আমাদিগের বাড়ীর ভিতর রাত্রি দিন যখন ইচ্ছা, তখনই গমন করিয়া থাকে। আমার বিবাহের পর হইতে সে ত বিনোদিনীর সহিত কথাবার্তা কহিয়া থাকে; কিন্তু, সেই সম্বন্ধে আজ দিবস পৰ্য্যস্ত ত কোন কথা হয় নাই। এখনই বা গোবর্দ্ধনকে বাড়ীর ভিতর যাইতে নিষেধ করে কেন? তবে কোন কথা শুনিয়াছে বা বিনোদিনীর চরিত্র- সম্বন্ধে তাহার মনে কোনরূপ সন্দেহের উদয় হইয়াছে? কেবল মাত্র সামান্য সন্দেহ হইলে সে কি আমার সম্মুখে আমার স্ত্রীর কথা সহসা বলিতে সাহসী হয়? না, কিছু গুরুতর ঘটনাই ঘটিয়া থাকিবে। হারাধন বিশেষরূপ কিছু অবগত হইতে পারিয়াছে বলিয়াই, সে আমাকে এখন হইতে সতর্ক করিয়া দিতেছে। হারাধনের স্ত্রী গোলাপ সময়ে সময়ে আমাদের বাড়ীতে আসিয়া থাকে ও আমার স্ত্রীর সহিত তাহার একটু ভালবাসাও আছে। সেই কি কোন বিষয় জানিয়া বা কোন রূপ ঘটনা দেখিয়া, তাহার স্বামীকে বলিয়া দিয়াছে। নতুবা হঠাৎ হারাধন আমাকে এরূপ কথা বলিবে কেন? এই সকল বিষয় হারাধনকে স্পষ্ট করিয়া জিজ্ঞাসা করা উচিত নয় কি? আর যদি সে কোন বিষয় বিশেষরূপ অবগত হইতেই পারিয়া থাকে, তাহা হইলে সেই কথা সে আমাকে বলিবেই বা কেন? অপ্রীতিকর কথা সহজে কি কেহ কাহাকেও বলিয়া থাকে? বিশেষতঃ, সে আমার একজন বন্ধু ও বিশেষরূপ হিতাকাঙ্ক্ষী। ওরূপ অবস্থায় প্রকৃত কথা কহিলে আমার মনে সহজে কষ্টের উদ্রেক না হইবে কেন? তবে যেটুকু তাহার কর্ত্তব্য, সেইটুকু সে আমাকে বলিয়াছে; আমার যাহাতে ইষ্ট হয়, তাহার নিমিত্ত পৰ্ব্ব হইতেই সে আমাকে সতর্ক করিয়া দিয়াছে। যাহা হউক, হারাধনকে আর একবার জিজ্ঞাসা করিয়া জানিব। দেখিব, সে যদি আরও কোন কথা বলিতে পারে।” 

রাসবিহারীর এই অবস্থা দেখিয়া হারাধন মনে মনে একটু হাসিলেন। ভাবিলেন, তিনি রাসবিহারীকে যে ঔষধ প্রদান করিয়াছেন, তাহার ফল ধরিতে আরম্ভ হইয়াছে। এত দিবস পরে বোধ হয়, তাহার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবার পথ প্রশস্ত হইয়াছে। 

এইরূপে দুই চারি দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। রাসবিহারীও আর কোন কথা হারাধনকে জিজ্ঞাসা করিলেন না, বা জিজ্ঞাসা করিবার উপযুক্ত সময় পাইলেন না। হারাধনও আর তাঁহাকে কোন কথা কহিল না। কিন্তু রাসবিহারীর মন সেই দিবস হইতেই দগ্ধ হইতে লাগিল। তিনি আর কোন রূপেই শান্তিসুখ অনুভব করিতে সমর্থ হইলেন না। এইরূপে আরও দুই এক দিবস গত হইয়া যাইবার পর রাসবিহারী হারাধনকে নির্জ্জনে ডাকিলেন, ও তাহাকে কহিলেন, “হারাধন, আমি তোমাকে আমার বিশেষ বন্ধু বলিয়া জানি, তাহা তুমি বুঝিতে পার কি।” 

হারাধন। তাহা আর আমি বুঝিতে পারি না? আমি কি বালক? আপনি কি আমার কেবল বন্ধু, আপনি আমার অন্নদাতা। আপনার উপর আমার যদি এত অনুগ্রহ না থাকিত, তাহা হইলে আমি কি এত দিবস আমার চাকরী রাখিতে পারিতাম? 

রাসবিহারী। সে যাহা হউক, তুমি সে দিবস আমাকে যে কথা বলিয়াছিলে, তাহা কি? 

হারা। কোন্ কথা? 

রাস। গোবর্দ্ধন সম্বন্ধে। 

হারা। এমন বিশেষ কোন কথা নহে। গোবর্দ্ধনের চরিত্র ভাল নহে, একথা সকলেই বলিয়া থাকে, আমরাও অবগত আছি। তাহাকে বাড়ীর ভিতর এরূপ ভাবে এখন গমনাগমন করিতে দেওয়া কি কৰ্ত্তব্য? তাই আপনাকে বলিতেছিলাম। 

রাস। সে ত বাল্যকাল হইতেই আমাদিগের বাড়ীর ভিতর গমনাগমন করিয়া থাকে। 

হারা। এত দিবস বাড়ীতে গমন করিত, সে কথা স্বতন্ত্র। এখন তোমার ভার্য্যা যুবতী, তাহার নিকট কি ঐরূপ চরিত্রের লোকের গমনাগমন করা কর্তব্য বা তাহার সহিত হাসি ঠাট্টা করা কি এখন আর শোভা পায়? আমরা যেন তোমার চরিত্রের বিষয় অবগত আছি, তাই কোন বিষয়ে সন্দেহ কর না; কিন্তু আর একজন শুনিলে সে কি মনে করিবে? এইরূপে নিরর্থক একটি কলঙ্কের কথা মিথ্যা রটনা হওয়া অপেক্ষা পূৰ্ব্ব হইতে সতর্ক হওয়া কি কৰ্ত্তব্য নহে? তাই আমি আপনাকে ঐ কথা বলিতেছিলাম। আপনার স্ত্রীর চরিত্র খুব ভাল, তাহা আমরা জানি বলিয়াই আপনাকে ঐ কথা বলিয়াছিলাম। 

রাস। আমার স্ত্রী যে গোবর্দ্ধনের সহিত হাসি ঠাট্টা করিয়া থাকে, একথা তুমি কিরূপে জানিতে পারিলে?

হারা। বড় লোকের ঘরের কথা নক্ষত্রবেগে বাহির হইয়া তাকে ও সর্ব্বসাধারণে সেই সকল কথা লইয়া আমোদ আহ্লাদ করিয়া থাকে, ইহা কি আপনি জানেন না? আমরা দরিদ্র লোক, আমরা যদি একটি হত্যাও করিয়া ফেলি, বা অনশনে যদি আমাদিগের জীবন বাহির হইয়া যায়, তাহা হইলেও সে কথা কেহ শুনিয়াও শুনেন না, শুনিলেও তাহার দিকে একবারও ফিরিয়া দেখেন না। কিন্তু বড় লোকের একটি সামান্য কথা যদি কোন গতিকে বাহির হয়, তাহা হইলে উহা কতরূপ আভরণে আভরিত হইয়া মুখে মুখে সর্ব্বত্র বিচরণ করিয়া থাকে, তাহা ত আপনি জানেন। সুতরাং আপনাদিগের ঘরের সামান্য কথা যে কোথায় শুনিলাম, তাহা বোধ হয় আমাকে বলিতে হইবে না। 

রাস। তুমি কি আমার স্ত্রীর চরিত্রের উপর কোনরূপ সন্দেহ কর? 

হারা। আপনার স্ত্রী সতী সাধ্বী, তাঁহার উপর কি কোনরূপে সন্দেহ হইতে পারে? তবে কি জানেন, স্ত্রীলোকের মন অতি সামান্য কারণেই পরিবর্তিত হইয়া পড়ে। তাহার দৃষ্টান্ত স্বরূপ আপনার বিবাহের ঘটনাই কেন মনে করিয়া দেখুন না। আমার সহিত বিনোদিনীর বিবাহ তাঁহার পিতা মাতা কর্তৃক স্থির হইয়া গিয়াছিল; কিন্তু, আমা অপেক্ষা আপনি সুপুরুষ, আপনাকে দেখিয়া তাঁহার মন মোহিত হইয়া গেল, মনের ভাব হঠাৎ পরিবর্ত্তিত হইয়া গেল, যে নিজে জিদ করিয়া তাঁহার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিয়া আপনাকে তাঁহার স্বামিত্বে বরণ করিলেন। যাঁহার মনের গতি এইরূপ, যিনি একজনকে দেখিয়া মোহিত হইয়া পিতা মাতার আদেশ পর্যন্ত লঙ্ঘন করিতে পারেন, তিনি আপনার অপেক্ষা অপর কোন সুশ্রী যুবককে দেখিয়া তিনি তাহার উপর আসক্তা হইতে পারেন না, তাহা কি কখন অনুমান করা যায়? আপনি আমার বিশেষ বন্ধু বলিয়াই, আপনাকে আমি এত কথা কহিলাম; নতুবা, এরূপ অনধিকার- চর্চ্চায় আমার কোন রূপ প্রয়োজন ছিল না। 

রাস। তুমি আমাকে পূর্ব্ব হইতে সতর্ক করিয়া দিয়া ভালই করিলে; বন্ধুর কার্য্যই সম্পাদন করিলে। এখন আমার কি করা কর্তব্য, তাহা বল দেখি। 

হারা। গোবর্দ্ধনকে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে না দিলেই সকল গোলযোগ মিটিয়া যাইবে। 

রাস। ইহা ত আমার পক্ষে একবারে অসম্ভব; কারণ, আমার পিতার নিকট আমিও যেমন, গোবর্দ্ধনও সেইরূপ। তাঁহার অনভিমতে আমি ত তাহাকে আমাদিগের বাড়ীতে গমনাগমন করিতে নিষেধ করিতে পারি না। 

হারা। তাহা হইলে তোমার পিতাকে বলিয়া তাহার যাতায়াত কি বন্ধ করা যায় না? 

রাস। পিতাকে বলিলে হয় ত তিনি তাহার যাতায়াত বন্ধ করিয়া দিতে পারেন, কিন্তু আমি তাহাকে বলি কি প্রকারে? কিরূপে আমি আমার পিতাকে বলি যে, গোবর্দ্ধন আমাদিগের বাড়ীতে আসিলে, আমার স্ত্রীর চরিত্র নষ্ট হইয়া যাইবে। 

হারা। ইহা কোন রূপেই বলা যাইতে পারে না? যাহা হউক, আপনি উত্তমরূপে ভাবিয়া চিন্তিয়া যাহা হয় একটা স্থির করুন। এ বিষয় লইয়া এখন বিশেষরূপ পীড়াপীড়ি করিবার কারণ নাই; কারণ আপনার স্ত্রীর চরিত্র একবারেই নবনী-নির্ম্মিত নহে, যে একটু উত্তাপ পাইলেই গলিয়া যাইবে। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

হারাধনের কথা শুনিয়া রাসবিহারী অকূল পাথার ভাবিতে লাগিলেন। কি করিবেন, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলেন না। আমার স্ত্রী কি তবে অসতী, এই কথা লোকমুখে কি সৰ্ব্বস্থানে প্রচারিত হইয়া পড়িয়াছে? 

নহিলে হারাধন পাকে প্রকারে আমাকে এরূপ বলিবে কেন? মনে মনে এইরূপ নানাপ্রকার চিন্তা করিতে করিতে তিনি আপন বাড়ীতে প্রবেশ করিলেন। অন্তঃপুরের ভিতর গমন করিলেন বটে, কিন্তু তাঁহার স্ত্রীর দৃশ্য তাঁহার অন্তরে যেন কে বিষ ঢালিয়া দিতে লাগিল। তাহার সহিত আর কথা কহিতে তাঁহার ইচ্ছা হইল না, বা তাহার প্রণয় সম্ভাষণ ইত্যাদি তাঁহার কিছুই ভাল লাগিল না। বিনোদিনী আপন স্বামীর এইরূপ অবস্থা দেখিয়া চিন্তিত হইলেন; ভাবিলেন, তাঁহার মনের গতি হঠাৎ আজ এরূপ পরিবর্তিত হইল কেন? আফিসের কর্ম কার্য্যে কি কোনরূপ গোলযোগ ঘটিয়াছে? নতুবা ইহার মন এরূপ খারাপ দেখিতেছি কেন? 

এইরূপে দুই এক দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। বিনোদিনী রাসবিহারীর মনের ভাব কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলেন না। ইহার পূর্ব্বে বিনোদিনীর সহিত তিনি যেরূপ ভাবে আমোদ আহ্লাদ করিতেন, যেরূপ ভাবে হাসিয়া হাসিয়া কথা কহিতেন, এখন আর সেরূপ ভাবে সেই বিনা প্রয়োজনে প্রায়ই রাসবিহারী কথা কহেন না। এক কথা দশবার জিজ্ঞাসা না করিলে, আর তাঁহার নিকট হইতে কোনরূপ উত্তর পাওয়া যায় না। 

এইরূপে আরও দুই চারি দিবস গত হইলে রাসবিহারী একাদিক্রমে চারি পাঁচ দিবস আফিসে গমন করিলেন না। সাহেবকে লিখিলেন যে, তাঁহার শরীর অসুস্থ। সাহেব তাঁহার কথায় বিশ্বাস করিয়া কোন কথা কহিলেন না, তাঁহার ছুটী মঞ্জুর করিলেন। গোবর্দ্ধন প্রায়ই আফিসে ভালরূপ কর্ম্মকার্য্য করিত না, ও প্রায়ই অনুপস্থিত থাকিত। কিন্তু রাসবিহারীর নিমিত্ত প্রায়ই সেই সকল বিষয় সাহেবের কর্ণগোচর হইত না। যে কোন গতিকে হউক, রাসবিহারীবাবু তাহার কার্য্য সমাপন করিয়া লইতেন। রাসবিহারীর অনুপস্থিতিতে গোবর্দ্ধনের সমস্ত বিষয় সাহেবের সম্পূর্ণরূপে কর্ণগোচর হইল। তিনি তাহাকে তাহার কর্ম্ম হইতে অপসারিত করিয়া দিলেন। কৰ্ম্ম হইতে অপসারিত হইয়া গোবর্দ্ধন অতিশয় বিপদগ্রস্ত হইয়া পড়িল; তাহার খরচ পত্রের একবারে অনাটন হইয়া পড়িল। 

গোবর্দ্ধন কৰ্ম্মচ্যুত হওয়ায় হারাধন তাঁহার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিবার আর এক সুযোগ প্রাপ্ত হইলেন। এক দিবস তিনি গোবর্দ্ধনের সহিত; সাক্ষাৎ করিয়া তাহার দুঃখে নিতান্ত দুঃখ প্রকাশ করিলেন ও কহিলেন, “রাসবিহারীবাবু মনে না করিলে, তুমি যে তোমার কর্ম্ম পুনরায় প্রাপ্ত হইবে, তাহা আমার বোধ হয় না। তোমার আফিসের ব্যবহারে রাসবিহারী তোমার উপর বিশেষরূপ অসন্তুষ্ট হইয়াছেন; সুতরাং তিনি তোমার বা অপর কাহার কথা শুনিয়া তোমার নিমিত্ত যে সাহেবকে অনুরোধ করিবেন, তাহা কিন্তু আমার অনুমান হয় না। তবে রাসবিহারীবাবুর স্ত্রী যদি তোমার হইয়া তাঁহাকে দুই চারি কথা বুঝাইয়া বলিতে পারেন, তাহা হইলেই তোমার কিছু উপকার হইবার সম্ভাবনা আছে; নতুবা, আর কোন উপায় আমি দেখিতেছি না। আফিসের সাহেব রাসবিহারী বাবুকে বিশেষরূপ অনুগ্রহ করিয়া থাকেন। তিনি তোমার হইয়া কোন কথা বলিলে, সে কথা তিনি একবারে অবহেলা করিতে পারিবেন না। এরূপ অবস্থায় তুমি বিনোদিনীকে গিয়া উত্তমরূপে ধর, ও যাহাতে তিনি তাঁহার স্বামীর নিকট তোমার হইয়া দুই চারি কথা কহেন, তাহার চেষ্টা দেখ।” 

হারাধনের কথাগুলি একবারে অব্যর্থ হইল না। গোবর্দ্ধনও বুঝিলেন যে, রাসবিহারীবাবু একটু মনে করিলেই তিনি তাঁহার চাকরী পুনঃপ্রাপ্ত হইবেন। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া রাসবিহারী বাবুর অনুপস্থিতিতে গোবৰ্দ্ধন রাসবিহারীবাবুর বাড়ীতে গমন করিলেন। ঐ বাড়ীর ভিতর গোবর্দ্ধনের গমনাগমন করিতে নিষেধ ছিল না। ঘরের ছেলের ন্যায় ইচ্ছামত তিনি সর্ব্বদা সকল স্থানে গমনাগমন করিতেন। বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়াই গোবর্দ্ধন বিনোদিনীকে দেখিতে পাইলেন ও ক্রমে তিনি তাঁহার নিকট গিয়া উপবেশনপূর্ব্বক নিজের মনের ভাব তাঁহার নিকট প্রকাশ করিলেন। তাঁহার চাকরী যাওয়ায় তাঁহার বিশেষ কষ্ট হইতেছে, পরিবারবর্গের সহিত তাঁহাকে অনশনে মরিতে হইতেছে, ভালরূপ লেখাপড়া, জানেন না, বা কাৰ্য্যক্ষেত্রেও তাঁহার কোনরূপ যশ নাই যেস্থানে ইচ্ছা সেইস্থানে যে কোন একটি চাকরীর যোগাড় অনায়াসেই করিয়া লইবেন। রাসবিহারীবাবু মনে না করিলে তাঁহার আর কোন উপায় নাই। রাসবিহারীবাবু যদি সাহেবদিগকে বুঝাইয়া বলেন, তাহা হইলেই তাঁহার চাকরী হইবে; নতুবা এ কার্য্য আর কাহার দ্বারা হইবার সম্ভাবনা নাই। তাঁহার হইয়া রাসবিহারীবাবুকে যে বলিতে পারে, এরূপ আর কোন লোক নাই; অথচ তিনি নিজে গিয়া তাঁহাকে কোন কথা বলিতে পারেন না, আর বলিলেই বা তিনি শুনিবেন কেন? এরূপ অবস্থায় বিনোদিনী ভিন্ন আর তাহার উপায় নাই। বিনোদিনী যদি তাঁহার স্বামীকে দুই কথা বুঝাইয়া বলিতে পারেন, তাহা হইলেই গোবর্দ্ধনের চাকরী হয়, নতুবা তাঁহাকে অনশনে মরিতে হইবে। এইরূপ ভাবে যতদূর তিনি বিনোদিনীকে বলিতে পারিলেন বলিলেন। বিনোদিনীও গোবর্দ্ধনের সমস্ত কথাগুলি বিশেষ মনোযোগের সহিত শুনিলেন, তাঁহার হৃদয়ে দয়ারও উদ্রেক হইল। আপন স্বামীর নিকট অপরের নিমিত্ত দুই কথা বলিলে যদি তাঁহার উপকার হয়, বা যদি তাঁহার দুঃখ দূর হয়, তাহা হইলে এই সামান্য উপকারটুকুই বা তাঁহার দ্বারা না হইবে কেন? মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া তিনি গোবৰ্দ্ধনকে কহিলেন, “আচ্ছা, আমার দ্বারা যদি তোমার কোনরূপ উপকার হইবার সম্ভাবনা থাকে, সাধ্যমত আমি তাহার চেষ্টা করিব। বোধ হয়, আফিসের কোন কারণে তাঁহার মন আজ কাল একটু চিন্তিত অবস্থায় দেখিতে পাই। দেখিয়া বোধ হয়, তাঁহার মনে যেন কিছুতেই তিনি সুখ পাইতেছেন না, অথচ জিজ্ঞাসা করিলেও তিনি স্পষ্ট করিয়া কোন কথা কহেন না। এরূপ অবস্থা তাঁহাকে কোন কথা বলিলে এই সময় যে বিশেষ ফলদায়ক হইবে, তাহা আমার মনে হয় না। তথাপি তোমার বিপদের কথা আমি তাঁহাকে কহিব। তাঁহাকে একটু প্রকৃতিস্থ দেখিলেই তোমার পক্ষ অবলম্বন করিয়া যতদূর বলিতে হয়, তাহা বলিতে কিছুমাত্র ত্রুটি করিব না। তোমার কথা শুনিয়া তিনি কি বলেন, তাহা দুই একদিবস পরে আসিয়া জানিয়া যাইও।” 

বিনোদিনীর এইরূপ বাক্যে গোবর্দ্ধন বিশেষরূপে আশ্বাসিত হইলেন। তাঁহার বিশ্বাস হইল, তিনি সময় পাইলেই তাঁহার স্বামীর নিকট সমস্ত অবস্থা বলিবেন, ও যাহাতে রাসবিহারী গোবর্দ্ধনের চাকরী পাইবার নিমিত্ত বিশেষরূপ চেষ্টা করেন তাহার যতদূর সম্ভব অনুরোধ করিবেন। গোবর্দ্ধনের এইরূপ বিশ্বাস হইবার কারণ এই যে, তিনি মনে মনে উত্তমরূপে জানিতেন যে, বিনোদিনী যাহা করিতে প্রতিশ্রুত হন, সাধ্যমতে তিনি তাহার চেষ্টা করিতে কখন বিস্মৃত হন না। তাঁহার মুখে একরূপ ও অন্তরে আর একরূপ থাকে না। 

বিনোদিনীর কথায় গোবর্দ্ধন বিশেষরূপ আশ্বাসিত হইয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিলেন, ও সময়মত হারাধনের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া বিনোদিনীর সহিত তাঁহার যেরূপ কথাবার্তা হইয়াছিল, তাহার সমস্ত তাঁহাকে কহিলেন। হারাধন গোবর্দ্ধনের সমস্ত কথা শুনিয়া মনে ভাবিলেন, তাঁহার অভীষ্ট হইবার আর অধিক বিলম্ব নাই। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া তিনি গোবর্দ্ধনকে কহিলেন, “মনুষ্য চরিত্র তুমি উত্তমরূপে অবগত আছ কি না জানি না, এই নিমিত্তই আমি তোমাকে সতর্ক করিয়া দিতেছি। যে ব্যক্তি অপর ব্যক্তির প্রকৃত শত্রু হইয়াও প্রত্যহ যদি তাঁহার বাড়ীতে গমনাগমন করিতে আরম্ভ করে, তাহা হইলে ক্রমে তিনি তাহাকে আপন শত্রু বলিয়া ভুলিয়া যান ও ক্রমে ক্রমে তাহাকে পুনরায় তিনি বিশ্বাস করিতে আরম্ভ করেন। কোন একটি কার্য্যের নিমিত্ত কাহার নিকট যদি প্রত্যহ গমন করা যায়, তাহা হইলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁহাকে সেই কাৰ্য্য সম্পন্ন করিতে হয়। পরস্পর পরস্পরের নিকট সদা সৰ্ব্বদা যাতায়াত থাকিলে পরস্পরের মধ্যে ক্রমে বন্ধুত্ব স্থাপিত হইয়া পড়ে, ইহা সৰ্ব্বজনবিদিত। এই নিমিত্তই আমি তোমাকে কহিতেছি, যে পর্য্যন্ত তোমার কার্য্য উদ্ধার না হয়, যে পর্য্যন্ত রাসবিহারী তোমাকে তোমার কার্য্য প্রদান করাইতে না পারেন, সেই পর্যন্ত তুমি বিনোদিনীর নিকট গমন করিতে ভুলিও না। রাসবিহারী যেমন আফিসে বাহির হইয়া যাইবেন, অমনি তুমি সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হইবে, ও যে পর্য্যন্ত রাসবিহারীর প্রত্যাগমন করিবার সময় উপস্থিত না হইবে, সেই পর্যন্ত তুমি সেই স্থান পরিত্যাগ করিবে না। ছায়ার ন্যায় তুমি সর্ব্বদা বিনোদিনীর নিকট থাকিবে, তাঁহার আদেশের সঙ্গে সঙ্গে সেই কাৰ্য্য সম্পন্ন করিবে। এইরূপ নিয়মে যদি তুমি কিছু দিবস অতিবাহিত করিতে পার, তাহা হইলে দেখিবে, যেরূপ উপায়েই হউক বিনোদিনী রাসবিহারীকে দিয়া তোমার কার্য্য সম্পন্ন করে দিবেন।”

হারাধনের কথা শুনিয়া গোবর্দ্ধন তাহাই করিবেন মনে মনে স্থির করিয়া সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলেন, ও তাহার পর দিবস হইতে গোবর্দ্ধন প্রত্যহ রাসবিহারীবাবুর বাড়ীতে গমন করিতে লাগিলেন। তাঁহার অনুপস্থিতিতে গোবর্দ্ধন সৰ্ব্বদাই বিনোদিনীর নিকট গমন ও যাহাতে তাঁহার তুষ্টিসাধন করিতে পারেন, কায়মনোবাক্যে কেবল তাহারই চেষ্টা করিতে লাগিলেন। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

অল্পবুদ্ধি গোবর্দ্ধনকে হারাধন যেরূপ পরামর্শ প্রদান করিলেন, গোবর্দ্ধন সেইরূপ ভাবে চলিতে প্রবৃত্ত হইলেন। বিনোদিনী গোবর্দ্ধনের নিমিত্ত নিজ স্বামীকে যেরূপ অনুরোধ করিবেন বলিয়াছিলেন, তাহার কিছুমাত্র ব্যতিক্রম ঘটিল না। সময় মত এক দিবস তিনি গোবর্দ্ধনের পক্ষ অবলম্বন করিয়া রাসবিহারীকে অনেক কথা কহিলেন; এবং যাহাতে তিনি পুনরায় গোবর্দ্ধনের চাকরি করিয়া দেন, তাহার নিমিত্ত তাঁহাতে বিশেষ রূপ অনুরোধ করিলেন। রাসবিহারী বিনোদিনীর কথাগুলি আগাগোড়া উত্তমরূপে শুনিলেন, কিন্তু ভাল মন্দ কোন কথা কহিলেন না। বিনোদিনী গোবর্দ্ধনের ভাল করিতে গিয়া তাঁহার সপক্ষে যতগুলি কথা রাসবিহারীকে কহিলেন, তাহাতে গোবর্দ্ধনের কিছুমাত্র উপকার ত হইলই না, কিন্তু তাঁহার প্রত্যেক কথায় বিনোদিনীর বিশেষরূপ অনিষ্ট সাধিত হইতে লাগিল। পূৰ্ব্ব হইতে রাসবিহারীর হৃদয়ে হারাধন যে মহাঅগ্নি প্রজ্বলিত করিয়া দিয়াছিল, বিনোদিনীর মুখ-নিঃসৃত প্রত্যেক কথাতে, সে অগ্নিতে ঘৃতাহুতি প্রদত্ত হইতে লাগিল। 

বিনোদিনী রাসবিহারীর মনের ভাব এ পর্যন্ত অবগত হইতে পারিয়াছিলেন না। তিনি জানিতেন, আফিসের কর্ম্ম-কার্য্যের নিমিত্ত সর্ব্বদা তাঁহার মন অস্থির থাকে বলিয়াই, তিনি ভাল করিয়া কথা কন না; এবং সংসারের কোন দিকে ভাল রূপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন না। কার্য্যের গোলযোগ একটু কমিয়া গেলেই, পুনরায় তাঁহার হৃদয়ে সুখের চিহ্ন দেখিতে পাইবেন, মনে প্রফুল্লতা আসিয়া পুনরায় বিরাজিত হইবে। স্বপ্নেও যদি বিনোদিনী একবার বুঝিতে পারিতেন যে, তাঁহার চরিত্রের উপর সন্দেহ করিয়াই রাসবিহারী সর্ব্বদা বিষণ্ণ বদনে দিন অতিবাহিত করেন; গোবর্দ্ধন তাঁহার প্রণয়-সূত্রে আবদ্ধ হইয়াছেন, এই মহাভ্রম রাসবিহারীর হৃদয়ে প্রবিষ্ট হওয়ায়, তাঁহার মস্তক ক্রমে বিকৃত করিয়া ফেলিতেছে; তাহা হইলে কি তিনি সেই গোবর্দ্ধনের ছায়া দর্শন করিতেন, না তাঁহাকে তাঁহার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে দিতেন? অথবা সেই গোবর্দ্ধনের পক্ষ সর্ব্বতোভাবে সমর্থন করিয়া, তাঁহাকে চাকরি করিয়া দিবার নিমিত্ত বার বার অনুরোধ করিতেন? সরলা স্ত্রীলোক তাঁহার স্বামীর মনের ভাব অবগত হইতে না পারিয়াই, আপন সর্ব্বনাশের পথ আরও প্রশস্ত করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। যাহার নিমিত্ত এই ভয়ানক সর্ব্বনাশের সূত্রপাত হইতেছে, যাঁহার নিমিত্ত রাসবিহারী সংসারের সকল সুখে জলাঞ্জলি দিতে বসিয়াছেন, তাহার নিমিত্ত আপনার হৃদয়ের হৃদয়কে হৃদয় হইতে দূরে নিক্ষেপ করিতে কৃতসংকল্প হইতেছেন, তাঁহারই নিমিত্ত সরলা তাঁহার পতির নিকট অনুগ্রহ প্রার্থনা করিতেছেন! ইহা অপেক্ষা বিশেষ সন্দেহের বিষয় আর কি হইতে পারে? 

গোবর্দ্ধনের নিকট হইতে যখন হারাধন অবগত হইতে পারিলেন যে, রাসবিহারীর অবর্তমানে গোবর্দ্ধন প্রায় সর্ব্বদাই বিনোদিনীর নিকট গমনাগমন এবং সেইস্থানে অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করিতে আরম্ভ করিয়াছেন, তখন তাঁহার আনন্দের আর পরিসীমা রহিল না। তখন তিনি যেন দেখিতে পাইলেন যে, তাঁহার স্বযত্ন-রোপিত আশা-বৃক্ষে ফল ধরিয়াছে; এবং সেই ফল পাকিতেও আর অধিক বিলম্ব নাই। 

সেই সময় হারাধন কথায় কথায় আর এক দিবস গোবর্দ্ধনের কথা তুলিলেন। তাঁহার চাকরি যাওয়ায় যে তাঁহার ভালই হইয়াছে, পাকে প্রকারান্তরে এইরূপ প্রকাশ করিলেন। অথচ স্পষ্ট কিছু না বলিয়া, কথায় কথায় রাসবিহারীর মনে এইরূপ এক ভাবের ধারণা করাইয়া দিলেন যে, চাকরি করিয়া গোবর্দ্ধন যাহা কিছু উপার্জ্জন করিত, তাহা হইতে এখন তাঁহার উপার্জ্জন অধিক হইয়া পড়িয়াছে। বিনোদিনী মাসে মাসে এখন তাঁহাকে যেরূপ ভাবে সাহায্য করিয়া থাকেন, তাহাতে আর তাহার কোনরূপ কষ্টই নাই। বিশেষতঃ ইতিপূৰ্ব্বে যে গোবর্দ্ধন প্রায়ই রাসবিহারীর বাটীতে গমন করিত না, সেই গোবর্দ্ধন এখন প্রায় সর্ব্বদাই বিনোদিনীর নিকট থাকিয়া সময় অতিবাহিত করিয়া থাকে। রাসবিহারী আফিসে আসিবার পরেই গোবর্দ্ধন সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করে; এবং রাসবিহারীর আফিস হইতে প্রত্যাগমন করিবার পূর্ব্বেই সেই স্থান পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যায়, ইহা বাড়ীর সকলেই অবগত আছেন। কিন্তু কোন কথা কহিলে পাছে বিনোদিনী অসন্তুষ্টা হন, এই ভয়ে কেহ কোন কথা বলিতে সাহসী হন না। 

রাসবিহারী হারাধনের সমস্ত কথাগুলি বিশেষ মনোযোগের সহিত শুনিলেন, কিন্তু হারাধনকে কোন কথা কহিলেন না। তথাপি হারাধন তাঁহার মুখ দেখিয়া তাঁহার অন্তরের ভাব বিশেষরূপে অনুমান করিতে সমর্থ হইলেন। বুঝিলেন, তাঁহার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইতে আর অধিক বিলম্ব নাই। 

পর দিবস রাসবিহারী নিয়মিত সময়ে আফিসে আগমন করিলেন; কিন্তু সেই দিবস নিয়মিত সময় পৰ্য্যন্ত সেইস্থানে অতিবাহিত করিলেন না। ২।১ ঘণ্টা কর্ম্ম করিবার পর, আফিস হইতে বহির্গত হইয়া নিজ বাড়ীতে গমন করিলেন। মনে মনে যাহা আন্দোলন করিতেছিলেন, সেইস্থানে গিয়া তাহাই দেখিতে পাইলেন। দেখিলেন, গোবর্দ্ধন প্রকৃতই তাঁহার বাড়ীতে আসিয়াছে; কিন্তু তাঁহার ঘরের মধ্যে বা বিনোদিনীর নিকট নাই, তাঁহার মাতার নিকট বসিয়া গল্প করিতেছে। রাসবিহারী এই অবস্থা দেখিয়া কাহাকেও কিছু কহিলেন না, কোন একটি দ্রব্য লইবার ভান করিয়া আপন ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলেন, ও পরক্ষণেই বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গেলেন। গোবর্দ্ধনকে বাড়ীতে দেখিতে পাইয়া একবার ভাবিলেন “হারাধন তাহাকে যাহা বলিয়াছে, তাহা কি তবে প্রকৃত? প্রকৃতই ত। আমার অনুপস্থিতি সময়ে গোবর্দ্ধনকে আমাদিগের বাড়ীতে দেখিতে পাইলাম। সে আমার মাতার নিকট উপবেশন করিয়া আছে, তাহা হইলে আমার মাতাও কি এই সকল বিষয় অবগত থাকিয়া এত দিবস পর্য্যন্ত আমার নিকট গোপন করিয়া রাখিয়াছেন? না, তাহা কখন হইতে পারে না। গোবর্দ্ধন পর হইলেও আমাদিগের বাড়ীর পরিবারগণের মধ্যে সে একরূপ পরিগনিত। বিশেষ আমার মাতা জানিয়া শুনিয়া এরূপ কার্য্যে কখনই অনুমোদন করিবেন না, অথচ তাঁহার অনুমতি না থাকিলেও গোবর্দ্ধন কখনই আমাদিগের বাড়ীতে প্রবেশ করিতে সাহসী হইবে না। কিন্তু যদি বিশেষরূপে ভাবিয়া দেখা যায়, তাহা হইলে যে সময় আমি আমার বাড়ীতে থাকি, সেই সময় গোবর্দ্ধন আমাদিগের বাড়ীতে আসে না, — আমি আফিসে গমন করিলেই সে আসিয়া উপস্থিত হয় কেন? ইহার নিশ্চয় কোন গূঢ় কারণ আছে। আর যদি লোকমুখে কোন কথা প্রচারিতই না হইবে, তাহা হইলে আমার ঘরের কথা আমি জানিতে পারিলাম না, অথচ হারাধন নিতান্ত পর হইয়াও সেই সকল কথা জানিতে পারিল কিরূপে? যাহা হউক এ বিষয়ে আরও একটু বিশেষরূপে অনুসন্ধান না করিয়া ইহার প্রতিবিধানের কোনরূপ চেষ্টা করা কর্তব্য নহে। দেখা যাউক, গোবর্দ্ধন ও বিনোদিনীর বিরুদ্ধে আরও কোন কথা জানিতে পারি কি না।” 

এইরূপে আরও দুই এক দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। সময় মত হারাধন আসিয়া এক দিবস পুনরায় গোবর্দ্ধনের কথা উঠাইলেন। সেই দিবস হারাধনের মনের প্রকৃত কথা জানিবার নিমিত্ত রাসবিহারী তাঁহাকে কহিলেন, “আমার স্ত্রীর সহিত যাহাতে বিশেষরূপে মনোমালিন্য হয়, এরূপ কোন কার্য্য করা তোমার কর্তব্য নহে। তুমি আমাকে এ পৰ্য্যন্ত যাহা যাহা কহিয়াছ, তাহার সমস্তই মিথ্যা, তাহার বিন্দুমাত্র সত্য নহে।” রাসবিহারীর এই সকল কথা শুনিয়া হারাধন একটু ক্রুদ্ধ হইলেন ও কহিলেন, “আমি আপনাকে এ পর্যন্ত আপনার স্ত্রীর বিরুদ্ধে কোন কথা কহি নাই। আপনি নিজে আমাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, বা আমার নিকট হইতে আপনি যাহা জানিতে চাহিয়াছেন, তাহার অনেক কথা আপনাকে গোপন করিয়া দুই একটি আভাস আপনাকে দিয়াছি মাত্র। কিন্তু যদি জানিতাম যে, আপনি ঐ সকল বিষয় জানিতে বা শুনিতে চাহেন না, তাহা হইলে এ পৰ্য্যন্ত কোন কথাই কহিতাম না। আপনি জানিবেন, আমি মিথ্যা কথা কহি নাই। আমি লোকমুখে যাহা শুনিয়াছি, সমস্ত লোকে যে কথা লইয়া সর্ব্বদা আলোচনা করিয়া থাকে, তাহা যদি আমি আপনার নিকট প্রকাশ করিতাম, তাহা হইলে আপনি যে আমাকে আরও কি বলিতেন, তাহা আমি বুঝিতে পারিতেছি না। আপনি কি বলিতে চাহেন যে, সরোবরের স্বচ্ছ জল বিনা-বাতাসে কি কখন বিচলিত হয়? বিনা-মেঘে কি কখন বৃষ্টিপাত হইয়া থাকে? না, কারণ বিনা কখন কাৰ্য্য আসিয়া উপস্থিত হয়? আপনি আপনার স্ত্রীর চরিত্রে কোনরূপ সন্দেহ না করেন ভালই, আপনি সাধু! আপনি গোবর্দ্ধনকে দেবতাস্থানীয় করিতে চাহেন ভালই, সে আপনার মহত্ত্ব! আপনি বড়লোক, আপনার সকল কাৰ্য্যই শোভা পায়; কিন্তু আমরা দরিদ্র, আমাদিগের ঘরে ওরূপ কার্য্য কখনই শোভা পাইতে পারে না। গোবর্দ্ধন আপনাদিগের উপস্থিতে আপনাদিগের বাড়ী যায় না কেন? আর আপনি যেমন বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া যান, অমনি সে আপনাদিগের অন্তঃপুরে প্রবেশ করে কাহার নিমিত্ত? তাহার চাকরী নাই। পূর্ব্বের সংগৃহীত অর্থাদি নাই, কোনদিকে অপর কোনরূপ উপার্জ্জন নাই; কিন্তু সে বিনাক্লেশে সংসারের সমস্ত ব্যয় নির্ব্বাহ করে কোথা হইতে? শুধুই কি তাহাই, তদ্ব্যতীত তাহার একটি উপপত্নী আছে। তাহা আপনি অবগত আছেন কি না জানি না। সে আপন স্ত্রী অপেক্ষা তাহাকে অধিক ভালবাসে, তাহার নিমিত্ত অনেক অর্থ ব্যয় করে। সে সকল অর্থ যে কোথায় পায়, তাহা কিছু আপনি অবগত আছেন কি? যখন আপনি আমার নিকট হইতে শুনিতে চাহিতেছেন শুনুন, আপনার স্ত্রীর একটি সোণার অঙ্গুরী আপনি এক দিবস দেখিতে চাহিয়াছিলেন, তাহা আপনার মনে হয় কি? আর সেই অঙ্গুরী আপনার স্ত্রী আপনাকে দেখাইতে না পারিয়া, আপনাকে এই বলিয়া বুঝাইয়া দিয়াছিলেন যে, উহা হারাইয়া গিয়াছে, আর আপনিও তাহাই বুঝিয়া গিয়াছিলেন, কেমন বলুন দেখি, আমার এই কথা সত্য কি না। সেই অঙ্গুরী কি হইয়াছে তাহা আপনি কিছু অবগত আছেন কি? যদি আপনি তাহা অবগত না থাকেন ও যদি জানিতে চাহেন তবে তাহা আমি আপনাকে বলিতেছি। সকল কথা আপনার কর্ণগোচর করা আমার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু যখন আপনি আমাকে মিথ্যাবাদী-বিবেচনা করিতেছেন তখন কাজেই আমাকে তাহা বলিতে হইতেছে। গোবৰ্দ্ধন যাহার উপর বিশেষ রূপ অনুরক্ত ও যাহাকে প্রকৃতপক্ষে ভালবাসিয়া থাকে, তাহাকেই সে উহা প্রদান করিয়াছে। যে বিনোদিনীকে সে ঐ অঙ্গুরী প্রদান করিয়াছে, সে এখন পৰ্য্যন্ত বৰ্ত্তমান আছে। ইচ্ছা করিলে আপনি স্বচক্ষে দেখিয়া নিজ চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করিয়া লইতে পারেন। 

রাসবিহারী। ইহা কী প্ৰকৃত? 

হারাধন। আমি কি মিথ্যা কথা কহিতেছি? আপনি আমার সহিত গমন করুন, আমি তাহাকে দেখাইয়া দিব; তাহা হইলেই আপনি জানিতে পারিবেন, আমি সত্য বলিতেছি, কি মিথ্যা বলিতেছি। 

রাসবিহারী। সে কে? 

হারাধন। সে বেশ্যা। 

রাসবিহারী। সে থাকে কোথায়? 

হারাধন। কর্ণওয়ালিশ ষ্ট্রীটে — থানার সন্নিকটে। 

রাসবিহারী। আপনি তাহাকে কখন দেখাইতে পারিবেন? 

হারাধন। যখন দেখিতে চাহিবেন। অদ্যই সন্ধ্যার পর চলুন, অদ্যই দেখিতে পাইবেন, ও তাহার নিকট হইতে জানিতে পারিবেন, কে তাহাকে ঐ অঙ্গুরী প্রদান করিয়াছে। 

হারাধনের কথা শুনিয়া প্রথম হইতে রাসবিহারীর মনে যে ভয়ানক সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল, অঙ্গুরীর কথা শুনিয়া তাঁহার সেই সন্দেহ আরও দৃঢ়ীভূত হইয়া গেল। বিনোদিনীর একটা অঙ্গুরী হারাইয়া গিয়াছিল, সুতরাং হারাধনের সহিত গমন করিয়া সেই অঙ্গুরী একবার নিজচক্ষুতে দেখিতে ইচ্ছা করিলেন। প্রকৃতই যদি কোন বার- বিলাসিনীর হস্তে সেই অঙ্গুরী দেখিতে পান ও তাহার সহিত গোবর্দ্ধনের যদি প্রণয় থাকে, তাহা হইলে রাসবিহারীর মনে তাঁহার স্ত্রীর চরিত্র সম্বন্ধে আর কোনরূপ সন্দেহ না থাকিবার কারণই রহিবে না। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

হারাধনের কথা শুনিয়া রাসবিহারী সেই দিবসে সন্ধ্যার পরই তাহার সহিত সেই বার-বিলাসিনীর ঘরে গমন করিতে মনস্থ করিলেন। 

সন্ধ্যা হইবামাত্রই হারাধন আসিয়া রাসবিহারীবাবুর বাড়ীতে উপস্থিত হইলেন। সন্ধ্যার পর উভয়েই একখানি ঠিকা গাড়ীতে উঠিয়া হারাধনের নির্দেশমত একটি অভাগিনীর বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন। রাসবিহারী এরূপ বাড়ীতে ইতিপূর্ব্বে আর কখন প্রবেশ করেন নাই। হারাধন তাহার ঘরে গমন করিয়া মৃত্তিকার উপরিস্থিত বিছানার উপর উপবেশন করিলেন, রাসবিহারীকেও অনন্যোপায় হইয়া সেইস্থানে উপবেশন করিতে হইল। স্ত্রীলোকটিও তাহাদিগের সন্নিকটে আসিয়া উপবেশন করিলে হারাধন তাহার সহিত নানারূপ কথাবার্তা কহিতে আরম্ভ করিলেন। উভয়ের কথা শুনিয়া অনুমান হইল উভয়েই অনেক দিবস হইতে উভয়ের নিকট পরিচিত, ও হারাধনের সেইস্থানে গমনাগমন আছে। স্ত্রীলোকটির অঙ্গুলিতে একটি অঙ্গুরী ছিল, হারাধন সেইদিকে ঈষৎ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া রাসবিহারীকে ইসারা করিয়া তাহা দেখাইয়া দিলেন, ও পরিশেষে সেই স্ত্রীলোকটিকে কহিলেন, “দেখি তোমার অঙ্গুরীয়কটি কেমন।” হারাধনের কথা শুনিয়া স্ত্রীলোকটি তাহার অঙ্গুলি হইতে সেই অঙ্গুরীটি খুলিয়া হারাধনের হস্তে প্রদান করিল। হারাধন উহা হস্তে লইয়া উত্তমরূপে দেখিলেন ও কহিলেন, “এটী কী তোমার সেই অঙ্গুরী? ইঁহার গঠন অতিশয় মনোহর। এটী তুমি কোথা পাইলে?” এই বলিয়া হারাধন ঐ অঙ্গুরীয়ক রাসবিহারীর হস্তে প্রদান করিলেন। রাসবিহারী উহা উত্তমরূপে দেখিলেন, ও দেখিবামাত্রই তাঁহার সেই অঙ্গুরীয়ক বলিয়া চিনিতে পারিলেন। সেই সময় হারাধন সেই স্ত্রীলোকটিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি এটা কোথা প্রস্তুত করাইয়াছ?” উত্তরে সে কহিল, “আমি উহা কোনস্থানে প্রস্তুত করাই নাই, গোবর্দ্ধন নামক একটি বাবু আমাকে একটু ভালবাসেন, তিনিই ইহা কোথা হইতে আনিয়া আমাকে দিয়াছেন।” এই কথা শুনিয়া রাসবিহারীর মনে আর কোনরূপ সন্দেহ রহিল না। হারাধন তথাপি সেই স্ত্রীলোকটিকে পুনর্ব্বার জিজ্ঞাসা করিলেন, “গোবর্দ্ধনবাবু এই অঙ্গুরীটি কোথায় প্রস্তুত করাইয়াছেন, তাহা কিছু বলিতে পার কি?” উত্তরে সে কহিল, “তাহা আমি বলিতে পারি না। এক দিবস তিনি আমাকে বলিয়াছিলেন যে, কোন একটি স্ত্রীলোক তাঁহাকে অতি ভালবাসেন; তিনি তাঁহাকে উহা প্রদান করিয়াছেন ও গোবর্দ্ধনবাবু আমাকে ভালবাসেন বলিয়া তিনি স্বহস্তে অমাকে উহা প্রদান করিয়াছেন।” 

স্ত্রীলোকের নিকট হইতে এই কথা শুনিয়া রাসবিহারীবাবুর মনে আর কোনরূপ সন্দেহই রহিল না। এখন তাঁহার সম্পূর্ণরূপ বিশ্বাস জন্মিল যে, বিনোদিনী অসচ্চরিত্রা ও গোবর্দ্ধনের প্রণয়মুগ্ধা, — এরূপ রমণীর সহিত কোনরূপেই সংস্রব রাখা কর্তব্য নহে। রাসবিহারী সেস্থান হইতে বহির্গত হইয়া আপনার বাড়ীতেই গমন করিলেন। কিন্তু হারাধন তাঁহার সহিত কিয়দ্দুর আগমন করিয়া, তাঁহার গাড়ি হইতে অবতরণপূর্ব্বক স্থানান্তরে প্রস্থান করিলেন, কোথায় যে গমন করিলেন, তাহা তিনি রাসবিহারীকে বলিয়া গেলেন মা। কিন্তু পরিশেষে আমরা অবগত হইতে পারিয়াছিলাম যে, তিনি পুনরায় সেই বার-বিলাসিনীর ঘরেই গমন করিয়াছিলেন। 

সেইস্থান হইতে প্রত্যাগমন করিবার কালীন রাসবিহারীর হৃদয় বিষম চিন্তায় জর্জ্জরীভূত করিয়া ফেলিল। তাঁহার মন অস্থির হইয়া গেল, মস্তিষ্ক ক্রমে বিকৃত হইয়া পড়িতে লাগিল। তখন তাঁহার মনে হইতে লাগিল যে, বাল্যকাল হইতে পিতা মাতার অবাধ্য হইয়া নিজের ইচ্ছামত যে নিজের স্বামী নিজেই বাছিয়া লইতে পারে, যৌবনে তাহার দ্বারা না হইতে পারে, এরূপ কোন কাৰ্য্যই নাই। যাহা হউক, ঐরূপ স্ত্রীলোকের সহিত একবারে সংস্রব পরিত্যাগ করাই কর্তব্য। কেবল আমার নিজের সংস্রব কেন, এই জগতের সহিত যাহাতে তাহার আর কোনরূপ সংস্রব না থাকে, তাহাই আমি করিব। উঃ! কি ভয়ানক কথা! যাহাকে আমি প্রাণের সহিত ভালবাসিতাম, আপনার হৃদয় ও মন যাহার হস্তে একবারে সমপর্ণ করিয়াছিলাম, তাহার চরিত্র এই! হৃদয়ের যে অর্দ্ধভাগিনী, তাহার চরিত্র এই! যাহাকে অবিশ্বাসী বলিয়া মনে করিতেও মন সঙ্কুচিত হয়, তাহার চরিত্র এই, এইরূপ চরিত্র-হীনা স্ত্রীর মুখ যে দর্শন করে, তাহার মুখ দর্শন করিতে নাই। যে আপন ঘরে তাহাকে স্থান প্রদান করে, তাহার ছায়াও স্পর্শ করিতে নাই। এরূপ অসতী পত্নীর শিরশ্ছেদ করিয়া চরমদণ্ডে দণ্ডিত হওয়াই বাঞ্ছনীয়, তথাপি এই ভয়ানক অপযশের কথা লোক-মুখে প্রচারিত হইতে দেওয়া কোনরূপেই কৰ্ত্তব্য নহে। 

মনে মনে এইরূপে চিন্তা করিতে করিতে যখন রাসবিহারী আপন বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন, তখন রাত্রি প্রায় ১১টা। তাঁহার আহারীয় প্রস্তুত ছিল; কিন্তু আহার না করিয়া নিতান্ত বিচলিতচিত্তে আপন শয়ন-ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলেন। আপনার পালঙ্কের সন্নিকটবর্ত্তী হইয়া দেখিলেন, বিনোদিনী সেই পালঙ্কোপরে অঘোর নিদ্রায় নিদ্রিতা। বিনোদিনীর এরূপ নিদ্রা রাসবিহারী আর কখন দেখিয়াছেন, বলিয়া তাঁহার মনে হইল না। তিনি একটু স্থিরভাবে সেই স্থানে দণ্ডায়মান হইলেন। ভাবিলেন, বিনোদিনী যে নিদ্রায় নিদ্রিতা, সেই নিদ্রাই তাহার চিরনিদ্রায় পরিণত হওয়া কর্ত্তব্য। আবার ভাবিলেন, আমি যে কার্য্য করিতে মনে মনে স্থির করিয়াছি, সেই কার্য্য সম্পন্ন করিবার পূর্ব্বে একবার উহাকে জিজ্ঞাসা করা কর্তব্য নহে কি? তাহার বিপক্ষে যে সমস্ত বিষয় আমি দেখিতে পাইতেছি, তাহার যে কি উত্তর করিতে পারে। আবার বললেন, না আর জিজ্ঞাসা করিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। উহার সহিত কথা কহিয়া মহাপাপের আর প্রশ্রয় দি কেন? আর বিলম্ব করা কর্ত্তব্য নহে। উহার কার্য্যের ফল এখন স্বহস্তে প্রদান করি। এই বলিয়া বিঘূর্ণিত নেত্রে তাঁহার সেই শয়নকক্ষের চতুৰ্দ্দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। দেখিলেন, সেই ঘরের এক পার্শ্বে একখানি দা, ইহা বহুদিবস হইতে রক্ষিত ছিল, তাহা এখন পৰ্য্যন্ত সেইরূপ ভাবে সেই স্থানে রহিয়াছে। রাসবিহারী ধীরে ধীরে সেই স্থানে গমন করিয়া ঐ দা খানি আপন হস্তে উঠাইয়া লইলেন; কিন্তু উহা তাঁহার হস্তচ্যুত হইয়া পুনরায় সেই স্থানে পতিত হইল। ঐ দা পতন শব্দে বিনোদিনীর নিদ্রাভঙ্গ হইল। তিনি চকিতের নায় গাত্রোত্থান করিয়া কহিলেন, “তুমি এখানে কি করিতেছ?” রাসবিহারীর কর্ণে সেই কথা প্রবেশ করিল। তিনি সেই দা খানি পুনরায় আপন হস্তে উঠাইয়া লইলেন ও কহিলেন, “ তোমার পাপের প্রতিফল দিতে প্রস্তুত হইতেছি”; এই বলিতে বলিতে রাসবিহারী বিনোদিনীর নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বিনোদিনী সদা সর্ব্বদা রাসবিহারীর যেরূপ মূর্তি দর্শন করিতেন, এ সেরূপ মূৰ্ত্তি নহে। যে মূৰ্ত্তি দেখিয়া তাহার হৃদয়ে আনন্দের উদ্রেক হইত, আজ সেই মূর্ত্তি দেখিয়া তাহার ভয়ানক ভয়ের উদ্রেক হইতে লাগিল। দা হস্তে রাসবিহারীকে দেখিয়া বিনোদিনী কহিলেন, “তোমার হস্তে দা কেন? আর তোমার এইরূপ ভয়ানক মূর্ত্তি দেখিতেছি কেন?” 

রাস। তোমার পাপের প্রতিফল দিবার নিমিত্ত এই দা ধারণ করিয়াছি। মরিতে প্রস্তুত হও। 

বিনো। আমার পাপের? আমি এমন কী পাপ করিয়াছি, যে, আপনি আজ আমাকে স্বহস্তে বধ করিতে প্রস্তুত হইয়াছেন? 

রাস। ইহা অপেক্ষা জগতে আর পাপ কী আছে? এখন তুমি তোমার প্রণয়াস্পদ গোবর্দ্ধনের স্মরণ কর। সেই আসিয়া এখন আমার হস্ত হইতে তোমাকে রক্ষা করুক। 

বিনো। গোবর্দ্ধন, গোবর্দ্ধন আমার কে? 

রাস। গোবর্দ্ধন তোমার কে? গোবর্দ্ধন তোমার সর্ব্বস্ব। যাহাকে সখের উপপতি করিয়াছ, সে তোমার কে? এই বলিতে বলিতে রাসবিহারী সজোরে বিনোদিনীর উপর এক অস্ত্রাঘাত করিলেন। তথাপি বিনোদিনী কিছুমাত্র বিচলিত না হইয়া কহিলেন, “এরূপ মিথ্যা কথা আপনাকে কে বলিল? আমিতো চলিলাম, আপনার হস্তে আমার স্বর্গবাসের রাস্তা হইল; কিন্তু পরে আপনি জানিতে পারিবেন, যে, আমি সতী কি না, আমার স্বামীই আমার জীবনের এক মাত্র অবলম্বন স্থল কি না!” 

এই সকল কথা বিনোদিনীর মুখ হইতে নির্গত হইতে না হইতেই, তাঁহার উপর ক্রমে সেই দা’র প্রবল আঘাত পতিত হইতে লাগিল। বিনোদিনী রক্তাক্ত কলেবরে সেই পালঙ্কের উপরে পতিত হইয়া ইহজীবন পরিত্যাগ করিলেন। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ

আমি যখন গিয়া ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইয়াছিলাম, সেই সময় পৰ্য্যন্ত বিনোদিনীর মৃতদেহ সেই পালঙ্কের উপরেই পতিত ছিল, ও রাসবিহারী পুলিসের হস্তে বন্দী হইয়া সেই স্থানে অবস্থিতি করিতেছিলেন। যে সকল ঘটনা ইহার পূর্ব্বে বর্ণিত হইয়াছে, এই সমস্ত ঘটনাই আমরা সেই সময় রাসবিহারীর প্রমুখ অবগত হইলাম। তিনি কোন কথা কোন রূপে গোপন না করিয়া, তাঁহার পাঠ্যাবস্থা হইতে সমস্ত অবস্থা একে একে আমাদিগের নিকট প্রকাশ করিলেন। আমরা সমস্ত অবস্থা অবগত হইয়া, তাঁহার কথা কতদূর সত্য, তাহা জানিবার নিমিত্ত এই সকল ঘটনার সংসৃষ্ট সমস্ত ব্যক্তিকেই এক স্থানে সমবেত করিলাম। হারাধনকে জিজ্ঞাসা করায়, সে সমস্ত কথা একবারে অস্বীকার করিল, ও কহিল “রাসবিহারী আমার বিপক্ষে যে সমস্ত কথা বলিতেছে, তাহার সমস্তই মিথ্যা। কেবল নিজের প্রাণ বাচাইবার আশায় এই সকল অভূতপূর্ব্ব কথার সমাবেশ করিয়া রাসবিহারী আমার উপর সমস্ত অর্পণ করিবার চেষ্টা করিতেছে।” 

গোবর্দ্ধনকে জিজ্ঞাসা করায় সে কহিল যে, বিনোদিনীকে আপন মাতার সদৃশ ভক্তি ও মান্য করিত। এক দিবসের নিমিত্ত ও সে কখন কুভাবে তাঁহার দিকে দৃষ্টিপাত করে নাই, বা কারবিলাসিনীকে সে কখন কোন অঙ্গুরী প্রদান করে নাই। যে বার-বিলাসিনীর অঙ্গুলিতে রাসবিহারী তাঁহার অঙ্গুরী দর্শন করিয়াছিলেন, সেও সেই স্থানে আনীত হইয়াছিল। তাহাকে জিজ্ঞাসা করায় সে যাহা কহিল, তাহাতে সকলেই স্তম্ভিত হইয়া পড়িলেন; সে গোবর্দ্ধনকে দেখিয়া কহিল যে, “ইহাকে ইতিপূর্ব্বে সে আর কখন দেখে নাই। সে তাহার ঘরে কখন গমন করে নাই, বা এই অঙ্গুরীয়ক সে কখন তাহাকে প্রদান করে নাই। আরও কহিল, যে, সে হারাধন কর্তৃক প্রতিপালিত। তাহার যে কোন খরচ পত্র, তাহা সমস্তই হারাধন তাহাকে প্রদান করিয়া থাকেন। যে অঙ্গুরী তাহার হস্তে রাসবিহারী দেখিয়া আসিয়াছিল, তাহা গোবৰ্দ্ধন নামীয় কোন ব্যক্তি তাহাকে প্রদান করে নাই, হারাধনই তাহাকে উহা প্রদান করিয়াছিল। কিন্তু হারাধন যে উহা কোথায় পাইয়াছিল, তাহা সে বলিতে পারে না। যখন হারাধন তাহাকে উহা প্রদান করিয়াছিল, সেই সময় সে তাহাকে বলিয়া দেয় যে, যদি কোন ব্যক্তি তাহাকে জিজ্ঞাসা করে, যে, ঐ অঙ্গুরী সে কোথায় পাইল, তাহা হইলে গোবর্দ্ধন নামীয় এক ব্যক্তি তাহাকে উহা প্রদান করিয়াছে, ইহা যেন তাহাকে বলা হয়। হারাধনের সেই নির্দ্দেশ অনুসারেই, সেই অঙ্গুরীয় তিনি গোবর্দ্ধনের নিকট হইতে পাইয়াছিলেন, এই কথা সেই দিবস সে রাসবিহারী বাবুকে বলিয়াছিল; কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সে উহা গোবর্দ্ধনের নিকট হইতে প্রাপ্ত হয় নাই, হারাধনের শিক্ষা অনুসারেই সে ঐরূপ মিথ্যা কথা কহিয়াছিল।” ঐ বার বিলাসিনীর কথা শুনিয়া আমাদিগের আর কিছুই বুঝিতে বাকি রহিল না। কিন্তু হারাধন তাহার কথা শুনিয়া কহিল, “এও দেখিতেছি সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা কথা কহিতেছে। আমি এই স্ত্রীলোকটিকে পূৰ্ব্ব হইতে জানিতাম না, গোবর্দ্ধন আমাকে সঙ্গে করিয়া এক দিবস উহার ঘরে লইয়া গিয়াছিল। সেই দিবস হইতেই আমি উহাকে চিনিয়াছি। অঙ্গুরীয়ক আমি উহাকে দেই নাই। উহার মুখেই শুনিয়াছিলাম, গোবর্দ্ধন তাহাকে উহা প্রদান করিয়াছিল। আমি জানি না, সকলেই আমার বিপক্ষে কেন দণ্ডায়মান হইয়া আমার সর্ব্বনাশের এইরূপ চেষ্টায় চেষ্টিত হইতেছে!” 

হারাধনের এই কথা শুনিয়া সেই বার-বিলাসিনী ভয়ানক ক্রোধে একবারে ক্রোধান্বিত হইয়া পড়িল ও হারাধানকে যাহা ইচ্ছা বলিয়া গালি প্রদান করিতে আরম্ভ করিল। সেই সময় তাহার মুখ দিয়া যে সকল অকথ্য ভাষা বাহির হইয়াছিল, তাহা ‘ হারাধনের চতুদর্শ পুরুষ পর্য্যন্ত অবগত হইতে পারিয়াছিলেন বলিয়া সকলের বিশ্বাস। 

পূৰ্ব্ব হইতেই পাঠকগণ অবগত আছেন যে, হারাধনের পত্নীর নাম গোলাপ। হারাধনের প্রকৃতি অপেক্ষা তাহার প্রকৃতি সম্পূর্ণরূপে স্বতন্ত্র। বিনোদিনীর সহিত তাহার ভালবাসা ছিল, ও উভয়ে উভয়ের বাড়ীতে গমনাগমন করিতেন, ইহাও পাঠকগণ পূৰ্ব্ব হইতে অবগত আছেন। রাসবিহারীর হাতে বিনোদিনী হতা হইয়াছেন, এই কথা শুনিয়া আর কোন রূপেই স্থির থাকিতে পারিলেন না। স্বামীর অনুমতির প্রতীক্ষা না করিয়াই তিনি কেবলমাত্র একটি পরিচারিকা সঙ্গে লইয়া একখানি গাড়িতে রাসবিহারীর বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিলেন। কিন্তু তিনি যে কোন সময় সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হন, তাহা কিন্তু আমরা পূর্ব্বে জানিতে পারি নাই। খুনী মোকদ্দমার অনুসন্ধানের নিয়ম অনুসারে আমরা সেই বাড়ীর আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা প্রভৃতি সকলেরই জবানবন্দী গ্রহণ করিতেছিলাম; সেই সময় জানিতে পারিলাম যে, হারাধনের পত্নী গোলাপও সেইস্থানে উপস্থিত আছেন সুতরাং তাঁহারও জবানবন্দী গ্রহণ করিলাম। তাঁহার জবানবন্দীর সারমর্ম্ম এই রূপ; – প্রায় পনর দিবস অতীত হইল, বিনোদিনী নিমন্ত্রণ উপলক্ষে আমার বাড়ীতে গমন করিয়াছিলেন। আমাদিগের দেশীয় স্ত্রীলোকগণ কোনস্থানে নিমন্ত্রণে গমন করিলে যেমন তাঁহাদিগের প্রায় সমস্ত অলঙ্কার পরিধান করিয়া যান, বিনোদিনীও সেইরূপ তাঁহার সমস্ত অলঙ্কার পরিধান করিয়া সেই স্থানে গমন করেন, এবং পরিশেষে তাহার প্রায় সমস্ত অলঙ্কার আপন অঙ্গ হইতে উন্মোচিত করিয়া একটি পাত্রে করিয়া আমাকে রাখিবার নিমিত্ত প্রদান করেন। আমি উহা আমার সিন্ধুকের মধ্যে চাবি দিয়া রাখিয়া দেই। সন্ধ্যার পর বিনোদিনী যখন নিজের বাড়ীতে গমন করেন, সেই সময় আমি তাঁহার সমস্ত অলঙ্কার তাঁহার নিকট আনিয়া দি; কিন্তু তিনি উহা পরিধান না করিয়া একখানি কাপড়ে উহা বাধিয়া লন, ও আপন বাড়ীতে চলিয়া যান। বিনোদিনী গমন করিবার পর আমি দেখিতে পাই, যে পাত্রে তাঁহার গহনাগুলি রক্ষিত ছিল, তাহাতে একটি অঙ্গুরী রহিয়াছে। উহা দেখিয়াই আমি বুঝিতে পারি যে, উহা তিনি পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছেন। আমি উহা তখন লইয়া পর দিবস রাসবিহারীবাবুকে ফিরত দিবার মানসে আমি উহা আমার স্বামীর হস্তে প্রদান করি। তিনি যে উহা কি করিয়াছিলেন, তাহা আমি অবগত নহি। 

এই সমস্ত অবস্থা অবগত হইবার পর, আমরা বেশ বুঝিতে পারিলাম, যে, হারাধন তাহার প্রতিহিংসা প্রবৃত্তি পরিতৃপ্ত করিবার মানসেই, কতকগুলি মিথ্যা ঘটনার সমাবেশ করিয়া এই সর্ব্বনাশ ঘটাইয়াছে। 

রাসবিহারী এই খুনি মোকদ্দমায় আসামী হইলেন, হারাধনকেও এই খুনির সহায়তা করা অপরাধে আসামী করিলাম। কিন্তু বিচারে হারাধনের কিছুই হইল না, রাসবিহারী চিরদিবসের নিমিত্ত নির্ব্বাসিত হইলেন। 

[জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৮] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *