দীর্ঘকেশী

দীর্ঘকেশী 

(অর্থাৎ দীর্ঘকেশী স্ত্রীলোকের মস্তক সম্বন্ধে অদ্ভুত রহস্য।)

প্রথম পরিচ্ছেদ

কলিকাতার মারকুইস্ স্কোয়ার নামক স্থানটি কলিকাতার পাঠকবর্গের নিকট উত্তমরূপে পরিচিত। মেছুয়াবাজার স্ট্রীটের পার্শ্বে ঐ বৃহৎ স্কোয়ারটি এখন স্কুল ও কলেজের বালকগণের ক্রীড়াস্থল। ঐ স্থানটির এখনও নাম আছে দীঘিপাড়। আমি যে সময়ের কথা বলিতেছি, সেই সময় ঐ স্থানে একটি প্রকাণ্ড পুষ্করিণী ছিল, ঐ পুষ্করিণীর নাম ছিল দীঘি। ঐ দীঘিকে এখন স্কোয়ারে পরিণত করা হইয়াছে। ঐ দীঘির চতুষ্পার্শ্ববর্তী স্থান সকল দীঘির পাড় বা দীঘির পাড়া নামে অভিহিত হইত। ঐস্থানে যে সকল লোক বাস করিত, তাহারা সমস্তই প্রায় নিম্নশ্রেণীর মুসলমান ও চোর ও বদমায়েস। ঐ স্থানে কোন ভদ্র মুসলমানকে বাস করিতে আমি দেখি নাই। 

ঐ পুষ্করিণীর জল অতিশয় গভীর ছিল ও উহার উত্তর পশ্চিম অংশে একটি বৃহৎ অশ্বত্থবৃক্ষ অর্দ্ধশায়িত অবস্থায় ঐ পুষ্করিণীর জলে আপনার প্রতিবিম্বকে প্রতিভাত করিত, এবং বর্ষাকালে অর্থাৎ যে সময় ঐ পুষ্করিণীর জল বর্দ্ধিত হইত, সেই সময় ঐ বৃক্ষের দুই একটি শাখাও ঐ জলের মধ্যে অৰ্দ্ধনিমগ্ন অবস্থায় অবস্থিতি করিত। 

একদিবস প্রত্যুষে সংবাদ আসিল যে, ঐ দীঘির জলের মধ্যে একটি মনুষ্য-মস্তক দৃষ্টিগোচর হইতেছে। 

এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া আমি সেই স্থানে গমন করিলাম। দেখিলাম, আলুলায়িত কেশযুক্ত একটি মনুষ্য-মস্তক, পূর্ব্বকথিত বটবৃক্ষের একটি অঙ্গে নিমগ্ন শাখায় সংলগ্ন হইয়া জলের মধ্যে ভাসিতেছে। আমি সেই অৰ্দ্ধশায়িত অশ্বত্থ বৃক্ষের উপর উঠিয়া যতদূর সম্ভব ঐ মস্তকের নিকট গমন করিলাম; দেখিলাম, উহার উপর প্রায় দুই ফিট জল থাকিলেও ঐ স্থানের জলের গভীরতা অধিক; মস্তকের চুল দীর্ঘ বলিয়া অনুমান হইল, সুতরাং মনে করিলাম, উহা কোন স্ত্রীলোকের মৃতদেহ হইবে। আরও মনে করিলাম, ঐ পাড়ার কোন স্ত্রীলোক জলমগ্ন হইয়া প্ৰাণত্যাগ করিয়াছে, মৃতদেহ উপরে উঠাইলেই উহা যে কাহার মৃতদেহ তাহা কোন না কোন ব্যক্তি বোধ হয় সহজেই চিনিতে পারিবে। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া ঐ মৃতদেহ উপরে উঠাইবার বন্দোবস্ত করিলাম। ডোম ডাকাইয়া ঐ মৃতদেহ ধীরে ধীরে তীরে আনিতে কহিলাম। উহারা আদেশ প্রতিপালন করিতে সেই অশ্বত্থ বৃক্ষের সাহায্যে সেই স্থানে গমন করিল ও ঐ মস্তক স্পর্শ করিয়াই কহিল, “ইহা দেখিতেছি কেবল মস্তক, ইহার সহিত দেহ নাই।” 

ডোমের এই কথা শুনিয়াই ভাবিলাম, আমি পূর্ব্বে যাহা মনে করিয়াছিলাম, এখন দেখিতেছি তাহার বিপরীত। মনে করিয়াছিলাম যে, কোন স্ত্রীলোক জলমগ্ন হইয়া ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছে, কিন্তু এখন দেখিতেছি, তাহা নঞ্চে যে মস্তকের সহিত দেহ সংযুক্ত নাই, তাহা কোন প্রকারেই জলমগ্নের মস্তক হইতে পারে না। যাহা হউক, উহা উপরে উঠাইয়া ভালরূপ পরীক্ষা করিয়া না দেখিলে কোনরূপ মতামত প্রকাশ করা যাইতে পারে না। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিতেছি, এমন সময়ে ডোম ঐ মস্তক পুষ্করিণীর তীরে উঠাইয়া আনিল। দেখিলাম, উহা প্রকৃতই একটি স্ত্রীলোকের মস্তক, কোন তীক্ষ্ণধার অস্ত্রের দ্বারা উহাকে উহার দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন করা হইয়াছে, ও উহার নাক মুখ প্রভৃতি স্থানে এরূপ ভাবে অস্ত্রাঘাত করা হইয়াছে যে, উহার মুখ দেখিয়া সহসা কেহই চিনিতে পারিবে না যে উহা কাহার মস্তক। তথাপি ঐ মস্তকটি দেখিয়া অনুমান হয় যে, ঐ স্ত্রীলোকটি কোন দরিদ্র ঘরের কন্যা বা বনিতা ছিল না, ও বিশেষ রূপবতীই ছিল বলিয়া বিবেচনা হয়। মস্তকের কেশরাশি অতিশয় ঘন নিবিড় কৃষ্ণবর্ণ ও দীর্ঘ। সদা সৰ্ব্বদা স্ত্রীলোকগণের মস্তকে যেরূপ দীর্ঘকেশ দেখিতে পাওয়া যায়, ইহা তাহা অপেক্ষা অনেক দীর্ঘ অর্থাৎ মাপিলে কোনক্রমেই চারিফিটের কম হইবে না। উহার চুল আলুলায়িত কিন্তু দুই তিনখানি ইষ্টক ঐ চুলের সহিত আবদ্ধ রহিয়াছে। দেখিলে অনুমান হয় যে, যাহাতে ঐ মস্তক জলের উপরে ভাসিয়া উঠিতে না পারে তাহার জন্যই ইষ্টক বাঁধিয়া উহা পুষ্করিণীর অগাধ জলে নিক্ষেপ করা হইয়াছে। 

মস্তকটি পুষ্করিণীর ভিতর প্রাপ্ত হওয়ায় স্বভাবতঃই মনে হইল যে, মৃতদেহটিও নিশ্চয়ই ঐরূপ পুষ্করিণীর মধ্যে নিক্ষেপ করা হইয়াছে। মনে মনে ঐরূপ ভাবিয়া যাহাতে ঐ পুষ্করিণীর মধ্যে উত্তমরূপে অনুসন্ধান করা যাইতে পারে, তাহার উদ্যোগ করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। সেই সময় পুষ্করিণীর ভিতর অনুসন্ধান করিতে হইলে জাল ও জেলিয়ার আবশ্যক হইত, সুতরাং অনুসন্ধান করিয়া তাহাই সংগ্রহ করিতে হইল। কতকগুলি জেলিয়াকে ধরিয়া বৃহৎ বৃহৎ জাল সমেত ঐ পুষ্করিণীর ভিতর নামাইয়া দিলাম। পুষ্করিণীটি বহু পুরাতন ছিল, সুতরাং উহার জল নানারূপ পুরাতন জঙ্গলে পূর্ণ ছিল। বহু বৎসরের মধ্যে ঐ পুষ্করিণীর যে কোনরূপ পঙ্কোদ্ধার হইয়াছিল ইহা অনুমান হয় না। একজন জেলিয়া ঐ পুষ্করিণী জমা লইত, সে মধ্যে মধ্যে উহা হইতে মৎস্য ধরিয়া লইলেও সম্পূর্ণরূপে মৎস্য শূন্য করিতে পারিত না, বা ঐ পুষ্করিণী কোনরূপেই পরিষ্কার রাখিতে সমর্থ হইত না। জেলিয়াগণ তাহাদের সাধ্যমত ঐ পুষ্করিণীতে জাল ফেলিয়া বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিল, কিন্তু মৃতদেহের কোনরূপই সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিল না। এইরূপ গোলযোগে প্রায় সমস্ত দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল, কোনরূপেই আমাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে সমর্থ হইল না। 

আমরা যে স্ত্রীর মুণ্ড প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, তাহা দেখিয়া কাহারও সাধ্য ছিল না যে, চিনিতে পারে উহা কাহার মস্তক! অনেক লোক ঐ ছিন্নমুণ্ড দর্শন করিল, কিন্তু কেহই চিনিয়া উঠিতে পারিল না, বা অনুমানও করিতে পারিল না যে, উহা কাহার মুণ্ড! উহা যে কাহার মস্তক, তাহা জানিবার উপায়ের মধ্যে কেবল একমাত্র তাহার দীর্ঘ কেশরাশী! এখন আমাদের একমাত্র ভরসার মধ্যে এই রহিল যে, যদি কেহ বলে— কোন দীর্ঘকেশী সুন্দরীকে পাওয়া যাইতেছে না, তাহা হইলে আমাদের কার্য্য সম্পূর্ণরূপে সিদ্ধ হউক বা না হউক, অনুসন্ধান করিবার কতকটা রাস্তা হইবে, পথটি খোলা থাকুক। মনে মনে এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়া আমরা ঊর্দ্ধর্তন কর্মচারীগণকে আমাদের অভিমত জ্ঞাপন করিলাম। 

ইহার একঘণ্টা পরেই ঐ মস্তক ও তাহার ঘোর কৃষ্ণবর্ণ সুদীর্ঘ কেশরাশীর বর্ণনযুক্ত বিজ্ঞাপন মুদ্রিত হইয়া সহর ও সহরতলীর প্রত্যেক থানায় প্রেরিত হইল। উহাতে এইরূপ আদেশ রহিল যে, ঢোল সোহরতের দ্বারা এই সংবাদ প্রত্যেক রাস্তায় রাস্তায় ও প্রত্যেক গলিতে গলিতে এরূপভাবে প্রচারিত করা হউক, যেন এই বিষয় জানিতে কাহারও বাকী না থাকে। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

উপরিতন কর্মচারীর আদেশ বাহির হইবার পর, দুই তিন ঘণ্টার মধ্যেই সহর ও সহরতলীর সমস্ত লোকই জানিতে পারিল যে, একটি ছিন্নমস্তক কোন এক পুষ্করিণীর ভিতর পাওয়া গিয়াছে। ঐ মস্তকে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ সুদীর্ঘ কেশরাশী বর্ত্তমান। আরও সকলে অবগত হইল যে, যদি কোন গৃহস্থের ঐরূপ দীর্ঘকেশী স্ত্রীলোক বাড়ীতে অনুপস্থিত থাকে, তাহা হইলে তিনি যেন তৎক্ষণাৎ থানায় সংবাদ প্রেরণ করেন। 

এই সংবাদ যে দিবস প্রচারিত হইল, সেই দিবস কোন স্ত্রীলোকেরই অনুপস্থিতি সংবাদ প্রাপ্ত হইলাম না; কিন্তু পর দিবস এক এক করিয়া তিনটি ও তৎপর দিবস দুইটি নিরুদ্দেশের সংবাদ প্রাপ্ত হইলাম। 

এদিকে ডাক্তার সাহেব স্পিরিট বা অপর কোন দ্রব্য দ্বারা যাহাতে ঐ মস্তকটি কিছু দিবস রক্ষা করিতে পারেন, তাহার সবিশেষ চেষ্টা করিতে লাগিলেন। 

এই পাঁচটি দীর্ঘকেশী স্ত্রীলোকের নিরুদ্দেশের সংবাদ যাহারা প্রদান করিয়াছিল, সৰ্ব্বপ্রথমে তাহাদিগকে আনাইয়া সেই দীর্ঘকেশযুক্ত ছিন্ন মস্তক দেখাইলাম, কেহই সবিশেষ চিনিতে পারিল না। উহাদিগের মধ্যে কেহ কহিল, যে স্ত্রীলোকটি পাওয়া যাইতেছে না, তাহার চুল প্রায়ই ঐরূপ ছিল। কেহ কহিল, তাহার চুল অত দীর্ঘ ছিল না। কিন্তু আমাদের এখন প্রধান কাৰ্য্য হইল, ঐ কয়জন স্ত্রীলোক সম্বন্ধে একটু বিশেষ অনুসন্ধান করা, ও যদি সম্ভব হয়, উহাদিগকে খুঁজিয়া বাহির করা। 

যাহাদিগের স্ত্রী কন্যা বা ভগ্নী দুশ্চরিত্রা হইয়া আপনাপন স্বামী বা পিতা ও ভ্রাতার গৃহ পরিত্যাগ করিয়া কুলের বাহির হইয়া গিয়াছে, অথচ অনুসন্ধান করিয়া এ পর্য্যন্ত যাহারা তাহাদিগের কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারে নাই, এখন তাহারা এই সুযোগ সহজে পরিত্যাগ করিল না। পুলিসের সাহায্যে যাহাতে এখন উহাদিগের অনুসন্ধান হইতে পারে, তাহার চেষ্টা করিতে লাগিল। যে স্ত্রীলোকের কেশ এক ফুটের অধিক নহে, তাহার কেশ ঐ ছিন্ন মস্তকের কেশের সমান লম্বা বলিয়া কেহ কেহ আমাদের নিকট প্রকাশ করিল। কাজেই আমাদিগকে ঐ সকল স্ত্রীলোকের অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইতে হইল। যে পাঁচটি স্ত্রীলোকের নিরুদ্দেশ-সংবাদ আমরা প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, তাহাদিগের অনুসন্ধানের ভার যে কেবল আমার উপরই ন্যস্ত হইল তাহা নহে, অপরাপর কর্ম্মচারীগণও তাহাদিগের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত নিযুক্ত হইলেন। পূর্ব্বে আমরা যে উদ্দেশ্যের উপর নির্ভর করিয়া দীর্ঘকেশী স্ত্রীলোকের মস্তক প্রাপ্ত হইবার সংবাদ সহর ও সহরতলির ঘরে ঘরে প্রচারিত করিয়াছিলাম, এখন দেখিলাম, আমাদিগের সেই উদ্দেশ্যের বিপরীত ফল ফলিতে আরম্ভ হইয়াছে। পাঁচটি স্ত্রীলোককে অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিতে প্রবৃত্ত হইয়া সেই কার্য্য শেষ হইবার পূর্ব্বেই আরও ত্রিশ, চল্লিশটি ঐরূপ সংবাদ আসিয়া উপস্থিত হইল। তখন বুঝিলাম, আমাদিগের কার্য্য সিদ্ধ হউক আর না হউক, যাহাদিগের গৃহ হইতে স্ত্রীলোক সকল বাহির হইয়া গিয়াছে, তাহারা তাহাদিগের কাৰ্য্য আমাদিগের দ্বারা সম্পন্ন করাইয়া লইতে প্রস্তুত। আরও বুঝিলাম, যে ব্যক্তি ঐ স্ত্রীলোকটিকে হত্যা করিয়া দেহ হইতে মস্তক বিচ্ছিন্ন পূর্ব্বক পুষ্করিণীতে নিক্ষেপ করিয়াছে, সে কখনই ঐ স্ত্রীলোকের নিরুদ্দেশ সংবাদ আমাদিগকে প্রদান করিবে না, আর যদি ঐ স্ত্রীলোকটি কোন সম্ভ্রান্ত ঘরের হন, তাহা হইলে তিনি সৰ্ব্ব সাধারণের নিকট কখনই বাহির হইতেন না; সুতরাং সাধারণের নিকট হইতে ঐরূপ স্ত্রীলোকের সন্ধান পাওয়া নিতান্ত সহজ নহে। 

মৃত স্ত্রীলোকের কোনরূপ সন্ধান পাওয়া যাউক বা না যাউক, অপরাপর স্ত্রীলোক দিগের অনুসন্ধানে যখন হস্তক্ষেপ করা হইয়াছিল, তখন তাহা শেষ করিতেই হইবে। এখন আমরা তাহাদিগকে অনুসন্ধান করিয়া বাহির করার চেষ্টা না করিয়া তাহাদিগের মস্তকের কেশ কিরূপ লম্বা ছিল কেবল তাহারই অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম, অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম, তাহাদিগের কাহারও মস্তকের কেশ দুই বা আড়াই ফুটের অধিক নহে। তখন বুঝিতে পারিলাম যে, এই অনুসন্ধানে আমাদিগের বিশেষ কোনরূপ ফল লাভ হইবে না, সুতরাং সে অনুসন্ধান পরিত্যাগ করিলাম। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

যে দিবস ঐ মস্তক পাওয়া গিয়াছিল, সেই দিবস ও তাহার পর তিন দিবস ঐরূপ গোলযোগে কাটিয়া গেল; পঞ্চম দিবস প্রত্যুষে সংবাদ পাইলাম যে, পূর্ব্বকথিত পুষ্করিণীর মধ্যে কি একটা ভাসিতেছে। এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া পুনরায় সেইস্থানে গমন করিলাম ও তীর হইতে দেখিলাম, প্রায় পঞ্চাশ ফুট ব্যবধানে জলের মধ্যে কি যেন একটা দেখা যাইতেছে, কিন্তু উহা যে কি, তাহা অনুমান করিতে পারিলাম না। 

এই কলিকাতা সহরের গতি, পাঠকগণ বিশেষরূপ অবগত আছেন, কোন পুলিস-কৰ্ম্মচারী কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে কোনস্থানে দণ্ডায়মান হইলে বিনা উদ্দেশ্যে শত শত লোক আসিয়া তাঁহাকে ঘিরিয়া দাঁড়ায়; বলা বাহুল্য, আমি সেই পুষ্করিণীর ধারে গমন করিলে শত শত লোক আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল। তাহার মধ্যে সকল প্রকার লোককেই দেখিতে পাইলাম। বালক, বৃদ্ধ, যুবক, স্ত্রীলোক প্রভৃতি অনেকেই আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইল; ভদ্রলোক হইতে অতি নীচ শ্রেণীর লোকদিগকে সেইস্থানে দেখিতে পাইলাম। জলের মধ্যে ঐ পদার্থটিকে দেখিয়া তাহাদিগের মধ্যে কেহই স্থির করিতে পারিল না যে উহা কি, কিন্তু সকলেরই বিশ্বাস হইল যে, কোন একটি পদার্থ ঐ স্থানে রহিয়াছে। এই অবস্থা দেখিয়া আমি সেই সমস্ত ব্যক্তিকে লক্ষ্য করিয়া কহিলাম, তোমাদিগের মধ্যে এরূপ কোন এক সাহসী ব্যক্তি আছে, যে সাঁতার দিয়া ঐস্থানে গিয়া দেখিয়া আসিতে পার, ঐ পদার্থটি কি? 

আমার কথার উত্তরে দুইজন নিম্নশ্রেণীর মুসলমান যুবক কহিল, আদেশ পাইলে আমরা এখনি গিয়া দেখিয়া আসিতে পারি, উহা কি? 

তাহাদিগের কথা শুনিয়া আমি তাহাদিগকে ঐস্থান যাইতে কহিলাম, তাহারাও সন্তরণ দিয়া ক্রমে সেই দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল, কিন্তু উহার সন্নিকটবর্ত্তী না হইয়া প্রায় দশ ফিট ব্যবধান হইতে উভয়েই প্রত্যাগমন করিল ও কহিল, আমরা উহার নিকটে যাইতে পারিলাম না ও বুঝিতে পারিলাম না যে, উহা কি? অনুমান হইল, দূর হইতে আমাদিগকে দেখিয়াই উহা যেন তাহার হস্ত পদ সঞ্চালন করিয়া আমাদিগকে ধরিতে আসিতেছে। আমাদিগের ভয় হইল, সুতরাং প্রাণ লইয়া আমরা সেইস্থান হইতে পলাইয়া আসিলাম। 

ঐ অবস্থা দেখিয়া ও মুসলমান যুবকদ্বয়ের কথা শুনিয়া কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। পূর্ব্বে মনে করিয়াছিলাম, যাহার ছিন্নমস্তক আমরা পূর্ব্বে প্রাপ্ত হইয়াছি, তাহারই দেহ ঐস্থানে ঐরূপ অবস্থায় ভাসিতেছে; আরও মনে করিয়াছিলাম যে, ঐ মৃতদেহ ঐ পুষ্করিণীর গভীর গর্ভে নিমগ্ন ছিল, ধীবরগণ কর্তৃক স্থানচ্যুত হইয়া ক্ৰমে ভাসিয়া উঠিতেছে; কিন্তু এখন মুসলমান যুবকদ্বয়ের কথা অনুসারে জানিতে পারা যাইতেছে যে, ঐ পদার্থটি তাহার হস্ত পদ নাড়িয়া উহাদিগকে ধরিতে আসিতেছিল। এরূপ অবস্থায় এখন কি করা যাইতে পারে?- যদি আমার পূর্ব্বের অনুমান সত্য হয়, তাহা হইলে মুসলমান যুবকদ্বয় ভীত হইয়া ঐরূপ কথা বলিতেছে; আর যদি উহাদিগের কথা সত্য হয়, তাহা হইলে আমার অনুমান যে সম্পূর্ণরূপে ভ্রমাত্মক, সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া দুইজন ডুবারিকে আনিবার নিমিত্ত একটি লোক পাঠাইয়া দিলাম। 

প্রায় দুই ঘণ্টা পরে দুইজন ডুবারির সহিত সে আসিয়া উপস্থিত হইল। ঐ দুইজন ডুবারিকে ঐ পদার্থটিকে দেখাইয়া দিলাম ও কহিলাম, তোমরা ঐস্থানে গমন করিয়া দেখ, উহা কি? যদি উহা তীরে আনিবার উপযুক্ত হয়, তাহা হইলে যে প্রকারে হউক, উহাকে তীরে আনয়ন কর। 

আমার কথা শুনিয়া ডুবারিদ্বয় সন্তরণ দিয়া যেস্থানে ঐ পদার্থটি দেখা যাইতেছিল, সেইস্থানে গমন করিল, ও ডুব দিল। প্রায় পাঁচ মিনিটকাল আর উহাদিগকে দেখিতে পাইলাম না বা জলের ভিতর উহারা কি করিতেছে, তাহাও কিছু বুঝিতে পারিলাম না। 

প্রায় পাঁচ মিনিট পরে উহারা আমাদিগের অতি নিকটবর্ত্তী স্থানে আসিয়া জল হইতে উত্থিত হইল। উহারা উত্থিত হইবার সঙ্গে সঙ্গে স্থানের জল কদমময় হইয়া গেল, সুতরাং ঐস্থানে যে কি আছে, তাহার কিছুই দেখিতে পাইলাম না। উহাদিগকে জল হইতে উঠিতে দেখিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, যে পদার্থটি আমি তোমাদিগকে দেখাইয়া দিয়াছিলাম, তাহা তোমরা দেখিতে পাইয়াছ কি? 

ডুবারি। হাঁ মহাশয়, পাইয়াছি। 

আমি। উহা কি পদার্থ বলিয়া অনুমান হয়? 

ডুবারি। বোধ হইতেছে উহা মৃতদেহ। 

আমি। মৃতদেহ হইলে তোমরা অনায়াসেই উহা ভাসাইয়া আনিতে পারিতে। 

ডুবারি। আমরা ভাসাইয়া আনিবার চেষ্টা করিয়াছিলাম, কিন্তু উহাকে কোন প্রকারেই ভাসাইতে পারি নাই।

আমি। কেন উহাকে ভাসাইতে পারিলে না? 

ডুবারি। বোধ হইতেছে, কোনরূপ ভারি দ্রব্য উহার সহিত বাঁধা আছে। 

আমি। তাহা হইলে ঐ স্থান হইতে উহা কি কোন প্রকারেই এখানে আনা যাইবে না? 

ডুবারি। আমরা উহা টানিয়া আনিয়াছি। এই স্থানের জল ঘোলা হইয়া গিয়াছে বলিয়া আপনারা উহা দেখিতে পাইতেছেন না, একটু অপেক্ষা করুন, কোন গতিকে আমরা উহা তীরে উঠাইয়া দিতেছি। 

আমি। বিশেষ সাবধানের সহিত তীরে উঠাইবার চেষ্টা কর, যে ভারি দ্রব্যের সহিত উহা বাঁধা আছে, তাহার সহিত উঠাইতে পারিলে ভাল হয়। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

আমার কথা শুনিয়া ডুবারিদ্বয় বহুকষ্টে ঐ মৃতদেহটি জল হইতে তীরে উঠাইয়া দিল। দেখিলাম, উহা একটি স্ত্রীলোকের মৃতদেহ, কিন্তু বিবর্জ্জিত মস্তক। আরও দেখিলাম, ঐ মস্তকহীন মৃতদেহের সহিত তিনটি জলপূর্ণ বৃহৎ কলসি রজ্জু দ্বারা তিন স্থানে বাঁধা আছে, কিন্তু মৃতদেহটি এরূপভাবে পচিয়া গিয়াছে যে, তাহার যেস্থানে হস্ত স্পর্শিত হইতেছে, সেইস্থানের মাংস গলিয়া পড়িতেছে ও উহা হইতে এরূপ দুর্গন্ধ বাহির হইতেছে যে, সেইস্থানে ক্ষণকালের জন্য অবস্থান করিতে পারে কাহার সাধ্য। 

পূর্ব্বে আমরা এই পুষ্করিণীতে দেহবিহীন স্ত্রীমুণ্ড প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, এখন মস্তকবিহীন স্ত্রীদেহ প্রাপ্ত হইয়া বুঝিতে পারিলাম, যাহার মস্তক প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, এ তাহারই দেহ। সুতরাং এ সম্বন্ধে নূতন করিয়া আর আমাদিগকে অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইতে হইল না; কারণ আমরা পূর্ব্ব হইতেই এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত ছিলাম। 

ঐ স্থানে ঐ মৃতদেহটি যখন আমরা উত্তমরূপে অবলোকন করিতেছি, সেই সময়ে আমাদিগের একজন ঊর্দ্ধতন কর্মচারী সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি আমাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, পূর্ব্বে এই পুষ্করিণীতেই দীর্ঘকেশী স্ত্রীলোকের মস্তক পাওয়া গিয়াছিল না? 

আমি। হাঁ। 

ঊর্দ্ধতন কৰ্ম্মচারী। এ মস্তকহীন দেহটিও স্ত্রীলোকের দেখিতেছি। 

আমি। হাঁ, ইহা স্ত্রীলোকের মৃতদেহ। 

ঊ-ক। ইহাকে বিবস্ত্র অবস্থায় রাখা হইয়াছে কেন? 

আমি। ইহাকে এইরূপ বিবস্ত্র অবস্থাতেই পাওয়া গিয়াছে। নিকটে বস্ত্র প্রাপ্ত না হওয়ায়, বাধ্য হইয়া বিবস্ত্র অবস্থায় রাখিতে হইয়াছে। একখানি বস্তু কিনিয়া আনিবার নিমিত্ত আমি একজন লোককে পাঠাইয়া দিয়াছি, আশা করি, সে এখনই প্রত্যাগমন করিবে। 

ঊ-ক। পূর্ব্বে যে মস্তক পাওয়া গিয়াছে, তাহা কি ইহারই মস্তক বলিয়া অনুমান হয়?

আমি। অনুমান কেন, উহা যে ইহারই মস্তক, সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। 

ঊ-ক। এই মৃতদেহের সহিত এরূপ জলপূর্ণ কলসী বাঁধিয়া রাখিবার প্রয়োজন কি? 

আমি। যাহাতে মৃতদেহটি সহজে ভাসিয়া উঠিতে না পারে, তাহার জন্যই উহার সহিত এইরূপে জলপূর্ণ কলসী বাঁধিয়া দিয়াছে। 

ঊ-ক। এ কার্য্য একজনের দ্বারা কখনই সম্পন্ন হইতে পারে না। 

আমি। না, ইহা একজনের কার্য্য নহে, দুই বা ততোধিক ব্যক্তির দ্বারা এই কার্য্য সম্পন্ন হইয়াছে। 

ঊ-ক। যে রজ্জুর দ্বারা কলসীত্রয় বাঁধা আছে, উহা কিরূপ রজ্জু বলিয়া অনুমান হয়? 

আমি। বাজারে যে সকল রজ্জু সদাসর্ব্বদা বিক্রয় হইয়া থাকে, ইহা সেই রজ্জু, ও দেখিয়া অনুমান হইতেছে, নূতন রজ্জু দ্বারাই এই সকল কলসী বাঁধা হইয়াছে। 

ঊ-ক। রজ্জু সম্বন্ধে বোধ হয় একটু অনুসন্ধান করা আবশ্যক। 

আমি। খুব আবশ্যক, উহা আমাদিগকে করিতেই হইবে। 

আমাদিগের সহিত এইরূপ কথাবার্তা হইবার পর ঊর্দ্ধর্তন কর্মচারী সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন, আমরাও ঐ মৃতদেহ স্থানান্তরিত করিয়া আমাদিগের কাৰ্য্যে নিযুক্ত হইলাম! 

আমরা। আমাদিগের কার্য্যে নিযুক্ত হইলাম সত্য কিন্তু এখন কোন্ পথ অবলম্বন করিলে আমরা যে আমাদিগের কার্য্য সম্পন্ন করিতে সমর্থ হইব, তাহার কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। যে উপায় অবলম্বন করিয়া আমরা এই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম, সেই উপায়ে আমরা কিছুমাত্র কৃতকার্য্য হইতে পারি নাই, কেবলমাত্র কয়েকদিবস বৃথা নষ্ট হইয়াছে। যে মৃতদেহ পাওয়া যায়, উহা কাহার মৃতদেহ, তাহা জানিতে না পারিলে হত্যা মকদ্দমার প্রায়ই কিনারা হয় না। সেই নিমিত্ত উহা যে কাহার মৃতদেহ, তাহা জানিবার জন্যই আমরা এই কয়দিবস চেষ্টা করিতেছিলাম, কিন্তু আমাদিগের সে চেষ্টা বিফল হইয়া গিয়াছে। দীর্ঘকেশী স্ত্রীলোকটি যে কে, এ পর্য্যন্ত আমরা তাহার কিছুমাত্র স্থির করিয়া উঠিতে পারি নাই। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

কলিকাতার ক্যানিং ষ্ট্রীট পাঠকগণের মধ্যে কাহারও অপরিচিত নহে। ঐস্থান বাণিজ্য কার্য্যের নিমিত্ত প্রসিদ্ধ। ঐ রাস্তার দুই ধারে সারি সারি দোকান, সূর্যোদয়ের পর হইতে রাত্রি নয়টা দশটা পৰ্য্যন্ত ঐ সকল দোকানে যেমন কেনা- বেচার বিরাম নাই, সেইরূপ লোক যাতায়াতেরও কিছুমাত্র কমবেশী নাই।। দোকানগুলি দেখিয়া নিতান্ত সামান্য দোকান বলিয়া অনুমান হয়, কিন্তু যাঁহারা উহাদিগের ভিতরের অবস্থা জানেন, তাঁহারা বলিয়া থাকেন, ঐ সকল দোকানের মূলধন কম নহে, ও উহাদিগের নিকট হইতে যে কোন দ্রব্য যত পরিমাণ চাহিবে, তৎক্ষণাৎ তাহা প্রাপ্ত হইবে। দোকানের সুদূরবর্তী স্থানে গলির ভিতর প্রত্যেক দোকানদারের দুই চারিটি করিয়া গুদাম আছে, ঐ সকল গুদাম দোকানের বিক্রেয় দ্রব্যের দ্বারা পরিপূর্ণ, যেমন কোন একটি দ্রব্য কম পড়িতেছে, অমনি ঐ সকল গুদাম হইতে ঐ সকল দ্রব্য আনাইয়া ঐ সকল স্থান পূর্ণ করিয়া রাখা হইতেছে। 

ঐ স্থানের একজন ব্রাহ্মণ দোকানদারের সহিত আমার পরিচয় ছিল, পরিচয়ই বা বলি কেন, তাহার সহিত আমার বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। সময় সময় আমি তাহার দোকানে গিয়া বসিতাম ও দোকানের বেচা-কেনার অবস্থা দেখিতে দেখিতে দুই এক ঘণ্টা অতিবাহিত করিতাম। যে দিবস মস্তক-বিবর্জ্জিত স্ত্রীলোকের মৃতদেহ পুষ্করিণীর মধ্য হইতে আমরা প্রাপ্ত হইয়া ছিলাম, তাহার তিন চারি দিবস পরে আমি আমার সেই বন্ধুর দোকানে গমন করিলাম। তখন বেলা প্রায় শেষ হইয়া গিয়াছে, অতি অল্প মাত্রই আছে। সেই সময় ঐ দোকান হইতে রাস্তার অপর পার্শ্বস্থিত একটি দ্বিতল বাড়ীর ছাদের উপর হঠাৎ আমার নয়ন আকৃষ্ট হইল। দেখিলাম, ছাদের উপর দুইটি স্ত্রীলোক পদচারণ করিতেছে। একটিকে দেখিয়া অনুমান হয় যে, তাহার বয়স হইয়াছে। বোধ হয়, তাহার বয়ঃক্রম ৫৫ বৎসরের কম নহে। অপরটি অল্পবয়স্কা দেখিয়া অনুমান হয়, তাহার বয়ঃক্রম ১৬।১৭ বৎসরের অধিক হইবে না। উভয়েই আলুলায়িতকেশা। যে দীর্ঘকেশী স্ত্রীলোকের অনুসন্ধানে আমরা প্রবৃত্ত ছিলাম, ইহাদিগের কেশের দৈর্ঘ্যতা তাহা অপেক্ষা কোন অংশে ন্যূন নহে, দেখিতেও প্রায় সেইরূপ। উভয়েই ছাদের উপর বেড়াইতেছে, কিন্তু দূর হইতে দেখিয়া অনুমান হইতেছে, ঐ কেশরাশী তাহাদিগের পদ সৃষ্ট করিয়া আছে। উভয় স্ত্রীলোকের কেশের সাদৃশ্য দেখিয়া আমার মনে হইল, যে দীর্ঘকেশীর মৃতদেহ আমরা প্রাপ্ত হইয়াছি ও যাহার অনুসন্ধানে অনর্থক কয়েক দিবস অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে, সেই স্ত্রীলোকের সহিত এই দীর্ঘকেশী স্ত্রীলোকদ্বয়ের কোনরূপ সংস্রব আছে কি? ঐ স্ত্রীলোকটি যে কে ছিল, তাহার কোনরূপ সন্ধান কি ইহাদিগের নিকট হইতে কিছুমাত্র প্রাপ্ত হইব না? এরূপ হইতে পারে, সেই স্ত্রীলোকটি ইহাদিগের কেহ না কেহ হইবে। দুইটি স্ত্রীলোকের চুলের ভাব যখন একই রূপ দেখিতেছি, তখন বোধ হইতেছে, ইহাদিগের বংশই এইরূপ দীর্ঘকেশী ও মৃতা স্ত্রীলোকটিও হয় ত ইহাদিগের কেহ না কেহ হইবে। এরূপ স্ত্রীলোকদ্বয় যখন হঠাৎ আমার নয়নগোচর হইল, তখন বিশেষরূপ অনুসন্ধান না করিয়া নিশ্চিন্ত থাকা আদৌ কৰ্ত্তব্য নহে। এইরূপ ভাবিয়া আমি আমার সেই দোকানদার বন্ধুকে কহিলাম, দেখ দেখি, স্ত্রীলোকের ঐরূপ কেশ আর কখন দেখিয়াছ কি? 

বন্ধু। দেখিব না কেন? আমি ত প্রত্যহই দেখিয়া থাকি। কেন, তুমি কি ইতিপূর্ব্বে উহাদিগকে আর কখন দেখ নাই? 

আমি। না, দেখিলে আর আমি তোমাকে বলিব কেন? 

বন্ধু। তুমি তো প্রায়ই আমার দোকানে আসিয়া থাক, আর উহারাও প্রায়ই ছাদের উপর বেড়াইয়া থাকে, এ পর্য্যন্ত কি উহারা তোমার নয়নপথে কখন পতিত হয় নাই? 

আমি। না, আজই আমি উহাদিগকে প্রথম দেখিলাম। উহারা কাহারা, তুমি কিছু অবগত আছ? 

বন্ধু। আছি। 

আমি। কিরূপ অবগত আছ? 

বন্ধু। তুমি জান যে, আমার সকল দ্রব্যের এই দোকানে স্থান কুলায় না। 

আমি। তাহা জানি, আর জানি এই নিমিত্ত তোমার কয়েকটি গুদাম ভাড়া আছে। 

বন্ধু। আমার কয়টি গুদাম আছে তাহা জান? 

আমি। না, তবে এইমাত্র জানি যে, কয়েকটি গুদাম ভাড়া আছে। 

বন্ধু। কোথায় আমার গুদাম জান? 

আমি। না, তাহাও জানি না, তবে এইমাত্র বলিতে পারি যে, দোকানের সন্নিকটবর্ত্তী কোন না কোন স্থানে তোমার গুদাম ভাড়া আছে। 

বন্ধু। যে বাড়িতে দুইটি দীর্ঘকেশী স্ত্রীলোক দেখিয়া তুমি হতজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছ, ঐ বাড়ীটিও আমার একটি গুদাম। 

আমি। ঐ বাড়ীটি যদি তুমি গুদামরূপে ব্যবহার করিয়া থাক, তাহা হইলে ঐ বাড়ীতে মনুষ্য কিরূপে বাস করিয়া থাকে? 

বন্ধু। বাড়ীর একতলায় যতগুলি ঘর আছে, সমস্তগুলিই আমার গুদাম। উহারা দোতালায় বাস করিয়া থাকে, নীচের তলার সহিত উহারদিগের কোনরূপ সংস্রব নাই। 

আমি। তাহা হইলে ঐ বাড়ীতে তুমি সৰ্ব্বদাই গিয়া থাক? 

বন্ধু। আবশ্যক হইলেই যাই। ঐ বাড়ীতে আমার একজন গুদাম সরকার আছে, তথাপি দিনের মধ্যে আমাকে তিন চারিবার তথায় গমন করিতে হয়। 

আমি। তাহা হইলে উহাদিগের সহিত নিশ্চয়ই তোমার আলাপ-পরিচয় আছে? 

বন্ধু। বন্ধুত্ব আছে। 

আমি। উহারা কি লোক? 

বন্ধু। ইহুদি। 

আমি। এই বাড়ীতে উহারা কত দিন হইতে আছে? 

বন্ধু। বহুকাল আছে, বোধ হয় বিশ বৎসরের কম হইবে না। 

আমি। উহারা কাহারা বা কি কার্য্য করিয়া থাকে? 

বন্ধু। উহারা একরূপ হাফ্ বেশ্যা, গৃহস্থের ধরণে বাস করে বটে, কিন্তু বেশ্যাবৃত্তি করিতেও সঙ্কুচিত হয় না।

আমি। উহারা কয়জন এই বাড়ীতে বাস করিয়া থাকে? 

বন্ধু। পুরুষের মধ্যে একজন বৃদ্ধ ইহুদি। ঐ যে প্রবীণা স্ত্রীলোকটিকে দেখিতেছ, সে উহাকেই আপনার স্ত্রী বলিয়া পরিচয় প্রদান করিয়া থাকে, কিন্তু উহাকে ঐ বৃদ্ধের স্ত্রী বলিয়া আমার বোধ হয় না, কারণ অপর পুরুষদিগের সহিত উহার সম্মুখে আমোদ আহ্লাদ করিতেও আমি দেখিয়াছি। 

আমি। অপর স্ত্রীলোকটি কে? 

বন্ধু। ঐ প্রবীণার কন্যা। 

আমি। উহারা কয় সহোদরা? 

বন্ধু। আমি উহাদিগের দুই ভগ্নীকে দেখিয়াছি। 

আমি। দুই ভগ্নীই কি এই বাড়ীতে থাকে? 

বন্ধু। যেটিকে দেখিতে পাইতেছ, সে এই বাড়ীতেই তাহার মাতার সহিত বাস করে। কলিকাতায় একটি বাঙ্গালী জমিদারবাবু ইহাকে রাখিয়াছে, তিনি প্রায়ই এখানে আসিয়া থাকেন, ও তাঁহা-কর্তৃকই ইহাদিগের খরচ-পত্রের সরবরাহ হইয়া থাকে। 

আমি। উহার অপর ভগ্নী কি এখানে থাকে না? 

বন্ধু। সে এই স্থানে থাকে না, কিন্তু মধ্যে মধ্যে এখানে আসিয়া থাকে। 

আমি। তুমি এখানে তাহাকে শেষ কতদিবস হইল দেখিয়াছ? 

বন্ধু। গত পনের দিবসের মধ্যে আমি তাহাকে এ বাটীতে দেখিয়াছি।

আমি। সে থাকে কোথায়? 

বন্ধু। শুনিয়াছি, সে কলুটোলায় থাকে। 

আমি। কলুটোলায় সে কাহার নিকট থাকে? তাহার কি বিবাহ হইয়াছে? 

বন্ধু। ইহাদিগের আবার বিবাহ, শুনিয়াছি কলুটোলায় একজন চামড়ার মহাজন তাহাকে রাখিয়াছে, তাহারই সহিত সে সেই স্থানে বাস করিয়া থাকে। 

আমি। সেই চামড়ার মহাজন কি উহাদিগের জাতীয়? 

বন্ধু। না। 

আমি। তবে সে কোন্ জাতীয়? 

বন্ধু। মুসলমান বলিয়া আমি শুনিয়াছি কিন্তু কখন তাহাকে দেখি নাই। 

আমি। তুমি সেই স্ত্রীলোকটিকে দেখিয়াছ? 

বন্ধু। খুব দেখিয়াছি, অনেকবার দেখিয়াছি। 

আমি। সে দেখিতে কেমন? 

বন্ধু। বেশ সুশ্রী। 

আমি। তাহার ভগ্নী দেখিতে যেরূপ? 

বন্ধু। আমার বোধ হয় ইহা অপেক্ষাও সে দেখিতে ভাল। 

আমি। সে এটি অপেক্ষা বড় না ছোট? 

বন্ধু। সেই বড়, আর যেটাকে এখন দেখিতে পাইতেছ, সেই ছোট। 

আমি। তাহার মস্তকের কেশ দেখিতে কিরূপ? 

বন্ধু। ইহাদিগের যেরূপ কেশের বাহার দেখিতেছ, তাহার কেশও সেইরূপ। ইহাদিগের তিনজনেরই কেশের সমান বাহার। 

আমি। এরূপ কেশ তুমি আর কখন দেখিয়াছ? 

বন্ধু। আমি অনেক জাতীয় স্ত্রীলোক দেখিয়াছি, হিসাব মত প্রায় ইহুদি পাড়ার মধ্যেই বাস করিয়া থাকি, কিন্তু এই তিনটি স্ত্রীলোক ভিন্ন অপর কোন স্ত্রীলোকের মস্তকে এরূপ কেশরাশী আর কখন দেখি নাই। 

আমি। যে মুসলমান চামড়াওয়ালা ইহার বড় ভগ্নীকে রাখিয়াছে, তাহার বাড়ী কে জানে বলিতে পার?

বন্ধু। উহারাই জানে, আর কে জানিবে। 

আমি। বৃদ্ধ ইহুদি তোমার নিকট পরিচিত? 

বন্ধু। খুব পরিচিত। এক হিসাবমত উহারা আমার প্রজা। 

আমি। কি সূত্রে উহারা তোমার প্রজা হইল? 

বন্ধু। যে বাড়ীতে উহারা বাস করে, সেই বাড়ীতে আমার গুদাম আছে, তাহা আমার নিজের বাড়ী না হইলেও যাহার বাড়ী তাহার নিকট হইতে ঐ সমস্ত বাড়ী আমি এগ্রিমেন্ট করিয়া লইয়াছি, সমস্ত বাড়ীর ভাড়া আমিই তাহাকে প্রদান করিয়া থাকি। আমার নিকট হইতে ঐ বৃদ্ধ ইহুদি ঐ বাড়ীর দোতালাটি ভাড়া করিয়া লইয়াছে। সে উহার ভাড়া আমাকেই প্রদান করিয়া থাকে, এরূপ অবস্থায় বোধ হয় আমি বলিতে পারি যে, উহারা আমার প্রজা। 

আমি। তা তো নিশ্চয়ই, এরূপ অবস্থায় ঐ বৃদ্ধ ইহুদিকে যদি তুমি কোনরূপ উপরোধ কর, তাহা হইলে বোধ হয় সে অনায়াসে শুনিতে পারে? 

বন্ধু। পারে বলিয়া তো আমার বিশ্বাস। 

আমি। আমি তাহাকে একটি সামান্য উপরোধ করিতে চাই। 

বন্ধু। কি উপরোধ? 

আমি। সে একবার কলুটোলায় গিয়া দেখিয়া আসে যে, তাহার কন্যা সেই স্থানে আছে কি না, আর যদি না থাকে, তাহা হইলে এখন সে কোথায় তাহা যদি জানিতে পারে। 

বন্ধু। এ অতি সামান্য কথা, বৃদ্ধ যদি বাড়ীতে থাকে, তাহা হইলে আমি এখনই তাহাকে ঐ স্থানে পাঠাইয়া দিতেছি, কিন্তু একটি কথা আমি জিজ্ঞাসা করিতে চাই। 

আমি। কি কথা? 

বন্ধু। ইহা জানিবার প্রয়োজন কি? 

আমি। বিশেষ প্রয়োজন না থাকিলে আর আমি বলিব কেন, সে যদি ঐ স্থানে না থাকে, তাহা হইলে আমার যে কি প্রয়োজন তাহার সমস্ত কথা তোমার নিকট বলিব। 

বন্ধু। আর সে যদি ঐ স্থানে থাকে। 

আমি। তাহা হইলেও যদি জানিতে চাও তবে বলিব। 

আমার কথা শুনিয়া আমার সেই বন্ধু দোকানদার তাহার দোকানের একজন কর্মচারীকে ঐ বাড়ীতে পাঠাইয়া দিলেন, ও বলিয়া দিলেন যে, “বৃদ্ধ যদি এখন বাড়ীতে থাকে, তাহা হইলে আমার নাম করিয়া তাহাকে একবার আমার নিকট ডাকিয়া আন।” 

বন্ধুর কথা শুনিয়া তাহার সেই কর্ম্মচারী ঐ বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল ও দেখিতে দেখিতে সেই বৃদ্ধকে সঙ্গে করিয়া সেই দোকানে আমার বন্ধুর নিকট আনিয়া উপস্থিত হইল। বৃদ্ধ ইহুদি সেই স্থানে আসিয়াই আমার সেই বন্ধুকে কহিল, “আপনি কি আমাকে ডাকিয়াছেন?” 

বন্ধু। হাঁ। 

বৃদ্ধ। কেন? 

বন্ধু। একটি সামান্য কথার জন্য। 

বৃদ্ধ। কি কথা? 

বন্ধু। আপনার বড় কন্যাটিকে অনেক দিবস দেখি নাই। তিনি এখন কোথায়? 

বৃদ্ধ। কলুটোলায় আছে। 

বন্ধু। আপনি তাহাকে কত দিবস দেখেন নাই? 

বৃদ্ধ। প্রায় ১৫ দিবস হইল সে আমার এখানে আসিয়াছিল, সেই সময় আমি তাহাকে দেখিয়াছিলাম। তার পর আর তাহাকে দেখি নাই। 

বন্ধু। তাহার সহিত আমার একবার সাক্ষাৎ করিবার বিশেষ প্রয়োজন হইয়াছে, আপনি একবার সেইস্থানে গিয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করুন ও জিজ্ঞাসা করিয়া আসুন, কোন্ সময় আমি সেই স্থানে গমন করিলে তাহার সহিত সাক্ষাৎ হইতে পারিবে। আমি জানি, তিনি কলুটোলায় থাকেন, কিন্তু কোন্ বাড়ীতেথাকেন, তাহা জানি না, এই জন্যই আপনাকে একটু কষ্ট প্রদান করিতেছি; তাহার ঠিক ঠিকানা আমার জানা থাকিলে আমি নিজে গিয়াই এতক্ষণ তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া আসিতাম। 

বৃদ্ধ। এ অতি সামান্য কথা, যে স্থানে আমার কন্যা থাকে সেই স্থান এখান হইতে বহু দূরবর্তী নহে, বোধ হয় অৰ্দ্ধ ঘণ্টার মধ্যেই আমি সেই স্থান হইতে ফিরিয়া আসিতে পারিব। আমি এখনই সেই স্থানে যাইতেছি। যদি তাহাকে বাড়ীতে পাই, তাহা হইলে আমি এখনই তাহাকে সঙ্গে লইয়া আপনার নিকট আসিতেছি। 

বন্ধু। আর যদি এখন তাহার সাক্ষাৎ না পান? 

বৃদ্ধ। তাহা হইলেও আমি সেই সংবাদ আপনাকে প্রদান করিব। 

এই বলিয়া বৃদ্ধ সেই দোকান হইতেই কলুটোলা অভিমুখে গমন করিল। মুরগিহাটা হইতে কলুটোলা বহুদূর ব্যবধান নহে, তাহা কলিকাতার পাঠকগণ সকলেই অবগত আছেন। সুতরাং তাহার প্রত্যাগমনের প্রত্যাশায় আমি সেই স্থানেই আপেক্ষা করিতে লাগিলাম। 

সেই সময় আপনার বন্ধু আমাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “ঐ ইহুদি স্ত্রীলোকটির জন্য এত অনুসন্ধান করিতেছেন কেন?”

আমি। দীঘির পাড়ায় একটি স্ত্রীলোকের মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, এ কথা তুমি শুন নাই কি? 

বন্ধু। শুনিয়াছি। 

আমি। যে দুইটি স্ত্রীলোক ছাদের উপর বেড়াইতেছে, তাহাদিগের মস্তকের চুলের সহিত মৃত স্ত্রীলোকের মস্তকের চুলের বিশেষ সাদৃশ্য আছে, তাই ঐ স্ত্রীলোকটির অনুসন্ধান করিতেছি। 

বন্ধু। তোমার উদ্দেশ্য এখন আমি বুঝিতে পারিলাম। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

আমার সেই দোকানদার বন্ধুর দোকানে প্রায় এক ঘণ্টাকাল বসিয়া থাকিবার পর সেই বৃদ্ধ ইহুদি একাকী প্রত্যাগমন করিল। তাহাকে দেখিয়া আমার বন্ধু তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি শীঘ্রই ফিরিয়া আসিয়াছেন!” 

বৃদ্ধ। হাঁ মহাশয়। 

বন্ধু। আপনার কন্যার সহিত আপনার সাক্ষাৎ হইয়াছে? 

বৃদ্ধ। না। 

বন্ধু। কেন সাক্ষাৎ হইল না? 

বৃদ্ধ। তিনি বাড়ীতে নাই। 

বন্ধু। কোথায় গিয়াছেন? 

বৃদ্ধ। তাহা কেহ বলিতে পারিল না। 

বন্ধু। এ কিরূপ কথা হইল? 

বৃদ্ধ। ইহা যে কিরূপ কথা তাহা আমিও বুঝিতে পারিতেছি না। 

বন্ধু। চামড়ার সওদাগরের সহিত আপনার সাক্ষাৎ হইয়াছিল? 

বৃদ্ধ। হইয়াছিল। 

বন্ধু। তিনি কি কহিলেন? 

বৃদ্ধ। তাহার কথা শুনিয়া আমার মন নিতান্ত অস্থির হইয়া পড়িয়াছে, আমি ভাল মন্দ কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। 

বন্ধু। সে কেমন কথা? 

বৃদ্ধ। তিনি কহিলেন, আজ কয়েক দিবস হইল তাহার সহিত আমার কন্যার কোন একটি সামান্য কথা লইয়া একটু মনোবিবাদ হয়। এই কারণে রাগ করিয়া রাত্রিযোগে তিনি কোথায় চলিয়া গিয়াছেন, তিনিও রাগ করিয়া তাহার আর কোন সন্ধান করেন নাই, কারণ তিনিও ভাবিয়াছেন যে, আমার কন্যা আমারই বাড়ীতে আসিয়াছে। 

বন্ধু। এ সংবাদ তো আপনাকে দেওয়া তাহার উচিত ছিল? 

বৃদ্ধ। ছিল বৈ কি, কিন্তু তিনি তাহা দেন নাই। 

বন্ধু। তাহা হইলে সে এখন কোথায় গমন করিল? 

বৃদ্ধ। আমি তাহার কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না ও আমার মনেরও এখন কিছুমাত্র স্থিরতা নাই। আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি আমার স্ত্রীকে এই সংবাদটি প্রদান করিয়া এখনই আপনার নিকট আগমন করিতেছি। 

এই বলিয়া বৃদ্ধ ইহুদি দ্রুতবেগে তাহার বাড়ীতে প্রবেশ করিল। 

যে স্ত্রীলোকদ্বয়ের চুলের বাহার দূর হইতে দেখিতেছিলাম, কিয়ৎক্ষণ পরে তাহাদিগকে সঙ্গে লইয়া সেই বৃদ্ধ ইহুদী আমার বন্ধুর দোকানে আসিয়া উপস্থিত হইল। সেই সময় আমি উহাদিগের চুলগুচ্ছ বিশেষরূপে দর্শন করিলাম, ও বুঝিলাম, এই চুলের সহিত সেই ছিন্নমস্তকের চুলের কিছুমাত্র প্রভেদ নাই। তখন বুঝিলাম, আমার উদ্দেশ্য অনেকদূর সফল হইয়াছে; ঐ মৃতদেহ এই বৃদ্ধ ইহুদীর জ্যেষ্ঠ কন্যার দেহ ভিন্ন অপর কাহারও নহে। 

বৃদ্ধ। আপনারা আমার কন্যা সম্বন্ধে কোন বিষয় অবগত আছেন কি? 

বন্ধু। না। 

বৃদ্ধ। তবে তাহার সহিত কি নিমিত্ত সাক্ষাৎ করিতে চাহিতেছিলেন?

বন্ধু। একটি প্রয়োজন ছিল বলিয়া। 

বৃদ্ধ। কি প্রয়োজন তাহা জানিতে পারি কি? 

বন্ধু। আমার নিজের কোন প্রয়োজন ছিল না। 

বৃদ্ধ। কাহার প্রয়োজন ছিল? 

বন্ধু। আমার এই বন্ধুটির। 

বৃদ্ধ। আপনার কি প্রয়োজন ছিল মহাশয়? 

আমি। যে প্রয়োজন, তাহা বলিবার সময় এখন নাই। 

বৃদ্ধ। কেন মহাশয় 

আমি। কারণ আপনার সহিত আমার পরিচয় নাই। 

বৃদ্ধ। আমার কন্যার সহিত কি আপনার পরিচয় আছে? 

আমি। না, পরিচয় না থাকিলেও তাহার সহিত একবার সাক্ষাৎ করিবার চেষ্টা করিতেছিলাম। 

বৃদ্ধ। কেন মহাশয়, তাহার সহিত কি প্রয়োজন ছিল, তাহা আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি?

আমি। পারেন? 

বৃদ্ধ। তাহা হইলে অনুগ্রহ পূর্ব্বক বলুন না মহাশয়? 

আমি। বলিতেছি, কিন্তু বলিবার পূর্ব্বে, আমি আপনাকে দুই চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাহি, যদি অনুগ্রহ করিয়া আপনি তাহার উত্তর প্রদান করেন। 

বৃদ্ধ। জিজ্ঞাসা করুন, আমি যাহা কিছু অবগত আছি তাহার উত্তর এখনই প্রদান করিতেছি। 

আমি। যে মুসলমানটির নিকট আপনার কন্যা ছিলেন, তিনি কি কর্ম্ম করিয়া থাকেন। 

বৃদ্ধ। তিনি চামড়ার ব্যবসা করিয়া থাকেন। তিনি খুব বড় মানুষ, অনেক টাকাকড়ি আছে, ও বড় মানুষেরা যেরূপ ভাবে থাকে তিনিও সেই রকমভাবে দিনযাপন করিয়া থাকেন। 

আমি। তাহা হইলে আপনার কন্যা কি মুসলমান ধর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছেন? 

বৃদ্ধ। না, তিনি আমাদিগের ধর্ম্মেই আছেন। 

আমি। তাহা হইলে আপনার কন্যার সহিত ঐ চামড়াওয়ালার বিবাহ, বা নিকা প্রভৃতি কিছুই হয় নাই?

বৃদ্ধ। না। 

আমি। ঐ চামড়াওয়ালার বিবাহিতা স্ত্রীও বোধ হয় আছেন। 

বৃদ্ধ। আছেন। 

আমি। তিনি যে বাড়ীতে বাস করিয়া থাকেন, আপনার কন্যাও বোধ হয় সেই বাড়ীতে বাস করিতেন? 

বৃদ্ধ। না। চামড়াওয়ালা তাহাকে আলাহিদা বাড়ীতে রাখিয়াছিলেন। 

আমি। সে বাড়ীতে অন্য কে থাকিত? 

বৃদ্ধ। চাকর চাকরাণী ব্যতীত আর কেহই সে বাড়ীতে থাকিত না। তবে রাত্রির অধিকাংশই চামড়াওয়ালা সেই স্থানে অবস্থিতি করিতেন। 

আমি। ঐ বাড়ীতে কয়টি চাকর থাকিত? 

বৃদ্ধ। দুইটি দরয়ান, একটি দাই, ও একটি বাবুর্চিকেই প্রায় সর্ব্বদা দেখিতে পাইতাম। 

আমি। চাকরগণ কোন জাতীয় ছিল? 

বৃদ্ধ। তাহারা সকলেই মুসলমান।

আমি। দরোয়ান দুইজন? 

বৃদ্ধ। তাহারাও মুসলমান! 

আমি। এখন আপনি তো সেই স্থানে গিয়াছিলেন? 

বৃদ্ধ। হ্যাঁ— সেই বাড়ীতেই গিয়াছিলাম। 

আমি। ঐ সমস্ত চাকরদিগের সহিত আপনার সাক্ষাৎ হইয়াছিল? 

বৃদ্ধ। না, কোন চাকরকেই দেখিতে পাই নাই। 

আমি। আপনি বাড়ীর মধ্যে গিয়াছিলেন? 

বৃদ্ধ। না, বাহির হইতে দেখিলাম, দরজায় তালাবন্ধ। 

আমি। তাহা হইলে চামড়াওয়ালার সহিত আপনার কি রূপে ও কোথায় সাক্ষাৎ হইল? 

বৃদ্ধ। যখন ঐ বাড়ী তালাবন্ধ আছে দেখিলাম, তখন আমি তাহার চামড়ার আড়তে গমন করি। সেই স্থানে তাহার সহিত আমার সাক্ষাৎ হয়, ও সেই সময় জানিতে পারি যে, আমার কন্যা রাগ করিয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে। 

আমি। আপনার কন্যা উহার আশ্রয়ে কত দিবস হইতে বাস করিতেছে? 

বৃদ্ধ। প্রায় ৫।৬ মাস হইতে। 

আমি। সে উহাকে কি প্রদান করিত? 

বৃদ্ধ। সমস্ত খরচপত্র বাদে ফি মাসে উহাকে পাঁচ শত টাকা করিয়া দিবার কথা ছিল। 

আমি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কত করিয়া দিত? 

বৃদ্ধ। তাহা আমি বলিতে পারি না। 

আমি। আপনার কন্যা এই কয়মাসের মধ্যে আপনারে কখন কিছু টাকা দিয়াছে? 

বৃদ্ধ। দুইবারে চারিশত করিয়া আটশত টাকা সে আমাকে দিয়াছিল। 

আমি। সে কত দিবস হইল? 

বৃদ্ধ। প্রথম ও তৃতীয় মাসে। 

আমি। তাহার পর আর কখন কিছু দেয় নাই? 

বৃদ্ধ। না। 

আমি। ঐ বাড়ীতে যে সকল চাকর ছিল, আপনি তাহাদিগের নাম জানে?

বৃদ্ধ। না। 

আমি। দেখিলে চিনিতে পারিবেন? 

বৃদ্ধ। তা পারিব, আমার এই স্ত্রী ও এই কন্যাও উহাদিগকে দেখিলে চিনিতে পারিবে।

আমি। তাহা হইলে উহারাও উহাদিগকে দেখিয়াছে? 

বৃদ্ধ। অনেকবার দেখিয়াছে। 

আমি। আজ যখন আপনি সেইস্থানে গমন করিয়াছিলে, সেই সময় উহাদিগের মধ্যে কাহার সহিত আপনার সাক্ষাৎ হইয়াছিল কি? 

বৃদ্ধ। না, আজ আমি তাহাদিগের কাহাকেও দেখিতে পাই নাই। 

আমি। আমার যাহা কিছু জিজ্ঞাস্য ছিল, তাহার সমস্তই প্রায় একরূপ আপনাকে জিজ্ঞাসা করিলাম। এখন আপনি কি জানিতে চাহেন, আমাকে বলিতে পারেন। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ

বৃদ্ধ ইহুদি আমার কথা শুনিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি আমার কন্যা সম্বন্ধে কোন বিষয় অবগত আছেন কি?” 

আমি। বোধ হয় কিছু অবগত আছি! 

বৃদ্ধ। কি অবগত আছেন মহাশয়? 

আমি। আপনার সেই কন্যা দেখিতে খুব সুন্দরী। 

বৃদ্ধ। তাহা ত সকলেই জানে, আমার এই কন্যা অপেক্ষাও অনেকে তাহাকে সুন্দরী কহিয়া থাকে।

আমি। তাহার মস্তকের চুলের খুব বাহার আছে, ও খুব দীর্ঘ। 

বৃদ্ধ। তাহার মাতার ও তাহার ভগ্নীর চুলরাশি যেরূপ দেখিতেছেন, উহার চুলও ঠিক সেইরূপ। এ সকল বিষয় তো সকলেই অবগত আছেন, কিন্তু আমার সেই কন্যা যে এখন কোথায়, তাহার কিছু আপনি অবগত আছেন কি?

আমি। ঠিক অবগত না থাকিলেও বোধ হয় আমি তাহার কিছু সন্ধান আপনাকে বলিয়া দিতে পারি। কিন্তু আমি যে অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া আপনাকে এই কথা বলিতেছি তাহা যে কতদূর সত্য তাহা আমি বলিতে পারি না; অথচ কোন বিষয় বিশেষরূপ অবগত না হইয়াও কাহাকে কোনরূপ অপ্রিয় সংবাদ দেওয়া কৰ্ত্তব্য নহে। 

বৃদ্ধ। অপ্রিয় সংবাদ! কি অপ্রিয় সংবাদ? 

আমি। আজ কয়েক দিবস অতীত হইল, কলুটোলার নিকটবর্তী দীঘির ভিতর হইতে একটি স্ত্রীলোকের মস্তক ও পরিশেষে মস্তকবিহীন একটি স্ত্রীলোকের দেহ পাওয়া যায়, একথা আপনি বোধ হয় ইতিপূর্ব্বে শুনিয়া থাকিবেন? 

বৃদ্ধ। না, আমি তাহা শুনি নাই। কোথায় উহা পাওয়া গিয়াছে বলিলেন? 

আমি। কলুটোলার কিছুদূর পূর্ব্বে যে একটি প্রকাণ্ড পুরাতন দীঘি আছে, তাহারই মধ্যে। 

বৃদ্ধ। আমি ঐ দীঘি জানি, যে স্থানে চামড়াওয়ালা আমার কন্যাকে রাখিয়াছিল, সেই স্থান হইতে ঐ দীঘি বহুদূরবর্তী নহে। যে স্ত্রীলোকের মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, তাহা কি আপনি দেখিয়াছেন? 

আমি। দেখিয়াছি। 

বৃদ্ধ। উহাকে দেখিতে আমার এই কন্যাটির ন্যায় কি? 

আমি। ঐ মৃতদেহ পচিয়া যাইবার পর আমি দেখিয়াছি, সেই অবস্থায় দেখিয়াও বোধ হয় সে দেখিতে আপনার এই কন্যাটির ন্যায়ই ছিল। 

বৃদ্ধ। উহার মস্তকের চুল ছিল কিরূপ? 

আম। আপনার এই কন্যার চুলের ন্যায়। চুল সমেত মস্তক এখনও রক্ষিত আছে, আপনি যদি ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে আমি উহা আপনাকে দেখাইতে পারি। 

আমার এই শেষ কথা শুনিবামাত্র সেই বৃদ্ধ, তাহার স্ত্রী ও কন্যা আমাকে সেইস্থানে আর তিলার্দ্ধ বিলম্ব করিতে দিল না, উহাদিগের নিজের গাড়ী ছিল, তৎক্ষণাৎ সেই গাড়ী আনিয়া সেইস্থানে উপস্থিত করিল, ও আমাকে তাহাদিগের গাড়ীতে লইয়া যে স্থানে ঐ মস্তক রক্ষিত ছিল সেই স্থানে যাইতে কহিল। 

যে কার্য্য আমাকে করিতেই হইত, যে কার্য্যের নিমিত্ত উহারা অসম্মত হইলে যে কোন উপায়ে হউক উহাদিগকে লইয়া যাইতেই হইত, সেই কার্য্যের নিমিত্ত আমাকে আর কোনরূপ কষ্টই করিতে হইল না, উহারাই বিশেষ আগ্রহের সহিত আমাকে লইয়া যাইতে লাগিল। 

যে স্থানে ডাক্তার সাহেব ঐ মস্তক রাখিয়াছিলেন, আমি উহাদিগের তিনজনকেই সেইস্থানে লইয়া গেলাম, ও ঐ মস্তক উহাদিগকে দেখাইলাম। ঐ মস্তক যদিচ সেই সময় বিকৃত অবস্থায় পরিণত হইয়াছিল, তথাপি উহা দেখিবামাত্র উহারা একেবারে চীৎকার করিয়া উঠিল। উহাদিগের চীৎকার শুনিয়াই আমি যেন বুঝিতে পারিলাম যে, ঐ মস্তক ঐ বৃদ্ধ ইহুদির জ্যেষ্ঠ কন্যা ভিন্ন অপর কাহারও নহে। কিছুক্ষণ আর্তনাদ করিবার পর উহারা একটু স্থির হইল। তখন আমি উহাদিগকে স্পষ্ট করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম। উহারা কহিল, ঐ মস্তক তাহাদের কন্যার মস্তক, আরও কহিল, সেই চামড়াওয়ালাই উহাকে কোন কারণে হত্যা করিয়া উহার মস্তক দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন করতঃ দীঘির জলে নিক্ষেপ করিয়াছে। 

এত দিবস পরে দেখিলাম, আজ আমাদিগের কার্য্যসিদ্ধি হইবার উপায় হইল। যখন মৃতদেহ সনাক্ত হইল, তখন এই মোকদ্দমার কিনারা হইতে আর বাকি থাকিল না। যে স্থান হইতে এই কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়াছে, এখন তাহাও যেন বুঝিতে পারিলাম। বুঝিলাম, বৃদ্ধ যাহা কহিতেছে, তাহাই প্রকৃত। চামড়াওয়ালা যখন উহাকে এত যত্ন করিয়া রাখিয়াছিল, যাহার নিমিত্ত এতদিন অকাতরে ব্যয় করিতেছিল, সেই যখন সামান্য ঝগড়া করিয়া তাহার বাড়ী পরিত্যাগ করিল, তখন ইহার নিমিত্ত সে একবার অনুসন্ধানও করিল না, বা তাহার পিতা-মাতাকে কোনরূপ সংবাদও প্রদান করিল না, ইহা কি নিতান্ত সন্দেহের কারণ নহে? যাহার নিমিত্ত চামড়াওয়ালা ঘর ভাড়া করিয়া দাস-দাসীর বন্দোবস্ত করিয়া দিয়াছিল, যাহার দরজায় বসিয়া দরোয়ানে পাহারা দিত, সে যখন ক্রোধভরে ঘর পরিত্যাগ করিল, অমনি দাস- দাসীর জবাব হইল, দরোয়ান স্থানান্তরিত হইল, সদর দরজায় তালা পড়িল, ইহাও কি বিশেষ সন্দেহের কারণ নহে? মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সাহসের উপর ভর ও ঈশ্বরের উপর নির্ভর করিয়া, পুনরায় কার্য্যক্ষেত্রে প্রবিষ্ট হইলাম।

অষ্টম পরিচ্ছেদ

এবার আমাদিগের সর্ব্বপ্রধান কার্য্য হইল সেই চামড়াওয়ালাকে গ্রেপ্তার করা। তাহার সেই বাড়ীর ভিতর উত্তমরূপে অনুসন্ধান করা, ও সেই বাড়ীতে যে সকল দাস-দাসী ও দরোয়ান ছিল, অনুসন্ধান করিয়া তাহাদিগকে বাহির করা। এই সকল কাৰ্য্য যত শীঘ্র সম্পন্ন করা যাইতে পারিবে, কার্য্যের পক্ষে ততই সুবিধা হইবে, সুতরাং অপরাপর কর্ম্মচারীর এই কার্য্যের নিমিত্ত সাহায্য গ্রহণ করা কর্তব্য হইয়া পড়িল। ঊর্দ্ধতন কৰ্ম্মচারীকে এই সমস্ত অবস্থার বিষয় তখনই সংবাদ প্রদান করিতে হইল ও তাঁহার আদেশক্রমে অপরাপর যে সকল কর্মচারীগণ ইতিপূর্ব্বে এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত ছিলেন, তাহাদিগের সকলেই এই মোকদ্দমায় আমাকে সাহায্য করিবার নিমিত্ত আসিয়া উপস্থিত হইলেন। 

চামড়াওয়ালা ধৃত হইল। যে ঘরভাড়া করিয়া চামড়াওয়ালা ঐ স্ত্রীলোকটিকে রাখিয়াছিল, সেই ঘরের তালা খুলিয়া সেই ঘরের ভিতর উত্তমরূপে অনুসন্ধান করা হইল, কিন্তু তাহার ভিতর আমাদিগের প্রয়োজন উপযোগী কিছুই প্রাপ্ত হইলাম না। সেই সময় ঐ ঘর একেবারে শূন্য অবস্থায় ছিল, উহার ভিতর দ্রব্যাদি কিছুই ছিল না, অধিকন্তু উহা দেখিয়া স্পষ্টই প্রতীয়মান হইল যে, চারিপাঁচ দিবসের মধ্যে ঐ ঘর উত্তমরূপে ধৌত করা হইয়াছে, ও দেওয়ালে নূতন কলিচুন ফিরান হইয়াছে। ঘরের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া মনে আরও সন্দেহ হইল। ভাবিলাম, সেই ঘরেই ঐ স্ত্রীলোককে হত্যা করা হইয়াছিল, ও স্থানে স্থানে বোধ হয় রক্তের চিহ্ন লাগিয়া ছিল বলিয়া নূতন করিয়া উহাতে চুন ফিরান হইয়াছে। 

চামড়াওয়ালা ঐ স্ত্রীলোকটিকে যে রাখিয়াছিল, তাহা সে স্বীকার করিল। আরও কহিল, সে ঐ বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইবার পর সে তাহার কিছুমাত্র অনুসন্ধান করে নাই, কারণ প্রথমতঃ সে ভাবিয়াছিল যে, সে তাহার পিতা-মাতার নিকটই গমন করিয়াছে। দ্বিতীয়তঃ ঐ স্ত্রীলোকটিকে রাখিবার কিছু দিবস পর হইতেই তাহার স্ত্রী এই সমস্ত অবস্থা অবগত হইতে পারিয়াছিল, ও সেই সময় হইতে তাহার স্ত্রী তাহার সহিত সদাসৰ্ব্বদা কলহ করিত, সুতরাং সে মনে করিয়াছিল, আপন স্ত্রীর সহিত মনোবিবাদ করা অপেক্ষা যদি তাহার রক্ষিতা স্ত্রীলোকটি তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যায় যাউক, তাহাতে তাহার কিছুমাত্র ক্ষতি নাই। তাহার মনের ভাব এইরূপ ছিল বলিয়াই সামান্য কারণে যখন সে গৃহ পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেল, তখন সে তাহার আর কোনরূপ অনুসন্ধানই করিল না। যাহার ঘর সে ভাড়া লইয়াছিল, তাঁহার সহিত তাহার এইরূপ কথা ছিল যে, যখনই সে ঘর পরিত্যাগ করিবে, সেই সময়ই তাহাকে ঐ ঘর চুন ফিরাইয়া দিতে হইবে, এই নিমিত্তই সে ঐ ঘরে নূতন চুন ফিরাইয়াছিল, মাস শেষ হইলেই ঐ ঘর সে ছাড়িয়া দিবে। আর যাহার নিমিত্ত সে দাস-দাসী ও দরোয়ান রাখিয়াছিল, সে যখন চলিয়া গেল, তখন ঐ সমস্ত লোকের আর তাহার কোনরূপ প্রয়োজন রহিল না। সুতরাং সে তাহাদিগকে কার্য্য হইতে অপসারিত করিয়া দিয়াছিল, ও তাহার যে কে কোথায় গমন করিয়াছে, তাহার কিছুমাত্র সে অবগত নহে। 

চামড়াওয়ালা আমাদিগকে এইরূপ কহিল সত্য কিন্তু তাহার কথায় আমরা কিছুমাত্র বিশ্বাস করিলাম না। অধিকন্তু যে সকল চাকর তাহার ঐ বাড়ীতে কার্য্য করিত, অপরাপর কর্ম্মচারীগণ এক এক করিয়া তাহাদিগের সকলকেই অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিলেন। 

ঐ সমস্ত লোক প্রাপ্ত হইবার সঙ্গে সঙ্গে ভিতরের সমস্ত অবস্থা বাহির হইয়া পড়িতে লাগিল। তখন সকলেই জানিতে পারিলেন যে, ঐ স্ত্রীলোকটি যদিও চামড়াওয়ালা কর্তৃক রক্ষিতা ছিল, তথাপি দুশ্চরিত্রা স্ত্রীলোকের স্বভাব যেরূপ কিছুতেই পরিবর্তিত হয় না, সেইরূপ তাহার স্বভাবেরও কিছুমাত্র পরিবর্তন হইয়াছিল না। চামড়াওয়ালা তাহাকে বিশেষরূপ যত্ন করিত, তাহার নিমিত্ত বিস্তর অর্থ ব্যয় করিত, তথাপি সে তাহার স্বভাবের গুণে গুপ্তভাবে অপর লোককে তাহার ঘরে চামড়াওয়ালার অবর্তমানে স্থান প্রদান করিত। অর্থে না হয় কি? সেই অর্থের গুণে দাস-দাসী ও দরোয়ান প্রভৃতির মুখ বন্ধ করিত, চামড়াওয়ালার কাণে কোন কথা প্রবেশ করিত না। কিন্তু দৈবের ঘটনা কেহ কখন রোধ করিতে পারে না। হঠাৎ একদিবস যে সময় সেই লোকটি সেই স্ত্রীলোকের ঘরে উপবেশন করিয়া আমোদ-প্রমোদ নিযুক্ত ছিল, অথচ সেই সময় ঐ চামড়াওয়ালার সেই স্থানে আসিবার কোন কারণই ছিল না, সেই সময় কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে সেই চামড়াওয়ালা সেই স্থানে হঠাৎ উপস্থিত হইল ও সমস্ত অবস্থা স্বচক্ষে দেখিতে পাইল। চামড়াওয়ালা যখন সেই স্থানে হঠাৎ আসিয়া উপস্থিত হইল, সেই সময় ঐ বাড়ীর চাকর চাকরাণী ও দরয়ান এরূপ ভাবে অন্যমনস্ক ছিল যে, তাহার আগমন সংবাদ কোনরূপেই সেই স্ত্রীলোকটিকে প্রদান করিতে পারিল না, চামড়াওয়ালা একেবারে গিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল কিন্তু সেই অপরিচিত লোকটি পলায়ন করিয়া যদিচ আপন প্রাণ রক্ষা করিল, ঐ স্ত্রীলোকটি তাহার হস্ত হইতে আর কোনরূপেই পরিত্রাণ পাইল না, ইহজীবনের নিমিত্ত তাহার ইহলীলা সেইখানেই শেষ হইয়া গেল। 

চামড়াওয়ালার লোকজনের অভাব ছিল না, সুতরাং রাত্রিকালে ঐ মৃতদেহ দুইভাগে বিভক্ত হইল, ও যেরূপ দীঘির জলের মধ্যে প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছিল, সেইরূপ ভাবে উহা সেই স্থানে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিল। 

চামড়াওয়ালা ও তাহার সাহায্যকারী সমস্ত লোকই ধৃত হইল, কিন্তু উহার অনেক অর্থের জোর ছিল, সাক্ষ্যগণ অনেকেই ক্রমে তাহার হস্তগত হইয়া পড়িল, ও হাইকোর্টের প্রধান প্রধান কৌন্সিলগণের বুদ্ধিবলে ও সাক্ষীগণের মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করায় সকলেই সে যাত্রা বিচারালয় হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিল। 

[আযাঢ়, ১৩১৩] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *