মিস্ মেরি
প্রথম পরিচ্ছেদ
এই মহানগরী কলিকাতার ভিতর বাস না করে, এরূপ জাতিই নাই। এই নগরী বঙ্গদেশের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত থাকিলেও হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্টান, বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি সকল সম্প্রদায়ের লোকই এখানে আছেন ও সকল সম্প্রদায়ের মধ্যেই আমাদিগের অনুসন্ধান-উপযোগী কোন না কোনরূপ ঘটনা প্রায়ই ঘটিয়া থাকে। হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যবর্তী ঘটনাবলীর অনেক বিবরণ সময় সময় দারোগার দপ্তরে প্রকাশিত হইয়াছে; কিন্তু অপরাপর জাতীয় ঘটনাবলী অধিক পরিমাণে প্রকাশিত হয় নাই বলিয়াই খৃষ্ট-ধর্ম্মাবলম্বীগণের অন্তর্ভূত আর একটি ঘটনা এই স্থানে লিপিবদ্ধ করিলাম। ইঁহাদিগের মধ্যেও সময় সময় যে কিরূপ ভয়ানক পাপ স্রোত প্রবাহিত হইয়া থাকে, তাহার একটি জাজ্জ্বল্যমান দৃষ্টান্ত পাঠকগণ এই স্থানে দেখিতে পাইবেন।
জুরেখার আর নাই। হঠাৎ তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে এই কথা অতি প্রত্যূষে হরের মধ্যে— বিশেষ ইংরাজ অধিবাসিগণের মধ্যে দেখিতে দেখিতে প্রচারিত হইয়া পড়িল। কেহ কহিল, সরদি-গরমিতে তিনি মরিয়াছেন; কেহ কহিল, তিনি আত্মহত্যা করিয়াছেন; কেহ বলিতে লাগিল, তিনি হত হইয়াছেন। এইরূপ যাহার মনে যাহা আসিয়া উদয় হইতে লাগিল তিনি তাহাই অপরকে কহিতে লাগিলেন। যাঁহাদের বিশ্বাস সংবাদপত্রে সমস্তই প্রকৃত কথা বাহির হয়, প্রকৃত তথ্য অবগত হইবার নিমিত্ত তাঁহারা সংবাদপত্র-বাহকের আশায় বিশেষ আগ্রহে:. সহিত অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। নিয়মিত সময়ে সেই দিবসের সংবাদপত্র তাঁহাদিগের হস্তগত হইল। বিশেষ কৌতূহলের সহিত তাঁহারা আপনাপন সংবাদপত্র দেখিতে লাগিলেন; কিন্তু দেখিলেন, জুবেয়ার সম্বন্ধে কোন কথা প্রকাশিত হয় নাই।
জুবেয়ারের মৃত্যু-সংবাদ লোকমুখে প্রচারিত হইবার পূর্ব্বেই আমরা কিন্তু এই সংবাদ অবগত হইতে পারিয়াছিলাম। রাত্রি শেষ হইবার দুই এক ঘণ্টা বাকী থাকিতেই টেলিফোনযোগে এই সংবাদ আসিয়া আমাদিগের নিকট উপনীত হয়। সংবাদ পাইবামাত্র আমরাও গিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হই।
আমরা সেইস্থানে উপস্থিত হইয়া কিরূপ অবস্থা দর্শন করিয়াছিলাম, তাহা বর্ণন করিবার পূর্ব্বে, জুবেয়ার কে, তিনি কোথায় অবস্থান করিয়া থাকেন, তাহার একটু পরিচয় পাঠকগণকে অগ্রেই অবগত করান আবশ্যক।
জুবেয়ারের জন্মস্থান কোথায়, তাহা আমরা সেই সময় অবগত নহি। কিন্তু গত ২০ বৎসর হইতে তিনি ইংরাজমহলে বাস করিতেছিলেন, তাঁহাকে দেখিয়া তাঁহাকে ইউরোপীয় দেশবাসী বলিয়া অনুমান হয়। তাঁহাকে
কোনরূপ কৰ্ম্মকার্য করিতে আমরা দেখি নাই; কিন্তু তাঁহার যে বিস্তর অর্থ আছে, তাহা কিন্তু সকলেই কহিত।
তিনি যে বাড়ীতে বাস করিতেন, উহা একটি দ্বিতলগৃহ। দ্বিতলের উপর তাঁহার ও তাঁহার কন্যা মেরির শয়ন ঘর। তদ্ব্যতীত, বসিবার উপযোগী আর একটি বৃহৎ ঘর ছিল। এ ঘর সদাসর্বদা খোলা থাকিত সত্য, কিন্তু বৃদ্ধ জুবেয়ার প্রায়ই সেইস্থানে বসিতেন না। মেরিই প্রায় সর্ব্বদা সেইস্থানে উপবেশন করিতেন। নিম্নতলে একটি প্রশস্ত ও সুদৃশ্য লাইব্রেরী ছিল। বৃদ্ধ জুবেয়ার সদা সৰ্ব্বদা সেইস্থানেই বসিতেন। তাঁহার আরাম ও বিরামের স্থল সেই লাইব্রেরী। আহারের সময় ঐ ঘরের পার্শ্ববর্তী একটি ঘরে গমন করিতেন বটে, কিন্তু দিবসের অধিকাংশ সময় সেই লাইব্রেরী ঘরের মধ্যে অতিবাহিত করিতেন। অতি প্রত্যযে তিনি শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিয়া নীচে আসিতেন। সেই বাড়ীর সংলগ্ন বাগানের মধ্যে দুই এক ঘণ্টা ভ্রমণ করিয়া লাইব্রেরীর মধ্যে গমন করিতেন। স্নান, আহার, বিশ্রাম প্রভৃতি সমস্তই সেইস্থানে সমাপন করিয়া রাত্রি ১১টার কম শয়ন করিবার মানসে তিনি আর উপরে গমন করিতেন না। ইহাই তাঁহার নিত্যকর্ম্মের মধ্যে পরিগণিত ছিল। মেরি প্রায় সর্ব্বদাই উপরে থাকিতেন। কেবল আহারের সময় পিতার সহিত একত্র বসিয়া আহারাদি করিতেন, ও কখন কখন চকিতের ন্যায় এক এক বার কোন না কোন কার্য্যের ভান করিয়া লাইব্রেরীর মধ্যে প্রবেশ করিতেন ও দেখিতে দেখিতে সেইস্থান হইতে অন্তর্হিত হইতেন। জুবেয়ারের গাড়ি-ঘোড়া যাহা ছিল, তাহা জুবেয়ার প্রায়ই ব্যবহার করিতেন না। মেরির ইচ্ছানুযায়ী উহা ব্যবহৃত হইত।
জুবেয়ার কোথা হইতে আসিয়া যে কলিকাতায় বাস করিতেছিলেন, তাহা কেহই জানিতেন না। কিন্তু যখন তিনি এইস্থানে আগমন করেন, তখন কেবলমাত্র তাঁহার স্ত্রী ও কন্যা মেরি তাঁহার সঙ্গে আসিয়াছিল। ক্রমে ইহাও এইস্থানে প্রকাশিত হইয়া পড়ে, যে, জুবেয়ারের প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি মেরির মাতার সহিত পরিণয় সূত্রে পুনরায় আবদ্ধ হন। সেই সময় মেরির বয়ঃক্রম ২ বৎসর। মেরির মাতা কোন সম্ভ্রান্ত ইংরাজের স্ত্রী ছিলেন। তাঁহার স্বামী জীবিত থাকিতে থাকিতেই তিনি জুবেয়ারের সহিত অবৈধ প্রণয়ে আবদ্ধ হন, ও পরিশেষে তাঁহাকে পুনরায় বিবাহ করেন, এই কথা এইস্থানে রাষ্ট্র হয়। মেরি সেই ইংরাজের ঔরসজাতা কন্যা। যে সময় জুবেয়ার মেরির মাতার সহিত পরিণয় সূত্রের আবদ্ধ হন, সেই সময় জুবেয়ারের বয়ঃক্রম ৫০ বৎসরের কম ছিল না। রাষ্ট্র, বিবাহের ৪।৫ বৎসর পরে তিনি কলিকাতায় আগমন করেন। সেই হিসাবে জুবেয়ারের বয়ঃক্রম এখন প্রায় অশীতি বৎসর। মেরির বয়ঃক্রম ২৭ বৎসরের কম নহে। কিন্তু মেরি এখনও অবিবাহিতা। কেন যে তিনি এখন পর্যন্ত বিবাহ করেন নাই, তাহা মেরিই বলিতে পারেন। বোধ হয়, জুবেয়ারও বলিতে পারিতেন। কলিকাতায় আসিবার ৪।৫ বৎসর পরেই মেরির মাতার মৃত্যু হয়, সেই সময় হইতে মেরি ও জুবেয়ার সেই বাড়ীতে বাস করিয়া আসিতেছিলেন।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
আমরা জুবেয়ারের বাড়ীতে উপনীত হইয়া দেখিতে পাইলাম, একটি ঘরের মধ্যে বৃদ্ধ জুবেয়ার পড়িয়া রহিয়াছেন; কিন্তু তাঁহার প্রাণ বহির্গত হইয়া গিয়াছে। লাইব্রেরীর এক পার্শ্বে একটি ছোট ঘর আছে। ঐ ঘরের পার্শ্বে উপরে উঠিবার সিঁড়ি। লাইব্রেরী হইতে উপরে উঠিতে হইলে, বা উপর হইতে লাইব্রেরীতে গমন করিতে হইলে, ঐ ঘরের মধ্য দিয়া গমন করিতে হয়। ঐ ঘরের মধ্যেই জুবেয়ারের মৃতদেহ পতিত আছে। মৃতদেহটি উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম, কিন্তু তাহার কোনস্থানে কোনরূপ আঘাতের চিহ্ন পরিলক্ষিত হইল না। কেবলমাত্র জিহ্বা ও মুখের মধ্যে স্থানে স্থানে যে একটু কাল বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। আমরা সেইস্থানে উপস্থিত হইবার পূর্ব্বেই একজন ইংরাজ ডাক্তার সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিলেন। জুবেয়ারের মৃতদেহ দেখিতে পাইবার পর মেরিই তাহাকে ডাকান। আমরা ঐ মৃতদেহটি উত্তমরূপে দর্শন করিবার পূর্ব্বেই ডাক্তার সাহেব বিশেষরূপে উহা পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছিলেন। জুবেয়ারের মৃত্যুর কারণ, কি অনুমান হয়, তাহা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি কহেন, তাঁহার অনুমান হয়, বিষপানে ইনি ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছেন। তিনি আরও কহিলেন, মহাবিষ প্রুসিক এসিডই তাঁহার উদরস্থ হইয়া ইহজগৎ হইতে তাঁহাকে বিতাড়িত করিয়াছে।
ডাক্তার সাহেবের কথা শুনিয়া আমাদিগেরও বেশ অনুমান হইল, তিনি যাহা বলিতেছেন, তাহা নিতান্ত অযৌক্তিক নহে। কোন না কোন প্রবল বিষই যে তাঁহার মৃত্যুর কারণ। সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।
মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সেই স্থানটি আমরা একবার উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়া দেখিলাম। যে ঘরে তাঁহার মৃতদেহ পড়িয়াছিল, সেই ঘরে কিছুই দেখিতে পাইলাম না। লাইব্রেরীর ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, টেবিলের উপর একটি বোতলে কিয়ৎপরিমাণে মদ্য রহিয়াছে ও তাহার সন্নিকটে একটি গ্লাসও আছে। গ্লাসটি হস্তে লইয়া দেখিলাম, উহা হইতে সুরার গন্ধ নির্গত হইতেছে। অনুমানে বুঝিতে পারিলাম, ঐ বোতল হইতে সুরা ঐ গ্লাসে ঢালিয়া তাহা কেহ পান করিয়াছে।
বৃদ্ধ জুবেয়ারের একটি পরিচারক তাঁহার আদেশ প্রতিপালন করিবার মানসে প্রায় সর্ব্বদাই লাইব্রেরীর বাহিরে অপেক্ষা করিত। কোন কার্য্যের আবশ্যক হইলে জুবেয়ার যেমন তাহাকে ডাকিতেন, অমনি সে লাইব্রেরীর মধ্যে গমন করিয়া প্রভুর আদেশ প্রতিপালন করিত। কিন্তু তাহাকে না ডাকিলে বা বিশেষ কোনরূপ প্রয়োজন না হইলে, তাহার সেই লাইব্রেরীর ভিতর গমন করিবার আদেশ ছিল না। পরিচারকও সেই আদেশ সম্পূর্ণরূপে প্রতিপালন করিত।
বৃদ্ধের আদেশ প্রতিপালন করিবার জন্য দুইজন পরিচারক নিযুক্ত ছিল। পর্যায়ক্রমে একজন না একজন লাইব্রেরীর বাহিরে উপস্থিত থাকিত। উহারা দুই জনই মুসলমান, ও বহু দিবস হইতে দুই জনই ঐ কাৰ্য্য সম্পন্ন করিয়া আসিতে ছিল। তাহারাই যদি বৃদ্ধের মৃত্যু সম্বন্ধে কোন কথা বলিতে পারে, এই ভাবিয়া আমরা তাহাদিগের উভয়কেই ডাকাইলাম। উহাদিগের নিকট হইতে সেই সময় এইমাত্র অবগত হইতে পারিলাম যে, বৃদ্ধ কোনস্থানে গমন করিতেন না, সদা সর্ব্বদা নিজের বাড়ীতেই থাকিতেন। অতিশয় প্রত্যূষে তিনি শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিয়া নীচে আসিতেন। বাগানের মধ্যে কিয়ৎক্ষণ ভ্রমণ করিয়া লাইব্রেরীর মধ্যে গমন করিতেন। সমস্ত দিবসের মধ্যে তিনি আর উপরে উঠিতেন না। লাইব্রেরীর সংলগ্ন স্নানের ঘরেই স্নান করিতেন। পার্শ্ববর্তী দুইটি ঘরের মধ্যে একটিতে বস্ত্রাদি পরিধান ও অপরটিতে আহারাদি করিতেন। দিবাভাগে বিশ্রামও করিতেন লাইব্রেরীর ভিতর। রাত্রি ১টার পর তিনি শয়ন করিবার মানসে উপরে উঠিতেন। যে সময়ে তিনি শয়ন করিবার মানসে উপরে উঠিতেন, সেই সময় পরিচারকগণের মধ্যে কেহই সেইস্থানে থাকিত না। রাত্রি দশটার সময় পরিচারক মাত্রেই আপনাপন স্থানে গমন করিত। ইহা বৃদ্ধের আদেশই ছিল। শয়ন করিবার অব্যবহিত পূর্ব্বেই বৃদ্ধ অতি অল্প পরিমাণে মদ্যপান করিতেন। পরিচারকগণ রাত্রি ১০টার সময় যখন সেইস্থান হইতে আপনাপন স্থানে গমন করিত, সেই সময় মদিরা সহিত একটি বোতল ও একটি গ্লাস লাইব্রেরী-ঘরের টেবিলের উপর রাখিয়া তাহারা চলিয়া যাইত। বৃদ্ধ শয়ন করিতে যাইবার সময় ইচ্ছামত ঐ মদিরা নিজ হস্তে গ্লাসে ঢালিয়া লইয়া পান করিতেন, ও উপরে গিয়া শয়ন করিতেন। ইহা তাঁহার নিত্য কর্ম্মের মধ্যে পরিগণিত ছিল।
পরিচারকগণের নিকট হইতে ইহা অবগত হইয়াছিল, তাহাদিগকে আরও দুই চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন মনে করিয়া, তাহাদিগের একজনকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি কাল কোন্ সময় হইতে কোন্ সময় পৰ্য্যন্ত এই স্থানে উপস্থিত ছিলে?”
পরিচারক। আমি প্রত্যূষ ছয়টা হইতে দশটা এবং সন্ধ্যা ছয়টা হইতে দশটা পৰ্য্যন্ত উপস্থিত ছিলাম।
আমি। সন্ধ্যা ছয়টা হইতে দশটা পৰ্য্যন্ত অপর কোন ব্যক্তি লাইব্রেরী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল?
পরিচারক। মিস্ মেরি ভিন্ন আর কাহাকেও এই ঘরে প্রবেশ করিতে দেখি নাই।
আমি। তিনি কোন সময়ে এই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিলেন?
পরিচারক। সন্ধ্যার পর যখন আহারের সময় হয়, সেই সময় ইনি আসিয়া আহারাদি করিয়া চলিয়া যান। তাহার পর আরও দুই একবার তিনি সেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিলেন।
আমি। শেষে দুই বার যখন তিনি সেই ঘরের মধ্যে প্রবিষ্ট হন, সেই সময় সেই গৃহের মধ্যে বৃদ্ধের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ বা কথোপকথন হইয়াছিল কি?
পরিচারক। তাহা তো আমি ঠিক বলিতে পারি না; কারণ আমি সেই গৃহের ভিতরে ছিলাম না, বাহিরে বসিয়াছিলাম। কিন্তু প্রথমবার যখন তিনি আসিয়াছিলেন, তখন বোধ হয়, সাহেবের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইয়াছিল। কারণ আমার বোধ হইতেছে, সেই সময় উভয়েরই কথোপকথনের শব্দ আমার কর্ণে প্রবেশ করিয়াছিল। শেষ কালের কথা কিন্তু আমি বলিতে পারি না। মিস্ বাবা সেই বার ভিতরে গমন করিয়া, অগ্রেই পুনরায় বাহির হইয়া আসেন, ঘরের মধ্যে তাঁহার দুই মিনিটেরও বিলম্ব হয় নাই।
আমি। যখন ইনি শেষ বার সেই ঘরের মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়াছিলেন, তখন রাত্রি কত?
পরিচারক। তখন রাত্রি ১০টা। মিস্ বাবাও ঘর হইতে বহির্গত হইয়া উপরে উঠিলেন, আমিও সেই স্থান পরিত্যাগ করিয়া আপন বাসাভিমুখে প্রস্থান করিলাম।
আমি। যখন তুমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান কর, সেই সময় বৃদ্ধ কোথায় ছিলেন এবং কি করিতেছিলেন?
পরিচারক। তিনি ঠিক কোথায় ছিলেন এবং কি করিতেছিলেন, তাহা আমি বলিতে পারি না। তবে আমি এইমাত্র বলিতে পারি যে, তিনি ভিতরেই ছিলেন।
আমি। কেন, তুমি গমন করিবার সময় তাঁহাকে বলিয়া যাইতে না?
পরিচারক। গমন করিবার সময় আমাদিগকে বলিয়া যাইতে হইত না; আমাদিগের উপর আদেশ আছে, রাত্রি দশটা বাজিলেই আমরা চলিয়া যাই।
আমি। সুরার বোতল আর গেলাস টেবিলের উপর কে রাখিয়া গিয়াছিল?
পরিচারক। উহা খানসামার কার্য্য। সন্ধ্যার পর আহারাদি করাইয়া যখন খানসামা বাহিরে যায়, সেই সময় সে-ই উহা টেবিলের উপর রাখিয়া যায়। ইহা তাহার প্রাত্যহিক কার্য্যের মধ্যে একটি।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
লাইব্রেরী ঘরের টেবিলের উপর সুরার বোতল আর গ্লাস দেখিয়া, এবং পরিশেষে পরিচারকের নিকট হইতে ইহার বৃত্তান্ত কিয়ৎপরিমাণে অবগত হইবার পর হইতেই, আমার হৃদয়ে কেমন একরূপ অদ্ভুত ভাবের উদয় হইল। কেমন অল্প অল্প মনে হইতে লাগল, আমি যেন ইহার কিছু অবগত আছি; কিন্তু কি যে অবগত আছি, তাহা হঠাৎ মনে আসিল না। লাইব্রেরী ঘর, সুরার বোতল, সুরার গ্লাসের কথা যেন আমার স্পষ্ট মনে হইতে লাগিল। এই সকল সম্বন্ধে পূর্ব্বে আমি কোন কথা শুনিয়াছি, কি এইরূপ ঘটনা-সম্বলিত অপর কোন মোকদ্দমার আমি ইতিপূর্ব্বে অনুসন্ধান করিয়াছি, তাহাও ঠিক মনে করিয়া উঠিতে পারিলাম না; কিন্তু ইহা আমার বেশ মনে পড়িতে লাগিল, ঠিক এইরূপ ঘটনা আমার অন্তরে বর্ত্তমান রহিয়াছে।
অনেক সময় আমার এইরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে যে, এখন যেটি ভাবিয়াছি, তাহার বহু বৎসর পরে ঠিক তাহা ঘটিয়াছে আবার অদ্য স্বপ্নে কোন একটি বিষয় দেখিলাম, সেই স্বপ্নের বিষয় ক্রমে আমার অন্তর হইতে অন্তর্হিত হইয়া গেল; কিন্তু বহু দিবস বা বহু বৎসর পরে সেই ঘটনা আমি সম্মুখে দেখিতে পাইয়াছি, ঠিক সেইরূপ অবস্থা আমার সম্মুখেই ঘটিয়াছে। সেই ঘটনা ঘটিবার পরে, উহা আমার যেন বিদিত আছে বলিয়া অনুমান হইতে থাকে; কিন্তু কি কারণে আমি বিদিত, তাহা ভাবিয়া চিন্তিয়া সেই সময় কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারি না; তবে অল্পে অল্পে স্মৃতির দ্বার উদ্ঘাটিত হইবার সঙ্গে সঙ্গে সেই ঘটনা বিস্মৃতির গর্ভ হইতে উত্থিত হইয়া, পুনরায় আমার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হয়। এরূপ ঘটনা যে আমার একটি ঘটিয়াছে, তাহা নহে, অনেক ঘটিয়াছে। বহু বৎসর পূৰ্ব্বে যাহা আমি স্বপ্নে দেখিয়াছি, বহু বৎসর পরে তাহা কার্য্যে পরিণত হইয়াছে। এ কথা আমি অনেককে বলিয়াছি, অনেকের সহিত এই সম্বন্ধে আমি অনেক তর্ক বিতর্ক করিয়াছি; কিন্তু ইহার প্রকৃত কারণ যে কি, তাহা আমি এ পর্যন্ত কিছুই অনুমান করিয়া উঠিতে পারি নাই।
লাইব্রেরী, সুরার বোতল, আর সুরার গ্লাসের কথা শুনিয়া আমার এ কথা মনে হইল, স্বপ্নে হয় ত এইরূপ অবস্থা কখনও দেখিয়াছিলাম, বা বহু পূর্ব্বে ঠিক এইরূপ অবস্থার কোনরূপ মোকদ্দমা আমি অনুসন্ধান করিয়াছিলাম, এখন তাহারই আভাষ হৃদয়ে আসিয়া উপস্থিত হইতেছে। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া, এই মোকদ্দমার অপরাপর বিষয়ে মনঃসংযোগ করিতে চেষ্টা করিতে লাগিলাম; কিন্তু কিছুতেই তাহা পারিলাম না। এই ঘটনা যে পুরাতন ঘটনা, কেবল তাহাই আমার মনে জাগরূকহইতে লাগিল। সেই চিন্তায় মনকে আচ্ছন্ন করিব না ভাবিলেও মন কিন্তু তাহাতে সম্মত হইল না, কেবল সেই চিন্তা আনিয়া আপনার অন্তরে প্রবেশ করাইতে লাগিল।
এইরূপে অর্দ্ধ ঘণ্টা কাল অতিবাহিত হইতে না হইতেই, ক্রমে অল্পে অল্পে আমার স্মৃতির দ্বার উন্মোচিত হইতে লাগিল। কিরূপ অবস্থায় লাইব্রেরী, সুরার বোতল এবং সুরার গ্লাসের কথা আমি পূর্ব্বে জানিতে পারিয়াছিলাম, ক্রমে তাহা স্পষ্ট রূপে আমার হৃদয়ে আসিয়া উপনীত হইল। তখন আমার বেশ মনে হইল, কেবল মাত্র দুই এক দিন হইবে, কোন একটি অপরাধীর অনুসন্ধান উপলক্ষে, রাত্রি আন্দাজ নয়টার সময় আমি গড়ের মাঠের একস্থানে অন্ধকারে আপন শরীর আবৃত করিয়া চুপ করিয়া বসিয়াছিলাম। আমি যে স্থানে বসিয়াছিলাম, তাহার একটু দূরে একখানি বেঞ্চ রক্ষিত ছিল। দেখিলাম, একটি সাহেব আর একটি মেম সেই অন্ধকারের ভিতর পদচারণ করিতে করিতে আসিয়া, সেই বেঞ্চের উপর আমাকে পশ্চাৎ করিয়া উপবেশন করিলেন। উহাদিগের মধ্যে ইতিপূর্ব্বে যে কি কথাবার্তা হইয়াছিল, তাহা আমি অবগত নহি, কিন্তু সেই স্থানে উপবেশন করিবার পর সাহেব কহিলেন, “আমি কিরূপে জানিব যে, বৃদ্ধ উপরে গিয়া শয়ন করিয়াছেন।”
উত্তরে মেম সাহেব কহিলেন, “রাত্রি ১১টার পর বৃদ্ধ আর লাইব্রেরীতে থাকেন না, প্রায় ১১টার সময় প্রত্যহই তিনি উপরে গিয়া শয়ন করিয়া থাকেন। তবে কোন কোন দিন রাত্রি অধিক হয় বটে, কিন্তু সেরূপ অতি অল্প দিনই হইয়া থাকে।”
সাহেব। আমি যে সময় গমন করিব, সেই সময় যদি তিনি লাইব্রেরীতে থাকেন, তাহা হইলে কি হইবে?
মেম। তিনি রাত্রিকালে উত্তমরূপ দেখিতে পান না, নিঃশব্দ পদসঞ্চারে যদি আপনি রাত্রিকালে তাঁহার সম্মুখেও গমন করেন, তাহা হইলেও তিনি দেখিতে পান না যে, কোন্ ব্যক্তি তাঁহার সন্নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে; কিন্তু তাঁহার শ্রবণশক্তি অতিশয় প্রবল, সামান্য একটু শব্দ হইলেই তাহা তাঁহার কর্ণে প্রবিষ্ট হইয়া থাকে। আপনি বাড়ীর ভিতর প্রবিষ্ট হইয়া, নিঃশব্দে লাইব্রেরীর ভিতর গমন করিবেন। লাইব্রেরীর দরজা কখন বন্ধ হয় না, রাত্রি দিনই খোলা থাকে। আপনি উহার ভিতর গমন করিলেই, যদি বৃদ্ধ সেই স্থানে থাকেন, তাহা হইলে তাঁহাকে দেখিতে পাইবেন। আর যদি তাঁহাকে দেখিতে না পান, তাহা হইলে বুঝিবেন যে, তিনি উপরে গিয়া শয়ন করিয়াছেন। তথাপি তিনি উপরে গিয়াছেন কি না, তাহা স্থির নিশ্চিত করিবার যদি আপনি প্রয়োজন মনে করেন, তাহা হইলেও তাহার এক উপায় আছে, তাহাও আমি আপনাকে বলিয়া দিতেছি। লাইব্রেরীর ভিতর টেবিলের উপর সুরা-সমেত একটি বোতল এবং একটি গেলাস দেখিতে পাইবেন। সেই গেলাসের আঘ্রাণ লইলে যদি তাহা হইতে সুরার গন্ধ প্রাপ্ত হন, তাহা হইলে জানিবেন যে, বৃদ্ধ উপরে গমন করিয়াছেন। আর যদি সুরার গন্ধ না পান, তাহা হইলে বুঝিবেন যে, তিনি নিশ্চয় কোন না কোন স্থানে আছেন। উপরে যান নাই।
সাহেব। ইহার কারণ?
মেম। কারণ আর কিছুই নহে,
ইহাই তাঁহার নিয়ম যে, উপরে উঠিবার সময় তিনি সেই বোতল হইতে নিজ হস্তে সেই গ্লাসে মদ্য ঢালিয়া লন এবং উহা পান করিয়াই উপরে উঠেন। সুতরাং গ্লাসে মদের গন্ধ পাইলেই বুঝিবেন যে, তিনি উহা পান করিয়াছেন এবং উপরে গিয়াছেন।
সাহেব। কোন্ সময় তিনি পুনরায় নীচে আগমন করেন?
মেম। তাহার পরদিবস প্রাতঃ পাঁচটার পূর্ব্বে তিনি উপর হইতে আর নামেন না।
সাহেব। আমি বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিব কিরূপে? দ্বারবান দরজা খুলিয়া দিবে কেন?
মেম। তাহার নিমিত্ত আপনাকে ভাবিতে হইবে না; যে পর্য্যন্ত আপনি বাড়ীর ভিতর প্রবেশ না করিবেন, সেই পর্যন্ত দ্বারবান দরজা বন্ধ করিবে না। আমি বন্দোবস্ত করিয়া রাখিব।
সাহেব। এই ত হইল রাত্রির বন্দোবস্ত, কিন্তু দিবা ভাগের বন্দোবস্ত কি?
মেম। দিনমানের নিমিত্ত আর নূতন করিয়া কোনরূপ বন্দোবস্ত করিতে হইবে না, আপনি প্রকাশ্য ভাবে যেরূপে গমন করিয়া থাকেন, সেই রূপেই গমন করিবেন। তাহাতে কাহারও মনে কোনরূপ সন্দেহ হইবে না, বা কেহই আপনাকে কোন কথা জিজ্ঞাসাও করিবে না।
উভয়ের মধ্যে এইরূপ কথাবার্তা হইবার পর, উভয়েই সেইস্থান হইতে গাত্রোত্থান করিলেন এবং ক্রমে সেই অন্ধকারের মধ্যে অন্তর্হিত হইয়া পড়িলেন।
এই অবস্থা আমার মনে উদিত হওয়ায়, আমি মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম। সেই সাহেব আর মেমের সহিত কি এই ঘটনার কোনরূপ সংস্রব আছে? তাহাদিগের মধ্যে যে সকল কথা হইয়াছিল, তাহার সহিত ইহার সম্পূর্ণ সাদৃশ্য আছে দেখিতেছি। বৃদ্ধ, লাইব্রেরী, মদের বোতল, গ্লাস, মদ্যপান করিয়া রাত্রি এগারটার সময় উপরে যাওয়া, প্রাতঃ পাঁচটার সময় নীচেয় আসা প্রভৃতি সকল কথাই তো এই ঘটনার সহিত মিলিতেছে। সেই সাহেব ও মেমের সহিত যদি এই ঘটনার সংস্রব থাকে, তাহা হইলে এখন কিরূপে অবগত হইতে পারিব যে, সেই সাহেবও মেমসাহেব কে? সে অন্ধকার রজনীর মধ্যে আমি ত তাহাদিগকে উত্তমরূপে দেখি নাই যে, তাহাদিগকে দেখিলে পুনরায় চিনিতে পারিব। মিস্ মেরির সহিত সেই মেম সাহেবের অনেকটা সাদৃশ্য থাকিলেও এবং কথাবার্তা কতকটা সেইরূপ হইলেও যখন আমি তাহাকে ঠিক চিনিতে পারি নাই, তখন আমি কিরূপে বলি যে, সেই মেম সাহেবই মেরি। মেরিকে এই কথাই বা এখন কিরূপে জিজ্ঞাসা করি? আর জিজ্ঞাসা করিলেই বা তিনি সেই সকল কথা স্বীকার করিবেন কেন?
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
সুরার বোতল ও গ্লাস, সরকারি রাসায়নিক পরীক্ষকের নিকট প্রেরিত হইল। মৃতদেহও ডাক্তারের দ্বারা পরীক্ষা হইবার পরে উহার পাকস্থলীও সেই স্থানে প্রেরিত হইল। রাসায়নিক পরীক্ষক, পরীক্ষা করিয়া পাকস্থলীতে এবং সুরার গ্লাসে প্রুসিক এসিডের চিহ্ন পাইলেন; কিন্তু সুরার বোতলে কোনরূপ বিষের চিহ্ন পাওয়া গেল না। রাসায়নিক পরীক্ষকের পরীক্ষার ফল অবগত হইবার পর সকলেই অবগত হইতে পারিলেন যে, প্রুসিক এসিড পানই বৃদ্ধের মৃত্যুর কারণ। আর ইহাও সকলের অনুমান হইল যে, বোতল হইতে গ্লাসে সুরা ঢালিবার পর গ্লাসের মধ্যেই সুরার সহিত সেই মহাবিষের সংমিশ্রণ হয়। এই অবস্থা দৃষ্টে অনুসন্ধানকারী কর্ম্মচারীগণের মধ্যে এখন দুইটি প্রধান চিন্তা আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল। প্রথম চিন্তা— বৃদ্ধ হত হইয়াছেন কি না, যদি হত হইয়া থাকেন, তাহা হইলে যে তাঁহাকে হত্যা করিল এবং কেনই বা তাঁহাকে হত্যা করিল, গ্লাসে সুরার সহিত কে এই মহাবিষ সংমিলিত করিতে সমর্থ হইল। যতদূর জানিতে পারা যাইতেছে, তাহাতে বৃদ্ধ বোতল হইতে সুরা নিজ হস্তে গ্লাসে ঢালিয়াই পান করিয়া থাকেন, এরূপ অবস্থায় সেই সময়ের মধ্যে গ্লাসে সুরার সহিত সহসা বিষ মিশ্রিত করিতে কে সমর্থ হন? তবে হইতে পারে, পূর্ব্ব হইতেই শূন্য গ্লাসে যদি কেহ সেই বিষ রাখিয়া দিয়া থাকে, এবং সুরা ঢালিবার সময় বৃদ্ধ যদি তাহা দেখিতে না পাইয়া তাহাতেই সুরা ঢালিয়া পান করিয়া থাকেন, তাহা হইলে হইতে পারে।
দ্বিতীয় চিন্তা, বৃদ্ধ সুরার সহিত বিষ পান করিয়া আত্মহত্যা করেন নাই ত? যদি তিনি আত্মহত্যাই করিবেন, তাহা হইলে আহারাদির পর শয়ন করিতে যাইবার সময়ে আত্মহত্যা করিবেন কেন? আর কি দুঃখেই বা তিনি আত্মহত্যা করিবেন? তাহার ত এরূপ কোন দুঃখ এখন পর্যন্ত দেখিতে পাইতেছি না, যাহার নিমিত্ত তিনি আত্মহত্যা করিতে পারেন। আর আত্মহত্যা করিবার নিমিত্ত তিনি প্রুসিক এসিড কোথা হইতে এবং কিসে করিয়াই আনিলেন? যদি তিনি আত্মহত্যা করিতেন, তাহা হইলে যে পাত্রে তিনি প্রুসিক এসিড সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছিলেন, বা যাহা হইতে তিনি উহা গ্লাসে ঢালিয়াছিলেন, তাহা নিশ্চয়ই এই স্থানে পাওয়া যাইত। এইরূপ অবস্থায় তিনি যে আত্মহত্যা করিয়াছেন, তাহাই বা কিরূপে অনুমান করা যাইতে পারে? যাহা হউক, লাইব্রেরী ঘরটি একবার অনুসন্ধান করিয়া দেখা কৰ্ত্তব্য; কারণ যদি তিনি আত্মহত্যাই করিয়া থাকেন, তাহা হইলে বিষের পাত্র তাহার মধ্যে কোন না কোন স্থানে নিশ্চয়ই পাওয়া যাইবে। তদ্ব্যতীত যদি তিনি কোন পত্রাদিও লিখিয়া গিয়া থাকেন, তাহাও কোন না কোন স্থানে থাকিবার সম্ভাবনা।
লাইব্রেরীর মধ্যে একপার্শ্বে একখানি টেবিল ছিল। কোন রূপ লেখাপড়া করিতে হইলে তিনি সেইস্থানে বসিয়া লেখাপড়া করিতেন ও লেখাপড়া করিবার কাগজপত্র ঐ টেবিলের একটি দেরাজের মধ্যে বন্ধ থাকিত। দেরাজের চাবি বৃদ্ধ তাঁহার পরিহিত কোটের পকেটেই সর্ব্বদা রাখিয়া দিতেন। বৃদ্ধ যে কোট পরিয়া লোকান্তর গমন করেন, সেই কোটের মধ্যে একগুচ্ছ চাবি ছিল। টেবিলের সংলগ্ন যে কয়েকটি দেরাজ আছে, তাহার প্রত্যেকের চাবি স্বতন্ত্র; এবং ঐ সমস্ত চাবি ও অপর আর কয়েকটি চাবি লইয়াই সেই চাবিগুচ্ছ।
লাইব্রেরীর ভিতর অন্যস্থানে অনুসন্ধান করিবার পূর্ব্বে ঐ টেবিলের দেরাজের মধ্যে আমরা প্রথমেই অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। একটি দেরাজের মধ্যে কতকগুলি কাগজ ছিল, ঐ কাগজগুলির মধ্যে বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিয়া দেখিতে দেখিতে একখানি পত্র ও একখানি উইলের খসড়া একত্র প্রাপ্ত হইলাম। ঐ পত্র ও উইলের সহিত এই হত্যাকাণ্ডের যে বিশেষ কোনরূপ সংস্রব আছে, তাহা প্রথমে আমরা কিছু অনুমান করিতে সমর্থ হই না; কারণ সেই সময় আমাদিগের বিশেষরূপ লক্ষ্য ছিল, যদি তিনি আত্মহত্যা করিয়া থাকেন, তাহা হইলে তাঁহার লিখিত কোন পত্রাদি সেইস্থানে পাইবার সম্ভাবনা। তাই আমরা সেই সময় সেইরূপ কোন পত্রাদি যদি পাওয়া যায়, তাহারই অনুসন্ধান করিতেছিলাম। উইল বা অপর কোন কাগজপত্রে সেই সময় হস্তক্ষেপ করার বিশেষ কোন প্রয়োজন উপলব্ধি হয় নাই।
টেবিলের ভিতর যে কয়েকটি দেরাজ ছিল, এক এক করিয়া তাহার সমস্তগুলিই আমাদিগের দেখা হইল, কিন্তু যে দ্রব্যের নিমিত্ত আমরা অনুসন্ধান করিতেছিলাম, তাহার কিছুই আমরা প্রাপ্ত হইলাম না। টেবিলের দেরাজগুলির অনুসন্ধান হইয়া গেলে সেই লাইব্রেরীর অপরাপর স্থানেরও অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু আমাদিগের অভীপ্সিত দ্রব্য কিছুই পাওয়া গেল না।
আমরা যে পর্য্যন্ত অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছিলাম, তাহার মধ্যে এ পর্যন্ত মেরিকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করা হয় নাই। কারণ মেরি ইউরোপীয় জাতি, তাহাতে আর তিনি এখনও মিস্ আছেন, অর্থাৎ এখন পর্যন্ত তিনি পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন নাই। সুতরাং আমাদিগের অর্থাৎ এদেশীয় কালা বাঙ্গালীদিগের কোন কথা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিরার অধিকার ছিল না। যে সকল ইংরাজ কৰ্ম্মচারী এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত ছিলেন, মেরিকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করা না করা তাঁহাদিগের কার্য্য, সে সম্বন্ধে আমাদিগের কোনরূপ কথা কহিবার প্রয়োজন ছিল না। সুতরাং আমরা তাঁহার নিকট কোন কথার নিমিত্ত অগ্রগামী হইলাম না। কিন্তু কোন কোন কথা মেরিকে জিজ্ঞাসা করিবার নিমিত্ত দুই একজন ইংরাজকর্মচারীকে অনুরোধ করিলাম। তাঁহারাও প্রথম প্রথম আমাদিগের অনুরোধ রক্ষা করিয়া মেরিকে দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করিবার মানসে অগ্রগামী হইলেন। মেরিকে তাঁহারা দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন, এই সংবাদ মেরির পরিচারককে দিয়া মেরির নিকট প্রেরণ করিলে তিনি উপর হইতে সংবাদ পাঠাইয়া দিলেন, “একজন কর্ম্মচারীকে উপরে আসিতে কহ।” এই সংবাদ পাইয়া একজন ইংরাজকর্মচারী আস্তে আস্তে উপরে উঠিলেন। যে ঘরে মেরি বসিয়াছিলেন, সেই ঘরের মধ্যে সহসা প্রবিষ্ট হইতে সাহসী না হইয়া সেই ঘরের পথে একটি দরজার সন্নিকটে দণ্ডায়মান হইলেন। মেরি ঘরের মধ্য হইতে এই অবস্থা দেখিতে পাইয়া, তাঁহাকে ঘরের ভিতরে আসিতে কহিলে, তিনি আপন মস্তক হইতে টুপি উন্মুক্ত করিয়া দূর হইতে সেলাম করিয়া, বিশেষ আদব কায়দার সহিত সেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলেন। মেরি তাঁহাকে একখানি চেয়ার দেখাইয়া দিয়া বসিতে বলায়, তিনি যেন আপনাকে বিশেষ কৃতার্থ মনে করিলেন এবং সেই চেয়ারের একটিমাত্র কোণ অবলম্বন করিয়া এরূপ ভাবে উপবেশন করিলেন যে, তাঁহার দেহের ভর যেন তাঁহার দেহেই রহিয়া গেল, চেয়ার যেন তাহার কিছুই উপলব্ধি করিতে পারিল না।
সেইস্থানে বসিয়া সেই খুনী মোকদ্দমার অনুসন্ধান-কারী ইংরাজ কর্মচারীর সহিত একজন বয়স্থা মিসেস খুনীর অনুসন্ধান সম্বন্ধে যেরূপ কথাবার্তা হইল, তাহা পাঠকগণ জানিতে চাহেন কি?
ইং কৰ্ম্মচারী। জুবেয়ার আপনার পিতা?
মিস্ মেরি। হাঁ।
ইং কর্ম্ম। আপনার কি বিবেচনা হয়, – জুবেয়ারকে কেহ হত্যা করিয়াছে, কি তিনি আত্মহত্যা করিয়াছেন?
মিস্। কেহ হত্যা করিয়াছে বলিয়া আমার অনুমান হয় না। আমি ভিন্ন যাঁহার আর কেহ নাই, অথচ যিনি সংসারের সহিত একরূপ সম্পর্ক পরিত্যাগ করিয়াছেন, তাঁহাকে হত্যা করিবার যে কাহারও স্বার্থ আছে, তাহা আমার বোধ হয় না। বোধ হয়, তিনি আত্মহত্যা করিয়া থাকিবেন।
ইং কর্ম্ম। আত্মহত্যার কারণ?
মিস্। তিনি অতিশয় বৃদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিলেন, ক্রমেই তাঁহার শরীর শিথিল হইয়া আসিতেছিল, আরও কিছু দিবস বাঁচিলে তাঁহাকে সম্পূর্ণরূপে পরাধীন হইতে হইত, এই ভাবিয়া শরীরে একটু বল থাকিতে থাকিতেই, পরাধীন হইতে না হইতেই তিনি ইহলোক হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিয়াছেন, আমার এইরূপ অনুমান হয়।
‘ইং কৰ্ম্ম। তিনি বিষ পাইলেন কোথা হইতে?
মিস্। যাঁহার অর্থের অভাব নাই, পরিচারকের অভাব নাই, যাহার নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধাচরণ করিবার যখন কাহার ক্ষমতা নাই, তখন তাঁহার পক্ষে সামান্য বিষের সংগ্রহ করা অসম্ভব কিসে?
ইং কৰ্ম্ম। কোন পরিচারক যে তাঁহাকে বিষ আনিয়া দিয়াছে, তাহা ত কেহ স্বীকার করে না।
মিস্। উহারা এদেশীয় লোক, একে সামান্য কারণে মিথ্যা কথা বলিতে কিছুমাত্র সঙ্কুচিত হয় না; তাহার উপর যখন দেখিতেছে, সেই বিষপান করিয়া বৃদ্ধ মরিয়া গিয়াছেন, তখন নিজহস্তে করিয়া বিষ আনিয়া দিয়াছে, এ কথা উহারা কখনই স্বীকার করিবে না।
ইং কৰ্ম্ম। যদি তাহারা কোন কথা স্বীকার না করে তাহা হইলে আমরা কিরূপে অবগত হইতে পারিব যে, তিনি কোথা হইতে বিষ সংগ্রহ করিলেন?
মিস্। তিনি নিজেও আনিতে পারেন। তাঁহার কোন স্থানে গমনাগমন করিবার কোনরূপ প্রতিবন্ধক ছিল না, অর্থেরও অভাব ছিল না।
ইং কৰ্ম্ম। কাল যে তিনি কোন স্থানে গমন করিয়াছিলেন, তাহা ত কোন পরিচারক বলে না।
মিস্। তিনি যে কালই উহা সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছিলেন, তাহারই বা অর্থ কি? ইতিপূর্ব্বে তিনি ঐ বিষ সংগ্রহ করিয়া অনায়াসেই আপনার নিকট রাখিতে পারেন।
ইং কৰ্ম্ম। তাহা হইলে আপনার বিবেচনায় বৃদ্ধ কি আত্মহত্যা করিয়াছেন?
মিস্। আমার তাহাই অনুমান হয়।
ইং কর্ম্ম। আপনার অপর আর কোনরূপ সন্দেহ হয় না?
মিস্। আমার আর কোনরূপ সন্দেহ নাই।
ইং কর্ম্ম। বৃদ্ধের আর আছে কে?
মিস্। আর কেহই নাই। আমিই কেবল তাঁহার একমাত্র কন্যা আছি।
মিস্ মেরিকে এই কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করিয়াই, তিনি সেই স্থান হইতে গাত্রোত্থান করিয়া আস্তে আস্তে নীচে আসিলেন। বলা বাহুল্য, মিসের নিকট হইতে বিদায়-গ্রহেণের সময় তিনি বিশেষ সম্মানের সহিত তাঁহাকে অভিবাদন করিতে ভুলিলেন না। নীচে আসিয়া তিনি আমাদিগের নিকট আগমন করিলেন, ও কহিলেন যে, মিস্ মেরির নিকট হইতে তিনি কতদূর অবগত হইতে পারিয়াছেন, তাহাতে তিনি বেশ বুঝিতে পারিয়াছেন যে, বৃদ্ধ জুবেয়ারকে কেহ হত্যা করে নাই, তিনি আত্মহত্যা করিয়া তাঁহার অতিশয় বার্দ্ধক্যের হস্ত হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিয়াছেন। ইংরাজকর্মচারীর এই কথা শুনিয়া তাঁহাকে কহিলাম, “আপনি ইহা কিরূপে অবগত হইতে পারিলেন, ও তাহার প্রমাণই বা কি?” উত্তরে তিনি কহিলেন, “যে কথা একজন বিলাতীয় মিসের মুখ হইতে বাহির হইয়াছে, তাহাতে কি আর কোনরূপ সন্দেহ হইতে পারে? আপনারা মনে কেন যাহাই ভাবুন না, ও যতই কেন অনুসন্ধান করুন না, আপনারা ঠিক জানিবেন যে, বৃদ্ধ আত্মহত্যা করিয়াছেন।”
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
ইংরাজকর্মচারীর কথা আমরা শ্রবণ করিলাম বটে, কিন্তু সেই কথার উপর আমরা আর কোনরূপেই আস্থা স্থাপন করিতে পারিলাম না। কারণ, রমণীর যে পিতা ভিন্ন জগতে আর কেহই নাই; যাহার মৃত্যুতে তাঁহাকে একেবারে চতুৰ্দ্দিক অন্ধকার দেখিতে হইবে, যাঁহার অবর্তমানে সংসারের সমস্ত ভার যাঁহার উপর সম্পূর্ণভাবে অর্পিত হইবে, তাঁহার মৃত্যুতে মিসের কোনরূপ দুঃখ হইয়াছে বলিয়া অনুমান হইল না। বিশেষ বৃদ্ধ জুবেয়ার আত্মহত্যা করিয়াছেন বলিয়া নানারূপ যুক্তি প্রদর্শন পূর্ব্বক অনুসন্ধানকারী পুলিস-কর্ম্মচারীগণকে বুঝাইতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। অথচ পুলিস-কৰ্ম্মচারীগণ কিরূপ অনুসন্ধান করিতেছেন, তাহা দেখিবার নিমিত্ত একবারও নীচে আসিলেন না। আমরা কি করিতেছি, না করিতেছি, উপরে বসিয়াই কেবল তাহার সন্ধান করিতে লাগিলেন।
মিসের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া তাঁহার উপর আমাদের কেমন একরূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল। এক বার মনে হইল, মেরি অবিবাহিতা রমণী; কোন দুষ্টমতি প্রণয়ীর সহিত তিনি কি কোনরূপ প্রণয়সূত্রে আবদ্ধ হইয়াছেন? এবং প্রণয়ীর নিমিত্ত তাঁহার কি বিশেষ কোনরূপ অর্থের প্রয়োজন হইয়াছে? সেই সমস্ত অর্থ বৃদ্ধ প্রদান করিতে অসম্ভত হওয়ায়, প্রণয়ীর পরামর্শে তিনি কি বৃদ্ধের সমস্ত অর্থ হস্তগত করিবার মানসে এই ভয়ানক কার্য্যের অবতারণা করিয়াছেন? সামান্য অর্থের আকাঙ্ক্ষায় স্নেহময়ী কন্যা তাহার পূজনীয় পিতাকে এইরূপে হত্যা করিতে বা হত্যার সহায়তা করিতে যে অনায়াসেই প্রস্তুত হইবে, তাহাই বা সহজে বিশ্বাস করি কি প্রকারে? তবে প্রণয়ে মুগ্ধ হইলে সেই প্রণয়ীর সন্তোষ সাধন করিবার মানসে, না হইতে পারে, এমন কেমন কাৰ্য্যই নাই।
আমরা মনে মনে এইরূপ ভাবিতেছি, সেই সময় বৃদ্ধের দেরাজের মধ্যে যে একখানি উইলের ও একখানি পত্রের খসড়া দেখিতে পাইয়াছিলাম, হঠাৎ তাহা মনে আসিল। উহাতে কি লেখা আছে, তাহা জানিবার মানসে পুনরায় সেই দেরাজ খুলিয়া উহা বাহির করিলাম, ও বিশেষ মনোযোগের সহিত উহা পাঠ করিলাম। পত্রখানি পড়িয়া জানিতে পারিলাম, উহা এই কলিকাতা মহানগরীর জনৈক বিখ্যাত ইংরাজ উকিলকে লিখিতেছেন। ঐ পত্রের মর্ম্ম এইরূপ—-
“আপনার সহিত আমার সে দিবস যে সকল কথা হইয়াছিল, তাহা বোধ হয় আপনার বেশ মনে আছে। আপনার সেই কথা অনুযায়ী আমি একখানি উইলের খসড়া প্রস্তুত করিয়াছি। উহাতে আমার সমস্ত বিষয় কিরূপে ও কাহাকে কাহাকে প্রদান করিতে চাহি, কেবলমাত্র তাহারই মোটামুটি লেখা আছে। ইহা দেখিলেই আপনি আমার মনের ভাব অবগত হইতে পারিবেন, ও সেইরূপ একখানি উইল দস্তুরমত লেখা পড়া করিয়া আমার নিকট পাঠাইয়া দিবেন। আমার যেরূপ বয়ঃক্রম হইয়াছে ও শরীরের অবস্থা দিন দিন যে-রূপ হইতেছে, তাহাতে আমি যে অধিক দিন বাঁচিব, তাহা বোধ হয় না। এরূপ অবস্থায় আমার কর্তব্য, আমার বিষয়াদি যাহা আছে, তাহার একটি বন্দোবস্ত করিয়া যাই। এই নিমিত্ত আমি উইল করিতে চাই। যত শীঘ্র পারেন, আমার কার্য্য শেষ করিয়া দিবেন। উইল লিখিবার সময় আর কোন বিষয় জানিবার যদি আপনার প্রয়োজন হয়, তাহা হইলে আমার সহিত আর একবার সাক্ষাৎ করিয়া সমস্ত অবস্থা জানিয়া লইবেন। আমি সমস্ত দিবসের মধ্যে প্রায়ই বাহিরে যাই না, সৰ্ব্বদাই আপন বাড়ীতে উপস্থিত থাকি। এই উইলের বিষয় এখন যেন কেহ কোনরূপে অবগত হইতে না পারেন, ইহা যেন বিশেষরূপ গোপন থাকে। আমার ইচ্ছা আছে, উইল প্রস্তুত হইলে আমি উহা রেজেষ্টারী করিয়া রাখিব, এবং আসল উইলও আপনাদিগের আফিসে থাকিবে। আমার মৃত্যুর পর উইলের মর্ম্মানুসারে আমার উত্তরাধিকারীগণকে আপনারা সংবাদ প্রদান করিয়া তাহাদিগকে সমস্ত সম্পত্তি বুঝাইয়া দিবেন।”
পত্রখানি পাঠ করিবার পর উইলের খসড়া নকলখানি বিশেষ মনোযোগের সহিত পাঠ করিলাম, উহার অর্থ এইরূপ—
১। আমার যে সকল স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি আছে ও যাহার তালিকা এই উইলের মধ্যেই প্রদর্শিত হইল, তাহা আমি নিম্নলিখিত রূপে বিভাগ করিয়া দিলাম। বলা বাহুল্য, আমার মৃত্যুর পর হইতে এই উইলের লিখিত মা অনুসারে কার্য্য আরম্ভ হইবে। আমার জীবিতকালে এই উইলের কোনরূপ স্বত্ব আমলে আসিবে না।
২। আমার বিষয় সম্পত্তি সকল বিভাগ করিয়া দিবার পূর্ব্বেই আমার নিজের বৃত্তান্ত কিয়ৎ পরিমাণে এই উইলের মধ্যে থাকা কর্তব্য। কারণ, আমি পরলোক গমন করিলে, আমার সমস্ত বিবরণই অপরিজ্ঞাত রহিয়া যাইবে। আমার জন্মস্থান ইয়ুরোপের কোন এক অংশে। শৈশবেই আমার পিতা মাতা পরলোক গমন করেন। আমি সাধারণের অনুগ্রহের উপর নির্ভর করিয়া জীবন ধারণ করি। যখন আমার বয়ক্রম ১৫।১৬ বৎসর সেই সময় আমি সৈনিক বিভাগে সামান্য পদাতিক রূপে প্রবেশ করি এবং সৈন্য দলের সহিত ক্রমে আমি ভারতবর্ষে আসিয়া উপস্থিত হই। আমি সামান্য পদাতিক সৈন্য হইলেও ৩।৪ বৎসরের অধিক আমাকে সেই কার্য্য করিতে হয় না। সামান্য সামান্য কার্য্যের নিমিত্ত আমি ক্রমে আমার উপরিতন কর্মচারীর নিকট পরিচিত হইয়া পড়ি এবং পরিশেষে সীমান্ত প্রদেশীয় একটা যুদ্ধে বিশেষ কৌশল প্রদর্শন করিয়া, আমাদিগের প্রধান সেনাপতির জীবন রক্ষা করিতে আমি সমর্থ হই। এই কার্য্যের নিমিত্ত প্রধান সেনাপতি আমার উপর বিশেষ রূপ সন্তুষ্ট হন; এবং সেই যুদ্ধ সংবাদ ইংলণ্ডে প্রকাশ কালীন, তিনি তাহাতে আমার বিশেষরূপ বীরত্বের কথা বিবৃত করিয়া, পরিশেষে ইহাতে লিখিয়া দেন যে, “এই যুদ্ধে যদি জুবেয়ার না থাকিতেন, বা তিনি আমাকে যেরূপ ভাবে রক্ষা করিয়াছিলেন, তাহা না করিতেন, তাহা হইলে আমার জীবন ত রক্ষা পাইতই না; অধিকন্তু সেই যুদ্ধে জয় লাভ না হইয়া সকলকে শত্ৰুহস্তে পড়িতে হইত।” সেনাপতি আমার বিষয়ে এইরূপে বিলাতীয় কৰ্ম্মচারী বা মহাসভার কর্ণগোচর করিবার অতি অল্পদিবস পর হইতেই আমি সামান্য পদাতিকের পদ হইতে বিনা-পরীক্ষায় উচ্চতর কর্মচারীর পদে উন্বিত হই। এবং ক্রমে ক্রমে দলের নেতৃত্ব পদ পর্যন্ত প্রাপ্ত হই। যখন আমি এই সকল কার্য্যে নিযুক্ত ছিলাম, সেই সময় হইতেই আমি কিছু অর্থের সংস্থান করিতে সমর্থ হইয়াছিলাম। পরিশেষে একটি যুদ্ধে আমার ভাগ্যলক্ষ্মী অতিশয় সুপ্রসন্ন হয়। সেই যুদ্ধে আমার হস্তে যে পরিমিত অর্থ পতিত হইয়াছিল, তাহা হইতেই আমি একাল পৰ্য্যন্ত সুখে ও স্বচ্ছন্দে কাল যাপন করিয়া আসিতেছি। যে সময় আমার হস্তে প্রচুর পরিমাণে অর্থ আসিয়া উপস্থিত হয়, তাহার অল্পদিবস পরেই আমি পরিণয়-সূত্রে আবদ্ধ হই। আমার স্ত্রীর জন্মস্থানও ইয়ুরোপের কোন এক স্থানে। তিনিও একজন সেনাপতির কন্যা। আমি পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হইবার অতি অল্প দিবস পরেই, কোন একটা যুদ্ধের কিয়ৎ পরিমাণ ভার আমার উপর ন্যস্ত হয়, এবং সেই স্থানে বাহিনীর সহিত গমন করিতে আমার উপর আদেশ হয়। সেই সময় আমার স্ত্রী অতিশয় পীড়িতা ছিলেন; সুতরাং তাঁহাকে তখন সেই অবস্থায় পরিত্যাগ করিয়া, যাহাতে আমাকে সেই যুদ্ধে গমন করিতে না হয়, তাহার নিমিত্ত আমি বিশেষ রূপে চেষ্টা করি; কিন্তু কোনরূপেই কৃতকার্য্য হইতে না পারিয়া, আমার পীড়িত পত্নীকে সেই স্থানে পরিত্যাগ করিয়া, আমাকে সেই যুদ্ধে গমন করিতে হয়। কিন্তু ভগবানের কৃপায় সেই যুদ্ধে আমাকে অধিক দিবস ব্যাপৃত থাকিতে হয় না; দুই এক মাসের মধ্যেই উহা শেষ হইয়া যায়। আমিও আপন স্থানে প্রত্যাগমন করিতে সমর্থ হই। যে সময় আমি প্রত্যাগমন করি, সেই সময় পর্যন্ত আমার স্ত্রী সম্পূর্ণ রূপে আরোগ্য হইতে পারেন না। আমি যে দিবস যুদ্ধ হইতে প্রত্যাগমন করি, তাহার পরদিবসেই আমি আপনার চাকরি পরিত্যাগ করিয়া, আজমীরের সন্নিকট একটি স্থানে একখানি বাড়ী খরিদ করিয়া, সেই স্থানে বাস করিতে আরম্ভ করি। যে স্থানে আমি আমার বাসস্থান সংস্থাপিত করি, সেইস্থান এখন ইংরাজ অধিবাসীবর্গের দ্বারা প্রায় পূর্ণ হইয়া গিয়াছে। সেই স্থানে বাস করিবার পর, আমার একটি পুত্র জন্ম গ্রহণ করে। তাহাকে আমি আমার সাধ্যমত লেখা পড়া শিখাইতে আরম্ভ করি এবং একটু বড় হইলে তাহাকে বিলাতে পাঠাইয়া দিয়া, তাহাকে ডাক্তারি বিদ্যায় পারদর্শী করিয়া লই। ডাক্তারি শিক্ষা করিয়া আমার পুত্রু পুনরায় আজমীরে আগমন করে এবং আমার বাড়ীতেই অবস্থিতি পূর্ব্বক ডাক্তারি ব্যবসা আরম্ভ করে। এখনও তিনি সেই স্থানে অবস্থিতি করিয়া ডাক্তারি করিতেছেন। সেই স্থানের ভদ্র-ইংরাজ সমাজের মধ্যে তাহার এখন বিশেষ রূপ প্রাধান্য হইয়াছে। তিনি বিবাহ করিয়াছেন, দুইটি পুত্র জন্মিয়াছে। কিন্তু আমার সহিত তাঁহাদিগের এখন কোনরূপ সংশ্রব নাই, এমন কি পুত্রাদি পৰ্য্যন্তও লেখালেখি হয় না। কেন যে পিতা পুত্রের মধ্যে এইরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহাও আমি এই স্থানে বর্ণন করিতেছি। আমার পুত্র ডাক্তার হইয়া প্রত্যাবর্তন করিবার অতি অল্প দিবস পরেই, আমার স্ত্রীর মৃত্যু হয়। তাহার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আমারও মনের গতি ক্রমে পরিবর্তিত হইয়া পড়ে। বাল্যকাল হইতে যে রাস্তায় আমি কখন পদার্পণ করি নাই, আমার পদস্খলিত হইয়া ক্ৰমে সেই রাস্তায় পতিত হয়। আমার বাড়ীর নিকট আর একটি ইংরাজ তাঁহার পত্নীর সহিত বাস করিতেন, আমাদিগের পরস্পরের মধ্যে পরস্পরের বাড়ীতে যাতায়াত ছিল। সেই ইংরাজ-পত্নীর সহিত ক্রমে আমার অবৈধ প্রণয় জন্মিয়া যায়, এবং কিছু দিবস মধ্যেই ক্রমে উহা প্রকাশিত হইয়া পড়ে। যাঁহার পত্নীর সহিত আমি এইরূপ অবৈধ প্রণয়ে আবদ্ধ হইয়াছিলাম, তিনি এই অবস্থা অবগত হইতে পারিয়া, তাঁহার পত্নীকে এবং আমাকে হত্যা করিতে কৃতসংকল্প হন। তাঁহার স্ত্রী তাঁহার মনের ভাব অবগত হইতে পারিয়া, এক দিবস তাঁহাকে স্পষ্টই বলেন, “যদি আমার চরিত্রের উপর তোমার কোনরূপ সন্দেহ উপস্থিত হইয়া থাকে, তাহা হইলে আইনের আশ্রয় লইয়া তুমি আমাকে অনায়াসেই পরিত্যাগ করিতে পার।” তাঁহার কথার উত্তরে তাঁহার স্বামী কহেন, “তুমি মনেও করিও না যে, আমি আইনের আশ্রয় লইয়া আমাদিগের মধ্যে বিবাহ-সম্বন্ধ ত্যাগ করিয়া তোমাকে পরিত্যাগ করিব, আর তুমি আমার সম্মুখে বসিয়া জুবেয়ারের সহিত আমোদ আহ্লাদে লিপ্ত হইবে। আমি আমার ভাগ্যফল স্থির করিয়া রাখিয়াছি। তোমাদিগের উভয়ের নিমিত্ত বিশেষ যত্ন করিয়া এই আগ্নেয় অস্ত্রকে ঘরে স্থান প্রদান ‘করিয়াছি এবং এক দিবস স্বচক্ষে দেখিবার সুযোগের কেবল অনুসন্ধান করিতেছি। আমার বোধ হয় সেই সুযোগ ঘটিবারও আর অধিক বিলম্ব নাই।” এই কথা শুনিয়া আমাদিগের মনে আরও ভয় হইল, আমরা উভয়ে গোপনে পরামর্শ করিয়া আমার নগদ টাকা কড়ি যাহা ছিল, কেবল মাত্র তাহাই গ্রহণ করিয়া এক রাত্রিতে গুপ্ত বেশে আমরা সেই স্থান পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিলাম। আমি যাহার সহিত প্রণয় সূত্রে আবদ্ধ হইয়াছিলাম, এবং যাহার সহিত সেই স্থান হইতে পলায়ন করিলাম, তাহার একটি দুই বৎসর বয়ঃক্রমের বালিকা ছিল, পলায়ন করিবার সময় তিনি তাহাকেও সঙ্গে করিয়া আনিলেন। সেই বালিকাই এখন এখানে আমার কন্যা বলিয়া পরিচিত। তাহারই নাম মিস্ মেরি।
পাপের কী ভয়ানক শক্তি, ও অবৈধ প্রণয়ের কী মায়াবিনী ক্ষমতা! আপন প্রাণ-অপেক্ষা প্রিয়তম পুত্রবে সেইস্থানে পরিত্যাগ করিয়া, নিজের বাড়ীর মায়া হৃদয় হইতে দূরীভূত করিয়া বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয় স্বজনের মুখ কালিমাময় করিয়া, নিজের মান-সম্ভ্রম, গৌরব অগাধ জলে নিক্ষেপ করিয়া পাপময় রাজনীর নিবিড় অন্ধকারের ভিতর অনায়াসেই হাসিতে হাসিতে প্রবেশ করিলাম! নিজের পত্নীকে বিসর্জ্জন দিয়া তাহার অকপট প্রণয়ের দুর্ভেদ্য গ্রন্থিকে হৃদয় হইতে সজোরে বিচ্ছিন্ন করিয়া সেইস্থানে অবিদ্যারূপিণী মায়াবিনী অপরের পত্নীকে স্থান প্রদান করিলাম। আপন উপযুক্ত, শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত ও অনুগত পুত্রকে ক্রোড় হইতে দূরে নিক্ষেপ করিয়া, সেইস্থানে দ্বিচারিণী মাতার গর্ভজাত কন্যাকে সযত্নে হাসিতে হাসিতে স্থান প্রদান করিলাম! আমি সেই সময় বালক ছিলাম না, আমার হিতাহিত জ্ঞান যে সেই সময় জন্মিয়াছিল না – তাহাও নহে; কিন্তু অবৈধ প্রণয়ের বিষম প্রলোভনে সে সমস্তই ভুলিয়া গেলাম! অনবরত যুদ্ধক্ষেত্রে বিচরণ করিয়া স্বহস্তে রাশি রাশি মনুষ্যের জীবন নষ্ট করিয়া যে হৃদয় ভয়ানক কঠিন হইয়া পড়িয়াছিল, সেই কঠিন হৃদয় অবৈধ প্রণয়ে একেবারে গলিয়া গেল! আমি পাগলের ন্যায় আত্মহারা হইয়া ভালমন্দ কিছুই বুঝিতে সমর্থ হইলাম না। পর-পত্নীর সহিত সেইস্থান হইতে পলায়ন করিয়া এই কলিকাতায় আসিয়া উপনীত হইলাম, ও যে বাড়ীতে এখন বাস করিতেছি, সেই বাড়ীতেই বাসস্থান সংস্থাপিত করিলাম। যে পৰ্য্যন্ত স্ত্রী বা স্বামী আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া স্বামী বা স্ত্রীকে পরিত্যাগ না করেন, আমাদিগের বিবাহ-আইন- অনুসারে সেই পর্যন্ত উভয়ের মধ্যে কেহই পুনরায় বিবাহ করিতে সমর্থ হন না। যাহার সহিত আমি অবৈধ প্রণয়ে আবদ্ধ হইয়াছিলাম, তাঁহার স্বামী বর্ত্তমান, অথচ আইন অনুসারে পরস্পরের মধ্যে কেহই পরিত্যক্ত হন নাই; সুতরাং আমার সেই প্রণয়িণীকে বিবাহ করিয়া আইনানুযায়ী তাহাকে আপন বিবাহিতা স্ত্রী রূপে পরিণত করিতে পারিলাম না। কিন্তু উভয়েই স্বামী ও স্ত্রীর ন্যায় বাস করিতে লাগিলাম। এই কলিকাতার মধ্যে এখন পৰ্য্যন্ত কেহই অবগত নহেন যে, তিনি আমার স্ত্রী ছিলেন না। সকলেই জানিত যে, আমরা স্ত্রী পুরুষ। সে যাহা হউক, কিছু দিবস পর্য্যন্ত আমরা উভয়েই এই স্থানে বাস করিবার পর সেই রমণী আমাকেও পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেল। এবার সে আমাকে পরিত্যাগ করিয়া এ জগতে অপর কাহার নিকট গমন করিল না, পর জগতে গমন করিল। এখন কেবলমাত্র তাহার সেই কন্যা মেরিই আমার নিকট অবস্থিতি করিতে লাগিল। মেরি অতি শৈশবেই তাহার মাতার সহিত অমন করিয়াছিল; সুতরাং এই সকল অবস্থা যে সে কিছু অবগত আছে, তাহা আমার বোধ হয় না। কারণ, আমি এ সকল প্রসঙ্গ কখন তাহার নিকট উত্থাপিত করি নাই। তবে তাহার মাতা তাহাকে কখন কিছু বলিয়াছে কিনা জানি না। মেরি আমাকে তাহার নিজের পিতা বলিয়াই অবগত আছে; এবং সেইরূপ ভাবেই এখন পর্য্যন্ত চলিতেছে। মেরির মাতার মৃত্যু হইবার পরে একবার মনে ভাবিয়াছিলাম, পুনরায় আপনার পুত্রের নিকট আজমীরে গমন করি। কিন্তু লজ্জার ভয়ে সেই স্থানে গমন করিতে সমর্থ হই না। বিশেষ মেরি এখন পর্যন্ত বিবাহ করে নাই, অবিবাহিত অবস্থায় তাহাকেই বা কোথায় রাখিয়া যাই। এই প্রকার নানারূপ ভাবিয়া চিন্তিয়া কলিকাতার বাসস্থান আর পরিত্যাগ করিতে পারিলাম না।
৩। আমার স্থাবর বিষয়ের মধ্যে আজমীরের সেই বাড়ী ব্যতীত আর কিছুই নাই। তাহা আমি বহু দিবস হইতে পরিত্যাগ করিয়া আসিয়াছি। এবং আমার পুত্র এখন এই বাড়ীতে বাস করিতেছেন। সেই বাড়ী তাহারই রহিল, তিনি যেরূপে ঐ বাড়ীতে বাস করিতেছেন, সেই রূপেই বাস করিবেন ও তাঁহার ইচ্ছামত দান বিক্রয়ও করিতে পারিবেন।
৪। আমার নগদ কিছু অর্থ আছে। উহা সমস্তই কোম্পানীর কাগজে পরিণত করিয়া রাখিয়াছি। ঐ সকল কাগজ বেঙ্গল ব্যাঙ্কে জমা আছে। ঐ কাগজের যে সকল সুদ পাওয়া যায়, তাহা হইতেই আমি সংসারের খরচ পত্র নির্ব্বাহ করিয়া থাকি। আমার ঐ সকল কাগজ আমি নিম্নলিখিতরূপে বিভাগ করিয়া দিলাম।
৫। আমার যে কাগজ আছে তাহার মূল্য ২,২৫,০০০ দুই লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা। ইহার মধ্যে আমার পুত্র পাইবেন ১,০০,০০০ এক লক্ষ টাকা, দুইটি পৌত্র ২৫,০০০ পঁচিশ হাজার হিসাবে পঞ্চাশ হাজার, পুত্রবধূ ২৫,০০০ পঁচিশ হাজার, আর আমার কন্যা বলিয়া পরিচিত মেরি ২৫,০০০ পঁচিশ হাজার টাকা পাইবেন; কিন্তু যদি মেরি বিবাহ না করিয়া চিরকালই অবিবাহিতা থাকেন, তাহা হইলে এক পয়সাও তিনি পাইবেন না। উহাও আমার পুত্রের হইবে। অবশিষ্ট যাহা থাকিবে, তাহার মধ্যে আমার ভৃত্যগণ প্রত্যেকে ২৫০ আড়াই শত টাকা করিয়া প্রাপ্ত হইবেন। তদ্ব্যতীত আমার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করিতে যাহা ব্যয় হইয়া যাইবে, তাহা বাদে যাহা অবশিষ্ট থাকিবে, তাহা আমার পুত্রের ইচ্ছামত দরিদ্রদিগকে দান বা অপর কোন সৎকর্ম্মে ব্যয়িত হইবে। আমার ঘরে যে সকল দ্রব্যাদি আছে, তাহা সমস্তই মেরি প্রাপ্ত হইবেন। কেবল লাইব্রেরীর পুস্তক তিনি পাইবেন না। কিন্তু যদি তিনি বিবাহ করেন ও তাহার স্বামী যদি বিদ্যোৎসাহী হন, তাহা হইলে আমার লাইব্রেরীর সমস্ত পুস্তক তিনি ব্যবহার করিতে পারিবেন; কিন্তু বিক্রয় করিতে পারিবেন না। নতুবা আমার পুত্র আমার পুস্তকগুলি গ্রহণ করিবেন, কিন্তু তিনিও উহা কোন রূপে বিক্রয় করিতে পারিবেন না। যদি তিনি নিজে ইহার স্থান দিতে অপারক হন, তাহা হইলে কোন সাধারণ লাইব্রেরীতে উহা দান করিবেন।
আমার ব্যবহৃত ঘড়ি ও চেন আমার পুত্রের। আংটা দুইটির মধ্যে একটি মেরির ও একটি আমার পুত্রবধূর।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
উইল ও চিঠির খসড়া দেখিয়া আমাদিগের বেশ অনুমান হইল যে, ইহার নকল বৃদ্ধ তাঁহার উকীলের নিকট পাঠাইয়া দিয়াছেন। মনে এইরূপ অনুমান করিয়া, আমরা সেই উকীলের নিকট গমন করিলাম ও তাঁহার নিকট হইতে অবগত হইতে পারিলাম যে, পূর্ব্বে একবার বৃদ্ধের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইয়াছিল। সেই সময় তাঁহার বিষয়ের উইল করা সম্বন্ধে তাঁহার কথাবার্তা হয় ও তিনি তাঁহার ইচ্ছামত কোন বিষয় কাহাকে প্রদান করিবেন, তাহার একটি খসড়া প্রস্তুত করিয়া তাঁহার নিকট পাঠাইয়া দিবেন বলিয়া যান। কিন্তু তাহার পর কোনরূপ কাগজ পত্র আর তাঁহার নিকট হইতে প্রেরিত হয় নাই। সুতরাং তিনি কোনরূপ উইলও প্রস্তুত করেন নাই।
উকীলের নিকট এই কথা অবগত হইয়া আমরা কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। একবার ভাবিলাম,—বৃদ্ধ উইল করিতে মনস্থ করিয়া একটি খসড়া প্রস্তুত করিয়াছিলেন; কিন্তু উকীলের বাড়ীতে উহা পাঠাইবার পূর্ব্বেই তাঁর মৃত্যু হইয়াছে। আবার ভাবিলাম, — উইল করিতে কৃতসঙ্কল্প হইয়া, সেই উইল শেষ না করিয়াই বা তিনি আত্মহত্যা করিলেন কেন? পুনরায় মনে হইল, মেরি যখন বৃদ্ধের একমাত্র কন্যা বলিয়া পরিচয় দিয়া থাকেন, তখন বুদ্ধের পরিত্যক্ত সমস্ত সম্পত্তিই তিনি প্রাপ্ত হইবার আশা যে না করিয়া থাকেন তাহা নহে, অথচ উইল অনুযায়ী দেখা যাইতেছে যে, বৃদ্ধ তাঁহার সম্পত্তির নিতান্ত সামান্য অংশ মেরিকে প্রদান করিতেছেন। এরূপ অবস্থায় মেরি যদি ঐ উইলের বিষয় কোনরূপে অবগত হইতে পারিয়া থাকেন, তাহা হইলে ঐ রূপ উইল মেরি যে সহজে করিতে দিবেন তাহা অনুমান হয় না। অথচ বৃদ্ধ যখন তাঁহার উইলের লেখাপড়া শীঘ্র শীঘ্র শেষ করিয়া রেজেষ্টারী করিয়া রাখিতে চান, তখন তিনিও যে বিলম্ব করিবেন, তাহা সম্ভবপর নহে। এরূপ অবস্থায় উকীলের বাড়ীতে উইলের খসড়া প্রেরিত হইল না কেন? মনে মনে এইরূপ চিন্তা করিতেছি, এমন সময় লাইব্রেরীর মধ্যস্থিত এক খানি পিয়নবুকের উপর হঠাৎ আমার নয়ন আকৃষ্ট হইল। ঐখানি হস্তে লইয়া তাহার ভিতর উল্টাইয়া উল্টাইয়া দেখিতে লাগিলাম। উহারই একস্থানে দেখিতে পাইলাম যে, উইলের খসড়া ও পত্র সেই উকীলের নিকট প্রেরিত হইয়াছে ও এখন ইংরাজ উহাতে স্বাক্ষর করিয়া উহা গ্রহণ করিয়াছেন। ইহা দেখিয়া ঐ পিয়ন বই হস্তে লইয়া পুনরায় সেই উকীলের বাড়ীতে গমন করিলাম ও তাঁহাকে উহা দেখাইলে, তিনি কহিলেন যে, ইহাতে লিখিত পত্র ও উইলের খসড়া তিনি প্রাপ্ত হন নাই, ও উহাতে যে স্বাক্ষর রহিয়াছে, তাহা তাঁহার আফিসের কাহারও স্বাক্ষর নহে। উকীলের নিকট এই অবস্থা শ্রবণ করিয়া আমাদিগের মনে আরও ভয়ানক সন্দেহের উদয় হইল। পুনরায় বৃদ্ধের বাড়ীতে আগমন করিয়া ঐ বাড়ীর দারোয়ান প্রভৃতি সমস্ত পরিচারকগণকে একত্র করিলাম, ও সকলকে সেই পুস্তক দেখাইয়া জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম যে, বৃদ্ধের মৃত্যুর পূর্ব্ব দিবস কোন কাগজ বা পত্রাদির সহিত ঐ পুস্তক বৃদ্ধ কাহার হস্তে অর্পণ করিয়াছিল, ও সেই বা উহা কি করিয়াছে।
প্রত্যেকের নিকট এইরূপ অনুসন্ধান করিতে করিতে তাহাদিগের মধ্য হইতে একজন দ্বারবান কহিল, “খুব বড় একখানি চিঠির সহিত আমার মনিব উহা আমাকে প্রদান করিয়াছিলেন”। দ্বারবানের এই কথা শুনিয়া আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম। “তোমাকে তিনি কী বলিয়া উহা প্রদান করিয়াছিলেন?”
দ্বারবান্। আমাকে বলিয়া দিয়াছিলেন, ইহাতে যে উকীলের নাম লেখা আছে, সেই উকীলের বাড়ীতে ইহা দিয়া আইস।
আমি। তুমি উহা সেই স্থানে লইয়া গিয়াছিলে?
দ্বারবান্। না।
আমি। কেন লইয়া যাও নাই? ঐ পত্র তুমি কী করিলে?
দ্বারবান্। আমি যখন ঐ পত্ৰ লইয়া যাইতেছিলাম, সেই সময় রাস্তায় মেম সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ হয়। একখানি টমটমে তিনি ও আর একজন সাহেব আসিতেছিলেন। রাস্তায় আমাকে দেখিয়া তিনি তাঁহার টমটম থামান ও আমাকে ডাকেন। আমি তাঁহার নিকট গেলে তিনি আমাকে কহেন, “এই পত্র লইয়া তুমি কোথায় যাইতেছ?” তাঁহার কথায় আমি কোনরূপ উত্তর প্রদান না করিয়া পিয়ন বহি সহ ঐ পত্রখানি তাঁহার হস্তে প্রদান করি। তিনি পিয়নবহিখানি দেখিয়া, তাঁহার সহিত যে সাহেবটি ছিলেন তাঁহাকে ইংরাজীতে কী বলিলেন। মেমের কথা শুনিয়া তিনি পিয়নবহিখানি আপন হস্তে লইয়া পড়িয়া দেখিলেন, ও আপন পকেট হইতে পেন্সিল বাহির করিয়া ঐ পুস্তকে সহি করিয়া দিলেন। পরে আমাকে কহিলেন, “ইহা আমারই পত্র। আর তোমাকে আমার আফিস পর্য্যন্ত গমন করিতে হইবে না।” এই বলিয়া তিনি পিয়নবহি খানি আমার হস্তে প্রদান করিলেন। আমি উহা লইয়া চলিয়া আসিলাম। পত্রখানি কিন্তু মেম সাহেবের হস্তে রহিয়াছিল। আমি ফিরিয়া আসিয়া পুস্তকখানি আমার মনিবের সম্মুখে টেবিলের উপর রাখিয়া দিলাম। তিনি উহা এক বার খুলিয়া দেখিয়া পুনরায় সেই স্থানেই রাখিয়া দিলেন।
আমি। যে সাহেব ঐ পুস্তকে সহি করিয়া দিয়াছিলেন, তাহাকে তুমি চিন কী?
দ্বারবান্। তাঁহাকে খুব চিনি। দিবাভাগে প্রায় সর্ব্বদাই তিনি আমার মনিবের বাড়ীতে আসিয়া থাকেন, ও মেম সাহেবের সহিত প্রায় সর্ব্বদাই আমোদ আহ্লাদ করিয়া বেড়ান। তদ্ব্যতীত প্রায় প্রত্যহ রাত্রিতে বৃদ্ধ উপরে গমন করিবার পর আসিয়া থাকেন, ও বৃদ্ধ শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিবার পর চলিয়া যান। কোন কোন দিন আবার প্রত্যূষে গমন না করিয়া দিবাভাগেই সৰ্ব্বসমক্ষে গমন করিয়া থাকেন। তাঁহাকে আর আমি চিনি না।
আমি। তিনি কোথায় থাকেন, তাহা তুমি বলিতে পার?
দ্বারবান্। তাহা আমি জানি না, কিন্তু তাঁহাকে আমি উত্তমরূপে চিনি, ও বাড়ীর সমস্ত লোকেই তাঁহাকে চিনে। আমার মনিবের মৃত্যুর পর হইতে আর তিনি পূর্ব্বের ন্যায় সদা সর্ব্বদা এখানে আসেন না, বা থাকেন না; কেবলমাত্র এক আধবার আসিয়া থাকেন।
এ পর্য্যন্ত আমাদিগের মনে যে একটু সন্দেহ ছিল, দ্বারবানের কথা শুনিয়া সে সন্দেহ আমাদিগের মন হইতে একটু দূরীভূত হইল। এই উইলই যে বৃদ্ধের মৃত্যুর কারণ, তখন কে যেন তাহা আমাদিগকে বলিয়া দিল। আরও আমাদিগের মনে বিশেষরূপ ধারণা হইল যে, মেরি নিজে বা অপর কাহার দ্বারা এই কার্য্য সম্পন্ন করাইয়াছেন, তাঁহার নিজের স্বার্থ সিদ্ধির নিমিত্ত তিনি এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিয়াছেন।
আমরা যে কয়েকজন দেশীয় কৰ্ম্মচারী এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছিলাম, দেখিলাম, তাঁহারা সকলেই ক্রমে আমার মতের অনুমোদন করিলেন। এখন এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে হইলে মিস্ মেরিকে ভাল করিয়া জিজ্ঞাসাবাদ করা, বা তাহাকে গ্রেপ্তার করার প্রয়োজন হইয়া পড়িল। কিন্তু এই কার্য্য এদেশীয় কর্ম্মচারীগণের দ্বারা সম্পন্ন হওয়া কোনরূপেই কৰ্ত্তব্য নহে; সুতরাং এই অনুসন্ধানে হস্তক্ষেপ করিতে হইলে ইংরাজ কৰ্ম্মচারীর সাহায্য গ্রহণ করা কর্তব্য। আমাদিগের সহিত কয়েকজন ইংরাজকর্মচারীও নিযুক্ত ছিলেন। এ কথা তাঁহাদিগকে কহিলে, তাঁহারা হাস্য করিয়া আমাদিগের কথা একবারেই উড়াইয়া দিলেন ও কহিলেন, ‘বিলাতীয় মিস্ মেরি তাঁহার পিতাকে হত্যা করিয়াছে, এ কথা কী কখন হইতে পারে? এরূপ অস্বাভাবিক অনুসন্ধানে আমরা কিছুতেই হস্তক্ষেপ করিতে সমর্থ নহি।” আমাদিগের সমপদস্থিত ইংরাজ কৰ্ম্মচারিগণের মুখ হইতে এই কথা শুনিয়া আমরা আমাদিগের মনের ভাব আমাদিগের ঊর্দ্ধতন কর্মচারীগণের মধ্যে দুই এক জনকে কহিলাম। দেখিলাম তাঁহারাও ইংরাজ কর্মচারীগণের মতের অনুমোদন করিলেন ও আমরা যে মহাভ্রমে পতিত হইয়াছি, তাহাই আমদিগকে বুঝাইয়া দিতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন।
এই অবস্থা দেখিয়া আমরা তাঁহাদিগকে আর কোন কথা কহিলাম না; আস্তে আস্তে সেস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। আমরা সেই স্থান হইতে ইংরাজ-কর্মচারীর অন্তরালে গমন করিলাম সত্য; কিন্তু আমাদিগের মনের ভাব একবারে পরিত্যাগ করিতে পারিলাম না। আমাদিগের মধ্যে কোন কোন কর্ম্মচারী কহিলেন, “যখন দেখিতেছি যে, আমাদিগের উর্দ্ধতন কর্মচারীগণ পর্য্যন্ত আমাদিগের বিপক্ষে অভিমত প্রকাশ করিতেছেন, তখন এই কাৰ্য্য হইতে আমাদিগেরও নিষ্কৃতি হওয়া কর্তব্য; কারণ এই মোকদ্দমার যদি কিনারা না হয়, তাহা হইলে আমাদিগের অনিষ্ট হইবার কোনরূপ সম্ভাবনাই নাই; কিন্তু এই মোকদ্দমার কিনারা করিতে গিয়া যদি মিসের অনিষ্ট করিবার চেষ্টা করি, তাহা হইলে আমাদিগের পদে পদে বিপদ ও বিশেষরূপ অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা আছে।” কেহ কহিলেন, “যখন আমরা বেশ বুঝিতে পারিতেছি যে, এই কার্য্য মেরির দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে, তখন কৰ্ত্তব্য-কর্ম্মের অনুরোধে আমাদিগকে এই কায্য হইতে পশ্চাৎপদ হইয়া কোনরূপেই কৰ্ত্তব্য নহে। আমাদিগের অদৃষ্টে যাহাই থাকুক না কেন, আমরা একবার মিসকে লইয়া অনুসন্ধান করিব ও তাঁহাকে দস্তুরমত জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া দেখিব যে, তিনি আমাদিগের কথার কিরূপ উত্তর প্রদান করেন।”
এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত সমস্ত দেশীয় কৰ্ম্মচারীগণ একস্থানে উপবেশ করিয়া এইরূপ পরামর্শ করিতেছি, এমন সময় আর একজন ঊর্দ্ধতন ইংরাজ কর্মচারী সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন ও আমাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন “তোমরা সকলে একস্থানে বসিয়া কি করিতেছ? এইরূপে একস্থানে বসিয়া থাকিলে কী এই মোকদ্দমার কিনারা হইবে?”
যে ইংরাজ-কৰ্ম্মচারী আমাদিগকে এই কথা কহিলেন, তাঁহার জন্মস্থান খাস বিলাতে ও তাঁহার বয়ঃক্রমও খুব অধিক নহে। অপরাপর ইংরাজ-কর্ম্মচারিগণের সহিত তাঁহার প্রায়ই মতের মিল হইত না, অথচ তিনি কখন অপরের মতে মত দিয়া তাহাদের কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতেন না। ভাল হউক বা মন্দ হউক নিজের মনে যেমন উদয় হইত, সেইরূপ ভাবে চলিতেন। তাঁহার সমপদস্থ অপরাপর কর্ম্মচারিগণ তাঁহাকে প্রায়ই দেখিতে পারিতেন না, ও তাঁহাদিগের কোনরূপ পরামর্শে তাঁহাকে ডাকিতেন না। তিনিও তাঁহাদিগের কাহার কোন কথা গ্রাহ্যের মধ্যে আনিতেন না। যাহা তাঁহার মনে উদয় হইত, তাহাই করিতেন।
এই কর্ম্মচারীর কথা শুনিয়া আমরা তাঁহাকে কহিলাম, “আমরা ত এই মোকদ্দমার কিনারা করিয়া আসিয়াছি, কিন্তু আপনারা তাহা চান কই? সুতরাং অনন্যোপায় হইয়া আমরা এইস্থানে চুপ করিয়া বসিয়া কেবল সময় অতিবাহিত করিতেছি।”
আমাদিগের কথা শুনিয়া তিনিও আমাদিগের সহিত সেই স্থানে উপবেশন করিলেন ও কহিলেন “এই মোকদ্দমার কিরূপ কিনারা করিয়াছ, তাহা সবিশেষ আমাকে কহ। তাহা হইলে আমি বুঝিতে পারিব যে, তোমাদিগের অনুমান কতদূর যুক্তিসঙ্গত।”
কর্ম্মচারীর কথা শুনিয়া মিস্ মেরি সম্বন্ধে আমাদিগের মনে যেরূপ সন্দেহ উপস্থিত হইয়াছিল, ও অনুসন্ধান করিয়া তাঁহার বিপক্ষে যাহা যাহা প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, তাহার সমস্তই একে একে তাঁহাকে কহিলাম। উইল ও পত্রের খসড়া তাঁহাকে দেখাইলাম। দ্বারবানের নিকট হইতে যেরূপে তিনি উহা হস্তগত করিয়াছিলেন, তাহাও তাঁহাকে কহিলাম। উইল করিবার পূর্ব্বে বৃদ্ধের মৃত্যু হইলে মেরির কিরূপ স্বার্থ রক্ষা হইতেছে, আমাদিগের কথা শুনিয়া,
তাহা তিনি সমস্তই বুঝিতে পারিলেন ও পরিশেষে আমাদিগের মতের অনুমোদন করিয়া কহিলেন, “এরূপ অবস্থায় মেরিকে ও মেরির যিনি প্রিয়বন্ধু তাঁহাকে ধৃত করিয়া তোমরা অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হও নাই কেন?”
আমাদিগের অপরাপর ঊর্দ্ধতন কর্মচারীগণ এই সম্বন্ধে আমাদিগকে যাহা যাহা বলিয়াছিলেন, তাহা তাঁহাকে কহিলাম, ও এরূপ অবস্থায় আমরা কিরূপে এই অনুসন্ধানে হস্তক্ষেপ করিতে পারি, তাহাও তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম। আমাদিগের কথা শুনিয়া তিনি আমাদিগের উপর একটু বিরক্তি ভাব প্রকাশ করিয়া কহিলেন, “ তোমরা ইংরাজ রাজত্বের কর্ম্মচারীর উপযুক্ত নহ, বা ইংরাজ আইনের অর্থ অবগত হইতে পার নাই। আমাদিগের আইনে শাদা ও কালায় প্রভেদ নাই, বড় ও ছোটর মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য নাই; আইন মতে যাহাকে পাইব, রাজা হউন বা দরিদ্র হউন, দেশীয় হউন বা বিদেশীয় হউন, শ্বেতাঙ্গ হউন বা কৃষ্ণাঙ্গ হউন, সকলকেই সমান রূপে দেখিব ও সকলের সহিত সমান ভাবে চলিব। তোমাদিগের সাহসে না কুলায়, আমার সহিত আইস। আমি নিজে এখন এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতেছি।”
সাহেবের কথা শুনিয়া আমাদিগের মনে এখন আশার উদয় হইল। ভাবিলাম, এখন বোধ হয় এই মোকদ্দমার কিনারা হইবে। এই ভাবিয়া আমরা সকলেই সেই ইংরাজ কর্মচারীকে সর্ব্বতোভাবে সাহায্য করিতে বদ্ধপরিকর হইলাম।
কর্ম্মচারী সাহেব আর কোন কথা না বলিয়া একবারে উপর উঠিলেন। সেই সময়ে মেম ও তাঁহার প্রণয়াকাঙ্ক্ষী সাহেব সেইস্থানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি একবারেই উভয়কে কহিলেন, “ তোমরা এখন প্রকৃত কথা কহিবে কি না? যদি মঙ্গল চাহ, তাহা হইলে প্রকৃত কথা কহ। নতুবা তোমাদিগের হস্তে বৃদ্ধের যে অবস্থা ঘটিয়াছে, আমার হস্তে তোমাদিগেরও সেই অবস্থা ঘটিবে।” কর্ম্মচারীর কথা শুনিয়া তাঁহারা সমস্তই অস্বীকার করিলেন। কিন্তু ঐ কৰ্ম্মচারী তাঁহাদিগের কোন কথায় বিশ্বাস না করিয়া, মিস্ মেরি যে ঘরে থাকিতেন, সেই ঘর অনুসন্ধান করিতে আমাদিগকে আজ্ঞা প্রদান করিলেন। আমরা কেবলমাত্র যে আদেশের অপেক্ষা করিতেছিলাম, সেই আদেশ পাইবামাত্রই ঐ ঘর উত্তমরূপে দেখিতে আরম্ভ করিলাম। মেমের দেরাজের ভিতর উইলের খসড়া ও সেই উকীলের পত্র পাওয়া গেল। উহা সেইস্থানে কিরূপে আসিল, মেম সাহেব তাহার কোনরূপ সন্তোষজনক উত্তর প্রদান করিতে পারিলেন না। এদিকে আর একটি আলমারী হইতে একটি প্রুসিক এসিডের শিশিও বাহির হইল। ঐ শিশির প্রায় এক-চতুর্থ অংশ শূন্য। ঐ ঔষধ কিরূপে তাঁহার ঘরের ভিতর আসিল, তাহাও তিনি আমাদিগকে উত্তমরূপে বুঝাইতে পারিলেন না। তিনি এ সম্বন্ধে অনেক বার অনেক রূপ বলিবার পর শেষে কহিলেন, লাইব্রেরীর ভিতর টেবিলের উপর উহা পড়িয়াছিল, সেইস্থান হইতে তিনি উহা আনিয়া নিজের নিকট রাখিয়া দিয়াছেন। সে যাহা হউক, পরিশেষে উভয়েই ধৃত হইলেন ও উভয়েই সমস্ত কথা স্বীকার করিলেন। আমরা যেরূপ অনুসন্ধান পাইয়াছিলাম, বা আমরা যেরূপ অনুমান করিয়াছিলাম, তাঁহারাও পরিশেষে সেইরূপই কহিলেন। তখন সকলেই জানিতে পারিলেন যে উইলই বৃদ্ধের মৃত্যুর কারণ, ও মিস্ মেরিই স্বহস্তে ঐ বিষ টেবিলস্থিত শূন্য গ্লাসে ঢাকিয়া রাখিয়া দিয়াছিলেন। বৃদ্ধ অনবধানবশতঃ সেই গ্লাসেই সুরা ঢালিয়া পান করিবার সঙ্গে সঙ্গে ইহজগৎ পরিত্যাগ করিয়াছেন। মেরির প্রণয়াভিলাষী সেই ইংরাজ যুবক ইহার মধ্যে সংসৃষ্ট থাকিলেও, তাঁহার দণ্ড হইতে পারে, এরূপ বিশেষ কোন প্রমাণ না পাওয়ার তিনি অব্যাহতি পাইলেন। কিন্তু মিস্ মেরি বিচারার্থ বিচারকের নিকট প্রেরিত হইলেন। তাঁহারও ভাগ্যে ইংরাজ আইন অনুসারে বিচার দণ্ড ঘটিল না, ঈশ্বরই তাঁহাকে দণ্ড প্রদান করিলেন। হাজতে থাকিবার কালীন বিশেষ সঙ্কটপীড়ায় আক্রান্ত হইয়া তিনি ইহজীবন ত্যাগ করিলেন। বলা বাহুল্য যে, বৃদ্ধের ইচ্ছানুসারে তাঁহার সমস্ত বিষয় বিভাগ হইয়া গেল; কেবল মিস্ মেরির অংশে যাহা পড়িয়াছিল, তাহাও তাঁহার পুত্র প্রাপ্ত হইলেন।
[বৈশাখ, ১৩০৮]