লাল পাগড়ি! (প্রথম অংশ)
(অর্থাৎ লাল-পাগড়ি পরিহিতের অদ্ভুত রহস্য! )
প্রথম পরিচ্ছেদ
লাল পাগড়ি কি? আর কেনই বা এই প্রবন্ধের নাম লাল পাগড়ি হইল, তাহার বিবরণ পাঠক পাঠিকাগণ ক্রমে অবগত হইতে পারিবেন; কিন্তু ঐ বিষয় অবগত হইবার পূর্ব্বে তিনটি মনুষ্যের পরিচয় সর্ব্বপ্রথমে অবগত হওয়া আবশ্যক। ঐ তিনটি লোকের মধ্যে সর্ব্বাগ্রে বঙ্গদেশীয় একটি লোকের পরিচয় এই স্থানে প্রদত্ত হইল। ঐ ব্যক্তি নিজে যাহা আমাকে বলিয়াছিল ও সেই সময় যাহার সারাংশ আমি লিখিয়া রাখিয়াছিলাম, তাহা হইতেই তাহার পরিচয় আপনারা প্রাপ্ত হইবেন।
ঐ ব্যক্তি বলিয়াছিল :- আমার বর্ত্তমান নাম গোবিন্দ দাস; অর্থাৎ যে নামে আমি এই কলিকাতার মধ্যে পরিচিত, তাহাই আমি আপনাকে বলিতেছি। আমার পিতা মাতার প্রদত্ত নাম এই স্থানে আমি প্রকাশ করিতে চাহি না। আমার বাসস্থান ছিল মেদিনীপুর জেলার মধ্যে কোন একটি সামান্য পল্লীগ্রামে; কিন্তু সেই প্রদেশে আমি পরিচিত নহি, কারণ বাল্যকাল হইতেই আমাকে আমার জন্মস্থান পরিত্যাগ করিতে হয়। আমাকে যে কোন আমার জন্মস্থান পরিত্যাগ করিতে হয়, তাহা আমি জানি না; তবে কেবল এইমাত্র অবগত ছিলাম যে, আমার মাতা আমার শৈশব অবস্থাতেই আমাকে লইয়া কলিকাতায় আগমন করেন। আমার অষ্টম বৎসর বয়ঃক্রম পর্যন্ত আমি আমার মাতার নিকট অবস্থিতি করিয়াছিলাম, তাহাও আমার উত্তমরূপ স্মরণ আছে। যে সময় আমার বয়ঃক্রম ৮ বৎসর, সেই সময় আমার মাতার মৃত্যু হয়; সুতরাং সেই সময় হইতে পরের উপর নির্ভর করিয়া আমাকে জীবন অতিবাহিত করিতে হয়।
আমরা যে পাড়ায় বাস করিতাম, সেই পাড়ায় আমাদিগের বাড়ীর নিকট একটি বাবু বাস করিতেন। আমার মাতার মৃত্যুর পর আমি তাঁহারই দ্বারা প্রতিপালিত হইতে থাকি। আমি সর্ব্বদাই তাঁহার বাড়ীতে থাকিতাম ও সাধ্যমত তাঁহার কার্য্য সকল অতি যত্নের সহিত সম্পন্ন করিতাম এবং তিনিও আমার ভরণ পোষণের ভার গ্রহণ করিতেন। এইরূপে কয়েক বৎসর অতিবাহিত হইয়া গেল। ঐ বাবু তাঁহার দেশে গমন করিলেন, আমাকেও ঐ স্থান পরিত্যাগ করিতে হইল। সেই সময় আমার বয়ঃক্রম ১২ বৎসর অতীত হইয়া গিয়াছিল। সেই সময় আমি কোথায় থাকিব ও কি করিয়া দিনপাত করিতে সমর্থ হইব, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারি না। সেই সময় এক দিবস আমি মেছুয়াবাজারের মোড়ে দাঁড়াইয়া আছি; এরূপ সময় দেখিলাম, একটি ভদ্রবেশী লোক সেইস্থানে আসিয়া দণ্ডায়মান হইলেন। তাঁহাকে দেখিয়া অনুমান হইল, তিনি একখানি গাড়ি ভাড়া করিবার প্রত্যাশায় সেই স্থানে আসিয়া দণ্ডায়মান হইয়াছেন। আমাকে তাঁহার নিকট দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আমি কে, কোথায় থাকি ও এখানে কেন দাঁড়াইয়া আছি। তাঁহার কথার উত্তরে আমি কহিলাম, “আমার কেহই নাই, থাকিবার স্থান নাই। যদি কোন স্থানে কোনরূপ চাকরির যোগাড় করিতে পারি, তাহারই চেষ্টা দেখিবার নিমিত্ত আমি এই স্থানে দণ্ডায়মান আছি।”
ভদ্রবেশী। তোমার কেহই নাই?
আমি। না।
ভদ্রবেশী। যদি তোমার কেহই নাই, তাহা হইলে তোমাকে এত বড়টি করিল কে?
আমি। আমার মাতার মৃত্যুর পর একটি ভদ্রলোক আমাকে প্রতিপালন করেন। তিনি সম্প্রতি দেশে গিয়াছেন, সুতরাং, আমার কোনস্থানে আর থাকিবার স্থান নাই।
ভদ্রবেশী। সেই ভদ্রলোকটির কাছে তুমি কি কার্য্য করিতে?
আমি। বিশেষ কিছুই কার্য্য করিতে হইত না, কেবল তামাক সাজিতাম ও আবশ্যক হইলে অপরাপর কাৰ্য্যও সমাপন করিতাম।
ভদ্রবেশী। তিনি তোমায় বেতন কি দিতেন?
আমি। বেতন কিছুই দিতেন না, আমাকে প্রতিপালন করিতেন। তাঁহার বাড়ীতেই আহার করিতে পাইতাম, পরিধানের বস্তুও তিনিই দিতেন।
ভদ্রবেশী। যদি তোমার কোন স্থানে চাকরী হয়, তাহা হইলে তুমি কত বেতন প্রত্যাশা কর?
আমি। আমার যাহা আবশ্যক।
ভদ্রবেশী। তোমার আবশ্যক কত?
আমি। যাহাতে আমার আহারের ও পরিধানের খরচ নির্ব্বাহ করিতে সমর্থ হই, এইরূপ অর্থ পাইলেই আমি সন্তুষ্ট; আমার অধিক অর্থের কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই।
ভদ্রবেশী। যদি কেহ তোমাকে কেবলমাত্র তোমার আহারের ও পরিধানের সংস্থান করিয়া দেয়, তাহা হইলে তুমি তাহার নিকট কার্য্য করিতে সম্মত আছ?
আমি। আছি, কারণ নিজের ভাবনা ব্যতীত আমার আর কোন ভাবনা নাই।
ভদ্রবেশী। তুমি আমার সহিত গমন করিবে?
আমি। কোথায়?
ভদ্রবেশী। কোন পাড়াগাঁয়ে।
আমি। আপনার সহিত গমন করিতে আমার কিছুমাত্র আপত্তি নাই, কিন্তু পাড়াগাঁয়ে আমি কখন থাকি নাই, আমাকে সেইস্থানে কি কার্য সম্পন্ন করিতে হইবে?
ভদ্রবেশী। কার্য্য আর তুমি কি করিবে, বাড়ীর ছেলের ন্যায় খাইবে, আর বেড়াইয়া বেড়াইবে। দেশে আমার চাষ আবাদ আছে, অনেক লোক আমার নিকট কার্য্য করে, তাহারা কি করে না, করে, তাহা দেখিবার লোক আমার নাই, মধ্যে মধ্যে কেবল তাহাই তোমাকে দেখিতে হইবে, বিশেষ আমার সন্তানাদি নাই।
আমি। তা আমি আপনার সহিত গমন করিব। কেথায় যাইতে হইবে তাহা আমাকে বলিয়া দিন।
ভদ্রবেশী। আমি এখন আমার দেশে গমন করিতেছি, যদি ইচ্ছা হয়, তাহা হইলে তুমি এখনই আমার সহিত গমন করিতে পার।
আমি। আমি প্রস্তুত আছি। আপনি যদি লইয়া যান, তাহা হইলে এখনই আমি আপনার সহিত গমন করিব।
ভদ্রবেশী। আচ্ছা চল।
এই বলিয়া তিনি সেইস্থানে একটু দাঁড়াইতে না দাঁড়াইতে একখানি খালি গাড়ি সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল। তিনি গাড়িখানি ভাড়া করিয়া তাহাতে আরোহণ করিলেন। আমিও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেই গাড়ির মধ্যে গিয়া বসিলাম। তিনি গাড়োয়ানকে কি বলিয়া দিলেন। গাড়ি চলিতে লাগিল। কিছুক্ষণ গমন করিবার পর ঐ গাড়ি একটি রেলওয়ে ষ্টেসনে আসিয়া উপস্থিত হইল। আমরা সেইস্থানে রেল গাড়িতে আরোহণ করিলাম। গাড়ি চলিতে লাগিল, ক্রমে একটি ষ্টেসনে আসিয়া আমরা অবতরণ করিলাম। যখন আমরা গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়াছিলাম, সেই সময় রাত্রি হইয়াছিল, সুতরাং ষ্টেসনের সন্নিকটবর্তী একটি দোকানে আমরা সেই রাত্রি অতিবাহিত করিলাম। পরদিন অতি প্রত্যূষে একখানি গরুর গাড়ি ভাড়া করিয়া আমরা তাহাতে উঠিলাম। সমস্ত দিবস গমন করিয়া আমরা তাঁহার বাড়ীতে সন্ধ্যার পর গিয়া উপস্থিত হইলাম।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
আমি সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হইবার পর জানিতে পারিলাম, যাঁহার সহিত আমি কলিকাতা হইতে গমন করিয়াছিলাম, তাঁহার নাম ভবানীপ্রসাদ। বর্দ্ধমান জেলার অন্তর্গত কোন একখানি গ্রামে তাঁহার বাসস্থান। জাতিতে তিনি কায়স্থ। তাঁহার বাড়ীতে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, ঐ গ্রামের মধ্যে তিনি একজন বৰ্দ্ধিষ্ণু প্রজা। চাষ আবাদ করিয়াই তিনি গ্রামের মধ্যে বড় হইয়াছেন, এইরূপ দেশ মধ্যে রাষ্ট্র। বাড়ী ইষ্টকনির্ম্মিত নহে, কিন্তু ইষ্টক-নিৰ্ম্মিত বাড়ী প্রস্তুত করিতে যত অর্থ ব্যয়িত হইবার সম্ভাবনা, তিনি তাঁহার মৃত্তিকা-নির্ম্মিত বাড়ী প্রস্তুত করিতে তাহা অপেক্ষা অনেক অধিক অর্থ ব্যয় করিয়াছেন। বাড়ীর ভিতর ৩।৪ খানি ঘর, তাহাতে তাঁহার একমাত্র স্ত্রী ও তিনি নিজে বাস করিয়া থাকেন। সময় সময় তাঁহার কোনরূপ দূরসম্পর্কীয় দুইটি স্ত্রীলোক সেই বাড়ীতে বাস করেন, রন্ধনাদি তাহারাই করিয়া থাকেন। ঐ অন্দর বাড়ীর পশ্চিমে সদর বাড়ী, উহাতে পূজার চণ্ডীমণ্ডপ আছে। বৎসর বৎসর সেইস্থানে মহামায়ার আগমন হয়। তদ্ব্যতীত আরও একখানি বিস্তৃত ঘর আছে। উহাতে অতিথিবর্গ প্রায়ই অবস্থিতি ও আহারাদি করিয়া থাকেন। যত লোকই কেন তাঁহার বাড়ীতে গমন করুন না, সকলকেই তিনি সেইস্থানে স্থান প্রদান করিয়া থাকেন। অনাহারে কাহাকেই তাঁহার বাড়ী হইতে প্রত্যাবর্তন করিতে হয় না। ঐ বাড়ীর পশ্চিমে গোয়াল বাড়ী। উহাতে একখানি বসিবার উপযোগী ঘর আছে, তাহাতেই ভবানীপ্রসাদ প্রায় সৰ্ব্বদাই উঠিয়া বসিয়া থাকেন। ঐ ঘরের সম্মুখ ও উভয় পার্শ্বে সারি সারি অনেকগুলি গোলা বা মরাই। উহার একটিও প্রায় খালি থাকে না; ধান্য, গোধূম, ছোলা, সরিযা প্রভৃতি কোন না কোন দ্রব্যে উহা সদাসৰ্ব্বদাই পূর্ণ থাকে। ঐ সমস্ত দ্রব্যের অধিকাংশ তাঁহার নিজের চাষ হইতে উৎপন্ন হয় ও কখন কখন অপরের নিকট হইতে খরিদ করিয়াও রাখিয়া দেন। অধিক মূল্য হইলে বেচিয়া ফেলেন। পুনরায় কম মূল্যে বা নূতন আমদানী বা উৎপন্নের সময় খরিদ করিয়া ঐ সকল গোলায় ভর্ত্তি করিয়া রাখেন। ঐ গোলার পশ্চিমে অর্থাৎ দক্ষিণদিকে দুইখানি বড় বড় গোয়াল ঘর; উহার একখানিতে গাভিবর্গের স্থান হয়, অপর খানিতে বলদ বা চাষ উপযোগী গরু সকল অবস্থিতি করে। উহার সংখ্যা নিতান্ত কম নহে। গোয়াল ঘরের সংলগ্ন আর একখানি ঘর আছে, তাহাতে রাখাল, কৃষক প্রভৃতি কৃষিকাৰ্য্য সংক্রান্ত মনুষ্যগণ বাস করে। ইহা ব্যতীত ভবানীপ্রসাদের বিস্তর জমি জারাতও ছিল, এককথায় ভবানী প্রসাদ সেই প্রদেশের অতুল সম্পত্তির অধিকারী। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই, তাঁহার ভাই ভগ্নী প্রভৃতি নিজের কেহই ছিল না, পুত্র কি কন্যা কিছুই জন্মায় নাই। তিনি অপুত্রক ছিলেন, উহা তাঁহার ও তাঁহার আত্মীয় স্বজনের পক্ষে দুঃখের বিষয় বটে; কিন্তু আমার পক্ষে তাহা নিতান্ত সুখের বিষয়, ইহা পাঠক পাঠিকাগণ অনায়াসেই অনুমান করিতে পারেন।
আমি সেইস্থানে গমন করিবার পর হইতেই বুঝিতে পারিলাম, আমার ভাগ্যলক্ষ্মী প্রসন্ন হইয়াছেন। আমার আর কোন বিষয়ে অভাব নাই, আহার বলুন, পরিধেয় বলুন কিছুরই নিমিত্ত আমায় ভাবিতে হয় না। তদ্ব্যতীত যখন যাহা আমার ইচ্ছা হয়, তখনই আমি তাহা নিজের ইচ্ছামত ব্যয় করিতে সমর্থ হই, কাহাকেও কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে হয় না, বা কাহাকেও কোনরূপ হিসাব পত্র প্রদান করিতে হয় না। বাড়ীর গোমস্তার নিকট যখন যাহা চাই, বিনাবাক্য- ব্যয়ে তিনি তাহাই আমাকে প্রদান করিয়া থাকেন। আমি দাসত্ব গ্রহণ করিয়া ঐ স্থানে গমন করিয়াছি, কিন্তু এখন দেখিতেছি আমারই শত শত দাস, যাহাকে যখন যেরূপ আদেশ করি, দেখিতে দেখিতে সে তখনই তাহাই সম্পন্ন করে। আমার কার্য্যের মধ্যে এই ছিল যে, অতিথি অভ্যাগত যখন যিনি আসিবেন, তাঁহাদিগের আহারাদির বন্দোবস্ত আমাকে করিতে হইবে। যাহাতে কোন ব্যক্তি বিনা আহারে চলিয়া যাইতে না পারে, তাহার দিকে আমায় দৃষ্টি রাখিতে হইবে। বলা বাহুল্য, আমার নিজ হস্তে এই সকল কার্য্যের কিছুই করিতে হইত না। কেবল বন্দোবস্ত করিয়া দিয়া অপর লোকজনের উপর আদেশ প্রদান করিতে হইত। তাহারাই সমস্ত নির্ব্বাহ করিত। কেবল আমাকে এইমাত্র দেখিতে হইত যে, আমি যাহাকে যেরূপ বন্দোবস্ত করিয়া দিয়াছি, সে ঠিক সেইরূপ ভাবে তাহা সম্পন্ন করিতেছে কি না।
এইরূপে মহাসুখে আমি সেইস্থানে অবস্থিতি করিতে লাগিলাম। ভবানীপ্রসাদ আমাকে পুত্র-নির্ব্বিশেষে প্রতিপালন করিতে লাগিলেন। তাঁহার স্ত্রীও আমাকে পুত্রবৎ স্নেহ আরম্ভ করিলেন। পিতৃস্নেহ ত আমি একেবারেই জানিতাম না, মাতৃস্নেহ হইতে শৈশবেই বঞ্চিত হইয়াছিলাম, এখন সেই স্থানে আমি পিতৃস্নেহ ও মাতৃস্নেহ প্রাপ্ত হইয়া মনের সুখে কালযাপন করিতে লাগিলাম। এখন আর কলিকাতায় আসিতে ইচ্ছা হয় না, বা অপর কোনস্থানে গমন করিতে প্রবৃত্তি হয় না। এইরূপ অবস্থাতেই সেইস্থানে দিন অতিবাহিত হইতে লাগিল। ক্রমে চারি পাঁচ বৎসর অতীত হইয়া গেল।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
ভবানীপ্রসাদ বৎসরের মধ্যে দুইবার কলিকাতায় গমন করিতেন, কোন কোন বৎসর অধিক বারও গমন করিতেন, কিন্তু কোন বারই তিন চারি দিবসের অধিক বিলম্ব হইত না। তিনি যে কেন কলিকাতায় গমন করিতেন, তাহা কিন্তু আমরা বুঝিয়া উঠিতে পারিতাম না; কিন্তু কলিকাতা হইতে যখন প্রত্যাবর্তন করিতেন, সেই সময় বিস্তর অর্থ সঙ্গে করিয়া আনিতেন। কৃষিলব্ধ কোন দ্রব্য কখন তাঁহাকে কলিকাতায় চালান দিতে দেখি নাই, সুযোগ পাইলেই ঐ সকল দ্রব্য বাড়ীতে বসিয়াই বিক্রম করিতেন, অথচ কলিকাতায় গমন করিলেই যে কোথা হইতে বিস্তর টাকা সংগ্রহ করিয়া আনিতেন, তাহা কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতাম না।
এইরূপে আরও দুই এক বৎসর অতীত হইয়া গেল; এখন আমার বয়ঃক্রম ১৮।১৯ বৎসর। সেই সময় আমি এক দিন ভবানীপ্রসাদকে কহিলাম, “পিতা, আপনি যখন কলিকাতায় গমন করেন, সেই সময় আমাকে কেন একবার সঙ্গে করিয়া লইয়া যান না? বহুদিবস হইল, আমি কলিকাতা হইতে আগমন করিয়াছি, ইচ্ছা একবার গিয়া সেইস্থান পুনরায় দর্শন করি।
পিতা। তুমি কলিকাতায় গমন করিতে চাহ, কেন, সেই স্থানে পুনরায় থাকিবে না কি?
আমি। সেইস্থানে আর আমি কোথায় থাকিব। আপনার আলয় ভিন্ন আর আমার থাকিবার স্থান নাই। পিতামাতাকে পরিত্যাগ করিয়া কে কোথায় সহজে গমন করিয়া থাকে।
পিতা। তবে তুমি কলিকাতায় যাইতে চাহিতেছ কেন?
আমি। প্রয়োজন কিছুই নাই। আপনি সর্ব্বদাই একাকী গমন করিয়া থাকেন, ভিন্ন দেশে একাকী গমন করিলে যে কষ্ট হয়, তাহা যাঁহারা একাকী গমন করিয়া থাকেন, তাঁহারাই অবগত আছেন। আমি সঙ্গে থাকিলে আপনার সেইরূপ কষ্ট হইবে না, বিশেষ আমিও অনেক দিবস পরে একবার কলিকাতা দেখিয়া আসিব।
পিতা। সেইস্থানে তুমি থাকিবে কোথা?
আমি। আপনি যে স্থানে থাকিবেন, আমিও সেইস্থানে থাকিব।
পিতা। আমি যে স্থানে থাকি, তুমি কি সেইস্থানে থাকিতে পারিবে?
আমি। কেন পারিব না?
পিতা। আচ্ছা, এবার যখন আমি কলিকাতায় গমন করিব, সেই সময় তোমাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইব।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
আমার সহিত কলিকাতায় যাইবার কথা হইবার আন্দাজ দুই মাস পরেই পিতা কলিকাতায় যাইবার জন্য প্রস্তুত হইলেন। এবার আমিও তাঁহার সহিত গমন করিলাম। তিনি বাড়ী হইতে বহির্গত হইবার পর একেবারে কলিকাতায় গমন করিলেন না, দুই এক ষ্টেসন গমন করিবার পর একস্থানে অবতরণ করিলেন, ও সেইস্থানে রেলের বাজারে এক দিবস অতিবাহিত করিবার পর, পুনরায় সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিয়া কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। যে সময় তিনি রেলের বাজারে এক দিবস অতিবাহিত করিয়াছিলেন, সেই দিবস একটি লোক আসিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করে ও একটি ব্যাগ তাঁহাকে প্রদান করিয়া যায়। ঐ ব্যাগের মধ্যে কি ছিল, তাহা তিনি দেখেন না ও আমিও তাহা জানিতে পারি না। কিন্তু কলিকাতায় গমন করিবার পর আমি উহা দেখিতে পাইয়াছিলাম, উহা সোণা ও রূপার অলঙ্কারে পূর্ণ ছিল। কলিকাতায় গমন করিয়া পিতা ঐ সকল দ্রব্য একটি পোদ্দারের বাড়ীতে লইয়া গেলেন ও সেইস্থানে সেই পোদ্দারের নিকট তিনি উহা বিক্রয় করিলেন। বিক্রয় করিয়া অনেক টাকা হইল। ঐ সকল টাকা তিনি আমার হস্তে প্রদান করিয়া কহিলেন, “এই সকল টাকা লইয়া তুমি বাড়ীতে যাও, আমি দুই এক দিবস পরেই বাড়ীতে যাইব।” আমি তাঁহার কথা শুনিয়া তাঁহার কথায় সম্মত হইলাম, ও ঐ সকল টাকা লইয়া আমি বাড়ীতে গেলাম। বাড়ীতে গিয়া উহা আমি আমার মাতার নিকট রাখিয়া দিলাম। আমি কলিকাতা হইতে গমন করিবার সময় পিতাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, “এই সকল অলঙ্কার কাহার ও কেনই বা উহা বিক্রয় করা হইল।” উত্তরে পিতা কহিলেন, “উহা আমাদিগের, কেন উহা বিক্রয় করা হইল, তাহা ক্রমে জানিতে পারিবে।” আমি তাঁহাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। টাকাগুলি মাতার হস্তে সমর্পণ করিলাম। কিন্তু তিনিও কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলেন না; অনুমানে বোধ হইল, এই টাকা সম্বন্ধে সমস্ত কথা তিনি জানেন।
দুই এক দিবস পরেই পিতা কলিকাতা হইতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহার আসিবার পর ক্রমে মধ্যে মধ্যে দুই একজন লোক আসিয়া তাঁহার নিকট উপস্থিত হইতে লাগিল, ও পিতার নিকট হইতে যে যত টাকা প্ৰাৰ্থনা করিতে লাগিল, তিনি তাহাকে তাহাই প্রদান করিতে লাগিলেন।
এইরূপে আরও কিছু দিবস অতিবাহিত হইবার পর, আমি ক্রমে ক্রমে পিতার সমস্ত অবস্থা অবগত হইতে পারিলাম। জানিতে পারিলাম, যে সকল লোক আসিয়া পিতার নিকট হইতে অর্থাদি গ্রহণ করিত, তাহারা কেহই ভদ্রলোক নহে, সমস্তই চোর ও ডাকাইত। ঐ সকল ব্যক্তির যখন যে কোন অর্থের প্রয়োজন হইত, পিতা অকাতরে তাহা প্রদান করিতেন। উহারা চুরি ও ডাকাইতি করিয়া যে সকল অলঙ্কারাদির সংস্থান করিতে সমর্থ হইত, তাহাও আনিয়া তাহারা আমার পিতাকে প্রদান করিত। পিতা ঐ সকল দ্রব্য আপনার নিকট ৫।৬ মাস কাল রাখিয়া, পরিশেষে কলিকাতায় লইয়া সেইস্থানে উহা বিক্রয় করিয়া ফেলিতেন। বাড়ী হইতে বহির্গত হইবার সময়, তিনি নিজে কোন দ্রব্য সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইতেন না, তাঁহার বিশ্বাসী কোন লোককে দিয়া তিনি অগ্রে উহা কোন স্থানে প্রেরণ করিতেন; নিজে বাড়ী হইতে শূন্যহস্তে বহির্গত হইয়া নিৰ্দ্দিষ্ট স্থানে গিয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতেন ও সেইস্থান হইতে ঐ সকল অলঙ্কার নিজে গ্রহণপূর্ব্বক কলিকাতায় লইয়া যাইতেন। সেইস্থানে ঐ সকল দ্রব্য খরিদ করিবার লোক স্থির থাকিত, তিনি ঐ সকল দ্রব্য তাঁহার নিকট লইয়া যাইবা মাত্রই তিনি উহার মূল্য প্রদান করিতেন। এইরূপ উপায়ে সেই প্রদেশীয় সমস্ত চোরা দ্রব্যই পিতা গ্রহণ করিতেন। ঐ অর্থ হইতেই তিনি বড় মানুষ, তাঁহার অতিথি-সেবা, কার-কারবার সমস্তই।
আমি ক্রমে ক্রমে এই সমস্ত অবস্থা অবগত হইতে পারিলাম, কিন্তু এ সকল কথা কাহার নিকট প্রকাশ করিতাম না; বরং সময় সময় পিতাকে ঐ কাৰ্য সম্বন্ধে সাহায্য করিতাম। ক্রমে পিতাও বুঝিতে পারিলেন যে, আমি তাঁহার সমস্ত বিষয় ক্রমে অবগত হইতে পারিয়াছি।
পিতা যে এইরূপ কার্য্য করিতেন, তাহা সেই প্রদেশীয় পুলিস-কৰ্ম্মচারীগণ কিছুই অবগত ছিলেন না; কিন্তু পিতা তাঁহাদিগের সহিত খুব প্রণয় রাখিয়া চলিতেন। কোন পুলিস-কৰ্ম্মচারী কোন কার্য্য-বশতঃ ঐ প্রদেশে আগমন করিলে, তাঁহার থাকিবার স্থান ঐ স্থানেই হইত। তাঁহাদিগের আহারাদি করিবার যতদূর ভাল বন্দোবস্ত হইতে পারে, তাহা হইত। তদ্ব্যতীত তাঁহাদিগের গমনকালীন তাঁহাদিগের যাহা কিছু পাথেয় খরচ হইত, তাহার সমস্তই আমার পিতা প্রদান করিতেন। তিনি ছোট বড় কর্ম্মচারীর মধ্যে কোনরূপ প্রভেদ করিতেন না, সকলকেই সমান চক্ষে দেখিতেন। কেবল যে পুলিস-কৰ্ম্মচারীগণই তাঁহার আতিথ্যগ্রহণ করিত, তাহা নহে; যে কোন প্রধান সরকারী কর্ম্মচারী বা বিচারক সেই প্রদেশে গমন করিতেন, তাঁহাদিগের নিমিত্ত সমস্ত দ্রব্যাদির যোগাড়ও তিনি করিয়া দিতেন। ঐ সকল কর্মচারী বা বিচারকের তিনি যেরূপ আজ্ঞাবহ থাকিতেন, তাঁহাদিগের আরদালী, চাপরাসীগণের সহিতও তিনি সেইরূপ ভাবে চলিতেন। স্থূল কথায়, সরকারী কর্মচারীগণ বা জমিদারগণের সর্ব্বদাই তিনি শরণাপন্ন থাকিতেন, ও তাঁহাদিগের আজ্ঞাবহ ভৃত্যের ন্যায় সর্ব্বদা চলিতেন।
পিতার আভ্যন্তরীণ বিষয় সকল আমি অবগত হইতে পারিবার পর হইতেই তিনি যখন কলিকাতায় যাইতেন, আমাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইতেন। আমি দুই এক দিবস পূর্ব্বে বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া দ্রব্যাদির সহিত কলিকাতায় গিয়া উপস্থিত হইতামে ও সেইস্থানে অবস্থিতি করিতাম। দুই এক দিবস পরেই পিতা আসিয়া উপস্থিত হইতেন ও আমাকে সঙ্গে লইয়া যে ব্যক্তি ঐ সকল দ্রব্য খরিদ করিতেন, তাঁহার বাড়ীতে গিয়া তাঁহার নিকট ঐ সমস্ত দ্রব্য বিক্রয় করিয়া ফেলিতেন। সময়মত আমিই টাকাকড়ি লইয়া বাড়ীতে আগমন করিতাম।
এইরূপে আরও কিছু দিবস অতিবাহিত হইবার পর পিতা আর কলিকাতায় গমন করিতেন না, আমাকেই পাঠাইয়া দিতেন; আমিই সমস্ত কাৰ্য্য শেষ করিয়া আসিতাম। সেই সময় হইতে পূর্ব্বকথিত চোর ডাকাইতগণের সহিত আমার উত্তমরূপে পরিচয় হইতে লাগিল। তাহাদিগের সহিত টাকাকড়ি দেনা-পাওনা এখন আমার দ্বারাই চলিতে লাগিল।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
এক দিবস সন্ধ্যার পর আমি আমার পিতার নিকট বাহির বাড়ীতে বসিয়া আছি। সেই সময় সেইস্থানে অপর আর কেহই নাই। এরূপ সময় একটি লোক আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইল। আমি তাহাকে পূৰ্ব্ব হইতেই চিনিতাম। সে একজন ডাকাইত-সর্দ্দার। ইতিপূর্ব্বে অনেকবার সে আমার নিকট আসিয়াছিল ও আমার নিকট হইতে অনেকবার টাকা কড়ি লইয়া গিয়াছিল। সে আসিয়াই পিতাকে কহিল, “আজ আমি বিশেষ আবশ্যকের নিমিত্ত এইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি।”
পিতা। কি?
ডাকাইত। খুব একটি ভাল কাজের স্থির হইয়াছে।
পিতা। কোথায়?
ডাকাইত। অধিক দূরে নহে, ৪।৫ ক্রোশের মধ্যেই।
পিতা। কিরূপ কার্য্য? বড় গোছের না কি?
ডাকাইত। হাঁ।
পিতা। কতজন লোক গমন করিবে?
ডাকাইত। ৪০ জনের কম নহে।
পিতা। ভাল,— কার্য্য শেষ করিয়া ফেল।
ডাকাইত। ঐ কার্য্যে সোণা রূপা যে খুব অধিক পাওয়া যাইবে, তাহা বোধহয় না।
পিতা। তবে কি পাওয়া যাইবে?
ডাকাইত। নগদ টাকা।
পিতা। সে আরও ভাল।
ডাকাইত। সে ভাল বটে, কিন্তু যেরূপ আমাদিগের সংবাদ আছে, তাহা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে নগদ অর্থ বিস্তর পাওয়া যাইবার সম্ভাবনা আছে। এরূপ অবস্থায় আপনার নিকট কোন দ্রব্য আসিয়া পৌঁছিবার কোনরূপ সম্ভাবনা নাই, যে যাহা পাইবে, সে তাহা লইয়া প্রস্থান করিবে। এই নিমিত্ত আপনার নিকট আসিয়াছি।
পিতা। তাহা হইলে আমি কি করিতে পারি?
ডাকাইত। আমার বিবেচনায় যদি আপনি আমাদিগের সঙ্গে থাকেন, তাহা হইলে কোন ব্যক্তি, উহা লইয়া প্রস্থান করিতে পারে না।
পিতা। তাহা সত্য, কিন্তু যে কার্য্যে আমি নিজে কখন গমন করি নাই, সেই কার্য্যে আমি কিরূপে এখন গমন করিব? বিশেষ এখন আমি ক্রমে বৃদ্ধ হইয়া পড়িতেছি। যদি কোনরূপে বাধা বিপত্তি জন্মে, তাহা হইলে পলায়ন করিতে আমি কখনই সমর্থ হইব না, সেইস্থানে ধৃত হইয়া এই বৃদ্ধ বয়সে কারারুদ্ধ হইব। ইহা কি কখন হইতে পারে? নগদ অর্থ আমার নিকট আনুক বা না আনুক, আমি নিজে এ কার্য্যে কখন গমন করিব না।
ডাকাইত। তাহা হইলে কি হইবে?
পিতা। ভাবিয়া চিন্তিয়া দেখ, যদি কোন উপায় থাকে।
ডাকাইত। এক উপায় আছে।
পিতা। কি?
ডাকাইত। গোবিন্দবাবু এখন আমাদিগের সকলের নিকট পরিচিত হইয়া পড়িয়াছেন। ইনি এখন আপনার স্থলাভিষিক্ত হইয়া সমস্ত কার্য্য নির্ব্বাহ করিয়া আসিতেছেন, ও দলের সকলেই এখন ইহাকে বিশ্বাস করিয়াছে। এরূপ অবস্থায় গোবিন্দবাবু যদি আমাদিগের সঙ্গে গমন করেন, তাহা হইলেও আমাদিগের উদ্দেশ্য সফল হইতে পারে। এরূপ অবস্থায় আপনি কি বলেন?
পিতা। গোবিন্দ ছেলে মানুষ।
ডাকাইত। পিতার নিকট পুত্র সর্ব্বদাই ছেলেমানুষ। যে পুত্রের বয়ঃক্রম ৬০ কি ৮০ বৎসর, সেও পিতার নিকট ছেলেমানুষ। গোবিন্দবাবু অপেক্ষা অনেক অল্প বয়স্ক লোক আমাদিগের সঙ্গে আছে, তাহা ত আপনি উত্তমরূপে অবগত আছেন।
পিতা। তাহা ত অবগত আছি, কিন্তু এরূপ কার্য্যে গোবিন্দ এ পর্যন্ত কখন গমন করে নাই।
ডাকাইত। দুই একবার সঙ্গে গমন না করিলে, কিছু কেহই পুরাতন হয় না। প্রথমবার তাহাকে আমাদিগের সহিত পাঠাইতে আপনি অত্যন্ত ভীত হইতেছেন, কিন্তু দুই একবার আমাদিগের সঙ্গে গমন করিলে পর, আর আপনাকে কোন রূপ ভীত হইতে হইবে না, বা তাঁহাকেও বলিতে হইবে না, আপনা হইতেই তিনি এই কার্য্যে গমন করিবেন। আপনি কিছু চিরদিন বাঁচিবেন না, এই সময় হইতে যদি গোবিন্দবাবু নিজে শিখিয়া লইতে না পারেন, তাহা হইলে চলিবে কিরূপে? আপনার অবর্তমানে সকলে উহাকে বিশ্বাস করিবে কেন? আপনার কোন ভয় নাই, উহাকে আপনি আমার জিম্মা করিয়া দিন। কল্য প্রত্যূষে আমি নিজে আসিয়া পুনরায় উহাকে আপনার নিকট রাখিয়া যাইব। .
পিতা। উহাকে লইয়া না গেলে হয় না?
ডাকাইত। হইবে না কেন? কিন্তু না গেলে আপনারই ক্ষতি, নগদ অর্থ আপনার নিকট একটিও আসিবে না।
পিতা। গোবিন্দ। তুমি কি বল?
আমি। বলিব আর কি, আমি এখনই ইহার সহিত গমন করিতে প্রস্তুত আছি।
পিতা। তুমি প্রস্তুত আছ কেন?
আমি। যে কাৰ্য্য কখন দেখি নাই, সেই কার্য্য দেখিতে কাহার না ইচ্ছা হয়?
পিতা। ইহাতে বিশেষ বিপদ হইবার সম্ভাবনা।
আমি। কিসে?
পিতা। তুমি এই কার্য্যে নূতন ব্রতী, কিছুই জান না; সুতরাং ধরা পড়িবার খুব সম্ভাবনা।
আমি। যদি সকলে ধরা পড়ে, তাহা হইলে আমিও না হয় ধৃত হইব
পিতা। সকলে এই কার্য্য করিয়া আসিতেছে, তাহারা বেশ জানে কোন সময়ে কিরূপ উপায় অবলম্বন করিতে হয়, কিন্তু তুমি তাহার কিছুই অবগত নহ।
আমি। অবগত নহি সত্য, কিন্তু অবগত হইতে আমার কিছুমাত্র বিলম্ব হইবে না। বিশেষ আমি দুৰ্ব্বল নহি। আপনি জানিবেন, দলের অপর কোন ব্যক্তি যদি ধরা পড়ে, তাহা হইলেও আমি ধৃত হইব না, আমি অনায়াসেই পলায়ন করিতে সমর্থ হইব!
পিতা। আমি দেখিতেছি, তোমার নিতান্ত ইচ্ছা যে, তুমি নিজে গমন কর।
আমি। এই ইচ্ছা আমার অনেক দিন হইতে হইয়াছে, কিন্তু পাছে আপনি অসন্তুষ্ট হন, এই ভয়ে এ পর্যন্ত তাহা আমি আপনার নিকট প্রকাশ করিতে সাহসী হই নাই।
পিতা। যদি তোমার নিতান্ত ইচ্ছা হইয়া থাকে, তাহা হইলে আর আমি তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধাচরণ করিব না। তুমি গমন করিতে পার, কিন্তু আজ না গিয়া ইহার পর যেদিন হইবে সেই দিবস গমন করিলে হয় না?
আমি। আপনি যদি আমাকে ঐ কার্য্যে গমন করিতে অনুমতি প্রদান করিলেন, তাহা হইলে আজই যাওয়া কর্তব্য; কারণ ইনি যেরূপ বলিতেছেন, তাহা যদি কার্য্যে পরিণত হয়, তাহা হইলে আজ গমন করিলে আমাদিগের কিছু অর্থ আসিবার সম্ভাবনা।
পিতা। যেরূপ ভাল বিবেচনা হয় কর। কিন্তু দেখিও, যেন কোনরূপে বিপদে পড়িও না।
ডাকাইত। আমরা থাকিতে কি আর ইনি কোনরূপে বিপদগ্রস্ত হইবেন? সে বিষয়ে আপনি নিশ্চিত্ত থাকুন।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
পিতাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া সেই ডাকাইত-সদারের সহিত আমি বাড়ী হইতে বহির্গত হইলাম। তিনি আমাকে সঙ্গে করিয়া একটি গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইলেন। ঐ গ্রাম আমাদিগের গ্রাম হইতে প্রায় ৩ ক্রোশ ব্যবধানে। সেইস্থানে যখন আমরা উপস্থিত হইলাম, তখন রাত্রি ১০টা বাজিয়া গিয়াছে। যাঁহার বাড়ীতে গিয়া আমরা উপস্থিত হইলাম, তিনি সেই সময় তাঁহার বাড়ীর বাহিরেই বসিয়াছিলেন। দেখিয়া অনুমান হইল, আমাদিগের প্রত্যাশায় তিনি সেইস্থানে বসিয়া আছেন। আমি তাঁহাকে দেখিবামাত্রই চিনিতে পারিলাম। ঐ ব্যক্তিও মধ্যে মধ্যে আমাদিগের বাড়ীতে গমন করিতেন, ও অনেকবার আমার নিকট হইতে টাকাও লইয়া আসিয়াছেন। আমরা সেইস্থানে উপনীত হইবামাত্রই বিশেষ যত্নের সহিত তিনি আমাদিগকে বসাইলেন।
আমার সমভিব্যাহারী সেই ডাকাইত তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “সংবাদ কি?”
২য় ব্যক্তি। সংবাদ খুব ভাল।
১ম ব্যক্তি। আর কি কেহ আসিয়াছে?
২য় ব্যক্তি। প্রায় সকলেই আসিয়াছে, দুই একজন আসিতে বাকী আছে।
১ম ব্যক্তি। তাহারা কখন আসিবে?
২য় ব্যক্তি। এখনই আসিয়া উপস্থিত হইবে।
১ম ব্যক্তি। যাহারা আসিয়াছে, তাহারা কোথায়?
২য় ব্যক্তি। সকলেই সেইস্থানে আছে।
১ম ব্যক্তি। কেমন, ঐ স্থানটি খুব ভাল নয়?
২য় ব্যক্তি। খুব ভাল, একে পুষ্করিণীর ধার, তাহাতে চতুর্দ্দিকে ঘন তাল গাছের সারি থাকায় জঙ্গলাদি নাই, তাহার উপর সন্ধ্যার পর কোন ব্যক্তি ঐ স্থানে গমন করে না। আমাদিগের বিশ্রাম করিবার উহা উপযুক্ত স্থান।
১ম ব্যক্তি। আমাদিগেরও সেইস্থানে গমন করিলে হয় না?
২য় ব্যক্তি। একটু বিশ্রাম করুন, তাহার পর আমরা সেইস্থানে গমন করিতেছি। বিশেষ গোবিন্দবাবু যখন আমার বাড়ীতে পদার্পণ করিয়াছেন, তখন তাঁহার একটু সেবা না করিয়াই আমরা সেইস্থানে গমন করিব, ইহা কি কখন হইতে পারে?
১ম ব্যক্তি। যাহার সংবাদে আমরা এই কার্য্যে গমন করিতেছি, সে আসিয়াছে কি?
২য় ব্যক্তি। সেও আসিয়াছে।
১ম ব্যক্তি। সে এখন কি বলিতেছে?
২য় ব্যক্তি। সে বলিতেছে সমস্তই ঠিক, এখন গমন করিতে যা বিলম্ব।
১ম ব্যক্তি। যাহার বাড়ীতে আমরা গমন করিতে মন করিতেছি, সে ব্যক্তি কে?
২য় ব্যক্তি। সে ব্যক্তি ঐ গ্রামের একজন ব্যবসায়ী লোক।
১ম ব্যক্তি। তাহার বাড়ী ইষ্টক-নির্ম্মিত কি খড়ের?
২য় ব্যক্তি। পাকা বাড়ী, দস্তুরমত বাড়ী।
১ম ব্যক্তি। যদি দস্তুরমত বাড়ী হয়, তাহা হইলে তাহার দরজায় দরয়ান ত আছে।
২য় ব্যক্তি। না। ব্যবসাদারের মধ্যে দরয়ান রাখিয়া থাকে, এরূপ কয়জন লোক আছে?
১ম ব্যক্তি। তাহার লোকজন ত বিস্তর থাকিবার কথা।
২য় ব্যক্তি। তাহার লোকজন অধিক নাই, বিশেষ যে স্থানে তাহার বাড়ী, সেইস্থানে অপর লোকের অধিক
বসবাস নাই; দুই চারি ঘর লোকের বাস আছে বটে, কিন্তু তাহারা নিতান্ত দরিদ্র।
১ম ব্যক্তি। তাহার ঘরে নগদ টাকা আছে বলিতেছ; কি পরিমাণে নগদ টাকা আছে?
২য় ব্যক্তি। প্রায় ২।৩ সহস্র মুদ্রা হইবে।
১ম ব্যক্তি। এত অর্থ সে কোথা হইতে একেবারে পাইল? ব্যবসাদারের ঘরে এত টাকা ত এক সঙ্গে মজুত থাকে না।
২য় ব্যক্তি। সে দ্রব্যাদি খরিদ করিবার নিমিত্ত কল্য কলিকাতায় যাইবে, তাই নগদ অর্থ সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছে। বিশেষ আজ সন্ধ্যার সময়ও তাহার বাড়ীতে কিছু অর্থ আসিয়া পৌঁছিয়াছে, এ সংবাদও আমরা প্রাপ্ত হইয়াছি।
১ম ব্যক্তি। আজ কত টাকা আসিয়াছে?
২য় ব্যক্তি। অধিক নহে, চারি পাঁচ শত টাকা।
১ম ব্যক্তি। ইহাও কি নগদ টাকা?
২য় ব্যক্তি। হাঁ, ইহাও নগদ টাকা।
১ম ব্যক্তি। তাহা হইলে আর অধিক বিলম্ব করিবার প্রয়োজন কি? আমাদিগের সাজ সরঞ্জাম সমস্ত প্রস্তুত হইয়াছে ত?
২য় ব্যক্তি। সমস্তই প্রস্তুত হইয়াছে, তাহার নিমিত্ত আপনাকে ভাবিতে হইবে না।
উভয়ের মধ্যে এরূপ কথাবার্তা হইবার পর দ্বিতীয় ব্যক্তি আমাদিগের উভয়ের জলযোগের বিশেষরূপ বন্দোবস্ত করিয়া দিলেন। আমি উহা আহার করিতে প্রথমে আপত্তি করলাম, কিন্তু পরিশেষে আমার সেই আপত্তি রহিল না। আমাকে উহা ভোজন করিতেই হইল। তাহার পর ঐ ব্যক্তি আমাদিগকে সঙ্গে লইয়া সেই পুষ্করিণীর ধারে গিয়া উপস্থিত হইল।
সেইস্থানে গমন করিয়া দেখিলাম, প্রায় ৩০/৪০ জন লোক সেইস্থানে সমবেত হইয়াছে। তাহারা একস্থানে স্থিরভাবে বসিয়া তামাকু খাইতেছে। উহাদিগের মধ্যে অনেকেই আমার পরিচিত ছিল, তাহাদিগকে অনেক সময়ে আমি আমাদিগের বাড়ীতে দেখিয়াছি। আমরা গিয়াও সেইস্থানে ক্ষণমাত্র উপবেশন করিলাম ও পরিশেষে সেইস্থান হইতে সকলে প্রস্থান করিলাম। সকলে একত্রে উঠিলাম বটে, কিন্তু একত্রে সেইস্থান হইতে গমন করিলাম না। একে একে বহির্গত হইয়া সকলে গমন করিতে লাগিল। যাইবার সময় দেখিলাম, সকলের হাস্তে কোন না কোন প্রকার অস্ত্র রহিয়াছে। কাহার হস্তে লাঠি, কাহার হস্তে বন্দুক, কাহার হস্তে তরবারি প্রভৃতি; তদ্ব্যতীত দেখিলাম, কতকগুলি মশালও সেইস্থানে প্রস্তুত ছিল, উহাও কেহ কেহ লইয়া সেইস্থান হইতে বহির্গত হইল। আমি যে দুই ব্যক্তির সহিত সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিলাম, তাহাদিগের সহিত সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। এইরূপে সেই স্থান হইতে বহির্গত হইয়া কে যে কোথায় গেল, তাহার কিছুই আমি তখন জানিতে পারিলাম না, কিন্তু পরিশেষে তাহা জানিতে পারিয়াছিলাম। আমরা ৩জন সেইস্থান হইতে চলিতে আরম্ভ করিলাম। ক্রমে ক্রোশাবধি গমন করিয়া একটি ময়দানের মধ্যে উপনীত হইলাম; সেইস্থানে গিয়া দেখি, যে সকল ব্যক্তি ঐ স্থান পরিত্যাগ করিয়া আসিয়াছিল, তাহারা সকলেই সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। ঐ স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইবার পর সকলেই গাত্রোত্থান করিল, ও সকলে কি পরামর্শ করিয়া দলবদ্ধ হইয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল। সেইস্থান হইতে গমন করিয়া আমরা একটি গ্রামের মধ্যে গিয়া উপস্থিত হইলাম, যে বাড়ীতে আমাদিগের ডাকাইতি করিবার কথা ছিল, দেখিলাম আমরা সেই বাড়ীর সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। দেখিতে দেখিতে বাড়ীর চতুর্দিকে সকলে বিকীর্ণ হইয়া পড়িল। সেই সময় ভয়ানক চীৎকার শব্দের সঙ্গে সঙ্গে একেবারে ২০।২৫ টি মশাল ধূ ধূ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। দেখিতে দেখিতে বাড়ীর খিল্কী দরজা ভাঙ্গিয়া গেল, অনেকেই ঐ দরজা দিয়া বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিয়া প্রথমেই সদর দরজা খুলিয়া ফেলিল। এতকাল পৰ্য্যন্ত ডাকাইতির নাম শুনিয়াছি, কিন্তু স্বচক্ষে উহা কখন দেখি নাই, আজ আমি উহাদিগের অবস্থা একস্থানে দণ্ডায়মান হইয়া স্বচক্ষে দেখিতে লাগিলাম। কি ভয়ানক দৃশ্য। কোন ঘরের দরজা সকল ঝন্ ঝন্ শব্দে ভাঙ্গিয়া যাইতেছে, কোনস্থানে অগ্নি লাগিয়া ধূ ধূ করিয়া জ্বলিতেছে, কোন ঘর হইতে স্ত্রীলোকের আর্তনাদ কর্ণে প্রবিষ্ট হইতেছে, কোন স্থানে জানালা দরজা ভাঙ্গার ঝন ঝন শব্দ, কোন স্থানে বাক্স, পেটরা প্রভৃতি ভাঙ্গার মড় মড় শব্দ, কোন স্থানে শিশুর আর্তনাদ, স্ত্রীলোকের চীৎকার, পুরুষের হৃদয় বিদারক ভয়ানক শব্দ। কেহ বলিতেছে, “আমাকে রক্ষা কর, আমি আমার যথাসর্ব্বস্ব তোমাদিগকে প্রদান করিতেছি,” কেহ বলিতেছে, “আমাকে প্রজ্বলিত অগ্নিতে দগ্ধ করিও না, আমাদিগের যে স্থানে যাহা আছে, তাহা সমস্তই বলিয়া দিতেছি;” প্রভৃতি শব্দ সকল কর্ণে প্রবিষ্ট হইতে লাগিল। আমি বাড়ীর ভিতর প্রবিষ্ট হইয়াছিলাম না, সর্দ্দারদ্বয়ের সহিত আমি বাড়ীর বাহিরে ছিলাম। আমাদিগের নিকট মশাল সকল প্রজ্বলিত হইতেছিল, ঘাটি সকল রক্ষা হইতেছিল, কোন ব্যক্তি সেই দিকে আসিতে সমর্থ না হয়, তাহার নিমিত্ত অস্ত্রশস্ত্র লইয়া আমরা সেই স্থানে উপস্থিত থাকিয়া মধ্যে মধ্যে গগনভেদী চীৎকারশব্দে দিমণ্ডল পরিব্যাপ্ত করিতেছিলাম। গ্রামস্থ অনেক লোক দলবদ্ধ হইয়া আমাদিগের নিকট উপস্থিত হইবার চেষ্টা করিতেছিল বটে, কিন্তু সাহসে কুলাইতেছিল না। আমাদিগের লোক জনের অবস্থা দৃষ্টি করিয়াই দূর হইতে প্রস্থান করিতেছিল।
এইরূপে অর্দ্ধঘণ্টা কাল কাটিয়া গেল, এই সময়ের মধ্যে সমস্ত কাৰ্য্য শেষ হইয়া গেল। যাহারা বাড়ীর ভিতর ছিল, তাহারা একটি ভয়ানক রব উত্থিত করিয়া ঐ বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া আসিল। তখন আমরা সকলে মিলিত হইয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিবার সময় পাছে আমি কাহার কর্তৃক ধৃত হই, এই ভাবিয়া তাহারা সকলে আমাকে পরিবেষ্টিত করিয়া সেইস্থান হইতে বহির্গত হইল। গ্রামের বাহিরে যে স্থানে আসিয়া আমরা সমবেত হইয়াছিলাম, সেইস্থানে আসিয়া সকলে তাহাদিগের হস্তস্থিত প্রজ্বলিত মশালাদি নিক্ষেপ করিল, কিন্তু সেইস্থানে আর কেহই বিলম্ব করিল না। আমরা সকলে সবেগে এই স্থান হইতে চলিতে আরম্ভ করিলাম। এইরূপে আন্দাজ ক্রোশাধিক গমন করিবার পর, একটি জঙ্গলের মধ্যে আমরা সকলে প্রবিষ্ট হইলাম, ও সেইস্থানে একটু বিশ্রাম করিলাম। ডাকাইতি করিয়া যে সকল দ্রব্য আনা হইয়াছিল, তাহা সকলে সেইস্থানে একত্র করিল। উহার ভিতর যে সকল অলঙ্কার ছিল, তাহা সেই সর্দারের নিকট প্রদত্ত হইল। ঐ সকল অলঙ্কারের মূল্য খুব অধিক ছিল না, বোধ হয়, দুই তিন শত টাকার অধিক হইবে না। নগদ টাকা প্রায় দুই সহস্র ছিল। উহার অর্দ্ধেক সেই সর্দ্দারের নিকট রক্ষিত হইল, অবশিষ্ট অর্দ্ধেক সকলের মধ্যে বণ্টন করিয়া দেওয়া হইল। অলঙ্কার ও নগদ টাকা ব্যতীত অনেকে বস্ত্র প্রভৃতি সামান্য দ্রব্য সকলও আনয়ন করিয়াছিল। ঐ সকল দ্রব্য আমরা পরামর্শ মত সেই সদার কাহাকেও লইয়া যাইতে দিলেন না, সমস্ত গুলি সেইস্থানে পরিত্যাগ করিয়া আমরা সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম। সেই জঙ্গলের বাহিরে আসিবার পরই সকলে পৃথক পৃথক হইয়া পড়িল, ও আপনাপন ইচ্ছানুযায়ী পন্থা অবলম্বন করিয়া সকলে প্রস্থান করিল। আমি ও সেই সর্দ্দার ঐ সকল অলঙ্কার ও অর্থের সহিত আমাদিগের বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। যে সময় আমরা আমাদিগের বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। যে সময় আমরা আমাদিগের বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলাম, সেই সময় প্রায় ভোর হইয়া গিয়াছে। দেখিলাম, পিতা আমাদিগের অপেক্ষায় বাহিরেই বসিয়া আছেন। আমাদিগকে দেখিয়াই তিনি সমস্ত অবস্থা জিজ্ঞাসা করিলেন। যেরূপ অবস্থা ঘটিয়াছিল, তাহার আদ্যোপান্ত সমস্ত অবস্থা বর্ণন করিয়া যে সকল দ্রব্য আমরা আনিয়াছিলাম, তাহা তাঁহার হস্তে অর্পণ করিলাম। আমার সহিত যে সর্দ্দার গমন করিয়াছিল, সে সেই দিবস আমাদিগের বাড়ীতেই রহিল ও পর দিবস প্রত্যূষে উঠিয়া আপন বাড়ীতে গমন করিল; যাইবার সময় পিতা তাহাকে কিছু অর্থ লইয়া যাইতে কহিলেন, কিন্তু সে তাহা লইয়া গেল না, বলিয়া গেল, গোলযোগ মিটিয়া গেলে এক দিবস আসিয়া সে তাহার অর্থ লইয়া যাইবে।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
এই ঘটনার পর প্রায় দুই মাস অতীত হইয়া গেল। দেখিলাম কোনরূপ গোলযোগ ঘটিল না। ইহার পর এক দিবস সেই সদার আসিয়া উপস্থিত হইলেন, ও আমাকে কহিলেন, আর একটি কার্য্য ঠিক হইয়াছে। ও আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ঐ কার্য সম্পন্ন হইবার সময় আমি তাহাদিগের সহিত গমন করিতে ইচ্ছুক আছি কি না। তাঁহার কথার উত্তরে আমি কহিলাম, “এখন হইতে যে স্থানে যে কাৰ্য্য হইবে, আমি সেই স্থানেই গমন করিব।” আমার কথা শুনিয়া তিনি অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন ও কহিলেন, “যদি প্রত্যেক কার্য্যে আপনি আমাদিগের সহিত গমন করেন, তাহা হইলে আমরা সকলেই আপনার অধীনতা স্বীকার করিব, ও আপনাকে আমাদিগের দলপতি বলিয়া মানিব।” আমি যে কার্য্যে প্রবৃত্ত হইতে স্বীকৃত হইলাম, সেই সর্দ্দার তাহা আমার পিতাকে কহিলেন। তিনি আমাকে ঐ কার্য্যে গমন করিতে অনেকরূপ আপত্তি করিলেন, কিন্তু তাঁহার সেই আপত্তি রহিল না, ঐ সর্দ্দার অনেক রূপ বুঝাইয়া পরিশেষে তাঁহার অভিমত গ্রহণ করিলেন। সেই সময় হইতে আমি নিয়মিতরূপে ডাকাইতি ব্যবসা অবলম্বন করিয়া কৰ্ম্মক্ষেত্রে বিচরণ করিতে প্রবৃত্ত হইলাম।
যে স্থানের ডাকাইতি শীঘ্র সম্পন্ন করিবে স্থির করিয়া ঐ সর্দ্দার আমাদিগের বাড়ীতে আগমন করিয়াছিল, ঐ ডাকাইতির দিবস আমি তাহাদিগের সহিত গমন করিলাম। ডাকাইতি কাৰ্য্য শেষ হইয়া গেল, তিন চারি শত টাকা মূল্যের অলঙ্কার ব্যতীত ঐ ডাকাইতিতে আর অধিক কিছুই পাওয়া গেল না। কিন্তু ডাকাইতি করিয়া প্রত্যাবর্তন করিবার সময় আমাদিগের দলস্থিত একটি লোক কয়েকজন প্রজা কর্তৃক ধৃত হইল। ঐ ব্যক্তি আমাদিগের একটু পশ্চাৎ পড়িয়াছিল; সুতরাং সে যখন ধৃত হয়, তাহা দলের অনেকেই জানিতে পারে নাই, কিন্তু আমি দূর হইতে তাহা দেখিতে পাইয়াছিলাম। সেই সময় আমিও যে স্থানে ছিলাম, সেইস্থান হইতে দলের অপরাপরকে সংবাদ দিতে হইলে একটু বিলম্ব হয়, ও সেই সাবকাশে ধৃত ব্যক্তিকে লইয়া প্রজাগণ অনেক দূরে গমন করিতে সমর্থ হয়; সুতরাং আমি অনন্যোপায় হইয়া আর কাল বিলম্ব করিলাম না। দ্রুতপদে গমন করিয়া তাহাদিগের মধ্যে পতিত হইলাম ও আমার হস্তস্থিত লাঠীর আঘাতে দুই তিন জনকে ধরাশায়ী করিয়া আমাদিগের দলস্থিত সেই ধৃত ব্যক্তিকে উদ্ধার পূর্ব্বক দুই একপদ অগ্রসর হইতে হইতে আমাদিগের দলের অপরাপর সমস্ত লোক আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল। তখন আমরা নির্ভীক অন্তঃকরণে একত্রে মিলিত হইয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। আমি এই কার্য্যে নূতন
ব্রতী হইয়া দলের একটি লোককে উদ্ধার করিবার মানসে যেরূপ ভয়ানক বিপদে পদার্পণ করিয়াছিলাম, ও একাকী যেরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া তাহাকে প্রজামণ্ডলীর হস্ত হইতে উদ্ধার করিয়া আনিয়াছিলাম, তাহা দলস্থিত সমস্ত ব্যক্তিই অবগত হইতে পারিয়া আমার উপর যে কতদূর সন্তুষ্ট হইল, তাহা বলিতে পারি না। সকলেই আমার বীরপনার সুখ্যাতি করিল। দলস্থিত ব্যক্তিবর্গের বিপদ হইতে উদ্ধার করিতে আমি যে সর্ব্বদাই প্রস্তুত, তাহা তাহাদিগের মনে দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত হইল। পূৰ্ব্বকথিত ডাকাইত-সদার মুখে যাহা বলিয়াছিল, কার্য্যেও দেখিলাম তাহাই করিল; সেই দিবস হইতে সকলেই আমাকে তাহাদিগের দলপতি-পদে বরিত করিল। বলা বাহুল্য, আমিও দলপতির ন্যায় সকলকে সমান ভাবে দেখিতে লাগিলাম। তাহাদিগের মধ্যে যখন যে ব্যক্তি কোনরূপ বিপদে পতিত হইতে লাগিল, প্রাণপণে তাহাকে সেই বিপদ হইতে উদ্ধার করিতে লাগিলাম। যাহার যখন যে অর্থের প্রয়োজন হইতে লাগিল, তাহাকে তখনই তাহার অপেক্ষা অধিক অর্থ প্রদান করিয়া তাহার সাহায্য করিতে লাগিলাম। দস্যুগণ আমার পিতাকে যেরূপ ভাবে মান্য করিত, আমাকে তাহা অপেক্ষা অধিক মান্য করিতে আরম্ভ করিল। সেই সময় হইতে আমিও তাহাদিগের সহিত প্রত্যেক ডাকাইতিতে গমন করিতে আরম্ভ করিলাম। এইরূপে প্রায় এক বৎসর অতিবাহিত হইয়া গেল।
এক বৎসর পরে আমার অবস্থার নিতান্ত পরিবর্তন হইয়া গেল। কতকগুলি অলঙ্কার বিক্রয় করিবার মানসে পিতা কলিকাতায় আসিয়াছিলেন, সেইস্থানে পুলিস কর্তৃক তিনি অলঙ্কারাদির সহিত ধৃত হইলেন। অনুসন্ধানে সমস্ত অলঙ্কারেরই ফরিয়াদি বাহির হইয়া পড়িল। পাঁচ ছয়টি ডাকাইতি মোকদ্দমার সমস্ত অলঙ্কার তাঁহার নিকট পাওয়া গিয়াছিল। পিতাকে অনেক রূপ পীড়াপিড়ি করা হইল, কিন্তু তিনি কিছুতেই কহিলেন না যে, ঐ সকল অলঙ্কার তাঁহাকে কে আনিয়া দিয়াছে। পরিশেষে পিতার নামেই মোকদ্দমা রুজু হইল। মোকদ্দমা অনেক দিবস পর্যন্ত চলিল। যতদূর অর্থের সংগ্রহ করিতে পারিয়াছিলাম, বা যে কিছু অর্থ আমাদিগের ঘরে ছিল, এই মোকদ্দমায় তাহার সমস্তই ব্যয় হইয়া গেল। এই মোকদ্দমায় মোট ব্যয় হইয়াছিল, বোধহয়, পঞ্চাশ সহস্র মুদ্রার কম নহে। এত অর্থ ব্যয় করিয়াও কিন্তু আমার পিতাকে উদ্ধার করিতে পারিলাম না। উচ্চ আদালতের বিচারে তিনি সাত বৎসরের নিমিত্ত কারারুদ্ধ হইলেন। পিতার কারারুদ্ধ হইবার পর মাতাও মৃত্যুশয্যায় শয়ন করিলেন। এক বৎসর কাল জেলের ভিতর বাস করিতে না করিতেই পিতাও আমার মাতার অনুবর্ত্তী হইলেন। এদিকে অগ্নি লাগিয়া আমাদিগের সমস্তই পুড়িয়া গেল। মোকদ্দম্মার খরচ পত্রের সংস্থান করিবার নিমিত্ত পূর্ব্বেই সমস্ত গরু বাছুর ও যে সমস্ত দ্রব্যাদি মজুত ছিল, তাহার সমস্তই বিক্রয় হইয়া গিয়াছিল, থাকিবার মধ্যে শূন্য গৃহ প্রভৃতি যাহা ছিল, অগ্নি লাগিয়া তাহাও ভস্মে পরিণত হইল। গোলা-গোয়াল পুড়িয়া গেল, অতিথিশালার অস্তিত্ব লোপ হইল, অতিথি অভ্যাগতের অন্ন পাইবার পথ রুদ্ধ হইয়া গেল, আমিও নিতান্ত দরিদ্র অবস্থায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। যে সকল ডাকাইতগণ আমাকে তাহাদিগের দলপতি বলিয়া মানিত, আমার নিকট হইতে তাহারা সেই সময় তাহাদিগের ইচ্ছামত অর্থ না পাওয়ায়, তাহাদিগের মধ্যে অনেকেই আমার দল পরিত্যাগ করিল। সেই সময় আমি যেরূপ অবস্থায় আসিয়া উপনীত হইয়াছিলাম, তাহাতে আমার অন্ন বস্ত্রেরও একরূপ কষ্ট হইয়া পড়িয়াছিল। আমি পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হইয়াছিলাম না, ইহাই মঙ্গল; নতুবা সেই সময় আমাকে যে কোথায় গমন করিতে হইত, তাহা জানি না। তথাপি একবার মনে করিয়াছিলা, ঐ দেশ পরিত্যাগপূর্ব্বক পুনরায় কলিকাতায় গমন করি, ও সেইস্থানে যেরূপ ভাবেই হউক দিন যাপন করি। কিন্তু দুই একজন ডাকাইত সর্দ্দারের পরামর্শে আমি তাহা করিতে পারিলাম না। বিশেষ যেস্থানে এত দিবস পর্য্যন্ত মনের সুখে দিন অতিবাহিত করিয়াছি, সেইস্থান সহজে পরিত্যাগ করাও সহজ নহে।
সেই সময় সেই ডাকাইত সদারগণের সহিত পরামর্শ করিয়া পুনরায় একটি ক্ষুদ্র দল গঠন করিলাম। এবার আমাদিগের দলে ১৫।১৬ জন লোক ব্যতীত সেই সময় আর অধিক লোক আসিয়া মিলিত হইল না। উহাদিগের সাহায্যে একটি কার্য্যের স্থির করিলাম। যে স্থানে আমরা বাস করিতাম, সেইস্থানে হইতে দশ ক্রোশ ব্যবধানে এই ডাকাইতি করিতে স্থির করিয়া এক দিবস অগ্রেই আমরা সেই দিকে গমন করিলাম। ঐ গ্রামে একজন নূতন বড়মানুষ হইয়াছিলেন, তাহারই উপর আমাদিগের এই নব দলের লক্ষ্য পতিত হইল। ঐ ব্যক্তি অতিশয় কৃপণ ছিল, কোনরূপে একটি পয়সাও ব্যয় করিতে সমর্থ হইতেন না। আমরা রাত্রিকালে তাঁহার বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। তাঁহাদের বাড়ীর বাহিরে একখানি খড়ের ঘর ছিল, আমরা সর্ব্বাগ্রে ঐ ঘর খানিতে অগ্নি লাগাইয়া দিলাম। ঘর ধু ধু করিয়া জ্বলিতে লাগিল। এদিকে আমরাও আমাদিগের কার্য্য করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। গ্রামস্থ সমস্ত লোক আসিয়া ক্রমে সেই দিকে উপস্থিত হইতে লাগিল।
একস্থানে ডাকাইতি হইলে গ্রামস্থ সমস্ত লোকে সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হয় ও ডাকাইতগণকে ধরিবার চেষ্টা করিয়া থাকে, ইহা আমি পূৰ্ব্ব হইতেই জানিতাম। কারণ ইতিপূর্ব্বে অনেকবার ডাকাইতি করিয়া প্রস্থান করিবার সময় গ্রামস্থিত লোকজনদিগের কর্তৃক আক্রান্ত হইয়াছিলাম, ও সময় সময় তাহাদিগের হস্তে বিপদগ্রস্ত হইতেও বসিয়াছিলাম। সুতরাং এবার পূর্ব্ব হইতেই আমি তাহার বন্দোবস্ত করিয়া কার্যক্ষেত্রে প্রবিষ্ট হইয়াছিলাম। সেই সময় আমার সেই ক্ষুদ্র দলে আমি ব্যতীত কেবল মাত্র ১৫ জন লোক ছিল, তাহাদিগের ১২জনকে লইয়া আমরা ঐ ডাকাইতি করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম। অবশিষ্ট ৩জনকে ঐ গ্রামের অপর তিন দিকে প্রেরণ করিয়াছিলাম। তাহাদিগের উপর এইরূপ আদেশ ছিল যে যখন তাহারা দেখিতে পাইবে যে, যে স্থানে আমরা ডাকাইতি করিতেছি, সেইস্থানের ঘর ধূ ধূ করিয়া জ্বলিয়া উঠিবে, তাহার কিয়ৎক্ষণ পরে অর্থাৎ গ্রামস্থ লোকগণ সেই দিকে গমন করিতে প্রবৃত্ত হইবার পরই তাহারা গ্রামের অপর তিন প্রান্তে অগ্নি লাগাইয়া দিবে। এরূপ বন্দোবস্ত করিবার উদ্দেশ্য এই ছিল যে, গ্রামস্থ প্রজাগণ যখন দেখিতে পাইবে, তাহারা যে স্থানে বাস করে, সেইস্থানেরও যখন গৃহ পুড়িতেছে, তখন সেইস্থানেও ডাকাইতি হইতেছে, ইহা ভাবিয়া আপনাপন ধন সম্পত্তি রক্ষা করিবার মানসে, তাহারা সকলেই আপনাপন বাড়ী অভিমুখে প্রস্থান করিবে। সুতরাং আমরা বিনা বাধা বিপত্তিতে অনায়াসেই আপন কার্য্য উদ্ধার করিতে সমর্থ হইব।
আমাদের যেরূপ বন্দোবস্ত ছিল, কার্য্যও ঠিক সেইরূপ হইল। যে স্থানে আমরা ডাকাইতি করিতেছিলাম, সেইস্থানে গ্রামস্থ লোকজন সমবেত হইতে না হইতেই গ্রামের অপর তিনদিকে একেবারে অগ্নি প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল, সুতরাং সকলেই আপনাপন ধন সম্পত্তি রক্ষা করিবার মানসে সেই স্থান হইতে দ্রুতবেগে আপনাপন গৃহাভিমুখে প্রস্থান করিল। আমরা বিনা বাধায় কার্য্য শেষ করিয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। এই কার্য্যে সোণা রূপার অলঙ্কার ও নগদ টাকায় আমরা প্রায় দুই সহস্র টাকার কার্য্য করিতে সমর্থ হইয়াছিলাম। অলঙ্কারগুলি পূর্ব্বের ন্যায় সকলে আমার হস্তে প্রদান করিল, আমি উহা লইয়া গিয়া আমার বাড়ীর নিকটবর্তী এক স্থানে প্রোথিত করিয়া রাখিলাম। নগদ অর্থ যাহা আমরা পাইয়াছিলাম, তাহা আমাদিগের সকলের মধ্যে নিম্নলিখিতরূপে বিভাগ করিয়া লইলাম। আমরা সর্ব্বশুদ্ধ ১৬ জন ছিলাম। আমি, দুইজন সর্দ্দার ও ১৩ জন ডাকাইত। সমস্ত অর্থ ২১ তুল্যাংশে বিভাগ হইল। তাহার এক এক অংশ প্রত্যেক ডাকাইতে গ্রহণ করিল। দুই অংশ করিয়া এক একজন সদার পাইল, আমি চারি অংশ গ্রহণ করিলাম।
এই ডাকাইতি মোকদ্দমার যত দিবস অনুসন্ধান হইতে লাগিল, তাহার মধ্যে ঐ সকল অর্থ আর বাহির করিলাম না। এক মাস পরে অনুসন্ধান শেষ হইয়া গেল, আমিও আমার অর্থ অল্প অল্প বাহির করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। যে স্থানে পিতার ঘর ছিল, সেইস্থানে পুনরায় ঘর প্রস্তুত করিতে লাগিলাম। পিতা যেরূপ ভাবে যে স্থানে ঘর বাঁধিয়াছিলেন, আমিও ঠিক সেইরূপ ভাবে সেইস্থানে ঘর সকল প্রস্তুত করিয়া ফেলিতে লাগিলাম। ঐ ঘর সকল প্রস্তুত করিবার সময় পুনরায় আর একটি ডাকাইতি করিবার বন্দোবস্ত স্থির হইয়া গেল, ঐ ডাকাইতিতেও আমি গমন করিলাম। এই ডাকাইতি করিলাম আর একজন ব্যবসায়ীর বাড়ীতে। এবার ডাকাইতি করিতে যাইবার কালীন আমার দলে প্রায় ত্রিশ জন লোক সমবেত হইয়াছিল। ঐ ত্রিশ জন লোকের সাহায্যে ঐ ডাকাইতি কার্য শেষ করিলাম। যাহার বাড়ীতে ডাকাইতি করিলাম, তাহার বন্ধকি কার্য্য ছিল। তাহার ঘরে নগদ অর্থ এক সহস্রের অধিক পাওয়া গেল না। কিন্তু সোনা রূপার অলঙ্কার বিস্তর পাওয়া গেল। ঐ সমস্ত অলঙ্কার সেই ব্যবসায়ী একটি লোহার সিন্দুকের ভিতর বদ্ধ করিয়া রাখিতেন। সিন্ধুকের চাবিও তাহার নিকট থাকিত। তাহার ঘরে প্রবিষ্ট হইয়া আমরা তাহার নিকট হইতে তাহার লোহার সিন্ধুকের চাবি চাহিলাম, কিন্তু প্রথমে তিনি ঐ চাবি আমাদিগকে প্রদান করিতে অনিচ্ছা প্রকাশ পূর্ব্বক নানারূপ ওজর আপত্তি করায়, আমরা তাহাকে উত্তমরূপে বাঁধিলাম এবং তাহার অঙ্গে দুই চারি বার জ্বলন্ত মশালের ছাঁকা দিতেই তিনি বলিয়া দিলেন, ঐ লোহার সিন্ধুকের চাবি কোথায় আছে। তাহার নির্দেশ মত আমরা ঐ সিন্ধুকের চাবি প্রাপ্ত হইলাম, ও ঐ চাবির দ্বারা লোহার সিন্ধুক খুলিয়া তাহার মধ্যে যে সমস্ত সোণা রূপা অলঙ্কার ছিল, তাহা লইয়া আমরা সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। গ্রাম হইতে প্রায় দুই ক্রোশ আসিয়া একটি পুষ্করিণীর ধারে আমরা উপবেশন করিলাম। সেইস্থানে উপবিষ্ট হইবার পর, এবার অনেকেই সেই সকল অলঙ্কার তাহাদিগের মধ্যে বণ্টন করিয়া লইতে ইচ্ছুক হইল। আমি কিন্তু তাহাদিগের প্রস্তাবে সম্মত না হইয়া কহিলাম, পিতা যেরূপ উপায়ে অলঙ্কার সকল বিক্রয় করিয়া আনিয়া সকলের মধ্যে বণ্টন করিয়া দিতেন, আমিও সেইরূপে উহা বিক্রয় করিয়া আনিব, ও পরিশেষে সকলের মধ্যে বণ্টন করিয়া দিব। কারণ, স্থানান্তরে ঐ সকল দ্রব্য বিক্রয় হইয়া গেলে, স্থানীয় পুলিস কোনরূপে তাহার সন্ধান পাইবে না; সুতরাং আমাদিগের বিপদে ভীত হইবার কোনরূপ সম্ভাবনাও থাকিবে না। আমার প্রস্তাবে কিন্তু অনেকেই সম্মত হইল না, সুতরাং সেইস্থানে বসিয়াই ঐ সকল অলঙ্কার সকলের মধ্যে বিভক্ত করিয়া লইলাম। সকলে আপনাপন অংশ লইয়া প্রস্থান করিল, আমিও আমার অংশ লইয়া আপন বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলাম।
পুলিস বিশেষ যত্নের সহিত এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলেন। দলস্থিত এক ব্যক্তি তাহার অংশের এক খানি অলঙ্কার ডাকাইতির পর দিবসেই এক ব্যক্তির নিকট বিক্রয় করিয়া ফেলিয়াছিল। পুলিস এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া সেই অলঙ্কার-ক্রেতার নিকট গমন করিলেন। সেই ব্যক্তি উহা চোরাদ্রব্য না জানিয়া খরিদ করিয়াছিল, সুতরাং পুলিস তাহাকে জিজ্ঞাসা করিবামাত্রই সে সেই অলঙ্কার বাহির করিয়া দিল, ও যাহার নিকট হইতে উহা খরিদ করিয়াছিল, তাহাকেও দেখাইয়া দিল। সুতরাং বিনাক্লেশেই সেই ব্যক্তি পুলিস কর্তৃক ধৃত হইল ও পুলিসের নিকট সমস্ত স্বীকার করিয়া, যে যে ব্যক্তির নাম সে অবগত ছিল, তাহা বলিয়া দিল। তাহার কথামত পুলিস সেই সমস্ত ব্যক্তিকেই ধৃত করিলেন ও সকলের খানা তল্লাসি করিলেন। একজনের নিকট হইতে তাহার অংশের অলঙ্কারগুলি বাহির হইল, কিন্তু অপর কাহারও নিকট কিছুই পাওয়া গেল না। তাহাদিগের মধ্যে কেহই কোন কথা স্বীকার করিল না। যাহার নিকট হইতে অলঙ্কার পাওয়া গিয়াছিল, সেও ডাকাইতির বিষয় অস্বীকার করিল ও কহিল, যে ব্যক্তি তাহার নাম করিয়া দিয়াছে, সেই ব্যক্তি ঐ অলঙ্কারগুলি তাহার নিকট বিক্রয় করিয়াছে। সে যে কোথা হইতে উহা প্রাপ্ত হইয়াছে, তাহা সে অবগত নহে।
পুলিস এই বিষয় লইয়া বিস্তর অনুসন্ধান করিলেন, কিন্তু ইহা অপেক্ষা অধিক আর কিছু প্রাপ্ত না হইয়া, ঐ ডাকাইতি মোকদ্দমা সম্বন্ধে যাহার যাহার নাম প্রকাশিত হইয়াছিল, সকলকেই বিচারার্থে প্রেরণ করিলেন। বিচারে দুইজন, অর্থাৎ যে ব্যক্তি অপরের নিকট একখানি অলঙ্কার বিক্রয় করিয়াছিল ও যাহার নিকট হইতে কয়েকখানি অলঙ্কার প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছিল, তাহারা দণ্ডিত হইল। এই মোকদ্দমায় আমার নাম কোনরূপে প্রকাশিত হইল না।
যত দিবস পর্য্যন্ত এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান হইতেছিল, তত দিবস আমরা আর কোন স্থানে কোনরূপ কার্য্য করিতে প্রবৃত্ত হইলাম না। মোকদ্দমা শেষ হইয়া গেল, আমরাও পুনরায় কার্য্য-ক্ষেত্রে উপস্থিত হইলাম। নিকটবর্ত্তী দুইটি গ্রামের দুই ব্যক্তি বিশেষরূপ অর্থ সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছে, ক্রমে এই সংবাদ আসিয়া আমাদিগের নিকট উপস্থিত হইল। আমরাও এক রাত্রিতেই দুই বাড়ীতে ডাকাইতি করিতে মনস্থ করিয়া লোক জন সংগ্রহ করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। একবার মনে করিলাম, পূর্ব্বের ডাকাইতি-মোকদ্দমায় যে সকল ব্যক্তির নাম পুলিস অবগত হইতে পারিয়াছে, ও যাহাদিগের গতিবিধির উপর পুলিস সর্ব্বদা লক্ষ্য রাখিয়াছে, তাহাদিগকে আমরা এই কার্য্যে সঙ্গে লইব না; কিন্তু তাহা হইল না। ঐ সকল বিশেষ উপযুক্ত ব্যক্তিগণকে পরিত্যাগ করিলে এই কার্য্য সুচারুরূপে সম্পন্ন হইতে পারিবে না ভাবিয়া, তাহাদিগকে পরিত্যাগ করিতে পারিলাম না। ক্রমে লোকজন সংগ্রহ হইয়া গেল, কার্য্য করিবার দিনও স্থির হইল। এই সময় আমাদিগের দলে প্রায় ৪০ ৪৫ জন লোক হইয়াছিল। ঐ সমস্ত লোককে দুই দলে বিভক্ত করিয়া এক সময়েই দুই গ্রামের দুই বাড়ীতেই ডাকাইতি করিতে মনস্থ করিলাম। যেরূপ মনস্থ করিয়াছিলাম, কার্য্যেও ঠিক সেইরূপ হইল। দুই বাড়ীতে ডাকাইতি করিয়া আমরা যে সকল নগদ অর্থ প্রাপ্ত হইলাম, তাহা আমাদিগের নিয়ম মত বিভাগ করিয়া লইলাম। এবার আর কিন্তু অলঙ্কারাদি কেহই গ্রহণ করিল না। পূর্ব্বের নিয়ম মত সমস্ত অলঙ্কারই আমার নিকট রহিয়া গেল। আমি উহা আমার বাড়ীতে আনিয়া এক স্থানে উত্তমরূপে প্রোথিত করিয়া রাখিলাম। পুলিসের অনুসন্ধানের গোলযোগ মিটিয়া গেলে, আমার নিকট এ পর্যন্ত যত অলঙ্কার জমা হইয়াছিল, তাহা লইয়া কলিকাতায় গমন করিলাম। আমার পিতা যাহার নিকট অলঙ্কারাদি বিক্রয় করিতেন, আমিও তাহার নিকট গিয়া ঐ সমস্ত অলঙ্কার প্রদান করিলাম। তিনি আমার সম্মুখেই সমস্ত অলঙ্কার গলাইয়া ফেলিলেন, ও যেরূপ হিসাবে পিতাকে তিনি মূল্য প্রদান করিতেন, সেইরূপ হিসাবে আমাকেও মূল্য প্রদান করিলেন। আমি ঐ সকল অর্থ লইয়া আমার বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। আমার পিতার নিয়ম ছিল যে, অলঙ্কার বিক্রয় করিয়া যে অর্থ পাওয়া যাইত, তাহার এক-চতুর্থাংশ তিনি গ্রহণ করিতেন, ও অবশিষ্ট তিন চতুর্থাংশ সকলের মধ্যে বিভক্ত করিয়া দিতেন। আমিও সেগুলি ঠিক সেই নিয়মে বিভক্ত করিয়া দিলাম, তাহা নহে। ঐ সকল দ্রব্য বিক্রয় ইত্যাদি করিবার নিমিত্ত পিতা যেমন এক চতুর্থাংশ গ্রহণ করিতেন, আমিও সেইরূপ এক-চতুর্থাংশ প্রথমেই গ্রহণ করিলাম। অবশিষ্ট যাহা রহিল, তাহা পূর্ব্ববর্ণিত নিয়ম অনুসারে বিভক্ত হইল, অর্থাৎ এই অংশ অনুযায়ী প্রত্যেক ডাকাইত যাহা পাইল, আমি তাহা অপেক্ষা তিন গুণ অধিক পাইলাম।
এইরূপ উপায়ে সেই সময় পুনরায় আমার হস্তে অনেকগুলি টাকা আসিয়া পড়িল। আমি পিতার ন্যায় পুনরায় অতিথিশালা খুলিলাম, পিতার ন্যায় পুনরায় চাষ আবাদ আরম্ভ করিলাম। পিতার ন্যায় পুনরায় গোলা সকল শস্যপূর্ণ করিতে লাগিলাম ও গোয়াল সকল পুনরায় গরুতে পূরিত হইতে লাগিল। অতিথি অভ্যাগতগণ পুনরায় আমার বাড়ীতে পদার্পণ করিতে লাগিল। সরকারী কর্ম্মচারীগণের পুনরায় আমার বাড়ীতে পদধূলি পড়িতে আরম্ভ হইল। চাষ আবাদ করিয়া আমি আমার অবস্থার পরিবর্তন করিতেছি, এ কথা এবার কিন্তু সরকারী কর্মচারীগণের মনে স্থান পাইল না। তাহাদিগের মনে ধারণা হইল যে, আমিও আমার পিতার ন্যায় অপহৃত দ্রব্য সকল খরিদ করিয়া থাকি বলিয়াই ক্রমে আমি আমার অবস্থার পরিবর্তন করিতে সমর্থ হইয়াছি। এই বিশ্বাসের উপর নির্ভর করিয়া পুলিস-কৰ্ম্মচারীগণ প্রায়ই আমার বাড়ীতে আসিতেন। আমিও তাহাদিগের মনের ভাব অবগত হইতে পারিয়া, তাহাদিগকে কোন কথা কহিতাম না, বরং পূর্ব্বাপেক্ষা অধিক যত্নই করিতাম।
এইরূপে কিছু দিবস অতিবাহিত হইবার পরই, এক দিবস অতি প্রত্যুষে দেখিতে পাইলাম যে, আমার বাড়ীর চতুৰ্দ্দিক পুলিস-প্রহরীর দ্বারা পরিবেষ্টিত। উচ্চপদস্থ দুই একজন পুলিস-কৰ্ম্মচারীও সেই সঙ্গে আছেন। ইহা দেখিয়া আমি সেই কৰ্ম্মচারীগণের নিকট গমন করিলাম ও কহিলাম, “এত পুলিসের দ্বারা আমার বাড়ী পরিবেষ্টিত করিবার প্রয়োজন কি? আমাকে ধৃত করিবার যদি আবশ্যক হইয়া থাকে, তাহা হইলে আমাকে সংবাদ দিলেই আমি গিয়া আপনাদিগের নিকট উপস্থিত হইতাম। বিশেষ কষ্ট করিয়া ও এত লোক জন সঙ্গে করিয়া আপনাদিগের এত দূর আসিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন ছিল না।”
উত্তরে একজন কৰ্ম্মচারী কহিলেন, “আমরা তোমাকে ধৃত করিতে আসি নাই, আমরা সংবাদ পাইয়াছি, তোমার ঘরে অপহৃত দ্রব্য আছে, তাহাই অনুসন্ধান করিবার মানসে আমরা এখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি।”
তাঁহার কথা শুনিয়া আমি মনে করিলাম, আমার ঘরে যে অপহৃত দ্রব্য ছিল, সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই, ও পুলিস যে সংবাদ প্রাপ্ত হইয়াছেন, তাহাও যে প্রকৃত, তাহারও আর কিছুমাত্র ভুল নাই; কিন্তু এই সংবাদ তাঁহারা সময়মত প্রাপ্ত হন নাই। আমি কলিকাতায় গিয়া সমস্ত দ্রব্য বিক্রয় করিয়া আসিবার পর তাঁহারা এই সংবাদ পাইয়াছেন। এখন আমার ঘরে অপহৃত দ্রব্যের চিহ্নমাত্রও নাই। প্রকাশ্যে কহিলাম, “ইহার নিমিত্ত আমার বাড়ী ঘিরিয়া রাখিবার প্রয়োজন কি? আপনারা আমার সঙ্গে আসুন, ও যে ঘরে অনুসন্ধান করিয়া দেখিবার প্রয়োজন হয় করুন। আপনারা যে সংবাদ পাইয়াছেন, তাহা মিথ্যা। আমার পিতার যেরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহা আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি, ও আমাদিগের সর্ব্বস্বান্ত হইয়া গিয়াছিল। এরূপ অবস্থায় আমি অপহৃত দ্রব্য পুনরায় গ্রহণ করিয়া সেইরূপ বিপদগ্রস্ত হইব, ইহা আপনারা কখনই মনে করিবেন না। সে যাহা হউক, আমি আপনাদিগকে আমার কথার উপর বিশ্বাস করিতে কহিতেছি না। আপনারা আমার সহিত আসুন, ও যে স্থানে ইচ্ছা, সেই স্থানে অনুসন্ধান করিয়া আপনাদিগের চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করিয়া লউন।”
আমার কথা শুনিয়া কর্ম্মচারীগণ আমার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন। সমস্ত ঘর উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়া দেখিলেন। বাড়ীর ভিতর স্থানে স্থানে মৃত্তিকা খনন করিয়াও দেখিলেন। যে স্থানে আমি অলঙ্কারগুলি পুৰ্ব্বে প্রোথিত করিয়া রাখিয়াছিলাম, সেই স্থানও তাঁহারা খনন করিলেন। এই অবস্থা দৃষ্টে আমার অনুমান হইল, আমার দলস্থিত যে কোন ব্যক্তি এ স্থানের বিষয় অবগত ছিল, তাহারই মধ্যে কেহ না কেহ এই সংবাদ পুলিসকে প্রদান করিয়াছে। আবার ভাবিলাম, যদি দলস্থিত কোন ব্যক্তি এই সংবাদ প্রদান করিয়া থাকে, তাহা হইলে যখন তাহারা অবগত হইতে পারিয়াছে যে, সমস্ত অলঙ্কার আমি বিক্রয় করিয়া ফেলিয়াছি ও তাহারা তাহাদিগের নিয়মিত অংশ প্রাপ্ত হইয়াছে, তখন ঐ স্থানে যে অলঙ্কার আছে, এই সংবাদ প্রদান করিবে কেন? যাহা হউক, পুলিস কর্ম্মচারীগণ প্রায় সমস্ত দিন ধরিয়া আমার বাড়ীতে অনুসন্ধান করিলেন, কিন্তু অপহৃত দ্রব্যের কিছুই প্রাপ্ত হইলেন না।
পুলিস কর্ম্মচারীগণ এদিকে আমার বাড়ীর খানা তল্লাসি করিতে লাগিলেন, ওদিকে আমি তাহাদিগের আহারাদির যোগাড় করিতে লাগিলাম। আমার ঘরের খানা তল্লাসি করিয়া পরিশেষে তাঁহারা আমার বাড়ীতেই উত্তমরূপে আহার করিলেন ও যাইবার সময় আমিই তাঁহাদিগকে পাথেয় স্বরূপ কিছু অর্থ প্রদান করিলাম।
এই ঘটনার এক মাস পরে একটি স্ত্রীলোকের নিকট আমরা যে কিরূপে প্রতারিত হইয়াছিলাম, তাহাও শুনুন। এক দিবস আমাদিগের দলের এক ব্যক্তি আসিয়া সংবাদ প্রদান করিল যে, একখানি গ্রামের কোন একটি বাবু বহুদিবস হইতে পশ্চিম দেশে বাস করিতেন, সম্প্রতি তিনি ও তাঁহার স্ত্রী তাঁহাদিগের বাড়ীতে আসিয়াছিলেন। বাবুটি পুনরায় তাঁহার চাকরিস্থলে গমন করিয়াছেন; কিন্তু তিনি এবার তাঁহার স্ত্রীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যান নাই। তিনি একাকীই তাঁহার বাড়ীতে আছেন। তাঁহার নিকট নগদ অর্থ কিছু আছে, কিন্তু অধিক মূল্যের সুবর্ণের অনেক অলঙ্কার আছে। এই সংবাদ পাইয়া আমরা আর কালবিলম্ব করিলাম না, আমাদের সেই সর্দ্দারদ্বয়ের নিকট সংবাদ প্রদান করিলাম। তাহারাও লোকজন সংগ্রহ করিয়া ও দিন স্থির করিয়া আমার নিকট সংবাদ প্রদান করিল। নির্দ্দিষ্ট দিনে আমরা দলবলে গিয়া সেই স্ত্রীলোকটির বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম। বাড়ীর সদর দরজা ভাঙ্গিয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া যেমন ঘরের দরজা ভাঙ্গিবার চেষ্টা করিতেছি, অমনি সেই স্ত্রীলোকটি ঘরের দরজা খুলিয়া দিয়া কহিল, “ঘরের দরজা ভাঙ্গিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই, আমি দরজা খুলিয়া দিয়াছি, আমার যাহা কিছু আছে, তাহা লইয়া আপনারা প্রস্থান করুন। এই বলিয়াই সে দ্রুতপদে আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল ও আমার পদপ্রান্তে পতিত হইয়া কহিল, “আমার উপর অত্যাচার করিবেন না। আমার যাহা কিছু আছে, তাহা সমস্তই আমি আপনাকে বাহির করিয়া দিতেছি।” উহার কথা শুনিয়া আমি তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইলাম।সে আমাকে সঙ্গে লইয়া তাহার ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল। ঘরের ভিতর একটি কাঠের বাক্স ছিল, তাহা খুলিয়া তাহা হইতে এক থলি মুদ্রা বাহির করিয়া আমার হস্তে প্রদান করিল। অনুমানে বুঝিলাম, উহার ভিতর নগদ প্রায় পাঁচ শত টাকা আছে। সেই টাকার থলি আমার হস্তে প্রদান করিয়া একটি বড় গোছের টিনের বাক্স বাহির করিয়া আমার সম্মুখে আনিল ও উহা খুলিয়া আমার সম্মুখে রাখিল। দেখিলাম সুবর্ণ অলঙ্কারে উহা পরিপূর্ণ। উহাকে আর কিছু না বলিয়া আমি সকলকে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিবার এক সঙ্কেতধ্বনি করিলাম। সকলেই বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গেল। নগদ টাকাগুলি নিয়মিতরূপে আমরা সেই দিনই আমাদিগের মধ্যে বিভাগ করিয়া লইলাম, কিন্তু অলঙ্কারগুলি আমার নিকটেই রহিয়া গেল।
তাহার পরই শুনিতে পাইলাম, ডাকাইতির সংবাদ পাইয়া পুলিস আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইয়াছিলেন ও সেই স্ত্রীলোকটি তাহাদিগকে বলিয়াছিলেন যে, “ডাকাইতগণ তাঁহার বাড়ীতে ডাকাইতি করিতে উপস্থিত হইয়াছিল সত্য, কিন্তু তিনি নিজে ডাকাইতগণকে কহিলেন, তাঁহার ঘরে একটি পয়সাও নাই। একখানি অলঙ্কারও নাই। ঘর খুলিয়া দিতেছি, ইচ্ছা করেন তো দেখিয়া যাউন। স্ত্রীলোকের এই কথা শুনিয়া কি জানি কি ভাবিয়া ডাকাইতগণ সেইস্থান হইতে প্রস্থান করে। তাহার কোন দ্রব্য অপহৃত হয় নাই, বা ডাকাইতগণ তাহার বাড়ীতে ডাকাইতিও করে নাই।
এই অবস্থা শুনিয়া পুলিস আর ইহার অনুসন্ধান করিলেন না। ডাকাইতগণ তাহাদিগের অংশে যে সকল নগদ টাকা পাইয়াছিল, তাহা নির্ভয়ে বাহির করিয়া খরচ করিতে আরম্ভ করিল। কিন্তু পরিশেষে জানিতে পারা যায় যে, ঐ সকল মুদ্রার একটিও প্রকৃত নহে, সমস্তই কৃত্রিম। সুতরাং কৃত্রিম মুদ্রা চালান অপরাধে ডাকাইতগণের অনেকেই পুলিস কর্তৃক ধৃত হন। ঐ সকল টাকা যে তাহারা কোন স্থান হইতে প্রাপ্ত হইয়াছিল, তাহার প্রকৃত কথা বলিতে পারে না, সুতরাং অব্যাহতিও পায় না। এই সকল কৃত্রিম মুদ্রা যে কোথা হইতে আসিল, তাহার প্রকৃত তথ্যও পুলিস অবগত হইতে পারিল না। কিন্তু কৃত্রিম মুদ্রা চালান ও তাহাদিগের ঘরে কৃত্রিম মুদ্রা প্রাপ্ত হওয়ার অপরাধে আমার দলস্থিত প্রায় ১০ জন লোকের কারাবাস হইয়া গেল। আমার নিকট যে সকল কৃত্রিম মুদ্রা ছিল, তাহা আমি নষ্ট করিয়া ফেলিলাম। সেই সময়ে ঐ সকল অলঙ্কার সম্বন্ধেও আমার মনে সন্দেহ হইল, তখন উহা পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম যে, উহার এক খানিও সুবর্ণের নহে, সমস্তই পিত্তলের উপর গিল্টিকরা। তখন বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, ঐ স্ত্রীলোকটি আমাদিগের সহিত খুব চতুরতা করিয়া আমাদিগের হস্ত হইতে রক্ষা পাইয়াছে। এই সকল অবস্থা অবগত হইবার পর আমরা সেই স্ত্রীলোকটির পুনরায় অনুসন্ধান করিয়াছিলাম, কিন্তু তাহাকে আর পাওয়া যায় না। শুনিয়াছিলাম, এই ঘটনার দুই এক দিবস পরেই, সে তাহার স্বামীর নিকট গমন করিয়াছে।
[ ভাদ্র, ১৩০৮]