উভয় সংকট

উভয় সঙ্কট 

প্রথম পরিচ্ছেদ

টিপ্‌ টিপ্‌ টিপ্‌ বৃষ্টি পড়িতেছে— গুড় গুড় গুড় আকাশ ডাকিতেছে— মিট্‌ মিট্‌ মিট্‌ গ্যাসের আলো জ্বলিতেছে, তবে মধ্যে মধ্যে বিদ্যুৎ চমকিতেছিল, তাই সেই অন্ধকার রাত্রে এখনও চলিতে পারা যায়। সেই দুর্যোগ রাত্রে আমি কলিকাতার রাস্তায় বাহির হইয়াছি। আবার রাত্রি তখন প্রায় দুই প্রহর। একে অমাবস্যার রাত্রি, তায় এই দুর্যোগ, সুতরাং আমার পক্ষে এরূপ সুযোগ আমি ছাড়িতে পারিলাম না। হাতে কাজ না থাকিলেও এ সময় শয্যার উপর অৰ্দ্ধমৃত অবস্থায় পড়িয়া থাকিতে আমার কেমন প্রবৃত্তি হয় না, তাই বাহির হইয়াছি। কারণ, পৃথিবীর যত পাপ কার্য্যই এইরূপ অন্ধকারে ও দুর্যোগ রাত্রে সম্পন্ন হইয়া থাকে। 

ঘুরিতে ঘুরিতে আমি যখন মেছুয়াবাজারের মোড়ের উপর আসিয়া পৌঁছিলাম, তখন দেখি, জনৈক সাহেব ইনস্পেক্টার একজন নিম্নপদস্থ পুলিস-কৰ্ম্মচারীর সহিত রোঁদে বাহির হইয়াছেন। তিনি আমায় দেখিয়া থম্‌কিয়া দাঁড়াইলেন, এবং কহিলেন, “এ দুর্যোগে আপনি এখানে কেন? কোন জরুরী কাজ হাতে আছে না কি?” 

আমি উত্তর করিলাম, “সেরূপ কাজ আমার হাতে নাই বলিয়াই আমি কাজের চেষ্টায় ঘুরিতেছি।” 

সাহেব ঈয়ৎ হাসিয়া কহিলেন, “না, অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে, এ স্থানটা যে অতি কু-স্থান। সেইজন্য সহরে এতস্থান থাকিতে এ দুর্যোগ রাত্রে এ স্থানে কাজের চেষ্টায় ঘোরা, কথাটা হঠাৎ আমি বিশ্বাস করিতে পারি না।” 

আমিও ঈযৎ হাসিয়া উত্তর করিলাম, “দুর্যোগ রাত্রে এরূপ কুস্থানেই কাজের চেষ্টায় ঘুরিতে হয়। আপনার মত অভিজ্ঞ ও পদস্থ পুলিস-কৰ্ম্মচারীর মুখে ওরূপ কথা শোভা পায় না।” 

আমাদের মধ্যে এইরূপ কথাবার্তা চলিতেছে, এমন সময় অদূরে একটা পিস্তলের শব্দ হইল। আমরা সকলেই সে শব্দ শুনিয়া একবারে চমকিয়া উঠিলাম। আমি কহিলাম, “এই দেখুন, এ যে পিস্তলের শব্দ! এমন সময় পিস্তলের শব্দ কেন হইল, সে বিষয় অনুসন্ধান করা উচিত।” 

সাহেব কহিলেন, “নিশ্চয় আর বিলম্বে কাজ নাই। আসুন, আসুন।” 

যেদিক হইতে শব্দ আসিয়াছিল, আমরা সকলেই তখন সেইদিকেই দৌড়িলাম। যে বাড়ীটা হইতে পিস্তলের আওয়াজ আসিয়াছে বলিয়া আমরা সন্দেহ করিলাম, সে বাড়ীটার দরজা ভিতর হইতে বন্ধ। প্রথমে দরজার কড়া নাড়িলাম, উত্তর নাই! ধাক্কা দিয়া জোরে জোরে শব্দ করিতে লাগিলাম, তথাপি সাড়া-শব্দ নাই। “কে আছ, দরজা খোল” বলিয়া চীৎকার করিলাম, তবুও কেহ কোন উত্তর দিল না। মৃতব্যক্তির একটা গোঁয়ানী শব্দ এই সময় আমাদের কর্ণে গিয়া পৌঁছিল। তখন আর বিলম্ব করিতে পারিলাম না, দরজা ভাঙ্গিয়া ফেলিলাম। বাড়ীর ভিতরে গিয়া দেখি, উপরে একটা গৃহের মধ্যে আলো জ্বলিতেছে। আমরা উপরে উঠিতে যাইতেছি, এমন সময় দেখি, একটা লোক বাড়ীর খিড়কীর দরজার দিকে অন্ধকারে পলাইতেছে। আমাদের সঙ্গে যে আলো ছিল, সেই আঁধার-আলো তখন সেই দিকে ধরা গেল। যেই আলো ধরা, লোকটা অমনি আমাদিগকে দেখিয়া আর পলাইল না, এক বিকট মূর্ত্তিতে আমাদের সম্মুখে দাঁড়াইল। বিস্ফারিত তাহার বড় বড় দুটা চক্ষু ক্রোধে তখন রক্তবর্ণ, হস্তে একটা পিস্তল, পিস্তলের লক্ষ্য সাহেবের দিকে। সে মূর্ত্তি দেখিয়া আমার প্রাণে বড় ভয় হইল, আর সেই লোকটাই যে এইমাত্র একটা খুন করিয়াছে, সে বিষয়ে আমাদের মনে আর কোন সন্দেহ রহিল না। লোকটা সেই স্থান হইতে চীৎকার করিয়া কহিল, “মৎ আও― হুঁই খাড়া রও, এক কদম্ আনেসে জান্ যাগা।” 

আমি ভয় পাইয়াছিলাম, কিন্তু এ অবস্থায়ও সাহেবকে ভীত দেখিলাম না। এই সময় হঠাৎ পিস্তলের দিকে আমার দৃষ্টি পড়িল। দেখিলাম, পিস্তলটা তে-নলা। আমরা একটা মাত্র আওয়াজ শুনিয়াছি, এখনও আরো দুইটা নল নিশ্চয়ই গুলিভরা আছে। মুহূর্ত্তের মধ্যে সেই কথা আমি সাহেবকে কাণে কাণে বলিলাম। আমার কথায় সাহেবের তখন চৈতন্য হইল; সাহেব বিপদ আশঙ্কা করিয়া আর অগ্রসর হইলেন না। এই সময় আমি আরো ভাল করিয়া দেখিলাম— পিস্তলের লক্ষ্য কেবল সাহেবের দিকে। হঠাৎ একটা কথা আমার মনে হইল, আমি অন্ধকারের মধ্যে লুকাইয়া গিয়া লোকটার পিছন দিক হইতে কায়দার সহিত একবারে তাহাকে জড়াইয়া ধরিলাম। তখন সম্মুখ দিক হইতেও সাহেব ও পাহারাওয়ালা আসিয়া পড়িল। এই সময় লোকটা চীৎকার করিয়া উঠিল, “পুলিস্ হামকো পাকড়া হ্যায়।” 

মুহূর্তের মধ্যে এই সকল ঘটনা ঘটিল, বে-কায়দায় পড়িয়া লোকটা গ্রেপ্তার হইল। তাহা না হইলে গুলি-ভরা পিস্তল হস্তে সেরূপ একজন বলবান্ লোককে গ্রেপ্তার করা বড় সহজ ব্যাপার নহে। সৌভাগ্যক্রমে আমার সঙ্গে একটা হাতকড়ি ছিল, আমি সেই হাতকড়ি বাহির করিয়া সাহেবকে দিলাম। সাহেব তৎক্ষণাৎ পিস্তল কাড়িয়া লইয়া তাহার হাতে হাত-কড়ি পরাইয়া দিলেন। লোকটা কাবুলেওয়ালা না পাঠান? সে কথার তখন মীমাংসা করিবার আমাদের অবকাশ ছিল না। সাহেব এই সময় উপরে যাইতে কহিলেন। আমি সিঁড়ি দিয়া দ্বিতলে উঠিলাম। যে ঘরে আলো জ্বলিতেছিল, সেই ঘরে গিয়া দেখি, এক ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ড! মেজের উপর একটা লোক চিৎ হইয়া পড়িয়া আছে—- তাহার বুকেই গুলির আঘাত লাগিয়াছে— ক্ষতস্থান হইতে তখনও রক্তস্রোত বহিতেছিল! কিন্তু আমার আসিবার পূর্ব্বেই তাহার প্রাণবায়ু বহির্গত হইয়া গিয়াছে। লোকটা যে অবস্থায় পড়িয়াছিল, সেই অবস্থাতেই রহিল; আমি আর কোনরূপ নাড়াচাড়া না করিয়া ধীরে ধীরে নীচে নামিয়া আসিলাম। আসিয়া সাহেবকে সকল কথা কহিলাম। সাহেব শুনিয়া শিহরিয়া উঠিলেন। তার পর আমায় কহিলেন—“এরূপ একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা আমি বড় সাহেবকে না জানাইয়া আর থাকিতে পারিতেছি না— আপনি এখানে লাসের কাছে থাকুন— আমি আসামীকে থানায় লইয়া যাই। সেখান হইতে বড় সাহেবকে টেলিফোঁ করি। আর একজন আপনার সঙ্গে রাখিতে পারিলে ভাল হয়, কিন্তু আমরা দুইজন না হইলে আসামীকে থানায় লইয়া যাইতে পারিব না।” সেই সময় একজন জমাদার সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়া আমি কহিলাম, “তবে জমাদারকে আমার কাছে রাখিয়া যান।” 

জমাদারকে রাখিয়া সাহেব তখন আসামীকে লইয়া থানায় চলিয়া গেলেন। যাইবার সময় আমায় কহিলেন, “লাস যে ভাবে যেখানে পড়িয়া আছে ঠিক্ যেন সেইভাবেই থাকে; কোন রকম নাড়া-চাড়া করা যেন না হয়।” 

আমি উত্তর করিলাম, “সে কথা আমায় বলিতে হইবে না।” 

ইনস্পেক্টার সাহেব যে জমাদারকে আমার নিকট রাখিয়া গেলেন, তাঁহার নাম – কেনারাম ঘোষ। ঘোষজা মহাশয় অনেক দিন এই পুলিস-বিভাগে কার্য্য করিতেছেন, কিন্তু সেরূপ চালাক চতুর নহেন বলিয়া আঁর তাঁহার উন্নতি হইল না— জমাদারীতেই বুড়া হইয়া গেলেন। তবে প্রথম শ্রেণীর জমাদার — সব-ইনস্পেক্টারী যে তাঁহার অদৃষ্টে আর ঘটিবে, তাহা ত বোধ হয় না। আমি তাঁহাকে কেনারাম দাদা বলিতাম। আসামী লইয়া সকলে চলিয়া গেলে পর, আমরা নীচের সদর ও খিড়কী দরজা বন্ধ করিয়া উপরে যে ঘরে হত্যাকাণ্ড হইয়াছে, সেই ঘরে আসিলাম। আমার মনে কেমন একটা খটকা জন্মিয়াছিল, আমি সেই কারণ কেনারাম দাদাকে কহিলাম, “কেনারাম- দা, খিড় কী দিয়া অমন পলাইবার পথ যখন রহিয়াছে, তখন আসামী মনে করিলে আমাদের সাড়া পাইয়াই স্বচ্ছন্দে পলাইতে পারিত, কিন্তু কেন পালায় নাই বলিতে পার?” 

কেনা। তা আসামীর মনের কথা আমি কেমন করিয়া জানিব ভাই? 

আমি। আমার বোধ হয়, আসামীর সঙ্গে আরো কেহ ছিল, সে ঐ খিড়্কী দিয়া পলায়ন করিয়াছে।

কেনারাম দাদা বড় সাদাসিদে লোক। তিনি অম্লানবদনে কহিলেন— “তার আর আশ্চর্য্যটা কি?”

আমি। কমিশনার সাহেব আসিবার পূর্ব্বে আমরা সে বিষয়ে একটা অনুসন্ধান করি এস না দাদা।” কেন। অত হাঙ্গামায় দরকার কি? লাস চৌকি দিবার ভার পাইয়াছি, লাসই চৌকী দিই এস। 

অল্পক্ষণ পরেই পুনরায় কেনারাম দাদা কহিলেন, “তবু তুমি যখন ডিটেকটিভ বিভাগের লোক, তখন সে বিষয়ে অনুসন্ধান করাটা তোমার উচিত বটে।”

আমি। আচ্ছা, তোমার কি মনে হয় দাদা? 

কেনা। কিসে তুমি অনুমান কর, তা ত আমি কিছুই বুঝিতে পারি না ভাই! একজন লোকে কি গুলি করিয়া অপর একজনকে মারিতে পারে না যে তুমি আসামীর সঙ্গে আরো লোক ছিল, অনুমান করিতেছ? 

আমি। তার একটা বিশেষ কারণ আছে— সে যখন ধরা পড়ে, তখন সে “পুলিস হামকো পাকড়া হ্যায়” বলে চীৎকার করিয়া উঠিবে কেন? আমার মনে হয়, নিশ্চয়ই তার সাক্ষী বাহিরে দাঁড়াইয়া ছিল, ঐ কথার দ্বারা তাহাকে অপেক্ষা করিতে নিষেধ করা হইল।

কেনা। কথাটা বলিয়াছ মন্দ নয় রে ভাই! সে কথা নিশ্চয়ই অন্যের উদ্দেশ্যে বলা হইয়াছিল। তা না হইলে সে কথার ত কোন অর্থই হয় না। 

কেনারাম দাদার মতন একজন লোকেরও মনে যখন আমার উক্ত কথায় এই সন্দেহ উপস্থিত হইয়াছে দেখিলাম, তখন আর আমি নিশ্চিন্ত থাকিতে পারিলাম না। দেখিলাম, সে গৃহটি সুসজ্জিত। সেখানে অন্য আলোরও অভাব ছিল না। আমি একটা হারিকেন ল্যাম্প জ্বালিয়া লইয়া কেনারাম দাদাকে আমার সঙ্গে আসিতে বলিলাম। প্রথমে আমরা তন্ন তন্ন করিয়া সেই বাড়ীর অন্যান্য ঘর খুঁজিলাম। কোথাও কিছু দেখিতে পাইলাম না। শেষে নীচে নামিয়া নীচেরও সমস্ত ঘর খোঁজা হইল— কি জানি, যদি এই বাড়ীর মধ্যেই অপর কেহ লুকাইয়া থাকে, তাহাকে উদ্দেশ্য করিয়াও আসামী উপরোক্ত কথা বলিতে পারে। কিন্তু কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না। তখন আমি আস্তে আস্তে খিড়কির দরজাটি খুলিলাম—দেখি— সম্মুখেই একটা বিস্তীর্ণ মাঠ। তখন হঠাৎ একটা কথা আমার মনে পড়িয়া গেল। অল্পক্ষণ পূৰ্ব্বেই বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে, যদি খিড়কী দিক হইতে কেহ মাঠের উপর দিয়া গিয়া থাকে, নিশ্চয়ই তাহার পায়ের দাগ দেখিতে পাওয়া যাইবে। আলো লইয়া দেখি—- একজন মানুষের পায়ের দাগ স্পষ্ট স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। তখন কেনারাম দাদাকে সঙ্গে লইয়া সেই মাঠে সেই পায়ের দাগ ধরিয়া চলিলাম। কেনারাম দাদার হস্তে আলো— আর আমার দৃষ্টি সেই পদচিহ্নের দিকে। মাঠের অর্দ্ধেকগিয়া দেখি আর একজন লোক মাঠের অপর দিক হইতে আসিয়া এইখানে দুইজনে একত্রিত হইয়াছে! তার পর দুইজনই একত্রে সে মাঠ পার হইয়া গিয়াছে। মাঠের অপর পারে একটা খোলার ঘরের বস্তি। দুইদিকে খোলার ঘর, আর তার মধ্যে সরু রাস্তা—– সেই রাস্তা বড় রাস্তায় গিয়া পড়িয়াছে। সেই সরু রাস্তার মধ্যেও আমি সেই দুইজনের পদ-চিহ্ন ধরিয়া চলিলাম। যখন বড় রাস্তায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম, তখন দেখিলাম, আর পদ-চিহ্ন নাই— একখানা গাড়ীর চাকার দাগ স্পষ্ট রহিয়াছে। সেইখানে গাড়ীখানা মোড় ফিরাইয়া চলিয়া গিয়াছে। আমার যেন স্পষ্ট বোধ হইল, সেই গাড়ীতেই সেই দুইজনে চলিয়া গিয়াছে। কিন্তু কোথায় যে গিয়াছে, তাহা আর ধরিতে পারিলাম না— কারণ বড় রাস্তায় সেইরূপ অনেক গাড়ী গিয়াছে— তাহাদের চাকার দাগের সঙ্গে এ গাড়ীর চাকার দাগ ধরিতে পারা গেল না। তখন আমরা ফিরিলাম। আসিতে আসিতে কেনারাম দাদাকে কহিলাম, “কেনারাম-দা, আমাদের আসিবার পূর্ব্বে কে পলাইয়া গিয়াছে— বলিতে পার?” 

কেনা। কেমন করিয়া বলিব ভাই? আমি ত জ্যোতিষশাস্ত্র পড়ি নাই? 

আমি। পুলিস-বিভাগে কর্ম্ম করিতে হইলে সকল শাস্ত্রই জানা উচিত। আসামীর সঙ্গে নিশ্চয়ই একজন স্ত্রীলোক ছিল। কারণ যে খিড়কীর দরজা দিয়া পলায়ন করিয়াছে, সে স্ত্রীলোক। এখন আমি সব বুঝিতে পারিয়াছি— সেই স্ত্রীলোককে বাঁচাইতে গিয়াই আসামী নিজে ধরা দিয়াছে। দাদা, আমার ত মনে হয় এ কেবল খুন নহে, ইহার মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর রহস্য লুক্কায়িত আছে। 

কেনারাম দাদা অবাক্ হইয়া আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। আমি কহিলাম, “চল দাদা, শীঘ্র চল— আমরা লাস ফেলিয়া আসিয়াছি।” 

তখন পুনরায় খিড়কী দিয়া আমরা সেই বাড়ীতে প্রবেশ করিলাম। প্রবেশ করিয়াই খিড়কীর দরজা বন্ধ করিয়া দিলাম। তার পর উপরে যে ঘরে লাস পড়িয়াছিল, সেই ঘরে আসিলাম। এইবার কেনারাম দাদা একটু বিশ্রাম করিবার চেষ্টা দেখিতে লাগিলেন, কিন্তু আমার প্রাণে সে ইচ্ছার লেশমাত্র ছিল না। আমি কেবল এই খুনের কথা ভাবিতে লাগিলাম। যে ব্যক্তি খুন হইয়াছে— সে ব্যক্তিকে একজন সম্ভ্রান্ত মুসলমানবংশীয় বলিয়া আমার মনে হইল। আর তাহার পোষাক-পরিচ্ছদ দেখিয়া বুঝিলাম, হয় বাহির হইতে এ বাড়ীতে আসিয়াছিল, না হয়— বাহিরে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছিল, এমন সময় খুন হইয়াছে বাড়ীর লোকে গৃহে থাকিবার সময় সচরাচর সেরূপ পোষাক পরিয়া থাকে না। আমি এ সকল কথা মনে মনে চিন্তা করিতেছি, এমন সময় একটা কথা হঠাৎ আমার মনে হইল। আমি কেনারাম দাদাকে কহিলাম, “কেনারাম-দা একখানা কোদাল আনিত পার?” 

কেনারাম দাদা আশ্চৰ্য্য হইয়া কহিল, “তুমি কোদাল লইয়া কি করিবে? লাসটা পুঁতিয়া ফেলিবার মলব আছে না কি?” 

কেনারাম দাদার কথা শুনিয়া আমি হাসিলাম। আমার হাসিবার অর্থ এই— কেনারাম দাদা পুলিসের একজন পুরাতন কৰ্ম্মচারী হইয়া কেমন করিয়া এরূপ কথা কহিলেন। লাস পুঁতিয়া ফেলিবার সম্বন্ধে আমাদের হাত কি থাকিতে পারে? তখন কেনারাম দাদাকে কোদালের আবশ্যকতা বুঝাইবার জন্য কহিলাম, “দেখ, কেনারাম-দা, পিছনের মাঠে যে দুই রকমের পায়ের দাগ দেখিয়া আসিয়াছি, সেই পায়ের দাগ রক্ষা করিবার উদ্দেশ্যে মাটী শুদ্ধ কাটিয়া লওয়াই আমার ইচ্ছা। সেই জন্যই কোদাল চাহিয়াছি, কারণ, এর পর সে পায়ের দাগ নষ্ট হইয়া যাইবে।” 

তখন আমার কথা কেনারাম দাদা বুঝিতে পারিয়া আমার বুদ্ধির অনেক প্রশংসা করিলেন। আমি তখন আরো একটু উৎসাহিত হইয়া কহিলাম, “আচ্ছা, কেনারাম-দা, আমার মনে হয়, যেমন সকল খুনের মধ্যে কোন না কোন রকমে মেয়েমানুষের সংস্রব থাকে, এ খুনের মধ্যেও তাই আছে। তবে বেশীর ভাগ আসামীকে এখানে ছদ্মবেশী পুরুষ বলিয়া আমার মনে হয়।” 

কেনা। খুনের মধ্যে মেয়েমানুষের সংস্রব থাকিতে পারে, কিন্তু খুনের মধ্যে আসামী যে একজন ছদ্মবেশী লোক একথা কিরূপে বুঝিলে? 

আমি। আসামী সাধারণ লোক হইলে সে অনায়াসে আমাদের এ বাড়ীতে প্রবেশের পূর্ব্বেই লম্বা দিতে পারিত। একজন শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত লোক না হইলে একজন স্ত্রীলোকের মানসম্ভ্রম রক্ষার জন্য আপনার জীবনকে বিপদাপন্ন করিবে কেন? আর সে স্ত্রীলোককেও সম্ভ্রান্তবংশীয়া বলিয়া আমার মনে হয়। 

কেনা। তোমার মাথাটা খারাপ হইয়া গিয়াছে ভাই— তাই এই সকল প্রলাপ বকিতেছ। তোমার কল্পনাশক্তির আমি প্রশংসা করিতে পারি— কিন্তু আর অন্যের কাছে এ সকল কথা মুখে আনিও না। 

কেনারাম দাদার এই মৃদু ভর্ৎসনায় আমার সে উৎসাহ কোথায় উড়িয়া গেল। আমি মনে মনে ক্ষুণ্ণ হইয়া সেই ঘরের মধ্যে ইতস্ততঃ বেড়াইতেছি এমন সময় ঘরের মেজের এক কোণে একটা কি চক্ চক্ করিতেছে দেখিতে পাইলাম। তাড়াতাড়ি গিয়া তুলিয়া দেখিলাম, সেটা একটা বহুমূল্যের হীরাচুনি পান্না বসান ইয়ারিং! সেই ইয়ারিং পাইয়া আমার আনন্দের আর সীমা রহিল না; আমার অনুমান যে সত্য— সে সম্বন্ধে আমার মনে আর কোন সন্দেহ রহিল না। আমি কেনারাম দাদাকে সেই ইয়ারিং দেখাইয়া কহিলাম, “কেনারাম দা, আমার কথা যে কল্পনা নয়, এই ইয়ারিং তাহার যথেষ্ট প্রমাণ। এই ইয়ারিং স্পষ্ট বলিতেছে— এখানে একজন স্ত্রীলোক ছিল— এই ইয়ারিং দেখিয়াই আমি বুঝিতেছি- সে স্ত্রীলোক সম্ভ্রান্ত বংশীয়া— এখন আমার মনে আর কোন সন্দেহ নাই।” 

আমি উপরোক্ত কথা বলিতেছি — এমন সময় একখানি গাড়ী আসিয়া সদর দরজায় থামিল। কে আসিলেন – বুঝিলাম। নীচে নামিয়া দরজা খুলিয়া দেখিলাম, পুলিসের বড় সাহেব! 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

আমরা দুইজনে পুলিসের কায়দাদুরস্ত লম্বা সেলাম করিলাম। বড় সাহেবের সঙ্গে সঙ্গে ইনস্পেক্টার সাহেব এবং পুলিস-সার্জ্জন সাহেবও গাড়ী হইতে নামিলেন। গাড়ীর ছাদের উপর দুইজন পাহারাওয়ালা ছিল, তাহারাও নামিল। আমরা বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিলাম। যে স্থলে যে অবস্থায় আমরা আসামীকে প্রথমে দেখিতে পাইয়াছিলাম, ইন্সপেক্টার সাহেব সেই স্থান দেখাইয়া সমস্ত বর্ণনা করিলেন। এক্ষেত্রে আমার বিশেষ প্রশংসাও সাহেব করিলেন। আমি পশ্চাৎদিক হইতে সেরূপভাবে আসামীকে কায়দা করিয়া না ধরিলে, নিশ্চয়ই সেই স্থলে আরো দুই তিনটা খুন হইত, কারণ আসামীর পিস্তলের আরো দুইটা নল যে গুলিভরা ছিল, সে পিস্তল পরীক্ষা করিয়া ইন্সপেক্টার সাহেব তাহা জানিতে পারিয়াছেন। বড় সাহেব কোন কথা কহিলেন না, কেবল একটিবার আমার দিকে কট্‌ট্ করিয়া চাহিয়া দেখিলেন। 

তার পর আমরা সকলে উপরে উঠিলাম। যে ঘরে লাস ছিল, প্রথমে সেই ঘরেই সকলে উপস্থিত হইলাম। পুলিস সার্জ্জন ক্ষতস্থান পরীক্ষা করিয়া কহিলেন, “রাইট ভেণ্টিকেলের মধ্যে গুলি প্রবেশ করিয়াছে, সেই কারণ আঘাতের দুই তিন মিনিটের মধ্যেই মৃত্যু হইয়াছে।” বড় সাহেব কহিলেন,—“আসামী যে বলে, এ ব্যক্তি আত্মহত্যা করিয়াছে— সে সম্বন্ধে আপনার মত কি? আহত ব্যক্তি যেরূপভাবে চিৎ হইয়া পড়িয়া আছে— আত্মহত্যাতে কি এরূপ হয়— সেই বিষয় পরীক্ষা করিবার জন্যই আপনাকে এই ভোরের সময় কষ্ট দিলাম।” 

পুলিস সার্জ্জন কহিলেন, “এ আত্মহত্যা নহে। হত ব্যক্তি যেভাবে পড়িয়া আছে, আমি কেবল তাহা দেখিয়া এ কথা বলিতেছি না। গুলির দ্বারা আত্মহত্যার অন্য পরীক্ষাও আছে। গুলি দ্বারা আত্মহত্যা করিবার সময় মানুষ পোষাক পরিয়া আত্মহত্যা করে না। আর আমাদের প্রধান পরীক্ষা এই -পিস্তল স্বহস্তে লইয়া আত্মহত্যা করিলে ক্ষতস্থানের উপর বারুদের কাল দাগ নিশ্চয়ই থাকিত। যেরূপ সাদা পোষাক পরা, তাহাতে কাল দাগ নিশ্চয়ই পড়িবে।” 

পুলিস-সার্জ্জনের কার্য্য শেষ হইয়া গেলে পর, তিনি বিদায় গ্রহণ করিলেন। তখন বড় সাহেব আমার মুখের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “তুমি এখানে কিরূপে আসিলে?” 

সে প্রশ্নের আমার আর কোন উত্তর দিতে হইল না। ইনস্পেক্টার সাহেবই উত্তর দিলেন,– “হঠাৎ রাস্তায় আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, আর তার পর বরাবরই সঙ্গে ছিলেন, সে সকল কথা ত আমি আপনাকে জানাইয়াছি।” 

বড় সাহেব সে কথা শুনিয়া এইবার আমায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ খুন সম্বন্ধে তোমার কোন কথা বলিবার আছে?” 

আমি বিনীতভাবে উত্তর করিলাম, “কি সম্বন্ধে আজ্ঞা করুন।” 

বড় সাহেব। এটা খুন না আত্মহত্যা? 

আমি। আজ্ঞে, এটা যে খুন— সে সম্বন্ধে আর কোন সন্দেহ নাই। আমি অনুসন্ধানে আরো কিছু জানিতে পারিয়াছি, অনুমতি হইলে নিবেদন করি। 

বড় সাহেব। কি জানিতে পারিয়াছ বল? 

আমি। খুনের সময় এখানে আর একজন সম্ভ্রান্ত স্ত্রীলোক ছিলেন, আমাদের আসিবার পূর্ব্বেই তিনি পলায়ন করিয়াছেন। 

বড় সাহেব। কিরূপে জানিলে? 

আমি। খিড়কীর দরজার দিকে যে মাঠ আছে, সেই মাঠের উপর পায়ের চিহ্ন দেখিয়া আমার মনে প্রথমে সন্দেহ হয়। রাত্রে বিলক্ষণ বৃষ্টি হইয়াছিল, সেইজন্য মাঠের উপর বেশ স্পষ্ট পায়ের চিহ্ন দেখিতে পাইলাম। আর সেই পায়ের চিহ্ন দেখিয়া স্ত্রীলোকের পায়ের দাগ বলিয়া আমার বড়ই সন্দেহ হইল। তার পর এই ঘরের মধ্যে এই ইয়ারিং যখন কুড়াইয়া পাইলাম, তখন আর আমার সন্দেহ রহিল না। নিশ্চয়ই এ বাড়ীতে একজন স্ত্রীলোক ছিল, সে পলাইয়া গিয়াছে। 

এই কথা কয়েকটি বলিয়া আমি সেই ইয়ারিং সাহেবের হস্তে দিলাম। সাহেব একবার মাত্র ইয়ারিং-এর প্রতি দৃষ্টি করিয়া আমায় কহিলেন, “সে স্ত্রীলোক যে সম্ভ্রান্ত — সে কথা কিরূপে বুঝিলে?” 

আমি। সম্ভ্রান্ত না হইলে, এরূপ বহুমূল্য ইয়ারিং কোথায় পাইবে? 

বড় সাহেব। অনুসন্ধানে আর কোন কথা জানিতে পারিয়াছ কি? 

আমি। আর একজন ঐ মাঠের অর্দ্ধপথ পৰ্য্যন্ত আসিয়া সেই স্ত্রীলোককে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছে।

বড় সাহেব। এ কথা কিরূপে জানিলে? 

আমি। সেও ঐ মাঠে পায়ের দাগ দেখিয়া জানিতে পারিয়াছি। 

বড় সাহেব। সে লোক স্ত্রীলোক না পুরুষ? 

আমি। পুরুষ। 

বড় সাহেব। কিরূপে জানিলে? 

আমি। পায়ে জুতা ছিল— সুতরাং পুরুষ। 

বড় সাহেব। তাহারা কোথায় গেল সে সম্বন্ধে কোন অনুসন্ধান করিয়াছ কি? 

আমি। তাহারা মাঠ পার হইয়া বস্তীর গলির রাস্তা দিয়া বড় রাস্তায় গিয়াছে। বড় রাস্তা হইতে গাড়ী করিয়া কোথায় গিয়াছে; তাহা আর ধরিতে পারা গেল না। 

বড় সাহেব। আর কিছু জান? 

আমি। আসামীও একজন ছদ্মবেশী সম্ভ্রান্ত লোক। 

বড় সাহেব। কিরূপে জানিলে? 

আমি। আসামী সেই স্ত্রীলোকের সম্ভ্রম বাঁচাইবার জন্য নিজে ধরা দিয়াছে; মনে করিলে আমাদের আসিবার পূর্ব্বে সে অনায়াসে পলাইতে পারিত। যে একজন স্ত্রীলোকের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য নিজের জীবনকে বিপন্ন করিতে পারে, তাহাকে সাধারণ খুনী আসামী বলিয়া মনে কেমন বিশ্বাস হয় না। আর ধরা পড়িবামাত্র সে চীৎকার করিয়া- “পুলিশ হামকো পাকড়া হ্যায়”- এ কথা বলিবে কেন? নিশ্চয়ই অন্যকে সতর্ক করিবার জন্যই সে এইরূপ ভাবে চীৎকার করিয়া সে কথা বলিয়াছিল। “আমায় পুলিসে ধরিয়াছে”- এ কথা বলিবার নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য ছিল, আমার ত এইরূপ মনে হয়। খুনের রহস্য উদ্ঘাটন করিতে গেলে সচরাচর যেমন মূলে স্ত্রীলোক প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায়, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই খুনের মূলেও সেইরূপ স্ত্রীলোক আছে। আর এই যে আসামী, এ একজন সাধারণ খুনী আসামী নয়- ছদ্মবেশী কোন অসাধারণ লোক।” 

আমার কথা শেষ হইলে বড় সাহেব একবার ইনস্পেক্টার সাহেবের মুখের দিকে চাহিলেন। ইনস্পেক্টার সাহেব সে চাহনির অর্থ বুঝিতে পারিয়া কহিলেন, “বাবুর মাথা, বোধ হয়, হঠাৎ খারাপ হইয়া গিয়াছে। তা না হইলে এরূপ প্রলাপ বাক্য কখনই শুনিতে পাইতাম না। আমি ত এর ভিতর কোন অসাধারণ ব্যাপার দেখিতে পাই না। আসামীর আকার-প্রকার দেখিয়া আমার ত মনে সে রকম কোন সন্দেহ হয় না।” 

সাহেব সে উত্তরের স্বপক্ষে বা বিপক্ষে কোন কথাই কহিলেন না। এই সময় কেবলমাত্র আমায় কহিলেন, “চল- সেই মাঠে গিয়া একবার দেখিয়া আসি।” 

আমি বড় সাহেবকে সঙ্গে লইয়া নীচে নামিলাম। আমাদের সঙ্গে ইনস্পেক্টার সাহেবও আসিলেন। খিড়কীর দরজা হইতে মাঠের উপর যে পায়ের দাগ আরম্ভ হইয়াছিল আমি বড় সাহেবকে তাহা দেখাইলাম। আর সে পায়ের দাগ যে স্ত্রীলোকের সে কথাও কহিলাম। সাহেব একবার ভাল করিয়া সে পায়ের দাগ দেখিলেন, কিন্তু কোন মতামত প্রকাশ করিলেন না। তারপর আমি সেই পায়ের দাগ ধরিয়া বরাবব গিয়া যে স্থলে অপর পায়ের দাগ আরম্ভ হইয়াছে, তাহাও সাহেবকে দেখাইলাম। আর সে পায়ের দাগ যে পুরুষের, সে কথাও কহিলাম। তারপর মাঠ পার হইয়া বস্তীর গলি দিয়া বড় রাস্তা পর্য্যন্ত সাহেবদ্বয়কে সঙ্গে করিয়া লইয়া গেলাম। সে রাস্তায় যে গাড়ীর চাকার দাগ ছিল, তাহাও বড় সাহেবকে দেখাইলাম। এই সময় বড় সাহেব কহিলেন, “পলাতকেরা যে গাড়ী করিয়া গিয়াছে, এ কথা কিরূপে স্থির করিলে বল? মাত্র গাড়ীর চাকার দাগ দেখিয়া সে কথা কিরূপে বিশ্বাস করা যাইতে পারে?” 

আমি তখন উত্তর করিলাম, “এই দেখুন, গাড়ীখানা দক্ষিণ দিক হইতে উত্তর দিকে আসিতেছিল, হঠাৎ এই গলির মোড়ে আসিয়াই মোড় ঘুরিয়া পুনরায় দক্ষিণ দিকে চলিয়া গিয়াছে। অবশ্য এ আমার অনুমান মাত্র। তবে এরূপ অনুমান করিবার কারণ এই যে, এরূপ বস্তীতে কেহ গাড়ী করিয়া আসা সম্ভব নয়। আর রাত্রে জল-ঝড়ের পরে এ গাড়ী এখান হইতে না যাইলে, রাস্তায় এরূপ ঢাকার দাগ হওয়া কখনই সম্ভব হইতে পারে না। আর একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি যখন সঙ্গে ছিল, তখন তাহাদের এরূপ প্রকাশ্য রাস্তায় হাঁটিয়া যাওয়া অপেক্ষা গাড়ী করিয়া যাওয়াই সম্ভব।” 

সাহেব আমার এ উত্তরেরও স্বপক্ষে বা বিপক্ষে কোন কথা কহিলেন না; কিন্তু এই সময় ইনস্পেক্টার সাহেব কহিলেন, “বাবুর কল্পনাশক্তির প্রশংসা করা যাইতে পারে।” 

যেরূপ বিদ্রূপস্বরে একথা বলা হইল, তাহাতে আমি বড়ই অপ্রস্তুত হইলাম। তবে আমার বিশ্বাসমতে আমি এই সকল কথা বলিয়াছি, এই কারণ, আমার মনে কোন কষ্ট হইল না। সাহেবকে এই সকল কথা বলা আমার কর্তব্য মনে করিয়া সেই কর্তব্যকর্ম্মের অনুরোধেই বলিয়া ফেলিয়াছি। বড় সাহেব অনেকক্ষণ কি চিন্তা করিলেন। তারপর আমায় কহিলেন, “তুমি এ খুনের তদন্ত করিবার ভার লইতে পার?” 

আমি। আপনার অনুমতি হইলে আমি প্রস্তুত আছি। 

বড় সাহেব। আমি এ কার্য্যের ভার তোমার উপরই অর্পণ করিলাম। কিন্তু দেখিও, খুব সাবধান— তোমার ভবিষ্যৎ জীবনের আশাভরসা সমস্তই এই কার্য্যের সফলতার উপর নির্ভর করিতেছে। আসামী ধৃত হইয়াছে বটে, কিন্তু তাহার বিপক্ষে কোন প্রমাণ নাই— আর সে নিজের পরিচয় পর্য্যন্ত দিতেছে না, সুতরাং তোমার কাজ বড় গুরুতর। 

আমি বিনীতভাবে কহিলাম, “মানুষের যাহা সাধ্য সে পক্ষে এ অধীনের কোন ত্রুটী হইবে না, আপনি সে বিষয়ে নিশ্চিত্ত থাকিতে পারেন।” 

বড় সাহেব। তুমি প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় আমার সহিত একবার করিয়া সাক্ষাৎ করিবে, দৈনিক রিপোর্ট অপেক্ষা তোমার বাচনিক প্রত্যেক দিনের ঘটনা আমি শুনিতে ইচ্ছা করি। 

আমি। হুজুরের হুকুম অনুযায়ী আমি প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় হুজুরের সহিত সাক্ষাৎ করিব। 

বড় সাহেব। এ কার্য্যে তোমার সাহায্যকারী আর কাহাকে চাও, আমায় বল? 

“আপাততঃ এই কেনারাম জমাদারকে পাইলে যথেষ্ট হইবে, তবে ডিটেকটিভ বিভাগের অন্য কাহাকেও আবশ্যক হইলে আমি হুজুরকে জানাইব।” 

এই কথা বলিয়া আমি আমার কেনারাম দাদাকে দেখাইয়া দিলাম। আমার এই প্রার্থনায় বড় সাহেব যেন কিছু বিস্মিত হইয়া একবার আমার মুখের দিকে চাহিলেন, তার পর কহিলেন, ‘আচ্ছা, তোমার যেরূপ অভিপ্রায় তাহাই হউক।” 

এই কথা বলিয়া ইনস্পেক্টার সাহেবের উপর লাস চালান দিবার ভার দিয়া বড় সাহেব চলিয়া গেলেন। বড় সাহেব চলিয়া গেলে পর, ইনস্পেক্টার সাহেব আমায় কহিলেন, “বাবু, আপনার মস্তিষ্ক খারাপ হইয়া গিয়াছে। এ খুনী মোকদ্দমার তদারক অপেক্ষা এখনই নিজের চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন, নহিলে শীঘ্রই গোল বাড়ীতে গিয়া বাসের ব্যবস্থা করিতে হইবে।” 

সাহেবের এই অযাচিত উপদেশের দরুণ তাঁহাকে আন্তরিক ধন্যবাদ দিয়া আমি কেনারাম দাদাকে সঙ্গে লইয়া থানায় আসিলাম। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

সমস্ত রাত্রি নিদ্রা নাই, তার উপর ইনস্পেক্টর সাহেব আমার মস্তিষ্ক খারাপের বড়ই একটা ভয় দেখাইয়াছিলেন, সেই কারণ থানায় আসিয়া প্রথমেই স্নান করিলাম। তার পর সামান্য একটু জলযোগের পর আমি কেনারাম দাদাকে সঙ্গে লইয়া থানা হইতে বাহির হইলাম। চিৎপুর রোডের যে বাড়ীতে খুন হইয়াছিল, প্রথমে সেই বাড়ীতে আসিলাম। অনুসন্ধানে জানিলাম— সে বাড়ীখানির মালিক— চোরবাগানের দত্তবাবুরা। এ বাড়ী কে ভাড়া লইয়াছিল, এ কথা প্রতিবাসীরা কিছুই বলিতে পারিল না, তবে এই মাত্র জানিতে পারিলাম বাড়ীখানা এতদিন খালি পড়িয়াছিল, সবে ৪।৫ দিন মাত্র ভাড়াটিয়া আসিয়াছে। গতরাত্রে ভাল করিয়া দেখা হয় নাই— প্রথমেই বাড়ীখানার নীচে উপর তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিলাম, কোন রূপ চিঠিপত্র পাওয়া যায় কি না তাহাও ভাল করিয়া দেখিলাম। আসামী বা হতব্যক্তির পরিচয় বাহির করা সম্বন্ধে সে বাড়ীর মধ্যে যাহা যাহা করা আবশ্যক, তাহা সমস্তই করিলাম, কিন্তু সে বিষয়ের কিছু অনুসন্ধান করিতে পারিলাম না। তখন কেনারাম দাদাকে সঙ্গে লইয়া চোরবাগানে দত্ত বাবুদিগের বাড়ীর উদ্দেশে বাহির হইলাম। 

পথে কেনারাম দাদা আমায় কহিল, “ভায়া হে, তোমার ডিটেকটিভ বিভাগের এত লোক থাকিতে আমার উপর এ অনুগ্রহ কেন?” 

আমি উত্তর করিলাম, —“কাজটা কি মন্দ করিয়াছি দাদা? চিরকালই কি জমাদারীতে কাটাইবে? নিজের উন্নতির কোন চেষ্টাও করিবে না? যদি আমরা এ খুনের কোন কিনারা করিতে পারি, তবে তোমার এ মৌরসী পাট্টার জমাদারী আগে ঘুচাইব।” 

কেনারাম দাদা তখন কহিলেন,—“আমি ত ভাই, তোমার কথা কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। খুন হইয়াছে ত একপ্রকার আমাদেরই চক্ষের সামনে। খুন হইয়াছে যে বন্দুকের গুলিতে—সেই বন্দুক হস্তে আসামীকে আমরা ধরিয়াছি, সুতরাং এইখানেইত কাজের খতম – এ খুনের কিনারা করিতে পারিলে উন্নতি হইবে বলিতেছ, কিন্তু এ খুনের কিনারা আবার কিরূপে করিতে হইবে, আমি ত ভাই, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।” 

আমি কহিলাম,—“কেন, বড় সাহেবের কথা কি ভুলিয়া গেলে দাদা? বড় সাহেব তোমারই সম্মুখে আমায় বলিলেন, এ কাজ বড় গুরুতর। আসামী ধৃত হইয়াছে বটে, তাহার বিপক্ষে প্রমাণ কি? আর সেই যে আসামী, তাই বা এখন কেমন করে বলা যাইতে পারে? তাহাকেই সন্দেহ হয় বটে, কিন্তু তাহার বিপক্ষে এখন অনেক প্রমাণ সংগ্রহ করিতে হইবে। প্রথমতঃ খুনের উদ্দেশ্য কি সেটা পর্যন্ত আমরা এখনও জানিতে পারি নাই।” 

কেনারাম দাদা কহিলেন, “বড় সাহেব ত তোমার মতেই মত দিলেন দেখিতেছি। মুখে বলুন আর নাই বলুন, যখন তোমার উপরই এ খুনের তদন্তের ভার দিয়াছেন, তখন তোমার মতে মত দেওয়া হইয়াছে। এই কারণ, আমাদের ইনস্পেক্টার সাহেবের তোমার উপর রাগ দেখিতে পাওয়া যায়। বড় সাহেবের সম্মুখে কিছু বলিতে পারিল না, কিন্তু মনে মনে বড়ই চটিয়া গিয়াছে। ইনস্পেক্টর সাহেবের বিশ্বাস, তুমিই একটা তিলকে তাল পাকাইতেছ। কোথা থেকে সম্ভ্রান্ত স্ত্রীলোক, আর আসামী একজন ছদ্মবেশী বড় লোক, ইহার ভিতর আনিয়া একটা গোল পাকাইতেছ।” 

এইরূপ কথা কহিতে কহিতে আমরা চোরবাগানের দত্তবাবুদের বাড়ী আসিয়া পৌঁছিলাম। প্রথমে কর্তাবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হইল। কিন্তু আমরা যে সংবাদের জন্য তাঁহার নিকট গিয়াছিলাম, তিনি সে সম্বন্ধে কিছুই বলিতে পারিলেন না। তবে তিনি একটা ভরসা দিলেন যে, তাঁহার সরকার মহাশয় সে সকল সংবাদ দিতে পারিবেন। তখন সরকার মহাশয় সেখানে ছিলেন না, তবে তাঁহার বাসা নিকটেই ছিল, আমাদের অনুরোধে তাঁহাকে বাসা হইতে ডাকিয়া আনিতে লোক পাঠান হইল। প্রায় অর্দ্ধঘণ্টা পরে সরকার মহাশয় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহার সহিত আমার নিম্নলিখিতরূপ কথাবার্তা হইল। 

আমি। আপনাদের— নং চিৎপুর রোডের বাড়িখানা ভাড়া হইয়াছে কোন্ তারিখ হইতে? 

সরকার। আজ ছয় দিন হইল। গত বুধবার হইতে। 

আমি। কোন এগ্রিমেন্ট হইয়াছে কি? 

সরকার। না মহাশয়, কোন এগ্রিমেন্ট হয় নাই। 

আমি। কে ভাড়া লইয়াছে? 

সরকার। একজন মুসলমান। 

আমি। তার নাম কি? 

সরকার। নামটা আমি জানি না। 

আমি। বাড়ী কাকে ভাড়া দিলেন, তার নাম পর্যন্ত জানেন না— কি রকম? 

সরকার। আপাততঃ এক মাসের ভাড়া অগ্রিম দিয়া ভাড়া লইয়াছিল, পরে এগ্রিমেন্ট হইবে— এরূপ কথা ছিল।

আমি। সে অগ্রিম টাকার রসিদ দেওয়া হয় নাই? 

সরকার। আজ্ঞে না— এগ্রিমেন্ট হইলে পর, তবে রসিদ দেওয়া হইত। 

আমি। এগ্রিমেন্টের কাগজ কেনাও হয় নাই? 

সরকার। আজ্ঞে না। 

আমি। আচ্ছা, যে লোক ভাড়া লইয়াছিল, তাহাকে দেখিলে চিনিতে পার?

সরকার। পারি। 

আমি। চেহারা কিরূপ? 

সরকার। লোকটা লম্বা— বেশী মোটাও নয়, আর খুব রোগাও নয়। রং শ্যামবর্ণ— বয়স আন্দাজ ৫০ বৎসর হইবে। 

আমি। দাড়ী আছে? 

সরকার। দাড়ী আছে— লম্বা দাড়ী নয় — ঝাঁটা দাড়ী আর দাড়ীতে কাঁচা পাকা চুল। 

সরকারের এই সকল কথা শুনিয়া আমি বড় আশায় নৈরাশ হইলাম। সরকার সে লোকের যে চেহারার পরিচয় দিল, ধৃত আসামী বা হত ব্যক্তির চেহারার সহিত তাহার কিছুই মিলিল না। তখন এ বাড়ীওয়ালার নিকট অনুসন্ধানে কোন ফল হইল না, বুঝিয়া আমি সেখান হইতে বিদায় লওয়াই শ্রেয়ঃ মনে করিলাম। তথাপি যাইবার সময় সেই সরকারকে কেনারাম দাদার সহিত একবার থানায় পাঠাইয়া দিলাম। ধৃত আসামী ও লাস দেখিয়া চিনিতে পারে কি না- ইহাই পরীক্ষা করা আমার উদ্দেশ্য ছিল। 

তার পর সে অঞ্চলের নিকট যে সকল গাড়ীর আড্ডা ছিল, আমি সেই সকল আড্ডা অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। গত রাত্রের দুর্যোগের পর, রাত্রি আন্দাজ সাড়ে বারটার সময় কোন্ গাড়োয়ান সেই বস্তির গলির মধ্য হইতে ভাড়া লইয়া গিয়াছে, সন্ধান করিয়া বাহির করাই আমার উদ্দেশ্য। অনেক চেষ্টার পর আমি মুক্তারামবাবুর ষ্ট্রীটের মোড়ে, যে ভাড়াটিয়া গাড়ীর আড্ডা আছে, সেই আড্ডার একজন কোচম্যানের নিকট যে সন্ধান পাইলাম, তাহাতে মনে কতকটা আশা জন্মিল। সে কহিল — “আবদুল কাল অধিক রাত্রে ঐখান হইতে একটা ভাড়া লইয়া খিদিরপুর গিয়াছিল।” 

আমি কহিলাম, “তুমি কিরূপে সে কথা জানিলে?” 

সে কহিল, “একবারে ৫ পাঁচ টাকা ভাড়া পায় বলিয়া আমার নিকট সে আজ সকালে গল্প করিয়াছিল।”

আমি তখন সেই আবদুলের সহিত দেখা করিতে চাহিলাম। কিন্তু আবদুল তখন আস্তাবলে ছিল না, ভাড়া খাটিতে কোথায় চলিয়া গিয়াছে। কখন ফিরিয়া আসিবে— তাহাও কেহ বলিতে পারিল না, তবে দুই প্রহরের সময় আসা সম্ভব, এই কথা শুনিলাম। কাজেই আমি তখন থানার ফিরিয়া গেলাম। সেইখানে কেনারাম দাদার সহিত আমার সাক্ষাৎ হইল। তাঁহারই মুখে শুনিলাম, “আমি যাহা অনুমান করিয়াছিলাম, তাহাই ঠিক। ধৃত আসামী বা হতব্যক্তির মধ্যে কেহ সে বাড়ী লয় নাই। আহারাদির পর আমি পুনরায় সেই মুক্তরাম বাবুর ষ্ট্রীটের সেই আস্তাবলে গিয়া উপস্থিত হইলাম। কেনারাম দাদাও আমার সঙ্গে ছিলেন। আস্তাবলে গিয়া শুনিলাম, আবদুল তখনও ভাড়া খাটিয়া ফিরিয়া আইসে নাই। আমি সেখানে তাহার জন্য অপেক্ষা করিব কি না— এই কথা মনে মনে চিন্তা করিতেছি, এমন সময় দেখি, একখানি গাড়ী আসিয়া আস্তাবলের সম্মুখে থামিল। তখন একজন সহিসের মুখে জানিলাম, সেই গাড়ীর গাড়োয়ানের নামই আবদুল। আমি তখন যেন স্বর্গ হাতে পাইলাম। আবদুল কোচবাস্ক হইতে নামিল, গাড়ীর ঘোড়া খুলিয়া দিল, গাড়ী রাস্তার উপরই রহিল, কিন্তু ঘোড়া দুইটাকে সহিসের হস্তে প্রদান করিল। আমি ততক্ষণ রাস্তায় দাঁড়াইয়া তাহার অপেক্ষায় রহিলাম। এই সকল কাৰ্য্য শেষ করিয়া সে একটু সুস্থ হইলে, আমি তাহার নিকটে গেলাম; এবং ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করিলাম, “হাঁ হে, তুমি কাল রাত্রে দুর্যোগের পর খিদিরপুরে ভাড়া লইয়া গিয়াছিলে?” 

আবদুল আমার প্রশ্ন শুনিয়া কিছুক্ষণ অবাক্ হইয়া আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, তাহার পর উত্তর করিল, “আমি ত কালরাত্রে খিদিরপুরে কোন ভাড়া লইয়া যাই নাই!” 

আমি। অস্বীকার কর কেন? তুমি যে ৫ পাঁচ টাকা ভাড়া পাইয়াছ, তাহা ত আর আমি কাড়িয়া লইব না।

আবদুল। হাঁ-হাঁ, মনে পড়িয়াছে; – আমি কাল অধিক রাত্রে খিদিরপুরে একটা ভাড়া লইয়া গিয়াছিলাম বটে।

আমি তখন পকেট হইতে দুইটি টাকা বাহির করিয়া আবদুলের হস্তে গুঁজিয়া দিয়া কহিলাম, “দেখ, এখন তোমায় দুই টাকা দিতেছি, আর তুমি যে বাড়ীতে সেই সওয়ারীদের রাখিয়া আসিয়াছ, সেই বাড়ী দেখাইয়া দিলে, তোমায় আর ৩ তিন টাকা দিব।” 

আবদুল টাকার মোহিনীশক্তিতে বশীভূত হইয়া, আমার নিকট হইতে সেই দুই টাকা গ্রহণ করিল। তখন আমি তাহাকে একে একে নিম্নলিখিত প্রশ্ন করিতে লাগিলাম। 

আমি। সওয়ারী কয়জন ছিল? 

আব। দুইজন; একজন পুরুষ আর একজন স্ত্রীলোক। 

আমি। তুমি নিজেই সেই বস্তির গলির মধ্যে গাড়ী লইয়া গিয়াছিলে, না অন্য স্থান হইতে কেহ তোমায় ঐ স্থানে ডাকিয়া আনে? 

আব। সেই পুরুষ আমার মেছুয়াবাজার ষ্ট্রীট হইতে ভাড়া করিয়া সেই বস্তির গলির মধ্যে লইয়া যায়। 

আমি। সে পুরুষ হিন্দু না মুসলমান— তুমি সে কথা বলিতে পার কি? 

আব। পারি, — লোকটা মুসলমান। 

আমি। আচ্ছা, তাহার চেহারা কি রকম? 

আব। তাহার চেহারাখানা মাফিক সই, রংটা খুব ফরসা নয়, বরং একটু ময়লা হইবে। 

আমি। আচ্ছা, তার দেহখানা লম্বা না বেঁটে? 

আব। বেঁটে নয়— বরং লম্বা হইবে। 

আমি। আচ্ছা, মুসলমান বলিয়া কি করিয়া জানিতে পারিলে? 

আব। কেন, আমার সহিত বেশ উর্দুতে কথা কহিল, আর আমিও নিজে একজন মুসলমান, আর মুসলমান দেখিলে চিনিতে পারিব না? 

আমি। সে লোকটার দাড়ি ছিল কি না? 

আব। হাঁ, দাড়ি ছিল— তবে লম্বা নয়–ঝাঁটা ঝাঁটা দাড়ি। 

আমি। সে দাড়িতে কি কাঁচা-পাকা চুল ছিল? 

আব। আমি রাত্রে তাহাকে দেখিয়াছি, সুতরাং সে কথা বলিতে পারি না। 

আমি। আচ্ছা, তার বয়স কত আন্দাজ কর? 

আব। বয়স–আন্দাজ ৫০ বৎসরেরই কাছাকাছি হইবে। 

আমি দেখিলাম, – দত্তবাবুদের সরকার যে চেহারা বর্ণনা করিয়াছিল, সেই চেহারার সহিত এই চেহারা প্রায় সমস্তই মিলিয়া গেল। তবে যে ব্যক্তি বাড়ী ভাড়া লইয়াছিল, সেই ব্যক্তিই সেই স্ত্রীলোককে উদ্ধার করিয়া লইয়া গিয়াছে। খুনের রহস্য ক্রমেই জমাট বাঁধিতে আরম্ভ করিল। আমি আগ্রহের সহিত জিজ্ঞাসা করিলাম, “তাহার সহিত যে স্ত্রীলোক ছিল, তাহার চেহারা কিরূপ, বলিতে পার কি?” 

আবদুল উত্তর করিল “ঠিক চেহারা বলিতে পারি না, কারণ তাহার আপাদমস্তক একখানা ঢাকাই চাদরের ঢাকা ছিল। তবে সে স্ত্রীলোক যে খুব সুন্দরী ও যুবতী— একথা আমি বলিতে পারি।” 

আমি। আচ্ছা, সে স্ত্রীলোককে কি কোন বড়ঘরের স্ত্রীলোক বলিয়া মনে হয় — গায়ে মূল্যবান গহনা ছিল কি না বলিতে পার? 

আব। অলঙ্কার নিশ্চয়ই ছিল, তবে মূল্যবান কি না বলিতে পারি না, কারণ আমি পূর্ব্বেই বলিয়াছি, সে স্ত্রীলোকের আপাদমস্তক চাদরে ঢাকা। 

আমি। তবে গায়ে গহনা ছিল কিরূপে বুঝিলে? 

আব। বৃষ্টির দরুণ গাড়ীর দরজা আঁট হইয়া গিয়াছিল, তাহারা দরজা বন্ধ করিতে পারে নাই। আমি দরজা বন্ধ করিতে গিয়া স্ত্রীলোকের গায়ের গহনার শব্দ পাইয়াছিলাম 

আমি। তুমি যখন মেছুয়াবাজার ষ্ট্রীট হইতে গাড়ী লইয়া সেই মাঠের ধারে যাও, তখন কি সেই স্ত্রীলোক সেখানে গাড়ীর অপেক্ষায় ছিল? 

আব। না— তখন সেখানে সে স্ত্রীলোক ছিল না, সেই লোকটা মাঠের দিক হইতে সেই স্ত্রীলোককে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিল। 

আবদুলের নিকট এই সকল সংবাদ পাইয়া আমার বড়ই আহ্লাদ হইল।তখন আর আমার কালবিলম্ব সহ্য হইল না। আমি আবদুলকে তৎক্ষণাৎ গাড়ী জুতিয়া আমায় খিদিরপুরে লইয়া যাইতে কহিলাম। সে এইমাত্র ঘোড়াকে খাটাইয়া আস্তাবলে আসিয়াছে— এখন নিজেও স্নানাহার করিবে, সুতরাং সে সময় যাইতে অস্বীকার করিল। আমি তখন তাহাকে আমার প্রতিশ্রুত আর তিনটি টাকা দিলাম। আমার নিকট সে টাকা পাইয়া আবদুল আর কোন আপত্তি করিল না। অন্য ঘোড়া জুতিয়া আমায় খিদিরপুরে লইয়া গেল। খিদিরপুরে লইয়া গিয়া সে আমায় একটা গেটওয়ালা বাড়ী দেখাইয়া দিল। গাড়ী হইতে নামিয়া দেখি, সে গেট চাবিবন্ধ। সে বাড়ীর মধ্যে কোন লোকজন নাই। অনুসন্ধানে জানিলাম, সে বাড়ী রামপুরের নবাবের। সে বাড়ীতে নবাব বাস করেন না— ভাড়া দেওয়া হয়। প্রায় সাহেব ভাড়াটিয়া সে বাড়ী ভাড়া লইয়া থাকে। আজ প্রায় দুই মাস হইল, সে বাড়ী খালি পড়িয়া রহিয়াছে— কোন ভাড়াটিয়া নাই। গত রাত্রে সে বাড়ীতে কেহ ছিল কি না— সে কথা কেহ বলিতে পারিল না। তবে একজন বুড়ো দরওয়ান সে বাড়ীর রক্ষণাবেক্ষণ করিত। প্রায় এক সপ্তাহ হইল, তাহার জ্বর হওয়ায় তাহাকে হাঁসপাতালে দেওয়া হইয়াছে। উহার স্থানে এ পর্যন্ত আর কোন নূতন লোক নিযুক্ত করা হয় নাই। আমি বড় আশায় নিরাশ হইলাম- এই সংবাদে আমার মাথায় যেন এক ভীষণ বজ্রাঘাত হইল! 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

ভগ্নহৃদয়ে ও বিষণ্নমনে থানায় ফিরিয়া আসিলাম। থানায় আসিয়া শুনিলাম, গত রাত্রে ভোরের সময় রাস্তায় একজন মাতালকে গ্রেপ্তার করা হইয়াছিল, কিন্তু পুলিসকোর্টে লইয়া যাইবার সময় কেহ তাহাকে দেখিতে পায় নাই। সে পলাতক হইয়াছে। যদিও আসামী বিশেষ কোন গুরুতর অপরাধী নয় বটে, কিন্তু থানার ভিতর হইতে পলায়ন করাতে একটা মহা হৈ চৈ পড়িয়া গিয়াছিল। তখন সে আসামীর চেহারা কিরূপ, এই কথা লইয়া অনেক তর্ক বিতর্ক হইতেছে শুনিলাম। সেই সকল তর্ক বিতর্কের কথা শুনিয়া আমার মনে কেমন একটা খটকা লাগিল। দুই চারি কথা প্রশ্ন করিয়া যাহা জানিতে পারিলাম, তাহাতে আক্কেল গুড়ুম হইয়া গেল! যে ব্যক্তি দত্তবাবুদের বাড়ী ভাড়া লইয়াছিল, আর যে গতরাত্রে সেই খুনের বাড়ী হইতে একজন স্ত্রীলোককে সঙ্গে লইয়া খিদিরপুরে পলাইয়া যায়, সেই পলাতক আসামীও সেই ব্যক্তি! তখন কে যেন আমার কানে কানে বলিয়া দিল— সে পলাতক আসামী বাস্তবিক মাতাল ছিল না, মাতালের ভাণ করিয়া থানার হাজতে আসিবার জন্য ধরা দিয়াছিল, তার পর নিজের কাজ উদ্ধার করিয়া চলিয়া গিয়াছে। সে মাতাল আসামীর সহিত খুনী আসামীর সাক্ষাৎ যে হয় নাই, সে কথা কেহ বলিতে পারিল না। আর যে পাহারাওয়ালা সেই মাতালকে থানায় ধরিয়া আনে, তাহাকে প্রশ্ন করিয়া জানিলাম যে, সে ব্যক্তির মুখে কোনরূপ মদের গন্ধ সে পায় নাই, তবে রাস্তায় বড়ই মাতলামী করিতে ছিল বলিয়া তাহাকে ধরিয়া আনা হয়। 

তখন আমার মনে আর কোন সন্দেহই রহিল না, আমি নিশ্চয় করিলাম — সেই পলাতক আসামী নিশ্চয়ই খুনী আসামীর লোক। সেই খুনী আসামীর জন্য মেছুয়াবাজার দত্তবাবুদের বাড়ী ভাড়া লইয়াছিল, সেই খুনী আসামীর স্ত্রীলোককে উদ্ধার করিয়া লইয়া গিয়াছে। সে স্ত্রীলোক যে গত রাত্রে নিরাপদ স্থলে পৌঁছিয়াছে, বোধ হয়, সেই সংবাদ খুনী আসামীকে দিবার জন্য মাতালের ভাণ করিয়া থানায় পৰ্য্যন্ত আসিয়াছিল। 

সে ব্যাটার কি সাহস! এই ঘটনায় এই খুনী আসামী যে একজন ছদ্মবেশী বড় লোক, সে কথা আমার মনে আরো দৃঢ় বিশ্বাস হইয়া গেল। তখন আমি থানার ইনস্পেক্টার সাহেবকে সেই সকল কথা কহিলাম। কিন্তু এই সকল প্রমাণ সত্ত্বেও তিনি আমার কথা হাসিয়া উড়াইয়া দিলেন এবং আমার উপর নানারূপ বিদ্রূপবাণ নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। সুতরাং সে সাহেবের নিকট আমি আর থৈ পাইলাম না। আমি সে স্থান হইতে সরিয়া পড়িলাম। 

তখন সন্ধ্যা হইবার আর অধিক বিলম্ব নাই। সুতরাং আমাদের ডিটেকটিভ পুলিস আফিসে আসিয়া সেই দিনকার রিপোর্ট লিখিতে বসিলাম। এক ঘণ্টার মধ্যে সে রিপোর্ট লেখা শেষ হইলে আমি সেই রিপোর্ট লইয়া বড় সাহেবের নিকট চলিলাম। কারণ প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় দৈনিক রিপোর্ট লইয়া বড় সাহেবের সহিত আমার সাক্ষাৎ করিবার হুকুম ছিল। 

আমি যখন বড় সাহেবের নিকট পৌঁছিলাম, তখন অপর কোন একজন পুলিস-কর্ম্মচারী তাঁহার কামরার মধ্যে ছিলেন, সুতরাং আমায় কিছুক্ষণ বাহিরে অপেক্ষা করিতে হইল। সে কর্মচারী বাহির হইয়া আসিলে আমি কামরার মধ্যে গিয়া সাহেবকে এক লম্বা সেলাম দিলাম। সাহেব যেন আমারই অপেক্ষায় ছিলেন, এইরূপ ভাব প্রকাশ করিয়া আমায় আগ্রহের সহিত কহিলেন-”তোমার সংবাদ কি?” 

আমি মুখে কোন কথা না বলিয়া আমার লিখিত রিপোর্টখানি সাহেবের সম্মুখে ধরিলাম। সাহেব বিশেষ মনোযোগের সহিত আমার রিপোর্ট পাঠ করিতে লাগিলেন। পাঠকালীন তাঁহার মুখের ভাব দেখিয়া বেশ বুঝিতে পারিলাম- তিনি আমার কার্য্যে বিশেষ সন্তুষ্ট হইয়াছেন। রিপোর্ট পাঠ শেষ হইলে তিনি আমার দিকে চাহিয়া কহিলেন, “তোমার অনুমানই যে ঠিক, সে বিষয়ে আমার আর কোন সন্দেহ নাই। এখন এই খুনের ভিতর যে একটা ভয়ঙ্কর রহস্য রহিয়াছে, একথা আমার মনেও দৃঢ়বিশ্বাস জন্মিয়াছে। তুমি সে রহস্য ভেদ করিতে পারিলে, আমি তোমার বিশেষরূপ পদোন্নতি করিয়া দিব। এরূপ রহস্যজনক খুন সচরাচর ঘটে না, সুতরাং তুমি কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিলে, নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করিতে পারিবে।” 

আমি বিনীতভাবে উত্তর করিলাম, “হুজুরের অধীনে এত বড় বড় উপযুক্ত কৰ্ম্মচারী থাকিতে, আমার উপর এই খুনের তদারকের ভার দিয়া হুজুর আমার প্রতি যথেষ্ট অনুগ্রহ প্রকাশ করিয়াছেন। এখন আমিও যে হুজুরের সে অনুগ্রহের অনুপযুক্ত নই, সে প্রমাণ প্রাণপণে দিতে চেষ্টা করিব।” 

সাহেব তখন হাসিতে হাসিতে কহিলেন, “এরূপ কার্য্যে দুই একবার অকৃতকার্য হইয়া নিরুৎসাহ হইতে নাই। যে নিরুৎসাহ হইল, তাহার দ্বারা কখন কোন কার্য্যের আশা করা যায় না। এবার কোন্ পথে অনুসন্ধান চালাইতে ইচ্ছা কর?” 

আমি বিনীতভাবে কহিলাম, “হুজুর যে পথে চালাইবেন, আমি সেই পথে চলিব।” 

বড় সাহেব কহিলেন, “তোমার কিরূপ মতলব জানিতে ইচ্ছা করি।” 

আমি তখন সাহস করিয়া বলিলাম, “যদি সে হীরার ইয়ারিংটা আমায় দেন, তবে আমি একবার তাহার মালিকের অনুসন্ধান করিতে পারি।” 

সাহেব। কিরূপে অনুসন্ধান করিবে? 

আমি। সেরূপ মূল্যবান ইয়ারিং নিশ্চয় কোন সাহেববাড়ীর বড় দোকানে প্রস্তুত হইয়াছে। আর যেখানে প্রস্তুত হইয়াছে, তাহারা নিশ্চয়ই ইহা দেখিলে চিনিতে পারিবে। কারণ এত বড় হীরা ও পান্না সাধারণ হীরা পান্না নহে। প্রস্তুতকারীকে জানিতে পারিলে, এরূপ বহুমূল্য ইয়ারিং যাঁহার জন্য প্রস্তুত হইয়াছিল, তাঁহাকে জানিতে আর অধিক বিলম্ব হইবে না। 

বড় সাহেব আমার প্রস্তাবে সন্তুষ্ট হইয়া আমায় সেই ইয়ারিং বাহির করিয়া দিলেন। তখন রাত্রি হইয়া গিয়াছিল, সুতরাং সে সময় সে অনুসন্ধান আর হইতে পারে না বলিয়া আমি আমার আড্ডায় ফিরিয়া আসিলাম। রাত্রে আর নিদ্রা হইল না, মনে মনে উচ্চ একটা প্রকাণ্ড অট্টালিকা বানাইতে লাগিলাম, আর কতক্ষণে রাত্রি প্রভাত হয়, সেই অপেক্ষায় রহিলাম। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পরদিন বেলা দশটার সময় আহারাদি করিয়া আমরা সেই ইয়ারিং লইয়া বাহির হইলাম। কলিকাতায় যে সকল ইংরাজ বণিকদিগের জুয়েলারী দোকান আছে, একে একে সেই সকল দোকানে সেই ইয়ারিং দেখাইতে লাগিলাম। আমার প্রথম প্রশ্ন ছিল— এই ইয়ারিং এই দোকানে প্রস্তুত হইয়াছে কি না? কিন্তু আমার সে প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর কোন দোকানেই পাইলাম না। শেষে আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন হইল— এইরূপ ইয়ারিং আর একটি প্রস্তুত করিতে কত ব্যয় হইবে? সে প্রশ্নের উত্তরে কেহ বলিল, আড়াই হাজার টাকা, কেহ বলিল, – দুই হাজার টাকা। দুই হাজারের কমে কেহ আর এইরূপ আর একটি ইয়ারিং প্রস্তুত করিয়া দিতে রাজী হইল না। তখন আমি বুঝিলাম, এই ইয়ারিং জোড়ার দাম চারি হাজার হইতে পাঁচ হাজার টাকা পর্য্যন্ত হইবে। এরূপ মূল্যবান ইয়ারিং নিশ্চয়ই কোন সম্ভ্রান্তবংশীয় স্ত্রীলোকের হইবে– এই কথা আমার মনে একবারে দৃঢ়বিশ্বাস জন্মিয়া গেল। কিন্তু সে বংশ যে কোন্ বংশ, তাহা জানিতে না পারিলে আর আমার উদ্দেশ্য সফল হইবে না। তখন বেলা তিনটা বাজিয়া গিয়াছে, কিন্তু তথাপি আমি নিরুৎসাহ হই নাই। আমার সঙ্গে কেনারাম দাদাও ছিলেন, তিনি ত আমার উপর চটিয়া লাল। তাঁহাকে সান্ত্বনা করাও আমার এক কাজের মধ্যে দাঁড়াইল। এদিকে তাঁহাকে ফিরিয়া যাইতে বলিলেও কেনারাম দাদা রাজী নহেন, আমি কেনারাম দাদাকে লইয়া তখন এক মুস্কিলে পড়িলাম। 

অবশেষে বেলা চারিটার সময় আমরা বম্পার্ড কোম্পানির দোকানে উপস্থিত হইলাম। দোকানের একজন সাহেব কৰ্ম্মচারী সেই ইয়ারিং দেখিয়াই কহিলেন, সে ইয়ারিং তাহারাই প্রস্তুত করিয়াছে। আমি যেন তখন একবারে স্বর্গ হাত বাড়াইয়া পাইলাম। তৎক্ষণাৎ আমি আমার পরিচয় দিয়া কহিলাম, “এই ইয়ারিং কেহ হারাইয়াছে, যাহার ইয়ারিং তাহাকে অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিবার ভার আমার উপর হইয়াছে, আপনারা কাহার জন্য এই ইয়ারিং প্রস্তুত করিয়াছিলেন— সে সন্ধান পাইলে আমি বিশেষ বাধিত হইব।” 

সাহেব তখন আমায় একটা ঘরের মধ্যে লইয়া গেলেন। সেই ঘরের টেবিলের উপর অনেক হিসাবপত্রের খাতাপত্র প্রভৃতি সাজান রহিয়াছে দেখিলাম। তাহাদের মধ্য হইতে একখানি খাতা বাহির করিয়া সাহেব উল্টাইয়া পাল্টাইয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া দেখিতে লাগিলেন। তাহার পর কহিলেন, “এ ইয়ারিং বিবি ইসাবেলার জন্য প্রস্তুত হইয়াছিল।” 

আমি। কতদিন পূর্ব্বে এ ইয়ারিং প্রস্তু হয়? 

সাহেব। প্রায় দুই বৎসর অতীত হইল—এই ইয়ারিং প্রস্তুত হইয়াছে। 

আমি। এই ইয়ারিং জোড়া কত টাকায় আপনারা বিক্রয় করিয়াছিলেন? 

সাহেব। চারিহাজার তিনশত বাহান্ন টাকায়। 

আমি। বিবি ইসাবেলার ঠিকানা কোথায় বলিতে পারেন কি? 

সাহেব। তখন ছিল- ৩২ নং এজরা ষ্ট্রীট। এখন সেইখানেই তিনি আছেন কি না, সে সংবাদ আমরা কিছুই বলিতে পারি না। 

আমি সাহেবকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়া এবং তাঁহাকে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া, সে স্থান হইতে বিদায় গ্রহণ করিলাম। সে দোকান হইতে বাহির হইয়াই আমি কেনারাম দাদাকে একখানি গাড়ী ডাকিতে কহিলাম। সৌভাগ্যক্রমে সম্মুখেই একখানা গাড়ী পাওয়া গেল। সেই গাড়ীতে চড়িয়াই আমি গাড়োয়ানকে দ্রুতগতিতে এজরা ষ্ট্রীটে যাইতে কহিলাম। ৩২নং এজরা ষ্ট্রীটে গিয়া অনুসন্ধানে জানিলাম— আজ প্রায় এক বৎসর হইল— বিবি ইসাবেলার মৃত্যু হইয়াছে। মৃত্যুর পর তাহার একজন উত্তরাধিকারী আসিয়া বিবির সমস্ত অস্থাবর সম্পত্তি নীলামে বিক্রয় করিয়া সে টাকা লইয়া গিয়াছে। আরো অনুসন্ধানে জানিলাম — বিবির জুয়েলারি গহনা না কি সেই নীলামে বিক্রয় হয়। তখন বড় আশায় নৈরাশ হইলাম। কে নীলাম করিয়াছিল, কেই বা সেই নীলামে এই ইয়ারিং জোড়া খরিদ করিয়াছিল, এই সকল অনুসন্ধানে বাহির করা বড় সহজ কথা নহে, সুতরাং আমি এইবার বড়ই নিরুৎসাহ হইয়া পড়িলাম। তখন বেলা ছিল, সেই কারণ থানায় ফিরিয়া না গিয়া, আমি কলিকাতার প্রধান প্রধান নীলামকারকের নিকট সেই সন্ধানে ঘুরিলাম; কিন্তু তাহাতে কোন ফল হইল না। তখন অগত্যা ভগ্নমনোরথ হইয়া থানায় ফিরিলাম। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

সেই দিন সন্ধ্যার পর আমার সেইদিনকার রিপোর্ট লইয়া বড় সাহেবের নিকট হাজির হইলাম। আমার রিপোর্ট পড়িয়া আর আমার বাচনিক সমস্ত কথা শুনিয়া আমি যে নিরুৎসাহ হইয়া পড়িয়াছি, বড় সাহেবের আর সে কথা জানিতে বাকি রহিল না। তিনি আমায় কহিলেন,—“দেখ, তুমি একজন এই বিভাগের যুবা কৰ্ম্মচারী। তোমার কাৰ্য্যকলাপ দেখিয়া আমার মনে তোমার উপর অনেক আশা জন্মিয়াছে। এ কার্য্যে দুই একবার বিফল হইলে নিরুৎসাহ হইতে নাই। তুমি যত বিফল হইবে, ততই যেন তোমার উৎসাহ বাড়িতে থাকিবে, ততই এ কার্য্যে জেদ হইবে, তবে তুমি উন্নতি করিতে পারিবে। তুমি এই খুনের সম্বন্ধে যে মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছ, আমিও তাহা সম্পূর্ণ অনুমোদন করি। তোমার মতের সহিত আমারও মত ঠিক্ মিলিয়াছে বলিয়া আমি তোমার উপর এই কার্য্যের ভার দিয়াছি। অনেক পুরাতন ও বহুদর্শী কর্মচারী সেই কারণ আমার উপর মনে মনে বিরক্ত হইয়াছে। এখনও অনুসন্ধানের অনেক বাকি আছে; তুমি ইহারই মধ্যে নিরুৎসাহ হইলে চলিবে কেন?” 

খোদ বড় সাহেবের মুখে উপরোক্ত কথাগুলি শুনিয়া আমার মনে মনে বড় আহ্লাদ হইল এবং সে উৎসাহও যেন দ্বিগুণ হইয়া ফিরিয়া আসিল। আমি কহিলাম, “আমার প্রতি হুজুরের যখন এত অনুগ্রহ হইয়াছে, তখন আর আমি এ কার্য্যে নিরুৎসাহ হইব না। আসামীকে আমি সেই ঘটনার দিন মাত্র দেখিয়াছিলাম, তার পর আর দেখি নাই। আসামী নিজে তাহার কি পরিচয় দিয়াছে, সে কি সূত্রে সে রাত্রে সে বাড়ীতে আসিল; আর সে যদি খুন না করিয়া থাকে, তবে কে খুন করিল— সেই বা পিস্তল হাতে করিয়া খিড়কীর দরজায় দাঁড়াইয়াছিল কেন— এই সকল বিষয় সম্বন্ধে সে কি এজেহার দিয়াছে, সেই এজাহার দেখিলে আমি পুনরায় দ্বিগুণ উৎসাহে তাহার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইতে পারি।” আমার কথা শুনিয়া বড় সাহেব কহিলেন, “তুমি বেশ কথা বলিয়াছ। সে এজাহার এখন এখানে নাই; কিন্তু কালই তাহার নকল তোমার নিকট পাঠান হইবে। আমি সে এজাহার ভাল করিয়া পড়িয়াছি। তুমি সে সম্বন্ধে একে একে প্রশ্ন করিলে যতদূর স্মরণ হয়, এখনই সে সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি।” 

আমার তখন প্রথম প্রশ্ন হইল, —“আসামীর নাম কি?” 

বড়-সাহেব। আসামী বলে যে, তাহার নাম মহম্মদ আলি। 

আমি। বাড়ী কোথায়? 

বড় সাহেব। সিঙ্গাপুর কিন্তু সিঙ্গাপুরেও তাহার কোন আত্মীয়স্বজন নাই। সেখানে সে যে হোটেলে চাকুরী করিত, এখন সে হোটেলও উঠিয়া গিয়াছে। 

আমি। কলিকাতায় কতদিন আসিয়াছে? 

বড় সাহেব। ঘটনার দিনের তিন দিন পূর্ব্বে।

আমি। কলিকাতায় কেন আসিল? 

বড় সাহেব। চাকুরীর চেষ্টায়। 

আমি। কি চাকুরী সে জানে? 

বড় সাহেব। সে বলে, সিঙ্গাপুরের হোটেলে সে পাচকের চাকুরী করিত, সেই চাকুরীর চেষ্টাতেই সে এখানে আসিয়াছে। 

আমি। হতব্যক্তির পরিচয় তাহার নিকট কোন পাইয়াছেন কি? 

বড় সাহেব। না–সে সেই ঘটনার দিন ঐ বাড়ীতে প্রথম চাকুরী পাইয়াছিল। তাহার প্রভুর কোন পরিচয় সে জানে না। 

আমি। আচ্ছা, ঘটনার দিনের তিনদিন পূর্ব্বে সে কলিকাতায় আসিয়া পৌঁছায়, তাহা হইলে আর দুই দিন সে কোথায় ছিল? 

বড় সাহেব। নীমুখানসামার লেনের ফেরোজা বাড়ীওয়ালীর বাড়ী। 

আমি। অতদূর দেশ হইতে সে যখন কলিকাতায় আসিয়াছে, নিশ্চয়ই তাহার সঙ্গে কাপড়চোপড় প্রভৃতি কিছু না কিছু দ্রব্য ছিল, সে সকল সে কোথায় রাখিয়াছে? 

বড় সাহেব। সেই ফেরোজা বাড়ীওয়ালীর বাড়ী। 

আমি। নীমুখানসামার লেনের ফেরোজা বাড়ীওয়ালীর বাড়ীর নম্বর কত? 

বড় সাহেব। সে কথা সে বলিতে পারে না। 

আমি। নীমুখাসামার লেন ত চাঁপাতলায়— দপ্তরীপাড়ার সন্নিকট। সেখানে কোন অনুসন্ধান করা হইয়াছিল কি? 

বড় সাহেব। না- কে সে অনুসন্ধান করিবে? তোমার উপর যখন এ খুনের তদারকের ভার, তখন আমি আর কাহাকেও সে কার্য্যে পাঠাইতে পারি না। 

আমি। এ খুন সম্বন্ধে সে কি বলে? 

বড় সাহেব। সে ত খুন স্বীকার করে না— সে বলে, তাহার প্রভু আত্মহত্যা করিয়াছে। 

আমি। সে আত্মহত্যার কারণ কিছু বলে? 

বড় সাহেব। না— সে বলে, সেইদিন সে চাকুরী লইয়াছে, সুতরাং সে আত্মহত্যার কারণ কিরূপে জানবে। সে যেভাবে সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়াছিল, তাহাতে তাহাকে একজন সামান্য পাচক বলিয়া বিশ্বাস করা যাইতে পারে না। সে যে একজন বিদ্বান ও বুদ্ধিমান, তাহার উত্তরের কায়দা দেখিয়াই আমি বুঝিয়াছি। সে নিশ্চয়ই ছদ্মবেশী— তোমার কথাই ঠিক্। 

আমি। আচ্ছা, সে যদি নিৰ্দ্দোষ, তবে যে সময় আমরা দরজা ভাঙ্গিয়া বাড়ীতে প্রবেশ করিলাম, আমাদের দেখিয়া যেরূপ ভাবে আমাদের দিকে পিস্তল তুলিয়া দাঁড়াইয়াছিল কেন? এই সকল কথা স্পষ্ট বলিলেই ত হইত। আর আমি গিয়া পশ্চাৎদিক হইতে তাহাকে বাগাইয়া না ধরিলে, সে ত আমাদের সম্মুখেই ইনস্পেক্টার সাহেবকে গুলি করিয়া মারিত। 

বড় সাহেব। সে বলে হঠাৎ তাহার সম্মুখে একটা আত্মহত্যা হওয়ায়, তখন তাহার মাথা খারাপ হইয়া যায়। সে কি করিয়াছে, তাহার জ্ঞান নাই। তবে ভয়ে সে পলাইবার চেষ্টা করে, আর আত্মরক্ষার জন্য তাহার আত্মহত্যাকারী প্রভুর পিস্তলটি সে হাতে করিয়া লয় এইমাত্র তাহার স্মরণ আছে। আর কোন কথা তাহার স্মরণ নাই। 

আমি। এই সকল এজাহার সে কি আপনার নিকট দিয়াছে? 

বড় সাহেব। না— পুলিসের নিকট সে কোন এজাহার দেয় নাই। পীড়াপীড়ি করিলে স্পষ্ট বলিত, সে পুলিসের নিকট কোন এজাহার দিবে না। সে যে একজন আইনজ্ঞ পাকা বদমায়েস, তাহার কথাবার্তার ধরণ দেখিয়াই বুঝিয়াছিলাম। এ সকল এজাহার সে করোণারের প্রশ্নের উত্তরে দিয়াছিল, করোণার্স কোর্ট হইতে আমরা সে সকল এজাহারের নকল লইয়াছি। আর আমিও সে সময় সে স্থানে উপস্থিত ছিলাম। 

আমার আর কোন কথা জানিবার আবশ্যক ছিল না, সুতরাং আমি সেদিনকার মত সাহেবের নিকট বিদায় গ্রহণ করিলাম। এ দিনও রাত্রে আমার নিদ্রা হইল না— নানা রকম চিন্তা আসিয়া মনের মধ্যে বড়ই উৎপাত করিতে লাগিল। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ

পরদিন অতি প্রত্যূষে আমি চাঁপাতলার নীমুখানসামার লেনের সেই ফেরোজা বাড়ীওয়ালীর সন্ধানে চলিলাম। বেলা নয়টা পর্যন্ত খুঁজিয়া খুঁজিয়া একবারে হায়রাণ হইলাম- কেহ আর ফেরোজা বাড়ীওয়ালীর সন্ধান দিতে পারিল না। তখন বুঝিলাম, আসামীর এজাহারের এই অংশ সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

শেষে আমি যখন নিরাশ হইয়া গৃহে ফিরিয়া আসিতেছি, এমন সময় দেখি একটা মুটে সম্মুখের গলির ভিতর হইতে এক ঝাঁকা খানার মোট লইয়া বাহির হইয়া আসিতেছে। সান্কীর মধ্যে অন্নব্যঞ্জন রাখিয়া অবর সাকী ঢাকা দিয়া কাপড় দিয়া বাঁধা— এইরূপ ২০।২৫ জনের খানা সেই মোটের মধ্যে ছিল। আমি তাহাকে ফেরোজা বাড়ীওয়ালীর কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। সেই মুটে কহিল, “ওকথা বললে কেউ তাকে চিনতে পারবে না— হোটেলওয়ালী বললে সকলেই তাকে চিনতে পারে। আপনি এই গলির মধ্যে যান ডানদিকের বড় খোলার ঘরেই তার হোটেল, আমি সেই হোটেল থেকেই আছি।” 

মুটের কথায় আমার মনে বড়ই আনন্দ হইল। আমি তৎক্ষণাৎ সেই গলির মধ্যে গেলাম। গলির মধ্যে গিয়া সে হোটেল খুঁজিয়া লইতে আর আমায় কষ্ট পাইতে হইল না। পিঁয়াজ ও রসুনের গন্ধে সে হোটেল একবারে আমোদিত ছিল। আমি তাহার মধ্যে প্রবেশ করিয়াই হোটেলওয়ালীর কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। দেখিলাম, বাড়ীর মধ্যে অনেক লোক— কেহ আহার করিতেছে, কেহ পরিবেশন করিতেছে, কেহ আচমন করিতেছে। সকলেই যে যাহার কার্য্যে ব্যস্ত। আমার কথায় আর কেহ উত্তর দেয় না। আমি প্রথমে বাড়ীর দরজার উপর দাঁড়াইয়া হোটেলওয়ালীকে ডাকিতেছিলাম, কারণ পিঁয়াজ রসুনের গন্ধে বাড়ীর মধ্যে যাইতে প্রবৃত্তি হয় নাই, কিন্তু তাহাতে কোন ফল হইল না দেখিয়া, শেষে বাড়ীর মধ্যে যাইতে বাধ্য হইলাম। সেখানে গিয়া জোর করিয়া কথা বলায়, তখন একজন লোক আমায় বাড়ীর ভিতর যাইতে কহিল। আমি, আবার বাড়ীর ভিতর কোথায় জিজ্ঞাসা করায়, আমায় একটি সরু গলি দেখাইয়া দিল। আমি সেই সরু গলির মধ্যে কিছু দূর গিয়া দেখি, এ বাড়ীর আর এক মহল আছে। এখানে বোধ হয়, বাসাড়ে ভাড়াটীয়ারা থাকে। কারণ, সে মহলের চারিদিকে ছোট ছোট অনেকগুলি ঘর দেখিলাম। এইখানে আমার সেই এত কষ্টের ফেরোজার বাড়ীওয়ালীই বল— আর হোটেলওয়ালীই বল- সঙ্গে সাক্ষাৎ হইল। দুই একটা কথা শুনিয়াই বুঝিলাম, ফেরোজা ঢাকা অঞ্চলের লোক। সে আমায় দেখিয়াই কহিল, “আপনি কি চাহেন মশাই?” 

আমি উত্তর করিলাম, “এখানে মহম্মদ আলি নামে কোন লোক আছে কি?” 

ফেরোজা। এজ্ঞে না। 

আমি। আচ্ছা, আজ ৪।৫ দিন পূর্ব্বে ঐ নামে কোন লোক এ বাসায় এসেছিল কি না? 

ফেরোজা। হাঁ-হাঁ——- আসিছ্যালো বটে। দুদিন থেকে সে কামে চলি গ্যাছে, তার হদ্দি কিছুই পাবার লাগিনে।

আমি। আচ্ছা, তার কোন জিনিষপত্র এখানে আছে কি? 

ফেরোজা। হাঁ, তেনার একটা আমকাঠের সিঁধুক আছে। তা হামার দু-রোজের ঘর ভাড়া আর খোরাকি পাওনা আছে। 

আমি। সে কোন্ ঘর ভাড়া নিয়েছিল? 

ফেরোজা। ঐ সানাকার কামরা। 

আমি। তবে সে কাম্বার দরজা খোলা রয়েছে যে?

ফেরোজা। কাম্বা ত আর পুরু ভাড়া লয় নাই।

আমি। আচ্ছা, তার সিন্ধুকটা একবার দেখাও দেখি। এবার ফেরোজা রাগিয়া কহিল, “ক্যান্ দেখাইমু?”

আমি। আমার দরকার আছে। 

ফেরোজা। তোমার দরকারে আমার কি কাম? 

আমি তখন একটু জোর করিয়া চক্ষু রাঙ্গাইয়া কহিলাম, “আমি কে জান?”

ফেরোজা। তুমি লাট হইছে তোমাগার চিনবার পারি না? 

আমি দেখিলাম, এই হোটেলওয়ালী সহজ স্ত্রীলোক নহে। তখন আর একবার তাহাকে একটু নরমভাবেই কহিলাম, “দেখ হোটেলওয়ালী, এই মহম্মদ আলি এখন এক খুনী মোকদ্দমার আসামী হইয়া পুলিসের হাজতে আছে, আমি একজন পুলিসকর্ম্মচারী- সরকারী কার্য্যে তার সিন্ধুক তদারক করিতে আসিয়াছি। এখন তুমি সেই সরকারী কাৰ্যে বাধা দিলে নিশ্চয়ই বিপদে পড়িবে, তোমায় আর একবার সাবধান করিয়া দিতেছি।” 

তখন সেই ফেরোজা একটু ভয় পাইয়া আমায় একটা ঘরের মধ্যে লইয়া গিয়া সেই সিন্ধুক দেখাইয়া দিল। সিন্ধুকটা চাবিবন্ধ ছিল। আমি ফেরোজার নিকট হইতে একটা চাবির তাড়া লইয়া সে সিন্ধুক খুলিয়া ফেলিলাম। খুলিয়া দেখি— সে সিন্ধুকে অন্য কিছুই নাই,— দুইটা পা-জামা, একটা কোর্তা, একটা চাপকান, একটা কোট, আর একটা টুপী ছিল। সিন্ধুকের উপর উর্দুভাষায় কি লেখা ছিল, আমি একজন উর্দু-জানা লোক ডাকিয়া পড়াইলাম। সে পড়িল— মহম্মদ আলি — সিঙ্গাপুর। বাক্সের মধ্যে অন্য কোন চিঠিপত্র কিছুই পাইলাম না। আমার মাথা ঘুরিয়া গেল! তবে কি এ ব্যক্তি যথার্থই মহম্মদ আলি—সিঙ্গাপুর হইতে কলিকাতায় আসিয়াছে? আমি তখন অগত্যা বিষণ্নমনে সে স্থান হইতে বাহিরে আসিলাম। মনের সে উৎসাহ আর নাই— আমার নিজের অনুমানের উপর তখন বড়ই একটা সন্দেহ হইল। আর কি অনুসন্ধান করিব— আমি তখন আর কিছুই ভাবিয়া স্থির করিতে পারিলাম না। বিষণ্নমনে থানায় ফিরিয়া আসিলাম। কেনারাম দাদা আমায় দেখিয়া নানা প্রশ্ন আরম্ভ করিয়া দিল, কিন্তু তখন আমার মন এতই খারাপ যে, তাহার সে সকল প্রশ্নের আর উত্তর দিতে পারিলাম না। সমস্ত দিন কাহারও সহিত ভাল করিয়া কথা পর্যন্ত কহিতে পারিলাম না। মনে মনে যে উচ্চাভিলাষ জন্মিয়াছিল,—আকাশে যে একটা অট্টালিকা গাঁথিয়া তুলিতেছিলাম, সে সকল একবারে চুরমার হইয়া গেল! 

মন যতই বিষণ্ণ থাকুক না কেন, আমাদের কর্তব্যকর্ম্ম অবহেলা করিলে চলিবে না। ঠিক সন্ধ্যার সময় আমায় পুনরায় বড় সাহেবের নিকট যাইতে হইল। আমি তাঁহাকে একে একে সমস্ত কথা জানাইলাম। আমি যে বড়ই নিরুৎসাহ হইয়া পড়িয়াছি, আমার কথাবার্তার ভাবভঙ্গী দেখিয়াই, তিনি তাহা বুঝিতে পারিলেন। আমার কথা শেষ হইলে তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া কহিলেন, “এ ঘটনাতেও আমাদের নিরুৎসাহ হইবার কোন কারণ আমি দেখিতেছি না। তোমার কি স্মরণ নাই, যে রাত্রে খুনী আসামী ধরা পড়ে, সেই রাত্রে একজন মাতলামীর ভাণ করিয়া পুলিসকে ধরা দেয়, আর ঐ আসামীর সঙ্গে থানায় এক হাজতে থাকিয়া ভোরের সময় পুলিসের চক্ষে ধূলি দিয়া পলায়ন করে। সেই ব্যক্তিই আসামীর জন্য বাড়ী ভাড়া লইয়াছিল, সেই ব্যক্তিই সেই রাত্রে আসামীর সঙ্গিনী স্ত্রীলোককে গাড়ী করিয়া লইয়া যায়। এও তারই কাজ! সেই আসামীকে ঐরূপ বলিতে শিখাইয়া দিয়াছিল, আর সেই নীমুখানসামার লেনে সেই হোটেলওয়ালীর বাড়ীতে একটা সিন্ধুক রাখিয়া পুনরায় আমাদের চক্ষে ধূলি দিবার চেষ্টা করিতেছে।” 

বড়সাহেবের উপরোক্ত কথায় হঠাৎ আমার যেন জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হইল। চক্ষের সম্মুখে একে একে আমি সমস্তই যেন দেখিতে পাইতে লাগিলাম। এতক্ষণের পর আমার সে মনের বিষাদ দূর হইয়া গেল, সঙ্গে সঙ্গে আবার আমার মন প্রফুল্লিত হইল। আমি বড়সাহেবকে শত সহস্র ধন্যবাদ দিয়া কহিলাম, “আপনার অনুগ্রহে আমার জ্ঞান জন্মিল। এখন এ রহস্য আমি বুঝিতে পারিয়াছি। এ নিশ্চয়ই সেই ব্যক্তির চক্রান্ত। কিন্তু এরূপ চতুর লোক যাহার সহায়, তাহার অপরাধের প্রমাণ করিবার উপায় কি?” 

বড়সাহেব অনেকক্ষণ চিন্তা করিয়া কহিলেন, “একমাত্র উপায় আছে, কিন্তু সে বড় দুঃসাহসের কাজ।” আমি কহিলাম, — “কিরূপ আজ্ঞা করুন। 

বড়সাহেব কহিলেন, “ সে এক নূতন রকম উপায়। কিন্তু আমি দেখিতেছি— সে উপায় ভিন্ন আর আমাদের কোন গতি নাই। কৌশলে অসাবধান হইয়া আসামীকে পলাইবার সুযোগ করিয়া দিতে হইবে। আর অলক্ষ্যে তাহার প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখিয়া তাহার অনুসরণ করিতে হইবে। কিন্তু খুব সতর্কতার সহিত এই কার্য্য করা চাই। আসামী যে ঘুণাক্ষরে আমাদের কৌশল বুঝিতে না পারে। সে যদি জানিতে পারে যে, তাহাকে ফাঁদে ফেলিবার জন্য আমরা এই ষড়যন্ত্র করিয়াছি, তাহা হইলে আমাদের এ কৌশল আর খাটিবে না। সে কারামুক্ত হইয়া সেই ফেরোজা হোটেলওয়ালীর বাড়ী যায়— কি আর কোথায় যায়, সেই কথা জানিতে পারিলে সে ব্যক্তি যে কে, তাহা জানিতে পারা যাইবে। তখন তাহাকে গ্রেপ্তার করিলে চলিবে। কাল প্রাতে পুলিসকোর্টে আনিবার ভাণ করিয়া আসামীকে পলাইবার সুযোগ করিয়া দিবে, তার পর যেমন যেমন বলিয়াছি সেইরূপ কার্য্য করিবে। তোমার সঙ্গে আর যাহাকে যাহাকে লইতে ইচ্ছা কর, তুমি লইতে পার, কিন্তু তোমাদের সকলকেই ছদ্মবেশে থাকিতে হইবে। 

আমি “যে আজ্ঞা” বলিয়া সাহেবের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিলাম। পরদিন প্রাতে বড়সাহেবের আজ্ঞামত কার্য্য করা হইল। আসামীকে হাজতের বাহিরে আনিয়া কৌশলে তাহাকে পলায়নের সুযোগ করিয়া দেওয়া হইল। আসামী সে সুযোগ পরিত্যাগ করিল না— পলায়ন করিল। এই সময় আমার বুক কি জানি কেন— ভয়ে দুরু দুরু করিয়া কাঁপিয়া উঠিল। আমি, কেনারাম দাদা আরও তিনজন পুলিস-কৰ্ম্মচারী এই পাঁচজনে দূরে দূরে আসামীর অনুসরণ করিতে লাগিলাম। পাছে আসামী আমাদের চিনিতে পারে, সেই কারণে আমরা ছদ্মবেশ করিয়া আসিয়াছিলাম। আলিপুরের জেলখানা হইতে আসামী ভবানীপুরের দিকে চলিল। আমরাও তাহার প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া পশ্চাতে পশ্চাতে চলিতে লাগিলাম। আসামী বড় রাস্তা দিয়া না গিয়া এইবার গলির রাস্তা ধরিল, আমরাও সেই গলির মধ্যে তাহার পিছু পিছু চলিতে লাগিলাম। গলি অনেক স্থলে আঁকিয়া বাঁকিয়া গিয়াছে, সুতরাং মধ্যে মধ্যে আসামী আমাদের চক্ষের অন্তরালও হইতে লাগিল। সেই সময় আমাদের প্রাণটা বড়ই আকুল হইয়া উঠিত। এইরূপে ভবানীপুর ও কালীঘাট ছাড়াইয়া আসামী আরো দক্ষিণদিকে চলিল। আমরাও প্রাণপণে তাহার অনুসরণ করিতে লাগিলাম। রাস্তায় যাইতে যাইতে আসামী একটা বাঁশের লাঠি কুড়াইয়া লইয়াছিল। ক্রমে আমরা একটা বাগানওয়ালা বাড়ীর পশ্চাতে আসিয়া পৌঁছিলাম। মধ্যস্থলে বাড়ী আর চারিদিকে প্রাচীরবেষ্টিত বাগান। আমরা সেই বাড়ীর পশ্চাদদিক দিয়া যাইতেছি— এমন সময় আমাদের সম্মুখস্থিত আসামী হস্তের লাঠির উপর ভর দিয়া মুহূর্ত্তের মধ্যে সেই প্রাচীরের উপর উঠিল, তার পরেই এক লম্ফে বাড়ীর মধ্যে পড়িল। আসামীর এই কাণ্ড দেখিয়া আমরা প্রথমে একবারে হতবুদ্ধি হইয়া গেলাম। পরমুহূর্তেই আমি আমার চারিজন সঙ্গীর মধ্যে তিনজনকে সেই প্রাচীরের তিনদিকে চৌকী দিতে রাখিয়া কেনারাম দাদাকে সঙ্গে লইয়া বাড়ীর গেটের সম্মুখে উপস্থিত হইলাম। আসামীর ন্যায় উল্লম্ফন করিয়া তাহার অনুসরণ করিবার ক্ষমতা আমাদের ছিল না, সুতরাং এইরূপ বন্দোবস্ত ভিন্ন আমাদের আর অন্য কোন উপায় ছিল না। গেটের সম্মুখে আসিয়া দেখি, গেটের কপাট ভিতর দিক হইতে বন্ধ। অনেক ঠেলাঠেলির পর ভিতর হইতে একজন লোক সে কপাট খুলিয়া দিল। দেখিলাম, সে লোক সে বাড়ীর দ্বারবান বা নিম্নশ্রেণীর ভৃত্য নহে— একজন পদস্থ কর্ম্মচারী। আমি তাহাকে আমাদের পরিচয় দিয়া কহিলাম, “মহাশয়, একজন খুনী আসামী এই বাড়ীর প্রাচীর লাফাইয়া বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে। আপনি অনুগ্রহ করিয়া সাহায্য না করিলে, আমরা সে আসামীকে ধরিতে পারিব না।” 

আমার কথা শুনিয়া সে ব্যক্তি প্রথমে শিহরিয়া উঠিলেন, তার পর কহিলেন, “আপ্‌নারা বাড়ীর মধ্যে আসুন, এ বাড়ীতে যদি সে আসামী থাকে, তবে এখনই তাহাকে ধরিয়া দিতে পারিব।” 

আমি কেনারাম দাদাকে গেটের নিকট রাখিয়া সে বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিলাম। সেই ব্যক্তি অন্যান্য ভৃত্যগণকে ডাকিয়া আসামীর অনুসন্ধান করিতে হুকুম দিলেন। সেই ভৃত্যগণ ও পদস্থ কর্মচারীর সহিত আমি তন্ন তন্ন করিয়া সে বাড়ীর সকল স্থান অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু কোথাও আসামীর সন্ধান পাইলাম না। তখন সেই কৰ্ম্মচারী কহিলেন, “না মহাশয়, আপনার ভ্রম হইয়াছে, এ বাড়ীর মধ্যে আসামী প্রবেশ করে নাই।” 

আমি কহিলাম, “সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই— আমাদের চক্ষের সম্মুখে এই ঘটনা ঘটিয়াছে।” 

তখন কর্ম্মচারী উত্তর করিলেন, – “ তবে সে নিশ্চয়ই প্রাচীর লাফাইয়া পুনরায় এস্থান হইতে পলায়ন করিয়াছে।” আমি কহিলাম,—“আমি বাড়ীর চারিদিকে লোক রাখিয়াছি, সুতরাং আপনার এ কথা আমি বিশ্বাস করিতে- পারিব না। আচ্ছা, এ বাড়ী কাহার?” 

কর্ম্মচারী। এ বাড়ী রামপুরের নবাব সাহেবের। 

একজন এরূপ সম্ভ্রান্ত লোকের বাড়ী সুতরাং অন্দরের মধ্যে অনুসন্ধান করিবার প্রস্তাব আমি আর উত্থাপন করিতে পারিলাম না। তথাপি কহিলাম, “আমি একবার নবাব সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিতে ইচ্ছা করি।” 

কর্ম্মচারী আমায় এক সুসজ্জিত গৃহের মধ্যে লইয়া গিয়া অপেক্ষা করিতে বলিলেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিবার পর নবাব সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ হইল। আমি সসম্ভ্রমে উঠিয়া দাঁড়াইয়া এক লম্বা সেলাম করিলাম। তার পর সমস্ত ঘটনা তাঁহার নিকট একে একে বর্ণনা করিলাম। তিনি ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “আপনারা নিশ্চয়ই ভ্রমে পড়িয়াছেন, আসামী এ বাড়ীর মধ্যে থাকিলে নিশ্চয়ই ধরা পড়িত। আপনি ত সকল স্থানই অনুসন্ধান করিয়াছেন?” 

আমি কহিলাম, “কেবল অন্দরের মধ্যে অনুসন্ধান করা হয় নাই।” 

তখন নবাব সাহেব পুনরায় ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “দেখুন, আমার অন্দরে এখন কোন জেনানা নাই, আপনি ইচ্ছা করিলে সে অন্দরও অনুসন্ধান করিতে পারেন।” 

আমি তখন নবাব সাহেবের সঙ্গে তাঁহার অন্দরও তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিলাম কিন্তু আসামীর কোন সন্ধানই পাইলাম না। তখন অগত্যা বিষণ্ন মনে আমরা থানায় ফিরিলাম। অপরাপর সকলকে থানায় অপেক্ষা করিতে বলিয়া আমি একবারে বড় সাহেবে নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলাম। তিনিও আমারই অপেক্ষা করিতেছিলেন, আমায় দেখিয়াই কহিলেন, “সংবাদ কি?” 

“আমি একে একে সমস্ত ঘটনা তাঁহার নিকট বর্ণনা করিলাম। আমার কথা শেষ হইলে তিনি কিছুক্ষণ কি চিন্তা করিয়া কহিলেন, “আসামীর সহিত নবাব সাহেবের কোন সাদৃশ্য দেখিতে পাইয়াছিলে কি?” 

আমি একটু ভাবিয়াই কহিলাম, “আকৃতি ও গঠন প্রায় একরূপ, কিন্তু আসামীর যেরূপ দাড়ী ছিল, নবাব সাহেবের সেরূপ দাড়ী দেখিলাম না, আর আসামীর রং কাল কিন্তু নবাব সাহেবের রং গৌরবর্ণ দেখিলাম।”

বড়সাহেব কহিলেন, “দাড়ী কামান যায়, রংও বদলাইতে পারা যায়। আসামী যে ছদ্মবেশী বড়লোক সে কথা কি ভুলিয়া গিয়াছ? আমার অনুমানই তবে ঠিক্, এ আসামী অন্য কেহ নহে, সেই রামপুরেরই নবাব স্বয়ং!” 

হঠাৎ আমারও চমক ভাঙ্গিয়া গেল, আমি আগাগোড়া ভাবিয়া দেখিলাম, বড়সাহেবের অনুমানই ঠিক, তখন আমরা এক ভয়ঙ্কর উভয় সঙ্কটে পড়িলাম। আমার মুখ হইতে এই সময় বাহির হইল—”তবে নবাব সাহেবকেই গ্রেপ্তার করা যাউক।” 

বড় সাহেব কহিলেন, —“এখন সে কাজ করিলে কোন ফল হইবে না। তবে এই নবাব সাহেব আর তাহার সেই সঙ্গী— এই দুইজনের প্রতি পুলিসের বিশেষ লক্ষ্য রাখিতে হইবে। কোন না কোন দিন এই নবাব সাহেব কি তাহার সঙ্গী পুলিসের হাতে পড়িবেই পড়িবে। তখন সে সময় এ মোকদ্দমারও কিনারা হইবে। এখন এ মোকদ্দমা চাপা দেওয়া ভিন্ন আর অন্য উপায় নাই।”

আমি দেখিলাম – যথার্থই উভয় সঙ্কট। 

[শ্রাবণ, ১৩১৩] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *