কুঠিয়াল সাহেব ১

কুঠিয়াল সাহেব! (প্রথম অংশ) 

(অর্থাৎ সেকেলে নীলকর সাহেবের ভীষণ-অত্যাচার কাহিনী!) 

প্রথম পরিচ্ছেদ

অদ্য আমি যে ঘটনা পাঠক পাঠিকাগণের সম্মুখে উপস্থিত করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি, সেই ঘটনার অনুসন্ধান আমা কর্তৃক না হইলেও আমার সম্মুখে উহার অনুসন্ধান করা হইয়াছিল বলিয়াই, আজ আমি তাহা এইস্থানে বর্ণন করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। আমি যে সময় পুলিস বিভাগে কর্ম্ম করিবার নিমিত্ত প্রথম প্রবিষ্ট হই, ইহা তাহার দুই তিন বৎসর পূর্ব্বের ঘটনা। 

এ দেশে পূর্ব্বে যে সকল নীলকর সাহেব নীলের চাষ করিতেন, তাহার মধ্যে সকলেই যে অতিশয় অত্যাচারী ও প্রজাপীড়ক ছিলেন, তাহা নহে; তাঁহাদিগের মধ্যে অনেক সদাশয় ও মহানুভব ব্যক্তি দেখিতে পাওয়া যাইত; কিন্তু অত্যাচারীর সংখ্যাই অধিক ছিল। কোন কোন গ্রন্থে ও সরকারী কাগজপত্রে নীলকরগণের অনেক অত্যাচার কাহিনী দেখিতে পাওয়া যায় বটে, কিন্তু সেই সকল ঘটনা আমাদিগের জন্মগ্রহণের পূর্ব্বে ঘটিয়াছিল বলিয়া, সে সম্বন্ধে আমাদিগের চাক্ষুষ জ্ঞান কিছুই নাই। আমরা যে সময় জন্মগ্রহণ করি, সেই সময় নীলকরগণের ভীষণ অত্যাচারের উপর গভর্ণমেন্টের দৃষ্টি আকৃষ্ট হইয়াছিল, সেই সকল প্রবল অত্যাচার ক্রমেই কমিয়া আসিতেছিল। যে সময় আমাদিগের বাল্যকাল অতীত হয়, যে সময় আমরা সংসারের ভালমন্দ বুঝিতে সমর্থ হই, অপরের উপর অত্যাচার করিতে দেখলে যে সময় হৃদয়ে আঘাত লাগিতে আরম্ভ করে, সেই সময় আমাদিগের দেশে নীলকরগণের প্রায় শেষ অবস্থা হইয়া আসিয়াছিল। তথাপি আমাদিগের সম্মুখে তাঁহারা যেরূপভাবে কার্য্য করিতেন, আমাদিগের চক্ষের উপর যে সকল ঘটনা রাত্রিদিন ঘটিত, এই প্রবন্ধের মূল বিষয় বর্ণন করিবার পূর্ব্বে, তাহার দুই একটি বিষয় এইস্থানে বর্ণন করিলে নব্য পাঠিকাগণ বোধ হয়, অসন্তুষ্ট হইবেন না; কারণ, পুলিসের অত্যাচার দেখিলে বা একজন চৌকিদারকে একটু অন্যায়রূপে চলিতে দেখিলে, যাঁহারা একেবারে ক্রোধান্ধ হইয়া পড়েন, ও সেই সকল অত্যাচার যাহাতে নির্ধারিত হইয়া নীচবংশসম্ভূত ও নিতান্ত অশিক্ষিত চৌকীদার বা সামান্য বেতনভোগী কনষ্টেবলগণ যাহাতে দণ্ডিত হইতে পারে, তাহার নিমিত্ত বৃহৎ বৃহৎ সভাসমিতির আহ্বান ও সংবাদপত্রে দীর্ঘ দীর্ঘ প্রবন্ধ সকল প্রকাশ করিতে থাকেন, তাঁহারা হইা পাঠে কখনই অসন্তুষ্ট হইতে পারিবেন না বলিয়াই, নীলকর ইতিবৃত্তের দুই একটি ঘটনা এইস্থানে লিপিবদ্ধ করিতে সাহসী হইলাম। 

দেশের মধ্যে যে সকল ফৌজদারী ও দেওয়ানী আদালত এখন পর্য্যন্ত দেখিতে পাওয়া যায়, তখনও তাহাই ছিল; কিন্তু, ঐ সময় আদালতে প্রজাগণ কর্তৃক একেবারেই কোনরূপে নালিস হইত না। প্রজাগণের মধ্যে প্রায় কাহাকেও ফরিয়াদীর শ্রেণীতে দেখিতে পাওয়া যাইতনা। তাঁহাদিগের মধ্যে এরূপ ক্ষমতা কাহারও ছিল না যে, তাঁহার উপর কোন রূপ অত্যাচার হইলে তিনি রাজদ্বারে গমন করিতে সমর্থ হন। তাঁহারা জানিতেন, নীলকরগণই দেশের রাজা; তাঁহাদিগের আজ্ঞা প্রতিপালন না করিলে তাঁহাদিগের বিপদের আর সীমা নাই; সুতরাং তাঁহারা কেহই আদালত চিনিতেন না। দেনা পাওনা হউক, মারপিট হউক, বা যে কোন দেওয়ানী বা ফৌজদারী মোকদ্দমাই হউক, তাহার নালিস করিতে হইলে প্রজামাত্রকেই নীলকর সাহেবের আশ্রয় গ্রহণ করিতে হইত। সরকারি আদালতে নালিস করিতে হইলে ষ্ট্যাম্প ও উকীল মোক্তারদিগের নিমিত্ত যেমন খরচ করিতে হয়, তখন তাহা অপেক্ষা অনেক অধিক খরচ পড়িত। দেওয়ানী হউক বা ফৌজদারী হউক, যে কোন নালিস করিতে সেই স্থানে গমন করিলে নায়েবের নজর ২ টাকা, তাঁহার মুহুরিকে।।০ আনা, দেওয়ানের নজর ১ টাকা, তাঁহার মুহুরিকে ০ এবং সরকারি বা সাহেবের নজর ১ টাকা মোট ৪No আনা না লইয়া কেহই নালিস করিবার নিমিত্ত গমন করিতে পারিতেন না। এই ব্যবস্থা ছিল নিতান্ত গরিবের পক্ষে। ধনশালী বা সম্রান্তশালী লোক হইলে তাঁহাদিগের ব্যবস্থা অন্যরূপ ছিল। এই ত গেল নালিস রুজু করিবার খরচ। সরকারি আদালতে নালিস করিলে সর্ব্ব প্রথম আসামীর নামে যেমন সমন বা ওয়ারেন্ট বাহির হয়, এই স্থানে নালিস হইলেও আসামীর নামে এক চিঠি বা হুকুম নামা বাহির হইত। ঐ চিঠি বা হুকুম নামা একজন বরকনদাজের জিম্মা হইত। এই কার্য্যের নিমিত্ত প্রত্যেক কুঠিতেই অনেকগুলি করিয়া পশ্চিমদেশীয় বরকনদাজ নিযুক্ত থাকিত। তাহাদিগের বেতন মাসিক ২/৩ টাকার অধিক ছিল না; কিন্তু ৫০ টাকার কম উপাৰ্জ্জন করিতে প্রায় কাহাকেও দেখা যাইত না। ঐ চিঠি বা হুকুমনামা যে বরকনদাজের জিম্মা হইত, সেও ফরিয়াদীর নিকট হইতে কিছু প্রাপ্ত হইত। ফরিয়াদী তাহার সাধ্যমত 10 আনা হইতে ১ টাকা পৰ্য্যন্ত প্রদান করিতে না পারিলে, তাহার কোনরূপ কাৰ্য্যই হইত না। তাহার পরই সেই বরকনদাজের সহিত ফরিয়াদীকে গমন করিতে হইত। আসামীকে বা তাহার বাটী দেখাইয়া দিতে পারিলেই ফরিয়াদীর কার্য্য কতক শেষ হইয়া যাইত। পরিশেষে বিচারকের কুঠিতে গিয়া উপস্থিত হইতে পারিলেই চলিত। বরকনদাজ আসামীর বাড়ীতে গমন করিয়া যদি তাহাকে দেখিতে পাইত, তাহা হইলে তাহার নিকট হইতে যথা সম্ভব “কোমর খোলানী’* গ্রহণ করিত, তবে তাহার বাড়ীতে উপবেশ করিত। এই “কোমর খোলানী” গ্রহণ করিবার উদ্দেশ্য এই যে, সে আসামীকে বন্ধন করিয়া লইয়া যাইবে না, ও তাহার সহিত গমন করিবার নিমিত্ত বা অর্থাদি সংগ্রহ করিয়া লইয়া যাইবার নিমিত্ত একটু সময় প্রদান করিবে। যদি কোন আসামীর নিকট হইতে বরকন্দাজ কোনরূপে “কোমর খেলানী” প্রাপ্ত না হইত, তাহা হইলে আর রক্ষা থাকিত না। তিনি সম্ভ্রান্তশালী লোক হউন বা সামান্য লোকই হউন, তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে সেই বরকনদাজের অগ্রে অগ্রে তাহার হস্তস্থিত বংশদণ্ডের সুমধুর রসাস্বাদন করিতে করিতে দ্রুতপদে নীলকুঠিতে গমন করিতে হইত। যে সকল আসামীকে সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যাইত, সেই সময় আসামীর সেই সময় প্রাপ্ত হইয়া যাইত না, তাহাদিগের অবস্থা আরও শোচনীয় হইয়া পড়িত। আসামীকে তাহার বাড়ীর বাহির হইতে দুই চারিবার ডাকিবার পর যদি সেই আসামী সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইতে না পারিত, তাহা হইলে সেই বরকনদাজ আর কালবিলম্ব না করিয়া একবারে সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিত ও এরূপ স্থানে গিয়া উপবেশন করিত যে, স্ত্রীলোকগণ যেন কোনরূপে বাড়ীর মধ্যে হইতে বাহিরে আসিতে সমর্থ না হয়। বরকন্দাজগণের এইরূপ অত্যাচার স্ত্রীলোকগণ কতক্ষণ সহ্য করিতে সমর্থ হয়? সুতরাং, যেরূপ উপায়ে হউক স্ত্রীলোকগণ কোন রূপে কিছু অর্থের সংগ্রহ করিয়া তাহাকে প্রদান করিলে, সে সেইস্থান হইতে উঠিয়া বাড়ীর বাহিরে গিয়া উপবেশন করিত ও যে পর্য্যন্ত আসামী আপন বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত না হইত, সেই পর্যন্ত বরকনদাজ সেইস্থান পরিত্যাগ করিত না। এমন কী, সময় সময় মাসাবধিকাল সে সেইস্থানে বসিয়া থাকিত। বলা বাহুল্য, তাহার চব্য চোষ্য করিয়া আহারের যোগাড় সেই স্ত্রীলোকগণকেই করিয়া দিতে হইত। 

এই ত হইল নীলকরগণের চিঠি জারি করিবার নিয়ম। এইরূপ উপায়ে আসামীগণ আনীত হইল, পরিশেষে তাহার বিচার হইত। বিচার হইবার পূর্ব্বে আসামীকে দেওয়ান বা নায়েবের নিকট আনা হইত। ফরিয়াদীও আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইত। আসামী ও ফরিয়াদীর মধ্যে যিনি অধিক অর্থব্যয় করিতে পারিতেন, ন্যায় হউক বা অন্যায় হউক, তাঁহারই জয়লাভ হইত; কিন্তু বিনা দণ্ডে আসামী ও ফরিয়াদীর মধ্যে যে কেহ অব্যাহতি পাইতেন, তাহা নহে। প্রায় বৈকালেই সাহেবের নিকট মোকদ্দমার শুনানি হইত। দেওয়ান বা নায়েব, আসামী ও ফরিয়াদীকে সাহেবের সম্মুখে উপস্থিত করিয়া যেরূপ বলিয়া দিতেন, সাহেব তাহাই শুনিয়া তাঁহার বিচার কার্য্য শেষ করিতেন। দেওয়ানি মোকদ্দমায় আসামী দোষী সাব্যস্ত হইলে, ফরিয়াদীর যে দাবী থাকিত, সেই টাকা ও আসামীর অবস্থা অনুযায়ী সরকারী জরিমানা হইত। মোকদ্দমা মিথ্যা সাব্যস্ত হইলে ফরিয়াদীকে জরিমানা দিবার আজ্ঞা হইত। এইরূপ দণ্ডাজ্ঞা হইয়া গেলে, যে পৰ্য্যন্ত দণ্ডিত ব্যক্তি জরিমানার টাকা প্রদান করিতে না পারিত, সে পর্য্যন্ত সে সেই কুঠির মধ্যে কয়েদ থাকিত। তাহার আত্মীয় স্বজন টাকার যোগাড় করিয়া জমা দিলে সে নিষ্কৃতি পাইত। আর যাহার জরিমানা দিবার ক্ষমতা নাই, তাহাকে মাসাবধি পর্য্যন্ত কয়েদ রাখিয়া ছাড়িয়া দেওয়া হইত। পরিশেষে যখন তাহার সঙ্গতি হইত, তখনই তাহার নিকট হইতে ঐ টাকা আদায় হইত। সমস্ত জরিমানার টাকা আদায় হইলে, অনেক হাঁটাহাঁটির পর ফরিয়াদীকে তাহার প্রাপ্য টাকা প্রদান করা হইত, কিন্তু সে তাহার অর্দ্ধেকও লইয়া আসিতে সমর্থ হইত না। সেলামি, নজর, বসিস্, তহুরি প্রভৃতি নানাভাবে তাহার অধিকাংশই চলিয়া যাইত। 

ফৌজদারী মোকদ্দমার বিচারে দেওয়ান বা নায়েবের অভিরুচি অনুসারে আসামী বা ফরিয়াদীর উপর “হাতার’** আদেশ হইত, ও সরকারী জরিমানার আদেশ হইত। বিচার শেষ হইয়া গেলে, যে পর্য্যন্ত সে জরিমানার টাকা প্রদান করিতে না পারিত, সেই পৰ্য্যন্ত সে কয়েদ থাকিত। টাকা আদায় হইবার পরই, যত হাতা মারিবার আদেশ থাকিত, 

সেই পরিমিত হাতা মারিয়া তাহাকে ছাড়িয়া দেওয়া হইত। এইরূপ বিচারের বন্দোবস্ত থাকায় গভর্ণমেন্টের অনেক ক্ষতি হইত বটে, কিন্তু জরিমানার টাকা আদায় হওয়ায় নীলকরগণের বিস্তর লাভ হইত। এইরূপ বিচার পদ্ধতির কথা সরকারী কর্মচারীগণের মধ্যে যে কেহই একেবারে জানিতে পারিতেন না, তাহা নহে; কিন্তু, নীলকরগণের বিপক্ষে কেহই কোন কথা বলিতে সাহসী হইতেন না, বা বলিলেও নীলকরগণের এতদূর প্রাধান্য ছিল যে, তিনি সেই সকল বিষয় কোনরূপেই প্রমাণ করিয়া উঠতে পারিতেন। 


* বরকনদাজগণ নীলকুঠির কোন কার্য্য উপলক্ষে কাহার নিকট গমন করিলে, প্রথমেই তাহার নিকট হইতে কিছু অর্থ প্রাপ্ত হইত। ইহা একরূপ নিয়মের মধ্যেই পরিগণিত ছিল। ঐ অর্থ পাইবার পর বরকনদাজ সেইস্থানে উপবেশন করিত। এই অর্থের নামই ছিল- “কোমরা খোলানী”। 

** প্রায় তিন হস্ত পরিমিত লম্বা চামড়ার দ্বারা প্রস্তুত এক প্রকার দ্রব্য বেত্রের কার্য্য করিত, উহাকেই হাতা কহিত। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

প্রথম পরিচ্ছেদে নীলকরদিগের বিচার কার্য্য যেরূপভাবে বর্ণিত হইল, লেখকের বাসস্থান যে গ্রামে, সেই গ্রামে নীলকরগণ সেই ব্যবসা চালাইতে পারিতেন না। ঐ গ্রামের নিতান্ত সন্নিকটে তাঁহাদিগের একটি নীলের কুঠি থাকিলেই ঐ গ্রাম তাঁহাদিগের জমিদারীর মধ্যে পরিগণিত ছিল না বলিয়া তাঁহারা তাঁহাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে সমর্থ হইত না। গ্রামের জমিদার ছিলেন সেই গ্রামের কয়েকজন বৰ্দ্ধিষ্ণু ব্যক্তি। তাঁহাদিগের অর্থাদির বিশেষরূপ অভাব ছিল না বলিয়াই, বহুদিবস পর্য্যন্ত ঐ গ্রাম নীলকুঠির অন্তর্গত জমিদারীভুক্ত হইয়াছিল না। সেই সকল জমিদার ক্রমে লোকান্তর গমন করিলে, তাঁহাদিগের পুত্র পৌত্রাদি ঐ সম্পত্তির অধিকারী হন। একে তাঁহাদিগের সংখ্যা অধিক হয়, তাহার উপর তাঁহাদিগের ক্রমে অর্থেরও বিশেষরূপ অভাব হইয়া পড়ে। নীলকরসাহেবও এই সুযোগ গ্রহণ করিতে অপেক্ষা করিতেছিলেন জমিদারগণের অবস্থার পরিবর্তন জানিতে পারিয়া, তিনি তাঁহাদিগকে হস্তগত করিবার মানসে দুই একজনকে নীলকুঠির মধ্যে চাকরী প্রদান করিতে লাগিলেন। কেহ বা কোন কুঠির নায়েব হইয়া গমন করিলেন, কেহ বা দেওয়ান হইয়া বিশেষরূপ অর্থ উপার্জ্জন করিতে আরম্ভ করিলেন। এইরূপ উপায়ে সাহেব যখন দেখিতে পাইলেন যে, গ্রামের জমিদারের মধ্যে ২/৪ জন তাঁহার হস্তগত হইয়াছে, তখন তাঁহাদিগকে নানারূপ প্রলোভন ও অপরিমিত অর্থ প্রদান করিয়া তাঁহাদিগের নিকট হইতে তাঁহাদিগের জমিদারীর অংশ ইজারা বন্দোবস্ত করিয়া লইলেন। অপরাপর অংশীদারগণ যখন দেখিলেন যে, সাহেব তাঁহাদিগের অংশীদার রূপে পরিগণিত হইয়াছেন, তখন তাঁহার সহিত বিবাদ করিয়া জমিদারি রক্ষা করা সহজ নহে। এইরূপ নানা প্রকারে চিন্তা করিয়া ও অপরিমিত অর্থের লোভও সংবরণ করিতে না পারিয়া, তাঁহারও পরিশেষে তাঁহাদিগের অংশও সাহেবকে ইজারা করিয়া দিলেন। এত দিবস পরে সাহেবের ইচ্ছা পূর্ণ হইল। ঐ গ্রামে এখন নীল-বুনানি করিবার উপায় হইল। 

জমিদারগণ নীলকরগণের বশ্যতাস্বীকার করিলেন সত্য, কিন্তু প্রজাগণ সহজে তাঁহাদিগের বশ্যতাস্বীকার করিতে সম্মত হইল না। কারণ তাহারা জানিত, যদি একবার তাহারা নীলের চাষ গ্রহণ করিয়া নীল-বুনানি আরম্ভ করে, তাহা হইলে পুত্র পৌত্রাদিক্রমে তাহাদিগকে নিজের চাষ আবাদ নষ্ট করিয়া ঐ কার্য করিতে হইবে। প্রজাগণের মধ্যে অনেক ভদ্রলোকও ছিলেন। তাঁহাদিগের যত্নে গ্রামের মধ্যে একটি সভা আহূত হয়। ঐ সভায় গ্রামস্থ প্রজামাত্রই উপস্থিত ছিলেন। অনেক বাদানুবাদের পর ঐ সভায় ইহাই স্থিরীকৃত হয় যে, কোন প্রজাই নীল বুনান করিবে না। আরও সাব্যস্ত হয় যে, নীল বুনান না করিলে নিশ্চয়ই অনেকের নামে মিথ্যা অভিযোগ উপস্থিত হইবে। ঐ সকল অভিযোগের নিমিত্ত যে সকল অর্থ ব্যয় হইবে, তাহা তাহাকে প্রদান করিতে হইবে না। সকলের নিকট হইতে চাঁদা লইয়া কিছু অর্থের সংস্থা করিয়া রাখা হইবে ও ঐ অর্থ হইতেই সমস্ত খরচ পত্রের সঙ্কুলান করা হইবে। 

এইরূপ সাব্যস্ত হইবার পর, প্রজামাত্রেই নীল বুনিতে একেবারে অসম্মত হইল। নীলকর সাহেব ইহা অবগত হইতে পারিয়া গ্রামের প্রধান প্রধান মণ্ডলগণকে ডাকাইলেন। তাঁহারাও সাহেবের নীলকুঠিতে গমন করিলেন। সাহেব তাঁহাদিগকে ভয় দেখাইয়া নীল সাটা গ্রহণ করিতে কহিলেন; কিন্তু, মণ্ডলগণ তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত না হওয়ায় বিশেষরূপ অবমানিত করিয়া সাহেব সেইস্থান হইতে তাঁহাদিগকে বিদায় করিয়া দিলেন। 

এইস্থানে নব্য পাঠকগণ জিজ্ঞাসা করিতে পারেন, “নীল বুনানি করিতে প্রজাগণ অসম্মত হয় কেন?” ধান্যাদি বপন করিয়া যেমন তাহারা অর্থের সংস্থান করিয়া থাকে, নীল বুনান করিলেও ত তাহাদিগের সেইরূপ অর্থের সংস্থান হইতে পারে। ইহার উত্তরে আমি এই মাত্র বলিতে পারি যে, নীলের চাষ করিলে প্রজাগণের কোনরূপেই অর্থ উপার্জ্জন হইতে পারিত না, অধিকন্তু তাহাদিগের বিস্তর ক্ষতি হইত। 

১। যাহার একখানি লাঙ্গলের আবাদ, অর্থাৎ সমস্ত বৎসর পরিশ্রম করিয়া যে ব্যক্তি কোন রূপেই ১৬/ ষোল বিঘার অধিক জমি চাষ করিতে পারে না, নীলের দাদন লইলে অভাব পক্ষে তাহাকে ১০/ বিঘা জমিতে নীল বুনানি করিতে হইবে। ঐ দশ বিঘা জমিতে নীল বুনানি করিবার নিমিত্ত তাহাকে ৫ টাকা অগ্রিম প্রদান করিয়া ৮/১০ বৎসর তাঁহাকে ঐ পরিমিত জমিতে নীল বুনানি করিতে হইবে, এই মর্ম্মে লেখা পড়া ও রেজেষ্টারি করিয়া লওয়া হইত। ঐ লেখা পড়ার প্রায়ই এই রূপ অর্থ থাকিত যে, তাহার বুনানি জমিতে যে পরিমাণে নীল উৎপন্ন হইবে, তাহার মূল্য হইতে অগ্রিম যে ৫ টাকা দাদন দেওয়া হইয়াছে, তাহা কর্তন করিয়া লইয়া অবশিষ্ট টাকা তাহাকে প্রদান করা হইবে, ও বৎসরের প্রথমেই পুনরায় তাহাকে দাদন দেওয়া হইবে। আর নীলের মূল্য হইতে ঐ দাদনি পাঁচ টাকা যদি আদায় না হয়, তাহা হইলে যাহা বাকী থাকিবে, তাহা পর বৎসরের দাদন রূপে পরিগণিত হইবে। দাদন বলিয়া তাহাকে যে পাঁচ টাকা প্রদান করা হইত, তাহা প্রায়ই প্রজার হস্তগত হইত না। নায়েব দাওয়ান, মুহুরি, আমিন, পাইক, বরকনদাজ প্রভৃতিকে কিছু কিছু প্রদান করিয়া, কেহবা অতি সামান্য অর্থ লইয়া আসিতে সমর্থ হইত, কেহবা এক পয়সাও আনিতে পারিত না। 

২। কোন্ জমিতে নীল বুনানি করিতে হইবে, তাহার কিছু স্থিরতা থাকিত না। জমি নির্বাচনের ভার আমিন ও দাওয়ানের উপর অর্পিত ছিল। প্রজা নিজের ধান্যাদি বপন করিবার নিমিত্ত যে সকল জমি উত্তম রূপে কর্ষণ করিয়া প্রস্তুত করিয়া রাখিত, দাওয়ান ও আমিন অনুগ্রহ করিয়া প্রায়ই সেই সকল জমিতে “নীলের মার্কা” দিয়া যাইতেন অর্থাৎ ইহাই আদেশ হইত যে, ঐ সকল জমিতে নীল বুনান করিতে হইবে। একে ত ধান্যাদি বপন করিবার নিমিত্ত তাহার নিতান্ত সামান্য জমি থাকিত তাহার উপর উৎকৃষ্ট জমিগুলি বাহির হইয়া যাওয়ায় তাহার যে কি অবস্থা হইত, তাহা পাঠকগণ অনায়াসেই অনুমান করিতে পারেন। প্রজাগণের অন্য কোন উপায় না থাকায়, পরিশেষে তাহাদিগকে আমিন ও দাওয়ান প্রভৃতির শরণাগত হইতে হইত, ও তাঁহাদিগকে কিছু অর্থ প্রদান করিয়া ঐ সকল ভাল জমির মধ্য হইতে ২/১ বিঘা অপর জমির সহিত পরিবর্ত্তন করিয়া লইতে হইত। 

৩। নীলের দাদন লইলে ধান্যাদি বপন করিবার জমির পরিমাণ অতিশয় অল্প হইয়া যাইত; তাহার উপর উর্ব্বরা ও উত্তমরূপে চাষ করা জমি নীলের চাষে বাহির হইয়া যাওয়ায়, ধান্যাদি উৎপন্ন হওয়ায় সম্ভাবনা অতি অল্প হইয়া পড়িত; সুতরাং, মহাজনগণ তাহাদিগকে অধিক পরিমাণে ধান্য বা অর্থ কর্জ দিতে পারিতেন না অতএব তাহাদিগের বিশেষরূপে অন্নকষ্ট উপস্থিত হইত। 

৪। আমাদের দেশে চাষ আবাদ ও বুনানি সম্পূর্ণ রূপে বৃষ্টির উপর নির্ভর করে। প্রজাগণ জমিতে চাষ দিয়া বীজ বপন করিবার নিমিত্ত বৃষ্টিপতনের অপেক্ষায় বসিয়া থাকে। সময়ে বৃষ্টিপতন হইলে তাহারা প্রায়ই ধান্য বপন করিতে সমর্থ হয়। সেই বৃষ্টিপতনের সঙ্গে সঙ্গে দাওয়ান, আমিন, পাইক, হালসানা ও বরকনদাজগণ আসিয়া লাঙ্গল গরুর সহিত প্রজাগণকে লইয়া গিয়া, তাহাদিগের নির্দ্দিষ্ট জমিতে অগ্রে নীল বুনানি করিয়া লইত। এইরূপে সমস্ত নীল বুনানি কাৰ্য্য শেষ হইয়া গেলে, তাহারা আপনাপন জমিতে ধান্য বপন করিবার আদেশ প্রাপ্ত হইত। সেই সময় ধান্যের জমি প্রায়ই শুখাইয়া যাইত; সুতরাং, পুনরায় যদি বৃষ্টি না হইত, তাহা হইলে তাহারা আর সময় মত ধান্য বপন করিয়া উঠিতে পারিত না। যদি পরিশেষে বৃষ্টিও হইত, তাহা হইলে বিলম্বে অর্থাৎ ধান্য বুনার উপযুক্ত সময়ের অনেক পরে বীজ বপন করিবার অবস্থা ত এই রূপ হইত। তাহার উপর যে বৎসর বর্ষাকালে অধিক পরিমাণে বৃষ্টি হইয়া ঘাসের অতিশয় প্রাদুর্ভাব হইত, সেই বৎসর প্রজাগণ আপনাপন ধান্যের জমি সময় মত “নিড়ানি” করিতে পাইত না। নিড়ানির সময় তাহাদিগকে অগ্রে নীলের জমি নিড়ানি করিয়া দিতে হইত। নীলের জমির নিড়ানি হইয়া গেলে, নিজের ধান্যের জমিতে নিড়ানি করিবার সময় পাইত। তাহারা কিন্তু সেই সময় ধান্যের জমিতে নিড়ানি করিয়া কোন রূপ উপকার প্রাপ্ত হইত না। জমিতে অধিক পরিমাণে ঘাস জন্মিয়া প্রায়ই ধান্যকে একরূপ নষ্ট করিয়া দিত। তদ্ব্যতীত, প্রথম অবস্থায় যে জমি নিড়াইতে এক টাকা মজুরি লাগিত, শেষ অবস্থায় ঘাস অতিশয় বৃদ্ধি হওয়ায় ৫।৬ টাকার কম সেই জমি নিড়ানি হইত না। বিশেষ সেই সময় নিড়াইয়া দিলেও সেই নিস্তেজ ধান্য আর প্রায়ই সতেজ হইতে পারিত না। এইরূপে নীল নিড়ানি করিতে যে নীলকরগণ একেবারেই কোন রূপ ব্যয় করিতেন না, তাহা নহে। অন্য স্থানে মজুরি করিলে যাহারা তিন আনা পাইয়া থাকে, নীলকরগণ তাহাদিগকে কখনই এক আনার অধিক প্রদান করিতেন না। ঐ এক আনার মধ্য হইতেও দাওয়ান আমিন প্রভৃতির কিছু কিছু কমিসন বাহির হইয়া যাইত। 

৫। নীল কাটিবার সময় আরও এক ভয়ানক বিপদ আসিয়া উপস্থিত হইত। যে সময় নীল কাটিতে হয়, ধান্যও সেই সময় কাটিতে হয়। সেই সময় আবার প্রবল প্রবল বন্যার সময়। যে বৎসর প্রবল বন্যার প্রাদুর্ভাব হইয়া অতিশয় জল বৃদ্ধি হইতে আরম্ভ হয়, সেই বৎসর সময়মত কাটিয়া উঠিতে না পারিলে, নীল ও ধান্য প্রায় ডুবিয়া যাইবার সম্ভাবনা। সুতরাং, নীলকরগণ প্রবল পরাক্রমের উপর নির্ভর করিয়া, প্রজাগণের উপর বল প্রকাশেই হউক বা অপর যেরূপেই হউক, বন্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নীল সকল কর্তন করিয়া কুঠিতে লইয়া যাইতেন। প্রজাগণ নীল কাটা পরিত্যাগ করিয়া আপনাপন ধান্য কাটিতে কোনরূপেই সমর্থ হইত না; সুতরাং, তাহাদিগের পাকাধান্য অতল জলে ডুবিয়া যাইত। তাহারা আর কি করিবে, আপনাপন স্ত্রী পুত্রের সহিত রোদন করিয়া অনশনে দিন যাপন করিত। তাহারা মহাজনের নিকট যে সকল ধান্য পূর্ব্বে কৰ্জ্জ লইয়াছিল, তাহা আর তাঁহাদিগকে প্রদান করিতে সমর্থ হইত না; সুতরাং, মহাজনগণ আর কর্জ্জও দিতেন না। এরূপ অবস্থায় অনশন ভিন্ন দরিদ্র প্রজার আর উপায় কি? যে সকল প্রজা কোনরূপে নীল কাটিয়া ও সপরিবারে রাত্রিদিন বিশেষ পরিশ্রম করিয়া আপনাপন ধান্য সকল কাটিয়া লইতে সমর্থ হইত, তাহাদিগেরও যে একেবারে লোকসান হইত না, তাহা নহে; ঐ সকল ধান্য জমী হইতে উঠাইয়া লইবার নিমিত্ত তাহারা কোনরূপেই গাড়ির সংস্থান করিয়া উঠিতে পারিত না; কারণ, গাড়ি মাত্রই নীল লইয়া যাইবার নিমিত্ত জোর করিয়া নিযুক্ত করা হয়। সুতরাং বন্যার প্রাদুর্ভাব অধিক হইলে, ঐ সকল কাটা ধান্য স্রোতে ভাসিয়া চলিয়া যায়। যে সকল ধান্য কোনরূপ আটকাইয়া রাখা হয়, অনেক দিবস পর্য্যন্ত জলের মধ্যে থাকায় তাহাও একেবারে পচিয়া যায়। 

৫। নীল ভাল জন্মিলেও যে প্রজাগণ তাহার উপযুক্ত মূল্য প্রাপ্ত হইত, তাহা নহে। যদি কাহারও দশ গাড়ি নীল জন্মাইত, হিসাবের সময় সে প্রায়ই পাঁচ গাড়ির অধিক প্রাপ্ত হইত না। ঐ নীলের মধ্যে ৬/৭ গাড়ি নীল সরকারী হিসাবে ৫ গাড়ির মধ্যেও পড়িয়া যাইত। অবশিষ্ট ৩/৪ গাড়ি কোন এক অজ্ঞাতনামে জমা থাকিত; বলা বাহুল্য, ঐ নীলের দাম পরিশেষে নায়েব হইতে সামান্য তাগাইতগিরি পর্য্যন্ত সকলের মধ্যে বিভক্ত করিয়া লওয়া হইত। 

এইরূপ নানাপ্রকার অত্যাচারের নিমিত্ত প্রায় কেহই নীলের সাটা লইতে চাহিত না। বিশেষ একবার পাঁচ টাকা গ্রহণ করিয়া নীলের দাদন লইলে, সেই পাঁচ টাকা তাহার পুত্র পৌত্রাদিক্রমেও পরিশোধ হইত না। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

গ্রাম ইজারা হইয়া গেলে, মণ্ডলগণের মধ্যে কেহই নীলের দাদন লইতে সম্মত হইল না; অপরাপর প্রজাগণও নীলের চাষ করিতে অস্বীকার করিল সত্য, কিন্তু নীলকরগণ সহজে ছাড়িবার পাত্র নহেন। তাহারা ক্রমে তাহাদিগের অমোঘ অস্ত্র সকল বাহির করিতে আরম্ভ করিলেন। প্রজাদিগকে বশীভূত করিয়া, তাহাদিগকে নীলের দাদন দেওয়ার যে কতরূপ উপায় ছিল, তাহা সমস্ত বর্ণনা করা আমার পক্ষে একেবারে অসম্ভব। তথাপি সামান্য সামান্য উপায়গুলি, যাহা আমাদিগের সম্মুখে ঘটিয়াছিল, তাহাই নিম্নে লিপিবদ্ধ হইল মাত্র। 

১। জমিদারি ইজারা লইবার পরই তাঁহারা গ্রামের সমস্ত স্থান একেবারে জরীপ করিতে আরম্ভ করিলেন; অর্থাৎ গ্রামের মধ্যে যে সকল জমি আছে, সেই সমস্ত জমির মাপ আরম্ভ হইল। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সময় হইতে প্রজাগণ যে সকল জমি উপভোগ করিয়া আসিতেছিল, এখন সেই সকল জমিতে নীলকরগণ সৰ্ব্বপ্রথমেই দৃষ্টিনিক্ষেপ করিলেন। ঐ সকল জমি মাপ করিবার প্রধান কারণ এই যে, প্রজাগণ যে সকল জমি বহুকাল হইতে দখল করিয়া আসিয়াছে, বৰ্ত্তমান সময়ের মাপ অপেক্ষা সাবেক সময়ের মাপে অধিক জমি প্রজাগণের দখলে ছিল। এমন কি জমিদারকে এক বিঘা জমির খাজনা প্রদান করিলে, তাহার প্রায় ১।।০ বিঘা পরিমিত জমি দখল করিয়া লইতে পারিত। ঐ সকল জমি বাহির করিয়া লওয়া ও খাজনার হার বৃদ্ধি করাই, পূর্ব্বোক্ত জরীপের প্রধান উদ্দেশ্য। 

কেবলমাত্র ১ বিঘার খাজনা দিয়া প্রজাগণ যে ১।।০ বিঘা জমি চুরি করিয়া দখল করিয়া রাখিত, তাহা নহে। কথিত আছে, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র যখন প্রজাগণের সহিত তাঁহার জমিদারীর জমি সকল বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন, সেই সময় সমস্ত জমি মাপিয়া একটি বন্দোবস্ত করা হয়। প্রজাগণ সেই সময় একত্র সমবেত হইয়া মহারাজের দরবারে গমন করেন, ও তথায় আপনাপন অবস্থা অবগত করাইয়া চলিত মাপের অপেক্ষা জমির মাপ কিছু বর্দ্ধিত করিয়া দিবার নিমিত্ত প্রার্থনা করেন। মহারাজাও প্রজাগণের উপর সন্তুষ্ট হইয়া জমির মাপ চারি আঙ্গুলি বাড়াইয়াদেন; অর্থাৎ ৮০ হস্ত পরিমিত জমিতে এক বিঘা হইয়া থাকে, ইহা সৰ্ব্ববাদীসম্মত; কিন্তু এখন হাতের পরিমাণ হইয়াছে ১৮ ইঞ্চি। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে সেই হাতের পরিমাণ ছিল ২০ ইঞ্চি; অর্থাৎ ২০ ইঞ্চিতে ১ হাত করিয়া, সেই হাতের ৮০ হাতে ১ বিঘা জমি হইত। জরীপের সময় প্রজাগণের আবেদন মঞ্জুর করিয়া মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সেই হাতের পরিমাণ আর চারি অঙ্গুলি বাড়াইয়া দেন; অর্থাৎ ১ হাতের পরিমাণ হয় ২০ ইঞ্চির উপর আরও চারি ইঞ্চি অর্থাৎ ২৪ ইঞ্চি। 

প্রজাগণ ইহাতেও সন্তুষ্ট না হইয়া পুনরায় কৃষ্ণচন্দ্রের রাজধানী নবদ্বীপে উপস্থিত হয়। মহারাজ অতিশয় হিন্দু ছিলেন; প্রত্যহ গঙ্গাস্নান ও পূজাদি না করিয়া জলগ্রহণ করিতেন না। এক দিবস স্নান করিবার কালীন যখন তিনি গঙ্গা গর্ভে অবতরণ করিয়াছিলেন ও গঙ্গা স্নান করিতে গঙ্গাস্তব পাঠ করিতেছিলেন, সেই সময় প্রজাগণ সেই ভাগীরথী তীরে সমবেত হয়। মহারাজ তাহাদিগকে সেই স্থানে সমবেত দেখিয়া সেই গঙ্গার গর্ভ হইতেই জিজ্ঞাসা করেন, “এত লোক এখানে সমবেত হইয়াছে কেন? উহারা কে?” উত্তরে তাঁহার একজন পারিষদ কহেন “উহারা সকলেই মহরাজের প্রজা। জমির মাপের পরিমাণ কিছু বর্দ্ধিত করিয়া লইবার নিমিত্ত আপনার নিকট আসিয়া দরবার করিয়াছিল। মহারাজও তাহাদিগের প্রার্থনা মঞ্জুর করিয়া জমির পরিমাণ প্রত্যেক হস্তে চারি আঙ্গুলি বর্দ্ধিত করিয়া দিবার আদেশ প্রদান করিয়াছিলেন; কিন্তু, প্রজাগণ তাহাতেও সন্তুষ্ট না হইয়া, পুনরায় মহারাজের নিকট দরবার করিবার নিমিত্ত এই স্থানে আসিয়া সমবেত হইয়াছে।” অনুচরের কথা শুনিয়া প্রজাগণের উপর মহারাজের ঈষৎ ক্রোধের উদয় হইল; কিন্তু সেই ক্রোধ সংবরণ করিতে না পারিয়া, তিনি গঙ্গাগর্ভে দণ্ডায়মান হইয়া বলিয়া ফেলিলেন, “আমি যাহা প্রজাগণকে দিয়াছি,তাহাতেও যদি তাহারা সন্তুষ্ট না হইয়া থাকে, তাহা হইলে তাহাদিগকে আর কলাটি প্রদান করিব।” এই বলিয়া তিনি তাঁহার দক্ষিণ হস্ত মুষ্টিবদ্ধ ও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ উত্তোলন পূর্ব্বক প্রজাগণকে দেখাইলেন। প্রজাবৃন্দের মধ্যে দুই একজন বিশেষ চতুর লোক ছিল। তাহারা “যে আজ্ঞে মহারাজ, তাহাই দিবেন” এইরূপ বলায়, সকলে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। পরিশেষে সেই প্রজাগণ মহারাজের দাওয়ানের নিকট গমন করিয়া কহিল, “আমাদিগের জমির মাপের পরিমাণ প্রত্যেক হস্তে ২০ ইঞ্চির উপর চারি ইঞ্চি মহারাজ বাড়াইয়া দিয়াছিলেন। পুনরায় তাহার উপর এককলা অর্থাৎ আরও প্রায় ৮ ইঞ্চি বাড়াইয়া দিয়াছেন।” দাওয়ান এই কথা শুনিয়া মহারাজকে জিজ্ঞাসা করিলেন। উত্তরে মহারাজ গঙ্গাস্নান করিবার সময় যে অবস্থা ঘটিয়াছিল, তাহা দাওয়ানকে বলিলেন, ও পরিশেষে একটু বিবেচনা করিয়া কহিলেন, “আমি যদিচ রাগভরে ঐ কথা বলিয়াছিলাম সত্য, কিন্তু আমার উদ্দেশ্য ছিল যে, আমি আর কিছু বাড়াইয়া দিব না; কিন্তু, এখন আমি বুঝিতে পারিতেছি যে, গঙ্গার গর্ভে দণ্ডায়মান অবস্থায় যখন আমার মুখ দিয়া এক কথা বাহির হইয়া গিয়াছে, তখন তাহা করিতেই হইবে; নতুবা সামান্য অর্থের নিমিত্ত আমি মহাপাতকে পতিত হইব।” 

সেই সময় হইতে প্রজাগণের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইল, অর্থাৎ জমির মাপের নিমিত্ত ১৮ ইঞ্চি হস্তের পরিবর্তে প্রায় ৩২ ইঞ্চি ব্যবহৃত হওয়ায়, এক বিঘা জমির খাজনা প্রদান করিয়া প্রজাগণ প্রায় ১।।০ বিঘা জমি ভোগ করিতে লাগিল। প্রজার পক্ষে ইহা বড় কম লাভ নহে। তদ্ব্যতীত, জমির নিরিখও অতিশয় কম ছিল। তিন বিঘা হইতে পাঁচ বিঘা পর্যন্ত জমির বাৎসরিক খাজনা একটাকা ধার্য্য ছিল। 

নীলকরগণ ইহা পূর্ব্ব হইতেই অবগত ছিলেন; সুতরাং জমির জরিপ করিয়া যে প্রজার দখলে ২০ বিঘা জমি ছিল, তাহা পরিমাণে প্রায় ৩০/৩৫ বিঘা হইল। পাঁচ বিঘার নিরিখে যাহার খাজনা ছিল, জমাবন্দি করিয়া ঐ জমির নিরিখ টাকায় দুই বিঘা করিতে চাহিলেন; অর্থাৎ যে প্রজা নীলকরগণের মাপের প্রায় ৩০। ৩৫ বিঘা জমিতে চাষ আবাদ করিয়া কেবল মাত্র ৪ টাকা খাজনা দিয়া আসিতেছিল, এখন নীলকরগণ সেই প্রজার নিকট হইতে বাৎসরিক ১৫।১৬ টাকা খাজনা প্রার্থনা করিলেন। প্রজাগণ সেই খাজনা প্রদানে অসম্মত হওয়ায় ক্রমে তাহাদিগের নামে নালিস হইতে লাগিল। সেই সময় বিচারকগণের মধ্যে প্রায় অনেকেই নীলকুঠিয়ালগণের বশীভূত ছিলেন; সুতরাং, প্রজার আপত্তি প্রায়ই গ্রাহ্য হইতে লাগিল না। কাহার ৪ টাকার স্থলে ১০ টাকা, কাহারও বা ১২ টাকার হিসাবে ডিক্রী হইতে লাগিল। ঐ সকল প্রজা যখন দেখিল যে, চিরদিবসের নিমিত্ত তাহাদিগকে এই ভয়ানক খাজনার ভার বহন করিতে হইবে, তখন কাজেই তাহারা এক এক করিয়া নীলকরের বশীভূত হইয়া, তাহাদিগের জমিজমা বজায় রাখিতে লাগিল। কিন্তু নীলকরগণ যে তাহাদিগের সাবেক জমা একেবারে বজায় রাখিলেন, তাহা নহে; জমির হার কিছু কিছু বাড়াইয়া বন্দোবস্ত করিতে লাগিলেন, ও সেই সঙ্গে সঙ্গে প্রজাগণও নীলের দাদন গ্রহণ করিতে আরম্ভ করিল। এই উপায়ে নীলকরগণের উদ্দেশ্য কিয়ৎপরিমাণে সফল হইতে লাগিল। যে সকল প্রজা অবশিষ্ট রহিল, তাহাদিগের উপর অন্য উপায় করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। 

২। যে সকল প্রজা জরীপ জবান বন্দীতে নীলকর সাহেবের বশ্যতাস্বীকার করিল না, তাহাদিগের ভদ্রাসন বাড়ীর চতুৰ্দ্দিকে যে সকল জমি ছিল, তাহা “লোকসান” জমি অর্থাৎ জমীদারের নিজের জমির মধ্যে পরিগণিত করিয়া, তাহাতে নীলকরগণ নীলের বীজ ছড়াইয়া দিতে লাগিলেন। ঐ সকল জমিতে নীল উৎপন্ন করা উদ্দেশ্য ছিল না, উদ্দেশ্য যাহাদিগের বাড়ীর চতুদিকে ঐ সকল নীল রোপিত হইয়াছে, তাহাদিগকে বিশেষ রূপে কষ্ট প্রদান করা। পল্লী গ্রামের প্রজামাত্রই দুই চারিটি গরু বাছুর লইয়া বাস করিয়া থাকে। তাহাদিগকে সদাসৰ্ব্বদা আবদ্ধ করিয়া রাখা একেবারেই অসম্ভব; সুতরাং, ঐ সকল গরু বাছুরের মধ্যে কোন গতিকে যদি একটি আসিয়া ঐ নীলের জমিতে উপস্থিত হইত, তখনই উহাকে ধরিয়া পাউণ্ডে প্রেরণ করা হইত; তদ্ব্যতীত, যাহার গরু তাহার নামে নীল খেসারত করা অপরাধে আদালতে নালিস রুজু করা হইত। ধনবান সাহেব ফরিয়াদী, এ দেশীয় গরীব প্রজা আসামী; সুতরাং, মোকদ্দমার প্রায়ই প্রজাগণকে পরাজিত হইতে হইত, ও ক্রমে তাহারা অনেক টাকার দায়ী হইয়া পড়িত। তখন অনন্যোপায় হইয়া তাহাদিগকে নীলকরগণের শরণাগত হইতে না পারিলে আর উপায় থাকিত না। 

৩। যে সকল প্রজা নীলকরগণের বশ্যতাস্বীকার করিতে কিছুতেই সম্মত হইত না, তাহাদিগকে বশীভূত করিবার নিমিত্ত নীলকরগণ আরও এক ভয়ানক উপায় বাহির করিতেন। তাঁহারা যেমন দেখিলেন যে, প্রজাগণ তাহাদিগের নিজের জমিতে উত্তমরূপে চাষ দিয়া ধান্যের বীজ বপন করিয়াছে, তাহার পরদিবসই নীলকর কর্ম্মচারিগণ অনেক লাঙ্গল গরু, লোকজন ও লাঠিয়াল প্রভৃতি সংগ্রহ করিয়া, সেইস্থানে উপস্থিত হইত ও সেই সকল ধান্যবোনা জমির উপর পুনরায় একখানি চাষ দিয়া নীলের বীজ বপন করিয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিত। ওদিকে পূর্ব্বেই বিচারালয়ে উপনীত হইয়া যাহারা পূর্ব্বে ধান্য বপন করিয়াছিল, তাহাদিগের নামে মিথ্যা এক নালিস এই মর্ম্মে উপস্থিতকরিতেন, যে, তাঁহাদিগের নীলবোনা জমি ভাঙ্গিয়া প্রজাগণ তাহাতে ধান্য বপন করিয়াছে। বিচারের সময় ঐ জমিতে নীল ও ধান্য উভয় প্রকার শস্যের চারা বাহির হইয়া পড়িত। বিচারেও বিনা যোগাড়ে ও বিনা অর্থব্যয়ে প্রজাগণ পরাজিত হইয়া নীলকরদিগের নিকট খেসারত প্রভৃতিতে অনেক টাকার দায়ী হইয়া পড়িত। তদ্ব্যতীত অন্যায় কার্য্য করা অপরাধে বিনাদোতে অনেককে জেলে পর্য্যন্তও গমন করিতে হইত। এই সকল কারণে অনন্যোপায় হইয়া, পরিশেষে সেই সকল প্রজাদিগকেও নীলকরগণের বশ্যতাস্বীকার করিয়া নীলের সাটা গ্রহণ ও নীলকরগণের ইচ্ছামত নীল বুনানি করিতে হইত। 

এই সকল উপায়েও যাহারা বশ্যতাস্বীকার করিত না, তাহাদিগের উপর আরও অতিশয় ভয়ানক ভয়ানক অত্যাচার আরম্ভ হইত। প্রগাঢ় অন্ধকার রাত্রির মধ্যে কাহার ঘরে ধূ ধূ করিয়া অগ্নি জ্বলিয়া উঠিত। দেখিতে দেখিতে তাহার যথাসর্বস্ব দগ্ধ হইয়া ভস্মে পরিণত হইত। কাহার ঘর হইতে সুন্দরী স্ত্রীলোকগণ হঠাৎ অন্তর্হিত হইয়া যাইত, কিন্তু কোথায় যে তাহারা গমন করিত, তাহা কেহই বলিতে পারিত না। কিন্তু নীলের সাটা গ্রহণ করিবার পরই কোথা হইতে আসিয়া তাহারা পুনরায় উপনীত হইত। যাহার যতগুলি গরু আছে, তাহার প্রত্যেকগুলিই প্রায় প্রত্যহ পাউণ্ডে গমন করিত। পাউণ্ডের জরিমানা দিতে অনেক প্রজার অনেক গরু বিক্রয় হইয়া যাইত। তাহার উপর পাউণ্ডে দিবার সময় সেই সকল গরু ছিনাইয়া লইয়াছে, প্রজাগণের উপর এইরূপ নালিস প্রায়ই ফৌজদারীতে উপস্থিত হইত; প্রমাণও হইয়া যাইত। প্রজাগণ জরিমানা দিয়া ও জেল খাটিয়া পরিশেষে নীলকর গণের বশ্যতাস্বীকার করিত। এই সকল কারণ ব্যতীত আর যে কতরূপ উপায় বাহির করিয়া নীলকরগণ প্রজাগণকে বশীভূত করিতে সমর্থ হইতেন, তাহার সমস্ত অবস্থা বর্ণন করা আমার এই ক্ষুদ্র লেখনীর কার্য্য নহে। কেবলমাত্র আর একটি ঘটনার উল্লেখ করিয়া এই সকল বিষয় বর্ণন করিতে আমি বিরত হ‍ইব। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

একদিবস দেখিলাম, তিনটি লোক আমদিগের সম্মুখ দিয়া গমন করিতেছেন ও ৮।১০ জন লাঠিয়াল উহাদিগকে বেষ্টন করিয়া লইয়া যাইতেছে। ঐ লোক তিনটিকে দেখিয়া আমার মনে অতিশয় কৌতূহল আসিয়া উপস্থিত হইল; কারণ, দেখিলাম উহাদিগের মস্তক প্রায় ৪ অঙ্গুলি মৃত্তিকার দ্বারা আবৃত; তাহার উপর দুই তিন অঙ্গুলি লম্বা নীলের ঢারা সকল বাহির হইয়া মস্তককে একেবারে আবৃত করিয়া ফেলিয়াছে। এই অবস্থা দেখিয়া, আমরাও তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলাম। কিয়দ্দূর গমন করিবার পর দেখিলাম, তাহারা একস্থানে উপনীত হইয়াছে। ঐ স্থানে পাড়ার যাবতীয় ভদ্রলোক আসিয়া উপবেশন করিতেন। যখন যাঁহার সাবকাশ হইত, তখনই তিনি ঐ স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইতেন। কোনরূপ প্রস্তাব, পরামর্শ, তর্ক, বিতর্ক, ভাল মন্দ বিচার প্রভৃতি সকলই সেইস্থানে বসিয়া হইত। ভদ্রলোকগণের মধ্যে দুই চারিজন প্রায় সৰ্ব্বদাই সেইস্থানে উপস্থিত থাকিতেন। পূর্ব্বোক্ত ব্যক্তিগণ সেইস্থানে উপস্থিত হইলে, ভদ্রলোকদিগের মধ্যে একজন তাহাদিগকে লক্ষ্য করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কি হে-মণ্ডল, তোমরা এতদিবস কোথায় ছিলে? তোমাদিগের নিমিত্ত অনুসন্ধান করা না হইয়াছে, এমন স্থানই নাই। তোমাদিগের মাথার উপর কি?” 

এই কথার উত্তরে মণ্ডল কহিল, “আর কি বলিব, মহাশয়! নীল বুনিতে অস্বীকার করিয়াছিলাম বলিয়া আমাদিগের এই দশা ঘটিয়াছে। জমিতে নীল বুনান করিবার পরিবর্তে পরিশেষে আপনাপন মস্তকের উপর নীল বপন করিতে হইয়াছে।” 

ভদ্রলোক। কোথায় তোমাদিগের এইরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে?

মণ্ডল। কুঠিতে। 

ভদ্রলোক। সেইস্থানে তোমরা গমন করিলে কেন? 

মণ্ডল। আমরা কি ইচ্ছা করিয়া সেইস্থানে গমন করিয়াছিলাম? আমাদিগকে বলপূর্ব্বক ধরিয়া লইয়া গিয়াছিল।

ভদ্রলোক। কিরূপে তোমাদিগকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছিল, তাহা ত আমরা কিছুই জানিতে পারি নাই। তোমরা কোথায় চলিয়া গিয়াছ, অনুসন্ধান করিয়া তোমাদিগকে পাওয়া যাইতেছে না, কেবলমাত্র ইহাই আমরা শুনিয়াছিলাম।

মণ্ডল। আজ প্রায় দশ দিবস হইল, একদিবস সন্ধ্যার পর আমরা কয়েকজন মিলিত হইয়া এইদিকে আসিতেছিলাম, এরূপ সময় প্রায় ২০/২৫ জন লাঠিয়াল কোথা হইতে আসিয়া আমাদিগের উপর পতিত হইল ও বলপূর্ব্বক আমাদিগকে ধরিয়া লইয়া কুঠিতে গিয়া উপস্থিত হইল। সাহেব আমাদিগকে দেখিয়াই গালি প্রদান করিলেন ও পরিশেষে দরয়ানদিগের জমাদারকে ডাকিয়া তাহাকে বলিয়া দিলেন “যে পর্য্যন্ত ইহারা নীল বুনান করিতে সম্মত না হইবে, সেই পৰ্য্যন্ত ইহারা গুদামে আবদ্ধ থাকিবে ও উহাদিগের মস্তকের উপর নীল বপন করা হইবে। যে পৰ্য্যন্ত উহার নীলের সাটা গ্রহণ করিয়া উহা রেজেষ্টারী করিয়া না দিবে, সেই পর্যন্ত উহারা গুদামে আবদ্ধ থাকিবে, ও উহাদিগের মস্তকের উপর সেই পর্যন্ত নীলের চারা বর্দ্ধিত হইতে থাকিবে।” সাহেবের আদেশ প্রতিপালিত হইল। আমাদিগের মস্তকের উপর উত্তমরূপে কাদা লাগাইয়া, তাহার উপর নীলের বীজ বপন করা হইল। আমাদিগের সাধ্য নাই যে, উহাতে আমরা অসম্মত হই, বা মস্তক হইতে উহা বিচ্যুত করিয়া ফেলি। কারণ, প্রত্যেক আদেশ লঙ্ঘনের নিমিত্ত সাহেব ২৫/২৫ হাতার ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছিলেন। তাহার উপর অনাহারে আমাদিগকে এই কয়দিবস অতিবাহিত করিতে হইয়াছে। সমস্ত দিবসের মধ্যে আহারের ব্যবস্থা ছিল, ধান্য মিশ্রিত এক পোয়া কাঁচা চাউল। এরূপ অবস্থায় নীল বুনিতে সম্মত না হইয়া আর কতদিবস আমরা থাকিতে পারি? সুতরাং, আমরা নীলের সাটা গ্রহণে প্রস্তুত হইয়াছি, দলিলও লেখাপড়া করিয়া রেজেষ্টারী করিয়া দিতে সম্মত হইয়াছি; তথাপি, আমরা এখনও অব্যাহতি পাই নাই। এই দরয়ানগণের উপর আদেশ হইয়াছে যে, এই অবস্থায় গ্রামের মধ্যে আমাদিগকে ঘুরাইয়া আমাদিগের অবস্থা প্রজামাত্রকেই দেখাইবে। তাহার পর আমাদিগকে পুনরায় কুঠিতে লইয়া যাইবে। যখন আমরা নীলের সাটা গ্রহণ করিয়া দলিল লেখাপড়া ও রেজেষ্টারী করিয়া দিব, তখন আমাদিগকে ছাড়িয়া দিবে। 

মণ্ডলগণের এই কথা শুনিয়া, সেইস্থানে যাঁহারা উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাদিগের চক্ষুতে জল আসিল। তাঁহারা আর কোনরূপেই স্থির থাকিতে না পারিয়া কহিলেন, “আচ্ছা, ইহারা তোমাদিগকে লইয়া যাউক। দেখি, আমরা কিছু করিয়া উঠিতে পারি কি না।” এই বলিয়া যে কয়েকজন ভদ্রলোক সেইস্থানে উপস্থিত ছিলেন, তাঁহারা সেইস্থান হইতে উঠিয়া স্থানান্তরে গমন করিলেন। দরয়ানগণও মণ্ডলগণকে লইয়া সেইস্থান হইতে গ্রামের অপর স্থানে গমন করিতে লাগিল। বাল্যস্বভাব-প্রযুক্ত আমরাও তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলাম। কিয়ৎদূর গমন করিবার পরই দেখিতে পাইলাম, গ্রামের কতকগুলি প্রজা রৈ রৈ শব্দে সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহাদিগের কাহার হস্তে লাঠি, কাহার হস্তে বংশ খণ্ড, কাহার হস্তে সড়কি। ফলতঃ, যে যা পাইয়াছে তাহাই লইয়া সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। উহারা আসিয়াই দরয়ানগণকে প্রহার করিতে আরম্ভ করিল। প্রহারের ভয়ে দরয়ানগণ মণ্ডলদিগকে সেই স্থানে পরিত্যাগ পূর্ব্বক সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। পরিশেষে আমরা বেশ বুঝিতে পারিয়াছিলাম, উহা পূৰ্ব্ব কথিত ভদ্রলোকদিগেরই কাণ্ড! তাঁহারাই পরামর্শ করিয়া লোকজন সংগ্রহ পূর্ব্বক মণ্ডলদিগকে নীলকরগণের হস্ত হইতে উদ্ধার করে। 

এই ঘটনার দুই দিবস পরেই গ্রামের মধ্যে একটি বৃহৎ সভা আহূত হইল। ঐ সভায় নিতান্ত দরিদ্র প্রজা হইতে ধনশালী ভদ্রলোক পর্যন্ত উপস্থিত হইলেন। তথায় উহাই স্থিরীকৃত হইল যে, এখন হইতে কিছুতেই আর নীলকরগণের বশ্যতা স্বীকার করা হইবে না। কেহই নীল বুনানী করিবে না; নীলের সাটা আর কেহই গ্রহণ করিবে না; নীলকুঠির কোন কর্ম্মচারীকে গ্রামের ভিতর একবারে প্রবেশ করিতে দিবেন না। ইহাতে গ্রামস্থ সমস্ত লোককে জেলে গমন করিতে হয়, তাহাতেও সকলে প্রস্তুত থাকিবেন। গ্রামের সীমান্তে নীলকরের কোন লোকজন আসিলে সমস্ত প্রজা একত্রিত হইয়া উত্তমরূপ প্রহারপূর্ব্বক তাহাদিগকে সেইস্থান হইতে তাড়াইয়া দিবেন। আরও সাব্যস্ত হইল, গ্রামের 

• মধ্যে স্থানে স্থানে এক একটি ডঙ্কা থাকিবে। একস্থান হইতে ডঙ্কা ধ্বনি হইবামাত্রই সমস্ত ডঙ্কা নিনাদিত হইবে। ঐ ডঙ্কারব শুনিয়া সকলেই অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত হইয়া যে স্থান হইতে প্রথম ডঙ্কা ধ্বনি উত্থিত হইয়াছিল, সেই দিকে গমন করিবেন। কারণ ডঙ্কাধ্বনি উত্থিত হইলেই বুঝিতে হইবে যে, সেইদিকে নীলকরগণ আসিয়া কোনরূপ অত্যাচার আরম্ভ করিয়াছে। 

প্রকাশ্য সভায় সেই সকল বিষয় স্থিরীকৃত হইবার পর হইতেই সেইরূপ ভাবে কার্য্য চলিতে লাগিল। নীলকর সাহেবও এই সকল বিষয় অবগত হইয়া একটু ভীত হইয়া পড়িলেন। সভার উদ্দেশ্য কতদূর সফল হয়, তাহা দেখিবার নিমিত্ত কোনরূপ কার্য্যে উপলক্ষ করিয়া, দুই একজন নিম্নপদস্থ কর্ম্মচারীকে গ্রামের মধ্যে প্রেরণ করিলেন। বলা বাহুল্য, গ্রামের মধ্যে পদক্ষেপ করিবামাত্রই তাহারা বিশেষরূপ অবমানিত হইয়া সেইস্থান হই ত পলায়ন করিল। এই সকল বিষয় ক্রমে মাজিষ্ট্রেট সাহেবের কর্ণগোচর হইল। কোন কোন প্রজার বিপক্ষে ফৌজদারিতে নালিস উপস্থিত হইতে লাগিল; তথাপি, কিন্তু প্রজাগণ আপনাপন প্রতিজ্ঞা পালন করিতে কিছুমাত্র পরাঙ্মুখ হইল না। 

এই গ্রামের প্রজাগণের অবস্থা দেখিয়ে, নিকটবর্তী গ্রাম সকলের প্রজাগণ আসিয়া তাহাদিগের সহিত যোগ দিতে লাগিল। তাহারাও নীলবুনানি বন্ধ করিয়া, পূর্ব্ব কথিত প্রজাগণের মতানুযায়ী চলিতে লাগিল। কলিকাতায় কয়েকখানি সংবাদপত্রও এই সুযোগ অবলম্বন করিয়া প্রজাগণের দুঃখকাহিনী সর্ব্বসাধারণে ও গভর্ণমেন্টের কর্ণগোচর করিতে আরম্ভ করিলেন। 

যে সময় গ্রামের মধ্যে এই সকল অবস্থা ঘটিতেছিল, সেই সময় গ্রামের কয়েকজন প্রধান লোক নীলকরগণের চাকরি করিতেন; কিন্তু, যে নীলকর সাহেবের সহিত প্রজাগণের এইরূপ মনোবিবাদ উপস্থিত হইয়াছিল, তাঁহারা সেই সাহেবের অধীনে কর্ম্ম করিতেন না, অপর সাহেবের অধীনে অপর কুঠিতে থাকিতেন। এক দিবস তাঁহাদিগের মধ্যে দুই তিন জন বাড়ীতে আগমন করেন ও অপরাপর সকলকে কহেন, “কোন সাহসের উপর নির্ভর করিয়া তোমরা প্রবলপরাক্রমশালী নীলকরের বিপক্ষে দণ্ডায়মান হইয়াছ? মোকদ্দমা প্রভৃতিতে যে সকল অর্থের ব্যয় হইবে, তাহা না হয় চাঁদা করিয়া সংগ্রহ হইতে পারে। কিন্তু, তোমাদিগের লোকবল কোথায়? লোকবল না থাকিলে এ সকল কার্য্যে কিছুতেই হস্তক্ষেপ করা কৰ্ত্তব্য নহে।” 

তাঁহারা স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া এই কথা বলিয়াছিলেন, কি তাঁহাদের মনিবের পরামর্শ মত প্রজাগণের বল পরীক্ষা করিবার নিমিত্ত এই কথা বলিয়াছিলেন, তাহা আমরা অবগত নহি। কিন্তু অনেকেই তাহার পর অনুমান করিয়াছিলেন যে, সাহেবদিগের পরামর্শ অনুযায়ী এই কথার উল্লেখ করা হইয়াছিল। 

তাঁহাদিগের কথার উত্তরে অপরাপর ভদ্রলোক কহিলেন, “আমাদিগের অর্থেরই কিছু টানাটানি আছে; কিন্তু, লোকবলের কিছু মাত্র অল্পতা নাই। যদি ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে আমরা আপনাদিগকে দেখাইতে পারি যে, আমরা কত লোক একত্র মিলিত হইয়া এই কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছি।” 

“ভাল, একবার দেখাও দেখি, তোমাদিগের কিরূপ লোকবল আছে।” 

“এখন সময়টি ঠিক নয়, দিবা দ্বিপ্রহর অতীত হইয়াছে; কৃষক মাত্রই এখন বাড়ীতে নাই, সকলেই আপনাপন কার্য্যে বাহির হইয়া গিয়াছে। তথাপি দেখি, এই অসময়েও কতগুলি লোককে এই স্থানে সমবেত করিতে সমর্থ হই।” 

এই বলিয়া একজন নিকটবর্ত্তী একটি প্রকাণ্ড ডঙ্কার নিকট গমন করিলেন ও ঐ ডঙ্কাটি লইয়া একটি দ্বিতল বাড়ীর ছাদের উপর উত্থিত হইয়া উহা বাজাইতে আরম্ভ করিলেন। দুই চারি ডঙ্কারধ্বনি হইবার পরই চতুৰ্দ্দিক হইতে ডঙ্কারব সকল শ্রুতিগোচর হইতে লাগিল। সেই ডঙ্কারবের সঙ্গে চারিদিক হইতে লোকজন আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইতে লাগিল। যে ব্যক্তি যেরূপ অবস্থায় ছিল, সে সেইরূপ অবস্থায় আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল। যাহারা কৃষিক্ষেত্রে কার্য্য করিতেছিল, তাহারা কৃষিকার্য্য উপযোগী দ্রব্যাদি হস্তে সেই স্থানে উপস্থিত হইল; অর্থাৎ, কাহার স্কন্ধে লাঙ্গল, কাহার হস্তে পাঁচনী, কাহার হস্তে নিড়ানি, কাহার হস্তে দা, কাহার হস্তে কোদালি প্রভৃতি; যাহারা স্নান করিতে গমন করিতেছিল, তাহারা তৈলাক্ত কলেবরেই সেই স্থানে উপস্থিত হইল। আসিবারকালীন পথিমধ্যে বাঁশ কাষ্ঠ প্রভৃতি যাহা কিছু প্রাপ্ত হইল, তাহাই লইয়া উপস্থিত হইল। যাহারা আপনাপন বাড়ীহইতে আগমন করিল, তাহারা সুসাজে সজ্জিত হইয়াই আসিল। তাহাদিগের কাহার হস্তে লাঠি, কাহার হস্তে বর্শা, সড়কি, কাহার হস্তে তরবারি, কাহার কাহার হস্তে বা সেকেলে পলিতা জ্বালা বন্দুক। এই রূপ অবস্থায় লোকজন সেই স্থানে উপস্থিত হইতে লাগিল। ক্রমে সেইস্থানে এতলোকের সমাগম হইল যে, সেই স্থানে আর তাহাদিগের দাঁড়াইবার সঙ্কুলান হইল না। তখন কি করা যায়, ও কিরূপ উপায়ে উহাদিগকে নিবৃত্ত করা যায়, তাহার পরামর্শ হইতে লাগিল। ভদ্রলোকদিগের মধ্যে একজন এই অবস্থা দেখিয়া, তাহাদিগকে সেই স্থান হইতে স্থানান্তরিত করিবার মানসে কহিলেন, “গ্রামের দক্ষিণ মাঠে নীলকরগণের কতকগুলি লোক আসিয়া গ্রামস্থ প্রজাগণের গরু ঘিরিয়া লইয়া যাইতেছে।’ 

এই কথা শুনিয়া সকলেই “মার মার” শব্দে গ্রামের দক্ষিণ দিকস্থ প্রকাণ্ড ময়দানের দিকে গমন করিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে সেই প্রকাণ্ড ময়দান একবারে পূর্ণ হইয়া গেল। তথাপি জনশ্রুতি বন্ধ হইল না। নিজের গ্রাম ব্যতীত অপর গ্রামস্থ লোকজন আসিয়া সেই স্থানে উপনীত হইতে লাগিল। এই অবস্থা দেখিয়া পূর্ব্ববর্ণিত নীলকরদিগের কাচারিগণের মনে ভয়ের উদয় হইল। তখন কোন গতিকে উহাদিগকে নিবৃত্ত করাই স্থির হইল। পরিশেষে গ্রামস্থ ভদ্রলোক সমস্ত সেই ময়দানে উপনীত হইয়া সমবেত প্রজামণ্ডলীকে কহিলেন “এই মাঠ হইতে প্রজাগণের গরু সকল ঘিরিয়া লইবার নিমিত্ত নীলকরদিগের কতকগুলি লোক আসিয়াছিল ও গরু সকল লইয়া যখন প্রত্যাবর্তন করিতেছিল, সেই সময় আমাদিগকে এই স্থানে আসিতে দেখিয়া গরু সকল পরিত্যাগ পূর্ব্বক পলায়ন করিয়াছে; সুতরাং, এই স্থানে সমবেত থাকা আর আমাদিগের কর্তব্য নহে। সকলে আপনাপর স্থানে প্রত্যাবর্তন কর। যে সকল গরু উহারা লইয়া যাইতেছিল, সেই সকল গরু ঐ রহিয়াছে।” এই বলিয়া ঐ মাঠে যে সকল গরুর পাল চরিতে গিয়াছিল, তাহাই সেই সকল সমবেত প্রজামণ্ডলীকে দেখাইয়া দিলেন। প্রজাগণও তাহাই বুঝিয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিতে উদ্যত হইল। সেই সময় ৩/৪ জন মণ্ডল যাহারা পূর্ব্বে নীলকরদিগের নিকট বিশেষ যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছিল, তাহারা সম্মুখবর্তী হইয়া কহিল, “আমরা যে স্থানে আসিয়া উপনীত হইয়াছি, সেই স্থান হইতে সাহেবের কুঠি অধিক দূর নহে; ঐ দেখা যাইতেছে। সুতরাং, আমরা সকলে ঐ কুঠির ভিতর গমন করিয়া উহা লুঠ করিতে চাই, ও কুঠি ভাঙ্গিয়া দিয়া উহার প্রত্যেক ইট নিকটবর্ত্তী “দোয়ার” ভিতর নিক্ষেপ করিতে চাই। ইহাতে আপনারা কি পরামর্শ দেন।” 

মণ্ডলদিগের কথা শুনিয়া ভদ্রলোকগণ কহিলেন, “না, এরূপ কার্য্যে আমাদিগের হস্তক্ষেপ করা কর্ত্তব্য নহে। আমরা কেবল আত্মরক্ষা করিব; অন্যায়রূপে আক্রমণ করিব না। তোমাদিগের ইচ্ছানুযায়ী কার্য্যে যদি আমরা হস্তক্ষেপ করি, তাহা হইলে এই নীলকুঠি এখনই সমূলে উৎপাটিত করিয়া এই দোয়ারগর্ভে নিক্ষেপ করিতে পারি সত্য, কিন্তু তাহা করা আমাদিগের কর্তব্য নহে। কারণ, এ কার্য করিলে গভর্ণমেন্ট আমাদিগের বিপক্ষে দণ্ডায়মান হইবেন। যে কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিলে রাজা বিপক্ষ হইবেন, সেরূপ কার্য্যে প্রজাকে কখনই হস্তক্ষেপ করিতে নাই। যে কার্য্যের নিমিত্ত তোমাদিগকে এখানে আনা হইয়াছিল, আমাদিগের সেই কার্য্য সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে। এখন প্রজাগণকে লইয়া আপনাপন স্থানে প্রস্থান কর।’ 

মণ্ডলগণ এই কথা বুঝিয়া প্রজাগণের সহিত সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিতে লাগিল। কিন্তু একদল গমন করিতে না করিতে আর একদল সেইস্থানে আসিয়া উপনীত হইতে লাগিল। তাহারা গমন করিতে করিতে আর একদল সেইস্থানে দেখা দিতে লাগিল। এইরূপে সন্ধ্যা পর্য্যন্ত নানাস্থান হইতে নানা লোক গমন করিয়া বিফল মনোরথ হইয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিতে লাগিল। আবশ্যক হইলে কেবলমাত্র গ্রামস্থ প্রজাগণই সমবেত হইবেন, এইরূপ বন্দোবস্ত ছিল; কিন্তু, এখন দেখা গেল যে, ১০/১২ ক্রোশ দূরবর্তী গ্রাম সকল হইতে প্রজাগণ আসিয়া নীলকরগণের বিপক্ষে দণ্ডায়মান হইতে লাগিল। এইরূপে কত লোক যে সেই দিবস সেইস্থানে উপস্থিত হইয়াছিল, তাহার ঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা সহজ নহে। কেহ বলেন, ২৫/৩০ হাজার লোক হইবে, কেহ বলেন, ৫০ হাজার লোকের কম হইবে না। 

যাঁহারা লোকবল দেখিতে চাহিয়াছিলেন, এই অবস্থা দেখিয়া তাঁহারা একেবারে বিস্মিত হইয়া পড়িলেন। বুঝিলেন, এখন ইহারা নীলকরগণের বিপক্ষে দণ্ডায়মান হইতে সমর্থ হইবে। নীলকরগণও এই অবস্থা দেখিয়া একটু ভীত হইয়া পড়িলেন। বুঝিলেন, ঐ গ্রামের প্রজাগণকে সহজে বশ্যতাস্বীকার করাইতে পারিবেন না। 

এই ঘটনার পরদিবসই তাঁহারা আপনাপন চাকরিস্থানে গমন করিলেন; কেহ বা চাকরী পরিত্যাগপূর্ব্বক আপন গ্রামে প্রত্যাগমন করিলেন, কেহ বা যে পর্য্যন্ত এইরূপ গোলযোগ রহিল, সেই পর্য্যন্ত আর গ্রামের মধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন না। 

নীলকরসাহেব, প্রজার একতা দেখিয়া তাহাদিগের উপর আর বলপ্রয়োগ করিতে সাহসী হইলেন না; কিন্তু, গ্রামস্থ প্রজা ও ভদ্রলোকদিগের নামে দেওয়ানি ও ফৌজদারী আদালতে অনবরত নালিস করিতে আরম্ভ করিলেন। প্রজাগণও চাঁদার উপর নির্ভর করিয়া ঐ সকল মোকদ্দমার যোগাড় করিতে লাগিলেন। মোকদ্দমার প্রজাগণ জয়ী হইতেও লাগিলেন, পরাজিত হইতেও লাগিলেন। দুই একজন জেলেও গমন করিতে লাগিলেন; কিন্তু অধিকাংশ স্থলেই অর্থদণ্ড হইতে লাগিল। একটি মোকদ্দমার কথা আমার এখনও বেশ মনে আছে; নীল ভাঙ্গিয়া হরিদ্রা বপন করা হইয়াছিল, এইরূপ নালিস জনৈক ভদ্রলোক ও তাঁহার কয়েকজন প্রজার নামে আনীত হয়। ঐ মোকদ্দমায় ভদ্রলোকটি ও প্রজাগণের জরিমানা হইয়াছিল — ১৭০০ টাকা; কিন্তু, আপীলে সমস্ত টাকাই ফেরত পাওয়া যায়। 

ঐ গ্রামের প্রজাগণ এরূপভাবে একতাবদ্ধ হইয়াছিল যে, সে বন্ধন নীলকরসাহেব কিছুতেই ছিন্ন করিতে পারিলেন না। পরিশেষে অনন্যোপায় হইয়া তাঁহাকে ঐ গ্রামের আশা পরিত্যাগ করিতে হয়। পরিশেষে তিনি ঐ গ্রামের নীলের দাদন একেবারে উঠাইয়া দিয়া কেবলমাত্র তাঁহাদিগের নিজের জমীতে নিজ আবাদে নীল বুনানি করিতে আরম্ভ করেন। ইহাতে প্রজাগণের বিশেষ কোনরূপ আপত্তি না থাকায়, তাহারা কিছুই বলিত না। তাঁহারা আপনারাই জমিতে চাষ দিতেন, আপনারাই নীল বপন করিতেন, আপনারাই উহা কর্তন করিতেন ও পরিশেষে আপনারাই উহা উঠাইয়া কুঠিতে লইয়া যাইতেন। প্রজাগণ তাঁহাদিগকে কোনরূপে সাহায্য করিত না, তাঁহারাও প্রজাগণের নিকট কোনরূপ সাহায্য প্রার্থনা করিতেন না। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

একদিবস অতিপ্রত্যূষে গ্রামের একজন চৌকিদার আসিয়া গ্রামস্থ সমস্ত ভদ্রলোকদিগকে সংবাদ প্রদান করিল যে, গ্রামের বাহিরে “দোয়ার” উপর একটি অশ্বত্থ বৃক্ষের শাখায় একটি ঘোড়ার জিন, গদি, লাগাম প্রভৃতি অদ্য দুই দিবস পর্য্যন্ত রক্ষিত আছে, কেহই উহা লইয়া যাইতেছে না, বা ঐ সকল দ্রব্য যে কাহার, তাহাও কিছু বুঝিতে পারা যাইতেছে না। 

এই সংবাদ শুনিয়া তাঁহারা কেহ কেহ সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলেন। আমরাও তাঁহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিলাম। দেখিলাম চৌকিদার যাহা বলিয়াছিল, তাহা প্রকৃত। এই অবস্থা দৃষ্টে পরিশেষে ইহাই স্থিরীকৃত হইল যে, থানায় গিয়া এই সংবাদ প্রদান করা কর্তব্য। 

চৌকিদার তাহাই করিল; থানায় গিয়া এই সংবাদ প্রদান করিল। পরদিবস অতি প্রত্যূষে থানার দারোগা ইহার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত ঘটনাস্থলে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। 

যে দারোগা এই অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিলেন, তিনি এখনও কোন না কোন থানায় আছেন, কি পেন্‌সন গ্রহণ করিয়াছেন, তাহা আমি এখন ঠিক বলিতে পারিতেছি না। 

অনুসন্ধান করিয়া দারোগাবাবু জিন লাগাম সম্বন্ধে বিশেষ কোন বিষয় অবগত হইতে পারিলেন না। যে কৃষকগণ নিকটবর্ত্তী ময়দানে চাষ আবাদ করিত, তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়াও বিশেষ কোন ফল হইল না। সকলেই কহিল, উহা যে কোথা হইতে আসিয়াছে, বা কে যে উহা ঐ স্থানে রাখিয়া গিয়াছে, তাহা তাহারা কিছুই অবগত নহে, কেবলমাত্র দুই দিবস ঐ রূপ অবস্থায় রক্ষিত আছে। দারোগাবাবু জিন লাগাম অনেককে দেখাইলেন, কিন্তু উহা যে কাহার দ্রব্য, তাহাও কেহ বলিয়া উঠিতে পারিলেন না। 

এইরূপ অবস্থায় সমস্ত দিবস অনুসন্ধান করিয়া দারোগাবাবু জিন লাগাম সমভিব্যাহারে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিবার উপক্রম করিতেছেন, এরূপ সময় তাঁহার থানার একজন হেড কনষ্টেবল আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইলেন। ইনি অপর একটি অনুসন্ধানের নিমিত্ত অপর স্থানে গমন করিয়াছিলেন। সেই কার্য্য সমাপ্ত করিয়া থানায় প্রত্যাগমন করিবার কালীন, দারোগাবাবুকে সেইস্থানে দেখিতে পাইয়া তথায় আসিয়া উপস্থিত হন, ও উভয়ে অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত কি পরামর্শ করিয়া, সেই দিবস সেই স্থানেই অবস্থিতি করিতে ইচ্ছা করেন। যে স্থানে দারোগাবাবু এই অনুসন্ধান করিতে ছিলেন, সেইস্থানে রাত্রি যাপন করিবার কোনরূপ স্থান বা লোকালয় ছিল না; সুতরাং, আমাদিগের গ্রামের মধ্যেই তাঁহাকে আগমন করিতে হয়, ও সেই স্থানেই জনৈক ভদ্রলোকের বাড়ীতে তাঁহারা রাত্রিযাপন করেন। যে স্থানে জিন লাগাম পাওয়া গিয়াছিল, সেই স্থান হইতে ঐ গ্রাম অর্দ্ধ ক্রোশ ব্যবধান হইবে। গ্রামের ভিতর রাত্রি অতিবাহিত করিয়া, পরদিবস অতি প্রত্যূষে তাঁহারা পুনরায় সেই স্থানে গমন করিলেন। বলা বাহুল্য, আমরাও তাঁহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেইস্থানে গমন করিলাম। 

সেইস্থানে গমন করিয়া দারোগাবাবু ও হেড কনেষ্টবল উভয়ে অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত পরামর্শ করিলেন। ঐ পরামর্শে গ্রামস্থ দুই একজন ভদ্রলোকও যোগ দান করিয়াছিলেন; অনেকক্ষণ পরামর্শের পর, ইহাই সকলের অনুমান হইল যে, কোন অশ্বারোহী হয়ত এই স্থান দিয়া গমন করিতেছিলেন। কোন কারণে অশ্ব হইতে অবতরণ করিয়া এই স্থানে কিয়ৎক্ষণ বিশ্রাম করেন এবং অশ্বটিও যাহাতে বিশ্রাম করিতে পারে, এই নিমিত্ত জিন লাগাম খুলিয়া ঐ অশ্বত্থ বৃক্ষের নিম্নে রাখিয়া দেন। পরিশেষে স্নান করিবার মানসেই হউক, বা জলপান করিবার মানসেই হউক, হয় ত তিনি এই “দোয়ায়” গমন করিয়াছিলেন ও জল মধ্যে পতিত হইয়া ডুবিয়া গিয়াছেন। অশ্বটিকে ধরিয়া রাখিতে পারে, এরূপ কোন লোক সেইস্থানে না থাকায়, সেও পরিশেষে কোনদিকে চলিয়া গিয়াছে; সুতরাং, জিন লাগাম প্রভৃতি যে স্থানে রক্ষিত ছিল, সেই স্থানেই পড়িয়া আছে। এই অনুমান যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে দোয়ার আভ্যন্তরীণ জলের ভিতর উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলে সেই অশ্বারোহীর মৃতদেহ প্রাপ্ত হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। 

এইরূপ পরামর্শ হইবার পর, নিকটবর্তী কয়েকখানি গ্রাম হইতে কয়েকজন ধীবরকে সেই স্থানে ডাকিয়া আনা হইল। তাহারা জালের সহিত সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলে, দারোগাবাবু তাহাদিগকে আদেশ প্রদান করিলেন, “তোমরা এই ‘দোয়ার’ মধ্যে উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়া দেখ যে, ইহার ভিতর কাহারও মৃত দেহ পাওয়া যায় কি না। এইরূপ অনুসন্ধান করিবারকালীন তোমরা যে সকল মৎস্য ধরিতে সমর্থ হইবে, তোমাদিগের পারিশ্রমিক স্বরূপ তোমরা তাহা অনায়াসেই গ্রহণ করিতে পারিবে।” 

দারোগাবাবুর কথা শুনিয়া ধীবরগণ জাল হস্তে একে একে সেই দোয়ার মধ্যে অবতরণ করিতে লাগিল। এই দোয়াটি নিতান্ত ক্ষুদ্র নহে। ইহার জল বহুদূরব্যাপী, কিন্তু সকল স্থানেরই গভীরতা অধিক নহে, নিতান্ত সামান্য। কেবল মাত্র এক স্থানের গভীরতা অত্যন্ত অধিক, প্রচণ্ড রৌদ্রের সময়ও ঐ স্থানের জল শুকাইয়া যায় না। সেই সময় নিকটবর্ত্তী গ্রাম সমূহের সমস্ত স্থানের জল একেবারে শুকাইয়া যায়, ভরসার মধ্যে কেবল মাত্র এই দোয়াই থাকে। উহারই জলে সেই সময় সকলে জীবন ধারণ করিতে সমর্থ হন। যে স্থলে এই দোয়াটি স্থাপিত, তাহা প্রকৃত পক্ষে দোয়া ছিল না, এখন দোয়া নামেই অভিহিত হইয়াছে। ঐ স্থানের উপর দিয়া পূর্ব্বে ভৈরব নদী প্রবল বেগে প্রবাহিত হইত। নানাদিক দিগন্তর হইতে বাণিজ্য পোত সকল ঐ স্থান দিয়া যাতায়াত করিত বলিয়া, উহার দুই পার্শ্বে সমৃদ্ধিশালী নগরীতে শোভিত ছিল, কিন্তু কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভৈরবের সেই প্রবল বেগ চলিয়া গিয়াছে, সমৃদ্ধিশালী নগর সকল এখন হতশ্রী হইয়া পড়িয়াছে। নৌ বাণিজ্য সকল একেবারে বন্ধ হইয়া গিয়াছে। এখন আর তাহার কিছুই নাই। থাকিবার মধ্যে সেই পূর্ব্ব সমৃদ্ধির চিহ্নস্বরূপ, ঐ ভৈরব নদীর কেবল চিহ্ন আছে মাত্র। প্রবল বর্ষার সময় উহার স্থানে স্থানে জল দেখিতে পাওয়া যায়। সেই সময় কেবল মাত্র বুঝিতে পারা যায় যে, এই স্থান দিয়া সময়ে কোন প্রবল নদীর প্রবাহিত হইত। যে দোয়ার কথা এখন বিবৃত হইতেছে, ইহাও সেই ভৈরব নদীর অংশ বিশেষ। ঐ স্থানের জল অতিশয় গভীর বলিয়া বারমাসেই ঐ স্থানে জল থাকে, ও নিকটবর্ত্তী গ্রামবাসিগণ ঐ জলের উপর নির্ভর করিয়া জীবন ধারণ করিয়া থাকেন। ঐ দোয়ার কিয়ৎদূর ব্যবধানে পূৰ্ব্ববর্ণিত নীলকুঠি স্থাপিত। নীলকর সাহেব সেই স্থানেই অবস্থান করিতেন। ঐ দোয়া হইতে জল উত্তোলন করিয়া নীল প্রস্তুতের সমস্ত কার্য্যেই নিৰ্ব্বাহ হইত। এখন পর্যন্ত ঐ দোয়া পূর্ব্বের ন্যায় বর্তমান আছে, কিন্তু সেই নীলকুঠির চিহ্ন মাত্রও নাই। 

ধীবরগণ ঐ দোয়ার ভিতর অবতরণ করিয়া সর্ব্বপ্রথম উহার চতুষ্পার্শ্বে, অর্থাৎ যে সকল স্থানে অল্প অল্প জল আছে, সেই সকল স্থানে জাল ফেলিয়া মৃত দেহের অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করিল; কিন্তু, কোনস্থানেই কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত হইল না। পরিশেষে গভীর জলের দিকে গমন করিল। অল্প জলে দণ্ডায়মান হইয়া, গভীর জলে জাল সকল ফেলিতে লাগিল; কিন্তু, তাহাতেও কোনরূপে মৃতদেহ পাওয়া গেল না। 

আমাদিগের দেশে বিল, দোয়া প্রভৃতিতে মৎস্য ধরিবার নিমিত্ত ধীবরগণ এক রূপ উপায় অবলম্বন করিয়া থাকে। বর্ষাকালে ঐ সকল স্থান জলময় হইয়া গেলে, যে যে স্থানে একটু গভীর জল হয়, অর্থাৎ চৈত্র বৈশাখ মাসেও যে যে স্থানে জল থাকিবার সম্ভাবনা, সেই সেই স্থানে ডাল দিয়া থাকে। বৃক্ষের ডাল প্রভৃতি কটিয়া ঐ সকল ডাল অধিক পরিমাণে জলের মধ্যে এক স্থানে রাখিয়া দেওয়ার নামই “ডাল দেওয়া”। রৌদ্রের তেজে জল যখন ক্রমে উত্তপ্ত হইতে আরম্ভ হয়, সেই সময় ঐ জলাশয়ের ছোট বড় মৎস্য সকল ঐ ডাল দেওয়া জলের মধ্যে আসিয়া অবস্থিতি করে। এইরূপে কিছু দিবস কাল ডাল সকল ঐ রূপে জলের মধ্যে থাকিবার পর যখন ধীবরগণ বেশ বুঝিতে পারে যে, ঐ সকল স্থানে প্রচুর পরিমাণে মৎস সকল আগমন করিয়াছে, তখন তাহারা ঐ ডাল দেওয়া স্থানের চতুষ্পার্শ্বে জাল দ্বারা উত্তমরূপে ঘিরিয়া রাখিয়া ঐ ডাল সকল ক্রমে উঠাইয়া ফেলে। এইরূপে সমস্ত ডাল স্থানান্তরিত করা হইলে, তখন সেই জাল বেষ্টিত ডালের মধ্যস্থিত মৎসগণ উহারা অনায়াসেই ধরিয়া লইতে সমর্থ হয়। 

যে দোয়ার কথা আমি বলিতেছি, ঐ দোয়ার মধ্যে স্থানে স্থানে ঐ রূপ অনেক ডাল দেওয়া ছিল। ধীবরগণ জলে যখন মৃতদেহের অনুসন্ধান করিতেছিল, সেই সময় একটি লোক হঠাৎ বলিয়া উঠিল “এই ডালের মধ্যে কী দেখা যাইতেছে।” 

এই কথা শুনিয়া সকলেই সেই ডালের নিকট গমন করিল। যে স্থানে ঐ ডাল রক্ষিত ছিল, তাহা কিনারা হইতে অধিক দূরে নহে, ও সেই স্থানের জলও অতিশয় গভীর নহে। ঐ স্থান স্নান করিবার ঘাট ও মনুষ্যগণের ব্যবহার করিবার স্থান হইতে কিছু দূর অন্তর। 

সকলে ঐ স্থানে গমন করিয়া উত্তমরূপে দেখিতে লাগিলেন। সেই ডালের আভ্যন্তরীণ পরিষ্কার জলের মধ্য হইতে যেন একটি মনুষ্যের কিয়দংশ দৃষ্টিগোচর হইতে লাগিল। তখন দারোগাবাবু তাই স্থানের ডালগুলি উঠাইয়া দিতে কহিলেন। দেখিতে দেখিতে তাঁহার আদেশ প্রতিপালিত হইল। সেইস্থান হইতে আস্তে আস্তে ডালগুলি উঠাইয়া একটু দূরে রাখা হইল। ডালগুলি উত্থিত করিবার পর, যখন সেই স্থান বেশ পরিষ্কার হইয়া গেল, তখন সকলেই উত্তমরূপে দেখিতে পাইল যে, ঐ স্থানে দুই খণ্ড কাষ্ঠ উত্তম রূপে প্রোথিত করা রহিয়াছে, এবং ঐ কাষ্ঠখণ্ডদ্বয়ের সহিত একটি মৃতদেহ বন্ধন অবস্থায় আছে। উহা এরূপ দৃঢ়রূপে আবদ্ধ করিয়া রাখা হইয়াছে যে, উং কোন রূপেই ভাসিয়া উঠিতে পারিতেছে না। 

এই অবস্থা দেখিয়া, দারোগাবাবু ঐ কাষ্ঠ দুই খণ্ডের সহিত মৃতদেহ যেরূপ অবস্থায় আছে, সেইরূপ অবস্থায় উঠাইতে কহিলেন। তাঁহার এই আদেশ নিতান্ত সহজে প্রতিপালিত হইল; কারণ, মৃতদেহের সহিত ঐ কাষ্ঠ দুই খণ্ড উপড়াইয়া ফেলিবার পর তাহার সহিত তখন মৃতদেহটি ভাসিয়া উঠিল। 

মৃতদেহটি তাহার পর জল হইতে উঠাইয়া সেই দোয়ার ধারে রক্ষিত হইলে দেখা গেল যে, উহা প্রায় বিকৃত হইয়া গিয়াছে। পচিয়া তাহা হইতে ভয়ানক দুর্গন্ধ বাহির হইতে আরম্ভ হইয়াছে। আরও বুঝিতে পারা গেল যে, উহার গলদেশ ও পদযুগল এক গাছি দড়ীর দ্বারা ঐ কাষ্ঠ দুই খণ্ডের সহিত উত্তমরূপে ঐ জলের ভিতর বাঁধিয়া রাখা হইয়াছিল। 

এই অবস্থা দেখিয়া দারোগাবাবু তাঁহার সমভিব্যাহারী সেই হেড কনেষ্টবলকে কহিলেন “দেখিলে?”

হেড কঃ। দেখিলাম তো। 

দারোগা। এখন কী বোধ হইতেছে? 

হেড কঃ। আর কি বোধ হইবে। এখন হত্যা মোকদ্দমা রুজু করিয়া “প্রথম এতলা” লিখুন। 

দারোগা। ইহা যে খুন, তাহার আর বোধ হয় কোন ভুল নাই। 

হেড কঃ। আর সন্দেহ কী হইবে। 

দারোগা। ইহাকে কী রূপ করিয়া হত্যা করা হইয়াছে বোধ হয়? জীবিত অবস্থায় ইহাকে এইরূপে বন্ধন করিয়া জলের মধ্যে রাখা হইয়াছে, কী মৃত্যুর পর ইহাকে এইরূপ অবস্থায় রাখা হইয়াছে? 

হেড কঃ। জীবিত অবস্থায় এরূপ করিয়া বাঁধিয়া, পরিশেষে জলের মধ্যে পুতিয়া রাখা সহজ নহে। 

দারোগা। কেন? 

হেড কঃ। তাহা হইলে সে আপন জীবন রক্ষা করিবার জন্য নিশ্চয়ই চেষ্টা করিত; সুতরাং জীবিত লোককে এই রূপে বন্ধন করিয়া জলের মধ্যে প্রোথিত করা নিতান্ত সহজ হইত না। 

দারোগা। লোক সংখ্যা অধিক হইলে জীবিত অবস্থায় এরূপ ভাবে জলের মধ্যে প্রোথিত করা যে একবারে অসম্ভব, তাহা হইতে পারে না। 

হেড কঃ। হইতে পারে; লোক সংখ্যা অধিক হইলে উহাকে অনায়াসেই ধরিয়া এইরূপ করিয়া জলের মধ্যে প্রোথিত করিতে পারে সত্য, কিন্তু তাহার মুখ বদ্ধ করিবে কী প্রকারে? তাহার চীৎকার শব্দ এই সদর রাস্তার ধারে নিশ্চয়ই কোন না কোন লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করিত। 

দারোগা। কেন, উহার মুখ বাঁধিয়া দিয়া বা তাহা চাপিয়া ধরিয়া কি এই কাৰ্য সম্পন্ন হইতে পারে না? 

হেড কঃ। পারে না, এ কথা আমি বলিতেছি না; কিন্তু, তাহার কোনরূপ চিহ্ন তো দেখিতে পাওয়া যাইতেছে না!

দারোগা। সে যাহা হউক, অনুসন্ধান করিলে ক্রমে সমস্ত কথা বাহির হইয়া পড়িবার সম্ভাবনা। এখন আমাদিগের প্রধান কাৰ্য্য এই যে, এই মৃতদেহ কাহার, তাহা অগ্রে স্থির করা। 

হেড কঃ। তাহা তো নিশ্চয়ই। তদ্ব্যতীত, আরও একটি বিষয় আমাদিগের দেখা কর্ত্তব্য। 

দারোগা। কী? 

হেড কঃ। মৃতদেহটি প্রায় বিবস্ত্র অবস্থায় পাওয়া গিয়াছিল। উহার পরিধানে কেবল মাত্র একখানি ধূতি ভিন্ন অন্য কোন বস্তু নাই। যে ব্যক্তি অশ্বারোহণে গমনাগমন করে, সে একমাত্র বস্ত্র পরিধান করিয়া প্রায়ই যায় না; তাহার চাদর, পিরাণ ও জুতা প্রভৃতি নিশ্চয়ই থাকে। এরূপ অবস্থায় ঐ সকল দ্রব্যের অনুসন্ধান করিয়া দেখা আমাদিগের একান্ত কর্তব্য। অনুসন্ধান করিলে হয় তো ঐ সকল দ্রব্যও এই “দোয়ার” কোন না কোন স্থানে পাওয়া যাইতে পারে। 

হেড কনেষ্টবলের কথা শুনিয়া দারোগাবাবু সেই সকল ধীবরগণকে পুনরায় বস্ত্রাদির অনুসন্ধান করিতে কহিলেন। ধীবরগণ দারোগাবাবুর আদেশ প্রতিপালন পূর্ব্বক সঙ্গে সঙ্গে জালক্ষেপণ করিতে লাগিল। এইরূপে প্রায় একঘণ্টাকাল অনুসন্ধান করিবার পর, এক জনের জালে একটা গারি বাধিয়া গেল। ঐ গািিট উঠাইলে দেখিতে পাওয়া গেল, যে, একটি পিরাণ, একখানি চাদর, ১ জোড়া জুতা, ও দুই খানি বড় বড় ইট একখানি গামছায় বাঁধা রহিয়াছে। উহা দেখিয়া অনুমিত হইল, যে ঐ সকল দ্রব্যও ঐ দোয়ার ভিতর কে ফেলিয়া দিয়াছে, ও যাহাতে উহা ভাসিয়া উঠিতে না পারে, তাহার নিমিত্ত উহার সহিত দুইখানি থান ইট বাঁধিয়া দিয়াছে। 

এই সকল দ্রব্য প্রাপ্ত হইবার পর, হেড কনেষ্টবল ঐ মৃতদেহটি “দোয়ার” পার্শ্ব হইতে উঠাইয়া সদর রাস্তার উপর রাখিলেন ও পথিকগণের প্রত্যেককে ডাকাইয়া উহা দেখাইতে লাগিলেন। “দোয়ার” ভিতর মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, এই কথা দেখিতে দেখিতে চারিদিকে ব্যাপ্ত হওয়াতে নিকটবর্ত্তী গ্রাম সকল হইতে অনেক বালক, যুবক ও স্ত্রীলোক উহা দেখিবার নিমিত্ত সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল। গোচারকগণ আপনাপন গরু ময়দানে ছাড়িয়া দিয়া, সেই স্থানে আগমন করিল। কৃষকগণ কৃষিকার্য্য পরিত্যাগপূর্ব্বক ঐ মৃতদেহ যে কাহার, তাহা দেখিবার নিমিত্ত, সেই স্থানে আসিয়া সমবেত হইতে লাগিল। এইরূপে দেখিতে দেখিতে সেইস্থান একেবারে লোকে লোকারণ্য হইয়া পড়িল। হেড কনেষ্টবল তাহাদিগের প্রত্যেককেই ঐ মৃতদেহ দেখাইতে লাগিলেন। 

দারোগাবাবু কয়েক জন চৌকিদারের সহিত সেই স্থান হইতে ঐ দুই খানি ইট লইয়া প্রস্থান করিলেন। নিকটবর্তী কোন স্থানে ঐ প্রকারের আরও ইট আছে কি না, তাহা দেখিবার বাসনায় তিনি সেই স্থান হইতে গমন করিলেন কারণ যে স্থানে মৃত দেহ পাওয়া গিয়াছে, তাহার চতুষ্পার্শ্বস্থ জমি সকল কৃষিকার্য্যে ব্যবহৃত হইয়া থাকে; সুতরাং উহার নিকটবর্তী কোন স্থানে ঐ প্রকারের কোন ইট থাকিবার সম্ভাবনা নাই। নিতান্ত নিকটে কোন গ্রামও নাই, সুতরাং ইটও দেখিতে পাওয়া যায় না। ইট থাকিবার মধ্যে নিকটবর্ত্তী নীলের কুঠি। ঐ কুঠির কোন স্থানে ঐ প্রকারের আরও ইট পড়িয়া আছে কি না, বা উহার কোন স্থান হইতে ঐ ইট দুই খানি স্থানান্তরিত করা হইয়াছে কি না, তাহাই দেখিবার নিমিত্ত দারোগাবাবু ধীরে ধীরে সেই নীলকুঠির দিকে গমন করিতে লাগিলেন। ঐ স্থানে একে নীলকুঠি, তাহাতে জনৈক নীলকর সাহেব ঐ স্থানে অবস্থিতি করিয়া থাকেন; সুতরাং, একজন সামান্য দেশীয় কর্মচারীর পক্ষে সেই স্থানে গমন করিয়া অনুসন্ধান করা নিতান্ত সহজ নহে। তথাপি দারোগাবাবু আপন সাহসের উপর নির্ভর করিয়া ধীরে ধীরে সেই নীলকুঠির হাতার মধ্যে প্রবেশ করিতেছেন, এমন সময় ঘটনাক্রমে, সেই কুঠির নীলকরসাহেবও অশ্বারোহণে তাঁহার দাওয়ানের সহিত কুঠি হইতে বহির্গত হইতেছিলেন। পুলিস কর্ম্মচারিগণকে সেই কুঠির মধ্যে গমন করিতে দেখিয়া, সাহেব তাঁহার সমভিব্যাহারী দাওয়ানকে জিজ্ঞাসা করিলেন “ইহারা কে?” 

উত্তরে দাওয়ান কহিলেন, “অনুমান হইতেছে উহারা পুলিস-কৰ্ম্মচারী। কোন কার্য্যের নিমিত্ত বোধ হয়, কুঠির মধ্যে গমন করিতেছে।” 

পুলিস-কৰ্ম্মচারীকে বল, “যে পর্য্যন্ত আমি প্রত্যাগমন না করি, সেই পর্য্যন্ত উহারা যেন কুঠির হাতার ভিতর গমন না করে। কোন আবশ্যক থাকে, আমি প্রত্যাগমন করিলে যেন আমার নিকট আগমন করে।” 

সাহেবের এই কথা শুনিয়া দাওয়ান সেই পুলিস-কৰ্ম্মচারীর নিকট গমন করিলেন ও সাহেবের আদেশ তাঁহাকে কহিলেন। সাহেবের কথা শুনিয়া দারোগাবাবুকে নিৰ্ব্বাক্ হইয়া সেইস্থান হইতে প্রত্যাগমন করিতে হইল। কারণ, তিনি সাহেবের বিনা অনুমতিতে ঐ স্থানে বলপূর্ব্বক গমন করিতে পারেন, আইন অনুযায়ী এমন কোন বিষয় তিনি এ পর্যন্ত সাহেবের বিপক্ষে প্রাপ্ত হন নাই। 

দারোগাবাবু সেই সময় তাঁহার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে সমর্থ হইলেন না। পক্ষান্তরে একটু অপমানিত হইয়া, তাঁহাকে সেইস্থান হইতে প্রত্যাবর্তন করিতে হইল। এই নিমিত্ত তাঁহার মনে একটু ক্রোধের উদয় হইল। কিন্তু সেই ক্রোধভাব প্রকাশ না করিয়া, তিনি সেইস্থান হইতে প্রত্যাগমন করিলেন। 

[কার্তিক, ১৩০৭] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *