বিষম বুদ্ধি

বিষম বুদ্ধি

(অর্থাৎ হত্যাকারীকে বাঁচাইবার অদ্ভুত রহস্য!) 

প্রথম পরিচ্ছেদ

প্রায় দশ বৎসর অতীত হইল, রাত্রি আন্দাজ ১১।। ০ টার সময় আমি আমার থানার দৈনিক কার্য্য সমাপন করিয়া আফিস হইতে উঠিয়া কেবলমাত্র আমার থাকিবার স্থানে প্রবেশ করিয়াছি, এরূপ সময়ে একজন প্রহরী আমাকে উচ্চৈঃস্বরে ডাকিতে আরম্ভ করিল। সে যেরূপ ব্যগ্রতার সহিতউচ্চৈঃস্বরে আমাকে ডাকিতেছিল, তাহা শুনিবামাত্রই আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, বিশেষ কোনরূপ গোলযোগ আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। এই ভাবিয়া আমিও দ্রুতগতি বাহিরে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। 

বাহিরে আসিয়া দেখিলাম, যে প্রহরী আমাকে ডাকিতেছিল, তাহার সমভিব্যাহারে অপর আর একটি লোক সেইস্থানে দাঁড়াইয়া আছে। আমাকে দেখিবামাত্র ঐ প্রহরী সেই লোকটির দিকে লক্ষ্য করিয়া কহিল, “এই ব্যক্তি কি বলিতেছে শুনুন।” 

প্রহরীর কথা শুনিয়া আমি তাহার দিকে লক্ষ্য করিলাম। দেখিলাম, ইনি একজন বাঙ্গালী যুবক, বয়ঃক্রম ত্রিশ বৎসরের অধিক হইবে বলিয়া অনুমান হয় না। মুখশ্রী ও পোষাক-পরিচ্ছদ দেখিয়া ইহাকে কোন ভদ্রবংশসম্ভূত বলিয়া অনুমান হয়। কিন্তু ইহাকে কোনরূপ উত্তেজিত বা ক্রোধপূর্ণ বলিয়া অনুমান হয় না, ইহার মুখ দেখিয়া অনুমান হয় যে, ইহার অন্তরে কোনরূপ গভীর চিন্তা প্রবেশ করিয়াছে। 

আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনার নাম কি? 

উত্তরে তিনি কহিলেন, আমার নাম রাজচন্দ্র দাস ঘোষ আমি জাতিতে কায়স্থ, আপনাদিগের দাস। 

আমি। এত রাত্রিতে থানায় আসিবার আপনার কি প্রয়োজন হইয়াছে? 

রাজ। বিশেষ প্রয়োজন হইয়াছে বলিয়াই আমি আপনার নিকট আগমন করিয়াছি। আমি আত্মসমর্পণ করিবার নিমিত্ত এইস্থানে উপস্থিত হইয়াছি। 

আমি। আত্মসমর্পণ করিতে আসিয়াছেন, এ কথার অর্থ কি? আপনি কি কোনরূপ অপরাধে অভিযুক্ত আছেন?

রাজ। অভিযুক্ত এখন পৰ্য্যন্ত হই নাই, কিন্তু হইবার নিমিত্তই আসিয়াছি। আমার দ্বারা একটিবিষম অপরাধ হইয়া গিয়াছে, তাই আমি আপনা হইতেই আত্মসমর্পণ করিতে আগমন করিয়াছি। 

আমি। বিষম অপরাধ! — কি বিষম অপরাধ করিয়াছেন? 

রাজ। হত্যা। 

আমি। কি! আপনি মনুষ্যহত্যা করিয়া আত্মসমর্পণ করবার নিমিত্ত এখানে আসিয়াছেন?

রাজ। হাঁ মহাশয়। 

আমি। কাহাকে হত্যা করিয়াছেন?

রাজ। আমি যাহাকে হত্যা করিয়াছি, তাহার নাম রসিক বসু বলিয়াই আমি জানি। 

আমি। তিনি কোথায় থাকিতেন? 

রাজ। আমার বাড়ীর নিকটেই তিনি বাস করিয়া থাকেন। কি করেন, তাহা বলিতে পারি না; বোধ হয় কোন আফিসে তিনি চাকরি করিয়া থাকেন। 

আমি। তাহার আর কে আপন লোক আছে? 

রাজ। আর কাহাকেও তো ঐ বাড়ীতে দেখিতে পাই না। বোধ হয় তিনি একাকীই ঐ বাড়ীতে বাস করিতেন। 

আমি। আপনি প্রকৃতই কি তাহাকে হত্যা করিয়াছেন? 

রাজ। হত্যা না করিয়া কি আর আমি আপনার নিকট মিথ্যা কথা বলিবার নিমিত্ত আগমন করিয়াছি।

আমি। আপনি তাহাকে হত্যা করিলেন কেন? 

রাজ। আমি ইচ্ছা করিয়া তাহাকে হত্যা করি নাই। আজ রাত্রি আন্দাজ নয়টার সময় যখন আমি আমার কার্য্য হইতে প্রত্যাগমন করিয়া আমার বাটীর ভিতর গমন করিতেছিলাম, সেই সময় উহাকে আমি আমার বাড়ীর সম্মুখে দেখিতে পাইলাম। আমাকে দেখিবামাত্র সে আমাকে নিতান্ত কটুভাষায় গালি প্রদান করিল। আমার সহিত তাহার ভালরূপ পরিচয়ও ছিল না বা আমাদিগের মধ্যে কোনরূপ শত্রুতাও ছিল না। তথাপি বিনাকারণে সে আমাকে গালি প্রদান করিতে লাগিল দেখিয়া আমি ভাবিলাম, সে অপরকে গালি প্রদান করিবার ইচ্ছা করিয়া, আমাকে চিনিতে না পারিয়া, আমায় সেই ব্যক্তি বিবেচনা করিয়া, গালি প্রদান করিতেছে। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমি তাহাকে কহিলাম, তুমি যাহার উদ্দেশে গালি প্রদান করিতেছ, আমি সেই ব্যক্তি নহি, তুমি আমাকে চিনিতে না পারিয়া আমাকেই সেই ব্যক্তি অনুমান করিয়া বিষম ভ্রমে পতিত হইয়া, আমাকে অকারণে গালি প্রদান করিতেছ। আমার কথা শ্রবণ করিয়া তিনি কহিলেন, আমি যাহাকে গালি প্রদান করিতেছি, তাহাকে আমি খুব চিনিতে পারিয়াছি, চিনিতে পারিয়াই গালি দিতেছি। এই কথা বলিয়া সে আমার সম্মুখে দাঁড়াইয়া আরও অকথ্যভাষায় আমাকে গালি প্রদান করিতে লাগিল। তাহার কথা শুনিলে নির্জীব পদার্থেরও ক্রোধের উদয় হয়; সুতরাং রক্তমাংসে গঠিত, আমি কিরূপে সেই ক্রোধ সংবরণ করিতে পারি! আমি নিতান্ত ক্রোধের বশবর্তী হইয়া তাহাকে সজোরে এক চপেটাঘাত করিলাম। সে আমার বিষম চপেটাঘাতের বেগ সংবরণ করিতে না পারিয়া চতুর্দিক অন্ধকার দেখিল, এবং ঘুরিতে ঘুরিতে সেইস্থানে পতিত হইয়া চির নিদ্রার আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে; সুতরাং এখন আমি হত্যাকারী আমার হস্তে রসিক হত হইয়াছে বলিয়াই আমি এখানে আসিয়া আত্মসমর্পণ করিতেছি। এখন আপনি আমাকে চরমদণ্ডে দণ্ডিত করিতে পারেন। 

আমি। আপনি যেরূপ বর্ণনা করিলেন, তাহাতে বুঝিলাম, আপনি জ্ঞানকৃত মনুষ্যবধের অপরাধ করেন নাই, সুতরাং আপনি কোনক্রমেই চরমদণ্ডে দণ্ডিত হইতে পারেন না। আপনি যাহা কহিলেন, তাহা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে আপনাকে ২/৪ মাসের জন্য কারাবাস ভোগ করিতে হইবে মাত্র। আপনি যাহা কহিলেন, তাহা সাক্ষীর দ্বারা প্ৰমাণ হইবে ত? 

রাজ। সাক্ষী আপনি পাইবেন না। কারণ, যে স্থানে এই ঘটনা ঘটিয়াছিল, সেইস্থানে সেই সময় আমি ও রসিক ভিন্ন আর কেহই ছিল না; সুতরাং এ ঘটনা আর কেহই দেখে নাই। আমি যাহা আপনাকে বলিতেছি, তাহা কখনই অস্বীকার করিব না। যে কোন স্থানে বা যে কোন বিচারকের নিকট আপনি আমাকে লইয়া যাইবেন, মুক্তকণ্ঠে আমি আপনার দোষ স্বীকার করিব। ইহাতে আমার ফাঁসীই হউক বা কারাবাসই হউক, কিছুতেই আমি মিথ্যাকথা কহিব না। 

আমি। আচ্ছা, সে বিষয় পরে দেখা যাইবে, এখন রসিকের মৃতদেহ কোথায়? 

রাজ। তাহা আমি বলিতে পারি না। মৃতদেহ কিছুক্ষণ পর্যন্ত রাজবর্জ্যের উপরই পতিত ছিল, কিন্তু তাহার কয়েকজন আত্মীয়ই হইবে, কি বন্ধুই হইবে আসিয়া সেই মৃতদেহের সৎকার করিবার নিমিত্ত লইয়া গিয়াছে। 

আমি। তাহা হইলে এতক্ষণ পৰ্য্যন্ত বোধ হয়, সেই মৃতদেহের সৎকার কার্য্য শেষ হইয়া গিয়াছে। 

রাজ। তাহা আমি বলিতে পারি না। 

আমি। তাহা হইলে তুমি আমার সহিত চল, কলিকাতা ও সহরতলীর মধ্যে শবদাহ করিবার যে কয়েকটি ঘাট আছে, অগ্রে সেই কয়েকটি স্থানে গমন করিয়া দেখি, রসিকের শব যদি পাওয়া যায়। তুমি বলিতে পার না যে, কোন ঘাটে সেই মৃতদেহ লইয়া গিয়াছে? 

রাজ। না মহাশয়, আমি তাহা জানি না। 

রাজচন্দ্র দাসের নিকট এই কথাগুলি শ্রবণ করিয়া আমি আর কালবিলম্ব করিতে সাহস করিলাম না। শবদাহের ঘাটে গমন করিবার নিমিত্ত তৎক্ষণাৎ একখানি গাড়ী আনিতে পাঠাইলাম। রাজচন্দ্রকেও সেই প্রহরীর নিকট অল্প সময়ের নিমিত্ত রাখিয়া আমি বাহিরে গমন করিবার উপযোগী কাপড় পরিধান করিয়া, পুনরায় সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। একজন প্রহরী আমার নিমিত্ত একখানি ভাড়াটিয়া গাড়ীও সেই স্থানে আনিয়া উপস্থিত করিল। আমি রাজচন্দ্র দাসকে সঙ্গে লইয়া সেই গাড়ীতে আরোহণ করিলাম। কলিকাতায় শবদাহ করিবার সর্ব্বপ্রধান ঘাট নিমতলা, সুতরাং সেইস্থানেই আমরা গমন করিলাম। সেই স্থানের সব-রেজিষ্ট্রারের নিকট হইতে অবগত হইলাম, সন্ধ্যার পর হইতে ঐ প্রকারের কোনরূপ মৃতদেহ দাহ করিবার মানসে সেইস্থানে আনীত হয় নাই, বা রসিক নামক কোন ব্যক্তির মৃতদেহ সেই রাত্রিতে দাহ করাও হয় নাই। 

নিমতলাঘাটে এই সংবাদ অবগত হইয়া পরিশেষে মনে করিলাম, এখন কাশীমিত্রের ঘাটে গিয়া অনুসন্ধান করা আবশ্যক। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া ঐ গাড়ীতেই কাশীমিত্রের ঘাট অভিমুখে গমন করিলাম। যাইবার সময় নিমতলার ঘাটে সেই কৰ্ম্মচারীকে বলিয়া গেলাম যে, ইহার পরও যদি ঐরূপের কোন মৃতদেহ সেইস্থানে কেহ আনয়ন করে, তবে হঠাৎ যেন ভস্মীভূত করা না হয় এবং ঐ মৃতদেহ ঐ স্থানে রাখিয়া তৎক্ষণাৎই যেন পুলিসে সংবাদ পাঠান হয়। সব-রেজিষ্ট্রারবাবু আমার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন, আমরাও কাশীমিত্রের ঘাট-অভিমুখে যাত্রা করিলাম। 

আমরা যখন কাশীমিত্রের ঘাটে গিয়া উপস্থিত হইলাম তখন রাত্রি একটা বাজিয়া গিয়াছে। সেইস্থানে গিয়া জানিতে পারিলাম, কয়েকটি লোক একটি মৃতদেহ ঐ স্থানে রাত্রি আন্দাজ এগারটার সময় লইয়া যায়, এবং বিসূচিকারোগে উহার মৃত্যু হইয়াছে, এইরূপ প্রকাশ করিয়া যাহাতে শীঘ্র ঐ মৃতদেহের দাহকার্য সম্পন্ন হয়, তাহার নিমিত্ত উহারা ঐ ঘাটের কর্ম্মচারীকে বিশেষরূপ অনুরোধ করে। ঐ মৃতদেহ দর্শন করিয়া ঐ কর্ম্মচারীর কেমন একরূপ সন্দেহের উদয় হয়। বিসূচিকারোগে মৃত্যু হইলে মৃতদেহে যে সকল নিদর্শন পরিলক্ষিত হয়, এই মৃতদেহে সেইরূপ কোন চিহ্নই দেখিতে পাওয়া যায় নাই। সুতরাং তাহার মনে কেমন একরূপ সন্দেহ হয় এবং সেই সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়াই তিনি ঐ মৃতদেহ দাহ করিতে অসম্মত হন, ও এই সংবাদ সেইস্থানের স্থানীয় পুলিসকে প্রদান করেন। স্থানীয় পুলিস সংবাদ পাইবামাত্র ঐ মৃতদেহের উপর একটি প্রহরীর পাহারা রাখিয়া দিয়া, ঐ সংবাদ আমার থানায় পাঠাইয়া দেন। আমি থানা হইতে এই অনুসন্ধানে বহির্গত হইয়া আসিবার পর ঐ সংবাদ আমার থানায় গিয়া উপস্থিত হয়। 

যাহারা ঐ মৃতদেহ দাহ করিবার নিমিত্ত লইয়া গিয়াছিল, তাহারা যখন জানিতে পারিল যে, ঐ মৃতদেহ তাহারা সহজে দাহ করিতে সমর্থ হইবে না, তখন তাহারা সেই রাত্রির অন্ধকারের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া সেইস্থানে পুলিস প্রহরী আসিবার পূর্ব্বেই সকলে তথা হইতে একে একে প্রস্থান করিল। আমরা যখন সেই ঘাটেগিয়া উপস্থিত হইলাম, তখন দেখিলাম, সেই মৃতদেহ সেইস্থানে পড়িয়া আছে, এবং তাহার নিকট জনৈক প্রহরী পাহারা দিতেছে। কিন্তু যাহারা ঐ মৃতদেহ সেইস্থানে আনয়ন করিয়াছিল, তাহারা কেহই সেইস্থানে নাই। রাত্রিকালে যতদূর সম্ভব, ঐ মৃতদেহটি আমি একবার দেখিলাম, উহা দেখিয়া উহার মৃত্যুর কারণ আমি কিছুই অনুমান করিতে সমর্থ হইলাম না। 

সেই ঘাটের কর্ম্মচারীকে তখন ডাকিলাম, ইনি একজন বহু পুরাতন কৰ্ম্মচারী। বয়ঃক্রম পঞ্চাশ বৎসর অতীত হইয়া গিয়াছে, এবং এই কার্য্যে তিনি প্রায় ত্রিশ বৎসর অতিবাহিত করিয়াছেন। এই দীর্ঘকালের মধ্যে তিনি যে কত মৃতদেহ দর্শন করিয়া ঐ সকল মৃতদেহের দাহকার্য সম্পন্ন করিতে অনুমতি প্রদান করিয়াছেন, তাহা নির্ণয় করা সহজ নহে। এই বহুদর্শিতার ফলেই এই মৃতদেহ দাহ করিতে তিনি অনুমতি প্রদান করেন নাই। তিনি আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলে আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, কি কারণে আপনি সন্দেহ করিলেন যে, এই ব্যক্তি স্বাভাবিক মৃত্যুতে মরে নাই? 

কর্ম্মচারী। কারণ কিছুই বলিতে পারি না। যাহারা ঐ মৃতদেহ এখানে আনয়ন করিয়াছিল, তাহারা আমাকে বলিয়াছিল যে, বিসূচিকারোগে উহার মৃত্যু হইয়াছে। আমি সহস্ৰ সহস্ৰ বিসূচিকা-রোগে মৃত ব্যক্তিকে দেখিয়াছি, কিন্তু এই মৃতদেহে বিসূচিকারোগের কোন চিহ্নই নাই। সুতরাং ইহার মৃত্যু সম্বন্ধে আমার সন্দেহ হয়, এবং সেই সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়াই আমি পুলিসে সংবাদ প্রদান করিয়াছি। 

আমি। ইহার কিসে মৃত্যু হইয়াছে বলিয়া আপনার অনুমান হয়? 

কর্ম্ম। আমি কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারি নাই। কোন রোগে ইহার মৃত্যু হইয়াছে বলিয়া আমার অনুমান হয় না।

আমি। বিসূচিকারোগে যদি উহার মৃত্যু হইত, তাহা হইলে মৃতদেহ দেখিয়াই আপনি তাহা অনুমান করিতে পারিতেন? 

কৰ্ম্ম। নিশ্চয়ই পারিতাম। বিসূচিকারোগে মৃত্যু হইলে মৃতদেহে ঐ রোগের লক্ষণ বিদ্যমান থাকিত, ইহাতে তাহার কিছুই নাই। 

আমি। যদি অপর কোন রোগে উহার মৃত্যু হইয়া থাকে? 

কর্ম্ম। কোন রোগে ইহার মৃত্যু হইয়াছে বলিয়া আমার অনুমান হয় না। কারণ, মৃতদেহে কোন প্রকার রোগের চিহ্ন পরিলক্ষিত হয় নাই, আমার বোধ হয়, কোন কারণে ইহার হঠাৎ মৃত্যু হইয়াছে। 

আমি। আপনার অনুমান প্রকৃত বলিয়াই অনুমতি হইতেছে, কিন্তু যে সকল ব্যক্তি এই মৃতদেহ দাহ করিবার মানসে এখানে আনয়ন করিয়াছিল, তাহারা পলায়ন করিল কিরূপে? 

কৰ্ম্ম। আমি যেমন এই সংবাদ থানায় প্রেরণ করিলাম, অমনই তাহারা বুঝিতে পারিল যে, তাহারা হয় ত বিশেষ বিপদে পতিত হইবে; সুতরাং সুযোগমতে তাহারা এইস্থান হইতে প্রস্থান করিল। আমি তাহাদিগকে এইস্থানে অপেক্ষা করিতে বলিয়া দিয়াছিলাম, এবং আমার অধীনে যে কয়েকটি ডোম আছে, তাহাদিগকেও বলিয়া দিয়াছিলাম, যে পৰ্য্যন্ত পুলিস আসিয়া উপস্থিত না হয় সেই পৰ্য্যন্ত উহারা যেন পলায়ন না করে। কিন্তু ডোমগণ আমার আদেশ প্রতিপালন করিতে সমর্থ হয় নাই, অন্ধকারের আশ্রয় অবলম্বন করিয়া তাহারা অনায়াসেই ডোমের হস্ত হইতে পলায়ন করিতে সমর্থ হয়। 

কর্মচারীর এই কথা শুনিয়া যে ডোমের নিকট হইতে উহারা পলায়ন করিতে সমর্থ হয়, তাহাকে ডাকিলাম। সে সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, যে কয়েক ব্যক্তি ঐ মৃতদেহ বহন করিয়া আনিয়াছিল, তাহারা কিরূপে পলায়ন করিতে সমর্থ হইল? আমার কথার উত্তরে ডোম যেরূপ কহিল, তাহাতে আমি বুঝিতে পারিলাম, যে ছয়জন ব্যক্তি ঐ মৃতদেহ বহন করিয়া সেইস্থানে আনিয়াছিল, তাহাদিগের মধ্যে চারিজন মৃতদেহ আনিবার পরই সেইস্থান হইতে প্রস্থান করে। শবদাহ করিবার নিমিত্ত কেবলমাত্র দুইজন ঐ মৃতদেহের নিকট থাকে ও ইহার পর তাহারা জানিতে পারে যে, যে পর্য্যন্ত পুলিস আসিয়া ঐ মৃতদেহ দাহ করিবার আদেশ প্রদান না করিবে, সেই পৰ্য্যন্ত উহাদিগকে সেইস্থানে অপেক্ষা করিতে হইবে। যাহাতে তাহারা তথা হইতে প্রস্থান করিতে না পারে, তাহা দেখিবার ভার ঐ ডোমের উপর ন্যস্ত হয়। ঐ ডোম তাহাদিগকে লইয়া যখন একস্থানে বসাইয়া রাখিবার চেষ্টা করে, সেই সময় তাহারা দুইজন ভিন্ন ভিন্ন দুইদিক অবলম্বন করিয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিবার চেষ্টা করে। ডোম একজনকে ধরিতে সমর্থ হয়, কিন্তু অপর একজন সেই স্থান হইতে অনায়াসেই পলায়ন করিতে সমর্থ হয়। ডোম যাহাকে ধরিতে সমর্থ হয়, তাহাকে সেইস্থানে বসাইয়া রাখে, কিয়ৎক্ষণ সেইস্থানে বসিয়া থাকিবার পর ঐ ব্যক্তি দূরে একটি মনুষ্য দেখিতে পাইয়া, সেই ডোমকে কহে যে, যে ব্যক্তি পলাইয়া গিয়াছে। ঐ দেখ, সেই ব্যক্তি গমন করিতেছে। এই কথা শুনিবামাত্র অগ্রপশ্চাৎ কিছুমাত্র না ভাবিয়াই সেই মূর্খ ডোম সেইদিকে দ্রুতপদে গমন করে এবং সেই মনুষ্যের নিকট গমন করিয়া দেখে যে, সে একটি স্ত্রীলোক। ইহা দেখিয়াই সে সেই স্থান হইতে প্রত্যাবর্তন করে ও দেখিতে পায়, যাহাকে সে সেইস্থানে রাখিয়া গিয়াছিল, সেও সেইস্থানে নাই; অন্ধকারের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া সে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিয়াছে। কিয়ৎক্ষণ তাহার অনুসন্ধান করিয়া দেখে, কিন্তু আর তাহাকে প্রাপ্ত হয় না। ইহার কিয়ৎক্ষণ পরেই পুলিস প্রহরী আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হয়। 

ডোমের নিকট এই অবস্থা অবগত হইয়া বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, তাহারই বুদ্ধির দোষে ঐ ব্যক্তি প্রস্থান করিতে সমর্থ হইয়াছে। ঐরূপ শব-বাহকগণ প্রস্থান করায় (বর্তমান ক্ষেত্রে না হউক) যে কতদূর অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা, পাঠকগণ তাহা অনায়াসেই অনুমান করিতে পারেন। এরূপ অবস্থায় শববহনকারী লোকগণকে প্রাপ্ত না হইলে ঐ মৃতদেহ কোথা হইতে যে আনীত হইয়াছে, তাহা স্থির করা নিতান্ত সহজ হয় না। তাহার উপর উহা যদি হত্যা মকদ্দমায় পরিণত হয়, তাহা হইলে ঐ মকদ্দমার অনুসন্ধান হওয়া একরূপ অসাধ্যই হইয়া উঠে। সে যাহা হউক, বর্তমানক্ষেত্রে উহারা পলায়ন করিলেও সেইরূপ ভয়ের বিশেষরূপ কোন কারণ ছিল না। কারণ ইহা যদি হত্যা মকদ্দমায় পরিণত হয়, তাহা হইলে হত্যাকারীর অনুসন্ধান করিতে হইবে না। সে পূর্ব্ব হইতেই আপনি থানায় আসিয়া আত্মসমর্পণ করিয়াছে এবং যে ব্যক্তি হত হইয়াছে তাহার নাম ও বাসস্থান সে আমাদিগকে বলিয়া দিয়াছে। এরূপ অবস্থায় শববহনকারীগণ পলায়ন করায় আমাদিগের কার্য্যের বিশেষ কোনরূপ অসুবিধা ঘটে নাই। 

সেই মৃতদেহটি পূর্ব্বে সেই ঘাটের কর্ম্মচারী নিজচক্ষে দেখিয়াছিলেন,এবং উহাতে বিসূচিকারোগের কোনরূপ লক্ষণ দেখিতে না পাইয়াই তাঁহার মনে সন্দেহ হয়, এবং সেই সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া তিনি থানায় সংবাদ প্রেরণ করেন। তিনি স্বচক্ষে উহা দর্শন করিলেও আমি তাঁহার কথার উপর সম্পূর্ণরূপ নির্ভর না করিয়া, নিজ চক্ষে সেই মৃতদেহটি পুনরায় দেখিবার ইচ্ছা করিলাম। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

রাজচন্দ্র দাস ইতিপূর্ব্বে আমাকে বলিয়াছিলেন যে, তাঁহার এক চপেটাঘাতে রসিক ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছে। সেই মৃতদেহ দেখিবার আমার প্রধান উদ্দেশ্য এই হইল যে, তাহার গণ্ডদেশে চপেটাঘাতের কোনরূপ চিহ্ন বৰ্ত্তমান আছে কি না। 

মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া, সেই কৰ্ম্মচারীকে সঙ্গে লইয়া রসিকের মৃতদেহটি উত্তমরূপে দেখিতে লাগিলাম। উহার গণ্ডদেশে বিষম চপেট ঘাতের কোনরূপ চিহ্নই দেখিতে পাইলাম না। সেইস্থানে সেই সময় যে ডোম উপস্থিত ছিল, তখন তাহাকে সেই মৃতদেহ সম্পূর্ণরূপে বিবস্ত্র করিতে কহিলাম। আদেশমাত্র উহার অঙ্গে যে সকল বস্তু ছিল, তাহা খুলিয়া সে-দূরে রাখিয়া দিল। দুইটি বাতীর সাহায্যে সেই মৃতদেহের সমস্ত অঙ্গ অতি উত্তমরূপে দেখিলাম, কোনস্থানেই বিশেষ কোনরূপ চিহ্ন প্রথমতঃ পরিলক্ষিত হইল না; কিন্তু অনেক অনুসন্ধানের পর, উহার বক্ষঃস্থলে পয়সা পরিমিত একটি কালো বর্ণের গোলাকার চিহ্ন দৃষ্টিগোচর হইল। উহা কিসের চিহ্ন, তাহা ভাল করিয়া দেখিলে বুঝিতে পারিলাম, উহা একটি লৌহ পেরেকের গোলাকার শেষ অংশ। বোধ হইল ঐ পেরেকটি জোরপূর্ব্বক উহার বক্ষঃস্থলে বসাইয়া দেওয়া হইয়াছে; কিন্তু ঐ স্থান দিয়া রক্তাদি বহির্গত হইবার এরূপ কোন চিহ্ন পরিলক্ষিত হইল না। অঙ্গুলির দ্বারা ঐ পেরেকটি আস্তে আস্তে উঠাইবার চেষ্টা করিলাম। দেখিলাম, উহা উত্তমরূপে সংবিদ্ধ রহিয়াছে। বিশেষরূপ জোর করিয়া না উঠাইলে উহা সহজে দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইবে না। সুতরাং উহা উঠাইবার আর চেষ্টা না করিয়া যেরূপ অবস্থায় উহা দেহের সহিত সংবিদ্ধ ছিল, সেইরূপ অবস্থাতেই রাখিয়া দিলাম। এখন বুঝিতে পারিলাম, রসিকের বক্ষঃস্থলে ঐ লৌহ পেরেক প্রবিষ্ট হইবার নিমিত্তই তাহার মৃত্যু ঘটিয়াছে। বিসূচিকারোগে উহার মৃত্যু হয় নাই বা কেবলমাত্র এক চপেটঘাতেই উহার ইহজীবন শেষ হয় নাই। 

রাজচন্দ্র দাসঘোষ সেই সময় আমাদিগের সহিত সেইস্থানে উপস্থিত ছিলেন এবং আমাদিগের ন্যায় ঐ লৌহপেরেক তিনিও সেই মৃতদেহে স্বচক্ষে দর্শন করিলেন। তখন আমি তাঁহাকে কহিলাম, যদি আপনার একটিমাত্র চপেটঘাতেই ইহার মৃত্যু হইয়া থাকে, তাহা হইলে ইহার বক্ষঃস্থলে এই লৌরপেরেক কিরূপে বিদ্ধ হইল? আমার বোধ হয়, কেবলমাত্র চপেটাঘাতে ইহার মৃত্যু হয় নাই, ইহার বক্ষঃস্থলে এই লৌহপেরেক প্রবিষ্ট হইয়াই ইহাকে ইহজীবন পরিত্যাগ করাইয়াছে। এ সম্বন্ধে আপনি এখন কি বলিতে চাহেন? যদি এই লৌহপেরেক আপনার কর্তৃকই ইহার বক্ষঃস্থলে প্রবিষ্ট হইয়া থাকে, তাহা আপনি এখন বলিতে পারেন। যখন নিজের দোষ স্বীকার করিতে আপনা হইতেই আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন, তখন প্রকৃত যাহা ঘটিয়াছিল, তাহাই প্রকাশ করা এখন আপনার সম্পূর্ণরূপে কৰ্ত্তব্য। কতক সত্য, কতক মিথ্যা বলিয়া আমাদিগকে নিরর্থক কষ্ট দেওয়া আপনার কর্তব্য নহে। কারণ, অনুসন্ধানে পরিশেষে সমস্তই বাহির হইয়া পড়িলে, কোন কথাই গোপন থাকিবে না। 

আমার কথার উত্তরে রাজচন্দ্র দাস কহিলেন, আমি আপনার নিকট প্রকৃত কথাই বলিয়াছি, কোন কথা গোপন করি নাই। যদি কোন কথা গোপন করিবার ইচ্ছা থাকিত, তাহা হইলে আমি নিজ ইচ্ছায় থানায় গমন করিয়া আত্মসমর্পণ করিব কেন? এ সম্বন্ধে আপনারা কিছুই জানিতেন না, কে হত হইল বা কাহা-কর্তৃক হত হইল, এ সংবাদ আপনাদিগের নিকট আসিয়া উপস্থিত হয় নাই। সুতরাং আমি যে আপনাদিগের কর্তৃক ধৃত হইব, তাহারই বা সম্ভাবনা কি ছিল? এরূপ অবস্থায় আমি নিজে আপনার নিকট আসিয়া আত্মসমর্পণ করিব কেন? পূর্ব্ব হইতে উহার বক্ষঃস্থলে যদি কোনরূপ লৌহপেরেক অবদ্ধ হইয়া থাকে, তাহা আমি অবগত নহি। কিন্তু আমি উহাকে কেবলমাত্র একটি ভিন্ন চপেটাঘাত করি নাই, সেই চপেটাঘাতের পরেই সে সেইস্থানে পড়িয়া যায় ও তাহার মৃত্যু হয়। সুতরাং আমার অনুমান হয় যে,আমার চপেটঘাতেই উহার মৃত্যু হইয়াছে। 

রাজচন্দ্র দাসের কথা শুনিয়া আমি সেই সময় কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। রাজচন্দ্র যাহা বলিতেছিলেন তৎসম্বন্ধে একটু ভাবিয়া দেখিলাম। দেখিলাম, এ পর্য্যন্ত যতদূর আমরা অবগত হইতে পারিয়াছি, তাহা রাজচন্দ্র বলিয়া না দিলে কোনরূপ উপায়েই আমাদিগের জানিবার উপায় ছিল না যে মৃতব্যক্তি কে? কোথা হইতে তাহাকে সেইস্থানে আনা হইয়াছে এবং কেই বা তাহাকে আনিয়াছে। মনে করুন, রাজচন্দ্র দাস আমাদিগের নিকট গমন করেন নাই বা আমাদিগকে কোন কথা বলেন নাই। এই মৃতদেহ দাহ করিবার ঘাট হইতে সংবাদ পাঠাইয়া দেওয়ার পর আমরা আসিয়া এখানে উপস্থিত হইয়াছি, এবং মৃতদেহ যাহারা এইস্থানে বহন করিয়া আনিয়াছিল, তাহাদিগের কাহাকেও প্রাপ্ত হই নাই, এইস্থানে আসিয়া কেবলমাত্র মৃতদেহই পাইয়াছি। তাহার অঙ্গে পেরেক বিদ্ধ আছে দেখিতে পাইয়াছি, এরূপ অবস্থায় এ মৃতদেহ কাহার, প্রথমতঃ অনুসন্ধান করিয়া তাহাই বাহির করা সহজ নহে, তাহার উপর কাহার কর্তৃক এ ব্যক্তি হত হইয়াছে, তাহা বাহির করা যে কিরূপ দুঃসাধ্য, তাহা পাঠকগণ সহজেই অনুমান করিতে পারেন। এরূপ অবস্থায় রাজচন্দ্র দাস নিজে আসিয়া থানায় উপস্থিত না হইলে তাহার উপর এই অপরাধ আমরা সহজে প্রমাণ করিতে পারিতাম বলিয়া অনুমান হয় না। প্রমাণ হওয়া দূরে থাকুক, রাজচন্দ্র দাসের দ্বারা যে এই কার্য্য ঘটিয়াছে, তাহাই বা জানিতে পারিতাম কিরূপে? এরূপ অবস্থায় রাজচন্দ্র দাস নিজে হাজির হইয়া যে সকল কথা বলিয়া তাঁহাকে বিষম বিপদে পতিত করিতেছে, তাহাই বা একেবারে অবিশ্বাস করি কি প্রকারে? হয়ত হইতে পারে, কোন ব্যক্তি কর্তৃক তাহার বক্ষঃস্থলে পেরেক বিদ্ধ হইয়াছে, রাজচন্দ্র হয়ত তাহার কিছুই অবগত নহে। সেই পেরেক বিদ্ধকারীর উদ্দেশে গালি প্রদানকালে রাজচন্দ্র দাস তাহাকে প্রহার করিয়াছে, এবং সেই প্রহারের পর রসিক সেইস্থানে পতিত হইয়া ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছে। 

মনে মনে এইরূপ নানাপ্রকার চিন্তা আসিয়া উপস্থিত হইল, কিন্তু সেই সকল চিন্তার দিকে কিছুমাত্র লক্ষ্য না করিয়া ইহার অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। মৃতদেহ আপাততঃ সেই স্থানেই প্রহরীর জিম্মায় রহিল। 

রাজচন্দ্র দাসকে সঙ্গে লইয়া প্রথমতঃ রাজচন্দ্র দাসের বাড়ীতেই গিয়া উপস্থিত হইলাম। রাজচন্দ্র দাসকে জিজ্ঞাসা করায়, তিনি তাঁহার বাড়ীর সম্মুখবর্তী রাস্তা দেখাইয়া দিয়া কহিলেন, এইস্থানে রসিক দাঁড়াইয়া আমাকে গালি দিয়াছিল। এইস্থানে আমি তাহাকে চপেটাঘাত করি, এবং এইস্থানে সে পতিত হইয়া ইহজীবন পরিত্যাগ করে। এই বাড়ীতে রসিক বাস করিত। 

রাজচন্দ্র দাসের কথা শুনিয়া ঐ স্থানের প্রত্যেককেই একে একে জিজ্ঞাসা করিলাম, কিন্তু কেহই কোন কথা বলিতে পারিল না বা ইচ্ছা করিয়া বলিল না। রাজচন্দ্র দাস যাহা কহিলেন, তাহার সমর্থন করিবার বা তাহার বিপক্ষে কোন কথা কহিতে পারে, এরূপ কোন ব্যক্তিকে সেইস্থানে প্রাপ্ত হইলাম না। 

যে বাড়ীতে রসিক বাস করিত, রাজচন্দ্র দাস তাহা আমাদিগকে দেখাইয়া দিলেন, ঐ বাড়ী রাজচন্দ্র দাসের বাড়ীর সন্নিকটে। আমরা ঐ বাড়ীতে প্রবেশ করিলাম, দেখিলাম, উহা একটি মেস বা বাসাড়িয়া বাড়ী। কেহ পরিবার লইয়া ঐ বাড়ীতে বাস করেন না, কয়েকটি স্কুলের ছাত্র ও কয়েকজন অফিসের কর্ম্মচারী ঐ বাড়ীতে বাস করিয়া থাকেন। বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলে একজন অর্দ্ধবয়স্ক যুবক আমাদিগের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে দেখিবামাত্র আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনি কে? এই বাসার সহিত আপনার কোনরূপ সংশ্রব আছে কি? আমার কথার উত্তরে তিনি কহিলেন, আমি এই বাসাতেই থাকি এবং এই বাসার বন্দোবস্তের ভার এখন আমার উপরই ন্যস্ত আছে। 

আমি। তাহা হইলে আপনিই এখন এই বাসার ম্যানেজার? 

ম্যানেজার। কতকটা বই কি? কেন, আপনার কি প্রয়োজন? 

আমি। প্রয়োজন অনেক আছে, আপনাদিগের নিকট আমার অনেক কথা জিজ্ঞাস্য আছে। আপনি বোধ হয় অবগত নহেন যে, আমি কে? আমি জনৈক পুলিস-কর্ম্মচারী একটি গুরুতর অপরাধের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমি এইস্থানে আগমন করিয়াছি। 

ম্যানে। এত রাত্রে আসিয়াছেন কেন, দিবাভাগে আসিলেই পারিতেন। এখন বাসার প্রায় সকলেই নিদ্রাগত, আপনি দিনমানে আসিবেন, আমাদিগের দ্বারা যে কোনরূপ সাহায্য হইবার সম্ভাবনা, তাহা অনায়াসেই আমাদিগের নিকট হইতে প্রাপ্ত হইবেন। 

আমি। বিশেষ প্রয়োজন না হইলে কি এই রাত্রিকালে আপনাদিগকে বিরক্ত করিতে আসিয়াছি। কল্য দিবাভাগে আসিলে যদি চলিত, তাহা হইলে এত রাত্রিতে এখানে আসিব কেন? 

ম্যানে। বলুন, আমাদিগকে কি করিতে হইবে? 

আমি। বিশেষ কিছুই করিতে হইবে না, কেবলমাত্র আমি আপনাদিগকে যে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিব, তাহার যথাযথ উত্তর পাইলেই আমার কার্য্য শেষ হইয়া যাইবে। 

ম্যানে। আপনি কি জানিতে চাহেন বলুন, আমার দ্বারা যতদূর সম্ভব, তাহার উত্তর আপনি এখনই প্রাপ্ত হইবেন।

আমি। আপনাদিগের এই বাসায় রসিক নামক কোন ব্যক্তি বাস করেন কি? 

ম্যানে। হাঁ, রসিকবাবু এই বাসায় থাকেন। 

আমি। তিনি এখন উপস্থিত আছেন কি? 

ম্যানে। আমি ঠিক বলিতে পারি না, সম্ভবত তিনি তাঁহার ঘরে শুইয়া আছেন। 

আমি। যদি আপনি একবার অনুগ্রহ করিয়া দেখিয়া আসেন, তাহা হইলে বড়ই অনুগৃহীত হই। 

আমার কথা শুনিয়া তিনি তৎক্ষণাৎ ভিতরে গমন করিলেন এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে ফিরিয়া আসিয়া কহিলেন, না মহাশয়! তিনি তাঁহার ঘরে নাই। তিনি কি কোনরূপে বিপদগ্রস্ত হইয়া আপনাদিগের হস্তে পতিত হইয়াছেন? 

আমি। না, তিনি কোনরূপ বিপদগ্রস্ত হইয়া আমাদিগের হস্তে পতিত হন নাই, কিন্তু জগতের সমস্ত বিপদ হইতে তিনি অব্যাহতি প্রাপ্ত হইয়াছেন। 

ম্যানে। আপনার এ কথার কোনরূপ অর্থ আমরা বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। 

আমি। আমার কথার অর্থ অতি পরিষ্কার, তিনি ইহজগতে নাই। সুতরাং ইহজগতের সমস্ত বিপদ হইতে তিনি অব্যাহতি প্রাপ্ত হইয়াছেন। 

ম্যানে। সে কি মহাশয়! কোথায় ও কিরূপে তাঁহার মৃত্যু ঘটিল। 

আমি। তাহাই অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমি এইস্থানে আগমন করিয়াছি। 

আমার কথা শুনিবামাত্র তিনি ঐ বাসার সমস্ত ব্যক্তিকেই ডাকিলেন। তাঁহার কথা শুনিয়া সকলেই নিদ্রা হইতে গাত্রোত্থান পূর্ব্বক আমার নিকট আগমন করিয়া আমার চতুস্পার্শ্বে বেষ্টন করিয়া দাঁড়াইলেন, এবং প্রত্যেকেই একেবারে আমাকে নানা কথা জিজ্ঞাসা আরম্ভ করিলেন। কেহ বলিলেন, ‘রসিকবাবু কোথায়? কেহ বলিলেন, তিনি কি একেবারে মরিয়া গিয়াছেন? কেহ জিজ্ঞাসা করিলেন, তিনি কোথায় মরিলেন, কোন স্ত্রীলোকের বাড়ীতে কি? কেহ বলিলেন, কে তাঁহাকে মারিয়া ফেলিল? কেহ জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কি করিয়া জানিতে পারিলেন? কেহ কহিল, যে মারিয়াছে, সে ধরা পড়িয়াছে ত? এইরূপ যাহার মনে যাহা আসিতে লাগিল, তিনি তাহাই কহিতে লাগিলেন। উহার মধ্য হইতে কোন বালক বলিয়া উঠিল, টাকা খাইয়া এই মকদ্দমা না উড়াইয়া দিলে, আর পুলিস এখানে আসিবে কেন? কেহ কহিল, আসল আসামীকে ছাড়িয়া দিয়া আমাদিগের মধ্যে কাহাকে ধরিয়া আসামী করিতে পারে, তাহাই দেখিবার নিমিত্ত পুলিস এখানে আসিয়াছে। পুলিসের যত ক্ষমতা তাহা জানি, উহারা দোষীকে দেখিতে পায় না, কেবল নির্দোষী লইয়াই টানাটানি করে। কোন কথা না শুনিয়াই বা কোন বিষয় অবগত না হইয়াই যাহার মনে যাহা আসিয়া উদয় হইতে লাগিল, তিনি তাহাই বলিতে আরম্ভ করিলেন। উহাদিগের অবস্থা দেখিয়া উহাদিগের কোন কথার উত্তর প্রদান না করিয়া আমি চুপ করিয়া যে যাহা বলিতে লাগিল, তাহাই শুনিতে লাগিলাম। 

এই কলিকাতা সহরের মধ্যে যে সকল স্কুলের ছাত্র ও অফিসের কর্ম্মচারী বা কেরাণীমহল বাসা করিয়া বাস করিতে থাকেন, তাঁহাদিগের গতিকই এইরূপ; তাঁহারা প্রথমতঃ কোন কথা উত্তমরূপে অনুধাবন করিয়া দেখেন না, যাহা ইচ্ছা তাহা বলিয়া সরকারী কর্মচারীগণকে নিরর্থক গালিবর্ষণ করিয়া থাকেন। তাঁহাদিগের মনের এই ধারণা যে, সরকারী কর্মচারী মাত্রই অবশ্বিাসী, উৎকোচগ্রাহী ও অনবরত নিরীহ লোকদিগের সর্ব্বনাশ করিতেই প্রস্তুত। এই বিশ্বাসের উপর নির্ভর করিয়াই যে কোন সরকারি কর্ম্মচারীর সহিত তাঁহাদিগের কোনরূপ সংস্রব ঘটে, অমনি তাহাদিগকে গালি প্রদান করেন, এবং তাহাদিগের সম্মুখেই তাহাদিগের বিপক্ষে নানারূপ মন্তব্য প্রকাশ করিয়া থাকেন। যে সকল উদ্ধতস্বভাবের কর্মচারীগণ ঐ সকল কথা সহ্য করিতে না পারিয়া তৎক্ষণাৎ তাহার প্রতিবাদ করিতে আরম্ভ করেন। তাহাদিগের সহিতই তৎক্ষণাৎ গোলযোগ বাধিয়া উঠে ও পরিশেষে উহার ফল বিষময় হইয়া দাঁড়ায়। আর যে সকল কৰ্ম্মচারী উহাদিগের স্বভাব উত্তমরূপে অবগত আছেন, তাঁহারা ঐ সকল কথা শুনিয়াও শোনেন না, বা উহার উপর কোনরূপ লক্ষ্যও করেন না। এইরূপে উহাদিগের যাহা যাহা বক্তব্য, তাহা শেষ হইয়া গেলে পরিশেষে তাহাদিগের দ্বারাই সকল কাৰ্য্য অনায়াসেই উদ্ধার করিয়া লইতে পারেন। তাহার উপর যে সকল কর্মচারী উহাদিগের পক্ষ অবলম্বন করিয়া, তাহাদিগের কথার পোষকতা করিয়া সেই সময় যদি দুই চারিটি কথা বলিতে পরেন, অর্থাৎ সরকারি কর্মচারীগণ সমস্তই অত্যাচারী, সমস্তই উৎকোচগ্রাহী, সমস্তই অবিশ্বাসী প্রভৃতি এইরূপ দুই চারিটি কথা বলিয়া তাহাদিগের মতে মত দিতে সমর্থ হন, তাহা হইলে যে কার্য্য সম্পন্ন করিবার নিমিত্ত তিনি এইস্থানে গমন করিয়াছেন, সেই কার্য্য নির্ব্বাহ করিতে তাঁহাকে কোনরূপ কষ্টই পাইতে হয় না। সেই স্থানে চুপ করিয়া বসিয়া থাকিলেও তাঁহার সমস্ত কার্য্য উহারা আপনা হইতেই বিশেষ আগ্রহ ও যত্নের সহিত নির্ব্বাহ করিয়া দিয়া থাকেন। এইরূপ উদাহরণ আমি শতশত দেখাইতে পারি। 

আমি, এই স্থানের বাসাড়িয়া বাড়ীর ছাত্রগণ ও অফিসের কর্ম্মচারীগণের অবস্থা উত্তমরূপে জানিতাম। সুতরাং উহাদিগের কথায় বিন্দুমাত্র লক্ষ্য না করিয়া, আমি কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিলাম ও উহাদিগের কথায় সমর্থন করিয়া পুলিস-কৰ্ম্মচারীগণ যে নিতান্ত অকৰ্ম্মণ্য ও অবিশ্বাসী, তাহার সত্য মিথ্যা দুই একটি উদাহরণ প্রদান করিলাম। দেখিলাম, আমার উপর সকলেই সন্তুষ্ট হইয়া তাঁহারা আপনাপন মুখ বন্ধ করিলেন ও আমাকে সর্ব্বতোভাবে সাহায্য করিতে প্রস্তুত হইলেন। তখন উহারা নিতান্ত অসঙ্গত কথা ছাড়িয়া দিয়া, সঙ্গত কথার আলোচনায় প্রস্তুত হইলেন। উহাদিগের মধ্যে একজন সকলকে চুপ করিতে বলিয়া আমার সহিত কথা কহিতে প্রবৃত্ত হইলেন। 

তিনি আমাকে প্রথমতঃ জিজ্ঞাসা করিলেন, রসিকবাবু কি প্রকৃতই মরিয়া গিয়াছেন? 

আমি। সত্য মরিয়া গিয়াছেন। 

বাসাড়িয়া। তাহার যেরূপ স্বভাব ছিল, তাহাতে আমরা পূর্ব্বেই ভাবিয়াছিলাম যে, উহার দশা এইরূপই হইবে। সে কোথায় মরিয়া গেল, কোন স্ত্রীলোকের বাড়ীতে কি তাহার মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে? 

আমি। না। 

বাসা। তাহার যেরূপ চরিত্রের কথা আমরা ইদানীন্তন জানিতে পারিয়াছিলাম, তাহাতে আমরা একরূপ স্থির করিয়াই রাখিয়াছিলাম যে, হয় বেশ্যাবাড়ীতে না হয় মদ খাইয়া কোনরূপ বেটক্করে পড়িয়া সে তাহার জীবন হারাইবে। 

আমি। আপনারা যেরূপ অনুমান করিয়া রাখিয়াছিলেন, ঘটিয়াছেও তাহাই। কিন্তু কিরূপে যে ঘটিল, তাহার এখন পর্যন্ত কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারি নাই বলিয়াই আপনাদিগের নিকট আগমন করিয়াছি। সে কি সদাসৰ্ব্বদাই নেশায় উন্মত্ত থাকিত? 

বাসা। সদাসৰ্ব্বদা না হইলেও রাত্রিকালে প্রায়ই সুরাপান করিয়া সে বাসায় আসিত। অবশ্য আমরা সকল দিন জানিতে পারিতাম না যে, কখন সে ফিরিয়া আসিয়াছে। তাহার খাদ্য প্রায় নষ্ট হইত। 

আমি। বেশ্যাবাড়ীর কথা বলিতেছেন, কোন্ বেশ্যাবাড়ীতে তাহার যাতায়াত ছিল? 

বাসা। এ কথা আমরা বলিতে পারিব না, ইহা আমাদিগের অনুমান মাত্র। তবে ইহা আমরা বেশ বুঝিতে পারিতাম যে, সে নিশ্চয়ই বেশ্যাসক্ত হইয়া পড়িয়াছে। তাহার উপর উহার আর একটিবিষম দোষ ঘটিয়াছিল। আপনি দেখিতে পাইতেছেন যে, আমরা গৃহস্থপল্লীর মধ্যে বাস করি। আমরা যে সময় বাসায় উপস্থিত না থাকিতাম, অথচ সে একাকী এইস্থানে থাকিত, সেই সময় নিকটবর্ত্তী গৃহস্থবর্গের কোন স্ত্রীলোককে জানালার সন্নিকটে আগমন করিবার বা ছাদের উপর উঠিবার যো ছিল না; স্ত্রীলোকগণকে দেখিতে পাইলেই প্রায়ই সে ঠাট্টা তামাসা ও অশ্লীলভাষা প্রয়োগ করিয়া তাহাদিগকে বিপথগামিনী করিবার চেষ্টা করিত; ইহার জন্য কতদিন প্রতিবেশীবর্গের নিকট আমাদিগকে লাঞ্ছনা ভোগ করিতে হইয়াছে। আমরা একরূপ স্থির করিয়াই রাখিয়াছিলাম ও উহাকে বলিয়া দেওয়াও হইয়াছিল যে, এই মাসের এই কয়েকদিবস গত হইলেই তাহাকে এ বাসা পরিত্যাগ করিয়া যাইতে হইবে। ইহার অনেক দিবস পূৰ্ব্বেই আমরা তাহাকে এই বাসা হইতে তাড়াইয়া দিবার সংকল্প করিয়াছিলাম, কিন্তু বাসার হিসাবে অনেকগুলি টাকা তাহার নিকট পাওনা থাকায় নিতান্ত দায়ে পড়িয়া কেবল তাহাকে এতদিবস রাখিতে হইয়াছে। কিন্তু এ মাসে আমরা সেই টাকার আশা পরিত্যাগ করিয়া তাহাকে বলিয়া দিয়াছিলাম যে, ১লা তারিখের মধ্যেই তিনি যেন এই বাসা পরিত্যাগ করিয়া অপর কোন স্থানে চলিয়া যান। তিনিও আমাদিগের কথায় সম্মত হইয়া, শুনিয়াছি অপর বাসার অনুসন্ধান করিতেছিলেন। সে যাহা হউক, এখন তাহার মৃতদেহ পাইলেন কোথায়? 

আমি। তাহার মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, কাশীমিত্রের শবদাহ করিবার ঘাটে। 

বাসা। সেই স্থানে কে লইয়া গেল? 

আমি। শুনিয়াছি, তাহার বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজন। 

বাসা। বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে এক তো আমরাই সকলে আছি। তাহার আত্মীয়স্বজন যে কেহ এখানে আছে, তাহা তো আমাদিগের বোধ হয় না; কারণ, এ কথা তো কখন আমরা শুনি নাই। যাহারা ঐ মৃতদেহ দাহ করিবার নিমিত্ত লইয়া গিয়াছিল, তাহাদিগকে পাইয়াছেন তো, তাহারা কি বলে? 

আমি। তাহাদিগকে পাওয়া যায় নাই, ঘাটে মৃতদেহ পরিত্যাগ করিয়া তাহারা পলায়ন করিয়াছে। 

বাসা। উহার মৃত্যু হইয়াছে কিসে? 

আমি। যাহারা মৃতদেহ বহন করিয়া লইয়া গিয়াছিল, তাহারা বলিয়াছিল যে, বিসূচিকা রোগে উহার মৃত্যু হইয়াছে, কিন্তু মৃতদেহের বক্ষস্থলে একটি বড় লৌহ পেরেক বিদ্ধ আছে, সুতরাং উহাই উহার মৃত্যুর কারণ বলিয়া অনুমান হইল। 

বাসা। উহার বক্ষস্থলে লৌহ পেরেক বিদ্ধ করিল কে? 

আমি। তাহাই জানিবার জন্য অনুসন্ধান করিতে হইতেছে। আপনি বাসার সকলকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখুন যে, এখান হইতে ঐ মৃতদেহ কেহ তো সৎকার করিবার নিমিত্ত লইয়া যায় নাই? 

বাসা। তাহা হইলে আমি নিশ্চয়ই জানিতে পারিতাম। 

উহার কথা শুনিয়া সকলেই বলিয়া উঠিলেন, “আমরা ইহার কিছুই জ্ঞাত নহি।” 

আমি। রসিক যদি এই বাড়ীতে বা ইহার সন্নিকটবর্তী কোন স্থানে হত হইতেন, তাহা হইলে নিশ্চয়ই বোধ হয়, আপনারা তাহা অনায়াসেই অবগত হইতে পারিতেন? 

বাসা। অবগত হইতে পারিবার খুব সম্ভাবনা। 

আমি। আর আপনাদিগের বাসার নিকটবর্ত্তী কোন স্থানে যদি উহার মৃতদেহ পাওয়া যাইত, তাহা হইলে ঐ স্থান হইতে ঐ মৃতদেহ কাশীমিত্রের ঘাটে লইয়া যাইবার কালীনও বোধ হয়, আপনারা জানিতে পারিতেন। 

বাসা। নিশ্চয়ই জানিতে পারিতাম, আর আমরা ভিন্ন এইস্থানে তাহার এরূপ আর কোন আত্মীয় আমরা দেখিতে পাইতেছি না যে, ঐ মৃতদেহ দাহ করিবার নিমিত্ত তাহারা লইয়া যাইতে সহজে সম্মত হয়। আমার বোধ হয়, যাহারা উহাকে হত্যা করিয়াছে, তাহারাই এ মৃতদেহ ভস্মে পরিণত করিবার মানসে ঐ স্থানে লইয়া গিয়াছিল। 

আমি। যিনি উহাকে মারিয়াছেন, তিনি তো আপনাদিগের সম্মুখেই উপস্থিত আছেন। তিনি বলিতেছেন, ঐ মৃতদেহ তাহারা স্থানান্তরিত করে নাই, রসিকের আত্মীয় স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবগণ ঐ মৃতদেহ লইয়া গিয়াছে। 

বাসা। তাহা হইলে রসিকবাবুকে যিনি হত্যা করিয়াছেন তাঁহাকে আপনারা প্রাপ্ত হইয়াছেন, তিনি কোথায়?

আমি। আপনাদিগের সম্মুখেই দণ্ডায়মান, আপনারা রাজচন্দ্র দাসকে চেনেন? 

বাসা। এই বাবুটিকে? 

আমি। হাঁ। 

বাসা। খুব চিনি, ইনি আমাদিগের প্রতিবাসী; আমাদিগের বাসাবাড়ীর সংলগ্ন বাড়ীতে ইনি বাস করিয়া থাকেন।

আমি। ইনিই রসিক বাবুকে হত্যা করিয়াছেন। 

বাসা। আমাদিগের সহিত মিথ্য উপহাস করিতেছেন কেন? রাজচন্দ্রবাৰু নিরীহ ভদ্রলোক, ইহাঁর দ্বারা এ কার্য্য কিছুতেই সম্পন্ন হইতে পারে না। এমন কি, যদি আমরা স্বচক্ষে ইহাঁকে ঐ কাৰ্য সম্পন্ন করিতে দেখি, তাহা হইলেও আমাদিগের বিশ্বাস হয় না যে, ঐ কার্য্য ইঁহার দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে। 

আমি। আমি আপনাদিগের সহিত উপহাস করিতেছি না। রাজচন্দ্র দাসকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখুন, তিনি নিজে আপনাদিগকে কি বলেন? 

বাসা। কি মহাশয়! এরূপ কথা হইতেছে কেন? 

রাজ। রসিক আমার দ্বারাই হত হইয়াছে, ইহাই আমার বিশ্বাস। 

বাসা। সে আপনার দ্বারা কিরূপে হত হইল? 

রাজ। সন্ধ্যার সময় যখন আমি আমার অফিস হইতে প্রত্যাগমন করিতেছিলাম, সেই সময় রসিক আমার বাড়ীর সম্মুখে আমাকে দেখিতে পাইয়া, বিনাকারণে নিতান্ত অশ্লীল ভাষায় আমাকে গালি প্রদান করিতে আরম্ভ করে। আমি তাহাকে যত নিষেধ করি, সে ততই অশ্লীল ভাষায় গালি প্রদান করিতে থাকে। এরূপ অবস্থায় আমার নিতান্ত ক্রোধের উদয় হয় ও ঐ ক্রোধ আমি কোনরূপে সংবরণ করিতে না পারিয়া, সজোরে তাঁহার গণ্ডদেশে এক চপেটাঘাত করি। আমার ঐ চপেটাঘাত সে সহ্য করিতে না পারিয়া ঐ স্থানে পতিত হয় ও ইহজীবন পরিত্যাগ করে। 

বাসা। এ কিরূপ কথা হইল! আপনার বাড়ীর সম্মুখে এই কার্য্য সম্পন্ন হইলে, প্রকারান্তরে আমাদিগের বাসার সম্মুখেই এই কাৰ্য্য সম্পন্ন হইল, অথচ আমরা তাহার কিছুমাত্র জানিতে পারিলাম না। বিশেষ আপনি যে সময়ের কথা বলিতেছেন, সেই সময় আমাদিগের বাসার অনেকেই বাসায় উপস্থিত ছিলেন, এরূপ একটি ভয়ানক ঘটনা বাসার সম্মুখে ঘটিলে আমাদিগের মধ্যে কেহ না কেহ নিশ্চয়ই উহা জানিতে পারিতেন। আর এক চপেটাঘাতেই যদি উহার মৃত্যু হইয়া তাকে, তাহা হইলে উহার বক্ষস্থলে লৌহ পেরেক কিরূপে সংবিদ্ধ হইল? 

রাজ। তাহা আমি বলিতে পারি না। 

বাসা। উহাকে দাহ করিবার জন্য কে লইয়া গিয়াছিল? 

রাজ। তাহা বলিতে পারি না। ও ঐ স্থানে পতিত হইবার পর আমি আমার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করি। হঠাৎ এই অবস্থা ঘটিয়া পড়ায়, আমার মনের কিছুমাত্র স্থিরতা থাকে না, সুতরাং আমি আর বাড়ী হইতে বহির্গত হই নাই। কিন্তু পরে শুনিয়াছিলাম, ঐ মৃতদেহ তাহার আত্মীয় স্বজন বা বন্ধুবান্ধবেরা লইয়া গিয়াছে। সুতরাং আমি মনে করিয়াছিলাম যে, আপনারাই ঐ মৃতদেহ সৎকারে মানসে স্থানান্তরিত করিয়াছেন। 

বাসা। আমরা অনেক দিবস হইতে এই স্থানে বাসা করিয়া আছি। আপনার সহিত বিশেষরূপ আলাপ পরিচয় না থাকিলেও আপনাকে আমরা বিশেষরূপে অবগত আছি। অবগত আছি যে, আপনি নিতান্ত ভদ্রলোক, নিজের বাড়ীতে পরিবারসহ বাস করিয়া থাকেন, এ পর্যন্ত কখন আপনার সহিত কাহারও বিবাদ বিসম্বাদ হইতে দেখি নাই বা শুনি নাই; সুতরাং এরূপ অবস্থায় এরূপ কার্য্য যে কখন আপনার দ্বারা হইতে পারে, তাহা বিশ্বাস করা সহজ নহে; কিন্তু আপনি যেরূপ বলিতেছেন, তাহা আমরা সহজে বিশ্বাস করিতে সমর্থ নহি। রসিক আজ যদি নিতান্ত অশ্লীল ভাষায় রাস্তার উপর দাঁড়াইয়া গালি প্রদান করিত, তাহা হইলে আমরা কেহ না কেহ নিশ্চয়ই তাহা জানিতে পারিতাম। তাহার উপর সে হত হইয়া রাস্তার উপর পতিত থাকিলে নিশ্চয়ই ঐ স্থানে লোকের জনতা হইত ও আমরা নিশ্চয়ই তাহা জানিতে পারিতাম। বৈকাল হইতে রাত্রি ৯টা ১০টা পর্যন্ত আমাদিগের এই বাসার কেহ না কেহ যে কতবার ঐ স্থান দিয়া গমনাগমন করিয়াছে, তাহার স্থিরতা নাই। এরূপ অবস্থায় আপনি মনে করেন কি, যে আমরা সকলেই অন্ধ হইয়া ঐ স্থান দিয়া যাতায়াত করিয়াছি। তাহার উপর বলুন দেখি, যদি আমরা ঐ মৃতদেহ বহন করিয়া না লইয়া গিয়া থাকি, তাহা হইলে এই স্থান হইতে অপর কোন ব্যক্তি উহা লইয়া যাইবে, আর লইয়া গেলেও যে আমরা উহা একেবারে জানিতে পারিব না, তাহাই বা বলি কি প্রকারে? আমার বোধ হয়, এই ঘটনা এই স্থানে আদৌ ঘটে নাই, বা আপনা কর্তৃক সে শমন-সদনে গমন করে নাই। ইহা অপর স্থানের ঘটনা ও যাহার দ্বারা এই কার্য্য সম্পন্ন হইয়াছে, আপনি তাহাকে বাঁচাইবার নিমিত্ত সমস্ত দোষ আপনার উপর গ্রহণ করিতেছেন। 

আমি। আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা নিতান্ত অযুক্তি সঙ্গত কথা নহে, তবে ইহার ভিতর একটি কথা বিবেচনা করা আবশ্যক যে, যাহারা ঐ মৃতদেহ সৎকার করিবার নিমিত্ত লইয়া গিয়াছিল, তাহারা যখন দেখিল, ঐ মৃতদেহের সৎকার হইল না, অথচ ঐ সংবাদ পুলিসে প্রদত্ত হইল, তখন তাহারা বিপদগ্রস্ত হইবে ভাবিয়া ঐ মৃতদেহ পরিত্যাগ করিয়া সেইস্থান হইতে পলায়ন করিল। এইরূপে যাহারা পলায়ন করিয়া আসিয়াছে, তাহারা কি আর এখন সহজে স্বীকার করিবে যে, তাহারা ঐ মৃতদেহ লইয়া গিয়াছিল। 

বাসা। আপনার কথা প্রকৃত মনে করুন, আমরাই ঐ মৃতদেহ লইয়া গিয়াছিলাম ও বিপদের আশঙ্কা করিয়া ঐ মৃতদেহ ঐ স্থানে পরিত্যাগ করিয়া আমরা পলাইয়া আসিয়াছি। সুতরাং এখন আমরা তাহা কোনরূপেই স্বীকার করিব না। কিন্তু যে স্থানে ঐ মৃতদেহ পড়িয়াছিল বলিয়া জানিতে পারিতেছেন, ও যে স্থান হইতে ঐ মৃতদেহ বহন করিয়া লইয়া যাওয়া হইয়াছিল, সেইস্থানে অনুসন্ধান করিলেই তো জানিতে পারিবেন যে, প্রকৃতপক্ষে সেইস্থানে কোন মৃতদেহ ছিল কি না, ও সেইস্থান হইতে কোন মৃতদেহ কেহ বহন করিয়া লইয়া গিয়াছে কি না? অনুসন্ধানে যদি অবগত হইতে পারেন যে, এইস্থানে ঐ মৃতদেহ পড়িয়াছিল ও এইস্থান হইতে ঐ মৃতদেহ কেহ বহন করিয়া লইয়া গিয়াছে, তাহা হইলেই প্রমাণ হইবে যে, আমরাই ঐ মৃতদেহ বহন করিয়া লইয়া গিয়াছিলাম, ও ঘাট হইতে ভয়ে পলাইয়া আসিয়াছি ও এখন পর্য্যন্ত মিথ্যা কথা বলিতেছি। 

আমি। আপনার কথায় আমি সম্পূর্ণরূপে অনুমোদন করি। যদি এই স্থান হইতে ঐ মৃতদেহ স্থানান্তরিত হইয়া থাকে ও মৃত অবস্থায় রসিক যদি কিয়ৎক্ষণ ঐ রাস্তার উপর পড়িয়া থাকে, তাহা হইলে নিশ্চয়ই পাড়ার লোকে তাহা দেখিয়াছে; ও একটু অনুসন্ধান করিলেই অনায়াসেই এখন জানা যাইতে পারিবে। এখন রসিক কোন ঘরে বাস করিত, একবার তাহা দেখিয়া লই। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

আমার কথা শুনিয়া বাসার সকলেই আমাকে সঙ্গে লইয়া যে ঘরে রসিকবাবু বাস করিত, সেই ঘরে লইয়া গেলেন। দেখিলাম, দোতালার উপরিস্থিত একটি ক্ষুদ্র ঘরে রসিক বাস করিত। ঐ ঘরের মধ্যে একখানি কেওড়া কাষ্ঠের তক্তাপোষের উপর কেবল একটি মাত্র বিছানা আছে, উহার উপরেই রসিক শয়ন করিত। এতদ্ব্যতীত ঐ ঘরের এক দিকে একটিটিনের বাক্স আছে, জানিলাম, উহাও রসিকের। তৈজসপত্রের মধ্যে রসিকের ইহা ভিন্ন আর কিছুই সেই স্থানে দেখিতে পাইলাম না, কিন্তু জানিতে পারিলাম, ইহা ব্যতীত তাহার একখানি থাল, একটি গেলাস ও দুইটি বাটি রান্না ঘরে আছে। বিছানাটি উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিলাম, কোনরূপ চিঠিপত্র বা অপর কিছুই দেখিতে পাইলাম না! টিনের বাক্সটি দেখিলাম, সেটি চাবিবদ্ধ অবস্থায় আছে। উহা খুলিবার চেষ্টা করিলাম, কিন্তু প্রথমতঃ উহা খুলিতে পারিলাম না, কিন্তু পরিশেষে ঐ বাসার সকলের চাবি সংগ্রহ করিয়া দেখিলাম, উহার মধ্যে একটি চাবি ঐ বাক্সের কলে লাগিয়া গেল, উহার দ্বারা বাক্সটি খুলিয়া দেখিলাম, উহার মধ্যে সামান্য পরিধেয় ভিন্ন আর কিছুই নাই। 

পূৰ্ব্বেই পাঠকগণ অবগত হইতে পারিয়াছেন যে, বাসাড়িয়া বাড়ীতে রসিক বাস করিত, সেই বাড়ী ও রাজচন্দ্র দাসের বাড়ী প্রায়ই পাশাপাশি অবস্থিত। রসিকের ঘরে গিয়া দেখিলাম, তাহার ঘর রাজচন্দ্র দাসের অন্দরমহলের প্রায় সংলগ্ন, রসিকের ঘরে যে একটি জানালা আছে, তাহা খোলা থাকিলে ঐ রাজচন্দ্র দাসের বাড়ীর অনেক স্থান দেখিতে পাওয়া যায়, বিশেষ ঐ জানালা সংলগ্ন রাজচন্দ্র দাসের একটি ঘর আছে। ঐ ঘরের একটি জানালা রসিকের ঘরের ঐ জানালার সহিত ঠিক রুজুভাবে সংস্থাপিত, উভয় জানালা এক সময়ে খোলা থাকিলে, উভয় ঘর হইতে উভয় ঘরের সমস্তই অবস্থা দেখিতে পাওয়া যায়। রাজচন্দ্র দাসকে বাধ্য হইয়া তাহার ঐ ঘরের জানালা প্রায় সৰ্ব্বদাই বন্ধ করিয়া রাখিতে হইত। রসিকের উপর ঐ জানালা বন্ধ করিয়া রাখিবার বাসার ম্যানেজারের আদেশ থাকিলেও তিনি কিন্তু উহা প্রায়ই বন্ধ করিয়া রাখিতেন না, ইহাতে রাজচন্দ্রকে প্রায় বিশেষরূপে অসুবিধা ভোগ করিতে হইত। 

রসিকের বাসস্থানের অবস্থা অবগত হইয়া যে স্থানে রাজচন্দ্র দাস রসিককে চপেটাঘাত করিয়াছিলেন, এবং যে স্থানে সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, সেইস্থানে আমরা সকলে গমন করিলাম। ঐ স্থানের নিকটবর্তী বাড়ীতে যাঁহারা বাস করিতেন, তাঁহাদিগকে যতদূর সম্ভব, সেই রাত্রিতেই উঠাইলাম। কিন্তু রসিকের মৃতদেহ কেহ যে সেইস্থানে দেখিয়াছেন বা উহার মৃত্যু সম্বন্ধে কোন কথা যে কেহ শ্রবণ করিয়াছেন, তাহা কিন্তু কেহই বলিলেন না। এখন যথার্থই জানিতে পারিলাম যে, রাজচন্দ্র দাস যে সকল কথা বলিতেছেন, তাহা সত্য নহে—মিথ্যা। রসিক ঐ স্থানে হত হয় নাই, বা ঐ স্থান হইতে তাঁহার মৃতদেহ কেহ স্থানান্তরিত করে নাই। এইরূপ অনুসন্ধানের পরও কিন্তু রাজচন্দ্র দাস তাঁহার কথার কোনরূপ পরিবর্তন করিলেন না, পূৰ্ব্ব হইতে যাহা বলিতেছিলেন, এখনও তাহাই বলিতে লাগিলেন। 

ইহার পর রাজচন্দ্র দাসকে লইয়া তাঁহার বাড়ীর ভিতর আমি প্রবেশ করিলাম। ঐ বাড়ীতে কেবলমাত্র তাঁহার স্ত্রী ও তাঁহার স্ত্রীর ভ্রাতা ভিন্ন আর কেহই ছিল না। তাঁহাদিগের নিকট হইতে জানিতে পারিলাম, তাঁহারা দুইজন ও রাজচন্দ্র ভিন্ন অপর আর কেহই ঐ বাড়ীতে বাস করে না, চাকর চাকরাণী প্রভৃতিও বিশেষ কেহ নাই। কেবলমাত্র একটি চাকর আছে, সে তাহার কার্য্যাদি শেষ করিয়া সন্ধ্যার পরই তাহার নিজের বাসায় গমন করিয়া থাকে, পরদিবস প্রাতঃকাল ভিন্ন সে আর প্রত্যাগমন করে না। উহাদিগকেও জিজ্ঞাসা করিয়া বিশেষ কোনরূপ কথাই প্রাপ্ত হইলাম না। ঐ বাড়ীর যে ঘরটির কথা পূর্ব্বে বলা হইয়াছে, অর্থাৎ রসিকের ঘরের দিকে যে ঘরের জানালা আছে, সেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম রাজচন্দ্র দাসের বাড়ীর মধ্যে ঐটিই সর্ব্বপ্রধান ও উৎকৃষ্ট ঘর। রাজচন্দ্র দাস ও তাঁহার যুবতী ভার্য্যা ঐ ঘরেই বাস করিয়া থাকেন। ঐ ঘরের যে জানালা রসিকের ঘরের দিকে স্থাপিত, তাহা বন্ধ করিয়া না রাখিলে ঐ ঘরে কি হইতেছে না হইতেছে তাহা রসিক সৰ্ব্বদাই দেখিতে পায়। আমি যে সময় ঐ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলাম, সেই সময় ঐ জানালা বদ্ধ অবস্থাতেই ছিল। উহা খুলিয়াও দেখিলাম। ঘরের অবস্থা দেখিয়াও বিশেষ কিছুই বুঝিতে পারিলাম না, যাহাতে রসিকের মৃত্যুর কারণ বিন্দুমাত্র নির্ণয় করিতে পারি। কিন্তু ঘরের অবস্থা দেখিয়া আমার বিশেষ সন্দেহ হইল যে, রাজচন্দ্র দাসের শয়ন-ঘরের ঐ জানালার সহিত রসিকের মৃত্যুর বিশেষরূপ সংশ্রব আছে। কিন্তু অনুসন্ধান করিয়া যখন এ সম্বন্ধে কোনরূপ প্রমাণ সংগ্রহ করিতে পারিলাম না, তখন কেবলমাত্র মনের সন্দেহে কি করা যাইতে পারে? আমার মনের সন্দেহ মনে রাখিয়াই ইহার অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। এইরূপে ঐ রাত্রি অতিবাহিত হইয়া গেল, অনুসন্ধানে বিশেষ কোনরূপ ফলই ফলিল না। 

পরদিবস মৃতদেহ পরীক্ষার নিমিত্ত প্রেরণ করা হইল। মৃতদেহ পরীক্ষা করিয়া ডাক্তার সাহেব তাঁহার অভিমত প্রকাশ করিলেন যে, “একটি প্রকাণ্ড লৌহপেরেক সজোরে হৃৎপিণ্ডের মধ্যে বিদ্ধ হওয়াতেই উহার মৃত্যু হইয়াছে।” ডাক্তার সাহেবের রিপোর্ট পাইয়া আমি উহা রাজচন্দ্র দাসকে দেখাইলাম, এবং তাঁহাকে বিশেষরূপে বুঝাইয়া তাঁহাকে সত্যকথা কহিতে কহিলাম। এখন দেখিলাম, রাজচন্দ্র দাস অন্য আর এক প্রকার ভাব অবলম্বন করিয়াছে, আমার কথাগুলি তিনি সবিশেষ মনোযোগের সহিত শুনিয়া পরিশেষে কহিলেন, মহাশয়! আপনারা আমাকে যতই বুঝাইয়া বলুন না কেন, যাহা আমি অবগত নহি, সে সম্বন্ধে আমি কোন কথা আপনাদিগকে কিরূপে বলিব? আমি যাহা অবগত আছি, তাহা সমস্তই আপনাদিগকে বলিয়াছি। আমি যাহা করিয়াছি, তাহা প্রথম হইতেই আপনাদিগের নিকট স্বীকার করিয়া আসিতেছি, কিন্তু যখন আপনারা আমার কথা কিছুতেই বিশ্বাস করিতেছেন না, তখন আমি আপনাদিগকে আর কি বলিতে পারি? ডাক্তার সাহেব বলিতেছেন, উহার হৃদপিণ্ডে পেরেক বিদ্ধ হওয়ায় উহার মৃত্যু হইয়াছে। তিনি যাহা বলিতেছেন, তাহা নিশ্চয়ই সত্য হইবে; কিন্তু আমি তাহার বিন্দুবিসর্গও অবগত নহি। এরূপ অবস্থায় আমার প্রকৃতকথা যখন আপনারা বিশ্বাস করিতেছেন না, তখন আপনাদিগের নিকট প্রকৃতকথা বলিবারও আরও প্রয়োজন নাই। এখন হইতে আমিও আপনাদিগের নিকট মিথ্যা কথা কহিব। যে প্রকৃত কথা আমি এ পর্য্যন্ত স্বীকার করিয়া আসিতেছিলাম, তাহাও স্বীকার করিব না। এখন আমি বলিতেছি, আমি ইহার কিছুই জানি না, আমি উহাকে চপেটাঘাত করি নাই, ও আমার চপেটাঘাতে উহার মৃত্যু হয় নাই; আপনারা আমাকে এখন যেরূপ দণ্ডে দণ্ডিত করিবার চেষ্টা করুন না কেন, আমি কিন্তু এখন হইতে সমস্ত কথা অস্বীকার করিব। যে কেহ আমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবে, তাহাকেই কহিব যে, আমি কিছুই জানি না, পুলিস আমাকে ধরিয়া নিরর্থক কষ্ট প্রদান করিতেছে; আপনি জিজ্ঞাসা করিলেও পরিশেষে আমার নিকট হইতে এই এক মাত্র উত্তরই প্রাপ্ত হইবেন। কিন্তু আমার একটি অনুরোধ এই যে, আমার উপর আপনারা যে সকল প্রকৃত প্রমাণপ্রাপ্ত হন, তাহাই গ্রহণ করিবেন, ইহাতে আমার ফাঁসি হইলেও আমার দুঃখ হইবে না, কিন্তু মিথ্যা প্রমাণ সংগ্রহ করিয়া যেন আমাকে চরম দণ্ডে দণ্ডিত না করেন। আপনাদিগের কাহারও চাকরি চিরস্থায়ী নহে, সামান্য চাকরির খাতিরে আমার বিপক্ষে মিথ্যা সাক্ষীর যোগাড় করিয়া দিয়া অধর্ম্ম সঞ্চয় করিবেন না, ইহাই আমার একমাত্র শেষ অনুরোধ। 

এই বলিয়া রাজচন্দ্র দাস চুপ করিলেন। আমিও এখন বুঝিতে পারিলাম যে, রাজচন্দ্র দাস তাহার মনের গতি অপর দিকে পরিবর্তিত করিতে সমর্থ হইয়াছে। আরও বুঝিতে পারিলাম যে, তাহার উপর আর কোনরূপ প্রমাণ এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত হওয়া যায় নাই দেখিয়াই, সে এখন বুঝিতে পারিয়াছে যে, এখন যদি সে আর কোন কথা স্বীকার না করে, তাহা হইলে তাহার কোনরূপই দণ্ড হইতে পারে না। এই ভাবিয়া পূৰ্ব্ব হইতে সে যাহা বলিয়া আসিতেছিল, এখন আর সে তাহাও বলিতে সম্মত নহে। রাজচন্দ্রের মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া, সেই সময় হইতে তাহাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না, তাহার সম্মুখে আর কোনরূপ অনুসন্ধান করিতেও প্রবৃত্ত হইলাম না। ইহার পর হইতেই রাজচন্দ্র দাস হাজতগৃহে আবদ্ধ হইল, তাহার বিপক্ষে অনুসন্ধান চলিতে লাগিল। এ পৰ্য্যন্ত আমি একাকীই এই বিষয়ে অনুসন্ধান করিতেছিলাম, কিন্তু এখন হইতে আরও তিন চারিজন বহুদর্শী কর্ম্মচারী আমার সমভিব্যাহারে ইহার অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

এখন আমরা যে অনুসন্ধানে নিযুক্ত, তাহা একটি সঙ্গীন হত্যাপরাধ, সুতরাং অনুসন্ধানও সেইরূপ ভাবে চলিতে লাগিল। রসিক যে বাসায় বাস করিত, সেই বাসার অপর ব্যক্তিগণের মধ্যে যেরূপ ভাবে অনুসন্ধান করার প্রয়োজন, তাহার কিছুই বাকী রহিল না; কিন্তু ঐ সমস্ত লোকের বিরুদ্ধে কোনরূপ প্রমাণ পাওয়া গেল না। যখন তাঁহারা বুঝিতে পারিলেন যে তাঁহাদিগের উপর আমাদিগের সন্দেহ হউক বা না হউক, তাঁহাদিগের বিপক্ষে আমরা বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিয়া কিছুই প্রাপ্ত হইলাম না, তখন তাঁহারাও আমাদিগের সহিত যোগ দিয়া যাহাতে এই হত্যারহস্যের নিগূঢ় তত্ত্ব বাহির করিতে সমর্থ হন, সাধ্যমতে তাহার চেষ্টা করিতে ত্রুটি করিলেন না। 

রসিক যে আফিসে কার্য্য করিত, যাহার যাহার সহিত তাহার একটু বিশেষরূপ মেসামিসি ছিল, তাহাদিগের সম্বন্ধেও বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিলাম, ও তাহাদিগের মধ্যে যাহাদিগের নীচ স্থানে গমনাগমন আছে, রসিককে লইয়া যে সকল স্থানে তাহারা যাতায়াত করিয়া থাকে, সেই সকল স্থানে বিশেষ রূপ অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু কাহারও বিপক্ষে কিছুই অবগত হইতে পারিলাম না, বা কাহারা ঐ মৃতদেহ বহন করিয়া দাহ করিবার ঘাটে লইয়া গিয়াছিল, তাহারও কিছুমাত্র সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিলাম না। 

যে স্থানে রসিক হত হইয়াছিল বলিয়া রাজচন্দ্র দাস আমাদিগকে দেখাইয়া দিয়াছিল, সেই স্থানের প্রত্যেক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করা হইয়াছিল, কিন্তু তাহারা কেহই ঐ স্থানে রসিকের মৃতদেহ দর্শন করে নাই বা কোনরূপ গোলযোগ ও শ্রবণ করে নাই। সুতরাং আমরা একরূপ স্থির করিয়াই লইয়াছিলাম যে রাজচন্দ্রের কথা মিথ্যা, ঐ স্থানে কোনরূপ গোলযোগ হয় নাই বা রসিকের মৃত্যুও ঐ স্থানে হয় নাই। কিন্তু হইা স্পষ্টই বুঝিতে পারিয়াছিলাম যে, রাজচন্দ্র দাস এই হত্যা-রহস্যের কিছু কিছু অবগত আছে ও কোনরূপ বিশেষ উদ্দেশ্য সাধন করিবার মানসে সে থানায় গিয়া আত্মসমর্পণ করিয়াছিল। কিন্তু তাহার সেই উদ্দেশ্য যে কি, তাহা কিছুতেই অবগত হইতে পারিলাম না। 

রাজচন্দ্র দাস সম্বন্ধে বিশেষরূপ অনুসন্ধান করা হইল, কিন্তু তিনি যাঁহার যাঁহার নিকট পরিচিত, তাঁহারা সকলেই একবাক্যে কহিলেন, রাজচন্দ্র দাস অতি নিরীহ ভদ্রলোক, কাহারও সহিত তাঁহার কোনরূপ কলহ বিবাদ কেহ কখন দেখে নাই, বা তাঁহার যে কোন শত্রু আছে, তাহাও কেহ অবগত নহেন, তিনি সকলের নিকট প্রিয় ও সকলেই তাঁহাকে ভালবাসিয়া থাকে। 

রাজচন্দ্র দাসের বাড়ীতে স্ত্রীলোকের মধ্যে কেবলমাত্র তাঁহার স্ত্রী বাস করিয়া থাকেন। তাঁহার চরিত্র সম্বন্ধে গোপনভাবে বিশেষরূপ অনুসন্ধান করা হইল, কিন্তু তাঁহার বিপক্ষে কাহারও মুখ দিয়া একটি কথাও বাহির হইল না; অধিকন্তু তাঁহার চরিত্র সমস্ত স্ত্রীলোকের আদর্শস্থানীয় বলিয়া সকলেই তাঁহার ভূরি ভূরি প্রশংসা করিতে লাগিল। যে পর্য্যন্ত এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান চলিতে লাগিল, রাজচন্দ্র দাস সেই পৰ্য্যন্ত হাজত-গৃহে আবদ্ধ রহিল, সেই সময় যে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, তাহাকেই সে উত্তর প্রদান করিল যে, সে কিছুই অবগত নহে, পুলিস তাহাকে ধরিয়া নিরর্থক কষ্ট প্রদান করিতেছে, তাহার বাড়ীর নিকট রসিক বাস করিত বলিয়াই তাহাকে এইরূপ অবমাননা সহ্য করিতে হইতেছে। “তিনি যদি নিরর্থক ধৃত হইয়া থাকেন, তাহা হইলে নিজে থানায় গিয়া তাহার আত্মসমর্পণ করিবার প্রয়োজন কি ছিল, ও কেনই বা তিনি স্বীকার করিয়াছিলেন যে, তাহার চপেটাঘাতে রসিক ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছে।” একথা যিনি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তাঁহাকেই রাজচন্দ্র দাস পরিশেষে এই উত্তর প্রদান করিলেন যে, তিনি কোন থানায় গিয়া কাহারও নিকট আত্মসমর্পণ করেন নাই বা কাহার নিকট স্বীকার করেন নাই যে, তাঁহারই চপেটাঘাতে রসিক ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছে। রাজচন্দ্রের নিকট হইতে এইরূপ উত্তর পাইবার পর তাহাকে আর কেহই কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলেন না কিন্তু তাহার বিপক্ষে যতদূর সম্ভব অনুসন্ধান চলিতে লাগিল। এইরূপে প্রায় পনের দিবস অনুসন্ধানের পর যখন দেখা গেল যে, রাজচন্দ্রের বিরুদ্ধে আর কোন প্রমাণই সংগ্রহ হইল না, তখন অনন্যোপায় হইয়া রাজচন্দ্রকে ছাড়িয়া দিতে হইল। তিনি জামিনে নিষ্কৃতি লাভ করিয়া আপন বাড়ীতে গমন করিলেন। রাজচন্দ্রকে জামিনে ছাড়িয়া দিবার পর যে ঐ অনুসন্ধান একবারে বন্ধ হইয়া গেল, তাহা নহে; তাহার বিপক্ষে, ও কিরূপে ও কাহার হস্তে রসিক হত হইয়াছে, সেই সম্বন্ধে আরও দুইমাস কাল অনুসন্ধান চলিতে লাগিল, কিন্তু কোনরূপ ফলই ফলিল না। প্রায় তিন মাসকাল অনুসন্ধানের পর ঐ অনুসন্ধান বন্ধ হইয়া গেল। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

এই অনুসন্ধান বন্ধ হইয়া গেল, রাজচন্দ্র দাস অব্যাহতি পাইয়া নিজ কার্য্যে মনোনিবেশ করিলেন, আমরাও অপরাপর কার্যে নিযুক্ত থাকিয়া দিনযাপন করিতে লাগিলাম। ঐ অনুসন্ধান শেষ হইয়া যাইবার পর অন্য কার্য্যে নিযুক্ত থাকিলেও আমি কিন্তু এই ঘটনাটি একেবারে ভুলিয়া যাইতে পারিলাম না। রসিকের মৃত্যুর কারণ জানিবার নিমিত্ত আমার মনে যে কৌতূহল প্রথম হইতে উদিত হইয়াছিল, তাহা কিন্তু কোন রূপেই দূর করিতে পারিলাম না; সুতরাং যে কোন কার্য্যে নিযুক্ত থাকি না কেন, ঐ হত্যারহস্যের দিকে আমার সদাসর্ব্বদা লক্ষ্য রহিল। রাজচন্দ্র দাসের গৃহকার্য্য নির্ব্বাহ করিবার জন্য এখন যে সকল চাকর চাকরাণি নিযুক্ত হইত, আমি প্রায়ই তাহাদিগের সহিত আলাপ পরিচয় রাখিতাম, তাহাদিগের নিকট হইতে উহার বাড়ীর ভিতরের অবস্থা জানিয়া লইতে সর্ব্বদাই চেষ্টা করিতাম; কারণ আমার মনে কেমন একরূপ দৃঢ়বিশ্বাস জন্মিয়াছিল যে, রসিকের হত্যা সম্বন্ধে রাজচন্দ্র দাসের বাড়ীর কেহ না কেহ সংশ্লিষ্ট আছে, ও থানায় হঠাৎ যাইয়া রাজচন্দ্র দাসের আত্মসমর্পণ করার বিশেষ কোনরূপ উদ্দেশ্য ছিল। 

এইরূপে প্রায় এক বৎসর অতিবাহিত হইয়া গেল। রাজচন্দ্র দাসের বাড়ীর সে সকল পুরাতন চাকর চাকরাণী ছিল, ক্রমে ক্রমে তাহারা সকলেই অবসর গ্রহণ করিয়া অপর স্থানে গমন করিল। রাজচন্দ্র দাসের বাড়ী পরিত্যাগ করিবার পরও আমি উহাদিগের নিকট হইতে যদি হত্যা সম্বন্ধে কোন কথা জানিতে পারি, তাহার নিমিত্ত, বিশেষরূপ চেষ্টা করিয়া ছিলাম, কিন্তু কোনরূপেই কৃতকাৰ্য্য হইতে সমর্থ হই নাই। 

রাজচন্দ্র দাসের বাড়ী হইতে পুরাতন চাকর চাকরাণী চলিয়া যাইবার পর যে চাকর চাকরাণী নিযুক্ত হইল, তাহাদিগের সহিতও আমি ক্রমে আলাপ পরিচয় করিয়া লইলাম। দেখিলাম, এবার যে চাকরাণী নিযুক্ত হইয়াছে, সে অতিশয় চতুরা, তাহাকে হস্তগত করিতে পারিলে যদি আমার মনোবাঞ্ছা কোনরূপে পূর্ণ করিতে পারি তাহার চেষ্টা করিলাম। এক দিবস তাহার সহিত নির্জ্জনে সাক্ষাৎ করিয়া জানিতে পারিলাম যে, সে সমস্ত দিবস রাজচন্দ্র দাসের 

বাড়ীতে কার্য্য করিয়া রাত্রি ১০টা ১১টার সময় নিজ বাসায় ফিরিয়া যায়, ও রাত্রি অবশিষ্ট অংশ তথায় থাকিয়া প্রত্যূষে পুনরায় আপন কার্য্যে গমন করে। আহারীয় ও পরিধেয় ভিন্ন রাজচন্দ্রের নিকট হইতে সে মাসিক আড়াই টাকা বেতন পাইয়া থাকে। তাহার নিকট হইতে এই তথ্য অবগত হইয়া আমিও নিজ হইতে তাহাকে মাসিক আর তিন টাকা বেতন বরাদ্দ করিয়া দিলাম, কিন্তু আমার আসল উদ্দেশ্যের কোন কথা তাহাকে না বলিয়া যাহাতে সে রাজচন্দ্র দাসের পত্নীর উত্তমরূপে সেবাশুশ্রূষা করিয়া তাহার প্রীতিভাজন হইতে পারে, কেবল সেই চেষ্টা করিতে বলিলাম। তাহাকে আরও বলিয়া দিলাম যে, সে আমার নিকট হইতে এইরূপ অতিরিক্ত বেতন প্রাপ্ত হইতেছে, তাহা যেন রাজচন্দ্র দাস বা তাহার পত্নী কোনরূপে অবগত হইতে না পারে। আরও বলিলাম যে দিবস উহারা এই কথা জানিতে পারিবে, সেই দিবস হইতে তাহার ঐ অতিরিক্ত বেতন বন্ধ হইবে। সে আমার কথায় সম্মত হইয়া তাহার নিজের কার্যসাধন করিতে লাগিল, আমিও মাসে মাসে তাহাকে ৩ টাকা করিয়া অতিরিক্ত বেতন প্রদান করিতে লাগিলাম, ও মধ্যে মধ্যে রাত্রিকালে তাহার বাসায় গমন করিয়া রাজচন্দ্র দাসের বাড়ীর অবস্থা অবগত হইতে লাগিলাম। এইরূপে আরও ছয় মাস অতিবাহিত হইয়া গেল। 

পরিচারিকাটি অতিশয় চতুরা ছিল, একথা পূৰ্ব্বেই আমি বলিয়াছি; সে আমার আদেশমত রাজচন্দ্র দাসের স্ত্রীর এরূপভাবে পরিচর্য্যা করিতে লাগিল যে, তিনি ক্রমে ঐ পরিচারিকাকে প্রাণের সহিত ভালবাসিতে লাগিলেন। সুতরাং তাঁহার মনের কথা ক্রমে ঐ পরিচারিকার নিকট প্রকাশ করিতে লাগিলেন। এইরূপে যে দিবস যে সকল কথা ঐ পরিচারিকা অবগত হইতে লাগিল, তাহার সমস্তই আমার সাক্ষাৎ হইলেই আমাকে বলিতে লাগিল। আমিও উহাদিগের ঘরের কোন কোন কথা জানিয়া লইবার মানসে ঐ পরিচারিকাকে দুই একটি কথা বলিয়া দিতে লাগিলাম; সেও সুযোগমত ঐ সকল বিষয় রাজচন্দ্র দাসের স্ত্রীর নিকট হইতে অবগত হইয়া আমাকে বলিয়া দিতে লাগিল। আমার আসল উদ্দেশ্যের কথা কিন্তু এখন পর্যন্ত আমি উহাকে বলি নাই, বাজে কথা লইয়াই আরো ছয় মাস অতিবাহিত হইয়া গেল। এইরূপে এক বৎসরকাল আমার নিকট হইতে মাসিক ৩ টাকা হিসাবে বেতন প্রাপ্ত হইবার পর, আমি একদিন আমার মনের কথার একটু আভাস তাহাকে প্রদান করিলাম, বলিয়া দিলাম, রাজচন্দ্র দাসের স্ত্রী এ সম্বন্ধে কি অবগত আছেন, তাহা ক্রমে সুযোগমত তাহার নিকট হইতে বাহির করিয়া লইতে হইবে। পরিচারিকা আমার কথা শুনিয়া কহিল, সে অনায়াসেই তাহা জানিয়া লইতে পারিবে। 

ইহার পনের দিবস পরেই আমার সহিত যখন তাহার সাক্ষাৎ হইল, তখন সে আমাকে কহিল, আপনি আমাকে যাহা জানিয়া লইতে বলিয়াছিলেন, তাহার সমস্তই আমি জানিতে পারিয়াছি। তাহার কথা শুনিয়া আমি তাহাকে কহিলাম, কি জানিতে পারিয়াছ তাহা আনুপূর্ব্বিক আমাকে বল। পরিচারিকা কহিল, আমি যেরূপে এ সমস্ত বিষয় রাজচন্দ্রের স্ত্রীর নিকট হইতে জানিতে পারিয়াছি, তাহা বলিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই, কিন্তু যাহা জানিতে পারিয়াছি তাহা বলিতেছি। রসিক যে ঘরে বাস করিত, সেই ঘর ও রাজচন্দ্রের স্ত্রীর ঘর আলাহিদা বাটীতে হইলেও প্রায় এক বলিলেও হয়। রাজচন্দ্র দাসের স্ত্রী অতিশয় সাধ্বী, কিন্তু রসিক সদা সৰ্ব্বদা তাঁহাকে দেখিতে পাইত ও তাঁহাকে বিপথগামিনী করিবার সাধ্যমত চেষ্টা করিতে কিছুমাত্র ত্রুটি করিত না। রাজচন্দ্র দাসের স্ত্রী উহার কথায়, উহার ভাবভঙ্গিতে ও উহার নির্লজ্জ ইঙ্গিতে নিতান্তই অস্থির হইয়া পড়িয়াছিলেন, তথাপি তিনি তাহার দিকে কিছুমাত্র লক্ষ্য না করিয়া নিজ গৃহকাৰ্য্য লইয়াই ব্যস্ত থাকিতেন। রসিক ঐরূপে অত্যাচার করিয়াই যে কেবল নিবৃত্ত থাকিত তাহা নহে, তাহার বন্ধুবান্ধবের মধ্যে যাহারা তাহার নিকট আগমন করিত, ও যাহাদিগের চরিত্র রসিকের চরিত্রের ন্যায় ছিল, তাহাদিগের নিকট রসিক সময়ে সময়ে বলিত, রাজচন্দ্র দাসের স্ত্রী তাহার উপপত্নী। এই রূপ ভয়ানক অপবাদের কথা রাজচন্দ্র দাসের স্ত্রী স্বকর্ণে শ্রবণ করিয়াও প্রথমত তিনি তাহার দিকে লক্ষ্য করেন নাই, ইহার পর আরও দুই তিনবার ঐকথা উহার বন্ধুগণের নিকট বিবৃত করিতে শ্রবণ করিয়া তিনি ক্রোধে একেবারে অধৈর্য্য হইয়া পড়েন, ও স্বহস্তে ইহার প্রতিশোধ লইতে মনস্থ করিয়া, কোন কথা তাহার স্বামীকে না বলিয়া তিনি মনে মনে স্থির করেন যে, উহার জীবন স্বহস্তে গ্রহণ করিয়া দারুণ অপমানের প্রতিশোধ প্রদান করিবেন। মনে মনে এরূপ স্থির করিয়া এক দিবস বৈকালে তিনি রসিককে তাহার ঘরে দেখিতে পাইয়া তাহাকে কহিলেন, “তুমি এত দিবস পৰ্য্যন্ত যে ইচ্ছা করিয়া আসিতেছ, আজ আমি তোমার সেই ইচ্ছা পূর্ণ করিতে মনস্থ করিয়াছি। আজ রাত্রিতে আমার স্বামী আমার গৃহে আসিবেন না, বাড়ীর চাকর চাকরাণী প্রভৃতি সকলকে আমি সন্ধ্যার পরেই বিদায় করিয়া দিব। বাড়ীর দরজা খোলা থাকিবে। সেই সময় তুমি আমার ঘরে আসিও, সমস্ত রাত্রি থাকিয়া ভোরে চলিয়া যাইও।” বলা বাহুল্য, তাহার এই প্রস্তাবে রসিক যেন হস্তে স্বর্গ পাইল, ভাল মন্দ কোন কথা না ভাবিয়াই সন্ধ্যার সময়েই সে রাজচন্দ্র দাসের স্ত্রীর ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইল। ইহার পূর্ব্বেই রাজচন্দ্র দাসের স্ত্রী, তাহার চাকর চাকরাণী প্রভৃতি সকলকে বিদায় করিয়া দিয়াছিলেন। রসিক আসিবামাত্র তিনি তাহাকে বিশেষ সমাদরে রাজচন্দ্র দাসের বিছানার উপর লইয়া গিয়া বসাইলেন ও তাহাকে সেই পালঙ্কের উপর শয়ন করিতে কহিলেন। রসিক আহ্লাদে উন্মত্ত প্রায় হইয়া আপনার হিতাহিত জ্ঞান হারাইয়া সেই পালঙ্কের উপর শয়ন করিলেন। রাজচন্দ্রের স্ত্রী পূর্ব্ব হইতে বৃহৎ ও তীক্ষ্মমুখ একটি পেরেক সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিলেন। রসিক শয়ন করিলে রাজচন্দ্রের স্ত্রী লুক্কাইতভাবে সেই পেরেকটি নিজের নিকট রাখিয়া তাহার পার্শ্বে আসিয়া উপবেশন করিলেন, ও তাহার গাত্রে হস্তার্পণ করিতে করিতে সেই পেরেকটি তাহার বক্ষঃস্থলে এরূপ সজোরে বসাইয়া দিলেন যে, সেই পেরেকের প্রায় অর্দ্ধেক রসিকের হৃৎপিণ্ডে বিদ্ধ হইয়া গেল। রসিক চীৎকার করিয়া উঠিল, কিন্তু ঘরের সমস্ত দরজা বন্ধ থাকায় সেই শব্দ বিশেষরূপে বাহিরে যাইতে পারিল না। সেই স্থানে বিছানার পার্শ্বেই একখণ্ড কাষ্ঠরাজচন্দ্রের স্ত্রী পূর্ব্ব হইতেই রাখিয়া দিয়াছিলেন, চকিতের ন্যায় তিনি ঐ কাষ্ঠখণ্ড গ্রহণ করিয়া সেই পেরেকের উপর সজোরে আঘাত করিয়া সেই পেরেকটি সম্পূর্ণরূপে উহার হৃৎপিণ্ডের মধ্যে বিদ্ধ করিয়া দিলেন। দেখিতে দেখিতে রসিক ইহজীবন পরিত্যাগ করিল; রসিক মৃত অবস্থায় সেইস্থানে পড়িয়া রহিল। রাজচন্দ্র দাসের স্ত্রী ঐ ঘরে তালা বন্ধ করিয়া দিয়া অপর এক ঘরে গিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন। বসিয়া রহিলেন সত্য, কিন্তু তাঁহার মনেক গতিক সেই সময় যে কি হইয়াছিল, তাহা পাঠকগণ অনায়াসেই অনুভব করিতে পারিবেন। তিনি একে স্ত্রীলোক, গৃহস্থঘরের বউ, তাহাতে তিনি চরিত্রবতী বলিয়া পাড়ার সকলের নিকট পরিচিতা, এরূপ অবস্থায় তাঁহার ঘরের মধ্যে অপরিচিত পুরুষের সমভিব্যাহারে কিয়ৎক্ষণ অবস্থিতি করিবার পর, তাহাকে হত্যা করা ও ঐ মৃতদেহ আপন পালঙ্কের উপর রাখিয়া ঘরে তালা বদ্ধ করিয়া একাকী সেই বাড়ীতে স্থির ভাবে বসিয়া থাকা, স্ত্রীলোকের পক্ষে যে কতদূর দুরূহ ব্যাপার তাহা পাঠকগণ অনায়াসেই অনুভব করিতে পারিবেন। কিন্তু রাজচন্দ্র দাসের স্ত্রীর হৃদয় কিরূপ তাহা জানি না, তিনি এইরূপ অবস্থায় ঐ মৃতদেহ ঘরের ভিতর রাখিয়া স্থিরভাবে নিকটবর্ত্তী আর একটি ঘরে উপবেশন করিয়া আপনার স্বামীর আগমনের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। ইহার অতি অল্পক্ষণ পরেই তাঁহার স্বামী অফিস হইতে প্রত্যাগমন করিলে, তিনি সমস্ত কথা তাঁহার নিকট বলিলেন ও ঘরের তালা খুলিয়া রসিকের মৃতদেহ দেখাইলেন। রাজচন্দ্র দাস চতুদিকে অন্ধকার দেখিলেন। এরূপ অবস্থায় কি করা কর্তব্য তাহা স্থির করিতে না পারিয়া ঘরের দরজা পূর্ব্ববৎ বন্ধ করিয়া দিয়া তাঁহার অফিসের একজন বিশ্বাসী বন্ধুর নিকট গমন করিলেন ও তাঁহাকে সমস্ত কথা বলিলেন। সমস্ত কথা শুনিয়া বন্ধুবর রাজচন্দ্র দাসের স্ত্রীকে ধন্যবাদ প্রদান করিলেন, ও কহিলেন, যাহা হইয়াছে তাহার নিমিত্ত বিশেষরূপ ভাবিবার কোন কারণ নাই। এই বলিয়া তিনি তাঁহার নিজের গাড়ী প্রস্তুত করিতে আদেশ প্রদান করিলেন, ও তাঁহার নিজের দুইজন বিশ্বাসী কৰ্ম্মচারীকে সঙ্গে লইয়া ঐ গাড়ীতে রাজচন্দ্র দাসের সহিত তাঁহার বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি, রাজচন্দ্র দাস ও ঐ দুইজন কর্ম্মচারী রসিকের মৃতদেহ ঘর হইতে বাহির করিয়া তাঁহার নিজের গাড়ীর মধ্যে এরূপ সতর্কতার সহিত রাখিয়া দিলেন যে, অপর কোন ব্যক্তি ইহার কিছুমাত্র জানিতে পারিল না। এইরূপে মৃতদেহ সেইস্থান হইতে লইয়া প্ৰস্থান করিলেন ও শবদাহ করিবার ঘাটের সন্নিকটবর্তী কোন স্থানে অন্ধকারের মধ্যে ঐ গাড়ী রাখিয়া একখানি খাট আনাইয়া তাহাতে ঐ মৃতদেহ স্থাপন পূর্ব্বক আপনারা বহন করিয়া শবদাহ করিবার ঘাটে লইয়া গেলেন, ও বিসূচিকা রোগে উহার মৃত্যু হইয়াছে বলিয়া, ঐ দেহ দাহ করিবার চেষ্টা করিলেন। কিন্তু যখন দেখিলেন যে তাঁহারা ঐ কার্য্যে কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না, তখন ঐ মৃতদেহ সেই স্থানে পরিত্যাগ পূর্ব্বক অন্ধকারের আশ্রয় লইয়া একে একে সকলেই তথা হইতে পলায়ন করতঃ তাঁহাদিগের গাড়ীতে আসিয়া উপবেশন করিলেন ও সেইস্থান হইতে চলিয়া আসিলেন। পরিশেষে ইহাই সাব্যস্ত হইল যে, পুলিস ইহার অনুসন্ধান করিলে সকল কথা বাহির হইয়া পড়িতে পারে, সুতরাং অনুসন্ধানের পূর্ব্বেই রাজচন্দ্র দাস থানায় গিয়া আত্মসমর্পণ করুন, তাহা হইলে আর বিশেষরূপ অনুসন্ধান হইবে না, তিনিই সামান্য দোষে দোষী হইবেন, তাঁহার স্ত্রীর উপর কোন দোষ পড়িবে না, সামান্য দণ্ডেই তিনি নিষ্কৃতি পাইবেন। কিন্তু কোনরূপেই যেন প্রকৃত কথা স্বীকার করা না হয়। 

এই পরামর্শ অনুসারে রাজচন্দ্র দাস আত্মসমর্পণ করিয়াছিলেন ও যাহা যাহা বলিয়াছিলেন, পাঠকগণ তাহা অবগত আছেন। 

এতদিন পরে হত্যার প্রকৃত অবস্থা জানিতে পারিলাম সত্য কিন্তু বিনা প্রমাণে মোকদ্দমা চলিল না, রাজচন্দ্র দাস অনায়াসেই নিষ্কৃতি লাভ করিলেন। 

[অগ্রহায়ণ, ১৩১১] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *