ডাক্তারবাবু (শেষ কাণ্ড)
(অর্থাৎ কুপথগামী বুদ্ধিমান লোকের ভয়ানক জীবনী! )
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
পরদিন পুনরায় দুই সহস্র মুদ্রা পাইলাম। এই টাকা লইয়া আপনার স্ত্রীর নিকট রাখিয়া দিলাম ও পূর্ব্বমত জাল রসিদ লিখিয়া আনিয়া জমীদার মহাশয়কে দিলাম। তিনি বুঝিতে পারিলেন,—এ টাকাও ডাক্তার সাহেব পাইয়াছেন।
সেইদিবস এই মৰ্ম্মে একখানি দরখাস্ত লিখিয়া আনিলাম যে, জমীদার মহাশয় ছোট লাট বাহাদুরের নিকট এই প্রার্থনা করিতেছেন যে, দেওয়ানী আদালতে তাঁহাকে আর সাক্ষী দিতে না হয়। তবে বিশেষ প্রয়োজন হইলে আদালতে তাঁহাকে স্বয়ং উপস্থিত না করাইয়া কমিশন দ্বারা তাঁহার সাক্ষ্য গৃহীত হয়। ঐ দরখাস্তে জমীদার মহাশয় স্বাক্ষর করিলেন। ডাক্তার সাহেবের দ্বারা ঐ দরখাস্ত পাঠাইতে হইবে বলিয়া আমি উহা লইয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। বাহিরে খাইয়া ঐ দরখাস্ত টুকরা টুকরা করিয়া ছিড়িয়া ফেলিলাম; কিন্তু পরদিন আসিয়া বলিলাম যে, ডাক্তার সাহেব অদ্য আপনার দরখাস্ত লইয়া নিজে ছোট লাট বাহাদুরের নিকট গমন করিয়াছেন।
এইরূপ চারি পাঁচ দিবস গত হইলে, এক দিবস আমি লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর সাহেবের সেক্রেটরির নিজ-কথা- স্বরূপ একখানি পত্র লিখিলাম। ঐ পত্রের মর্ম এই যে, ছোট লাট বাহাদুর জমীদার মহাশয়ের দরখাস্ত পাইয়াছেন, যে প্রকার আদেশ হয়, পরে জানিতে পারিবেন। এই পত্র, একখানি সরকারী খামের ভিতর বন্ধ করিয়া, তাহার উপর দুইটি পোষ্টাফিসের মোহর জাল করিলাম; এবং নিজহস্তে উহা লইয়া জমীদার মহাশয়ের বাটীতে গিয়া বলিলাম, “একজন ডাক পিয়ন এই পত্রখানি এখনই দিয়া গেল।” তিনি পত্রখানি খুলিলেন, ও পড়িয়া তাহার মর্ম্ম অবগত হইলেন। সন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, “এখন আমি জানিতে পারিলাম যে, ডাক্তার সাহেব আমার নিমিত্ত একান্তই পরিশ্রম করিতেছেন।” সেইদিবস অবশিষ্ট সহস্র মুদ্রা তাঁহার নিকট হইতে লইয়া ইচ্ছানুযায়ী খরচ করিয়া ফেলিলাম। কিন্তু পরদিবস জাল রসিদ আনিয়া দিতে ভুলিলাম না।
ইতিমধ্যে আরও একখানি পত্র জাল করিলাম; এখানি মহামান্য ষ্টেট সেক্রেটরীর নাম-স্বাক্ষরিত। ইহাতে উল্লেখ রহিল, “আপনার বিষয় বিশেষরূপে বিবেচিত হইবে ও তাহার ফল পরে জানিতে পারিবেন।” পত্রখানি পূর্ব্বোক্ত উপায়ে জমীদার মহাশয়কে আনিয়া দিলাম; আমার উপর তাঁহার বিশ্বাস আরও দৃঢ় হইল। এইরূপে পাঁচ সহস্র টাকা আত্মসাৎ করিয়া নিজ নিকৃষ্টবৃত্তি চরিতার্থ করিলাম সত্য; কিন্তু মনে মনে ভাবিলাম, এখন কোন উপায় অবলম্বন করিয়া, জমীদার মহাশয়কে বুঝাইব যে, তাঁহার মনস্কামনা পূর্ণ হইয়াছে। যাহা হউক এইরূপে কিয়দিবস গত হইল। জমীদার মহাশয় মধ্যে মধ্যে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন, “কৈ ডাক্তার। এখন পর্যন্ত গবর্ণমেন্ট হইতে আর কোন সংবাদ আসিল না, আর কত দিবস এরূপ কষ্টভোগ করিতে হইবে?” আমি বলিলাম “মহাশয়! গবর্ণমেন্টের কার্য্যের গতিকই এইরূপ, কোন কার্য্য সহজে ও শীঘ্র সম্পন্ন হয় না। যাহা হউক, আমি অদ্যই নিজে যাইয়া অনুসন্ধান লইব। সেই আফিসে আমার একজন বন্ধু কর্ম করেন, তাঁহার নিকট সমস্ত সংবাদ পাইব।” এই বলিয়া সে দিবস চলিয়া আসিলাম।
পরদিন পুনরায় জমীদার মহাশয়ের নিকট গমন করিলাম ও তাঁহাকে বলিলাম, “মহাশয়! কল্য আমি আফিসে যাইয়া সমস্ত বিষয় জানিয়া আসিয়াছি। আপনাকে কখন আর কোন দেওয়ানী আদালতে উপস্থিত হইতে হইবেক না। তাহার আজ্ঞাপত্র লেখাপড়া শেষ হইয়াছে, কেবলমাত্র সেক্রেটরী সাহেবের স্বাক্ষর বাকি আছে। তাহাও বোধ হয় চারি পাঁচদিবসের মধ্যেই সম্পন্ন হইবে। আপনি সেস্থান হইতে আর কোন পত্রাদি পাইবেন না, কেবলমাত্র ঐ আজ্ঞাপত্র ডাকযোগে আপনার নিকট প্রেরিত হইবে।” জমীদার মহাশয় সেইদিবস আমার কথা শুনিয়া অতিশয় আহ্লাদিত হইলেন এবং বলিলেন, “এখন বোধ হইতেছে যে, পাঁচ সাত দিবসের মধ্যেই তোমার অনুগ্রহে আমি ঐ বিপদ হইতে রক্ষা পাইব।”
সেইদিবস রাত্রিকালে শয়ন করিবার সময় মনে মনে একটু ভাবনা হইল। ভাবিলাম, এখন কোন উপায় অবলম্বন করি অব্যবহিত পরে উপায় আসিয়া আমার চিত্তাপথে প্রবেশ করিল। এক টুকরা কাগজ ও একটি পেন্সিল লইয়া তাহাতে ভাবিয়া ভাবিয়া এই মর্ম্মে ইংরাজীতেও একটি মুশাবিদা করিলাম যে, “লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর বাহাদুর তোমাকে তাদ্য হইতে এই আজ্ঞাপত্র প্রদান করিতেছেন যে, তুমি যতদিবস পর্য্যন্ত জীবিত থাকিবে, ততদিবস পর্য্যন্ত তোমাকে কোন দেওয়ানী আদালতে উপস্থিত হইয়া সাক্ষ্য দিতে হইবেক না। যে মোকদ্দমায় তোমার সাক্ষ্য নিতান্ত আবশ্যক বলিয়া বিবেচিত হইবে, সে মোকদ্দমায় কমিশন দ্বারা তোমার সাক্ষ্য গৃহীত হইবে।”
পরদিন বেলা ১০টার পর রাধাবাজার হইতে দুইখানা পার্চমেন্ট কাগজ ক্রয় করিয়া লইয়া একটি নূতন এদেশীয় ছাপাখানায় যাইয়া উপস্থিত হইলাম। ছাপাখানার অধ্যক্ষকে বলিলাম, “গবর্ণমেন্ট আফিসের নিমিত্ত কতকগুলি ফরম ছাপাইবার আবশ্যক হইয়াছে। যদি আপনি ভালরূপ কার্য্য করিতে পারেন, তাহা হইলে আপনাকে আমি অনেক কার্যা আনিয়া দিতে পারি। আপাততঃ একটি ফরম আনিয়াছি, যদি বলেন আপনাকে দিতে পারি।” ছাপাখানার অধ্যক্ষ অতিশয় আগ্রহের সহিত বলিলেন, “মহাশয়! আমি অতি অল্প মূল্যে ও অল্প সময়ের মধ্যে ভালরূপ কাৰ্য করিয়া দিতে পারিব; কারণ আপনি বোধ হয় জানেন যে, এটি আমার নূতন ছাপাখানা, অদ্যাবধি কর্ম্মের অতিশয় ভার পড়ে নাই।” আমি বললাম, “তবে এইটি এখনই করিয়া দিন, আমি বসিতেছি।” এই বলিয়া আমি যে মুশাবিদাটি সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিলাম, তাহা তাঁহাকে দিলাম। যেখানে যেখানে যে যে প্রকার ছোট বড় বা অন্যান্য প্রকার অক্ষর দিতে বলিলাম, তিনি নিজেই বাছিয়া বাছিয়া সেই প্রকার অক্ষর লইয়া আমার সম্মুখে বসাইতে লাগিলেন। প্রায় এক ঘণ্টার মধ্যে কার্য্য সম্পন্ন করিয়া একখানি কাগজে তাহার ছাপা উঠাইলেন এবং বলিলেন, “দেখুন মহাশয়! কি প্রকার হইয়াছে।” আমি দেখিলাম, ও ২।১ স্থানে কিছু কিছু পরিবর্ত্তন করিয়া, তাঁহাকে ফিরাইয়া বলিলাম, “ইহা পার্চমেণ্ট কাগজে ছাপাইতে হইবে, সুতরাং আমার নিকট হইতে এই পার্চমেন্ট কাগজ লইয়া উহার উপরে ছাপাইয়া দিউন।” তিনি তাহাই করিলেন; দুইখানি কাগজেই ছাপা উঠাইয়া আমাকে দিলেন। তিনি আমার ভিতরের অভিসন্ধি কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। তাঁর মনে এমন কোনও সন্দেহ হইল না যে, আমি তাহাকে প্রতারণা করিতেছি। সেই নির্ব্বোধ ছাপাখানাধ্যক্ষ ইহাও ভাবিলেন না যে, গবর্ণমেন্টর নিজের বৃহৎ ছাপাখানা থাকিতে কেনই বা অন্য ছাপাখানায় এই কাৰ্য্য হইতেছে। যাহা হউক, আমি সেই কাগজ লইয়া তাঁহাকে বলিয়া চলিয়া আসিলাম, “আফিসের সাহেবের অনুমতি লইয়া দুই একঘণ্টার মধ্যে আসিয়া, কত ছাপিতে হইবে বলিয়া যাইব। যে হিসাবে আপনি মূল্য পাইবেন, তাহাও স্থির করিয়া আসিব।” দুই ঘণ্টার মধ্যেই আমি ফিরিয়া আসিয়া তাঁহাকে বলিলাম, “মহাশয়! আমি অতিশয় দুঃখিত হইলাম যে, আমার ইচ্ছা পূর্ণ করিতে পারিলাম না। আপনার ছাপা অতিশয় সুন্দর হইয়াছে, ইহা দেখিয়া আমাদিগের অধ্যক্ষ সাহেব অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছেন। কিন্তু আমি আফিসে ফিরিয়া যাইবার অর্দ্ধঘণ্টা পূর্ব্বে অন্য এক ব্যক্তির সহিত কথাবার্তা স্থির হইয়া গিয়াছে, তিনি তাঁহাকে ছাপাইবার অনুমতি দিয়াছেন। এই জন্য সাহেব মহোদয় আপনাকে দিতে পারিলেন না বলিয়া অতিশয় দুঃখিত হইলেন। তবে আসিবার সময় আমাকে বলিয়া দিলেন, ভবিষ্যতে আর যে কার্য্য হইবে, তাহা আপনাকে দেওয়া যাইবে; আর আপনার পরিশ্রমের নিমিত্ত এই ৫টি টাকা প্রদান করিয়াছেন, গ্রহণ করুন; এবং যে অক্ষর প্রভৃতি সাজান রহিয়াছে ও যে সকল কাগজে প্রথমে ছাপা উঠাইয়াছিলেন, তাহা এখনই আমার সম্মুখে নষ্ট করুন। যখন আপনার এখানে কাৰ্য্য হইল না, তখন এখানে ইহার চিহ্নমাত্রও রাখা উচিত নহে।” আমার কথায় সেই মূর্খ ছাপাখানাধ্যক্ষ তাহাই করিলেন।
আমি সেইস্থান হইতে চলিয়া আসিয়া ঐ ছাপান মার্চমেন্ট কাগজের একখানি লইয়া, তাহাতে যাহা যাহা হস্তের লেখা থাকা উচিত, তাহা নিজহস্তে লিখিলাম। অতঃপর লেপ্টে নেণ্ট গবর্ণর সাহেবের সেক্রেটারীর সহি জাল করিয়া একখানি সরকারী খামের ভিতর উহা বন্ধ করিলাম। পরে তাহাতে পূর্ব্বমত ডাকের মোহর জাল করিয়া নিয়মিত সময় মধ্যে নিজেই লইয়া গিয়া জমীদার মহাশয়কে দিলাম এবং বলিলাম, “আমি মহাশয়ের বাটীর ভিতর প্রবেশ করিবার সময় দরজায় একজন ডাকপিয়ন আমার হস্তে এই পত্রখানি অর্পণ করিয়া চলিয়া গেল।” জমীদার মহাশয় আমার হস্ত হইতে উহা লইয়া খুলিলেন, পড়িয়া অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন এবং আমাকে আশীর্ব্বাদ করিলেন। তখনই বাস্ক হইতে আরও একখানি ৫০০ টাকার নোট বাহির করিয়া আমাকে পারিতোষিক প্রদান করিলেন। বলা বাহুল্য যে, ঐ টাকা সুরাপান প্রভৃতি দুষ্কর্ম্মে ব্যয় করিলাম।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
জমীদার মহাশয়ের বাটীতে ধূম পড়িয়া গেল, চারিদিকে আনন্দের ধ্বনি উঠিতে লাগিল, বন্ধুবান্ধবগণ নিমন্ত্রিণ হইলেন, আহারাদি ও নৃত্য গীত চলিতে লাগিল। জমীদার মহাশয় সকলের সহিত আলাপ সম্ভাষণ করিতে লাগিলেন এবং কোন কোন ব্যক্তিকে ঐ আজ্ঞাপত্র দেখাইতে লাগিলেন। নিমন্ত্রিতগণের মধ্যে একজন এই আজ্ঞাপত্রখানি নিজের হস্তে লইলেন এবং বারম্বার মনোযোগের সহিত দেখিতে লাগিলেন; ইনি হাইকোর্টের একজন কৃতবিদ্য উকীল। অন্য আর একজন তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি এরূপ করিয়া কি দেখিতেছেন।” উকীল মহাশয় বলিলেন, “পূর্ব্বে আমি অন্য আর একজন রাজার আজ্ঞাপত্র দেখিয়াছি, কিন্তু তাহা অন্য প্রকার; এই জন্যই আমি বিশেষ করিয়া দেখিতেছি যে, পূর্ব্বে যে প্রকার ধরণের দেখা থাকিত, এখন তাহার পরিবর্তন হইয়াছে।” এই বলিয়া উহা জমীদার মহাশয়কে ফিরাইয়া দিলেন এবং বলিলেন, “মহাশয় আমি সরকারী গেজেট লইয়া থাকি; যে দিবস এই বিষয় সেই গেজেটে ছাপা হইবেক, সেই দিবসের কাগজ মহাশয়ের নিকট পাঠাইয়া দিব; আপনি সেই কাগজটিও ইহার সঙ্গে রাখিয়া দিবেন।” জমীদার মহাশয় তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইহা কি গেজেটে ছাপা হইবে?” তিনি বললেন, “গবর্ণমেণ্ট হইতে যখন যে কোন আজ্ঞা প্রচার হয়, তখনই তাহা সরকারী গেজেটে ছাপা হইয়া থাকে; নতুবা অপর সাধারণের জানিবার সুবিধা নাই।”
আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম, সমস্ত শুনিলাম; শুনিয়া অতিশয় চিন্তিত হইলাম। যদি সরকারী গেজেটে ছাপাইবার কোন প্রকার সুযোগ না করিতে পারি, তাহা হইলে সমস্তই প্রকাশ হইয়া পড়িবে।
এইরূপে ক্রমে ক্রমে এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ, এক মাস, দুই মাস, তিন মাস অতীত হইল। সরকারী গেজেটে কিছুই ছাপা হইল না, জমীদার মহাশয় জিজ্ঞাসা করিলেই বলিতাম, “শীঘ্র ছাপা হইবে।” কিন্তু আমি কোনও প্রকারে সুযোগ করিতে পারিলাম না, সুতরাং ছাপাও হইল না। মধ্যে একদিন জমীদার মহাশয়কে বলিলাম, “আমি ছাপাখানায় গিয়াছিলাম, সে স্থানের হেড বাবুর সহিত কথাবার্তা শেষ করিয়া আসিয়াছি, এখন আর কোন প্রকার বিলম্ব হইবার সম্ভাবনা নাই। কারণ যাহাতে কাৰ্য্য শীঘ্র সম্পন্ন হয়, তাহার নিমিত্ত আমি ৫০০ পাঁচ শত টাকা তাহাকে দিতে স্বীকার করিয়া আসিয়াছি, তিনি টাকা পাইলেই, পর সপ্তাহের কাগজে প্রকাশ করিয়া দিবেন।” বলা বাহুল্য যে, এইরূপ প্রকারে আরও ৫০০ শত টাকা হস্তগত করিলাম। পর সপ্তাহে ছাপা না হওয়াতে জমীদার মহাশয় আবার আমাকে বলিলেন; আর এক প্রকার উত্তর দিয়া তাঁহাকে বুঝাইলাম। তিনি এইরূপে বারম্বার আমাকে বলিতে বলিতে বিরক্ত হইয়া একদিবস সেই উকীলকে ডাকাইলেন এবং তাঁহাকে ঐ আজ্ঞাপত্ৰ দিয়া বলিয়া দিলেন, “এতদিবস পর্য্যন্ত সরকারী গেজেটে ইহা কোন ছাপা হইল না, তুমি একবার নিজে যাইয়া তাহার কারণ জানিয়া আসিও।” তিনি আজ্ঞাপত্ৰ লইয়া চলিয়া গেলেন। আমি সমস্ত জানিতে পারিলাম; ভাবিলাম, আমার সমস্ত জুয়াচুরি এখনই প্ৰকাশ হইয়া পড়িবে, এবং নিশ্চয়ই জমীদার মহাশয় কুপিত হইয়া আমাকে পুলিসের হস্তে সমর্পণ করিবেন; তাহা হইলে আর আমার দুর্দ্দশার শেষ থাকিবে না।
অধিক সময়ের নিমিত্ত এই ভাবনা যে আমার হৃদয়কে অধিকার করিতে পারিল, তাহা নহে; অতি অল্প সময় ব্যতিরেকে সেই ভাবনাকে আমার হৃদয়ে স্থান দিবার প্রয়োজন হইল না।
সেই সময় পর্যন্তও জমীদার মহাশয়ের শরীর উত্তমরূপে সুস্থ না হওয়ায় প্রায় প্রত্যহই তাঁহাকে আমার প্রদত্ত ঔষধ সেবন করিতে হইত। সেবন করিবার নিমিত্ত যে ঔষধ আমি তাঁহাকে প্রত্যহ প্রদান করিতাম, আজ বাধ্য হইয়া আমাকে সেই ঔষধের কিছু পরিবর্তন করিতে হইল। নিজের আলমারিতে যে সকল ঔষধ ছিল, তাহারই মধ্য হইতে কয়েকটি ঔষধ বাছিয়া লইয়া আজ জমীদার মহাশয়ের নিমিত্ত নূতন ঔষধ প্রস্তুত করিলাম। রাত্রিকালে সেবন করিতে কখনও একবারের অধিক ঔষধ তাঁহাকে প্রদান করি নাই, সুতরাং সেইরূপ একবার সেবনোপযোগী ঔষধ লইয়া নিজেই জমীদার মহাশয়ের নিকট উপস্থিত হইলাম। তিনি উহা নিয়মিতরূপে আমার সম্মুখে সেবন করিলে, তাঁহার নিকট বিদায় লইয়া সেই রাত্রির নিমিত্ত আমি আমার বাড়ীতে গমন করিলাম।
রাত্রি ১১টার সময় জানিলাম, একটি লোক আমাদিগের বাটীর দরজার সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়া আমাকে ডাকাডাকি করিতেছে। এই সংবাদ পাইবামাত্র আমি বাড়ীর বাহিরে আসিলাম, দেখিলাম, যে ব্যক্তি আমাকে ডাকিতেছিল, সে অপর কেহ নহে, আমার প্রভু জমীদার মহাশয়ের দ্বারবান্। তাহার নিকট অবগত হইলাম, আমি তাঁহার বাটী পরিত্যাগ করিবার কিয়ৎক্ষণ পর হইতেই জমীদার মহাশয়ের পীড়াক্রমেই প্রবলরূপ ধারণ করিতেছে। সেই নিমিত্তই তিনি আমাকে সেইস্থানে গমন করিবার নিমিত্ত এই দ্বারবানের দ্বারা অনুরোধ করিয়া পাঠাইয়াছেন।
দ্বারবানের নিকট হইতে এই সংবাদ প্রাপ্ত হইবামাত্র আমি আর কালবিলম্ব করিতে পারিলাম না। দ্রুতপদে জমীদার মহাশয়ের বাড়ীতে গিয়া উপনীত হইলাম। কিন্তু সেইস্থানে উপস্থিত হইয়া কি দেখিলাম? দেখিলাম— জমীদার মহাশয়ের ইহজীবনের অভিনয় শেষ হইয়াছে, তাঁহার অস্তিম কাল উপস্থিত! রাত্রি ১২টার সময় সেই হতভাগ্য জমীদার মহাশয়ের সাধের রঙ্গালয় বন্ধ হইল, তাঁহার জীবনের অভিনয় শেষ হইল। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, স্ত্রীপুত্র প্রভৃতি সকলকে অগাধ শোকসাগরে নিমগ্ন করিয়া দেওয়ানি আদালতে উপস্থিত হইবার বিষম কষ্টের মস্তকে পদাঘাত করিয়া এবং এই নীচাশয়ের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিয়া, তিনি ইহ জগৎ পরিত্যাগ করিলেন।
এই অসম্ভাবিত ও নৃশংস কার্য্য আমার দ্বারা সম্পন্ন হইল সত্য, কিন্তু এই সময়ে আমার পাষাণ হৃদয়েও একটু দুঃখের সঞ্চার হইয়াছিল। ইহা দুঃখ কি আক্ষেপ, তাহা জানি না; কারণ তাঁহার মরণে আমার ইষ্ট অপেক্ষা অনিষ্টই অধিক হইল দেখিলাম। তবে বুঝিলাম, কেবলমাত্র ৬০০০ হাজার টাকার লোভের বশবর্তী হইয়াই আমি আমার চিরদিবসের দ্বারা রুদ্ধ করিলাম। যখন বুঝিলাম, সামান্য টাকার নিমিত্ত আমার উপার্জ্জনের প্রধান পথ রুদ্ধ হইল, তখন ভয়ানক আক্ষেপ আসিয়া আমার হৃদয় আশ্রয় করিল।
জমীদার মহাশয়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া যথারীতি সমাধা হইয়া গেল। তাঁহার মৃত্যুসম্বন্ধে কোনরূপ সন্দেহ কাহারও হৃদয়ে উপস্থিত হইল না। এদিকে আজ্ঞাপত্রের কথা লইয়া আর কোনরূপ আন্দোলনও হইল না, বা সেই বিষয়ের অনুসন্ধানের আর কোনরূপ প্রয়োজনও রহিল না। যে সকল কাগজপত্র উকীলের নিকট ছিল, তাহা তাহারই নিকটে রহিয়া গেল।
এই সময় হইতে জমীদার মহাশয়ের সহিত আমার সম্বন্ধ ঘুচিল। আমার চাকরি গেল। মাসে মাসে যে ২০০ দুই শত টাকা বেতন পাইতাম, তাহাও বন্ধ হইল।
আমার উপার্জ্জনের পন্থা রুদ্ধ হইল; সুতরাং গোলাপকে তাহার নিয়মিত খরচের টাকা যেরূপ ভাবে দিয়া আসিতেছিলাম, তাহার আর সংস্থান করিয়া উঠিতে পারিলাম না। ক্রমে খরচপত্র বন্ধ হইয়া যাওয়ায় প্রথমতঃ গোলাপ যেন সততই আমার উপর ক্রোধভাব প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিল ও পরিশেষে সে আমাকে তাহার বাড়ী হইতে একেবারেই বাহির করিয়া দিল। সে যে প্রকৃতই আমাকে তাহার বাড়ীতে আর প্রবেশ করিতে দিবে না, তাহা কিন্তু আমি প্রথমে বুঝিতে না পারিয়া সেই সময়ে পাঁচ সাতদিবস আমি তাহার বাড়ীতে গিয়াছিলাম। কিন্তু সে আমার সহিত সেই সময়ে যেরূপ ব্যবহার করিয়াছিল এবং আমি তাহার যে সকল ব্যবহার সহ্য করিয়াছিলাম, তাহা যদি পাঠকগণ প্রত্যক্ষ করিতেন, তাহা হইলে বুঝিতে পারিতেন যে, আমার মত নীচাশয় নর ইহজগতে অতি অল্পই দেখিতে পাওয়া যায়। রক্ত-মাংস-নির্ম্মিত মনুষ্য দেহ লইয়া এরূপ নৃশংস ব্যবহার কেহ যে কখন সহ্য করিতে সমর্থ হন, তাহা কেহই চিন্তা করিয়াও ধারণা করিতে পারেন না। আমি কিন্তু সেই অপমান সহ্য করিয়াও কয়েকদিবস গোলাপের বাড়ীতে গিয়াছিলাম। ভাবিয়াছিলাম, গোলাপ অন্তরের সহিত আমার উপর এরূপ কুব্যবহার করিতেছে না। কিন্তু পরে জানিতে পারিয়াছিলাম যে, সত্যই গোলাপ আমাকে তাহার বাড়ীর ভিতর আর প্রবেশ করিতে দিবে না। সেই সময় ইহাও জানিতে পারিয়াছিলাম, সেইস্থানে আমার মত আর একজন হতভাগার কপাল পুড়িতেছে।
এই সময় আমার মন স্থির ছিল না, হিতাহিত জ্ঞান একেবারেই আমাকে পরিত্যাগ করিয়াছিল। গোলাপের ব্যবহার ভাবিয়া ভাবিয়া আমি এক প্রকার পাগলের মত হইয়াছিলাম।
চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ
গোলাপের বাড়ী হইতে তাড়িত হইবার কিছুদিবস পর হইতেই আমার ক্রোধের ভাগ এত বৃদ্ধি হইয়াছিল যে, তাহা বলিতে পারি না। সেই সময়ে সামান্য ক্রোধের বশবর্তী হইয়া আমি যে প্রকার একটি লোমহর্ষণকর ও অস্বাভাবিক কার্য্য করিয়াছিলাম, তাহা শ্রবণ করিলেও প্রায়শ্চিত্তের প্রয়োজন হয়।
গোলাপের ভবনে আর স্থান না পাইয়া, সেই সময়ে আমাকে আমাদিগের বাড়ীতেই বাধ্য হইয়া থাকিতে হইয়াছিল। বাড়ীতে আমার একটি তৃতীয় বৎসর বয়স্কা কন্যা ছিল; সেই সময় আমার ঐ কন্যাটির একটু অসুখ বোধ হইয়াছিল। অসুখ অবস্থায় একদিবস সন্ধ্যার সময় সে এরূপ ক্রন্দন করিতে আরম্ভ করে যে, কোন প্রকারে কেহই তাহাকে সান্ত্বনা করিতে সমর্থ হয় না। আমিও প্রথমে তাহাকে সান্ত্বনা করিবার নিমিত্ত অনেক চেষ্টা করিলাম, কিন্তু কোন রূপেই তাহাকে শান্ত করিতে সমর্থ না হওয়ায়, হঠাৎ আমার প্রচণ্ড ক্রোধের উদয় হইল। হিতাহিতজ্ঞান বিবর্জ্জিত হইয়া, অপত্যস্নেহের সুদৃঢ় বন্ধন ছেদন করিয়া, আমার নিকট যে সকল ঔষধ ছিল, তাহার মধ্য হইতে একটি ঔষধ বাহির করিলাম। উহার কিয়দংশ একটি কাচপাত্রে ঢালিয়া লইয়া, কিঞ্চিৎ জল সহযোগে উহা নিজহস্তেই আমার সেই কন্যাকে পান করাইয়া দিলাম। মহাশয়! বলিব কি, দেখিতে দেখিতে তাহার রোদন থামিল, সে ঘুমাইয়া পড়িল; কিন্তু সেই অঘোর নিদ্রা হইতে সুকুমারী কন্যা আমার আর উত্থিত হইল না। পিতামাতা স্ত্রী প্রভৃতি সকলেই বুঝিলেন, প্রবল রোগের প্রতাপেই আমার অবোধ কন্যা ইহজীবন পরিত্যাগ করিল। সকলের অবস্থা আমি স্বচক্ষে সন্দর্শন করিলাম, কিন্তু কাহাকেও কিছু বলিলাম না। আপনার হৃদয়ের ভিতর মুখ লুকাইয়া একবারমাত্র অতি অল্পকালের নিমিত্ত রোদন করিয়াছিলাম, কিন্তু আমার প্রস্তর-কঠিন মন তখনই আরও দৃঢ়তর হইল! মনের অবস্থা দেখিয়া আসন্ন দুঃখ সুদূরে পলায়ন করিল।
কিছু দিবসের মধ্যেই গোলাপকে ভুলিলাম, কিন্তু এক গোলাপের পরিবর্তে শত গোলাপ আসিয়া জুটিল। তখন সোনাগাছির এমন কোন স্থান বাকি ছিল না, সে স্থানে আমার পদধূলি না পড়িয়াছিল। কিন্তু তখন আমার হস্তে একটিও পয়সা ছিল না; অতএব কি প্রকারে কিছু টাকা সংগ্রহ করিব, তাহার চিন্তায় নিযুক্ত হইলাম। ভাবিয়া ভাবিয়া তাহারও এক অভূতপূর্ব্ব উপায় বাহির করিলাম। পাঠকগণ মনোযোগ পূর্ব্বক পাঠ করিলে বুঝিতে পারিবেন যে, আর্মার পরিণামদর্শিতা কতদূর ছিল এবং আমি কি প্রকার চতুরতার সহিত সকল সময়ে কার্য্য করিয়াছি। কিন্তু
দুঃখের বিষয় এই যে, আমার এই প্রকার তীক্ষ্ণবুদ্ধিকে সৎপথে না চালাইয়া সতত অসৎপথ অবলম্বন করিতেই প্রশ্রয় দিয়াছি। আমি যে প্রকার নিকৃষ্টবৃত্তি অবলম্বন পূর্ব্বক অর্থ সংগ্রহের উপায় বাহির করিলাম, তাহা প্রথম হইতে ক্রমে বলিতেছি।
আমার স্ত্রীর নিকট যে ২০০০ টাকা ছিল, তাহা লইয়া কলিকাতায় নিকটবর্তী একটি প্রসিদ্ধ স্থানে গমন করিলাম তথায় একটি বড় গোছের বাটী ভাড়া লইলাম এবং ঐ দুই সহস্র টাকার দ্বারা কতকগুলি ঔষধ সংগ্রহ করিয়া একটি ঔষধালয় (ডিপেন্সারী) স্থাপিত করিলাম। বলা বাহুল্য আমি “এম. বি. ডাক্তার বলিয়া পরিচয় দিয়া চিকিৎসা করিতে লাগিলাম। ঐ চিকিৎসালয় আমার ছোট ভ্রাতার নামে স্থাপিত হইল। এক্সচেঞ্জ গেজেটে বিজ্ঞাপন বাহির করিয়া সর্ব্বসাধারণকে জানাইতে লাগিলাম যে, এই ঔষধালয়ের অধিকারী আমি নহি, আমার ভ্রাতা। সেইস্থান হইতে ১০।১৫ দিবস পরে কলিকাতায় আসিলে আমার দুষ্কর্ম্মের সাথী অথচ সঙ্গতিশালী কতিপয় ইয়ার আমাকে বলিলেন, “ডাক্তার, তুমি নূতন ডাক্তারখানা করিয়াছ; তোমার উচিত সেইস্থানে আমাদিগকে একদিন নিমন্ত্রণ করিয়া আমোদ-আহ্লাদ করা। তাঁহাদিগের প্রস্তাবে আমি স্বীকৃত হইলাম। এই সুযোগে অর্থ উপার্জ্জনের আর একটি অদ্ভুত অসৎ উপায় উদ্ভাবন করিয়া তাঁহাদিগকে নিমন্ত্রণ করিবার একটি দিন স্থির করিলাম। সেই নির্দিষ্ট দিবসে তাহাদিগের আটজনকে ও তাহাদিগের আটটি রক্ষিতা বারবনিতাকে নিমন্ত্রণ করিয়া অতিশয় যত্নের সহিত সেই ঔষধালয়ে আনয়ন করিলাম। বারবনিতাগণ উত্তম উত্তম অলঙ্কারে অলঙ্কৃতা হইয়া বাবুদের সহিত আসিয়া উপস্থিত হইল। উহাদিগকে নিমন্ত্রণ করিলাম সত্য, কিন্তু কোন প্রকার আহারাদির আয়োজন করিলাম না। কেবল কিছু সুরা আনিয়া, অল্প মাত্রায় পান করিলেও যাহাতে অতিশয় নেসা হয়, এইরূপ একটু একটু ঔষধি তাহাতে মিশাইয়া রাখিয়া দিলাম। সকলে আসিলে একত্র বসিয়া সুরাপান করিতে লাগিলাম। আমি প্রথমে অল্প পরিমাণ পান করিলাম এবং সকলকে অধিক পরিমাণ দিয়া আমি অল্প অল্প করিয়া আরও ২।১ বার পান করতঃ সেইস্থানে যেন অজ্ঞান হইয়া পড়িলাম। সকলে ভাবিলেন, আমার, আমার অতিশয় নেসা হইয়াছে। কেহ কিছু না বলিয়া আমাকে উঠাইয়া একখানা কোচের উপর শোয়াইয়া রাখিয়া দিলেন। আমি মাতাল হইয়াছি, এইরূপ ভান করিয়া সেইস্থানে শুইয়া শুইয়া তাহাদিগের অবস্থা দেখিতে লাগিলাম। ইহারা সকলে সুরাপান করিতে করিতে এক এক করিয়া ক্রমে সকলেই হত-চেতন হইয়া পড়িলেন। আমি যখন দেখিলাম আর কাহারও সংজ্ঞা মাত্র নাই, তখন আমি উঠিয়া আস্তে আস্তে স্ত্রীলোক আটটির শরীরে যতগুলি অলঙ্কার ছিল, তাহার সমস্তগুলিই খুলিয়া লইয়া, আমার ডিস্পেন্সারীর পশ্চাদ্ভাগে একস্থানে মাটীর ভিতর পুতিয়া রাখিলাম, এবং যাহাতে আমারও অতিশয় নেসা হয়, সেই প্রকার সুরাপান করিয়া রহিলাম। পরদিন সকলের শেষে আমার নেসা ছুটিল; উঠিয়া দেখি সকলেই হাহাকার করিতেছেন। আমি তাঁহাদিগের অবস্থা দৃষ্টি করিয়া অতিশয় দুঃখ প্রকাশ করিতে লাগিলাম। স্ত্রীলোক কয়টি থানায় গিয়া নালিস করিতে চাহিল; কিন্তু বাবুগণ তাহাদিগকে নিবারণ করিয়া বলিলেন, “তোমাদিগের গহনা যে আমাদের দোষে চোরে চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে, তাহার আর কিছুমাত্র ভুল নাই; কিন্তু নালিস করিলেই যে গহনাগুলি পাওয়া যাইবে, তাহারই বা সম্ভাবনা কি? লাভের মধ্যে আমাদের এই অকার্য্য প্রকাশ হইয়া পড়িবে। ঐ সকল গহনা আমারই দিয়াছিলাম, গিয়াছে, না হয় পুনরায় প্রস্তুত করিয়া দিব।’ এই বলিয়া তাহাদিগকে নিবৃত্ত করিয়া সকলেই কলিকাতায় চলিয়া আসিলেন। আমি সেইস্থানে থাকিলাম। কিছুদিবস পরে ঐ সকল অলঙ্কার ক্রমে ক্রমে বাহির করিয়া বিক্রয় করিলাম। তাহাতে প্রায় ৮০০০ টাকা সংগ্রহ হইল; কিন্তু এক বৎসরের মধ্যেই সুরাপান প্রভৃতি দুষ্কর্ম্মে উহা নিঃশেষ হইয়া গেল।
আমি যে উদ্দেশ্যে আমার ছোট ভ্রাতার নামে ডাক্তারখানা স্থাপন করিয়াছিলাম, এতদিবস সে উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টা করিতে হয় নাই; কারণ হঠাৎ বিনাকষ্টে ৮০০০ আট হাজার টাকা পাওয়ায় এক বৎসরকাল আর কোনও কষ্ট ছিল না। এখন পুনরায় আবার টাকার প্রয়োজন হইল, এখন চেষ্টা দেখিতে আরম্ভ করিলাম। সেই সময় আমার ছোট ভ্রাতা, তাহার স্ত্রী ও আমার স্ত্রী, সকলকে সেইস্থানে লইয়া গিয়া অতিশয় যত্নের সহিত রাখিলাম। আমার ভ্রাতা আমার ব্যবহারে যে কতদূর সন্তুষ্ট হইল, তাহা বলিতে পারি না। সেই সময় আমি আমার এক বৎসর পূর্ব্বের আশাকে ক্রমে ফলবতী করিতে ইচ্ছা করিলাম।
একদিবস আমার ভ্রাতাকে বলিলাম, “ভাই! আমি ইচ্ছা করিয়াছি, ৩০,০০০ ত্রিশ হাজার টাকায় আমার জীবনকে বীমা করিব; কিন্তু আমার শরীর সুস্থ নহে, একারণ আমার জীবন বীমা হইতে পারে না, তুমি বোধ হয়, ইহার অবস্থা বিশেষরূপ অবগত নহ। কলিকাতায় এই জন্য কয়েকটি আফিস প্রতিষ্ঠিত আছে, যদি কেহ তাহার জীবনকে কোন নির্দ্দিষ্ট টাকার নিমিত্ত বীমা করিতে চাহে, তাহা হইলে প্রথমে ডাক্তার তাহাকে পরীক্ষা করে। যদি তাহার কোন প্রকার রোগ না থাকে, তাহা হইলে তাহার যে পরিমাণ বয়স হইয়াছে, ও যত টাকার জন্য সে তাহার জীবনকে বীমা করিতে চাহে, তাহা ধরিয়া হিসাব করিয়া, অন্ততঃ তিন মাস অন্তর একটি নির্দ্দিষ্ট টাকা ঐ আফিসে জমা দিতে হয়। পরে সে অতিশয় বৃদ্ধ, বা তাহার মৃত্যু হইলে, যত টাকার জন্য জীবন বীমা থাকে, সেই টাকাটি, সে বা তাহার উত্তরাধিকারী, একেবারে সেই আফিস হইতে প্রাপ্ত হয়। আমি ইচ্ছা করিয়াছি যে, তুমি আমার নিমিত্ত তোমার জীবনকে বীমা কর। ইহাতে যে টাকা প্রতি তিন-মাসে দিতে হইবে, তাহা আমি দিব। পরে তোমার নিকট হইতে আমি লেখাপড়া করিয়া উহা ক্রয় করিয়া লইব। তাহাতে কাহারও কোন ক্ষতি হইবে না, বিশেষতঃ সকলেরই একটি মোটা টাকার সংস্থান থাকিবে।
আমার হতভাগ্য ভ্রাতা আমার চাতুরী বুঝিল না। সে সরল অন্তঃকরণে আমার প্রস্তাবে সম্মত হইল। তাহার জীবনকে ৩০,০০০ ত্রিশ হাজার টাকায় বীমা করিয়া, একবার যে টাকা জমা দিবার আবশ্যক, তাহা আমি জমা করিয়া দিলাম এবং উহা আমার ভ্রাতার নিকট হইতে ১০,০০০ দশ হাজার টাকায় ক্রয় করিয়া লইলাম। উক্ত প্রয়োজন অনুযায়ী লেখাপড়া হইল, কিন্তু ঐ ১০,০০০ দশ হাজার টাকা আমাকে দিতে হইল না, উহা কেবল কাগজ-কলমে রহিল। টাকা জমা দেওয়ার পর হইতে আর দুই মাস গত হইল; আর এক মাস অতীত হইলেই আবার নিয়মিত টাকা জমা দিতে হইবে, এই ভাবনা একবার মনে মনে ভাবিলাম। ইতিমধ্যে ভ্রাতাকে সঙ্গে লইয়া কলিকাতায় আসিলাম, তাহার স্ত্রী সেইস্থানেই রহিল।
কলিকাতায় আসিয়া ভ্রাতা আমাকে বলিল, “দাদা! আমার একটু মাথা ধরিয়াছে। আমি তাহাকে একটি ঔষধ দিয়া বলিয়া দিলাম, “ইহাতে তোমার মাথা ধরা ভাল হইবে।” ঔষধ খাইতে খাইতেই তাহার ভেদবমি আরম্ভ হইল। সকলেই বলিল, “ইহার কলেরা হইয়াছে।” আমিও তাহাই ভাবিলাম। একজন প্রধান ইংরাজ ডাক্তারকে ডাকিয়া আনিলাম, তাহাকেও কলেরা বলিয়া বুঝাইলাম; তিনিও ভাল করিয়া দেখিলেন না। ডাক্তারগণ প্রায়ই কলেরা রোগীর নিকট না যাইয়া দূর হইতেই অবস্থা শুনিয়া ঔষধের ব্যবস্থা করিয়া চলিয়া যান। ইনিও তাহাই করিলেন। আমি সেই ঔষধ একটি প্রধান ঔষধালয় হইতে আনিলাম। বলা বাহুল্য, আমি নিজেই ঔষধ খাওয়াইতে লাগিলাম; কিন্তু যে ঔষধ আনিয়াছিলাম, তাহার এক এক দাগ ফেলিয়া দিয়া তাহার পরিবর্তে আমার নিজের ঔষধ এক একবার খাওয়াইতে লাগিলাম।
ব্যারাম ক্রমেই বৃদ্ধি হইতে লাগিল, ডাক্তার সাহেবকে আবার আনাইলাম; আবার সেইরূপে বুঝাইলাম, আবার সেইরূপে ঔষধ আনাইলাম এবং সেইরূপে পরিবর্তন করিয়া আমার নিজের ঔষধ সেবন করাইলাম। পাঠকগণের মধ্যে হয় ত কেহ কেহ জিজ্ঞাসা করিতে পারেন যে, যখন আমার অন্যরূপ উদ্দেশ্য দেখা যাইতেছে, তখন ভাল ডাক্তার ও ঔষধ আনাইবার প্রয়োজন কি? ইহার উত্তর, বোধ হয়, আমার দেওয়া নিষ্প্রয়োজন। তথাপি বলি, এরূপ অবস্থায় যদি কোন প্রকার গোলযোগ উপস্থিত হয়, পুলিস যদি কোনরূপ সন্দেহ করিয়া অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হয়, তাহা হইলে তাহাদিগের চক্ষে ধুলি দেওয়াই প্রয়োজন হইবে বলিয়াই, আমি এই পথ অবলম্বন করিলাম।
রাত্রি প্রায় দুইটার সময় আমার সেই হতভাগ্য ভ্রাতা অকালেই আমা-কর্তৃক ইহজীবন পরিত্যাগ করিল! তাহার মৃত্যুতে বাড়ীর সকলেই শোকসাগরে নিমগ্ন হইলেন। তাঁহাদের সকলের রোদন-ধ্বনিতে দিমণ্ডল প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। বিশেষ তাহার স্ত্রীর আর্তনাদ সকলের হৃদয় বিদীর্ণ করিতে লাগিল, আমার মত পাষণ্ডের চক্ষেও জলবিন্দু আসিয়া উপস্থিত হইল।
সকলেই মৃতদেহ লইয়া ব্যস্ত, সকলেই শোকসাগরে নিমগ্ন। আমি কিন্তু আমার কঠিন হৃদয়কে আরও দৃঢ় করিলাম। সেই হৃদয়-বিদারক আর্তনাদ-মিশ্রিত ক্রন্দন-ধ্বনির দিকে ক্ষণকালের নিমিত্ত কর্ণপ্রদান না করিয়া, তাহাতে শীঘ্র তাহার সৎকার কার্য্য সমাপন করিতে সমর্থ হই, আমি তাহারই বন্দোবস্ত করিতে লাগিলাম। যত শীঘ্র পারিলাম, সেই হতভাগ্যের মৃতদেহ সেই পতিপ্রাণা হতভাগিনীর হৃদয় হইতে কাড়িয়া লইয়া, গঙ্গাতীরের যে স্থানে মৃতের সৎকার কার্য্য সমাধা হয়, সেইস্থানে লইয়া গেলাম; এবং যত শীঘ্র সেই কাৰ্য্য সমাধা করিতে সমর্থ হই, তাহারই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ করিতে প্রবৃত্ত হইলাম।
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
মফঃস্বলের পাঠকগণের মধ্যে, বোধ হয়, অনেকেই অবগত নহেন যে, কলিকাতায় যে সকল স্থানে শবদাহ হইয়া থাকে, সেই সকল স্থানে মিউনিসিপালিটী হইতে এক একজন কর্ম্মচারী নিযুক্ত থাকেন। কোন মৃতদেহ সৎকারার্থ সেইস্থানে নীত হইলে, তিনি উত্তমরূপে সেই দেহ প্রথম পরীক্ষা করিয়া থাকেন। এইরূপ পরীক্ষা করিয়া মৃত্যুর কারণ সম্বন্ধে যদি তাঁহার মনে কোনরূপ সন্দেহের উদয় না হয়, তাহা হইলে সেই শব দাহ করিতে তিনি আদেশ প্রদান করেন, ও পরিশেষে উহার সৎকার কাৰ্য্য সমাপন হয়। যে সকল শব দেখিয়া মৃত্যুর কারণ সম্বন্ধে কর্মচারীর মনে সন্দেহ হয়, সেই সকল মৃতদেহের সৎকার করিতে না দিয়া, তিনি তৎক্ষণাৎ নিকটস্থ পুলিসে সংবাদ প্রদান করিয়া থাকেন। সংবাদ প্রাপ্তিমাত্র পুলিস সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হয়, এবং লাস দেখিয়া বা প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান করিয়া যদি তাহাদিগের সন্দেহ দূর না হয়, তাহা হইলে তাহারা সেই মৃতদেহ পরীক্ষার নিমিত্ত মেডিকেল কলেজে পাঠাইয়া দেয়। সেইস্থানে গবর্ণমেণ্ট-নিয়োজিত ডাক্তার কর্তৃক সেই শব ছেদিত হইয়া উত্তমরূপে পরীক্ষিত হইলে পর সেই মৃত ব্যক্তির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সমাধা হয়।
“কাশীমিত্রের ঘাটে সেই সময় যে কৰ্ম্মচারী নিযুক্ত ছিলেন, তিনি বহুদিবস হইতে সেই কার্য্য করিয়া আসিতেছিলেন। এই মৃতদেহ দেখিবামাত্র তাহার মনে সন্দেহের উদয় হইল, তিনি উহার সৎকার কার্য্য সমাধা করিতে না দিয়া, উহা সেইস্থানে রাখিয়া দিলেন এবং নিকটবর্ত্তী পুলিসে ইহার সংবাদ প্রদান করিলেন। সংবাদ পাইবামাত্র একজন উচ্চপদস্থ পুলিস-কৰ্ম্মচারী সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ঘাটের কর্ম্মচারী পুলিসকে উক্ত মৃতদেহ দেখাইয়া দিয়া আমার সম্মুখেই কহিলেন, “মৃতদেহের লক্ষণ দেখিয়া, আমার বোধ হইতেছে, ইহার স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে নাই; বিষপানে ইহার মৃত্যু হইয়াছে।”
কর্ম্মচারীর এই কথা শুনিয়া আমি অতিশয় চিন্তিত হইলাম; ভাবিলাম,—’ এই মৃতদেহ যদি কাটিয়া পরীক্ষা করা হয়, তাহা হইলে আমার সমস্ত গুপ্ত অভিসন্ধি প্রকাশ হইয়া পড়িবে। তখন আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হওয়া ত পরের কথা, নরহত্যা অপরাধে পরিশেষে আমাকেই দণ্ডিত হইতে হইবে। এইরূপ অবস্থায় ক্ষণকালের নিমিত্ত আমার হৃদয় আলোড়িত হইল সত্য; কিন্তু দেখিতে দেখিতে আমার মনের গতি পরিবর্তিত করিয়া হৃদয়কে দৃঢ় করিলাম, এবং গম্ভীরভাবে সেই পুলিস-কৰ্ম্মচারীকে কহিলাম,—” এই মৃতদেহ সম্বন্ধে আপনাকে চিন্তিত হইতে হইবে না। এই ঘাটের কর্ম্মচারী নিজের মূর্খতা নিবন্ধন আপনাকে সংবাদ প্রদান করিয়াছে সত্য, কিন্তু ইহার মৃত্যুসম্বন্ধে কোনরূপ সন্দেহ করিবার কোন প্রকার কারণই নাই। এই মৃত ব্যক্তি অন্য কেহ নহে, ইনি আমার সহোদর ভ্রাতা। আমি নিশ্চয় জানি, এ কোন প্রকারে বিষপান করে নাই। বিসূচিকারোগে ইহার মৃত্যু হইয়াছে। বিসূচিকারোগে মৃত ব্যক্তির কতকটা লক্ষণ বিষপানের লক্ষণের মত হয় বটে, কিন্তু সে প্রভেদ-আমরা ডাক্তার —- আমরাই বুঝিতে পারি, ইহারা বুঝিবেন কোথা হইতে? যাহা হউক, আমি আপনাদিগের সে সন্দেহ এখনই মিটাইয়া দিতেছি। ভ্রাতা আমার যখন বিসূচিকারোগে আক্রান্ত হন, সেই সময়ে এই সহরের সর্ব্বপ্রধান ইংরাজ ডাক্তার ইহার চিকিৎসা করেন। আপনি এই মৃতদেহ স্থানান্তরিত না করিয়া একটু অপেক্ষা করুন। আমি এখনই সেই ডাক্তার সাহেবের নিকট হইতে নিদর্শন পত্র (Certificate) লইয়া আসিতেছি, উহা দেখিলেই আপনাদিগের সকল সন্দেহ মিটিয়া যাইবে।”
দেখিলাম, পুলিস-কৰ্ম্মচারী আমার কথায় ভুলিলেন এবং আমার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া সেইস্থানেই অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। আমি একখানি গাড়ি আনাইয়া ডাক্তার সাহেবের বাটী-অভিমুখে প্রস্থান করিলাম। তাঁহার বাড়ীতে উপস্থিত হইয়া জানিতে পারিলাম, ডাক্তারসাহেব বাড়ীতেই আছেন। ডাক্তারসাহেব আমাকে উত্তমরূপে জানিতেন। তাঁহার চাপরাশি গিয়া সংবাদ প্রদান করিবামাত্র, দেখিলাম, তিনি আসিয়া আমার নিকট উপস্থিত হইলেন। ডাক্তার সাহেবকে দেখিবামাত্র কোন কথা না বলিয়া, তাঁহার নিয়মিত দর্শনীর দ্বিগুণ টাকা প্রথমেই তাঁহার হস্তে প্রদান করিলাম, ও পরিশেষে কহিলাম, “মহাশয়! রাত্রি প্রায় দুইটার সময় আমার ভ্রাতা, যাহার বিসূচিকারোগের চিকিৎসা আপনি করিয়াছিলেন, আমাদিগকে ফাঁকি দিয়া ইহলোক পরিত্যাগ করিয়াছে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সমাপন করিবার নিমিত্ত তাহার মৃতদেহ আমরা কাশীমিত্রের ঘাটে লইয়া গিয়াছিলাম, কিন্তু ঘাটের যে কর্ম্মচারী মৃতদেহ পরীক্ষা করে, সে পুলিসের সাহায্যে আমার এই বিপদের সময় আমার নিকট ৫০০ পাঁচ শত টাকা চাহিয়া বসিয়াছে, ও বলিতেছে যে, যদি তাহাদিগের প্রার্থনা মত টাকা প্রদান না করি, তাহা হইলে উহারা উক্ত মৃতদেহ পরীক্ষা নিমিত্ত মেডিকেল কলেজে পাঠাইয়া দিবে। মৃতদেহের এরূপ অবমাননা এতদ্দেশীয় হিন্দুজাতির পক্ষে অতিশয় নিন্দনীয়। এই নিমিত্তই আমি মহাশয়ের নিকট আগমন করিয়াছি, আমার ভ্রাতার কোন রোগ হইয়াছিল, এবং তাহার মৃত্যুর কারণ বা কি, এই সকল বিষয় বিবৃত করিয়া, অনুগ্রহ পূর্ব্বক একখানি নিদর্শন পত্র যদি আমাকে প্রদান করেন, তাহা হইলে আমি কোন প্রকারে এই বিপদ হইতে উত্তীর্ণ হইতে সমর্থ হই। নতুবা যে কোন প্রকারেই হউক, এই বিপদের সময় ৫০০ পাঁচ শত টাকা সংগ্রহ করিয়া উহাদিগকে প্রদান করিতে হইবে; অন্যথা হিন্দু হইয়া জীবন থাকিতে সহোদরের মৃতদেহের অবমাননা কোনক্রমেই দেখিতে পারিব না।” এই বলিয়া ডাক্তারসাহেবের সম্মুখেই দুই চারি ফোঁটা কৃত্রিম অশ্রু বিসর্জ্জন করিলাম।
ডাক্তারসাহেব আমার এই সকল কথা শুনিয়া প্রথমে পুলিসের উপর অতিশয় বিরক্তিভাব প্রকাশ করিলেন, ও আমাকে সমভিব্যাহারে লইয়া তাঁহার অফিস ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলেন। কাগজ কলম প্রভৃতি সমস্তই সেইস্থানে প্রস্তুত ছিল, আমাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া একখানি নিদর্শন পত্র লিখিয়া আমার হস্তে প্রদান করিলেন। উহার মর্ম এইরূপ — “ডাক্তারবাবুর ভ্রাতার চিকিৎসা আমি নিজে করিয়াছি। উহার বিসূচিকারোগ হইয়াছিল, ও সেই রোগেই উহার মৃত্যু হইয়াছে। আমি জোর করিয়া বলিতে পারি, উহার মৃত্যু সম্বন্ধে পুলিসের সন্দেহ করিবার কোন কারণই নাই।”
এই নিদর্শন পত্র সমভিব্যাহারে দ্রুতগতি আমি কাশীমিত্রের ঘাটে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, পুলিস- কর্ম্মচারী সেই মৃতদেহের নিকট বসিয়া রহিয়াছেন। সেই পত্র তাঁহার হস্তে অর্পণ করিলাম। একবার দুইবার করিয়া কয়েকবার মনে মনে তিনি এই পত্রপাঠ করিলেন, ও নিতান্ত ভগ্নহৃদয়ে পরিশেষে কহিলেন, “কলিকাতার সর্ব্ব প্রধান ইংরাজ ডাক্তার যখন বলিতেছেন – এই মৃত্যুতে কোনরূপ সন্দেহ নাই, তখন কি প্রকারে আমি এই সব পরীক্ষার নিমিত্ত ডেড়হাউসে পাঠাইয়া দিই, আমি এই পত্র আপনার নিকট রাখিলাম। আপনারা মৃতদেহের সৎকার কার্য সমাপন করিতে পারেন।” এই বলিয়া পুলিস-কৰ্ম্মচারী উক্ত পত্র হস্তে লইয়া, আস্তে আস্তে সেইস্থান পরিত্যাগ করিলেন। সৎকারের সমস্ত দ্রব্যই প্রস্তুত ছিল; দেখিতে দেখিতে চিতা প্রজ্বলিত হইল, আমার ভ্রাতার মৃতদেহ ভস্মে পরিণত হইয়া গেল। আমার মনে যে ভয়ের কারণ উদিত হইয়াছিল, এতক্ষণে তাহা দূর হইল, আমিও নিশ্চিন্ত হইলাম।
পিতামাতা প্রভৃতি সকলেই রোদন করিতে লাগিলেন। চিতার প্রজ্বলিত অগ্নি নির্ব্বাণের সঙ্গে সঙ্গে তাহার স্ত্রীর আর্তনাদ নিৰ্ব্বাপিত না হইয়া ক্রমে আরও প্রবলরূপ ধারণ করিতে লাগিল। আমি স্বচক্ষে উহাদিগের অবস্থা দেখিতে লাগিলাম। উহাদিগের মর্ম্মভেদী আর্তনাদ আমার কর্ণকুহরে সবলে প্রতিঘাত করিতে লাগিল, কিন্তু, ইহাতে আমার কঠিন হৃদয় কিছুমাত্র দ্রবীভূত হইল না। আমি আমার পাষাণ হৃদয়কে আরও দৃঢ় করিলাম, এবং কি উপায় অবলম্বন করিলে বিনাক্লেশে উক্ত ত্রিশ হাজার টাকা পাইতে পারি, তাহাই মনে চিন্তা করিতে লাগিলাম।
এইরূপে ক্রমে পাঁচ সাতদিবস গত হইয়া গেল; দেখিলাম, সকলের শোকাবেগ ক্রমে মন্দীভূত হইয়া আসিতে লাগিল। এই কয়েকদিবস ভাবিয়া-চিন্তিয়া যে উপায় আমি মনে মনে স্থির করিয়াছিলাম, সেই উপায় অবলম্বন করিলাম, অর্থাৎ বীমা আফিসে উক্ত টাকার নিমিত্ত আমি প্রথমে একখানি পত্র লিখিলাম। এই পত্রের সারমর্ম্ম এই :—– “আপনাদিগের আফিসে ত্রিশ হাজার টাকার নিমিত্ত আমার ভ্রাতার জীবন বীমা আছে। অদ্য ছয় সাতদিবস হইল, তিনি বিসূচিকা রোগে আক্রান্ত হইয়া ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছেন। মৃত্যুর পূর্ব্বে তিনি তাঁহার বীমার স্বত্ত্ব আমার নিকট বিক্রয় করিয়াছিলেন। সুতরাং আইন-অনুযায়ী আমি এখন উক্ত টাকার ন্যায্য অধিকারী। অতএব মহাশয়দিগকে লিখিতেছি যে, আপনারা কোন তারিখে উক্ত টাকাগুলি আমাকে প্রদান করিবেন, তাহা লিখিয়া বাধিত করিবেন। আপনাদিগের নিয়মানুসারে উহার মৃত্যুসম্বন্ধে যদি কোন বিষয় জানিবার প্রয়োজন হয়, তাহা হইলে যে প্রধান ইংরাজ ডাক্তার তাহার চিকিৎসা করিয়াছিলেন, তাঁহার নিদর্শন পত্র (Certificate) পাঠাইয়া দিব।”
এই পত্র লেখার পর ক্রমে পাঁচ সাত দিবস অতীত হইয়া গেল; কিন্তু তাহার কোন প্রকার উত্তর পাইলাম না। দশম দিবসের দিন উক্ত পত্রের উত্তর আসিল। উহা পাঠ করিয়া আমি একেবারে বিস্মিত ও স্তম্ভিত হইলাম। মনে নানাপ্রকার দুর্ভাবনা আসিয়া উপস্থিত হইল। পত্রের মর্ম্ম এইরূপ ছিল : “আমরা শুনিলাম, আপনার ভ্রাতার মৃত্যুতে অনেক গূঢ় রহস্য আছে। সুতরাং বিশেষরূপ অনুসন্ধান ব্যতিরেকে আপনাকে উক্ত টাকা কোনক্রমেই দেওয়া যাইতে পারে না। এ বিষয়ে অনুসন্ধান করিবার ভার আমরা কোন উপযুক্ত হস্তে অর্পণ করিয়াছি; ফলাফল পরে জানিতে পারিবেন।”
বীমা অফিস হইতে কি প্রকার সংবাদ আসে, জানিবার নিমিত্ত কিছুদিবস আমার মন নিতান্ত অস্থির রহিল; কিন্তু কোনরূপ সংবাদ না পাইয়া আর স্থির থাকিতে পারিলাম না। একদিবস স্বয়ং বীমা আফিসে গিয়া উপস্থিত হইলাম। বীমা আফিসের বড় সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তিনি আমাকে দেখিয়া একটু হাসিলেন ও কহিলেন, — ‘তোমার ভ্রাতার প্রাপ্য টাকার নিমিত্ত আর তোমাকে অধিক বিলম্ব করিতে হইবে না। তোমার সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিয়া যে ফল আমরা প্রাপ্ত হইয়াছি, তাহা শীঘ্রই তুমি জানিতে পারিবে। সাহেবের কথা শুনিয়া তাহাকে অধিক আর কিছুই বলিলাম না। আমার সম্বন্ধে কে অনুসন্ধান করিয়াছেন এবং অনুসন্ধানের ফলই বা কি হইয়াছে, তাহাই ভাবিতে ভাবিতে অফিস পরিত্যাগ করিলাম। আফিস হইতে প্রত্যাগমন করিয়া আপনার বাড়ীতে আসিলাম। সেই সময়ে নানাপ্রকার চিত্তা আসিয়া হৃদয়কে অধিকার করাতে দুই তিনদিবস একেবারে বাড়ীর বাহির হইলাম না।
নানাপ্রকার চিন্তার মধ্যে কখনও মনে হইল, উহারা বুঝি আমার দুরভিসন্ধি বুঝিতে পারিয়াছে। আমি যে প্রকার অসৎ উপায় অবলম্বন করিয়া উহাদিগকে প্রবঞ্চনাপূর্ব্বক একেবারে তিরিশ হাজার টাকা হস্তগত করিবার সংকল্প করিয়াছিলাম, উহারা বোধ হয়, তাহার প্রমাণ সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়াছে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হইল, যে বিষয় কেবল আমি ভিন্ন অন্য কেহই অবগত নহে, সেই বিষয়ের বিশেষ অবস্থা উহারা কি প্রকারে সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইবে? এইরূপ নানাপ্রকার ভাবনা ভাবিতে ভাবিতে বাড়ীতে বসিয়াই প্রায় তিন চারিদিবস অতিবাহিত করিলাম।
যখন দেখিলাম, আফিস হইতে আর কোনরূপ পত্রাদি পাইলাম না, তখন উহাদিগকে আর কিছু না বলিয়া উক্ত ত্রিশ হাজার টাকা আদায় করিবার অভিপ্রায় আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করিলাম। কিন্তু আদালতে এই বিষয়ের চূড়ান্ত বিচার হইবার পূর্ব্বেই একদিবস দেখিলাম, কয়েকজন কৰ্ম্মচারী হঠাৎ আমাদিগের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। আমার বাড়ীর ভিতর তাহাদিগের হঠাৎ প্রবেশের কারণ জিজ্ঞাসা করিবার অভিপ্রায়ে আমি যেমন উহাদিগের সম্মুখীন হইলাম, অমনি উহারা আমাকে ধৃত করিয়া উত্তমরূপে বন্ধন করিল এবং সেইস্থান হইতে আমাকে স্থানান্তরে লইয়া গেল। আমি যে ধৃত হইলাম, তখন তাহার কিছুই বুঝিতে পারিলাম না; কিন্তু পরদিবস দেখিলাম, আমি মাজিষ্ট্রেট সাহেবের সম্মুখে নীত হইলাম।
মাজিষ্ট্রেট আদালতে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, যে জমীদার মহাশয়ের অন্নে প্রতিপালিত হইয়া সামান্য অর্থের লাভে তাঁহার অমূল্য জীবনরত্ন হরণ করিয়া আমার নিজেরই ভবিষ্যৎ আশায় পাংশু প্রক্ষেপ করিয়াছিলাম, সেই বঙ্গদেশীয় জমীদার মহাশয়ের কয়েকজন কর্মচারী, কয়েকজন উকীল, প্রভৃতি অনেকে সেইস্থানে উপস্থিত। তাঁহাদিগকে দেখিয়াই প্রথমে আমার হৃদয় হঠাৎ চমকিয়া উঠিল; কারণ, সেই সময় আমি বুঝিতে পারিলাম যে,আমার উপর জালের অভিযোগ আনীত হইয়াছে, জাল করা অপরাধে আমি বন্দী হইয়াছি।
অকস্মাৎ এই বিপদ্পাতে আমি কিছুই কৰ্ত্তব্য অবধারণা করিতে পরিলাম না। যাহা হউক, মাজিষ্ট্রেট সাহেবের এজলাসে এই মোকদ্দমার সম্বন্ধে অনেক সাক্ষীর এজাহার গৃহীত হইল, ও পরিশেষে বিচারের নিমিত্ত আমি দায়রায় সোপরদ্দ হইলাম। সেইস্থানে জুরির বিচার ছয় বৎসরের নিমিত্ত আমার কারাদণ্ড হইয়াছে।
পাঠকগণ! আপনারা এখন আমার হৃদয়ের মধ্যে একবার দৃষ্টিনিক্ষেপ করুন। টাকার নিমিত্ত আমি যে সকল মহাপাতকের অবতারণা করিয়াছি, তাহা আপনাদিগের দ্বারা সম্পন্ন হওয়া দূরে থাকুক, আপনারা স্বপ্নেও কি কখন ভাবিয়াছেন? সামান্য টাকার লোভে, কে আপন অন্নদাতাকে হত্যা করিতে পারে, কে আপনার প্রাণের ভ্রাতাকে বিনাদোষ শমন-সদনে প্রেরণ করিতে সমর্থ হয়? যাহা হউক, ইহা সংসারেই, জন্মান্তরে নহে —– এই জন্মেই, আমি আমার ঘোর পাপের ফলভোগ করিতেছি। কিন্তু জানি না, আমি যেরূপ অপ্রতিবিধেয় দুষ্কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছি, এই শাস্তিই তাহার পক্ষে যথেষ্ট কি না, অথবা পরজন্মে ইহাপেক্ষা কঠিন প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা আমার ভাগ্যে আছে।”
লেখকের বক্তব্য
প্রথম পরিচ্ছেদ
অবতরণিকায় বিবৃত বেনামী পত্র সম্বন্ধীয় বিষয়ের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমিই যে পরিশেষে নিযুক্ত হইয়াছিলাম, তাহা পাঠকগণ পূৰ্ব্বেই অবগত হইয়াছেন।
আমি প্রথমে গিয়া কাশীমিত্রের ঘাটের সেই প্রবীণ কর্ম্মচারীর সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তাঁহার নিকট পূর্ব্ববর্ণিত সমস্ত বিষয় শ্রবণ করিয়া আমার বিলক্ষণ বিশ্বাস হইল যে, ডাক্তারবাবুর দ্বারা তাঁহার ভ্রাতার জীবন শেষ হইয়াছে। কিন্তু কেবল বিশ্বাসের উপর নির্ভর করিয়া, আমি কি করতে পারি? ডাক্তারের পরীক্ষার পূৰ্ব্বেই যখন শব জ্বালান হইয়াছে, তখন প্রকৃত হত্যা হইলেই বা তাঁহাকে কি প্রকারে রাজদ্বারে আনিতে সমর্থ হই? এরূপ অবস্থায় ভ্রাতাকে হত্যা করা অপরাধে ডাক্তারের কোনরূপ দণ্ড হইতে পারে না, জানিয়াও কিন্তু কোনরূপ নিশ্চিন্ত থাকিতে পারিলাম না। বীমা অফিসের অনুরোধ অনুসারেই আমাকে অনুসন্ধানে নিযুক্ত থাকিতে হইল।
ইহার পূর্ব্বে আমি ডাক্তারবাবুকে জানিতাম না, কার্য্যের অনুরোধে কোনরূপে উহাকে চিনিয়া লইতে হইল। এক দিবস সন্ধ্যার পর ডাক্তারবাবুর বাড়ীতে গমন করিলাম, বাড়ীর সম্মুখেই সেই বাড়ীর একজন পরিচারকের সহিত সাক্ষাৎ হইল। তাহাকে ডাক্তারবাবুর কথা জিজ্ঞাসা করায় সে কহিল, “ডাক্তারবাবু এখন বাড়ীতেই আছেন, কিন্তু এইক্ষণেই বাহিরে গমন করিবেন।’
পরিচারকের কথা শ্রবণমাত্র আমি দ্রুতগতি সেই কাশী মিত্রের ঘাটে গমন করিলাম। ডাক্তারবাবুর বাড়ী হইতে ঐ স্থান অতি নিকট, বোধ হয়, দুই তিন শত হস্তের অধিক হইবে কি না সন্দেহ। ঘাটের কর্ম্মচারী ঘাটেই উপস্থিত ছিলেন, তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম, ও কহিলাম, “ডাক্তারবাবু এখন বাড়ীতেই আছেন, কিন্তু এখনই বাহিরে গমন করিবেন। সেই সময়ে যদি আপনি দূর হইতে তাঁহাকে দেখাইয়া দেন, তাহা হইলে আমি বিশেষ বাধিত হইব। কারণ উহাকে চিনিয়া লইতে না পারিলে অনুসন্ধানের সুবিধা হইতেছে না।”
কর্ম্মচারী আমার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন, ও তৎক্ষণাৎ আমার সহিত গমন করিলেন। আমরা উভয়েই ডাক্তার বাবুর বাটীর নিকটবর্ত্তী একস্থানে কিয়ৎক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিলাম। প্রায় অর্দ্ধঘণ্টা পরে ডাক্তারবাবু বাড়ীর বাহিরে আসিলেন ও ধীরে ধীরে পদব্রজে ক্রমে চিৎপুররোডে গিয়া উপস্থিত হইলেন। কর্ম্মচারী দূর হইতে ডাক্তারবাবুকে দেখাইয়া দিয়া আপন কার্য্যে প্রস্থান করিলেন, আমি অলক্ষিতভাবে ডাক্তারবাবুর অনুগমন করিলাম।
ডাক্তারবাবু এখন প্রকৃতই “বাবুর বেশ” ধারণ করিয়াছেন। তাঁহার পরিধানে একখানি কালাপেড়ে ফুরফুরে শান্তিপুরে ধুতি। অঙ্গে পাঞ্জাবী আস্তেনোর একটি ঢিলে পিরাণ, সেই আস্তেনের সর্ব্বস্থানই “গিলে করা” কোঁচান। গলায় একখানি পাকদেওয়া কোঁচান চাদর। মস্তকের চুলগুলি বাবু ফ্যাশনে কাটা এবং দুইভাগে বিভক্ত। পায়ে একজোড়া বার্ণিস করা চকচকে জুতা এবং হাতে একগাছি সাদা হাতের হ্যাণ্ডেলযুক্ত বেতের ছড়ি। বাবু তাঁহার পরধেয় বস্ত্রের কোঁচন কোঁচা বামহস্তে ধরিয়া, দক্ষিণ হস্তের ছড়িগাছটি অল্প অল্প ঘুরাইতে ঘুরাইতে চিৎপুর রাস্তা ধরিয়া দক্ষিণমুখে চলিলেন। বাবু রাস্তা বাহিয়া চলিলেন সত্য কিন্তু তাঁহার দৃষ্টি সম্মুখের রাস্তার উপর না পড়িয়া রাস্তার উভয় পার্শ্বের বারান্দার উপর দৌড়াদৌড়ি করিতে লাগিল। চিৎপুর রাস্তা ছাড়িয়া ক্রমে ডাক্তার সোণাগাছির ভিতর প্রবেশ করিলেন। আমিও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ পশ্চাদবর্ত্তী ছায়ার ন্যায় গমন করিতে লাগিলাম। দেখিলাম, সেইস্থানের একটি বাড়ীর ভিতর ডাক্তার প্রবেশ করিলেন। আমি বাহিরেই রহিলাম। সেই বাড়ীর সম্মুখে একটি পানের দোকান ছিল। আমি সেই দোকানে গিয়া উপবেশন করিলাম, এক এক পয়সা করিয়া ক্রমে দুই আনার পান ক্রয় করিলাম, এবং সেই স্থানে বসিয়া বসিয়াই ঐ পান খাইতে লাগিলাম। খিলিওয়ালার সহিত এ কথা ও কথা নানাকথা পাড়িয়া ক্রমে অবগত হইতে পারিলাম যে, ডাক্তারবাবু ঐ বাড়ীতে হরিনাম্নী একটি বেশ্যার ঘরে প্রত্যহই সন্ধ্যার পরে আগমন করেন এবং সমস্ত রাত্রি সেইস্থানে অতিবাহিত পরদিবস বেলা নয়টা দশটার সময় সেই বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যান।
পানওয়ালার নিকট হইতে এই বিষয় অবগত হইয়া, সেই দিবস আমি সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম।
পরদিবস দিবাভাগে আমি সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, হরিনাম্নী একটি স্ত্রীলোক বাস্তবিকই সেই বাড়ীর ভিতর একখানি ঘরে বাস করে। হরির ঘরের পার্শ্ববর্তী ঘরে সাগরনাম্নী অপর আর একটি স্ত্রীলোকের ঘর।
অনুসন্ধানোপলক্ষে অনেক সময় আমি দেখিতেছি যে কাৰ্য্যে সফলতা লাভের উপক্রম হয়, তাহার অনুকূল উপায় দেখিতে দেখিতে আপনি জুটিয়া যায়। সাগরের ঘরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিবামাত্র দেখিতে পাইলাম, সেই ঘরে আমার বিশেষ পরিচিত বিনোদ নামধেয় একটি যুবক বসিয়া আছে। আমাকে দেখিবামাত্র বিনোদ যেন একটু লজ্জিত হইয়া, ঘাড় হেট করিয়া সরিয়া বসিল। বিনোদের ভাবগতি দেখিয়া আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম, সাগরের ঘরে বিনোদের যাওয়া আসা আছে। আমি কিন্তু বিনোদের অবস্থা দেখিয়াও দেখিলাম না। একেবারে সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া, বিনোদের নিকট উপবেশন করিলাম ও কহিলাম, “বিনোদবাবু! তোমার অনুসন্ধানের নিমিত্তই আমি এইস্থানে আসিয়াছি।”
“কেন মহাশয় আমার অনুসন্ধান করিতেছেন?”
“বিশেষ প্রয়োজন আছে বলিয়াই তোমাকে খুঁজিতেছি।” বিনোদকে সঙ্গে করিয়া সম্মুখস্থ বারান্দায় গমন করিলাম। সেইস্থানে বিনোদকে কহিলাম, “বিনোদ বাবু! আমি যে কার্য্যের নিমিত্ত এখানে আগমন করিয়াছি, তাহা সমস্ত তোমাকে বলিব এবং তোমার সাহায্য লইয়াই আমি আমার কার্য্য উদ্ধারের চেষ্টা করিব, কিন্তু আমার বিশেষ অনুরোধ — আমার প্রকৃত পরিচয় এইস্থানে তুমি কাহারও নিকট প্রকাশ করিও না।”
বিনোদ আমার প্রস্তাবে সম্মত হইল। আমিও তাহাকে আমার অভিসন্ধির সমস্ত কথা বলিলাম। আমার কথা শুনিয়া বিনোদ যদিও বিস্মিত হইল সত্য, কিন্তু সাধ্যানুসারে আমার সাহায্য করিতে অঙ্গীকার করিল।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
সেইদিবস হইতেই বিনোদের সহিত সেইস্থানেই প্রায় সমস্ত দিবস অতিবাহিত করিতে আরম্ভ করিলাম। রাত্রির অধিকাংশ সময়ও সেইস্থানে কাটিতে লাগিল। দুই একদিনের মধ্যেই ডাক্তারের সহিত আমার আলাপ হইয়া গেল। সেইস্থানে ডাক্তার আগমন করিবামাত্র আমি তাঁহার নিকট গমন করিতাম, এবং যে পর্য্যন্ত তিনি শয়ন না করিতেন, সেই পর্যন্ত আমি তাঁহার সেবায় নিযুক্ত থাকিতাম। তিনি আমার সেবায় ও যত্নে ক্রমে আমার উপর সন্তুষ্ট হইতে লাগিলেন ও ভালবাসিতে লাগিলেন। মদ্য, মাংস, খাদ্য প্রভৃতি যখন যে দ্রব্য তাঁহার আবশ্যক হইতে লাগিল, আমি নিজব্যয়েই তাহা তাঁহার নিমিত্ত সংগ্রহ করিতে লাগিলাম। দেখিলাম, ক্ৰমে ডাক্তার আমার উপর তাঁহার বিশ্বাস স্থাপন করিতে আরম্ভ করিলেন। এই সুযোগ পাইয়া আমিও ক্রমে তাঁহার সহিত তাঁহার বাড়ী পর্য্যন্ত গমনাগমন করিতে লাগিলাম। তাঁহার পিতা, ভ্রাতা ও দাস-দাসী প্রভৃতি অপর সকলের সহিত ক্রমে আমার আলাপ পরিচয় হইয়া গেল।
হরির বাড়ীতে আমার গমন করিতে একদিবস রাত্রি একটু অধিক হইয়া গেল। সেইদিবস ইচ্ছা পূৰ্ব্বকই আমি একটু বিলম্ব করিয়া সেইস্থানে গমন করিয়াছিলাম। আমার পরামর্শমত বিনোদ কর্তৃক সেইদিবস হরির ঘরে সুরাপানের আয়োজন হইয়াছিল। আমি যখন সেইস্থানে গমন করিলাম, তখন দেখিলাম, তথাকার প্রায় সকলেই সুরা পানে উন্মত্ত হইয়াছে। ডাক্তারেরও বেশ নেসা হইয়াছে। আমি সেইস্থানে গমন করিয়া ডাক্তারকে কহিলাম, “কি ডাক্তার! আজ একটি বড় ভাল মাল আনিয়াছি, খাবে কি?” এই বলিয়া আমার নিকট হইতে আর এক বোতল সুরা বাহির করিয়া দিলাম। সেই সময় এক বোতল অতি উৎকৃষ্ট সুরা পাইয়া ডাক্তার অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন এবং আমার হস্ত হইতে গ্রহণ করিয়া, উহা পান করিতে লাগিলেন। ডাক্তারের যাহা কখন দেখি নাই, আজ তাহাই দেখিলাম; দেখিতে দেখিতে সুরাদেবী ডাক্তারের হিতাহিত জ্ঞান ক্রমে রহিত করিয়া দিল। সময় বুঝিয়া আমিও আজ ডাক্তারের মনের কথা লইতে প্রবৃত্ত হইলাম। নানাপ্রকারের কথা নানাভাবে ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম। ডাক্তার অসম্ভবভাবে সমস্ত কথার উত্তর প্রদান করিতে এবং সময়ে সময়ে নিজেও অনেক কথা বলিতে লাগিলেন। ময়মনসিংহে গমন; সেইস্থানে সামান্য টাকার লোভে একজন ‘জমীদারের সর্ব্বনাশসাধন; নিজের প্রভু জমীদারকে কৌশলে বঞ্চনা করিয়া তাঁহার কতকগুলি অর্থ অপহরণ ও পরিশেষে ইহজগৎ হইতে তাঁহাকে অন্য জগতে প্রেরণ পূর্ব্বক পূর্ব্বকথিত উকীলের নিকট হইতে আপনাকে রক্ষা করণ, কলিকাতার নিকটবর্তী যে স্থানে ঔষধালয় স্থাপন করিয়াছিলেন, সেইস্থানে নিমন্ত্রিত স্ত্রীলোকদিগের সর্ব্বনাশসাধন; ও পরিশেষে বীমা অফিস হইতে ত্রিশ হাজার টাকা হস্তগত করিবার উপায় প্রভৃতি নির্দ্ধারণ ইত্যাদি যে সকল বিষয় পূর্ব্বে পাঠকগণ ডাক্তারবাবুর মুখে শ্রবণ করিয়াছেন, তাহার সমস্ত বিষয়ই অসংলগ্নভাবে ক্রমে ক্রমে নেশার ঝোঁকে বলিয়া ফেলিলেন। আমি মোটামুটিভাবে যদিও সমস্ত বিষয় সেই সময় জানিতে পারিলাম, কিন্তু তাঁহার ভ্রাতার মৃত্যু ব্যতীত আর কোন কথাই বিশেষরূপে বুঝিতে পারিলাম না। সমস্ত বিষয় বুঝিতে পারিলাম না সত্য; কিন্তু যাহা শুনিলাম, তাহা স্মৃতির স্তরে অঙ্কিত করিয়া লইলাম।
এই ঘটনার দুই তিন দিবস পরেই আমি একদিবস ডাক্তারকে কহিলাম, “ডাক্তার! আমি দেশ হইতে পত্ৰ পাইয়াছি, বিশেষ কার্য্যোপলক্ষে আমাকে সেইস্থানে গমন করিতে হইবে। বোধ হয়, সেইস্থানে আমার মাসাবধি বিলম্ব হইতে পারে।”
“যত শীঘ্র পার, প্রত্যাগমন করিও” এই বলিয়া ডাক্তার আমাকে বিদায় দিলেন। পরদিবস আমি কলিকাতা পরিত্যাগ করিলাম। দেশে গমন করিবার পরিবর্তে, গমন করিলাম, ময়মনসিংহে। সেইস্থানে ডাক্তারের সেই পরলোকগত প্রভু জমীদারের পুরাতন কর্মচারীগণের নিকট যে সকল বিষয় শ্রবণ করিলাম, তাহা, ও ডাক্তারের নিজের মুখে বর্ণিত বিষয়, এই উভয় মনে মনে একত্র স্থাপন করিয়া বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, প্রকৃত অবস্থা কি?
ময়মনসিংহে প্রয়োজনোপযোগী অনুসন্ধান সমাপন করিয়া কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিলাম। জমীদার মহাশয়ের কাগজ পত্র যে উকীলবাবুর নিকট ছিল, তাঁহার নাম সেইস্থানেই অবগত হইতে পারিয়াছিলাম। কলিকাতায় আসিয়া সন্ধান করিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম, এবং যে সকল কাগজ পত্র তাঁহার নিকট ছিল, তাহা সংগ্রহপূর্বক অন্যান্য অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলাম। যত অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম, ডাক্তারের বিপক্ষে ততই প্রমাণ সংগ্রহ হইতে লাগিল। সেই কাগজ-পত্রের সমস্তই যে জাল, তাহা প্রকাশ হইয়া পড়িল।
আমার গুপ্ত অনুসন্ধানের ফল বীমা আফিসে প্রেরণ করিলাম। তাঁহারা জানিতে পারিলেন, জুয়াচুরি করিয়া ৩০,০০০ ত্রিশ হাজার টাকা হস্তগত করিবার মানসে ডাক্তার তাহার ভ্রাতাকে হত্যা করিয়াছে; সুতরাং ঐ টাকা আর তাঁহাদিগকে প্রদান করিতে হইল না।
এদিকে জালকরা অপরাধে ডাক্তারবাবুকে রাজদ্বারে উপস্থিত করিলাম। সেই সময় তিনি জানিতে পারিলেন, আমি কে ও তাঁহার কিরূপ বন্ধু! এলাহাবাদের যে ডাক্তারের কথা পাঠকগণ অবগত আছেন, যাহার ভয়ে সেইস্থান হইতে ডাক্তারবাবুকে পলায়ন করিতে হইয়াছিল, সেই ডাক্তারকে কলিকাতায় আনয়ন করিলাম। তিনি এইস্থানে আসিয়া আমাদিগের ডাক্তারবাবুর বিপক্ষে সাক্ষ্যপ্রদান করিলেন। ডাক্তারবাবু কর্তৃক এলাহাবাদে যে সকল বিষয় ঘটিয়াছিল, তাহার আনুপূর্ব্বিক সমস্ত বিষয় তিনি বিচারকের নিকট প্রকাশ করিলেন। ময়মনসিংহ হইতে যে সকল সাক্ষী আমি সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়াছিলাম, তাহারা সকলেই এখানে আগমন করিলেন। সেইস্থানের জমিদারকে তিনি কিরূপে প্রতারণা করিয়া তাঁহার নিকট হইতে অজস্র অর্থ শোষণ করিতে সমর্থ হইয়া, পরিশেষে তাহাকে শমন-সদন পর্যন্ত প্রেরণ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, তাহার যতদূর তাহাদিগের দ্বারা প্রমাণিত হইতে পারে, তাহা তাহারা প্রমাণ করিলেন। যে উকীলের হস্তে ঐ সকল জাল কাগজ ছিল, তিনি তাহা বিচারালয়ে উপস্থিত করিলেন ও সেই সম্বন্ধে যে সকল বিষয় তিনি অবগত হইতে পারিয়াছিলেন, তাহা প্রকাশ করিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হইলেন না। তদ্ব্যতীত বেঙ্গল গবর্ণমেন্টের সেক্রেটারী এবং পূর্ব্বকথিত প্রধান ইংরাজ ডাক্তার আসিয়া ডাক্তারবাবুর বিপক্ষে সাক্ষ্যপ্রদান করিলেন। লোকে কহিত, ঐ ডাক্তার সাহেব ডাক্তারবাবুর সহিত এই জুয়াচুরী-কার্য্যে কিয়ৎপরিমাণে মিলিত ছিলেন, কিন্তু ডাক্তারবাবুর বিপক্ষে তিনি যেরূপ ভাবে সাক্ষ্যপ্রদান করিলেন, তাহাতে সেই সন্দেহ আর কাহার মনে উদিত হইল না। ইহাদিগের দ্বারা উত্তমরূপ প্রমাণিত হইল যে, যে সকল দলিল দ্বারা জমিদার মহাশয়ের নিকট হইতে অর্থ সংগৃহীত হইয়াছিল তাহার সমস্তই জাল, একখানিও প্রকৃত নহে। এই সকল প্রমাণের দ্বারা উত্তমরূপে প্রমাণিত হইল যে, ডাক্তারবাবু সম্পূর্ণরূপে দোষী। হাইকোর্টে জুরীর বিচারে পরিশেষে ডাক্তারবাবু অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ায় তিনি পুর্ব্বকথিত কঠিন দণ্ডে দণ্ডিত হইলেন।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
ছয় বৎসরের নিমিত্ত ডাক্তারবাবু কারারুদ্ধ হইলেন। ভাবিলাম, ছয় বৎসরের মধ্যে ডাক্তারবাবুর ভাবনা আর আমাদিগকে ভাবিতে হইবে না, বা অপর কাহাকেও তাঁহার দিকে লক্ষ্য রাখিয়া চলিতে হইবে না। কিন্তু আমি যে আশা করিয়াছিলাম, দেখিলাম, এক বৎসর গত হইতে না হইতেই তাহা ভস্মে পরিণত হইল।
একদিবস সন্ধ্যার পূর্ব্বে আমি গরাণহাটার মোড়ে দাঁড়াইয়া অপর আর এক ব্যক্তির সহিত কথা কহিতেছি, এমন সময় একখানি দ্বিতীয় শ্রেণীর গাড়ির দিকে হঠাৎ আমার নয়ন আকৃষ্ট হইল। দেখিলাম, উহার ভিতর আমাদিগের ডাক্তারবাবু। ঐ গাড়ি দক্ষিণদিক হইতে আসিয়া চিৎপুর রাস্তা বাহিয়া উত্তর মুখে চলিয়া গেল। উঁহাকে দেখিয়া আমার মনে হঠাৎ কয়েকটি ভাবনার উদয় হইল। প্রথম ভাবিলাম, ইনি কি ডাক্তারবাবু? যদি ডাক্তারবাবু হয়েন, তাহা হইলে ইনি কি প্রকারে জেলের বাহিরে আসিলেন? ইনি কি জেল হইতে পলায়ন করিয়াছেন? যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে সে সংবাদ আমরা ত নিশ্চয়ই প্রাপ্ত হইতাম? আমার দ্বিতীয় চিন্তা, ইনি পলায়ন করেন নাই, জেলের কোন কৰ্ম্মচারী কোন প্রকার প্রলোভনে পড়িয়া ইহাকে উহার বাড়ীতে লইয়া যাইতেছেন। এখনই আবার জেলে লইয়া যাইবে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হইল, যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে ইহার পরিহিত জেলের পোষাক কি হইল? গুপ্তভাবে জেল হইতে আসিবার কালে ভদ্রলোকের পরিধানোপযোগী কাপড় ইনি কোথায় পাইবেন? আমার তৃতীয় চিন্তা, ইনি ডাক্তারবাবু না হইয়া, সেইরূপ অবয়ব-বিশিষ্ট অপর কোন ব্যক্তি ত নহেন?
এই ভাবিয়া সে দিবস আমি সে সম্বন্ধে আর কোন ভাবনা ভাবিলাম না। পরদিবস পুনরায় এই ভাবনা আমার হৃদয় আশ্রয় করিল; সুতরাং এ সম্বন্ধে একটু অনুসন্ধান করা কর্তব্য বিবেচনা করিয়া, আমি ডাক্তারবাবুর বাড়ীতে গমন করিলাম। সেইস্থানে তাঁহার পিতার সহিত সাক্ষাৎ হইল। তাঁহার নিকট অবগত হইলাম, প্রকৃতই ডাক্তারবাবু বাড়ীতে আগমন করিয়াছেন, সরকার বাহাদুর অনুগ্রহপূর্বক তাঁহাকে মুক্তি প্রদান করিয়াছেন— কেন যে তিনি সেই কঠিন দণ্ড হইতে অব্যাহতি পাইয়াছেন, তাহা কিন্তু তাঁহার পিতা বলিতে পারিলেন না, বা ইচ্ছা করিয়াই বলিলেন না। ডাক্তারবাবু সেই সময়ে বাড়ীতে ছিলেন না, সুতরাং তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইল না, আমি নিজ স্থানে প্রত্যাবর্তন করিলাম।
গুরুতর অপরাধে যাঁহার কেবল ছয় বৎসরমাত্র কারাদণ্ড হইয়াছে, এক বৎসর গত হইতে না হইতেই তিনি কি প্রকারে জেল হইতে বহির্গত হইলেন, এই বিষয় অবগত হইবার নিমিত্ত আমার মনে নিতান্ত কৌতূহল জন্মিল। উহার প্রকৃত তত্ত্ব কি, জানিবার নিমিত্ত পরদিবসই আমি ‘হরিণবাড়ী জেলে’ গমন করিয়া আমার মনোগত ভাব সেই স্থানের প্রধান কর্ম্মচারীর নিকট প্রকাশ করিলাম। তিনি কাগজ-পত্র দেখিয়া ডাক্তারবাবু সম্বন্ধে আমাকে কহিলেন, “কঠিন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইয়া ডাক্তারবাবু জেলে আগমন করিবার কয়েক মাস পর পর্য্যন্ত তিনি জেলের নিয়মানুযায়ী কৰ্ম্মকাৰ্য্য প্রভৃতি সমস্তই সুচারুরূপে সম্পন্ন করিয়া আসিতেছিলেন। ইহার পরেই তাঁহার মস্তিষ্ক ক্রমে বিকৃতাবস্থা প্রাপ্ত হইতে আরম্ভ হইয়াছিল। প্রথম প্রথম ক্রমে তাঁহাকে অন্যমনস্ক বোধ হইত, পরিশেষে তিনি মৌনভাবে চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতেন। ক্রমে থাকিয়া থাকিয়া তাঁহার মুখে ‘টাকা’ শব্দ বাহির হইতে লাগিল; পরে সর্ব্বদাই তিনি ‘টাকা টাকা’ শব্দে জেলের ভিতর চীৎকার করিতে আরম্ভ করিলেন। শয়নে ‘টাকা’ স্বপনে ‘টাকা’ আহারের সময় ‘টাকা’ বিশ্রামের সময় ‘টাকা’, বস্তুতঃ সৰ্ব্বদাই “টাকা, টাকা, টাকা” শব্দ করিয়া রাত্রিদিন অতিবাহিত করিতে লাগিলেন। কয়েক দিবসের মধ্যে তাঁহার এই প্রকার অবস্থা দেখিয়া, আমরা সকলেই স্থির করিলাম যে উহার মস্তিষ্ক বিকৃত হইয়া গিয়াছে। এই সময় যদি ইহার উপযুক্তরূপ চিকিৎসা না হয়, তাহা হইলে ইনি একেবারে বদ্ধ পাগল হইয়া যাইবেন; এই ভাবিয়া চিকিৎসার নিমিত্ত অবিলম্বেই ডাক্তারকে আমরা পাগলা হাঁসপাতালে প্রেরণ করিলাম। তাহার পর যে কি হইয়াছে, তাহা আর আমরা অবগত নহি।”
জেলের প্রধান কর্মচারীর নিকট এই সকল অবগত হইয়া পরিশেষে পাগল, হাসপাতালে গিয়া, একটু অনুসন্ধান করা কর্তব্য বিবেচনা করিলাম। হরিণবাড়ী জেল হইতে পাগলা হাসপাতাল বহুদূর নহে, সুতরাং জেল হইতে বহির্গত হইয়া সেইস্থানে গমন করিলাম। সেইস্থানে জিজ্ঞাসা করায় তথাকার একজন ডাক্তার কহিলেন, “ডাক্তারবাবু পাগল হইয়া, হাসপাতালে আসিবার পরই ক্রমে তাহার পাগলামী সারিতে লাগিল। ইহার অবস্থা দেখিয়া হাসপাতালের প্রধান ডাক্তার কহিলেন, অপরাপর পাগল অপেক্ষা ইহার অবস্থা অন্য প্রকার। ইহাকে যদি আবদ্ধ করিয়া রাখা যায়, তাহা হইলে ইহার পাগলামী ভাল হওয়া দূরে থাকুক, ক্রমে আরও বৰ্দ্ধিত হইতে থাকিবে। আমার বিবেচনায় ইহাকে স্বাধীনতা দিয়া ছাড়িয়া দিলে শীঘ্র ইহার পাগলামী ভাল হইবার সম্ভাবনা।’ পরে দেখিলাম, এক এক করিয়া হাসপাতালের ডাক্তারগণ, মেম্বরগণ, সকলেই ডাক্তার সাহেবের মতে মত দিলেন এবং এই বিষয় সম্বন্ধে রিপোর্ট করাও হইল। জানা গেল জেল হইতে মুক্তিপ্রদান করিলে সে চিরদিবসের নিমিত্ত সুখে কালাতিবাহিত করিতে পারিবে, তখন তাহাকে মুক্তিপ্রদান করাই কৰ্ত্তব্য। পাগল হইয়া চিরদিবস একটি লোকের জীবনযাপনের বিষম কষ্ট দর্শন করা অপেক্ষা, তাঁহাকে অব্যাহতি প্রদান করিলে যদি তাঁহার সেই উৎকট-রোগ আরোগ্য হয়, তাহা হইলে কোন সদাশয় ব্যক্তি ক্ষমতা স্বত্ত্বে এরূপ দয়াপ্রকাশ করিতে কুণ্ঠিত হইতে পারেন? লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর সাহেব তাহাই করিলেন। ডাক্তারগণের প্রার্থনা-অনুযায়ী তিনি তাহাকে ছাড়িয়া দিবার আদেশ প্রদান করিলেন; ডাক্তারবাবু এইস্থান হইতে বহির্গত হইয়া, আপনার আলয়অভিমুখে প্রস্থান করিলেন। শুনিয়াছি, এখন তাহার সমস্ত পাগলামী ভাল হইয়া গিয়াছে, তিনি পুনরায় তাহার পূৰ্ব্ব অবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছেন।”
পাগলা হাসপাতাল হইতে এই সকল বিষয় অবগত হইয়া বুঝিলাম, কি প্রকারে ডাক্তারবাবু এই কঠিনদণ্ডের হস্ত হইতে নিষ্কৃতিলাভ করিয়াছেন। ভাবিলাম, গবর্ণমেণ্ট ইঁহাকে অব্যাহতি দিয়া ভালই করিয়াছেন, রাজার কর্তব্যই করিয়াছেন। কিন্তু পরিশেষে আমি যাহা অবগত হইতে পারিয়াছিলাম তাহাতে মনে অতিশয় কষ্ট হইয়াছিল। রাজা প্রজা কর্তৃক বিশেষ রূপে বঞ্চিত হইলে সহৃদয় প্রজার মনে যেরূপ কষ্ট হয়, এ সেইরূপ কষ্ট। পরে বুঝিয়াছিলাম, জেল হইতে খালাস হওয়াও ডাক্তারবাবুর জুয়াচুরি কাণ্ডের অপর আর এক অধ্যায়। কারণ তিনি পাগলা হাসপাতালের প্রধান ডাক্তারের বিশেষ পরিচিত, ও আর একজন বড় ডাক্তারের সহিত তাহার বিশেষ হৃদ্যতা ছিল। ডাক্তারবাবু তাঁহার পরিচিত ডাক্তারকে তোষামোদ বলেই হউক, বা অপর কোন অসৎ উপায় অবলম্বনেই হউক, প্রথমেই বশীভূত করিয়া রাখিয়াছিলেন এবং এক বৎসর মেয়াদ উত্তীর্ণ হইবার পর তাহারই পরামর্শ অনুযায়ী ডাক্তারবাবু পাগল সাজিলেন, ও ক্রমে পাগলা হাসপাতালে আসিলেন। হাসপাতালে তাঁহাকে যে কয়েকদিবস অতিবাহিত করিতে হইয়াছিল, তাহার মধ্যে প্রথম প্রথম তিনি পূর্ব্বরূপ “টাকা টাকা” বলিয়া মধ্যে মধ্যে চীৎকার করিতে লাগিলেন; ক্রমে তাঁহার সেই চীৎকারধ্বনি বন্ধ হইয়া আসিতে লাগিল, ক্রমে তাঁহার পাগলামি কমিয়া আসিতে লাগিল। পাগলা হাসপাতালের কর্মচারীগণ অনুমান করিতে লাগিলেন, যেরূপ ভাবে ডাক্তারবাবু উন্নতিলাভ করিতেছেন, তাহাতে শীঘ্রই তাঁহার পাগলামী সারিয়া যাইবে ও তিনি অল্পকালের মধ্যেই প্রকৃতিস্থ হইবেন। এইরূপে কয়েকদিবস অতিবাহিত হইলেই, হাসপাতালের প্রধান ডাক্তারকে সেই ডাক্তার সাহেব যেরূপ বুঝাইলেন, সেইরূপই বুঝিলেন, ও পরিশেষে পূৰ্ব্বকথিত উপায় অবলম্বন করিয়া ডাক্তারবাবুকে অব্যাহতি প্রদান করিলেন।
আমাদিগের ডাক্তারবাবু এখন আর পাগল নহেন, তিনি কিন্তু এখন কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়াছেন।
[ চৈত্র, ১৩০৮ ]