কাল-পরিণয়
প্রথম পরিচ্ছেদ
বিগত রাত্রিতে এক খুনী-মোকদ্দমার তদারকে প্রায় সমস্ত রাত্রি বিনানিদ্রায় অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে। পরদিন শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিতে বিলম্ব হইয়াছে। বেলা আন্দাজ দশটার সময় হস্ত-মুখ প্রক্ষালন করিয়া, পূৰ্ব্বমত আমার অফিসঘরে উপস্থিত আছি, এমন সময় টেলিফোন-যোগে সংবাদ আসিয়া উপস্থিত হইল যে, আমাকে ক্ষণমাত্র বিলম্ব ব্যতিরেকে “–” থানায় গিয়া একটি খুনী-মোকদ্দমার তদারক করিতে হইবে। সুতরাং নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও কালবিলম্ব না করিয়া, ট্রামযোগে একবারে সেই থানায় উপনীত হইলাম।
থানায় উপস্থিত হইবামাত্র তত্রত্য একজন নিম্ন-কর্মচারী আমাকে ঘটনা স্থলে লইয়া গেল। আমরা একটি দ্বিতল বাটীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, সেখানে স্থানীয় পুলিস ইনস্পেক্টার দলবলসহ হত্যাব্যাপারের তদারক করিতেছেন। আমাকে দেখিতে পাইয়াই, অতি যত্নের সহিত তিনি আমার নিকট উপস্থিত হইয়া বলিলেন, “মহাশয়! আজ আমরা বড় সমস্যায় পড়িয়াছি। আজ অতি প্রত্যূষেই এই হত্যাকাণ্ড সাধিত হইয়াছে, আমরাও তৎক্ষণাৎ ইহার সংবাদ পাইয়া এখানে আসিয়া কোনমতেই ইহার কিনারা করিতে পারিতেছি না। সেইজন্য আপনাকে উপস্থিত হইবার জন্য অনুরোধ করিয়াছিলাম। যাহা হউক, আপনি সৌভাগ্যক্রমে শীঘ্রই আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। এক্ষণে অনুগ্রহ করিয়া ইহার তদন্তে মনোযোগী হউন। আমরা যথাসাধ্য আপনার সাহায্য করিতেছি।”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “লাস এক্ষণে কোথায়? আমি কি তাহা একবার দেখিতে পাইব?”
অমনই কৰ্ম্মচারী আমাকে লইয়া, সেই বাটীর দ্বিতলস্থ ভিতর-বাটীর এক কক্ষে উপস্থিত করিলেন। বলিলেন- “ঐ দেখুন, হতব্যক্তি ঐ শয্যার উপর পড়িয়া রহিয়াছে। উহার শরীর হইতে রক্ত নির্গত হইবার কোন চিহ্ন দেখিতে পাই নাই। বিষপ্রয়োগে মৃত্যুরও কোন চিহ্ন নাই। আরও দেখুন, হত ব্যক্তির মুখভঙ্গিমার কোন বৈলক্ষণ্য নাই, যেন অকাতরে নিদ্রা যাইতেছে বলিয়া বোধ হয়।”
আমি বলিলাম — “এই স্থানে এইরূপেই কি হত হইয়াছে বা অন্য কোন স্থানে হত হইবার পর কেহ এইস্থানে এই লাস আনিয়াছে?”
কৰ্ম্মচারী বলিলেন,–“অন্য কোন স্থানে হত্যা-ব্যাপার সম্পন্ন হয় নাই। এইখানে এইরূপেই হত হইয়াছে।”
আমি বলিলাম, –“আপনারা যতদূর তদারক করিয়াছেন, তাহাতে এ পর্য্যন্ত খুনী ব্যক্তির কোন সন্ধান পাইয়াছেন?”
কর্ম্মচারী। আমরা এখানকার সকলকে নানা প্রকারে জিজ্ঞাসা করিয়াছি; তাহাদের বিশ্বাস যে হত ব্যক্তির স্ত্রীই উহাকে হত্যা করিয়াছে। আমাদেরও তাহাই ধারণা হইতেছে। কারণ আসামী পলাতক; সেইজন্য আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস হইতেছে যে, উহার স্ত্রীই উহার হত্যাকারিণী। কিন্তু কি উপায়ে খুন করিয়াছে, বুঝিতে পারিতেছি না। আর হত্যাকারিণী কোথায়, কিরূপে পলায়ন করিয়াছে, তাহাও স্থির করিতে পারিতেছি না।
আমি তখন হতব্যক্তির আচ্ছাদিত শরীর উন্মুক্ত করিয়া তন্ন তন্ন করিয়া পরীক্ষা করিতে লাগিলাম। বাস্তবিক শরীরে বা শয্যাতলে কোন স্থানে রক্তের চিহ্ন দেখিতে পাইলাম না। লাসের মূর্ত্তি বিকটাকার ধারণ করে নাই। কিন্তু মুখে ভয়ানক দুর্গন্ধ মদের গন্ধে সে গৃহ পৰ্য্যন্ত আমোদিত।
আমি তখন কৰ্ম্মচারীকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনারা কিরূপে এই হত্যার সম্বাদ পাইলেন?”
কৰ্ম্মচারী। অদ্য প্রাতঃকালে এই বাটীর একজন চাকর থানায় গিয়া সংবাদ দেয় যে, তাহার মনিব অদ্য প্রত্যূষে হত হইয়াছে। বাবুর স্ত্রী তাঁহাকে হত্যা করিয়া পলাইয়া গিয়াছে।
আমি। বোধ হয়, আপনারা সেই কথা শুনিয়াই এখানে আসিয়া তদারকে নিযুক্ত আছেন, এবং সেই কথা শুনিয়া প্রথম হইতেই আপনাদিগের ধারণা যে, তাহার নিরুদ্দিষ্ট স্ত্রীই তাহার হত্যাকারিণী!
কর্ম্ম। না, তাহার কথায় আমাদের ধারণা হয় নাই। আদ্যোপান্ত যেরূপ হইয়াছে, শুনুন। শুনিলেই বুঝিতে পারিবেন।
এই বলিয়া কৰ্ম্মচারী অনুসন্ধানে যতদূর জানিতে পারিয়াছিলেন, তাহাই বলিতে লাগিলেন। আমি তাঁহার কথা শুনিয়া ঘটনার সারমর্শ এইরূপ বুঝিলাম, –
হতব্যক্তি গত রাত্রিতে একটি কন্যার সহিত পরিণীত হয়। গত রাত্রিতে ঘটনার বাটীতে নিমন্ত্রিত অনেক ব্যক্তির সমাগম হইয়াছিল। বাটীটি হত ব্যক্তির নিজের, এবং এই বাটীতেই বিবাহ-কাৰ্য্য সম্পন্ন হয়। এই বাটীটি বরের নূতন ক্রীত। নিকটেই বরের একটি পুরাতন পৈতৃক বাটী আছে। সে বাটীতে কেবলমাত্র তাহার মাতা আছেন। ঘটনার বাটীতে ইতিপূর্ব্বে বরের আত্মীয়-জন কেহই থাকিত না; কেবল গত পূর্ব্ব রজনীতে তাহারা সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন। প্রায় সপ্তাহকাল হইতে এই বাটীতে কন্যা ও তাহার এক ভগিনী বাস করিতেছিল। কন্যাটি বয়স্থা এবং উদ্ধস্বভাবা। বিবাহকার্য নির্ব্বাহিত হইবার পর সমস্ত নিমন্ত্রিত ব্যক্তির সম্মুখে কন্যা স্বয়ং উপস্থিত হইয়া এইরূপ বলিয়াছিল, “আমি এখন আমার প্রতিজ্ঞাপাশ হইতে মুক্ত। আমি অমুককে বিবাহ করিতে প্রতিশ্রুত ছিলাম, এখন আপনাদের সাক্ষাতেই তাহা সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে। কিন্তু আমি বিবাহ করিয়াছি বলিয়া উহাকে স্বামীভাবে দেখিতে বাধ্য নহি। আমার প্রতিজ্ঞার মধ্যে সেরূপ কথা ছিল না। আপনারা সকলেই শুনুন, এ বিবাহ আমার আন্তরিক ইচ্ছার বিরুদ্ধে হইয়াছে। আমাকে বলপূর্ব্বক কৌশলজালে জড়িত করিয়া, এই বিবাহের সত্যপাশে আমাকে বদ্ধ করিয়াছিল। প্রথমে আমাকে অনুরোধ করিলেও যখন আমি কোনমতেই বিবাহে স্বীকৃত হইলাম না, তখন একদিন আমাকে কৌশল পূৰ্ব্বক একটি জুয়াচোরের আড্ডায় লইয়া গিয়া উপস্থিত করে। সেখানে মর্য্যাদাহানি, মাননাশের ভয় দেখাইয়া বলে, আমি উহাকে বিবাহ না করিলে, এইরূপ প্রকাশ করিয়া দিবে যে, ভদ্র গৃহস্থের যুবতী অনূঢ়া হইয়া এই জুয়াখেলার আড্ডায় উপস্থিত হইয়াছিলাম, সুতরাং সেরূপ প্রকাশ হইলে আর কাহারও সহিত বিবাহ হইবে না এবং একঘরে হইয়া থাকিতে হইবে। এইরূপ কৌশলে সেইস্থানে পতিত হইয়া আমি অগত্যা প্রতিজ্ঞা করিলাম যে, অদ্য হইতে পনের দিবস পরে বিবাহ করিব। কিন্তু ইতিমধ্যে উহার সংস্পর্শে কখনই যাইব না। যদি সে বলপূর্ব্বক ইতিমধ্যে আমাকে স্পর্শ করে, তবে আমি এ প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিব না। এইরূপ করারে ঐ ব্যক্তি স্বীকৃত হয়। আমরা সে স্থান হইতে চলিয়া আসি। নানা কারণে উক্ত ঘটনা এ পর্য্যন্ত প্রকাশিত হয় নাই। আমি ইহা প্ৰকাশ না করিলে আর কেহ ইহা প্রকাশ করিত না। কিন্তু আমি যখন আমার ইচ্ছার সম্পূর্ণ বিপরীতে এই বিবাহব্যাপারে মত দিয়াছি, তখন ভদ্রলোকের কন্যা হইয়া আমার প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করিতে পারি না। তবে যখন ইহকালের সকল সুখে জলাঞ্জলি দিলাম, এই বিবাহ হইয়াছে বলিয়া যখন হিন্দুশাস্ত্রমতে পুনর্ব্বার অন্যকে বিবাহ করিতে আমি সম্পূর্ণ অক্ষম, তখন আমার ইহজীবনের সুখ, উন্নতির কণ্টককেও আমি সুখী হইতে দিব না। সে যে আশায় আমাকে বিবাহ করিতে এতদূর বলপ্রকাশ করিয়াছে, তাহার সেই আশার মূলোচ্ছেদ করিয়া, তাহার ইহজীবনের সুখের পথ একবারে বন্ধ করিব। আমি মুক্তকণ্ঠে সকলের সম্মুখে বলিতেছি যে, ইহজীবনে উহার শত্রুরূপে উহার জীবনপথের কণ্টক হইব; কেহই আমাকে এই সঙ্কল্পিত পথ হইতে ভ্রষ্ট করিতে পারিবে না। জগদীশ্বরের নিকট প্রার্থনা করি, আজই দুরাত্মা নিজ কর্ম্মের ফলভোগ করিবে।”
উপস্থিত ব্যক্তিমাত্রেই এই অশ্রুতপূর্ব্ব অভাবনীয় কথা শুনিয়া আশ্চর্য্যান্বিত ও স্তম্ভিত হইল। বরের মুখে আর কোন বাক্য নাই। সকলেই নিস্তব্ধ, আহ্লাদ আমোদ মাথার উপর উঠিল। শোকে দুঃখে ক্রোধে ক্ষোভে বর তথা হইতে প্রস্থান করিল। কন্যা যে কোথায় অন্তর্হিত হইল, কেহ বলিতে পারিল না।
তৎপরে নিমন্ত্রিত সকলে বাটী ফিরিয়া গেলেন। বর গৃহে গিয়া মদ্যপান করিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরেই অসাড়, অচেতন হইয়া পড়িল। বাটীর সকলে যথাস্থানে শয়ন করিতে গেল।
বিশ্বাসী চাকর-একটি বাবুকে অত মদ খাইতে নিষেধ করিলেও বাবু তাহা শুনেন নাই, সুতরাং বাবু অতিরিক্ত মদ্যপানে যখন মৃতবৎ নিদ্রিত হইলেন, তখন সে চাকরও বাবুকে ত্যাগ করিয়া তাহার নিজ গৃহে শয়ন করিয়া রহিল। কিন্তু বাবু কিরূপ আছেন, জানিবার জন্য অতি প্রত্যূষে, যে ঘরে মদ্যপান করিয়া বাবু শয়ান ছিলেন, সেইখানে গিয়া সে বাবুকে ডাকিতে লাগিল। কিন্তু বাবু কোন মতেই উত্তর দিতে পারিলেন না। কিছুক্ষণ পরে প্রাতঃকাল হইলে পুনরায় ডাকাডাকি করিল; কিন্তু তাহাতেও বাবুর নিদ্রাভঙ্গ না হওয়ায় সেই চাকর অপর লোককে দেখাইল। সকলেই দেখিল, বাবু মৃত। তখন চাকর গিয়া থানায় সংবাদ দেয়। যখন সকলেই বাবুকে মৃত বিবেচনা করেন, তখন চাকরও মনে করে যে, কন্যা যখন কাল রাত্রিতে অত কথা বলিয়া গেল, তখন সেই কন্যাই এই কাজ করিয়াছে, নতুবা আর কে করিবে? সেই ধারণায় চাকর গিয়া থানায় বলিয়াছিল যে, কন্যার দ্বারা বর হত হইয়াছে! শুদ্ধ তাহাই নহে, উক্ত বাটীর সকলেরই বিশ্বাস যে, কন্যাই বরের হন্ত্রী।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
কর্মচারীর মুখে সমস্ত ঘটনা শুনিয়া আমারও মনে প্রথমতঃ বিশ্বাস হইল যে, কন্যাই বরকে হত্যা করিয়াছে। কিন্তু চাকরেরও উপর আমার কিঞ্চিৎ সন্দেহ হইতে লাগিল। যাহা হউক, আর একবার লাসের শরীর ও গৃহের অবস্থা পরীক্ষা করিলাম। অতি সূক্ষ্মভাবে দেখাতে বোধ হইল, রগের শিরায় একটি সূক্ষ্ম ক্ষত রহিয়াছে, কিন্তু তাহা হইতে রক্ত নির্গমের কোন চিহ্ন দেখিতে পাইলাম না। গৃহের মধ্যে কয়েকটি বোতল ও গ্লাস ছিল, অন্য কোন সন্দেহাত্মক দ্রব্য দেখিতে পাইলাম না। অতঃপর লাস পরীক্ষার্থ প্রেরিত হইল। সঙ্গে সঙ্গে উক্ত তরল পদার্থপূর্ণ মাদকদ্রব্যের বোতল ও গ্লাসও পরীক্ষার জন্য পাঠান গেল। বলা বাহুল্য, যদি কোন বিষাক্ত দ্রব্য উহার মধ্যে থাকে, যাহার জন্য হতব্যক্তি মৃত হইয়াছে, তাহা পরীক্ষার জনাই বোতল ও গ্লাস প্রেরিত হইল।
লাস স্থানান্তরিত হইলে আমি বাটীর লোকদিগকে একে একে ডাকিয়া তাহাদিগকে প্রশ্ন করিতে লাগিলাম। প্রথমতঃ যে চাকর থানায় গিয়া সংবাদ দেয়, তাহাকেই জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি এ বাটীতে কতদিন চাকুরী করিতেছ?”
চাকর। বাবু যখন নিতান্ত শিশু, তখন বাবুর পিতা আমাকে উহার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিযুক্ত করেন। আমি সেই অবধিই এখানে আছি।
আমি। সে কত দিনের কথা হইবে?
চাকর। প্রায় ২৫ বৎসর।
আমি। তুমি এ বাড়ীতে কি কি কার্য্য কর?
চাকর। তাহার কিছু স্থিরতা নাই,– যখন যে কার্য্য করিতে বলেন, তখন আমি তাহাই করিয়া থাকি।
আমি। কৰ্ত্তা বাবু কোথায় আছেন?
চাকর। তিনি আর বর্তমান নাই।
আমি। কোথায় তবে? মৃত হইয়াছেন?
চাকর। হাঁ মহাশয়।
আমি। কতদিন তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে?
চাকর। প্রায় ১০/১২ বৎসর হইবে।
আমি। তাঁহার বিষয়াদি কি আছে?
চাকর। এই সহরে তাঁহার কয়েকখানি ভাড়াটিয়া বাড়ী আছে; কোম্পানির কাগজ আছে। এ ছাড়া গৃহিণীর নিকট গহনাপত্র ও কর্তার জীবন-বিমার জন্য নগদ টাকা আছে।
আমি। তুমি কত টাকা মাহিনা পাও?
চাকর। আমি আট টাকা করিয়া পাই, এ ছাড়া সময়ে সময়ে নানা রকমে টাকা ও দ্রব্যাদি পাইয়া থাকি।
আমি। অন্য উপায়ে কিরূপে টাকা পাও?
চাকর। গৃহিণী আমাকে বড় ভালবাসেন এবং বিশ্বাস করেন। তিনি নানা উপায়ে আত্মীয় স্বজনের বাটী তত্ত্ব তালাস আমার দ্বারা পাঠাইয়া, কিম্বা নিজের আত্মীয়ের কোন ক্রিয়া কাণ্ড উপলক্ষে আমাকে বক্সিস্ করেন।
আমি। তোমার আর কে আছে?
চাকর। আমার আর কেহই নাই। আমি ও আমার পরিবার। দুইজনেই এই বাটীতে থাকি।
আমি। তোমার বাড়ী কোথায়?
চাকর। আমার বাড়ী খরসরাই, বেগমপুর
আমি। সেখানে তোমার কে আছে?
চাকর। এখন কেহ নাই। আমার একমাত্র মাতা ঠাকুরাণীর মৃত্যুর পর আমার স্ত্রীকে এখানে লইয়া আসি। সেখানে আমার আর কেহই নাই।
আমি। তোমার স্ত্রী এখানে কি করে?
চাকর। এই সংসারের সকল কাজই করে।
আমি। তুমি যে এই মাহিনা পাও, তাহার কি সবই খরচ হয়? না, কিছু বাঁচে? যদি বাঁচে, তাহা লইয়া তুমি কি কর?
চাকর। আমার খরচ অতি অল্পই হয়। যাহা বাঁচে, তাহা গৃহিণীর হাতে সব দি। গৃহিণী তাহা সুদে খাটাইয়া, আমার টাকা বাড়াইয়া রাখেন।
আমি। যে টাকাগুলি তোমার জমিয়াছে এবং যাহা এখনও জমিবে, তাহা লইয়া তুমি কি করিবে?
চাকর। টাকা লইয়া আর কি করিব? যদি আমার সন্তানাদি হয়, তাহার জন্য খরচ হইবে। আর যাহা বাঁচিবে, আমার সন্তানের থাকিবে।
আমি। আচ্ছা, তুমি এই খুন সম্বন্ধে কি জান?
চাকর। যা জানি, সমস্তই বাবুকে বলিয়াছি। আমি নিতান্ত বারণ করিলেও জোর করিয়া আমার হাত হ’তে মদের বোতল লইয়া শেষবার মদ খাইয়া যখন বাবু অচেতন হইয়া শুইয়া পড়িলেন, আমি তখন তাঁহাকে ভাল করিয়া শোয়াইয়া বাতাস দিয়া, ঘরে দরজাবন্ধ করিয়া চলিয়া আসি। কিন্তু ভোরের সময়ও গিয়া বাবুকে সেই অবস্থাতেই দেখি। ডাকাডাকিতে না উঠাতে সকলে বলে, মারা গিয়াছে। তাই আমি থানায় গিয়া সংবাদ দিয়া আসি।
এই বলিয়া চাকরটি অজস্র অশ্রুপাত করিতে লাগিল। আমি আর তখন তাহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না।
তৎপরে উক্ত চাকরের স্ত্রীকে ডাকাইলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি এখানে কি কর?”
চাকর-স্ত্রী। চাকরী করি।
আমি। কে তোমাকে এখানে আনিয়াছে?
চাকর-স্ত্রী। আমার স্বামী I
আমি। তুমি এখানে কতদিন আসিয়াছ?
চাকর-স্ত্রী। প্রায় আট দশ বৎসর।
আমি। তোমার বাড়ী কোথায়?
চাকর-স্ত্রী। খরসরাই বেগমপুর!
আমি। দেশে তোমার কে আছে?
চাকর-স্ত্রী। এখন আমাদের কেহ নাই।
আমি। এই বাড়ীর খুনের বিষয় তুমি কি জান?
চাকর-স্ত্রী। আমি কিছুই জানি না।
আমি। তুমি এ বাড়ীতে ছিলে না?
চাকর-স্ত্রী। বিবাহের সময় ছিলাম। বিবাহ শেষ হইলে বাড়ী চলিয়া যাই।
আমি। তোমাদের বাড়ী কোথায়?
চাকর-স্ত্রী। বাবুর পুরাতন বাড়ী, যেখানে বাবুর মা-ঠাকরুণ আছেন।
আমি। সে কোথায়?
চাকর-স্ত্রী। এই কাছেই।
আমি। তোমার বাবু যে মরিয়া গিয়াছেন, সে খবর কোথায় পাইলে?
চাকর-স্ত্রী। একজন চাকর গিয়া গিন্নি ঠাকুরুণকে খবর করে, তা’তেই জানতে পারি।
আমি। তারপর তোমরা কি কর?
চাকর-স্ত্রী। তার পর গিন্নি-ঠাকুরুণের সঙ্গে কাঁদতে কাঁদতে এইখানে আসি।
আমি। আসিয়া কি দেখ?
চাকর-স্ত্রী। বাবু শুইয়া যেন ঘুমাইতেছেন।
আমি। তখন সে ঘরে আর কে ছিল?
চাকর-স্ত্রী। আমার স্বামী, আর একজন নূতন চাকর, আর বাবুর শ্বশুর বাড়ীর কয়জন পুরুষ ও স্ত্রীলোক।
আমি। তুমি তাদের সকলকে চিন?
চাকর-স্ত্রী। আমি তাদের কাকেও জানি না।
আমি। কালরাত্রিতে তোমার স্বামী কোথায় শুইয়াছিল?
চাকর-স্ত্রী। জানি না।
আমি। অন্য দিন রাত্রিকালে কোথায় শয়ন করে?
চাকর-স্ত্রী। আমার নিকট।
আমি। কাল তোমার নিকট যায় নাই কেন?
চাকর-স্ত্রী। বোধ হয় বিবাহের গোলযোগে।
আমি। কনে কোথায়?
চাকর-স্ত্রী। শুনিতেছি, পলাইয়া গিয়াছে।
আমি। তুমি তাহাকে দেখ নাই?
চাকর-স্ত্রী। দেখিয়াছিলাম। বিবাহের পর সে সকলের সাক্ষাতে বলে যে, আমাদের বাবু তাহাকে জোর করিয়া বিবাহ করিয়াছে। সেইজন্য সে বাবুর কাছে থাকিবে না, বাবুকে জব্দ করিবে।
আমি। একথা তোমাকে কে বলিল?
চাকর-স্ত্রী। আমি নিজের কাণে শুনিয়াছি।
আমি। তুমি তখন কোথায় ছিলে?
চাকর-স্ত্রী। এই বাড়ীর অন্দরের ঘরে, যে ঘরের বাহিরের দিকে দাঁড়াইয়া কনে সকলকে ডাকিয়া বলিয়াছিল।
আমি। তবে যে তুমি বলিলে, বিবাহের পর বাড়ী চলিয়া গিয়াছিলে?
চাকর-স্ত্রী। বিবাহের পর ঐ কথা হয়, তাহাতেই অনেকে চলিয়া যান, আমরাও তাহার পর চলিয়া যাই।
আমি। তোমরা চলিয়া গেলে, এ বাড়ীতে কাহারা ছিল?
চাকর-স্ত্রী। তাহা জানি না।
আমি। কাহার উপর তোমার এই খুনের সন্দেহ হয়?
চাকর-স্ত্রী। তাহা কেমন করিয়া বলিব? তবে যখন কনে নিজে সকলের সাক্ষাতে শাসাইয়াছিল ও পরিশেষে পলাইয়া গিয়াছে, তখন সেই খুন করিয়াছে বলিয়া বোধ হয়। আমি ত আর দেখি নাই।
আমি। তোমরা যখন বাড়ী গিয়াছিলে, তখন তোমাদের বাবু কি করিতেছিলেন?
চাকর-স্ত্রী। আমি দেখি নাই। শুনিয়াছি, বাবু রাগে দুঃখে মদ খাইতেছিলেন।
আমি। কে বলিয়াছিল?
চাকর-স্ত্রী। আমার স্বামী। সেইজন্য গিন্নি ঠাকরুণ আমাকে বাড়ী যাইতে বলেন।
আমি। তোমার বাবু কি মদ খান?
চাকর-স্ত্রী। খুব খান। এক এক দিন বন্ধু-বান্ধবে মিলিয়া খুব মদ খান!
আমি। বন্ধু-বান্ধব কি এই পাড়ার, না বাহিরের?
চাকর-স্ত্রী। তা অত জানি না।
আমি। তোমার বাবুর শ্বশুরবাড়ীর কেহ ঐরূপ বন্ধু আছেন?
চাকর-স্ত্রী। তাহা জানি না।
চাকরের স্ত্রীর জবানবন্দী এইখানেই শেষ হইল। তাহার পর সেই বাড়ীতে যে যে উপস্থিত ছিল, একে একে সকলকেই প্রায় ডাকাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, সকলেই এক প্রকার উত্তর দিল।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
এই স্থানে হত ব্যক্তির একটু পরিচয় দিবার আবশ্যক হইয়াছে। হতব্যক্তির নাম অভয়াচরণ ঘোষ, ইনি জাতিতে কায়স্থ। ইঁহার পিতার নাম মধুসূদন ঘোষ, তেজারতি কারবার করিয়া ইনি বিস্তর অর্থ উপার্জ্জন করেন। এই কলিকাতা সহরে ইঁহার কয়েকখানি ভাড়াটীয়া বাঢ়ী আছে। মধুসূদন নিতান্ত অকালে, প্রায় ত্রিশ বৎসর বয়সে মৃত্যুগ্রাসে পতিত হন। ইনি মৃত্যুর পূর্ব্বে ইঁহার স্ত্রীর নামে কয়েকখানি কোম্পানীর কাগজ ক্রয় করিয়া রাখিয়া যান। অভয়াচরণ মধুসূদনের একমাত্র সন্তান। পিতার মৃত্যুর পর মাতার আদরে, যত্নে অভয়াচরণ লালিত পালিত ও বৰ্দ্ধিত হইয়াছিলেন। অভয়াচরণের লেখাপড়া তত ভাল হয় নাই, তবে ইনি বড়ই চতুর ও বুদ্ধিমান ছিলেন।
অভয়াচরণ কোন প্রকার চাক্রী বা কাজকর্ম্ম কিছুই করিতেন না। পিতৃপরিত্যক্ত ভাড়াটীয়া বাটী কয়খানির জোরে এবং মাতার নামে কয়খানি কোম্পানীর কাগজের দৌলতে আজন্ম আদর-বর্দ্ধিত অভয়াকে খাটিয়া নিজের জীবিকানির্ব্বাহ করিতে হয় নাই। তাঁহার সংসারে ভাড়ায় ও সুদে যাহা আদায় হইত, তাহার দ্বারা বেশ স্বচ্ছলে সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ হইত। পরিবারের মধ্যে বাটীতে আর কেহই ছিল না; আত্মীয় স্বজন ত বাটীতে কেহই নাই, কেবল দুইজন চাকর, একজন দ্বারবান, একজন দাসী ও একজন রাঁধনী ছিল।
কলিকাতা সহর জুড়িয়া অভয়ার অনেক বন্ধু-বান্ধব ছিলেন। তাঁহাদের বাটীতে অভয়া প্রায়ই যাতায়াত করিতেন। ঐ সকলের মধ্যে কতকগুলি বাড়ীতে অন্দরমহল পর্যন্ত তাঁহার প্রবেশাধিকার ছিল। সেই সকল বাটীর পুরুষদিগের অপেক্ষা স্ত্রীলোকের সহিত হৃদ্যতা বড় বেশী ছিল।
অভয়াচরণ এত বয়স পর্যন্ত অবিবাহিত ছিলেন। অনেক স্থান হইতে অনেকবার সম্বন্ধ আসিয়াছিল, কিন্তু কোন স্থানেই অভয়া বিবাহ করিতে সম্মত হন নাই। তাহার কারণ অভয়া প্রকাশ করেন নাই; সংসারের একমাত্র অভিভাবক মাতাঠাকুরাণীও সে বিষয়ে জেদাজেদি করেন নাই।
বহুবাজারের জগজ্জ্যোতি সরকার নামে এক ব্যক্তির সহিত অভয়াচরণের বড়ই আত্মীয়তা ছিল। ইঁহার বাটীতে অভয়াচরণের একাধিপত্য ছিল, অন্দর বাহির কোন স্থানেই অভয়ার যাইবার বাধা ছিল না। জগজ্জ্যোতি বাবু বয়সে বড় হইলেও অভয়াকে আত্মীয় বন্ধুর ন্যায় দেখিতেন। জগজ্জ্যোতিবাবুর অবর্তমানে অভয়া যখন-তখন তাঁহার বাড়ীতে উপস্থিত হইয়া জগজ্জ্যোতিবাবুর উপযুক্ত অবিবাহিতা কন্যার সহিত হাস্য-কৌতুক আমোদ-বিদ্রূপ করিতেন, ইহাতে কেহই কিছুই বলিতেন না।
সিমলার বাবু বিমলশশী মিত্রের সহিতও অভয়াচরণের ঐ রূপ আত্মীয়তা ছিল। বিমলশশীবাবুও অভয়ার অপেক্ষা বয়সে জ্যেষ্ঠ ছিলেন। তবে তিনি অভয়াচরণের একজন দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়। সুতরাং স্বভাবতই অভয়া বিমলবাবুর বাটীর আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার নিকট বিমুক্ত আত্মীয়-বন্ধুত্ব লাভ করিয়াছিলেন। বিশেষতঃ অভয়াচরণ নিতান্ত আমোদপ্রিয়, সদালাপী এবং মিশ্রপ্রবণ অর্থাৎ সকলের সহিত মিলিতে মিশিতে বড়ই দক্ষ ছিলেন। বিমলবাবুর বাটীর ভিতর গিয়া অভয়া স্ত্রীলোকদিগের সহিত রঙ্গরস করিতে ছাড়িতেন না। তবে জগজ্জ্যোতিবাবুর বাটীর মত এখানে এ পর্যন্ত সেরূপ অবাধ আনন্দ-উচ্ছ্বাস ছিল না। জগজ্জ্যোতিবাবুর কন্যার মত বিমলবাবুর কন্যার সহিত সেরূপ ভাব ছিল না, বিমলবাবুর স্ত্রীর সহিতও সেরূপ মেশামেশি ছিল না। কিন্তু বিমলবাবুর একজন বিধবা শ্যালিকা তাঁহার বাটীতেই থাকিতেন; তাহার সহিত অভয়ার বেশ হৃদ্যতা ছিল। ইনি বালবিধবা, ইঁহার নাম কুসুমকুমারী; ইনি অনেক দিবস হইতে বিমলবাবুর সংসারে বাস করিতেছেন। কুসুমকুমারী অভয়াকে বড় স্নেহ করেন এবং তাঁহার সহিত অন্তরঙ্গ বন্ধুর ন্যায় ব্যবহার করেন।
বিমলবাবু অতিশয় সদাশয় ব্যক্তি ছিলেন। সাধ্যমত পরের উপকার করিয়া থাকেন। তাঁহার অবস্থাও নিতান্ত মন্দ নহে। তাঁহার সংসারে স্ত্রীলোকের মধ্যে তাঁহার স্ত্রী, বিধবা শালী এবং অনুঢ়া একটি কন্যা ভিন্ন অপর একটি কন্যাও প্রতিপালিতা হইত। এটি তাঁহার কন্যার প্রায় সমবয়স্কা— কন্যার অপেক্ষা দুই এক বৎসরের বড়। ইনি বিমলবাবুর আত্মীয় কেহ নহেন। তবে এই কন্যার পিতা মাতা বা আত্মীয় স্বজন কেহ না থাকাতে বিমলবাবুর একজন আত্মীয় কন্যাটিকে বিমল বাবুর আশ্রয়ে রাখিবার জন্য বিমলবাবুকে অনুরোধ করিয়াছিলেন; তাহাতে পরোপকারী দয়াদ্রচিত্ত বিমলবাবু কর্তব্য জ্ঞানে আহ্লাদের সহিত তাঁহার আত্মীয়ের অনুরোধ রক্ষা করেন এবং কন্যাকে নিজ কন্যার ন্যায় এতাবৎ পালন করিয়া আসিতেছেন। এই কন্যাটির নাম সারদাসুন্দরী।
সারদাসুন্দরী যখন উদ্ভিন্ন কুসুমকলিকার মত যৌবনসমাগমে রূপ-গরিমায় উদ্ভাসিত বপু লইয়া, সূর্য্যের অগ্রগামী দূত অরুণের ন্যায় আগত যৌবনের রক্তিমাভ বরণ-জ্যোতি লইয়া, বাটির মধ্যে বিচরণ করিয়া অজ্ঞাতে— অদৃষ্টে অবরোধের ভিতরে স্ত্রীজাতির পূর্ণাবয়ব, পূর্ণসৌন্দর্য্য, পূর্ণপ্রভা প্রকাশ করিত এবং স্ত্রী-পুরুষ সকলেরই মনোহরণ করিত, সেই সময় একদিন হঠাৎ তখনকার সৌভাগ্যবান, কিন্তু এখনকার দুর্ভাগ্যবান, অভয়াচরণ সেই রূপমোহে একবারে মুগ্ধ হইয়া যান। একে যৌবনের দোর্দণ্ড প্রতাপ, তাহাতে মাথার উপর শাসনের লোক কেহই নাই, অপিচ নাচাইবার লোক অনেক আছে, এরূপ অবস্থায় যাহা হইবার তাহাই হইল; কুল, শীল, মান, বংশ মর্য্যাদা দেখিবার সময় হইল না, স্বভাব-চরিত্র অনুসন্ধানের অপেক্ষা রহিল না, কাহারও মতামতের উপর নির্ভর করিবার আবশ্যকতা হইল না, নিজের মতেই অভয়াচরণ সারদাসুন্দরীকে বিবাহ করিবার জন্য মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইলেন। কিছুদিন নিঃশব্দে থাকিয়া, নীরবে সারদার রূপরাশির মোহজালে জড়িত হইয়া, একদিন মনের আবেগে স্থির থাকিতে না পারিয়া, অভয়া বলিয়া ফেলিল, “সারদার সহিত আমার বিবাহ দিতেই হইবে।” কুসুমকুমারী এ প্রস্তাবে তৎক্ষণাৎ অনুমোদন করিল; কিন্তু যাহার সহিত সম্বন্ধ, সে সম্মত হইল না— সারদাসুন্দরী বিবাহে একান্ত নারাজ।
কন্যা বিবাহে নারাজ, কিন্তু বর প্রাণপণে বিবাহ-মিলনের জন্য চেষ্টা করিতে লাগিলেন। যখন দেখিলেন, অনুনয়-বিনয়, সাধ্যসাধনায় কোনও ফল দর্শিল না, তখন কৌশলে বলপ্রয়োগে উদ্যোগী হইলেন। কিন্তু বলপ্রয়োগে কি প্রণয়লাভ হয়? তাহার ফল যাহা হইয়া থাকে, তাহাই হইল!
এই বিবাহ-সম্মতির প্রধান সহায় বিমলশশী বাবুর শ্যালী কুসুমকুমারী। এ বিবাহ-সংমিলনে তাহার যে কি স্বার্থ বা ইষ্ট আছে, তাহা কেহই জানে না; আমরাও বুঝিতে পারি নাই। কিন্তু সে এ বিবাহে বড়ই আনন্দিত।
অভয়াচরণের আরও কয়েকটি আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব ছিলেন, তাঁহাদের সহিত উপস্থিত ঘটনার কোন সম্পর্ক নাই। তবে উপেন্দ্রমোহন বসু নামক এক ব্যক্তির সহিত অভয়ার বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। উপেন্দ্র অভয়ার “এক গ্ল্যাসের ইয়ার।” অভয়াচরণের সহিত বহুবাজারের জগজ্জ্যোতি সরকারের আলাপ-পরিচয়ের মধ্যবর্তী এই উপেন্দ্রমোহন বসু।
মাদক-সেবনে অভয়ার কোন দিন ফাঁক পড়িত না; হয় নিজের বাড়ী, নয় বন্ধু-বান্ধবের বাড়ী, কোন না কোন স্থানে তাহা হইতই হইত। তবে রাস্তায় বা কোন প্রকাশ্য স্থানে কখন ঢলাঢলি হইত না, বাড়ীর ভিতরেই তাহা আবদ্ধ থাকিত।
অভয়ার মাতা অভয়ার এরূপ উচ্ছৃঙ্খলতা দেখিয়া বড় কিছু বলিতে পারিতেন না; কারণ কখন কিছু বলিলে, অভয়াচরণ নানাপ্রকার ভয় প্রদর্শনে মাতাকে নিরস্ত করিতেন। মাতা ভাবিতেন, “আমার একমাত্র পুত্র, যাহা ইচ্ছা, তাহাই করুক। আর উহার জীবনে ত কখন কষ্ট হইবে না; কারণ বিষয়ের আয় যাহা আছে, তাহাতেই ভালরূপে সংসার চলিবে।” অধিকন্তু মাতার হস্তে অলঙ্কার ও নগদ টাকাদি বিস্তর ছিল। অভয়া কিন্তু সে টাকার উপর কখনও লোভ করেন নাই। তবে মাতার অনুমতি লইয়া পৈতৃক বসতি-বাটীর নিকট একটি বাড়ী সম্প্রতি ক্রয় করিয়াছিল। এই বাটীতেই বক্ষ্যমাণ ঘটনা হইয়া গিয়াছে, সারদার সহিত অভয়ার কাল-বিবাহ হইয়া গিয়াছে!
অভয়ার সহিত যেমন অনেক ভদ্র মৰ্য্যাদাশালী বিত্তবান লোকের সহিত সৌহার্দ্য ছিল, তেমনি কতকগুলি বদমায়েস জুয়াচোর লোকের সহিতও আলাপ পরিচয় ছিল। তাহার পরিচয় পাঠক ইতিপূর্ব্বেই কিঞ্চিৎ পাইয়াছেন।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
পূর্ব্ব-পরিচ্ছেদ-বর্ণিত অভয়াচরণের পূর্ব্ব-কাহিনীর বিষয় শুনিয়া উপস্থিত ঘটনার সম্যক নিরাকরণ করিতে সমর্থ হইলাম না। নানাবিষয়ে আমার সন্দেহ হইতে লাগিল। সারদাসুন্দরী ভদ্র গৃহস্থের কন্যা হইয়া খুন করিতে সাহসী হইল, ইহা অতীব আশ্চর্য্যের কথা! আবার কি উপায়েই বা খুন করিল? হতব্যক্তির শরীরে ত কোন অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন নাই। তবে কি বিষপ্রয়োগেই হত্যাকাৰ্য্য সাধিত হইয়াছে? যাহা হউক, করোণার কোর্টের বিচার পৰ্য্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করিতে হইবে।
বিমলশশীবাবুর কন্যা শ্রীমতী জ্যোৎস্নাবালা মিত্র আমাদের খুনী আসামীর শৈশব-সহচরী এবং হৃদয়ের বন্ধু। নূতন বাটীতে সারদাসুন্দরী কেবলমাত্র এই জ্যোৎস্নার সহিতই বিবাহের দুই তিন দিবস পূর্ব্ব হইতে বাস করিতেছিল। সারদাসুন্দরীর বিষয় অনেক অধিক জানিতে পারিব ভাবিয়া এখন আমি জ্যোৎস্নাকে ডাকাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমার সহিত সারদাসুন্দরীর আলাপ পরিচয় কত দিন হইতে?”
জ্যোৎস্না। অতি শিশুকাল হইতে আমরা উভয়ে আমাদের বাড়ীতে একত্র বাস করিয়া আসিতেছি। সারদা যদিও আমা অপেক্ষা দুই তিন বৎসরের বড়, তথাপি আমাদের সমবয়স্কের মত পরস্পরের বন্ধুত্ব ছিল
আমি। সারদার সহিত তোমার সম্বন্ধ কি?
জ্যোৎ। সম্বন্ধ এমন কিছুই নাই। বাবার একজন আত্মীয় সারদাকে অতি শৈশব অবস্থা হইতে আমাদের বাটীতে রাখিয়া দেন। সারদার মা, বাপ, ভাই, বন্ধু কেহই নাই।
আমি। তাহার স্বভাব-চরিত্র কিরূপ?
জ্যোৎ। স্বভাব অতি নম্র। সে অতি মিষ্টভাষী ও গুরুজন অনুগামিনী ছিল। বাড়ীর সকলের সহিতই অতি সদ্ব্যবহার করিত।
আমি। আর কাহারও সহিত তাহার বিবাহ সম্বন্ধ হইয়াছিল?
জ্যোৎ। অপর কয়েক স্থানে সম্বন্ধ হইয়াছিল। আমার পিতার সহিত সে সব কথাবার্তা হইয়াছিল। শুনিয়াছি, পাত্র মনোনীত না হওয়াতে সম্বন্ধ স্থিরীকৃত হয় নাই।
আমি। উপস্থিত বিবাহ-সম্বন্ধও তোমার পিতার সম্মতি অনুসারে হইয়াছিল?
জ্যোৎ। না, মাসিমার অনেক উপরোধে বাবা সম্মত হইয়াছিলেন বটে; কিন্তু বাবা ইহাতে উদ্যোগীও ছিলেন না, আর আন্তরিক অনুমোদনও করেন নাই।
আমি। এত বয়স হইয়াছিল, এখন পৰ্য্যন্ত বিবাহ না হইবার কারণ কি?
জ্যোৎ। বাবার মতে— বেশী বয়সে বিবাহ হওয়া যুক্তিসম্মত বলিয়া।
আমি। আচ্ছা, আমি জিজ্ঞাসা করিতেছি, তুমি সত্য গোপন না করিয়া অকপটে উত্তর দাও দেখি; তাহাতে হয় ত তোমার সঙ্গিনী নির্দোষ প্রমাণিত হইলেও হইতে পারে। অন্য কাহারও সহিত চাক্ষুষ আলাপ পরিচয় হইয়া তাহাদের পরস্পরের মনের মিল হইয়াছিল কি না? আর তাহাদের মধ্যে বিবাহের কথা ভিতরে ভিতরে স্থির হইয়াছিল, অথবা হইবার সম্ভাবনা ছিল কি না?
জ্যোৎ। সারদাসুন্দরী বড় বাটীর বাহির হইত না যে, অপর কাহারও দৃষ্টিপথে পতিত হইবে। কিম্বা তাহার এমন স্বভাব ছিল না যে, কোন পুরুষের সহিত সে কথাবার্তা কহিবে বা মিশিতে যাইবে; এমন কি, কোন পুরুষ তাহাকে দেখিতেই পাইত না। আমরা বরং আমাদের বাটীতে আগত পুরুষের নিকট ততদূর লজ্জা প্রকাশ করিতাম না, যতদূর সারদা করিত।
আমি। তবে অভয়াচরণ কিরূপে তাহাকে বিবাহ করিতে এত উন্মত্ত হইল?
জ্যোৎ। অভয়াবাবু আমাদের বাড়ীতে কখন কখন আসিতেন। তিনি নিজেই সারদাকে বিবাহ করিতে উৎসুক হন এবং মাসি-মার নিকট অনেক অনুরোধ অনুনয় করাতে এই বিবাহ সম্বন্ধ স্থির হয়। কিন্তু ইহাতে সারদার একটুমাত্র ইচ্ছা ছিল না; তাহাকে জোর করিয়া একার্য্যে সম্মত করা হইয়াছিল।
আমি। সারদা বয়স্থা, হিন্দুর কন্যা। উপযুক্ত সময়ে যখন পুরুষ যাচিয়া তাহাকে বিবাহ করিতে চাহিয়াছিল, তখন কেন সে তাহাতে আন্তরিক অসম্মত ছিল?
জ্যোৎ। সারদা মদ্যপায়ী কুপথগামীকে দেখিয়া ভয় ও ঘৃণা করিত। সেইজন্য অভয়ার সহিত বিবাহে সে সম্মত ছিল না।
আমি। সারদা লেখাপড়া জানিত?
জ্যোৎ। জানিত।
আমি। সে কোন পুরুষকে কখন চিঠিপত্র লিখিত, এরূপ দেখিয়াছ?
জ্যোৎ। সারদা লিখিতে ভাল পারিত না। সে এ পর্য্যন্ত কোন চিঠি লিখিয়াছে, তাহা দেখি নাই। তবে সে বই পড়িতে বেশ পারিত।
আমি। তোমাদের যে আত্মীয় ব্যক্তি সারদাকে তোমাদের বাটীতে রাখিয়া গিয়াছিলেন, তিনি কখন সারদাকে দেখিতে আসিতেন?
জ্যোৎ। তিনি কখন কখন আমাদের বাটীতে আসেন বটে; কিন্তু সারদার উপর তাঁহার সেরূপ টান নাই। সারদার জনাই যে তিনি আমাদের বাড়ীতে আসেন, তাহা বোধ হয় না; তিনি আমাদের আত্মীয় বলিয়াই আমাদের বাড়ীতে আসেন।
আমি। তাঁহার বাটী কোথায়?
জ্যোৎ। তাঁহার বাটী মজিলপুর, জয়নগর। তিনি হুগলীতে চাকরি করেন বলিয়া হুগলীতেই থাকেন।
আমি। তাঁহার নাম কি?
জ্যোৎ। বাবু রামতনু ঘোষ।
আমি। আচ্ছা, সারদা বাটী হইতে পলায়ন করিবার সময় তোমার সহিত বা অন্য কাহারও সহিত দেখা করিয়াছিল?
জ্যোৎ। না। কখন যে গিয়াছিল, তাহা কেহই জানে না।
আমি। তোমার সহিত শেষ কখন দেখা হইয়াছিল?
জ্যোৎ। বিবাহের ঠিক পূর্ব্বে
আমি। তখন তোমার সহিত কোন কথাবার্তা হইয়াছিল?
জ্যোৎ। না।
আমি। এই বিবাহে সে যে সম্পূর্ণ অসম্মত, তাহা কখনও সে তোমার সাক্ষাতে বলিয়াছিল?
জ্যোৎ। না, তাহা বলে নাই। এমন কি, তাহাকে যে জোর করিয়া ইহাতে সম্মত করা হইয়াছিল, তাহাও আমাকে বলে নাই। বিবাহের পর সেই রাত্রিতে যখন সকলের সাক্ষাতে সে কথা প্রকাশ করে, আমি তখনই শুনিয়াছিলাম। সারদা বিবাহের পূর্ব্বে কয়দিবস কাহারও সহিত বড় কথা কহিত না এবং সর্ব্বদাই বিমর্য ও অন্যমনস্কভাবে থাকিত। মাসি-মার একান্ত আগ্রহেই এই বিবাহ স্থির হইয়াছে বলিয়া আমরা কিছু বলিতে সাহসী হই নাই। বিশেষতঃ সারদা এ বিষয়ে পূর্ব্বে আমাকে কিছু না বলাতে আমিও কিছু বলিতে সাহস করি নাই।
আমি। এতৎসত্ত্বেও তুমি সারদাকে নিৰ্দ্দোর্য কেমন করিয়া বলিবে? সে এতদিন মনে মনে স্থির করিতেছিল, কেমন করিয়া এই হত্যাকাণ্ড সমাধা করিবে। সেইজন্য কাহারও সঙ্গে কথা কহিত না, সর্ব্বদা বিমর্ষভাবে থাকিত।
জ্যোৎ। আমি নিশ্চয় বলিতে পারি, সারদার অভিপ্রায় কখনই খুনের পথে যাইবে না। আর আমি একত্রে তাহার সহিত এতদিন বাস করিয়া, তাহার সহিত ব্যবহার করিয়া, তাহার যেরূপ স্বভাব বুঝিয়াছি, তাহাতে আমার কোনমতেই বিশ্বাস হইবে না যে, সে হত্যা কিম্বা এইরূপ কোন ভয়ানক দুঃসাহসিক নিষ্ঠুর কার্য্যে ইচ্ছাও করিবে— সম্পন্ন করা ত দূরের কথা! তবে যে সেদিন রাত্রিতে অভয়াচরণবাবুকে প্রতিফল দিবে বলিয়া ভয় প্রদর্শন করিয়াছিল, তাহার তার্থ আমার এইরূপ বোধ হয় যে, যেমন তিনি তাহাকে বলপূর্ব্বক বিবাহে সম্মত করাইয়াছেন, সেইরূপ তাঁহার সেই আশা – সারদার সহিত বৈবাহিকসূত্রে স্ত্রী-সম্বন্ধে আবদ্ধ হইয়া একত্র সহবাস আশা—সমূলে বিনাশ করিবে, – প্রাণবধ করিয়া নহে— পরস্পর জন্মের মত বিচ্ছিন্ন হইয়া। সেইজন্যই সারদা, বোধ হয়, দেশত্যাগিনী হইয়া সকলের চক্ষুর অন্তরাল হইয়াছে। সে যে স্বভাবের স্ত্রীলোক, তাহাতে বরং নিজ জীবন বিসর্জ্জন তাহার পক্ষে সম্ভব, কিন্তু পর প্রাণে হিংসা করিতে সে কখনই পারিবে না।
আমি। তুমিই তাহাকে নির্দোষ বলিতেছ; কিন্তু অন্যান্য সকলেরই ধারণা যে, সে ভিন্ন অন্য কেহই এই হত্যাকাৰ্য্য করে নাই। বিশেষতঃ যেরূপ পরস্পর ঘটনা ঘটিয়াছে এবং নিজমুখে সারদা যে সকল কথা সকলের সাক্ষাতে প্রকাশ করিয়া বলিয়াছে, তাহাতে স্বতঃই প্রমাণিত হয় যে, সে হত্যা করিয়া পলায়ন করিয়াছে।
জ্যোৎ। যে যাহাই বলুক, আমি তাহাতে বিশ্বাস করি না। আপনি ত এ বিষয়ে অনুসন্ধান করিতেছেন, আপনিও কিছুদিন পরে বুঝিতে পারিবেন যে, সারদা নির্দোষ। তাহার সহিত আমার অত্যন্ত ভালবাসা বলিয়া আমি একথা বলি না; তাহার প্রকৃতি বুঝি বলিয়াই এই কথা বলিতেছি।
আমি তখন আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবার আবশ্যকতা দেখিলাম না; সুতরাং চলিয়া আসিলাম।
যথাসময়ে করোণারের রিপোর্ট প্রকাশিত হইল। সমস্ত জুরী একবাক্যে সাব্যস্ত করিলেন যে, অভয়াচরণ সারদাসুন্দরীর দ্বারাই হত হইয়াছে।
কেমিকেল একজামিনার সেই প্রেরিত গ্লাস, বোতলের জলীয় পদার্থ পরীক্ষা করিয়া রিপোর্ট দিলেন, তাহাতে যে মদ্য আছে, তাহা বিষাক্ত নহে, তবে তেজস্কর মদ্য।
লাস পরীক্ষায় ডাক্তার মন্তব্য করিলেন যে, কোন সূচিবৎ সূক্ষ্ম অস্ত্র দ্বারা মস্তকের শিরা আহত হওয়াতেই হতব্যক্তির মৃত্যু সংঘটিত হইয়াছে।
এই শেষ মন্তব্যে আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। এ নূতন উপায়ে খুন কে করিল? কোন পরিপক খুনে-লোক ভিন্ন এ কার্য্য কাহার? হিন্দু গৃহস্থের কন্যা হইয়া একার্য্যে সে কিরূপে সিদ্ধহস্ত হইল?
এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে সেদিন অতিবাহিত হইল। নূতন সমস্যায় পড়িয়া অনুসন্ধানের পথ নির্ণয় করিতে পারিলাম না। সে দিন তখন উক্ত বিষয় লইয়া আর মাথা বকাইলাম না। আস্তে আস্তে শয়ন করিয়া নিদ্রিত হইয়া পড়িলাম।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পরদিন পুনর্ব্বার বিমলশশীবাবুর বাড়ী গিয়া উপস্থিত হইলাম। পুনর্ব্বার জ্যোৎস্নাবালাকে ডাকাইয়া বলিলাম, “তোমার সখির নির্দোষতার প্রমাণ কিছুই পাইতেছি না; সকল ঘটনাই তাহার দোষ সাব্যস্ত করিতেছে; কিন্তু আমার মনে কিছুতেই লইতেছে না যে, সে খুন করিয়াছে, অথচ কোন উপায়েই তাহার প্রমাণ আবিষ্কার করিতে পারিতেছি না! তুমি সে বিষয়ে আমাকে কোন প্রমাণ দেখাইতে পার?”
জ্যোৎস্না। প্রমাণ দেখাইতে পারি না বটে, কিন্তু ইহা আমি নিশ্চয় বলিতে পারি যে, সে খুন কোনমতেই করে নাই।
আমি। তবে কাহার উপর এই খুনের সন্দেহ হয়?
জ্যোৎ। সন্দেহ করিবার লোকও ত দেখিতে পাইতেছি না। আমার বোধ হয়, বাহিরের কোন লোকের দ্বারা ইহা হইয়াছে।
আমি। কিরূপে বাহিরের লোক আসিয়া করিতে পারিবে? চাকরেরা বলিয়াছে যে, রাত্রিতে বাড়ীর সমস্ত দ্বার বদ্ধ ছিল। পরদিন প্রাতঃকালে তাহারা যে সকল দ্বার খুলিয়াছে। বাহিরের লোক একার্য্য করিলে দ্বার খুলিয়া রাখিয়া বাহিরে যাইত।
জ্যোৎ। হয়ত উপর দিয়া কোন লোক আসিয়া এই কাজ করিয়া যাইতে পারে।
এই কথায় হঠাৎ আমার একটা কথা মনে পড়িয়া গেল। যে দিন তন্ন তন্ন করিয়া বাটী অনুসন্ধান করিয়াছিলাম, সে দিন দেখিয়াছিলাম যে, সিঁড়ির উপরের দ্বার বন্ধ ছিল না। চাকরকে জিজ্ঞাসা করাতে বলিয়াছিল যে, সে দ্বার কখন কেহ বন্ধ করে না। আমার একটু সন্দেহ হইয়াছিল; কিন্তু নিকটবর্তী কোন বাটীর ছাদের সহিত যখন এই বাটীর ছাদের মেশামেশি নাই, এ বাটীর ছাদের চারি পার্শ্বে উচ্চ প্রাচীর আছে— ইহা যখন দেখিয়াছিলাম, তখন সে সন্দেহ মনে অধিকক্ষণ স্থায়ী হয় নাই। কিন্তু এক্ষণে জ্যোৎস্নার কথায় পুনর্ব্বার সেই সন্দেহের উদয় হইল। তখন আগ্রহ সহকারে জ্যোৎস্নাকে পুনর্ব্বার কহিলাম, “আমি আর একবার সেই ছাদ দেখিয়া আসিব।”
বলা বাহুল্য, তৎক্ষণাৎ আমি অভয়াচরণের বাটীতে যাইয়া উপরে উঠিয়া আর একবার ছাদের চতুর্দিক নিরীক্ষণ করিলাম। কিন্তু উপর হইতে যে কোন লোক এই বাটীতে প্রবেশ করিয়াছিল, তাহার চিহ্ন দেখিতে পাইলাম না। কিন্তু মনে যখন একবার সন্দেহ আসিয়াছে, তখন মনে হইল যে, কোন লোক পার্শ্বস্থ বাড়ীর ছাদ হইতে কোনরূপে ত এ বাটীতে আসিতে পারে? বিশেষত সে বাটীর ছাদ অন্যান্য বাটী অপেক্ষা কিঞ্চিৎ উচ্চ। সেখান হইতে সহজে এ বাটীর ছাদের প্রাচীরে উঠিতে পারা যায়, এরূপ বোধ হইল। এখন এই সন্দেহের বশীভূত হইয়া অনুসন্ধানের একটি নূতন পথ পাইলাম।
জ্যোৎস্না আমার সঙ্গে ছিল। নীচে নামিয়া জ্যোৎস্নাকে জিজ্ঞাসা করিলাম “এ বাটীর উত্তর পার্শ্বের বাটীতে কে থাকে? তাহার নাম কি?”
জ্যোৎস্না ইহার সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারিল না। আমি তখন হত অভয়াচরণের চাকরকে ডাকাইয়া তাহাকে ও ঐ প্রশ্ন করিলাম।
চাকর বলিল, “কে উহাতে থাকে, জানি না। এতদিন উহাতে কেহ থাকিত না; সম্প্রতি উহাতে কাহারা আসিয়া বাস করিতেছে; কিন্তু কেহই তাহার কথা বলিতে পারে না। কখন কখন স্ত্রীলোক ও পুরুষ উভয়কেই উহাতে যাইতে দেখি, আবার উহা হইতে বাহির হইতেও দেখি। তাহারা কাহারও সহিত আলাপ করে না।”
আমি। উহা কি ভাড়াটিয়া বাটী? যাহারা এখন উহাতে থাকে, তাহারা কতদিন হইল, উহা ভাড়া লইয়াছে?
চাকর। উহা ভাড়াটীয়া বাটী। আমাদের বাবুর পরিবার, যিনি বাবুকে মারিয়া ফেলিয়া নিরুদ্দেশ হইয়াছেন, তিনি এই বাটীতে আসিবার পূর্ব্বেই শুনিয়াছিলাম যে, ঐ বাড়ী একজন স্ত্রীলোক ভাড়া লইয়াছে। কিন্তু এতদিন ত কাহাকেও উহাতে থাকিতে দেখি নাই। সম্প্রতি দুই দিন হইল, উহাতে ঐরূপ লোকের সমাগম দেখিতে পাইতেছি। অদ্য আবার দেখিলাম যে, আমাদের বাবুর একজন বন্ধু উহার ভিতর প্রবেশ করিয়াছিলেন এবং কিছুক্ষণ পরে বাহির হইয়া গেলেন।
আমি। তোমার বাবুর সে বন্ধুর নাম কি?
চাকর। তাঁহার নাম উপেন্দ্রবাবু। বহুবাজার অঞ্চলে তিনি থাকেন। বাবু থাকিতে প্রায়ই তিনি বাবুর বাটীতে আসিতেন, আর বাবুর সহিত একত্র বসিয়া মদ খাইতেন।
আমি। বহুবাজারের কোথায় বলিতে পার?
চাকর। তাহা জানি না।
আমি। আমাকে তাহাকে দেখাইয়া দিতে পার?
চাকর। এখানে আসিলে দেখাইব।
আমি। পার্শ্বের ঐ ভাড়াটীয়া বাটীটি কাহার বলিতে পার?
চাকর। উহা কাঁসাড়িপাড়ার বাবু অমরনাথ মুখুয্যের। তিনি ট্যাক্স অফিসে কাজ করেন।
চাকরকে আর আমি কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। সে চলিয়া গেল। আমি মনে মনে বলিতে লাগিলাম, একজন স্ত্রীলোক পার্শ্বের বাটী ভাড়া লইয়াছে শুনিলাম। সে স্ত্রীলোক কি বেশ্যা? কৈ, এখানে ত সে বেশ্যাবৃত্তি করিতেছে না। তবে সে কে? হয় ত তাহার বা তৎসংসৃষ্ট আর কাহারও কোন গুপ্ত অভিসন্ধি আছে।
ইহা ভাবিতে ভাবিতে আমি সে স্থান পরিত্যাগ করিয়া জোড়াসাঁকোর অমরনাথ মুখুয্যের বাটীতে গমন করিলাম। সেখানে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “মহাশয়! আপনার দর্জ্জিপাড়ায় অমুক লেনে বাটী ভাড়া দিবেন? আমি লইতে ইচ্ছা করি।”
অমর। সে বাটী ত ভাড়া হইয়া গিয়াছে।
আমি। আপনি বোধ হয় বুঝিতে পারিতেছেন না, আমি কোন্ বাটীর কথা কহিতেছি। ৪।৫ দিন পূর্ব্বে তাহা তালাবদ্ধ দেখিয়াছি, এবং সেই বাটীর সম্মুখে দেওয়ালে একখণ্ড কাগজে লেখা রহিয়াছে, “এই বাটী ভাড়া দেওয়া যাইবে।”
অমর। দরজীপাড়ায় আমার ঐ একমাত্র বাটী আছে। প্রায় মাসাধিক কাল হইল, সে বাটা একজন স্ত্রীলোক ভাড়া লইয়াছেন। আমি যে কাগজখণ্ডে ভাড়ার নোটিশ দিয়াছিলাম, তাহা ত উঠাইয়া লইয়াছি। সে স্ত্রীলোকও এক মাসের ভাড়া অগ্রিম দিয়া গিয়াছে।
আমি। সে স্ত্রীলোক কি কোন বেশ্যা?
অমর। না, বোধ হয় কোন সম্ভ্রান্ত-কুলমহিলা। বহুবাজারে তাঁহারা থাকিতেন। তাঁহার পিতা কার্য্যোপলক্ষে পশ্চিমে থাকেন, তাঁহার মাতা বা ভ্রাতা কেহই নাই। তাই বহুবাজারের বড় বাড়ী ত্যাগ করিয়া আমার ঐ বাড়ী ভাড়া লইয়াছেন।
আমার জ্ঞাতব্য বিষয় জানিতে পারিয়া আমি বলিলাম, “তবে আমি চলিলাম। অন্যত্র চেষ্টা করি।”
পথে আসিয়া চিন্তা করিলাম, বহুবাজারের জগজ্জ্যোতিবাবুর কন্যা শুনিয়াছি অভয়াচরণের প্রণয়াকাঙ্ক্ষিণী ছিল। মনে করিলাম সে ত এই বাড়ী ভাড়া লয় নাই? আশা বৈতরণী নদী! আশার অনুকূল ঘটনাগুলি যেন চক্ষুর সম্মুখেই আসিয়া পড়ে। যাহা হউক, দেখা যাক্, কতদূর কি হয়।
আমার এ অনুসন্ধানের প্রধান সহায় জ্যোৎস্না। জ্যোৎস্না ব্যতীত আর কেহই আমাকে এ অন্ধকার পথে সামান্যমাত্র আলোকও দেখাইতে পারে নাই। সেই জন্য বিমলশশীবাবুর অনুমতি লইয়া আমাকে ঘন ঘন জ্যোৎস্নার সহিত দেখা করিতে হইল। পুনর্ব্বার জ্যোৎস্নার নিকট উপস্থিত হইলাম।
জ্যোৎস্নাকে ডাকাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “শুনিয়াছি, বহুবাজারের জগজ্জ্যোতি সরকারের কন্যার সহিত অভয়াচরণের বিবাহের সম্বন্ধ হইয়াছিল। সেই কন্যাকে কি তুমি দেখিয়াছ?”
জ্যোৎ। একবার মাত্র তাহাকে দেখিয়াছিলাম। বিবাহের দুই তিন দিন পূর্ব্বে সে একবার ঐ নূতন বাটীতে আসিয়া সারদার সহিত দেখা করিয়াছিল। সেই সময় হঠাৎ তাহাকে দেখিয়াছিলাম।
আমি। সে কেন এখানে আসিয়াছিল?
জ্যোৎ। কেন আসিয়াছিল, জানি না। তখন আমি নীচের ঘরে কোন কার্য্যে ব্যস্ত ছিলাম। সে অবগুণ্ঠনবতী হইয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করে, “এ বাড়ীতে সারদাসুন্দরী আছে কি?” আমি তাহাকে বলি, “সারদা উপরে আছে। আপনার কি প্রয়োজন?” তাহাতে সে বলে যে, সারদা তাহার আত্মীয়, তাহার সহিত কোন গোপনীয় কথা আছে। আমি তাহা শুনিয়া তাহাকে সারদার গৃহ দেখাইয়া নীচে আসি। সে চলিয়া গেলে, আমি সারদাকে জিজ্ঞাসা করাতে বুঝিলাম যে, সে বহুবাজারের জগজ্জ্যোতি সরকারের কন্যা। সারদা তাহার সম্বন্ধে আর কোন কথা আমার নিকট প্রকাশ করে নাই। বিবাহের দিন সে নিমন্ত্রিত হইয়াছিল; মনে করিয়াছিলাম, সে আসিবে, পুনর্ব্বার তাহাকে ভাল করিয়া দেখিব। কিন্তু শরীর অসুস্থ হওয়াতে সে দিন আসিতে পারে নাই; সুতরাং আর আমি তাহাকে দেখিতে পাই নাই।
আমি। তাহাকে পুনর্ব্বার দেখিলে চিনিতে পারিবে?
জ্যোৎ। বোধ হয় পারিব।
আমি। সে কখন সারদাকে কোন পত্র লিখিয়াছিল, বলিতে পার?
জ্যোৎ। কৈ, তাহা আমি দেখি নাই, বা সারদাও আমাকে সে কথা বলে নাই।
আমি। সারদার অন্য কোন পত্র কিছু আছে, জান কি?
জ্যোৎ। সারদার একটি বাক্স ছিল। বোধ হয়, সেই বাক্সে তাহার পত্রাদি আছে।
আমি। সে বাক্স কোথায়?
জ্যোৎ। সে বাক্স নূতন বাটীতে লইয়া গিয়াছিল। এখনও তাহা সেইখানে আছে।
আমি পুনর্ব্বার সে বাটীতে আসিয়া সারদার বাক্স খুলিলাম। দেখিলাম, উপরেই জ্যোৎস্নার শিরোনামাঙ্কিত একখানি পত্র রহিয়াছে। তৎপরে সে বাক্সের ভিতর আরও অনেকগুলি পত্র পাইলাম। তাহার অনেকগুলি সারদার হুগলীস্থ আত্মীয়ের নিকট হইতে আসিয়াছিল। সকল পত্ৰই আমি একে একে পড়িলাম। আমাদের উপস্থিত ঘটনা সম্বন্ধের কোন পত্র দেখিলাম না। কেবল একখানি পত্র দেখিলাম, তাহাতে নাম-স্বাক্ষর নাই, স্ত্রীলোকের লেখা বলিয়া বোধ হইল। সেইখানি সন্দেহাত্মক বলিয়া তাহা লইলাম। সেখানিতে লেখা ছিল,–“সে দিন তোমার সহিত দেখা করিতে গিয়া প্রত্যাখ্যাত হইয়াছি। অতএব তুমি জানিও, তোমাকে তোমার সুখের আশায় জলাঞ্জলি দিতে হইবে। তোমার সুখের একমাত্র আশ্রয় একবারে ধরাশায়ী হইবে, ইহা নিশ্চয় জানিও।”
পত্রগুলি লইয়া আমি পুনরায় জ্যোৎস্নার নিকট আসিলাম। তাহাকে তাহার শিরোনামাঙ্কিত পত্র দিলাম। জ্যোৎস্না তাহা পাঠ করিয়া বলিল, “মহাশয়! এই দেখুন, ইহাতে যাহা লেখা আছে, তাহাতে যে সারদা নির্দোষ, তাহার প্রমাণ আছে।” এই বলিয়া সারদা-লিখিত সেই পত্রখানি জ্যোৎস্না আমাকে পড়িতে দিল!
পত্রে লেখা ছিল :
“জ্যোৎস্না!
তুমি আমার বাল্যসখী। বয়সে তুমি ছোট হইলেও, আমি তোমাকে সমবয়স্ক বন্ধুর ন্যায় দেখি। এ সংসারে তুমি ভিন্ন বাস্তবিক আর কেহ আমার আত্মীয় বান্ধব নাই। তুমি আমার হৃদয় ভালরূপে জান। আমি কাহাকেও কখন কষ্ট দিই নাই; কিন্তু আমার মনে যে কষ্ট হইয়াছে, তাহা কেহ কখন যেন ভোগ না করে। ইদানীং আমার মন অত্যন্ত খারাপ হওয়াতে আজ তোমার সহিত পর্যন্ত ভাল করিয়া কথা কহিলাম না; তজ্জন্য আমাকে ক্ষমা করিও। আমি তোমাদের নিকট অনেক বিষয়ে ঋণী। বাবাকে বলিও, এ জন্মে তোমাদের ঋণ শোধ করিতে পারিলাম না। আমার মনের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। কষ্টে আমার জন্ম হইয়াছিল; কিন্তু তোমাদের আশ্রয়ে আমি সুখ পাইয়াছিলাম। এইবার একেবারে জন্মের মত সুখের পথে কণ্টক পড়িয়াছে, আমার ইহজীবন একবারে নষ্ট হইয়া গেল। তুমি সকলই জান, আর অধিক কি বলিব? আমার সম্পূর্ণ আন্তরিক অমতে এই বিবাহ হইতে চলিল। কিন্তু ইহা ভবিতব্য; ইরাতে আমার আর কোন হাত নাই। আমার এ ঘূর্ণিত জীবন এ লোকালয়ে দেখাইবার আবশ্যকতা নাই, এ পোড়ামুখ আর কাহাকেও দেখাইব না। কিন্তু আত্মহত্যাও মহাপাপ; তা করিতেও সাহস নাই। যাহা হউক, পরদিবস আর আমাকে কেহই দেখিতে পাইবে না। দেখিবার জন্য কেহ চেষ্টাও করিও না, ইহা আমার দিব্য। তোমরা সুখে থাক, ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করি। আমার কথা পুনর্ব্বার ভাবিলে, আমার অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলে, ইহা নিশ্চয় জানিও, তাহাতে আমারই অনিষ্টসাধন করা হইবে। অতএব সে বিষয়ে নিজেও সম্পূর্ণ উদাসীন থাকিবে, আর অপরকেও উদাসীন করিতে চেষ্টা করিবে, ইহা আমার শেষ সবিনয় অনুরোধ। মনের কথা তোমায় বলিলাম। আর কেহ যেন ইহা জানিতে না পারে। ইতি—”
তখন আমি সারদা সুন্দরীর হুগলীস্থ আত্মীয়ের বাটী উদ্দেশে প্রস্থান করিলাম। সামান্য অনুসন্ধানেই রামতনু ঘোষের বাড়ী পাইলাম। রামতনুবাবুকে সমস্ত বিষয় বিবৃত করিলাম এবং কহিলাম, “সকলেই বিশ্বাস করিতেছে এবং ঘটনাচক্রেও প্রমাণিত হইতেছে যে, সারদা দ্বারাই অভয়াচরণ হত হইয়াছে। অতএব আমি সারদারই অনুসন্ধান করিতেছি। আমার বিশ্বাস, আপনি এ সমস্ত জানেন এবং এক্ষণে সারদা কোথায় আছে, তাহাও জানেন। এ বিষয়ে আপনি কিছুমাত্র গোপন করিবেন না, কারণ গোপন করিলে আপনার ইষ্ট ত হইবে না, প্রত্যুত অনিষ্টই হইবে। আমি কলিকাতা ডিটেকটিভ পুলিস হইতে আসিতেছে, আমার সহিত প্রতারণা করিবেন না।”
দেখিলাম, আমার কথায় রামতনুবাবু স্তম্ভিত ও চমৎকৃত হইলেন। শুষ্কমুখে বলিলেন, “আমি এ কথার বাষ্প ও জানি না। দোহাই ধর্ম্মের, আমি আপনার সহিত মিথ্যা বলিব না। যে দিন ঐ ঘটনা হইয়াছে আপনি বলিতেছেন, তাহার দুই একদিন পূর্ব্বে আমি সারদার নিকট হইতে পত্র পাইয়াছিলাম। তাহাতে লেখা ছিল যে, তাহার অমতে বিমলশশীবাবু এক পাত্রের সহিত সারদার বিবাহের সম্বন্ধ স্থির করিয়াছেন, শীঘ্রই তাহার সহিত বিবাহ হইবে। কিন্তু সে সারদার শত্রুপক্ষীয় লোক, সারদাকে জোর জবরদস্তি করিয়া বিবাহ করিতেছে। সুতরাং তাহার কবল হইতে উদ্ধার করিবার জন্য সারদা আমাকে পত্রখানি লেখে এবং বলিয়া দেয় যে, কাহাকেও কিছু জিজ্ঞাসা না করিয়া, এমন কি বিমলশশীবাবুকেও না জানাইয়া, একবারে হঠাৎ নির্দ্ধারিত দিবসে আমি যেন তথায় উপস্থিত হইয়া রাত্রিযোগে তাহাকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করি; নতুবা সারদার প্রাণহানির সম্ভাবনা। এইজন্য আমি মনে কিঞ্চিন্মাত্রও দ্বিধা না করিয়া সারদার কথায় সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিয়া, সেই দিন রাত্রিযোগে আমি আমার অন্যতম আত্মীয় টালা-নিবাসী বাবু হরিহর ঘোষের বাটীতে তাহাকে রাখিয়া আসিয়াছি। যদি আমি ঘুণাক্ষরে জানিতাম যে, সারদা খুন করিয়া এইরূপ উপায়ে পলায়ন করিবে, তাহা হইলে কি আমি তাহার সহায়ত করি? মহাশয়? মাপ করিবেন, আমার মনে এখনও সে বিশ্বাস হইতেছে না। সারদা আজন্ম-দুঃখিনী! তাহার কোন দুষ্ট নীচাশয় নরপিশাচ আত্মীয় সারদাকে নিপাতিত করিবার চেষ্টায় আজ বার তের বৎসর ঘুরিতেছে। আমি সেই ভয়ে বিমলবাবুর বাড়ীতে তাহাকে রাখিয়াছিলাম, আর এখনও সেইজন্য হরিহরবাবুর বাড়ীতে রাখিয়াছি। যাহা হউক, আমি অদ্যই সেখানে গিয়া আপনার হস্তে সারদাকে অর্পণ করিব। কিন্তু মহাশয়! আর অধিক কি বলিব, দেখিবেন, ন্যায় বিচার হইয়া যাহাতে সারদার শাস্তি বিধান হয়, তাহাই করিবেন। সারদার মাতা মৃত্যুকালে তাঁহার ঐ একমাত্র কন্যারত্নকে আমার হতে হাতে সঁপিয়া গিয়াছেন।”
আমাদের এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময় পিয়ন আসিয়া একখানি টেলিগ্রাম রামতনু বাবুর হস্তে দিয়া গেল। তিনি অন্যমনস্কভাবে সেখানি গ্রহণ করিয়া সম্মুখস্থ তক্তাপোষের উপর ফেলিয়া দিলেন।
আমি জিজ্ঞাসিলাম, “টেলিগ্রাফ কোথা হইতে আসিতেছে?”
রামতনুবাবু বলিলেন, “কি জানি? আমরা আগামী ট্রেণে কলিকাতায় যাই চলুন।”
আমি। ভাল কথা। ঐ টেলিগ্রাফখানি কোথা হইতে আসিতেছে? আপনি উহা খুলিয়া দেখুন।
রামতনুবাবু নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও অন্যমনস্কভাবে টেলিগ্রাফখানি লইয়া শূন্যনয়নে পাঠ করিতে লাগিলেন।
আমি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, “টেলিগ্রাফপত্রখানি কোথা হইতে আসিল?”
রামতনু বাবু হঠাৎ শিহরিয়া নিতান্ত আকুলভাবে শশব্যস্ত হইয়া টেলিগ্রাফখানি আমার হস্তে ফেলিয়া দিলেন, বলিলেন, “আসুন! আর তিলার্দ্ধ বিলম্ব করিবার প্রয়োজন নাই।”
আমি টেলিগ্রাফখানি হাতে লইয়া দেখিলাম, ওখানি কলিকাতা হইতে আসিতেছে। আমরা যাহার অনুসন্ধান করিতেছি, উহা তাহারই সম্বন্ধীয়। উহার সংবাদ বড়ই গুরুতর! হরিহরবাবু লিখিতেছে, “সারদা নিরুদ্দেশ হইয়াছে, সম্ভবতঃ হরিচরণ বাবু তাহাকে হরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে।”
রামতনুবাবু আর তিলার্দ্ধ অপেক্ষা করিলেন না। আমি উঠি আর না উঠি, রামতনুবাবু একবারে রাস্তায় উপস্থিত হইয়া আমাকে পশ্চাতে ফেলিয়া দ্রুতবেগে ষ্টেসন অভিমুখে ধাবমান! আমি ডাকিয়া বলিলাম, “অত ব্যস্ত হইবার আবশ্যকতা নাই। ট্রেণ আসিতে বিলম্ব আছে।”
কিন্তু রামতনুবাবুর মন বুঝিল না। নিতান্ত উতলাভাবে বলিলেন, “মহাশয়, শীঘ্র চলুন। বিলম্ব হইলে সারদাকে জীবিত দেখিতে পাইব না।”
যাহা হউক, যথাসময়ে আমরা টালার হরিহরবাবুর বাটীতে আসিয়া পৌঁছিলাম। হরিহর বাবুও ব্যস্ত সমস্ত হইয়া নিতান্ত উৎকণ্ঠিত মনে ঘর-বাহির করিতেছিলেন। আমরা উপস্থিত হইলে, তাঁহার উৎকণ্ঠাভাবের —ভীতিভাবের বৃদ্ধি হইল।
আমি বলিলাম,—“কিরূপ ঘটনা হইয়াছে?”
হরিহরবাবু বলিলেন,—“আপনি কি সারদার কোন আত্মীয়?”
আমি। আত্মীয় না হইলেও আমি তাহার অনুসন্ধানে ব্যস্ত। আপনার কোন চিন্তা নাই। সমস্ত খুলিয়া বলিতে পারেন।
রামতনুবাবু বলিলেন,—“যাহা হইয়াছে, আপনি খুলিয়া বলুন। হয়ত সারদার কিনারা হইতে পারিবে। উনি একজন পুলিস-কৰ্ম্মচারী।”
তখন হরিহরবাবু বলিলেন, “কল্য সন্ধ্যার সময় সারদা আমার এই বাটীর বাগান হইতে কাষ্ঠ আনিবার জন্য ভিতর হইতে বাগানে যায়; কিন্তু অৰ্দ্ধ ঘণ্টার মধ্যেও সে যখন ভিতরে ফিরিয়া না আসে, তখন আমার স্ত্রী তাহার নাম ধরিয়া ডাকিয়া ছিল। কোন উত্তর না পাইয়া বাহিরে বাগানে আসিয়া দেখে, জন মানব নাই। তখন আমরা বাড়ী ছিলাম না। কিয়ৎক্ষণ পরেই বাটী আসিলে এই সর্বনাশের কথা শুনি। আরও শুনি, হরিচরণ বসু দুই একদিন এই সম্মুখের রাস্তা দিয়া গমনাগমন করিয়াছে। সুতরাং নানাস্থানে অন্বেষণ করিয়াও যখন সারদাকে পাইলাম না, তখন ইহাই স্থির করিলাম যে, সে হরিচরণ কর্তৃকই অপহৃত হইয়াছে। কাজেই সেইরূপভাবে আপনাদের টেলিগ্রাফ করিয়াছি।”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কোন হরিচরণ বসু? যাহার একজন ধনী কুটুম্ব উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে আছেন?”
রামতনুবাবু বলিলেন, “হাঁ মহাশয়! সেই হরিচরণ। আমি উহারই কথা আপনাকে বলিতেছিলাম। এ কথা যদি সত্য হয়, তবে এতক্ষণ বোধ হয় সারদা আর জীবিত নাই!”
আমি কথায় বাধা দিয়া বলিলাম, “তজ্জন্য কোন চিন্তা নাই। যদি ইহা সত্য হয় এবং যে হরিচরণের কথা আমি বলিতেছি, সে যদি অপনাদের কথিত হরিচরণ হয়, তবে সে আমাদের হাতের ভিতর আছে।”
তখন আর আমি অপেক্ষা করিলাম না। রামতনুবাবুকে সঙ্গে লইয়া একেবারে আমাদের থানায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। আমার একজন সহকারী কর্মচারীকে ডাকাইয়া পাঠাইলাম। শুনিলাম, তিনি কার্য্যোপলক্ষে কালীঘাট অঞ্চলে গিয়াছেন। আমি তখন রামতনুবাবুকে হস্ত-মুখ প্রক্ষালন করিতে বলিলাম এবং তাঁহাকে আশ্বাস দিলাম, এইবার আমরা উভয়কেই এক সঙ্গে পাইব। এই বলিয়া রামতনুবাবুর জলযোগের ব্যবস্থা করিয়া দিলাম, নিজেও কিঞ্চিৎ আহার করিয়া লইলাম।
এমন সময় টেলিফোনযোগে সংবাদ আসিল, আমার সেই সহকারী কর্ম্মচারী আমাকে ভবানীপুর থানায় যাইতে অনুরোধ করিতেছেন।
তদনুসারে আমরা তৎক্ষণাৎ ভবানীপুর থানায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। গিয়াই দেখিলাম, হরিচরণ বন্দীকৃত। শুনিলাম, সারদাও থানায় আনীত হইয়াছে। রামতনুবাবুর আর আহ্লাদের সীমা রহিল না। আমি তখন উপস্থিত ঘটনার সংবাদ লইতে লাগিলাম। ঘটনাটি এই—
অন্য কোন মোকদ্দমা উপলক্ষে আমি আমার সহকারী কর্ম্মচারীকে হরিচরণের উপর তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখিতে বলি। আরও বলি যে, যখনই হরিচরণ কখনও কোন স্ত্রীলোকের প্রতি কোন প্রকার দুর্ব্যবহার করে, তখনই তাহাকে এবং স্ত্রীলোকটিকে পর্য্যন্ত যেন গ্রেপ্তার করা হয়। এই উপদেশ অনুসারে কর্ম্মচারী হরিচরণকে চোখে চোখে রাখিয়াছিলেন। হরিচরণ টালায় গিয়া কয়েক দিন যেন কাহার অনুসন্ধান করিয়া আসে। তাহাতে কাচারীর সন্দেহ বৃদ্ধি হওয়াতে তাহার সঙ্গ আর নিমেষমাত্রও ত্যাগ করে না, কেবল যাতায়াতের পথ হইলে আমাকে অন্বেষণ করিয়া থাকে। এইরূপে সে দিন সন্ধ্যার সময় হরিহর ঘোষের বাটী হইতে সারদার মুখ বাঁধিয়া বলপূর্ব্বক লইয়া কালীঘাটের নিকট এক বাটীতে উপস্থিত হয়। সেখানে উহাদের পরস্পর খুব বচসা হয়। তৎপরে অদ্য তাহাকে ভবানীপুরের একখানি জনশূন্য বৃহৎ বাড়ীতে লইয়া আসে। এখানেও অনেক কথা কাটাকাটির পর হরিচরণ সারদাকে ছোরা দেখাইয়া ভয় দেখায় এবং অনেকক্ষণ পরে যখন যথাযথই মারিবার জন্য ছোরা উত্তোলন পূর্ব্বক সারদার দিকে ধাবিত হয়, তখন আমার সহকারী হঠাৎ সেই গৃহে প্রবেশ করিয়াই, পিস্তলের আওয়াজ করে। তাহাতে হরিচরণ হঠাৎ স্তম্ভিত হয়, এবং তাহার হাতের ছোরা পড়িয়া যায়। সহকারীর সঙ্গী একজন পুলিস-কৰ্ম্মচারী তৎক্ষণাৎ চকিতমাত্র দৌড়িয়া গিয়া হরিচরণের হস্ত হইতে ছোরা গ্রহণ করে এবং অন্য কনষ্টেবলের সাহায্যে তাহাকে বাঁধিয়া ফেলে। কৰ্ম্মচারী আমার উপদেশ মত সারদাকেও সঙ্গে লইয়া থানায় উপস্থিত হয়, এবং আমাকে আহ্বান করিয়া টেলিফোন করে।
তখন আমরা উভয় আসামীকে লইয়া পৃথক পৃথক পীড়াপীড়ি আরম্ভ করিলাম। বলা বাহুল্য, আমি নিজে সারদাকে নানা কথা জিজ্ঞাসা করিয়া যে উত্তর পাইলাম, তাহাতে তাহার দোষ-প্রমাণোপযোগী কোন কথা পাইলাম না।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
এখন আমার মনে নূতন সন্দেহের উদয় হইল। হরিচরণের যখন সারদার উপর এত জাতক্রোধ, যখন উহাকে বাগে পাইলে হত্যা করিতে পারে, তখন আমার মনে এইরূপ হইল যে, হয় ত সুবিধা খুঁজিতে খুঁজিতে পূর্ব্বোক্ত বিবাহের দিন গুপ্তভাবে আসিয়া সারদাকে খুন করিয়া যাইবে,—গোলমালে অন্য কেহই ঠিক করিতে পারিবে না, এই ভাবিয়া হরিচরণ সেই রাত্রিতে সারদাকে হত্যা করিবার জন্য কোন উপায়ে সে বাটীতে প্রবেশ করিয়া সারদাভ্রমে অভয়াচরণকে হত্যা করিয়া পলায়ন করিতে পারে। পরে যখন শুনিতে পাইল, সারদা হত্যা হয় নাই, তখন তাহার অনুসন্ধান করিতে করিতে তাহাতে সফলকাম হইয়া পূর্ব্বোক্তরূপে তাহাকে হত্যা করিতেছিল, বিধিচক্রে ধরা পড়িয়াছে।
এই নূতন সন্দেহের উদয় হওয়াতে তখন হরিচরণকে লইয়া নানারূপ অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। তাহার বাসায় গিয়া সেখানে তন্ন তন্ন করিয়া ঘরগুলি অনুসন্ধান করিলাম। হরিচরণকে নানা প্রশ্ন করিয়াও সুচতুর বদামায়েস হরিচরণের পেট হইতে কোন কথা বাহির করিতে পারিলাম না। আমার সন্দেহ কিন্তু দিন দিন বৰ্দ্ধিত হইতে লাগিল। এদিকে হরিচরণকে ছাড়িয়া দিতেও পারি না, অথচ তাহাকে রীতিমত কারাবদ্ধও করিতে পারি না। ওদিকে সারদার খুন করিবার চেষ্টারূপ মোকদ্দমাকে আপাততঃ স্থগিত রাখিবার চেষ্টা করিলাম, তজ্জন্য কালবিলম্ব করিতে লাগিলাম। কিন্তু কোনরূপেই অভয়াচরণ-হত্যাব্যাপারের কোন কিনারা করিতে পারিলাম না।
যে পুলিস-কর্ম্মচারীর উপর হরিচরণের গতিবিধি লক্ষ্য রাখিবার ভার দিয়াছিলাম, তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি হরিচরণকে কোথায় কোথায় যাইতে দেখিয়াছ? আর কাহার সহিত সে বেশী মেশামিশি করিত, বলিতে পার?”
কৰ্ম্ম। মহাশয়। এমন কোন বদমায়েসেদের আড্ডা নাই, যেখানে হরিচরণ যাইত না। আর তাহার সহিত বিস্তর বদমায়েসদিগের এবং অন্য স্ত্রীলোকদিগের সহিত বড়ই ঘনিষ্ঠতা আছে। বড়বাজারস্থ জুয়াখেলার আড্ডায়, মেছুয়াবাজারের গুণ্ডাদের আড্ডায়, চোরেদের আড্ডায় সে যাইবেই যাইবে। সময় সময় স্ত্রীলোক সঙ্গে করিয়াও যাইত। বহুবাজারের জগজ্জ্যোতিবাবুর বাটিতে সে ঘন ঘন যাতায়াত করিত। আর সম্প্রতি সে দরজীপাড়ার এক খালি বাটীতে বড়ই যাতায়াত করিত। এই খালি বাড়ীর সদর দরজা দিবসের মধ্যে অধিকাংশ সময় বাহিরের দিকে তালাবদ্ধ থাকিত; কিন্তু রাত্রিতে ভিতর হইতে বদ্ধ থাকিত। বহুবাজারের জগজ্জ্যোতিবাবুর বাটীর স্ত্রীলোকও এই বাটীতে রাত্রিকালে আসিয়া থাকে, ইহা আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি। আবার–
আমি তাহাকে বাধা দিয়া বলিলাম, “দরজীপাড়ার সেই বাড়ী আমাকে দেখাইয়া দাও। আমার জগজ্জ্যোতিবাবুর বাটির স্ত্রীলোককে সেখানে যাইতে দেখিয়াছ ইহা ত ভ্রম নহে? জগজ্জ্যোতিবাবু ত নিরীহ ব্রাহ্ম-ধরণের বর্দ্ধিষ্ণু লোক!”
কৰ্ম্ম। না মহাশয়, তাহা ভ্রম নহে।
ইহার পর আমরা সেই দরজীপাড়ার বাড়ী দেখিলাম। দেখিলাম, আমাদের বর্ণিত হত্যাকাণ্ডঘটিত বাটীর ঠিক পার্শ্বের বাটীই ঐ বাটী। তখন আমার মনে আশার সঞ্চার হইল। এখন সেই বাটী পরীক্ষার অবসর খুঁজিতে লাগিলাম।
উক্ত খালি বাটীর বাহিরে তালাবদ্ধ রহিয়াছে। আমি অভয়াচরণের নূতন বাটীর চাবি আনাইয়া তাহার মধ্যে অতি গুপ্তভাবে আমার সঙ্গীর সহিত প্রবেশ করিলাম। সিঁড়ি বাহিয়া একবারে উপরকার ছাদে উঠিলাম। তথা হইতে সিঁড়ি লাগাইয়া পার্শ্বের বাটীর প্রাচীরের উপর দিয়া তাহার ছাদে গিয়া পড়িলাম। দেখিলাম, ঠিক সেই স্থানে প্রাচীরের গাত্রে বড় বড় পেরেক পোঁতা আছে। সেই পেরেকের একটির মাথায় দেখিলাম, একটুকরা বস্ত্রখণ্ড আছে। একটু জোর করিয়া টানিতেই সে নেকড়াটুকু খুলিয়া আমার হস্তে আসিল। ভাল করিয়া দেখিলাম, সেটুকু পাছাপেড়ে সাড়ীর মধ্যের এক সামান্য অংশ। সেখানি ময়লা বা পরিত্যক্ত বস্ত্রের অংশ বলিয়া বিশ্বাস হইল না, টুকরাটি বেশ শক্ত ও পরিষ্কার। টুকরা নেকড়ায় কোন কার্য্যসিদ্ধির সম্ভাবনা স্বপ্নের অগোচর হইলেও, আমি সেটুকু কি জানি কি ভাবিয়া যত্ন করিয়া সংগ্রহ করিলাম। সেই বাটীর নীচের তলায় অবরোহণ মানসে সিঁড়ির দরজায় গিয়া দেখিলাম, তাহা ভিতর হইতে বন্ধ। ছাদের পার্শ্ব হইতে সে বাটীর নীচের ঘরগুলি দেখিতে চেষ্টা করিলাম, ভালরূপ দেখিতে পাইলাম না।
তখন আমরা প্রত্যাবৃত্ত হইয়া অভয়ার বাটী দিয়া বাহির হইয়া আসিলাম। রাস্তায় গুপ্তভাবে অবস্থান করিতে লাগিলাম। বৈকালে একখানি গাড়ী আসিয়া সেই বাটীর সম্মুখে লাগিল। একজন স্ত্রীলোক চাবি খুলিয়া বাটীর ভিতর প্রবেশ করিল। স্ত্রীলোকটি অবগুণ্ঠনবতী ছিল, চিনিতে পারিলাম না। কিয়ৎক্ষণ পরে দুইটি বাবু আসিয়া সেই বাটীর দ্বারে আসিয়া মৃদু করাঘাত করিল। তৎক্ষণাৎ দ্বার খুলিয়া গেল। উভয়ে তাহার মধ্যে প্রবেশ করিল। দেখিলাম, উক্ত দুই জনের মধ্যে একজন ঘোর জালিয়াত, নাম উপেন্দ্রমোহন বসু। যে গাড়ী লইয়া স্ত্রীলোকটি আসিয়াছিল, সেখানি একটু অন্তরে গিয়া তখন পর্যন্ত অপেক্ষা করিতেছিল। দেখিতে দেখিতে আর একটি পুরুষ ও তাড়াতাড়ি আসিয়া সেই বাটীর মধ্যে প্রবেশ করিল। তৎপরে আর একটি বলশালী হিন্দুস্থানী যুবক আসিয়া ঐ বাটীর দল বৃদ্ধি করিল। এই সময় ঐ বাটী হইতে একজন বাহিরে চলিয়া গেল। তাহার যাইবার পরই পূর্ব্বোক্ত গাড়ী আসিয়া বাড়ীর দ্বারে লাগল। পূর্ব্বোক্ত স্ত্রীলোকটি আসিয়া তাহাতে আরোহণ করিল। আমি চকিতের ন্যায় সেই স্ত্রীলোককে দেখিয়া কতক চিনিলাম। ইতিপূর্ব্বে আমার সঙ্গীকে একখানি ভাড়াটিয়া গাড়ী ভাড়া করিয়া আনিতে বলিয়াছিলাম। সে এখনও ফিরে নাই। দেখিলাম, স্ত্রীলোক গাড়ীর ভিতর বসিলে গাড়ী সেখান হইতে চলিয়া গেল। আমি আর অপেক্ষা না করিয়া পদব্রজেই সেই গাড়ীর অনুসরণ করিলাম; কিন্তু দুই চারি পা যাইতে না যাইতে আমি দেখিলাম, আমার সঙ্গী আমার জন্য গাড়ী লইয়া উপস্থিত। আমি গাড়োয়ানকে মৃদুস্বরে পূর্ব্বোক্ত গাড়ীর অনুসরণ করিতে কহিলাম। দেখিলাম, ক্রমে সেই গাড়ী বড়বাজারের জগজ্জ্যোতিবাবুর বাড়ীর সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল। স্ত্রীলোকটি বাটীর মধ্যে প্রবেশ করিল। তখন তাহাকে নিঃসন্দেহে চিনিলাম, জগৎবাবুর কন্যার সহচরী।
এখানে বলিয়া রাখি, ইহার কিছুদিন পূর্ব্বে উক্ত জগৎবাবুর বিস্তর ধন-সম্পত্তি চুরি যায়। তাহার অনুসন্ধানের ভার আমার উপর পড়ে। আমি তাহার কিছু কিনারা করিতে পারি নাই। সেই সময় হইতে জগৎবাবুর বাটীর স্ত্রীলোকদিগকে চিনি।
যাহা হউক, আমি বড়ই আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। জগৎবাবুর কন্যাই ত অভয়ার প্রেমাকাঙিক্ষণী, সুতরাং সারদার সপত্নী। আমার মনে নূতন সন্দেহ আসিল। সেই খালিবাড়ী হইতে পেরেকসংলগ্ন বস্ত্রখণ্ডের কথা স্মরণ হইল। মনে হইল, এই বস্ত্রখণ্ড ধরিয়া অনুসন্ধানের পথ বাহির হইবে।
রাত্রিযোগে আমার সঙ্গীর সাহায্যে সেই খালিবাড়ীর মধ্যে কোন সুযোগে সকলেরই অজ্ঞাতসারে চোরের ন্যায় প্রবেশ করিলাম। ইতিপূর্ব্বেই পার্শ্বস্থ অভয়াচরণের বাটীতে গুপ্তভাবে পুলিস রাখিয়া আসিয়াছিলাম। নিঃশব্দ পদসঞ্চারে উপরে উঠিলাম। দেখিলাম, কতকগুলি পুরুষ বসিয়া একটি ঘরে কি জাল লেখাপড়া করিতেছে। একটি স্ত্রীলোক কিঞ্চিদ্দূরে উপবিষ্ট। সে ঘরের দরজা ভিড়ান ছিল, কিন্তু অর্গল বদ্ধ ছিল না। আমি চুপি চুপি তাহা বাহির হইতে শিকলবদ্ধ করিলাম। নিঃশব্দে অথচ দ্রুতভাবে নীচে নামিয়া পার্শ্ববাটীস্থিত কতকগুলি পুলিস প্রহরীকে বাড়ী ঘেরাও করিয়া থাকিতে কহিয়া অবশিষ্টাংশ সমভিব্যাহারে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে পুনরায় উপরে উঠিলাম। আমাদের সকলকার হস্তেই এক একটি পিস্তল। আমরা উপরে উঠিয়া পূর্ব্বোক্ত ঘরের শিকল খুলিয়া হঠাৎ সকলেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলাম এবং আমি অগ্রসর হইয়া সেই গৃহস্থিত সমস্ত লোককেই বজ্রগম্ভীরস্বরে ভয় দেখাইয়া বলিলাম, “যে যেখানে আছ সে সেইখানেই থাক। নড়িলেই পিস্তলের গুলিতে প্রাণ হারাইবে।”
হঠাৎ তাহারা স্তম্ভিত হইল। ক্ষণপরেই তাহাদের দুই এক জন আত্মরক্ষার্থে অস্ত্র লইয়া আমাদের সম্মুখে আসিবার উপক্রম করিল। আমি বলিলাম, “আত্মরক্ষা-চেষ্টা বৃথা। এখানকার অপেক্ষা নীচে চতুর্গুণ পুলিস আছে।” তখন তাহারা হঠাৎ পশ্চাৎপদ হইয়া নিরস্ত হইল এবং আত্মসমর্পণ করিল। স্ত্রীলোকটি সকলের অজ্ঞাতে পার্শ্বস্থ ঘরে পলাইয়া অন্য ঘর দিয়া নীচে যাইতেছিল, অপর পুলিস-প্রহরী কর্তৃক ধৃত হইল। তখন সকলকে লইয়া থানায় পাঠাইয়া দিলাম ও আমি সেই বাড়ীর চারিদিক অনুসন্ধান করিলাম। সেখান হইতে ছোরা, পিস্তল, লাঠী, ছুরি, শলার মত অতি সূক্ষ্ম লম্বা শাণিত একখানি নূতন ধরণের অস্ত্র, জাল করিবার ষ্ট্যাম্পকাগজ প্রভৃতি নানাপ্রকার দ্রব্য দেখিলাম, সেগুলিও থানায় চালান দিলাম।
তখন নানা প্রকারে তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়াও কোন সূত্র পাইলাম না দেখিয়া, তাহাদিগকে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে আবদ্ধ করিয়া তাহাদিগকে অব্যাহতির আশা দিয়া, অনেক কথা বাহির করিতে চেষ্টা করিলাম। আমার লক্ষ্য খুনী- মোকদ্দমা-সংক্রান্ত কথা বাহির করিব, কিন্তু তাহারা জানিল, জালমোকদ্দমা সম্বন্ধে কথা বাহির করিবে। সুতরাং অজ্ঞাতসারে এই খুনের কতক আভাস পাইলাম।
এদিকে সেই স্ত্রীলোকের বাটী গিয়া তাহার ঘরদ্বার তোলপাড় করিয়া অনুসন্ধান করিলাম। অনেকক্ষণের পর আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইল; একখানি ছিন্ন পাছাপেড়ে কাপড় পাইলাম। পূর্ব্বোক্ত ছিন্নাংশ খণ্ড মিলাইয়া দেখিলাম, ঠিক মিলিয়া গেল। আর সন্দেহ রহিল না। তখন কয়েদীদিগকে একে একে সকলকে বলিলাম, “আর কেন, ঠিক কথা বল, সব প্রকাশ হইয়াছে।”
অনেক ভয়প্রদর্শন, অনুরোধ, অব্যাহতি-আশা প্রদানের পর সেই স্ত্রীলোকটি বলিল, “সারদা হরিচরণের একজন আত্মীয়, কিন্তু জ্ঞাতি শত্রু। সারদাকে মারিবার জন্য হরিচরণ অনেকবার চেষ্টা করিয়াছে; কিন্তু হরিচরণকে সম্মুখে দেখিলেই সারদা পলাইয়া যায় সুতরাং ধরিতে পারে না। সেই জন্য আমাকে অনুরোধ করে যে, আমি কোন সুযোগে একটি নূতন অস্ত্র দ্বারা তাহাকে মারিয়া ফেলি। আমি প্রথমে সম্মত হই নাই; পরে সম্মত হইলাম। তারপর একদিন আমাকে হরিচরণ বলিল, “অমুক দিন সারদার বিবাহ হইবে। সেই দিন রাত্রিতে, যখন ঐ বাটীতে বর কন্যা বাসর ঘরে শুইবে, সেই সময় ঐ বাটীতে কৌশলে প্রবেশ করিয়া সকলের অজ্ঞাতসারে উহাকে মারিবার সুবিধা হইবে।” ইতিপূব্বেই পার্শ্বের বাটী ভাড়া লওয়া হইয়াছিল। আমি সেই বিবাহ-রাত্রির পূর্ব্বে সন্ধান লইয়াছিলাম, বর কন্যা কোন্ ঘরে শয়ন করিবে। আমি উক্ত পার্শ্বের বাটী দিয়া পেরেকের সাহায্যে অভয়ার বাটীর ছাদের উপর উঠি; তার সেখান হইতে নীচে নামিয়া সারদার শয়নঘরে প্রবেশ করি। আমি অন্ধকারে যথাসাধ্য লক্ষ্য করিয়া অস্ত্র ব্যবহার করিবার উপক্রম করিতেছি, এমন সময় বোধ হইল যে, নীচে হইতে কে যেন উপরে আসিতেছে। আমি অন্য কিছু লক্ষ্য না করিয়া শয্যায় শায়িত ব্যক্তির রগে অস্ত্র প্রয়োগ করিয়াই দ্রুতপদে গৃহের বাহির হই এবং উপরকার ছাদ দিয়া পার্শ্বের বাটীতে প্রত্যাবৃত্ত হই। ফিরিবার সময় পেরেকে লাগিয়া আমার কোমরে জড়ান কাপড়ের একস্থান খোঁচা লাগিয়া ছিঁড়িয়া যায়; কিন্তু আমি সে সময় তাহা লক্ষ্য করি নাই। তাহাতেই ধরা পড়িয়াছি।
পৃথক ভাবে পীড়াপীড়ি করিয়া হরিচরণকে জিজ্ঞাসা করাতে হরিচরণও সকল কথা স্বীকার করিল। রীতিমত মোকদ্দমা রুজু হইলে বিচারে অপরাধীগণের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হইয়াছিল।
[আশ্বিন, ১৩১৩]