চেনা দায়
(অর্থাৎ কলিকাতার জুয়াচোরগণকে চেনা ভার!)
সূচনা
এই কলিকাতা সহরের ভিতর জুয়াচোরগণ সোণা বলিয়া পিতল দিয়া যে কতরূপ জুয়াচুরি করিতেছে, এবং নিত্য নিত্য নূতন নূতন উপায় বাহির করিয়া, নবাগত নিরীহ পল্লীগ্রামবাসীগণকে যে কতরূপ ঠকাইতেছে, তাহার সবিশেষ বর্ণনা করা একবারেই অসম্ভব। যতদূর সম্ভব, তাহার কয়েকটি বিবরণ আমি নিম্নে লিপিবদ্ধ করিলাম। আশা করি, কি সহর, কি পল্লীগ্রামবাসীগণ, যাঁহাদিগের সহিত এই কলিকাতার কিছু না কিছু সংশ্রব আছে, তাঁহারা সবিশেষ মনোযোগের সহিত ইহা পাঠ করিয়া ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক হইবেন। জুয়াচোরগণ সুবর্ণ পরিচয়ে পিতল দিয়া যত প্রকারে লোক ঠকাইয়া থাকে, বা উহাদিগের যতরূপ কৌশল আমরা অবগত আছি, তাহার সমস্তই যে আমি এই স্থানে বর্ণন করিতেছি, তাহা নহে। উহার মধ্যে যে সকল মোকদ্দমায় আমি হস্তক্ষেপ করিয়াছি, বা যে সকল জুয়াচোর আমা কর্তৃক ধৃত হইয়াছে, কেবল তাহাদিগের কৃত জুয়াচুরি সকল এই স্থানে প্রকাশিত হইল।
(এক) বন্ধকে জুয়াচোর
কামিনীর বয়ঃক্রম এখন পঞ্চাশ বৎসরের অধিক হইয়াছে। কায়স্থ বংশ-সম্ভূতা বলিয়া সে সকলের নিকট পরিচয় দিয়া থাকে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে যে কোন কুল উজ্জ্বল করিয়াছে, তাহা আমরা অবগত নহি। তাহার বাল্য পরিচয় আমরা পাই নাই, যৌবনের পরিচয় যতদূর অবগত হইতে পারিয়াছি, বা তাহার যৌবনের কার্য্য-কলাপের কথা যতদূর আমাদিগের কর্ণগোচর হইয়াছে, তাহার যথাযথ পরিচয় আমি কোন ক্রমেই এই দপ্তরের ভদ্রবংশীয়া পাঠিকাগণের সম্মুখে উপস্থিত করিতে পারি না। কেবল এইমাত্র বলিতে পারি যে, কামিনীর বয়ঃক্রম চল্লিশ বৎসর অতিক্রান্ত হইলে পর, তাহার যৌবনের ব্যবসা পরিত্যাগ করিয়া নিজ উদরান্নের সংস্থানের নিমিত্ত তাহাকে অপর ব্যবসা অবলম্বন করিতে হইয়াছিল।
কামিনী যদি কোনরূপ সদব্যবসা অবলম্বন করিয়া তাহার উদরানের চেষ্টা করিত, তাহা হইলে তাহার কার্য্য বিবরণী আজ আমাকে লোক-সমাজে প্রকাশ করিতে হইত না। কামিনী যখন প্রথম তাহার এই নূতন ব্যবসা আরম্ভ করে, তখন কেহই মনে করিয়াছিলেন না যে, কামিনী অসদ্উপায় অবলম্বন করিয়া অর্থ উপার্জ্জনের চেষ্টা করিতেছে। বস্তুতঃ তাহার কার্য্যের গতিতে, প্রথম প্রথম তাহার জুয়াচুরির কোন লক্ষণই প্রকাশ পায় নাই, বরং সকলেই তাহার কথায় বিশ্বাস করিত। বিশেষতঃ ভদ্রমহিলাগণের নিকট তাহার একটু সবিশেষরূপ প্রতিপত্তি জন্মিয়াছিল।
কামিনী অতিশয় চতুরা, তাহার মুখ অতিশয় মিষ্ট, গৃহস্থগণের অন্দরে প্রবেশ করিয়া মহিলাগণের সহিত মিলিত হইবার ক্ষমতা তাহার অদ্বিতীয়। কোন কায না থাকিলেও, সে স্থিরভাবে আপন বাড়ীতে কখনও বসিয়া থাকিত না, বিনা-কারে এবাড়ী ওবাড়ী করিয়া বেড়াইত, ও গৃহস্থ-মহিলাগণের সহিত গল্প করিয়া দিন কাটাইত। পাঠক-পাঠিকাগণ সকলেই জানেন যে, ভদ্র গৃহস্থের অনেকের অনেক সময়ে হঠাৎ কিছু না কিছু অর্থের প্রয়োজন হইয়া পড়ে, অথচ বিশেষ কষ্ট হইলেও লোক-সজ্জা ও অপমানের ভয়ে আপন আপন অলঙ্কারাদি বন্ধক দিয়া অপরের নিকট কর্জ্জ করিয়া অর্থ সংগ্রহ করতে কেহই সহজে সম্মত হন না। কামিনী ভদ্রমহিলাগণের এই অভাব পূরণে প্রথমতঃ প্রবৃত্ত হয়, অর্থাৎ কাহারও কোনরূপ সামান্য অর্থের প্রয়োজন হইলে কামিনী তাঁহার অলঙ্কারাদি তাপর স্থানে কম সুদে বন্ধক দিয়া টাকা আনিয়া দিত। পরিশেষে টাকার সংস্থান হইলে, সুদসমেত টাকা মিটাইয়া দিয়া সেই সকল অলঙ্কার ফিরাইয়া আনিত। ইহাতে বন্ধক-দাতা ও গ্রহীতার পরস্পরের কেহই জানিতে পারিত না যে, সেই অলঙ্কার কাহার, কেইবা বন্ধক দিতেছে, এবং কাহার নিকটেই বা বন্ধক দেওয়া হইতেছে। এই কার্য্য করিয়া কামিনী যে কিছুই পাইত না, তাহা নহে। পারিতোষিক বলিয়া হউক, গাড়িভাড়া প্রভৃতি বলিয়া হউক, বা সুদের অল্প-বিস্তর করিয়াই হউক, সে এই উপায়ে নিজের অন্নের সংস্থান করিতে সমর্থ হইত। এইরূপে কিছুদিবস অতীত হইবার সঙ্গে সঙ্গে মহিলামহলে ক্রমে তাহার পরিচয় হইতে লাগিল, অনেকেই তাহাকে বিশ্বাস করিতে লাগিলেন, অনেকে তাহার সাহায্যে অর্থাদি কৰ্জ্জ লইতে প্রবৃত্ত হইলেন, এবং অলঙ্কার প্রভৃতি বিক্রয়ের প্রয়োজন হইলে অনেকে তাহারই সাহায্যে সেই কার্য্য সম্পন্ন করিতে লাগিলেন।
এইরূপে যতদিবস অতিবাহিত হইতে লাগিল, কামিনীর পশার ততই বাড়িতে লাগিল। সেই সঙ্গে সঙ্গে তাহার উপার্জ্জনও বাড়িয়া গেল। আয় বাড়িলেই ব্যয় বাড়ে, ইহা এই জগতের নিয়ম। সুতরাং কামিনীর কার্য্যও সেই নিয়মের বহির্ভূত হইতে পারিল না। কেন যে তাহার ব্যয় বাড়িয়া গেল, তাহার কারণ আমি পাঠিকাগণের নিকট বর্ণনা করিতে অসমর্থ। কিন্তু আয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবিক তাহার ব্যয় অধিক হইতে লাগিল; ব্যয় বাড়িলেই অর্থেরও অধিক প্রয়োজন হইয়া পড়িল। সদুপায় অবলম্বনে এ পর্যন্ত কামিনী যত অর্থ উপার্জ্জন করিতেছিল, তাহাতে আর তাহার ব্যয় সঙ্কুলান হইল না। সদুপায়ের পরিবর্তে অসদুপায় অবলম্বন করিয়া কামিনী এখন অর্থ সংগ্রহ করিতে প্রবৃত্ত হইল।
পাঠক পাঠিকাগণের মধ্যে সকলেই অবগত আছেন যে, পিত্তলের গহনা এই কলিকাতা সহরের মধ্যে কিরূপ ভাবে দিন দিন প্রচলিত হইতেছে। পিত্তলের অলঙ্কার, গিটির গহনা, কেমিকেল স্বর্ণের অলঙ্কার প্রভৃতি নানাপ্রকার নামে পিত্তলের গহনা এই কলিকাতার বাজারে অহরহঃ বিক্রীত হইতেছে। মহিলাগণ সর্ব্বদা যে প্রকার সুবর্ণ অলঙ্কার ব্যবহার করিয়া থাকেন, সেই প্রকারের সমস্ত পিত্তলের গহনা আজকাল কলিকাতার বাজারে পাওয়া যায়। সেই সকল গহনা দেখিতে এতই পরিষ্কার, এবং এরূপ কৌশলের সহিত গিলটি করা যে, উহা দেখিয়া সহজে কেহই অনুমান করিতে পারেন না যে, উহা সুবর্ণের অলঙ্কার নহে, পিত্তলের। সুবর্ণ-ব্যবসায়ীগণও সময় সময় উহা সহজে চিনিয়া উঠিতে পারেন না। কষ্টিপাথরে কষিয়া দেখিয়াও সময় সময় তাহারাও মহাভ্রমে পতিত হন। সেই সকল অলঙ্কারের মধ্যে কোন কোনটি এরূপ কৌশলের সহিত গিলটি করা যে, সেই সকল গহনা একবার পুড়াইয়া লইলেও পিত্তল বলিয়া সহজে অনুমান করা যায় না।
কামিনী অল্পে অল্পে এইরূপ কতকগুলি গিটির গহনা ক্রয় করিয়া আপনার নিকট রাখিয়া দিল। কোন মহিলা কোন সুবর্ণঅলঙ্কার বন্ধক দিবার নিমিত্ত তাহাকে প্রদান করিলে, তাহার পরিবর্তে সেইরূপের একখানি গিটির গহনা অপরের নিকট সুবর্ণ অলঙ্কার পরিচয়ে বন্ধক দিয়া প্রয়োজনমত টাকার সংস্থান করিত; কিন্তু সুবর্ণ অলঙ্কারখানি বিক্রয় করিয়া আপন কার্য্যে ব্যয় করিয়া ফেলিত। যাঁহার অলঙ্কার, তিনি সুদসমেত টাকা প্রদান করিলে, তাহার পরিবর্তে কামিনী সেই পিতলের গহনাখানি আনিয়া তাহাকে অর্পণ করিত। সেই অলঙ্কারের অধিকারিণী যদি টাকার সংগ্রহ করিয়া দিতে না পারিতেন, তাহা হইলে সেই পিত্তলের গহনা যাহার নিকট বন্ধক রাখিত, তাহারই নিকট থাকিয়া যাইত। কামিনীর উপর সকলেরই সবিশেষ বিশ্বাস ছিল বলিয়া, তাঁহারা যে তাহা কর্তৃক প্রতারিত হইতেছেন, একথা তাঁহারা স্বপ্নেও মনে করিতেন না।
এইরূপে কামিনী যে কত ভদ্রমহিলার সর্ব্বনাশ করিয়াছিল, তাহার ইয়ত্তা নাই। এইরূপে এই অসদুপায় অবলম্বন করিয়া কিছুদিবস পর্য্যন্ত তাহার ব্যবসা চলিল সত্য; কিন্তু শীঘ্রই তাহা প্রকাশ হইয়া পড়িল। তাহার এই জুয়াচুরির বিষয় প্রকাশিত হইয়া পড়িবার পরও কিছুদিবস পর্য্যন্ত কামিনী শ্রীঘরে গমন করিল না। কারণ, কুলবধূগণকে পাছে আদালতে গিয়া সাক্ষ্য প্রদান করিতে হয়, এই ভয়ে কেহই তাহার বিপক্ষে নালিশ করিতে সাহসী হইলেন না। অনেকেই কামিনীর উপর নালিশ করিলেন না বলিয়াই যে কামিনী একবারেই নিষ্কৃতি লাভ করিল, তাহা নহে। এইরূপ উপায়ে সে একবার একস্থান হইতে প্রায় তিন সহস্র মুদ্রার মূল্যের অলঙ্কার আত্মসাৎ করায়, সে আমা কর্তৃক ধৃত হয়। বিচারে তাহার দুই বৎসরের নিমিত্ত কারাবাসের আজ্ঞা হয়। জেল হইতে খালাস হইয়া আসিয়াও সে তাহার সেই জুয়াচুরি ব্যবসা একেবারে পরিত্যাগ করিতে পারে নাই। যদিও মহিলামহলে তাহার এখন সে পশার বা সেইরূপ প্রতিপত্তি নাই, তথাপি সে তাহার সেই পুরাতন ব্যবসা এখনও একবারে পরিত্যাগ করিতে পারে নাই। সুযোগ পাইলে এখনও সে অপরকে প্রতারণা করিয়া থাকে; কিন্তু তাহার অবস্থা এখন অতি শোচনীয়।
পাঠক পাঠিকাগণ মনে করিবেন না যে, কেবল একমাত্র কামিনীই এইরূপে ভদ্রমহিলাগণকে ঠকাইয়া আপন জীবন অতিবাহিত করিয়া থাকে। এই কলিকাতা সহরের মধ্যে এইরূপ কামিনী এখন শত শত বিদ্যমান।
(দুই) বিক্রয়ে জুয়াচোর
আজ কয়েক বৎসর অতীত হইল, এই সহরতলীর কোন একটি প্রসিদ্ধ পোদ্দারের দোকানে সিঁদ হওয়াতে অনেকগুলি সুবর্ণ ও রৌপ্যের অলঙ্কার অপহৃত হয়। অপরাপর কর্ম্মচারীগণের সহিত আমিও সেই অনুসন্ধানে লিপ্ত হই। ঘটনাস্থলে গমন করিয়া দেখিতে পাই যে, যে অলঙ্কার-ব্যবসায়ীর দোকান হইতে অলঙ্কার প্রভৃতি অপহৃত হইয়াছে, তিনি সেই স্থানের একজন সর্ব্বপ্রধান পোদ্দার। দোকান ঘরটি ইষ্টক নির্ম্মিত। সেই দোকানের পশ্চাদ্ভাগে একটু সামান্য পতিত জমি আছে, দস্যুগণ সেই স্থানে বসিয়া দোকানের পাকা ভিত্তিতে সিঁদ দেয়, এবং সিঁদের মধ্য দিয়া দোকানের ভিতর প্রবেশ করিয়া তাহার মধ্যস্থিত কাষ্ঠনির্ম্মিত সিন্ধুক, বাক্স প্রভৃতি ভাঙ্গিয়া ফেলে। পরে উহার ভিতর হইতে মূল্যবান যে সকল দ্রব্য প্রাপ্ত হয়, তাহার সমস্তই অপহরণ করে। দস্যুগণ যে সকল বাক্স ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছিল, তাহার একটির মধ্যে সেই দোকানের প্রকাণ্ড লোহার সিন্ধুকের চাবি থাকিত। সুতরাং অনায়াসেই সেই চাবি দস্যুগণের হস্তগত হয়। তাহারা উহার দ্বারা সেই লোহার সিন্ধুকটি খুলিয়া তাহার মধ্যস্থিত বিক্রয়োপযোগী যে সকল মূল্যবান্ অলঙ্কার ছিল, তাহার সমস্তই অপহরণ করিয়া লইয়া যায়। আমরা সকলে মিলিয়া, কয়েকদিবস পর্য্যন্ত এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করি; কিন্তু কোনরূপে সেই অপহৃত দ্রব্যের সন্ধান করিয়া উঠিতে পারি না। যে সকল অলঙ্কার অপহৃত হইয়াছিল, তাহার একখানি বিস্তৃত তালিকা প্রস্তুত করান হয়, এবং উহা মুদ্রিত করিয়া সহর ও সহরতলির মধ্যস্থিত সমস্ত পোদ্দার ও সুবর্ণ-ব্যবসায়ীগণের দোকানে তাহার এক একখানি প্রেরণ করা হয়। সেই সকল তালিকা সকলের মধ্যে বিতরণ করার আমাদিগের প্রধান উদ্দেশ্য এই ছিল যে, যদি সেই সকল অপহৃত দ্রব্য কাহারও নিকট কোন ব্যক্তি বিক্রয় করিবার নিমিত্ত লইয়া যায়, তাহা হইলে তিনি পুলিসে সংবাদ দিয়া তাহাকে ধরাইয়া দিতে পারেন।
এই চুরি হইবার পর, ক্রমে দুই তিনমাস অতিবাহিত হইয়া গেল; কিন্তু অপহৃত দ্রব্যের কোনরূপ অনুসন্ধান হইল না, বা চোরও কোনরূপে ধৃত হইল না। একদিবস সন্ধ্যার পর আমি বসিয়া আছি, এমন সময়ে আমার সবিশেষ পরিচিত একটি লোক আসিয়া আমার নিকট উপস্থিত হইলেন। তাঁহার সহিত অপর আর একটি লোককে দেখিতে পাইলাম।
সেই পরিচিত লোকটি আমাকে কহিলেন, “আমি কোন একটি সবিশেষ গোপনীয় কার্য্যের পরামর্শ লইবার নিমিত্ত আপনার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। এখন আমাদিগের কি করা কর্তব্য, তাহা যদি আমাকে বলিয়া দেন, তাহা হইলে আমার সমভিব্যাহারী এই লোকটি সবিশেষরূপ উপকৃত হন। আপনি যেমন আমার বন্ধু, ইনিও আমার সেইরূপ।”
আমি। ইঁহার কি হইয়াছে?
পরিচিত। ইঁহার যথাসর্ব্বস্ব গিয়াছে। ইঁহার মত অবস্থার লোকের একবারে পাঁচ হাজার টাকা লোকসান হইলে যে কিরূপ অবস্থা হয়, তাহা আপনি অনায়াসেই বিবেচনা করিতে পারেন।
আমি। কি হইয়াছে? কিরূপে ইঁহার পাঁচ সহস্ৰ মুদ্রা লোকসান হইয়াছে?
পরিচিত। যেরূপ উপায়ে পাঁচ সহস্ৰ মুদ্রা লোকসান হইয়াছে, তাহা সবিশেষরূপে বর্ণনা করাও সহজ ব্যাপার নহে। কারণ, সমস্ত কথা প্রকাশ হইয়া পড়িলে, সেই ভয়ানক লোকসানের উপর হয়ত ইনি সবিশেষরূপে বিপদগ্রস্তও হইতে পারেন।
আমি। ইনি যখন আপনার বন্ধু, এবং আপনি যখন ইঁহাকে সঙ্গে করিয়া আমার নিকট আনিয়াছেন, তখন আমার নিকট সমস্ত কথা প্রকাশ করিলে, ইঁহার কোনরূপে আর অধিক বিপদাপন্ন হইবার সম্ভাবনা নাই।
পরিচিত। আমি তাহা অবগত আছি, এবং আপনার উপর আমার বিশ্বাস আছে বলিয়াই, আমি ইঁহাকে সঙ্গে লইয়া আপনার নিকট আনিয়াছি। আপনি ইহার আমূল বৃত্তান্ত ইঁহারই নিকট হইতে অবগত হউন।
এই বলিয়া তিনি তাঁহার সমভিব্যাহারী লোকটিকে কহিলেন, “আপনার যাহা যাহা ঘটিয়াছে, তাহার কোন কথা গুপ্তভাবে রাখিবার আপনার প্রয়োজন নাই। আপনি মন খুলিয়া সমস্ত কথা ইঁহাকে বলিতে পারেন। বিশেষতঃ সমস্ত কথা অবগত হইতে না পারিলেই বা কিরূপে সৎপরামর্শ পাওয়া যাইতে পারে?”
আমার পরিচিত ব্যক্তির কথা শুনিয়া তাঁহার বন্ধু কহিতে লাগিলেন-
“মহাশয়! আমার বাসস্থান নিচুবাগান। সামান্য দালালীই আমার ব্যবসা, বাড়ী ও জমি বন্ধক বা বিক্রয়ের দালালী করিয়া আমি এ পর্য্যন্ত আমার জীবন অতিবাহিত করিয়া আসিতেছি। তাহা হইতেই কষ্টে-সৃষ্টে সংসার প্রতিপালন করিয়া, আমার জীবনে আমি পাঁচ হাজার টাকার সংস্থান করিয়াছিলাম; কিন্তু মহাশয়! লোভে পড়িয়া আমি আমার চিরোপার্জিত সমস্ত অর্থ নষ্ট করিয়াছি!”
আমি। কিরূপ লোভে পড়িয়া আপনি আপনার সমস্ত অর্থ নষ্ট করিয়া ফেলিয়াছেন?
বন্ধু। যেরূপ লোভে পড়িয়া আমি আমার যথাসর্ব্বস্ব নষ্ট করিয়াছি, তাহার সমস্ত বৃত্তান্ত আনুপূর্ব্বিক আমি বলিতেছি।
“আমি যেরূপ কষ্টে সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিয়া কিছু অর্থের সংস্থান করিয়া রাখিয়াছিলাম, তাহা অপর কেহ জানিত বলিয়া আমার বিশ্বাস ছিল না। এমন কি, একথা আমি কখনও আমার স্ত্রী-পুত্রগণের নিকটেও ঘূণাক্ষরে উহা প্রকাশ করি নাই; কিন্তু জুয়াচোরগণ যে কিরূপে তাহা জানিতে পারিয়াছিল, তাহা অতীব আশ্চর্য্যের বিষয়!
“সেখ বছিরুদ্দিন নামক এক ব্যক্তিকে আমি পূৰ্ব্ব হইতে চিনিতাম। ইতিপূর্ব্বে তাহার বাসস্থান আমি না জানিলেও অনেকদিবস হইতে সে আমার নিকট পরিচিত ছিল। সে প্রায়ই আমার নিকট আগমন করিত, এবং মধ্যে মধ্যে দুই একটি দালালী কার্য্যে আমার সহায়তা করিয়া আমার কিছু উপকার করিত। তাহাতে নিজেও সে দুই পয়সা উপার্জ্জন করিত।
“প্রায় দুই সপ্তাহ অতীত হইল, একদিবস সন্ধ্যার পর আমি আমার বাড়ীতে বসিয়া আছি, এমন সময়ে সে আসিয়া আমার বাড়ীতে উপস্থিত হইল। আমি তাহাকে বসিতে বলিলাম, সে সেই স্থানেই উপবেশন করিল। এরূপভাবে বছিরুদ্দিন মধ্যে মধ্যে কখন কখন আমার নিকট আসিত, এবং এক-আধঘণ্টাকাল গল্প-গুজব করিয়া চলিয়া যাইত। আমি যে দিবসের কথা বলিতেছি, সেইদিবসও বছিরুদ্দিন পূর্ব্বের ন্যায় আসিয়া উপবেশন করিল। পরে একথা ওকথা প্রভৃতি নানা কথা বলিয়া প্রায় একঘণ্টাকাল অতিবাহিত করিল। পরিশেষে আপন স্থানে গমন করিবার নিমিত্ত গাত্রোত্থান করিল, এবং সেই সময় আমাকে কহিল, “মহাশয়! দশ টাকা উপার্জ্জনের একটি সবিশেষ সুযোগ উপস্থিত হইয়াছে; কিন্তু আপনার সহিত পরামর্শ না করিয়া, আমি কোন প্রকারেই তাহাতে হস্তক্ষেপ করিতে পারিতেছি না। যদি আপনার মত হয়, বা আপনি যদি এ বিষয়ে পরামর্শ দেন, তাহা হইলে এবার আমি অনায়াসেই কিছু অর্থ উপার্জ্জন করিয়া লইতে পারি।”
আমি। হঠাৎ কিরূপ সুযোগ আসিয়া উপস্থিত হইল?
বছিরুদ্দিন। কিছুদিবস অতীত হইল, সহরতলীর কোন এক পোদ্দারের দোকান হইতে বিস্তর টাকার সোণার অলঙ্কার অপহৃত হইয়াছে; ইহা বোধ হয়, আপনি অবগত আছেন।
আমি। এরূপ যে কোন চুরি হইয়াছে, আমি তাহার কিছুই অবগত নহি।
বছিরুদ্দিন। উহা আপনি শ্রবণ করেন নাই? যে চুরি লইয়া সহরময় গোলযোগ হইয়াছে, পুলিস-কৰ্ম্মচারীগণ যে মোকদ্দমা সবিশেষ যত্ন ও পরিশ্রমের সহিত অনুসন্ধান করিয়াছিলেন, এবং এখন পর্যন্ত করিতেছেন, সেই মোকদ্দমার কথা আপনি অবগত হন নাই! আমি শুনিয়াছি, এই চুরির বিষয় সংবাদ পত্রেও প্রকাশিত হইয়াছিল।
আমি। না, আমি ইহার কিছুই জানিতে পারি নাই।
বছিরুদ্দিন। আপনি যদি ইহার কিছুই না শুনিয়া থাকেন, তাহা হইলে সে সম্বন্ধে আমি আপনাকে কিছু দেখাইতেছি, তাহা হইলেই আপনি ইহার বিষয় সম্পূর্ণরূপে অবগত হইতে পারিবেন। যে সময়ে পুলিস-কর্মচারীগণ সেই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতেছিলেন, সেই সময় তাহার অপহৃত দ্রব্যের একখানি বিস্তৃত তালিকা প্রস্তুত করিয়া সর্ব্বসাধারণের গোচরার্থে তাহা প্রচারিত করা হয়। সেই তালিকার একখানি আমার হস্তে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। উহা আমি আমার নিকটেই রাখিয়াছিলাম, এবং এখন উহা আমি সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি। উহা দেখিলেই আপনি তাহার সমস্ত ব্যাপার অবগত হইতে পারিবেন।
“এই বলিয়া বছিরুদ্দিন একখানি মুদ্রিত তালিকা আমার হস্তে প্রদান করিল। উহা পাঠ করিয়া আমি অবগত হইতে পারিলাম যে, পূর্ব্ব-কথিত পোদ্দারের দোকান হইতে কোন্ কোন্ দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে।
তালিকাখানি পাঠান্তে আমি বছিরুদ্দিনকে কহিলাম, “চুরি গিয়াছে অপরের, এবং চুরি করিয়াছে চোরে, ইহাতে আমাদিগের লাভ-লোকসান কি?”
বছিরুদ্দিন। লোকসান না হউক, যদি কিছু লাভের আশা না থাকিবে, তাহা হইলে আপনাকে একথা বলিব কেন?
আমি। ইহাতে আমাদিগের আর কি লাভ হইবে?
বছিরুদ্দিন। আমার সমস্ত কথা শুনিলেই অবগত হইতে পারিবেন যে, ইহাতে আমাদিগের কোনরূপ লাভ হইতে পারে কি না?
আমি। আচ্ছা, কি বলিতে চাহ, বল; আমি সমস্ত কথাই সবিশেষ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিতেছি।
বছিরুদ্দিন। এই চুরি যে কাহার দ্বারা হইয়াছে, তাহা আমি জানিতে পারি নাই; কিন্তু অপহৃত অলঙ্কারগুলি কাহার নিকট আছে, তাহা আমি অবগত হইতে পারিয়াছি।
আমি। তাহা হইলে কিছু লাভের সম্ভাবনা আছে সত্য। সেই গহনাগুলি যাহার নিকট আছে, তাহাকে অপহৃত অলঙ্কারগুলির সহিত পুলিসের হস্তে ধরাইয়া দিতে পারিলে, বোধ হয়, সরকার হইতে ও ফরিয়াদীর নিকট হইতে পারিতোষিক পাওয়ার বেশ সম্ভাবনা আছে।
বছিরুদ্দিন। আপনি যাহা কহিলেন, তাহা সত্য। আপনার প্রস্তাবিতরূপ কার্য্য করিয়া, সময় সময় অনেকেই পারিতোষিক পাইয়া থাকেন সত্য; কিন্তু তাহার সংখ্যা অতি অল্প। আমি যে বিষয়ের প্রস্তাব করিতেছি, তাহা যদি আমরা সম্পন্ন করিতে পারি, তাহা হইলে আমাদিগের লাভের সংখ্যা ইহা অপেক্ষা অনেক অধিক।
আমি। তুমি কিরূপ প্রস্তাব করিতেছ?
বছিরুদ্দিন। আমি যে ঠিক প্রস্তাব করিতেছি, তাহা নহে। আপনাকে সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করি বলিয়া, আমি যাহা কিছু জানিতে পারিয়াছি, তাহাই আপনাকে বলিতে আসিয়াছি। আমার সমস্ত কথা শুনিয়া, আপনি যেরূপ কহিবেন, আমি সেইরূপ কার্য্য করিব।
আমি। আচ্ছা বল; তোমার সমস্ত কথা অগ্রেই শোনা যাউক।
বছিরুদ্দিন। সেই সকল অপহৃত সুবর্ণ-অলঙ্কার যাহার নিকট এখন আছে, তিনি আমার নিকট পরিচিত, এবং আপনি আমাকে যেরূপ বিশ্বাস করিয়া থাকেন, তিনিও আমাকে সেইরূপ ভাবে বিশ্বাস করেন।
আমি। তিনি কি বলেন?
বছিরুদ্দিন। তিনি বলেন যে, তাঁহার পরিচিত এক ব্যক্তি তাঁহার নিকট সেই সকল অলঙ্কার রাখিয়া গিয়াছেন। আর উহা উচিত-মূল্যে যাহাতে বিক্রীত হয়, সেই বিষয়ে বন্দোবস্ত করিতে আমাকে বলিয়া গিয়াছেন।
আমি। উচিত-মূল্য কিরূপ?
বছিরুদ্দিন। চোরা-দ্রব্যের যেরূপ উপযুক্ত মূল্য আছে।
আমি। সে কিরূপ?
বছিরুদ্দিন। অর্দ্ধ মূল্য।
আমি। কিরূপ অর্দ্ধমূল্য? যাচাই করিয়া যে মূল্যের সুবর্ণ আছে, তাহার অর্দ্ধ মূল্য? না, অলঙ্কার প্রস্তুত করাইতে সুবর্ণের মূল্য, প্রস্তুত করিবার মজুরি প্রভৃতি যাহা কিছু ব্যয় হইয়াছে, তাহার অর্দ্ধ মূল্য?
বছিরুদ্দিন। চোরা-দ্রব্যের অর্দ্ধ মূল্য সেরূপ নহে। সমস্ত সুবর্ণ গলাইলে, বা কোন পোদ্দারের নিকট হইতে যাচাই করিয়া, যখন জানিতে পারা যাইবে, সেই অলঙ্কার গলাইলে, উহা কি মূল্যের সুবর্ণে পরিণত হইবে, তাহারই অর্দ্ধ মূল্য।
আমি। এরূপ অবস্থায় উহা ক্রয় করিতে পারিলে, সবিশেষ লাভের সম্ভাবনা আছে সত্য কিন্তু বিপদও যথেষ্ট আছে। ধরা পড়িলে জেল হইতে কোনরূপেই নিষ্কৃতি পাইবার আশা নাই।
বছিরুদ্দিন। ধরা পড়িলে জেল হইবার সম্ভাবনা আছে, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু যাহাতে ধরা না পড়া যায়, এরূপ বিবেচনার সহিত কার্য্য করিতে পারিলে, একবারে চিরদিবসের জন্য দুঃখ ঘুচিয়া যাইবার সম্ভাবনা। আর এত টাকা একবারে লাভ করিতে গেলে, একটু দায়িত্ব স্বীকার করিতে না পারিলেই বা চলিবে কি প্রকারে?
আমি। সেই অলঙ্কারগুলি এখন সেই ব্যক্তি কাহার নিকট বিক্রয় করিতে চাহে?
বছিরুদ্দিন। সেই সকল অলঙ্কার বিক্রয়ের ভার তিনি এখন আমার হস্তে অর্পণ করিয়াছেন। আমি যাহাকে লইয়া যাইব, তিনি তাহারই নিকট উহা বিক্রয় করিতে পারেন।
আমি। তুমি কোন লোক ঠিক করিতে পারিয়াছ?
বছিরুদ্দিন। না, আমি অনেক চেষ্টা করিতেছি; কিন্তু এ পর্য্যন্ত কোন লোক ঠিক করিতে পারি নাই।
আমি। যে কার্য্যে এরূপ লাভ হইবার সম্ভাবনা, তাহা বিক্রয় করিতে আর ভাবনা কি?
বছিরুদ্দিন। ভাবনা খুব অধিক। কারণ, মনের মত গ্রাহক এরূপ কার্য্যের নিমিত্ত কয়জন পাওয়া যাইতে পারে?
আমি। তাহার কারণ?
বছিরুদ্দিন। তাহার কারণ বিস্তর। প্রথমতঃ সবিশেষ বিশ্বাসী লোক ভিন্ন একথা যাহাকে ইচ্ছা, তাহাকে বলা যায় না। কারণ, কি জানি কাহার মনে কি আছে, কি করিতে কি হইবে; যাহাকে তাহাকে বিশ্বাস করিয়া হঠাৎ বিপদগ্রস্ত হইব? দ্বিতীয়তঃ সবিশেষ বিশ্বাসী লোকও পাওয়া যায়; কিন্তু তাঁহাদিগের হয় ত টাকার অভাব, অধিক টাকা সংগ্রহ করিবার ক্ষমতা তাঁহাদিগের নাই সুতরাং কেবল বিশ্বাসী লোক পাইলেও তাহাতে আমাদিগের কিছুমাত্র উপকার হয় না। যে ব্যক্তির পয়সা আছে, অথচ বিশ্বাসী, এরূপ কয়জন লোক কয়জনের পরিচিত আছে? এইরূপ নানাকারণে এ কার্য্যে সবিশেষ লাভের সম্ভাবনা থাকিলেও, উপযুক্তরূপ লোক পাওয়া যায় না বলিয়াই, চোরা-দ্রব্য সকল এত অল্প মূল্যে বিক্রীত হইয়া থাকে। কেন, আপনি কি অবগত নহেন যে, এক একজন এইরূপে চোরা-দ্রব্য ক্রয় করিয়া পূর্ব্বে কিরূপ বড়লোক হইয়া পড়িয়াছে, এবং তাঁহাদিগের পুত্র পৌত্রগণ এখনও জমিদার নামে অভিহিত? আমি যে সকল জমিদারের কথা বলিতেছি, তাঁহাদিগের পূর্ব্ব-পুরুষগণের মধ্যে অনেকেই যে কেবল চোরা-দ্রব্য আহরণ করিয়াই বড়লোক হইয়াছিলেন, তাহা নহে। তাঁহাদিগের মধ্যে অনেকে চোর প্রতিপালিত করিয়া, অপরের গৃহে চুরি পর্য্যন্ত করাইয়া সেই সকল দ্রব্য গ্রহণ করিতেন। তাহাতেই তাঁহারা বড়লোক হইয়াছিলেন।
আমি। তাঁহার নিকট কতগুলি সুবর্ণের অলঙ্কার আছে?
বছিরুদ্দিন। অনেক টাকার অলঙ্কার আছে। আমার বোধ হয়, বিশ হাজার টাকার মূল্যের কম হইবে না। দেখুন না কেন, এই তালিকাতেই ত সমস্ত অলঙ্কারের মূল্য লেখা আছে। আমি হিসাব করিয়া দেখিয়াছি, তালিকায় যে মূল্য লেখা আছে, তাহাতে জানা যায়, সেই সকল অলঙ্কারের মূল্য পঁচিশ হাজার টাকা। কিন্তু আমরা উহা ধরিব কেন, উহার “পান” মজুরি প্রভৃতি মোটামুটি বাদ দিয়া, আমি বিশ হাজার টাকা মূল্য ধরিয়া লইতেছি।
আমি। আচ্ছা বছিরুদ্দিন! আমরা যদি সেই সকল অলঙ্কার গ্রহণ করি, তাহা হইলে উহা আমরা বিক্রয় করিব কি প্রকারে?
বছিরুদ্দিন। তাহা অতি সহজ। একজন বিশ্বাসী স্বর্ণকারকে কিছু দিয়া, যদি তাহার দ্বারা সেই সকল অলঙ্কার গলাইয়া ফেলিতে পারি, তাহা হইলে আমাদিগের আর কোনরূপ চিন্তাই থাকিবে না। যেস্থানে ইচ্ছা, সেই স্থানে লইয়া গিয়া, যাহার নিকট ইচ্ছা হইবে, তাহার নিকটে অনায়াসেই বিক্রয় করিতে পারিব। কিন্তু সেই সকল অলঙ্কার গলাইয়া ফেলিতে পারে, যদি এরূপ কোন বিশ্বাসী লোক প্রাপ্ত না হই, তাহা হইলে রহিয়া বসিয়া সেই সকল অলঙ্কার বিক্রয় করিতে হইবে, অর্থাৎ নিজের পরিবারের গহনা পরিচয়ে দুই একখানি করিয়া, ক্রমে ক্রমে উহা বিক্রয় করিতে হইবে।
আমি। দেখ বছিরুদ্দিন। আমি তোমার নিকট হইতে সমস্ত অবগত হইলাম। মনে হইতেছে, সেই সকল গহনা আমরা উভয়ে মিলিয়া ক্রয় করি, কিন্তু এত টাকা কোথায় পাইব? দশ হাজার টাকা সংগ্রহ করা, আমাদিগের ন্যায় মনুষ্যের পক্ষে কি সহজ কথা?
বছিরুদ্দিন। দশ হাজার টাকাই যে আপনাকে সংগ্রহ করিতে হইবে, তাহা নহে। আমার বোধ হয়, সবিশেষ চেষ্টা করিলে, উহার মূল্য আরও দুই এক হাজার কম করিতে সমর্থ হইব। তদ্ব্যতীত আমার নিকটেও সামান্য কিছু আছে, তাহা দিয়াও আমি কিছু সাহায্য করিতে পারিব।
আমি। তুমি কত টাকা দিয়া আমাকে সাহায্য করিতে পারিবে?
বছিরুদ্দিন। আমি আপনাকে এক পয়সা দিয়া সাহায্য করিব না। আমি যে পরিমিত টাকা প্রদান করিব, সেই পরিমিত অংশ আমাকে প্রদান করিতে হইবে।
আমি। তাহা ত নিশ্চয়। তুমি কত টাকা সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইবে?
বছিরুদ্দিন। আমার নিকট এক সহস্র টাকা আছে, তাহা দিয়া আমি আপনাকে সাহায্য করিতে প্রস্তুত আছি।
আমি। মনে কর, সেই সকল অলঙ্কারের মূল্য যদি আট হাজার টাকা হয়, তাহা হইলে তুমি না হয়, সহস্র মুদ্রা প্রদান করিলে, অবশিষ্ট সাত হাজার টাকা আমি কোথায় পাইব? অত টাকা ত আমার নাই।
বছিরুদ্দিন। আপনার কত টাকা আছে?
আমি। আমার নিকট যে কত টাকা আছে, তাহা আজ পৰ্য্যন্ত কেহই অবগত নহে; আমি উহা কাহাকেও কখন বলি নাই। এমন কি, আমার স্ত্রী পর্য্যন্তও অবগত নহেন যে, আমার নিকট কি আছে; কিন্তু আজ আমি তাহা তোমার নিকট বলিতেছি। তুমি কিন্তু একথা কাহারও নিকট প্রকাশ করিও না, আমি আজীবনকাল খাটিয়া অনেক কষ্টে পাঁচ হাজার টাকার সংস্থান করিয়া রাখিয়াছি।
বছিরুদ্দিন। আপনার নিকট পাঁচ হাজার ও আমার নিকট এক হাজার, মোট ছয় হাজার টাকা হইল। অভাব পক্ষে আর দুই হাজার টাকা কোথায় পাওয়া যাইবে?
আমি। আমার নিকট পাঁচ হাজার টাকা আছে, বটে, কিন্তু আমি তাহার সমস্ত এই কার্য্যের নিমিত্ত প্রদান করিতে পারিব না। অভাব পক্ষে এক সহস্র টাকা আমি আমার হস্তে রাখিব। চারি হাজার টাকা আমি প্রদান করিতে সম্মত আছি।
বছিরুদ্দিন। তাহা হইলে কোন প্রকারেই হইবে না।
আমি। আচ্ছা, আর এক কাজ করিলে হয় না,—প্রত্যেক অলঙ্কারের মোটামুটি একটা একটা পৃথক্ পৃথক্ দাম স্থির করিয়া লইয়া আমরা যে পরিমাণ অর্থ প্রদান করিব, সেই পরিমাণ অলঙ্কার ক্রয় করিলে চলিবে না? উহা বিক্রয় করিয়া বা অপর কোন উপায়ে যখন যেরূপ অর্থের সংস্থান করিতে পারিব, তখন পুনরায় সেই পরিমিত অলঙ্কার লইলে চলিবে না?
বছিরুদ্দিন। যদি তাহাই হইত, তাহা হইলে আমি সেই কার্য্যের নিমিত্ত কি আপনার নিকট আসিতাম? আমার নিকট যে সহস্র মুদ্রা আছে, তাহার দ্বারাই আমি এতদিবস ক্রমে ক্রমে সেই অলঙ্কারগুলি গ্রহণ করিয়া, বিক্রয় করিয়া ফেলিতাম। উহারা অল্পে অল্পে বিক্রয় করিতে চাহে না, সমস্তগুলি একবারে ক্রয় না করিলে উহারা বিক্রয় করিবে না।
আমি। তাহা হইলে আমি আর কি করিব? যাহা আমার ক্ষমতার অতীত, তাহা আমি কিরূপে সম্পন্ন করিতে পারিব?
বছিরুদ্দিন। এরূপ সুযোগ আমরা সহজে পরিত্যাগ করিব না; সবিশেষরূপ চেষ্টা করিয়া দেখিতেই হইবে, যাহাতে সেই সকল অলঙ্কার আমাদিগের হস্তগত হয়। আপনি এক কাজ করুন, একটি সময় অবধারিত করুন, সেই সময় আপনি ও আমি উভয়ে একত্র গমন করিয়া প্রথমতঃ অলঙ্কারগুলি দেখিয়া আসি। পরিশেষে যেরূপ বিবেচনা হয়, করা যাইবে। যাঁহার নিকট অলঙ্কারগুলি আছে, তিনি একজন অতিশয় বিশ্বাসী লোক, এবং কখনও মিথ্যা কথা কহেন না সত্য; কিন্তু আমি নিজ চক্ষে সেই অলঙ্কারগুলি এখন পর্যন্ত আপন চক্ষে দেখি নাই। হাজার বিশ্বাসী লোকেরও সহিত কার্য্য করিতে হইলে সেই কাৰ্য্য একবার নিজ চক্ষে দেখিয়া লওয়া মানবমাত্রেরই সর্ব্বতোভাবে কর্তব্য।
আমি। তাহাতে ক্ষতি কি? আপনি যে সময় বলিবেন, আমি সেই সময়েই আপনার সহিত গমন করিতে প্রস্তুত আছি। আজকাল আমার হস্তে কোন কায কৰ্ম্ম নাই, রাত্রি-দিন বাড়ীতেই বসিয়া আছি।
বছিরুদ্দিন। তাহা হইলে এখন আমি বিদায় হইলাম। তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ-পূৰ্ব্বক সমস্ত ঠিক করিয়া সন্ধ্যার পর, আমি পুনরায় আগমন করিব, এবং যদি সুবিধা হয়, তাহা হইলে সেই সময়েই আপনাকে সঙ্গে করিয়া লইযা যাইব।
আমি। রাত্রিতে কেন?
বছিরুদ্দিন। এ সকল কার্য্যে রাত্রিতেই সুবিধা হয়। কারণ, দিবাভাগে সকল স্থানেই নানা লোকজনের যাতায়াত, পাছে কেহ টের পায়, ও গোলযোগ হইয়া পড়ে।
“আমাদিগের মধ্যে এইরূপ কথাবার্তা হইবার পর, বছিরুদ্দিন সেই সময় সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। “বছিরুদ্দিন প্রস্থান করিলে পর, নানাপ্রকার চিন্তা আসিয়া আমার মনে উদয় হইতে লাগিল। এরূপ ভয়ানক কার্য্যে হস্তক্ষেপ করা আমাদিগের ন্যায় লোকের কর্তব্য কি না। ঈশ্বর না করুন, এইরূপ কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিলে যদি কোনরূপ বিপদগ্রস্ত হইয়া পড়ি, তাহা হইলে সেই বিপদ হইতে উদ্ধার পাইবার সম্ভাবনা আছে কি না। যদি সেই বিপদ হইতে কোনরূপে উদ্ধার পাইতে না পারি, তাহা হইলে আমার ও আমার পরিবারবর্গের দশা কি হইবে? অথচ চিরোপার্জিত অর্থগুলি একবারেই নষ্ট হইয়া যাইবে! আবার ভাবিলাম, এতকাল সবিশেষরূপ কষ্ট স্বীকার করিয়া “পেটের উপর বাণিজ্য” করিয়া পরিবারবর্গকে অন্ন-বস্ত্রের কষ্ট দিয়া এই সামান্য কয়েক সহস্র টাকা সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়াছি। ইহা অপেক্ষা আর যে কিছু সংস্থান করিতে পারিব, তাহাও আমার মনে হয় না। এরূপ অবস্থায় এরূপ সুযোগ পরিত্যাগ করা কি আমার কর্তব্য? এরূপ সুযোগ সকল সময়ে পাওয়া যায় না, জীবনে অর্থোপার্জ্জনের উপায় দুই একবার মাত্র ঘটিয়া থাকে। সেই সময় বিবেচনার সহিত কার্য্য করিতে পারিলে, কখনও কষ্ট পাইবার সম্ভাবনা থাকে না।
“মনে মনে এইরূপ নানাপ্রকার চিন্তা করিলাম; কিন্তু কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। কখনও মনে হইল, এরূপ কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিব না; আবার মনে হইল, এরূপ সুযোগ পরিত্যাগ করিব না।
“সন্ধ্যার পর বছিরুদ্দিন আসিয়া উপস্থিত হইল ও কহিল, “মহাশয়! আমি সমস্তই ঠিক করিয়া আসিয়াছি। আমার সহিত আপনি তাঁহার বাড়ীতে গমন করিলেই, আপনি সমস্ত অলঙ্কার দেখিতে পাইবেন।”
“অলঙ্কার ক্রয় করি, আর না করি, একবার সেই স্থানে গমন করিয়া সেই অলঙ্কারগুলি স্বচক্ষে দেখিয়া আসিলে ক্ষতি কি? মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া তাহার সহিত গমন করিতে সম্মত হইলাম।
“বছিরুদ্দিন আমাকে সঙ্গে লইয়া বাড়ী হইতে বহির্গত হইল। নানাস্থান অতিক্রম করিয়া একটি সামান্য বাড়ীর মধ্যস্থিত একখানি খোলার ঘরে আমাকে লইয়া গিয়া উপস্থিত হইল।
“সেই স্থানে গিয়া দেখি, একটি লোক— জাতিতে মুসলমান, তাহার বাহিরের বসিবার একখানি সামান্য ঘরের মধ্যে বসিয়া রহিয়াছে। বছিরুদ্দিন আমাকে সঙ্গে লইয়া একবারে সেই ঘরের মধ্যে গিয়া উপস্থিত হইল, এবং আমাকে সেই স্থানে বসিতে বলিল। আমি সেই ঘরের মধ্যস্থিত একটি মোড়ার উপর উপবেশন করিলাম।
“সেই ব্যক্তি। ইনি কে?
বছিরুদ্দিন। আমি আপনাকে যাহার কথা বলিয়াছিলাম, ইনি সেই ব্যক্তি।
সেই ব্যক্তি। তোমার সহিত ইঁহার কত দিবসের পরিচয়?
বছিরুদ্দিন। অনেক দিবসের। আমি সে কথা ত আপনাকে পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি।
সেই ব্যক্তি। তুমি ইঁহাকে বিশ্বাস করিতে পার?
বছিরুদ্দিন। সামান্য বিষয়ে বিশ্বাস কেন? আমি আমার প্রাণ দিয়া ইঁহাকে বিশ্বাস করিতে পারি।
সেই ব্যক্তি। কথাবার্তা সমস্ত স্থির হইয়াছে ত?
বছিরুদ্দিন। প্রায় স্থির হইয়াছে। যাহা কিছু বাকী আছে, তাহা গহনাগুলি দেখিবার পরেই স্থির হইয়া যাইবে।
সেই ব্যক্তি। গহনাগুলি পূর্ব্বে দেখিবার প্রয়োজন কি? অগ্রে সমস্ত ঠিক হইয়া গেলে, পরিশেষে যখন ইনি উহা গ্রহণ করিবেন, সেই সময় দেখিয়া ও যাচাইয়া লইলে চলিতে পারে।
বছিরুদ্দিন। তাহা হইতে পারে সত্য; কিন্তু আমার ইচ্ছা আপনি গহনাগুলি ইঁহাকে অগ্রে একবার দেখাইয়া দিন।
সেই ব্যক্তি। তাহাই যদি তোমার একান্ত অভিমত হয়, তাহা হইলে তাহাই হইবে। তুমি কোনদিবস সন্ধ্যার পর ইঁহাকে সঙ্গে করিয়া আমার নিকট লইয়া আসিও। সেইদিবস আমি গহনাগুলি সেই তালিকার সহিত এক একখানি করিয়া মিলাইয়া দেখাইয়া দিব।
বছিরুদ্দিন। আজ যখন ইনি আসিয়াছেন, তখন পুনরায় আর একদিবস আসিবার প্রয়োজন কি? এখনই কেন আপনি তাহা ইঁহাকে একবার দেখাইয়া দিন না। আমিও একবার উহা দেখিয়া লই। কারণ, ইতিপূর্ব্বে আমিও ত সেই সকল অলঙ্কার দর্শন করি নাই।
সেই ব্যক্তি। ইহাই যদি তোমার নিতান্ত ইচ্ছা হয়, তাহা হইলে তোমার মনোবাঞ্ছা আমি পূর্ণ করিতেছি; কিন্তু এইস্থানে তাহা হইতে পারে না। এরূপ প্রকাশ্য স্থানে সেই সকল দ্রব্য কোনরূপেই বাহির করা যাইতে পারে না। আচ্ছা, আপনারা এই স্থানে একটু অপেক্ষা করুন, আমি তাহার বন্দোবস্ত করিয়া আসিতেছি।
“এই বলিয়া সেই ব্যক্তি সেই স্থান হইতে উঠিয়া একটি দরজার পরদা ঠেলিয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল, এবং কিয়ৎক্ষণ পরে বাড়ীর ভিতর হইতে সেই ঘরে প্রত্যাবর্তন করিয়া কহিল, “আইস, আমার পরিবারগণকে অপর একটি ঘরের মধ্যে রাখিয়া আসিয়াছি। আপনারা আমার সহিত বাড়ীর ভিতর আসুন। সেই স্থানে আমি সমস্তই আপনাদিগকে দেখাইতেছি; কিন্তু উহা লইয়া বেশী দেরী করিতে পারিবেন না। যতশীঘ্র পারেন, কার্য্য সম্পন্ন করিয়া লইতে হইবে।”
এই বলিয়া তিনি আমাদিগকে সঙ্গে লইয়া তাঁহার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন, এবং ঘরের মধ্যস্থিত একটি ঘরের ভিতর আমাদিগকে বসাইয়া, তিনি পুনরায় সেই ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে একটি টিনের বাক্স হস্তে সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলেন। আমরা যে ঘরের ভিতর বসিয়াছিলাম, সেই ঘরের এক পার্শ্বে একটি মৃন্ময় প্রদীপ টিপ্ টিপ্ করিয়া জ্বলিতেছিল। তিনি সেই বাক্সটি আনিয়া আমাদিগের সম্মুখে রাখিলেন, এবং উহা খুলিয়া দিয়া কহিলেন, ইহার ভিতরই সমস্ত অলঙ্কার আছে। এই বলিয়া সেই বাক্সের মধ্য হইতে গহনাগুলি বাহির করিয়া, মৃত্তিকার উপর স্থাপন করিলেন ও বছিরুদ্দিনকে কহিলেন, “তোমার নিকট যে তালিকাখানি আছে, তাহা বাহির করিয়া এই বাবুটির হস্তে প্রদান কর। বাবু এই অলঙ্কারগুলির এক একখানি করিয়া সেই তালিকার সহিত মিলাইয়া দেখুন।”
“এই বলিয়া তিনি পুনরায় ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন, এবং একবার এদিক ওদিক চতুৰ্দ্দিক দেখিয়া পুনরায় বাটীর ভিতর প্রবেশ করিয়া বাটীর দরজা ও যে ঘরে আমরা বসিয়াছিলাম, সেই ঘরের দরজা ভিতর হইতে বন্ধ করিয়া দিলেন।
“যে তালিকাখানি বছিরুদ্দিন পূর্ব্বে আমাকে দেখাইয়াছিল, সে তাহা সঙ্গে করিয়াই লইয়া গিয়াছিল। সে সেই তালিকাখানি বাহির করিয়া আমার হস্তে প্রদান করিল ও কহিল, “বেশ করিয়া গহনাগুলি এই তালিকার সহিত মিলাইয়া দেখুন।” এই বলিয়া বছিরুদ্দিনও দুই একখানি গহনা আপন হস্তে লইল ও কহিল, “বেশ গহনা।”
“সেই সামান্য প্রদীপালোকে সেই গহনাগুলি দেখিয়া আমারও বেশ প্রতীয়মান হইল যে, উহা সুবর্ণ অলঙ্কার। “সেই ব্যক্তি আমাকে কহিল, “আপনি তালিকা দেখিয়া বলিয়া যাউন। আমি সেই অনুযায়ী গহনাগুলি মিলাইয়া এই বাক্সের ভিতর রাখিয়া দি।”
“কাৰ্য্যে তাহাই হইল, আমি সেই তালিকা দেখিয়া এক একখানি গহনার নাম বলিতে লাগিলাম, তিনি সেই গহনাগুলির মধ্য হইতে সেই সেই গহনা বাছিয়া লইয়া প্রথমতঃ আমার হস্তে প্রদান করিতে লাগিলেন, এবং পরিশেষে টিন-বাক্সের মধ্যে রাখিতে লাগিলেন।
“এইরূপে সমস্ত গহনা মিলাইয়া দেখা হইলে বছিরুদ্দিন কহিল, “এখন আপনি স্পষ্ট করিয়া বলিয়া দিন, এই সকল অলঙ্কারের মূল্য কত টাকা আপনাকে প্রদান করিতে হইবে।”
সেই ব্যক্তি। আমি ত বলিয়াছি, দশ হাজার টাকা।
বছিরুদ্দিন। আপনি দশ হাজার টাকা বলিয়াছিলেন; কিন্তু আমি আসিয়া আপনাকে আট হাজার টাকা বলিয়া গিয়াছিলাম; কিন্তু এখন দেখিতেছি, সেই টাকাও আমরা কোনরূপে সংগ্রহ করিতে পারিতেছি না।
সেই ব্যক্তি। তাহা হইলে কিরূপে তোমরা ইহা গ্রহণ করিবে?
বছিরুদ্দিন। আরও দুই এক হাজার টাকা, হয়, কম করিয়া দিন, না হয়, এখন অর্দ্ধেকগুলি অলঙ্কার বিক্রয় করুন, কিছুদিবস পরে অপর অর্দ্ধগুলি লইয়া যাইব।
সেই ব্যক্তি। আমি ত পূৰ্ব্বেই তোমাকে বলিয়াছি যে, একত্র ভিন্ন এই সকল অলঙ্কার কোনরূপেই বিক্রয় করা হইবে না একবারে লইতে হইলে তোমরা কত টাকা পর্য্যন্ত দিতে পারিবে?
বছিরুদ্দিন। পাঁচ হাজার টাকা।
সেই ব্যক্তি। তাহা কি কখন হয়? কোথায় বিশ হাজার টাকা মূল্যের অলঙ্কারের দাম দশ হাজার, তাহাও না হইয়া একবারে পাঁচ হাজার! ইহা কোনরূপেই হইতে পারে না।
বছিরুদ্দিন। তাহা না হইলে আমরা কোনরূপেই আর অধিক টাকার সংগ্রহ করিতে পারিব না। তবে যদি তাহাতে আপনি একান্তই সম্মত না হন, তাহা হইলে না হয়, আর এক সহস্র টাকা পর্যন্ত যেরূপে হউক, সংগ্রহ করিয়া আপনাকে প্রদান করিব, তাহার অধিক আমরা কোনরূপেই দিতে পারিব না। ইহাতে যদি আপনি একান্ত অপারগ হয়েন, তাহা হইলে এই সকল অলঙ্কার আর আমরা গ্রহণ করিতে পারিব না।
“উভয়ের মধ্যে এইরূপ কথাবার্তা হইলে পর, তাহারা আমাকে সেই গৃহের মধ্যে রাখিয়া বাহিরে গমন করিল, এবং উভয়ে কিয়ৎক্ষণ কি পরামর্শ করিয়া পুনরায় সেই গৃহের ভিতর প্রত্যাবর্তন করিল।
“যাহার নিকট অলঙ্কার ছিল, তিনি অলঙ্কারের বাক্স লইয়া সেই ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন।
“তিনি বাহির হইয়া যাইলে পর, বছিরুদ্দিন আমাকে কহিল, “আমি উঁহাকে অনেক বুঝাইয়া দেখিলাম; কিন্তু উনি কোনরূপেই আট হাজার টাকার কমে স্বীকার করেন না। পরিশেষে অনেক কষ্টে ও অপরাপর প্রলোভন দেখাইয়া সাত হাজার টাকায় তাঁহাকে সম্মত করাইয়াছি। আপনি পাঁচ হাজার টাকা প্রদান করুন, আমি যেরূপে পারি, দুই হাজার টাকার সংস্থান করিয়া ইঁহাকে প্রদান করিব। ইহার কমে এ কার্যও কোনরূপেই সম্পন্ন হইতে পারে না। ইহাতে যদি আপনি সম্মত হন বলুন, নতুবা এই কাৰ্য্য আমাদিগকে পরিত্যাগ করিতে হয়, এরূপ লাভের আশায় একবারে জলাঞ্জলি দিতে হয়। তবে আপনাকে আমি এইমাত্র বলিতে পারি যে, এরূপ কার্য্য একবার হাতছাড়া হইয়া গেলে, পুনরায় আর এরূপ সুযোগ কখনও যে উদয় হইবে, তাহা আমার বোধ হয় না।”
“বছিরুদ্দিনের কথা শুনিয়া আমি মনে করিলাম, এখন আমার কি করা কর্ত্তব্য? আমার যাহা কিছু সংস্থান আছে, তাহার সমস্তই হস্তান্তর করা কর্তব্য কি না। আবার ভাবিলাম, যদি চারি হাজার টাকাই প্রদান করিতে পারি, তাহা হইলে সহস্র মুদ্রা রাখিয়া আমার আর সবিশেষ কি উপকার হইবে? এদিকে গহনাগুলি দেখিয়া আমি অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছিলাম, এবং আমার মনে প্রকৃতই প্রতীতি জন্মিয়াছিল যে, সেই সকল অলঙ্কারের মূল্য বিশ হাজার টাকার কম কোনরূপেই হইতে পারে না। অতএব এরূপ লাভের লোভই বা কিরূপে সম্বরণ করিতে পারি? মনে মনে এইরূপ নানাপ্রকার চিন্তা করিয়া পরিশেষে পাঁচ হাজার টাকা প্রদান করিতে একরূপ সম্মতই হইলাম, ও বছিরুদ্দিনকে কহিলাম, “যখন তুমি আমাকে পাঁচ হাজার টাকা প্রদান করিবার নিমিত্ত অনুরোধ করিতেছ, তখন কার্যেই আমাকে তোমার প্রস্তাবে সম্মত হইতে হইবে; কিন্তু আমি তোমাকে পূর্ব্বে একটি কথা অতি গোপনে বলিতে চাই।”
বছিরুদ্দিন। কি?
আমি। এই কলিকাতা সহর জুয়াচোরে পরিপূর্ণ। তাহা বোধ হয়, তুমি অবগত আছ।
বছিরুদ্দিন। তাহা আর আমি জানি না; কিন্তু এ সম্বন্ধে আমরা কিরূপে জুয়াচোরের হস্তে পতিত হইতে পারি?
আমি। তাহার অনেক উপায় আছে।
বছিরুদ্দিন। কি?
আমি। আমরা ইঁহাকে অগ্রে টাকা প্রদান করিব; কিন্তু পরিশেষে যদি ইনি আমাদিগকে অলঙ্কারগুলি প্রদান না করেন, তাহা হইলে কি উপায় হইবে?
বছিরুদ্দিন। কেন?
আমি। তাহা হইলে নালিশ করিয়া ইঁহার নিকট হইতে টাকা আদায় করা দূরে থাকুক, আমরা জানিয়া শুনিয়া চুরি করা দ্রব্য গ্রহণ করিবার নিমিত্ত উহাকে অর্থ প্রদান করিয়াছি, একথা কাহারও নিকট বলিতে পারিব না। তাহা হইলে আমাদিগের দশা কি হইবে, তাহা একবার ভাবিয়া দেখ দেখি।
বছিরুদ্দিন। আপনার এ চিন্তা করিবার প্রয়োজন নাই।
আমি। কেন?
বছিরুদ্দিন। আপনি বেশ জানিবেন, ইনি আমার সবিশেষ বিশ্বাসী, এবং অনেকদিবসের পরিচিত হইলেও, আমি ইঁহাকে একেবারে এত টাকা দিয়া কখনও বিশ্বাস করিব না।
আমি। তাহা হইলে তুমি কি করিবে?
বছিরুদ্দিন। গহনাগুলি অগ্রে বুঝিয়া লইব, তাহার পর তাঁহার হস্তে টাকা প্রদান করিব।
আমি। এরূপ করিতে পারিলে আর কোন চিন্তা নাই। কিন্তু কলিকাতা সহরের মধ্যে যেরূপ জুয়াচুরি আজকাল বাহুল্যরূপে প্রচারিত হইয়া পড়িয়াছে, যদি সেইরূপ হয়, তাহা হইলে কি উপায় হইবে?
বছিরুদ্দিন। সে কিরূপ জুয়াচুরি?
আমি। এই সকল অলঙ্কার সুবর্ণ বলিয়া আমরা ত এখন লইয়া গেলাম; কিন্তু বিক্রয়ের সময় যদি দেখিতে পাই, উহার একখানি অলঙ্কারও সুবর্ণের নহে, সমস্তই পিত্তলের, তবে আমাদিগের দশা কি হইবে, তাহা একবার ভাবিয়া দেখ দেখি।
বছিরুদ্দিন। এরূপ হইলে সবিশেষ অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা; কিন্তু তাহা কখনই হইতে পারে না।
আমি। কেন?
বছিরুদ্দিন। এরূপ ভাবে ইনি কখনও আমাকে ঠকাইতে পারিবেন না। মনে করুন, উঁহার অবস্থায় যদি আপনি থাকিতেন, আপনার নিকট যদি অলঙ্কারগুলি থাকিত, এবং আপনি উহা আমার নিকট বিক্রয় করিতেন, তাহা হইলে আপনি কি আমাকে সেইরূপ ভাবে প্রতারিত করিতে পারিতেন?
আমি। আমি অবশ্য তাহা পারিতাম না।
বছিরুদ্দিন। ইনিও সেইরূপ তাহা পারিবেন না। কারণ, আপনি আমাকে যেরূপ ভালবাসেন, বা অনুগ্রহ করেন, ইনিও আমাকে সেইরূপ ভালবাসেন ও একটু অনুগ্রহ করিয়া থাকেন।
আমি। সে যাহা হউক, যাহাতে সেইরূপ ভাবে আমরা প্রতারিত না হই, সেই সম্বন্ধে পূৰ্ব্ব হইতে সতর্ক হইবার কি কোনরূপ উপায় নাই?
বছিরুদ্দিন। উপায় থাকিবে না কেন?
আমি। কি উপায় আছে?
বছিরুদ্দিন। আমার এরূপ ক্ষমতা আছে যে, আমি সে সকল গহনার মধ্য হইতে একখানি গহনা কোন প্রকার ভাগ করিয়া অনায়াসেই লইয়া যাইতে পারি। তাহার পর, তাহা অগোচরে কোন স্থানে যাচাইয়া দেখিলেই আমরা জানিতে পারি যে, সেই গহনাখানি সোণার কি পিত্তলের। যদি উহা সোণার গহণা হয়, এবং তালিকার লিখিত মূল্য অপেক্ষা উহার মূল্য কম না হয়, তাহা হইলে এ সম্বন্ধে কোনরূপ চিন্তা করিবার আর প্রয়োজন হইবে না।
আমি। এ উত্তম কথা, তাহা হইলে কোন গতিতে একখানি অলঙ্কার তুমি এখনই লইয়া চল।
বছিরুদ্দিন। এ অতি সামান্য কথা।
“এই বলিয়া বছিরুদ্দিন সেই ব্যক্তিকে ডাকিল। তাহা শুনিয়া তিনি ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলেন। তখন তাহাকে সম্বোধন করিয়া বছিরুদ্দিন কহিল, “আমি আপনাকে আর একবার একটু কষ্ট দিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি।”
সেই ব্যক্তি। কিরূপ কষ্ট প্রদানে ইচ্ছা করিতেছ?
বছিরুদ্দিন। যে গহনাগুলি আমরা এখনই দেখিলাম, সেই গহনাগুলি আমরা আর একবার দেখিতে চাই।
সেই ব্যক্তি। কেন?
বছিরুদ্দিন। একটু সবিশেষ প্রয়োজন আছে।
সেই ব্যক্তি। কখন দেখিতে চাও?
বছিরুদ্দিন। এখনই।
সেই ব্যক্তি। সেই গহনাগুলি আপনারা আমার বাড়ীতে দেখিলেন বলিয়া, মনে করিবেন না যে, উহা আমার বাড়ীতেই থাকে। চোরা-দ্রব্য সহজে আপন বাড়ীতে কে রাখিতে চাহে? বিশেষতঃ আমি যখন উহা বিক্রয় করিতে প্রস্তুত হইয়াছি? গহনাগুলি আমি অপর কোন গোপনীয় স্থানে রাখিয়া থাকি। আপনারা এখানে আসিলে পর, সেই স্থান হইতে আনিয়া আপনাদিগকে দেখাইয়াছিলাম। আপনাদিগের দেখা হইয়া গেলে, পুনরায় উহা আমি সেই স্থানে রাখিয়া আসিয়াছি। এখন ত উহা আর আমার নিকট নাই যে, এখনই আমি উহা আপনাদিগকে পুনরায় দেখাইব?
বছিরুদ্দিন। একটু কষ্ট হইবে বলিয়া আর কি করিবেন, পুনরায় সেই স্থানে গমন করিয়া আর একবার উহা আপনাকে আনিতে হইতেছে।
সেই ব্যক্তি। অন্য সময় দেখাইলে চলিবে না?
বছিরুদ্দিন। না।
সেই ব্যক্তি। তাহা হইলে পুনরায় এখনই আমাকে সেই সকল গহনা আনিতে হইবে?
বছিরুদ্দিন। তাহাই আমাদিগের নিতান্ত ইচ্ছা।
সেই ব্যক্তি। যদি আপনাদিগের একান্ত ইচ্ছাই হয়, তাহা হইলে আপনারা এই স্থানে আর একটু অপেক্ষা করুন, আমি সেই স্থানে গমন করিয়া পুনরায় উহা লইয়া আসিতেছি।
“এই বলিয়া সেই ব্যক্তি আমাদিগকে সেই স্থানে রাখিয়া পুনরায় বাহির হইয়া গেলেন, এবং কিয়ৎক্ষণ পরে সেই বাক্সের সহিত প্রত্যাবর্তন করিয়া সেই বাক্সের চাবি খুলিয়া উহা আমাদিগের সম্মুখে রাখিয়া দিলেন।
“সেই সময় বছিরুদ্দিন কহিল, “আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন কি?”
সেই ব্যক্তি। এ নূতন কথা আজ বলিতেছ কেন?
বছিরুদ্দিন। বলিবার প্রয়োজন হইয়াছে বলিয়াই বলিতেছি নতুবা এরূপ কথা কখনই বলিতাম না।
সেই ব্যক্তি। কি প্রয়োজন হইয়াছে?
বছিরুদ্দিন। এই সকল গহনার মধ্য হইতে যদি একখানি গহনা আমি আমার সঙ্গে করিয়া আমার বাড়ীতে লইয়া যাইতে চাহি তাহা হইলে বিশ্বাস করিয়া উহা আমাকে ছাড়িয়া দিতে পারেন কি?
সেই ব্যক্তি। একখানি গহনা কেন, এই বাক্স সহিত সমস্ত গহনা তুমি লইয়া যাও, তাহাতে তোমার উপর আমার কিছুমাত্র অবিশ্বাস নাই। কিন্তু আমি জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি, হঠাৎ একখানি অলঙ্কার তুমি লইয়া যাইতে চাহ কেন?
বছিরুদ্দিন। তাহা অনায়াসেই আপনি জিজ্ঞাসা করিতে পারেন; কিন্তু জিজ্ঞাসা করিবার পূৰ্ব্বেই আমি আপনাকে বলিতেছি, আমার কোন সবিশেষ প্রয়োজন আছে বলিয়া আমি উহা লইয়া যাইতে মনস্থ করিয়াছি। কি নিমিত্ত লইয়া যাইতেছি, তাহা আমি এখন আপনাকে বলিতে ইচ্ছা করি না; পরে আপনাকে বলিব।
সেই ব্যক্তি। আচ্ছা, তাহা আর আমার এখন শুনিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। ইহার মধ্য হইতে তোমার যেখানি ইচ্ছা হয়, সেইখানি লইয়া যাও, না হয়, বাক্স সমেত সমস্তই লইয়া যাও।
বছিরুদ্দিন। সমস্তই আমি লইয়া যাইতে চাহি না, একখানি হইলেই চলিবে।
“এই বলিয়া বছিরুদ্দিন সেই বাক্সের ডালা খুলিয়া তাহার মধ্য হইতে তাহার ইচ্ছামত একখানি গহনা বাহির করিয়া লইয়া কহিল, “আপনি এখন এই গহনার বাক্স যে স্থানে ছিল, সেই স্থানে লইয়া যাইতে পারেন। একখানি গহনা এখন আমরা লইয়া যাইতেছি, দুই একদিবসের মধ্যে টাকা সহিত আসিয়া সমস্ত গহনা লইয়া যাইব।”
“বছিরুদ্দিনের উপরি-উক্ত প্রস্তাবে তিনিও সম্মত হইলেন; কিন্তু কহিলেন, “জিজ্ঞাসা করি, একখানি গহনা তোমরা লইয়া যাইতেছ কেন?”
বছিরুদ্দিন। একটু প্রয়োজন আছে বলিয়াই, লইয়া যাইতেছি। কেন মহাশয়! ইহাতে আপনার কোনরূপ আপত্তি আছে কি? যদি আমাদিগকে কোনরূপে অবিশ্বাস করেন, তাহা হইলে বলুন, উহা রাখিয়া যাই।
সেই ব্যক্তি। তোমার উপর আমি কখনও কোনরূপে অবিশ্বাস করিয়াছি কি যে, আজ অবিশ্বাস করিতেছি। একখানি গহনা কেন, ইচ্ছা হয়, বাক্স সমেত সমস্ত অলঙ্কার লইয়া যাও, তাহাতেও আমার কিছুমাত্র অবিশ্বাস নাই। সমস্ত গহনা পরিত্যাগ করিয়া, কেবলমাত্র একখানি লইয়া যাইতেছ, তাই আমি জিজ্ঞাসা করিতেছিলাম যে, একখানি গহনা কি করিবে?
বছিরুদ্দিন। একখানি গহনা কেন লহয়া যাইতেছি, তাহা কি আপনি বুঝিতে পারিতেছেন না। আমি যেমন আপনাকে সৰ্ব্বতোভাবে বিশ্বাস করি, এবং আপনিও আমাকে যথেষ্টরূপে বিশ্বাস করিয়া থাকেন; কিন্তু যে ব্যক্তি এক কথার উপর নির্ভর করিয়া, একবারে এতগুলি টাকা প্রদান করিতেছেন, তিনি আমাদিগকে কি কখনও এক কথায় বিশ্বাস করিতে পারেন। এই যে গহনাখানি আমি গ্রহণ করিলাম, তাহা একবার উত্তমরূপে যাচাইয়া দেখিব। দেখিব, তালিকার লিখিত ইহার মূল্য ঠিক কি না। যদি ঠিক হয়, তাহা হইলে আর কোন কথাই থাকিবে না। তাহা হইলে ইনি আমাদিগকে অনায়াসেই বিশ্বাস করিতে পারিবেন।
সেই ব্যক্তি। এ উত্তম কথা। একখানি কেন, তুমি সমস্ত গহনাগুলিই লইয়া গিয়া কোন পোদ্দারের দ্বারা যাচাইয়া দেখ। যদি আমার কথা ঠিক হয়, তাহা হইলে পরে উহার মূল্য পাঠাইয়া দিও। তোমার উপর আমার কোন প্রকারে অবিশ্বাস নাই।
বছিরুদ্দিন। আপনি ত জানেন যে, ইহা কি প্রকারের অলঙ্কার। এতগুলি অলঙ্কার লইয়া বাজারে যাচাইতে গেলে যেরূপ বিপদ্ ঘটিবার সম্ভাবনা, তাহাও আপনি অনায়াসেই অনুমান করিতে পারেন। সমস্ত গহনা লইয়া আমরা বাহির হইলে হয়ত আমরাও বিপদগ্রস্ত হইয়া পড়িব, আপনারও লোকসান হইবে। এই কারণবশতঃ আমরা সমস্ত গহনা লইয়া যাইতে চাহি না; একখানিতেই আমাদিগের অভীষ্ট সিদ্ধ হইবে।
সেই ব্যক্তি। আমার কিছুতেই আপত্তি নাই। তোমাদিগের যেরূপ অভিরুচি হয়, সেইরূপ করিতে পারেন।
এই বলিয়া তিনি গহনার বাক্স লইয়া সেই গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া গেলেন। আমরাও সেই একখানিমাত্র অলঙ্কার সঙ্গে লইয়া তাঁহার বাহিরের গৃহে আসিয়া উপবেশন করিলাম।
“গহনার বাক্স রাখিয়া তিনিও পরিশেষে সেই বাহিরের ঘরে আসিয়া আমাদিগের নিকট উপবেশন করিলেন।
“পরিশেষে আমাদিগের সহিত এইরূপ সাব্যস্ত হইল যে, কল্য এই গহনাখানি আমরা যাচাইয়া দেখিব, এবং টাকার সংগ্রহ করিয়া, পরশ্ব সন্ধ্যার পর, সেই স্থানে আগমন করিয়া গহনাগুলি লইয়া প্রস্থান করিব।
“এইরূপ কথাবার্তা স্থির হইয়া গেলে, আমরা সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। রাস্তায় গমন করিবার সময় বছিরুদ্দিন আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি গহনাগুলি আপন চক্ষে ত দেখিলেন, উহা দেখিয়া আপনার কি মনে হয়?”
আমি। এখন আমার মনে আর কোনরূপ সন্দেহ উপস্থিত হয় না। কারণ, সেই লোকটি যখন সমস্ত অলঙ্কারই সম্পূর্ণ বিশ্বস্তচিত্তে আমাদিগের হস্তে যাচাইয়া দেখিবার নিমিত্ত প্রদান করিতে প্রস্তুত আছেন দেখিলাম, তখন উহা কৃত্রিম অলঙ্কার বলিয়া আমার মনে হয় না।
বছিরুদ্দিন। তাহা হইলে বোধ হইতেছে, উহা প্রকৃতই সুবর্ণের অলঙ্কার?
আমি। আমার ত সেইরূপ অনুমান হইতেছে।
বছিরুদ্দিন। যে কার্য্য করিতে হইবে, তাহা পূর্ব্বে দেখিয়া শুনিয়া করাই কৰ্ত্তব্য। বিশেষতঃ সাত হাজার টাকা একবারে প্রদান করিতে হইতেছে।
আমি। তাহা ত নিশ্চয়।
বছিরুদ্দিন। এই নিমিত্তই আমি নিজ হস্তে একখানি গহনা উঠাইয়া লইয়া আসিলাম।
আমি। একথাটি আমি বুঝিতে পারিলাম না।
বছিরুদ্দিন। কি?
আমি। ওরূপ ভাবে পুনরায় বাক্স আনাইয়া নিজ হস্তে একখানি গহনা তুমি বাহির করিয়া লইলে কেন? তাঁহাকে বলিলেই ত তিনি একখানি অলঙ্কার বাহির করিয়া আনিয়া তোমার হস্তে প্রদান করিতেন।
বছিরুদ্দিন। ইহার অর্থ আছে।
আমি। ইহার আর অর্থ কি?
বছিরুদ্দিন। কেন, আপনি কি তাহা বুঝিতে পারেন নাই?
আমি। বুঝিতে পারিলে আর জিজ্ঞাসা করিব কেন?
বছিরুদ্দিন। আমি চাহিলে যদি উনি সেই সকল গহনা হইতে অলঙ্কার না আনিয়া অপর কোন একখানি অলঙ্কার আনিয়া হস্তে প্রদান করিতেন, তাহা হইলে আমি কিরূপে জানিতে পারিতাম, সেই সমস্ত অলঙ্কার সুবর্ণের?
আমি। এখন তাহা কিরূপে বুঝিতে পারিবে?
বছিরুদ্দিন। হয়ত এমন হইতে পারিত, বাক্সের ভিতর যে সকল অলঙ্কার আছে, তাহার সমস্তই পিত্তলের। আর আমরা চাহিলে, তিনি একখানি অপর সুবর্ণের অলঙ্কার বাহির করিয়া আনিয়া দিতেন। যাচাইয়া নিশ্চয়ই আমরা উহাতে সুবর্ণ পাইতাম, এবং উহার উপর নির্ভর বা বিশ্বাস করিয়া পরিশেষে পিত্তলের অলঙ্কারগুলি আমাদিগকে লইতে হইত। এখন আর তাহা হইতে পারে না। কারণ, আমি বাক্সের ভিতর হইতে কোন গহনাখানি গ্রহণ করিব, তাহা যখন তিনি অবগত নহেন তখন তাহার মধ্যে তিনি একখানি সুবর্ণের অলঙ্কার রাখিয়া আমাদিগকে প্রতারিত করিতে সাহসী হইতে পারেন না। যখন আমি নিজে সমস্ত অলঙ্কারের মধ্য হইতে যে কোন একখানি অলঙ্কার গ্রহণ করিতেছি, তখন উহা পিত্তলের অলঙ্কার হইবারই সম্ভাবনা। সুতরাং যখন উহা আমরা যাচাইয়া দেখিব, তখন সমস্ত কথাই বাহির হইয়া পড়িবে। এখন বুঝিতে পারিলেন, আমি কেন নিজ হস্তে সমস্ত গহনার মধ্য হইতে যে কোন একখানি গহনা বাহির করিয়া লইলাম?
আমি। এ অতি উত্তম উপায়। কারণ, সমস্ত পিত্তলের গহনার মধ্যে যদি একখানি বা দুইখানি সোণার গহনা রাখা থাকে, এবং একজন অপরিচিত লোক তাহার মধ্য হইতে তাহার ইচ্ছামত যে কোন একখানি অলঙ্কার বাহির করিয়া লয়, তাহার হস্তে যে সেই সুবর্ণের অলঙ্কারই আসিয়া পড়িবে, তাহারই বা অর্থ কি?
বছিরুদ্দিন। তাহা ত হইল। অলঙ্কার যাচাইয়া দেখিব; কিন্তু এখন টাকার সংগ্রহ হইবে কি প্রকারে?
আমি। আমারও সেই ভাবনা।
বছিরুদ্দিন। যখন এ কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছি, তখন একরূপ উপায় করিতেই হইবে।
আমি। কি উপায় করিতে চাহ বল?
বছিরুদ্দিন। আপনি পাঁচ হাজার টাকা অপেক্ষা আর কিছু অধিক দিতে পারিবেন না কি?
আমি। মোটে আমার সম্বল পাঁচ হাজার টাকা। একথা আমি পূৰ্ব্বেই তোমাকে বলিয়াছি, আর তাহা হইতে এক সহস্র মুদ্রা আমি আমার নিকট রাখিতে চাই। তাহাও তুমি অবগত আছ। সুতরাং আর অধিক অর্থ কোথা হইতে আসিবে?
বছিরুদ্দিন। তাহা ত অবগত আছি; কিন্তু সামান্য টাকার নিমিত্ত কাযটা যে নষ্ট হইয়া যাইবে, তাহাই বা কিরূপে দেখিতে পারি। আচ্ছা, আপনি এক কায করুন।
আমি। কি?
বছিরুদ্দিন। আপনার নিকট যে পাঁচ হাজার টাকা আছে, তাহার সমস্তই আপনি প্রদান করুন। উহা হইতে এক হাজার টাকা রাখিবার এখন কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। ঈশ্বর যদি দিন দেন, ত সেই এক হাজার টাকার পরিবর্তে আপনি আরও কয় হাজার টাকা রাখিতে পারিবেন, দেখিবেন।
আমি। আচ্ছা, তাহাই যেন হইল, আমি না হয়, পাঁচ হাজার টাকা প্রদান করিলাম। এক হাজার টাকা তুমি প্রদান করিতেছ; কিন্তু অবশিষ্ট আর এক হাজার টাকা কোথা হইতে আসিবে?
বছিরুদ্দিন। তাহার নিমিত্ত আপনাকে আর অধিকচিন্তা করিতে হইবে না। আমার স্ত্রীর যে সকল অলঙ্কার আছে, তাহাই বন্ধক দিয়া না হয়, আর এক হাজার টাকার যোগাড় করিয়া লইব। কারণ, এরূপ অবস্থায় সামান্য অর্থের নিমিত্ত এই কার্য্য পরিত্যাগ করিলে, এরূপ সুযোগ জীবনে আর কখনও পাইব না।
“আমাদিগের মধ্যে এইরূপ কথাবার্তা হইবার পর, আমরা উভয়ে উভয়দিকে গমন করিলাম। বছিরুদ্দিন তাহার গৃহে গমন করিতেছে বলিয়া একদিকে চলিয়া গেল, আমিও আমার গৃহে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। যাইবার সময় বছিরুদ্দিন গহনাখানি আমাকে প্রদান করিয়া গেল। রাত্রিকালে উহা আমার নিকটেই রহিয়া গেল।
পরদিবস প্রাতঃকালে বছিরুদ্দিন আসিয়া আমার বাড়ীতে উপস্থিত হইল ও কহিল, “আপনার পরিচিত যদি কোন পোদ্দার থাকে, তাহাকে এই স্থানে ডাকাইয়া গহনাখানি যাচাইয়া দেখিলে ভাল হয়।”
“আমার বাড়ীর অতি সন্নিকটেই একজন স্বর্ণকারের একটি দোকান ছিল। তাহাকে ডাকিয়া আমি আমার বাড়ীতে আনিলাম, এবং বছিরুদ্দিনকে লক্ষ্য করিয়া কহিলাম, “এই ব্যক্তি আমার নিকট একখানি অলঙ্কার বিক্রয় করিতে চাহেন, কি মূল্যে আমি উহা গ্রহণ করিতে পারি, তাহা যদি তুমি বলিয়া দিতে পার, তাহা হইলে আমি সবিশেষরূপে উপকৃত হই।”
উত্তরে স্বর্ণকার কহিল, “সে আর আশ্চর্য্য কি! আপনারা গহনাখানি লইয়া আমার দোকানে আসুন, সেই স্থানে বসিয়া উত্তমরূপে যাচাই করিয়া, আধঘণ্টার মধ্যে মূল্য অবধারিত করিয়া দিব।”
আমরা উভয়েই তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া তাহার সহিত তাঁহার সেই দোকানে সেই অলঙ্কারের সহিত গমন করিলাম। দোকানদার আমাদিগকে তাহার দোকানে বসাইয়া আমাদিগের সম্মুখে সেই গহনাখানি ওজন করিয়া, কসিয়া দেখিয়া, এবং পরিশেষে তাহার এক অংশ পোড়াইয়া পৰ্য্যন্ত দেখিয়া, যে দাম বলিয়া দিল তাহাতে দেখিলাম, তালিকার লিখিত দাম অপেক্ষাও উহার দাম অধিক।
“তালিকায় যে দাম লেখা আছে, তাহা অপেক্ষা উহাতে অধিক মূল্যের স্বর্ণ আছে জানিতে পারিয়া, আমি বছিরুদ্দিনকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তালিকার লিখিত মূল্য অপেক্ষা ইহার মূল্য অধিক হইতেছে কেন?”
“উত্তরে বছিরুদ্দিন কহিল, “যে সময় সেই সকল দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে, সেই সময় অপেক্ষা যে সময় সেই সকল অলঙ্কার প্রস্তুত হইয়াছিল, সেই সময় সুবর্ণের মূল্য অনেক কম ছিল। সুতরাং পুলিস তালিকা প্রস্তুত করিবার সময় যে মূল্যের সুবর্ণ দ্বারা উহা প্রস্তুত হয়, সেই মূল্যই তালিকাতে লিখিয়া লইয়াছে; সুতরাং এখন তাহার দাম আরও অধিক হইবেই ত। এরূপ অবস্থায় দেখিতেছি, আমাদিগের আরও কিছু অধিক লাভ হইবার সম্ভাবনা। কিন্তু যাহার নিকট সেই সমস্ত অলঙ্কার আছে, একথা তাহাকে বলিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই।”
“এইরূপে অলঙ্কারখানি যাচাইয়া দেখিয়া আমরা উভয়েই অতিশয় সন্তুষ্ট হইলাম, এবং টাকার সংগ্রহ করিবার মানসে আপন স্থানে প্রস্থান করিলাম।
“আমি যে পাঁচ হাজার টাকার কথা বলিয়াছিলাম, তাহা সংগ্রহ করিয়া তাহার পরিবর্তে পাঁচখানি হাজার হাজার টাকার নোট আনিয়া আমার নিকট রাখিয়া দিলাম
“পরদিবস সন্ধ্যার পূর্ব্বেই বছিরুদ্দিন আসিয়া উপস্থিত হইল ও আমাকে কহিল, “আমি দুই সহস্র টাকাই সংগ্রহ করিয়া তাঁহাকে প্রদান করিয়া আসিয়াছি। সন্ধ্যার পর অবশিষ্ট টাকাগুলি সংগ্রহ করিয়া তাঁহার নিকট লইয়া আসিব, এইরূপ বন্দোখস্ত ঠিক করিয়া আসিয়াছি।”
“সন্ধ্যার পর সেই পাঁচ হাজার টাকার নোট লইয়া বছিরুদ্দিনের সহিত তাঁহার বাড়ীতে গমন করিলাম। দেখিলাম, তিনি তাঁহার সেই বাহিরের ঘরে আমাদিগের প্রত্যাশায় বসিয়া আছেন। আমরা গিয়া সেই স্থানে উপবেশন করিলে, তিনি কহিলেন, “কেমন বছিরুদ্দিন! সমস্তই ঠিক করিয়া আসিয়াছ ত?”
“উত্তরে বছিরুদ্দিন কহিল, “দুই সহস্ৰ টাকা ত আমি আপনাকে দিয়াই গিয়াছি, অবশিষ্ট পাঁচ হাজার টাকা আমরা সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি।”
“এই কথা শুনিয়া তিনি আমাদিগকে সঙ্গে লইয়া তাঁহার বাড়ীর ভিতর গমন করিলেন। পূর্ব্বে যেরূপ ভাবে ঘরের এবং বাড়ীর দরজা বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন, সেইরূপভাবে উহা বন্ধ করিয়া, যে ঘরের ভিতর আমরা সেইদিবস গিয়া উপবেশন করিয়াছিলাম, সেই ঘরের ভিতর আমাদিগকে বসিতে বলিয়া তিনি বাহিরে গমন করিলেন, এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে পূৰ্ব্ববর্ণিত সেই গহণার বাক্সটি সঙ্গে করিয়া পুনরায় সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলেন। পরে গহনার বাক্সটির চাবি আমার হস্তে প্রদান করিয়া কহিলেন, “আপনি এখন গহনাগুলি, আপনাদিগের নিকট যে তালিকা আছে, তাহার সহিত মিলাইয়া গ্রহণ করিতে পারেন।”
“আমরা সেই বাক্সটি খুলিয়া সেই তালিকার সহিত সমস্ত গহনা মিলাইয়া দেখিলাম যে, উহা ঠিক আছে। তখন সেই গহনাগুলি পুনরায় সেই বাক্সের ভিতর পূরিয়া তাহাতে চাবি বন্ধ করিয়া দিলাম। চাবি আপনার নিকট রাখিয়া, আমার যে পাঁচ হাজার টাকার নোট ছিল, তাহা বাহির করিয়া দিলাম। তিনি সেই নোটগুলি উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিয়া লইয়া কহিলেন, “এখন আপনারা এই সকল গহনা লইয়া নিজ স্থানে প্রস্থান করিতে পারেন।”
“তাঁহার এই কথা শুনিয়া গহনাসমেত সেই বাক্সটি লইয়া, আমরা সেই গৃহ হইতে বহির্গত হইলাম। তিনিও সেই নোটগুলির সহিত আমাদিগের সঙ্গে সঙ্গে সেই ঘর হইতে বহির্গত হইলেন, এবং অন্য দিকে প্রস্থান করিলেন।
“রাস্তা হইতে একখানি গাড়ি ভাড়া করিয়া আমরা বাড়ীতে গমন করিলাম। বছিরুদ্দিন আমাকে আমার বাড়ীতে পৌঁছিয়া দিয়া আপন বাসায় গমন করিল। বাক্সসমেত সমস্ত গহনা আমার নিকটেই রহিয়া গেল। গমন করিবার সময় বছিরুদ্দিন বলিয়া গেল যে, কল্য পুনরায় আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবে, এবং সেই সময় হইতে গহনাগুলি বিক্রয় করিবার বন্দোবস্ত ঠিক করিবে।
“পরদিবস যে সময়ে বছিরুদ্দিনের আসিবার কথা ছিল, সেই সময়ে বছিরুদ্দিন আর আগমন করিল না। সমস্ত দিবস তাহার অপেক্ষায় বাড়ীতে বসিয়া রহিলাম; কিন্তু সে আর সেইদিবস আসিল না। পরদিবসও সেইরূপ হইল। এইরূপে ক্রমে এক সপ্তাহ অতিবাহিত হইয়া গেল। বছিরুদ্দিনকে আর দেখিতে পাইলাম না। মনে করিলাম, হয়ত সে পীড়িত হইয়া পড়িয়াছে। তাহার বাড়ী যে কোথায়, তাহা আমি জানিতাম না। সুতরাং সেই স্থানে গমন করিয়া তাহার কোনরূপ যে সন্ধান করিব, তাহাও হইল না। এইরূপে ক্রমে পনরদিবস অতিবাহিত হইয়া গেল।
“পনরদিবসের মধ্যে যখন দেখিলাম, বছিরুদ্দিন আমার বাড়ীতে আর আগমন করিল না, তখন সেই সকল অলঙ্কারের দুই একখানি বিক্রয় করিবার বাসনা করিলাম। আমাদিগের বাড়ীর সন্নিকটে যে স্বর্ণকার বাস করিত, এবং যাহার নিকট গিয়া পূৰ্ব্বে একখানি গহনা যাচাই করিয়া দেখিয়াছিলাম, আর একখানি গহনা লইয়া পুনরায় তাহার নিকট গমন করিলাম, এবং তাহাকে কহিলাম, “কয়েকখানি অলঙ্কার আমার নিকট অনেকদিবস পর্য্যন্ত বন্ধক ছিল। যে ব্যক্তির অলঙ্কার, তিনি সুদসমেত টাকা প্রদান করিয়া সেই সকল অলঙ্কার পুনরায় গ্রহণ করিতে অসমর্থ হইয়া, সেই সকল অলঙ্কার আমাকে বিক্রয় করিয়া লইতে বলিয়াছেন। সুতরাং সেই অলঙ্কারগুলি আমি ক্রমে বিক্রয় করিয়া ফেলিতে ইচ্ছা করিয়াছি, এবং একখানি আনয়নও করিয়াছি। আমার ইচ্ছা, এই অলঙ্কারখানি গলাইয়া উহাতে কত মূল্যের সুবর্ণ আছে, তাহা আমাকে ঠিক করিয়া দেও। আমি অপর স্থানে লইয়া গিয়া উহা বিক্রয় করিয়া ফেলি। আর যদি তুমি নিজেই উহা ক্রয় করিতে সম্মত হও, তাহা হইলে আমি উহা তোমার নিকট বিক্রয় করিতে প্রস্তুত আছি।”
“এই বলিয়া সেই অলঙ্কারখানি আমি তাহার হস্তে প্রদান করিলাম। তিনি উহা উত্তমরূপে কসিয়া মাজিয়া দেখিয়া আমাকে কহিলেন, “যে ব্যক্তি এই অলঙ্কারখানি আপনার নিকট বন্ধক দিয়াছিল, সেই ব্যক্তি আপনার পরিচিত, কি অপরিচিত?
আমি। কেন মহাশয়! আপনি একথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন?
স্বর্ণকার। প্রয়োজন হইয়াছে বলিয়াই জিজ্ঞাসা করিতেছি।
আমি। কি প্রয়োজন?
স্বর্ণকার। কি প্রয়োজন, তাহা আমি পরে বলিতেছি, অগ্রে আপনি আমার কথার উত্তর প্রদান করুন দেখি।
আমি। যে ব্যক্তি এই অলঙ্কার আমার নিকট বন্ধক রাখিয়াছিলেন, তিনি আমার নিকট সবিশেষরূপে পরিচিত নহেন; কিন্তু একবারেই যে অপরিচিত, তাহাও নহে।
স্বর্ণকার। এরূপ অলঙ্কার আর কয়খানি সে ব্যক্তি আপনার নিকট বন্ধক রাখিয়াছিল?
আমি। আরও দুই একখানি আছে।
স্বর্ণকার। কত টাকায়?
আমি। তাহা আমার ঠিক মনে নাই। কাগজ না দেখিয়া আমি আপনার একথার উত্তর দিতে সমর্থ নহি।।
স্বর্ণকার। সুদ, কি আসলের টাকা সে কখনও কিছু প্রদান করিয়াছে কি?
আমি। না।
আমার এই কথা শুনিয়া সেই স্বর্ণকার সেই গহনাখানি আর একবার উত্তমরূপে কসিয়া দেখিলেন ও কহিলেন, “আমার বোধ হইতেছে, আপনার অনেকগুলি টাকা লোকসান হইবে।”
আমি। কেন?
স্বর্ণকার। আমার বিবেচনায় এই অলঙ্কারখানি সুবর্ণের বলিয়া অনুমান হয় না।
আমি। কি বলিয়া অনুমান হয়?
স্বর্ণকার। পিত্তলের।
আমি। তাহা কখনই হইতে পারে না। সে যে আমাকে ঠকাইবে, ইহা আমি কোন প্রকারেই মনে করিতে পারি না।
স্বর্ণকার। আপনি মনে করুন বা না করুন, কিন্তু আপনি যে প্রতারিত হইয়াছেন, সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। এ অলঙ্কার কোনরূপেই সুবর্ণের হইতে পারে না, ইহা পিত্তলের গহনা।
আমি। আপনি ঠিক বুঝিতে পারিয়াছেন যে, ইহা পিত্তলের?
স্বর্ণকার। তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। আমি কেন, আপনি যে কোন সুবর্ণ-ব্যবসায়ী লোককে দেখান, হাতে করিয়াই তিনি কহিবেন, ইহা পিত্তলের। কসিয়া দেখিবারও কোনরূপ প্রয়োজন হইবে না।
আমি। তাহা হইলে আপনাকে আর একটু কার্য্য করিতে হইতেছে।
স্বর্ণকার। কি?
আমি। আমার সহিত একবার আপনাকে আমার বাড়ীতে গমন করিতে হইবে।
স্বর্ণকার। কেন?
আমি। সে যে গহনা কয়খানি আমার নিকট রাখিয়াছিল, তাহার সমস্তগুলিই আমি আপনাকে দেখাইব। আপনি
দেখিয়া বলিয়া দিন যে, সেই সকল অলঙ্কার পিত্তলের কি সুবর্ণের। নতুবা আমি কোনরূপেই আমার মন স্থির করিতে পারিতেছি না।
স্বর্ণকার। আর কয়খানি গহনা আছে?
আমি। চারি পাঁচখানি হইবে।
স্বর্ণকার। আচ্ছা, চলুন, আপনি আমার প্রতিবেশী, আপনার একটি কথা না শুনিলে চলিবে কিরূপে? বিশেষতঃ আমাদিগের কার্য্যই এই।
“এই বলিয়া কষ্টিপাথর হস্তে লইয়া সেই স্বর্ণকার আমার সহিত আমার বাড়ীতে গমন করিলেন।
‘বাড়ীতে গিয়া সেই বাক্স হইতে আরও চারি পাঁচখানি অলঙ্কার বাহির করিয়া আনিয়া আমি সেই স্বর্ণকারের হস্তে প্রদান করিলাম। তিনি এক একখানি করিয়া সমস্তগুলিই কসিয়া দেখিলেন ও কহিলেন, “ইহার একখানিও সুবর্ণের নহে। সমস্তই পিত্তলের গহনা, সোনালি গিলটি করা।”
আমি। তাহা হইলে ত দেখিতেছি, আমার সর্ব্বনাশ হইয়াছে আমার যথাসর্ব্বস্ব গিয়াছে!
স্বর্ণকার। কেন, এই সকল গহনা রাখিয়া আপনি কত টাকাই দিয়াছেন যে, আপনার যথাসৰ্ব্বস্ব গিয়াছে?
আমি। আমার আর দুঃখের কথা বলিব কি, আমি পূর্ব্বে আপনাকে যাহা বলিয়াছি, তাহার সমস্ত প্ৰকৃত নহে। আমি ইচ্ছা করিয়া দুই একটি মিথ্যা কথা কহিয়াছি। কেবল যে এই কয়খানি গহনাই আমি বন্ধক রাখিয়াছি, তাহা নহে; আমার যাহা কিছু ছিল, তাহাই যে কেবল গিয়াছে, তাহা নহে। তদ্ব্যতীত আমি ঋণগ্রস্ত হইয়া পড়িয়াছি। আমি আজীবনকাল পরিশ্রম করিয়া অতি কষ্টে কোনরূপে পাঁচ হাজার টাকার সংস্থান করিয়াছিলাম। তদ্ব্যতীত আর এক ব্যক্তির নিকট হইতে আরও দুই সহস্র মুদ্রা ঋণ করিয়া অধিক সুদের লোভে সেই সাত হাজার টাকা একজনকে কর্জ্জ দিয়াছিলাম। তিনি আমার নিকট প্রায় বিশ হাজার টাকা মূল্যের অলঙ্কার বন্ধক রাখিয়াছিলেন।
“এই বলিয়া সেই বাক্সের ভিতর যতগুলি গহনা ছিল, সমস্তই আনিয়া সেই স্বর্ণকারের সম্মুখে উপস্থিত করিলাম। “স্বর্ণকারও এক একখানি করিয়া তাহার সমস্তগুলিই কসিয়া দেখিলেন ও কহিলেন, “ইহার একখানিও সুবর্ণের নহে, সমস্তই পিত্তলের।”
“স্বর্ণকারের এই কথা শুনিয়া আমার মনে যে কিরূপ ভাবের উদয় হইল, তাহা, পাঠকপাঠিকাগণ! আপনারাই অনুমান করিয়া দেখুন। আমি চতুৰ্দ্দিক অন্ধকার দেখিলাম, এবং কিছুক্ষণের নিমিত্ত আমি আমার বিবেচনা ও বুদ্ধি হারাইয়া ফেলিলাম। সেই সময় আমার যে কি করা কর্তব্য, তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, সমস্ত গহনা সেই বাক্সের ভিতর পুরিয়া বাড়ীর ভিতর লইয়া গেলাম। তাহার পর ঘরের ভিতর একস্থানে উহা রাখিয়া আমি আমার বিছানার উপর গিয়া শয়ন করিলাম। স্বর্ণকারও আমার বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া ধীরে ধীরে আপন দোকানাভিমুখে গমন করিল।
“আমি কতকক্ষণ যে আমার বিছানার উপর একরূপ অর্দ্ধঅচেতন অবস্থায় ছিলাম, তাহা জানি না। কিন্তু যখন আমার সম্পূর্ণ জ্ঞানের পুনরায় উদয় হইল, তখন দেখিলাম, আমার স্ত্রী আমার নিকট নিতান্ত বিষণ্ণবদনে বসিয়া আমাকে ব্যজন করিতেছে। আমার সম্পূর্ণরূপে চৈতন্যের উদয় হইলে, সামার স্ত্রী আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তোমার এরূপ অবস্থা হইয়াছিল কেন?”
“উত্তরে আমি কহিলাম, “কেন তাহা আর কি বলিব? আমার জীবনের ত একরূপ শেষ হইয়াছে! কিন্তু তোমাদিগকেও একবারে পথের ভিখারী করিয়া দিয়াছি! তোমাদিগের অন্নবস্ত্রের যে সংস্থান ছিল, তাহার সমস্তই আমি নিজ বুদ্ধির দোষে নষ্ট করিয়াছি!
“আমার কথা শুনিয়া, আমার স্ত্রী কিছুই বুঝিতে পারিল না। কারণ, সে আমার সেই পাঁচ হাজার টাকার কথা কিছুমাত্র অবগত ছিল না। আমার যে অবস্থা ঘটিয়াছিল, এখন তাহার সমস্ত অবস্থা তাহাকে বলিলাম। আমার কথা শুনিয়া সে একটি দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিল এবং কহিল, “যাহা হইবার তাহা হইয়াছে, যাহা ঘটিবার তাহা ঘটিয়াছে, এখন আপন মনকে স্থির করিয়া যদি ইহার কোনরূপ উপায় করিতে পারেন, তাহার চেষ্টা দেখুন।” তাহার কথার উত্তরে আমি কহিলাম, “এখন আর আমি কি চেষ্টা দেখিব? যখন হস্তের টাকা হস্তান্তর করিয়া ফেলিয়া তাহার পরিবর্তে কতকগুলি পিত্তলের অলঙ্কার ক্রয় করিয়াছি, তখন নিজের বুদ্ধিকে ধিক্কার দেওয়া ভিন্ন আর কি করিতে পারি?”
“প্রত্যুত্তরে আমার স্ত্রী কহিল, “যাহার নিকট হইতে তুমি এই সকল অলঙ্কার ক্রয় করিয়াছ, তাহার বাড়ী ত তুমি চিন। তাহার নিকট গমন করিয়া দেখ, সে এখন কি বলে।’
“আমি আমার স্ত্রীর কথা শুনিয়া মনে করিলাম, এ পরামর্শ মন্দ নহে। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, যাহার নিকট হইতে অলঙ্কারগুলি ক্রয় করিয়াছিলাম, তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসে তাহার বাড়ীতে গমন করিলাম। সেই স্থানে গিয়া দেখি, সেই বাড়ী শূন্য অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে, লোকজন কেহই সেই বাড়ীতে নাই। কোন ব্যক্তি সেই বাড়ীতে বাস করিত, তাহা জানিবার নিমিত্ত সেই স্থানে একটু অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু কেহই তাহার নাম বলিতে পারিল না। তাহাদিগের নিকট হইতে কেবলমাত্র ইহাই জানিতে পারিলাম যে, কেবলমাত্র দশ পনরদিবসমাত্র সেই ব্যক্তি সেই স্থানে বাস করিয়া আট দশবদিবস হইল, সেই স্থান পরিত্যাগ করিয়া তিনি কোথায় চলিয়া গিয়াছেন। এই ব্যাপার জানিতে পারিয়া আমি তাহাকে বাহির করিবার নিমিত্ত অনেক চেষ্টা করিলাম; কিন্তু তাহার কোনরূপ সন্ধানই করিয়া উঠিতে পারিলাম না। যখন তাহার কোনরূপ সন্ধান পাইলাম না, তখন বছিরুদ্দিনের নিমিত্তও অনেক স্থানে অনেকরূপ অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু তাহারও কোনরূপ ঠিকানা করিয়া উঠিতে সমর্থ হইলাম না।
“এখন মহাশয়! আমি আপনার নিকট আসিয়াছি, এবং যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, তাহার সমস্ত কথা অপকটচিত্তে আপনার নিকট প্রকাশ করিয়া বলিলাম, এখন আপনার বিবেচনায় যাহা কর্ত্তব্য হয়, তাহা করুন।” এই বলিয়া তিনি রোদন করিতে লাগিলেন।
তাঁহাকে আমি সান্ত্বনা করিয়া, ‘এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের ভার আমি গ্রহণ করিব,’ এই বলিয়া তাহাকে কথঞ্চিৎ পরিমাণে সুস্থ করিলাম।
পরদিবস হইতেই আমি এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলাম। এইরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া, যে সকল লোক জীবনযাপন করিয়া থাকে, তাহাদিগের অনেককেই আমি জানিতাম। সেই লোকদিগকে ক্রমে আমি সেই বাবুকে দেখাইতে লাগিলাম। এইরূপে প্রায় দুই তিনদিবসকাল অনেক লোককে তাঁহাকে দেখাইতে দেখাইতে একটি লোককে তিনি চিনিতে পারিলেন এবং কহিলেন, “মহাশয়! ইহার নামই বছিরুদ্দিন।”
বছিরুদ্দিনকে এই কথা জিজ্ঞাসা করিলে, যেরূপ ঘটনা হইয়া ছিল, সে আমার নিকট সেইরূপই বলিল। পরিশেষে কহিল, “মহাশয়! আমারও ইহাতে দুই সহস্র টাকা ক্ষতি হইয়াছে। আমি পীড়িত হইয়া পড়িয়াছিলাম বলিয়া, ইঁহার সহিত এই কয়দিবস সাক্ষাৎ করিতে পারি নাই।”
বছিরুদ্দিন যাহাই বলুক না কেন, অনুসন্ধানে সমস্তই বাহির হইয়া পড়িল। যে ব্যক্তি গহনাগুলি বিক্রয় করিয়াছিল, সেই ব্যক্তিও পরিশেষে ধৃত হইল, এবং তাহাকে দুই সহস্র টাকা বছিরুদ্দিন প্রদান করে নাই, ইহাও জানিতে পারিলাম। অনুসন্ধানে আরও জানিতে পারিলাম যে, সেই ব্যক্তি বছিরুদ্দিনের একজন সহচর। উভয়ে মিলিত হইয়া এই ভয়ানক জুয়াচুরি ব্যবসা অবলম্বন করিয়া, সেই ব্যক্তির নিকট হইতে পাঁচ হাজার টাকা হস্তগত করিয়াছে।
অনেক কষ্টে আমি উভয়ের নিকট হইতে তিন হাজার টাকা আদায় করিলাম। অবশিষ্ট দুই হাজার টাকার আর কোনরূপ উদ্ধার হইল না।
বিচারে বছিরুদ্দিন এবং তাহার সঙ্গী উভয়েই কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইল।
[ চৈত্র, ১৩০৫]