কৃপণের ধন (শেষ অংশ)
(অর্থাৎ কৃপণের ধন ও জীবনের পরিণাম)
প্রথম পরিচ্ছেদ
রাসবিহারীবাবু আত্মহত্যা করেন নাই, দস্যুগণ তাঁহাকে হত্যা করিয়া তাঁহার যথাসর্বস্ব অপহরণ করিয়াছে। ইহা আমার প্রমুখাৎ অপরাপর কর্ম্মচারিগণ যখন প্রথম শুনিয়াছিলেন সেই সময়ে তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই আমার মতের পোষকতা করিতে সমর্থ হন নাই, বরং আমার মতের বিরুদ্ধে মত প্রদান করিয়া ছিলেন, এখন আমার নিকট হইতে যখন তাঁহারা অবগত হইলেন যে আমি হত্যাকারিগণকে ধৃত করিয়াছি ও তাহাদিগের নিকট হইতে অপহৃত দ্রব্যও প্রাপ্ত হইয়াছি, তখন তাঁহারা একেবারে বিস্মিত হইয়া পড়িলেন ও পরস্পর পরস্পরের মুখাবলোকন করিতে লাগিলেন। যে উপরিতন কর্ম্মচারির সহিত আমার এতক্ষণ পর্য্যন্ত কথা হইতেছিল তিনিও আমার কথা শুনিয়া নিতান্ত বিস্মিত হইলেন ও আমাকে কহিলেন “আপনি প্রকৃতই কি এই মকদ্দমার আসামীগণের কোন সন্ধান পাইয়াছেন? না আমাকে আপনার মতের অনুমোদন করাইবার নিমিত্ত এইরূপ বলিতেছেন।”
আমি। আমি কি আপনার সহিত উপহাস করিতেছি, না আপনার নিকট মিথ্যা কথা কহিতেছি!
উঃ কৰ্ম্ম। কয়জন আসামীকে আপনি পাইয়াছেন?
আমি। দুই জন।
উঃ কৰ্ম্ম। তাহারা কোথায়?
আমি। আমার গাড়ীর ভিতর আছে।
উঃ কর্ম্ম। আপনার গাড়ী কোথায়?
আমি। এই স্থান হইতে একটু দূরে আছে।
উঃ কৰ্ম্ম! কত দূর?
আমি। অধিক দূরে নহে এই গলির মোড়ে।
উঃ কৰ্ম্ম। আমাসীদ্বয়ের নিকট আর কেহ আছে কি?
আমি। আছে বই কি! আমার অধীনস্থ অপর দুই জন কর্ম্মচারী তাহাদের সহিত সেই গাড়ীতেই আছে।
উঃ কৰ্ম্ম। অপহৃত দ্রব্য সমস্তই পাওয়া গিয়াছে কি?
আমি। সমস্তই পাওয়া গিয়াছে কি না তাহা কি প্রকারে বলিব? কারণ কোন কোন দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে তাহার তালিকা দেওয়ার লোক কেহই নাই। কিন্তু আসামীদ্বয় যাহা বলিতেছে তাহাতে অনুমান হইতেছে তাহারা যে সকল দ্রব্য অপহরণ করিয়াছিল তাহার সমস্তই তাহারা আমাকে প্রদান করিয়াছে।
উঃ কৰ্ম্ম। তাহা হইলে আসামীগণ অপরাধ স্বীকার করিতেছে।
আমি। এখনও তো স্বীকার করিতেছে, কিন্তু পরে যে কি করিবে তাহা বলিতে পারি না।
উঃ কর্ম্ম। তাহারা এখন কিরূপ ভাবে অপরাধ স্বীকার করিতেছে?
আমি। তাহা তাহাদিগের মুখে শুনিলে ভাল হয় না কি?
উঃ কৰ্ম্ম। তাহা হইলে তাহাদিগকে এখানে আনয়ন করা উচিত নয় কি?
আমি। আমি এখনি তাহাদিগকে এখানে আনাইয়া দিতেছি।
আমার মুখ হইতে এই কথা বহির্গত হইতে না হইতেই সেই স্থানে যে সকল কর্ম্মচারী উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাদিগের মধ্যে দুই তিন জন কর্ম্মচারী আমার সেই গাড়ীর উদ্দেশে চলিলেন, দেখিতে দেখিতে গাড়ি আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল।
গাড়ীর ভিতর যে দুই জন আমার কর্ম্মচারী ছিলেন, তাঁহাদিগকে কহিবা মাত্র তাঁহারা দ্রব্যাদির সহিত আসামীদ্বয়কে গাড়ী হইতে নামাইয়া আমরা যে স্থানে ছিলাম সেই স্থানে উপস্থিত করিলেন। খুনী আসামীগণকে দেখিবার নিমিত্ত অপরাপর কর্মচারীগণ এরূপ ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন যে, সকলেরই ইচ্ছা তিনি অগ্রে গিয়া তাহাদিগকে দর্শন করেন, সুতরাং সেই স্থানে একেবারে ভিড় হইয়া গেল; এক জনের উপর আর একজন গিয়া পড়িতে লাগিলেন।
রাসবিহারীবাবুকে খুন করিয়াছে খুনিগণ ধৃত হইয়াছে এই সংবাদ বিদ্যুৎবেগে চারিদিকে আপনাপনিই ছুটিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে সেই স্থানে এত লোক একত্রিত হইয়া পড়িল যে তাহার সংখ্যা করিতে পারে কাহার সাধ্য। এইরূপ গোলযোগে আমাদিগের কার্য্যের ক্ষতি হইতে লাগিল। আমরা অনন্যোপায় হইয়া আসামীদ্বয়কে লইয়া রাসবিহারীবাবুর বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। বাহিরের লোকজন সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে না পারে এই অভিপ্রায়ে ঐ বাড়ীর সদর দরজা ভিতর হইতে বদ্ধ করিয়া দেওয়া হইল।
বাড়ীর ভিতর আমরা সকলে গমন করিবার পর, আমার সেই ঊর্দ্ধতন কৰ্ম্মচারী মহাশয় আমাকে কহিলেন “আপনি কিরূপে ইহাদিগকে ধৃত করিতে সমর্থ হইলেন, ও কিরূপেই বা জানিতে পারিলেন ইহাদিগের দ্বারা এই কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়াছে?”
আমি। আমি পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া অনেক সময়ে আমাদিগকে এইরূপ গুরুতর কার্য্য সম্পন্ন করিতে হয়, সেইরূপ অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছিলাম ও পরে কৃতকার্য্যও হইয়াছি। আমি কি নিমিত্ত যে ইহাদিগের উপর সন্দেহ করিয়াছিলাম, তাহা আমি এখনই আপনার নিকট প্রকাশ করিতেছি।
এই বলিয়া আমি সেই ডিসপেনসারির ডাক্তার সুশীলবাবুকে সেই স্থানে ডাকাইলাম; ডাকিবামাত্র তিনি সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। যে দুইজন আসামীকে আমি ধৃত করিয়া আনিয়াছিলাম, সুশীলবাবুকে তাহাদিগের সম্মুখীন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “দেখুন দেখি সুশীলবাবু আপনি ইহাদিগকে চিনিতে পারেন কি না?”
সুশীলবাবু উহাদিগের দিকে একটু বিশেষ লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “ইহাদিগকে আমি বেস চিনিতে পারিয়াছি। ইহারা সেই পিতা পুত্র; ইহারাই পীড়ার চিকিৎসা করাইবার নিমিত্ত পূর্ব্বে আমাকে পত্র লিখিয়া পরে আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইয়া এই বৃদ্ধের পীড়ার অনেক কথা আমাকে বলিয়াছিল, ও পুনরায় আমার নিকট আগমন করিয়া ঔষধাদি লইয়া যাইবে এই বলিয়া সে দিবস আমার ডিসপেনসারি হইতে প্রস্থান করিয়াছিল, কিন্তু তাহার পর ঔষধ লইবার নিমিত্ত আর ইহারা আমার নিকট আইসে নাই। ইহারাই কি রাসবিহারীবাবুর হত্যাকারী? কি আশ্চর্য্য! সুশীলবাবুর কথা শুনিয়া আমার সেই ঊর্দ্ধতন কৰ্ম্মচারী কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলেন না। তিনি আমাকে কহিলেন ডাক্তারবাবু কি বলিলেন তাহার অর্থ আমি কিছুইতো বুঝিতে পারিতেছি না।
উত্তরে আমি তাঁহাকে কহিলাম “আমি সমস্ত অবস্থা আপনাকে বুঝাইয়া দিতেছি” এই বলিয়া সুশীলবাবুর সহিত পূর্ব্বে আমার যে সকল অবস্থা ঘটিয়াছিল তাহার আনুপূর্ব্বিক বিবরণ আমি সেই কৰ্ম্মচারী মহাশয়কে কহিলাম, অর্থাৎ রাসবিহারীবাবুর গৃহে সুশীলবাবু প্রবেশ করিয়াছিলেন, অনুমানে তিনি সুশীলবাবুর সহিত যেরূপ ব্যবহার করিয়াছিলেন, ও পরিশেষে তাঁহার ব্যবহারে সুশীলবাবু বিশেষ অসন্তুষ্ট হইয়া, যেরূপ উপায়ে আমার সহিত সাক্ষাৎ করেন, আমি সুশীলবাবুর সহিত ঐ স্থানে আগমন করিলে রাসবিহারীবাবু আমাদিগের সহিত যেরূপ ব্যবহার করেন, তাহার সমস্ত অবস্থা আমি এক এক করিয়া কৰ্ম্মচারী মহাশয়কে কহিলাম, দেখিলাম তাহাতেও তিনি সম্পূর্ণ রূপ বুঝিয়া উঠিতে পারিলেন না যে, আসামীদ্বয়ের সহিত এই হত্যার কিরূপ সংস্রব আছে। তখন আমি তাহার পূর্ব্ব ঘটনাও তাঁহার নিকট বর্ণন করিলাম; সুশীলবাবুর ডাকযোগে পত্র পাওয়া, পিতা ও পুত্রের সুশীলবাবুর গৃহে আগমন করা, পুত্রকে ডাক্তারবাবুর নিকট হইতে বাহির করিয়া দিয়া, ডাক্তারবাবুর সহিত পীড়া সম্বন্ধে পিতার কথোপকথন, ও পরিশেষে পুত্র আসিয়া পিতাকে লইয়া অন্য কাৰ্য্যোপলক্ষে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করা প্রভৃতি অবস্থা শুনিয়া ও কর্ম্মচারী মহাশয় কহিলেন, “ইহাতেই বা আপনার কিরূপ সন্দেহ হইয়াছিল যে ইহাদিগের দ্বারাই এই কাৰ্য্য হইয়াছে?”
আমি। আমার মনে যে কোন সন্দেহ হইল, তাহা অপরকে বুঝান সহজ নহে। ডাক্তারবাবুর নিকট হইতে রোগীদ্বয়ের অবস্থা পূর্ব্বে শুনিয়াছিলাম, পরিশেষে এই স্থানে এই ঘটনা ঘটাতেই উহাদিগের উপর আমার বিশেষরূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল, সেই সময়ে আমার মনের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে প্রতীতি জন্মিয়াছিল যে, উহাদিগের কোনরূপ রোগ হয় নাই, কেবল সন্ধান জানিবার নিমিত্তই উহারা অসময়ে এখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল।
উঃ কর্ম্ম। যাহারা রোগ হইয়াছে বলিয়া ডাক্তারবাবুর নিকট পরিচয় প্রদান করিয়াছিল, সে যে সময় পৰ্য্যন্ত এই স্থানে উপস্থিত ছিল, সুশীলবাবু তাহার নিকটেই ছিলেন, সুতরাং সেই সময়ে সে যে বিষয়ে কিছু অবগত হইতে পারিয়াছিল তাহা আমার মনে হয় না।
আমি। বৃদ্ধ ডাক্তারবাবুর নিকটে ছিল সত্য, কিন্তু অপর ব্যক্তিকে সেই স্থান হইতে স্থানান্তরিত করিবার কারণ আর কি হইতে পারে, বৃদ্ধ কথায় কথায় ডাক্তার বাবুকেনিযুক্ত রাখিয়াছিল আর অপর ব্যক্তি সেই সাবকাশে তাহাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিয়া লইয়াছিল। সে যাহা হউক যখন উহারা এখন সমস্ত কথা স্বীকার করিতেছে তখন ইহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেই সমস্ত অবস্থা জানিতে পারিবেন।
উঃ কৰ্ম্ম। সে উত্তম কথা, উহাদিগের মুখেই সমস্ত কথা শুনা যাউক।
আমি। আমি আপনাকে একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি।
উঃ কৰ্ম্ম। কি?
আমি। আপনি আসামীদ্বয়কে উত্তম রূপে দেখিয়াছেন কি?
উঃ কৰ্ম্ম। দেখিয়াছি।
আমি। তাহাদিগকে চিনিতে পারিয়াছেন কি?
উঃ কৰ্ম্ম। না।
আমি। বেস ভাল করিয়া দেখুন দেখি।
উঃ কৰ্ম্ম। ভাল করিয়াই দেখিতেছি, কিন্তু উহাদিগকে ইতি পূর্ব্বে আর কখন দেখিয়াছি বলিয়া মনে করিতে পারিতেছি না।
আমি। আপনি ইহাদিগকে বেশ উত্তমরূপেই চিনেন, কিন্তু এখন মনে করিয়া উঠিতে পারিতেছেন না।
উঃ কৰ্ম্ম। উহারা কাহারা?
আমি। বৃদ্ধ হইতেছে সেই ঈশানচন্দ্র ঘোষ ও যুবকটি তাহার সেই নব সহচর তারাপ্রসাদ দে।
উঃ কৰ্ম্ম। ইহারা কি তাহারাই?
আমি। হাঁ।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
আমার নিকট হইতে আসামীদ্বয়ের পরিচয় পাইবার পর সেই কৰ্ম্মচারী কহিলেন, “এখন আমি তোমাদিগকে বেশ চিনিতে পারিতেছি ঈশান তুমি আমাকে চিনিতে পারিয়াছ কি?
ঈশান। আপনারা বড় লোক সুতরাং সকল সময়ে সকলকে চিনিয়া উঠিতে পারেন না। আমরা দরিদ্র লোক আমরা আপনাদিগকে আর চিনিতে পারিব না?
উঃ কর্ম্ম। তুমি এবার কত দিবস জেল হইতে আসিয়াছ?
ঈশান। প্রায় ছয় মাস হইবে।
উঃ কর্ম্ম। আর তারাপ্রসাদ?
ঈশান। উহার প্রায় এক বৎসর অতীত হইয়া গিয়াছে।
উঃ কৰ্ম্ম। জেল হইতে খালাস হইবার এত অল্প দিবস পরেই তুমি এরূপ কার্য্যে পুনরায় হস্তক্ষেপ করিলে কেন?
ঈশান। দুই কারণে পুনরায় এই কার্য্য হস্তক্ষেপ করিতে হইয়াছে।
উঃ কৰ্ম্ম। দুইটি কারণ কি কি?
ঈশান। প্রথম কারণ উদরান্নের সংস্থান।
উঃ কৰ্ম্ম। আর দ্বিতীয় কারণ?
ঈশান। দ্বিতীয় কারণ অভ্যাসের দোষ।
উঃ কৰ্ম্ম। অন্য কোন উপায়ে কি আর উদরান্নের সংস্থান করা যায় না?
ঈশান। আজীবন যে কার্য্য আমার দ্বারা হয় নাই, এখন কি আর সেই কার্য্য আমার দ্বারা হইতে পারে? এই বৃদ্ধ বয়সে সামান্য উদরান্নের নিমিত্ত আর কাহার খোসামদ করিতে যাইব?
উঃ কৰ্ম্ম। সে যাহা হউক তোমরা দুই জনে এই কার্য্য সম্পন্ন করিলে কি প্রকারে?
ঈশান। এ নিতান্ত সামান্য কার্য্য, এরূপ কাৰ্য্য আমি একাকীই অনেক সম্পন্ন করিয়াছি। কিন্তু এখন বৃদ্ধ হইয়াছি বলিয়া তারাপ্রসাদের সাহায্য গ্রহণ করিতে হইয়াছে।
উঃ কৰ্ম্ম। তুমি আরও এরূপ অনেক কার্য্য একাকী সম্পন্ন করিয়াছ?
ঈশান। হাঁ, বোধ হয় এরূপ কার্য্য আরও চারি পাঁচটি আমার দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে।
উঃ কৰ্ম্ম। এইরূপ হত্যা?
ঈশান। হাঁ,
উঃ কৰ্ম্ম। সেই সকল মকদ্দমায় তুমি কখন ধৃত হও নাই?
ঈশান। কোন কোনটিতে কেহই জানিতে পারে নাই, যে আমা কর্তৃক ঐ কাৰ্য্য হইয়াছে, ও কোন কোনটিতে ধৃতও হইয়াছি।
উঃ কৰ্ম্ম। যাহাতে ধৃত হইয়াছিলে, তাহাতে কি কোন রূপ দণ্ড প্রাপ্ত হও নাই?
ঈশান। না!
উঃ কৰ্ম্ম। কিরূপে পরিত্রাণ পাইয়াছিলে?
ঈশান। অর্থের জোরে।
উঃ কর্ম্ম। এবারও তাহা হইলে পরিত্রাণ পাইলেও পাইতে পার?
ঈশান। না, এবার আর আশা নাই।
উঃ কৰ্ম্ম। কেন?
ঈশান। এবার আর আমাদিগের নিকট অর্থ নাই, এই কার্য্য করিয়া যাহা কিছু পাইয়াছিলাম তাহার সমস্তই আপনাদিগের হস্তগত হইয়াছে।
উঃ কৰ্ম্ম। সে যাহা হউক তোমরা এ কার্য্য করিলে কি নিমিত্ত?
ঈশান। কেন! অর্থের নিমিত্ত!
উঃ কৰ্ম্ম। তাঁহার যে অর্থ ছিল, এ সন্ধান তোমরা কোথা হইতে প্রাপ্ত হইলে?
ঈশা। রাসবিহারীবাবু যে ধনশালী ব্যক্তি এ কথা কে না অবগত আছে। আর তিনি যে নিতান্ত কৃপণ, সহজে একটি পয়সাও খরচ করিতে পারেন না, একথা যখন আবাল বৃদ্ধ বনিতা মাত্রই অবগত আছে, তখন আমরাই বা না জানিতে পারিব কেন?
উঃ কৰ্ম্ম। ভাল তাহাই হইল, তোমরা না হয় জানিতে পারিলে রাসবিহারীবাবুর অনেক অর্থ আছে, আরও না হয় জানিতে পারিয়াছিলে যে, তিনি নিতান্ত কৃপণ, কিন্তু তোমরা কেবল মাত্র সেই কৃপণের ধন অপহরণ না করিয়া তাহাকে হত্যা করিলে কেন?
ঈশান। সৰ্ব্বপ্রথমে কেবল তাঁহার অর্থ অপহরণ করিবার চেষ্টা করিয়াছিলাম, কিন্তু কৃতকাৰ্য্য হইতে পারি নাই বলিয়াই, পরিশেষে তাঁহাকে হত্যা পৰ্য্যন্তও করিতে হইয়াছে।
উঃ কৰ্ম্ম। কিরূপে তাঁহার অর্থ অপহরণ করিবার চেষ্টা করিয়াছিলে:
ঈশান। আমরা জানিতাম প্রত্যহ সন্ধ্যার পর রাসবিহারীবাবু তাঁহার বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া যাইতেন ও রাত্রি দশটার পূর্ব্বে প্রায়ই প্রত্যাগমন করিতেন না, সেই সময়ে আমরা তাঁহার ঘরে প্রবেশ করিয়া তাঁহার অর্থাদি অপহরণ করিবার চেষ্টা করিয়াছিলাম, কিন্তু তাঁহার পরিচারকের নিমিত্ত তাহা করিয়া উঠিতে পারি নাই। রাসবিহারী বাবু বাহিরে গমন করিতেন কিন্তু তাঁহার অবর্তমানে তাঁহার চাকর কোন স্থানে গমন করিত না, তাঁহার ঘরের সম্মুখেই বসিয়া থাকিত। এইরূপে ক্রমাগত কয়েক দিবস পর্য্যন্ত বিশেষ রূপ চেষ্টা করিবার পর আমরা জানিতে পারি যে, যে দিবস সন্ধ্যার পর সুশীলবাবু কোন স্থানে গমন না করেন সেই দিবস রাসবিহারীবাবু বাহিরে গমন করিবার পরই তাঁহার চাকরও বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া যায়। এই অবস্থা জানিতে পারিয়া যাহাতে তাঁহার চাকর বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া যায় আমরা তাহার এক উপায় উদ্ভাবন করি।
উঃ কৰ্ম্ম। কিরূপ উপায় উদ্ভাবন করিয়া তোমরা ঐ চাকরকে স্থানান্তরে প্রেরণ করিতে সমর্থ হত?
ঈশান। যখন আমরা জানিতে পারিলাম যে ডাক্তারবাবু সন্ধ্যার পর বহির্গত না হইলেই সেই পরিচারক বহির্গত হইয়া যায়, তখন আমাদিগের প্রধান কার্য্য হইল যাহাতে ডাক্তার বাবু সন্ধ্যার পর বহির্গত না হন।
উঃ কৰ্ম্ম। কিরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া ডাক্তারবাবুর বহির্গমন স্থগিত করিলে?
ঈশান। সন্ধ্যার পর তাঁহার ডিসপেনসারিতে গমন করিয়া আমার রোগের চিকিৎসা করাইব, এই মর্ম্মে প্রথমে তাঁহাকে একখানি পত্র লিখিলাম ও পরিশেষে সন্ধ্যার সময় তাঁহার ডিসপেনসারিতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, আমাদিগের অভিসন্ধি পূর্ণ হইয়াছে, রাসবিহারীবাবুর পরিচারক রাসবিহারীবাবুর পশ্চাৎ পশ্চাৎ বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গিয়াছে।
উঃ কৰ্ম্ম। রাসবিহারীবাবু ও তাঁহার চাকর বাড়ীতে নাই জানিতে পারিয়া তোমরা কি করিলে?
ঈশান। আমি নানারূপ রোগে জড়ীভূত, এইরূপ নানা প্রকার মিথ্যা বাহানা করিয়া ডাক্তারবাবুকে আমি অনেকক্ষণ পৰ্য্যন্ত কথায় কথায় অন্যমনস্ক রাখিলাম। ওইদিকে আমার পরামর্শ মত, তারাপ্রসাদ, ডিসপেনসারি গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া রাসবিহারীবাবুর বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। তারাপ্রসাদের সহিত অনেকগুলি চাবি ছিল, তাহার মধ্যস্থিত একটা চাবির দ্বারা সে রাসবিহারীবাবুর ঘরের তালা খুলিয়া ফেলিল ও ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিল অপহরণ করিবার উপযোগী কোন দ্রব্য ঘরের মধ্যে নাই, অনুমান হইল, তাঁহার যাহা কিছু আছে, তাহা সমস্তই সেই ঘরের মধ্যস্থিত লোহার সিন্ধুকের মধ্যে আবদ্ধ। ঘরের মধ্যে অপরাপর যে সকল বাক্স পেটরা ছিল, একে একে সমস্তগুলিই খুলিয়া দেখা হইল তাহার মধ্যে মূল্যবান কোন দ্রব্যাদি বা লোহার সিন্ধুকের চাবি কিছুই পাওয়া যাইল না, তারাপ্রসাদের সহিত যে সকল চাবি ছিল তাহার একটিও লোহার সিন্ধুকে লাগিল না, সুতরাং অনন্যোপায় হইয়া সে দিবস প্রত্যাবর্তন করিতে হইল। ঘরের যে সকল চাবি তালা খোলা হইয়াছিল, তাহার সমস্তগুলিই পূর্ব্বের ন্যায় বন্ধ করিয়া তারাপ্রসাদ ঐ ঘর হইতে বহির্গত হইয়া আসিল। কিন্তু কিরূপ চাবি হইলে লোহার সিন্ধুক খোলা যাইতে পারে তাহা উত্তমরূপে দেখিয়া আসিল। আমাদিগের উদ্দেশ্য সফল করিতে না পারায় আমরা সে দিবস সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। তাহার পর আমাদিগের প্রধান কার্য্য হইল কোনরূপে ঐ লোহার সিন্ধুকের একটি চাবি সংগ্রহ করা।
উঃ কৰ্ম্ম। ঐ লোহার সিন্ধুকের চাবি সংগ্রহ করা হইয়াছিল?
ঈশান। অনেকগুলি লোহার সিন্ধুকের চাবি আমরা সংগ্রহ করিয়াছিলাম, ও চুরি করিবার সময় উহার একটি দ্বারা লোহার সিন্ধুক খুলিতেও সমর্থ হইয়াছিলাম।
উঃ কৰ্ম্ম। যেরূপ উপায়ে তোমরা প্রথম দিবস রাসবিহারীবাবুর ঘরে প্রবেশ করিয়া অপরাপর বাক্স পেটরা খুলিয়া অনায়াসেই দেখিয়াছিলে, সেইরূপ উপায়ে ঐ ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া তাঁহার লোহার সিন্ধুক খুলিয়া তাঁহার যথাসর্বস্ব অপহরণ করিলে না কেন?
ঈশান। আমাদিগের ইচ্ছা ছিল তাহাই কিন্তু কার্য্যে তাহা পরিণত করিতে সাহসী হই না, কারণ একে সন্ধ্যার পরই এইরূপ দুরূহ কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে হয়, সেই সময় দ্রব্যাদি লইয়া আসা নিতান্ত সহজ নহে, তাহার উপর ডাক্তারবাবুর নিকট পুনরায় গমন করা কর্তব্য মনে করি নাই। কারণ প্রথম দিবস ডাক্তারবাবুর সহিত আমার রোগ সম্বন্ধে যে সকল কথা হইয়াছিল, তাহা তিনি বিশ্বাস করেন নাই, ইহা তাঁহার কথা শুনিয়া ও তাঁহার মুখের ভাব দেখিয়া আমি বেস অনুমান করিতে পারিয়াছিলাম। এরূপ অবস্থায় পুনরায় তাঁহার নিকট গমন করিলে আমাদিগের কার্য্যে কতদূর কৃতকার্য হইতে পারিতাম তাহা বলিতে পারি না। বিশেষতঃ সেই পুরাতন উপায় অবলম্বন করিয়া তাঁহার নিকট গমন করিলেও, আমাকে তাঁহার নিকটেই থাকিতে হইত। কিন্তু যে কার্য্যের নিমিত্ত আমরা সেই স্থানে গমন করিতাম সেই কার্য্য একেলা তারাপ্রসাদের দ্বারা কখনই নির্ব্বাহ হইতে পারিত না। অভাব পক্ষে দুইজন ব্যতীত এরূপ কার্য্য কখনই সম্পন্ন হইতে পারে না।
উঃ কৰ্ম্ম। ভাল তাহাই যেমন হইল, তোমরা চুরি করিবার উদ্দেশে, রাসবিহারীবাবুর ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলে, তাঁহার যথাসর্ব্বস্ব অপহরণও করিলে, কিন্তু তাঁহাকে হত্যা করিলে কেন?
ঈশান। তাঁহাকে হত্যা করিবার আমাদিগের ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু কাৰ্য্যগতিকে সেই কাৰ্য্যও আমাদিগকে করিতে হইয়াছে।
উঃ কৰ্ম্ম। এমন কি কাৰ্য্য আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল যাহাতে রাসবিহারীবাবুকে হত্যা না করিলে আর উপায় ছিল না।
ঈশান। রাসবিহারীবাবু আমাকে উত্তমরূপে চিনিতেন। আমরা যে সময় তাঁহার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করি সেই সময় তিনি নিদ্রিত ছিলেন, কিন্তু তাঁহার ঘরের মধ্যে একটি প্রদীপ জ্বলিতেছিল। আমরা যে সময় তাঁহার লোহার সিন্ধুক খুলিয়া তন্মধ্যস্থিত মূল্যবান দ্রব্যাদি সকল অপহরণ করিতেছিলাম, সেই সময় হঠাৎ তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ হয়। তিনি একেবারে গাত্রোত্থান করিয়া তাঁহার খাটের উপর উপবেশন করেন, ও আমাকে দেখিতে পাইয়াই তিনি আমাকে চিনিতে পারেন।
উঃ কৰ্ম্ম। চিনিতে পারিয়া তিনি কি করেন?
ঈশান। চিনিতে পারিয়াই তিনি একেবারে আমার নাম ধরিয়া চীৎকার করিয়া উঠেন ও কহেন, “ঈশান তুই আমার সর্বনাশ করিতেছিস কেন?” এই কথা একবার মাত্র কথিত হইবার পরই তারাপ্রসাদ তাঁহার বাকরোধ করিয়া দেয়।
উঃ কর্ম্ম। তারাপ্রসাদ কিরূপে তাঁহার বাকরোধ করিতে সমর্থ হয়?
ঈশান। তারাপ্রসাদ দ্রুতগতি তাঁহার নিকট গমন করিয়া, তাঁহার পশ্চাৎ হইতে তাঁহার গলা, দড়ি দিয়া জড়াইয়া ধরে।
উঃ কৰ্ম্ম। দড়ি কোথায় পাইলে?
ঈশান। দড়ি আমরা সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিলাম।
উঃ কৰ্ম্ম। দড়ি সঙ্গে করিয়া আনিবার প্রয়োজন? তোমরা আসিয়াছিলে চুরি করিতে, কিন্তু সঙ্গে করিয়া দড়ি আনিয়াছিলে কেন?
ঈশান। দড়ি আনিবার উদ্দেশ্য ছিল, দড়ি ব্যতীত আরও কতকগুলি দ্রব্য আমরা সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিলাম।
উঃ কর্ম্ম। আর কি কি দ্রব্য আনিয়াছিলে?
ঈশান। আর কি কোন দ্রব্য আপনারা কেহ ঘরের ভিতর প্রাপ্ত হন নাই?
উঃ কৰ্ম্ম। একটি লোহার হুক পাওয়া গিয়াছিল।
ঈশান। তাহাও আমরা আনিয়াছিলাম।
উঃ কৰ্ম্ম। একটি হাতুড়িও সেই ঘরের মধ্যে পড়িয়াছিল।
ঈশান। উহাও আমরা সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিলাম।
উঃ কৰ্ম্ম। এই সকল দ্রব্য তোমাদিগের সঙ্গে করিয়া আনিবার কি প্রয়োজন ছিল?
ঈশান। প্রয়োজন না থাকিলে আর আনিব কেন? যাহার ঘরে আমরা চুরি করিতে প্রবেশ করি চুরি করিবার সময়, বা চুরি করিয়া বহির্গত হইবার সময়, যদি সেই বাড়ীর কোন লোক আমাদিগকে চিনিতে পারে, তাহা হইলে তাহাকে হত্যা করিবার প্রয়োজন হইয়া পড়ে নতুবা তাহারই সনাক্ত মতে ঐ সকল চোরা দ্রব্যের সহিত আমাদিগকে ধৃত হইতে হয়। কাজেই প্রয়োজন মত কাহাকেও হত্যা করিতে হইলে, হত্যার উপযোগী দ্রব্যাদি আমাদিগকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইতে হয়।
উঃ কৰ্ম্ম। এরূপ অবস্থায় কাহাকেও হত্যা করিবার প্রয়োজন হইলে, কোন না কোন প্রকারে অস্ত্রেরই প্রয়োজন হয়। হুক, হাতুড়ি, দড়ি প্রভৃতির প্রয়োজন হইবে কেন?
ঈশান। আপনারা কেবল অস্ত্রই অবগত আছেন, কারণ অস্ত্রের দ্বারা হত্যা করিলে আপনাদিগের সমস্ত বিষয়ে সুবিধা হয়। হত ব্যক্তির অঙ্গে অস্ত্রের দাগ দেখিতে পাইলেই আপনারা অনায়াসেই অনুমান করিয়া লইতে পারেন যে কোন না কোন ব্যক্তির দ্বারা ঐ ব্যক্তি হত হইয়াছে, ডাক্তার সাহেবও ঐ মৃত দেহ পরীক্ষা করিয়া অনায়াসেই আপনাদিগের অনুমানের পোষকতা করিতে সমর্থ হন; কাজেই আপনাদিগের কার্যক্ষেত্রে বিস্তৃত হইয়া পড়ে। কোন ব্যক্তি এইরূপে হত্যা করিতে সমর্থ হইল, ও কোন ব্যক্তিই বা হত ব্যক্তির মূল্যবান দ্রব্য সকল অপহরণ করিল, তাহার অনুসন্ধান করিতে আপনারা বদ্ধপরিকর না। এরূপ অবস্থায় আমাদিগের ধৃত হইবার খুব সম্ভাবনা বলিয়াই আমরা সহজে কাহার উপর অস্ত্রাঘাত করিতে প্রবৃত্ত হই না।
উঃ কৰ্ম্ম। তাহা হইলে তোমরা কিরূপে হত্যা কাৰ্য্য সম্পন্ন করিয়া থাক।
ঈশান। যেরূপ উপায়ে রাসবিহারীবাবুকে হত্যা করিয়াছি। হত্যা করিবার সময় উহার গলায় দড়ি বাঁধিয়া হত্যা করিলাম ও সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার সময় উহার গলায় দড়ি বাঁধিয়া সেই ঘরের মধ্যে কোন স্থানে ঝুলাইয়া রাখিয়া দিলাম, এবং ঘরের অবস্থা এরূপ করিয়া রাখিয়া দিলাম যে, আমাদিগের প্রস্থান করিবার পর, সেই ঘরের অবস্থা দেখিয়া সহজে কেহ অনুমান করিতে না পারেন যে সেই ঘর হইতে কোন দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে।
উঃ কৰ্ম্ম। এরূপ উপায়ে হত্যা করিয়া তোমাদিগের লাভ কি?
ঈশান। ইহাতে যে আমাদিগের লাভ কি তাহাও আপনাকে বলিয়া দিতে হইবে? এরূপ অবস্থায় হত্যা করিলে সেই হত্যা প্রায় হত্যাকাণ্ডেই পরিণত হয় না, আপনারা মৃত ব্যক্তির অবস্থা দেখিয়াই স্থির করিবেন যে, সেই ব্যক্তি গলায় দড়ি বাঁধিয়া আত্মহত্যা করিয়াছে; ডাক্তারসাহেবও ঐ মৃত দেহ পরীক্ষা করিয়া আপনাদিগের মতেরই পোষকতা করিয়া বলিয়া দেন, “শ্বাসরোধেই ঐ ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ।” এইরূপ উহার মৃত্যুর কারণ স্থির হইয়া গেলে আপনাদিগের অনুসন্ধান বন্ধ হইয়া যায়, সুতরাং কোনরূপে আমাদিগের ধরা পড়িবার আর ভয় থাকে না।
উঃ কৰ্ম্ম। তোমরাও এক মন্দ উপায় উদ্ভাবন কর নাই, এখন বুঝিতে পারিতেছি, যে সকল ব্যক্তি তোমাদের কর্তৃক হত হয়, তাহারা আত্মহত্যা করিয়াছে, ইহাই প্ৰতিপন্ন হইয়া যায়।
ঈশান। অনেক সময় হয় বলিয়াই আমরা ঐরূপ উপায় অবলম্বনে কার্য্য করিয়া থাকি।
উঃ কৰ্ম্ম। তাহা বুঝিতে পারিতেছি এই বর্ত্তমান মোকদ্দমাতেই তোমরা আমাদিগের চক্ষে বিলক্ষণ ধূলি দিতে চেষ্টা করিয়াছিলে; চেষ্টাই বা কেন একরূপ প্রায় কৃতকার্য্যও হইয়াছিলে। সে যাহা হউক, বৰ্ত্তমান ক্ষেত্রে হুক ও হাতুড়ি সঙ্গে করিয়া আনিবার কি প্রয়োজন ছিল?
ঈশান। ঘরের মধ্যে যে আড়াতে ঐ মৃত দেহ আমরা ঝুলাইয়া রাখিয়া গিয়াছিলাম, সেই আড়াতে পূৰ্ব্ব হইতে হুক লাগান ছিল, তাহা আমরা অবগত ছিলাম না, আমরা ভাবিয়াছিলাম আবশ্যক হইলে আমাদিগকে নূতন করিয়া হুক মারিয়া সেই হুকে মৃতদেহ ঝুলাইয়া রাখিতে হইবে, সেই নিমিত্ত ছক, ও হুক পুতিবার নিমিত্ত হাতুড়ি, আমরা সঙ্গে করিয়াই আনিয়াছিলাম। কিন্তু যখন দেখিলাম ঐ সকল দ্রব্য আমাদিগের কোনরূপ প্রয়োজনে লাগিল না, তখন আমরা উহা ঐ স্থানেই ফেলিয়া গিয়াছিলাম।
উঃ কর্ম্ম। তোমাদিগের অভিসন্ধিতো নিতান্ত সহজ দেখিতেছি না, তোমাদিগের দ্বারা না হইতে পারে এরূপ কাৰ্য্য আমি দেখিতেছি না। আমি জানি পাশ্চাত্য শিক্ষায় তোমরা শিক্ষিত নহ, কিন্তু তোমরা এই সকল অভিসন্ধি কোথা হইতে অবগত হইতে পারিলে?
ঈশান। পাশ্চাত্য শিক্ষায় আমরা শিক্ষিত নহি সত্য, কিন্তু পাশ্চাত্য শিক্ষায় সুশিক্ষিত এরূপ কোন লোকের সহিতও কি আমাদিগের পরিচয় নাই? বিশেষ ডাক্তার পরীক্ষা করিয়া যে মৃত্যুকে হত্যা বলিয়া প্রকাশ না করেন, তাহা প্রকৃত পক্ষে হত্যা হইলেও হত্যায় পরিণত হয় না, একথা আজ কাল কে না অবগত আছেন?
উঃ কৰ্ম্ম। সে যাহা হউক তোমাদিগকে আমি আর একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাই।
ঈশান। কি?
উঃ কৰ্ম্ম। তোমারা যে সকল দ্রব্য রাসবিহারীবাবুর গৃহ হইতে অপহরণ করিয়াছ, সেই সকল দ্রব্য কোথায় ছিল?
ঈশান। কেন। তাঁহার ঘরে।
উঃ কৰ্ম্ম। ঘরের কোন স্থানে?
ঈশান। ঘরের ভিতর যে লোহার সিন্ধুক আছে, তাহারই মধ্যে ছিল।
উঃ কর্ম্ম। ঐ সিন্ধুকের চাবি তোমরা পাইয়াছিলে কি?
ঈশান। না।
উঃ কৰ্ম্ম। তাহা হইলে ঐ সিন্ধুক তোমরা খুলিলে কিরূপে, ও পরিশেষে বন্ধই বা করিলে কি প্রকারে?
ঈশান। চাবি দিয়া।
উঃ কর্ম্ম। ঐ সিন্ধুকের চাবি যদি না পাইলে তাহা হইলে ঐ সিন্ধুক চাবি দ্বারা খোলা হইল, কি প্রকারে?
ঈশান। অপর চাবির দ্বারা।
উঃ কৰ্ম্ম। অপর চাবি পাইলে কোথায়?
ঈশান। কিরূপ চাবির প্রয়োজন তাহা যদি জানিতে পারা যায় তাহা হইলে চাবির আর ভাবনা কি?
উঃ কৰ্ম্ম। কোন ভাবনা নাই কেন?
ঈশান। যে স্থানে ইচ্ছা সেই স্থানেই উহা খরিদ করিতে পাওয়া যায়।
উঃ কৰ্ম্ম। কি প্রকার চাবি হইলে ঐ সিন্ধুক খুলিতে পারা যাইবে তাহা তোমরা জানিতে পারিয়াছিলে কি প্রকারে?
ঈশান। যে দিবস আমি পীড়িত সাজিয়া সুশীলবাবু ডাক্তারের নিকট চিকিৎসার ভানে গমন করিয়াছিলাম, সেই দিবস তারাপ্রসাদ আমার পুত্র পরিচয়ে বাহিরে যাইবার ভান করিয়া আমাদিগের নিকট হইতে উঠিয়া যায়, কিন্তু সে অন্য স্থানে গমন না করিয়া অপর চাবির দ্বারা রাসবিহারীবাবুর ঘরের চাবি খুলিয়া সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করে, কিন্তু মূল্যবান কোন দ্রব্য বা লোহার সিন্ধুকের চাবি না পাইয়া কেবলমাত্র সেই ঘর হইতে সেই লোহার সিন্ধুকের চাবির মাপ লইয়া আইসে ও মাপ অনুসারে আমরা একটি চাবির সংগ্রহ করিয়া পরিশেষে এই কার্য্যে হস্তক্ষেপ করি।
উঃ কৰ্ম্ম। কিরূপ উপায়ে চাবির ঠিক মাপ আনিতে সমর্থ হইয়াছিলে?
কর্ম্মচারী মহাশয়ের এই প্রশ্নের উত্তর ঈশান যেরূপ ভাবে প্রদান করিল তাহাতে তিনি বেস বুঝিতে পারিলেন যে লোহার সিন্ধুকের চাবি প্রস্তুত করিতে হইলে বন্ধ সিন্ধুক দেখিয়া চাবির মাপ ঠিক লওয়া যাইতে পারে।
যেরূপ উপায়ে ও যে দ্রব্যের দ্বারা ঐ কাৰ্য্য নিৰ্ব্বাহ হইতে পারে তাহা আমরা এই স্থানে প্রকাশিত করিতে পারিলাম না, কারণ কি উপায়ে অপরের লোহার সিন্ধুকের চাবি প্রস্তুত হইতে পারে তাহা এই স্থানে প্রকাশিত হইলে কেহই তাহার সঞ্চিত অর্থ বা মূল্যবান দ্রব্যাদি নিজের লোহার সিন্ধুকের মধ্যে রাখিয়া নিশ্চিন্ত থাকিতে পারিবেন না। ঈশানের কথা শুনিয়া কৰ্ম্মচারী মহাশয় কহিলেন, “ঈশান তোমার সাহসকে ও ধন্য, কৌশলকেও ধন্য, ও তোমাদিগের বুদ্ধি যে কতদূর প্রসংশনীয় তাহা সহজে অনুসন্ধান করিয়া উঠা যায় না। তোমাদিগের এইরূপ বুদ্ধি ও কৌশলাদি যদি এইরূপ অসৎ পথে ধাবিত না হইয়া সৎপথ আশ্রয় করিত তাহা হইলে তোমরা মহৎ লোকের মধ্যে পরিগণিত হইতে।”
ঈশান। আমাদিগের অদৃষ্টে যাহা আছে তাহা খণ্ডন করিতে পারে এরূপ সাধ্য কাহারও নাই।
উঃ কৰ্ম্ম। ঐরূপ উপায়ে তোমরা লোহার সিন্ধুক হইতে কত টাকা অপহরণ করিতে সমর্থ হইয়াছিলে?
ঈশান। নগদ ও মূল্যবান দ্রব্য প্রভৃতি লইয়া বোধ হয় দশ সহস্ৰ মুদ্রা হইবে।
উঃ কৰ্ম্ম। যে সকল দ্রব্য তোমরা অপহরণ করিয়াছিলে, তাহার সমস্তই কি তোমরা বাহির করিয়া দিয়াছ?
ঈশান। কপৰ্দ্দক মাত্র আমাদের নিকট নাই, সমস্তই বাহির করিয়া দিয়াছি।
উঃ কৰ্ম্ম। এই সমস্ত দ্রব্য এক কথায় বাহির করিয়া দিলে যে?
ঈশান। প্রহারের ভয়ে।
উঃ কর্ম্ম। প্রহারের ভয় কি এতই?
ঈশান। আমরা জেল অপেক্ষা প্রহারের ভয়ই অধিক করিয়া থাকি, এ কথা কি আপনি অবগত নহেন?
উঃ কৰ্ম্ম। কিছু কিছু অবগত আছি বৈকি।
ঈশান। তাহা হইলে এ কথা আর আমাদিগকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন?
উঃ কর্ম্ম। একবার জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিলাম তোমরা ইহার কি উত্তর প্রদান কর।
ঈশান। যে উত্তর প্রদান করিলাম তাহা তো দেখিলেন, আমরা কোন কথা মিথ্যা বলিব না।
উঃ কর্ম্ম। আমার নিকট তুমি যে সকল কথা অকপটচিত্তে স্বীকার করিলে তাহা বোধ হয় সকলেরই নিকট স্বীকার করিতে প্রস্তুত আছ।
ঈশান। পুলিশ কৰ্ম্মচারীগণের মধ্যে যিনি জিজ্ঞাসা করিবেন তাঁহারই নিকট বলিতে সম্মত আছি, কিন্তু অপর আর কাহারও নিকট বলিব না!
উঃ কা। অপর কেহ কে?
ঈশান। মাজিষ্ট্রেট বা বিচারক।
উঃ কৰ্ম্ম। তাঁহাদিগের নিকট তুমি এই সকল কথা স্বীকার করিবে না?
ঈশান। না, তাহাদিগের নিকট কহিব আমরা ইহার কিছুই অবগত নহি। পুলিস মিথ্যা করিয়া আমাদিগের উপর এই মকদ্দমা সাজাইয়াছে।
উঃ কা। এরূপ অস্বীকার করিবার কারণ?
ঈশান। আপনি এত বড় একজন পুরাতন পুলিস কৰ্ম্মচারী হইয়া যে ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করিতেছেন, ইহাই আশ্চৰ্য্য।
ইহার পর ঈশান বা তাহার সঙ্গী তারপ্রসাদকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন হইল না। উহাদিগের কথায় উপর নির্ভর করিয়া এই মকদ্দমার অনুসন্ধান ও তাহাদিগের বিপক্ষে সাক্ষ্য সকল সংগৃহীত হইতে লাগিল। যে সকল কৰ্ম্মচারী মনে মনে স্থির সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন যে রাসবিহারীবাবু আত্মহত্যা করিয়াছেন, তাঁহারা মনে মনে বিশেষরূপ লজ্জিত হইলেন সত্য, কিন্তু প্রকাশ্যে কোন কথা বলিতে না পারিয়া পরিশেষে আমার মতে মত দিয়া আমার সাহায্য করিতে নিযুক্ত হইলেন। দুই দিবসের মধ্যে এই অনুসন্ধান শেষও হইয়া গেল। আসামীগণ আমাদিগের নিকট যে সকল কথা স্বীকার করিয়াছিল তাহার উপর নির্ভর করিয়া অনুসন্ধান করায় তাহাদিগের উপর নিম্নলিখিত আনুসন্ধানিক প্রমাণ সকল সংগৃহীত হইল।
১। আসামীদ্বয় সুশীলবাবুর নিকট চিকিৎসার্থ আগমন করে; ও একজন অনেকক্ষণ পর্যন্ত তাঁহার নিকট হইতে অনুপস্থিত থাকে।
২। যাহার নিকট হইতে নূতন দড়ি খরিদ করা হইয়াছিল তাহার প্রমাণ
৩। যাহার নিকট হইতে হুক খরিদ করিয়া আনা হইয়াছিল, তাহার সাক্ষী।
৪। যাহার নিকট হইতে হাতুড়ি চাহিয়া আনিয়াছিল তাহার জবানবন্দী।
৫। যাহাদিগের সম্মুখে আপনাপন দোষ স্বীকার করিয়া অপহৃত দ্রব্য সকল বাহির করিয়া দেয় তাহাদিগের সাক্ষী।
৬। হত্যা ও চুরি করিবার পর যাহার গাড়ি ভাড়া করিয়া উহারা অপহৃত দ্রব্যের সহিত গমন করে তাহার ও পূর্ব্বে যে গাড়ি করিয়া সুশীলবাবুর ডিসপেনসারিতে আগমন করিয়াছিল তাহার প্রমাণ।
৭। লাস ছেদনকারী ডাক্তারের রিপোর্ট।
৮। রাসবিহারীবাবুর চাকর ও অপরাপর ব্যক্তিগণ, যাহারা অপহৃত দ্রব্য সকল রাসবিহারীবাবুর চিনিত তাহাদিগের প্রমাণ।
৯। যাহার নিকট হইতে লোহার সিন্ধুকের চাবি খরিদ করিয়া লওয়া হইয়াছিল তাহার সাক্ষী প্রভৃতি প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া দুই তিন দিবস মধ্যেই ঐ মকদ্দমা মাজিস্ট্রেট সাহেবের নিকট প্রেরিত হইল।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
যে দিবস আমাদিগের ঊর্দ্ধর্তন কর্মচারী এই মকদ্দমার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত ঘটনা স্থলে আগমন করিয়াছিলেন বা যে দিবস আমাকর্তৃক আসামীদ্বয় ধৃত হয়, সেই দিবস অপরাপর আরও অনেক কৰ্ম্মচারী ঐ মকদ্দমার অনুসন্ধান উপলক্ষে সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন। যে কৰ্ম্মচারীর সহিত সর্ব্বপ্রথম আমার সেই স্থানে সাক্ষাৎ হইয়াছিল, ও যিনি আমাকে সঙ্গে করিয়া রাসবিহারীবাবুর ঘরের ভিতর লইয়া গিয়া মৃতদেহ আমাকে প্রথমে দেখান, তিনিও সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন। আবশ্যকীয় কাৰ্য্য শেষ করিয়া ঊর্দ্ধতন কর্মচারীরা সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার পর পূর্ব্বকথিত কর্ম্মচারী মহাশয় আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন “আমাদিগের ঊর্দ্ধতন কর্মচারী এই আসামীদ্বয়কে জানিলেন কি প্রকারে?”
আমি। ইনি এখন যে পদে উন্নীত হইয়াছেন, সেই পদ প্রাপ্ত হইবার কিছু দিবস পূর্ব্বে একটি সিঁদ চুরি মকদ্দমার অনুসন্ধানে উনি নিযুক্ত ছিলেন, সেই মকদ্দমার অনুসন্ধানকালীন আমিও তাঁহার সহায়তা করিয়াছিলাম। সেই মকদ্দমায় এই উভয় আসামীই ধৃত হইয়াছিল ও উহাদিগের নিকট হইতে অনেক চোরামালও বাহির হইয়াছিল। এই নিমিত্তই ইহারা তাঁহার নিকট পরিচিত।
ঐ যে বৃদ্ধ ঈশানচন্দ্রকে দেখিতেছেন, ও অতিশয় ভয়ানক লোক। উহার দ্বারা না হইতে পারে এরূপ কোন কাৰ্য্য এ জগতে আছে বলিয়া আমার বোধ হয় না।
কর্ম্মচারী। ও কি চরিত্রের লোক ও কিকি কার্য্য উহার দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে তাহা আমরা জানিতে পারি না কি?
আমি। কেন পারিবেন না, উহার চরিত্র সম্বন্ধে আমি যতদূর অবগত আছি, তাহার দুই একটি ঘটনা আমি আপনাকে বলিতেছি তাহা হইলেই আপনি ইহার অনেক বিষয় অবগত হইতে পারিবেন।
ঈশানচন্দ্র ঘোষ জাতিতে কায়স্থ একথা অনেকেই বলিয়া থাকেন, কিন্তু উহার প্রকৃত জন্মস্থান যে কোথায় তাহা এ পর্যন্ত কেহ স্থির করিতে পারেন নাই। যে কোন স্থানে যে মকদ্দমায়, যতবার ঈশান ধৃত হইয়াছে, ততস্থানে, ততবার সে তাহার ভিন্ন ভিন্ন বাসস্থান লিখাইয়াছে। উহার কথাবার্তা শুনিয়া কোন কোন কর্ম্মচারী অনুমান করেন, উহার বাসস্থান জশোহর জেলার অন্তর্গত পাঙ্খাচর নামক গ্রামে ও জাতিতেও সে পাঙ্খাচরি কায়স্থ, কিন্তু অনুসন্ধানে ইহার প্রকৃত তথ্য এ পর্য্যন্ত কেহই বাহির করিতে পারেন নাই। পাঙ্খাচর নামক স্থানে ঈশান সম্বন্ধে অনেক অনুসন্ধান করা হইয়াছে কিন্তু সেইস্থানে উহার সম্বন্ধে কোন কথা জানিতে পারা যায় নাই। পাঙ্খাচরি কায়স্থগণ যেরূপ ভয়ানক সিঁদিয়াল চোর তাহা পুলিস কৰ্ম্মচারী মাত্রই অবগত আছেন। যেরূপ সাহসের উপর নির্ভর করিয়া উহারা যেরূপ ভাবে সিঁদ দিয়া চুরি করিয়া থাকে, ঠিক সেইরূপ সাহসের উপর নির্ভর করিয়াই ঈশান তাহার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিয়া থাকে বলিয়াই, তাহাকে পাঙ্খাচরি কায়স্থ চোর বলিয়া অনুমান করিয়া লইবার আর একটি প্রধান কারণ।
ঈশানের জীবনের দুই একটি ঘটনা এই স্থলে বর্ণনা করিলেই আপনারা তাহার পরাক্রমের অনেক পরিচয় পাইবেন!
একটি গৃহস্থের একখানি ইষ্টকনির্ম্মিত বাড়ীতে সিঁদ কাটিয়া চুরি করিবার মানসে ঈশান এক দিবস একাকী বহির্গত হয়। ঐ বাড়ীর কোন ঘরে মূল্যবান দ্রব্যাদি থাকিত, তাহা ঈশান পূর্ব্বে কিছুমাত্র জানিতে না পারিয়াই এই কার্য্যে প্রবৃত্ত হয়। কোন ঘরে মূল্যবান অর্থাদি থাকিত তাহা জানিয়া লইবার নিমিত্ত ঈশান অনেক চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু কিছুতেই সে তাহার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে পারে না, অথচ সে কার্য্য করিবার নিমিত্ত ঈশান মনে মনে সংকল্প করিয়াছে সেই সংকল্প পরিত্যাগ করিবার লোক ঈশান নহে। রাত্রি দ্বিপ্রহরের সময় ঈশান তাহার সিঁদ কাটিবার অস্ত্রটি হস্তে লইয়া সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইল ও সদর রাস্তার নিকটবর্ত্তী একটি ঘরে, বাহির হইতে সিঁদ দিল। ঈশানের সিঁদ কাটিবার ক্ষমতাও অতি অদ্ভুত ছিল। যে সিঁদ কাটিতে অপর কোন সিঁদিয়ালের যে স্থানে এক ঘন্টা অতিবাহিত হইয়া যাইত, সেই সিঁদ দশ মিনিটের মধ্যে ঈশান কাটিতে পারিত। ঐ বাড়ীতে সিঁদ দিবার সময় বাড়ীর কোন ব্যক্তিই জানিতে পারে না যে কোন ব্যক্তি তাহাদিগের বাড়ীতে সিঁদ দিতেছে। সিঁদ দেওয়া শেষ হইয়া গেলে ঐ সিঁদের মধ্যে দিয়া ঈশান ঐ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিল ঐ স্থানে অপহরণপযোগী কোন দ্রব্যই নাই। এই অবস্থা দৃষ্টে ঈশান ঐ সিঁদের মধ্য দিয়া পুনরায় বহির্গত হইল, ও আপনার অস্ত্র — সিঁদ কাটি এক স্থানে লুকাইয়া রাখিয়া চোর চোর বলিয়া চীৎকার আরম্ভ করিল। তাহার চীৎকারে বাড়ীর সমস্তই জাগরিত হইয়া বাহিরে আসিয়া উপস্থিত হইল, সম্মুখে ঈশানকে দেখিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল “চোর কোথায়।”
তাহাদিগের কথার উত্তরে ঈশান কহিল “আমি এই স্থান দিয়া গমন করিতেছিলাম যাইবার সময় দেখিতে পাইলাম একটি চোর আপনাদিগের বাড়ীতে সিঁদ দিতেছে। ইহা দেখিয়া আমি যেমন ‘চোর চোর’ বলিয়া চীৎকার করিলাম, অমনি সে দৌড়িয়া পলাইয়া গেল। আমি তাহাকে ধরিবার চেষ্টা করিলাম কিন্তু কোন রূপেই ধরিতে পারিলাম না।” এই বলিয়া যে স্থানে ঈশান নিজে সিঁদ কাটিয়াছিল সেই স্থান তাহাদিগকে দেখাইয়া দিল। তাহারা সেই স্থানে গিয়া দেখিতে পাইল যে তাহাদিগের ঘরে প্রকৃতই একটি সিঁদ কাটা রহিয়াছে। এই অবস্থা দৃষ্টে সেই বাড়ীতে একটি গোলযোগ পড়িয়া গেল, ক্রমে পাড়ার আরও দুই চারিজন আসিয়া উপস্থিত হইলেন, যে ঘরে সিঁদ হইয়াছিল তাহা সকলেই দেখিলেন, ও অপরাপর ঘর হইতে কোন দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে কি না তাহাও তাঁহারা দেখিতে লাগিলেন, যে ঘরে মূল্যবান দ্রব্যাদি থাকিত, সেই ঘর খুলিয়াও দেখা হইল যে সেই ঘর হইতে কোন দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে কি না? এইরূপ গোলযোগের সময় ঈশানও তাহাদিগের সহিত বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল ও বাড়ীর অভ্যন্তরীণ ঘরগুলিও উত্তমরূপে দেখিয়া লইল। যে ঘরে মূল্যবান দ্রব্যাদি থাকে তাহাও জানিতে তাহার আর বাকী রহিল না। গোলযোগের মধ্যে বাড়ীর কোন ব্যক্তিই তাহার দিকে লক্ষ্য করিল না সে যে কে কোথায় থাকে ও এই রাত্রিতে সেই বা কি নিমিত্তে সেই স্থানে আগমন করিয়াছিল তাহাও তাহাকে কেহ জিজ্ঞাসা করিল না। পাড়ার বা বাড়ীর লোকের মত ঈশান সেই স্থানের সমস্ত অবস্থা দেখিয়া লইল।
ক্রমে গোলযোগ মিটিতে আরম্ভ হইয়া এক এক করিয়া প্রতিবেশীরা আপনাপন গৃহে গমন করিতে লাগিলেন, বাড়ীর সকলেও একে একে পুনরায় শয়ন করিতে গেলেন, বাড়ীর দরজাদি পুনরায় বদ্ধ হইল। ঈশানও সেই স্থান হইতে স্থানান্তরে প্রস্থান করিল কিন্তু সে যে কোথায় গেল তাহার দিকে কেহ লক্ষ্য করিল না; বলা বাহুল্য ঈশান সেই স্থান হইতে একটু দূরে গমন করিয়া আপনার মনোভিলাষ পূর্ণ করিবার আশায় বসিয়া রহিল।
এইরূপে প্রায় দুই তিন ঘন্টা কাল অতিবাহিত হইয়া গেল। ঈশান বেশ বুঝিতে পারিল ঐ বাড়ীর সকলে পুনরায় নিদ্রিত হইয়া পড়িয়াছে, তখন সে তাহার লুক্কাইত সিঁদ কাটী বাহির করিয়া পুনরায় ঐ বাড়ীর উদ্দেশে গমন করিল। যে ঘরে মূল্যবান দ্রব্যাদি আছে, এবার সেই ঘরে সিঁদ কাটিল। এবারও সিঁদ দিবার সময় কেহই কিছু জানিতে পারিল না। সিঁদের মধ্য দিয়া পুনরায় ঈশান সেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল ও আপনার ইচ্ছানুসারে দ্রব্যাদি সকল অপহরণ করিয়া পুনরায় সেই সিঁদ দিয়া দ্রব্যাদির সহিত বহির্গত হইয়া প্রস্থান করিল।
প্রাতঃকালে বাড়ীর সকলে গাত্রোত্থান করিয়া দেখিতে পাইল রাত্রিকালে যে সিঁদ তাহারা দেখিয়াছিল তদ্ব্যতীত আরও একটি সিঁদ কাটা রহিয়াছে। একটি সিঁদ কাটিবার পর যে সকল দ্রব্যাদি তাহারা ঘরের মধ্যে দেখিয়াছিল, দ্বিতীয় সিঁদ দেখিতে পাইবার পর সেই সকল দ্রব্যাদি আর তাহারা দেখিতে পাইল না।
গ্রামের চৌকিদার গিয়া এই সংবাদ থানায় প্রদান করিল, থানা হইতে কর্ম্মচারীগণ আসিয়া ইহার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলেন। যে ব্যক্তি সৰ্ব্বপ্রথমে প্রথম সিঁদ কাটিতে দেখিয়া গৃহস্থকে ডাকিয়া দিয়াছিল, সেই ব্যক্তিকে দুই চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করিবার মানসে তাঁহারা উহার বিস্তর অনুসন্ধান করিলেন, কিন্তু কিছুতেই জানিতে পারিলেন না যে ঐ ব্যক্তি কে, কোথায় থাকে ওকি রূপেই বা ঐ সময়ে সে স্থানে আসিয়াছিল।
ঐ মকদ্দমার বিশেষরূপ অনুসন্ধান হইয়াছিল সত্য কিন্তু সেই সময়ে ইহার প্রকৃত কেহই অবগত হইতে পারেন না। ঐ ঘটনার অনেক দিবস পরে অন্য আর একটি সিঁদ চুরি মকদ্দমায় ঈশান ধৃত হয়, সেই সময় তাহার প্রমুখাৎ এই সকল কথা প্রকাশিত হইয়া পড়ে।
যে মকদ্দমায় সৰ্ব্বপ্রথমে ঈশান ধৃত হয় তাহাও নিতান্ত কম নহে।
কলিকাতার মধ্যে নামক একটি স্থান আছে, কলিকাতার পাঠকগণের মধ্যে সকলেই তাহা অবগত আছেন। ঐ স্থানে সারি সারি কতকগুলি পোদ্দারের দোকান আছে, ঐ সকল দোকানের যাহারা অধিকারী তাহাদিগের মধ্যে বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিলে সৎ লোক দুই একজনও পাওয়া যায় কি না সন্দেহ। ঐ সকল দোকানদারগণের মধ্যে অনেকেরই পোদ্দারের দোকান আছে সত্য, কিন্তু সৎব্যবসায়ী পোদ্দারগণ যে রূপে কার্য্য করিয়া থাকেন ইহাদিগের কার্য্য তাহার অন্যরূপ
পোদ্দারদিগের একটি প্রধান কার্য এই, তাহারা প্রায়ই সম্ভ্রান্ত লোকদিগের আদেশ মত গহনাদি প্রস্তুত করিয়া দিয়া বেশ দশটাকা উপার্জ্জন করিয়া থাকেন; কিন্তু ঐ স্থানের পোদ্দারদিগের মধ্যে ঐরূপ কার্য্য করিতে আমি যে কাহাকেও দেখিয়াছি বলিয়া আমার মনে হয় না। উহাদিগের কার্য্য সুবর্ণ বা রৌপ্য নির্ম্মিত অলঙ্কার যাহার নিকট হইতে কম মূল্যে প্রাপ্ত হইবে, তাহারই নিকট হইতে খরিদ করিয়া, তখনই উহা প্রজ্বলিত হাপরের মধ্যে ফেলিয়া গলাইয়া ফেলিবে। কারণ, তাহারা বেশ অবগত আছে যে, অপহৃত দ্রব্য ব্যতীত কেহই মূল্যবান অলঙ্কার নিতান্ত কম মূল্যে প্রদান করিতে পারে না। ঐ সকল অলঙ্কারের মধ্যে যদি নিতান্ত নতুন গহনাও থাকে তাহা হইলেও তখনই তাহারা তাহা গলাইয়া ফেলিবে। কারণ তাহারা বেশ অবগত আছে অপহৃত অলঙ্কার গলাইয়া ফেলিলে আর কেহ উহা চিনিয়া উঠিতে পারে না, সুতরাং তাহাদিগের আর কোনরূপ বিপদের সম্ভাবনাও থাকে না, আবশ্যক হইলে ঐ সকল দ্রব্য খরিদ করিবার কথা অস্বীকার করিতে পারিলেই প্রায় সকল গোলযোগ মিটিয়া যায়। কারণ ঐ সকল অলঙ্কার খরিদ বিক্রয়ের জমা খরচ তাহাদিগের থাকে না। দোকানে খাতা আছে বটে কিন্তু ঐ খাতা খুজিয়া দেখিলে কিছুই জানিতে পারিবার উপায় নাই।
ঐ সকল পোদ্দরগণের মধ্যে কয়েকজন পোদ্দার আছেন, তাহাদিগের ব্যবহার আরও ভয়ানক, তাহারা নিয়মিতরূপ বেতন দিয়া চোরগণকে প্রতিপালন করিয়া থাকে, নিয়মিতরূপ বেতন ব্যতীত যদি কোন চোরের আরও অর্থের প্রয়োজন হয় তাহাও তাহাদিগকে “দাদন” রূপে প্রদান করা হইয়া থাকে। ঐ চোরগণ চুরি করিয়া যাহা কিছু যখন আনয়ন করিবে তখনই ঐ পোদ্দারগণ তাহার অর্দ্ধেকমূল্যে উহা খরিদ করিয়া লইবে।
ঈশান এই সকল অবস্থা বেশ জানিতে পারিয়া প্রথমতঃ উহাদিগের সহিত মিলিত হইবার ইচ্ছা করিল কিন্তু প্রথমেই সেই ইচ্ছা কার্য্যে পরিণত না করিয়া একবার চোরের উপর চুরি করিবার বাসনায় তাহার সুযোগ অনুসন্ধান করিতে লাগিল। সেই সময় ঐ স্থানের পোদ্দারগণের মধ্যে একজন পোদ্দার কোন কারণে তাহার দোকান উঠাইয়া দেয়, ঈশান তাহা জানিতে পারিয়া সেই পোদ্দারের নিকট হইতে ঐ ঘর খানি ভাড়া করিয়া লয় ও সেই পোদ্দারের লোহার সিন্ধুক প্রভৃতি দোকানের যে কোন আবশ্যকীয় দ্রব্যাদি ছিল তাহার সমস্তই ঈশান খরিদ করিয়া লইয়া সেই ঘরেই একখানি পোদ্দারের দোকান খোলে।
অপরাপর পোদ্দারগণ সন্ধ্যার পরই দোকান বন্ধ করিয়া আপনাপন স্থানে গমন করে, ঈশান কিন্তু তাহার নিজ দোকানে শয়ন করিয়া থাকে। এইরূপে কিছু দিবস দোকান করিতে করিতে সেই স্থানের উভয় পার্শ্বের পোদ্দারগণের সহিত ক্রমে জানা শুনা হইতে লাগিল ও সদা সৰ্ব্বদা তাহাদিগের দোকানে গিয়া বসা উঠাও করিতে লাগিল।
দোকানদারদিগের সহিত এইরূপ বন্ধুত্ব স্থাপন করিবার ঈশানের একটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। সেই উদ্দেশ্য এই, —সকল পোদ্দারের দোকানে যে সকল লোহার সিন্ধুক ছিল, সেই সকল সিন্ধুক ও তাহার চাবি সকল উত্তম রূপে দেখিয়া লওয়া ও ক্রমে ক্রমে ঐ সকল সিন্ধুকের সেইরূপ চাবি সকল সংগ্রহ করিয়া রাখা। বলা বাহুল্য, ঈশান অতি অল্প দিবসের মধ্যেই তাহার উদ্দেশ্য সফল করিয়া লইল। প্রায় সমস্ত পোদ্দারের লোহার সিন্ধুকের চাবির অনুযায়ী চাবি সকল সংগৃহীত হইল।
এক দিবস সন্ধ্যার পরে অপরাপর পোদ্দারগণ তাহাদিগের দোকানে চাবি বন্ধ করিয়া আপনাপন স্থানে প্রস্থান করিলে, ঈশান আপনার দোকানে প্রবেশ করিয়া ভিতর হইতে তাহার দোকান বন্ধ করিয়া দিল! কিন্তু প্রাতঃকালে দেখা গেল ঈশান তাহার দোকানে নাই ও দোকানে বাহির হইতে তালা বন্ধ রহিয়াছে।
অপরাপর পোদ্দারগণ নিয়িমিত রূপে দোকানে আসিয়া আপনাপন দোকান খুলিতে লাগিল, কিন্তু দোকানের ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখে তাহার দোকানের অভ্যন্তরে যে লোহর সিন্ধুক ছিল তাহা উন্মুক্ত। তাহার মধ্যে স্বর্ণ রৌপ্য প্রভৃতি যাহা ছিল তাহার কিছুই নাই ও দুই দোকানের মধ্যস্থিত দেওয়ালে সিঁদ কাটা। সমস্ত পোদ্দারগণ আসিয়া আপনাপন দোকান খুলিলে দেখা গেল ঈশানের দোকানের দুই পার্শ্বের প্রায় আটখানি দোকানের অবস্থা এইরূপ ঘটিয়াছে। যখন এই রূপ গোলযোগ চলিতেছে, সেই সময় ঈশানও কোথা হইতে আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল। সেও তাহার দোকান খুলিল, তাহার দোকানের অবস্থাও অপরাপর দোকানদারগণের সদৃশ।
এই সংবাদ ক্রমে থানায় গিয়া উপস্থিত হইল, তথা হইতে কর্মচারীগণ আসিয়া এই ভয়ানক সিঁদ চুরি মকদ্দমার অনুসন্ধানে লিপ্ত হইলেন।
যে ৮/৯ খানি দোকানে এইরূপে সিঁদ হইয়াছিল, তাহা দেখিয়া অনুমান হইল, একপ্রান্তের একখানি দোকানের মধ্যে কোন ব্যক্তি কিরূপে প্রবেশ করিয়াছে, ও সেই দোকান ও তাহার পার্শ্ববর্তী দোকানের মধ্যস্থিত দেওয়ালে সিঁদ কাটিয়া সেই পার্শ্বের দোকানে প্রবেশ করিয়াছে ও সেই দোকান ও তাহার অপর পার্শ্ববর্তী দোকানের মধ্যস্থিত দেওয়ালে সিঁদ দিয়া পুনরায় সেই অপর পার্শ্ববর্তী দোকানের ভিতর প্রবেশ করিয়াছে, এইরূপে এক এক করিয়া সেই ৮/৯ খানি দোকানের মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া প্রত্যেক দোকানের লোহার সিন্ধুকের মধ্যস্থিত মূল্যবান দ্রব্যাদি সকল অপহরণ করিয়াছে কিন্তু পরিশেষে ঐ চোর কোথা দিয়া বাহির হইয়া গিয়াছে তাহা অনুমান করা নিতান্ত সহজ নহে, কারণ সমস্ত দোকান গুলিই বাহির হইতে তালা বন্ধ।
এই মকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে আসিয়া পুলিসকে বিপদগ্রস্ত হইতে আসিয়াছিল। কারণ প্রথমে তাঁহারা স্থির করিয়াই উঠিতে পারেন না যে এই চুরি বাহিরের কোন চোরের দ্বারা হইয়াছে, না দোকানদার দিগের মধ্যে কোন ব্যক্তি এই চুরিতে সংমিলিত আছে।
পুলিসের ভাল ভাল কৰ্ম্মচারীগণ একত্র মিলিত হইয়া এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছিলেন, তাঁহাদিগকে আমিও আমার সাধ্যানুযায়ী সাহায্য করিতে পরাঙ্মুখ হই না। কিন্তু পনর দিবস অনুসন্ধানের পর এই মকদ্দমার কিনারা হয়, সেই সময়ে সকলেই নিতান্ত বিস্মিতের সহিত জানিতে পারেন যে পোদ্দার বেশী ঈশানচন্দ্রই এই ভয়ানক কাৰ্য্য সম্পন্ন করিয়াছে। ঈশানের-নিকট হইতে এই সকল সিঁদ চুরির অনেক দ্রব্যাদি বাহির হয় ও পরিশেষে ঈশানকেও দীর্ঘকাল কারাদণ্ড ভোগ করিতে হয়।
কর্ম্ম। অপরাপর পোদ্দারগণের দোকানে সিঁদ দিয়া যেরূপভাবে তাহাদিগের দ্রব্যাদি অপহৃত হইয়া, ঈশানের দোকানেও সিঁদ দিয়া তাহারও অর্থাদি সেইরূপ অপহৃত হয়, ইহা সকলেই বুঝিতে পারেন। কিন্তু ঈশানই যে চোর একথা কিরূপে বাহির হইয়া পড়ে?
আমি। এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াই কৰ্ম্মচারীগণ দুইটি পন্থা অবলম্বন পূর্ব্বক কার্যক্ষেত্রে প্রবিষ্ট হন।
১ম। বাহিরের চোরের দ্বারা এই কার্য্য হইলেও হইত পারে। একটি দোকানের যে সকল তালা বন্ধ ছিল তাহা বাহির হইতে খুলিয়া দুই তিন জন চোর সিঁদ কাটি লইয়া ঘরের ভিতর প্রবেশ করিবার পর এক ব্যক্তি বাহির হইতে ঐ সকল তালা পূর্ব্বের ন্যায় বন্ধ করিয়া দিয়া বাহিরে বসিয়া থাকিতে পারে। দোকানের মধ্যস্থিত চোরগণ আপনাদিগের কার্য্য শেষ করিয়া বহির্গত হইবার সময়, বাহিরের চোর পূর্ব্বকথিতরূপে তালাগুলি খুলিয়া দিলে তাহারা অনায়াসেই সেই সকল অপহৃত দ্রব্যাদির সহিত বাহিরে আসিলে, পুনরায় বাহির হইতে তালা বন্ধ করিয়া দিয়া তাহারা অনায়াসেই প্রস্থান করিতে পারে। এই রূপে বা অপর কোন উপায়ে যদি বাহিরের চোরের দ্বারা এই কার্য্য হইয়া থাকে, তাহার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত কয়েক জন কর্ম্মচারী নিযুক্ত হইলেন।
২য়। চুরির পূর্ব্বে যে সকল দোকানদারগণ বা দোকানের কর্ম্মচারিগণ দোকানে কার্য্য করিতেন, দোকান বন্ধ হইবার পর তাহারা কে কোথায় গমন করিয়াছিলেন, কে কোন স্থানে সেই রাত্রিতে অবস্থিতি করিয়াছিলেন, তাহার অনুসন্ধান বিশেষরূপে আরম্ভ হইল। প্রত্যহ রাত্রিকালে ঈশান আপনার দোকানেই থাকিত, কিন্তু সেই রাত্রিতে দোকানে শয়ন না করিবার বিশেষ কোন কারণ না থাকিলেও সে যে কেন অপর স্থানে গমন করিয়াছিল সেই সম্বন্ধে ঈশান বিশেষ সন্তোষজনক কোনরূপ উত্তর প্রদান করিতে পারিল না। তদ্ব্যতীত একজন পুরাতন ডিটেকটিভ কর্মচারী ঘটনাস্থল দেখিয়াই কহিলেন, এই কাৰ্য্য হয় ঈশানের দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে, না হয় চোরগণ ঈশানের দোকান খুলিয়া, উহার মধ্য হইতে দুই দিকে এক একটি সিঁদ কাটিয়াছে। ডিটেকটিভ কৰ্ম্মচারীর এই কথা শুনিয়া একজন নূতন কৰ্ম্মচারী জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, ঈশানের ঘর হইতেই যে দুই ধারে সিঁদ কাটা হইয়াছে, তাহার প্রমাণ কি? নূতন কৰ্ম্মচারীর কথা শুনিয়া, ডিটেকটিভ কৰ্ম্মচারী তাঁহাকে দেখাইয়া দেন যে দোকানের বামপার্শ্বের দেওয়ালে যখন সিঁদকাটা হইয়াছে তখন ঐ দোকানের মধ্যে বসিয়াই চোর সিঁদ কাটিয়াছে, তাহার প্রমাণ যে সকল ইট কাটিয়া বাহির করিতে হইয়াছে তাহা ঈশানের দোকানের ভিতরই পড়িয়াছে, পুনরায় যখন দক্ষিণ দিকের দেওয়ালে সিঁদ দিয়াছে তখনও ঐরূপ কাটা ইট সকল উহার দোকানের মধ্যেই পড়িয়াছে। ইহা দেখিয়া সহজেই বলা যাইতে পারে যে, ঈশানের দোকানের মধ্য হইতে প্রথমে সিঁদ কাটিতে আরম্ভ করিয়া পরে ক্রমে ক্রমে দুই দিকেই গমন করিয়াছে। ডিটেকটিভ কৰ্ম্মচারীর এই কথা শুনিয়া অনেকে ঈশানকেই একবারে চোর স্থির করিয়া লইলেন, ও ২য় পন্থা অবলম্বনপূর্ব্বক তাহার সম্বন্ধে প্রকাশ্যরূপে অনুসন্ধান যতদূর হইতে পারে তাহা শেষ করিয়া পরিশেষে তাহার বিপক্ষে গুপ্ত অনুসন্ধান আরম্ভ করিলেন। গুপ্তভাবে তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ লোক থাকিয়া তাহার গতিবিধি উত্তমরূপে পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিল। এইরূপে দশ পনের দিবস গত হইতে না হইতেই এক দিবস ঈশান ধৃত হইল। সেই দিবস কতকগুলি মূল্যবান অপহৃত দ্রব্য সঙ্গে করিয়া উহা বিক্রয় মানসে কোথায় গমন করিতেছিল। অপহৃত দ্রব্যের সহিত হইবার পর ঈশান আর কোন কথা গোপন করিল না সমস্তই স্বীকার করিল; কিন্তু যে অপহৃত দ্রব্যের সহিত সে ধৃত হইয়াছিল তাহা ব্যতীত আর কোন দ্রব্য প্রদান করিল না। তাহার সহিত আরও একজন লোক ছিল। সে অবশিষ্ট দ্রব্য সকল লইয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে, এই বলিয়া পুলিস কর্মচারীগণকে বুঝাইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু তাহার কথায় কেহ বিশ্বাস করিল না অথচ অপর আর কোন দ্রব্য সে বাহির করিয়াও দিল না। যে কয়েকখানি অলঙ্কারের সহিত ঈশান ধৃত হইয়াছিল, তাহাই লইয়া তাহার উপর মকদ্দমা চলিল, ও পরিশেষে উহারই নিমিত্ত সে কারাগারে প্রেরিত হইল।
ঈশান সিঁদ কাটিতে এরূপ পারদর্শী যে, অতি অল্প সময়ের মধ্যে তাহার সদৃশ সিঁদ কাটিতে পারে এরূপ সিঁদিয়াল আমি অল্পই দেখিয়াছি। পোদ্দারগণের দোকানে সিঁদ কাটিয়া চুরি করিবার পর তাহার জেল হয় সত্য, কিন্তু জেলের ভিতর সিঁদ কাটিয়া সে জেল হইতে বাহির হইয়া পড়ে।
কর্ম্ম। জেলের মধ্যে সে সিঁদ কাটিল কি প্রকারে? কোথায়ই বা সে সিঁদ দিয়াছিল এবং সিঁদ কাটিবার অস্ত্রই বা ঈশান কোথায় পাইয়াছিল?
আমি। জেলের মধ্যে যে সকল কয়েদী থাকে তাহারা চুপ করিয়া এক স্থানে বসিয়া থাকে না, জেলের মধ্যে বা জেলের বাহিরে বাগানের মধ্যে তাহাদিগকে নানা প্রকার কার্য্য করিতে হয়। ঈশান জেলে গমন করিবার পর প্রথমতঃ তাহাকে ঘানি গাছে সরিষা ভাঙ্গিয়া তৈল বাহির করিতে দেওয়া হয়, সেই কার্য্যে এক সপ্তাহ কাল কাটিয়া গেলে, জেলের কর্তৃপক্ষগণ তাহাকে কাজের লোক বলিয়া অনুমান করেন, ও তাহাকে ছাপাখানার কার্য্যে নিযুক্ত করিয়া দেন। বিশেষ যত্ন ও মনোযোগের সহিত ঈশান ছাপাখানার কার্য্য নির্ব্বাহ করিতে আরম্ভ করে। ছাপাখানায় যে স্থানে কয়েদীগণ কার্য্য করে সেই স্থানে মুদ্রাযন্ত্রের ব্যবহার উপযোগী অনেকরূপ লৌহের যন্ত্রাদি রক্ষিত থাকে। ঈশান সেই স্থানে কার্য্য করিবার সময় সুযোগ মতে তাহার কার্য্যের উপযোগী বড় গোছের একটা লৌহ পেরেক সংগ্রহ করিয়া লয়।
অপরাপর কয়েদীগণের সহিত ঈশান যে ঘরে বাস করিত, সেই ঘরটি জেলের এক পার্শ্বে অর্থাৎ জেলের চতুৰ্দ্দিকে প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত, তাহার এক অংশ ঐ ঘরের এ পার্শ্বের দেওয়াল রূপে পরিগণিত ছিল। রাত্রিকলে সুযোগমত একটু একটু করিয়া ঈশান তাহার সংগৃহীত পেরেকের দ্বারা ঐ দেওয়াল ক্রমে ছেঁদা করিতে প্রবৃত্ত হয়। রাত্রিকালে সুযোগমত সে যতদূর পারিত তাহা করিত, ও দিবাভাগে একখানি কম্বল সেই স্থানে এরূপভাবে রাখিয়া দিত যে সহজে ঐস্থানের উপর কাহার নজর পড়িত না, এইরূপে কয়েকরাত্রি পরিশ্রম করিয়া ঈশান ঐ স্থান দিয়া বাহির হইবার উপযোগী একটি পথ প্রস্তুত করিয়া লইল ও একরাত্রিতে সে ঐ স্থান দিয়া অনায়াসেই বহির্গত হইয়া প্রস্থান করিল। বলা বাহুল্য তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আরও কয়েকজন কয়েদী ঐ স্থান দিয়া সেই রাত্রিতেই ঈশানের অনুগমন করিয়াছিল। পরদিবস প্রাতঃকালে ঐ সিঁদ প্রকাশ হইয়া পড়িল, ঈশান প্রভৃতি কয়েকজন কয়েদী জেল হইতে পলায়ন করিয়াছে এ কথাও ক্রমে রাষ্ট্র হইয়া গেল। সেই সঙ্গে অনুসন্ধান ও আরম্ভ হইল। জেলের সেই পাকা গাঁথনির দেওয়ালে যেরূপ ভাবে ও যে অস্ত্রের দ্বারা সিঁদ কাটা হইয়াছিল, তাহা যিনি দেখিলেন, তিনিই বিশেষরূপে আশ্চর্যান্বিত হইলেন ও মনে মনে সকলেই ঈশানের অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের প্রশংসা করিতে লাগিলেন।
ঈশান এইরূপ উপায়ে জেল হইতে বহির্গত হইয়াই যে আপন ব্যবসা পরিত্যাগ করিয়াছিল তাহা নহে, জেল হইতে বহির্গত হইয়া সমস্ত রাত্রি সে পদব্রজে একদিকে ক্রমাগত চলিয়া যায়। পরদিবস সন্ধ্যা পর্য্যন্ত অনবরত চলিয়া, সন্ধ্যার কিছু পরেই এক খানি গ্রামে গিয়া উপস্থিত হয় ও সেই স্থানের জনৈক গৃহস্থের বাড়ীতে অতিথি রূপে আশ্রয় গ্রহণ করে। গৃহস্থ ঈশানকে প্রকৃতই একজন অতিথি বিবেচনা করিয়া তাহাকে বিশেষ যত্নের সহিত আপন গৃহে স্থান প্রদান করেন, ও তাহাকে উত্তমরূপে আহারাদি করাইয়া তাহার বাহিরের একখানি ঘরে তাহার থাকিবার স্থান নির্দ্দেশ করিয়া দেন। গৃহস্থ প্রত্যূষে গাত্রোত্থান করিয়া দেখেন, যে ঘরে অতিথি শয়ন করিয়াছিল সেই ঘর শূন্য অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে, ও তিনি নিজে যে ঘরে শয়ন করিতেন সেই ঘরের পশ্চাৎদিগের দেওয়ালে একটি সিঁদ কাটা রহিয়াছে। তাঁহার সেই ঘরে যে সকল মূল্যবান দ্রব্যাদি থাকিত তাহার কিছুই নাই, সমস্তই অপহৃত হইয়াছে। এই অবস্থা দেখিয়া তিনি বেশ বুঝিতে পারিলেন, যে ব্যক্তিকে অতিথি জ্ঞানে আপন বাড়ীতে স্থান প্রদান করিয়াছিলেন, এ তাহারই কার্য্য। এই সিঁদের সংবাদও থানায় গিয়া উপস্থিত হইল, পুলিস কর্ম্মচারীগণ আসিয়া মকদ্দমার অনুসন্ধানও করিলেন কিন্তু ফলে কিছুই হইল না।
জেল হইতে পলায়ন করিবার অপরাধে ঈশান ধৃত হইয়া পুনরায় কারারুদ্ধ হইবার পর এ কথা সে আপনা হইতেই প্রকাশ করিয়াছিল বলিয়াই, সকলে অবগত হইতে পারিয়াছিল। নতুবা ঐ অতিথি যে কে তাহা কেহই জানিতে পারিত না।
দীর্ঘ কারাবাসের পর ঈশান জেল হইতে খালাস হইয়া আইসে ও কিছু দিবস পর্য্যন্ত সে আর কোন মকদ্দমায় ধৃত হয় না, কিন্তু পরিশেষে এমন এক ভয়ানক মকদ্দমায় সে ধৃত হয় যে, তাহা বর্ণন করা আমার সাধ্য নহে।
যে গ্রামে ঈশান বাস করিত তাহার প্রায় পাঁচক্রোশ ব্যবধানে একজন ধনবান ব্যক্তি বাস করিতেন। এক দিবস প্রাতঃকালে সংবাদ আসিল যে, কে ঐ ধনবান ব্যক্তিকে হত্যা করিয়া তাঁহার যথাসর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়াছে। এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া পূব্ববর্ণিত ঊর্দ্ধতন কর্ম্মচারী মহাশয়ের সহিত আমি সেই অনুসন্ধানে গমন করি। ক্রমাগত একমাস কাল অনুসন্ধান করিয়া এই মকদ্দমার কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত হওয়া যায় না। থানায় প্রথমতঃ হত্যা ও চুরি মকদ্দমা রুজু করা হইয়াছিল সত্য, কিন্তু ডাক্তার সাহেব লাস পরীক্ষা করিয়া রিপোর্ট দেন যে, ঐ ব্যক্তির প্রবল শ্বাস রোগ ছিল, সেই রোগেই উঁহার মৃত্যু হইয়াছে, ডাক্তারের পরীক্ষায় যখন স্থির হইল যে সেই ধনবান ব্যক্তি স্বাভাবিক মৃত্যুতে মরিয়া গিয়াছেন তখন হত্যা মকদ্দমাও ঐ স্থানে শেষ হইয়া গেল, থাকিল কেবল চুরি। আমরা ঐ চুরি মকদ্দমার অনুসন্ধান ক্রমাগত একমাস করি, কিন্তু ফলে কিছুই হইল না; যাহার দ্বারা এই ভয়ানক কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়াছে তাহার কিছুই আমরা জানিয়া উঠিতে পারিলাম না। এইরূপে এক মাসকাল অনুসন্ধান করিয়া আমরা ঐ অনুসন্ধান পরিত্যাগ পূর্ব্বক অপরাপর স্থানে প্রস্থান করিলাম। ইহার পর আরও এক মাস কাল অতিবাহিত হইয়া গেল। এক দিবস সংবাদ পাওয়া গেল যে, যে গ্রামে ঐ চুরি হইয়াছিল, সেই গ্রামের একজন লোক কিছু মূল্যবান দ্রব্য অপর আর একখানি গ্রামে লইয়া গিয়া উহা বিক্রয় করিবার নিমিত্ত বিশেষরূপ চেষ্টা করিতেছে এই সংবাদ পাইয়া আমি আর কালবিলম্ব করিলাম না, আমার সেই ঊর্দ্ধতন কর্মচারীকে সমস্ত কথা বলিয়া ও তাঁহাকে সঙ্গে লইয়া সেই গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইলাম। জানিতে পারিলাম সেই ব্যক্তি সেই গ্রামে বাস্তবিকই কয়েক খানি মূল্যবান অলঙ্কার বিক্রয় করিয়া আপন গ্রামে প্রস্থান করিয়াছে। আরও জানিতে পারিলাম তাহার নিকট মূল্যবান আরও কয়েকখানি অলঙ্কার আছে।
অনুসন্ধান করিয়া সেই ব্যক্তিকেও আমরা প্রাপ্ত হইলাম তাহার নিকট হইতে আরও দুই তিন খানি অলঙ্কার বাহির হইল তখন সে সমস্ত কথা স্বীকার করিল ও কহিল ঐ চুরি তাহার দ্বারা হয় নাই কিন্তু সে ঐ চুরির সমস্ত সংবাদ প্রদান করিয়াছিল বলিয়া চোরের নিকট হইতে সে কয়েকখানি অলঙ্কার প্রাপ্ত হইয়াছিল মাত্র। সে আরও বলিয়াছিল ঈশান নামক এক ব্যক্তি অপর আর একজনের সহিত মিলিত হইয়া কেবল যে ঐ চুরি করিয়াছিল তাহা নহে যাঁহার ঘরে তাহারা চুরি করিয়াছিল তাঁহাকে হত্যাও করিয়া রাখিয়া গিয়াছিল।
উহার কথার উপর নির্ভর করিয়া ওপরিশেষে তাহারই সাহায্য ক্রমে আমরা ঈশান ও তাহার অনুসঙ্গী আর ব্যক্তিকে ধৃত করিতে সমর্থ হই। তাহাদিগের নিকট হইতে অপহৃত সমস্ত দ্রব্য বাহির করিতে সমর্থ না হইলেও অনেকগুলি দ্রব্য আমরা বাহির করিয়াছিলাম। বর্তমান মকদ্দমায় যে দুই ব্যক্তি ধৃত হইয়াছে উহারা দুইজনই ঐ মকদ্দমার আসামী হয় ও চুরি করা অপরাধে উভয়েই বিশেষরূপ দণ্ডে দণ্ডিত হয়। ডাক্তার সাহেবের রিপোর্টের উপর নির্ভর করিয়া খুনি মকদ্দমা হইতে উহাদিগকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এই ঘটনার পূর্ব্বে ঈশান আরও একটি ভয়ানক কার্য করিয়াছিল, আমরা তাহা জানিতে পারিয়াছিলাম কিন্তু ঐ মকদ্দমায় ঈশান বা তাহার অনুসঙ্গী কেহ ধৃত হয় না।
কৰ্ম্ম। সে মকদ্দমা কিরূপ?
আমি। বৰ্ত্তমান যে মকদ্দমায় উহারা ধৃত হইয়াছে, উহাও ঠিক সেই প্রকারের মকদ্দমা। একজন কিছু সম্পত্তিশালী লোক একাকী ঈশানের থাকিবার স্থানের নিকট বাস করিতেন, কিরূপ সুযোগ অবলম্বন করিয়া একরাত্রিতে তাহারা উঁহার ঘরের ভিতর প্রবিষ্ট হয়, ও তাঁহাকে হত্যা করিয়া তাঁহার গলাতেও দড়ি বাঁধিয়া ঐ ঘরের ভিতর এক স্থানে টাঙ্গাইয়া দেয় ও তাঁহার বাক্স পেটরা খুলিয়া তাহার মধ্য হইতে তাঁহার যথাসর্বস্ব অপহরণ পূর্ব্বক পুনরায় সেই সকল সিন্ধুক পেটরা পূর্ব্বের ন্যায় বন্ধ করিয়া দিয়া প্রস্থান করে।
কর্ম্ম। এই মকদ্দমার অনুসন্ধানে কি হয়?
আমি। বর্তমান মকদ্দমার অনুসন্ধান যাহা হইতে বসিয়া ছিল, ঐ মকদ্দমা সেই রূপেই শেষ হইয়া যায়। গলায় দড়ি দিয়া তিনি আত্মহত্যা করিয়াছেন, ইহাই সাব্যস্ত হওয়ায় ঐ মকদ্দমার অনুসন্ধান শেষ হইয়া যায়, সুতরাং ঈশান ও তাহার সাহায্যকারী ঐ সকল দ্রব্য নির্ভয়ে ও আপনাপন ইচ্ছানুযায়ী খরচ করিয়া আপনাপন নীচ প্রবৃত্তি সকল পরিতৃপ্ত করিয়া লয়।
কর্ম্ম। ঐ মকদ্দমায় উহারা ধৃত হয় না কিন্তু ঐ সকল কথা প্রকাশ হইয়া পড়িল কিরূপে?
আমি। বহু দিবস পরে এ কথা আমি ঈশানের মুখেই শুনিয়াছিলাম। অপর আর একটি মকদ্দমায় ধৃত হইবার পরে সেই এই সকল কথা আমার নিকট স্বীকার করিয়াছিল।
কর্ম্ম। অপর যে মকদ্দমায় ঈশান ধৃত হইয়াছিল তাহা কি?
আমি। তাহাও একটি সিঁদের মকদ্দমা।
কৰ্ম্ম। সে কিরূপ।
আমি। এক সময় ঈশান এক স্থানে তাহার বাস করিবার উপযোগী একটি ঘর ভাড়া লয়। ঐ স্থানে সে পূৰ্ব্বে কখন ছিল না। সুতরাং সেই পাড়ার কোন লোক তাহাকে চিনিত না। যে ঘরটি ঈশান ভাড়া করিয়া লইয়াছিল তাহার পার্শ্ববর্তী আর একখানি পাকা ঘরে একখানি পোদ্দারের দোকান ছিল। দোকানদার সেই ঘরে তাহার দোকানের সোনারূপা প্রভৃতির সমস্ত মূল্যবান দ্রব্য রাখিয়া আপনার বাসায় গমন করিত। রাত্রিকালে কেহ থাকিত না।
সেই দিবস প্রাতঃকালে সে আপনার দোকান খুলিয়া দেখিল তাহার দোকানের মধ্যে তাহার লোহার সিন্ধুক প্রভৃতি যাহা ছিল, তাহার সমস্তই উন্মুক্ত অবস্থায় রহিয়াছে ও তাহার মধ্যস্থিত সমস্ত দ্রব্যই অপহৃত হইয়া গিয়াছে। আরও দেখিতে পাইল, তাহার দোকান ঘরের ছাদের উপর একটি যেন বড় গোছের সিঁদ কাটা রহিয়াছে।
কৰ্ম্ম। চোরে ছাদের উপর বসিয়া সিঁদ কাটিতে পারে কিন্তু সেই সিঁদের ভিতর গিয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিতে সমর্থ হয় কি প্রকারে।
আমি। অনেক সময়ে ছাদের উপর সিঁদ কাটিয়া সেই সিঁদের ভিতর দিয়া সময় সময় সিঁড়ি প্রভৃতি ঘরের ভিতরে রাখিয়া উহার সাহায্যে ঘরের ভিতর প্রবেশ করে কিন্তু যে সিঁদ চুরির কথা আমি বলিতেছি, তাহাতে কিরূপ উপায়ে যে উহারা ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিল তাহা যে পর্য্যন্ত উহারা ধৃত না হয় সেই পর্যন্ত আমরা কিছু মাত্র অবগত হইতে পারি না।
কৰ্ম্ম। কি রূপেই বা ইহারা এই মকদ্দমায় ধৃত হয় ও কি রূপেই বা ইহারা ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিল।
আমি। সেই স্থানে অনুসন্ধান করিতে করিতে আমরা জানিতে পারিলাম, যে ঘরে সিঁদ হইয়াছিল, তাহার নিকটবর্ত্তী অপর একটি ঘরে অপর একজন বাস করিত। সেই অপর একজন যে কে তাহা প্রথমে জানিতে পারা যায় না। কিন্তু চুরির পর হইতেই আর তাহাকে সেই স্থানে দেখিতে পায় না। অনুসন্ধান করিতে করিতে পরিশেষে অবগত হইতে পারা যায় যে ঈশানই আসিয়া ঐ ঘরে কিছু দিবস বাস করিয়াছিল।
এই সংবাদ জানিতে পারিয়া আমরা ঈশানের বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হই ও পরিশেষে ঈশান আমাদিগের কর্তৃক ধৃত হয়। সেবারেও ঈশানের নিকট হইতে আমরা সমস্ত অপহৃত দ্রব্য বাহির করিতে সমর্থ হই না, যাহা কিছু পাওয়া গিয়াছিল, তাহাতেই কঠিন পরিশ্রমের সহিত তাহাকে কারাবাসে গমন করিতে হয়। ঈশান যদিও সমস্ত অপহৃত দ্রব্য আমাদিগকে প্রদান করিয়াছিল না কিন্তু সমস্ত কথা আমাদিগের নিকট স্বীকার করিয়াছিল। তাহারই নিকট হইতে পরিশেষে আমরা জানিতে পারিয়াছিলাম কি প্রকারে সেই পোদ্দারের দোকান ঘরের মধ্যে সে প্রবেশ করিয়াছিল।
কৰ্ম্ম। কি রূপে সেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে?
কৰ্ম্ম। ঈশান আমাদিগকে বলিয়াছিল যে তাহার একখানি দড়ির সিঁড়ি ছিল। কাঠের বা বাঁশের সিঁড়ি আমাদিগের দেশে যেরূপভাবে প্রস্তুত হইয়া থাকে, ঈশান ঠিক সেইরূপভাবে একখানি দড়ির সিঁড়ি প্রস্তুত করিয়াছিল, সেই সিঁড়ির সাহায্যে সেই এইরূপ কার্য্যে সর্ব্বদা প্রবৃত্ত হইত।
কৰ্ম্ম। সে সিঁড়ি সে কিসের সহিত আবদ্ধ করিয়া রাখিত?
আমি। ছাদের উপর সিঁদ কাটিতে হইলে সে প্রায়ই একখানি কড়ি কাটের নিকটবর্ত্তী স্থানে সিঁদ করিত ও উহার ভিতর দিয়া সেই দড়ির সিঁড়িখানি ঘরের মধ্যে ফেলিয়া দিয়া তাহার এক প্রান্তে সেই কড়ি কাটের সহিত উত্তমরূপে বাঁধিয়া সেই সিঁড়ি বাহিয়া ঘরের ভিতর গমন করিত ও ঘরের ভিতরস্থিত দ্রব্য সামগ্রী অপহরণ করিয়া উহার সহিত সেই দড়ির সিঁড়ির সাহায্যে পুনরায় ছাদের উপর আসিয়া উপস্থিত হইত। ছাদ হইতে গমন করিবার সময় দড়ির সিঁড়ি খানি কড়ি কাট হইতে খুলিয়া লইয়া যাইত।
কৰ্ম্ম। উঃ ঈশান কি ভয়ানক চোর!
আমি। ঈশানের সদৃশ চোর কয়জন দেখিতে পাওয়া যায়। এইতো ঈশানের চরিত্র। বর্তমান মকদ্দমায়ও তাহাদিগের উদ্ধার হত্যা করার প্রমাণ হইল না কিন্তু রাসবিহারীবাবুর দ্রব্যাদি হরণ করিবার নিমিত্ত ঈশান ও তাহার সমভিব্যাহারী বিশেষরূপ কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইল।
[মাঘ, ১৩০৬]