লাল পাগড়ি ২

লাল পাগড়ি! (দ্বিতীয় অংশ) 

(অর্থাৎ লাল-পাগড়ি পরিহিতের অদ্ভুত রহস্য!) 

অষ্টম পরিচ্ছেদ

গোবিন্দ দাস বলিতে লাগিল। 

কৃত্রিম-মুদ্রা চালান ও অধিকারে কৃত্রিম-মুদ্রা প্রাপ্ত হওয়া অপরাধে আমার দলস্থিত ৮।১০ জন লোকের জেল হইয়া যাইবার পর, পুনরায় আমার দল নিতান্ত বলহীন হইয়া পড়িল। তখন নিতান্ত অনন্যোপায় হইয়া পুনরায় আমাকে নব দল বল সংগ্রহ করিবার চেষ্টা করিতে হইল। দল বলও সংগৃহীত হইল; কিন্তু যে সকল লোক এইবার আমাদিগের দলে আসিয়া মিলিত হইল, তাহাদিগের অধিকাংশই এই কার্য্যে নূতন ব্রতী। 

আমাদিগের যে সকল পুরাতন লোক ছিল, তাহাদের মধ্যে একজন কি জানি কি ভাবিয়া, অথবা পুলিস- কর্ম্মচারীগণের কি জানি কি কুহক মন্ত্রে পতিত হইয়া, আমাদিগের বিপক্ষতাচরণে প্রবৃত্ত হইল; কিন্তু আমরা পূর্ব্বে তাহার বিন্দুমাত্রও অবগত হইতে না পারিয়া আমরা তাহাকে যেরূপ ভাবে বিশ্বাস করিয়া আসিতেছিলাম, সেইরূপ ভাবেই বিশ্বাস করিতে লাগিলাম। সুতরাং সেও তাহার মনোবাঞ্ছা সৰ্ব্বতোভাবে পূর্ণ করিতে সমর্থ হইল। আমরা যখন যাহা করিতাম, বা যখন যেরূপ পরামর্শ করিতাম, সে সেই সমস্ত সংবাদ গুপ্তভাবে গুলিসকে প্রদান করিয়া আসিত; কিন্তু আমরা তাহার কিছুই অবগত হইতে পারিতাম না। এই রূপে কিছু দিবস অতিবাহিত হইবার পর, একস্থানে আমরা একটি ডাকাইতি করিতে মনস্থ করিলাম। লোকজন লইয়া সেইস্থানে গমনও করিলাম, ও নিয়মিতরূপে ডাকাইতি করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। যে সময়ে আমরা ডাকাইতি করিতেছি, সেই সময় দেখিলাম, আমাদিগের চতুৰ্দ্দিক পুলিসে পরিবেষ্টিত করিয়াছে, পুলিস প্রহরীগণের হস্তে লাঠী। তৎব্যতীত দুই তিন জন অশ্বপৃষ্ঠে আরূঢ়, তাহাদিগের মধ্যে একজনকে ইংরাজ বলিয়া অনুমান হইল। এই অবস্থা দৃষ্টে আমাদিগের মনে একটু ভয় হইল। আমি একটি মা সাঙ্কেতিক ধ্বনি করিলাম। সেই শব্দ অনুযায়ী সকলে ডাকাইতি পরিত্যাগ পূর্ব্বক একস্থানে আসিয়া সমবেত হইল। আমি সকলকে সেই পুলিস দল দেখাইয়া দিয়া কহিলাম, এখন আমাদিগকে এই স্থান হইতে প্রস্থান করাই মঙ্গল। এই বলিয়া সকলে একযোগ হইয়া, আমরা যেরূপ ভয়ানকরব উত্থিত করিয়া ডাকাইতি করিতে প্রবৃত্ত হই, সেইরূপ এক ভয়ানক শব্দ উত্থিত করিয়া একদিক অবলম্বন পূর্ব্বক সেইস্থান হইতে বহির্গত হইবার চেষ্টা করিলাম। পুলিস প্রহরীগণও সেই দিকে আসিয়া আমাদিগের গতিরোধ করিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু তাহারা আমাদিগের প্রবল বেগ সহ্য করিতে সমর্থ হইল না। আমরা তাহাদিগের হস্তে দুই চারি ঘা লাঠী খাইলাম সত্য, কিন্তু আমরা তাহাদিগের অনেককেই ধরাশায়ী করিয়া সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম। কিন্তু ২০০ শত হাত গমন করিতে না করিতেই পূর্ব্বকথিত অশ্বারোহী কৰ্ম্মচারীগণ আমাদিগের পশ্চাদ্দিকে আগমন করিয়া আমাদিগের উপর গুলি মারিতে লাগিলেন। আমি দলের পশ্চাতেই ছিলাম, সুতরাং আমি প্রথমেই গুলি খাইয়া আঘাতিত ও সেইস্থানে পতিত হইলাম। তাহার পর দেখিলাম, আরও দুইজনের দশা আমারই ন্যায় হইল। অবশিষ্ট সকলে সেইস্থান হইতে পলায়ন করিল। উহাদিগের মধ্যেও কেহ কেহ সামান্য পরিমাণে আহত হইয়াছিল। 

সে যাহা হউক, আমরা কেবলমাত্র তিনজন সেই সময় ধৃত হইলাম। আমাদিগের দলস্থিত যে ব্যক্তি পুলিসের সাহায্য করিতেছিল, সেই ব্যক্তিও পরিশেষে প্রকাশিত হইয়া পড়িল, ও তখন হইতে প্রকাশ্যভাবে পুলিসকে সাহায্য করিয়া আমাদিগের দলস্থিত প্রত্যেক ব্যক্তিকেই ধরাইয়া দিতে লাগিল। যাহারা এই সংবাদ পূৰ্ব্ব হইতে অবগত হইতে পারিল, তাহারা আপনাপন ঘর পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করিয়া সেই সময় পুলিসের হস্ত হইতে আপনাদিগকে রক্ষা করিল। অবশিষ্ট যাহারা পূর্ব্বে কোনরূপ সংবাদ প্রাপ্ত হইল না, তাহারা অনায়াসেই পুলিস কর্তৃক ধৃত হইল। এইরূপে আমাদিগের দলের ৬।৭ জন সেইবার ধৃত হয়, ও বিচারে সকলেই পাঁচ বৎসর করিয়া কারারুদ্ধ হয়। আমি আমার দলস্থিত ৬ জনকে লইয়া জেলে গমন করিলাম ও একস্থানেই অবস্থিতি করিতে লাগিলাম। ইতিপূর্ব্বে আমি আর কখন জেলের ভিতর প্রবেশ করি নাই; সুতরাং জেলের যে কিরূপ অবস্থা, তাহা আমি জানিতাম না; 

সুতরাং জেলে যে কিরূপ কষ্ট পাইতে হয়, তাহাও আমি অনুমান করিতে পারিতাম না। জেলে গমন করিবার পর প্রথম প্রথম আমি বৎসরাবধি কষ্ট অনুভব করিতে লাগিলাম। নিয়মিত কার্য্য শেষ করিয়া উঠিতে পারিতাম না বলিয়া প্রায়ই আমার অদৃষ্টে বেত্রাঘাতের ব্যবস্থা হইত। কিন্তু এইরূপ কষ্ট আমাকে অধিক দিন সহ্য করিতে হইল না, আমার দলস্থিত অপর ৬ জন আমাকে মধ্যে মধ্যে সাহায্য করিতে আরম্ভ করিল। তাহাদিগের নিয়মিত কাৰ্য্য শেষ করিয়া সময় সময় তাহারা আমার কার্য্যও করিতে লাগিল। এইরূপে কিছু দিবস অতিবাহিত হইয়া গেলে, আমি সেইস্থানের “মেটের” কার্য্যে নিযুক্ত হইলাম; অর্থাৎ আমার অধীনে কতকগুলি কয়েদী রহিল, তাহাদিগকে কাৰ্য্য করান ও তাহাদিগের উপর বিশেষরূপে দৃষ্টি রাখার ভার আমার উপর অর্পিত হইল। আমি বাহিরেও যেরূপ দলপতি ছিলাম, জেলের ভিতরেও সেইরূপ দলপতিরূপে ক্রমে পরিণত হইলাম। আমার অধীনস্থ কয়েদীগণ আমার উপর বিশেষরূপ ভক্তি করিতে আরম্ভ করল, আমিও তাহাদিগকে বিশেষ রূপে যত্ন করিতে লাগিলাম। এইরূপে ৬/৭ মাস অতীত হইতে না হইতে দেখিলাম, আমার আজ্ঞানুবর্ত্তী প্রায় ২০।২৫ জন হইয়াছে। তাহাদিগের মধ্যে অধিকাংশই ডাকাইতি মোকদ্দমায় অপরাপর স্থান হইতে কারারুদ্ধ হইয়াছিল। দেখিলাম, ঐ সমস্ত লোকই এখন আমার আজ্ঞাধীন, ও সুযোগ মতে সকলেই জেল হইতে পলায়ন করিতে প্রস্তুত। আমরা সকলেই জেল হইতে পলায়ন করিবার মনস্থ করিয়া কেবল সুযোগ অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। আমার দলস্থিত যে সকল ব্যক্তি ধৃত হইয়াছিল না, তাহাদিগের মধ্যে একজন সেই সময় আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিল। আমাদিগের মনের কথা তাহাকে কহিলাম, ও ২৫।৩০ জনের পরিধান উপযোগী বস্ত্রাদি সংগ্রহপূর্ব্বক নিকটবর্ত্তী কোন একস্থানে রাখিয়া পুনরায় আমাদিগকে সংবাদ দিতে কহিলাম। কয়েদিগণকে সংবাদ প্রভৃতি প্রদান করা সম্বন্ধে জেলের কঠোর নিয়ম থাকিলেও, আমাকে সংবাদ দেওয়া ততটা কষ্টসাধ্য ছিল না; কারণ আমি আমার অধীনস্থ কয়েদিগণকে লইয়া জেলের বাহিরে বাগানের কার্য্যে প্রায়ই নিযুক্ত থাকিতাম। সুতরাং বাগানের বাহিরে যে কোন ব্যক্তি আসিলে, আমি তাহার সহিত অনায়াসেই কথা কহিতে পারিতাম। 

আমার দলস্থিত যে ব্যক্তিকে আমি বস্ত্রের সংগ্রহ করিতে কহিয়াছিলাম, ১০।১২ দিবস পরেই সে পুনরায় আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিল ও কহিল, সে সমস্তই ঠিক করিয়া রাখিয়াছে, ও যে স্থানে বস্ত্রাদি রাখিয়াছে, তাহাও আমাকে বলিয়া দিল। যে সময় আমরা জেল হইতে পলায়ন করিতে মনস্থ করিলাম, তখন শীতকাল; বোধ হয় পৌষ মাস। ঐ সময় বাগানের কার্য্য করিতে করিতে প্রায়ই সন্ধ্যা হইয়া যাইত। সেই সময় এক দিবস বাগানের কার্য্য করিয়া জেলের মধ্যে প্রত্যাগমন করিবার পূর্ব্বেই অর্থাৎ সন্ধ্যা হইবার অল্পমাত্র বাকী থাকিতেই আমরা সকলেই সেই বাগানের বাহির হইয়া গেলাম। আমাদিগকে একযোগে বাগানের বাহিরে গমন করিতে দেখিয়া, জেলের “ওয়াড়ডার” চীৎকার করিয়া উঠিল। আমরাও সকলে সেই সময় পৃথক্ পৃথক্ হইয়া, যাহার যে দিকে ইচ্ছা, সেই দিকেই দ্রুতপদে প্রস্থান করিলাম। “কয়েদী পলায়ন করিল” এই শব্দ উত্থিত হইতে হইতেই জেলের কর্ম্মচারীগণ বাহিরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কিন্তু কে কোন্ দিকে কাহার অনুধাবন করিবেন, তাহা স্থির করিতে করিতে আমরা ক্রমে দূরে গিয়া উপস্থিত হইলাম। ক্রমে একটা ভয়ানক গোলযোগ হইয়া পড়িল। সেই সঙ্গে সঙ্গে সন্ধ্যাও হইয়া গেল। অনেকে আমাদিগের অনুধাবন করিল, কিন্তু অন্ধকারের সাহায্যে ক্রমে আমরা তাহাদিগের দৃষ্টির বহির্ভূত হইয়া পড়িলাম। 

এইরূপ উপায়ে আমরা ৩০।৪০ জন লোক জেল হইতে বহির্গত হইয়া ভিন্ন ভিন্ন দিক অবলম্বন পূর্ব্বক প্রস্থান করিয়া পরিশেষে নির্দিষ্টস্থানে আসিয়া সকলে মিলিত হইলাম। সেই স্থানে আমাদিগের কাপড় প্রভৃতি পূৰ্ব্ব হইতেই রক্ষিত ছিল। জেলের যে সকল বস্ত্রাদি আমাদিগের পরিধানে ছিল, তাহার সমস্তই আমরা সেইস্থানে পরিত্যাগপূর্ব্বক আমাদিগের বেশ পরিবর্তন করিলাম। আমাদিগের গলায় যে সকল লোহার হাঁসুলি ছিল, তাহা ভাঙ্গিয়া সেইস্থানে নিক্ষেপ করিলাম, ও পরিশেষে সকলে সেইস্থান হইতে বহির্গত হইয়া যে প্রদেশে আমাদিগের বাসস্থান ছিল, একেবারে সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। আমরা সেই রাত্রিতেই যে সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইতে পারিয়াছিলাম, তাহা নহে, দুই তিন দিবস আমাদিগের রাস্তায় অতিবাহিত হইয়া গেল। 

আমরা সোজা রাস্তা বহিয়া যে কেবল গমন করিতে লাগিলাম, তাহা নহে; সমস্ত দিন চলিয়া সন্ধ্যার সময় কোন গ্রামের বাজার প্রভৃতি স্থানে গিয়া উপস্থিত হই, সেইস্থানে সকলে পৃথক পৃথক ভাবে রন্ধনাদি ও আহারাদি করিয়া পুনরায় সেইস্থান হইতে গমন করিতে আরম্ভ করি। এই রূপে রাত্রি ১২টা ১টা পর্য্যন্ত গমন করিবার পর, সকলে যে গ্রাম দেখিতে পাই, সেই গ্রামের ভিতর যে কোন বাড়ীতে ডাকাইতি করি। 

যে দিবস সন্ধ্যার সময় আমরা জেল হইতে পলায়ন করিয়াছিলাম, সেই রাত্রিতেই আমাদিগকে ডাকাইতি করিতে হয়। কারণ, যে সময় আমরা জেল হইতে বহির্গত হইয়াছিলাম, সেই সময় আমাদিগের কাহার নিকট একটিমাত্রও পয়সা ছিল না, অথচ কোন গতিকে কোনরূপে অর্থের সংগ্রহ করিয়া লইতে না পারিলে উপায় নাই; অন্নাভাবে মরিতে হয়। সুতরাং সেই রাত্রি ১২টার সময় আমরা যে গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইলাম, সেই গ্রামের বাজারে একজন দোকানদার ছিলেন, তাঁহারই উপর আমাদিগের প্রথম লক্ষ্য হইল। নিকটবর্তী কৃষিক্ষেত্রের বেড়া ভাঙ্গিয়া লাঠির সংগ্রহ হইল। ঐ বাজারের মধ্যে সেই দোকানদারের দোকানের সম্মুখে একখানি বড় গোছের চালা ঘর ছিল, দিবাভাগে নানাস্থান হইতে ছোট ছোট দোকানদারগণ সেইস্থানে বসিয়া তরিতরকারী বিক্রয় করিত। রাত্রিকালে উহাতে কিছুই থাকিত না, খালি পড়িয়া থাকিত। ডাকাইতি করিতে হইলে আলোর আবশ্যক; কিন্তু আমাদিগের যে যোগাড় কিছুমাত্র ছিল না। সুতরাং ঐ খালি ঘরে আগুন লাগাইয়া দিয়া, ঐ আলোর সাহায্যে আমরা ডাকাইতি করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। ঐ ঘর প্রজ্বলিত হইবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ভয়ানক রব উত্থিত করিয়া, সেই দোকানদারের দোকানের ভিতর প্রবেশ করিলাম। ঐ দোকানের ভিতর যে সকল বাক্সাদি ছিল, তাহা ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া তাহার মধ্য হইতে যাহা পাইলাম, তাহা গ্রহণ করিয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। এই ডাকাইতিতে আমরা নগদ প্রায় ১০০ শত টাকা ও আন্দাজ ২০০ টাকা মূল্যের রূপার অলঙ্কার প্রাপ্ত হইয়াছিলাম। অপর কোন দ্রব্য আমরা গ্রহণ করি না। নগদ যে অর্থ আমরা প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, তাহাই রাস্তার সম্বল করিয়া আমরা সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম। রাস্তার খরচপত্র আমরা ঐ অর্থ দ্বারা সম্পন্ন করিতে লাগিলাম। 

ঐ ডাকাইতি করিয়া আমরা সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম, ও ক্রমাগত চলিয়া দিবা ১২টার সময় একটি গ্রামে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। ঐ গ্রাম একটি ছোটখাট সহরের ন্যায়। ঐ গ্রামের বাজারে আমরা উপস্থিত হইয়া সেইস্থানে রন্ধনাদি করিয়া উত্তমরূপে আহারাদি করিলাম। যত দিবস জেলের ভিতর অতিবাহিত করিতে হইয়াছিল, তাহার মধ্যে এইরূপ ভাবে আহার আর আমাদিগের ভাগ্যে ঘটিয়াছিল না। পরিতোষের সহিত আহার করিয়া আমরা সেইস্থানে উত্তমরূপে বিশ্রাম করিলাম। অতি অল্পমাত্র বেলা থাকিতে আমরা সেইস্থান হইতে বহির্গত হইয়া পুনরায় চলিতে আরম্ভ করিলাম। এইরূপে গমন করিতে করিতে রাত্রি ১২টার পর যে গ্রাম আমাদিগের সম্মুখে পড়িল, সেই গ্রামের মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া এক বাড়ীতে ডাকাইতি করিলাম। কিন্তু সেইস্থানে আমাদিগের পরিশ্রমোপযোগী কোন দ্রব্যই প্রাপ্ত হইলাম না। নগদ ১২টি মাত্র টাকা ও আন্দাজ ৪০।৫০ টাকার অলঙ্কার মাত্র প্রাপ্ত হইয়া আমরা সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম, ও ক্রমাগত চলিতে আরম্ভ করিয়া সমস্ত দিন অতিবাহিত করিলাম। এইরূপে তিন চারি দিবস চলিয়া ও তিন চারি স্থানে ডাকাইতি করিয়া আমরা সকলে আমাদিগের দেশে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। রাত্রি ১১টার পর আমরা সকলে আপনাপন বাড়ীতে প্রবিষ্ট হইয়া আপনাপন স্ত্রীপুত্র ও আত্মীয় স্বজনের সহিত সাক্ষাৎ পূৰ্ব্বক, অতি প্রত্যূষেই পুনরায় বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া কোন নিভৃতস্থানে অপেক্ষা পূৰ্ব্বক সেই দিবস অতিবাহিত করিলাম। পরদিন রাত্রিতে পুনরায় আপনাপন বাড়ীতে আগমন করিয়া সেইস্থানে অতিবাহিত করিলাম। বাড়ী হইতে বহির্গত হইবার কালীন ইহা স্থির হইল যে, আমরা সকলে কলিকাতায় গমন করিয়া সেইস্থানে অবস্থিতি করিব। কারণ কলিকাতা যেরূপ জনাকীর্ণ স্থান, তাহাতে সেইস্থানে বাস করিলে সহজে কেতুই আমাদিগকে জানিতে পারিবে না। কলিকাতায় লুক্কাইতভাবে বাস করিবার যেমন সুবিধা, ওরূপ সুবিধা যে আর কোনস্থানে আছে, তাহা বোধ হয় না। কারণ এক বাড়ীতে পৃথক্ পৃথক্ ঘরে যাহারা বাস করে, অপর ঘরের লোকের সহিত তাহাদিগের আলাপ পরিচয় প্রায় থাকে না। আমার দলস্থিত সকলেই এইরূপ মনস্থ করিয়া আসিল যে, তাহারা কলিকাতায় গমন করিয়া সেইস্থানে আপনাপন নাম পরিবর্ত্তন করিয়া বাস করিবে। বাসস্থান স্থির হইলে, তাহাদিগের দলস্থিত একজন আসিয়া, পরিবারবর্গের মধ্যে যাহারা সেইস্থানে গমন করিতে চাহে, তাহাদিগকে সঙ্গে করিয়া সেইস্থানে লইয়া যাইবে। 

এইরূপ স্থির করিয়া আমরা সকলে সেইস্থান হইতে বহির্গত হলাম। আমার স্থির করিবার কিছুই ছিল না, বা কাহাকে বলিবারও কোন কথা ছিল না; কারণ আপনি অবগত আছেন যে, সেই সময় পৰ্য্যন্ত আমি কাহার সহিত পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হই নাই, বা সংসারে আমার কেহই ছিল না। সে যাহা হউক, তথাপি আমি আমার বাড়ীতে গমন করিলাম। আমার একজন পরিচারকের উপর আমি আমার বাড়ীর সমস্ত ভার অর্পণ করিয়া জেলে গিয়াছিলাম। বাড়ীতে আসিয়া কেবলমাত্র সেই পরিচারকের সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। যে ঘরে আমি থাকিতাম, সেই ঘরে গিয়া উপবেশন করিলাম। চক্ষু দিয়া জল আসিল, অতীত স্মৃতি সকল একেবারে মনে আসিয়া উদিত হইল, সেইস্থান হইতে উঠিলাম। যে ঘরে পিতা মাতা থাকিতেন, সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। তাঁহাদিগের মৃত্যুর পর ঐ ঘর পুড়িয়া গিয়াছিল সত্য, কিন্তু ঠিক আমি পূর্ব্বের ন্যায় পুনরায় সেই ঘর প্রস্তুত করিয়া লইয়াছিলাম। তাঁহারা আমার আপন পিতা মাতা না হইলেও আমি অন্তরের সহিত তাঁহাদিগকে নিজের পিতা মাতা বলিয়া জানিতাম। তাঁহারাও আমাকে নিজ পুত্র-নির্ব্বিশেষে প্রতিপালন, ও অন্তরের সহিত ভালবাসিতেন। ঐ ঘরের মধ্যে প্রবিষ্ট হইবা মাত্রই আমার সেই সকল পূৰ্ব্ব-বৃত্তান্ত মনে আসিয়া উদয় হইল, চক্ষু দিয়া বেগে জলধারা বহির্গত হইল। কঠিন-হৃদয় ডাকাইতের চক্ষু দিয়া যে এরূপ ভাবে জল আসে, তাহা আমি জানিতাম না, কঠোর হৃদয় যে এরূপ ভাবে দ্রবীভূত হয়, তাহা আমি কখন ভাবি নাই। অতীত স্মৃতির যে এরূপ ভয়ানক ক্ষমতা, তাহা আমি ইতিপূৰ্ব্বে কখন বুঝিতে পারি নাই। যাহা হউক, সেইস্থানে বসিয়াই আমার সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত হইয়া গেল, নিদ্রা আসিল না, অথচ কিরূপে যে রাত্রি প্রভাত হইয়া গেল, তাহাও কিছু বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। পর দিবসও আমি আমার ঘরের মধ্যে অতিবাহিত করিলাম। যে সকল গরু বাছুর আমি রাখিয়া গিয়াছিলাম, দেখিলাম, তাহার অর্দ্ধেকও নাই। যে সকল গোলা শস্যপূর্ণ ছিল, তাহার অধিকাংশই খালি হইয়া গিয়াছে। অতিথি অভ্যাগত আর ঐ বাড়ীতে পদার্পণ করেন না। যাঁহার উপর আমি সমস্ত অর্পণ করিয়া গিয়াছিলাম, তাঁহার দোষে অতিথিগণের পদধূলি আমার বাড়ীতে আর পতিত হয় না, কি তাঁহারা ডাকাইতের অর্থে আপনাপন উদর পূর্ণ করিতে ইচ্ছুক নহেন, তাহা কিন্তু আমি ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। কিন্তু মনে করিলাম, যখন ঐ গ্রামের সহিত আমি আর আমার কোনরূপ সংস্রব রাখিব না, তখন ঐ সকল দ্রব্যে আমার আর প্রয়োজন কি? মনে মনে এই রূপ ভাবিয়া আমি আমার সেই লোকটিকে সমস্ত দ্রব্য বিক্রয় করিতে বলিলাম। আমি কিন্তু কাহারও সম্মুখবর্তী না হইয়া আমার ঘরের মধ্যে গুপ্তবেশে অবস্থিতি করিতে লাগিলাম। আমার আদেশ মত তিনি আমার সমস্ত দ্রব্য বিক্রয় করিতে আরম্ভ করিলেন। এক দিবসের মধ্যেই আমার সমস্ত সম্পত্তি বিক্রয় হইয়া গেল; কারণ যে দ্রব্যের মূল্য, যে যাহা বলিল, তাহাতেই তাহা তাঁহাকে প্রদান করা হইল। ঐ সকল দ্রব্যের সংস্থান করিতে আমার যত অর্থব্যয় হইয়াছিল, তাহার এক-অষ্টমাংশও আমি প্রাপ্ত হইলাম না। আমার যাহা কিছু ছিল, তাহা এইরূপে বিক্রয় করিয়া ফেলিলাম, থাকিবার মধ্যে কেবল আমার বাড়িটি রহিল। উহা আমি আমার সেই লোকটিকে প্রদান করিয়া তাহার পর দিবস অতি প্রত্যূষে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। কিন্তু শুনিয়াছিলাম, আমি সেই স্থান হইতে চলিয়া আসিবার পর পুলিস-কর্ম্মচারীগণ আমার অনুসন্ধানের নিমিত্ত আমার বাড়ীতে গমন করিয়াছিলেন। 

নবম পরিচ্ছেদ

আমার সমস্ত দ্রব্যাদি ঐরূপে বিক্রয় করিয়া আমি যাহা কিছু সংস্থান করিতে পারিয়াছিলাম, তাহা লইয়া আমি কলিকাতায় আগমন করিলাম। সেইস্থানে একখানি ঘর ভাড়া লইয়া ও আমার নাম পরিবর্ত্তন করিয়া অবস্থিতি করিতে লাগিলাম। যে সমস্ত লোক জনের সহিত আমি জেল হইতে বহির্গত হইয়া আসিয়াছিলাম, তাহারাও ক্রমে আসিয়া কলিকাতায় উপনীত হইতে লাগিল। কেহ কেহ বা তাহাদিগের স্ত্রী-পুত্রগণকে সঙ্গে লইয়া সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল। কেহ বা একাকীই আগমন করিল। তাহারাও সকলে তাহাদিগের নাম পরিবর্তন করিয়া কলিকাতার ভিতর বাস করিতে আরম্ভ করিল। কিন্তু এক স্থানে বা এক বাড়ীতে কেহই রহিল না, সকলেই পৃথক পৃথক স্থানে ও পৃথক পৃথক বাড়ীতেই বাস করিতে আরম্ভ করিল। কোন না কোন একটি কার্য্য উপলক্ষ করিয়া আমরা এই স্থানে বাস করিতে লাগিলাম। কেহ সামান্য একটি দোকান খুলিল, কেহ বা জাহাজে বা কলে কুলির কার্য্য করিতে আরম্ভ করিল। এই রূপে কোন না কোন একটি কার্য্য উপলক্ষ করিয়া আমরা প্রতিবাসীগণকে দেখাইতে লাগিলাম, যে আমরা কোনরূপ অসৎ কার্য্য করিয়া দিন যাপন করি না; কিন্তু আমরা রাত্রিকালে প্রায়ই বাড়ীতে থাকিতাম না, সময় সময় একাদিক্রমে উপর্যুপরি তিন চারি দিবসও অনুপস্থিত থাকিতাম। আমরা যে কোথায় গমন করি, বা কোথা হইতে প্রত্যাগমন করি, তাহা কিন্তু অপরে কিছুই জানিত না, কেবল আমরাই জানিতাম। রাস্তায় রাস্তায় আমরা পরস্পর পরস্পরের সহিত দেখাসাক্ষাৎ করিতাম। আমরা কোন সময় কোথায় কোন কার্য্য করিতে যাইব, রাস্তায় রাস্তায়ই তাহার পরামর্শ স্থির করিতাম ও সেই পরামর্শ অনুযায়ী সকলেই নির্দিষ্ট স্থানে গমন করিতাম। 

কলিকাতা হইতে বাহিরে গমন করিয়া আমাদিগের মনোভিলাষ পূর্ণ করার যেরূপ সুযোগ আমরা প্রাপ্ত হইতাম, দেশে থাকিয়া সেইরূপ সুযোগ আমরা কখন প্রাপ্ত হইতাম না। লৌহ-বর্গের সাহায্যে আমরা আমাদিগের অভীপ্সিত কাৰ্য্য অনায়াসেই সম্পন্ন করিয়া আসিতাম। আমরা আমাদিগের কার্য্য শেষ করিবার সময় সকলেই কলিকাতা হইতে বহির্গত হইতাম। কিন্তু যে ষ্টেসনে আমরা রেলগাড়ীতে উঠিতাম, সেই ষ্টেসনে আমরা কখন আমাদিগের গন্তব্য স্থানের টিকিট খরিদ করিতাম না। পৃথক পৃথক ব্যক্তি পৃথক পৃথক ষ্টেসনের টিকিট খরিদ করিয়া একত্রে গাড়িতে উঠিতাম। কিন্তু সকলেই পৃথক পৃথক পৃথক ষ্টেসনে অবতরণ করিতাম। সেইস্থান হইতে আমাদিগের গন্তব্যস্থানের টিকিট খরিদ করিয়া তাহার পরের গাড়িতে আরোহণ করিয়া নির্দিষ্ট স্থানে গিয়া উপস্থিত হইতাম। সেইস্থানে সকলে একত্র মিলিত হইয়া আপনাদিগের কার্য্য উদ্ধার করিবার মানসে গমন করিতাম। এখন হইতে আমরা মসালের প্রথা উঠাইয়া দিলাম। মোমবাতিই আমাদিগের মসালের কার্য্য করিত। আমাদিগের প্রত্যেকের সহিত মোমবাতি ও দেশলাই থাকিত। সময় সময় যে বাড়ীতে ডাকাইতি করিতাম, সেই বাড়ীর কোন ঘরে অগ্নি লাগাইয়া দিয়া সেই আলোকে আমাদিগের কার্য্য শেষ করিয়া লইতাম। লাঠি বা কোনরূপ অস্ত্র আমরা প্রায়ই ব্যবহার করিতাম না। যে গ্রামে ডাকাইতি করিতাম, সেই গ্রামের কোন বেড়া ভাঙ্গিয়া লইয়া তাহারই দ্বারা লাঠির কার্য সম্পন্ন করিতাম। অস্ত্রাদির মধ্যে আমি সৰ্ব্বদাই একটি সাতনলা পিস্তল সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইতাম। আমার অধীনে যে দুই এক জন সর্দ্দার ছিল, তাহারাও তাহাদিগের সঙ্গে পিস্তল রাখিত। ঐ সকল পিস্তল আমরা ডাকাইতি করিয়া ক্রমে ক্রমে সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছিলাম। আমাদিগের নিকট পিস্তল থাকিত বটে, কিন্তু সহজে আমরা উহা ব্যবহার করিতাম না। যদি আগ্নেয় অস্ত্র দ্বারা আমাদিগকে কেহ আক্রমণ করিত, তাহা হইলে আমরাও তাহাদিগের উপর পিস্তলের গুলি মারিতে ছাড়িতাম না। ডাকাইতি হইয়া গেলে আমরা সেই রাত্রিতেই সেইস্থান হইতে পৃথক হইয়া পড়িতাম, ও যে যেদিকে সুবিধা পাইত, সে সেই দিকেই গমন করিত। এইরূপে গমন করিয়া, যে, যে ষ্টেসনে আসিয়া উপস্থিত হইতে পারিত, সে সেই স্টেসনেই রেল-গাড়িতে আরোহণ করিত; কিন্তু কেহই একেবারে কলিকাতার টিকিট খরিদ করিত না, বা কেহই এক সঙ্গে কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইত না। মধ্যবর্তী কোন না কোন ষ্টেসনে আসিয়া কেহ অবতরণ করিত, কেহ বা সেইস্থানে বা অপর কোন স্থানে দুই এক দিবস অপেক্ষা করিয়া পরিশেষে কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইত। কিন্তু এক সপ্তাহের অধিক আমরা কেই বাহিরে থাকিতাম না। সপ্তাহের মধ্যেই একে একে সকলেই আমরা কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইতাম। নগদ টাকা আমরা পূর্ব্বের ন্যায় বিভাগ করিয়া লইতাম। অলঙ্কার পত্র যাহা পাওয়া যাইত, তাহা আমিই সময় মত বিক্রয় করিয়া ফেলিতাম, ও পরিশেষে নিয়মিতরূপ অংশে আমাদিগের মধ্যে বণ্টন করিয়া লইতাম। আমরা যে কেবল কলিকাতার নিকটবর্তী স্থান সমূহেই ডাকাইতি করিতাম, তাহা নহে; রেলযোগে আমরা সময় সময় দুই তিন দিবসের পথ পর্যন্তও গমন করিয়া আমাদিগের কার্য্য শেষ করিতাম। এইরূপ ক্রমে ক্রমে আমরা যে কত ডাকাইতি করিয়াছিলাম, তাহার হিসাব নাই। 

দেশে থাকিবার কালীন ডাকাইতি করিয়া যে সকল অর্থ উপার্জ্জন করিতাম, তাহার অধিকাংশই নানারূপ সৎকার্য্যে বায় করিতাম। কিন্তু কলিকাতায় আসিয়া ঐরূপ উপায়ে যাহা উপার্জ্জন করিতাম, তাহার একটি পয়সাও সৎকার্য্যে ব্যয়িত না। 

আপনি পূৰ্ব্ব হইতেই অবগত আছেন যে, আমি এ পর্য্যন্ত পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হই নাই; কিন্তু কলিকাতায় আসিবার পর আমার মনের গতি অন্য রূপ হইল। অনেক পিশাচিনীর সহিত ক্রমে আমার সহবাস ঘটিতে লাগিল। তাহাদিগের মধ্যে দুই একজনকে আমি ভালও বাসিতে লাগিলাম। একজনকে পত্নী পরিচয়ে আমার নিকটেও রাখিয়া দিলাম। তাহার নিমিত্ত যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করিতে লাগিলাম। তৎব্যতীত সহরের মধ্যে নানা স্থানে পরিভ্রমণ করিয়া আপনার নীচ প্রবৃত্তি সকল পরিতৃপ্তি করিবার মানসে অনেক অর্থ ব্যয় করিতে লাগিলাম। কিন্তু নীচ প্রবৃত্তি সকল কোন রূপেই দমিত হইল না, বরং প্রশ্রয় পাইয়া ক্রমেই তাহা আরও বৰ্দ্ধিত হইতে লাগিল। ঐরূপ অসৎ উপায়ে আমি যে সকল অর্থ সংগ্রহ করিতে লাগিলাম, ঐরূপ অসৎকার্য্যে আমি তাহা জলের ন্যায় ব্যয় করিতে লাগিলাম। অদ্য একটি ডাকাইতি করিয়া যদি দুইশত টাকা আমি প্রাপ্ত হইলাম, কিন্তু কল্য তাহার একটি পয়সাও আমার নিকট রহিল না। যখন যে অর্থ হস্তে আসিয়া পতিত হইত, তখনই তাহা ব্যয় করিয়া ফেলিতাম, কলা যে কি হইবে, তাহা এক বারের নিমিত্তও ভাবিতাম না। 

এইরূপ দুইবৎসর কাল কলিকাতার ভিতর অতিবাহিত হইল। দুই বৎসরের মধ্যে বিস্তর ডাকাইতি করিলাম, বিস্তর অর্থ উপার্জ্জন করিলাম ও বিস্তর অর্থ ব্যয় করিয়া ফেলিলাম, সংস্থান কিছুই রহিল না। দুই বৎসরের পর একটি ডাকাইতি মোকদ্দমায় আমরা তিন জন ধৃত হইলাম। ডাকাইতি করিয়া আমরা যে সময় চলিয়া আসিতেছিলাম, সেই সময় একটি রেলওয়ে ষ্টেসনে আমরা ধৃত হই। কিন্তু আমরা কে কোথায় থাকি, তাহার প্রকৃত পরিচয় আমরা প্রদান করি না। যে সময় আমরা ধৃত হই, সেই সময় আমাদিগের নিকট কলিকাতার বা সেই দিকের টিকিট ছিল না, আমরা তাহার বিপরীত দিকে গমন করিতেছিলাম। তৎব্যতীত আমরা যে স্থানে ধৃত হই, বা যে স্থানে ডাকাইতি হয়, তাহা বাঙ্গালা হাতার মধ্যে নহে, উত্তর পশ্চিম প্রদেশে। পুলিস যখন আমাদিগকে লইয়া বিশেষরূপ পিড়াপিড়ি করে, সেই সময় আমরা কিছুতেই আমাদিগের ঠিকানা দি না, ঐ প্রদেশের একটি নগর দেখাইয়া দিয়া কহি, আমরা এইখানেই থাকি। কিন্তু আমরা যে সেই স্থানে থাকি, তাহার প্রমাণ হয় না, অথচ আমাদিগের প্রকৃত বাসস্থান বা প্রকৃত নামও বাহির হয় না। ঐ মোকদ্দমায় আমাদিগের কেবল মাত্র দুইবৎসর করিয়া কারাবাসের আজ্ঞা হয়। 

দশম পরিচ্ছেদ

উত্তর পশ্চিম অঞ্চলের যে জেলের মধ্যে আমি দুইবৎসর কাল আবদ্ধ ছিলাম, তাহার মধ্যে আরও অনেক কয়েদী ছিল। উহাদিগের মধ্যে দুই জনের সহিত আমার বিশেষ রূপ সৌহৃদ্য জন্মিল, তাহাদিগের এক জনের নাম সীতারাম সিং, জাতিতে হিন্দু ছত্রিয়। আর এক জনের নাম ওমরাও খাঁ, ইহার বাসস্থান পশ্চিমদেশে, জাতিতে মুসলমান পাঠান। ইহারা দুই জনই ডাকাইত সর্দ্দার। উভয়েরই পৃথক পৃথক দল ছিল। উভয়েই আপনাপন দলের সাহায্যে অনেক ডাকাইতি করিয়াছে, কিন্তু পরিশেষে উভয়েই ধৃত হইয়া কারারুদ্ধ হয়। সীতারাম ১০ বৎসরের নিমিত্ত ও ওমরাও ১২ বৎসরের নিমিত্ত কারারুদ্ধ হয়। কিন্তু উভয়ের কারাবাস সময় জেলের মধ্যে প্রায় অতিবাহিত হইয়া গিয়াছিল। একজনের দুই বৎসর ও অপর ব্যক্তির দেড় বৎসর মাত্র বাকী থাকিতে আমি ঐ জেলের মধ্যে গমন করি। যে সময় আমি জেল হইতে নিষ্কৃতি পাইব, প্রায় সেই সময়ই সীতারামের মেয়াদ অতীত হইয়া যাইবে। ওমরাও আমাদিগের অব্যাহতির ৬ মাস পূৰ্ব্বেই জেল হইতে বহির্গত হইবে। আমরা তিন জন তিন প্রদেশের ও ভিন্ন ভিন্ন জাতি হইলেও আমাদিগের মধ্যে প্রগাঢ় ভালবাসা জন্মিয়াছিল। আমরা তিন জনই স্থির করিয়াছিলাম যে, এবার জেল হইতে বহির্গত হইবার পর, আমরা তিন জনেই একত্র মিলিত হইয়া পুনরায় কার্যক্ষেত্রে বিচরণ করিব ও সকলেই কলিকাতায় অবস্থান করিব। আমাদিগের মধ্যে যেরূপ পরামর্শ স্থির হইয়াছিল, কার্য্যেও ঠিক সেইরূপ হইল। ওমরাও আমাদিগের ৬ মাস পূর্ব্বে জেল হইতে বহির্গত হইল। জেল হইতে অব্যাহতি হইবার পর সে আপন দেশে গমন করিল, কিন্তু মাসাবধি কাল সে সেই স্থানে অবস্থিতি পূর্ব্বক, তাহার স্ত্রী-পুত্রাদি লইয়া কলিকাতায় গমন করিল। সে সেই স্থানে একটি বাসা লইয়া সামান্য কুলির কার্য্য করিয়া দিন অতিবাহিত করিতে লাগিল। কিন্তু আমাদিগের জেল হইতে বহির্গত হইবার দিনেই সে আমাদিগের নিকট উপস্থিত হইয়া আমাদিগের পরিধান উপযোগী বস্ত্রাদি পরিধান পূর্ব্বক আপনাপন স্থানে গমন করিলাম, অর্থাৎ সীতারাম আপন দেশে গমন করিল; আমি কলিকাতায় আসিলাম। আমার সহিত আমার দলস্থিত যে অপর দুই ব্যক্তির কারাবাস হইয়াছিল, দণ্ডের পরই তাহাদিগকে অপর জেলে প্রেরণ করা হয়, সুতরাং ঐ দুই বৎসর কাল আর তাহাদিগের সহিত সাক্ষাৎ হয় না। কিন্তু কলিকাতায় আসিবার পর পুনরায় তাহাদিগের সহিত সাক্ষাৎ হইয়াছিল। জেল হইতে বহির্গত হইবার পরই তাহারা কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হয়। কলিকাতায় আসিয়া দেখি, আমার দলস্থিত সকলেই এই দুই বৎসরের মধ্যেই ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িয়াছে। কেহ মরিয়া গিয়াছে, কেহ বা সর্দ্দার বিহীন হইয়া ডাকাইতি করিতে গিয়া ধৃত ও কারারুদ্ধ হইয়াছে। আমি কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইবার দুইতিন মাস পরেই সীতারাম সিং তাহার স্ত্রী-পুত্রাদি লইয়া কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইল। 

আমি উত্তর পশ্চিম প্রদেশীয় জেল হইতে বহির্গত হইয়া কিরূপে কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিলাম, তাহাও সংক্ষেপে এইস্থানে বর্ণন করিলাম। জেলের নিয়ম আছে, যে ব্যক্তি জেল হইতে নিষ্কৃতি পাইবার পর আপন দেশে গমন করিতে ইচ্ছা করে, তাহাকে সেইস্থানে গমন করিবার উপযোগী কিছু পাথেয় ও তাহার বাড়ীর নিকটবর্তী রেলওয়ে ষ্টেসনের একখানি টিকিট খরিদ করিয়া দেওয়া হয়। আমি কলিকাতায় থাকি, একথা পূৰ্ব্বে বলি নাই, বা আমার প্রকৃত নাম বলিয়া আমার দেশের ঠিকানাও দিতে পারি নাই, কারণ আমি জেলের ফেরারী আসামী। আমি যে কোথায় যাইর, তাহা বলিতে পারি না; সুতরাং আমি রেলের টিকিট বা পাথেয় কিছুই পাই না। কিন্তু জেল হইতে বহির্গত হইবার পর ওমরাও খাঁ আমাদিগকে পরিধেয় বস্ত্র প্রদান করিয়াছিল, ও পাথেয় বলিয়া একটিমাত্র টাকাও দিয়াছিল, তাহার অবস্থা সেই সময় ভাল ছিল না, অর্থের নিতান্ত টানাটানি ছিল। সে আমাদিগকে উহা প্ৰদান করিয়াই সেই স্থানের পুলিসের ভয়ে আমাদিগকে সেইস্থানে পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করে। সীতারাম দেশে যাইবার টিকিট পাইয়াছিল, সে আপন দেশে চলিয়া যায়। আমি ঐ একটি মাত্র টাকা লইয়া পদব্রজে সেইস্থান হইতে বহির্গত হই। নিকটবর্তী বাজারে আসিয়া উহা হইতে আটআনা খরচ করিয়া উত্তমরূপ আহার করি। অবশিষ্ট আট আনা লইয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করি। চলিতে চলিতে ক্রমে সন্ধ্যা হইয়া যায়। সন্ধ্যার পর একটি গ্রামে গিয়া উপস্থিত হই। আমার নিকট যে আট আনা ছিল, তাহার দ্বারা একখানি পুরাতন কাপড়, কিছু তৈল ও দেশলাই সংগ্রহ করি। কৃষিক্ষেত্রের একটি বেড়া ভাঙ্গিয়া ঐ কাপড় ও তৈলের দ্বারা কয়েকটি মসাল প্রস্তুত করি। রাত্রি ১২টার পর ঐ মসালগুলি লইয়া একটি গৃহস্থের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হই। ঐ বাড়ীর চতুষ্পার্শ্বে ঐ সকল মশাল পুঁতিয়া তাহাতে দেশালাই জ্বালিয়া দিই। এইরূপ ভাবে মসালগুলি পুঁতিবার উদ্দেশ্য এই যে, অনেক স্থানে মসাল প্রজ্বলিত হইতেছে দেখিতে পাইলে সকলেই মনে করিবে যে, অনেকগুলি ডাকাইত আসিয়া ডাকাইতি করিতেছে। এই রূপে মসাল সকল প্রজ্জ্বলিত করিয়া এক প্রকাণ্ড রব উত্থিত পূর্ব্বক আমি ঐ বাড়ীর খিড়কি দরজা ভাঙ্গিয়া ফেলি ও চারি পাঁচটি প্রজ্বলিত মসাল হস্তে বাড়ীর ভিতর প্রবেশপূর্ব্বক একাকীই ঐ বাড়ীতে ডাকাইতি কাৰ্য শেষ করি। বাড়ীর মধ্যে কেবল মাত্র দুই খানি খোলার ঘর ছিল। দরজা ভাঙ্গিয়া উভয় ঘরের মধ্যেই প্রবেশ পূৰ্ব্বক যাহা কিছু পাইলাম, তাহাই লইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। মসাল সকল সেই স্থানেই জ্বলিতে লাগিল। প্রথমতঃ লোকজন ভয়ে ভয়ে সেই দিকে অগ্রবর্তী হইল না। এইরূপ উভয়ে আমি প্রায় দুই শত টাকার রূপার অলঙ্কার ও নগদ আন্দাজ ৫০ টাকা প্রাপ্ত হইলাম। বলা বাহুল্য, ঐ টাকা হইতেই আমার রাস্তার খরচ, রেলের মাশুল প্রভৃতি সমস্ত ব্যয় নিৰ্ব্বাহ হইল। কলিকাতায় আসিয়া অলঙ্কারগুলি বিক্রয় করিয়া যাহা পাইলাম, তাহার দ্বারাই আবশ্যকীয় খরচ পত্ৰ নিৰ্ব্বাহ করিতে লাগিলাম। যে স্ত্রীলোকটিকে আমি, আমার স্ত্রী পরিচয়ে এতদিন প্রতিপালন করিয়াছিলাম, কলিকাতায় আসিয়া দেখি, সে আমাকে পরিত্যাগ করিয়া অপরের আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে, কিন্তু আমি তাহাকে যে সকল অলঙ্কার ইত্যাদি প্রদান করিয়াছিলাম, তাহার একখানিও নাই। যাহার সহিত সে নবপ্রণয়ে অভিভূত হইয়াছিল, সে এক এক খানি করিয়া উহা বিক্রয় পূর্ব্বক সমস্তই খরচ করিয়া ফেলিয়াছে। যাহা হউক, আমি কলিকাতায় আসিয়াছি এই সংবাদ পাইবামাত্রই পুনরায় সে আসিয়া আমার পদানত হইল। আমিও বিশেষ কিছু না বলিয়া পুনরায় তাহাকে আশ্রয় প্রদান করিলাম। আমি তাহাকে আশ্রয় প্রদান করিলাম সত্য, কিন্তু সেই ব্যক্তি আমার বিশিষ্ট রূপ শত্রু হইয়া দাঁড়াইল। যাহাতে সে ঐ স্ত্রীলোকটিকে পুনরায় পাইতে পারে, তাহার নিমিত্ত বিধিমতে চেষ্টা করিতে লাগিল। কোন রূপে আমার সর্ব্বনাশ সাধন করিতে না পারিলে তাহার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে না, এই ভাবিয়া কিসে আমার অনিষ্ট করিতে পারে, তাহার চেষ্টায় রাত্রি দিন ঘুরিতে লাগিল। আমি ডাকাইত, ডাকাইতি আমার ব্যবসা, ডাকাইতি করিয়া আমি দিন যাপন করিয়া থাকি, ডাকাইতি মোকদ্দমায় আমি কারারুদ্ধ হইয়াছি, এই সকল সংবাদ সে সৰ্ব্বদাই পুলিসের নিকট গমন করিয়া প্রদান করিতে লাগিল। পুলিসও তাহার কথায় বিশ্বাস করিয়া সর্ব্বদাই আমার উপর দৃষ্টি রাখিতে আরম্ভ করিলেন। আমি পূর্ব্বে যে জেল হইতে পলায়ন করিয়াছি ও আমার প্রকৃত নাম যে কি, তাহা ঐ স্ত্রীলোকটি বা ঐ ব্যক্তি জানিত না, ইহাই মঙ্গল; নতুবা সে যে আমার বিশেষ রূপ অনিষ্ট করিতে পারিত, সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। আমি যখন দেখিলাম যে, সে আমার উপর নানাপ্রকার অত্যাচার আরম্ভ করিল, অথচ আমি সেই স্ত্রীলোকটিকে কোন প্রকারেই পরিত্যাগ করিতে সমর্থ হইলাম না, তখন অনন্যোপায় হইয়া আমাকে ঐ স্থান পরিত্যাগ করিতে হইল। এই সহরের মধ্যে অপর আর এক স্থানে একখানি ঘর ভাড়া করিয়া, এক দিবস রাত্রিকালে আমরা এই বাসস্থান পরিত্যাগপূর্ব্বক সেই স্থানে গমন করিলাম। ঐ স্ত্রীলোকটিকে আমার পত্নী পরিচয়ে একজন গৃহস্থের বাড়ীর ভিতরেই বাস করিতে লাগিলাম। ঐ বাড়ীতে আরও কতকগুলি মুসলমান তাহাদিগের স্ত্রী পুত্র লইয়া বাস করিত। উহারা সকলেই ভিন্নদেশবাসী ও আমার অপরিচিত, সুতরাং তাহাদিগের মধ্যে কেহই আমাকে জানিত না। আমিও আমার ঐ স্ত্রীলোকটিকে বিশেষরূপে নিষেধ করিয়া দিয়াছিলাম ও বলিয়া দিয়াছিলাম, কিছুতেই সে যেন আমাদিগের পরিচয় কাহার নিকট প্রদান না করে। 

আমি যে স্থানে গমন করিলাম, সেই স্থান আমার দলস্থিত সমস্ত লোকই অবগত ছিল, সুতরাং আমাদিগের সকলের একত্র সংমিলন বা পরামর্শ ইত্যাদি করিবার কোনরূপ অসুবিধা হইত না। সীতারাম সিং ও ওমরাও খাঁ আসিয়াও সেই সময় কলিকাতায় উপস্থিত হইল, তাহাদিগের সমভিব্যাহারে আরও দুই চারি জন লোক আগমন করিল। এখন আমরা সকলে মিলিত হইয়া একটি সুদৃঢ় দলের গঠন করিলাম। 

একাদশ পরিচ্ছেদ

সীতারাম সিং ও ওমরাও খাঁ যে কে, তাহা পাঠকগণ অবগত নহেন, কেবল আপনারা এই মাত্র অবগত আছেন যে, উভয়েই ডাকাইতি মোকদ্দমায় কয়েদ হইয়া আমার সহিত একই জেলে থাকিত। তাহাদিগের একটু সংক্ষিপ্ত পরিচয় এই স্থানে প্রদান করা আবশ্যক। 

সীতারাম সিং যে প্রদেশে বাস করিত, সেই প্রদেশের সকলেই তাহাকে একজন প্রধান ডাকাইত সদার বলিয়া অবগত ছিল। কিন্তু সীতারাম কখন কোন গ্রামে ডাকাইতি করে নাই; আমাদিগের ন্যায় কোন গৃহস্থের বাড়ীতে প্রবেশ করিয়া ডাকাইতি করা তাহার অভ্যাস ছিল না, সে তাহার দলবল লইয়া সৰ্ব্বদাই জলপথে ডাকাইতি করিত। তাহার নিজের একখানি নৌকা ছিল, ঐ নৌকায় উঠিয়া রাত্রিকালে সে তাহার দল বলের সহিত নদী বাহিয়া বহুদূর পর্য্যন্ত গমন করিত। এমন কি সময় সময় তাহারা মাসাবধি সেই নৌকায় বাস করিয়া, নানাস্থান পরিভ্রমণপূর্ব্বক আপনাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিত। মহাজনী নৌকার উপরই তাহাদিগের বিশেষরূপ লক্ষ্য ছিল। ঐ সকল নৌকা সুবিধামত কোন স্থানে দেখিতে পাইলেই তাহারা উহার মধ্যে প্রবেশপূর্ব্বকযাহা কিছু পাইত, তাহা অপহরণপূর্ব্বক তাহাদিগের নিজের নৌকায় আনিত ও দ্রুতবেগে ক্ষেপণী নিক্ষেপ পূৰ্ব্বক সেইস্থান হইতে পলায়ন করিত। উহাদিগের নৌকা এত দ্রুতগামী ছিল যে আর কোন নৌকাই তাহাদিগের পশ্চাৎ ধাবিত হইতে পারিত না। উহারা যে কেবল নগদ অর্থ ও অলঙ্কারই চুরি করিত, তাহা নহে। চাউল, গোধূম প্রভৃতি আহারীয় দ্রব্য যাহা পাইত, তাহাও গ্রহণ করিত। স্থানে স্থানে অনেক দোকানদারের সহিত সীতারামের বন্দোবস্ত ছিল। ঐ সকল অপহৃত দ্রব্য রাতারাতিই আনিয়া তাহাদিগকে প্রদান করিয়া যাইত ও পরিশেষে সময় মত আসিয়া উহার মূল্য গ্রহণ করিতসীতারাম ডাকাইত, ডাকাইতিই তাহার ব্যবসা, একথা সকলেই অবগত ছিল; কিন্তু সে এরূপ সতর্কতার সহিত নিজের কার্য্য সম্পন্ন করিত, যে অপহৃত দ্রব্যের সহিত সে কখনই ধৃত হয় নাই। ঐ স্থানের পুলিস সন্দেহ করিয়া তাহাকে দুই চারি বার ধরিয়াছিল সত্য, ও দুই একবার বিচারার্থ বিচারকের নিকট প্রেরণ করিয়াছিল সত্য, কিন্তু প্রমাণ অভাবে তাহার কখনই দণ্ড হয় নাই। এইরূপে সীতারাম যে কত ডাকাইতি করিয়াছিল, তাহার হিসাব সীতারাম নিজেই প্রদান করিতে অক্ষম। কিন্তু পরিশেষে একবার সে ধৃত হয়। একজন বহুদর্শী পুলিস কর্ম্মচারী তাহাকে ধরিবার নিমিত্ত নিযুক্ত হইয়া প্রায় মাসাবধি তাহার প্রতীক্ষায় বসিয়া থাকেন। তিনি যে কেবল একাকীই ঐ কার্য্যে নিযুক্ত হন, তাহা নহে। ডাকাইতি করিবার সময় তিনি যাহাতে উহাদিগকে ধরিতে সমর্থ হন, এইরূপ লোকজনের সহিত সৰ্ব্বদাই প্রস্তুত থাকিতেন, ও কোন সময় উহারা নৌকায় উঠিয়া ডাকাইতি করিতে গমন করে, কেবল তাহারই উপর বিশেষরূপ দৃষ্টি রাখিতেন। এই রূপে কিছু দিবস অতিবাহিত হইবার পর, তিনি এক দিবস অবগত হইতে পারিলেন, যে সীতারাম তাহার দলবলের সহিত এক দিবস একখানি নৌকায় আরোহণ করিয়াছেন। নৌকায় দাঁড়িমাঝি অপর লোক কেহই নাই। ঐ দলের মধ্যে কোন ব্যক্তি মাঝি ও প্রায় সকলেই দাঁড়ির কার্য্যে নিযুক্ত হইয়া গমন করিতেছে। ইহাদিগের সহিত অস্ত্র শস্ত্র কিছুই থাকে না, লাঠি, সড়কি, তরবারি প্রভৃতি ইহারা কেহই ব্যবহার করে না, দাঁড়ই ইহাদিগের অস্ত্র। নৌকা চালনা করিবার সময় উহারা যে দাঁড় ব্যবহার করিয়া থাকে, ডাকাইতি করিবার সময় যদি আবশ্যক হয়, তাহা হইলে ঐ দাঁড়ই তাহারা ব্যবহার করে। 

সীতারাম আপন দলবলের সহিত নৌকায় উঠিয়া ডাকাইতি করিবার মানসে জলপথে গমন করিতে লাগিল সেই পুলিস কর্ম্মচারীও তাঁহার লোকজন লইয়া দূরে দূরে স্থলপথে তাহার অনুসরণ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। সীতারাম সমস্ত রাত্রি গমন করিল। পর দিবস সমস্ত রাত্রিও চলিল। পুলিস কর্মচারীগণও রাত্রি দিবস চলিয়া ক্রমে অবসন্ন হইয়া পড়িল, কিন্তু ডাকাইতগণের অবসন্ন হওয়া দূরে থাকুক, তাহারা ক্রমেই বেগে ক্ষেপণী নিক্ষেপ আরম্ভ করিল। ক্রমে রাত্রি হইয়া আসিল। সেই রাত্রিতে সীতারাম দেখিতে পাইল যে, একখানি গহনার নৌকা গমন করিতেছে। ঐ নৌকাখানি দেখিয়া সীতারাম ক্রমে ঐ নৌকার অনুগমন আরম্ভ করিল। 

গহনার নৌকা কাহাকে কহে, তাহা বোধ হয়, নব্য পাঠকগণের মধ্যে অনেকেই অবগত নহেন। যে সময় আমাদিগের দেশে রেলগাড়ির প্রচলন হয় না, সেই সময় নানাস্থানে বিশেষ দূরদেশে গমনাগমনের নিমিত্ত নৌকাই প্রধান উপায় ছিল। নদীর তীরবর্তী যে সকল নগর ব্যবসা বাণিজ্যের নিমিত্ত প্রসিদ্ধ ছিল, সেই সকল নগরের নিকট সদাসর্বদা অনেক নৌকা প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যাইত। উহার অধিকাংশ পণ্য দ্রব্যের নিমিত্ত ব্যবহৃত হইত, কিন্তু ঐ সকল নৌকা ব্যতীত আরও অনেক খালি নৌকা থাকিত। ঐ সকল নৌকা যাত্রীদিগকে লইয়া নানাস্থানে গমন করিত। যে সকল নৌকায় এইরূপে যাত্রী বোঝাই করিয়া লইয়া যাইত, সেই সকল নৌকাকে গহনার নৌকা কহিত এ দেশে রেলগাড়িতে লোকজনের যাতায়াত আরম্ভ হইবার সঙ্গে সঙ্গে গহনার নৌকায় যাতায়াত কমিয়া গিয়াছে, কেবল কমিয়া যাওয়া কেন, একেবারে উঠিয়া গিয়াছে বলিলেও হয়। যে সকল স্থানে এখন পর্য্যন্ত রেলগাড়িতে যাতায়াত করিবার সুবিধা হয় নাই, অথচ নৌকারোহণে যাতায়াত করিবার সুবিধা আছে, সেই সকল স্থানে এখনও দুই একখানি গহনার নৌকা দেখিতে পাওয়া যায়। ঐ সকল নৌকা প্রায়ই দ্রুতগামী হয়। নানাস্থান হইতে বাণিজ্য ব্যবসা করিয়া অথবা চাকরি প্রভৃতি করিয়া আপন দেশে গহনার নৌকায় প্রত্যাগমন করিবার সময় যাত্রীদিগের সহিত প্রায়ই মূল্যবান দ্রব্য ও নগদ অর্থাদি থাকে। তৎব্যতীত সেই প্রদেশীয় স্ত্রীলোকগণকে ঐ উপায়ে গমনাগমন করিতে হয় বলিয়া, সময় সময় বিস্তর অলঙ্কার পত্রের সহিত স্ত্রীলোকদিগকে ঐ গহনার নৌকায় আশ্রয় গ্রহণ করিতে হয়। 

জলদস্যুগণ গহনার নৌকা দেখিতে পাইলে অপর নৌকার দিকে তাঁহারা প্রায়ই তাহাদিগের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে না। ঐ গহনার নৌকায় যে পর্য্যন্ত ডাকাইতি করিয়া আপনাপন মনোভিলাষ পূর্ণ করিতে না পারে, সেই পৰ্য্যন্ত তাহারই অনুসরণ করিতে থাকে। 

সীতারাম একখানি গহনার নৌকা দেখিতে পাইয়া ঐ নৌকার অনুসরণ করিতে আরম্ভ করিল। পুলিস কর্ম্মচারীগণও বেশ বুঝিতে পারিলেন যে, ঐ গহনার নৌকাই তাহাদিগের প্রধান লক্ষ্য হইয়াছে, সুযোগ পাইলেই উহারা ঐ নৌকায় ডাকাইতি করিয়া তাহাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিবে। 

সেই পুলিস কৰ্ম্মচারী যদিও বেশ বুঝিতে পারিলেন যে, তাহারা ঐ নৌকায় ডাকাইতি করিবে; কিন্তু এখন তাহাদিগের চিন্তা হইল, কিরূপে তাঁহারা ডাকাইতদিগকে ধৃত করিতে সমর্থ হইবেন। ডাকাইতগণ ডাকাইতি করিবে জলের মধ্যে, আর তাঁহারা থাকিবেন স্থলের উপর; ডাকাইতি করিবার সময় যদি তাঁহারা সেই স্থানে গমন করিবার চেষ্টা করেন, তাঁহা হইলে তাহারা তাহা অনায়াসেই জানিতে পারিবে ও তাহাদিগের দ্রুতগামী নৌকায় আরোহণ করিয়া প্রস্থান করিবে। এদিকে যদি তাঁহারা অপর একখানি নৌকায় আরোহণ করিয়া তাহাদিগকে ধরিবার নিমিত্ত তাহাদিগের নৌকার নিকট গমন করিবার চেষ্টা করেন, তাহাতেও কৃতকাৰ্য্য হইবেন না; কারণ তাঁহারা যত তেজেই নৌকা চালনা করিবার চেষ্টা করুন না কেন, উহাদিগের নৌকার নিকট কিছুতেই পৌঁছিতে পারিবেন না। আর নিকটে পৌঁছিলেই বা কি হইবে। প্রথমত : তাহারা পুলিসের উপর বলপ্রয়োগ করিয়া তাহাদিগকে পরাস্থ পূৰ্ব্বক সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবে, ও তাহাতেও যদি কৃতকাৰ্য্য হইতে না পারে, তাহা হইলে তাহারা তাহাদিগের চিরাভ্যস্ত পন্থা অবলম্বন করিবে অর্থাৎ সকলেই তাহাদিগের নৌকা পরিত্যাগপূর্ব্বক এক একজন এক এক দিকে নদীর মধ্যে ঝম্প প্রদানপূর্ব্বক যে যে দিকে পাইবে, সে সেই দিক দিয়াই প্রস্থান করিবে। পুলিস কর্ম্মচারীগণ সকলেই কিছু নদীর মধ্যে ঝম্পপ্রদান করিতে পারিবেন না, সুতরাং ডাকাইতগণকে ধরিতেও সমর্থ হইবেন না। 

পুলিস কর্ম্মচারীগণ মনে মনে এইরূপ নানাপ্রকার চিন্তা করিতে লাগিলেন। এদিকে সীতারামের নৌকা সেই গহনার নৌকার পার্শ্বে আসিয়া উপস্থিত হইল। ডাকাইতগণ সেই গহনার নৌকার মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া আপন কাৰ্য্য উদ্ধার করিতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কিন্তু পুলিস কর্মচারীগণ সেই সময় তাহাদিগের দিকে অগ্রসর হইবার কোনরূপ সুযোগই করিতে পারিলেন না। 

যে পুলিস কৰ্ম্মচারী এই দল ধরিবার নিমিত্ত নিযুক্ত হইয়াছিলেন, তাঁহার নিকট একটি বন্দুক ছিল, ও তিনি উহা আপনার সঙ্গে করিয়া ডাকাইতদিগের অনুসরণ করিয়াছিলেন। ডাকাইতি করিবার সময় তিনি একবার মনে করিলেন, গুলি মারিয়া উহাদিগের মধ্যে যে কয়জনকে পারা যায়, আহত পূর্ব্বক ধৃত করেন, কিন্তু কার্য্যে তাহা পারিয়া উঠিলেন না। ডাকাইতি করিবার সময় কে ডাকাইত ও কাহার দ্রব্য লুণ্ঠিত হইতেছে, তাহা অন্ধকার রজনীর ভিতর কেহ ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারিলেন না; সুতরাং ডাকাইতদিগকে আহত করিতে গিয়া পাছে যাহাদিগের দ্রব্য অপহৃত হইতেছে, তাহাদিগকে আহত করিয়া বসেন, এই ভয়ে তিনি তাঁহার আগ্নেয় অস্ত্র ব্যবহার করিতে পারিলেন না। 

ডাকাইতগণ নিৰ্ব্বিবাদে ডাকাইতি করিয়া তাহাদিগের নিজ নৌকায় আরোহণপূর্ব্বক সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল। পুলিসকর্মচারীগণও অনন্যোপায়ে তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ পুনরায় গমন করিতে লাগিলেন। এইরূপে রাত্রির অবশিষ্ট অংশ অতিবাহিত হইয়া গেল। সেই সময় পুলিস-কৰ্ম্মচারীগণ দেখিলেন যে, ডাকাইতগণ এখন সহজে তাহাদিগের নয়নের অন্তরালে গমন করিতে পারিবে না, এই ভাবিয়া কৰ্ম্মচারীগণ দুইভাগে বিভক্ত হইয়া পড়িলেন। একস্থানে একখানি খেয়ার নৌকা অবলম্বন করিয়া একদল নদীর অপর পার্শ্বে গমন করিয়া দস্যুগণের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে আরম্ভ করিলেন, অপর দল যেরূপ গমন করিতেছিলেন, সেইরূপ ভাবেই গমন করিতে লাগিলেন। এইরূপে আরও কিছুদূর গমন করিবার পর, ঐ নদীর তীরস্থিত একটি স্থান তাঁহাদিগের নয়নগোচর হইল। সেই প্রধান পুলিস-কৰ্ম্মচারী ঐ স্থানে গমন করিয়া সেই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। যে সময় তিনি থানায় গমন করিলেন, সেই সময় সেইস্থানে সেই মহকুমার হাকিম উপস্থিত ছিলেন। তিনি জাতিতে মুসলমান। পুলিস-কর্ম্মচারীর নিকট সমস্ত অবস্থা অবগত হইয়া ঐ ডাকাইতগণকে ধরিবার মানসে তিনিও প্রস্তুত হইলেন ও সেই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীকে সঙ্গে লইয়া ডাকাইতদিগের অন্বেষণে বহির্গত হইলেন। হাকিম সাহেবের সহিত থানার অপরাপর লোকজন গমন করিতে লাগিল, চৌকীদারগণ তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিতে লাগিল, একটা মহা গোলযোগ হইয়া পড়িল। সকলেই নদীর তীরে যাইয়া সেই ডাকাইতগণের নৌকার অনুসরণ করিতে লাগিল। সীতারাম এই অবস্থা দেখিয়া বেশ বুঝিতে পারিল, পুলিস কর্ম্মচারীগণ তাহাদিগকে ধরিবার নিমিত্ত তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবিত হইতেছে। ইহা বুঝিতে পারিয়াই সে তাহাদিগের হস্ত হইতে কিরূপে পরিত্রাণ পাইতে পারিবে, তাহার চেষ্টা করিল। নদীর অপর পারে লক্ষ্য করিয়া দেখিল, কতকগুলি লোক সেই পারেও তাহাদিগকে অনুসরণ করিতেছে। কিন্তু উহাদিগের সংখ্যা অধিক নহে। এই অবস্থা দেখিয়া সে তাহার অনুচরগণকে কি বলিল। সকলে বিশেষ জোর করিয়া ক্ষেপণী নিক্ষেপ করিতে লাগিল, নৌকাও প্রবলবেগে চলিতে লাগিল। এইরূপে কিছুদূর অগ্রসর হইয়াই সীতারাম দেখিল যে, এবার আর পুলিসের হস্ত হইতে তাহাদিগের রক্ষা নাই। দলবলের সহিত সকলকেই এখন পুলিসের হস্তগত হইতে হইবে। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া নৌকা পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করাই কৰ্ত্তব্য বিবেচনা পূর্ব্বক যে দিকে অল্প পরিমিত পুলিস-কৰ্ম্মচারী ছিলেন, সেই দিক দিয়া পলায়ন করিতে স্থির করিয়া তাহাদিগের নৌকা সেইদিকে লইয়া যাইতে লাগিল। নৌকা যেমন তীরের নিকটবর্তী হইল, অমনি সকলে লম্ফ প্রদানপূর্ব্বক নৌকা পরিত্যাগ করিয়া তীরে উঠিল ও দ্রুতবেগে প্রস্থান করিতে লাগিল। 

হাকিম সাহেব যখন ঐ ডাকাইতগণের অনুসরণ করিতে প্রবৃত্ত হন, সেই সময় তিনি পূর্ব্বকথিত পুলিস কর্মচারীকে নদীর অপর পার্শ্বে গমন করিতে আদেশ প্রদান করিয়াছিলেন। ঐ পুলিস কৰ্ম্মচারীও সেই থানার সন্নিকটেই একখানি নৌকায় আরোহণ করিয়া নদীর অপর পার্শ্বে গমন করেন ও সেই স্থান হইতে নদীর অপর পার্শ্ব দিয়া ঐ ডাকাইতগণের অনুসরণ করিতে থাকেন। যে সময় ডাকাইতগণ তাহাদিগের নৌকা ছাড়িয়া তীরে উঠিয়া পলায়ন করিতে আরম্ভ করে, সেই সময় তিনি তাহাদিগের সন্নিকটবর্তী হইতে পারিয়াছিলেন না। একটু দূরে ছিলেন। পাঠকগণ পূৰ্ব্ব হইতেই অবগত আছেন যে, ঐ পুলিস কর্ম্মচারীর সহিত একটি বন্দুক ছিল। তিনি যখন দেখিলেন যে, ডাকাইতগণ প্রায় প্রস্থান করিল, অথচ তাহাদিগকে ধরিবার কোনরূপ সুযোগ ঘটিল না, তাঁহার এত দিবসের সমস্ত পরিশ্রম ব্যর্থ হইয়া গেল, তখন আর তিনি কাহারও আদেশের প্রতীক্ষা না করিয়াই দূর হইতেই ঐ পলায়িতমান ডাকাইতগণের উপর গুলি নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলেন। গুলি খাইয়া দুই তিনজন ডাকাইত সেই স্থানে পতিত হইল। অবশিষ্ট সকলে প্রস্থান করিল। যে দুই তিনজন ডাকাইত আঘাতিত হইয়া পতিত হয়, তাহাদিগের মধ্যে দলপতি সীতারাম ও একজন। এইরূপ উপায়ে দলপতি ধৃত হওয়ায় তাঁহাদিগের এত কষ্ট ও পরিশ্রমের কতকটা সার্থক হইল। হাকিম সাহেব ঐ পুলিস কৰ্ম্মচারীর সৎসাহসের প্রশংসা করিলেন ও তাঁহারই ইচ্ছানুযায়ী ডাকাইতগণের উপর গুলি চালান হইয়াছিল, এইরূপ ভাবে গবর্ণমেন্টের নিকট কৈফিয়ৎ প্রদান করিলেন। 

ঐরূপ উপায়ে যাহারা ধৃত হইয়াছিল, তাহারা জেলার হাসপাতালে প্রেরিত হইল। সেইস্থানে মাসাবধি চিকিৎসা হইবার পর তাহারা সকলেই আরোগ্য হইয়া ও পরিশেষে তাহাদিগের ডাকাইতি মোকদ্দমার বিচার হয়, বিচারে সকলেই কারারুদ্ধ হয়। যে সময় তাহারা কারাগারে বাস করিতেছিল, সেই সময় সেই কারাগারের ভিতর আমার সহিত তাহাদিগের আলাপ হইয়াছিল। 

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

ওমরাও খাঁর একটু সংক্ষেপ পরিচয় এই স্থানে প্রদত্ত হইল। উহারা বাসস্থান উত্তর পশ্চিম অঞ্চলের প্রায় শেষ সীমায়। ওমরাও খাঁর পিতা একজন প্রধান ডাকাইত ছিল। কতবার যে সে ডাকাইতি করিয়াছে, ও কতবার যে সে ধৃত হইয়া, কারারুদ্ধ হইয়াছে, তাহার হিসাব আমাদিগের নিকট নাই। কিন্তু জেলের মধ্যেই তাহার জীবন লীলা শেষ হয়। ওমরাও তাহার পিতার নিকট হইতে ঐ ব্যবসা শিক্ষা করে ও পরিশেষে ক্রমে তাহার পিতা অপেক্ষাও প্ৰধান ডাকাইতরূপে পরিণত হয়। ওমরাও খাঁর একটু ক্ষুদ্রদল ছিল, ঐ দলের সাহায্যে সে ডাকাইতি করিত। কখন যে কাহার বাড়ীতে সে ডাকাইতি করিয়াছে, তাহা আমরা অবগত নহি। তাহার ডাকাইতি করিবার নিয়ম ছিল অন্য প্রকার। সে তাহার দলবল লইয়া একদিকে বাহির হইয়া যাইত। যে রাস্তা বাহিয়া গমন করিত, সেই রাস্তার উপর যাহাকে দেখিতে পাইত, তাহারই যথাসর্ব্বস্ব কাড়িয়া লইত। দ্রব্যাদি বোঝাই কোন শকট গাড়ি প্রভৃতি দেখিতে পাইলে তাহাতেই ডাকাইতি করিত। উহাদিগের অত্যাচারে টাকা কড়ি বা মূল্যবান দ্রব্যাদি লইয়া কাহার রাস্তা চলিবার যো ছিল না, মহাজনগণ নির্ভয়ে টাকা কড়ি বা মালামাল স্থানান্তরে প্রেরণ করিতে পারিতেন না। ক্রমে উহাদিগের অত্যাচার এতদূর প্রবল হইয়া পড়িয়াছিল যে রাত্রিকালে কেহই রাস্তা ঘাটে চলিতে বা দ্রব্যাদি লইয়া যাইতে সহজে সম্মত হইত না। আমাদিগের দেশের ডাকাইতগণের নিয়ম তাহারা আলো জ্বালিয়ে মসাল ধরিয়ে ডাকাইতি করে, কিন্তু ওমরাওর দল ঠিক তাহার বিপরীত করিত। মসাল বা আলো ইত্যাদি জ্বালা ত পরের কথা, জ্যোৎস্না রাত্রিতে উহারা প্রায়ই ঘরের বাহির হইত না। গাঢ় অন্ধকারের ভিতর লুক্কায়িতভাবে উহারা কাৰ্য্য ক্ষেত্রে প্রবিষ্ট হইত ও অন্ধকারের মধ্যেই কার্য্য শেষ করিয়া লইত। একে গাঢ় অন্ধকার, তাহার উপর উহারা প্রায়ই আপনাপন মস্তক ও মুখ বস্ত্রের দ্বারা আবৃত করিয়া ডাকাইতি করিত, সুতরাং কেহই তাহাদিগকে চিনিয়া উঠিতে পারিত না। এইরূপে তাহারা যত ডাকাইতি করিত, তাহার অধিকাংশই পুলিস অবগত হইতে পারিত না, যাহা জানিতে পারিত, অনুসন্ধানে তাহার কোন ফলও ফলিত না। এইরূপে অনেক দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল, রাস্তায় এইরূপে অনেকগুলি ডাকাইতি হইল, কিন্তু তাহার একটিরও কোনরূপ কিনারা হইল না, বা দলস্থিত এক ব্যক্তিও ধৃত হইল না। 

এই সকল ডাকাইতির কোনরূপ সন্ধান না হওয়ায়, বা কোন্ ব্যক্তিগণ কর্তৃক এই সকল ডাকাইতি হইতেছে, তাহার কিছুমাত্র প্রকাশিত না হওয়ায়, উপরিতন পুলিস-কর্ম্মচারীগণের মনে নানারূপ সন্দেহ হইতে লাগিল। যাহাতে এই ডাকাইতি বন্ধ হয়, তাহার নিমিত্ত তাঁহারা বিশেষরূপ চেষ্টা করিতে লাগিলেন। 

কালে খাঁ নামক একজন পুলিস-ইনস্পেক্টার সেই সময় সেই প্রদেশে কার্য্য করিতেন। অতি অল্প দিবসের মধ্যে তাঁহার খুব নাম ডাক হইয়া পড়িয়াছিল। কেহ কেহ বলিত, পুলিসের বড় সাহেবের প্রধান খানসামার সহিত কালে খাঁর বিশেষরূপ আত্মীয়তা ছিল, তাহার উপর কালে খাঁ একটু লেখাপড়া শিখিয়াছিলেন, ইংরাজী বলিবার সময় প্রত্যেক কথায় ইংরাজীর ভুল হইলেও তিনি দ্রুতগতি ইংরাজী বলিতে পারিতেন। সকলে কহিত, সাহেবের সেই খানসামার সুপারিসে কালে খাঁ একেবারে দারোগাগিরি কার্য্য অর্থাৎ সব ইনস্পেক্টারীর পদে নিযুক্ত হন, ও অল্প দিবসের মধ্যেই ইনস্পেক্টার হইয়া যান। সরকারী কার্য্যে তাঁহার বিশেষরূপ ক্ষমতা থাকুক বা না থাকুক, তিনি সাহেবদিগকে বিশেষরূপে সন্তুষ্ট রাখিতে জানিতেন। যে সাহেব যেরূপ প্রকৃতির লোক, তিনি তাহা ঠিক বুঝিতে পারিতেন, ও যেরূপ উপায় অবলম্বনে চলিলে সাহেবগণ সন্তুষ্ট থাকেন, তিনি সেইরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া চলিতেন। ইহার নিমিত্ত তিনি তাঁহার নিজের মান অপমানের উপর কিছুমাত্র দৃষ্টি রাখিতেন না। সুতরাং জেলার ম্যাজিষ্ট্রেট বলুন, জজ বলুন, ডাক্তার সাহেব বলুন, বা পুলিস সাহেব বলুন, সকলেই তাঁহাকে বিশেষরূপ ভালবাসিতেন ও অনুগ্রহ করিতেন। তাঁহাদিগের নিজের যে কোন কার্য্যের প্রয়োজন হইত, কালে খাঁ ভিন্ন অপরের হস্তে তাহা প্রায়ই প্রদত্ত হইত না। 

জেলার সমস্ত প্রধান ইংরাজ কৰ্ম্মচারীগণ তাঁহার সহায় ছিলেন বলিয়া অপরাপর সমস্ত লোকই তাঁহাকে অতিশয় ভয় করিয়া চলিত। তিনি কোনরূপ অন্যায় কার্য্য করিলেও সকলে বিনা বাঙনিষ্পত্তিতে তাহা সহ্য করিত, ও তিনি যাহার উপর যে আদেশ করিতেন, তিনিও তাহার সাধ্যমত তাহা সম্পন্ন করিতেন। কালে খাঁর কথায় কোনরূপ প্রতিবাদ করিতে প্রায় কেহই সাহসী হইতেন না। 

ঐ প্রদেশে ঐরূপ ডাকাইতগণের অত্যাচার যখন ক্রমেই প্রবল হইয়া উঠিল, তখন জেলার ইংরাজ কর্মচারীগণ পরামর্শ করিয়া কালে খাঁর হস্তে ঐ সকল মোকদ্দমার অনুসন্ধানের ভার অর্পণ করিলেন। তাঁহার উপর এই আদেশ রহিল যে, যে প্রকারেই হউক, তাহকে ঐ ডাকাইত দলকে ধৃত করিতেই হইবে, ও যাহাতে ঐ প্রদেশে ঐরূপ ডাকাইতি আর না হইতে পারে, তাহার বিশেষরূপ বন্দোবস্ত করিতে হইবে। 

কালে খাঁর হৃদয় বড়ই অহঙ্কারে পূর্ণ ছিল। তাঁহার মনে মনে বিশ্বাস ছিল, তাঁহার মত পুলিস-কৰ্ম্মচারী আর দ্বিতীয় নাই; যে কার্য্য তাহার দ্বারা সম্পন্ন না হইবে, সেই কাৰ্য্য আর কাহার দ্বারা কোন রূপেই সম্পন্ন হইতে পারে না। এইরূপ অহঙ্কার ও বিশ্বাসের উপর নির্ভর করিয়া কালে খাঁ কার্য্য-ক্ষেত্রে পদনিক্ষেপ করিলেন। কেবল দুইজন মাত্র প্রহরী সঙ্গে লইয়া তিনি একখানি শকটে আরোহণ করিলেন। বলা বাহুল্য, তাঁহার আবশ্যকীয় দ্রব্য অর্থ ও বস্ত্রাদি তিনি সঙ্গে করিয়া লইলেন। তিনি জেলা হইতে বহির্গত হইয়া একটি রাস্তা অবলম্বন পূর্ব্বক গমন করিতে লাগিলেন। যে স্থান হইতে তিনি বহির্গত হইলেন, তাহার ২০ ক্রোশ অন্তরে একটি থানা ছিল। কালে খাঁ ইচ্ছা করিলেন, তিনি ঐ থানায় গিয়া অবস্থিতি করিবেন; ও সেই থানার কর্ম্মচারীগণের দ্বারা যাহাতে ডাকাইতগণকে ধৃত করিতে সমর্থ হন, তাহার চেষ্টা করিলেন; ও কোনরূপে যদি কৃতকার্য হন, তাহা হইলে সমস্ত বাহাদুরী নিজে গ্রহণ করিবেন। মনে মনে এইরূপ অভিসন্ধি করিয়া আহারাদির পরই তিনি তাঁহার বাসস্থান পরিত্যাগপূর্ব্বক শকটারোহণে বহির্গত হইলেন। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া যাইবার পর তিনি একটি বাজারে গিয়া উপস্থিত হইলেন। সেই বাজারের জনৈক দোকানদারের সহিত তাঁহার আলাপ পরিচয় ছিল। সেইস্থানে দারোগা সাহেব উপবেশন করিয়া তাহার সহিত কথা কহিতে কহিতে একটু রাত্রি হইয়া পড়িল। তখন তিনি গাত্রোত্থান করিয়া পুনরায় তাঁহার শকটে আরোহণ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। তাঁহাকে গমনোদ্যত দেখিয়া সেই দোকানদার তাঁহাকে কহিল, “মহাশয়! এখন উঠিলেন যে?” 

দারোগা। তোমার দোকানে এতক্ষণ থাকিলাম, আরও উঠিব না! আমাকে যে অনেক দূর গমন করিতে হইবে। দোকানদার। আপনি যে অনেক দূর গমন করিবেন, তাহা আপনার নিকট হইতে পূৰ্ব্বেই অবগত হইয়াছি; কিন্তু এখন কোথায় যাইতেছেন?. 

দারোগা। আমার গন্তব্য স্থানে। 

দোকানদার। রাত্রি হইয়া আসিয়াছে, এখন আর কোথায় যাইবেন? আমার এইস্থানে রাত্রিবাস করুন, কল্য প্রত্যূষে পুনরায় গমন করিবেন। 

দারোগা। কেন –আপনি ভাবিতেছেন কি যে, রাত্রিকালে গমন করিতে আমি ভয় পাইতেছি? 

দোকানদার। তাহা যদিচ আমি ভাবি নাই, কিন্তু রাত্রিকালে গমন করা ভাল নহে; কারণ যে রাস্তা দিয়া আপনি গমন করিবেন, সে রাস্তা ভাল নহে। 

দারোগা। রাস্তা ভাল নয় কেন? আমি জানি, ঐ রাস্তা ত খুব ভালই ছিল। এখন কি উহার কোন স্থান ভাঙ্গিয়া গিয়াছে? 

দোকানদার। রাস্তা ভাঙ্গিয়া যায় নাই, কিন্তু আজকাল ঐ রাস্তা দিয়া রাত্রিকালে কেহ গমনাগমন করে না বলিয়াই আপনাকে নিষেধ করিতেছি। 

দারোগা। রাত্রিকালে ঐ রাস্তা দিয়া কেহই যাতায়াত করে না? 

দোকানদার। না। 

দারোগা। কেন? 

দোকানদার। আজকাল ঐ রাস্তায় অত্যন্ত দস্যুভয় হইয়াছে। যে ঐ রাস্তা দিয়া রাত্রিকালে গমনাগমন করে, দস্যুগণ তাহারই যথাসৰ্ব্বস্ব কাড়িয়া লয়। 

দারোগা। তাহা হইলে আপনি কি মনে করেন যে, আমি দস্যুগণকে ভয় করিয়া রাস্তায় চলিয়া থাকি? 

দোকানদার। আপনি যে ভয় করেন, তাহা আমি বলিতেছি না, তবে কি না আপনার সহিত লোকজন অধিক নাই। দস্যুগণ যদি চিনিতে না পারিয়া আপনাকেই আক্রমণ করে, তাহা হইলে আপনি কি করিবেন, বলুন দেখি? তখন আপনার লজ্জা রাখিবার স্থান থাকিবে না। এ কথা হয় ত কাহাকে বলিতেও পারিবেন না। এরূপ অবস্থায় রাত্রি কালে ঐ রাস্তা দিয়া গমন না করাই আমার বিবেচনায় কৰ্ত্তব্য। 

দারোগা। দস্যুগণকে ধরিবার নিমিত্ত যে কালে খাঁ। নিযুক্ত হইয়াছে, সেই দস্যুগণের ভয়ে আপনি সেই কালে খাঁকে ভীত হইতে কহেন! আপনি দেখিতেছি আমাকে সম্পূর্ণরূপে চিনেন না। আপনি জানিবেন, কালে খাঁর হৃদয়ে কিছুমাত্র ভয় নাই। সে কর্তব্য সাধনের নিমিত্ত না করিতে পারে, এইরূপ কোন কার্য্যই নাই। আমার সহিত এখন ২।১ জন লোক আছে, কিন্তু যদি আমার সহিত কেহই না থাকিত, তাহা হইলেও কি আমি দস্যুভয়ে ভীত হইয়া আপনার এই স্থানে রাত্রিযাপন করিতাম। কালে খাঁর শরীরে যে পর্য্যন্ত রক্ত থাকিবে, সে পর্য্যন্ত কালে খাঁ কখনই দস্যু কর্তৃক ভীত হইবে না। যে কার্য্যের নিমিত্ত আমি নিযুক্ত হইয়াছি, যে দস্যুগণকে অনুসন্ধান করিয়া ধরিবার নিমিত্ত আমি গমন করিতেছি, সেই দস্যুগণই যদি আমার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হয়, তাহা হইলে জানিব যে, আমার উপর ঈশ্বর নিতান্ত অনুগ্রহ করিয়া থাকেন। 

কালে খাঁর এইরূপ দর্পোক্তি শ্রবণ করিয়া সেই দোকানদার মনে মনে হাসিলেন ও কহিলেন, “যদি আপনার এতদূর সাহসই না থাকিবে, তাহা হইলে আপনার এত নামই বা হইবে কেন, এবং সাহেবগণ আপনাকে এতই অনুগ্রহ করিবেন কেন? যাহা হউক, আমি বুঝিতে না পারিয়া আপনার গতিরোধ করিতে চেষ্টা করিতেছিলাম। ইহাতে যদি আমার কোনরূপ অপরাধ হইয়া থাকে, তাহা মনে করিবেন না।” 

কালে খাঁ তাঁহার কথায় আর কোনরূপ উত্তর প্রদান না করিয়া, দ্রুতগতি আপন শকটে গিয়া আরোহণ করিলেন। শকট চালক ঐ রাত্রিতেই গমন করিতে হইবে দেখিয়া, নানারূপ ওজর আপত্তি করিতে লাগিল। তাঁহার সহিত যে দুই জন প্রহরী ছিল, তাহারাও নানাপ্রকার অনিচ্ছা প্রকাশ করিল; কিন্তু কাহারও কথা থাকিল না, পরিশেষে সকলকেই সেই কালে খাঁ দারোগার সহিত সেই রাত্রিতেই সেইস্থান পরিত্যাগ করিতে হইল। 

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

কালে খাঁ দারোগা গাড়ির ভিতর শয়ন করিয়া নিদ্রা যাইতে লাগিলেন। শকট চালক আস্তে আস্তে শকট চালাইয়া সেই রাস্তা বহিয়া গমন করিতে লাগিল। যে দুইজন প্রহরী দারোগা সাহেবের সহিত গমন করিতেছিল, তাহারা ঐ শকটের পশ্চাৎ পশ্চাৎ পদব্ৰজে চলিল। 

রাত্রি দুই প্রহরের সময় একটি গোলযোগে দারোগা সাহেবের নিদ্রাভঙ্গ হইল। তিনি তাড়াতাড়ি গাত্রোত্থান করিলেন, কিন্তু শকট চালক বা প্রহরীগণ কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না। তাহার পরিবর্তে দেখিলেন, আট দশজন লোক তাঁহার সম্মুখে দণ্ডায়মান। কালে খাঁকে গাড়ির মধ্য হইতে বাহিরে আসিতে দেখিয়া একজন কহিল, “তোর নিকট যাহা কিছু আছে, তাহা আমাদিগকে সহজে প্রদান করিবি, কি আমরা বলপূর্ব্বক তাহা গ্রহণ করিব?” 

কালে খাঁ। তোরা জানিস্ আমি কে? আমি কালে খাঁ দারোগা। 

এক ব্যক্তি। জানি জানি তোর কালে খাঁকে। আমার নাম ফতে খাঁ। তোর মত কত কালে খাঁকে আমরা ফতে করিয়াছি। এই বলিয়া সকলে মিলিয়া দারোগা সাহেবকে উত্তম মধ্যমরূপে প্রহার করিল, ও তাঁহার যথাসর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া লইয়া গেল। ডাকাইতগণ ইতিপূর্ব্বে যাহাকে ধরিত, কেবল তাহার নিকট হইতে মূল্যবান দ্রব্য লইয়া চলিয়া যাইত, বস্ত্র বা অপরাপর কোন দ্রব্যের উপর লক্ষ্যও করিত না। কিন্তু দারোগা কালে খাঁর সহিত তাহারা স্বতন্ত্ররূপ বন্দোবস্ত করিল। ঐ গাড়ির ভিতর যে কোন দ্রব্য ছিল, তাহার সমস্তই তাহারা গ্রহণ করিল। বিছানা পত্র যাহা ছিল, তাহা পর্যন্তও তাহারা পরিত্যাগ করিল না। অধিকন্তু কালে খাঁর অঙ্গে যে বস্ত্র পরিহিত ছিল, তাহাও তাহারা তাঁহার শরীর হইতে উন্মোচিত করিয়া লইয়া তাঁহাকে একেবারে বিবস্ত্র অবস্থায় সেইস্থানে পরিত্যাগপূর্ব্বক প্রস্থান করিল। যাইবার সময় তাহারা কেবল এইমাত্র বলিয়া গেল যে, ডাকাইতদিগকে ধৃত করিতে যাইতেছ বলিয়া তোমার এই দশা হইল, কিন্তু যখন তাহাদিগকে ধরিবার চেষ্টা করিবে, সেই সময় তোমার যে কি অবস্থা ঘটিবে, তখন সেই সময়ই অবগত হইতে পারিবে। 

দারোগা কালে খাঁ যাহাদিগকে ধরিবার নিমিত্ত নিযুক্ত হইয়াছিলেন। তাহাদিগের হস্তে পতিত হইয়া তিনি তাঁহার নিকট যাহা কিছু ছিল, তাহার সমস্তই হারাইলেন। টাকা কড়ি যাহা ছিল, তাহার কথাতো দূরে থাকুক, পরিধেয় বস্ত্র বা সরকারি পোষাক পরিচ্ছদ প্রভৃতি যাহা কিছু ছিল, তাহার সমস্ত ডাকাইতগণ লইয়া প্রস্থান করিল। তাহার উপর তাহাদিগের হস্তে তিনি যেরূপ প্রহারিত হইয়াছিলেন, সেরূপ প্রহার তাঁহার অদৃষ্টে আর কখন হইয়াছিল কি না তাহা মনে হয় না। তাঁহার লজ্জা নিবারণ উপযোগী বস্ত্রাদি কিছুই নাই। ওরূপ অবস্থায় তিনি সেই গাঢ় অন্ধকারে আপন লজ্জা নিবারণ করিয়া আপনার সঙ্গীগণের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। সাহসী দারোগা কালে খাঁর তখন এরূপ সাহস হইল না যে, তিনি চীৎকারপূর্ব্বক আপনার সঙ্গীগণকে ডাকেন। তিনি সেইস্থানে উপবেশন পূর্ব্বক আপনার অদৃষ্টফল চিন্তা করিতেছেন, সেই দোকানদারের কথা কেন অবহেলা করিলেন ভাবিতেছেন, ও কি করিয়া তাঁহার এই শোচনীয় অবস্থার বিষয় অপরের নিকট পরিচয় প্রদান করিবেন, ও সাহেবগণ তাঁহার এই অবস্থা শুনিয়া কি মনে করিবেন, তাহারই চিন্তা করিতেছেন, এরূপ সময় সেই প্রহরী দুইজন ও শকটচালক কাঁপিতে কাঁপিতে তাঁহার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহাদিগকে দেখিয়া কালে খাঁ পুনরায় অতিশয় ভীত হইয়া পড়িলেন, ভাবিলেন, ডাকাইতগণ তাঁহার যথাসর্ব্বস্ব পূর্ব্বেই অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়া পুনরায় যখন প্রত্যাগমন করিতেছে, তখন এবার নিশ্চয়ই তাহার তাঁহার জীবন নষ্ট করিবে। মনে মনে এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে কালে খাঁ সেইস্থানে অৰ্দ্ধমূৰ্চ্ছিত অবস্থায় পতিত হইলেন। তাঁহার মুখ দিয়া একটি বাক্যও নির্গত হইল না। 

প্রহরীদ্বয় দারোগা সাহেবের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া তাঁহার নিকট আসিলেন ও কহিলেন, “আপনার আর ভয় নাই, আমরা আসিয়াছি।” 

কালে খাঁ। তোমরা কোথায় ছিলে? 

প্রহরী। দস্যুগণ আমাদিগকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছিল। 

কালে খাঁ। তাহার পর? 

প্রহরী। তাহার পর আমাদিগকে ধরিয়া ঐ জঙ্গলের মধ্যে লইয়া যায়, সেইস্থানে আমাদিগকে উত্তমরূপে প্রহার করিয়া লতাপাতার সহিত আমাদিগকে সেইস্থানে বাঁধিয়া চলিয়া যায়। তাহারা গমন করিবার পর কোনরূপে আমরা সেই লতাপাতা ছিন্ন করিয়া পলায়ন করিয়া আসিয়াছি। 

কালে খাঁ। তোমাদিগকে তাহারা কিরূপে ধরিয়া লইয়া গিয়াছিল? 

প্রহরী। আপনি যখন নিদ্রিত হইয়াছিলেন, সেই সময় এই শকট চালক শকট চালাইয়া গমন করিতেছিল। আমরা গাড়ির পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতেছিলাম। যখন আমরা এই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলাম, সেই সময় দেখিলাম, ঐ জঙ্গল হইতে ১০/১২ জন লোক বহির্গত হইয়া আমাদিগের গাড়ীর দিকে আগমন করিতে লাগল। ইহা দেখিয়া আমরা গাড়ির পশ্চাদ্দিক হইতে সেইদিকে গমন করিলাম, ও উহাদিগের সম্মুখীন হইয়া কহিলাম, “তোমরা কে?” তাহারা আমাদিগের কথায় কোনরূপ উত্তর প্রদান না করিয়াই আমাদিগের উপর লাঠি মারিতে আরম্ভ করিল। আমরাও তাহাদিগকে দুই চারি ঘা মারিলাম, কিন্তু তাহাদিগের সহিত পারিলাম না। তাহাদিগের মধ্যে কয়েকজন আমাদিগকে পরাজিত করিয়া আমাদিগের তিন জনকেই ধরিয়া ঐ জঙ্গলের ভিতর লইয়া গেল। অবশিষ্ট যাহারা ছিল, তাহারা আপনার গাড়ির দিকে গমন করিতে লাগিল। 

কালে খাঁ। আমার যখন হঠাৎ নিদ্রাভঙ্গ হইল, তখন দেখি, ডাকাইতগণ আমাকে ঘিরিয়া ফেলিয়াছে। তথাপি আমি তাহাদিগের সহিত যুদ্ধ করিয়া তাহাদিগকে উপযুক্তরূপ শিক্ষা প্রদান করিলাম সত্য, কিন্তু পরিশেষে আমি পরাজিত হইলাম; কারণ আমি একাকী, আর তাহারা ৪০।৫০ জন। 

প্রহরী। আমাদিগের কোন দ্রব্য ত তাহারা লইয়া যায় নাই? 

কালে খাঁ। সমস্তই লইয়া গিয়াছে, কিছুই নাই। 

প্রহরী। এ কি, আপনাকে যে একবারে বিবস্ত্র দেখিতেছি! 

কালে খাঁ। আমার পরিধানে যে কাপড় ছিল, তাহা পর্যন্তও উহারা খুলিয়া লইয়া গিয়াছে। 

প্রহরী। আমাদিগের কিছুই উহারা লইতে পারে নাই। উহাদিগকে দেখিয়াই আমাদিগের ঝোলা আমরা দূরে নিক্ষেপ করিয়াছিলাম, উহারা তাহা দেখিতে পায় নাই বলিয়া আমাদিগের সমস্ত বাঁচিয়া গিয়াছে। ঐ ঝোলায় আমাদিগের অতিরিক্ত কাপড় আছে, তাহাই আপনাকে প্রদান করিতেছি। উহা পরিধান করিয়া আপাততঃ লজ্জা নিবারণ করুন। তাহার পর যাহাতে এই ডাকাইত বংশ নিৰ্ব্বংশ হয়– বিধিমতে আমরা তাহার চেষ্টা করিব। 

প্রহরীগণ কালে খাঁকে যে সকল কথা কহিল, তাহার সমস্তই মিথ্যা কথা। দস্যুগণকে দূর হইতে আসিতে দেখিয়া তাহারা তিন জনে গাড়ী পরিত্যাগপূর্ব্বক নিকটবর্তী একটি জঙ্গলের ভিতর আস্তে আস্তে প্রবেশ করে। ডাকাইতগণ ডাকাইতি করিয়া চলিয়া যাইবার পর, তাঁহারা সেইস্থান হইতে বহির্গত হইয়া দারোগা সাহেবের সম্মুখে আগমন করে ও মিথ্যা কথা বলিয়া তাহার বিশ্বাস জন্মায় যে, তাহাদিগের কিছু মাত্র দোষ নাই। 

কালে খাঁ ঐ গাড়িতে আরোহণ করিয়া পুনরায় চলিতে লাগিলেন। ক্রমে প্রভাত হইয়া গেল। সেই সময় দেখিতে পাইলেন, তিনি যে থানায় গমন করিতেছিলেন, সেই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্ম্মচারী কতকগুলি লোক জনের সহিত অশ্বে আরোহণ করিয়া সেইদিকে আগমন করিতেছেন। 

[আশ্বিন, ১৩০৮] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *