কু-বুদ্ধি (শেষ অংশ)
(অর্থাৎ অল্পবুদ্ধি স্ত্রীলোকের বুঝিবার বিষম ভ্ৰম।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
আমরা ক্রমে গিয়া সেই বাজারে উপস্থিত হইলাম। যখন আমরা সেই বাজারে উপস্থিত হইলাম, তখন বেলা প্রায় ২টা বাজিয়া গিয়াছে। অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম, ঐ বাজারের নিকটেই ডাকঘর ও পুলিসের থানা আছে। ঐ ডাকঘরে গমন করিয়া আমার লিখিত সেই পত্রখানি সেই স্থানের ডাকবাক্সে ফেলিয়া দিয়া, আমি নিকটবর্ত্তী থানায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। ঊষা ঐ গাড়ির ভিতরেই বসিয়া রহিল।
থানায় উপনীত হইয়া দেখিলাম, সেই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী অর্থাৎ দারোগা সেইস্থানে উপস্থিত আছেন। তিনি উৎকলবাসী জনৈক কায়স্থ। ইতিপূর্ব্বে সরকারী কোন কার্য্য উপলক্ষে আমি যখন ঐ প্রদেশে গমন করিয়াছিলাম, সেই সময় তাঁহার সহিত আমার প্রথম পরিচয় হয়। সুতরাং আমাকে দেখিবামাত্রই তিনি আমাকে চিনিতে পারেন ও আমি কি নিমিত্ত তাঁহার নিকট আগমন করিয়াছি, তাহাও তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন।
আমি। আপনার এলাকার মধ্যে কি ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহার কিছু অবগত আছেন কি?
দারোগা। কিরূপ ঘটনা?
আমি। চুরি।
দারোগা। না, আমি তো তাহার কিছুই অবগত নহি। কবে ও কোথায় চুরি হইয়াছে?
আমি। গতকল্য দিবাভাগে অথবা রজনীতে।
দারোগা। কোথায় এই চুরি হইয়াছে?
আমি। পুরী যাইবার এই রাস্তার উপর।
দারোগা। কি চুরি হইয়াছে?
আমি। অলঙ্কার ও নগদ টাকা।
দারোগা। কি মূল্যের দ্রব্য চুরি হইয়াছে?
আমি। প্রায় ৪।৫ হাজার টাকার হইবে।
দারোগা। এত টাকা মূল্যের দ্রব্য চুরি হইয়াছে, কিন্তু আমি তো তাহার কিছুই অবগত হইতে পারি নাই! আমাদিগের থানায় এই সংবাদ তো কেহই প্রদান করেন নাই। কাহার অলঙ্কার-পত্র অপহৃত হইয়াছে?
আমি। যাহার অলঙ্কার-পত্র অপহৃত হইয়াছে, তিনি আমার গাড়িতে আছেন।
দারোগা। তিনি কি নালিস করিতে আসিয়াছেন?
আমি। তিনি যে নালিস করিতে আসিয়াছেন, একথা আমি বলিতে পারি না। তবে আমিই তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া এখানে আনিয়াছি।
দারোগা। আপনি উঁহাকে পাইলেন কোথায়?
আমি। রাস্তার উপরই পাইয়াছি। তাঁহাকে নিতান্ত সহায়হীনা দেখিয়া আমি তাঁহাকে নিজের সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি, কারণ তিনি কলিকাতার কোন ভদ্রঘরের মহিলা, বিশেষ তাঁহার পিতা আমার নিকট পরিচিত।
দারোগা। কিরূপে তাঁহার দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে?
আমি। তিনি তাঁহার পিতা মাতাকে লুকাইয়া কতকগুলি যাত্রীর সহিত পুরীধামে গমন করিবার মানসে কলিকাতা পরিত্যাগ করেন। তাঁহার নিকট অনেকগুলি অলঙ্কার-পত্র ও নগদ টাকা ছিল, ইহা কোনরূপে জানিতে পারিয়া, অনুমান হয়, কলিকাতা হইতে দুইটি লোক তাঁহার অনুগমন করে। রাস্তায় সুযোগ পাইয়া যাত্রী পরিচয়ে ক্রমে ঐ দুই ব্যক্তি ঐ যাত্রীদলের সহিত মিলিত হয় ও পরে তাহাদিগের সহিত গমন করিতে থাকে। পরিশেষে সুযোগ পাইয়া গতকল্য কিছু খাদ্য আনিয়া ঐ স্ত্রীলোকটিকে দেয়। উহা আহার করিবার পর হইতেই ক্রমে তিনি অজ্ঞান হইয়া পড়েন। তাহার পর যে আর কি ঘটে, তাহার কিছুই তিনি বলিতে পারেন না। পরিশেষে যখন তাঁহার জ্ঞান হয়, তখন তিনি দেখিতে পান যে, নিতান্ত অসহায় অবস্থায় তিনি রাস্তার পার্শ্বে পড়িয়া আছেন। তাঁহার সহিত অপর যে সকল যাত্রী ছিল, তাহারা নাই; বা যে দুই ব্যক্তি তাঁহাকে আহারীয় আনিয়া দিয়াছিল, তাহারাও নাই। তাঁহার সমভিব্যাহারে যে সকল জিনিস-পত্র ছিল, তাহাও নাই এবং তাঁহার পরিহিত অলঙ্কারগুলির কিছুমাত্রও নাই। কেবল তাঁহার পরিধানে যে বস্ত্রখানি ছিল, তাহাই মাত্র আছে। আমি ঐ রাস্তা দিয়া পুরী হইতে প্রত্যাগমন করিতেছিলাম। প্রত্যূষে নিতান্ত সহায়হীন অবস্থায় আমি তাঁহাকে রাস্তার উপর দেখিতে পাইয়া আমার গাড়িতে উঠাইয়া লই, ও ক্রমে তাঁহার পরিচয় ও যেরূপ অবস্থায় তিনি পতিত হইয়াছেন, তাহা আমি অবগত হইতে পারি। তাঁহার নিকট হইতে আমি যাহা অবগত হইতে পারিয়াছি, তাহাই আপনাকে কহিলাম।
দারোগা। উনি যাত্রীগণের সহিত পদব্রজে গমন করিতেছিলেন?
আমি। যাত্রীগণ সকলেই পদব্রজে গমন করিতেছিল, কিন্তু ইনি একখানি গরুর গাড়ি ভাড়া করিয়া তাহাতে আরোহণ পূর্ব্বক উহাদিগের সহিত গমন করিতেছিলেন।
দারোগা। উনি যখন ঐ আহারীয় দ্রব্য আহার করেন, তখন গাড়িতেই ছিলেন, কি অপর যাত্রিগণের সহিত ছিলেন?
আমি। আমি যতদূর অবগত হইতে পারিয়াছি, তাহাতে এইমাত্র বলিতে পারি যে, তিনি ঐ গাড়ির মধ্যে উপবেশন করিয়াই ঐ সকল আহারীয় দ্রব্য আহার করেন, ও গাড়ির ভিতরই ক্রমে জ্ঞানশূন্য হইয়া যান।
দারোগা। সে গাড়োয়ান কোথায়?
আমি। তাহারও কিছুমাত্র ঠিকানা নাই। যখন তাঁহার জ্ঞান জন্মে, তখন তিনি রাস্তার পার্শ্বে পড়িয়াছিলেন, এ কথা আমি পূৰ্ব্বেই আপনাকে বলিয়াছি। সেই গাড়োয়ানকে তিনি আর দেখিতে পান নাই।
দারোগা। আপনার নিকট হইতে যতদূর অবগত হইলাম, তাহাতে ইহা যে কেবল চুরি মোকদ্দমা, তাহা নহে; কোনরূপ বিষাক্তদ্রব্য সেবন করাইয়া উঁহাকে প্রথমতঃ অজ্ঞান করা হয়, পরিশেষে তাঁহার যথাসর্বস্ব অপহরণ করিয়া লয়। এরূপ অবস্থায় এখন আমাকে কি করিতে হইবে বলুন?
আমি। কি করিতে চাহেন?
দারোগা। এই মোকদ্দমা কি কোনরূপে কিনারা হইবে বলিয়া অনুমান করেন?
আমি। বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিলে, যে এই মোকদ্দমার কিনারা হইবে না, তাহা আমি বলিতে পারি না। কারণ, কলিকাতা হইতে যে দুইটি লোক উঁহার অনুসরণ করিয়াছিল, যদি তাহাদিগের কোনরূপ ঠিকানা করিতে পারা যায়, অর্থাৎ তাহারা কে, কোথায় থাকিত ও তাহাদিগের বাসস্থান কোথায়, তাহা যদি জানিতে পারা যায়, তাহা হইলে এই মোকদ্দমার যে কিনারা হইবে না, একথা আমি বলিতে পারি না।
দারোগা। আর যদি সেই গাড়োয়ানের অনুসন্ধান করিয়া তাহাকে বাহির করিতে পারা যায়, তাহা হইলেও বোধ হয়, এই মোকদ্দমার কিনারা হইতে পারে।
আমি। না হইলেও হইতে পারে।
দারোগা। কেন?
আমি। ঐ স্ত্রীলোকটি অজ্ঞান হইবার পরই যদি ঐ দুই ব্যক্তি তাঁহাকে গাড়ি হইতে নামাইয়া লইয়া, তাহাদিগের নিকট হইতে ভাড়া দিয়া, যদি ঐ গাড়ি বিদায় করিয়া দিয়া থাকে, ও ভাড়া পাইয়া ঐ গাড়োয়ান সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিয়া থাকে, তাহা হইলে তাহার দ্বারা বিশেষ কোনরূপ উপকার পাইবার সম্ভাবনা নাই। তবে আসামীদ্বয় ধৃত হইলে ঐ গাড়োয়ানের সাক্ষ্য তাহাদিগের বিরুদ্ধে গমন করিতে পারে।
দারোগা। আর যদি ঐ গাড়োয়ানের দ্বারা ঐ কার্য্য হইয়া থাকে?
আমি। তাহা আমার বোধ হয় না; কারণ তাহা হইলে ইহাকে এইরূপ অবস্থায় পরিত্যাগ করিয়া ঐ দুই ব্যক্তি প্রস্থান করিবে কেন?
দারোগা। আপনার যদি বিশ্বাস হয়, যে ঐ দুই ব্যক্তির দ্বারা এই কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়াছে, ও উহারা কলিকাতা হইতে তাঁহার অনুসরণ করিয়া আসিয়াছে, তাহা হইলে, এই মোকদ্দমা কলিকাতায় রুজু করিয়া লইয়া তাহার অনুসন্ধান করুন না কেন? এ প্রদেশে অনুসন্ধান করিতে হইলে যে কোনরূপ সাহায্যের প্রয়োজন হইবে, আমি তাহা আপনাকে প্রদান করিব।
আমি। এই মোকদ্দমা গ্রহণ করিয়া অনুসন্ধান করিতে আপনি এত ভীত হইতেছেন কেন?
দারোগা। আপনি একজন বহুদর্শী কৰ্ম্মচারী, আপনাকে আমার এ কথার উত্তর আর প্রদান করিতে হইবে কেন। আমি যদি এত বড় একটি মোকদ্দমা রুজু করিয়া লই, তাহা হইলে ইহার অনুসন্ধান সুচারুরূপে শেষ করা আমার দ্বারা কখনই সম্ভবপর হইবে না। এই মোকদ্দমা রুজু হইয়াছে, এই সংবাদ পাইবামাত্রই আমাদিগের ইনস্পেক্টার এখনই আসিয়া এখানে উপস্থিত হইবেন। তদ্ব্যতীত জেলার বড় সাহেব ও তাঁহার সাহায্যকারী সাহেবও আসিয়া ইহার অনুসন্ধানের সহায়তা করিতে প্রবৃত্ত হইবেন,— অর্থাৎ অনুসন্ধানের বিষয় গোলযোগ ঘটাইবেন; কারণ, আপনি বেশ অবগত আছেন যে, যে মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত প্রথম প্রথম ঊর্দ্ধর্তন ও বড় বড় কর্ম্মচারীগণ একত্রিত হন, সেই মোকদ্দমার কপাল পুড়িয়া থাকে। ঐ সকল মোকদ্দমার কিনারা প্রায়ই হয় না; কারণ প্রত্যেক কৰ্ম্মচারীর পৃথক পৃথক মত হইয়া পড়ে, সুতরাং সেই সকল পৃথক পৃথক মতের অনুসরণ করিয়া অনুসন্ধান করিতে হয়। এদিকে উপরিতন প্রধান কর্ম্মচারীগণ উপস্থিত থাকিলে নিম্নতর কর্ম্মচারীগণের বিশেষরূপ জবাবদিহি থাকে না বলিয়া তাঁহারা আপন মনের সহিত কোন কার্য্যই করেন না। এক কথায় আমাদের দেশে যে একটি প্রাচীন কথা চলিত আছে, “অনেক সন্ন্যাসীর সমাবেশে গাজন নষ্ট হয়”- অনেক বড় বড় কর্মচারীর একত্র সমাবেশে প্রায় তাহাই ঘটিয়া থাকে। তাই আমি বলিতেছিলাম, যদি এই মোকদ্দমা কলিকাতায় রুজু করিয়া লইয়া আপনি একাকী তাহার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হন, ও আমরা সকলে আপনার সাহায্য করি, তাহা হইলে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে সুফল ফলিবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা।
আমি। আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা সম্পূর্ণ সত্য; এ কথা আমি অবগত আছি। বিশেষ এই মোকদ্দমা যে এই স্থানে রুজু হয়, তাহারও আন্তরিক ইচ্ছা আমার নাই; কারণ আমি উত্তমরূপে অবগত আছি যে, এই মোকদ্দমা এইস্থানে রুজু হইয়া অনুসন্ধান আরম্ভ হইলে, এই ভদ্র রমণীর আর দুর্দ্দশার সীমা থাকিবে না; কারণ যখন যিনি ইঁহার অনুসন্ধান উপলক্ষে আগমন করিবেন, তিনিই একবার ফরিয়াদীকে দেখিতে চাহিবেন, ও তাঁহার নিকট সমস্ত অবস্থা একবার অবগত হইতে চাহিবেন। আমি ঊষার নিকট হইতে সমস্ত অবস্থা উত্তমরূপে অবগত হইয়াছি, ও তাঁহার অলঙ্কার পত্র যাহাতে পুনরায় প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহার ভার আমি নিজেই গ্রহণ করিয়া, একরূপ অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়াছি। তবে আপনার নিকট আমার আগমন করার একটু মহৎ উদ্দেশ্য আছে। আমি যে দুই ব্যক্তির উপর সন্দেহ করিতেছি, নিশ্চয় বলিতে পারি, ঐ কার্য্য তাহাদিগের দ্বারা ব্যতীত অপর কাহার দ্বারা হয় নাই। আরও বলিতে পারি, যাহারা গতকল্য এই কার্য্য সম্পন্ন করিয়াছে, তাহারা এই স্থান হইতে যে অধিক দূরে গমন করিতে সমর্থ হইয়াছে, তাহাও আমার অনুমান হয় না; কারণ নিকটে রেলপক্ষ বা দ্রুত গমন করিবার অপর কোন সুযোগ নাই, হয় শকটারোহণে, না হয় পদব্রজে তাহাদিগকে গমন করিতে হইতেছে। এই স্থানে আমি অপরিচিত, সমস্ত রাস্তা ঘাটও আমি জানি না, বা উপযুক্তরূপ লোক জনও আমার সঙ্গে নাই, এইরূপ অবস্থায় তাহাদিগের অনুসন্ধান ও অনুসরণ করিয়া তাহাদিগকে সহজে ধৃত করিবার ক্ষমতা আমার নাই। কিন্তু আপনি যদি চেষ্টা করেন, তাহা হইলে এই কার্য্য আপনার দ্বারায় অনায়াসেই সম্পন্ন হইতে পারে। এই নিমিত্তই আমি আপনার নিকট আগমন করিয়াছি।
দারোগা। এই মোকদ্দমা রুজু করিয়া আমাকে যে ভয়ানক বিপদে পড়িতে হইত, তাহা হইতে যখন আপনি আমাকে রক্ষা করিলেন, তখন আর আমি আপনার এই কার্য্য সম্পন্ন করিব না? আপনি আমার এই স্থানেই অপেক্ষা করুন, আমি আপনার কার্য্যের এখনই আমার সাধ্যমত বন্দোবস্ত করিয়া দিতেছি।
এই বলিয়া দারোগা সাহেব, তাঁহার অধীনস্থ যে সকল লোকজন সেই সময় থানায় উপস্থিত ছিল, সকলকেই ডাকাইলেন, ও ঐ দুই ব্যক্তির চেহারা কিরূপ, তাহা আমার নিকট হইতে উত্তমরূপে জানিয়া লইয়া সেই সমস্ত লোক জনকে চারিদিকে প্রেরণ করিলেন। কেহ পদব্রজে, কেহ শকটারোহণে, কেহ বা অশ্বারোহণে গমন করিল। সকলের উপর আদেশ রহিল যে, যিনি যে দিকে যখন গমন করিবেন সেই দিকের প্রত্যেক বাজারে তাহাদিগের অনুসন্ধান করিবেন, প্রত্যেক দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করিবেন, প্রত্যেক শকটচালকের নিকট হইতে সংবাদ গ্রহণ করিবেন, এবং রাস্তায় যে কোন পথিকের সহিত সাক্ষাৎ হইবে, তাহার নিকট জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিবেন যে, ঐ রূপ দুইটি লোককে তাহারা কোন দিকে গমন করিতে দেখিয়াছে কি না। বলা বাহুল্য, তাহাদিগের নানা স্থানে গমন করিবার নিমিত্ত যে কোন খরচপত্রের প্রয়োজন হইল, তাহা তখন আমিই প্রদান করিলাম। খরচ পত্র লইয়া সকলেই তৎক্ষণাৎ এক এক এক দিকে প্রস্থান করিল।
উহাদিগকে এইরূপে বিদায় করিয়া দিয়া দারোগা সাহেব পরিশেষে আমার নিমিত্ত একটি বাসা স্থির করিয়া দিলেন, ও বলিয়া দিলেন যে, যে পর্য্যন্ত তাঁহার প্রেরিত লোকজন প্রত্যাগমন না করে, সেই পর্য্যন্ত আমাকে সেইস্থানে অবস্থিতি করিতে হইবে। আমিও তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া ঊষার সহিত সেই বাসায় বাস করিতে লাগিলাম এবং মধ্যে মধ্যে আমি ও দারোগা সাহেব সেইস্থান হইতে বহির্গত হইয়া পথিক প্রভৃতি অনেক লোকজনকে ঐ দুইজন লোক সম্বন্ধে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিতে আরম্ভ করিলাম।
যে দিবস আমরা সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হইয়াছিলাম, তাহার পর দিবস সেই থানার অধীনস্থ সমস্ত গ্রামের চৌকিদারগণের হাজিরা দিবার দিন ছিল। প্রাতঃকাল হইতে আরম্ভ করিয়া দিবা ১২টার মধ্যে সমস্ত গ্রামের চৌকিদারগণ সেই থানায় আসিয়া উপস্থিত হইল।
সকল চৌকিদারগণ একস্থানে সমবেত হইলে, দারোগা সাহেব সকলকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন “এইরূপ চেহারার দুই জন লোককে অদ্য দুই তিন দিবস হইল পাওয়া যাইতেছে না, তাহাদিগের নিকট বিস্তর অর্থ ও অলঙ্কার আছে। যে কোন চৌকিদার উহাদিগের ঠিকানা করিয়া আমার নিকট তাহাদিগকে আনিতে পারিবে, বা কোনরূপ সংবাদ আনিয়া দিতে পারিবে, সে পরিশেষে সরকার বাহাদুর হইতে উপযুক্তরূপ পারিতোষিক প্রাপ্ত হইবে, তদ্ব্যতীত এখনই আমাদিগের নিকট হইতে তাহাকে একেবারে ২০০ টাকা প্রদান করিব।
সামান্য বেতনভোগী চৌকিদারগণ একেবারে নগদ দুই শত টাকা এখনই প্রাপ্ত হইবে, তদ্ব্যতীত সরকার হইতেও পরিশেষে উপযুক্তরূপ পারিতোষিক পাইবে, এই আশায় সকলেই ঐ দুই ব্যক্তির অনুসন্ধানের নিমিত্ত তখনই আপনাপন এলাকার দিকে গমন করিতে লাগিল। যে থানার চৌকিদারগণ এই কার্য্যে গমন করিল, সেই থানার এলাকা প্রায় ৪০ মাইল হইবে। ঐ ৪০ মাইলের মধ্যে ঐ দুই ব্যক্তি যদি সেই পৰ্য্যন্ত থাকে, তাহা হইলে চৌকিদারগণ তাহাদিগকে যে অনায়াসেই ধৃত করিতে সমর্থ হইবে, তদ্বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ থাকিল না।
চৌকিদারগণ পারিতোষিকের লোভে বিশেষরূপে উৎসাহিত হইয়া, ঐ দুই ব্যক্তির অনুসন্ধান উপলক্ষে বাহির হইল; কিন্তু আমার মনে আর এক নূতন ভাবনা আসিয়া উপস্থিত হইল। উহাদিগকে ধরিয়া আনিতে পারিলে বা তাহাদিগের নিকট হইতে অপহৃত দ্রব্য সকল বাহির করিতে পারিলে, দুই শত টাকা পারিতোষিক আমরা প্রদান করিব সত্য, কিন্তু যাহাদিগকে ধরিবে, তাহাদিগের নিকট অনেক অর্থ আছে, সুতরাং মনে করিলে, তাহারা ধৃতকারীকে আমাদিগের অঙ্গীকৃত অর্থ অপেক্ষা অনেক অধিক অর্থ অনায়াসেই প্রদান করিতে পারিবে। নীচবংশসম্ভূত দরিদ্র চৌকিদারগণ কি সেই অধিক অর্থের লোভ সম্বরণ করিয়া আমাদিগের অঙ্গীকৃত সামান্য অর্থের লোভে দ্রব্যাদির সহিত কি তাহাদিগকে আমাদিগের সন্নিকটে আনিয়া উপস্থিত করিবে? মনে মনে এইরূপ চিন্তা একবার উদিত হইল বটে, কিন্তু ঐ পথ রুদ্ধ করিবার অপর আর কোনরূপ উপায় প্রাপ্ত না হইয়া, সেই চৌকিদারগণের সততার উপর আমাদিগকে বিশ্বাস করিতে হইল।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
দারোগা আমাদিগের নিমিত্ত যে বাসা স্থির করিয়া দিয়াছিলেন, আমি, ঊষা ও আমার সমভিব্যাহারী সেই এক মাত্র কনষ্টেবলের সহিত সেইস্থানেই অবস্থিতি করিতে লাগিলাম। থানার সন্নিকটে যে বাজারের কথা পাঠকগণ পূর্ব্বে অবগত হইয়াছেন, সেই বাজারের মধ্যে একখানি ঘরে আমাদিগের থাকিবার স্থান নিৰ্দ্ধারিত হইল। যে ঘরে আমরা অবস্থিতি করিতে লাগিলাম, উহা ঐ স্থানের জনৈক দোকানদারের ঘর। যাত্রিগণের সেইস্থানে অবস্থিতি ও রন্ধনাদি করিয়া সেই স্থানে আহারাদি করিবার নিমিত্তই ঐ ঘর প্রস্তুত করা হইয়াছে। উহা যাহার ঘর, ঐ ঘরের সন্নিকটেই তাহার আর একখানি ঘর আছে; উহাতে ঐ গৃহস্বামীর একখানি দোকান আছে। রন্ধনাদি করিবার উপযুক্ত প্রায় সমস্ত দ্রব্যই তিনি ঐ দোকানে রাখিয়া থাকেন। দ্রব্যাদি সকল উৎকৃষ্ট না হইলেও সেই প্রদেশের নিয়ম অনুসারে প্রায় সকল দ্রব্যই সেইস্থানে থাকে, অর্থাৎ হাঁড়ী, কাষ্ঠ, মোটা চাউল, ডাউল ও কোন কোন তরকারি, এবং তৈল লবণ প্রভৃতি সেই স্থানে পাওয়া যায়। তদ্ব্যতীত চিড়া, মুড়ি ও বাতাসাও তাহার দোকানে প্রায় সর্ব্বদাই প্রস্তুত থাকে। ঐ দোকানে আমাদিগের বাসা হইবার পর, আমার সমভিব্যাহারী সেই ব্রাহ্মণ কনষ্টেবলটি উহার দোকান হইতে দ্রব্যাদি সংগ্রহ করিয়া আমাদিগের তিনজনের উপযুক্ত অন্ন ব্যঞ্জন প্রস্তুত করিল। সে তাহার নিজের অন্ন ব্যঞ্জন আলাহিদা রাখিয়া, আমার ও ঊষার আহারীয় একবারেই পৃথক পৃথক স্থানে প্রদান করিল। যে সময় আহারীয় প্রস্তুত করিয়াছিল, সেই সময় সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছিল। সমস্ত দিবস অনশনে থাকায়, ক্ষুধায় জঠরানল প্রজ্বলিত হইতেছিল। আহারীয় প্রদান করিবার পর আমি আহার করিতে বসিলাম, ও ঊষাকেও বসিতে বলিলাম। ঊষাও ক্ষুধায় অস্থির হইয়া পড়িয়াছিল, সুতরাং সেও তাহার স্ত্রী সুলভ লজ্জা পরিত্যাগ করিয়া যে স্থানে আমি আহারার্থ উপবেশন করিলাম, তাহার একটু দূরে সেও সেই সময় আহারার্থ উপবেশন করিল। ঊষার নিকট আমি সম্পূর্ণরূপে অপরিচিত না হইলেও, আমার নিকট আর ঊষার একেবারেই লজ্জাসরম রহিল না, সে আমাকে তাহার নিতান্ত আত্মীয় ও একপরিবার-ভুক্তের ন্যায় জ্ঞান করিয়া চলিতে লাগিল। আমাকে দেখিয়া সে আর কোনরূপ লজ্জাসরম করে না, বা কোনরূপে আর সঙ্কুচিতা হয় না। এইরূপে ঐ স্থানে আমরা ক্রমে দুই দিবস অতিবাহিত করিলাম।
যে সকল লোকজন সেই ব্যক্তিদ্বয়ের অনুসন্ধানের নিমিত্ত প্রেরিত হইয়াছিল, ঐ দুই দিবসের মধ্যে তাহাদিগের মধ্যে অনেকেই উহাদিগের কোনরূপ সন্ধান না পাইয়া ক্ৰমে প্রত্যাগমন করিল। যে সকল চৌকিদার আপনাপন গ্রামাভিমুখে উহাদিগের অনুসন্ধান করিবার মানসে গমন করিয়াছিল, তাহাদিগের মধ্যে অনেকেই সংবাদ প্রদান করিল যে, তাহারা উহাদিগের কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত হয় নাই। এইরূপে আরও এক দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। আমরা বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, শরৎ প্রভৃতির কোনরূপ সন্ধান সেই প্রদেশে আর পাইবার উপায় নাই। তখন আমরা সেই স্থান পরিত্যাগ করিয়া কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিবার নিমিত্ত প্রস্তত হইলাম। যে শকটে আরোহণ করিয়া আমরা সেই স্থানে গমন করিয়াছিলাম, তাহা সেই স্থানেই উপস্থিত ছিল। আমরা ঐ শকটে পুনরায় আরোহণ করিবার উদযোগ করিতেছি, এরূপ সময় দুইজন চৌকিদার ও থানার একজন কনষ্টেবল আমাদিগের সম্মুখে আসিয়া দণ্ডায়মান হইল। উহাদিগকে দেখিয়া অনুমান হইল, উহারা যে কোনরূপ সংবাদ আনয়ন করিয়াছে। আমি কনষ্টেবলকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি কি কোনরূপ সংবাদ প্রাপ্ত হইয়াছে?”
কনষ্টেবল। একটু সংবাদ যেন পাইয়াছি বলিয়া অনুমান হয়, কিন্তু ঠিক বলিতে পারি না।
আমি। কি সংবাদ পাইয়াছ?
কনষ্টেবল। আমাদিগের এই স্থান হইতে পুরীতে গমন করিতে হইলে প্রায় ৬।৭ ক্রোশ ব্যবধানে একটি বাজার আছে।
আমি। তাহা আমি জানি। আমিও ঐ বাজারের মধ্য দিয়া আসিয়াছি।
কনষ্টেবল। সেই বাজারে এক ঘর বেশ্যা থাকে।
আমি। তাহার পর
কনষ্টেবল। আপনি যে প্রকারের দুইজন লোকের অনুসন্ধানের নিমিত্ত আমাকে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন, অনুসন্ধানে জানিতে পারি, ঠিক সেই প্রকারের দুইজন লোক ঐ বেশ্যার ঘরে একরাত্রি ও এক দিবস অতিবাহিত করে। তাহাদিগের কাপড় প্রভৃতি অনেক দ্রব্যাদি ছিল। সেইস্থানে অবস্থিতি করিবার কালীন পুরীর দিক হইতে একখানি খালি ঘোড়ার গাড়ি আসিতে দেখিয়া তাহারা ঐ গাড়ি ভাড়া করে, ও উহাতে আরোহণ করিয়া কলিকাতা যাইবার পথে গমন করিয়াছে।
আমি। এ রাস্তায় ত ঘোড়ার গাড়ি পাওয়া যায় না, এরূপ অবস্থায় উহারা ঘোড়ার গাড়ি পাইল কি প্রকারে?
কনষ্টেবল। এই রাস্তায় প্রায়ই ঘোড়ার গাড়ি আসে না সত্য; কিন্তু সময় সময় দুই একখানি আসিয়াও থাকে। কলিকাতা প্রভৃতি স্থান হইতে যদি কোন ধনী লোক এই প্রদেশে আগমন করেন, তাঁহারা প্রায়ই অধিক মূল্যে গাড়ি ভাড়া করিয়া এদিকে আসিয়া থাকেন, ও কখন কখন পুনরায় ঐ গাড়িতেই প্রত্যাবর্তন করেন, আর যদি প্রত্যাগমন করিবার প্রয়োজন সেই সময় না হয়, তাহা হইলে তাঁহারা ঐ গাড়ি ছাড়িয়াও দিয়া থাকেন; সুতরাং ঐ সকল গাড়ি কলিকাতা অভিমুখে প্রত্যাগমন করিবার সময়— কখন কখন খালিও থাকে। বোধ হয়, ঐ রূপ ভাবে খালি গাড়ি পুরীর দিক হইতে প্রত্যাগমন করিতেছিল, উহারা হঠাৎ ঐ গাড়ি পাইয়া তাহা ভাড়া করিয়া উহাতে আরোহণ পূর্ব্বক প্রস্থান করিয়াছে।
আমি। তাহা হইলে ত ভাহাদিগকে আর সহজে পাইবার কোনরূপ উপায় দেখিতেছি না। যাহারা দুই দিবস হইল, ঘোড়ার গাড়িতে আরোহণ করিয়া প্রস্থান করিয়াছে, দুই দিবস পরে পদব্রজে বা শকটারোহণে তাহাদিগের অনুসরণ করিলে তাহাদিগকে আর কোনরূপে পাইবার সম্ভানা নাই। তবে দ্রুতগামী অশ্বে আরোহণ করিয়া গমন করিতে পারিলে বোধহয়, তাহাদিগের পাইবার কতকটা সম্ভাবনা থাকে।
যে সময় ঐ কনষ্টেবলের সহিত আমার কথা হইতেছিল, সেই সময় দারোগাও সেইস্থানে উপস্থিত ছিলেন। আমার কথা শুনিয়া তিনি কহিলেন, “এই স্থানে চারি পাঁচ ক্রোশের মধ্যে কাহার অশ্ব নাই, থাকিবার মধ্যে কেবল একটি আমার আছে। তাহাতে আরোহণ করিয়া একজন কর্মচারী উহাদিগের অনুসন্ধানের নিমিত্ত প্রস্থান করিয়াছে, এখন পর্য্যন্ত প্রত্যাগমন করে নাই। যদি ইতিমধ্যে আমার সেই ঘোড়া আসিয়া উপস্থিত হয়, তাহা হইলে, আমি কোন না কোন ব্যক্তিকে ঐ গাড়ির অনুসরণ করিতে প্রেরণ করিব, অথবা নিজেই গমন করিব। আপনি যে রাস্তা দিয়া গমন করিবেন, অশ্বারোহীও সেই রাস্তা দিয়া গমন করিবে; সুতরাং আপনি তাহাকে রাস্তাতেই দেখিতে পাইবেন।”
দারোগার প্রস্তাবে আমি সম্মত হইয়া আমি আমার সেই শকটে আরোহণ করিলাম। বিনা বাক্যব্যয়ে ঊষা আপনি গিয়া আমার অগ্রেই ঐ গাড়ির ভিতর প্রবেশ করিল। গাড়ি পুরীর রাস্তা অবলম্বন করিয়া কলিকাতা অভিমুখে গমন করিতে লাগিল। আমার সঙ্গে যে কনষ্টেবল ছিল, সে গাড়ির পশ্চাৎ পশ্চাৎ হাঁটিয়া যাইতে লাগিল। ঐ রাস্তা’ দিয়া গমন করিবার কালীন আমি বিশেষরূপ লক্ষ্য রাখিলাম যে, আমাদিগের পশ্চাদ্দিক হইতে কোন অশ্বারোহী আগমন করিতেছে কি না। কিন্তু অশ্বারোহণে কোন ব্যক্তিই আর আগমন করিল না।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
আমরা পুরীর রাস্তা অবলম্বন করিয়া ক্রমে কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। স্ত্রীলোক সঙ্গে থাকিলে রাস্তায় যেরূপ নানা প্রকারের অসুবিধা ঘটিবার সম্ভাবনা, আমি যে সেই সকল অসুবিধা হইতে একেবারে নিষ্কৃতি পাইয়াছিলাম, তাহা নহে। যে কয় দিবস আমাকে রাস্তায় অতিবাহিত করিতে হয়, সেই কয়েক দিবস যে কতরূপ অসুবিধা আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল, তাহার সবিশেষ বর্ণন করিতে হইলে আমাকে এইরূপ অপর একখানি স্বতন্ত্র পুস্তক লিখিতে হয়। যাহা হউক, সেই সকল অসুবিধা ক্রমে অতিক্রম করিয়া আমি কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। রাস্তায় যে পর্য্যন্ত ঘোড়ার গাড়ি সংগ্রহ করিতে পারিলাম না, সেই পর্য্যন্ত শকটারোহণেই গমন করিলাম। যে স্থান হইতে ঘোড়ার গাড়ি পাইলাম, সেইস্থান হইতে উহা ভাড়া করিয়া কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। আসিবার কালীন রাস্তায় ঊষার পিতার প্রেরিত কোন লোকজনের সহিত সাক্ষাৎ হইল না।
কলিকাতায় উপস্থিত হইয়া আমি ঊষাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এখন তুমি কি করিবে ঊষা? একাই তুমি তোমার পিতার আলয়ে গমন করিবে কি?”
ঊষা। আমার পিতাকে আপনি যে পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহা কি তিনি পাইয়াছেন বলিয়া অনুমান হয়?
আমি। না পাইবার আমি ত কোন কারণ দেখিতেছি না। বোধ হয় নিশ্চয়ই পাইয়া থাকিবেন।
ঊষা। আপনি আমা সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছেন, তাহা কি তিনি তবে বিশ্বাস করেন নাই?
আমি। তুমি কিরূপে জানিলে যে, তিনি তোমার কথা বিশ্বাস করেন নাই?
ঊষা। তাহা হইলে কি তিনি আমার নিমিত্ত একজন লোকও পাঠাইতেন না?
আমি। লোক পাঠাইলেন কি না, তাহাই বা তুমি জানিলে কি প্রকারে?
ঊষা। তাহা হইলে সেই লোককে আমরা রাস্তায় নিশ্চয়ই দেখিতে পাইতাম।
আমি। নিশ্চয়ই যে দেখিতে পাইতাম, তাহা আমি বলিতে পারি না। কারণ সকল সময়েই যে আমরা রাস্তার উপর অবস্থিতি করিয়াছি, তাহা নহে; রাত্রিকালে প্রায়ই ত আমরা কোন না কোন দোকানদারের ঘরের ভিতর শয়ন করিয়া রাত্রিযাপন করিয়াছি। সেই সময় তোমার পিতার প্রেরিত লোক আমাদিগকে না দেখিতে পাইয়া অনায়াসেই অতিক্রম করিয়া চলিয়া যাইতে পারে। এরূপ অবস্থায় আমি ঠিক বলিতে পারি না যে, তোমার নিমিত্ত তোমার পিতা কোন লোককে পাঠাইয়া দিয়াছেন কি না।
ঊষা। তবে কি আপনার ইচ্ছা যে আমি একেবারে পিতারই বাড়ীতে গমন করি?
আমি। আমার বিবেচনায় তাহাই কৰ্ত্তব্য বলিয়া বোধ হয়।
ঊষা। আপনার বিবেচনায় যাহা কৰ্ত্তব্য, তাহা আমাকে করিতেই হইবে; কিন্তু মনে করিয়া দেখুন, যদি পিতা আমার কথা বিশ্বাস না করিয়া আমার নিমিত্ত যদি কোন লোক পাঠাইয়া না থাকেন ও মনে মনে স্থির করিয়া থাকেন, আমি কুলটা; তাহা হইলে বলুন দেখি, সেই সময় যে সময় তিনি কহিবেন, ‘আমি তোর মুখ দেখিতে চাহি না, তুই আমার কুলে কালী দিয়াছিস, তুই আমার সম্মুখ হইতে দূর হ’—তখন বলুন দেখি, আমার কি অবস্থা হইবে? সেই সময় আমি কি করিব? সেই সময় আত্মহত্যা ভিন্ন আমার আর কোনরূপ উপায় থাকিবে না; কিন্তু আত্মহত্যা করিবার উপযোগী কোন দ্রব্য সেই সময় প্ৰাপ্ত হইব?
আমি। তুমি যে কুলটা, ও অপরের সহিত কুল পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছ, এ কথা তোমার পিতা কিরূপে জানিতে পারিবেন? তুমি আমার নিকট সমস্ত কথা বলিয়াছ বলিয়াই আমি তোমার চরিত্রের বিষয় অবগত হইতে পারিয়াছি; কিন্তু তোমার পিতা তাহা কি প্রকারে জানিতে পারিবেন?
ঊষা। শরৎ আমাকে গৃহত্যাগ করাইয়াছে বা আমি শরতের সহিত গৃহের বাহির হইয়া আসিয়াছি; এ কথা কি রাষ্ট্র হইতে এখনও বাকী আছে, ইহা কি আপনি ভাবিতেছেন? যে সময় পিতা মাতা জানিতে পারিয়াছেন, আমি গৃহ পরিত্যাগ করিয়া কোন স্থানে চলিয়া গিয়াছি, তাহার পর নিশ্চয়ই প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে যে, শরতও তাহার গৃহ পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে। এরূপ অবস্থায় সকলে সহজে কি অনুমান করিতে পারে? কারণ আমাদিগের বাড়ীতে শরতের যখন যাতায়াত ছিল, তখন আমরা উভয়েই এক সময়ে নিরুদ্দেশ হইলে সকলকেই ইহা অনুমান করিতেই হইবে যে, আমি শরতের সহিত গৃহত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছি। আমি এরূপ অবস্থায় কখনই পিতার নিকট গমন করিব না, আপনি আমাকে স্থান প্রদান করুন। আমি যতদিন বাঁচিব, আপনার দাস্যবৃত্তি করিয়া জীবনধারণ করিব।
আমি। আমি তোমার মনের ভাব বেশ বুঝিতে পারিতেছি। যদি তোমার পিতা তোমাকে গ্রহণ না করেন, ও শরৎ যদি তোমাকে গ্রহণ করিতে চাহে, তাহা হইলে তুমি তাহার নিকট গমন করিতে প্রস্তুত আছ কি?
ঊষা। না মহাশয়, আমি আপনার আশ্রয় পরিত্যাগ করিয়া অপর কাহার আশ্রয় আর গ্রহণ করিব না। আপনি শরতের কথা বলিতেছেন কিন্তু একবার ভাবুন দেখি, যাহাকে আমি প্রাণের সহিত ভালবাসিয়া, যাহার নিমিত্ত এই মহাপাপ অর্জ্জন করিয়া, যাহার নিমিত্ত কুলের বাহির হইয়া পড়িয়াছি – সে পরিশেষে আমার সহিত কিরূপ ব্যবহার করিয়া আমার সর্ব্বনাশ সাধন করিল, তাহা আপনিই কেন একবার ভাবিয়া দেখুন না। তাহার নাম আপনি আর করিবেন না। আপনি যদি আমাকে আত্মহত্যা করিতে কহেন, তাহাতেও আমি প্রস্তুত আছি, কিন্তু উহার আশ্রয় গ্রহণ করা দূরে থাকুক, উহার নাম পর্য্যন্তও আমি কখন মুখে আনিব না। আপনি আমাকে আশ্রয় প্রদান করুন আর না করুন, “আমি কিন্তু আপনাকে কোনরূপেই পরিত্যাগ করিব না। যত দিবস বাঁচিব, আপনার আজ্ঞাধীন হইয়া আপনার নিকট অবস্থিতি করিব।”
আমি। আমি তোমার মনের ভাব উত্তমরূপে বুঝিতে পারিয়াছি। আমি প্রথমতঃ তোমাকে আমার থাকিবার স্থানে লইয়া যাইব না, তোমার পিতার বাড়ীতেই লইয়া যাইব। কিন্তু তাঁহার সম্মুখে তোমাকে একেবারে লইয়া যাইব না। তুমি গাড়িতে দরজা বন্ধ করিয়া বসিয়া থাকিবে, আর গাড়ি তোমাদিগের বাড়ী হইতে দূরে রাখিয়া দিয়া আমি একাকী গিয়া তোমার পিতার সহিত সাক্ষাৎ করিব। তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইলে আমি অনায়াসেই জানিতে পারিব যে, তাঁহার মনের ভাব কিরূপ। তখন যেরূপ বিবেচনা হয়, সেইরূপ করিব, অর্থাৎ যদি বুঝিতে পারি যে, তোমার কথা তিনি সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করিয়াছেন ও তোমার চরিত্রের উপর তাঁহার কোনরূপ সন্দেহ হয় নাই, তাহা হইলে তোমাকে লইয়া গিয়া তোমার পিতার হস্তে অর্পণ করিব। নতুবা আমি আমার আশ্রয়েই তোমাকে স্থান প্রদান কবিব।
ঊষাকে এই বলিয়া তাহার পিতার বাড়ী গমন করিলাম। দূরে গাড়ির মধ্যে ঊষাকে রাখিয়া আমি একাকী সেই বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। ঊষার পিতা সেই সময় তাঁহার বৈঠকখানায় আরও কয়েকজন লোকের সহিত উপবিষ্ট ছিলেন। আমি সেইস্থানে গমন করিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। দেখিলাম, আমাকে দেখিয়া তিনি কতকটা চিনিতে পারিলেন; কিন্তু আমি যে কে, ও আমার কি নাম, তাহা ঠিক অনুমান করিয়া আনিতে পারিলেন না। আমি সেইস্থানে গমন করিলে তিনি আমার দিকে লক্ষ্য করিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন “আপনি কি চান?”
আমি। আমি আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাই।
ঊষার পিতা। কি প্রয়োজন বলুন।
আমি। আমি যে প্রয়োজনের নিমিত্ত আপনার নিকট আগমন করিয়াছি, তাহা গোপনীয়; সুতরাং আমি একটু গোপনে আপনার সহিত কথা কহিতে ইচ্ছা করি।
আমার কথা শুনিয়া তিনি সেইস্থান হইতে গাত্রোত্থান করিয়া বারান্দায় আসিলেন ও আমাকে কহিলেন, “আপনি কি বলিতে চাহেন?”
আমি। আমি আপনাকে একখানি পত্র লিখিয়াছিলাম, তাহা আপনি পাইয়াছেন কি?
ঊষার পিতা। আপনি আমাকে পত্র লিখিয়াছিলেন? কোথা হইতে ও কি নিমিত্ত আমাকে পত্র লিখিয়াছিলেন?
আমি। পুরীর রাস্তা হইতে আপনাকে আমি এক পত্র লিখি।
ঊষার পিতা। যাহাতে ঊষার সংবাদ লেখা ছিল?
আমি। হাঁ।
ঊষার পিতা। তাহা পাইয়াছি, ও ঊষাকে আনিবার নিমিত্ত আমি আমার একটি পুত্রকে তথায় পাঠাইয়া দিয়াছি। কেন, তাহার সহিত আপনার কি সাক্ষাৎ হয় নাই?
আমি। না মহাশয়।
ঊষার পিতা। তাহা হইলে ঊষা এখন কোথায়?
আমি। আমি তাহাকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি।
ঊষার পিতা। আপনি লিখিয়াছিলেন তাহার যথাসর্ব্বস্ব অপহৃত হইয়াছে। তাহার কি কি দ্রব্য চোরে অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে?
আমি। তাহার পরিধানে যে সকল অলঙ্কার ছিল, তাহার সমস্তই লইয়া গিয়াছে, তদ্ব্যতীত তাহার সহিত যে সকল নগদ টাকা ছিল, তাহাও অপহরণ করিয়াছে।
ঊষার পিতা। তাহার অঙ্গ হইতে দস্যুগণ কিরূপে অলঙ্কারগুলি খুলিয়া লইল?
আমি। ঊষার আহারীয় দ্রব্যের সহিত উহারা বিষ মিশ্রিত করিয়া দিয়াছিল। ঐ আহারীয়, আহার করিবার পর ঊষা ক্রমে হতজ্ঞান হইয়া পড়ে, তখন তাহার অঙ্গ হইতে অলঙ্কারগুলি উহারা অনায়াসেই খুলিয়া লইতে সমর্থ হয়।
ঊষার পিতা। যখন বিষপ্রয়োগ করিয়াছিল, তখন ঊষা মরিয়া যাইলেও ত যাইতে পারিত?
আমি। মরিয়া যাইবার ত আর কিছুমাত্র বাকী ছিল না, কেবল ঈশ্বর তাহাকে বাঁচাইয়াছেন। দৈবগতিকে আমি সময়মত যদি সেইস্থানে উপস্থিত না হইতাম, তাহা হইলে ঊষা নিশ্চয়ই মৃত্যুমুখে পতিতা হইত।
ঊষার পিতা। আপনি আমাকে লিখিয়াছিলেন যে, কলিকাতা হইতে কোন দুই ব্যক্তি ঊষার অনুগমন করিয়াছিল, তাহারাই পরিশেষে সুযোগ পাইয়া ঊষার অলঙ্কার প্রভৃতি চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে।
আমি। অনুসন্ধান করিয়া আমি ঐরূপ অবগত হইতে পারিয়াছিলাম।
ঊষার পিতা। তাহারা কাহারা, তাহার কিছু অবগত হইতে পারিয়াছেন কি?
আমি। তাহার এখন কিছুমাত্র অবগত হইতে পারি নাই, কারণ সেই সম্বন্ধে আমি এখন পর্যন্ত কোনরূপ অনুসন্ধান করিতে সমর্থ হই নাই, কেবল এই মাত্র আমি কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিতেছি।
ঊষার পিতা। এ সম্বন্ধে একটু সংবাদ আমি প্রাপ্ত হইয়াছি। আপনি ইচ্ছা করেন ত তাহা আমি আপনাকে বলিতে পারি।
আমি। কি সংবাদ প্রাপ্ত হইয়াছেন?
ঊষার পিতা। আমাদিগের বাড়ীর নিকটেই একটি বাসাড়িয়া বাড়ী আছে।
আমি। তাহার পর?
ঊষার পিতা। যে রাত্রি ঊষা আমার বাড়ী হইতে প্রস্থান করিয়াছিল, সেই রাত্রি হইতে ঐ বাসার দুইটি লোকও কোথায় হঠাৎ চলিয়া গিয়াছে।
আমি। তাহারা যে কোথায় গিয়াছে, তাহা কেহ বলিতে পারে না?
ঊষার পিতা। তাহা কেহই কিছু বলিতে পারে না, কিন্তু সেই সময় অনেকে আমার সহিত শত্রুতা-সাধন উদ্দেশ্যে এই কথা রাষ্ট্র করিয়াছিল যে, উহাদিগের সহিত ঊষা কুলের বাহির হইয়া গিয়াছে।
আমি। উহাদিগের নাম কি বলিতে পারেন?
ঊষার পিতা। এক জনের নাম শুনিয়াছি শরৎ, অপর আর এক জনের নাম বলিতে পারি না।
আমি। তাহা হইলে এখন বোধ হইতেছে, ঊষা এই স্থান হইতে গমন করিবার সময় তাহারাই উহার অনুসরণ করিয়াছিল ও সুযোগ পাইয়া তাহারাই ঊষার সর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া চলিয়া আসিয়া থাকিবে। করণ আমি একটু অনুসন্ধান করিয়া সেইস্থানে অবগত হইতে পরিয়াছিলাম যে, দুই ব্যক্তি কলিকাতা হইতে যাত্রীগণের অনুসরণ করিয়া আসিয়া পরিশেষে সকলের যথাসর্বস্ব লইয়া প্রস্থান করিয়াছে। সে যাহা হউক, আপনি কিছু অবগত হইতে পারিয়াছেন কি শরৎ ও তাহার সঙ্গী পুনরায় কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিয়াছে কি না?
ঊষার পিতা। সে সংবাদ পাই নাই, ও পাইবার কোনরূপ চেষ্টাও করি নাই।
আমি। একবার চেষ্টা করিয়া দেখা কর্তব্য যে, এখন উহারা কলিকাতায় আসিয়াছে কিনা, কারণ এই সময় যদি তাহাদিগকে ধরিতে পারি, তাহা হইলে যে সকল দ্রব্য তাহারা অপহরণ করিয়া আনিয়াছে, সেই সকল দ্রব্য এখন তাহাদিগের নিকট হইতে অনায়াসেই পাওয়া যাইতে পারে।
ঊষার পিতা। ঊষা কি কি দ্রব্য লইয়া গিয়াছিল ও তাহার কি কি দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে, তাহার কিছুমাত্র আমি অবগত নহি। ঊষা এখন কোথায়, সে কি বাড়ীর ভিতর গমন করিয়াছে?
আমি। না, তিনি এখনও আপনার বাড়ীতে আসেন নাই, আমি তাহাকে আমার গাড়ির ভিতর রাখিয়া আপনাকে অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিবার মানসে এখানে আসিয়াছি। তিনি গাড়ির ভিতর এখন পৰ্য্যন্ত বসিয়া আছেন। অনুমতি হয় ত আমি তাহাকে আপনার নিকট আনয়ন করি।
ঊষার পিতা। আপনি তাহাকে আনুন, বা গাড়ি যেখানে আছে তাহা বলিয়া দিন, আমি একজন পরিচারিকাকে পাঠাইয়া দিতেছি, সে আপনার গাড়ি সহিত উহাকে এখনই এখানে লইয়া আসিবে।
আমি। আমি নিজেই গিয়া তাহাকে এখানে আনয়ন করিতেছি।
এই বলিয়া আমি সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
যে গাড়ির ভিতর আমি ঊষাকে রাখিয়া আসিয়াছিলাম, তাহার নিকট আমি গমন করিলে ঊষা আমাকে দেখিয়াই জিজ্ঞাসা করিল “সংবাদ কি?”
আমি। সংবাদ ভাল।
ঊষা। কিরূপ ভাল সংবাদ?
আমি। আমি পত্রে যাহা কিছু লিখিয়াছিলাম, তাহা তোমার পিতা বিশ্বাস করিয়াছেন, ও তোমাকে আনিবার নিমিত্ত তোমার ভ্রাতাকে কটকের রাস্তায় প্রেরণ করিয়াছেন।
ঊষা। আমার চরিত্রের উপর কি তাঁহার কিছুমাত্র সন্দেহ হইয়াছিল না?
আমি। হইয়াছিল। প্রথমে সকলেই ভাবিয়াছিল, তুমি কুলে জলাঞ্জলি দিয়া শরতের সহিত বাহির হইয়া গিয়াছ, কিন্তু আমার পত্র পাইবার পর তাঁহাদিগের সেই সন্দেহ মিটিয়া গিয়াছে। এখন সকলেই জানিতে পারিয়াছেন, শরৎ চোর, সেই তোমাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিয়া তোমাদিগের যথাসর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া লইয়া আসিয়াছে।
ঊষা। তাহা হইলে এখন আমাকে কি করিতে হইবে?
আমি। এখন তুমি আমার সঙ্গে আইস, আমি তোমাকে তোমার পিতার হস্তে অর্পণ করিয়া আমার কর্তব্যকর্ম্ম হইতে নিষ্কৃতি লাভ করি।
ঊষা। তাহা হইলে এখন আমাকে গৃহে যাইয়া পুনরায় কয়েদীর ন্যায় কি দিন অতিবাহিত করিতে হইবে?
আমি। তোমার এ কিরূপ কথা ঊষা? আমি ত তোমার কথার কোনরূপ অর্থ বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। তবে কি তোমার ইচ্ছা নহে যে, তুমি পুনরায় তোমার পিতার গৃহে গমন কর?
ঊষা। ইচ্ছা সম্পূর্ণ আছে, কিন্তু আপনার সহিত ত আমার সাক্ষাৎ হইবার কোন উপায় রহিবে না। যদি আমি বাড়ীতে কোনরূপ যন্ত্রণা পাই, যদি কেহ আমার চরিত্রের উপর সন্দেহ করিয়া আমাকে কিছু বলে বা কানাঘুসা করিতে আরম্ভ করে, তাহা হইলে আমি ত তাহা কোনরূপেই সহ্য করিতে পারিব না, আমাকে নিশ্চয়ই তখন পিতার বাড়ী পরিত্যাগ করিতে হইবে; কিন্তু আপনার থাকিবার স্থান যদি আমি দেখিতে পাইতাম, তাহা হইলে ঐরূপ অবস্থায় গৃহ পরিত্যাগ করিয়া আমি আর কোন স্থানে গমন করিতাম না, আপনার নিকট গিয়াই উপস্থিত হইতাম। কারণ আপনার সহিত এই কয়েক দিবস একত্র সহবাসে আমি আপনাকে উত্তমরূপে অবগত হইতে পারিয়াছি ও আমার সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস জন্মিয়াছে যে, আমি আপনাকে সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করিতে পারি।
আমি। তোমার এতদূর চিন্তিত হইবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই, তোমাকে কিছুই করিতে হইবে না, তোমাকে আর গৃহ পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইতে হইবে না, তুমি তোমার পিতা মাতার নিকট যথেষ্ট যত্ন পাইবে। তবে নিতান্তই যদি আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবার কখন প্রয়োজন হইয়া পড়ে তাহা হইলে তুমি আমাকে পত্র লিখিও, আমি এখানে আসিয়া তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিব। আমার ঠিকানা ত তোমায় বলিয়া দিয়াছি। তদ্ব্যতীত কোন কাৰ্য্যোপলক্ষে আমি যখন এই দিকে আসিব, তখনও তোমাদিগের বাড়ীতে আসিয়া তোমার সংবাদ গ্রহণ করিতে ভুলিব না।
ঊষা। আপনি আমার সংবাদ গ্রহণ করিবেন সত্য, কিন্তু আমাদিগের বাড়ীতে সকলের সম্মুখে প্রাণ খুলিয়া সকল কথা আমি বলিতে পারিব না, বা মনের ভাবও আমি প্রকাশ করিতে পারিব না। আপনার কথামত যদি আমাকে নিতান্তই আমার পিতার গৃহে বাস করিতে হয়, তাহা হইলে আপনি আমাকে আপনার থাকিবার স্থান দেখাইয়া দিন, “আবশ্যক হইলে যে রূপে পারি, কোন উপায় অবলম্বন করিয়া আমি আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব।
আমি। সে সময় এখন আর নাই। এ কথা যদি তুমি আমাকে পূর্ব্বে বলিতে, তাহা হইলে আমি প্রথমেই তোমাকে আমার থাকিবার স্থানে লইয়া যাইতাম ও পরিশেষে তোমাকে এখানে লইয়া আসিতাম। যাহা পূর্ব্বে হয় নাই, তাহার আর এখন কোন উপায় নাই। তবে যে পর্য্যন্ত তোমার গহনাগুলি পুনরায় প্রাপ্ত হইয়া না যায় বা শরৎ যে পর্য্যন্ত ধৃত না হয়, সেই পৰ্য্যন্ত আমি প্রায়ই তোমাদিগের বাড়ীতে আসিব ও কোনরূপ উপায় অবলম্বনে তোমার পিতাকে বলিয়া এক দিবস আমি তোমাকে আমার থাকিবার স্থান দেখাইয়া দিব। তাহার পর তোমার যখন ইচ্ছা হইবে, তখনই তুমি সেইস্থানে গমন করিতে পারিবে।
ঊষা। দেখুন মহাশয়, আমি আপনার কথায় বিশ্বাস করিয়া আপনার প্রস্তাবে সম্মত হইতেছি ও আমার পিতার আলয়ে গমন করিতেছি, কিন্তু আপনি আপনার প্রতিজ্ঞা ভুলিয়া যাইবেন না। যত শীঘ্র পারেন, আমাকে লইয়া গিয়া আপনার থাকিবার স্থান আমাকে দেখাইয়া দিবেন। নতুবা এখনই আমাকে বলুন, তাহা হইলে আমি আপনার স্থান না দেখিয়া কখনই আমি আমার পিতার গৃহে পদার্পণ করিব না।
আমি। তুমি নিশ্চিন্ত থাক, যেরূপ উপায়ে হউক, আমি তোমাকে এক দিবস সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইবই যাইব। আমার শেষ কথা শুনিয়া ঊষা আমার প্রস্তাবে সম্মত হইল ও আমার সহিত তাহার পিতার গৃহে গমন করিল। আমাদিগের গাড়ি ঊষার পিতার বাড়ীর দরজায় গিয়া উপনীত হইল। দেখিলাম ঊষার মাতা ও বাড়ীর অপরাপর স্ত্রীলোকগণ ঊষার প্রত্যাগমনে অন্দর বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া সদর বাড়ীর দরজায় আসিয়া দাঁড়াইয়া আছে। গাড়ি হইতে নামিবামাত্র ঊষার মাতা আসিয়া তাহার হস্ত ধারণ করিল ও তাহার মুখ চুম্বন করিয়া তাহাকে তাহাদিগের বাড়ীর ভিতর লইয়া গেল। আমি পুনরায় ঊষার পিতার নিকট গিয়া উপবেশন করিলাম। তাঁহার নিকট অপরাপর দুই চারিটি কথা বার্তার পর, আমি তাঁহাকে কহিলাম,—“মহাশয়! অনেক দিবস পৰ্য্যন্ত আমাকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়ে বেড়াইতে হইয়াছে, সুতরাং পথশ্রমজনিত ক্লেশ আমি বিস্তর অনুভব করিয়াছি, এখন যদি অনুমতি করেন, তাহা হইলে আমি এখন আমার বাসায় প্রস্থান করি, পরে সময় মত আসিয়া আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব।”
ঊষার পিতা। আপনি যেরূপ বিবেচনা করেন; কিন্তু ঊষার গহনা পত্রগুলি পাইবার কি হইবে?
আমি। আপনি প্রথমত : সমস্ত অবস্থা ঊষার নিকট শ্রবণ করিয়া একটু স্থিরভাবে উত্তমরূপে বিবেচনা করুন, এ দিকে একটু অনুসন্ধান করিয়াও দেখুন যে, শরৎ প্রত্যাগমন করিয়াছে কি না। আমিও ক্লান্তি দূর করিয়া ও এই সমস্ত অবস্থা আমার উপরিতন কর্ম্মচারিগণের গোচর করিয়া, পুনরায় আপনার নিকট আগমন করিব; এবং যেরূপ সদ্যুক্তি হয়, সেইরূপ উপায় যাহাতে অবলম্বন করিতে পারি, তাহার চেষ্টাও করিব।
ঊষার পিতা। যাহা আপনি ভাল বিবেচনা করেন, তাহাই করুন। আমিও সন্ধান লইয়া দেখি যে, শরৎ প্রত্যাগমন করিয়াছে কি না। আপনি পুনরায় কখন আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন?
আমি। আমি আজ আর আপনার নিকট আসিব না, কল্য সন্ধ্যার পর আসিয়া আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব, ও যেরূপ কৰ্ত্তব্য, তাহা করিতে চেষ্টা করিব।
ঊষার পিতা। দেখিবেন যেন ভুলিবেন না, আপনি একটু চেষ্টা না করিলে আমার অনেকগুলি টাকা নষ্ট হইবে।
আমি। না, আমি ভুলিব না, কল্য সন্ধ্যার পর আপনার সহিত আসিয়া সাক্ষাৎ করিব।
এই বলিয়া আমি সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম।
নবম পরিচ্ছেদ
আমি ঊষার পিতার নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিয়া আপন বাসায় প্রত্যাগমন করিলাম ও সময় মত আমার ঊর্দ্ধতন কর্মচারীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া ঊষা-ঘটিত কতক কথা বলিলাম, অর্থাৎ আমি কটকের রাস্তায় তাহাকে কিরূপে প্রাপ্ত হই ও তাহার দ্রব্যাদি কিরূপে অপহৃত হইয়াছে প্রভৃতি যে সমস্ত কথা ঊষার পিতাকে বলিয়াছিলাম, তাহাই তাঁহাকে কহিলাম। আমার কথা শুনিয়া আমার ঊর্দ্ধতন কৰ্ম্মচারী কহিলেন, “যদি এরূপে ঊষার দ্রব্যাদি অপহৃত হইয়া থাকে, তাহা হইলে সেই স্থানের স্থানীয় পুলিসের নিকট এই মোকদ্দমা রুজু করিয়া দিলে না কেন? তাহারা এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতেন, আর যদি নিতান্ত প্রয়োজন হইত, তাহা হইলে তুমিও না হয় তাহাদিগের সাহায্যে করিতে।”
আমি। আমি থানায় গিয়াছিলাম, ও সে কথা সেই থানার কর্ম্মচারীকেও কহিয়াছিলাম, কিন্তু ঊষা ঐরূপ অবস্থায় সেইস্থানে চুরির নালিস করিতে প্রস্তুত হয় না বলিয়াই তাহাকে আমি কলিকাতায় আনয়ন করিয়াছি।
কৰ্ম্মচারী। সে এখন কোথায়?
আমি। তাহার পিতার বাড়ীতে আমি তাহাকে রাখিয়া আসিয়াছি।
কর্ম্মচারী। এখন কি সে নালিস করিতে প্রস্তুত?
আমি। তাহার সহিত আর একবার সাক্ষাৎ না করিয়া আমি এই কথার কোনরূপ উত্তর প্রদান করিতে পারি না, কারণ সে তাহার পিতা মাতার সহিত সাক্ষাৎ হইবার পর কি স্থির করিয়াছে, তাহা এখন আমি বলিতে পারি না।
কৰ্ম্মচারী। যদি সে নালিস করে, তাহা হইলে এই মোকদ্দমার কিনারা হইবার সম্ভাবনা নিতান্তই অল্প।
আমি। তাহা এখন বলিতে পারি না, কারণ যাহাদিগের দ্বারা এই কাৰ্য্য হইয়াছে, তাহা আমি জানিতে পারিয়াছি।
কৰ্ম্মচারী। কে এই কার্য্য করিয়াছে?
আমি। শরৎ নামক এক ব্যক্তি তাহার জনৈক বন্ধুর সাহায্যে এই কার্য্য সম্পন্ন করিয়াছে।
কর্ম্মচারী। তুমি ইহা কিরূপে জানিতে পারিলে?
আমি। আসিতে আসিতে ঐ সম্বন্ধে আমি একটু অনুসন্ধান করিয়াছিলাম, তাহাতেই জানিতে পারিয়াছি যে, ঊষা প্রভৃতি স্ত্রীলোকগণ যখন তীর্থ করিবার নিমিত্ত বাড়ী হইতে বহির্গত হয়, সেই সময় তাহারা কলিকাতা হইতেই উহাদিগের সঙ্গ লয় ও রাস্তার মধ্যে যেমন সুযোগ পায়, অমনি তাহা দিগের যথাসর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া লইয়া প্রস্থান করে। শরৎ ও তাহার বন্ধু এই কলিকাতার কোন স্থানে বাস করিত, তাহা আমি জানিতে পারিয়াছি। আরও জানিতে পারিয়াছি যে, অপহৃত দ্রব্যাদির সহিত একখানি ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করিয়া তাহারা কলিকাতা অভিমুখে অগমন করিয়াছে। তাহারা যে রাস্তা অবলম্বন করিয়া আসিয়াছে, আমরাও সেই রাস্তা অবলম্বন করিয়া আসিয়াছি; সুতরাং আসিবার কালীন একটু একটু অনুসন্ধান করিতে করিতে আসিতে হইয়াছে। তাহারা যে গাড়িতে আসিয়াছে, সেই গাড়ি বরাবর আসিয়া কলিকাতায় প্রবেশ করিয়াছে, এই সংবাদও আমি অবগত হইতে পারিয়াছি।
কৰ্ম্মচারী। যদি তুমি বিবেচনা কর যে, ঐ মোকদ্দমার কিনারা হইবার সম্ভাবনা আছে, তাহা হইলে উহা গ্রহণ করিয়া অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলে হয় না?
আমি। আমি, ঊষা ও তাহার পিতার সহিত আর একবার সাক্ষাৎ করিয়া দেখি যে, তাহারা এখন কি বলে, এবং শরতেরও অনুসন্ধান করিয়া দেখি যে, সে এখন কোথায় ও অপহৃত দ্রব্যাদি সে কোথায় রাখিয়াছে। এই সকল অবস্থা প্রথমতঃ উত্তমরূপে দেখিয়া পরিশেষে বিবেচনা করিয়া দেখিব যে, যদি উহারা নালিস করে, তাহা হইলে ঐ মোকদ্দমা আমরা রাখিয়া তাহার অনুসন্ধান করিব, কি যে স্থান হইতে দ্রব্যাদি অপহৃত হইয়াছে, সেই স্থানের স্থানীয় পুলিসের হস্তে অর্পণ করিব।
আমার ঊর্দ্ধতন কর্ম্মচারীর সহিত এইরূপ কথাবার্তা হইবার পর, পর দিবস সন্ধ্যার পর আমি পুনরায় ঊষার পিতার বাড়ীতে গমন করিলাম। ঊষার পিতা আমাকে দেখিয়াই জিজ্ঞাসা করিলেন, “অপহৃত অলঙ্কারগুলির কি কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিয়াছেন?”
আমি। আপনারা এই মোকদ্দমা রুজু করিতে কি স্থির করিয়াছেন?
ঊষার পিতা। যদি রুজু করিতে বলেন, তাহা হইলে করিতে পারি।
ঊষার পিতা। আপনি আমার যেরূপ উপকার করিয়াছেন, সেই উপকারের আমি কোনরূপে প্রতিশোধ করিতে পারিব না। আর ইহাও আমি বেশ জানিতে পারিয়াছি যে, আপনি আমাদিগের যাহাতে কোনরূপ অনিষ্ট হয়, সেইরূপ পরামর্শ কখনই প্রদান করিবেন না, সুতরাং আপনি যাহা বলিবেন তাহাই করিব। অত টাকা মূল্যের অলঙ্কার পত্রের আশা যদি আপনি পরিত্যাগ করিতে কহেন, তখনই তাহা করিব, ইহা আপনি বেশ জানিবেন।
আমি। আমি আপনাকে যাহা বলিয়া গিয়াছিলাম, তাহার কি করিয়াছেন?
ঊষার পিতা। কিসের?
আমি। কিরণের কোনরূপ অনুসন্ধান লইয়াছিলেন কি?
ঊষার পিতা। লইয়াছিলাম।
আমি। অনুসন্ধান করিয়া কি অবগত হইতে পারিয়াছেন?
ঊষার পিতা। যে রাত্রিতে ঊষা আমার গৃহ পরিত্যাগ করিয়া যায়, শরৎ ও তাহার একজন বন্ধুও সেই রাত্রি হইতে নিরুদ্দেশ হয়, ইহা আমার পূর্ব্বেই অবগত হইতে পারিয়াছিলাম। এখন জানিতে পারিয়াছি, আপনি ও ঊষা আমার বাড়ীতে আগমন করিবার তিন দিবস পূর্ব্বে উহারা তাহাদিগের বাসায় প্রত্যাগমন করে। এক দিবস সেইস্থানে অবস্থিতি করিয়া পুনরায় উহারা কোথায় চলিয়া গিয়াছে। যাইবার সময় বাসায় বলিয়া গিয়াছে যে, তাহারা তাহাদিগের দেশে যাইতেছে।
আমি। তাহাদিগের দেশ কোথায়, তাহা কিছু জানিতে পারিয়াছেন?
ঊষার পিতা। কোন্ জেলা তাহা জানি, কিন্তু কোন্ গ্রাম তাহা জানি না। শুনিয়াছি ঐ বাসায় তাহাদিগের গ্রামের আরও দুই এক জন লোক আছে।
আমি যে সময় ঊষার পিতার নিকট উপবেশন করিয়া এই সকল কথাবার্তা কহিতেছিলাম, সেই সময় সেইস্থানে অপর আর কেহ ছিল না; কিন্তু দেখিতে পাইলাম, একটু অন্তরালে ঊষা আসিয়া দণ্ডায়মানা আছে। আমি ঊষাকে সেইস্থানে দণ্ডায়মানা দেখিয়া তাহার পিতাকে কহিলাম, “দেখিতেছি ঊষা এইস্থানে আগমন করিয়াছে। আপনি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিয়াছেন কি, তাহার কি কি দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে?”
ঊষার পিতা। তাহাকে আমি জিজ্ঞাসা করিয়াছি।
আমি। এখন আপনারা কি স্থির করিয়াছেন? যে সকল দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে, তাহার নিমিত্ত শরৎ ও তাহার বন্ধুর নামে কি এখন নালিস করিতে প্রস্তুত আছেন?
ঊষার পিতা। নালিস না করিলে চলিবে কি প্রকারে? তাহা না হইলে এতগুলি টাকা আমার বৃথায় যাইবে!
আমি। যদি আপনি নালিস করিতে চাহেন, তাহা হইলে ঊষাকে একবার আমার ঊর্দ্ধতন কর্ম্মচারীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তাহাকে সমস্ত কথা বলিবার প্রয়োজন হইবে।
ঊষার পিতা। তিনি না সাহেব?
আমি। হ্যাঁ।
ঊষার পিতা। তাহা কি প্রকারে হইবে? একজন সাহেবের নিকট গমন করিয়া তাঁহার সহিত ঊষা কিরূপে কথা কহিবে।
আমি। তাঁহার নিকট গমন করিতে হইবে না, আমার সহিত গমন করিয়া ঊষা আমার বাসায় থাকিবে, সেইস্থানে সেই সাহেব কৰ্ম্মচারী আসিয়া তাহাকে যে দুই চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করিবেন, তাহার উত্তর আমিই করিব, তবে ঊষাকে উপস্থিত থাকা চাই মাত্র।
ঊষার পিতা। আপনার নিকট আমরা যেরূপ উপকার প্রাপ্ত হইয়াছি, তাহাতে ঊষার আপনার বাড়ী গমনের আমার কিছুমাত্র আপত্তি নাই! তবে ঊষা যাইতে প্রস্তুত আছে কি না, তাহা বলিতে পারি না।
ঊষা সেইস্থানেই উপস্থিত ছিল। তাহার পিতার কথা শুনিয়া ঊষা কহিল “যে ব্যক্তি আমার জীবনদান করিয়াছেন, তাঁহার বাসায় যাইতে আমার কিছুমাত্র আপত্তি নাই। আমি এখনই গমন করিতেছি।”
পাঠকগণ বোধ হয় এখন বুঝিতে পারিয়াছেন যে, আমার ঐরূপ প্রস্তাবের উদ্দেশ্য কী? আমি ইতিপূর্ব্বে ঊষার নিকট প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হইয়াছিলাম যে, কোনরূপে আমি তাহাকে একবার আমার বাসায় লইয়া যাইব ও তাহাকে আমার বাসা চিনাইয়া দিব। ঊষা আমার কথা শুনিবামাত্র আমার মনের ভাব উত্তমরূপে বুঝিতে পারিল ও তখনই আমার সহিত গমন করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইল। আমিও ঊষাকে লইয়া আমার বাসায় গমন করিলাম। এবার তাহার সহিত একজন পরিচারিকা গমন করিল। আমার ঊর্দ্ধতন কর্মচারীর ঊষার সহিত সাক্ষাৎ করিবার যে কথা আমি তাহার পিতার নিকট বলিয়ছিলাম, তাহার কোন প্রস্তাবই ছিল না; সুতরাং সাহেবও আমার বাসায় আগমন করিলেন না, ঊষার সহিত তাঁহার সাক্ষাৎও হইল না। আমার বাসায় প্রায় রাত্রি দশটা পৰ্য্যন্ত অবস্থিতি করিবার পর পুনরায় আমি ঊষাকে সঙ্গে করিয়া আনিয়া তাহার পিতার বাড়ীতে রাখিয়া গেলাম। ইহার পর সুযোগ বা ইচ্ছামত প্রায়ই ঊষা আমার বাসায় আগমন করিত ও চলিয়া যাইত। তাহার পিতা মাতা ইহা জানিতে পারিয়াও কোনরূপ আপত্তি করিতেন না।
দশম পরিচ্ছেদ
শরৎ ও তাহার বন্ধুর বিরুদ্ধে মোকদ্দমা রুজু হইল। অনুসন্ধান আমি নিজেই করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। যে বাড়ীতে শরৎ ও তাহার বন্ধু বাস করিত, সেইস্থানে গিয়া জানিতে পারিলাম, যে, উহারা প্রকৃতই কয়েকদিবস বাসা হইতে অনুপস্থিত ছিল। তাহার পর হঠাৎ প্রত্যাগমন করিয়া কেবল মাত্র এক দিবস সেইস্থানে অবস্থিতি পূর্ব্বক আপনার দেশে গমন করিতেছে বলিয়া চলিয়া গিয়াছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাহারা যে কোথায় গমন করিয়াছে, তাহা কেহই অবগত নহে। আরও জানিতে পারিলাম যে গ্রামে শরতের বাস, সেই গ্রামের দুই এক ব্যক্তি ঐ রাস্তায় অবস্থিতি করে। উহাদিগের নিকট হইতে শরতের দেশের ঠিকানা উত্তমরূপে অবগত হইয়া ও তাহাদিগের উভয়কেই চিনিত এরূপ এক ব্যক্তিকে সঙ্গে লইয়া, আমি তাহাদিগের দেশাভিমুখে গমন করিলাম। শরৎ ও তাহার বন্ধু প্রকৃত ই তাহাদিগের দেশে গমন করিয়াছিল, সেইস্থানে গমন করিবামাত্রই তাহাদিগের উভয়কেই প্রাপ্ত হইলাম। তাহারা প্রথমতঃ কটকের রাস্তায় যাওয়ার বিষয় অস্বীকার করিল, আরও কহিল যে, তাহারা কেহই ঊষা নামক কোন স্ত্রীলোককে চিনে না, বা তাহার অনুসরণ করিয়া কোন স্থানে গমন করে নাই।
আমি উহাদিগের আভ্যন্তরীণ সমস্ত বিষয় অবগত ছিলাম; সুতরাং উহারা যাহাই বলুক না কেন, আমি তাহার কোন কথা বিশ্বাস করিলাম না। উহাদিগের বাড়ীর খানাতল্লাসী করিলাম, কিন্তু অপহৃত অলঙ্কারগুলির একখানি ও দেখিতে পাইলাম না, কিন্তু শরৎ ও তাহার বন্ধুর বাক্স হইতে অনেকগুলি টাকা প্রাপ্ত হইলাম। উহারা যে অবস্থার লোক, তাহাতে অত টাকা উহাদিগের থাকা একেবারেই অসম্ভব; তথাপি তাহারা ঐ সকল টাকা তাহাদিগের নিজের বলিয়া দাওয়া করিল। আমি কিন্তু তাহাদিগের কথায় কোনরূপ কর্ণপাত না করিয়া ঐ সমস্ত অর্থের সহিত তাহাদিগকে লইয়া সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম। যে থানার অধীনে ঐ গ্রাম, সেই থানায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম, এবং উহাদিগের হাতে হাতকড়ি দিয়া সেই থানার হাজতে উহাদিগকে আটক করিয়া রাখিলাম। সমস্ত রাত্রি উহারা সেই হাজতগৃহে অবস্থিতি করিল।
পর দিবস অতি প্রত্যূষে আমি উহাদিগকে হাজত গৃহ হইতে বাহির করিয়া আপনার নিকট বসাইলাম, ও তাহাদিগকে কহিলাম “তোমরা বিনাদোষে জেলে যাইতে বসিয়াছ।”
শরৎ। কেন!
আমি। প্রকৃত কথা না বলিয়া।
শরৎ। আমি ত প্রকৃত কথাই বলিতেছি।
আমি। কি বলিতেছ?
শরৎ। আপনি কি জিজ্ঞাসা করিতেছেন?
আমি। তোমার নিকট হইতে আমরা যে সকল টাকা পাইয়াছি, সেই সকল টাকা তোমরা কোথায় পাইলে?
শরৎ। উহা আমাদিগের নিজের টাকা।
আমি। মিথ্যাকথা, আমি সমস্ত অবস্থা অবগত আছি, আমার নিকট তোমাদিগের কোন কথা গোপন করিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। মিথ্যা কথা বলিয়া তোমরা জেলে যাইবার পথ প্রশস্ত করিতেছ, প্রকৃত কথা কহিলে আমার বিবেচনায় এই মোকদ্দমায় তোমাদিগের কিছুই হইবে না।
শরৎ। প্রকৃত কথা কি?
আমি। দেখ শরৎ অপরের দ্রব্য অপহরণ করা এক, আর কোন রমণী যদি কাহারও প্রণয়ে আশক্ত হইয়া তাহাকে তাহার যথাসর্বস্ব প্রদান করে, তাহা হইলে ঐ ব্যক্তির চৌর্য্য অপরাধ হয় না। অনেক দিবস হইতে ঊষা তোমার প্রণয়ে আশক্তা হইয়াছিল, অনেক দিবস হইতে কিরূপে সে তোমার সহিত নির্জ্জনে দেখা সাক্ষাৎ করিতে পারে, তাহার চিন্তায় সতত নিযুক্ত ছিল। অনেক দিবস হইতে সে ইচ্ছা করিতে ছিল যে, কোনরূপে সে তাহার গৃহ পরিত্যাগ করিয়া তোমার আশ্রয় গ্রহণ করিবে, ও জীবনের অবশিষ্ট অংশ তোমার আশ্রয়ে অবস্থিতি ও তোমার প্রণয়ে মোহিত হইয়া জীবন যাপন করিবে; কিন্তু সুযোগ না পাইয়া এত দিবস পৰ্য্যন্ত সে তাহার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে সক্ষম হয় না। সময়মত যেমন সে সুযোগ পাইল, অমনি সে তোমার সহিত তাহার গৃহ পরিত্যাগ করিল, তোমাকে ভালবাসিয়া তাহার যথাসর্বস্ব তোমাকেই প্রদান করিল। আর তুমি ঐ সকল দ্রব্য গ্রহণ করিয়া নিজের বুদ্ধির দোষে এখন দস্যুতে পরিণত হইতেছ। বল দেখি, তোমার অপেক্ষা মূর্খ এ জগতে আর কে আছে?
শরৎ। আপনি এ সকল বিষয় কিরূপে অবগত হইলেন? ঊষা আপনাকে এই সকল কথা বলিয়াছে কি?
আমি। কেন ঊষা না বলিলে কি আর আমি এই সকল বিষয় অবগত হইতে পারি না? তোমরা কটকের রাস্তা অবলম্বন করিয়া পুরী অভিমুখে গমন করিতেছিলে। যে সকল ঘোড়ার গাড়িতে তোমরা গমন করিয়াছ ও পরিশেষে যে সকল গরুর গাড়ি ভাড়া করিয়া তাহার মধ্যে তোমরা তিন জনে আরোহণ করিয়াছ, সেই গাড়োয়ানগণ আমাকে সমস্ত কথা বলিয়াছে। যে সকল দোকানে তোমরা আহারাদি, বিশ্রাম ও রাত্রিবাস করিয়াছ, তাহারাও আমার নিকট কোন কথা গোপন করে নাই। ঊষা তোমাদিগকে তাহার অলঙ্কার পত্র প্রদান করিবার পর পুরী হইতে প্রত্যাগত যে গাড়িতে তোমরা আরোহণ করিয়া কলিকাতায় আসিয়াছিলে, সেই গাড়োয়ানকেও আমি প্রাপ্ত হইয়াছি। সুতরাং তোমাদিগের সমস্ত অবস্থা আমি অবগত হইতে পারিয়াছি কি না, তাহা তুমিই কেন বিবেচনা করিয়া দেখ না। এখন যে সকল দ্রব্য তোমরা ঊষার নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়াছ, সেই সকল দ্রব্য সেই ঊষার নিকট হইতে তোমরা অপহরণ করিয়াছ বলিয়া তোমাদিগকে জেলে গমন করিতে হইতেছে, ইহা অপেক্ষা নির্ব্বোধের কার্য্য আর কি হইতে পারে?
আমার কথা শুনিয়া শরৎ ও তাহার বন্ধু একটু অন্তরালে গিয়া কি পরামর্শ করিল ও পরিশেষে আমার নিকট উপস্থিত হইয়া কহিল “আপনি যে সকল বিষয় অবগত হইতে পরিয়াছেন, তাহার সমস্তই প্রকৃত ও তাহার এক বর্ণও মিথ্যা নহে। এখন আমাদিগকে কি করিতে হইবে, তাহাই বলুন। ঊষা কি আমাদিগের উপর চুরির নালিস করিয়াছে?”
আমি ঊষার সহিত আমার এখন পর্য্যন্ত সাক্ষাৎ হয় নাই। ঊষার পিতা ও ভ্রাতা তোমাদিগের উপর চুরির নালিস করিয়াছে। ঊষা যে কি বলিবে, তাহা আমি বলিতে পারি না। এখন প্রকৃত কথা কি বল দেখি।
শরৎ। আপনি যাহা শুনিয়াছেন, তাহার সমস্তই প্ৰকৃত।
আমি। তাহা হইলে ঊষাই তোমাকে তাহার অলঙ্কার পত্র সমস্ত প্রদান করিয়াছে?
শরৎ। হাঁ মহাশয়, সেই উহা আমাদিগকে দিয়াছে।
আমি। তাহা হইলে যে সকল অলঙ্কার ঊষা প্রদান করিয়াছে, সেই সকল অলঙ্কার তুমি কি করিলে? শরৎ। আমার টাকার প্রয়োজন হইয়াছিল বলিয়া, ঐ সকল অলঙ্কার একস্থানে বন্ধক রাখিয়াছি।
আমি। কোথায় তুমি উহা বন্ধক রাখিয়াছ?
শরৎ। কলিকাতায়।
আমি। আমাকে দেখাইতে পারিবে?
শরৎ। আমাকে সেইস্থানে লইয়া চলুন, দেখাইয়া দিব।
এইরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া আমি শরতের নিকট হইতে অবগত হইলাম যে, সে ঊষার অলঙ্কারগুলি কোথায় বন্ধক রাখিয়াছে।
ইহার পরই আমি তাহাদিগকে কলিকাতায় আনয়ন করিলাম। যে স্থানে তাহারা ঊষার অলঙ্কারগুলি বন্ধক দিয়াছিল তাহা আমাকে দেখাইয়া দিল। আমিও সেইস্থান হইতে অলঙ্কারগুলি গ্রহণ করিলাম।
শরতের আর এখন কোনরূপ লজ্জা সরম নাই, সে এখন সৰ্ব্বসমক্ষে প্রকাশ্যভাবে, ও এমন কি ঊষার পিতা এবং ভ্রাতার নিকট পৰ্য্যন্ত বলিতে লাগিল যে, সে চোর নহে; ঊষার অলঙ্কার পত্র সে কখন চুরি করে নাই। ঊষা তাহার পিতৃগৃহ পরিত্যাগ করিবার অনেক পূর্ব্ব হইতেই সে তাহার প্রণয়ে আকৃষ্ট হইয়াছিল ও সেই সময় হইতে ঊষা মধ্যে মধ্যে তাহাকে এক একখানি করিয়া তাহার কতকগুলি অলঙ্কার প্রদান করে, এবং পরিশেষে লোকলজ্জা পরিত্যাগ ও কুলে জলাঞ্জলি দিয়া তাহার সহিত কুলের বাহির হয়। সে কটকের রাস্তার অনেক দোকানদার প্রভৃতির দ্বারা প্রমাণ করিতে সমর্থ যে, সে চোরের ন্যায় ঊষার অনুসরণ করিয়া গমন করিতেছিল, কি ঊষা তাহার স্ত্রীর ন্যায় তাহার সহিত সহবাস করিতেছিল। ঊষা কুলটা, কুল পরিত্যাগ করিয়া শরতের আশ্রয় গ্রহণপূর্ব্বকও সে সন্তুষ্টা হয় না। উহার মধ্যেই অপরের দিকে পুনরায় তাহার লক্ষ্য পতিত হয়। এই নিমিত্তই শরৎ তাহাকে একাকী পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া আইসে। যে রমণীর সহিত সে গৃহ পরিত্যাগ করিল, সেই রমণী পুনরায় যদি অপর পুরুষের দিকে হস্ত প্রসারিত করে, তাহা হইলে ঐরূপ রমণীর সহবাস কে প্রার্থনা করে? এই সকল কারণেই শরৎ ঊষাকে পরিত্যাগ করিয়া প্রস্থান করিয়াছে।
শরৎ এই প্রকার নানারূপ কথা বলিয়া যাহাতে সকলে ঊষার চরিত্র অবগত হইতে পারে, তাহার চেষ্টা করিতে লাগিল; কিন্তু এই অবস্থায় তাহার কথার উপর কেহই বিশ্বাস করিল না। শরৎ এখন চৌর্য্য অপরাধে অভিযুক্ত। এখন তাহার কথা কে বিশ্বাস করিবে? সে ব্যক্তি কোন অপরাধে অভিযুক্ত হইয়া যে সকল কথা বলিয়া থাকে, বিনা প্রমাণে কোন বিচারকই সেই সকল কথা বিশ্বাস করিতে পারেন না। শরৎ ও তাহার বন্ধু পূর্ব্বকথিতরূপ অনেক কথা বিচারককে কহিল, এবং ঊষার চরিত্রে সম্পূর্ণরূপ দোষ প্রদর্শন করিবার নিমিত্ত তাহারা বিশেষরূপে চেষ্টা করিল; কিন্তু তাহাদিগের কথার পোষকতার কোনরূপ সাক্ষ্য প্রমাণ দিতে না পারায়, কেহই তাহা বিশ্বাস করিলেন না। এদিকে ‘যেরূপ ভাবে ও যে স্থান হইতে শরৎ ঊষার অলঙ্কার পত্র আত্মসাৎ করিয়া পলায়ন করিয়াছিল, যে স্থান হইতে আহারীয় দ্রব্য আনয়ন করিয়া ঊষাকে আহার করিতে দিয়াছিল, যে গাড়িতে বসিয়া ঐ সকল দ্রব্য আহার করিয়া ঊষা ক্রমে হতজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিল, এই সকল কথা সেই প্রদেশীয় দোকানদার ও গাড়োয়ান প্রভৃতির দ্বারা ক্রমে প্রকাশিত হইয়া পড়িল। আমাদিগের যোগাড়ে ও গভর্ণমেন্টের ব্যয়ে সকলেই কলিকাতায় আসিয়া যে যাহা জানিত, তাহার সমস্তই অকপটে স্বীকার করিল, ও প্রকাশ্যভাবে আদালতে সাক্ষ্য প্রদান করিল। ইহার মধ্যে একটি শকটচালক যেরূপ কহিল, তাহাতে সকলে উত্তমরূপে বুঝিতে পারিলেন যে, শরৎ ও তাহার বন্ধু ঊষাকে কোনরূপ দ্রব্য সেবন করাইয়া তাহাকে বেহুঁস করিয়া দেয় ও পরিশেষে তাহার সমস্ত দ্রব্য অপহরণ করে। ঐ গাড়োয়ান বলিয়াছিল, শরৎ ও তাহার বন্ধু তাহার গাড়ি ভাড়া করিয়া ঊষাকে লইয়া তিন জনেই ঐ গাড়িতে গমন করিতে থাকে, এক দিবস কোন স্থানে উহারা পাক করিয়া আহারাদি করিবার কিছুমাত্র বন্দোবস্ত করে না, একটি দোকান হইতে কিছু আহারীয় দ্রব্য দুই জায়গায় করিয়া খরিদ করিয়া আনে। তাহার একটি ঊষাকে আহারার্থ প্রদান করে। অপরটি হইতে ইহারা দুই জন আহার করে। ঊষা ঐ দ্রব্য আহার করিবার পর হইতেই ক্রমে বেহুঁস হইয়া যায়। সেই বেহুঁস অবস্থায় একটি মাঠের ভিতর ঊষাকে উহারা গাড়ি হইতে নামাইয়া লইয়া, রাস্তার এক পার্শ্বে ফেলিয়া রাখে, ও তাহারা গাড়ি হইতে সমস্ত দ্রব্য অবতরণ করিয়া লইয়া ঐ গাড়োয়ানকে বিদায় করিয়া দেয়। যেস্থানে ঊষাকে রাখিয়া দেয়, তাহার দুই তিন ক্রোশের মধ্যে লোকালয় ছিল না। গাড়োয়ান গাড়ি লইয়া চলিয়া যায় ও একটি বাজারে গিয়া বিশ্রাম করে, সেই সময় সে দেখিতে পায়, শরৎ ও তাহার বন্ধ সমস্ত দ্রব্যাদি আর একখানি গাড়িতে করিয়া লইয়া প্রস্থান করিতেছে; কিন্তু ঊষা তাহাদিগের সহিত নাই। সে তাহাদিগকে ঊষার কথা জিজ্ঞাসা করে, কিন্তু তাহারা তাহার কথার কোনরূপ উত্তর প্রদান না করিয়া চলিয়া যায়। এই অনুসন্ধানে প্রকৃত বিষয়ের অনেকটা আমাকে গোপন রাখিয়া শরতের বিপক্ষে প্রমাণ সকল আদালতে উপস্থিত করিয়া আমিও যে কিয়ৎপরিমাণে ‘পাপ সঞ্চয় করিয়াছিলাম, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। একটি স্ত্রীলোকের লজ্জা রক্ষা করিবার নিমিত্ত অন্যায় প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হইয়াছিলাম বলিয়া আমাকে সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিতে হইল। ঊষার সমস্ত চরিত্র আমি উত্তমরূপে অবগত থাকিয়া তাহা জনসাধারণে গোপন করি।
শরৎ ও তাহার প্রিয় বন্ধু চৌর্য্যাপরাধে বিচারকের সম্মুখে আনীত হইলে ঊষাকে এই মোকদ্দমার সাক্ষ্য প্ৰদান করিতে হয়, সুতরাং তাহার মুখ হইতে ঐ সকল কথা বাহির করিবার মানসে শরৎ তাহাকে কতরূপ প্রশ্ন করিল, কিন্তু ঊষার নিকট হইতে কোন কথাই বাহির করিতে সমর্থ হইল না। বিচারকের মনেও বিশ্বাস হইল যে, শরৎ বাঁচিবার নিমিত্তই ঐ স্ত্রীলোকের উপর এই সকল মিথ্যা দোষারোপ করিতেছে। সুতরাং উভয়কেই উপযুক্তরূপ দগ্রহণ করিতে হইল। ঊষার চরিত্র যে কি উপাদানে নির্ম্মিত, তাহা শরৎ ও তাহার বন্ধু জানিত এবং আমিও উত্তমরূপে জানিলাম। ঊষা এখন পৰ্য্যন্ত জীবিতা আছে। তবে তাহার বয়ঃক্রম এখন কিছু অধিক হইয়া পড়িয়াছে। এখনও সে মধ্যে মধ্যে আমার বাসায় আসিয়া আমাদিগের সহিত আত্মীয়তা করিয়া যায়।
[পৌষ, ১৩০৮ ]