রাঙ্গা বউ
(অর্থাৎ স্ত্রী চরিত্রের অদ্ভুত দৃষ্টান্ত!)
প্রথম পরিচ্ছেদ
বিদ্যুৎ কিরূপ দ্রুতগতি, তাহা সকলেই অবগত আছেন; কিন্তু আমার বোধ হয়, ভদ্রঘরের কুৎসা-কাহিনী তাহা অপেক্ষা দ্রুতবেগে দেশ প্লাবিত করিয়া ফেলে। আমি যাহা বলিলাম, তাহা যে কেবল আমার নিজের মনের ভাব, তাহা নহে; আপনি যাহাকে জিজ্ঞাসা করিবেন, তিনিই আমার এই কথার সত্যতা প্রতিপাদন করিবে। পাঠকগণ! আমার কথা যে সম্পূর্ণ সত্য, তাহার একটি বিশিষ্ট প্রমাণ আমার এই দারোগার দপ্তরেই রহিয়াছে। অনেক দিবস হইল, এই দারোগার দপ্তরে “বামুন ঠাকুর” নামক একটি গল্প বাহির হয়। উহাতে একটি ভদ্রমহিলার চিত্র কিয়ৎপরিমাণে চিত্রিত হইয়াছিল। ঐ পুস্তকখানি বাহির হইবামাত্র চারিদিক হইতে আমি পত্র পাইতে লাগিলাম যে, ওরূপ ভাবে ভদ্রগৃহের গুপ্তকথা সকল বাহির করা কর্তব্য নহে। এইরূপ ভাবে অনেকগুলি পত্র পাইলাম সত্য, কিন্তু সেই সঙ্গে ঐ পুস্তক যতগুলি ছাপা হইয়াছিল, তাহার সমস্তই নিঃশেষিত হইয়া গেল। পুনরায় মুদ্রাঙ্কণের প্রয়োজন হইল, উহাও ছাপাখানা হইতে বাহির না হইতে হইতেই আর একখানিও দেখিতে পাইলাম না। পুনরায় ছাপিতে হইল। পাঠকগণ ভাবিয়া দেখুন দেখি, আমাদিগের চরিত্র কি রূপ! বাল্যকালে আপনারা সকলেই “লুকোচুরি” খেলা করিয়াছেন, কিন্তু বলুন দেখি, আপনাদের সকলের হৃদয় সেইরূপ লুকোচুরিময় কি না! “বামুন ঠাকুর” নামক পুস্তকখানি বাহির হইবার পর আমি মনে মনে ইচ্ছা করিয়াছিলাম, ভদ্রলোকের ঘরের কুৎসা যত কম পারি বাহির করিব, ও সেই ইচ্ছার উপর নির্ভর করিয়া এত দিবস পৰ্য্যন্ত চলিয়া আসিতেছিলাম, কিন্তু “কু-বুদ্ধি” লিখিতে গিয়া পুনরায় সেইরূপ কতক অবস্থা প্রকাশিত হইয়া পড়িয়াছে, ও এই “রাঙ্গা বউ” লিখিতে গিয়া আমাকে পুনরায় আপন ইচ্ছার বিরুদ্ধে চলিতে হইতেছে; কারণ আমাকে সদা সৰ্ব্বদা যে সকল কাৰ্য্য লইয়া বিরাজ করিতে হয়, তাহাতে ভদ্রগৃহের কাহিনী বাহির না করিলে, আমাকে এই দারোগার দপ্তর বাহির করাও পরিত্যাগ করিতে হয়। যে স্থানেই খুন, সেই স্থানেই চরিত্রের গোলমাল; যে স্থানে চুরি জুয়োচুরি, সেই স্থানে কোন না কোনরূপ স্ত্রীলোক লইয়া গণ্ডগোল। এরূপ অবস্থায় পাঠকগণ বলুন দেখি, আমি কিরূপে ঐ সমস্ত চরিত্র বর্ণন না করিয়া থাকিতে পারি! যখন আমাকে অনন্যোপায় হইয়া এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতে হইতেছে, তখন আপনারা দশজনে অসন্তুষ্ট হইলেও আমাকে ঐ সকল বিষয় বর্ণনে নিবৃত্ত হওয়া বড়ই কঠিন। এক বিষয় আমি নিশ্চয় বলিতে পারি, আপনারা প্রকাশ্যে ঐ সকল বিষয় বর্ণন করিতে আমাকে নিষেধ করিবেন, কিন্তু আপনাদিগের আন্তরিক ইচ্ছা, ঐ সকল বিষয় আমি যত অধিক বিবৃত করিব, আপনারা এই দারোগার দপ্তর তত অধিক পাঠ করিবেন। “বামুনঠাকুর” তাহার জাজ্জ্বল্যমান প্ৰমাণ।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
গোপালচন্দ্র মিত্র এই কলিকাতার একজন বড়লোক ছিলেন। বড় রাস্তার উপর বড় গোছের চকমিলান বাড়ী, বাড়ীর বড় বড় দরজায় বড় বড় লাঠি লইয়া বড় বড় পশ্চিমে দরোয়ান। বসত বাড়ী ছাড়া কলিকাতায় গোপালবাবুর অনেকগুলি ভাড়াটিয়া বাড়ী আছে, অনেক স্থানে বড় বড় রেওয়াতি জমী আছে, এতদ্ভিন্ন মফঃস্বলে দুই তিনখানি বড় বড় পরগণাও আছে। গোপালবাবু কপালে পুরুষ। তাঁহার পৈতৃক বিষয় যথেষ্ট থাকিলেও তিনি তাঁহার কপালের জোরে ঐ সকল অগাধ বিষয় খরিদ করিয়া সুখভোগ করিয়া আসিয়াছেন। গোপালবাবুর বিষয় অগাধ, কিন্তু উহা ভোগ করিবার লোক ছিল না। তাঁহার পুত্র জন্মে নাই। পাঁচ জন আত্মীয়স্বজন ও কুটুম্ব সাক্ষাৎ লইয়াই তাঁহার বাড়ীর জমজমাট ছিল। বাড়ীতে ক্রিয়াকলাপ হইত, দোল দুর্গোৎসব কিছুই বাদ যাইত না, কিন্তু সমস্তই পরের হাতে, চাকর চাকরাণীর হাতে। স্থূল কথায়, দশ জন পর গোপালবাবুর আশ্রয়ে প্রতিপালিত হইত। গোপালবাবুর স্ত্রী দেখিতে যেমন লক্ষ্মী, কাৰ্য্যেও ঠিক সেইরূপ ছিলেন। তিনি কাহার উপর যে কখন কটু কথা বলিয়াছেন, তাহা কেহই বলিতে পারে না। তাঁহার গুণও অসাধারণ ছিল, মুক্তহস্তে তিনি দরিদ্রকে দান করিতেন, যে কোন স্ত্রীলোক তাঁহার নিকট গমন করিয়া কষ্ট জানাইত, অগাধ অর্থ প্রদান করিয়া তখনই তিনি তাঁহার কষ্ট নিবারণ করিতেন। স্থূলকথায়, এক প্রধান কষ্ট ব্যতীত তাঁহার আর কোন কষ্টই ছিল না। ঐ কষ্টের নিমিত্ত তিনি তাঁহার অন্তরে সুখ অনুভব করিতে পারিতেন না। ঐ কষ্ট এই যে, তিনি অপুত্রক।
স্ত্রীর কষ্ট দূর করিবার মানসে গোপালবাবু একটি পোষ্য পুত্র গ্রহণ করিলেন। কোন আত্মীয়ের পুত্র প্রাপ্ত না হওয়ায় দূরদেশ হইতে একটি পঞ্চম বৎসরের পুত্র খরিদ করিয়া আনিয়া আইন অনুসারে তিনি তাহাকে পোষ্য পুত্ররূপে আপন গৃহে স্থান প্রদান করিলেন। পূর্ব্বে ঐ বালকের যে নাম ছিল, এখন তাহা পরিবর্তিত হইয়া রামচন্দ্র মিত্র নামে তিনি পরিচিত হইলেন। *
[*পাঠকগণ মনে করিবেন, রামচন্দ্র মিত্রও তাহার প্রকৃত নাম নহে, আইনের ভয়ে আমি তাহার নাম গোপন করিয়া রামচন্দ্র নামে অভিহিত করিলাম।]
পোষ্যপুত্ৰ গ্ৰহণ হইয়া গেল, রামচন্দ্র বিশেষ যত্নের সহিত লালিত পালিত হইতে লাগিলেন। লেখাপড়া শিখিবার নিমিত্ত গোপালবাবু বিশেষরূপ যত্ন গ্রহণ করিলেন না, কারণ তাঁহার বিশ্বাস ছিল, জমিদারের ছেলে অধিক লেখাপড়া শিখিয়া কি করিবে, উদরানের নিমিত্ত ত আর তাঁহাকে কাহারও দ্বারস্থ হইতে হইবে না, বা কাহার নিকট চাকরী করিয়া তাঁহাকে উদরান্নের সংস্থান করিতে হইবে না; সুতরাং কষ্ট করিয়া লেখাপড়া শিক্ষা করিবার প্রয়োজন কি? নিজের নাম সহি করিতে পারিলেই যথেষ্ট হইবে। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া যাহাতে রামচন্দ্র একটু লিখিতে সমর্থ হন, সেইরূপ ভাবে শিক্ষা প্রদান করিবার নিমিত্ত গোপালবাবু একজন মাষ্টার নিযুক্ত করিয়া দিলেন। কর্তৃপক্ষীয়গণের বিশেষরূপ দৃষ্টি না থাকিলে, এই কলিকাতার মাষ্টার মহাশয়গণ যেরূপ ভাবে বহু লোকের সন্তানগণকে শিক্ষাপ্রদান করিয়া থাকেন, রামচন্দ্রকেও মাষ্টারবাবু সেইরূপভাবে শিক্ষাপ্রদান করিতে লাগিলেন। রামচন্দ্র বেশ তামাক চুরুট খাইতে আরম্ভ করিল, লুকাইয়া চুরাইয়া মাষ্টারবাবু এক এক গ্লাস সুরা তাঁহার উদরস্থ করাইতে শিক্ষা দিতে লাগিলেন। মাষ্টারবাবু হাওয়া খাইবার সময় তাহার সঙ্গে সর্ব্বদাই বাহিরে গমন করিতেন, সুতরাং রামচন্দ্রের বড় হইবার সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া খাইবার সময় মাষ্টারবাবু নানা দরজায় তাঁহাকে হাওয়া খাওয়াইতে আরম্ভ করিলেন।
ক্রমে রামচন্দ্রের বয়ঃক্রম ১৫ বৎসর উত্তীর্ণ হইয়া ১৬ বৎসরে পতিত হইল। কলিকাতার কায়স্থ বংশের অনেক বড়লোক রামচন্দ্রকে কন্যাদান করিবার মানসে গোপালবাবুর নিকট যাতায়াত করিতে লাগিলেন। গোপালবাবুও অনেক কন্যা দেখিলেন, কিন্তু কোন কন্যাই তাঁহার মনোনীত হইল না। গোপালচন্দ্র সর্ব্বদাই বলিতেন, আমি একটি রাঙ্গা বউ করিব। সুতরাং রাঙ্গা বউ করিতে পারেন, এরূপ কন্যা তিনি অনেক খুঁজিয়াও সহজে প্রাপ্ত হইলেন না।
সমস্ত পিতা মাতাই রাঙ্গা বউ করিতে ইচ্ছা করিয়া থাকেন সত্য, কিন্তু তাহার মধ্যে অনেকে ভাল বংশের কন্যা না পাইলে প্রায়ই গ্রহণ করেন না। আবার অনেকে বংশের দিকে লক্ষ্য না করিয়া কেবল রাঙ্গা বউ’র দিকেই লক্ষ্য করিয়া থাকেন। গোপালবাবু ঐ শ্রেণীর একজন ছিলেন। ভাল বংশে রাঙ্গা বউ প্রাপ্ত না হইয়া, পরিশেষে তিনি নীচ বংশ হইতেও রাঙ্গা বউ বাছিয়া লইতে প্রবৃত্ত হইলেন। তাঁহার বাড়ীর প্রায় ২ মাইল ব্যবধানে একজন কায়স্থ বাস করিতেন। তাঁহার অবস্থা ভাল ছিল না, তিনি বংশ মর্যাদায় যে গোপালবাবুর কম ছিলেন, তাহাও নহে। কিন্তু তাঁহার একটি অতিশয় সুন্দরী স্ত্রী ছিল, ঐ সুন্দরীর যৌবনকালে তাহার চরিত্র সম্বন্ধে অনেকে অনেক কথা প্রকাশ করিয়াছিল। সেই সময় তাঁহার দুইটি কন্যা জন্মগ্রহণ করে, তাহারাও অতিশয় সুশ্রী। গোপালবাবু যেরূপ রাঙ্গা বউ খুঁজিতেছিলেন, ঐ দুইটি কন্যাই ঠিক সেইরূপ ছিল। বড়টির বিবাহ হইয়া গিয়াছিল, কিন্তু ছোটটির বিবাহ সেই পৰ্য্যন্ত হইয়াছিল না। কন্যার পিতা গোপালবাবুর মনের ভাব জানিতে পারিয়া এক দিবস কন্যাটিকে সঙ্গে করিয়া গোপালবাবুর নিকট আগমন করিলেন। গোপালবাবু কন্যাটিকে দেখিয়াই তাঁহাকে কহিলেন “এই কন্যাটি কেন আমাকে প্রদান কর না, আমি রামচন্দ্রের সহিত ইহার বিবাহ দি।” কন্যার পিতার আন্তরিক ইচ্ছা তাহাই ছিল, ও সেই নিমিত্তই তিনি তাঁহার কন্যাটিকে সঙ্গে করিয়া গোপালবাবুর বাড়ীতে গমন করিয়াছিলেন, সুতরাং তিনি গোপালবাবুর প্রস্তাবে অসম্মত হইবেন কেন? গোপালবাবু তাঁহার মনের ভাব অবগত হইতে পারিয়া কন্যাটিকে সঙ্গে করিয়া বাড়ীর মধ্যে লইয়া গিয়া তাঁহার স্ত্রীকে দেখাইলেন। তাঁহার স্ত্রীও ঐ বালিকাটি দেখিয়া তাহাকে আপন পুত্র-বধূ করিতে মনস্থ করিলেন।
কন্যার পিতা গোপালবাবুর মনের ভাব অবগত হইতে পারিয়া যে কি পর্য্যন্ত আনন্দিত হইলেন, তাহা বলা যায় না। কারণ তিনি বেশ বুঝিতে পারিলেন, তাঁহার ছোট কন্যাটির অদৃষ্ট ভাল; নতুবা এরূপ রাজার ন্যায় সংসারে তাহাকে গ্রহণ করিতে সম্মত হইবে কেন?
তাঁহার প্রথম কন্যাটির বিবাহ যে কোন বড় ঘরে হইয়াছিল, তাহা নহে; গৃহস্থের ঘরেই তাহার বিবাহ হয়। সেও এখন বয়স্থা হইয়াছে, কিন্তু শ্বশুর বাড়ীতে প্রায়ই সে থাকে না; কারণ তাহার আন্তরিক ইচ্ছা নহে যে, সে তাহার স্বামীর ঘর করে। বৎসরের মধ্যে অধিকাংশ সময়ই সে তাহার পিতা মাতার বাড়ীতে বাস করিয়া থাকে। তাহার মাতার চরিত্র সম্বন্ধে পূর্ব্বে যেমন অনেক কথা শুনিতে পাওয়া গিয়াছিল, তাহার চরিত্র সম্বন্ধেও সেইরূপ নানাকথা তাহার যৌবনের সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশিত হইতে আরম্ভ হইয়াছে। ঐ সকল কথা প্রকৃত, কি দুষ্ট লোকদিগের কর্তৃক প্রচারিত, তাহা আমি বলিতে পারি না, তাহার সত্যাসত্য পাঠকগণ অনুমান করিবেন।
কোন বড়লোক দরিদ্রের কন্যাকে পুত্রবধূ করিবেন মনে করিলে অর্থের নিমিত্ত সেই কাৰ্য্য সম্পন্ন হইতে বাকী থাকে না, সুতরাং গোপালবাবুর ইচ্ছা দেখিতে দেখিতে কার্য্যে পরিণত হইয়া গেল। তিনি তাঁহার মনের মত রাঙ্গা বউ ঘরে আনিয়া নিজের চির দিবসের অভীষ্টসিদ্ধি ও সেই সঙ্গে সঙ্গে নিজের ঘর আলো করিলেন।
গোপালবাবুর স্ত্রীর পুত্র কন্যা কিছুই হয় নাই, কিন্তু তিনি পরের পুত্র রামবাবুকে, ও পরের কন্যা রাঙ্গা বউকে লইয়া নিজের পুত্র কন্যার সাধ নিবৃত্তি করিতে লাগিলেন। ক্রমে রাঙ্গা বউ বড় হইতে লাগিলেন, ক্রমে যৌবনে পদার্পণ করিলেন। সেই সঙ্গে সঙ্গে গোপালবাবুর স্ত্রী কালকবলে পতিতা হইলেন।
স্ত্রীর মৃত্যুর অল্প দিবস পরেই গোপালবাবুও তাঁহার অনুসরণ করিলেন। এখন রামবাবুই বাড়ীর কর্তা ও রাঙ্গা বউই বাড়ীর গৃহিণী হইয়া উঠিলেন।
রামবাবু সৰ্ব্বময় কর্তা হইয়া সমস্ত বিষয় নিজ হস্তে গ্রহণ করিবার সঙ্গে সঙ্গে, তাঁহার অনেক পারিষদ ক্রমে তাঁহার বাড়ীতেই আসিয়া অধিষ্ঠান করিতে লাগিল। মাষ্টারবাবুর খাতির এখন আরও বাড়িল; এখন তিনি যাহা বলেন, রামবাবু তাহাই শুনিতে লাগিলেন। মাষ্টারবাবুর অনুগ্রহে, রামবাবুর কোন বিষয়ই শিক্ষা করিতে বাকী ছিল না। বার-বিলাসিনীগণের বাড়ীতে তাঁহার পদধূলি অনেক পূর্ব্ব হইতেই পড়িতে আরম্ভ হইয়াছিল, তাহার সঙ্গে সঙ্গে সুরাদেবীর আরাধনাও তিনি উত্তমরূপে করিতে শিখিয়াছিলেন; কিন্তু বৃদ্ধ গোপালবাবু বৰ্ত্তমান থাকিতে রামবাবু ঐ সকল কাৰ্য্য অতিশয় গোপনে সম্পন্ন করিতেন, ও বাহিরে বাহিরেই ঐ সকল কার্য্য সারিয়া আসিতেন। এখন তিনি সৰ্ব্বময় কর্ত্তা, সমস্ত বিষয়ের অধীশ্বর, তাহার উপর মাষ্টারবাবু তাঁহার সম্পূর্ণরূপে সহায়, এখন আর তিনি ভয় করিবেন কাকে? ঐ সকল কার্য্যের নিমিত্ত এখন আর তাঁহাকে তাঁহার গৃহের বাহির হইতে হইত না, বাড়ীর বৈঠকখানা গৃহে বসিয়াই এখন সকল কাৰ্য্য সম্পন্ন হইতে লাগিল। ঐ গৃহের মধ্যেই এখন সুরার ঢেউ খেলিতে লাগিল। বারবিলাসিনীগণের গীতধ্বনিতে সমস্ত প্রাসাদ প্রতিধ্বনিত ও নর্তকীর পদভরে উহা টলমল করিতে লাগিল। সেই সঙ্গে সঙ্গিগণের উচ্চহাস্যে সেইস্থান সর্ব্বদাই পরিপূরিত হইতে লাগিল। এইরূপে কিছুদিবস অতিবাহিত হইতে না হইতেই রামবাবুর চরিত্র ক্রমে সৰ্ব্বজন বিদিত হইয়া পড়িল।
রাঙ্গা বউ গৃহে বসিয়া স্বামীর এই সকল অবস্থা স্বচক্ষে দেখিতে লাগিলেন। প্রথম প্রথম দুই একবার তাহার স্বামীকে ঐরূপ কার্য্যে বিরত হইতে কহিলেন; কিন্তু যখন দেখিলেন যে, রামবাবু কিছুতেই ঐ সকল কার্য্য পরিত্যাগ করিতে সম্মত নহেন, তখন আর তাঁহাকে কোনরূপ কথা কহিতেন না। বরং সময় সময় অন্তরালে দণ্ডায়মান থাকিয়া তাঁহার স্বামী কিরূপ আমোদ উপভোগ করিতেছেন, তাহা দেখিতেন। রাঙ্গা বউ এইরূপে দুই চারি দিবস তাহার স্বামীর ক্রিয়াকলাপ দেখিবার পর রামবাবুও জানিতে পারিলেন যে, রাঙ্গা বউ তাঁহার কার্য্য-কলাপে স্বচক্ষ দেখিয়া থাকেন। তাঁহার সঙ্গীগণের মধ্যে কেহ কেহ দুই এক দিবস রাঙ্গা বউকে ছায়ার ন্যায় এক আধবার দেখিতে পাইলেন। এইরূপে দিন অতিবাহিত হইতে লাগিল। সুরার ঢেউ চলিতে লাগিল। সেই তরঙ্গের জোরে রামচন্দ্রের বিষয়ও ক্রমে ক্ষয় পাইতে আরম্ভ হইল। গোপালবাবু যে সকল নগদ অর্থ সঞ্চয় করিয়া রাখিয়া গিয়াছিলেন, তাহা ক্রমে শেষ হইয়া গেল। জমিদারী হইতে যে টাকা আয় হইতেছিল, তাহাতে রামচন্দ্রের খরচ আর কুলাইল না, ক্ৰমে দেনা হইতে আরম্ভ হইল।
নিজে বুঝিতে না পারিয়া, নানাপ্রকারে অসৎ ব্যয়-পূর্ব্বক যিনি একবার দেনা করিতে আরম্ভ করিয়াছেন, তাঁহার দেনা প্রায়ই শোধ হয় না। ঋণজালে জড়ীভূত হইয়াও যিনি তাহার অসব্যয় হইতে নিবৃত্তি না হইতে পারেন, তাঁহার বিষয় সম্পত্তি ও জমিদারী প্রভৃতি প্রায়ই থাকে না। দেনার আসল ও সুদের টাকা প্রায় উহা গ্রাস করিয়া ফেলে।
এক সময়ে রামচন্দ্রের হস্তে অনেকগুলি টাকা আসিয়া পড়িয়াছিল। সেই সময় রাঙ্গা বউ বিশেষ আবদার করিয়া ধরায় তিনি তাঁহাকে একখানি অলঙ্কার প্রদান করেন। ঐ অলঙ্কারখানি অতিশয় মূল্যবান; উহা একখানি কণ্ঠাভরণ। খুব বড় বড় হীরা ও মাণিক দ্বারা উহা খচিত। এই কলিকাতার ভিতর কোন প্রধান জহুরীর নিকট তিনি উহা পঁচিশ সহস্র মুদ্রায় খরিদ করিয়া আপন স্ত্রীকে প্রদান করেন। গোপালবাবু রাঙ্গা বউকে যথেষ্ট অলঙ্কার প্রদান করিয়াছিলেন; কিন্তু তাহার সমস্তই সুবর্ণ নিৰ্ম্মিত; জড়োয়া অলঙ্কার তাঁহার এক খানিও ছিল না। কিন্তু রামচন্দ্র ঐ একখানি কণ্ঠাভরণ তাঁহাকে খরিদ করিয়া দিয়া রাঙ্গা বউ’র জড়োয়া অলঙ্কারের সাধ মিটাইয়া দিয়াছিলেন। যে রামচন্দ্র অসৎকার্য্যে সৰ্ব্বদাই অর্থ জলের ন্যায় ব্যয় করিতেন, সেই রামচন্দ্র তাঁহার স্ত্রীকে এত টাকা মূল্যের অলঙ্কার খরিদ করিয়া দিয়াছিলেন, ইহা বড়ই আশ্চর্য্য; কিন্তু ঐ অলঙ্কার খরিদ করিয়া দিবার তাঁহার এক বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। তাঁহার আন্তরিক ইচ্ছা ছিল যে, যখন তাঁহার টাকার বিশেষ প্রয়োজন হইবে, তখন তিনি কোন উপায় অবলম্বন করিয়া ঐ অলঙ্কারখানি তাঁহার স্ত্রীর নিকট হইতে গ্রহণ করিয়া উহা হইতে মূল্যবান আসল প্রস্তরগুলি খুলিয়া লইয়া তাহা বিক্রয়পূর্ব্বক আপন কার্য্য সম্পন্ন করিবেন ও সেই প্রকারের নকল প্রস্তর বসাইয়া উহা আপন স্ত্রীকে প্রদান করিবেন। তাঁহার স্ত্রী ইহার কিছুই অবগত হইতে পারিবেন না, অথচ তাঁহার মনোভিলাষ পূর্ণ হইবে।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
রামচন্দ্র তাঁহার স্ত্রীকে পূর্ব্বকথিত অলঙ্কারখানি খরিদ করিয়া দিবার দুই বৎসরের মধ্যে তাঁহার অবস্থা অতিশয় শোচনীয় হইয়া উঠিল। বাজারের দেনায় তাঁহাকে একেবারে অস্থির করিয়া তুলিল। অথচ বাজারে সম্ভ্রম রাখিতে না পারিলে তাঁহার বড়ই বিপদ। সুতরাং টাকার নিমিত্ত তাঁহাকে বড়ই বিপদগ্রস্ত হইতে হইল। মনে মনে যে অভিসন্ধি করিয়া তিনি তাঁহার স্ত্রীকে মূল্যবান কণ্ঠাভরণ খরিদ করিয়া দিয়াছিলেন, তখন তিনি তাঁহার সেই অভিসন্ধি পূর্ণ করিবার মানসে তাঁহার স্ত্রীর নিকট গমন করিলেন ও রাঙ্গা বউকে কহিলেন “তোমার সেই হীরা ও মাণিক নিৰ্ম্মিত হার ছড়াটি কোথায়?”
রাঙ্গা বউ পূর্ব্ব হইতেই তাঁহার অভিসন্ধির বিষয় অবগত হইতে পারিয়া কহিলেন “কেন? আমার অলঙ্কারের ত তুমি কখন কোনরূপ সন্ধান লও না, এখন অনুসন্ধান করিতেছ কেন?
রাম। একটু বিশেষ প্রয়োজন হইয়াছে বলিয়া।
রাঙ্গা বউ। কি বিশেষ প্রয়োজন, তাহা জানিতে পারি না কি?
রাম। আমার একটি বন্ধু তাঁহার স্ত্রীর নিমিত্ত ঐরূপ একছড়া কণ্ঠাভরণ প্রস্তুত করিবেন, তাই তিনি উহা দেখিতে চাহেন। উহা দেখাইয়া তিনি ঠিক সেইরূপ আর একখানি প্রস্তুত করিয়া লইবেন।
রাঙ্গা বউ। উহা আমার নিকট আছে। যখন প্রয়োজন হইবে, তাঁহাকে কহিবেন, এই স্থানে আসিয়া দেখিয়া যান।
রাম। এইস্থানে আসিয়া কেবল দেখিয়া গেলে চলিবে না। যে কারিকর উহা প্রস্তুত করিবে, উহা দুই চারি দিবসের নিমিত্ত তাহার নিকট রাখিতে হইবে। সম্মুখে নমুনা না রাখিয়া সে ঐ রূপ দ্রব্য প্রস্তুত করিবে কি প্রকারে?
রাঙ্গা বউ। আর সে লইয়া গিয়া যদি উহা আর ফিরাইয়া না দেয়, তাহা হইলে কি হইবে?
রাম। তাহা কি কখন সম্ভব? যে আমার নিকট হইতে উহা লইয়া যাইতে ইচ্ছা করিয়াছে, সে সেইরূপ প্রকৃতির লোক নহে। তাহাকে বিশ্বাস করিয়া অনায়াসেই আমি ২৫ সহস্র মূল্যের দ্রব্য প্রদান করিতে পারি। তাহার নিমিত্ত তোমার কোনরূপ চিন্তা নাই। তুমি উহা আমাকে প্রদান কর।
রাঙ্গা বউ। আমি উহা দিব না।
রাম। কেন দিবে না?
রাঙ্গা বউ। কেন- তাহা কি বলিব? আমার দ্রব্য যদি কাহাকেও প্রদান না করি।
রাম। আমি তাহাকে উহা দিতে চাহিয়াছি; এখন যদি না দি, তাহা হইলে আমাকে বিশেষরূপে অপদস্ত হইতে হইবে। এরূপ অবস্থায় তুমি কখন অন্যমত করিও না, উহা আমাকে প্রদান কর।
রাঙ্গা বউ। আমি ত পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি যে, আমি আমার গহনা কাহাকেও দিব না।
রাম। তাহা হইবে না, তোমাকে উহা দিতেই হইবে।
রাঙ্গা বউ। আমি কিছুতেই দিব না।
রাম। না দাও ত আমি তোমার বাক্স ভাঙ্গিয়া এখনই বাহির করিয়া লইয়া যাইব। ছোট ঘরের মেয়ের প্রায়ই এইরূপ অবস্থা হইয়া থাকে।
রাঙ্গা বউ। বাক্স ভাঙ্গিবার প্রয়োজন কি? এই নাও আমার সিন্ধুকের চাবি, তোমার যাহা ইচ্ছা হয়, তাহাই কর। কিন্তু আমি আর তোমার মুখাবলোকন করিব না, বা তোমার অর্থ গ্রহণ করিব না। আমি ছোট ঘরের মেয়ে, ছোট ঘরে গিয়াই থাকিব, বড় ঘরে আমার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই।
এই বলিয়া রাঙ্গা বউ তাঁহার চাবির গোছা রামচন্দ্রের সম্মুখে ফেলিয়া দিয়া সেইস্থান হইতে গাত্রোত্থান করিয়া অপর প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিলেন।
রামচন্দ্র অম্লান বদনে রাঙ্গা বউ’র বাক্স খুলিয়া তাহা হইতে সেই কণ্ঠাভরণখানি বাহির করিয়া লইয়া বাহিরে গমন করিলেন।
মাষ্টারবাবু বাহিরে ঐ অলঙ্কারের প্রত্যাশায় বসিয়াছিলেন। রামচন্দ্র উহা লইয়া গিয়া মাষ্টারবাবুর হস্তে প্রদান করিলেন। ইতিপূর্ব্বে রামচন্দ্র তাঁহার মনোভিলাষ মাষ্টারবাবুর নিকট প্রকাশ করিয়াছিলেন; সুতরাং তিনি অবগত ছিলেন যে, উহা লইয়া মাষ্টারবাবুকে কি করিতে হইবে। যাহা করিতে হইবে, মাষ্টারবাবুও তাহা ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলেন। বড় বাজারের একজন জহুরীর সহিত তাঁহার এইরূপ কথাবার্তা স্থির ছিল যে, উহাতে যে সকল মূল্যবান প্রস্তর আছে, তাহা খুলিয়া লইয়া তাহার পরিবর্তে ঠিক সেইরূপ কৃত্রিম প্রস্তর সকল বসাইয়া দিয়া, মূল্যবান প্রস্তরগুলি বিক্রয় করিয়া দিবেন। অলঙ্কারখানি মাষ্টারবাবুর হস্তগত হইবামাত্র তিনি সেইস্থানে আর তিলার্দ্ধ বিলম্ব না করিয়া উহা লইয়া একেবারে প্রস্থান করিলেন।
রাঙ্গা বউ ক্রোধ ভাব প্রকাশ করিয়া তাঁহার চাবি সকল রামচন্দ্রের নিকট ফেলিয়া দিয়া অপর আর একটি গৃহে প্রবেশ করিয়াছিলেন সত্য, কিন্তু তিনি যে আন্তরিক ক্রোধান্বিত হইয়াছিলেন, তাহা নহে, ক্রোধ দেখাইয়াছিলেন মাত্র; কারণ ঐরূপ কৃত্রিম ক্রোধ প্রকাশ করিবার তাঁহার বিশেষ কারণ ছিল। সেই কারণ যে কি, তাহা পাঠক ক্ৰমে জানিতে পারিবেন। রামচন্দ্র তাঁহার প্রকোষ্ঠ হইতে বহির্গত হইয়া যাইবার পরই তিনি সেই ঘরে প্রবেশ করিয়া তাঁহার নিজের অপরাপর অলঙ্কারগুলি দেখিয়া লইয়া পুনরায় আপন বাক্স বন্ধ করিয়া দিলেন।
মাষ্টারবাবু ঐ অলঙ্কার লইয়া প্রস্থান করিলেন। সেই দিবস আর তিনি প্রত্যাগমন করিলেন না। তাহার পর দিবস সন্ধ্যার পর তিনি ঐ অলঙ্কার-সহ প্রত্যাগমন করিলেন। যে সময় তিনি প্রত্যাগমন করিলেন, সেই সময় রামচন্দ্র তাঁহার বৈঠকখানায় একাকী বসিয়াছিলেন। মাষ্টারবাবুকে দেখিবামাত্র রামচন্দ্র কহিলেন “কি মাষ্টার! এত দেরি কেন? সমস্ত কাৰ্য্য শেষ হইয়া গিয়াছে তো?”
মাষ্টার। আমি শেষ হইতে বসিয়াছিলাম, কোন গতিকে আপন জীবন বাঁচাইয়া আসিয়াছি। আমার সহিত কি আপনাকে এইরূপে প্রতারণা করিতে হয়?
রাম। কি হইয়াছে মাষ্টার?
মাষ্টার। যা হইয়াছে, তা বেশই হইয়াছে! বড় লোকের সহিত সদাসর্বদা থাকিতে হইলে তাহার পরিণাম প্রায় এইরূপই হইয়া থাকে।
রাম। আমি তোমার কথা কিছুমাত্র বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। কি হইয়াছে পরিষ্কার করিয়া বল দেখি।
মাষ্টার। আমি গহনাখানি লইয়া গিয়া সেই জহুরীর হস্তে প্রদান করিবামাত্রই সে আমাকে কহিল “তুমি কি আর জুয়াচুরি করিবার স্থান পাও নাই, তাই আমার সহিত জুয়াচুরি করিতে আসিয়াছ? তুমি জান, আমি এখনই তোমাকে পুলিসের হস্তে সমর্পণ করিয়া ১৪ বৎসরের নিমিত্ত তোমাকে জেলে পাঠাইয়া দিতে পারি?” তাহার কথা শুনিয়া আমি কহিলাম “কেন মহাশয়, আমি এমন কি অপরাধ করিয়াছি যে, আপনি আমাকে পুলিসের হস্তে সমর্পণ করিতে চাহেন? আমি তো ইহা কাহার নিকট হইতে চুরি করিয়া আনি নাই। এই অলঙ্কার যাঁহার, তিনি একজন বড়লোক ও এখন পর্য্যন্ত তিনি বর্তমান আছেন। আমার কথায় যদি আপনার কোনরূপ সন্দেহ হয়, তাহা হইলে আপনি আমার সহিত তাঁহার নিকট আগমন করুন, তাহা হইলেই জানিতে পারিবেন, আমি চোর কি সাধু।’ আমার কথা শুনিয়া তিনি কহিলেন, “তুমি চোর নও, কিন্তু চোরের অপেক্ষাও অধম, তুমি জুয়াচোর। তুমি কোন্ সাহসে আমার সহিত জুয়াচুরি করিতে আসিলে? বহু মূল্যবান প্রস্তুর খচিত বলিয়া যে অলঙ্কার আমার হস্তে প্রদান করিয়াছ, ইহা কি? ইহাতে একখানিও মূল্যবান প্রস্তর নাই, সমস্তই নকল— ঝুটা। আমার সহিত তুমি যেরূপ করিলে, এরূপ আর কাহার সহিত করিও না।’ এই বলিয়া সেই জহুরী আমার হস্তে ঐ অলঙ্কারখানি প্রদান করিলেন। উহা লইয়া আমি আপনার নিকট আসিতেছি। মহাশয় এরূপভাবে আমাকে বিপদগ্রস্ত করা আপনার ভাল হয় নাই।
রাম। কি বলিলে, আমার এই অলঙ্কারে একখানিও আসিল প্রস্তর নাই, সমস্তই নকল? ইহা কখনই হইতে পারে না। কারণ আমি যাহার নিকট হইতে উহা খরিদ করিয়াছিলাম, সে একজন বড়দরের জহুরী। গবর্ণমেন্ট হইতে তাহার খেতাব আছে। তৎব্যতীত ঐ অলঙ্কার খরিদ করিবার পর আমি উহা আরও কয়েকজন জহুরীকে দেখাইয়াছিলাম, তাঁহারা সকলেই আমাকে এক দাম বলিয়াছিল। যখন আমি উহা বিক্রয় করিব, তখনই আমি ২৫ হাজার টাকা প্রাপ্ত হইব, অধিক হইলেও হইতে পারে; কারণ উহাতে যে সকল প্রস্তর ছিল, তাহা অতিশয় বড় ও নিখুঁত, বাজারে সেই প্রকার প্রস্তর প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায় না। উহা খরিদ করিবার পর হইতেই আমার বাড়ীতে আছে, এক দিবসের নিমিত্তও অপরের হস্তে পতিত হয় নাই। এরূপ অবস্থায় ঐ সকল প্রস্তর একেবারে ঝুটা প্রস্তরে কিরূপে পরিণত হইবে, তাহা আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারি না। তুমি যে জহুরীর হস্তে ইহা প্রদান করিয়াছিলে, হয় সেই কোনরূপে উহা বদ্লাইয়া লইয়াছে, নতুবা ভাল ভাল প্রস্তরগুলি তুমি নিজেই আত্মসাৎ করিয়া তাহার পরিবর্তে কৃত্রিম প্রস্তর বসাইয়া দিয়াছ।
মাষ্টার। এ মন্দ কথা নহে, পরিশেষে আমিই চোর হইলাম! কারণ আমি যে জহুরীর হস্তে উহা প্রদান করিয়াছিলাম, সে এক মুহূর্ত্তের নিমিত্তও উহা আমার চক্ষুর অন্তরালে লইয়া যায় নাই; সুতরাং তাহার দ্বারা এরূপ কার্য্য যে হয় নাই, তাহার চাক্ষুষ প্রমাণ
আমি। এরূপ অবস্থায় আমিই চোর; কারণ আমার কথা আর এখন কে বিশ্বাস করিবে? বড়লোকের সংসর্গে থাকিলে দরিদ্রলোকের অদৃষ্টে প্রায়ই যাহা ঘটিয়া থাকে, আমার অদৃষ্টতেও যে তাহা ঘটিবে না, তাহাই বা আমি বলি কি প্রকারে? আপনার জন্য আমি যে সকল অসৎকার্য্য সম্পন্ন করিয়াছি, তাহার প্রতিফল আমার নিশ্চয়ই পাওয়া কৰ্ত্তব্য। এখন বুঝিতে পারিতেছি যে, আমার সেই প্রতিফল প্রাপ্ত হইবার সময় আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। আপনার যদি বিশ্বাস হয়, যে আপনার বহুমূল্য প্রস্তরগুলি যদি আমি চুরি করিয়া থাকি, তাহা হইলে আপনি আমাকে যে কোন দণ্ডে দণ্ডিত করিতে পারেন।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
মাষ্টারবাবুর কথা শুনিয়া রামচন্দ্র তাহার কোনরূপ উত্তর প্রদান না করিয়া তাহাকে সেই স্থানে বসিতে বলিলেন। মাষ্টারবাবু সেই স্থানে উপবেশন করিলে, ঐ অলঙ্কারখানি তিনি নিজ হস্তে গ্রহণ করিয়া একজন দরয়ানকে ডাকিলেন। ডাকিবামাত্রই দরয়ান আসিয়া তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইল। তখন তিনি সেই দরয়ানের প্রতি আদেশ প্রদান করিলেন, “এই মাষ্টারবাবুকে এই স্থানে বসাইয়া রাখ। আমার বিনা আদেশে উহাকে এই স্থান হইতে উঠিতে বা কোন স্থানে গমন করিতে দিও না।” এই বলিয়া কাগজ কলম লইয়া রামচন্দ্র একখানি পত্র লিখিলেন। ঐ পত্র লেখা সমাপন হইলে, আর একজন দরয়ানকে ডাকিয়া তাহাকে কহিলেন, “তুমি শীঘ্র এই পত্রখানি পুলিসে লইয়া যাও।” আদেশ পাইবামাত্র দরয়ান ঐ পত্রসহ দ্রুতবেগে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। মাষ্টারবাবু ও রামচন্দ্র সেই স্থানেই বসিয়া রহিলেন।
ঐ পত্রখানি পরিশেষে আমার হস্তে আসিয়া পতিত হইয়াছিল। উহা আমার ঊর্দ্ধতন কর্মচারী সাহেব আমার নিকট পাঠাইয়া দেন ও তাহাতে আমার উপর এই আদেশ প্রদান করেন যে, “এই পত্র পাঠমাত্র তুমি এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইবে।” ঐ পত্রখানি আমার হস্তে আসিয়া উপনীত হইবার পর, আমি উহা পাঠ করিলাম। উহাতে কেবল এই কয়েকটি মাত্র কথা লেখা ছিল। “২৫,০০০ সহস্র টাকা মূল্যের কতকগুলি মূল্যবান প্রস্তর এখনই চুরি হইয়া গিয়াছে! যিনি চুরি করিয়াছেন, তাহাও আমি জানিতে পারিয়া আমার বাড়ীতেই তাহাকে রাখিয়াছি। আপনারা যত শীঘ্র পারেন, এই স্থানে আসিয়া উহার অনুসন্ধান করিবেন। বিলম্ব করিলে অপহৃত দ্রব্য স্থানান্তরিত হইয়া যাইবার সম্ভাবনা।”
উপরিতন কর্মচারীর এই আদেশপত্রখানি পাইবামাত্র আমি রামচন্দ্রবাবুর বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, সেইস্থানে স্থানীয় পুলিস আমার পূর্ব্বেই গমন করিয়াছেন ও অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছেন। আমি সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া তাহাদিগের নিকট হইতে ও রামচন্দ্র ও মাষ্টারবাবুর প্রমুখাৎ যাহা কিছু অবগত হইতে পারিলাম, পাঠকগণও ইতিপূৰ্ব্বে তাহা অবগত হইতে পারিয়াছেন; সুতরাং সে বিষয়ের পুনরুক্তি করিবার আর কিছু মাত্র প্রয়োজন নাই।
সমস্ত অবস্থা আমি উত্তমরূপে অবগত হইয়া ও অলঙ্কারখানি উত্তমরূপে দেখিয়া, প্রথমতঃ কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না, যে এই কার্য্য কাহার দ্বারা সম্পন্ন হইল। কারণ, যে প্রকারের প্রস্তর সকল উহাতে বসান আছে, সেই অনুরূপ প্রস্তর সকল সংগ্রহ করিয়া, উহাতে বসান ও আসল প্রস্তরগুলি অপহরণ করা নিতান্ত অল্প সময়ের কার্য্য নহে। তবে ইহা হইতে পারে যে, অলঙ্কারখানি পূর্ব্বে উত্তমরূপে দেখিয়া, সেই প্রকারের আর একখানি অলঙ্কার সেইরূপ অনুকরণ প্রস্তরের দ্বারা প্রস্তুত করিয়া রাখিতে পারিলে, অল্প সময়ের মধ্যে উহা পরিবর্তন করিয়া লওয়া যাইতে পারে। কিন্তু সেই সুযোগ যাহার ঘটিতে পারে, তাহা উত্তমরূপে অগ্রে অবগত হইতে না পারিলে, এই অনুসন্ধানে হস্তক্ষেপণ করিলেই যে সহজে সমস্ত বিষয় বাহির হইয়া পড়িবে, তাহা কোন রূপেই অনুমান করা যাইতে পারে না। সুতরাং সেই পন্থা অবলম্বন করিয়া আমাকে প্রথমেই এই সন্ধানে নিযুক্ত হইতে হইল।
প্রথমেই আমি রামচন্দ্রবাবুকে নিম্নলিখিতরূপ দুই চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করিলাম।
আমি। আপনি অলঙ্কারখানি প্রস্তুত করিয়া লইয়াছিলেন, কি কাহার নিকট হইতে খরিদ করিয়াছিলেন?
রাম। আমি উহা খরিদ করিয়াছিলাম।
আমি। কাহার নিকট হইতে খরিদ করিয়াছিলেন?
রাম। বড়বাজারের একজন প্রসিদ্ধ জহুরী। গবর্ণমেণ্ট হইতে তাহার উপাধি আছে।
আমি। তিনি এখন কোথায়?
রাম। তিনি কলিকাতাতেই আছেন।
আমি। তাহার নিকট হইতে উহা খরিদ করিবার পর, আপনি উহা আর কাহার নিকট যাচাইয়া লইয়াছিলেন?
রাম। যাচাইয়াছিলাম।
আমি। কোথায় যাচাইয়াছিলেন? তাহাদিগের বাড়ীতে যাচাইবার নিমিত্ত পাঠাইয়া দিয়াছিলেন?
রাম। না, দুই একজন জহুরি সেই সময় আমার বাড়ীতে আইসে, আমি তাহাদিগকে দেখাইয়াছিলাম। উহারা আমার সম্মুখেই দেখিয়া আমাকে ফিরাইয়া দেয়।
আমি। ঐ দ্রব্য উহারা বাহিরে লইয়া যায় না?
রাম। না।
আমি। খরিদ করিবার পর ঐ অলঙ্কার আপনি কোথায় রাখিয়াছিলেন?
রাম। আমি উহা আমার স্ত্রীকে প্রদান করিয়াছিলাম।
আমি। তিনি সদাসর্ব্বদা উহা কোথায় রাখিতেন?
রাম। তাঁহার নিজের নিকটেই তাঁহার বাক্সের মধ্যে রাখিতেন।
আমি। বাক্সের চাবি কাহার নিকট থাকিত?
রাম। চাবি তিনি কাহাকেও প্রদান করিতেন না, সদাসর্ব্বদা নিজের নিকটেই রাখিতেন।
আমি। ঐ অলঙ্কার দেখিবার নিমিত্ত বা পরিবার নিমিত্ত আর কোন ব্যক্তি কখন চাহিয়া লইয়া গিয়াছিল?
রাম। আমার জানিত মতে কোন ব্যক্তি উহা কখন লইয়া যায় নাই।
আমি। আপনার স্ত্রীর নিকট হইতে?
রাম। তাহা আমি অবগত নহি।
আমি। মাষ্টারবাবুর হস্তে যখন আপনি উহা অর্পণ করেন, সেই সময় ইহা ঠিক এইরূপ ছিল, কি কিছু প্রভেদ ছিল বলিয়া অনুমান হয়?
রাম। তাহা আমি ঠিক বলিতে পারিতেছি না, এখনও আমি যেরূপ দেখিতেছি, তখনও আমি ঠিক সেইরূপ দেখিয়াছিলাম, কোনরূপ বৈলক্ষণ্য আমি বুঝিতে পারিতেছি না।
রামচন্দ্রকে কেবল এই কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করিয়া মাষ্টারবাবুকে নিম্নলিখিত কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম।
আমি। কেমন মহাশয় আপনি ইহা লইয়া গিয়াছিলেন?
মাষ্টার। হাঁ, আমি লইয়া গিয়াছিলাম।
আমি। কেন লইয়া গিয়াছিলেন?
মাষ্টার। এই কথার উত্তর আমি দিতে সাহসী হই না। কেন লইয়া গিয়াছিলাম, তাহা না জিজ্ঞাসা করিলে যদি চলে, তাহা হইলে ঐ কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিবেন না। আর যদি নিতান্তই ঐ কথার উত্তর দিতে হয়, তাহা হইলে রামবাবুকে একবার জিজ্ঞাসা করুন, যে, আমি এই প্রশ্নের উত্তর দিব কি না?
আমি। রামবাবুকে আমি এ সম্বন্ধে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাহি না। আপনাকে আমি যাহা জিজ্ঞাসা করিতেছি, আইন অনুসারে তাহার উত্তর প্রদান করিতে আপনি বাধ্য। যদি উত্তর প্রদান করিতে অসম্মত হন, তাহা হইলে আপনি আমাকে অনায়াসেই বলিতে পারেন যে, আপনি আমার কোন কথার উত্তর দিবেন না। তাহা হইলে, আমিও আপনাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিব না।
মাষ্টার। আপনার কথার আমি উত্তর প্রদান করিব না, ইহা আমি বলিতেছি না। কি প্রশ্নের উত্তর দিতে হইবে বলুন।
আমি। এই অলঙ্কার তুমি কেন লইয়া গিয়াছিলে?
মাষ্টার। রামবাবু কিছু দেনায় পড়িয়াছেন। ঐ দেনা পরিশোধ করিবার নিমিত্ত তিনি এই অভিসন্ধি করেন যে, এই অলঙ্কার হইতে মূল্যবান্ প্রস্তরগুলি বাহির করিয়া লইয়া তাহা বিক্রয়পূর্বক তাঁহার দেনার কতক অংশ পরিশোধ করিবেন। আর ঐ মূল্যবান প্রস্তরগুলির পরিবর্তে কৃত্রিম প্রস্তর ঐ ঐ স্থানে বসাইয়া দিয়া, উহার স্ত্রীর যেরূপ অলঙ্কার ছিল, সেইরূপ অলঙ্কার তাঁহাকে অর্পণ করিবেন। আমি সেই জন্য উহা লইয়া গিয়াছিলাম।
আমি। যে নিজের সহধর্মিণী বা নিজের সহিত জুয়াচুরি করিতে চাহে, তাহার প্রায় ঐরূপ দশাই ঘটিয়া থাকে। যে জহুরীর কাছে তুমি উহা লইয়া গিয়াছিলে, তাহার সহিত পূর্ব্ব হইতে কোনরূপ বন্দোবস্ত ছিল কি?
মাষ্টার। ছিল।
আমি। কিরূপ বন্দোবস্ত ছিল?
মাষ্টার। তিনি আসল প্রস্তরগুলি খুলিয়া লইয়া তাহার পরিবর্তে কৃত্রিম প্রস্তর বসাইয়া দিবেন, এবং আসল প্রস্তরগুলি বাছাই করিয়া যে দাম হইবে, তাহাও অর্পণ করিবেন।
আমি। এরূপ বন্দোবস্ত হইবার পূর্ব্বে সেই জহুরী ঐ অলঙ্কারখানি দেখিয়াছিল?
মাষ্টার। না।
আমি। অলঙ্কার না দেখিয়াই এরূপ স্থির হয়?
মাষ্টার। হাঁ।
আমি। তুমি অলঙ্কারখানি কল্য এখান হইতে লইয়া গিয়াছিলে না?
মাষ্টার। হাঁ!
আমি। কল্য উহা কোথায় রাখিয়াছিলে?
মাষ্টার। আমার বাড়ীতে।
আমি। পরের অলঙ্কার লইয়া গিয়া তুমি তোমার নিজের বাড়ীতে রাখিয়াছিলে কেন? মাষ্টার। আমার আহাম্মকি! নতুবা আমি চৌর্য্য অপরাধে অভিযুক্ত হইব কেন?
আমি। তোমার নিকট উহা কে কে দেখিয়াছে?
মাষ্টার। আর কেহই দেখে নাই, কেবল আমার স্ত্রীকে উহা একবার দেখাইয়াছিলাম মাত্র।
আমি। তাহা হইলে, উহা তোমার বাড়ীতে যে পৰ্য্যন্ত ছিল, সেই পর্য্যন্ত উহা তোমার স্ত্রীর নিকটেই ছিল?
মাষ্টার। না।
আমি। তবে কোথায় ছিল?
মাষ্টার। আমার স্ত্রীকে একবার দেখাইয়াছিলাম মাত্র; কিন্তু উহা আমি তাহার নিকট রাখিয়া না দিয়া আমার নিজের নিকটেই রাখিয়া দিয়াছিলাম।
আমি। আজ কোন্ সময় তুমি বাজারে লইয়া যাও?
মাষ্টার। আহারাদির পর।
আমি। যে জহুরীর নিকট উহা লইয়া যাইবার কথা ছিল, তাহার নিকট উহা লইয়া যাইবার পূর্ব্বে আর কয়জন জহুরীকে তুমি উহা দেখাইয়াছিলে?
মাষ্টার। আমি উহা আর কোন জহুরীকে দেখাই না, এক-একেই উহার নিকট লইয়া যাই
আমি। যখন তুমি ঐ জহুরীর নিকট উহা লইয়া যাও, তখন সে কি করিতেছিল?
মাষ্টার। সে তাহার গদিতে বসিয়াছিল।
আমি। সেই সময় সেই স্থানে আর কোন লোক উপস্থিত ছিল?
মাষ্টার। ছিল, তাহার কয়েকজন কর্মচারী ব্যতীত আরও কয়েকজন লোক সেই স্থানে উপস্থিত ছিল।
আমি। ঐ অলঙ্কারখানি সেই জহুরীর হস্তে প্রদান করিবার কতক্ষণ পরে তিনি কহেন যে, উহার প্রস্তরগুলি কৃত্রিম?
মাষ্টার। আমি যখন তাহার হস্তে উহা প্রদান করি, অমনি তিনি দেখিয়াই কহেন, ইহা কৃত্রিম।
আমি। উহা কৃত্রিম, এই কথা বলিয়া এই গহনাখানি লইয়া তিনি কি করিলেন?
মাষ্টার। প্রথমতঃ তিনি ইহা নিজের সম্মুখে রাখিলেন, ও পরে আবার অন্য জনের হস্তে প্রদান করিলেন। তিনি যখন দেখিতেছিলেন সেই সময় তাঁহার হস্ত হইতে আর একজন গ্রহণ করিল, ও সেইস্থানে যে কয়েকজন লোক উপস্থিত ছিল, সকলেই একে একে উহা দেখিয়া পুনরায় সেই জহুরীর হস্তে অর্পণ করিল। তাহার পর তিনি উহা আমাকে প্রদান করেন।
আমি। আপনার হস্ত হইতে উহা অপর হস্তে যাওয়ার পর ও পুনরায় আপনার হস্তে উহা প্রত্যাগমন করিবার মধ্যে উহা কি কখন আপনার চক্ষুর বাহিরে গমন করিয়াছিল?
মাষ্টার। না।
আমি। উহা কিরূপের অলঙ্কার ও কি প্রকারে কত বড় বড় প্রস্তর আছে, তাহা কি আপনি পূর্ব্বে সেই জহুরীকে বলিয়াছিলেন?
মাষ্টার। না, ইতিপূৰ্ব্বে আমি নিজেই উহা দেখিয়াছিলাম না; সুতরাং উহা যে কিরূপের, তাহা কি প্রকারে তাঁহাকে বলিব?
আমি। উহাতে যে সকল প্রস্তর বসান আছে, তাহার মূল্য কত, তাহা তুমি জান কি?
মাষ্টার। আমি নিজে উহার কিছুই জানি না, বা বুঝি না। তবে রামবাবু বলিয়াছিলেন, ইহাব মূল্য ২৫০০০ সহস্র টাকা, তাহাই শুনিয়াছি। সত্য মিথ্যা অবগত নহি।
আমি। আমি শুনিয়াছি, রামবাবুর বাল্যকাল হইতে আপনি এই সংসারে আছেন। রামবাবুর পিতা আপনাকে এখানে আনয়ন করেন। সেই সময় হইতেই আপনি প্রায় সর্ব্বদাই রামবাবুর কাছেই থাকেন; সুতরাং রামবাবুর সমস্ত অবস্থা আপনি উত্তমরূপে অবগত আছেন। যে অলঙ্কার লইয়া এখন গোলযোগ উপস্থিত হইয়াছে, সেই অলঙ্কার যখন রামবাবু খরিদ করেন, সেই সময় আপনি তাঁহার পারিষদ ছিলেন। সুতরাং যখন তিনি উহা খরিদ করিয়াছিলেন, তখন নিশ্চয়ই আপনি তাহা দেখিয়াছিলেন। এরূপ অবস্থায় আপনি নিরর্থক মিথ্যা কথা কহিতেছেন কেন? আপনি এখনই বলিলেন যে, ইতিপূর্ব্বে ইহা আর কখন দর্শন করেন নাই। আপনার এ কথা আমি সহজে বিশ্বাস করি কি প্রকারে?
মাষ্টার। আপনি যাহা বলিলেন, তাহা সত্য; অথচ আমিও আপনার নিকট মিথ্যা কথা কহি নাই। আপনি রামবাবুকে জিজ্ঞাসা করিতে পারেন। যদি তাঁহার মনে থাকে, তাহা হইলে, তিনিও কহিবেন যে, আমি সত্য কথা কহিতেছি কি মিথ্যা কথা কহিতেছি। যে সময় এই অলঙ্কার রামবাবু খরিদ করেন, সেই সময় আমি তাঁহার পারিষদ ছিলাম বটে, কিন্তু ঠিক সেই সময় আমি কলিকাতায় উপস্থিত ছিলাম না; রামবাবুই তাঁহার কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে আমাকে তাঁহার জমিদারীতে পাঠাইয়া দেন। আমি যে সময় তাঁহার জমিদারীতে তাঁহারই কার্য্যে নিযুক্ত ছিলাম, সেই সময় তিনি কলিকাতায় ঐ অলঙ্কার খরিদ করেন; সুতরাং উহা দেখিবার সুযোগ আমার আর ঘটে না। তবে তাঁহারই প্রমুখাৎ শুনিয়াছিলাম যে, তিনি একখানি মূল্যবান অলঙ্কার খরিদ করিয়াছেন।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
রামবাবু ও মাষ্টারবাবুর কথা শুনিয়া আমি কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। যদি মাষ্টারবাবুর কথা প্রকৃত হয়, তাহা হইলে যে জহুরীর হস্তে উহা পতিত হইয়াছিল, তাহার দ্বারা ঐ কার্য্য কোনরূপেই সম্পন্ন হইতে পারে না; কারণ, উহা ক্ষণকালের নিমিত্ত মাষ্টারবাবুর নয়নের অন্তরাল হয় নাই। তাহা হইলে মাষ্টারবাবুর দ্বারাই কি এই কার্য সম্পন্ন হইল? মাষ্টারবাবু এক দিবসের সময় পাইয়াছিলেন। সেই এক দিবসের মধ্যে কি তিনি অপর কোন জহুরীর দ্বারা এই কার্য্য সম্পন্ন করাইয়া লইলেন? ইহা একেবারে অসম্ভব না হইলেও কি মাষ্টারবাবু এইরূপ কার্য্য করিতে সাহসী হইবেন? আর মাষ্টারবাবু কি ইহা একবারের নিমিত্তও ভাবিবেন না যে, তাঁহার মত অবস্থার লোক ঐ মূল্যবান প্রস্তর সকল সহজে বিক্রয় করিতে সমর্থ হইবেন না। মাষ্টারবাবুর দ্বারা যদি এই কার্য্য সম্পন্ন না হইয়া থাকে, তাহা হইলে আর কাহার দ্বারা এই কার্য্য হইবার সম্ভাবনা? গত দুই বৎসর পর্য্যন্ত এই অলঙ্কারখানি রাঙ্গা বউর নিকট ছিল। রামবাবু উহা তাঁহাকে প্রদান করিয়াছিলেন, সুতরাং তাঁহার দ্বারা ঐ কার্য সম্পন্ন হইতে পারে না। তিনি তাঁহার কি অভাবের নিমিত্ত নিজের দ্রব্য অপহরণ করিবেন? তবে এককথা এই হইতে পারে যে, ঐ অলঙ্কারখানি যদি তাঁহার নিকট হইতে কেহ বাহিরে লইয়া গিয়া থাকে, তাহা হইলে সেই ব্যক্তির দ্বারা এই কার্য্য হইলেও হইতে পারে। কিন্তু একথা কি প্রকারে জানিতে পারিব? রাঙ্গা বউ বড়লোকের পত্নী, তাঁহাকে ইহা আমার কি প্রকারে জিজ্ঞাসা করি? রামবাবুই বা তাঁহার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিতে আমাদিগকে অনুমতি প্রদান করিবেন কেন? রামবাবু গিয়া তাঁহার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিয়া আসিতে পারেন সত্য, কিন্তু যে স্ত্রীর নিকট হইতে তিনি বলপূর্ব্বক ইহা লইয়া আসিয়াছেন, সেই স্ত্রী ঐ দ্রব্য সম্বন্ধে রামবাবুকে প্রকৃত কথা বলিবেন কি? বলুন বা না বলুন, ইহা ভিন্ন আর কোন প্রকার উপায় নাই, এই বলিয়া রামবাবুকে তাঁহার স্ত্রীর নিকট ঐ কথা জিজ্ঞাসা করিবার নিমিত্ত পাঠাইয়া দিলাম। কিছুক্ষণ পরে তিনি বাড়ীর ভিতর হইতে বাহিরে আসিয়া ছিলেন, “যে পর্য্যন্ত ঐ অলঙ্কার তাঁহার নিকট ছিল, সেই পর্যন্ত তাঁহার নিকট হইতে উহা কেহ গ্রহণ করে নাই, বা তিনিও উহা কাহাকেও প্রদান করেন নাই।”
রামচন্দ্রের স্ত্রীর কথা শুনিয়া কিছুই অনুমান করিতে পারিলাম না যে, তিনি সত্য কহিলেন, কি মিথ্যা কহিলেন। সত্য বলুন বা মিথ্যা বলুন, যাহা তিনি কহিলেন, তাহাই আমাদিগকে বিশ্বাস করিয়া লইতে হইল।
এই সমস্ত বিষয় অবগত হইয়া তখন মনে করিলাম, যাহার নিকট হইতে রামবাবু উহা খরিদ করিয়াছেন, সেই জহুরীর দ্বারা যদি এই কাৰ্য্য হইয়া থাকে! অর্থাৎ বিক্রয় করিবার কালীন তিনিই যদি আসল দ্রব্য দেখাইয়া দিবার সময় যদি নকল দ্রব্য দিয়া থাকেন, তাহা হইলেও হইতে পারে। কিন্তু রামবাবু বলিতেছেন, সেই জহুরী একজন বিশেষ সম্ভ্রান্ত লোক। সম্ভ্রান্ত জহুরীর দ্বারা এই কার্য্য কি কখন সম্পন্ন হইতে পারে? একেবারে যে না পারে, তাহাও আমি বলিতে পারি না। কিন্তু রামবাবুর কথায় ইহাও অবগত হইতে পারা যাইতেছে যে, ঐ দ্রব্য খরিদ করিবার পরে দুই তিন জন জহুরী রামবাবুর বাড়ীতে উহা দেখিয়াছেন। যদি কৃত্রিম দ্রব্য হইত, তাহা হইলে তাহারা যে উহা দেখিয়া একেবারেই চিনিতে পারিত না, তাহাই বা বলি কি প্রকারে? এরূপ অবস্থায় আমি কখনই বলিতে পারি না যে, যে জহুরী উহা বিক্রয় করিয়াছে, তাহার দ্বারা এই কার্য্য সম্পন্ন হইয়াছে।
মনে মনে এইরূপ নানাপ্রকার চিন্তা আসিয়া উদিত হইল। কিন্তু কে প্রকৃত কথা বলিতেছে, বা কেই বা মিথ্যা কথা কহিতেছে, বা কোন্ পন্থাবলম্বনে এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইব, ভাবিয়া চিন্তিয়া তাহার কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। যে দিবস আমি এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছিলাম, এইরূপ নানাপ্রকার গোলযোগে সেই দিবস কাটিয়া গেল। কিন্তু ঐ অলঙ্কারখানি আমার নিকটেই রহিল।
অনুসন্ধানের অপর কোনরূপ পন্থা না পাইয়া, পর দিবস অতি প্রত্যূষে যে জহুরীর নিকট হইতে ঐ অলঙ্কার রামবাবু খরিদ করিয়াছিলেন, তাহার নিকট গমন করিলাম।
ঐ জহুরীর সহিত আমার পূর্ব্ব হইতেই জানাশুনা ছিল। তিনি যে একজন প্রধান জহুরী, তাঁহার আর কিছুমাত্র ভুল ছিল না। বিশেষ গবর্ণমেন্টের ঘরে তাঁহার একটু নাম থাকায় তিনি আপনাকে সর্ব্বেসর্বা মনে করিতেন; কিন্তু তাঁহার কথাবার্তার ততটা ঠিক ছিল না। এক সময় তাঁহার বাড়ী হইতে প্রায় দশ সহস্র টাকা মূল্যের অলঙ্কার অপহৃত হয়। তিনি থানায় আসিয়া নালিস করেন। দুই এক দিবস অনুসন্ধানের পর যখন তিনি বুঝিতে পারেন যে, তাঁহার অপহৃত দ্রব্য ধরা পড়িবার আর কোনরূপ সম্ভাবনা নাই, তখন তিনি সহস্র মুদ্রা, বা যে পরিমিত অপহৃত দ্রব্য পাওয়া যাইবে, তাহার দশ অংশের এক অংশ, পুরস্কার দিতে অঙ্গীকার করিয়া এক বিজ্ঞাপন বাহির করিয়া বিতরণ করেন। ঐ বিজ্ঞাপনের একখানি আমি রাখিয়া দিয়াছিলাম। এই ঘটনার প্রায় ছয় মাস পরে, সমস্ত অপহৃত দ্রব্যের সহিত চোর আমা কর্তৃক ধৃত হয়। সেই সময় সকলেই জানিতে পারেন যে, তাহারই একজন আত্মীয় এই চুরি করিয়াছিল। সমস্ত অপহৃত দ্রব্য প্রাপ্ত হইবার পর, তাঁহার সেই আত্মীয় চোরের উপর তিনি কোনরূপেই মোকদ্দমা চালাইতে সম্মত হন না; কিন্তু পুলিস তাহাকে ছাড়িয়া দেয় না। মোকদ্দমা মাজিষ্ট্রেটে যায়, সমন ও ওয়ারেন্ট দ্বারা ফরিয়াদী ও সাক্ষীগণকে হাজির করিয়া এই মোকদ্দমার বিচার হয়, বিচারে আসামীর কারাদণ্ডও হইয়া যায়। জহুরী মহাশয় তাঁহার অপহৃত দ্রব্যগুলি পুনঃপ্রাপ্ত হন, কিন্তু তাঁহার অঙ্গীকৃত সহস্র মুদ্রা পারিতোষিকের এক পয়সাও তিনি প্রদান করেন না ও কহেন, একে তাঁহার আত্মীয়ের জেল হইয়া গেল, তাহার উপর আবার তিনি পারিতোষিক প্রদান করিবেন, কখনই না।
এত বড় একজন জহুরীর কথা শুনিয়া তাঁহার উপর আমার নিতান্ত অভক্তি জন্মে, তাঁহার নামে নালিস করিয়া তাঁহার নিকট হইতে পারিতোষিকের টাকা আদায় করিয়া লইবার মানসে আমাদিগের সর্ব্বপ্রধান কর্মচারীর আদেশ প্রার্থনা করি। কিন্তু জানি না, কি ভাবিয়া তিনি নালিস করিতে আদেশ প্রদান করেন না, সুতরাং আমরাও আমাদিগের প্রাপ্য পারিতোষিকের টাকা আদায় করিতে সমর্থ হই না।
আমি সেই জহুরীর নিকট গমন করিবামাত্র তিনি আমাকে চিনিতে পারিলেন, ও জানি না, কেন, বিশেষ খাতির করিয়া তিনি আমাকে বসাইলেন।
আমি। কোন একটি বিশেষ কার্য্যের নিমিত্ত আমি আপনার নিকট আসিয়াছি।
জহুরী। কি প্রয়োজন?
আমি। আপনি রামচন্দ্র মিত্রকে চিনেন কি?
জহুরী। কোন রামচন্দ্র মিত্র? তাহাতো আমি ঠিক মনে করিয়া আনিতে পারিতেছি না, কেন?
আমি। সমস্তই বলিব বলিয়াই আমি আপনার নিকট আসিয়াছি। প্রায় দুই বৎসর অতীত হইল, এক ছড়া কণ্ঠাভরণ আপনি তাঁহার নিকট ২৫০০০ সহস্র টাকায় বিক্রয় করিয়াছিলেন?
জহুরী। ওরূপ অনেক অলঙ্কার তো আমি বিক্রয় করিয়া থাকি। সকল কথা মনে করিয়া বলা আমার পক্ষে সহজ নহে। অলঙ্কার দেখিলে, আমি বোধ হয় বলিতে পারি।
আমি। দেখুন দেখি এই অলঙ্কার খানি?
জহুরী। হাঁ এইরূপ একখানি অলঙ্কার আমি একটা বাঙ্গালীকে বেচিয়াছিলাম বলিয়া মনে হইতেছে, কিন্তু কত টাকায় বিক্রয় করিয়াছিলাম, তাহা মনে নাই; উহা এই অলঙ্কারও নহে। ইহাতে যে সমস্ত প্রস্তর বসান আছে, তাহা সমস্ত গুলিই কৃত্রিম। আমি যাহা বিক্রয় করিয়াছিলাম, তাহা ঠিকই প্রকারের, কিন্তু প্রস্তরগুলি খুব ভাল ছিল।
এই বলিয়া তিনি তাঁহার একজন কর্ম্মচারীকে পুরাতন খাতা বাহির করিতে বলিলেন, সেই কৰ্ম্মচারী অনেক খুঁজিয়া খুঁজিয়া একখানি খাতা বাহির করিয়া সেই জহুরীর হস্তে প্রদান করিলেন। তিনি উহা দেখিয়া কহিলেন, “২৫০০০ হাজার টাকায় আমি উহা রামচন্দ্র মিত্র নামক এক ব্যক্তির নিকট বিক্রয় করিয়াছিলাম।” আরও কহিলেন, “ঐ সকল প্রস্তরের পরিমাণ এবং ওজনও খাতায় লেখা আছে। আবশ্যক হইলে, তাহাও আমি আপনাকে প্ৰদান করিতে পারি। প্রস্তরগুলি খুব ভাল ছিল, ওরূপ প্রস্তর আর এখন প্রায়ই দেখিতে পাই না। ঐরূপ প্রস্তর পাইলে আমি যে মূল্যে বিক্রয় করিয়া লাভ করিয়াছিলাম, এখন সেই মূল্যে উহা গ্রহণ করিতে পারি।
আমি। এই অলঙ্কারে যে সকল প্রস্তর এখন দেখা যাইতেছে, উহা কি? ও উহার বর্ত্তমান মূল্যই বা কি?
জহুরী। উহা সাদা ও লাল প্রভৃতি বর্ণের কাঁচ। মূল্য অতি সামান্য দুই এক টাকার অধিক হইবে না।
আমি। তাহা হইলে আপনার অনুমান হয় যে, আসল প্রস্তরগুলি ইহা হইতে খুলিয়া লইয়া তাহার পরিবর্তে কয়েক খণ্ড কাঁচ বসাইয়া দিয়াছে।
জহুরী। তাহাই তো দেখিতেছি। কিন্তু কাঁচগুলি বেশ পরিপাটীর সহিত বসান হইয়াছে, যে স্থানে যে প্রকারের প্রস্তর ছিল, ঠিক সেইস্থানে সেই প্রকারের কাঁচ বসান হইয়াছে বিশেষ ইহা দেখিয়া অনুমান হইতেছে, কোন অব্যবসায়ী লোকের দ্বারা ইহা বসান হয় নাই, কোন ভাল জহুরীর দ্বারা ইহা বসান হইয়াছে।
আমি। কাহার দ্বারা ইহা বসান হইয়াছে? তাহার কি কোন প্রকার সন্ধান হইতে পারে?
জহুরী। সমস্ত অবস্থা আমাকে খুলিয়া বলুন, তাহা হইলে আমার দ্বারা যতদূর সম্ভাবনা ততদূর সাহায্য আমি করিতে প্রস্তুত আছি। সন্ধান না পাইবার কোন কারণ আমি দেখিতেছি না।
জহুরীর এই কথা শুনিয়া আমি সমস্ত অবস্থা যাহা এই পৰ্য্যন্ত অবগত হইতে পারিয়াছিলাম, তাহা তাঁহাকে কহিলাম। তিনি আমার সমস্ত কথা শুনিয়া পরিশেষে কহিলেন, “আমি ইহার সমস্ত অবস্থা এখন বুঝিতে পারিতেছি। প্রায় এক বৎসর হইল, সেই প্রকারের কতকগুলি প্রস্তর আমার নিকট আর একটি জহুরী বিক্রয় করিতে আনিয়াছিল। সেই সময়েই আমার মনে কেমন একরূপ সন্দেহ হয়। কিন্তু পরিশেষে মনে করি, এক প্রকারের প্রস্তর অনেক হইতে পারে; বিশেষ ঐ প্রস্তর যাঁহার নিকট আছে, তিনি দরিদ্রলোক নহেন যে, ঐ সকল প্রস্তর তিনি বিক্রয় করিয়া ফেলিয়াছেন, বিশেষ যে মূল্যে ঐ সকল প্রস্তর আমি বিক্রয় করিয়াছিলাম, তাহা অপেক্ষা অনেক অধিক মূল্য প্রার্থনা করায় আমি উহা গ্রহণ করি না। আমার বোধ হয়, সেই সকল প্রস্তর সমস্ত এখনও বিক্রয় হয় নাই, দুই চারি খানি সেই জহুরীর নিকট থাকিলেও থাকিতে পারে। যে জহুরী আমার নিকট সেই প্রস্তর বিক্রয় করিতে আসিয়াছিল, সেই জহুরী অতিশয় ভদ্রলোক। আমার বিশ্বাস, সে কখন মিথ্যা কথা কহিবে না। আমি তাহাকে এখনই এখানে ডাকাইতেছি, যদি তাহার নিকট ঐ প্রস্তরের দুই চারি খানি এখনও থাকে তাহা সে সঙ্গে লইয়া আসিবে, এবং তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে, সে সমস্তই আমাকে কহিবে।”
আমাকে এই কথা বলিয়া সেই জহুরী তাঁহার একজন লোককে কি কহিলেন। সে তখনই সেইস্থান হইতে স্থানান্তরে গমন করিল; কিয়ৎক্ষণ পরে সে আর একজন জহুরী সঙ্গে করিয়া আসিয়া উপস্থিত হইল। পূৰ্ব্বকথিত জহুরী তাঁহাকে একটু নির্জ্জন স্থানে লইয়া গেলেন। দুইজনে কিয়ৎক্ষণ কথাবার্তার পর, তিনি আমাকেও সেইস্থানে ডাকিলেন। আমি তাঁহাদিগের নিকট গমন করিলে, তিনি কহিলেন “আমি পূর্ব্বে যে অনুমান করিয়াছিলাম, তাহা সত্য। আমি যে সকল প্রস্তর বিক্রয় করিয়াছিলাম, সেই সকল প্রস্তরই ইনি বিক্রয় করিবার নিমিত্ত আমার নিকট আলয়ন করিয়াছিলেন। তাহার কতকগুলি পরিশেষে ইনি বিক্রয় করিয়া ফেলিয়াছেন, অবশিষ্ট কতকগুলি এখনও ইহার নিকট আছে। আমি উহা পুনরায় পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম, উহা সেই প্রস্তর। ঐ সকল প্রস্তরের ওজনও আমার কথায় লেখা আছে। ওজন করিয়া দেখিলেই বুঝিতে পারিবেন যে, আমার কথা সত্য কি না।
এই কথা শুনিয়া আমি দ্বিতীয় জহুরীকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এই সমস্ত মূল্যবান প্রস্তর আপনি কোথায় পাইলেন?”
২য় জহুরী। আমি উহা খরিদ করিয়াছি।
আমি। যে ব্যক্তি উহা আপনার নিকট বিক্রয় করিয়াছে, তাহাকে আপনি দেখাইয়া দিতে পারিবেন?
২য় জহুরী। আমি তাহাকে দেখাইয়া দিতে পারিব না; কিন্তু একজন দালাল তাহাকে আমার নিকট আনিয়াছিল। ঐ দালাল আমাকে বলিয়াছিল, সে তাহার পরিচিত ও তাহার বাড়ী ঘর সে চিনে। আমি তাহার কথার উপর বিশ্বাস করিয়া ঐ দ্রব্য খরিদ করিয়াছিলাম। আর ইহাও আমি শুনিয়াছিলাম যে, সেই দালাল কিছু পারিতোষিক পাইবার প্রত্যাশায় তাঁহার বাড়ী পর্য্যন্তও গমন করিয়াছিল।
আমি। প্রস্তরগুলি সে কিরূপ অবস্থায় লইয়া আসিয়াছিল? উহা এই অলঙ্কার হইতে খুলিয়া আনিয়াছিল, কি অলঙ্কার সহিতই আনিয়াছিল?
২য় জহুরী। এই অলঙ্কার সহিত আনিয়াছিল। আমিই উহা এই অলঙ্কার হইতে খুলিয়া লইয়া তাহার পরিবর্তে ঠিক সেইরূপের নকল প্রস্তর তাহাতে বসাইয়া দি।
আমি। আপনি ওরূপ করিলেন কেন?
২য় জহুরী। পয়সা পাইলে না করিব কেন? ইহাই আমার ব্যবসা।
আমি। তাহা হইলে, এই কাঁচখণ্ড প্রভৃতি আপনারই বসান?
এই বলিয়া সেই অলঙ্কারখানি তাঁহার হস্তে প্রদান করিলাম। তিনি উহা উত্তমরূপে দেখিয়া কহিল “হাঁ, ইহা আমারই বসান।”
ঐ জহুরীর নিকট প্রকৃত প্রস্তর কতকগুলি ছিল, তাহা আমি দেখিলাম। দেখিলাম, উহার পরিবর্তে যে প্রস্তর বসান হইয়াছে, তাহা দেখিতে ঠিক একই প্রকারের; জহুরী ভিন্ন উহা সহজে চিনিয়া উঠিবার ক্ষমতা অনেকেরই নাই
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় জহুরীর এই কথা শুনিয়া আমি তাঁহাকে লইয়া সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম। যে দালালের কথা তিনি আমাকে বলিয়াছিলেন, সেই দালালকে তিনি আমাকে দেখাইয়া দিলেন। দালালও সমস্ত কথা স্বীকার করিল ও আমাকে সঙ্গে লইয়া যে ব্যক্তি ঐ প্রস্তর বিক্রয় করিয়াছিল, তাহাকে ও তাহার বাড়ী দেখাইয়া দিল।
উহার নাম, শ্যামসেরউদ্দিন, কিন্তু সকলে তাহাকে শ্যামবাবু বলিয়া ডাকিয়া থাকে। শ্যামবাবুর বয়ঃক্রম ত্রিশ বৎসরের অধিক হইবে না; বর্ণগৌর, দেখিতে সুশ্রী, হঠাৎ তাঁহাকে দেখিয়া কেহই তাঁহাকে মুসলমান বলিয়া জানিতে পারেন না। মুসলমানদিগের ন্যায় তাঁহার দাড়ি নাই, মুসলমানের পোষাক তিনি কখন পরিধান করেন না। চাল চলন, পোষাক পরিচ্ছদ সমস্তই বাঙ্গালীর ন্যায়। ইহার পিতামহের বাসস্থান ফরিদপুর জেলায় ছিল। তিনি প্রথমে কলিকাতায় আসিয়া বাসস্থান স্থাপন করেন। সেই সময় হইতেই তাঁহাদিগের বাসস্থান কলিকাতাতেই হয়। শ্যামবাবুর পিতার জন্মস্থান কলিকাতায়। তিনি ব্যবসা বাণিজ্য করিয়া তাঁহার অবস্থার বেশ পরিবর্তন করিয়াছিলেন। পাকা বাড়ী ও কিছু বিষয়ও করিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার মৃত্যুর সময় তাঁহার অবস্থা হীন হইয়া পড়ে। শ্যামবাবু কলিকাতার বকাটে ছোকরা; কখন কোন কর্ম্মকার্য্য করে নাই, লেখাপড়াও শিখেও নাই, বদ্ ছেলেদের সহিত মিলিয়া বস্থানে গমনাগমনই তাহার কার্য্য ছিল। শ্যামবাবুর বাড়ী রামচন্দ্রের বাড়ীর খিড়কিতেই। দুই বাড়ীর মধ্যস্থলে কেবল চারি হাত পরিমিত চওড়া একটি গলি আছে। ঐ গলির ভিতর রামবাবুর বাড়ীর একটি ছোট দরজা আছে। ঐ স্থানে দরয়ান প্রভৃতি কেহই থাকে না, ঐ দরজা প্রায়ই খোলা হইত না। ভিতর হইতে তালা চাবি দ্বারা বন্ধ থাকিত। ঐ দরজাটি রামবাবুর অন্দর মহলের সংলগ্ন।
দালাল যখন আমাকে শ্যামবাবুকে দেখাইয়া দিলেন, সেই সময় আমি তাহাকে ঐ অলঙ্কারের কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। সে সমস্ত কথা অস্বীকার করিল, ও কহিল “আমি এই অলঙ্কার সম্বন্ধে কোন কথা অবগত নহি, বা ইহা ইতিপূর্ব্বে আর কখন দেখি নাই।” শ্যামবাবুর কথা শুনিয়া ও তাহার ভাবভঙ্গি দেখিয়া আমার বেশ অনুমান হইল, সে ইহার সমস্ত অবস্থা উত্তমরূপে অবগত আছে। সুতরাং তাহাকে সঙ্গে লইয়া যে জহুরীর নিকট ঐ সকল প্রস্তর বিক্রয় করিয়াছিল, তাহার নিকট লইয়া গেলাম। ঐ জহুরী উহাকে দেখিবামাত্রই চিনিতে পারিল ও কহিল “এই ব্যক্তিই ঐ অলঙ্কার লইয়া আসিয়াছিল। ইহারই কথামত ঐ অলঙ্কার হইতে আসল প্রস্তরগুলি খুলিয়া লইয়া তাহার পরিবর্তে নকল প্রস্তর বসাইয়া দিয়াছিলাম এবং আসল প্রস্তরগুলি এই আমার নিকট বিক্রয় করিয়া তাহার মূল্য লইয়া গিয়াছিল।
জহুরীর কথা শুনিয়া শ্যামবাবুর মুখ হইতে আর কোন কথা বহির্গত হইল না। তখন আমি তাহাকে কহিলাম, “তুমি এখন চোর। চোরের সহিত আমরা যেরূপ ব্যবহার করিয়া থাকি, তোমার সহিত আমাদিগকে এখন সেইরূপ ব্যবহার করিতে হইবে; নতুবা তুমি প্রকৃত কথা কোনরূপেই বলিবে না।”
শ্যাম। আমি চোর নহি। চোরের সহিত আপনারা যেরূপ ব্যবহার করিয়া থাকেন, সেইরূপ ব্যবহার আমার সহিত করিতে হইবে না। আমি যাহা কিছু অবগত আছি, তাহার সমস্তই আমি আপনাকে বলিতে প্রস্তুত; কিন্তু মহাশয় আমার এক নিবেদন আছে। আমি যাহা বলিব, তাহা অতিশয় গোপনীয় কথা। ঐ কথা কোনরূপেই প্রকাশ করা কর্ত্তব্য নহে, কিন্তু প্রাণের দায়ে তাহাও আমাকে এখন প্রকাশ করিতে হইতেছে। আপনি কোন নিৰ্জ্জন স্থানে আমাকে একাকী লইয়া চলুন। সেইস্থানে আমি আপনাকে সমস্ত কথা বলিব। আমার কথা শুনিয়া পরিশেষে আপনার যাহা কৰ্ত্তব্য, তাহা আপনি করিবেন।
শ্যামবাবুর কথা শুনিয়া আমি তাহাকে একটি নিভৃত কক্ষের মধ্যে লইয়া গেলাম। বলা বাহুল্য, আমাদিগের সহিত আর কেহই রহিল না। সেইস্থানে উপনীত হইয়া আমি শ্যামবাবুকে কহিলাম, “তুমি কি বলিতে চাহ, বল। এই চুরি তুমি করিয়াছ?”
আমার কথা শুনিয়া শ্যামবাবু ওরফে শ্যামসের উদ্দিন যাহা কহিল, তাহা শুনিয়া আমি একেবারে হতজ্ঞান হইলাম। প্রথমত তাহার কথা বিশ্বাস করিতে আমার প্রবৃত্তি হইল না, কিন্তু সে তাহার কথার সত্যাসত্য কতকগুলি চিঠিপত্রের দ্বারা প্রমাণ করাইয়া দিবে বলায়, তাহার কথা সেই সময় বিশ্বাস করিয়াছিলাম, ও পরিশেষে কয়েকখানি পত্র দেখাইয়া তাহার কথা যে সত্য, তাহা আমার সম্পূর্ণরূপে প্রতীতি জন্মাইয়া দিয়াছিল।
শ্যামবাবু আমাকে যাহা বলিয়াছিল, তাহার সারমর্ম্ম, এইরূপ—মহাশয়! আমি গরিব লোক, কিন্তু বড় মানুষের সংসর্গে পড়িয়া বা বড়লোকের বাসস্থানের নিকট বাস করিয়াই আমার এইরূপ দুরবস্থা ঘটিয়াছে। বাবু রামচন্দ্র মিত্র অর্থাৎ যিনি তাঁহার অলঙ্কার অপহৃত হইয়াছে বলিয়া আপনাকে সংবাদ প্রদান করিয়াছেন, তাঁহার চরিত্র যে কিরূপ, তাহা অবগত হইতে বোধ হয় আপনার বাকী নাই। তাঁহার চরিত্র যতদূর কলুষিত, কাহারও চরিত্র যে ততদূর কলুষিত হইতে পারে এ বিশ্বাস আমার ছিল না। কারণ আমি জানিতাম, আমা অপেক্ষা কলুষিত চরিত্রের লোক আর কেহ নাই; কিন্তু এখন দেখিতেছি, তিনি আমা অপেক্ষা আরও উন্নতি লাভ করিয়াছেন। লোকে মদ্যপায়ী হয় বটে, কিন্তু ইহার মত কেহ হয় না; লোকে গোপনে বা প্রকাশ্যে বেশ্যালয়ে গমন করে বটে বা আপন বাড়ীতে বা বাগানে বার-বণিতাগণকে আনাইয়া আহ্লাদ করিয়া থাকে বটে, কিন্তু ইহার ন্যায় আপন স্ত্রীকে দেখাইয়া তাহার চক্ষুর উপর যে কেহ এইরূপ কার্য্য করিয়া আনন্দ উপভোগ করিয়া থাকে, তাহার দৃষ্টান্ত কেবলমাত্র রামবাবু ভিন্ন আর কেহই নাই। আপনি বোধ হয় অবগত আছেন যে, রাঙ্গা বউ রামবাবুর স্ত্রী। রামবাবুর পিতা সাধ করিয়া ও অনেক খুঁজিয়া এই রাঙ্গা বউকে আনিয়া আপন ঘরে স্থান প্রদান করিয়াছিলেন। আমরা রামবাবুর প্রতিবাসী। ঐ রাঙ্গা বউকে বাল্যকাল হইতেই দেখিয়া আসিতেছি। কিন্তু তাহার চরিত্র সম্বন্ধে কখন কোন কথা আমাদিগের কর্ণগোচর হয় না। যে সময় রামবাবু বার-বিলাসিনীগণকে লইয়া আপন বাড়ী প্রমোদ-কানন করিয়া তুলিলেন, সেই সময় হইতে রাঙ্গা বউর চরিত্রও কেমন কেমন বোধ হইতে লাগিল। আমি যে ঘরে থাকি, ঠিক তাহার সম্মুখে রামবাবুর একটি ঘর আছে। আমার ঘরের দিকে ঐ ঘরের একটি জানালা আছে ঐ জানালা কখন খোলা হইত না, আমরা বাল্যকাল হইতে ঐ জানালা কখন খোলা দেখি নাই। রামবাবুর বাহির বাড়ীতে যেমন প্রমোদ-কানন হইল, সেই সঙ্গে সঙ্গে অন্দরের ঐ জানালাটিও দেখিলাম মধ্যে মধ্যে খোলা থাকে, ও সেই বাতায়ন পথে মধ্যে মধ্যে রাঙ্গা বউকে দেখিতে লাগিলাম। রাঙ্গা বউ একে প্রতিবেশিনী, তাহাতে বড়লোকের স্ত্রী; সুতরাং তিনি সময় সময় যেমন আমার নয়নগোচর হইতে লাগিলেন, অমনি আমি সেইস্থান হইতে স্থানান্তরে প্রস্থান করিতে লাগিলাম বা আমার ঘরের জানালা বন্ধ করিয়া দিতে লাগিলাম। কিন্তু ক্রমে ক্রমে দেখিতে লাগিলাম, রাঙ্গা বউর ইচ্ছা তাহা নহে; তাহার ইচ্ছা আমার সহিত যেন সে দেখা করে ও আমাকে যেন কিছু বলিতে চাহে। আমিও তাহার মনের ভাব অবগত হইয়া আর তাহাকে দেখিয়া সঙ্কুচিত হইতাম না, তিনি তো হইতেনই না; কিন্তু উভয়ের মধ্যে কোনরূপ কথা হইবার সুযোগ ঘটিল না। চক্ষুর সঙ্কেতে উভয়ের মধ্যে যতদূর কথাবার্তা হইতে পারে, তাহাই চলিতে লাগিল। এইরূপে কিছু দিবস অতিবাহিত হইবার পর, এক দিবস রাঙ্গা বউ একখানি পত্র আমাকে তাহার ঘর হইতে দেখাইল, ও জানালা দিয়া উহা পূর্ব্বকথিত গলির মধ্যে ফেলিয়া দিয়া সঙ্কেত পূৰ্ব্বক আমাকে উহা উঠাইয়া লইতে কহিল। আমি ঐ পত্রখানি উঠাইয়া লইলাম ও পড়িয়া দেখিলাম, উহাতে লেখা আছে। “তোমার সহিত আমি সাক্ষাতের অভিলাষী। রাত্রিকালে ছোট খিড়কি দরজা খোলা থাকিবে; এ দরজা দিয়া তুমি আমাদিগের বাড়ীতে আসিও। দরজা ঠেলিতেই একটি চাকরাণীকে সেইস্থানে দেখিতে পাইবে, সেই তোমাকে সঙ্গে করিয়া আমার নিকট লইয়া আসিবে।” এইরূপ মর্মের পত্র পাইয়া আমি ভাবিলাম, কি সর্ব্বনাশ! ভদ্রলোকের ঘরের স্ত্রীলোকের কি ভয়ানক সাহস। সে যাহা হউক, আমি ঐ পত্রখানি পাইয়া মনে মনে একটু ইতস্ততঃ করিলাম, ভাবিলাম, এত বড়লোকের বাড়ীর ভিতর রাত্রিকালে প্রবেশ করিলে, পাছে কোনরূপ বিপদে পতিত হই। মনে মনে এইরূপ ভাবিলাম সত্য, কিন্তু এই সুযোগ পরিত্যাগ করিতেও পারিলাম না। রাত্রি ১১টার পর দেখিলাম কে যেন ঐ দরজাটি একবার খুলিয়া পুনরায় বন্ধ করিয়া দিল। আমিও আস্তে আস্তে দরজার নিকট গিয়া সেই দরজাটি নিঃশব্দে ঠেলিলাম, উহা খুলিয়া গেল। দেখিলাম, একটি স্ত্রীলোক সেইস্থানে দাঁড়াইয়া আছে। সে আমাকে দেখিয়াই আমাকে ভিতরে ডাকিল। আমি যেমন দরজার মধ্যে প্রবেশ করিলাম, অমনি সে ঐ দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া কহিল, “আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আইস।’ সে অগ্রে অগ্রে চলিল, আমি তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলাম। ক্রমে দোতলার উপর একটি ঘরের মধ্যে সে আমাকে লইয়া গেল। দেখিলাম, ঐ ঘরের মধ্যে কেবলমাত্র একখানি পালঙ্ক ভিন্ন আর কোন দ্রব্য নাই। ঐ পালঙ্কের উপর রাঙ্গা বউ শুইয়া আছেন। ঐ ঘরের মধ্যে আমি প্রবেশ করিলে, সেই স্ত্রীলোকটি আমাকে কহিলেন “তুমি এইস্থানে বস।’ আমি কহিলাম, “বসিবার তো কোন স্থান নাই, কোথায় বসিব?” আমার কথা শুনিয়া সে আমাকে ঐ পালঙ্ক দেখাইয়া দিয়া কহিল, “ঐ পালঙ্কের উপর।” এই বলিয়া সে ঐ ঘরের বাহির হইতে দরজা ভেজাইয়া দিয়া প্রস্থান করিল।
এই দিবস হইতে আমি প্রায়ই রাত্রিকালে ঐ বাড়ীর ভিতর যাইতাম, ও সময় সময় সমস্ত রাত্রি সেইখানে অতিবাহিত করিতাম। যে রাত্রিতে আমার নিমিত্ত ঐ দরজা খোলা থাকিত, তাহার পূর্ব্বে রাঙ্গা বউ জানালা দিয়া আমাকে কহিতেন। স্থূল কথায়, যে দিবস তিনি আমাকে কহিতেন, সেই দিবস যাইতাম, অপর দিবস আমি বাড়ীর ভিতর পদার্পণ করিতাম না। এইরূপে প্রায় বৎসরাবধি অতিবাহিত হইয়া গেল, কিন্তু আমাদিগের এই গুপ্ত কাহিনী কেবল রাঙ্গা বউর দুইটি পরিচারিকা ভিন্ন আর কেহই জানিতে পারিল না। আমার অবস্থা অতিশয় হীন হইয়া আসিয়াছিল কিন্তু রাঙ্গা বউর কৃপায় পুনরায় আমার অবস্থার পরিবর্তন হইয়া গেল। যখন যে অর্থ আমি চাহিতাম, তখনই সেই অর্থ তিনি প্রদান করিতে লাগিলেন। এইরূপে তাঁহার হস্তে যে কিছু নগদ টাকা ছিল, তাহার সমস্তই নিঃশেষিত হইয়া গেল। সেই সময় তিনি আমাকে এক দিবস ঐ অলঙ্কারখানি দেখাইলেন ও কহিলেন, “কোন জহুরীর নিকট লইয়া গিয়া ইহাতে যে সমস্ত বহুমূল্য প্রস্তর আছে, তাহা খুলিয়া বিক্রয়পূৰ্ব্বক যে অর্থ পাওয়া যাইবে, তাহা আমাকে আনিয়া দেও ও যেরূপ প্রস্তর সকল ইহাতে বসান আছে, ঠিক সেই রূপের কৃত্রিম প্রস্তর সকল ইহাতে এরূপ ভাবে বসাইয়া দেও যে, উহা দেখিলে কেহই যেন বুঝিতে না পারে যে ইহা কৃত্রিম।” এই বলিয়া রাঙ্গা বউ ঐ অলঙ্কার আমাকে প্রদান করিয়াছিলেন। আমিও তাঁহারই আদেশ মত এই জহুরীর দ্বারা ঐ কার্য্য সম্পন্ন করিয়া ঐ সমস্ত টাকা তাঁহার হস্তেই প্রদান করি। বলা বাহুল্য, ঐ টাকা তিনিও পরিশেষে ক্রমে ক্রমে আমাকে দিয়াছেন। যাহার দ্রব্য, তাহারই আদেশমত ঐ কার্য্য সম্পন্ন করায়, যদি আমি চোর হই, তাহা হইলে, আর আমার কিছুই উপায় নাই।
শ্যামবাবুর কথা শুনিয়া আমার আর বাক নিষ্পত্তি হইল না। এত বড় জমীদার পত্নী একজন সামান্য মুসলমানের প্রণয়ে এরূপ মুগ্ধ, তাহা শুনিয়া আমার সমস্ত বুদ্ধি লোপ পাইয়া গেল! কিন্তু পরিশেষে এই সমস্ত কথা আমি রামবাবুকে নির্জ্জনে ডাকিয়া কহিলাম। তিনি সমস্ত শুনিয়া চুপ করিয়া রহিলেন, ও পরিশেষে আমাকে এই মর্ম্মের এক পত্র লিখিয়া দিলেন যে, “এই অনুসন্ধান আর আপনাকে করিতে হইবে না। যে সমস্ত প্রস্তর আমার অপহৃত হইয়াছিল বলিয়া সন্দেহ করিয়াছিলাম, তাহা চুরি হয় নাই; যাহার অলঙ্কার তিনি অর্থাৎ আমার স্ত্রী উহা খুলিয়া লইয়াছেন। ইহা এখন আমি জানিতে পারিতেছি।” এই পত্র পাইয়া ঐ অনুসন্ধান পরিত্যাগ পূর্ব্বক আমরা প্রস্থান করিলাম।
পরিশেষে আমি অবগত হইতে পারিয়াছিলাম যে, এই সমস্ত কথা রামবাবু তাঁহার স্ত্রীকে কহিয়াছিলেন। তাহার উত্তরে রাঙ্গা বউ এই কহেন যে, “যাহার স্বামী বাড়ীতে মুসলমান বাইজি-উপপত্নী আনিতে পারে, তাহার স্ত্রী তাহার বাড়ীতে মুসলমান উপপতি আনিতে পারে না কেন? তুমি আমার স্বামী, তুমি যেরূপ করিবে, আমি তোমার পত্নী, আমিও সেইরূপ করিব। যে কার্য্যে তোমার লজ্জা হয় না, সেই কার্য্যে আমার লজ্জা হইবে কেন?”
এখন শুনিতে পাই, এই ঘটনার পর উভয়েই আপনাপন চরিত্র সংশোধিত করিয়া একত্রে বাস করিতেছেন।
[ মাঘ, ১৩০৮ ]