ভীষণ হত্যা
প্রথম পরিচ্ছেদ
একটি স্ত্রীলোকের মৃতদেহ যেরূপ অবস্থায় জঙ্গলময় বাগানের মধ্যে প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছিল ও ঐ মৃতদেহের সুরথহাল করিতে আমাদিগকে যেরূপ ভয়ানক বিপদে পতিত হইতে হইয়াছিল, তাহা পাঠকগণ “সুরথহালে বিপদ” * নামক প্রবন্ধে বিশেষরূপে অবগত হইতে পারিয়াছেন।
[* সন ১৩১২ সালের আশ্বিন মাসের ১৫০ সংখ্যা দারোগার দপ্তর দ্রষ্টব্য]
ঐ মৃতদেহ যে কাহার, তাহা জানিবার নিমিত্ত আমরা বিশেষরূপ চেষ্টা করিয়াছিলাম; সহর ও সহরতলীর নানা স্থানে সহস্র সহস্র নরনারীগণকে ঐ মৃতদেহ দেখান হইয়াছিল; প্রত্যেক রাস্তায় রাস্তায়,—গলিতে গলিতে,—পাড়ায় পাড়ায় ঢোল সোহবতের দ্বারা এই সংবাদ প্রত্যেক ব্যক্তিকে জানাইয়া দেওয়ার বিশেষরূপ চেষ্টা করা হইয়াছিল, কিন্তু সেই সময় কোনরূপেই আমাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয় নাই। ঐ মৃতদেহ যখন কোন রূপেই সনাক্ত হইল না, তখন বাধ্য হইয়া উহা ভষ্মে পরিণত করাইতে হইল, কিন্তু আমরা উহার ফটোগ্রাফ লইতে ভুলিলাম না।
ঐ মৃতদেহ ভস্মে পরিণত হইয়া যাইবার সঙ্গে সঙ্গে ঐ মকদ্দমার অনুসন্ধানও যে শেষ হইয়া গেল, তাহা নহে; আবশ্যকীয় অনুসন্ধান আমাদিগের সাধ্যমত চলিতে লাগিল। এইরূপে ক্রমে দুই তিন দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল, কিরূপে ও কাহা কর্তৃক ঐ স্ত্রীলোকটি হত হইয়াছে, তাহার কোনরূপ সন্ধান হওয়া দূরে থাকুক, ঐ স্ত্রীলোকটি যে কে, তাহা পর্য্যন্ত কোনরূপ সন্ধান আমরা করিয়া উঠিতে পারিলাম না। এইরূপে আরও দুই তিন দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। এই মোকদ্দমার কিনারা হইবার আশা ক্রমে আমরা পরিত্যাগ করিতে লাগিলাম। আরও দুই এক দিবস দেখিয়া এই মকদ্দমার অনুসন্ধান হইতে আমরা বিরত হইব, মনে মনে এইরূপ স্থির করিতেছি, এরূপ সময় জানিতে পারিলাম যে, একটি স্ত্রীলোক থানায় গিয়া সংবাদ প্রদান করিয়াছে যে, তাহার বাড়ীর ভাড়াটিয়া একটি স্ত্রীলোক আজ কয়েক দিবস হইতে কোথায় চলিয়া গিয়াছে, এ পর্যন্ত তাহার কোনরূপ সন্ধান নাই।
এই কথা জানিতে পারিয়া, যে থানায় এই সংবাদ প্রদত্ত হইয়াছে সেই থানায় গিয়া উপস্থিত হইলাম ও জানিতে পারিলাম প্রকৃতই ঐরূপ সংবাদ ঐ থানায় প্রদত্ত হইয়াছে। যে স্ত্রীলোক ঐ সংবাদ থানায় প্রদান করিয়াছে, তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসে ঐ থানার একজন কর্মচারীকে সঙ্গে লইয়া যে স্ত্রীলোক ঐ সংবাদ থানায় প্রদান করিয়াছিল, তাহার বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। ঐ স্ত্রীলোকটার নাম বেলা। বেলা একটি বেশ্যা, বেশ্যাবৃত্তি করিয়া সে একখানি দ্বিতল পাকা বাড়ী করিয়াছে। ঐ বাড়ীতে কয়েকজন বেশ্যা ভাড়াটিয়া আছে। বেলাও ঐ বাড়ীতে বাস করিয়া থাকে।
বেলার নিকট হইতে অবগত হইলাম, তাহার ঐ বাড়ীতে চন্দ্রমুখী নাম্নী অপর আর একটি বেশ্যা অনেক দিবস হইতে বাস করিত। বেশ্যাবৃত্তি করিয়া সেও কতকগুলি তৈজসপত্র ও অলঙ্কারের সংস্থান করিয়াছিল। সে অতিশয় চতুরা ছিল, সহজে সে কাহাকেও বিশ্বাস করিত না, ও অপরের পরামর্শমত সে কখনই চলিত না, নিজে যাহা বুঝিত, ভাল হউক বা মন্দ হউক, সে তাহাই করিত। এরূপও দেখা গিয়াছে যে, তাহার ঘরে যাহাদিগের যাতায়াত ছিল, তাহাদিগের মধ্যে কেহ কেহ উহার নিকট হইতে সময় সময় দুই একখানি অলঙ্কার হস্তগত করিবার চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু কৃতকার্য্য হইতে পারে নাই। চন্দ্রমুখীকে তাহারা যেরূপ ভাবে বুঝাইবার চেষ্টা করিত, সে কিন্তু সেরূপ ভাবে বুঝিত না বা কাহার কথায় সে কখন বিশ্বাস করিত না। যত দিবস পর্য্যন্ত সে এই বাটীতে বাস করিয়া ছিল, তাহার মধ্যে তাহাকে বাগান বা অপর কোন স্থানে রাত্রি যাপন করিতে কেহ কখন দেখেন নাই, কিন্তু আজ কয়েক দিবস পর্য্যন্ত দেখা যাইতেছে যে, উহার ঘর তালাবদ্ধ রহিয়াছে, ও সে-যে কোথায় গমন করিয়াছে, তাহার কিছুই জানিতে পারা যাইতেছে না।
বেলার নিকট হইতে এই কয়েকটি কথা জানিতে পারিয়া তাহাকে কহিলাম, চন্দ্রমুখী সম্বন্ধে অনেক কথা জিজ্ঞাস্য আছে, কিন্তু সে সমস্ত কথা জিজ্ঞাসা করিবার পূর্ব্বে একটি কথা আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, তুমি ফটোগ্রাফ দেখিয়া চিনিতে পারিবে কি উহা চন্দ্রমুখীর ফটোগ্রাফ কি না?
বেলা। ফটোগ্রাফ দেখিয়া বোধ হয় আমি বলিতে পারিব যে, উহা চন্দ্রমুখীর ফটোগ্রাফ কি না।
যে মৃতদেহ সম্বন্ধে আমরা অনুসন্ধান করিতেছিলাম ও ঐ মৃতদেহ ভস্মীভূত হইবার পূর্ব্বে যাহার ফটোগ্রাফ আমরা উঠাইয়া লইয়াছিলাম, তাহার একখণ্ড আমার নিকট ছিল, উহা বাহির করিয়া আমি বেলার হস্তে প্রদান করিলাম ও কহিলাম, “দেখ দেখি, ইহা কাহার ফটোগ্রাফ?”
বেলা ঐ ফটোগ্রাফখানি হস্তে লইয়া অনেকক্ষণ পর্যন্ত দর্শন করিল ও পরিশেষে কহিল, “যেরূপ অবস্থায় এই ফটোগ্রাফ লওয়া হইয়াছে দেখিতেছি, তাহাতে উহা যে, কাহার ফটোগ্রাফ, তাহা চিনিতে পারা নিতান্ত সহজ নহে, তথাপি আমার যেন বোধ হইতেছে যে, উহা চন্দ্রমুখীরই ফটোগ্রাফ, চন্দ্রমুখীর ও অবস্থা কে করিল মহাশয়?
আমি। উহার এরূপ অবস্থা কিরূপে হইল, তাহার সমস্তই ক্রমে ক্রমে জানিতে পারিবে। এখন আমি তোমাকে যাহা যাহা জিজ্ঞাসা করিতেছি, তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান কর, ও আমাদিগকে যতদূর সম্ভব সাহায্য কর; তোমার সাহায্য ব্যতীত আমরা কোনরূপেই এই বিষয়ের অনুসন্ধানে কৃতকার্য্য হইতে পারিব না।
বেলা। আমার নিকট হইতে কি কি বিষয় আপনি জানিতে চাহেন বলুন, আমার দ্বারা যতদূর হইতে পারে, আমি আপনাদিগকে সাহায্য করিতে প্রস্তুত আছি।
আমি। চন্দ্রমুখী তোমার বাড়ীতে কত দিবস হইতে বাস করিতেছে?
বেলা। প্রায় ৮।১০ বৎসর হইবে, আমার বোধ হয়, সে তাহার পিতা মাতার ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিবার পর হইতেই আমার বাড়ীতে বাস করিতেছিল।
আমি। তাহার ঘরে কাহার যাতায়াত ছিল?
বেলা। তাহার কিছুমাত্র স্থিরতা ছিল না, সে একজন লোকের অন্নে প্রতিপালিত হইত না, বা একজনের আশ্রয়ে বাস করিত না। প্রায়ই তাহার ঘরে অপরিচিত লোক দেখিতে পাইতাম।
আমি। সে যখন তাহার পিতা মাতার ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছিল, তখন সে একাকী আসিয়াছিল, কি অপর কোন লোক তাহাকে আনিয়াছিল?
বেলা। সেই সময় অপর একটি লোক উহার সঙ্গে আগমন করে, বোধ করি, সেই তাহাকে বাহির করিয়া আসিয়াছিল। প্রায় এক বৎসরকাল সে নিয়ত চন্দ্রমুখীর ঘরে যাতায়াত করিত, সেই সময় অপর আর কাহাকেও উহার ঘরে আসিতে দেখি নাই। এইরূপে প্রায় এক বৎসর অতীত হইয়া যাইবার পর, আর সেই ব্যক্তিকে দেখিতে পাই না। এক দিবস আমি চন্দ্রমুখীকে উহার কথা জিজ্ঞাসা করি, তাহাতে সে কহে যে, সে এত দিবস যাহার অন্নে প্রতিপালিত হইতেছিল, সে মরিয়া গিয়াছে। ইহার পর ৮। ৯ বৎসর কাল চন্দ্রমুখীতে একজনের অন্নে প্রতিপালিত হইতে দেখি নাই। মধ্যে মধ্যে অপরিচিত লোককেই তাহার ঘরে আসিতে দেখিয়াছি।
আমি। সেই সকল অপরিচিত লোক যে কাহারা তাহা এখন আমরা কিরূপে জানিতে পারিব?
বেলা। ইহা আমি বলিতে পারিব না, তবে আমার বাড়ীতে সরলা নাম্নী একটি ভাড়াটিয়া আছে, তাহার সহিত চন্দ্রমুখীর খুব প্রণয় ছিল, সে সর্ব্বদা উহার ঘরে যাতায়াত ও বসা উঠা করিত। সময় সময় সে তাহার ঘরে যে সকল লোক আগমন করিত, তাহাদিগের সহিত আমোদ প্রমোদেও যোগ দিত। সেই যদি কোন সংবাদ আপনাকে প্রদান করিতে পারে; তৎভিন্ন এই বাড়ীর অপর আর কাহার নিকট হইতে বিশেষ কোন কথা অবগত হইতে পারিবেন না।
আমি। সরলা এখন কোথায়?
বেলা। সে আমার বাড়ীতেই আছে, আবশ্যক হয়তো বলুন, এখনই আমি তাহাকে আপনার সম্মুখে ডাকিয়া আনিতেছি।
আমি। কেবল ডাকিয়া দিলে হইবে না, যাহাতে সে সমস্ত কথা বলিয়া আমাদিগের বিশেষরূপ সাহায্য করিতে পারে, তাহার বন্দোবস্ত তোমাকে করিয়া দিতে হইবে। আরও একটি কথা তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, তোমার বাড়ীর ভিতর এই ঘরে যে, সে বাস করে, ও অপরিচিত লোককে সে তাহার ঘরে স্থান প্রদান করে, এ কথা অপরিচিত লোক সকল কিরূপে অবগত হইতে পারিত?
বেলা। এ অতি সামান্য, কথা, তাহার ঘর খুলিলেই আপনি দেখিতে পাইবেন যে উহার ঘরের সম্মুখে রাস্তার উপর একটি বারান্দা আছে। প্রায় সদা সর্ব্বদাই যে ঐ বারান্দায় বসিয়া থাকিত, ও ঐ স্থানে বসিয়া বসিয়াই রাস্তার লোক সংগ্রহ করিয়া আপন ঘরে আনিত।
আমি। তাহা হইলে কি তোমার অনুমান হয় যে, এইরূপে নবাগত কোন ব্যক্তি তাহাকে এই স্থান হইতে লইয়া গিয়া তাহার এইরূপ দশা করিয়াছে?
বেলা। আমার ত তাহাই বোধ হয়; কিন্তু ইতিপূর্ব্বে তাহাকে কাহারও সহিত কোন স্থানে গমন করিতে দেখি নাই। বিশেষ অর্থলোভ দেখাইলেও সে কাহারও সহিত কোন স্থানে কখন গমন করে নাই।
আমি। তাহার কি অনেকগুলি গহনা ছিল?
বেলা। কতকগুলি গহনা ছিল ও সে প্রায়ই উহা পরিধান করিত।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
বেলার কথা শুনিয়া আমি তাহার ঘরের দিকে দৃষ্টিপাত করিলাম, দেখিলাম, ঘরের দরজায় তালাবদ্ধ আছে। ঘরের ঐরূপ অবস্থা দেখিয়া, আমি বেলাকে কহিলাম, ঘরের চাবি সে কোথায় রাখিত?
বেলা। বিশ্বাস করিয়া কখন তাহার ঘরের চাবি তাপরকে দিতে দেখি নাই।
আমি। উহার ঘরটি খুলিয়া একবার দেখিবার প্রয়োজন, অপর কোন চাবি দ্বারা কি ঐ তালা খোলা যাইবে না? “যাইলেও যাইতে পারে?” এই বলিয়া বেলা ঐ বাড়ীতে তাঁহার যে সকল চাবি ছিল, তাহা সংগ্রহ করিয়া আমার হস্তে প্রদান করিল ও কহিল, দেখুন দেখি, ইহার কোনটির দ্বারা যদি ঐ তালা খোলা যায়।
চাবিগুলি আমি হস্তে লইয়া একটি একটি করিয়া দেখিতে আরম্ভ করিলাম যে, উহার কোন চাবি দ্বারা তাহার ঘরের তালা খোলা যায় কি না। দেখিতে দেখিতে একটি চাবি ঐ তালায় লাগিয়া গেল, উহার দ্বারা তাহার ঘরের দরজা খুলিয়া আমরা উহার মধ্যে প্রবেশ করিলাম।
বেলা যাহা বলিয়াছিল, দেখিলাম, তাহা প্রকৃত, উহার ঘরের সংলগ্ন একটি ছোট বারান্দা আছে; ঐ স্থানে দণ্ডায়মান হইলে রাস্তা দিয়া যে সকল লোক যাতায়াত করে, তাহাদিগকে দেখিতে পাওয়া যায় ও ইচ্ছা করিলে তাহাদিগের সহিত কথাও কহা যাইতে পারে।
উহার ঘরের ভিতর যে সকল আলমারি বাক্স ছিল, তাহার কোনটি বা অপর চাবি দিয়া খুলিয়া, কোনটি বা ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া দেখিলাম, উহার যে সকল গহনা ছিল, ও যে সকল গহনা সে সদা সর্ব্বদা পরিধান করিত, তাহার একখানিও অপহৃত হয় নাই। পূৰ্ব্বকথিত আলমারির একটি দেরাজের ভিতর তাহার সমস্ত রহিয়াছে। ঐ সকল অলঙ্কার দেখিয়া বেলা কহিল, তাহার যে সমস্ত গহনা ছিল, তাহার সমস্তই আছে, যে সকল গহনা সে তাহার অঙ্গ হইতে কখন খুলিত না, তাহাও দেখিতেছ, সে খুলিয়া রাখিয়া গিয়াছে। ইহা বড়ই আশ্চৰ্য্য বিষয়!
ইতিপূর্ব্বে আমরা মনে মনে একরূপ সিদ্ধান্তই করিয়াছিলাম যে, চন্দ্রমুখীর অলঙ্কারগুলিই তাহার কাল হইয়াছে। এখন কিন্তু বেলার কথা শুনিয়া আমাদের সে অনুমান দূরে পলায়ন করিল। এখন বুঝিতে পারিলাম, কোন চোর বা অলঙ্কার-লোলুপ কোন ব্যক্তি দ্বারা এ কার্য্য সম্পন্ন হয় নাই। এ হত্যার অভিযুদ্ধি বেলার নিকট হইতে জানিতে পারিয়াছিলাম যে, সরলার সহিত চন্দ্রমুখীর প্রণয় ছিল, সেই তাহার নিকট সদা সর্ব্বদা যাতায়াত করিত। তাহার নিকট হইতে যদি কোন কথা অবগত হইতে পারি, এই ভাবিয়া সরলাকে ডাকাইলাম। সরলা আমার নিকট আগমন করিলে আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “সরলা, আমি তোমাকে যে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিব, তুমি তাহার প্রকৃত উত্তর প্রদান করিবে, কি তোমাদিগের ন্যায় স্ত্রীলোকগণ যেমন প্রথম হইতেই মিথ্যা কথা কহিয়া থাকে, সেইরূপ করিবে?”
সরলা। মিথ্যা কথা কহিবার তো আমি কোন কারণ দেখি না। চন্দ্রমুখী মরিয়া গিয়াছে, আপনার নিকট শুনিতে পাইতেছি যে, কেহ তাহাকে হত্যা করিয়াছে, এখন যাহাতে হত্যাকারী ধৃত হয়, সেই বিষয়ে আমাদিগের চেষ্টা করা আবশ্যক। আপনি আমাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিবেন, আমি তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান করিব। আমি কোন কথা গোপন করিব না। আমাকে কি বলিতে হইবে বলুন?
আমি। তুমি অবগত আছ যে, চন্দ্রমুখী আজ কয়দিবস হইতে এ স্থান হইতে চলিয়া গিয়াছে?
সরলা। সে যে দিবস চলিয়া গয়াছে তাহা আমি জানি, সেই দিবস হইতে আর তাহাকে দেখি নাই, সে এ বাড়ীতে আর ফিরিয়া আসে নাই।
আমি। সে কোন্ সময় চলিয়া গিয়াছে?
সরলা। দিবা ৩।৪ টার সময়।
আমি। দিবা না রাত্র?
সরলা। রাত্রিতে নহে, দিবাভাগে।
আমি। কাহার সহিত ও কিরূপ অবস্থায় সে বাহির হইয়া যায়?
সরলা। কয়েক দিবস হইতে দুইটি লোক তাহার নিকট আগমন করিত, সে তাহাদিগের সহিতই বাহির হইয়া যায়।
আমি। এ দুইটি লোক যে কে তাহা তুমি বলিতে পার?
সরলা। না, তাহা আমি বলিতে পারি না।
আমি। কত দিবস হইতে চন্দ্রমুখীর ঘরে উহাদিগের যাতায়াত ছিল?
সরলা। ঘরে যাতায়াত শব্দের আমরা যেরূপ অর্থ করিয়া থাকি, তাহারা কিন্তু সেরূপ ভাবে আসিত না। উহাদিগের সহিত চলিয়া যাইবার ৩।৪ দিবস পূর্ব্ব হইতে উহারা চন্দ্রমুখীর ঘরে আসিত। তাহাদিগকে দেখিয়া ও তাহাদিগের কথা শুনিয়া অনুমান হইত যে, তাহারা চন্দ্রমুখীর কোনরূপ আত্মীয় বা দেশস্থ ব্যক্তি হইবে। রাত্রিকালে উহারা প্রায়ই আসিত না, যখন আসিত, তখনই তাহারা দিবাভাগে আসিত ও দুই এক ঘণ্টার অধিক প্রায়ই তাহারা থাকিত না।
আমি। উহাদিগের সম্মুখে চন্দ্রমুখী কিরূপ ভাবে চলিত?
সরলা। উহাদিগকে দেখিয়া চন্দ্রমুখী বিশেষরূপ লজ্জা করিয়া চলিত।
আমি। যখন চন্দ্রমুখী তাহাদিগের সহিত বাহির হইয়া যায়, তাহা তুমি দেখিয়াছ কি?
সরলা। যাইবার সময় যদিও আমি তাহার ঘরে ছিলাম না, তথাপি আমি দেখিয়াছি।
আমি। সেই সময় চন্দ্রমুখীর অঙ্গে কোনরূপ অলঙ্কার আদি ছিল কি?
সরলা। সে কোন অলঙ্কার পরিধান করিয়া যায় নাই। কেবলমাত্র একখানি বস্তু তাহার পরিধানে ছিল।
আমি। সদাসর্ব্বদা তাহার অঙ্গে যে সকল অলঙ্কার থাকিত, তাহা পর্য্যন্ত খুলিয়া রাখিয়া উহাদিগের সহিত গমন করিবার কারণ কি বলিতে পার?
সরলা। কারণ যে কি, তাহা আমি বলিতে পারি না, কিন্তু তাহারা যে সময় উহার নিকট আগমন করিত, তাহার পূর্ব্ব হইতেই সে তাহার অঙ্গের গহনা সকল খুলিয়া রাখিত।
আমি। এরূপ করিবার তাৎপর্য কি?
সরলা। তাহা আমি বলিতে পারি না, আমি একথা এক দিবস তাহাকে জিজ্ঞাসাও করিয়াছিলাম।
আমি। তাহাতে সে কি উত্তর প্রদান করে?
সরলা। সে কহে, উহারা আমার গুরুজন, আর আমি বিধবা, সুতরাং উহাদিগের সম্মুখে গহনা পরিয়া বাহির হইতে যেন কেমন কেমন বোধ হয় বলিয়াই উহাদিগের সম্মুখে গহনা পরিয়া আমি বাহির হই না।
আমি। উহারা গুরুজন! কিরূপ গুরুজন, তাহা তুমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে?
সরলা। এক দিবস তাহাও আমি জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম।
আমি। তাহার উত্তর সে কি প্রদান করে?
“সে সকল কথা আর তোমার শুনিবার আবশ্যক নাই”, এই বলিয়া সরলা আমার কথার উত্তর প্রদান করে।
আমি। উহারা যখন চন্দ্রমুখীর ঘরে আসিত, সেই সময় তুমিও সেই স্থানে থাকিতে?
সরলা। না, আমাকে প্রায়ই সেই সময়ে সেই স্থানে থাকিতে দিত না। কোন না কোনরূপ ছল করিয়া আমি সময় সময় সেই স্থানে গমন করিলে, সেও কোন না কোনরূপ ছল অবলম্বন করিয়া আমাকে সেই স্থান হইতে বিদায় করিয়া দিত। উহাদিগের মধ্যে যে সকল কথাবার্তা হইত, তাহা আমি প্রায়ই শুনিতে পাইতাম না।
আমি। তুমি সময় সময় উহাদিগের মধ্যে যে সকল কথাবার্তা হইতে শুনিয়াছ, তাহা যতদূর মনে করিতে পার, আমাকে বল দেখি?
সরলা। বিশেষ কোন কথা আমার মনে হয় না, তবে এক দিবস উহাদিগের এক ব্যক্তি যেন কহিয়াছিল, “ইহাতে তোমার বিশেষরূপ লাভ হইবার সম্ভাবনা,” কিন্তু কি লাভ, তাহা আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই।
আমি। আর কোন কথা মনে হয়?
সরলা। আরও যেন একদিন বলিতে শুনিয়াছিলাম, “ছেলেটি বড় বুদ্ধিমান, ও বিশেষরূপ বিবেচক হইয়াছে, ও এখন এখানেই আছে, তাহার সহিত একবার কোনরূপে দেখা করিতে পারিলে তাহার কোনরূপ কষ্ট থাকিবে না, সে নিশ্চয়ই তোমার মাসহারার বন্দোবস্ত করিয়া দিবেন।’
আমি। ইহা ব্যতীত আর কোন কথা তোমার মনে হয়?
সরলা। আর কোন কথা আমি শুনিয়াছি বলিয়া মনে করিতে পারিতেছি না।
আমি। সরলা, তুমি আমাদিগের বিশেষরূপ উপকার করিলে, যে দুইটি কথা তুমি বলিলে, ইহাতেই বোধ হয় আমাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে। আর আমাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইলে তুমিও যে গবর্ণমেন্টের নিকট হইতে কোনরূপ উপকৃত হইবে না, তাহাও নহে। সে যাহা হউক, আর তুমি যদি কোন কথা মনে করিতে পার, তাহাও আমাদিগের নিকট প্রকাশ করিতে সঙ্কোচিত হইও না।
সরলা। আর যদি কোন কথা আমার মনে হয়, তাহা তৎক্ষণাৎ আপনাকে বলিব, সে বিষয়ে আপনি কোনরূপ চিন্তা করিবেন না।
আমি। এখন আমার’ আর একটি বিষয় জানিবার বিশেষ আবশ্যক, তাহাতে যদি আমাকে কোনরূপে সাহায্য করিতে পার, তাহা হইলেই জানিব যে আমাদিগের সকল কাৰ্য্য সফল হইয়াছে।
সরলা। সে কার্য্যটি কি?
আমি। চন্দ্রমুখী কোন্ দেশীয় লোক, তাহার পিতা মাতার বা স্বামীর নাম কি, ও কোন্ স্থানে তাহাদিগের বাসস্থান, এই কয়েকটি বিষয় অবগত হইতে পারিলেই বুঝিতে পারিব যে, আমাদিগের এত পরিশ্রমের ফল ফলিয়াছে।
সরলা। আমি ত তাহা বলিতে পারিব না, কিন্তু শুনিয়াছি, তাহার বাসস্থান মেদেনীপুর জেলার অন্তর্গত কোন একটি গ্রামে। কিন্তু কোন্ গ্রামে তাহা আমি বলিতে পারি না।
আমি। উহার দেশস্থ লোকের মধ্যে কখন কাহাকেও এখানে আসিতে দেখিয়াছ?
সরলা। না।
আমি। তুমি এই বাড়ীতে কত দিবস আছ?
সরলা। বহু দিবস।
আমি। চন্দ্রমুখী যখন প্রথম এই বাড়ীতে আগমন করে, তখন তুমি কোথায় বাস করিতে?
সরলা। সেই সময়েও আমি এই বাড়ীতে থাকিতাম।
আমি। যে ব্যক্তি চন্দ্রমুখীকে বাহির করিয়া আনিয়াছিল, তাহা হইলে তাহাকেও তুমি দেখিয়াছ?
সরলা। সে প্রায় বৎসরাবধি এই বাড়ীতে যাতায়াত করিয়াছিল, তাহার পর সে মরিয়া যায়।
আমি। তাহার নাম তোমার মনে হয় কি?
সরলা। আমার বোধ হইতেছে, তাহার নাম ছিল কৈলাসচন্দ্র দত্ত।
আমি। কলিকাতায় সে কোথায় থাকিত তাহা বলিতে পার?
সরলা। তাহা আমি জানি না।
আমি। সে কি কাজ করিত শুনিয়াছিলে?
সরলা। কোন আফিসে কাজ করিত, কিন্তু কোন আফিস বা কি কার্য্য করিত তাহা আমি শুনি নাই।
আমি। যে সময় কৈলাসচন্দ্র দত্ত চন্দ্রমুখীর ঘরে আসিত, সেই সময় অপর কোন ব্যক্তি তাহার সহিত আসিত কি?
সরলা। অনেক দিবসের কথা, তাহা এখন ঠিক মনে হয় না। অবিনাশবাবু নামক এক ব্যক্তি বহুদিবস পূর্ব্বে কখন কখন উহার ঘরে আসিত। তিনি বড় ডাকঘরে চাকরি করেন, কিন্তু কোথায় যে থাকেন, তাহা আমি বলিতে পারি না। কৈলাসচন্দ্র দত্তের সঙ্গে তিনি আসিতেন, কি অপর কাহার সঙ্গে বা একাকী আগমন করিতেন, তাহা এখন আমার ঠিক মনে হয় না; তবে তিনি যে বহু পূর্ব্বে উহার সঙ্গে আসিতেন তাহা কিন্তু আমার বেশ মনে হয়। অবিনাশ বাবু এখনও বর্ত্তমান আছেন, বোধ হয় ১৫ দিবস হইতে আমি তাঁহাকে দেখিয়াছি।
আমি। ১৫ দিবস পূর্ব্বে তুমি অবিনাশবাবুকে কোথায় দেখিয়াছ?
সরলা। আমি গঙ্গা স্নান করিবার নিমিত্ত ট্রামগাড়ীতে গমন করিতেছিলাম। অবিনাশবাবুও সেই ট্রামে ছিলেন, তিনি ট্রাম হইতে নামিয়া বড় ডাকঘরের মধ্যে প্রবেশ করেন, ইহা আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি।
আমি। যখন তিনি ডাকঘরের মধ্যে প্রবেশ করেন, তখন তাঁহার কিরূপ পোষাক ছিল ও বেলা কত?
সরলা। বেলা তখন অনুমান ১০।।০ টা, তাঁহার পরিধানে পেন্টুলন ও চাপকান ছিল।
আমি। তুমি বলিতে পার, অবিনাশচন্দ্রের পদবী কি, বা তিনি কোন্ জাতি?
সরলা। তাহা আমি বলিতে পারি না, কিন্তু তাঁহাকে উত্তমরূপে চিনি, দেখিলেই চিনিতে পারিব।
আমি। যে দুই ব্যক্তির সহিত চন্দ্রমুখী সকালে এই বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছে, তাহাদিগকে দেখিলে ত চিনিতে পারিবে?
সরলা। খুব পারিব।
সরলার নিকট এই সকল বিষয় অবগত হইয়া সেই দিবসের নিমিত্ত সেই স্থান হইতে বিদায় গ্রহণ করিলাম, কিন্তু যাইবার সময় বলিয়া গেলাম, কল্য প্ৰাতঃ ৮।৯ টার সময় আমি পুনরায় তোমার নিকট আগমন করিব।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
পরদিবস বেলা ৯টার সময় আমি পুনরায় সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া বাড়ীওয়ালী বেলার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম ও তাহাকে কহিলাম, তুমি সরলাকে বলিয়া দাও, সে যেন এক কি দেড় ঘণ্টার জন্য আমার সহিত গমন করে।
বেলা। কোথায় যাইবে?
আমি। আমি যেখানে যাইব, সে আমার সহিত গাড়ীতে যাইবে, পোষ্ট আফিসের সম্মুখে গাড়ীর ভিতর বসিয়া থাকিবে। অবিনাশবাবু যে সময় ডাকঘরের মধ্যে প্রবেশ করিবেন, সেই সময় সে যেন আমাকে গাড়ীর ভিতর হইতেই দেখাইয়া দেয় যে, অবিনাশবাবু কে?
বেলা। অবিনাশবাবুকে কি আবশ্যক?
আমি। বহুপূর্ব্বে অবিনাশবাবু চন্দ্রমুখীর ঘরে আগমন করিতেন, সুতরাং তিনি কৈলাসচন্দ্রকে জানিলেও জানিতে পারেন। অবিনাশকে চিনিতে পারিলে আমি তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিব, ও তাহার নিকট হইতে আমার যাহা কিছু জানিবার আবশ্যক হয় আমি জানিয়া লইব।
আমার কথা শুনিয়া বেলা সরলাকে ডাকিল ও তাহাকে আমার সহিত গমন করিয়া অবিনাশবাবুকে দেখাইয়া দিতে কহিল। প্রথমতঃ সে সেই সময় আমার সহিত যাইতে অসম্মত হইল, কিন্তু আমি ও বেলা তাহাকে বিশেষ করিয়া বুঝাইয়া বলায় সে আমার প্রস্তাবে সম্মত হইল ও আমার গাড়ীতে আসিয়া আরোহণ করিল।
আমি গাড়ী লইয়া লালদীঘির ধারে যেস্থানে পোষ্ট আফিসের কর্ম্মচারীগণ ট্রামওয়ে গাড়ী হইতে অবতরণ করে, সেইস্থানে উপস্থিত হইলাম। গাড়োয়ানকে সেইস্থানে অপেক্ষা করিতে কহিয়া, আমি গাড়ী হইতে অবতরণ করিলাম ও গাড়ী ধরিয়া গাড়ীর নিকটেই দাঁড়াইয়া রহিলাম। সরলা গাড়ীর ভিতরেই বসিয়া রহিল। সে গাড়ীর দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া, খড়খড়ির ফাঁক দিয়া, রাস্তা ও ট্রামওয়ের দিকে দেখিতে লাগিল। এইরূপে সেইস্থানে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া ১০।।০ টা বাজিয়া গেল; কিন্তু ইহার মধ্যে অবিনাশবাবুকে দেখিতে পাওয়া গেল না। প্রায় ১১টার সময় সরলা গাড়ীর দরজা একটু ফাঁক করিয়া আমাকে কহিল, “ঐ দেখুন, অবিনাশবাবু ট্রামগাড়ী হইতে অবতরণ করিয়া পোষ্ট আফিস অভিমুখে গমন করিতেছে। এই বলিয়া পেন্টুলেন চাপকান পরিহিত প্রায় ৪৫ বৎসর বয়স্ক এক ব্যক্তিকে দেখাইয়া দিয়া কহিল, উহারই কথা আমি বলিয়াছিলাম, উহার নামই অবিনাশবাবু।
সরলার কথা শুনিয়া আমি অবিনাশবাবুর নিকট দ্রুত গমন করিয়া কহিলাম, “অবিনাশবাবু!” আমার কথা শুনিয়া অবিনাশবাবু কহিলেন, “আমাকে ডাকিতেছেন কি?”
“হাঁ মহাশয়, আমি আপনাকেই ডাকিতেছি, আমার সহিত আপনার আলাপ নাই, কিন্তু আপনার সহিত আমার একটু বিশেষ প্রয়োজন আছে। কোন্ সময়ে এবং কোথায় আপনার সহিত সাক্ষাৎ হইতে পারিবে, তাহা আমাকে বলিয়া দিন, সেই সময়ে সেইস্থানে গিয়া আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব।”
অবিনাশ। আপনার কি প্রয়োজন, বলিতে পারেন।
আমি। আপনাকে বলিবার অনেকগুলি কথা আছে; তাহাতে একটু সময়ের প্রয়োজন হইবে, ও আমি আপনাকে যাহা কিছু বলিতে চাহি, তাহা নিৰ্জ্জনে হইলেই ভাল হয়। এখন আপনার আফিসের সময়, সুতরাং এ সময় আমি আপনাকে বিরক্ত করিতে চাহি না।
অবি। তাহা হইলে সন্ধ্যার পর আমার বাসায় গমন করিলে আপনার সহিত কথাবার্তা হইতে পারিবে।
আমি। আপনার বাসা যে কোথায়, তাহা আমি জানি না, জানিলে এখানে না আসিয়া আপনার বাসায় গিয়াই আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতাম।
আমার কথা শুনিয়া অবিনাশবাবু তাঁহার বাসার ঠিকানা আমাকে বলিয়া দিলেন। আমি তাঁহার ঠিকানা আমার পকেট বহিতে লিখিয়া লইয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। অবিনাশবাবুও পোষ্ট আফিসের ভিতর প্রবেশ করিলেন।
যে গাড়ীতে সরলা বসিয়াছিল, আমি সেই গাড়ীতে উঠিলাম ও সরলাকে তাহার বাসায় পৌছাইয়া দিয়া আপন স্থানে প্রস্থান করিলাম।
সেই দিবস সন্ধ্যার পর অবিনাশবাবুর বাসায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। অবিনাশবাবু আফিস হইতে আসিয়া বিশ্রাম করিতেছিলেন, এইরূপ সময়ে আমি সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হইয়া অবিনাশবাবুর নিকট সংবাদ পাঠাইয়া দেওয়ায় তিনি আমাকে ডাকাইয়া পাঠাইলেন। আমি বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলে তিনি আমাকে উপরে আসিতে কহিলেন, ও আমি উপরে উঠিলাম। দেখিলাম, এ বাড়ীতে অবিনাশবাবু পরিবার লইয়া বাস করেন না, উহা একটি মেস্, অর্থাৎ তাঁহার সদৃশ কয়েকজন ভিন্ন ভিন্ন আফিসের কর্ম্মচারী একত্রে মিলিত হইয়া এইস্থানে বাস করিয়া থাকেন। সকলে মিলিয়া একটি ব্রাহ্মণও একটি ঝি রাখিয়াছেন, তাহারাই বাসার সকল কার্য্য নির্ব্বাহ করিয়া থাকে। এই মেস্ বা বাসায় যে কয়েকজন বাস করিয়া থাকেন, তাহাদিগের প্রত্যেকের সম্বলের মধ্যে এক একখানি কেওড়া কাঠের তক্তাপোষ, তাহার উপর একটি করিয়া বিছানা, ও এক একটি টিনের বাক্স ও কাপড় রাখিবার নিমিত্ত দেওয়ালের গায়ে এক একটি করিয়া আলা আছে। এইরূপ আস্থাব লইয়া ঘরের আয়তন অনুসারে কোন ঘরে একজন, কোন ঘরে দুইজন, কোন ঘরে তিনজন, ও কোন ঘরে বা চারিজন বাস করিয়া থাকেন।
আমি উপরে উঠিলে, অবিনাশবাবু আমাকে সঙ্গে লইয়া যে ঘরে তিনি বাস করিয়া থাকেন, সেই ঘরে প্রবেশ করিলেন ও তাহার তক্তপোষের উপর আমাকে বসিতে কহিলেন। আমি সেই স্থানে উপবেশন করিলে, তিনি তক্তাপোষের একপ্রান্তে উপবেশন করিলেন, ও আমাকে কহিলেন, “মহাশয় আপনি কে? কোথায় থাকেন? ও আমার নিকট আপনার প্রয়োজনই বা কি?”
আমি। আমি একজন পুলিসকর্ম্মচারী, একটি মোকদ্দমায় নিযুক্ত হইয়া আমি নানাস্থানে ঘুরিয়া বেড়াইতেছি। সর্ব্বসাধারণের উপকারের নিমিত্ত এই মোকদ্দমার কিনারা হওয়া নিতান্ত আবশ্যক। কিন্তু এখন যদি আপনি আমাদিগকে একটু সাহায্য করেন, তাহা হইলে এই মোকদ্দমার অনায়াসেই কিনারা হইয়া যায়। এই নিমিত্তই আমি আপনার নিকট আগমন করিয়াছি।
অবি। এমন কি মোকদ্দমা আছে যে আমি সাহায্য করিলে ঐ মোকদ্দমার কিনারা হইতে পারে। আমি ত এরূপ’ কিছুই মনে করিয়া উঠিতে পারিতেছি না।
আমি। আমি যাহার জন্য আপনার নিকট আসিয়াছি, তাহা আপনি সহজে মনে করিয়া উঠিতে পারিবেন না। ইহা বহু দিবসের ঘটনা, অথচ এরূপ কোন ঘটনা নাই যে, সহজে তাহা আপনার মনে হইতে পারে। সে যাহা হউক, আমি আপনাকে গোপনে গুটীকতক কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাহি, আপনি অনুগ্রহ করিয়া যদি উহা আমাকে বলিয়া দেন, তাহা হইলে বিশেষ উপকার করা হয়। আমি আরও আপনাকে বলিতেছি, আপনি ঐ সম্বন্ধে আমাকে যাহা বলিবেন, তাহা আমি গোপন রাখিব, অপর আর কেহই তাহা অবগত হইতে পারিবে না, বা কোনরূপে আপনাকে সাক্ষ্যস্থানেও দণ্ডায়মান হইতে হইবে।
অবিনাশ। বলুন, আমাকে কি বলিতে হইবে?
আমি। বহু দিবস অতীত হইল, চন্দ্রমুখী নাম্নী একটি স্ত্রীলোককে কৈলাসচন্দ্র দত্ত নামক এক ব্যক্তি বাহির করিয়া আনিয়াছিল, সেই সময় আপনি মধ্যে মধ্যে তাহার ঘরে গমন করিতেন। এখন আমার সেই মাত্র জানিবার প্রয়োজন যে, চন্দ্রমুখী কোন্ দেশীয় স্ত্রীলোক বা তাহার আত্মীয় স্বজনের মধ্যে কেহ বর্ত্তমান আছে কি না?
আমার কথা শুনিয়া অবিনাশবাবু অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত চুপ করিয়া রহিলেন ও পরিশেষে কহিলেন, চন্দ্রমুখী কে আমি তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না।
অবিনাশবাবুর কথা শুনিয়া, চন্দ্রমুখী দেখিতে কিরূপ স্ত্রীলোক ছিল ও কোন্ স্থানে কাহার বাড়ীতে ও কিরূপ ঘরে বাস করিত, তাহা তাঁহাকে বিশেষ করিয়া বুঝাইয়া বলায়, তখন অবিনাশ বাবু কহিলেন, হাঁ, এখন আমার মনে হইতেছে। আমি তাহার ঘরে মধ্যে মধ্যে যাতায়াত করিতাম এ কথা সত্য, কিন্তু সে অনেক দিবসের কথা।
আমি। আমিতো সে কথা আপনাকে পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, উহা অনেক দিবসের ঘটনা। এখন স্মরণ করিয়া দেখুন দেখি, কৈলাসচন্দ্র দত্তকে আপনার মনে পড়ে কি না?
অবিনাশ। কৈলাসচন্দ্র দত্ত যে কে, তাহা আমার ঠিক মনে পড়িতেছে না, কিন্তু ইহা আমার বেশ মনে হইতেছে যে, আমি সেই স্ত্রীলোকটির নিকট শুনিয়াছি যে, এক ব্যক্তি তাহাকে তাহার গৃহ হইতে বাহির করিয়া আনে, কিন্তু আমি যখন উহার ঘরে যাই, তখন সে মরিয়া গিয়াছিল; আরও যেন মনে হইতেছে, যে তাহাকে বাহির করিয়া আনিয়াছিল, তাহার বাসস্থান ও ঐ স্ত্রীলোকটির বাসস্থান যেন একই গ্রামে।
আমি। কোন্ গ্রামে উহাদিগের বাসস্থান ছিল, তাহা চন্দ্রমুখী আপনাকে কোন দিন বলিয়াছিল কি?
অবিনাশ। তাহা মনে হয় না, যদি বলিয়া থাকে, তাহা হইলে আমি তাহা ভুলিয়া গিয়াছি।
আমি। গ্রাম মনে নাই, কিন্তু উহাদিগকে কোন্ দেশীয় লোক বলিয়া আপনার বিশ্বাস ছিল?
অবিনাশ। আমার বিশ্বাস কিছুই ছিল না, কিন্তু ঐ স্ত্রীলোকটি আমাকে বলিয়াছিল যে, উহার বাসস্থান মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত কোন গ্রামে, আমার যেন আরও মনে হয় যে, ঐ গ্রামটি দাঁতন নামক কোন প্রসিদ্ধ গ্রামের নিকটবর্তী একটি
ক্ষুদ্র পল্লী। বোধ হইতেছে, গ্রামের নামও যেন উল্লেখ করিয়াছিল, কিন্তু আমি মনে করিতে পারিতেছি না।
আমি। আপনি যতদূর মনে করিতে পারিয়াছেন, তাহাই যথেষ্ট। ইহা হইতে আমরা কার্য্য উদ্ধার করিয়া লইতে পারিব এরূপ ভরসা করি।
অবিনাশ। কেহ মহাশয়, ঐ স্ত্রীলোকটির সম্বন্ধে এত অনুসন্ধান? এসকল কথা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেই তো অনায়াসেই জানিতে পারেন?
আমি। স্ত্রীলোকটি জীবিত থাকিলে আর আপনার নিকট আমাকে আগমন করিতে হইত না। উহার সম্বন্ধে আমি কেন যে এত কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তাহা আর এক দিবস আগমন করিয়া আপনাকে বলিব। ইতি মধ্যে উহাদিগের সম্বন্ধে আরও যদি কোন কথা মনে করিতে পারেন, তাহা দেখিবেন।
এই বলিয়া আমি সেই দিবস তাহার নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিলাম।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত দাঁতন নামক স্থানটি যে কোথায় তাহা আমি পূৰ্ব্ব হইতেই জানিতাম। উহা একটি প্রসিদ্ধ স্থান ও ঐ স্থানে ইতিপূর্ব্বে আমি অনেকবার গমন করিয়াছিলাম। অবিনাশ বাবুর কথায় বিশ্বাস করিয়া আমি সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। বেঙ্গল নাগপুর রেলের কল্যাণে এখন ঐ স্থানে গমনাগমন করিতে আর কোনরূপ কষ্টই হয় না, ঐ স্থানে এখন একটি ষ্টেসনও হইয়াছে। কিন্তু আমি যে সময়ের কথা বলিতেছি, তখন রেলওয়ে ছিল না; খাল বাহিয়া ষ্টিমার মেদিনীপুর গমন করিত ও সেই স্থান হইতে পদব্রজে অথবা শকটারোহণে দাঁতন গমন করিতে হইত। যে বহু পুরাতন রাস্তা পুরুষোত্তমে গমন করিয়াছে, ঐ রাস্তার উভয় পার্শ্বে দাঁতন গ্রাম, অর্থাৎ দাঁতন গ্রামকে দুই ভাগে বিভক্ত করিয়া ঐ প্রশস্ত রাস্তা সোজা দক্ষিণমুখে চলিয়া গিয়াছে। ঐ দাঁতন গ্রামের একটু অবস্থা এই স্থানে বর্ণন করা বোধ হয় আমার কর্তব্য কৰ্ম্ম। এই স্থানে সামলেশ্বর নামক মহাদেবের পুরাতন মন্দির এখনও বর্তমান। ঐ মন্দিরের সম্মুখে কাল প্রস্তর-নির্ম্মিত একটি বৃহৎ বৃষমূর্ত্তি শুইয়া আছে, উহার সম্মুখের দুইখানি পদ কাটা। কথিত আছে, উহার এইরূপ অবস্থা সেই ভয়ানক কালাপাহাড় কর্তৃক হইয়াছিল। মন্দিরের গাত্রে বর্তমান রুচিবিরুদ্ধ দুই একটি অশ্লীল মূৰ্ত্তি এখনও দেখিতে পাওয়া যায়। ঐ সকল অশ্লীল মূৰ্ত্তি পবিত্র দেব মন্দিরের গায়ে যে কেন স্থাপিত হইয়াছিল, তাহার কারণ এখনও অবগত হইতে পারা যায় না। কথিত আছে যে, ভোজরাজ কর্তৃক ঐ মন্দির প্রস্তুত ও তাঁহা কর্তৃকই ঐ সামলেশ্বর মূর্ত্তি স্থাপিত হয়। ঐ মন্দিরের চতুষ্পার্শ্বে আম্রবৃক্ষ সকল ও ময়দান ধূ ধূ করিতেছে। পুরুষোত্তম যাত্রীগণের মধ্যে অনেকেই যে ঐ স্থানে গমন করিয়া সামলেশ্বর মহাদেব দর্শন ও তাঁহার পূজাদি করিয়া গমন করিতেন, তাহার আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু ঐ মন্দিরের বর্তমান অবস্থা নিতান্ত শোচনীয়, একজন পূজারির হস্তে ঐ মন্দিরের ভার এখন ন্যস্ত আছে; তাঁহার ইচ্ছামত একবার তিনি ঐ স্থানে আগমন করিয়া সামলেশ্বরের পূজা করিয়া মন্দিরের তালা বন্ধ করিয়া চলিয়া যান, তাহার পর যদি কেহ ঐ মূৰ্ত্তি দর্শন বা পূজা করিবার নিমিত্ত সেই স্থানে আগমন করেন, তাহা হইলে তাহার অদৃষ্টে ঐ মূর্ত্তি দর্শন প্রায়ই ঘটে না। পূজারি ব্রাহ্মণকে প্রায় খুঁজিয়া পাওয়া যায় না।
এই স্থানের নাম যে কেন দাঁতন হইল, সে বিষয়ে অনেক কিম্বদন্তী আছে। কেহ কহেন, চৈতন্যদেব পুরুষোত্তম গমনকালে ঐ স্থানে দাঁতন করিয়া হস্তমুখাদি প্রক্ষালন করিয়াছিলেন বলিয়া, ঐ স্থান দাঁতন নামে প্রসিদ্ধ হইয়াছে। কেহ কহেন, ভগবান মনুষ্যরূপ ধারণ করিয়া যে সময় ঐ স্থান দিয়া পুরী গমন করিতেছিলেন, সেই সময় তিনিই ঐ স্থানে দাঁতন করিয়া হস্তমুখাদি প্রক্ষালন করেন বলিয়া ঐ স্থানকে দাতন কহে। কিন্তু প্রায় ২৫০ বৎসর পূর্ব্বে যদুনন্দন যে দাঁতনের ইতিহাস লিখিয়া গিয়াছেন, তাহা পাঠ করিলে স্পষ্টই জানিতে পারা যাইবে যে চৈতন্যদেবের বহু পূৰ্ব্ব হইতেই এই দাঁতন নাম বিদ্যমান আছে।
এই স্থানে দুইটি বৃহৎ পুষ্করিণী আছে। উহার একটির নাম বিদ্যাধর, ও অপরটির নাম শশাঙ্ক। বিদ্যাধরের প্রায় ১২০০ ফিট্ লম্বা ১০০০ ফিট্ প্রস্থ জলকর। উহার জল অতি গভীর ও নিৰ্ম্মল। উহার ঠিক মধ্যস্থলে জলের মধ্যে একটি দেবমন্দির প্রতিষ্ঠিত আছে। গ্রীষ্মকালে জল কমিয়া গেলে এখনও পর্যন্ত ঐ মন্দিরের চূড়া দৃষ্টিগোচর হইয়া
থাকে। কথিত আছে, রাজা তেলিঙ্গা মুকুন্দদেবের মন্ত্রী বিদ্যাধর কর্তৃক এই পুষ্করিণী খোদিত হইয়াছিল।
শশাঙ্ক নামক পুষ্করিণী অতিশয় বৃহৎ, উহার জলকরের পরিমাণ দৈর্ঘ্যে ৫০০০ ফিট, ও প্রস্থে ২৫০০ ফিট। রাজা শশাঙ্কদেব জগন্নাথগমনকালীন এই পুষ্করিণী খোদিত করিয়াছিলেন। এরূপ কথিত আছে যে, উভয় পুষ্করিণী প্রস্তর নির্ম্মিত ৭।।০ ফিট উচ্চ ও ৪।।০ ফিট প্রস্থ একটি সুড়ঙ্গ দ্বারা সংযোজিত ও উভয় পুষ্করিণীর জলের উচ্চতা একরূপই দেখিতে পাওয়া যায়।
আমি দাঁতন গ্রামে অবস্থিতি করিতে লাগিলাম, এই স্থানে আমাকে অষ্টাহকাল বাস করিতে হইল। বলা বাহুল্য, আমি দাঁতন থানাতেই অবস্থিতি করিয়া সেই স্থানের ভারপ্রাপ্ত কর্ম্মচারীর সাহায্যে গোপনে অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম।
পাঠকগণের মধ্যে সকলেই অবগত আছেন যে, প্রত্যেক থানার অধীনে যতগুলি গ্রাম আছে, সেই সকল গ্রামের প্রত্যেকে চৌকিদারকে সপ্তাহে এক দিবস থানায় আসিয়া উপস্থিত হইতে হয়; ও তাহাদিগের এলাকাভুক্ত স্থানে যে সকল নূতন সংবাদাদি ঘটিয়াছে, তাহার সংবাদ প্রদান করিতে হয়।
ঐ চৌকিদারগণের মধ্যস্থিত একজন পুরাতন চৌকিদারের নিকট হইতে অবগত হইতে পারিলাম যে, দাঁতনের প্রায় ৬।৭ ক্রোশ দূরে একখানি গ্রাম আছে। ঐ গ্রামে কৈলাসচন্দ্র দত্ত নামক এক ব্যক্তি বাস করিত, ও কলিকাতার সে স্থানে চাকরি করিত। ঐ গ্রামের বিমলাচরণ দত্ত নামক তাহার একজন কুটুম্বের কন্যাকে সে বাহির করিয়া লইয়া যায়। ঐ স্ত্রীলোকটির যে কি নাম ছিল, তাহা সে বলিতে পারে না, কিন্তু সেই সময় হইতে সেই কন্যাটি বা কৈলাসচন্দ্র দত্ত আর দেশে প্রত্যাগমন করে নাই। কিন্তু লোকপরম্পরায় শুনিতে পাওয়া যায় যে, অনেক দিবস হইল, কৈলাসচন্দ্র দত্ত মরিয়া গিয়াছে, ও সেই স্ত্রীলোকটি কলিকাতার কোন স্থানে বেশ্যাবৃত্তি করিতেছে। চৌকিদারের নিকট হইতে এই সংবাদ অবগত হইয়া বুঝিতে পারিলাম, যে বিষয় অবলম্বন করিয়া আমি তথায় আগমন করিয়াছি, তাহাতে কৃতকার্য হইবার পন্থা প্রাপ্ত হইতে পারা যাইবে সন্দেহ নাই। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমি সেই চৌকিদারকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ঐ স্ত্রীলোকটির পিতা বিমলাচরণ দত্ত, এখন কোথায়?
চৌকিদার। তিনি বৃদ্ধ হইয়াছেন, কোন স্থানে গমনাগমন করেন না, বাড়ীতেই থাকেন। গতকল্য আমি তাঁহাকে তাঁহার বাড়ীতেই দেখিয়াছি।
আমি। এ স্ত্রীলোকটির কোথায় বিবাহ হইয়াছিল তাহা বলিতে পারো?
চৌকি। তাহা আমি বলিতে পারি না, কিন্তু সে বিধবা হইয়া তাহার পিতার আলয়ে বাস করিতেছিল। সেই স্থান হইতেই সে বাহির হইয়া যায়।
আমি। বিমলাচরণ দত্ত কি প্রকার লোক, তাহাকে ডাকিলে সে এখানে আসিবে কি?
চৌকি। তিনি খুব ভদ্রলোক, সামান্য বিষয় আদিও আছে, দারোগাবাবু তাহাকে ডাকিয়াছেন বলিলে তিনি নিশ্চয়ই এখানে আসিবেন।
আমার সহিত যখন চৌকিদারের কথাবার্তা হইতেছিল, সেই সময় সেই থানার দারোগাবাবুও সেইস্থানে উপস্থিত ছিলেন। চৌকিদারের কথা শুনিয়া তিনি একখানি আদেশনামা লিখিয়া ঐ চৌকিদারের হস্তে প্রদান করিলেন ও আগামী কল্য সন্ধ্যার পূর্ব্বেই বিমলাচরণ দত্তকে সঙ্গে লইয়া থানায় প্রত্যাগমন করিতে আদেশ দিলেন। আরও বলিয়া দিলেন, যদি কোন কারণে বিমলাচরণ দত্ত কল্য আসিতে না পারেন, তাহা হইলে ঐ চৌকিদার আসিয়া সেই সংবাদ যেন প্রদান করিয়া যায়। তাহা হইলে উপস্থিতমত যে কোনরূপ বন্দোবস্ত করিবার প্রয়োজন বিবেচিত হইবে, তাহা তখনই করা যাইতে পারিবে।
দারোগাবাবুর আদেশ অবগত হইয়া ও আদেশনামা সঙ্গে লইয়া চৌকিদার সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। চৌকিদার প্রস্থান করিবার পর এ বিষয় অনেক চিন্তা করিলাম, ও ভাবিলাম, যদি বিমলাচরণ দত্ত চৌকিদারের সমভিব্যাহারে কলা আগমন না করে, তাহা হইলে আমাদিগকেই সেই স্থানে গমন করিতে হইবে, ও সেই স্থানে গিয়া অনুসন্ধান করিলে যদিচ সকল বিষয় অবগত হইতে পারিব সত্য, কিন্তু এ সম্বন্ধে যদি তাহার পিতার কোনরূপ স্বার্থ থাকে, তাহা হইলে সে পূৰ্ব্ব হইতেই অনেকটা সতর্ক হইয়া যাইবে। আর যদি শ্বশুর-বাড়ীর সম্পর্কীয় কোন লোকের দ্বারা ঐ কার্য্য হইয়া থাকে, তাহা হইলে তাহার পিতার দ্বারা অনেকটা সাহায্য পাইলেও পাইতে পারিব। মনে মনে এইরূপ চিন্তা করিয়া সে দিবস অতিবাহিত করিলাম।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পরদিবস অপরাহ্ন ৪টার সময় ঐ চৌকিদারের সহিত বিমলাচরণ দত্ত আসিয়া থানায় উপস্থিত হইল। তাঁহাকে লইয়া আমি ও দারোগাবাবু নির্জ্জনে কথাবার্তা কহিতে আরম্ভ করিলাম।
আমি। মহাশয়, আমরা আপনাকে কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করিবার অভিপ্রায়ে এই স্থানে ডাকাইয়া আনিয়াছি, যে সকল কথা আমরা আপনাকে জিজ্ঞাসা করিব, তাহা আপনার পক্ষে বিশেষ লজ্জাস্কর কথা হইলেও আপনি কোন কথা গোপন না করিয়া উহার প্রকৃত উত্তর প্রদান করেন, ইহাই আমাদিগের অভিলাষ; গোপনীয় কথা গোপনে জিজ্ঞাসা করিব বলিয়া আমরা আপনার বাড়ীতে না গিয়া আপনাকে এই স্থানে ডাকাইয়া আনিয়াছি।
বিমলা। কি জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন করুন, আমি কোন কথা গোপন করিব না, যাহা জিজ্ঞাসা করিবেন, তাহার যথাযথ সত্য উত্তর প্রদান করিব।
আমি। আপনাদিগের গ্রামে কৈলাসচন্দ্র দত্ত নামে এক ব্যক্তি বাস করিত?
বিমলা। হাঁ, করিত, কিন্তু সে মরিয়া গিয়াছে, তাহার পিতা ও ভ্রাতারা এখনও আমাদিগের গ্রামে বাস করিতেছে।
আমি। উহারা আপনাদিগের জাতীয়।
বিমলা। হাঁ, আমাদিগের স্বজাতীয়।
আমি। ঐ কৈলাসচন্দ্র দত্ত, আপনার একটি বিশেষ সর্বনাশ করে না?
বিমলা। হাঁ, তাহার উপর আমাদিগের সন্দেহ হইয়াছিল।
আমি। সন্দেহ হইয়াছিল যে, সেই আপনার কন্যাকে বাহির করিয়া লইয়া যায়?
বিমলা। হাঁ।
আমি। আপনার সেই কন্যার নাম কি?
বিমলা। তাহাকে আমরা গিরিবালা বলিয়াই ডাকিতাম।
আমি। কৈলাসচন্দ্র দত্ত তো মরিয়া গিয়াছে, কিন্তু গিরিবালা এখন কোথায় আছে তাহা বলিতে পারেন?
বিমলা। শুনিয়াছি, সে কলিকাতায় আছে, কিন্তু কোন স্থানে যে আছে, তাহা আমি অবগত নহি।
আমি। গিরিবালা যখন আপনার বাড়ী হইতে চলিয়া যায়, সেই সময় সে সধবা কি বিধবা ছিল?
বিমলা। তাহার প্রায় দুই বৎসর পূর্ব্বে সে বিধবা হয়।
আমি। তাহার কোন সন্তান-সন্ততি হইয়াছিল?
বিমলা। হাঁ, একটি পুত্রসন্তান হয়।
আমি। সে পুত্রটি এখন কোথায়?
বিমলা। সে তাহার পিতার বাটীতেই আছে, উহার ঠাকুরদাদা কখন তাহাকে এখানে পাঠায় না। আমি! তাহার বয়ঃক্রম এখন কত হইবে?
বিমলা। বোধ হয়, ১৬।১৭ বৎসর হইবে। মহাশয়! আপনি গিরিবালা সম্বন্ধে এতদূর অনুসন্ধান করিতেছেন কেন? আপনি কি বলিতে পারেন, গিরিবালা এখন কোথায় আছে?
আমি। পারি।
বিমলা। যদি এখন তাহার ঠিকানা আমাকে বলিয়া দেন, তাহা হইলে আমার বিশেষ উপকার করা হয়। আমি তাহার অনেক অনুসন্ধান করিতেছি, কিন্তু কোনরূপেই তাহার সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিতেছি না।
আমি। বহুবৎসর হইল, সে আপনার বাটী হইতে বহির্গত হইয়া গিয়াছে; এত দিবস তাহার কোনরূপ সন্ধান করেন নাই; কিন্তু এখন তাহার সন্ধান করিবার প্রয়োজন কি? আমি জানি, সে এখন কোথায় আছে; যদি আপনি আমাকে সমস্ত কথা কহেন, তাহা হইলে আমি গিরিবালার সন্ধান আপনাকে বলিয়া দিতে প্রস্তুত আছি।
পাঠকগণকে বোধ হয় বলিয়া দিতে হইবে না যে, যে চন্দ্রমুখী ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছে, তাহারই নাম গিরিবালা। সে ঘর হইতে বাহির হইয়া কলিকাতায় আসিবার পর আপনার নাম পরিবর্তন করিয়া, নূতন নাম চন্দ্রমুখী ধারণ করিয়াছিল। উহার নাম গিরিবালা, ও কলিকাতার নাম চন্দ্রমুখী। কলিকাতার মধ্যে এখন যে সকল বেশ্যা দেখিতে পাওয়া যায়, তাহার মধ্যে যাহারা নিজে বাহির হইয়া আসিয়াছে, তাহাদের প্রায় সকলের নাম পরিবর্তন হইয়া গিয়াছে।
আমার কথা শুনিয়া বিমলাচরণ দত্ত কহিলেন, মহাশয়, আমি যে কেন গিরিবালাকে অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেছি, তাহা আপনার নিকট সমস্তই প্রকাশ করিতেছি, তাহা হইলে আপনি সমস্তই অবগত হইতে পারিবেন।
প্রায় ছয় মাস হইল, আমার স্ত্রী ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছে, তাহার মৃত্যুর প্রায় ছয় মাস পূর্ব্বে সে একটি মূল্যবান জমীদারী প্রাপ্ত হয়। তাহার পিতার বংশের কোন ব্যক্তির ঐ জমীদারী ছিল। তাঁহার মৃত্যু হওয়ায় আমার স্ত্রী ব্যতীত তাঁহার আর কোন উত্তরাধিকারী ছিল না, সুতরাং স্ত্রীই সেই অগাধ বিষয়ের উত্তরাধিকারিণী হয়। যিনি ঐ বিষয়ের স্বত্তাধিকারী ছিলেন, হঠাৎ তাঁহার মৃত্যু হওয়ায়, তিনি ঐ বিষয়ের জন্য উইল বা অপর কোনরূপ বন্দোবস্ত করিয়া যাইতে পারেন নাই। সুতরাং আমার স্ত্রী বিষয়ের স্বত্তাধিকারিণী হইয়া আদালত হইতে সার্টিফিকেট প্রভৃতি গ্রহণ করিয়া উহা দখল করিয়া লয়; কিন্তু ঐ জমীদারীর প্রজাগণের সহিত বন্দোবস্ত করিয়া খাজনাপত্র আদায় হইবার পূর্ব্বেই কোথা হইতে কাল আসিয়া আমার স্ত্রীকে গ্রাস করে।
আমার স্ত্রী ঐ বিষয়ের উত্তরাধিকারিণী হইয়া ইহজীবন পরিত্যাগ করে, সুতরাং আইনানুসারে ঐ বিষয়ের উত্তরাধিকারিণী তাহার কন্যা। কিন্তু গিরিবালা ব্যতীত আমার আর কন্যা নাই, সুতরাং গিরিবালাই এখন সেই অগাধ বিষয়ের অধিকারিণী। এই নিমিত্তই আমি গিরিবালার অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেছি। সে ঘরের বাহির হইয়া গিয়াছে সত্য, কিন্তু এখন তাহার সন্ধান পাইলে সমাজের দিকে দৃষ্টিপাত না করিয়াও আমি তাহাকে ঘরে লইয়া আসিব।
বিমলাচরণ দত্তের কথা শুনিয়া আমি এখন বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, কি নিমিত্ত বিমলাচরণ দত্ত তাহার কন্যার বৰ্ত্তমান ঠিকানা জানিতে এত ব্যস্ত হইয়াছেন। আরও বুঝিতে পারিলাম, চন্দ্রমুখী ওরফে গিরিবালাকে হত্যা করিবার কারণ কি, ও গিরিবালার অবর্তমানে তাহার অগাধ সম্পত্তির অধিকারী কে হইবে?
গিরিবালা যখন কুলের বাহির হইয়া যায়, সেই সময় তাহার একটি পুত্র ছিল, ঐ পুত্রটি তাহার পিতামহের দ্বারা প্রতিপালিত হইয়া এখন ১৬।১৭ বৎসরের হইয়াছে। কিন্তু একদিনের নিমিত্তও সে তাহার মাতামহের নিকট আগমন করে নাই। গিরিবালার অবর্তমানে ঐ বিষয়ের উত্তরাধিকারী তাহার সেই একমাত্র পুত্রই হইবে।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
বিমলাচরণ দত্তের বাড়ী হইতে প্রায় ১০ ক্রোশ ব্যবধানে চন্দ্রমুখী ওরফে গিরিবালার শ্বশুর-বাড়ী। গিরিবালার পুত্রের নাম শশীভূষণ, শ্বশুরের নাম কমলাকান্ত। বিমলাচরণ দত্তের নিকট হইতে সমস্ত কথা অবগত হইয়া, আমি কমলাকান্তের গ্রামাভিমুখে গমন করিলাম। ঐ স্থানে গমন করিতে হইলে শকট ভিন্ন উপায়ান্তর ছিল না; সুতরাং শকটযানে আরোহণ করিয়া ঐ গ্রামের নিকটবর্তী এক গ্রামে উপনীত হইলাম। মনে মনে ইচ্ছা, একেবারে কমলাকান্তের বাড়ীতে উপস্থিত না হইয়া যতদূর সম্ভব বাহিরে বাহিরে অনুসন্ধান করিব, ও পরিশেষে সেই গ্রামে উপস্থিত হইয়া ঐ অনুসন্ধান শেষ করিব।
সকল দেশেই ও সকল গ্রামেই ভাল মন্দ উভয় প্রকারের লোক দেখিতে পাওয়া যায়। মন্দ লোকের মধ্যে আবার এরূপ অনেক লোক পাওয়া যায় যে, কাহারও সহিত তাহাদিগের কোনরূপ মনোবিবাদ না থাকিলেও কোনগতিকে সুযোগ পাইলে, তাহারা অপরের অনিষ্ট করিতে কোনরূপে পরাঙ্মুখ হয় না; ইহাতে তাহাদিগের কোনরূপ স্বার্থ থাকুক বা না থাকুক, পরের অপকার করাই যেন তাহাদিগের জীবনের প্রধান কার্য্যের মধ্যে পরিগণিত। এরূপ লোক-চরিত্রের কথা যে আমি কল্পনা করিয়া বলিতেছি তাহা নহে। সহর বলুন বা পল্লীগ্রাম বলুন, যে স্থানে অনুসন্ধান করিবেন, সেইস্থানেই এরূপ প্রকৃতির লোক প্রাপ্ত হইবেন। যে সকল কার্য্য বা কথার দ্বারা অপরের অনিষ্ট হইবার কোনরূপ সম্ভাবনা থাকে, সেই সকল বিষয় প্রকৃত হইলেও ভাল লোকের মুখ হইতে উহা প্রায়ই বাহির হয় না, আবশ্যক হইলে তাহাদিগের মধ্যে কেহ কেহ মিথ্যা কহিয়াও দোষী ব্যক্তিদিগকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিয়া থাকেন। সুতরাং ঐ সকল লোকদিগের সাহায্যে পুলিস-কৰ্ম্মচারীগণের কোন বিষয় অনুসন্ধান করিবার বা তাঁহাদিগের নিকট হইতে কোন বিষয় অবগত হইবার প্রায় সুবিধাই হয় না; সুতরাং অনন্যোপায় হইয়া কাৰ্য উদ্ধার করিবার জন্য পুলিস-কৰ্ম্মচারীগণের ঐ সকল মন্দ লোকের সাহায্য গ্রহণ করিতে হয়। এই নিমিত্তই সময় সময় পুলিস-কৰ্ম্মচারীরা পদস্খলিত হইয়া পড়ে ও এই নিমিত্তই তাঁহারা বিশেষ চেষ্টা করিয়াও কোনরূপ যশলাভ করিতে পারেন না।
আমি যে গ্রামে গিয়া উপনীত হইলাম, সেই গ্রামের পঞ্চায়েৎ ও চৌকিদারগণের সাহায্যে আমাকে অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইতে হইল। তাহাদিগের ও তাহাদিগের আনীত অপর ব্যক্তিগণের দ্বারা অবগত হইলাম যে, কমলাকান্ত একজন অতিশয় ভয়ানক লোক। তিনি এখন বৃদ্ধ হইয়াছেন সত্য, কিন্তু তাঁহার যৌবনকালে তিনি না করিয়াছেন এরূপ কোন দুষ্কাৰ্য্যই নাই। তিনি ডাকাইতদের একজন সর্দার ছিলেন। কোন কোন ডাকাইতিতে তিনি নিজেও গমন করিতেন, একবার ধরাও পড়িয়াছিলেন, কিন্তু অর্থের জোরে ও ইংরাজ-আইনের গুণে তিনি সে যাত্রা নিষ্কৃতি পান। এখন তাঁহার বয়ঃক্রম হইয়াছে, নিজে সদাসৰ্ব্বদা সকল স্থানে যাতায়াত করিতে সমর্থ না হইলেও, তাঁহার পূৰ্ব্ব-দলস্থিত ব্যক্তিগণ এখনও তাঁহার নিকট প্রায়ই পরামর্শ গ্রহণ করিয়া থাকেন। তিনি দেশের মধ্যে একজন মামলাবাজ। মামলা-মোকদ্দমায় কি করিলে কি হয়, তাহা তিনি উত্তমররূপ জানেন, ও অনেক নামজাদা উকীলগণ অপেক্ষাও তিনি কূট পরামর্শ প্রদানে শ্রেষ্ঠ। এইরূপ নানাপ্রকার অসৎ উপায়ে অর্থ লুণ্ঠন করিয়া তিনি কিছু অর্থের সংস্থান করিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার অবর্তমানে ঐ অর্থ ভোগ করিবার পূর্ব্বেই তাঁহার একমাত্র পুত্র অকালে কাল- কবলে পতিত হয়, ও পুত্রবধূ গিরিবালা কুল পরিত্যাগ করিয়া তাহার পিত্রালয় হইতে চলিয়া যায়। এখন তাঁহার ভরসার মধ্যে কেবল ১৬।১৭ বৎসর বয়স্ক একমাত্র পৌত্র শশীভূষণ।
অনুসন্ধানে আরও জানিতে পারিলাম, কমলাকান্তের বিশ্বাসী চাকর প্রভৃতি কে কে আছে, ও অপরাপর ব্যক্তিগণের মধ্যে তাঁহার বিশেষরূপ অনুগতই বা কে কে? আরও জানিতে পারিলাম, যে সময় চন্দ্রমুখীর মৃতদেহ পাওয়া যায়, সেই সময় কোন্ কোন্ ব্যক্তি গ্রাম হইতে অনুপস্থিত ছিল।
এই সকল বিষয় অবগত হইবার পর, আমরা অনুসন্ধানের বিস্তৃত পথ প্রাপ্ত হইলাম।
সেই সময় আমাদিগের প্রধান কার্য্য হইল, যে যে ব্যক্তি সেই সময় গ্রামে অনুপস্থিত ছিলেন, সৰ্ব্ব প্রথমে তাহাদিগের সন্ধান করা। স্থানীয় পুলিসের সাহায্যে সেই কাৰ্য সম্পন্ন করিতে আমার বিশেষ কষ্ট বা অধিক বিলম্ব হইল না। উহাদিগকে করায়ত্ব করিয়া পরিশেষে আমরা সদলবলে কামলাকান্তের গ্রামে গিয়া উপনীত হইলাম। কমলাকান্ত ও শশীভূষণ উভয়ে বাড়ীতেই ছিলেন, সুতরাং তাঁহারও অনায়াসে আমাদিগের আয়ত্ত্বাধীন হইলেন।
ইঁহাদিগকে আমরা প্রথমে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলাম, কিন্তু আমাদিগের কার্য্যোপযোগী কোন কথাই তাঁহাদিগের নিকট হইতে প্রাপ্ত হইলাম না। তখন অনন্যোপায় হইয়া সকলকেই থানায় পাঠাইয়া দেওয়া হইল। এদিকে আমার ঊর্দ্ধ তন কৰ্ম্মচারীকে তারযোগে সংবাদ পাঠাইয়া দিলাম, যত শীঘ্র পারেন, বেলা বাড়ীওয়ালির ভাড়াটিয়া সরলাকে যেন, আমাদিগের নিকট পাঠাইয়া দেওয়া হয়।
পরদিবসেই সরলা আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইল, ও ঐ সমস্ত লোকদিগের মধ্যে দুইজনকে চিনতে পারিল, ও কহিল, “এই দুইজনকে আমি দুই তিনবার চন্দ্রমুখীর ঘরে দেখিয়াছি, ইহাদেরই সহিত চন্দ্রমুখী বাহির হইয়া যায়, কিন্তু আর প্রত্যাগমন করে নাই।
সরলার এই কথা শুনিয়া ঐ দুই ব্যক্তির মুখ দিয়া প্রথমতঃ কোন কথাই বাহির হইল না, অধিকন্তু তাহাদের মুখ শুষ্ক হইয়া গেল— শূন্যদৃষ্টিতে এদিক-ওদিক দেখিতে লাগিল। উহাদের ঐরূপ অবস্থা দেখিয়া আমাদের বেশ অনুমান হইল যে, চন্দ্রমুখী ঐ দুই ব্যক্তি দ্বারা বা তাহাদের সাহায্যে হত হইয়াছে। আরও বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, কমলাকান্তই এই হত্যাকাণ্ডের মূলীভূত কারণ; ইহাতে তাঁহার যতদূর স্বার্থ, প্রকৃত হত্যাকারীর কিছু অর্থের প্রলোভন ভিন্ন তত বিশেষ কোন স্বার্থ নাই। চন্দ্রমুখী ওরফে গিরিবালা অগাধ বিষয়ের অধিকারিণী হইয়াছিল, তাহার অবর্তমানে ঐ সমস্ত বিষয় নামে মাত্র তাহার পৌত্র শশীভূষণের হইবে। কারণ, যতকাল কমলাকান্ত জীবিত থাকিবেন, ততকাল ঐ অগাধ বিষয় প্রকৃতপক্ষে তিনিই ভোগ করিবেন, শশীভূষণ নামে ঐ বিষয়ের অধিকারী থাকিবেন মাত্র।
মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া ঐ দুই ব্যক্তিকে আমরা পৃথক পৃথক স্থানে ও পৃথক পৃথক প্রহরীর পাহারায় রাখিয়া দিলাম। কমলাকান্ত ও তাঁহার পুত্র শশীভূষণও ঐরূপ পৃথক পৃথক প্রহরীর তত্ত্বাবধানে রহিলেন।
এইরূপে কিছুক্ষণ অতিবাহিত হইবার পর, আমরা প্রথমে শশীভূষণকে লইয়া নানারূপ জিজ্ঞাসাবাদ করিতে লাগিলাম; কিন্তু তাহার ভাবভঙ্গীতে আমরা বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, শশীভূষণ নিজে ইহার কিছুই অবগত নহে, যাহা কিছু হইয়াছে, তাহা তাহার পিতামহ কমলাকান্তের দ্বারা।
ইহার পর আমরা কমলাকান্তকে লইয়া পড়িলাম। পূর্ব্বেই আমরা যাহা অনুমান করিয়াছিলাম, কার্য্যেও দেখিলাম তাহাই; অর্থাৎ ভাবিয়াছিলাম যে, কমলাকান্তের মুখ হইতে সহজে আমরা কোন কথাই প্রাপ্ত হইব না। কাজেও তাহাই হইল। তাঁহাকে যাহা কিছু জিজ্ঞাসা করিলাম, সম্ভব হউক, বা অসম্ভব হউক, তিনি সকল কথারই উত্তর প্রদান করিতে লাগিলেন যে, তিনি ইহার কিছুই অবগত নহেন। গিরিবালা নাম্নী একটি স্ত্রীলোক তাঁহার পুত্রবধূ ছিল সত্য, কিন্তু সে তাঁহার বাড়ী হইতে কোথায় চলিয়া গিয়াছে, কি মরিয়া গিয়াছে, তাহা তিনি অবগত নহেন। তাহার যে কোন বিষয় সম্পত্তি আছে, বা কাহারও কোনরূপ বিষয়াদি প্রাপ্ত হইয়াছে, তাহার কিছুমাত্র তিনি জ্ঞাতনহেন। তিনি আরও কহিলেন, উহার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত কখন কোন ব্যক্তিকে তিনি কলিকাতায় প্রেরণ করেন নাই।
কমলাকান্তের কথা শুনিয়া বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, তিনি যে চরিত্রের লোক, তাঁহার নিকট হইতে সেই প্রকারের উত্তর ভিন্ন অন্য কিছু আশা করিতে পারি না। কাজেই তাঁহাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করা যুক্তিযুক্ত বিবেচনা করিলাম না।
যে দুই ব্যক্তিকে দেখিয়া সরলা কহিয়াছিল যে, ইহারাই চন্দ্রমুখীর গৃহে গমন করিয়াছিল ও ইহাদিগেরই সহিত চন্দ্রমুখী বাহির হইয়া যাইবার পর আর গৃহে প্রত্যাগমন করে নাই, তাহাদিগকেই আমরা তখন উত্তমরূপে জিজ্ঞাসাবাদ করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। উহারা প্রথমে কোন কথা সহজে স্বীকার করিল না, কিন্তু উহাদিগকে বিশেষ করিয়া বুঝাইয়া বলায়, পরিশেষে উভয়েই পৃথক পৃথক স্থান হইতে পরস্পরের সহিত সাক্ষাৎ করিবার পূর্ব্বে যাহা কহিল, তাহার সারাংশ প্রায়ই একরূপ। তাহাদিগের কথা হইতে আমরা বুঝিতে পারিলাম যে, গিরিবালার অনুসন্ধানের নিমিত্ত কমলাকান্ত কর্তৃক তাহারাই নিযুক্ত হইয়া কলিকাতায় গমন করিয়াছিল। তাহাদের সহিত এইরূপ বন্দোবস্ত হইল যে, কোনরূপে গিরিবালার সন্ধান আনিয়া দিতে পারিলে কমলাকান্তের নিকট হইতে তাহারা সমস্ত খরচা বাদে দুইশত টাকা পারিতোষিক প্রাপ্ত হইবেক। ঐ প্রলোভনের বশবর্তী হইয়া তাহারা গিরিবালা ওরফে চন্দ্রমুখীর অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করে ও পরিশেষে তাহার সন্ধান প্রাপ্ত হইয়া কমলাকান্তকেজানায়, তাঁহার নিকট হইতে দুইশত টাকা পারিতোষিক ও খরচা বাবদ একশত টাকা প্রাপ্ত হয়।
ইহার পর পুনরায় ঐ দুই ব্যক্তিকে কমলাকান্ত কলিকাতায় পাঠাইয়া দেন ও নিজেও তাহাদিগের সমভিব্যাহারের তথায় আগমন করেন। এবার কমলাকান্তের সহিত আরও তিন চারি ব্যক্তিগণ কলিকাতায় আসিয়াছে। পূৰ্ব্বকথিত দুই ব্যক্তির উপর এবার এইরূপ কার্য্যের ভার অর্পিত হয় যে, যদি তাহারা কোনরূপে তাকে চন্দ্রমুখীকে একাকী আনিয়া কমলাকান্তের নিকট উপস্থিত হইতে পারে, তাহা হইলে তিনি তাহাদিগকে পাঁচশত টাকা প্রদান করিবেন। ঐ অর্থের প্রলোভনে প্রলোভিত হইয়া ঐ ব্যক্তি চন্দ্ৰমুখীর ঘরে দুই তিন দিবস গমন করে ও নানারূপ খেয়াল অবলম্বন করিয়া সে যাহাতে একাকী আসিয়া কমলাকান্তের সহিত সাক্ষাৎ করে, তাহার বন্দোবস্ত করিয়া, পরিশেষে তাহাকে সঙ্গে লইয়া কমলাকান্তের নিকট উপস্থিত হয়, ও তাঁহার হস্তে চন্দ্রমুখীকে অর্পণ করিয়া আপনাদিগের পারিতোষিকের টাকা গ্রহণ পূৰ্ব্বক সেইস্থান হইতে প্রস্থান করে। তাহার পর যে কি হইয়াছে, তাহার কিছুই তাহারা অবগত নহে।
এবার কমলাকান্ত কলিকাতায় আসিয়া একটি বাড়ি ভাড়া লইয়া তাঁহার সহিত অপর যাহারা আগমন করিয়াছিল, তাহাদের সহিত সেই বাড়ীতেই বাস করিতেছিলেন। পূর্ব্বকথিত ব্যক্তিদ্বয় চন্দ্রমুখীকে আনিয়া এই বাটীতেই কমলাকান্তের হস্তে অর্পণ করে।
কমলাকান্তের সহিত অপর যে কয় ব্যক্তি আগমন করিয়াছিল, ঐ দুই ব্যক্তি তাহাদের নামও বলিয়া দিল। বলা বাহুল্য, তাহারাও আমাদিগের কর্তৃক ধৃত হইল, ও ঐ দুই ব্যক্তি যাহা যাহা বলিয়া দিল, উহারাও কেবল তাহাই স্বীকার করিল ও কহিল, যে দিবস ঐ দুই ব্যক্তি চন্দ্রমুখীকে কমলাকান্তের হস্তে প্রদান করিয়া চলিয়া যায়, তাহারাও সেই দিবস সেই স্থান হইতে প্রস্থান করে। উহারা যখন চলিয়া যায়, সেই সময় চন্দ্রমুখী সেই বাড়ীতেই ছিল।
ইহার পর সেই মোকদ্দমা সম্বন্ধে অনেক অনুসন্ধান করিলাম। কলিকাতা ও মেদিনীপুর হইতে যে সকল প্রমাণ সংগৃহীত হইল, তাহাতে কমলাকান্তের উপর চন্দ্রমুখী হত্যা করার অপরাধ একরূপ সাব্যস্ত হইল; কিন্তু অপরের বিপক্ষে বিশেষ কোন প্রমাণ পাওয়া গেল না।
কমলাকান্ত হত্যাপরাধে বিচারকের নিকট প্রেরিত হইলেন, কিন্তু বিচারককে আর এ মোকদ্দমার বিচার করিতে হইল না। ঈশ্বর স্বয়ংই তাঁহার বিচার করিলেন। হাজত-গৃহে কমলাকান্ত ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়া মনুষ্য-বিচারকের হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইলাম।
[ বৈশাখ, ১৩১৩]