মণিপুরের সেনাপতি (দ্বিতীয় অংশ)
(অর্থাৎ টিকেন্দ্রজিৎ সিংহের জন্ম হইতে ১৩ আগষ্ট ফাঁসী হওয়ার দিবস পর্যন্ত যাবতীয় ঘটনার আশ্চর্য্য রহস্য!)
একাদশ পরিচ্ছেদ
ইংরাজী ১৮৮৭ সাল কুকিদিগের সহিত যুদ্ধ
মণিপুর-সীমান্তে কুকিদিগের বাসস্থান। কুকিগণ যদিও জঙ্গলি জাতি বলিয়া পরিচিত, কিন্তু তাহাদিগের বীরত্ব অসাধারণ। ইহাদিগের মধ্যে একতার অভাব নাই, এবং সকলেই গ্রামের প্রধান ব্যক্তির বশীভূত। কোন কুকির উপর কোনরূপ অত্যাচার হইলে, কোন কুকি কোনরূপে বিপদগ্রস্ত হইলে, কুকি-মাত্রেই একতাসূত্রে আবদ্ধ হইয়া তাহার প্রতিবিধানের চেষ্টা করিয়া থাকে। এই কুকিদিগের মধ্যে তমহু কুকি সর্ব্বপ্রধান। কুকি মাত্রেই তাহার আদেশ প্রতিপালনে পরাঙ্গুখ নহে। এমন কি, প্রাণের আশা পর্যন্তও পরিত্যাগ করিয়া কুকিগণ তমহুর আদেশ শিরোধার্য্য করিয়া থাকে। অনেক দিবস হইতে এই কুকিগণ মণিপুর-রাজার বশীভূত ছিল। বহুদিবস হইতেই ইহারা রাজাকে কর প্রদান করিয়া আসিতেছিল। কিন্তু কি জানি, কি কারণে হঠাৎ তমহু সুরাচন্দ্রের উপর অসন্তুষ্ট হইল; কাজেই তখন কুকি- মাত্রেই মহারাজার আদেশ লঙ্ঘন করিতে আরম্ভ করিল। মহারাজকে যে কর প্রদান করিতেছিল, তাহাও বন্ধ করিয়া দিল। মহারাজ পুনরায় উহাদিগকে বশীভূত করিবার নিমিত্ত নানারূপ চেষ্টা করিলেন অনেকরূপে বুঝাইলেন, অনেক মিষ্ট কথায় তমহুকে পরিতুষ্ট করিবার চেষ্টা করিলেন। কিন্তু যখন কিছুতেই কিছু হইল না, স্বদলবলে তমহু যখন কিছুতেই মহারাজের বশীভূত হইতে সম্মত হইল না, তখন কাজেই রাজকার্য্যের অনুরোধে মহারাজকে তমহুর বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করিতে হইল।
তমহুকে পরাজয় করিবার অভিপ্রায়ে উপযুক্ত রূপ সৈন্যসামন্ত প্রেরিত হইল। কিন্তু পরিশেষে তাহার বিপরীত ফল ফলিল। তমহু মহারাজের সৈন্যের সহিত বীরদর্পে সমরে অগ্রসর হইল। উভয়পক্ষে যুদ্ধ বাধিল ও সেই যুদ্ধে মহারাজের বিস্তর ক্ষতি হইল। তমহু সেই যুদ্ধে জয়লাভ করিল। কুকিগণের জয়লাভ হওয়াতে তাহাদিগের প্রতিজ্ঞাই স্থির হইল তখন তাহারা মহারাজকে আরও অপদার্থের ন্যায় বোধ করিতে লাগিল।
টিকেন্দ্রজিৎ মহারাজের এইরূপ অপমান দেখিয়া, আর কোন প্রকারে সহ্য করিতে পারিলেন না। অগ্রহায়ণ মাসে তিনি স্বয়ং সমরসাজে সাজিয়া, সৈন্যসামন্ত সমভিব্যাহারে তমহুর সহিত যুদ্ধ করিবার অভিপ্রায়ে রাজধানী হইতে বহির্গত হইলেন। তমহু এই সংবাদ পাইয়া কুকিদিগকে সংগ্রহ করিয়া, টিকেন্দ্রের সহিত যুদ্ধ করিবার অভিপ্রায়ে চসার পাহাড়ে সমবেত হইল। টিকেন্দ্র সেই স্থানে উপস্থিত হইবামাত্রই উভয়পক্ষে ভয়ানক সংগ্রাম আরম্ভ হইল। টিকেন্দ্রও সহজে ছাড়িবার পাত্র নহেন, তমস্থও সহজে পরাজিত হইবার নহে। উভয়পক্ষে ভয়ানক যুদ্ধ হওয়ায় ক্ষতি উভয় পক্ষেরই হইল; কিন্তু তমহুর কুকি সৈন্য অধিক পরিমাণে হত ও আহত হইয়া পড়িল। তমহু যতক্ষণ পারিলেন, প্রাণপণে যুদ্ধ করিলেন। যখন দেখিলেন, ক্রমে হীনবল হইতেছেন, তখন সমরাঙ্গন হইতে পলায়নের চেষ্টা করিলেন। টিকেন্দ্র এই অবস্থা বুঝিতে পারিয়া, তাহার পলায়নের পক্ষে বিশেষরূপ প্রতিবন্ধক হইলেন। কাজেই তমহু টিকেন্দ্রের হস্তে ধৃত ও আবদ্ধ হইল। অন্যান্য কুকিগণ যাহারা পলায়ন করিল, তাহাদিগকে ধরিবার নিমিত্ত আর কোনরূপ চেষ্টা না করিয়া, তমহুকে বন্ধন অবস্থায় আনিয়া মহারাজ সুরাচন্দ্রের সম্মুখে উপনীত করিলেন।
মহারাজ টিকেন্দ্রের বীরত্বে যারপরনাই সন্তুষ্ট হইয়া বার বার প্রশংসা করিলেন, এবং তাঁহার বাহুবলেই মণিপুরের সিংহাসন দৃঢ় থাকিবে বলিয়া, তাঁহাকে সৰ্ব্বসমক্ষে সাধুবাদ প্রদান করিতে লাগিলেন।
অন্ধকার কারাগারের ভিতর তমহুর বাসস্থান নিৰ্দ্দিষ্ট হইল। তমহু সেই স্থানেই অতিশয় কষ্টের সহিত দিনযাপন করিতে লাগিল। এইরূপে দুই মাসকাল কারাগারে আবদ্ধ থাকিয়া তমহু ভাবিল যে, এইরূপে জীবন-যাপন অপেক্ষা মহারাজের বশ্যতা স্বীকার করাই ভাল। মনে মনে এইর যুক্তি আঁটিয়া মহারাজের সাক্ষাৎ অভিলাষে তমহু প্রতীক্ষা করিতে লাগিল। কিয়দ্দিবস গত হইতে হইতেই এক দিবস মহারাজের সহিত তমহুর সাক্ষাৎ হইল। সেই দিবস তমহু আপনার দোষ স্বীকার-পূর্ব্বক মহারাজের নিকট কৃতাঞ্জলিপুটে অভর ভিক্ষা করিল ও কহিল,—“আমি আমার কর নিয়মিতরূপ প্রদান করিব, ও আমার আজ্ঞানুবর্ত্তী যত কুকি আছে, তাহাদের করও আমি ধার্য্য করিয়া দিব, এবং সময় মতে কর আদায় করিয়াও মহারাজের নিকট পাঠাইয়া দিব।” একে মহারাজের হৃদয় দয়ায় পরিপূর্ণ, তাহাতে কুকিগণ আপন আপন জীবন অপেক্ষাও সত্য কথারই অধিক আদর করিয়া থাকে বলিয়া, মহারাজা তমহুকে অভয় প্রদান করিলেন। তমহু জেল হইতে বহির্গত হইয়া আপনার দলের সহিত গিয়া মিশিল, এবং সকলের নিকট হইতে নিয়মিতরূপ রাজস্ব আদায় করিয়া প্রেরণ করিতে লাগিল।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
ইংরাজী ১৮৮৮ ও ১৮৮৯ সাল টিকেন্দ্র কর্তৃক হত্যা
ইংরাজী ১৮৮৮ সালে বিশেষ কোন ঘটনাই ঘটে নাই কেবলমাত্র যোগেন্দ্র সিংহ নামীয় এক ব্যক্তি পাঁচ শত মাত্ৰ কাছাড়বাসী মণিপুরী সৈন্য লইয়া মণিপুর-রাজসিংহাসন অধিকার করিবার আশায় অগ্রসর হইতেছিলেন। পথিমধ্যে ইংরাজ সৈন্য তাঁহার গতি রোধ করে। ইংরাজ সৈন্যের সহিত যোগেন্দ্রের একটি সামান্য যুদ্ধ হয়, সেই যুদ্ধে যোগেন্দ্ৰ সিংহ পরাভূত ও মৃত্যুমুখে পতিত হন।
ইংরাজী ১৮৮৯ সালে গ্রিমউড সাহেব মণিপুরের পলিটিকেল এজেন্ট ছিলেন। তিনি টিকেন্দ্রকে অতিশয় ভালবাসিতেন। কেন ভালবাসিতেন, তাহার কতক পরিচয় পাঠকগণ পরে জানিতে পারিবেন।
টিকেন্দ্রজিৎ সিংহ একজন অতিশয় সাহসী পুরুষ ছিলেন। প্রত্যহ রাত্রিতে তিনি গুপ্তবেশে একাকী সহর পর্যটন করিয়া বেড়াইতেন। কেবল পৰ্য্যটন নহে, তিনি প্রত্যেকের বাড়ীর নিকট, ঘরের পশ্চাদ্ভাগে, জঙ্গলের মধ্যস্থল প্রভৃতি স্থানে লুক্কায়িত থাকিয়া, প্রজামণ্ডলীর কথোপকথন গোপনে শ্রবণ করিতেন। ইঁহার একটি মহৎ দোষ ছিল যে, ইনি তোষামোদকারীকে একটু বিশেষ ভালবাসিতেন। গোপনে বেড়াইবার সময় যদি কাহারও মুখে তিনি আপনার যশোগান শ্রবণ করিতেন, তাহা হইলে যে কোন প্রকারেই হউক, তিনি তাহার উপকার করিতে কোন প্রকারেই পরাঙ্গুখ হইতেন না। আর, যাহার মুখে তিনি তাঁহার কথা শুনিতেন, তাহার সর্ব্বনাশ উপস্থিত হইত; তাহার প্রাণ লইয়া টানাটানি পড়িত।
এক দিবস রাত্রিযোগে যখন তিনি একাকী ভ্রমণ করিতে ছিলেন, সেই সময় ওঁকাইবাপুচার বাড়ীর ভিতর হইতে তাঁহার নাম হঠাৎ শুনিতে পাইলেন। অমনি তিনি সেই স্থানে দাঁড়াইয়া, উহারা কি বলিতেছে, তাহা শ্রবণ করিতে লাগিলেন। শুনিলেন, ওঁকাইবাপুচা তাহার ভ্রাতার নিকট টিকেন্দ্রজিতের চরিত্রদোষ উল্লেখ করিয়া তাঁহার নিন্দা করিতেছে, এবং তাহার ভ্রাতাও উহা সমর্থন করিতেছে। এই কথা শ্রবণে টিকেন্দ্র অতিশয় ক্রোধ-পরবশ হইয়া সেইস্থান হইতে তখন চলিয়া গেলেন; কিন্তু পরদিবস প্রাতঃকালে উভয় ভ্রাতাকেই আপনার নিকট ডাকাইয়া আনিলেন, এবং কাহাকেও কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া উভয়কেই স্বহস্তে সজোরে বেত্রাঘাত আরম্ভ করিলেন। উহারা বেত্রাঘাত সহ্য করিতে না পারিয়া, সেই স্থানে পড়িয়া গেল, তথাপি বেত্রাঘাত বন্ধ হইল না। উহারা অবিশ্রান্ত বেত্রাঘাতে ক্ৰমে অচৈতন্য হইয়া পড়িল; কিন্তু তাহাতেও বেত্রাঘাত নিবৃত্তি হইল না। পরিশেষে উভয়েই বেত খাইতে খাইতে সেই স্থানেই মানবলীলা সম্বরণ করিল।
এ কথা কিন্তু অপ্রকাশ থাকিল না। ক্রমে চীফ কমিসনার সাহেবের কর্ণে গিয়া এই বিবরণ পৌঁছিল। টিকেন্দ্রের উপর নরহত্যা করা অপরাধ আনা হইল, এবং বিচারে তিনি দোষী প্রমাণিত হওয়ায় চিরদিবসের নিমিত্ত তাঁহার নির্বাসনের আজ্ঞা হইল। কিন্তু অনেকের অনেকরূপ সহি-সুপারিসে, এবং পূর্ব্বে তিনি গবর্ণমেণ্টকে যেরূপ সহায়তা করিয়া ভয়ানক বিপদ হইতে উদ্ধার করিয়াছিলেন, সেই পূর্ব্বকর্ম্মের অনুরোধে, তাঁহাকে চির-নির্ব্বাসন হইতে মুক্তি প্রদান করা হইল। কেহ কেহ কিন্তু বলিয়া থাকেন, এই দণ্ড হইতে তাঁহাকে একেবারে নিষ্কৃতি দেওয়া হয় নাই। তিনি দোষীই সাব্যস্ত থাকেন, এবং তাঁহাকে কেবল মাত্র পঞ্চাশ টাকা অর্থদণ্ড দিতে হয়।
১৮৮১ সালে তিনি এইরূপ আরও একটি বিষয়ে পতিত হইয়াছিলেন। সেবারেও যে তিনি একেবারে নির্দোষী ছিলেন, তাহা নহে; কিন্তু সেবারেও তাঁহাকে পরিত্রাণ দেওয়া হইয়াছিল। সেবার তিনি তাঁহার দুই জন ভৃত্যের উপর নিতান্ত অসন্তুষ্ট হইয়াছিলেন বলিয়াই, এইরূপ বিপদে পতিত হন। ঐ চাকরদ্বয় তাঁহার কতকগুলি দ্রব্য অপহরণ করিয়াছিল। উহাদিগকে টিকেন্দ্রজিৎ প্রথমে সেই চুরির বিষয় জিজ্ঞাসা করেন; কিন্তু তাহারা মনিবের সম্মুখে মিথ্যা কথা বলিয়া প্রকাশ করে যে, তাহারা সেই চুরির বিষয় কিছুমাত্র অবগত নহে। টিকেন্দ্র উহাদিগের কথা বিশ্বাস না করিয়া, নিজেই এই চুরির অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হন, ও উহাদিগের নিকট হইতেই চোরাই দ্রব্য সকল বাহির করেন। তখন তিনি তাঁহার সেই ভৃত্যদ্বয়কে পুনরায় ডাকাইয়া, চুরি করা ও মিথ্যা বলার অপরাধে স্বহস্তে উহাদিগকে বেত্রাঘাত আরম্ভ করেন, ও সেই বেত্রাঘাতেই উভয়ে মানবলীলা সম্বরণ করে।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
ইংরাজী ১৮৯০ সাল
গ্রিমউডের সহিত টিকেন্দ্রের বন্ধুত্ব
মহারাজ সুরাচন্দ্র সিংহ যত দিবস রাজ-সিংহাসনে অধিরূঢ় ছিলেন, তত দিবস তিনি ইংরাজ-রাজের সহিত বিশেষ মিত্রতাসূত্রেই আবদ্ধ ছিলেন। চীফ কমিসনার ও পলিটিকেল এজেন্ট যখন তাঁহাকে যে কার্য্যের সাহায্যের নিমিত্ত আহ্বান করিতেন, তিনি তখনই আপনার সাধ্যমত তাহা সমাপন করিতে ত্রুটি করিতেন না। তাঁহারা ও মহারাজের উপর অসন্তুষ্ট ছিলেন।
গ্রিমউড সাহেব যখন পলিটিকেল এজেন্ট ছিলেন, সেই সময়ে তিনি মহারাজ সুরাচন্দ্র সিংহ অপেক্ষা সেনাপতি টিকেন্দ্রজিৎকে বিশেষরূপ অনুগ্রহ করিতেন, এবং ভালবাসার ভাগও তাঁহার উপরেই অধিক পরিমাণে ন্যস্ত ছিল; একথা সত্য বা মিথ্যা হউক, অনেকে কিন্তু বলিয়া থাকেন, মহারাজ সুরাচন্দ্রের উপর প্রজাবর্গ কেহই অসন্তুষ্ট ছিলেন না। সকল প্রজাই তাঁহাকে মান্য ও ভক্তি করিত, এবং তাঁহার আজ্ঞা প্রতিপালনে কেহই কখন অসম্মত হইত না। মহারাজ প্রজারঞ্জক ছিলেন, সময় সময় তিনি প্রজাগণকে বিশেষরূপে সাহায্য করিতে ত্রুটি করিতেন না। গত বৎসর যখন ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হয়, তখন তিনি যে কেবলমাত্র এক বৎসর প্রজাগণের রাজস্ব মাপ করেন তাহা নহে। যত দিবস দুর্ভিক্ষের বিশেষ প্রকোপ ছিল, তত দিবস তিনি রাজসংসার হইতে প্রজাবর্গের আহারের সংস্থান করিয়া দিয়াছিলেন; এবং নিয়মিত মূল্যে খাদ্যাদি খরিদ করিয়া যে সকল ব্যক্তি দান লইতে অসম্মত ও খাদ্যাদি খরিদ করিতে সমর্থ তাহাদিগের নিকট অর্দ্ধ মূল্যে ঐ সকল দ্রব্যাদি বিক্রয় করিয়া তাহাদিগেরও জীবন রক্ষা করিয়াছিলেন। *
[* See class F. Para 16th of letter date 14th November, 1890, from His Highness Sura Chandra Singh, Maharaja of Monipur, to the Hon’ble J. W. Quinton C.S.I, Chief-Commissioner of Assam. “It was at this time that Mr. Grimwood wanted to take Photographs of some of the Monipur ladies. When the Maharajaḥ heard this he was shocked, so was whole Monipur which is eminently conservative. The Maharajah said he would not permit it, and thus offended the dignity of Mr, Grimwood. But the Senaputty sided with Mr. Grimwood in this matter, and the bond of friendship between them in this manner grews stronger day by day.”
Amrita Bazar Patrika,
Dated 12th May, 1891.]
সুরাচন্দ্র যদিও একজন প্রজারঞ্জক রাজা সত্য কিন্তু রাজকার্য্যে তিনি ততদূর পারদর্শী নহেন। ইনি একজন পরম হিন্দু (বৈষ্ণব) রাজা। ঈশ্বর আরাধনা করিয়াই তিনি দিনযাপন করিতেন। সর্ব্বদাই ঈশ্বর-উপাসনায় নিযুক্ত থাকিতেন বলিয়া, রাজকার্য্যে সর্ব্বদা আপনার মন-সংযোগ করিতে পারিতেন না; সুতরাং রাজার যেরূপে রাজ্যশাসন করা কর্তব্য, তিনি সেইরূপে রাজ্যপালন করিতে সমর্থ হইতেন না। কাজেই শত্রুগণ ছিদ্রানুসন্ধান করিয়া বেড়াইত, ভ্রাতাগণের মধ্যেও সকলে তাঁহার বশীভূত হইত না।**
[**The Maharaja personally was popular, but he was a weak ruler, paid little attention to public business, and spents hours every day in worshipping in the temple.”
Para 22 of letter No. 4209, dated 9th October, 1890, from Secretary to the Chief- Commissioner of Assam, to the Secretary to the Government of India.]
টিকেন্দ্রজিৎ সিংহ যদিও সেনাপতি ছিলেন সত্য, কিন্তু রাজা অপেক্ষা তাঁহার প্রাধান্য অধিক ছিল। একে সৈন্য- সামন্ত তাঁহার বশীভূত, তাহাতে প্রজাবর্গেরও তাঁহার আদেশ লঙ্ঘন করিবার ক্ষমতা ছিল না। প্রজাগণ তাঁহাকে যেরূপ ভালবাসিত, সেইরূপ ভয়ও করিত। তাঁহার প্রভাব ও পরাক্রমে সকলেই বিস্মিত ছিল বলিয়া, তিনি রাজা না হইয়াই রাজত্ব করিতেন। তিনি যে কেবল মণিপুরিদিগের সহিত বন্ধুত্ব স্থাপন করিতেন, তাহা নহে; সকল জাতির সহিতই সহজে মিশিতে পারিতেন, এবং সকলের সহিতই অনায়াসে বন্ধুত্ব স্থাপন করিতে হইতেন। ***
[*** “The Senapati is the most popular of all his brothers, not only with Manipuries but with the Natives of India who reside here.”
Para 17th of Letter No. 4209, dated 9th October, 1890, to the Government of India from commissioner of Assam.]
কেহ কেহ বলেন, গ্রিমউড সাহেব মহারাজকে একেবারে দেখিতে পারিতেন না; কিন্তু টিকেন্দ্রকে প্রাণের অপেক্ষাও ভাল বাসিতেন। সেনাপতি যাহা বলিতেন, তিনি তৎক্ষণাৎ তাহাই সম্পাদন করিতেন। যে সকল কারণে সাহেব টিকেন্দ্রকে ভাল বাসিতেন, তাহার কারণ অনেকে অনেকরূপ বলিয়া থাকেন। টিকেন্দ্রের অসাধারণ বল-বিক্রম, অসীম সাহসই তাঁহার ভালবাসার মূল কারণ। কিন্তু সত্য হউক বা মিথ্যা হউক, কেহকেহ বলিয়া থাকেন, গ্রিমউড সাহেব আমোদ-প্রমোদ অতিশয় ভাল বাসিতেন। যাহাতে তাঁহার মনে কোনরূপ আমোদের উপলব্ধি হয়, তিনি তাহা করিতে সততই যত্নবান থাকিতেন। ****
[**** “He had no work, and the while away his time he wanted some pleasant occupation.”
Amrita Bazar Patrika,
Dated 21st May, 1891. ]
এক দিবস হঠাৎ তাঁহার মনে উদয় হইল যে, মণিপুরী স্ত্রীলোকদিকের ফটোগ্রাফ লইতে হইবে। মনে যেমন সেইভাবের উদয় হইল, অমনি তাহা কার্য্যে পরিণত করিবার নিমিত্ত চেষ্টিত হইলেন। কিন্তু মণিপুরের রাজার অনুমতি ও সাহায্য ব্যতিরেকে এ কাৰ্য সম্পন্ন হওয়া অসম্ভব, কাজেই তিনি মহারাজ সুরাচন্দ্রকে আপন মনোভাব জ্ঞাপন করিলেন। মহারাজ হিন্দুর ধর্ম্মের দিকে লক্ষ্য করিয়া, হিন্দু-সমাজের দিকে তাকাইয়া এই প্রস্তাবে আপনার অনভিমত প্রকাশ করিয়া, তাহাতে প্রতিবাদ করিলেন। কিন্তু টিকেন্দ্রজিৎ তাহা শ্রবণ করিয়া, গ্রিমউডের পক্ষ সমর্থন-পূর্ব্বক তাঁহার সেই কার্য সম্পাদন করিবার নিমিত্ত সাহায্য প্রদান করিলেন। এই কারণেও গ্রিমউড টিকেন্দ্রকে আরও অধিক ভালবাসিতেন, এ কথা কেহ বলিয়া থাকেন।
চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ
সুরাচন্দ্রের সিংহাসন
ভৈরব সিংহ বা পাকা সেনা মহারাজ সুরাচন্দ্রের সহোদর ভ্রাতা। লেখা-পড়ায় ও মুন্সিয়ানায় সকল ভ্রাতা অপেক্ষা তিনিই শ্রেষ্ঠ। টিকেন্দ্রজিৎ মহারাজের সহোদর ভ্রাতা নহেন, বৈমাত্র ভ্রাতা। টিকেন্দ্র মহারাজের নিমিত্ত যত কষ্টই করুন না কেন, যত যুদ্ধ জয়ই করুন না কেন, কিন্তু কিছুতেই তাঁহার মন পাইতেন না। মনুষ্যের যে কেমন স্বভাব, সহোদর ভ্রাতা অপেক্ষা বৈমাত্র ভ্রাতার স্নেহ কম হইয়া থাকে। মহারাজ, টিকেন্দ্রজিৎ অপেক্ষা পাকা সেনাকে অতিশয় ভালবাসিতেন। পাকা সেনা যাহা বলিতেন, বিনা আপত্তিতে মহারাজ তখনই তাহা করিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হইতেন না। এইরূপ নানা কারণে পাকা সেনার সহিত টিকেন্দ্রের মনের মিল অনেক দিবস হইতেই ছিল না। পাকা সেনারও কেমন একটি স্বভাব ছিল যে, তিনি রাত্রি-দিন টিকেন্দ্র ও টিকেন্দ্রের অনুগতদিগের উপর কেবল বিরক্তই থাকিতেন।
মহারাজও সকল ভ্রাতার উপর সমান দৃষ্টি না রাখিয়া, সকল ভ্রাতাকে সমভাবে না দেখিয়া, সর্ব্বদা পাকা-সেনার পক্ষই সমর্থন করিতেন। পাকা সেনা কোনরূপ অন্যায় কার্য্য করিলে বা অপর ভ্রাতাদিগের সহিত অসদ্ব্যবহার করিলেও, তিনি তাঁহার উপর অসন্তুষ্ট না হইয়া, তাঁহার পক্ষই অবলম্বন-পূর্ব্বক অপর ভ্রাতা দিগকে লাঞ্ছনা করিতে ত্রুটি করিতেন না। পাকা-সেনাকে মহারাজ ভালবাসিতেন; কিন্তু প্রজামণ্ডলী তাঁহার উপর নিতান্ত অসন্তুষ্ট ছিল। কেহই তাঁহাকে দেখিতে পারিত না, কেহই তাঁহার আজ্ঞা পালনে রত থাকিত না। এদিকে কিন্তু সেনাপতিকে সকলেই যেমন মান্য করিত, ভক্তিও করিত সেই প্রকার; এবং মণিপুরি-মাত্রই তাঁহার আজ্ঞা-পালনে সতত প্রস্তুত থাকিত। কেবল মণিপুরি কেন, টিকেন্দ্রের সহিত যাহার একবার আলাপ হইত, সেই তাঁহার বশীভূত হইয়া পড়িত।
অনেক দিবস হইতে টিকেন্দ্রের সহিত পাকা-সেনার যদিও মনের মিল ছিল না, কিন্তু তিনি প্রকাশ্যে তাঁহার প্রতিশোধ লইবার কোন চিন্তা কখন মনেও করেন নাই। টিকেন্দ্রের যেরূপ পরাক্রম, লোকজন যেরূপ তাঁহার বশীভূত, তাহাতে তিনি মনে করিলেই পাকা-সেনাকে যথেষ্ট শিক্ষা দিতে পারিতেন। কিন্তু তাঁহার সেরূপ ইচ্ছা ছিল না।
যে কারণে এই সময় মণিপুরে ভয়ানক অগ্নি প্রজ্বলিত হইল, যে অগ্নিতেজে মহারাজ সুরাচন্দ্র রাজ্য পরিত্যাগ- পূর্ব্বক পলায়ন করিলেন, যে ঘটনার মূল অতি সামান্য। এরূপ সামান্য ফুৎকারে ২১শে সেপ্টেম্বর তারিখের রাত্রে যে এইরূপ প্রলয়-অগ্নি প্রজ্বলিত হইবে, তাহা কেহ স্বপ্নেও ভাবেন নাই।
দলারই হানজাবা সেনাপতির বশীভূত ছিলেন। সর্ব্বদাই সেনাপতির নিকট গমনাগমন করিতেন, কোন কার্য্য করিতে হইলে অগ্রে সেনাপতিরই পরামর্শ লইতেন, এবং সেনাপতি যেরূপ বলিতেন, তিনি সেই পন্থাই অবলম্বন করিতেন। এই সমস্ত পাকা-সেনা বরাবরই দেখিয়া আসিতেছিলেন; কিন্তু প্রকাশ্যে কখনও কিছুই বলেন নাই। আজ কিন্তু সেই প্রকার দেখিয়া তাঁহার মনে হঠাৎ ক্রোধের উদ্রেক হইল। এক ভ্রাতার সহিত কথা কহিবার নিমিত্ত অপর ভ্রাতা দলারই হানজাবার সে ভয়ানক অপরাধ (!) তাহা আর সহ্য করিতে পারিলেন না!! তিনি তাঁহাতে যৎপরোনাস্তি কটুকাটব্য বলিয়া গালিগালাজ দিলেন। দলারই হানজাবা পূর্ব্বে অনেক সহ্য করিয়াছিলেন; আজ আর কিন্তু কোনরূপে সহ্য করিতে পারিলেন না, তিনিও তদুত্তরে কটুকাটব্য বলিতে ত্রুটি করিলেন না।
এই সময় জিলা সিংহ ব্যাঘ্র-শিকারে বহির্গত হইতেছিলেন। বালক বলিয়া, সরকার হইতে তাঁহার সহিত শিকারে গমন করিবার উপযোগী কোন ‘বিউকিলধারী’ তিনি পাইতেন না। ব্যাঘ্র-শিকারে নিতান্ত ইচ্ছুক দেখিয়া, তাঁহার সহিত গমন করিবার নিমিত্ত একজন বিউকিলধারীকে’ আদেশ প্রদান করেন। মহারাজ এই সংবাদ জানিতে পারিয়া .সেই বিউকিলধারীর হস্ত হইতে বিউকিল কাড়িয়া লয়েন, ও জিলা সিংহের সহিত ব্যাঘ্র-শিকারে গমন করিবার নিমিত্ত তাহাকে নিষেধ করেন। জিলা সিংহ ইহাতে নিতান্ত লজ্জিত ও অবমানিত হন, ও টিকেন্দ্রের নিকট আগমন করিয়া মহারাজ কর্তৃক যেরূপ ব্যবহার প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, তাহা আনুপূর্ব্বিক বিবৃত করেন। টিকেন্দ্রও এই অবস্থা শুনিয়া নিতান্ত ব্যথিত হইলেন, ও মনে মনে নিতান্ত অপমান বোধ করিতে লাগিলেন।
২১শে সেপ্টেম্বর তারিখে টিকেন্দ্রজিৎ মহারাজের নিকট গমন করিয়া জিলাসিংহ-সম্বন্ধীয় সমস্ত কথা বলিলেন। কিন্তু মহারাজ তাহাতে ভালমন্দ কিছুই বলিলেন না, বা ভ্রাতাদিগকে কোনরূপে সান্ত্বনা করিবার চেষ্টাও করিলেন না। টিকেন্দ্রজিত তখন, প্রত্যাগমন করিয়া আপনার ভ্রাতাদ্বয়ের সহিত পরামর্শ করিলেন।
সেই ২১শে সেপ্টেম্বর তারিখের রাত্রে যখন মহারাজ সুরাচন্দ্র সিংহ আপন অন্তঃপুরের ভিতর নিদ্রিত অবস্থায় ছিলেন, সেই সময় তাঁহার দুই ভ্রাতা জিলা সিংহ ও দলারই হানজাবা কয়েকজন সৈন্য সমভিব্যাহারে মহারাজের অন্তঃপুরের নিকট গমন করিলেন, ও একখানি সিঁড়ির সাহায্যে অন্তঃপুর প্রাচীর উল্লঙ্ঘন করিয়া মহারাজের শয়ন- মন্দির-সন্নিকটে উপনীত হইলেন। সৈন্য কয়েকজন অনবরত গুলি চালাইতে লাগিল। মহারাজ কোনরূপে হত বা আহত না হন, অথচ তাঁহার মনের ভিতর ভয়ের সঞ্চার হয়, এই উদ্দেশ্যেই অনবরত গুলি চলিতে লাগিল। সেই অবিশ্রান্ত বন্দুকের শব্দে মহারাজের হঠাৎ নিদ্রা ভাঙ্গিয়া গেল। তিনি উত্থিত হইয়া দেখিলেন, সৈন্যগণ আসিয়া তাঁহার শয়ন-ঘর আক্রমণ করিয়াছে। তখন হঠাৎ কোন উপায় অবলম্বন করিবেন, কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না। কিন্তু মনে ভাবিলেন, এখন সম্মুখীন হইলেই মরণ নিশ্চয়; বিশেষ নিকটে রাজ-তরবারি ভিন্ন অন্য অস্ত্র-শস্ত্র আর কিছুই নাই। তখন তিনি, কি করিবেন তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, আমাদিগের আর একজন হিন্দুরাজা লক্ষ্মণ সেন যে পন্থা অবলম্বন করিয়াছিলেন, তাহারই অনুবর্তী হইলেন। বাড়ীর পশ্চাৎ দরজা খুলিয়া ২।৩ জন মাত্র অনুচর- সহ পলায়ন করিয়া আপনার বহুমূল্য জীবন রক্ষা করিলেন।
মহারাজ যখন রাজপ্রাসাদ পরিত্যাগ-পূর্ব্বক কেল্লার বাহিরে গমন করেন, সেই সময় সংগেনথন পুলের নিকট তাঁহার সহোদর লেফটেনান্ট জেনারেল পাকা-সেনাকে দেখিতে পাইলেন। সঙ্গে তাঁহার কর্ম্মচারী মণিলাল দে ও ৮০ জন সুসজ্জিত সৈন্য। সকলেই ব্যস্ত সমস্ত হইয়া মহারাজকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত প্রাসাদ অভিমুখে আগমন করিতেছেন। মহারাজ সুরাচন্দ্র সেই সময়ে এইরূপ সাহায্য প্রাপ্ত হইয়াও, আপনার সিংহাসন রক্ষা করিবার নিমিত্ত প্রত্যাগমন করিতে সাহসী হইলেন না। নিতান্ত কাপুরুষের ন্যায় প্রাণের মায়ায় মুগ্ধ হইয়া দ্রুতপদে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। পাকা সেনাও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন।
যে সময় অন্তঃপুরের ভিতর গুলি চলিতেছিল, সেই সময় টিকেন্দ্রজিৎ সিংহও আসিয়া তাহাতে যোগ দিলেন। সেই স্থানে যে সকল দ্রব্যাদি ছিল, তাহা তিনি আপনার অধিকারভুক্ত করিয়া লইলেন। গুলি, বারুদ, কামান, বন্দুক প্রভৃতি যে কিছু ‘ম্যাগাজিন’ ছিল, তাহা অধিকার করিয়া, মহারাজের সহোদর ভ্রাতা কয়েকটিকে এবং তাঁহার অনুগত মণিপুরিগণকে রাজবাড়ী হইতে বহির্গত করিয়া দিলেন, ও সমস্ত স্থান আপনিই অধিকার করিয়া রাখিলেন।
এই সময় কেল্লার ভিতর সৈন্যগণের বিজয়নাদে দিমণ্ডল প্রকম্পিত হইতে লাগিল। “দুর্গা মায়ি কি জয়” “সেনাপতি কি ফতে হুয়া” প্রভৃতি হৃদয়-উন্মত্তকারী চীৎকার বহুকণ্ঠ হইতে একত্রে নির্গত হইয়া, মণিপুরের পাহাড়ে গিয়া প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। যোদ্ধাগণের সেইরূপ ভীষণ চীৎকারে মহরাজ প্রাণভয়ে একেবারে ব্যথিত হইয়া, রেসিডেন্সি-অভিমুখে দ্রুতপদে চলিতে লাগিলেন।
যুবরাজ কুলাচন্দ্র ও সেনাপতি টিকেন্দ্রজিৎ যদিও সহোদর ভ্রাতা ছিলেন না, তথাপি তাঁহাদের জননীদ্বয় সহোদরা ভগ্নী ছিলেন বলিয়া, উভয় বৈমাত্র ভ্রাতায় অতিশয় সদ্ভাব ছিল। এই ঘটনার রাত্রে যুবরাজ কতকগুলি সৈন্য- সমভিব্যাহারে রাজবাড়ী হইতে বহির্গত হন। তাঁহার এই অবস্থা দেখিয়া অনেকেই মনে মনে বিবেচনা করিয়াছিলেন যে, তিনি পলায়িত মহারাজ সুরাচন্দ্রের পশ্চাৎ ধাবমান হইতেছেন। পরিশেষে কিন্তু জানা গিয়াছিল যে, যুবরাজ রাজধানী পরিত্যাগ করিয়া ৪ ক্রোশ দূরে গমন করিয়াছেন। কি কারণে যে তিনি সেই সময় রাজধানী পরিত্যাগ করেন, তাহা কেহই অবগত নহেন। কিন্তু কেহ কেহ বলিয়া থাকেন, এই ভ্রাতৃবিরোধে যোগদানে অসম্মত-হেতু তিনি দূরে গিয়া অবস্থিতি করিয়াছিলেন।
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
রাজবাড়ী আক্রমণ ও সুরাচন্দ্রের পলায়ন
২১শে সেপ্টেম্বর রাত্রি আন্দাজ ২টার সময় রাজপ্রাসাদ-বিনির্গত অনবরত বন্দুকের ধ্বনিতে পলিটিকেল এজেন্ট গ্রিমউড সাহেবের নিদ্রাভঙ্গ হইল। তিনি তখনই শয্যা পরিত্যাগ-পূর্ব্বক দেখিলেন, রাজপ্রাসাদ হইতে মধ্যে মধ্যে প্রবলবেগে গুলি আসিয়া তাঁহার রেসিডেন্সির ভিতর পর্যন্তও পতিত হইতেছে। দুই একটি গুলি লাগিয়া তাঁহার ঘরের সারসি খড়খড়ি প্রভৃতি ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। নিদ্রা হইতে উত্থিত হইয়া গ্রিমউড সাহেব প্রথমে ইহার কোন কারণ নির্দ্দেশ করিতে পারিলেন না, বা রাজপ্রাসাদ হইতে কোনরূপ সংবাদ আনাইবার উপায়ও উদ্ভাবন করিতে সমর্থ হইলেন না। তাঁহার নিজের যে সকল সিপাহী ছিল, আত্মরক্ষার্থ তৎক্ষণাৎ তাহাদিগকে প্রস্তুত হইতে আদেশ প্রদান করিলেন; এবং লাংথোবালে যে সকল ইংরাজ-সৈন্য আছে, তাহার কমান্ডিং অফিসারের নিকট তৎক্ষণাৎ সাহায্যার্থ সংবাদ প্রেরণ করিলেন।
রাত্রি ২।।০ টার সময় মহারাজ সুরাচন্দ্র সিংহ ও তাঁহার প্রাণের ভ্রাতা পাকা সেনা নিতান্ত কাপুরুষের ন্যায় ত্রাসিত হৃদয়ে আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন। তাঁহাদের সহিত আরও দুই তিন জন অনুচর ছিল। সকলেই প্রাণভয়ে ভীত, সকলেই প্রাণ লইয়া পলাইতে উদ্যত, এবং সকলেই গ্রিমউড সাহেবের সাহায্য পাইবার প্রত্যাশায় লালায়িত।
গ্রিমউড সাহেব এইরূপ অবস্থা দেখিয়া, মহারাজকে ইহার প্রকৃত কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। সেই সময়ে মহারাজ প্রাণের ভয়ে এতই অভিভূত ছিলেন যে, তাঁহার মুখ হইতে কোনরূপে স্পষ্ট বাক্য স্ফুরিত হইল না। কোনরূপে তিনি গ্রিমউড সাহেবকে কহিলেন, — তাঁহার নিদ্রিত অবস্থায় কে তাঁহাকে আক্রমণ করিয়াছে, এবং তাঁহাকে হত্যা করিবার নিমিত্ত এখন পর্যন্তও গুলি চালাইতেছে। প্রাণের ভয়ে ভীত হইয়া, স্ত্রী-পুত্রাদির সহিত সমস্ত দ্রব্যাদি সেই স্থানে পরিত্যাগ করিয়া,তিনি চলিয়া আসিয়াছেন। এই কথা শ্রবণে গ্রিমউড, মহারাজকে আর কিছু বলিলেন না; কিন্তু পাকা সেনাকে নিতান্ত ভর্ৎসনা করিলেন। তাঁহার কাপুরুষতা দেখিয়া নিতান্ত দুঃখিত হইলেন; এবং কহিলেন,—”তুমি এখনই কতকগুলি সৈন্যের সহিত গমন করিয়া রাজবাড়ীর ভিতর প্রবেশ কর। সমস্ত দ্রব্যাদি রক্ষা করিতে পার, আর না পার, কিন্তু কিছুতেই ‘ম্যাগাজিন’ পরিত্যাগ করিও না; বিপক্ষ পক্ষ ‘ম্যাগাজিন’ দখল করিতে পারিলে, তোমাদিগের সর্ব্বনাশের আর কিছুই বাকী থাকিবে না। তোমরা সিংহাসনচ্যুত, এবং দেশ হইতে তাড়িত হইবে।” গ্রিমউডের এ কথা পাকার ভাল লাগিবে না; তিনি প্রাণের মায়া পরিত্যাগ করিয়া, সেই গুলি বৃষ্টির ভিতর প্রবেশ করিতে সাহসী হইলেন না। ইহার কিয়ৎক্ষণ পরেই মহারাজের অপর দুই সহোদর সামুহানজামা ও গোপাল সেনা আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন। তাঁহাদের সঙ্গে আরও আসিল— কর্ণেল সামুসিংহ ধালা রাজা, মেজর জাম্বুবান সিংহ ও থঙ্গেল জেনারেল। কয়েকটি বন্দুকের সহিত কতকগুলি মণিপুরিও তাঁহাদিগের সমভিব্যাহারে সেই স্থানে আগমন করিল। কিন্তু বিপক্ষদিগের প্রতিরোধ করিতে কেহই সাহসী হইল না, ‘ম্যাগাজিন’ রক্ষা করিবার চেষ্টাও কেহ করিলেন না।
বৃদ্ধ থঙ্গেল জেনারেল মহারাজের এইরূপ কাপুরুষতা দেখিয়া অতিশয় অসন্তুষ্ট হইলেন; এবং সেই স্থানে সৰ্ব্বসমক্ষে সগৰ্ব্বে কহিলেন, “মহারাজ! যদি আপনার সিংহাসন রাখিবার চেষ্টা থাকে, যদি আপনি রাজছত্র পরিত্যাগ করিতে চাহেন, তাহা হইলে আপনার যাহা ইচ্ছা হয়, তাহাই করুন। আর, যদি আপনার মহারাজ নাম রাখিতে মনে ইচ্ছা থাকে, যদি এই কেল্লা পুনরায় দখল করিবার আশা করেন, তবে এই বৃদ্ধের কথা শ্রবণ করুন। চলুন, এই রেসিডেন্সি প্ররিত্যাগ করিয়া কিছুদূর গমন করি, ও সেই স্থানে আমাদিগের সৈন্য-সামন্তের যোগাড় করিয়া, বীরদর্পে কেল্লা আক্রমণ করি। যখন আমরা সকলেই এখনও আপনার আজ্ঞাধীন আছি, তখন এত কাপুরুষের ন্যায় কার্য্য করিতেছেন কেন? মহারাজ চন্দ্রকীর্তির নাম কলঙ্কিত করিতেছেন কেন? আমি এখন বৃদ্ধ, আমার কথা আপনার ভাল লাগিবে না; কিন্তু আপনার পূর্ব্ব পূর্ব্ব পুরুষ— যাঁহাদের নিকটও আমি কর্ম্ম করিয়াছি, তাঁহারা কিন্তু আমার কথা শুনিতেন। আমার পরামর্শ মত চলিতেন।” এই বলিয়া বৃদ্ধ নিরস্ত হইল যুদ্ধ করিতে মহারাজের ইচ্ছা ছিল না; কাজেই সেই কথা তাঁহার ভাল লাগিল না।
‘ম্যাগাজিন’ রক্ষা করিবার চেষ্টা করিলেই যে সহজে কৃতকাৰ্য্য হইতেন, তাহাও নহে; তথাপি যোদ্ধার উচিত একবার চেষ্টা করা। টিকেন্দ্রজিৎ সর্ব্বকর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া অগ্রেই ‘ম্যাগাজিন’ অধিকার করিয়াছেন, অন্যদিকে বিশেষ লক্ষ্য না রাখিয়া এই ‘ম্যাগাজিন’ রক্ষা করিবার আশায় সসৈন্যে সুসজ্জিত হইয়া সেই স্থানেই অবস্থান করিতেছেন। টিকেন্দ্র ইহা বেশ জানিতেন যে, যুদ্ধ করিতে হইলে ‘ম্যাগাজিন্’ অগ্রে আবশ্যক; গুলি, বারুদ অস্ত্র-শস্ত্র না পাইলে কিসের দ্বারা যুদ্ধ করিবে! *
এই সময়ে সেনাপতি স্বহস্তে জেল-দ্বার মোচন করিয়া দেন তাহার ভিতর প্রায় একশত কয়েদী ছিল, সকলেই জেল হইতে মুক্তিলাভ করিল। সেনাপতি টিকেন্দ্র কি অভিপ্রায়ে যে কয়েদীদিগকে ছাড়িয়া দিয়াছিলেন, তাহা কেহ
830
বলিতে পারে না। সুরাচন্দ্র বলেন যে, তাহারা সেনাপতির পক্ষ হইয়া যুদ্ধ করিয়াছিল; কিন্তু গ্রিমউড সাহেবের পত্রে জানা যায় যে, কোন কয়েদিই এই যুদ্ধে কোনরূপ সাহায্য করে নাই। *
[* See Para 19th of letter No. 351-c. dated 4-12-90 from F. St. C. Grimwood Esq, C.S., Political Agent Monipur to the Secretary to the Chief Commissioner of Assam. ]
গ্রিমউড সাহেব পাকা সেনার উপর অসন্তুষ্ট হইলেন; কিন্তু আর কি করিতে পারেন! মহারাজের থাকিবার নিমিত্ত আপনার দরবার-ঘর ছাড়িয়া দিলেন। রাত্রির নিমিত্ত মহারাজ সেই স্থানেই অবস্থান করিতে লাগিলেন।
ষোড়শ পরিচ্ছেদ
সুরাচন্দ্রের বৃন্দাবন-গমনের প্রস্তাব
২২শে সেপ্টেম্বর সোমবার প্রাতঃকালে সংবাদ আসিল যে, সেনাপতি টিকেন্দ্রজিৎ অপর দুই ভ্রাতা ভুবন সিংহ বা দোলারি হানজামা ও জিলা সিংহের সাহায্যে মহারাজকে আক্রমণ করিয়া তাঁহাকে রাজপ্রাসাদ হইতে বিতাড়িত করিয়াছেন। এখন তাঁহারা তিন ভাই প্রাসাদের ভিতরস্থিত সমস্ত দ্রব্যাদি, ম্যাগাজিন এবং চারিটি পাৰ্ব্বতীয় ভীষণ কামান অধিকার করিয়া লইয়াছেন। যুবরাজ কাছাড়-রাস্তা অভিমুখে গমন করিয়াছেন। মন্ত্রিদিগের মধ্যে কে যে কোথায় গমন করিয়াছেন, তাহার ঠিকানা নাই; কেবলমাত্র আয়াপুরেল সেনাপতির সঙ্গে অবস্থান করিতেছেন। ২৫ জন মাত্ৰ সিপাহী সঙ্গে বারকেলি সাহেব লংথোবাল হইতে গিমউডের সাহায্যের জন্য উপস্থিত হইলেন। এই সামান্য মাত্র সৈন্য লইয়া মহারাজের সাহায্যের নিমিত্ত তাঁহারা রাজবাড়ীতে প্রবেশ করিতে সাহসী হইলেন না। বিশেষ টিকেন্দ্রের বলবিক্রম গ্রিমউড উত্তমরূপেই অবগত ছিলেন। যখন সেনাপতি রণমদে মত্ত হইয়াছেন, তখন এই সামান্য সৈন্যে তাঁহার কি করিতে পারে? তখন ঐ সকল সৈন্যের দ্বারায় রেসিডেন্সি রক্ষা করাই সুযুক্তি বলিয়া সকলের অনুমোদিত হইল। কারণ, যে স্থানে সুরাচন্দ্র আশ্রয় প্রাপ্ত হইয়াছেন, কে জানে সেই স্থান আক্রমণের চেষ্টা সেনাপতি করিবেন কি না!
সেনাপতি, গ্রিমউড সাহেবের একজন আজ্ঞাকারী বন্ধু ছিলেন। গ্রিমউড যখন যাহা বলিতেন, কৈরৎ তখনই তাহা প্রতিপালন করিতেন। সেই পূর্ব্ব-বন্ধুত্বের দিকে দৃষ্টি করিয়া, গ্রিমউড টিকেন্দ্রকে তাঁহার রেসিডেন্সিতে আসিয়া তাঁহার সহিত দেখা করিবার নিমিত্ত, একখানি পত্র লিখিয়া তাঁহার নিজের চাপরাসীর দ্বারা প্রেরণ করিলেন। টিকেন্দ্র সেই পত্র প্রাপ্তে তাহার উত্তর লিখিলেন যে, যে পর্য্যন্ত মহারাজ সুরাচন্দ্র তাঁহার রেসিডেন্সিতে অবস্থিতি করিবেন, সেই পর্যন্ত তিনি সেই স্থানে যাইতে ইচ্ছা করেন না। ইহাতে কোন ফল ফলিল না দেখিয়া, গ্রিমউড পুনরায় তাঁহাকে আর এক পত্র লিখিলেন; এবং তাঁহাকে বুঝাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন যে, সুরাচন্দ্র মহারাজ যেমন রাজা ছিলেন, তেমনি রাজা থাকুক। পাকা সেনার সহিত সেনাপতির মনান্তরের অবস্থা গ্রিমউড নিজে অনুসন্ধান করিয়া, পাকা- সেনাকে উপযুক্তরূপ শাস্তি প্রদান করিবেন। কৈরৎ এ কথায় কর্ণপাত করিলেন না; বরং একরূপ স্পষ্টই বলিলেন যে, সুরাচন্দ্রকে তিনি প্রাসাদের ভিতর প্রবেশ করিতে দিবেন না।
পাঠকগণ শুনিয়া বিস্মিত হইবেন যে, যেস্থানে সমস্ত রাত্রি গুলি-বৃষ্টি হইয়াছে, সেই স্থানে একটি লোকও মৃত বা আহত হয় নাই। সেই ভীষণ বন্দুকের গুলি কাহারও শরীর স্পর্শ করে নাই। তবে একজন মাত্র রক্ষকের গাত্রে অসাবধানতা বশতঃ তরবারির একটি কোপ লাগিয়াছিল, তাহাও নিতান্ত সামান্য।
এই ঘটনায় স্পষ্টই প্রতীয়মান হইতেছে যে, টিকেন্দ্রজিতের ভ্রাতৃহত্যার ইচ্ছা ছিল না। যদি তিনি তাঁহার ভ্রাতাগণকে হত্যা করিবার ইচ্ছা করিতেন, তাহা হইলে তাঁহার হস্ত হইতে কাহারও পরিত্রাণ থাকিত না। তিনি একজন প্রকৃত বীরপুরুষ, তিনি কাপুরুষ ভ্রাতৃহন্তা নহেন। যদি মহারাজ সুরাচন্দ্র প্রাণের ভয়ে নিতান্ত ভীত হইয়া সেই স্থান পরিত্যাগ না করিতেন, তাহা হইলে নিশ্চিত বলা যাইতে পারে যে, টিকেন্দ্র তাঁহাকে হত্যা করিয়া তাঁহার রাজ্য-অপহরণে চেষ্টা কখনই করিতেন না। কেবলমাত্র ভয়-প্রদর্শনে যতদূর পারিতেন, ততদূরই করিতেন।
সেই দিবস অপরাহ্নে ক্রমে ক্রমে অধিক সংখ্যক মণিপুরী আসিয়া রেসিডেন্সিতে উপস্থিত হইতে আরম্ভ করিল, এবং রাত্রিতে সেই স্থানে থাকিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিল। ঐ সমস্ত মণিপুরীর মধ্যে অনেকে শূন্যহস্তে আসিয়াছিল, কাহারও কাহারও হাতে অস্ত্র ছিল। গ্রিমউড সকলকে সেইস্থানে অবস্থান করিবার আদেশ দিতে অসম্মত হইলেন। কারণ, তিনি মনে মনে ভাবিলেন, যদি ইহারা রাত্রে এইস্থানে থাকে, তাহা হইলে ইহার কোন্ ব্যক্তি কোন্ পক্ষীয় লোক, তাহা রাত্রে স্থির করা বড় সহজ হইবে না; বিশেষ, যদি একজন কাহারও উপর আক্রমণ করে, তাহা হইলে ঘটনা বড় গুরুতর হইয়া দাঁড়াইবে। এই ভাবিয়া, গ্রিমউড সেই সমস্ত মণিপুরীবর্গকে নিরস্ত্র করিয়া সকলকে সেইস্থান হইতে বিদায় করিয়া দিলেন।
গ্রিমউড সাহেবের এইরূপ আচরণে মহারাজ সুরাচন্দ্র অতিশয় ব্যথিত হইলেন। তিনি ভাবিলেন, “বন্ধুজ্ঞানে আমি যাঁহার আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছি, যাঁহার পরামর্শ-মত কার্য্য করিবার নিমিত্তই এখানে আসিয়াছি, এখন দেখিতেছি, তিনিই আমার পরম শত্রু। কোথায় তিনি আমার লোকজনকে বিশেষরূপে সাহায্য করিয়া, যাহাতে আমি আমার রাজপাটে বসিতে পারি, তাহার চেষ্টা করিবেন; না, তিনিই আমার সমস্ত লোকের অস্ত্র-শস্ত্র কাড়িয়া লইয়া, তাহাদিগকে এইস্থান হইতে বহির্গত করিয়া দিলেন। ইহাতে বোধ হইতেছে গ্রিমউড ও আমার উপর শঠতা-জাল বিস্তার করিয়া আমাকে বন্দী করিবার উপায় উদ্ভাবন করিতেছেন।” গ্রিমউড সাহেবের মনের ইচ্ছা যাহাই থাকুক, মহারাজ কিন্তু এইরূপ ভাবিয়া গ্রিমউড সাহেবের উপর অসন্তুষ্ট হইলেন। এখন তিনি একে রাজ্যশূন্য রাজা তাহাতে গ্রিমউড সাহেবের নিকটই অবস্থান করিতেছেন। সহায়-সম্পদ যখন কিছুই নাই, তখন তাঁহার মনে ক্রোধের উদয় হইলেই বা তিনি কি করিতে পারেন! তখন তিনি তাঁহার রাজ্য পরিত্যাগ-পূর্ব্বক সন্ন্যাস-ধৰ্ম্ম গ্রহণই উপযুক্ত বিবেচনা করিলেন। মনের ভাব তখন মনে রাখিতে পারিলেন না; গ্রিমউডের নিকট আপন ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন, ও কহিলেন,—“আমি বৃন্দাবনে গমন করিয়া জীবনের অবশিষ্টাংশ দেবারাধনায় নিয়োজিত করিব।”
মহারাজের এই কথা শুনিয়া গ্রিমউড কিছুই বিস্মিত হইলেন না। কারণ, এ প্রস্তাব তাঁহার নূতন নহে।* পূর্ব্ব হইতেই তাঁহার ইচ্ছা যে, মথুরায় ৪০০০ হাজার বিঘা জমি সমেত একটি স্থান খরিদ করিয়া সেইস্থানে দেব-মন্দির স্থাপিত করেন, এবং নিজেও সেই স্থানে অবস্থিতি করিবেন।
[* See Political Agent’s diary, dated 27th June, 1890.]
মহারাজের মানসিক ইচ্ছা যদিও সৰ্ব্ব-সমক্ষে তিনি প্রকাশ করিয়া বলিলেন, তথাপি গ্রিমউড সাহেব তাঁহাকে সময় লইয়া সেই বিষয় বিশেষরূপে ভাবিতে অনুরোধ করিলেন। মহারাজ তাহাতে সম্মত হইয়া ভ্রাতাদিগের সহিত সেই বিষয় উত্তমরূপে পরামর্শ করিতে সম্মত হইলেন।
বিনা গোলযোগে ২২শে সেপ্টেম্বর তারিখের রাত্রি অতিবাহিত হইয়া গেল। মহারাজ প্রায় দুইশত মণিপুরীর সহিত রেসিডেন্সিতেই রাত্রি অতিবাহিত করিলেন।
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
সুরাচন্দ্রের কলিকাতায় গমন ও কুলাচন্দ্রের রাজ্য-গ্রহণ
২৩শে সেপ্টেম্বর শুক্রবার প্রাতঃকালে মহারাজ পুনরায় গ্রিমউড সাহেবকে কহিলেন, “আমি বিশেষ বিবেচনা করিয়া দেখিয়াছি যে, তীর্থযাত্রাই আমার পক্ষে শ্রেয়ঃ। আপনি ইহার বন্দোবস্ত করিয়া দিউন; কিন্তু দেখিবেন, যেন বড়চৌবার মত কয়েদ করিয়া আমাকে হাজারিবাগে রাখা না হয়।” গ্রিমউড তাহাতেই সম্মত হইলেন; এবং কহিলেন,— “যদি আপনি একবার এই স্থান পরিত্যাগ করেন, তাহা হইলে মণিপুর, কাছাড় ও সিলেট এই কয়েকটি স্থানে আপনি আর কখনই আসিতে পারিবেন না।” মহারাজ তাহাতেই সম্মত হইয়া আপনার অভিমত ব্যক্ত করিয়া তখনই সেনাপতিকে এক পত্র লিখিলেন। সেই সময়ে গ্রিমউড সাহেব রাজবাড়ীতে গমন করেন; সেনাপতি তাঁহার ভ্রাতা- দ্বয়ের সহিত এই সম্বন্ধে অনেক কথাবার্তা হয় ও পরিশেষে মহারাজের ইচ্ছাও তিনি তাঁহাকে জ্ঞাত করেন। টিকেন্দ্র মহারাজের কথা শুনিয়া অতিশয় সন্তুষ্ট হন, এবং বৃন্দাবন যাইবার সমস্ত ব্যয় ভার নিজে বহন করিতে সম্মত হন। কেবল যে সম্মত হইলেন, তাহা নহে; কুলাচন্দ্র ও টিকেন্দ্রজিৎ সুরাচন্দ্রের শ্রীবৃন্দাবন গমনের ও আবশ্যকীয় খরচের নিমিত্ত প্রথম লক্ষ্মীপুরে সহস্র মুদ্রা, পরে কাছাড়ে এক হাজার পাঁচ শত টাকা, এবং ভারত-গবর্ণমেন্টের ‘ফরেন সেক্রেটারীর’ হাত দিয়া দেড় হাজার ও আসামের ‘চীফ কমিশনারের’ মারফতে তিন হাজার, মোট ৭০০০ হাজার টাকা অর্পণ করেন।
সেই বিরোধের সময় টিকেন্দ্রজিৎ মহারাজের পত্রের যেরূপ প্রতি-উত্তর লেখেন, তাহা দেখিলে টিকেন্দ্রকে একজন সদাশয় ব্যক্তি ভিন্ন আর কিছুই বলিতে পারিবেন না। ভ্রাতার উপর তখনও তাঁহার যেরূপ ভক্তি, যেরূপ ভালবাসা, তাহা সেই সময়ের সেই পত্রের ছত্রে ছত্রে প্রকাশিত আছে। কৌতূহলাক্রান্ত পাঠকগণের কৌতূহল নিবারণের জন্য সেই পত্রখানিও এইস্থানে উদ্ধৃত হইল,—
“মহামহিম মহিমা-সাগর-বর শ্রীল শ্রীযুক্ত শ্রীপঞ্চযুক্ত মণিপুরেশ্বর মহারাজা প্রবল প্রচণ্ড প্রতাপেষু
শ্রীল শ্রীযুক্ত জ্যেষ্ঠভ্রাতঃ মহারাজের চরণে কোটী দণ্ডবৎপূর্ব্বক মিনতি করিয়া প্রার্থনা এই শ্রীযুক্ত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতঃ মহারাজের প্রেরিত নবমীর কৃপা-পত্র প্রাপ্তে রাজ-আজ্ঞা আদেশ সমস্ত জ্ঞাত হইলাম; শ্রীযুক্ত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার রাজ- আজ্ঞা অনুসারে শ্রীধাম ব্ৰজ নিৰ্ব্বিঘ্নে পৌঁছিবার চেষ্টিত হইব। অধীনেরা শ্রীযুক্ত মহারাজের চরণে যাহা অপরাধ করি, তাহা মার্জ্জনা করিবেন। এইবারকার ঘটনাটি বিপরীত অসম্ভব বলিতে হয়। সন ১৮৯১ সাল, তারিখ ২৩শে সেপ্টেম্বর।”
এই সময়ে টিকেন্দ্রজিৎ মনে করিলে আপনিই সেই রাজসিংহাসনে অধিরোহণ করিয়া রাজছত্র ধারণ করিতে পারিতেন; কিন্তু তিনি সেরূপ ভ্রাতা নহেন। তিনি যেরূপ পরাক্রমশালী, সেইরূপ ন্যায়বান। তাহাতে অন্যায় আচরণে প্রবৃত্ত হইবেন কি প্রকারে? বংশরীতি লঙ্ঘন করিতে কিরূপে তিনি সমর্থ হইবেন? সুরাচন্দ্রের পরই সেই রাজ্যের অধিকার কুলাচন্দ্রের। কুলাচন্দ্র সেই স্থানে ছিলেন না; তিনি কাছাড়-রাস্তা অভিমুখে গমন করিয়াছিলেন। টিকেন্দ্র তাঁহাকে আনিবার নিমিত্ত তখনই লোক পাঠাইলেন। প্রায় ৩ ঘণ্টা পরে সেনাপতির অভিমত জানিতে পারিয়া, কুলাচন্দ্ৰ রাজধানীতে আগমন করিলেন। সেনাপতি তখনই তাঁহাকে সুরাচন্দ্রের সিংহাসনে উপবেশন করাইয়া, আপনারা সকলেই তাঁহার আজ্ঞাবহ হইলেন। সেই সময় হইতেই কুলাচন্দ্র যুবরাজ-পদ পরিত্যাগ-পূর্ব্বক মণিপুরের মহারাজ হইয়া বসিলেন; আর সেনাপতি টিকেন্দ্র আজ যুবরাজের পদ প্রাপ্ত হইলেন।
মহারাজ সুরাচন্দ্র সিংহ রাজ্যচ্যুত হইয়াছিলেন বলিয়াই যে তাঁহাকে প্রজাপীড়ক রাজা বলিব, তাহা নহে। যখন রাজ্যমধ্যে প্রচার হইল যে, তিনি রাজ্য পরিত্যাগ করিয়া বৃন্দাবন-ধামে গমন করিতেছেন, তখন দলে দলে মণিপুরী প্রজা আসিয়া তাঁহার দুঃখে দুঃখ করিতে লাগিল; যাহার যেরূপ সাধ্য, সে সেই প্রকার উপঢৌকন, পাথেয় প্রভৃতি আনিয়া মহারাজের সম্মুখে উপস্থিত করিতে লাগিল। মহারাজ সকলের নিকট বিদায় লইয়া, মিষ্ট কথায় সকলকে সন্তুষ্ট করিয়া, সেই দিবস সন্ধ্যা ৭।।০ টার সময় মণিপুর পরিত্যাগ করিলেন। মহারাজের সহোদর তিন ভ্রাতা অর্থাৎ কেশরজিৎ বা সামুহানজামা, ভৈরবজিৎ বা পাকা সেনা বা সগলহানজামা এবং পদ্মলোচন বা গোপাল সেনা ৬০ জন অনুচরের সহিত মহারাজের সহিত প্রস্থান করিলেন। বৃদ্ধ থঙ্গেল জেনারেল এবং অন্যান্য মন্ত্রিগণ নূতন মহারাজ কুলাচন্দ্রের নিকট গমন করিয়া আত্মসমর্পণ করিলেন। গ্রিমউড সাহেব ৩৫ জন সুশিক্ষিত গুর্খা সৈন্য সুরাচন্দ্রের সহিত অর্পণ করিলেন; তাঁহারা উহাকে কাছাড় পর্যন্ত নিৰ্ব্ববাদে পৌঁছিয়া দিল।
মহারাজ সুরাচন্দ্র একজন প্রকৃত বৈষ্ণব ছিলেন। তিনি যতক্ষণ গ্রিমউড সাহেবের রেসিডেন্সির ভিতর অবস্থিতি করিয়াছিলেন, সে পর্য্যন্ত তিনি এক বিন্দু জল পর্যন্তও পান করিতে পান নাই। গ্রিমউড কি তাঁহার পান-ভোজন বন্ধ করিয়াছিলেন? তাহা নহে। তিনি হিন্দু হইয়া কিরূপে খৃষ্টানের আবাসে থাকিয়া আহারাদি করিবেন! প্রাণের ভয়ে সেই স্থান পরিত্যাগ-পূর্ব্বক অন্য স্থানে গমন করিতেও সাহস করেন না, দুই দিবসকাল তাঁহাকে ক্ষুধা-তৃষ্ণা সহ্য করিতে হইয়াছিল।
হিন্দু যতই কেন পাষণ্ড হউক না, তাঁহার মন কিন্তু তত পাষাণ হয় না। মহারাজ সুরাচন্দ্র যাঁহার নিমিত্ত সিংহাসন- চ্যুত হইয়া দেশ হইতে বিতাড়িত হইলেন, যাইবার সময়ও তাঁহাকে ভ্রাতৃভাবে আলিঙ্গন করিলেন। আরও তাঁহার নিকট কতকগুলি স্বর্ণ-অলঙ্কার ছিল, গমন করিবার সময়, সেই অলঙ্কারগুলি ও কতকগুলি বিশেষ আবশ্যকীয় চাবি যুবরাজকে অর্পণ করিয়া আশীর্ব্বাদ করিলেন। এবং তাহার নিকট রাজ-কাপড় (কোট) ও রাজ-তরবারি ছিল, তাহাও আপনার ভ্রাতা নবীন মহারাজকে অর্পণ করিলেন।
সুরাচন্দ্রের গমনকালে তাঁহার ব্যবহার দেখিয়া যুবরাজ ও সেনাপতি বিশেষ লজ্জিত হইলেন। কিন্তু তখন আর কি করিবেন! যাহাতে মহারাজ খরচপত্রের নিমিত্ত কোন স্থানে কষ্ট না পান, তাহার বন্দোবস্ত করিতে লাগিলেন। এবং গমনকালে এক হাজার টাকা নগদ অর্পণ করিলেন।
মহারাজ সুরাচন্দ্র প্রকৃতই নিজের ইচ্ছায় তীর্থ-পর্যটনে গমন করিলেন, কি গ্রিমউড সাহেবের কৌশলে পতিত হইয়া রাজ-কয়েদী হইলেন, সে বিষয়ে অনেক অনেক কথা বলিয়া থাকেন। কিন্তু সরকারী কাগজপত্রে দৃষ্ট হয় যে, যখন মহারাজা মণিপুর হইতে বহির্গত হন, সেই সময় একজন পুলিশ-ইনস্পেক্টার সেই স্থান হইতে উহাদিগের সহিত কলিকাতা পৰ্য্যন্ত আগমন পূৰ্ব্বক তাঁহাদিগকে কলিকাতার পুলিশ-কমিসনরের নিকট উপস্থিত করিয়া দেন।*
[* See telegram No. 4208-P., Dated 9th October 1890, from the Secretary to the Chief Commissioner of Assam, to the Commissioner of Police, Calcutta. ]
কুলাচন্দ্রকে কাছাড় হইতে আনিয়া সিংহাসনে বসানোর পর, কুলাচন্দ্র এবং সেনাপতি ইংরাজ-সন্ধির নিয়ম- অনুযায়ী কুলাচন্দ্রকে রাজসিংহাসনে বসিবার অনুমতি প্রার্থনা করিয়া ইংরাজ-গবর্ণমেন্টের নিকট এক আবেদন করেন। গবর্ণমেণ্টও তাঁহাদের আবেদন মঞ্জুর করিয়া কুলাচন্দ্রকে রাজা হইবার অনুমতি প্রদান করেন। *
[* See letter dated 15th Aswin, 1812 – B, from Kula Chunder Singh, Maharaja of Manipur, to his Excellency the most Hon’ble Sir Charles Keith Marquis of Lansdowne G.C.M.G.G.C.S.I & c, &c, Viceroy and Governor General of India.]
মহারাজ সুরাচন্দ্র সিংহ তাঁহার ভ্রাতাত্রয় ও সহচরবর্গের সহিত কলিকাতায় আগমন করিলেন। এখন তাঁহারা মাণিকতলা রোড, কাঁকুড়গাছি, মহামান্যা স্বর্ণময়ীর উদ্যানে অবস্থিতি করিতেছেন!**
[** See the heading of the letter dated 27th November, 1890, from His Highness Sura Chunder Singh, Maharaja of Manipur, to Hon’ble J. W. Quinton C. S. I. Chief Commissioner of Assam. ]
এইস্থান হইতে তিনি তাঁহার দুরবস্থা জানাইয়া গবর্ণমেণ্টকে কয়েকখানি দরখাস্ত করিলেন; কিন্তু সেই দরখাস্তের যে ফল ফলিল, তাহা পাঠকগণ পর পরিচ্ছেদে অবগত হইতে পারিবেন।
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
(ইংরাজী ১৮৯১ সাল)
সেনাপতিকে ধৃত করিবার মন্ত্রণা
২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে আসামের চীফ কমিসনার কুইন্টন সাহেব গবর্ণর জেনারেলের ৩৬০ ইঃ নম্বরের উপদেশপূর্ণ এক পত্র লইয়া কলিকাতা পরিত্যাগ করিলেন। ঐ পত্রের সংক্ষিপ্ত উপদেশ এই যে,—“গবর্ণমেণ্ট বিশেষ বিবেচনা করিয়া দেখিয়াছেন যে, মহারাজ সুরাচন্দ্র পুনরায় তাঁহার সিংহাসন প্রাপ্ত হইতে পারিবেন না। কুইণ্টন সাহেব উপযুক্ত পরিমাণ সৈন্যের সহিত মণিপুর গমন করিয়া, কুলাচন্দ্রকে রাজ-সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করিবেন। আর যে টিকেন্দ্রজিৎ বিদ্রোহী হইয়া আপনার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে রাজ্যচ্যুত করিয়াছেন, সেই সেনাপতিকে মণিপুর হইতে নির্ব্বাসিত করিতে হইবে।”
সেনাপতি টিকেন্দ্রজিৎ সিংহ সহজে যে আত্মসমর্পণ করিবার লোক নহেন, তাহা কুইণ্টন বিশেষরূপে অবগত হইয়াছিলেন। বিশেষ সেনাপতির আজ্ঞাধীনে যে কয়েকটি কামান আছে, তাহাও তিনি জানিতেন। এই নানা কারণে আসামের ‘জেনারেল কমান্ডিং আফিসারের’ সহিত পরামর্শ করিয়া পাঁচ শত মাত্র গুর্খা সৈন্য লইয়া, কুইণ্টন সাহেব মণিপুরে গমন করিবার নিমিত্ত ৭ই মার্চ তারিখের কুক্ষণে গোলাঘাট পরিত্যাগ করিলেন।
এ্যাসিষ্ট্যান্ট কমিসনার গর্ডন সাহেব, মণিপুরের পলিটিকেল এজেন্ট গ্রিমউড সাহেবের সহিত এই বিষয়ের পরামর্শ করিবার নিমিত্ত পূর্ব্বেই রওনা হইয়াছিলেন। তিনি ১৫ মার্চ তারিখে মণিপুরে উপনীত হইলেন। গ্রিমউড সাহেবকে সমস্ত কথা বলিলেন, এবং সহজে কি উপায়ে সেনাপতি ধৃত হইতে পারেন তাহার পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিলেন। গ্রিমউড সাহেব সেনাপতি বল-বিক্রম যতদূর অবগত ছিলেন, ততদূর আর কেহই জানিতেন না। তিনি তখন স্পষ্টই কহিলেন যে, “সেনাপতিকে সহজে ধৃত করিবার উপায় আমি দেখিতে পাইতেছি না। তিনি সহজে আত্ম-সমর্পণ করার লোক নহেন; প্রাণপণে চেষ্টা করিয়া পূর্ব্বে একবার দেখিবেন, কিন্তু যদি পরাজিত হয়েন, তাহা হইলে আত্মসমর্পণ করিতে পারেন, নতুবা তিনি সহজে কোনরূপেই বশীভূত হইবেন না।” এই কথা শুনিয়া গর্ডন সাহেব ১৮ই মার্চ তারিখে কয়রং গমন করিয়া, কুইণ্টন সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন; গ্রিমউড তাঁহাকে যাহা যাহা বলিয়াছিলেন, তিনি তাহা সমস্তই তাঁহার নিকট প্রকাশ করিলেন।
গর্ডনের নিকট সমস্ত শুনিয়া, কুইণ্টন একটু ভাবিত হইলেন। তিনি একটু বিবেচনা করিয়া, কিরূপ উপায় অবলম্বন করিবেন, ‘কমাণ্ডিং অফিসারের’ সহিত পরামর্শ করিয়া তাহা স্থির করিলেন, ও তখনই তারযোগে ‘ফরেন সেক্রেটারির’ নিকট সংবাদ পাঠাইয়া দিলেন। *
[* See telegram, dated the 18th March, 1891, from the Chief Commissioner of Assam, Camp Kairong, to the Foreign Secretary, Calcutta.]
তাহার সংক্ষিপ্ত মর্ম্ম এই যে, ২১শে মার্চ রবিবার আমি মণিপুর গিয়া উপনীত হইব। সেই সময়েই একটি প্রকাশ্য দরবার আহ্বান করিয়া কুলাচন্দ্র ও সেনাপতিকে আনয়ন করিব। গবর্ণমেন্টের আদেশ উভয়কে তখনই জ্ঞাত করাইয়া, কুলাচন্দ্রকে রাজ্যভার অর্পণ ও টিকেন্দ্রজিৎকে ধৃত করিয়া আপনার নিকটেই রাখিব। এবং আমাদিগকে রক্ষার নিমিত্ত কুলাচন্দ্রকে আদেশ প্রদান করিব যে, তিনি একটি কামান আমাদিগের নিকট সতত প্রস্তুত রাখেন। এই স্থানে অধিক দিবস থাকিলে সেনাপতি পাছে কোন গোলযোগ বাধান, এই নিমিত্ত ২৫শে তারিখে তাঁহাকে আমি সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইব। আসাম ব্যতীত ভারতের কোন স্থানে তাঁহাকে রাখিবার স্থান নির্দিষ্ট হওয়া আবশ্যক। ইহাঁকে রাখিবার ব্যয় ৫০ টাকার অধিক হওয়ার সম্ভাবনা নাই। সুরাচন্দ্রকে বৃন্দাবনে রাখিতে ১০০ টাকা হইলেই যথেষ্ট হইবে। পাকা সেনা মণিপুরে গমন করিতে পাইবেন না, তাঁহাকে ৪০ টাকা করিয়া দিয়া কোন স্থানে আবদ্ধ করিয়া রাখা যাইতে পারে। শনিবারের মধ্যে ইহার কোনরূপ উত্তর না পাইলে, পূৰ্ব্ব-প্রস্তাবিত মতে আমি কাৰ্য্য সম্পন্ন করিব।”
এই টেলিগ্রাফ প্রাপ্তে ‘ফরেন সেক্রেটারী’ তাহার অনুমোদন করিয়া, ২১শে মার্চ তারিখে তাহার সংবাদ পাঠাইলেন।**
[** See Telegram No, 545 – E, dated the 19th March, 1891, from the Foreign Secretary, Calcutta to the Chief Commissioner of Assam.]
২১শে মার্চ তারিখে গ্রিমউড সাহেব সেংমাই আগমন করিয়া কুইণ্টনের সহিত মিলিত হইলেন। কুইণ্টন যেরূপ যুক্তি করিয়াছিলেন, তাহার সমস্তই তাঁহার নিকট প্রকাশ করিলেন।
কুইণ্টনের সহিত তখন নিম্নলিখিত ইংরাজ-কর্মচারিগণ ছিলেন, —- (১) রেসিডেন্ট গ্রিমউড সাহেব, (২) এসিষ্ট্যান্ট সেক্রেটারি মিঃ কানস, (৩) এসিষ্ট্যান্ট কমিশনর লেফটেনান্ট গর্ডন, (৪) এসিষ্ট্যন্ট কমিশনর, এ, ই, উডস্, (৫) আসাম টেলিগ্রাফ ডিপার্টমেন্টের মিঃ মেলভাইল, (৬) টেলিগ্রাফ সিগনালর মিঃ উইলিয়মস্, (৭) কর্ণেল স্কেন, (৮) কাপ্তেন বুচার, (৯) লেফটেনান্ট চেটারটন, (১০) এডজুটেন্ট লেফটেনেণ্ট লুগার্ড, (১১) ডাক্তার কালভার্ট, (১২) কাপ্তেন বইলিউ, (১৩) লেফটেনান্ট ব্লাকেনবরি, (১৪) লেফটেনেন্ট সিমসন।
ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
কুইণ্টনের আগমন
চীফ-কমিসনার কুইণ্টন সাহেব সসৈন্যে মণিপুরে আগমন করিয়াছেন, এই সংবাদ টিকেন্দ্রজিৎ প্রাপ্ত হইলেন। ইতিপূৰ্ব্বে কুইণ্টন অনেকবার মণিপুরে আগমন করিয়াছিলেন, কিন্তু সৈন্যসামন্তের সহিত কখন তিনি আসেন নাই। যে সকল লোকজন সদাসর্ব্বদা তাঁহার সহিত থাকিত, সেই সমস্ত লোকজন ব্যতীত অধিক লোক প্রায়ই তিনি সঙ্গে করিয়া আসিতেন না। এবার কিন্তু অনেকগুলি সৈন্য সামন্তের সহিত তিনি মণিপুরের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। এত সৈন্যের সহিত তিনি কখনও মণিপুরে আগমন করেন নাই; কাজেই সেনাপতির মনে কেমন একটু সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। তিনি গোপনে একটু অনুসন্ধান করিলেন। অনুসন্ধানে তাঁহার নিকট কোন কথা অব্যক্ত থাকিল না; তিনি সহজেই জানিতে পারিলেন যে, এবার কুইণ্টন সাহেবের আগমন কেবল তাঁহাকেই ধৃত করিবার মানসে। কিন্তু কি কারণে যে কুইণ্টন সাহেব তাঁহাকে ধৃত করিয়া লইয়া যাইবেন, ভাবিয়া চিন্তিয়া তাহার কোন কারণই তিনি উপলব্ধি করিতে পারিলেন না। তাঁহার কোন একজন দেশীয় বিশ্বাসী বন্ধুর নিকট হইতে এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া, তিনি মনে মনে একটু হাসিলেন; ভাবিলেন, কুইণ্টনের কি সাহস! কেবল পাঁচশত মাত্র সৈন্য লইয়া যিনি টিকেন্দ্রকে ধরিতে সাহস করেন, তাঁহার ক্ষমতাই না জানি কেমন হইবে। যাহা হউক, এখন আমার কুইণ্টন সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করা সম্পূর্ণ ইচ্ছা ছিল না; কিন্তু যখন তিনি আমাকে ধরিতে আসিতেছেন তখন আমার অনুপস্থিত থাকা উচিত নহে; আমি নিজে গমন করিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিব, এবং অভিবাদন-পূৰ্ব্বক তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া মণিপুরে আনয়ন করিব। আর যদি ভিতরে ভিতরে উহাদিগের আরও কোন অভিসন্ধি থাকে সুরাচন্দ্রকে রাজ-সিংহাসনে বসাইবার অভিসন্ধি করিয়াই যদি তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া আনিয়া থাকেন, আর জোর করিয়া কুলাচন্দ্রকে সিংহাসন হইতে বিতাড়িত পূৰ্ব্বক সুরাচন্দ্রকেই সেই সিংহাসন অর্পণ করেন, তাহাই বা আমি চক্ষের উপর কি প্রকার দেখিব? যতক্ষণ আমার দেহে প্রাণ থাকিবে, যতক্ষণ আমার ধমনীতে রক্ত প্রবাহিত হইবে, ও যতক্ষণ আমার একজন মাত্র সৈন্য অবশিষ্ট থাকিবে, ততক্ষণ পর্য্যন্ত আমি উহাদিগের গতিরোধ করিব। যাহাতে আর একপদ অগ্রসর হইতে না পারেন তাহার চেষ্টা করিব। যদি কৃতকার্য্য হই, ভালই; নচেৎ সম্মুখে সংগ্রামে সেইস্থানেই আপনার জীবন অর্পণ করিব।’ মনে মনে এইরূপ যুক্তি করিয়া যে রাস্তায় কুইণ্টন আগমন করিতেছিলেন টিকেন্দ্র সেই পথে পাঁচশত সৈন্য পাঠাইয়া দিলেন। ঐ সৈন্য সকল রাজপ্রাসাদ হইতে ৪ ক্রোশ পর্য্যন্ত রাস্তায় শ্রেণীবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান হইয়া, অভিবাদন করিবার আশায়, ইংরাজ-কর্মচারী গণের আগমন-প্রতীক্ষা করিতে লাগিল। আর কি? সুরাচন্দ্রকে লইয়াই কমিশনর সাহেব যদি আগমন করিয়া থাকেন তাহা হইলে তাঁহাদিগের গতিরোধ করিতে হইবে। মণিপুরের ভিতর যাহাতে তাঁহারা প্রবেশ করিতে না পারেন, তাহার নিমিত্ত এক সহস্র সুশিক্ষিত মণিপুরী সৈন্য অস্ত্র-শস্ত্রে সুসজ্জিত হইয়া টিকেন্দ্রজিতের আদেশ মত মাও থানায় অবস্থিতি করিবার নিমিত্ত প্রেরিত হইল।
সেই দিবস অর্থাৎ ২২শে মার্চ তারিখের প্রাতঃকালে সেনাপতি টিকেন্দ্রজিৎ রণসাজে সজ্জিত হইয়া, দুই রেজিমেন্ট সৈন্যের সহিত, ইংরাজ-কৰ্ম্মচারীগণকে অভিবাদন-পূর্ব্বক সঙ্গে করিয়া আনিবার নিমিত্ত ৪ ক্রোশ পথ গমন করিলেন। রাস্তায় কুইন্টন প্রভৃতি ইংরাজ-কর্ম্মচারীগণের সহিত সাক্ষাৎ হইল। সুরাচন্দ্রকে তাঁহাদিগের সহিত দেখিতে পাইলেন না, এবং সেই সময়ে কলিকাতা-স্থিত তাঁহার কোন বন্ধুর নিকট হইতে তারে সংবাদ প্রাপ্ত হইলেন যে, সুরাচন্দ্র কলিকাতা পরিত্যাগ-পূর্ব্বক কোন স্থানে গমন করেন নাই; কাঁকুড়গাছির বাগানের অবস্থিতি করিতেছেন। এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া এবং স্বচক্ষে তাঁহাকে দর্শন করিতে না পাইয়া সেনাপতি অতিশয় আনন্দিত হইলেন।
সেনাপতির অবস্থা দেখিয়া কুইণ্টন ভাবিত হইলেন। এত কষ্ট সহ্য করিয়া ৫০০ শত সৈন্যের সহিত যাঁহাকে ধরিবার নিমিত্ত গমন করিতেছিলেন, সেই বিক্রমশালী সেনাপতি আপনি আসিয়াই তাঁহার নিকট সসৈন্যে উপস্থিত হইলেন। কিন্তু কুইণ্টন তখন তাঁহাকে কিছুই বলিলেন না, বা তাঁহাকে ধরিবার কোন উদ্যোগও করিলেন না। কেন করিলেন না? — সেনাপতি টিকেন্দ্রজিতের সহিত দুই রেজিমেণ্ট সৈন্য দেখিয়া, মনে মনে ভীত হইলেন, কি তাঁহার অন্য কোন অভিসন্ধি ছিল? তাহা কুইণ্টনই জানেন, আমরা কিন্তু তাহা বলিতে অক্ষম।
সেনাপতি যখন সকলকে সমভিব্যাহারে আনয়ন করিলেন সেই সময় মহারাজ কুলাচন্দ্র কেল্লার বাহিরে কৰ্ম্মচারিদিগকে অভিবাদন করিবার নিমিত্ত দণ্ডায়মান ছিলেন। কুইণ্টনের সহিত তাঁহার দেখা হইলে, উভয়ে উভয়কে মিত্রভাবে গ্রহণ করিলেন।
এখন পৰ্য্যন্ত কেহই প্রকাশ্যরূপে অবগত নহেন যে, কুইন্টন কি নিমিত্ত সসৈন্যে আগমন করিয়াছেন। সেই সময় কুইণ্টন কুলাচন্দ্রকে বিদায় দিয়া রেসিডেন্সিতে গমন করিলেন। যাইবার সময় বলিয়া গেলেন, দিবা ১২টার সময় রেসিডেন্সিতে দরবার হইবে; সেই দরবারে কুলাচন্দ্র, সেনাপতি প্রভৃতি সকলে উপস্থিত হইয়া যেন তাঁহার অনুরোধ রক্ষা ও ইংরাজ-গবর্ণমেন্টের উপর বিশেষরূপ সম্মান প্রদর্শন করা হয়। কুইণ্টনের এই আদেশ শ্রবণ করিয়া, মহারাজ, সেনাপতি প্রভৃতি তখন সেই স্থান হইতে আপন আপন স্থানে গমন করেন।
ইহার পূর্ব্ব-দিবস অর্থাৎ ২১শে মার্চ ভারত-গবর্ণমেন্টের অণ্ডার সেক্রেটারী জে, ডব্লিউ কনিংহ্যাম সাহেব সুরাচন্দ্র মহারাজকে এক পত্র লেখেন। তাহাতে সমস্ত কথা প্রকাশ করিয়া বলিয়া দেন যে, সুরাচন্দ্র আর তাঁহার রাজ্য পুনঃপ্রাপ্ত হইবেন না। বরং স্থান নিৰ্দ্দিষ্ট হইলে গবর্ণমেন্টের দাতব্যের উপর নির্ভর করিয়া, তাঁহাকে সেই স্থানে থাকিতে হইবে। কুলাচন্দ্র যেরূপ রাজত্ব করিতেছেন, তাহাই করিবেন। আর, যাহারা বিদ্রোহের সূত্র করিয়া সুরাচন্দ্রকে বিতাড়িত করিবে, তাহারাও উপযুক্তরূপে দণ্ডিত হইবে। *
[* See letter dated Calcutta, ths 21st March, 1891, in W. J. Cuningham Esq., officiating Secretary to the Government of India, Foreign Department, to Maharaja Sura Chandra Singh of Monipur. ]
বিংশ পরিচ্ছেদ
দরবার
দিবা ১২টার সময় মহারাজ কুলাচন্দ্র রেসিডেন্সির দ্বারে গিয়া উপস্থিত হইলেন; তাঁহার সঙ্গে অশ্বারো- হণে সেনাপতিও গমন করিলেন। সেই সময় দরবারের বন্দোবস্ত শেষ হয় নাই, কাজেই গ্রিমউড মহারাজকে কিয়ৎক্ষণ অপেক্ষা করিতে কহিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরেই দরবারের সমস্ত বন্দোবস্ত শেষ হইয়া গেল। মহারাজ রেসিডেন্সির ভিতর প্রবেশ করিলেন।
সেনাপতি যখন কুইন্টনের অভিসন্ধি অবগত হইয়াছিলেন, তখন রেসিডেন্সির ভিতর প্রবেশ করেন কি প্রকারে? সেই স্থানের দরবার-গৃহে বিনা-সৈন্যে গমন করিতে হইবে, সুতরাং কুইন্টন কর্তৃক অনায়াসেই তিনি ধৃত হইবেন। এইরূপ ভাবিয়া সেনাপতি দরবারে গমন করিলেন না। অশ্বে কষাঘাত, পূর্ব্বক আপন আলয়-অভিমুখে প্রস্থান করিলেন। কুইণ্টন সাহেব দরবারে উপস্থিত হইয়া সকলকেই দেখিতে পাইলেন, কিন্তু কেবল দেখিতে পাইলেন না—- সেনাপতি টিকেন্দ্রজিৎকে। মহারাজ কুলাচন্দ্রের নিকট হইতে অবগত হইতে পারিলেন যে, তিনিও দরবারে আগমন করিয়াছিলেন, কিন্তু দরবারের মধ্যে প্রবেশ না করিয়া সেই স্থান হইতে অশ্বারোহণে প্রস্থান করিয়াছেন। সুতরাং সেনাপতিকে ঐ দরবারে উপস্থিত হইবার নিমিত্ত অনুরোধ করিয়া দ্রুতগামী অশ্বারোহী প্রেরণ করিলেন। কিন্তু টিকেন্দ্র তথাপি আগমন না করিয়া বলিয়া পাঠাইলেন যে, হঠাৎ তিনি অতিশয় পীড়িত হইয়াছেন, কোন ক্রমেই তিনি দরবারে উপস্থিত হইতে পারিবেন না। কুইন্টন দেখিলেন যে, যে উদ্দেশ্যে তাঁহার দরবার, যখন তাহাই হইল না, তখন দরবার করিয়া আর প্রয়োজন কি? চিফ কমিশনার সাহেব তখন স্পষ্টই বলিলেন যে, সেনাপতি দরবারে উপস্থিত না হইলে কোন ক্রমেই তিনি দরবার করিবেন না। টিকেন্দ্রজিৎকে ক্ষণকালের জন্য সেই দরবারে উপস্থিত হইবার নিমিত্ত বারে বারে সংবাদ প্রদান করা হইল, কিন্তু তাহাতেও তিনি আসিলেন না। এইরূপে প্রায় দুই ঘণ্টাকাল সেই স্থানে অবস্থিতি পূর্ব্বকপরিশেষে কুলাচন্দ্রও সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।
দিবা অপরাহ্ণে গ্রিমউড সাহেব রাজবাড়ীতে গমন করিয়া মন্ত্রিবর্গকে বুঝাইলেন, ও সেনাপতি প্রভৃতিকে দরবারে উপস্থিত হইবার পরামর্শ প্রদান করিলেন। পরদিবস অর্থাৎ ২৩শে মার্চ তারিখের দিবা ৯টার সময় পুনরায় দরবারের সময় নির্দ্ধারিত হইল। এইবার কুলাচন্দ্র প্রভৃতি কেহই আগমন করিলেন না। এই অবস্থা দেখিয়া গ্রিমউড পুনরায় রাজবাড়ী গমন করিয়া সকলকে বুঝাইলেন; দরবারে উপস্থিত হইবার নিমিত্ত উপদেশ প্রদান করিলেন। কিন্তু এবার তাঁহার কথা কেহই শুনিলেন না, তাঁহার যুক্তি-অনুযায়ী দরবারে আগমন করিতে কেহই সম্মত হইলেন না।
কুইণ্টন এই অবস্থা দেখিয়া ভাবিলেন, তিনি যে উপায় অবলম্বনে সেনাপতিকে ধৃত করিবার ইচ্ছা করিয়াছিলেন, তাহা হইল না; সহজে সেনাপতি যে ধরা দিবেন, তাহা বোধ হইতেছে না। তখন তিনি কুলাচন্দ্রকে এক পত্র লিখিলেন; তাহার মর্ম্ম এই,— “সেনাপতি আত্মসমর্পণ না করিলে তিনি ধৃত হইবেন।” ঐ ২৩শে তারিখের দিবা ২টার সময় গ্রিমউড সাহেব স্বয়ং ঐ পত্র-বাহক হইয়া রাজবাড়ীতে গমন করিলেন; পত্র কুলাচন্দ্রকে অর্পণ করিয়া কহিলেন, — “যদি আপনি সেনাপতিকে অর্পণ না করেন, তাহা হইলে আপনিও মহারাজ-উপাধি ধারণ করিয়া এই সিংহাসনে বসিতে সমর্থ হইবেন না।” কিন্তু কুলাচন্দ্র তাহাতেও সম্মত হইলেন না, এবং স্পষ্টই কহিলেন, “আমি কোনক্রমেই সেনাপতিকে কুইণ্টন সাহেবের হস্তে অর্পণ করিতে সমর্থ হইব না।”
পরিশেষে স্কেন ও গ্রিমউডের সহিত পরামর্শ করিয়া ইহাই সাব্যস্ত হইল যে, রাত্রিযোগে সেনাপতি যখন আপন গৃহে নিদ্রিত থাকিবেন, সেই সময় সৈন্য দ্বারা সেই ঘর আক্রমণ-পূর্ব্বক তাঁহাকে নিদ্রিত অবস্থায় ধৃত করা হইবে। এ পরামর্শ ব্রিটিশ-সিংহের উপযুক্তই বটে!
আরও স্থিরীকৃত হইল যে, সেনাপতিকে ধরিবার নিমিত্ত ২৫০ জন সৈন্য কেল্লার মধ্যস্থিত সেনাপতির বাড়ীর ভিতর গমন করিবে। এক শত লোক ঐ বাড়ী বেষ্টন করিয়া থাকিবে, এবং আবশ্যক হইলে, তাহারাও ভিতর গমন করিয়া সেনাপতিকে ধৃত করিতে সাহায্য করিবে। ৩০ জন লোকে কেল্লার বাহিরের প্রাচীর উল্লঙ্ঘন করিয়া ভিতরে প্রবিষ্ট হইবে, এবং ভিতর হইতে সদর দরজা উদ্ঘাটন করিয়া দিবে। অবশিষ্ট ১২০ জন কর্ণেল স্কেনের অধীনে রেসিডেন্সির নিকট উপস্থিত থাকিবে, এবং যে দিকে আবশ্যক হইবে, সেই দিকেই গমন করিয়া সাহায্য করিবে।
একবিংশ পরিচ্ছেদ
সেনাপতির গৃহ আক্রমণ
সেনাপতি টিকেন্দ্রজিৎ যেমন যোদ্ধা সেইরূপ বুদ্ধিমানও ছিলেন; এবং তাঁহার মত গুপ্ত-সংবাদ-সংগ্রহকারী ব্যক্তি মণিপুরের ভিতর আর কেহ ছিল কি না, সন্দেহ। কুইন্টন সাহেবের নিকট হইতে বিদায় লওয়ার পর, তিনি আপন ঘরের বাহির হন নাই; কিন্তু রেসিডেন্সির ভিতর যখন যেরূপ পরামর্শ হইয়াছে, তখনই তিনি তাহা অবগত হইতে পারিয়াছেন। যে উপায়ে তিনি পূৰ্ব্বেই কুইণ্টন সাহেবের চক্রান্ত জানিতে পারিয়াছিলেন, সেই উপায়েই আবার উহাদিগের সমস্ত পরামর্শ জানিতে পারিলেন। জানিতে পারিলেন যে, তাঁহাকে ধৃত করিবার নিমিত্ত অদ্য রাত্রে তাঁহার বাড়ী ইংরাজ-সৈন্য দ্বারা আক্রমণিত হইবে। সেনাপতি যে কি উপায়ে এই সংবাদ প্রাপ্ত হইলেন, তাহা আমরা এখন বলিতে অপারক। কারণ, এখনও মণিপুরের সমস্ত অনুসন্ধান শেষ হয় নাই, সকলের বিচারও হইয়া যায় নাই।
রাত্রে যে কি ঘটনা ঘটিবে, তাহা পূৰ্ব্বেই জানিতে পারিয়া স্ত্রী-পুত্র প্রভৃতি পরিবারবর্গকে ঐ স্থান হইতে স্থানান্তরে রাখিলেন। নিজে উপযুক্ত রূপ সৈন্য লইয়া তাহাদিগকে অস্ত্র-শস্ত্রে সুসজ্জিত করিলেন, ও তাহাদিগকে আপনার বাড়ীর ভিতর লুক্কাইত অবস্থায় রাখিলেন। সেনাপতি মনে করিলে তিনি নিজেও সেই স্থান হইতে স্থানান্তরে গমন করিয়া লুক্কাইত থাকিতে পারিতেন, কিন্তু তিনি সে প্রকৃতির লোক ছিলেন না, সেরূপ উপাদানে তিনি গঠিত হন নাই। সুতরাং তিনি স্থানান্তরে গমন না করিয়া, ব্রিটিশ সিংহের সহিত যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইবার মানসে রণসাজে সজ্জিত হইয়া আপন গৃহেই অবস্থিতি করিতে লাগিলেন।
এদিকে রাত্রি প্রভাত হইবার কিছু পূর্ব্বে, পূর্ব্বের বন্দোবস্ত অনুযায়ী ইংরাজ-সৈন্য সকল আপন আপন স্থান অধিকার করিল। অর্দ্ধ ঘণ্টা পরেই সেনাপতির বাড়ী হইতে বন্দুকের শব্দশ্রুত হইতে লাগিল। মধ্যে মধ্যে কামানের ধ্বনিতেও কর্ণ বধির করিতে লাগিল। সেই বাড়ীর ভিতর আক্রমণকারী ইংরাজ সৈন্য এবং লুক্কাইত মণিপুরী সৈন্য উভয়পক্ষে ভয়ানক যুদ্ধ আরম্ভ হইল, উভয়পক্ষ হইতেই যথেচ্ছা গুলিবর্ষণ হইতে লাগিল, উভয় পক্ষই হত ও আহত হইয়া সেই স্থানে পতিত হইতে লাগিল। এই যুদ্ধে প্রথমে মণিপুরী সৈন্য পরাজিত হইল; ইংরাজ-সৈন্যগণ সেনাপতিকে ধরিবার নিমিত্ত দ্রুতগতিতে ঘরের ভিতর প্রবেশ করিতে আরম্ভ করিল। এই সময় সেই দলের কর্তা লেফটেনেন্ট ব্রাকেনবরি সাংঘাতিক রূপে আহত হইয়া সেই স্থানে পতিত হইলেন। তিনি এরূপ আঘাত প্রাপ্ত হইয়াছিলেন যে, তাঁহাকে সেই স্থান হইতে ডুলি করিয়া রেসিডেন্সিতে লইয়া যাইবারকালীন পথিমধ্যে তাঁহার মৃত্যু হয়। আহত হইয়া ব্রাকেনবরি যেমন পড়িলেন অমনি একজন দেশীয় প্রধান কৰ্ম্মচারীও হত হইয়া সেই স্থানে শয়ন করিলেন। সৈন্যগণ তথাপি দ্রুতবেগে ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল; তখনও মনে আশা, সেনাপতিকে ধৃত করিয়া বাহাদুরি লইবে। কিন্তু ভিতরে গিয়া দেখিল, ঘর শূন্য— না আছেন সেনাপতি, না আছেন তাঁহার পরিবারবর্গ। তখন সকলেই বিবেচনা করিলেন যে, সেনাপতি রাজার বাড়ীতে আশ্রয় লইয়াছেন। কিন্তু সেইস্থানে তখন অবশিষ্ট যে সৈন্য আছে, তাহা লইয়া রাজবাড়ী অভিমুখে গমন করিতে হইলে একটি মাত্রও অবশিষ্ট থাকে কি না, সন্দেহ। সুতরাং আরও সৈন্যের সাহায্যের নিমিত্ত তাঁহাদিগকে সেই স্থানেই অপেক্ষা করিতে হইল। সেইস্থানে অপেক্ষা করিতে হইল বলিয়া যে তাঁহারা বিশ্রাম করিতে পাইলেন, তাহা নহে; চারিদিক হইতেই মণিপুরী সৈন্যের গুলি আসিয়া তাঁহাদিগের উপর পতিত হইতে লাগিল। ইংরাজ- সৈন্যও অবিশ্রান্ত গুলি চালাইতে চালাইতে বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরের উপর উঠিয়া সেই স্থান হইতে চতুৰ্দ্দিকে গুলিবর্ষণ আরম্ভ করিল।
কেহ কেহ বলেন, “২৩শে মার্চের শেষ রাত্রে ব্রিটিশ সৈন্য রাজবাড়ী প্রথমে আক্রমণ করেন। কেবল যে আক্রমণ, তাহা নহে; তাহাদের সেই ভীষণ অনির্দিষ্ট গুলিতে স্ত্রীলোক সকল হত হয়; বালক সকল মৃত হয়। হিন্দুর আরাধ্য গরু সকল সেই স্থানে গড়াগড়ি যায়। মন্দির সকল অপবিত্র, দেবমূর্ত্তি চূর্ণিকৃত, এবং গৃহ সকল অগ্নির দ্বারা ভস্মীভূত করিয়া দেয়।”*
[*Extract from a telegram from Baboo Janoki Nath Bysack to Lord Ripon, dated Manipur, June 26, 1891]
এই অবস্থা দেখিয়া কোন্ হিন্দুর হৃদয়ে শোক-দুঃখ উপস্থিত না হয়? কোন্ বীর-হৃদয় প্রাণের ভয়ে লুকাইত থাকিতে পারে? কোন্ হিন্দু এরূপ অবস্থায় আপনার ধর্ম্মের নিমিত্ত সামান্য প্রাণকে উৎসর্গীকৃত না করিতে পারে? টিকেন্দ্রজিৎ হিন্দু, ইংরাজ-সৈন্যের এই অবস্থা দেখিয়া তাঁহার হিন্দু প্রাণে বড়ই আঘাত লাগিল। তাঁহার জীবিতকালে তাহার সম্মুখে ঐ সকল দৃশ্য দর্শন তিনি কোন রূপেই সহ্য করিয়া উঠিতে পারিলেন না। জীবিত থাকিয়া ঐ সকল অবস্থা দর্শন করা অপেক্ষা, সেই স্থানে সম্মুখ-যুদ্ধে দেহ পতন করাই কৰ্ত্তব্য, ইহাই তিনি মনে মনে সাব্যস্ত করিলেন। কাজেই তখন টিকেন্দ্রজিৎ সমর প্রাঙ্গণে উপস্থিত হন, আপনার বীরত্বের সহিত ব্রিটীশ-সৈন্যের সম্মুখীন হইয়া রণমদে মত্ত হন। তখন উভয় পক্ষেই ভয়ানক যুদ্ধ হয়। উভয় পক্ষের অনেকেই কালগ্রাসে পতিত হয়।
[শ্রাবণ, ১৩১১]