চূৰ্ণ প্ৰতিমা
(বা, পাগলের অদ্ভুত পাগলামি।)
প্রথম পরিচ্ছেদ
রথযাত্রার পরদিন বেলা এগারটার সময়, আমার অফিস-ঘরে বসিয়া আছি, এমন সময়ে আমার উপরিতন কর্ম্মচারী সাহেব—একটি বাঙ্গালীবাবুকে লইয়া সেখানে উপস্থিত হইলেন। আমি তাড়াতাড়ি চেয়ার ছাড়িয়া দাঁড়াইয়া উঠিলাম।
আমার অফিস-ঘরটি নিতান্ত ছোট নয়। দৈর্ঘ্যে প্রায় বার হাত, প্রস্থেও আট হাতের কম নয়। ঘরটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। একটা টেবিল, তাহার চারিপার্শে খানকতক চেয়ার; দেওয়ালের নিকট দুইটি আলমারী, তাহার মধে! নানাপ্রকার পুস্তক ও অফিসের কাগজ-পত্র স্তরে স্তরে সজ্জিত।
বাঙ্গালীবাবুকে একখানি চেয়ারে বসিতে বলিয়া সাহেব আমার সম্মুখে আসিলেন এবং আমাকে বসিতে ইঙ্গিত করিয়া স্বয়ং একখানি চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন।
কিছুক্ষণ পরে সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি এই বাবুটিকে চেন?”
আমি বাবুর দিকে ভাল করিয়া চাহিলাম। দেখিলাম, তাঁহার দেহ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, হৃষ্টপুষ্ট ও বলিষ্ঠ; বয়স প্রায় চল্লিশ বৎসর, তাঁহার চক্ষুদ্বয় আয়ত, ভ্রু যুগ্ম। তাঁহার পরিধানে নরুনপেড়ে শান্তিপুরের একখানি পালা ধুতি, একটা চুড়ীদার পিরাণ, অতি সুন্দর তসরের চাদর, পায়ে কানপুরের জুতা। কিছুক্ষণ ভাল করিয়া দেখিয়াও আমি বাবুকে চিনিতে পারিলাম না। অপ্রতিভ হইয়া সাহেবকে বলিলাম, “না মহাশয়! আমি বাবুকে চিনিতে পারিতেছি না।”
সাহেব গম্ভীরভাবে বলিলেন, “ইঁহার নাম রায় পার্ব্বতীচরণ দেব—পূর্ব্ববঙ্গের একজন প্রসিদ্ধ জমীদার।”
আমি ইতিপূর্ব্বে তাঁহার নামও শুনি নাই, সাহেবকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এখানে থাকা হয় কোথায়?”
সাহেব ঈষৎ হাস্য করিয়া উত্তর করিলেন, “বাগবাজারে।”
আমি আগ্রহের সহিত জিজ্ঞাসা করিলাম, “এখানে আগমন কিসের জন্য?”
সাহেব বলিলেন, “বড় বিপদে পড়িয়াই উনি আমাদের এখানে আসিয়াছেন। সকল কথা ইঁহারই মুখে শুনিতে পাইবেন।”
আমার হাতে অনেক কাজ ছিল। সাহেব আবার একটা কাজ আমার ঘাড়ে চাপাইবার যোগাড় করিতেছেন দেখিয়া, আমি আন্তরিক দুঃখিত হইলাম; এবং কাষ্ঠহাসি হাসিয়া, মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে বলিলাম, “আমার হাতে যথেষ্ট কাজ আছে।”
সাহেব আমার মনোভাব বুঝিতে পারিলেন। হাসিতে হাসিতে উত্তর করিলেন, “তা আমি জানি। সেগুলি দুই চারিদিন দেরী হইলেও কোন ক্ষতি হইবে না। সকল কৰ্ম্ম ত্যাগ করিয়া, তুমি জমীদার মহাশয়ের কাজটা আগে শেষ কর। ব্যাপারটি নিতান্ত সহজ বলিয়া বোধ হয় না, সুতরাং এই কার্যের জন্য একটু বিশেষ পরিশ্রম করিবার প্রয়োজন।”
সাহেবের কথা শুনিয়া বলিলাম, “যে আজ্ঞা, তাহাই হইবে।”
সাহেবও আমার কথায় আনন্দিত হইয়া সেখান হইতে চলিয়া গেলেন।
পাৰ্ব্বতীবাবু এতক্ষণ আমার কাছে আসিবার জন্য চঞ্চল হইয়াছিলেন। তিনি আমার দিকে ঘন ঘন দৃষ্টিপাত করিতেছিলেন; কখন দাঁড়াইতেছিলেন, কখন বা বসিতেছিলেন, যেন কোন কথা বলিবার জন্য নিতান্ত ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন। কিন্তু এতক্ষণ আমাকে সাহেবের সহিত কথা কহিতে দেখিয়া, তিনি সাহস করিয়া আমার নিকটে আসিতে পারেন নাই।
সাহেব প্রস্থান করিবামাত্র পার্ব্বতীবাবু আমার নিকটে আসিলেন এবং আমার সম্মুখস্থ চেয়ারে বসিয়া কহিলেন, “অনেক আশা করিয়া আপনার নিকট আসিয়াছি। এখন আপনিই আমার ভরসা। স্থানীয় পুলিস ত একরকম হাল ছাড়িয়াই দিয়াছে।”
আমি ঈষৎ হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি কতদিন কলিকাতায় বার করিতেছেন?”
পাৰ্ব্বতীবাবু সসম্ভ্রমে উত্তর করিলেন, “অনেক দিন দশ বার বৎসর হইবে। আপনি আমায় না চিনিলেও আমি আপনাকে চিনি।”
আমি। আপনার কি হইয়াছে বলুন?
পাৰ্ব্বতীবাবু উত্তর করিলেন, “রথযাত্রা উপলক্ষে কাল বৈকালে পুত্র-কন্যাগণকে লইয়া কুমারটুলীর দিকে বেড়াইতে গিয়াছিলাম। পথে একটি কুমারের দোকানে কয়েকজন কারিগর বসিয়া মাটীর পুতুল গড়িতেছিল। আমার জ্যেষ্ঠ কন্যা সুহাসিনীর ইচ্ছা দোকানের ভিতর গিয়া পুতুলগুলি দেখিয়া আইসে; এবং এই অভিপ্রায়ে সে আমাকে বারম্বার অনুরোধ করিতে লাগিল। দুই একবার তাহার কথায় অস্বীকৃত হইলেও অপরাপর পুত্রকন্যাগণের ইচ্ছায় আমি গাড়ী থামাইতে বলিলাম এবং সকলে মিলিয়া দোকানের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দোকানদারও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে গেল। দোকানের ভিতর গিয়া দেখিলাম, পাঁচজন কারিগর নানা রকমের পুতুল গড়িতেছে। তাহাদের মধ্যে দুইজনকে ভাল কারিগর বলিয়া বোধ হইল। উভয়ের মধ্যে একজন কতকগুলি শিবমূর্ত্তি, অপর ব্যক্তি কতকগুলি শ্যামামূর্ত্তির গঠন করিতেছিল। সুহাসিনীর পুতুল গড়িবার বড় সখ। সে দোকানের ভিতর গিয়া একবার এদিক একবার ওদিক করিয়া বেড়াইতে লাগিল। তাহার সঙ্গে অন্যান্য বালক-বালিকাগণও অত্যন্ত আহ্লাদিত হইল। কিছুক্ষণ এইরূপ দেখিবার পর সুহাসিনীর গলার দিকে আমার নজর পড়িল। দেখিলাম, তাহার গলার জড়োয়া কণ্ঠির ধুকধুকিখানি নাই। ধুক্ধুকিখানি অত্যন্ত দামী। উহাতে একখানা বড় হীরা বাসন ছিল। সে রকম হীরা আজ-কাল পাওয়া দায়। আর যদিও পাওয়া যায়, তাহা হইলে তাহার দাম এখন দশ হাজার টাকার কম নহে। আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোর কণ্ঠির ধুকধুকিখানা কোথায় সুহাস?”
“সে কি! বলিয়া সুহাসিনী তাহার গলায় হাত দিল। দেখিল, সত্য সত্যই ধুকধুকিখানি নাই। তাহার হাসি হাসিমুখ তখনই মলিন হইয়া গেল। সে আর কোন কথা কহিতে পারিল না।
আমি মনে করিয়াছিলাম, সুহাসিনী হয়ত উহা বাড়ীতে রাখিয়া আসিয়াছে। কিন্তু বাস্তবিক তাহা নহে বুঝিতে পারিয়া আমারও অত্যন্ত ভাবনা হইল। ধুক্ককিখানির দাম পাঁচ হাজার টাকার কম নহে। আমি তখন সুহাসিনীর দিকে চাহিয়া অতি কর্কশভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম, “চুপ করিয়া রহিলি যে? কোন্ খানে লাফাইতেছিলি? কোথায় হেঁট হইয়াছিলি মনে কর। ও রকম হীরা আজকাল পাওয়া দায়।”
আমায় রাগান্বিত দেখিয়া সুহাসিনী আরও ভীত হইল। ইচ্ছা থাকিলেও সে কোন কথা বলিতে পারিল না। সুহাস আমার বড় আদুরে মেয়ে। আমি তাহাকে আর কখনও তিরস্কার করি নাই। আমার ধমকে সে কাঁদিয়া ফেলিল; কিন্তু তাহার ক্রন্দনে কোনরূপ শব্দ হইল না—সে নীরবে অধোমুখে অশ্রু বিসর্জ্জন করিতে লাগিল। আমি তখন তাহাকে আর কোন কথা না বলিয়া, দোকান-ঘরটি পাঁতি পাঁতি করিয়া অন্বেষণ করিলাম। দোকানদার স্বয়ং আমার কার্য্যে যথেষ্ট সাহায্য করিল। কারিগরগণও সকলে চারিদিক দেখিতে লাগিল। অতি অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘরটি তোলপাড় করা গেল। কিন্তু বাহিরের কোন লোককে ভিতরে আসিতে দেওয়া হইল না।
এইরূপে প্রায় আধঘণ্টা অন্বেষণের পর আমি ধুকধুকিখানি দেখিতে পাইলাম। দেখিলাম একটা চৌকির পায়ার কাছে উহা পড়িয়া রহিয়াছে। আমি শশব্যস্তে উহাকে তুলিয়া লইলাম। মনে করিয়াছিলাম, আমাদের পরিশ্রম সফল হইল। কিন্তু না, তাহা হইল না! জগদীশ্বরের সেরূপ ইচ্ছা নহে। ধুধুকিখানি পাইলাম বটে, কিন্তু উহার মধ্যস্থ হীরাখানি দেখিতে পাইলাম না। তখন আবার সকলে মিলিয়া ভাল করিয়া চারিদিক দেখিতে লাগলাম, কিন্তু কিছুতেই হীরাখানিকে বাহির করিতে পারিলাম না।
ক্রমে সন্ধ্যা হইল। ঘরে ঘরে আলোক জ্বলিল, দোকানদার ঘর হইতে বাহিরে যাইবার উদ্যোগ করিল। আমি তাহাকে বাধা দিয়া বলিলাম, “কোথায় যাইতেছ বাপু?”
দোকানদার সসম্ভ্রমে উত্তর করিল, “ঘরের আলো আনিতে যাইতেছি। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে, সকল ঘরে আলো জ্বালা হইয়াছে, কেবল আমার দোকানে এখনও ধূনা গঙ্গাজল দেওয়া হইল না।”
আ। আমি তাহার বন্দোবস্ত করিতেছি। এখন এঘর হইতে কাহাকেও বাহির হইতে দিব না। যখন আমার পাঁচ হাজার টাকার জিনিষ হারাইয়াছে, তখন আমি সহজে ছাড়িব না, এখনই পুলিসে খবর দিব। পুলিস আসিয়া যাহা ইচ্ছা করুক।
দো। স্বচ্ছন্দে –– আমি তাহাতে কিছুমাত্র ভীত নহি। আর যখন এই ঘরের মধ্যেই আপনার দামী হীরাখানি হারাইয়া গিয়াছে, তখন আপনিই বা সহজে ছাড়িবেন কেন? কিন্তু হয় আগে আমার দোকানে আলোকের বন্দোবস্ত করুন, না হয় পাঁচ মিনিটের জন্য আমায় ছাড়িয়া দিন, আমিই আলোক আনি।
আ। বাপু! আমি এখন কাহাকেও এ ঘর হইতে ছাড়িতে পারিব না। তুমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর, আমি তোমার দোকানে আলোক দিতেছি।
দোকানদার আর কোন কথা কহিল না। আমি তখন সহিসকে ডাকিলাম এবং গাড়ী হইতে একটা লণ্ঠন আনিতে আদেশ করিলাম।
লণ্ঠনটি আনীত হইলে আমি সহিসকে উহা জ্বালিতে বলিলাম। তাহার পর কোচমানকে ডাকিয়া বলিলাম, “গাড়ী লইয়া শীঘ্র থানায় যাও। ইন্সপেক্টারবাবুকে আমার নমস্কার জানাইয়া এই গাড়ীতে লইয়া আইস। আমিই যাইতাম, কিন্তু আমি না থাকিলে হীরাখানি আর পাওয়া যাইবে না।”
“যো হুকুম মহারাজ!” এই বলিয়া কোচমান গাড়ীর অপর লণ্ঠনটি জ্বালিয়া ফেলিল এবং তৎক্ষণাৎ গাড়ী থানার দিকে লইয়া গেল।
আধ ঘণ্টার মধ্যেই ইন্সপেক্টারবাবু দুইজন কনষ্টেবল লইয়া তথায় উপস্থিত হইলেন এবং আমার মুখে সমস্ত কথা শুনিয়া কনষ্টেবল দুইজনকে ঘরটি আবার ভাল করিয়া অন্বেষণ করিতে আদেশ করিলেন।
ইন্সপেক্টারবাবুর সহিত আমার অনেক দিনের আলাপ। আমাদের উভয়ের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব ছিল। আমায় বিমর্য দেখিয়া তিনি বলিলেন, “পাৰ্ব্বর্তীবাবু! আপনার কোন চিন্তা নাই। যখন বুকধুকিখানি এই ঘরে পাওয়া গিয়াছে, তখন হীরাখানিও এখানে আছে।”
আমি অতি বিমর্ষভাবে উত্তর করিলাম, “আপনার কথাই যেন সত্য হয়। কিন্তু আমরা সকলে মিলিয়া এই ঘরটি তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিয়াছি।”
ইনস্পেক্টারবাবু অনেক দিন পুলিসের চাকরি করিতেছেন। অনেক কার্য্যে সুখ্যাতি লাভ করিয়াছেন। তাঁহার মনে মনে কেমন এক প্রকার অহঙ্কার জন্মিয়াছিল। তিনি আমার কথায় হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “পুলিসের লোকে আর সাধারণ লোকে অনেক প্রভেদ। আপনার কোন চিন্তা নাই; দেখুন না, আমি এখনই আপনার হীরা বাহির করিয়া দিতেছি।”
আমি কোন উত্তর করিলাম না, চুপ করিয়া বসিয়া কনষ্টেবলদ্বয়ের কার্য্য দেখিতে লাগিলাম। রাত্রি সাড়ে আটটা বাজিয়া গেল, তখনও হীরা বাহির হইল না। যত সময় যাইতে লাগিল, ইনস্পেক্টরবাবু ততই গম্ভীর হইতে লাগিলেন। শেষে আর স্থির থাকিতে না পারিয়া স্বয়ং অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলেন।
আরও আধ ঘণ্টা কাটিয়া গেল। রাত্রি নয়টা বাজিল, কিন্তু কোথাও সেই হীরা পাওয়া গেল না। কনষ্টেবলদ্বয় হতাশ হইয়া একস্থানে দাঁড়াইয়া রহিল। আমি ইনস্পেক্টারের দিকে দৃষ্টিপাত করিলাম। দেখিলাম, তিনিও গম্ভীরভাবে একটা বেতের মোড়ার উপর বসিয়া কি চিন্তা করিতেছেন। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “এখন কি করা যায়?”
আমার প্রশ্ন শুনিয়া তিনি আমার দিকে চাহিলেন। বলিলেন, “এই ছোট ঘরের মধ্যে ধুকধুকিখানি পাওয়া গেল, অথচ উহার মধ্যস্থ হীরাখানি পাওয়া গেল না; এ বড় আশ্চর্য্যের কথা! আপনি এ দোকানে কখন আসিয়াছিলেন?”
আ। বেলা পাঁচটার পর।
ই। কখন ধুকধুকিখানি হারাইয়াছিল?
আ। কখন হারাইয়াছিল, ঠিক বলিতে পারি না, তবে আমি যখন জানিতে পারি, তখন বেলা প্রায় ছয়টা।
ই। দোকানে কয়জন লোক ছিল?
আ। পাঁচজন কারিগর আর স্বয়ং দোকানদার।
ই। এখনও কি সে সকল লোক আছে?
আ। আজ্ঞা হাঁ।
ই। ইহার মধ্যে কোন লোক এই ঘরের বাহির হইয়াছিল?
আ। না। আমি আগেই সে বিষয়ে সাবধান হইয়াছিলাম। এমন কি, দোকানদারকে এ ঘরের আলোক পর্যন্ত আনিতে দিই নাই।
ই। ভালই করিয়াছেন।
এই বলিয়া ইনস্পেক্টারবাবু দোকানদারকে নিকটে ডাকিলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার নাম কি বাপু?” দোকানদার নির্ভয়ে উত্তর করিল, “আমার নাম নফর।”
ই। নফর কি? তোমার পদবী কি?
ন। নফরচন্দ্র পাল।
ই। কতদিন এ কাজ করিতেছ?
ন। জন্মাবধি। আমার বয়স যখন বার বৎসর, তখন আমার পিতা মারা যান। সেই সময় হইতেই আমি এই দোকান চালাইয়া আসিতেছি।
ই। তোমার কারিগর কয়জন?
ন। এই পাঁচজন।
ই। ইহারা মাহিনা হিসাবে কাজ করে, না ফুরণে কাজ করিয়া থাকে?
ন। আজ্ঞা, সকলেই আমার মাহিনা খায়।
ই। ইহারা লোক কেমন?
ন। এ পর্যন্ত কোন দোষ দেখিতে পাই নাই।
ই। ইহারা কতদিন তোমার কাছে চাকরি করিতেছে?
ন। সকলে এক সময় হইতে চাকরি করিতেছে না বটে, কিন্তু ইহারা সকলেই পাঁচ বৎসরের অধিক এখানে কাজ করিতেছে।
“আমি সকলকেই ভাল করিয়া পরীক্ষা করিতে চাই।”
এই বলিয়া ইনস্পেক্টারবাবু কনষ্টেবল দুইজনকে ইঙ্গিত করিলেন। তাহারা এক একজন কারিগরের কাছে গিয়া রীতিমত কাপড় ঝাড়া লইতে লাগিল।
আরও আধ ঘণ্টা এইরূপে কাটিয়া গেল। রাত্রি দশটা বাজিল। সকলকেই বিশেষ করিয়া পরীক্ষা করা হইল, কিন্তু কাহারও নিকট হইতে হীরা বাহির হইল না। তখন ইনস্পেক্টরবাবু বলিয়া উঠিলেন, “এখন এই ছয়জনকেই থানায় লইয়া যাওয়া যাউক। সেখানে যাইলে অতি সহজেই সকল কথা বাহির হইয়া পড়িবে।”
ইনস্পেক্টারবাবুর কথা শুনিয়া একজন কনষ্টেবল তখনই একখানি গাড়ী ডাকিয়া আনিল, এবং তাহাতে সকলকে তুলিয়া দিয়া থানায় লইয়া গেল। দুইজন কনষ্টেবল গাড়ীর উপরে বসিল।
আমিও ইনস্পেক্টারবাবুর সহিত থানায় গেলাম ও পরিশেষে আপন বাসার প্রত্যাগমন করিলাম।
আজ প্রাতে সংবাদ পাইলাম, অনেক উৎপীড়ন করা হইলেও কোন লোক সেই হীরার কোন সন্ধান বলিতে পারে নাই। এখন আপনিই আমার একমাত্র ভরসা। আশা করি, আপনিই আমায় এই বিপদ হইতে উদ্ধার করিবেন।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
জমীদার মহাশয়ের কথা শুনিয়া বুঝিলাম, ব্যাপার নিতান্ত সহজ নয়। সাহেব যে কেন আমার উপর এই কার্য্যের ভার দিয়াছেন, তাহাও জানিতে পারিলাম। কিছুকাল চিন্তা করিয়া আমি পাৰ্ব্বর্তীবাবুকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনারা যতক্ষণ সেই দোকানে ছিলেন, ততক্ষণ আর কোন লোক সেখানে গিয়াছিল?”
পাৰ্ব্বর্তীবাবু উত্তর করিলেন, “আজ্ঞা না।”
আ। আপনি যখন ঘরটি ভাল করিয়া পরীক্ষা করিয়াছেন, তখন আপনি ঘরটির কথা ভাল রকমই জানেন। বলিতে পারেন, সে ঘরের কয়টি দরজা?
পা। আজ্ঞা, পারি বই কি। দরজা একটি।
আ। জানালা?
পা। দুইটি?
আ। জানালা দুইটির কাছে কোন কোন কারিগর বসিয়া ছিল আপনার মনে আছে?
পা। ঘরের যে দিকে জানালা আছে, সে দিকে কোন কারিগর বসে নাই। জানালা দুইটির কাছে বসিবার জায়গাও নাই।
আ। আপনারা যখন হীরক অন্বেষণে বড় ব্যস্ত ছিলেন, তখন হয়ত কোন লোক দোকানে প্রবেশ করিয়াছিল, নতুবা হীরাখানি গেল কোথায়?
পা। আজ্ঞা না, বাহিরের কোন লোক ভিতরে আসিতে কিম্বা ভিতরের কোন লোক বাহিরে যাইতে পারে নাই। আমি সেদিকে বড় সতর্ক ছিলাম।
আ। পুলিস কি বলেন?
পা। পুলিস বলেন, হীরাখানি আর কোথাও পড়িয়া গিয়াছে।
আ। ধুন্ধুকিখানি যখন ঘরের ভিতর পড়িয়াছিল, তখন হীরাও সেইখানে পড়িয়াছে। তবে যদি হীরাখানি ধুকধুকির সহিত ভাল করিয়া বসান না থাকে, তাহা হইলে স্বতন্ত্র কথা।
পা। আমার বোধ হয়, হীরাখানি ধুকধুকির সহিত ভাল রকমই জোড়া ছিল।
আ। কেমন করিয়া জানিতে পারিলেন?
পা। হীরকখানি যাচাইবার জন্য আমি একদিন উহাকে ধুকধুকি হইতে খুলিতে চেষ্টা করিয়াছিলাম, কিন্তু কৃতকাৰ্য হইতে পারি নাই। সেই জন্য বলিতেছি যে, উহা ভাল করিয়াই জোড়া ছিল।
আ। এ কথা আপনি পুলিসে বলিয়াছিলেন?
পা। আজ্ঞা হাঁ।
আ। পুলিস কি বলিলেন?
পা। আমার কথা বোধ হয় বিশ্বাস করিলেন না, তাঁহাদের নিজের মতই বজায় রাখিলেন।
আ। কারিগর পাঁচজন আর দোকানদারের কি হইল?
পা। মুক্তি পাইয়াছে।
আ। কেন? এরই মধ্যে মুক্তি কেন?
পা। ইনস্পেক্টার মহাশয় বলিলেন যে, যখন তাহাদের কাছে চোরাই মাল কিম্বা তাহার কোন রকম নিদর্শন পাওয়া গেল না, তখন তিনি তাহাদিগকে আর গ্রেপ্তার রাখিতে পারেন না।
আ। তিনি আইনসঙ্গত কথাই বলিয়াছেন।
পা। এখন উপায়?
আ। উপায় অবশ্যই আছে।
আমার আশ্বাস-বাক্যে পার্ব্বতীচরণ আন্তরিক সন্তুষ্ট হইলেন। বলিলেন, যদি আপনি আমার হীরাখানি বাহির করিয়া দিতে পারেন, তাহা হইলে আমি চিরকালের জন্য আপনার নিকট কৃতজ্ঞ থাকিব।
আমি বলিলাম, “আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করিব, ফল ঈশ্বরের হাতে।”
কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞাসা করিলাম, “পার্ব্বতীবাবু! আপনার কয়টি সন্তান?”
পা। পাঁচটি;- দুই কন্যা, তিন পুত্র।
আ। জ্যেষ্ঠ কন্যারই নাম সুহাসিনী?
পা। আজ্ঞা হাঁ।
আ। বহার বয়স কত?
পা। নয় বৎসর।
আ। সুহাসিনীর নিকট হইতে ত হীরাখানি হারাইয়াছে?
পা। আজ্ঞা হাঁ।
আ। সেই দোকানদারের সহিত আজ আর দেখা করিয়াছিলেন?
পা। আজ্ঞা না। তাহাদের মুক্তির কথা শুনিয়া আমার মন এত খারাপ হইয়াছিল যে, আমি সেই সংবাদ পাইবামাত্র আপনার সাহেবের সহিত দেখা করিবার জন্য বাড়ী হইতে বাহির হই।
ঠিক এই সময় ঘড়ীতে দুইটা বাজিল। পার্ব্বতীচরণ চমকিত হইলেন। বলিলেন, “এত বেলা হইয়াছে,– তবে আজ চলিলাম; কিন্তু আমার মন আপনার নিকট পড়িয়া রহিল, আবার করে আপনার সহিত দেখা করিব বলিয়া দিন?”
আমি ঈযৎ হাসিয়া উত্তর করিলাম, “আপনার আর এখানে আসিবার দরকার নাই। কিছু জানিতে পারিলে আমি নিজেই আপনার বাড়ী যাইব।”
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
পরদিন বেলা আটটার পর আমি বাড়ী হইতে বাহির হইলাম এবং একখানি সেকেণ্ড ক্লাশ ভাড়াটীয়া গাড়ীতে উঠিয়া কোচমানকে কুমারটুলি যাইতে হুকুম করিলাম।
আধ ঘণ্টার মধ্যেই আমি কুমারটুলিতে উপস্থিত হইলাম। নফরের দোকান খুঁজিয়া লইতে অধিক বিলম্ব হইল না। সে তাঞ্চলে নফরের মত কারিগর অতি অল্পই ছিল, সুতরাং নফরের নামডাক যথেষ্ট।
নফরের দোকানের সম্মুখেই আমার গাড়ী থামাইতে বলিলাম। গাড়ী থামিলে, নামিয়া কোচমানকে ভাড়া ঢুকাইয়া দিলাম। কোচমান আশার অধিক অর্থ পাইয়া হাসিমুখে সেলাম করিয়া বিদায় হইল।
শশব্যস্তে একজন লোক দোকানের ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিল। বলিল, “কি চান্ মশায়? ভিতরে আসুন না।”
লোকটাকে দেখিয়া বোধ হইল, তাহারই নাম নফর। তাহাকে দেখিতে কৃষ্ণবর্ণ, স্থূল, নাতিদীর্ঘ নাতিখর্ব্ব। তাহার বয়স প্রায় পঞ্চাশ বৎসর। অতি শিষ্ট শান্ত; একজন পাকা দোকানদার।
ঘরের ভিতরে চারিজন লোক মাটীর পুতুল গড়িতেছে। সকলেই কাজে ব্যস্ত। সম্মুখে এক একটা মাটীমাখান ছোট চৌকি। চৌকির উপর এক এক তাল কাল মাটী ও কতকগুলি করিয়া ছাঁচ, একটা হাঁড়ীতে খানিক কাদাগোলা জল ছিল।
আমি সেই লোকের মিষ্টকথায় পরিতুষ্ট হইলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, “এইটি কি নফরের দোকান?”
লোকটা একে আমায় গাড়ী হইতে নামিতে দেখিয়াছে, তাহার উপর আমার পরিচ্ছদ নিতান্ত সামান্য ছিল না। নফরের সহিত দেখা করিব বলিয়াই আমি বাবু সাজিয়া গিয়াছি। লোকটা যখন শুনিল, আমি নফরের দোকান খুঁজিতেছি, তখন সে এক গাল হাসিয়া বলিল, “আজ্ঞা হাঁ, এইটিই এই অধীনের দোকান। আমারই নাম নফর।”
আগেই বলিয়াছি যে, আমিও সেইরূপ ভাবিয়াছিলাম। বলিলাম, “তোমারই নাম নফর? তুমি নাকি খুব ভাল পুতুল গড়িতে পার? শুনিয়াছি, এ অঞ্চলে তোমার মত কারিগর আর নাই।”
এইরূপ প্রশংসাবাদ শুনিয়া নফর আন্তরিক সন্তুষ্ট হইল। বলিল, “আপনি ভিতরে আসিয়া দেখুন। দোষ গুণ নিজেই বিচার করিবেন।”
আমার উদ্দেশ্যও সেইরূপ ছিল। নফরের সঙ্গে তাঁহার দোকানের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম ঘরের একটা কোণে আর একখানি চৌকি রহিয়াছে; কিন্তু সেখানে কোন লোক নাই।
নফর আমাকে আর একটা ঘরে লইয়া গেল। দেখিলাম, সেখানে একটি কাচের আলমারির মধ্যে নানারকমের ভাল ভাল পুতুল সাজান রহিয়াছে। প্রায় আধ ঘণ্টাকাল পুতুলগুলি অতি মনোযোগের সহিত দেখিলাম, যতবার দেখি, আশ যেন আর মেটে না। যে পুতুলের দিকে চাই, চক্ষু যেন আর নাড়িতে ইচ্ছা করে না। শুনিলাম, পুতুলগুলি কাঁচা মাটীর। কাঁচা মাটীর উপর তেমন সুন্দর রং আর কখনও দেখি নাই। নফরে কাজ দেখিয়া তাহার সুখ্যাতি না করিয়া থাকিতে পারিলাম না। বলিলাম, “এই সকল পুতুল কি তুমি নিজে গড়িয়াছ?”
নফর হাসিতে হাসিতে উত্তর করিল, “আজ্ঞা না—ইহার কোন পুতুলই আমার হাতে গড়া নয়। আমি এইগুলির ছাঁচ প্রস্তুত করিয়াছি। আমার কারিগরেরা সেই ছাঁচের সাহায্যে পুতুল গড়িয়া থাকে।”
আমি বলিলাম, “পুতুলগুলি অতি সুন্দর। কৃষ্ণনগরের কারিগর ভিন্ন এরূপ মাটীর পুতুল আর কেহই গড়িতে পারে না। এমন চমৎকার রং ফলান আর কখনও দেখি নাই।”
আরও কিছুক্ষণ সেই ঘরে থাকিয়া আমরা বাহিরের ঘরে আসিলাম। দেখিলাম, দুইখানি তক্তার উপর কতকগুলি পুতুল রহিয়াছে। নিকটে গিয়া দেখিলাম, একখানি তক্তায় পাঁচটি শিবমূর্তি, অপর তক্তাখানিতে ছয়টি শ্যামামূৰ্ত্তি। যে চারিজন লোক কাজ করিতেছিল, তাহাদের মধ্যে একজন আর একটি শিব গড়িতেছে। অপর তিনজন অন্য পুতুল গঠন করিতেছে।
অনেক রকম শ্যামামূর্তি এই কলিকাতা সহরে দেখিয়াছি। কলিকাতা ভিন্ন অপরাপর স্থানের শ্যামামূর্তিও আমি অনেক দেখিয়াছি, কিন্তু সেই ক্ষুদ্র প্রতিমার মত সৰ্ব্বাঙ্গসুন্দর প্রতিমূর্ত্তি আর কোথাও আমার দৃষ্টিগোচর হয় নাই।
আমি নফরকে সেগুলি দেখাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “ঐ প্রতিমাগুলির দাম কত?”
আগেই বলিয়াছি যে, নফর একজন পাকা দোকানদার। সে দেখিল যে, কালীর প্রতিমাগুলি আমার মনোমত হইয়াছে। তাই বলিল, “আজ্ঞে বেশী নয়—পাঁচ টাকা।”
আ। আর ঐ শিবের মূর্তিগুলি?
ন। আজ্ঞে একই দর।
আ। মাটীর পুতুলের এত দর? প্রতিমাগুলি আট ইঞ্চির অধিক বড় নয়। আর যখন ইহা ছাঁচে প্ৰস্তুত হয়, তখন এত দরই বা কেন?
ন। আজ্ঞে বড় পরিশ্রম। একটা লোকে চারিদিনের কমে একখানা প্রতিমা গড়িতে পারে না।
আ। এত দরের মাটির পুতুল কয়জনে কিনিতে পারে?
ন। আজ্ঞে, আপনার আশীর্ব্বাদে আমি যোগাইতে পারি না।
আ। পাঁচ টাকা করিয়াই বেচিয়া থাক?
ন। আজ্ঞে না— আর মিথ্যা বলিব না। পাঁচ টাকা জোড়া।
আ। তবে আমায় এক জোড়া দাও।
ন। আপনাকে কিছু বেশী দিতে হইবে।
আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কেন বাপু! আমার অপরাধ কি?”
আমার কথা শুনিয়া নফর হাসিতে হাসিতে বলিল, “আগে ঐ দরে পুতুলগুলি বিক্রয় করিয়াছি বটে, কিন্তু এখন আর করিতে পারিব না।”
আ। কেন?
ন। আমার একটি কারিগর উন্মাদ হইয়া গিয়াছে। সেই লোকটাই আমার ভাল কারিগর ছিল। ঐ দেখুন না, তাহার চৌকিখানি খালি পড়িয়া রহিয়াছে।
আ। সেই লোকই বুঝি ঐ শ্যামা-প্রতিমাগুলি গড়িয়াছিল?
ন। আজ্ঞা হাঁ!
আ। লোকটা হঠাৎ পাগল হইয়া গেল?
ন। আজ্ঞে হাঁ।
আ। কোন কারণ জানিতে পারিয়াছ?
ন। কই না। তবে বিনা কারণে তাহাকে একদিন হাজতে থাকিতে হইয়াছিল বলিয়াই বোধ হয়, সে পাগল হইয়া গিয়াছে।
আ। সে কি! হাজত হইল কেন?
ন। রথযাত্রার দিন একটি বাবু আমার দোকানে আসিয়াছিলেন। তাঁহার এক কন্যার গলায় একখানি হীরা ছিল। সেই হীরাখানি এই দোকানেই হারাইয়া যায়। অনেক খোঁজ করা হইলেও আমরা কেহই উহা বাহির করিতে পারি নাই। বাবু শেষে আমাদিগকে সন্দেহ করিয়া আমাকে ও আমার পাঁচজন কারিগরকে পুলিসে পাঠাইয়া দেন। সেখানে আমরা নির্দোষী বলিয়া সাব্যস্ত হইলে মুক্তিলাভ করি। আমার বোধ হয়, এইজন্যই লোকটা পাগল হইয়া গিয়াছে।
আ। লোকটার নাম কি?
ন। জহরলাল দে।
আ। বাড়ী কোথায়?
ন। সিকদের পাড়া।
আ। পুলিস হইতে ছাড় পাইয়া কি জহর এখানে আসিয়াছিল?
ন। আজ্ঞে না।
আ। তবে তুমি কেমন করিয়া জানিলে যে, সে পাগল হইয়াছে?
ন। আমি তাহাকে দেখিতে গিয়াছিলাম।
আ। কেন?
ন। যে দিন আমরা পুলিস হইতে মুক্তি পাই, জহর সেই দিন এখানে কাজ করিতে আইসে নাই। বাড়ীতে আসিবার সময় আমি জহরকে আহারাদির পর এখানে আসিতে বারম্বার বলিয়া দিয়াছিলাম। যখন সে তাহা করে নাই, তখন আমি ভাবিলাম যে, তাহার নিশ্চয়ই অসুখ করিয়া থাকিবে। এই জন্যই তাহাকে দেখিতে গিয়াছিলাম।
আ। সেখানে গিয়া কি দেখিলে?
ন। দেখিলাম, চিহ্ন সেই অল্প সময়ের মধ্যে উন্মাদ পাগল হইয়া গিয়াছে। জহরের বৃদ্ধ পিতা এখনও বৰ্ত্তমান। তিনি বলিলেন, জহর বাড়ীতে আসিয়া, নিজের ঘরে বসিয়া আপনাআপনি কি বকিতেছিল। তিনি তাহাকে স্নানাহারের কথা বলিলে পর জহর ভয়ানক হাস্য করিতে লাগিল। অনেকক্ষণ হাসিয়া জহর দাঁড়াইয়া উঠে এবং বেগে তাহার পিতার নিকট আসিয়া তাঁহাকে আক্রমণ করে। এখনও বৃদ্ধের হাতে, মুখে ও বুকে অনেক দাগ দেখিতে পাওয়া যায়। অনেক কষ্টে অব্যাহতি পাইয়া বৃদ্ধ কতকগুলি প্রতিবেশীর সাহায্যে জহরের হাতে হাতকড়ি দিতে পারিয়াছেন।
আ। জহর এত শীঘ্র পাগল হইয়া গেল কেন, জান?
ন। আজ্ঞে না, সে কথা বলিতে পারিলাম না, কিন্তু জহর পাগল হওয়ায় আমার যথেষ্ট ক্ষতি হইল।
আ। কেন? আর একজনকে শিখাইয়া লইতে পার। জহরকে শিখাইয়াছিল কে?
ন। আজ্ঞে
আমি।
আ। তবে আর ভাবনা কিসের?
ন। জহর একদিনে ভাল কারিগর হয় নাই। একটা লোককে ক্রমাগত দশ বৎসর শিখাইলেও জহরের মত কারিগর হইতে পারে কি না বলা যায় না। মনে করিবেন না, আমাদের কার্য্য অতি সহজ।
আ। যতদিন না আর কোন লোক শিক্ষিত হয়, ততদিন তুমি স্বয়ং ওগুলি গড়িবে। ঐ পুতুলগুলির কাটূতি কেমন? না। যথেষ্ট। এত বেশী যে, আমি গড়িয়া দোকানে রাখিবার সুযোগ পাইতেছি না। গঠনের আগেই লোকে মূল্য দিয়া যান। পুতুল প্ৰস্তুত হইলে আমি পাঠাইয়া দিয়া থাকি।
আ। তবে কি ঐ সমস্ত পুতুলেরই মূল্য পাইয়াছ?
ন। উহাদের মধ্যে পাঁচ জোড়ার ফরমাইস্ দেওয়া আছে।
আ। এক জোড়া বেশী গড়িলে কেন?
ন। ছয় জোড়া করিয়া গড়িলে পরিশ্রমের কিছু লাঘব হয়। আর দোকানে রাখিতে না রাখিতে উহাও বিক্রয় হইয়া যাইবে।
আ। ও জোড়াটি আমিই লইব। এখন আমায় কত দিতে হইবে বলিয়া দাও!
ন। আপনার বিবেচনায় যাহা হয় তাহাই দিবেন। আপনি এখন আমার সকল কথাই শুনিয়াছেন; আপনার যাহাতে ভাল হয় তাহাই করুন।
আ। যে পাঁচ জোড়া ফরমাইস মত গড়িয়াছ, সেগুলির কত করিয়া মূল্য লইয়াছ?
নফর হাসিতে হাসিতে বলিল, “প্রতি জোড়া পাঁচ টাকা। আগে আমি জানিতাম না যে, জহর পাগল হইয়া যাইবে।”
আ। যখন তুমি ঐ রকম পুতুল গড়িতে পার, তখন তোমার মূল্য বৃদ্ধি করিবার কোন কারণ দেখিতেছি না। ন। প্রায় পাঁচ বৎসর হইল, জহর ঐ কার্য্য করিতেছে। যে অবধি জহর ঐ কাজ ভাল রকম করিতে শিখিয়াছে, সেই অবধি আমি আর পুতুল গড়ি না। যতই ভাল কারিগর হউক না কেন, পাঁচ বৎসর অভ্যাস না থাকিলে কোন কাৰ্য্যই মনোমত হয় না। আমারও সেই দশা। আমি এখন সাহস করিয়া বলিতে পারি না যে, আমার গড়া শ্যামা প্রতিমা ঠিক জহরে মত হইবে। বলিতে কি, জহরের এই ছয়টি পুতুল যত সুন্দর হইয়াছে, আগেকারগুলি তত নহে।
আ। ভাল, আর এক টাকা অধিক দিব—ছয় টাকা পাইবে।
নফর আর কোন কথা কহিল না। তখনই সেই তক্তাগুলির কাছে গেল ও একখানি শিব ও একখানি কালী প্রতিমা তুলিয়া লইয়া আমার নিকট ফিরিয়া আসিল।
আমি দুই প্রতিমা দুই হস্তে গ্রহণ করিয়া উত্তমরূপে নিরীক্ষণ করিলাম। দেখিলাম, অতি সুন্দর। ইহা সাধকের কল্পনার ধন, বালকের মনভুলান খেলনা, রমণীর গৃহসজ্জার প্রধান উপকরণ, ধার্ম্মিকের প্রাণের সামগ্রী। গঠন অতি চমৎকার। বর্ণের মাধুরী ও লাবণ্য তদ্রূপ হৃদয়গ্রাহী।
দেখা হইলে প্রতিমা দুইখানি নফরের হাতে ফিরিয়া দিলাম। বলিলাম, “শ্যামার পদতলে মহাদেবের মস্তকে দুইটা সাপ কেন? তোমার সমস্ত কালীপ্রতিমাতেই কি এইরূপ আছে?”
নফর অতি বিনীতভাবে উত্তর করিল, “আজ্ঞে না। যে পাঁচজন এই পাঁচ জোড়া পুতুলের ফরমাইস দিয়াছেন, তাঁহারা পরস্পর বন্ধু। তাঁহাদের হুকুম মত মহাদেবের মাথায় দুইটা সাপ দেওয়া হইয়াছে। আর যখন ছয়টি একসঙ্গে গড়া হইয়াছিল, তখন এটাও অন্য পাঁচটার মত হইয়াছে। আমার আগেকার পুতুলগুলির দুইটা করিয়া সাপ দেওয়া হয় নাই। আমার বোধ হয়, দুইটা সাপ দেওয়ায় এগুলি দেখিতে আরও সুন্দর হইয়াছে।”
আমি কোন উত্তর করিলাম না। নফর তখন একজন কারিগরকে ডাকিয়া পুতুল দুইটি ভাল করিয়া বাঁধিয়া দিতে বলিল। সে হাত পরিষ্কার করিয়া নফরের হাত হইতে পুতুল দুইটি লইল, এবং দেবদারু কাষ্ঠের একটি ক্ষুদ্র বাক্সমধ্যে রাখিল। পরে বাক্সটি বন্ধ করিয়া একখানি মোটা কাগজে মুড়িয়া আমার হস্তে দিল। আমিও নফরের হাতে মূল্য দিয়া সেখান হইতে প্রস্থান করিলাম।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
বাসায় গিয়া পুতুল দুইটি নিজের শোবার ঘরে রাখিলাম। যেখানে থাকিলে প্রাতে শয্যা হইতে উঠিবার সময় প্রতিমাগুলিকে দেখিতে পাওয়া যাইবে, শ্যামা ও শিবমূর্ত্তিকে ঘরের সেইখানেই রাখা হইল। বাড়ীর সকলে সে প্রতিমা দুখানি দেখিয়া যৎপরোনাস্তি আহ্লাদিত হইয়াছিল।
বেলা দুইটার পর আমি আফিসে যাইলাম। সেখানে সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করিলাম। দীর্ঘ শ্মশ্রু, সুদীর্ঘ জটা, খালি পা, গায়ে ভস্মরাশি, হাতে ও গলায় রুদ্রাক্ষের মালা।
এইরূপে ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া ঠিক, সন্ধ্যার পর আমি সিকদার পাড়ায় হাজির হইলাম। গলিতে প্রবেশ করিয়া তিন চারিখানি বাড়ী পার হইয়া, একখানি মুদির দোকান দেখিতে পাইলাম। হিন্দুস্থানী ভাষায় কথাবার্তা কহা আমার খুব অভ্যাস আছে। আমি মুদীর সম্মুখে হিন্দীতে নানা রকম অনেক দেব-দেবীর নাম উচ্চারণ করিয়া, কবিতা পাঠ করিয়া তাহার মন আকর্ষণ করিলাম। মুদী ভক্তি করিয়া আমায় একটা পয়সা দিতে আসিল আমি, উহা লইলাম না—- কহিলাম, আমি কাহারও দান গ্রহণ করি না। এই কথায় আমার উপর মুদীর আরও ভক্তি হইল। কিছুক্ষণ পরে সে জিজ্ঞাসা করিল, “ঠাকুরজী! আমায় হাঁপানির একটা ওষুধ দিতে পারেন?”
আমি বলিলাম, “হাঁপানি এক রকম নয়। অনেক রকমের হাঁপানি আছে। সকল রকমের হাঁপানির ঔষধ আমার কাছে নাই। এক রকম ঔষধ আছে মাত্র।”
মু। আমাকে সেই ঔষধই দিন। আমার অদৃষ্টে যাহা হয় হউক। আর একটা কথা আছে।
আ। কি কথা বল?
মু। আপনার কাছে পাগলের ওষুধ আছে?
আ। খুব ভাল রকম ঔষধ আছে। কেন বল দেখি?
মু। আমাদের পাড়ার একটি লোক হঠাৎ পাগল হইয়া গিয়াছে। বেচারা একদিনের মধ্যে উন্মাদ পাগল। বাপকে দাঁত ও নখ দিয়া ক্ষত বিক্ষত করিয়াছে। যদি আপনার কাছে ওষুধ থাকে, দয়া করিয়া একবার তাহাদের বাড়ীতে যাইবেন কি?
আ। সে তোমার কে?
মু। বন্ধু। ছেলেবেলা হইতে এক জায়গায় বাস। তাছাড়া জহরের মত লোক আজকাল দেখা যায় না।
আ। তবে চল। তোমার বন্ধুর নাম তবে জহুর?
মু। আজ্ঞে হাঁ।
এই বলিয়া দোকানে একটা লোককে বসাইয়া মুদী আমার আগে আগে চলিল। আমি তাহার অনুসরণ করিলাম। কিছুদূর যাইবার পর মুদী একখানি ক্ষুদ্র একতলা বাড়ীতে প্রবেশ করিল, এবং অতি যত্নের সহিত আমাকে ভিতরে লইয়া গেল। সন্ন্যাসীর বেশ দেখিয়া পথে কেহ কোন কথা কহিল না।
বাড়ীর ভিতর গিয়া দেখিলাম, একজন বৃদ্ধ একখানি ঘরের দরজায় বসিয়া তামাক সেবন করিতেছে। একতলা হইলেও বাড়ীখানি বেশ উঁচু। বাড়ীর ভিতরে তিনখানি ঘর, বাহিরেও তিনখানি ঘর। ভিতরে একখানি রান্নাঘর, অপর দুইখানি শোবার ঘর। শুনিলাম, সে দুইখানি ঘরে জহর ও তাহার ভাই পান্না থাকে। বৃদ্ধকে বাহিরে থাকিতে হয়। তাহার অনেক দিন পূর্ব্বে স্ত্রী-বিয়োগ হইয়াছে। দুইটি পুত্রবধূ তাহার সংসারের সকল কাজই করিয়া থাকে।
বৃদ্ধ আমাকে দেখিয়া আশ্চৰ্য্যান্বিত হইল। বলিল, “কি ঠাকুর, একেবারে অন্দরে যে? ব্যাপার কি?” আমি কোন উত্তর করিবার আগেই মুদী বৃদ্ধকে বাধা দিয়া বলিল, “ও কি করেন জ্যেঠামশায়! আমি এঁকে ডাকিয়া আনিয়াছি। ইঁহার নিকট পাগলের খুব ভাল ওষুধ আছে, জহরকে দেখাইতে আনিয়াছি।”
মুদীর কথা শুনিয়া বৃদ্ধের মুখ মলিন হইয়া গেল। সে ভাবিল, আমি বুঝি সত্য সত্যই দেবতা— তাহার পুত্রকে আরোগ্য করিবার জন্য তাহার বাড়ীতে আসিয়াছি। সে আগে অতি বিনীতভাবে ভূমিষ্ঠ হইয়া আমায় প্রণাম করিল, পরে বলিল, “ঠাকুর, আমি না জানিয়া আপনাকে রূঢ় কথা বলিয়াছি। আমার অপরাধ মার্জ্জনা করুন। আমার ছেলেটি হঠাৎ পাগল হইয়া গিয়াছে, তাহাকে আরোগ্য করিয়া দিন। আমার এই দুই পুত্র ছাড়া আর কেহ নাই, দেখিবেন, এই বৃদ্ধবয়সে যেন পুত্রশোক পাইতে না হয়।”
এই কথা বলিতে বলিতে বৃদ্ধ কাঁদিয়া ফেলিল! বৃদ্ধের অবস্থা দেখিয়া আমার দয়া হইল। বলিলাম, “তুমি কাঁদিতেছ কেন? তোমার পুত্র আরোগ্য লাভ করিবে। আমি আজই একটা ঔষধ দিয়া যাইতেছি। চল, তোমার পুত্র কোথায় আছে দেখিয়া আসি।”
বৃদ্ধ আমাকে লইয়া যে ঘরে তাহার পুত্র ছিল, সেই ঘরের দ্বারে আসিল। বলিল, আমি আর ভিতরে যাইব না। আপনি ঘরের ভিতরে যান।”
বৃদ্ধের কথা শুনিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমিও কেন আমার সঙ্গে চল না?”
বৃ। না মহাশয়! আমায় দেখিলে জহর আরও ক্ষেপিয়া উঠে। কি জানি, আমার উপর তাহার এত আক্রোশ কেন হইল।
আ। আমার সঙ্গে আইস। আমি কাছে থাকিলে তোমায় কিছু বলিবে না। জহর কি কেবল তোমায় দেখিলেই রাগান্বিত হয়?
বৃ। আজ্ঞে হাঁ। আরও অনেক লোক জহরকে দেখিতে আসিয়াছিল; কিন্তু জহর তাহাদিগের উপর কোনরূপ অত্যাচার করে নাই; বরং তাহাদের সহিত ভাল রকমে কথাবার্তা কহিয়াছিল।
আ। তুমি জহরকে কোন কথা বলিয়াছিলে?
বৃ। যে দিন জহর থানা হইতে মুক্তি পাইয়া বাড়ীতে ফিরিয়া আসিল, সেই দিন আমি তাহার নিকট হইতে সংসার- খরচের টাকা চাহিয়াছিলাম। এই আমার অপরাধ।
আ। জহর ত নফরের দোকানে চাকরি করে; কত টাকা বেতন পায়?
বৃ। বেতন কিছুই নাই। যত কাজ করে সেই মত টাকা পায়।
আ। কেবল জহরের টাকাতেই কি তোমার সংসার চলিতেছে?
বৃ। আজ্ঞে না। আমার ছোটছেলেও প্রেসে কাজ করে। তাহার বেতন কুড়ি টাকা। সেও সমস্ত টাকা আমার হাতে দেয়।
আ। তোমার নিজের কোন আয় আছে?
বৃ। এই বৃদ্ধবয়সে কোথায় চাকরী করিব বলুন, আর কেই বা আমায় এ বয়সে চাকরী দিবে?
আ। এ বাড়ীখানি কার?
বৃ। আজ্ঞা আমার।
আ। তোমার কেনা বাড়ী?
বৃ। আজ্ঞা না; আমার পৈতৃক বাড়ী।
আ। কতদিন এখানে বাস করিতেছ?
বৃ। তিনপুরুষ।
বৃদ্ধকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া আমি ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। বৃদ্ধও আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিল।
ঘরে গিয়া দেখিলাম, এক যুবক একস্থানে বসিয়া গম্ভীরভাবে কি ভাবিতেছে। যুবকের বয়স প্রায় ত্রিশ বৎসর। তাহাকে দেখিতে শ্যামবর্ণ ও শীর্ণ। তাহার চক্ষু কোটরগ্রস্ত, দেখিলেই বোধ হয়, লোকটা নেশাখোর। তাহার পরিধানে একখানি ময়লা কাপড় ছাড়া আর কিছুই না। তাহার হাত পা লৌহশিকলে আবদ্ধ।
আমাকে দেখিয়াই সে দাঁড়াইয়া উঠিল এবং আমার নিকট আসিতে চেষ্টা করিল, কিন্তু পদদ্বয় শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকায় সহজে আসিতে পারিল না। আমি অনেক পাগল দেখিয়াছি, পাগলের মেজাজ আমার বেশ জানা আছে। তাহাদের সহিত রূঢ় ব্যবহার না করিলে তাহারা বশীভূত হয় না। আমি জহরকে নিকটে আসিতে চেষ্টা করিতে দেখিয়া, অতি কর্কশভাবে বলিলাম, “যেখানে আছ, সেইখানেই থাক; আমার কাছে আসিবার চেষ্টা করিও না। আমি সংসারী নহি যে, তোমায় দেখিয়া ভয় পাইব। আমি তোমার মত অনেক পাগল আরাম করিয়াছি। যদি আমার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দাও, তাহা হইলে তুমিও শীঘ্র আরোগ্য হইবে।”
আমার কথা শুনিয়া জহর আবার বসিয়া পড়িল, কোন কথা কহিল না। সে আপন মনে কখন হাসিতে, কখন কাঁদিতে লাগিল। আমার কিম্বা তাহার পিতার দিকে দৃকপাতও করিল না।
আমি তখন জহরকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “জহরলাল! আমি তোমায় গোটাকতক কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি।”
জহর কথা কহিল না; ঘাড় নাড়িয়া উত্তর দিল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি হঠাৎ এমন উন্মাদ পাগল হইলে কিসে?”
এবার জহরের মুখ ফুটিল। সে বলিল, “সেকথা আমি কি করিয়া বলি।”
একটি উত্তর পাইয়া আমার আনন্দ হইল। ভাবিলাম, যখন একটি কথার উত্তর পাইয়াছি, তখন আর ভাবনা কি? পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, “তাধিক মাদক সেবন করিয়াছ কি?”
জহর বোধ হয় আমার কথা বুঝিতে পারিল না, আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। আমি তাহার মনোগত ভাব বুঝিতে পারিলাম। বলিলাম, “অতিরিক্ত নেশা করিয়াছিলে?”
এবার জহর আমার কথা বুঝিল। বলিল, “না মহাশয়, ভাতের খরচ যোগাইতে পারি না, নেশা করিবার পয়সা কোথায় পাইব?”
কথা শুনিয়া আমি চমকিত হইলাম। ভাবিলাম, লোকটা যখন এমন কথা বলিতেছে, তখন তাহাকে পাগল বলা যায় না। বৃদ্ধকে বলিলাম, “তোমার পুত্র শীঘ্রই আরোগ্য হইবে। জহর যেরূপভাবে আমার কথার জবাব দিয়াছে, তাহাতে বোধ হয়, সে পাগল হয় নাই। মস্তিষ্কের কোন রকম গোলযোগ হইয়াছে। তোমার কোন চিন্তা নাই, জহর শীঘ্রই আরোগ্য লাভ করিবে। এখন আমি জহরকে আর গোটাকতক কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাই। তুমি কাছে থাকিলে সে হয়ত কোন উত্তর দিবে না। তুমি এখন এখান হইতে চলিয়া যাও।”
বৃদ্ধ প্রস্থান করিলে পর আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি কাজ কর কোথায় বাপু?”
অতি শান্তভাবে জহর উত্তর করিল, “আমি নফরের দোকানে কাজ করিতাম।”
আ। সেখানে আর যাও না কেন?
জ! আমায় যাইতে দেয় না।
আ। কে তোমায় যাইতে দেয় না।
জ। বাড়ীর লোক।
আ। কে বাড়ীর লোক? তোমার পিতা?
জ। না, আর সকলে।
আ। তোমার ভাই?
জ। না, আর সকলে।
আ। তবে আর-সকল কে?
জহর কোন উত্তর করিল না, মুখ টিপিয়া হাসিতে লাগিল। আমি তাহার মনোগত অভিপ্রায় বুঝিতে পারিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম “তোমার স্ত্রী?”
এক গাল হাসি হাসিয়া জহর উত্তর করিল, “হাঁ।”
আ। তুমি এখন সেই রকম কাজ করিতে পারিবে?
জ। বোধ হয় না।
আ। কেন?.
জ। মাথার ভিতর কেমন একটা গোলযোগ হইয়াছে, কি করিতেছি, কি বলিতেছি, কিছুই আমার মনে নাই। আমার হাত পা সদাই যেন কাঁপিতেছে। হাত ঠিক না হইলে, পুতুল-গড়া হয় না।
আ। লোকে তোমায় পাগল বলিতেছে, কিন্তু আমার সঙ্গে তুমি যে রকম ভাবে কথা কহিতেছ, তাহাতে আমি পাগলের কোন লক্ষণই দেখিতে পাইতেছি না। মধ্যে মধ্যে ক্ষেপিয়া উঠ কেন?
জ। কেন বলিতে পারি না। বোধ হয়, আমায় যেন কে মারিতেছে, কে যেন আমায় ধমকাইতেছে, কে যেন আমায় তাড়া করিতেছে। তখন আমি কি করি, কি বলি, আমার জ্ঞান থাকে না।
আ। তোমার বাপকে যে সেদিন মারিয়া প্রায় খুন করিয়া ফেলিয়াছ। তাহার গায়ের দাগ এখনও তেমনই রহিয়াছে। জহরলাল হাসিয়া উঠিল। সে হাসির যেন শেষ নাই; ক্রমাগত এক কোয়ার্টার ধরিয়া জহরলাল হাসিল। পরে বলিল, “এও কি কখন হয়? ছেলে হইয়া বাপকে মারিবে? না মহাশয়! আপনি আমাকে উপহাস করিবেন না। আপনারা দেবতা-জ্ঞানী পুরুষ হইয়া আমার সঙ্গে তামাসা করিবেন না।”
আমি আর সেকথা তুলিলাম না। জহরের মন তখন স্থির আছে দেখিয়া, আমি নফরের দোকানের কথা পাড়িবার মৎলব করিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি নফরের নিকট হইতে কত টাকা করিয়া বেতন পাইতে?”
জহর আমার কথায় রাগিয়া গেল। বলিল, “আমি কাহারও মাহিনার চাকর নহি। আমি মাহিনা লইয়া কাজ করিতাম না।”
আমি বলিলাম, “আমি সে রকম মাহিনার কথা বলি নাই। তুমি মাসে কত টাকা উপায় করিতে এই আমার জিজ্ঞাস্য।”
জহর উত্তর করিল, “নফরবাবু যদি আমায় যথার্থ উচিতমত মূল্য দিতেন, তাহা হইলে আমার আয় যথেষ্ট হইত। কিন্তু তিনিই আমার ঐ কার্য্যের গুরু, আমি তাঁহারই নিকট হইতে শিক্ষালাভ করিয়াছি। সুতরাং প্রায় অর্দ্ধ মূল্যেই আমায় কার্য্য করিতে হয়। অন্য কোথাও যাইলে আমি দ্বিগুণ উপায় করিতে পারি, কিন্তু বোধ হয়, আমি আর কার্য্য করিতে পারিব না।”
আ। কত টাকা উপায় কর বলিলে না?”
জ। পঁচিশ ত্রিশ টাকার কম নহে।
আ। নফরের দোকানে সেদিন কি হইয়াছিল?
প্রশ্ন শুনিয়া জহর আমার দিকে কটমট করিয়া চাহিয়া রহিল। সে শূন্য দৃষ্টি পাগলেরই শোভা পায়। আমার মনে কেমন সন্দেহ হইল, আমিও জহরের দিকে ভাল করিয়া চাহিয়া রহিলাম।
বোধ হয়, জহর আমার মনোগত ভাব বুঝিতে পারিয়াছিল। সে একবার মুখ অবনত করিয়াই, হাসিতে হাসিতে আমার দিকে চাহিয়া বলিল, “আপনি দেবতা। তাহা না হইলে কিছু হইয়াছিল কি না, কেমন করিয়া জানিতে পারিলেন? যখন সমস্তই জানেন, তখন আর আমায় জিজ্ঞাসা করেন কেন?”
আমি সে কথা চাপা দিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “শুনিলাম, তুমি নফরের সঙ্গে হাজতে গিয়াছিলে; মুক্তিলাভ করিয়া বাড়ী আসিয়াই পাগল হইয়াছ। এ কথা সত্য কি?”
জ। আজ্ঞা হাঁ। কিন্তু আপনি সকলই জানেন, মিথ্যা জিজ্ঞাসার দরকার কি?
আ। হাজতে গিয়াছিলে কেন?
জ। আর কেন আমায় কষ্ট দেন।
আ। কষ্ট কি?
জ। আপনি যখন সকলই জানেন, তখন কেন আমি বকিয়া মরি।
আ। আমি সামান্য সন্ন্যাসী। বারবার আমার অত সুখ্যাতি করিও না। আমার মনোমধ্যে অহঙ্কার জন্মিতে পারে, যেমন শুনিয়াছি, তেমনই জানি। তুমি যেমন জান, তুমি যেমন বলিতে পারিবে, অপরে তোমার মুখ হইতে শুনিয়া তেমন বলিতে পারিবে না। সেই জন্য তোমার মুখ হইতে শুনিবার আমার এত ইচ্ছা। আমি শুনিয়াছি, একখানি দামী হীরা হারাইয়াছে।
আমার শেষ কথা মুখ হইতে বাহির হইতে না হইতে জহর এক বিকট চীৎকার করিয়া উঠিল। পরক্ষণেই সে কাঁপতে কাঁপিতে শুইয়া পড়িল, সঙ্গে সঙ্গে তাহার জ্ঞানলোপ হইল।
বৃদ্ধ দৌড়িয়া জহরের নিকট গেল, আমিও তাহার পার্শ্বে বসিয়া মূৰ্চ্ছা ভাঙ্গাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। একটি যুবতীও ঘোমটা দিয়া সেই ঘরে আসিল, এবং দূর হইতে জহরকে দেখিতে লাগিল।
প্রায় আধ ঘণ্টার পর জহরের জ্ঞান হইল। সে চক্ষু উন্মীলন করিল। সম্মুখেই আমাকে দেখিতে পাইল। আমার দিকে চাহিয়াই অট্টহাস্য করিয়া উঠিল। অনেকক্ষণ ধরিয়া হাসিল। হাসি থামিলে সে চুপ করিয়া রহিল— কোন কথার উত্তর দিল না। অনেক লোভ দেখাইলাম, নানা রকম ভয় দেখাইলাম, কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না। জহরলাল তখন সত্য সত্যই উন্মাদ পাগলের মত ব্যবহার করিতে লাগিল দেখিয়া, আমি বৃদ্ধের নিকট হইতে একটি মাদুলী লইয়া, তাহাতে ঔষধরূপে শুষ্ক বিল্বপত্র দিয়া বৃদ্ধকে ফিরাইয়া দিলাম। তাহার পর আর সেখানে বিলম্ব না করিয়া অফিসের দিকে আসিলাম। অফিসে ছদ্মবেশ ত্যাগ করিয়া গৃহে ফিরিলাম।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
যখন বাড়ীতে ফিরিয়া আসিলাম, তখন রাত্রি আটটা বাজিয়াছে। কিছুকাল বিশ্রাম করিয়া, আহারাদি শেষ করিয়া শয়ন করিলাম।
শয়ন করিলাম সত্য, কিন্তু নিদ্রা আসিল না। জহরের আচরণের কথা ভাবিতে লাগিলাম। জহর প্রথমতঃ আমার সহিত যেরূপ ভাবে কথাবার্তা কহিয়াছিল, তাহাতে তাহাকে সুস্থ বলিয়াই বোধ হইয়াছিল। মনে করিয়াছিলাম, কোন লোক অন্যায় করিয়া তাহার নামে মিথ্যা দোষারোপ করিয়াছে। কিন্তু শেষে সে যেরূপ আচরণ দেখাইল, তাহাতে তাহাকে উন্মাদ বলিয়াই বোধ হইল। হীরাখানির নাম উল্লেখ করিবামাত্র জহরলাল অজ্ঞান হইয়া পড়িল কেন? এইরূপ নানাপ্রকার চিত্তা করিয়া এই স্থির করিলাম, জহরলালই হীরাখানি কুড়াইয়া পাইয়াছে। কিন্তু বোধ হয়, এখনও বিক্রয় করিবার কোনরূপ পন্থা করিতে পারে নাই।
এইরূপ যতই ভাবিতে লাগিলাম, জহরের উপর সন্দেহ ততই বাড়িতে লাগিল। অবশেষে স্থির করিলাম, পরদিন স্থানীয় পুলিসের সাহায্যে জহরলালের বাড়ী অনুসন্ধানের জন্য মাজিষ্ট্রেটের অনুমতি লইব।
পরদিন বেলা প্রায় এগারটার পর মাজিষ্ট্রেটের অনুমতি পাইলাম। চারিজন কনষ্টেবল ও একজন ইনস্পেক্টার আমার সঙ্গে চলিলেন।
সদলবলে জহরের বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম। আমি আগে আগে যাইতে লাগিলাম, পুলিসের লোক সকল আমার অনুসরণ করিতে লাগিল। দরজার সম্মুখেই বৃদ্ধকে দেখিতে পাইলাম, কিন্তু সে আমায় চিনিতে পারিল না। যখন সন্ন্যাসীবেশে আসিয়াছিলাম, তখন কৃত্রিম কণ্ঠে কথাবার্তা কহিয়াছিলাম। আজ স্বাভাবিক কণ্ঠে বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এ বাড়ীর মালিক কে?”
বুদ্ধ এতগুলি পাহারাওয়ালা ও আমাদের দুইজনকে দেখিয়া, ভয়ে কাঁপিতে লাগিল; বলিল, “আজ্ঞে, আমারই এ বাড়ী!”
আমি বলিলাম, “মাজিষ্ট্রেটের হুকুম মত আমি এই বাড়ী তল্লাস করিতে আসিয়াছি।”
বৃদ্ধ আমার কথায় চমকিত হইল; বলিল “এই বাড়ী কি? আপনাদের ভুল হয় নাই ত?”
আমি হাসিতে হাসিতে উত্তর করিলাম, “বাপু, আমরা পুলিসের লোক। আমাদের এত ভুল হয় না।”
বৃ। আমাদের বাড়ীতে কি হইয়াছে? কোন অপরাধে আপনি আমার বাড়ী তল্লাস করিতে আসিয়াছেন?
আ। সে কথা কি জান না? মিছামিছি কথা বাড়াও কেন?
বৃ। দোহাই ধর্ম্মাবতার, আমি কিছুই জানি না। আমায় যে শপথ করিতে বলিবেন, আমি সেই শপথ করিয়া বলিতে পারি যে, আমি সত্য সত্যই কিছু জানি না।
আ। জহর ব’লে কোন লোক এখানে থাকে?
বু। আজ্ঞে হাঁ, থাকে। জহর আমারই বড় ছেলে।
তা। সে একখানা হীরা চুরি করিয়া আনিয়াছে।
বৃদ্ধ গম্ভীরভাবে বলিল, “একথা আমি বিশ্বাস করিতে পারি না। জহর আমার আজ চারিদিন হইল, পাগল হইয়া গিয়াছে। সে এই চারি দিন বাড়ী হইতে বাহির হয় নাই।”
আমি অতি কর্কশভাবে বলিলাম, “তোমার ছেলে যদি এতই সাধু হয়, তবে সেদিন হাজতে গিয়াছিল কেন?”
বৃদ্ধ উত্তর করিল, “সন্দেহ করিয়া তাহাকে হাজতে পাঠান হইয়াছিল। জহর আমার তেমন নয়। সে যাহাই হউক, আপনারা যাহা করিতে আসিয়াছেন করুন। আমি আপনাদিগকে বাধা দিব না।”
আমাদিগের এইরূপ কথাবার্তার পর, ইনস্পেক্টার মহাশয় কনষ্টেবলেিক ইঙ্গিত করিলেন। কনষ্টেবলগণ তন্ন তন্ন করিয়া বৃদ্ধের বাড়ী অন্বেষণ করিল, কিন্তু কোথাও সেই হীরাখানিকে পাওয়া গেল না।
প্রায় দুইঘণ্টা ধরিয়া চারিদিক দেখিবার পর আমরা বিমর্যভাবে পুলিসে ফিরিয়া আসিলাম।
পুলিস হইতে যখন বাড়ী ফিরিলাম, তখন বেলা পাঁচটা বাজিয়া গিয়াছে। সে দিন আর কোন কাজ করিতে ভাল লাগিল না, কোথায়, কি করিয়া হীরাখানি পাইব, তাহাই চিন্তা করিতে লাগিলাম।
পরদিন অফিসে বসিয়া আছি, এমন সময় একজন পুলিস কর্ম্মচারী তথায় উপস্থিত হইলেন; বলিলেন, “শুনিয়াছেন মহাশয়! পুলিসের কাজে আপনি চুল পাকাইয়াছেন, কখন কোন পাগলকে চুরি করিতে শুনিয়াছেন?”
ইনস্পেক্টার মহাশয়ের সহিত আমার যথেষ্ট সদ্ভাব ছিল। আমি তাঁহাকে অতি সমাদরে অভ্যর্থনা করিয়া একখানি চেয়ারে বসিতে বলিলাম। তাহার পর জিজ্ঞাসা করিলাম, “ব্যাপার কি?”
ই। এমন কিছু নয়। তবে এক পাগল চুরি অপরাধে ধরা পড়িয়াছে।
আ। কে সে পাগল? তাহার নাম কি?
ই। জহরলাল।
আ। বাড়ী কোথায়?
ই। সিকদার পাড়া।
আ। কোথায় চুরি করিয়াছে?
ই। চুরি করে নাই, করিতে গিয়াছিল।
আ। কোথায়?
ই। জোড়াসাঁকোর মুখুয্যেদের বাড়ী।
আ। জোড়াসাঁকোর মুখুয্যেরা ত বড়লোক। তাহাদের দেউড়িতে সর্ব্বদাই তিন চারিজন দারোয়ান আছে। সে বাড়ীতে চোর গেল কেমন করিয়া?
ই। সে কথা বলিতে পারিলাম না; কিন্তু চুরি অপরাধে জহর ধরা পড়িয়াছে।
আ। জহর কি চুরি করিয়াছিল?
ই। না, চুরি করিতে পারে নাই, তবে কতকগুলি জিনিষপত্র তোলপাড় করিয়াছে।
আ। জহর এখন কোথায়?
ই। হাজতে।
আ। কেন? সে যখন কিছুই চুরি করি নাই, তখন তাহাকে হাজতে রাখা ভাল হয় নাই।
ই। চুরি করে নাই বটে, কিন্তু কতকগুলি দামী জিনিষ নষ্ট করিয়াছে।
আ। কিসে?
ই। একটি দামী শ্যামা-প্রতিমা ভাঙ্গিয়া চুরমার করিয়া দিয়াছে। আমার ইচ্ছা, আপনি একবার তাহাকে দেখিয়া আসুন। লোকটা যে রকম করিয়া সেই বাড়ীতে প্রবেশ করিয়াছিল, তাহা দেখিলে আপনিও আশ্চৰ্য্যান্বিত হইবেন, তখন লোকটাকে একজন পাকা চোর বলিয়া বুঝিতে পারিবেন।
আমি বলিলাম, “যদি তুমি আমাকে জোড়াসাঁকোয় লইয়া যাও, তাহা হইলে দেখিয়া আসিতে পারি। কিন্তু সে যাহাই করুক না কেন, যখন সে পাগল, আর যখন কিছুই লয় নাই, তখন তাহাকে কিছুই করা যাইতে পারে না। তথাপি চলুন, আমরা গিয়া দেখিয়া আসি।”
এই বলিয়া আমি চাকরকে একখানি গাড়ী ডাকিয়া আনিতে বলিলাম, গাড়ী আনীত হইলে, আমি ইনস্পেক্টারকে লইয়া তাহাতে উঠিলাম। ইনস্পেক্টার গাড়োয়ানকে জোড়াসাঁকো যাইতে আদেশ করিলেন।
প্রায় আধ ঘণ্টার পর আমরা জোড়াসাঁকোর মুখুয্যেবাড়ীতে উপস্থিত হইলাম। বাড়ীর কর্তা বাড়ীতেই ছিলেন। তিনি আমাদিগের আগমন বার্তা পাইয়া তাড়াতাড়ি দরজায় আসিলেন, এবং অতি সমাদরে বাড়ীর ভিতর লইয়া গেলেন। দেখিলাম, জহরলাল অনেকগুলি জিনিষ নষ্ট করিয়াছে। তাহার মধ্যে এক কালীপ্রতিমা এমন করিয়া ভাঙ্গিয়াছে যে, তাহার আর কোন চিহ্ন নাই। একখানা ইট দিয়া যেন গুঁড়াইয়া ফেলিয়াছে। আরও আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, অপর জিনিযগুলি যেখানে ভাঙ্গা পড়িয়াছিল, প্রতিমাখানি সেখানে গুঁড়ান হয় নাই। উহাকে একটি নিভৃত স্থানে লইয়া গিয়া জহর সে কার্য্য করিয়াছে। কিছুক্ষণ চারিদিক ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম, “কোন্ কোন্ জিনিষ চুরি গিয়াছে?”
বাড়ীর কর্তার নাম সুধীন্দ্রনাথ। তাঁহার বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ বৎসর। তাঁহাকে দেখিতে খৰ্ব্বাকৃতি, হৃষ্টপুষ্ট ও গৌরবর্ণ। কালাপেড়ে একখানি পাতলা দেশী ধুতি পরিয়া, খালি গায়ে, একজোড়া চটীজুতা পায়ে দিয়া, তিনি এতক্ষণ আমার সহিত চারিদিকে ঘুরিতে ছিলেন। আমার প্রশ্ন শুনিয়া উত্তর করিলেন, “আজ্ঞে না, কোন জিনিষ চুরি যায় নাই। আপনিই দেখিলেন, আমার অনেক টাকার জিনিষ নষ্ট হইয়াছে। কিন্তু বলিতে কি, একটি কড়ার জিনিষও চুরি যায় নাই!”
আ। কখন আপনারা এই ব্যাপার জানিতে পারেন?
সু। আজ প্রাতে।
আ। কে প্রথমে দেখিতে পায়?
সু। আমার এক চাকর।
আ। চোর ধরিল কে?
সু। সেই চাকর।
আ। কোথায় সে? আমি তাহার মুখের গোটাকতক কথা শুনিতে চাই।
সুধীন্দ্রনাথ তখনই “সদা সদা” বলিয়া চীৎকার করিলেন। দূর হইতে একজন উত্তর করিল, “যাই।” কিছুক্ষণ পরে একজন ঘোর কৃষ্ণবর্ণ হৃষ্টপুষ্ট বলিষ্ঠ উৎকলনিবাসী যুবক সুধীন্দ্রবাবুর নিকট আসিল। সুধীন্দ্রনাথ তাহাকে দেখাইয়া বলিলেন, “এই লোক চোর ধরিয়াছে।”
আমি তাহাকে ভাল করিয়া দেখিলাম। বলিলাম, “তুমিই চোর ধরিয়াছ?”
সদা অতি বিনীতভাবে উত্তর করিল, “আজ্ঞে হাঁ; কিন্তু তাহাকে ধরিতে কোনরূপ কষ্ট পাইতে হয় নাই। সে নিজেই ধরা দিয়াছে।”
আ। কি রকমে চোর ধরিয়াছ বল দেখি?
স। আমি প্রতিদিনই রাত্রি চারিটার সময় বিছানা হইতে উঠিয়া থাকি। কাল রাত্রি চারিটার পূর্ব্বে একটা শব্দ শুনিয়া আমার ঘুম ভাঙ্গিয়া যায়। আমি তাড়াতাড়ি বিছানা হইতে উঠিলাম; একটা আলো জ্বালিলাম, তাহার পর সেই আলো লইয়া ঘরের বাহির হইলাম। আবার একটা শব্দ শুনিতে পাইলাম। বোধ হইল, কে যেন কাচের বাসনগুলি আছাড় মারিয়া ভাঙ্গিতেছে। আমি তখনই উপরে গেলাম। বৈঠকখানার সম্মুখে যাহা দেখিলাম, তাহাতে আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। দেখিলাম, বড় বড় কাচের পুতুল, ভাল ভাল ছবি, দুটি ভাল ঘড়ি, বড় আয়নাখানা, আর সমস্ত ভাল ভাল জিনিষ চুরমার হইয়া গিয়াছে। সকল জিনিষই বাবুর বড় সখের ছিল। আমিও ছেলেবেলা হইতে ঐ সকল জিনিষ দেখিয়া আসিতেছি। জিনিষগুলির অবস্থা দেখিয়া আমার বড় দুঃখ হইল। বাবুকে খবর দিতে অন্দরে যাইতেছি, এমন সময়ে বৈঠকখানার ভিতর একজন লোককে দেখিতে পাইলাম। তখনই বৈঠকখানার ভিতর গমন করিলাম। দেখিলাম, একটা লোক আপনাআপনি কি বকিতে বকিতে ঘরের ভিতর পায়চারি করিতেছে। আমায় দেখিয়াই সে অট্টহাস্য করিল। সে বিকট হাসি দেখিয়া আমার কেমন সন্দেহ হইল, তাহাকে উপদেবতা বলিয়া ভ্রম হইল; কিন্তু বিশেষ ভয় হইল না। সাহস করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কে তুমি? এত রাত্রে এখানে কি করিতেছ?”
লোকটা কিছুক্ষণ আমার দিকে কটমট করিয়া চাহিয়া রহিল; বলিল, “আমি কে, জান? আমার নাম জহরলাল। এ অঞ্চলে আমায় কেহ চেন না বটে, কিন্তু আমাদের ওদিকে অনেকেই এ অধীনকে চেনে।”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “এখানে কি করিতেছ? বাড়ীর মধ্যেই বা আসিলে কেমন করিয়া? এই সব ভাল ভাল জিনিষগুলি নষ্ট করিয়াছ কেন?”
লোকটা অট্টহাস্য করিয়া উঠিল; সে হাসি অনেকক্ষণ থামিল না। যখন তাহার হাসি থামিল, তখন আমি তাহাকে আরও গোটাকতক কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। কিন্তু সে কোন কথার জবাব দিল না। আপনার মনে কখন হাসিতে কখন বা বকিতে লাগিল। আমি তখন তাহাকে উন্মাদ বলিয়া ভাবিলাম এবং বাবুর কাছে ধরিয়া লইয়া যাইবার উপক্রম করিলাম। লোকটার শরীরে অসুরের মত বল। আমি নিজে বড় জোয়ান বলিয়া মনে মনে অহঙ্কার করিতাম, আমার সেই অহঙ্কার চূর্ণ হইল। এইরূপ গোলযোগে প্রায় এক ঘণ্টা কাটিয়া গেল। বাড়ীর আর আর চাকরেরা তখন উঠিয়াছিল। আমি তাহাদের একজনকে বাবুকে ডাকিতে বলিলাম। বাবুও তখনই আমার নিকট উপস্থিত হইলেন। আমি তাঁহাকে সমস্ত কথা বলিলাম। তিনি আমার কথা শুনিয়া লোকটাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া, একেবারে থানায় দিলেন। থানার লোক আসিয়া তাহাকে ধরিয়া লইয়া গেল।”
সদার কথা শুনিয়া আমি সুধীন্দ্রবাবুকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার ইচ্ছা কি? লোকটাকে আমি চিনি। সে সম্প্রতি পাগল হইয়া গিয়াছে। যদি আপনার ইচ্ছা থাকে, তাহা হইলে তাহাকে পাগলা গারদে পাঠাইতে পারি। কিন্তু যখন সে কোন জিনিষ লয় নাই, আর যখন সে উন্মাদ অবস্থায় এই কার্য্য করিয়াছে, তখন তাহাকে বৃথা কষ্ট দেয়া ভাল নয়।”
সুধীন্দ্রবাবু অতি সজ্জন লোক। তিনি বলিলেন, “আপনি যেরূপ বলিবেন, তাহাই হইবে। যে সকল জিনিষ সে নষ্ট করিয়াছে, তাহা আর ফিরিয়া পাইবার আশা নাই। আমার পরে ক্ষতি হইলেও যদি আপনি তাহাকে ছাড়িয়া দিতে বলেন, তাহাতে আমার আপত্তি নাই।”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “সে আপনার বাড়ীতে প্রবেশ করিল কিরূপে? আর কত রাত্রেই বা সে এ বাড়ীতে আসিল?”
সু। ঠিক কত রাত্রে আসিয়াছে বলা যায় না। তবে বোধ হয়, রাত্রি দুইটার পূর্ব্বে সে এখানে আসিতে পারে নাই।
আ। কেমন করিয়া জানিলেন?
সু। আমার ছোট ভাই গত রাত্রে থিয়েটার দেখিতে গিয়াছিল। সে রাত্রি দুইটার সময় বাড়ীতে ফিরিয়া আইসে। খুব সম্ভব, সে দরজা বন্ধ করিতে ভুলিয়া গিয়াছিল।
আ। দরজা কি তবে খোলা ছিল?
সু। না, খোলা ছিল না।
আ। তাঁহাকে দরজা খুলিয়া দেয় কে?
সু। আমাদের জমাদার।
আ। তাহা হইলে সেই দরজা বন্ধ করিয়াছিল?
সু। সে তাহা ঠিক করিয়া বলিতে পারে না। সে বলে যে, ঘুমের ঘোরে সে কি করিয়াছে, তাহা তাহার মনে নাই।
আ। তবে তাহাই সম্ভব। যে মাটীর পুতুলটা গুঁড়াইয়া ফেলিয়াছে, শুনিলাম, সেখানা কালীর প্রতিমূর্তি। আপনি উহা কোথায় পাইয়াছেন?
সু। কিনিয়াছি।
আ। কোথা হইতে?
সু। কুমারটুলি হইতে।
আ। দোকানদারের নাম জানেন?
সু। জানি বই কি,
নফরের দোকান। নফর কুমোরের নাম শুনিয়াছেন বোধ হয়?
আ। শুনিয়াছি। কত টাকায় উহা কিনিয়াছেন?
সু। ঐ কালীমূর্ত্তি আর একখানা শিবের মূর্ত্তি এই দুইখানা পাঁচ টাকায় লইয়াছি।
আ। কতদিন পূর্ব্বে কিনিয়াছেন?
সু। প্রায় মাস খানেক হইল টাকা দিয়াছিলাম বটে, কিন্তু কাল বৈকালে উহা আমার বাড়ীতে পৌঁছিয়াছে।
আ। শিবের মূর্ত্তিটা কোথায়?
সু। অন্দরে রাখিয়াছি। এখানে রাখিলে তাহারও এই দুৰ্দ্দশা হইত।
আ। এখন যদি তাহাকে পাগলা গারদে পাঠাইতে আপনার ইচ্ছা না থাকে, তাহা হইলে সেই মৰ্ম্মে একখানি পত্ৰ লিখিয়া দিন। আমি থানায় গিয়া তাহার মুক্তির উপায় দেখিব। বেচারাকে বৃথা হাজতে রাখিবার কোন কারণ দেখি না।
আমার কথায় সুধীন্দ্রনাথ সম্মত হইলেন; এবং তৎক্ষণাৎ একখানি পত্র লিখিয়া দিলেন। আমি ইনস্পেক্টারবাবুর সহিত থানায় আসিলাম। পরে পুলিসের সুপারিনটেন্ডেন্টের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া আমার উদ্দেশ্য জ্ঞাপন করিলাম। সুপারিনটেণ্ডেণ্ট সাহেব আমাকে বিলক্ষণ চেনেন, তিনি আমার অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া হাসিলেন এবং তখনই জহরলালের মুক্তির আদেশ দিলেন। জহরলাল মুক্ত হইল।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
পরদিন প্রাতে জহরলালের বাড়ীতে যাইলাম। সোমবার সন্ন্যাসীবেশেই গিয়াছিলাম। বৃদ্ধ আমায় দেখিয়া অত্যন্ত রোদন করিল; বলিল, “ঠাকুর, ভাল হওয়া দূরের কথা, জহরের পাগলামি আরও বাড়িয়াছে। পরশ্ব রাত্রে হাত- পায়ের বন্ধন ছিঁড়িয়া সে-যে কোথায় গিয়াছিল, তাহার সন্ধান পাই নাই। কাল সকালে শুনিলাম, সে নাকি জোড়াসাঁকোর কোন ধনাঢ্য লোকের বাড়ীতে গিয়া কি উৎপাত করিয়াছিল। কত টাকার জিনিষ যে সে নষ্ট করিয়াছে, তাহাও বলিতে পারি না। বাড়ীর কর্তা তাহাকে প্রথমে থানায় দিয়াছিলেন। শেষে জহরকে পাগল বলিয়া স্থির করিয়া অব্যাহতি দেন। কাল সন্ধ্যার পর জহর ফিরিয়া আসিয়াছে। সেই অবধি সে কোন জিনিষ খায় না, কাহারও সহিত কোন কথা কয় না, কেবল কাঁদিতেছে। এমন কেন হইল ঠাকুর? কোন্ পাপে আমার রোজগারি ছেলের এ দুৰ্দ্দশা হইল?”
আমি পূর্ব্বের মত কৃত্রিম কণ্ঠে বলিলাম, “পরে সমস্তই জানিতে পারিবে। আমার বোধ হয়, তোমার ছেলে কোন গুরুতর পাপ করিয়াছে। সেই জন্য তাহার এই রকম পরিবর্ত্তন হইয়াছে।”
বৃদ্ধ আমার কথায় প্রথমতঃ আশ্বস্ত হইল; পরে বলিল, “ঠাকুর আপনার অগোচর কিছুই নাই। বলুন, কি করিলে জহরের পাপ শাস্তি হয়। যদি আমার জীবন দিয়াও জহরকে সুস্থ করিতে পারি, তাহাতেও আমি পশ্চাৎপদ হইব না।”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “জহর কোথায়?”
বৃ। সে ঘরেই আছে।
আ। হাত-পা বাঁধা?
বৃ।আজ্ঞে না। যখন বন্ধন ছিঁড়িয়া সে একবার পলায়ন করিয়াছিল, তখন আর তাহাকে বাঁধিবার কোন আবশ্যকতা দেখি না। সে খোলাই আছে, তবে তাহার ঘর বাহির হইতে চাবি দেওয়া হইয়াছে।
আ। ভাল কাজ কর নাই। তাহাকে সম্পূর্ণরূপে ছাড়িয়া দাও। সে নিজের ইচ্ছামত কাজ করুক। তাহা হইলে বোধ হয়, তাহার মেজাজ ঠাণ্ডা হইতে পারে।
বৃ। যে আজ্ঞা। আপনি যেমন আদেশ করিবেন, আমি সেইরূপ করিব; কিন্তু ভয় হয়, পাছে জহর আমায় আবার প্রহার করে।
আ। জহরের ঘর খুলিয়া দাও এবং তোমরা সকলে একটি ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া থাক, তাহা হইলে সে আর তোমাদের উপর অত্যাচার করিতে পারিবে না। কিন্তু আমার বোধ হয়, ছাড়া পাইলে সে বাড়ীতে থাকিবে না।
বৃ। তবেই ত ঠাকুর! সেও এক জ্বালা। এই বুড়ো বয়সে কোথায় তাহার অন্বেষণ করিয়া বেড়াইব?
আ। জহরের বেশ জ্ঞান আছে। তবে মধ্যে সে উন্মাদ হইয়া উঠে। তাহার জন্য তোমাদের চিন্তা করিবার কোন কারণ নাই। সে যেখানেই থাকুক না কেন, দুই একদিনের মধ্যেই বাড়ী ফিরিবে ইহা নিশ্চয়।
বৃ। তবে আপনি এই চাবি লউন। জহরের ঘর আপনিই খুলিয়া দিন। ইতিমধ্যে আমি মেয়েদের লইয়া একটি ঘরের ভিতর গিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দি।
আমি বৃদ্ধের হাত হইতে চাবি লইলাম এবং যে ঘরে জহর আবদ্ধ ছিল, সেই ঘরের দরজা খুলিয়া দিলাম। চক্ষের পলক পড়িতে না পড়িতে জহরলাল বেগে ঘর হইতে বাহির হইল এবং কাহাকেও কোন কথা না বলিয়া একেবাবে রাস্তায় গিয়া উপস্থিত হইল। আমিও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিলাম, কিন্তু পাগলের সঙ্গে দৌড়ান বড় সহজ ব্যাপার নহে। অনেক চেষ্টা করিয়াও তাহাকে আর দেখিতে পাইলাম না, অগত্যা বাড়ীতে ফিরিলাম।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
বেলা একটার পর আমি নফরের দোকানে আসিলাম। দেখিলাম, নফর বড় ব্যস্ত। জিজ্ঞাসা করিলাম, “নফরচন্দ্র! আমায় চিনিতে পার?”
নফর আমার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করিল; বলিল, “আজ্ঞে হাঁ, চিনিতে পারিয়াছি; কিন্তু মহাশয়, আমি এক ভয়ানক বিপদে পড়িয়াছি, এখন আপনার কথা শুনিতে পারিব না।”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি হইয়াছে? আমিও বিশেষ কোন কার্য্যের জন্য তোমার এখানে আসিয়াছি।” ন। আমার সর্ব্বনাশ হইয়াছে। দুইজন কারিগর সাংঘাতিক রূপে আহত হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। তাহাদের বাঁচিবার আশা নাই।
আ। কেন? কিসে তাহাদের এমন অবস্থা হইল?
ন। আমি আহার করিতে গিয়াছিলাম। দোকানে দুই জন কারিগর বসিয়া কার্য্য করিতেছিল। এমন সময়ে কোথা হইতে জহরলাল দৌড়িয়া দোকানে প্রবেশ করে। দোকানের ভিতর আসিয়া সে আপনার জায়গায় বসিয়াছিল। সে কি জন্য আসিয়াছে, একজন কারিগর জিজ্ঞাসা করিলে, সে বলে যে, তাহার হস্তনির্মিত কালীমূর্তিগুলি দেখিতে আসিয়াছে। আগেই বলিয়াছি যে, ছয়খানি প্রতিমার মধ্যে পাঁচখানির ফরমাইস ছিল। তাহার মধ্যে দুইখানি কেবল পাঠান হইয়াছিল। তিনখানির রং ভাল শুকায় নাই বলিয়া পাঠান হয় নাই। সেগুলি সেদিনের মত শুকাইতে দেওয়া হইয়াছিল। জহরলাল তাহা দেখিতে পায় এবং সেই তিনখানি প্রতিমা লইয়া সে পলায়ন করিতে ইচ্ছা করে। পুতুল তিনটি লইয়া সে যখন পলায়ন করিতে ছিল, তখনই দুইজন কারিগর তাহাকে ধরিয়া ফেলে। পাগলের বল বড় ভয়ানক। সেই দুইজনকে ধাক্কা দিয়া দূরে নিক্ষেপ করে, এবং দৌড়িয়া আমার দোকান হইতে পলায়ন করে। কারিগর দুইজনও তাড়াতাড়ি উঠিয়া তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ দৌড়িতে লাগিল এবং অনেক কষ্টে দুইজনে তাহাকে ধরিয়া ফেলে। জহরলাল ধরা পড়িয়া আগে পুতুল তিনটি একস্থানে ফেলিয়া দেয়, পরে দুইজনকে এমন আঘাত করে যে, তাহাদের বাঁচিবার আশা নাই। এখন তাহারা হাসপাতালে রহিয়াছে।
আমি শুনিয়া আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, “এখন পুতুল তিনটি কোথায়?”
ন। কারিগর দুইজনকে সাংঘাতিকরূপে আঘাত করিয়া জহরলাল পুতুল তিনটি লইয়া কোম্পানীর বাগানের ভিতর যায়। সেখানে সে সেগুলিকে গুঁড়াইয়া ফেলিয়া যেমন পলায়ন করিবে, অমনি তিন চারিজন পাহারায়ালা তাহাকে ধরিয়া ফেলে।
আ। তাহা হইলে জহরলাল আবার ধরা পড়িয়া থানায় গিয়াছে। এই সেদিন তাহাকে পাগল বলিয়া মুক্ত করিয়া দিলাম; আবার ধরা পড়িল!
ন। আজ্ঞে না, সে এখন ধরা পড়ে নাই। পাহারাওয়ালাগুলিকে আধমরা করিয়া সে সেখান হইতে কোথায় পলায়ন করিয়াছে, তাহা জানা যায় নাই।
আ। যে সকল লোক তোমার দোকানে কালীর প্রতিমা গড়িবার ফরমাইস দিয়াছিল, তাহাদের নাম-ধাম জহর জানিত?
ন। আজ্ঞে হাঁ, জানিতে বই কি! সেই ত খাতায় তাঁহাদের নাম-ধাম লিখিয়াছিল।
আ। দুইখানি প্রতিমা তুমি যথাস্থানে পাঠাইয়াছ, কেমন?
ন। আজ্ঞে হাঁ।
আ। একখানি ত জোড়াসাঁকোর সুধীন্দ্র মুখুয্যের বাড়ী পাঠাইয়াছ, আর একখানি?
ন। আমার মনে নাই। খাতা দেখিয়া বলিতে পারি।
আ। বেশ, তোমার খাতা আন দেখি!
নফরচন্দ্র তাড়াতাড়ি খাতা আনিল। দুই চারিখানি পাতা উল্টাইয়া বলিল, “সেখানি নিকটেই পাঠান হইয়াছে।”
আ। কোথায়?
ন। বাগবাজারে।
আ। কাহার বাড়ীতে?
ন। হরিশ বোসের বাড়ী।
আ। হরিশ বোস? তাঁহার সঙ্গে আমার বেশ আলাপ আছে। জহরের আর কোন খোঁজ করিয়াছ?
ন। আমি আর কি খোঁজ করিব? যখন সে পুলিসের হাত হইতে পলায়ন করিয়াছে, এবং পাহারাওয়ালাগুলিকে আধমরা করিয়াছে, তখন পুলিসের লোকই তাহার সন্ধান লইতেছে।
আ। এ সব ঠিক, জান?
ন। স্বচক্ষে দেখি নাই বটে, কিন্তু শুনিয়াছি, জনকতক পাহারাওয়ালা জহরের বাড়ীর দরজার নিকট বসিয়া আছে। সে বাড়ীতে আসিলেই ধরা পড়িবে।
জহরলালের অদ্ভুত আচরণে আমার সন্দেহ আরও বাড়িতে লাগিল। কেনই বা সে প্রতিমাগুলিকে গুঁড়াইয়া ফেলিতেছে! নিজের হাতের গড়াজিনিষ লোকে ইচ্ছা করিয়া ভাঙতে চায়! জহর কেন এ নিয়মের বাতিক্রম করিল।
এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে আমি বাগবাজারে হরিশবাবুর বাড়ীতে যাইলাম। তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। ঘরে ঘরে আলো জ্বালা হইয়াছে। বাড়ীর ছোট ছোট ছেলেরা চীৎকার করিয়া পাঠাভ্যাস করিতেছে। বাবুরা বাহিরে বসিয়া সান্ধ্যসমীরণ সেবা করিতেছেন। এমন সময়ে আমি সেখানে উপস্থিত হইলাম।
হরিশবাবু সেখানে ছিলেন। আমাকে দেখিয়া সমাদরে অভ্যর্থনা করিয়া নিকটে বসিতে বলিলেন। আমি তাঁহার অনুরোধ রক্ষা করিয়া কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর জিজ্ঞাসা করিলাম, “হরিশবাবু কেমন আছেন? অনেক দিন আপনার সহিত সাক্ষাৎ হয় নাই।”
হরিশবাবু সহাস্যবদনে বলিলেন, “না, অনেকদিন আপনাকে দেখিতে পাই নাই। কোথাও গিয়াছিলেন নাকি?” আমি উত্তর করিলাম, “না। চাকরে কি ইচ্ছামত কাজ করিতে পারে?”
হ। এখন এদিকে কোথায় গিয়াছিলেন?
আ। আপনারই নিকট আসিয়াছি।
হ। আমার পরম সৌভাগ্য। এখন কি করিতে হইবে বলুন?
আ। আপনি কি নফরের দোকান হইতে একখানি কালীপ্রতিমা কিনিয়াছেন? হ। হাঁ, কিনিয়াছি। কিন্তু আপনি সে কথা জানিতে পারিলেন কিরূপে?
আ। নফরের মুখে শুনিয়াছি। প্রতিমাখানি খুব যত্নে রাখিবেন।
হ। কেন বলুন দেখি? একটা মাটীর পুতুল আবার ঘরে রাখিব কি?
আ। প্রতিমাখানির দাম সামান্য নহে।
হ। মাটীর পুতুল বলিয়া দাম কিছু বেশী বলিয়া বোধ হয় বটে, কিন্তু কারিকুরি দেখিলে উহার মূল্য অতি সামান্য বলিয়া মনে হয়।
আ। হাঁ, পুতুলগুলির গঠন অতি সুন্দর। প্রতিমাখানি রাখিয়াছেন কোথায়?
হ। আমার বৈঠকখানায়।
হরিশবাবুর কথা শেষ হইতে না হইতে একজন চাকর দৌড়িয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে আমাদের নিকট আসিল। বলিল, “বাবু! কোথা হইতে একটা লোক আসিয়া আপনার বৈঠখানার সমস্ত জিনিষ ভাঙ্গিয়া চুরমার করিয়া ফেলিয়াছে।”
হরিশবাবু বড় ভাল মানুষ, চাকরদেরও তিনি কখনও কড়া কথা বলেন না। কিন্তু তখন তাহার মুখ দেখিয়া বোধ হইল, তিনি অত্যন্ত রাগান্বিত হইয়াছেন। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, কোন কথা কহিলেন না। পরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে সে?”
ভৃত্য সসম্ভ্রমে উত্তর করিল, “আজ্ঞে, তাহাকে আর কখনও দেখি নাই।”
হ। অচেনা লোক এ বাড়ীতে আসিল কেমন করিয়া? দরওয়ান বেটারা কি করিতেছিল? আর যখন সে বৈঠকখানার দরজার কাছে আসিয়াছিল, তখন তোরাই বা কি করিতেছিলি?
ভৃ। আজ্ঞে, আমি বাজারে গিয়াছিলাম।
হ। রামচরণ কোথায়?
ভৃ। সে যে মার সঙ্গে নিমন্ত্রণে গিয়াছে।
হ। আর দোবে?
ভৃ। আজ্ঞে, দরোয়ানদের কথা বলিতে পারি না।
হ। লোকটা ধরা পড়িয়াছে ত?
ভৃ। আজ্ঞে হাঁ।
হ। তাহাকে এখানে আন্।
ভৃ। আজ্ঞে—-লোকটার গায়ে অসুরের মত বল। তিনজন দরোয়ানে অতিকষ্টে ধরিতে পারিয়াছে। এখনও তাহারা লোকটাকে ধরিয়া রহিয়াছে। বোধ হয়, একবার ছাড়া পাইলে এখনই পলায়ন করে। তাহাকে এখানে আনা বড় সহজ নহে।
“তরে চল, আমরাই সেখানে যাইতেছি”, এই বলিয়া হরিশবাবু দাঁড়াইয়া উঠিলেন। পরে আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “আমার পরম সৌভাগ্য যে, আপনি এ সময়ে আমার বাড়ীতে আছেন। একবার আমার সঙ্গে আসুন, ব্যাপার কি, দেখা যাউক।”
আমি সম্মত হইলাম; বলিলাম, “আপনি না বলিলেও আমি আপনার সঙ্গে যাইতাম। বোধ হয়, আপনার স্মরণ আছে যে, বাল্যকাল হইতে আমি এই সকল কার্য্যে আনন্দ বোধ করিয়া থাকি।”
বৈঠকখানার দরজার নিকট গিয়া দেখিলাম, উহার একপার্শ্বে নফরের দোকানের সেই কালীপ্রতিমাখানি চূর্ণ- বিচূর্ণ হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, প্রায় তিন ভাগ ভাল ভাল জিনিয় একবারে নষ্ট হইয়া গিয়াছে। কলিকাতার বনীয়াদী বড়লোকের বৈঠকখানা যেমন সুন্দর করিয়া সাজান, তাহা বোধ হয়, সকলেরই জানা আছে। ঘরে যত দামী ও সৌখিন জিনিয ছিল, প্রায় সকলগুলিই ভগ্নাবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে। আর সেই ঘরের একপাশে তিনজন বলিষ্ঠ দরোয়ান জহরলালকে বলপূর্ব্বক ধরিয়া রহিয়াছে।
সহসা জহরলালের দৃষ্টি আমার দিকে পতিত হইল, সে যেন চমকিত হইল। তাহার মুখ পাংশুবর্ণ ধারণ করিল এবং পরক্ষণেই এক বিকট চীৎকার করিয়া অজ্ঞান হইয়া মেঝের উপর পড়িয়া গেল। দরোয়ান তিনজন হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিল।
হরিশবাবু এই ব্যাপার দেখিয়া, একজন চাকরকে লোহার শিকল আনিতে আদেশ করিলেন। শিকল আনীত হইলে জহরলালকে উত্তমরূপে বন্ধন করা হইল।
হরিশবাবু তখন আমার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন কি করা যায় বলুন দেখি? – থানায় খবর দিব কি?”
আমি বলিলাম, “এখনই থানায় লোক পাঠাইয়া দিন। বড় ভয়ানক ব্যাপার! লোকটা সামান্য নয়।”
হরিশবাবু আমার কথা বোধ হয় ভাল বুঝিতে পারিলেন না। তিনি কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। পরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে কি এ লোক আপনার চেনা?”
আমি বলিলাম, “এখন আমায় কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবেন না। কিছু পরেই সমস্ত ব্যাপার জানিতে পারিবেন। আগে আমি আপনাকে দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি।”
হ। কি বলুন?
আ। এই দরজার পার্শ্বে একটা ভাঙ্গা প্রতিমূৰ্ত্তি পড়িয়া আছে। ওটি কি? জিনিষটা এমন করিয়া ভাঙ্গা হইয়াছে যে, উহাকে আর কিছুতেই চেনা যায় না।”
হ। ইহাই বোধ হয়, সেই কালীমূর্তি। হাঁ, ইহারই কথা আপনি বলিয়াছিলেন।
আ। প্রতিমাখানি আপনি কাল পাইয়াছেন?
হ। প্রতিমাখানি, বোধ হয়, কাল প্রাতেই পাইয়াছি।
আমি ইতিপূৰ্ব্বেই নফরের মুখে সে সংবাদ লইয়াছিলাম। প্রতিমাখানির অবস্থা দেখিয়া বোধ হইল, জহরলাল ঘরের অন্যান্য জিনিষ যে রকমে ভাঙ্গিয়াছে, পুতুলটিকে তাহার অপেক্ষা অনেক অধিক যত্ন করিয়া গুঁড়ান হইয়াছে। কেন এমন হইল? ঘরের আরও ভাল ভাল জিনিষ থাকিতে জহরলাল এই মাটীর পুতুলটাকে এমন করিয়া ভাঙ্গিল কেন? ঘরের চারিটি দেওয়ালে চারিটি এক রকমের ইংলিস-মেডঘড়ি ছিল। সেগুলিকে ও রকম করিয়া গুঁড়ায় নাই কে? এই সকল প্রশ্ন আমার মনের মধ্যে উদয় হইল।
পরক্ষণেই জোড়াসাঁকোর সুধীন্দ্রবাবুর আসবাব ভাঙ্গার কথা মনে পড়িল। সেও জহরলালের কাজ। সেখানেও জহরলাল পুতুলটিকে গুঁড়াইয়াছে। ঘরের অপরাপর জিনিষগুলিকে কেবল আছাড় মারিয়া ভাঙ্গিয়া ফেলা হইয়াছিল। জহরলাল কি রকমের পাগল? লোকের বাড়ীতে প্রবেশ করিয়া বৈঠকখানার জিনিষপত্র ভাঙ্গিবার তাৎপৰ্য্য কি? আর পুতুলগুলিকেই বা এ রকমে গুঁড়াইয়া ফেলিবার অর্থ কি?
নফরের দোকানে যে তিনটি পুতুল ছিল, তাহাদেরও এই দুর্দশা। সেখানেও জহরলাল পুতুলগুলিকে গুঁড়াইয়াছিল। পুতুল গুঁড়ানই জহরলালের উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশেই সে সুধীন্দ্র ও হরিশবাবুর বাড়ীতে প্রবেশ করিয়াছে। যখন জহরলালের উদ্দেশ্য স্থির রহিয়াছে, তখন সে পাগল কোথায়? জহরলাল নিশ্চয়ই পাগল নয়। তবে বোধ হয়, কোন ভয়ানক দুশ্চিন্তায় তাহাকে পাগলের মত করিয়া ফেলিয়াছে। নতুবা পাগলের উদ্দেশ্য ঠিক থাকে না। তাহাদের মনে যখন যাহা উদয় হয়, তাহাই করিয়া থাকে। পাগলের মনের ঠিক থাকে না। জহরলাল যখন মন ঠিক করিয়া কাজ করিতেছে, তখন সে কোন মতেই পাগল নহে।
তবে সে কেন এমন পাগলামি করে? এই প্রশ্ন আমার মনোমধ্যে উদয় হইল। ভাবিলাম, জহরলাল অনেক দিন ধরিয়া ঐ রকম প্রতিমা গড়িয়া আসিতেছে। কলিকাতার অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তির বাড়ীতেই জহরলালের প্রস্তুত কালীমূর্তি আছে। জহরলাল সেগুলি ভাঙ্গিবার চেষ্টা করিতেছে না কেন? যদি নিজের হাতের প্রস্তুত পুতুলগুলি ভাঙ্গিয়া ফেলিতে তাহার এতই ইচ্ছা হইয়া থাকে, তাহা হইলে সে অন্যগুলি না ভাঙ্গিয়া নূতন প্রস্তুত পুতুলগুলি ভাঙ্গিতেছে কেন?
কিছুক্ষণ এইরূপ নানা প্রকার চিন্তা করিয়া আমি হরিশবাবুকে বলিলাম, “জহরলাল এখনও অজ্ঞান অবস্থায় পড়িয়া আছে। ইত্যবসরে একবার উহার কাপড়খানি ভাল করিয়া দেখা দরকার। পুলিস আসিতে না আসিতে সে কার্য করিলে ভাল হয়।”
হরিশবাবু আশ্চর্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন বলুন দেখি? আমার বোধ হয়, লোকটা কিছুই লইতে পারে নাই।”
আ। একবার দেখা দরকার। যদি কোন দামী জিনিষ কোথাও লুকাইয়া রাখিয়া থাকে, সহজেই বাহির করা যাইবে। হ। তবে কি লোকটা চোর?
আ। সে কথা এখন বলিব না। পরে সমস্ত কথাই জানিতে পারিবেন। এতদিন উহাকে পাগলই মনে করিয়াছিলাম! কিন্তু আজ আমার সে ভ্রম গিয়াছে।
হ। লোকটার কাজ দেখিলে বোধ হয়, সে পাগল।
আ। আমিও আগে সেইরূপ মনে করিতাম, কিন্তু এখন আমার বোধ হয়, লোকটা পাগল নয়।
হ। কেন?
আ। পাগলের মনের ঠিক থাকে না। এ লোক একটা উদ্দেশ্য করিয়া এই সকল কার্য্য করিতেছে।
হ। লোকটা কে? ইহার বাড়ী কোথায়? আপনি যখন ইহাকে চেনেন, তখন ইহার নামধামও আপনার জানা
আছে।
আ। হাঁ, আছে। লোকটার নাম জহরলাল, বাড়ী সিকদার পাড়া।
হ। জহরলাল তবে আরও দুই এক জায়গায় এ রকম কাণ্ড করিয়াছে?
আ। হাঁ, আরও দুই জায়গায় জহরলাল এইরূপ উৎপাত করিয়াছে। বড় ভয়ানক রহস্য হরিশবাবু! এখন আমায় আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবেন না। শীঘ্রই সমস্ত ব্যাপার জানিতে পারিবেন। এখন একবার জহরলালের কাপড় খুঁজিয়া দেখুন!
হরিশবাবু তখনই দুইজন লোককে সেই কার্যে নিযুক্ত করিলেন। অনেকক্ষণ ধরিয়া জহরলালের কাপড় দেখা হইল, কিন্তু কোন জিনিষ পাওয়া গেল না।
এই সময়ে পুলিসের লোক আসিয়া উপস্থিত হইল। ইনস্পেক্টারবাবু আমার পরিচিত ছিলেন। আমায় দেখিয়া বলিলেন, “আপনি প্রথমেই আসিয়াছেন দেখিতেছি! কিছু বুঝিতে পারিলেন কি? লোকটা কে?”
আ। জহরলাল।
ই। আমিও তাই ভাবিয়াছিলাম। সে’বার আপনার অনুরোধেই সে মুক্তি পাইয়াছিল।
আ। হাঁ। জহরলালকে মুক্তি দিবার কারণ আছে।
ই। কি কারণ?
আ। সে কথা পরে জানিবেন। এখন লোকটাকে এখান হইতে লইয়া যান।
ই। জহরলাল কোথায়?
আ। ঐ যে, বৈঠকখানার ভিতরে পড়িয়া আছে। এতক্ষণ অজ্ঞান হইয়া গিয়াছিল। এখন দেখিতেছি, উহার জ্ঞান হইয়াছে।
ই। হঠাৎ অজ্ঞান হইল?
আ। হাঁ—আমাকে এখানে দেখিয়াই জহর হতচেতন হইয়া মেঝের উপর পড়িয়াছিল। আপনি উহাকে এখান হইতে লইয়া যান। কিন্তু বিশেষ সাবধানে থাকিবেন। নতুবা সুবিধা পাইলেই ও আবার পলায়ন করিবে।
ই। কিসে জানিলেন?
আ। উহার কার্য্য এখন শেষ হয় নাই। খুব সম্ভব, এবার আমার বাড়ীতে গিয়া উৎপাত করিবে। ইনস্পেক্টার মহাশয় হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন, আপনার অপরাধ কি?”
আমি বলিলাম, “আমার ঘরে উহার হাতের প্রস্তুত একখানি কালীমূর্তি আছে। এবার সেইখানা ভাঙ্গিবার জন্য চেষ্টা করিবে বলিয়া বোধ হয়।”
ই। শুনিয়াছি ও লোকটা ভাল ভাল পুতুল গড়িতে পারিত। ও কি নিজের হাতের প্রস্তুত পুতুলগুলি এই রকম করিয়া ভাঙ্গিয়া বেড়াইতেছে?
আ। হাঁ; কিন্তু সকলগুলি নয়।
ই। তবে কোনগুলি?
আ। পাগল হইবার ঠিক আগে যে পুতুলগুলি গড়িয়াছিল, ও এখন কেবল সেইগুলিই ভাঙ্গিয়া বেড়াইতেছে। ই। আপনার বাড়ীতে উৎপাত করিবে কেন?
আ। আমিও যে উহার হাতের একখানি কালীমূৰ্ত্তি কিনিয়াছি।
ই। সৰ্ব্বশুদ্ধ কয়খানি মূৰ্ত্তি লোকটা ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছে?
আ। পাঁচখানি।
ই। পাগল হইবার আগে কয়খানি গড়িয়াছিল?
আ। ছয়খানি।
ই। তবে যেখানি ভাঙ্গিতে বাকি আছে, সেখানি আপনারই বাড়ীতে?
আ। হাঁ, সেইজন্যই সাবধান হইতে বলিতেছি।
ই। আমরা বিশেষ সাবধানে থাকিব, সে জন্য আপনার কোন চিন্তা নাই। আপনি কি আমাদের সঙ্গে থানায় যাইবেন না?
আ। না, আপনাদের সঙ্গে যাইতে পারিব না বটে, কিন্তু আমিও শীঘ্রই থানায় যাইব। ইনস্পেক্টার মহাশয় তখন জহরলালকে আবদ্ধ অবস্থায় একখানা গাড়ীর উপর তুলিলেন এবং আপনি ভিতরে বসিয়া পাহারাওয়ালাগুলিকে গাড়ীর চালে বসিতে বলিলেন। কিছুক্ষণ পরেই গাড়ী চলিয়া গেল।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
ইনস্পেক্টারবাবু জহরলালকে লইয়া যাইবার পর, আমি হরিশবাবুকে বলিলাম, “মহাশয়! কিছুদিন পূর্ব্বে নফরের দোকানে পূর্ব্ববঙ্গের এক জমীদার পুত্রকন্যা লইয়া পুতুল কিনিতে গিয়াছিল। কিছুক্ষণ দোকানে থাকিবার পর জমীদার মহাশয়ের কন্যার গলার হারের একখানি ধুকধুকি হারাইয়া যায়। ধুকধুকিখানি সোনার ছিল কিন্তু তাহাতে একখানি খুব দামী হীরা বসান ছিল। সম্ভবতঃ হীরাখানি ভাল করিয়া বসান ছিল না। অনেক অনুসন্ধানের পর ধুকধুকিখানি পাওয়া গেল বটে, কিন্তু হীরাখানি পাওয়া গেল না।
জমীদার মহাশয় তখন থানায় খবর দিলেন। যথাসময়ে পুলিস আসিল। চারিদিক অন্বেষণ করা হইল, কিন্তু হীরাখানি কোথাও পাওয়া গেল না। কাজেই নফর ও তাহার কারিগরগুলিকে থানায় চালান দেওয়া হইল। সেখানে সকলের কাপড়চোপড় বেশ করিয়া খোঁজা হইল, কিন্তু হীরাখানি কাহারও নিকট হইতে বাহির হইল না।
অনেক অনুসন্ধানের পরও যখন হীরা পাওয়া গেল না, তখন লোকগুলিকে ছাড়িয়া দেওয়া হয়। নফর ও তাহার আর আর কারিগর থানা হইতে ফিরিয়া আসিয়া আগেকার মত কাজ করিতে লাগিল, কেবল এই জহরলাল বাড়ী ফিরিয়া আসিয়া একেবারে উন্মাদ হইয়া গেল।
হরিশবাবু আমার কথা শুনিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ঐ লোকটা কি নফরের কারিগর?”
আ। হাঁ।
হ। হঠাৎ পাগল হইবার কারণ কি?
আ। আমি প্রথমে মনে করিয়াছিলাম যে, জহরলাল আর কখনও থানায় যায় নাই। ভয়ে ও লজ্জায় হয়ত সে পাগল হইয়া গিয়াছে,—লোকটা ভাবিয়া ভাবিয়া পাগলের মত হইয়া গিয়াছে। নতুবা সে একেবারে উন্মাদ পাগল হয় নাই।
হ। এমন কি দুশ্চিন্তা যে, তাহাতে একজন সুস্থ লোককে অতি সামান্য সময়ের মধ্যে পাগল করিয়া ফেলিল?
আ। সে কথা এখনও সাহস করিয়া বলিতে পারি না। যদি প্রমাণ করিতে পারি, তবেই একথা জানিতে পারিবেন। এখন আপনি যদি থানায় যাইতে ইচ্ছা করেন, আমার সহিত আসিতে পারেন।
হ। আপনি কি এখনই থানায় যাইবেন?
আ। আগে একবার বাড়ী যাইব। সেখান হইতে আমার পুতুলটি লইয়া থানায় যাইব।
হ। পুতুল লইয়া যাইবার কারণ কি?
আ। থানায় গিয়া সকলের সমক্ষে উহাকে ভাঙ্গিয়া ফেলিব।
হ। কেন?
আ। সে কথা এখন বলিব না। যদি আমার সঙ্গে যান, তাহা হইলে স্বচক্ষে দেখিতে পাইবেন।
হরিশবাবু আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া একখানি গাড়ী তৈয়ার করিতে হুকুম দিলেন। গাড়ী দরজায় আসিলে আমরা তাহাতে উঠিলাম।
আমার বাড়ীর দরজায় গাড়ী থামিলে, আমি গাড়ী হইতে নামিয়া বাড়ীর ভিতর গমন করিলাম, হরিশবাবু গাড়ীর ভিতর বসিয়া রহিলেন।
পুতুলটি আমার শোবার ঘরে রাখিয়াছিলাম। সেখানে গিয়া দেখিলাম, পাড়ার জনকতক লোক সেই প্রতিমাখানি দেখিতে আসিয়াছে। আমায় দেখিয়া সকলেই সরিয়া গেল। আমিও প্রতিমা লইয়া সেখান হইতে বাহির হইলাম।
প্রায় আধ ঘণ্টার পর আমরা পুলিসে উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, ইনস্পেক্টারবাবু জহরলালকে হাজত-ঘরে রাখিয়া আমাদের জন্য অপেক্ষা করিতেছেন। আমাদিগকে দেখিয়া তিনি বলিলেন, “আমি ভাবিয়াছিলাম, আজ রাত্রে আর আপনারা কষ্ট করিয়া এখানে আসিবেন না।”
আমি বলিলাম, “আমরা সাহেবের বাড়ী যাইতেছি। আপনার সহিত এখানে দেখা করিব বলিয়াছিলাম, সেইজন্যই এখানে আসিয়াছি, এখন চলিলাম।”
এই বলিয়া পুলিস হইতে বাহির হইতেছি, এমন সময়ে ইনস্পেক্টারবাবু বলিলেন, “আমিও আপনাদের সঙ্গে যাইতে ইচ্ছা করি।”
আমি সম্মত হইলাম, এবং তিনজনে সেই প্রতিমাখানি লইয়া সাহেবের নিকট গমন করিলাম। সাহেবের তখন আহারাদি শেষ হইয়া গিয়াছে। তিনি একটা প্রকাণ্ড দালানে একখানি আরামচৌকির উপর শুইয়া চুরুট সেবন করিতেছিলেন। সেই রাত্রে আমাদের তিনজনকে দেখিয়া তিনি প্রথমতঃ আশ্চর্যান্বিত হইলেন, পরে সহাস্যমুখে বসিতে বলিলেন।
আমি তাঁহার নিকট বসিয়া প্রথমে আমার সঙ্গী দুইজনের পরিচয় দিলাম. এবং তাঁহাদিগকে সেখানে লইয়া যাইবার উদ্দেশ্যও প্রকাশ করিলাম। পরে বলিলাম, “কিছুদিন পূর্ব্বে আপনি পার্ব্বতীচরণ নামে পূর্ব্ববঙ্গের এক জমীদারের একখানি দামী হীরার সন্ধানে নিযুক্ত করিয়াছিলেন, ঈশ্বরের ইচ্ছায়, আমি তাহার সন্ধান পাইয়াছি।’
সাহেব প্রথমে আশ্চর্য্যান্বিত হইলেন। পরে হাসিতে হাসিতে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায়?”
আমি কালীপ্রতিমাখানি দেখাইয়া উত্তর করিলাম, “ইহারই মধ্যে।”
সাহেব আরও আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন। আগ্রহের সহিত বলিলেন, “কই? বাহির কর দেখি?”
আমি তখন মনে মনে কালীমাতার নাম স্মরণ করিয়া প্রতিমাখানি চূর্ণ করিয়া ফেলিলাম। সেই চূর্ণগুলি একখানি শিলার উপর রাখিয়া আস্তে আস্তে গুঁড়াইতে লাগিলাম। তখনই হীরাখানি বাহির হইয়া পড়িল। আমি তুলিয়া লইয়া ভাল করিয়া পরিষ্কার জলে ধুইয়া ফেলিলাম। দেখিলাম, পাথরখানি দামী বটে। পার্ব্বতীচরণ যে দর বলিয়াছিল, আমার বিবেচনায় তদপেক্ষা অধিক।
দেখিয়া সাহেব, হরিশবাবু ও ইনস্পেক্টারবাবু স্তম্ভিত হইলেন। কিছুক্ষণ তাঁহাদের কাহারও মুখ দিয়া কোন কথা বাহির হইল না।
কিছুক্ষণ পরে সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোন সূত্র ধরিয়া আপনি এ রহস্য ভেদ করিলেন?”
আমি হাসিতে হাসিতে বলিলাম, “সেই কথা বলিবার জন্যই এত রাত্রে আপনার নিকট আসিয়াছি। জহরলাল যে কি ভয়ানক লোক, তাহা আপনারা শুনিলে আশ্চৰ্য্যান্বিত হইবেন। জহরলালই হীরাখানি কুড়াইয়া পাইয়াছিল। ধুকধুকিখানা যখন গলা হইতে মাটীতে পড়িয়া যায়, তখন হীরাখানি খুলিয়া নিশ্চয়ই জহরলালের টুলের পায়ার নিকট গড়াইয়া গিয়াছিল। জহরলাল সকলের অলক্ষ্যে সেখানি কুড়াইয়া লইয়া, সে যে মাটী দিয়া পুতুল গড়িতেছিল, সেই মাটীর ভিতর লুকাইয়া ফেলিল। সেই হীরা সমেত পুতুল গড়িয়াছিল। সুতরাং দোকান ঘর খুঁজিয়া তোলপাড় করিলেও হীরা পাওয়া যায় নাই। সৌভাগ্যক্রমে আমি এই প্রতিমাখানি কিনিয়াছিলাম। সেই জন্য ইহা পুনঃপ্রাপ্ত হইতে বিশেষ কষ্ট করিতে হইল না।”
সাহেব বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন করিয়া জানিলে যে, জহরলাল এ কাজ করিয়াছে?
আমি হাসিতে হাসিতে বলিলাম, “জহরলাল যেদিন থানা হইতে মুক্তি পায়, সেই দিন বাড়ীতে ফিরিয়াই পাগল হইয়া যায়। যখন তাহাকে দেখিতে যাই, তখন আমি কৌশলে হীরার কথা ফেলিয়াছিলাম। কিন্তু হীরার নাম শুনিবামাত্র সে অজ্ঞান হইয়া পড়ে। আমি প্রথমে তাহাকে পাগল মনে করিয়াছিলাম, কিন্তু যখন দেখিলাম যে, সে তাহার প্রস্তুত শেষ ছয়খানি কালীমূর্তি ভাঙ্গিবার জন্য এইরূপ পাগলামী করিয়া বেড়াইতেছে, তখনই আমার সন্দেহ হইল যে, সে নিশ্চয়ই হীরাখানি কুড়াইয়া পাইয়াছিল এবং এই পুতুলের মাটির সঙ্গে রাখিয়াছিল। সকল পুতুলই এক প্রকার, সুতরাং কোটি সেই হীরা সমেত মাটী দিয়া গঠিত, তাহা জানিতে না পারিয়া, একে একে সকলগুলিই ভাঙ্গিতে লাগিল।
সা। যেগুলি বিক্রয় হইয়াছিল, তাহাদের সন্ধান পাইলে কিরূপে?
আ। পাঁচখানি প্রতিমার বায়না দেওয়া ছিল। সকলেই অগ্রিম দাম দিয়াছিল। যে খাতায় সেই সকল লোকের নাম ধাম লেখা আছে, তাহা জহরলাল জানিত, এবং মধ্যে মধ্যে সেও উহাতে লিখিয়া থাকিত।
সা। কয়খানি প্রতিমা প্রস্তুত হইয়াছিল?
আ। ছয়খানি। তাহার মধ্যে পাঁচখানির মূল্য আগেই দেওয়া হইয়াছিল, অবশিষ্ট একখানি আমি কিনিয়া লইলাম। সা। আপনার পুতুলের মধ্যেই যে হীরা আছে, তাহা কি করিয়া জানিলেন?
আ। যখন জহরলাল পাঁচখানি ভাঙ্গিয়া পায় নাই তখন বুঝিলাম, ইহার মধ্যে আছে।
সা। অপরগুলিতে পায় নাই, আপনি কি রকমে জানিতে পারিলেন?
আ। যখন সে হরিশবাবুর বাড়ীর পুতুলটি ভাঙ্গিতে আসে, তখন যে সে অপর চারিখানিতে পায় নাই, তাহা নিশ্চয়।
সা। ঠিক কথা। জহরলাল বড় চতুর লোক। পাগলের ভাণ করিয়া অনেকবার অব্যাহতি পাইয়াছে।
আ। পাগলের ভাণ বলা যায় না। কারণ সময়ে সময়ে সত্য সত্যই উহার মস্তিষ্ক বিকৃত হইয়া যায়। তখন ও কি করে, কি বলে, কিছুই জ্ঞান থাকে না। কিন্তু অধিকাংশ সময়েই সে ভাল থাকে। পাগলের মন ঠিক থাকে না, জহরলাল মন ঠিক করিয়া স্বহস্ত-নির্ম্মিত শেষ পুতুল ছয়টি ভাঙ্গিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইয়াছিল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যদি ও ছাড়া পায়, তাহা হইলে কোন না কোন দিন এই প্রতিমা ভাঙ্গিবার জন্য আমার বাড়ীতে যাইত। যদিও আমি নগদ মূল্য দিয়া কিনিয়াছি, সুতরাং আমার নাম ধাম কোনস্থানে লেখা নাই, তবুও জহরলাল কোন না কোন কৌশলে আমার সন্ধান বাহির করিত। দোকানের দুই একজন লোক ও নফর নিজে আমার নাম এখন বেশ জানে।
সাহেবের সহিত এই সকল কথাবার্তা হইবার পর, আমরা সেই স্থান হইতে বিদায় গ্রহণ করিলাম।
এবারে জহরকে আর পরিত্রাণ দেওয়া হইল না। মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট তাহাকে বিচারার্থ প্রেরণ করা হইল। ফলে প্রমাণ-প্রয়োগ গ্রহণ করিয়া ও আমার নিকট সমস্ত কথা শুনিয়া, এখন জহরলাল প্রকৃত পাগলে পরিণত হইয়াছে কি না, তাহা জানিবার নিমিত্ত, উহাকে ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে রাখিলেন। প্রায় ১৫ দিবস পরে ডাক্তার সাহেব উহাকে পাগল বলিয়া স্থির করিলেন। সুতরাং জহরলাল পাগলা গারদে গমন করিল। পাৰ্ব্বর্তীবাবু তাঁহার হীরা পুনঃপ্রাপ্ত হইলেন। আমার কথাও শেষ হইল।
[ চৈত্র, ১৩১৩]