বাঁশী

বাঁশী 

প্রথম পরিচ্ছেদ

শ্রাবণ মাস। প্রাতঃকাল। গতরাত্রে অনবরত মুষলধারে বৃষ্টি হইয়াছে। এখনও আকাশ মেঘাচ্ছন্ন; অল্প অল্প বৃষ্টিও পড়িতেছে। বাতাসের জোর ভয়ানক, যেন ঝড় বহিতেছে। 

আমাকে প্রায়ই সকালে উঠিতে হয়। কিন্তু গতরাত্রে প্রায় তিনটা পর্য্যন্ত কার্য্য করিয়া, এত ভোরে উঠিবার আমার আদৌ ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু মানুষের আরজি আর ঈশ্বরের মরজি। মানুষ ভাবে এক হয় আর। 

এত দুৰ্য্যোগেও কোন ভদ্রলোক আমার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছেন। আমার চাকর বলিল, “বাবুর বড় দরকার।” 

আমি সে কথা আগেই বুঝিতে পারিয়াছিলাম। দরকার না হইলে এই ভয়ানক দুর্যোগে এত সকালে আমার নিকট আসিবেন কেন? কাজেই তাড়াতাড়ি মুখ হাত ধুইয়া বাবুর সহিত দেখা করিলাম। দেখিলাম, তিনি সুপুরুষ; তাঁহার দেহ উন্নত, বয়স প্রায় চল্লিশ বৎসর। তাঁহার মস্তকে সুচিক্কণ কুঞ্চিত কেশরাশি, হস্তে একগাছি লাঠী, পরিধানে একখানি পাৎলা কালাপেড়ে ধুতি, একটি পাঞ্জাবী জামা, একখানি কোঁচান উড়ানি। পায়ে বার্ণিস জুতা ও রেশমী মোজা। 

দেখা হইবামাত্র আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “মহাশয়ের কোথা হইতে আসা হইতেছে?” 

তিনি অতি বিমর্ষভাবে উত্তর কহিলেন, “আমি বালিগঞ্জ হইতে আসিতেছি। আমার নাম অমরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। বড় বিপদে পড়িয়াই এই অসময়ে আপনার নিকট আসিয়াছি।” 

বিখ্যাত জমীদার অমরেন্দ্রকে চিনে না এমন লোক কলিকাতায় অতি কম। আমিও অনেকবার তাঁহার নাম শুনিয়াছিলাম, কিন্তু এ পর্য্যন্ত দেখা করিবার সুবিধা হয় নাই। 

আমি কোন উত্তর না করিয়া, তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া আছি দেখিয়া, তিনি বলিলেন, “আমার পরিচিত দুই একটি বড় লোকের বাড়ীতে আপনি যেরূপ সুখ্যাতির কার্য্য করিয়াছেন, তাহাতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, আপনার দ্বারাই আমার যথেষ্ট উপকার হইবে।” 

আমি হাসিয়া উত্তর করিলাম, “অনুমতি করুন, আমি কিরূপে আপনার উপকার করিতে পারি। কি হইয়াছে বলুন, “আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করিব।” 

অমরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “চক্রবেড়ের বিখ্যাত জমীদার প্রাণকৃষ্ণ বাঁড়য্যের ভ্রাতুষ্পুত্রীর সহিত আমার পুত্রের বিবাহ স্থির হইয়া গিয়াছে। গত কল্য আয়ুবৃদ্ধন্ন উপলক্ষে আমরা চক্রবেড়ে গিয়াছিলাম। জমীদার বাড়ীতে বিবাহ; ছোট বড় অনেক লোকের সমাগম হইয়াছিল। সকলের আহারাদি শেষ না হইলে আমার ফিরিয়া আসা ভাল দেখায় না। মনে করিয়া, আমাকে কাল চক্রবেড়েই থাকিতে হইয়াছিল। আমাদের বাড়ীর আর সকলে কলিকাতায় ফিরিয়াছিল। প্রাণকৃষ্ণবাবুর পরিবারের মধ্যে তাঁহার স্ত্রী ও একটি দুগ্ধপোষ্য বালক; দুইটি ভ্রাতুষ্কন্যা ছিল। — দুই বৎসর পূর্ব্বে একটির মৃত্যু হওয়ায় এখন আমার ভাবী বধূমাতাই একমাত্র ভ্রাতুষ্কন্যা; তাঁহার শাশুড়ী ঠাকুরাণী ও দূরসম্পর্কীয়া এক বিধবা ভগ্নী। সরকার, চাকর, দাসী, দারোয়ান প্রভৃতি অনেকগুলি বাজে লোকও আছে। রাত্রি প্রায় একটার পরে আমি শয়ন করি। আমার পার্শ্বের গৃহে আমার ভাবী বধূমাতা শয়ন করিয়াছিল। একজন দাসী তাহাকে মানুষ করিয়াছিল, সেও সেই ঘরে থাকিত। অধিক রাত্রিজাগরণ জনাই হউক, অথবা অন্যত্র শয়ন করিবার জন্যই হউক, আমার ভাল নিদ্রা হইল না। রাত্রি চারিটার সময় সহসা পার্শ্বের গৃহ হইতে এক ভয়ানক চীৎকার ধ্বনি শুনিতে পাইলাম। কণ্ঠস্বর আমার ভাবী বধূমাতার বলিয়াই বোধ হইল। আমি শয্যা হইতে উঠিলাম, আস্তে আস্তে গৃহ হইতে বহির্গত হইলাম। মনে করিলাম, পাশের ঘরে গিয়া ব্যাপার কি দেখিয়া আসি; কিন্তু সাহস করিলাম না। নূতন কুটুম্বের বাড়ী, তাঁহার উপর সে ঘরে আমারই ভাবী বধূমাতা শুইয়া আছে। সাত পাঁচ ভাবিতেছি, এমন সময়ে সেই ঘরের দরজা খুলিয়া গেল! দাসী এক হস্তে একটি আলোক ও অপর হস্তে বধূমাতাকে ধরিয়া তাড়াতাড়ি ঘর হইতে বাহির হইল। আমি তখনই তাহাদের নিকট যাইলাম। অন্য সময় হইলে বধূমাতা আমাকে দেখিবামাত্র পলায়ন করিত; কিন্তু তখন সে পলায়ন করিল না। তাহার অবস্থা দেখিয়া বোধ হইল, তাহার জ্ঞান নাই। তাহার সর্ব্বাঙ্গ থর থর করিয়া কাঁপিতেছে, ঘন ঘন দীর্ঘনিশ্বাস পড়িতেছে ও মুখ নিতান্ত মলিন হইয়া গিয়াছে। বধূমাতার এইরূপ অবস্থা দেখিয়া, আমারও ভয় হইল। আমি ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া, দাসীকে লক্ষ্য করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি হইয়াছে? বৌমা অমন করিতেছে কেন?”

দাসী অতি বিষণ্ণবদনে উত্তর করিল,—“সুধা বড় ভয় পাইয়াছে।” 

আ। ভয় কিসের? 

দা। সুধাকে জিজ্ঞাসা করুন। উহার কথা আমি ভাল বুঝিতে পারিতেছি না। 

আমি সুধার দিকে চাহিলাম। দেখিলাম, সে মাথায় কাপড় দিয়াছে। বোধ হইল, আমাদের কথাবার্তায় তাহার জ্ঞান সঞ্চার হইয়াছিল, সে আমার কথা বুঝিয়াছিল। আমাকে তাহার দিকে চাহিতে দেখিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে অস্পষ্ট ভাবে বলিল, “সেই বাঁশীর আওয়াজ! আমার বড় ভয় হইয়াছে; হয় ত আমি আর এ যাত্রা রক্ষা পাইব না।” 

বৌমার কথায় আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। আমিও তাহার কথার ভাব বুঝিতে পারিলাম না। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কোন্ বাঁশী মা? বাঁশীর আওয়াজ শুনিয়া এত ভয়ই বা কিসের? তুমি শান্ত হও; অমন অলক্ষণে কথা আর মুখে আনিও না!” 

বৌমা যেন আমার কথায় একটু সুস্থ হইল, খানিক পরে বলিল, “দুই বৎসর হইল দিদির বিবাহের সম্বন্ধ স্থির হয়। বিবাহের এক সপ্তাহ আগে সেও দুই তিন দিন এই রকম হিস্ হিস্ শব্দ ও এক রকম বাঁশীর স্বর শুনিতে পায়। তার পরেই একদিন সে হঠাৎ মারা পড়ে। আজ রাত্রে আমিও প্রথমে একপ্রকার হিস্ হিস্ শব্দ শুনিতে পাই। শব্দ শুনিয়াই আমার প্রাণে কেমন আতঙ্ক হয়। আমি উঠিয়া বামাকে ডাকি। বামা উঠিয়া আলোক জ্বালিল; কিন্তু কিছুই দেখিতে পাইলাম না। আমি আবার শুইবার চেষ্টা করিতেছি, এমন সময়ে বাঁশীর স্বর আমার কর্ণে প্রবেশ করে। আমি ভয়ে চীৎকার করিয়া উঠি। তখন বামা আমায় ধরিয়া গৃহ হইতে বাহির করিয়া আনে।” 

সুধার কথা শুনিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমার দিদি কি তোমাদের খুড়া মহাশয়কে সে সকল কথা বলিয়াছিল?” 

সু। হাঁ; কিন্তু তিনি উপহাস করিয়া সে কথা উড়াইয়া দেন। 

আ। তোমার দিদির হঠাৎ মৃত্যুতে পুলিস কোনরূপ গোলযোগ করে নাই? 

সু। হাঁ; পুলিসের লোকে বাড়ী ভরিয়া গিয়াছিল; কিন্তু তাহারাও কিছু করিতে পারিল না। 

আ। তবে তাহার হঠাৎ মৃত্যুর কারণ কি? 

সু। ডাক্তার বলিয়াছিল, অত্যন্ত ভয়েই আমার দিদির মৃত্যু হইয়াছিল। 

আ। আর পুলিস কি বলিল? 

সু। পুলিসেরও সেই মত। 

আ। আমার ইচ্ছা এ বিষয় একবার তোমার খুড়াকে জানাই। 

সু। ইচ্ছা করেন, জানান; কিন্তু কোন ফল হইবে না! তিনি বিশ্বাস করিবেন না; হাসিয়া কথাটা উড়াইয়া দিবেন।

আ। বামাও কি বাঁশীর স্বর শুনিয়াছে? 

সু। আজ্ঞে হাঁ। 

সকল কথা শুনিয়া আমার বড় ভাল বোধ হইল না। বৌমা ও তাহার দাসীকে সেই সকল কথা অপর কাহাকেও বলিতে নিষেধ করিয়া, আমি তাহাদিগকে বিদায় দিলাম। পরদিবস প্রাতে আমার ভাবী বৈবাহিকের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, আমি আমার বাড়ীতে ফিরিয়া আসিলাম; কিন্তু বাঁশীর কথা আর কাহাকেও বলিলাম না। 

অমরেন্দ্রনাথের কথা শুনিয়া আমার মনে হইল, ইহার মধ্যে কোন একটি গুরুতর রহস্য আছে। আমি তাঁহাকে কহিলাম, ‘আমার সর্ব্বপ্রধান কর্মচারীর আদেশ না পাইলে ত আমি ইহাতে হস্তক্ষেপ করিতে পারি না, সে বিষয়ে আপনি কোনরূপ বন্দোবস্ত করিয়াছেন কি?” 

আমার কথা শুনিয়া অমরেন্দ্রবাবু কহিলেন, “হাঁ, সে বন্দোবস্ত আমি করিয়াছি, সে কথা আমি আপনাকে বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি। আমি আপনার প্রধান কর্ম্মচারীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, তাঁহাকে সমস্ত কথা বলি ও যাহাতে আপনার সাহায্যপ্রাপ্ত হই, তাহার নিমিত্ত উপরোধ করি। তিনিও আমার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া, এই কার্য্যের ভার আপনার হস্তে প্রদান করিয়াছেন ও আপনাকে এক পত্রও লিখিয়া দিয়াছেন। তাঁহারই নিকট হইতে আমি আপনার নিকট আগমন করিতেছি।” এই বলিয়া অমরেন্দ্রবাবু একখানি পত্র আমার হস্তে প্রদান করিলেন। দেখিলাম, উহা আমার প্রধান কর্মচারীর হস্তলিখিত ও যতদুর সম্ভব তিনি আমাকে এই বিষয়ে সাহায্য করিতে আদেশ করিয়াছেন। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

অমরেন্দ্রবাবুর মুখে সুধার ভগ্নীর মৃত্যুর কথা যেরূপ শুনিলাম, তাহাতে বড়ই আশ্চর্য্য হইলাম। যখন পুলিস হঠাৎ মৃত্যুর কথা শুনিয়াছিল, তখন মৃতদেহ নিশ্চয়ই পরীক্ষা করা হইয়াছিল; এই স্থির করিয়া অমরেন্দ্রবাবুকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার ভাবী বধূমাতার ভগ্নীর মৃতদেহ পরীক্ষা করিয়া, ডাক্তার সাহেব কি বলিয়াছিলেন?” 

অমরেন্দ্র উত্তর করিলেন, “আজ্ঞে সে কথা আমি বলিতে পারিলাম না। সুধা আমায় সে কথা বলে নাই; সম্ভবতঃ সে কিছু জানে না।” 

আমি দেখিলাম, সুধার সহিত এ বিষয়ে একবার কথা না কহিলে কোনরূপ সুবিধা করিতে পারিব না। অমরেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আমার বেয়াদবী মাপ করিবেন। আমি একবার আপনার ভাবী পুত্রবধূর সহিত দেখা করিতে ইচ্ছা করি। কোনরূপ সুবিধা হইতে পারে?” 

অমরেন্দ্র উত্তর করিলেন, “বিবাহের আগে সুধাকে আর এ বাড়ীতে আনা যায় না। তবে যদি। আজ্ঞা হাঁ, সুধার সহিত দেখা হইবার সুবিধা করিতে পারি। সুধার মামী আমাদের দূর-সম্পর্কের একজন আত্মীয়। তিনি এখন জোড়াসাঁকোয় আছেন। তিনি সুধাকে আইবড় ভাত খাওয়াইবার ছলে জোড়াসাঁকোয় আনিতে পারেন। আপনি সেখানে বাইলে আমি কৌশলে তাহাকে আপনার সাক্ষাতে আনিতে পারিব।” 

আমি হাসিয়া বলিলাম, “উত্তম পরামর্শ করিয়াছেন। কিন্তু অধিক বিলম্ব করিবেন না। আপনার পুত্রের বিবাহ কবে?” 

আ। আজ বুধবার আর বুধবারে। 

আ। তবে এখনও ছয়দিন দেরী। 

অ। আজ্ঞে হাঁ। বলেন ত আজই সুধাকে জোড়াসাঁকোয় আনাইবার চেষ্টা করি। 

আা। বেশ– তাহাই করুন। আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করিয়া থাকিব। আপনি বেলা একটার সময় সংবাদ দিবেন। 

অমরেন্দ্রনাথ চলিয়া গেলেন। আমিও স্নানাহার সমাপন করিয়া হাতের কাজ সারিলাম। বেলা একটার কিছু পরেই অমরেন্দ্র পুনর্বার আমার বাসায় আসিলেন। বলিলেন, “সুধা আজই বেলা তিনটার সময় জোড়াসাঁকোয় আসিবে। সম্ভবতঃ সে আজ সেই স্থানেই থাকিবে। আপনি কখন যাইতে ইচ্ছা করেন?” 

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “সুধার খুড়া মহাশয় কিছু বলিলেন না?” 

তা। আজ্ঞে না, তবে তিনি বলিয়া দিয়াছেন যে, সুধাকে আজই ফিরিতে হইবে। 

আ। যিনি আনিতে গিয়াছিলেন, তিনি কি উত্তর করিলেন? 

অ। তিনি বলিয়াছেন, যদি অধিক বিলম্ব হয়, তাহা হইলে সে আজ ফিরিতে পারিবে না। সুধার খুড়া তাহার কথায় মনে মনে রাগান্বিত হইয়াছিলেন বটে, কিন্তু তাঁহার কথার উপর বেশী কথা বলিতে সাহস করেন নাই। 

আ। আমার বিশ্বাস, সুধাকে আজই যাইতে হইবে। যদি আপনারা স্ব-ইচ্ছায় না পাঠাইয়া দেন, তাহা হইলে, তিনি স্বয়ং লোক পাঠাইয়া সুধাকে লইয়া যাইবেন। 

অ। আপনার অনুমান সত্য হইতে পারে; কেন না, প্রাণকৃষ্ণ বাবু বড় কড়া লোক, তিনি যাহা বলেন তাহা করেন।

আ। প্রাণকৃষ্ণ বাবুর বয়স কত? 

অ। বয়স প্রায় চল্লিশ বৎসর। 

আ। তাঁহাকে দেখিতে কিরূপ? 

অ। অত্যন্ত বলিষ্ঠ। এমন কি, প্রতিবেশীগণ তাঁহাকে অসুর বলিয়া সম্বোধন করিয়া থাকে? 

আ। তাঁহার চরিত্র? 

তা। নিতান্ত মন্দ নয়। কিন্তু বড় একগুঁয়ে। পল্লীর সকলেই তাঁহাকে ভয় করে। এক সময়ে তিনি এক প্রতিবেশীকে এমন আঘাত করেন যে, তাহার হাত ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল। সেই অবধি আর কোন লোক তাঁহার মতের বিরুদ্ধে কোন কথা বলিতে সাহস করে না। এখন আপনি কখন যাইতে চান বলুন? 

আ। তবে চলুন, এখনই যাইতেছি। আপনার বৈবাহিক মহাশয় যেমন লোক শুনিতেছি, তাহাতে তিনি কখন আসিয়া সুধাকে লইয়া যাইবেন বলা যায় না। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

আমাকে বৈঠকখানায় রাখিয়া অমরেন্দ্র বাড়ীর ভিতর গমন করিলেন। তাঁহার আত্মীয়ার বাড়ীখানি ছোট, কিন্তু যেন ছবির মত। বাড়ীতে লোকজন অতি কম। একজন চাকর ও এক দাসী বাড়ীর কর্তা ও গৃহিণীর সেবা করে। সন্তানাদি দেখিতে পাইলাম না! 

আমি বৈঠকখানায় একখানি মখমলের গদী পাতা চেয়ারে বসিয়া রহিলাম। অমরেন্দ্র আমার উপদেশ মত অন্দরে গিয়া প্রকাশ করিলেন, তাঁহার এক বন্ধু সুধাকে দেখিতে আসিয়াছেন। শুনিলাম, বাড়ীর কর্তা উপস্থিত নাই। প্রায় আধঘণ্টা বসিয়া ভাবিতেছি, এমন সময় অমরেন্দ্র এক বালিকার হাত ধরিয়া বৈঠকখানায় প্রবেশ করিলেন। আমি দেখিয়াই তাঁহাকে বলিয়া উঠিলাম, “দিব্যি মেয়ে। আপনার বৌমা বেশ সুন্দরী।” 

অমরেন্দ্রনাথ বিমর্যভাবে উত্তর করিলেন, “ভগবানের ইচ্ছায় আগে সেই দিনই হউক।” 

আমি বলিলাম, “সে কি! আপনি হতাশ হইতেছেন কেন? যখন ঠিক সময়ে জানিতে পারিয়াছি, তখন নিশ্চয়ই ইহার একটা উপায় করিব। তবে তাদৃষ্টের লিখন অখণ্ডনীয়।” 

সুধাকে আমার নিকট বসাইয়া অমরেন্দ্রনাথ বৈঠকখানার দরজা বন্ধ করিয়া দিলেন। আমি তখন সুধার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমার নাম কি মা?” 

সুধা লাজুক নহে। সে লজ্জিতা না হইয়া বেশ পরিষ্কার করিয়া উত্তর করিল, “আমার নাম শ্রীমতী সুধাবালা দেবী।” 

উত্তর শুনিয়া ও সুধার সাহস দেখিয়া, আমার মনে আনন্দ হইল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কাল রাত্রে তুমি ভয় পাইয়াছিলে কেন? তোমার শ্বশুর মহাশয় আমায় তখন তোমার ভয়ের কথা বলিতেছিলেন।” 

ভয়ের কথা শুনিয়া সুধার মুখ মলিন হইল। সে অতি কষ্টে গত রাত্রের সমস্ত কথা বলিল। অমরেন্দ্র যাহা বলিয়াছিলেন, তাহার সমস্ত মিলিল। আমি সুধাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমার দিদির মৃত্যুর আগে এই রকম শব্দ হইয়াছিল, একথা তোমায় কে বলিল 

সুধা বলিল, “দিদি নিজেই বলিয়াছিল। সে খুড়া মহাশয়কে পর্যন্ত জানাইয়া ছিল, কিন্তু তিনি সে কথা হাসিয়া উড়াইয়া দেন।” 

সুধার বয়স বেশী নয়; বোধ হয় এগার বৎসরও পূর্ণ হয় নাই। কিন্তু তাহার গোলগাল গড়ন দেখিয়া, লোকে যুবতী বলিয়া মনে করিতে পারে। সে যে আমায় বিশ্বাস করিয়া শেযোক্ত কথাগুলি কেন বলিল, তাহা জানিও না। আমিও তাহাকে প্রকৃত কথা বলিতে ইচ্ছা করিলাম! 

দুই একটি অন্য কথার পর আমি বলিলাম, “দেখ মা! আমি একজন গোয়েন্দা, তোমার ভাবী শ্বশুর মহাশয় আমার উপর তোমার গতরাত্রের ভয়ের বিষয় সন্ধান করিবার ভার দিয়াছেন। সেই জন্যই আমি কৌশলে তোমাকে এখানে আনাইয়া তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছি। আমার কতকগুলি জিজ্ঞাস্য আছে।” 

আমার কথায় সুধা যেন প্রফুল্ল হইল। বলিল, “আপনি যাহা ইচ্ছা জিজ্ঞাসা করুন; আমি যাহা জানি বলিব।”

আ। যে ঘরে কাল রাত্রে তুমি ভয় দেখিয়াছিলে, সেই ঘরেই কি তোমার দিদির মৃত্যু হইয়াছিল? 

সু। আজ্ঞে না, তাহার পাশের ঘরে; 

কিন্তু সে ঘরের দরজা ভিতর মহলে। 

আ। এই দুইটি ঘরের মধ্যে যাতায়াতের কোন পথ আছে কি না? 

সু। না। 

আ। তুমি সচরাচর কোন্ ঘরে শুইয়া থাক? যে ঘরে ভয় দেখিয়াছ সেই ঘরে? 

সু। না। যতদিন দিদি ছিল, আমি তাহারই ঘরে থাকিতাম। দিদির মৃত্যুর পর আমি এই ঘরে আসিয়াছি।

আ। সেই অবধি এই ঘরে রহিয়াছ? 

সু। না। মধ্যে দিনকতকের জন্য একবার দিদির ঘরে গিয়াছিলাম। 

আ। কেন? 

সু। মেরামতের জন্য। 

আ। কি মেরামতের জান? 

সু! আজ্ঞে না। তবে বেশীর মধ্যে একটা নল বসান হইয়াছিল। 

আ। তোমার খুড়ার কয়টি সন্তান? 

সু। কেবল একটি পুত্ৰ। 

আা। তাহার বয়স কত? 

সু। চারি বৎসর। 

আ। তোমার খুড়া মহাশয়ের কি এই প্রথম পুত্র? 

সু। হাঁ। তাঁহার বেশী বয়সে ছেলে হইয়াছে। 

আ। তিনি তোমাদের ভালবাসেন? 

সু। হাঁ। তিনিও ভালবাসেন, খুড়ীমাও খুব ভাল বাসেন। 

আ। তোমার পিতার কোন উইল আছে জান? 

সু। শুনিয়াছি–আছে। 

আ। কি শুনিয়াছ? কাহার মুখে শুনিয়াছ? 

সু। খুড়ামহাশয় ও খুড়ী মা উভয়েই বলিয়াছেন। শুনিয়াছি আমাদের বিবাহের পর প্রত্যেকে দশহাজার করিয়া টাকা ও ঐ টাকার সুদ পাইব। 

আ। সুদ কেন? কতদিনের সুদ? 

সু। আমাদিগের যত বয়স ততদিনের সুদ। শুনিয়াছি, আমাদের জন্ম হইবার একমাসের মধ্যে ঐ টাকা কোন ব্যাঙ্কে জমা আছে। 

আ। ও টাকা ত তোমার পিতার উপার্জিত ধন বলিয়া বোধ হইতেছে। তাঁহার পৈত্রিক সম্পত্তির কি হইল? তাহার কোন অংশ পাও নাই? 

সু। হাঁ। সে কথাও আছে। 

আ। কি কথা? 

সু। ঐ দশহাজার টাকা ও তাহার সুদ ছাড়া আমরা প্রত্যেকে আরও পাঁচ হাজার করিয়া টাকা পাইব।

আ। সে ত বিবাহের যৌতুক? 

সু। না না–যৌতুকের কথা স্বতন্ত্র আছে। 

আ। ঠিক জান? 

সু। না, সে কথা বলিতে পারিনা। তবে ইহা স্থির জানি যে, বিবাহের পর আমি প্রায় পনের ষোল হাজার টাকা পাইব। তবে যদি মরিয়া যাই, ফুরাইয়া যাইবে। 

এই বলিয়া সুধা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিল। আমি তাহার কথায় দুঃখিত হইলাম। বলিলাম, “যখন আমি এ কাজে লাগিয়াছি, তখন তোমার কোন ভয় নাই। আর অমন কথা মুখেও আনিও না। আর একটি কথা আছে, কোন উপায়ে আমাকে সেই ঘর দুইটি দেখাইতে পার? 

সু। কোন ঘর? দিদির ও আমার ঘরের কথা বলিতেছেন? 

আ। হাঁ। 

সু। সে কি করিয়া হইতে পারে? আপনি অন্দরে যাইবেন কিরূপে? অন্দরে না যাইলে ত দিদির ঘর দেখিতে পাইবেন না। বিশেষতঃ আমার খুড়ামহাশয় বড় ভয়ানক লোক। লোকে তাঁহাকে পাগল বলিয়া থাকে। এবং সেই জন্য সকলেই তাঁহাকে অত্যন্ত ভয় করিয়া থাকে। 

আ। আমি কৌশলে তোমাদের বাড়ীতে যাইব মনে করিয়াছি। যদি সফল হই, তাহা হইলে আমায় দেখাইতে পারিবে? 

সু। কেন পারিব না? কিন্তু আপনি কেমন করিয়া সেখানে যাইবেন? 

আ। তোমার বিবাহ উপলক্ষে তোমার খুড়ামহাশয়কে নিশ্চয়ই কতকগুলি নূতন চাকর রাখিতে হইবে। 

সু। হাঁ। আমিও এই কথা শুনিয়াছি। 

আ। আমি একজন চাকর সাজিয়া তোমার খুড়ার বাড়ীতে যাইব। কিন্তু সাবধান, যেন এ কথা আর কেহ জানিতে না পারে। 

সু। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। এ কথা আর কেহ জানিতে পারিবে না। 

অমরেন্দ্রনাথ আমাদের সমস্ত কথাবার্তা শুনিয়া মনে মনে আনন্দিত হইলেন। বলিলেন, “আপনাকে যথেষ্ট কষ্ট দিতেছি। কিন্তু কি করিব, আপনি না হইলে এই ভয়ানক রহস্য আর কেহ ভেদ করিতে পারিবে না।” 

আমি মিষ্ট কথায় তাঁহাকে সান্ত্বনা করিয়া বৈঠকখানা হইতে বাহির হইয়াছি, এমন সময় একজন চাকরের মুখে শুনিলাম, চক্ৰবেড়ে হইতে ধাকে লইতে আসিয়াছে। আমি পূৰ্ব্বেই সেইরূপ মনে করিয়াছিলাম। কাৰ্য্যসিদ্ধ হইয়াছে জানিয়া, আর তথায় অপেক্ষা করিলাম না। অমরেন্দ্র আমাকে জল খাওয়াইবার জন্য বিস্তর অনুরোধ করিলেন, কিন্তু আমি সে অনুরোধ রক্ষা করিতে পারিলাম না। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

সেইদিন সন্ধ্যার পরই আমি ঢাকরের বেশে চক্রবেড়ে উপস্থিত হইলাম। জমীদার মহাশয়ের বাড়ী খুঁজিয়া লইতে আমার কিছু মাত্র বিলম্ব হইল না। দেখিলাম, বাড়ীখানি প্রকাণ্ড ও ত্রিতল; সম্প্রতি মেরামত করা হইয়াছে। দরজার পার্শ্বে দুই দুইটি নহবৎ বসিয়াছে। বাড়ীর চাকরেরা লাল রঙ্গের কাপড় পরিয়া চারিদিকে দৌড়াদৌড়ি করিতেছে। কতকগুলি লোক আলো জ্বালিতে ব্যস্ত, কেহ বা আপনাপন আত্মীয় স্বজনের আহারের যোগাড় দেখিতেছে। কেহ আবার এই সুবিধা পাইয়া কোন যুবতী দাসীর সহিত রসালাপ করিতেছে। 

দরজার সম্মুখে অনেক লোক জমায়েত হইয়াছিল। আমিও সেই ভিড়ের মধ্যে দাঁড়াইয়া চারিদিকে লক্ষ্য করিতেছি, এমন সময় আমার পরিচিত একজন চাকরকে দেখিতে পাইলাম। তাহাকে দেখিয়া আমার মনে আশা হইল। আমি তাহাকে নিকটে ডাকিয়া অতি গোপনে সকল কথা প্রকাশ করিলাম। 

লোকটার নাম ভোলা, বড় বিশ্বাসী। এক সময়ে সে আমারই বাসায় চাকরি করিত। কিন্তু জমীদার মহাশয়ের নিকট অধিক বেতন পাইবে আশা করিয়া, আমায় জানাইয়া, সে চাকরি ত্যাগ করে। কিন্তু তখন কোথায় চাকরি করিবে, সে কথা তখন তাহাকে আমি জিজ্ঞাসা করি নাই। 

ভোলা নিকটে আসিলে আমি তাহাকে লইয়া এক নিৰ্জ্জন স্থানে যাইলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম, “ভোলা, আমায় চিনতে পারিস?” 

ভোলা হাসিয়া বলিল, “খুব পারি। আপনি যেমনই ছদ্মবেশ করুন না কেন আমি আপনাকে নিশ্চয়ই চিনিতে পারিব। আপনার নিকট এতকাল চাকরি করিয়াছি, আর আপনাকে ভুলিয়া যাইব! আমার নাম ভোলা বটে, কিন্তু আমি প্রায় কোন কথা ভুলি না। 

আমি ভোলার কথায় হাসিয়া ফেলিলাম! বলিলাম, “এখন আমার একটা উপকার করিতে হইবে; পারবি?” ভোলা আমার কথায় আশ্চর্য হইল। বলিল, “আপনি জমীদারের বাড়ীতে কি করিতে আসিয়াছেন?”

আ। সে কথা পরে জানতে পারবি। এখন আমার কথার উত্তর দে। 

ভো। আপনার উপকার? নিশ্চয়ই পারিব। আপনার উপকার করিতে গিয়া যদি প্রাণবিনাশ হয়, সেও ভাল।

আ। তবে এক কাজ কর। আমাকে তোর মনিব বাড়ীতে একটা চাকরি করে দে। 

ভো। চাকুরি? আপনি কি চাকরি করিবেন? তা ছাড়া আমাদের মনিব যে গোঁয়ার, কোন দিন আপনাকে মারিয়া বসিবে। 

আ। সে সকল কথা আমি জানি। এখন তোকে এই জমিদার-বাড়ীতে আমায় কোন চাকরি যোগাড় করে দিতে হবে? 

ভো। আপনি কি চাকরি করিবেন? 

আ। কেন? তোরা যা করিস্। 

ভোলা হাসিয়া উঠিল। বলিল, “মহাশয় আমি এক সময়ে আপনার চাকর ছিলাম। আমার সহিত উপহাস করা ভাল দেখায় না। 

আ। না ভোলা! আমি উপহাস করছি না। আমি কি কাজ করি, তুই কি জানিস্ না? আমার কাছ থেকে দু-দিন এসেই কি সব ভুলে গিয়াছিস? 

আমার কথা শুনিয়া ভোলা কি ভাবিল, পরে বলিল, “সেই জন্যই বুঝি আপনার এই বেশ? আচ্ছা, আমি এখনই সরকার মশাইকে জিজ্ঞাসা করিতেছি। তাঁহার মুখে শুনিয়াছিলাম, জনকতক লোকের দরকার।” 

আমি বলিলাম, “তবে যা একবার। যদি দরকার হয়, আমায় খবর দিস। আমি এইখানেই রহিলাম।” ভোলা চলিয়া গেল। আমি সেইখানেই বেড়াইতে লাগিলাম। প্রায় আধঘণ্টার পর ভোলা হাসিতে হাসিতে আমার নিকট ফিরিয়া আসিল এবং আমাকে লইয়া জমীদার বাড়ী প্রবেশ করিল। 

সরকার মহাশয় প্রবীণ লোক। তিনি আমার মুখের দিকে অনেকক্ষণ চাহিয়া রহিলেন। পরে ভোলাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভোলা! এ লোক তোর চেনা ত?” 

ভোলা হাসিয়া উত্তর করিল, “আজ্ঞে হাঁ, আমরা একগাঁয়ের লোক।” 

সরকার মহাশয় বলিলেন, “লোকটিকে ভদ্রঘরের ছেলে বলিয়া বোধ হইতেছে। বাবুর যে রকম মেজাজ, তাতে এ যে এখানে থাকিতে পারিবে, এমন ত বোধ হয় না।” 

ভোলাও খুব চালাক ছিল। সে বলিল, “আপনি ঠিক বলিয়াছেন। এদের অবস্থা আগে খুব ভাল ছিল। সম্প্রতি দৈন্যদশায় পড়িয়া চাকরি করিতে আসিয়াছে।” 

সরকার মহাশয় তখন আমায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার নাম কি বাপু?” 

আমি বলিলাম, “আমার নাম সদানন্দ।” 

স। জাতিতে? 

আ। কায়স্থ। 

স। লেখাপড়া জান? 

আ। যৎসামান্য। 

স। তবে ভালই হইয়াছে। আপাততঃ বিবাহের কয়দিন এই কাজই কর। বিয়ের পর তোমায় ভাল কাজ দেওয়া যাইবে। এখন বাবুর মন রাখিতে পারিলে হয়। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

বাড়ীতে অনেকগুলি চাকর ছিল; কিন্তু ভোলা ভিন্ন আর কাহারও অন্দরে যাইবার অধিকার ছিল না। গৃহিণী ভোলাকে পুত্ৰাধিক স্নেহ করিতেন। 

যে কাজে আমি লাগিয়াছি, তাহাতে অন্দরে যাইতে না পাইলে আমিও কিছুই করিতে পারিব না। ভোলাকে অগত্যা সেই কথা বলিলাম। ভোলা গৃহিণীর নিকট হইতে আমার অন্দরে যাইবার অনুমতি আনিল। 

প্রথমে আমি ভোলার সঙ্গে অন্দরে প্রবেশ করিলাম। ভোলা আমাকে সকলকার ঘর দেখাইয়া দিল। আমি সরকার মহাশয়ের হুকুম মত কাজ করিতে করিতে সময়মত ঘরগুলি লক্ষ্য করিতে লাগিলাম। কিন্তু ইতিমধ্যে একবারও সুধাকে দেখিতে পাইলাম না। সন্ধানে জানিলাম, সুধা নিকটেই কোন ব্রাহ্মণের বাড়ী খাইতে গিয়াছে। 

সন্ধ্যার পর আমি অন্দর হইতে বাহির হইতেছি, এমন সময়ে জমীদার মহাশয়কে অন্দরে আসিতে দেখিলাম। তাঁহাকে দেখিতে কাল, অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও গজস্কন্ধ। তাঁহার বয়স চল্লিশের উপর। লোকটাকে দেখিয়াই ভয়ানক দুষ্ট বলিয়া বোধ হইল। 

আমাকে দেখিয়াই তিনি রাগিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “তুমি কে হে বাপু? অন্দরে কি করিতেছিলে?” কথাগুলি বড় কৰ্কশ, শুনিয়া আমার বড় রাগ হইল। অবশেষে সাহস করিয়া উত্তর করিলাম, “আমি নতুন চাকর। আজ ভর্তি হইয়াছি।” 

জ। তোমার নাম কি? কোথা হইতে আসিয়াছ? 

আ। আমার নাম সদানন্দ। সম্প্রতি চাকরি না থাকায় এখানে আসিয়াছি। 

জ। অন্দরে আসিয়াছ কেন? কে তোমার অন্দরে আসিতে বলিল? 

আ। আজ্ঞে, গিন্নীমার হুকুম পাইয়াছি। 

জ! সত্যি না কি? কিন্তু বাপু তুমি সাবধান হইয়া কাজ করিও। তোমার মুখ যেন আমার চেনা বলিয়া বোধ হইতেছে। তোমায় ভদ্রলোক বলিয়া আমার অনুমান হইতেছে। যদি কোন রকম কু-মতলব থাকে। সরে পড় বাপু —গরিবের ছেলে, শেষে কি মারা যাইবে? 

আমি যেন অত্যন্ত ভীত হইলাম। ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে হাতজোড় করিয়া বলিলাম, “না হুজুর! আমার কু মংলব কি? খাইতে না পাইয়া আপনার দ্বারস্থ হইয়াছি।” 

জমীদার মহাশয় আমার কথায় আরও গরম হইলেন। বলিলেন, “তোমার মত অনেক দেখিয়াছি। এ বয়সে আর আমার দেখিতে কিছু বাকি নাই। যাও এখন কাজ দেখ গে। কিন্তু সাবধান! আমি যে সে লোক নই। গ্রামের সকলে আমায় বাঘের মত ভয় করে। আমার সহিত কোন রকম চাতুরী করিলে মারা যাইবে।” 

এই বলিয়া জমীদার মহাশয় ভিতরে গেলেন, আমিও বাহিরে আসিয়া ভোলাকে সকল কথা বলিলাম। ভোলা বলিল, ‘বাবু কি আর কখনও আপনাকে দেখিয়া ছিলেন?” 

আমি বলিলাম, “কই, আমার ত মনে পড়ে না। কিন্তু তিনি যে রকম ভাবে কথা বলিলেন, তাহাতে বোধ হয়, তিনি আমায় পূর্ব্বে কোথাও দেখিয়া থাকিবেন।” 

ভোলা বলিল, “আপনি সে সন্দেহ করিবেন না। বাবু সকলকেই ঐ কথা বলিয়া থাকেন। তাঁহার কথাই ঐরূপ কর্কশ।” 

ভোলার কথায় আমি সন্তুষ্ট হইলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম, সুধা আসিয়াছে?” 

ভো। হাঁ, আসিয়াছে। 

আ। একবার আমাকে তাহার সহিত দেখা করিয়া দিতে পারিস? 

ভো। এখন নহে। বাবুর আজ শরীর বড় ভাল নয়। তিনি এখনই বিশ্রাম করিতে যাইবেন। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

সুধার সহিত আমার যখন দেখা হইল, তখন রাত্রি প্রায় দশটা। বাড়ীর গৃহিণী পুত্রকে লইয়া শয়ন করিয়াছেন। কর্তা অনেকক্ষণ পূর্ব্বেই বিশ্রাম করিতে গিয়াছেন। বাড়ীর আর আর চাকর দাসীও যে যাহার ঘরের মধ্যে গিয়াছে। দুই দ্বারে দুইখানা নহবৎ বসিয়াছে। শানাইদার বেহাগ গাহিয়া খানিক আগেই দলবল সমেত চলিয়া গিয়াছে। 

বাড়ী নিস্তব্ধ। সুধা আমায় প্রথমে তাহার দিদির ঘরে লইয়া গেল। আমি তাহার সহিত সেই ঘরের ভিতর গিয়া, দরজা বন্ধ করিয়া দিলাম। 

ঘরের চারিদিক উত্তমরূপে পরীক্ষা করিলাম; কিন্তু বিশেষ কিছু বাহির করিতে পারিলাম না। ঘরখানি নিতান্ত ছোট নয়। দৈর্ঘ্যে প্রায় বার হাত, প্রস্থেও দশ হাতের কম নয়। ঘরের ভিতর একখানি পালঙ্ক ছিল, কিন্তু তাহাতে কোন শয্যা ছিল না। তা ছাড়া সেখানে একটি দেরাজ, দুইটি আলমারি ও আটখানি ছবিও ছিল। ছবিগুলি সমস্তই হিন্দু দেবদেবীর প্রতিমূর্তি। 

ঘরের চারিটি জানালা ও একটি দরজা। এ ছাড়া বাহির হইতে ভিতরে আসিবার আর কোন পথ ছিল না। কেবল ঘরের এক কোণে উপরের ঘরের সহিত সংলগ্ন একটা মোটা নল ছিল। নলটি বাস্তবিকই ঘরের শোভা নষ্ট করিয়াছে। কারণ উহা ছাদ ভেদ করিয়া ঘরের মেঝে হইতে প্রায় দেড় হস্ত দূরে আসিয়া শেষ হইয়াছে। 

ঘরের ভিতর এ রকম ভাবে নল রাখা আর কখনও দেখি নাই। তানেক লোকের ঘর দেখিয়াছি,—রাজাধিরাজের প্রাসাদ হইতে দরিদ্রের কুটীর পর্যান্ত সমস্তই আমার দেখা হইয়াছে; কিন্তু এরূপ ভাবে ঘরের ভিতর নল রাখিতে আর কাহাকেও দেখি নাই, আমি আশ্চর্য্য হইয়া সুধাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এই নলটি কোন কাজে লাগে?” 

সু। উহা দিয়া উপরের জল বাহির হয়। 

আ। এ ঘরের জল বাহির হইবার পথ কোথায়?

সু। সে নলটা ঘরের উত্তর দিকের কোণে আছে।

আ। আমি ত দেখিতে পাইলাম না। 

সু। না পাইবার কারণ আছে। নলের মুখটা প্রায়ই ঢাকা থাকে। আপনি ঐ কোণের একখানি মার্বেল পাথর তুলিলেই দেখিতে পাইবেন। 

সুধার কথামত কার্য্য করিলাম। দেখিলাম, সুধা যাহা বলিয়াছিল তাহা সত্য। আমি তখন আরও আশ্চর্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাস! করিলাম, “এ নলের মুখটা ঢাকা কেন?” 

সু। কাকার হুকুম! 

আ। সে কিরূপ? 

সু। কাকার অনুমতি ছাড়া ঐ নলের মুখ খোলা হয় না। যেদিন উপরের ঘর ধৌত করা হয়, সেইদিন তাঁহার অনুমতি লইয়া ঐ নলের মুখও খোলা হয়। 

আ। উপরের ঘর হইতে জল পড়িলে এই ঘরের মেঝেও জলময় হইয়া থাকে? 

সু। হাঁ; কিন্তু সে সময় এ ঘরও ধৌত হয়। 

আ। উপরের নলটি ঘরের মেঝের নিকট পর্যন্ত নামিল না কেন? অতটা জায়গা ফাঁকা রাখিবার প্রয়োজন কি? স্। সে কথা আমি বলিতে পারিলাম না। 

আ। এখন যেখানে পালঙ্কখানি রহিয়াছে, ঐ স্থানেই কি উহা পূৰ্ব্বেও ছিল? 

সু। হাঁ। 

আ। তুমিও পূর্ব্বে এই ঘরে বাস করিতে, বলিয়াছ না? তোমরা কি উভয়ে একই শয্যায় শয়ন করিতে?

স। না-আমারও এখানে এই রকম একখানি পালঙ্ক ছিল। আমি তাহাতেই শয়ন করিতাম। 

আ। এখন সেখানি কোথায়? 

সু। আমার শোবার ঘরে। 

আ। তোমার দিদির বিছানার নিকটেই ঐ নলটা ছিল বোধ হইতেছে কেমন? 

সু। হাঁ, আপনি ঠিক বলিয়াছেন। 

আমি আরও খানিকক্ষণ নলটা পরীক্ষা করিলাম। পরে সুধাকে বলিলাম, “এইবার তোমার শোবার ঘরে লইয়া চল।” 

সুধা ঘরের দরজা খুলিয়া একবার চারিদিক লক্ষ্য করিল এবং কাহাকেও দেখিতে না পাইয়া আমার সঙ্গে লইয়া তাহার শয়নগৃহে প্রবেশ করিল। আমি ভাবিয়াছিলাম, সুধার দাসী সেই ঘরে থাকিবে কিন্তু গৃহের ভিতর যাইয়া কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না। তখন সুধাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আজ তোমার দাসী কোথায় গেল? শুনিয়াছিলাম, সে তোমারই ঘরে নিদ্রা যায়।” 

সু। হাঁ, সে এইখানেই শোয়, কিন্তু আজ তাহার কি প্রয়োজন আছে ঠিক জানি না। সে সন্ধ্যার পর এ বাড়ী হইতে চলিয়া গিয়াছে। 

আ। তবে কি সে তোমাদের চাকরি ছাড়িয়া দিল? 

সু। না না, সে তেমন নয়; কাকা তাহাকে অনেকবার দূর করিয়া দিয়াছিলেন, কিন্তু সে আমায় ছাড়িয়া আর কোথাও যাইতে চাহে না। 

আ। তবে আজ সে কোথায় গেল? 

সু। শুনিয়াছি, তাহার দেশ হইতে কোন আত্মীয় আসিয়াছে। বোধ হয়, সে তাহারই সহিত দেখা করিতে গিয়াছে।

আ। আজই ফিরিবে কি? 

সু। না, কাল প্রাতে এখানে আসিবার কথা আছে। 

আ। তবে ভালই হইয়াছে। 

এই বলিয়া আমি সেই ঘরও ভাল করিয়া দেখিতে লাগিলাম। এ ঘরখানি পূর্ব্বেকার ঘর অপেক্ষা ছোট। দৈর্ঘ্যে প্রায় দশ হাত, প্রস্থেও প্রায় আট হাত হইবে। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, এ ঘরেও পূর্ব্বের মত একটি নল ছাদ ভেদ করিয়া মেঝে হইতে প্রায় দেড় হস্ত উপর পর্যন্ত আসিয়া শেষ হইয়াছে। 

সে ঘরেও ঐ প্রকার নল দেখিয়া, আমার কেমন সন্দেহ হইল। আমি সুধাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এ বাড়ীর সকল ঘরেই কি এই রকম নল আছে?” 

সু। না, কেবল এই দুইটি ঘরে। 

আ। তোমার ঘরের এই নলটা কতদিন আগে বসান হইয়াছে? 

স। সম্প্রতি। 

আ। কত দিন আগে মনে নাই? 

সু। প্রায় তিন চারি মাস হইবে। 

আ। সে সময় তুমি কোথায় শুইতে? 

সু। দিদির ঘরে। 

আ। তখন কোন শব্দ শুনিতে পাইয়াছিলে?

সু। কই, না। 

আ। সে সময় কি তুমি একা শুইতে? 

সু। না, আমার দাসীও আমার কাছে থাকিত। 

আ। এ ঘরে নল বসান কেন হইল, বলিতে পার? 

সু। না-সে কথা কাকাকে কে জিজ্ঞাসা করিবে? আর জিজ্ঞাসা করিলেও কাকা কোন উত্তর করিতেন না। 

আ। কেন? 

সু। তিনি বলেন, আমার বাড়ী, আমি যাহা ইচ্ছা করিব, অপরের তাহাতে কোন ক্ষতি বৃদ্ধি নাই।

আ। তখন তোমার বিবাহের কোন কথা হইয়াছিল কি? 

বিবাহের নাম শুনিয়া সুধার মুখ লজ্জায় রক্তিমাবর্ণ ধারণ করিল। সে ঘাড় হেঁট করিয়া হাতের নখ খুঁটিতে লাগিল, মুখে কোন উত্তর করিল না। 

সুধাকে লজ্জিতা দেখিয়া আমি অতি নম্রভাবে বলিলাম, “মা! আমি তোমার পিতার মত। বিশেষতঃ তোমার ভাবী শ্বশুরের কথায় এই কার্যে নিযুক্ত হইয়াছি। আমার কাছে কথা বলিতে লজ্জা কি? সকল কথা না জানিতে পারিলে আমি এ কার্য্যে সফল হইতে পারিব না।” 

আমার কথা শুনিয়া সুধা মুখ তুলিল, এবং অল্প হাসিতে হাসিতে মৃদুস্বরে বলিল, “যে দিন আমার বিবাহের কথা উত্থাপন হয়, তাহারই দুই দিন পরে এই নল বসান হইয়াছিল।” 

আ। এ নলটিও কি উপরের ঘরের জল বাহির করিবার জন্য বসান হইয়াছে? 

সু। হাঁ, কাকা এইরূপই বলিয়া থাকেন। 

আ। ইহার উপরে কাহার ঘর? 

সু। কাকার। 

আ। তোমার দিদির ঘরের উপরে কাহার ঘর? 

সু। কাকার। 

আ। তবে তোমার কাকার কয়টি ঘর? 

সু। একটি। ঘরটি বড়; আমাদের দুজনের ঘরের সমান। 

আ। সে ঘরের জল বাহির হইবার ত পথ ছিল, তবে আবার এ নলটা বসান হইল কেন? 

সু। কাকা বলেন, একটি পথে সমস্ত জল বাহির হইবার সুবিধা হয় না। 

আ। এ বড় আশ্চর্য্য কথা! এতকাল এক পথ দিয়াই ত জল বাহির হইতেছিল! 

সু। কার সাধ্য তাঁহার কথার উপর কথা কহিবে। 

আ। আর একটি কথা। দেখিতেছি, তোমারও বিছানা নলের নিকট রহিয়াছে। তুমি কি ইচ্ছা করিয়া তোমার পালঙ্কখানি ঐ স্থানে রাখিয়াছ? 

সু। না না, উহাও আমার কাকার হুকুম! 

আ। কেন? তিনি কি বলেন? 

সু। তিনি বলেন, ঐখানে বিছানা থাকিলে লোকে সহসা নলটি দেখিতে পাইবে না। তাঁহার কথা নিতান্ত মিথ্যা নয়? আমার বিছানা প্রায় মসারি ঢাকা থাকে, সুতরাং নলও কেহ দেখিতে পায় না। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ

সুধাকে তখন আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। দুইটি ঘর পরীক্ষা করিতে প্রায় একঘণ্টার উপর কাটিয়া গেল। সুধাকে আর রাত্রি জাগরণ না করাইয়া, আমি তাহাকে তাহার ঘরে রাখিয়া বাহিরে আসিলাম। আসিবার সময় সুধাকে বলিলাম, “আজ তোমার দাসী নাই। তোমাকে একাই এখানে শুইতে হইবে। কিন্তু মা! তোমার কোন ভয় নাই। আজ আমি সমস্ত রাত্রি এইখানেই থাকিব। কোনরূপ ভয় পাইলে শীঘ্র দ্বার খুলিয়া ঘরের বাহিরে আসিবে, আমি নিকটেই রহিলাম।” 

সুধার ইচ্ছা ছিল, অপর কোন দাসীকে তাহার ঘরে লইয়া আসিবে, কিন্তু আমি তাহাকে নিষেধ করিলাম। বলিলাম, “এত রাত্রে কোন দাসীকে ডাকাডাকি করিলে তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে একথা উঠিতে পারে, তাহা হইলে হয়ত আমার কথা প্রকাশিত হইয়া পড়িবে।” 

সুধা আমার কথা বুঝিতে পারিল। সে ভীত হইয়া একাই সে ঘরে রাত্রি যাপন করিতে সম্মত হইল এবং আমি গৃহ হইতে বাহির হইলে দ্বার বন্ধ করিয়া দিল। আমিও নিকটে এক নিভৃত স্থানে রহিলাম। 

রাত্রি ১২টা বাজিয়া গেল। দুই একটি আলো ছাড়া বাড়ীর আর সকল আলোকই নিভিয়া গেল। আমিও চুপ করিয়া সেইস্থানে বসিয়া আছি, এমন সময়ে উপরে কাহার পদশব্দ শুনিতে পাইলাম। এত রাত্রে উপরে কে বেড়াইতেছে, জানিবার জন্য আমি গাত্রোত্থান করিলাম। একবার মনে হইল, সুধার কাকা কোন কারণ বশতঃ বাহিরে আসিয়াছেন, কিন্তু তাহা হইলে তাঁহার ঘরের দরজা খোলার শব্দ পাইতাম। বিশেষতঃ আজ তাঁহার শরীর অসুস্থ। যতই এই বিষয় ভাবিতে লাগিলাম, ততই আমার সন্দেহ বাড়িতে লাগিল। আমি তখন আর স্থির থাকিতে পারিলাম না। আস্তে আস্তে তেতলায় উঠিলাম। 

চারিদিক অন্ধকার। একটি মাত্র আলোক মিট্‌ মিট্‌ করিয়া জ্বলিতেছিল। আমি সেই সামান্য আলোকে দেখিলাম, একজন লোক দালানে ধীরে ধীরে বেড়াইতেছে। লোকটাকে পূৰ্ব্বে কখনও দেখি নাই। ভাল চিনিতে পারিলাম না।

আমি সুধার কাকার ঘরের দরজা হইতে প্রায় দশ হাত দূরে একটা কোণে আসিয়া দাঁড়াইলাম। লোকটা খানিকক্ষণ এদিক ওদিক বেড়াইয়া, প্রাণকৃষ্ণবাবুর ঘরের দরজার নিকট দাঁড়াইল। খানিকক্ষণ নিস্তব্ধভাবে দাঁড়াইয়া কি যেন ভাবিতে লাগিল। পরে আস্তে আস্তে কপাটে ঘা মারিতে লাগিল। 

তৎক্ষণাৎ ঘরের দরজা খুলিয়া গেল। ঘরের ভিতর হইতে প্রাণকৃষ্ণবাবু বাহির হইলেন এবং অতি মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমায় যাহা বলিয়াছিলাম, তাহার কি হইল?” 

আগন্তুকও চুপি চুপি উত্তর করিল, “আপনার হুকুম কবে অমান্য করিয়াছি?” 

প্রা। আনিয়াছ? 

আ। আনিয়াছি। 

প্রা। কোথায়? 

আ। বলেন ত আপনার কাছে আনি 

প্রা। যাও, শীঘ্র আন। 

আ। সিঁড়ির উপরে রাখিয়াছি; – এখনই আনিতেছি। 

এই বলিয়া লোকটা ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া সিঁড়ির কাছে গেল। পরে একটা বাঁশের চুবড়ী লইয়া পুনরায় প্রাণকৃষ্ণবাবুর নিকট আনিল। বলিল, “এই আনিয়াছি। কোথায় রাখিব বলুন?” 

দেখিলাম, লোকটার কথায় প্রাণকৃষ্ণবাবু সন্তুষ্ট হইলেন। তিনি বলিলেন, “ঘরের ভিতরেই রাখ।” 

লোকটা তাহাই করিল। সে সেই চুবড়ীটিকে ঘরের ভিতর রাখিয়া বলিল, “এ জিনিষটা বড় ভয়ানক। ঘরের ভিতর এ সকল জিনিষ রাখা ভাল নয়। আপনার ছেলেপিলের ঘর; তাই ভয় করে।” 

প্রাণকৃষ্ণ হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “অত ভয় করিলে কোন কাজ হয় না। তা ছাড়া, এ ঘরে আসিবার কাহারও অধিকার নাই। এই যে এতকাল আমার ঘরে এই সকল জিনিষ রহিয়াছে, কেহ ঘুণাক্ষরেও কিছু জানিতে পারিয়াছে কি?” 

লো। আজ্ঞা না। বলিহারি যাই আপনার বুদ্ধিকে। এমন না হ’লে কি কাজ হয়? তবে আমায় বিদায় করুন। প্ৰা। আজই? 

লো। আজ্ঞা হাঁ। এ সব কাজ হাতাহাতই ভাল। কি জানি, কবে কি হয় বলা যায় না। 

প্রা। ভাল–আজ এত রাত্রিতে আর গোলযোগে কাজ নাই। কাল প্রাতেই হইবে। 

লো! আপনার সঙ্গে দিনের বেলায় দেখা করা আমার ভাল দেখায় না। লোকে নানা রকম সন্দেহ করিতে পারে। তাই বলিতেছি, আজই আমায় বিদায় করুন। 

প্রা। জিনিযটা না দেখিয়া– 

লো! তবে কি আপনি আমায় অবিশ্বাস করেন? আপনি কি মনে করেন, আমি আপনাকে ঠকাইতেছি। 

প্রা। না না, সে কথা মনে করি না। তোমার সঙ্গে আমার এই প্রথম কারবার নয়। 

লো। আমিও তাই বলিতেছিলাম। 

তখন প্রাণকৃষ্ণবাবু ঘরের ভিতর হইতে কি আনিয়া লোকটার হাতে দিলেন। সে সন্তুষ্ট হইয়া সেখান হইতে চলিয়া গেল। প্রাণকৃষ্ণবাবুও আবার ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলেন। আমিও আর সেখানে থাকা যুক্তিসিদ্ধ নয় বিবেচনা করিয়া, নামিয়া আসিলাম এবং এক গোপনীয় স্থানে লুকাইয়া রহিলাম। 

লোকটা কোথা হইতে আসিল, কেনই বা এত রাত্রে জমীদারবাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিল। সেই চুবড়ী করিয়া কি আনিল। তাহাকে দেখিয়া সন্ন্যাসীর ন্যায় বোধ হইয়াছিল। এই গভীর রাত্রে সন্ন্যাসীর সহিত প্রাণকৃষ্ণের প্রয়োজন কি? বিশেষতঃ আজ তাঁহার শরীর অসুস্থ বলিয়া শীঘ্র শীঘ্র বিশ্রাম করিতে গিয়াছেন। এই সকল প্রশ্ন আমার মনোমধ্যে উদিত হইল। সমস্ত রাত্রি আমি এই সকল বিষয় ভাবিতে লাগিলাম। 

এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে রাত্রি প্রায় তিনটা বাজিয়া গেল। আমি সে রাত্রি আর কোনরূপ গোলযোগের সম্ভাবনা নাই ভাবিয়া, এক প্রকার নিশ্চিত্ত হইয়াছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার তন্দ্রাও আসিয়াছিল, এমন সময়ে সহসা সুধার গৃহদ্বার খুলিয়া গেল এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে এক আশ্চর্য বংশীরব আমার কর্ণগোচর হইল। আমি তখনই লম্ফ দিয়া উঠিয়া দাড়াইলাম। দেখিলাম, সুধা অত্যন্ত ভীতা হইয়া আমারই দিকে আসিতেছে। আমি তাহাকে তদবস্থ দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি হইয়াছে মা? আজও কি সেই রকম ভয় পাইয়াছ?” 

সুধা কাঁপিতে কাঁপিতে বলিল, “হাঁ মহাশয়, আজ আবার সেই রকম শব্দ শুনিয়াছি। আমার নিশ্চয় রোধ হইতেছে, আমি আর বাঁচিব না। দিদিও মৃত্যুর আগে তিন চারিদিন এই রকম শব্দ শুনিয়াছিল।” 

আমি তাহাকে শান্ত করিলাম। বলিলাম, “মা! আর কখনও তোমার এ রকম শব্দ শুনিতে হইবে না। আমি এ রহস্য শীঘ্রই ভেদ করিব। আজ তুমি ভিতরে যাও। রাত্রি প্রায় সাড়ে তিনটা বাজিয়াছে। কিন্তু আজিকার ভয়ের কথা যেন আর কেহ জানিতে না পারে। তোমার কোন ভয় নাই। আমি কালই তোমার ভয়ের প্রকৃত কারণ বাহির করিব।” 

আমার কথা শুনিয়া সুধা বলিল, “আপনি কি আজ সমস্ত রাত্রি জাগরণ করিয়া আছেন?” 

আ। হাঁ মা! আমি যখন যে কার্যে নিযুক্ত হই, তখন তাহা শেষ না করিয়া বিশ্রাম করিতে যাই না। আর এক কথা তোমার খুড়ার সহিত কোন সন্ন্যাসীর আলাপ আছে কি? 

সু। কেন? এ কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন? 

আ। আগে আমার কথার উত্তর দাও, তার পরে আমি সকল কথা বলিতেছি। 

সু। আমার খুড়া সন্ন্যাসীদিগকে ভক্তি করেন। সন্ন্যাসী দেখিলেই তিনি যত্ন করিয়া তাহাদের সেবা করেন।

আ। কখনও তোমার খুড়াকে কোন সন্ন্যাসীর সহিত গোপনে পরামর্শ করিতে দেখিয়াছ? 

সু। যখনই তিনি কোন সন্ন্যাসীর সহিত কথা কহিতে ইচ্ছা করেন, তখনই তিনি গোপনে তাহার সহিত আলাপ করেন। 

আ। কেন জান? 

সু। না-কাকিমা বলেন, তিনি ঐ সন্ন্যাসীদিগের নিকট হইতে অনেক উপকার পাইয়াছেন। শুনিয়াছি, উহাদের ঔষধ ধারণ করিয়াই কাকিমা পুত্র প্রসব করিয়াছেন। 

আ। তোমার কাকার ঘরটি একবার দেখাইতে পার? 

সু। কাকার ঘর! সে ঘরে কাকি-মারও যাইবার অধিকার নাই। 

আ। তুমি কি কখনও সে ঘরে যাও নাই? 

সু। না। 

আ। কেন? সে ঘরে কি আছে? 

সু। দরকারি দলিল আছে। 

আ। জমীদারীর কাগজপত্র সরকারের নিকট থাকে না কেন? 

সু। সরকারের কাছেও আছে। তবে খুব দরকারী কাগজপত্র সব নিজের কাছেই রাখেন। 

আ। একবার আমায় সে ঘরটা দেখিতে হইবে। যদি কাল কোনরূপ সুবিধা হয় আমায় খবর দিও। 

এই বলিয়া সুধাকে বিদায় দিলাম। সে তাহার দিদির ঘরে শুইতে গেল। আমিও বাহিরে আসিয়া একস্থানে শয়ন করিলাম। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ

পরদিন বেলা নয়টার পর শুনিলাম, প্রাণকৃষ্ণবাবু বিবাহের জিনিস-পত্র কিনিবার জন্য কলিকাতায় যাইবেন। তাঁহার সঙ্গে ভোলা ও আর আর চাকরগুলিও যাইবে। আমার শরীর অসুস্থ ছিল বলিয়া, বাবু আমায় সঙ্গে লইতে ইচ্ছা করিলেন না। 

এদিকে শুনিলাম, বাড়ীর গৃহিণী, তাঁহার পুত্র ও সুধাকে লইয়া নিকটস্থ এক আত্মীয়ের বাড়ী নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে যাইবেন। তাঁহার সহিত দুইজন দাসীও যাইবে। বাড়ীতে কেবল আমি, দ্বারবান ও একজনমাত্র দাসী থাকিবার কথা হইল। 

সুযোগ উপস্থিত হওয়ায়, আমি আন্তরিক সন্তুষ্ট হইলাম। ভাবিলাম, এই সুযোগে প্রাণকৃষ্ণবাবুর ঘরটি দেখিতে পাইব। 

আহারাদির পর কর্ত্তা দল-বল সমেত বাহির হইলেন। গিন্নিও তার কিছু পরেই সুধা ও তাঁহার আদরের পুত্রকে লইয়া নিমন্ত্রণ রক্ষার্থ গমন করিলেন। আমার অসুখ হইয়াছে প্রচার করিয়াছিলাম, সুতরাং সেখানে কোনরূপ আহার না করিয়া বাজারে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। সেখানে একটি দোকানে বসিয়া আহার করিয়া গৃহে ফিরিলাম। পরে বিশ্রামের আশায় একস্থানে শয়ন করিলাম। 

বেলা প্রায় দুইটা বাজিল। বাড়ীর দরোয়ান ও সেই দাসী অকাতরে ঘুমাইতেছিল। বাড়ীতে জনপ্রাণীর সাড়া নাই। আমি তখন গাত্রোত্থান করিলাম; এবং ধীরে ধীরে তেতলায় যাইলাম। দেখিলাম, প্রাণকৃষ্ণবাবুর ঘর বন্ধ। ঘরের দরজায় দুইটি তালা লাগান রহিয়াছে। আমার কাছে তালা খুলিবার যন্ত্র ছিল, অনায়াসে দুইটি তালাই খুলিয়া ফেলিলাম এবং কোন শব্দ না করিয়া আস্তে আস্তে ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, ঘরটি প্রকাণ্ড। কিন্তু দুইভাগে বিভক্ত। মধ্যে এক কাঠের ব্যবধান। তাহার মধ্যে একটি ক্ষুদ্র দরজা। সেই দরজা পার হইয়া ঘরের অপর অংশে যাইলাম। দেখিলাম, সেখানে তিনটি বড় বড় সেকেলে সিন্ধুক। সিন্ধুকের নিকট বোতলে করা দুগ্ধ, এক কাঁদি সুপক্ক রম্ভা, তিনটি কাচের বাটীতে অল্প অল্প দুধ। দুধের উপর এক একটি রম্ভা। ইচ্ছা ছিল, সিন্ধুকগুলি খুলিয়া দেখি। কিন্তু অনেক চেষ্টা করিয়াও উহাদিগকে খুলিতে পারিলাম না। 

ঘরের ভিতর আর কোন আশ্চর্য্য দ্রব্য দেখিতে পাইলাম না। অপর অংশে বড় বড় গোটাকতক আলমারি। আলমারিগুলির মধ্যে পুরাতন খাতায় পরিপূর্ণ। ঘরের পাঁচ ছয়খানি চেয়ার, দুইখানি কৌচ, একখানা প্ৰকাণ্ড আয়না, খানকতক বিলাতী ছবি, একটি প্রকাণ্ড ঘড়ি ও একটি আলা রহিয়াছে। আমি প্রত্যেকটি বিশেষ করিয়া পরীক্ষা করিলাম, কিন্তু কোন সন্ধান পাইলাম না। তখন সেই নল দুইটির নিকট যাইলাম। দেখিলাম, নলের মুখ ঢাকা। মুখের আবরণ খুলিয়া ফেলিলাম, পকেট হইতে দুরবীণটা বাহির করিয়া বেশ করিয়া দেখিলাম। নলের মুখ খোলা হইলে এক প্রকার আমিষ গন্ধ বাহির হইল। সেই গন্ধে আমার আনন্দ হইল। আমি যাহা সন্দেহ করিয়াছিলাম, এখন তাহা সত্য বলিয়া ধারণা হইল; এবং সেই রাত্রেই রহস্য ভেদ করিতে মনস্থ করিলাম। 

প্রায় আধ ঘণ্টার মধ্যেই এই সকল কাৰ্য্য সমাপন করিয়া আমি প্রাণকৃষ্ণবাবুর ঘরের দরজা পূর্ব্বের মত বন্ধ করিলাম এবং নিজের জায়গায় আসিয়া আবার শয়ন করিলাম। 

নবম পরিচ্ছেদ

সন্ধ্যার কিছু পূর্ব্বে শুনিলাম, বাবুর শরীর বড় অসুস্থ। আগেই তাঁহার শরীর খারাপ ছিল; বিশেষতঃ, সেদিন কলিকাতায় নানা কাৰ্য্যে ঘুরিয়া তিনি আরও অসুস্থ হইয়াছিলেন। সুতরাং সান্ধ্য জলযোগ করিয়া সন্ধ্যার পরই বিশ্রাম করিতে গেলেন। 

গৃহিণী যখন নিমন্ত্রণ রক্ষা করিয়া আসিলেন, তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। তিনিও খানিক পরেই পুত্রকে লইয়া শয়ন-গৃহে গমন করিলেন। সুধাও দাসীর সহিত আপনার ঘরে বিশ্রাম করিতে গেল। 

আমি তখন ভোলার নিকট গিয়া বলিলাম, “ভোলা! আজ একটা কাজ করতে পারবি?” 

ভোলা আমার কথায় আশ্চর্য্য হইল। বলিল, “এখানে আপনার এমন কি কাজ?” 

আ। পারবি কি না বল্‌? 

ভো। আপনার কাজ করিব না ত কার কাজ করিব? কি করিতে হইবে বলুন? 

আ। একবার সুধাকে ডাকতে পারিস? 

ভো। এই কাজ? এখনই ডাকিতেছি। 

এই বলিয়া ভোলা বাড়ীর ভিতর গেল। খানিক পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, “সুধা শুইয়াছিল, অনেক কষ্টে তাহাকে ডাকিয়া তুলিয়াছি। আপনি আসুন।” 

আমি সুধার সহিত দেখা করিলাম। বলিলাম, “আজ কি তুমি এই ঘরেই শুইবে?”

সু। তা না হইলে আর কোথায় শুইব? 

আ। কেন, তোমার দিদির ঘরে? 

সু। কাকা জানিতে পারিলে আমার উপর রাগ করিবেন। 

আ। তোমার দাসী কোথায়? 

সু। সে ঘুমাইয়াছে? 

আ। এই ঘরেই আছে না কি? 

সু। হাঁ, এই ঘরেই শুইয়া আছে। 

আ। দাসী কি তোমার বিশ্বাসী? 

সু। হাঁ। ঐ দাসীই আমায় মানুষ করিয়াছিল। ও আমায় মায়ের মত ভালবাসে। 

আ। তবে এক কাজ কর। দাসীকে লইয়া আজ তোমার দিদির ঘরে যাও। আমরা আজ এ ঘরে থাকিব। সু। যদি কাকা জানিতে পারেন? 

আ। তোমায় সে ভয় করিতে হইবে না। আমি পুলিসের লোক, তোমার কাকাকে বড় ভয় করি না। 

সু। আপনি করিবেন কেন? আমাকে ত ভয় করিতে হইবে। আমার অন্যায় দেখিলে বাড়ী হইতে দূর করিয়া দিবেন। 

আ। তিনি অন্য উপায়ে সেই চেষ্টাই করিতেছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কাল প্রাতে সমস্তই প্রকাশিত হইবে। তোমার দিদি যে কেবল তয়েই মারা পড়িয়াছিল, তাহা সম্পূর্ণ মিথ্যা। হয়ত কাল প্রাতেই পাঁচ জনে তাহা জানিতে পারিবে। এখন আমি যাহা বলি, কর। তোমার দাসীকে আমার কথা না বলিয়া, এখান হইতে তোমার দিদির ঘরে লইয়া যাও। আজিকার মত সেই ঘরেই শয়ন কর। কিন্তু দেখিও, যেন আজ আর কেহ এ বিষয় জানিতে না পারে। এখন বাড়ীর সকলেই বিশ্রাম করিতে গিয়াছে। সুতরাং আমার বিশ্বাস, এ কথা কেহই জানিতে পারিবে না। তবে তোমার দাসীকেও তুমি সাবধান করিয়া দিও। 

সুধা আর কোন কথা বলিল না। সে ঘরের ভিতর যাইয়া দাসীকে ডাকিতে লাগিল। আমি ভোলাকে লইয়া আবার বাহিরে আসিলাম। 

খানিক পরে ভোলা জিজ্ঞাসা করিল, “তবে আমি শুই গে?” 

আমি হাসিতে হাসিতে বলিলাম, “সে কি! এরই মধ্যে বুঝি কাজ শেষ হয়ে গেল? এখনও বল্ আজ আমার সঙ্গে রাত্রি জাগিতে পারবি কি না?” 

ভোলা অপ্রতিভ হইল। সেও লজ্জার হাসি হাসিয়া বলিল, “সকল কথা আমায় না বলিলে আমি কেমন করিয়া জানিতে পারিব? আর যে রাত্রি জাগরণের কথা বলিতেছেন তাহা একটার কথা কি, আমি আপনার কাজে ক্রমান্বয়ে তিন চারি রাত্রি জাগিতে পারি।” 

আমি ভোলার কথার অর্থ বুঝিতে পারিলাম না। পূর্ব্বে সে আমার চাকর ছিল, আমাকে সে বড় ভালবাসিত। মনিব বলিয়া নয়, যেন আমি তাহার আত্মীয়। আমিও কখন তাঁহাকে একটি রূঢ় কথা বলি নাই। সেই আমার নিকট চারি টাকা বেতন পাইত। কিন্তু ইহা ছাড়া আমার মক্কেলদিগের নিকট হইতে মধ্যে মধ্যে মাসে প্রায় দশ বার টাকা আদায় করিত। 

যে কারণেই হউক, ভোলা এখনও আমায় সেই রকম ভালবাসে, তাহা বুঝিতে পারিলাম। বলিলাম, “তোকে তিন চার রাত্রি জাগতে হ’বে না। এক রাত্রি জাগলেই যথেষ্ট হবে, আর এই কাজের জন্য তুই পুরস্কারও পাবি!” 

ভোলা বলিল, “সে কথা পরে, এখন আমায় কি করিতে হইবে বলুন?” 

আ। আমার সঙ্গে সুধার ঘরে গিয়া সমস্ত রাত্রি জাগতে হবে। 

ভো। তবে চলুন। 

দশম পরিচ্ছেদ

সুধার ঘরে আসিয়া আগে আলো জ্বালিলাম। পরে ভোলাকে এক স্থানে বসিতে বলিয়া, স্বয়ং সুধার বিছানার উপর সেই নলের নিকট গিয়া বসিলাম; এবং আলোক নিভাইয়া দিলাম। 

আমার প্রায় ছয় হাত দূরে ভোলা বসিয়াছিল। আমি তাহাকে কোনরূপ শব্দ করিতে নিষেধ করিয়াছিলাম। সেও নির্দ্দিষ্ট স্থানে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। আমার হাতে এক গাছি মোটা লাঠি ও একটি দেশলাই ছিল। ভোলা আমার হাতে লাঠি দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার হাতে লাঠি কেন?” 

আমি হাসিয়া উত্তর করিলাম, “যদি তুই আমার কথা না শুনিস্ এই লাঠি তোর পিঠে পড়বে।” 

ভোলার ভয় হইল, বলিল, “আমি আপনাকে বেশ চিনি। এ পর্যন্ত আপনি কখনও কোন চাকরের গায়ে হাত তুলেন নাই।” 

আমি বলিলাম, “যদি তাই জানিস, তবে চুপ ক’রে ব’সে মজা দেখ। তোদের বাবু কত বড় ভয়ানক লোক এখনই জানতে পারবি।” 

ভোলা আর কোন কথা কহিল না। যখন আমরা সুধার ঘরে আসিলাম, তখন ঘড়ীতে বারটা বাজিল। তখনও অনেক বিলম্ব ছিল বটে, কিন্তু আমি কোনমতে নিশ্চিত্ত হইয়া ঘুমাইতে পারিলাম না। 

খানিক পরে ভোলা আস্তে আস্তে আমার নিকট আসিয়া চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করিল, “এখন আলোটা জ্বালিয়া দিব?” 

আ। না না, এমন কাজ করিস্ না। 

ভো। অন্ধকারে বড় কষ্ট হইতেছে। বিশেষতঃ একে ঘুমের সময়, তাহার উপর ঘর অন্ধকার। ইহাতে সহজেই আমার ঘুম পাইতেছে। 

আ। আলো জ্বাললে এখনই তোর বাবু সন্দেহ করবে। 

ভো। তিনি ত উপরের ঘরে। তাহার উপর তিনি আজ বড় অসুস্থ। আপনি যে এই ঘরে আলো জ্বালিয়াছেন, একথা তিনি কিরূপে জানিতে পারিবেন? 

আ। তোর মনিব বেশ সুস্থ আছেন, তিনি যে ভয়ানক কার্য্যে নিযুক্ত হ’য়েছেন, তা’ শেষ করবার জন্যই তিনি আপনাকে অসুস্থ ব’লে রাষ্ট্র ক’রেছেন। তিনি এখন উপরের গৃহে জে’গে ব’সে আছেন, কেবল সুযোগ অন্বেষণ করছেন। আমি এখানে আলো জ্বাল্লে তিনি জানতে পারবেন। 

ভো। কি করিয়া জানিতে পারিবেন? 

আ। এই নলের সাহায্যে। ঐ কার্য্যের জন্যই এই নলটী সম্প্রতি এখানে বসান হ’য়েছে। 

ভোলা আর কোন উত্তর করিল না। আমরা দুইজনে নিঃশব্দে সেখানে বসিয়া রহিলাম। দেখিতে দেখিতে একটা দুইটা ও তিনটা বাজিয়া গেল; — কোনরূপ গোলযোগ বা কোন প্রকার শব্দ শুনিতে পাইলাম না। 

সহসা সেই ভয়ানক নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া, হিস্ হিস্ শব্দ আমার কর্ণগোচর হইল। শব্দ শুনিয়া আমার বোধ হইল যে, সেই নলের ভিতর হইতেই ঐরূপ শব্দ আসিতেছে। ক্রমে সেই শব্দ যেন নিকটবর্ত্তী হইতে লাগিল। আমার হাতেই দেশলাই ছিল : আমি তৎক্ষণাৎ জালিয়া ফেলিলাম। যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমার অন্তরাত্মা শুকাইয়া গেল। এক ভয়ানক বিষাক্ত কৃষ্ণবর্ণ কেউটে সাপ সেই নলের মুখ হইতে ফোঁস ফোঁস শব্দ করিতে করিতে ধীরে ধীরে বাহির হইতেছে। আমি পূর্ব্বেই ঐরূপ সন্দেহ করিয়াছিলাম এবং সেই জন্য সেই মোটা লাঠি গাছটিও সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিলাম। ভোলাকে ইঙ্গিত করিয়া, সেই সর্প দেখাইয়া, আমার হাতের লাঠী দিয়া তিন চারিবার সজোরে আঘাত করিলাম। সাপ নিস্তেজ হইয়া পড়িল। 

ভোলা আমার কার্য্য দেখিয়া চমৎকৃত হইল, — ভয় করিল না। সেও ঘরের ভিতর হইতে এক গাছি লাঠি লইয়া সাপকে তাড়না করিল। উভয়ের বারম্বার আঘাতে সাপটি প্রায় মর মর হইল। তখন সাপটিকে উত্তমরূপে বাঁধিয়া একস্থানে লুকাইয়া রাখিলাম। 

আমার এই কার্য্য শেষ হইতে না হইতে বাঁশীর শব্দ শুনিতে পাইলাম। তখনই বলিলাম, “ভোলা! আমার সহিত শীগির আয়?” 

ভো। কোথায়? 

আ। আমাদিগের নিজ নিজ থাকিবার স্থানে। 

আমি ভোলাকে লইয়া সেই স্থান হইতে বাহিরে আসিলাম, ও ভোলাকে আপন স্থানে শয়ন করিতে কহিলাম। সেও নির্দিষ্ট স্থানে শয়ন করিল। আমি ঐ স্থান হইতে দ্রুতপদে বাহির হইয়া, আমার ঊর্দ্ধতন কৰ্ম্মচারীর নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলাম ও তাঁহাকে সমস্ত বৃত্তান্ত আগাগোড়া কহিলাম। তিনি সমস্ত অবস্থা শুনিয়া, অতিশয় বিস্মিত হইলেন ও কহিলেন, “এরূপ অবস্থায় প্রাণকৃষ্ণবাবুকে ধৃত করাই কর্তব্য। কারণ, এখন বেশ বোধ হইতেছে, সুধার ভগ্নী সর্পভ্রষ্ট হইয়াই ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছে ও তাহার মৃত্যুর কারণই প্রাণকৃষ্ণ। যাহাতে তাহার ঘরের অর্থ বাহির হইয়া না যায়, এই নিমিত্তই তিনি তাহাকে হত্যা করিয়াছেন। এখন যদিও বেশ বুঝিতে পারা যাইতেছে যে, প্রাণকৃষ্ণই তাহাকে হত্যা করিয়াছে, কিন্তু এত দিবস পরে ঐ হত্যা প্রমাণ করা সহজ না হইলেও, তাহাকে কিন্তু ধৃত করিয়া আর একবার অনুসন্ধান করিয়া দেখা কৰ্ত্তব্য।’ 

আমার প্রধান কৰ্ম্মচারী আমাকে এইরূপ বলিয়া নিজেই আমার সহিত সেইস্থানে যাইতে প্রস্তুত হইলেন ও উপযুক্তরূপ আরও কয়েকজন কর্ম্মচারী ও প্রহরী সঙ্গে লইয়া আমার সহিত প্রাণকৃষ্ণবাবুর বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম। যখন আমরা সেইস্থানে উপস্থিত হইলাম, তখন ৬টা বাজিয়াছে, ভোলাকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম যে, প্রাণকৃষ্ণবাবু এখনও গাত্রোত্থান করেন নাই; ও বাড়ীর অনেকেই এখনও পর্যন্ত নিদ্রাগত। 

আমরা সকলে একেবারে প্রাণকৃষ্ণবাবুর বাটীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। আমি বাড়ীর অবস্থা সমস্তই জানিতাম সুতরাং প্রাণকৃষ্ণবাবুর গৃহে গমন করিতে আমাদিগের কোনরূপ কষ্ট হইল না, আমরা সকলে একেবারে তাঁহার গৃহদ্বারে উপনীত হইলাম। 

তাঁহার কক্ষ তখনও পর্যন্ত রুদ্ধ ছিল। আমার প্রধান কর্মচারী তাঁহার দ্বারে দণ্ডায়মান হইয়া তাঁহাকে বার বার ডাকিতে লাগিলেন, কিন্তু প্রাণকৃষ্ণবাবুর কোনরূপ উত্তর পাওয়া গেল না। ক্রমে বাড়ীর ও প্রতিবেশীবর্গের অনেকেই আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন; তাহারাও প্রাণকৃষ্ণবাবুকে বার বার ডাকিলেন কিন্তু কোনরূপই তাঁহার উত্তর পাওয়া গেল না। তখন অনন্যোপায় হইয়া সেই কৰ্ম্মচারী ঐ কক্ষদ্বার ভাঙ্গিয়া উহার ভিতর প্রবেশ করিলেন। বলাবাহুল্য, আমিও সেই সঙ্গে ঐ কক্ষ মধ্যে প্রবেশ করিলাম। উহার ভিতর প্রবেশ করিয়া যাহা দেখিলাম, তাহাতে সকলেই একেবারে বিস্মিত হইয়া পড়িলেন। 

যে সময় আমি আমার ঊর্দ্ধতন কর্মচারীর সহিত সেইস্থানে আগমন করিয়াছিলাম, সেই সময় অমরেন্দ্রবাবুকেও সংবাদ প্রদান করিয়া আসিয়াছিলাম। কিয়ৎক্ষণ পরে তিনিও আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইলেন; ও আমাকে সেইস্থানে দেখিতে পাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন— 

“মহাশয়! খবর কি?” 

আমি হাসিতে হাসিতে উত্তর কহিলাম, “খবর ভাল। আপনি যেরূপ সন্দেহ করিয়াছিলেন, ব্যাপার বাস্তবিকই সেইরূপ। গত রাত্রে প্রাণকৃষ্ণবাবুর সমস্ত চাতুরী প্রকাশ পাইয়াছে। 

অমরেন্দ্রনাথ আশ্চর্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “সুধা যে শব্দ শুনিতে পাইয়াছিল, তাহা কি?” 

আ। ভয়ানক বিষাক্ত সাপের শব্দ। প্রাণকৃষ্ণবাবু সর্পবশীকরণে বিশেষ পারদর্শী। তাঁহার সহিত অনেক সাপুড়ের আলাপ আছে। তিনি ভ্রাতুষ্কন্যা দুইটিকে কৌশলে হত করিবার জন্য বাড়ীতে বিষাক্ত সর্প রাখিতেন। 

অ। আপনি কি সাপ স্বচক্ষে দেখিয়াছেন? 

আ। নিশ্চয়ই। যে সর্প সম্ভবতঃ আপনার ভাবী বধূমাতাকে দংশন করিত, তাহাকে মারিয়া ফেলিয়াছি।

অ। সুধা যে বাঁশীর শব্দ শুনিতে পাইত, তাহাই বা কিসের? 

প্রাণকৃষ্ণবাবু সর্পগুলিকে এরূপ শিখাইয়াছিলেন যে, সেই বাঁশীর স্বর শুনিলেই তাহারা যথাস্থানে ফিরিয়া যাইত। অ। কেন তিনি এমন নিষ্ঠুরের কাজ করিতেন? 

আ। অর্থলোভ: ভ্রাতুষ্কন্যাগণের বিবাহ হইলে তাঁহাকে অনেক টাকা দিতে হয়। আমরা যখন সেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলাম, সেই সময় ঐ স্থানের কয়েকজন লোক ও অমরেন্দ্রবাবু আমাদিগের সহিত ঐ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিলেন। ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়াই দেখিলাম, প্রাণকৃষ্ণবাবু সেই ঘরের মধ্যে মৃত্তিকার উপর অচৈতন্য অবস্থায় পড়িয়া আছেন। তাঁহার কি অবস্থা হইয়াছে জানিবার নিমিত্ত যেমন তাঁহার নিকট গমন করিলাম, অমনি ভয়ানক সৰ্প গৰ্জ্জন শব্দ সকলের কানে প্রবেশ করিল। সকলে অতিশয় বিস্মিত হইয়া কেহ বা ভয়ে ঘরের বাহিরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন; কেহ বা কিসের শব্দ জানিবার নিমিত্ত সেইস্থানে একটু দাঁড়াইলেন। 

সেই সময় দেখিতে পাওয়া গেল, ঐ ঘরের এক প্রান্তে একটি ভয়ানক বিষধর তাহার ফণা প্রায় দেড় হস্ত উত্থিত করিয়া, দক্ষিণ ও বামে সঞ্চালিত পূর্ব্বক ভয়ানক গৰ্জ্জন করিতেছে। 

এই অবস্থা দেখিয়া আমরা অতিশয় বিস্মিত হইলাম; ও দ্রুতবেগে সকলেই সেই ঘর হইতে বহির্গত হইলাম।

আমাদিগের এই অবস্থা দেখিয়া, প্রধান কর্মচারী সাহেবও ঐ ঘরের বাহিরে আসিলেন ও আমাদিগের সকলকেই সেই স্থান হইতে দূরে গমন করিতে কহিলেন। তাঁহার কথা শুনিয়া সকলেই সুদূরে গমন করিল, কেবল আমি তাঁহার পশ্চাতে রহিলাম। সাহেব তাঁহার পকেট হইতে একটি পাঁচনলা পিস্তল বাহির করিয়া, ঐ সর্পের মস্তক লক্ষ্য করিয়া দূর হইতে এক গুলি করিলেন। কিন্তু ঐ গুলি ব্যর্থ হইয়া গেল। পুনরায় দ্বিতীয়বার গুলি করিলেন, তাহাও ব্যর্থ হইয়া গেল। তৃতীয়গুলিতে উহার মস্তক চূর্ণ হইয়া গেল, কিন্তু তাহার বিক্রমের কিছুমাত্র হ্রাস হইল না, সেই মস্তকহীন সৰ্প সেই ঘর আলোড়িত করিতে লাগিল। তখন আমরা উভয়ে দুই গাছি মোটা লাঠী হস্তে ঐ ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম ও লগুড়াঘাতে ঐ সর্পের জীবন নাশ করিলাম। 

প্রাণকৃষ্ণবাবুকে তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে পাঠাইয়া দিলাম। তিনি হাসপাতালে গমন করিলে ঐ ঘরের ভিতর উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু আর সর্প দেখিতে পাইলাম না; তাহাদিগের আহারীয় দুগ্ধ ও রম্ভা প্রভৃতি স্থানান্তরিত করিয়া ফেলিলাম। দুইটি বাঁশের ঝুড়ি শূন্য অবস্থায় দেখিতে পাইয়া বুঝিলাম, সৰ্প দুইটি উহাতে রক্ষিত হইত। 

হাসপাতালে ডাক্তারগণ উহাকে বাঁচাইবার নিমিত্ত অনেক চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কোনরূপেই কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না। কেবল একবারমাত্র প্রাণকৃষ্ণের জ্ঞান হইয়াছিল, তাহাও অতি অল্প সময়ের নিমিত্ত। সেই সময় তিনি ডাক্তারের সমক্ষে কেবল এইমাত্র বলিয়াছিলেন যে, “অর্থের নিমিত্ত আমি যে কার্য্য করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম, তাহার উপযুক্ত ফল পাইয়াছি। সর্পের দ্বারা দংশিত করাইয়া সুধার ভগ্নীকে হত্যা করিয়াছিলাম; সুধাকেও সেইরূপে নষ্ট করিবার চেষ্টা করিয়াছিলাম, কিন্তু ঈশ্বর হাতে হাতে তাহার ফল প্রদান করিয়াছেন। সুধাকে দংশন করিবার নিমিত্ত একটি সর্পকে নল দিয়া তাহার ঘরে নামাইয়া দিয়াছিলাম, কিন্তু অনেকবার বংশীধ্বনি করিয়াও যখন দেখিলাম, সেই সর্প আর প্রত্যাগমন করিল না, অথচ সুধা জীবিত আছে, তখন দ্বিতীয় সপটি পুনরায় তাহার ঘরে প্রবেশ করাইয়া দিবার নিমিত্ত যেমন উহাকে তাহার ঝুড়ি হইতে বাহির করিতে গেলাম, অমনি সে আমাকে ভীষণরূপে দংশন করিল, আমিও অচৈতন্য হইয়া সেইস্থানে পতিত হইলাম। আমি যেরূপ কার্য্য করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম, তাহার উপযুক্ত ফল প্রাপ্ত হইয়াছি।” 

এই কয়টি কথা বলিবার পরই প্রাণকৃষ্ণবাবু পুনরায় অচৈতন্য হইয়া পড়িলেন ও তাঁহার আর কোনরূপেই চৈতন্য সঞ্চার হইল না। 

প্রাণকৃষ্ণবাবু ইহ-জীবন পরিত্যাগ করিয়া আমাদিগের হস্ত হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিলেন। কিন্তু তাঁহার সেই ভীষণ চরিত্রের কথা কাহারও জানিতে বাকী রহিল না। সামান্য অর্থের লোভে জগতে যে কিরূপ ভয়ানক কার্য্য হইতে পারে, তাহার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত বর্ত্তমান থাকিলেও, এই আর একটি জাজ্জ্বল্যমান দৃষ্টান্ত সকলের মনে জাগরূক রহিল। 

অমরেন্দ্রবাবুর পুত্রের সহিত সুধার বিবাহ সম্বন্ধ প্রাণকৃষ্ণবাবু স্থির করিয়া গিয়াছিলেন, তাঁহার স্ত্রী তাঁহার স্বামীর ইচ্ছা স্থির রাখিয়া, অশৌচান্তে শুভদিনে শুভলগ্নে ঐ বিবাহ কাৰ্য্য সম্পন্ন করাইয়া দিলেন। প্রাণকৃষ্ণবাবু যে সকল বিষয় রাখিয়া গিয়াছিলেন, তাহা হিন্দু আইন অনুসারে, সুধা ও প্রাণকৃষ্ণবাবুর পুত্রের মধ্যে বিভাগিত হইয়া গেল, কিন্তু প্রাণকৃষ্ণবাবু যে সমস্ত নগদ টাকা ও অলঙ্কারপত্র রাখিয়া গিয়াছিলেন, তাহার বিন্দুমাত্রও সুধা প্রাপ্ত হয় নাই। লোকে কাণা-ঘুষা করিয়াছিল —ঐ সমস্ত অর্থ ও অলঙ্কার তাঁহার স্ত্রী আত্মসাৎ করিয়াছিল। 

[ মাঘ, ১৩১৩] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *