সাবাইস চোর

সাবাইস চোর

(অর্থাৎ চোরের অদ্ভুত বুদ্ধি!) 

প্রথম পরিচ্ছেদ

একদিবস সংবাদ পাইলাম, গগনচন্দ্র ঘোষ নামক এক ব্যক্তির পাকা ঘরে সিঁদ দিয়া, চোরে অধিক মূল্যের সোণা-রূপার অলঙ্কার চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে। 

সংবাদ পাইয়া, যেস্থানে গগনচন্দ্র ঘোষের বাড়ী, সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। গগনবাবুর সহিত সাক্ষাৎ হইলে, তাঁহার নিকট শুনিয়া অবগত হইতে পারিলাম যে, গগনবাবুর বাসস্থান কলিকাতায় নহে, মফঃস্বলে। তিনি একজন জমিদার। যে স্থানে তাঁহার বাড়ী, সেই স্থানের জল হাওয়া অস্বাস্থকর হওয়ায়, তিনি অতি অল্পদিবস হইতে কলিকাতায় আসিয়া বাস করিতে আরম্ভ করিয়াছেন। একটিভদ্র ও বর্দ্ধিষ্ণু পল্লির মধ্যে একটু বড়গোছের একখানি দ্বিতল বাড়ী ভাড়া করিয়া, গত দুইমাস হইতে সপরিবারে সেই স্থানে বাস করিতেছেন। 

তাঁহার বাড়ীতে গিয়া দেখিলাম, তাঁহার বাড়ীর পশ্চাদ্ভাগে একটু খালি জমী আছে। সেই পতিত জমীর দিকে তাঁহার অন্দরমহলের একটি ঘরের জানালা। জানালাগুলি বেশ মজবুত, মোটা মোটা লোহার সিক দেওয়া। সেই জানালার নিম্ন হইতে কয়েখানি ইষ্টক খুলিয়া, দেওয়ালে একটি সিঁদ কাটা হইয়াছে। সিঁদটি দেখিতে নিতান্ত ক্ষুদ্র, একটি লোকের মস্তক তাহার ভিতর অতি কষ্টে প্রবিষ্ট হইতে পারে। যাঁহারা ইতিপূর্ব্বে সেইরূপ সিঁদ কখনও দেখেন নাই, তাঁহারা উহা দেখিয়া কখনই বলিবেন না যে, এই সিঁদের ভিতর দিয়া, কোনরূপেই মনুষ্য প্রবেশ করিতে পারে। কিন্তু আমরা সেইরূপ সিঁদ অনেক দেখিয়াছি, এবং সেইরূপ সিঁদের মোকদ্দমা অনেক অনুসন্ধান করিয়াছি বলিয়াই, সাহস করিয়া বলিতে পারি যে, যে ব্যক্তি প্রকৃত সিঁদেল, সে অনায়াসেই সেইরূপ ক্ষুদ্র সিঁদের ভিতর দিয়া প্রবেশ বা ভিতর হইতে বাহিরে আগমন করিতে পারে। যে সিঁদের ভিতর দিয়া যে চোরের মস্তক প্রবিষ্ট হয়, সেই সিঁদের ভিতর দিয়া সে অনায়াসেই গমনাগমন করিতে সমর্থ হয়। 

সিঁদটির অবস্থা দেখিয়া বেশ অনুমান হয়, উহা বাড়ীর বাহিরে বসিয়া কাটা হইয়াছে। যে খালি জায়গায় বসিয়া সেই সিঁদ কাটা হইয়াছে বলিয়া অনুমান হয়, সেই জমীর উপর তিনটি কাঠের বাক্স ভগ্নাবস্থায় পড়িয়া আছে। উহা উত্তমরূপে দেখিলে, দেখিতে পাওয়া যায়, উহাতে অস্ত্রের চিহ্ন এখন পর্যন্ত বিদ্যমান। বাক্সের ডালার নিম্নভাগে সন্ধিস্থলে সিঁদকাঠি প্রবিষ্ট করাইয়া সেই সকল বাক্স বলপূর্ব্বক ভাঙ্গিয়া ফেলা হইয়াছে। 

গগনবাবুকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম, সেইদিবস অতি প্রত্যূষে তিনিই সকলের অগ্রে গাত্রোত্থান করেন, এবং তিনিই প্রথমে জানিতে পারেন, তাঁহার বাড়ীর সদর দরজা খোলা রহিয়াছে। ইহা দেখিয়া, তাঁহার মনে বিষম সন্দেহের উদয় হয়, ও বাটীর মধ্যস্থিত ঘরগুলির ভিতর অনুসন্ধান করিয়া দেখেন যে, একটি ঘরে সিঁদ হইয়াছে, এবং সেই ঘরের মধ্যে যে কয়েকটি বাক্স ছিল, তাহা নাই। পরিশেষে বাড়ীর অপরাপর সকলের সাহায্যে বাটীর চতুঃপার্শ্বে অনুসন্ধান করিতে করিতে, দেখিতে পান, সেই সকল অপহৃত বাক্সগুলি ভগ্নাবস্থায় সেই স্থানে পড়িয়া রহিয়াছে; কিন্তু উহার মধ্যে যে সকল মূল্যবান্ দ্রব্যাদি ছিল, তাহার কিছুই নাই। ইহা দেখিয়াই, তিনি তাঁহার একজন পরিচারক দ্বারা এই সংবাদ থানায় পাঠাইয়া দেন। 

সিঁদ-চুরি মোকদ্দমার যেরূপ ভাবে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন, সেইরূপ অনুসন্ধান করিতে কিছুই বাকি থাকিল না। বাটীতে চাকর-চাকরাণী প্রভৃতি যে সকল লোকজন ছিল, তাহাদিগের চরিত্রাদি সম্বন্ধে গোপনে সমস্ত অনুসন্ধান করা হইল, কোন চোরের সহিত তাহারা পরিচিত কি না, তাহা উত্তমরূপে জানা হইল, এবং তাহাদিগের দ্বারা বাহিরের অপর কোন ব্যক্তি সেই বাড়ীর সমস্ত সংবাদ অবগত হইতে পারে কি না, তাহাও জানিলাম; কিন্তু কিছুই করিতে পারিলাম না। 

পাড়ার লোকজনের মধ্যে কোন্ কোন্ ব্যক্তির সেই বাড়ীতে যাতায়াত আছে, তাহাদিগের স্বভাব-চরিত্র কিরূপ, সেই বাড়ীর সমস্ত অবস্থা তাহাদিগের জানিবার সম্ভাবনা কিনা, কোন চোর, বদমাইস প্রভৃতির সহিত উহাদিগের কোনরূপ সংশ্রব আছে কি না, তাহাদিগের নিকট হইতে কোন লোকজনেরও সেই বাড়ী সম্বন্ধে কোনরূপ সংবাদ পাইবার সম্ভাবনা আছে কি না, প্রভৃতি বিষয় যতদূর সম্ভব অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু কিছুই অবগত হইতে পারিলাম না। 

কোন স্থান হইতে সন্দেহ-যুক্ত কোন নূতন লোক আসিয়া সেই পাড়ার ভিতর বাস করিতেছে কি না, এ সম্বন্ধে সেই পাড়ার কোন ব্যক্তির উপর কোনরূপ সন্দেহ হইতে পারে কি না, প্রভৃতি বিষয় সম্বন্ধে যতদূর জানিতে হয়, জানিলাম; কিন্তু কোনরূপে কোন সংবাদই প্রাপ্ত হইলাম না। 

স্থানীয় চোরগণের উপর বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিলাম, যাহার উপর কোন বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ হইল, তাহারই খানাতল্লাসি করিলাম, তাহার এবং তাহার বন্ধুবান্ধব সম্বন্ধে যতদূর অনুসন্ধান করিবার সম্ভাবনা, তাহারও কিছুই বাকি রহিল না; কিন্তু কোনরূপ ফলই ফলিল না। 

যে সকল বিখ্যাত চোরা-দ্রব্যগ্রহণকারী, কলিকাতা সহরে বাস করিয়া থাকে, তাহাদিগের সম্বন্ধে প্রকাশ্যে ও গোপনে যতদূর অনুসন্ধান হইতে পারে, তাহারও ত্রুটি হইল না; কিন্তু ফল পূর্ব্বের ন্যায় হইল। 

যে সকল পুরাতন চোর বা গোয়েন্দাদিগের সাহায্যে পূর্ব্বে এইরূপ মোকদ্দমার অনেক কিনারা করিয়াছিলাম, এবারও তাহাদিগের সম্পূর্ণরূপ সাহায্য গ্রহণ করিয়া, প্রাণপণে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু ফলে কিছুই হইল না। 

সোণা-রূপার অলঙ্কার প্রভৃতির ব্যবসা যাহারা করিয়া থাকে, তাহাদিগকেও সেই মালের নিমিত্ত বিশেষ পারিতোষিকের প্রলোভন দেখাইয়া সংবাদ প্রদান করিলাম; কিন্তু কেহ কোন দোকানদারের নিকট সেই সকল অলঙ্কার প্রকাশ্যে বিক্রয় করিল না। সুতরাং কেহই কোনরূপ সংবাদ প্রদান করিতে সমর্থ হইল না। 

এইরূপে আহার-নিদ্রা পরিত্যাগ-পূর্ব্বক বিশেষ যত্ন ও পরিশ্রম সহকারে প্রায় একমাসকাল এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু কোন ফলই ফলিল না। কেবল আহার নিদ্রা পরিত্যাগ এবং পরিশ্রম মাত্র সার হইল। 

আমিই যে কেবল এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিয়াছিলাম, তাহা নহে, অপরাপর অনেক কর্ম্মচারীও এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে লিপ্ত ছিলেন; কিন্তু সকলের অনুসন্ধানের ফল, আমার অনুসন্ধানের ফল অপেক্ষা যে কিছু অধিক হইল, তাহা নহে। 

ক্রমে ক্রমে সকলেই নিরাশ হইয়া, এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান পরিত্যাগ করিলেন। 

এই মোকদ্দমার ফরিয়াদী গগনবাবু ইহার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমাদিগকে বিশেষরূপ সাহায্য করিতে লাগিলেন, কেবল যে, যে বিষয় আমরা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিতাম, সেই সকল বিষয়ের যথাযথ উত্তর দিয়াই যে সাহায্য করিতেন, তাহা নহে; আবশ্যক হইলে, সর্ব্বদাই তিনি আমাদিগের সহিত নানাস্থানে গমন করিতেন। যদি কোন অর্থের প্রয়োজন হইত, তখনই তিনি তাহা আমাদিগকে প্রদান করিতেন; ফলতঃ কোন বিষয়ে তিনি আমাদিগকে সম্পূর্ণরূপে সাহায্য করিতে কোনরূপেই ত্রুটি করিতেন না। কিন্তু ফলে ইহার কিছুই হইল না, কেবলমাত্র অনুসন্ধান ও অর্থ ব্যয়ই হইতে লাগিল। 

এইরূপে প্রায় একমাসকাল আমি বিশেষ যত্নের সহিত এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু কোনরূপে ইহার কিছুমাত্র সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিলাম না। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

পূৰ্ব্ব-কথিত মোকদ্দমার অনবরত একমাসকাল অনুসন্ধান করিবার পরে, যখন দেখিলাম যে, আমি সেই মোকদ্দমার কিছুই করিয়া উঠিতে পারিলাম না, তখন সেই মোকদ্দমা পরিত্যাগ করিয়া আমাকে অন্য মোকদ্দমার অনুসন্ধানের ভার গ্রহণ করিতে হইল, ও শেষোক্ত মোকদ্দমার অনুসন্ধানের নিমিত্ত এই সহর পরিত্যাগ করিয়া, আমাকে মফঃস্বলেও গমন করিতে হয়। যে কার্য্যের নিমিত্ত আমি সহর পরিত্যাগ করিয়া, মফঃস্বলে গমন করিয়াছিলাম, সেই মোকদ্দমার অনুসন্ধান-কার্য্য শেষ করিয়া, কলিকাতায় প্রত্যাবর্তন করিতে আমার প্রায় পনরদিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। 

কলিকাতায় প্রত্যাবর্তন করিয়াই শুনিতে পাইলাম যে, যে ভদ্রপল্লীর মধ্যে পূর্ব্বে একটি সিঁদচুরি হইয়াছিল, রারদিবস অতীত হইল, সেই স্থানে পুনরায় আর একটিসিদ হইয়া, বিস্তর অলঙ্কার ও অর্থ অপহৃত হইয়াছে। অনেক কর্মচারী মিলিয়া উহার অনুসন্ধানও করিয়াছেন; কিন্তু কার্য্যে তাহার কোন ফলও ফলে নাই। পূর্ব্বে যে বাটীতে সিঁদ দিয়া অনেক দ্রব্যাদি অপহরণ করিয়াছিল, এবার সেই বাটীতে সিঁদ দেয় নাই; কিন্তু সেই বাড়ীরই নিতান্ত নিকটস্থিত আর একখানি বাড়ীতে সিঁদ দিয়া চুরি করিয়াছে। অপহৃত মালের মুদ্রিত তালিকা দেখিয়া জানিতে পারিলাম, এবার যে সকল দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে, তাহার মূল্য নিতান্ত অল্প নহে, প্রায় পাঁচ হাজার টাকা, এবং নগদ টাকাও কম নহে; কিন্তু কত, তাহার ঠিক পরিমাণ জানা যায় নাই। 

এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের ভার আমার উপর ন্যস্ত না হইলেও ইহার অবস্থা কি, তাহা জানিবার নিমিত্ত আমারও একটু বিশেষ কৌতূহল জন্মিল। স্থানীয় যে পুলিস কর্মচারীর হস্তে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের ভার অর্পিত ছিল, তাঁহার নিকট গিয়া ইহার আদ্যোপান্ত অবস্থা নিম্নলিখিত রূপে অবগত হইলাম। 

কর্ম্মচারী মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ হইলে, তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আজ কয়দিবস হইল, এই সিঁদ ও চুরি হইয়াছে?” 

কর্ম্মচারী। আজ তেরদিবস হইল, এই মোকদ্দমার প্রথম সংবাদ, আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হয়। 

আমি। সৰ্ব্বপ্রথমে এই সংবাদ কে থানায় লইয়া আসেন? 

কর্ম্মচারী। যাঁহার বাটীতে এই চুরি হইয়াছে, তিনি নিজে আসিয়া আমাকে এই সংবাদ প্রদান করেন। 

আমি। কোন্ সময় আসিয়া, তিনি এই সংবাদ প্রদান করেন? 

কর্ম্মচারী। প্রাতঃকালে, ছয়টার সময় তিনি আসিয়া, আমাকে এই সংবাদ প্রদান করেন। 

আমি। সংবাদ পাইয়া, প্রথমেই কি আপনি ঘটনাস্থলে গমন করিয়াছিলেন? 

কর্ম্মচারী। পুলিস-কর্মচারিগণের মধ্যে আমিই সৰ্ব্বপ্রথমে সেই স্থানে গমন করিয়াছিলাম। 

আমি। যে গগনবাবুর বাটীতে পূর্ব্বে চুরি হইয়াছিল, তাঁহার বাটী হইতে বর্তমান ফরিয়াদীর বাটী কতদূর অন্তর?

কর্ম্মচারী। অতি নিকট, একখানি বাটী ব্যবধান মাত্র। 

আমি। যে বাটীতে এই চুরি হইয়াছে, তাহা গগনবাবুর বাড়ীর একখানি বাড়ীর অব্যবহিত পরেই, কিন্তু তাঁহার বাড়ীর কোন পার্শ্বে? 

কর্ম্মচারী। গগনবাবুর বাড়ীর বাম পার্শ্বে। 

আমি। তাহা হইলে লাল রংয়ের দোতালা বারান্দাওয়ালা বাড়ীর কথা আপনি বলিতেছেন, বোধ হয়?

কৰ্ম্মচারী। হাঁ, সেই বাড়ীই বটে। 

আমি। সেই বাড়ীটি একজন উকীলের নহে? 

কর্ম্মচারী। হাঁ, যাঁহার বাড়ী হইতে এই চুরি হইয়াছে, তিনি একজন উকীলই বটেন। 

আমি। সেই উকীলবাবুর নাম প্রাণনাথবাবু নহে? 

কর্ম্মচারী। হাঁ, প্রাণনাথ বাবুই বৰ্ত্তমান মোকদ্দমার ফরিয়াদী? 

আমি। এবার কিরূপে চোর সেই বাটীর ভিতর প্রবেশ করে? 

কৰ্ম্মচারী। পূর্ব্বে যেরূপ ভাবে গগনবাবুর বাড়ীতে প্রবেশ করিয়াছিল, এবারও সেইরূপভাবে প্রাণনাথবাবুর বাড়ীতে তাহারা প্রবেশ করিয়াছিল, অবস্থা দেখিয়া এইরূপ মনে হয়। 

আমি। তাহা হইলে এবারেও সিঁদ কাটিয়াছে? 

কৰ্ম্মচারী। হাঁ। 

আমি। এবার বাড়ীর কোন স্থানে সিঁদ দিয়াছে? 

কর্ম্মচারী। বাড়ীর পশ্চাতে, জানালার নিম্নে। 

আমি। গগনবাবুর বাড়ীর পশ্চাদ্ভাগে যে ময়দানে বসিয়া গগনবাবুর বাড়ীতে সিঁদ দিয়াছিল, এবারও কি সেই ময়দানে বসিয়া সিঁদ কাটিয়াছে? 

কর্ম্মচারী। হাঁ, এবারেও সেই ময়দানে বসিয়া সিঁদ কাটিয়াছে। 

আমি। গগনবাবুর বাড়ীর সিঁদের সহিত এ সিঁদের প্রভেদ কি? 

কর্ম্মচারী। প্রভেদ কিছুমাত্র নাই। 

আমি। তাহা হইলে দুইটি সিঁদ দেখিতে একই প্রকার? 

কর্ম্মচারী। দুইটি সিঁদের মধ্যে কিছুমাত্র প্রভেদ নাই। দুইটি সিঁদই একই প্রকারের। দেখিয়া অনুমান হয়, দুইটি সিঁদই একই প্রকারে এক ব্যক্তিদ্বারা, এবং এক অস্ত্রদ্বারা খোদিত হইয়াছে। দুইটি সিঁদ যিনি দেখিয়াছেন, তিনিই বলিয়াছেন, হইা যে একই ব্যক্তির কার্য্য, সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। 

আমি। যে সকল দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে, সেই সকল দ্রব্য কিসের ভিতর ছিল? 

কর্ম্মচারী। বাক্সের ভিতর। 

আমি। সেই সকল বাক্স কোথায় থাকিত? 

কর্ম্মচারী। দোতালার একটি ঘরের মধ্যে। 

আমি। আপনার কথায় অনুমান হইতেছে না কি যে, বাড়ীর পশ্চাদ্ভাগে অর্থাৎ ময়দানের দিকে একখানি নীচের ঘরের জানালার নিম্নে সিঁদ দিয়াছে? 

কর্ম্মচারী। হাঁ, তাহাই ঠিক। 

আমি। আর, দ্রব্যাদি সকল অপহৃত হইযাছে, দোতালার একখানি ঘর হইতে? 

কর্ম্মচারী। তাহাও ঠিক। 

আমি। সিঁদ দিয়াছে, নীচের ঘরে; কিন্তু উপরের ঘরে কিরূপে প্রবেশ করিল? 

কর্ম্মচারী। নীচের যে ঘরে সিঁদ দিয়াছে, তাহার দরজা বাটীর ভিতরের দিকে খোলা ছিল। সুতরাং অনায়াসেই সেই দরজা দিয়া বাহির হইয়া, চোর উপরে গমন করে। উপরকার ঘরের সমস্ত দরজাই খোলা ছিল; সুতরাং সেই ঘর হইতে বাক্স সকল বাহির করিয়া আনিতে আর কিছুমাত্র কষ্ট পাইতে হয় না। 

আমি। এবারেও কি সদর দরজা খুলিয়া, বাক্সগুলি বাহির করিয়া আনিয়াছিল? 

কর্ম্মচারী। না। সদর দরজা খুলিয়া রাখিয়াছিল বটে; কিন্তু উহা দিয়া বাক্স সকল বাহির করিয়া আনে নাই।

আমি। তাহা হইলে বাক্স সকল কোথা দিয়া বাহির করিল? 

কর্ম্মচারী। বাক্স সকল এবার ঘর হইতে বাহির করিয়া আনিয়াছিল বটে, কিন্তু বাড়ীর ভিতর হইতে বাহির করিয়া, একবারে বাহিরে আনে নাই। 

আমি। কোথায় বসিয়া বাক্স সকল ভাঙ্গিয়াছে? 

কর্ম্মচারী। বাক্স সকল ঘর হইতে বাহির করিয়া, একবারে ছাদের উপর লইয়া যায়, এবং সেইস্থানে বসিয়াই উহা ভাঙ্গিয়া ফেলে। 

আমি। তাহা হইলে এবার বাক্সগুলি ছাদের উপর বসিয়া ভাঙ্গিয়া তাহার মধ্যস্থিত দ্রব্যাদি অপহরণ করিয়া লইয়াছে? 

কৰ্ম্মচারী। হাঁ। 

আমি। উহারা বাহির হইয়া গিয়াছে, কোন পথ দিয়া? ছাদে ছাদেই কি প্রস্থান করিয়াছে? 

কর্ম্মচারী। ছাদের উপর এরূপ কোন চিহ্ন দেখিতে পাওয়া যায় না, যাহাদ্বারা বুঝিতে পারা যায় যে, তাহারা ছাদে ছাদে প্রস্থান করিয়াছে। 

আমি। তাহা হইলে কোথা দিয়া উহারা বাহির হইয়া গিয়াছে বলিয়া, অনুমান হয়। 

কৰ্ম্মচারী। যখন সদর দরজা খোলা ছিল, তখন সেই স্থান দিয়া বহির্গত হইয়া যাইবারই খুব সম্ভাবনা। কিন্তু সে সম্বন্ধে বিশেষ কোন প্রমাণ নাই। 

আমি। এই চুরি কোন সময় হইয়াছে বলিয়া অনুমান হয়। 

কর্ম্মচারী। রাত্রি বারটার পর। 

আমি। কিরূপে জানিলেন যে, রাত্রি বারটার পর এই ঘটনা ঘটিয়াছে? 

কর্ম্মচারী। বাটীতে একটি চাকর আছে, তাহার কথা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে বারটার পরই, এই ঘটনা ঘটিবার সম্ভাবনা। কারণ, সে আমাদিগের নিকট বলিয়াছে, “আমি বাহিরের বৈঠকখানায় শুইয়াছিলাম, রাত্রি যখন বারটা, সেই সময় আমি উঠিয়া সদর দরজা খুলিয়া একবার বাহিরে গমন করি, ও পুনরায় সদর দরজা বন্ধ করিয়া শয়ন করি। তাহার পর যে কি হইয়াছে, তাহা বলিতে পারি না। ভোর পাঁচটার সময় উঠিয়া দেখি যে, বাড়ীর সদর দরজা খোলা আছে।” 

আমি। পাঁচটার সময় যখন সে দেখিতে পাইল, সদর দরজা খোলা রহিয়াছে, তখন সে কি করিল? 

কর্ম্মচারী। কিছুই নয়। 

আমি। কেন? তাহার মনিবকে, কি বাটীর কাহাকেও সে এ সংবাদ প্রদান করিল না? 

কর্ম্মচারী। তাহাকে একথা জিজ্ঞাসা করাতে, উত্তরে সে এইরূপ কহে যে, “প্রত্যহই প্রত্যূষে আমি সদর দরজা খোলা পাই; উহা নিত্য ঘটনা বলিয়া, সে কথা কাহাকেও বলি নাই।” 

আমি। তাহার কথা কি প্রকৃত? প্রত্যহ প্রত্যূষেই কি, সেই বাটীর সদর দরজা খোলা থাকে? 

কর্ম্মচারী। থাকে। 

আমি। কেন? 

কর্ম্মচারী। প্রত্যহ অতি প্রত্যূষে বাটীর একটি বৃদ্ধা স্ত্রীলোক গঙ্গা স্নান করিতে গমন করেন, তিনিই প্রত্যহ সদর দরজা খুলিয়া রাখিয়া যান। 

আমি। তাহা হইলে এ সম্বন্ধে সেই চাকরকে কোন কথা বলা যাইতে পারে না। যাহা হউক, তাহার যোগে অপর কোন চোর কর্তৃক এ কার্য হয় নাই ত? 

কৰ্ম্মচারী। তাহা ত আমার বোধ হয় না, তবে বলিতে পারি না। 

আমি। কেন? 

কর্ম্মচারী। একে সে পুরাতন চাকর, তাহাতে তাহাকে বিশেষ চালাক চতুর বলিয়া বোধ হয় না। তদ্ব্যতীত যদি উহার সহিতই চোরে যোগ করিয়া, বাটীর ভিতর প্রবেশ করিবে, তাহা হইলে সিঁদ কাটিবে কেন? সেই ব্যক্তি ভিতর হইতে অনায়াসেই দরজা খুলিয়া দিতে পারিত। 

আমি। সিঁদ না কাটিলে উহার উপর বিশেষরূপ সন্দেহ হইবার সম্ভাবনা। যে চাকর, চোরের সহিত মিলিত হইয়া থাকে, তাহার উপর যাহাতে কোনরূপ সন্দেহ উপস্থিত না হয়, চোরগণ প্রথমেই তাহার বন্দোবস্ত করিয়া থাকে। 

কর্ম্মচারী। তাহা প্রকৃত। যে পৰ্য্যন্ত এই মোকদ্দমা ধরা না পড়িবে, সেই পর্য্যন্ত চাকর সম্বন্ধে কোনরূপ বিশেষ কথা বলা যায় না। 

আমি। উহাকে একবারে পরিত্যাগ করাও কর্তব্য নহে? 

কৰ্ম্মচারী। তাহা ত নিশ্চয়ই। 

আমি। আপনি বলিলেন না যে বাটীর একটি স্ত্রীলোক প্রত্যহ প্রত্যূষে গঙ্গাস্নান উপলক্ষে সদর দরজা খুলিয়া রাখিয়া যান? 

কর্ম্মচারী। হাঁ। 

আমি। যেদিবস চুরি হয়, সেইদিবস প্রত্যূষে তিনি সেই দরজা পূর্ব্বের ন্যায় খুলিয়া রাখিয়া যান নাই?

কৰ্ম্মচারী। না। 

আমি। তাহা আপনি কিরূপে জানিতে পারিলেন? 

কর্ম্মচারী। সে সম্বন্ধে আমি অনুসন্ধান করিয়াছিলাম। 

আমি। আপনি কি সেই স্ত্রীলোকটিকে সেই সম্বন্ধে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন? 

কর্ম্মচারী। করিয়াছিলাম। 

আমি। তিনি কি বলেন? 

কর্ম্মচারী। তিনি কহেন, “প্রত্যহ ভোর চারিটার সময় যখন আমি গঙ্গাস্নান করিবার নিমিত্ত বাটী হইতে বহির্গত হইয়া যাই, সেই সময় সদর দরজা বদ্ধ থাকে, আমি নিজে দরজা খুলিয়া বহির্গত হইয়া যাই; কিন্তু সে দিবস আমি দেখিতে পাই যে, সদর দরজা খোলা আছে। সুতরাং দরজা খুলিয়া সেইদিবস অর আমাকে বাহির হইয়া যাইতে হয় না।” 

আমি। যে দরজা প্রত্যহ বদ্ধ থাকে, সেই দরজা সেইদিবস খোলা দেখিতে পাইয়া, তাঁহার মনে কোনরূপ সন্দেহের উদয় হয় নাই? 

কর্ম্মচারী। একথাও আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, তাহার উত্তরে তিনি কহিয়াছিলেন যে, “আমার মনে একটু সন্দেহ হয়; কিন্তু পরক্ষণেই ভাবি, বাড়ীর কোন লোক হয় ত, কোন কাৰ্য্য বশতঃ বাহির হইয়া গিয়াছে। এই ভাবিয়া, আমি সেই সময় কাহাকেও কিছু বলি না। বিশেষতঃ আমার গঙ্গাস্নানের সময় অতিবাহিত হইয়া যাইতেছে বলিয়া, আমি সেই সময় দ্রুতপদে গমন করি। আমার ইচ্ছা ছিল, গঙ্গাস্নান করিয়া প্রত্যাবর্তন করিবার পর, এ বিষয়ে একটু অনুসন্ধান করিব।” 

আমি। গঙ্গাস্নান করিয়া প্রত্যাবর্তন করিবার পর, তিনি এ সম্বন্ধে আর কোনরূপ অনুসন্ধান করিয়াছিলেন কি?

কৰ্ম্মচারী। না। 

আমি। কেন? 

কর্ম্মচারী। অনুসন্ধান করিবার আর কোনরূপ প্রয়োজন হয় নাই বলিয়াই, তিনি আর কাহাকেও কোনরূপ কথা বলেন নাই, বা এ সম্বন্ধে কোনরূপ অনুসন্ধানও করেন নাই। 

আমি। কেন প্রয়োজন হয় নাই? 

কর্ম্মচারী। গঙ্গাস্নান করিয়া আসিবার পরই তিনি জানিতে পারেন যে, তাঁহাদিগের বাটীতে চুরি হইয়া গিয়াছে।

আমি। চুরি হইয়াছে, একথা সৰ্ব্বপ্রথমে কে জানিতে পারেন? 

কর্ম্মচারী। যে ঘর হইতে বাক্স সকল স্থানান্তরিত হইয়াছিল, সেই ঘরে একটি স্ত্রীলোক নিদ্রিতা ছিলেন। প্রত্যূষে যখন তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ হয়, সেই সময় তিনি দেখিতে পান যে, তাঁহার ঘরে যে সকল বাক্স ছিল, তাহার একটিও নাই। ইহা জানিতে পারিয়াই, তিনি গিয়া, প্রাণনাথবাবুকে এই সংবাদ প্রদান করেন, ক্রমে বাটীর সকলে ইহা জানিতে পারেন, এবং সকলে মিলিয়া অনুসন্ধান করিতে করিতে, সেই সকল বাক্স ভগ্নাবস্থায় ছাদের উপর দেখিতে পান। বাক্স সকল পাওয়া যাইবার পর, জানিতে পারা যায় যে, ঘরে সিঁদ দিয়া চোর বাটীর ভিতর প্রবেশ করিয়াছিল। 

আমি। এ সংবাদ থানায় গিয়া কে প্রদান করে? 

কর্ম্মচারী। প্রাণনাথবাবু নিজে? 

আমি। যে সকল দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে, তাহা কাহার দ্রব্য? 

কর্ম্মচারী। প্রাণনাথবাবুর নিজের দ্রব্য। 

আমি। বাটীর কোন ব্যক্তির উপর প্রাণনাথবাবুর কোনরূপ সন্দেহ হয়? 

কর্ম্মচারী। না। 

আমি। পাড়ার কোন লোকের উপর? 

কর্ম্মচারী। পাড়ার কোন লোকের উপরও তিনি কোনরূপ সন্দেহ করেন না। 

আমি। আজ তেরদিবস হইল—এই চুরি হইয়াছে, এবং এত দিবস যে ইহার বিশেষরূপ অনুসন্ধান হইয়াছে, তাহাতে আর বোধ হয়, কিছুমাত্র সন্দেহ নাই? 

কর্ম্মচারী। যাহা কিছু অনুসন্ধান হইতে পারে, তাহার আর কিছুমাত্র বাকি নাই। 

আমি। ফলে কি হইয়াছে? 

কর্ম্মচারী। গগনবাবুর বাটীর চুরির অনুসন্ধান করিয়া যেরূপ ফল ফলিয়াছিল, এই মোকদ্দমার ফল তাহা অপেক্ষা অধিক কিছু প্রাপ্ত হওয়া যায় নাই। 

আমি। এ চুরি দেখিয়া গগনবাবু কি বলেন? 

কর্ম্মচারী। তিনি কহেন, “বুঝিতে না পারিয়া, আপন দেশ পরিত্যাগ করিয়া সপরিবারে কলিকাতায় আসিয়া, বাস করিয়া নিতান্ত অন্যায় কার্য্য করিয়াছি। কলিকাতা এইরূপ স্থান, তাহা পূর্ব্বে জানিতে পারিলে, কখনই কলিকাতা সহরে আসিয়া বাস করিতাম না।” 

আমি। আপনি যেরূপ বলিতেছেন, তাহাতে বোধ হয়, এ চুরির কিনারা হইবার আর কোনরূপ সম্ভাবনা নাই।

কর্ম্মচারী। যতদূর বুঝিতে পারিতেছি, তাহাতে বেশ অনুমান হইতেছে যে, এই সিঁদ চুরির কোনরূপ কিনারা হইবে না। 

আমি। এই দুইটি চুরি সম্বন্ধে আপনার কি অনুমান হয়? 

কর্ম্মচারী। আমার বোধ হয়, কোন স্থান হইতে কোন প্রসিদ্ধ সিঁদেল চোর আসিয়া, কলিকাতায় উপস্থিত হইয়াছে; এ চুরি, তাহারই কার্য্য। 

আমি। আমারও তাহাই অনুমান হয়। আমার আরও বোধ হয়, বাহিরের যে চোর, কলিকাতায় আগমন করিয়া, এই সকল সিঁদ দিতেছে, সে নিকটবর্তী কোন স্থানেই বাস করিতেছে। 

কর্ম্মচারী। আপনি এ অনুমান কিরূপে করিতেছেন যে, সেই চোর নিকটবর্তি কোন স্থানে বাস করিতেছে?

আমি। দেড়মাসের মধ্যে দুই-দুইটি প্রধান চুরি হইয়া গেল, দুইটিই এক স্থানে, এমন কি, এক বাড়ীতে বলিলেও চলে; অথচ এই দেড়মাসের মধ্যে সহরের অপর কোন স্থানে এইরূপ আর একটিও চুরি হয় নাই। ইহাতেই আমি অনুমান করিতেছি যে, যে স্থানে ক্রমান্বয়ে দুইটি চুরি হইয়া গেল, হয়, সেই স্থানে, বা তাহার নিকটবর্তি অপর কোন স্থানে, সেই চোর আসিয়া বাসস্থান গ্রহণ করিয়াছে। অথবা সে, যে স্থানেই বাস করুক না, এই স্থানে সে এরূপ কোন লোককে ঠিক করিয়া লইয়াছে যে, এই পাড়ার সমস্ত সংবাদ, সে, সেই চোরকে নিয়ত প্রদান করিতেছে। 

কর্ম্মচারী। আমার অনুমানও তাহাই; কিন্তু বিশেষ অনুসন্ধান করিয়াও ঘটনাস্থলের নিকটবর্তি কোন স্থানে সেইরূপ কোন লোক দেখিতে পাইতেছি না। কারণ, সিঁদেল চোর ভদ্রলোকের মধ্যে প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায় না, ইহা নীচ জাতীয় ব্যক্তিরই কার্য্য। কিন্তু যে স্থানে দুই-দুইটি সিঁদ চুরি হইয়া গেল, সেইস্থানে ভদ্রলোক ব্যতীত একজনও নীচ জাতীয় লোকের বাসস্থান নাই। 

আমি। কোন নূতন লোক আসিয়া সেই স্থানে বাস করার, কোন সংবাদ, বোধ হয়, এখনও পাওয়া যায় নাই।

কৰ্ম্মচারী। এক গগনবাবু ভিন্ন সেই পাড়ার ভিতর অন্য কোন লোক ছয়মাসের মধ্যে আগমন করেন নাই। সেই পাড়ায় যে সকল লোক বাস করিয়া থাকেন, তাঁহাদিগের প্রায় সমস্ত লোকই সেই স্থানের বাসিন্দা। দুই একখানি ভাড়াটিয়া বাটী আছে বটে; কিন্তু তাহাতে যাঁহারা বাস করিতেছেন, তাঁহারাও একরূপ সেই স্থানের বাসিন্দার সামিল। বহুদিবস হইতে তাঁহারা একই স্থানে বাস করিয়া আসিতেছেন। নূতনের মধ্যে এক গগনবাবু; তিনি জমিদার। বিশেষতঃ সর্ব্বাগ্রে চোরগণ তাঁহারই সর্ব্বনাশ করিয়াছে। 

আমি। কুটুম্ব পরিচয়ে কোন লোক আসিয়া, আজকাল সেই পাড়ার ভিতর আছে কি? 

কর্ম্মচারী। সে বিষয়ে আপনিও ত পূৰ্ব্বে অনুসন্ধান করিয়াছেন, এবার আমরাও অনুসন্ধান করিতে ত্রুটি করি নাই; কিন্তু সেরূপ কোন লোককেই খুঁজিয়া বাহির করিয়া উঠিতে পারি নাই। 

আমি। গগনবাবুর বাড়ীতে যে চুরি হয়, তাহার অনুসন্ধান কালীন, সেই পাড়ার যে সমস্ত লোককে আমরা উপস্থিত পাইয়াছিলাম, তাঁহারা সকলেই এখন পৰ্য্যন্ত সেই স্থানে উপস্থিত আছেন, কি কোন কোন ব্যক্তি সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়া স্থানান্তরে প্রস্থান করিয়াছেন? 

কর্ম্মচারী। সেই স্থান পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে, এমন লোক অনুসন্ধান করিয়া, একটিও বাহির করিতে সমর্থ হই নাই। 

আমি। প্রথম অনুসন্ধান কালে সেই পাড়ার ভিতর যে সকল চাকর ছিল, তাহারা সকলেই এখন পৰ্য্যন্ত আছে কি? 

কর্ম্মচারী। দুই একজন চলিয়া গিয়াছে, তাহাদিগের স্থানে দুই একজন নূতন নিযুক্তও হইয়াছে। 

আমি। যে সকল চাকর, চাকরী পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে, তাহাদিগের সম্বন্ধে কোনরূপ অনুসন্ধান করা হইয়াছে কি? 

কর্ম্মচারী। অনুসন্ধান করা হইয়াছে; কিন্তু বিশেষ কিছুই জানিতে পারি নাই। 

আমি। আর যে সকল লোক নূতন নিযুক্ত হইয়াছে? 

কর্ম্মচারী। তাহাদিগের সম্বন্ধেও অনুসন্ধান করা হইয়াছে; কিন্তু তাহাদিগের বিপক্ষেও কিছু অবগত হইতে পারা যায় নাই। 

আমি। এখন সেই মোকদ্দমার কিরূপ অনুসন্ধান হইতেছে? 

কর্ম্মচারী। অনুসন্ধান একরূপ রহিত হইয়া গিয়াছে। এ পর্যন্ত এরূপ কোন বিষয় জানিতে পারা যায় নাই যে, তাহা অবলম্বন করিয়া এই অনুসন্ধান চলিতে পারে। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

প্রাণনাথবাবুর বাটীতে চুরি হইবার পর, প্রায় দেড়মাসকাল অতিবাহিত হইয়া গেল। এই দেড়মাসকাল যে প্রাণনাথবাবুর চুরির ক্রমান্বয়ে অনুসন্ধান চলিয়াছিল, তাহা নহে। পনর কুড়িদিবস অনুসন্ধানের পরই যখন দেখা গেল যে, গগনচন্দ্রবাবুর বাটীর চুরির ন্যায় এই চুরিরও কোনরূপ কিনারা হইবার সম্ভাবনা নাই, তখন সকলেই ক্রমে ক্রমে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান পরিত্যাগ করিয়া অপরাপর কার্য্যে নিযুক্ত হন। 

এইরূপে প্রায় দেড়মাসকাল অতিবাহিত হইবার পর, পুনরায় সংবাদ পাওয়া গেল যে, গগনবাবু ও প্রাণনাথবাবুর বাটীর নিকটস্থ আর একখানি বাটীতে সিঁদ কাটিয়া বহুমূল্য অলঙ্কার ও নগদ টাকা চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে। সহরের ভিতর এইরূপ কোন স্থানে কোনরূপ মোকদ্দমা উপস্থিত হইলে, আমার উপর সেই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের ভার অর্পিত হউক, বা না হউক, জানিতে পারিলে, অভাবপক্ষে একবারও আমি, সেই স্থানে গমন করিয়া, মোকদ্দমার অবস্থা জানিয়া আসিতাম, ইহাই আমার স্বভাব। 

এই মোকদ্দমায় ইচ্ছা করিয়া, আমি আমার সেই স্বভাবের কিছু পরিবর্তন করিলাম। এই সিঁদ ও চুরি মোকদ্দমার সংবাদ পাইয়াও, কিন্তু আমি আর সেই স্থানে গমন করিলাম না। অপরাপর যে সকল কার্য্যের ভার আমার উপর ন্যস্ত ছিল, সেই সকল কার্য্য উপলক্ষ করিয়া, সময় অতিবাহিত করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। এইরূপে দুইদিবস অতিবাহিত হইয়া গেল, তৃতীয় দিবসে আমি আমাদিগের সর্ব্বপ্রধান কর্মচারীর নিকট হইতে একখানি আদেশপত্র প্রাপ্ত হইলাম। সেই পত্রের সারমর্ম এইরূপ :- 

“ইতিপূৰ্ব্বে অতি অল্পদিবসের মধ্যে যে স্থানে দুই-দুইটি সিঁদ হইয়া, অনেক মূল্যবান দ্রব্য-সামগ্রী অপহৃত হইয়াছে, এবং যে দুইটি মোকদ্দমার একটি মোকদ্দমা, তুমি অনেকদিবস পর্য্যন্ত অনুসন্ধানও করিয়াছিলে, সেই স্থানে পুনরায় আর একটি সিঁদ হইয়াছে, এবং অনেক টাকার অলঙ্কার পত্রাদিও অপহৃত হইয়াছে। এতদ্বারা তোমার প্রতি এই আদেশ প্রদত্ত হইতেছে যে, তুমি এই আদেশ পাইবামাত্র ঘটনাস্থলে গমন করিয়া সেই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইবে। যে পৰ্য্যন্ত জানিতে না পারা যাইবে যে, কাহাদ্বারা এই সকল চুরি হইতেছে, বা যে পর্য্যন্ত আসল অপরাধী ধৃত না হইবে, সেই পর্য্যন্ত তোমার হস্তে অপর কোন কার্য্য-ভার প্রদত্ত হইবে না। ইহার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত যদি তুমি অপর আর কোন কর্মচারীর সাহায্য গ্রহণ করিতে ইচ্ছা কর, তাহা হইলে আমাকে লিখিও, আমি সেই কৰ্ম্মচারীকে তৎক্ষণাৎ তোমার সাহায্যের নিমিত্ত প্রেরণ করিব। তদ্ব্যতীত আর যাহা তোমার প্রয়োজন হইবে, আমাকে জানাইলে, তাহাও তুমি প্রাপ্ত হইবে।” 

সর্ব্বপ্রধান কর্মচারীর এইরূপ আদেশ-পত্র পাইয়া, আমি অতিশয় চিন্তিত হইলাম। যে মোকদ্দমার অনুসন্ধান, আমি একবার প্রাণপনে করিয়াও, তাহার কিছু করিয়া উঠিতে পারি নাই; পুনরায় সেইরূপ মোকদ্দমার অনুসন্ধান- ভার গ্রহণ করিয়া, আমি যে কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিব, সে সম্বন্ধে আমি ক্ষণকালের নিমিত্তও আশা করিতে পারিলাম না। অধিকন্তু মনে হইল, এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের ভার গ্রহণ করিয়া, যশোপার্জ্জন করা দূরে থাকুক, সম্পূর্ণরূপে অপমানভাগী হইতে হইবে। 

মনে এইরূপ চিন্তা আসিয়া উদিত হওয়ায়, একবার ভাবিলাম, পত্র লিখিয়া হউক, বা সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়াই হউক, আমার মনের কথা তাঁহার নিকট প্রকাশ করি, ও তাঁহাকে স্পষ্টরূপেই বলি যে, এ কার্য্য আমা-কর্তৃক কোনরূপেই সম্পন্ন হইবার সম্ভাবনা নাই। আমা অপেক্ষা উপযুক্ত ও উচ্চপদস্থ অনেক কৰ্ম্মচারী আছেন, তাঁহাদিগের মধ্যে কাহারও হস্তে এই অনুসন্ধানের ভার প্রদান করা হউক। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, সৰ্ব্বপ্রধান কৰ্ম্মচারীর নিকট গমন করাই স্থির করিলাম। ঘটনাস্থলে যাইবার পরিবর্তে তাঁহার নিকট গমন করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইয়া, থানা হইতে বহির্গত হইলাম; কিন্তু কিছু দূর গমন করিবার পর, আমার মনের গতি পরিবর্তিত হইয়া গেল, তখন পুনরায় মনে হইল, সৰ্ব্বপ্রধান কৰ্ম্মচারী আমার উপর যে আদেশ প্রদান করিয়াছেন, তাহা আমি সাধ্যমত প্রতিপালন না করিয়া, কেন তাঁহার নিকট গমন করিয়া, তাঁহার অপ্রতিভাজন হইবার চেষ্টা করি? আমার উপর তিনি যে আদেশ প্রদান করিয়াছেন, প্রাণপনে সেই আদেশ প্রতিপালন করিবার চেষ্টা করি, কৃতকার্য্য হইতে পারি ভালই; অকৃতকাৰ্য্য হই, তাহাতেও ক্ষতি নাই, তাহা হইলে তিনি পরিশেষে এই অনুসন্ধানের ভার, অপর কোন সুযোগ্য কর্ম্মচারীর হস্তে আপনা হইতেই প্রদান করিবেন, তখন আমি অনায়াসেই নিষ্কৃতি লাভ করিতে সমর্থ হইব। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, সৰ্ব্বপ্রধান কর্মচারীর নিকট গমন না করিয়া, ঘটনাস্থলে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, পূর্ব্বোক্ত কর্ম্মচারী মহাশয় অনুসন্ধান উপলক্ষে সেই স্থানে উপস্থিত আছেন। তিনি সেই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী, অর্থাৎ যে স্থানে উপর্যুপরি এইরূপ তিনটি চুরি হইয়া গেল, সেই স্থানটি তাঁহারই থানার অন্তর্গত। 

আমাকে দেখিবামাত্র তিনি কহিলেন, “কি মহাশয়! আপনি কি এই অনুসন্ধানের নিমিত্ত এখানে আসিয়াছেন?”

আমি। হাঁ মহাশয়! 

কর্ম্মচারী। ভালই হইয়াছে। 

আমি। ভাল হইল কিসে? 

কর্ম্মচারী। এই স্থানের একটি অনুসন্ধান আপনি পূর্ব্বে করিয়াছিলেন, তাহার পর দ্বিতীয় মোকদ্দমার অবস্থাও আপনি উত্তমরূপে অবগত হইয়াছিলেন। সুতরাং নূতন করিয়া আপনাকে আর কোন কথা বলিতে হইবে না। বিশেষতঃ এই স্থানের সমস্ত অবস্থা আপনি উত্তমরূপে অবগত আছেন। 

আমি। একবার একটি মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিয়াছি, পুনরায় দ্বিতীয় মোকদ্দমার সমস্ত বিষয় আপনার নিকট হইতে আবগতও হইয়াছি সত্য; কিন্তু এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করা আমার যে একবারে সাধ্যাতীত, তাহা বোধ হয়, আপনার জানিতে কিছুমাত্র বাকি নাই। 

কর্ম্মচারী। এক মোকদ্দমায় একবার কৃতকার্য হইতে পারেন নাই বলিয়া, দ্বিতীয় মোকদ্দমায় যে কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিবেন না, তাহা কে বলিতে পারে? 

আমি। অপর কেহ বলিতে পারুন, আর না পারুন, আমি নিজে কিন্তু তাহা বেশ বুঝিতে পারি। 

কর্ম্মচারী। সে পরের কথা, এখন যে মোকদ্দমার অনুসন্ধানের নিমিত্ত আপনি এখানে আগমন করিয়াছেন, তাহার অবস্থা কিছু শুনিয়াছেন কি? 

আমি। না। কেবলমাত্র এই শুনিয়াছি যে, সিঁদ দিয়া, অনেকগুলি টাকার অলঙ্কার-পত্র চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে; কিন্তু কিরূপে যে এই চুরি হইয়াছে, তাহার বিস্তৃত বিবরণ কিছু শুনি নাই। 

কর্ম্মচারী। তাহা শুনিতে চাহেন কি? 

আমি। যদি না শুনিব, তাহা হইলে আর, এই স্থানে আসিব কেন? 

কর্ম্মচারী। কি কি কথা জানিতে চাহেন, একে একে আমাকে জিজ্ঞাসা করুন, আমি তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান করি, তাহা হইলেই ক্রমে আপনি সকল বিষয় অবগত হইতে পারিবেন। 

আমি। এবার চুরি হইয়াছে, কাহার বাটীতে? 

কর্ম্মচারী। নগেনবাবুর বাটীতে। 

আমি। নগেনবাবুর কোন বাটী? 

কর্ম্মচারী। প্রাণনাথবাবুর ঠিক সম্মুখের বাটী। 

আমি। নগেনবাবু কি করেন? 

কর্ম্মচারী। শুনিয়াছি, তিনিও মফঃস্বলের একজন জমিদার; কিন্তু বহুদিবস হইতে এই স্থানে বাস করিতেছেন। 

আমি। নগেনবাবুর বাটীর পশ্চাদ্ভাগে কি ময়দান আছে? 

কর্ম্মচারী। না, তাঁহার বাটীর কোন দিকে ময়দান নাই। 

আমি। তাহা হইলে এবার কোথায় বসিয়া সিঁদ কাটিয়াছে? 

কর্ম্মচারী। নগেনবাবুর বাড়ীর পূর্ব্ব পার্শ্বে একটি সংকীর্ণ গলি আছে। শুনিয়াছি, উহা পূৰ্ব্বে নৰ্দ্দমা ছিল, এখন নৰ্দ্দমা বুজাইয়া দেওয়ায়, উহা একটি সংকীর্ণ গলিতে পরিণত হইয়াছে, সেই গলির ভিতর বসিয়া এবার সিদ কাটিয়াছে। 

আমি। সেই গলি দিয়া লোকজনের যাতায়াত নাই? 

কৰ্ম্মচারী। সেই স্থান দিয়া প্রায় কেহই সহজে গমনাগমন করে না। তবে বিশেষ প্রয়োজন হইলে, অতি কষ্টে যাতায়াত করা যাইতে পারে। 

আমি। এবার যে সিঁদ কাটিয়াছে, তাহার অবস্থা কিরূপ? 

কর্ম্মচারী। ইহার অবস্থাও পূর্ব্বের সদৃশ জানালার নীচে, পূর্ব্ববৎ একটি ক্ষুদ্র সিঁদ কাটিয়া, একখানি খালি ঘরের ভিতর প্রবেশ করে। 

আমি। সিঁদ কাটিয়া চোর যে ঘরে প্রবেশ করে, এবার দেখিতেছি, সে ঘরে কিছু পায় নাই। কারণ, আপনি বলিতেছেন, সেইখানি খালি ঘর। 

কর্ম্মচারী। যে ঘরে চোর প্রথম প্রবিষ্ট হয়, সে ঘরে মূল্যবান্ দ্রব্যাদি কিছুই ছিল না। সুতরাং সেই স্থান হইতে কোন দ্রব্যই অপহৃত হয় নাই। 

আমি। তাহা হইলে এবার কোন ঘর হইতে দ্রব্যাদি অপহৃত হইল? এবারও কি উপরের কোন ঘর হইতে চুরি হইয়াছে, এবং সেই ঘরের দরজাও কি পূর্ব্বের ন্যায় খোলা ছিল? 

কর্ম্মচারী। এবারও দ্বিতলের একখানি ঘর হইতে সমস্ত দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে। সেই ঘরের দরজা এবারও খোলা ছিল; কিন্তু নীচের ঘরের দরজা এবার খোলা ছিল না। 

আমি। নীচের কোন ঘরের দরজা খোলা ছিল না। চোর বাহির হইতে সিঁদ দিয়া যে ঘরের ভিতর প্রবেশ করে, সেই ঘরের দরজা কি বদ্ধ ছিল? 

কর্ম্মচারী। হাঁ সেই ঘরের দরজা এবার বদ্ধ ছিল। 

আমি। কিরূপ বদ্ধ ছিল, ঘরের ভিতর হইতে না বাহির হইতে? 

কর্ম্মচারী। বাহির হইতে; অর্থাৎ বাহির হইতে সিঁদ দিয়া, চোর যে ঘরের ভিতর প্রবেশ করে, সেই ঘরের দরজা বাটীর ভিতর হইতে বদ্ধ ছিল। অর্থাৎ বাটীর ভিতর হইতে সেই ঘরের দরজা না খুলিয়া দিলে, কাহারও সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ বা সেই ঘর হইতে বহির্গত হইবার উপায় ছিল না। 

আমি। এবার দেখিতেছি, চোরকে একটু ভুগিতে হইয়াছে? 

কর্ম্মচারী। তাহা ত নিশ্চয়ই। 

আমি। তাহা হইলে চোরে সিঁদ কাটিয়া ঘরের ভিতর প্রবেশ করিবার পর, সেই ঘর হইতে বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিবার নিমিত্ত তাহাকে অপর কোনরূপ উপায় উদ্ভাবন করিতে হইয়াছে? 

কৰ্ম্মচারী। হাঁ। 

আমি। এবার সে কিরূপে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল? 

কর্ম্মচারী। এবার নিতাত্ত সহজে সে কাৰ্য্য সম্পন্ন করিতে পারে নাই। অন্যান্যবার অপেক্ষা এবার তাহাকে একটু পরিশ্রম করিয়া বাটীর ভিতর প্রবেশ করিতে হইয়াছে। 

আমি। বাটীর ভিতর প্রবেশ করিতে তাহাকে কিরূপ পরিশ্রম করিতে হইয়াছে? কিরূপে এবার সে বাটীর ভিতর প্রবেশ করিতে সমর্থ হইল? 

কর্ম্মচারী। প্রথমতঃ একটি সিঁদ কাটিয়া, তাহাকে ঘরের ভিতর প্রবেশ করিতে হয়, এবং ঘরের ভিতর হইতে আর একটি সিঁদ কাটিয়া তাহাকে বাড়ীর ভিতর যাইতে হইয়াছে। সুতরাং অন্যান্যবার একটি সিঁদ কাটিতে তাহাকে যেরূপ পরিশ্রম করিতে হইত; এবার দুইটি সিঁদ কাটিতে তাহাকে যে দ্বিগুণ পরিশ্রম করিতে হইয়াছে, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। 

আমি। তাহা হইলে এবার দুইটি সিঁদ কাটিয়াছে? 

কৰ্ম্মচারী। হাঁ। 

আমি। ঘরের ভিতর হইতে যে সিঁদটি কাটিয়াছে, তাহা কোন স্থানে? দেওয়ালে, কি দরজার নিম্নে?

কৰ্ম্মচারী। ইহাও একটি জানালার নিম্নে, বাহিরের সিঁদটি যেরূপ ভাবে কাটিয়াছে, ভিতরের সিঁদটিও ঠিক সেইরূপ ভাবে কাটিয়াছে। উভয় সিঁদের মধ্যে কিছুমাত্র প্রভেদ বা তারতম্য নাই, দুইটিই এক ব্যক্তিদ্বারা ও একইরূপ অস্ত্রের দ্বারা কাটা হইয়াছে বলিয়া অনুমান হয়। 

আমি। সিঁদের অবস্থা ত এইরূপ; কিন্তু চুরির অবস্থা এবার কিরূপ? 

কর্ম্মচারী। দ্বিতীয়বার যেরূপ ভাবে চুরি হইয়াছে, এবার তাহা অপেক্ষা কিছুমাত্র প্রভেদ নাই। দোতালার একটি ঘরের ভিতর চোর প্রবেশ করিয়া, সেই ঘরে যে কয়েকটি বাক্স ছিল, তাহা সমস্তই ছাদের উপর লইয়া যায়, সেই স্থানেই, সেই সকল বাক্স ভাঙ্গা হয়, এবং উহার মধ্যস্থিত মূল্যবান্ দ্রব্য সকল গ্রহণ করিয়া, বাড়ীর সদর দরজা খুলিয়া, বাটী হইতে বহির্গত হইয়া যায়। 

আমি। তাহা হইলে পূর্ব্বে যেরূপ ভাবে চুরি হইয়াছে, এবারের চুরির অবস্থাও ঠিক সেই প্রকার। প্রভেদের মধ্যে কেবল একটি সিঁদ অধিক হইয়াছে? 

কৰ্ম্মচারী। হাঁ। 

আমি। এবার এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান কিরূপ হইতেছে? 

কৰ্ম্মচারী। পূর্ব্বে যেরূপ ভাবে অনুসন্ধান হইয়াছে, এবারেও সেইরূপ ভাবে অনুসন্ধান চলিতেছে; কিন্তু ফলে এ পৰ্য্যন্ত কিছুই হয় নাই, ও হইবারও কিছু আশা দেখিতেছি না। 

আমি। যে সকল দ্রব্য চুরি হইয়া গিয়াছে, আমাদিগের বিশেষ যত্নের সহিত তাহার অনুসন্ধান করা যে কর্তব্য, সে বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই; কিন্তু আমাদিগের প্রধান কার্যা, যাহাতে আর এরূপ ভাবে চুরি না ও হইতে পারে? 

কর্ম্মচারী। তাহা ত নিশ্চয়ই; কিন্তু কিরূপে এই চুরি রহিত হইতে পারে? 

আমি। কিরূপে চুরি রহিত করা যাইতে পারে, তাহা অনুমান করা নিতান্ত সহজ নহে। আমার বিবেচনায় এই স্থানে পাহারার বিশেষ বন্দোবস্ত করা কর্তব্য? 

কর্ম্মচারী। তাহা ত আমি করিয়াছিলাম, যখন দেখিলাম, দুই দুইবার চুরি হইয়া গিয়াছে, তখন এই স্থানে পাহারার বিশেষ বন্দোবস্ত করিয়া দিলাম। আমরাও, যতদূর সম্ভব এই স্থানের উপর বিশেষরূপ দৃষ্টি রাখিতে লাগিলাম, তথাপি পুনরায় চুরি হইয়া গেল। 

আমি। পাহারার কিরূপ বিশেষ বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন? 

কর্ম্মচারী। যে ব্যক্তি এই স্থানে পাহারা দেয়, তাহার উপর এই আদেশ প্রদত্ত হয় যে, সে তাহার “ঘাঁটির” অপরাপর স্থানে দুই একবার গমন করিবে মাত্র; কিন্তু অধিকাংশ সময় এই স্থানে উপস্থিত থাকিবে। 

আমি। সে তাহা থাকিত? 

কর্ম্মচারী। থাকিত। 

আমি। আপনি কিরূপে জানিতে পারিলেন যে, প্রহরী আপনার আদেশ সম্পূর্ণরূপে প্রতিপালন করিত?

কর্ম্মচারী। কারণ, আমরা যে কোন সময়ে সেই স্থানে গমন করিতাম, সেই সময় প্রায়ই তাহাকে সেই স্থানে উপস্থিত পাইতাম। 

আমি। এরূপ কার্য্য কেবলমাত্র একজন প্রহরীর উপর নির্ভর করা কর্ত্তব্য নহে? 

কর্ম্মচারী। তাহা হইলে কিরূপভাবে বন্দোবস্ত করা উচিত ছিল। 

আমি। আমার বিবেচনায় অভাব পক্ষে আরও দুই তিনজন লোক, গুপ্তভাবে এই স্থানে পাহারা দেওয়ার নিমিত্ত নিযুক্ত করা উচিত ছিল। তাহারা এই স্থানে গুপ্তভাবে থাকিয়া, যদি বিশেষ সতর্কতার সহিত পাহারা দিতে প্রবৃত্ত হইত, তাহা হইলে হয়, সেই চোর ধরা পড়িত, না হয়, পুনরায় আর চুরি হইত না। বিশেষতঃ প্রকাশ্যে গলির ভিতর বসিয়া যখন চোরে সিঁদ কাটিয়াছে, তখন বেশ অনুমান হইতেছে, আপনার প্রহরী যদি এই স্থানে পাহারায় নিযুক্ত থাকিত, ও সেই গলির ভিতর গমন করিত, তাহা হইলে নিশ্চয়ই সে সেই সিঁদ দেখিতে পাইত? 

কর্ম্মচারী। আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা প্রকৃত। সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। সে যাহা হউক, যাহা হইবার তাহা হইয়াছে, যাহা ঘটিবার তাহা ঘটিয়াছে, এখন কিরূপ বন্দোবস্ত করিলে, এরূপ ঘটনা আর না ঘটে, এখন তাহারই পরামর্শ করুন, আমি সেইরূপই বন্দোবস্ত করিব। 

আমি। বিবেচনা করিয়া দেখি, এখন কিরূপ ভাবে বন্দোবস্ত করা কর্তব্য, যে পর্য্যন্ত এই চোর ধৃত না হয়, সেই পৰ্য্যন্ত যখন আমাকে এই মোকদ্দমা লইয়া থাকিবার আদেশ হইয়াছে, তখন যাহাতে আর এরূপ ঘটনা না ঘটে, সেই বিষয়ে আমাকে বিশেষরূপ চেষ্টা করিতে হইবে, ও বন্দোবস্তও সেইরূপভাবে করিতে হইবে। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের নিমিত্ত আমি যে একাকী নিযুক্ত হইয়াছিলাম, তাহা নহে; অপরাপর কর্মচারীগণের মধ্যেও অনেকের উপর ইহার অনুসন্ধানের ভার অর্পিত হইয়াছিল। কর্মচারীগণের মধ্যে, যিনি যেরূপ ভাল বিবেচনা করিতে লাগিলেন, তিনিই সেইরূপের অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন; কিন্তু কেহই তাহার অনুসন্ধানের সুফল প্রাপ্ত হইলেন না। বলা বাহুল্য, আমার অনুসন্ধানের ফলও সেইরূপ হইল। 

অনুসন্ধান করিয়া এই মোকদ্দমার কিনারা করা আমার পক্ষে একবারে অসম্ভব। ইহা যখন আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম, তখন এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান আমি একরূপ পরিত্যাগ করিলাম, সেই সময় হইতে আমার প্রধান লক্ষ্য হইল, সেই স্থানে আর যেন চুরি হইতে না পারে, আর যদি পুনরায় চুরিই হয়, তাহা হইলে সেই চুরি কাহাদ্বারা হইল, তাহা যাহাতে জানিতে পারা যায়। 

অপরাপর কর্ম্মচারীগণ প্রায় পনরদিবস পর্য্যন্ত এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিয়া আপন স্থানে প্রস্থান করিলেন, আমিও প্রকাশ্যে সেই স্থান, তাঁহাদিগের সহিত যদিও পরিত্যাগ করিলাম সত্য; কিন্তু কার্য্যে সেই স্থান একবারে পরিত্যাগ করিলাম না। 

যে স্থানে এই সকল চুরি হইতে ছিল, সেই স্থানের অপর আর একটিভদ্রলোকের সহিত আমি একটু বিশেষরূপ বন্ধুত্ব স্থাপিত করিলাম, তাঁহার সহিত এখন পর্যন্ত আমার বন্ধুত্ব থকিলেও, যে সময়ে আমি তাঁহার সহিত বন্ধুত্ব স্থাপিত করিয়াছিলাম, সেই সময়ে আমার উদ্দেশ্য অন্যরূপ ছিল। পাঠক-পাঠিকাগণের মধ্যে যদি কেহ আমার উদ্দেশ্যের অর্থ জানিতে চাহেন, তাহা হইলে তাঁহাদের নিকট আমার সেই উদ্দেশ্যের কথা প্রকাশ করিতে কিছুমাত্র আপত্তি নাই। 

আমার উদ্দেশ্য ছিল, — যে বাটী হইতে সেই স্থানের সমস্ত বাটী, দেখিতে পাওয়া যায়, সেই বাটীতে, যাহাতে আমি কোনরূপে মাসাবধি রাত্রি অতিবাহিত করিতে পারি, তাহার কোনরূপে বন্দোবস্ত করা। এই নিমিত্ত পূৰ্ব্ব- কথিত ভদ্রলোকটির সহিত আমি প্রথমতঃ বন্ধুত্ব স্থাপন করিয়াছিলাম, তাঁহার সহিত দশ পনরদিবসের আলাপ- পরিচয়ের পর, একদিন কথায় কথায়, আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনাদের পাড়ায় যেরূপ ভাবে চুরি হইতে আরম্ভ হইয়াছে, তাহাতে আপনার মনে কিরূপ হইতেছে?” 

উত্তরে ভদ্রলোকটি কহিলেন, “এই সকল মোকদ্দমায় আপনারা পুলিসের অনুপযুক্ততা সম্বন্ধে যেরূপ পরিচয় প্রদান করিতেছেন, তাহাতে বোধ হয়, এ পাড়ার কাহারও ঘরে কিছুই থাকিবে না। ক্রমে ক্রমে সমস্তই চোরের হস্তে গমন করিবে, জানি না অপহৃত দ্রব্যাদি সমস্তই চোরের হস্তে গমন করিতেছে, কি তাহার কোন অংশ আপনাদিগের হস্তেও যাইতেছে। ভিতরের কোনরূপ বিশেষ কারণ না থাকিলে, এতগুলি কৰ্ম্মচারীদ্বারা যে এই চোর ধৃত হইতেছে না, তাহাই বা সহজে আমরা বিশ্বাস করি কি প্রকারে?” 

আমি। আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহাতে আমরা কোনরূপ উত্তর করিতে পারিতেছি না। যদি আমাদিগের কর্তৃক এই চোর ধৃত না হয়, তাহা হইলে আমরা যাহা বলিব, তাহা আপনি বিশ্বাসই বা করিবেন কেন? সে যাহা হউক, আমি একটি কথা আপনাকে বলিতে ইচ্ছা করি। 

ভদ্রলোক। কি বলিতে চাহেন? 

আমি। আপনাদিগের পাড়ার ভিতর যেরূপ ভাবে চুরি হইতে আরম্ভ হইয়াছে, তাহা ত আপনি নিজেই দেখিতেছেন, এখন সেইরূপ চুরি আর যাহাতে না হইতে পারে, সেই বিষয়ে আমাদিগের চেষ্টা করা কর্তব্য কি না? 

ভদ্রলোক। একথা আর আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন? আমার বিবেচনায়, উহাই এখন আপনাদিগের একটি প্রধান কার্য্য। 

আমি। সেই কাৰ্য্য সম্পন্ন করিবার নিমিত্ত যদি কোন ভদ্রলোকের নিকট কোনরূপ সাহায্যের প্রয়োজন হয়, তাহা হইলে আমাদিগকে সাহায্য করা তাঁহার কর্তব্য কি না? 

ভদ্রলোক। তাহার সাধ্যানুযায়ি হইলে আপনাদিগকে সম্পূর্ণরূপে সাহায্য করা সেই ভদ্রলোকের অবশ্য কর্তব্য কৰ্ম্ম। 

আমি। তাহা হইলে আপনার নিকট আমাদিগের যদি কোনরূপ সাহায্য লইবার প্রয়োজন হয়, তাহা হইলে আপনি বোধ হয়, তাহা করিতে সম্মত আছেন? 

ভদ্রলোক। যদি আমার সাধ্যাধীন হয়। 

আমি। আপনার অসাধ্য নহে। আমরা যেরূপ সামান্য সাহায্য আপনার নিকট প্রার্থনা করিতেছি, আপনি মনে করিলেই তাহা অনায়াসেই করিতে পারিবেন? 

ভদ্রলোক। আমাকে কি করিতে হইবে বলুন? 

আমি। আর কিছুই নহে, কেবলমাত্র আমাকে রাত্রি এগারটার পর হইতে প্রাতঃকাল পর্য্যন্ত আপনার বাড়ীতে স্থান প্রদান করিতে হইবে? 

ভদ্রলোক। সে অতি সামান্য কথা; কিন্তু রাত্রিকালে আপনি আমার বাটীতে থাকিয়া কি করিবেন? 

আমি। কি যে করিব, তাহা আপনি দেখিলেই জানিতে পারিবেন। মনে করুন না কেন, রাত্রিকালে যাহাতে আপনার বাড়ীতে চুরি না হয়, তাহার জন্য আমি আপনার বাড়ীতে পাহারায় নিযুক্ত থাকিব। 

ভদ্রলোক। আমার বৈঠকখানায় রাত্রিকালে কেহই থাকেন না, সেই ঘর সমস্ত রাত্রি খালি থাকে, আপনি অনায়াসেই সেই ঘরে রাত্রিযাপন করিতে পারেন। সেই ঘরে বিছানা-পত্রের কোনরূপ কষ্ট হইবে না। আমি আমার চাকরকে বলিয়া দিতেছি, যে সময় আপনি আসিবেন, সেই সময়েই সে, সেই ঘরের দরজা খুলিয়া দিবে। 

আমি। আপনি অনুগ্রহ পূর্ব্বক আমার উপর যেরূপ দয়া প্রকাশ করিলেন, তাহাতে আমি বিশেষরূপ বাধিত হইলাম; কিন্তু আপনার বৈঠকখানায় বসিয়া থাকিলে, আমি আমার কার্য্য- সাধন করিতে সমর্থ হইব না। আমাকে এরূপ একটি স্থান নির্দ্দেশ করিয়া দিতে হইবে যে, সেই স্থানে বসিলে পাড়ার সমস্ত অবস্থা আমি উত্তমরূপে দেখিতে পাই। 

ভদ্রলোক। এরূপ স্থান আমার আছে কি? 

আমি। আছে, সেই স্থানে আমার রাত্রিযাপন করিতে যদি আপনার কিছু আপত্তি না হয়। 

ভদ্রলোক। কোন্ স্থানে? 

আমি। আপনার বাটীর ছাদের উপর 

ভদ্রলোক। আমার কিছুমাত্র আপত্তি নাই; কিন্তু ছাদের উপর বসিয়া আপনি কিরূপে রাত্রিযাপন করিবেন?

আমি। যেরূপেই হউক, করিতে হইবে। 

ভদ্রলোক। ইহাতে আপনার যে অতিশয় কষ্ট হইবে? 

আমি। কষ্ট হউক, তাহাতে আমার কিছুমাত্র দুঃখ নাই। যদি কোন গতিকে কার্য্য উদ্ধার করিতে পারি, তাহা হইলে আমরা কোনরূপ কষ্টকেই কষ্ট জ্ঞান করি না। 

ভদ্রলোক। ছাদের উপর আপনার শয়নের নিমিত্ত আমি কিরূপ বন্দোবস্ত করিব? সেই স্থানে কোনরূপ বিছানা- পত্রের বন্দোবস্ত করিয়া দিতে হইবে কি? 

আমি। কোনরূপ বন্দোবস্ত করিতে হইবে নাই, সেই স্থানে আমার শয়ন করিবার প্রয়োজন হইবে না, একটু বসিবার স্থান পাইলেই যথেষ্ট উপকার মনে করিব। 

ভদ্রলোক। আমি ছাদের উপর একখানি চেয়ার রাখিয়া দিব, আপনি অনায়াসেই সেইস্থানে বসিয়া রাত্রিযাপন করিতে পারিবেন। আমি আমার ভৃত্যকে এখনি আদেশ প্রদান করিতেছি। আপনার যখন যাহা আবশ্যক হইবে, তৎক্ষণাৎ সে তাহা সম্পন্ন করিবে। 

আমি। আমি ইচ্ছা করি না যে, আপনার চাকর আমার এই সকল বিষয় অবগত হইতে পারে। 

ভদ্রলোক। তাহা হইলে কিরূপে এই কাৰ্য্য সম্পন্ন হইতে পারিবে? 

আমি। তাহার উপায় আছে। আপনি কোন্ সময় অন্দরে গমন করিয়া শয়ন করিয়া থাকেন? 

ভদ্রলোক। রাত্রি দশটার পূর্ব্বে প্রায়ই, আমি অন্দরে গমন করি না। কোন কাৰ্য্য না থাকিলেও, আমি আমার বৈঠকখানায় বসিয়া রাত্রি দশটা পর্যন্ত অতিবাহিত করিয়া থাকি। 

আমি। যদি রাত্রি দশটার পূর্ব্বে প্রত্যহ আসিয়া আপনার নিকট উপস্থিত হই, তাহা হইলেও কি আপনার চাকরকে না বলিলে চলিবে না? 

ভদ্রলোক। তাহা হইলে না বলিলেও চলিতে পারে। আপনার যদি সেইরূপ সুবিধা হয়, তাহা হইলে আপনি · প্রত্যহ দশটার পূর্ব্বে আসিবেন, আমি নিজেই আপনার স্থানের বন্দোবস্ত করিয়া দিয়া, পরিশেষে বাটীর ভিতর প্রবেশ করিব। 

আমি। আপনার বাটীর সদর দরজা রাত্রিকালে ভিতর হইতে হুড়কাদ্বারা বদ্ধ থাকে, না তালাচাবিদ্বারা বদ্ধ করিয়া রাখেন? 

ভদ্রলোক। আপনার একথা জিজ্ঞাসা করিবার উদ্দেশ্য কি? 

আমি। যদি আমার হঠাৎ বাটীর বাহিরে যাইবার প্রয়োজন হইয়া পড়ে? 

ভদ্রলোক। তাহা আপনি অনায়াসেই যাইতে পারিবেন। বাহির বাটী হইতে ছাদে উঠিবার সে সিঁড়ি আছে, তাহার দরজা খোলা রাখিব, এবং সদর দরজাও কেবল হুড়কাদ্বারা ভিতর হইতে বদ্ধ থাকিবে। আপনি ইচ্ছা করিলেই কাহাকেও কিছু না বলিয়া, অনায়াসে বাহিরে যাইতে সমর্থ হইবেন। 

আমি। আপনার এইরূপ সাহায্য যে, আমি কতদূর উপকৃত হইলাম, তাহা বলিতে পারি না; এখন কোনরূপে যদি কার্য্য উদ্ধার করিতে পারি, তাহা হইলেই মঙ্গল। নতুবা প্রধান কর্মচারীগণের নিকট আমাকে নানারূপ লাঞ্ছনা ভোগ করিতে হইবে। 

সেই ভদ্রলোকটির সহিত এইরূপ বন্দোবস্ত করিয়া, সেই সময় আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। তাঁহার সহিত আমার যেরূপ বন্দোবস্ত হইয়াছিল, সেইরূপ বন্দোবস্ত অনুসারে রাত্রি নয়টার সময়েই আমি একাকী তাঁহার বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। রাত্রি দশটা পর্য্যন্ত তাঁহার নিকট তাঁহারই বৈঠকখানায় বিশ্রাম করিলাম, যে সময় তিনি অন্দর মহলে শয়ন করিবার নিমিত্ত গমন করেন, সেই সময় আমাকে সঙ্গে লইয়া বৈঠকখানা পরিত্যাগ করিলেন। বাহিরের সিঁড়ি দিয়া, আমি তাঁহার সহিত তাঁহার ছাদের উপর গমন করিলাম। দেখিলাম, সেই স্থানে দুইখানি চেয়ার রাখা আছে, তাহার একখানিতে আমি উপবেশন করিলাম, অপরখানিতে তিনিও কিয়ৎক্ষণ উপবেশন করিয়া, আমার সহিত অপরাপর দুই চারিটি কথাবার্তার পর, সেইস্থান হইতে অন্দর মহলের সিঁড়ি দিয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন। আমার অনুরোধ মতে অন্দর মহলের সিঁড়ির ছাদের দরজা তিনি ভিতর হইতে বদ্ধ করিয়া দিলেন। 

আমি সেই ছাদের উপর সেই চেয়ারখানি এরূপ স্থানে স্থাপিত করিয়া, তাহাতে উপবেশন করিলাম যে, সেইস্থান হইতে সেই পাড়ার প্রধান প্রধান সকল গলির উপর বিশেষরূপ দৃষ্টি রাখা যাইতে পারে। 

সেই স্থানে বসিয়া বসিয়া, সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত করিলাম; কিন্তু বিশেষ কিছুই দেখিতে পাইলাম না। তবে কেবল এইমাত্র দেখিতে পাইলাম যে, সেই স্থানের উপর আজকাল স্থানীয় পুলিসের একটু বিশেষ দৃষ্টি পতিত হইয়াছে। যখন যে কর্ম্মচারী রাউণ্ডে আসিতেছেন, তখনই তিনি সেই স্থানটি একবার ভাল করিয়া না দেখিয়া গমন করিতেছেন না। “ঘাঁটির” পাহারাওয়ালাও এদিক ওদিক একটু ঘুরিয়া প্রায়ই সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইতেছে। 

আমি সেই ছাদের উপর বসিয়া সমস্ত রাত্রি জাগরণ-পূর্ব্বক ক্রমে আট দশ রাত্রি অতিবাহিত করিলাম; কিন্তু আমাদিগের অভিলাষ পূর্ণ হইবার কোনরূপ সম্ভাবনা দেখিতে পাইলাম না। পরন্তু সেই সকল দিবসের মধ্যে সেই স্থানে আর চুরিও হইল না। 

আমি যাহার ছাদের উপর বসিয়া রাত্রি অতিবাহিত করিতাম, তিনি অন্দর মহলে থাকিলেও, অন্দর মহল সংলগ্ন ছাদের দরজা খুলিয়া কখনও কখনও ছাদের উপর আগমন করিতেন, ও আমি কি করিতেছি, তাহাও মধ্যে মধ্যে দেখিয়া যাইতেন, এবং সময় সময় আমার নিকট বসিয়া, অনেক সময়ও অতিবাহিত করিতেন। 

এইরূপে প্রায় কুড়ি রাত্রি অতিবাহিত করিলাম। একদিবস রাত্রি দুইটার পর, আমি নিয়মিতরূপে আপন স্থানে বসিয়া আছি, এমন সময়ে সেই ভদ্রলোকটিও আসিয়া আমার নিকট উপস্থিত হইলেন। সেইস্থানে কিয়ৎক্ষণ উপবেশন করিবার পর, একটি লোকের উপর তিনি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করাইয়া কহিলে, “ওই যে লোকটি গলির ভিতর গমন করিতেছে, তাহা আপনি দেখিয়াছেন কি?” 

আমি। যদি না দেখিব, তাহা হইলে এত কষ্ট করিয়া এখানে বসিয়া থাকিব কেন? 

ভদ্রলোক। এত রাত্রে ওই লোকটি আস্তে আস্তে গলির ভিতর প্রবেশ করিতেছে কেন? 

আমি। আমিও তাহাই ভাবিতেছি। 

ভদ্রলোক। আপনার কি অনুমান হয়? 

আমি। আমিও কিছু অনুমান করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। 

ভদ্রলোক। ওই চোর নয় ত? 

আমি। চোর বলিয়া, কিন্তু আমার অনুমান হয় না। 

ভদ্রলোক। কেন? 

আমি। যে বাটী হইতে ওই লোকটি বাহির হইয়াছে, সেই বাটীতে কোন চোর থাকিবার সম্ভাবনা নাই। 

ভদ্রলোক। কোন্ বাটী হইতে ওই লোকটি বাহির হইয়াছে? 

আমি। তাহা আপনি দেখেন নাই? 

ভদ্রলোক। না। 

আমি। গগনবাবুর বাটী হইতে। 

ভদ্রলোক। কোন গগনবাবু? 

আমি। যে গগনবাবুর বাটীতে সর্ব্বপ্রথমে চুরি হয়? 

ভদ্রলোক। তাহা হইলে বোধ হয়, নিজের কোন কার্য্যে উনি বাহির হইয়াছেন, অথবা কোনরূপ শব্দ শুনিতে পাইয়া, চোর বিবেচনায় বাটীর বাহিরে আসিয়া মনের সন্দেহ মিটাইয়া লইতেছেন। 

আমরা সেই লোকটির প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া আস্তে আস্তে কথা কহিতে কহিতে, দেখিতে লাগিলাম; যে গলির ভিতর ইতিপূর্ব্বে চুরি হইয়াছিল, সেই গলির ভিতর আস্তে আস্তে তিনি গমন করিলেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই পুনরায় সেই গলি হইতে বহির্গত হইয়া যে বাটী হইতে তিনি বহির্গত হইয়াছিলেন, সেই বাটীর দরজার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া, কিয়ৎক্ষণ সেই স্থানে দণ্ডায়মান রহিলেন। পরিশেষে এক পা দুই পা করিয়া সদর রাস্তায় আগমন করিলেন, সেই স্থানে একটু দাঁড়াইয়া, এদিক ওদিক দেখিতে লাগিলেন। সেই সময় দেখিতে পাইলাম, একজন প্রহরী সেই দিকে আগমন করিতেছে। তিনি সেই প্রহরীকে দূর হইতে দেখিতে পাইয়া, সেই স্থান হইতে পশ্চাদপদ হইলেন, এবং যে বাটী হইতে বহির্গত হইয়াছিলেন, সেই বাটীর ভিতর প্রবেশ করিয়া, ভিতর হইতে দরজা বদ্ধ করিয়া দিলেন। 

সেই লোকটির এই অবস্থা দেখিয়া, আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। সেই লোকটিযে কে? এবং কেনইবা তিনি এত রাত্রিতে এরূপ ভাবে বাটী হইতে বহির্গত হইয়া, একটু এদিক ওদিক বেড়াইয়া, কেন যে পুনরায় বাটীর ভিতর প্রবেশ করিলেন, তাহা ভাবিয়া চিন্তিয়া কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না; কিন্তু আমার মনে এরূপ প্রতীতি জন্মিল যে, সেই ব্যক্তি চোর নহে। 

এই ঘটনার পরই, ভদ্রলোকটি তাঁহার অন্দরে গমন করিলেন, আমিও পূর্ব্ব পূর্ব্ব রাত্রির ন্যায় সেই স্থানে বসিয়া রহিলাম। 

পরদিবস প্রাতঃকালে মনে করিলাম, গগনবাবুর বাটীতে গিয়া গত রজনীর বিষয়টি একবার অনুসন্ধান করিয়া আসি; কিন্তু তৎক্ষণাৎ মনের গতি পরিবর্তন হইয়া গেল। মনে হইল, এ সম্বন্ধে কোন কথা কাহাকেও বলা কৰ্ত্তব্য নহে। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, প্রাতঃকালে সেই ভদ্রলোকটির সহিত একার সাক্ষাৎ করিলাম, ও গত রাত্রির ঘটনা তিনিও যেন কাহারও নিকট প্রকাশ না করেন; তাঁহাকে এইরূপ বলিয়া, আস্তে আস্তে আমি সেই স্থান পরিত্যাগ করিলাম। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পরদিবস রাত্রিতে নিয়মিতরূপে সেই ভদ্রলোকটির বাটীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম, এবং আমার নিয়মিত স্থানে বসিয়া রাত্রিযাপন করিতে আরম্ভ করিলাম। 

রাত্রি দুইটার পর, অর্থাৎ পাহারার বদলী হইয়া যাইবার পর, একজন প্রহরী সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল। যে সংকীর্ণ গলির মধ্যে ইতিপূর্ব্বে চুরি হইয়াছিল, সেই প্রহরী সেই গলির ভিতর গমন করিয়া, সেই সকল স্থান উত্তমরূপে দেখিয়া, বাহির হইয়া আসিল; ও তাহার নিকটবর্তি অপরাপর স্থান সকল উত্তমরূপে দেখিয়া, সদর রাস্তায় আসিয়া উপস্থিত হইল, ও সেইস্থানে অতি অল্পক্ষণ দাঁড়াইবার পরই, সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়া স্থানান্তরে প্রস্থান করিল। 

প্রহরী সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিবার প্রায় পাঁচ মিনিট পরেই গগনবাবুর বাটীর দরজা খুলিয়া একব্যক্তি আস্তে আস্তে বাহির হইলেন, দরজার সম্মুখে একটু দাঁড়াইয়া, একবার এদিক ওদিক দেখিলেন। পরিশেষে সেই সংকীর্ণ গলির ভিতর প্রবেশ করিলেন। 

পূর্ব্ব রাত্রিতে যে ব্যক্তি বাহির হইয়াছিলেন, অনুমানে বোধ হইল, ইনি সেই ব্যক্তি; কিন্তু তিনি যে কে, তাহা রাত্রিকালে দূর হইতে দেখিয়া, কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। 

গত রজনীতে সেই গলিতে প্রবেশ করিবার অতি অল্পক্ষণ পরেই তিনি বাহির হইয়া আসিয়াছিলেন, আজ কিন্তু সেই গলির ভিতর হইতে তাঁহাকে আর বাহির হইতে দেখিলাম না। মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম, হয়ত কোন সময় আমার মন, সেই দিকে ঠিক আকৃষ্ট ছিল না, সেই সময় তিনি ফিরিয়া আসিয়াছেন বলিয়া, দেখিতে পাই নাই। আবার ভাবিলাম, যে কার্য্যের নিমিত্ত আমি এই স্থানে বসিয়া রহিয়াছি, সেই কার্য্যের নিমিত্তই কি আমি এত অমনোযোগী হইয়া পড়িলাম? যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে বড়ই দুঃখের বিষয়। 

এইরূপ নানাপ্রকার ভাবিতে ভাবিতে, প্রায় অৰ্দ্ধঘন্টা অতিবাহিত হইয়া গেল, তথাপি তাঁহাকে প্রত্যাবর্তন করিতে আর দেখিলাম না। আরও প্রায় পনর মিনিট গত হইল, তখন মনে হইল, সেই ব্যক্তি প্রত্যাবর্তন করুন, আর না করুন, সেই গলির অবস্থা আমার একবার এখনই দেখিয়া লওয়া কৰ্ত্তব্য। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, সেই ছাদ হইতে অবতরণ করিবার মানসে যেমন গাত্রোত্থান করিলাম, অমনি সেই লোকটিকে সদর রাস্তার উপর দেখিতে পাইলাম। তিনি যে কোথা হইতে সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, তাহ আমি কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না; কিন্তু তিনি যে সেই সংকীর্ণ গলির মধ্য হইতে বহির্গত হইয়া, সেই স্থানে আগমন করেন নাই, তাহা আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম। সদর রাস্তার উপর তিনি আর ক্ষণমাত্র বিলম্ব না করিয়া, দ্রুতপদে গগনবাবুর বাটীর ভিতর প্রবেশ করিয়া, আস্তে আস্তে বাটীর দরজা বদ্ধ করিয়া দিলেন। 

উপর্যুপরি দুই রাত্রিতেই সেই লোকটিকে সেইরূপ অবস্থায় ঘুরিতে দেখিয়া, আমার মনে কেমন একরূপ সন্দেহের উদয় হইল; কিন্তু কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। প্রত্যুষে ভদ্রলোকটির সহিত সাক্ষাৎ হইলে, তাঁহাকেও রাত্রির বিবরণ সমস্ত কহিলাম। তিনিও ভাবিয়া-চিন্তিয়া কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না। 

আমি, ও সেই ভদ্রলোকটি, তাঁহার বৈঠকখানায় বসিয়া, সেই সম্বন্ধে কথাবর্তা কহিতেছি, এরূপ সময় সেই পাড়ার ভিতর একটু গোলোযোগ উঠিল। কিসের গোলযোগ জানিবার নিমিত্ত আমি, ও সেই ভদ্রলোকটি বাটীর বাহিরে আগমন করিলাম। 

বাহিরে আসিয়া শুনিলাম, সেইস্থানের বনোয়ারীবাবুর বাটীতে সিঁদ দিয়া, কতকগুলি অলঙ্কার পত্র চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে। 

এই সংবাদ পাইবামাত্র আমি ত একবারে স্তম্ভিত হইয়া পড়িলাম, আমার মুখ দিয়া কিয়ৎক্ষণ আর কোন কথা বাহির হইল না। কিয়ৎক্ষণ পরে, আমি সেই ভদ্রলোকটিকে কহিলাম, “বনোয়ারী বাবুর কোন্ বাটী?” 

আমার কথার উত্তরে সেই ভদ্রলোকটি কহিলেন “ওই বাটী।” 

ইহা শুনিয়া আমি সেই ভদ্রলোকটির সহিত বনোয়ারীবাবুর বাটীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, বনোয়ারীবাবু বাটীতে নাই। শুনিলাম, সেই চুরির সংবাদ প্রদান করিবার নিমিত্ত তিনি থানায় গিয়াছেন। তাঁহার ভ্রাতা কিশোরীবাবু বাড়ীতে আছেন। 

কিশোরীবাবু আমাকে চিনিতেন, আমি সেইস্থানে গমন করিবামাত্র তিনি কহিলেন, “শুনিয়াছেন মহাশয়! আমাদিগের বাটীতে আবার কি হইয়াছে?” 

আমি। সম্পূর্ণরূপ শুনি নাই, কেবল এইমাত্র শুনিতে পাইতেছি যে, আপনাদিগের বাটীতে চুরি হইয়াছে; কিন্তু কিরূপে চুরি হইয়াছে, তাহার বিস্তৃত বিবরণ আমি এ পর্যন্ত জানিতে পারি নাই। 

আমার কথা শুনিয়া কিশোরীবাবু কহিলেন, “বিস্তৃত বিবরণ আর শুনিবেন কি? আমার সহিত আগমন করুন, আমি সমস্ত অবস্থা আপনাকে দেখাইতেছি, তাহা হইলেই সমস্ত বিষয় উত্তমরূপে অবগত হইতে পারিবেন।” 

এই বলিয়া কিশোরীবাবু আমাকে সঙ্গে লইয়া, তাঁহার বাটীর ভিতর গমন করিলেন, পূর্ব্বে যে গলির ভিতর বসিয়া, চোরে সিঁদ কাটিয়াছিল, কিশোরীবাবুর বাড়ীর পশ্চাদ্ভাগে সেই অপ্রশস্ত গলি। দেখিলাম, এবারও চোরে সেই গলির ভিতর বসিয়া, কিশোরীবাবুর বাটীর পশ্চাদ্ভাগের একখানি ঘরের জানালার নিম্নে পূর্ব্ব-বর্ণিতরূপ একটিক্ষুদ্র সিঁদ কাটিয়া, সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়াছে। সেই ঘরের দরজা ভিতর হইতে খোলা ছিল। সুতরাং বাটীর ভিতর গমন করিতে যদিও তাহার বিশেষরূপ কষ্ট হয় নাই; কিন্তু উপরে উঠিতে তাহাকে একটু বিশেষ কষ্টভোগ করিতে হইয়াছিল। বাটীর ভিতর হইতে উপরে উঠিবার যে সিঁড়ি অঅছে, সেই সিঁড়ির দরজা ভিতর হইতে বদ্ধ ছিল, সেই দরজা খুলিবার নিমিত্ত, উহার পার্শ্বে এরূপ স্থানে তাহাকে আর একটি সিঁদ কাটিতে হয় যে, উহার ভিতর হস্ত প্রবেশ করাইয়া, সেই দরজার ভিতরের খিল অনায়াসেই খুলিয়া ফেলা যায়। 

এইরূপে সিঁড়ির দরজা খুলিয়া, চোর দোতালার উপর উঠিতে সমর্থ হয়। যে ঘর হইতে অলঙ্কার-পত্র অপহৃত হইয়াছে, সেই ঘরে তালাবদ্ধ ছিল, সেই ঘরের তালা ভাঙ্গিয়া, সে উহার ভিতর প্রবেশ করে, ও সেই ঘরের মধ্যস্থিত কয়েকটি বাক্স, প্যাট্রা প্রভৃতি ছাদের উপর লইয়া যায়, এবং উহা ভাঙ্গিয়া, উহার মধ্যস্থিত অলঙ্কারপত্রাদি অপহরণ করিয়া, বাটীর সদর দরজা খুলিয়া পূর্ব্বের ন্যায় বাটী হইতে বহির্গত হইয়া যায়। 

আমি। কিশোরীবাবুর সহিত এই সকল অবস্থা উত্তমরূপে দেখিতেছি, এরূপ সময়ে বনোয়ারীবাবু স্থানীয় পুলিসের সেই কৰ্ম্মচারীকে সঙ্গে করিয়া, সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আমাকে দেখিয়াই, কৰ্ম্মচারী মহাশয় কহিলেন, “এবার দেখিতেছি, আপনি সৰ্ব্বাগ্রেই আসিয়া এখানে উপস্থিত হইয়াছেন?” 

উত্তরে আমি কহিলাম, “হাঁ মহাশয়! কিন্তু এবারকার অবস্থা দেখিতেছি, আরও গুরুতর। আমি এখন এই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম, যেরূপ অনুসন্ধান করিবার প্রয়োজন বিবেচনা করেন, তাহা আপনি করিতে পারেন। আমি যে এই পাড়া হইতে একবারে চলিয়া যাইতেছি, তাহা নহে; কিন্তু আমি এই অনুসন্ধানে এখন হস্তক্ষেপ করিব না। আমি এই পাড়ার ভিতর কোন না কোন স্থানে থাকিব মাত্র।” 

এই বলিয়া, আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিয়া, গগনবাবুর বাটীর সম্মুখের রোয়াকের উপর উপবেশন করিলাম। 

কৰ্ম্মচারী মহাশয়, চুরির সমস্ত অবস্থা উত্তমরূপে দেখিয়া; যে যে স্থানে বা যে যে কর্ম্মচারীর নিকট তাঁহার সংবাদ দেওয়ার প্রয়োজন, তাহা দিযা, তিনি উপস্থিত মত অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলেন। 

এক এক করিয়া, ক্রমে অনেক কৰ্ম্মচারী এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান উপলক্ষে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। এবার দেখিলাম, আমাদিগের সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারী সাহেবও আগমন করিলেন। তিনি আমাকে দেখিয়া কহিলেন, “তোমাকে সমস্ত কাৰ্য্য হইতে নিষ্কৃতি প্রদান করিয়া, এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত করিয়াছি; কিন্তু তথাপি তুমি ইহার কিছুই করিয়া উঠিতে পারিতেছ না।” এই বলিতে বলিতে, তিনি অপরাপর কর্ম্মচারীগণের সহিত বনোয়ারীবাবুর বাড়ীতে সেই সিঁদের অবস্থা দেখিবার নিমিত্ত গমন করিলেন। আমি কিন্তু সেই স্থান হইতে গমন করিলাম না। 

কিয়ৎক্ষণ পরে অপর আর একজন কর্মচারী আসিয়া, আমাকে কহিলেন, “সৰ্ব্বপ্রধান কৰ্ম্মচারী সাহেব আপনাকে ডাকিতেছেন।” 

উত্তর আমি কহিলাম, “আপনি গিয়া তাঁহাকে বলুন, আমি এখন সেই স্থানে গমন করিতে পারি না, সাহেব যে সময় এই স্থান দিয়া প্রস্থান করিবেন, সেই সময় তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিব।” 

আমার কথা শুনিয়া, কৰ্ম্মচারী মহাশয় আমার নিকট হইতে চলিয়া গেলেন; কিন্তু প্রধান কৰ্ম্মচারী সাহেবকে যে কি বলিলেন, তাহা আমি জানি না; কিন্তু কিয়ৎক্ষণ পরে প্রধান কর্ম্মচারী সাহেব একটু রাগভরে আসিয়া আমার নিকট উপস্থিত হইলেন, ও আমাকে কহিলেন, “তুমি আমার আদেশ প্রতিপালন করিলে না কেন? আমি তোমাকে ডাকিলাম; তুমি কেন আমার নিকট গমন করিলে না?” 

আমি। অপরাধ মার্জ্জনা করিবেন, কোন বিশেষ কারণ বশতঃ আমি এই স্থান হইতে গমন করিতে সাহসী হই নাই। 

প্রধান কৰ্ম্মচারী। কি বিশেষ কারণ? 

আমি। এখানে যত লোক উপস্থিত আছেন, তাঁহাদিগের সকলকে দুই তিন মিনিটের জন্য যদি একটু দূরে যাইতে বলেন, তাহা হইলে ভাল হয়। কারণ, আমি যাহা আপনাকে বলিতে চাহি, ইচ্ছা করি না যে, তাহা এখন অপর আর কোন ব্যক্তি শ্রবণ করেন। 

প্রধান কৰ্ম্মচারী। আমরাই কেন একটু দূরে যাই না? 

আমি। না, তাহা হইতে পারে না; আমি যে পৰ্য্যন্ত সমস্ত কথা আপনাকে না বলিব, সেই পৰ্য্যন্ত আমি একপদমাত্রও এই স্থান হইতে প্রস্থান করিব না। 

আমার কথা শুনিয়া, সর্ব্বপ্রধান কৰ্ম্মচারী সাহেব সেই স্থানীয় কৰ্ম্মচারীকে ডাকিলেন, এবং কহিলেন, “এই স্থান হইতে সমস্ত লোককে একটু দূরে যাইতে বল। 

প্রধান কৰ্ম্মচারী সাহেবের আদেশ তখনই প্রতিপালিত হইল সমস্ত লোকই সেই স্থান পরিত্যাগ করিয়া, দূরে গমন করিলেন। কেবলমাত্র গগনবাবু বিশেষ সমাদরের সহিত একখানি চেয়ার আনিয়া সাহেবকে সেইস্থানে বসিতে দিলেন, এবং নিজে সেইস্থানে দাঁড়াইয়া রহিলেন। তখন আমি গগনবাবুকে কহিলাম, “আপনিও এখন একটু দূরে গমন করুন।” আমার কথা শুনিয়া, তিনিও একটু দূরে গিয়া দাঁড়াইলেন। 

প্রধান কৰ্ম্মচারী সাহেব সেই স্থানে উপবেসন করিলে, আমি যেরূপ ভাবে রাত্রি জাগরণ করিয়া, সেই স্থানে পাহারা দিতেছিলাম, তাহারসমস্ত বিবরণ তাঁহাকে একে একে কহিলাম, ও গত পরশ্ব রাত্রিতে গগনবাবুর বাটী হইতে একটি লোক বাহির হইয়া, যেরূপ ভাবে সেই স্থানে ভ্রমণ করিয়াছিল এবং গত রজনীতে সেই লোকটি যেরূপে বাহির হইয়া, যেদিকে গমন করে, ও পরিশেষে যে স্থান দিয়া প্রত্যাবর্তন করে, তাহার সমস্ত বিবরণ আমি একে একে সাহেবের নিকট বর্ণন করিলাম, এবং আরও কহিলাম, “যে সময় সেই লোকটি গগনবাবুর বাটীর ভিতর প্রবেশ করে, সেই সময় যদিও আমি ভালরূপ দেখিতে পাই নাই; কিন্তু আমার বেশ বোধ হইতেছে, উহার হস্তে একটি ছোটগোছের বাণ্ডিল ছিল। আমি অনুসন্ধান করিয়া দেখিয়াছি, গগনবাবুর বাটীতে একা গগনবাবু ভিন্ন আর কোন পুরুষ নাই। সেই সময় হইতেই আমি গগনবাবুর বাটীর সম্মুখে আছি, বাটী হইতে কোন দ্রব্য এখনও বাহিরে যাইতে পারে নাই। আমার বোধ হয়, গগনবাবুই চোর, তাহার বাটীতে সর্বপ্রথমে যে চুরি হইয়াছিল, তাহা মিথ্যা। অপরাপর স্থানে চুরি করিলে, তাহার উপর আমাদিগের কোনরূপ সন্দেহ পতিত না হয়, এই ভাবিয়া তিনি আপন বাড়ীতে সৰ্ব্বপ্রথমে সিঁদ কাটিয়া আমাদিগের সকলের চক্ষে ধূলিমুষ্টি নিক্ষেপ করিয়া রাখিয়াছেন।” 

আমার কথা শুনিয়া, কৰ্ম্মচারী সাহেব সেই স্থানে অপরাপর যে সকল কৰ্ম্মচারী উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাদিগকে তাঁহার নিকট ডাকিলেন, এবং তাঁহাদিগের কাহারও সহিত একটু পরামর্শ করিয়া, তাঁহার সম্মুখেই গগনবাবুর বাটী উত্তমরূপে খানাতল্লাসী করিতে আদেশ প্রদান করিলেন। 

প্রধান কৰ্ম্মচারী সাহেব গগনবাবুর বাটীতে খানাতল্লাসী করিবার নিমিত্ত কেবলমাত্র যে আদেশ প্রদান করিলেন, তাহা নহে; অপরাপর কর্মচারীগণের সাহায্যে তিনি নিজেই উহার বাটীর খানাতল্লাসী করিতে আরম্ভ করিলেন। 

গগনবাবু যখন জানিতে পারিলেন যে, আমরা সকলে তাঁর বাটীর খানাতল্লাসী করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি, তখন তিনি বিশেষরূপ ক্রোধ ও ভয় প্রদর্শন করিয়া, যাহাতে আমরা উহা হইতে নিবৃত্ত হইত তাহার নিমিত্ত বিশেষরূপ চেষ্টা করিলেন; কিন্তু তাঁহার চেষ্টার কোনরূপ ফল দর্শিল না। 

আমরা সকলে বাটীর ভিতর প্রবেশ করিয়া, সমস্ত স্থান উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু কোন স্থানেই বিশেষ কোন দ্রব্য পাওয়া গেল না। দোতালার উপর একখানি নিতান্ত ক্ষুদ্রঘর ছিল, সেই ঘরের দরজা একটি তালাদ্বারা বদ্ধ ছিল। সেই ঘরটি দেখিয়া, তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এই ঘরের ভিতর কি আছে?” উত্তরে গগনবাবু কহিলেন, “উহা ঠাকুর ঘর, উহার ভিতর ঠাকুর আছেন, আপনারা ওই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিবেন না।” 

সর্ব্বপ্রধান কর্মচারী সাহেব তাঁহার কথায় কর্ণপাত না করিয়া, সেই ঘরের দরজা খুলিয়া দিতে কহিলেন, গগনবাবু কিছুতেই সেই ঘরের দরজা খুলিয়া দিলেন না। সুতরাং সেই ঘরের দরজা ভাঙ্গিয়া ফেলা হইল। উহার ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখি, উহাতে ঠাকুর প্রভৃতি কিছুই নাই, একটি কাষ্ঠের সিন্ধুক আছে মাত্র। সেই সিন্ধুক ভাঙ্গিয়া দেখা গেল, উহার মধ্যে সেই পাড়ায় যে কয়েকটি চুরি হইয়াছিল, তাহার প্রায় সমস্ত দ্রব্যই রহিয়াছে, কেবল গগনবাবুর বাটী হইতে যে সকল দ্রব্য অপহৃত হইয়াছিল বলিয়া, তিনি নালিশ করে, সেই সকল দ্রব্য নাই। 

ইহার পরই গগনবাবু ধৃত হইলেন, তাঁহার সেই ঘরের ভিতর হইতে চারিটি সিঁদ কাটিবার অস্ত্র বাহির হইল। অনুসন্ধান করিয়া, পরিশেষে জানিতে পারা গেল যে, গগনবাবু এক জন প্রসিদ্ধ “বেদিয়া” চোর, যশোহর জেলায় তাঁহার নিবাস। ইতিপূর্ব্বে তিনি অনেকবার জেল খাটিয়াছেন, তাঁহার প্রকৃত নাম গোপালচন্দ্ৰ। 

এই মোকদ্দমায় গগনবাবু ওরফে গোপালচন্দ্রকে পাঁচ বৎসরের জন্য কারাগারে গমন করিতে হয়। 

[শ্রাবণ, ১৩০৬] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *