কুবুদ্ধি ১

কু-বুদ্ধি (প্রথম অংশ)

(অর্থাৎ অল্পবুদ্ধি স্ত্রীলোকের বুঝিবার বিষম ভ্রম। )  

প্রথম পরিচ্ছেদ

আষাঢ় মাস। সমস্ত রাত্রি টিপি টিপি বৃষ্টি হইয়া রাস্তা কদমাক্ত হইয়া গিয়াছে। সামান্য চাঁচ-নির্ম্মিত আবরণের মধ্যে শকটোপরি উপবেশন করিয়া সমস্ত রাত্রি প্রায় আমাকে ভিজিতে হইয়াছে। সরকারী কোন কাৰ্য্যোপলক্ষে আমাকে কটকে গমন করিতে হয়। যাইবার সময় জাহাজে উঠিয়া গমন করিয়াছিলাম, কিন্তু প্রত্যাবর্তনকালীন আমাকে হাঁটাপথে আসিতে হয়। যে প্রশস্ত রাজবর্ম অবলম্বন করিয়া ইতিপূর্ব্বে এদেশীয় লোকগণ পুরুষোত্তমে গমন করিতেন, সেই প্রশস্ত রাজবর্ম অবলম্বন করিয়া আমি শকটারোহণে কলিকাতাভিমুখে আগমন করিতেছিলাম। আমার সহিত কেবল একটি কনষ্টেবল ভিন্ন আর কেহই ছিল না। আমরা উভয়েই সেই শকটোপরি বসিয়াছিলাম। শকট-চালক আস্তে আস্তে শকটখানি চালাইয়া লইয়া যাইতেছিল। ভোর হইতে অতি অল্পমাত্র বাকী আছে, এরূপ সময় দূর হইতে সকরুণ ক্রন্দন-ধ্বনি আমার কর্ণগোচর হইল। আমরা যত অগ্রবর্ত্তী হইতে লাগিলাম, ঐ ক্রন্দন- ধ্বনি ততই যেন নিকটবর্তী হইতে লাগিল। তখন বেশ অনুমান হইতে লাগিল, ঐ শব্দ যেন কোন স্ত্রীলোকের কণ্ঠ- নিঃসৃত স্বর। উহা কাহার ক্রন্দন-ধ্বনি, তাহা জানিবার নিমিত্ত আমার নিতান্ত কৌতূহল জন্মিল। শকট চালককে শকট থামাইতে কহিলাম। সে তাহার শকট থামাইল। আমি আমার সমভিব্যাহারী সেই কনষ্টেবলটিকে সঙ্গে লইয়া শকট হইতে অবতরণ করিলাম। তখনও সম্পূর্ণরূপ পরিষ্কার হয় নাই, অল্প অল্প অন্ধকার তখনও পৃথিবীকে আবরিত করিয়া রাখিয়াছে। 

শকট হইতে অবতরণ করিয়া সেই ক্রন্দন-ধ্বনি লক্ষ্য করিয়া আমরা অগ্রবর্ত্তী হইলাম। দেখিলাম, ঐ রাস্তার একপার্শ্বে কতকগুলি লতা পাতার অন্তরালে একটি স্ত্রীলোক বসিয়া রোদন করিতেছে। তাহার পরিধানে একখানি অর্দ্ধময়লা কাপড়, তাহা একেবারে ভিজিয়া গিয়াছে। অপর দ্রব্যাদি কিছুই তাহার নিকট নাই। দেখিয়া অনুমান হইল, ঐ স্ত্রীলোকটির বয়স ৩০ বৎসরের অধিক হইবে না, দেখিতে খুব সুরূপা না হইলেও তাহাকে কোন ভদ্র- গৃহের রমণী বলিয়া অনুমান হয়। পরিধানের বস্ত্র দেখিয়া অনুমান করিয়া লওয়া যাইতে পারে যে তিনি সধবা, কিন্তু তাহার অঙ্গে কোনরূপ অলঙ্কারের চিহ্নমাত্রও নাই। কপালে কোনরূপ সিন্দুরের চিহ্নও দেখিতে পাইলাম না। 

আমি তাহার নিকট গমন করিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম,—“আপনি কে?” 

আমার কথার কোনরূপ উত্তর পাইলাম না, কিন্তু তাহার ক্রন্দন-ধ্বনি বন্ধ হইয়া গেল। সে চুপ করিয়া রহিল।

আমি। আপনার কোনরূপ ভয় নাই, আমি চোর ডাকাইত নহি বা আমার কোনরূপ দুরভিসন্ধি নাই। আপনার ক্রন্দন শুনিয়া যদি আপনাকে কোনরূপ সাহায্য করিতে সমর্থ হই, এই নিমিত্তই আপনার নিকট আসিয়াছি। আপনি যেন কোনরূপ বিপদ্‌গ্রস্ত হইয়াছেন বলিয়া অনুমান হইতেছে, তাহাই আমি আপনার সন্নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। আপনি কোনরূপ ভয় করিবেন না, আপনার অন্তরের কথা আমার নিকট অনায়াসেই প্রকাশ করিতে পারেন। 

স্ত্রীলোক। আপনি কে? 

আমি। আমি জনৈক পুলিস-কৰ্ম্মচারী, কিন্তু এ প্রদেশীয় পুলিস-কৰ্ম্মচারী নহি, আমি কলিকাতায় থাকি। সরকারী কোন কাৰ্য্যবশতঃ আমাকে এই প্রদেশে আগমন করিতে হইয়াছিল। আপনি কে? 

স্ত্রীলোক। আমার বাসস্থানও কলিকাতায়। 

আমি। আপনি এখানে আসিলেন কি প্রকারে? 

স্ত্রীলোক। সে অনেক দুঃখের ও লজ্জার কথা। 

আমি। আপনি এখন কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিতে চাহেন কি? 

স্ত্রীলোক। সেইস্থানে আর আমি কিরূপে যাইব? সেই স্থানে আর আমার মুখ দেখাইবার যো নাই। 

আমি। সে পরের কথা, সেইস্থানে গিয়া আপনার মুখ দেখাইবার যো আছে কি না, তাহা পরে বিবেচিত হইবে, এখন আপনি আমার সহিত কলিকাতায় গমন করিতে ইচ্ছা করেন কি? 

স্ত্রীলোক। না। 

আমি। কেন? 

স্ত্রীলোক। সেই স্থানে আর আমি যাইব না। 

আমি। কোথায় গমন করিবেন? 

স্ত্রীলোক। কোন স্থানেই যাইব না, আমার আর কোন স্থানেই স্থান নাই। 

আমি। আপনার সহিত আর কেহ আছেন? 

স্ত্রীলোক। না। 

আমি। কেহই নাই? আপনি একাকী? 

স্ত্রীলোক। এখন আমি একাকী, আমার সহিত কেহই নাই। 

আমি। আপনার সহিত অর্থাদি কিছু আছে? 

স্ত্রীলোক। যথেষ্টই ছিল, কিন্তু এখন কপদকমাত্রও নাই। 

আমি। বস্ত্রাদি? 

স্ত্রীলোক। আমার পরিধানে যাহা দেখিতেছেন। 

আমি। এরূপ অবস্থায় আপনি এখানে থাকিয়া কি করিবেন? আমার সহিত আসুন, আপনি যে স্থানে যাইতে চাহিবেন, আপনাকে সেই স্থানেই পাঠাইয়া দিব। 

স্ত্রীলোক। মহাশয়, আপনাকে অতিশয় দয়ালু বলিয়া অনুমান হইতেছে, কিন্তু আমি আপনার দয়ার উপযুক্তা নহি। আমাকে এই স্থানেই পরিত্যাগ করিয়া আপনি গমন করিতে পারেন। আমার অদৃষ্টে যাহা আছে, তাহা আমি উত্তমরূপে অবগত হইতে পারিতেছি। 

আমি। আপনার অদৃষ্টে কি আছে? 

স্ত্রীলোক। আত্মহত্যা ভিন্ন আমার এ জগতে আর কোন উপায় নাই। 

আমি। আত্মহত্যা মহাপাপ! 

স্ত্রীলোক। তাহা আমি জানি, জানিয়াও আমাকে ঐ মহাপাপ করিতে হইবে। 

আমি। কেন? 

স্ত্রীলোক। কেন যে, তাহাও বলা আমার পক্ষে একেবারে অসম্ভব। 

আমি। সে যাহা করিতে হয়, তাহা পরে করিবেন, আমার সহিত আপনাকে গমন করিতে হইবে। 

স্ত্রীলোক। কোথায়? 

আমি। আমি কলিকাতায় যাইতেছি, যদি কলিকাতায় গমন করিতে চাহেন, তাহা হইলে আমি অনায়াসেই আপনাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইতে পারি, আর যদি অপর কোন স্থানে গমন করিতে চাহেন, তাহা হইলেও আমি আপনাকে সেইস্থানে পাঠাইয়া দিতে পারি। এরূপ অবস্থায় আমি এখানে আপনাকে একাকী কখনই পরিত্যাগ করিয়া যাইতে পারি না। কারণ আপনার সহিত লোক-জন কাহাকেও দেখিতে পাইতেছি না, বা কোন দ্রব্যাদিও নাই, দ্বিতীয় বস্তু পৰ্য্যন্তও নাই। 

স্ত্রীলোক। আমি কোন স্থানে যাইতে চাহি না, বা লোকালয়ে আমার মুখও দেখাইতে চাহি না।

আমি। আপনার সহিত কোনও লোক নাই দেখিতেছি। 

স্ত্রীলোক। কেহই নাই। 

আমি। কোন লোক কি আপনার সহিত ছিল না? 

স্ত্রীলোক। ছিল। 

আমি। তিনি এখন কোথায়? 

স্ত্রীলোক। তাহা আমি জানি না। 

আমি। তিনি তোমাকে কিছু বলিয়া যান নাই? 

স্ত্রীলোক। না। 

আমি। তিনি কোন্ সময় হইতে চলিয়া গিয়াছেন? 

স্ত্রীলোক। তাহাও আমি জানি না। 

আমি। তাহার প্রত্যাবর্তন করিবার কোনরূপ সম্ভাবনা আছে? 

স্ত্রীলোক। বোধ হয় না। 

আমি। তাহা হইলে আর কোন কথার প্রয়োজন নাই, আপনি আমার সহিত আসুন, এই রাস্তার উপর দাঁড়াইয়া থাকাও উচিত নহে, আমার সহিত একখানি শকট আছে, আপনি তাহাতে অনায়াসেই গমন করিতে পারিবেন। যে পর্যন্ত অপর আর একখানি শকটের যোগাড় করিতে না পারি, সেই পর্য্যন্ত আমি আপনার গাড়ির সহিত পদব্ৰজে অনায়াসেই গমন করিতে পারিব। 

এবার আমার কথা শুনিয়া স্ত্রীলোকটি আর কোনরূপ আমার কথায় প্রতিবাদ করিল না। আস্তে আস্তে গাত্রোত্থান করিল ও আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আগমন করিতে লাগিল। দূরে আমার নিকট দাঁড়াইয়াছিল, তাহার নিকট গমন করিয়া আমি আমার পোর্টমেণ্ট খুলিলাম ও তাহা হইতে একখানি বস্ত্র বাহির করিয়া স্ত্রীলোকটিকে প্রদানপূর্ব্বক কহিলাম, “আপনার পরিহিত বস্ত্র একেবারে ভিজিয়া গিয়াছে। আপনি আমার এই কাপড়খানি পরিধান পূর্ব্বক ঐ ভিজাবস্ত্রখানি পরিত্যাগ করুন।’ এই বলিয়া ঐ বস্ত্রখানি আমি তাহার হস্তে প্রদান করিলাম। সেও বিনা-বাক্য-ব্যয়ে উহা আমার হস্ত হইতে গ্রহণপূর্ব্বক গাড়ির অপর পার্শ্বে গমন করিয়া আপন বস্ত্র পরিবর্তন করিল। এখন বুঝিতে পারিলাম, পূর্ব্বাপেক্ষা ইহার মনের গতি এখন পরিবর্তিত হইয়া পড়িয়াছে। আত্মহত্যা করিবার ইচ্ছা আর নাই, এখন যেন তাহার মনের ইচ্ছা, সে আমার সহিত গমন করিয়া তাহার জীবনরক্ষা করে। তাহার বস্ত্র পরিবর্তন করা হইলে, আমি তাহাকে আমার গাড়িতে আরোহণ করিতে কহিলাম। সে বিনাবাক্যব্যয়ে আমার গাড়ির ভিতর প্রবেশ করিয়া উপবেশন করিল। এখন রাত্রি প্রভাত হইয়া গিয়াছে, সূৰ্য্যদেব পূৰ্ব্বাকাশে উদিত হইতেছেন। 

‘গাড়ির ভিতর উপবেশন করিয়া সে আমাকে কহিল, “আমি আপনার গাড়ি অধিকার করিয়া বসিলাম, কিন্তু আপনি এখন কিরূপে গমন করিবেন?” 

আমি। অপর আর একখানি গাড়ি করিয়া লইব। 

স্ত্রীলোক। সে পর্য্যন্ত গাড়ি না পাইবেন? 

আমি। সে পৰ্য্যন্ত আমি পদব্রজেই গমন করিব। বিশেষ প্রাতঃকালে একটু হাটিয়া বেড়ান কিছু মন্দ নহে। 

স্ত্রীলোক। আপনি আমার উপর যেরূপ অনুগ্রহ করিলেন, তাহাতে আমি ইচ্ছা করি না যে, আপনি আমার নিমিত্ত কষ্ট করিয়া হাটিয়া যান। আমি এই গাড়ির ভিতর এক প্রান্তে বসিতেছি, আপনিও এই গাড়িতে আরোহণ করুন। যখন আপনার আশ্রয় গ্রহণ করিলাম, তখন আপনার নিকট আর আমার লজ্জা কি? আপনি আমার জীবন দাতা। 

ঐ স্ত্রীলোকের কথা শুনিয়া আমার মনে হইল, আমি যে স্ত্রীলোকের সহিত পূর্ব্বে কথা কহিয়াছিলাম, এই স্ত্রীলোক যেন সেই স্ত্রীলোক নহে। যে পূৰ্ব্বে আমার সহিত কথা কহিতে সঙ্কুচিতা হইতেছিল, সেই স্ত্রীলোক এখন যে গাড়িতে উপবেশন করিয়াছে, আমাকেও সেই গাড়িতে বসিতে বলিতেছে। যে স্ত্রীলোক পূৰ্ব্বে আত্মহত্যা করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিল, সেই স্ত্রীলোক এখন আমার প্রদত্ত বস্ত্র পরিধান করিয়া সিক্ত বস্ত্র হইতে আপন শরীর রক্ষা করিতে বসিয়াছে। এইরূপ অবস্থা দৃষ্টে আমার মনে পুনরায় কেমন একরূপ ভাবের উদয় হইল। আমি পূর্ব্বে ঐ স্ত্রীলোকটিকে ভদ্র-ঘরের রমণী বলিয়া অনুমান করিয়া লইয়াছিলাম, কিন্তু এখন উহার কথা শুনিয়া আমার মনে হইল, তবে কি ইনি ভদ্র-মহিলা নহেন? অথবা ভদ্র ঘরে জন্মগ্রহণ করিয়া পরিশেষে আপন চরিত্রকে নষ্ট করিয়া ফেলিয়াছেন। যাহা হউক, ইনি যদি আমার সহিত কলিকাতায় গমন করেন, তাহা হইলে এই গাড়ির ভিতর আমাদিগকে দুই তিন দিবস অতিবাহিত করিতে হইবে। এবং উনি যখন একই গাড়িতে আমার সহিত গমন করিতে প্রস্তুত হইয়াছেন, তখন ইহার মধ্যে আমি অনায়াসেই জানিতে পারিব যে, ঐ স্ত্রীলোকটি কে, কোথায় তাহার বাড়ী, তাহার চরিত্র কিরূপ ও কেনই বা সে এই প্রদেশে আগমন করিয়াছে, ও তাহার এইরূপ দুর্দ্দশাই বা হইয়াছে কেন? মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া আমিও সেই শকটে আরোহণ করিলাম, এবং শকট চালককে শকট চালাইতে কহিলাম। শকট চলিল। আমার সহিত যে একটি কনেষ্টবল ছিল, সে আমাদিগের গাড়ির পশ্চাৎ পশ্চাৎ আগমন করিতে লাগিল। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

কটক যাইবার রাস্তায় যে সকল শকট গাড়ি পূর্ব্বে গমন করিত, তাহা পাঠকগণ কখন দেখিয়াছেন কি? যদি না দেখিয়া থাকেন, তাহা হইলে, ঐ প্রকারের গাড়ি এখনও সময় সময় ঐ দেশে দেখিতে পাওয়া যায়। মনে করিলেই আপনারা দেখিতে পারেন। ঐ সকল গাড়ির নাম “উড়িয়া গাড়ি।” 

গাড়িগুলি বেশ উচ্চ। তাহার উপর খুব উচ্চ ও প্রশস্ত ছই বা ছাপ্পড় আছে। উহা এরূপ উচ্চ যে, গাড়ির উপর ভালরূপ বিছানা বিছাইয়া তাহার উপর উপবেশন করিলেও মস্তকের উপর প্রায় এক হাত ফাঁক থাকে। আমাদিগের দেশের চাঁচের ছই নির্ম্মিত গাড়ির ভিতর বসিলে যেমন মস্তক প্রায়ই উহাতে ঠেকিয়া থাকে, বা পার্শ্বদেশে যেরূপ স্থান পাওয়া যায় না, উহা সেরূপ নহে। মস্তকোপরি যেরূপ স্থান থাকে, দুই পার্শ্বে, সম্মুখ ও পশ্চাতেও সেইরূপ পরিসর স্থান থাকে। ঐ ছই অতিশয় মজবুতরূপে প্রস্তুত এবং গাড়ির উপর এরূপ ভাবে আবদ্ধ করা থাকে যে, উহা কোনরূপেই নড়ে না, ও উহার উপর দিয়া গমনাগমন করিলে, উহা কোন রূপে নত হইয়াও পড়ে না। গাড়ির পশ্চাদ্ভাগে ছইর নিম্নে যে অর্দ্ধ গোলাকার খোলা স্থান, আমাদিগের দেশের গাড়িতে দেখিতে পাওয়া যায়, ঐ সকল উড়িয়া গাড়িতে ঐ স্থানও আবদ্ধ থাকে। অর্থাৎ গাড়ির পশ্চাদ্দিক হইতে কোন ব্যক্তি গাড়ির ভিতরস্থিত কোন দ্রব্য বাহির করিয়া লইতে সমর্থ হয় না, বা গাড়ির ভিতর কি আছে না আছে, তাহাও পশ্চাদ্দিক হইতে কাহার নয়ন গোচর হয় না। গাড়ির সম্মুখে ছইর বাহিরে অর্থাৎ যে স্থানে বসিয়া শকট-চালক শকট চালাইয়া থাকে, তাহার উপর ঐ ছইর কতক অংশ বহির্গত করা থাকে। উহা দ্বারা যে কেবল শকট-চালক রৌদ্র বৃষ্টি হইতে আপন দেহকে রক্ষা করিতে সমর্থ হয়, তাহা নহে; আরোহীর উপর সম্মুখস্থিত সূর্য্যের কিরণ বা সম্মুখ দিক হইতে আগত বৃষ্টির ছাট পতন হইতেও অনেকটা রক্ষা করে। তদ্ব্যতীত গাড়ির সম্মুখবর্তী ছইর আভ্যন্তরীণ অর্দ্ধ গোলাকৃতি যে শূন্যস্থান থাকে, অর্থাৎ যাহার মধ্য দিয়া ছইর মধ্যে প্রবেশ করিতে হয়, তাহার পরিমাণ মত দুইখানি ঝাপ প্রস্তুত থাকে, ইচ্ছা করিলে, এক খানির দ্বারা অর্দ্ধেক স্থান বা দুই খানির দ্বারা সম্পূর্ণস্থান আবরিত করা যাইতে পারে। কোন আরোহী যদি ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে ঐ ঝাপবদ্ধ করিয়া দিয়া ঘরের ন্যায় তাহার মধ্যে অনায়াসে শয়ন করিয়া নিদ্রা যাইতে পারেন। 

আমি যে গাড়িতে আরোহণ করিয়া আসিতেছিলাম, উহাও সেই প্রকারের একখানি উড়িয়া গাড়ি। ঐ গাড়ির মধ্যে প্রায় অর্দ্ধ হস্ত পরিমিত পুরু করিয়া বিচালি বা খড় বিছান ছিল। তাহার উপর একখানি কম্বল, কম্বলের উপর একখানি তোষক, ও তাহার উপর একখানি চাদর ছিল এবং তদোপরি একটি উপাধানও ছিল। গাড়ির ভিতর পশ্চাদ্দিকে পোর্টমেন্ট প্রভৃতি আমার সহিত যে সকল দ্রব্যাদি ছিল, তাহাই রক্ষিত ছিল। আমার সহিত যে কনষ্টেবল ছিল, সে প্রায় হাঁটিয়াই গমন করিত, কিন্তু রাত্রিকালে বা ক্লান্ত হইয়া পড়িলে তাহাকেও আমি গাড়ির ভিতর উঠাইয়া লইতাম। উহার স্থান ছিল, আমার পূর্ব্বকথিত পোর্টমেন্টের নিকট। তৎব্যতীত সমস্ত স্থানই আমার অধিকার ভুক্ত ছিল, সেই স্থানে কখন উপবেশন করিয়া, কখন শয়ন করিয়া, সময় অতিবাহিত পূর্বক গমন করিতাম। আমার সহিত কেবলমাত্র একখানি বাঙ্গালা পুস্তক ছিল, উহা মধ্যে মধ্যে পাঠ করিতাম। উহা আমার বিছানার উপরই সর্ব্বদা পড়িয়া থাকিত। 

ঐ স্ত্রীলোকটি গাড়িতে উপবেশন করিয়া, আমি যেস্থানে উপবেশন করিতাম, সেইস্থানে গিয়া উপবেশন করিল। কিন্তু আমি যখন তাহার ইচ্ছানুসারে ঐ গাড়ির ভিতর প্রবেশ করিলাম, তখন সে আমার স্থান পরিত্যাগ করিয়া যে স্থানে আমার কনষ্টেবল উপবেশন করিত, সেইস্থানে গিয়া অবগুণ্ঠনে তাহার মুখ সম্পূর্ণরূপে আবৃত করিয়া উপবেশন করিল। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

ঐ স্ত্রীলোকটি যে কে, কোথায় তাহার বাসস্থান, কেনই বা সে এ প্রদেশে আগমন করিল, তাহা জানিবার নিমিত্ত আমার নিতান্ত কৌতূহল জন্মিল। মনে করিলাম, যেরূপেই হউক, ক্রমে আমি তাহার সমস্ত বিষয় তাহারই নিকট হইতে অবগত হইব। আবার মনে হইল, একটি অপরিচিত স্ত্রীলোককে আমার গাড়ির ভিতর করিয়া লইয়া যাইতেছি, ইহাতে আমার কোনরূপ বিপদ ঘটিবে না ত! যদি এই স্ত্রীলোকটি অপর কাহার সঙ্গে তাহার গৃহ পরিত্যাগ করিয়া আসিয়া থাকে, ও উহার আত্মীয়-স্বজন উহার অনুসন্ধানে বহির্গত হইয়া থাকেন ও পরিশেষে আমার গাড়ির ভিতর যদি তাঁহারা উহাকে দেখিতে পায়, তাহা হইলে তাঁহারা নিশ্চয়ই মনে করিবেন যে, আমিই কু-পরামর্শ দিয়া তাহাকে তাহার ঘরের বাহির করিয়া আনিয়াছি। তখন আমার অবস্থা কিরূপ ভয়ানক হইয়া দাঁড়াইবে? প্রকৃত কথা বলিলে সে সময় কেতুই আমার কথা বিশ্বাস করিবেন না। এরূপ অবস্থায় ঐ স্ত্রীলোকটিকে আমার সঙ্গে করিয়া লইয়া যাওয়া কি কর্তব্য? এ দিকে যদি সে প্রকৃতই বিপদাপন্ন হইয়া থাকে, অথচ সে যদি কোন ভাল ঘরের রমণী হয়, তাহা হইলে তাহাকে এইরূপ অবস্থায় একাকী পরিত্যাগ করিয়া যাই বা কি প্রকারে? মনে মনে এইরূপ নানা প্রকার চিন্তা আসিয়া ক্রমে আমার মনে উদিত হইতে লাগিল। আমি স্থিরভাবে অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত সেই গাড়িতে উপবেশন করিয়া ঐ সকল চিন্তা করিতে লাগিলাম, কিন্তু সেই অবস্থায় কি কৰ্ত্তব্য ও কি অকর্তৃব্য, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে না পারিয়া, ইহাই পরিশেষে স্থির করিলাম, লোকে যাহা বলে বলুক, ও আমার অদৃষ্টে যাহা ঘটে ঘটুক, ইহাকে একেবারে সহায়হীনা অবস্থায় পরিত্যাগ করিব না। 

আমি বসিয়া বসিয়া এই সকল চিন্তা করিতে লাগিলাম, আমার শকটও ক্রমে অগ্রবর্ত্তী হইতে লাগিল, এদিকে ক্রমে বেলা হইয়া আসিতে লাগিল। আমি গাড়ির ভিতর যেরূপ অবস্থায় বসিয়াছিলাম, তাহাতে তাহার দিকে আমার দৃষ্টি পতিত হইতেছিল না। অর্থাৎ আমি সম্মুখ দিকে আমার মুখ করিয়া বসিয়াছিলাম, সে আমার পশ্চাদ্ভাগে বসিয়াছিল। একবার হঠাৎ আমি আমার মুখ ফিরাইয়া দেখিলাম সে কি করিতেছে। দেখিলাম, অবগুণ্ঠনে তাহার যে মুখমণ্ডল সম্পূর্ণ রূপে আবৃত ছিল, এখন তাহা নাই, অবগুণ্ঠনের কাপড় তাহার কপাল অতিক্রম করিয়া মস্তকের অৰ্দ্ধভাগ পর্য্যন্ত আগমন করিয়াছে। আমি ফিরিবামাত্রই তাহার চক্ষুর উপর আমার চক্ষু যেমন পতিত হইল, অমনি সে তাহার মস্তকের কাপড় টানিয়া লইয়া পুনরায় অবগুণ্ঠনে তাহার মুখ আবৃত করিয়া দিল। সে কে তাহা তাহার নিকট হইতেই অবগত হইবার নিমিত্ত আমি তাহাকে নানারূপ প্রশ্ন করিতে লাগিলাম, প্রথমেই আমি তাহাকে কহিলাম, “আমি আপনাকে একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি?” 

কোন উত্তর পাইলাম না। 

আমি। আমি আপনাকে একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাহি। 

তাহাতেও কোন উত্তর নাই। 

আমি। আপনি আমার সহিত যখন পূর্ব্বে কথা কহিয়াছেন, তখন এখন কথা না কহেন কেন? বিশেষ আমার সহিত যখন আপনাকে ২/৩ দিবস গমন করিতে হইবে, তখন আমার সহিত কথা না হইলে কখনই চলিবে না। আমি আপনাকে যে দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করি, আপনি তাহার উত্তর প্রদান করুন। 

স্ত্রীলোক। আপনি আমাকে কি জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন? 

আমি। আপনি কোন জাতি? ব্রাহ্মণ না শূদ্র? 

স্ত্রীলোক। ইহা শুনিয়া আপনার লাভ কি? 

আমি। লাভ না থাকুক, প্রয়োজন হইয়াছে বলিয়াই জিজ্ঞাসা করিতেছি।

স্ত্রীলোক। কি প্রয়োজন, তাহা আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি? 

আমি। আমি অনেকক্ষণ পর্যন্ত এই গাড়ির ভিতর বসিয়া আছি, এখন ইচ্ছা করিতেছি, একটু শুই। তাই আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি। 

স্ত্রীলোক। আপনি শয়ন করুন না কেন? : 

আমি। আপনি কোন জাতি তাহা না জানিতে পারিলে আমি শয়ন করিতে পারিতেছি না, কারণ আমি শয়ন করিলে আপনি যে দিকে বসিয়া আছেন সেই দিকেই আমার পা পড়িবে, ও উহা পাছে আপনার গায়ে লাগে, এই নিমিত্তই আমি জানিতে চাহিতেছি আপনি কোন্ জাতি। যদি আপনি ব্রাহ্মণ-কন্যা হয়েন, তাহা হইলে আমার মহাপাপ হইবে। 

স্ত্রীলোক। আপনি কোন জাতি? 

আমি। আমি ব্রাহ্মণ। 

স্ত্রীলোক। আপনি অনায়াসে শয়ন করিতে পারেন। আপনার পা যদি কোন গতিকে আমার অঙ্গ স্পর্শ করে, তাহাতে আপনার কোনরূপ পাপ অশিবে না। 

আমি। আপনি যে কোন্ জাতি তাহা আপনি বলিতে চাহেন না কি? 

স্ত্রীলোক। না, তাহা আর আপনি শুনিবেন না। আমি অতিশয় নীচ জাতি, বাগদী অপেক্ষাও নীচ। 

আমি। মিথ্যা কথা; ইহা কখনই হইতে পারে না, আপনি হয় ব্রাহ্মণ, না হয় কায়স্থের অথবা কোন সৎশূদ্রের কন্যা। 

স্ত্রীলোক। হইতে পারে, আমি কোন ভদ্রলোকের কন্যা, কিন্তু সেই ভদ্রবংশের বা ভদ্রলোকের কন্যা বলিয়া পরিচয় দিবার তাধিকার আমার নাই বলিয়াই আমি তাহার পরিচয় প্রদানে অসম্মত 

ঐ স্ত্রীলোকটি যখন এই কথা বলিতেছিল, সেই সময় আমি সেই গাড়ির ভিতর শয়ন করিলাম। আমার মস্তক উপাধানের উপর সেই শকটচালকের পশ্চাদ্ভাগে রহিল, পদদ্বয়ের যে দিকে স্ত্রীলোকটি বসিয়াছিল, সেই দিকেই রাখিতে হইল। আমাকে শয়ন করিতে দেখিয়া স্ত্রীলোকটি যে স্থানে বসিয়াছিল, সেইস্থান হইতে একটু সরিয়া বসিল। তাহাকে সরিতে দেখিয়া আমার মনে হইল, পাছে আমার অঙ্গ তাহার অঙ্গে স্পর্শিত হয়, এই নিমিত্তই সে সরিয়া বসিতেছে। কিন্তু যে স্থানে সে সরিয়া বসিল, সেইস্থান হইতে আমার অঙ্গ তাহার আরও নিকটবর্ত্তী হইল, অর্থাৎ সেই সঙ্কীর্ণ গাড়ির মধ্যে আমার এক পার্শ্বে অর্থাৎ আমার হাটুর সন্নিকটে সে সরিয়া বসিল। ঐ স্থান আমার শরীরের নিকট হইতে এত নিকটবর্তী, যে গাড়ির ঝেকুনিতে মধ্যে মধ্যে তাহার অঙ্গ আমার অঙ্গ দ্বারায় স্পর্শিত হইতে লাগিল, কিন্তু তাহাতে সে সেইস্থান হইতে কোন রূপে স্থানান্তরিত হইল না। এদিকে তাহার অবগুণ্ঠনও ক্রমে শিথিল হইয়া আসিতে লাগিল। উহার এইরূপ অবস্থা দেখিয়া তখন আমার মনে আর এক সন্দেহ আসিয়া উদিত হইতে লাগিল, আমার বেশ বিশ্বাস জন্মিল যে, সে কুচরিত্রা স্ত্রীলোক। যাহা হউক, আমি তাহাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি আমার নিকট প্রকৃত পরিচয় কেন দিতেছ না? এখানে অপর আর কেহই নাই, তুমি আমাকে যাহা বলিবে, তাহা তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনরূপে প্রকাশিত হইবার সম্ভাবনা নাই, অথচ আমি তোমার সমস্ত অবস্থা অবগত হইতে পারিলে আমার দ্বারা যে তোমার কোনরূপ উপকার হইবার সম্ভাবনা নাই, তাহাও মনে করিও না। আমি সমস্ত অবস্থা উত্তমরূপে অবগত হইতে পারিলে যে তোমার অভীষ্ট সিদ্ধি হইবে না, তাহা নহে! জানিও, আমার দ্বারা তোমার উপকার ভিন্ন কোনরূপ অপকারের সম্ভাবনা নাই। 

স্ত্রীলোক। আমি তাহা এখন বুঝিতে পারিতেছি। আপনি আমাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিবেন, আমি তাহার যথাযথ উত্তর দিতে এখন প্রস্তুত হইয়াছি। এখন আমাকে কি বলিতে হইবে বলুন। 

আমি। তোমার নাম কি? 

স্ত্রীলোক। আমার নাম ঊষা। 

আমি। তুমি থাক কোথায়? 

ঊষা। কলিকাতায়। 

আমি। কলিকাতার কোন স্থানে? 

ঊষা। শ্যামবাজারে। 

আমি। শ্যামবাজারে তোমার শ্বশুর বাড়ী, না বাপের বাড়ী? 

ঊষা। বাপের বাড়ী। 

আমি। তোমার পিতার নাম কি? 

ঊষা। সুরেশচন্দ্র অধিকারী। 

আমি। অধিকারী? ব্ৰাহ্মণ? 

ঊষা। হাঁ। 

আমি। আমি এক সুরেশবাবুকে জানি, কিন্তু তাঁহার পদবী আমি জানি না, তিনি একজন বড়লোক। 

ঊষা। তিনিই আমার পিতা। 

আমি। ভাল, তোমার শ্বশুর বাড়ী কোথায়? 

ঊষা। তাহা আমি জানি না, সেইস্থানে আমি কখন যাই নাই। আমার স্বামী আমার পিতার বাড়িতেই থাকিতেন।

আমি। তোমার স্বামী তোমার বাড়ীতে থাকিতেন, ও কথার অর্থ কি? এখন তিনি কোথায় আছেন? 

আমি। কেন, যাহার বাড়ী তোমাদিগের বাড়ীর নিকট, তাহার পিতা মাতাকে তুমি চিন না? 

ঊষা। ঐ স্থানে উহার বাড়ী নহে, কিন্তু আমাদিগের বাড়ীর নিকটে একটি বাসায় সে থাকিত। 

আমি। সেই বাসায় তাহার আর কে থাকে? 

ঊষা। তাহা আমি জানি না। সেই বাসায় আরও অনেক পুরুষ মানুষকে দেখিতে পাইতাম। 

আমি। উহারা কি বাসাড়ে? 

ঊষা। হাঁ। 

আমি। কিরূপ বাসাড়ে? 

ঊষা। স্কুলের ছাত্র বলিয়া আমার বোধ হয়। 

আমি। শরতের সহিত তোমার কিরূপে পরিচয় হইল? 

ঊষা। আমার যে ভাই এখন পড়িতেছে, তাহার সহিত সর্ব্বদাই সে আমাদিগের বাড়ীতে আসিত, তাই আমি তাহাকে চিনিতাম। 

আমি। তাহা হইলে, তুমি সেই অপরিচিতের সহিত কেন তোমার গৃহ পরিত্যাগ করিলে? 

ঊষা। যখন আমি আপনার নিকট সমস্ত কথা প্রকাশ করিতেছি, তখন কোন কথাই গোপন করিব না। উহাকে দেখিয়া আমার মনের গতি কেমন পরিবর্তন হইয়া যায়, আমি কেমন করিয়া উহার সহিত কথা কহিব, কেমন করিয়া উহাকে ভালবাসিতে পাইব, মনে সদা সর্ব্বদা এইরূপ চিন্তা উদিত হয়। শরত্ত আমার মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া, তাহাদিগের বাড়ীর চাকরাণীকে একখানি পত্রসহ আমার নিকট এক দিবস পাঠাইয়া দেয়। পত্রখানি পাঠ করিয়া আমি বুঝিতে পারি, আমার যে দশা উপস্থিত হইয়াছে, শরতের দশাও সেইরূপ হইতে বসিয়াছে। শরতের পত্র পাইয়া আমিও তাহাকে একখানি পত্র লিখিলাম, উহাতে আমার মনের ভাব সমস্ত বলিয়া ফেলিলাম। সেই দিবস হইতে যাহাতে আমি শরতের আশ্রয় গ্রহণ করিতে পারি, তাহার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। এইরূপে দুই তিন মাস ক্রমে অতীত হইয়া গেল, কিন্তু কোনরূপেই আমাদিগের মনের বাসনা পরিপূর্ণ করিতে সমর্থ হইলাম না। আমি যে বাড়ীতে বাস করিতাম, সেই বাড়ীর অন্দরের ভিতর রাত্রিকালে শরতের কোনরূপেই প্রবেশ করিবার উপায় ছিল না। আমিও ঘরের বাহির হইয়া কোনরূপেই যাইতে পারিতাম না। গঙ্গাস্নান করিতে, কালিঘাটে যাইতে বা অপর কোন স্থানে গমন করিতে হইলে, আমাকে একাকী গমন করিবার কোনরূপ উপায় ছিল না। তখন দেখিলাম, কোন উপায়েই শরতের সহিত নির্জ্জনে সাক্ষাৎ করিবার সুযোগ ঘটিল না, তখন শরতের ইচ্ছানুসারে গোপনে পিত্রালয় পরিত্যাগ করিয়া তাহার সহিত আপন কোন স্থানে গমন করিবার ইচ্ছা করিলাম, ও ক্রমে তাহার সুযোগ অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। আমার যে সকল অলঙ্কার পত্র ছিল, তাহার সমস্তই, ও আমার নিকট নগদ টাকা যাহা ছিল, তাহা সংগ্রহপূর্বক এক দিবস সন্ধ্যাকালে একাকী খিড়কি দরজা দিয়া ঘরের বাহির হইয়া পড়িলাম। পূর্ব্বের পরামর্শ মত শরৎ নিকটেই ছিল, সে আমাকে সঙ্গে লইয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল। বড় রাস্তার উপর একখানি গাড়ি ছিল, উহাতে আরও এক ব্যক্তি বসিয়া ছিল। শরৎ আমাকে লইয়া ঐ গাড়িতে উপবেশন করিল। গাড়ি চলিতে লাগিল। ঐ গাড়ি করিয়া কিছু দূর আসিয়া ঐ গাড়ি ছাড়িয়া দেওয়া হইল। আর একখানি গাড়ি করিয়া আরও কিছু দূর গমন করিলাম। এইরূপে একখানি পরিত্যাগ করিয়া অপর আর একখানি গাড়িতে আরোহণ ও সেই গাড়ি পরিত্যাগ পূর্ব্বক অপর গাড়ি গ্রহণ করিতে করিতে গমন করিতে লাগিলাম। ক্রমে রাত্রি প্রভাত হইয়া পড়িল, আমি যে কোথায় আসিলাম বা কোথায় যাইতেছি, তাহার কিছুই জানিতে পারিলাম না। প্রত্যূষে আমরা যে স্থানে গাড়ি পরিত্যাগ করিলাম, সেইস্থানে আর ঘোড়ার গাড়ি পাওয়া গেল না! সেইস্থান হইতে একখানি গরুর গাড়ি ভাড়া করিয়া আমরা তিনজনেই তাহাতে আরোহণ করিলাম। গরুর গাড়িতে ক্রমাগত দুই দিবস কাল অনবরত গমন করিলাম। তাহার পর যে কি হইল, তাহা বলিতে পারি না। গাড়ির ভিতর হঠাৎ আমার নিদ্রা আসিল, ক্রমে আমি নিদ্রিত হইয়া পড়িলাম। যে সময় আমার নিদ্রাভঙ্গ হইল, সেই সময় দেখিলাম, রাস্তার এক পার্শ্বে মৃত্তিকোপরি আমি শয়ন করিয়া আছি। পরিধানে একমাত্র বস্ত্র ভিন্ন আর কিছুই নাই, তাহাও বৃষ্টিতে ভিজিয়া গিয়াছে। আমার নিকট যে সকল অলঙ্কার পত্র ও নগদ টাকা ছিল, বা যে সকল অলঙ্কার আমার অঙ্গে পরিহিত ছিল, তাহার এক খানিও নাই। যে গাড়িতে আমরা আসিতেছিলাম সে গাড়ি নাই, শরৎ নাই, বা তাহার সঙ্গে অপর যে ব্যক্তি ছিল সেও নাই। এই অবস্থা দেখিয়া আমি আস্তে আস্তে গাত্রোত্থান করিলাম। 

আমি। এ সকল কথা তুমি আমাকে প্রথমেই বল নাই কেন? তাহা হইলে আমি এতদূর আগমন না করিয়া সেই স্থান হইতেই ইহার অনুসন্ধান আরম্ভ করিতাম, শরৎ ও তাহার বন্ধু এবং সেই গাড়ি কোথায় গিয়াছে, তাহাও বাহির করিবার চেষ্টা করিতাম। 

ঊষা। লজ্জায় ঐ সকল কথা আমি আপনাকে বলি নাই। 

আমি। তোমার নিকট কি পরিমাণ অর্থ ছিল? 

ঊষা। নগদ এক সহস্র মুদ্রার কম ছিল না। 

আমি। গহনা? 

ঊষা। তাহাও দুই তিন সহস্র টাকার হইবে। 

আমি। এখন তোমার কি অনুমান হইতেছে? 

ঊষা। কিসের? 

আমি। তোমার এই সকল টাকা ও অলঙ্কার কে লইয়া গেল? 

ঊষা। তাহা আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। 

আমি। শরৎ লইয়াছে বলিয়া অনুমান হয় কি? 

ঊষা। সে কি এরূপ কার্য্য করিবে? 

আমি। তাহা হইলে সে গেল কোথায়? 

ঊষা। তাহার অবস্থাও যদি আমার অবস্থার মত হইয়া থাকে। 

আমি। যাহাকে ভালবাসা যায়, তাহার উপর কখন সহজে সন্দেহ হয় না। যাহা হউক, আমার আর গমন করা হইল না। পুনরায় প্রত্যাগমন করিতে হইল। আমরা যে দিক যতদুর আসিয়াছি, তাহার ভিতর শরৎ নাই। কিন্তু যে দিকে হইতে আসিয়াছি, সেই দিকে যদি সে কোন স্থানে পতিত থাকে, তাহা বলিতে পারি না। কিন্তু বোধ হয়, সে দিকেও সে নাই, কারণ তোমার সহিত সাক্ষাৎ হইবার পূর্ব্বে সেই দিক হইতেই আমি আসিয়াছি; তবে রাত্রিকাল বলিয়া যদি দেখিতে না পাইয়া থাকি। যাহা হউক, এরূপ অবস্থায় আমাদিগের আর চলিয়া যাওয়া কৰ্ত্তব্য নহে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, তুমি যাহাকে প্রাণের সহিত ভালবাসিতে বসিয়াছিলে, যাহাকে বিশ্বাস করিয়া আপন গৃহ পরিত্যাগ ও ধর্ম্ম নষ্ট করিয়াছ, সেই তোমার সর্ব্বনাশ করিয়াছে। অবশ্য এ কথা এখন তোমার মনে স্থান পাইবে না। 

ঊষা। শরৎ সে প্রকৃতির লোক বলিয়া আমার বোধ হয় না। 

আমি। এখন বোধ হইবে না, কিন্তু পরে জানিতে পারিবে। আচ্ছা আমি এখন তোমাকে যে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি, তুমি বিশেষরূপে মনে করিয়া তাহার ঠিক উত্তর প্রদান কর। 

ঊষা। বলুন। 

আমি। আমরা যে রাস্তা দিয়ে গমন করিতেছি, উহা কোন্ স্থানে যাইবার রাস্তা তাহা জান? 

ঊষা। না। 

আমি। ঘোড়ার গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া যে সময় হইতে গরুর গাড়িতে আরোহণ করিয়াছিলে, সেই সময় হইতে সমস্ত অবস্থা আমি যেমন যেমন জিজ্ঞাসা করিতেছি, বিশেষরূপ মনে করিয়া তাহার যথাযথ উত্তব প্ৰদান কর। 

ঊষা। বলুন। 

আমি। যে স্থানে গরুর গাড়িতে প্রথম আরোহণ কর, সেই স্থানের নাম কি? 

ঊষা। তাহা আমি জানি না। 

আমি। মনেও নাই! 

ঊষা। না, কারণ আমি ঘোড়ার গাড়ির ভিতর বসিয়াছিলাম, শরৎ ও তাহার সঙ্গী গরুর গাড়ি ঠিক করিয়া আনিলে, আমি ঘোড়ার গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া ঐ গরুর গাড়ির ভিতর প্রবেশ করি। সুতরাং সেই স্থানের কোন অবস্থাই আমি জানিতে পারি না। 

আমি। সেইস্থানে দোকানাদি বা লোকের ঘরদরজা ছিল কি?

ঊষা। তাহা ছিল, ঐ স্থানটি একটি গঞ্জ বলিয়া বোধ হয়। 

আমি। তুমি পুনরায় ঐ স্থানটি দেখিলে চিনিতে পারিবে? 

ঊষা। বোধ হয় পারিব। 

আমি। যে গরুর গাড়িতে তোমরা আরোহণ করিয়াছিলে, সেই গরুর গাড়িখানি কি রূপের? যেরূপ গাড়িতে এখন বসিয়া আছ, সেই রূপের গাড়ি, কি অপর কোন প্রকারের গাড়ি? 

ঊষা! এইরূপ ধরণেরই গাড়ি। উহাতে দুইটি বড় সাদা রঙ্গের গরু ছিল, ও গাড়োয়ান একজন উড়িয়া। 

আমি। ঐ গাড়োয়ানকে দেখিলে তুমি চিনিতে পারিবে? 

ঊষা। তাহা আমি ঠিক বলিতে পারি না, কারণ উড়িয়াগণ প্রায়ই দেখিতে কতকটা একরূপ হয়। সহজে উহাদিগকে দেখিয়া চিনিতে পারা যায় না। দেখিলে বলিতে পারি যে, তাহাকে আমি চিনিতে পারিব কি না? 

আমি। যে সময় তুমি গাড়িতে আরোহণ করিয়াছিলে, সেই সময় বেলা কত আন্দাজ হইয়াছিল।

ঊষা। বেলা তত অধিক হয় নাই, বোধ হয় ৮।৯ টা হইবে। 

আমি। সে দিবস তোমরা আহারাদি কর কোন্ স্থানে? 

ঊষা। কিছুদূর আসিয়া আমরা একটি বাজারে উপস্থিত হই। সেইস্থানে একখানি ঘর ভাড়া করিয়া তাহার ভিতর রন্ধনাদি করিয়া আমরা আহার করি। 

আমি। রন্ধন কে করিয়াছিল? 

ঊষা। আমিই রন্ধন করিয়াছিলাম। শরৎ ও তাহার বন্ধু উদ্যোগ করিয়া দিয়াছিল। 

আমি। আহারাদির পর কি হইল? 

ঊষা। আহারাদির পর আমরা পুনরায় ঐ গাড়িতে আরোহণ করিয়া চলিতে লাগিলাম। ক্রমে সন্ধ্যা হইয়া আসিল। রাত্রি ১০টার পর আমরা আর একটি বাজারের ন্যায় স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। সেইস্থানে একখানি ঘর ভাড়া করিয়া ঐ ঘরেই আমরা রাত্রি অতিবাহিত করিলাম। 

আমি। ঐ স্থানে পুনরায় রন্ধনাদি করিয়া আহার করিয়াছিলে? 

ঊষা। না, ঐ স্থানে আর রন্ধনাদি করা হয় নাই, জলযোগ করিয়াই রাত্রি অতিবাহিত করি। 

আমি। শয়ন করিলে কিসে? তোমাদের সহিত বিছানাপত্র ত কিছুই ছিল না। 

ঊষা। আমাদিগের সহিত বিছানাপত্র কিছুই ছিল না। যাহার ঘর আমরা ভাড়া লইয়াছিলাম, সেই একটি মাদুর ও একটি বালিস দেয়, উহাতেই আমরা শয়ন করিয়াছিলাম। 

আমি। তিন জনেই? 

ঊষা। হাঁ, ঐ এক বিছানায় এক বালিশে মাথা দিয়া আমরা তিন জনেই রাত্রি অতিবাহিত করি।

আমি। ঐ দোকান ও দোকানদারকে দেখিলে তুমি চিনিতে পারিবে? 

ঊষা। পারিব বলিয়া অনুমান হয়। 

আমি। তাহার পর? 

ঊষা। তাহার পরদিবস অতিশয় প্রত্যূষে আমরা সেইস্থান পরিত্যাগ করি। 

আমি। তোমাদিগের সহিত যে গাড়ি ছিল, সেই গাড়িতেই পুনরায় আরোহণ কর? 

ঊষা। না, আমরা যে গাড়িতে আসিয়াছিলাম, সেই গাড়ির গাড়োয়ান আর অধিক দূর যাইতে সম্মত হয় না, সে তাহার ভাড়া মিটাইয়া লইয়া সেই রাত্রিতেই প্রস্থান করে। 

আমি। তাহা হইলে অপর আর একখানি গাড়ি করিয়া তোমরা কি সেইস্থান হইতে বহির্গত হও? 

ঊষা। হাঁ। 

আমি। সেই গাড়ি তোমরা কোথায় পাইলে? 

ঊষা। আমরা যে দোকানদারের ঘরে রাত্রি যাপন করি, তিনিই ঐ গাড়ি ভাড়া করিয়া দেন। 

আমি। কোথায় যাইবার নিমিত্ত ঐ গাড়ি ভাড়া হয়? 

ঊষা। ঐ গাড়োয়ানের সহিত এই কথা হয় যে, সে আমাদিগকে পুরীতে পৌঁছিয়া আসিবে। 

আমি। পুরী পর্য্যন্ত তুমি গমন করিতে পারিয়াছিলে? 

ঊষা। না। 

আমি। কতদূর গমন করিয়াছিলে? 

ঊষা। যে স্থানে আপনি আমাকে পাইয়াছেন। 

আমি। আর কোন স্থানে কোন গাড়ি পরিবর্তন করিয়াছিলে, না ঐ দোকানদার যে গাড়ি করিয়া দেয়, ঐ গাড়িতেই যে স্থানে আমি তোমাকে পাইয়াছি, সেইস্থান পৰ্য্যন্ত গমন করিয়াছিলে? 

না। 

ঊষা। আমার যতদূর পর্যন্ত মনে আছে, তাহাতে অপর গাড়ি যে ভাড়া করা হইয়াছিল, তাহা আমার মনে হয় 

আমি। ভাল, ঐ দোকান হইতে বহির্গত হইয়া তোমরা কিরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া গমন করিতে লাগিলে?

ঊষা। গাড়ির ভিতর তিনজনেই বসিয়া গমন করিতে লাগিলাম। কোন দিবস মধ্যাহ্নে বা কোন দিবস অপরাহ্ে অর্থাৎ যে দিবস যে সময় যে স্থানে সুবিধা হইত, সেইস্থানে গাড়ি হইতে অবতরণপূর্ব্বক বিশ্রাম ও রন্ধনাদি করিতাম। রাত্রিকালে, কোন রাত্রি গাড়ির ভিতরই, কোন রাত্রি বা কোন দোকানদারের ঘরে অতিবাহিত করিতাম। এইরূপে অনবরত তিন চারি দিবস গমন করিবার পর, আমার এই দশা আসিয়া উপস্থিত হয়। 

আমি। কিরূপে তুমি এইরূপ অবস্থায় পতিত হও? 

ঊষা। তাহা আমি বলিতে পারি না। আমার যতদূর মনে হয়, তাহাতে আমি এই মাত্র বলিতে পারি যে, রাত্রিকালে আমরা একটি দোকানে বিশ্রাম করিয়াছিলাম। অতিশয় প্রত্যূষে আমরা ঐ স্থান হইতে গাত্রোত্থান করিয়া পুনর্ব্বার সেই শকটে আরোহণপূর্ব্বক গমন করিতে থাকি। ক্রমে মধ্যাহ্ণ অতিবাহিত হইয়া যায়। একটি বাজারের মধ্যে দিয়া দিবা ১০।১১ টার সময় আমাদিগের গাড়ি গমন করিলেও, আহারাদি করিবার মানসে আমরা সেইস্থানে গাড়ি হইতে অবতরণ করি না। শরৎ ও তাহার বন্ধু গাড়ি হইতে অবতরণ করে ও বাজারের ভিতর গমন করে, আমি গাড়ির ভিতরই বসিয়া থাকি। প্ৰায় অৰ্দ্ধ ঘণ্টা আন্দাজ পরে তাহারা দুইটি পাতার ঠোঙ্গায় করিয়া কিছু মিষ্টান্ন আনয়ন পূৰ্ব্বক আমাকে কহে, “এই স্থানে রন্ধনাদি করিবার উপযুক্ত স্থান নাই, সন্ধ্যার সময় যে স্থানে আমরা উপনীত হইব, সেইস্থানে রন্ধনাদি করিব। এখন কেবলমাত্র জলযোগ করিয়া আমরা দিন অতিবাহিত করিব।” এই বলিয়া খাবার-পূর্ণ একটি ঠোঙ্গা আমার হস্তে প্ৰদান করে, অপর ঠোঙ্গায় যে খাদ্য ছিল, তাহা তাহারা খাইতে আরম্ভ করে। এদিকে গাড়ি চলিতে থাকে। কিছুদূর গমন করিবার পর যে খাবার আমাকে প্রদত্ত হইয়াছিল, সেই খাবার আমি খাই। ইহার কিছুক্ষণ পরেই আমার নিদ্রা আইসে, আমি ঐ গাড়ির ভিতর নিদ্রিত হইয়া পড়ি। তাহার পর যে কি হয়, তাহা আমি অবগত নহি। প্রথমত যখন আমার নিদ্রাভঙ্গ হয়, তখন আমার একেবারে হুস হয় না, কেমন যেন অর্দ্ধ জাগরিত ও অৰ্দ্ধ নিদ্রিত অবস্থায় আছি বলিয়া আমার অনুমান হয়। এইরূপে কিছুক্ষণ অতিবাহিত হইয়া যাইবার পর, ক্রমে আমার উত্তমরূপে সংজ্ঞা হয়। সেই সময় আমি বুঝিতে পারি, আমি রাস্তার এক পার্শ্বে মৃত্তিকার উপর শয়ন করিয়া আছি, নিকটে কেহই নাই, বৃষ্টিতে আমার সমস্ত পরিধেয় ভিজিয়া গিয়াছে। আমার বোধ হয়, সেই সময় রাত্রি অধিক হইয়াছে। 

আমি। এই অবস্থা দৃষ্টে তুমি কি করিলে? 

ঊষা। আমি প্রথমত আস্তে আস্তে শরৎ শরৎ করিয়া ডাকিলাম, কিন্তু কাহারও কোনরূপ উত্তর পাইলাম না।

আমি। উত্তর না পাইয়া তুমি কি করিলে? 

ঊষা। আস্তে আস্তে গাত্রোত্থান করিলাম, কিন্তু সহজে উঠিতে সমর্থ লইলাম না, উঠিবার সময় আমি অতিশয় দুর্ব্বলতা অনুভব করিতে লাগিলাম। যাহা হউক, অনেক কষ্টে উঠিলাম, উঠিয়া দাঁড়াইলাম। সেই গাঢ় অন্ধকার রজনীর মধ্য দিয়া কিছুই দেখিতে পাইলাম না। নিকটবর্ত্তী জঙ্গলের ও বৃক্ষোপরি বৃষ্টি পতনের শব্দ ভিন্ন আর কিছুই কর্ণগোচর হইল না। মনে অতিশয় ভয় হইল, নানা চিন্তা আসিয়া তাহার উপর উপস্থিত হইল। নিকটে কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না, গাড়ির কোনরূপ শব্দও পাইলাম না। সজোরে একবার শরৎ বলিয়া ডাকিলাম, কোন উত্তর পাইলাম না; কিন্তু দূর হইতে আমার স্বর অনুকরণে কে যেন ডাকিল। “শরৎ” পুনরায় ডাকিলাম, দূরে পুনরায় সেইরূপ শব্দ উত্থিত হইল। আবার ডাকিলাম, আবারও সেইরূপ। তখন আমার মনে ভয়ানক শঙ্কা আসিয়া উদিত হইল। সেই সময় বুঝিতে পারিলাম, আমার অঙ্গে যে সকল অলঙ্কার পরিহিত ছিল, তাহার একখানিও নাই, পরিধেয় বস্ত্রখানি পরিধানে আছে মাত্র। নিকটে যদি কোন লোকালয় পাইতে পারি, এই ভাবিয়া সেইস্থান হইতে অন্ধকার ভেদ করিয়া একটু গমন করিলাম, কিন্তু বোধ হইল, নিকটে কোন লোকালয় নাই, বা সেই সময় সেইস্থান দিয়া কোন লোকজনের গতিবিধিও নাই। যেন একটি বিস্মৃত প্রান্তরের মধ্যে আমি রহিয়াছি বলিয়া অনুমান হইল। তখন অনন্যোপায় হইয়া আমি রাস্তার এক পার্শ্বে একটি জঙ্গলের অন্তরালে উপবেশন করিলাম। সেইস্থানে বসিয়া বৃষ্টি জলে ভিজিতে ভিজিতে মনের কষ্টে ও দুঃখে রাত্রি অতিবাহিত করিতে লাগিলাম। এরূপ সময়ে আপনি আসিয়া উপস্থিত হইলেন। নিদ্রাভঙ্গের পর আপনার সহিতই আমার প্রথম সাক্ষাৎ হইল। 

আমি। তোমাকে এরূপ বিপদগ্রস্ত কে করিল? 

ঊষা। তাহা আমি বলিতে পারি না। 

আমি। কি অনুমান হয়? 

ঊষা। আমার অনুমান হয়, দস্যুগণ কর্তৃক আমাদিগের এই দশা ঘটিয়াছে।

আমি। তোমাদিগের না তোমার? 

ঊষা। আমার অবস্থাতো আমি নিজেই দেখিতেছি, আমার বোধ হয়, শরৎ ও তাহার বন্ধুর অবস্থাও এইরূপ ঘটিয়াছে। আমি জীবিতা আছি, কিন্তু তাহারা জীবিত আছে কি না, তাহাতেও আমার বিশেষরূপ সন্দেহ আছে। 

আমি। যদি তোমার অনুমান সত্য হইত, তাহা হইলে উহাদিগকেও তো পাওয়া যাইত? আর তোমাদিগের সেই গরুর গাড়িই বা গেল কোথায়? 

ঊষা। দস্যুগণ হয়তো তাহাদিগকে ধরিয়া লইয়া যাইতে পারে। 

আমি। দস্যুগণের আবশ্যক অর্থে, উহাদিগকে ধরিয়া লইয়া যাইবার প্রয়োজন? 

ঊষা। দস্যু ভয়ে পলায়ন করিতেও পারে। 

আমি। অসম্ভব নহে, কিন্তু উহাও হইতে পারে যে, তাহারাই তোমার এইরূপ সর্ব্বনাশ করিয়াছে। 

ঊষা। তাহা হইলে আপনি অনুমান করেন কি, শরৎই আমার যথাসর্ব্বস্ব লইয়া প্রস্থান করিয়াছে? 

আমি। তাহা কি হইতে পারে না? 

ঊষা। আমার বোধ হয় না। 

আমি। কেন? 

ঊষা। শরতের দ্বারা এইরূপ বিশ্বাসঘাতকের কার্য্য কখনই সম্ভবপর নহে। সে আমাকে প্রাণের সহিত ভালবাসে।

আমি। সে তোমাকে তাহার প্রাণের সহিত ভালোবাসে, কিন্তু তোমার অলঙ্কার ও টাকা কড়ি সে কি তাহার প্রাণের সহিত ভালবাসে, তাহা বলা সহজ নহে। যাহাকে তুমি কখন উত্তমরূপে অবগত নহ, যাহার কুল শীলের বিষয় তোমার কিছুমাত্র জানা নাই, যাহার রূপে মুগ্ধ হইয়া, অগ্র পশ্চাৎ না ভাবিয়া যাহাকে আত্মসমর্পণ করিয়াছ, তাহার দ্বারা এই কার্য্য যে কেন হইতে পারে না, তাহা বলা অসম্ভব। এই রূপের কার্য্য যখন নিত্য নিত্য ঘটিতেছে, অল্পবুদ্ধি স্ত্রীলোকগণ এইরূপে যাহাকে বিশ্বাস করিয়া পরিশেষে অর্থের নিমিত্ত তাহারই হস্তে যখন জীবন পর্যন্ত বিসর্জ্জন করিতেছে, তখন তোমার অদৃষ্টে সে এইরূপ না ঘটিবে, তাহার কারণ কি? পতঙ্গকুল রূপে মুগ্ধ হইয়া জ্বলন্ত বহ্নির মধ্যে অনায়াসেই প্রবেশ করিতে সমর্থ হয় বলিয়াই কি সেই প্রজ্বলিত বহুি কখন তাহাকে রক্ষা করিয়া থাকে, না দেখিতে দেখিতে তাহাকে ভস্মে পরিণত করিয়া দেয়? তুমি রূপের তেজে ভুলিয়াছ, প্রজ্বলিত বহিতে ঝাঁপ দিয়াছ, তবে কেন তোমার মনে হইতেছে না যে, তুমিও কেন ঐ প্রজ্বলিত বহ্নিতে দগ্ধ না হইবে? তুমি জানিও, তুমি যাহার নিমিত্ত সংসার পরিত্যাগ করিয়া, যাহার রূপে মুগ্ধ হইয়া, হিতাহিত জ্ঞান বিসর্জ্জন করিয়া রাস্তায় রাস্তায় পরিভ্রমণ করিতেছ, সেই তোমার সর্ব্বনাশ করিয়াছে। ইহা যে কেবল তোমার অদৃষ্টে ঘটিয়াছে, তাহা নহে; সেই অল্পবুদ্ধি স্ত্রীলোকের অদৃষ্টে প্রায়ই এইরূপ অবস্থা ঘটিয়া থাকে। প্রথমত বুঝিতে না পারিয়া অল্পবুদ্ধি স্ত্রীলোকগণ প্রথমে হঠাৎ এক কাৰ্য্য করিয়া ফেলেন, কিন্তু পরিশেষে সেই কার্য্যের ফল তাঁহাকে আজীবন ভোগ করিতে হয়, চক্ষের জলে মেদিনী ভিজাইয়া আজীবন তাহাকে রাত্রি দিন অতিবাহিত করিতে হয়। ধৰ্ম্মহীনা হইয়া, সমাজহীনা হইয়া, আত্মীয়হীনা হইয়া চিরদিন মনের কষ্টে তাহাকে দিন যাপন করিতে হয়। তোমার অদৃষ্টেতেও যে তাহা হইবে না, তাহাই বা আমি কি প্রকারে বলিতে পারি? তোমার সেই কষ্টের প্রথম সোপান আরম্ভ হইয়াছে, ইহার পরিণামে যে আর কি হইবে, তাহা ভগবানই বলিতে পারেন! 

ঊষা। আপনার কথা শুনিয়া আমার দিব্যজ্ঞান জন্মিতেছে। এখন আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি যে, যাহাকে আমি আমায় হৃদয়ের অন্তর পর্যন্ত দেখাইয়াছি, সেই আমার সর্ব্বনাশ সাধন করিতে বসিয়াছে। আমার অলঙ্কার যাউক, আমার অর্থ যাউক, তাহাতে আমি কিছুমাত্র দুঃখ মনে করিব না, কিন্তু লোক গঞ্জনার হস্ত হইতে আমি এখন কিরূপে রক্ষা হইতে পারি। আমি যে কার্য্য করিয়াছি, তাহার কিছুতেই প্রায়শ্চিত্ত নাই জানি, হৃদয়ের শান্তি আমি কখনই পাইব না তাহা আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি, কিন্তু লোক গঞ্জনার হস্ত হইতে যদি আমি কোনরূপে মুক্ত হইতে পারি, তাহা হইলেই এখন আমি আমাকে সৌভাগ্যশালী মনে করিব। আমার চরিত্র যে কলুষিত হইয়াছে, আমি অপরের প্রণয়ে মুগ্ধ হইয়া স্ত্রীলোকের প্রধান গৌরবের রত্ন “সতীত্ব” নষ্ট করিয়া ফেলিয়াছি, এই কথাও যদি এখন কেহ অবগত হইতে না পারেন, তাহা হইলেও আমি আমাকে সৌভাগ্যশালী জ্ঞান করিব। আমার হৃদয়ে কখনই আন্তরিক শান্তি পাইব না সত্য, কিন্তু সামাজিক শান্তি পাইলেও লোকালয়ে মুখ দেখাইতে আমি ঘৃণা বোধ করিব না। নতুবা পূর্ব্বে আমি আপনাকে যাহা বলিয়াছিলাম, আমাকে প্রকৃতই তাহা করিতে হইবে, অর্থাৎ আত্মহত্যা করিয়া লোক-গঞ্জনা হইতে আমাকে মুক্তিলাভ করিতে হইবে। 

আমি। আমার বোধ হইতেছে যে, এখন তুমি তোমার ভ্রম কিয়ৎপরিমাণে বুঝিতে পারিয়াছ। যাহা হউক, আমি যাহা জানিলাম, তাহা এই জগতে আর কাহাকেও জানিতে দিব না, যাহাতে তুমি লোক-গঞ্জনা হইতে নিষ্কৃতি পাও, তাহার চেষ্টা আমি করিব। তুমি নিজ ধৰ্ম্ম নষ্ট করিয়া যে কুলত্যাগ করিয়া আসিয়াছ, তাহা যাহাতে কেহই বুঝিতে না পারেন, তাহাও আমি করিতে পারিব। তোমার নিতান্ত সৌভাগ্য যে আমার সহিত প্রথমেই তোমার সাক্ষাৎ হইয়াছে, ও আমার নিকট তোমার মনের সমস্ত কথা প্রকাশ করিয়াছ। এ পর্যন্ত তোমার অবস্থা অপর আর কেহই অবগত হইতে পারে নাই; কিন্তু তুমি এক কথা মনে রাখিওযে, আমি তোমাকে যাহা কহিব, বা যেরূপ উপদেশ প্রদান করিব, তুমি ঠিক সেইরূপে চলিবে, কিছুতেই সেই পথ পরিত্যাগ করিবে না। 

ঊষা। আপনার যাহা ভাল বোধ হয়, তাহাই করুন। আমাকে আপনার আজ্ঞানুবর্ত্তী ভৃত্য বলিয়া জানিবেন ও সৎ হউক বা অসৎ হউক, আপনি আমাকে যে কোনরূপ উপদেশ প্রদান করিবেন, আমি ঠিক সেইরূপ ভাবেই তাহা পালন করিব, আপনার বিনা-আদেশে আমি তাহার বিন্দুমাত্রও অবহেলা করিব না। আমাকে কি করিতে হইবে বলুন। 

আমি। যখন যাহা করিতে হইবে, বা যখন যাহাকে যেরূপ বলিতে হইবে, তখন তাহা আমি তোমাকে বলিয়া দিব, তুমি ঠিক সেইরূপ করিবে ও বলিবে। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

দেখিলাম, এখন ঊষার মনের ভাব পরিবর্তিত হইয়াছে। কিন্তু মনে করিলাম, যে স্ত্রীলোক একবার কুলটা হইয়াছে, পিতা, মাতা, ভ্রাতা, ভগিনী, আত্মীয়স্বজন সকলকে যে রমণী অনায়াসেই পরিত্যাগ করিয়া একজন অজ্ঞাত- নাম-ধাম অপরিচিতের সহিত অনায়াসেই গৃহ পরিত্যাগ করিয়া আপন ধৰ্ম্মে জলাঞ্জলি প্রদান করিয়াছে, তাহার মনোভাব এত সহজেই কি পরিবর্ত্তিত হইতে পারে? সে যাহা হউক, লোকসমাজে যাহাতে উহার কলঙ্ক প্রচারিত না হয়, তাহার নিমিত্ত আমাকে বিশেষ রূপ চেষ্টা করিতে হইবে; অথচ শরৎ ও তাহার বন্ধুর দ্বারা যদি এই কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়া থাকে, তাহা হইলেও দেখিতে হইবে যে, ঊষার অলঙ্কার ও নগদ অর্থাদি তাহাদিগের নিকট হইতে কোনরূপে পাওয়া যাইতে পারে কি না! 

মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া গাড়োয়ানকে গাড়ি থামাইতে কহিলাম। সে গাড়ি থামাইলে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “নিকটবর্তী কোন স্থানে ডাকঘর আছে?” 

গাড়োয়ান। তাহা বলিতে পারি না। 

আমি। এখান হইতে বাজার কতদূর? 

গাড়োয়ান। প্রায় তিন ক্রোশ হইবে। 

আমি। আমরা যে বাজার পরিত্যাগ করিয়া আসিয়াছি, সেই স্থান এখান হইতে কত দূর হইবে? 

গাড়োয়ান। তাহাও দুই ক্রোশের কম হইবে না। 

আমি। এই দুইটি বাজারের মধ্যে প্রধান স্থান অর্থাৎ বড় গোছের বাজার কোনটি? 

গাড়োয়ান। যেটি আপনারা পরিত্যাগ করিয়া আসিলেন সেইটি একটু ভাল বলিয়া অনুমান হয়; কিন্তু ভালরূপ দ্রব্যাদি কোন স্থানেই পাওয়া যায় না। 

আমি। এই দুইটি বাজারের মধ্যে পুলিসের থানা আছে কোন্ স্থানে? 

গাড়োয়ান। উহার এক স্থানেও নাই। 

আমি। এখান হইতে নিকটবর্ত্তী থানা কোথায়? 

গাড়োয়ান। আমরা কাল রাত্রিতে যে বাজারে ছিলাম, সেই বাজারের নিকট একটি স্থানে থানা আছে। সেইস্থানে দারোগাবাবু থাকেন। 

আমি। সেইস্থানে ডাকঘর আছে? 

গাড়োয়ান। বোধ হয় থাকিতে পারে, কিন্তু আমি তাহা ঠিক বলিতে পারি না। 

গাড়োয়ানের কথা শুনিয়া মনে করিলাম, যেস্থানে পুলিসের থানা আছে, সেইস্থানে বা তাহার নিকটবর্ত্তী কোন স্থানে নিশ্চয়ই ডাকঘর আছে। কারণ ডাকঘরের নিকটবর্তী স্থান ব্যতীত অপর স্থানে থানা থাকিলে সরকারী কৰ্ম্ম কার্য্যের বিশেষ অসুবিধা হয়। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, যে বজারে আমরা রাত্রিযাপন করিয়াছিলাম, অর্থাৎ যে বাজারের সন্নিকটে পুলিসের থানা আছে, সেইস্থানে যাইবার নিমিত্ত গাড়োয়ানকে কহিলাম। উড়িয়া গাড়োয়ান আমার কথা শুনিয়া প্রথমত উড়িয়া ভাষায় আপনা আপনি কি বলিতে লাগিল, আমি তাহার বিন্দু বিসর্গও বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। কিন্তু তাহার ভাবগতিক দেখিয়া ও কথার ভাবে এইরূপ অনুমান হইল যে, সে যেস্থান পরিত্যাগ করিয়া আসিয়াছে, সেইস্থানে প্রত্যাগমন করিতে সে সম্মত নহে। আমি তাহার মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া, তাহাকে কহিলাম “যেস্থানে আমি তোমাকে যাইতে বলিতেছি, সেইস্থানে গমন করিতে তুমি ইচ্ছুক নহ, কেমন?”

গাড়োয়ান। সেইস্থান এখান হইতে অনেক দূর। 

আমি। কতদূর? 

গাড়োয়ান। প্রায় চারি পাঁচ ক্রোশ হইবে। 

আমি। তাহা হইলই বা। 

গাড়োয়ান। আমার ওখানে যাইবার ত কথা নাই। 

আমি। নাই থাকিল! 

গাড়োয়ান। তবে কেন যাইব। 

আমি। যদি মজুরি পাও 

গাড়োয়ান। যদি আলাহিদা মজুরি পাই, তাহা হইলে যাইতে পারি। 

আমি। ইহার নিমিত্ত তুমি কত মজুরি চাও? 

গাড়োয়ান। এক টাকার কম লইব না। 

আমি। কম লইতে হইবে না, অধিকই লইও। আমি তোমাকে তোমার স্থিরীকৃত ভাড়া অপেক্ষা আরও দেড় টাকা অধিক প্রদান করিব। 

আমার কথা শুনিয়া গাড়োয়ান আর কোন কথা কহিল না, তাহার গাড়ি ফিরাইয়া লইল। 

আমরা যে দিক হইতে আগমন করিয়াছিলাম, সেইদিকে পুনরায় প্রত্যাগমন করিতে দেখিয়া, ঊষা আমাকে জিজ্ঞাসা করিল “আমরা যে দিকে গমন করিতেছিলাম, সেই দিকে না গিয়া পুনরায় বিপরীত দিকে গমন করিতেছেন যে?” 

আমি। তোমার নিমিত্তই। 

ঊষা। আমার নিমিত্ত কি রূপ? 

আমি। আমি তিনটি উদ্দেশ্য সাধন করিবার মানসে ঐ দিকে গমন করিতেছি। 

ঊষা। তিনটি উদ্দেশ্য কি? 

আমি। আমার প্রথম উদ্দেশ্য- যাহাতে তোমার চরিত্রের উপর কেহ কোনরূপ সন্দেহ করিতে না পারে, তাহার উপায় করা। 

ঊষা। সে উপায় আপনি কিরূপে করিতে সমর্থ হইবেন? 

আমি। কেন! আমি তোমার পিতা বা ভ্রাতা যাঁহাকে হয় তাঁহাকে তোমার এই বিপদের সংবাদ প্রদান করিব।

ঊষা। তাহা হইলে উহারা সহজেই অবগত হইতে পারিবেন যে, আমি কুল পরিত্যাগ করিয়া গৃহের বাহির হইয়া আসিয়াছি। 

আমি। তুমি আজ কয়েক দিবস হইল রাত্রিকালে হঠাৎ তাহাদিগের গৃহ পরিত্যাগ করিয়া আসিয়াছ, ও তোমাদিগের বাড়ীর নিকটবর্ত্তী শরৎ ও তাহার বন্ধু হঠাৎ সেই রাত্রি হইতে নিরুদ্দেশ হইয়াছে, ইহা কি তাঁহাদিগের জানিতে বাকী আছে? না তাহাদিগের উহা বুঝিতে কি বাকী আছে যে, তুমি তাহাদিগের সঙ্গেই কুলপরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছ। তোমার যে কলঙ্ক প্রচারিত হইয়া পড়িয়াছে, সেই কলঙ্কের যদি কোন রূপ এখন অপনোদন করিতে পারি, তাহারই চেষ্টা দেখা আমার সর্ব্বপ্রথম প্রথম কাৰ্য্য। 

ঊষা। কিরূপে আপনি এই ভয়ানক কার্য্য সাধন করিতে সমর্থ হইবেন? 

আমি। কিরূপে যে সমর্থ হইব, তাহা তোমাকে দেখাইতেছি, এই বলিয়া গাড়ির মধ্যস্থিত আমার পোর্টমেন্টটি খুলিয়া তাহার ভিতর হইতে দোয়াত কলম ও কাগজ বাহির করিয়া, সেই গাড়ির মধ্যে বসিয়াই একখানি পত্ৰ লিখিলাম। লেখা শেষ হইয়া গেলে, আমি উহা ঊষার হস্তে প্রদান করিবার মানসে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি লেখাপড়া জান কি?” 

ঊষা। অতি সামান্য বাঙ্গলা জানি। 

আমি। আমার হাতের লেখা পড়িতে সমর্থ হইবে কি? 

ঊষা। পারিলেও পারিতে পারি। 

আমি। তাহা হইলে উহা পাঠ করিয়া দেখ দেখি, আমি তোমার পিতাকে কি লিখিতেছি। 

আমার কথা শুনিয়া, ঊষা আমার লিখিত পত্রখানি আমার নিকট হইতে গ্রহণ করিয়া, উহা নিম্নলিখিতরূপে পাঠ করিল। 

“মহাশয় আপনার সহিত আমার চাক্ষুষ আলাপ না থাকিলেও আমি আপনাকে অবগত আছি। কিন্তু আপনি আমাকে চিনেন কি না, তাহা বলিতে পারি না। আমার নাম এই পত্রের নিম্নে লিখিত আছে। আমি কলিকাতা পুলিসের একজন কর্ম্মচারী। সরকারী কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে আমি কটকে গমন করিয়াছিলাম, প্রত্যাবর্তনকালে আপনার কন্যা শ্রীমতী ঊষাদেবীকে নিতান্ত সহায়-হীনা অবস্থায়। পুরীধামে গমন করিবার রাস্তার উপর প্রাপ্ত হই। তাহাকে যে একাকী এই অবস্থা পাইয়াছি তাহা নহে, আরও কয়েকটি স্ত্রীলোঁক যাহাদিগের সহিত ঊষা গমন করিতেছিলেন, তাঁহাদিগের অবস্থাও ঊষার অবস্থার ন্যায় হইয়াছে। তাহাদিগের আত্মীয়গণের নিকট আমি সংবাদ প্রদান করিলাম। পুরীধাম হইতে একজন উড়িয়া পাণ্ডা কলিকাতায় গমন করিয়া কতকগুলি যাত্রীর সংগ্রহ করিয়া তাহাদিগের সহিত পুরীতে গমন করিবার নিমিত্ত বাহির হন। আপনার কন্যা ঊষাও কিরূপে এই সংবাদ জানিতে পারিয়া, পাছে আপনারা তাহাকে গমন করিতে না দেন, এই ভয়ে আপনাদিগকে কোন কথা না বলিয়া ঐ সকল যাত্রিগণ ও পাণ্ডার সহিত গুপ্তভাবে কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া আসে। আসিবার সময় আপনাদিগের নিকট হইতে কোন অর্থাদি চাহিয়া লইতে সমর্থ হয়েন নাই, সে তাহার অঙ্গে যে সকল অলঙ্কার ও তাহার হস্তে যে কিছু ‘নগদ টাকা ছিল, তাহা লইয়াই চলিয়া আসে। প্রথম প্রথম গাড়ি প্রভৃতি ভাড়া করিয়া আগমন করে, কিন্তু পরিশেষে সকলে একত্রিত হইয়া পদব্রজেই পুরীর রাস্তা ধরিয়া গমন করিতে থাকেন। সেই সময় এক রাত্রিতে তাহারা সকলেই যখন রাস্তার ধারে নিদ্রিতা ছিলেন, সেই সময় দস্যুগণ তাহাদিগের যথাসর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া লইয়া প্রস্থান করে। অপমানের ভয়ে সেই উড়িয়া পাণ্ডাও ঐ স্ত্রীলোকগণকে সহায়-হীনা অবস্থায় সেই স্থানে পরিত্যাগ করিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করে। স্ত্রীলোকগণ নিতান্ত সহায়হীনা অবস্থায় সেইস্থানে পড়িয়া থাকে। উহাদিগের কাহার নিকট এরূপ একটি মাত্র পয়সাও ছিল না যে, তাহার দ্বারা তাহারা অভাব পক্ষে একদিবসও দিন যাপন করে। অপরাপর স্ত্রীলোকগণের একরূপ বন্দোবস্ত হইয়া গিয়াছে, তাহাদিগের সকলকেই প্রায় তাহাদিগের দেশে পাঠাইয়া দেওয়া হইয়াছে, কাহার বা আত্মীয় স্বজনগণ তাহাদিগের অনুসন্ধান করিবার মানসে এই দিকে আসিয়াছিলেন, তাঁহারা তাহাদিগকে লইয়া গিয়াছেন। কেবল এক ঊষা অবশিষ্ট আছে, তাহাকে আমি অতি যত্নে নিজের আত্মীয়ের ন্যায় রাখিয়াছি। আমিও কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিতেছি, তাহাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়া আপনার নিকট পৌঁছিয়া দিব। আর যদি আপনারা কেহ আসিয়া তাহাকে লইয়া যাইতে চাহেন, তাহা হইলে কটকের রাস্তা ধরিয়া আসিবেন। রাস্তায় আমার সহিত সাক্ষাৎ হওয়ার সম্ভাবনা; কারণ আমিও ঐ রাস্তা অবলম্বনে কলিকাতায় গমন করিতেছি। তবে নিতান্ত আস্তে আস্তে যাইতেছি, পাঁচ ছয় ক্রোশের অধিক একদিনে প্রায়ই গমন করিতে পারি না। এইরূপে বিশেষ বিপদগ্রস্ত হইয়াও কিন্তু ঊষার ধর্ম্মভাব এখনও বিলোপিত হয় নাই। তাহার ইচ্ছা, যদি যে অর্থ ও উপযুক্ত আনুসঙ্গি পায়, তাহা হইলে সে এখনও পুরীধামে গমন করিতে প্রস্তুত; কিন্তু তাহাকে সে দিকে যাইতে এখন আমি নিষেধ করিয়া বলিয়া দিয়াছি, তোমার পিতার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া যাহাতে তোমার এই মহাতীর্থ দর্শন হয়, তাহার আমি বন্দোবস্ত করিয়া দিব। আমার কথা শুনিয়া সে তাহাতেই এখন সম্মত হইয়াছে। যদি আপনি ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে আপনি কোন বিশ্বাসী লোককে খরচ পত্রের সহিত কটকের রাস্তা ধরিয়া পাঠাইয়া দিবেন, তিনি ঊষাকে লইয়া প্রত্যাগমন করিবেন। আর যদি কেহ না আইসে, তাহা হইলে আমিই তাহাকে লইয়া গিয়া আপনার নিকট পৌঁছিয়া দিব। আমি এখন শুনিতে পাইতেছি যে, যখন ঊষা ও অপরাপর কয়েকজন যাত্রী কলিকাতা হইতে বহির্গত হন, সেই সময় কলিকাতা হইতে দুই তিন জন লোক তাহাদিগের অনুসরণ করিয়াছিল। বোধ হয়, তাহাদিগের দ্বারা এই কার্য্য সম্পন্ন হইয়াছে। আমি কলিকাতায় গিয়া সে সম্বন্ধে অনুসন্ধান লইব। যদি কলিকাতায় কোন লোকের দ্বারা এই কাৰ্য্য হইয়া তাকে, তাহা হইলে, একটু বিশেষরূপ চেষ্টা করিলেই অনায়াসে অবগত হইতে পারিব যে, উহারা কাহারা ও উহাদিগের দ্বারা এই কার্য সম্পন্ন হইয়াছে কি না। সমস্ত অবস্থা আপনাকে লিখিলাম, আপনার যেরূপ ভাল বিবেচনা হয়, সেইরূপ করিবেন। নিবেদন ইতি। 

শ্রীপ্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় “কটকের রাস্তা।” পত্রখানি পাঠ করিয়া ঊষা কহিল, “এখন আমি জানিতে পারিলাম যে, আমার পিতা মাতার নিকট আমাকে কি বলিতে হইবে, আপনি যে উপায় বাহির করিয়াছেন, তাহাতে আমার বেশ অনুমান হইতেছে যে, আমার চরিত্র সম্বন্ধে কোনরূপ সন্দেহ কাহার মনে উদিত হইবে না। আপনার এই মহৎ কার্য্যের নিমিত্ত আমি যে আপনার কি উপকার করিব, তাহা ভাবিতেও পারি না। যতদিন বাঁচিব, আপনার আজ্ঞানুবর্তিনী হইয়া চলিব।” 

আমি। তোমার চরিত্র যেরূপ, তাহা কেবল আমিই অবগত হইলাম। উহা আমি কাহার নিকট কোনরূপে প্রকাশ করিব না; সুতরাং লোক-সমাজে লোক-লজ্জায় তোমার কোন ভয়ই নাই, তবে এক কথা এই যে, শরৎ ও তাহার সঙ্গী তোমার চরিত্রের বিষয় কেবল জানে। তাহারা যদি তোমার বিরুদ্ধে কোন কথা প্রকাশ করে, তাহা কেহই বিশ্বাস করিবে না। কারণ, তাহারাই যে চোর, তাহাই প্রতিপন্ন করিবার মানসে আমি ঐ পত্রের শেষ ভাগের অংশটুকু লিখিয়াছি। কারণ, আমরা প্রথম হইতেই যাহাদিগকে চোর বলিয়া প্রতিপন্ন করিব, তাহারা পরিশেষে যাহাই বলুক না কেন, সে কথা কেহই বিশ্বাস করিবে না। তোমাকে লইবার নিমিত্ত যদি কেহ আইসে, তাহা হইলে তুমি তাহার সহিত গমন করিও। কোনরূপ ওজর আপত্তি করিও না; কারণ, যাইতে অসম্মত হইলে, পশ্চাৎ তোমার চরিত্রের উপর যদি তাহার কোনরূপ সন্দেহের উদয় হয়! 

ঊষা। আমি আপনাকে পরিত্যাগ করিয়া অপর কাহার সহিত গমন করিব না। 

আমি। আমিও তোমার সহিত কলিকাতায় গমন করিয়া তোমার পিতার সহিত সাক্ষাৎ করিব ও তাঁহাকে সমস্ত অবস্থা উত্তমরূপে বুঝাইয়া বলিব। 

ঊষা। আপনার তিনটি উদ্দেশ্যের প্রথম উদ্দেশ্যটি বুঝিতে পারিলাম। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য কি? 

আমি। শরতের উপর তোমার এখনও অটল বিশ্বাস রহিয়াছে। কিন্তু আমি বেশ বলিতে পারি, ঐ শরতই তোমার ধর্ম্ম ও অর্থ অপহরণ করিয়াছে। তথাপি তোমার বিশ্বাস জন্মাইবার নিমিত্ত আমি ঐ প্রদেশে একবার তাহার অনুসন্ধান করিব। দেখিব, তাহাকে কোন স্থানে পাওয়া যায় কি না; যদি সে কোনরূপ বিপদাপন্ন হইয়া থাকে, তাহা হইলে তাহাদিগকে অনায়াসেই পাইব। তাহা না হইতে তখন তুমি জানিতে পারিবে যে, আমার অনুমান সত্য কি না। 

ঊষা। আপনার তৃতীয় উদ্দেশ্য? 

আমি। আমার তৃতীয় উদ্দেশ্য এই যে, তোমার অলঙ্কার পত্র যে ব্যক্তি অপহরণ করিয়াছে, তাহার অনুসন্ধানের চেষ্টা ও বন্দোবস্ত করা। 

ঊষা। আমি আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কথা বলিতে পারি না, বিশেষ আমি স্ত্রীলোক। এক কথায় সমস্ত ভুলিয়া যাই, নতুবা আমার দশা এইরূপ হইবে কেন? আপনি যাহা ভাল বিবেচনা করেন, তাহাই করুন। আপনি আমাকে যখন যে আদেশ প্রদান করিবেন, আমি তখনই তাহাই সম্পন্ন করিতে প্রস্তুত আছি। 

আমি। তাহা ত এখন দেখিতে পাইতেছি, কিন্তু ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না, তোমার মনের ভাব ঠিক কি প্রকার। দুই চারি দিবস একত্রে অতিবাহিত হইলেই বোধ হয়, তোমার মনের ভাব অনেকটা আমি বুঝিয়া লইতে পারিব। সমস্ত বুঝিয়া উঠা আমার কার্য নহে; কারণ স্ত্রীলোকের মনের ভাব ও মনের কথা সহজে বুঝিয়া উঠিতে পারে, এরূপ পুরুষ এই জগতে কেহ আছে কি না সন্দেহ। 

ঊষা। আপনি আমাকে যাহাই ভাবুন, বা আমার উপর যেরূপ বিশ্বাসই করুন, আমি কিন্তু আপনার নিকট কোন কথা গোপন করি নাই, কখন করিবও না, বা কোনরূপেই আপনার আজ্ঞা আমি কখনই লঙ্ঘন করিব না। ইহাতে আমার অদৃষ্টে যাহা হয় হউক, তাহাতে আমি কোনরূপে দৃপাতও করিব না। 

আমাদিগের মধ্যে এইরূপ কথাবার্তা হইতে লাগিল, গাড়ী ক্রমে বিপরীত দিকে চলিতে লাগিল, আমিও সেই গাড়ির ভিতর পূর্ব্ববর্ণিত ভাবে শয়ন করিলাম। ঊষা আমার পায়ের নিকট বসিয়া রহিল। এখন আর আমাকে দেখিয়া তাহার আর কোনরূপ লজ্জা সরম রহিল না। 

[অগ্রহায়ণ, ১৩০৮] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *