খুনী কে?
প্রথম পরিচ্ছেদ
গ্রীষ্মকাল। বেলা প্রায় ছটা বাজিতে চলিল, তবুও রৌদ্রের উত্তাপ কমিল না। গরমের ভয়ে এতক্ষণ অফিস- ঘরের জানালাগুলি বন্ধ করিয়া রাখিয়াছিলাম, বেলা শেষ হইতেছে দেখিয়া, একে একে সকলগুলিই খুলিয়া দিয়া যেমন বসিতে যাইব, অমনি টুং টুং করিয়া টেলিফোঁর ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল।
ঘণ্টার শব্দ শুনিয়াই মনে করিলাম, সাহেবের ডাক পড়িয়াছে। তাড়াতাড়ি যন্ত্রের নিকট যাইলাম। যাহা শুনিলাম, তাহাতে আমার ধারণাই সত্য হইল।
সাহেব ডাকিয়াছেন, নিশ্চয়ই কোন হুকুম আছে। মনিবের হুকুম, আর দেরি করিতে পারিলাম না। তখনই সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত গমন করিলাম।
সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ হইলে, তিনি একখানি কাগজ আমার হাতে দিয়া কহিলেন, “এইটি পড়িয়া দেখ।” আমি উহার আগাগোড়া পড়িলে পর, তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই ঘটনা কি তুমি পূর্ব্বে শুনিয়াছ?”
আমি সসম্ভ্রমে উত্তর করিলাম, “আজ্ঞা হাঁ, শুনিয়াছি।”
সা। আমি এখন তোমার হাতে উহার অনুসন্ধানের ভার দিতেছি, ইহার প্রকৃত অবস্থা কি, তাহা বাহির করিতে হইবে।
আমার হাতে একটি কাজ ছিল। আবার সাহেবের হুকুম একেবারে অমান্য করিতেও সাহস করিলাম না। মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে বলিলাম, “আমার হাতে —”
আমার কথায় বাধা দিয়া সাহেব সহাস্যবদনে বলিলেন, “তোমার হাতে যে কাজ আছে, তাহাতে দুই চারি দিন বিলম্ব হইলেও ক্ষতি হইবে না। তুমি অগ্রে এই কার্য্যে প্রবৃত্ত হও এবং যত শীঘ্র পার, এই কাজ শেষ করিতে চেষ্টা কর।”
সাহেবের কথায় মনে বড় দুঃখ হইল। ভাবিলাম, লোকে যে বলে, চাকরে আর কুকুরে কোন প্রভেদ নাই, তাহা সম্পূর্ণ সত্য। যখন চাকরের কার্য্য স্বীকার করিয়াছি, তখন আর দুঃখ করিলে চলিবে কেন। সাহেবের নিকট বিদায় লইয়া, এই নূতন কার্য্যের অনুসন্ধানের নিমিত্ত প্রস্থান করিলাম।
সাহেব-প্রদত্ত কাগজখানি পাঠ করিয়া যাহা আমি অবগত হইতে পারিয়াছিলাম, তাহার একটু আভায এইস্থানে প্রদান করিতেছি।
সহরতলীর এক স্থানের একজন আধুনিক জমিদারের নাম কেশবচন্দ্র দত্ত। এই কেশববাবুর এক প্রজা সেদিন খুন হইয়াছে। প্রজার নাম দামোদর ঘোষ। দামোদরের একমাত্র পুত্র এখনও বর্তমান, তাঁহার নাম যতীন্দ্র। স্থানীয় পুলিসের বিশ্বাস, যতীন্দ্রই পিতৃহত্যা করিয়াছেন। সুতরাং তিনি ধৃত হইয়াছেন। জমিদার মহাশয়ের সহিত দামোদরের বন্ধুত্ব থাকায় তিনি দামোদরকে কয়েক বিঘা জমি দান করিয়াছিলেন। কেশববাবু তাহার জন্য কোনরূপ খাজনা লইতেন না। কেশববাবুর একমাত্র কন্যা বর্ত্তমান, নাম অমলা। উভয়েরই স্ত্রী নাই। তাঁহার বাড়ী হইতে প্রায় এক মাইল দূরে একটি বিস্তৃত জলা আছে। দামোদর মধ্যে মধ্যে সেখানে পক্ষী শীকার করিতে যাইতেন। গত জ্যৈষ্ঠ মাসের তো তারিখে বেলা প্রায় তিন ঘটিকার সময়, দামোদর শীকার করিবার অভিপ্রায়ে সেই জলাতীরে উপস্থিত হন। সেই অবধি তিনি আর বাড়ীতে ফিরিয়া যান নাই। কিন্তু তাঁহার মৃতদেহ সেই জলার ধারেই পাওয়া যায়। অনুসন্ধানে দুইজন সাক্ষী স্থানীয় পুলিস পাইয়াছেন। তাহাদিগের একজন জমীদার মহাশয়ের ভৃত্য অপর একজন প্ৰজা।
ভৃত্য বলে যে, সে দামোদরকে মাঠ দিয়া বেলা তিনটার কিছু পূর্ব্বে যাইতে দেখিয়াছিল। দামোদরের যাইবার পরেই তাঁহার পুত্র যতীন্দ্র তাঁহার অনুসরণ করেন। কিন্তু ভৃত্যের মনে কোন সন্দেহ না হওয়ায় সে তাঁহাদিগকে আর লক্ষ্য করে নাই।
প্রজা কহে, যখন সে সেই জলার ধার দিয়া বাড়ী ফিরিতেছিল, সে পিতাকে পুত্রের সহিত বিবাদ করিতে দেখিতে পায়। কিন্তু সেও আর অধিক কোন কথা বলিতে পারে না।
পুলিস যখন যতীন্দ্রনাথকে গ্রেপ্তার করে, তখন তিনি বলিয়াছেন যে, তিনি পুলিসের কার্য্যে কিছুমাত্র আশ্চর্য্য হন নাই। পুলিস যে তাঁহাকেই হত্যাকারী বলিয়া গ্রেপ্তার করিবে, ইহা তিনি জানিতেন।
তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি গম্ভীরভাবে একবার উপর দিকে চাহিয়া, মস্তক অবনত করিলেন ও পরে বলিলেন, “যিনি খুন হইয়াছেন, আমি তাঁহারই একমাত্র পুত্র। বাবা যে দিন খুন হন, আমি তাহার পূর্ব্বের তিন দিন বাড়ীতে ছিলাম না। বিশেষ কোন কার্য্যের জন্য আমায় কলিকাতায় যাইতে হইয়াছিল। সোমবার প্রাতে আমি কলিকাতা ত্যাগ করি। যখন আমি বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম, তখন বাবা বাড়ীতে ছিলেন না। শুনিলাম, তিনি তখনই পাখী শীকারে গিয়াছেন। বাবা শীকার করিতে বড় ভালবাসিতেন। আমি জানিতাম যে, তিনি জলার ধারেই শীকার করেন। সুতরাং আমিও বাহির হইলাম, পথে আমাদের এক চাকরের সহিত দেখা হইল। সে আমায় নমস্কার করিল। কিন্তু সে যে বাবাকে আমার খানিক আগেই যাইতে দেখিয়াছে, সে কথা কিছু বলিল না। জলার নিকটে পৌঁছিয়া আমি বাবাকে দেখিতে পাইলাম। তাঁহার নিকটে যাইলাম। আমাকে হঠাৎ সেখানে দেখিয়া বাবার রাগ হইল। তিনি বিনা কারণে আমায় কতকগুলি তিরস্কার করিলেন। আমারও রাগ হইল। আমিও তাঁহাকে দুই চারিটি কথা বলিলাম। ইহাতে তিনি আরও ক্রোধান্ধ হইয়া, আমাকে মারিবার নিমিত্ত বন্দুক তুলিলেন। আমি পলায়ন করিলাম। জলা হইতে প্রায় অর্দ্ধক্রোশ দূরে আমাদের এক প্রজা আছে। আমি তাহারই বাড়ীতে যাইবার ইচ্ছা করিয়াছিলাম কিন্তু কিছুদুর যাইতে না যাইতে পশ্চাতে এক ভয়ানক চীৎকার ধ্বনি শুনিতে পাইলাম। কণ্ঠস্বর বাবার বলিয়া বোধ হইল। আমি আর অগ্রসর হইতে পারিলাম না; দৌড়িয়া পুনরায় জলার ধারে উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, বাবার মাথার খুলি ফাটিয়া গিয়াছে। সর্ব্বাঙ্গ রক্তাক্ত। মাথা হইতে তখনও ভয়ানক রক্ত ঝরিতেছে। আমি পিতার নিকট যাইলাম। তাঁহাকে আস্তে আস্তে তুলিয়া কোলে লইলাম! যত পারিলাম, রক্ত মুছাইলাম। তিনি তখনও জীবিত। কিন্তু মৃত্যুর আর বেশী বিলম্ব ছিল না। দুই একটি কথা কহিয়া তিনি একবার দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন। পরক্ষণেই তাঁহার প্রাণবায়ু দেহ হইতে -বহির্গত হইল।
মরিবার পূর্ব্বে তিনি অনেক কথা বলিবার চেষ্টা করেন, কিন্তু আমি তাঁহার কোন কথা বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই। তিনি সৰ্ব্বশেষে “আম্ সদ্দা” এইরূপ একটি কথা বলিয়া মরিয়া যান। ইহার পূর্ব্বে আর যে দুই একবার কথা কহিয়াছিলেন, তাহা এত অস্পষ্ট ও এত মৃদু যে আমি তাহার কিছুই বুঝিতে পারি নাই। “আম্ সদ্দা” এই কথাটার কোন অর্থ নাই। আমিও উহার কিছুই বুঝিতে পারি নাই। মনে করিয়াছিলাম, তিনি ভুল বকিতেছেন। যে বিষয় লইয়া আমাদিগের পিতাপুত্রের বিবাদ হয়, সে কথা বলিতে আমি ইচ্ছা করি না। তবে ঐ কথার সহিত এই খুনের কোন সম্বন্ধ নাই, একথা আমি শপথ করিয়া বলিতে পারি।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
যে থানার এলাকায় এই ঘটনা ঘটিয়াছিল, আমি সেই থানায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। গাড়ী হইতে নামিয়াই দারোগা লালমোহনবাবুর সহিত সাক্ষাৎ হইল। তিনি আমাদের জন্যই অপেক্ষা করিতেছিলেন। আমাকে দেখিয়া তিনি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইলেন। বলিলেন, “আপনি যে এই অনুসন্ধানে আসিবেন, তাহা আমি জানিতাম। লালমোহনবাবু আমার পরিচিত। তাঁহার বয়স ছাব্বিশ বৎসরের অধিক হইবে না। কিন্তু এই বয়সেই তিনি একজন বিখ্যাত দারোগা হইয়াছেন। তাঁহাকে দেখিতে শ্যামবর্ণ হইলেও সুপুরষ বলিতে হইবে। তিনি অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও কার্যক্ষম।
লালমোহনবাবুর নিকট হইতে এই খুনি মোকদ্দমার সমস্ত অবস্থা যাহা তিনি এ পর্যন্ত অবগত হইতে পারিয়াছেন, তাহা শ্রবণ করিলাম ও সেই ঘটনার স্থল পরীক্ষার জন্য বাহির হইবার উদ্যোগ করিতেছি, এমন সময়ে, থানার দ্বারে একখানি গাড়ী আসিল।
একটি ভদ্র যুবক সেই গাড়ী হইতে অবতরণ করিলেন এবং থানার ভিতর প্রবেশ করিয়া লালমোহনের নিকট আগমন করিলেন। লালমোহন তাঁহাকে দেখিয়াই বলিয়া উঠিলেন, “এই যে আপনিও আসিয়াছেন! ভালই হইয়াছে।
যুবকের বয়স পঁচিশ বৎসরের অধিক হইবে না। তাঁহাকে দেখিতে গৌরবর্ণ, পুষ্টকায়, বলিষ্ঠ ও কার্যক্ষম। যৌবন- সুলভ-চপলতা তাঁহাতে দেখিতে পাই নাই। এ বয়সে তাঁহার ধীর ও প্রশান্ত মূৰ্ত্তি দেখিয়া আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। চারি চক্ষুর মিলন হইলে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “মহাশয় কি আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছেন? আপনার নাম?”
যুবক ঈষৎ হাস্য করিয়া বলিলেন, “আজ্ঞা হাঁ, আমি আপনারই নিকট আসিয়াছি। শুনিলাম, আপনি এখানে আসিয়াছেন। সেই জন্য একেবারে থানায় আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। আমার নাম ভবানীপ্রসাদ, পিতৃহত্যাপরাধে যিনি অন্যায়রূপে বন্দী হইয়াছেন, আমি তাঁহারই এক বন্ধু। আপনার সহিত গোপনে আমার অনেক কথা আছে।
শুনিয়াছি, আপনি একজন প্রসিদ্ধ গোয়েন্দা। লোকমুখে আপনার যথেষ্ট সুখ্যাতি শুনিয়া আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনিই আমার বন্ধুকে মুক্ত করিতে পারিবেন।”
ভবানীপ্রসাদের মুখে সকল কথা শুনিবার ইচ্ছা হইল। আমি ভবানীপ্রসাদকে অফিস-ঘরে ডাকিয়া আনিলাম। লালমোহনও আমাদের সহিত আসিলেন।
সকলে অফিসের টেবিলের চারিদিকে চেয়ারে ও বেঞ্চের উপর উপবেশন করিলে ভবানীপ্রসাদ আমাকে বলিলেন, “মহাশয়! যে লোক একদিন একটি পায়রার ছানা মরিয়া যাওয়ায় কাঁদিয়া ফেলিয়াছিল, তাহাকে কি আপনি পিতৃঘাতী বলিয়া সন্দেহ করিতে পারেন? আমি ঈশ্বরের শপথ করিয়া বলিতে পারি, আমি স্বচক্ষে তাহাকে কাঁদিতে দেখিয়াছি। এখন আপনি একমাত্র ভরসা। আপনি কি আমার বন্ধুকে মুক্ত করিতে পারিবেন না?”
আমি ভবানীপ্রসাদের কথায় মুগ্ধ হইলাম। বন্ধুর জন্য লোকে আজকাল যে এতটা করে, আমার বিশ্বাস ছিল না। আমি বলিলাম, “যথাসাধ্য চেষ্টা করিব, ফল ভগবানের হাতে। তবে আপনার বন্ধু যদি নিষ্পাপ হন, তাহা হইলে তিনি নিশ্চয়ই মুক্তি লাভ করিবেন।”
ভ। আপনি অবশ্যই এই বিষয় সমস্ত শুনিয়াছেন। আপনার কি বোধ হয়? আমার বন্ধুর মুক্তির কি কোন উপায় আছে? আপনি নিজে তাহাকে নির্দোষী বলিয়া মনে করেন না কি?
আ। সম্ভব?
আমার কথা শুনিবামাত্র ভবানীপ্রসাদ লালমোহনের দিকে চাহিয়া বলিয়া উঠিলেন, “দেখিলেন মহাশয়, আপনি ত আমায় একেবারেই হতাশ করিয়াছিলেন।”
লালমোহন আশ্চৰ্য্য হইয়া আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন। পরে বলিলেন, “আমার বিশ্বাস, উনি কিছু তাড়াতাড়ি নিজের মত প্রকাশ করিয়া ফেলিয়াছেন।”
আমি হাসিয়া উঠিলাম। ভবানীপ্রসাদ বলিয়া উঠিলেন, “উনিই সত্য বলিয়াছেন। আমি জানি, সে নিদোষী।” আমি সে কথা চাপা দিয়া ভবানীপ্রসাদকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার সহিত যতীন্দ্রনাথের কি কোন সম্পর্ক আছে?”
ভ। আজ্ঞা আছে;—যতীন আমার জ্ঞাতি ভাই।
আ। কি রকম জ্ঞাতি ভাই?
ভ। যতীনের পিতা ও আমার পিতা পরস্পরের খুড়তত ভাই।
আ। আপনার এখন নিবাস কোথায়?
ভ। যতীনের বাড়ীর পার্শ্বেই।
আ। শুনিলাম, যতীন্দ্রনাথ একটি প্রশ্নের উত্তর করিতে অস্বীকার করিয়াছিলেন। আপনি সেই বিষয়ের কি কোন সংবাদ রাখেন? যতীন্দ্রনাথের সহিত তাঁহার পিতার কোন্ বিষয় লইয়া বিবাদ হইয়াছিল জানেন? যতীন্দ্রনাথ স্বয়ং এ প্রশ্নের উত্তরই বা কেন করেন নাই, বলিতে পারেন?
ভ। আজ্ঞা হাঁপারি; কিন্তু যে কথা যতীন স্বয়ং প্রকাশ করিতে ইচ্ছা করে না, সেই কথা আমি জানিলেও সকলের সমক্ষে বলিতে পারিব না।
আমি দারোগাবাবুকে দেখাইয়া বলিলাম, “লালমোহনবাবু ত এখানকার দারোগা। যাহা কিছু বলিবেন, উঁহার সমক্ষে বলিতেই হইবে। এখানে আর কেহ নাই। আপনি স্বচ্ছন্দে বলিতে পারেন।”
আমার কথা শুনিয়া ভবানীপ্রসাদ বলিলেন, “যতীনের পিতার আন্তরিক ইচ্ছা এই ছিল যে, তিনি জমীদারের একমাত্র কন্যাকে যতীনের সহিত বিবাহ দেন, যতীন তাহাতে সম্মত ছিল না। এই মতভেদই বিবাদের একমাত্র কারণ। পাছে অমলার নাম পুলিসে প্রকাশ করিতে হয়, এই ভয়ে যতীন সে কথা বলে নাই।”
আমি কিছু বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “অমলার পিতা কি এই বিবাহে সম্মত ছিলেন?”
ভ। আজ্ঞা না।
আ। তবে যতীন্দ্রনাথের পিতা ঐ স্থানে পুত্রের বিবাহ দিতে ইচ্ছা করিলে কি হইবে? তাঁহার এরূপ অন্যায় প্রস্তাবের কারণ কি জানেন?
ভ। কারণ কি জানি না, তবে, তিনি জমীদারকে যাহা বলিতেন, তিনি তাহা না করিয়া থাকিতে পারিতেন না।
আ। ইহার কারণ কি?
ভ। সে কথা বলিতে পারিলাম না। দামোদরবাবুকে জমীদার মহাশয় যথেষ্ট অনুগ্রহ করিতেন।
আ। অনুগ্রহ করিতেন বলিয়া নিজের কন্যা দান করিবেন, এ বড় আশ্চৰ্য্য কথা!
ভবানীপ্রসাদ উত্তর করিলেন, “জানি না, কেন তিনি জমীদার মহাশয়কে যাহা বলিতেন, জমীদার মহাশয় তাহা করিতে বাধ্য হইতেন।”
আ। কেশববাবু বাড়ীতেই আছেন ত?
ভ। আজ্ঞা হাঁ। তিনি নড়িতে পারেন না। তাঁহার শরীর পূর্ব্ব হইতেই ভাঙ্গিয়া ছিল, সম্প্রতি বোধ হয় প্রিয়বন্ধুর মৃত্যুতে একেবারে শয্যাগত হইয়াছেন। ডাক্তারেরা কাহাকেও নিকটে যাইতে দিতেছেন না।
আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া বলিলাম, “বটে! বন্ধুর মৃত্যু সংবাদে তাঁহার এমন অবস্থা হইয়াছে? ভাল, যতীন্দ্রনাথের সহিত দেখা করিতে বোধ হয় বাধা নাই।”
লালমোহন আমার কথায় হাসিয়া উত্তর করিলেন, “না—যখনই বলিবেন, তখনই আমি আপনাকে সেখানে লইয়া যাইব।”
ভবানীপ্রসাদ তখন তাঁহার বন্ধুর মুক্তির জন্য আমায় বারম্বার অনুরোধ করিয়া থানা হইতে বাহির হইলেন।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
ভবানীপ্রসাদ প্রস্থান করিলে পর, লালমোহন আমার দিকে চাহিয়া ঈষৎ হাস্য করিলেন। বলিলেন, “এমন করিয়া লোককে বৃথা আশা দেওয়া আপনার ন্যায় জ্ঞানবান্ ব্যক্তির উচিত হয় নাই। আপনি যখন স্পষ্টই দেখিতেছেন যে, যতীন্দ্রনাথই দোষী, এবং তাঁহার আর অব্যাহতির উপায় নাই, তখন তাঁহার একজন প্রিয় বন্ধু ও আত্মীয়কে সান্ত্বনা দিবার জন্য মিথ্যা বলা ভাল হইয়াছে কি?”
লালমোহনের কথা শুনিয়া আমার বড় রাগ হইল। কিন্তু তাহা প্রকাশ না করিয়া হাসিতে হাসিতে জিজ্ঞাসা করিলাম, “কে বলিল, আমি যতীন্দ্রনাথকে দোষী বলিয়া সাব্যস্ত করিয়াছি? যদি তাহাই করিব, তবে আর এতদূরে কি করিতে আসিয়াছি? আমি তাঁহার মুক্তির উপায় দেখিতে পাইয়াছি এবং আশা করি, শীঘ্রই তাঁহাকে মুক্ত করিব। এখন আমাকে একবার তাঁহার সহিত দেখা করাইয়া দিউন।”
যতীন্দ্রনাথ থানাতেই ছিলেন, তাঁহাকেও ঐ অফিসের মধ্যে আনাইয়া অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। তখন লালমোহনবাবু অফিসঘরে ছিলেন না। তাঁহার অসাক্ষাতে যদি কোন নূতন কথা আমাকে বলে, এই বিবেচনা করিয়া, লালমোহনবাবুকে সেই সময় একটু বাহিরে থাকিতে বলিয়াছিলাম, কিন্তু তাঁহার নিকট হইতে আর অধিক কিছু শুনিতে পাই নাই। তিনি যেরূপ পূর্ব্বে বলিয়াছিলেন, এখনও সেইরূপ বলিলেন। আমি এক-একবার মনে করিতাম, তিনি বোধ হয় হত্যাকারীকে জানে এবং তাহাকে গোপন করিবার চেষ্টায় আছেন। কিন্তু তাঁহার কথা শুনিয়া আমার সে ভ্রম দূর হইল। ইহার কিছুক্ষণ পরে লালমোহনবাবু আসিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “যতীন্দ্রনাথ অমন সুন্দরী জমীদার-কন্যাকে বিবাহ করিতে অসম্মত কেন, জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন?”
আ। হাঁ—তাঁহার অস্বীকারের বিশেষ কারণ আছে।
লা। কি?
আ। যতীন্দ্রনাথ কলিকাতার কোন দরিদ্রের রূপসী কন্যার রূপে মুগ্ধ হইয়া তাহাকে বিবাহ করিতে প্রতিশ্রুত হইয়াছেন।
লা। অমলাও ত বেশ সুন্দরী শুনিয়াছি?
আমি হাসিয়া বলিলাম, “সুন্দরী সকলেই। যে যাহার চক্ষে যেমনটি দেখায়। তোমার চক্ষে তোমার স্ত্রী যেমন সুন্দরী তেমনটি কি আর কেহ হইতে পারিবে?”
লা। সে কথা যাউক, এখন আমাকে কি করিতে হইবে বলুন?
আ। ডাক্তারের পোষ্ট মরটমের রিপোর্ট পাইয়াছেন কি?
লা। পাইয়াছি।
আ। সেখানি কোথায়?
লা। আমার নিকটই আছে। এই বলিয়া কাগজখানি বাক্সের মধ্যে হইতে বাহির করিয়া আমার হস্তে প্রদান করিলেন। উহা পড়িয়া আমি বুঝিতে পারিলাম, দামোদরের মাথার খুলির যে অংশে ফাটিয়া গিয়াছে, তাহাতে বোধ হয়, কোন লোক পশ্চাৎ হইতে আসিয়া দামোদরকে আঘাত করিয়াছিল।
লালমোহনবাবু পরিশেষে আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “যদি বাস্তবিকই যতীন্দ্রনাথ কাহাকেও বিবাহ করিতে অস্বীকার করিয়া থাকেন, তবে তিনি সে কথা তাঁহার পিতাকে বলেন নাই কেন?”
আ। সে কথা তাঁহার পিতা জানিতে পারিলে তাঁহাকে বাটী হইতে দূর করিয়া দিতেন।
লা। এখন আপনি কি মনে করেন? যতীন্দ্র দোষী কি না?
আ। আমার বিশ্বাস নির্দোষী।
লা। তবে দামোদরকে কে হত্যা করিল? খুনী কে?
আ। সেইটিই ত বিষম সমস্যা।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
পরদিন বেলা আটটার পর লালমোহনকে লইয়া জলার ধারে যাইতে মনস্থ করিলাম। থানা হইতে সেই জলা অধিক দূর নহে। আকাশ মেঘশূন্য, ঝড়বৃষ্টির কোন সম্ভাবনা ছিল না, সুতরাং আমরা পদব্রজেই যাইতে লাগিলাম।
অতি সঙ্কীর্ণ পথ। পথের দুই ধারে বিস্তৃত মাঠ। কৃষকগণ কার্য্যে ব্যস্ত। কেহ লাঙ্গল দিতেছে, কেহ বা বৃক্ষ রোপণ করিতেছে; কেহ আবার গরুর পাল লইয়া কোন প্রকাণ্ড বৃক্ষের ছায়ায় আশ্রয় লইতেছে। এখন প্রায়ই সহরে থাকা যায়; ঘর, বাড়ী, কাষ্ঠই আমাদের দৃষ্টিগোচর হইয়া থাকে। সুতরাং প্রভাতের এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখিয়া, আর মনে কেমন এক অভূতপূর্ব্ব আনন্দের উদয় হইল — বাল্যকালের কথা মনে পড়িল।
কিছুদূর যাইলে পর, লালমোহন বলিয়া উঠিলেন, “আজ প্রাতে এক নূতন খবর পাইলাম।”
আমার কৌতূহল জন্মিল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি সংবাদ লালমোহনবাবু?”
লা। জমীদার মহাশয় বাঁচেন কি না?
আ। সে কি! কাল রাত্রে ত সেরূপ কোন সাংঘাতিক পীড়ার কথা শুনি নাই!
লা। না শুনিলেও তাঁহার জীবনের আর কোন আশা নাই।
আ। তাঁহার বয়স কত?
লা। ষাট বৎসর হইবে।
আ। কদিন তিনি এখানকার জমীদার হইয়াছেন?
লা। অধিক দিন নহে। এখানকার পূর্ব্বে জমীদারের অবস্থা নিতান্ত মন্দ হওয়ায়, এবং তাঁহার কোন উত্তরাধিকারী না থাকায় তিনি এই জমীদারী বিক্রয় করেন। কেশববাবুই উহা ক্রয় করেন এবং সেই অবধি তিনি এখানকার জমীদার হইয়াছেন।
আ। সে কতদিনের কথা?
লা। ঠিক বলিতে পারিলাম না। শুনিয়াছি, প্রায় পনের ষোল বৎসর পূর্ব্বে কেশববাবু এই জমীদারী ক্রয় করেন।
আ। কেশবচন্দ্র আগে কোথায় ছিলেন, বলিতে পারেন?
লা। শুনিয়াছি—কলিকাতায়।
আ। তাঁহার আসিবার কত পরে দামোদর এখানে আসেন?
লা। প্রায় এক বৎসর পরে।
আ। তিনিই বা পূর্ব্বে কোথায় বাস করিতেন?
লা। শুনিয়াছি, তিনিও কলিকাতায় থাকিতেন। কেশববাবুর সহিত তাঁহার বহুদিনের আলাপ। যখন কলিকাতায় বাস করিতেন, তখন তিনি না কি কেশববাবুর অনেক উপকার করিয়াছিলেন।
আ। সত্য না কি? সেই জন্যই বুঝি, কেশববাবু দামোদরকে নিষ্কর ভূমি বাস করিতে দিয়াছেন এবং অনেক বিষয়ে সাহায্য করিয়া থাকেন?
লা। আজ্ঞা হাঁ। কেশববাবু এতদিন নানা প্রকারে দামোদরের উপকার করিয়া আসিতেছিলেন।
আ। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, দামোদর কেশববাবুর নিকট হইতে এত উপকার পাইয়াও তাঁহার কন্যাকে আপন পুত্রের সহিত বিবাহ দিতে ইচ্ছা করেন। আরও আশ্চর্য্য, জমীদার মহাশয় স্বয়ং দামোদর-পুত্রকে আপনার কন্যাদান করিতে সম্মত নন। দামোদরের এমন কি ক্ষমতা যে, তিনি কেশববাবুর অমতে তাঁহার কন্যার সহিত আপন পুত্রের বিবাহ দেন। ইহার মধ্যে নিশ্চয়ই কোন রহস্য আছে। আপনি কি কিছু বুঝিতে পারিয়াছেন?
লা। কই, বিশেষ কিছু বুঝিতে পারি নাই।
আমি হাসিয়া উত্তর করিলাম, “ব্যাপারটি নিতান্ত সহজ নহে। বাহ্যিক সহজ দেখিলেও এ রহস্য জটিল।” লা। সহজই হউক আর জটিলই হউক, আমি যাহা অনুমান করিয়াছি, ভবিষ্যতে তাহাই সত্য হইবে।
আ। আপনি কি অনুমান করিয়াছেন?
লা। যতীন্দ্রনাথই হত্যাকারী।
আ। আমার ত সেরূপ বোধ হয় না। এখন সে কথা যাউক; এই সম্মুখেই বোধ হয় সেই জলা, কেমন লালমোহনবাবু?
কথায় কথায় আমরা জলার ধারে উপস্থিত হইলাম। আমি তখন লালমোহনকে সকল স্থানগুলি দেখাইয়া দিতে বলিলাম। লালমোহন আমাকে সঙ্গে লইয়া যেখানে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, যেখানে পিতাপুত্রে বিবাদ হইয়াছিল, যেখানে পুত্র পিতাকে কোলে লইয়া বসিয়াছিল, সেই সকল স্থান একে একে দেখাইয়া দিলেন।
আমি একে একে সমস্ত স্থানগুলি উত্তমরূপে পরীক্ষা করিলাম। জলার ধার দিয়া অনেক দূর গমন করিলাম। পরে সেখান হইতে ফিরিয়া যে স্থানে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, সেইখানে উপস্থিত হইলাম।
দেখিলাম, জলার চারিধারই ভিজা, সেই ভিজামাটীতে অনেকগুলি পায়ের দাগ দেখিতে পাইলাম। আমি কখনও দাঁড়াইয়া কখনও বসিয়া, কখনও বা হামাগুড়ি দিয়া, সেই সকল পদচিহ্ন পরীক্ষা করিতে লাগিলাম। লালমোহন ও আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিতেছিলেন। কিন্তু আমি তাহাদের গতিবিধি লক্ষ্য করিবার অবসর পাই নাই।
কিছুকাল এইরূপ পরীক্ষা করিয়া আমি লালমোহনকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “সে দিন আপনি জলার ভিতরে গিয়াছিলেন কি জন্য?”
লালমোহন আমার কথায় আশ্চর্যান্বিত হইয়া বলিলেন, “ভাবিয়াছিলাম, হয়ত হত্যাকারী জলার ভিতরেই কোন অস্ত্র নিক্ষেপ করিয়া থাকিবে।”
আ। কোন অস্ত্র পাইয়াছিলেন কি?
লা। না-কিন্তু আপনি ত সেদিন উপস্থিত ছিলেন না? আমিও আপনাকে এ বিষয়ে কোন কথা বলি নাই। তবে আপনি জানিতে পারিলেন কিরূপে?
আ। সে কথা বলিবার এখন সময় নয়। আপনার পদচিহ্ন দেখিয়া আমি কেন, সকলেই এ কথা বলিতে পারেন। এই দেখুন, এইগুলি যতীন্দ্রনাথের পায়ের দাগ। তিনি এখান দিয়া যে যাতায়াত করিয়াছিলেন, তাহা এই পায়ের দাগ দেখিয়াই বুঝিতে পারা যায়। আবার যে সময় আপনি তাহাকে সঙ্গে লইয়া এখানে আসিয়াছিলেন ও যে যে স্থান তিনি আপনাকে দেখাইয়া দিয়াছেন, তাহাও পদচিহ্ন দেখিয়া বেশ বুঝিতে পারা যাইতেছে। এই দেখুন, এইখানে দামোদরের দেহ প্রথমে মাটীতে পড়ে। এইখানে দেখুন, দামোদর পদচারণা করিয়াছিলেন। সম্ভবতঃ যখন পিতাপুত্রের বিবাদ হয় তখন দামোদর ক্রোধে উন্মত্ত হইয়া ইতস্ততঃ বেড়াইয়াছিলেন। আর এইটি কি দেখুন দেখি, এই দাগটি কিসের বলিয়া বোধ হয়?
লালমোহন অনেকক্ষণ চিন্তা করিলেন। কিন্তু কিছুই বলিতে পারিলেন না। তিনি অপ্রতিভ হইয়া আমার দিকে চাহিয়া রহিলেন। আমি বলিলাম, “এইখানে বন্দুকের উপর ভর দিয়া দামোদর দাঁড়াইয়া ছিলেন। বন্দুকের তলাটা মাটীতে কতখানি বসিয়া গিয়াছে দেখিয়াছেন?”
এইরূপ দেখিতে দেখিতে সহসা আর কতকগুলি চিহ্ন আমার নয়নপথে পতিত হইল। আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া বলিয়া উঠিলাম, “এগুলি কিসের দাগ? নিশ্চয়ই কোন লোক ধীরে ধীরে এদিকে আসিয়াছিলেন। এই যে তিনি আবার প্রস্থান করিয়াছেন। এই দাগগুলি কতদূর আছে একবার দেখিতে হইল।”
এই বলিয়া আমি সেই দাগ দেখিতে দেখিতে অগ্রসর হইলাম। অবশেষে নিকটস্থ মাঠে উপস্থিত হইলাম। সে মাঠজমি ভিজা ছিল না। সুতরাং আর কোন পদচিহ্ন দেখিতে পাইলাম না। আমি তখন জলার ধারে আসিলাম। লালমোহনকে কহিলাম, “মৃতদেহ পাইবার পর, এই স্থান আপনার দ্বারা মাড়ামাড়ি হইয়াছে, তাহা না হইলে এই স্থান হইতেই এই মোকদ্দমার কিনারা হইয়া যাইত।”
লালমোহনকে পুনর্ব্বার কহিলাম, “এখন একবার সেই সাক্ষী প্রজার সহিত দেখা করিতে ইচ্ছা করি। আমায় তথা লইয়া চলুন?”
লালমোহন হাস্য করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আর কষ্ট করিয়া কি হইবে? সে জাহা জানে তাহা ত আগেই বলিয়াছে।”
আমার বড় রাগ হইল। আমি বলিলাম, “কিজন্য দেখা করিতে চাহিতেছি তাহা আপনি জানিলেন কিরূপে? আপনি দেখা করাইয়া দিউন, তাহার পর সমস্তই জানিতে পারিবেন।”
লা। আপনার কি এখনও বোধ হইতেছে যে, এই হত্যা যতীন্দ্রের দ্বারা হয় নাই?
আ। আমার বোধ হয়, এই হত্যা যতীন্দ্রের দ্বারা হয় নাই।
লা। তবে হত্যাকারী কে?
আ। হত্যাকারী কে, তাহা এখনও ঠিক হয় নাই। তবে তাহার আকৃতি দীর্ঘ, ডানহাত অকৰ্ম্মণ্য, ডান পায়ের জোর নাই। তাহার পরিধানে মোটা তলাযুক্ত জুতা, আরও অনেক চিহ্ন পাওয়া গিয়াছে, কিন্তু সেগুলি বিশেষ প্রয়োজনীয় নহে।
লালমোহন আমার কথায় হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “সমস্তই কল্পনা মাত্র।”
আমি বলিলাম, “আপনি আপনার মনের মত কার্য্য করিয়াছেন, আমি আমার নিয়ম মত কার্য্যা করিতেছি। হয়ত আজ বৈকালে সমস্ত জানিতে পারিবেন।”
লা। তবে কি এ রহস্য ভেদ করিয়াছেন?
আ। নিশ্চয়ই।
লা। খুনী কে?
আ। আমি ত তাহার আকৃতি বর্ণনা করিয়াছি। এই স্থানে অধিক লোকের বাস নয়। এখানে ঐ রকম লোক খুঁজিয়া বাহির করা তত কষ্টকর হইবে না।
লা। সে কার্য্য আমার দ্বারা হইবে না।
আ। কেন?
লা। লোকে আমাকে উপহাস করিবে।
আ। কি জন্য?
লা। আপনি যেরূপ আকৃতি বর্ণনা করিলেন, সেই আকৃতির লোক খুঁজিয়া বাহির করিতে হইল আমায় লোকের বাড়ী বাড়ী ঘুরিতে হয়।
আ। না পারেন আমিই দেখিতেছি। কিন্তু পরে আমায় দোষ দিবেন না। আপনার সাহায্যের জন্যই আমি আসিয়াছি, আমার এমন ইচ্ছা নয় যে, এ কার্য্যের সুখ্যাতি আমিই লাভ করি। চলুন, এখন থানায় যাওয়া যাউক।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
থানায় ফিরিয়া আসিয়া আমি স্নানাহার সমাপন করিলাম। পরে বিশ্রামার্থ নির্দ্দিষ্ট গৃহে উপস্থিত হইলাম। ক্ষণকাল বিশ্রামের পর আমি লালমোহনকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “দামোদর মৃত্যুর পূর্ব্বে যে কথা বলিয়াছিল, তাহার কোন অর্থ বুঝিয়াছেন?”
লালমোহন উত্তর করিলেন, “না— আমি সে কথা ভুলিয়া গিয়াছিলাম, কথাটা বড় অস্পষ্ট।”
আ। অস্পষ্ট হইলেও তাহার অর্থ আছে।
লা। কি বলুন দেখি?
আ। দামোদর কি বলিয়াছিল, মনে আছে?
লা। “আম সদ্দ” না কি ঐ রকম একটা কথা বলিয়াছিল।
আ। ঠিক বলিয়াছেন। কিন্তু আপনি উহার কোন অর্থ বুঝিতে পারেন নাই?
লা। না।
আ। রাম সর্দ্দার।
লা। সে কে?
আ। সেই খুনী। দামোদর বলিতে ইচ্ছা করিয়াছিল, রাম সর্দার আমায় খুন করিয়াছে, কিন্তু সকল কথা স্পষ্টরূপে প্রকাশ করিতে পারে নাই।
লা। রাম সর্দ্দার কে? তাহার বাসই বা কোথায়?
আ। সে কথা পরে হইবে। এখন আর একটি কথা, হত্যাকারী যে পথ দিয়া জলার ধারে গিয়াছিল, তাহাতে বোধ হয়, সে এখানকার একজন পাকা লোক। অনেকদিন হইতে সে এখানে বসবাস করিয়া আসিতেছে।
লা। ঠিক বলিয়াছেন। কিন্তু আপনি হত্যাকারীর আকৃতি জানিলেন কিরূপে? তাহার আকৃতি যে দীর্ঘ, তাহা কেমন করিয়া জানিলেন?
আ। কেন? দুইটি পদচিহ্নের মধ্যবর্তী স্থান দেখিয়া। যে যত লম্বা হয়, সে তত লম্বা লম্বা পা ফেলিয়া থাকে।
লা। সে যে খোঁড়া, কিরূপে জানিলেন?
আ। পায়ের দাগ দেখিয়া। এক পায়ের দাগ যত স্পষ্ট অপর পায়ের দাগ তত নয়। সে একপায়ে বেশী জোর দিয়া চলে। কাজেই সে খোঁড়া।
লা। আর তাহার ডান হাতের জোর নাই, এ কথা কেমন করিয়া জানিলেন?
আ। দামোদরের মাথায় যেখানে যেরূপ ভাবে আঘাত লাগিয়াছে, তাহা ডানহাতে মারিলে ওরূপ ধরণের জখম হইত না। হত্যাকারী যে নিশ্চয়ই বামহস্তে পশ্চাৎ দিক হইতে আঘাত করিয়াছে, তাহা স্পষ্টই প্রতীয়মান হইতেছে। এ কথা পরে দেখিবেন ডাক্তারের সাক্ষাতেই প্রমাণিত হইবে।
আমার কথা শুনিয়া, লালমোহনের মুখ প্রসন্ন হইল। তিনি হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “আমরা একই জায়গায় একই রকম জিনিষ ও দাগ দেখিয়া আসিলাম। কিন্তু আমি চক্ষু থাকিতেও অন্ধ; দেখার মত দেখিতে পারিলাম না। আপনি যে একজন নিরীহ ব্যক্তির জীবন রক্ষা করিতে পারিবেন, ইহাই আপনার যথেষ্ট পুরস্কার। অন্য কোন পুরস্কার আপনার যোগ্য হইতে পারে না।”
আমি এখন লালমোহনের কথায় আন্তরিক আনন্দিত হইলাম। আত্মা প্রশংসায় নহে, তাঁহার একটি কথা আমার প্রাণে লাগিয়াছিল। আমি একজন নির্দোষী লোকের জীবন রক্ষা করিয়া যে, পুরস্কার লাভ করিলাম, অন্য কোন পুরস্কার তাহার তুলনায় বাস্তবিকই তুচ্ছ বলিয়া বোধ হইল। খানিক পরে বলিলাম, “দারোগাবাবু! এখন একবার চলুন, শেষ কাজটা সারিয়া ফেলি।”
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
তখনই দারোগা মহাশয়কে কেশববাবুর শারীরিক অবস্থার কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। শুনিলাম, তাঁহার বাঁচিবার আশা নাই, বটে, কিন্তু তিনি লোকজনের সহিত এখনও বেশ কথাবার্তা কহিতে পারেন, ― তবে শয্যাগত। বিছানা হইতে নড়িবার শক্তি নাই। সুতরাং তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার ইচ্ছা হইল।
আমি কেশববাবুর বাড়ী জানিতাম না। কেশববাবু যে সে লোক না; দেশের জমীদার, সুতরাং কাহারও সাহায্য ব্যতীত তাঁহার বাড়ী চিনিতে পারিলেও, গ্রাম বেড়াইবার ছলে থানা হইতে বহির্গত হইলাম। লালমোহন আমার সঙ্গে রহিলেন, কিন্তু তাঁহাকে কোন কথা ভাঙ্গিলাম না।
থানা হইতে জমীদার বাটী প্রায় একক্রোশ, আমরা গল্প করিতে করিতে আধ ঘন্টার মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হইলাম। শুনিলাম, কেশববাবু একটু ভাল আছেন।
বাড়ীর এক ভৃত্য আমাদিগকে তাঁহার গৃহে লইয়া গেল। ঘরে প্রবেশ করিলে কেশববাবু হাত নাড়িয়া আমাদিগকে তাঁহার নিকটে বসিতে ইঙ্গিত করিলেন। আমরা বসিলাম।
আমরা বসিলে পর, তিনি অতি ক্ষীণস্বরে আমার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কোথা হইতে আসিতেছেন? আপনার সঙ্গীটিই বা কে?”
আমি বলিলাম, “আমি একজন ডিকেটিভ পুলিস কর্ম্মচারী ও আমার সঙ্গী আপনাদিগের থানার দারোগা।”
আমি এই কথা বলিবামাত্র কেশববাবু চমকিত হইলেন। তাঁহার মুখ পাংশুবর্ণ ধারণ করিল। সমস্ত শরীর যেন কাঁপিতে লাগিল। তিনি অতি বিমর্যভাবে আমার দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিলেন।
তাঁহার এইরূপ অবস্থা দেখিয়া, আমি তাঁহার মনের ভাব বুঝিতে পারিলাম। বলিলাম, “আমি দামোদরের খুনের বিষয় ও রাম সর্দ্দারের সমস্তই জানি।”
কেশববাবু অতি মৃদুস্বরে বলিয়া উঠিলেন, “কি সৰ্ব্বনাশ!”
আমি কোন কথা কহিলাম না। তখন তিনি যেন আপনা আপনি বলিতে লাগিলেন, “ঈশ্বর যাহা করেন মঙ্গলের জন্য। যে দিন হইতে যতীন্দ্র জেলে রহিয়াছে, সে দিন অবধি আমিও শয্যাগত হইয়াছি; অনুতাপের জন্য নহে, কেবল আমার দোষে একজন নিরীহ প্রাণী শাস্তি পাইবে এই জন্য। শেষে এই সাব্যস্ত করিয়াছিলাম যে, যদি আমারজীবন থাকিতে থাকিতে যতীন্দ্রনাথের ফাঁসির হুকুম হয়, তাহা হইলে আমি স্বয়ং সমস্ত কথা প্রকাশ করিয়া নিজেই শাস্তি লইব।”
কেশববাবুর কথায় আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইলাম। বলিলাম, “আপনাকে এখনও সেইরূপই করিতে হইবে। যদি আমি আপনাকে বন্দী করিয়া লইয়া যাই, যদি রোগ হইতে আপনি মুক্ত হন, তাহা হইলে আপনার নিশ্চয়ই ফাঁসি হইবে। কিন্তু আপনার এখন যেরূপ অবস্থা দেখিতেছি, ও আপনার চিকিৎসকের নিকট হইতে আমি যতদূর জানিয়াছি, তাহাতে বেশ বুঝিয়াছি, এ যাত্রা আপনার কোনরূপেই রক্ষা নাই। আপনার মৃত্যুকাল নিকটবর্ত্তী, কিন্তু মরিবার সময় একজন নিরপরাধী ব্যক্তির প্রাণ নাশ করাইয়া পরকালের পথ নষ্ট করেন কেন? ইহজন্মে যাহা করিবার করিয়াছেন, যাহা হইবার তাহা হইয়াছে; এখন অকপট চিত্তে সমস্ত কথা স্বীকার করিয়া, নিরপরাধী ব্যক্তির প্রাণ দান করিয়া, নিশ্চিন্তমনে ইহধাম পরিত্যাগ করুন।”
আমার কথা শুনিয়া লালমোহনবাবু আমার কানে কানে কহিলেন, “আপনার অনুমান সত্য, ইনি লম্বাকৃতি, একটু খোঁড়া ও ইহার দক্ষিণ হস্তে সম্পূর্ণরূপ বল নাই।”
আমার কথা শুনিয়া জমিদার মহাশয় কহিলেন, “আপনার কথা সত্য, এ যাত্রা এ পীড়া হইতে আমার রক্ষা নাই, সুতরাং এখন সমস্ত কথা স্বীকার করিয়া একজন নিরপরাধীকে বাঁচানই আমার কর্তব্য। কিন্তু আমার কন্যার জন্যই সেরূপ কার্য্য করিতে ইচ্ছা হইতেছে না।”
আ। কেন? আপনার কন্যার তাহাতে আপত্তি কি?
কে। তাহার আপত্তি নাই। সে এ পর্যন্ত আমার পাপের কথা জানে না। কিন্তু সে যদি আমায় খুনী বলিয়া জানিতে পারে, তাহার আর মুখ দেখাইবার উপায় থাকিবে না।
আ। সে কি! আপনার কথা ভাল বুঝিতে পারিলাম না।
কে। অমলা যদি জানিতে পারে যে, আমিই দামোদরকে খুন করিয়াছি, তাহা হইলে সে আত্মঘাতিনী হইবে।
আ। আপনি সেরূপ মনে করিতে পারেন কিন্তু আত্মহত্যা করা বড় সহজ কথা নয়।
কে। আপনি আমায় কি করিতে বলেন?
আ। সমস্ত কথা একখানি কাগজে লিখিয়া স্বাক্ষর করিয়া দিন। প্রয়োজন মত আমি উহা মাজিষ্ট্রেটকে দেখাইয়া যতীন্দ্রের প্রাণরক্ষা করিব।
কে। অমলা জানিতে পারিবে?
আ। আপাততঃ যাহাতে আপনার কন্যা জানিতে না পারে তাহার চেষ্টা করিব; কিন্তু পরে সমস্তই জানিতে পারিবে।
কে। কত দিন পরে?
আ। সে কথা আমি নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারি না।
কে। আমি শীঘ্রই হইলোক ত্যাগ করিব। ডাক্তার কবিরাজ আমায় জবাব দিয়া গিয়াছেন, আমি মরিবার পর যদি এ কথা প্রকাশ হয়, তাহা হইলে আমার কোন ক্ষতি বৃদ্ধি হইবে না।
আ। তাহাই হইবে।
এই সময় তাঁহার চিকিৎসক ডাক্তার আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন, তিনিও সকল কথা শুনিলেন। কেশববাবু ক্ষণকাল কি চিন্তা করিলেন। পরে বলিলেন, “আমার এমন শক্তি নাই যে, আমি স্বয়ং লিখিতে পারি। আমার কথা কহিতেও কষ্ট বোধ হয়।”
আমি উত্তর করিলাম, “আপনাকে লিখিতে হইবে না। আপনার চিকিৎসক এই ডাক্তারবাবু সে কার্য্য করিবেন। আপনি কেবল স্বাক্ষর করিলেই হইবে”
ডাক্তারবাবু আমার কথা শুনিয়া নিতান্ত কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া একখানি কাগজ লইলেন। পরে বলিলেন, “কি বলিবেন—বলুন, আমিই লিখিয়া দিতেছি।”
সপ্তম পরিচ্ছেদ
কেশববাবু বলিতে আরম্ভ করিলেন:—
“দামোদর সামান্য লোক নহে। সে মানবাকারে একজন দস্যু। এই বিশ বৎসর সে আমায় জ্বালাতন করিয়া আসিতেছে।”
আমি তাঁহাকে বাধা দিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি সেই দুৰ্দ্দান্ত লোকের বশীভূত হইলেন কিরূপে?”
কে। শুনুন, আমি সমস্তই বলিতেছি। ডাক্তারবাবু আপনি লিখিয়া যান। আমার বয়স যখন ত্রিশ বৎসর, তখন আমার পিতার মৃত্যু হয়। পিতার মৃত্যুর পর আমি তাঁহার বিষয়ের উত্তরাধিকারী হইলাম। আমার আর কেহ ছিল না। মাথার উপর বাবা ছিলেন, তিনিত মারা পড়িলেন। আমি সমস্ত বিষয় আশয় বিক্রয় করিয়া নগদ টাকা করিলাম। একে আমার যৌবনকাল, তাহার উপর হাতে বেশ টাকাও ছিল, এ অবস্থায় সচরাচর যাহা হয়, তাহাই ঘটিল। আমার অনেক সঙ্গী জুটিল। আমি মদ খাইতে শিখিলাম; এবং অতি অল্প দিনের মধ্যেই ঘোর বেশ্যাশক্ত হইয়া উঠিলাম। সর্ব্বশুদ্ধ আমার পাঁচজন বন্ধু হইল। তাহারা আমার পয়সায় আমোদ-প্রমোদ করিতে লাগিল। দামোদর সেই পাঁচ জনের মধ্যে একজন। ক্রমে ক্রমে আমার সমস্ত অর্থ শেষ হইয়া গেল। আমার হাতে একটিও পয়সা রহিল না। তখন আমরা অর্থোপার্জ্জনের উপায় দেখিতে লাগিলাম।
আমরা সন্ধ্যার পর খিদিরপুর অঞ্চলে কোন নির্জ্জন স্থানে দাঁড়াইয়া থাকিতাম এবং সুবিধা পাইলে লোকজনের নিকট হইতে টাকা কড়ি কাড়িয়া লইতে লাগিলাম। সেই অবধি সঙ্গীরা আমার নাম রাম সর্দ্দার রাখিল। এইরূপে অর্থোপার্জ্জন করিয়া, আমরা আমোদ করিতে লাগিলাম। লোকে আমাদিগের উপর কোনরূপ সন্দেহ করিতে না। একদিন শুনিলাম, কোন জমীদারের অনেক টাকা যাইবে। আমরা সেই টাকা লুঠ করিবার পরামর্শ করিলাম। আমরা সৰ্ব্বশুদ্ধ ছয় জন ছিলাম, কিন্তু পাছে সফল না হই, এই নিমিত্ত আরও জন কয়েক লোক সংগ্রহ করিলাম। রাত্রি নয়টার পর আমরা সেই অর্থ লাভ করিলাম। যাহাদিগকে আমাদের সাহায্যের জন্য সংগ্রহ করিয়াছিলাম, তাহাদিগকে পুরস্কার দিয়া বিদায় করিলাম এবং অবশিষ্ট সমস্ত অর্থ আমাদের বাসায় লইয়া আসিলাম। অংশ লইয়া কথায় কথায় দামোদরের সহিত আমার বিবাদ হয়। আমার ভয়ানক রাগ হইয়াছিল, আমি দামোদরকে হত্যা করিতে এক লাঠি তুলিলাম। কিন্তু দামোদর আমার হাতে লাঠি দেখিয়া সম্পূর্ণ বশীভূত হইল এবং আমি যাহা দিলাম, তাহাতে বাহ্যিক সন্তুষ্ট হইয়া দল ছাড়িয়া প্রস্থান করিল। আমার অবশিষ্ট সঙ্গিগণ যথেষ্ট টাকা পাইয়া স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিল। আমিও এই জমীদারী কিনিয়া এখানে বাস করিতে লাগিলাম। এই জমীদারীর আয় সামান্য নহে। বাৎসরিক ছয় হাজার টাকা হইবে। এত টাকার মালিক হওয়ায় আমার বিবাহ করিতে ইচ্ছা হইল। আমি বিবাহ করিলাম এবং তিন বৎসর একরূপ নির্ব্বিবাদে সংসার যাত্রা নির্ব্বাহ করিলাম। বিবাহের তিন বৎসর পরে অমলার জন্ম হয়। অমলার বয়স যখন এক বৎসর, তখন তাহার মাতার মৃত্যু হয়। আমি অধিক বয়সে বিবাহ করিয়াছিলাম, সুতরাং আমরা আর দ্বিতীয়বার বিবাহ করিবার ইচ্ছা ছিল না; অমলাকে নিজেই মানুষ করিতে লাগিলাম। অমলার বয়স যখন সাত বৎসর, তখন আমি একদিন হাট হইতে বাড়ী ফিরিতেছি, এমন সময়ে দামোদরের সহিত সাক্ষাৎ হয়। দামোদরের পরিধানে একখানি ছেঁড়া কাপড়, পায়ে জুতা নাই, গায়ে জামা নাই, একখানি ছেঁড়া চাদরে সর্ব্বাঙ্গ আবৃত করিয়াছিল। দামোদরকে দেখিয়া আমার দয়া হইল। কিন্তু আমি প্রথমে তাহাকে কোন কথা বলিতে সাহস করিলাম না। দামোদর আমার মনের ভাব বোধ হয় বুঝিতে পারিয়াছিল। সে আমাকে নির্জ্জনে ডাকিয়া লইয়া গেল এবং বলিল, ‘তার পর সর্দ্দার এখন তুমি বড় লোক — জমীদার। আর আমি ভিখারীর মত ঘুরিয়া বেড়াইতেছি, এক সময়ে আমি তোমার কত উপকার করিয়াছি আর এখন তুমি থাকিতে আমার এই দুর্দ্দশা! যদি ভাল চাও, আমার উপায় করিয়া দাও। নতুবা পূর্ব্ব কথা সমস্তই প্রকাশ করিয়া দিব।’ দামোদরের কথা শুনিয়া আমার ভয় হইল। আমি তাহাকে আশ্বাস দিলাম এবং খানিকটা জমী নিষ্কর ভোগ দখল করিতে দিলাম। দামোদর তখন সন্তুষ্ট হইল এবং একরূপ আনন্দে দিনপাত করিতে লাগিল। আমাকেই তাহার ও তাহার পুত্রের ভরণপোষণের অর্থ দিতে হইত। তা ছাড়া, যখনই দামোদরের টাকার দরকার হইত, তখনই সে আমার নিকটে হাত পাতিত। আমিও ভয়ে তাহার আবশ্যক মত অর্থ দিতাম। ক্রমে তাহার সাহস বাড়িয়া উঠিল। তাহার পুত্র যতীন্দ্র বড় ভাল ছেলে। তাহার বয়স তখন বিশ বৎসর, আমার অমলা এগার বৎসরের। দামোদর কথায় কথায় একদিন তাহার পুত্র যতীন্দ্রের সহিত আমার কন্যার বিবাহের কথা উত্থাপন করিল। আমি তাহার সাহসে আশ্চর্য্য হইলাম। বলিলাম, “তুমি যে দিন দিন বড় বাড়িয়া উঠিতেছ! তুমি কি মনে কর, তুমি যাহা ইচ্ছা তাহাই করিবে? তোমার ন্যায় হতভাগ্যের পুত্রের সহিত জমীদার-কন্যার বিবাহ সম্ভবে না। দামোদর আমার কথায় হাসিয়া বলিল, অত রাগ করিলে কি হইবে? তোমার পূর্ব্ব অপরাধ কি ভুলিয়া গিয়াছ? লোকে জানিলে কি হইবে, একবার ভাবিয়া দেখ?’ আমি বলিলাম, ‘বারম্বার একই কথায় আর আমার ভয় নাই। তুমি যাহা ইচ্ছা করিতে পার। কিন্তু ইহা স্থির জানিও যে, তোমার পুত্রের সহিত আমার কন্যার বিবাহ অসম্ভব।’ এইরূপ বিবাদ চলিতেছিল। দামোদরের সহিত দেখা হইলেই সে ঐ কথা উত্থাপন করে দেখিয়া, আমি আর তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতাম না। গত জ্যৈষ্ঠমাসের তো দামোদর যখন শীকার করিতে যায়, আমি দেখিয়াছিলাম। দামোদরের উপর আমার বড় রাগ ছিল। তাহাকে একেবারে হত্যা করিতে না পারিলে আমার আর নিষ্কৃতি নাই দেখিয়া, আমি তাহাকে খুন করিতে মনস্থ করিলাম এবং সেই জন্য ঐ কার্যের উপযোগী একগাছি লাঠি লইয়া দামোদর যে জলার ধারে শীকার করিতে গিয়াছে, সেই স্থানে উপস্থিত হইলাম। যখন আমি জলার ধারে যাই, দেখিলাম –পিতা পুত্র বিবাদ হইতেছে। আমি গোপনে তাহাদের বিবাদের কারণ জানিতে পারিলাম। পুত্রের বিবাহে আদৌ ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু পিতা অমলার সহিত তাহার বিবাহ দিবার জন্য জেদ করিতেছিল। দামোদরের উদ্দেশ্য এই যে, তাঁহার পুত্র অমলাকে বিবাহ করিলে সেই এক সময়ে আমার সমস্ত বিষয়ের উত্তরাধিকারী হইবে। দামোদরের পরামর্শ শুনিয়া আমার ভয়ানক ক্রোধ হইল, রাগে সৰ্ব্বশরীর জুলিয়া উঠিল। দেখিলাম, যতীন্দ্র দামোদরের নিকট হইতে চলিয়া গেল। আমি তখন পা টিপিয়া টিপিয়া দামোদরের পশ্চাতে যাইলাম এবং সেই লাঠির দ্বারা সজোরে তাহার মাথায় আঘাত করিলাম। দামোদর চাঁৎকার করিয়া অজ্ঞান হইয়া পড়িল, আমিও পলায়ন করিলাম। বাড়ী ফিরিয়া আসিয়া আমার চৈতন্য হইল। আমি যে ভয়ানক কার্যা করিয়াছি তখন তাহা বুঝিতে পারিলাম। মহাশয়! এই আমি সমস্ত সত্য বলিলাম; ইহার মধ্যে একটুও মিথ্যা নাই।
আ। আপনি জমিদার, টাকা পয়সা ও লোক-জনের অভাব নাই, তবে এ কাৰ্য্য আপনি নিজ হস্তে সম্পন্ন করিলেন কেন?
কে। একবার দামোদরের সাহায্যে এক কার্য্য করিয়া এত দিবস পর্য্যন্ত সেই যন্ত্রণায় জ্বলিতেছিলাম, আবার এই কার্যের জন্য যদি কোন লোকের সাহায্য গ্রহণ করি, তাহা হইলে তাহার পরিণাম ফলও ঐরূপ দাঁড়াইবে; এই ভাবিয়া, কাহারও সাহায্য গ্রহণ না করিয়া, আমি নিজেই কাৰ্য্য সম্পন্ন করিয়াছি।
কেশববাবুর কথা শেষ হইলে আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “ডাক্তারবাবু! সব লিখিয়াছেন ত?”
ডা। হাঁ, সকলই লিখিয়াছি, কেবল জমীদার মহাশয়ের স্বাক্ষর বাকি।
আ। কি লিখিয়াছেন একবার পড়ন দেখি?
ডাক্তারবাবু তখন সেই কাগজ পড়িলেন এবং পড়া শেষ হইলে কাগজখানি আমার হাতে দিলেন, আমি কেশববাবুকে উহা সহি করিতে দিলাম, কেশববাবু সহি করিলে পর, আমি ডাক্তারকেও স্বাক্ষীস্বরূপ সহি করিতে বলিলাম।
ডাক্তার স্বাক্ষর করিলেন এবং কাগজখানি আমার হস্তে দিলেন। আমি উহা লইয়া কেশববাবুর নিকট হইতে বিদায় লইলাম কিন্তু গোপনে কেশববাবুর উপর পাহারা রাখিলাম।
প্রায় এক ঘণ্টার মধ্যেই আমাদের কার্য্য শেষ হইল। আমরা থানায় ফিরিয়া আসিলাম; এবং সেই কাগজখানি একজন্য মাজিষ্ট্রেটকে দিলাম; ও তাঁহাকে কহিলাম, “পুলিস কৰ্ম্মচারীর অবর্তমানে পুনরায় কেশরবাবুর নিকট গমন করিয়া, তাঁহার সমস্ত কথা পুনরায় লিখিয়া লইতে আজ্ঞা হয়, কারণ যদি তিনি আরোগ্যলাভই করেন, তাহা হইলে এই খুনি মোকদ্দমা তাঁহার উপর চালাইতে হইবে।”
আমাদিগের প্রার্থনামত মাজিষ্ট্রেট সাহেব একজন সাহেব ডাক্তার সঙ্গে লইয়া সেই স্থানে গমন করিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহাদিগের সেই স্থানে উপস্থিত হইবার অতি অল্পক্ষণ পূর্ব্বে জমিদার মহাশয়ের মৃত্যু হয়; সুতরাং তিনি মোকদ্দমার হস্ত হইতে নিষ্কৃতি লাভ করেন।
যতীন্দ্রনাথ যথাসময়ে নিষ্কৃতি লাভ করেন ও পরে শুনিয়াছিলাম, ঐ যতীন্দ্রনাথের সহিত অমলার বিবাহ হয়. ও তিনিই পরিশেষে কেশববাবুর সমস্ত জমিদারীর অধিকারী হন। যে দরিদ্র কন্যাকে তিনি বিবাহ করিতে চাহিয়াছিলেন, এই গোলোযোগের সময় সেই কন্যার অভিভাবকেরা অপরের সহিত বিবাহ দিয়াছিলেন।
[ পৌষ, ১৩১৩ ]