গুপ্তরহস্য

গুপ্ত-রহস্য 

(অর্থাৎ তারামণির প্রমুখাৎ ভয়ানক গুপ্ত-রহস্য প্রকাশ।) 

প্রথম পরিচ্ছেদ

তারামণি যে কে তাহা পাঠকগণ ইতিপূর্ব্বে “মতিয়া বিবি” নামক পুস্তক পাঠে অবগত আছেন। তাঁহারা আরও অবগত আছেন যে, কিরূপে সিঁদ হইয়া তাহার ঘর হইতে তাহার যথাসর্ব্বস্য অপহৃত হয়, ও কিরূপে তাহার লোহার সিন্ধুকের মধ্য হইতে একটি স্ত্রীলোকের মৃত দেহ প্রাপ্ত হওয়া যায়। আরও অবগত আছেন যে ঐ লোহার সিন্ধুকের ভিতর-প্রাপ্ত মৃত দেহ তারামণির মৃত দেহ সাব্যস্ত করিয়া আমরা কি ভয়ানক ভ্রমে পতিত ও কিরূপ বিপদগ্রস্ত হইয়াছিলাম। ইতিপূর্ব্বে যদি আমাদিগের মনে কিছুমাত্র সন্দেহ হইত যে ঐ মৃত দেহ তারামণির নহে, অপর কোন স্ত্রীলোকের মৃত দেহ তাহা হইলে মসলিকে তারামণির হত্যাকারী বলিয়া কখনই আমরা সাব্যস্ত করিয়া লইতাম না, বা হত্যাপরাধে বিচারকের নিকট তাহাকে বিচারার্থ কখনই প্রেরণ করিতাম না। সে যাহা হউক এখন তারামণি জীবিত, মসলিম বিচারকের নিকট হইতে অব্যাহতি পাইয়া তাহার দলবল বা বন্ধুবান্ধবের সহিত স্থানান্তরিত। 

প্রধান কর্ম্মচারীর ইচ্ছা যে তারামণির ঘরস্থিত লোহার সিন্ধুকের অভ্যন্তরিণ প্রাপ্ত মৃত দেহের রহস্য যাহাতে উদ্ঘাটিত হয়। এই নিমিত্তই তিনি আমাদিগের উপর ইহার পুনঃ অনুসন্ধানের ভার অর্পণ করিয়াছেন। 

এখন এই অনুসন্ধানে লিপ্ত হইবার পর আমাদের মনে এই সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল যে মতিয়া বিবির মৃত দেহের সহিত, তারামণির লোহার সিন্ধুকের মধ্যস্থিত মৃত দেহের কোনরূপ সম্বন্ধ আছে কি না? আর যদি সম্বন্ধই থাকে তাহা হইলেই বা কিরূপে ইহার যথাযথ অবস্থা নির্ণয় করিতে আমরা এখন সমর্থ হইব। ইতিপূর্ব্বে যে পৰ্য্যন্ত মসলিম্ ও তাহার অনুচরবর্গ আমাদিগের আয়ত্তাধীনের ভিতর ছিল তখন তাহাদিগের নিকট হইতে এ সম্বন্ধে কোন কথা প্ৰকাশ পাই নাই। এখন উহারা সকলেই আমাদিগের হস্তের বহির্ভূত হইয়া পড়িয়াছেও কোথায় যে এখন ইহারা গমন করিয়াছে তাহার কিছুই আমরা এখন স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না; সুতরাং এই মোকদ্দমায় প্রধান কর্ম্মচারীর শেষ আদেশ যে আমরা কত দূর প্রতিপালন করিতে পারিব, তাহা পাঠকগণ অনায়াসেই অনুমান করিয়া লইতে পারেন। সে যাহা হউক, এখন দেখা যাউক তারামণি রহস্য কি? যে তারামণি হত হইয়াছে বলিয়া সৰ্ব্বসাধারণে অবগত হইয়াছিলেন, যাহার হত্যা সংবাদ, সংবাদ পত্র সম্পাদকগণ দ্বারে দ্বারে প্রচারিত করিয়াছিলেন, সেই তারামণির এখন জীবিতাবস্থায় সৰ্ব্ব সমক্ষে আসিয়া উপস্থিত হইবার রহস্যই বা কি? এত দিবস পর্য্যন্ত তারামণি কোথায় ছিল, কিরূপেই বা মসলিম তাহাকে বিচারালয়ে আনিয়া উপস্থিত করিতে সমর্থ হইয়াছিল এখন তাহাই দেখা যাউক। আরও দেখা যাউক তারামণির ঘর হইতে কোন মূল্যবান দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে কি না? আর যদি অপহৃত হইয়াই থাকে তাহা হইলে কি কি দ্রব্য কিরূপে ও কাহা কর্তৃক অপহৃত হইল। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমরা তারামণিকে ডাকিলাম, আমাদিগের কথা শুনিয়া, তারামণি আমাদিগের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলে আমরা তাহাকে কহিলাম, “তারামণি তোমার ঘর হইতে তোমার কোন মূল্যবান দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে কি? ও যদি হইয়াই থাকে তাহা হইলে বলিতে পার কি, কাহা কর্তৃক তোমার সমস্ত দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে? ও তুমিই বা কিরূপে তোমার ঘর হইতে স্থানান্তরিত হইয়াছিলে ও এত দিবস পর্য্যন্ত কোথায় ও কিরূপে অবস্থিতি করিতেছিলে? ইহার আনুপূর্ব্বিক অবস্থা আমরা জানিতে বাসনা করি। আমাদিগের প্রস্তাবে যদি তোমার কোনরূপ আপত্য না থাকে তাহা হইলে, এই সকল বিষয়ের নিগুঢ় রহস্য কি, তাহা প্রকাশ করিয়া আমাদিগের কৌতূহল নিবারণ ও আমাদিগের বাসনা, পরিতৃপ্ত কর।” 

আমাদিগের কথার উত্তরে তারামণি কহিল, “আমার ঘর হইতে দস্যুগণ কিরূপে আমার যথাসর্বস্ব অপহরণ করিয়া লইয়া যায় ও সেই সময় হইতে আমার অদৃষ্টে যে কিরূপ ভয়ানক কষ্ট ও দুঃখ আসিয়া উপস্থিত হয়, ও এত দিবস পর্য্যন্ত যেরূপে আমি দিনযাপন করিয়াছি তাহার আনুপূর্ব্বিক অবস্থা আমি যতদূর স্মরণ করিয়া বলিতে পারিব তাহা আপনাদিগের নিকট বর্ণন করিতেছি। আমার অবস্থা শুনিলে, আমি কিরূপ দুর্ব্বিপাকে পতিত হইয়াছিলাম তাহা জানিতে পারিলে, আপনারা অনায়াসেই বুঝিতে পারিবেন যে, সভ্য অধিবাসীগণ পূরিত ও সুবিজ্ঞ রাজ কর্মচারীগণের দ্বারা শাসিত এই ভারত রাজধানীর মধ্যে এখন পর্যন্ত কিরূপ ভয়ানক ভয়ানক কাৰ্য্য সকল চলিতেছে। আমার কথা শুনিলে আপনারা জানিতে পারিবেন যে, এই সুসভ্য ইংরাজ রাজত্যের মধ্যে শান্তির স্রোত প্রবাহিত থাকিলেও ভয়ানক ভয়ানক অশান্তি তরঙ্গ উত্থিত হইয়া নিরীহ অধিবাসীগণকে সময় সময় কিরূপে আপ্লুত করিতেছে। বিচারকগণের হস্তে শাসন দণ্ড স্থাপিত থাকিলেও সময়ে সময়ে সেই দণ্ড একেবারে অকর্ম্মণ্য হইয়া প্রজাহিতের পক্ষে অন্যরপ ধারণ করিয়া নিরীহ অধিবাসীবর্গের সর্ব্বনাশ সাধন করিতেছে। আমার চিরদিবসের বিশ্বাস ছিল যে পাপ করিলে তাহার প্রতিফল আছে, কিন্তু এখন দেখিতেছি আমার সেই বিশ্বাস ভ্রমাত্মক। আমার বিশ্বাস ছিল যে পুণ্যেরই সদা সৰ্ব্বদা জয় লাভ হইয়া থাকে, কিন্তু এখন দেখিতেছি পাপের জয় ক্রমে সর্ব্বব্যাপী হইয়া দাঁড়াইতেছে। আমার বিশ্বাস ছিল দুষ্কর্ম্ম করিলে তাহাকে রাজদণ্ডে দণ্ডিত হইতে হয়, কিন্তু এখন দেখিতেছি যে, যে দুষ্কর্ম্মকারী তাহারই জয়লাভ হইয়া থাকে; আর যে সৎপথ অবলম্বন করিয়া নিরীহ ভাবে দিনাতিপাত করিবার চেষ্টা করে, পদে পদে তাহাকেই বিপদ সাগরে পতিত হইয়া হাবুডুবু খাইতে হয়। আগে জানিতাম সৰ্ব্বস্থানে নিরীহ লোক মনের সুখে দিনযাপন করিয়া থাকে, কিন্তু এখন দেখিতেছি দুষ্ট লোকেই সুখ স্বচ্ছন্দে দিনযাপন করিতে আরম্ভ করিয়াছে। যে সকল ব্যক্তি এখন পদে পদে দুষ্কর্ম্ম করিতেছে, প্রত্যেক কথায় মিথ্যা কথা কহিতেছে, পরের দ্রব্য সদা সর্ব্বদা অপহরণ করিয়া যে জলের মত অর্থ ব্যয় করিতেছে, পরের কুলে কালি লাগাইয়া যে দূরে দাঁড়াইয়া হাসিতেছে এখন দেখিতেছি তাহাদিগেরই জয়। তাহারাই মনের সুখে দিনযাপন করিতেছে। জানি না এখনও ভগবান আছেন কি না, জানি না, ঐ সকল লোককে তাহাদিগের কৃত কর্ম্মের ফলাফল ভোগ করিতে হইবে কি না। সে যাহা হউক আমি দুষ্ট লোকের হস্তে পতিত হইয়া যেরূপ কষ্ট ও মনঃস্তাপ সহ্য করিয়াছি তাহাই আমি এখন আপনাদিগের নিকট বর্ণন করিতেছি। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

তারামণি কহিল, যে দিবস ও যেরূপ ভাবে আমার ঘর হইতে চুরি হয় তাহাই আপনাদিগকে অগ্রে বলিতেছি। যে রাত্রিতে আমার ঘরে সিঁদ হয় সেই রাত্রিতে নিয়মিতরূপ আহারাদি করিয়া আমি আমার ঘরের দরজা ভিতর হইতে বন্ধ করিয়া দিয়া নিয়মিতরূপ আপন শয্যার উপর শয়ন করি ও ক্রমে নিদ্রিত হইয়া পড়ি। রাত্রি আন্দাজ দুইটার সময় কোনরূপ শব্দ শুনিয়া হঠাৎ আমার নিদ্রা ভঙ্গ হয়; সেই সময় আমার ঘরের মধ্যে একটি প্রদীপ জ্বলিতেছিল। ঐ আলোর সাহায্যে আমি দেখিতে পাই আমার ঘরের ভিতর তিনজন লোক প্রবেশ করিয়াছে ও আমার ঘরস্থিত দ্রব্যাদি অপহরণ করিবার চেষ্টা করিতেছে। আরও দেখিলাম আমার ঘরের পশ্চাৎ দিকের দেওয়ালে একটি প্রকাণ্ড সিঁদ হইয়াছে। বুঝিলাম ঐ সিঁদের মধ্য দিয়াই চোরগণ আমার ঘরে প্রবেশ করিয়াছে। আমি স্ত্রীলোক, বিশেষ ঐ ঘরের মধ্যে আমি একাকী শুইয়াছিলাম। হঠাৎ নিদ্রা ভঙ্গ হইলে, ঘরের ভিতর দস্যুদিগকে দেখিয়া আমি একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া পড়িলাম। আমার মুখ দিয়া একটি কথাও বহির্গত হইল না। এরূপ অবস্থায় সাহসিক পুরুষগণের অবস্থা যেরূপ হইয়া থাকে তাহা আপনারা অবগত আছেন। আমি স্ত্রীলোক, এরূপ অবস্থা দৃষ্টে সেই সময় আমার অবস্থা যে কিরূপ হইয়াছিল তাহা আর আপনাদিগের নিকট আমাকে বলিতে হইবে না। বিশেষ সেই অবস্থা বর্ণন, করিবার ক্ষমতাও আমার নাই। আপনারা অনায়াসেই আমার সেই সময়ের অবস্থা অনুমান করিয়া লইতে সমর্থ হইবেন। 

আমার নিদ্রা ভঙ্গ হইবার সঙ্গে সঙ্গে ঐ দস্যুগণের মধ্যস্থিত দুই ব্যক্তি আমার সন্নিকটে আসিয়া দণ্ডায়মান হইল। উহাদিগের মধ্যে এক জনের হস্তে একখানি তীক্ষ্ণ ছুরিকা বা ভোজালী ছিল। সে ঐ অস্ত্র খানি আমার বুকের নিকট ধরিয়া, আমাকে কহিল, এখন যদি তুই কোনরূপ গোলযোগ করিবি বা চেঁচাইবার জন্য বা কথা কহিবার চেষ্টা করিবি তাহা হইলে দেখিবি এই তীক্ষ্ণ অস্ত্র এখনই তোর বুকের ভিতর প্রবিষ্ট হইবে। 

সেই সময় অপর ব্যক্তি কহিল তোর বাক্স প্যাঁটরা প্রভৃতির চাবিগুলি কোথায়? উহা আমাদিগকে এখনই প্ৰদান কর। নতুবা আমার হস্তে এখনই তুই শমন সদনে গমন করিবি। তাহাদিগের কথা শুনিয়া আমি ভাবিলাম, অপরের হস্তে অপঘাত মৃত্যু অপেক্ষা আমার যথা সৰ্ব্বস্ব অপহৃত হওয়াই মঙ্গল। এই ভাবিয়া আমার চাবিগুচ্ছ যাহা আমি আমার বিছানার নিম্নে লুকাইয়া রাখিয়াছিলাম, তাহা বাহির করিয়া উহার হস্তে প্রদান করিলাম। সেই ব্যক্তি উহা দ্বারা তৃতীয় ব্যক্তির সাহায্যে আমার ঘরস্থিত বাক্স প্যাঁটরা প্রভৃতি খুলিতে আরম্ভ করিল। যে ব্যক্তি ছুরিকা হস্তে আমার নিকট দণ্ডায়মান ছিল, সে আমার অঙ্গস্থিত অলঙ্কারগুলি খুলিয়া দিতে কহিল। আমি নিতান্ত ভীতবিহ্বল চিত্তে এক একখানি করিয়া আমার পরিহিত অলঙ্কারগুলি খুলিয়া তাহার হস্তে অর্পন করিলাম। যাহারা বাক্স প্যাঁটরা প্রভৃতি খুলিতেছিল তাহারা একটি বাক্সের মধ্য হইতে আমার লোহার সিন্ধুকের চাবি বাহির করিল; ও ঐ চাবি দ্বারা ঐ লোহার সিন্ধুক খুলিয়া তাহার ভিতর সোণা রূপার অলঙ্কার ও নগদ অর্থাদি যাহা কিছু ছিল তাহা সমস্তই বাহির করিয়া লইল। এইরূপে যাহা কিছু মূল্যবান দ্রব্য আমার ঘরে ছিল তাহার সমস্তই উহারা আত্মসাৎ করিয়া পরিশেষে দুই ব্যক্তি আমার ঘরের দরওয়াজা খুলিয়া ও আমাকে তাহাদিগের সঙ্গে লইয়া সেই ঘর হইতে বহির্গত হইল। আমরা ঘরের বাহিরে আসিলে তৃতীয় ব্যক্তি যে ঘরের ভিতর ছিল সে পুনরায় ঐ ঘরের দরওয়াজা ভিতর হইতে বন্ধ করিয়া দিয়া সিঁদের মধ্য দিয়া ঘরের বাহিরে আসিল ও পরিশেষে তিন জন একত্রিত হইয়া অপহৃত দ্রব্য সকল ও আমাকে লইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। সেই সময়ে আমি উহাদিগের ভয় প্রর্শনে এরূপ ভীত হইয়া পড়িয়াছিলাম যে আমার মুখ দিয়া একটি মাত্র কথাও বহির্গত হইল না। ইহারা যেরূপ ভাবে আমাকে যাইতে বলিল, আমি সেইরূপ ভাবেই উহাদিগের সঙ্গে সঙ্গে গমন করিতে লাগিলাম। আমি জানি না যে কোথায় যাইতেছি ও কেনই বা যাইতেছি। উহারা আমাকে বলিল না যে আমাকে কোথায় লইয়া যাইতেছে ও কেনই বা লইয়া যাইতেছে; তথাপি কিন্তু আমি তাহাদিগের ইচ্ছানুবর্তী হইয়া তাহাদিগের সমভিব্যাহারে গমন করিতে লাগিলাম। যে পাড়ার ভিতর আমার বাসস্থান, ক্রমে সেই পাড়া অতিক্রম করিয়া আমি তাহাদিগের সহিত চলিতে লাগিলাম। গভীর রজনীর আবরণে পাড়ার কেহই আমাদিগকে দেখিতে পাইল না বা কেহই জানিতে পারিল না যে আমারা কোথায় যাইতেছি। কমে আমরা সকলেই সদর রাস্তায় আসিয়া উপনীত হইলাম, দেখিলাম সেই স্থানে এক খানি গাড়ী দাঁড়াইয়া আছে। গাড়ীর উপরে এক জন কোচওয়ান ভিন্ন আর কেহই নাই, ভিতরেও কেহ ছিল না। গাড়ীর নিকট আগমন করিয়া ঐ তিন ব্যক্তি আমার ঘর হইতে অপহৃত দ্রব্যাদির সহিত সেই গাড়ীর ভিতর আরোহণ করিল। আমাকেও সেই সঙ্গে উঠাইয়া লইল। আমরা গাড়ীতে উপবিষ্ট হইবার পর, ঐ গাড়ীর উভয় পার্শ্বের দরওয়াজা উহারা বন্ধ করিয়া দিল ও গাড়ী চলিতে আরম্ভ করিল। অনেকক্ষণ ‘চলিবার পর ঐ গাড়ি এক স্থানে আসিয়া দণ্ডায়মান হইল। সেই স্থানে ঐ গাড়ীর দরওয়াজা খুলিলে দেখিতে পাইলাম একটি দ্বিতল বাড়ীর সম্মুখে ঐ গাড়ী আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। ঐ স্থানে আরোহিগণ গাড়ী হইতে অবতরণ করিল ও আমাকেও গাড়ী হইতে নাবাইয়া লইয়া সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। আমরা বাড়ীর ভিতর প্রবিষ্ট হইবা মাত্ৰ ঐ বাড়ীর সদর দরওয়াজা এক ব্যক্তি ভিতর হইতে বন্ধ করিয়া দিল। বাড়ীর ভিতর প্রবিষ্ট হইয়া দেখিলাম যে বাড়ীটি নিতান্ত ক্ষুদ্র নহে। উপর ও নিম্নে প্রায় পোনের ষোলটি ঘর, কিন্তু ঘরগুলি অধিকাংশই শূন্য অবস্থায় পতিত আছে। কেবল মাত্র একটি ঘরে উহারা বাস করে, ও অপর একটি ঘরে উহাদিগের রন্ধনাদি হইয়া থাকে। 

ঐ বাড়ীর ভিতর প্রবিষ্ট হইলে উহারা ঐ বাড়ীর মধ্যস্থিত একটি খালি ঘরে আমার থাকিবার স্থান নির্দেশ করিয়া দিল। অনন্যোপায় হইয়া আমাকে সেই স্থানেই থাকিতে হইল। তখন পৰ্য্যস্ত আমি জানিতে পারিলাম না, যে কেনই বা উহারা আমাকে সেই স্থানে লইয়া গেল, ও কেনই বা আমাকে সেই স্থানে রাখিয়া দিল। আমি যখন সেই স্থানে উপস্থিত হইয়াছিলাম তখন রাত্রি ভোর হইয়া আসিয়াছিল। ক্রমে সূৰ্য্যদেব উদয় হইলেন, আমিও আমার ঘর হইতে বহির্গত হইয়া দেখিলাম ঐ বাড়ীর সংলগ্ন আর কাহারও বাড়ী আছে কি না। আরও দেখিলাম ঐ বাড়ীর মধ্য হইতে বাহিরের কোন লোকের সহিত কথা কহিবার কোনরূপে উপায় আছে কি না ও আরও দেখিবার চেষ্টা করিলাম যে ঐ বাড়ীর মধ্য হইতে কোনরূপ উপায়ে পলায়ন করিবার পথ আছে কি না। কিন্তু দেখিলাম ঐ বাড়ীটি একটি বাগানের মধ্যে সংস্থাপিত। উহার এক দিকে রাস্তা ও অপর তিন দিকে আম্রাদি বৃক্ষ সংযুক্ত পতিত জমি; নিকটেও কাহারও বাসস্থান নাই, ঐ বাড়ী হইতে অপর কাহারও সহিত কথা কহিবার উপায় নাই বা কোন দিক্ দিয়া ঐ বাড়ী হইতে পলায়ন করিবার সুবিধা নাই। আমি পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি যে আমার থাকিবার নিমিত্ত উহারা ঐ বাড়ীর দ্বিতলের উপর একটি প্রকোষ্ঠ নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছিল। আমি দ্বিতল হইতে ক্রমে নিম্নতলে গমন করিলাম। যে প্রকোষ্ঠে আট দশজন দস্যু অবস্থিতি করিতেছিল, তাহারা প্রায় সকলেই আমাকে নিম্নতলে যাইতে দেখিল কিন্তু কেহই আমাকে কিছুই বলিল না বা জিজ্ঞাসা করিল না যে আমি কোথায় যাইতেছি। উহাদিগের মধ্যে কেবল দুই একজন আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া একটু হাসিল মাত্র। আমি নীচে গমন করিলাম, ঐ বাড়ীর নিম্নতলে গমন করিবার আমার এই মাত্র উদ্দেশ্য ছিল যে যদি দেখিতে পাই ঐ বাড়ীর কোন দরওয়াজা খোলা আছে বা ঐ বাড়ী হইতে বহির্গত হইবার অপর কোন উপায় আছে তাহা হইলে আমি ঐস্থান হইতে পলায়ন করিবার চেষ্টা করিব; কিন্তু নিম্নতলে গমন করিয়া দেখিলাম যে আমার উদ্দেশ্য সফল করিবার কোনরূপ উপায়ই নাই। বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিবার বা বাড়ী হইতে বহির্গত হইবার কেবলমাত্র দুইটি দরওয়াজা আছে। একটি সদর দরওয়াজা অপরটি খিড়কি। দরওয়াজার নিকট গমন করিলাম, কিন্তু দেখিলাম আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিবার কোনরূপ উপায় নাই। দুইটি দরওয়াজার ভিতর হইতে তালা বদ্ধ ও দুইটি দরওয়াজার নিকটেই দুই জন করিয়া লোক উপবিষ্ট। আমি উহাদিগের প্রত্যেককেই ঐ দরওয়াজা খুলিয়া দিতে বলিলাম, কিন্তু কেহই আমার কথা শুনিল না। অধিকন্তু আমাকে যৎপরোনাস্তি গালি দিয়া সেই স্থান হইতে আমাকে তাড়াইয়া দিল। আমি অনন্য উপায় হইয়া আমার থাকিবার নির্দিষ্ট ঘরে পুনরায় গমন করিলাম ও সেই স্থানে বসিয়া অশ্রুজলে আপন বস্ত্র অভিষিক্ত করিতে লাগিলাম। আমার দিকে কেহই দৃষ্টিপাত করিল না, বা কেহই আমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিল না। আমি সেই ঘরের মধ্যে শুইয়া কেবল ক্রন্দন করিতে লাগিলাম। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

এই রূপে ক্রমে বেলা দুই প্রহর অতীত হইয়া গেল। সেই সময় আমি দেখিলাম যে মসলিম (অবশ্য তাহার নাম আমি সেই সময় জানিতাম না) আমার ঘরের সম্মুখ দিয়া গমন করিতেছে। আমি তাহাকে ডাকিলাম, সেও আমার ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল। তখন আমি তাহাকে কহিলাম, “বাবা তোমরা তো আমার যথা সর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া লইয়া আসিয়াছ, কিন্তু তাহাতে আমি তোমাদিগকে কিছুই বলি নাই। আমার বৃদ্ধ বয়সের নিমিত্ত যাহা কিছু সংস্থান ছিল তাহার সমস্তই তোমরা গ্রহণ করিয়াছ বলিয়া আমি এখনও তোমাদিগকে কিছু বলিতেছি না; কিন্তু আমাকে এখানে ধরিয়া আনিলে কেন? আমি এখন বৃদ্ধা হইয়া পড়িয়াছি। আমার দ্বারা তোমাদিগের কোনরূপ উপকারের সম্ভাবনা নাই, বা আমার দ্বারা যে তোমাদের কোনরূপ কার্য্য সম্পন্ন হইবে এরূপ আশাও তোমরা করিও না। তোমরা আমাকে এখন ছাড়িয়া দেও, আমি আপন স্থানে গমন করি। আমি শপথ করিয়া বলিতেছি যে, তোমরা আমাকে ছাড়িয়া দিলে তোমাদিগের কথা, বা তোমাদিগের বাসস্থানের কথা আমি কাহাকেও বলিব না; এমন কি আমার ঘরে যে সিঁদ হইয়াছে তাহাও আমি কাহাকেও কহিব না।” 

আমার কথার উত্তরে মসলিম্ কহিল, “আমাদিগের কোনরূপ উদ্দেশ্য আছে বলিয়াই আমরা তোমাকে এই স্থানে আনিয়াছিও এই স্থানে তোমাকে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছি। তুমি যতই কেন রোদন করনা বা এই স্থান হইতে পলায়ন করিবার যতই কেন চেষ্টা করনা কিছুতেই তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে না। অভাব পক্ষে পোনের দিবস কাল তোমাকে এই স্থানে থাকিতে হইবে, তাহার পর তোমাকে ছাড়িয়া দিব, তুমি ইচ্ছামত আপন স্থানে গমন করিও। এখানে যে কয় দিবস তুমি থাকিবে, সেই কয় দিবস তোমার কোনরূপ কষ্ট হইবে না, তুমি আমাদিগের প্রস্তুত আহারীয় খাইতে চাহিলে অনায়াসে খাইতে পারিবে; আর তাহা যদি না চাও তাহা হইলে তোমার যে কোন দ্রব্যের প্রয়োজন হইবে তাহা আমাদিগকে বলিবা মাত্রই প্রাপ্ত হইবে ও স্বহস্তে অনায়াসেই রন্ধনাদি করিয়া খাইতে পারিবে। এই স্থানে তোমাকে আর একটি কথা বলিয়া রাখি, মনোযোগ দিয়া তাহা শ্রবণ কর। তোমার যথা সৰ্ব্বস্ব যে আমরা অপহরণ করিয়া আনিয়াছি, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই; কিন্তু জানিও, যে পোনের দিবস কাল তুমি এই স্থানে অবস্থিতি করিবে সেই পোনের দিবসের মধ্যে আমরা জানিতে পারিব তুমি কিরূপ চরিত্রের স্ত্রীলোক, তুমি কিরূপ আমাদের আজ্ঞানুবর্ত্তী হইয়া চল ও তুমি কোনরূপ দয়ার পাত্রী কি না? যদি বুঝিতে পারি যে তুমি প্রকৃতই দয়ার পাত্রী, তাহা হইলে তুমি নিশ্চয় জানিও যে তোমার অপহৃত দ্রব্যের কিয়দংশ আমরা তোমাকে প্রত্যার্পন করিব। উহা লইয়া তুমিও আপন স্থানে প্রত্যাগমন করিতে পারিবে। আর যদি জানিতে পারি যে তুমি দয়ার পাত্রী নহ, তাহা হইলে ঐ পোনের দিবস পরে তোমাকে এই স্থান হইতে দূরীভূত করিয়া দিব”। এই বলিয়া মসলিম্ সে স্থান হইতে প্রস্থান করিল। 

মসলিমের প্রমুখাৎ এই অবস্থা অবগত হইয়া আমি মনে মনে স্থির করিলাম যে দস্যুগণের সহিত কলহ করিয়া কোন লাভ নাই। পোনের দিবস কাল উহারা আমাকে এই স্থানে রাখিবে বলিতেছে। এখন আমি যতই চেষ্টা করি না কেন ইহাদিগের হস্ত হইতে উদ্ধার পাইবার কোনরূপ উপায় করিয়া উঠিতে পারিব না; অথচ যদি উহাদিগের কথা প্রকৃত হয়, উহাদিগকে সন্তুষ্ট করিতে পারিলে আমার ঘর হইতে অপহৃত দ্রব্যের কিয়দংশ যদি প্রত্যর্পন করে, তাহা হইলেও আমার বৃদ্ধ বয়সে কিছু না কিছু সংস্থান হইবে। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমি সেই স্থানে পোনের দিবস কাল অবস্থিতি করিয়া যদি উহাদিগকে কোনরূপে সন্তুষ্ট করিতে পারি তাহার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। আহারাদি করিবার নিমিত্ত যে কোন দ্রব্য আমি উহাদিগের নিকট হইতে যাচিঞা করিতাম তাহা প্রাপ্ত হইতাম। উহা স্বহস্তে রন্ধন করিয়া আমি ভক্ষণ করিতাম ও আমার নির্দ্দিষ্ট প্রকোষ্ঠে শয়ন ও উপবেশন করিয়াই দিনযাপন করিতাম। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

যে দিবস দিবা দ্বিপ্রহরের সময় মসলিমের সহিত আমার কথাবার্তা হইয়াছিল, সেই রাত্রিতে ঐ বাড়ীর ভিতর একটি ভয়ানক লোমহর্ষণ ব্যাপার সংঘটিত হয়। সেই দিবস সন্ধ্যার পর মসলিম্ ও অপর দুই ব্যক্তি ঐ বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া যায় ও রাত্রী আন্দাজ নয়টার সময় উহারা একটি স্ত্রীলোকের সহিত পুনরায় প্রত্যাগমন করে। ঐ স্ত্রীলোকটি যখন ঐ বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হয় তখন আমি উহাকে দেখিয়াছিলাম। এ স্ত্রীলোকটি অতিশয় সুন্দরী না হইলেও বয়ঃক্রমে তাহাকে যুবতী বলিয়া অনুমান করিয়াছিলাম ও দেখিয়াছিলাম উহার অঙ্গে অনেকগুলি সুবর্ণনির্ম্মিত অলঙ্কার ছিল। কিন্তু ঐ স্ত্রীলোকটি যে কে, কোথায় হইতে সে আনীতা হইল ও কেনই বা আসিল তাহা আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। যে ঘরে আমার থাকিবার স্থান নির্দিষ্ট হইয়াছিল, তাহারই পার্শ্বে একটি প্রকোষ্ঠে উহাকে রাখিল। কেবল একমাত্র স্ত্রীলোককে ঐ বাড়ীর ভিতর দেখিতে পাইয়া তাহার সহিত কথা কহিবার মানসে আমি তাহার নিকট গমন করিলাম, কিন্তু মসলিম উহা দেখিতে পাইয়া আমাকে উহার নিকট যাইতে নিষেধ করিল; সুতরাং অনন্যোপায় হইয়া আমি আপন প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিলাম। এই উভয় প্রকোষ্ঠের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র গবাক্ষ ছিল। উহা সৰ্ব্বদা বন্ধ থাকিত, আমার প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিয়া ঐ গবাক্ষটি ধীরে ধীরে অতি অল্প পরিমাণে উন্মোচীত করিলাম। অর্থাৎ এরূপ ভাবে ও এরূপ পরিমাণে উহা খুলিলাম যে উহা দেখিয়া কেহ অনুমান করিতে না পারেন যে আমি উহা খুলিয়াছি। অথচ উহার মধ্য দিয়া আমি দেখিতে পাই যে অপর প্রকোষ্ঠে কি হইতেছে। 

ঐ স্ত্রীলোকটিকে মসলিম্ প্রথমতঃ সঙ্গে লইয়া সেই ঘরের ভিতর উপবেশন করিল। ঐ দস্যুগণের মধ্যে হইতে এক এক করিয়া ক্রমে আরও পাঁচ ছয় জন লোক ঐ ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া ক্রমে সকলে একত্রে উপবেশন করিল ও ঐ স্ত্রীলোকটির সহিত ক্রমে উহারা হাসি ঠাট্টা আরম্ভ করিয়া সময় অতিবাহিত করিতে লাগিল। ক্রমে রাত্রি দশটা বাজিয়া গেল, যে বাড়ীটির কথা আমি বলিতেছি তাহা একে নির্জন স্থানে স্থাপিত ছিল, তাহার উপর রাত্রি অধিক হইবার সঙ্গে সঙ্গে ঐ স্থান আরও নিস্তব্ধ হইয়া পড়িল। সেই সময় দেখিলাম একটি সামান্য তুচ্ছ কথা অবলম্বন করিয়া ঐ স্ত্রীলোকটির সহিত উহারা ক্রমে বচসা আরম্ভ করিল। আমি আমার ঘরে বসিয়া উহাদিগের আদ্যোপান্ত অবস্থা দর্শন ও উহাদিগের কথাবার্তা সমস্তই শ্রবণ করিয়াছিলাম, সুতরাং আমি বেশ জানিলাম যে এই কলহে ঐ স্ত্রীলোকটির কিছুমাত্র দোষ ছিল না, সমস্ত দোষই ঐ দস্যুগণের। স্ত্রীলোকটি ভাল কথা বলিলেও উহারা তাহার বিপরীত অর্থ করিয়া, তাহার সহিত মিথ্যা কলহ করিতে আরম্ভ করিল। প্রথম প্রথম আমি বুঝিতে পারিলাম না যে উহারা নিরর্থক ঐ স্ত্রীলোকটির সঙ্গে কলহ করিতেছে কেন? আমি তখন বুঝিতে পারিলাম না যে এই নিরর্থক কলহের উদ্দেশ্য কি? ও তখন আমি বুঝিতে পারিলাম না যে ঐ কলহে ঐ দস্যুগণের কোনরূপ স্বার্থ আছে কি না? কিন্তু পরে জানিতে পারিয়াছিলাম যে, কিরূপ ভয়ানক স্বার্থের বশবর্তী হইয়া উহারা ঐ স্ত্রীলোকটির সহিত এই মিথ্যা কলহ উপস্থিত করিয়াছিল। পরে জানিতে পারিয়াছিলাম যে উহারা সামান্য স্বার্থের বশবৰ্ত্তী হইয়া কি ভয়ানক নিশ্বংস কার্য্যে প্রবৃত্ত হইবার মানসে এই কলহের সূত্রপাত করিয়াছিল। পরে জানিতে পারিয়াছিলাম যে সেই নিতান্ত সামান্য স্বার্থ কি ও সেই স্বার্থের বশবর্তী হইয়া উহারা কিরূপ ভয়ানক কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিল। 

আপনারা অনেক দস্যু দেখিয়াছেন; দস্যুবৃত্তি যাহাদিগের ব্যবসা, দস্যুবৃত্তি করিয়া যাহারা জীবন ধারণ করিয়া থাকে এরূপ শত সহস্র দস্যু আপনাদিগের হস্তগত হইলেও এরূপ দস্যু আপনারা কখনই দেখেন নাই। আপনারা অনেক হত্যাকারী দেখিয়াছেন, অনেক হত্যা মোকদ্দমার আপনারা অনুসন্ধান করিয়াছেন, অনেক হত্যাকারী, আপনাদিগের সম্মুখে দণ্ডনীয় হইয়া চির জীবনের নিমিত্ত ইহলোক পরিত্যাগ করিয়া পরলোক গমন করিয়াছে; কিন্তু আমি বলিতে পারি এরূপ হত্যাকারী এ পর্য্যন্ত আপনাদিগের হস্তগত হয় নাই। 

ঐ স্ত্রীলোকটির সহিত কলহ বাধাইয়া দিয়া দেখিলাম সকলেই একপক্ষ অবলম্বন করিল। সকলেই ঐ স্ত্রীলোকটির বিপক্ষে দণ্ডায়মান হইয়া তাহাকে যৎপরোনাস্তি গালিগালাজ করিতে লাগিল, কেহ কেহ বা তাহাকে অল্প অল্প প্রহার দিতেও পশ্চাৎপদ হইল না; কেহ বা তাহার অঙ্গ হইতে কতকগুলি অলঙ্কার উন্মোচিত করিয়া লইল। স্ত্রীলোকটিকে সকলই সহ্য করিতে হইল। প্রথম প্রথম সে একটু জোর করিয়াছিল, কিন্তু পরে বুঝিল সেই স্থানে সেই অবস্থায় জোর করিলে তাহার অপকার ভিন্ন উপকারের সম্ভাবনা নাই। প্রথম প্রথম সে চিৎকার করিয়াছিল কিন্তু পরে দেখিল চিৎকার করিতে গিয়া হিতের পরিবর্তে তাহার বিপরীত ফল ফলিতে আরম্ভ করিল। উহাদিগের মধ্যে একজন বলিয়া উঠিল, যদি ও চিৎকার করিবার চেষ্টা করে তাহা হইলে উহার মুখের ভিতর একখানি বস্ত্র প্রবিষ্ট করাইয়া দেও। এই কথা শুনিয়া ঐ স্ত্রীলোকটি আর কোনরূপ কথা বলিতে সাহসী হইল না। সেই স্থানে বসিয়া বসিয়াই মনের দুঃখে কষ্টে ও যন্ত্রণায় কেবল অশ্রুজল বিসর্জ্জন করিয়া আপনার বুক ভাসাইতে লাগিল। ঐ স্ত্রীলোকটি যে কে কেনই বা সে ঐ স্থানে আসিল ও কি নিমিত্তই বা তাহার উপর এইরূপ অত্যাচার হইতেছে তাহার কিছুমাত্র আমি অনুমান করিয়া উঠিতে পারিলাম না। সেই সময় দেখিলাম আর একটি লোক সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল, তাহাকে দেখিয়া অপরাপর ব্যক্তিগণ যেন একটু জড়সড় হইয়া পড়িল। সেই ব্যক্তি উহাদিগকে গালি দিতে আরম্ভ করিল ও কহিল “এই নিঃসহায় স্ত্রীলোকটির উপর তোরা এরূপ অত্যাচার করিতেছিস কেন? সামান্য স্ত্রীলোকের উপর অত্যাচার করিয়া তোদের কি লাভ হইতেছে?” এই বলিয়া ঐ স্ত্রীলোকটির দিকে লক্ষ্য করিয়া কহিল— “তোমার দেখিতেছি বড়ই কষ্ট হইয়াছে, ও পিপাসায় তোমার মুখ শুখাইয়া গিয়াছে।” জল আনিয়া আমি তোমাকে দিতেছি, পান করিয়া একটু সুস্থ হও, তাহার পর আমি তোমাকে তোমার স্থানে পাঠাইয়া দিব। এই বলিয়া এক গ্লাস জল আনিয়া সে ঐ স্ত্রীলোকটির হস্তে প্রদান করিল। স্ত্রীলোকটি প্রকৃতই অতিশয় তৃষাতুরা হইয়া পড়িয়াছিল। জলপূর্ণ গ্লাস তাহার হস্তে প্রদান করিবা মাত্র সে এক নিশ্বাসে ঐ এক গ্লাস জল পান করিল। জল পান করিবার পর হইতেই তাহার অবস্থা যেন কেমন একরূপ বোধ হইতে লাগিল। ক্রমে যন্ত্রণায় সে ছটফট করিতে আরম্ভ করিল; এইরূপে কিয়ৎক্ষণ পর্য্যন্ত সে ভয়ানক যন্ত্রণা ভোগ করিয়া ক্রমে সে সেই স্থানে শয়ন করিল, ও ক্রমে সে সমস্ত যন্ত্রণার হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইল। এই অবস্থাদৃষ্টে তখন আমার যেন অনুমান হইল যে যাহারা তাহার সহিত মিথ্যা কলহ উৎপাদন করিয়া তাহাকে নানারূপে যন্ত্রণা প্রদান করিতেছিল, তাহার উপর যাহারা তাহাকে প্রহারাদি করিয়া তাহার মনের কষ্ট ও যন্ত্রণাকে দ্বিগুণিত করিতেছিল, তাহাদিগকে নিতান্ত নির্দয় ভাবে গ্রহণ করিলেও এখন দেখিতেছি ঐ স্ত্রীলোকের নিতান্ত ইষ্টকারী পরিচয়ে যিনি আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন, তাহার অপেক্ষা উহারা সহস্র গুণে ভাল। উহারা শত্রু পরিচয়েই উহাকে কষ্ট প্রদান করিতেছিল কিন্তু মিত্র পরিচয়ে উহার সর্ব্বনাশ সাধন করে নাই। মিত্র জ্ঞানে যাহাকে বিশ্বাস করা যায়, তাহার দ্বারা এইরূপ কার্য্য সমাধান হইলে তাহাকে কি বলিয়া যে অভিবাদন করিতে হয়, তাহা আমার ন্যায় সামান্য বুদ্ধির স্ত্রীলোক অবগত নহে। জানিনা এই কার্য্য সকলের পরামর্শ মত হইল কি না, জানিনা সকলে পরামর্শ করিয়া কেহ বা তাহার শত্রু ও কেহ বা তাহার মিত্র সাজিয়া এই ভয়ানক কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিয়া ঐ স্ত্রীলোকটির সর্ব্বনাশ সাধন ও তাহার পরিহিত অলঙ্কার গুলি অপহরণ করিল কি না? জানিনা এই হত্যা কাণ্ডে সকলেই সম্মিলিত আছে কি না? 

এই রূপে হত হইয়া ঐ স্ত্রীলোকটি ঐ ঘরের মধ্যেই পড়িয়া রহিল। দস্যুগণ উহার অঙ্গস্থিত অলঙ্কারগুলি খুলিয়া লইয়া, ঐ ঘরে তালাবদ্ধ করিয়া দিয়া তাহাদিগের থাকিবার ঘরে গমন করিল। এই অবস্থা দেখিয়া আমারও অন্তরাত্মা শুখাইয়া গেল, আমিএ এক রূপ হতবুদ্ধি ও অজ্ঞান হইয়া আমার ঘরের মধ্যে পড়িয়া রহিলাম। পর দিবস প্রত্যূষে দেখিলাম যে ঘরের ভিতর উহারা ঐ মৃত দেহ তালাবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিল ঐ ঘর উন্মোচিত অবস্থায় রহিয়াছে ও উহার ভিতর মৃত দেহ প্রভৃতি কিছুই নাই। রাত্রিকালে উহারা যে ঐ মৃত দেহ কোথায় লইয়া গেল তাহার কিছু মাত্র অবগত হইতে পারিলাম না। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

সেই দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। আমি দ্বিতল হইতে সমস্ত দিবসের মধ্যে অবতরণ করিলাম না। সে দিবস আমার মনের গতিক এরূপ অবস্থায় পরিণত হইয়াছিল যে, আমার কিছুই ভাল লাগিল না, এমন কি সে দিবস আহারাদি করিতেও আমার প্রবৃত্তি হইল না। আমি আপন ঘরের মধ্যে অবস্থিতি করিয়াই সমস্ত দিবস অতিবাহিত করিলাম। সমস্ত দিবস এক স্থানে বসিয়া থাকিতে থাকিতে আমার মন যেন নিতান্ত অস্থির হইয়া পড়িল। তখন সন্ধ্যা অতীত হইয়া গিয়াছে সেই সময় আমি একবার ঐ বাড়ীর নিম্নতলে অবতরণ করিলাম কিন্তু দেখিতে পাইলাম এক খানি চারপায়ের উপর ঐ মৃত দেহটি একটি ঘরের মধ্যে রক্ষিত আছে। রাত্রিকালে উহার মৃত্যু হইয়াছে, মৃত্যুর পর অবশিষ্ট রাত্রি অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে। তাহার পর সমস্ত দিবস গত হইয়া পুনরায় রাত্রি আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে, ইহার মধ্যে ঐ মৃত দেহের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া হয় নাই কেন? বা উহাকে ঐ ঘর হইতে স্থানান্তরিত করাই বা হয় নাই কেন? মনে মনে আজ নানা চিত্তা আসিয়া উপস্থিত হইল। কিন্তু সাহস করিয়া আমার মনের কথা কাহাকেও জিজ্ঞাসা করিতে সাহসী হইলাম না। আর জিজ্ঞাসা করিলেই বা উহারা আমাকে তাহাদিগের অভিসন্ধির কথা বলিবেই বা কেন? সেই সময়ে আমার মনের যেরূপ অবস্থা হইয়াছিল তাহা আপনারা কিছু মাত্র অনুমান করিতে পারিবেন না। আমি মনে করিলাম ঐ স্ত্রীলোকটির অবস্থা আমার সম্মুখে যাহা ঘটিল পরে আমার অদৃষ্টেও সেই অবস্থা ঘটিবে। এক দিবস না এক দিবস কোনরূপ ছল অবলম্বন করিয়া ইহারা আমাকেও ঐ স্ত্রীলোকটির অনুগামিনী করিবে। মনে মনে এরূপ ভাবিয়া পুনরায় আমি আপন প্রকোষ্ঠে আগমন করিলাম ও সেই স্থানে শুইয়া নানারূপ চিন্তায় সেই রাত্রি অতিবাহিত করিলাম। আমি ভয়ানক বিপদে পতিত হইয়া ঐ স্থানে আবদ্ধাবস্থায় অতিবাহিত করিলেও, সময় সময় নিদ্রাদেবী আমার উপর অনুকম্পা প্রকাশ করিতেন, কিন্তু জানিনা কি ভাবিয়া সমস্ত রাত্রির মধ্যে এক বারের নিমিত্ত তিনি আমাকে দর্শন দিলেন না। পর দিবস প্রত্যূষে আমি আপন প্রকোষ্ঠ পরিত্যাগ করিয়া পুনরায় নিম্নতলে গমন করিলাম কিন্তু সেই সময় ঐ মৃত দেহ আর সেই স্থানে দেখিতে পাইলাম না। উহা যে কোথায় গেল, কে লইয়া গেল বা কখনই স্থানান্তরিত হইল, তাহা ও কিছু বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। মনে মনে ভাবিলাম রাত্রিকালে ঐ মৃত দেহের অন্তেষ্টি ক্রিয়া সমাপন হইয়া গিয়াছে বলিয়াই বোধ হয় উহাকে আর দেখিতে পাইলাম না। 

যে দিবস প্রত্যূষে ঐ মৃত দেহ ঐ বাড়ীর ভিতর দেখিতে পাইলাম না সেই রাত্রিতে দস্যুগণের মধ্যে আপসে যে সকল কথা হইতেছিল তাহা শুনিয়া আমার তন্দ্রা ভঙ্গ হইল। কিন্তু আমি আমার বিছানা হইতে গাত্রোত্থান না করিয়া উহাদিগের কথা গুলি বিশেষরূপ লক্ষ্য করিয়া শুনিতে লাগিলাম। যাহা শুনিলাম তাহাতে আমার অন্তরাত্মা শুকাইয়া গেল। এই ভয়ানক বিপদে পড়িয়া, কয়েদীর ন্যায় এই স্থানে বন্দী হইয়া, আমার চির দিবসের উপার্জিত সমস্ত অর্থ হইতে বঞ্চিত হইয়া আমি যেরূপ ভীত হইয়া পড়িয়াছিলাম দস্যুগণের কথা শুনিয়া আমার সেই ভীতি আরও শতগুণে বর্দ্ধিত হইল। মনে হইল উহারা আমার আরও যেরূপ ভয়ানক সর্ব্বনাশ সাধনের চেষ্টা করিতেছে তাহা অপেক্ষা আর কোনরূপ সৰ্ব্বনাশই সাধিত হইতে পারে না, কিন্তু উহারা কি স্বার্থের উপর নির্ভর করিয়া এই ভয়ানক কার্য্য সাধন করিয়া আসিয়াছে তাহারও কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। উহারা আপসে যে সকল কথাবার্তা কহিতেছিল তাহার সারাংশ আমি আপনাদিগের নিকট বলিতেছি, আপনারা বিবেচনা করিয়া দেখুন উহাদিগের এরূপ কার্য্যের উদ্দেশ্য কি। 

আমার তন্দ্রাভঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে শুনিলাম, একজন দস্যু অপর আর একজনকে কহিতেছে, “অনন্যোপায় হইয়া ঐ মৃত দেহ, আমি এই বাড়ীতে রাখিয়া দিয়াছিলাম, কারণ কবরস্থানে যখন গোল উঠিল, আমাদিগের মনোবাঞ্ছা যখন সেই স্থানে পূর্ণ করিতে পারিলাম না অথবা বুঝিতে পারিলাম যে মৃতদেহের সহিত সেই স্থানে পুলিসের হস্তে পতিত হইলে আমাদিগের আর কোনরূপেই নিষ্কৃতি নাই। তখন অনন্যোপায় হইয়া ঐ মৃতদেহ লইয়া আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম, ও উহা এই স্থানে লুকাইয়া রাখিয়া সেই সময়ের নিমিত্ত পুলিসের হস্ত হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিলাম। কিন্তু কিরূপ উপায়ে ঐ মৃতদেহের অস্তিত্ব নাশ করিতে পারিব ভাবিয়া চিন্তিয়া তাহার কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। আমরা যে স্থানে বাস করিতেছি সেই স্থান হইতে একটি মৃতদেহের সহজে অস্তিত্ব নষ্ট করা নিতান্ত সহজ নহে। হিন্দু পরিচয়ে শবদাহ করিবার জন্য কোন স্থানে উহাকে লইয়া গেলে সহজে ঐ শব দাহ করিতে সমর্থ হইব না, কারণ ঐ মৃতদেহ যে দর্শন করিবে সেই বলিবে বিষপানই ইহার মৃত্যুর কারণ। সুতরাং পুলিসের বিনা অনুমতিতে কিছুতেই উহারা ঐ মৃত দেহ ভষ্মীভূত করিতে দিবে না অথচ পুলিসের নিকট হইতে অনুমতি প্রাপ্ত হওয়াও সহজ নহে। মৃতদেহ ভষ্মীভূত করিবার অনুমতি প্রাপ্ত হওয়া দূরের কথা, পুলিস যখন ইহার মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করিবে তখন আমাদিগের জীবন রক্ষা সহজ হইয়া পড়িবে না। আর কবর স্থানে ঐ মৃত দেহ প্রোথিত করিবার নিমিত্ত লইয়া গিয়া ভয়ানক বিপদ হইতে যেরূপে জীবন রক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছি, তাহা তুমি নিজেই অবগত আছ; সুতরাং কিরূপ উপায় অবলম্বন করিলে আমরা কোনরূপে বিপদগ্রস্ত হইব না অথচ মৃতদেহের অস্তিত্ব নাশ করিতে সমর্থ হইব, তাহাই ভাবিতেছিলাম, কিন্তু ভাবিয়া চিন্তিয়া তাহার কোনরূপ উপায় স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছিলাম না। আজ মনে করিতে ছিলাম, যদি কোনরূপ উপায়ে ঐ মৃতদেহের অস্তিত্ব নাশের কোনরূপ উপায় স্থির করিয়া উঠিতে না পারি তাহা হইলে ঐ মৃতদেহ বাড়ীর মধ্যে কবলিত করিয়া এই বাড়ী পরিত্যাগ পূর্ব্বক স্থানান্তরে প্রস্থান করিব। সে যাহা হউক এখন দেখিতেছি আমাদিগকে আর এই বাড়ী পরিত্যাগ করিতে হইবে না, এই বাড়ী পরিত্যাগ করিলে আমাদিগের কার্য্যের সুবিধাজনক এরূপ বাড়ী আর যে কোন স্থানে সহজে প্রাপ্ত হইব তাহা বোধ হয় না। 

প্রথম ব্যক্তির কথা শুনিয়া দ্বিতীয় ব্যক্তি কহিল, আমি একরূপ উপায় করিয়া ঐ মৃত দেহ লুক্কায়িত করিয়া রাখিয়াছি কিন্তু ভবিষ্যতে যে কি হইবে তাহা এখন বলিতে পারিতেছি না। 

প্রথম ব্যক্তি। ঐ মৃতদেহ কোথায় লুক্কাইত করিয়া রাখিয়া আসিয়াছ? 

দ্বিতীয় ব্যক্তি। যে বৃদ্ধা আমাদিগের এই বাড়ীতে আবদ্ধা আছে তাহাকে আপনি জানেন তো? 

প্রথম ব্যক্তি। খুব জানি। যাহার ঘরে সিঁদ কাটিয়া যাহার যথা সর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া লইয়া আসিয়াছি ও যাহাকে সেই দিবস হইতে কয়েদ করিয়া এই স্থানে রাখিয়া দিয়াছি তাহাকে আর জানি না? ঐ পার্শ্বের ঘরে সে তো এখনও শুইয়া আছে। 

দ্বিতীয় ব্যক্তি। তাহার ঘরে একটি লোহার সিন্ধুক আছে তাহা আপনার মনে আছে কি? 

প্রথম ব্যক্তি। খুব মনে হয়, যাহা কিছু মূল্যবান দ্রব্য আমরা তাহার বাড়ী হইতে প্রাপ্ত হই, তাহার সমস্তই ঐ সিন্ধুকের ভিতর ছিল। 

দ্বিতীয় ব্যক্তি। ঐ লোহার সিন্ধুকের চাবিও আমরা অপহরণ করিয়া আনিয়াছিলাম। 

প্রথম ব্যক্তি। তাহাও আমার মনে আছে। লোহার সিন্ধুক হইতে মূল্যবান দ্রব্য সকল বাহির করিয়া লইয়া পুনরায় ঐ সিন্ধুক আমরা বন্ধ করিয়া দি ও চাবি লইয়া আসি। 

দ্বিতীয় ব্যক্তি। আজ সন্ধ্যার পর আমি বেড়াইতে বেড়াইতে সেই স্থানে গমন করিয়াছিলাম ও দেখিয়াছিলাম ঐ ঘরের দরওয়াজার বাহির হইতে তালা বন্ধ আছে। যে সিঁদ কাটিয়া আমরা ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিলাম সেই সিঁদ তখন পৰ্য্যন্ত বর্তমান আছে। এই অবস্থা দেখিয়া আমার মনোবাঞ্ছা পূরণ করিতে পারিব বিবেচনা করিয়া সে স্থান হইতে চলিয়া আসি। যে সময় ঐ বাড়ীতে আমরা সিঁদ দিয়া চুরী করিয়াছিলাম, তাহার পূর্ব্ব হইতেই ঐ স্থানের অধিবাসিবর্গের অবস্থা আমরা উত্তমরূপে অবগত হইয়া ছিলাম। জানিতে পারিয়াছিলাম রাত্রি ১২ টার পর ঐ পাড়ার ভিতর লোকের চিহ্ন মাত্রও দেখিতে পাওয়া যায় না। রাত্রি ১২টার পর ঐ স্থান হইতে একখানি গৃহ উঠাইয়া লইয়া গেলেও কেহ তাহা জানিতে পারে না। সেই সময় ঐ স্থানে অধিবাসিবর্গ ঘোর নিদ্রায় অভিভূত থাকে। 

ঐ গৃহের অবস্থা দর্শন করিয়া আমি এই স্থানে আগমন করিয়া আমাদিগের দলস্থিত অপর কয়েক ব্যক্তির সাহায্যে যে চারিপায়ার উপর ঐ মৃত দেহ রক্ষিত ছিল, সেই চারিপায়ার সহিত আর উহাকে লইয়া সেই স্থানে গমন করি। স্থানে স্থানে দুই একটি লোকের সহিত আমাদিগের সাক্ষাৎ হইয়াছিল বটে কিন্তু দেহ বহন করিয়া লইয়া যাইতেছি দেখিয়া কেহ আমাদিগকে কথা জিজ্ঞাসা করিল না। ক্রমে আমরা সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম ও সিঁদের সন্নিকটে ঐ চারিপায়া সন্নিবেশিত করিয়া শেষে ঐ মৃত দেহ লইয়া ঐ সিঁদ পথে আমরা সেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। ঐ ঘরের মধ্যে যে লোহার সিন্ধুকছিল ও চুরি করিবার দিবস যাহার চাবি আমরা সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিলাম মৃত দেহ লইয়া যাইবার কালীন ঐ চাবি আমি সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিলাম। মৃত দেহের সহিত ঐ ঘরের ভিতর প্রবিষ্ট হইয়া ঐ চাবির দ্বারা ঐ সিন্ধুকের খুলিলাম ও ঐ সিন্ধুকের ভিতর ঐ মৃতদেহ আস্তে আস্তে সংস্থাপিত করিয়া ঐ সিন্ধুকের চাবি বন্ধ করিলাম, ও চাবির সহিত পুনরায় ঐ সিঁদ পথে বহির্গত হইয়া ঐ চারিপায়ার সহিত সেই স্থান পরিত্যাগ করিলাম। 

প্রথম ব্যক্তি। এরূপ ভাবে ঐ মৃত দেহ ঐ স্থানে রাখিয়া আসিবার উদ্দেশ্য কি? 

দ্বিতীয় ব্যক্তি। বিনা উদ্দেশ্যে কি এই কাৰ্য্য করিয়া আসিয়াছি? প্রথমতঃ এই সিঁদ চুরি মোকদ্দমার অনুসন্ধান নিশ্চয়ই পুলিশ করিয়াছে। পুলিশ নিশ্চয়ই এই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া ঐ ঘরের অবস্থা উত্তমরূপে দর্শন করিয়া গিয়াছে। হয় তো লোহার সিন্ধুক খুলিয়া লোহার সিন্ধুকের ভিতর কি আছে না আছে তাহাও দেখিয়া লইয়াছে; এরূপ অবস্থায় দশ পাঁচ দিবসের মধ্যে কেহ যে ঐ সিন্ধুক আর খুলিবে তাহা বোধ হয় না। দশ পাঁচ দিবস ঐ সিন্ধুকের ভিতর ঐ মৃত দেহ থাকিলে ইহা পচিয়া প্রায় গলিয়া যাইবে। সেই অবস্থায় ঐ মৃত দেহ কেহ দেখিতে পাইলেও উহা যে কাহার মৃত দেহ তাহা জানিবার বা চিনিবার কোনরূপ উপায় থাকিবে না। মৃত দেহ সনাক্ত না হইলে আমাদিগের বিপদের আর কোন রূপ সম্ভাবনা থাকিবে না। 

দ্বিতীয়তঃ তারামণির ঘরে সিঁদ হইয়া চুরি হইয়াছে। তারামণি আমাদিগের এই স্থানে আবদ্ধা আছে সুতরাং তাহার পর আর কেহই তারামণিকে দেখিতে পায় নাই। ইহার পর যদি ঐ মৃত দেহ গলিত ভাবে সিন্ধুক হইতে বহির্গত হয় তাহা হইলে নিশ্চয়ই সকলকে ভাবিতে হইবে যে ঐ মৃত দেহ তারামণির, আর তারামণির গৃহে সিঁদ দিয়া তাহার যথা সর্ব্বস্ব অপহরণ, ও তাহাকে হত্যা করা অপরাধে যদি আমরা কেহ ধৃতই হই তাহা হইলে তারামণির অস্তিত্ব প্রমাণ করিতে পারিলে কোন বিচারকই আমাদিগকে কোনরূপ দণ্ড প্রদানে সমর্থ হইবেন না। মনে মনে এই অভিসন্ধি স্থির করিয়াই ঐ মৃত দেহটিকে তারামণির লোহার সিন্ধুকের ভিতর আমরা আবদ্ধা করিয়া রাখিয়া আসিয়াছি। 

প্রথম ব্যক্তি। তোমরা যে অভিসন্ধি করিয়াছ, তাহা নিতান্ত মন্দ নহে কিন্তু আমাদিগকে এখন আর এই স্থানে থাকিবার প্রয়োজন কি? এই স্থান পরিত্যাগ করিয়া আপন আপন স্থানে প্রস্থান করিলে বোধ হয় এখন ভাল হয়; কারণ যে উদ্দেশ্যে আমরা এই ঘরটি লইয়াছিলাম, আমাদিগের সেই উদ্দেশ্য অনেক পরিমাণে সফলিত হইয়াছে। এখন বোধ হয় আমাদিগের এই স্থান পরিত্যাগ করাই মঙ্গল। 

দ্বিতীয় ব্যক্তি। আমি আপনার এই প্রস্তাবে সম্মত নহি। কারণ সম্প্রতি যে দুইটি কার্য্য আমাদিগের দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে। তাহার যে অনুসন্ধান পুলিস কর্তৃক হইতেছে না তাহা নহে। যে কোন ব্যক্তি দ্বারা এই সকল কার্য্য সম্পন্ন হইয়াছে, পুলিস নিশ্চয়ই তাহার অনুসন্ধান করিয়া ফিরিতেছে। এই রূপ অবস্থায় আমরা যদি হঠাৎ এই গৃহ পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যাই, তাহা হইলে পুলিস নিশ্চয়ই আমাদের উপর সন্দেহ করিবে ও আমাদিগের নাম ধাম অবগত হইতে পারিলে আমরা যে ধৃত হইব না তাহাই বা বলি কি প্রকারে। আমরা এই স্থান হইতে আপনাপন স্থানে গমন করিলে আমরা সকলেই পৃথক হইয়া পড়িব ও পৃথক পৃথক স্থানে প্রত্যেকে পৃথক পৃথক রূপে ধৃত হইলে প্রত্যেকে হয়ত পৃথক কথা বলিয়া প্রত্যেককে বিপদ গ্রস্থ করিয়া ফেলিবে। এদিকে যে কার্য্যের নিমিত্ত আমরা একত্রিত হইয়া এই গৃহ ভাড়া করিয়াছি, সেই কার্য্য আমরা এখনও এই স্থান হইতে বিস্তর সম্পন্ন করিতে পারিব; অথচ এই বাড়ী পরিত্যাগ করিলে এই রূপ সুবিধাজনক গৃহ যে আমরা সহজে প্রাপ্ত হইব তাহাও বোধ হয় না। 

উহাদের মধ্যে এইরূপ ভাবে কথাবার্তা হইবার পর আর যে কি কথা হইল তাহা আমি আর বুঝিতে পারিলাম না। ইহার পর হইতেই উহারা যেরূপ আস্তে আস্তে কথা কহিতে আরম্ভ করিল, তাহার এক কথার মর্ম্মও আমি বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না; কিন্তু যাহা আমি শুনিলাম তাহাতেই আমার অন্তরাত্মা শুকাইয়া গেল। অপরের মৃতদেহ আমার ঘরের মধ্যে, আমার লোহার সিন্ধুকের মধ্যে রাখিয়া আসিয়াছে জানিতে পারিয়া, আমার বুদ্ধি লোপ পাইল। একে আমার এই সর্ব্বনাশ হইয়াছে তাহার উপর আবার কি সর্ব্বনাশ আসিয়া উপস্থিত হইবে তাহা ভাবিয়াই আমি হতজ্ঞান হইয়া পড়িলাম। যাহা আমি শুনিলাম তাহা আমি কখন স্বপ্নেও ভাবি নাই। চোরে চুরি করে, হত্যাকারী হত্যা করে; কিন্তু এরূপ ভাবে এক স্থানের মৃত দেহ অপর স্থানে রাখিয়া আসিতে, বা যাহার ঘরে চুরি করে তাহাকে আবার অন্য স্থানে আবদ্ধ করিয়া রাখিতে আমি ইতিপূর্ব্বে আর কখনও শ্রবণ করি নাই। আরও কিছু দিবস বাঁচিয়া থাকিলে যে দিন দিন আরও কতই কাণ্ড দেখিতে হইবে তাহার হিসাব নাই। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

তারামণির কথা শুনিয়া তখন আমরা বুঝিতে পারিলাম যে কেন আমরা মহাভ্রমে পতিত হইয়াছিলাম, তারামণিকে হত্যা করা অপরাধে মসলিম প্রভৃতিকে বিচারার্থ প্রেরণ করিয়া কেনই বা আমরা বিশেষরূপে লাঞ্ছিত ও অবমানিত হইয়াছিলাম। তারামণির লোহার সিন্ধুকের ভিতর যে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, রাসায়ণিক পরীক্ষকের পরীক্ষায় ঐ মৃতদেহের অভ্যন্তর হইতে যে কেন বিষের চিহ্ন প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছিল তাহা এখন জানিতে পারিলাম। এখন জানিতে পারিলাম কবরস্থান হইতে মতিয়া বিবি নাম্নী স্ত্রীলোকের মৃতদেহের হঠাৎ অন্তর্ধানের রহস্য কি, এখন জানিতে পারিলাম সেই সময় বহু অনুসন্ধান করিয়াও আমরা কেন মতিয়া বিবির মৃতদেহের অনুসন্ধান করিয়া উঠিতে পারি নাই। 

এই সমস্ত অবস্থা তারামণির নিকট হইতে অবগত হইয়া পুনরায় তাহাকে কহিলাম, “তারামণি তোমার কথা শুনিয়া আজ আমাদের চক্ষু ফুটিল। যে বিষয় আমরা কখনও স্বপ্নেও অনুমান করিতে পারি নাই, আজ দেখিতেছি দস্যুগণ, সেই সকল বিষয় হাঁসিতে হাঁসিতে সম্পন্ন করিয়া থাকে। যে সকল বিষয় মানব চক্ষুর অগোচর যে সকল বিষয় মানব হৃদয়ে সহজে স্থান পায় না। এখন দেখিতেছি সেই সকল বিষয় দস্যুগণের চক্ষুর সম্মুখে সতত বিদ্যমান থাকে ও উহা দস্যু হৃদয়ে সতত বিরাজ করে। দস্যুগণ ও মনুষ্য, কিন্তু জানি না কোনরূপ দৈব অনুগ্রহে উহারা মনুষ্য জ্ঞানের অতিরিক্ত বুদ্ধি ও কৌশল অবগত হইয়া থাকি কি না? সে যাহা হউক তারামণির জন্য আমরা মসলিম্ ও তাহার কয়েক জন অনুচরকে ধৃত করিয়াছিলাম, সেই সময়ে উহারা একটি স্থান আমাদিগকে দেখাইয়া দিয়াছিল ও কহিয়াছিল যে উঁহারা সেই স্থানে বাস করিয়া থাকে। কিন্তু এখন তুমি যে বাড়ীর কথা বলিতেছ, যে বাড়ীতে উহাদিগকে বাস করিতে তুমি স্বচক্ষে দেখিয়াছ সেই বাড়ী, ও যে বাড়ী আমরা দেখিয়াছিলাম ইহা এক বাড়ী নহে। তুমি বলিতে পার ইহার ভিতরেও আর কোনরূপ রহস্য আছে কি না?” 

তারামণি। আমার মনে হইতেছে, যে রাত্রিতে মতিয়া বিবি হত হয়, মসলিম তাহার সঙ্গিগণকে তাহার পর দিবসেই বলিয়াছিল, যদি কেহ কোনরূপে ধৃত হও তাহা হইলে আমাদিগের এই বাসস্থান কেহ পুলিসকে দেখাইয়া দিও না। কারণ পুলিস যদি আমাদের এই বাসস্থান জানিতে পারে তাহা হইলে তারামণি বাহির হইয়া পড়িবে ও তারামণিকে প্রাপ্ত হইলে পুলিস অনেক কথা তাহার নিকট হইতে জানিতে পারিবে। তাহা হইলে আমাদের বিপদের আর সীমা থাকিবে না। অথচ বাসস্থান দেখাইয়া না দিলে পুলিস কোনরূপেই ছাড়িবে না। এরূপ অবস্থায় আমার বিবেচনায় অপর কোন স্থানে আর একটি ঘর স্থির করিয়া রাখ। পুলিস যখন যাহাকে জিজ্ঞাসা করিবে তখন সে যেন ঐ ঘর পুলিসকে দেখাইয়া দেয়। 

আমি। তারামণি, তোমার কথাই প্রকৃত বলিয়া বোধ হইতেছে। যখন আমরা উহাদিগকে ধরিয়াছিলাম তখন প্রকৃতই উহারা আমাদিগকে একটি ঘর দেখাইয়া দিয়াছিল, কিন্তু অনুসন্ধান করিয়া আমাদের মনে প্রতীত জন্মিয়াছিল যে উহারা যে ঘর আমদিগকে দেখাইয়া দিতেছে সে ঘরে উহারা বাস্তবিকই বাস করে না। আচ্ছা তারামণি, তোমাকে আর একটি কথা জিজ্ঞাসা করি, বেশ মনে করিয়া দেখ, উহাদিগের নিকট হইতে মতিয়া বিবি সম্বন্ধে যদি কোন কথা শুনিয়া থাক? কারণ যে স্ত্রীলোকটিকে উহারা বিষ প্রয়োগে হত্যা করিয়াছিল, ও যাহাকে মসলিমের স্ত্রী মতিয়া বিবি পরিচয়ে কবর স্থলে লইয়া গিয়াছিল ও এখন জানিতে পারিতেছি তোমার ঘরে তোমার লোহার সিন্ধুকের ভিতর যাহার মৃত দেহ উহারা লুকিয়া রাখিয়াছিল, সেই স্ত্রীলোকটি কে? 

তারামণি। আমার যেন অল্প অল্প মনে হইতেছে, যে এক দিবস উহাদের মধ্যে এইরূপ কথা বার্তা হইতেছিল— এক ব্যক্তি কহিল সহরে উহার সম্বন্ধে কোনরূপ উচ্চ-বাচ্য বা কোনরূপ কথাবার্তা কিছু শুনিতে পাইতেছ? 

অপর ব্যক্তি। না কিছুই তো শুনিতে পাইতেছি না। যাহা ত্রিকুলে কেহ নাই তাহার আর কে অনুসন্ধান করিবে? প্রথম ব্যক্তি। ত্রিকুলে কেহ নাই একথা তুমি কিরূপে বলিতেছ। আমি শুনিয়াছি উহার একটি চাকর আছে দুইটা চাকরাণী আছে ও উপপতীর ন্যায় এক ব্যক্তির আশ্রয়ে সে বাস করিয়া থাকে; ইহা যদি প্রকৃত হয় তাহা হইলে উহাকে বেওয়ারিস্ বলিব কিরূপে? 

দ্বিতীয় ব্যক্তি। তুমি যাহা বলিলে তাহা সত্য, কিন্তু সব সময়ে ও একাকী বাহিরে গমন করিয়া থাকে ও এমন কি দশ পোনের দিবস পর্য্যন্ত কোন বাবুর বাগানে একাকী বাস করিয়া আমোদ আহ্লাদ করিতে পরাঙ্মুখ হয় না। এই জন্য উহার কেহ অনুসন্ধান করে না। 

তারামণির নিকট হইতে মতিয়া বিবির কথা যাহা কিছু জানিতে পারিলাম তাহাতে বুঝিলাম যে ইহাতে আমাদিগের অনেকটা উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইবে। আরও জানিতে পারিলাম, মলিম্ মতিয়া বিবিকে তাহার বণিতা বলিয়া যে পরিচয় দিয়াছিল তাহা মিথ্যা, সে এক জনের বণিতা নহে, বার বণিতা। সে এক জনের আশ্রয়ে কখনও বাস করিত না- দশ জনের আশ্রয় অবলম্বন করিয়া জীবন ধারণ করিত। তাহার থাকিবার নির্দ্দিষ্ট স্থান থাকিলেও সময়ে সময়ে সে বাবুদিগের সহিত বাগানে গিয়া দিন যাপন করিত। এরূপ অবস্থায় মতিয়া বিবি যে কে, কোথায় তাহার বাস স্থান, তাহার চাকর চাকরাণী ও উপপতী প্রভৃতি কে কোথায় আছে তাহা এখন অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিতে বিশেষরূপ কষ্ট হইলেও একেবারে দুঃসাধ্য হইবে না। আরও মনে করিলাম মতিয়া বিবির বন্ধু বান্ধব প্রভৃতিকে অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিতে পারিলে আরও অনেক নূতন কথা নিশ্চয়ই বাহির হইবে। তখন হয় ত মসলিম্ ও তাহার অনুচরবর্গের 

পুনরায় অনুসন্ধানের বিশেষ প্রয়োজন হইয়া পড়িবে। তখন হয় ত উহাদিগের উপর মতিয়া বিবিকে হত্যা করার নিমিত্ত হত্যা মোকদ্দমার অবতারণা করিয়া পুনরায় ঐ মোকদ্দমার অনুসন্ধান ক্ষেত্রে আমাদিগকে বিচরণ করিতে হইবে। তারামণির মোকদ্দমায় উহাদিগকে কোনরূপ দণ্ড প্রদান করাইতে আমরা সমর্থ হই নাই। কিন্তু জানি না, মতিয়া বিবির মোকদ্দমায় উহারা পুনরায় নিষ্কৃতি পাইবে কি না। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ

তারামণিকে উহাদের সম্বন্ধে আরও অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলাম কিন্তু আমাদিগের কার্য্যোপযোগী আর কোন বিশেষ কথা প্রাপ্ত হইলাম না। 

আমাদিগের উপরিতন কর্ম্মচারীর আদেশ ছিল এই মোকদ্দমার পুনরায় অনুসন্ধান করা, মতিয়া বিবির মৃত্যু রহস্য উদঘাটন করা, ও যাহাতে মসলিম্ প্রভৃতির কৃত কর্ম্মের উপযুক্ত দণ্ড হয় তাহার সাধ্যমত চেষ্টা করা। সুতরাং তারামণির নিকট হইতে যে সকল বিষয় আমরা জানিতে পারিলাম তাহা কোনরূপে উপেক্ষা করিতে পারিলাম না। পুনরায় অনুসন্ধান ক্ষেত্রে উপনীত হইয়া এই কঠোর কার্য্য স্বহস্তে গ্রহণ করিলাম। 

কলিকাতার মধ্যে যে যে স্থানে যেরূপ বারবনিতাদিগের বাসস্থান তাহা আমরা জানিতাম। যে সকল বারবনিতাগণ নৃত্যগীতে পটু ও বাবুদিগের বাগানে বাগানে অবস্থিতি করিয়া যাহারা আপনাপন জীবিকা নির্ব্বাহ ও অলঙ্কার ও অর্থের সংস্থান করিয়া থাকে তাহাদিগের অনেকেই আমাদিগের পরিচিত না থাকিলেও আমরা উহাদিগের অনেকেরই সন্ধান রাখিতাম। 

এই বিষয়ের অনুসন্ধান করিবার প্রথম সোপান মতিয়া বিবির বাসস্থানের অনুসন্ধান; অর্থাৎ সে যে কোথায় থাকিত ও কাহার দ্বারা প্রতিপালিত হইত তাহার বিস্তারিত বিবরণ জানিবার নিমিত্ত আমরা প্রথমেই প্রবৃত্ত হইলাম। মতিয়া বিবি এই নাম শুনিয়া আমাদিগের প্রথম হইতেই বিশ্বাস হইয়াছিল যে সে কোন মুসলমানী বেশ্যা। ঐ রূপ মুসলমান বেশ্যাগণের অধিকাংশই প্রায় ফৌজদারী বালাখানার সন্নিকটবর্ত্তী স্থানে বাস করিয়া থাকে। সুতরাং ঐ স্থানে আমরা গিয়া প্রথম অনুসন্ধান আরম্ভ করিলাম। মতিয়া বিবি নাম্নী কোন স্ত্রীলোক অথবা অপর নামধারিণী অপর কোন বিলাসিনী ঐ স্থান হইতে অন্তর্হিতা হইয়াছে কি না তাহা জানিবার জন্য বিশেষরূপ চেষ্টা করিলাম; কিন্তু ঐ স্থান হইতে কোন স্ত্রীলোকের অন্তর্হিতা হইবার কোনরূপ সন্ধানই প্রাপ্ত হইলাম না। 

মৃত স্ত্রীলোকটির নাম মতিয়া বিবি, ইহা দস্যুগণের মুখ হইতেই প্রকাশিত হইয়াছে ও উহাদিগের নিকট হইতে জানিতে পারা গিয়াছে যে মতিয়া বিবি জাতিতে মুসলমান। এদিকে মুসলমান বেশ্যাগণের মধ্য হইতে ওরূপ কোন স্ত্রীলোক অন্তর্হিতা হইয়াছে জানিতে না পারিয়া স্বভাবতই আমাদিগের মনে সন্দেহ হইল, যে দস্যুগণ যাহাকে হত্যা করিয়াছে তাহার নাম মতিয়া বিবি নহে ও সে জাতিতে মুসলমানও নহে। মসলিম্ মিথ্যা কথা বলিয়া উহার মিথ্যা পরিচয় দিয়াছিল। 

মনে মনে এইরূপ অনুমান করিয়া তখন হিন্দু বিলাসিনীদিগের মধ্যে আমরা অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। যেরূপ প্রকৃতির স্ত্রীলোকের অনুসন্ধানে আমরা প্রবৃত্ত হইলাম তাহাদিগের অধিকাংশই প্রায় সোনাগাছির ও তাহার নিকটবর্ত্তী স্থানে বাস করিয়া থাকে; সুতরাং ঐ স্থানে গিয়া আমাদিগকে অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইতে হইল। সোণাগাছির মধ্যে ঐরূপ প্রকৃতির অনেক স্ত্রীলোক বাস করিয়া থাকে। তাহাদিগের মধ্যে একটিকে আমি উত্তমরূপে জানিতাম, সেও আমাকে ভালরূপে চিনিত। সম্ভ্রান্তশালী ব্যক্তিগণের বাগানে বাস করাই উহার প্রধান ব্যবসা। আমি সোনাগাছির মধ্যে প্রবেশ করিয়া সর্ব্বপ্রথম উহারই নিকট গমন করিলাম ও কিরূপ লোকের অনুসন্ধানের নিমিত্ত আমি সেই স্থানে গমন করিয়াছিলাম তাহার সমস্ত অবস্থা আমি তাহাকে কহিলাম। আমার কথা শুনিয়া সে পাঁচ সাতটি স্ত্রীলোকের নাম ও ঠিকানা আমাকে বলিয়া দিল ও কহিল, ইহাদিগের মধ্যে বেলা নাম্নী স্ত্রীলোকটি অতিশয় মদ্যপায়ী। মদ্যপান না করিয়া সে একটি দিবসও অতিবাহিত করিতে পারে না। কোন ধনশালী ব্যক্তি যদি তাহাকে বাগানে লইয়া যায় ও যদি নিয়মিতরূপে সে সেই স্থানে মদ্যপান করিতে পায় তাহা হইলে সময় সময় মাসাবধি পর্যন্ত সে সেইস্থানে পড়িয়া থাকে। সে আরও কহিল সে অনেক দিবস পর্য্যন্ত তাহাকে দেখে নাই ও বলিতে পারে না সে এখন কোথায় আছে। উহার নিকট হইতে এই অবস্থা অবগত হইবামাত্রই আমার উত্তমরূপ অনুমান হইল যে, মতিয়া বিবি বেলা ভিন্ন আর কেহই নহে। দস্যুগণ এই বেলাকেই এই স্থান হইতে লইয়া গিয়া তাহার সর্বনাশ সাধন ও তাহার যথাসর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া পরিশেষে তাহাকেই তারামণির লোহার সিন্ধুকের ভিতর আবদ্ধা করিয়া রাখিয়াছিল। 

মনে মনে এরূপ ভাবিয়া বেলা যে বাড়ীতে বাস করিত সে বাড়ীতে গিয়া উপনীত হইলাম ও জানিতে পারিলাম প্রকৃতই বেলা সেই সময় হইতে অন্তর্ধান হইয়াছে। একটি অপরিচিত লোক যে বেলার ঘরে প্রায়ই সর্ব্বদা আসিত, সেই একদিবস আসিয়া বেলাকে সঙ্গে করিয়া সেই স্থান হইতে লইয়া যায় কিন্তু এ পর্যন্ত বেলা আর প্রত্যাগমন করে নাই। বেলার একটি চাকর ও একটি চাকরাণী এখন পর্য্যন্ত ঐ বাড়ীতে বেলার ঘরে, বেলার প্রত্যাগমনের প্রত্যাশায় বাস করিতেছে। বেলার একটি উপপতি আছে। সে কোন ভদ্রবংশসম্ভূত জনৈক ধনাঢ্য ব্যক্তির গৃহতাড়িত পুত্র। নানারূপ দুষ্কর্ম্মে রত ও মদ্যপানে অনুরক্ত হইয়া পিতার যথেষ্ট অর্থ নষ্ট করায়, তাহার পিতা তাহাকে গৃহ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিয়াছেন। পূর্ব্বে এই বেলার নিমিত্ত সে বিস্তর অর্থ নষ্ট করিয়াছিল ও অলঙ্কার ও অর্থে অনেক টাকা সে বেলাকে দিয়াছিল। কিন্তু যে পর্য্যন্ত তাহার পিতা তাহাকে তাহার বাড়ী হইতে বহির্গত করিয়া দিয়াছে সেই পৰ্যন্ত সেও কপৰ্দ্দক শূন্য হইয়া পড়িয়াছে; এখন বেলাকে কোনরূপে সাহায্য করা দূরে থাকুক বেলার দ্বারাই এখন তিনি প্রতিপালিত। তাহার আহারীয়, পরিধেও ও সুরাপান প্রভৃতির সমস্ত খরচই এখন বেলা নির্ব্বাহ করিয়া থাকে। 

আমি বেলার বাড়ীতে উপনীত হইবা মাত্রই ঐ বাবুটির সহিত আমার প্রথম সাক্ষাৎ হইল। তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া অবগত হইলাম যে, যে সময়ে তারামণির গৃহে সিঁদ দিয়া তাহার যথাসর্বস্ব অপহৃত হইয়াছে প্রায় সেই সময় হইতে বেলাও তাহার ঘর পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে। নাম ধাম অজ্ঞাত একটি লোক উহার কিছু দিবস পূৰ্ব্ব হইতে বেলার ঘরে গমনাগমন করিত। বেলা তাহারই সহিত ঐ স্থান পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে, কিন্তু এ পর্যন্ত আর প্রত্যাগমন করে নাই। যাইবার সময় বেলা বলিয়া গিয়াছিল যে, কোন ধনাঢ্য ব্যক্তির বাগানে সে যাইতেছে। সেই স্থানে বোধ হয় তাহার দুই চারি দিবস বিলম্ব হইলেও হইতে পারে। সে অনেক দিবসের কথা, সেই দিবসের পর আরও কত দুই চারি দিবস অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে, কিন্তু বেলা এখন পর্যন্তও প্রত্যাগমন করে নাই। বেলার প্রত্যাগমন করিতে বিলম্ব দেখিয়া নানা স্থানে ও নানা বাগানে উহার অনুসন্ধান করা হইয়াছে কিন্তু এ পৰ্য্যন্ত কোন স্থানে বেলার সন্ধান পাওয়া যায় নাই। যে ব্যক্তি বেলাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিল তাহাকেও সেই পৰ্য্যন্ত কেহ দেখিতে পায় নাই। উহার নিকট হইতে আরও অবগত হইলাম যে বেলার অনেকগুলি সুবর্ণ নির্ম্মিত অলঙ্কার আছে। কয়েক বৎসর পূর্ব্বে মদের নেশায় বিভোর করিয়া বেলার অঙ্গ হইতে অনেক সোণার অলঙ্কার কোন ব্যক্তি চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছিল। সেই সময় হইতে বেলা কিছু সতর্ক হয় তাহার সুবর্ণ নির্ম্মিত যে সকল অলঙ্কার আছে ঠিক সেইরূপ কতকগুলি পিতলের অলঙ্কার বেলা প্রস্তুত করাইয়া তাহাতে সোণার গিল্টী করিয়া লয়। ঐ গহণাগুলি বেলা এরূপভাবে প্রস্তুত করাইয়া লইয়াছিল যে তাহা দেখিয়া পিতলের গহণা বলিয়া কেহ অনুমান করিতে পারিত না। সকলেই ভাবিত যে উহা বিশুদ্ধ সুবর্ণ নির্ম্মিত অলঙ্কার। বেলা যে সময় আপন গৃহে থাকিত কিম্বা যে সময় মদ্যাদি পান করিত না সেই সময় সে তাহার সুবর্ণ নির্ম্মিত অলঙ্কারগুলি পরিধান করিত, আর যখন সে মদ্যাদি পান করিয়া আমোদ প্রমোদে রত থাকিত, অথবা সে যখন কোন অপরিচিতস্থানে বা বাগানে গমন করিত তখন সে তাহার সেই কৃত্রিম অলঙ্কারগুলি ব্যবহার করিত। এবারও যখন সে সেই অপরিচিত ব্যক্তির সহিত গমন করিয়াছিল তখনও তাহার অঙ্গে দুই একখানি সুবর্ণ অলঙ্কার ব্যতিত প্রায় সমস্তই পিতলের গহনা ছিল। 

বেলা সম্বন্ধে ঐ সমস্ত বিষয় অবগত হইয়া যে প্রকোষ্ঠে বেলা বাস করিত তাহার ভিতর প্রবেশ করিলাম, দেখিলাম সোণাগাছি অঞ্চলে একটু ইজ্যৎদার বা অর্থশালী বেশ্যাগণ যেরূপ ধরণে বাস করিয়া থাকে ইহার বাসগৃহের অবস্থাও সেই রূপ। ঘরটি উত্তম রূপে সুসজ্জীভূতও ঘরের অভ্যন্তরীণ দ্রব্যাদি যথাযথ স্থানে বিন্যস্ত। ঘরের এক প্রান্তে একটি লোহার সিন্ধুক আছে। ঐ সিন্ধুকটি দেখিয়া আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম বেলা তাহার মূল্যবান অলঙ্কার প্রভৃতি কি এই সিন্ধুকের ভিতর রাখিয়া থাকে? আমার প্রশ্নের উত্তরে জানিতে পারিলাম ঐ লোহার সিন্ধুক ব্যতিরেকে তাহার মূল্যবান দ্রব্য রাখিবার অপর কোন স্থান নাই। আরও জানিতে পারিলাম এবার যখন সে তাহার গৃহ পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে তাহার পূর্ব্বে তাহার মূল্যবান অলঙ্কারাদি ঐ সিন্ধুকের ভিতর রাখিয়া দিয়াছিল। লোহার সিন্ধুকের চাবিও সে কখনও তাহার সঙ্গে করিয়া লইয়া যায় না; ঐ ঘরের মধ্যস্থিত একটি বাক্সের মধ্যে সে উহা বন্ধ করিয়া রাখে, কেবল ঐ বাক্সের চাবিটি তাহার সঙ্গে থাকে মাত্র। 

এই সমস্ত বিষয় অবগত হইয়া আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম, এইবেলাই সেই মতিয়া বিবি। বেলার বাগানে বেড়াইবার সাধ মসলিমের গৃহেই শেষ হইয়া গিয়াছে। পূর্ব্বে তারামণির প্রমুখাৎ অবগত হইয়াছিলাম যে মতিয়া বিবি হত হইবার পর তাহার অঙ্গস্থিত সমস্ত অলঙ্কারই অপহৃত হইয়াছিল, কিন্তু এখন যত দূর অবগত হইলাম তাহাতে সম্যক রূপে বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না যে, বেলার অঙ্গস্থিত যে সকল অলঙ্কার অপহৃত হইয়াছে তাহা মূল্যবান সোণার অলঙ্কার কি পিতলের গহনা। 

আমার মনের এই সন্দেহ মিটাইতে আর অধিক বিলম্ব করিলাম না, যে বাক্সের মধ্যে বেলার লোহার সিন্ধুকের চাবি থাকিত সেই বাক্স খুলিবার নিমিত্ত প্রথমত : চেষ্টা করিলাম কিন্তু খুলিতে না পারিয়া উহা ভাঙ্গিয়া ফেলিলাম; ও ঐ বাক্সের ভিতর অনুসন্ধান করিতে করিতে দেখিতে পাইলাম যে উহার মধ্যে এক স্থানে সিন্ধুকের চাবি লুক্কায়িত অবস্থায় রক্ষিত আছে। ঐ বাক্স হইতে সেই চাবি বাহির করিয়া সেই বাড়ীর সমস্ত লোকের সম্মুখে লোহার সিন্ধুব খুলিলাম। দেখিলাম বেলার যতগুলি সুবর্ণ নির্ম্মিত অলঙ্কার ছিল তাহার সমস্তই ঐ সিন্ধুকের ভিতর রক্ষিত আছে, সামান্য সামান্য দুই এক খানি সুবর্ণ অলঙ্কার যাহা সদা সর্ব্বদা ব্যবহার করিত কেবল তাহাই দেখিতে পাইলাম না। ঐ ঘরের মধ্যে উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়াও তাহার যে সকল পিতলের গহনা ছিল তাহার এক খানিও প্রাপ্ত হইলাম না। বুঝিলাম মলিম ও তাহার দলস্থিত ব্যক্তিবর্গ বিষয় ভ্রমে পতিত হইয়া বেলার সর্ব্বনাশ সাধন করিয়াছে, যে উদ্দেশ্যে তাহারা উহাকে হত্যা করিয়াছে তাহাদিগের সে উদ্দেশ্য সফল হয় নাই। 

যে সময় তারামণির লোহার সিন্ধুকের ভিতর স্ত্রীলোকের মৃতদেহ প্রাপ্ত হওয়া যায় সেই সময় উহার অবস্থা এরূপ ছিল না যে আমরা তাহার প্রতিমূর্তি কোনরূপে উঠাইয়া লই; সুতরাং ঐ মৃতদেহ যে বেলার তাহা আমরা বেশ বুঝিতে পারিলেও আইন অনুযায়ী কিন্তু আমরা সে কথা বলিতে পারি না। ঐ মৃত দেহ যে কাহার তাহা যখন সনাক্ত হইবার এখন কোন উপায় নাই তখন মসলিম প্রভৃতি যে বেলাকে হত্যা করিয়াছে একথা আইন অনুসারে বলিতে সমর্থ হই ও কি রূপেই বা বেলাকে হত্যা করার নিমিত্ত মলিম প্রভৃতির নামে হত্যা মোকদ্দমার অবতারণা করি। তাহা বলিয়াই যে এ মোকদ্দমার অনুসন্ধান একেবারে পরিত্যাগ করিতে হইবে তাহাই বা বলি কি প্রকারে। ঐ মৃত দেহ বেলার মৃত দেহ বলিয়া সনাক্ত না হইলেও এখনও একটু সামান্য পথ আছে। বেলার অঙ্গে সুবর্ণ বা পিত্তল নিৰ্ম্মিত যে সকল অলঙ্কার ছিল তাহার কোন অলঙ্কার যদি মসলিম বা তাহার দলস্থিত অপর কোন ব্যক্তির নিকট হইতে প্রাপ্ত হওয়া যায় তাহা হইলেও এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের পথে আমরা অনেক দূর অগ্রগামী হইতে পারিব। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ

দস্যুগণ যে বাড়ীতে তারামণিকে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিল, প্রথমতঃ তারামণির সাহায্যে সেই বাড়ীটি কোথায় তাহার অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করিলাম। পূর্ব্বে যখন তারামণিকে উহারা তারামণির বাড়ী হইতে আনয়ন করিয়াছিল তখন তাহারা গাড়ীর ভিতর তারামণিকে বন্ধ করিয়া আনিয়াছিল ও পরিশেষে তাহারা তারামণীকে বন্ধ করিয়া আনিয়াছিল ও পরিশেষে যেন যখন তাহারা তারামণিকে লইয়া বিচার গৃহে উপনীত হয় তখনও তারামণিকে গাড়ীর ভিতর বন্ধ করিয়া লইয়া গিয়াছিল; অথচ যে পর্যন্ত তারামণি সেই গৃহে বাস করিয়াছিল তাহার মধ্যে ক্ষণ কালের নিমিত্ত সে ঐ বাড়ীর বাহিরে যাইতে পারে নাই সুতরাং ঐ বাড়ীটি যে কোন স্থানে স্থাপিত তাহা তারামণি জানিত না, সুতরাং অনুসন্ধান করিয়া ঐ বাড়ী বাহির করা নিতান্ত সহজ হইল না। ঐ বাড়ীর দরওয়াজার সম্মুখে যে রাস্তা আছে তাহাতে গাড়ী যাইতে পারে, এ কথা তারামণি আমাদিগকে বলিয়াছিল। তারামণিকে সঙ্গে লইয়া সহর, সহরতলি ও তাহার নিকটবর্ত্তী স্থান সকলের মধ্যে যে যে রাস্তায় গাড়ী যাইতে পারে সেই সেই রাস্তায় গমন করিয়া ঐ বাড়ীর অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। 

অনবরত দুই তিন দিবস ঘুরিয়া ঘুরিয়া পরিশেষে তারামণি একটি বাড়ী দেখাইয়া দিয়া কহিল, যে বাড়ীতে তাহাকে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিল তাহা ঐ বাড়ীর ন্যায় কিন্তু ভতরে গিয়া দেখিতে না পারিলে ঠিক সে বলিতে পারে না ঐ বাড়ী কি না। ঐ বাড়ীর সদর দরওজায় একটি তালা লাগান ছিল সুতরাং অনুমান হইল ঐ বাড়ী এখন শূন্য অবস্থায় আছে। অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম ঐ বাড়ীর কিয়দ্দূরে একখানি মুদিখানার দোকান আছে সেই মুদির নিকট ঐ বাড়ীর চাবি থাকে। মুদির নিকট গমন করিয়া জানিতে পারিলাম ঐ বাড়ী খানি কলিকাতা সহরের জনৈক প্রসিদ্ধনাঢ্য ব্যক্তির। সহর হইতে অনেক দূরে ঐ বাড়ী খানি স্থাপিত আছে বলিয়া উহাতে প্রায়ই স্থায়ী ভাড়া হয় না; সময় সময় আবশ্যক অনুযায়ী কোন ব্যক্তির কিছু দিবসের জন্য উহার প্রয়োজন হইলে ঐ বাড়ীর ভাড়া হয়, নতুবা ঐ মুদির প্রায়ই খালি থাকে। ঐ বাড়ির নিকট হইতে আরও জানিতে পারিলাম যে গত ছয় মাস হইতে কয়েকটি লোক ঐ বাড়ীতে বাস করিতেছিল। সম্প্রতি তাহারা বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে, কিন্তু তাহারা যে কে, কোথায় তাহাদিগের বাসস্থান ও কি কার্য্য করিত তাহা কিছুই সে বলিতে পারিল না। ঐ মুদির নিকট হইতে চাবি লইয়া ঐ বাড়ীটি খুলিলাম। বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবা মাত্র তারামণি কহিল ঐ বাড়ীতেই সে এত দিবস বাস করিয়া গিয়াছে ও, মসলিম প্রভৃতি সকলে ঐ বাড়ীতে বাস করিত। ঐ বাড়ীতে মতিয়া বিবি হত হয় ও ঐ বাড়ী হইতেই তাহার মৃত দেহ স্থানান্তরিত হয়। যে ঘরে তারামণি বাস করিত সে ঘর আমাদিগকে দেখাইয়া দিল, যে ঘরে মতিয়া বিবি হত হইয়াছিল, যে ঘরে মসলিম প্রভৃতি সকলে বাস করিত, মতিয়া বিবির মৃত্যুর পর যে গরে তাহার মৃত দেহ রাখিয়া দিয়াছিল তাহা সমস্তই আমরা দেখিয়া লইলাম। ঘরের অবস্থা দেখিয়া বেশ বুঝিতে পারিলাম যে তারামণি আমাদিগকে যাহা যাহা বলিয়াছিল, তাহার একটি কথাও মিথ্যা নহে। 

ঐ বাড়ীর ভিতর আমরা উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু আমাদিগের আবশ্যক উপযোগী কোন দ্রব্য উহার মধ্যে প্রাপ্ত হইলাম না। সমস্ত ঘর গুলি বিশেষ পরিষ্কার অবস্থায় রক্ষিত ছিল, কোন দ্রব্যাদি উহার মধ্যে ছিল না। ঐ বাড়ীর দ্বিতলের উপর কিছু মাত্র প্রাপ্ত না হইয়া নিম্নতলে আসিলাম। সমস্ত ঘর পরিষ্কার করিয়া সমস্ত ঘরের আবর্জ্জনা যে স্থানে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিল, সেই স্থানটি উত্তমরূপে দেখিলাম। দেখিলাম উহার মধ্যে নিতান্ত ছিন্ন অবস্থায় দুই একখানি পত্র পড়িয়া আছে; ঐ ছিন্ন পত্রগুলি বিশেষ সতর্কতার সহিত সংগ্রহ করিলাম, দেখিলাম, উহা নাগরি ভাষায় লিখিত। পত্র ডাকে আসিয়াছে বলিয়া অনুমান হইল। আমাদিগের মধ্যে যে সকল কর্ম্মচারী ছিলেন তাহাদিগের মধ্যে একজন কিছু নাগরি জানিতেন, ঐ ছিন্ন পত্রগুলি তাহাকেই প্রদান করিলাম, উহাতে যে কি লেখা আছে তাহা জানিতে তাহার প্রায় সমস্ত দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। ঐ পত্রহইতে অবগত হইলাম, ঐ পত্রগুলি রায়বেরেলী জেলার অন্তর্গত কোন একখানি পল্লি হইতে মহম্মদ আলি নামক এক ব্যক্তি তাহার পত্র ওসমান আলিকে লিখিতেছে- ঐ পত্রের সার মর্ম্ম এইরূপ; অনেক দিবস ওসমান আলি কলিকাতা হইতে তাহার দেশে যায় নাই, তাহার পরিবারবর্গ তাহার নিমিত্ত অতিশয় ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে, যাহাতে ওসমান অভাব পক্ষে দুই চারি দিবসের নিমিত্তও বাড়ীতে যাইয়া তাহার পরিবারবর্গের সহিত সে সাক্ষাৎ করিয়া আসিতে পারে এই নিমিত্ত ওসমান এই পত্র লিখিতেছে। আরও লিখিতেছে ওসমান আলি ডাকে যে সকল দ্রব্য পাঠাইয়া দিয়াছিল তাহার সমস্তই মহম্মদ আলি প্রাপ্ত হইয়াছে। 

ঐ নাগরি পত্র হইতে যাহা কিছু অবগত হইতে পারিলাম তাহাতে বুঝিতে পারিলাম ঐ বাড়ীতে যাহারা বাস করিত তাহাদিগের মধ্যে ওসমান আলি নামক এক ব্যক্তি ছিল ও তাহার বাসস্থান রায়বেরেলী। 

মলিম্ ও তাহার অনুচরবর্গ এখানে যে যে স্থানে বাস করে বলিয়া আমাদিগকে দেখাইয়া দিয়াছিল পুনরায় আমরা সেই সকল স্থানে উহাদিগের অনুসন্ধান করিলাম ও সহর ও সহরতলীর মধ্যে তন্ন তন্ন করিয়া উহাদিগের অনুসন্ধান করিতে ত্রুটি করিলাম না, কিন্তু কোন স্থানই উহাদিগের কিছুমাত্র সন্ধান প্রাপ্ত হইলাম না। তখন একবার রায়বেরেলী গমন করিয়া ওসমান আলির অনুসন্ধান করিতে প্রস্তুত হইলাম। 

উহাদিগের দলস্থিত প্রায় সমস্ত ব্যক্তিকেই আমি চিনি সুতরাং উহাদিগকে দেখাইয়া দিবার নিমিত্ত অপর কোন ব্যক্তি বা তারামণিকে সঙ্গে লওয়ার কোন রূপ প্রয়োজন হইল না আমি কেবলমাত্র একটা কনষ্টেবল সঙ্গে লইয়া রায়বেরেলী অভিমুখে গমন করিলাম। যে গ্রামে ওসমান আলির বাসস্থান সেই গ্রামে না গিয়া মহম্মদ আলির অনুসন্ধান করায় জানিতে পারিলাম যে সেই গ্রামে মহম্মদ আলি নামক এক ব্যক্তি আছে তাহার একটি পুত্রও আছে; উহার নাম ওসমান আলি। আজ কয়েক দিবস ওসমান আলি কলিকাতা হইতে বাড়ী আসিয়াছে। 

এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া সেই স্থানের স্থানীয় পুলিশের জনৈক কর্ম্মচারীকে সঙ্গে লইয়া সেই গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইলাম ও ওসমান আলিকেও প্রাপ্ত হইলাম। উহাকে দেখিবা মাত্রই চিনিতে পারিলাম। সেও আমাকে উত্তমরূপে চিনিল। ঐ ব্যক্তি আমাদিগের সেই সৰ্ব্বজন পরিচিত মলিম্ ভিন্ন আর কেহই নহে। মসলিমের ঘরের খানা তল্লাসি করিয়া কতকগুলি অর্থ প্রাপ্ত হইলাম, ও কতকগুলি অলঙ্কারও পাইলাম। ঐ সকল অলঙ্কারের মধ্যে কতকগুলি তারামণির ঘর হইতে অপহৃত অলঙ্কার বলিয়া পরিশেষে তারামণি সনাক্ত করিয়াছিল। আর যে সকল গিটির গহনা পাওয়া গিয়াছিল তাহার অধিকাংশই বেলার গহনা বলিয়া পরিশেষে সাব্যস্ত হইয়াছিল। 

মলিকে ধৃত করিবার পর তাহার নিকট হইতে তাহার অনুসঙ্গিগণের ঠিকানা জানিয়া লইবার নিমিত্ত বিশেষরূপে চেষ্টা হইয়াছিল, কিন্তু কিছুতেই তাহার নিকট হইতে কোন কথা বাহির করিতে পারি নাই। এমন কি মসলিমের সঙ্গে তাহারা যে সকল পারিষদ, তারামণিকে হত্যা করা অপরাধে ধৃত হয়, সে তাহাদিগের পর্য্যন্ত নাম বলিল না, কহিল তাহারা কে জানি না, তাহাদিগকে চিনি না, বা তাহাদিগের সহিত একত্র কখন সে বাস করে নাই। তাহার কথা শুনিয়া তাহাকে লইয়া যখন আমরা নিতান্ত পিড়াপিড়ি করিতে লাগিলাম তখন সে মুক্তকণ্ঠে কহিল সে কোন কথার উত্তর প্রদান করিবে না, তাহাকে মারিয়া ফেলিলে বা তাহাকে টুকরা টুকরা করিয়া কাটিয়া ফেলিলেও সকলে দেখিবে যে তাহার একই কথা, সে কিছুতেই কোন কথার উত্তর প্রদান করিবে না। যাহা হউক মলিকে সেই স্থান হইতে কলিকাতায় আনিলাম। 

অপরাপর যে সকল কর্ম্মচারী এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে নিযুক্ত ছিলেন তাহারাও মলিকে লইয়া নানারূপ চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কেহ বা তাহাকে নানারূপ ভয় প্রদর্শন করিতে লাগিলেন, কেহ বা তাহাকে মিষ্ট কথায় ভুলাইয়া তাহার অন্তরের কথা বাহির করিয়া লইবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন কিন্তু কেহই কোনরূপে কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিলেন না। মলিমের অনুচরগণ যখন প্রথম ধৃত হয় সেই সময় আমরা তাহাদিগের দেশ প্রভৃতির বিষয় জিজ্ঞাসা করিয়া ছিলাম, ও তাহার উত্তরে তাহারা যাহা বলিয়াছিল তাহা লিখিয়াও লইয়াছিলাম, সেই সকল স্থানে লোক পাঠাইয়া অনুসন্ধান করা হইল, কিন্তু সেই নামের কোন ব্যক্তি বা সেরূপ কোন স্থান পাওয়া গেল না। 

মসলিমের ঘরে যে সকল অলঙ্কার পাওয়া গিয়াছিল কেবল ঐ সকল অলঙ্কার লইয়াই উহার উপর দুইটি মকদ্দমা পুনরায় রুজু হইল। একটি তারামণির গৃহে সিদ দিয়া তাহার যথা সর্ব্বস্য অপহরণ করায়, অপরটি বেলা নাম্নী স্ত্রীলোকের অঙ্গে যে সব অলঙ্কার ছিল, ও যে সকল অলঙ্কারের সহিত তাহাকে পাওয়া যাইতেছে না, সেই সকল অলঙ্কার অপহরণ করায়। 

বেলা যে হত হইয়াছে তাহার মৃতদেহ তারামণির লোহার সিন্ধুকের ভিতর পাওয়া গিয়াছে; ইহা অকাট্য সত্য হইলেও ইংরাজ আইনের গুণে যে কথা প্রমাণিত করিতে পারিলাম না। বেলাকে হত্যা করার প্রধান প্রমাণ তারামণী, কিন্তু সে বলিতে পারে না যে স্ত্রীলোকটিকে তাহার সম্মুখে হত্যা করা হইয়াছে তাহার নাম বেলা। যে মৃতদেহ লোহার সিন্ধুকের মধ্যে প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে উহা যে বেলার মৃতদেহ তাহা প্রমাণ করিবার ক্ষমতাও আমাদিগের নাই কারণ সেই সময় ঐ মৃতদেহ সনাক্ত হয় নাই বা উহার ফটোগ্রাফ প্রভৃতি কিছুই সেই সময় লওয়া হয় নাই, কারণ মৃতদেহ যখন পাওয়া যায় সেই সময় উহা নিতান্ত গলিত অবস্থায় ছিল। ফটোগ্রাফ লইবার কোনরূপ উপায় ছিল না। সুতরাং মলিম্ ওরফে ওসমান আলির উপর খুনি মোকদ্দমা কোন রূপেই রুজু হইতে পারিল না। 

উভয় মোকদ্দমাই কিন্তু আমরা পরিশেষে বিচারার্থ প্রেরণ করিলাম। মেজিষ্ট্রট সাহেব সমস্ত প্রমাণাদি গ্রহণ করিয়া তিনিও এই মোকদ্দমার প্রকৃত অবস্থা উত্তমরূপে বুঝিতে পারিলেন কিন্তু তিনি নিজে উহাদিগকে কোনরূপ দণ্ডে দণ্ডিত না করিয়া উপযুক্ত দণ্ডে দণ্ডিত হইবার নিমিত্ত তিনি উহাদিগকে দায়রায় সোপরদ্দ করিলেন। 

দায়রার বিচারে সর্ব্বপ্রথম এক মহাতৰ্ক উত্থিত হইল। একবার যখন তারামণিকে হত্যাকরা অপরাধে ও তাহার অলঙ্কারপত্র অপহরণ করা অপরাধে মসলিমের বিচার হইয়া সে অব্যাহতিপাইয়াছে তাহার উপর তখন এই মোকদ্দমা পুনরায় দিতে পারে না। তর্কের মিমাংসা পরিশেষে হাইকোর্ট হইতে হইয়া মসলিমের পুনরায় চলিতে হয়, ও বিচারে তারামণির অলঙ্কার অপহরণের নিমিত্ত তাহার কঠিন পরিশ্রমের সহিত পাঁচ বৎসর কারাদণ্ড হয়। বেলার মোকদ্দমা বেলার অবর্তমানে প্রমাণিত হয় না সুতরাং ঐ মোকদ্দমায় তাহাকে কোনরূপে দণ্ড গ্রহণ করিতে হয় না। 

[ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১১ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *