খুনিতে-খুনিতে

খুনিতে-খুনিতে

(অর্থাৎ যেমন কৰ্ম্ম তেমনই ফল!) 

প্রথম পরিচ্ছেদ

এই জগতে যিনি যেরূপ কার্য্য করিয়া থাকেন, তাহার অধিকাংশ কার্য্যের ফলই সময়ে সময়ে তিনি সঙ্গে সঙ্গে যে প্রাপ্ত হন, তাহার জ্বলন্ত দৃষ্টান্তস্বরূপ একদিবসের একটি ঘটনা আমি এই স্থানে বর্ণন করিতেছি। ইহা পাঠ করিলেই পাঠকগণ অবগত হইতে পারিবেন যে, আমাদিগের এই অনুমান কতদূর সত্য। 

প্রায় দশ বৎসর অতীত হইল, সরকারি কার্য্য উপলক্ষে আমি বাঙ্গালা প্রেসিডেন্সির মধ্যস্থিত কোন জেলার অন্তর্গত একটিথানায় গমন করিয়াছিলাম। থানা বা জেলার নাম উল্লেখ করিবার এস্থলে বিশেষ কোনরূপ প্রয়োজন নাই বলিয়া উহা পরিত্যক্ত হইল। 

আমি যে কার্য্যের নিমিত্ত সেই স্থানে গমন করিয়াছিলাম, সেই কার্য্য সম্পন্ন করিবার নিমিত্ত প্রায় মাসাবধি আমাকে সেই স্থানে অবস্থান করিতে হয়। এই একমাসকাল আমাকে যে সর্ব্বদা আমার কার্য্যোপলক্ষে ঘুরিয়া বেড়াইতে হইত, তাহা নহে; থানায় বসিয়া বসিয়াই আমার কার্য্য হইত, অথচ থানা পরিত্যাগ করিয়া কোন দূরদেশে গমন করিবার প্রায়ই প্রয়োজন হইত না। 

আমি যে থানার কথা বলিতেছি, সেই থানায় সেই সময় একজন ব্রাহ্মণ দারোগা ছিলেন। তিনি অনেকদিবস পৰ্য্যন্ত পুলিস-বিভাগে কর্ম্ম করিয়া আসিতেছিলেন। তাঁহার পেসনের সময়ও নিকটবর্তী হইয়া আসিয়াছিল; কিন্তু তাঁহার স্বভাব-চরিত্র দেখিয়া ও তাঁহার কথাবার্তা শুনিয়া তাঁহাকে “পুলিসের দারোগা” বলিয়া মনে হইত না। প্রজাগণের নিকটে তাঁহার একটু খাতিরও ছিল, এবং অনেকেই তাঁহার অবশীভূত ছিল না। 

অনেকদিবস আমাকে সেই স্থানে অবস্থান করিতে হইবে বলিয়া, সেই স্থানে গমন করিবার দুই একদিবসপরেই আমি থানার বাহিরে বাসা করিবার মানসে বন্দোবস্ত করিতেছিলাম। এই কথা তিনি কিরূপে জানিতে পারিয়া, আমাকে কতকগুলি মিষ্ট মিষ্ট ভর্ৎসনা করেন, এবং আমার অন্য স্থানে বাসা করার প্রস্তাব একবারেই বন্ধ করিয়া দেন; সুতরাং তাঁহার কথার অন্যথাচরণ করিয়া আমি আর কোন স্থানে বাসার বন্দোবস্ত করিতে সমর্থ হই না। যত দিবস আমাকে সেই স্থানে অবস্থান করিতে হয়, ততদিবস অনিচ্ছাসত্বেও আমাকে তাঁহার বাসাতেই থাকিতে হয়। 

একদিবস অতি প্রত্যূষে আমি থানার বারান্দায় বসিয়া পূর্ব্বদিবসের একখানি ইংরাজী সংবাদ-পত্র পাঠ করিতেছি, ও দারোগাবাবু সেই স্থানে বসিয়া তাঁহার হস্ত মুখ প্রক্ষালন করিতেছেন, এরূপ সময় একজন চৌকিদার দ্রুতপদে থানা-অভিমুখে আগমন করিতেছে, দেখিতে পাইলাম। 

সেই চৌকিদারের প্রতি দারোগাবাবুরও দৃষ্টি পড়িল। তিনি আমার দিকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “আজ প্রাতঃকালেই কি আপদ আসিয়া উপস্থিত হইতেছে।” 

আমি। কোথা হইতে আপদ আসিয়া উপস্থিত হইতেছে? 

দারোগা। কোথা হইতে, তাহা এখনও বুঝিতে পারিতেছি না; কিন্তু একটি যে আপদ আসিয়া উপস্থিত হইতেছে, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। 

আমি। কে আপদ সংগ্রহ করিয়া আনিতেছে? 

দারোগা। ওই যে চৌকিদার আসিতেছে দেখিতেছেন, ওই ব্যক্তি নিশ্চয়ই কোন না কোন আপদ সঙ্গে করিয়া আনিতেছে, বা কোন জরুরি বিষয়ের সংবাদ দিতে আসিতেছে। 

আমি। আপনি কিরূপে জানিতে পারিলেন? 

দারোগা। ও যেরূপ ভাবে আসিতেছে, উহার চলন দেখিয়াই আমি উহার উদ্দেশ্য বেশ অনুমান করিতে পারিতেছি। আমাদিগের মধ্যে এইরূপ ভাবে কথা হইতেছে, ইত্যবসরে সেই চৌকিদার আমাদিগের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার হস্তস্থিত পাঁচহস্ত পরিমিত বংশ্যষ্টি সেই স্থানে রাখিয়া দারোগাবাবুকে এক প্রণাম করিল। 

দারোগা। কি রে! কিছু সংবাদ আছে নাকি? 

চৌকিদার। আজ্ঞে হুজুর। 

দারোগা। কি সংবাদ?

চৌকিদার। আজ্ঞে। 

দারোগা। বেটা কেবল আজ্ঞে আজ্ঞে করিতেছে, কি সংবাদ লইয়া আসিয়াছিস্ বল না? 

চৌকিদার। আজ্ঞে বলছিলাম যে, গতরাত্রে আমাদিগের গ্রামে বড় গোলযোগ হইয়াছে। এরূপ গোলযোগ আমি আর কখনও দেখি নাই। 

দারোগা। কিরূপ গোলযোগ? 

চৌকিদার। আজ্ঞা খুব গোলযোগ হইয়াছে। 

দারোগা। বেটা স্পষ্ট করিয়া বল না, কি হইয়াছে; ডাকাইতি হইয়াছে, না খুন হইয়াছে? 

চৌকিদার। আজ্ঞে, আপনি ত অগ্রেই জানিয়াছেন, দেখিতেছি। 

দারোগা। আমি কিছুই জানি নাই, কি হইয়াছে; এখন স্পষ্ট করিয়া বল। 

চৌকিদার। আজ্ঞে, আপনি যাহা বলিলেন। 

দারোগা। তবে কি ডাকাইতি হইয়াছে?

চৌকিদার। আজ্ঞে হাঁ। 

দারোগা। কাহার বাড়ীতে ডাকাইতি হইয়াছে?

চৌকিদার। আজ্ঞে বিশ্বাসদিগের বাড়ীতে।

দারোগা। কোন সময়ে ডাকাইতি হইয়াছে?

চৌকিদার। রাত্রিতে। 

দারোগা। রাত্রিতে, তা ত শুনিয়াছি, কোন্ সময়? সন্ধ্যার পর মধ্য রাত্রিতে, কি শেষ রাত্রিতে? 

চৌকিদার। আজ্ঞে, শেষ রাত্রিতে। 

দারোগা। দ্রব্যাদি কিছু লইয়া গিয়াছে? 

চৌকিদার। তা আমি জানি না, যখন ডাকাইতি হইয়াছে, তখন কিছু না লইয়াই কি তাহারা খালি হাতে চলিয়া গিয়াছে? 

দারোগা। কিছু লইয়া গিয়াছে কি না, না জানিয়া তুই এখানে আসিলি কেন? 

চৌকিদার। আজ্ঞে লাস দেখিয়া আমার অতিশয় ভয় হইয়াছে, তাই দৌড়িতে দৌড়িতে আপনার নিকট আসিয়াছি। 

দারোগা। লাস দেখিয়া তোর ভয় হইয়াছে, বলিতেছিস্, ডাকাইতগণ কাহাকেও খুন করিয়া গিয়াছে নাকি?

চৌকিদার। আজ্ঞে হাঁ। 

দারোগা। কাহাকে খুন করিয়াছে? 

চৌকিদার। তাহা জানি না। 

দারোগা। তুই বিশ্বাসদিগের সকলকে চিনিস্ ত, তাহাদিগের মধ্যে কে হত হইয়াছে? লাস দেখিয়া তাহা চিনিতে পারিস্ নাই? 

চৌকিদার। না! 

দারোগা। তুই লাস দেখিয়াছিস্ ত? 

চৌকিদার। দেখিয়াছি; কিন্তু ভাল করিয়া দেখি নাই। 

দারোগা। কে মরিয়া গিয়াছে, স্ত্রীলোক না পুরুষ? 

চৌকিদার। স্ত্রীলোক নহে, পুরুষ। 

দারোগা। গ্রামের সকল পুরুষ মানুষকে ত তুই চিনিস্‌ তবে কেন বলিতে পারিতেছিস না যে, সে কে? 

চৌকিদার। তাহাদিগের একজনকেও চিনিতে পারি নাই। 

দারোগা। তাহারা কয়জন? 

চৌকিদার। দুইজন। 

দারোগা। দুইজনই কি মরিয়া গিয়াছে? 

চৌকিদার। হাঁ, দুইজনই মরিয়া গিয়াছে। 

দারোগা। কিরূপে মরিয়া গিয়াছে? 

চৌকিদার। তাহা জানি না। 

দারোগা। তাহাদিগের গাত্রে কোনরূপ দাগ আছে? 

চৌকিদার। কাটা দাগ আছে। রক্তে সব লাল হইয়া গিয়াছে, দেখিলেই বড় ভয় হয়। 

দারোগা। তাহা হইলে বোধ হয়, উহারা দুইজনই ডাকাইত? কেমন কি বলিস্। 

চৌকিদার। যাহা আপনি বলেন। 

দারোগা। তবে কি ডাকাইতি করিবার সময় বিশ্বাসরা ডাকাইতদিগকে খুন করিয়াছে? কি বলিস্? চুপ করিয়া রহিলি যে। 

চৌকিদার। আজ্ঞে তাহাই হইবে। 

দারোগা। বিশ্বাসরা কয়জন বাড়ীতে আছে? 

চৌকিদার। মেয়েরা সকলেই বাড়ীতে আছে। 

দারোগা। আমি স্ত্রীলোকদিগের কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি না। পুরুষদিগের মধ্যে কে কে বাড়ীতে আছে? 

চৌকিদার। তিনজন। 

দারোগা। কে কে? 

চৌকিদার। তাহারা ছেলে মানুষ, তাহাদিগের নাম আমি জানি না। 

দারোগা। আমি বালকদিগের কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি না। 

চৌকিদার। বালকদ্বয় ব্যতীত অপর কোন পুরুষ বাড়ীতে নাই। 

দারোগা। কোন সময় হইতে তাহারা বাড়ীতে নাই? 

চৌকিদার। তাহারা বাড়ীতে কেহই থাকে না, সকলেই চাকুরে, সকলেই চাকরী স্থানে থাকে। 

দারোগা। তাহাদিগের মধ্যে কেহই বাড়ীতে আইসে নাই? 

চৌকিদার। একমাস হইল আসিয়াছিল, একমাসের মধ্যে কেহ আইসে নাই। মেয়েরা ও ছেলেগণ সকল সময়েই বাড়ীতে থাকে, সকল সময়েই তাহাদিগকে দেখিতে পাই। 

চৌকিদারকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করা নিষ্প্রয়োজন বিবেচনা করিয়া দারোগাবাবু আমাকে কহিলেন, “দেখিলেন মহাশয়! কিরূপ লোক লইয়া আমাদিগকে কার্য্য করিতে হয়। গতরাত্রিতে ভয়নাক ডাকাইতি হইয়া গিয়াছে, এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে দুই দুইটি নরহত্যাও হইয়াছে। সেই সংবাদ লইয়া আসিয়া গ্রাম্য চৌকিদার যেরূপ ভাবে সংবাদ প্রদান করিল, তাহাত আপনি শুনিলেন। এখন আইন অনুসারে আমার কর্তব্য কাৰ্য্য এখনই “প্রথম এতেলা” লেখা; আর সেই “প্রথম এতেলার” সংবাদ দাতা হইবে-–এই চৌকিদার। অথচ এই “প্রথম এতেলার” উপর এই মোকদ্দমার শুভাশুভ সমস্তই নির্ভর করিবে, আসামী ধৃত হইলে বিচারের সময় এই “প্রথম এতেলাই” বেদবাক্যরূপে পরিগণিত হইবে। এই “প্রথম এতেলায়” যাহা লিখিত থাকিবে, অনুসন্ধানে যদি তাহার কোনরূপ বিপরীত ঘটনা বাহির হইয়া পড়ে, বিচারের সময় সে ঘটনাকে কেহ বিশ্বাস করিবেন না, বা “প্রথম এতেলায়” যে সকল আসামীর নাম বা অপর কোন বিষয় এখন লিখিত হইবে, পরিশেষে অনুসন্ধানে যদি অপর কোন নূতন বিষয় প্রকাশিত হইয়া পড়ে, তাহা হইলে বিচারের সময়, জুরীগণ সহজে তাহা বিশ্বাস করিতে চাহিবেন না। কেহবা হয়ত বলিয়া বসিবেন, যাহার নাম বা যে ঘটনা “প্রথম এতেলায়” নাই, এবং এখন যাহা বাহির হইতেছে, তাহা পুলিসের চালাকী। পুলিস ইচ্ছা করিয়া অপর লোকদিগকে বিপদগ্রস্ত করিবার নিমিত্ত, বা তাহাদিগের নিকট হইতে কিছু অযথা অর্থ গ্রহণ করিবার মানসে, এই ঘটনার সমাবেশ করিয়াছেন। এদিকে এই চৌকিদারের কথার উপর নির্ভর না করিয়া যদি এখন “প্রথম এতেলা” না লিখি, বা নিজে ভাল করিয়া দেখিয়া শুনিয়া, যদি “প্রথম এতেলা” লিখিবার বন্দোবস্ত করি, তাহা হইলে স্থানান্তরে আমাদিগের উদরানের সংগ্রহ করিতে হইবে। এতদিবস পর্য্যন্ত এই সরকারী চাকরী করিয়া বৃদ্ধ বয়সে বিনা পরিশ্রমে উদরান্নের যে আশা করিতেছি, তাহা আমাকে একবারেই পরিত্যাগ করিতে হইবে।” 

এই বলিয়া দারোগাবাবু সেই চৌকিদারের কথা হইতে যতদূর সংগ্রহ করিতে পারিলেন, তাহাই অবলম্বন করিয়া, “প্রথম এতেলা” লিখিয়া লইলেন। পরিশেষে সেই চৌকিদারকে সঙ্গে লইয়া ঘটনাস্থলে গমন করিবার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দারোগাবাবু সেই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে গমন করিবার নিমিত্ত থানা হইতে বহির্গত হইবার সময় আমাকে কহিলেন, “আপনার কার্য্যের যেরূপ বন্দোবস্ত হইয়াছে, তাহাতে দুই তিনদিবস থানায় উপস্থিত না থাকিলেও, অনায়াসেই চলিতে পারে। বিশেষতঃ আপনার কার্য্যের নিমিত্ত যদি বিশেষ প্রয়োজনীয় কোন বিষয়ের হঠাৎ আবশ্যক হইয়া পড়ে, তাহা হইলে আমি যে স্থানেই থাকি না কেন, সেই সংবাদ প্রথমতঃ আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইবে। পরিশেষে আমি যেরূপ বন্দোবস্ত করিব, সেইরূপ হইবে, বা আপনাকে সংবাদ পাঠাইয়া দিলে তাহার পর আপনি উহাতে হস্তক্ষেপ করিতে সমর্থ হইবেন। এরূপ অবস্থায়। আপনিও কেন আমার সহিত গমন করুন না, আপনি অনেক খুনী মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিয়াছেন সত্য; কিন্তু সেই পরিমাণে ডাকাইতি মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিয়াছেন, কি না, তাহা আমি জানি না। কারণ, আমরা সর্ব্বদা শুনিতে পাই, কলিকাতা সহরে খুনের সংখ্যা অত্যন্ত অধিক; কিন্তু ডাকাইতি প্রায়ই হয় না। তাহাতে এ ডাকাইতি কেবল ডাকাইতি নহে, ডাকাইতির সহিত দুই-দুইটি হত্যা। এরূপ অবস্থায় আপনি যদি আমার সহিত গমন করেন, তাহা হইলে আমি যে কতদূর সন্তুষ্ট হইব, তাহা এখন বলিতে পারি না। এরূপ ভয়ানক মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে হইলে অনেক সময়ে প্রায়ই বিশেষ ভ্রমে পতিত হইতে হয়, আপনি যদি আমার সহিত সেই স্থানে উপস্থিত থাকেন, তাহা হইলে বোধ করি, আমার বিশেষ ভ্ৰমে পতিত হইবার সম্ভাবনা অতি অল্প। কারণ, সর্ব্বদা আপনার সহিত পরামর্শ করিয়া কার্য্য করিতে পারিব। উভয়ে মিলিত হইয়া যদি এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করি, বা আপনার সহিত প্রত্যেক বিষয়ে পরামর্শ করিয়া যদি আমি এই অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করি, তাহা হইলে আমার বিশ্বাস যে, দুইদিবসে হউক, বা দশদিবসে হউক, অনায়াসেই আমি এই মোকদ্দমার কিনারা করিতে সমর্থ হইব।” 

দারোগাবাবুর কথা শুনিয়া আমিও মনে করিলাম, যখন প্রকৃতই থানায় বসিয়া থাকা ব্যতীত আমার অপর আর কোন কাৰ্য্য নাই, তখন দারোগাবাবুর সহিত গমন করিয়া তিনি কিরূপ ভাবে এই ভয়ানক মোকদ্দমার অনুসন্ধান করেন, তাহা দর্শন করা, ও সাধ্যমত তাঁহার সাহায্য করা নিতান্ত মন্দ নহে। কারণ, একে তিনি পুরাতন ও বহুদর্শী দারোগা, তাহার উপর এইরূপ দুই দুইটি হত্যা সম্বলিত ভয়ানক ডাকাইতির অনুসন্ধানে তাঁহার সহিত একত্র অতিবাহিত করিতে পারিলে, আমার কিছুই অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা নাই; অধিকন্তু অনেক নূতন বিষয় শিক্ষা করিবারই সম্পূর্ণরূপ সম্ভাবনা। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমিও দারোগাবাবুর সহিত গমন করিতে প্রস্তুত হইলাম। ঘটনাস্থলে গমন করিবার জন্য আমার নিমিত্ত তিনি একটি ঘোটক সংগ্রহ করিয়া আনিলেন। আমি অশ্বারোহণে বিশেষরূপ পারদর্শী না হইলেও, সেই অশ্বে আরোহণ করিয়া, তিনি যে অশ্বে আরূঢ় ছিলেন, সেই অশ্বের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলাম। 

আমাদিগের অগ্রে অগ্রে, যে চৌকিদার সেই সংবাদ লইয়া আসিয়াছিল, সেই চৌকিদার ও দুইজন কনষ্টেবল পদব্রজে গমন করিতে লাগিল। এইরূপে আমরা যে সকল গ্রামের মধ্য দিয়া গমন করিতে লাগিলাম, কনষ্টেবলদ্বয় সেই সেই গ্রামের চৌকিদারগণের মধ্যে যাহাকে যাহাকেসংগ্রহ করিতে পারিল, তাহাদিগকে আপন দলভুক্ত করিয়া লইতে লাগিল। এইরূপে গমন করিতে করিতে আমরা যে সময় সেই গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইলাম, সেই সময় আমাদিগের সমভিব্যাহারে প্রায় বার চৌদ্দজন চৌকিদার। 

আমরা যথাসময়ে সেই গ্রামে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, ঘটনাস্থলে গ্রামের প্রায় অনেক লোকই উপস্থিত আছেন। আমরা সেই স্থানে গমন করিব, ও সেই অনুসন্ধানের নিমিত্ত আমাদিগকে সেইস্থানে কিছুদিবস অতিবাহিত করিতে হইবে, এই ভাবিয়া সেইস্থানে আমাদিগের বাসোপযোগি একটিস্থানও তাঁহারা ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলেন। আমাদিগকে দেখিয়া অনেক লোক ভয়ে পলায়ন করিল। কিন্তু ছোট ছোট বালকবালিকাগণ আমাদিগকে প্রায় ঘেরিয়া ফেলিল। প্রথমতঃ আমরা সেইস্থানেই গিয়া উপস্থিত হইলাম। আমাদিগের যে সকল দ্রব্যাদি চৌকিদারগণ মস্তকে বহিয়া লইয়া গিয়াছিল, তাহা সেইস্থানে রাখিয়া দিয়া, নিকটবর্ত্তী ঘটনাস্থলে আমরা গমন করিলাম। 

যে বিশ্বাসদিগের বাড়ীতে এই ঘটনা ঘটিয়াছিল, তাঁহাদিগের বাড়ীতে গমন করিয়া দেখিলাম, সেই বাড়ীর কোন লোকই সেই স্থানে নাই; কেবলমাত্র দুইটি মৃতদেহ দুই স্থানে পতিত রহিয়াছে। দুইজনই অপরিচিত। অনুমান হয়, —একজনের বয়ঃক্রম পঁয়তাল্লিশ বৎসরের কম হইবে না। গঠন বলিষ্ঠ ও শক্ত, বর্ণ কাল, মালকোচা মারিয়া কাপড় পরা, তাহাকে দেখিয়া নীচবংশ-সম্ভূত বলিয়া বোধ হয়। অপরটির বয়ঃক্রম ত্রিশ বৎসরের অধিক হইবে না। এই ব্যক্তিও খুব বলশালী ছিল বলিয়া অনুমান হয়। পরিহিত কাপড় উভয়েরই প্রায় একরূপ। তাহাকেও কোন নীচ বংশ সম্ভূত বলিয়া অনুমান হয়। উভয়ের শরীরেই অস্ত্রাঘাতের বিশেষ সাংঘাতিক চিহ্ন বর্ত্তমান। সেই সকল ক্ষতস্থান হইতে রক্ত পড়িয়া সেই স্থানকে একবারে রক্তাপ্লুত করিয়াছে। দেখিয়া অনুমান হয়, উহাদিগের মৃত্যুর কারণ সেই সকল ক্ষতস্থান হইতে অধিক পরিমাণে রক্তস্রাব হওয়া। 

সেই দুই ব্যক্তির মধ্যে যাহার বয়ঃক্রম কিছু অধিক হইয়াছে বলিয়া অনুমান হয়, তাহার মৃতদেহ’ পড়িয়াছিল,—একখানি ঘরের ভিতরে; অপরের মৃতদেহটি ছিল, বাড়ীর প্রাঙ্গণে। 

যে ঘরের ভিতর মৃতদেহ পড়িয়াছিল, সেই ঘরের অবস্থা বাড়ীর সমস্ত ঘর অপেক্ষা আরও অধিক শোচনীয়। সেই ঘরের ভিতর বাক্স, পেট্রা প্রভৃতি যাহা কিছু ছিল, সমস্তই ভগ্ন; ও সামান্য সামান্য দ্রব্য সকল, সেই ঘরের মধ্যে ছড়ান রহিয়াছে। উহার মধ্যে কোন কোন দ্রব্য, প্রজ্বলিত মশালের অগ্নিতে পুড়িয়া ভস্মে পরিণত হইয়াছে, আর কতকগুলি অৰ্দ্ধদগ্ধ অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে; এবং কোন কোন স্থানে দগ্ধাবশিষ্ট মশাল সকল পতিত রহিয়াছে। এই সকল দ্রব্যের সহিত মানব রক্ত মিশ্রিত হইয়া কেমন একরূপ ভয়ানক দৃশ্য হইয়াছে। 

উভয় মৃতদেহের উপর যে অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন ছিল, তাহা দেখিয়া অনুমান হয়, উহা তরবারী বা সেইরূপ কোন অস্ত্রের আঘাত-চিহ্ন; কিন্তু যেস্থানে মৃতদেহ পড়িয়াছিল, তাহার সন্নিকটে বা সেই বাড়ীতে অনুসন্ধান করিয়া সেই প্রকার কোনরূপ অস্ত্র দেখিতে পাইলাম না। 

গ্রামস্থ প্রায় সমস্ত লোকই সেই মৃতদেহদ্বয় দর্শন করিল; কিন্তু কোনটিকেই কেহ চিনিতে পারিল না। 

বিশ্বাসদিগের বাড়ীতে কিরূপ ভাবে ডাকাইতি হইয়াছে, তাহার অনুসন্ধান করিতে গিয়া জানিতে পারিলাম যে, চৌকিদার তাঁহাদিগের বাড়ীর লোকজন সম্বন্ধে যেরূপ বলিয়াছিল, তাহা নিতান্ত অপ্রকৃত নহে। বিশ্বাসদিগের যে বাড়ীতে ডাকাইতি হয়, তাহা ইষ্টক নির্ম্মিত একখানি একতালা বাড়ী, বাড়ীর ভিতর কেবলমাত্র চারিখানি ঘর আছে। বাড়ীর পুরুষ মানুষদিগের মধ্যে কেহই প্রায় নিয়মিতরূপে বাড়ীতে থাকেন না। বাড়ীতে সর্ব্বদা থাকিবার মধ্যে দুই তিনটি বালকবালিকা ও চারিটি স্ত্রীলোক। চারিটি স্ত্রীলোকের মধ্যে একটি সেই বাড়ীর পরিচারিকা, সেও অহোরাত্র সেই বাড়ীতেই অবস্থান করিয়া থাকে। সেই পরিচারিকা ব্যতীত সেই বাড়ীতে অপর চাকর-চাকরাণী আর কেহই নাই। 

আমরা যখন সেই বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইয়াছিলাম, সেই সময় সেই বাড়ীতে, বাড়ীর লোকজনের মধ্যে কাহাকেও দেখিতে পাই না; কিন্তু অনুসন্ধানে অবগত হইতে পারিলাম যে, পার্শ্ববর্তী অপর আর একজনের বাড়ীতে তাঁহারা সকলেই আছেন। ডাকাইতির সময় বাড়ী হইতে পলায়ন করিয়া তাঁহারা প্রাণ রক্ষা করিয়াছেন। বাড়ীতে দুই দুইটি নরহত্যা হইয়া গিয়াছে বলিয়া, ভয়ক্রমে তাঁহারা এখনও সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে সাহসী হন নাই। 

সেই বাড়ীর স্ত্রীলোকদিগের নিকট হইতে পরিশেষে আমরা অবগত হইতে পারিলাম যে, কেবলমাত্র একটি স্ত্রীলোক ভিন্ন সেই ডাকাইতির প্রথম অবস্থা হইতে আর কেহই অবগত নহেন। অপরাপর সকলে বাড়ীতে ডাকাইত প্রবেশ করিয়াছে, এই কথা যেমন জানিতে পারেন, অমনি খিড়কী দরজা খুলিয়া সকলেই বহির্গত হইয়া পার্শ্বের বাড়ীতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। 

এই অবস্থা জানিতে পারিয়া, যে স্ত্রীলোকটি ডাকাইতি হইবার অব্যবহিত পূর্ব্বেই ডাকাইতির অবস্থা কিয়ৎ পরিমাণে জানিতে পারিয়াছিলেন, তাঁহাকে ডাকিয়া, নিম্নলিখিতরূপ দুইটি চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। 

আমি। যাঁহার বাড়ীতে এই ডাকাইতি হইয়াছে, আপনি তাঁহার কেহ হয়েন কি? 

স্ত্রীলোক। হাঁ। 

আমি। তিনি আপনার কে? 

স্ত্রীলোক। আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা। 

আমি। আপনি আপনার ভ্রাতার বাড়ীতেই বাস করেন? না, দুই একদিবসের নিমিত্ত আপনি এখানে আসিয়াছেন?

স্ত্রীলোক। আমি এই বাড়ীতে বাস করিয়া থাকি। আমি বিধবা হইবার পর হইতেই আমার ভ্রাতার সংসারে বাস করিতেছি। 

আমি। আপনি কতদিবস হইতে আপনার ভ্রাতার সংসারে আছেন? 

স্ত্রীলোক। এখন আমার বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ বৎসর হইয়াছে। আমি যখন বিধবা হই, তখন আমার বয়স ছিল—কুড়ি বাইশ বৎসর, সেই সময় হইতেই আমি আমার ভ্রাতার সংসারে আছি। 

আমি। তাহা হইলে আপনার ভ্রাতার সংসারের সমস্ত ভারই আপনার উপর ন্যস্ত আছে? 

স্ত্রীলোক। হাঁ, আমিই তাঁহার সংসারের কার্য্য দেখিয়া থাকি। 

আমি। আপনাদিগের বাড়ীতে যে ডাকাইতি হইয়াছে, তাহা আপনি প্রথমে কোন সময় জানিতে পারেন?

স্ত্রীলোক। রাত্রি আন্দাজ দুইটার সময়, হঠাৎ আমার নিদ্রাভঙ্গ হয়, সেই সময় আমার বোধ হইল, আমাদিগের বাড়ীর বাহিরে যেন কতকগুলি লোক কি বলাবলি করিতেছে। উহাদিগের কোন কোন কথা আমার কর্ণগোচর হওয়ায়, আমার মনে কেমন একরূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হয়; কিন্তু আমি কাহাকেও কিছু না বলিয়া ধীরে ধীরে উঠিয়া ছাদের উপর গমন করিলাম। 

আমি। ছাদের উপর গিয়া আপনি কি দেখিতে পান? 

স্ত্রীলোক। দেখিতে পাই, আমাদিগের বাড়ীর সম্মুখে প্রায় পনর কুড়িজন লোক একত্র হইয়া একস্থানে দাঁড়াইয়া আছে। তাহাদিগের প্রত্যেকেরই হাতে লাঠি তরবারী প্রভৃতি কোন না কোনরূপ অস্ত্র আছে; কাপড় মালকোচা মারিয়া পরা, অনেকের মাথায় কিছুই নাই, কাহারও কাহারও মাথায় পাকড়ী বাঁধা। 

আমি। উহারা সেই সময় কোন কথা বলিয়াছিল? 

স্ত্রীলোক। আমার যতদূর মনে হয়, উহাদিগের মধ্যে একজন কহিল, “মিথ্যা মিথ্যা গোলযোগ করিয়া কি হইবে? একজনকে ধরাধরি করিয়া প্রাচীরের উপর উঠাইয়া দেও, সে ভিতরে গিয়া সদর দরজা খুলিয়া দিউক, তাহা হইলে বাড়ীর বাহিরে আমাদিগকে কোনরূপ গোলযোগ করিতে হইবে না। বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে পারিলে, উপস্থিত মত যাহা হয়—করিব। বাড়ীর বাহিরে প্রথম অবস্থায় গোলযোগ না করিলে, সহজেই গ্রামের লোকজন কোন বিষয় জানিতে পারিবে না। সুতরাং তাহারা সকলে একত্র হইয়া হঠাৎ আসিয়া আমাদিগের কার্য্যের কোনরূপ প্রতিবন্ধক হইবার সম্ভাবনা নাই। বাড়ীর ভিতরে গোলযোগ হইবার পর, যদি গ্রামের লোক জানিতে পারে, তাহা হইলে তাহারা সকলে একত্র হইয়া আসিতে আসিতে, আমরা আমাদিগের কার্য্য উদ্ধার করিয়া অনায়াসেই প্রস্থান করিতে সমর্থ হইব।” এই কথা শুনিয়া তাহাদিগের মধ্য হইতে আর একজন কহিল, “নাচিতে নাবিয়া ঘোমটার আবশ্যক কি? যদি তোর প্রাণের এত ভয়, তাহা হইলে এ কার্য্যে আসিলি কেন? যেরূপ কার্য্য করিতে আসিয়াছিস, সেইরূপ ভাবে কাৰ্য্য করিতে যদি ভয় হয়, প্রাণ লইয়া এই স্থান হইতে প্রস্থান কর।” দ্বিতীয় ব্যক্তির কথা শুনিয়া আর এক ব্যক্তি কহিল, ‘যখন ডাকাইতি করিতে আসিয়াছি, তখন চোরের মত বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিব কেন? ডাকাইতের মতনই প্রবেশ করিব।” এই কথা শেষ হইবামাত্রই, উহারা সেই স্থানে দাঁড়াইয়া তাহাদিগের সঙ্গে যে সকল মশাল ছিল, তাহা জ্বালিতে আরম্ভ করিল। এই অবস্থা দেখিয়া ও তাহাদিগের সেই সকল কথা শুনিয়া আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, উহারা আমাদিগের বাড়ীতেই ডাকাইতি করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইতেছে, অনতিবিলম্বেই উহারা আমাদিগের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবে। 

ইহার পর আমি ক্ষণমাত্রও আর সেই ছাদের উপর অপেক্ষা করিলাম না। দ্রুতবেগে আমি ছাদ হইতে অবতরণ করিয়া আমাদিগের বাড়ীতে বালকবালিকাগণ এবং অপর যে কয়জন স্ত্রীলোক ছিলেন, তাঁহাদিগকে শীঘ্র শীঘ্র উঠাইলাম ও কহিলাম, “আর আমাদিগের বাড়ীতে এক মুহূৰ্ত্তও থাকা কৰ্ত্তব্য নহে। ডাকাইতগণ আসিয়াছে, এখনই আমাদিগের বাড়ীতে প্রবেশ করিবে, তখন আমাদিগের পলায়ন করিবার আর উপায় থাকিবে না, তাহাদিগের হস্তে বিশেষরূপে আমাদিগকে পীড়িত হইতে হইবে।” এই বলিয়া যতশীঘ্র পারিলাম, সকলকে লইয়া বাড়ীর খিড়কী দরজা খুলিয়া বাড়ী হইতে বহির্গত হইলাম। যে সময় আমরা খিড়কী দরজা খুলিয়া বাড়ী হইতে প্রস্থান করিতেছি, সেই সময় আমাদিগের সদর দরজায় ভয়ানক গোলোযোগ উত্থিত হইল। সকলে দরজা ভাঙ্গিয়া মশাল হস্তে ভয়ানক রবে চীৎকার করিতে করিতে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। 

আমি। আপনারা বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া কোথায় গমন করিলেন? 

স্ত্রীলোক। আমাদিগের পার্শ্বের এই বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। 

আমি। বাড়ী হইতে বহির্গত হইবার সময় কোন দ্রব্য-সামগ্রী বাহির করিয়া আনিতে পারিয়াছিলেন কি?

স্ত্রীলোক। একটি ছোট বাক্সের ভিতর কিছু টাকা ও কতকগুলি অলঙ্কার থাকিত, সেই বাক্সটি ঘরের ভিতর আর একটি বড় বাক্সের উপর রাখা ছিল, আসিবার সময় কেবলমাত্র সেই বাক্সটি বাহির করিয়া আনিয়াছিলাম। 

আমি। আপনাদিগের বাড়ীতে যে সকল অলঙ্কার আছে, তাহার সমস্তগুলিই কি সেই বাক্সের ভিতর ছিল?

স্ত্রীলোক। প্রায় সমস্তই ছিল, কয়েকখানিমাত্র কেবল অপর বাক্সের ভিতর আছে। তদ্ব্যতীত সেই বাক্সের ভিতর আরও কতকগুলি বন্ধক অলঙ্কার আছে। 

আমি। সেই সকল অলঙ্কার যাহা বড় বাক্সের ভিতর ছিল, তাহা আছে? কি দস্যুগণ উহা লইয়া গিয়াছে?

স্ত্রীলোক। তাহা আমি জানি না। কারণ, ডাকাইতি হইবার পর আর আমরা কেহই সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করি নাই। 

আমি। আপনারা বাড়ীর ভিতর আর প্রবেশ করেন নাই কেন? 

স্ত্রীলোক। শুনিয়াছি যে সেই বাড়ীর ভিতর দুইটি লাস পড়িয়া আছে, সেই কারণে বাড়ীর ভিতর গমন করি নাই।

আমি। এখন গিয়া একবার দেখুন না কেন, আপনাদিগের কি কি দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে। 

স্ত্রীলোক। যে পর্য্যন্ত সেই লাস আমাদিগের বাড়ীর ভিতর থাকিবে, সেই পৰ্য্যন্ত আমরা সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে পারিব না। 

আমি। আপনি উহাদিগের কথাবার্তা ছাদের উপর হইতে শুনিয়াছেন? 

স্ত্রীলোক। যাহা শুনিয়াছি, তাহা ত আপনাকে বলিয়াছি। 

আমি। উহারা কোন ভাষায় কথা কহিয়াছিল, বাঙ্গালা ভাষায়, না হিন্দী ভাষায়? 

স্ত্রীলোক। কথা বাঙ্গালা ভাষাতেই কহিয়াছিল; কিন্তু তাহার মধ্যে দুই একটি হিন্দী কথাও ছিল। 

আমি। ছাদের উপর হইতে আপনি তাহাদিগকে দেখিয়াছিলেন; কিন্তু পুনরায় যদি তাহাদিগকে দেখিতে পান, তাহা হইলে আপনি তাহাদিগকে চিনিতে পারিবেন কি? 

স্ত্রীলোক। না মহাশয়! আমি তাহাদিগকে রাত্রিকালে অন্ধকারের ভিতর একবার দেখিয়াছিলাম। বিশেষতঃ সেই সময় আমার মনের স্থিরতা ছিল না, আমি অতিশয় ভীত হইয়া পড়িয়াছিলাম; সুতরাং আমি তাহাদিগকে দেখিলে, কোনরূপেই আর চিনিতে পারিব না। 

আমি। একটু পরে লাস দুইটি আপনাদিগের বাড়ী হইতে স্থানান্তরিত করা হইবে। সেই সময় আপনি আপনাদিগের বাড়ীতে গমন করিয়া, আপনাদিগের কি কি দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে, তাহা বেশ করিয়া দেখুন, তাহার পর আমরা সেই সকল অপহৃত দ্রব্যের একখানি তালিকা প্রস্তুত করিয়া লইব। 

এই বলিয়া আমরা সেইস্থান হইতে উঠিলাম, এবং সেই বাড়ীর ভিতর পুনরায় গমন করিয়া, সেই লাস ও বাড়ীর অবস্থা সম্বন্ধে আমাদিগের যাহা যাহা সেই সময় লিখিয়া লইবার প্রয়োজন ছিল, তাহা স্থিরভাবে সেই স্থানে বসিয়া উত্তমরূপ লিখিয়া লইলাম। পরিশেষে সেই মৃতদেহ দুইটি সেই স্থান হইতে উঠাইয়া আনিয়া, যে স্থানে আমাদিগের থাকিবার স্থান স্থির হইয়াছিল, তাহার নিকটবর্ত্তী একটি বিস্তৃত অনাবৃত স্থানের উপর সেই মৃতদেহদ্বয় রাখিয়া দিলাম। আমাদিগের সমভিব্যাহারী কনষ্টেবলদ্বয়কে বলিয়া দিলাম, যে কোন ব্যক্তি ওই মৃতদেহ দেখিতে চাহে, তাহাকে উহা দেখিতে দেও, এবং প্রত্যেককেই জিজ্ঞাসা কর, তাহাদিগের মধ্যে কেহ বলিতে পারে কি না যে, উহা কাহার মৃতদেহ। 

কনষ্টেবলদ্বয় আমাদিগের সমক্ষে থাকিয়াই, আমাদিগের আদেশ প্রতিপালন করিতে লাগিল। 

যেদিবস আমরা সেই অনুসন্ধানে নিযুক্ত, সেইদিবস দারোগাবাবু যে থানায় থাকিতেন, সেই থানার চৌকিদারগণের হাজিরার দিন ছিল। 

“হাজিরার দিন” এই কথার অর্থ, পুলিস-কৰ্ম্মচারীগণ ব্যতীত অনেক পাঠকেই বুঝিতে পারিবেন না বলিয়া, তাহা এই স্থানে আমার একটু পরিষ্কার করিয়া বলা কৰ্ত্তব্য। 

মফঃস্বলের প্রত্যেক থানার এলাকায় যতগুলি গ্রাম আছে, সেই সেই গ্রামে, গ্রামের অবস্থা ও প্রয়োজন অনুসারে চৌকিদার নিযুক্ত আছে। কোন গ্রামে একজন চৌকিদার আছে, এবং কোন কোন গ্রামে দশ বারজন চৌকিদারেও কার্য্য করিয়া থাকে, অর্থাৎ গ্রামের লোক সংখ্যার উপরই চৌকিদারের সংখ্যা নির্ভর করে। চৌকিদারগণ প্রায়ই স্থানীয় লোক হইয়া থাকে। তাহাদিগের কার্য্য রাত্রিকালে গ্রামের ভিতর চৌকি দেওয়া, এবং রাত্রিদিন গ্রামের মধ্যে থাকিয়া গ্রামের মধ্যে কি হইতেছে, না হইতেছে, তাহার সমস্ত সংবাদ সংগ্রহ করা, গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা প্রত্যেক লোকের সহিত পরিচয় রাখা, চুরি ডাকাইতি, খুন প্রভৃতি কোনরূপ ঘটনা ঘটিলে তৎক্ষণাৎ থানায় গিয়া তাহার সংবাদ প্রদান করা এবং মধ্যে মধ্যে বিনাদোষেও দারোগার নিকট গালি খাওয়া! তদ্ব্যতীত সপ্তাহের মধ্যে এব দিবস প্রত্যেক চৌকিদারকে এক সময় থানায় গিয়া উপস্থিত হইতে হয়। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীর কর্ত্তব্য, সেই সময় কতকগুলি বিষয় তাহাদিগের প্রত্যেকের নিকট হইতে অবগত হইয়া লিখিয়া লওয়া। নির্দ্ধারিত দিবসে যে চৌকিদার থানায় উপস্থিত হইয়া হাজিরা না লেখায়, তাহার উপরে পুলিস-কৰ্ম্মচারী-কর্তৃক অভিযোগ আনা হয়, এবং সেই অপরাধের নিমিত্ত তাহাকে দণ্ড গ্রহণ করিতে হয়। এই সকল কারণে বিশেষ আবশ্যকীয় সরকারি কার্য ভিন্ন কোন চৌকিদারই হাজিরার দিন কোন ক্রমেই গরহাজির হইতে পারে না। 

আমি যে দিবসের কথা বলিতেছি, সেই দিবস হাজিরার দিন ছিল। আমার সহিত পরামর্শ করিয়া, দারোগাবাবু সেই সময় থানায় যে কর্ম্মচারী উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাকে একখানি পত্র লিখিলেন। তাহাতে লিখিয়া দিলেন, পত্রপাঠমাত্র একজন কৰ্ম্মচারী চৌকিদারগণের হাজিরার পুস্তকসহ এই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইবেন, এবং চৌকিদারগণকেও সঙ্গে করিয়া আনিবেন। কারণ, এবার তাহাদিগের হাজিরা থানায় না হইয়া, তাঁহার সম্মুখেই হইবে। 

একজন চৌকিদার সেই পত্ৰ লইয়া দ্রুতগতি থানায় গমন করিল, সময়মত একজন কৰ্ম্মচারী “হাজিরা পুস্তক” ও চৌকিদারগণের সহিত আসিয়া আমাদের নিকট উপস্থিত হইলেন। 

চৌকিদারগণের সেই স্থানে উপস্থিত হইতে যে সময় অতিবাহিত হইল, তাহার মধ্যে ঘটনাস্থলের আবশ্যকীয় যে সকল লেখা-পড়ার কার্য্য ছিল, তাহার অধিকাংশ দারোগাবাবু শেষ করিয়া ফেলিলেন। 

যে কনষ্টেবলদ্বয়কে আমরা লাসের উপর পাহারা রাখিয়াছিলাম, তাহারা বিস্তর লোককে ডাকিয়া ডাকিয়া, সেই মৃতদেহ দেখাইতে লাগিল; কিন্তু কেহই ওই লাস চিনিয়া উঠিতে পারিল না। 

থানা হইতে চৌকিদারগণ আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইলে, আমি অনুমান করিয়া দেখিলাম, তাহাদিগের সংখ্যা প্রায় দেড়শত হইবে। কি নিমিত্ত তাহাদিগকে ডাকাইয়া আনা হইয়াছে, তাহা তাহাদিগকে আমি উত্তমরূপে বুঝাইয়া দিলাম, এবং মৃতদেহের নিকট হইতে অপরাপর লোকজনকে ক্ষণকালের নিমিত্ত সরাইয়া দিয়া, সেই সকল চৌকিদারগণকে একে একে উত্তমরূপে দেখাইতে লাগিলাম। যে সকল চৌকিদারগণ আগমন করিয়াছিল, তাহার মধ্যে দূরবর্তী গ্রাম সকলের চৌকিদার অনেক ছিল। সেই মৃতদেহদ্বয় একে একে সকলেই দেখিতে লাগিল ও সকলেই কহিতে লাগিল, “না মহাশয়! আমরা ইহাদিগকে চিনিয়া উঠিতে পারিতেছি না।”

এইরূপে অনেকেই দেখিতে দেখিতে তাহার মধ্য হইতে একজন চৌকিদার হঠাৎ বলিয়া উঠিল, ইহারা দুইজনই যেন আমার চেনা চেনা বোধ হইতেছে। এই বলিয়া সে আর একজন চৌকিদারকে ডাকিল, ও কহিল, “দেখত ভাই! এই ব্যক্তি** গ্রামের গোপাল, এবং এই লোকটি** গ্রামের রাধা নয়?” অপর চৌকিদারও উহাদিগকে বেশ করিয়া অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত দেখিল ও কহিল, “এ রাধার মৃতদেহই বটে; এবং এই দেহটি কৃষ্ণ গোয়ালার পিতা গোপাল গোয়ালার মৃতদেহ বলিয়া বোধ হইতেছে।” 

চৌকিদারদ্বয়ের এই কথা শুনিয়া সেই স্থানে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া, যে স্থানে আমাদিগের বসিবার স্থান ছিল, সেই স্থানে তাহাদিগকে লইয়া গেলাম। সেই স্থানে অপরাপর যে সকল লোক ছিল, তাহাদিগকে ক্ষণকালের নিমিত্ত স্থানান্তরিত হইতে বলিলাম। গ্রামস্থ যে সমস্ত লোক সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন, আমার কথা শুনিয়া তাঁহাদিগের মধ্যে কেহ কেহ সেই স্থান হইতে উঠিয়া তৎক্ষণাৎ স্থানান্তরে গমন করিলেন। অবশিষ্ট যাঁহারা সেইস্থান হইতে উঠিলেন না, কোনরূপ কৌশল করিয়া তাঁহাদিগকে সেই স্থান হইতে উঠাইয়া দিতে হইল। 

সকলে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলে, আমি সেই চৌকিদারদ্বয়কে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এই মৃতদেহ দুইটি কাহার, তাহা তোমরা ঠিক চিনিতে পারিয়াছ কি? না আন্দাজে এক কথা কহিতেছ? 

চৌকিদার। আমাদিগের নিশ্চয় বোধ হইতেছে, এই দুইটি লাস গোপাল ও রাধার ভিন্ন আর কাহারও নহে।

আমি। গোপাল কোন জাতি? 

চৌকিদার। গোয়ালা।

আমি। আর রাধা? 

চৌকিদার। রাধা বাগদী। 

আমি। ইহাদিগের বাড়ী কোথায়? 

চৌকিদার। যে গ্রামে আমরা চৌকি দিয়া থাকি। 

আমি। গোপাল কেমন লোক? 

চৌকিদার। সে লোক ভাল নয়; শুনিয়াছি, ডাকাইতি করিয়াছিল বলিয়া, বহুবৎসর পূর্ব্বে সে একবার ধৃত হয়, এবং মেয়াদও খাটিয়া আইসে। চারি পাঁচ বৎসর হইল, আরও একবার সে ডাকাইতি মোকদ্দমায় ধৃত হয়; কিন্তু তাহার নিকট হইতে কোন মাল বাহির হয় না, ও উহার উপর বিশেষ প্রমাণ হয় না বলিয়া, সে সেবার বাঁচিয়া যায়; উহার চাল-চলন ভাল নহে। 

আমি। উহার আর কে আছে? 

চৌকিদার। একটি পুত্র। 

আমি। তাহার নাম কি? 

চৌকিদার। তাহার নাম কৃষ্ণ গোয়ালা। 

আমি। সে কত বড়? 

চৌকিদার। সেও জোয়ান মরদ। 

আমি। সে কি করে? 

চৌকিদার। কিছুই নয়; বসিয়া বসিয়া খায় দেখিতে পাই, কখনও কখনও চাষ আবাদ করিয়া থাকে। 

আমি। প্রত্যহ রাত্রিতে উহারা বাড়ীতে থাকে কি? 

চৌকিদার। সকল দিন থাকে না। 

আমি। উহাদিগের অবস্থা কেমন? 

চৌকিদার। অবস্থা যে খুব ভাল, তাহ বোধ হয় না, তবে অন্নবস্ত্রের কোনরূপ কষ্টও দেখিতে পাই না। 

আমি। গোপাল গোয়ালার বাড়ী যে গ্রামে, রাধা বাগ্দীর বাড়ীও কি সেই গ্রামে? 

চৌকিদার। না, পার্শ্ববর্তী আর একখানি গ্রামে 

আমি। রাধার চরিত্র কিরূপ ছিল? 

চৌকিদার। উহার বিপক্ষে বিশেষ কিছুই এ পৰ্য্যন্ত শুনি নাই। 

আমি। প্রত্যহ রাত্রিতে ও বাড়ী থাকিত? 

চৌকিদার। সবদিন রাধা বাড়ীতে থাকিত না, সময় সময় দুই তিন দিবসের নিমিত্ত কোথায় চলিয়া যাইত; জিজ্ঞাসা করিলে বলিত, –কটুম্ব বাড়ীতে গিয়াছিলাম। 

আমি। রাধা বাগ্দীর বাসস্থান বাগ্দী পাড়ার মধ্যে? 

চৌকিদার। হাঁ মহাশয়! সেই স্থানে আরও কয়েক ঘর বাগ্দী বাস করে। 

আমি। যে সময় রাধা তাহার বাড়ীতে অনুপস্থিত থাকিত, সেই সময় বাগ্দী পাড়ার আর কোন লোক, তাহার সহিত অনুপস্থিত থাকিত কি? 

চৌকিদার। কোন কোন সময় একত্রে উহারা দুই তিন জন নিমন্ত্রণে গমন করিত। 

আমি। উহারা নিমন্ত্রণে যাইত, কি অপর কোন কার্য্যে গমন করিত, তাহা তুমি কিরূপে জানিতে পারিতে?

চৌকিদার। উহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলে, উহারা বলিত যে, “আমরা কুটুম্বিতায় গমন করিয়াছিলাম।” 

আমি। গোপাল গোয়ালাও কি, ওইরূপ মধ্যে মধ্যে নিমন্ত্রণে যাইত? কি অপর কোন কার্য্যে গমন করিত বলিয়া, অনুপস্থিত থাকিত? 

চৌকিদার। সেও মধ্যে মধ্যে অনুপস্থিত থাকিত। 

আমি। তাহার পুত্র কৃষ্ণ? 

চৌকিদার। কোন কোন সময় কৃষ্ণও তাহার বাপের সহিত গমন করিত, কখনও বা গোপাল একাকীই গমন করিত। 

চৌকিদারদিগকে এই কয়টি কথা জিজ্ঞাসা করিয়াই তাহাদিগকে বলিয়া দিলাম, তোমরা যে উহাদিগকে চিনিতে পারিয়াছ, কেবল এই কথা ব্যতীত অপর কোন কথা আর কাহাকেও কহিও না। 

আমার কথার উত্তরে তাহারা কহিল, “অপরকে আমরা কেন বলিব? আমরা কাহাকেও কিছু বলিব না।”

চৌকিদারদ্বয় আমাদিগকে এইরূপ বলিল সত্য; কিন্তু বলা বাহুল্য, আমাদিগের চক্ষুর অন্তরাল হইতে না হইতেই আমাদিগের সহিত তাহাদিগের যে সকল কথাবার্তা হইয়াছিল, তাহা অপেক্ষা দ্বিগুণ বাড়াইয়া যাহাকে দেখিতে পাইল, তাহাকেই বলিতে আরম্ভ করিল। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

ঘটনাস্থলের যে সকল অনুসন্ধান করিবার প্রয়োজন ছিল, তাহা আমরা সেই স্থানে বসিয়া করিতে লাগিলাম। থানা হইতে যে পুলিস-কৰ্ম্মচারী চৌকিদারগণকে লইয়া আসিয়াছিলেন, কয়েকজন কনষ্টেবল ও চৌকিদারের সহিত তাঁহাকে, গোপাল গোয়ালা এবং রাধা রাগ্দীর গ্রামে পাঠাইয়া দিলাম। তাঁহার উপর আদেশ রহিল যে, ওই দুই ব্যক্তির বাড়ীতে যে সকল লোক আছে, তাহাদিগের প্রত্যেককেই এই স্থানে পাঠাইয়া দিবেন, এবং তাহাদিগের বাড়ী হইতে কোন দ্রব্যাদি স্থানান্তরিত না হয়, তাহার নিমিত্ত উহাদিগের বাড়ীতে যেন উপযুক্তরূপ পাহারা রাখা হয়। তদ্ব্যতীত সেই দুইখানি গ্রামের গোমস্তা, পঞ্চায়েৎ ও অপর লোক যাঁহারা ইচ্ছা করিয়া এখানে আসিতে চাহেন, তাঁহাদিগকেও যেন এই স্থানে পাঠাইয়া দেওয়া হয়। মূল কথা, যাঁহারা গোপাল গোয়ালা ও রাধা বাগ্দীকে চিনেন, এরূপ যে কয়জন ভদ্র লোক সংগ্রহ করিতে পারেন, ওই লাস দুইটি সনাক্ত করিবার নিমিত্ত তাঁহাদিগকে যেন এখানে পাঠাইয়া দেওয়া হয়। 

কর্ম্মচারী, কনষ্টেবল ও চৌকিদারগণকে সঙ্গে লইয়া গোপাল গোয়ালা ও রাধা বাগ্দীর গ্রাম উদ্দেশে প্রস্থান করিলেন। আমরা সেইস্থানে বসিয়া বিশ্বাসদিগের বাড়ীর স্ত্রীলোকগণের সাহায্যে অপহৃত দ্রব্য সকলের একখানি বিস্তৃত তালিকা প্রস্তুত করিতে আরম্ভ করিলাম। তালিকা প্রস্তুত হইলে দেখিলাম, অনেক অলঙ্কারপত্র স্ত্রীলোকদিগের কর্তৃক স্থানান্তরিত হইলেও, যে সকল দ্রব্যাদি অপহৃত হইয়াছে, তাহার মূল্য অনুমান এক সহস্র মুদ্রার কম নহে। 

যে কর্ম্মচারীকে আমি গোপাল গোয়ালা ও রাধা বাগ্দীর গ্রামে প্রেরণ করিয়াছিলাম, সময় মত তিনি সেই গ্রামদ্বয়ের চৌকিদার, পঞ্চায়েৎ ও অপর দুই একজন ভদ্রলোকের সহিত আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং কহিলেন, “গোপাল ও রাধার বাড়ীর সকলকেই তিনি কনষ্টেবল ও চৌকিদারগণের দ্বারা পাঠাইয়া দিয়াছেন, তাহারা সকলে পদব্রজে আসিতেছে, অতি অল্প সময়ের মধ্যেই এখানে আসিয়া উপস্থিত হইবে। 

গ্রামদ্বয়ের চৌকিদার, পঞ্চায়েৎ ও অপর যে কয়েকজন ভদ্রলোক কৰ্ম্মচারীর সহিত আগমন করিয়াছিলেন, তাঁহারা সেই মৃতদেহ দুইটি দেখিয়াই এক বাক্যে বলিয়া উঠিলেন, ইহা গোপাল গোয়ালা ও রাধা বাগ্দীর মৃতদেহ। ইহাদিগের যে এইরূপ অবস্থা ঘটিবে, তাহা আমরা পূর্ব্ব হইতেই জানিতাম। আমরা অনেকদিবস হইতে ইহাদিগের উপর অনেকরূপ সন্দেহ করিয়া আসিতেছিলাম। চুরি ও ডাকাইতি করিয়াই যে ইহারা জীবনযাপন করিত, সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। 

উঁহাদিগকে আমরা দুই চারি কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি, এরূপ সময়ে কনষ্টেবল ও চৌকিদারগণ গোপাল গোয়ালা ও রাধা বাগ্দীর পরিজন সকলকে আনিয়া সেই স্থানে উপস্থিত করিল। তাহারা সকলেই গোপাল ও রাধার মৃতদেহ দেখিয়া উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিল, কেবলমাত্র গোপাল গোয়ালার পুত্র কৃষ্ণ গোয়ালার মুখে কোন কথা শুনিতে পাইলাম না, সে সেই স্থানে একটু দাঁড়াইয়া উভয় মৃতদেহের উপর এক একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল, ও পরিশেষে একটু দূরে গিয়া উপবেশন করিল। 

উহার এই অবস্থা দেখিয়া আমার মনে কেমন একরূপ সন্দেহের উদয় হইল। সেই স্থানে যে সকল কনষ্টেবল উপস্থিত ছিল, তাহাদিগের মধ্যে একজনকে আমি কহিলাম, কৃষ্ণকে লইয়া তুমি একটু দূরে অপেক্ষা কর; কিন্তু দেখিও, সে যেন কাহারও সহিত কোনরূপ কথা কহিতে না পারে, এবং তোমার হস্ত হইতে সে যেন কোনরূপে পলায়ন করিতে সমর্থ না হয়। 

আমার আদেশ প্রতিপালিত হইল, কনষ্টেবল তাহাকে তৎক্ষণাৎ একটু দূরে লইয়া গিয়া সেই স্থানে আপনার নিকট বসাইয়া রাখিল। 

গোপাল বা রাধার পরিবারস্থিত অপর সকলকে একটু দূরে বসিতে বলিয়া আমি গোপালের স্ত্রীকে প্রথমে আমার নিকট ডাকিলাম। সে আমার সন্নিকটে আগমন করিলে আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি গোপালের স্ত্রী।” 

গোপালের স্ত্রী। হাঁ মহাশয়! 

আমি। গোপাল কি কার্য্য করিয়া থাকে? 

গোপালের স্ত্রী। চাষ-বাস আছে, তাহাতেই আমাদিগের জীবন ধারণ হইয়া থাকে। 

আমি। তোমার স্বামী চাষ করিয়াই যদি তোমাদিগকে প্রতিপালন করিয়া থাকে, তাহা হইলে এখানে কি করিতে আসিয়াছিলে? 

গোপালের স্ত্রী। তাহা আমি কিকরিয়া বলিব। 

আমি। গোপাল কখন বাড়ী হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছিলে? 

গোপালের স্ত্রী। গত কল্য বৈকালে। 

আমি। কোথায় গমন করিতেছে, তাহা কিছু বলিয়া বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গিয়াছিল কি? 

গোপালের স্ত্রী। পার্শ্ববর্তী গ্রামে নিমন্ত্রণ আছে, সেই স্থানে নিমন্ত্রণ উপলক্ষে গমন করিতেছেন, বলিয়া গিয়াছিলেন।

আমি। তাহার সহিত তোমার পুত্র কৃষ্ণও ত গমন করিয়াছিল? 

গোপালের স্ত্রী। হাঁ কৃষ্ণও গমন করিয়াছিল, কিন্তু সে সেই স্থানে থাকে নাই, আহারাদি করিয়া রাত্রিতেই চলিয়া আসিয়াছিল। 

আমি। আর কোন কোন ব্যক্তি তাহাদিগের সহিত গমন করিয়াছিল। 

গোপালের স্ত্রী। আর কাহাকেও যাইতে দেখি নাই। 

আমি। কেন তুমি মিথ্যা কথা বলিতেছ? আরও কয়েকজন লোক তোমাদিগের বাড়ীতে আইসে, তাহাদিগের সহিতই ত গোপাল ও কৃষ্ণ গমন করে? 

গোপালের স্ত্রী। তাহারা নিমন্ত্রণে গমন করিয়াছিল, কি না তাহা আমি কিরূপে জানিব? 

আমি। তাহারা নিমন্ত্রণে গিয়াছিল, কি অপর কোন স্থানে গমন করিয়াছিল, তাহা তুমি কিরূপে জানিবে, ইহা আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি না। 

গোপালের স্ত্রী। তবে আমাকে কি জিজ্ঞাসা করিতেছেন? 

আমি। তোমাকে আমি কেবলমাত্র ইহাই জিজ্ঞাসা করিতেছি যে, যে সময় তোমার স্বামী ও পুত্র নিমন্ত্রণে গমন করিতেছে বলিয়া, বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া যায়, সেই সময় তাহাদিগের সহিত আর কে কে গমন করিয়াছিল? 

গোপালের স্ত্রী। কেশব গোয়ালা ও রাখাল গোয়ালা তাঁহাদিগের সহিত গমন করিয়াছিল। 

আমি। ইহাদিগের বাড়ী কোন্ কোন্ গ্রামে? 

গোপালের স্ত্রী। ইহাদিগের বাড়ী একই গ্রামে, আমাদিগের গ্রাম হইতে এক ক্রোশ ব্যবধান মাত্র। 

আমি। তোমার স্বামী ও পুত্র তোমাদিগের বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া যাইবার কত পূর্ব্বে তাহারা তোমাদিগের বাড়ীতে আগমন করিয়াছিল? 

গোপালের স্ত্রী। পূর্ব্বে তাহারা আসে নাই, যে সময় উঁহারা বাহিরে যাইবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইতেছেন, সেই সময় উভয়ে আমাদিগের বাড়ীতে আগমন করে; কিন্তু তাহারা আমাদিগের বাড়ীতে না বসিতে বসিতেই আমার স্বামী বাহির হইয়া আসেন, এবং তাহাদিগের সহিত গমন করেন। তাঁহারা যে কোথায় গিয়াছিলেন, তাহা আমি অবগত নহি। 

গোপালের স্ত্রীর নিকট এই কয়েকটি কথা অবগত হইয়া, তাহার বাড়ীর আর যে যে লোক আগমন করিয়াছিল, কৃষ্ণ ব্যতীত সকলকেই একে একে ডাকাইয়া, সেই সকল কথা জিজ্ঞাসা করিলাম, গোপালের স্ত্রী যেরূপ বলিয়াছিল, উহারা সকলেই সেইরূপ কহিল। 

ইহার পরই রাধা বাগ্দীর স্ত্রীকে ডাকিলাম, তাহাকেও কতকগুলি কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। উত্তরে সে যাহা কহিল, তাহাতে এই মাত্র বুঝিতে পারিলাম যে, যে গ্রামে তাহার বাসস্থান, সেই গ্রামের রামা বাগ্দীর সহিত তাহার স্বামী পূৰ্ব্বদিবস বৈকালে বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া যায়। যাইবার সময় তাহার স্ত্রীকে কেবল এইমাত্র বলিয়া যায় যে, “আমরা বিশেষ কোন কার্য্য-উপলক্ষে দূরবর্তি কোন স্থানে গমন করিতেছি, সেই স্থান হইতে প্রত্যাবর্তন করিতে আমাদিগের অধিক রাত্রি হইবার সম্ভাবনা। আর একান্তই যদি আমরা রাত্রিকালে প্রত্যাবর্তন করিতে না পারি, তাহা হইলে, পরদিবস আগমন করিব।” ইহার পূর্ব্বেও সে কখনও কখনও রাত্রিতে বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া যাইত; কিন্তু রাত্রি প্রভাত হইবার পূর্ব্বেই সে প্রত্যাবর্তন করিত। 

এই কয়েকটি কথা রাধার স্ত্রীর নিকট হইতে অবগত হইয়া, আমি পুনরায় তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম যে, যে সকল রাত্রিতে রাধা বাড়ী হইতে বাহির হইয়া যাইত, সেই সকল রাত্রিতে সে একাকী গমন করিত, না তাহার সহিত আর কেহ গমন করিত? 

রাধার স্ত্রী। সে একাকীও গমন করিত, কখনও বা অপর কাহারও সহিত গমন করিত। 

আমি। অপরাপর যাহাদিগের সহিত সে গমন করিত, তাহাদিগের নাম বোধ হয়, তোমার মনে আছে? 

রাধার স্ত্রী। কবে, কাহার সহিত গমন করিত, তাহা কি আমি এখন মনে করিয়া রাখিয়াছি? 

আমি। যে রামা বাগ্দী গত কল্য তোমার স্বামীর সহিত গমন করিয়াছিল, সে ইহার পূর্ব্বে আর কখনও তাহার সহিত গমন করিয়াছিল কি? 

রাধার স্ত্রী। ইতি পূর্ব্বে দুই একবার গমন করিয়াছিল বলিয়া, মনে হয়। 

আমি। আর কাহারও নাম মনে হয়? 

রাধার স্ত্রী। আর কাহারও কথা মনে হইতেছে না। বোধ হয়, একবার সিধু তাহার সহিত গমন করিয়াছিল।

আমি। সিধু কোন জাতি? 

রাধার স্ত্রী। আমাদিগেরই কুটুম্ব, সেও বাগ্দী। 

আমি। তাহার বাসস্থান কোথায়? 

রাধার স্ত্রী। আমাদিগের গ্রামের নিকটবর্তী আর একখানি গ্রামে তাহার বাড়ী। 

আমি। গত কল্য তোমার স্বামী যখন রামা বাগ্দীর সহিত বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া যায়, সেই সময় সিধু কি তাহাদিগের সহিত গমন করিয়াছিল? 

রাধার স্ত্রী। তাহা আমি দেখি নাই। 

আমি। রামা রাত্রিতে তাহার বাড়ীতে ফিরিয়া আসিয়াছিল কি? 

রাধার স্ত্রী। তাহা আমি জানি না, তাহাকে আজ দেখি নাই। 

আমি। তোমার স্বামী যে সকল রাত্রিতে বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া যাইত, সেই সকল রাত্রিশেষে বা তাহার পরদিবস প্রাতঃকালে যখন প্রত্যাবর্তন করিত, তখন কিরূপ দ্রব্য-সামগ্রী সঙ্গে করিয়া আনিত? 

রাধার স্ত্রী। কখনও কোন দ্রব্য তাহাকে বাড়ীতে আনিতে দেখি নাই। 

আমি। নগদ টাকা? 

রাধার স্ত্রী। তাহাও কখনও আনিয়া আমাকে দেয় নাই। 

আমি। কখনও বলিত যে, সে কত টাকা আনিয়াছে? 

রাধার স্ত্রী। তাহাও কখনও বলে নাই। 

আমি। সে কি কাৰ্য্য করিত? 

রাধার স্ত্রী। কোন কার্য্য করিতে আমি দেখি নাই। তবে বলিত, “এক জমিদারের বাড়ীতে আমার চাকরী আছে, সেই স্থানে মধ্যে মধ্যে গমন করিতে হয়; কিন্তু মাসে মাসে বেতন প্রাপ্ত হইয়া থাকি।” আমার ঠিক মনে হইতেছে যে, সকল সময়ে তাহাকে কার্য্য করিতে হইত না। বৎসরের মধ্যে দুই একবার কার্য্য পড়িতমাত্র; কিন্তু জমিদার মহাশয় বারমাসেরই বেতন প্রদান করিতেন। 

আমি। সেই জমীদারের নাম কি? 

রাধার স্ত্রী। তাহা আমি জানি না। 

আমি। তিনি কোথায় থাকেন? 

রাধার স্ত্রী। তাহাও কখনও তিনি আমাকে বলেন নাই। 

আমি। তোমার স্বামী মাসে কত বেতন পাইত? 

রাধার স্ত্রী। তাহাও আমি জানি না। 

আমি। বেতনের টাকা আনিয়া সে তোমার হস্তে প্রদান করিত না?

রাধার স্ত্রী। না। 

আমি। তাহা হইলে সংসারের খরচ-পত্র তুমি কিরূপে নির্ব্বাহ করিতে? 

রাধার স্ত্রী। যখন যাহা প্রয়োজন হইত, তখন তিনি তাহা প্রদান করিতেন। 

আমি। তাহার টাকা-কড়ি কোথায় থাকিত? 

রাধার স্ত্রী। তাহা আমি জানি না। 

আমি। তুমি সব জান, জানিয়া শুনিয়া আদ্যোপান্ত মিথ্যা কথা কহিতেছ; কিন্তু পরে তোমাকে ইহার ফলভোগ করিতে হইবে। 

এই বলিয়া আমি রাধা বাগ্দীর স্ত্রীকে একাকিনী একস্থানে রাখিবার নিমিত্ত আদেশ প্রদান করিলাম। আদেশ প্রদান করিবার সঙ্গে সঙ্গেই আমার আদেশ প্রতিপালিত হইল। 

ইহার পর রাধা বাগ্দীর বাড়ী হইতে আর যাহাকে যাহাকে আনা হইয়াছিল, তাহাদিগকে একে একে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলাম; কিন্তু সকলের কথা একরূপ পাইলাম না, প্রত্যেকেরই কথা পৃথক পৃথক হইয়া গেল। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

কৃষ্ণ গোয়ালাকে আমি এ পর্য্যন্ত কোন কথা, জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম না। তাহাকে দুই চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করিবার সময়, এখন উপস্থিত হইয়াছে; এই ভাবিরা, উহাকে আমাদিগের নিকট আনিতে কহিলাম। যে কনষ্টেবলের জিম্মায় তাহাকে রাখা হইয়াছিল, আদেশ পাইবামাত্র সেই কনষ্টেবল উহাকে আনিয়া আমাদিগের সম্মুখে উপস্থিত করিল। সে ধীরে ধীরে আমাদিগের সম্মুখে আসিয়া উপবেশন করিল। 

গোপাল গোয়ালার স্ত্রী ও তাহার বাড়ীর অপরাপর স্ত্রীলোকদিগের নিকট হইতে আমি যতদূর অবগত হইতে পারিয়াছিলাম, তাহাতে আমার সর্ব্বতোভাবে প্রতীতি জন্মিয়াছিল যে, কৃষ্ণ গোয়ালাও তাহার পিতার সহিত এই ডাকাইতি মোকদ্দমায় লিপ্ত ছিল। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া কৃষ্ণকে কহিলাম, “কি হে কৃষ্ণ! তুমি এখন প্রকৃত কথা কহিবে, কি মিথ্যা কথা কহিবে?” 

কৃষ্ণ। কেন মহাশয়! আমি মিথ্যা কথা কহিব? আমাকে কি জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন? 

আমি। এই ডাকাইতিতে তোমরা কয়জন ছিলে? 

কৃষ্ণ। কোন্ ডাকাইতিতে? 

আমি। যে ডাকাইতির এখন আমরা অনুসন্ধান করিতেছি, যে ডাকাইতি করিতে আসিয়া তোমার পিতা হত হইয়াছে, ও যাহার নিমিত্ত আমরা এখন তোমাকে এখানে আনাইয়াছি, সেই ডাকাইতি। কেমন, এখন বুঝিতে পারিলে?

কৃষ্ণ। আমার বাড়ী এখান হইতে বহুদূরে, আমি কিরূপে জানিব যে, কোন্ কোন্ ব্যক্তির দ্বারা এই ডাকাইতি হইয়াছে? 

আমি। বাড়ী দূরে হইলেই যে, আমার কথার উত্তর দেওয়া যায় না, তাহা নহে। তোমার পিতার বাড়ীও ত দূরে, তবে সে এখানে কিরূপে আসিয়াছিল? বাজে কথা পরিত্যাগ করিয়া এখন দুটা কাযের কথা বল। আমরা যদিও অনেকদূর অবগত হইতে পারিয়াছি, তথাপি তোমাকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিতেছি যে, তুমি প্রকৃত কথা বল কি না? এই ডাকাইতিতে কে কে ছিল, তাহা স্পষ্ট করিয়া এখন বল দেখি? 

কৃষ্ণ। আমি তাহা কিরূপে জানিব? 

আমি। যেখানে তুমি উপস্থিত ছিলে, সেই স্থানে তোমার পরিচিত অপর কোন্ কোন্ ব্যক্তি ছিল, তাহা তুমি জান না, একথা আমরা কিরূপে বিশ্বাস করিতে পারি? 

কৃষ্ণ। তবে কি আপনারা বলিতে চাহেন যে, আমিও এই ডাকাইতির মধ্যে ছিলাম? 

আমি। তুমি যে ডাকাইতদিগের মধ্যে একজন, সে সম্বন্ধে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। 

কৃষ্ণ। আপনারা ভুল বুঝিয়াছেন, এবং মিথ্যা আমার উপর দোষারোপ করিতেছেন, আমি ইহার কিছুই অবগত নহি! 

আমি। আমি তোমার উপর অন্যায়রূপে দোষারোপ করিতেছি, কি না, তাহা সময় হইলেই অবগত হইতে পারিবে, ও সেই সময় সকল কথা স্পষ্ট করিয়া আমাদিগের নিকট প্রকাশ করিতেও কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হইবে না। সে যাহা হউক, তোমাকে আর একটি কথা এখন জিজ্ঞাসা করিব। দেখি সেই কথারও তুমি কিরূপ উত্তর প্রদান কর। 

কৃষ্ণ। কি অনুমতি করেন? 

আমি। গত কল্য তুমি তোমার পিতার সহিত কোথায় গমন করিয়াছিলে? 

কৃষ্ণ। পিতার সহিত আমি কল্য কোন স্থানে যাই নাই। 

আমি। যদি কল্য না গিয়া থাক, তাহা হইলে করে গিয়াছিলে? 

কৃষ্ণ। গত একমাসের মধ্যে আমি আমার পিতার সহিত কোন স্থানে গমন করি নাই। 

আমি। কোন স্থানে নিমন্ত্রণ খাইতে? 

কৃষ্ণ। নিমন্ত্রণ খাইতে আমি আমার পিতার সহিত কখনও কোন স্থানে গমন করি নাই। 

আমি। তোমার পিতার সহিত ত কোন স্থানে গমন কর নাই, কিন্তু কেশব গোয়ালা বা রাখাল গোয়ালার সহিত কোন স্থানে গমন করিয়াছিলে কি? 

কৃষ্ণ। না। 

আমি। যদি কেহ আমাদিগকে বলিয়া থাকে যে, তুমি, তোমার পিতাও কেশব গোয়ালার সহিত নিমন্ত্রণ উপলক্ষে গত কল্য বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গিয়াছিলে? 

কৃষ্ণ। এরূপ যদি কেহ বলিয়া থাকে, তাহা হইলে সে মিথ্যা কথা বলিয়াছে। 

আমি। যদি তোমার মাতাই এইরূপ বলিয়া থাকে? 

কৃষ্ণ। তাহা হইলে তিনিও আপনাদিগের ভয়ে দায়ে পড়িয়া, মিথ্যা কথা বলিয়াছেন। গত কল্য আমি বাড়ী হইতে একবারেই বাহিরে গমন করি নাই। আপনারা কি জন্য মিছামিছি এরূপ কথা বলিতেছেন। 

কৃষ্ণকে আর কোন কথা এখন জিজ্ঞাসা করা নিষ্প্রয়োজন, মনে মনে এরূপ ভাবিয়া, তাহাকে পুনরায় কনষ্টেবলের জিম্মায় একখানি ঘরের ভিতর বন্ধ করিয়া রাখিয়া দিলাম। বলা বাহুল্য, এবার তাহার উপর একটু কড়া ভাবেই পাহারা পড়িল। 

কৃষ্ণকে সেইস্থানে রাখিয়া, এবার আমিও দারোগাবাবু গোপাল গোয়ালা ও রাধা বাগ্দীর পরিবারবর্গের সহিত তাহাদিগের গ্রামে দল-বলে গিয়া উপস্থিত হইলাম। আমাদিগের পূর্ব্ব প্রেরিত কর্ম্মচারী তাহাদের বাড়ীতে পূর্ব্বেই পাহারা রাখিয়া আসিয়াছিলেন। আমরা সেই স্থানে গমন করিয়া, কেশব গোয়ালা, রাখাল গোয়ালা, রামা বাগ্‌দী ও সিধু বাগ্দীকে প্রথমে ধৃত করিলাম, এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে তাহাদিগের বাড়ীতেও উত্তমরূপে খানাতল্লাসি করিলাম। উহাদিগের প্রত্যেকের ঘর হইতেই নানাপ্রকার বস্ত্র, সোণারূপার অলঙ্কার এবং পিত্তল-কাঁসার দ্রব্যাদি অনেক বাহির হইল। 

গোপাল গোয়ালা ও রাধা বাগ্দীর ঘর অনুসন্ধান করিয়াও, পূর্ব্ব মত অনেক দ্রব্যাদি পাওয়া গেল। 

এই সকল দ্রব্যাদি দেখিয়া আমরা বেশ বুঝিতে পারিলাম এ সমস্তই ডাকাইতির দ্রব্য; কিন্তু কোথা হইতে ডাকাইতি করিয়া যে, উহারা সেই সকল দ্রব্য আনিয়াছে, তাহার কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। 

একজন কর্মচারিদ্বারা সেই সকল দ্রব্য বিশ্বাসদিগের বাড়ীতে পাঠাইয়া দিয়াই সঙ্গে সঙ্গে আমরাও গমন করিয়া দেখি, সেই বাড়ীর স্ত্রীলোকগণ সেই সমস্ত প্রেরিত দ্রব্যের মধ্য হইতে কতকগুলি দ্রব্য বাহির করিলেন ও কহিলেন, “যে সকল দ্রব্য আমাদিগের বাড়ী হইতে অপহৃত হইয়াছে, এই গুলিই সেই অপহৃত দ্রব্য।” 

যে সকল ব্যক্তি ধরা পড়িয়াছিল, তাহারা যখন দেখিল যে, তাহাদিগের ঘরে যে সকল দ্রব্য পাওয়া গিয়াছে, তাহার কোন কোন দ্রব্য সনাক্ত হইয়া গেল, তখন আর তাহারা কোন কথা গোপন করিল না। বিশ্বাসদিগের বাড়ীতে তাহারা যে ডাকাইতি করিয়াছিল, ক্রমে ক্রমে, একে একে তাহারা সকলেই তাহা স্বীকার করিতে লাগিল, এবং তাহাদিগের সঙ্গে সেই ডাকাইতিতে কোন্ কোন্ ব্যক্তি সংমিলিত ছিল, তাহাও ক্রমে বলিয়া দিতে লাগিল। 

এইরূপে অনেকের নাম তাহাদিগের নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়া, ক্রমে তাহাদিগের সকলকেই ধৃত করিতে আরম্ভ করিলাম, এবং তাহাদিগের ঘরতল্লাসি করিয়া অনেক চোরা-দ্রব্যও প্রাপ্ত হইলাম। তাহাদিগের মধ্যে অনেকেই আপনাপন দোষ স্বীকার করিয়া লইল। এইরূপে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান শেষ করিতে প্রায় এক সপ্তাহ কাল অতিবাহিত হইয়া গেল। 

ক্রমে আমরা জানিতে পারিলাম, ইহারা এইরূপে দলবদ্ধ হইয়া কোন্ কোন্ স্থানে ডাকাইতি করিয়াছে। পরিশেষে কিরূপেই বা বিশ্বাসদিগের বাড়ীতে ডাকাইতি করে, কিরূপে এবং কাহা কর্তৃক গোপাল গোয়ালা এবং রাধা বাগ্দী হত হয়। 

অনুসন্ধানে এই সকল বিষয় যখন আমরা জানিতে পারিলাম, সেই সময় গোপাল গোয়ালার পুত্র কৃষ্ণ গোয়ালাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম। কৃষ্ণ যখন দেখিল যে, সমস্ত কথা প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে, ও অপরাপর সকলেই যখন এক বাক্যে সমস্ত কথা স্বীকার করিতেছে, তখন কৃষ্ণও আর কোন কথা গোপন করিল না; সে প্রথম হইতে আরম্ভ করিয়া সমস্ত কথা বলিয়া দিল। কৃষ্ণ আমাদিগকে যাহা বলিয়াছিল, তাহা শুনিলে, পাঠক-পাঠিকাগণ এই ডাকাইতিও হত্যাকাণ্ডের সমস্ত অবস্থা উত্তমরূপে বুঝিতে পারিবেন। কৃষ্ণ বলিয়াছিল :— 

“মহাশয়! পূৰ্ব্ব হইতে আপনারা অনুসন্ধান করিয়া যাহা জানিতে পারিয়াছিলেন, তাহা প্রকৃত। আমি প্রকৃতই এই ডাকাইতি মোকদ্দমায় সংমিলিত ছিলাম। তদ্ব্যতীত এবার আমি আরও যে কার্য্য করিয়াছি, তাহা আপনারা এখন পৰ্য্যন্তও অবগত হইতে পারেন নাই। তাহা শুনিলে আপনারা একবারে স্তম্ভিত হইবেন। যে দুইটি মৃতদেহ আপনারা প্রাপ্ত হইয়াছেন, তাহার মধ্যে একটির ওইরূপ অবস্থা আমা-কর্তৃকই হইয়াছে।” 

আমি। তাহা হইলে ডাকাইতির সময় তুমিই কি হত্যা করিয়াছ? 

কৃষ্ণ। এই হত্যা আমা-কর্তৃকই হইয়াছে। 

আমি। তবে তুমিই কি তোমার পিতাকে এইরূপে হত্যা করিয়াছ? 

কৃষ্ণ। না, আমি পিতৃহত্যা করিব কেন? 

আমি। তাহা হইলে রাধা তোমা-কর্তৃক হত হইয়াছে? 

কৃষ্ণ। হাঁ, আমিই রাধাকে হত্যা করিয়াছি। 

আমি। তুমি রাধাকে হত্যা করিলে কেন? 

কৃষ্ণ। তাহাই আমি বিশেষ করিয়া বলিতেছি। সমস্ত অবস্থা প্রথম হইতে অবগত হইতে চাহেন? কি, কিরূপে রাধাকে হত্যা করিয়াছি, কেবলমাত্র তাহাই শুনিতে চাহেন? 

আমি। আচ্ছা তুমি প্রথম হইতেই সমস্ত কথা বল। 

কৃষ্ণ। আমি এ পর্য্যন্ত অনেক ডাকাইতি করিয়াছি; কিন্তু এ পৰ্য্যন্ত কখনও আমি ধৃত হই নাই, বা আমি যে ডাকাইতি করিয়া থাকি, তাহাও এ পর্যন্ত কেহ সন্দেহ করেন নাই। আমি ডাকাইতি করিতে যখন গমন করিতাম, তখনই আমি আমার পিতার সহিত গমন করিতাম। পিতা দুই একবার ডাকাইতি মোকদ্দমায় ধৃত হইয়াছিলেন বটে; কিন্তু তিনি তাঁহার এই ব্যবসা কোনরূপেই পরিত্যাগ করিতে পারেন নাই। অধিকন্তু, ক্রমে আমাকেও তিনি তাঁহার একজন প্রধান সহকারী করিয়া তোলেন। আমি প্রথম প্রথম দুই একবার তাঁহার সহিত গমন করি বটে; কিন্তু কোন কার্য্য করিতেই সমর্থ হই না। কেবল তাঁহাদিগের সহিত উপস্থিত থাকিতামমাত্র, এবং আবশ্যক হইলে অপহৃত দ্রব্য সকল বহন করিয়াও আনিতাম। এইরূপে দুই চারি স্থানে ডাকাইতি করিবার সময় ডাকাইতগণের সহিত থাকিতে থাকিতে, ক্রমে আমার সাহস বৃদ্ধি হইতে লাগিল, এবং ক্রমে নিজহস্তেই ডাকাইতি করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। এইরূপে এ পৰ্য্যন্ত আমি যে কতগুলি ডাকাইতি করিয়াছি, তাহা আর এখন বলিতে পারি না। আমাদিগের ঘর হইতে যে সকল দ্রব্য আপনারা পাইয়াছেন, তাহার সমস্তই ডাকাইতির দ্রব্য। কিন্তু উহার কোন দ্রব্য যে আমরা কোন্ ডাকাইতি করিয়া আনিয়াছি, তাহা আর এখন ঠিক করিয়া বলিতে পারি না, অপরাপর যে সকল আসামীগণ আপনারা ধরিয়া আনিয়াছেন, ইহাদিগের সকলের ব্যবসাই ডাকাইতি। যে যে স্থানে আমরা ডাকাইতি করিয়াছি, তাহার প্রত্যেক স্থানেই ইহারা গমন করিয়াছিল। তবে হয়ত হইতে পারে, ইহার মধ্যে কোন ব্যক্তি এক স্থানে যায় নাই, অপর স্থানে গিয়াছিল। সকলেই যে একসঙ্গে সকল বাড়ীতে ডাকাইতি করিয়াছে, তাহা নহে; তবে সকলেই কোন না কোন বাড়ীতে ডাকাইতি করিয়াছে। এই কয়েকজন ব্যতীত আমাদিগের সহিত ডাকাইতি করিতে আরও অনেক লোক গমন করিত, যদি ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে তাহাদিগের নামও আমি আপনাদিগকে বলিয়া দিতে প্রস্তুত আছি। 

পূর্ব্বে যে সকল ডাকাইতি করিয়াছি, তাহার বৃত্তান্ত এখন থাকুক, বর্তমান ডাকাইতির অবস্থা এখন আমি আপনাদিগকে বলিতেছি। 

এই বাড়ীতে ডাকাইতি করিলে যে, আমরা অনেক দ্রব্য প্রাপ্ত হইব, এই সংবাদ যে কে আনিয়াছিল, তাহা আমি বলিতে পারি না; কিন্তু শুনিয়াছিলাম, এই বাড়ীতে টাকা-কড়ি গহনা-পত্র অনেক আছে, অথচ পুরুষদিগের মধ্যে কেহই প্রায় বাড়ীতে থাকে না। কেবলমাত্র কয়েকজন স্ত্রীলোক ও তাহাদের শিশু-সন্তানগুলি বাড়ীতে থাকে। 

এই সংবাদ জানিতে পারিবার পরই এ বাড়ীতে ডাকাইতি করিতে হইবে, ইহা আমাদিগের স্থির হইয়া গেল। যে কয়জনে মিলিয়া এই কার্য্য করিতে গমন করিব, স্থির হইল, তখন তাহাদিগের নিকট সংবাদ প্রদান করা হইল যে, কোন্ তারিখে ও কোন্ সময়ে এই ডাকাইতি করিতে হইবে। 

যে রাত্রিতে ডাকাইতি করা স্থির হইল, সেইদিবস বৈকালে আমরা সকলে গিয়া নির্ধারিত স্থানে উপস্থিত হইলাম। আমি আমাদিগের বাড়ী হইতে আমার পিতার সহিত গমন করিয়াছিলাম, যাইবার সময় আরও দুই একজন আসিয়া আমাদিগের সহিত মিলিত হইয়াছিল। 

যে স্থানে আমাদিগের সকলের সম্মিলিত হইবার কথা ছিল, তাহাও একজন ডাকাইতির বাড়ী। আমরা যখন সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম, সেই সময় সন্ধ্যা অতীত হইয়া গিয়াছিল। আমরা সেইস্থানে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, কেহ কেহ আসিয়া আমাদিগের পূর্ব্বেই উপস্থিত হইয়াছে, কেহ কেহ বা আমাদিগের পরে আসিয়া উপস্থিত হইল। আমরা সকলে সেই স্থানেই আহারাদি করিয়া আমাদিগের কার্য্য উদ্ধার করিবার মানসে, তথা হইতে বহির্গত হইলাম। সকলে একত্র গমন না করিয়া একে একে সেই স্থান হইতে বহির্গত হইয়া, যে গ্রামে ডাকাইতি করিতে মনস্থ করিয়াছিলাম, সেই গ্রামের বাহিরে মাঠের মধ্যে একটি অশ্বত্থ বৃক্ষের তলে গিয়া ক্রমে ক্রমে মিলিত হইলাম, এবং সেইস্থান হইতে সকলে দলবদ্ধ হইয়া গ্রামের মধ্যে যে বাড়ীতে ডাকাইতি করিতে মনস্থ করিয়াছিলাম, সেইবাড়ীর সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম সদর দরজা বাটীর ভিতর হইতে রীতিমত বন্ধ করিয়া দিয়াছে। যে সময় আমরা গ্রামের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিলাম, বা যে সময় সেই বাড়ীর সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিলাম, সেই সময় গ্রামের কোন লোকের সহিত আমাদিগের সাক্ষাৎ হয় নাই। 

ডাকাইতি করিবার নিমিত্ত বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার পূর্ব্বে আমাদিগের মধ্যে প্রথমতঃ একটু তর্ক আসিয়া উপস্থিত হয়, সে অতি সামান্য কালের নিমিত্ত। কেহ কেহ ইচ্ছা করিল, চোরের মত বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া ডাকাইতি করাই কৰ্ত্তব্য। কেহ বলিল, “ডাকাইতি করিতে আসিয়া চোরের ন্যায় কেন বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিব?” আমাদিগের মধ্যে অতি অল্পক্ষণ এইরূপ সামান্য তর্ক-বিতর্ক হইবার পর, আমরা আমাদিগের আনীত মশাল সকল প্রজ্বালিত করিয়া সদর দরজা ভাঙ্গিয়া সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম; প্রবেশ করিবার সময় আমরা কাহারও কর্তৃক কোন প্রকার বিঘ্ন প্রাপ্ত হই নাই। 

ডাকাইতি করিবার নিমিত্ত আমরা বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম সত্য; কিন্তু কি পুরুষ, বা কি স্ত্রীলোক, কাহাকেও আমরা সেই বাড়ীর ভিতর দেখিতে পাইলাম না। দেখিলাম, বাড়ীর খিড়কী দরজা খোলা। ভাবিলাম, বাড়ীর সকলে আমাদিগের সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার পূর্ব্বেই খিড়কী দরজা খুলিয়া বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গিয়াছে। 

আমরা সকলে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া, আমাদিগের যাহা কিছু কর্তব্য, তাহা সাধন করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। বাড়ীর মধ্যস্থিত প্রত্যেক ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া, আমাদিগের গ্রহণ করিবার উপযোগী যে সকল দ্রব্য আমরা প্রাপ্ত হইলাম, তাহা গ্রহণ করিতে লাগিলাম। 

আমি, আমার পিতা ও রাধা বাগ্দী একখানি ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া উহার দ্রব্যাদি অপহরণ করিতে আরম্ভ করিলাম। রাধার হস্তে ও আমার হস্তে এক একখানি তরবারী ছিল, আমার পিতার হস্তে ছিল— কেবলমাত্র একখানি বংশ দণ্ড। সেই ঘরের মধ্যস্থিত একটি বাক্স আমার পিতা ভাঙ্গিয়া ফেলিলে, দেখা গেল, উহার ভিতর কতকগুলি সোণা-রূপার অলঙ্কার আছে। আমাদিগের নিয়ম মত সেই সকল দ্রব্য সংগ্রহ করিয়া, আমরা একস্থানে রাখিতে লাগিলাম; কিন্তু রাধা সেই সময় সাবকাশ বুঝিয়া তাহার মধ্য হইতে দুইখানি ভাল ভাল সোণার অলঙ্কার অপহরণ করিল। পিতা ইহা দেখিতে পাইয়া, রাধাকে গালি দিলেন ও কহিলেন, “তোর মত নীচ প্রবৃত্তির লোক আমাদিগের দলের মধ্যে কোনরূপে রাখা কর্তব্য নহে।”

রাধা এই কথা শুনিয়া আমার পিতাকেও গালি দিল, কিন্তু পিতা তাহার সেই কথা শুনিয়া অতিশয় ক্রুদ্ধ হইলেন, এবং তাঁহার হস্তস্থিত সেই বংশ দণ্ড দ্বারা তাহাকে প্রহার করিলেন। রাধা ইহা সহ্য করিতে না পারিয়া, তাহার হস্তস্থিত তরবারী দ্বারা আমার পিতার উপর সজোরে এক আঘাত করিল। সেই আঘাতেই পিতা ধরাশায়ী হইয়া ইহজীবন পরিত্যাগ করিলেন। রাধা যখন দেখিল যে, তাহার তরবারীর আঘাতে আমার পিতা ইহজীবন পরিত্যাগ করিলেন, তখন সে সেই ঘরের ভিতর হইতে বহির্গত হইয়া অন্য স্থানে গমন করিতে লাগিল। 

রাধা আমার সম্মুখেই আমার পিতাকে হত্যা করিল, ইহা দেখিয়া আমি কোনরূপেই আমার প্রজ্বলিত ক্রোধকে সংবরণ করিতে পারিলাম না। আমিও আমার তরবারী হস্তে দ্রুতবেগে রাধার পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেই ঘর হইতে বহির্গত হইয়া তাহার পশ্চাৎ হইতেই তাহার উপর অস্ত্রাঘাত করিলাম। এই সময়ে আমি একবারে জ্ঞানশূন্য হইয়া পড়িয়াছিলাম, তাহার পর যে আমি কি করিলাম তাহা আমার মনে নাই। আমি রাধাকে একবার মাত্র অস্ত্রাঘাত করিয়াছিলাম, কি বারম্বার তাহার উপর অস্ত্রক্ষেপ করিয়াছিলাম, তাহা আমার মনে নাই। 

সেই সময়, যখন আমার একটু জ্ঞানের উদ্রেক হইল, তখন দেখিলাম, রাধাও রক্তাক্ত কলেবরে মৃতাবস্থায় সেই স্থানে পড়িয়া গড়াগড়ি খাইতেছে। 

ইহা দেখিয়া, আমি আর সেইস্থানে ক্ষণকালের নিমিত্তও দণ্ডায়মান হইলাম না, বাড়ী হইতে বহির্গত হইলাম। আমি বাড়ী হইতে বহির্গত হইবার সঙ্গে সঙ্গে অপরাপর যে সকল ডাকাইতগণ সেই বাড়ীর ভিতর ডাকাইতি করিতেছিল, তাহারাও সকলে অপহৃত দ্রব্যের সহিত বাহিরে আসিয়া উপস্থিত হইল। 

সেই স্থানেই আমরা সকলে একত্র হইয়া, তথা হইতে প্রস্থান করিলাম; কিন্তু আমার পিতার ও রাধার মৃতদেহ সেই বাড়ীর ভিতরই পড়িয়া রহিল। 

ক্রমে আসিয়া আমরা যে বাড়ীতে পূর্ব্বে একত্র হইয়াছিলাম, সেই বাড়ীতেই সকলে পুনরায় একত্র হইলাম, এবং অপহৃত দ্রব্যাদি আমরা সেইস্থানে বসিয়াই বণ্টন করিয়া লইলাম। আমার ও আমার পিতার অংশে যাহা পড়িল, তাহা লইয়া আমি সেই রাত্রিতেই বাড়ীতে ফিরিয়া আসিলাম। রাধার অংশ অপর আর একজনের নিকট রহিয়া গেল। 

এই ত মহাশয় এ ডাকাইতির বিবরণ ও হত্যার অবস্থা, ইহা ব্যতীত যদি আরও কোন কথা জানিতে চাহেন, তাহা এখন আমাকে আপনি জিজ্ঞাসা করিতে পারেন। 

আমি। আর জিজ্ঞাসা করিবার বিশেষ কিছুই নাই, যাহা আমাদিগের জানিবার প্রয়োজন, তাহার সমস্তই প্ৰায় তুমি আমাদিগের নিকট প্রকাশ করিয়াছ। তবে সামান্য আরও দুই চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করিব মাত্র। 

কৃষ্ণ। কি? তাহা জিজ্ঞাসা করুন, আপনার নিকট আমার আর কিছু গোপন রাখিবার প্রয়োজন নাই। যাহা জিজ্ঞাসা করিবেন, এখন তাহার প্রকৃত উত্তরই প্রাপ্ত হইবেন। 

আমি। যখন তুমি বাড়ীতে আসিয়া, এই সংবাদ তোমার মাতাকে প্রদান করিলে, তখন তোমার মাতা কি বলিলেন? 

কৃষ্ণ। ডাকাইতি করিতে গিয়া আমার পিতা যে হত হইয়াছেন, একথা আমি, আমার মাতার নিকট প্রকাশ করিতে সাহসী হই নাই। 

আমি। যে সকল দ্রব্য-সামগ্রী লইয়া, তুমি বাড়ীতে আসিয়াছিলে, সেই সকল দ্রব্য যখন তুমি তোমার মাতার হস্তে প্রদান করিলে, তখন তিনি তোমাকে কি বলিয়াছিলেন? 

কৃষ্ণ। আমি কোন দ্রব্য-সামগ্রী তাঁহার হস্তে প্রদান করি নাই, ঘরের ভিতর একস্থানে আমি উহা লুকাইয়া রাখিয়াছিলাম। 

আমি। তুমি সমস্ত কথা পূর্ব্বে একবারে অস্বীকার করিয়াছিলে কেন? 

কৃষ্ণ। ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিতে, কোন ব্যক্তি সহজে স্বীকৃত হইতে পারে?

আমি। তাহা হইলে এখন সমস্ত কথা কেন স্বীকার করিতেছ? 

কৃষ্ণ। এখন দেখিতেছি, আমি স্বীকার করি বা না করি, যখন অপরাপর সকলেই সমস্ত কথা বলিয়া ফেলিয়াছে, তখন আমার কোনরূপেই আর বাঁচিবার উপায় নাই। সুতরাং এরূপ অবস্থায় মিথ্যা কথা বলা অপেক্ষা প্রকৃত কথা বলাই যুক্তি-সঙ্গত, তাই এখন আমি সমস্ত কথা স্বীকার করিতেছি। 

ইহার পর কৃষ্ণকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন হইল না। এই মোকদ্দমায় কুড়িজন আসামী ধৃত হইয়াছিল, তাহাদিগের মধ্যে সকলেই আমাদিগের নিকট সমস্ত কথা স্বীকার করিয়াছিল। মাজিস্ট্রেট সাহেবের নিকট গিয়া, তাহাদিগের মধ্যে দশজন সমস্ত কথা অস্বীকার করিল; কিন্তু অবশিষ্ট দশজন সমস্ত স্বীকার করিয়া গেল। দায়রার বিচারের সময় সেই স্বীকৃত দশজনের মধ্যে নয়জন সমস্ত কথা অস্বীকার করিল ও কহিল, “পুলিসের অত্যাচারে আমরা নিম্ন আদালতে সমস্ত কথা স্বীকার করিয়াছি; কিন্তু প্রকৃত পক্ষে আমরা কোন দোষে দোষী নহি।” এই কুড়িজন আসামীর মধ্যে যে ব্যক্তি আদ্যোপান্ত সমস্ত, আদালতে স্বীকার করিয়া গেল, সে আর কেহই নহে, কৃষ্ণ গোয়ালা। 

হত্যা অপরাধে অপরাধী হইলেও জজসাহেব তাহাকে আজীবন অর্থাৎ কুড়ি বৎসরের নিমিত্ত দ্বীপান্তরে প্রেরণ করিলেন। অবশিষ্ট আসামীগণের মধ্যে কেবলমাত্র দুইজন আসামীকে অব্যাহতি প্রদান করিলেন, অবশিষ্ট সকলেই পনর বৎসরের নিমিত্ত কারাগারে প্রেরিত হইল। তাহারা সকলেই যে কেবলমাত্র এই একটি মোকদ্দমার আসামী হইয়াছিল, তাহা নহে; তাহাদিগের নিকট হইতে যে সকল মাল বাহির হয়, তাহাতে আরও পাঁচ ছয়টি ডাকাইতি মোকদ্দমার কিনারা হয়। সেই সমস্ত মোকদ্দমার সাজা একত্র করিয়া, জজসাহেব তাহাদিগকে উপরি-উক্ত দণ্ড প্রদান করেন। 

[আষাঢ়, ১৩০৬] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *