মণিপুরের সেনাপতি ১

মণিপুরের সেনাপতি (প্রথম অংশ)

(অর্থাৎ টিকেন্দ্রজিৎ সিংহের জন্ম হইতে ১৩ আগষ্ট ফাঁসী হওয়ার দিবস পর্যন্ত যাবতীয় ঘটনার আশ্চর্য রহস্য!) 

প্রথম পরিচ্ছেদ

গম্ভীরসিংহের রাজত্ব 

মহারাণীর রাজত্বের প্রারম্ভেই হিন্দুরাজত্ব মণিপুরের সিংহাসনে মহারাজ গম্ভীরসিংহ নামীয় একজন নরপতি স্থাপিত ছিলেন। ইংরাজের কার্য্যের নিমিত্তই ইঁহার মন একেবারে উৎসর্গীকৃত ছিল। কোন বিষয়ে আপনার অনিষ্ট হইলেও, সেই অনিষ্টের দিকে মুহূর্তের নিমিত্ত দৃকপাত না করিয়া, ইংরাজ-গবর্ণমেন্টকে বিশেষরূপে উপকৃত করিতে সতত যত্নবান থাকিতেন। ইংরাজ-গবর্ণমেন্টও ইঁহার উপর অতিশয় সদয় ছিলেন। কোনরূপে ইঁহার বিপদ উপস্থিত হইলে, অর্থ-বলে, সৈন্য-বলে বা যে কোন উপায়েই হউক, তাঁহাকে সেই বিপদ হইতে উদ্ধার করিতেন। বন্ধুর সহিত যেরূপে বন্ধুত্বরক্ষা করিতে হয়, কোন পক্ষেরই সেই বিষয়ে কোনরূপ ত্রুটি হইত না। মণিপুরের রাজবংশীয় দিগের মধ্যে ইনিই ইংরাজ-গবর্ণমেন্টের সহিত ১৮৩৩ সালে প্রথম সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হয়েন। * 

[* (A Translation of the conditions entered into by Rajah Gumbheer Sing of Munipore, on the British Government agreeing to annex to Munipore the two ranges of Hills situated between the eastern and western bends of the Barak, Dated 18th April, 1833.) 

The Governor-General and Supreme Council of Hindoostan declare as follows:-With regard to the ranges of Hills, the one called the Kalanaga Range, and the other called the Noon-jai Range, which are situated between the eastern bend of the Barak and the western bend of the Barak, we will give up all claim on the part of the Honorable Company thereunto and we will make these Hills over in possession to the Rajah, and give him the line of the Jeeree and the western bend of the Barak as a boundary, provided that the Rajah agrees to the whole of what is written in this paper, which is as follows;— 

1st – The Rajah will agreeably to instructions received, without delay, remove his Thanna from Chundrapore, and establish it on the eastern bank of the Jeeree. 

2nd – The Rajah will in no way obstruct the trade carried on between the two countries by Bengals or Munipuree merchants. He will not extract heavy duties, and he will make a monopoly of no articles of merchandise whatsoever. 

3rd The Rajah will in no way prevent the Nagas inhabiting the Kalanaga and Noon jai Ranges of Hill, from selling or bartering ginger, cotton, pepper, and every other article, the product of their country, in the plain of Cachar, at the Banskandee and Oodharbun bazaars, as has been their custom. 

4th – With regard to the road commencing from the eastern bank of the Jeeree and continued via Kalanaga and Kowpoom, as far as the valley of Munipore-after this road has been finished, the Rajah will keep it in repairs, so as to enable laden bullocks to Pass during the cold and dry seasons, Further at the making of the road, if British Officers be sent to examine or superintend the same, the Rajah will agree to everything these Officers may suggest. 

5th.-With reference to the intercourse already existing between the territories of the British Government and those of the Rajah, if the intercourse be farther extended, it will be well in every respect and it will be highly advantageous to both the Rajah and his country. In order, therefore that this may speedily take place, the Rajah, at the requisition of the British Government, will furnish a quota Nagas to assist at the construction of the road.

6th.- In the event of war with the Burmese if troops sent to Munipore, either to protest that country, or to advance beyond the Ningthee the Rajah, at the requisition of the British Government, will provide Hill porters to assist in transporting the ammunition and baggages of such troops. 

7th.- In the event of anything happening the Eastern Frontier of the British territories, the Rajah will, when required, assist the British Government with a portion of his troops. 

8th- * The Rajah will be answerable for all the ammunition he received from the British Government, and will, for the information of the British Government, give in every month, a statement of expenditure to the British Officer attached to the Levy. 

SEAL 

I, Sree Joot Gumbheer Sing of Munipore, agree to all that is written above in this paper sent by the Supreme Council. Dated 18th April, 1833, 

(A true translation.) 

(Signed) Geo, Gordon, Lieut, Adjutant, Gumbheer Sing’s Levy. 

( Singed ) Sree Joot Rajah Gumbheer Sing, Signed and sealed in my presence. (Singed) F. J. Grant. Commissioner. 

As the connection of the British Government with the Munipore Levy and the supply of ammunition to the Levy have ceased, this clause is inapplicable to present circumstances. 

[Agreement regarding compensation for the Kubo valley.] 

Major Grant and Captain Pemberton, under instructions from the Right Honorable the Governor-General in Council, having made over the Kubo Valley to the Burmese Commissioners deputed from ava, are authorized to state,- 

1st. That it is the intention of the Supreme Government to grant a monthly stipend of five hundred Sicca Rupees to the Rajah of Munipore to commence from the Ninth day of January, One Thousand Eight Hundred and Thirty four, the date at which the transfer of Kubo tookplace, as shown in the agreement mutually signed by the British and Burmese Commissioners. 

2nd,- It is to be distinctly understood, that should any circumstances hereafter arise by which the portion of territory lately made over to Ava again reverts to Munipore, the allowance now granted by the British Government will cease from the date of such reversion. 

(Signed) F. J. GRANT. MAJOR. R. Boileau Pemberton, Capt. Commissioners. 

LANGTHABAL MUNNIPORE. January 25th, 1834 ]

রাজা নরসিংহ মহারাজা গম্ভীরসিংহের ভ্রাতা। ইনি একজন অতিশয় বলশালী ও সাহসী পুরুষ ছিলেন। মহারাজা ইঁহার সাহস ও রণ-পাণ্ডিত্যে অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া ইঁহাকে সেনাপতিত্বে (Commander-in-chief) বরণ করেন। ইনি রণ বিভাগের সর্ব্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হইয়া যশের সহিত বহুদিবস পর্য্যন্ত আপনার কর্ম্ম সমাপন করেন। গম্ভীরসিংহ যত দিবস রাজত্ব করিয়াছিলেন, তত দিবস তাঁহার বুদ্ধি-কৌশলে এবং নরসিংহের রণ-কৌশলে, কেহই তাঁহাদিগের সহিত প্রতিযোগিতা প্রদর্শন করিতে সমর্থ হন নাই। 

গম্ভীরসিংহের রাজত্বের শেষ অংশে তাঁহার প্রথমা পত্নী গর্ভবতী হন। মহারাজ পুত্রমুখ-সন্দর্শনে অপার আনন্দ অনুভব করিবেন ভাবিয়া তাঁহার প্রিয়তমাকে প্রাণের অপেক্ষা আরও প্রিয়তম দেখিতে লাগিলেন। মহারাণী যখন যাহা আদেশ করিতে লাগিলেন, তখনই তাহা সম্পাদিত হইতে লাগিল। 

এখন মহারাজ পূর্ব্ব অপেক্ষা তাঁহাকে আরও যত্ন করিতে লাগিলেন। একদিবস তিনি রাজ্ঞীকে রাজ-সিংহাসনে উপবেশন করাইয়া কহিলেন, “দেখ রাজ্ঞী, আজ আমি তোমাকে এই রাজ-সিংহাসনে বসাইয়াছি। যদি তুমি পুত্ৰ প্রসব করিতে পার, তাহা হইলে জানিও, এই সিংহাসন তাহারই। সেই রাজছত্র ধারণ-পূর্ব্বক এই সিংহাসনে বসিয়া রাজত্ব করিবে।” 

মহারাজ যাহা ভাবিয়াছিলেন, হইলও তাহাই। সময়ে মহারাণী একটি পুত্র-সন্তান প্রসব করিলেন; পুত্রের জন্ম উপলক্ষে ধূমধাম যথেষ্ট হইল। নাচ, তামাসা, গান, বাদ্য, দান, ধ্যান প্রভৃতি কিছুই বাকী থাকিল না। মহারাজ সখ করিয়া পুত্রের নাম রাখিলেন, চন্দ্রকীর্ত্তি সিংহ। 

ইহার অল্প দিবস পরেই মহারাজ গম্ভীরসিংহ ইহলোক পরিত্যাগ করিলেন। মৃত্যুকালে কিন্তু তিনি আপনার প্রতিজ্ঞা প্রতিপালন করিতে ভুলিলেন না। যখন তিনি মৃত্যু-শয্যায় শায়িত, সেই সময় তিনি তাঁহার ভ্রাতা সেনাপতি নরসিংহকে ডাকাইলেন, ও আপনার পুত্রটিকে আনাইয়া তাঁহার হস্তে অর্পণ-পূৰ্ব্বক কহিলেন,—“ভাই, আমার এই নাবালক পুত্রটি রহিল। আমি ইহাকে আমার সিংহাসন অর্পণ করিয়াছি; কিন্তু এখন এ নিতান্ত শিশু। যত দিবস এ বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া রাজ্যপালনে সমর্থ না হয়, তত দিবস তুমিই রাজকার্য্য ও সেনাপতির কার্য্য, উভয় কার্য্যই সমাপন করিও। পরিশেষে চন্দ্রকীৰ্ত্তি উপযুক্ত হইলে তাহার হস্তে রাজ্যভার অর্পণ করিও।” নরসিংহ মহারাজের নিকট তাহাই স্বীকার করিলেন। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দেবেন্দ্রসিংহের রাজত্ব 

দেবেন্দ্রসিংহ, রাজা নরসিংহের সহোদর ভ্রাতা; কিন্তু উভয়ের মধ্যে সৌহার্দ্যভাব অতি অল্পই পরিলক্ষিত হইত। রাজা নরসিংহকে রাজ্য করিতে দেখিয়া তিনি সর্ব্বদাই দুঃখিত থাকিতেন, ও কোন্ উপায় অবলম্বন করিলে রাজা নরসিংহকে সিংহাসনচ্যুত করিয়া নিজে রাজা হইতে পারিবেন, সতত সেই চিন্তাতেই দিন যাপন করিতেন। 

নবীনসিংহ নামীয় একজন মণিপুরী দেবেন্দ্রের নিতান্ত বিশ্বাস-ভাজন ছিলেন। তিনি দেবেন্দ্রসিংহকে আপনার প্রাণ অপেক্ষাও অতিশয় প্রিয়তর দেখিতেন। নরসিংহ রাজ-সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, নবীন কিরূপে দেবেন্দ্রের উপকার সাধন করিতে পারিবেন, তাহারই সুযোগ অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলেন। অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া ও পরামর্শ করিয়া দেখিলেন যে, কোন প্রকারে রাজা নরসিংহকে সমন সদনে প্রেরণ করিতে না পারিলে, দেবেন্দ্ৰসিংহ কোন প্রকারে সেই সিংহাসন অধিকার করিতে সমর্থ হইবেন না, এবং ভবিষ্যৎ শত্রু চন্দ্রকীর্তির ভবিষ্যৎ আশাও নিবারণ করিতে পারিবেন না। 

রাজা নরসিংহ একজন প্রধান বৈষ্ণব ছিলেন। প্রত্যহই নিয়মিতরূপে আপনার ধর্ম্মালোচনা ও দেব-দেবীর পূজা করিতেন এক দিবস নবীনসিংহ দেখিতে পাইলেন যে, রাজা নরসিংহ দেব-মন্দিরে বসিয়া ঈশ্বর আরাধনায় নিযুক্ত আছেন। সঙ্গে লোক-জন বা অনুচরবর্গ কেহই নাই। এই সময়ে নিজের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিবার আশায়ে নবীন প্রোৎসাহিত হইলেন। তখনই দ্রুতপদে আপন স্থানে প্রবেশপূর্ব্বক একখানি সুতীক্ষ্ণ তরবারী সহ প্রত্যাগমন করিলেন, এবং রাজা নরসিংহের অজ্ঞাতে সেই মন্দির মধ্যে প্রবেশ করিলেন। যে সময়ে নবীন মন্দিরে প্রবেশ করেন, সেই সময়ে রাজা নরসিংহ আপনার পূজাদি সমাপন করিয়া সাষ্টাঙ্গে দেবীকে প্রণাম করিবার উদ্যোগ করিতে ছিলেন। তিনি যেমন প্রণিপাত করিবেন, নবীনও সেই সময় তাঁহাকে দেবী-সম্মুখে বলিদান দিবার অভিপ্রায়ে, তাঁহার সেই সুশাণিত সুতীক্ষ্ণ তরবারী উত্তোলন করিয়া, তাঁহার শরীর হইতে মস্তককে বিচ্ছিন্ন করিবার আশয়ে, সজোরে এক আঘাত করিলেন। রাজা নরসিংহ নিতান্ত চতুর ছিলেন। তিনি দেবীকে প্রণিপাত করিতে গিয়া কি জানি, কি ভাবিয়া হঠাৎ উত্থিত হইলেন, এবং পশ্চাদ্ভাগে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া দেখিলেন যে, নবীন তাঁহার উপর ভীষণ তরবারী আঘাতের উদ্‌যোগ করিতেছে। তখন অনন্যোপায় হইয়া রাজা নরসিংহ স্বীয় হস্ত উত্তোলন পূর্ব্বক আপন মস্তক বাঁচাইবার চেষ্টা করিলেন; কিন্তু নবীনের সেই ভীষণ আঘাত নরসিংহের বুদ্ধি-কৌশলে একেবারে ব্যর্থ হইল না। শরীর হইতে মস্তক বিচ্ছিন্ন হইতে পারিল না সত্য, কিন্তু সেই তরবারি আঘাতে তাঁহার দক্ষিণ, বাহু শরীর হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া দেবী সম্মুখে পতিত হইল। 

রাজা নরসিংহ তাঁহার দক্ষিণ বাহু সেই দেবী-মন্দিরে রাখিয়া আপন ঘরে প্রবেশ করিলেন। যে বাহুবলে তিনি এতদিবস রাজত্ব করিতেছিলেন, যখন তিনি সেই বাহুশূন্য হইলেন, তখন আর রাজত্ব থাকে প্রকারে? তাঁহার সেই পাষণ্ড ভ্রাতা দেবেন্দ্রসিংহ তখন সেই রাজ্য অপহরণ করিয়া আপনি রাজা হইলেন। 

রাজা নরসিংহের মৃত্যুর পরই তিনি আপনাকেই সৰ্ব্বেসর্বা মহারাজ বলিয়া প্রচার করিলেন। তখন তাঁহার প্রতিযোগী আর কেহই ছিল না। সুতরাং নির্ব্বিবাদে তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া আপনার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে সমর্থ হইলেন। 

দেবেন্দ্রসিংহ এইরূপ বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াই যে সন্তুষ্ট হইলেন, তাহা নহে; চন্দ্রকীৰ্ত্তিকে একজন সামান্য ব্যক্তির ন্যায় অবহেলার চক্ষে দেখিতে লাগিলেন। যাহাতে তাঁহার বিশেষ অনিষ্ট হয়, সততই তাহার উপায় উদ্ভাবন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। চন্দ্রকীর্ত্তির বয়ঃক্রম যতই অধিক হইতে লাগিল, ততই তাঁহার নানারূপ বিপদ আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল। যখন তাঁহার বয়ঃক্রম ১৩ বৎসর, সেই সময় দেবেন্দ্রসিংহ এমন একটি কৌশল-জাল বিস্তীর্ণ করিলেন যে, সেই জালে পতিত হইলেই চন্দ্রকীর্তির নিশ্চয়ই মৃত্যু। 

চন্দ্রকীৰ্ত্তি যদিও বালক, কিন্তু তাঁহার বুদ্ধির অতিশয় তীক্ষ্ণতা ছিল। তিনি সহজেই কৌশলচক্র বুঝিতে পারিয়া, সেই দুর্ভেদ্য বিপদ-সঙ্কুল মায়াজাল ছিন্ন করিয়া, রাত্রিযোগে রাজধানী পরিত্যাগ পূর্ব্বক আপনার প্রাণ রক্ষা করিলেন। চন্দ্রকীর্ত্তি এইরূপে আপনার বাসস্থান পরিত্যাগ পূর্ব্বক শ্রীহট্টে গিয়া ছয় বৎসর অতিবাহিত করিলেন। 

যে সময়ে তিনি শ্রীহট্টে অবস্থিতি করিয়াছিলেন, সেই সময়ে তিনি আপনার রাজ্য পাইবার প্রত্যাশায় ইংরাজ- গবর্ণমেন্টের আশ্রয় গ্রহণ করেন। আপনার রাজ্যে অভিষিক্ত হইবার নিমিত্ত তিনি ইংরাজ-গবর্ণমেন্টের নিকট অনুনয়- বিনয় করিয়া অনেক দরখাস্ত করেন; কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না, ইংরাজ-রাজ তাঁহার দুঃখে কর্ণপাত করেন না। 

তখন তিনি অনন্যোপায় হইয়া, অন্য উপায় অবলম্বনে কৃতসঙ্কল্প হন। 

চন্দ্রকীৰ্ত্তি এইরূপে প্রায় ছয় বৎসর শ্রীহট্টে থাকিয়া পরে জানিতে পারিলেন যে, ইংরাজের দ্বারা তাঁহার বিশেষ কোন সাহায্যই হইবে না। তখন তিনি কাহাকেও কিছু না বলিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন, এবং মণিপুরে আগমন-পূৰ্ব্বক লোকজন সংগ্রহ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। 

সেই সময়ে দেবেন্দ্র সিংহ অতিশয় প্রজা-পীড়ক হইয়া উঠিয়াছিলেন। সমস্ত প্রজা একত্রিত হইয়া তাঁহাকে রাজ্যচ্যুত করিবার সুযোগ অনুসন্ধান করিতেছিল। এরূপ সময়ে তাহারা আপনাদিগের প্রকৃত রাজাকে পাইয়া সকলেই চন্দ্রকীর্ত্তির নিকট আগমন করতঃ তাঁহার বশ্যতা স্বীকার করিল; এবং লোকজন ও অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ পূর্ব্বক চন্দ্রকীর্তিকে বিশেষরূপে সাহায্য করিতে প্রবৃত্ত হইল। তাহাদের মধ্যে অনেকেই রাজপুত্রের সহিত অস্ত্র ধরিতেও প্রস্তুত হইল। তখন চন্দ্ৰকীৰ্ত্তি প্রজাদিগের উপর নির্ভর ও নিজের সাহসের উপর ভর করিয়া, একদিবস হঠাৎ রাজধানী আক্রমণ করিলেন। দেবেন্দ্রসিংহের সহিত তাঁহার তুমুল উপস্থিত হইল, এবং পরিশেষে চন্দ্ৰকীৰ্ত্তিই সেই যুদ্ধে জয়লাভ করিয়া আপনার পৈত্রিক সিংহাসন অধিকার করিয়া লইলেন। 

ইংরাজ-গবর্ণমেণ্ট যখন দেখিলেন যে, চন্দ্রকীর্ত্তি আপন বীরত্বের গুণে রাজ্য অধিকার করিয়া রাজা হইলেন, তখন তাঁহাকে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ করা কর্তব্য। এই ভাবিয়া সন্ধির প্রস্তাব হইল। চন্দ্রকীৰ্ত্তিও সেই প্রস্তাবে অনুমোদন করিয়া ইংরাজের সহিত সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হইলেন, ও তাঁহাদের সহিত বন্ধুত্ব স্থাপন করিলেন। 

চন্দ্রকীৰ্ত্তি সেতুসিংহ নামীয় একজন রাজবংশীয়কে আপনার সেনাপতির পদে (Commander-in-chief) বরণ করিলেন এবং ভুবনসিংহকে মন্ত্রিপদে (Minister) প্রতিষ্ঠিত করিলেন। ইংরাজ রাজের সহিত সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হইয়া মহারাজ চন্দ্রকীৰ্ত্তি নিৰ্ব্বিবাদে একাদিক্রমে ৩৫ বৎসর রাজত্ব করেন। 

মহারাজ চন্দ্রকীর্তি ক্রমান্বয়ে আটটি বিবাহ করেন। প্রথম স্ত্রী চারিটি পুত্র প্রসব করেন; যথা :—সুরাচন্দ্র সিংহ, কেশরজিৎ সিংহ, ভৈরবজিৎ সিংহ বা পাকা সেনা, এবং পদ্মলোচন সিংহ বা গোপাল সেনা। দ্বিতীয় রাণীর গর্ভে কুলাচন্দ্র সিংহ গান্ধার সিংহ, তৃতীয় রাণীর গর্ভে টিকেন্দ্রজিৎ সিংহ বা কৈরং চতুর্থ রাণীর গর্ভে ঝালকৃতি সিংহ, পঞ্চম রাণীর গর্ভে ভুবনসিংহ অঙ্গো সেনা, এবং ষষ্ঠ রাণীর গর্ভে জিনা সিংহ জন্মগ্রহণ করেন। সপ্তম ও অষ্টম স্ত্রীর কোন পুত্রাদি হয় নাই। এই আটটি মহিষীর মধ্যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় রাণী সহোদরা ভগ্নী। 

আমরা যাঁহার জীবনচরিত লিখিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি, যে সেনাপতি টিকেন্দ্রজিৎ সিংহ বা কৈরং, চন্দ্রকীর্ত্তি মহারাজের . ঔরসে এবং তৃতীয় রাণীর গর্ভে ১৮৫৮ খৃষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

(১৮৫৮ হইতে ১৮৬৭) 

বাল্য-জীবনের প্রথম দশ বৎসর 

ইংরাজী ১৮৫৮ খৃষ্টাব্দে তৃতীয় রাণীর গর্ভে মহারাজ চন্দ্রকীর্ত্তির বিখ্যাত পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। ইনি তৃতীয়া রাণীর যদিও প্রথম বা একমার পুত্র, কিন্তু মহারাজের ইনিই চতুর্থ সন্তান। মহারাজের প্রথম পুত্র সুরাচন্দ্র সিংহ, ইনি প্রথমা রাণীর গর্ভে প্রথমে জন্মগ্রহণ করেন। মহারাজের দ্বিতীয় পুত্র কুলাচন্দ্র সিংহ, ইনি দ্বিতীয়া মহিষীর প্রথম পুত্র। মহারাজের তৃতীয় পুত্র ঝালকৃতি সিংহ, ইনি চতুর্থ রাণীর কেবল মাত্র সন্তান; আর টিকেন্দ্রজিৎ সিংহ বা কৈরৎ মহারাজের চতুর্থ সন্তান। 

মহারাজের প্রথম তিন পুত্রের জন্মগ্রহণ কালে মণিপুরে যে প্রকার আনন্দ-স্রোত বহিয়াছিল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে, প্রত্যেক দ্বারে দ্বারে যেরূপ আনন্দ উৎসব উচ্ছলিত হইয়াছিল, টিকেন্দ্রের জন্মদিনেও সেইরূপ আনন্দের কিছুমাত্র তারতম্য পরিলক্ষিত হয় নাই। ইহাঁর জন্ম-উপলক্ষে নগরের সমস্ত দেব-মন্দির শঙ্খ-ঘণ্টা-নাদে প্রতিধ্বনিত হইয়াছিল। অসংখ্য দরিদ্রদিগের মধ্যে অন্নবস্ত্র অপর্যাপ্তরূপে বিতরিত হইয়াছিল। রাজ-সংসারস্থ দাসদাসী ও কর্ম্মচারী-মাত্রই নববস্ত্রে সুশোভিত ও উপযুক্তরূপ পারিতোষিকে পরিতুষ্ট হইয়াছিল। সৈন্যগণকে চৰ্ব্বচোষ্য-লেহ্য-পেয় প্রভৃতি আহারীয় দ্রব্যে পরিতৃপ্ত-পূর্ব্বক প্রত্যেককে তিন মাসের বেতন পারিতোষিক প্রদত্ত হইয়াছিল। কারাগারের দ্বার 

একেবারে উন্মোচিত হইয়াছিল। এই সমস্ত ব্যতীত নৃত্য, গীত, বাদ্য, বাজানা প্রভৃতির তো কথাই নাই। বৈঠকখানায় মধুর হরিনাম সম্মিলিত খোল ও করতালের বাদ্যে দিমণ্ডল পরিব্যাপ্ত হইয়াছিল। 

সময় মতে মহারাজ পণ্ডিতমণ্ডলীর পরামর্শ-অনুযায়ী হোমযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়া এই বালকের নামকরণ সমাপন করিলেন। সেই দিবস হইতেই সকলে এই বালককে টিকেন্দ্রজিৎ বলিয়া সম্বোধন করিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে টিকেন্দ্র ক্রমে বড় হইতে লাগিলেন। তাঁহার অঙ্গ প্রত্যঙ্গে ক্রমে বলের সঞ্চার হইতে আরম্ভ হইল। টিকেন্দ্র বসিতে শিখিলেন; হামাগুড়ি দিতে আরম্ভ করিলেন। সেই সময় হইতেই তাঁহার অস্ত্রশস্ত্রের উপর লক্ষ্য পতিত হইতে লাগিল। হামাগুড়ি দিয়া বেড়াইতে বেড়াইতে একস্থানে যদি আহারীয় দ্রব্য ও অস্ত্রাদি দেখিতে পাইতেন, তাহা হইলে সেইস্থানে গমন-পূৰ্ব্বক সেই অস্ত্র লইতেই চেষ্টা করিতেন, — আহারীয় দ্রব্যের প্রতি একবারও লক্ষ্য করিতেন না। নিতান্ত শৈশবকাল হইতেই অস্ত্রশস্ত্রের উপর টিকেন্দ্রের অনুরাগ দেখিয়া মহারাজ চন্দ্রকীর্তি বেশ বুঝিতে পারিলেন যে, কালে টিকেন্দ্রজিতের বলবিক্রম জনসমাজে প্রচারিত হইবে — সময়ে সকলের হৃদয়ে টিকেন্দ্রজিতের নাম অঙ্কিত হইবে তাঁহার বীরত্বে দিঙমণ্ডল প্রকম্পিত হইবে। বাল্যকাল হইতেই টিকেন্দ্রের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া মহারাজ তাঁহাকে অতিশয় ভালবাসিতে লাগিলেন। এইরূপে পাঁচ বৎসর কাল উত্তীর্ণ হইয়া গেল। টিকেন্দ্ৰজিৎ এখন ষষ্ঠ বৎসরে পদার্পণ করিলেন। 

মহারাজ চন্দ্রকীর্তির মনে স্পষ্টই ধারণা হইয়াছিল যে, উপযুক্তরূপ শিক্ষাপ্রাপ্ত হইলে টিকেন্দ্ৰজিৎ একজন বীরপুরুষ হইতে পারিবেন। বাদামসিংহ নামীয় এক ব্যক্তি সেই সময়ে চন্দ্রকীর্তি মহারাজের অশ্বাধ্যক্ষ ছিলেন; এবং এনকাইবা চাওবা নামক একব্যক্তি অস্ত্র-চালনে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন; টিকেন্দ্রজিৎকে শিক্ষা দিবার নিমিত্ত মহারাজ উভয়কেই নিযুক্ত করিলেন, উভয়েই বিশেষ যত্নের সহিত টিকেন্দ্রজিৎকে শিক্ষা দিতে লাগিলেন। 

সকলে শুনিয়া আশ্চর্য্য হইবেন যে, ছয় বৎসর বয়স হইতে আরম্ভ করিয়া দশ বৎসর বয়ঃক্রমের মধ্যে টিকেন্দ্রজিৎ সিংহ অশ্বারোহণে একজন বিশেষ উপযুক্ত হইয়া উঠিলেন। মহারাজের অশ্বশালায় এমন কোন অশ্ব ছিল না যে, সেই বয়সে টিকেন্দ্রজিৎ তাহার উপর আরোহী না হইয়াছেন। টিকেন্দ্র এরূপ দ্রুতগতিতে অশ্ব চালাইতে শিক্ষা করিয়াছিলেন যে, তাঁহার শিক্ষক বাদামসিংহ পৰ্য্যন্তও সময় সময় আশ্চৰ্য্যান্বিত হইতেন। এই সামান্য বয়সেই কেবল যে তিনি অশ্বারোহীই হইয়াছিলেন, তাহা নহে; এনকাইবা চাওবারও তিনি একজন অতিশয় প্রিয় শিষ্য হইয়া উঠিলেন। অস্ত্র-চালনায় তিনি সকল শিষ্য অপেক্ষা প্রধান হইলেন। অশ্বের উপর আরোহণ করিয়া তিনি সেই তরুণ বয়সে এরূপ অস্ত্রচালনা করিতে শিখিয়াছিলেন যে, দর্শকমণ্ডলী তাঁহার কৌশল দেখিয়া নিতান্ত বিস্মিত হইতেন। 

মহারাজ তাঁহাকে কেবলমাত্র অশ্বারোহণ ও অস্ত্রচালন শিখাইয়াই যে ক্ষান্ত ছিলেন, তাহ নহে। তিনি লেখাপড়া শিক্ষা দিবার নিমিত্ত যত্ন করিতেও ত্রুটি করেন নাই। মণিপুরী বাঙ্গালা ভাষা শিক্ষা দিবার নিমিত্ত ঘনেশ্বর সিংহ নামক একজন পণ্ডিতকে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। ঘনেশ্বর যদিও বিশেষ সারধন এবং যত্নের সহিত তাঁহাকে মণিপুরী ও বাঙ্গালা ভাষা শিক্ষা দিতেন সত্য, কিন্তু অন্যান্য ছাত্রদিগের অপেক্ষা টিকেন্দ্র উত্তমরূপ পারদর্শিতা প্রদর্শন করিতে সমর্থ হইলেন না। অশ্বারোহণে এবং অস্ত্রচালনে তিনি যেরূপ কৃতবিদ্য হইয়াছিলেন, লেখা-পড়ায় কিন্তু ততদূর অগ্রসর হইতে সমর্থ হইতে পারিলেন না। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

(১৮৬৮ হইতে ১৮৮৩)

বাল্য-শিক্ষা 

ইংরাজী ১৮৬৮ সালে এক দিবস মহারাজ চন্দ্রকীর্তি দেখিলেন যে, টিকেন্দ্রজিৎ একাদশ বৎসর বয়সে পদার্পণ করিয়াছেন তাঁহার যজ্ঞোপবিতের সময় উপস্থিত হইয়াছে। দ্বিজদিগের উপনয়নের বয়ঃক্রম ৯ বৎসর। বালক ৯ বৎসর উপনীত হইলেই যজ্ঞোপবীতের ব্যবস্থা হিন্দু-শাস্ত্রে দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু যদি কেহ কোন কারণবশতঃ ৯ বৎসর বয়সের সময় বালকের যজ্ঞোপবীত দিতে সমর্থ না হন, তাহা হইলে ১১ বৎসর বয়ঃক্রমের সময় তাঁহাকে সেই শুভকৰ্ম্ম সমাপন করিতেই হইবে। সেই সময়ে না হইলে ১৩ বৎসর ভিন্ন যজ্ঞোপবীত ধারণের আর সময় নাই; কিন্তু সেই সময় শাস্ত্রানুমোদিত উপযুক্ত সময় নহে। চন্দ্রকীৰ্ত্তি দেখিলেন, বালক যখন ১১ বৎসর বয়ঃক্রমে উপনীত হইয়াছেন, তখন আর নিরস্ত থাকা যুক্তিযুক্ত নহে। তিনি তৎক্ষণাৎ পুরোহিতকে সমাচার প্রদান করিলেন। সংবাদ পাইবামাত্র রাজ-পুরোহিত আসিয়া মহারাজের নিকট উপস্থিত হইলেন। মহারাজের অভিমতে পাঁজি-পুঁথি খুলিয়া, গণিয়া পড়িয়া, যজ্ঞ-উপবীতের উপযুক্ত একটি শুভদিন স্থির করিয়া দিলেন। সেই নির্দিষ্ট দিনে টিকেন্দ্র যজ্ঞ-উপবিত ধারণ করিবেন, এই সংবাদ দেখিতে দেখিতে, কর্ণে কর্ণে, মণিপুরময় রাষ্ট্র হইয়া গেল। সেই শুভদিনে ক্রমে নিকট হইয়া আসিল। উদযোগ-আয়োজন যথেষ্টই হইতে লাগিল। পরিশেষে সেই শুভদিনে পুরোহিত আগমন করিলেন ও হিন্দুশাস্ত্রানুযায়ী হোম-যজ্ঞ করিয়া টিকেন্দ্রের উপনয়ন-কার্য সমাপন করিয়া দিলেন। বলা বাহুল্য, সেই উপলক্ষে মণিপুরে আমোদ-আহ্লাদ যথেষ্টই হইয়াছিল। 

যে বৎসর টিকেন্দ্রের উপনয়ন হয়, তাহার পর বৎসর অর্থাৎ ইংরাজী ১৮৬৯ সালে মণিপুরের পলিটিকেল এজেন্ট ছিলেন— কর্ণেল ম্যাক্লক সাহেব। ইনি যদিও একজন সৈনিক কৰ্ম্মচারী. কিন্তু অতিশয় পণ্ডিত বলিয়া প্রসিদ্ধ ছিলেন।’ ইংরাজী-সাহিত্যে ইহার অতিশয় ব্যুৎপত্তি ছিল; সেই সময়ের প্রধান প্রধান কলেজের প্রফেসারদিগের অপেক্ষা ইংরাজী- সাহিত্যে ইনি কোন অংশে ন্যূন ছিলেন না। রাজবাড়ীর অতি নিকটে ইহাঁর রেসিডেন্সি ছিল। বোধ হয়, এক চতুর্থ মাইলেরও কম হইবে। 

মহারাজ চন্দ্রকীর্ত্তি তাঁহার পুত্রদিগকে ইংরাজী শিখাইবার অভিলাষ করেন; কিন্তু সেই স্থানে এমন কোন ব্যক্তিই ছিল না যে, সেই ভার আপনার স্কন্ধে লইতে সমর্থ হয়। একদিবস্ মহারাজ চন্দ্রকীর্ত্তি গল্পচ্ছলে ম্যাক্লক সাহেবকে তাঁহার মনের ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন, ও একজন উপযুক্ত ইংরাজী-শিক্ষক পাইতেছেন না, তাহাও তাঁহাকে কহিলেন। ম্যাক্লক সাহেব মহারাজের মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া নিজেই তাঁহার বালকগণকে ইংরাজী-শিক্ষা দিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। মহারাজ চন্দ্রকীর্তি তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া, তাঁহার উদারতার নিমিত্ত বারবার তাঁহাকে ধন্যবাদ প্রদান করিলেন। সেই দিবস হইতেই অন্যান্য ভ্রাতা কয়েকটির সহিত টিকেন্দ্রজিৎ ম্যাক্লক সাহেবের ছাত্ররূপে পরিণত হইয়া, তাঁহার নিকট ইংরাজী-ভাষা শিক্ষা করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। 

টিকেন্দ্রজিৎ প্রত্যহ অশ্বারোহণে সাহেবের নিকট ইংরাজী শিখিতে গমন করিতেন; কিন্তু নিরস্ত্রে কখনও বাড়ীর বাহিরে হইতেন না। কোন দিবস বন্দুক, কোন দিবস তরবারী প্রভৃতি কোন না কোন একটি অস্ত্র সঙ্গে লইয়া গমন করিতেন। এইরূপে কয়েক বৎসর তিনি সাহেবের নিকট গমনাগমন করিলেন, কিন্তু লেখা-পড়া কিছুই শিখিতে পারিলেন না। লেখা-পড়ায় তিনি মন-সংযোগ করিতে পারিতেন না। কাজেই পড়াশুনা তাঁহার ভাল লাগিল না। দেখিয়া শুনিয়া সাহেবও ঢিল দিলেন, তিনি ঐ রাস্তা পরিত্যাগ করিলেন। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

টিকেন্দ্রের মৃগয়া এবং কৈরৎ নাম ধারণ 

এখন টিকেন্দ্র তাঁহার নিজের সখ মিটাইবার অনেক সময় পাইলেন। প্রায় প্রত্যহই তিনি লোকজন সমভিব্যাহারে অশ্বারোহণে শিকার-অন্বেষণে বহির্গত হইতেন। তাঁহার হস্তের নিশান অতি অদ্ভুত ছিল। উড্ডীয়মান পক্ষিগণকে তিনি দ্রুতগামী অশ্বোপরি হইতে গুলি করিতে পারিতেন। দিবসের অধিকাংশ সময়ই তিনি জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরিয়া নানা-প্রকারের পক্ষী ও মৃগ প্রভৃতি শিকার করিয়া লইয়া আসিতেন। ইহার ভিতর আহারোপযোগী যে কোন পক্ষী প্রভৃতি থাকিত, তাহা তিনি নিজহস্তে পাক করিয়া নিজে আহার করিতেন, এবং তাঁহার আনুসঙ্গী এবং ভৃত্যবর্গকে প্রদান করিতেন। 

এই সময়ে টিকেন্দ্রজিৎ সিং কৈরৎ নাম ধারণ করেন। যে ব্যক্তি অন্য কার্য্য পরিত্যাগ-পূর্ব্বক রাত্রিদিন কেবল জঙ্গলে জঙ্গলে শিকার অন্বেষণ করিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়, মণিপুরিরা তাহাকেই কৈরৎ কহে। টিকেন্দ্রের সেইরূপ অবস্থা দেখিয়া মহারাজ উহাকে একদিবস ‘কৈরৎ’ বলিয়া সম্বোধন করেন। সেই দিবস হইতেই সকলে তাঁহাকে ‘কৈরৎ’ শব্দে অভিহিত করিত। 

টিকেন্দ্রজিৎ প্রচুর পরিমাণে আহার করিতে পারিতেন। কিন্তু কোন পাচকের দ্বারা যে খাদ্য প্রস্তুত হইত, তাহা তিনি খাইতে ভাল-বাসিতেন না। তিনি স্বহস্তে ইচ্ছামত রন্ধন করিয়া, পরিতৃপ্তির সহিত উদর পুরিয়া আহার করিতেন ও সকলকে আপন সম্মুখে বসাইয়া আহার করাইতেন। ইনি মাংসের উপর এত অনুরক্ত ছিলেন যে, যে দিবস তিনি শিকারে গমন করিতে সমর্থ হইতেন না, বা শিকারে আহারোপযুক্ত পশু পক্ষী প্রভৃতি প্রাপ্ত হইতেন না, সেই দিবস তাঁহার আহারই হইত না। 

ইনি যেরূপ মাংসভক্ত ছিলেন, মৎস্যের উপরও ইঁহার সেইরূপ অনুরাগ ছিল। ইনি স্বহস্তে জাল ফেলিয়া মৎস্য ধরিতেন ও সেই মৎস্য স্বহস্তে রন্ধন করিয়া নিজে আহার করিতেন, ও সকলকে প্রদান করিতেন। 

রন্ধনে ইনি অতিশয় উপযুক্ত ছিলেন। ইনি নিজহস্তে যে সকল দ্রব্যাদি রন্ধন করিতেন, তাহা এক দিবসের নিমিত্তও যিনি আহার করিয়াছেন, তিনি জন্মে তাহার সুমধুর তার ভুলিতে পারিবেন না। টিকেন্দ্র বিশেষ যত্ন ও পরিশ্রম করিয়া রন্ধন করিতে শিখিয়াছিলেন। যে ব্যক্তি যে দ্রব্য উত্তমরূপে রন্ধন করিতে পারিত, তিনি তাহারই নিকট গমন করিয়া সেইরূপ রন্ধন করিতে শিক্ষা করিতেন। এমন কি, সময় সময় তিনি অনেক মুসলমানদিগের বাড়ীতে গমন করিয়া তাহাদের রন্ধন-পদ্ধতি স্বচক্ষে দেখিয়া লইতেন, এবং বাড়ী আসিয়া নিজহস্তে সেইরূপ রন্ধন করিতে অভ্যাস করিতেন। 

টিকেন্দ্রজিতের বয়ঃক্রম যখন ১৮ বৎসর, সেই সময় হইতে তিনি শিকার করিতে গিয়া যে কেবলমাত্র মৃগ ও পক্ষী মারিতেন তাহা নহে। তিনি যে কত ভয়ানক ভয়ানক ব্যাঘ্র শিকার করিয়াছেন, তাহার সংখ্যা করা সহজ নহে। তাঁহার ব্যাঘ্র শিকার সম্বন্ধে মণিপুরে অনেক কথা অনেকে বলিয়া থাকেন। তাহার একটি মাত্র এই স্থানে সন্নিবেশিত হইল। এক দিবস টিকেন্দ্রজিৎ পাঁচটি ব্যাঘ্র শিকার করিয়া আনিয়াছিলেন। কিন্তু সহরের ভিতর একটি সামান্য কথা হইলে কাণে কাণে ঊহা যেমন বিস্তীর্ণ হইয়া পড়ে ও জনস্রোতে পরিশেষে ক্রমে উহা এরূপ আকার ধারণ করে যে, তাহার ভিতর হইতে প্রকৃত কথা বুঝিয়া লওয়া সহজ হয় না; সেইরূপ এই ব্যাঘ্র-শিকারের কথাও ক্রমে ক্রমে বিস্তীর্ণ হইয়া পড়িল। পাঁচটি ব্যাঘ্র স্থানে ক্রমে পঞ্চাশটি হইল, পঞ্চাশটিও ক্রমে শতে পরিণত হইল। টিকেন্দ্রজিৎ তাঁহার একজন কৰ্ম্মচারীকে ডাকিয়া, তাঁহার আনীত ব্যাঘ্রগুলিকে মৃত্তিকার ভিতর পুঁতিয়া ফেলিতে কহিলেন। সে মৃত ব্যাঘ্র গুলিকে পুঁতিবার নিমিত্ত একটি প্রকাণ্ড খাদ খনন করিল। সে শুনিয়াছিল যে, টিকেন্দ্রজিৎ একশত ব্যাঘ্র মারিয়া আনিয়াছেন; সুতরাং সেই সমস্ত ব্যাঘ্রের স্থান হইতে পারে, এরূপ প্রকাণ্ড খাদ খনন করার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। সেই ভৃত্য তাঁহাকে কহিল, — “আপনি একশত ব্যাঘ্র শিকার করিয়া আনিয়াছেন, এত বড় খাদ ভিন্ন সঙ্কুলান হইবে কেন?” এই কথা শুনিয়া তাঁহার একটি ভ্রাতা একটু হাসিলেন, ও যেন নিতান্ত তাচ্ছিল্যভাবে কহিলেন, “একশত বাঘ শিকার করা যদি যাহার তাহার কর্ম্ম হইত, তাহা হইলে আর ভাবনা কি?” এই কথা টিকেন্দ্রের ভাল লাগিল না। তিনি ঐ ব্যাঘ্র পোঁতা স্থগিত রাখিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন, এবং প্রতিজ্ঞা করিলেন, যে পর্যন্ত এক শত ব্যাঘ্র শিকার না করিতে পারিবেন, সেই পর্যন্ত রাজধানীতে প্রত্যাগমন করিবেন না। হইলও তাহাই। জন্মেজয় যেরূপ সর্পযজ্ঞ আরম্ভ করিয়াছিলেন, টিকেন্দ্রজিতও সেইরূপ ব্যাঘ্রযজ্ঞ আরম্ভ করিলেন। নানাস্থান ভ্রমণ করিয়া তিনি পূর্ণ শত ব্যাঘ্র শিকার করিয়া প্রত্যাগমন করিলেন, ও সেই সমস্ত ব্যাঘ্রই সেই স্থানে প্রোথিত হইল। 

কেহ কেহ বলিয়া থাকেন, তিনি অনেক ভল্লুক এবং সিংহও শিকার করিয়াছেন। শিকার করিতে গিয়া তিনি যে কত দিন কত বিপদে পড়িয়াছেন, তাহার শেষ নাই; কিন্তু সেই সকল বিপদকে তিনি ভ্রূক্ষেপও করিতেন না। যে দিবস ভয়ানক বিপদে পড়িয়া তিনি কষ্টে জীবন রক্ষা করিয়া ফিরিয়া আসিতেন, তাহার পরদিবস সে কথা আর তাঁহার মনে থাকিত না। পর দিবস হৃষ্টমনে আবার শিকার অন্বেষণে বহির্গত হইতেন। তাঁহার এতদূর সাহস ছিল, এতদূর ক্ষমতা ও বিক্রম ছিল যে, ব্যাঘ্রাদি দেখিলে তিনি দূর হইতে গুলি করিয়া তাহাকে মারিতেন না। ব্যাঘ্রাদি দেখিলেই অমনি অশ্ব-পৃষ্ঠ হইতে অসিহস্তে লম্ফপ্রদান করিয়া ভূমিতে অবতরণ করিতেন ও দ্রুতপদে সেই ব্যাঘ্রাভিমুখে গমন করিতেন। এইরূপে ব্যাঘ্রের নিকটে গমন করিলে, যদি সেই ব্যাঘ্র তাঁহার উপর আক্রমণ করিত, ভালই; নচেৎ সেই স্থান হইতে লোষ্ট্রাদি কোন দ্রব্য উঠাইয়া লইয়া তাহার উপর নিক্ষেপ করিতেন। কাজেই সেও ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহার উপর আক্রমণ করিত। যেমন সে লম্ফ প্রদান করিয়া তাঁহার উপর পতিত হইত, অমনি তিনি তাঁহার দৃঢ় মুষ্টি-আবদ্ধ তরবারি দ্বারা সজোরে এমন এক আঘাত করিতেন যে, সেই ব্যাঘ্র তখনই দ্বিখণ্ডিত হইয়া ভূতলে পতিত হইত। টিকেন্দ্র যে সকল ব্যাঘ্রাদি শিকার করিয়াছেন, তাহা কেহ কখন সম্পূর্ণ দেখে নাই। সমস্তই দুইখণ্ডে পরিণত হইত। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

নাগা-যুদ্ধ 

ইংরাজী ১৮৭৮ সালে মণিপুরের সীমান্ত-প্রদেশীয় নাগাদিগের সহিত ইংরাজ-গবর্ণমেন্টের এক তুমুল যুদ্ধ হয়। কি কারণে এই যুদ্ধের সূত্রপাত, কি নিমিত্তই বা ইংরাজরাজ উহাদিগের উপর অসন্তুষ্ট হইয়া এই ভীষণ যুদ্ধের ঘোষণা করেন ও কি কারণেই বা নাগাগণ বীরমদে মত্ত হইয়া ইংরাজের সহিত রণভেরী বাজায়, তাহা প্রায় বর্তমান পাঠকমণ্ডলী সকলেই অবগত আছেন। কাজেই সে সকল বিষয়ের বর্ণনা এস্থলে পরিত্যক্ত হইল। বিশেষ সেই যুদ্ধের ইতিহাসের সহিত উপস্থিত বিষয়ের বিশেষ কোন সংস্রব নাই। তবে টিকেন্দ্রজিৎ সম্বন্ধীয় যে যে বিষয়ের আবশ্যক, তাহাই সংক্ষেপে নিম্নে আলোচিত হইল। 

কর্ণেল জনষ্টন সাহেব এই সময় মণিপুরের ‘পলিটিকেল এজেন্ট’ ছিলেন। এই নাগা-যুদ্ধের ভার তাঁহারই উপর অর্পিত হয়। এই গুরুভার হস্তে লইয়া জনষ্টন সৈন্য-সামন্তের সহিত নাগাদিগকে পরাজয় করিবার অভিলাষে সেইস্থানে গমন করেন। মণিপুরের সীমান্ত ছাড়িয়া, নাগাদিগের সীমান্তের মধ্যে আপনাদিগের শিবির সন্নিবেশিত পূর্ব্বক, বীরদর্পে নাগাদিগের সহিত যুদ্ধ-ক্ষেত্রে উপস্থিত হন। নাগাগণও বলবীর্য্যে কম নহে, যুদ্ধবিষয়ে ইহারা পরাঙ্গুখ নহে, ও সহজে ব্রিটিশ-ভয়ে ভীত হইবার জাতিও নহে। কাজেই উভয়পক্ষে তুমুল সংগ্রাম উপস্থিত হইল। 

ইংরাজ-কামানের ভীষণ গর্জ্জনে ভীত না হইয়া, চাকচিক্যময় সারি সারি সঙ্গীনের দিকে দৃকপাতও না করিয়া, তাহারা ইংরাজ শিবির আক্রমণ করিল। রাস্তাঘাট বন্ধ করিয়া দিল, টেলিগ্রাফের তার ছিন্ন ভিন্ন করিল, সৈন্যের রসদ 

লুটিয়া লইল। এইরূপ দুর্ব্বিপাকে পড়িয়া ইংরাজ-সৈন্য ক্রমে লোপ পাইতে লাগিল সংবাদ পাইবার উপায় নাই, অন্য সৈন্য আসিয়া উপস্থিত হইবার রাস্তা বন্ধ! কাজেই জনষ্টনকে বিশেষ বিপদগ্রস্ত হইতে হইল। 

এই ঘটনার অবস্থা দেখিয়া প্রসিদ্ধ সিপাহি-বিদ্রোহের ইতিহাস বৃত্তান্ত মনে উদয় হইল। সেই প্রদেশে যত ইংরাজ- কৰ্ম্মচারী ছিলেন, তাঁহারা সকলেই অতিশয় ভীত অন্তঃকরণে স্ত্রীপুত্রাদি সহিত কহিমার দুর্গে আসিয়া আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। গুলি বারুদ কামান প্রভৃতি সমস্তই সেই দুর্গে ছিল। নাগাগণ যে সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া সেই কহিমা-দুর্গ আক্রমণ করিল। সে স্থানের গমনাগমনের রাস্তা বন্ধ হইল; টেলিগ্রাফের তার বিচ্ছিন্ন হইয়া গেল; খাদ্যাদি সমস্তই লুঠিয়া লইতে লাগিল কেল্লার ভিতর আর কোনরূপে সংবাদ পাঠাইবার উপায় রহিল না। ইংরাজগণ যেন কয়েদীর মত সেই স্থানে আবদ্ধ থাকিয়া আপন আপন প্রাণের আশায় জলাঞ্জলি দিতে লাগিলেন। স্ত্রী-পুত্র-কন্যার মায়াজাল ছিন্ন করিবার চেষ্টা দেখিতে লাগিলেন। নাগাগণ তাঁহাদিগের যে কিরূপ দুর্গতি করিবে, তাহাই ভাবিয়া অস্থির হইতে লাগিলেন; আর সিপাহি বিদ্রোহের সেই ভয়াবহ দৃশ্য স্মরণ করিয়া একেবারে অজ্ঞান হইতে লাগিলেন। 

এই দুর্বিপাকের সময় জনষ্টন সাহেব কোনরূপে তাঁহার ঊর্দ্ধতন কর্মচারীর নিকট সংবাদ পাঠাইলেন। জনষ্টন সাহেব মহারাজ চন্দ্রকীর্তির বলবীর্য্যের বিষয় বিশেষরূপে অবগত ছিলেন। তাঁহার সাহায্য ব্যতীত এই বিপদ হইতে উদ্ধারের আর উপায় নাই ভাবিয়া, মহারাজ চন্দ্রকীর্ত্তির সাহায্য প্রার্থনা করিতে পরামর্শ দিলেন! এই সংবাদ পাইয়া, ইংরাজ-রাজ জনষ্টনের পরামর্শই সুপরামর্শ ভাবিয়া, মহারাজ চন্দ্রকীর্ত্তির নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। মহারাজ ইংরাজদিগের একজন পরম মিত্র ছিলেন। তিনি মিত্রের মিত্রতা রক্ষা করিলেন; নাগাযুদ্ধে ইংরাজদিগকে বিশেষরূপে সাহায্য করিতে প্রতিশ্রুত হইলেন। 

চন্দ্রকীর্ত্তি মহারাজের সেনাপতি তখন সেতুসিংহ। সেতুসিংহের বলবিক্রম যদিও কিছুমাত্র কম ছিল না, কিন্তু সেই সময়ে তিনি অতিশয় বৃদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিলেন। সেতুসিংহের ইচ্ছাসত্ত্বেও মহারাজ এই বৃদ্ধ বয়সে আপনার প্রধান সেনাপতিকে নাগা-যুদ্ধে পাঠাইতে অসম্মত হইলেন ও এই যুদ্ধে আপনার পুত্রগণের বল-বীর্য্যের পরিচয় লইবার ইচ্ছা করিলেন। প্রকাশ্য দরবারে এক দিবস মহারাজ আপনার সমস্ত পুত্রগণকে ডাকাইলেন। নিজের মনের ভাব সৰ্ব্বসমক্ষে তাহাদিগের নিকট প্রকাশ করিলেন, ও কহিলেন, “পুত্রগণ, আমার সৈন্যগণের মধ্য হইতে কম সৈন্য লইয়া যে এই যুদ্ধ জয় করিতে পারিবে, প্রস্তুত হও। আমার দেখিতে ইচ্ছা হইয়াছে যে, সামান্য সৈন্যের সাহায্যে * তোমাদিগের মধ্যে কে বিশেষ বীরত্ব দেখাইতে সম্মত হয়।” 

মহারাজের এই কথা শুনিয়া সকলেই যুদ্ধ-গমনে প্রস্তুত হইবার আজ্ঞা প্রার্থনা করিল। কিন্তু টিকেন্দ্রজিৎ সকলের প্রার্থিত সৈন্যের অপেক্ষা অনেক কম সৈন্য লইয়া সেই যুদ্ধে গমন করিলেন। সুরাচন্দ্র সিংহ টিকেন্দ্রের সহিত মিলিত হইলেন। তখন উভয় ভ্রাতা কেবলমাত্র দুই সহস্ৰ সৈন্য লইয়া সেই ভীষণ নাগাযুদ্ধে ইংরাজের সাহায্য করিতে অগ্রসর হইলেন। 

একবিংশ মাত্র বয়ঃক্রমের সময় টিকেন্দ্রজিৎ এই সামান্য সৈন্য লইয়া সেই মহাসমরে প্রথম পদার্পণ করিলেন। দুই ভাই সৈন্য-সামন্ত লইয়া সেই স্থানে উত্তীর্ণ হইবা মাত্রই নাগাদিগের সহিত প্রথম এক যুদ্ধ হইল। সেই যুদ্ধেই নাগাগণ পরাস্ত হইয়া পলায়ন করিল। তখন যদিও পলায়ন করিল, কিন্তু দুই এক দিবস পরে আবার অধিক পরিমাণ নাগার সহিত মিলিত হইয়া পুনরায় যুদ্ধ করিল। পুনরায় পলায়ন করিল। পুনরায় আসিল, পুনরায় পলাইল। এইরূপে ক্রমান্বয়ে দেড়মাস কাল নাগাদিগের সহিত যুদ্ধ করিয়া, পরিশেষে টিকেন্দ্রজিৎ তাহাদিগকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করিলেন। টিকেন্দ্রজিৎ যেরূপ উৎসাহ ও সাহসের সহিত, যেরূপ বীরত্ব ও পরাক্রমের সহিত, যেরূপ বুদ্ধি ও কৌশলের সহিত, এই নাগাযুদ্ধ জয় করিয়াছিলেন, তাহা শুনিলে অবাক্ হইতে হয়। ইঁহার বুদ্ধি-কৌশল, মন্ত্রণা-কৌশল ও রণ- কৌশল দেখিয়া ইংরাজগণ একেবারে আশ্চর্যান্বিত হইয়াছিলেন। জনষ্টন সাহেব একেবারে মোহিত হইয়াছিলেন! একজন যুবকের যে এতদূর পরাক্রম, তাহা দেখিয়া কর্ণেল সাহেব আপনার পদ-গৌরব ভুলিয়াছিলেন। উপযুক্ত পরিমাণ আহার প্রাপ্ত না হইয়া, তৃষ্ণায় উপযুক্ত জলপান করিতে না পাইয়া, বিনা নিদ্রায় ক্রমান্বয়ে দেড়মাস কাল যুদ্ধ করিয়া বৃটিশ কর্ম্মচারীদিগকে এ বিপদ হইতে রক্ষা করা— স্ত্রী-পুত্র প্রভৃতির সহিত অন্যান্য সাহেবগণের জীবনে জীবন দান করা দুর্গের ভিতরস্থিত গুলি-বারুদ প্রভৃতি রক্ষা করা কি সহজ কথা?* এদেশীয়দিগের এইরূপ অসম্ভাবনীয় কাৰ্য্য দেখিয়া ইংরাজ বিস্মিত না হইবেনই বা কি প্রকারে? 

[* “He saved valuable lives of British officers, ladies, children and the garrison at Kohima during the Naga expedition of 1878, and the Government of India very warmly acknowledged him then as the principal hero of the operations which were so successfully and speedily terminated.”]

সপ্তম পরিচ্ছেদ

পুরস্কার 

ক্রমান্বয়ে দেড়মাস কাল কঠোর যুদ্ধ করিয়া টিকেন্দ্রজিৎ নাগাদিগকে সেই স্থান হইতে একেবারে দূরীভূত করিয়া দিলেন। তাহাদিগের বাসস্থান প্রভৃতি কুটীর সকল ভস্মরাশিতে পরিণত করিয়া দিলেন, এবং কহিমার দুর্গ রক্ষা করিয়া সেইস্থান হইতে নাগাদিগকে বিতাড়িত করিয়া, তিনি যে কত ইংরাজের প্রাণ বাঁচাইলেন, কত ইংরাজ-রমণীর সতীত্ব রক্ষা করিলেন, কত ইংরাজ-বালককে অকাল মৃত্যুর হস্ত হইতে উদ্ধার করিলেন, তাহার সংখ্যা কে করে? ইংরাজের “ম্যাগাজিন” বাঁচাইয়া তাঁহাদিগের যে কি মহৎ উপকার করিলেন, তাহার বর্ণনাই বা কে করে? 

এই দেড়মাস কাল কঠোর যুদ্ধের পর টিকেন্দ্রজিৎ সিংহের রণবিক্রমে ইংরাজ-রাজ এই ভয়ানক বিপদ হইতে যে কেবলমাত্র ঊত্তীর্ণ হইলেন, তাহা নহে। সেই প্রদেশে ইংরাজের বিজয় নিশান উড্ডীন হইল। ইংরাজ-দর্পে সেই স্থান প্রকম্পিত হইল। কর্ণেল জনষ্টন সাহেব বিজয়-ডঙ্কা বাজাইয়া সেইস্থান হইতে আপন স্থানে গমন করিলেন। 

ভারত-গবর্ণমেন্ট মহারাজ চন্দ্রকীর্ত্তির উপর যে কতদূর সন্তুষ্ট হইলেন, তাহা বর্ণন অসম্ভব। মহারাজকে ধন্যবাদ দিবার নিমিত্ত একটি প্রকাশ্য দরবার আহুত হইল। সেই দরবারে প্রধান প্রধান ইংরাজ কৰ্ম্মচারিগণ আগমন করিলেন। মহারাজ চন্দ্রকীর্তি অমাত্য, পুত্র ও সৈন্যগণের সহিত সেই সভায় উপস্থিত হইলেন। মহারাজ চন্দ্রকীর্ত্তির যশোগান কীৰ্ত্তন করিয়া, তাঁহার সাহায্যের নিমিত্ত শত শত ধন্যবাদ প্রদান করিয়া, ভারত-গবর্ণমেণ্ট তাঁহাকে কে. সি. এচ, আই, এই সম্মান-সূচক উপাধি প্রদান এবং তাঁহার পুত্র ও সৈন্যগণের বীরত্বের নিমিত্ত দুই সহস্র উৎকৃষ্ট বন্দুক মহারাজকে উপঢৌকন প্রদান করিলেন। পরিশেষে মহারাজের পুত্র টিকেন্দ্রজিৎ সিংহের বীরত্ব, সাহস, ধৈর্য্য এবং উৎসাহকে অশেষরূপে ধন্যবাদ প্রদান করিয়া ভারত-গবর্ণমেণ্ট কৃতজ্ঞতার চিহ্নস্বরূপ তাঁহাকে একটি অত্যুৎকৃষ্ট সুবর্ণ-পদক অর্পণ করিলেন। আর সেই কঠোর পরিশ্রমকারী রণবিজয়ী দুই সহস্র মণিপুরি হিন্দুসৈন্যদিগের প্রত্যেককেই কোং ১০ টাকা পারিতোষিক ও এক একটি মেডেল অর্পিত হইল। 

মহারাজ চন্দ্রকীর্ত্তি ভারত-গবর্ণমেণ্ট হইতে এইরূপে সম্মানিত হইয়া, ইংরাজের সহিত বিশেষ মিত্রতা-সূত্রে আবদ্ধ থাকিয়া, মনের সুখে আপনার রাজকার্য্য পর্যালোচনা করিতে লাগিলেন। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ

টিকেন্দ্র গুরুমন্ত্রে দীক্ষিত 

মণিপুরের রাজবংশীয়গণ সকলেই বৈষ্ণব-ধর্ম্মে দীক্ষিত। বৈষ্ণব ধর্ম্ম যে কি, ইহা কিরূপে যে পালন করিতে হয়, তাহা মণিপুরের রাজবংশীয়গণ যেমন জানেন, তাহা নবদ্বীপের বৈষ্ণবগণও জানেন কি না, সন্দেহ। এই বংশের দীক্ষা-গুরু পিতা। পিতাই পুত্রগণকে মন্ত্রদানে দীক্ষিত করিয়া থাকেন। 

মহারাজ চন্দ্রকীর্ত্তি একজন গোঁড়া বৈষ্ণব ছিলেন। বৈষ্ণবের পক্ষে মাংস অত্যন্ত নিষিদ্ধ খাদ্য। টিকেন্দ্রজিতকে সেই মাংস প্রত্যহ ভোজন করিতে দেখিয়া চন্দ্ৰকীৰ্ত্তি মনে মনে নিতান্ত অসন্তুষ্ট হইতেন; কিন্তু প্রকাশ্যে টিকেন্দ্রকে কিছুই বলিতেন না। ইংরাজী ১৮৮২ সালে অর্থাৎ টিকেন্দ্রের বয়ঃক্রম যখন ২৫ বৎসর, সেই সময়ে একদিবস মহারাজ মনে মনে ভাবিলেন, কিরূপ উপায় অবলম্বন করিলে টিকেন্দ্র মাংস পরিত্যাগ করিয়া কুলধর্ম্ম বৈষ্ণব-ধর্ম্মের উপর আপনার মনপ্রাণ সমর্পণ করিতে সময় দিতে হয়। এক দিবস মহারাজা আপনার পুরোহিতকে ডাকাইলেন, তাঁহার সহিত এসম্বন্ধে অনেক প্রকার কথাবার্তা হইল, ও অনেকক্ষণ পরামর্শের পর ইহাই স্থির হইল যে, টিকেন্দ্রকে এখন গুরুমন্ত্রে দীক্ষিত করাই কর্তব্য। গুরুমন্ত্র পাইলে, গুরুমন্ত্র মনের ভিতর ধর্ম্মবীজ রোপণ করিতে সমর্থ হইলে, টিকেন্দ্ৰ নিশ্চয়ই সমস্ত নিষিদ্ধ বিষয় পরিত্যাগ করিবেন — এই পরামর্শই সুপরামর্শ বলিয়া স্থিরীকৃত হইল। সময়মত একদিবস মহারাজ টিকেন্দ্রকে ডাকাইলেন। আপনার মনের ইচ্ছা তাঁহাকে কহিলেন। টিকেন্দ্র পিতৃ-আজ্ঞা শিরোধার্য্য করিয়া গুরুমন্ত্রে দীক্ষিত হইবার অভিলাষ প্রকাশ করিলেন। 

গুরুমন্ত্রের দিন স্থির হইল। দীক্ষা-উপযোগী সমস্ত দ্রব্য আহরিত হইল। ব্রাহ্মণমণ্ডলী নিমন্ত্রিত হইলেন। শাস্ত্রানুসারে যে যে বিষয়ের আবশ্যক, তাহার কিছুই বাকি থাকিল না। তখন মহারাজ চন্দ্রকীর্ত্তি শুভলগ্নে আপনার পুত্রের কর্ণে বীজমন্ত্রে অর্পণ করিলেন। টিকেন্দ্রজিৎ অদ্য হইতে শাক্ত- পদ্ধতি পরিহার পূর্ব্বক বৈষ্ণব-রীতিনীতির অনুসরণ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। 

টিকেন্দ্র বৈষ্ণব হইলেন, কিন্তু মৃগয়া-পদ্ধতি পরিত্যাগ করিতে সমর্থ হইলেন না। পূর্ব্বে যেরূপ মৃগয়ার্থ গমন করিতেন, এখনও নিত্য নিত্য সেইরূপ ভাবেই মৃগয়ায় বহির্গত হইতে লাগিলেন এবং মৃগয়া-উপলব্ধ আহারোপযোগী মৃগাদিও পূৰ্ব্বমত হত্যা করিতে লাগিলেন, ও উহা পূর্ব্বের ন্যায় আপন হস্তে রন্ধন করিতে লাগিলেন। পূর্ব্বের মত নিজের সম্মুখে সকলকে ভক্ষণ করাইতে লাগিলেন। কিন্তু এখন আর নিজে আহার করিতেন না; অপরকে আহার করাইয়াই সন্তুষ্ট হইতেন। গুরুমন্ত্রে দীক্ষিত হওয়ার দিন হইতেই টিকেন্দ্রজিৎ মাংস পরিত্যাগ পূর্ব্বক বৈষ্ণবধর্ম প্রতিপালন করিতে লাগিলেন। 

ইহার কিছু দিবস পরে মহারাজ চন্দ্রকীর্ত্তি ইহলোক পরিত্যাগ করিলেন। মৃত্যুর পূর্ব্বেই মণিপুর রাজবংশের রীত্যনুসারে তিনি তাঁহার প্রথম পুত্র সুরাচন্দ্রকে আপনার সিংহাসন অর্পণ করিলেন। দ্বিতীয় পুত্র কুলাচন্দ্র-সিংহ যুবরাজ হইলেন। তৃতীয় পুত্র ঝালকৃতি-সিংহ সেনাপতির বা কমেণ্ডার-ইন-চিফের’ পদ প্রাপ্ত হইলেন। চতুর্থ পুত্র টিকেন্দ্র জিৎ বা কৈরৎ হইলেন, — কমেণ্ডার। পঞ্চম পুত্র কেশরজিৎ কমেণ্ডিং জেনারেল; ষষ্ঠ পুত্র ভৈরবজিৎ- লেফটেনেন্ট জেনারেল বা পাকাসেনার পদ অধিকার করিলেন। সপ্তম পুত্র ভুবন সিংহ- মেজর জেনারেলের বা অঙ্গো-সেনার পদ পাইলেন। অষ্টম পদ্মলোচন সিংহ হইলেন — সিভিল মিনিষ্টার বা গোপাল-সেনা। এইরূপ রাজকার্য্যের বন্দোবস্ত করিয়া দিয়া, ইংরাজী ১৮৮৪ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসে মহারাজ ইহলোক পরিত্যাগপূর্ব্বক স্বর্গারোহণ করেছিলেন। 

নবম পরিচ্ছেদ

ইংরাজী ১৮৮৪ সাল বড়চাওবার সহিত যুদ্ধ 

মহারাজ গম্ভীর সিংহের ভ্রাতা, সেনাপতি নরসিংহের পরিচয় পাঠকগণ পূৰ্ব্বেই অবগত হইয়াছেন। এই নরসিংহের ভ্রাতার বিশ্বাসঘাতকতাতেই মহারাজ চন্দ্রকীর্তি প্রাণের ভয়ে বাল্যকালে আপনার জন্মস্থান পরিত্যাগ করেন। যখন নরসিংহের মৃত্যু হয়, সেই সময় তাঁহার দুইটি অল্প বয়স্ক পুত্র ছিল। তাহারা বড়-চওবা সিংহ এবং মেকজিন সিংহ নামেই পরিচিত; এখন বড়-চাওবা একজন বলবান ব্যক্তি এবং রাজপুত্র বলিয়া কতকগুলি লোকও তাঁহার বশীভূত। 

যে সময়ে মহারাজ চন্দ্রকীর্তি-সিংহের মৃত্যু হয়, যে সময়ে তাঁহার মৃতদেহ সেই রাজপ্রাঙ্গণে পতিত থাকে, যে সময়ে তাঁহার অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার আয়োজন নিমিত্ত পুত্রগণ বিশেষরূপ ব্যস্ত থাকেন, যে সময়ে রাজার মৃত্যুতে অন্তঃপুরবাসিনীরা শোকাভিভূতা হইয়া করুণস্বরে রোদন করিতে থাকেন, যে সময়ে সৈন্য-সামন্ত সমস্ত লোকই রাজার পরলোক-হেতু আপন আপন কার্য্য পরিত্যাগ-পূর্ব্বক শোকসাগরে ভাসমান হন, সেই সময় হঠাৎ একটি নূতন দৃশ্যের আবির্ভাব হইল; সেই দৃশ্যে সকলেই স্তম্ভিত, চিন্তিত এবং ভীত হইয়া পড়িলেন। 

সেই সময়ে হঠাৎ সৈন্যের কোলাহলধ্বনি অন্তঃপুরের ভিতর প্রবেশ করিল। রণবাদ্য ঘোর রোলে নিনাদিত হইতে লাগিল। ঘন ঘন বন্দুকের শব্দে সকলের কর্ণ বধিরপ্রায় হইল। রাজ প্রাসাদের চতুর্দ্দিকে এই ভয়ানক দৃশ্য দেখিয়া সকলই বিস্মিত এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িলেন। বাদ্যধ্বনিতে সকলেই বুঝিতে পারিলেন যে, উহা রণবাদ্য। ঘন ঘন বন্দুকের শব্দে সকলেই জানিলেন যে, কোন প্রবল শত্রু রাজ-সিংহাসন অধিকার করিয়া লইবার মানসে সসৈন্যে সেই রাজপুরী পরিবৃত্ত করিয়াছেন। কিন্তু শত্রু কে? সেই রাজবংশীয় কোন ব্যক্তি বা অপর কোন ব্যক্তি, তাহা সেই সময়ে কেহই বুঝিয়া উঠিতে পারিলেন না। পরন্তু ইহা বুঝিলেন, সেই শত্রু যিনিই হউন না কেন, তাঁহার হৃদয় নাই, তিনি শোক দুঃখের বশীভূত নহেন, তাঁহার হৃদয় পিশাচের অপেক্ষাও কঠিন, নিষ্ঠুর অপেক্ষাও অপকৃষ্ট। – . 

সেনাপতি টিকেন্দ্রজিৎ, যিনি সেই সময়ে কমেণ্ডার (Commander) মাত্র ছিলেন, তিনি এই অদ্ভুত দৃশ্য অবলোকনে কিছুমাত্র ভীত বা বিস্মিত না হইয়া মুহূর্তের মধ্যে কতকগুলি সৈন্যসুসজ্জিত করিয়া শত্রুর গতিরোধ করিতে অগ্রসর হইলেন; এবং কমেণ্ডিং জেনারেল (Commanding General) কেশরজিৎ সিংহ অবশিষ্ট সৈন্য সুসজ্জিত করিয়া তাঁহার অনুগমন করিলেন। যখন তাঁহারা রণসজ্জায় সুসজ্জিত হইয়া শত্রুর সম্মুখীন হইলেন, তখন পর্য্যন্তও তাঁহারা অবগত নহেন যে, কাহার সহিত যুদ্ধ করিতে যাইতেছেন, বা কোন ব্যক্তি এই বিপদের সময় সিংহাসন অধিকার করিবার চেষ্টায় আগমন করিয়াছেন। টিকেন্দ্রজিৎ সিংহ যখন রণক্ষেত্রে উপস্থিত হইলেন, তখন দেখিলেন যে, সেই নরসিংহ সিংহের পুত্র বড়চাওবা ও মেকজিন আজ এই যুদ্ধ ঘোষণা করিয়া রাজ-সিংহাসন অধিকার করিবার চেষ্টায় আগমন করিয়াছেন। তাহাদিগকে দেখিয়া, সেই সময়ে যাহাতে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবিষ্ট হইতে না হয়, টিকেন্দ্রজিৎ তাহার নিমিত্ত বিশেষ রূপ চেষ্টা করিলেন। প্রথমতঃ তাহাদিগের উভয়কেই কহিলেন, “প্রথমে মৃতের সৎকাৰ্য্য হউক, তাহার পর সিংহাসন অধিকার করিয়া লইবার চেষ্টা করিবেন। যুদ্ধক্ষেত্রে রণভেরী বাজাইতে চাহেন, তখন তাহা বাজাইবেন। সেই সময় টিকেন্দ্রজিৎ বা অপর কেহই তাহাতে দৃকপাতও করিবেন না, আপন কর্তব্য প্রতিপালন করিয়া প্রবল আগ্নেয় অস্ত্রের সম্মুখে আপন বক্ষ সর্বসমক্ষে বিস্তৃত করিয়া রাখিবেন। কিন্তু এই অবস্থায় যুদ্ধ করিলে, এই রাজবংশের বিশেষ হিন্দু রাজবংশের এই নিন্দা কখনই তিরোহিত হইবে না। আপনাদিগের নাম ক্রমে এই জগৎ হইতে লোপ পাইবে, কিন্তু এই দুর্নাম কিছুতেই তিরোহিত হইবে না। আপনারা অপেক্ষা করুন, প্রথমত মৃতদেহের সৎকার হইয়া যাউক; যে হস্তে এই মৃতদেহের সৎকার করিব, সেই হস্তে অসি ধারণ করিতে আর কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হইব না।” 

টিকেন্দ্র এইরূপ ভাবে বুঝাইতে চেষ্টা করিলেন সত্য, কিন্তু তাহার প্রস্তাব কোন রূপেই স্থান পাইল না, তখন টিকেন্দ্রজিৎ বুঝিতে পারিলেন যে, বিনা যুদ্ধে বড়চাওবা ক্ষান্ত হইবেন না বিজয় বা পরাজয় ভিন্ন এই যুদ্ধের আর কোন প্রকার শেষ নাই। তখন তিনি ও কেশরজিৎ উভয়ে মিলিত হইয়া বড় চাওবার সেই সৈন্যবর্গের গতিরোধ করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইলেন। অচল পর্ব্বতের ন্যায় তাঁহারা সেই স্থানে দণ্ডায়মান হইয়া আপন আপন কৰ্ত্তব্য পালন ও সিংহাসনরক্ষার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। মহারাজ সুরাচন্দ্র, যুবরাজ কুলাচন্দ্র এবং সেনাপতি ঝালকৃতি প্রভৃতি অপরাপর সকলে চন্দ্রকীর্তির সংকারাদি করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তাঁহারা বিশেষরূপে অবগত ছিলেন যে, যে যুদ্ধে টিকেন্দ্র রণসজ্জা করিবেন, সেই রণে আর কাহারও সাহায্য করা নিষ্প্রয়োজন মাত্ৰ। 

সেই জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রচণ্ড রৌদ্র সহ্য করিয়া, টিকেন্দ্রজিৎ ও কেশরজিৎ বড়চাওবার সহিত ক্রমান্বয়ে চারি দিবস অবিশ্রান্ত যুদ্ধ করিলেন। এই চারি দিবসের মধ্যে কখন যে তাঁহারা পান ভোজন বা বিশ্রাম করিতেন, তাহা কেহই অবগত ছিলেন না। অনেকে বলিয়া থাকেন, চারি দিবস কাল তাঁহারা পান ভোজন ও নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। চারি দিবসের এই ভয়ানক যুদ্ধে বড়চাওবা বিশেষ ক্ষতি সহ্য করিলেন। তাঁহার সৈন্য সামন্ত প্রায় সমূলে নির্মূল হইল। তাঁহার গুলিবারুদ এবং বন্দুকাদি প্রায় সমস্তই টিকেন্দ্র কাড়িয়া হইলেন। বড়চাওবা যখন দেখিলেন যে, তাহাদিগের দর্প সম্পূর্ণরূপে চূর্ণ হইয়াছে, যেরূপে পরাজয় হইতে হয়, তাহার কিছুই আর অবশিষ্ট নাই, কেবল টিকেন্দ্রজিতের হস্তে তাহাদিগের বন্দী হওয়াই মাত্র বাকী আছে, তখন অনন্যোপায় হইয়া বড়চাওরা সেই স্থান হইতে পলায়ন করিলেন। অনেকে বলিয়া থাকেন তিনি লুক্কাইত-ভাবে কাছাড়ে অবস্থান করিয়া টিকেন্দ্রের হস্ত হইতে আপন জীবন রক্ষা করেন। ইংরাজ গভর্ণমেন্ট বড়চাওবার এই কথা শুনিয়া মিত্র-রাজকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত পরিশেষে বিশেষ চেষ্টা করেন। তাঁহাকে ধৃত করিবার অভিপ্রায়ে বিশেষরূপে উহার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হন; কিন্তু কোন স্থানেই তাঁহার সন্ধান প্রাপ্ত হয়েন না। কাজেই সে যাত্রা বড়চাওবা ধৃত বা কারারুদ্ধ হন না। 

ঝালকৃতি সিংহ জ্যৈষ্ঠ মাসে সেনাপতি পদে প্রতিষ্ঠিত হন। কিন্তু তাঁহার শরীর সুস্থ ছিল না; কেবলমাত্র ১৫ দিবস কাল তিনি এই কার্য্য নির্ব্বাহ করেন। ক্রমে তাঁহার স্বাস্থ্য একেবারে লোপ-প্রাপ্ত হয় ও পরিশেষে তিনি ইহলোক পরিত্যাগ করেন। যে দিবস ঝালকৃতি পরলোক গমন করেন, সেই দিবস হইতেই মহারাজ সুরাচন্দ্র, টিকেন্দ্রজিৎকেই সেই সেনাপতি পদে বরণ করেন। সেই দিবস হইতে কৈরৎ সেনাপতি নামে প্রসিদ্ধ। 

এই সময়ে রাজবংশের নিয়ম-অনুসারে মণিপুরে একটি প্রকাশ্য দরবার হয়; সেই দরবারে সহোদর ও বৈমাত্র সকল ভ্রাতাই উপস্থিত ছিলেন। তাঁহারা পরস্পর বিবাদ-বিসম্বাদে লিপ্ত হইবেন না এবং এই রাজবংশের রীত্যনুসারে রাজকার্য্য পর্য্যালোচন করিবেন, এইরূপ প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হইবার নিমিত্ত সকলে মৃত রাজা চন্দ্রকীর্ত্তি সিংহের পাদুকা ও রাজ-তরবারী স্পর্শ করিয়া কঠোর প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হন। 

মহারাজ সুরাচন্দ্র এই নূতন সেনাপতির বিক্রমে কিছু দিবস নির্ব্বিবাদে রাজত্ব করিতে না করিতেই আশ্বিন মাসের এক দিবস ভয়ানক তোপধ্বনিতে সহর তোলপাড় হইয়া উঠিল। হঠাৎ তোপধ্বনি শুনিয়া সেনাপতির হৃদয়ের মধ্যেও যেন তোপধ্বনি ধ্বনিত হইতে আরম্ভ হইল। পুনরায় কোথা হইতে শত্রুর আগমন হইল, প্রথমত তাহার কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলেন না। তবে ইহা বুঝিলেন যে, যে শত্রু প্রথম হইতেই কামান লইয়া আক্রমণ করে, সে নিতান্ত ক্ষুদ্ৰ শত্ৰু নহে, ও তাহাকে দমন করাও নিতান্ত সহজ নহে। এইরূপ ভাবিয়া সেনাপতি যত শীঘ্র পারিলেন, সৈন্য-সামন্ত সুসজ্জিত করিয়া বহির্গত হইলেন। দেখিলেন, সেই পলায়িত বড়চাওবা প্রায় দুই সহস্র সৈন্য ও তোপ লইয়া ভ্রাতার সহিত রাজধানী আক্রমণ করিয়াছেন। টিকেন্দ্র প্রাণপণে যুদ্ধ করিয়া বড়চাওবার গতিরোধ করিতে লাগিলেন। পাঁচ দিবস কাল উভয় পক্ষে ঘোরতর যুদ্ধ হইল। উভয় পক্ষেরই অনেক সৈন্য সামন্ত হত ও আহত হইয়া পড়িল। বড়চাওবা বিশেষ দক্ষতার সহিত তাঁহার সেই কামান পাঁচ দিবস কাল অবিশ্রান্ত চালাইলেন। সেই ভীষণ ও দুর্জ্জয় কামান গর্জ্জনের সঙ্গে সঙ্গে যেন বড়চাওবার বিজয়বার্তা চতুর্দিকে ঘোররবে প্রচার করিতে লাগিল। এই দুর্জ্জয় কামানের সম্মুখে পাঁচ দিবসকাল অনবরত যুদ্ধ করিয়া টিকেন্দ্র বিশেষরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হইলেন, এবং মনে মনে এবার বিজয় আশা একেবারে পরিত্যাগ করিলেন। তথাপি কিন্তু মনের ভাব কাহারও নিকট প্রকাশ না করিয়া প্রাণপণে যুদ্ধ করিতে ক্ষান্ত হইলেন না। এই সময়ে হঠাৎ ইংরাজের সাহায্য আসিয়া উপস্থিত হইল। একশত সুশিক্ষিত ইংরাজ সিপাহি আসিয়া টিকেন্দ্রের সহিত যোগ দিল। টিকেন্দ্র ইংরাজ-বল প্রাপ্তে নববলে বলীয়ান হইয়া উঠিলেন, এবং একেবারে ঘোররবে বড় চাওবাকে আক্রমণ করিলেন। বড়চাওবা সেই আক্রমণ সহ্য করিতে সমর্থ হইলেন না। তাঁহার সৈন্য-সামন্তের মধ্যে কেহ হত, কেহ আহত এবং কেহ বা রণভঙ্গ দিয়া পলায়ন করিল। বড় চাওবা ভ্রাতার সহিত ধৃত হইলেন। এখন তাঁহারা রাজার কয়েদী (State prisoner) হইয়া হাজারিবাগে অবস্থান করিতেছেন। রাজ্য-প্রাপ্তির আশা এখন তাঁহারা ভুলিয়াছেন। ইংরাজ-গভর্ণমেন্টের নিকট হইতে তিনি কেবলমাত্র ৬০ টাকা এবং তাঁহার ভ্রাতা মেকজিন ২০ টাকা মাত্র মাসে মাসে প্রাপ্ত হইয়া তাহারই দ্বারা কষ্টে জীবনধারণ করিতেছেন। বড়- চাওবার একটি পুত্র আছে; তাহার নাম সেনা আহাল। শুনিতে পাওয়া যায়, পিতাপুত্রের বিশেষরূপ অসম্ভাব; উভয়ের কথাবার্তা পর্য্যন্ত বন্ধ এবং পরস্পরের মধ্যে পত্রাদি পর্যন্তও লেখা-লিখি নাই। 

দশম পরিচ্ছেদ

ইংরাজী ১৮৮৫-৮৬ সাল 

বাল্কোরাপোর সহিত যুদ্ধ 

মহারাজ চন্দ্রকীর্ত্তির মৃত্যুর পর বৎসর অর্থাৎ ১৮৮৫ সাল বিনা গোলযোগে উত্তীর্ণ হইয়া যায়। এই বৎসর কেহই মহারাজ সুরাচন্দ্রের উপর কোনরূপ অন্যায় আচরণে প্রবৃত্ত হন নাই। 

ইংরাজী ১৮৮৬ সালে পুনরায় আর একটি গোলযোগ উপস্থিত হয়; মহারাজ চন্দ্রকীর্ত্তির রাজ্যকালে তাঁহার মন্ত্রী (Minister) ছিলেন, ভুবনসিংহ। ভুবনসিংহের মৃত্যুকালে তিনি বল্কোরাপো নামীয় একটি বিশেষ ক্ষমতাশালী পুত্র রাখিয়া যান। বস্কোরাপোরও চারিটি সাহসী পুত্র জন্ম-পরিগ্রহ করেন। তাহার মধ্যে লাইরেন্জা ও মাইপা বিশেষ বলশালী ছিলেন। 

ভাদ্র মাসে কতকগুলি সৈন্য সংগ্রহ করিয়া বল্কোরাপো ও তাঁহার চারিপুত্র মণিপুরের এই সিংহাসন অধিকার করিবার বাসনায় বিশেষরূপে প্রোৎসাহিত হইলেন, ও সুযোগমতে এক দিবস আসিয়া রাজধানী আক্রমণ করিলেন। এবার গোপালসেনা বা পদ্মলোচন ও সেনাপতি টিকেন্দ্রজিৎ উভয়ে রণক্ষেত্রে উপস্থিত হন। উভয় পক্ষে ভয়ানক যুদ্ধ আরম্ভ হয়। রাত্রিদিন চব্বিশ ঘণ্টা শিলাবৃষ্টির ন্যায় উভয় পক্ষে গুলি বর্ষণ হইতে থাকে। এই যুদ্ধে টিকেন্দ্রের সৈন্য অধিক পরিমাণে হত ও আহত হইয়া পড়ে। টিকেন্দ্র এবারও জয়-আশা মন হইতে পরিত্যাগ-পূর্ব্বক ইংরাজের সাহায্য প্রার্থনা করেন। এই সময় প্রিমরোজ সাহেব ছিলেন, পলিটিকেল এজেন্ট। কি জানি, কি ভাবিয়া এবার তিনি ব্রিটিশ সৈন্যের সাহায্য দানে অসম্মত হয়েন। টিকেন্দ্রজিৎ যে আশায় প্রোৎসাহিত হইয়া এতক্ষণ পৰ্য্যন্ত ভয়ানক যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন, এখন সেই আশায় নিরাশ হইয়া অতিশয় চিন্তিত হইলেন। টিকেন্দ্রজিৎ কিন্তু রণকৌশলে একজন অতিশয় পণ্ডিত লোক ছিলেন। বঙ্কোেরাপোকে তখন কৌশলজালে পাতিত করিয়া জয়লাভ করিবার এক উপায় স্থির করিলেন। 

যে সকল সৈন্য লইয়া তাঁহারা দুই ভ্রাতায় একত্রে যুদ্ধ করিতেছিলেন, তাহা হঠাৎ দুই ভাগে বিভাগ করিয়া ফেলিলেন। গোপাল সেনা এক অংশ লইয়া তাঁহাদের কেল্লার ভিতর গমন করিলেন। কেল্লার ভিতর গিয়া উহার প্রধান দ্বার একেবারে উন্মোচিত করিয়া দিলেন, এবং সেই মুক্ত দ্বারের ভিতর সারি সারি কামান সাজাইয়া ঠিক হইয়া বসিয়া রহিলেন। এদিকে টিকেন্দ্রজিৎ তাঁহার সৈন্য লইয়া বল্কোরাপোর সহিত সম্মুখ যুদ্ধে নিযুক্ত রহিলেন। যখন দেখিলেন যে, গোপাল সেনা পরামর্শমত কার্য্য ঠিক করিয়াছেন, তখন কৈরৎ সসৈন্যে ক্রমে বক্রগতিতে পশ্চাৎ পদ হইতে আরম্ভ করিলেন। কেল্লার দ্বার সম্মুখ, যেখানে তিনি দণ্ডায়মান ছিলেন, সেই স্থান পরিত্যাগ পূর্ব্বক পশ্চাৎ পদে যুদ্ধ করিতে করিতে অন্য দিকে গমন করিতে লাগিলেন। বল্কোরাপো যখন দেখিলেন যে, টিকেন্দ্র পলায়নের রাস্তা অন্বেষণ করিতেছেন, তখন তিনিও সাধ্যমতে সেনাপতির সৈন্যগণকে বিশেষরূপে আক্রমণ করিতে লাগিলেন I টিকেন্দ্র যখন দেখিলেন যে, তিনি তাঁহার নির্দ্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হইয়াছেন, অর্থাৎ কেল্লার অপর একটি দ্বারে, যেখানে আসিবার নিমিত্ত পশ্চাৎভাগে ক্রমে ক্রমে হটিয়া যাইতেছিলেন, সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন, তখন তাঁহার পূর্ব্বের আদেশ মত ভিতর হইতে সেই দ্বার উন্মোচিত হইল। তখন তাঁহারা পূর্ব্বের মত পশ্চাৎ পদে চলিতে চলিতে কেল্লার ভিতর প্রবেশ করিলেন। কেল্লার দ্বার ভিতর হইতে বদ্ধ হইয়া গেল। তখন সেই দরজার উর্দ্ধর্ভাগে একস্থানে দণ্ডায়মান হইয়া, বিপক্ষ-পক্ষীয় সৈন্যগণের উপর গুলি বর্ষণ আরম্ভ করিলেন। 

বল্কোরাপো যখন দেখিলেন যে, টিকেন্দ্র সমস্ত সৈন্যের সহিত পলায়ন করিলেন, তখন তাঁহার আর আনন্দের পরিসীমা রহিল না। তিনি বিজয়-নিশান উড়াইয়া সেই কেল্লার ভিতর প্রবেশ করিবার পথ অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। এরূপ সময় সংবাদ পাইলেন যে, সৈন্যগণ কেল্লা ছাড়িয়া পলায়ন করিয়াছে, এবং সেই প্রধান দ্বার উন্মোচিত রাখিয়া চলিয়া গিয়াছে। এই সংবাদ প্রাপ্তে বল্কোরাপোর আনন্দের আর পরিসীমা রহিল না; তিনি বিজয়-ডঙ্কা বাজাইয়া, বিজয়-নিশান উড়াইয়া, সৈন্য-সামন্তের সহিত সেই দরজা দিয়া কেল্লার ভিতর প্রবেশ করিলেন 

গোপাল-সেনা এতক্ষণ পর্য্যন্ত চুপ করিয়াছিলেন। নিস্তব্ধভাবে প্রস্তুত অবস্থায় সেই স্থানে বসিয়া ছিলেন। যেমন বল্কোরাপো সেই দ্বারের ভিতর সমস্ত সৈন্যের সহিত প্রবেশ করিলেন, অমনি ভীষণ কামান সকল একেবারে গর্জিয়া উঠিল। এদিকে টিকেন্দ্র আপনার সৈন্যের সহিত সেই সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলেন, এবং দ্রুতপদে আসিয়া বাহির হইতে সেই প্রধান দ্বার অবরোধ করিলেন। তিনি বাহির হইতে ভিতরে আক্রমণ করিলেন; আর গোপাল- সেনা ভিতর হইতে দুৰ্জ্জয় তোপের দ্বারা আক্রমণ করিলেন। বল্কোরাপো ভিতরে প্রবেশ করিতে সমর্থ হইলেন না, এবং বাহিরে আসিবারও কোন উপায় না দেখিয়া যতক্ষণ পারিলেন, তাহার ভিতরই থাকিয়া যুদ্ধ করিলেন। পরিশেষে সমস্ত সৈন্য-সামন্ত, অমাত্য ও পুত্রগণের সহিত সেই স্থানে পতিত হইয়া আপন আপন যুদ্ধ-আকাঙ্ক্ষা পরিতৃপ্ত করিলেন। 

টিকেন্দ্র এইরূপ কৌশল অবলম্বন করিয়া যে কেবলমাত্র এই যুদ্ধে জয়লাভ করিলেন, তাহা নহে; সেই শত্রুকুল একেবারে সমূলে নির্মূল করিলেন। তাঁহার কৌশল ও সাহসের কথা যিনি শ্রবণ করিলেন, তিনিই অতিশয় আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন। মহারাজ সুরাচন্দ্র টিকেন্দ্রের বীরত্বের ও কৌশলের অনেক প্রশংসা করিলেন। 

[আষাঢ়, ১৩১১] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *