মানিনী

মানিনী

প্রথম পরিচ্ছেদ

মানিনী ও রাজকিশোরী দু’জনেই এখন এক বাড়ীর বউ। উভয়েই দুইটি সহোদর ভ্রাতার পত্নী। রজনীকান্তের পিতা বর্তমান থাকিতে রাজকিশোরীর সহিত রজনীর বিবাহ দিয়া যান। রজনীকান্তের বিবাহের অতি অল্পদিবস পরেই রজনীকান্তের পিতা ইহলোক পরিত্যাগ করেন; মাতাও বহুপূর্ব্বে স্বর্গারোহণ করিয়াছিলেন। রজনীর পিতা একজন পরম হিন্দু ছিলেন, দেব-দেবীর পূজা না করিয়া কখনও জলগ্রহণ করিতেন না। সুতরাং অনেক দেখিয়া শুনিয়া হিন্দুর ঘর হইতে হিন্দুর কন্যা রাজকিশোরীকে বাছিয়া আনিয়া আপনার প্রথম পুত্র রজনীকান্তের সহিত তাহার বিবাহ দিয়াছিলেন। যে সময় রজনীকান্তের বিবাহ হয়, সেই সময় পিতার মত ধৰ্ম্ম কৰ্ম্ম লইয়া রজনীকান্ত সৰ্ব্বদা ব্যস্ত না থাকিলেও হিন্দুর আচরণ-বিরুদ্ধ কার্য্যে কখনই লিপ্ত থাকিতেন না। 

পিতার মৃত্যুর পর রজনীকান্তের উপরই সমস্ত সংসারের ভার পড়িল। সংসারের মধ্যে অপর কেহই ছিল না; কেবল মাত্র রজনীকান্ত, তাঁহার পত্নী রাজকিশোরী, এবং তাহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিপিন। 

পিতা বৰ্ত্তমান থাকিতে বিপিন সামান্যমাত্র লেখাপড়া শিখিয়াছিল; এন্ট্রেন্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া এক বৎসর কাল এল-এ ক্লাসে অধ্যয়ন করিবার পরই তাহার পিতার মৃত্যু হয়। কিন্তু রজনীকান্তের সংসারের বিশেষরূপ অনাটন থাকিলেও তিনি অতিকষ্টে বিপিনের লেখাপড়ার সমস্ত ব্যয় নির্ব্বাহ করিয়া আসিতে লাগিলেন। বিপিন ক্রমে এল-এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া বি-এ ক্লাসে অধ্যয়ন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। রজনীকান্ত আপনার স্ত্রী রাজকিশোরীর দুই একখানি অলঙ্কার বিক্রয় করিয়া বিপিনের পুস্তক সকল ক্রয় করিয়া দিলেন। 

বিপিনের বি-এ ক্লাসে অধ্যয়ন করিবার কালে রজনীকান্ত তাহার বিবাহের চেষ্টা দেখিতে লাগিলেন। ভদ্রবংশের একটি সুরূপা কন্যা যাহাতে প্রাপ্ত হইতে পারা যায়, তাহার নিমিত্ত অনেক স্থানে চেষ্টা করিতে লাগিলেন; কিন্তু মনোমত একটি কন্যাও দেখিতে পাইলেন না। তথাপি চেষ্টা করিতেও নিরস্ত হইলেন না। 

বিপিনের বিবাহের নিমিত্ত রজনীকান্ত বিশেষরূপে চেষ্টা করিতেছেন, এই কথা ক্রমে বিপিনের কর্ণগোচর হইল। তিনি এই বিষয় জানিতে পারিয়া একদিবস রাজকিশোরীকে কহিলেন, “শুনিলাম যে, দাদা আমার বিবাহের নিমিত্ত চেষ্টা করিতেছেন। ইহা যদি প্রকৃতই হয়, তাহা হইলে আপনি দাদাকে কহিবেন যে, এখন আমার বিবাহ করিবার ইচ্ছা নাই। বি-এ পাস করিয়া কোনরূপে একটি চাকরীর যোগাড় করিয়া লইতে পারিলে তাহার পর বিবাহ করিব। এখন বিবাহের গোলযোগে আমার পড়াশুনার সবিশেষ ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা। অথচ দেখিতে পাইতেছি, আমাদিগের অবস্থাও ভাল নহে।” 

বিপিন রাজকিশোরীকে যেমন বুঝাইলেন, রাজকিশোরীও সেইরূপ বুঝিয়া সময় মত স্বামীর নিকট বিপিনের মনের ভাব ব্যক্ত করিলেন। রজনীকান্ত স্ত্রীর নিকট সমস্ত ব্যাপার অবগত হইয়া কহিলেন, “আচ্ছা, তাহাই হইবে। বিপিন যে সময়ে বিবাহ করিতে চাহিবে, সেই সময়েই তাহার বিবাহ দিব। বিপিন এখন লেখাপড়া শিখিয়াছে, নিজের ভালমন্দ সে এখন নিজেই বুঝিতে সমর্থ হইয়াছে; সুতরাং তাহার অনভিপ্রায়ে কোনরূপ কার্য্য করা কোনমতেই যুক্তিসঙ্গত নহে।” 

রজনীকান্ত আপন স্ত্রীকে যাহা যাহা কহিলেন, স্ত্রীও তাহাই ভাল বিবেচনা করিয়া সময় মত স্বামীর সেই কথা বিপিনকে জানাইলেন। রাজকিশোরীর কথা শুনিয়া বিপিন সবিশেষ সন্তুষ্ট হইল। 

বিপিন যখন বি-এ ক্লাসে অধ্যয়ন করেন, সেই সময়ে রজনীকান্ত মনে করিয়াছিলেন যে, বিপিনের লেখাপড়ার ব্যয়ের সংস্থান করা ভিন্ন তাহার দিকে দৃষ্টি রাখিবার আর প্রয়োজন নাই। কারণ, যখন সে লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে দিন দিন জ্ঞান উপার্জ্জন করিতেছে, তখন তাহার কিসে ভাল হইবে, আর কিসেই বা মন্দ হইবে, তাহা সে নিজে উত্তমরূপে বুঝিতে সমর্থ হইয়াছে। রজনীকান্ত কিন্তু কখনও স্বপ্নেও ভাবেন নাই যে, বিপিনের মতিগতি ক্রমে অন্যদিকে ধাবিত হইতেছে, এবং তাঁহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনরূপ কর্মে হস্তক্ষেপ করিতে সে সমর্থ হইয়াছে। 

কলেজের যে ক্লাসে বিপিন অধ্যয়ন করিতেন, সেই ক্লাসে আরও কয়েকজন ছাত্র পাঠ করিত। তাহাদিগের মধ্যে সকলে না হউক, কয়েকজন ছাত্র একটু স্বাধীনভাবে চলিয়া ফিরিয়া বেড়াইত। বিপিন ক্রমে তাহাদিগের সঙ্গেই মিলিত হইয়া তাহাদিগের ন্যায় একটু স্বাধীনভাবে চলিতে লাগিলেন। 

যে স্থানে সভাসমিতি হয়, যে স্থানে দেশের উন্নতিকল্পে দুই চারিটি কথা হয়, সেই স্থানেই বিপিন উপস্থিত হইয়া সেই সকল কার্য্যের উদ্যোক্তাগণের সহিত যোগ দিতে লাগিলেন। ক্রমে বিপিন দেশহিতৈষীগণের মধ্যে যাহাতে একজন প্রধান ব্যক্তি হইতে পারেন, সর্ব্বদা তাহার চেষ্টাতে নিযুক্ত হইলেন। দেশের হিতকর কার্য্য সকলের মধ্যে নিম্নলিখিত কয়েকটি বিষয়ের দিকে সর্বপ্রথম তাঁহার মন আকৃষ্ট হইল। 

১ম। অবরোধ-রুদ্ধা স্ত্রীলোকদিগকে লেখাপড়া শিক্ষা প্রদান করা। 

২য়। স্ত্রীলোকদিগের মধ্যে এখন যেরূপ অবরোধ-প্রথা প্রচলিত আছে, তাহার মত অন্যায় প্রথা আর কিছুই হইতে পারে না। সুতরাং সেই অবরোধ প্রথা সমূলে নির্মূল করা। 

৩য়। স্ত্রীলোকদিগকে পুরুষের মত সর্ব্বতোভাবে স্বাধীনতা দেওয়া। 

৪র্থ। আমাদিগের দেশে বিধবা স্ত্রীলোকদিগকে যেরূপ ভাবে আজীবন কষ্ট সহ্য করিতে হয়, সেই কষ্ট হইতে তাহাদিগকে উদ্ধার করিয়া যাহাতে তাহারা পুনরায় বিবাহ করিতে সমর্থ হয়, তাহার উপায় বিধান করা। 

নিজের লেখাপড়ার দিকে বিপিনের এখন যত দৃষ্টি থাকুক বা না থাকুক, উপরোক্ত বিষয় কয়েকটির দিকে তিনি সর্ব্বদা লক্ষ্য রাখিয়া চলিতে লাগিলেন। 

এই সময়ে সমাজের দুই চারিটি প্রধান প্রধান লোকদিগের সহিতও তাঁহার আলাপ পরিচয় হইল। তাঁহারা বিপিনের মতের সর্ব্বতোভাবে পোষকতা করিতে লাগিলেন। সুতরাং বিপিনও প্রথম প্রথম মধ্যে মধ্যে ও পরিশেষে সৰ্ব্বদাই সেই সকল সমাজে উপস্থিত হইয়া তাঁহাদিগের সহিত মিলিত হইতে লাগিলেন; ক্রমে তাঁহাদিগের আচার ব্যবহার ও চাল-চলন শিক্ষা করিতে লাগিলেন। 

যে সকল সমাজে তিনি গমন করিতে লাগিলেন, সেই সকল সমাজের পুরুষদিগের সহিত যে কেবল তাঁহার আলাপ পরিচয় হইল, তাহা নহে; স্ত্রীলোকদিগের সহিতও তাঁহার বিশেষরূপে আলাপ পরিচয় হইতে লাগিল। কারণ, এই সমাজস্থ স্ত্রীলোকগণ অবরোধ প্রথার ধার ধারেন না, এবং পরপুরুষের সহিত আলাপ পরিচয় করিতে তাঁহাদিগের কোনরূপ আপত্তি বা প্রতিবন্ধক নাই; যেহেতু তাঁহারা শিক্ষিতা ও জ্ঞানালোকিতা। 

বিপিন যে এইরূপ ভাবে দেশহিতৈষিকতার ভান করিয়া সমাজে সমাজে বেড়াইতে লাগিলেন, দেশহিতৈষিণীদিগের সহিত মিলিতে লাগিলেন, তাহা কিন্তু রজনীকান্ত বা রাজকিশোরী কিছুমাত্র জানিতে পারিলেন না। 

এইরূপে কিছুদিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। বিপিনের পরীক্ষার সময় আসিয়া উপস্থিত হইল। বিপিন ইতিপূর্ব্বে সকল পরীক্ষায় ভালরূপে উত্তীর্ণ হইয়া আসিয়াছিলেন; এবার কিন্তু কোনরূপে পাস হইলেন মাত্র। 

রজনীকান্তের যাহা কিছু সংস্থান ছিল, বিপিনকে বিদ্যা শিক্ষা করাইবার নিমিত্ত ক্রমে ক্রমে সমস্তই ব্যয় করিয়া ফেলিয়াছিলেন। তিনি য়ে সামান্য বেতনে কর্ম্ম করিতেন, তাহা দ্বারা কোনরূপে আপনাদিগের গ্রাসাচ্ছাদন নিৰ্ব্বাহ হইত মাত্র; তাহা হইতে অতিরিক্ত ব্যয় একটিমাত্র পয়সাও হইবার সম্ভাবনা ছিল না। সুতরাং বিপিনের লেখাপড়া শিখাইতে রজনীকান্ত আর সমর্থ হইলেন না। রজনীকান্তের ইচ্ছা ছিল যে, যদি কোন স্থান হইতে কিছু টাকা তিনি কৰ্জ্জ লইতে পারেন, তাহা হইলে সেই টাকা ব্যয় করিয়া বিপিন যাহাতে আরও কিছু লেখাপড়া শিখিতে সমর্থ হয়, তাহার চেষ্টা করেন। পরিশেষে চাকরী হইলে বিপিন নিজের দেনা নিজেই পরিশোধ করিয়া দিবে। রজনীকান্ত মনে যাহা ভাবিলেন, কাৰ্য্যে তাহা ঘটিল না। কোন স্থান হইতে আর কোন অর্থ সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইলেন না। কারণ, রজনীকান্ত সকলের নিকট ঋণী। বিপিনকে লেখাপড়া শিখাইবার নিমিত্ত যখন যে টাকার প্রয়োজন হইয়াছে, তখনই রজনীকান্ত তাহার সংস্থান করিয়া দিয়াছেন! যে পর্য্যন্ত নিজের বিষয়াদি বা অলঙ্কার পত্র ছিল, সেই পৰ্য্যন্ত তাহা বিক্রয় করিয়া বা বন্ধক দিয়া তদ্দ্বারা অর্থের সংস্থান হইত। সেই সমস্ত অর্থ যখন নিঃশেষিত হইয়া গেল, তখন অপরের নিকট ঋণ করিতে আরম্ভ করিলেন। এইরূপে ক্রমে ক্রমে প্রায় সকলের নিকটেই তিনি ঋণগ্রস্ত হইয়া পড়ায় এখন কেহ আর তাঁহাকে ঋণদানে সম্মত হইলেন না; সুতরাং বিপিনের লেখাপড়া এইস্থানে বন্ধ হইল। 

অর্থাভাবে বিপিনের লেখাপড়া বন্ধ হইল বলিয়া রজনীকান্ত ও তাঁহার অশিক্ষিতা স্ত্রী রাজকিশোরীর অন্তঃকরণে বিশেষরূপ কষ্ট হইতে লাগিল কিন্তু বিপিন এক দিবসের নিমিত্তও দুঃখিত হইলেন না। কারণ, আর অধিক লেখাপড়া শিখিবার ইচ্ছা তাঁহার মন হইতে এখন দূরে পলায়ন করিয়াছিল। এখন তাঁহার মনে বিষম চিন্তার আবির্ভাব হইয়াছে। এখন তিনি বিধবাদিগের বৈধব্য যন্ত্রণায় রোদন করিতে শিক্ষা করিয়াছেন। সেই অবরোধ প্রথার নিমিত্ত বুদ্ধ সমাজপতিগণকে শত সহস্র গালি দিতে আরম্ভ করিয়াছেন! স্ত্রীলোকদিগকে অশিক্ষিতাবস্থায় রাখা হইয়াছে বলিয়া সমাজের বৃদ্ধগণের সহিত নানা তর্ক করিতে শিখিয়াছেন! এরূপ অবস্থায় তাঁহার আর লেখাপড়া ভাল লাগিবে কেন? 

বিপিনের লেখাপড়া বন্ধ হইল সত্য; কিন্তু সংসারের কার্য্যেও তাঁহাকে উদাসীন বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। চাকরী প্রভৃতির চেষ্টা করিয়া সংসারের উন্নতির দিকে লক্ষ্য করিবার সময় তাঁহার নাই। তিনি সৰ্ব্বদাই “দেশ দেশ” করিয়া নানাস্থানে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। রজনীকান্ত এ সকল বিষয় বুঝিয়াও বুঝিলেন না, দেখিয়াও দেখিলেন না। এইরূপে কিছুদিবস অতীত হইয়া গেল; তথাপি রজনীকান্ত আপন ভ্রাতাকে এক দিবসের নিমিত্ত অনুযোগ করিলেন না। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

রজনীকান্ত যে আফিসে কর্ম্ম করিতেন, তিনি সেই আফিসের একজন নিতান্ত সামান্য কর্মচারী হইলেও আফিসের সাহেব তাঁহাকে ভাল বাসিতেন। কারণ, সাহেবের বিশ্বাস ছিল যে, রজনীকান্তের বেতন নিতান্ত অল্প হইলেও তিনি অবিশ্বাসী কৰ্ম্মচারী নহেন। 

বিপিনের কলেজ পরিত্যাগ করিবার কিছু দিবস পরেই রজনীকান্তের আফিসে ৬০ টাকা বেতনের একটি চাকরি খালি হইল। রজনীকান্ত সময় বুঝিয়া এক দিবস তাঁহার সাহেবকে আপন ভ্রাতা বিপিনের নিমিত্ত বলিলেন। উক্ত চাকরীর নিমিত্ত অনেক লোক উপস্থিত হইলেও, কি জানি, কি ভাবিয়া রজনীকান্তের মনিব সেই কর্ম্মে বিপিনকে নিযুক্ত করিলেন। 

চাকরী হইবার পরও বিপিন আপনার ভ্রাতা রজনীকান্তের সহিত পূর্ব্বের মত একত্র বাস করিতে লাগিলেন। রজনীকান্ত মনে করিলেন যে, এখন দুই ভ্রাতার উপার্জিত অর্থ হইতে সাংসারিক খরচ পত্র বাদে যাহা কিছু বাঁচাইতে পারিবেন, তাহার দ্বারা পূর্ব্ব ঋণ সকল প্রথমে পরিষ্কার করিয়া পরিশেষে বিপিনের বিবাহের বন্দোবস্ত করিবেন। রজনীকান্ত মনে যাহা ভাবিয়াছিলেন, কার্য্যে কিন্তু তাহা ঘটিল না। বিপিন আপনার বেতন হইতে একটিমাত্র পয়সা দিয়াও সংসারের সাহায্য করিলেন না। এইরূপে দুই মাস গত হইয়া গেলে, এক দিবস রজনীকান্ত খরচের নিমিত্ত বিপিনকে কহিলেন। উত্তরে বিপিন কহিলেন, “আমি যে সামান্য বেতন পাই, তাহাতে আমি নিজের খরচই কুলাইয়া উঠাইতে পারি না—- সংসারের সাহায্য করিব কি প্রকারে?”

বিপিনের কথা শুনিয়া রজনীকান্ত মর্ম্মাহত হইলেন, তথাপি তাহাকে আর কিছু না বলিয়া নিজের সাধ্যানুযায়ী সংসার খরচের সংস্থান করিতে লাগিলেন। কিন্তু ঋণের ভাগ ক্রমেই বৰ্দ্ধিত হইতে লাগিল। 

রজনীকান্ত মনে করিলেন যে, এই সময় বিপিনের বিবাহ দেওয়ার নিতান্ত আবশ্যক; নতুবা যে তাহার স্বোপার্জিত অর্থ সকল এইরূপেই নষ্ট করিয়া ফেলিবে। এই ভাবিয়া রজনীকান্ত একটি বয়স্থা পাত্রীর অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। 

বিপিনও জানিতে পারিলেন যে, রজনীকান্ত তাঁহার বিবাহের চেষ্টা করিয়া বেড়াইতেছেন। কিন্তু লজ্জার খাতিরে সম্মুখে তিনি কোন কথা না বলিয়া, একখানি পত্রে তাঁহার মনের ভাব ব্যক্ত করিয়া আপন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার নিকট পাঠাইয়া দিলেন। রজনীকান্ত ঐ পত্র পাঠ করিয়া যে কিরূপ মর্মাহত হইলেন, তাহা বলা যায় না। ক্রমে রাজকিশোরীও এই পত্রের কথা অবগত হইয়া দুঃখ করিতে লাগিলেন। বিপিন রজনীকান্তকে যে পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহার মৰ্ম্ম এইরূপ:- 

“দাদা! আমি অনেক দিবস হইতে আমার মনের কথা আপনাকে বলিব বলিয়া মনে করিতেছি, এবং সেই সকল কথা আপনার নিকট প্রকাশ না করিলে কোনরূপেই চলিতে পারে না, তাহা আমি অবগত আছি। কিন্তু দারুণ লজ্জার নিমিত্ত এত দিবস তাহা আপনাকে বলিতে পারি নাই। যাহা হউক, এখন দেখিতেছি যে, আমার মনের কথা আপনার নিকট গোপন রাখিলে আর চলে না। মনে করিয়াছিলাম যে, সংসারের খরচ আমি আমার বেতনের টাকা হইতে কেন দিই না ও ঐ টাকা কিসে খরচ করিয়া থাকি, এই কথা যে দিবস আপনি আমাকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিবেন, সেই দিবস আমি আমার মনের কথা আপনাকে বলিব; কিন্তু আপনি এক দিবস ভিন্ন দ্বিতীয় দিন আর সে কথা স্পষ্ট করিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন না। সুতরাং এ পর্যন্ত আমিও কোনমতে আমার মনের কথা প্রকাশ করিবার সুযোগ পাইলাম না। 

“এখন দেখিতেছি, আপনি আমার বিবাহের নিমিত্ত সবিশেষ ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছেন। সুতরাং আর আমি আমার অন্তরের কথা গোপন রাখিতে পারি না। আপনি আমার বিবাহের চেষ্টা আর করিবেন না। কারণ, বিবাহ হইতে আমার বাকী নাই; প্রায় এক বৎসরের অধিক হইল, আমার বিবাহ হইয়া গিয়াছে। বিবাহের পর যে পর্যন্ত আমি তাঁহাকে সাহায্য করিতে সমর্থ না হইয়াছিলাম, সেই পর্যন্ত আমার স্ত্রী আমার জনৈক বন্ধুর দ্বারা প্রতিপালিত হন। কিন্তু যে পর্য্যন্ত আমার চাকরী হইয়াছে, সেই পৰ্য্যন্ত আমি আমার বেতন হইতে তাঁহার খরচপত্র নির্ব্বাহ করিয়া আসিতেছি, এবং যাহাতে তিনি আরও একটু লেখা-পড়া ভাল করিয়া শিখিতে পারেন, তাহার নিমিত্ত এখন আমি তাঁহাকে একটি স্কুলে রাখিয়া দিয়াছি। সেইস্থানে তিনি রাত্রি দিবস অবস্থিতি করিয়া লেখা-পড়া শিক্ষা করিতেছেন। এখন যেরূপ আপনার বিবেচনা হয়, সেইরূপ আপনি করিতে পারেন। যদি আপনি তাঁহাকে আনিয়া বাড়ীতে রাখেন, তাহাতে আমার কোন আপত্তি নাই। তিনি এখন লেখাপড়া শিখিয়াছেন, নিজের ভালমন্দ তিনি এখন নিজে বেশ বুঝিয়াছেন। সুতরাং আমার বিবেচনা হয়, বাড়ীতে আসিয়া বাস করিতে তাঁহার কোন আপত্তি হইবে না। এরূপ অবস্থায় আপনি যাহা ভাল বিবেচনা করিবেন, তাহাই হইবে। একত্র বাস করিলে খরচ-পত্রের অনেক সুবিধা হইবার সম্ভাবনা।। এরূপ অবস্থায় আমার বোধ হয়, সকলে মিলিয়া একত্র বাস করাই কৰ্ত্তব্য। বিশেষতঃ যাঁহাকে বিবাহ করিয়াছি, তাঁহাকে অন্য স্থানে রাখিয়া আমার অন্য স্থানে থাকা কোনরূপেই কৰ্ত্তব্য নহে। আপনার আদেশ পাইলেই স্কুল হইতে আমি আমার স্ত্রীকে বাড়ীতে আনয়ন করিব। ইতি :—” 

বিপিনের পত্র পাঠ করিয়া রজনীকান্ত যে কিরূপ মনস্তাপ পাইলেন, তাহা ভ্রাতামাত্রেই সহজে অনুভব করিতে পারিবেন। অশিক্ষিতা রাজকিশোরীর চক্ষু দিয়াও জলধারা বহিল। কিন্তু উভয়ে পরামর্শ করিয়া পরিশেষে বিপিনের মতে মত দিলেন, এবং বিপিনের স্ত্রীকে বাড়ী আনাই স্থির করিলেন। 

রজনীকান্ত বিপিনের সেই পত্রের উত্তর প্রদান করিলেন না; কিন্তু সময়ক্রমে রাজকিশোরী এক দিবস তাঁহার ও স্বামীর মনের ভাব বিপিনের নিকট প্রকাশ করিলেন। বিপিন তাঁহাদিগের কথা শুনিয়া বিশেষরূপে সন্তুষ্ট হইলেন, এবং বর্তমান মাসের অবশিষ্ট কয়েক দিবস গত হইলেই, তিনি তাঁহার পত্নীকে আপন গৃহে আনয়ন করিবেন স্থির করিলেন। 

ক্রমে মাসের অবশিষ্ট কয়েক দিবস গত হইয়া গেল। এক দিবস সন্ধ্যার সময় বিপিন তাঁহার পত্নীর সহিত আপন বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। 

বিপিনের স্ত্রী বাড়ীতে পদার্পণ করিবামাত্রই তাহাকে দেখিয়া রজনীকান্ত ও রাজকিশোরী একেবারে আশ্চর্যান্বিত হইয়া পড়িলেন। তাঁহারা ভাবিয়াছিলেন যে, বিপিনের স্ত্রী মানিনী নিতান্ত বালিকা হইবেন; নতুবা স্কুলে থাকিয়া এখনও পর্যন্ত লেখাপড়া শিখিতেছে এক প্রকারে? আরও ভাবিয়াছিলেন যে, কোন বন্ধুর অনুরোধ লঙ্ঘন করিতে না পারিয়া, তাঁহাদিগের অজ্ঞাতে বিপিন এই বিবাহ করিয়া ফেলিয়াছেন। কিন্তু যখন বিপিন তাঁহার স্ত্রীকে গাড়ী হইতে নামাইলেন, তখনই তাঁহাদিগের মস্তকে বজ্রাঘাত হইল। বিপিনের স্ত্রীকে ঘরে উঠাইবেন কি- মস্তকে হাত দিয়া তাঁহারা সেইস্থানে বসিয়া পড়িলেন। 

রজনীকান্ত দেখিলেন যে, মানিনী বালিকা নহেন — যুবতী। বিপিন অপেক্ষা তাহার বয়স অধিক না হইলেও নিতান্ত কম হইবে না। তাহার পরিধানে একখানি শাটী থাকিলেও কেমন একরূপ করিয়া পরিধান করা। তাহার নিম্নে গলা হইতে লম্ববান একটি সাদা ঘাঘ্রা বা সেমিজ। পায়ে ফুল মোজা, তাহার উপর বুট জুতা। মাথার উপর একটি লেজ বাহির করা পাগড়ী। 

এইরূপ অবস্থায় মানিনী গাড়ী হইতে নামিয়াই সম্মুখে রজনীকান্ত ও রাজকিশোরীকে দেখিতে পাইলেন। উহাদিগকে দেখিয়াই বিপিনকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইঁহারা দুইজন কে?” 

উত্তরে বিপিন কহিলেন, “ইনি আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, আর ইনিই উঁহার বনিতা।”

বিপিনের কথা শুনিবামাত্র, মানিনী আপন দক্ষিণ হস্ত প্রসারণ করিয়া উঁহাদিগকে শেকহ্যাণ্ড করিবার মানসে প্রথমে রজনীকান্তের দিকে অগ্রসর হইলেন। রজনীকান্ত এই অশ্রুতপূর্ব্ব ব্যাপার দেখিয়া লজ্জায় আধোবদন হইয়া দ্রুতপদে বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গেলেন। 

অশিক্ষিতা রাজকিশোরী এরূপ অস্ত প্রসারণের উদ্দেশ্য কি, জানিতে না পারিয়া মানিনীর হাত ধরিয়া গৃহের ভিতর লইয়া গেলেন। সেই স্থানে একখানি চেয়ার পূর্ব্ব হইতে রক্ষিত ছিল। কাহাকেও কিছু না বলিয়া মানিনী তাহাতেই উপবেশন করিলেন। 

মানিনীর অবস্থা দেখিয়া রজনীকান্ত ভাবিলেন যে, বিপিনের মতে মত দিয়া তিনি কি সর্ব্বনাশই করিয়াছেন! এখন সমাজের লোক তাঁহাকে কি বলিবে? 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

রজনীকান্ত বা বিপিনের সংসারে স্ত্রীলোকের মধ্যে কেবল রাজকিশোরী এবং মানিনী। কিন্তু উভয়ের মধ্যে পার্থক্য বিস্তর। রাজকিশোরী অশিক্ষিতা, মানিনী শিক্ষিতা; সুতরাং রাজকিশোরীর চাল-চলন মানিনী হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। রাজকিশোরী প্রত্যূষে উঠিয়া সংসারের সমস্ত কার্য্য আপন হস্তে নির্ব্বাহ করেন, এবং পরিশেষে রন্ধনাদি করিয়া আপন স্বামী ও দেবরকে সময়মত প্রদান করেন। 

মানিনীর নিদ্রা দিবা নয়টার কম কোনরূপেই ভঙ্গ হয় না। নিদ্রাভঙ্গ হইলে হস্ত-মুখাদি প্রক্ষালন করিতেও প্রায় একঘণ্টা অতিবাহিত হইয়া যায়। তাহার পর সাবান মাখিতে, স্নান করিতে ও পোষাক পরিচ্ছদ আদি পরিধান করিতেও অনেক সময়ের আবশ্যক হয়। ইহা ব্যতীত নাটক, নভেল পাঠ করা আছে, কারপেট বোনা আছে; সুতরাং সংসারের কোন কার্য্যের দিকে লক্ষ্য করিতে তিনি কিছুমাত্র সময় পান না। অধিকন্তু তাঁহার আহারীয় দ্রব্য প্রস্তুত করিয়া তাঁহার সম্মুখে আনিয়া দিতে রাজকিশোরীর যদি কিছুমাত্র বিলম্ব হয়, তাহা হইলেই সর্ব্বনাশ! অমনি সংসারের খরচ বন্ধ! 

অশিক্ষিতা রাজকিশোরী তাঁহার স্বামীকে কিরূপ ভালবাসেন, তাহা প্রকাশ্যে দেখিতে পাওয়া যায় না। কারণ সর্ব্বদা স্বামীর নিকট তিনি বসিয়া থাকিতে পারেন না, বা “তোমার অদর্শন আমি সহ্য করিতে পারি না— মুহূর্তের নিমিত্ত আমার চক্ষুর অন্তরাল হইলে আমি চতুর্দিক অন্ধকার দেখি— তোমাকে আমি প্রাণের সহিত ভালবাসি–“ প্রভৃতি বাক্য সকল কখন কেহ রাজকিশোরীর মুখে শ্রবণ করেন নাই। সৰ্ব্বদাই তাঁহাকে সংসারের কার্য্যে ঘুরিয়া বেড়াইতে হইত। 

শিক্ষিতা মানিনী তাঁহার স্বামীকে প্রাণের সহিত ভালবাসেন, এ বিশ্বাসে বিপিনের অন্তঃকরণ পরিপূর্ণ। কারণ, অফিস হইতে আগমন করিবামাত্রই মানিনী বিপিনের নিকট গমন করিয়া ইজি চেয়ারের উপর অর্দ্ধ-শায়িতভাবে উপবেশন করেন। জলখাবারের সময়ে, পূর্ব্বে আপনি অর্দ্ধেক ভোজন করিয়া অবশিষ্ট উচ্ছিষ্ট (?) খাদ্য বিপিনকে প্রদান করেন। কারণ, খাদ্যের মধ্যে কোনরূপ বিষাক্ত দ্রব্য আছে কি না, তাহা পরীক্ষা না করিয়া উহা স্বামীকে কিরূপে প্রদান করিবেন? জল-পূর্ণ গ্লাসের জল পূর্ব্বে আপনি না পান করিয়াই বা কিরূপে উহা স্বামীর হস্তে প্ৰদান করেন? সুতরাং মানিনী যেরূপ ভাবে স্বামীকে ভক্তি করিয়া থাকেন, সেইরূপ ভাবে এ দেশীয় কয়টি অশিক্ষিতা স্ত্রীলোক স্বামীভক্তি দেখাইতে পারে? ইহা ব্যতীত স্বামীর নিকট বসিয়া “প্রাণেশ্বর, প্রাণবল্লভ” প্রভৃতি আনন্দদায়িনী ভাষায়, মানিনী বা মানিনী-সদৃশ শিক্ষিতা স্ত্রীলোক ভিন্ন আর কোন রমণী আপন পতির হৃদয় আনন্দে পূর্ণ করিতে সমর্থ হয়? 

অশিক্ষিতা রাজকিশোরী বৈকালে রন্ধনাদির উদ্যোগ করিতে পুনরায় ব্যস্ত হইয়া পড়েন, এবং রন্ধনাগারে প্রবেশ করিয়া উনানে ফু পাড়িতে পাড়িতে মুখমণ্ডল ঘৰ্ম্মে আপ্লুত করিয়া ফেলেন। কিন্তু শিক্ষিতা মানিনী নূতন সাজে সজ্জিতা হইয়া, পাউডারে মুখ মাজিয়া, ছাদের উপর উঠিয়া বায়ু সেবন করেন, কোন দিবস বা গাড়ী ডাকাইয়া হাওয়া খাইতে বাহির হইয়া চলিয়া যান। 

এই সকল ঘটনা দেখিয়া রাজকিশোরীর বা রজনীকান্তর কোন কথা কহিবার উপায় নাই। কারণ, মানিনী যাহা করেন, বিপিন তাহারই অনুমোদন করিয়া থাকেন। বিপিনকেও কোন কথা বলিবার কাহারও সাধ্য নাই। কারণ, দুই ভ্রাতার মধ্যে বিপিনের উপার্জ্জনই অধিক। মানিনীর বিপক্ষে তাহার নিকট কোন কথা বলিলে, তিনি তাহা শ্রবণ করেন না; অধিকন্তু খরচের টাকা বন্ধ করিয়া দিবেন বলিয়া ভয় প্রদর্শন করেন। 

এইরূপে কিছুদিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। অশিক্ষিতা রাজকিশোরী বিস্তর সহ্য করিয়া আসিতেছিলেন, কিন্তু আর কোনরূপেই সহ্য করিয়া উঠিতে পারিলেন না। শিক্ষিতা মানিনীর গুণের কথা সকলে ক্রমে রজনীকান্তের কর্ণগোচর করাইলেন। রজনীকান্তও দেখিলেন যে, মানিনী প্রকৃতই সংসারের কোন কার্য্যে হস্তক্ষেপ করেন না, অথচ কোন বিষয়ে একটু ত্রুটি হইলে রাজকিশোরীকে সহস্র কথা শুনাইয়া দেন। 

এই সময়ে রাজকিশোরী হঠাৎ অসুস্থা হইয়া পড়ায় সংসারের কোন কার্য্য দেখিতে বা রন্ধনাদি করিতে সমর্থ হইলেন না। কিন্তু মানিনী তাঁহার দিকে একবারও দৃষ্টিপাত করিলেন না, বা কোনরূপ রন্ধনাদি ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিলেন না। সুতরাং অনাহারেই রজনীকান্তকে অফিসে গমন করিতে হইল। বিপিন বাজার হইতে কিছু আহারীয় আনিয়া কিয়দংশ আপনি আহার করিয়া অফিসে গমন করিলেন, কিয়দংশ মানিনীর নিমিত্ত রাখিয়া গেলেন। বাজারের খাবার খাইলে পাছে মানিনীর অসুখ হয়, এই ভয়ে মানিনী উহা স্পর্শও করিলেন না। একখানি গাড়ী আনাইয়া তৎক্ষণাৎ তিনি তাঁহার কোন বন্ধুর বাড়ীতে গমন করিয়া আহারাদি করিলেন; এবং যে পর্য্যন্ত রাজকিশোরী আরোগ্য না হইবেন, সেই পৰ্যন্ত তিনি তাঁহার সেই শিক্ষিত বন্ধুর বাড়ীতেই অবস্থিতি করিবেন, ইহাই স্থির করিলেন। শিক্ষিত বন্ধুর অর্থের অনাটন ছিল না, সুতরাং তিনি শিক্ষিতা মানিনীকে তাঁহার থাকিবার স্থান প্রদান করিতে অসমর্থ হইলেন না। মধ্যে মধ্যে বিপিনও সেইস্থানে গমন করিয়া আহারাদি করিতে লাগিলেন। মানিনী তাঁহার শিক্ষিত বন্ধুর শিক্ষিতা স্ত্রী ও শিক্ষিতা কন্যার সহিত আহার বিহার করিয়া মনের সুখে কাল কাটাইতে লাগিলেন, এবং সভা-সমিতি প্রভৃতি স্থানে ইচ্ছামত গমনাগমন করিতে লাগিলেন। 

পাঠকগণ পূৰ্ব্ব হইতেই অবগত আছেন যে, বিপিনের মাসিক আয় ৬০ টাকা। যত দিবস পর্য্যন্ত মানিনী, রাজকিশোরী বা রজনীকান্তের সহিত একত্র বাস করিতেছিলেন, সেই পর্যন্ত বিপিন আপনার বেতন হইতে ২৫ টাকা সংসারের খরচের নিমিত্ত প্রদান করিতেন। অপর ৩৫ টাকা দ্বারা তিনি তাঁহার শিক্ষিতা বনিতার ফরমাইস্ সকল কষ্টে নির্ব্বাহ করিতেন। 

যে দিবস হইতে রাজকিশোরী অসুস্থা হইয়া পড়িলেন, বা যে দিবস হইতে মানিনী আপনার বন্ধুর বাড়ীতে বাস করিতে লাগিলেন, সেই দিবস হইতে বিপিন সাংসারিক খরচও বন্ধ করিয়া দিলেন। এই কাৰ্য্য বিপিন নিজের ইচ্ছামত করিলেন, কি তাঁহার শিক্ষিতা বনিতার পরামর্শ মত বাধ্য হইয়া করিলেন, তাহা লেখক অবগত? যে বিষয়ের বিচারের ভার পাঠকগণের উপর রহিল। 

ক্রমে রাজকিশোরী আরোগ্যলাভ করিয়া পুনরায় সংসারের কার্য্যে মনঃসংযোগ করিলেন। কিন্তু মানিনী সেই অশিক্ষিতার নিকট আর আগমন করিলেন না। ক্রমে বিপিনও বাড়ী আসা বন্ধ করিয়া আপনার শিক্ষিতা বনিতার বন্ধুর বাড়ীতেই বাস করিতে লাগিলেন। বলা বাহুল্য, সেইস্থানে বিপিনের যত্নের কিছুমাত্র ত্রুটি হইত না। 

ভ্রাতার এই অবস্থা দেখিয়া রজনীকান্ত বিপিনকে আর কোন কথা বলিলেন না, বা তাহার স্ত্রীকে পুনরায় বাড়ীতে আনিতে কোনরূপ অনুরোধও করিলেন না; ভাবিলেন, অশিক্ষিতের সহিত একত্র বাস করিয়া যদি ভিক্ষা করিয়াও দিনপাত করিতে হয় তাহাও ভাল, তথাপি শিক্ষিতার সহিত একত্র বাস করিয়া স্বর্গীয় সুখেরও বাসনা করা বিড়ম্বনা মাত্র। 

তাঁহার মাসিক ২৫ টাকা কমিয়া গেল সত্য, কিন্তু ভ্রাতা ও ভ্রাতৃজায়া বাড়ী পরিত্যাগ করায় তাঁহার খরচও অনেক কমিয়া গেল। নিজের উপার্জ্জনের উপর নির্ভর করিয়া তাঁহার খরচপত্র অনায়াসে চলিতে লাগিল; অধিকন্তু মাসে মাসে কিছু কিছু জমিতেও লাগিল। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

মানিনী তাঁহার যে বন্ধুর বাড়ীতে বাস করিতেন, সেই বাড়ীতে একজন ডাক্তারও থাকিতেন। পরিবারবর্গের ভিতর কাহারও পীড়া হইলে সেই ডাক্তারই তাহার চিকিৎসা করিতেন। উক্ত বাড়ীর স্ত্রীলোকমাত্রেই শিক্ষিতা; সুতরাং প্রয়োজন হইলে যাহাকে ইচ্ছা তাহার নিকট গমন করিতে ডাক্তার বাবুর কোনরূপ প্রতিবন্ধক হইত না। বিশেষতঃ পরস্পরের মধ্যে “ভ্রাতা ভগ্নী” সম্বন্ধ হইয়া পড়িয়াছিল। 

মানিনীর সহিত ডাক্তারবাবুর বিশিষ্ট ভালবাসা থাকা প্রযুক্ত বিপিনের সহিতও তাঁহার অত্যন্ত ভালবাসা জন্মিয়াছিল। ডাক্তারবাবুর স্ত্রী শিক্ষিতা, কি অশিক্ষিতা, তাহা আমরা অবগত নহি। কারণ তিনি তাঁহার স্ত্রীকে লইয়া এই স্থানে বাস করিতেন না; একাকীই সেই বাড়ীতে থাকিতেন! কিন্তু কোন নাচে বলুন, থিয়েটারে বলুন, কি গড়ের মাঠে বলুন, এইরূপ স্থানে যখন ডাক্তারবাবু গমন করিতেন, তখন মানিনীকে তিনি তাঁহার গাড়ীতে করিয়া লইয়া যাইতেন, এবং বিপিনও সকল দিবস তাঁহাদিগের সহিত গমন করিতে না পারিলেও প্রায়ই তাঁহাদিগের সঙ্গে থাকিতেন। 

ডাক্তারবাবুর ব্যবহারে বিপিন সর্ব্বদা তাঁহার উপর বিশেষরূপে সন্তুষ্ট থাকিতেন। তাঁহার মনে মনে বিশ্বাস ছিল যে, ডাক্তারবাবু তাঁহাকে ও তাঁহার স্ত্রীকে যতদূর ভালবাসেন, ততদূর ভালবাসা তিনি তাঁহার সহোদর ভ্রাতা বা অপর কোন ব্যক্তির নিকট প্রাপ্ত হন নাই। 

এইরূপ ভাবে কিছুদিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। বন্ধুর বাড়ীতে এইরূপ ভাবে অধিক দিবস বাস করা আল দেখায় না বিবেচনা করিয়া, বন্ধুর বাড়ীর সন্নিকটেই একটি ছোট গোছের বাড়ী ভাড়া করিভা বিপিন আপন স্ত্রীর সহিত বাস করিতে লাগিলেন। 

তিনি তাঁহার শিক্ষিতা প্রণয়িনীর প্রণয়ে বিশেষরূপে মোহিত থাকিলেও আর্থিক কষ্টে তাঁহাকে বিশেষরূপ কষ্ট পাইতে হইল। কারণ, তাঁহার সংস্থানের মধ্যে কেবলমাত্র মাসিক নগদ ৬০ টাকা, তাহা হইতে বাড়ী ভাড়া, একটি চাকর, একটি চাকরাণী ও একটি পাচকের বেতন ও খরচ বাদে যাহা কিছু অবশিষ্ট থাকিত, তাহাতে আপনাদিগের আবশ্যক মত ব্যয়ের সঙ্কুলান করা অতীব কষ্টকর হইয়া পড়িতে লাগিল। মানিনী শিক্ষিতা; সুতরাং সাংসারিক কাজ- কৰ্ম্ম করিবার ক্ষমতা তাঁহার নাই! তজ্জন্য চাকরাণী না রাখিলে কোন প্রকারেই চলে না। রন্ধনের ক্ষমতা তাঁহার নাই; বিশেষতঃ রন্ধনাদির নিমিত্ত তাঁহার যে সময়ের আবশ্যক হইবে, সেই সময়ে তাঁহার পাঠের সবিশেষ ক্ষতি হয়; অথচ রান্না-ঘরের ধোয়া শিক্ষিতা মানিনী কিরূপে সহ্য করিতে পারেন? সুতরাং পাচকের একান্ত প্রয়োজন। বাবু নিজেও শিক্ষিত, বি-এ পাস করা, সুতরাং হাটবাজার করা কি অপর কোন দ্রব্যাদি সংগ্রহ করা, তাঁহার পক্ষে অসম্ভব; কাজেই চাকরেরও নিতান্ত প্রয়োজন। 

এই সকল নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যয় বাদে উভয়ের জুতা, কাপড় আছে; ধোপা, নাপিত আছে; আতর, গোলাপ আছে; মোজা, পাউডার আছে; চেয়ার, টেবিল আছে; বরফ, লেমনেড আছে, নাটক, নভেল, খবরের কাগজ আছে; এবং সন্ধ্যার সময় বায়ু সেবনের নিমিত্ত গাড়ীভাড়া আছে। অথচ বেতন নিতান্ত সামান্য, ইহাতে কিরূপে সঙ্কুলান হইতে পারে? ইহা ব্যতীত মধ্যে মধ্যে আপনার বন্ধু-বান্ধব এবং ভ্রাতা-ভগিনীদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া না খাওয়াইলে, তাঁহাদিগের নিকট নিতান্ত অপদস্থ হইয়া থাকিতে হয়। 

এইরূপ নানাকারণে ক্রমে বিপিনচন্দ্র ঋণজালে বিশেষরূপে জ্বালাতন হইয়া পড়িলেন। অথচ পূৰ্ব্ববর্ণিত নিতান্ত প্রয়োজনীয় খরচের মধ্য হইতে যে কোন একটি খরচ কমাইতে পারেন, তাহার কোন উপায় দেখিলেন না। 

ডাক্তারবাবু মালিনী ও বিপিনকে অশেষ ভালবাসিতেন; সুতরাং মধ্যে মধ্যে তিনি বিশেষরূপে অর্থ সাহায্য করিতেও ত্রুটি করিতেন না। তথাপি বিপিন আপনাদিগের খরচ-পত্র কোনরূপেই সুচারুরূপে নির্ব্বাহ করিয়া উঠিতে পারিতেন না। 

ক্রমেই মাসে মাসে ঋণের সংখ্যা বৃদ্ধি হইতে লাগিল। উত্তমর্ণগণ ক্রমে তাগাদা আরম্ভ করিলেন; কিন্তু বিপিন তাঁহাদিগের ঋণ কোনরূপেই পরিশোধ করিতে পারিলেন না। মাসে মাসে হ্রাস হওয়া দূরের কথা— ক্রমে বৃদ্ধিই পাইতে লাগিল। 

উত্তমর্ণগণ এইরূপে যখন কিছুতেই আপন আপন প্রাপ্য টাকা আদায়ের কোনরূপ উপায় করিতে পারিলেন না, তখন অনন্যোপায় হইয়া ক্রমে ক্রমে সকলেই আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করিতে লাগিলেন। আর ডিক্রী করিয়া কেহ বা তাঁহার তৈজসপত্র বিক্রয় করিয়া লইতে লাগিলেন, কেহ বা তাঁহার বেতনের টাকা ক্রোক দিয়া বসিলেন। এইরূপে একের টাকা পরিশোধ হইতে না হইতে অপর ব্যক্তি তাঁহার বেতন ক্রোক করিতে লাগিলেন। 

এই সকল অবস্থা দেখিয়া বিপিনের মনিব সাহেব তাঁহার উপর অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইয়া পড়িলেন, এবং পরিশেষে বিনাবেতনে বিপিনকে ছুটি দিয়া কহিলেন, “যে পর্য্যন্ত তুমি তোমার সমস্ত দেনা পরিষ্কার করিতে না পারিবে, সেই পর্য্যন্ত তুমি চাকরী পাইবে না। সমস্ত দেনা পরিশোধ করিয়া উঠিতে পার, তবে চাকরীর নিমিত্ত আমার নিকট পুনরায় আসিও; নতুবা আমার নিকট আসিবার আর কোন প্রয়োজন নাই।” 

মনিবের নিকট এই কথা শ্রবণ করিয়া বিপিন বিষণ্ণবদনে আপন বাসায় প্রত্যাগমন করিলেন, এবং মানিনীকে সকল কথা কহিলেন। উত্তরে মানিনী কহিলেন, “যদি একমাত্র স্ত্রীর খরচের সংস্থান করিয়া উঠিবার ক্ষমতা তোমার না থাকে, তাহা হইলে বিবাহ করিতে তোমাকে কে পরামর্শ দিয়াছিল? তোমার হস্তে পড়িয়া আমি যেরূপ কষ্টে কালযাপন করিতেছি, সেরূপ কষ্ট কখন কোন স্ত্রীলোকে সহ্য করিয়াছে বলিয়া বোধ হয় না। অপর স্ত্রী হইলে তুমি নিশ্চয়ই দেখিতে, এরূপ কষ্ট সে কখনই সহ্য করিতে পারিত না। তোমাকে পরিত্যাগ করিয়া এতদিবস সে কোথায় চলিয়া যাইত। আমি তোমাকে নিতান্ত ভালবাসি বলিয়াই এখনও তোমাকে পরিত্যাগ করি নাই।” 

শিক্ষিতা স্ত্রীর কথা শুনিয়া শিক্ষিত যুবক মস্তকে হাত দিয়া সেইস্থানে বসিয়া পড়িলেন, এবং মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন, “দাদা আমা অপেক্ষা এত অল্প বেতন পাইয়া কিরূপে খরচ-পত্র নির্ব্বাহ করিয়া থাকেন, আমি তাহার কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারি না। আমি এমন শিক্ষিতা বনিতা পাইয়াও অর্থের অপ্রতুল নিবন্ধন এক দিবসের নিমিত্তও সুখী হইতে পারিলাম না! আর দাদা অশিক্ষিতা স্ত্রীর সহবাসে থাকিয়াও মনের সুখে সর্ব্বদা বাস করিয়া থাকেন! ভগবানের লীলা বোঝা ভার। 

যে সকল ব্যক্তির নিকট বিপিন ঋণগ্রস্ত, তাঁহারা যখন দেখিলেন যে, তাঁহাদিগের টাকা আদায়ের একমাত্র উপায় বিপিনের চাকরী পর্য্যন্ত গেল, তখন কিরূপ উপায়ে যে তাঁহারা তাঁহাদিগের প্রাপ্য টাকা আদায় করিয়া লইতে সমর্থ হইবেন, তাহার কিছুমাত্র স্থির করিয়া উঠিতে না পারায় স্থিরভাবে বসিয়া রহিলেন। কিন্তু উহাদিগের মধ্যে একজন মহাজন ছিলেন, তাঁহার উপজীবিকাই ঋণদান ও সুদগ্রহণ। তিনি কিন্তু অপরাপর মহাজনদিগের ন্যায় স্থির থাকিতে পারিলেন না। প্রথমতঃ একদিবস বিপিনের বাড়ীতে আসিয়া টাকার নিমিত্ত বিপিনকে অযথা গালি দিয়া প্ৰস্থান করিলেন, এবং তাহাকে উত্তমরূপে জব্দ করিবার অভিপ্রায়ে আদালতে গিয়া বিপিনকে কয়েদ করিবার প্রার্থনা করিলেন। পরে প্রয়োজনীয় খরচের টাকাও জমা করিয়া দিলেন। 

সময়মত বিপিনের নামে ওয়ারেন্ট বাহির হইল, এবং আদালতের একজন লোক আসিয়া তাঁহাকে ধৃত করিয়া লইয়া গেল। সেই টাকা পরিশোধ করিবার ক্ষমতা বিপিনের ছিল না; সুতরাং কারাগারের ভিতর গমন করিয়া সেইস্থানেই কিছুদিবসের নিমিত্ত তাঁহাকে অবস্থান করিতে হইল। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

প্রায় দেড় মাস কাল জেলের মধ্যে বাস করিয়া বিপিন আপন বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিলেন। কিন্তু বাড়ীতে আসিয়া যাহা দেখিলেন, তাহাতে তাঁহার মস্তক ঘুরিয়া গেল। বাড়ীতে সামান্য তৈজসপত্র ও অন্যান্য দ্রব্যাদি যাহা কিছু রাখিয়া গিয়াছিলেন, তাহার চিহ্নমাত্র নাই, এবং তাঁহার শিক্ষিতা বনিতা মানিনীকেও দেখিতে পাইলেন না। দেখিলেন যে, সেই বাড়ী এখন অন্য লোক দ্বারা অধিকৃত। তাঁহাদিগকে মানিনীর কথা জিজ্ঞাসা করাতে কেহই তাঁহার কথার উত্তর প্রদান করিতে পারিলেন না। সকলেই কহিলেন, তাঁহারা যখন সেই বাড়ী ভাড়া লয়েন, তখন বাড়ীতে কেহই ছিলেন না, বা কোন দ্রব্যাদিও ছিল না, বাড়ীটি সম্পূর্ণরূপেই খালি ছিল। 

ভাড়াটিয়াদিগের নিকট হইতে যখন তিনি এই সকল কথা জানিতে পারিলেন, তখন মনে মনে ভাবিলেন, “আমাকে যখন জেলের ভিতর অবস্থান করিতে হইয়াছিল, তখন মানিনী একাকী কিরূপে এই স্থানে অবস্থিতি করিবেন। বোধ হয়, তিনি তাঁহার বন্ধুর বাড়ীতে গমন করিয়াছেন এবং যে পৰ্য্যন্ত আমি প্রত্যাগমন না করি, সেই পৰ্য্যন্ত তিনি সেইস্থানেই বাস করিতেছেন। সেইস্থানে গমন করিলেই আমি মানিনীকে দেখিতে পাইব।” 

এই ভাবিয়া দ্রুতগতিতে তিনি সেই বন্ধুর বাড়ীতে গমন করিলেন। তথায় অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলেন যে, মানিনী সেইস্থানে গমন করেন নাই। ডাক্তারবাবু যদি মানিনীর কোন কথা বলিতে পারেন, এই ভাবিয়া বিপিন তাঁহার অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন; কিন্তু ডাক্তারবাবুর সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইল না। জানিতে পারিলেন যে, বিপিন ধৃত হইবার দুই এক দিবস পরেই ডাক্তারবাবু তাঁহার দেশে গমন করিবেন বলিয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছেন; সেই সময় পৰ্য্যন্ত প্রত্যাগমন করেন নাই। 

তখন অনন্যোপায় হইয়া যে বাড়ীতে বিপিন বাস করিতেন, সেই বাড়ীর অধিকারীর নিকট গমন করিয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিবার ইচ্ছা করিলেন। যে স্থানে বিপিন বাস করিতেন, সেইস্থান হইতে বাড়ীওয়ালার বাড়ী বহুদূর নহে সেইস্থানে গমন করিয়া তিনি যাহা জানিতে পারিলেন, তাহাতে তাঁহার মন আরও অস্থির হইল। জানিতে পারিলেন যে, তাঁহার জেলে গমন করিবার দুই তিন দিবস পরেই বাড়ীওয়ালা বিপিনের বাড়ীতে গমন করিয়াছিলেন। সেইস্থানে গমন করিয়া দেখিতে পাইলেন যে, বাড়ীর সদর দ্বার খোলা, এবং ঘরগুলি উন্মুক্ত অবস্থায় রহিয়াছে। উহার ভিতর দ্রব্যাদি কিছুই নাই, এবং মানিনী বা অপর লোকজন কেহই নাই। এই অবস্থা দেখিয়া সহজেই তিনি অনুমান করিলেন যে, এই বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া মানিনী অন্য কোন স্থানে উঠিয়া গিয়াছেন। এইরূপ অবস্থায় উক্ত বাড়ী আরও দুই তিন দিবস পড়িয়া থাকার পর, বর্তমান ভাড়াটিয়াকে উহা ভাড়া দিয়াছেন। 

যে যে স্থানে মানিনীর যাতায়াত ছিল, এবং যাহার যাহার সহিত তাঁহার আলাপ পরিচয় ছিল, ক্রমে বিপিন সেই সকল স্থানে মানিনীর অনুসন্ধান করিলেন। কিন্তু কোন স্থানে তাঁহার কোনরূপ সন্ধান না পাইয়া মনের দুঃখে দিনযাপন করিতে লাগিলেন। 

ইতিপূর্ব্বে বিপিন স্বপ্নেও মনে করেন নাই যে, যাহাকে তিনি প্রাণের সহিত ভালবাসেন, এবং যাহার নিমিত্ত তিনি আপন সহোদরকে পর্য্যন্ত পরিত্যাগ করিয়াছেন, সেই প্রাণের মানিনী তাঁহাকে এইরূপ ভাবে পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইবেন। 

এখন আর বিপিনের স্থান নাই। যাঁহাদিগকে বন্ধু বলিয়া তাঁহার মনে বিশ্বাস ছিল, এখন আর তাঁহারা তাঁহাকে আপন বাড়ীতে স্থান প্রদান করেন না। অথচ বিনাদোষে যে ভ্রাতাকে পরিত্যাগ করিয়া আসিয়াছেন, সামান্য পরিমাণ অর্থ দিয়া যাঁহার বিপদের সময় সাহায্য করিতে উপেক্ষা করিয়াছেন, আজ কি প্রকারে সেই ভ্রাতার নিকট গমন করিবেন, এবং সেই রাজকিশোরীকে কিরূপে আপন মুখ দেখাইবেন? 

যে ভ্রাতার সহিত নিতান্ত অসদ্ব্যবহার করিয়া বিপিন আপন স্ত্রীকে লইয়া চলিয়া আসিয়াছিলেন, নিতান্ত অনন্যোপায় হইয়া পুনরায় তাঁহাকে সেই ভ্রাতার নিকট গমন করিতে হইল! যে সময় বিপিন ভ্রাতার বাড়ীতে গমন করিলেন, সেই সময় রজনীকান্ত বাড়ীতে ছিলেন না, কার্য্যবশতঃ স্থানান্তরে গমন করিয়াছিলেন। অশিক্ষিতা রাজকুমারী অতীব যত্নের সহিত আপন বাড়ীতে বিপিনের স্থান করিয়া দিলেন। বিপিন সেইস্থানে অবস্থান পূর্ব্বক আপনার শিক্ষিতা বনিতার অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। 

এইরূপে প্রায় এক মাসাধিক কাল অতীত হইয়া গেল, কিন্তু বিপিন তাঁহার শিক্ষিতা বনিতা মানিনীর কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিলেন না। অথচ তাঁহার আশাকে হৃদয় হইতে একবারে দূরীভূত করিতে পারিলেন না। বিপিনের দৃঢ়বিশ্বাস ছিল যে, মানিনী প্রাণের সহিত তাঁহাকে ভাল বাসেন, সুতরাং অবিশ্বাসিনীর কার্য্য তাঁহার দ্বারা কখনই হইতে পারে না। তাই মনে করিলেন যে, কোনরূপ বিপদে পতিতা হইয়া মানিনী তাঁহাকে কোনরূপ সংবাদ প্রদান করিতে সমর্থ হইতেছেন না। অনুসন্ধান করিলে নিশ্চয়ই তাঁহার কোন না কোন সন্ধান প্রাপ্ত হওয়া যাইবে। এদিকে ডাক্তারবাবু— যিনি আপন দেশে গমন করিতেছেন বলিয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়াছিলেন, তিনিও এ পর্যন্ত প্রত্যাগমন করিলেন না, বা তাঁহার কোনরূপ সংবাদও পাওয়া গেল না। সেই অবস্থা দেখিয়া বিপিনের মনে ইহাও একবার উদয় হইল, “হয় ত দুরবস্থায় পড়িয়া মানিনী ডাক্তারবাবুর সহিত তাঁহার দেশে গমন করিয়াছেন। কিন্তু কোনরূপ সুযোগ না পাওয়ায় প্রত্যাগমন করিতে পারিতেছেন না, এবং আমার বর্তমান ঠিকানা জানিতে না পারায় পত্রাদিও লিখিতে পারিতেছেন না। ডাক্তারবাবু যে সময় এই স্থানে আগমন করিবেন, সেই সময় মানিনী তাঁহার সহিত নিশ্চয়ই আগমন করিবেন।” 

এইরূপ নানাপ্রকার ভাবনা ভাবিতে ভাবিতে বিপিন ক্রমে দিনযাপন করিতে লাগিলেন। দেনা পরিশোধ বা কোনরূপ কাজ-কর্ম্মের কোন চেষ্টাই করিলেন না। তাঁহার নিজে খরচ পত্র এখন রজনীকান্তের উপরে পতিত হইল। 

এইরূপে আরও কিছুদিবস অতীত হইয়া গেল, একদিবস জনিতে পারিলেন যে, ডাক্তারবাবু তাঁহার দেশ হইতে প্রত্যাগমন করিয়াছেন। এই সংবাদ পাইবামাত্র দ্রুতগতি তাঁহার বাড়ীতে গমন করিলেন। ইচ্ছা সেইস্থানে গমন করিবামাত্রই মানিনীর সহিত সাক্ষাৎ হইবে। 

বিপিন মনে যাহা ভাবিয়াছিলেন, ডাক্তারবাবুর নিকট গিয়া তাহার বিপরীত অবস্থা অবগত হইলেন। জানিতে পারিলেন যে, মানিনী ডাক্তারবাবুর সহিত গমন করেন না, বা তিনি কোথায় আছেন, তাহাও ডাক্তারবাবু অবগত নহেন। যে দিবস বিপিন জেলে গিয়াছিলেন, সেইদিবস হইতে মানিনীকে ডাক্তারবাবু দেখেন নাই, বা তাঁহার কোনরূপ সংবাদ অবগত হয়েন নাই। 

বিপিনের নিকট হইতে মানিনীর বিষয় কিছুমাত্র অবগত হইতে না পারিয়া ডাক্তারবাবু বিপিনের তখনকার দুঃখে বিশেষরূপ সহানুভূতি দেখাইয়া দুঃখ প্রকাশ করিতে লাগিলেন, এবং তন্ন তন্ন করিয়া মানিনীকে অনুসন্ধান করিবেন বলিয়া বিপিনের নিকট প্রতিশ্রুত হইলেন। 

এইরূপে আরও কিছুদিবস অতীত হইয়া গেল। একদিবস সন্ধ্যার সময় বিপিন রাস্তা দিয়া গমন করিতেছেন, এরূপ সময় একখানি দ্বিতীয় শ্রেণী ঘোড়ার গাড়ীর প্রতি তাঁহার নয়ন আকৃষ্ট হইল। তিনি দেখিলেন যে, সেই গাড়ীর ভিতর দুইজন বসিয়া রহিয়াছেন, তাহার মধ্যে একজন পুরুষ ও অপরটি স্ত্রীলোক। এই স্ত্রীলোকটিকে হঠাৎ দেখিয়া মানিনীর মত অনুমান হইল, এবং পুরুষটিকে ডাক্তারবাবু বলিয়া বিবেচনা হইল। এই ব্যাপার দেখিয়া তিনি আরও উত্তমরূপে দেখিবার নিমিত্ত সেই দিকে যেমন লক্ষ্য করিবেন, অমনি গাড়ীর ঝিলমিল গাড়ীর ভিতর হইতে উঠাইয়া দেওয়া হইল, ও গাড়ী আরও দ্রুতবেগে চলিয়া গেল। 

যে দিবস বিপিন এই ঘটনা দেখিলেন, সেই দিবসই গিয়া তিনি ডাক্তারবাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন, এবং যাহা দেখিয়াছিলেন, তাহাও তাঁহার নিকট প্রকাশ করিয়া বলিলেন। উত্তরে ডাক্তারবাবু সে সমস্ত কথা অস্বীকার করিলেন ও কহিলেন যে, সেই দিবস সন্ধ্যার সময় তিনি কোন গাড়ীতে কোনস্থানে গমন করেন নাই। 

ডাক্তারবাবুর কথা এবার বিপিন বিশ্বাস করিলেন। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবিলেন যে, যাহাকে আমি মানিনীর সহিত একত্র একগাড়ীর ভিতর দেখিয়াছি, তাহার কথা আমি কিরূপে বিশ্বাস করিতে পারি? আবার ভাবিলেন, ডাক্তারবাবু, আমার ও মানিনীর পরম বন্ধু, তাঁহাকেই বা অবিশ্বাস করি কি প্রকারে? 

এইরূপ নানাপ্রকার ভাবনা চিন্তার পর বিপিন বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিলেন; কিন্তু তাঁহার মনের গোলযোগ মিটিল না; তথাপি নানাস্থানে তিনি মানিনীর অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন, কিন্তু কোনস্থানেই তাঁহার সন্ধান পাইলেন না। 

একদিবস সন্ধ্যার পূর্ব্বে বিপিন মনে করিলেন, সমস্ত কার্য্য পরিত্যাগ করিয়া রাত্রি দিন মানিনীর অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে বেড়াইতে ক্রমেই শরীর দুর্ব্বল ও মন অস্থির হইয়া পড়িতেছে; আজ ময়দানে গমন করিয়া কিয়ৎক্ষণ পরিষ্কার বায়ু সেবন করিয়া দেখি, তাহাতেই যদি মনের অবস্থার কিছু পরিবর্তন হয়। 

এই ভাবিয়া বিপিন ধীরে ধীরে পদব্রজে ক্রমে গড়ের মাঠে গিয়া উপনীত হইলেন, এবং ক্রমে ক্রমে ইডেন উদ্যানের নিকট গমন করিলেন। যে সময় তিনি ইডেন উদ্যানে গিয়া উপস্থিত হইলেন, সেই সময় সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। উদ্যানের ভিতর কেল্লার গোরাগণ সমবেত হইয়া ব্যাণ্ড বাজাইয়া সমাগত ব্যক্তিগণের আনন্দ উৎপাদন করিতেছে। যাঁহারা গাড়ী করিয়া সন্ধ্যার সময় বায়ুসেবনে বহির্গত হইয়াছিলেন তাঁহাদিগের গাড়ী সমূহ উদ্যানের পশ্চিম পার্শ্বে সমবেত হইয়াছে। তাঁহারা গাড়ীর ভিতর উপবেশন করিয়াই মনোহর বাদ্য শ্রবণ করিতেছেন। 

কিয়ৎক্ষণ উদ্যানের ভিতর ভ্রমণ করিবার পর আর তাহা বিপিনের ভাল লাগিল না, তিনি উদ্যানের পশ্চিম দ্বার দিয়া বহির্গত হইয়া যে স্থানে গাড়ী সকল দণ্ডায়মান ছিল, সেই স্থান দিয়া গমন করিতে লাগিলেন। কিয়দ্দূর গমন করিবার পর একখানি দ্বিতীয় শ্রেণীর গাড়ীর প্রতি তাঁহার নয়ন আকৃষ্ট হইল। তাঁহার বেশ বোধ হইল যে, সেই গাড়ীর ভিতর প্রাণের শিক্ষিতা মানিনী এবং পরম বন্ধু ডাক্তারবাবু বসিয়া আছেন। এই ব্যাপার দেখিয়া তাঁহার মনের গতি যে কি হইল, তাহা পাঠকগণ সহজে অনুমান করিয়া লউন। বিপিন আস্তে আস্তে গাড়ীর নিকট গমন করিলেন। তাঁহাকে দেখিবামাত্রই ডাক্তারবাবু বিশেষরূপ লজ্জিত হইলেন ও কহিলেন, “কে, বিপিন! তুমি কোথা হইতে এখানে আগমন করিলে? তোমার সহিত সাক্ষাৎ হইবার পর হইতেই আমি সমধিক যত্ন ও পরিশ্রম করিয়া মানিনীর অনুসন্ধান করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলাম; কিন্তু এতদিবস কোনরূপে ইঁহার কোনরূপ সন্ধান পাই নাই। আজ আমি একজন রোগীকে দেখিবার নিমিত্ত গমন করিয়াছিলাম। সেইস্থান হইতে প্রত্যাগমন করিবার সময় পথিমধ্যে মানিনীর সহিত সাক্ষাৎ হইল। এতদিবস পর্য্যন্ত ইনি কোথায় ছিলেন, জানিবার নিমিত্ত আমার মনে বিশেষরূপ কৌতূহল জন্মিল। আমি ইঁহার গাড়ী দাঁড় করাইয়া সেই গাড়ীতেই উঠিলাম, এবং ইঁহার সহিত কথা বলিতে বলিতে ক্রমে এইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি।” 

অনেক দিবস পরে মানিনীকে দর্শন করিয়া বিপিনের মনের গতি যেরূপ হইয়াছিল, তাহাতে উক্ত ডাক্তারবাবু যাহা কহিলেন, তাহা তিনি শুনিতে পাইলেন, কি না, এবং যদি শুনিতেও পাইলেন তাহা হইলে তাহার অর্থ সংগ্রহ করিতে পারিলেন কি না, জানি না। কিন্তু সকলে দেখিলেন যে, মানিনীকে দর্শন করিবার পর বিপিনের মুখ হইতে একটি কথাও বহির্গত হইল না, তিনি গাড়ী ধরিয়া কিয়ৎক্ষণ স্থিরমনে দণ্ডায়মান রহিলেন। আর ডাক্তারবাবু পূর্ব্ববর্ণিত কথাগুলি বর্ণন করিতে লাগিলেন। 

এইরূপে কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হইলে বিপিন কহিলেন, “মানিনী! তুমি এতদিবস কোথায় ছিলে? তোমার তাদর্শনে ও তোমার পত্রাদি না পাইয়া আমি যে কিরূপ কষ্ট ভোগ করিয়া আসিতেছি, তাহা আর তোমাকে কি বলিব মানিনী! তোমার নিমিত্ত আমাকে সৰ্ব্ব কৰ্ম্ম পরিত্যাগ করিতে হইয়াছে, এবং এ পর্যন্ত কোন কৰ্ম্ম না করিয়া নানাস্থানে কেবল তোমারই অনুসন্ধান করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছি, তুমি ভাল ছিলে ত?” 

উত্তরে মানিনী কহিল, “মানিনীর নাম মুখে আনিতে তোর লজ্জা করিতেছে না। রাত্রি দিন কেবল তারই অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে তুই একটু কুণ্ঠিত হইতেছিস না। যাহাকে একমুষ্টি অন্ন দিবার সংস্থান তোর নাই, যাহার একসুট পোষাক খরিদ করিয়া দিতে তুই অসমর্থ, তাহাকে স্ত্রী বলিতে ও তাহার অনুসন্ধান করিতে তোর একটু লজ্জাও হইতেছে না? আমি ভদ্রলোকের কন্যা ও শিক্ষিতা, তাই বিশেষরূপ কষ্ট ভোগ করিয়াও কিছুদিবস তোর অনুগত হইয়াছিলাম। কোন অশিক্ষিতা স্ত্রীলোক হইলে দেখতিস, তিন দিবসের মধ্যে তোকে পরিত্যাগ করিয়া কোথায় চলিয়া যাইত। কিন্তু আমি ততদূর করি নাই, আমার ধর্ম্ম আমি রাখিয়াছি। সবিশেষ কষ্টে পড়িয়াও একাদিক্রমে কয়েক বৎসর তোর সহবাসে কাল কাটাইয়াছি। প্রথম হইতে যদি আমি বুঝিতে পারিতাম যে, আমার খরচ পত্রের সংস্থান করিবার ক্ষমতা তোর নাই, তাহা হইলে এক সময় আমি কখন কি নষ্ট করিতাম? না তোর নিকট থাকিয়া এত কষ্ট অনুভব করিতাম? এখন তোকে বলিতেছি, তুই আমার সম্মুখ হইতে প্রস্থান কর, এবং আমার আশা পরিত্যাগ করিয়া কোন অশিক্ষিতা স্ত্রীলোকের চেষ্টা দেখ।” 

এই বলিয়া গাড়ীর যে পার্শ্বে বিপিন দণ্ডায়মান ছিল, তাহার বিপরীত পার্শ্ব দিয়া আপনার গলা বাহির করিয়া গাড়িবানকে গাড়ী হাঁকাইতে কহিল। আদেশ পাইবামাত্র গাড়িবান বিপিনকে পশ্চাদ্‌পদ হইতে কহিয়া আপনার গাড়ী হাঁকাইয়া দিল। কোনরূপে আপনার পা বাঁচাইয়া বিপিনও গাড়ীর পশ্চাৎ পশ্চাৎ “একটু দাঁড়াও একটু দাঁড়াও” বলিতে বলিতে গমন করিতে লাগিলেন; কিন্তু মানিনী গাড়ীর ভিতর হইতে কহিতে লাগিলেন, “জোরসে হাঁকাও।” কাজেই গাড়ী দ্রুতগতি চলিতে লাগিল। অনন্যোপায় হইয়া বিপিন ক্ষান্ত হইলেন; কিন্তু বহুদূর পর্য্যন্ত তিনি সেই গাড়ীর উপর লক্ষ্য করিয়া রহিলেন। গাড়ী ক্রমে অদৃশ্য হইয়া গেল। যে সময় বিপিন একদৃষ্টে গাড়ীর দিকে চাহিয়াছিলেন, সেই সময় সেই ভাড়াটিয়া গাড়ীর পশ্চাৎ সংবদ্ধ নম্বরের উপর তাঁহার দৃষ্টি পড়িয়াছিল। তিনি দেখিলেন, সেই গাড়ীর নম্বর ২৫৯। 

বিপিনের উপর মানিনী যদিও এইরূপ কঠোর বাক্য প্রয়োগ করিয়া চলিয়া গিয়াছিল, তথাপি বিপিন তাহার উপর একবারে অসন্তুষ্ট হইলেন না। ভাবিলেন, মানিনী নিতান্ত কষ্টে পড়িয়াছে বলিয়াই, তাঁহার মুখ হইতে ঐরূপ কঠোর বাক্য নির্গত হইল। উহা মুখের বাক্য মাত্র— অন্তরের নহে। 

আরও ভাবিলেন যে, যখন ডাক্তারবাবু মানিনীর গাড়ীতে আছেন, তখন আর ভাবনা কিসের? আমাকে এইরূপ ভয় প্রদর্শন করিয়া, সে হয়—আমার বাটীতেই গমন করিল, না হয়— এতক্ষণ ডাক্তারবাবুর বাসায় গিয়া উপস্থিত হইল। 

সেইস্থানে গমন করিলে নিশ্চয় তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইবে তখন জানিতে পারিব, এতদিবস পর্য্যন্ত তিনি কোথায় ছিলেন, এবং কিরূপ কষ্টে তিনি তাঁহার দিন অতিবাহিত করিয়াছেন। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া বিপিন সেইস্থান হইতে দ্রুতপদে চলিতে লাগিলেন; কিন্তু তাহাতেও তিনি সন্তুষ্ট না হইয়া, রাস্তা হইতে একখানি গাড়ী ভাড়া করিয়া আপন বাটীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

যে বাটীতে এখন তিনি বাস করিতেন, প্রথমে তিনি সেই বাটীতে উপস্থিত হইলেন। বাটীতে গমন করিয়া সম্মুখে রাজকিশোরীকে দেখিতে পাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মানিনী আসিয়াছে কি?” 

উত্তরে রাজকিশোরী বলিলেন, “না। কেন, তাহার কোনরূপ সন্ধান পাইয়াছ কি?” 

বিপিন রাজকিশোরীর এই কথার উত্তর প্রদানে আর সময় পাইলেন না; যে গাড়ীতে করিয়া তিনি আসিয়াছিলেন, সেই গাড়ীর গাড়িবানকে দ্রুতগতি ডাক্তারবাবুর বাটীতে গমন করিতে কহিলেন। 

আদেশ প্রতিপালিত হইল। কিন্তু ডাক্তারবাবুর বাটীতে গিয়া জানিতে পারিলেন যে, ডাক্তারবাবু তখনও প্রত্যাগমন করেন না। সুতরাং তাঁহার অপেক্ষায় বিপিন সেইস্থানেই বসিয়া রহিলেন। বলা বাহুল্য, এই গাড়ীভাড়া প্রদানের ভার, পরিশেষে রজনীকান্ত বা রাজকিশোরীর উপর অর্পিত হইয়াছিল। 

যে সময় বিপিন ডাক্তারবাবুর বাটীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন, সেই সময় রাত্রি আটটার অধিক হয় নাই। সুতরাং ডাক্তারবাবুর প্রত্যাশায় তিনি তখন সেইস্থানেই অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। 

নয়টা বাজিয়া গেল, ডাক্তারবাবু প্রত্যাগমন করিলেন না; তথাপি বিপিন নিতান্ত চিন্তিত অন্তঃকরণে সেইস্থানে বসিয়া রহিলেন। ক্রমে দশটা, এগারটা, বারটা বাজিয়া গেল, তথাপি ডাক্তারবাবুর সাক্ষাৎ নাই। বিনা আহারে সেইস্থানে বসিয়া বিপিন রাত্রি অতিবাহিত করিতে লাগিলেন, এবং মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন, এত রাত্রিতেও যখন ডাক্তারবাবু বা মানিনী প্রত্যাগমন করিলেন না, তখন কি তাঁহারা আর কোন স্থানে গমন করিয়াছেন? মানিনীর এমন বন্ধু আর কে আছেন যে, এই অসময়ে তিনি মানিনীকে স্থান প্রদান করিবেন? 

এইরূপে ক্রমে রাত্রি দুইটা বাজিয়া গেল। দুইটার পর ডাক্তারবাবু একখানি গাড়ী ভাড়া করিয়া আপন বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মানিনীর সহিত যে গাড়ীতে ডাক্তারবাবুকে বিপিন পূর্ব্বে দেখিয়াছিলেন, বৰ্ত্তমান গাড়ী সেই গাড়ী নহে। উহার নম্বর ৩২৬১। 

ডাক্তারবাবু গাড়ী হইতে অবতরণ করিবার সময় সম্মুখেই বিপিনকে দেখিতে পাইলেন। বিপিনকে দেখিবামাত্র তাঁহার মনে এক অপূর্ব্ব ভাবের উদয় হইল। কিন্তু তিনি তাঁহার মনের ভাব গোপন করিয়া কহিলেন, “ কি হে বিপিন! এত রাত পর্য্যন্ত এইস্থানে বসিয়া আমার অপেক্ষা করিতেছ নাকি? একটি রোগীকে লইয়া আমি অত্যন্ত ব্যস্ত ছিলাম বলিয়া, বাসায় আসিতে আমার এতরাত্রি হইয়া গিয়াছে। কি সংবাদ? সমস্ত মঙ্গল?” 

বিপিন। সংবাদ আপনার কাছে। আপনি প্রত্যাগমন করিলেন, কিন্তু মানিনীকে কোথায় রাখিয়া আসিলেন? তাঁহারই সংবাদ জানিবার নিমিত্ত রাত্রি আটটা হইতে এ পর্যন্ত আমি আপনার এখানে বসিয়া আছি। আপনি কোথায় তাঁহাকে ছাড়িয়া আসিলেন, কোথায় গেলে এখন তাঁহার সহিত আমার সাক্ষাৎ হইবে? আমি যে এখন আমার ভ্রাতার সহিত এক বাটীতে বাস করিতেছি, এ কথা তাঁহাকে বলেন নাই কি? 

ডাক্তার। আমি তাঁহাকে কোন কথাই বলি নাই। তাঁহার সহিত আমার দেখা হইবার পরই তুমি আসিয়া উপস্থিত হও; সুতরাং আমি তাঁহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবার অবসর পাই নাই। বিশেষতঃ তোমার উপর তিনি যেরূপ ব্যবহার করিলেন, তাহাতে আমার কোন কথা জানিবার ইচ্ছা হইল না। আর তাঁহাকে কোন কথা বলিবার পূর্ব্বেই সে গাড়িবানকে গাড়ী হাঁকাইতে কহিল; সুতরাং কোন কথা বলিতেও পারিলাম না, অথচ গাড়ী হইতে অবতরণ করিতেও সমর্থ হইলাম না। গাড়ী কিয়দ্দূর গমন করিলে যখন দেখিলাম, গাড়ীর গতি ক্রমে কমিয়া আসিয়াছে, তখন আমি গাড়িবানকে কহিলাম, “গাড়ী থামাও।” গাড়ী থামিল। আমি তাঁহাকে আর কোন কথা না বলিয়া, গাড়ী হইতে অবতরণ করিলাম। গাড়ী পুনরায় চলিয়া গেল। কোথায় গেল, তাহা বলিতে পারি না। দেখিলাম, আমার সহিত তাঁহার এতদিবসের বন্ধুত্ব তিনি ভুলিয়া গিয়াছেন। আমি গাড়ী হইতে অবতরণ করিবার পর, তিনি একবার আমার দিকে দৃষ্টিপাতও করিলেন না, অবলীলাক্রমে চলিয়া গেলেন। 

ডাক্তারবাবুর কথা শ্রবণ করিয়া বিপিন আরও বিস্মিত হইলেন, এবং পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে কি আমার মানিনী কোন্ স্থানে গমন করিয়াছে, তাহা আপনি অবগত নহেন?” 

ডাক্তারবাবু কহিলেন, “না, তাহার কিছুই আমি অবগত নহি।” 

বিপিন সেইস্থানে বসিয়া পড়িলেন। ডাক্তারবাবু বিপিনকে সেইরূপ অবস্থায় সেই স্থানে পরিত্যাগ করিয়া, আপনার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন। 

এইরূপ অচেতন অবস্থায় কিয়ৎক্ষণ সেইস্থানে উপবেশন করিয়া বিপিন পরিশেষে নিতান্ত দুঃখিত অন্তঃকরণে আপন বাসা অভিমুখে গমন করিলেন। 

রাত্রির অবশিষ্টাংশ মানিনীর চিন্তাতেই বিপিন অতিবাহিত করিলেন। যে ভাবনা তাঁহার অন্তঃকরণ হইতে সময়ের গতিক্রমে অনেক কমিয়া আসিয়াছিল, পুনরায় সেই চিন্তা সবেগে তাঁহার হৃদয়ে প্রবেশ করিল। কিন্তু আপনার মনের কথা রজনীকান্ত বা রাজকিশোরীকে বলিতে পারিলেন না। তাঁহার অবস্থা দেখিয়া বরং রাজকিশোরী দুই একবার জিজ্ঞাসা করিলেন, কিন্তু বিপিন তাঁহার কথায় কোনরূপ উত্তর প্রদান করিতে পারিলেন না। বিপিনের একজন বাল্যবন্ধু ছিল। পরদিবস প্রাতঃকালে তাঁহার নিকট গমন করিয়া আপনার মনের সমস্ত কথা ব্যক্ত করিলেন। বন্ধু তাঁহার কথায় নিতান্ত দুঃখিত হইলেন। কিন্তু মানিনীকে সন্ধান করিবার তাপর কোন উপায় দেখিতে না পাইয়া পূর্ব্বকথিত ২৫৯ নম্বরের গাড়ীর অনুসন্ধানে বহির্গত হইলেন, এবং সমস্ত দিবস অনেক পরিশ্রম করিয়া রাত্রি প্রায় দশটার পর সেই গাড়িবানের সহিত তাঁহাদিগের সাক্ষাৎ লইল। পূর্ব্বদিবস ইডেন উদ্যানের নিকট মানিনী বিপিনের সহিত যেরূপ ব্যবহার করিয়াছিল, তাহা গাড়িবানকে স্মরণ করাইয়া দেওয়ার পর সে কহিল, “যে স্থান হইতে আমি সেই স্ত্রীলোকটি ও পুরুষটিকে আনয়ন করিয়াছিলাম, এবং পরিশেষে তাঁহাদিগকে যে স্থানে রাখিয়া আসিয়াছি, তাহার ঠিক ঠিকানা আমি এইস্থান হইতে বলিয়া দিতে পারি না, তবে আমি দেখাইয়া দিতে পারি।” 

গাড়িবানের এই কথা শুনিয়া বিপিন ও তাঁহার বন্ধু তাহারই গাড়ী ভাড়া করিয়া তাহার ভিতর গিয়া উপবেশন করিলেন। গাড়িবান তাঁহাদিগকে লইয়া, যে বাড়ীতে মানিনীকে রাখিয়া আসিয়াছিল, সেই বাড়ীর সম্মুখে গিয়া উপনীত হইল ও কহিল, “এই বাড়ীতে তাঁহারা গমন করিয়াছিলেন।” গাড়িবানের কথা শুনিয়া বিপিন ও তাঁহার 

বন্ধু সেই গাড়ী হইতে অবতরণ করিয়া আস্তে আস্তে সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন। বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, উহা বেশ্যালয়; উক্ত বাড়ীতে অনেকগুলি বেশ্যা বাস করিয়া থাকে। বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার সময় সম্মুখেই একটি স্ত্রীলোকের সহিত তাঁহাদিগের সাক্ষাৎ হইল। মানিনীর কথা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে সে কহিল, “তিন তালায় গমন করুন, সেইস্থানে তাহাকে দেখিতে পাইবেন।” 

এই স্ত্রীলোকটির কথা শ্রবণ করিয়া তাঁহারা উভয়েই একবারে তিন তলায় গমন করিলেন। সেই তিন তলায় কেবলমাত্র দুইখানি মাত্র ঘর ছিল। তাহার একখানিতে প্রবেশ করিয়া তাঁহারা দেখিলেন, মানিনী নুতন সাজসজ্জায় সজ্জিতা হইয়া, ডাক্তারবাবু ও আরও কয়েকজন লোকের সহিত একত্র একশয্যায় উপবেশন করিয়া সুরাদেবীর আরাধনায় কায়মনোবাক্যে নিযুক্ত আছে! হাসি-তামাসার মধ্যে একটি একটি গীতও গাইতেছে। 

এই অবস্থা দেখিয়া বিপিন ও তাঁহার বন্ধুর মনের ভাব যে কিরূপ হইল, তাহা আর এই স্থানে বর্ণন করিবার প্রয়োজন নাই। পাঠকগণ আপনাপন মনেই তাহা স্থির করিয়া লইবেন। 

যে সময় তাঁহারা উভয়ে সেইস্থানে প্রবেশ করেন, সেই সময় মানিনী তাহা দেখিতে পাইল। দেখিবামাত্র মানিনী দ্রুতপদে তাঁহাদিগের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল, এবং ভয়ানক চীৎকার স্বরে বলিতে লাগিল, “এই স্থানেও তো’রা আমাকে জ্বালাতন করিতে আসিয়াছিস্? নির্জ্জনে আসিয়াও তো’দের হাত হইতে আমার নিস্তার নাই। ভাল চাস্ ত, এখনই এখান হইতে বাহির হইয়া যা; নতুবা পদাঘাতে এইস্থান হইতে বাহির করিয়া দিব।” 

এই কথা শ্রবণ করিয়াও বিপিন সেইস্থান হইতে তখনই প্রস্থান করিতে যেন একটু ইতস্ততঃ করিতে লাগিলেন। ইচ্ছা— মানিনীকে দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করেন; কিন্তু মানিনীর তাহা সহ্য হইল না। তাঁহার মুখের কথা কাৰ্য্যে পরিণত করিল। লিখিতে লজ্জা হয়, সে প্রকৃতই বিপিনকে পদাঘাত করিল, এবং ভয়ানক চীৎকার করিয়া উঠিল। হঠাৎ পদাঘাতে বিপিন দূরে গিয়া পতিত হইলেন। সেই সময় মানিনীর ঘরে বসিয়া যাহারা আমোদ প্রমোদে ব্যস্ত ছিল, তাহারা বহির্গত হইয়া পদাঘাতে পতিত সেই বিপিন ও তাঁহার বন্ধুকে নির্দয়রূপে প্রহার করিতে করিতে বাটি হইতে বহির্গত করিয়া দিল। মানিনী সেইস্থানে দণ্ডায়মান হইয়া হাসিতে হাসিতে কহিতে লাগিল, “বেটাদের যেমন কৰ্ম্ম তেমনি ফল।” 

এই ঘটনার পর বিপিনকে কেমন কেমন বোধ হইতে লাগিল। তিনি আসিয়া আপনার ঘরে প্রবেশ করিলেন, সে ঘর হইতে আর বাহির হইলেন না। তিনি কোন স্থানে গমন করিতেন না, কোন লোকজনের সহিত সাক্ষাৎ করিতেন না; রাত্রিদিন নির্জ্জনে থাকিতেই ভালবাসিতেন। 

কোন্ সময়ে যে অবস্থায় কিরূপ পরিবর্তন হয়, তাহা কেহই বলিতে পারেন না। এইরূপ কিছুদিবস অতিবাহিত হইবার পর সঙ্গে সঙ্গে রজনীকান্তের অবস্থার পরিবর্তন হইতে লাগিল। বিনাদোষে সাহেব সন্দেহ করিয়া তাঁহাকে চাকরী হইতে জবাব দিল। অনন্যোপায় হইয়া রজনীকান্ত নানাস্থানে ঘুরিয়া চাকরীর যোগাড় করিতে লাগিলেন; কিন্তু এক বৎসরের মধ্যে কোন স্থানেই তিনি কোনরূপ চাকরীর যোগাড় করিয়া উঠিতে পারিলেন না। এত দিবস পর্য্যন্ত তিনি যাহা কিছু সংগ্রহ করিয়াছিলেন, প্রথমতঃ তাহা ব্যয়িত হইয়া গেল। রাজকিশোরী যখন দেখিলেন যে, সঞ্চিত অর্থ সমস্তই ব্যয় হইয়া গেল, তখন এক একখানি করিয়া আপনার গাত্র হইতে অলঙ্কার সকল উন্মোচিত করিয়া তাহা বিক্রয় করিতে লাগিলেন, এবং খরচ যতদূর কম করিবার সম্ভাবনা, তাহা করিয়া নিতান্ত কষ্টের সহিত সংসার চালাইতে লাগিলেন। কিন্তু এত কষ্টে থাকিলেও একদিবসের জন্য তাঁহার মুখে কেহ কখনও কষ্টের চিহ্ন দেখিতে পাইলেন না। সময়ে সময়ে তিনি আপনি না খাইয়া স্বামী ও দেবরের সেবা করিতে লাগিলেন। ইঁহার অবস্থা দেখিয়া, ইঁহার চরিত্র দেখিয়া, ইঁহার স্বামী-ভক্তি দেখিয়া ও সর্ব্বদা ইঁহার মুখে মিষ্ট কথা শুনিয়া সেই সময় বিপিন একদিন আপনার মনের ভাব প্রকাশ করিয়া ফেলিলেন ও কহিলেন, “শিক্ষিতা ও অশিক্ষিতা স্ত্রীলোকের মধ্যে যে কি প্রভেদ, তাহা আমি এখন বুঝিতে পারিতেছি; কিন্তু ইহা যদি পূর্ব্বে বুঝিতে পারিতাম, তাহা হইলে আমার আজ এ দশা ঘটিত না।” 

এইরূপ কষ্টে “একবৎসর কাল অতীত হইতে না হইতেই রজনীকান্তের উপর ঈশ্বর পুনরায় প্রসন্ন হইলেন। পূর্ব্বের চাকরী তাপেক্ষা এবার তাঁহার একটি ভাল চাকরী জুটিল। অতি অল্প দিবসের মধ্যেই তিনি তাঁহার অবস্থার পরিবর্তন করিয়া ফেলিলেন। অলঙ্কার-পত্র প্রভৃতি যে সকল দ্রব্যাদি তাঁহাকে বিক্রয় করিতে হইয়াছিল, অনতিবিলম্বেই তিনি তাহা পুনরায় প্রস্তুত করাইলেন, এবং পূর্ব্বে যাহা কিছু ছিল, এবার তাহা অপেক্ষা অনেক অধিক হইল। ক্রমে নিজে একখানি বাটী খরিদ করিয়া তাহাতে গিয়া বাস করিতে লাগিলেন। বিপিন তাঁহার সঙ্গেই রহিলেন। তিনি মনে করিয়াছিলেন, এবার দেখিয়া শুনিয়া পুনরায় তিনি বিপিনের বিবাহ দিবেন, কিন্তু সে প্রস্তাবে বিপিন কিছুতেই সম্মত হইলেন না। 

এদিকে বেশ্যামহলে মানিনীর নাম জাঁকিয়া উঠিল। তৈজসপত্র, অলঙ্কার, বস্ত্র প্রভৃতি নিত্য নূতন দ্রব্য সকল তাহার ঘরে আসিয়া ঘরের শ্রী সম্পাদন করিতে থাকিল। একখানি বাড়ীও হইল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এইরূপে পাঁচ সাত বৎসর অতীত হইতে না হইতেই পুনরায় সকলে শুনিলেন যে, মানিনীর অবস্থা ক্রমে শোচনীয় হইয়া গিয়াছে। কোন কোন দুষ্ট ব্যক্তি মানিনীকে ফাঁকি দিয়া তাহার বাড়ী ঘর প্রভৃতি আত্মসাৎ করিয়াছে, অলঙ্কারপত্র চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে, দেনার দায়ে তৈজস-পত্র বিক্রয় হইয়া গিয়াছে। 

বিশ্বস্ত বন্ধু ডাক্তারবাবুর উপর ঈশ্বর যে অসন্তুষ্ট হইলেন, তাহা আর বলিতে হইবে না। যে সময় মানিনীর অবস্থার উন্নতি হইয়াছিল সেই সময় ডাক্তারবাবু বিষম রোগে আক্রান্ত হন। তাঁহার শরীরের এক অঙ্গ পতিত হইয়া যায়। কয়েক বৎসরকাল সেই অবস্থায় শয্যাগত থাকিয়া সবিশেষ কষ্ট ও যন্ত্রণা অনুভব করিয়া পরিশেষে ইহজীবন পরিত্যাগ করেন। 

শিক্ষিতা স্ত্রীর ব্যবহার দেখিয়া বিপিনের মন একবারে ভঙ্গ হইয়া গেল। অনেক চেষ্টা করিয়াও কোনরূপে তিনি আপন মনকে অন্য পথে চালিত করিতে পারিলেন না। ক্রমে তাঁহার অঙ্গ সকল শিথিল হইয়া পড়িতে লাগিল এবং পরিশেষে ইহধাম পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলেন। জীবনের শেষ মুহূর্তে তিনি যাহা বলিলেন, তাহা শ্রবণ করিয়া শ্রোতামাত্রেরই চক্ষুতে জল আসিল। মৃত্যুকালে বিপিন বলিয়াছিলেন, “এ দেশে কেহ যেন স্ত্রীকে শিক্ষিতা না করেন, বা শিক্ষিতা স্ত্রীলোকগণকে কহে যেন আপনার হৃদয়ে স্থান প্রদান না করেন। পূর্ব্ব হইতে আমাদিগের যে প্রথা চলিয়া আসিতেছে, বৃদ্ধ ঋষিগণ নিঃস্বার্থভাবে যে প্রকার নীতি-পদ্ধতি প্রচলন করিয়া গিয়াছেন, কেহ যেন তাহার বিপর্যয় না করেন। স্বামী-সেবাই যাঁহাদিগের জীবনের প্রধান কার্য্য, গৃহের আবশ্যকীয় কার্য্যাদি লইয়া যাঁহাদিগের সৰ্ব্বদা ব্যস্ত থাকা আবশ্যক, তাঁহারা তাঁহাদিগের সেই সকল কৰ্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া শিক্ষার প্রভায় অভিমানিনী হইলে, পরিশেষে তাঁহাদিগের যে কিরূপ শোচনীয় দশা হয়, আমার শিক্ষিতা স্ত্রীই তাহার জাজ্জ্বল্যমান প্ৰমাণ। শিক্ষিতার মায়ায় মুগ্ধ হইয়া যাঁহারা শিক্ষিতা স্ত্রীকে আপজ্জু হৃদয়ে স্থাপন করেন, তাঁহাদিগের দশা আমার মত হওয়াই উচিত।” 

মানিনীর নাম যশ, খ্যাতি প্রতিপত্তি, রূপ যৌবন, সমস্তই ফুরাইয়া গিয়াছে, সে অকালে বৃদ্ধত্ব প্রাপ্ত হইয়াছে। আর কেহ তাহার অনুসন্ধান করে না। কেহ তাহাকে ফিরিয়াও দেখে না। সাধিয়া কথা কহিলেও তাহার সঙ্গে কেহ বাক্যালাপ করিতে ভালবাসে না। সুতরাং বাল্যে শিক্ষিতা, যৌবনে গণিকা-প্রধানা মানিনী এখন অতি হেয়, ঘৃণ্য, নগণ্য হইয়া পড়িয়াছে। জীবিত থাকিলেও সে এখন অস্তিত্বহীন হইয়া পড়িয়াছে। কেহ তাহার সন্ধান লয় না, সুতরাং আমরাও এখন তাহার কোন সন্ধান পাইলাম না। 

বিপিন অসময়ে ইহজীবন পরিত্যাগ করিলেন সত্য, কিন্তু রজনীকান্ত ও রাজকিশোরীকে অনেক দিবস বাঁচিতে হইয়াছিল। এখন তাঁহাদিগের অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাজকিশোরীর কষ্টও দূর হইয়াছিল; এখন আর তাঁহাকে স্বহস্তে অন্নাদি পাক করিতে হইত না। এখন একজন পাচিকার উপর সে কার্য্যের ভার পড়িয়াছিল, গৃহ কার্য্যের নিমিত্ত একজন পরিচারিকাও নিযুক্ত হইয়াছিল, তদ্ব্যতীত রজনীকান্তের নিজ কার্য্যের নিমিত্ত একজন পরিচারকও ছিল। 

যে পরিচারিকা সর্ব্বদা গৃহকার্য্যে নিযুক্ত থাকিত, পরিবার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাহার দ্বারা এখন সমস্ত কৰ্ম্ম নির্ব্বাহ হওয়া এক প্রকার কঠিন হইয়া পড়িল। সেই সময় আর একটি চাকরাণীর আবশ্যক হইল। পুরাতন চাকরাণী এই কথা জানিতে পারিয়া, একদিবস কথায় কথায় রাজকিশোরীকে কহিল, “ যে স্থানে আমরা বাস করিয়া থাকি, সেইস্থানে নিতান্ত দরিদ্র একটি স্ত্রীলোক বাস করে। ভিক্ষাই তাহার একমাত্র উপজীবিকা। কিন্তু তাহাও সকল দিবস প্রাপ্ত হয় না বলিয়া প্রায় তাহাকে উপবাস করিয়া দিনযাপন করিতে হয়। যদি কেবলমাত্র আপনি তাহাকে খাইতে দেন, তাহা হইলে সে আপনাদের বাটীতে দাস্যবৃত্তি করিতে প্রস্তুত আছে।” 

পরিচারিকার কথা শুনিয়া রাজকিশোরীর অন্তরে দয়ার উদ্রেক হইল। তিনি তাহাকে আনিবার নিমিত্ত পরিচারিকাকে আদেশ প্রদান করিলেন। আদেশ পাইবামাত্র পরিচারিকা একটি জীর্ণ শীর্ণ ও ছিন্নবস্ত্রপরিহিত স্ত্রীলোককে আনিয়া উপস্থিত করিল। ইহার অবস্থা দেখিযা রাজকিশোরীর হৃদয়ে দয়ার উদ্রেক হইল। সেইদিবস হইতেই তিনি তাহাকে পরিচারিকার কার্য্যে নিযুক্ত করিলেন। 

পাঠক মহাশয়! এই দাসী-বেশিনী বামাকে চিনিতে পারিয়াছেন কি? ইনিই আমাদিগের পূর্ব্ব-পরিচিতা সেই শিক্ষিতা রমণী মানিনী। মানিনীকে দেখিয়া রজনীকান্ত বা রাজকিশোরী চিনিতে পারিলেন না; কিন্তু মানিনী তাহাদিগকে চিনিতে পারিল। সুতরাং কোন কথা না বলিয়া পেটের দায়ে সেইস্থানেই দাস্যবৃত্তি করিতে লাগিল 

রজনীকান্ত এখন অতুল বিভবশালী এবং দান ধ্যানে সর্ব্বদা নিযুক্ত। অনেক গরিব অসহায় লোক এখন তাঁহার অন্নে প্রতিপালিত। সংসারের পুত্র কন্যা, জামাতা বধূ, পৌত্র দৌহিত্র প্রভৃতিতেও এখন তাঁহার বহু পরিবার; এত পরিবার লইয়াও একসঙ্গে অতীব সুখে তিনি এখন কালাতিপাত করিতেছেন। 

[ভাদ্র, ১৩১৩] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *