বিশ্বাস কারে করি?
(অর্থাৎ আত্মীয় কর্তৃক একটি বালিকার হত্যা-রহস্য ও পুলিসের জুলুম)
প্রথম পরিচ্ছেদ
আজ কয়েক বৎসর অতীত হইল, সহরতলীর কোন থানা হইতে এক দিবস অতি প্রত্যূষে সংবাদ পাইলাম, নবম বৎসর বয়স্কা গিরিবালা নাম্নী একটি বালিকাকে গত দুই দিবস হইতে পাওয়া যাইতেছে না। উহার অঙ্গে প্রায় একশত টাকা মূল্যের অলঙ্কার আছে। এরূপ অবস্থায় সেই বালিকা সম্বন্ধে বিশেষরূপ অনুসন্ধানের আবশ্যক।
এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া আরও কয়েকজন কর্মচারীর সহিত সহরতলীর সেই থানায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। কিরূপ অবস্থায় বালিকাটি নিরুদ্দেশ হইয়াছে, জানিবার নিমিত্ত থানার কর্মচারীগণের অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু কাহাকেও থানায় উপস্থিত পাইলাম না। জানিতে পারিলাম যে, সেই থানার কর্ম্মচারীমাত্রই উক্ত বালিকাটির অনুসন্ধানের নিমিত্ত বাহির হইয়া গিয়াছেন।
থানার কনষ্টেবলগণের মধ্যে যে ব্যক্তি বালিকাটির পিতামাতার বাড়ী জানিত, তাহাকে সঙ্গে লইয়া বালিকার পিতার বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম।
দেখিলাম— সেই স্থানে থানার দুই তিনজন কর্মচারী সেই বালিকার অনুসন্ধানে নিযুক্ত আছেন।
তাঁহাদিগের নিকট হইতে কেবলমাত্র ইহাই অবগত হইতে পারিলাম যে, গত কল্য দিবা বারটার পর আহারাদি করিয়া, বালিকা গিরিবালা খেলা করিতে করিতে বাড়ীর বাহিরে গমন করে। সেই সময় তাহার পায়ে চারগাছি রূপার মল, হাতে একযোড়া সোণার বালা ও কাণে ছয়টি সোণার মাড়ী ছিল। ইহার পর যে কোথায় গেল, তাহা বাড়ীর অপর কেহ বলিতে পারে না।
কর্ম্মচারীগণের নিকট যতদূর অবগত হইতে পারিলাম, তাহাতে মনে কয়েকটি সন্দেহের উদয় হইল।—
১ম। কলিকাতা হইতে সময়ে সময়ে যেরূপ ভাবে বালিকাগণ অপহৃত হইয়া থাকে, এই বালিকাও কি সেইরূপ ভাবে অপহৃত হইয়াছে? গিরিবালাকে একাকিনী পথে খেলা করিতে দেখিয়া, কোনরূপ প্রলোভনে তাহাকে মুগ্ধা করিয়া, বার-বনিতাগণের নিকট বিক্রয় করিবার অভিলাষে কি কেহ ইহাকে অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে? ইহা একবারে অসম্ভব নহে। কারণ, মধ্যে মধ্যে প্রায়ই এইরূপ দেখিতে পাওয়া যায় যে, কলিকাতা হইতে অপহৃত বালিকাগণকে প্রায়ই দূরদেশে লইয়া গিয়া, অপহরণকারীগণ কোন না কোন চরিত্রহীনার হস্তে বিক্রয় করিয়া আইসে, কখন বা অপহরণ কারীগণের মধ্যে কেহ বালিকার পিতা, কেহ বালিকার ভ্রাতা প্রভৃতি পরিচয় দিয়া বালিকাকে পূৰ্ব্ববঙ্গে লইয়া যায়, ও বালিকার সৌন্দর্য্য ও বয়ঃক্রম অনুসারে ন্যূনাধিক পরিমাণে পণ গ্রহণ করিয়া, সেই বালিকার বিবাহ দিয়া আপনাপন স্থানে প্রত্যাগমন করে। পরে উহাদিগের নিয়মানুযায়ী সেই পণের টাকা আপনাদিগের মধ্যে বণ্টন করিয়া লয়। মফঃস্বল হইতে প্রত্যাগমন করিবার সময় সুযোগমত কোন বালিকাকে দেখিতে পাইলে, তাহাকেও অপহরণ করিয়া আনিতে উহারা পরাস্থ হয় না। সেই সকল বালিকা সহরের বার- বনিতাগণের নিকট বিক্রীত হইয়া থাকে, এবং বয়সের সঙ্গে সঙ্গে উহারাও নীচ ব্যবসা অবলম্বন করিয়া, আপনাপন চরিত্র কলুষিত ও অপরের মহা-পাপের প্রশস্ত পথ পরিষ্কার করিয়া দেয়।
২য়। মূল্যবান অলঙ্কারের সহিত কোন বালক বালিকাকে একাকী দেখিতে পাইলে, সময়ে সময়ে দুরাচারগণ উহাকে কোন না কোনরূপ প্রলোভনে মুগ্ধ করিয়া, অপহরণ করিয়া লইয়া যায় সত্য; কিন্তু কোন দূরবর্তী বাগানে বা নির্জ্জন স্থানে লইয়া গিয়া, উহাদিগের অলঙ্কারগুলি অপহরণ করিয়া লয়। পরে সেই স্থানেই অপহৃত বালক বালিকাগণকে পরিত্যাগ করিয়া উহারা প্রস্থান করিয়া থাকে। এরূপ অবস্থায় অলঙ্কারগুলি অপহৃত হয় মাত্র; কিন্তু উহাদিগের জীবনের উপর কোনরূপ হস্তার্পণ করা হয় না। অনুসন্ধানে অপহৃত বালক বালিকাগণকে প্রায়ই পাওয়া গিয়া থাকে। যদি এইরূপ ভাবেই গিরিবালা অপহৃত হইয়া থাকে, তাহা হইলে এ পর্য্যন্ত তাহাকে পাওয়াই বা না যাইতেছে কেন?
৩য়। সময়ে সময়ে মূল্যবান্ অলঙ্কার পরিহিত বালক বালিকাগণকে একাকী দেখিতে পাইলে, দস্যুগণ কোনরূপ ছল অবলম্বন করিয়া স্থানান্তরে লইয়া গিয়া, যদি সহজে তাহাদিগের অলঙ্কারগুলি অপহরণ করিতে না পারে, তাহা হইলে আবশ্যক বিবেচনায় সময়ে সময়ে উহারা তাহাদিগকে হত্যা করিয়া, তাহাদিগের অলঙ্কারগুলি অপহরণ করিতে পরাঙ্মুখ হয় না। এইরূপ উপায়ে অলঙ্কারগুলি অপহৃত হইলে কোন উদ্যান, জঙ্গল, পুষ্করিণী, বা কোন নিভৃত স্থানে সেই মৃতদেহ পরিত্যাগ করিয়া প্রস্থান করিয়া থাকে। এইরূপ প্রকৃতির কোন দস্যুর হস্তে কি গিরিবালা পরিশেষে পতিত হইল?
৪র্থ। কখন কখন এরূপও দেখিতে পাওয়া গিয়াছে, যে, বালক বালিকার বিশেষরূপ পরিচিত লোকও সময় সময় লোভ সম্বরণ করিতে না পারিয়া, মূল্যবান অলঙ্কার প্রাপ্তির আশায় উহাদিগকে অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়া, তাহাদিগের অঙ্গ হইতে সমস্ত অলঙ্কার উন্মোচিত করিয়া লইয়াছে। কিন্তু পরিশেষে সেই বালক বালিকার নির্দ্দেশ মত ধৃত হইবার সম্ভাবনা বিবেচনা করিয়া, অনিচ্ছা থাকিলেও তাহাদিগকে হত্যা করিয়া কোনরূপ নিভৃত স্থানে মৃতদেহ লুক্কায়িত করিয়া রাখিয়াছে। এইরূপ অবস্থাতেও যদি গিরিবালা হত হইয়া থাকে, তাহা হইলে বালিকার মৃতদেহও এ পর্যন্ত কোন স্থানে না কোন স্থানে পাওয়া যাইত; কিন্তু কই, এরূপ মৃতদেহ যে কোন স্থানে প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে, তাহার সংবাদ এ পর্য্যন্ত কেহই অবগত হইতে পারেন নাই।
মনে এইরূপ প্রকারের নানারূপ চিন্তা আসিয়া উপস্থিত হইল সত্য; কিন্তু কোন্ পন্থা অবলম্বন করিয়া যে এই অনুসন্ধানে লিপ্ত হইব, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। একবার ভাবিলাম, — নিকটবর্তী জঙ্গল, পুষ্করিণী প্রভৃতি অনুসন্ধান করিয়া দেখি, যদি উহার মধ্য হইতেই গিরিবালার মৃতদেহ বাহির হইয়া পড়ে। আবার মনে হইল, বালিকাটি কোনদিকে গমন করিয়াছে, তাহা পূর্ব্বে অবগত হইতে না পারিলে, চতুষ্পার্শ্বের বহুদূর পৰ্য্যন্ত অবস্থিত বাগান, জঙ্গল ও পুষ্করিণী প্রভৃতির অনুসন্ধান নিতান্ত সহজ ব্যপার বা অল্প ব্যয়-সাধ্য নহে।
আবার ভাবিলাম,, — যে সকল ব্যক্তিকে বালক বালিকা অপহরণ করিয়া দূরদেশে লইয়া গিয়া, বিক্রয় করিয়া আইসে বলিয়া আমরা সন্দেহ করিয়া থাকি, এবং যে সকল ব্যক্তি এইরূপ অপরাধের নিমিত্ত সময়ে সময়ে ধৃতও হইয়াছে, এখন তাহাদিগের মধ্যেই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হওয়া কৰ্ত্তব্য, কি না? সেই সকল ব্যক্তির মধ্যে যদি কেহ এই সময় হঠাৎ সহর পরিত্যাগ করিয়া থাকে, তাহা হইলে তাহাদের সম্বন্ধে বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিলে হয় ত গিরিবালার কোনরূপ অনুসন্ধান হইলেও হইতে পারে।
মনে মনে এইরূপ নানা বিষয় ভাবিতে লাগিলাম। কিন্তু কোন স্থির-সিদ্ধান্ত বিষয়ে আপন মনকে লইয়া যাইতে পারিলাম না।
.
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
যে সময়ে আমি কর্ম্মচারীগণকে নিরুদ্দেশ গিরিবালার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করিতেছিলাম, সেই সময়ে গিরিবালার পিতা সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন।
তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি আমার কোন কথারই উত্তর প্রদান করিতে পারিলেন না। তিনি কেবলমাত্র এই বলিলেন যে, দিবা দশটার সময় আহারাদি করিয়া তিনি আপন কার্য্যে বাহির হইয়া গিয়াছিলেন। সন্ধ্যার সময় আপন কাৰ্য্য হইতে প্রত্যাগমন করিয়া অবগত হইলেন যে, দিবা বারটা হইতে অনুসন্ধান করিয়া গিরিবালাকে প্রাপ্ত হওয়া যাইতেছে না। এই সংবাদ পাইয়া, তাঁহার নিজের যতদূর সাধ্য ততদূর অনুসন্ধান করিলেন। কিন্তু কোনরূপেই গিরিবালার কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত না হইয়া, পরিশেষে থানায় গিয়া সংবাদ প্রদান করিলেন।
গিরিবালার পিতার নিকট হইতে যখন কোনরূপ সংবাদ প্রাপ্ত হইতে পারিলাম না, তখন তাহার মাতাকে দুই চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে মনস্থ করিলাম। কিন্তু তিনি আমাদিগের কথায় কিরূপে উত্তর দিবেন,—আমাদিগের সম্মুখে বাহির হইয়া, আমাদিগের প্রশ্নের উত্তর প্রদান করিবেন, কি অপর কোন স্ত্রীলোককে মধ্যবর্তী করিয়া আমাদিগের প্রশ্নের উত্তর দিবেন, তৎসম্বন্ধে একটু মতান্তর উপস্থিত হইল। পরিশেষে ইহাই সাব্যস্ত হইল যে, আমরা তাঁহাকে যে সকল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিব, দ্বারের অন্তরাল হইতে অপর আর একটি প্রবীণা স্ত্রীলোকের দ্বারা তাহার উত্তর প্রদান করিবেন। যাহা হউক, এইরূপ ভাবে দুই চারিটি প্রশ্নের উত্তর প্রদান করিবার পর, তিনি আর দ্বারের অন্তরালে থাকিতে পারিলেন না; আমাদিগের সম্মুখেই বাহির হইয়া, আমাদিগের প্রশ্নের যথাযথ উত্তর প্রদান করিতে লাগিলেন।
ভদ্রবংশীয়া যুবতী স্ত্রীলোক— যিনি কখনও অন্তঃপুরের বাহিরে পদার্পণ করিয়াছেন বলিয়া অনুমান হয় না, তিনি এইরূপ ভাবে আমাদিগের সম্মুখে বাহির হইয়া আমাদিগের প্রশ্নের যথাযথ উত্তর প্রদান করিলেন; এই কথা পাঠকগণ শ্রবণ করিয়া হয় ত মনে করিতে পারেন যে, ভদ্রবংশীয় গৃহস্থ স্ত্রীলোকের পক্ষে ইহা কখনই সম্ভবপর বলিয়া অনুমান হয় না। কিন্তু যাঁহারা সরলা স্ত্রীলোকগণের অন্তঃকরণ কখনও পরীক্ষা করিয়াছেন, পুত্র-কন্যা- শোক মাতার অন্তঃকরণে কিরূপ দাবানল-ভাবে প্রজ্বলিত হয়, তাহা যিনি অনুমান করিতে পারেন, তিনি কখনই মনে করিবেন না যে, এইরূপ কাৰ্য্য শোক-সন্তপ্তা স্ত্রীলোকের পক্ষে একবারে অসম্ভব।
আমি গিরিবালার মাতাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “গিরিবালার বয়ঃক্রম কত হইবে?”
গিরিবালার মাতা। এই সবে মাত্র সে নবম বৎসরে পড়িয়াছে।
আমি। সে হাবা গোছের মেয়ে, না বেশ চালাক চতুর?
গিরি-মা। না মহাশয়! আমার মেয়ে বোকা নহে, সে বেশ চালাক।
আমি। কোন্ সময়ে সে বাড়ী হইত বহির্গত হইয়া গিয়াছিল?
গিরি-মা। বেলা আন্দাজ দুই প্রহরের সময়
আমি। যখন সে বাহির হইয়া যায়, তখন তাহার অঙ্গে কি কি অলঙ্কার ছিল?
গিরি-মা। তাহার পায়ে চারগাছি রূপার মল, হাতে এক যোড়া সোণার বালা ও কাণে ছয়টি সোণার মাকড়ি ছিল।
আমি। এই কয়েকখানি অলঙ্কার ব্যতীত, গিরিবালার অঙ্গে আর কোন অলঙ্কার ছিল না?
গিরি-মা। না মহাশয়! আর কিছুই ছিল না।
আমি। যে গহনা কয়েকখানি তাহার অঙ্গে ছিল, সেই অলঙ্কার কয়েকখানি সে সর্ব্বদা পরিধান করিত কি?
গিরি-মা। না, যখন তখন এ সকল গহনা তাহার অঙ্গে থাকিত না।
আমি। সর্ব্বদা তাহার অঙ্গে কি কি অলঙ্কার থাকিত?
গিরি-মা। কোন গহনাই থাকিত না।
আমি। যদি সৰ্ব্বদা তাহার অঙ্গে কোনরূপ অলঙ্কার থাকিত না, তাহা হইলে সেই সকল অলঙ্কার তাহার অঙ্গে কিরূপে ছিল বলিতেছেন?
গিরি-মা। আজ কয়েক দিবস হইতে এক স্থানে তাহার বিবাহের কথাবার্তা হইতেছে। কখন যে তাহাকে দেখিতে আসিবে, তাহার স্থিরতা নাই। এই নিমিত্তই সেই গহনা কয়েকখানি তাহাকে পরিতে দেওয়া হইয়াছিল।
আমি। কোথায় তাহার বিবাহের সম্বন্ধ হইতেছে? সেই স্থানে ত তাহাকে কেহ লইয়া যায় নাই?
গিরি-মা। কোথায় বিবাহের সম্বন্ধ হইতেছে, তাহা আমি ঠিক বলিতে পারি না। শুনিয়াছি, হাবড়ার কোন স্থানে তাহার বিবাহের সম্বন্ধ হইতেছে। কিন্তু সেই স্থানে তাহাকে কে লইয়া যাইবে?
আমি। যাঁহারা দেখিতে আসিয়াছিলেন, তাঁহারা লইয়া যাইতে পারেন।
গিরি-মা। গিরিবালাকে দেখিতে আসিবে, কেবলমাত্র এইরূপ কথাবার্তা হইতেছিল; কিন্তু এ পর্যন্ত কেহ দেখিতে আইসে নাই। সুতরাং সেই স্থানে তাহাকে কে লইয়া যাইবে?
আমি। যে দিবস গিরিবালা তাহার গহনাগুলি প্রথম পরিয়াছিল, সেই দিবস হইতেই তাহাকে পাওয়া যাইতেছে না, কি তাহার দুই এক দিবস পূৰ্ব্ব হইতে সে সেই গহনাগুলি পরিতেছে?
গিরি-মা। যে দিবস হইতে গিরিবালাকে পাওয়া যাইতেছে না, তাহার পূর্ব্ব দিবস হইতে অলঙ্কারগুলি গিরিবালার অঙ্গে পরিহিত আছে।
আমি। যে সময় হইতে গিরিবালার কোনরূপ সন্ধান পাওয়া যাইতেছে না, সেই সময় তাহার পরিধানে কিরূপ কাপড় ছিল, তাহা আপনার মনে আছে কি?
গিরি-মা। একখানা লাল কালার ডুরে সাটী তাহার পরিধানে ছিল।
আমি। ঠিক যে সময় সে বাড়ী হইতে বাহির হইয়া যায়, তাহা আপনার ঠিক স্মরণ হয় কি?
গিরি-মা। না, কোন সময় যে সে বাড়ী হইতে বাহির হইয়া গিয়াছে, তাহা আমি ঠিক দেখি নাই।
আমি। আর কেহ দেখিয়াছে কি?
গিরি-মা। না।
আমি। আর কেহ যে দেখে নাই, তাহা আপনি কিরূপে জানিতে পারিলেন?
গিরি-মা। আমি ব্যতীত সেই সময় বাড়ীতে আর কেহই ছিল না। সুতরাং কিরূপ অবস্থায় কখন সে বাড়ী হইতে বাহির হইয়া গিয়াছে, তাহা আর কে দেখিবে?
আমি। আপনি ব্যতীত বাড়ীতে কি আর কেহ থাকেন না?
গিরি-মা। কর্তা বাহির হইয়া গেলে, আমি ও গিরিবালা ব্যতীত বাড়ীতে থাকিবার অপর লোক আর কেহই নাই।
আমি। আপনি তাহাকে শেষ কিরূপ অবস্থায় দেখিয়াছেন, তাহা আপনার মনে হয় কি?
গিরি-মা। আমার যতদূর মনে আছে, তাহাতে আমি এইমাত্র বলিতে পারি যে, গৃহের বারান্দায় আমি তাহাকে ভাত দিয়াছিলাম। সেই স্থানে বসিয়া সে আহার করিল। আহারান্তে হাত মুখ ধুইয়া সে একটি গৃহের ভিতর গমন করিল। মনে করিলাম যে, গৃহে বসিয়া সে খেলা করিবে। আমি সেই সময় সাংসারিক কতকগুলি কার্য্যে ব্যস্ত হইয়া পড়িলাম। সুতরাং তাহার দিকে আর আমার লক্ষ্য রহিল না। প্রায় অর্দ্ধ ঘণ্টা পরে কি একটা কার্য্যের নিমিত্ত তাহাকে আমার আবশ্যক হইল। আমি তাহাকে “গিরি গিরি” বলিয়া ডাকিতে লাগিলাম; কিন্তু তাহার কোন উত্তর না পাইয়া, সে কি করিতেছে, তাহাই দেখিবার নিমিত্ত ক্রোধভরে সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। বস্তুতঃ সেই গৃহের ভিতরে তাহাকে দেখিতে পাইলাম না। তখন বাড়ীর ভিতর তাহার অনুসন্ধান করিলাম, কোন স্থানেই আর তাহাকে দেখিতে পাইলাম না। তখন মনে করিলাম যে, খেলা করিবার নিমিত্ত বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া সে পাড়ার কোন স্থানে গমন করিয়া থাকিবে, সময় মত ফিরিয়া আসিবে। কিন্তু সে আর ফিরিয়া আসিল না। যখন তাহার ফিরিবার সময় অতিবাহিত হইয়া গেল, তখন মনে নানারূপ শঙ্কার উদয় হইতে লাগিল। নানা স্থানে তাহার অনুসন্ধান আরম্ভ করিলাম; কিন্তু কোন স্থানেই আর তাহাকে পাইলাম না। এখন পর্য্যন্ত মা আমার আর প্রত্যাগমন করিল না!
আমি। আপনি বেশ মনে করিয়া দেখুন দেখি, সে কোনও স্থানে বা কাহারও সহিত কোনও স্থানে খেলা করিতে গমন করিবে, এইরূপ ভাবের কোনও কথা সে সেই দিবস কিছু বলিয়াছিল কি?
গিরি-মা। আমার যতদূর মনে হয় তাহাতে সে সেইরূপ কোন কথা বলিয়াছিল বলিয়া আমার মনে হয় না। কিন্তু অন্য দিবসের অপেক্ষা সেই দিন শীঘ্র ভাত দিবার নিমিত্ত বারবার তাগাদা করিয়াছিল।
আমি। সে যেরূপ ভাবে তাগাদা করিয়াছিল, ওরূপ ভাবে তাগাদা সে আর কোন দিন করে নাই?
গিরি-মা। না।
আমি। ইহাতে আপনি তাহাকে জিজ্ঞাসা করেন নাই, আজ ভাতের নিমিত্ত এত তাগাদা করিতেছ কেন?
গিরি-মা। জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম।
আমি। তাহাতে সে কি বলিয়াছিল?
গিরি-মা। তাহাতে সে এইমাত্র বলিয়াছিল, ‘গোবিন্দ দাদা বাদাম পাড়িয়া দিবে বলিয়াছে, খাইয়া তাহার সহিত গমন করিব। ‘
আমি। গোবিন্দ দাদা কে?
গিরি-মা। আমাদিগের বাড়ীর পার্শ্বেই তাহার বাড়ী। গোবিন্দ বড় ভাল ছোকরা, আমার গিরিবালাকে আপনার ভগিনী অপেক্ষা ভালবাসে।
আমি। গিরিবালা গোবিন্দের সহিত বাদাম পাড়িতে গিয়াছিল কি?
গিরি-মা। না।
আমি। আপনি কিরূপে জানিতে পারিলেন যে, গিরি গোবিন্দের সহিত গমন করে নাই?
গিরি-মা। আমি গোবিন্দকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। তাহাতে জানিতে পারিয়াছি যে, সে গোবিন্দের সহিত গমন করে নাই।
আমি। গোবিন্দকে জিজ্ঞাসা করায় সে কি বলিয়াছিল?
গিরি-মা। সে এইমাত্র বলিয়াছিল যে, ‘একটি বালককে বাদাম খাইতে দেখিয়া সে আমাকে বাদাম পাড়িয়া দিতে কহে। আমি প্রথমতঃ তাহার কথায় অসম্মত হই; কিন্তু কিছুতেই যখন তাহার অনুরোধ এড়াইতে না পারি, সেই সময় তাহাকে বলি— আচ্ছা তুই ভাত খাইয়া আয়, তাহার পর আমি বাদাম পাড়িয়া তোকে দিব। আমার এই কথা শুনিয়া গিরিবালা ভাত খাইবার নিমিত্ত তাহার বাড়ীতে গমন করে। আমার এক স্থানে যাইবার প্রয়োজন ছিল, আমিও আমার সেই কার্য্যে বাহির হইয়া যাই। সন্ধ্যার সময় যখন আমি প্রত্যাগমন করি, সেই সময় শুনিতে পাই যে, গিরিবালাকে পাওয়া যাইতেছে না।’
আমি। গোবিন্দের কথায় আপনি বিশ্বাস করিতে পারেন কি?
গিরি-মা। আমার নিজের কথায় আমি অবিশ্বাস করিতে পারি; তথাপি গোবিন্দের কথায় আমি কোনরূপ অবিশ্বাস করিতে পারি না।
আমি। গোবিন্দ কি কার্য্য করে?
গিরি-মা। সে যে কি কার্য্য করে, তাহা আমি ঠিক বলিতে পারি না। কিন্তু শুনিয়াছি, কোন টিনের দোকানে সে চাকরি করিয়া থাকে।
আমি। গোবিন্দের বয়ঃক্রম কত হইবে?
গিরি-মা। অনুমান হয়, তাহার বয়ঃক্রম পঁচিশ বৎসরের কম হইবে না।
আমি। তাহার বিবাহ হইয়াছে?
গিরি-মা। না, তাহার বিবাহ হয় নাই; কিন্তু বিবাহ হইবার কথাবার্তা চলিতেছে।
আমি। তাহার স্বভাব চরিত্র কেমন?
গিরি-মা। খুব ভাল, তাহার বিপক্ষে আমরা কখনও কোন কথা শুনি নাই।
আমি। গোবিন্দ তোমাদিগের বাড়ীতে প্রায়ই আসিয়া থাকে কি?
গিরি-মা। কেবল আসা নহে, সে আমাদিগের বাড়ীতে প্রায় সৰ্ব্বদাই থাকে।
আমি। গিরিবালার সহিত তাহার কিরূপ সম্ভাব?
গিরি-মা। আমার বোধ হয়, আমা অপেক্ষাও সে গিরিবালাকে অধিক স্নেহ করে, ও প্রাণের সহিত ভালবাসে। যদি কোন দিন সে গিরিবালাকে দেখিতে না পায়, সেই দিবস কতবার যে সে গিরিবালার কথা জিজ্ঞাসা করে, তাহা বলা যায় না।
আমি। সে গিরিবালাকে এত ভালবাসে কেন?
গিরি-মা। তাহা আমি বলিতে পারি না।
আমি। গোবিন্দের এ পর্যন্ত বিবাহ হয় নাই; কিন্তু তাহার আর আছে কে? তাহার পিতা এখন পর্যন্ত বৰ্ত্তমান আছে কি?
গিরি-মা। তাহার পিতা নাই। থাকিবার মধ্যে তাহার মাতা ও একটি ভগিনী ভিন্ন যে আর কেহ আছে, তাহা আমার বোধ হয় না।
আমি। উহাদিগের চলাচলের উপায় কি?
গিরি-মা। উপায় আর কিছুই নাই, গোবিন্দের উপার্জ্জনের উপর ভরসা। গোবিন্দ যাহা উপার্জ্জন করে, তাহার দ্বারাই উহারা কষ্টে একরূপ জীবন ধারণ করিয়া থাকে।
আমি। গোবিন্দ জাতিতে কি?
গিরি-মা। জাতিতে উহারা বৈষ্ণব।
আমি। গোবিন্দ এখন কোথায়?
গিরি-মা। সে এখন গিরিবালার অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেছে।
.
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
গিরিবালার মাতার নিকট হইতে পূর্ব্ব অধ্যায় বর্ণিত বিষয় সকল অবগত হইয়া আমি সেই বাড়ী হইতে বহির্গত হইলাম। কিন্তু কোন্ পন্থা অবলম্বন করিয়া এই অনুসন্ধানে অগ্রবর্ত্তী হইব, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না।
দিবা দুই প্রহরের সময় গিরিবালা বাড়ী হইতে গমন করিয়াছে, এরূপ দিবাভাগে গমন করিবার সময় পথের দুই পার্শ্বের দোকানদারগণের মধ্যে কেহ না কেহ, বা রাস্তার কোন না কোন লোক তাহাকে নিশ্চয়ই দেখিতে পারে।
মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া পথের দুই পার্শ্বের দোকানদারদিগকে ও যে সকল লোক সেই স্থান দিয়া গমনাগমন করিতেছে, তাহাদিগের প্রত্যেককেই জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম, গত কল্য দিবা দুই প্রহরের সময় ডুরে কাপড় পরা কোন একটি বালিকাকে কোন দিকে গমন করিতে কেহ দেখিয়াছে, কি না?
আমার কথা শুনিয়া, যাহারা গিরিবালাকে চিনিত, তাহাদিগের মধ্যে সকলেই কহিল— কল্য দিবাভাগে গিরিবালাকে কোন দিকে গমন করিতে তাহারা দেখে নাই। আর যাহারা তাহাকে না চিনে, তাহারও কহিল, ডুরে কাপড় পরা কোন বালিকাকে দিবাভাগে কোন দিকে গমন করিতে তাহারা দেখে নাই।
এইরূপ ভাবে অনেকক্ষণ ধরিয়া পথের অনেকদূর পর্য্যন্ত অনুসন্ধান করিলাম। কিন্তু কাহারও নিকট হইতে কোনরূপ সন্ধান না পাইয়া, ক্ষুণ্ন মনে প্রত্যাগমন করিতেছি, এমন সময় একটি স্ত্রীলোকের সহিত রাস্তার উপর হঠাৎ সাক্ষাৎ হইল। তাহাকেও সেইরূপ ভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম; উত্তরে সে কহিল, “আমি নিজে গিরিবালাকে কখনও দেখি নাই, বা তাহাকে চিনিও না। কিন্তু গিরিবালা নাম্নী একটি বালিকা যে গত কল্য হইতে পাওয়া যাইতেছে না, এ কথা আমি শুনিয়াছি। আরও বোকার মার নিকট হইতে অবগত হইয়াছি যে, সে কল্য দিবা দুই প্রহরের পর গিরিবালাকে কোন দিকে গমন করিতে দেখিয়াছে। সে গিরিবালাকে চিনে।”
আমি। এ কথা তুমি কিরূপে জানিতে পারিলে?
স্ত্রীলোক। বোকার মার নিকট আমি এ কথা শ্রবণ করিয়াছি।
আমি। বোকার মা কে?
স্ত্রীলোক। আমি যে পাড়ায় থাকি, সেও সেই পাড়ায় বাস করিয়া থাকে।
আমি। বোকার মা এখন কোথায় আছে, তাহা তুমি কিছু বলিতে পার কি?
স্ত্রীলোক। সে আর কোথায় যাইবে, সে তাহার বাড়ীতেই আছে।
আমি। তাহার সহিত আমার কিরূপে সাক্ষাৎ হইতে পারে?
স্ত্রীলোক। তাহার সাক্ষাৎ অনায়াসেই হইতে পারে।
আমি। কিরূপে সাক্ষাৎ হইবে? আমি ত তাহার বাড়ী চিনি না।
স্ত্রীলোক। আপনি তাহার বাড়ী চিনেন না; কিন্তু আমি চিনি। আপনি আমার সহিত আগমন করুন, আমি তাহার বাড়ী দেখাইয়া দিব।
আমি। তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে, সে আমার নিকট সকল কথা বলিবে ত?
স্ত্রীলোক। কেন না বলিবে? প্রকৃত কথা বলিতে সে অসম্মত হইবে কেন? আর পূর্ব্বে আমাদিগের নিকট যখন সে বলিয়াছে, তখন সে, সে কথা অস্বীকার করিবেই বা কি প্রকারে?
আমি। তোমাদিগের নিকট বলিয়াছে, তুমি ছাড়া এ কথা আর কেহ শুনিয়াছে কি?
স্ত্রীলোক। শুনিয়াছে বৈকি! পাড়ার অনেকেই এ কথা শুনিয়াছে।
আমি। তবে চল, আমি তোমার সহিত যাইতেছি, তুমি বোকার মাকে দেখাইয়া দেও।
ইহা বলিয়া আমি সেই স্ত্রীলোকটির পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলাম। সে আমার অগ্রে অগ্রে গমন করিয়া, ক্রমে একটি পাড়ার ভিতর গিয়া উপস্থিত হইল। তথায় কয়েকখানি বাড়ী অতিক্রম করিয়া একটি বাড়ীতে প্রবেশপূর্ব্বক কহিল, “বোকার মা বাড়ীতে আছিস।” উত্তরে একটি প্রবীণা স্ত্রীলোক কহিল,—“হাঁ আছি।”
“একবার বাহিরে আয়, তোর সহিত একটি লোক দেখা করিতে আসিয়াছে।”
এই কথা শুনিয়া সেই স্ত্রীলোকটি তাহার ঘরের বাহিরে আসিয়া উপস্থিত হইল। সম্মুখে আমাকে দেখিয়া কহিল, “কি মহাশয়! আপনি কাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহেন?”
আমি। আমি বোকার-মার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহি।
বোকার মা। আমিই বোকার মা। কেন মহাশয়! আমার নিকট আপনার কি প্রয়োজন আছে?
আমি। একটু বিশেষ প্রয়োজন না থাকিলে কি আর আমি আপনার নিকট আসিয়াছি?
বোকার মা। কি প্রয়োজন বলুন।
আমি। আপনি গিরিবালাকে চিনেন কি?
বোকার মা। কোন্ গিরিবালা?
আমি। যে গিরিবালাকে গত কল্য হইতে অনুসন্ধান করিয়া পাওয়া যাইতেছে না।
বোকার মা। তাহাকে চিনি বৈকি। আজ প্রাতেই আমি শুনিয়াছি, তাহাকে পাওয়া যাইতেছে না। সে কিরূপে হারাইয়া গেল মহাশয়?
আমি। কিরূপে হারাইয়া গেল, তাহাই জানিবার নিমিত্ত আমি তোমার নিকট আগমন করিয়াছি।
বোকার মা। সে যে কিরূপে হারাইয়াছে, তাহার কিছু ত আমি অবগত নহি।
আমি। গত কল্য তুমি তাহাকে দেখিয়াছিলে কি?
বোকার মা। হাঁ মহাশয়! আমি তাহাকে দেখিয়াছিলাম।
আমি। কোথায় দেখিয়াছিলে?
বোকার মা। তাহাদিগের বাড়ীর সম্মুখ দিয়া যে রাস্তা আছে, সেই রাস্তার উপর দেখিয়াছিলাম।
আমি। যখন তুমি তাহাকে দেখিয়াছিলে, তখন বেলা কত হইবে?
বোকার মা। বেলা দুই প্রহর অতীত হইয়া গিয়াছিল।
আমি। সেই সময় তুমি সেই রাস্তার উপর কি করিতে গিয়াছিলে?
বোকার মা। আমি বাজার করিয়া সেই সময় সেই রাস্তা দিয়া ফিরিয়া আসিতেছিলাম।
আমি। অত বেলায় বাজার করিয়া আসিতেছিলে?
বোকার মা। আমার গরিব মানুষ, বাজার করিতে আমাদিগের এইরূপ বেলাই হইয়া থাকে।
আমি। যে সময় তুমি তাহাকে দেখিয়াছিলে, সেই সময় সে রাস্তার উপর কি করিতেছিল?
বোকার মা। রাস্তার উপর দিয়া চলিয়া যাইতেছিল।
আমি। সে কোন্ দিকে গমন করিতেছিল?
বোকার মা। রাস্তা বাহিয়া বরাবর পূর্ব্ব দিকে গমন করিতেছিল।
আমি। সেই সময় তাঁহার পরিধানে কিরূপ কাপড় ছিল, মনে করিতে পার কি?
বোকার মা। আমার বোধ হয়, একখানি ডুরে কাপড় তাহার পরিধানে ছিল।
আমি। কি প্রকারের ডুরে কাপড়, লাল, কাল, কি অপর কোন প্রকার?
বোকার মা। তাহা আমার ঠিক মনে হয় না।
আমি। সেই সময় তাহার অঙ্গে কোনরূপ অলঙ্কার-পত্র ছিল কি?
বোকার মা। উহার অঙ্গে কোন অলঙ্কার ছিল কি না, তাহা আমি ঠিক বলিতে পারি না। কারণ, আমি বিশেষ মনোযোগের সহিত উহা দেখি নাই। কিন্তু আমার যেন মনে হয়, উহার পায়ে সে সময় কয়েক গাছি রূপার মল ছিল।
আমি। কয়গাছি মল ছিল বলিয়া অনুমান হয়?
বোকার মা। তাহা আমি ঠিক বলিতে পারি না। তবে চারগাছি মল থাকিবার সম্ভাবনা।
আমি। যে সময় তুমি গিরিবালাকে রাস্তা বাহিয়া পূর্ব্বদিকে গমন করিতে দেখিয়াছিলে, সেই সময় সে একাকিনী যাইতেছিল, কি, তাহার সহিত অপর আর কোন ব্যক্তি ছিল?
বোকার মা। তাহার সহিত অপর কোন লোককে গমন করিতে দেখি নাই। কিন্তু তাহার অনেক অগ্রে অগ্রে গোবিন্দ গমন করিতেছিল।
আমি। গোবিন্দ কে?
বোকার মা। গোবিন্দ বৈষ্ণব।
আমি। সে কোথায় থাকে, জান কি?
বোকার মা। গিরিবালা যে বাড়ীতে থাকে, তাহার সন্নিকটেই তাহার বাড়ী।
আমি। ‘গোবিন্দ! কোথায় গমন করিতেছ’ এ কথা তাহাকে তুমি কিছু জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে কি?
বোকার মা। না মহাশয়! তাহা আমি জিজ্ঞাসা করি নাই। কারণ, আমার জিজ্ঞাসা করিবার কোন প্রয়োজন ছিল না।
আমি। ইহার পূর্ব্বে গিরিবালার সহিত গোবিন্দকে আর কখনও দেখিয়াছ কি?
বোকার মা। অনেকবার দেখিয়াছি। গোবিন্দ গিরিবালাকে খুব ভালবাসে, এবং সর্ব্বদাই প্রায় সঙ্গে করিয়া লইয়া বেড়ায়।
আমি। গিরিবালার অগ্রে অগ্রে গোবিন্দ গমন করিতেছিল, এ কথা কি প্ৰকৃত?
বোকার মা। মিথ্যা বলিবার আর কি প্রয়োজন?
আমি। তুমি যে মিথ্যা বলিতেছ, তাহা আমি বলিতেছি না; কিন্তু ভুল হইতে পারে। হয় ত গোবিন্দের মত অপর কোন ব্যক্তিকে সেই সময় সেই পথ দিয়া গমন করিতে দেখিয়া থাকিবে!
বোকার মা। যে ব্যক্তিকে প্রায় প্রত্যহই দেখিয়া থাকি, তাহাকে চিনিতে কি কখনও ভুল হইয়া থাকে? আমি নিশ্চয় বলিতে পারি, সে অপর কোন ব্যক্তি নহে, গোবিন্দ। কোনরূপেই আমার ভুল হয় নাই।
আমি। তাহা হইলে তোমার বিশ্বাস যে, গোবিন্দই গিরিবালার অগ্রে অগ্রে গমন করিতেছিল?
বোকার মা। বিশ্বাস কেন, আমি নিশ্চয় বলিতে পারি যে, গোবিন্দ ভিন্ন অপর আর কেহ নহে।
আমি। যে সময় তুমি তাহাকে দেখিতে পাও, সেই সময় সে গিরিবালার কতদূর অগ্রে অগ্রে গমন করিতেছিল?
বোকার মা। বোধ হয়, এক রশির কম নহে।
.
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
বোকার মার নিকট এই সকল কথা অবগত হইয়া, মনে করিলাম— তবে কি প্রকৃতই গোবিন্দ অলঙ্কারের লোভে এই কার্য্য করিয়াছে? আবার মনে হইল— না, যে গোবিন্দ প্রাণের সহিত গিরিবালাকে ভালবাসে, তাহার দ্বারা এ কার্য্য কখনই হইবার সম্ভাবনা নাই।
মনে মনে এইরূপ ভাবিলাম সত্য, কিন্তু গোবিন্দের কথা মন হইতে একবারে তাড়িত করিতে পারিলাম না। অতঃপর গোবিন্দের অনুসন্ধান করা আবশ্যক বিবেচনা করিলাম।
একটু অনুসন্ধানের পরই গোবিন্দকে পাওয়া গেল। দেখিবামাত্র তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “গোবিন্দ, তুমি কোথায় গমন করিয়াছিলে?”
গোবিন্দ। কখন?
আমি। এখন।
গোবিন্দ। গিরিবালার অনুসন্ধানে গমন করিয়াছিলাম।
আমি। তুমি আপন কার্য্য পরিত্যাগ করিয়া গিরিবালার অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেছ কেন?
গোবিন্দ। পাড়ার কোন ব্যক্তির বিপদ উপস্থিত হইলে যদি আমাদিগের দ্বারা কোনরূপ উপকার না হইবে, তাহা হইলে এই সংসারে থাকিয়া লাভ কি?
আমি। পাড়ার ত অনেকেই আছে; কিন্তু কই আর কাহাকেও ত গিরিবালার অনুসন্ধান করিতে দেখিতেছি না।
গোবিন্দ। অপরে উহার অনুসন্ধান না করুক, কিন্তু আমি উহার অনুসন্ধান না করিয়া, কিছুতেই স্থির থাকিতে পারি না।
আমি। কেন?
গোবিন্দ। আমি গিরিবালাকে প্রাণের সহিত ভালবাসিতাম, আমার ছোট ভগিনী অপেক্ষাও আমি তাহাকে স্নেহ করিতাম বলিয়া, তাহার নিমিত্ত আমার প্রাণ নিতান্ত অস্থির হইয়া পড়িতেছে। এই নিমিত্তই আপন কার্য্য পরিত্যাগ করিয়া, আমি তাহার অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেছি।
আমি। কেবল আজই তাহার অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেছ, কি, কালও তাহার অনুসন্ধান করিয়াছিলে?
গোবিন্দ। কাল সমস্ত রাত্রি আমি তাহার অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইয়াছি। সত্য মিথ্যা আপনি আমার বাড়ীতে গিয়া জিজ্ঞাসা করুন যে, কাল সমস্ত রাত্রি আমি বাড়ীতে ছিলাম কি না।
আমি। তবে কাল রাত্রিতে তুমি বাটীতে ছিলে না?
গোবিন্দ। না মহাশয়! আমি বাটীতে ছিলাম না।
আমি। কোথায় ছিলে?
গোবিন্দ। গিরিবালার অনুসন্ধান করিয়া আমি সমস্ত রাত্রি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়া বেড়াইয়াছি, এখনও বেড়াইতেছি।
আমি। কাল রাত্রিতে যখন তুমি গিরিবালার অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেছিলে, সেই সময় তোমার সঙ্গে আর কে ছিল?
গোবিন্দ। আর কেহ ছিল না, কেবল আমি একাকীই ছিলাম।
আমি। ভাল, সে সব কথা যাউক। এখন আমি তোমাকে দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করি, তুমি তাহার প্রকৃত উত্তর প্রদান কর দেখি?
গোবিন্দ। আপনি আমাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিবেন, আমার নিকট হইতে আপনি তাহার প্রকৃত উত্তরই প্রাপ্ত হইবেন। কিসের নিমিত্ত আমি মিথ্যা কথা কহিব?
আমি। গত কল্য গিরিবালাকে তুমি সর্ব্বশেষ কোন সময় দেখিয়াছিলে?
গোবিন্দ। বোধ হয় বেলা দশটার পর তাহার সহিত আমার আর সাক্ষাৎ হয় নাই।
আমি। সর্ব্বশেষ তোমার সহিত তাহার কোন্ স্থানে সাক্ষাৎ হইয়াছিল?
গোবিন্দ। তাহাদিগের দরজায় তাহার সহিত আমার শেষ সাক্ষাৎ হইয়াছিল।
আমি। সে সময় গিরিবালা কি করিতেছিল?
গোবিন্দ। উহাদিগের দরজার চৌকাষ্ঠের উপর দাঁড়াইয়াছিল।
আমি। সেই সময় উহার পরিধানে কিরূপ কাপড় ছিল?
গোবিন্দ। একখানি ময়লা সাদা ধুতি ছিল।
আমি। উহার পর তাহার সহিত আর তোমার সাক্ষাৎ হয় নাই?
গোবিন্দ। না।
আমি। কোন সময় সে ডুরে কাপড় পরিয়াছিল, তাহা তুমি বলিতে পার কি?
গোবিন্দ। না, আমি তাহাকে ডুরে কাপড় পরিতে কল্য একবারেই দেখি নাই।
আমি। কল্য দিবা আন্দাজ ১২টার সময় এই রাস্তা বাহিয়া, তুমি পূর্ব্ব-মুখে কোথায় গমন করিয়াছিলে?
গোবিন্দ। কোন স্থানে যাই নাই। আমি পূৰ্ব্ব দিকে কল্য একবারেই যাই নাই।
আমি। গিরিবালাকে তুমি কাল পূৰ্ব্বদিকে গমন করিতে দেখিয়াছিলে?
গোবিন্দ। না।
আমি। তুমি তাহাকে কাল বাদাম পাড়িয়া দিতে চাহিয়াছিলে?
গোবিন্দ। না।
আমি। তুমি বোকার-মাকে চিন?
গোবিন্দ। না।
আমি। কল্য বোকার-মার সহিত তোমার দেখা হইয়াছিল?
গোবিন্দ। তাহাকে চিনিই না। তাহার সহিত দেখা হইবে কি প্রকারে?
গোবিন্দকে এই কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করিয়া ভাবিলাম যে, এইরূপে উহাকে জিজ্ঞাসা করিলে চলিবে না। বোকার মাকে আনাইয়া বা তাহার নিকট গোবিন্দকে লইয়া গিয়া, তাহার সম্মুখেই সেই সকল কথা তাহাকে জিজ্ঞাসা করাই কর্তব্য। উভয়ের মোকাবিলায় কথা হইলে সহজেই বুঝিতে পারা যাইবে, কে মিথ্যা কথা কহিতেছে।
মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া যে স্থানে বোকার মা বাস করিত, সেই স্থানে গোবিন্দকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গেলাম। বোকার মা সেই সময় বাড়ীতেই ছিল, আমাদিগকে দেখিবামাত্র সে আমাদিগের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। দেখিতে দেখিতে একজন দুইজন করিয়া ক্রমে পাড়ার অনেক লোক সেই স্থানে আগমন করিল।
বোকার মাকে যে সকল কথা পূর্ব্বে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, গোবিন্দের সম্মুখে পুনরায় সেই সকল কথা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম। সে আমার নিকট পূর্ব্বে যাহা বলিয়াছিল, গোবিন্দের সম্মুখেও ঠিক সেই সকল কথা কহিল। বোকার মার কথা শুনিয়া গোবিন্দ দুই একবার তাহার প্রতিবাদ করিল সত্য; কিন্তু তাহার মুখের সম্মুখে ভাল করিয়া কথা কহিতে পারিল না। গোবিন্দের কথা শুনিয়া ও তাহার ভাবভঙ্গি দেখিয়া সকলেই অনুমান করিল যে, গোবিন্দ সম্পূর্ণরূপ সত্য কথা কহিতেছে না।
সেই সময় গোবিন্দকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করা, নিষ্প্রয়োজন বিবেচনা করিয়া, তাহাকে সঙ্গে লইয়া সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম। এখন গোবিন্দের উপর আমাদিগের একটু সন্দেহ হইল সত্য; কিন্তু কিরূপ উপায়ে তাহার নিকট হইতে প্রকৃত কথা অবগত হইতে পারিব, এখন সেই চিন্তায় আমাদিগের মন অস্থির হইল।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
কি উপায় অবলম্বন করিলে গোবিন্দের নিকট হইতে প্রকৃত কথা অবগত হইতে পারিব, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। অথচ মনে মনে দুই একবার সন্দেহ আসিয়াও উপস্থিত হইল যে, যে গোবিন্দ গিরিবালাকে প্রাণের সহিত ভালবাসে জানিতে পারা যাইতেছে, সেই গোবিন্দের দ্বারা এইরূপ একটি ভয়ানক কার্য্য অনায়াসেই সম্পন্ন হইতে পারিবে, তাহাই বা সহজে কিরূপে অনুমান করা যাইতে পারে? গোবিন্দ হয় ত প্রকৃতপক্ষে নির্দোষ; বিনা অপরাধে আমাদিগের কর্তৃক সে অপরাধী সাব্যস্ত হইতেছে, এই ভাবিয়া হয় ত সে বিশেষরূপ ভীত হইয়া পড়িয়াছে। সুতরাং সরল ভাবে সকল কথার উত্তর প্রদান করিয়া উঠিতে সমর্থ হইতেছে না।
ক্ষণকালের নিমিত্ত আমার মনে এইরূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল সত্য; কিন্তু নির্দোষ সাব্যস্ত করিয়া গোবিন্দকে একবারে পরিত্যাগ করিতে পারিলাম না। তাহাকে লইয়া অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইতে হইল।
বোকার মা যে দিকে গিরিবালার সহিত গোবিন্দকে গমন করিতে দেখিয়াছিল, আমিও গোবিন্দকে সঙ্গে লইয়া ক্রমে সেইদিকে গমন করিতে লাগিলাম; এবং পথের দুই পার্শ্বে যাহাকে দেখিতে পাইলাম, তাহাকেই জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম। কিন্তু অপর আর কোন ব্যক্তি গোবিন্দ বা গিরিবালা সম্বন্ধে আর কোন কথাই বলিতে পারিল না।
আমরা যে পথ অবলম্বন করিয়া গমন করিতেছিলাম, ক্রমে সেই পথ শেষ হইয়া আসিল। যে স্থানে সেই পথ ফুরাইয়া গেল, সেই স্থান হইতে ময়দান আরম্ভ হইয়াছে। সেই ময়দানে কৃষকগণ কৃষিকার্য সম্পন্ন করিয়া থাকে। সেই ময়দানের অপর পার্শ্বে কয়েকটি বাগান আছে, সেই বাগানে গমন করিতে হইলে, সেই ময়দান অতিক্রম করিয়া গমন করিতে হয়।
সেই বাগানগুলির ভিতর অনুসন্ধান করিবার মানসে, আমরা সেই ময়দান অতিক্রম করিতে আরম্ভ করিলাম। কিয়দ্দূর গমন করিবার পর, দেখিতে পাইলাম,— দুইজন কৃষক এক স্থানের কিছু জমী খনন করিতেছে। উহাদিগকে দেখিয়া মনে করিলাম— গোবিন্দ কি গিরিবালা এইদিক দিয়া গমন করিয়াছে কি না, এ পর্য্যন্ত যে কত লোককে জিজ্ঞাসা করিয়াছি, তাহার কিছুমাত্র সংখ্যা নাই। এখন আর এই কৃষক দুইজনকেই বা জিজ্ঞাসা করিতে বাকী থাকে কেন?
মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সেই কৃষকদ্বয়কে ডাকিলাম। ডাকিবামাত্র উহারা আমাদিগের সন্নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করায়, এক ব্যক্তি কহিল, “আমি এই প্রকারের কোন ব্যক্তিকে এই দিক দিয়া গমন করিতে দেখি নাই।” কিন্তু অপর ব্যক্তি কহিল, “আমার যেন একটু মনে হইতেছে— আমি এই ব্যক্তিকে এই স্থান দিয়া গমন করিতে দেখিয়াছি।”
কৃষকের কথা শুনিয়া আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “ইহাকে কবে এই স্থান দিয়া গমন করিতে দেখিয়াছ?”
কৃষক। কাল কি পরশু, এ কথা আমি ঠিক মনে করিয়া উঠিতে পারিতেছি না।
আমি। তুমি ইহাকে কবে দেখিয়াছ, তাহা তোমার মনে হইতেছে না; কিন্তু কোন সময়ে দেখিয়াছ, তাহা তোমার মনে হয় কি?
কৃষক। বোধ হয়, দিবা দুই প্রহরের পর, এই ময়দানের ভিতর দিয়া গমন করিতে দেখিয়াছি।
আমি। কোন দিকে গমন করিয়াছিল?
কৃষক। পূৰ্ব্ব দিকে। সম্মুখে ওই যে বাগান দেখিতে পাইতেছেন, ওই দিকে ও গমন করিয়াছিল।
আমি। এই ব্যক্তি একাকী গমন করিতেছিল, কি তাহার সহিত অপর কোন লোকজন ছিল?
কৃষক। লোকজন অপর কেহই ছিল না। কেবলমাত্র একটি বালিকা উহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতেছিল।
আমি। সেই বালিকাটির পরিধানে কিরূপ প্রকারের কাপড় ছিল, তাহা মনে করিয়া বলিতে পার কি?
কৃষক। আমার বোধ হইতেছে, সেই বালিকাটির পরিধানে একখানি ডুরে শাড়ি ছিল।
আমি। কিরূপ ডুরে, তাহা মনে করিয়া ঠিক বলিতে পার কি?
কৃষক। উহা লাল ডুরে কি কাল ডুরে, তাহা আমি ঠিক মনে করিয়া বলিতে পারিব না। হাঁ, হাঁ মহাশয়! আমার বেশ অনুমান হইতেছে, উহা কাল রঙ্গের ডুরে কাপড় হইবে।
আমি। তুমি উহাদিগকে কতদূর পর্য্যন্ত গমন করিতে দেখিয়াছিলে?
কৃষক। আমি আপনাকে যে বাগানের কথা কহিলাম, ওই বাগানের ভিতর পর্যন্ত আমি উহাদিগকে গমন করিতে দেখিয়াছি।
যে সময় সেই কৃষক আমার সহিত কথা কহিতেছিল, সেই সময় গোবিন্দ সেই স্থানে স্থির ভাবে দাঁড়াইয়াছিল, তাহার মুখ দিয়া একটিমাত্র কথাও নির্গত হইতেছিল না।
গোবিন্দের সেইরূপ অবস্থা দেখিয়া, আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “কৃষক যাহা কহিল, তাহা তুমি শ্রবণ করিলে। এ সম্বন্ধে তুমি এখন কি বলিতে চাহ?”
উত্তরে গোবিন্দ কেবল এইমাত্র কহিল, “এ ব্যক্তি মিথ্যা কথা কহিতেছে। আমি গিরিবালাকে লইয়া এ দিকে কি নিমিত্ত আগমন করিব?”
গোবিন্দের কথায় আর কোনরূপ উত্তর প্রদান না করিয়া, তাহাকে সঙ্গে লইয়া আমরা পূর্ব্ব-বর্ণিত বাগানের দিকে গমন করিতে লাগিলাম।
বাগানের ভিতর প্রবেশ করিয়া বুঝিলাম যে, এক সময়ে এই বাগানের অবস্থা খুব ভালই ছিল। কিন্তু সময় ও অবস্থার পরিবর্তনে সেই বাগানের পূর্ব্ব অবস্থা এখন লোপ পাইয়া গিয়াছে। বাগানের ভিতর অনেকগুলি ভাল ভাল বৃক্ষ থাকিলেও ভয়ানক জঙ্গলে উহা প্রায় আচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছে। বাগানের মধ্যস্থলে একটি পুষ্করিণী আছে। উহার চতুষ্পার্শ্বের বাঁধা ঘাটগুলি ভাঙ্গিয়া গিয়াছে, এবং উহার চতুষ্পার্শ্বে নানারূপ লতাগুল্ম সকল বৰ্দ্ধিত হইয়া সেই বাঁধা ঘাটগুলি একবারে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছে। সেই বাগানের অবস্থা এখন এরূপ হইয়া রহিয়াছে যে, তাহার ভিতর সূর্য্যরশ্মি প্রবেশ করিবার আর কোনরূপ উপায় নাই। পুষ্করিণীতে জল আছে সত্য; কিন্তু শৈবাল-দল দ্বারা উহা এরূপ ভাবে আচ্ছন্ন হইয়া রহিয়াছে যে, সেই জলের উপর কাহারও দৃষ্টি পড়ে না।
যতদূর সাধ্য, সেই সকল জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করিয়া, সেই বাগানের প্রায় সমস্ত স্থান একরূপ অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু কোন স্থানেই সন্দেহ-সূচক কোন বিষয় দেখিতে পাইলাম না। পরিশেষে পুষ্করিণীর ভিতরও একবার অনুসন্ধান করিয়া দেখিতে ইচ্ছা করিলাম। পুষ্করিণীর চতুষ্পার্শ্ববর্তী লতাগুল্ম সকল যতদূর সম্ভব স্থানান্তরিত করিয়া, আমরা ক্রমে সেই পুষ্করিণীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। জলের দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করিয়া দেখি, উহার একস্থানে কতকগুলি শৈবাল দল যেন স্থানান্তরিত করা হইয়াছে, এবং আর এক স্থানে কতকগুলি শৈবাল দল স্তূপীকৃত করিয়া রাখিয়া দেওয়া রহিয়াছে। এই ব্যাপার দেখিয়া আমাদিগের মনে বিশেষরূপ সন্দেহ হইল। ভাবিলাম, এরূপ জঙ্গলের ভিতর কে আসিয়া পুষ্করিণীর শৈবাল দল সকল স্থানান্তরিত করিবে? মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, দুই তিনজন কৰ্ম্মচারী সহ ক্রমে সেই পুষ্করিণীর ভিতর অবতরণ করিলাম। যে স্থানের শৈবাল দল সকল স্তূপীকৃত ভাবে রাখা ছিল, সেই স্থানে গমন করিয়া, সেই শৈবালদলের নিম্নদেশে উত্তমরূপে দেখিতে ইচ্ছা করিলাম; কিন্তু সেই স্থানের জলের গভীরতাবশতঃ তাহার নিকট গমন করিতে পারিলাম না। একগাছি যষ্টির দ্বারা দূর হইতে সেই শৈবাল-দলগুলি ক্রমে স্থানান্তরিত করিতে লাগিলাম। কতকগুলি শৈবাল-দল স্থানান্তরিত হইলেই, কি একটা কাল পদার্থ হঠাৎ নয়নগোচর হইল। বিশেষরূপ লক্ষ্য করিয়া অনুমান হইল, যেন একখানি কাল রঙ্গের ডুরে কাপড়ে কি বাঁধা রহিয়াছে, এবং বস্ত্র সহিত উহা জলের উপর ভাসিতেছে।
এই ব্যাপার দেখিয়া মনে মনে সবিশেষ কৌতূহলের উদয় হইল। ভাবিলাম, যখন গিরিবালার কাপড়ের মত কাপড় এই নির্জ্জন স্থানে পুষ্করিণীর ভিতর দেখিতে পাওয়া যাইতেছে, তখন গিরিবালার মৃতদেহও ইহার নিকটবর্তী কোন না কোন স্থানে থাকিবার অসম্ভাবনা নহে।
মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সন্তরণ-পটু দুইজন কনষ্টেবলকে সেই পুষ্করিণীর মধ্যে অবতরণ করিতে কহিলাম। আদেশমাত্র দুইজন কনষ্টেবল পুষ্করিণীর ভিতর অবতরণ করিয়া, যে স্থানে কাপড়ে বাঁধা কোন দ্রব্য দৃষ্টিগোচর হইতেছিল, সেই স্থানে গমন করিল, এবং সেই কাপড়ের এক স্থান ধারণ করিয়া ক্রমে উহা অধিক জল হইতে অল্প জলে আনয়ন করিল। সেই কাপড়ের সঙ্গে সঙ্গে একটি শৈবাল স্তূপও আগমন করিল।
উহা অল্প-গভীর জলে আনীত হইলে, আমরা স্বহস্তে সেই শৈবালরাশি ক্রমে স্থানান্তরিত করিতে লাগিলাম। এইরূপে কতকগুলি শৈবাল দল স্থানান্তরিত হইলে, দেখিতে পাইলাম যে, সেই শৈবাল-দলের নিম্নে একটি বালিকার মৃতদেহ রহিয়াছে। উহার পরিধানে কাল রঙ্গের একখানি ডুরে শাটি, এবং সেই শাটির অঞ্চলে কতকগুলি শুষ্ক বাদাম বাঁধা রহিয়াছে।
এইরূপ অবস্থায় একটি বালিকার মৃতদেহ প্রাপ্ত হওয়ায় উহাই যে গিরিবালার মৃতদেহ, তাহা আমরা একরূপ স্থির করিয়া লইলাম। তথাপি আমাদিগের মতে যাহাতে আর কোনরূপ সন্দেহ না থাকে, তাহার নিমিত্ত যে ব্যক্তি গিরিবালাকে পূর্ব্ব হইতে ভালরূপে চিনিত, তাহাদিগের মধ্যে কোন একজনকে ডাকাইয়া পাঠাইলাম। এদিকে সেই মৃতদেহ জল হইতে উঠাইয়া সেই পুষ্করিণীর পুরাতন ঘাটের উপর রাখিয়া দিলাম। সেই সময় সেই মৃতদেহ উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম; কিন্তু কোন স্থানে কোনরূপ আঘাতের চিহ্ন দেখিতে পাইলাম না। কেবলমাত্র গলার উপর অতি সামান্য একটি কাশিরার সদৃশ চিহ্ন দেখিতে পাওয়া গেল। মৃতদেহের শরীরের কোন স্থানে একখানি অলঙ্কারও দেখিতে পাওয়া গেল না।
আমরা সেই পুরাতন ঘাটের উপর মৃতদেহটি রাখিয়া, উত্তমরূপে দর্শন করিতেছি, এরূপ সময় দেখিতে পাইলাম, দ্রুতপদে গিরিবালার পিতা সেই বাগানের ভিতর প্রবেশ করিতেছে। দেখিতে দেখিতে সে আসিয়া আমাদিগের নিকট উপস্থিত হইল, এবং সেই বালিকার মৃতদেহটি দেখিতে পাইয়া “গিরি গিরি” বলিয়া, সে একবারে উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিয়া উঠিল। গিরিবালার পিতার এইরূপ অবস্থা দেখিয়া, উহা যে গিরিবালার মৃতদেহ, সে বিষয়ে আমাদিগের আর কিছুমাত্র সন্দেহ রহিল না।
গোবিন্দের দোষ সম্বন্ধে পূর্ব্বে আমাদিগের মনে যে একটু সন্দেহ ছিল, সে সন্দেহ এখন একবারে আমাদিগের হৃদয় হইতে অন্তর্হিত হইল। এখন আমাদিগের মনে সম্পূর্ণরূপে প্রতীতি জন্মিল যে, এই হত্যা গোবিন্দ ভিন্ন অন্য কাহারও দ্বারা সম্পন্ন হয় নাই। গিরিবালার পরিহিত অলঙ্কারগুলি অপহরণ করিবার মানসে গোবিন্দই গিরিবালাকে হত্যা করিয়া এই পুষ্করিণীর ভিতর শৈবাল-দলের মধ্যে লুকাইয়া রাখিয়াছে।
এতক্ষণ পর্য্যন্ত গোবিন্দ আমাদিগের সঙ্গে ছিল মাত্র; কিন্তু এখন আর তাহাকে সেরূপ অবস্থায় রাখিলাম না। এখন তাহাকে ধৃত করিয়া দস্যুর মত তাহার উপর পাহারা দেওয়া হইল।
গোবিন্দ এখন মনে মনে বিলক্ষণ বুঝিতে পারিল যে, সে হত্যাপরাধে ধৃত হইয়াছে। তথাপি এই কাৰ্য্য যে তাহার দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে, একথা সে একবারেরও নিমিত্ত স্বীকার করিল না।
গোবিন্দকে হত্যাপরাধে ধৃত করিলাম সত্য; কিন্তু সে-ই যে গিরিবালাকে হত্যা করিয়াছে, তাহার প্রমাণ কি? যে বাগানের ভিতর গিরিবালার মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, গিরিবালাকে সঙ্গে লইয়া গোবিন্দ সেই বাগানের দিকে আগমন করিয়াছে, ইহা ভিন্ন তাহার বিপক্ষে অপর কোন প্রমাণ নাই। এ প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া কখনই গোবিন্দের দণ্ড হইতে পারে না। একথা আমরাও যেমন জানি, গোবিন্দও সেইরূপ যে অবগত আছে, তাহার আর কোন সন্দেহ নাই। না থাকিলেও সময় মত উকীল মোক্তারের নিকটও সে তাহা অবগত হইতে পারিবে।
গোবিন্দের নিকট হইতে কোনরূপে যদি গিরিবালার অপহৃত দ্রব্যগুলির পুনরুদ্ধার করিতে পারা যায়, তাহা হইলেই গোবিন্দের দণ্ড হইবার সম্ভাবনা, নতুবা দণ্ড হইবার অপর কোন উপায়ই নাই।
এখন আমাদিগের প্রধান কাৰ্য্য হইল, কোনরূপ উপায়ে সেই অলঙ্কারগুলির পুনরুদ্ধার করা। কিন্তু এই সকল অলঙ্কারের পুনরুদ্ধার করা যে কিরূপ দুরূহ ব্যাপার, যাঁহারা এরূপ মোকদ্দমার কখন অনুসন্ধান করিয়াছেন, তাঁহারাই তাহা অনায়াসে বুঝিতে পারিবেন; অপরে যে সহজে তাহা বুঝিতে পারিবেন, তাহা অনুমান হয় না।
এরূপ অবস্থায় বোধ হয়, পাঠকগণ সহজেই অনুমান করিতে পারিবেন যে, গোবিন্দ যদি সহজে তাহার দোষ স্বীকার করে, ও অপহৃত দ্রব্যাদি কিরূপ অবস্থায় ও কোথায় রাখিয়া দিয়াছে, তাহা যদি প্রকাশ করে, তবেই সেই সকল অপহৃত দ্রব্যের সহজে উদ্ধার হইবার সম্পূর্ণরূপ সম্ভাবনা। নতুবা এরূপ ধরণের মোকদ্দমায় অন্ধকারের মধ্যে অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া অনুসন্ধান করিলে প্রায়ই সুফল প্রাপ্ত হইতে পারা যায় না।
মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া পুনরায় গোবিন্দকে বারবার জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম; কিন্তু গোবিন্দও বারবার উত্তর প্রদান করিতে লাগিল, “আপনারা বিনাদোষে আমাকে ধৃত করিয়াছেন, আমি ইহার কিছুই অবগত নহি।”
.
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
অনেক মোকদ্দমায় আমরা দেখিয়াছি যে, যে ব্যক্তি যাহাকে প্রাণের সহিত ভালবাসে, ও কোনরূপ অনিবাৰ্য্য কারণে সেই ব্যক্তি যদি তাহা কর্তৃক হত হয়, তাহা হইলে হত্যাকারী কখনই সেই দোষ অস্বীকার করে না। আর যদি কেহ প্রথমতঃ অস্বীকারও করে; কিন্তু পরিশেষে সেই মৃত ব্যক্তির সন্নিকটে যদি তাহাকে কিয়ৎক্ষণ একাকী রাখা যায়, তাহা হইলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে তাহার মনের গতি পরিবর্তিত হইয়া যায়, ও পরিশেষে সে তাহার সমস্ত দোষ স্বীকার করিয়া ফেলে।
মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, গিরিবালার মৃতদেহের সন্নিকটবর্ত্তী সমস্ত লোককে কিয়ৎক্ষণের নিমিত্ত স্থানান্তরিত করিয়া গোবিন্দকে সেই স্থানে আনয়ন করিলাম, এবং তাহাকে কহিলাম, “দেখ দেখি গোবিন্দ! ইহা কাহার মৃতদেহ?”
আমার কথা শুনিয়া গোবিন্দ একবার সেই মৃতদেহের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিল; কিন্তু পরক্ষণে সেই দিক্ হইতে আপনার নয়নযুগল অপরদিকে স্থাপন করিয়া কহিল, “কি জানি মহাশয়! ইহা কাহার মৃতদেহ, তাহা আমি চিনিয়া উঠিতে পারিতেছি না।” এই বলিয়া সে আপন মুখ বন্ধ করিল। ইহার পর যতক্ষণ তাহাকে সেই বাগানের ভিতর রাখা হইয়াছিল, তাহার মধ্যে সে কাহারও কোন কথার উত্তর প্রদান করে নাই। গিরিবালার মৃতদেহের দিকে যাহাতে তাহার নয়ন পুনরায় আকৃষ্ট হয়, তাহার নিমিত্ত অনেক চেষ্টা করিলাম; কিন্তু কিছুতেই কৃতকার্য্য হইতে পারিলাম না। যখন সে দেখিল, গিরিবালার মৃতদেহের দিকে তাহার নয়ন আকৃষ্ট করিবার নিমিত্ত আমরা বিশেষরূপ পীড়াপীড়ি ও নানাপ্রকার কৌশল অবলম্বন করিলাম, তখন সে আপনার চক্ষুদ্বয় মুদিত করিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।
আমরা কোনরূপে আমাদিগের অভিসন্ধি পূর্ণ করিতে না পারিয়া, সেই পুরাতন প্রথা পরিত্যাগ করিলাম। তৎপরে গোবিন্দকে সঙ্গে লইয়া, আমি সেই বাগান হইতে বহির্গত হইয়া গেলাম। অপরাপর কর্মচারীগণ সেই স্থানের আবশ্যকীয় অনুসন্ধানে নিযুক্ত রহিলেন।
সরকারী কার্য্যে নিযুক্ত থাকিয়া, নিজের অত্যাচারের কথা সর্ব্বসমক্ষে প্রকাশ করা যে কিরূপ দুরূহ ব্যাপার, তাহা অনুমান করা সহজ নহে।
১ম। যে সকল লোক আমার চরিত্রকে নিৰ্ম্মল বলিয়া অবগত আছেন, আমা কর্তৃক কখনও কোন ব্যক্তির উপর কোনরূপ অত্যাচার হয় না, ইহা যাঁহাদিগের বিশ্বাস, তাঁহাদিগের নিকট নিজের চরিত্র নিজে প্রকাশ করিয়া তাহাদিগের চির-দিবসের বিশ্বাসের অপলাপ করা, এই সংসারের লোকের পক্ষে যে কিরূপ দুরূহ ব্যাপার, তাহা মনুষ্যমাত্রেই অবগত আছেন।
২য়। যাঁহারা আমাকে বিশেষরূপে বিশ্বাস করিয়া থাকেন, তাঁহারা আমার কুচরিত্র অবগত হইতে পারিলে, সেইরূপ বিশ্বাস কি তাঁহারা আমার উপর আর রাখিতে পারেন?
৩য়। আইনে যে সকল দোষ করিতে বিশেষরূপে নিষেধ আছে, সেই সকল দোষ জানিয়া শুনিয়া সরকারের কর্ম্মচারী হইয়া, অনায়াসেই করিতে সমর্থ হইয়াছি, একথা সরকারী কর্মচারীর পক্ষে, বা ঊর্দ্ধতন কর্মচারীগণের নিকট কিছু সুখ্যাতির কথা নহে।
৪র্থ। লেখকের কর্তব্য কর্ম্মের অনুরোধে যদি কখন নিজের গুণের সহিত নিজের দোষও প্রকাশ করি, তাহা হইলে সংবাদ-পত্র-সম্পাদকদিগের নিকট হইতেও কিছুতে রক্ষা পাইবার উপায় নাই, — অমনি তাঁহারা একস্বরে বলিয়া বসেন, —একেই পুলিশে অত্যাচার করিয়া থাকে, তাহাতে অত্যাচারের নূতন প্রথা জানিতে পারিলে অনভিজ্ঞ কর্মচারীগণ সেই পন্থা অবলম্বন করিয়া অত্যাচারের পথ আরও প্রশস্ত করিতে ত্রুটী করিবেন না।
এইরূপ নানা কারণে নিজের দোষ স্বীকার করিতে প্রায় কেহই সম্মত হন না সত্য; কিন্তু ইহাতে যিনি যাহাই বলুন, আমি কিন্তু নিজের দোষ এই স্থানে স্বীকার করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। ইহাতে আমার অপযশ হইবে সত্য, কিন্তু কর্তব্য কর্ম্মের অনুরোধে ও অনুসন্ধানের প্রকৃত অবস্থা বর্ণন করিতে আমি কোনরূপেই কুণ্ঠিত হইব না। ইহাতে যিনি যাহা মনে করেন, করুন।
যাহা হউক, অতঃপর গোবিন্দকে আমি নিকটবর্তী একটি থানায় লইয়া গেলাম। সেই স্থানে মিষ্ট কথায় তাহাকে অনেকক্ষণ ধরিয়া অনেকরূপে বুঝাইলাম; কিন্তু গোবিন্দ কোনরূপেই আসল কথা প্রকাশ করিল না। কেবলমাত্র একই কথা বলিতে লাগিল, “মহাশয়! আমি ইহার কিছুই অবগত নহি।”
আমি। আমি মিষ্ট কথায় তোমাকে এত করিয়া বুঝাইতেছি, কিন্তু কিছুতেই তোমার নিকট হইতে আসল কথা পাইলাম না।
গোবিন্দ। আমি যাহা অবগত নহি, তাহা কি প্রকারে কহিব? আমি সামান্য অলঙ্কারের নিমিত্ত গিরিবালাকে কি কখন হত্যা করিতে পারি?
আমি। তবে তাহাকে কে হত্যা করিল?
গোবিন্দ। তাহা আমি কি প্রকারে কহিব?
আমি। দেখ গোবিন্দ! তুমি এখন আমার হস্তে পতিত হইয়াছ। তুমি এখনও যদি আমার কথার প্রকৃত উত্তর প্রদান না কর, তাহা হইলে জানিও আমি তোমার ধর্ম্ম নষ্ট করিব।
গোবিন্দ। আপনি সকলই করিতে পারেন।
আমি। জাতিতে তুমি হিন্দু, কেমন?
গোবিন্দ। হাঁ মহাশয়! আমি হিন্দু।
আমি। আমি যদি এখন তোমাকে মুসলমানের অন্ন খাওয়াইয়া দি, তাহা হইলে তুমি কি করিতে পার?
গোবিন্দ। আপনার আর আমি কি করিতে পারিব? কিন্তু আপনি হিন্দু, এ কার্য্য আপনার দ্বারা কখনই হইবার নহে।
আমি। আমার দ্বারা না হইতে পারে, এমন কোন কাৰ্য্যই নাই। মুসলমানের অন্ন কেন, মুসলমানের রন্ধনশালা হইতে, মুসলমানের দ্বারা গোমাংস আনিয়া এখনই তোমাকে ভক্ষণ করাইয়া দিব। নতুবা এখনও তুমি আমার নিকট প্রকৃত কথা কহ।
গোবিন্দ। যাহা প্রকৃত, তাহা আমি বলিয়াছি, আমি অপর আর কিছুই অবগত নহি।
গোবিন্দের এই কথা শুনিয়া, আমি সেই স্থান হইতে একটু অন্তরালে গমন করিলাম, ও থানার দুইজন কর্মচারীকে আমার নিকট ডাকাইয়া লইলাম। উহাদিগের মধ্যে একজন হিন্দু, অপরজন মুসলমান। ব্রাহ্মণ-কর্মচারীকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম যে, সেই দিবস কালীঘাট হইতে তিনি কিয়ৎপরিমাণে ছাগ-মাংস আনয়ন করিয়াছিলেন, “দিবাভাগে রন্ধন করিয়া তিনি তাহার অধিকাংশই ভক্ষণ করিয়াছেন, রাত্রির নিমিত্ত অতি সামান্যই অবশিষ্ট আছে। তাঁহাকে তখন আমার মনের কথা প্রকাশ করাতে, তিনি আমার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন, ও আমাদিগের পরামর্শ অনুযায়ী মুসলমানের বেশ পরিধান করিলেন। পরিহিত ধুতি পরিত্যাগ করিয়া তাহার পরিবর্তে একখানি লুঙ্গি পরিধান করিলেন, পিরাণের উপর একটি মুসলমানি চাপকান আঁটিলেন, মুখে একটি কৃত্রিম দাড়ি লাগাইলেন ও মস্তকে সাদা কাপড়ের একটি কলপ করা উঁচু টুপী পরিধান করিয়া আমাদিগের আদেশের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন।
আমি ও সেই মুসলমান কর্ম্মচারী পুনরায় গোবিন্দের নিকট আসিয়া উপবেশন করিলাম। তখন সেই মুসলমান কর্ম্মচারীকে সম্বোধন করিয়া গোবিন্দর সম্মুখেই কহিলাম, “এ ব্যক্তি যদি কোনরূপে প্রকৃত কথা না কহে, তাহা হইলে আপনি অনায়াসেই ইহার ধর্ম্ম নষ্ট করিতে পারেন, তাহাতে আমার কিছুমাত্র আপত্তি নাই।”
গোবিন্দ। আপনারা অনর্থক আমার ধর্ম্ম নষ্ট করিতে চাহিতেছেন। আমি ইহার কিছুই অবগত নহি।
মু-কৰ্ম্মচারী। ও কথা চলিবে না, তুমি প্রকৃত কথা না বলিলে, এখনই আমি তোমাকে গোমাংস ভক্ষণ করাইয়া তোমার ধর্ম্ম নষ্ট করিয়া দিব।
গোবিন্দ। আমার ধর্ম্ম নষ্ট করিবেন না। প্রকৃতই আমি কোন বিষয় অবগত নহি।
মু-কৰ্ম্মচারী। ও কথা আমি শুনিব না। ছমির! তুমি ওখানে আছ কি?
যে ব্রাহ্মণ-কৰ্ম্মচারী মুসলমান সাজিয়া বসিয়াছিলেন, তিনি সেই মুসলমান বেশে আমাদিগের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে দেখিবামাত্র মুসলমান কৰ্ম্মচারী বলিলেন, “ছমির! আজ যে গোমাংস রন্ধন করিয়া আমায় খাওয়াইয়াছিলে, তাহার কিছু অবশিষ্ট আছে কি?”
ব্রাহ্মণ-কর্ম্মচারী। হাঁ, আছে বৈকি?
মু-কৰ্ম্মচারী। যদি থাকে, তাহা হইতে একটু আন দেখি। প্রকৃত কথা না বলিলে, উহা এই হিন্দু আসামীকে খাওয়াইয়া দিয়া উহার ধর্ম্ম নষ্ট করিব।
এই কথা শুনিবামাত্র সেই মুসলমানবেশী হিন্দু-কর্মচারী সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল, ও একটি কাচপাত্রে কয়েক টুকরা মাংস আনিয়া আমাদিগের সম্মুখে রাখিয়া দিল।
মুসলমান কর্তৃক প্রকৃতই গোমাংস আনীত হইল দেখিয়া, গোবিন্দ অতিশয় ভীত হইয়া পড়িল, ও বার বার আমার মুখের দিকে চাহিতে লাগিল। তাহার এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আমি কহিলাম, “এখন আর আমার দিকে দেখিলে কি হইবে? এখনও যদি তুমি প্রকৃত কথা বল, তাহা হইলে আমি এখনও তোমার ধর্ম্ম রক্ষা করিতে পারি। নতুবা এই মুসলমান-কর্ম্মচারীর হস্ত হইতে তোমাকে উদ্ধার করিবার ক্ষমতা আমার নাই।”
আমার কথা শুনিয়া গোবিন্দ কহিল, “মহাশয়! আমি প্রকৃতই কহিতেছি, আমি ইহার কিছুই অবগত নহি।”
গোবিন্দের মুখ হইতে এই কথা বাহির হইতে না হইতেই সেই মুসলমান কর্ম্মচারী মুসলমানবেশী ব্রাহ্মণ কর্ম্মচারীকে আদেশ প্রদান করিলেন, “যখন এখন পর্যন্ত প্রকৃত কথা কহিতেছে না, তখন জোর করিয়া উহাকে গোমাংস ভক্ষণ করাইয়া উহার ধর্ম্ম নষ্ট করিয়া দেও। আর বিলম্ব করিবার প্রয়োজন নাই।”
আদেশ পাইবামাত্র সেই মুসলমানবেশী হিন্দু-কর্মচারী জোর করিয়া উহাকে সেই স্থানে শোয়াইয়া দিলেন, ও সেই কাচ পাত্র হইতে এক টুকরা মাংস হাতে লইয়া কহিলেন, “এখনও প্রকৃত কথা বলিয়া দে, নতুবা এখনই তোর ধৰ্ম্ম নষ্ট করিলাম।”
কর্মচারীর এ কথায় গোবিন্দ আর কোন উত্তর করিল না। জোর করিয়া সে আপন মুখ বন্ধ করিয়া রহিল। মনে ভয়— কথা কহিতে গেলে সেই অবকাশে পাছে কর্ম্মচারী গোমাংস তাহার মুখের মধ্যে প্রবিষ্ট করাইয়া দেয়।
এই অবস্থা দৃষ্টি করিয়া মুসলমানবেশী-হিন্দু-কৰ্ম্মচারী সেই মাংস-টুকরা তাহার নাকের উপর স্থাপন করিলেন ও পরিশেষে কহিলেন, “এবার আমি এই পর্যন্ত করিয়াই ক্ষান্ত হইলাম। ইহাতেও যদি তুমি প্রকৃত কথা না কহ, তাহা হইলে দেখিবে, এখনই আমরা তোমার ধর্ম্ম নষ্ট করিব।” এই বলিয়া তিনি গোবিন্দকে ছাড়িয়া দিলেন। গোবিন্দ আস্তে আস্তে উঠিয়া বসিল, ও পরিশেষে আমার দিকে লক্ষ্য করিয়া কহিল, “যাহা হইবার হইয়াছে, যাহা করিবার করিয়াছি, ও যাহা হইবার তাহা হইবে; কিন্তু আমার ধর্ম্ম নষ্ট করিবেন না।”
আমি। তুই এখনও প্রকৃত কথা বল।
গোবিন্দ। কি বলিতে হইবে বলুন, আমি বলিতেছি।
আমি। গিরিবালাকে তুই হত্যা করিলি কেন?
গোবিন্দ। অলঙ্কারের লোভে।
আমি। সে অলঙ্কারগুলি কোথায়?
গোবিন্দ। বিক্রয় করিয়া ফেলিয়াছি।
আমি। কোথায় বিক্রয় করিয়াছ?
গোবিন্দ। তালতলা বাজারের জনৈক পোদ্দারের নিকট।
আমি। বিক্রয় করিয়া যে টাকা পাইয়াছিলে, তাহা কি করিলে?
গোবিন্দ। নষ্ট করিয়াছি।
আমি। কিরূপে নষ্ট করিলে?
গোবিন্দ। মদে ও বেশ্যায়।
আমি। কোথায়?
গোবিন্দ। হাড়কাটা গলিতে।
আমি। যাহার নিকট তুমি গহনাগুলি বিক্রয় করিয়াছ, তাহাকে দেখাইয়া দিতে পারিবে?
গোবিন্দ। পারিব, আমার সঙ্গে আসুন, আমি তাহার দোকান দেখাইয়া দিব।
গোবিন্দের এই অবস্থা দৃষ্টি করিয়া সহজেই অনুমান করিলাম যে, গোবিন্দ আপনার ধর্ম অপেক্ষা আপনার প্রাণকে তুচ্ছ জ্ঞান করিল ও পরিশেষে আমাকে সঙ্গে লইয়া তালতলা বাজারে যে পোদ্দারের নিকট সে অলঙ্কারগুলি বিক্রয় করিয়াছিল তাহাকে দেখাইয়া দিল। পোদ্দারের খাতায় সেই সকল অলঙ্কারের জমা খরচ বাহির হইল ও তাহার দোকান হইতে অলঙ্কারগুলিও পাওয়া গেল।
হাড়কাটা গলির যে স্ত্রীলোকের বাড়ীতে সে সেই অর্থ নষ্ট করিয়াছিল, তাহাকেও দেখাইয়া দিল। তাহার নিকট গিয়া অনুসন্ধান করাতে, তাহার নিকট হইতেও একখানি অলঙ্কার পাওয়া গেল। সেই অলঙ্কারখানি গোবিন্দ তাহাকে প্রদান করিয়াছিল।
যথাসময়ে মোকদ্দমা রীতিমত রুজু হইল। সাক্ষীগণও উপস্থিত হইল। আদালতে গোবিন্দ নিজ অপরাধ আর গোপন করিল না।
গোবিন্দের বিপক্ষে এখন মোকদ্দমা বেশ প্রমাণিত হইল, বিচারে গোবিন্দ চিরদিবসের নিমিত্ত ইহজীবন পরিত্যাগ করিল।
তাই বলিয়াছি—“বিশ্বাস কারে করি?” যে ব্যক্তি অনেক দিবস একত্র বাস করিয়াও স্নেহশীল বালকবালিকার মায়ায় বদ্ধ হইয়াও সামান্য অর্থলোভ সম্বরণ করিতে পারে না, সেই ব্যক্তি কি কোন বিশ্বাস রক্ষা করিতে পারে?
[ চৈত্র, ১৩০৩]