মা, না রাক্ষসী?
(অর্থাৎ সতী, অসতী হইলে তাহার ভয়ানক ফল!)
প্রথম পরিচ্ছেদ
৬১ নম্বর বা ষষ্ঠ বৎসরে বৈশাখ মাসের দপ্তরে মাংস ভোজন নামক একটি প্রবন্ধ লিখিত হইয়াছিল, যে সকল পাঠক ওই প্রবন্ধের নায়ক নায়িকার নিকট পরিচিত ছিলেন, তাঁহারাই উহাতে লিখিত ঘটনাবলী সহজে বিশ্বাসস্থলে আনিয়াছিলেন। এ ঘটনা যে সম্পূর্ণরূপ প্রকৃত ঘটনা, তাহাতে এখন পর্যন্তও অনেকে বিশ্বাস করিতে সমর্থ হন নাই, ইহাও আমি কোন কোন ব্যক্তির মুখে শুনিয়াছি।
যে সকল পাঠক-পাঠিকা মাংস ভোজন সম্বন্ধীয় ঘটনায় এখন পর্যন্ত বিশ্বাস করিতে সমর্থ হন নাই, অদ্যকার বর্ণিত বিষয়ে, আমি যে তাঁহাদিগকে কিরূপে বিশ্বাস করাইতে সমর্থ হইব, তাহা ভাবিয়া-চিন্তিয়া, কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। তাঁহারা উহাতে বিশ্বাস করুন বা না করুন; প্রকৃত ঘটনা বলিয়া, যাহাতে আমার বিশ্বাস হইয়াছে, বা যাহার সমস্ত অবস্থা প্রকৃত বলিয়া আমি অবগত আছি, তাহাই আজ আমি পাঠক-পাঠিকাগণের সম্মুখে উপস্থিত করিতেছি, বিশ্বাস করা, না করা, তাঁহাদিগের ইচ্ছা।
পাঠক-পাঠিকাগণের মধ্যে যদি কেহ এই ঘটনায় বিশ্বাস না করেন, তাহা হইলেও আমি তাঁহাদিগের উপর কোনরূপে দোষার্পণ করিতে পারি না। কারণ, প্রকৃত জানিয়াও, যে ঘটনায়, সময় সময় আমার নিজেরই বিশ্বাস করিতে ইছা হয় না, সেই অস্বাভাবিক ভয়ানক ঘটনায়, অপরে সহজেই বা বিশ্বাস করিবেন কিরূপে?
যে ঘটনা, আজ আমি পাঠক-পাঠিকাগণের সম্মুখে উপস্থিত করিতেই, তাহা এদেশীয় ঘটনা নহে, বা লেখক কর্তৃক এ ঘটনার অনুসন্ধানও হয় না, ইহা অপর স্থানের ঘটনা, এবং অনুসন্ধানকারীও অপরে। কিন্তু আমার সম্মুখে এই ঘটনার অনুসন্ধান হইয়াছিল বলিয়া, ইহার বিবরণী এই দপ্তরের মধ্যে প্রদত্ত হইল।
দশ বার বৎসর অতীত হইল, অপর আর একটি মোকদ্দমার অনুসন্ধান-উপলক্ষে আমাকে রাজপুতানায় গমন করিতে হয়। সেই স্থানের একটি থানায় আমাকে তিন চারিদিবস অতিবাহিত করিতে হইয়াছিল।
একদিবস সন্ধ্যার পূর্ব্বে আমি থানায় বসিয়া আছি, এরূপ সময়ে একজন চৌকিদার, একটি স্ত্রীলোক ও অগর
আর একটি পুরুষকে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্ম্মচারীর নিকট আনিয়া উপস্থিত করিল।
তাহাদিগকে দেখিয়াই ভারপ্রাপ্ত কর্ম্মচারী মহাশয় সেই চৌকিদারকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “উহাদিগকে এখানে আনিয়াছ কেন? উহারা কি করিয়াছে?”
চৌকিদার। খুন করিয়াছে।
কৰ্ম্মচারী। খুন করিয়াছে?
চৌকিদার। হাঁ মহাশয়! খুন করিয়াছে।
কর্ম্মচারী। কে খুন করিয়াছে?
চৌকিদার। এই স্ত্রীলোকটি।
কৰ্ম্মচারী। কাহাকে খুন করিয়াছে?
চৌকিদার। একটি বালককে।
কর্ম্মচারী। কোন বালককে খুন করিয়াছে?
চৌকিদার। যাহাকে খুন করিয়াছে, সে সেই স্থানে আছে।
কর্ম্মচারী। সে বালকটি, কে কাহার পুত্র?
চৌকিদার। এই যে পুরুষ মানুষটিকে আনিয়াছি, সে ইহারই পুত্র।
কৰ্ম্মচারী। কেমন হে! তোমারই পুত্র হত হইয়াছে?
পুরুষ। হাঁ মহাশয়! আমারই পুত্র হত হইয়াছে।
কৰ্ম্মচারী। এই স্ত্রীলোকটিই কি তোমার পুত্রকে হত্যা করিয়াছে?
পুরুষ। তাহা আমি জানি না, ও নিজে বলিতেছে যে, সে আমার পুত্রটিকে হত্যা করিয়াছে।
কৰ্ম্মচারী। তুমি হত্যা করিতে দেখ নাই?
পুরুষ। না।
কৰ্ম্মচারী। অপর আর কেহ দেখিয়াছে?
পুরুষ। তাহা আমি বলিতে পারি না।
কর্ম্মচারী। এ স্ত্রীলোকটি কে?
পুরুষ। আমারই স্ত্রী।
কর্ম্মচারী। তোমার স্ত্রী?
পুরুষ। হাঁ মহাশয়! ইনি আমার স্ত্রী।
কর্ম্মচারী। আর যে বালকটিকে হত্যা করা হইয়াছে বলিতেছ, সেটি তোমার পুত্র?
পুরুষ। হাঁ মহাশয়!
কর্ম্মচারী। তোমার কয়টি স্ত্রী আছে?
পুরুষ। একটি।
কর্ম্মচারী। তোমার বিবাহ হইয়াছে কয়বার?
পুরুষ। আমার দুই বিবাহ।
কর্ম্মচারী। এটি তোমার প্রথম পক্ষের স্ত্রী, না দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী?
পুরুষ। এটি আমার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী।
কর্ম্মচারী। তোমার প্রথম পক্ষের স্ত্রীও কি বর্তমান আছে?
পুরুষ। না মহাশয়! তাহার মৃত্যুর পর, আমি ইহাকে বিবাহ করিয়াছিলাম।
কর্ম্মচারী। সপত্নী দ্বারা সপত্নী-পুত্র যে হত না হইতে পারে, তাহা নহে। এ পর্যন্ত আমি অনেক ঘটনা দেখিয়াছি, এবং অনেক ঘটনার বিষয় শ্রবণও করিয়াছি, এক সপত্নীর পুত্র, অপর সপত্নী সামান্য সামান্য কারণে খুন করিয়া থাকে; সুতরাং ইহাদ্বারা তোমার পুত্র যে হত না হইতে পারে, তাহা কিছু অসম্ভব নহে। তোমার বালকের বয়ঃক্রম কত ছিল?
পুরুষ। সাত বৎসর মাত্র।
কর্ম্মচারী। তাহাকে এ হত্যা করিল কেন?
পুরুষ। কেন যে হত্যা করিল, তাহা আমি বলিতে পারি না; ও কোন কথা আমাকে বলে নাই।
কর্ম্মচারী। তোমার বালকের মৃতদেহ এখন কোথায়?
পুরুষ। আমাদিগের বাড়ীতেই রহিয়াছে।
কর্ম্মচারী। তাহাকে কিরূপে হত্যা করা হইয়াছে?
পুরুষ। তাহাকে কাটিয়া ফেলিয়াছে।
কর্ম্মচারী। তোমার প্রথমা স্ত্রী আজ কতদিন মরিয়া গিয়াছে?
পুরুষ। প্রায় দশ বৎসর হইবে।
কর্ম্মচারী। তুমি বলিলে না যে, তোমার পুত্রের বয়ঃক্রম সাত বৎসর?
পুরুষ। হ্যাঁ।
কর্ম্মচারী। যদি তোমার স্ত্রী দশ বৎসর মরিয়া গিয়া থাকে, তাহা হইলে তোমার পুত্রের বয়স সাত বৎসর হইল কিরূপে?
পুরুষ। কেন মহাশয়! হইতে পারে না। আমার প্রথমা স্ত্রী প্রায় দশ বৎসর ইহল মরিয়া গিয়াছে। যে বৎসর তাহার মৃত্যু হয়, সেই বৎসরেই আমি পুনরায় বিবাহ করি, এবং বিবাহ করিবার প্রায় দুই তিন বৎসর পরে আমার সেই পুত্র জন্মগ্রহণ করিয়াছে; সুতরাং এক্ষণে তাহার বয়ঃক্রম সাত বৎসর।
কৰ্ম্মচারী। তাহা হইলে সেই পুত্র, তোমার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর গর্ভজাত নহে?
পুরুষ। না।
কর্ম্মচারী। ইহারই সন্তান?
পুরুষ। হাঁ, ইহারই সন্তান।
কর্ম্মচারী। ইহারই গর্ভে সে জন্মগ্রহণ করিয়াছে?
পুরুষ। হাঁ মহাশয়! সে, ইহারই গর্ভজাত সন্তান।
কর্ম্মচারী। আর ইনিই তাহাকে হত্যা করিয়াছেন?
পুরুষ। এই কথা ত সকলে বলিতেছে।
কর্ম্মচারী। তাহা হইলে তোমরা আমাকে এই বুঝাইতে চাহ যে, এই স্ত্রীলোকটি ইহার গর্ভজাত সন্তানকে আপন হস্তে হত্যা করিয়াছে।
পুরুষ। ইহাই সকলে বলিতেছে।
কৰ্ম্মচারী। তাহা হইলে সকলে এই কথা বলিতেছে যে, গর্ভধারিণী মাতা, আপনার স্নেহমমতা ভুলিয়া, আপনার সপ্তম বৎসর বয়স্ক বালককে নিজ হস্তে হত্যা করিয়াছে?
পুরুষ। হাঁ।
কর্ম্মচারী। মিথ্যা কথা; ইহা কখনও হইতে পারে না, আজ পর্য্যন্ত এরূপ কার্য্য কখনও হয় নাই, এবং কখনও হইতে পারিবে বলিয়াও, আমি বিশ্বাস করি না। এরূপ কার্য্য মনুষ্য জগতে কোনরূপেই হইবার সম্ভাবনা নাই।
চৌকিদার। এই কথা ত সকলে বলিতেছে।
কৰ্ম্মচারী। যে বলে, সে বলুক, আমি কখনও বলিব না। এরূপ কার্য্যে, যে বিশ্বাস করে, সে করুক; নিজ চক্ষে দেখিলেও, আমি ইহাতে বিশ্বাস করিতে প্রস্তুত নহি। জননীর নিকট পুত্র যে কি পদার্থ, তাহা জননীই জানেন; তুমি আমি, তাহা বুঝিব কি প্রকারে? স্ত্রী হৃদয়ে পুত্রস্নেহ যে কি ভয়ানক বলবান, তাহা পুত্রবতী নারীই বুঝিতে পারেন। জননীর মনের ভাব জননী ভিন্ন আর কেহই বুঝিয়া উঠিতে সমর্থ হন না। তুমি সামান্য লোক, সামান্য চৌকিদারী কার্য্য করিয়া, জীবিকা নির্ব্বাহ করিয়া থাক, তোমার একটি নহে, চারি পাঁচটি সন্তান আছে, তাহা আমি জানি। তাহারা অন্নবস্ত্রের জন্য সদাসৰ্ব্বদা কষ্ট পাইয়া থাকে, তাহাও আমি দেখিতে পাইতেছি; কিন্তু তুমি তোমার স্ত্রীর নিকট হইতে তোমার একটি পুত্রকে আনিয়া আমাকে একবারে প্রদান কর দেখি। সেই পুত্রের বিনিময়ে আমি তোমাদিগকে তানেক অর্থ প্রদান করিব। এমন কি, সেই অর্থ পাইলে, কিছুদিবসের নিমিত্ত তোমাদিগের দরিদ্রতাও বিদূরিত হইবে। অথচ তোমার পুত্রকে কেহ হত্যা করিবে না, বরং সেও সুখে থাকিবে। কেবলমাত্র তুমি ও তোমার স্ত্রী তাহাকে জন্মের মত আর দেখিতে পাইবে না। কারণ, আমি উহাকে কোন দূরদেশে পাঠাইয়া দিব। এরূপ অবস্থায় যদি তোমার একটি পুত্রকেআমার হস্তে প্রদান করিতে পার, তাহা হইলে আমি বুঝিতে পারিব যে, পুত্রস্নেহ মাতার হৃদয় হইতে ক্রমে অন্তর্হিত হইতেছে। তখন আমার মনে হইলেও ইহতে পারিবে যে, সময়ের পরিবর্তনে স্নেহময়ী জননী তাঁহার স্নেহকে হৃদয় হইতে ক্রমে অন্তর্হিত করিতে সমর্থ হইতেছেন, এবং তখন আমি বুঝিব যে, কোন কোন জননী হয়ত এতদূর অগ্রগামিনী হইতেছে যে, তাঁহার পুত্রকেও তিনি হত্যা করিতে পরাঙ্মুখ নহেন। আর তুমি তোমার স্ত্রীর নিকট হইতে পাঁচটি পুত্রের মধ্যে যদি একটিকেও আনিতে সমর্থ না হও, তাহা হইলে জানিব, জননী হৃদয় যাহা ছিল, এখনও তাহাই আছে; সময়ের পরিবর্তনে তাহার কিছুমাত্র পরিবর্তন হয় নাই। যাও, ইহারা এইস্থানে অপেক্ষা করুক, তুমি তোমার একটি পুত্রকে আমার নিকট লইয়া আইস।
চৌকিদার। আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা কি কখনও হইতে পারে। আমরা দরিদ্র বলিয়া, আপন সন্তানকে কি কখনও বিক্রয় করিতে পারি?
কর্ম্মচারী। তোমরা যাহাই বল না কে, আমি কিন্তু এখন তোমাদিগের কথায় বিশ্বাস করিতে প্রস্তুত নহি। খুন হইয়াছে, মৃতদেহ সেই স্থানে পড়িয়া আছে। চল, আমি সেই স্থানে গিয়া, প্রথমে অনুসন্ধান করিয়া দেখি, তাহা হইলে জানিতে পারিব, এ হত্যা কাহাদ্বারা হইয়াছে। তুমি, মৃতদেহ সেই স্থানে কাহার নিকট রাখিয়া আসিয়াছ?
চৌকিদার। আর একজন চৌকিদারের জিম্মায় সেই মৃতদেহ আমি রাখিয়া আসিয়াছি, যে পর্যন্ত আমরা সেই স্থানে গমন না করিব, সেই পর্য্যন্ত সেই চৌকিদার সেইস্থান পরিত্যাগ করিবে না।
কর্ম্মচারী। তোমার নাম কি?
স্ত্রী। আমার নাম সোহাগিয়া।
কৰ্ম্মচারী। তুমি ইহার স্ত্রী?
সোহাগিয়া। হাঁ।
কর্ম্মচারী। যে বালকটি হত হইয়াছে, সে তোমার কে হইত?
সোহাগিয়া। সে আমার পুত্র।
কর্ম্মচারী। তোমার কয়টি সন্তান?
সোহাগিয়া। সেই একটিমাত্র সন্তান ছিল।
কর্ম্মচারী। তুমি তোমার একমাত্র সন্তানকে কেন হত্যা করিলে?
সোহাগিয়া। আপনি ত ইহার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত সেই স্থানে গমন করিতেছেন, সেই স্থানে নিৰ্জ্জনে আমি সকল কথা আপনাকে বলিব।
কর্ম্মচারী। এখন এখানে সমস্ত কথা বলিতে দোষ কি?
সোহাগিয়া। দোষ কিছুই নাই, এখানে সকলের সম্মুখে আমি কোন কথা বলিতে চাহি না। বিশেষতঃ এখন আমার মস্তকের স্থিরতা নাই, আপনি আমাদিগের বাড়ীতে চলুন, সেই স্থানে আমি সকল কথা আপনাকে বলিব।
কর্ম্মচারী। আচ্ছা, তাহাই হইবে। এখন তোমার স্বামীকে দুই চারটি কথা জিজ্ঞাসা করিয়া দেখি, তিনি কি বলেন?
এই বলিয়া, সোহাগিয়ার স্বামীকে কর্ম্মচারী মহাশয় তাঁহার সম্মুখে ডাকিয়া, তাহাকে পুনরায় নিম্নলিখিতরূপ কয়েকটি কথা জিজ্ঞসা করিলেন। এবং বলিলেন, “তুমি কিছু গোপন না করিয়া, যাহা সত্য ঘটনা, তাহাই বল, তোমার নাম কি?”
পুরুষ। আমার নাম রামসুন্দর।
কর্ম্মচারী। তুমি কি কার্য্য করিয়া থাক?
রামসুন্দর। আমি নানাবিধ দ্রব্যসামগ্রী ফেরি করিয়া, নানাস্থানে বিক্রয় করিয়া থাকি। তাহাতে যে সামান্য উপার্জ্জন করিতে সমর্থ হই, তাহাদ্বারাই আমাদিগের জীবিকা নিৰ্ব্বাহ হয়।
কর্ম্মচারী। তুমি দ্রব্যাদি বিক্রয় করিবার নিমিত্ত কোন্ সময়ে বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া যাইতে?
রামসুন্দর। তাহার কিছু স্থিরতা ছিল না। কোন দিবস প্রাতঃকালেই বহির্গত হইয়া যাইতাম, কোন দিবস বা আহারাদি করিয়া বাড়ী পরিত্যাগ করিতাম।
কর্ম্মচারী। ফেরি করিয়া, তুমি প্রত্যাবর্তন করিতে কোন্ সময়ে?
রামসুন্দর। তাহারও কিছুমাত্র স্থিরতা ছিল না। যেদিবস নিকটবর্ত্তী গ্রাম সকলে গমন করিতাম, সেইদিবস সন্ধ্যার পরই প্রত্যাবর্তন করিতাম। আর যেদিবস ক্রমে দূরে গিয়া পড়িতাম, সেইদিবস এবং সময় সময় দুই তিন দিবস পর্য্যন্তই ফিরিয়া আসিতে পারিতাম না। এই কারণবশতঃ দুই চারিদিবস স্থানান্তরে অতিবাহিত হইয়াও যাইত।
কর্ম্মচারী। যেদিবস তুমি ফেরি করিবার নিমিত্ত বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া যাইতে, বা যে সকল দিবস তুমি প্রত্যাবর্তন করিতে সমর্থ হইতে না, সেই সকল দিবস তোমার বাড়ীতে আর কে থাকিত?
রামসুন্দর। আর কে থাকিবে মহাশয়! আমার স্ত্রীও সেই পুত্রটি ব্যতীত আর কেহই ছিল না, তাহারাই বাড়ীতে থাকিত।
কর্ম্মচারী। ইতিপূর্ব্বে তুমি বলিয়াছ না যে, তোমার বর্ত্তমান স্ত্রী তোমার দ্বিতীয় পক্ষের পরিবার?
রামসুন্দর। হাঁ মহাশয়! তাহা ত পূৰ্ব্বেই আমি আপনাকে বলিয়াছি।
কর্ম্মচারী। তোমার বয়ঃক্রম এখন কত হইয়াছে?
রামসুন্দর। তা ঠিক বলিতে পারি না, বোধ হয়, পঁয়তাল্লিশ বৎসর হইবে।
কর্ম্মচারী। তোমার স্ত্রীর বয়ঃক্রম এখন কত?
রামসুন্দর। দশ বৎসর হইল, আমি তাহাকে বিবাহ করিয়াছি, যখন বিবাহ করিয়াছিলাম, তখন তাহার বয়ঃক্রম চৌদ্দ বৎসর ছিল, এরূপ শুনিয়াছিলাম।
কৰ্ম্মচারী। তাহা হইলে ইহার বয়ঃক্রম এখন আন্দাজ চব্বিশ বৎসর হইবে।
রামসুন্দর। এইরূপই অনুমান হয়।
কর্ম্মচারী। তোমার স্ত্রীর চরিত্র কিরূপ?
রামসুন্দর। পূর্ব্বে খুব ভালই ছিল, কিন্তু ইদানীং তাহার উপর আমার একটু সন্দেহ হইয়াছিল; কিন্তু আমি নিজ চক্ষে কখনও কোন বিষয় দেখি নাই।
কর্ম্মচারী। ইদানীং তুমি যে তাহার চরিত্রের উপর সন্দেহ করিয়াছিলে, তাহা সে জানিতে পারিয়াছিল কি?
রামসুন্দর। জানিতে পারিয়াছিল বৈকি? সেই বিষয় লইয়া, প্রায়ই আমার সহিত তাহার ঝগড়া হইত।
কৰ্ম্মচারী। তুমি যে এক্ষণে তোমার স্ত্রীর চরিত্রের উপর সন্দেহ করিয়াছিলে, এবং মধ্যে মধ্যে তাহার সহিত সেই সম্বন্ধে ঝগড়া হইত, তাহা আর কেহ জানিত কি? কিম্বা ঝগড়া শুনিয়া কেহ তাহার মীমাংসার জন্য আসিত কি?
রামসুন্দর। আমার বাড়ীর আভ্যন্তরীণ কথা, অপরে কি জানিবে? পাড়ার অপর কোন লোক তাহা জানিত কি না, তাহা আমি জানি না।
কর্ম্মচারী। তোমার স্ত্রীর চরিত্রের উপর সত্য হউক, অরা মিথ্যা হউক, তুমি সন্দেহ করিয়াছিলে; সুতরাং তোমাদিগের উভয়ের মধ্যে সময় সময় ঝগড়াও হইত। এরূপ অবস্থায় যাহা কিছু ঘটিবার সম্ভাবনা, তাহা তোমাদিগের উভয়ের মধ্যেই ঘটিবার কথা, কিন্তু তোমার স্ত্রী আপন শিশুসন্তানকে হত্যা করিবে কেন?
রামসুন্দর। কেন, তাহা আমিও ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না, তবে বালকটি তাহার মাতা অপেক্ষা আমার নিতান্ত অনুগত ছিল। অনেক সময় তাহার জননীর অনেক কথা, তাহার সম্মুখেই আমাকেই বলিয়া দিত; তাহাতে সে সময় সময় বালকটির উপর রাগও করিত।
কর্ম্মচারী। তোমার স্ত্রী যে তোমার বালকটিকে হত্যা করিয়াছে, তাহা তুমি কিরূপে জানিতে পারিলে?
রামসুন্দর। আমি নিজে কিছু দেখি নাই, ও আপন মুখে যাহা বলিয়াছিল, তাহাই আমি শুনিয়াছি মাত্র।
কর্ম্মচারী। ও কি বলিয়াছিল?
রামসুন্দর। আমি আপন কাৰ্য্য হইতে প্রত্যাবর্তন করিবামাত্রই বালকটি আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইত। অদ্য যখন আমি প্রত্যাবর্তন করিলাম, তখন আর তাহাকে দেখিতে পাইলাম না। উহার কথা আমি বার বার আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করায়, সে নিতান্ত বিরক্তভাব প্রকাশ করিয়া কহিল, “আমি জানি না, সে কোথায়।” এই কথা শুনিয়া, আমি তাহার উপর ক্রোধ প্রকাশ করিতে লাগিলাম, এবং তাহাকে যৎপরোনাস্তি তিরস্কার, ও উচ্চৈঃস্বরে গালাগালি দিতে লাগিলাম, ইহা পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশিবর্গের শ্রুতিগোচর হওয়াতে, ক্রমে দুই একটি লোকও আসিয়া আমার বাটীতে উপস্থিত হইল। আমার গালাগালিতে সে নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া কহিল, “যা, দেখ, তোমার ছেলে ওই বিচালি গাদার মধ্যে আছে।”
“এই কথা শুনিয়া, আমি প্রথমে উহাতে বিশ্বাস করিলাম না। কিন্তু পাড়ার একটি লোক আমার বাটীতে মধ্যস্থিত বিচালি গাদার নিকট গিয়া, দেখিতে লাগিলেন। দেখিতে দেখিতে, তিনি দেখিতে পাইলেন, সেই বিচালি গাদার একস্থানের বিচালি যেন কিঞ্চিৎ স্থানচ্যুত হইয়া রহিয়াছে। এই অবস্থা দেখিয়া, তিনি সেই স্থানের দুই চারিটি বিচালির আটি সরাইবামাত্রই দেখিতে পাইলেন যে, উহার ভিতর আমার পুত্রের মৃতদেহ রহিয়াছে। এই অবস্থা দেখিয়া, তিনি চীৎকার করিয়া উঠিলেন, আমরা সকলেই সেই স্থানে গমন করিয়া দেখিলাম, বাস্তবিকই উহা আমার পুত্রের মৃতদেহ। উহার শীরের অস্ত্রের আঘাত, ও সেই স্থান রক্তে আপ্লুত রহিয়াছে।
“এই অবস্থা দেখিয়া, আমি আমার মৃত পুত্রকে সেইস্থান হইতে বাহিরে আনিলাম। সেই সময় যাঁহারা সেইস্থানে উপস্থিত ছিলেন, তাঁহারা সকলেই আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইহাকে কে হত্যা করিয়াছে?’
“উত্তরে সে কহিল, ‘আর কে উহাকে হত্যা করিবে, ও যাহার গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছে, সেই-ই উহাকে হত্যা করিয়াছে। আমিই উহাকে মারিয়া ফেলিয়াছি।”
“আমার স্ত্রীর কথা শুনিয়া, সকলেই একবারে আশ্চর্য হইয়া পড়িলেন। পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে চাহিতে লাগিলেন। এই কথা ক্রমে নক্ষত্রবেগে গ্রাম মধ্যে প্রকাশিত হইয়া পড়িল। জননী কর্তৃক পুত্র হত্যা হইয়াছে, এই কথা যাঁহার কর্ণে প্রবেশ করিল, তিনিই আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন। ক্রমে চৌকিদারগণও এই সংবাদ জানিতে পারিয়া, আমার বাড়ীতে আগমন করিল, এবং সেই স্থান হইতে আমাদিগকে আনিয়া, আপনার সম্মুখে উপস্থিত করিয়াছে।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্ম্মচারী মহাশয় উহাদিগকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া, সেই সময়ের প্রয়োজনীয়, যাহা কিছু লেখাপড়ার প্রয়োজন ছিল, তাহা যতশীঘ্র পারিলেন, শেষ করিয়া লইয়া, ঘটনাস্থলে যাইবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইলেন। আমাকে কহিলেন, “ঘটনাস্থল এই স্থান হইতে বহুদূরবর্তী নহে, যদি আপনার বিশেষ কোনরূপ প্রয়োজনীয় কাৰ্য্য এখন না থাকে, তাহা হইলে আপনিও কেন আমার সঙ্গে চলুন না; এই মোকদ্দমায় আমার প্রথম হইতেই কেমন একরূপ ধোঁকা লাগিতেছে। গর্ভধারিণী জননী তাহার সপ্তম বৎসর বয়স্ক শিশুকে স্বহস্তে হত্যা করিয়াছে, ইহা যেমন আমার মনেই স্থান পাইতেছে না। আমি রাত্রিকালে সেই স্থানে অবস্থিতি করিব না, ঘটনাস্থলটি একবার দেখিয়া, এবং মৃতদেহটি সেই স্থান হইতে স্থানান্তরিত করিবার ব্যবস্থা করিয়াই প্রয়োজনীয় সমস্ত লোককে থানায় লইয়া আসিব, এবং এই স্থানে বসিয়া বসিয়াই অনুসন্ধান শেষ করিব। সুতরাং আপনি যদি আমার সহিত গমন করেন, তাহা হইলে আপনাকেও সেইস্থানে থাকিতে হইবে না। আমরা উভয়েই শীঘ্র সেই স্থান হইতে প্রত্যাবৰ্ত্তন করিব। আর কার্য্যগতিকে যদি এরূপ ঘটনাই ঘটিয়া পড়ে যে, আমাকে সেই স্থানে অবস্থিতি করিতে হইবে, তাহা হইলে দুই একজন চৌকিদার লইয়া, আপনি চলিয়া আসিবেন। আপনাকে সেই স্থানে যাইবার নিমিত্ত আমার অনুরোধ করিবার উদ্দেশ্য এই যে, যে বিষয় আমি প্রথম হইতেই ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না, সেই বিষয় সম্বন্ধে পরামর্শ করিয়া, কার্য্য করাই কর্তব্য। অথচ এ সম্বন্ধে একটু বুঝিতে পারেন, এরূপ কোন ব্যক্তিই, এখন এখানে নাই।
কর্ম্মচারী মহাশয়ের কথা শুনিয়া, আমি তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হইলাম, ও তৎক্ষণাৎ তাঁহার সহিত সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম।
নিয়মিত সময়ে আমরা ঘটনাস্থলে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, সপ্তম বৎসর বয়স্ক বালকের মৃতদেহ রামসুন্দরের বাটীর প্রাঙ্গণে পড়িয়া রহিয়াছে। একজন মাত্র চৌকিদার সেই মৃতদেহের নিকট উপস্থিত আছে; কিন্তু গ্রামের লোকদ্বারা সেইস্থান একেবারে আচ্ছন্ন হইয়া রহিয়াছে। আমরা সেই স্থানে উপস্থিত হইবামাত্র, কতকগুলি লোক সেই স্থান হইতে বহির্গত হইয়া বাটীর বাহিরে গমন করিল। তাহাদিগের মধ্যে অনেকের মুখেই এই কথা, কি ভয়ানক! মায়ের এই কার্য্য! গর্ভধারিণী যে তাহার গর্ভজাত পুত্রকে স্বহস্তে হত্যা করিতে পারে, এই কথা ত আর পূর্ব্বে শুনি নাই। কিন্তু আজ স্বচক্ষে তাহা দর্শন করিলাম। তোর চরিত্র কলুষিত হইয়াছে, পাপ কাৰ্য্য করিতে তোর মন অগ্রগামী হইয়াছে, হউক, তাই বলিয়া, আপন পুত্রকে হত্যা? কি ভয়ানক!! ওরূপ নারকিনীর মুখ দেখিলেও প্রায়শ্চিত্ত করিতে হয়।
দর্শকমণ্ডলীর মুখে এইরূপ কথা শুনিতে শুনিতে, আমরা সেই মৃতদেহের নিকট গিয়া উপস্থিত হইলাম। মৃতদেহটি উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম, উহার গলদেশে একটি ভয়ানক আঘাতের চিহ্ন রহিয়াছে। বুঝিলাম, উহার মৃত্যুর কারণই সেই ভয়ানক আঘাত। তদ্ব্যতীত উহার উভয় উরুর উপর দুইটি স্থানের মাংস দেখিতে পাইলাম না। দেখিয়া বোধ হইল, কোন অস্ত্রদ্বারা সেই দুই স্থানের মাংস যেন কাটিয়া লওয়া হইয়াছে। সেইস্থানে সেই মাংস দুইখণ্ডের অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু কোন স্থানেই তাহার কোনরূপ চিহ্ন দেখিতে পাইলাম না। যে বিচালিগাদার মধ্যে সেই মৃতদেহ প্রথম দেখিতে পাওয়া গিয়াছিল, সেই স্থানটিও উত্তমরূপে দেখিলাম, সেই স্থানের বিচালি সকল একবারে রক্তাপ্লুত; কিন্তু দেহ হইতে বিচ্যুত মাংস দুইখণ্ডের কোনরূপ চিহ্ন সেই স্থানে দেখিতে পাইলাম না।
একবার ভাবিলাম, সেই বালকটি হত্যা করিবার পর, কোন জন্তু উহার উভয় উরুর মাংস ভক্ষণ করিয়া ফেলিয়াছে বলিয়াই বোধ হয়, এইরূপ চিহ্ন হইয়াছে, এবং সেই নিমিত্তই ওই দুই মাংস খণ্ডের সন্ধান পাওয়া যাইতেছে না। কিন্তু ক্ষতস্থান দুইটি উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিয়া, কোন জন্তুর কোনরূপ দত্ত চিহ্ন সেই স্থানে দেখিতে পাইলাম না। অধিকন্তু বোধ হইল, যেন কোনরূপ তীক্ষ্ণ অস্ত্রদ্বারা সেই স্থান ছেদিতে হইয়াছে। যাহা হউক, ভাবিয়া-চিন্তিয়া এ সম্বন্ধে কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না।
ইহার পর প্রতিবেশিদিগের মধ্যে একটু অনুসন্ধান আরম্ভ করা হইল। কৰ্ম্মচারী মহাশয় এক এক করিয়া, অনেককেই অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলেন; কিন্তু তাহাদিগের মধ্যে অনেকেই কহিল, “আমরা ইহার কিছুই অবগত নহি।” দুই একজন দুই একটি কথা বলিল বটে; কিন্তু কেহ যে কোন বিষয় স্বচক্ষে দর্শন করিয়াছে তাহা কহিল না। কিন্তু তাহাদিগের নিকট হইতে নিম্নলিখিত কথাগুলি জানিতে পারা গেল।
১। রামসুন্দর সেইস্থানে অনেকদিবস হইতে বাস করিতেছে, তাহার চরিত্রের বিপক্ষে এ পর্য্যন্ত কেহ কোন কথা শ্রবণ করে নাই।
২। রামসুন্দর প্রায়ই তাহার বাড়ীতে থাকে না। আপন কাৰ্য্য উপলক্ষে প্রায় সদা সৰ্ব্বদাই সে নানাস্থানে ঘুরিয়া বেড়ায়।
৩। রামসুন্দরের প্রথম পক্ষের স্ত্রীর জীবিত অবস্থায়, উভয়ের মধ্যে একদিবসের নিমিত্ত কেহ কখনও ঝগড়া- বিবাদ হইতে দেখে নাই, বা কোন কথা শুনিতেও পায় নাই। যতদিবস রামসুন্দরের প্রথমা পত্নী জীবিতা ছিল, ততদিবস উভয়েই মনের সুখে দিনযাপন করিয়াছে, ইহাই সকলে দেখিয়াছে।
৪। রামসুন্দরের প্রথমা পত্নী নিঃসন্তান অবস্থায় মরিয়া যায়।
৫। পুনরায় দারপরিগ্রহের ইচ্ছা রামসুন্দরের ছিল না; কিন্তু আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশিগণের অনুরোধ এড়াইতে না পারিয়া, সে সোহাগিয়াকে বিবাহ করে।
৬। যে বালকটি হত হইয়াছে, সেইটিই রামসুন্দরের একমাত্র সন্তান ছিল।
৭। রামসুন্দরের বাটীতে অপর লোকজন আর কেহই নাই। রামসুন্দর যে সময় বাটীতে থাকিতে না, সেই সময় সোহাগিয়াও প্রায় তাহার বাটীতে থাকিত না, পাড়ার ভিতর এবাড়ী ওবাড়ী করিয়াই প্রায় দিন অতিবাহিত করিত।
৮। রামসুন্দরের অনুপস্থিতিতে এই বালকটিও সৰ্ব্বদাই সোহাগিয়ার সঙ্গে সঙ্গে থাকিত।
৯। বালকটিকে সদাসর্বদা সঙ্গে রাখিতে যেন সোহাগিয়া ভালবাসিত না। তাঁহার উপর সদাসর্বদা যেন বিরক্তিভাব প্রকাশ করিত, এবং সামান্য সামান্য কারণে উহাকে খুব প্রহার করিত
১০। সময় সময় বালকটিকে তাহার বাটীতে রাখিয়া সোহাগিয়া বাটী হইতে বাহির হইয়া যাইত। বালকটি যখন জানিতে পারিত যে, তাহার মাতা বাটীতে নাই, তখন সে চীৎকারস্বরে ক্রন্দন করিতে করিতে, বাটী হইতে বহির্গত হইত, এবং কাঁদিতে কাঁদিতে, পাড়ার ভিতর প্রবেশ করিত। সোহাগিয়ার কর্ণে সেই ক্রন্দনধ্বনি উপস্থিত হইলে, কাযেই তাহাকে আসিয়া সেই বালকটিকে লইয়া যাইতে হইত; কিন্তু বালকটি সেই সময় তাহার নিকট যথেষ্ট প্রহারও খাইত।
১১। বালকটি রামসুন্দরের নিতান্ত অনুগত ছিল, রামসুন্দর যতক্ষণ বাটীতে থাকিত, বালকটি মুহূর্তের নিমিত্ত তাহার সঙ্গ পরিত্যাগ করিত না।
১২। রামসুন্দরও বালকটিকে প্রাণের সহিত ভালবাসিত, এবং যে পর্য্যন্ত সে বাটীতে থাকিত, সেই পৰ্য্যন্ত সে তাহাকে আপনার চক্ষুর অন্তরালে থাকিতে দিত না।
১৩। সোহাগিয়ার চরিত্রের উপর আজকাল পাড়ার অনেকেই অনেকরূপ সন্দেহ করিয়া থাকেন।
১৪। তাহার প্রতিবেশী ব্রজভূখনের উপর আজকাল যেন সোয়াগিয়ার একটু ভালবাসা পড়িয়াছে। পাড়ার অনেকেরই মুখে ইহা মধ্যে মধ্যে শুনিতে পাওয়া যায়।
১৫। সোহাগিয়া আজকাল প্রায় ব্রজভূখনের দোকানেই থাকে, বাটী হইতে বহির্গত হইয়া, পূর্ব্বে যেমন পাড়ার অনেকের বাটীতে গমন করিত, আজকাল আর সোহাগিয়া অপর কোন স্থানে গমন করে না, একবারে ব্রজভূখনের দোকানে গিয়া উপস্থিত হয়।
১৬। সময় সময় ব্রজভূখনকেও সোহাগিয়ার বাটীতে দেখিতে পাওয়া যায়; কিন্তু যে সময় রামসুন্দর বাটীতে থাকে, সেই সময় ব্রজভূখন সেই স্থানে গমন করে না।
১৭। ব্রজভূখনের বাটীতেই তাহার একটি সামান্য মুদিখানার দোকান আছে, তাহার স্ত্রী সেই দোকানে বসিয়া দোকানদারী করে, ব্রজভূখন দোকানের আবশ্যক দ্রব্যসামগ্রী আনিয়া দেয়, ও নানাস্থানে ঘুরিয়া বেড়ায়। সেই দোকান হইতে সামান্য যাহা কিছু উপার্জ্জন করিয়া থাকে, তাহাদ্বারাই ব্রজভূখন তাহার বৃদ্ধ মাতা ও স্ত্রীর ভরণপোষণ নির্ব্বাহ করিয়া থাকে।
১৮। ব্রজভূখনের স্ত্রীর সহিত সোহাগিয়ার আজকাল খুব ভাব, এমন কি, সময় সময় কোন কোন দ্রব্যসামগ্রী দিয়াও সোহাগিয়া ব্রজভূখনের স্ত্রীর সাহায্যও করিয়া থাকে।
১৯। ব্রজভূখনের বয়ঃক্রম খুব অধিক নহে; বোধ হয়, ত্রিশ বৎসরের অধিক হইবে না।
২০। আজকাল অনেকেই অনুমান করেন, ব্রজভূখনের সহিত সোহাগিয়ার অবৈধ প্রণয় জন্মিয়াছে। সে এক্ষণে ব্রজভূখনকে প্রাণের সহিত ভালবাসে, তাহার জন্য সে সব করিতে প্রস্তুত।
প্রতিবেশিগণের নিকট হইতে এই সকল বিষয় অবগত হইয়া, কর্ম্মচারী মহাশয়ের মনের গতি ক্রমে পরিবর্তিত হইতে লাগিল, তখন তাঁহার মনে হইল—
১। সকলে যাহা অনুমান করিতেছে, হয়ত তাহাই প্রকৃত।
২। চৌকিদার ও রামসুন্দর যাহা তাঁহাকে পূৰ্ব্বে বলিয়াছিল, হয়ত তাহাই সত্য।
৩। তিনি যে কথায় সহজে বিশ্বাস করিতে চাহিতেছিলেন না, এখন সেই কথাই যেন প্রকৃত বলিয়া বোধ হইতেছে।
৪। সংসারে যাহা হইতে পারে না বলিয়া সকলে অনুমান করেন, কালের পরিবর্তনে এখন তাহাই ঘটিতে বসিয়াছে।
মনে মনে এইরূপ অনুমান করিয়া, কৰ্ম্মচারী মহাশয় সেই বাটীর আভ্যন্তরীণ সমস্ত স্থান উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলেন। ঘরের মধ্যে একস্থানের অবস্থা দেখিয়া, বোধ হইল, সেইস্থানটি নূতন পরিষ্কৃত; কিন্তু উহার ভিতর যেন রক্তের চিহ্ন আছে বলিয়া অনুমিত হয়। ঘরের মধ্যে একখানি বড়গোছের বঁটি রহিয়াছে, সেই বঁটিখানি উত্তমরূপে পরিষ্কৃত হইলেও, উহাতে রক্তের চিহ্ন এখন পৰ্য্যন্ত বিদ্যমান।
অনুসন্ধান করিয়া ঘরের মধ্যে সন্দেহযুক্ত আর কোন দ্রব্য বাহির হইল না। যেস্থানে উহাদিগের “চৌকা” বা রন্ধনশালা, সেই স্থানে আহারীয় প্রস্তুত রহিয়াছে। বোধ হইল, আহারীয় প্রস্তুত হইয়াছিল, কিন্তু আহার করিবার পূৰ্ব্বেই এই সকল গোলযোগ উপস্থিত হইয়াছিল বলিয়া, যে স্থানের আহারীয় সেইস্থানেই রহিয়াছে, কেহই আহার করেন নাই।
বাটীর এই সকল অবস্থা দেখিবার বর, প্রতিবেশিদিগের মধ্যে একটু অনুসন্ধান করা হইল; কিন্তু বিশেষ আর কোন কথা অবগত হইতে পারা গেল না।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
এই সকল অবস্থা দেখিবার পর, আমরা নিকটবর্তী একটি স্থানে গিয়া উপবেশন করিলাম। সেই স্থানে অপর আর কেহই রহিলেন না, কেবলমাত্র আমি ও সেই কৰ্ম্মচারী মহাশয় থাকিলাম মাত্র। এই ঘটনা সম্বন্ধে আমরা উভয়ে একটু পরামর্শ করিয়া সোহাগিয়াকে সেইস্থানে আনাইলাম। কৰ্ম্মচারী মহাশয় তাহাকে কহিলেন, “দেখ সোহাগিয়া, এই ঘটনার প্রকৃত অবস্থা কি? তাহা বল দেখি। ইতিপূর্ব্বে এই অবস্থা যখন আমি চৌকিদার ও তোমার স্বামীর মুখে শ্রবণ করিয়াছিলাম, তখন আমার বেশ প্রতীতি জন্মিয়াছিল যে, যে কাৰ্য্য এদেশে কখনও হইতে পারে না, সেই কার্য্য তোমাদ্বারা কিরূপে সাধিত হইবে। কিন্তু এখন দেখিতেছি, এই কাৰ্য্য হয়— তোমাদ্বারা, হইয়াছে না হয়— তোমার বন্ধু ব্রজভূখনের দ্বারা হইয়াছে। এখন তোমার উচিত প্রকৃত কথা আমাদিগের নিকট প্রকাশ করা; কারণ, প্রকৃত কথা জানিতে পারিলে, আমাদিগের কোন্ পথ অবলম্বন করা কর্তব্য, তাহা আমরা অনায়াসেই বুঝিতে পারিব, ও ইচ্ছা করিলে, তোমাকে বাঁচাইতেও পারিব। কিন্তু যদি তোমার নিকট হইতে প্রকৃত কথা অবগত হইতে না পারি, তাহা হইলে নিশ্চয় জানিও এই সপ্তম বৎসর বয়স্ক শিশুকে হত্যা করার অপরাধে, ব্রজভূখনকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিতে হইবে, এবং তোমারও পরিণামে যে কি হইবে, তাহাও আমরা এখন বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না।”
সোহাগিয়া। ব্রজভূখন ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিবে কেন?
কর্ম্মচারী। মনুষ্য হত্যা করিলে, ফাঁসি যাইতে হয়, ইহা কি তুমি অবগত নহ?
সোহাগিয়া। অবগত আছি বলিয়াই জিজ্ঞাসা করিতেছি। ব্রজভূখনের ফাঁসি হইবে কেন?
কর্ম্মচারী। সে তোমার পুত্রটিকে হত্যা করিয়াছে, এই নিমিত্ত তাহাকে ফাঁসি যাইতে হইবে।
সোহাগিয়া। সে যে আমার বালকটিকে হত্যা করিয়াছে, একথা আপনাদিগকে কে বলিল?
কর্ম্মচারী। আমরা জানিতে না পারিয়াই কি, তোমাকে এই কথা কহিতেছি?
সোহাগিয়া। একথা আপনাদিগকে যিনি বলিয়াছেন, তিনি মিথ্যা কথা কহিয়াছেন। এ হত্যা ব্রজভূখনদ্বারা হয় নাই।
কৰ্ম্মচারী। তুমি বলিতেছে, এ হত্যা ব্রজভূখনদ্বারা হয় নাই; কিন্তু ব্রজভূখন যদি নিজে স্বীকার করে যে, এই হত্যা তাহাদ্বারা হইয়াছে?
সোহাগিয়া। কেন, সে স্বীকার করিয়াছে নাকি?
কর্ম্মচারী। না করিলে তোমাকে বলিব কেন?
সোহাগিয়া। যদি সে স্বীকার করিয়া থাকে, তাহা হইলে সে মিথ্যা কথা কহিয়াছে।
কর্ম্মচারী। তাহার মিথ্যা কথা কহিবার প্রয়োজন?
সোহাগিয়া। প্রয়োজন আছে।
কাচারী। কি?
সোহাগিয়া। অপরের জীবন রক্ষা করা।
কর্ম্মচারী। কাহার জীবন রক্ষা করা?
সোহাগিয়া। যে হত্যা করিয়াছে, তাহার জীবন রক্ষা করা।
কর্ম্মচারী। কে হত্যা করিয়াছে?
সোহাগিয়া। কে হত্যা করিয়াছে, তাহা কি আপনারা এখনও বুঝিতে পারেন নাই?
কর্ম্মচারী। বুঝিতে পারিয়াছি, ব্রজভূখন হত্যা করিয়াছে।
সোহাগিয়া। না মহাশয়! মিথ্যা মিথ্যা তাহার নাম করিতেছেন, কেন? এই হত্যা তাহাদ্বারা হয় নাই।
কর্ম্মচারী। তাহা হইলে স্পষ্ট করিয়াই বল না কেন, এ হত্যা কাহাদ্বারা হইয়াছে?
সোহাগিয়া। এই হত্যা আমাদ্বারা হইয়াছে, আমিই আমার পুত্রকে হত্যা করিয়াছি।
কৰ্ম্মচারী। মিথ্যা কথা, গর্ভধারিণী কখনও তাহার পুত্রকে হত্যা করিতে পারে না; তোমাদ্বারা এই হত্যা হয় নাই, তুমি মিথ্যা কেন এই গুরু অপরাধ নিজের উপর অর্পণ করিতেছ।
সোহাগিয়া। আমি মিথ্যা কথা বলিতেছি না, বা আমি অপরকে বাঁচাইবার চেষ্টাও করিতেছি না; এই হত্যা প্রকৃতই আমি আমার নিজ হস্তে সম্পন্ন করিয়াছি?
কর্ম্মচারী। কেবলমাত্র তোমার মুখের কথায়, আমরা বিশ্বাস করিতে কোনরূপেই প্রস্তুত নহি, তোমার এই কার্য্য করিবার সময়, যদি কেহ দেখিয়া থাকে, এবং তিনি যদি তাহা স্বীকার করেন, তাহা হইলে তুমি যে প্রকৃত কথা বলিতেছ, তাহা আমরা বিশ্বাস করিতে পারি, নতুবা তোমার কথা আমরা কিরূপে বিশ্বাস করিব?
সোহাগিয়া। হত্যা করিবার সময় এক ব্যক্তি দেখিয়াছেন, তিনি যদি প্রকৃত কথা কহেন, তাহা হইলেই আপনারা জানিতে পারিবেন যে, আমার কথা প্রকৃত কি না। আর তাঁহাকে বুঝাইয়া বলিলে তিনিই বা প্রকৃত কথা না বলিবেন কেন?
কর্ম্মচারী। হত্যা করিবার সময় কে সেই স্থানে উপস্থিত ছিল, এবং কেইবা তাহা স্বচক্ষে দর্শন করিয়াছে?
সোহাগিয়া। ব্রজভূখন সেই সময় আমার ঘরের ভিতর উপস্থিত ছিলেন, তাঁহার সম্মুখেই আমি এই কাৰ্য্য সম্পন্ন করিয়াছি। তিনিই ইহার সাক্ষী, এখন তিনিই যদি প্রকৃত কথা কহেন, তাহা হইলেই আপনারা জানিতে পারিবেন, আমি মিথ্যা কথা কহিতেছি, কি সত্য কথা বলিতেছি।
কর্ম্মচারী। তুমি তোমার গর্ভজাত পুত্রকে হত্যা করিলে কেন?
সোহাগিয়া। সে অনেক কথা। যদি আপনারা শুনিতে চাহেন, তাহাও এখন আমি বলিতে প্রস্তুত আছি। আমি আমার অবস্থা প্রথম হইতে বলিতেছি, আপনারা এবণ করুন।
এই বলিয়া সোহাগিয়া তাহার কাহিনী প্রথম হইতে আরম্ভ করিয়া, সমস্তই বলিতে লাগিল।
তাহার কথা শ্রবণ করিতে করিতে, কর্মচারী মহাশয় কহিলেন, “সোহাগিয়া যখন সমস্ত অবস্থা আনুপূর্ব্বিক বর্ণন করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে, তখন এইস্থানে ব্রজভূখনের উপস্থিতি, আবশ্যক নাহয় কি?”
তাঁহার কথার উত্তরে আমি কহিলাম, আমার বিবেচনায় ব্রজভূখনকে এখন কোন কথা জিজ্ঞাসা করা কর্তব্য নহে। কারণ, এই হত্যার প্রধান সাক্ষীই ব্রজভূখন; কিন্তু তাহাকে এখন যদি কোন কথা জিজ্ঞাসা করেন, তাহা হইলে সে নিশ্চয়ই সমস্ত কথা অস্বীকার করিবে। সে একবার অস্বীকার করিলে, তাহাকে পুনরায় স্বীকার করান দায় হইয়া পড়িবে। কিন্তু এখন যদি সে এই স্থানে আনীত হয়, ও তাহার সম্মুখে সোহাগিয়া সমস্ত কথা স্বীকার করে, তাহা হইলে সেও সমস্ত কথা বলিলেও বলিতে পারে।
আমার কথা শুনিয়া কৰ্ম্মচারী মহাশয় কহিলেন, “আমারও সেই মত।” এই বলিয়া, তিনি ব্রজভূখনকে সেই স্থানে আনাইবার নিমিত্ত একজন লোক প্রেরণ করিলেন। দেখিতে দেখিতে, সেই লোকটি ব্রজভূখনকে সঙ্গে করিয়া, সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল।
ব্রজভূখন সেই স্থানে আসিয়াই আমাদিগকে কহিল, “ আমাকে কি নিমিত্ত ডাকিয়াছেন?” ইহাতে কৰ্ম্মচারী মহাশয় কহিলেন, “প্রয়োজন আছে, তুমি এই স্থানে উপবেশন কর।” ব্রজভূখন সেই স্থানে উপবেশন করিল।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
সোহাগিয়া কহিলেন, “মহাশয়! আমি নিতান্ত দরিদ্রের কন্যা নহি। আমার স্বামীর যেমন অবস্থা, তাহা অপেক্ষা আমার পিতার অবস্থা অনেক ভাল। কিন্তু পিতৃদেব কি জন্য যে ইঁহার সহিত বিবাহ দিয়াছিলেন, তাহা জানি না। যে সময় আমার বিবাহ হয়, সেই সময় আমি নিতান্ত বালিকা ছিলাম না। সংসারের সমস্ত বিষয় আমি বুঝিতে পারিতাম। যখন দেখিলাম, ইঁহার প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর পর, আমার পিতৃদেব, ইঁহারই সহিত আমার বিবাহের সম্বন্ধ করিতেছেন, সেই সময়েই আমি বুঝিতে পারিয়াছিলাম যে, আমার অদৃষ্টে অনেক দুঃখ আছে। কথায় কথায়, আমি আমার মনের ভাব একদিবস আমাদিগের পাড়ার একটি স্ত্রীলোকের নিকট বলিয়াছিলাম, এবং শুনিয়াছিলাম, তিনিও উহা আমার পিতাকে বলিয়াছিলেন; কিন্তু আমার পিতা সেই কথায় কর্ণপাত করেন না। সে অনেকদিবসের কথা। যাহা হউক, পরিশেষে আমার বিবাহ হইয়া গেল, কিছুদিবস পরে আমার পিতাও ইহলোক পরিত্যাগ করিলেন। আমাকে আমার স্বামিগৃহে আসিয়া বাস করিতে হইল। আমি আমার স্বামিগৃহে বাস করিতে লাগিলাম, তাহার উপার্জিত অর্থে জীবনধারণ করিতে লাগিলাম। কিন্তু স্বামীর উপর আমার মন স্থির করিতে পারিলাম না। আপন মনকে বশীভূত করিবার নিমিত্ত প্রথম অনেক চেষ্টা করিয়াছিলাম; কিন্তু যখন কোনরূপেই কৃতকার্য্য হইতে পারিলাম না, তখন আমি আমার মনের গতিরোধ করিতে আর কোনরূপ চেষ্টাও করিলাম না, সে তাহার ইচ্ছানুযায়ী পথ অবলম্বন করিতে প্রবৃত্ত হইল।
“যদিও আমি আমার স্বামীর উপর চিত্ত স্থির করিতে পারি নাই, তথাপি তাঁহার ঔরসে ও আমার গর্ভে ওই বালকটি জন্মগ্রহণ করে। আমার মনের গতি নানারূপ পরিবর্ত্তিত হইলেও, পুত্রটি জন্মিবার পূর্ব্ব পর্য্যন্ত আমার চরিত্র একবারে কলুষিত হয় না। লোকলজ্জার ভয়ে, আমি কোনরূপ দুষ্কার্য্য করিতে পারি নাই। এইরূপে কিছুদিবস অতিবাহিত হইতে হইতে, আমি যে সুযোগ অনুসন্ধান করিতেছিলাম, ক্রমে সেই সুযোগ প্রাপ্ত হইলাম। এই ব্রজভূখনের সহিত আমার স্বামীর অতিশয় সৌহার্দ্য ছিল। ব্রজভূখন সদাসৰ্ব্বদা আমাদিগের বাটীতে আসিতেন, আমার স্বামীও সদাসর্ব্বদা তাঁহাদিগের বাড়ীতে গমন করিতেন। ব্রজভূখনের সহিত আমারও কোনরূপ ‘পরদা’ ছিল না, আমি তাঁহার সম্মুখে বাহির হইতাম, তাঁহার সহিত কথা কহিতাম, ও সদাসর্ব্বদা তাঁহার বাড়ীতেও গমন করিতাম। সুতরাং ক্রমে তাঁহার উপর আমার লক্ষ্য পড়িল, ইহার পূর্ব্ব হইতেই ব্রজভূখনের মনের গতিও আমি কতক বুঝিতে পারিয়াছিলাম; কিন্তু একদিবস আমার স্বামীর অনুপস্থিতিতে তাঁহার সহিত অপরাপর কথা উপলক্ষে, আমাদিগের উভয়ের মনের ভাব প্রকাশ হইয়া পড়িল। তাহার পর হইতেই আমি আমার নারীধর্ম্ম বিসর্জ্জন দিয়া, চিরদিবসের নিমিত্ত মহাপাপে লিপ্ত হইলাম। আমি যদিও মনে জানিতাম যে, আমি কি ভয়ানক দুষ্কার্য্যই করিতেছি, তথাপি মনের গতিরোধ করিতে সমর্থ হইতাম না।
“আমি এইরূপ ভয়ানক মহাপাপ করিতে প্রবৃত্ত হইলাম সত্য; কিন্তু লোকলজ্জার ভয় এ পর্যন্তও পরিত্যাগ করিতে পারিয়াছিলাম না। আমি যে সকল মহাপাপ করিতাম, তাহা বিশেষ গোপন রাখিবারই চেষ্টা করিতাম। ব্রজভূখনের সহিত যে আমি অস্বাভাবিক প্রণয়ে আবদ্ধা হইয়াছি, তাহা যাহাতে প্রকাশ না পায়, সদাসর্ব্বদা সেইরূপ চেষ্টাতেই নিযুক্ত থাকিতাম। পূর্ব্বে যেরূপ ভাবে ব্রজভূখনের সহিত কথাবার্তা কহিতাম, যেরূপভাবে তাঁহাদিগের বাড়ীতে গমন করিতাম, আমার মনের ভিতর যাহাই হউক, এখনও কিন্তু সেইরূপ ভাব, দেখাইয়া চলিতাম বলিতে কি, আমি ব্রজভূখনের সহিত অবৈধ প্রণয়ে আসক্তা হইবার পর, দুই তিন বৎসর পর্য্যন্ত একথা কেহই জানিতে পারে না, বা আমার উপর কাহারও কোনরূপ সন্দেহও হয় না।
“এখনও বোধ হয়, এক বৎসর অতীত হয় নাই, একদিবস দিবাভাগে ব্রজভূখন আমাদিগের বাটীর দাওয়ায় বসিয়া আছেন, বালকটি সেই স্থানে খেলা করিয়া বেড়াইতেছে, আমিও ব্রজভূখনের কিঞ্চিৎ দূরে উপবেশন করিয়া, তাঁহার সহিত গল্প করিতেছি। এমন সময় আমার স্বামী হঠাৎ বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি সেই সময়ে আমাদিগকে কিছু বলিলেন না; কিন্তু ব্রজভূখন চলিয়া যাইবার পর আমাকে কহিলেন, “যখন আমি বাটীতে নাই, তখন এরূপ ভাবে অপরের সহিত কথাবার্তা কহা, তোমার কর্ত্তব্য নহে।’
“আমার স্বামীর কথার উত্তরে, আমি একটু রাগভাব প্রকাশ করিয়া কহিলাম, ‘বয়স অধিক হইলেই তাহার মনে নানারূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হয়। ব্রজভূখন পাড়ার লোক, সদাসর্বদা আমাদিগের বাটীতে আসিয়া থাকেন, আমিও সৰ্ব্বদা তাঁহাদিগের বাটীতে গিয়া থাকি, এবং সর্ব্বদাই তাঁহার সহিত কথা কহিয়া থাকি। এরূপ অবস্থায় তাঁহার সহিত কথা কওয়া যে দোষাবহ, তাহা আমি মনে করি নাই। আমাকে যাহা বলিবার তাহা বলিলে, কিন্তু ভবিষ্যতে এরূপ কথা আর মুখে আনিও না, পাড়ার লোক একথা শুনিতে পাইলে নিশ্চয়ই মনে করিবে যে, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তোমার মস্তিষ্কের বৈপরীত্য ঘটিয়াছে।’
“আমার কথা শুনিয়া, আমার স্বামী আর কোন কথা কহিলেন না; আমি ভাবিলাম, আমার কথা শুনিয়া, তাঁহার মনের সন্দেহ দূর হইয়াছে।
“যখন আমাদিগের মধ্যে এইরূপ কথাবার্তা হইতেছিল, তখন ওই বালকটি সেই স্থানে উপস্থিত ছিল। দেখিলাম, আমাদিগের কথাগুলি সে বিশেষ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিল।
“বালকটি আমার গর্ভজাত সন্তান হইলেও, সে আমার ততটা অনুগত ছিল না। আমা অপেক্ষা তাহার পিতার সে অধিক অনুগত ছিল। যে পর্য্যন্ত আমার স্বামী বাড়ীতে থাকিতেন, সে পর্য্যন্ত সে তাঁহার সঙ্গ ছাড়িত না। তাঁহার সঙ্গে ভোজন, তাঁহার সঙ্গে উপবেশন, এবং তাঁহারই সহিত শয়ন করিত। নিকটবর্তী কোন স্থানে তিনি গমন করিলে, সেও ছায়ার ন্যায় তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিত। আমার স্বামীও উহাকে আপন প্রাণ অপেক্ষা ভালবাসিতেন, সদাসৰ্ব্বদা তাহাকে ক্রোড়ে ক্রোড়েই রাখিতেন।
“যে পর্য্যন্ত তিনি বাটীতে থাকিতেন, সেই সময় সে আমার নিকটেও আসিত না। আমি আহারীয় প্রদান করিলেও, সে তাহা লইবার নিমিত্ত আগমন করিত না। কার্য্য উপলক্ষে তিনি যখন স্থানান্তরে গমন করিতেন, সেই সময় কেবলমাত্র সে আমার নিকট থাকিত।”
বালকটির বয়স নিতান্ত অল্প হইলেও, সে অতিশয় চালাক-চতুর ছিল, এবং তাহার বুদ্ধি নিতান্ত প্রখরা ছিল বলিয়া, অনুমান হইত। ব্রজভূখন সম্বন্ধে যেদিবস সর্ব্বপ্রথম আমাদের উভয়ের কথাবার্তা হয়, সেইদিবস সে আমাদিগের নিকট উপস্থিত ছিল। আমাদিগের মধ্যে কি সম্বন্ধে যে কথাবার্তা হইতেছে, তাহা সে না বুঝিতে পারিলেও, ইহা সে বেশ বুঝিতে পারিয়াছিল যে, ব্রজভূখন আমাদিগের বাটীতে আসিয়া, আমার সহিত কথা কহিয়াছিলেন, ইহাতে তাহার পিতা অসন্তুষ্ট।
এই ঘটনার চারিদিবস পরে, আমার স্বামী তাঁহার কার্য্য উপলক্ষে স্থানান্তরে গমন করিলেন, দুই তিনদিবস প্রত্যাবর্তন করিলেন না। চতুর্থদিবসে যেমন তিনি বাড়ীতে আগমন করিলেন, অমনি বালকটি দ্রুতগতিতে তাঁহার নিকট গমন করিল, এবং তাঁহাকে যাহা বলিল, তাহাতে আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, সে বলিতেছে, ‘ব্রজভূখন পুনরায় আমাদিগের বাটীতে আসিয়াছিল, মা তাহার সহিত গল্প করিয়াছে, এবং তাহার সহিত হাসি-তামাসা করিয়া পান-তামাক দিয়াছে।’
“বালকের এই কথা শুনিয়াই, আমিও একবারে হতজ্ঞান হইয়া পড়িলাম, মনে করিলাম, একি ভয়ানক বালক! আমার স্বামীর অনুপস্থিতিতে আমি ব্রজভূখনের সহিত যে কথাবার্তা কহিয়াছিলাম, তাহা প্রকৃত, এবং বালকও তাহা দেখিয়াছিল; কিন্তু সে আমাকে ইহার কিছুমাত্র আভাস না দিয়া, এই কথা আপনার অন্তরের ভিতর রাখিয়া দিয়াছে, ও যেমন তাহার পিতা আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে, অমনি সে তাহাকে বলিয়া দিয়াছে। এখন দেখিতেছি, ওই বালককে পর্য্যন্ত ভয় করিয়া আমাকে চলিতে হইবে।
“মনে মনে এইরূপ ভাবিলাম; কিন্তু তাহাকে সেই সময় কোন কথা বলিলাম না। বালকের কথার উত্তরে আমার স্বামী কহিলেন, ‘আমার অনুপস্থিতিতে ব্রজভূখন যখন আমাদিগের বাটীতে আসিবে, তাহা তুমি আমাকে বলিয়া দিও।
“সেইদিবস হইতে সেই বালকের উপর আমার বিশেষ লক্ষ্য রাখিয়া চলিতে হইতে। যে সময় বালকটি আমার নিকট থাকিত, সেই সময় ব্রজভূখন আমাদিগের বাটীতে আসিলেও, তাঁহার সহিত কথা কহিতে সাহস করিতাম না। বালকটি নিদ্রিত হইয়া পড়িলে, বা ক্রীড়া করিবার নিমিত্ত বাহিরে গমন করিলেই, আমি তাঁহার সহিত বাক্যালাপ করিতে সমর্থা হইতাম।
“এইরূপে দিন অতিবাহিত হইতে লাগিল, যেদিবস সে আমাকে ব্রজভূখনের সহিত কথা কহিতে দেখিত, যেদিবস আমাকে তাঁহার বাটীতে যাইতে দেখিত, সেইদিবসের কথাই, সে আমার স্বামীর আগমনমাত্রই তাঁহাকে বলিয়া দিত। তাহার কথা শুনিয়া, ক্রমে আমার স্বামী আমার উপর অবিশ্বাস করিতে লাগিলেন। প্রথম প্রথম আমাকে কিছু না বলিলেও, ক্রমে তিনি আমাকে দুই এক কথা বলিতেও আরম্ভ করিলেন। আমার চরিত্র সম্বন্ধে আমার স্বামীর মনে যে একটু সামান্য সন্দেহ হইয়াছিল, একদিবসের ঘটনায় সেই সন্দেহ তাহার দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত হইল। সেই ঘটনাটি এই—
“একদিবস বালকটি ক্রীড়া করিতে বাটীর বাহির হইয়া গিয়াছে, এরূপ সময় ব্রজভূখন আমাদিগের বাটীতে আগমন করিলেন। তাঁহাকে দেখিয়াই আমি কহিলাম, “তুমি যে এখন আমাদিগের বাটীর ভিতর প্রবেশ করিলে, তাহা যদি বালকটি দেখিতে পায়, তাহা হইলে কি হইবে; সেই হতভাগা বালক সমস্ত কথাই ত আমার স্বামীর নিকট বলিয়া দিবে। এমন কি, একটি কথাও ত বাদ দিবে না, বরঞ্চ দুটি একটি কথা অলঙ্কার দিয়া বলিবে।”
“ইহা শ্রবণ করিয়া, ব্রজভূখন কহিলেন, ‘বালকটি এখন এই পাড়ার ভিতর নাই। সে অপর কয়েকটি বালকের সহিত ক্রীড়া করিতে করিতে, ময়দানের দিকে গমন করিতেছে, ইহা আমি এখনই দেখিয়া আসিতেছি। সুতরাং এতশীঘ্র তাহার বাটীতে ফিরিবার কোনরূপ সম্ভাবনা নাই। এই বলিয়া ব্রজভূখন আমার ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া, আমার চারিপায়ার উপর উপবেশন করিল, আমিও তাহার সন্নিকটে সেই চারিপায়ার উপর গিয়া, কেবলমাত্র উপবেশন করিয়াছি, অমনি বালকটি কোথা হইতে দৌড়িয়া আসিয়া, সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল, আমরা উভয়েই একটু অসাবধান ভাবে ছিলাম। সুতরাং ঘরের ভিতর প্রবেশকালীন তাহার উপর আমাদিগের লক্ষ্য পড়িল না। যখন তাহাকে দেখিতে পাইলাম, সেই সময় আর আমাদিগের স্থানান্তরিত হইবার উপায় ছিল না। বালকটিকে দেখিয়াই, আমি তাহাকে আমার ক্রোড়ে উঠাইয়া লইলাম; তাহার মুখচুম্বন করিলাম, এবং কিছু আহারীয় তাহার হস্তে দিয়া তাহাকে কহিলাম, ‘তুমি যে ব্রজভূখনকে এই চারিপায়ার উপর বসিয়া থাকিতে দেখিয়াছ, তাহা তোমার পিতাকে বলিয়া দিও না।
“আমার কথা শুনিয়া, বালকটি কোন উত্তর প্রদান করিল না। আহারীয় হস্তে আমার ক্রোড় হইতে অবতরণ করিয়া, ঘরের সম্মুখে দাওয়ার উপর ক্রীড়া করিতে লাগিল।
ব্রজভূখন আস্তে আস্তে আমার ঘর হইতে বহির্গত হইয়া প্রস্থান করিলেন, আমিও আমার গৃহকার্যে নিযুক্ত হইলাম। সেদিবস এই সম্বন্ধে আর কোন কথা বালকের মুখে শুনিতে পাইলাম না। কিন্তু পরদিবস তাহার পিতা প্রত্যাবর্তন করিবামাত্রই, সে সেই কথা তাঁহাকে বলিয়া দিল। আমাকে ও ব্রজভূখনকে চারিপায়ার উপর একত্র বসিতে দেখিয়াছিল, কেবল ইহাই বলিয়া যে, সে ক্ষান্ত হইল, তাহা নহে; আমি তাহাকে যেরূপ ভাবে নিষেধ করিয়াছিলাম, তাহা সমস্তই বর্ণন করিল।
“বালকের কথায় বিশ্বাস করিয়া, তিনি আমাকে যৎপরোনাস্তি অবমাননা করিলেন, সেইদিবস পাড়ার কেহ কেহ আমার চরিত্রের কথা জানিতে পারিল। সেইদিবস হইতেই অনেকেই আমার চরিত্র সম্বন্ধে নানারূপ সন্দেহ করিতে লাগিল।
“সেইদিবস হইতে ব্রজভূখনের দিবাভাগে আমাদিগের বাটীতে আসা বন্ধ করিয়া দিলাম। আমি মধ্যে মধ্যে যদিও তাঁহার বাটীতে যাইতাম, কিন্তু প্রকাশ্য ভাবে আর তাঁহার সহিত কথা কহিতাম না, তাঁহার স্ত্রীর নিকট বসিয়া, তাঁহার সহিত দুই চারিটি কথা বলিয়াই সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিতাম।
“সেই সময় হইতে যেদিবস আমার স্বামী বাটীতে না থাকিতেন, সেইদিবস গভীর রাত্রে ব্রজভূখন আমার বাটীতে আসিতেন, এবং রাত্রি প্রভাত না হইতে হইতেই, চলিয়া যাইতেন। আমার বাটীতে অপর কেহ থাকিত না; সুতরাং একথা প্রকাশিত হইয়া পড়িত না। বালকটি সন্ধ্যার পরই নিদ্রিত হইয়া পড়িত; সুতরাং রাত্রিকালে ঘরের ভিতর কি হইতেছে, বা না হইতেছে, তাহা সে জানিত না।
“এইরূপে কিছুদিবস অতিবাহিত হইয়া গেল, আর কোনরূপ গোলযোগ হইল না, আমার স্বামীও আর কোন কথা জানিতে পারিলেন না। কিন্তু পাপকার্য্য কতকাল লুক্কায়িত থাকে, পাঁচ সাত দিবস মাত্র অতিবাহিত হইল, একরাত্রিতে বালকটি ঘরের ভিতর নিদ্রিত আছে, রাত্রিও অধিক হইয়াছে, এরূপ সময় ব্রজভূখন আস্তে আস্তে আমার ঘরের ভিতর নিয়মিতরূপ প্রবেশ করিয়া, আমার চারিপায়ার উপর উপবেশন করিল। ঘরে একটিমাত্র প্রদীপ জ্বলিতেছে, আমরা উভয়ে বসিয়া, আস্তে আস্তে গল্প করিতেছি, এরূপ সময় বালকটির হঠাৎ নিদ্রাভঙ্গ হইল। সে তাহার বিছানা হইতে গাত্রোত্থান করিয়া, “বাবা তুই কখন আসিয়াছিস্’ এই বলিতে বলিতে দ্রুতপদে ব্রজভুখনের ক্রোড়ে আসিয়া উপবেশন করিল, এবং ব্রজভূখনের মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “বাবা নয়, তুই’, এই বলিয়া সে আপন বিছানায় গিয়া পুনরায় শয়ন করিল। ব্রজভূখন এই অবস্থা দেখিয়া, ঘরের দরজা খুলিয়া, আস্তে আস্তে বাহির হইয়া গেল, আমি বালকের নিকট গমন করিয়া, তাহাকে কত আদর করিলাম, এবং তাহাকে অনেকরূপ বুঝাইয়া বলিলাম, যাহাতে সে এই সকল কথা তাহার পিতার নিকট না বলে। কিন্তু হতভাগা বালক আমার কথা কিছুতেই শুনিল না, তাহার পিতা বাটীতে পদার্পণ করিতে, না করিতেই, রাত্রির যে সকল ঘটনা সে স্বচক্ষে দেখিয়াছিল, তাহা আদ্যোপান্ত তাঁহাকে বলিয়া দিল।
“বালকের কথা শুনিয়া আমার স্বামী যে, আমার উপর কিরূপ কুপিত হইলেন, তাহা আপনারা অনায়াসেই বুঝিতে পারিতেছেন। সেইদিবস তিনি আমার সহিত তুমুল ঝগড়া করিলেন, ও আমাকে প্রহার করিতেও বিরত হইলেন না; কিন্তু আমি তাঁহার সমস্ত তাড়না বিনা বাক্যব্যয়ে সহ্য করিলাম, পরে তাঁহার ক্রোধ একটু অন্তর্হিত হইলে, তাঁহাকে বুঝাইয়া কহিলাম, আপনি এই শিশুর কথা শুনিয়া আমার চরিত্রের উপর এরূপ সন্দেহ করিতেছেন কেন, এ বালক, ইহার মনে যাহা উদয় হয়, তখনই তাহা বলিয়া থাকে। এ তোমার ও পাড়ার অপরাপর সকলের বিপক্ষে আমাকে সদাসৰ্ব্বদা যেরূপ বলিয়া থাকে, তাহা যদি আমি তোমাকে বলি, তাহা হইলে তুমি যে কি কর, তাহা আমি জানি না। কিন্তু আমি উহার যে সকল কথায় বিশ্বাসও করি না, বা অপর আর কাহাকেও বলি না। ব্রজভূখন পাড়ার লোক বলিয়া, আমি তাঁহার সহিত নিৰ্জ্জনে কথা কহিতেও কোনরূপ সঙ্কুচিত হইতাম না; কিন্তু যে দিবস হইতে এই হতভাগা বালক আমার চরিত্রের উপর তোমার সন্দেহ জন্মাইয়া দিয়াছে, সেইদিন অবধি আমি তাঁহার সহিত বাক্যালাপ রহিত করিয়া দিয়াছি, ও তাঁহাকে তোমার অসাক্ষাতে আমাদিগের বাটীতে আসিতেও নিষেধ করিয়া দিয়াছি। সেই অবধি ব্রজভূখন আর এই বাটীতে পদার্পণ করেন না। তোমার বালকের কথা যদি প্রকৃত হইত, তাহা হইলে আমার বিপক্ষে কোন কথা কি তুমি এ পর্য্যন্ত পাড়ার অপর কোন লোকের মুখে শুনিতে পাইতে না? অদ্য তুমি রাগের বশীভূত হইয়া আমাকে যাহা করিতে হয়, তাহা করিয়াছ, পাড়ার কোন ব্যক্তির নিকট আমার আর মুখ দেখাইবার যো রাখ নাই। তোমার মনে আমার চরিত্র সম্বন্ধে যদি কোনরূপ সন্দেহই হইয়া থাকে, তাহা হইলে ইচ্ছা করিলেই, তুমি তাহা স্বচক্ষে দেখিতে পারিতে। তুমি সকল দিবস বা সকল রাত্রিতে বাটীতে থাক না, এবং কোন সময়ে যে প্রত্যাবর্তন কর, তাহারও কিছুমাত্র স্থিরতা নাই। এরূপ অবস্থায় গভীর রাত্রিতে হঠাৎ বাটীর ভিতর প্রবেশ করিলেই ত তোমার মনের সকল সন্দেহ মিটিয়া যাইত। সে যাহা হউক, যাহা করিবার তাহা তুমি ভালই করিয়াছ, স্বামীর কর্তব্য, স্ত্রীর চরিত্রে প্রকৃত কোন দোষ থাকিলেও, তাহা গোপন করিয়া রাখা; কিন্তু তুমি আমার বিনা দোষে কিরূপ কলঙ্ক রটনা করিলে, বল দেখি।’
“ইহা শুনিয়া, আমার স্বামী কোনরূপ উত্তর করিলেন না। অনুমান করিলাম, তিনি আমার কথাগুলি উত্তমরূপে বুঝিতে পারিয়াছেন।
“ইহার পর দুই তিনদিবস আর আমার স্বামী বাটী হইতে স্থানান্তরে গমন করিলেন না। আমাদিগের উভয়ের যে একটু মনোমালিন্য ঘটিয়াছিল, তাহা ক্ৰমে মিলাইয়া যাইতে লাগিল। একদিবস দেখিলাম, তিনিই ব্রজভূখনের সহিত গল্প করিতে করিতে, আমাদিগের বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সেইদিবস হইতে ব্রজভূখন পুনরায় দিবাভাগেই আমাদিগের বাটীতে যাতায়াত আরম্ভ করিলেন। আমার স্বামী বাটীতে না থাকিলেও, আসিতেন; কিন্তু বসিতেন না। আমার সহিত অন্তরালে দুই একটি কথা বলিয়াই চলিয়া যাইতেন।
“ইহার পরই, আমার স্বামী আপন কার্য্য উপলক্ষে পুনরায় স্থানান্তরে গমন করিলেন।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
“যে দিবস আমার স্বামী স্থানান্তরে গমন করিলেন, তাহার পরদিবস প্রাতঃকালেই ব্রজভূখন আমাদিগের বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সেই সময় বালকটি খেলা করিবার নিমিত্ত, বাটী হইতে বহির্গত হইয়া গিয়াছিল, আমি গৃহকার্য্যে নিযুক্ত ছিলাম। ব্রজভূখনকে দেখিয়াই, আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তুমি ত অবগত আছ যে, আমার স্বামী বাটীতে নাই, তবে গতরাত্রিতে আসিলে না কেন? উত্তরে ব্রজভূখন কহিল, “নিমন্ত্রণ উপলক্ষে গতরাত্রিতে আমাকে স্থানান্তরে গমন করিতে হইয়াছিল বলিয়া, আসিতে পারি নাই; তাই আজ প্রাতঃকালেই আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি।’
“ব্রজভূখনের কথা শুনিয়া, আমি তাঁহাকে আমার ঘরের ভিতর গিয়া, উপবেশন করিতে বলিলাম। আমার কথা শুনিয়া তিনি আমার ঘরের ভিতর প্রবেশ-পূর্ব্বক আমার চারিপায়ার উপর উপবেশন করিলেন। আমিও আপন হস্তপদাদি প্রক্ষালন-পূর্ব্বক সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম।
“সেই ঘরের ভিতর আমরা কিয়ৎক্ষণ থাকিবার পরই, হতভাগা বালকটি কোথা হইতে আসিয়া, সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল। এবং আমাদিগের উভয়কেই সেই স্থানে দেখিয়া কহিল, ‘ বাবা আসিলেই আমি বলিয়া দিব।’ “বালকটির এই কথা শুনিয়া ব্রজভূখন তাহাকে ক্রোড়ে উঠাইয়া লইল, এবং তাহাকে অনেক করিয়া বুঝাইয়া বলিল যে, এ সকল কথা তোমার পিতার নিকট বলিতে নাই, তুমি ইহা তাঁহাকে বলিও না।’ আমিও তাহাকে অনেক আদর করিয়া কহিলাম, ‘মায়ের কোন কথা পিতাকে বলিতে নাই, ইহাতে লোকে নিন্দা করে। তুমি এই সকল কথা তোমার পিতাকে বলিয়াছ, একথা যদি পাড়ার অপরাপর ছেলেরা জানিতে পারে, তাহা হইলে কোন বালক তোমাকে লইয়া আর খেলা করিবে না, সকলেই তোমাকে দেখিলেই মারিবে, ও তোমার কথা কেহ বিশ্বাস করিবে না।’ এই বলিয়া তাহাকে অনেকরূপ বুঝাইলাম ও অনেকরূপ বিভীষিকাও প্রদর্শন করিলাম; কিন্তু কিছুতেই সে আমার কথা শুনিল না, বা আমার প্রস্তাবে সম্মত হইল না!
“আমাদিগের কথা শুনিয়া হতভাগা বালক কহিল, ‘তা তোমরা যাই বল না কেন, আমি আমার পিতাকে বলিয়া দিব।’
“বালকের এই কথা শুনিয়া, আমার অতিশয় ক্রোধের উদয় হইল, ব্রজভূখনের ক্রোড় হইতে উহাকে লইয়া, আমি ঘরের মেঝের উপর নিক্ষেপ করিলাম। সে কাঁদিতে কাঁদিতে সেই স্থান হইতে উঠিয়া কহিল, ‘আমি এখনই গিয়া পাড়ার সকলকে একথা বলিয়া দিতেছি।’ এই বলিয়া সে ঘর হইতে বহির্গত হইবার উপক্রম করিতে লাগিল।
“তাহার এই অবস্থা দেখিয়া, আমি তাহার পশ্চাৎ ধাবিত হইয়া হস্ত চাপিয়া ধরিলাম, এবং জোর করিয়া তাহাকে ঘরের ভিতর আনিলাম। তাহাতে কোথায় সে চুপ করিবে, না আরও উচ্চৈঃস্বরে চীৎকার করিতে করিতে বলিতে লাগিল, ‘ওগো তোমরা কে কোথায় আছ, দৌড়িয়া আইস; মা ও ব্রজভূখন, ইহারা দুইজনে আমাকে মারিয়া ফেলিল, আমার আর এখানে কেহ নাই, তোমরা সকলে রক্ষা কর।
“স্বগর্ভজাত অবাধ্য বালকের এই অবস্থা দেখিয়া, আমি কোনরূপেই আপন ক্রোধকে সম্বরণ করিতে পারিলাম না। নিকটেই একখানি বঁটি ছিল, সেই বঁটিখানি হস্তে লইয়া, উহাকে ভয় প্রদর্শন পূর্ব্বক কহিলাম, ‘তুই যদি এই বিষয় লইয়া গোলযোগ করিবি, তাহা হইলে এখনই তোকে কাটিয়া ফেলিব।”
“আমার হস্তস্থিত বঁটি দেখিয়া, ও আমার কথা শুনিয়া, বালক কিছুমাত্র ভীত হইল না, বরং উচ্চৈঃস্বরে চীৎকার করিয়া বলিল, মার ঘরে কে আসিয়াছে, দিদি দেখসে আয়।’
“আমাদিগের বাটীর নিকটে ছোটকিয়া নামক একটি স্ত্রীলোক বাস করিত, তাহাকে বালকটি দিদি বলিয়া ডাকিত।
“বালকটি এইরূপে অতি উচ্চৈঃস্বরে ছোটকিয়াকে ডাকিতে আরম্ভ করায়, আমার মনে আরও বিজাতীয় ক্রোধের উদয় হইল। আমি উহার ব্যবহার আর কোনরূপেই সহ্য করিতে না পারিয়া, পুত্রস্নেহ একবারে ভুলিয়া গেলাম। দুর্জয় রিপুর বশীভূতা হইয়া যাহা জননীদ্বারা কোনরূপেই সম্ভবে না, সেই কার্য্য করিয়া ফেলিলাম; অর্থাৎ আমার হস্তস্থিত সেই সুতীক্ষ্ণ বঁটিদ্বারা তাঁহার গলদেশে এরূপ সজোরে এক আঘাত করিলাম যে, হতভাগা বালকটি আর কথা কহিতে পারিল না; সেই স্থানে পড়িয়া কিয়ৎক্ষণ ধড়ফড় করিতে করিতে ইহজীবন পরিত্যাগ করিল।
“এই সমস্ত ঘটনা ব্রজভূখনের সম্মুখেই ঘটিয়াছিল, আমাকে পিশাচীবৎ এই কার্য্য করিতে দেখিয়া তিনি ভয়ে একবারে অভিভূত হইয়া পড়িলেন, ‘হতভাগিনী তুই কি সর্ব্বনাশ করিলি, নিজেও মরিলি, আমাকেও মারিলি।’ এই বলিতে বলিতে, তিনি আস্তে আস্তে আমার ঘর হইতে বহির্গত হইয়া গেলেন।
“মৃত বালকটিকে লইয়া তখন যে আমি আমি কি করিব, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। সেই পুত্রের উপর আমার যেরূপ ক্রোধ জন্মিয়াছিল এইরূপে হত্যা করিয়াও, তাহা কিন্তু অন্তর্হিত হইল না তখনও আমি বুঝিতে পারিলাম না যে এই বালককে হত্যা করার অপরাধে আমিই ধৃত হইব এবং তাহার উপযুক্ত দণ্ড গ্রহণ করিতে হইবে। তখনও আমার মনে ছিল, পুত্র হইলেও, আমার মহাশত্রুকে বিনাশ করিলাম। আমার কার্য্যের কোনরূপ প্রতিবন্ধক হইবার আর কেহই রহিল না। স্বামীর অনুপস্থিতিতে যে সকল কাৰ্য্য করিব, এখন হইতে আর তাহা প্রকাশিত হইবে না। সুতরাং নিঃশঙ্কচিত্তে এবার আমরা আমোদ-প্রমোদ সম্পন্ন করিব।
মনে মনে এইরূপ করিলাম সত্য; কিন্তু মৃতদেহ লইয়া তখন যে আমি কি করিব, হঠাৎ তাহারও কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। অন্য উপায় না দেখিয়া, তখন সেই মৃতদেহটি বাটীর মধ্যস্থিত বিচালিগাদার ভিতর লুকাইয়া রাখিলাম। মনে মনে স্থির করিয়াছিলাম, স্বামী যদি অদ্য বাটীতে প্রত্যাবর্তন না করেন, তাহা হইলে ব্রজভূখনকে সঙ্গে লইয়া রাত্রিকালে মৃতদেহটি দূরবর্ত্তি কোন স্থানে ফেলিয়া দিব, বা কোনস্থানে মৃত্তিকার মধ্যে প্রোথিত করিয়া রাখিব। আর যদি স্বামীই রাত্রিতে প্রত্যাবর্তন করেন, তাহা হইলেও, অদ্য প্রাতঃকালাবধি পুত্রটিকে খুঁজিয়া পাইতেছি না, এই প্রকার ছলনা করিয়া বালকটির অনুসন্ধানের নিমিত্ত তাঁহাকে বাটী হইতে বহির্গত করিয়া দিব, এবং সেই সুযোগে বাটীর ভিতরেই হউক, বা অপর কোন স্থানেই হউক, সেই মৃতদেহটি উত্তমরূপে পুতিয়া ফেলিব।
“মনে যাহা ভাবা যায়, কার্য্যে তাহা প্রায়ই পরিণত হয় না। স্বামী বাহির হইতে অদ্য বৈকালেই প্রত্যাবৰ্ত্তন করিলেন, আসিবামাত্রই বালকটির অনুসন্ধান করিয়া, তাহার কথা আমাকে বার বার জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। আমি তাঁহাকে যেরূপ বলিব মনে করিয়াছিলাম, কার্য্যের সময় তাহা কিন্তু একেবারেই ভুলিয়া গেলাম। পুত্রটি নিতান্ত অবাধ্য হইলেও, তাহাকে স্বহস্তে হত্যা করার নিমিত্ত আমার মন নিতান্ত খারাপ হইয়াছিল, তাহার উপর স্বামীর কথা শুনিয়া, মনের ভাব আর স্থির করিতে পারিলাম না। হঠাৎ মুখ হইতে বাহির হইয়া গেল, বালকটি বিচালি গাদার ভিতর আছে। আমার এরূপ কথায় আমার স্বামী বিশ্বাস করিলেন না; কিন্তু পাড়ার কোন কোন ব্যক্তি যাঁহারা সেই সময় আমাদিগের বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ সেই বিচালি গাদা দেখিবার নিমিত্ত গমন করিলেন, ও সেই স্থানে একটু অনুসন্ধান করিবামাত্রই আমার বালকের মৃতদেহটি বাহির হইয়া পড়িল।
“এখন আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি যে, আমার পাপের ষোল আনা পূর্ণ হইয়া আসিয়াছে; কিন্তু আমার যে কি সাজা হইবে, তাহা আমি এখন কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। যে স্ত্রী, তাহার আপন স্বামীর নিকট অবিশ্বাসিনী এবং আপন স্বামীকে লুকাইয়া, তাহার অনুপস্থিতিতে যে স্ত্রীলোক পাপের সোপানাবলী হেলায় অতিক্রম করিতে প্রবৃত্ত হয়, তাহার পাপের উপযুক্ত দণ্ড কি কখনও হইতে পারে? এরূপ পাপের উপযুক্ত দণ্ড যখন ইহজগতে পাওয়া যায় না, তাহার উপর, আপন নীচ প্রবৃত্তি চরিতার্থ করিবার আশায়, স্বগর্ভজাত সুকুমার শিশুকে স্বহস্তে হত্যা করিয়া, সেই পাপ কর্ম্মে অগ্রগামী হইবার পথ পরিষ্কার করিবার চেষ্টা, আরও কি ভয়ানক! আপনারা এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিয়া আর মিথ্যা সময় নষ্ট করিতেছেন কেন? যখন হত্যাকারিণী ধৃত হইয়াছে, সে অকপটচিত্তে সমস্ত কথা স্বীকার করিতেছে, তখন আপনারা ইহাকে ফাঁসি দিতে আর অধিক বিলম্ব করিতেছেন কেন? কাৰ্য্য যতশীঘ্র হয়, শেষ করিয়া দিন, আমার পাপের দণ্ড শীঘ্র শীঘ্র আরম্ভ হউক। আমার মনে এখন যে ভয়নাক যন্ত্রণার উদয় হইয়াছে, তাহা আর আমি কোনরূপেই সহ্য করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। আপনাদিগের কর্ত্তব্য কার্য্যের আর বিলম্ব করিবেন না।’ এই বলিয়া, সোহাগিয়া চুপ করিল।
ইহার কথা শুনিয়া, আমারও ক্ষণকালের নিমিত্ত আত্মজ্ঞান হারাইলাম। একবার মনে করিলাম, চরিত্রহীনা স্ত্রীলোকদ্বারা না হইতে পারে, এরূপ কার্য্য জগতে নাই। পুনরায় ভাবিলাম, ইতিপূর্ব্বে যে কথা কখনও কর্ণগোচর হয় নাই, নিতান্ত অসচ্চরিত্রা স্ত্রীলোকগণ পর্যন্তও যখন, গর্ভধারিণী আপন গর্ভজাত সন্তানকে স্বহস্তে হত্যা করিয়াছে শুনিয়া, স্ব স্ব কর্ণে হস্ত প্রদান করিতেছে, তখন একথা সহজে বিশ্বাস করা কর্তব্য নহে। কিন্তু পাপীয়সী যখন সমস্ত কথা অকপটে স্বীকার করিতেছে, তখন তাহার কথায় বিশ্বাস না করিলেই বা চলিবে কেন? আবার ভাবিলাম, ইহা ইহলেও ত হইতে পারে যে, সোহাগিয়া তাহার সপ্তম বৎসর বয়স্ক শিশুকে হত্যা করে নাই; এই হত্যা তাহার সম্মুখে, তাহার অবৈধ প্রণয়াকাঙ্ক্ষী ব্রজভূখন কর্তৃক হইয়াছে। কারণ, এখন তাহাকে বাঁচাইবার নিমিত্ত, ব্রজভূখন যাহা করিয়াছিল, তাহা সমস্তই নিজে করিয়াছে বলিয়া স্বীকার করিয়া লইতেছে। এখন সে পুত্রশোক কোনরূপে সহ্য করিতে না পারিয়া, নিজের জীবন পাত করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে।
আবার মনে হইল, যেরূপভাবে সোহাগিয়া তাহার চরিত্র সম্বন্ধে আমূল বৃত্তান্ত বর্ণন করিল, তাহাতে তাহার কথার কোনরূপে অবিশ্বাস করিবার কারণ ত দেখিতে পাইতেছি না। আমার মনে এইরূপ নানাকথা উদিত হইতেছে, সেই সময় কৰ্ম্মচারী মহাশয় কহিলেন, “সোহাগিয়া! তুমি যে সকল কথা বলিলে, তাহা কি প্রকৃত?”
সোহাগিয়া। এ অবস্থায় আর আমি মিথ্যা কথা কহিব কেন, এখন আর আমার লজ্জাসরম কিসের?
কৰ্ম্মচারী। তাহা হইলে এই সকল কার্য্য ব্রজভূখনের সম্মুখেই ঘটিয়াছে?
সোহাগিয়া। সকল কাৰ্য তাহার সম্মুখে হয় নাই, কেবল হত্যাকাণ্ড তাহার সম্মুখে ঘটিয়াছে; মৃতদেহ লুকাইয়া রাখিবার সময় তিনি সেই স্থানে ছিলেন না।
কৰ্ম্মচারী। তখন ব্রজভূখন কোথায় ছিল?
সোহাগিয়া। তাহা আমি বলিতে পারি না, হত্যাকাণ্ড শেষ হইয়া যাইবার পরই, তিনি আমার ঘর হইতে বহির্গত হইয়া গিয়াছিলেন।
কর্ম্মচারী। এই হত্যা তোমার ঘরের মধ্যেই হইয়াছে?
সোহাগিয়া। হাঁ।
কর্ম্মচারী। সেই ঘরের ভিতর এই হত্যা হইয়াছে বলিয়া ত, আমার বোধ হইতেছে না; কারণ, সেই স্থানে রক্তের চিহ্নাদি ত কিছুই নাই?
সোহাগিয়া। মৃতদেহ বিচালি গাদার ভিতর লুকাইয়া রাখিবার পর ঘরের ভিতর যে স্থানে নিজ হস্তে বালকটিকে হত্যা কারিয়াছিলাম, সেই স্থানটি আমি উত্তমরূপে পরিষ্কার করিয়া ফেলিয়াছি বলিয়া রক্তের কোন চিহ্ন দেখিতে পাইতেছেন না।
কর্ম্মচারী। যে বঁটিদ্বারা তুমি হত্যা করিয়াছ বলিতেছ, সেই বঁটিখানি কোথায়?
সোহাগিয়া। তাহা আমার ঘরেই আছে।
কর্ম্মচারী। যে বঁটিখানি আমি হস্তে করিয়া দেখিতেছিলাম?
সোহাগিয়া। হাঁ।
কর্ম্মচারী। তাহাতেও ত কোনরূপ রক্তের চিহ্ন দেখিতে পাই নাই।
সোহাগিয়া। উহাও আমি উত্তমরূপে পরিষ্কার করিয়া রাখিয়া দিয়াছি।
কর্ম্মচারী। আর একটি কথা তোমাকে জিজ্ঞাসা করি।
সোহাগিয়া। কি?
কর্ম্মচারী। তোমার মৃত বালকটি এখন যেরূপ অবস্থায় তোমার বাটীর প্রাঙ্গণে পড়িয়া রহিয়াছে, তাহা তুমি দেখিয়াছ কি? যদি না দেখিয়া থাক, তাহা হইলে একবার গিয়া দেখিয়া আইস।
সোহাগিয়া। আর দেখিতে হইবে না, আমি দেখিয়াছি।
কর্ম্মচারী। তাহা হইলে তুমি বেশ দেখিয়াছ যে, উহার উভয় ঊরু হইতে কিয়ৎ পরিমাণে মাংস বিচ্যুত করা হইয়াছে?
সোহাগিয়া। দেখিয়াছি।
কৰ্ম্মচারী। তাহা হইলে সেই মাংস কি হইল?
সোহাগিয়া। তাহাও আছে।
কর্ম্মচারী। কোথায় আছে?
সোহাগিয়া। রন্ধনশালায়।
কৰ্ম্মচারী। রন্ধনশালা ত আমি উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়াছি, কিন্তু কোন স্থানে ত উহা দেখিতে পাই নাই?
সোহাগিয়া। দেখিতে পাইয়াছেন, কিন্তু চিনিতে পারেন নাই।
কৰ্ম্মচারী। চিনিতে পারি নাই কেন?
সোহাগিয়া। যে স্থানে আমাদিগের আহারীয় দ্রব্য প্রস্তুত আছে, তাহা আপনি দেখিয়াছেন কি?
কৰ্ম্মচারী। দেখিয়াছি।
সোহাগিয়া। সেই আহারীয়ের কিঞ্চিৎ দূরে একটি পাত্রে কিছু রন্ধন করা মাংস আছে, তাহার উপর আপনার নজর পড়িয়াছে কি?
কর্ম্মচারী। তাহাও আমি দেখিয়াছি।
সোহাগিয়া। সেই মাংসই বালকের ঊরুদেশের মাংস।
কর্ম্মচারী। সেই মাংস ত রন্ধন করা, মনুষ্য মাংস কে রন্ধন করিল?
সোহাগিয়া। আমি
কর্ম্মচারী। তুমি উহা রন্ধন করিলে কেন?
সোহাগিয়া। সেই বালকটি যাহার নিতান্ত প্রিয় ছিল, আমার সমস্ত কথা, সে যাহাকে বলিয়া দিত, যে তাহাকে সদাসর্ব্বদা ক্রোড়ে করিয়াই লইয়া বেড়াইত, সেই মাংস তাহাকেই জন্মের মত খাওয়াইবার নিমিত্ত রন্ধন করিয়া রাখিয়াছিলাম; কিন্তু ইচ্ছাপূর্ণ করিতে পারি নাই, আহার করিবার পূৰ্ব্বেই সমস্ত কথা প্রকাশিত হইয়া পড়ে।
কর্ম্মচারী। তোমার কথা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে তুমি কি ভয়ানক স্ত্রীলোক! জানি না, তুমি—“মা না রাক্ষসী?”
সোহাগিয়া। আপনারা যাহাই বলুন আমি রাক্ষসী হইতেও অধম। এ পৰ্য্যন্ত শুনি নাই যে, কোন রাক্ষসী তাহার সামান্য ইন্দ্রিয় সুখ-লালসা পরিতৃপ্ত করিবার মানসে, আপন গর্ভজাত সুকুমার শিশুকে হত্যা করিয়াছে। এবং দুৰ্জ্জয় ক্রোধের বশবর্ত্তিনী হইয়া, সেই বালকের অঙ্গ হইতে মাংস সকল বিচ্যুত করিয়া ধৈর্য্য সহকারে উহা রন্ধন করিয়া, আপন স্বামীকে সেই মাংস খাওয়াইবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইয়াছে। মহাশয়! আপনারা আমাকে রাক্ষসী বলিয়া সম্বোধন করিবেন না; কারণ, আমার সহিত তুলনা করিলে রাক্ষসীদিগেরও অবমাননা করা হয়।
কর্মচারী মহাশয় সোহাগিয়াকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলেন না। ইহার পরই ব্রজভূখনকে জিজ্ঞাসা করা হইল, কেমন হে ব্রজভূখন! সোহাগিয়া যাহা বলিতেছে, তাহা প্রকৃত? না তোমাকে বাঁচাইবার নিমিত্ত সে মিথ্যা কথা কহিতেছে।
সোহাগিয়া যে সমস্ত কথা বলিয়াছিল, ব্রজভূখন তাঁহার সমস্ত বিশেষ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিতেছিল। কর্ম্মচারী মহাশয়ের কথা শুনিয়া, সে আর কোন কথা একবারে অস্বীকার করিতে পারিল না। প্রথম প্রথম একটু এদিক ওদিক করিয়া কথা বলিবার চেষ্টা করিয়াছিল বটে; কিন্তু পরিশেষে কহিল, “না মহাশয়! সোহাগিয়া যাহা বলিয়াছে, তাহার একবিন্দুও মিথ্যা নহে; ইহার আদ্যোপান্ত প্রকৃত। যে সময় সোহাগিয়া আমার সহিত অবৈধ প্রণয়ে আবদ্ধা হয়, তাহার পর আমি সোহাগিয়াকে বারবার নিষেধ করিয়াছিলাম, এবং কহিয়াছিলাম, দেখ সোহাগিয়া, যাহা হইবার তাহা হইয়াছে, বুঝিতে না পারিয়া, যাহা করিবার, তাহা উভয়ে করিয়াছি; কিন্তু এখনও লোকমুখে এ সকল কথা প্রচারিত হয় নাই। এখন হইতে আমাদিগের এই সকল কার্য্য পরিত্যাগ করাই মঙ্গল; নতুবা কোন দিবস যে কিরূপ ঘটনা আসিয়া উপস্থিত হইবে, তাহা এখন অনুমান করাও সহজ নহে। এইরূপ অসৎ কাৰ্যে সৰ্ব্বদা লিপ্ত থাকিলে, কোন দিবস না কোন দিবস কাহারও সম্মুখে পতিত হইব, সেই দিবস আমাদিগের উভয়ের জীবন বাঁচান দায় হইয়া পড়িবে।
আমি এইরূপ করিয়া বুঝাইয়া বলাতেও, সোহাগিয়া তাহাতে কোনরূপ সম্মত হইল না। সুতরাং আমারও তাহার ঘরে যাওয়া বন্ধ হইল না। আমার সম্মুখে যে, সোহাগিয়া এই হত্যা কার্য্য করিয়াছে, সেই সম্বন্ধে আপনাদিগের মনে কোনরূপ সন্দেহ করিবার নাই। সোহাগিয়া যাহা বলিয়াছে, তাহাই প্রকৃত, ইহার একবিন্দুও মিথ্যা বা রঞ্জিত নহে।
ব্রজভূখন ও সোহাগিয়ার কথা শুনিয়া আমাদিগের মনে আর কোনরূপ সন্দেহ রহিল না; তখন আমরা বেশ বুঝিতে পারিলাম, এই হত্যা সোহাগিয়া দ্বারাই হইয়াছে। সুতরাং সেই স্থানে আমাদিগের আর অধিকক্ষণ বিলম্ব করা নিষ্প্রয়োজন বিবেচনা করিয়া, কৰ্ম্মচারী মহাশয়, সেই মৃতদেহ পরীক্ষার্থ যথাস্থানে প্রেরণ করিয়া, সেই স্থানের সেই সময়ের অপর যে সকল আনুষঙ্গিক প্রমাণের প্রয়োজন, তাহা সংগ্রহ করিয়া, রন্ধন করা মাংস, যে বঁটিদ্বারা হত্যা করা হইয়াছে, সেই বঁটি, যে স্থানে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, সেইস্থানের রক্তাক্ত বিচালি ও যে সকল ব্যক্তিদিদ্বারা এই ঘটনার আনুষঙ্গিক বিষয় সকল প্রমাণিত হইবে, তাহাদিগকে সঙ্গে লইয়া তিনি সেই রাত্রিতেই আপনার থানায় প্রত্যাবর্তন করিলেন। বলা বাহুল্য, আমিও সেই সঙ্গে চলিয়া আসিলাম।
সোহাগিয়া আমাদিগের নিকট যেরূপ বলিয়াছিল, আর তাহার পরিবর্তন করিল না। মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট হইতে আরম্ভ করিয়া, সেসনজজ পর্যন্ত সকলের নিকট মুক্তকণ্ঠে সে আপন দোষ স্বীকার করিয়া লইল। ব্রজভূখন ও অপর সকলে যে সকল কথা জানিত, সকলেই সেই সকল কথা বলিয়া, সোহাগিয়াই বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিল। বিচারে সোহাগিয়া দোষিনী সাব্যস্ত হইয়া গেল, এবং আইনের চরমদণ্ডে তাহাকে দণ্ড গ্রহণ করিতে হইল। চরমদণ্ডের আদেশ শুনিয়া, সোহাগিয়াকে ক্ষণকালের নিমিত্ত বিকৃতি ভাবাপন্না বলিয়া অনুমতি হইল না; বিনা- বাক্য ব্যয়ে সে প্রহরিগণের সহিত বিচার-গৃহের বাহিরে গমন করিল।
এইস্থানে বলা বাহুল্য যে, সময়মত তাহার ফাঁসিও হইয়া গেল।
[আশ্বিন, ১৩০৬]