রক্ষক না ভক্ষক
(অর্থাৎ ছেলেধরা বা সহরে অশান্তি!)
প্রথম পরিচ্ছেদ
কাল বৈশাখ। বেলা চারিটা পর্যন্ত রৌদ্রে কাঠ ফাটিতেছিল; সহসা ছায়া পড়িল—রৌদ্রের তেজ কমিয়া গেল। একটা অদ্ভুত চুরির তদারক করিয়া বেলা প্রায় দুইটার সময় ফিরিয়া আসিয়াছি। হাতে তখন আর বিশেষ কোন কাজ ছিল না। দারুণ গ্রীষ্মের প্রকোপে এতক্ষণ গলদঘর্ম হইয়াছিলাম। হঠাৎ ছায়া পড়িল দেখিয়া, মনে কেমন এক প্রকার আনন্দের উদয় হইল। চেয়ার হইতে উঠিয়া, পশ্চিম দিকের জানালার নিকট যাইলাম। দেখিলাম, পশ্চিম গগনে একখানি ঘোর কৃষ্ণবর্ণ মেঘ উঠিয়া এইমাত্র সূৰ্য্যকে ঢাকিয়া ফেলিয়াছে। আচ্ছাদিত সূর্য্যরশ্মি মেঘের উপর পতিত হইয়া অপূৰ্ব্ব শ্রীধারণ করিয়াছে।
এতক্ষণ জোর বাতাস বহিতেছিল। বাতাস উষ্ণ হইলেও ঘর্ম্মাক্ত কলেবরে নিতান্ত অপ্রিয় ছিল না। ক্রমশঃ বাতাসের বেগ কমিয়া আসিল, গ্রীষ্মের উত্তাপও সঙ্গে সঙ্গে অসহ্য হইয়া উঠিল।
দেখিতে দেখিতে সেই মেঘমণ্ডল আকাশ ছাইয়া ফেলিল। ঘোর অন্ধকার পৃথিবীকে গ্রাস করিল—এমন কি, কোলের মানুষ পর্যন্ত অদৃশ্য হইল। সহসা বাতাস বহিল, ক্রমেই তাহার বেগ বাড়িতে লাগিল, শেষে ঝড় উত্থিত হইল। পৰ্ব্বতপ্রমাণ ধূলিরাশি চারিদিকে বিক্ষিপ্ত হইতে লাগিল। জানালা বন্ধ করিয়া দিলাম।
কিছুক্ষণ ঝড় হইবার পর বৃষ্টি আসিল। ক্রমে মুষলধারে বৃষ্টি পড়িতে লাগিল। এই দুর্যোগের সময় বাহিরে একজন সাহেব ইনস্পেক্টরের পরিচিত কণ্ঠস্বর আমার কর্ণগোচর হইল।
এত দুর্যোগে সাহেবের সাড়া পাইয়া, আমি কিছুমাত্র আশ্চর্যান্বিত হইলাম না। ভাবিলাম, ব্যাপার গুরুতর, নচেৎ এই ঝড় বৃষ্টির সময় সাহেব আমার কাছে আসিবেন কেন?
সাহেব ঘরে প্রবেশ করিয়া— কিছুক্ষণ বিশ্রামলাভের পর আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, সাহেব! ব্যাপার কি? এই দুর্যোগে আপনি কষ্ট করিয়া এখানে আসিলেন কেন?”
সাহেব হাসিতে হাসিতে উত্তর করিলেন, “কেন আসিলাম? এক ভয়ানক গোলযোগে পড়িয়াছি, আপনার সাহায্য ভিন্ন উপায়ান্তর নাই। কাশীপুরে একটা খুন হইয়াছে শুনিয়াছেন?”
কাশীপুরের খুনের বিষয় সত্য সত্যই আমি কিছুই শুনি নাই। জিজ্ঞাসা করিলাম, “কাশীপুরে খুন হইয়াছে! কই, সে বিষয়ে কোন কথাই ত শুনি নাই!”
সা। আমি ঐ খুনের বিষয় কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। সেই জন্য আপনার নিকট উপস্থিত হইয়াছি।
আ। আমার সাহেবকে জানাইয়াছেন?
সা। না, তাঁহাকে এখনও জানান হয় নাই। খুব সম্ভব, তিনি এখন উপস্থিত নাই, পরে জানাইলেই চলিবে।
আ। কি রকমে খুন হইয়াছে?
সা। অতি অদ্ভুত, বড়ই আশ্চর্য্য ব্যাপার! যে লোক খুন হইয়াছেন, তিনি অতি নিরীহ। তাঁহার মত লোকের যে কেহ শত্রু থাকিতে পারে, এ রকম সন্দেহই করা যায় না।
আ। বলুন দেখি, কি ব্যাপার শোনা যাউক।
সা। কাশীপুরে মল্লিকদের বাগানের ঠিক পশ্চিমে একখানি অতি সুন্দর বাগান আছে। বাগানখানি বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন; ছোট হইলেও তিন চারিজন মালি ইহার পরিচর্য্যায় নিযুক্ত আছে; প্রবোধচন্দ্র ঘোষ এই বাগানের অধিকারী। প্রবোধচন্দ্রের বাড়ী পূর্ব্ববঙ্গে, কিন্তু তিনি কলিকাতায় বিবাহ করিয়াছেন, কদাচ কখনও দেশে গিয়া থাকেন। বাগানের দক্ষিণে একখানি দ্বিতল অট্টালিকায় তিনি বাস করেন। প্রবোধবাবু কলিকাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন এম-এ। তাঁহার বয়স প্রায় পঞ্চাশ বৎসর। এই বয়সেই তিনি জ্বরাগ্রস্ত হইয়াছেন। বাতে তাঁহাকে পঙ্গু করিয়া ফেলিয়াছে। প্রায় সমস্ত দিনই তিনি খাটের উপর এক অতি কোমল শয্যায় শুইয়া থাকেন। তিনি একজন বিখ্যাত ডাক্তার। ধাত্রীবিদ্যায় তিনি বিশেষ পারদর্শী। এই কাজ করিয়া তিনি অনেক টাকা উপার্জ্জন করিয়াছেন। সম্প্রতি অসমর্থ হওয়ায়, ঐ বিষয়ে পুস্তক লিখিয়া যথেষ্ট উপার্জ্জন করিয়া থাকেন। তাঁহার প্রণীত অনেকগুলি পুস্তকের বেশ সুখ্যাতি ও কাট্তি আছে।
সাহেবকে বাধা দিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “যে লোক সমস্ত দিন শুইয়া থাকেন, তিনি এতগুলি বই-কিরূপে লিখিলেন?”
সাহেব হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “আমি সেই কথাই বলিতেছিলাম। প্রবোধবাবু স্বয়ং লেখেন না। তাঁহার একজন সহকারী আছেন, তিনিই লিখিয়া থাকেন। যে লোকের হাত নাড়িতে কষ্ট হয়, তিনি এত বই কিরূপে লিখিবেন? প্রায় ছয় বৎসর হইল, তিনি এইরূপ রোগগ্রস্ত হইয়াছেন। এই সময়ের মধ্যে অনেকেই তাঁহার সহকারীরূপে নিযুক্ত হইয়াছিলেন, কিন্তু কেহই তাঁহার মনোমত হয় নাই। তাঁহার এখনকার সহকারী প্রতাপচাঁদও একজন কৃতবিদ্য যুবক। তিনিও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন এম-এ। প্রতাপচাঁদের বয়স প্রায় ত্রিশ বৎসর। তাঁহাকে দেখিতে শ্যামবর্ণ, নাতিদীর্ঘ, নাতিখর্ব্ব, তাঁহার চক্ষু উজ্জ্বল ও স্থির। প্রতাপচাঁদ জাতিতে কায়স্থ, পিতৃ-মাতৃহীন; এক আত্মীয়ের বাড়ীতে প্রতিপালিত হইয়াছিলেন। তিনি অতি নিরীহ—সকলেরই প্রিয়। অথচ সেই লোকই আজ দুপুর বেলায় খুন হইয়াছে। আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া বলিলাম, “বলেন কি! দিনের বেলা কলিকাতার পার্শ্বে খুন? বাড়ীর কোন লোক কিছু বলিতে পারে না? প্রতাপচাঁদ থাকেন কোথায়?”
“ঐ বাগানেই থাকেন? বেলা দশটা হইতে ছয়টা পর্যন্ত তাঁহাকে প্রবোধবাবুর কাজ করিতে হয়। তাঁহাকে স্বতন্ত্ৰ একটি ঘর দেওয়া হইয়াছে। অধিকাংশ অবকাশ সময় তিনি সেই ঘরে বসিয়া পুস্তক পাঠ করেন। তাঁহার বন্ধু-বান্ধব ছিল না।”
আ। বাড়ীতে কে আছে? প্রবোধবাবুর পরিবার কয়জন?
সা। শুনিয়াছি, প্রবোধবাবুর অনেকগুলি সন্তান হইয়াছিল, কিন্তু আপাততঃ একজনও জীবিত নাই। প্রবোধবাবুর স্ত্রী বর্ত্তমান। একজন দাসী, একজন চাকর, একজন কোচমান, দুই জন সহিস এবং চারিজন মালিও আছে।
আ। এতগুলি লোক থাকিতে দিনের বেলায় সেখানে খুন হইয়া গেল, এ বড় আশ্চৰ্য্য কথা! ইহাদের মধ্যে এই খুন সম্বন্ধে কেহ কোন কথা বলিতে পারে না? আপনি তাহাদিগকে ভাল করিয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন?
সা। দুঃখের বিষয় সে সময় বাড়ীতে কেহই ছিল না।
আ। সে কি! কোথায় গিয়াছিল?
সা। মালী চারিজনের মধ্যে তিন জন হাটে গিয়াছিল, একজন রসুই করিতেছিল। বাড়ীর চাকর গিন্নীর বাপের বাড়ী তত্ত্ব লইয়া গিয়াছিল। কোচমান ও সহিস দুইজন প্রবোধবাবুর শ্যালককে আনিবার জন্য গাড়ী লইয়া দমদম ষ্টেসনে গিয়াছিল। বাড়ীতে কেবল গিন্নী ও সেই দাসী ছিল।
আ। গিন্নী এই খুনের বিষয় কিছু বলিতে পারেন?
সা। না, —আহারাদির পর তিনি ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলেন। বিশেষতঃ প্রতাপবাবু যে ঘরে খুন হইয়াছেন, প্রবোধবাবুর স্ত্রীর শোবার ঘর হইতে সে ঘর অনেক দূর।
আ। দাসী কিছু শুনিয়াছে?
সা। দাসীকে জিজ্ঞাসা করায় সে বলিল, “আহারাদির পর সে ছাদ হইতে কতকগুলি কাপড় আনিয়া ঘরে ঘরে রাখিতেছিল, এমন সময়ে এক ভয়ানক চীৎকার তাহার কর্ণগোচর হয়। সেই বিকট শব্দে সে চমকিত ও ভীত হয় এবং কোথা হইতে সেই শব্দ আসিতেছে, জানিবার জন্য ব্যস্ত হয়; কিন্তু সাহস করিয়া সে কোথাও যাইতে পারে নাই।’
আ। সে তখন কোথায় ছিল?
সা। বাড়ীর ভিতর অন্দর মহলে।
আ। বাড়ীখানা কেমন?
সা। বাড়ীখানা দ্বিতল ও দুই মহল। অন্দর মহলের উপরে তিনখানি ঘর। একখানিতে প্রবোধবাবু থাকেন, একখানিতে তাঁহার স্ত্রী থাকেন এবং অপরখানি প্রায়ই খালি থাকে। নীচেও তিনখানি ঘর; একখানি রান্নাঘর, একখানি ভাঁড়ার ঘর, আর একখানিতে দাসী থাকে। বাহির মহলে উপরে দুইখানি প্রকাণ্ড ঘর ও একটা বড় দালান আছে। ঘর দুইখানির মধ্যে একখানিতে প্রবোধবাবুর লাইব্রেরী; অপরখানিতে প্রতাপবাবু থাকেন। নীচের তিনটি ঘর, একটিতে চাকর থাকে, অপর দুইটি ঘর প্রায়ই বন্ধ থাকে।
আ। প্রবোধবাবু কোন ঘরে বসিয়া পুস্তক রচনা করেন?
সা। অন্দরমহলে–নিজের শোবার ঘরে।
আ। সেখানে ত প্রতাপবাবুকেও যাইতে হয়?
সা। নিশ্চয়ই। প্রবোধবাবুর অনুমতি অনুসারে তিনি স্বচ্ছন্দে অন্দরে যাইতে পারিতেন। প্রবোধবাবুর শোবার ঘরের সঙ্গে বাহির মহলের লাইব্রেরীর যোগ আছে; মধ্যে একটি দরজা।
আ। লাইব্রেরী ঘর হইতে প্রতাপবাবুর ঘর কতদূর?
সা। লাইব্রেরীর পার্শ্বেই প্রতাপবাবুর ঘর।
আ। কোন ঘরে প্রতাপবাবু খুন হইয়াছেন?
সা। তাঁহারই শোবার ঘরে।
আ। বাড়ীর মধ্যে হঠাৎ একটা বিকট চীৎকার শব্দ শুনিয়া দাসী কিছুই করিল না?
সা। আগেই বলিয়াছি, সেই ভয়ানক চীৎকারধ্বনি শুনিয়া, দাসীর বড় ভয় হইয়াছিল। সে কি করিবে, স্থির করিতে না পারিয়া, কিছুক্ষণ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ক্ষণকাল পরেই তাহার বোধ হইল, কে যেন প্রতাপবাবুর ঘরের ভিতর পড়িয়া গেল। তখন সে তাড়াতাড়ি প্রতাপচন্দ্রের ঘরে যাইল। দেখিল, তিনি মেজের উপর নিস্পন্দভাবে পড়িয়া রহিয়াছেন, তাঁহার গলদেশ হইতে প্রবলবেগে রক্ত বহির্গত হইতেছে, ঘরের ভিতরে যেন রক্তের নদী বহিতেছে। ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া এবং চারিদিকে রক্তের ছড়াছড়ি দেখিয়া, সে চীৎকার করিয়া উঠে। সৌভাগ্যক্রমে সেই সময় বাড়ীর চাকর ও মালী তিনজন ফিরিয়া আসিয়াছিল। দাসীর চীৎকার শব্দ শুনিয়া, সকলেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল এবং প্রতাপবাবুর ঘরে আসিয়া সমস্ত ব্যাপার দেখিতে পাইল।
আ। প্রতাপবাবু কি তখন মরিয়া গিয়াছিলেন?
সা। দাসী ও বাগানের মালী তিনজন সেই রকমই ভাবিয়াছিল। কিন্তু চাকর প্রতাপবাবুকে বড় ভালবাসিত। সে নিকটে গিয়া ভাল করিয়া দেখিয়া বুঝিতে পারিল যে, তিনি তখনও মরেন নাই। সে তখন মালীদিগের সাহায্যে প্রতাপবাবুকে তাঁহার বিছানায় শোয়াইতে মনস্থ করিল। সেই সময়ে প্রতাপবাবু সহসা চক্ষু উন্মীলন করিলেন, যেন কোন কথা বলিবার জন্য চেষ্টা করিলেন। বাড়ীর চাকরটি অতি চতুর; সে তাঁহার মনোভাব বুঝিতে পারিয়া, তাঁহার মুখের কাছে আপনার কান লইয়া গেল। শুনিল, “প্রবোধবাবুর সেই লোক।” বোধ হয়, তিনি আরও কোন কথা বলিতেন, কিন্তু পারিলেন না। শেষ কথাটির সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার চক্ষু উপরে উঠিল, পরক্ষণেই তাঁহার দেহ হইতে প্রাণবায়ু বাহির হইল।
আ। প্রবোধবাবু কি বলেন? তিনি কিছু শুনিয়াছিলেন?
সা। হাঁ, তিনিও সেই চীৎকারধ্বনি শুনিতে পাইয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার উঠিবার শক্তি নাই এবং নিকটেও কোন লোক না থাকায় কিছুই করিতে পারেন নাই।
আ। প্রতাপবাবু খুনের কথা কখন তিনি জানিতে পারেন?
সা। প্রতাপচন্দ্রের মৃত্যুর ঠিক পরেই বাড়ীর চাকর তাঁহাকে এই সংবাদ দেয়। তিনি তখনই পুলিসে সংবাদ পাঠান। সঙ্গে সঙ্গে আমিও সেখানে উপস্থিত হই। প্রতাপচন্দ্রের মৃত্যুর পর ঘরের কোন দ্রব্য স্থানান্তরিত করা হয় নাই। আমি সমস্তই পরীক্ষা করিয়াছি, কিন্তু কে যে প্রতাপচন্দ্রকে খুন করিয়াছে এবং কি অভিপ্রায়েই বা একার্য্য করিয়াছে, তাহার কিছুই বুঝিতে পারি নাই। আপনি অনেকবার অনেক বিষয়ে আমায় সাহায্য করিয়াছেন, তাই আপনার ভরসায় এখানে আসিয়াছি।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
সাহেবের মুখে সমস্ত ব্যাপার অবগত হইয়া আমি কিছুক্ষণ চিন্তা করিলাম। পরে বলিলাম, “সাহেব! পরীক্ষা করিয়া আপনি কি জানিতে পারিয়াছেন, না জানিলে, আমি কি করিয়া আপনাকে সাহায্য করিব।”
সাহেব বলিলেন, “আমার ইচ্ছা আপনি স্বয়ং একবার পরীক্ষা করেন।”
আ। আগে আপনি কতদূর অগ্রসর হইয়াছেন শুনি, পরে যাহা হয় বিবেচনা করা যাইবে। যদি সেখানে না গিয়া কোন উপায় করিতে পারি ভালই, নচেৎ কাৰ্য্যস্থানে যাওয়া যাইবে।
সা। বাড়ী ও বাগানের চারিদিক পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম বাড়ীর দুইটি দরজা আছে। একটি সদর, অপরটি খিড়কী। সদর দরজা দিয়া বাড়ীতে যাইতে হইলে বাগানের ভিতর দিয়া যাইতে হয়। খিড়কী দরজা দিয়া প্রবেশ করিলে একেবারে অন্দরে উপস্থিত হওয়া যায়। খিড়কী দরজা প্রায়ই বন্ধ থাকে, আজও ছিল; সুতরাং সে পথে হত্যাকারী প্রবেশ করে নাই। আমি সে পথ ভাল করিয়া পরীক্ষা করিয়াছি, সেদিকে কাহারও পদচিহ্ন বা অপর কোন চিহ্ন দেখিতে পাই নাই। সুতরাং হত্যাকারী যে সদর দরজা দিয়া প্রবেশ করিয়াছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।
আ। প্রতাপচন্দ্র মরিবার পূর্ব্বে প্রবোধবাবুর নাম করিয়াছিলেন কেন? এ কথা প্রবোধবাবুকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন?
সা। হাঁ, কিন্তু তিনি ভাল করিয়া উত্তর দিতে পারেন নাই। বলিলেন, “চাকর কি শুনিতেকি শুনিয়াছে?’
আ। প্রবোধবাবুর কোন পরিচিত লোক কি তাঁহার বাড়ীতে যাতায়াত করিতেন?
সা। না। শুনিয়াছি, তাঁহার সহিত কোন লোকের সদ্ভাব নাই।
আ। সদর দরজা দিয়া বাড়ীতে যাইতে হইলে বাগানের যে পথ দিয়া যাইতে হয়, সে পথটি ভাল করিয়া দেখিয়াছেন?
সা। হাঁ— দেখিয়াছি।
আ। সে পথে কাহারও পায়ের দাগ বা অপর কোন চিহ্ন দেখিতে পাইয়াছেন?
সা। হাঁ। কিন্তু হত্যাকারী বড় সামান্য লোক নহে। পথ দিয়া যাইলে পাছে পায়ের দাগ পড়ে, সেই জন্য সে পথের ধারে ধারে যে ঘাস জন্মিয়াছে, তাহারই উপর দিয়া গিয়াছিল। পথে কোন দাগ দেখিতে না পাইলেও সেই ঘাসের উপর কতকগুলি দাগ দেখিতে পাইয়াছি।
আ। দাগগুলি বাড়ীর দিকে যাইবার, না বাড়ী হইতে আসিবার?
সা। যাইবার দাগ। কোন্ পথে যে সে বাহির হইয়াছে, তাহা বুঝিতে পারি নাই।
আ। প্রবোধবাবুর শ্যালকের বাড়ী কোথায়?
সা। কলিকাতায়।
আ। আজ কি তাঁহার কাশীপুরে যাইবার কথা ছিল?
সা। হাঁ।
আ। তিনি কি গিয়াছেন?
সা। সে কথা বলিতে পারিলাম না।
আ। কেন? কোচম্যানকে জিজ্ঞাসা করিলেই জানিতে পারিতেন।
সা। জিজ্ঞাসা করিতে ভুলিয়া গিয়াছি।
আ। কোচম্যানের সহিত আপনার দেখা হইয়াছিল?
সা। হাঁ-হইয়াছিল।
আ। ষ্টেসন হইতে সে কখন ফিরিয়া আসিল?
সা। আমি সেখানে যাইবার কিছু পূর্ব্বে।
আ। বাড়ীর ভিতরে কোন দাগ দেখিতে পাইয়াছেন?
সা। না। বাড়ীর একতলায় আগাগোড়া পাপোষ পাতা। তাহার উপরের দাগ সহজে জানা যায় না।
আ। যে ঘরে খুন হইয়াছে, সেখানে কোনরূপ দাগ আছে?
সা। জানিবার উপায় নাই। সেখানেও পাপোষ পাতা। সেই ঘরে গিয়া আমি আগেই পায়ের দাগ অন্বেষণ করি,
কিন্তু দুঃখের বিষয়, কোন দাগই দেখিতে পাই নাই। ঘরের ভিতর একটা বড় দেরাজ ও একটা টেবিল আছে। টেবিলের উপর একটি কলমদানে দুইটি দোয়াত, চারিটি কলম, একখানি রবার ও একখানি ছুরি ছিল। দেরাজটি সর্ব্বদাই খোলা থাকে। তাহার ভিতরে কোন দামী জিনিষ নাই।
আ। ঘরের কোন জিনিষ চুরি গিয়াছে?
সা। সকল জিনিষ মিলাইয়া দেখিয়া আমি জানিতে পারিলাম যে, কোন জিনিষই চুরি যায় নাই।
আ। মৃতদেহ পরীক্ষা করিয়াছেন?
সা। হাঁ। টেবিলটার পার্শ্বেই প্রতাপবাবুর মৃতদেহ পড়িয়াছিল। তাঁহার গলার প্রায় অর্দ্ধেকটা কাটিয়া গিয়াছে। ক্ষতস্থান দিয়া তখনও অল্প অল্প রক্ত বাহির হইতেছিল। গলার এমন যায়গা কাটিয়া গিয়াছে যে, তাহা দেখিলে বেশ বোঝা যায়, প্রতাপবাবু আত্মহত্যা করেন নাই।
আ। কোন্ অস্ত্রে গলা কাটা হইয়াছে, বলিতে পারেন? ঘরে কোন অস্ত্র পাইয়াছেন কি?
সা। না, কোন অস্ত্র পাই নাই বটে, তবে একখানি সোণার চা পাওয়া গিয়াছে।
এই বলিয়া সাহেব পকেট হইতে একখানি চমা বাহির করিয়া আমাকে দিলেন। বলিলেন, “এই চ্যাখনি টেবিলের উপর পড়িয়াছিল।”
চাখানি হাতে লইয়া আমি একবার চোখে দিলাম। কিছুক্ষণ ভাল করিয়া পরীক্ষা করিবার পর বলিলাম, “এই চমা হইতে অনেক খবর পাওয়া যাইবে।”
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
আমার কথা শুনিয়া সাহেব আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। বোধ হয় তিনি আমার কথা বিশ্বাস করিলেন না। আমি তাঁহার মনোগত অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “সাহেব! আমার দিকে অমন করিয়া চাহিয়া রহিলেন কেন? আমার কথা বিশ্বাস হইতেছে না?”
সাহেব ঈষৎ হাস্য করিলেন। বলিলেন, “এই চস্মা হইতে আপনি এমন কি বুঝিতে পারিলেন, বলিতে পারি না?”
আ। আপনি নিশ্চয় জানেন, চাখানি প্রতাপবাবুর নয়?
সা। হাঁ। তিনি চসমা ব্যবহার করিতেন না। চাখানি যে হত্যাকারীর সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নাই। এখন আপনি ইহা হইতে কি জানিতে পারিয়াছেন বলুন?
আ। চাখানি সাধারণ লোকের নয়। ইহার জোর এত অধিক যে, যে লোক ইহা ব্যবহার করিতেন, তাঁহার দৃষ্টিশক্তি বড় কম। লোকটা ধনী। তিনি যখন সোণার চা ব্যবহার করেন, তখন এ কথা সহজেই জানিতে পারা যায়। তাঁহার নাক মোটা। চার ফাঁদ দেখিয়া আমি তাহাও বুঝিতে পারিয়াছি। লোকটা সম্প্রতি কোন চাওয়ালার দোকানে দুই তিনবার গিয়াছিলেন। যদিও চমাখানিতে প্রস্তুতকারকের নাম নাই, তবুও ইহা যে কোন সাহেব-বাড়ী হইতে কেনা হইয়াছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।
সা। কেমন করিয়া জানিলেন যে, তিনি সম্প্রতি কোন চার দোকানে গিয়াছিলেন?
আ। চখানির যে অংশ নাকের উপর থাকে, তাহার দুই দিকে দুইখানি পাতলা কর্ক দেওয়া রহিয়াছে। কর্ক দুইখানির মধ্যে একখানি নূতন আর একখানি পুরাতন। নূতন কর্কখানি এরূপে বসান হইয়াছে যে, দেখিলে সহজে বোধ হয় না যে, উহা বদলান হইয়াছে। খুব ভাল কারিগর না হইলে কর্কখানি ওরূপে বসাইতে পারিত না। সেই জন্যই বলিতেছিলাম যে, তিনি সম্প্রতি কোন চার দোকানে গিয়াছিলেন। আমার বোধ হয়, যে দোকান হইতে চমাখানি কেনা হইয়াছিল, সেই দোকানেই এই কর্ক বদলান হইয়াছে।
আমার কথা শুনিয়া সাহেব আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন। বলিলেন, “এখন একবার চার দোকানগুলি দেখিতে হইবে।”
আ। আপনার আর কিছু বলিবার আছে?”
সা। না। আমি এ পর্য্যন্ত যাহা জানিতে পারিয়াছি, সমস্তই আপনাকে বলিয়াছি। এখন আমিও যাহা জানি, আপনিও তাহা জানিতে পারিয়াছেন। তবে একটি কথা বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি।
আ। কি?
সা। স্থানীয় লোকদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিয়াছি যে, তাহারা সেদিন সেখানে কোন অপরিচিত লোক দেখে নাই।
আ। তবে কে খুন করিল? আর কেনই বা প্রতাপচন্দ্রের মত নিরীহ লোককে খুন করিল?
সা। সেই কথাই ত আমি আপনার কাছে জানিতে আসিয়াছি। আজ সন্ধ্যা হইয়া গেল, তা ছাড়া এত বৃষ্টিতেই বা কি করা যায়? যদি অনুগ্রহ করিয়া কাল প্রাতে একবার কাশীপুর যান, তাহা হইলে বড় উপকৃত হই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, আপনি সেখানে যাইলেই সমস্ত রহস্য জানিতে পারিবেন।
আমি সম্মত হইলাম। বলিলাম, “কাল অতি প্রত্যূষে আমি সেইস্থানেই উপস্থিত হইব।”
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
পরদিন অতি প্রত্যূষে যখন আমি কাশীপুরের বাগানে উপস্থিত হইলাম, তখনও আকাশ ধরে নাই। ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে অল্প অল্প বৃষ্টি পড়িতেছিল। গাড়ী হইতে নামিয়া দেখিলাম, সাহেব সেই স্থানে উপস্থিত আছেন।
আমরা বাগানের ভিতর কিছুদূর অগ্রসর হইতেছি, এক স্থানে সাহেব দাঁড়াইয়া পড়িলেন। তিনি আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “এইখানেই পায়ের দাগ দেখিয়াছিলাম।”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কোন দিকে?”
সা। আপনার ঠিক দক্ষিণ দিকে। রাস্তার পাশে যে ঘাস দেখিতে পাইতেছেন, ঐ ঘাসের উপর আমি পায়ের দাগ দেখিয়াছিলাম। কাল দাগগুলো বেশ পরিষ্কার ছিল, কিন্তু আজ আর দেখা যাইতেছে না। কালিকার বৃষ্টিতে দাগগুলি উঠিয়া গিয়াছে।
সাহেবের কথায় আমি সেই স্থানটি ভাল করিয়া দেখিলাম। ঘাসের উপর যে সকল দাগ ছিল, বৃষ্টিতে সেইগুলি উঠিয়া গিয়াছে। কোন কথা না বলিয়া আমি অগ্রসর হইলাম। সাহেব আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতে লাগিলেন। বাড়ীর সম্মুখে গিয়া দেখিলাম, দরজা খোলা রহিয়াছে। সাহেবকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এই দরজা এই রকম কি খোলা থাকে।”
সাহেব সম্মতিসূচক উত্তর দিলেন। আমি তখন বলিয়া উঠিলাম, “তবে আর কষ্ট কি? খুনী ত সহজেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়াছিল। বাগানের ফটক দিয়া প্রবেশ করিয়া যে পথে আমরা আসিলাম, সেও ঠিক সেই পথ দিয়া আসিয়া, এই দরজা দিয়া বাড়ীর ভিতর আসিয়াছিল। কিন্তু সে যে এই স্থানে কতক্ষণ ছিল, তাহা বলা যায় না।
আমায় বাধা দিয়া সাহেব বলিয়া উঠিলেন, “আমি বলিতে পারি। এক কোয়ার্টারের অধিক সে সেখানে ছিল না।”
সাহেবের কথায় আমি চমকিত হইলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, “সে কথা আপনি কেমন করিয়া জানিতে পারিলেন?”
সাহেব বলিলেন, “দাসীর মুখে শুনিয়াছি, সে যখন ছাদে কাপড় আনিতে গিয়াছিল, তখন সে প্রতাপবাবুকে বই পড়িতে দেখিয়াছিল। ছাদ হইতে কাপড়গুলি তুলিয়া আনিতে নিশ্চয়ই দশ মিনিটের অধিক লাগে নাই। নীচে নামিবার অতি অল্পকাল পরেই সে সেই চীৎকারধ্বনি শুনিতে পায়। এই সময়ের মধ্যেই যে সেই লোক প্রতাপবাবুর ঘরে আসিয়া তাঁহাকে খুন করিয়া গিয়াছে, তাহাতে আর কোন সন্দেহ নাই।”
সাহেবের কথা যুক্তিপূর্ণ বলিয়া বোধ হইল। আমি তখন তাঁহাকে বলিলাম, “এইবার একবার প্রতাপচন্দ্রের ঘর দেখিতে ইচ্ছা করি।”
সাহেব আমার কথায় সম্মত হইলেন এবং অবিলম্বে যে ঘরে প্রতাপচন্দ্র খুন হইয়াছেন, সেই ঘরে আমাকে লইয়া গেলেন।
ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, ঘরটি নিতান্ত ছোট নয়। দৈর্ঘ্যে প্রায় ষোল হাত, প্রস্থেও বার হাতের কম নয়। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ঘরের মধ্যে একটা দেরাজ, দুইটা আলমারি, তিন চারিখানি চেয়ার, খান কতক ভাল ভাল ছবি ছিল। টেবিলের উপর অতি সুন্দর একটি আলোকাধারও ছিল। ঘরের মেঝেয় ম্যাটিং পাতা। আমি ঘর ও তাহার ভিতরের জিনিষপত্র ভাল করিয়া পরীক্ষা করিলাম, কিন্তু বিশেষ কোন সূত্র বাহির করিতে পারিলাম না। কিছুক্ষণ সকল বিষয় ভাবিয়া আমি যেমন দেরাজের নিকট যাইলাম, অমনি উহাতে একটি আঁচড় দেখিতে পাইলাম। দেরাজের যে স্থানে সেই দাগ দেখিতে পাইলাম, তাহাতে স্পষ্টই বোধ হইল যে, কোন লোক সেই দেরাজ খুলিবার সময় অসাবধানতা বশতঃ হঠাৎ চাবি দ্বারা ঐরূপ দাগ করিয়াছে। আমি সাহেবকে সেই দাগ দেখাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “সাহেব! এই দাগটা কে করিল? আপনি আগে এই দাগ দেখিয়াছিলেন কি?”
সা। হাঁ দেখিয়াছিলাম।
আ। এই দাগ হইতে কোনরূপ সূত্র বাহির করিতে পারিয়াছেন?
সা। না। দেরাজে অমন আঁচড়ের দাগ প্রায়ই দেখা যায়।
আ। সত্য। কিন্তু একটু ভাল করিয়া দেখিলেই জানিতে পারিতেন যে, দাগটা সম্পূর্ণ নূতন। আমার এই কাচখানির সাহায্যে আর একবার দাগটি দেখুন দেখি, এখনই বুঝিতে পারিবেন উহা নূতন কি পুরাতন।
সাহেব আমার হাত হইতে কাচখানি গ্রহণ করিলেন এবং অতি যত্নের সহিত পরীক্ষা করিলেন, পরে বলিলেন, “আপনার কথাই সত্য— দাগটা নূতন বলিয়া বোধ হইতেছে।”
আ। একবার দাসীকে ডাকাইয়া পাঠান। তাহাকে গোটাকতক কথা জিজ্ঞাসা করিয়া দেখি, সে কি বলে।
সা। সে যাহা বলিয়াছিল, আমিত আগেই আপনাকে সে কথা বলিয়াছি।
আ। বলিয়াছেন বটে, কিন্তু এখন আমি একবার তাহার মুখের কথা শুনিতে চাই।
সাহেব তখনই সে ঘর হইতে চলিয়া গেলেন এবং অল্পক্ষণ পরেই দাসীকে সঙ্গে লইয়া পুনরায় আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দাসীকে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,-
“এই দরজার চাবি কোথায় থাকিত?”
দা। প্রতাপবাবুর কাছেই থাকিত।
আ। দেরাজের কলগুলি কেমন?
দা। ভাল কল শুনিয়াছি, সকলগুলিই বিলাতী।
আ। চীৎকার শুনিবার কতক্ষণ পরে তুমি এ ঘরে আসিয়াছিলে?
দা। প্রায় সিকি ঘণ্টা পরে।
আ। কোন লোককে বাহিরে পলায়ন করিতে দেখিয়াছ?
দা। আজ্ঞে না।
আ। এই ঘরের দুইটি দরজা দেখিতেছি। একটি দিয়া বাহিরে যাওয়া যায়, আর একটি দিয়া অন্দরে প্রবোধবাবুর ঘরে যাওয়া যায়। খুব সম্ভব, প্রতাপচন্দ্র এই শেষোক্ত পথ দিয়া প্রবোধবাবুর ঘরে যাইতেন। তুমি যখন এই ঘরে আসিতেছিলে, তখন খুনী সহজেই অপর পথ দিয়া অন্দরে যাইতে পারে।
দা। তাহা হইলে বাবু নিজেই জানিতে পারিতেন। কারণ তিনি প্রায়ই জাগিয়া থাকেন। নিজে অপটু হইলেও তিনি অনায়াসে চীৎকার করিয়া চাকরদের ডাকিতে পারিতেন। তা ছাড়া, তিনি যখন আগেই এই হত্যাকাণ্ডের বিষয় পুলিসে সংবাদ দিতে হুকুম দিয়াছিলেন, তখন তিনি নিশ্চয়ই কোন লোককে দেখিতে পান নাই।
দাসীকে বিদায় দিলাম। একবার প্রবোধবাবুর সহিত দেখা করিবার ইচ্ছা হইল। সাহেব আমার অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া অন্দরে সংবাদ পাঠাইলেন।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
প্রবোধবাবুর ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, তাঁহার ঘরটি প্রতাপবাবুর ঘরের অপেক্ষা বড়। ঘরের ভিতর অনেকগুলি দেরাজ ও আলমারি ছিল। সকলগুলিতেই বড় বড় পুস্তকে পূর্ণ। প্রতাপবাবুর ঘরটি যেমন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, এ ঘরটি তেমন নয়। ঘরের ঠিক মধ্যে একখানি পালঙ্ক। তাহার উপর একটি সুকোমল শয্যা। প্রবোধবাবু শয্যায় শুইয়া আছেন। তাঁহাকে দেখিলে জরাগ্রস্ত বলিয়া বোধ হয় না। সাহেব তাঁহাকে আমার কথা বলিলে পর, তিনি বাহ্যিক অত্যন্ত আনন্দিত হইলেন; এবং আমাদিগকে বসিতে অনুরোধ করিলেন। আমরা সেই স্থানে বসিলাম।
অনেকক্ষণ পরে প্রবোধবাবু কহিলেন, “মহাশয় এ খুনী ধরা পড়িবে কি?” আমি বলিলাম, “খুব সম্ভব, সে ধরা পড়িবে। কিন্তু এখনও কিছু স্থির করিতে পারি নাই।”
প্র। যদি আপনি আসামীকে গ্রেপ্তার করিতে পারেন, তাহা হইলে চিরদিনের জন্য আপনার নিকট কৃতজ্ঞ থাকিব। বলিতে কি, প্রতাপ চাঁদের সহসা মৃত্যুতে আমার যেন বুদ্ধিশক্তি লোপ হইবার উপক্রম হইয়াছে।
আ। আমি আপনাকে দুই একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি।
প্র। আমি সৰ্ব্বদাই শুইয়া থাকি। কে কোথায় কি করে, তাহা জানিবার উপায় নাই।
আ। আমিও সাহেবের মুখে সেই রকম শুনিয়াছি। অধিক কথা জিজ্ঞাসা করিব না। আমি জানিতে ইচ্ছা করি, প্রতাপচন্দ্র মরিবার পূর্ব্বে আপনার নাম উচ্চারণ করিলেন কেন?—”প্রবোধবাবুর- সেই লোক” এ কথার তাৎপর্য কি বুঝিতে পারিয়াছেন?
প্র। আজ্ঞা না। চাকরের মুখে শুনিয়া কোন কথা বিশ্বাস করিবেন না। আমাদের চাকরের বাড়ী এ দেশে নহে। একে সে মূর্খ, তাহাতে পল্লীগ্রামে বাস, সুতরাং তাহার কথায় বিশ্বাস করা যায় না।
আ। আপনি কি বলিতে চান, সে মিথ্যা কথা বলিয়াছে।
প্র। সে বুঝিতেই পারে নাই। প্রতাপচাঁদ মরিবার পূর্ব্বে যে কি বলিয়াছিল, তাহা সে ভাল শুনিতেই পায় নাই। কি শুনিতে কি শুনিয়াছে, কে জানে?
আ। আপনি তাহা হইলে ও বিষয়ে কোন কথা বলিতে পারেন না। আপনার কাহার উপর সন্দেহ হয়? প্র। না। আমার বোধ হয় তিনি হয় আত্মহত্যা করিয়াছেন, নচেৎ দৈবাৎ কোন রকমে হত হইয়াছেন।
আ। যদি আত্মহত্যাই হয়, তবে কোন অস্ত্রে প্রতাপবাবু আপনার গলদেশ ঐরূপ করিয়া কাটিলেন। অস্ত্রের মধ্যে একখানি ছোট ছুরি ছাড়া আর ত কিছুই সে ঘরে দেখিতে পাইলাম না। আর এক কথা, একখানি সোণার চা পাওয়া গিয়াছে। সাহেবের মুখে শুনিয়াছি, প্রতাপবাবু স্বয়ং চমা লইতেন না। যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে সেই চাখানি কাহার? কোথা হইতে আসিল?
প্র। ঠিক বলিয়াছেন। আমি নিতান্ত বালকের মত কথা বলিয়াছি। আপনার কথা শুনিয়া এখন আমার বিশ্বাস হইতেছে, প্রতাপচাঁদ আত্মহত্যা করেন নাই।
প্রবোধবাবুর কথা শুনিয়া আমার বোধ হইল, তিনি আমার খাতিরে শেষোক্ত কথাগুলি বলিয়াছেন। কারণ তাঁহার মুখ দেখিয়া আমার স্পষ্টই বোধ হইল, যে তিনি এখনও বিশ্বাস করেন, প্রতাপচন্দ্র আত্মহত্যা করিয়াছেন। আমি আর সে কথা না তুলিয়া একটি আলমারী দেখাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “ঐ আলমারীতে কি আছে?”
প্র। এমন কোন জিনিষ নাই, যাহাতে এই ঘরে চোর আসিতে পারে। আপনি উহা খুলিয়া দেখিতে পারেন। বাল্যকাল হইতে যত রকম পারিতোষিক, প্রশংসাপত্র ও সার্টিফিকেট পাইয়াছি, সেই সমস্তই উহার ভিতর রাখা হইয়াছে।
তাঁহার কথা শুনিয়া আমি আলমারীর নিকট গমন করিলাম ও কাগজ পত্রগুলি দেখিবার ভানে আমি অনেকক্ষণ সেই স্থানে দাঁড়াইয়া, ঐ ঘরটির চতুৰ্দ্দিকের অবস্থা উত্তমরূপে দেখিয়া লইলাম, কিন্তু কাহাকেও কোন কথা কহিলাম না। আমি পুনরায় আসিয়া আপন স্থানে বসিলাম। সেই সময় প্রবোধবাবু আমায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়, এ রহস্য কি ভেদ হইবে না।” উত্তরে কহিলাম, “কেন হইবে না। আমি এই অদ্ভুত রহস্য ভেদ করিয়াছি।”
প্রবোধবাবু চমকিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “সত্য না কি? আসামী কোথায়?”
আ। নিকটেই আছে।
প্র। কোথায়? বাগানে?
আ। না না—এইখানে।
প্র। কোথায়? এই বাড়ীতে?
আ। আজ্ঞে হাঁ।
প্রবোধচন্দ্র হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “আমার সহিত তামাসা করিতেছেন? কিন্তু আমার এই বিপদের সময় আপনার উপহাস করা ভাল দেখায় না। এ উপহাসের কথা নয়, আর আমিও তামাসা বড় ভালবাসি না।”
আ। আমিও আপনার সহিত তামাসা করিতেছি না। আপনি আমার চেয়ে সকল বিষয়ে বড়, আপনার সহিত আমি কোন সাহসে তামাসা করিব? মনে মনে সমস্ত ব্যাপার আন্দোলন করিয়া আমি যতদূর বুঝিতে পারিয়াছি, তাহা এখনই আপনাকে বলিতেছি।
প্রবোধবাবুর মুখ মলিন হইল। তিনি কিয়ৎক্ষণ আমার দিকে চাহিয়া রহিলেন। পরে বলিলেন, “কি জানিতে পারিয়াছেন বলুন?”
আমি বলিলাম, “গতকল্য আপনার পরিচিত কোন লোক আপনার জ্ঞাতসারেই হউক বা অজ্ঞাতসারেই হউক, এ বাড়ীতে আসিয়াছিলেন। তিনি আপনার সহিত প্রথমে সাক্ষাৎ না করিয়া প্রতাপবাবুর ঘরে গিয়াছিলেন। সম্ভবতঃ সেই ঘরের দেরাজ হইতে দরকারি কোন কাগজ লইবার অভিপ্রায়েই তিনি সে ঘরে গিয়াছিলেন। প্রতাপবাবু তখন সে ঘরে ছিলেন না। আগন্তুক এই সুযোগে দেরাজটি খুলিয়া—”
আমার কথায় বাধা দিয়া প্রবোধবাবু বলিয়া উঠিলেন, “দেরাজের চাবি কোথায় পাইল? প্রতাপচন্দ্রের কাছেই উহার চাবি আছে। যখন তিনিই উপস্থিত ছিলেন না, তখন আগন্তুক কোথা হইতে সেই চাবি পাইল?
আ। তাঁহার কাছে যে সে দেরাজের একটা চাবি ছিল, তাহাতে আর কোন সন্দেহ নাই। সম্ভবতঃ তিনি ঐরূপ একটি চাবি গড়াইয়া ছিলেন।
প্র। দেরাজে এমন কি কাগজ আছে যে, তিনি তাহা চুরি করিতে আসিবেন?
আ। সে কথা আপনি আমার অপেক্ষা ভাল জানেন।
প্র। সে যে দেরাজের চাবি খুলিয়াছিল, তাহা আপনি কেমন করিয়া জানিতে পারিলেন?
আ। দেরাজের উপর একটা নূতন আঁচড়ের দাগ দেখিয়া জানিয়াছি।
প্র। দেরাজটি খুলিয়া দেখিলেই জানিতে পারিবেন, সে কোন কাগজ-পত্র চুরি করিয়াছে কি না?
আ। সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন। ইচ্ছা থাকিলেও সে কোন দ্রব্য দেরাজ হইতে বাহির করিতে পারে নাই। প্র। আর কিছু জানিয়াছেন? সে লোক কোথায় গেল?
আ। সকল কথাই বলিতেছি—ব্যস্ত হইবেন না। প্রতাপবাবুর প্রতি তাঁহার জাতক্রোধ ছিল। প্রতাপবাবুর প্রতি তাঁহার কেন যে এত আক্রোশ ছিল, তাহাও বুঝিতে পারিয়াছি। প্রতাপচন্দ্র ইত্যবসরে ফিরিয়া আসিলেন এবং আগন্তুককে তাঁহার ঘরে দেখিয়া রাগান্বিত হইলেন। সম্ভবতঃ উভয়ের মধ্যে কিছুক্ষণ বচসা হইল। তখন আগন্তুক একখানি ক্ষুর কিম্বা ছোরা বাহির করিয়া প্রতাপচন্দ্রকে এমন আঘাত করিলেন যে, সেই আঘাতেই প্রতাপচন্দ্র পঞ্চত্ত্ব প্রাপ্ত হইলেন। আগন্তুক বোধ হয়, হত্যা করিবার উদ্দেশ্যে এখানে আসে নাই। ক্রোধের বশীভূত হইয়া তিনি যে কার্য্য করিয়া ফেলিয়াছেন, তাহাতে তাঁহার অত্যন্ত ভয় হইল। তিনি সেই ঘর হইতে পলায়ন করিয়া একেবারে এই ঘরে উপস্থিত হইলেন।
এই পর্য্যন্ত শুনিয়া প্রবোধবাবু উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “এই ঘরে? আমিত সমস্ত দিনই এখানে শুইয়া আছি। এখানে একজন অপরিচিত লোক আসিলে আমি কি জানিতে পারিতাম না?”
আ। লোকটি অপরিচিত না হইতেও পারে।
প্র। পরিচিত হইলেও আমি ত জানিতে পারিতাম। আপনি কি মনে করেন, আমি শুইয়া থাকি বলিয়া, আমি সমস্ত দিনই নিদ্রা যাই?
আ। না, আমি সেরূপ মনে করি না।
প্র। তবে কি আমার সাক্ষাতেই সেই লোক এই ঘরে প্রবেশ করিল? আর আমি কি তাহাকে দেখিয়াও কিছু বলি নাই, মনে করেন?
আ। আজ্ঞা হাঁ, আপনি সমস্তই জানিতে পারিয়াছেন। এমন কি, আপনি তাঁহার সহিত কথাও কহিয়াছিলেন এবং আপনি তাঁহাকে পলাইবার সাহায্য করিয়াছিলেন।
প্রবোধবাবু আবার অট্টহাস্য করিয়া উঠিলেন। কিন্তু এবার আর শুইয়া থাকিতে পারিলেন না। বিছানার উপর উঠিয়া বসিলেন এবং আমার মুখের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিলেন। তাঁহার চক্ষু দিয়া যেন আগুন বাহির হইতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে তিনি বলিলেন, “আপনি পাগল হইয়াছেন দেখিতেছি। যাবজ্জীবন মস্তিষ্ক চালনা করায় আপনি এখন পাগল হইয়া গিয়াছেন। আমি খুনীকে পলায়ন করিতে সাহায্য করিয়াছি। একথা কি সম্ভব হইতে পারে? আর যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে সে লোক এখন কোথায় বলিতে পারেন?”
আমি ঘরের পূর্ব্বকোণের একটা আলমারীর পশ্চাৎ দিক লক্ষ্য করিয়া বলিলাম, “ঐ আলমারীর পার্শ্বে।” আমার মুখ হইতে এই কথাগুলি বাহির হইতে না হইতে প্রবোধবাবু দুই হাত উত্তোলন করিয়া এক বিকট শব্দ করিলেন এবং পরক্ষণেই প্রায় অচেতন হইয়া পুনরায় শয্যার উপর পড়িয়া গেলেন।
ইত্যবসরে সহসা সেই আলমারীর পার্শ্ব হইতে এক ভদ্র যুবক দৌড়িয়া আসিয়া আমার সম্মুখে দাঁড়াইলেন। বলিলেন, “আপনি যথার্থ অনুমান করিয়াছেন। আমি ঐ আলমারীর পশ্চাতেই ছিলাম। আপনি যে সকল কথা প্রবোধবাবুকে বলিতেছিলেন, তাহা সম্পূর্ণ সত্য, কিন্তু আপনি যে কোন্ সূত্র ধরিয়া এত সংবাদ বাহির করিয়াছেন, তাহা বুঝিতে পারিলাম না। বুঝিলাম, আপনার চক্ষে ধূলি দেওয়া আমার মত সাধারণ লোকের কর্ম্ম নয়।”
যুবকের বয়স প্রায় পঁয়ত্রিশ বৎসর। দেখিতে সুশ্রী। তাঁহার পরিধানে একখানা বিলাতি মোটা লালপেড়ে ধুতি, একটা মোটা কাপড়ের জামা, খালি পা। আমি সাহেবকে ইঙ্গিত করিয়া আগেই সাবধান করিয়া দিলাম। তিনি আমার মনোভাব বুঝিতে পারিয়া ঘরের দরজার নিকট গিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন।
আমি তখন যুবককে জিজ্ঞাসা করিলাম, “মহাশয়ের নাম কি? প্রবোধবাবুর সহিত আপনার কি সম্বন্ধ?” কিছুক্ষণ ভাবিয়া তিনি উত্তর করিলেন, “যখন আপনি অনেক কথা জানিতে পারিয়াছেন, তখন আপনার কাছে কোন কথা লুকান নিতান্ত মূর্খতা। আমার নাম পুলিনবিহারী; আমি প্রবোধবাবুর শ্যালক।”
আমি প্রবোধবাবুর দিকে দৃষ্টিপাত করিলাম। দেখিলাম, তিনি একদৃষ্টে যুবকের মুখের দিকে চাহিয়া রহিয়াছেন। তাঁহার মুখ দেখিয়া বোধ হইল, তিনি অত্যন্ত দুঃখিত ও লজ্জিত হইয়াছেন।
আমি প্রবোধবাবুকে কোন কথা না বলিয়া পুলিনবিহারীকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনাকে দমদম ষ্টেসন হইতে আনিতে এখান হইতে গাড়ী গিয়াছিল। আপনি তাহাতে আসিয়াছিলেন?”
পু। আজ্ঞে না। যে ট্রেণে আমার আসিবার কথা ছিল, আমি তাহার আগেকার গাড়ীতে আসিয়া পড়িয়াছি।
আ। ইচ্ছা করিয়াই কি এ কার্য্য করিয়াছিলেন?
পু। হাঁ।
আ। কখন এখানে আসিয়াছিলেন?
পু। তখন এগারটা বাজিয়া গিয়াছে।
আ। এখানে আসিয়া অগ্রে আপনার ভগ্নীপতির সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন কি?
পু। আজ্ঞা না।
আ। কেন?
পু। যে জন্য এখানে আসিয়াছি, আগে তাহারই চেষ্টায় গিয়াছিলাম।
আ। কি জন্য এখানে আসিয়াছিলেন? আপনি স্ব ইচ্ছায় আসিয়াছেন? না— কাহারও কথায় আসিয়াছেন?
পু। স্ব ইচ্ছায় আসি নাই। বাড়ীতে আমার অনেক কাজ। কাজ ফেলিয়া এখানে আসিব কেন?
আ। তবে কাহার কথায় আসিয়াছেন? সকল কথা পরিষ্কার করিয়া বলুন। প্রতাপচন্দ্র অতি নিরীহ লোক ছিলেন। আপনি কোন অপরাধে তাঁহাকে খুন করিলেন?
পু। সকল কথা বলিতে হইলে এ সংসারের অনেক গোপনীয় কথা বাহির হইয়া পড়ে। সুতরাং প্রবোধবাবুর অনুমতি সাপেক্ষ। যদি উনি আমায় বলিতে বলেন, তবেই বলিতে পারি।
আমি প্রবোধবাবুর দিকে চাহিলাম। দেখিলাম, তিনি চক্ষু মুদ্রিত করিয়া অজ্ঞানের মত পড়িয়া আছেন। তাঁহার জ্ঞান আছে কি না বুঝিতে পারিলাম না। তাঁহার নিকটে যাইলাম। দেখিলাম, তাঁহার নিশ্বাস বহিতেছে। তিনি জীবিত আছেন। তাঁহার গাত্র স্পর্শ করিলাম। তিনি চক্ষু চাহিলেন, কিন্তু আমাকে দেখিবামাত্র এক বিকট চীৎকার করিয়া মূর্ছিত হইয়া পড়িলেন।
সেই বিকট চীৎকারধ্বনি শুনিয়া বাড়ীর ভিতর হইতে দাসী ছুটিয়া আসিল এবং তাঁহাকে তদবস্থ দেখিয়া চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। বোধ হয়, সেই রোদনধ্বনি প্রবোধবাবুর স্ত্রী শুনিতে পাইলেন। তিনিও পাগলিনীর মত আলুথালু বেশে চীৎকার করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে সেই ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
সাহেব ক্রোধে ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া দিলেন, এবং দুইজন স্ত্রীলোককে বুঝাইয়া বলিলেন যে, প্রবোধবাবু মারা যান নাই, মূৰ্চ্ছিত হইয়া পড়িয়াছেন।
স্ত্রীর কণ্ঠস্বরেই হউক কিম্বা অতিরিক্ত গোলমাল বশতঃ হউক, প্রবোধবাবু চক্ষু চাহিলেন। তাঁহার জ্ঞান হইল! তিনি আমার দিকে চাহিলেন; কিন্তু কোন কথা বলিতে পারিলেন না। তাঁহার জ্ঞান হইয়াছে দেখিয়া তাঁহার স্ত্রী শশব্যস্তে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হইয়াছে? অমন করিয়া চীৎকার করিলে কেন?”
অনেক কষ্টে প্রবোধচন্দ্র উত্তর করিলেন, “কেন? সে কথা তুমি কি বুঝিবে? আমার হৃদয়ে যে আগুন জ্বলিতেছে, তাহা তুমি কি করিয়া জানিবে? যাও — অন্দরে যাও। তুমি এখানে কেন? এখানে দুইজন পুলিসের লোক রহিয়াছেন। ইহাদের সাক্ষাতে তোমার এখানে আসা ভাল হয় নাই।”
তাঁহার স্ত্রী আমাদের দিকে চাহিলেন, কিন্তু আমাদিগকে কোন কথা বলিলেন না; কিম্বা ঘোমটা দিয়া চলিয়াও যাইলেন না। তাঁহার স্বামীর দিকে ফিরিয়া অতি ধীরে ধীরে বলিলেন, “ভাল হয় নাই? তোমার চীৎকার শুনিয়া আমি কি নিশ্চিত্ত থাকিতে পারি?”
সহসা তাঁহার ভ্রাতার উপর দৃষ্টি পড়িল। এতক্ষণ শোকে দুঃখে স্বামীর দিকেই তাঁহার মন ছিল। এতক্ষণ তিনি তাঁহার ভ্রাতাকে দেখিতে পান নাই, হঠাৎ পুলিনবিহারীকে দেখিয়া তিনি যেন চমকিত হইলেন। এত তেজ, এত সাহস কোথায় যেন পলাইয়া গেল। তাঁহার মুখ মলিন ও বিবর্ণ হইল। ঘর হইতে পলায়ন করিবার ইচ্ছায় তিনি তখনই দরজার নিকট গেলেন এবং দরজার খিল খুলিয়া অতি দ্রুতবেগে সেখান হইতে পলায়ন করিলেন। দাসীও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ঘর হইতে চলিয়া গেল।
আমি কিছুই বুঝতে পারিলাম না। যিনি এতক্ষণ আমাদের সম্মুখে দাঁড়াইয়া স্বামীর সহিত কথা কহিতেছিলেন, তিনি সহসা ভ্রাতাকে দেখিয়া সে ঘর হইতে পলায়ন করিলেন কেন? সাহেব আমার মুখের দিকে চাহিলেন। আমি তাঁহার মনোগত ভাব বুঝিতে পারিয়া ঈষৎ হাস্য করিলাম। তিনিও হাসিয়া আমার হাসির উত্তর দিলেন।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
প্রবোধবাবুর স্ত্রী প্রস্থান করিলে পর, আমি পুলিনবিহারীকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “প্রবোধবাবুর স্ত্রী কি আপনার সহোদরা?”
পু। আজ্ঞে না—আমার পিস্তুত ভগ্নী।
আ। তিনি আপনাকে দেখিয়াই চলিয়া গেলেন কেন? আপনি যে প্রতাপচন্দ্রকে খুন করিয়াছেন, তাহা কি তাঁহার জানা আছে?
পু। বোধ হয়, না।
আ। আপনি যে এখানে আছেন, তাহাও কি তিনি জানেন না?
পু। আজ্ঞে, না।
আ। এ বড় আশ্চর্য ব্যাপার! সমস্ত কথা জানিতে না পারিলে আমি ত কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।
পু। আমার বলিতে কোন আপত্তি নাই। কিন্তু প্রবোধবাবুর হুকুম না পাইলে বলিতে পারিব না।
আমি তখন প্রবোধবাবুকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এখন কি করা যায় বলুন? আপনি আমাকে এই কার্য্যে নিযুক্ত করিয়াছেন। কিন্তু এখন দেখিতেছি, আপনিই প্রকৃত দোষী। যদি সকল কথা এখন না বলেন, ভবিষ্যতেসকলের সম্মুখে বলিতে হইবে। আমার স্পষ্টই বোধ হইতেছে, যে পুলিনবাবু আপনার উপদেশে প্রতাপচন্দ্রকে খুন করিয়াছেন। মনে করিবেন না, আমি আপনাকে ছাড়িয়া দিব। আপনিই প্রধান দোষী, পুলিনবাবু আপনার হাতের যন্ত্র ভিন্ন আর কিছুই নন।”
আমার কথায় প্রবোধবাবুর ভয় হইল। তিনি পুলিনবিহারীকে সমস্ত কথা বলিতে হুকুম দিলেন। পরে আমাকে বলিলেন, “আমার মরণই মঙ্গল। এ জীবনে অনেক কার্য্য করিয়াছি, এখন যত শীঘ্র এখান হইতে যাইতে পারি ততই মঙ্গল। তবে সাধারণে যাহাতে আমাদের এ পাপ কথা জানিতে না পারে, আপনি তাহার চেষ্টা করিবেন, এই আমার শেষ অনুরোধ।”
আমি বলিলাম, “কি করিব, কি না করিব, এখন বলিতে পারি না। যতক্ষণ না সমস্ত ব্যাপার জানিতে পারিতেছি, ততক্ষণ কোন বিষয়ে প্রতিশ্রুত হইতে পারি না।”
আমার কথা শুনিয়া পুলিনবাবু বলিলেন, “পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, প্রবোধবাবুর স্ত্রী আমার পিসতুত ভগ্নী। সহোদরা না হইলেও তাহার কলঙ্কের কথা বলিতে আমার লজ্জা হইতেছে। কিন্তু কি করিব — অদৃষ্টলিপি অখণ্ডনীয়। প্রবোধবাবুর স্ত্রীর নাম মনোরমা। যৌবনে সে বড় সুন্দরী ছিল। যদিও এখন তাহার বয়স প্রায় ৪০ বৎসর হইয়াছে, তথাপি তাহার সৌন্দর্য্যের কিছুমাত্র হ্রাস হয় নাই। তবে তাহার রূপের আর সে জ্যোতিঃ নাই, চক্ষের সে চঞ্চলতা নাই, মুখে সে মুচকি হাসি নাই, মনে সেই দুৰ্দ্দমনীয় আশা নাই। যৌবনের সঙ্গে সঙ্গে এই সকলও কোথায় চলিয়া গিয়াছে। কিন্তু এখনও তাহার আকাঙ্ক্ষা মিটে নাই। বিশেষতঃ স্বামীরও চরিত্রদোষ থাকায় সুবিধা পাইলেই নিজের ইন্দ্রিয়বৃত্তি চরিতার্থ করিয়া থাকে। যে দিন হইতে প্রতাপবাবু এ বাড়ীতে আসিয়াছেন, সেই দিন হইতে মনোরমা তাঁহাকে বশীভূত করিতে চেষ্টা পাইতেছিল। কিন্তু কিছুতেই তাঁহাকে হস্তগত করিতে পারে নাই। মনোরমা যখন দেখিল, সহজে তাঁহাকে বশীভূত করা অসম্ভব, তখন সেও নানা প্রকার কৌশল করিতে লাগিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ প্রতাপচন্দ্র সেরূপ হীনচরিত্রের লোক ছিলেন না। তিনি কিছুতেই মনোরমার কথায় স্বীকৃত হইলেন না। মনোরমা তখন অন্য উপায় অবলম্বন করিল। সে ভয় দেখাইয়া প্রতাপচন্দ্রকে হস্তগত করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। বাড়ীর দাসীকে দিয়া মনোরমা তাঁহার নিকট পত্রাদি পাঠাইয়া দিত। প্রতাপচন্দ্র সে সকল পত্র নষ্ট করিতেন না। নিজের কাছেই রাখিতেন। কিন্তু কোন পত্রের উত্তর দিতেন না। প্রতাপচন্দ্র যখন দেখিলেন যে, মনোরমা ভয় দেখাইয়া তাঁহাকে বশীভূত করিবার চেষ্টা করিতেছে, তখন তিনি একদিন মনোরমার সমস্ত পত্র প্রবোধবাবুকে দেখাইলেন। পত্রগুলি পাঠ করিয়া প্রবোধবাবু চমকিত হইলেন। বলিলেন, “এতদিন আমায় ঐ সকল পত্র দেখান নাই কেন?” প্রতাপচন্দ্র উত্তর করিলেন, “এগুলি আপনাকে দেখাইবার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু এখন দেখিতেছি না দেখাইলে আমাকে ভবিষ্যতে অপমানিত ও তাড়িত হইতে হইবে।”
প্রতাপচন্দ্রের কথা শুনিয়া প্রবোধচন্দ্র তাঁহাকে বিদায় দিলেন এবং মনোরমাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। পত্রগুলি ফেরৎ লইয়া প্রতাপচন্দ্র আপনার ঘরে প্রস্থান করিলেন।
কিছুক্ষণ পরেই মনোরমা স্বামীর নিকট উপস্থিত হইল। তাঁহাকে দেখিয়া প্রবোধবাবু যৎপরোনাস্তি তিরস্কার করিলেন। বলিলেন, “এ বয়সেও তুমি এ বৃত্তি ছাড়িতে পারিলে না? বিবাহ হইয়া অবধি কতবার যে তোমার এই কলঙ্কের কথা শুনিলাম, তাহা বলা যায় না। তুমি এখনই আমার বাড়ী হইতে দূর হও। এ বাড়ীতে তোমার ন্যায় হীনচরিত্রা রমণীর স্থান হইবে না।”
প্রবোধচন্দ্রের কথা শুনিয়া মনোরমা প্রথমে কোন কথা বলিল না। লজ্জায় মাথা হেঁট করিয়া নীরবে সমস্ত তিরস্কার সহ্য করিল। পরে স্বামীর দিকে ফিরিয়া বলিল, “স্বীকার করি, আমি চরিত্রহীনা। কিন্তু কাহার দোষে আমার নিষ্কলঙ্ক চরিত্রে কালি পড়িয়াছে? মনে করিয়া দেখ, কে আমার এই অধঃপতনের মূল?”
প্র। তুমি নিজেই।
ম। কিসে?
প্র। কিসে নয়?
মা। কে আমায় মদ্যপান করিতে শিখাইয়াছে? কোন পুরুষ নিজের বন্ধু বান্ধব লইয়া আপনার স্ত্রীর নিকট আসিয়া আমোদ করেন?
প্র। হাঁ, দুই একদিন তোমায় মদ খাইতে অনুরোধ করিয়াছিলাম বটে, কিন্তু তোমার ইচ্ছা না হইলে তুমি খাইলে কেন?
ম। কু-সংসর্গে পড়িয়া কত শত লোকের অধঃপতন হইয়াছে বলা যায় না। তোমারই বন্ধুগণের উত্তেজনায়, আমার যৌবনের উৎপীড়নে, অর্থের লোভে, মদ্যের নেশায় বিভোর হইয়া আমি নিজের পায়ে নিজেই কুঠার মারিয়াছি বটে, কিন্তু তুমিই তাহার মূল। তুমি যদি তখন আমায় শাসন করিতে, তোমার বন্ধুগণকে এখানে রাখিয়া স্বয়ং বেশ্যালয়ে গমন না করিতে, তাহা হইলে কি আজ আমার এ দশা ঘটিত? একবার অধোগতি আরম্ভ হইলে সে গতিকে ফিরান কি বড় সহজ কথা? এখন তোমার বন্ধুগণ তোমার বিষ হইয়াছে, আর তাহারা এখানে আসে না। তোমার মদের মাত্রা দিন দিনই বাড়িয়া উঠিতেছে। ভাঁড়ারে বোতল বোতল মদ সঞ্চিত রহিয়াছে। আমি যখন মদ খাইতে শিখিয়াছি, তখন কি তুমি ভাব যে, আমি মদ না খাইয়া আছি। আমি প্রত্যহ মদ খাই। মদে কি না হয়? আমার হিতাহিত জ্ঞান লোপ হইয়াছে, কিসে আমার অভিপ্রায় সফল হইবে, আমি ক্রমাগত সেই চেষ্টাই করিতেছি। শুনিলে? আশা করি, এই বিষয় লইয়া অধিক আন্দোলন করিবে না।
মনোরমার কথা শুনিয়া প্রবোধবাবু আর রাগিয়া উঠিলেন। তিনি মনোরমাকে মারিতে উদ্যত হইলেন। তখন মনোরমা নির্ভয়ে বলিয়া উঠিল, “তোমায় আমি ভয় করি না। তুমি আমায় এখানে একেলা পাইয়া মারিতে পার স্বীকার করি, কিন্তু তাহার পর কি হইবে ভাবিয়া দেখিয়াছ? তুমি কি মনে কর, আমি কিছুই জানি না? সেদিনকার কথা তোমার কিছুই মনে নাই? যোগেনবাবুকে কে খুন করিল, তাহা কি আমার জানিতে বাকী আছে? মারিতে ইচ্ছা হয় মার—আমি মার খাইব কিন্তু পরে কি হইবে ভাবিয়া দেখ।”
প্রবোধবাবু উত্তেজিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘যোগেনবাবু? কে যোগেনবাবু?”
ম। এখন কে যোগেনবাবু? তোমার পরম বন্ধু। যিনি প্রত্যহ এখানে আসিয়া তোমার কথায় তোমার স্ত্রীর সহিত আলাপ করিতেন, তোমার স্ত্রীর মনোরঞ্জনের জন্য যিনি অকাতরে অর্থ ব্যয় করিতেন, সেই যোগেনবাবুকে কে খুন করিল?
প্র। তাঁহাকে কেহ খুন করে নাই। তিনি বিসূচিকা রোগে মারা পড়িয়াছেন।
ম। পয়সার জোরে তাঁহার বিসূচিকা রোগে মৃত্যু সাব্যস্ত হয়, তাহাও আমি জানি। তুমি মনে কর, আমি কিছুই বুঝি না, স্ত্রীলোক ভাবিয়া আমাকে অগ্রাহ্য করিয়া থাক; কিন্তু আমি সকলই জানি। মদের সঙ্গে সেদিন তাঁহাকে যাহা খাওয়াইয়াছিলে, তাহা কি একবারে ভুলিয়া গিয়াছ? তুমি মনে করিয়াছিলে, আমি অত্যন্ত মাতাল হইয়া পড়িয়াছিলাম, তোমার কৌশল জানিতে পারি নাই। না-না, সে তোমার ভুল। আমি তোমার সমস্ত কথাই জানি। যদি আমার উপর এখন সামান্যও অত্যাচার কর, আমি পরে তোমায় যোগেনবাবুর হত্যাপরাধে ধরাইয়া দিব।
মনোরমার কথায় প্রবোধবাবুর ভয় হইল। তিনি আমাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। আমি আসিলে সমস্ত কথা বলিলেন। আমি উভয়ের বিবাদভঞ্জন করিয়া দিলাম।
স্বামী-স্ত্রীর বিবাদ মিটিয়া গেল। মনোরমা হৃষ্টচিত্তে সংসারকর্মে মনঃসংযোগ করিল। প্রবোধবাবু সুবিধা বুঝিয়া আমাকে ডাকিয়া গোপনে বলিলেন, “প্রতাপকে আর বিশ্বাস করিতে পারি না। ভরসা করিয়া তাঁহাকে ছাড়িয়া দিতেও পারিতেছি না। তাহা হইলে তিনি নিশ্চয়ই সকলের কাছে মনোরমার কলঙ্কের কথা বলিয়া দিবে। সেই জন্য তাঁহাকে অন্য কোন উপায়ে একেবারে সরাইতে ইচ্ছা করি। বিশেষতঃ যতক্ষণ তাঁহার নিকট মনোরমার পত্রগুলি রহিয়াছে, ততক্ষণ তাঁহাকে কিছুতেই বিশ্বাস করিতে পারি না।”
আমি বলিলাম, “একটা লোককে খুন করা বড় সহজ কথা নহে। বিশেষতঃ ধরা পড়িলে আমাকেই ফাঁসি যাইতে হইবে।”
প্র। এমন ভাবে খুন করিতে হইবে, যাহাতে লোকে তোমায় কোনরূপ সন্দেহ করিতে না পারে।
আ। আপনি তাহার উপায় বলিয়া দিন?
প্র। তুমিই তোমার উপায় করিয়া লইও। আমি যদি তোমার চরিত্র না জানিতাম, তাহা হইলে এ সকল কথা বলিতে পারিতে। কিন্তু তোমায় আমি বিলক্ষণ চিনি। এ রকম অনেক কাজ তোমার দ্বারা সম্পাদিত হইয়াছে।
আ। সে সকল কথা স্বতন্ত্র। আপনি আমার আত্মীয়। আপনার নিকট হইতে
প্র। টাকার কথা বলিতেছ? তোমার প্রাপ্য অবশ্যই পাইবে।
“আমি সম্মত হইলাম। মনোরমা এ সকল কথার বিন্দুমাত্র জানিতে পারিল না। আমার একার্য্য নূতন নহে। পুলিসের চক্ষে অনেকবার ধূলি দিয়াছি। কিন্তু এবার আর পারিলাম না।”
পুলিনবিহারীর মুখে এই সমস্ত কথা শুনিয়া আমি প্রবোধবাবুকে বলিলাম, “আপনিই প্রকৃত দোষী। আপনাকেও গ্রেপ্তার করিতে বাধ্য হইলাম।”
এই বলিয়া সাহেবের দিকে দৃষ্টিপাত করিলাম, সাহেব আমার মনোভাব বুঝিতে পারিয়া তখনই তাঁহাকে বাঁধিবার জন্য অগ্রসর হইলেন। প্রবোধবাবু অত্যন্ত ভীত হইলেন। তিনি কাঁপিতে কাঁপিতে বললেন, “আমার এমন ক্ষমতা নাই যে, আমি পলায়ন করি। পলায়ন করা দূর থাক, আমি নড়িতেও পারি না। এ অবস্থায় আমায় বাঁধিবার প্রয়োজন কি?”
সাহেব তাঁহার কথায় সম্মত হইলেন। বলিলেন, “আপনি যদি আমাদের কথামত কার্য্য করেন, তাহা হইলে আপনাকে বাঁধিবার কোন প্রয়োজন দেখি না।”
আমি বলিলাম, “বেশ কথা। তবে পুলিনবিহারীকে গ্রেপ্তার করুন। উনি এইমাত্র স্বমুখেই প্রকাশ করিলেন যে, অনেকবার পুলিসের চক্ষে ধূলি দিয়াছেন। এবার যাহাতে আর পলায়ন করিতে না পারেন, তাহার উপায় করিতে হইবে।”
আমার কথা শুনিয়া সাহেব ঈষৎ হাস্য করিলেন, এবং পুলিনবাবুকে দৃঢ়রূপে বাঁধিয়া ফেলিলেন।
আমার কার্য্য শেষ হইতে না হইতে প্রবোধবাবু বিছানা হইতে একটি শিশি বাহির করিলেন, এবং একটিবার মাত্র আমার দিকে চাহিয়া তখনই তাহার ভিতরের সমস্ত আরক খাইয়া ফেলিলেন। আমি তাড়াতাড়ি তাঁহার নিকটে গিয়া হাত ধরিলাম, কিন্তু কোন ফল হইল না। তিনি আগেই উহা পান করিয়াছিলেন। শিশিটা কাড়িয়া লইয়া দেখিলাম, উহাতে বিয লেখা রহিয়াছে। দেখিতে দেখিতে প্রবোধচন্দ্র ঢলিয়া পড়িলেন। তাঁহাকে তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে পাঠাইলাম, কিন্তু সেই স্থানেই তাঁহার প্রাণবায়ু দেহ হইতে বাহির হইয়া গেল।
সাহেব তখন পুলিনবাবুকে প্রতাপবাবুর হত্যা সম্বন্ধে শেষ কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। তিনি বলিলেন, “যখন আমি সেই ঘরে গিয়াছিলাম, তখন প্রতাপচাঁদ প্রস্রাব করিতে গিয়াছিল। আমি বাস্তবিকই তাঁহার দেরাজ হইতে মনোরমার পত্রগুলি লইতে গিয়াছিলাম; এবং সেই জন্য দেরাজ খুলিতেছিলাম। এমন সময়ে প্রতাপচাঁদ ঘরে আসিয়া আমায় আক্রমণ করেন। আমার কাছে একখানি ক্ষুর ছিল। সেই অস্ত্রে আমি তাঁহার গলায় আঘাত করি। ইত্যবসরে তিনি আমার চশমাখানি কাড়িয়া লন। ইচ্ছা ছিল, চশমাখানি আদায় করিব, কিন্তু সেই সময়ে কাহার পদশব্দ শুনিতে পাইলাম, ক্ষুরখানি প্রতাপচাঁদের কাপড়ে মুছিয়া এই ঘরে আসিয়া উপস্থিত হই।”
প্রবোধবাবুর বিছানার নীচে হইতে রক্তমাখা ক্ষুরখানি বাহির হইল। আলমারির ভিতর হইতে পুলিনবিহারীর রক্তমাখা কাপড় পাওয়া গেল। পুলিন আমাদিগের নিকট যেমন সমস্ত কথা বলিয়াছিলেন, মাজিষ্ট্রেটের নিকটও সেই দিবস তিনি সমস্ত কথা স্বীকার করিলেন। চশমাওয়ালার দোকান হইতে জানা গেল যে, তিনিই ঐ চশমা সেহ স্থান হইতে খরিদ ও মেরামত করিয়াছিলেন। এই সকল সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করিয়া তাঁহাকে বিচারার্থ প্রেরণ করা হইল। ঐ মোকদ্দমায় আমাকেও সাক্ষ্য দিতে হয়। কিরূপে আলমারির পার্শ্বে তাঁহাকে দেখিয়া ও তাঁহার মোটা নাক দেখিয়া আমি তাঁহার উপর সন্দেহ করিয়াছিলাম, তাহা সমস্তই প্রকাশ করিলাম। প্রতাপবাবুর স্ত্রীও সমস্ত কথা প্রকাশ্য আদালতে স্বীকার করিল। তাহার লিখিত সেই পত্রগুলিও মৃতের আলমারিতে পাওয়া গিয়াছিল, উহাও বিচারালয়ে প্রমাণের এক অংশে পরিণত হইল। পুলিনবিহারী বিচারকের নিকট আপনার দোষ স্বীকার করিল ও পরিশেষে চরম দণ্ডে দণ্ডিত হইল।
[ফাল্গুন, ১৩১৩]