শেষ লীলা

শেষ লীলা

(অর্থাৎ ত্রৈলোক্যতারিণীর জীবনের শেষ অভিনয়!)

প্রথম পরিচ্ছেদ

দিবা আন্দাজ নয়টার সময় সংবাদ পাইলাম যে, আজ কয়েকদিবস হইল, পাঁচুধোপানির গলিতে রাজকুমারী নাম্নী একটি স্ত্রীলোককে কে হত্যা করিয়া, তাহার যথাসর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া পলায়ন করিয়াছে। পুলিসের প্রধান প্রধান কর্মচারীগণের মধ্যে প্রায় সকলেই সেই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছেন। কিন্তু এ পর্যন্ত কেহই তাহার কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারেন নাই। 

যে দিবস রাজকুমারীর হত্যা-সংবাদ প্রথমে থানায় আসিয়া উপস্থিত হয়, সে দিবস আমি কলিকাতায় ছিলাম না; অপর একটি সরকারী কার্য্যের নিমিত্ত স্থানান্তরে গমন করিয়াছিলাম। 

কলিকাতায় আসিয়া, যেমন এই সংবাদ জানিতে পারিলাম, অমনি পাঁচুধোপানির গলির যে বাড়ীতে রাজকুমারী হত্যা হইয়াছিল, সেই বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, সেই স্থানে বসিয়া চারি পাঁচজন উচ্চপদস্থ পুলিস- কর্ম্মচারী অনুসন্ধান করিতেছেন। 

আমাকে দেখিয়া, তাঁহারা যে স্থানে বসিয়াছিলেন, অনুগ্রহপূর্ব্বক তাহার এক পার্শ্বে আমাকে বসিবার স্থান প্রদান করিলেন। আমি সেই স্থানে উপবেশন করিলে, একজন কর্মচারী আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এতদিবস আপনি কোথায় ছিলেন? আজ কয়েকদিবস হইল, এই হত্যা হইয়া গিয়াছে; কিন্তু আপনি একবারের নিমিত্তও এদিকে আসেন নাই কেন?” 

আমি। আমি কলিকাতায় ছিলাম না। অপর কার্য্যের নিমিত্ত স্থানান্তরে গমন করিয়াছিলাম বলিয়া, আপনাদিগের সহিত এই অনুসন্ধানে যোগ দিতে পারি নাই। অদ্য কলিকাতায় আসিয়া এই ব্যাপার যেমন শুনিতে পাইলাম, অমনি আপনাদিগের সাহায্যের নিমিত্ত আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। এখন আমাকে কি করিতে হইবে বলুন? 

কর্ম্মচারী। আপনাকে এখন আর বেশী কিছু করিতে হইবে না, কেবল যে ব্যক্তি রাজকুমারীকে হত্যা করিয়া, তাহার যথাসর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে, কেবল তাহারই অনুসন্ধান করিয়া ধরিয়া দিলেই হইবে। 

আমি। আপনারা দেখিতেছি, সমস্ত কাৰ্য্যই প্রায় শেষ করিয়াছেন, আমার নিমিত্ত অতি অল্পই রাখিয়া দিয়াছেন!!

কৰ্ম্মচারী। সে যাহা হউক, এখন এই মোকদ্দমার অবস্থা সমস্ত শুনিয়াছেন কি? 

আমি। রাজকুমারীকে কোন ব্যক্তি হত্যা করিয়া তাহার যথাসর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে, ইহা ব্যতীত আর কোন বিষয়ই আমি এ পর্যন্ত শ্রবণ করি নাই। কিরূপে ঘটিয়াছিল, এবং অনুসন্ধান করিতে করিতে আপনারাই বা কতদূর অগ্রগামী হইতে পারিয়াছেন, তাহা আমাকে বিস্তারিতরূপে বলুন দেখি। 

কর্ম্মচারী। আজ চারিদিবস অতীত হইল, এই সংবাদ প্রথমে থানায় গিয়া উপস্থিত হয়। 

আমি। কে গিয়া প্রথম সংবাদ দেয়? 

কর্ম্মচারী। যাহার এই বাড়ী, সেই থানায় গিয়া এই সংবাদ প্রথমে প্রদান করে। 

আমি। সে গিয়া সৰ্ব্বপ্রথমে কি বলে? 

কর্ম্মচারী। তাহার সংবাদ এইরূপ,—“আমার যে বাড়ীতে রাজকুমারী বাস করিত, আমি সেই বাড়ীতে থাকি না। আমার অপর আর একখানি বাড়ী আছে, সেই বাড়ীতে আমি থাকি। অদ্য দিবা আন্দাজ আটটার সময় সেই বাড়ীর একজন ভাড়াটিয়া আসিয়া আমাকে সংবাদ দেয় যে, রাজকুমারীকে কে হত্যা করিয়াছে। এই সংবাদ শুনিবামাত্র আমি সেই বাড়ীতে গমন করিলাম। দেখিলাম, রাজকুমারীর গৃহের দরজা খোলা রহিয়াছে, ও রাজকুমারী মৃত-অবস্থায় তাহার গৃহের মেঝের উপর পড়িয়া রহিয়াছে। এই ব্যাপার দেখিয়া, আমি থানায় সংবাদ প্রদান করিতে আসিয়াছি।”

আমি। এইরূপ সংবাদ পাইয়া আপনারা যখন এই বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, তখন বাড়ীর অবস্থা কিরূপ দেখিলেন? 

কৰ্ম্মচারী। দেখিলাম, বাড়ীওয়ালার সংবাদ সম্পূর্ণরূপে সত্য; এই বাড়ীর নীচের তালায় এই গৃহের ভিতর একটি মৃতদেহ পড়িয়া রহিয়াছে। অনুসন্ধানে আরও জানিতে পারিলাম, উহারই নাম রাজকুমারী। 

আমি। গৃহের দরজা? 

কর্ম্মচারী। গৃহের দরজা খোলা রহিয়াছে। 

আমি। উহার মৃতদেহ সৰ্ব্বপ্রথমে কাহা কর্তৃক এবং কিরূপে দেখিতে পাওয়া গেল? 

কর্ম্মচারী। প্রায় প্রত্যহই রাজকুমারী অতি প্রত্যূষে গাত্রোত্থান করিত। সেই দিবস প্রাতঃকালে উহাকে দেখিতে না পাইয়া, এই বাড়ীর একজন ভাড়াটিয়া তাহার গৃহের বাহির হইতে রাজকুমারীকে প্রথমে ডাকিতে থাকে। কিন্তু কোনরূপে তাহার উত্তর না পাইয়া তাহার গৃহের দরজায় ধাক্কা দেয়। ধাক্কা দিবামাত্রই গৃহের দরজা খুলিয়া যায়। সে গৃহের ভিতর প্রবেশ করিতে গিয়াই দেখিতে পায়, রাজকুমারী মেঝের উপর মৃত-অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে। এই ব্যাপার দেখিয়া সে চীৎকার করিয়া উঠে। তাহার চীৎকারে বাড়ীর অপরাপর ভাড়াটিয়াগণ আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হয়, এবং সকলেই রাজকুমারীর এই দশা দেখিতে পায়। পরিশেষে একজন গিয়া বাড়ীওয়ালাকে সংবাদ প্রদান করে। সংবাদ পাইয়া বাড়ীওয়ালা যাহা করিয়াছিল, তাহা আমি পূৰ্ব্বেই আপনাকে বলিয়াছি। 

আমি। বাড়ীতে যে সকল ভাড়াটিয়া আছে, তাহারা কি সকলেই স্ত্রীলোক? 

কর্ম্মচারী। ভাড়াটিয়ামাত্রেই স্ত্রীলোক। কিন্তু তাহাদিগের প্রত্যেকের গৃহেই রাত্রিকালে পুরুষ মানুষের সমাগম হইয়া থাকে। 

আমি। রাজকুমারীর গৃহের দরজায় সামান্য ধাক্কা দিলেই সেই গৃহের দরজা খুলিয়া যায়। তখন বোধ হয়, হত্যাকারী হত্যা করিয়া প্রস্থান করিবার সময় সেই গৃহের দরজা ভেজাইয়া রাখিয়া গিয়াছিল? 

কর্ম্মচারী। তদ্বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। 

আমি। পুলিস কর্ম্মচারীগণের মধ্যে সর্ব্বপ্রথমে সেই গৃহের ভিতর কে প্রবেশ করিয়াছিল?

কৰ্ম্মচারী। আমিই প্রথমে সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করি। 

আমি। আপনি গিয়া গৃহের কিরূপ অবস্থা দেখিতে পান? 

কর্ম্মচারী। গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া প্রথমেই রাজকুমারীকে মৃতাবস্থায় গৃহের মেঝের উপর পড়িয়া রহিয়াছে দেখিতে পাই। 

আমি। উহার মৃতদেহ একবারে মৃত্তিকার উপর পতিত ছিল, কি কোনরূপ বিছানার উপর পড়িয়াছিল?

কৰ্ম্মচারী। একখানি বিছান মাজুরের উপর উহার মৃতদেহ পড়িয়াছিল। 

আমি। সেই মৃতদেহের অঙ্গে কোনরূপ আঘাতের চিহ্ন ছিল কি? 

কর্ম্মচারী। সবিশেষ কোনরূপ আঘাতের চিহ্ন ছিল না। কেবল উহার গলার দুই পার্শ্বে আঙ্গুলের দাগের সহিত নখের দাগ ছিল মাত্র। 

আমি। তবে কি উহাকে গলা টিপিয়া মারিয়া ফেলা হয়? 

কর্ম্মচারী। যে ডাক্তার সাহেব সেই মৃতদেহ পরীক্ষা করিয়াছেন, তাঁহার বিবেচনায় গলা টিপিয়া উহাকে মারিয়া ফেলা হইয়াছে। তিনি আরও বলেন, রাজকুমারীকে চিৎ করিয়া লইয়া তাহার বুকের উপর বসিয়া তাহার গলা টেপা হয়। 

আমি। তাঁহার এ অনুমানের কারণ কি? 

কর্ম্মচারী। বুকের উপর যে সকল ছোট ছোট হাড় আছে, তাহার কতকগুলি ভগ্নাবস্থায় পাইয়াছেন বলিয়াই, ডাক্তার সাহেব এইরূপ অনুমান করেন। 

আমি। তাঁহার এ অনুমান কিছু একবারে অমূলক নহে। 

কৰ্ম্মচারী। এ অনুমান প্রকৃত বলিয়াই অনুমান হয়। 

আমি। গৃহের ভিতর আর কোন দ্রব্য পাওয়া গিয়াছিল কি? 

কৰ্ম্মচারী। দুইখানি কাঁসার বাসন সেই গৃহের এক পার্শ্বে পাওয়া গিয়াছিল, উহাতে চিড়া ও দধি কিছু কিছু লাগিয়াছিল। বোধ হয়, উহাতে করিয়া চিড়া ও দই দিয়া ফলার করা হইয়াছিল। 

আমি। যখন দুইটি পাত্রে চিড়া-দধির চিহ্ন রহিয়াছে, তখন অনুমান হয়, দুইজন সেই গৃহের ভিতর বসিয়া পৃথক্ পৃথক্ পাত্রে চিড়া-দধির ফলার করিয়াছিল। এখন সেই দুই ব্যক্তি কে? 

কর্ম্মচারী। একজন রাজকুমারী। 

আমি। তাহার প্রমাণ? 

কর্ম্মচারী। পরীক্ষায় তাহার পেটের ভিতর চিড়া-দধির চিহ্ন পাওয়া গিয়াছে।

আমি। তাহা হইলে যে রাজকুমারীকে হত্যা করিয়াছে, সেই অপর ব্যক্তি হইবে।

কৰ্ম্মচারী। খুব সম্ভব। 

আমি। গৃহের ভিতর আর কিছু দেখিতে পাইয়াছিলেন কি? 

কর্ম্মচারী। উহার গাত্রে অলঙ্কার-পত্র কিছুই ছিল না, বাক্সপেট্রা ভাঙ্গা।

আমি। উহার যে সকল অলঙ্কার ছিল, তাহার তালিকা পাইয়াছেন কি? 

কর্ম্মচারী। প্রস্তুত করিয়া লইয়াছি। 

আমি। রাজকুমারী ত মরিয়া গিয়াছে, তাহার যে সকল দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে, তাহার সমস্ত বৃত্তান্ত কিরূপে প্রাপ্ত হইলেন? 

কর্ম্মচারী। সমস্ত যে পাইয়াছি, তাহা বোধ হয় না। বাড়ীর অপরাপর স্ত্রীলোকগণের নিকট হইতে যতদূর অবগত হইতে পারিয়াছি, তাহারই তালিকা প্রস্তুত করিয়াছি। 

আমি। রাজকুমারীর গৃহে সেই রাত্রিতে কোন্ ব্যক্তি আসিয়াছিল, তাহার কোন কথা জানিতে পারা গিয়াছে কি?

কর্ম্মচারী। না, তাহার গৃহে যে কোন পুরুষ মানুষ আসিয়াছিল, এ কথা কেহই বলিতে পারিতেছে না। কেবলমাত্র ইহাই জানিতে পারা গিয়াছে যে, সন্ধ্যার পর এই বাড়ীর অপর দুইটি স্ত্রীলোক উহার গৃহে গমন করিয়াছিল; কিন্তু তাহারা অতি অল্পক্ষণ থাকিয়াই তাহার গৃহ হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছিল। 

আমি। সেই দুইটি স্ত্রীলোক কে? 

কর্ম্মচারী। তাহাদিগের একজনের নাম প্রিয়, এবং অপর আর একজনের নাম ত্রৈলোক্য। তাহারা উভয়েই এই বাড়ীর ভাড়াটিয়া ও উভয়েই উপরে থাকে। 

আমি। সেই দুইটি স্ত্রীলোক ভিন্ন এই বাড়ীতে আর কে কে থাকে? 

কর্ম্মচারী। আরও চারি পাঁচজন স্ত্রীলোক এই বাড়ীতে বাস করে। 

আমি। অনুসন্ধান করিয়া কিছু জানিতে পারিয়াছেন কি, এই বাড়ীর সদর দরজা রাত্রিতে বন্ধ করা হইয়াছিল কি না? যদি হইয়া থাকে, তাহা হইলে কত রাত্রিতে ও কাহার দ্বারা বন্ধ হইয়াছিল? 

কর্ম্মচারী। কে যে এই দরজা শেষ বন্ধ করিয়াছিল, তাহা এ পর্য্যন্ত ঠিক করিতে পারা যায় নাই। কিন্তু এখন যতদূর জানিতে পারা যাইতেছে, তাহাতে রাত্রি বারটার সময় কামিনী সদর দরজা বন্ধ করিয়া দেয়; তাহার পর আর কেহ খুলিয়াছিল কি না, তাহা এ পর্যন্ত কেহই স্বীকার করিতেছে না। 

আমি। পরদিবস প্রত্যূষে সদর দরজা কে প্রথম খুলিয়াছিল? 

কর্ম্মচারী। বিধু নাম্নী অপর আর একটি স্ত্রীলোক প্রত্যূষে সদর দরজা খুলিয়া বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া যায়। সেই স্ত্রীলোকটি নিতান্ত অল্পবুদ্ধি-সম্পন্না। যে সময় সে দরজা খুলিয়া বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া যায়, সেই সময় সেই দরজা ভিতর হইতে বন্ধ ছিল, কি খোলা ছিল, তাহা ঠিক করিয়া বলিতে পারে না। কখনও বলে, দরজার হুড়কা খুলিয়া সে বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া যায়, কখনও বলে, না, হুড়কা খোলা ছিল। 

আমি। উহার কথা শুনিয়া প্রকৃতপক্ষে সদর দরজা বন্ধ ছিল, কি খোলা ছিল, তাহার কিছু অনুমান করিয়া লইতে পারা যায় না কি? 

কর্ম্মচারী। সে অনুমান ঠিক নহে। কারণ, তাহার কথার উপর নির্ভর করিলে, সেই দরজা খোলা ছিল, এরূপ অনুমান করা যায় না। আর যদি দরজা ভিতর হইতে বদ্ধই থাকিবে, তাহা হইলে হত্যাকারী কোন্ সময় ও কোথা দিয়া বাহির হইয়া গেল? 

আমি। বিধু দরজা খুলিয়া বাহির হইয়া যাইবার পর যদি হত্যাকারী বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গিয়া থাকে?

কৰ্ম্মচারী। তাহা অসম্ভব। কারণ, যে সময় বিধু বাড়ীর বাহির হইযা যায়, সেই সময় এই বাড়ীর আরও দুই একটি স্ত্রীলোক উঠিয়াছিল। সেই সময় হত্যাকারী বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া যাইলে কাহার না কাহারও নয়নগোচর হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। 

আমি। তাহা হইলে এই বাড়ীর ভিতর যে সকল স্ত্রীলোক আছে, তাহাদিগের গৃহে যে সকল পুরুষ মানুষ আসিয়াছিল, তাহাদিগের মধ্যে কাহার দ্বারা ত এই কাৰ্য্য হয় নাই? 

কর্ম্মচারী। প্রত্যেকের গৃহে যে সকল পুরুষ মানুষ সেই দিবস আসিয়াছিল, এবং যাহারা প্রায়ই এই বাড়ীতে আসিয়া থাকে, অনুসন্ধান করিয়া তাহাদিগের প্রত্যেককেই বাহির করা হইয়াছে, ও তাহাদিগের সম্বন্ধে অনেকরূপ অনুসন্ধানও করা হইয়াছে, কিন্তু ফলে কিছুই হয় নাই। 

আমি। এ বাড়ীতে যে সকল স্ত্রীলোক বাস করে, তাহাদিগের মধ্যেও সবিশেষরূপ যে অনুসন্ধান করা হইয়াছে, তাহার আর কিছু মাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু ইহাদিগের মধ্যে কাহারও উপর কোনরূপ সন্দেহ হয় না কি? 

কর্ম্মচারী। পূর্ব্বে কাহারও উপর কোনরূপ সন্দেহ হয় নাই। কিন্তু পরিশেষে একটি স্ত্রীলোকের উপর সবিশেষরূপ সন্দেহ হইয়াছে, তাহাকে লইয়া আজ তিন দিবসকাল অনবরত অনুসন্ধান চলিতেছে। কিন্তু এ পর্য্যন্ত তাহার নিকট হইতে কোন প্রকৃত কথা বাহির হয় নাই। 

আমি। সেই স্ত্রীলোকটির উপর সন্দেহ হইবার কারণ কি? 

কর্ম্মচারী। সে নাকি পূর্ব্বে আরও কয়েকটি স্ত্রীলোককে হত্যা করা অভিযোগে অভিযুক্ত হইয়াছিল। কিন্তু বিচারে অব্যাহতি পায়। শুনিয়াছি, তাহার চরিত্র ভাল নহে, তাই তাহারই উপর সমস্ত কর্ম্মচারীরই সবিশেষরূপ সন্দেহ। 

আমি। সেই স্ত্রীলোকটির নাম কি? 

কর্ম্মচারী। তাহার নাম ত্রৈলোক্য। 

আমি। হত্যাপরাধে যে ত্রৈলোক্যের আলিপুর সেসন-কোর্টে বিচার হয়, এবং পরিশেষে সেই মোকদ্দমা হইতে অব্যাহতি পায়, এই কি সেই ত্রৈলোক্য? 

কর্ম্মচারী। আলিপুরের মোকদ্দমার সময় আমি তাহাকে দেখি নাই। কিন্তু শুনিয়াছি, এ সেই ত্রৈলোক্য। 

আমি। আমি সে ত্রৈলোক্যকে উত্তমরূপে চিনি। যে মোকদ্দমায় আলিপুরে তাহার বিচার হয়, সেই মোকদ্দমায় আমি উহাকে ধৃত করিয়াছিলাম। সেই ত্রৈলোক্য যদি এই বাড়ীতে থাকে, তাহা হইলে এই কার্য্য যে তাহার দ্বারা হয় নাই, ইহা আমি বলিতে পারি না। কারণ, তাহার দ্বারা না হইতে পারে, এরূপ কার্য্য এ জগতে নাই। আমি তাহাবে দেখিলে এখনই জানিতে পারিব, বর্ত্তমান ত্রৈলোক্য সেই ত্রৈলোক্য, কি না। 

কাচার!! আপনি কি তাহাকে এখন দেখিতে চান? 

আমি। না, এখন নয়। অগ্রে আপনার নিকট হইতে সমস্ত বিষয় অবগত হইয়া লই, তাহার পর তাহাকে দেখিব। এখন ত্রৈলোক্য সম্বন্ধে আমার দুই একটি কথা জিজ্ঞাস্য আছে। 

কর্ম্মচারী। কি? 

আমি। আপনি যখন প্রথম অনুসন্ধান করিতে আসিয়াছিলেন, তখন তাহাকে কিরূপ অবস্থায় দেখিতে পান?

কর্ম্মচারী। বাড়ীতে প্রবেশ করিয়া অপর স্ত্রীলোকগণকে যেরূপ অবস্থায় দেখিতে পাইয়াছিলাম, তাহাকেও সেইরূপ অবস্থায় দেখিতে পাই। আমরা বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার পর, অপরাপর স্ত্রীলোকগণ যেমন আমাদিগের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল, ত্রৈলোক্যও সেইরূপ তাহাদিগের সঙ্গে আমাদিগের নিকট উপস্থিত হইল, এবং যাহাকে যেরূপ কথা জিজ্ঞাসা করিলাম, তাহারাও পরিষ্কাররূপে তাহার উত্তর প্রদান করিতে লাগিল। 

আমি। অপরাপর স্ত্রীলোকগণ আপনাদিগের সহিত যেরূপ ব্যবহার করিয়াছিল, ত্রৈলোক্য কি ঠিক সেইরূপ ভাবে ব্যবহার করিয়াছিল, কি তাহার মধ্যে একটু পার্থক্য বুঝিতে পারিয়াছিলেন। 

কর্ম্মচারী। পার্থক্য একটু কেন সবিশেষরূপই ছিল। অপরাপর সকলকে যখন ডাকিতাম, তখনই তাহারা আমাদিগের নিকট আসিত; যাহা জিজ্ঞাসা করিতাম, তাহার উত্তর প্রদান করিয়া, আমাদিগের অনুমতি লইয়া আমাদিগের নিকট হইতে গমন করিত; কিন্তু ত্রৈলোক্যকে একবারের নিমিত্ত ডাকিতে হইত না। আমরা যতক্ষণ পর্য্যন্ত এই বাড়ীর ভিতর থাকিতাম, ছায়ার ন্যায় সে আমাদিগের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিত, মুহূর্তে মুহূর্ত্তে তামাক সাজিয়া দিত। এক পান ফুরাইতে না ফুরাইতে অপর পান আসিয়া, আমাদিগের সম্মুখে উপস্থিত করিত। তাহার এইরূপ যত্ন দেখিয়া কর্ম্মচারীমাত্রেই তাহার উপর সবিশেষ সন্তুষ্ট ছিলেন; সুতরাং তাহাকে অধিক কথা প্রায় কেহই জিজ্ঞাসা করিতেন না। সামান্য যাহা কিছু তাহাকে জিজ্ঞাসা করা হইত, সঙ্গে সঙ্গে সে তাহার উত্তর প্রদান করিত। অধিকন্তু তাহার উপর কাহারও কোনরূপ সন্দেহ হইত না। বরং সকলেই তাহাকে একটু ভালবাসিতেন। 

আমি। কখন তাহার উপর সন্দেহ হইল? 

কৰ্ম্মচারী। দুই দিবস অনুসন্ধান হইবার পর, আপনার থানার একজন কর্মচারী কোন কার্য্য উপলক্ষে এই স্থান দিয়া গমন করিতে ছিলেন। এই বাড়ীতে খুন হইয়াছে শুনিতে পাইয়া, এই বাড়ীর ভিতর আগমন করেন, এবং সম্মুখেই ত্রৈলোক্যকে দেখিতে পাইয়া তাহাকে কহেন, ওগো ত্রৈলোক্য! তুমি এই বাড়ীতে থাক নাকি? তবে এই সকল কৰ্ম্মচারীকে কেন আর মিথ্যা কষ্ট দিতেছ, রাজকুমারীকে কেন হত্যা করিলে, তাহা বলিয়া দেও না; তাহা হইলে সমস্ত গোলযোগ চুকিয়া যাউক।” সেই কৰ্ম্মচারীর এইরূপ কথা শুনিয়া আমি তাঁহাকে কহিলাম, “কেন মহাশয়! ত্রৈলোক্য এই হত্যা করিয়াছে, এরূপ সন্দেহ আপনার হইতেছে কেন?” উত্তরে তিনি কহিলেন, “আপনারা কি তবে ইহাকে চিনেন না? এই ত্রৈলোক্য যে কত স্ত্রীলোককে পুষ্করিণীতে ডুবাইয়া মারিয়া, তাহাদিগের অলঙ্কার সকল আত্মসাৎ করিয়াছে, তাহা কি আপনারা পূর্ব্বে শ্রবণ করেন নাই?” আমি কহিলাম, “শুনিয়াছি, আলিপুর কোর্টে তাহার মোকদ্দমা হয়, এবং বিচারে তাহার দণ্ড হয় নাই; কিন্তু এই কি সেই ত্রৈলোক্য?” কৰ্ম্মচারী কহিলেন, “ইনিই সেই ত্রৈলোক্য।” এই কথা শুনিয়া আমরা আর স্থির থাকিতে পারিলাম না; তখন উহাকে লইয়া আমরা সকলেই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলাম, এবং সেই পর্যন্ত উহাকে লইয়া সবিশেষরূপে অনুসন্ধান চলিতেছে; কিন্তু এ পর্যন্ত ইহার নিকট হইতে কোন কথা প্রকাশ করাইতে পারা যায় নাই। 

28 

আমি। উহার নিকট হইতে কোন কথা বাহির করা, বা অপহৃত অলঙ্কারগুলির পুনরুদ্ধার করা নিতান্ত সহজ কাৰ্য্য নহে। ও যে কি ভয়ানক স্ত্রীলোক, তাহা আপনারা জানেন না; কিন্তু আমি উহাকে উত্তমরূপে চিনি। 

কর্ম্মচারী। তাহা হইলে আপনারও কি বিশ্বাস যে উপস্থিত মোকদ্দমায় এ-ই আসামী এ-ই রাজকুমারী ত্রৈলোক্যের দ্বারা হত হইয়াছে? 

আমি। তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। 

কৰ্ম্মচারী। তাহা হইলে উহাকে লইয়া এখন আর কি করা যাইতে পারে? 

আমি। উহাকে লইয়া উত্তমরূপে অনুসন্ধান করা আবশ্যক। 

কৰ্ম্মচারী। তাহা হইয়াছে, এবং এখনও হইতেছে; কিন্তু ফল ত কিছুই হইতেছে না। 

আমি। ও কোন গৃহে থাকে? 

কর্ম্মচারী। উপরের একখানি গৃহে। 

আমি। সেই ঘরখানি উত্তমরূপে অনুসন্ধান করা হইয়াছে কি? 

কর্ম্মচারী। যেরূপে অনুসন্ধান করিতে হয়, তাহার কিছুমাত্র বাকী নাই। উহার গৃহে অনুসন্ধান করিবার উপযোগী দ্রব্য-সামগ্রী অধিক নাই, কেবল একটি আলমারী আছে মাত্র। তাহা পাঁচ সাতজন কৰ্ম্মচারী পাঁচ সাতবার উত্তমরূপে দেখিয়াছে। কিন্তু তাহার ভিতর অলঙ্কার পত্র প্রভৃতি কোনরূপ অপহৃত দ্রব্য পাওয়া যায় নাই। 

আমি। আমি ত্রৈলোক্যের বিষয় উত্তমরূপে অবগত আছি। তাহার নিকট হইতে কোন কথা সহজে বাহির করিয়া লইবার ক্ষমতা যে কোন পুলিস কর্মচারীর আছে, তাহা আমার বোধ হয় না। কোনরূপ কৌশল করিয়া উহার নিকট হইতে যদি কথা বাহির করিতে পারেন, তাহা হইলেই হইবে; নতুবা উহার কিছুই করিয়া উঠিতে পারিবেন না। 

কর্ম্মচারী। উহাকে লইয়া আজ তিনদিবস অনুসন্ধান করিতেছি; সুতরাং উহার চরিত্রের বিষয় বেশ বুঝিতে পারিতেছি। আপনি যাহা বলিলেন, তাহা প্রকৃত; কিন্তু এমন কি কৌশল আছে যে, তাহা অলম্বন করিলে, আমরা সফল কাম হইব? 

আমি যতদিবস পর্য্যন্ত ত্রৈলোক্যকে দেখিতেছি, ততদিবস হইতে আমি জানিতে পারিয়াছি, ও একাকী কোন কাৰ্য্যে হস্তক্ষেপ করে না। যখন যে কার্য্য করে, তাহার নিমিত্ত একজন না একজন সহকারী সংগ্রহ করিয়া লয়। ইতিপূর্ব্বে একটি হাবা স্ত্রীলোক উহার সহকারিণী ছিল, তাহার সাহায্যে ও অনেক হত্যা করিয়াছে। কিন্তু কিছুদিবস হইল, সেই হাবা স্ত্রীলোকটি মরিয়া গিয়াছে; সুতরাং অপর কোন একটি স্ত্রীলোককে যে সে তাহার সহকারিণী করিয়া লইয়াছে, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। উহার সহিত সবিশেষ প্রণয় আছে, এমন কোন স্ত্রীলোক এই বাড়ীতে, বা নিকটবর্ত্তী অপর কোন বাড়ীতে কি নাই? 

কর্ম্মচারী। আছে ওই বাড়ীতে প্রিয় নাম্নী একটি স্ত্রীলোক আছে; সে তাহার বিশেষরূপে অনুগতা। 

আমি। তাহা হইলে অনুসন্ধান করিয়া দেখুন, এই হত্যা যদি ত্রৈলোক্যের দ্বারা হইয়া থাকে, তাহা হইলে প্রিয় যে তাহার সহকারিণী তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। 

কর্ম্মচারী। প্রিয় সম্বন্ধে আমরা এ পর্যন্ত কোনরূপ অনুসন্ধান করি নাই, বা প্রিয় যে এই হত্যাকাণ্ডে সংলিপ্ত হইতে পারে, তাহাও আমরা ইতিপূর্ব্বে মনে করি নাই। 

আমি। ত্রৈলোক্যের একটি পুত্র আছে, তাহার নাম হরি। ত্রৈলোক্য তাহাকে আপন প্রাণ অপেক্ষাও ভালবাসে। সেই হরি এখন কোথায়, তাহার কিছু অবগত হইতে পারিয়াছেন কি? 

কর্ম্মচারী। সেই হরিও এই বাড়ীতে থাকে; কিন্তু এখন তাহাকে দেখিতে পাইতেছি না। বোধ হয়, সে তাহার মায়ের সহিত গমন করিয়া থাকিবে। 

আমি। ত্রৈলোক্য এখন কোথায়? সে কি এখন এখানে উপস্থিত নাই? 

কর্ম্মচারী। না, একজন কর্ম্মচারী এখন তাহাকে লইয়া বাহির হইয়া গিয়াছে। যদি বলেন, তাহা হইলে তাহাদিগকে ডাকিয়া আনিবার নিমিত্ত লোক পাঠাই। 

আমি। না, ত্রৈলোক্যকে এখন ডাকিবার প্রয়োজন নাই। প্রিয় এখন কোথায়? 

কর্ম্মচারী। সে বাড়ীতেই আছে। তাহাকে একবার দেখিতে চাহেন কি? 

আমি। না, এখন নহে; কিন্তু একটি কার্য্যের প্রয়োজন হইয়াছে। 

কৰ্ম্মচারী। কি? 

আমি। প্রিয়কেও কোন কার্য্যে, বা কোনরূপ অনুসন্ধানের নিমিত্ত জনৈক কর্ম্মচারীর সঙ্গে এখন বাড়ী হইতে বাহির করিয়া দিন। 

কর্ম্মচারী। কেন? 

কর্মচারীর কথার উত্তরে আমি আমার অভিসন্ধির কথা তাঁহাকে কহিলাম, এবং আমি যাহা যাহা করিতে ইচ্ছা করিতেছি, তাহাও তাঁহাকে কহিলাম। তিনিও আমার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন। সন্ধ্যার কিছু পূর্ব্বে আমি পুনরায় আসিব বলিয়া, আমিও সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার পর, কর্ম্মচারী মহাশয় আমার প্রস্তাবানুযায়ী কার্য্য করিলেন। একজন কর্মচারীর সহিত একটি অনুসন্ধানের ভান করিয়া প্রিয়কে বাড়ী হইতে বাহির করিয়া দিলেন। ত্রৈলোক্য এবং হরি পূর্ব্ব হইতেই বাহিরে ছিল। তাহার পর বাড়ীর অপরাপর ভাড়াটিয়াগণকে একত্র করিয়া আমি যাহাদিগকে যাহা যাহা বলিতে বলিয়াছিলাম, তিনি তাহাদিগকে সেইরূপ বলিলেন। ভাড়াটিয়াগণও আমাদিগের অভিসন্ধি বুঝিতে পারিয়া, আমাদের প্রস্তাবে সম্মত হইল। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

সেই সময় আমি আমার বাসায় গমন করিলাম। স্নান আহার বিশ্রামাদি করিয়া, পুনরায় অপরাহ্ন চারিটার সময় সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, কর্ম্মচারী মহাশয় আমার অপেক্ষায় সেই স্থানে বসিয়া আছেন, আরও তিন চারিজন কৰ্ম্মচারী সেই স্থানে উপবিষ্ট। বাড়ির ভাড়াটিয়ামাত্রেই বাড়ীতে উপস্থিত, কৰ্ম্মচারীগণের নিকট ত্রৈলোক্য বন্ধনাবস্থায় বসিয়া রহিয়াছে। 

আমি সেই স্থানে গমন করিয়া, অপরাপর কর্ম্মচারীগণ যে স্থানে বসিয়াছিলেন, সেই স্থানে গিয়া উপবেশন করিলাম, এবং পূর্ব্বকথিত কৰ্ম্মচারীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া কহিলাম, “এই যে বন্ধনাবস্থায় বসিয়া আছে, এ ত্রৈলোক্য নহে?” 

কৰ্ম্মচারী। হাঁ। 

আমি। ইঁহার এ দশা কেন? 

কর্ম্মচারী। হত্যাপরাধে এ ধৃত হইয়াছে। 

আমি। এই কি রাজকুমারীকে হত্যা করিয়াছে? 

কর্ম্মচারী। হাঁ মহাশয়! রাজকুমারীকে হত্যা করা অপরাধে এ ধৃত হইয়াছে। 

আমি। এই হত্যা যে ইহার দ্বারা হইয়াছে, তাহা কি বেশ প্রমাণিত হইয়াছে? 

কর্ম্মচারী। এখন পর্য্যন্ত সম্পূর্ণরূপে প্রমাণিত না হইলেও, এই হত্যা যে ইহার দ্বারা হইয়াছে, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। 

আমি। ইহার উপর সন্দেহ হইবার কারণ কি? 

কর্ম্মচারী। যাহার ব্যবসাই কেবল হত্যা করা, তাহার দ্বারা যে এই হত্যা হয় নাই, তাহা আমি কিরূপে বলিতে পারি? 

আমি। হত্যাই যে ইহার ব্যবসা তাহা আপনাকে কে বলিল? 

কর্ম্মচারী। তাহা আর কে বলিবে? কেন আপনি কি জানেন না যে, হত্যা করাই ইহার ব্যবসা। আপনিই ত হত্যাপরাধে ইহাকে চালান দিয়াছিলেন। 

আমি। পূর্ব্বে হত্যাপরাধে আমি ইহাকে চালান দিয়াছিলাম বলিয়াই যে, এই হত্যা ইহা দ্বারা হইয়াছে তাহা বলা যায় না। পূর্ব্বে আমি ইহার বিরুদ্ধে অনেক লোকের নিকট হইতে অনেক কথা শুনিতে পাই; সেইরূপ কথা শুনিতে শুনিতে আমার মনের গতি খারাপ হইয়া যায়। সেই সময় যেমন ইহার উপর একটি নালিশ হয়, অমনি আমি তাহা বিশ্বাস করিয়া, সেই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হই। অনুসন্ধান আর কি করি? ইহার শত্রুপক্ষীয় লোকে যাহা বলে, তাহারই উপর বিশ্বাস করিয়া, হত্যাপরাধে ইহাকে দোষী স্থির করিয়া লই, এবং বিচারার্থ ইহাকে মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট প্রেরণ করি। মাজিষ্ট্রেট সাহেব ইহাকে দায়রায় পাঠাইয়া দেন। যখন দায়রার বিচারে সাক্ষীগণের উপর জেরা হইতে থাকে, তখনই আমি বুঝিতে পারি যে, ত্রৈলোক্যকে আমি অনর্থক মিথ্যা কষ্ট দিয়াছি। জজসাহেবও সেই মোকদ্দমার ব্যাপার ঠিক করিয়াছেন, এবং ইহাকে সম্পূর্ণরূপ নিরপরাধা জানিয়া অব্যাহতি দিয়াছেন। সেই মোকদ্দমার পূর্ব্বে ত্রৈলোক্যের চরিত্রের উপর আমার যেরূপ বিশ্বাস ছিল, মোকদ্দমার পর হইতে সেই বিশ্বাস সম্পূর্ণরূপে পরিবর্ত্তিত হইয়া গিয়াছে। ত্রৈলোক্যের ব্যবসাই হত্যা, এই বিশ্বাস ব্যতীত এই মোকদ্দমায় যদি ইহার উপর আর কোন প্রমাণ না থাকে, তাহা হইলে ইহাকে নিরর্থক আর কষ্ট দিবেন না, এখনই ইহাকে ছাড়িয়া দিন। 

কৰ্ম্মচারী। তাহা হইলে আপনার বিশ্বাস যে, এই হত্যা ত্রৈলোক্যের দ্বারা হয় নাই? 

আমি। আমি নিশ্চয়ই বলিতে পারি যে, এই হত্যা ত্রৈলোক্য কখনও করে নাই। 

কৰ্ম্মচারী। তবে কে এই হত্যা করিয়া, রাজকুমারীর সমস্ত অলঙ্কার পত্র চুরি করিয়া লইল? 

আমি। কে যে এই হত্যা করিয়াছে, তাহা আমি ঠিক জানি না; কিন্তু আমি যতদূর অবগত হইতে পারিয়াছি, তাহাতে বেশ বুঝিতে পারিতেছি যে এই হত্যা ত্রৈলোক্য করে নাই। আরও একটু একটু শুনিতে পাইতেছি যে, এই হত্যা কোন লোকের দ্বারা সম্পাদিত হইয়াছে। 

কৰ্ম্মচারী। তাহা হইলে বলুন না, আপনি কি শুনিয়াছেন ও কে এই হত্যা করিয়াছে। 

আমি। বলিবার সময় এখনও উপস্থিত হয় নাই। যখন সে সময় হইবে তখন আপনি তাহার সমস্ত বৃত্তান্ত অবগত হইতে পারিবেন। এখন ইহাকে ছাড়িয়া দিন, বিনা অপরাধে এরূপ বন্ধনাবস্থায় ইহাকে আর কষ্ট প্রদান করিবেন না। 

আমার কথা শুনিয়া কর্ম্মচারী মহাশয় ত্রৈলোক্যের বন্ধন মুক্ত করিয়া দিতে কহিলেন। জনৈক প্রহরী আসিয়া তাহার বন্ধন মোচন করিয়া দিল। আমার কথা শুনিয়া এবং আমার ব্যবহার দেখিয়া ত্রৈলোক্য আমার উপর যে কিছু পৰ্য্যন্ত সন্তুষ্ট হইল, তাহা আর আমি বলিতে পারি না। আমার কৃপায় সে এ যাত্রাও নিষ্কৃতি পাইল, এই ভাবিয়া সে অন্তরের ধন্যবাদ প্রদান করিতে করিতে আমার পার্শ্বে আসিয়া দণ্ডায়মান হইল। 

সেই সময় অপরাপর কর্মচারীদিগকে সম্বোধন করিয়া কহিলাম, “আজ কয়েকদিবস পর্য্যন্ত আপনারা এই বাড়ীর ভাড়াটিয়াগণের মধ্যে যে সকল অনুসন্ধান করিয়াছেন বা তাহাদিগের নিকট হইতে যাহা কিছু অবগত হইতে পারিয়াছেন, তাহা ঠিক নহে। আমি জানিতে পারিয়াছি, ভীত হইয়া তাহারা কেহই বিকৃত কথা কহে নাই। আমার বিবেচনা হয়, এখন তাহারা প্রকৃত কথা বলিবে। এই বাড়ীর সমস্ত ভাড়াটিয়াগণকে ডাকাইয়া পুনরায় তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখুন। দেখুন দেখি, এখন তাহারা প্রকৃত কথা বলে কি না? আর পূর্ব্বে তাহারা যে সকল কথা বলিয়াছে, বা আপনারা যাহা লিখিয়া লইয়াছেন, সেই সকল কাগজপত্র আর রাখিবার কোন প্রয়োজন নাই, সেই সকল কাগজপত্র পূৰ্ব্বেই নষ্ট করিয়া ফেলা আবশ্যক।” এই বলিয়া তাঁহাদিগের নিকট হইতে কতকগুলি কাগজ লইয়া আমি সেই স্থানেই ছিঁড়িয়া ফেলিলাম। সকলে বুঝিতে পারিল যে, যে কাগজে ভাড়াটিয়াগণের জবানবন্দী লেখা হইয়াছিল, আমি সেই সকল কাগজ ছিঁড়িয়া ফেলিলাম; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমি সেই সকল কাগজে হস্তক্ষেপ করিলাম না, কতকগুলি বাজে কাগজ ছিঁড়িয়া ফেলিলাম মাত্ৰ 

ইহার পর বাড়ীর কি স্ত্রী, কি পুরুষ, সকল লোককেই আমি সেইস্থানে ডাকিলাম, সকলেই আসিয়া আমার নিকট উপবেশন করিল। আমি অন্য আর একজন কর্মচারীকে কহিলাম “আপনি এখন ইহাদিগের জবানবন্দী পুনরায় লিখিতে আরম্ভ করুন।” আমার কথা শুনিয়া সেই স্থানে যে সকল কর্ম্মচারী উপস্থিত ছিলেন, তাঁহারা স্থিরভাবে বসিয়া রহিলেন, কাহারও মুখে কোন কথা বাহির হইল না। বাড়ীর ভাড়াটিয়াগণ পুনরায় কিরূপ জবানবন্দী দেয়, তাহাই সকলে নিতান্ত ঔৎসুক্য সহকারে শুনিতে লাগিলেন। আমি এক একজনকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম, সেই অপর কর্ম্মচারী মহাশয় তাহা লিখিতে আরম্ভ করিলেন। ভাড়াটিয়াগণ যাহা বলিতে লাগিল, তাহা শুনিয়া অপরাপর কর্মচারীগণ নিতান্ত বিস্মিত হইতে লাগিলেন ত্রৈলোক্যের মস্তক ঘুরিতে লাগিল, তাহার সমস্ত শরীর কাঁপিতে লাগিল; তথায় কে কি বলে, তাহা শুনিবার নিমিত্ত সে সেইস্থানে বসিয়া রহিল। 

পুনরায় সেই বাড়ীর ভাড়াটিয়াগণের যেরূপ ভাবে জবানবন্দী লেখা হইতে লাগিল তাহার সংক্ষেপ মৰ্ম্ম এইরূপ : 

একটি স্ত্রীলোক কহিল, “আমি হরিকে উত্তমরূপে চিনি, সে ত্রৈলোক্যের পুত্র। তাহার মাতার সহিত সে এই বাড়ীতেই থাকে। কোনরূপ কার্য কৰ্ম্ম করিতে তাহাকে কখনও দেখি নাই, বা শুনি নাই। অথচ বেশ্যালয়ে গমন ও মদ্যাদি পান করিতে তাহাকে প্রায়ই দেখিতে পাই। এই সকল কার্য্যের নিমিত্ত যে সকল অর্থের প্রয়োজন হয়, তাহা সে কোথা হইতে প্রাপ্ত হয়, তাহা বলিতে পারি না। যে দিবস রাজকুমারীর মৃতদেহ পাওয়া যায়, তাহার পূর্ব্বদিবস সন্ধ্যার পূর্ব্বে রাজকুমারীর সহিত সে নির্জ্জনে কি পরামর্শ করিতেছিল, তাহা আমি দেখিতে পাই, এবং উহারাও আমাকে দেখিতে পাইয়া উভয়ে উভয় দিকে প্রস্থান করে। ইহার পর রাত্রে আন্দাজ বারটা কি একটার সময় আমি কোন কাৰ্য্যবশতঃ আমার গৃহ হইতে বাহির হই। সেই সময় দেখিতে পাই, হরি ধীরে ধীরে তাহার মাতার গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া রাজকুমারীর গৃহের দিকে গমন করিতেছে। রাজকুমারীর গৃহের দরজা ভিতর হইতে বন্ধ ছিল না, কেবল ভেজান ছিল মাত্র। হরি সেই দরজা ধীরে ধীরে ঠেলিয়া নিঃশব্দে সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল। এই ব্যাপার দেখিয়া আমি সেই সময় অনুমান করিয়াছিলাম, রাজকুমারী হরির প্রেমে আসক্ত হইয়াছে, তাই হরি উহার গৃহে গোপনে গমন করিয়া থাকে। আমি পুলিসের ভয়ে এ কথা পূর্ব্বে বলিতে সাহসী হই নাই।” 

অপর আর একটি স্ত্রীলোক কহিল, “রাত্রি আন্দাজ দুইটার সময় আমি আমার গৃহ হইতে বহির্গত হইলাম। আমার গৃহে একটি লোক ছিল, সেই সময় সে আমার গৃহ হইতে চলিয়া যাইবার ইচ্ছা প্রকাশ করায়, সদর দরজা খুলিয়া তাহাকে বাহির করিয়া দিবার নিমিত্ত, আমি তাহার সহিত আমার গৃহ হইতে বহির্গত হই এবং তাহার সহিত সদর দরজা পর্য্যন্ত গমন করিয়া দেখি যে, সদর দরজা খোলা রহিয়াছে। কে যে সেই দরজা খুলিয়া বাহিরে গমন করিয়াছে, সেই সময় তাহার কিছুমাত্র স্থির করিতে না পারিয়া, সেই দরজা ভিতর হইতে পুনরায় আমি বন্ধ করিয়া দি, এবং আমার গৃহে গিয়া আমি শয়ন করি।” 

তৃতীয় ভাড়াটিয়া কহিল, “ যে দিবস রাজকুমারীর মৃতদেহ পাওয়া যায়, সেই দিবস অতি প্রত্যূষে আমি গাত্রোত্থান করিয়া, আমার বাবুর সহিত সহিত সদর দরজা পর্যন্ত গমন করিলাম। সেই দরজা ভিতর হইতে বন্ধ ছিল। সেই দরজা আমি খুলিয়া দিলে, আমার বাবু বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া যান। সেই সময় সেই দরজা আমি পুনরায় বন্ধ করিবার বাসনা করিয়া যেমন উহা বন্ধ করিবার চেষ্টা করি, সেই সময় হরি বাহির হইতে আসিয়া বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করে। সেই সময় তাহার অবস্থা দেখিয়া, আমার মনে কেমন একরূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হয়। উহাকে দেখিয়া আমি বেশ বুঝিতে পারিয়াছিলাম, ও যেন সমস্ত রাত্রি জাগরণ করিয়াছে, আর উহার মনে যে কি একটি ভয়ানক চিন্তা আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। ইহার পূর্ব্বে আমাদিগের সহিত যখন হরির সাক্ষাৎ হইত, সেই সময় দুই একটি কথা না বলিয়া, সে কখনও প্রস্থান করিত না। কিন্তু সে দিবস আমার সহিত কোন কথা না বলিয়া, যেন নিতান্ত চিন্তিত অন্তঃকরণে সে তাহার মাতার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল।” 

চতুর্থ ভাড়াটিয়া কহিল,—“যে দিবস রাজকুমারীর মৃতদেহ পাওয়া যায়, তাহার পূর্ব্ব রাত্রিতে আমিই সকলের শেষে সদর দরজা বন্ধ করিয়া আপন গৃহে গিয়া শয়ন করিয়াছিলাম। আমি যখন সদর দরজা বন্ধ করি, তখন বোধ হয়, রাত্রি বারটা। সেই সময় হরিকে দেখিতে পাই, যে তাহার মাতার গৃহের সম্মুখে বারান্দার উপর চুপ করিয়া বসিয়াছিল। ওরূপ সময় ওরূপ স্থানে আমি হরিকে ইতিপূর্ব্বে আর কখনও বসিতে দেখি নাই; সুতরাং আমার মনে একটু সন্দেহ হয়। মনে হয়, বোধ হয়, তাহার কোনরূপ অসুখ হইয়া থাকিবে। এই ভাবিয়া আমি হরিকে জিজ্ঞাসা করি, “এমন সময় এরূপভাবে তুমি বাহিরে বসিয়া রহিয়াছ কেন?” আমার কথায় হরি কোন উত্তর দান করে নাই; সুতরাং তাহার ব্যবহারে আমি বিরক্ত হইয়া তাহাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। গৃহে গিয়া শয়ন করিয়াছিলাম।” 

পঞ্চম ভাড়াটিয়া বা কামিনী কহিল,—“রাত্রি আন্দাজ বারটা কি একটার সময় আমার নিদ্রাভঙ্গ হইয়া যায়। আমি আমার গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া, আমার গৃহের বারান্দার উপর আসিয়া উপবেশন করি। সেই সময় রাজকুমারীর গৃহ হইতে কেমন একরূপ গোঁ গোঁ শব্দ আসিয়া আমার কর্ণে প্রবেশ করে। আমি উঠিয়া ধীরে ধীরে রাজকুমারীর গৃহের নিকট গমন করি, এবং তাহার গৃহের দরজা ঠেলিয়া দেখি, উহা ভিতর হইতে বন্ধ। বেড়ার ফাঁক দিয়া দেখিতে পাই, উহার গৃহে একটি প্রদীপ জ্বলিতেছে, মেঝেয় পার্টির উপর রাজকুমারী চিৎ হইয়া শুইয়া রহিয়াছে, হরি তাহার বুকের উপর বসিয়া রহিয়াছে, রাজকুমারী অল্প গোঁ গোঁ শব্দ করিতেছে। এই ব্যাপার দেখিয়া আমার মনে অন্য এক ভাবের উদয় হইল। আমি মনে মনে সবিশেষ লজ্জিত হইয়া আমার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। তৎপরে আমার গৃহের দরজা বন্ধ করিয়া, আমি আমার বিছানায় শয়ন করিলাম।” 

ষষ্ঠ স্ত্রীলোক বা বিধু কহিল, “ যে দিবস প্রাতঃকালে রাজকুমারীর মৃতদেহ পাওয়া যায়, তাহার পূর্ব্ব রজনী আন্দাজ একটা কি দেড়টার সময় আমি আমার গৃহ হইতে বাহিরে গমন করিয়াছিলাম। সেই সময় রাজকুমারীর গৃহ হইতে অল্প গোঁ গোঁ শব্দ আমার কর্ণে প্রবেশ করে। কিসের শব্দ তাহা আমি কিছুই বুঝিতে না পারিয়া, কিয়ৎক্ষণ আমার গৃহের সম্মুখে দাঁড়াইয়া থাকি। তাহার পরই দেখিতে পাই, হরি রাজকুমারীর গৃহ হইতে বাহিরে গমন করে, এবং দ্রুতপদে সদর দরজার নিকট গমন করিয়া, সেই দরজা খুলিয়া বাড়ী হইতে বাহির হইয়া যায়। যে সময় রাজকুমারীর গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া যায়, সেই সময় তাহার হস্তে সাদা রুমাল, বা সাদা নেকড়ায় বাঁধা ছোটগোছের একটি পুঁটুলি ছিল। এখন আমার বেশ অনুমান হইতেছে যে, সেই পুঁটুলির মধ্যে রাজকুমারীর গৃহ হইতে অপহৃত অলঙ্কারগুলি ভিন্ন আর কিছুই ছিল না।” 

সেই বাড়ীতে যতগুলি ভাড়াটিয়া ছিল, সকলেই কিছু না কিছু হরির বিপক্ষে বলিল। কেবলমাত্র প্রিয় কহিল,—“আমি ইহার কিছুই অবগত নহি, বা হরির বিপক্ষে আমি এ পর্যন্ত কোন কথা শুনি নাই।”

আমরা ত্রৈলোক্যকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। সাক্ষীগণ যেরূপ জবানবন্দী দিতে লাগিল, ত্রৈলোক্য সেই স্থানে বসিয়া স্থিরভাবে তাহা শ্রবণ করিতে লাগিল, এবং মধ্যে মধ্যে একটি একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিতে লাগিল। এইরূপে সমস্ত সাক্ষীর জবানবন্দী হইয়া গেল। তখন কর্ম্মচারীমাত্রেই এক বাক্যে বলিয়া উঠিলেন, “এখন এই মোকদ্দমার উদ্ধার হইল, এখন উত্তম রূপে জানিতে পারা গেল যে, এই হত্যা কাহার দ্বারা হইয়াছে। রাজকুমারীর গৃহ হইতে অপহৃত অলঙ্কারগুলি পাওয়া যাউক, বা না যাউক, এই সকল সাক্ষীর সাক্ষ্যে যে হরির ফাঁসি হইবে তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।” 

এ পর্যন্ত হরিও সেই স্থানে উপস্থিত থাকিয়া, সকল কথা শ্রবণ করিতেছিল। কৰ্ম্মচারীগণের কথা শেষ হইবার পর, আমি কহিলাম এখন আর হরিকে এরূপ ভাবে রাখা উচিত নহে। হত্যাকারীকে যেরূপ ভাবে রাখা হইয়া থাকে, ইহাকেও এখন সেইরূপ ভাবে রাখা কৰ্ত্তব্য।” 

আমার কথা শেষ হইবামাত্রই একজন কৰ্ম্মচারী উঠিয়া তাহাকে ধরিলেন, ও তাহার হাতে হাতকড়ি পরাইয়া বস্ত্ৰ দ্বারা পুনরায় উত্তমরূপে বন্ধন করিয়া দুইজন প্রহরীর হস্তে তাহাকে অর্পণ করিলেন। 

হরির মুখ দিয়া কোন কথাই বাহির হইল না। কেবল তাহার চক্ষু দিয়া বেগে জলধারা বহিতে লাগিল এবং সজলনয়নে মধ্যে মধ্যে এক একবার কেবল ত্রৈলোক্যের মুখের দিকে তাকাইয়া বলিতে লাগিল “মা! আমি তোমার পায়ে হাত দিয়া দিব্য করিয়া বলিতে পারি, আমি ইহার কিছুই জানি না। রাজকুমারীকে আমি হত্যা করি নাই, বা তাহার অলঙ্কার পত্র প্রভৃতি কোন দ্রব্যই আমি অপহরণ করি নাই। আমি সমস্ত রাত্রি বাড়ীতেই ছিলাম, একবারের নিমিত্ত আমি বাড়ীর বাহিরে গমন করি নাই।” 

আমরা হরির কথায় কর্ণপাত করিলাম না। অধিকন্তু তাহাকে কহিলাম, “রাজকুমারীর গহনাগুলি তুমি কোথায় রাখিয়া আসিয়াছ, তাহা এখনও বলিয়া দেও। নতুবা আমাদিগের হস্তে তোমার যন্ত্রণার শেষ থাকিবে না।” 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

আমাদিগের এই সকল ব্যাপার দেখিয়া ত্রৈলোক্য যে স্থানে বসিয়াছিল, সেই স্থান হইতে গাত্রোত্থান করিয়া, আমার পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইল, এবং আমাকে কহিল, “আমি নিৰ্জ্জনে আপনাকে দুই একটি কথা বলিতে চাহি।” 

ত্রৈলোক্যের কথা শুনিয়া আমিও গাত্রোত্থান করিলাম এবং তাহার সহিত সেই বাড়ির ভিতরএকটু অন্তরালে গমন করিলাম। 

সেই স্থানে ত্রৈলোক্য কহিল, “মহাশয়! হরি আমার পুত্র, তাহা আপনি অবগত আছেন, এবং উহাকে আমি কিরূপ প্রাণের সহিত ভালবাসি, তাহাও আপনি জানেন। আপনি যে অপরাধের নিমিত্ত হরিকে বন্ধন করিয়াছেন, এবং যাহার বিপক্ষে বাড়ীর সকলেই সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে, সেই হরির দ্বারা সেই হত্যাকাণ্ড ঘটে নাই; নিরপরাধ হইয়াও হরি আমার সঙ্গে যাইতেছে!” 

আমি। হরি যদি এই হত্যা না করিল, তাহা হইলে বাড়ীর সমস্ত লোকেই উহার বিপক্ষে চলিতেছে কেন? আর কেইবা রাজকুমারীকে হত্যা করিল? 

ত্রৈলোক্য। বাড়ীর সকলে যে কেন হরির বিপক্ষে বলিতেছে, তাহা আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। প্রকৃতপক্ষে কেবল একটি মাত্র স্ত্রীলোক ভিন্ন অপরে ইহার কিছুই অবগত নহে। 

আমি। সেই স্ত্রীলোকটি কে? 

ত্রৈলোক্য। প্রিয়। 

আমি। প্রিয় কি জানে? 

ত্রৈলোক্য। প্রিয় জানে যে, আমার দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড হইয়াছে। প্রিয় জানে যে, এই হত্যাকাণ্ডে সেই আমাকে সহায়তা করিয়াছে। 

আমি। আপন পুত্রকে বাঁচাইবার নিমিত্ত কেন মিথ্যা কথা বলিতেছ? 

ত্রৈলোক্য। মিথ্যা কথা নহে, আমি সম্পূর্ণরূপ সত্য কথা কহিতেছি। 

আমি। যদি তুমি প্রকৃত কথা বলিতে চাও তাহা হইলে গোপনে আমাকে বলিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। প্রকৃতপক্ষে যাহা তুমি অবগত আছ, বা নিজে তুমি যাহা করিয়াছ, তাহা সকলের সম্মুখে প্রকাশ কর। তোমার সমস্ত কথা শুনিলে তখন আমরা বুঝিতে পারিব যে, তোমার কথা কতদূর প্রকৃত। বুঝিব, এই হত্যা তোমার দ্বারা হইয়াছে কি না, মিথ্যা কথা কহিয়া তুমি হরিকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিতেছ কি না। 

ত্রৈলোক্য। আমি মিথ্যা কথা বলিয়া হরিকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিতেছি না। চলুন, আমি যাহা জানি, তাহা সৰ্ব্বসমক্ষে বলিতেছি। আমার সকল কথা শুনিলে নিশ্চয়ই আপনারা আমার প্রাণের হরিকে ছাড়িয়া দিবেন। 

এই বলিয়া ত্রৈলোক্য পুনরায় আপনার স্থানে আসিয়া উপবেশন করিল, আমিও আপন স্থানে প্রত্যাবর্তন করিলাম সেই স্থানে উপবেশন করিয়া, ত্রৈলোক্য আমাকে লক্ষ্য করিয়া কহিল, “আপনি আমার অনেক বিষয় অবগত আছেন। সুতরাং মনোযোগ দিয়া শ্রবণ করিলে, আপনি আমার অবস্থা যতদূর বুঝিতে পারিবেন, ততদূর আর কেহই বুঝিয়া উঠিতে পারিবেন না!” 

এই বলিয়া ত্রৈলোক্য বলিতে আরম্ভ করিল,—যে হত্যাপরাধে আপনি আমাকে বিচারার্থ প্রেরণ করিয়াছিলেন, আমি প্রকৃতই সেই অপরাধে অপরাধী ছিলাম; কিন্তু ইংরাজের আইনের বলে ও বিচারকের বিচারের গুণে, আমি সে যাত্রায় পরিত্রাণ পাই। বিচারে অব্যাহতি পাইয়া, যে স্থানে আমি পূর্ব্বে বাস করিতাম, সেই স্থানে গিয়া পুনরায় বাস করিতে আরম্ভ করি। আমার দুষ্কার্য্যের প্রধান সহায় সেই বোবা, তাহা বোধ হয়, আপনি জানেন, তাহার পর আমি পুনরায় সেইরূপ কার্য্য করিতে একবারে অসহায় হইয়া পড়ি, এদিকে সেই পাড়ার সমস্ত লোকেই ক্রমে আমার চরিত্রের বিষয় অবগত হইয়া পড়ে। সুতরাং আমার কথায় আর কেহই বিশ্বাস করিত না। এমন কি, আমার সঙ্গে অনেকেই বাক্যালাপ পর্য্যন্তও করিত না। তখন সেই স্থানে আর বাস করা যুক্তি-যুক্ত নহে, বিবেচনা করিয়া আমি আমার সমস্ত দ্রব্য-সামগ্রী এবং আমার প্রাণের পুত্র হরিকে লইয়া সেই স্থান পরিত্যাগ করি। পরিশেষে পাঁচুধোপানির গলির এই বাড়ীতে আসিয়া একখানি ঘর ভাড়া করিয়া লই। এই স্থানের কোন লোকেই আমাকে চিনিত না, বা কোন স্ত্রীলোকের সহিত আমার আলাপ-পরিচয়ও ছিল না। সুতরাং এই স্থানেই এতদিবস পর্য্যন্ত আমি নির্ব্বিবাদে বাস করিয়া আসিতেছিলাম। আমি এই বাড়ীতে উঠিয়া আসিবার কিছুদিবস পরে, প্রিয় আসিয়াও এই বাড়ীতে একখানি ঘর ভাড়া লয়, এবং সেই পর্য্যন্ত সেও এইস্থানে অবিস্থিতি করিতেছে। যে সময় প্রিয় এই বাড়ীতে উঠিয়া আসে, সেই সময় হইতেই তাহার উপর কেমন আমার একটু ভালবাসা জন্মায়। পরে কিছুদিন থাকিতে থাকিতে প্রিয়ও আমাকে বিশেষরূপ যত্ন করিতে আরম্ভ করে, এবং ক্রমে আমার সবিশেষ অনুগত হইয়া পড়ে 

যে সময় আমি এই বাড়ীতে উঠিয়া আসিয়াছিলাম, সেই সময় আমার চলাচলের সবিশেষ কোন কষ্ট ছিল না। পূর্ব্বে নানারূপ অসৎ উপায়ে যে সকল অর্থ উপার্জ্জন করিয়াছিলাম, এখনও পর্যন্তও তাহার কিছু অর্থ আমার নিকট ছিল; কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে সকল অর্থ ক্রমে নিঃশেষিত হইয়া গেল। পুনরায় আমার অর্থের প্রয়োজন হইতে লাগিল। 

“এই বাড়ীতে যতগুলি স্ত্রীলোক বাস করিত; সকলের অপেক্ষা রাজকুমারীই কিছু দরিদ্রভাবে থাকিত; কিন্তু সকলের যাহা নাই, রাজকুমারীর তাহা ছিল। তাহার কতকগুলি উৎকৃষ্ট উৎকৃষ্ট সোণার অলঙ্কার ছিল; কিন্তু তাহার অধিকাংশই সে ব্যবহার করিত না, উহা তাহার বাক্সের মধ্যে প্রায়ই আবদ্ধ থাকিত। 

“সেই সকল অলঙ্কার দেখিয়া উহার উপর আমার অতিশয় লোভ হইল। কিরূপে সেই অলঙ্কারগুলি আমার হস্তগত হইতে পারে, সর্ব্বদা কেবল তাহারই চিন্তা করিতে লাগিলাম; কিন্তু মনের চিন্তা অধিক দিবস গোপনে রাখিতে পারিলাম না। কথায় কথায় একদিবস আমার মনের ভাব প্রিয়র নিকট প্রকাশ করিয়া ফেলিলাম। দেখিলাম, প্রিয়ও আমার ইচ্ছার অনুগামিনী হইল। তখন কিরূপ উপায়ে রাজকুমারীর অলঙ্কারগুলি অপহরণ করিতে সমর্থ হই, উভয়ে মিলিয়া তাহার পরামর্শ করিতে আরম্ভ করিলাম। পরিশেষে ইহাও সাব্যস্ত হইল যে, উহাকে কোনরূপে অজ্ঞান করিয়া তাহার গহনাগুলি অপহরণ করিব। যেরূপ পরামর্শ হইল, কার্য্যেও তাহার সেইরূপ সংগ্রহ করিলাম; কিয়দ্দিন পরে ধুতুরার বীজ সংগ্রহ করিয়া তাহা উত্তমরূপে চূর্ণ করিয়া রাখিলাম।” 

আমি। ধুতুরার বীজ সংগ্রহ করিলে কিরূপে? 

ত্রৈলোক্য। আমার পূর্ব্ব বাসস্থান ছিল পাড়া গাঁয়ে; সুতরাং ধৃতরা যে কি জিনিষ, তাহা আমি বেশ জানি। উহার গুণ আমি অবগত আছি, এবং কোথায় যে উহা পাওয়া যায়, তাহাও আমার জানিতে বাকী নাই। একদিবস সহরের বাহিরে একখানি বাগানে কতকগুলি ধুতুরার গাছ দেখিতে পাই। উহা হইতে কয়েকটি ফল আনিয়া, তাহা চূর্ণ করিয়া আপন গৃহে রাখিয়া দি। 

আমি। তারপর কি হইল? 

ত্রৈলোক্য। ধুতুরার গুঁড়া সংগ্রহ করিয়া রাখিলাম সত্য; কিন্তু রাজকুমারীকে উহা প্রয়োগ করিবার সুযোগ কয়েকদিবসের মধ্যে করিয়া উঠিতে পারিলাম না। আমি পূর্ব্বে শুনিয়াছিলাম যে, যেরূপ করিয়া তামাকু সাজিয়া খাইতে হয়, সেইরূপ করিয়া সিদ্ধি সাজিয়া খাইলে অতিশয় নেসা হয়; সুতরাং কিছু সিদ্ধিও আমি সংগ্রহ করিয়া রাখিয়া দিয়াছিলাম। সেই সকল দ্রব্য সংগ্রহ করিয়া আমি চারি পাঁচদিবস রাখিলাম; কিন্তু কোনরূপ সুযোগ করিতে পারিলাম না। 

“একদিবস রাজকুমারী তাহার একটি পরিচিতা স্ত্রীলোকের সহিত সাক্ষাৎ করিতে গমন করিয়াছিল। আমিও তাহার সহিত গিয়াছিলাম। যখন আমরা উভয়ে সেই স্থান হইতে প্রত্যাগমন করি, সেই সময় কিছু সন্দেশ আমি খরিদ করিয়া আনিয়াছিলাম। সেই সন্দেশ যে আমি নিজে ভোজন করিব বলিয়া আনিয়াছিলাম, তাহা নহে, উহার দ্বারাই আমি ‘রাজকুমারীর সর্ব্বনাশ সাধন করিব, এই অভিপ্রায়েই আমি উহা আনিয়াছিলাম। 

“আমি পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি যে, আমি কতকটা ধুতুরার গুঁড়া সংগ্রহ করিয়া রাখিয়া দিয়াছিলাম। এখন আমি এবং প্রিয়-উভয়ে মিলিয়া সেই সন্দেশের কতকগুলিতে সেই গুঁড়া মিশ্রিত করিয়া দিলাম, কতকগুলি সন্দেশ ভাল রহিল। তখন উহা আমরা পৃথক পাত্রে আমাদের ঘরের ভিতরে যে একটি আলমারি আছে, তাহার মধ্যে চাবি বদ্ধ করিয়া রাখিয়া দিলাম। আলমারির ভিতর হইতে বদ্ধ করিয়া রাখিবার কারণ এই যে, পাছে হরি জানিতে পারিয়া সেই সন্দেশ খাইয়া ফেলে। 

“যে দিবস প্রাতঃকালে রাজকুমারীর মৃতদেহ পাওয়া যায় তাহার পূর্ব্ব দিবস সন্ধ্যার সময় রাজকুমারী আমার কাছে উপবেশন করে, এবং সন্ধ্যার অনেকক্ষণ পর পর্য্যন্ত আমার গৃহে বসিয়া নানারূপ গল্প-গুজবে নিযুক্ত হয়। প্রিয়ও সেই সময় আমার গৃহে ছিল। সেই সময়ে মনে করিয়াছিলাম, বিষমিশ্রিত সন্দেশ কোনরূপে সেইস্থানে 

রাজকুমারীকে খাওয়াইয়া দি; কিন্তু কাৰ্য্যে তাহা করিয়া উঠিতে পারি নাই। কারণ, আমার মনে হয়, যদি রাজকুমারী অজ্ঞান হইয়া আমারই গৃহে পতিত হয়, তাহা হইলে গোলযোগ হইয়া পড়িবে; সুতরাং আমার মনোবাঞ্ছা কোনরূপেই পূর্ণ করিতে সমর্থ হইব না। এই ভাবিয়া যতক্ষণ পর্য্যন্ত সে আমার গৃহে ছিল, ততক্ষণ পর্যন্ত তাহাকে সেই সন্দেশ খাওয়াইবার নিমিত্ত কোনরূপ উদযোগ করিলাম না। পরিশেষে সে যখন উঠিয়া আমার গৃহ হইতে তাহার নিজের গৃহে গমন করিল, তখন উভয়েই তাহার সহিত গমন করিয়া তাহার গৃহে গিয়া উপবেশন করিলাম। যে একখানি মাজুরের উপর রাজকুমারীর মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, আমাদিগের বসিবার নিমিত্ত রাজকুমারী সেই মাজুর বিছাইয়া দেয়। আমরা তাহার উপর উপবেশন করিলে, সেও আমাদিগের সন্নিকটে উপবেশন করে। সেই গৃহে বসিয়া বসিয়া ক্রমে রাত্রি এগারটা বাজিয়া গেল। 

“রাত্রি আন্দাজ সাড়ে এগারটার সময় আমি প্রিয়কে কহিলাম, ‘ভাই! বড় ক্ষুধা লাগিয়াছে, কিছু খাইতে ইচ্ছা করিতেছে।’ 

“প্রিয় আমার মনের ভাব বুঝিতে পারিল ও কহিল আমারও ক্ষুধা লাগিয়াছে। রাজকুমারী ত আমাদিগকে কিছু খাইতে দিবে না, চল আমরা গিয়া আমাদের গৃহে আহার করিয়া আসি।’ 

“উত্তরে রাজকুমারী কহিল, ‘কেন আমার কি কিছুই নাই যে, তোমাদিগকে আহার করিতে দিতে পারিব না? কি খাইতে চাও, বল না। 

“আমি কহিলাম, “আর কিছুই খাইব না। অনেক দিন ফলার করি নাই, আজ মনটা বলিতেছে ফলার করি।’ “এই বলিয়া প্রিয়কে কহিলাম, “দেখ বোন, দই-চিড়া ও কিছু মিষ্ট দ্রব্য যদি এখন খরিদ করিয়া আনিতে পার, তাহা হইলে খরিদ করিয়া আন না কেন। আমরা তিনজনেই এই স্থানে বসিয়া ফলার করিব এখন?” 

“আমার কথা শুনিয়া রাজকুমারী গাত্রোত্থান করিল, এবং প্রিয়কে সেই স্থানে বসিতে বলিয়া একটি পয়সা লইয়া সে বাহিরে গমন করিল। আমরা তাহার গৃহে বসিয়া নানারূপ দুরভিসন্ধির উপায় স্থির করিতে লাগিলাম। সেদিন বাড়ীর অপর আর কেহই জাগরিত ছিল না। কিয়ৎক্ষণ পরে রাজকুমারী কিছু চিড়া, দই ও মিষ্টান্নের সহিত প্রত্যাবৰ্ত্তন করিল। আমরা সেই সকল দ্রব্য দুইখানি পাত্রে রাখিয়া তাহাতেই আহারের বন্দোবস্ত করিলাম। একখানি পাত্রে রাজকুমারীকে দিলাম; সে সেই পাত্রে আহার করিতে লাগিল; আর একখানি পাত্রে আমি ও প্রিয় উভয়ে আহার করিতে বসিলাম। সেই সময় প্রিয় কহিল, ‘ফলারে মিষ্টতা কিছু কম হইয়াছে।’ প্রিয়র কথার উত্তরে আমি প্রিয়কে কহিলাম, ‘আমার এই চাবি লইয়া যাও, আলমারির ভিতর সন্দেশ ছিল, যদি থাকে, তাহা হইলে উহা আন।’ 

“প্রিয় আমার অভিসন্ধি বুঝিতে পারিয়া আমার আলমারি হইতে বিষমিশ্রিত এবং বিষ-অমিশ্রিত সমুদায় সন্দেশ আনিয়া আমার নিকট রাখিয়া দিল। যে সন্দেশ বিষমিশ্রিত ছিল না, তাহার কিয়দংশ আমি গ্রহণ করিলাম, অবশিষ্ট প্রিয়কে দিলাম। যাহাতে বিষমিশ্রিত ছিল, তাহা রাজকুমারীকে প্রদান করিলাম। রাজকুমারী তাহার কিয়ৎ পরিমাণে ভোজন করিল; খাইতে ভাল লাগিতেছে না বলিয়া, সমস্ত খাইয়া উঠিতে পারিল না। কিন্তু সে যাহা আহার করিল, তাহাতেই তাহার নেসা হইল; তবে একবারে হতজ্ঞান হইয়া পড়িল না। 

“এই ব্যাপার দেখিয়া আমি প্রিয়কে এক ছিলুম তামাকু সাজিতে কহিলাম। প্রিয় আমার দুরভিসন্ধি বুঝিতে পারিয়া তামাকুর পরিবর্তে সিদ্ধি সাজিয়া আনিল। তামাকু বলিয়া রাজকুমারীকে সেই সিদ্ধির ধূমও পান করাইলাম; কিন্তু তাহাতেও রাজকুমারী একবারে সংজ্ঞাশূন্য হইয়া পড়িল না। আমার ইচ্ছা ছিল যে, রাজকুমারী অজ্ঞান হইয়া পড়িলে পর, উহার সমস্ত অলঙ্কারাদি লুঠ করিয়া লইব। কিন্তু সেও অজ্ঞান হইল না, আমিও তাহার অলঙ্কারগুলি হস্তগত করিতে সমর্থ হইলাম না। তখন আমি অনন্যোপায় হইয়া উহার বুকের উপর বসিয়া জোর করিয়া উহার গলা টিপিয়া ধরিলাম; প্রিয়কে কহিলাম, উহার পা দুইখানি চাপিয়া ধর। প্রিয় তাহাই করিল, জোর করিয়া তাহার গলা চাপিয়া ধরাতে রাজকুমারী আর জোর করিতে পারিল না। দেখিতে দেখিতে তাহার প্রাণবায়ু বাহির হইয়া গেল। তখন আমরা উহার সমস্ত অলঙ্কার বাহির করিয়া লইয়া উহার গৃহের দরজা ভেজাইয়া রাখিয়া উহার গৃহ হইতে বাহির হইয়া আসিলাম। আমার ইচ্ছা ছিল উহাকে হত্যা করিয়া উহার যথাসর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া লইব; কিন্তু কার্য্যের গতিতে এবং লোভের বশবর্তী হইয়া, পরিশেষে আমি তাহাকে হত্যা করিয়া ফেলিলাম। 

এখন ত জানিতে পারিলেন যে, রাজকুমারীকে কে হত্যা করিয়াছে। এখন ত আপনি বুঝিতে পারিলেন যে, এই হত্যাকাণ্ডের কিছুই হরি অবগত নহে। এখন আপনি হরিকে অব্যাহতি প্রদান করুন, নির্দোষ হরিকে আর কষ্ট দিবেন না। এ খুন হরি করে নাই, হরির সে কার্য্য করিবার ক্ষমতাও নাই। বাড়ীর সকলে মিথ্যা কথা বলিয়া হরির সর্ব্বনাশ করিতে বসিয়াছে। এই মহাপাপের নায়িকা

আমি। আমার দ্বারাই এই মহাপাপ সম্পাদিত হইয়াছে। আমিই রাজকুমারীকে হত্যা করিয়াছি। এই মহাপাপের নিমিত্ত যে দণ্ড আপনারা আমার উপর বিধান করিবেন, আমি সে-ই দণ্ড গ্রহণ করিতে সম্মত আছি। 

“মহাশয়! আমি যেসব কথা আপনাদিগের নিকট স্বীকার করিলাম, তাহা আজ পর্য্যন্ত স্বীকার করিয়াছিলাম না, এবং কখনও করিতাম না; কিন্তু হরির উপর যেরূপ প্রমাণ সংগ্রহ হইয়াছে, দেখিতে পাইতেছ গহনা পাওয়া যাউক, আর না যাউক, তাহার ফাঁসি নিশ্চয়। এই ব্যাপার দেখিয়া আমার প্রাণ হু হু করিয়া কাঁদিয়া উঠিতেছে। আমার পাপে নির্দোষ হরির প্রাণ যায় দেখিয়া, মন একবারে অস্থির হইয়া পড়িতেছে! প্রবল পুত্রস্নেহ আসিয়া আমার মন অধিকার করিতেছে! পূর্ব্বে আমার যেরূপ মনের গতি ছিল, এখন আর তাহা নাই, উহা একবারে পরিবর্তিত হইয়া পড়িতেছে। হরির প্রাণ অপেক্ষা এখন আমার প্রাণকে নিতান্ত তুচ্ছ জ্ঞান করিতেছি। আমি আপনাকে বলিতেছি, যখন আপনি প্রকৃত দোষীকে প্রাপ্ত হইয়াছেন, তখন হরিকে আর নিরর্থক কষ্ট প্রদান করিতেছেন কেন? আমার সম্মুখে তাহাকে মুক্তি প্রদান করুন। তাহার কষ্ট আর আমি দেখিতে পারিতেছি না!” 

ত্রৈলোক্যের এই কথা শুনিয়া, সেই স্থানে যে সকল কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন, সকলেই একবারে বিস্মিত হইয়া পড়িলেন। বাড়ীর অপরাপর স্ত্রীলোকগণ, যাহারা ইতিপূর্ব্বে হরির বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছিল, তাহারা মস্তক অবনত করিয়া সেই স্থানে বসিয়া রহিল; এবং মধ্যে মধ্যে এক একবার বক্রদৃষ্টি করিয়া ত্রৈলোক্যকে দেখিতে লাগিল। 

আমি কহিলাম, “আপনার পুত্রকে বাঁচাইতে কে না চেষ্টা করিয়া থাকে? তুমি তোমার পুত্র হরিকে বাঁচাইবার নিমিত্ত যে এইরূপ মিথ্যা কথা কহিবে, তাহার আর আশ্চর্য্য কি? আমি যেরূপ প্রমাণ পাইতেছি, তাহাতে রাজকুমারী যে হরি কর্তৃক হত হইয়াছে, তাহা আমরা একরূপ স্থিরই করিয়া লইয়াছি। কিন্তু তুমি এখন বলিতেছ, সেই হত্যা হরির দ্বারা হয় নাই, তোমার দ্বারাই হইয়াছে। কেবল তোমার কথার উপর নির্ভর করিয়া, আমি কার্য্য করিতে পারি না। এই খুন যে তুমি করিয়াছ, তোমার নিজের কথা ব্যতীত তাহার আর প্রমাণ কি?—যে, সেই প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া, আমি হরিকে অব্যাহতি প্রদান করিতে পারি?” 

ত্রৈলোক্য। এই খুন যে আমি করিয়াছি তাহার যথেষ্ট প্রমাণ আছে। প্রথমতঃ এই কথা আমি সৰ্ব্বসমক্ষে মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিতেছি। দ্বিতীয়তঃ ওই প্রিয় ইহার সমস্ত অবগত আছে, উহাকে ঈশ্বরের দিব্য দিয়া জিজ্ঞাসা করুন; ও প্রকৃত কথা বলিলে, আপনাদিগের মনে আর কোনরূপ সন্দেহ থাকিবে না, আপনারা সমস্ত বিষয়ই জানিতে পারিবেন। আমার বিশ্বাস যে, প্রিয় এখন আমাকে বাঁচাইবার অভিপ্রায়ে আর মিথ্যা কথা কহিবে না। তৃতীয়তঃ, যে বিষমিশ্রিত সন্দেশের কিয়দংশ রাজকুমারীকে খাইতে দিয়াছিলাম, তাহার অবশিষ্ট সন্দেশ এখনও আমার আলমারির ভিতর আছে। যে সকল কর্মচারী আমার আলমারি অনুসন্ধান করিয়াছেন, তাহারা সকলেই সেই সন্দেশ দেখিয়াছেন। সেই সন্দেশ পরীক্ষা করিয়া দেখুন যে, উহাতে ধৃতুরা চূর্ণ আছে কি না। সিদ্ধির কাগজও বোধ হয়, এখনও আমার ঘরে পড়িয়া আছে। ইহা অপেক্ষা অধিক প্রমাণ আর কি চাহেন? 

আমি। অধিক প্রমাণ আর কিছুই চাহি না, যদি তুমি রাজকুমারীকে হত্যা করিয়া তাহার অলঙ্কারগুলি অপহরণ করিয়া থাক, তাহা হইলে সেই অপহৃত অলঙ্কারগুলি সর্ব্বসমক্ষে বাহির করিয়া দেও। তাহা হইলে বুঝিতে পারিব যে, এই হত্যা হরির দ্বারা হয় নাই, তোমার দ্বারাই এই হত্যা হইয়াছে। তখন হরিকে অব্যাহতি প্রদান করিতে আমাদিগের আর কিছু মাত্র আপত্তি থাকিবে না। 

ত্রৈলোক্য। উত্তম কথা, যদি ইহাতেও আপনারা আমার কথা বিশ্বাস না করেন, নির্দোষ হরিকে ছাড়িয়া না দেন, তাহা হইলে আপনারা আমার সঙ্গে আসুন, আমি সেই সকল অপহৃত অলঙ্কার বাহির করিয়া আপনাদিগের হস্তে অর্পণ করিতেছি। তাহা হইলে হরিকে ছাড়িয়া দিতে আপনাদিগের ত আর কোনরূপ আপত্তি থাকিবে না? 

আমি। তাহা হইলে আর আমাদিগের আপত্তি থাকিবে কেন? কিন্তু তুমি অলঙ্কারগুলি কোথায় রাখিয়াছ, বল দেখি। 

ত্রৈলোক্য। কোথায় আর রাখিব? আমার ঘরেতেই আছে। 

অপরাপর কর্ম্মচারীগণ। ঘরের কোথায় আছে? 

ত্রৈলোক্য। আমার ঘরে আলমারির মধ্যেই আছে। 

অপরাপর কর্ম্মচারীগণ। মিথ্যা কথা। সেই আলমারি আমরা প্রত্যেকেই এক একবার করিয়া দেখিয়াছি। উহার ভিতর সেই সকল অলঙ্কার কোনরূপেই থাকিতে পারে না। 

ত্রৈলোক্য। পারে, না পারে, তাহা লইয়া তর্ক করিবার প্রয়োজন নাই। আপনারা আমার সঙ্গে আসুন, দেখুন, সেই আলমারির ভিতর হইতে রাজকুমারীর সমস্ত অলঙ্কার আমি বাহির করিয়া দিতে পারি কি না। 

এই বলিয়া ত্রৈলোক্য আমাদিগের সকলের সমভিব্যাহারে তাহার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল, এবং আমাদিগকে কহিল “যে স্থানে আলমারিটি স্থাপিত আছে, সেই স্থান হইতে উহা একটু সম্মুখের দিকে সরাইয়া দিন।” এই কথা বলিবামাত্র, সেই আলমারি আমার প্রায় এক হস্ত সম্মুখ ভাগে সরাইয়া দিলাম। ত্রৈলোক্য সেই আলমারির পশ্চাৎ ভাগে গমন করিয়া, উহার পশ্চাদ্ভাগে যে একটি দেরাজের মত অংশ ছিল, তাহা খুলিয়া, তাহার মধ্য হইতে রাজকুমারীর সমস্ত অলঙ্কারগুলি বাহির করিল, এবং আমাদিগের হস্তে প্রদান করিল। এই ব্যাপার দেখিয়া কৰ্ম্মচারী মাত্রেই, একবারে বিস্মিত হইয়া পড়িলেন; কারণ তাঁহারা প্রত্যেকেই সেই আলমারি এক একবার অনুসন্ধান করিয়াছিলেন। 

সেই আলামারির ভিতর হইতে কর্ম্মচারীগণ যে সেই সকল অলঙ্কার পূর্ব্বে বাহির করিতে পারেন নাই, তাহাতে তাঁহাদিগের কিছুমাত্র দোষ ছিল না। কারণ সেই আলমারির নির্ম্মাণ স্বতন্ত্ররূপ ছিল। আলমারির সর্ব্ব-উপরিস্থিত তক্তার ছয় ইঞ্চি নিম্নে অথচ কার্ণিসের ভিতরে আর একখানি তক্তা এরূপ ভাবে বসান ছিল যে, ভিতর হইতে দেখিলে বোধ হইত, সেই তক্ততা খানিই আলমারির সর্ব্ব উপরের তক্তা। উপরের তক্তা খানি যেরূপ ভাবে কার্ণিসের সহিত আবদ্ধ থাকে, উহাও ঠিক সেইরূপ ভাবে সম্মুখ হইতে আবদ্ধ ছিল; কিন্তু আলমারির কার্ণিসের মধ্যে উপর্যুপরি দুই খানি তক্তার ভিতর দুই ইঞ্চি পরিমিত ব্যবধান ছিল। তাহার ভিতর দ্রব্যাদি রাখিবার বা উহা হইতে দ্রব্যাদি বাহির করিয়া লইবার নিমিত্ত আলমারির পশ্চাৎ ভাগে একটি দরজা ছিল। একখানি কাষ্ঠে উহা এরূপ আড়ভাবে বসান ছিল যে, পশ্চাৎ হইতে দেখিলেও কেহ সহজে বুঝিতে পারিতেন না যে, উহার মধ্যে একটি দেরাজের মত স্থান আছে। সেই এড়ো কাষ্ঠ খানি আলমারির যে পার্শ্বে শেষ হইয়াছে, সেই পার্শ্বে সেই কাষ্ঠের গায়ে একটু সামান্য ফাটা দাগ ছিল মাত্র। সেই দাগের ভিতর নখ বসাইয়া এক পার্শ্বে সরাইয়া দিলে সেই এড়ো কাষ্ঠ খানি সরিয়া যাইত; সুতরাং সেই দেরাজের মুখ ফাঁক হইয়া পড়িত। তখন তাহার মধ্যে ইচ্ছানুযায়ী দ্রব্য রাখিয়া দিয়া বা তাহা হইতে কোন দ্রব্য বাহির করিয়া লইয়া, সেই এড়ো কাষ্ঠ সরাইয়া দিলে ঠিক আপন স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইত। তখন উহার মধ্যে দ্রব্যাদি রাখিবার যে একটি স্থান আছে, তাহা আর কাহারও অনুমান করিবার সাধ্য থাকিত না। 

পরিশেষে দেখা গেল যে, ত্রৈলোক্য আপন পুত্রকে বাঁচাইবার নিমিত্ত যাহা যাহা বলিয়াছে, তাহার সমস্তই প্রকৃত। সন্দেশে বাস্তবিকই বিষ পাওয়া গেল, তাহার ঘর অনুসন্ধান করিয়া, কিছু সিদ্ধির সহিত একখানি কাগজও বাহির হইল। প্রিয়ও পরিশেষে সমস্ত কথা স্বীকার করিয়া, তাহার বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিল। তখন আমরা হরিকে অব্যাহতি প্রদান করিলাম, এবং বন্দীরূপে ত্রৈলোক্যকে মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট পাঠাইলাম। মাজিষ্ট্রেট সাহেব তাহার বিপক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণাদি গ্রহণ করিয়া, বিচারার্থ তাহাকে হাইকোর্টে প্রেরণ করিলেন। 

এই সময় ত্রৈলোক্য আমাদিগের জুয়াচুরি বুঝিতে পারিয়াছিল। সেই সময় সে আমাকে এক দিবস কহিল, “এত দিবসের মধ্যে আমি কখনও কাহারও কথায় ভুলি নাই, বা কাহারও কৌশলে কখনও পতিত হই নাই; কিন্তু আপনার কৌশল-জাল আমি ছিন্ন করিতে পারিলাম না। সেই সময় আমি একবার স্বপ্নেও ভাবি নাই যে, আপনি আমার মত শঠের উপরেও শঠতা বিস্তার করিয়াছেন। এখন আমি জানিতে পারিয়াছি যে, সেই সময় আপনি যাহা করিয়াছিলেন, তাহার সমস্তই আপনার চাতুরী। আপনি বাড়ীর সমস্ত লোককে শিখাইয়া, আমাকে চাতুরী-জালে জড়ীভূতা করিবার মানসেই তাহাদিগের দ্বারা মিথ্যা কথা বলাইয়াছিলেন, এবং প্রকাশ্যরূপে সকলকেই দেখাইয়াছিলেন যে, আমার নির্দোষ পুত্র হরিই এই ভয়ানক অপরাধে অপরাধী, সে-ই রাজকুমারীর প্রাণহস্তা। উঃ আপনাদিগের কি ভয়ানক চাতুরী! কি ভয়ানক কৌশল!! যদি আমি সেই সময় আপনার ভয়ানক চাতুরী জালে না পড়িতাম, পুত্রস্নেহের ভয়ানক পীড়নে পীড়িত না হইতাম, এবং আপনার ভয়ানক কৌশলে আমি হতবুদ্ধি না হইয়া রাজকুমারীর অপহৃত অলঙ্কারগুলি আমার আলমারির ভিতর হইতে বাহির করিয়া আপনাদিগের হস্তে প্রদান না করিতাম, তাহা হইলে আজ আমি যে ভয়ানক অবস্থায় পড়িয়াছি, সেইরূপ অবস্থায় কখনই পতিত হইতাম না। আপনারা সকলে মিলিয়া আমার আলমারি অনুসন্ধান করিয়াছিলেন; কিন্তু উহার ভিতর হইতে রাজকুমারীর অপহৃত অলঙ্কারগুলি কোনরূপেই বাহির করিতে সমর্থ হন নাই এবং আমার বিশ্বাস যে, আপনারা বিধিমত চেষ্টা করিলেও সেই গহনার কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিতেন না। কেবল আমিই আমার সর্ব্বনাশ সাধন করিয়াছি, আমিই আমার নিজের পায়ে সবলে কুঠারাঘাত করিয়াছি। যদি আপনারা সেইরূপ কৌশলজালে আমাকে নিপাতিত না করিয়া, আমার নিকট হইতে সেই সকল অলঙ্কারগুলি বাহির করিয়া লইতে সমর্থ না হইতেন, তাহা হইলে আপনারা আমার কিছুই করিয়া উঠিতে পারিতেন না; পূর্ব্বে যেরূপ অসংখ্য হত্যা করিয়া, অসংখ্য স্ত্রীলোকের সর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া, বিনা-দণ্ডে নিষ্কৃতি লাভ করিয়াছিলাম, এ যাত্রাও আমি সেইরূপ ভাবে আপন জীবন রক্ষা করিতে সমর্থ হইতাম; আপনারা বিধিমতে চেষ্টা করিয়াও, আমার মস্তকের এক গাছি কেশও উৎপাটিত করিতে সমর্থ হইতেন না। যে পর্য্যন্ত আমি আপন মুখ খুলি নাই, সেই পৰ্য্যন্ত প্রিয়ও কোন কথা বলে নাই; এবং সহজে সে কোন কথা প্রকাশও করিত না। প্রিয় মনে মনে জানিত, আমি রাজকুমারীর যে সকল অলঙ্কার অপহরণ করিয়াছিলাম, সেই সকল অলঙ্কার আমি একাকী কখনই গ্রহণ করিব না। তুল্যাংশ না হউক, সে যে উহার কোন না কোন অংশ প্রাপ্ত হইত, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ ছিল না। বিশেষতঃ রাজকুমারীকে হত্যার নিমিত্ত আমিও যেরূপ দোষে দোষী, তাহার অপরাধও আমার সেই দোষ অপেক্ষা কোন অংশে ন্যূন নহে। সে বেশ জানিত এই কথা তাহার মুখ দিয়া প্রকাশ পাইলে, আমার দশা এবং তাহার দশা সমানই হইবে, তখন সে কোনরূপেই এই সকল কথা আপনাদিগের নিকট প্রকাশ করিত না। কিন্তু যখন সে দেখিল যে, আমি সমস্ত গুহ্য কথা প্রকাশ করিয়া ফেলিলাম, তখন সে বুঝিল যে, সমস্ত কথা প্রকাশ করিয়া দেওয়া তাঁহার পক্ষেও মঙ্গল। কারণ, যখন তাহাকেও আমার সহিত ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলিতে হইবে, তখন যদি সমস্ত কথা প্রকাশ করিয়া কোনরূপে সে আপনাদিগের অনুগ্রহ প্রার্থী হইতে পারে, তাহা সে না করিবে কেন? প্রকৃত কথা বলিলে আপনারা তাহার জীবন রক্ষা করিবেন, এই কথা যখন আপনারা সকলে মিলিয়া তাহাকে বুঝাইলেন, তখন সে তাহার অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রকৃত কথা কহিল। আর প্রকৃত কথা না বলিলেই বা তাহার উপায় কি? আপনাদিগের কথা শুনিয়া সে সমস্ত প্রকৃত কথা প্রকাশ করিয়া দিয়াছিল বলিয়াই, আজ আপনারা তাহার জীবন রক্ষা করিলেন, সে কেবল মাত্র আমার বিপক্ষে সাক্ষ্য দিয়া পরিত্রাণ পাইল। নতুবা আজ আমার যে দশা, তাহারও ঠিক সেই দশা ঘটিত। এই কার্য্যের নিমিত্ত আমি প্রিয়কে দোষ দিই না, বরং তাহার বুদ্ধিরই প্রশংসা করি। কারণ, আপনাদিগের কথা শুনিয়া, এই একমাত্র উপায় অবলম্বন না করিলে, তাহার আর কোনরূপেই বাঁচিবার উপায় ছিল না। আর আপনারাও যে, আমাকে ভয়ানক কৌশল- জালে ফেলিয়া আমার নিকট হইতে সমস্ত কথা বাহির করিয়া লইয়াছিলেন, তাহার নিমিত্তও আমি আপনাদিগের উপর কোনরূপ দোষার্পণ করি না।। কারণ দোষীগণকে দণ্ড দেওয়াই আপনাদিগের কার্য্য। 

“হরি যে নিরপরাধ, তাহা আপনারা পূর্ব্ব হইতেই জানিতেন, আপনারা কৌশল-জাল বিস্তার করিয়া, বাড়ীর সমস্ত লোকদিগের দ্বারা মিথ্যা কথা বলাইয়া, হরি যে এই ভয়ানক হত্যা করিয়াছে তাহা লোক-দেখান মত প্রমাণ করিতেছিলেন সত্য; কিন্তু বলুন দেখি, যদি আমার নিকট হইতে প্রকৃত কথা প্রাপ্ত না হইতেন, তাহা হইলে নিরপরাধ হরিকে মিথ্যা করিয়া কি কখনও ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলাইতে পারিতেন? কখনই না, বাধ্য হইয়া আপনারা হরিকে যে নিশ্চয়ই ছাড়িয়া দিতেন, তাহার আর কিছু মাত্র সন্দেহ নাই। নিজ বুদ্ধির দোষে যাহা করিয়া ফেলিয়াছি, তাহার নিমিত্ত এখন আর পরিতাপ করিলে ফল কি? এ পর্যন্ত যে সকল মহাপাপ করিয়াছি, তাহার উপযুক্ত দণ্ড পাওয়াই আমার সৰ্ব্বতোভাবে কৰ্ত্তব্য।” 

যাহা হউক, হাইকোর্টে জজসাহেব জুরির সাহায্যে ত্রৈলোক্যের বিচার করিলেন। বিচার কালে যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, এবং বিচার ফল যাহা হইয়াছিল, তাহা স্বতন্ত্র করিয়া বর্ণন করিবার আর আমার প্রয়োজন নাই। 

[আশ্বিন, ১৩০৫] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *