রাজা সাহেব ২

রাজা সাহেব (শেষ অংশ) 

নবম পরিচ্ছেদ

টাকা জমা 

মন্ত্রী মহাশয় সেক্রেটারীকে কহিলেন, “আপনি যেরূপ অবস্থায় পতিত হইয়াছেন, তাহা আমি বেশ বুঝিতে পারিয়াছি, তাহার নিমিত্ত বিশেষ ক্ষতি হইবে না, আমি একরূপ বন্দোবস্ত করিয়া দিব।” তৎপরে দাওয়ানজী মহাশয়কে কহিলেন, “আপনি একখানি আদেশপত্র লিখিয়া প্রস্তুত করিয়া রাখুন, রাজা মহাশয় আগমন করিবামাত্র উহাতে তাঁহার স্বাক্ষর করাইয়া দিব। আর সেক্রেটারী বাবু যে টাকা জমা দিতেছেন, তাহার নিমিত্ত একখানি পাঁচ হাজার টাকা রসিদ লিখিয়া প্রস্তুত করুন, এবং ইঁহাকে এখনই যে লক্ষ টাকা প্রদান করিতে হইবে, তাহারও একখানি রসিদ প্রস্তুত হউক। রাজা মহাশয় আগমন করিবামাত্র যত শীঘ্র পারি, সমস্ত কার্য্য শেষ করিয়া লইব।” 

মন্ত্রী মহাশয়ের কথা শ্রবণ করিয়া দাওয়ানজী মহাশয় তৎক্ষণাৎ তাঁহার আদেশ প্রতিপালন করিলেন, এবং সমস্ত কাগজপত্র প্রস্তুত করিয়া রাজা মহাশয়ের প্রত্যাশায় বসিয়া রহিলেন। 

সময়-মত রাজা মহাশয় দরবার গৃহে আগমন করিয়া উপবেশন করিলেন ও অপরাপর রাজকার্য্যের অনেক কথাবার্তার পর কহিলেন, “পাট ক্রয় করিবার জন্য সেক্রেটারী মহাশয় অদ্যই গমন করিতে সমর্থ হইবেন কি?”

মন্ত্রী। সেক্রেটারী মহাশয় প্রস্তুত হইয়াই আসিয়াছেন। এখন আপনার আদেশ প্রাপ্ত হইলেই গমন করেন।

রাজা। ডিপজিটের টাকা জমা হইয়া গিয়াছে? 

মন্ত্রী। এখনও জমা হয় নাই। জমা দিবার অভিপ্রায়ে সেক্রেটারী মহাশয় টাকা সঙ্গে করিয়া আনিয়াছেন, আপনার আদেশ হইলে এখনই জমা করিয়া দেন। 

রাজা। টাকা জমা করিয়া দেওয়া হউক। দাওয়ানজী মহাশয়! আপনি টাকা জমা করিয়া লউন। 

মন্ত্রী। সেক্রেটারী মহাশয়! আর বিলম্বে প্রয়োজন নাই, টাকাগুলি জমা করিয়া দিউন। 

এই কথা শ্রবণ করিয়া এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয় কতকগুলি নোট বাহির করিয়া মন্ত্রী মহাশয়ের হস্তে প্রদান করিলেন। মন্ত্রী মহাশয় উহা দেখিয়া লইয়া রাজা মহাশয়ের হস্তে অর্পণ করিলেন, এবং দাওয়ানজী মহাশয়কে কহিলেন, “সাড়ে চারি হাজার টাকা সেক্রেটারী বাবুর নামে জমা করিয়া লউন।” রাজা মহাশয় উক্ত নোটগুলি গ্রহণ করিয়া গণিয়া আপনার ক্যাসবাক্সের ভিতর বন্ধ করিয়া রাখিলেন ও কহিলেন, “আর পাঁচশত টাকা?” 

মন্ত্রী। সেক্রেটারী মহাশয় আর পাঁচ শত টাকা সংগ্রহ করিয়া উঠিতে পারেন নাই।

রাজা। এই সরকারে যে নিয়ম আছে, তাহার অন্যথাচরণ আমি কিরূপে করিতে পারি? 

মন্ত্রী। নিয়মের অন্যথাচরণ করিতে আমি বলিতে পারি না। কিন্তু যখন কেবলমাত্র পাঁচশত টাকা সংগৃহীত হয় নাই; তখন সাড়ে চারি হাজার টাকা ফিরাইয়া দিলে সেক্রেটারী মহাশয়ের অবমাননা করা হয়। ইনি অপর কার্য্যের নিমিত্ত এইস্থানে আগমন করিয়াছেন; সুতরাং এত টাকা সঙ্গে করিয়া আনিবার ইঁহার কিছুমাত্র প্রয়োজন ছিল না। পূর্ব্বে যদি ইনি জানিতে পারিতেন, ইঁহার হস্তে এইরূপ কার্য্যের ভার অর্পিত হইবে, তাহা হইলে পাঁচ হাজার কেন, দশ হাজার টাকা সঙ্গে করিয়া আনিতে পারিতেন। এরূপ অবস্থায় রাজ-সরকারের নিয়ম ভঙ্গ করিতে যদি মহারাজ একান্তই অসম্মত হয়েন, তাহা হইলে সেক্রেটারী মহাশয় বক্রী পাঁচ শত টাকার নিমিত্ত একখানি হ্যাণ্ডনোট লিখিয়া দিতেছেন, তাহা হইলেই রাজ-সরকারের নিয়ম রক্ষা হইল; অথচ এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারীর মান রক্ষা হইল। 

মন্ত্রী মহাশয়ের কথা শ্রবণ করিয়া রাজা মহাশয় যেন একটু অপ্রতিভ হইলেন ও কহিলেন, “আপনার বিবেচনায় বক্রী পাঁচশত টাকার হ্যাঙনোট লিখিয়া লইলে যদি রাজসরকারের নিয়ম ভঙ্গ করা না হয়, তাহা হইলে আমার আর কোনরূপ আপত্তি নাই।” এই বলিয়া আপনার ক্যাসবাক্স খুলিয়া পূর্ব্ববর্ণিতরূপ এক তাড়া নোট বাহির করিলেন। করেন্সী আফিস হইতে নূতন নোটের তাড়া বাহির হইবার সময় যেরূপ ভাবে লাল সূতার দ্বারা সেলাই করা থাকে, ইহাও সেরূপ ভাবে সেলাই করা। সুতরাং বোধ হইল যে, উহার মধ্যে একশতখানি করেন্সী নোট আছে। তাড়ার উপরের যে নোটখানি দেখা যাইতেছিল, তাহা একখানি হাজার টাকার নোট বলিয়া বোধ হইল। 

রাজা মহাশয় উক্ত নোটের তাড়া আপনার ক্যাসবাক্স হইতে বাহির করিয়া সেইস্থানেই রাখিয়া দিলেন, এবং মন্ত্রী মহাশয়কে কহিলেন, “আপনাদিগের লেড়াপড়া শেষ হইলে এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয়কে এই লক্ষ টাকা প্রদান করিয়া এখনি বিদায় করিয়া দিউন। কারণ, আজ রাত্রিকালেই পাট ক্রয় করিবার নিমিত্ত ইহাঁকে গমন করিতে হইবে।” রাজা মহাশয় ও মন্ত্রী মহাশয়ের মধ্যে যে কথা হইল, তাহা শুনিয়া ও লক্ষ টাকার নোটের তাড়া সম্মুখে দেখিয়া, এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয় বক্রী পাঁচশত টাকার হ্যাণ্ডনোট লিখিয়া দিতে সম্মত হইলেন। 

মন্ত্রী মহাশয়ের আদেশমত দাওয়ানজী মহাশয় আবশ্যক-মত লেখাপড়া করিতে আরম্ভ করিলেন। এদিকে রাজা মহাশয় এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয়কে নানাপ্রকার উপদেশ দিয়া কিরূপে কত পার্ট ক্রয় করিতে হইবে, কত দিবসের মধ্যে পাট ক্রয় শেষ হওয়া আবশ্যক, এই সকল বিষয় পরিষ্কাররূপে বুঝাইয়া দিতে লাগিলেন। 

দরবার গৃহে বসিয়া সকলেই যখন এইরূপ ভাবে আপন আপন কৰ্ম্মে ব্যস্ত আছেন, সেই সময়ে অন্তঃপুরের মধ্য হিইতে হঠাৎ এক ভয়ানক গোলযোগ উত্থিত হইল। এই গোলযোগ শুনিয়া রাজা মহাশয় অতিশয় বিস্মিত হইলেন; সেক্রেটারী বাবুকে দিবার নিমিত্ত যে নোটের তাড়া বাহির করিয়া রাখিয়াছিলেন, তাহা আপনার ক্যাসবাক্সের ভিতর রাখিয়া উহাতে চাবি বন্ধ করিয়া গাত্রোত্থান করিলেন, এবং কি হইয়াছে, তাহা অবগত হইবার নিমিত্ত দ্রুতপদে অন্তঃপুরের ভিতর প্রবেশ করিলেন। ক্যাসবাক্সবাহীও ক্যাসবাক্স আপন হস্তে উঠাইয়া লইয়া রাজা মহাশয়ের পশ্চাৎ পশ্চাৎ অন্তঃপুরের ভিতর প্রবেশ করিল। 

অন্তঃপুরের ভিতর গোলযোগ ক্রমেই বৃদ্ধি হইতে লাগিল। হঠাৎ কিসের গোলযোগ উত্থিত হইল, তাহা জানিবার নিমিত্ত দরবারস্থিত সমস্ত লোকই ক্রমে অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। মন্ত্রী মহাশয়, দাওয়ানজী মহাশয় প্রভৃতি ক্রমে ক্রমে সকলেই দরবার গৃহ পরিত্যাগ করিয়া কিসের গোলযোগ, তাহা জানিবার নিমিত্ত, অন্তঃপুরের দিকে গমন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। কিন্তু রাজার বিনা-আদেশে কেহই অন্তঃপুরের ভিতর প্রবেশ করিতে না পারিয়া, নিতান্ত চিন্তিতান্তঃকরণে সকলেই সেইস্থানে দণ্ডায়মান রহিলেন। ইচ্ছা-অন্দরের দাস-দাসী প্রভৃতি কাহাকেও দেখিতে পাইলে জিজ্ঞাসা করিবেন যে, অন্দরের ভিতর কিসের গোলযোগ উপস্থিত হইয়াছে। কিন্তু তাঁহাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইল না। কারণ, দাস-দাসী প্রভৃতি কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না। এদিকে অন্তঃপুরের ভিতরে সেই গোলযোগ ক্রমেই বৃদ্ধি হইতে লাগিল; সুতরাং সকলেই বড় উৎকুণ্ঠিত হইয়া পড়িলেন। 

সেই সময় মন্ত্রী মহাশয় কহিলেন, “রাজা মহাশয়ের অন্তঃপুরের ভিতর যখন এরূপ গোলযোগ হইতেছে, তখন নিশ্চয়ই বিশিষ্ট কোন বিপদ ঘটিয়াছে। এরূপ অবস্থায় আমি আর স্থির থাকিতে পারি না; কি হইয়াছে, তাহা অন্তঃপুরের ভিতর গিয়া দেখিয়া আসি।” এই বলিয়া মন্ত্রী মহাশয় যেমন অন্তঃপুরের ভিতর গমন করিবার উদ্যোগ করিতেছেন, এরূপ সময় সেই ক্যাসবাক্স-বাহী দ্রুতবেগে অন্দর মহল হইতে বহির্গত হইয়া মন্ত্রী মহাশয়কে কহিল, “সৰ্ব্বনাশ হইয়াছে! কুমার বাহাদুর উপরের বারান্দা হইতে পড়িয়া গিয়াছেন। বোধ হইতেছে যে, তাঁহার হস্তপদ চূর্ণ হইয়া গিয়াছে, একজন ডাক্তার আনিবার নিমিত্ত কাহাকেও শীঘ্র পাঠাইয়া দিন।” 

এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র দাওয়ানজী মহাশয় কহিলেন, “আমি এখনই ডাক্তার লইয়া আসিতেছি।” এই বলিয়া কাগজ পত্র তাঁহার বাক্সের ভিতর বন্ধ করিয়া দ্রুতপদে বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গেলেন। 

দাওয়ানজী মহাশয় বাড়ী হইতে বহির্গত হইবার অতি অল্প সময় পরেই একখানি ব্রুহাম গাড়ী রাজবাটীর ভিতর প্রবেশ করিল। গাড়ী দেখিয়া সকলেই কহিলেন, “ডাক্তার আসিয়াছেন, আর ভয় নাই।” 

গাড়ীখানি একবারে অন্তঃপুরের ভিতর প্রবেশ করিল, এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে আরও একখানি গাড়ী আসিয়া উপনীত হইল; কিন্তু তৎক্ষণাৎ উভয় গাড়ীই পুনরায় বাড়ীর বাহির হইয়া গেল। গাড়ী বাহির হইয়া যাইবার সঙ্গে সঙ্গে অন্তঃপুরের গোলযোগও একবারে কমিয়া গেল। সেই সময় যে সকল ভৃত্য অন্তঃপুরের ভিতর ছিল তাহার মধ্যে কোন কোন ব্যক্তি বাহিরে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহাদিগের মুখে সকলেই জানিতে পারিলেন যে, যে সময় রাজা মহাশয় দরবার গৃহে বসিয়াছিলেন, সেই সময় অন্তঃপুরের ভিতর তাঁহার এক বৎসর বয়স্ক একমাত্র কুমার বাহাদুর উপরের বারান্দায় খেলা করিতেছিলেন। খেলা করিতে করিতে বালক হঠাৎ কিরূপে নিম্নে পড়িয়া যায়, এবং তাহাতে সাংঘাতিকরূপে আঘাত প্রাপ্ত হয়। তাহার এখনও কোনমতে চেতনা সঞ্চার হয় নাই। ডাক্তার সাহেব আসিয়া উহাকে দর্শন করিবামাত্র উপদেশ দেন যে, এইস্থানে এই বালককে রাখিলে কোনরূপেই ইহার চিকিৎসা হইবে না। ইহাকে এখনই হাঁসপাতালে লইয়া যাওয়া আবশ্যক। এই বলিয়া ডাক্তার সাহেব নিজেই তাহাকে ক্রোড়ে করিয়া আপন গাড়ীতে উঠাইয়া লয়েন। রাজা মহাশয়ও ডাক্তার সাহেবের সহিত তাঁহার গাড়ীতে এবং রাণী ও এই বাটীর অপরাপর স্ত্রীলোকগণ সকলেই অপর আর একখানি গাড়ীতে উঠিয়া, এই বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছেন। 

এই সকল কথা শ্রবণ করিয়া সকলেই অতিশয় দুঃখিত হইলেন। কাহার কাহারও চক্ষু দিয়া অশ্রুজল নির্গত হইল। কেহ হাসপাতালে যাইবার নাম করিয়া বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গেল। সেই সময় মন্ত্রী মহাশয় এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয়কে কহিলেন, “হঠাৎ কি ভয়ানক বিপদ উপস্থিত হইল দেখিলেন! আমি এই স্থানে আর অপেক্ষা করিতে পারিতেছি না। আপনিও অদ্য গমন করুন, কল্য আগমন করিবেন। সেই সময় আপনার পার্ট ক্রয় করিতে যাইবার বন্দোবস্ত করিয়া দিব।” এই বলিয়া মন্ত্রী মহাশয় দ্রুতপদে বাহির হইয়া গেলেন। এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবুও নিতান্ত চিন্তিত অন্তঃকরণে আপন বাসায় প্রত্যাগমন করিলেন। 

দশম পরিচ্ছেদ

নূতন বিপদ –অপার ভাবনা 

পরদিবস নিয়মিত সময়ে এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয় পুনরায় রাজবাড়ীতে গমন করিলেন। অপরাপর দিবস রাজবাড়ীতে গমন করিলে তথায় সে লোকদিগকে দেখিতে পাইতেন, আজ আর তাহাদিগের কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না। বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার সময় একজন পরিচারকের সহিত সাক্ষাৎ হইল মাত্র। তাহাকে দেখিয়া এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “কুমার কেমন আছেন, কোন সংবাদ পাইয়াছ কি? রাজা সাহেব এখন কোথায় আছেন?” চাকর কোন প্রকার উত্তর প্রদান করিয়া বিষন্নবদনে দরবার গৃহ দেখাইয়া দিল। এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবুও তাহাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া এবং অপর কাহাকেও দেখিতে না পাইয়া পূর্ব্বপরিস্থিত সেই দরবার গৃহে গিয়া উপস্থিত হইলেন। 

সেক্রেটারী বাবু দেখিলেন, আজ দরবার গৃহ শূন্য। লোকজন প্রভৃতি আজ কেহই সে গৃহে নাই, কেবলমাত্র মন্ত্রী মহাশয় একাকী নিতান্ত বিষণ্ণবদনে বসিয়া রহিয়াছেন এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবুকে দেখিয়া মন্ত্রী মহাশয় তাঁহাকে বসিতে কহিলেন। তিনি সেইস্থানে উপবেশন করিবা মাত্র মন্ত্রী মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কুমার বাহাদুর কেমন আছেন? তিনি ভাল আছেন ত?” 

উত্তরে মন্ত্রী মহাশয় কহিলেন, “কুমার বাহাদুরের কথা আর জিজ্ঞাসা করিবেন না। জানি না, জগদীশ্বর কি কারণে আমাদিগের উপর নিতান্ত নির্দয় হইয়া গত রজনীতে কুমার বাহাদুরকে লইয়া গিয়াছেন। সেই শোকে সকলেই বিহ্বল হইয়া পড়িয়াছেন, এই নিমিত্ত আজ আপনি আর কাহাকেও এখানে দেখিতে পাইতেছেন না। কেবল যে আমাকে দেখিতেছেন, সেও কেবল আপনার নিমিত্ত। অদ্য আপনার এইস্থানে আগমন করিবার কথা ছিল; আপনি আগমন করিয়া কাহাকেও দেখিতে না পাইলে মনে কি ভাবিবেন? এই বিবেচনায় আপনার অপেক্ষায় আমি এই স্থানে বসিয়া রহিয়াছি। এই ভয়ানক বিপদের পর আমি আর রাজা মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ করিতে পারি নাই, বা আপনাকে যে টাকা প্রদান করিতে হইবে, তাহাও তাঁহার নিকট হইতে চাহিয়া লইতে সমর্থ হই নাই। এদিকে আপনি যদি সেইস্থানে গমন করিতে বিলম্ব করেন, তাহা হইলেও বিশেষরূপে কার্য্যের ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা। এরূপ অবস্থায় কি করা কৰ্ত্তব্য, তাহা আমি কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না।” 

সেক্রেটারী। আপনি যাহা কহিলেন, তাহা সত্য। যে কাৰ্য্যে আমাকে গমন করিতে হইতেছে, যত বিলম্বে সেই কার্য্যে গমন করিব, ততই কার্য্যের ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা। পাট আমদানীর সময় প্রায় শেষ হইয়া আসিতেছে। আরও দশ পাঁচ দিবসের মধ্যে একরূপ আমদানী হইবে, পরে কিন্তু কম পড়িয়া আসিবে। আমদানী কমিয়া গেলে, এত পাট ক্রয় একবারেই অসম্ভব হইয়া পড়িবে। 

মন্ত্রী। আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা ঠিক। বিলম্বে যে সবিশেষ ক্ষতি হইবে, তাহা আমি এইস্থানে বসিয়াই বেশ বুঝিতে পারিতেছি। আমদানী কমিয়া গেলে পাটের মূল্য অধিক হইবারই সম্ভাবনা। তদ্ব্যতীত আমাদিগের প্রয়োজনীয় সকল পাটই যে পাওয়া যাইবে, তাহারই বা ভরসা কি? যে পরিমাণ পাটের সাটা মহারাজ গ্রহণ করিয়াছেন, তাহার সমস্ত যদি তিনি প্রদান করিতে না পারেন, তাহা হইলে তাঁহার পক্ষে কি অপমান, তাহা একবার ভাবুন দেখি? আমার বিবেচনায় আপনি আর বিলম্ব করিবেন না, অদ্যই পার্ট ক্রয় করিবার স্থানে গমন করুন। সেইস্থানে গমন করিয়াই কিছু পাট ক্রয় করিতে পারিবেন না। আপনাদিগের থাকিবার স্থান ঠিক করিতে, পাট ক্রয় করিবার নিমিত্ত আপনাকে সাহায্য করিতে পারে, এরূপ লোকজন সংগ্রহ করিতে, এবং পাট ক্রয় করিয়া আপাততঃ তাহা কোথায় রাখিবেন, তাহার বন্দোবস্ত করিতে অভাব পক্ষে আপনার দুই তিন দিবস অতীত হইয়া যাইবে। যে পর্য্যন্ত এই সকল বন্দোবস্ত ঠিক না হইবে, সেই পর্যস্ত পার্ট ক্রয় আরম্ভ করিতে সমর্থ হইবেন না। আপনি অদ্যই গমন করিয়া এই সকল বিষয় স্থির করিয়া লউন। এদিকে মহারাজার শোকাবেগও একটু কমিয়া যাউক। যেমন তিনি একটু প্রকৃতিস্থ হইবেন, অমনি আমি তাঁহার নিকট হইতে টাকা চাহিয়া লইয়া আপনার নিকট পাঠাইয়া দিব। আর দুই তিন দিবসের মধ্যে যদি তাঁহাকে কোন কথা বলিবার সুযোগ নাই পাই, তাহা হইলেও আপনি টাকা পাইবেন। আমাদিগের হস্তে যে সকল তহবিল আছে, তাহা হইতে কোন খরচ না করিলে দুই তিন দিবসের মধ্যে লক্ষ টাকা জমিয়া যাইবে। রাজা মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ না হইলে তাঁহার বিনা অনুমতিতে আমি সেই টাকা পাঠাইয়া দিতে পারিব। অতএব সে বিষয়ে কিছুমাত্র চিত্তা নাই আপনি আর কালবিলম্ব করিবেন না, অদ্যই এইস্থান হইতে গমন করিয়া যাহাতে সুচারুরূপে কার্য্য-নিৰ্ব্বাহ করিতে পারিবেন, তাহার বন্দোবস্ত করুন। 

মন্ত্রী মহাশয়ের কথা শ্রবণ করিয়া এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয় আর কালবিলম্ব করিতে পারিলেন না। তাঁহার প্রস্তাবে মত দিয়া, সেই দিবসই কলিকাতা পরিত্যাগ করিবেন, এই রূপ বলিয়া মন্ত্রী মহাশয়ের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিলেন। যাইবার সময় তাঁহার নিজের কার্য্যের বিষয় মন্ত্রী মহাশয়কে একবার কহিলেন। উত্তরে মন্ত্রী মহাশয় বলিলেন, “তাহার নিমিত্ত আপনাকে আর কোন কথা বলিতে হইবে না। আপনি আপনার রাজা মহাশয়কে পত্ৰ লিখিয়া দিউন। যে দিবস তিনি আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন, সেই দিবসই আমি তাঁহার কার্য্য শেষ করিয়া দিব।” 

বলা বাহুল্য, পাট ক্রয় করিতে প্রবৃত্ত হইবার পূর্ব্বে যে সকল বন্দোবস্ত করিবার প্রয়োজন, সেই সকল বন্দোবস্ত করিয়া লইবার নিমিত্ত এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবু সেইদিবস রাত্রিতেই কলিকাতা পরিত্যাগ করিলেন। কলিকাতা পরিত্যাগ করিবার পূর্ব্বে তাঁহার মনিবকে এক পত্র লিখিয়া জানাইলেন যে, টাকার সমস্তই ঠিক হইয়া গিয়াছে। তাঁহার পরিচিত জনৈক উকীলের বাড়ীতে দলিল লেখাপড়া হইতেছে। এক মাসের মধ্যে কলিকাতায় আসিয়া যে দিবস সেই দলিল তিনি রেজেষ্টারী করিয়া দিবেন, সেই দিবসই টাকা প্রাপ্ত হইবেন। রাজা মহাশয়কে যেরূপভাবে পত্র লিখিলেন, তাঁহার সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারীকেও সেইরূপ ভাবে আর এক পত্র লিখিলেন। অধিকন্তু তাঁহাকে এই লিখিয়া দিলেন যে, রাজা মহাশয়ের কলিকাতায় আগমনের দিবস স্থির হইলে, তারযোগে যেন তাঁহাকে পূর্ব্বে সংবাদ প্রদান করা হয়। 

এদিকে এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবু তাঁহার ভ্রাতার সহিত এইরূপ বন্দোবস্ত করিয়া গেলেন যে, তাঁহার নামে যে সকল পত্রাদি আসিবে, তাহা তিনি খুলিয়া পাঠ করিবেন। তাহার মধ্যে যদি কোন বিশেষ প্রয়োজনীয় বিষয় না থাকে, তাহা হইলে সেই সকল পত্রাদি এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবুর নিকট পাট ক্রয় করিবার স্থানে পাঠাইয়া দিবেন; সেই স্থান হইতে তিনি উহার উত্তর লিখিয়া দিবেন। কোন পত্রে যদি কোন সবিশেষ প্রয়োজনীয় কর্ম্মের উল্লেখ থাকে, বা রাজা মহাশয়ের কলিকাতায় আসিবার দিন স্থির করিয়া যদি কেহ কোন পত্র লেখেন, তাহা হইলে, তাঁহাকে তারযোগে সংবাদ প্রদান করিলে যত শীঘ্র পারেন, তিনি কলিকাতায় আগমন করিবেন। এইরূপ ভাবে বন্দোবস্ত করিয়া তিনি কলিকাতা পরিত্যাগ করিলেন। 

সময়মত এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবু পাট ক্রয় করিবার বন্দোবস্ত করিতে সিরাজগঞ্জে গিয়া উপস্থিত হইলেন। সেইস্থানে উপস্থিত হইয়াই মন্ত্রী মহাশয়কে এক পত্র লিখিলেন। 

এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবু ইতিপূর্ব্বে আর কখন সিরাজগঞ্জে পদার্পণ করেন নাই। সুতরাং সেই স্থানে তিনি সম্পূর্ণরূপে অপরিচিত হইলেও ক্রমে ক্রমে সমস্ত কার্য্যের বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া লইতে লাগিলেন। যে স্থানে থাকিলে পাট খরিদ করিবার বিশেষরূপ সুযোগ ঘটিবার সম্ভাবনা হয়, এরূপ স্থান দেখিয়া তাঁহার থাকিবার স্থান স্থির করিয়া লইলেন, যেরূপ লোকজন নিযুক্ত করিলে ঐ পাট খরিদ কার্য্য অনায়াসেই সম্পন্ন করিতে সমর্থ হইবেন, বাছিয়া বাছিয়া ও বিশেষরূপ বিবেচনা করিয়া সেইরূপ লোকজন নিযুক্ত করিতে আরম্ভ করিলেন। পাট খরিদ হইলে যে স্থানে উহা রাখিতে হইবে অনেক দেখিয়া শুনিয়া সেইরূপ একটি স্থানেরও বন্দোবস্ত করিলেন। এই সকল কাৰ্য্য শেষ করিতে প্রায়ই ৩/৪ দিবস অতীত হইয়া গেল, এইরূপে পাট ক্রয় করিতে আরম্ভ করিতে হইলে যে সকল বন্দোবস্তের বিশেষ প্রয়োজন, তাহার সমস্তই স্থির করিয়া মন্ত্রী মহাশয়কে দ্বিতীয় পত্র লিখিলেন। কিন্তু কোন পত্রেরই কোন উত্তর না পাইয়া টাকা পাঠাইয়া দিবার নিমিত্তই উপর্যুপরি আরও দুই একখানি পত্র লিখিলেন; কিন্তু তাহারও কোন উত্তর আসিল না। এইরূপে তিন চারি দিবসের পরিবর্তে ক্রমে আট দশ দিবস অতীত হইয়া গেল, তথাপি টাকাও আসিল না, বা পত্রের উত্তরও পাইলেন না। তখন কি করা কর্তব্য, তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া এক টেলিগ্রাফ করিলেন। তাহারও কোনরূপ উত্তর না পাইয়া সেক্রেটারী বাবু অতিশয় চিন্তিত হইলেন এইরূপে প্রায় পনর দিবস বিনাকার্য্যে অতিবাহিত হইয়া গেল। পাটের আমদানী ক্রমে কমিয়া আসিতে লাগল। তখন অনন্যোপায় হইয়া সমস্ত বিষয় বিবৃত করিয়া আপনার ভ্রাতাকে এক পত্র লিখিলেন। সেই পত্রের উত্তরে তাঁহার ভ্রাতার নিকট হইতে অবগত হইলেন, “যে বাড়ীতে রাজা মহাশয় বাস করিতেন, তথায় গমন করিয়া দেখিলাম যে, সেই বাড়ীতে এখন লোকজন কেহই বাস করে না, তাহার সদর দ্বার তালাবদ্ধ আছে। রাজা মহাশয় উক্ত বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া যে কোথায় গমন করিয়াছেন তাহাও সেখানকার কেহই বলিতে পারিল না।” 

ভ্রাতার নিকট হইতে এই সকল বিষয় অবগত হইয়া সেক্রেটারী বাবু যে কতদূর ভাবিত হইলেন, তাহা আর কি বলিব? কখনও ভাবিলেন, রাজা মহাশয় কোথায় উঠিয়া গেলেন, তাহা কিরূপে স্থির করিব? কখনও ভাবিলেন এত বড় একটা রাজা মনের কষ্টে যদি সেই বাড়ী পরিত্যাগ করিয়াই থাকেন, তাহা হইলে তিনি যে কোথায় উঠিয়া গিয়াছেন, তাহা অনায়াসেই জানিতে পারা যাইবে। আবার ভাবিলেন, যদি রাজা মহাশয়ের কোনরূপ সন্ধান না করিয়া উঠিতে পারি, তাহা হইলে মনিবের নিকট যে কিরূপ লজ্জিত ও লাঞ্ছিত হইব, তাহা বলিতে পারি না। তাহার উপর আমার নিজের পাঁচ হাজার টাকা আদায় হইবার উপায় কি? কখনও ভাবিলেন, পূর্ব্বে শুনিতাম যে, কলিকাতা জুয়াচোরে পরিপূর্ণ। ইহা ত সেই প্রকার কোন জুয়াচোরের খেলা নহে? আবার ভাবিলেন যে, এত বড় বাড়ী, এত লোকজন কি কখনও জুয়াচোরের সম্ভবে? এইরূপ নানাপ্রকার চিন্তা করিতে করিতে এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবু সিরাজগঞ্জ পরিত্যাগ করিয়া কলিকাতায় আগমন করিলেন। 

পরদিবস অতি প্রত্যূষে সেক্রেটারী বাবু আপনার ভ্রাতা ও অপরাপর দুই একজন বন্ধুবান্ধবকে সঙ্গে লইয়া যে বাড়ীতে রাজা বাস করিতেন, সেই বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন যে, দ্বারে একমাত্র দ্বারবান্ ভিন্ন সেই বাড়ীর ভিতর জনমানব কেহই নাই। বাড়ীর সম্মুখে লেখা আছে যে, এই বাড়ী ভাড়া দেওয়া যাইবে। এই অবস্থা দেখিয়া সেক্রেটারী বাবু সেই দ্বারবানকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই বাড়ীতে যে রাজা মহাশয় বাস করিতেন, তিনি এখন কোথায় গমন করিয়াছেন?” 

দ্বারবান্। কে এই বাড়ীতে বাস করিত, তাহা আমি জানি না। যে পৰ্য্যন্ত আমি কৰ্ম্মে নিযুক্ত হইয়াছি, সেই পৰ্য্যন্ত এ বাড়ী খালিই দেখিতেছি। 

এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী। কতদিন হইতে তুমি কৰ্ম্মে নিযুক্ত হইয়াছ?

দ্বারবান্। দিন পনর হইবে। 

সেক্রেটারী। কে তোমাকে নিযুক্ত করিয়াছে? 

দ্বারবান্। যাঁহার বাড়ী, তিনিই আমাকে কৰ্ম্মে নিযুক্ত করিয়াছেন। 

সেক্রেটারী। যাঁহার বাড়ী তাঁহার নাম কি? 

দ্বারবান। নাম আমি বলিতে পারি না। তাঁহার থাকিবার বাড়ী জানি—সুকিয়া ষ্ট্রীটে তাঁহার বাড়ী। আমাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবেন না। আপনি যেরূপ ভাবে আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, এরূপ ভাবে কত লোক যে প্রত্যহ আসিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করে, তাহা আর কি বলিব? সকলের কথার উত্তর দিতে দিতে আমি জ্বালাতন হইয়া গিয়াছি। ঐ দেখুন—একটি লোক আসিতেছেন, উনি প্রায় প্রত্যহই আসিয়া আমাকে এইরূপে জ্বালাতন করেন। দ্বারবান্ এই কথা বলিলে পর সেই লোকটি আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইলেন, এবং এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়! আপনারা এখানে কাহার অনুসন্ধান করিতেছেন?” 

সেক্রেটারী। এই বাটীতে যে রাজা মহাশয় বাস করিতেন, তাঁহারই অনুসন্ধান করিতেছি। 

আগন্তুক। রাজা মহাশয়ের কোন সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিয়াছেন কি? 

সেক্রেটারী। তাঁহার অনুসন্ধানের নিমিত্ত এইমাত্র আমরা এখানে আগমন করিতেছি, এবং এই বাড়ীর অবস্থা দেখিয়া, রাজা মহাশয় কোথায় উঠিয়া গিয়াছেন, তাহাই দ্বারবানকে জিজ্ঞাসা করিতেছি; এমন সময় আপনি আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। 

আগন্তুক। রাজা মহাশয়ের অনুসন্ধানে আপনারা এইমাত্র আসিয়াছেন, আমি কিন্তু গত পনর দিবস হইতে তাঁহার অনুসন্ধান করিয়া ফিরিতেছি; এ পর্য্যন্ত কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারি নাই। 

সেক্রেটারী। আপনি কি নিমিত্ত রাজা মহাশয়ের সন্ধান করিয়া ফিরিতেছেন? 

আগন্তুক। সে দুঃখের কথা আপনাকে আর কি বলিব? আমার নিকট হইতে তিনি প্রায় সহস্র টাকা মূল্যের কাপড় ক্রয় করিয়াছেন, কিন্তু একটিমাত্র পয়সাও এ পর্যন্ত প্রাপ্ত হই নাই। যে তারিখে আমাকে টাকা দিবার কথা ছিল, সেই তারিখে আসিয়া দেখি যে, এ বাটী খালি পড়িয়া রহিয়াছে। ইহাতে না আছেন রাজা, না আছেন তাঁহার লোকজন।

সেক্রেটারী। এত বড় একটা রাজা এই বাড়ী হইতে উঠিয়া অপর কোন বাড়ীতে গমন করিয়াছেন, তাহার সন্ধান হইবে না, ইহাও বড় আশ্চর্য্যের কথা! 

আগন্তুক। আমি এখন যেরূপ জানিতে পারিতেছি, তাহাতে আমার বোধ হইতেছে যে এ বাড়ীতে কোন রাজা কোন সময়েই বাস করেন নাই। রাজা বলিয়া যে এই বাড়ীতে বাস করিত, সে একজন জুয়াচোর, এবং মন্ত্রী, দাওয়ান প্রভৃতি যত লোকজন এই বাড়ীতে থাকিত তাহারা সকলেই সেই জুয়াচোরের দলের লোক। 

সেক্রেটারী। আপনি কি বলেন মহাশয়! ইহারা কি সকলেই জুয়াচোর? যদি ইহারা জুয়াচোর হয়, তাহা হইলে ইহারা আমার কি সর্ব্বনাশই করিল। 

আগন্তুক। কেন মহাশয়! আপনার নিকট হইতেও উহারা কিছু লইয়াছে নাকি? 

সেক্রেটারী। নিতান্ত কিছু নহে মহাশয়! পাঁচ হাজার টাকা লইয়াছে! আপনি কি ঠিক জানিতে পারিয়াছেন যে, উহারা জুয়াচোর? 

আগন্তুক। আমি যতদূর অবগত হইতে পারিয়াছি, তাহাতে ঠিক বলিয়াই বোধ হয়। 

সেক্রেটারী। আপনার নিকট হইতে কাপড় ক্রয় করিবার কালে কোন দালাল দালালী করিয়াছিল কি?

আগন্তুক। ইহার ভিতর একজন দালাল ছিল বটে; কিন্তু তাহারও আর কোনরূপ সন্ধান পাওয়া যাইতেছে না, সেও এখন পলাতক। 

সেক্রেটারী। সেই দালালের নাম আপনি কি জানেন? 

আগন্তুক। সে আমাদিগের বাজারের দালাল। তাহাকে বহু দিবস হইতে আমি চিনি, তাহার নাম ভগবান দাস।

সেক্রেটারী। আমারও দালাল ছিল—-ভগবান দাস। ভগবান দাসকে পাওয়া যাইতেছে না? সেও কি পলায়ন করিয়াছে? কি সর্ব্বনাশ! মনে মনে এ পর্যন্ত যাহার ভরসা করিতেছিলাম, সেও জুয়াচোর? কি ভয়ানক! এ জগতে কাহাকে বিশ্বাস করিব? 

আগন্তুক। আপনিও দেখিতেছি, আমার মত ভগবান দাসকে বিশ্বাস করিয়াছিলেন। 

সেক্রেটারী। যেমন বিশ্বাস করিয়াছিলাম, তেমনই তাহার উপযুক্ত ফল প্রাপ্ত হইলাম। যাহা হউক, এখন এই বাড়ী যাঁহার চলুন দেখি মহাশয়! একবার তাঁহার নিকট গমন করি। তাঁহার বাড়ী কে ভাড়া লইয়াছিল, তাহার যদি তিনি কোনরূপ সন্ধান বলিয়া দিতে পারেন। 

আগন্তুক। তাহা দেখিতে কি আর আমি বাকি রাখিয়াছি মহাশয়! বাড়ীওয়ালা বাবু আমাদিগের প্রয়োজনীয় কোন সংবাদই প্রদান করিতে পারেন না। তিনি বলেন যে, একদিবস একজন লোক তাঁহার নিকট আগমন করেন, এবং এক মাসের ভাড়া অগ্রিম দিয়া এই বাড়ী এক মাসের-নিমিত্ত গ্রহণ করেন; কিন্তু একমাস পূর্ণ হইতে না হইতেই কাহাকেও কিছু না বলিয়া চলিয়া যান। এই কথা যখন তিনি জানিতে পারেন, সেই সময় যাহাতে এই খালি বাড়ী কেহ কোনরূপে নষ্ট করিতে না পারে, এই নিমিত্ত এই দারোয়ানকে এইস্থানে নিযুক্ত করিয়া রাখিয়া দিয়াছেন। যে ব্যক্তি এই বাড়ী ভাড়া লইয়াছিল, তাহাকে পূর্ব্বে তিনি কখনও দেখেন নাই, বা তাহার নামও অবগত নহেন; কিন্তু যদি পুনরায় তাহাকে তিনি দেখিতে পান, তাহা হইলে তাহাকে চিনিতে পারিবেন। 

সেক্রেটারী। সে উপায়ও নাই। তবে এখন কি করা যায় মহাশয়?

আগন্তুক। ভাবিয়া চিন্তিয়া আমি ত কোন উপায়ই দেখিতেছি না।

সেক্রেটারী। তবে কি আমাদিগের এতগুলি টাকা মারা যাইবে? 

আগন্তুক। টাকা মারা যাইবে, বলিতেছেন কি মহাশয়! মারা ত গিয়াছে। টাকা আদায়ের আমি কোন উপায়ই দেখিতে পাইতেছি না। 

উভয়ের মধ্যে এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এরূপ সময়ে অপর এক ব্যক্তি আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল, ও সেক্রেটারী মহাশয়কে সেইস্থানে দেখিয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “আপনারা এখানে কাহার অনুসন্ধানের নিমিত্ত আসিয়াছেন?” 

সেক্রেটারী। রাজা সাহেবের অনুসন্ধানে আমরা এইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি, তুমিও কি তাঁহার অনুসন্ধান করিতে আসিয়াছ? 

নবাগত। হাঁ মহাশয়, আমিও আজ কয়েক দিবস পর্য্যন্ত তাঁহার অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেছি, কিন্তু কোন স্থানে তাহাদিগের কিছু অনুসন্ধান করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। 

সেক্রেটারী। কেন তুমি তাহাদিগের অনুসন্ধান করিতেছ? তুমিও কি তাহাদিগের কর্তৃক কোন প্রকারে প্রতারিত হইয়াছ? 

নবাগত। হাঁ মহাশয়! উহারা আমার বিশেষরূপে সর্ব্বনাশ করিয়াছে, আমি উহাদিগের কর্তৃক বিশেষরূপে প্রতারিত হইয়াছি। 

সেক্রেটারী। তুমি কিরূপে প্রতারিত হইয়াছ, তুমিও কি পাট খরিদ করিতে গমন করিয়াছিলে? 

নবাগত। না মহাশয়, আমি পাট খরিদ করিতে যাই নাই। 

সেক্রেটারী। তবে কি তোমার নিকট হইতে উহারা কাপড় খরিদ করিয়াছিল? 

নবাগত। না মহাশয়, আমার কাপড়ের দোকান নাই, বা আমার নিকট হইতে উহারা কাপড় খরিদ করিয়া আমাকে প্রতারিত করে নাই। 

সেক্রেটারী। তাহা হইলে তুমি কিরূপে প্রতারিত হইয়াছ? 

নবাগত। আপনি রাজা সাহেবের বাড়ীর ভিতর নিশ্চয়ই গমন করিয়াছিলেন? 

সেক্রেটারী। অন্দরের ভিতর যাই নাই কিন্তু সদরের সমস্ত স্থানই প্রায় দেখিয়াছি। নবাগত। ঐ সকল স্থান কিরূপ সজ্জিত ছিল? 

সেক্রেটারী। উত্তম উত্তম তৈজস পত্র দ্বারা ভালরূপেই সজ্জিত ছিল। 

নবাগত। এই বাড়ীতে যত দ্রব্য দেখিয়াছেন, সমস্তই আমার। আমার নিকট হইতে ঐ সকল দ্রব্য এক মাসের জন্য ভাড়া করিয়া আনিয়া এই বাড়ী সুসজ্জিত করা হয়। ঐ সকল দ্রব্যাদির নিমিত্ত যে ভাড়া দেওয়ার কথা ছিল, তাহা দেওয়া দূরে থাক, আজ কয় দিবস হইতে তাহাদিগের কাহাকেও দেখিতে পাইতেছি না। আমার বোধ হয়, ঐ সকল দ্রব্যাদির সহিত উহারা এই স্থান পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে। 

সেক্রেটারী। উহারা যে কোথায় গিয়াছে, তাহার কিছু তথ্য কি জানিতে পারিয়াছ? 

নবাগত। না, মহাশয়। 

সেক্রেটারী। তুমি ঐ সকল দ্রব্য কেন দিয়াছিলে? 

নবাগত। আমরা ঐরূপ দিয়া থাকি। ইহাই আমাদিগের ব্যবসা। ইহার কৰ্ম্মচারীগণ ইহাকে মফস্বলের জনৈক রাজা বলিয়া আমার নিকট পরিচয় প্রদান করে ও কহে, কন্যার বিবাহ উপলক্ষে তিনি কলিকাতায় আগমন করিয়া বাড়ী ভাড়া করিয়াছেন, এক মাসের মধ্যেই বিবাহ শেষ হইয়া যাইবে। বিবাহের পরে আমার দ্রব্যাদি ফিরাইয়া দিবেন ও ভাড়ার টাকা মিটাইয়া দিয়া আপন দেশে গমন করিবেন। উহাদিগের কথায় বিশ্বাস করিয়া আমি দ্রব্যাদি প্রদান করিয়াছিলাম। কিন্তু এখন এইরূপ বিপদে ঠেকিয়াছি। 

সেক্রেটারী। তিনি কোন স্থানের রাজা তাহা আপনাকে বলিয়াছিলেন কি? 

নবাগত। না, কেবল মাত্র এই কথা বলিয়াছিলেন, যে তিনি মফস্বলের রাজা, কিন্তু কোন্ স্থানের তাহা স্পষ্ট করিয়া বলেন নাই। 

সেক্রেটারী। এই জুয়াচোর দলের হস্তে দেখিতেছি আপনিও পড়িয়াছেন এবং উহারা আপনারও সর্ব্বনাশ করিয়াছে। এইরূপ উভয়ের মধ্যে কথাবার্তা হইবার পর, সেই আগন্তুক দোকানদারদ্বয়ের নাম ও ঠিকানা জানিয়া লইয়া এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবু নিতান্ত দুঃখিতমনে ও চিন্তিতান্তঃকরণে আপন বাসায় প্রত্যাগমন করিলেন। বাসায় গিয়া অপরাপর বন্ধু বান্ধবদিগকে এই সকল কথা বলিলেন। যিনি এই সকল কথা শুনিলেন, তিনিই সেক্রেটারী বাবুর দুঃখে দুঃখ প্রকাশ করিতে লাগিলেন, এবং অতঃপর কোন্ উপায় অবলম্বন করিলে অর্থগুলির পুনরুদ্ধার ও অপরাধীগণ দণ্ডিত হইতে পারে, সকলে মিলিয়া সেই বিষয় চিন্তা করিতে লাগিলেন। পরিশেষে ইহাই স্থিরীকৃত হইল যে, পুলিসের সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারীর সাহায্য গ্রহণ করিতে না পারিলে কিছুই হইতে পারিবে না। এইরূপ পরামর্শ স্থিরীকৃত হইলে কলিকাতার পুলিসের সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারীর সহিত যে প্রধান লোকের বিশেষরূপ আলাপ পরিচয় আছে, এরূপ কোন একজন গণ্য মান্য লোকের সহায়তায় তিনি পুলিসের সাহায্য প্রাপ্ত হইবার উপায় স্থির করিতে লাগিলেন। এদিকে সমস্ত অবস্থা বর্ণন করিয়া এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবু তাঁহার মনিব রাজা মহাশয়কে পত্র লিখিলেন, এবং তাঁহাকে আপাততঃ কলিকাতায় আসিতে নিষেধ করিলেন। 

একাদশ পরিচ্ছেদ

“ভায়ারও ফলার?” 

পুলিসের হস্তে কোনরূপে এই মোকদ্দমার ভার যাহাতে অর্পিত হইতে পারে, এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবু প্রাণপণে তাহার চেষ্টা দেখিতে লাগিলেন। কারণ, যেরূপ ভাবে তাঁহাকে লোভ দেখাইয়া জুয়াচোরগণ তাঁহার নিকট হইতে পাঁচ হাজার টাকা বাহির করিয়া লইয়াছে, তাহা নিতান্ত সহজ অপরাধ না হইলেও আইন অনুসারে একায়েক অনুসন্ধান করিবার ক্ষমতা সেই সময় কোন পুলিস-কর্ম্মচারীর ছিল না। এখন যে আইনমতে কাৰ্য্য হইতেছে, সেই আইনের পরিবর্তন সেই সময় ঘটে নাই, সুতরাং ম্যাজিষ্ট্রেট বা ম্যাজিষ্ট্রেটের ভারপ্রাপ্ত কোন পুলিস-কৰ্ম্মচারীর আদেশ ব্যতীত অপর কোন পুলিস কর্ম্মচারী এই অনুসন্ধানে সেই সময় লিপ্ত হইতে পারিতেন না, একথা বোধ হয়, অনেক পাঠকই অবগত আছেন। 

যে সকল লোকের সহানুভূতি প্রাপ্ত হইলে পুলিসের হস্তে এই অনুসন্ধানের ভার অর্পিত হইতে পারিবে, এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবুর বন্ধু-বান্ধবগণ তাহার জন্য চেষ্টা করিতে লাগিলেন। সেক্রেটারী বাবু সেই দিবসই আহারাদির পর বড়বাজারে সেই দোকানদারের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। 

দোকানে গিয়া দেখিলেন যে, সেক্রেটারী বাবুর মত যিনি হাজার টাকা জলাঞ্জলি দিয়াছেন তিনিও একজন নিতান্ত সামান্য দোকানদার নহেন। ইনি শাল, চেলি, প্রভৃতি মূল্যবান কাপড়সকল বিক্রয় করিয়া থাকেন। সেক্রেটারী বাবুকে দেখিবামাত্র তিনি চিনিতে পরিলেন, তাঁহাকে আপন দোকানে বসাইয়া কিরূপে তাঁহার নিকট হইতে জুয়াচোরগণ একবারে পাঁচ হাজার টাকা গ্রহণ করিতে সমর্থ হইল, তাহা জিজ্ঞাসা করিলেন। উত্তরে সেক্রেটারী বাবু যেরূপ অবস্থায় পড়িয়া পাঁচ হাজার টাকা তাহাদিগের হস্তে অর্পণ করিয়াছিলেন, তাহা আনুপূর্ব্বিক বিবৃত করিলেন। এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয়ের এই কথা শ্রবণ করিয়া দোকানদার মহাশয় আরও বিস্মিত হইলেন ও কহিলেন, “জুয়াচোরগণ না করিতে পারে, এরূপ কার্য্যই প্রায় দেখিতে পাওয়া যায় না!” 

সেক্রেটারী। আমার বাড়ী বঙ্গদেশে, কলিকাতায় আমি প্রায়ই থাকি না। সুতরাং জুয়াচোরগণের হস্তে পতিত হওয়া আপনার পক্ষে একেবারে অসম্ভব নহে; কিন্তু আপনি কলিকাতায় থাকিয়া, বিশেষতঃ বড় বাজারের দোকানদার হইয়া কিরূপে উহাদিগের হস্তে পতিত হইলেন? 

দোকানদার। বিশ্বাস। বিশ্বাসের উপর নির্ভর না করিলে কোন প্রকারেই আমাদিগের এই কার্য্য চলিতে পারে না। সুতরাং সেই বিশ্বাসের উপর নির্ভর করিয়া সময় সময় আমাদিগকে এইরূপ লোকসানও দিতে হয়। 

সেক্রেটারী। কি ছল অবলম্বন করিয়া আপনার নিকট হইতে উহারা বস্ত্রাদি আত্মসাৎ করিতে অসমর্থ হইল, যদি কোন বাধা না থাকে, অনুগ্রহ পূর্ব্বক বলিতে পারেন কি? 

দোকানদার। সর্ব্বপ্রথমে যে ব্যক্তি আপনাকে এই কার্য্যে লওয়াইয়াছিল, সেই ব্যক্তি কর্তৃক আমরাও এইরূপে প্রতারিত হইয়াছি। ভগবান দাস এই বাজারের একজন পুরাতন দালাল, সে আমাদিগের দোকান হইতে সময় সময় অনেক বস্ত্রাদি তাহার আনীত গ্রাহকগণের নিকট বিক্রয় করাইয়া দিয়াছে। তাহাতে সেও কিছু পাইয়াছে, আমরাও দু পয়সা লাভ করিয়াছি; সুতরাং তাহার কথায় আমরা হঠাৎ অবিশ্বাস করিতে না পারিয়া এইরূপে প্রতারিত হইয়াছি। 

সেক্রেটারী। সে কিরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া আপনাদিগকে প্রতারিত করিল? 

দোকানদার। একদিবস সে আসিয়া আমাকে কহিল, “মফঃস্বল হইতে একজন রাজা আসিয়া কিছুদিবস হইতে এই কলিকাতা সহরে বাস করিতেছেন, কোন কাৰ্য্য গতিতে আমাকে সেইস্থানে গমন করিতে হয়। সেই সুযোগে রাজা মহাশয় ও মন্ত্রী মহাশয় প্রভৃতির সহিত আমার আলাপ পরিচয় হইয়াছে। রাজা মহাশয়ের সহিত রাণীও এইস্থানে আগমন করিয়াছেন, তাঁহার দুই একখানি বেনারসী শাটীর আবশ্যক। রাজা মহাশয় আমাকে বলিয়া দিয়াছেন যে, যদি কোন দোকানদারের সহিত আমার আলাপ পরিচয় থাকে, তাহা হইলে ভাল ভাল কয়েকখানি বেনারসী শাটীর সহিত সেই দোকানদারকে তাঁহার বাড়ীতে লইয়া যাইতে পারিলে ভাল হয়; কারণ সেই বস্ত্র রাণী স্বচক্ষে দেখিয়া পরে ক্রয় করিবেন। যদি তাঁহার মনোনীত হয়, তাহা হইলে নগদ মূল্য প্রদান করিবেন। নচেৎ বস্ত্র লইয়া দোকানদার আপন দোকানে চলিয়া আসিবেন।” দোকানদার হইয়া একথা শুনিবার পর আর কোন্ ব্যক্তি স্থির থাকিতে পারে? প্রায় এক হাজার টাকা মূল্যের চারি পাঁচখানি ভাল ভাল শাটী লইয়া তৎক্ষণাৎ ভগবান দাসের সহিত সেই রাজবাটীতে গমন করিলাম। বাড়ীর অবস্থা দেখিয়া এবং লোকজন প্রভৃতির অবস্থা দেখিয়া আমার মনে প্রত্যয় হইল যে, প্রকৃত রাজা না হইলেও কোন একজন বড়লোক আসিয়া এই বাড়ীতে যে বাস করিতেছেন, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। ভগবান দাস ক্রমে আমাকে মন্ত্রী মহাশয়ের নিকট লইয়া গেল। মন্ত্রী মহাশয় রাজা মহাশয়কে সংবাদ প্ৰদান করিলে তিনি অন্তঃপুর হইতে বাহিরে আগমন করিয়া আমার সহিত নানাপ্রকার কথাবার্তা কহিলেন এবং পরিশেষে আমার নিকট হইতে শাটী কয়েকখানি লইয়া প্রথমে তিনি উহার মূল্য জিজ্ঞাসা করিলেন। বলা বাহুল্য সুযোগ বুঝিয়া সেই হাজার টাকা মূল্যের শাটী কয়েকখানির মূল্য দেড় হাজার টাকা বলিয়া দিলাম। তাহাতেও রাজা মহাশয়ের ভাব দেখিয়া বোধ হইল যে, শাটী কয়খানিই রাজা মহাশয়ের মনোনীত হইয়াছে। মনুষ্যের আশার কিছুতেই নিবৃত্ত হয় না। রাজা মহাশয়ের ভাবগতি দেখিয়া মনে করিলাম, সেই কয়খানিমাত্র শাটী ভিন্ন আরও অনেক দ্রব্য ইঁহার নিকট বিক্রয় করিতে পারিব, এবং এই সুযোগে বেশ দশ টাকা লাভও করিয়া লইব। মনে মনে এইরূপ ভাবিতেছি, এরূপ সময়ে রাজা মহাশয় আমাকে কহিলেন, “আপনার আনীত শাটী কয়েকখানি মন্দ নয়, ইহা আমার বেশ মনোনীত হইয়াছে। কিন্তু যিনি ইহা পরিধান করিবেন, তাঁহাকে একবার দেখাইয়া ইহা ক্রয় করাই কৰ্ত্তব্য। যদি আপনার কোনরূপ আপত্তি না থাকে, তাহা হইলে ইহা একবার অন্তঃপুরের ভিতর পাঠাইয়া দি!” রাজা মহাশয়ের কথা শ্রবণ করিয়া আমি কহিলাম, 

“আমার কোন আপত্তি নাই, আপনি স্বচ্ছন্দে ইহা অন্তঃপুরের ভিতর প্রেরণ করিতে পারেন।” 

আমার কথা শ্রবণ করিয়া রাজা মহাশয় একজন পরিচারকের দ্বারা উহা অন্তঃপুরের ভিতর প্রেরণ করিলেন, এবং পরিচারককে বলিয়া দিলেন, রাণীকে ইহা দেখাইয়া আন। আর জিজ্ঞাসা করিয়া আইস, ইহার মধ্যে কোন্ কোন্‌খানি তাঁহার পছন্দ হয়। 

রাজা মহাশয়ের কথা শ্রবণ করিয়া বস্ত্র কয়েকখানি হস্তে গ্রহণ করিয়া পরিচারক অন্তঃপুরের ভিতর প্রবেশ করিল এবং কিয়ৎক্ষণ পরে প্রত্যাগমন করিয়া কহিল, “রাণীমা পত্রাদি লিখিতে এখন অতিশয় ব্যস্ত আছেন। তিনি উক্ত বস্ত্র কয়েকখানি আপনার হস্তে গ্রহণ করিয়া একবার দেখিলেন, এবং আপনার নিকট রাখিয়া দিয়া কহিলেন, আমি এখন অতিশয় ব্যস্ত। সময় মত আমি ইহা ভালরূপে দেখিব, এবং ইহার মধ্যে কোন্ কোন্খানি লইব, তাহা বলিয়া দিব। ইহা ব্যতীত আমার আরও যে সকল বস্ত্রের প্রয়োজন আছে, তাহাও আনিতে বলিব।” 

পরিচারকের কথা শ্রবণ করিয়া রাজা মহাশয় আমাকে কহিলেন, “যখন রাণী বস্ত্র কয়েকখানি রাখিয়া দিয়াছেন, তখন বোধ হয়, সমস্তগুলিই তাঁহার মনোনীত হইয়া থাকিবে। যাহা হউক, আপনি কতক্ষণ বসিয়া থাকিবেন। আপনি অদ্য গমন করুন, কল্য এই সময় পুনরায় আগমন করিবেন। ইহার মধ্যে যে যে বস্ত্র তাঁহার মনোনীত হয়, কল্য তাহার মূল্য লইয়া যাইবেন, এবং তাঁহার অপরাপর কি কি বস্ত্রের প্রয়োজন আছে, তাহাও শুনিয়া যাইবেন। 

রাজা মহাশয়ের কথা শ্রবণ করিয়া সেইদিবস সেই বস্ত্র কয়েকখানি সেইস্থানে রাখিয়া আপনার দোকানে প্রত্যাগমন করিলাম। পুনর্ব্বার পরদিবস নিয়মিত সময়ে সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। রাজা মহাশয় সেই সময় দরবার গৃহেই বসিয়াছিলেন, “আমাকে দেখিবামাত্র তিনি কহিলেন, “আপনার সমস্ত বস্ত্রই রাণীর মনোনীত হইয়াছে। তিনি উহা নিজের বাক্সের ভিতর বন্ধ করিয়া রাখিয়াছেন, আরও কিছু বস্ত্রের ফরমাইসও দিয়াছেন।” এই বলিয়া একটি ফর্দ্দ আমার হস্তে প্রদান করিলেন ও কহিলেন, “এই সকল বস্তু লইয়া আপনি পরশ্ব দিবস আগমন করিবেন, এবং আপনার সমস্ত টাকা লইয়া যাইবেন। কল্য আমার একটু সবিশেষ কার্য্য আছে, সুতরাং কল্য আসিলে আমার সহিত আপনার সাক্ষাৎ হইবে না।” 

রাজা মহাশয়ের এই কথা শ্রবণ করিয়া, এবং লাভের আরও কিছু প্রত্যাশা করিয়া আমি রাজা মহাশয়ের প্রস্তাবে সম্মত হইলাম, এবং সেইদিবস আপন দোকানে প্রত্যাগমন করিলাম। তাহার পরদিবস রাজা মহাশয়ের প্রদত্ত ফদ অনুযায়ী সমস্ত দ্রব্যাদি সংগ্রহ করিয়া পুনর্ব্বার নিয়মিত সময়ে রাজবাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেইস্থানে গিয়া যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমার মস্তক ঘুরিয়া গেল, বুদ্ধিলোপ হইল, আমি সেইস্থানে বসিয়া পড়িলাম। দেখিলাম যে, সেই বাড়ী তখন শূন্য; লোকজন প্রভৃতি কেহই নাই। তথাপি এক পা দুই পা করিয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। দরবার গৃহে গমন করিলাম; সেইস্থানে না আছেন রাজা, না আছেন মন্ত্রী, না আছেন অপর কোন ব্যক্তি। তাহার পর অন্তঃপুরের ভিতর গমন করিলাম, সে স্থানেও কাহাকে দেখিতে পাইলাম না। অধিকন্তু অন্তঃপুরের অবস্থা দেখিয়া বোধ হইল যে, সেইস্থানে কোন লোক কখন বাস করে নাই। এই অবস্থা দেখিয়া বিষণ্ণবদনে আপন দোকানে চলিয়া আসিয়া ভগবান দাসের অনুসন্ধান করিলাম। কিন্তু তাহাকেও আর কোনস্থানে দেখিতে না পাইয়া, আজ কয়েক দিবস পর্য্যন্ত তাহাদিগের সন্ধান করিয়া বেড়াইতেছি; কিন্তু কোনরূপ সন্ধানই করিয়া উঠিতে পারি নাই! এই ত মহাশয় আমার অবস্থা! এই অবস্থায় পড়িয়া আমি হাজার টাকা জলাঞ্জলি দিয়াছি। 

দোকানদারের কথা শ্রবণ করিয়া এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী মহাশয় আরও বিস্মিত ও ক্রোধান্বিত হইলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে কহিলেন, “ইহার প্রতিবিধানের নিমিত্ত পুলিসের সাহায্য লইলে হয় না?” 

উত্তরে দোকানদার মহাশয় কহিলেন, “আমার অদৃষ্টে যে লোকসান ছিল, তাহা হইয়াছে। ইহার নিমিত্ত আর থানা পুলিসের হাঙ্গাম করিতে চাহি না।” 

দোকানদারের নিকট এই সকল অবস্থা অবগত হইয়া এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবু সন্ধ্যার পর আপন বাসায় প্রত্যাগমন করিলেন। 

এদিকে এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী যে ভদ্রলোকের সহানুভূতিতে পুলিসের সাহায্য পাইবার চেষ্টা করিতেছিলেন, তাঁহারই চেষ্টায় পুলিসের সর্ব্বপ্রধান কর্মচারী এই জুয়াচুরি কাণ্ডের অনুসন্ধানের ভার গ্রহণ করিয়া জনৈক স্থানীয় ইনস্পেক্টারকে ইহার যথাযথ রিপোর্ট করিতে আদেশ দিলেন। ইনস্পেক্টার বাবুও সেই আদেশ প্রতিপালনের নিমিত্ত অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলেন। 

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

রহস্য-ভেদ—অপরাধীর দণ্ড 

কয়েক দিবস অনুসন্ধানের পর অনুসন্ধানকারী ইনস্পেক্টার বাবু তাঁহার অনুসন্ধান বিবরণী সর্বপ্রধান কর্মচারীর নিকট প্রেরণ করিলেন। তাঁহার অনুসন্ধানের ফল ক্রমে প্রকাশ হইয়া পড়িল। সেক্রেটারী বাবু প্রভৃতি সকলেই তাহা জানিতে পারিলেন। অনুসন্ধানের ফল জানিতে পারিয়া এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবু বিশেষরূপে অসন্তুষ্ট ও হতাশ হইলেন। ক্রমে সংবাদ সম্পাদকদিগের নিকটও সেই সংবাদ গিয়া উপস্থিত হইল। 

যাহা হউক, ইনস্পেক্টার বাবু অনুসন্ধান বিবরণীর সারমর্ম্ম এইরূপ ছিলঃ- 

যে বাড়ীতে রাজবাহাদুর ও তাঁহার লোকজন বাস করিত বলিয়া দরখাস্তে প্রকাশ আছে, সেই বাড়ীতে কখনও কোন রাজা বাস করেন নাই। কিছুদিবস পূর্ব্বে সেই বাড়ীর কয়েকজন জুয়াড়ি দ্বারা অধিকৃত হইয়াছিল। তাহাদিগের মধ্যে অনেকেই পুলিসের নিকট পরিচিত। এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবুরও বোধ হয়, একটু আধটু জুয়াখেলা করা অভ্যাস আছে; নতুবা তিনি সেইস্থানে গমন করিয়া জুয়াড়ি দিগের সহিত মিলিত হইবেন কেন? এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবুর পাঁচ হাজার টাকা উহাদিগের কর্তৃক যে নষ্ট হইয়া গিয়াছে, তাহার আর কিছুমাত্র ভুল নাই। কিন্তু দরখাস্তে বিবৃত উপায় অবলম্বনে অর্থাৎ পাট ক্রয় করিতে তাঁহাকে নিযুক্ত করিয়া তাহার জামিনস্বরূপ পাঁচ হাজার টাকা যে উহারা গ্রহণ করিয়াছে, তাহা আমার বোধ হয় না। অনুসন্ধানে আমি যতদূর অবগত হইতে পারিয়াছি, তাহাতে আমি নিশ্চয় বলিতে পারি যে, এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবু জুয়াখেলা করিয়া তাঁহার পাঁচ হাজার টাকা নষ্ট করিয়াছেন এবং পরিশেষে লোক লজ্জার ভয়ে এই এক অভিনব মিথ্যা উপায় বাহির করিয়া জুয়াড়িগণের নিকট হইতে যাহাতে টাকাগুলি আদায় করিতে পারেন তাহার নিমিত্ত এই মিথ্যা অভিযোগ উপস্থিত করিয়াছেন।” 

এইরূপ অনুসন্ধানের ফল জানিতে পারিয়া সর্ব্বপ্রধান পুলিস-কৰ্ম্মচারী, সেক্রেটারী বাবু, সংবাদ-পত্রের সম্পাদকগণ কেহই সন্তুষ্ট হইলেন না। এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবু এ বিষয়ের পুনরায় ভালরূপ অনুসন্ধান হইবার নিমিত্ত পুনরায় আবেদন করিলেন। সংবাদপত্র সম্পাদকগণ, সেক্রেটারী বাবুর মতের পোষকতা করিয়া আপন আপন সংবাদপত্রে দীর্ঘ দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখিতে লাগিলেন! সৰ্ব্বপ্রধান পুলিস কর্মচারীও কি জানি, কি ভাবিয়া সেই বিষয়ের পুনরায় অনুসন্ধানের ভার আমাদিগের হস্তে সমর্পণ করিলেন। আমরা এই অনুসন্ধানে লিপ্ত হইবার পরই পূৰ্ব্ব অনুসন্ধানকারী কর্মচারী সম্বন্ধে অনেক রহস্য বাহির হইয়া পড়িল। সেই সকল রহস্য এইস্থানে প্রকাশ করা এ পুস্তকের উদ্দেশ্য নহে বলিয়া তাহা পরিত্যক্ত হইল। 

অনুসন্ধানে যতদূর অগ্রবর্তী হইতে লাগিলাম, এসিষ্টেন্ট সেক্রেটারী বাবুর দরখাস্ত-লিখিত বিবরণ সকল ততই প্রকৃত বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম, রাজা কে, মন্ত্রী কে দাওয়ান কে, এবং অপরাপর রাজ কৰ্ম্মচারীই বা কাহারা। এই সমস্ত বিষয় অবগত হইয়া সেই জুয়াচোর দলের মধ্যস্থ সমস্ত লোকের নামে ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট গ্রেপ্তারী ওয়ারেন্ট প্রার্থনা করিলাম। ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব আমাদিগের প্রার্থনা মঞ্জুর করিয়া সকলকেই ধৃত করিবার নিমিত্ত ও সকলের থাকিবার স্থান অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত ওয়ারেন্ট প্রদান করিলেন। 

সৰ্ব্বপ্রথমেই ধৃত হইলেন—দাওয়ানজী মহাশয়! ইহার বাসস্থান লক্ষ্ণৌ জেলায়, জাতিতে ইনি মুসলমান! এইরূপ কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিবার নিমিত্ত পূর্ব্বেও ইনি দুই একবার শ্রীঘরও দর্শন করিয়াছেন। ইহার বাক্সের ভিতর হইতে সেক্রেটারী বাবুর পাট ক্রয় কৰ্ম্মে নিযুক্ত হইবার আদেশপত্র, হ্যাণ্ডনোট প্রভৃতি কয়েকখানি কাগজ পাওয়া গেল। 

দাওয়ানজী মহাশয় ধৃত হইবার পরই ধৃত হইলেন—মন্ত্রী মহাশয়। সেই সময় মাণিকতলায় একখানি বাড়ী ভাড়া করিয়া ইনি বাস করিতেছিলেন। ইঁহার জন্মস্থান কলিকাতায়। এইরূপ ভাবে জুয়াচুরি করিয়া ইনি আজীবন কাটাইয়া আসিয়াছেন, পুলিসের সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারী হইতে সর্ব্ব নিম্ন কর্ম্মচারী পর্যন্ত সকলের নিকটই ইনি উত্তমরূপে পরিচিত। কিন্তু এ পৰ্য্যন্ত কখন ইনি ধরা ছোঁয়ার ভিতর যান নাই। ইতিপূর্ব্বে ইনি যে সকল কার্য্য করিয়াছেন, তাঁহাতে ইনি ধৃত হইলেও কখন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন নাই, ইঁহার দলস্থিত অনেকেই কারাগার ভোগ করিয়াছে কিন্তু ইনি বরাবরই নিষ্কৃতি লাভই করিয়া আসিয়াছেন। ইঁহার বাঁচিয়া যাইবার কারণ, ইঁহার পয়সার জোর অনেক ছিল, এক এক মোকদ্দমায় বিস্তর পয়সা ইনি খরচ করিয়াছিলেন, এইরূপ শুনিতে পাওয়া যায়। ইঁহার বাসস্থান অনুসন্ধান করিয়া রাজা মহাশয়ের সেই রাজপরিচ্ছদ ও লক্ষ লক্ষ টাকা পরিপূর্ণ ক্যাসবাক্স প্রাপ্ত হইলাম। তাহার ভিতর তখনও দুই তাড়া নোট ছিল। পূর্ব্ববর্ণিত ভাবে করেন্সী অফিসের নোটের তাড়ার মত ইহাও লাল সূতোয় সেলাই করা; এবং উপরে এক একখানি হাজার টাকার নোট দেখা যাইতেছে। সেই তাড়া দুইটি হস্তে গ্রহণ করিয়া উহা উত্তমরূপে পরীক্ষা করিলাম। দেখিলাম যে, সেই হাজার টাকার নোট প্রকৃত নোট নহে, উহাও জাল নোট! এইরূপ অবস্থা দেখিয়া একটি নোটের তাড়া খুলিয়া ফেলিলাম। দেখিলাম, উহার মধ্যে একখানিও নোট নাই, সমস্তগুলিই তাড়াবান্ধা সাদা কাগজ! 

মন্ত্রী মহাশয় ধৃত হইবার পরই রাজা মহাশয়ও ধৃত হইলেন। সেই সময় সকলেই জানিতে পারিলেন যে, এ কার্য্যে রাজা মহাশয় এই প্রথম ব্রতী। ইনি একজন ভদ্র সন্তান; কিন্তু সঙ্গদোষে চরিত্র হারাইয়া, পরিশেষে সহরের প্রধান জুয়াচোর মন্ত্রী মহাশয়ের সহিত মিলিত হইয়াছেন। 

ইহার পর এক এক করিয়া অপরাপর “রাজ কৰ্ম্মচারী” মাত্রই ধৃত হইল; কিন্তু কাহারও নিকট হইতে নগদ অর্থ কিছুই পাওয়া গেল না। 

দালাল ভগবান দাস পূৰ্ব্ব হইতেই লুক্কায়িত হইয়াছিল সত্য, কিন্তু কলিকাতা পরিত্যাগ করে নাই; সুতরাং সেও কলিকাতায় ধৃত হইল। 

বড়বাজারের দোকানদারের নিকট হইতে হাজার টাকা মূল্যের যে কাপড় উহারা জুয়াচুক্তি করিয়া লইয়াছিল, তাহাও স্থানে স্থানে” বন্ধক রাখিয়াছিল, এবং কতক বিক্রয়ও করিয়াছিল, তাহাও পাওয়া গেল। 

যে ব্যক্তির নিকট হইতে গৃহ সাজাইবার আসবাব ভাড়া করিয়া লইয়াছিল ও যে সকল দ্রব্যের সহিত উহারা ঐ ঘর পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যায়, সেই সকল দ্রব্যও ক্রমে আমাদিগের হস্তগত হইল; উহার কতক কতক উহাদিগের বাসস্থানেই পাওয়া গেল, অবশিষ্ট যাহা বিক্রয় করিয়া ফেলিয়াছিল, তাহাও সেই সকল স্থান হইতে বাহির হইয়া পড়িল। 

আসামীগণের নিকট হইতে প্রাপ্ত দ্রব্যাদির সহিত রাজা, মন্ত্রী প্রভৃতি সকলেই পরদিবস মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট আনীত হইল। অমাত্যবর্গ-পরিবেষ্টিত মহারাজাকে দর্শন করিবার নিমিত্ত আদালত গৃহ পূর্ণ হইয়া গেল। উপর্যুপরি কয়েক দিবস পৰ্য্যন্ত মাজিষ্ট্রেট সাহেব এই মোকদ্দমা শ্রবণ করিয়া পরিশেষে উহাদিগের সকলকেই উচ্চ আদালতে প্রেরণ করিলেন। দায়রায় উহাদিগের রাজকার্য্যের পর্যালোচনা (!) হইলে জুরিগণ উহাদিগের সকলকেই দোষী সাব্যস্ত করিলেন, আর বিচারক উহাদিগের প্রত্যেককেই কঠিন দণ্ডে দণ্ডিত করিলেন। স্বদলবলে রাজা মহাশয় এইরূপে কারাগারে গমন করিবার পর এরূপ অনুসন্ধানে আমাদিগকে আর হস্তার্পণ করিতে হয় নাই। 

[ফাল্গুন, ১৩১১] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *