ডাক্তারবাবু ১

ডাক্তারবাবু (প্রথম কাণ্ড)

(অর্থাৎ কুপথগামী বুদ্ধিমান লোকের ভয়ানক জীবনী!) 

অবতরণিকা 

এই কলিকাতা সহরের কোন বিমা আফিসের বড় সাহেব এক দিবস একখানি বেনামী পত্র প্রাপ্ত হয়েন। ঐ পত্রের সারমর্ম্ম এইরূপ—“আপনাদিগের আফিসে ‘ডাক্তারবাবুর’ ভ্রাতার ত্রিশ হাজার টাকার জীবন-বীমা আছে ও ঐ বীমা ভ্রাতার নিকট হইতে ডাক্তারবাবু খরিদ করিয়াছেন। সম্প্রতি ভ্রাতার মৃত্যু হওয়ায় ঐ বীমার টাকা আদায় করিবার নিমিত্ত ডাক্তারবাবু নিশ্চয়ই আপনাদিগের নিকট গমন করিবেন। কিন্তু তাঁহার ভ্রাতার মৃত্যু সম্বন্ধে বিশেষরূপ অনুসন্ধান না করিয়া ঐ টাকা প্রদান করিলে, আপনারা নিরর্থক ক্ষতিগ্রস্ত হইবেন; কারণ, অনুসন্ধান করিলেই কুৎসিত অবগত হইতে পারিবেন, তাঁহার ভ্রাতার মৃত্যু সম্বন্ধে কিরূপ রহস্য বাহির হইয়া পড়ে।” অন্ন নাই—মোটা চাউলের ভাত খাইতে হয়। পেট ভরিয়া যে কতদিন খাই নাই, তাহা মনে করিয়া আনিতেও পারি না। এক কথায় আমার কষ্টের ও দুঃখের শেষ নাই; যাহারা আমার মত অবস্থায় অন্ততঃ দুই দিনও কাটাইয়াছে, তাহারাই আমার দুঃখ কতক বুঝিবে; ভদ্রলোকে আমার দুঃখ বুঝিতে কখনই সমর্থ হইবেন না, কল্পনা করিয়াও আমার অবস্থা বুঝিতে পারিবেন না। 

আমার মনের ভিতর যে দুঃখরাশি আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে, তাহা যদি দেখাইবার হইত, তবে দেখাইতাম; বলিয়া কি করিব? যে দুঃখের আদি নাই, মধ্য নাই, অন্ত নাই—যাহা আজীবন বলিয়াও শেষ করিতে পারিব না, সেই অসীম অন্তত দুঃখের কাহিনী বলিয়া লাভ কি? 

আপনারা কি আমার দুঃখ বুঝিবেন? আমার জীবনকাহিনী কি একবার পড়িবেন? ইহাতে আপনাদিগের মনে আনন্দ হইবে না, ইহা ভাল লাগিবে না। ইহা গল্প নহে, উপন্যাস নহে—ইহাতে রাজা বা রাজপুত্র নাই, সেনাপতি নাই, যুদ্ধ বিগ্রহ নাই, ঝড় বৃষ্টি মেঘ-গৰ্জ্জন নাই, বজ্রপাত নাই, সুন্দর বন বা উপবন নাই, দেবমন্দির নাই, যোগী ঋষি নাই, সরোবর নাই, পদ্ম নাই, সুন্দরী রমণী নাই, রূপ-বর্ণন নাই, নবদম্পতির নব-প্রণয় সম্ভাষণ প্রভৃতি কিছুই নাই। ইহাতে কেবলমাত্র এই হতভাগার জীবনের স্থূল কয়েকটি প্রকৃত কথা আছে। কিরূপে আমার মন কলুষিত হইয়া ক্ৰমে ক্ৰমে দুষ্কর্ম্মের সোপান-শ্রেণী উল্লঙ্ঘন করিয়াছে এবং পরিশেষে কিরূপেই বা আমার এরূপ দুর্গতি হইয়াছে, সেই সকল দুঃখের কাহিনী যতদূর পর্য্যন্ত বলিতে সমর্থ হইয়াছি, বলিতে চেষ্টা করিয়াছি; সমস্ত বলিবার ক্ষমতা নাই, মনেও নাই। যে দুঃখরাশি আমার অদৃষ্টে ঘটিয়াছে, এবং প্রতিদিন অন্যান্য অনেকের অদৃষ্টেও ঘটিতেছে, ইহাতে কেবলমাত্র তাহাই বর্ণিত হইয়াছে। যাঁহার মানব-জীবন অধ্যয়ন করিতে চাহেন, তাঁহারা যদি অনুগ্রহ করিয়া আমার এই দুঃখ কাহিনী একবার পাঠ করেন, তাহা হইলে বুঝিবেন যে, মনুষ্যগণ দুষ্ট লোকের কুচক্রে ও প্রলোভনে পতিত হইয়া, হিতাহিত জ্ঞানের মস্তকে পদাঘাত করিয়া, ক্রমে কি ভয়ানক অবস্থায় আসিয়া উপনীত হয়, এবং মানব-সমাজের ঘৃণার পাত্র হইয়া কিরূপ দুঃখ ও কষ্টের সহিত জীবনের অবশিষ্টাংশ যাপন করে! 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

“এই কলিকাতা নগরীতে আমার জন্মস্থান। আমার পিতা কায়স্থ মণ্ডলীর মধ্যে একজন গণ্য মান্য লোক। তিনি প্রকৃত বড় মানুষ না হইলেও, তাঁহাকে দরিদ্র অবস্থাপন্ন বলা যায় না। নিজের যেমন হউক, বড়গোছের একটি বাসোপযোগী ও কয়েকখানি ভাড়াটিয়া বাড়ী আছে। মুহূর্তের নিমিত্ত দিনপাতের ভাবনা ভাবিতে হয় না। 

আমরা তিন সহোদর, তাহার মধ্যে আমি সকলের জ্যেষ্ঠ। মধ্যমটি এখন বিশ্ব-বিদ্যালয়ের উপাধি প্রাপ্ত হইয়া কেবলমাত্র সংসারক্ষেত্রে উপস্থিত। কনিষ্ঠের যেরূপ শোচনীয় অবস্থা আমাকর্তৃক ঘটিয়াছে তাহা পাঠকগণ ক্রমে জানিতে পারিবেন। 

কলিকাতায় আমি অনেকের নিকট সুপরিচিত। আমার পিতা ও ভ্রাতা সভ্য সমাজে স্থান পাইয়া থাকেন বলিয়া, আমি বাধ্য হইয়া জনসমাজে আমার নাম পরিচিত করিতে বিরত রহিলাম। একে আমি আমাদের কুল কলঙ্কিত 

৩৭৩ 

করিয়াছি, তাহাতে আবার সকলের নিকট প্রকাশ হওয়া অতীত লজ্জার বিষয়। পাঠকগণের মধ্যে যাঁহারা আমার অবস্থা বিশেষরূপে অবগত আছেন, তাঁহাদিগের নিকট আমার করযোড়ে ও বিনীতভাবে নিবেদন যে, তাঁহারা যেন অন্যের নিকট আমার পরিচয় প্রদান না করেন। আমিও প্রকৃত নাম গোপন করিয়া আমার সর্ব্বজন বিদিত “ডাক্তার” বা “ডাক্তার বাবু” নামেই পরিচিত হইলাম। 

অতি শৈশবকাল হইতে পিতা মাতা আমাকে অতি যত্নের সহিত লালন পালন করেন ও পঞ্চম বর্ষ বয়ঃক্রম হইতে না হইতে একটি সুশিক্ষিত ও সদ্বংশজাত শিক্ষক নিযুক্ত করিয়া দেন। তিনি দিবা রাত্রি আমাদের বাটিতে থাকিতেন এবং অনবরত আমাকে তাঁহার সঙ্গে রাখিয়া নানাপ্রকার সদুপদেশ ও শিক্ষা প্রদান করিতেন। তিনি আমার চরিত্র, পাঠে মনঃসংযোগ ও অধ্যবসায় প্রভৃতি দেখিয়া আমার পিতার নিকট সর্ব্বদা বলিতেন যে, এরূপ বুদ্ধিমান বালক সহস্রের মধ্যে একটিও পাওয়া যায় কি না, সন্দেহ। সপ্তম বর্ষ বয়ঃক্রমের সময় একটি শুভদিন দেখিয়া পিতা আমাকে কলিকাতার একটি প্রধান বিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট করাইয়া দিলেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ দুই তিন দিবসের মধ্যেই আমার বুদ্ধির সবিশেষ পরিচয় পাইয়া আমাকে অতিশয় ভালবাসিতে লাগিলেন। এক দিবস শিক্ষাবিভাগের একজন কর্মচারী আমাদিগের পরীক্ষা লইলেন, এবং যাইবার সময় আমার প্রতি লক্ষ্য করিয়া শিক্ষক মহাশয়কে বলিয়া গেলেন, “আমি যতদিন শিক্ষাবিভাগে কর্ম্ম করিতেছি, তাহার মধ্যে এরূপ বুদ্ধিমান বালক আমার নয়নগোচর হয় নাই। যদি ইহার চরিত্র কলুষিত না হয়, তাহা হইলে এই বালকটি বিশ্ব-বিদ্যালয়ের একটি উজ্জ্বল রত্ন হইবে। 

আমি এই কথাগুলি শুনিলাম; শুনিয়া আমার মনে কেমন এক প্রকার আনন্দ হইল 

নূতন ভাবের আবির্ভাব হইল। কিন্তু সেই ভাব মনে গোপন রাখিতে পারিলাম না। বাটীতে যাইবামাত্র প্রথমে মাতা, তৎপরে শিক্ষককে সবিশেষ বলিলাম। তাঁহারা সকলেই শুনিলেন, কিন্তু কেহই কিছু বলিলেন না। 

পূর্ব্বে আমার হৃদয়ে যে ভাবের ছায়া পড়িয়াছিল, ক্রমে তাহা আরও স্পষ্টরূপে প্রত্যক্ষ হইতে লাগিল। মনে মনে সৰ্ব্বদা ভাবিতে লাগিলাম, আমার মত বুদ্ধিমান বালক আর নাই। আমি যেরূপ লেখাপড়া শিখিতেছি, সেরূপ ভাবে লেখাপড়া করা অন্যের অসাধ্য। 

এইরূপে বৎসর বৎসর সুখ্যাতির সহিত পারিতোষিক পাইয়া প্রথম শ্রেণীতে উত্থিত হইলাম। তখন আমার বয়ঃক্রম চতুর্দ্দশ বৎসর, কিন্তু ১৬ বৎসর বয়ঃক্রম না হইলে সেই সময়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা দিবার অধিকার ছিল না; সুতরাং সেই শ্রেণীতে তিন বৎসর কাল থাকিতে হইল। সেই সময় আমার শিক্ষক—যিনি আমাদের বাটীতে থাকিয়া নিয়ত আমার উন্নতি চেষ্টা করিতেন — যাঁহার যত্ন ও পরিশ্রমের গুণে সকলেই আমাকে ভালবাসিতেন, তিনি—হঠাৎ কাল-কবলে পতিত হইলেন। পিতা আমাকে একজন অধ্যবসায়-শালী বিদ্যার্থী জানিয়া আর অন্য শিক্ষক নিযুক্ত করা আবশ্যক বিবেচনা করিলেন না। আমিও ক্রমে ক্রমে আমার সম্পূর্ণ ইচ্ছার বশবৰ্ত্তী হইয়া চলিতে লাগিলাম। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

“আমার বয়ঃক্রম ১৬ বৎসর হইল, এই বৎসর প্রবেশিকা পরীক্ষা দিতে হইবে। মনে মনে আমার পিতা মাতা আশা করিতে লাগিলেন যে, আমি বৎসরের শেষে ঐ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইব, এবং নিয়মিত মাসিক বৃত্তি পাইব। আমারও মন হইতে সেই আশা মুহূর্ত্তের নিমিত্ত তিরোহিত হইল না; কারণ আমি বাল্যকাল হইতে পিতা, মাতা, শিক্ষক ও আত্মীয়স্বজন প্রভৃতি সকলের মুখেই শুনিতাম, “আমার মত বুদ্ধিমান বালক অতি অল্পই দেখিতে পাওয়া যায়।’ এই সকল কথা শুনিতে শুনিতে আমার মনে ক্রমেই ধারণা হইয়াছিল যে, আমি যতদূর বিদ্যাভ্যাস করিয়াছি, তাহা অন্যের অসাধ্য; আর যত পড়ি, বা না পড়ি, পরীক্ষায় নিশ্চয়ই উত্তীর্ণ হইব এবং মাসিক বৃত্তি প্রাপ্ত হইয়া পিতা মাতার বহুকাল-সেবিতা আশালতাকে ফলবতী করিব। 

এই সময় ঘটনাক্রমে ঐ শ্রেণীতে আমার একজন সঙ্গী মিলিল। ইঁহার নাম কেদারনাথ বসু। কেদারনাথ ৫ বৎসর এই শ্রেণীতে পড়িতেছেন। প্রত্যেক বৎসরেই পরীক্ষা দেন, কিন্তু তাঁহার নিজের দোষেই হউক বা তাঁহার পরীক্ষকের দোযেই হউক, একবারও উত্তীর্ণ হইতে পারেন না। কেদার অতিশয় গল্প-পটু। তাঁহার গল্প একবার শুনিতে আরম্ভ করিলে, শেষ না, করিয়া কাহারও উঠিয়া যাইতে ইচ্ছা হয় না; বরং তাঁহার হাবভাব দেখিয়া মিষ্ট মিষ্ট কথাগুলি শুনিয়া, হাসিতে হাসিতে পেটের ভিতর বেদনা উপস্থিত হয়। তাঁহার গল্প যিনি একবার শুনিয়াছেন, তিনি মুহূর্তের জন্যও তাঁহাকে ভুলিতে পারিবেন না। ইহা ব্যতীত তিনি অতি উত্তম গান করিতে ও বাজাইতে পারিতেন। তাঁহার গান ও গল্প শুনিবার নিমিত্ত বালকগণ তাঁহাকে অতিশয় যত্ন করিত এবং তিনিও সকল সময়েই অনুরোধ রক্ষা করিতেন। বর্তমান গায়ক-মণ্ডলীর মত তাঁহার অহঙ্কার বা আপত্তি ছিল না। 

কেদারের কিন্তু দুইটি মহৎ দোষ ছিল, তাহা বালকগণ অবগত ছিল না, আমিও পূর্ব্বে তাহার কিছুমাত্র বুঝিতে সমর্থ হই নাই। তিনি সকলকে লুকাইয়া কখন কখন একটু একটু মদ্য পান করিতেন এবং প্রায়ই সন্ধ্যার পর, কখনও বা অবকাশ-মত দিবাভাগে তাঁহার কোন বন্ধুর বাটীতে যাইবেন বলিয়া বাটী হইতে বহির্গত হইতেন, কিন্তু সেই সময় কেদারকে তাঁহার কোনও বন্ধুর বাটীতে দেখা যাইত না; বরং দুই এক দিবস সন্ধ্যার পর তাঁহাকে কখন হাড়কাটা গলিতে, কখন চিৎপুর রাস্তায়, কখন বা সোণা গাছিতে কেহ কেহ দেখিয়াছেন, এরূপ শুনা গিয়াছে। কেদার সর্ব্বদা পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন থাকিতেন। কি গ্রীষ্মকাল কি বর্ষাকাল, সকল সময়েই তাঁহার পায়ে বিলাতী বার্ণিস করা চক্চকে জুতা ও পরিষ্কার সাদা মোজা দেখা যাইত। তাঁহার গায়ে যে কামিজটা ও কোঁচান চাদর খানি থাকিত, তাহা কেহ কখন একটুমাত্র অপরিষ্কার দেখে নাই। সোণার বোতামগুলি ও চেন ছড়াটি সকল সময়েই ঝক্‌ঝক্ করিত। কেদারের মস্তকের চুলগুলি সতত দুইভাগে বিভক্ত থাকিত, ও তাহা হইতে সুগন্ধি গোলাপের গন্ধ ভুর্ ভুর্ করিয়া সর্ব্বদা বাহির হইত। 

গত তিন বৎসর হইতে আমার হৃদয়ে যে সর্ব্বনাশের বীজ রোপিত হইয়াছিল, তাহা ক্রমে অঙ্কুরিত হইয়া পরিবর্দ্ধিত হইতে লাগিল। কেদারের সহিত অল্পে অল্পে আমার যে প্রকার বন্ধুতা ও ভালবাসা স্থাপিত হইয়াছিল, এখন ক্রমে ক্রমে তাহা আরও গাঢ়তর হইতে লাগিল। কেদার আমার সহিত যেরূপ ভাবভঙ্গী দেখাইতে লাগিলেন, আমার উপর সতত যেরূপ দয়া প্রকাশ করিতে লাগিলেন, সর্ব্বদা যেরূপ আমার উপকারের চেষ্টায় মন ও প্রাণ অর্পণ করিতে লাগিলেন, তাহাতে আমি মুহূর্তের জন্যও বুঝিতে পারিলাম না যে, কেদার হইতে আমার কোনও রূপ অনিষ্ট সংঘটিত হইবে, অথবা তাঁহার দ্বারা আমার সর্ব্বনাশের দ্বার উদ্ঘাটিত হইবে। 

ক্রমে ক্রমে কেদার আমার একজন পরম বন্ধু হইয়া উঠিলেন। অবিরত উভয়ে একত্রে থাকিতে ইচ্ছা হইল। এমন কি কেদার যদি এক দিবস স্কুলে না আসিতেন, এক দিবস যদি তাঁহাকে দেখিতে না পাইতাম, তাহা হইলে সেই দিবস আমার মনে কি প্রকার কষ্ট হইত, তাহা আমিই জানিতাম। যে পর্য্যন্ত তাঁহাকে পুনরায় দেখিতে না পাইতাম, সেই পর্যন্ত কষ্টের লাঘব হইত না। 

এইরূপে দুই বৎসর অতীত হইয়া গেল, ক্রমে আমরা উভয়েই উভয়ের বাটীতে যাতায়াত করিতে আরম্ভ করিলাম; একত্রে শয়ন, একত্রে উপবেশন ও একত্রে ভ্রমণ করিতে লাগিলাম। সন্ধ্যার সময় কখন ইডেন উদ্যানে যাইয়া মনোহর বাদ্য শ্রবণ করিতে করিতে কলিকাতা নগরীর প্রায় সমস্ত প্রধান প্রধান ইংরাজ, বাঙ্গালী, মুসলমান, ইহুদি প্রভৃতির সহিত পদচারণ করিতে লাগিলাম; কখন বিড স্কোয়ার, ওয়েলিংটন স্কোয়ার প্রভৃতি স্থানে গমন করিয়া, হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান প্রভৃতির ধর্ম্ম-বিবাদ শ্রবণ করিতে লাগিলাম; এবং কখন বা কলনাদিনী ভাগীরথীর তীরে বসিয়া প্রকৃতির সায়ংকালীন মনোহর শোভা সন্দর্শন করিতে করিতে দিনযাপন করিতে লাগিলাম। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

“এক দিবস সন্ধ্যার পর আমরা উভয়ে গল্প করিতে করিতে চিৎপুর রাস্তা দিয়া গমন করিতেছি, এমন সময় “কেদারবাবু”, “কেদারবাবু” এই শব্দ আমার কর্ণ কুহরে প্রবেশ করিল। পশ্চাতে ফিরিয়া দেখিলাম, কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না। পার্শ্বে বা সম্মুখে কাহাকেও লক্ষ্য হইল না; কিন্তু দুই এক পদ অগ্রসর হইতে না হইতেই আমার “কেদারবাবু” শব্দটি শুনিতে পাইলাম। স্বর বামাকণ্ঠ-নিঃসৃত বলিয়া বোধ হইল। ঊর্দ্ধে লক্ষ্য করিয়া দেখিলাম, ইষ্টকনির্ম্মিত একটি দ্বিতল গৃহের বারাণ্ডায় ৮।১০টি স্ত্রীলোক উত্তম উত্তম বসন ভূষণে ভূষিতা হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। তাহাদের মধ্যে একটি স্ত্রীলোক বারম্বার কেদারবাবুকে সম্বোধন করিতেছে। 

বাল্যকাল হইতে উহাদিগকে আমি চিৎপুর রাস্তার দুই পার্শ্বে ও অন্যান্য স্থানে দেখিয়া আসিতেছি। উহারা এই নগরীর বিশেষ অনিষ্টকারী বারবনিতা বলিয়া অতিশয় ঘৃণাও করিয়া থাকি। বাল্যকাল হইতে আমার বিশ্বাস যে, উহাদিগের বাটির ভিতর একবার প্রবেশ করিলে, মানবগণকে ভয়ানক বিপদে পতিত হইতে হয়। অদ্য উহাদিগের মধ্যে একজন স্ত্রীলোক কেদারবাবুকে ডাকিতেছে দেখিয়া আমি অতিশয় বিস্মিত হইলাম ও সেইস্থানে দাঁড়াইলাম। কেদারবাবু উহাদিগের মধ্যে একজনকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “আমাকে ডাকিতেছ কেন?” সে উত্তর করিল, “বিশেষ প্রয়োজন না থাকিলে, আর আপনাকে ডাকিব কেন? আপনি যদি অনুগ্রহ পূর্ব্বক একবার উপরে আসেন, তাহা হইলে বড়ই উপকৃত হই। বিশেষ আবশ্যক ভিন্ন আপনাকে বিরক্ত করিতে সাহসী হইতেছি না।” 

কেদারবাবু উত্তর করিলেন, “আমি এখন যাইতে পারি না; কারণ আমার সহিত এই বন্ধুটি আছেন, ইঁহাকে এই স্থানে রাখিয়া যাইতে পারিব না, অথচ ইঁহাকে সমভিব্যাহারে লইয়া যাইতেও ইচ্ছা করি না। যদি তোমার কোন বিশেষ আবশ্যক থাকে, তাহা হইলে তুমি আমাদিগের বাটীতে যাইয়া, দেওয়ানজিকে বলিলেই তোমার উদ্দেশ্য সাধন হইবে।” 

কেদারবাবু এই সময় আমাকে আস্তে আস্তে বলিলেন, — “এই বাড়ীটি আমাদিগের, উহারা আমাদিগের প্রজা। বোধ হয় কোন প্রকার কষ্ট হইয়াছে, বা কেহ উহাদিগের উপর কোনও রূপ অত্যাচার করিয়াছে, তাহাই বলিবার নিমিত্ত আমাকে ডাকিতেছে।” 

ঐ স্ত্রীলোকটি পুনরায় বলিল, “কেদারবাবু! বিশেষ আবশ্যক না থাকিলে, আমি আপনাকে ডাকিতাম না, আপনাদিগের বাটিতে যাইতাম। বিশেষ আপনার সহিত একটি ভদ্রলোক রহিয়াছেন দেখিতেছি। তবে নিতান্ত দায়ে পড়িয়াছি, এই জন্য পুনরায় বলিতেছি, যদি আপনার কোন বিশেষ প্রতিবন্ধক না থাকে, তাহা হইলে অনুগ্রহ করিয়া অন্ততঃ দুই মিনিটের নিমিত্ত একবার উপরে আসিলে বিশেষ বাধিত হইব। আর আপনার সঙ্গী ভদ্রলোকটিকেও সঙ্গে লইয়া আসুন। কেবল একটিমাত্র কথা শুনিয়া চলিয়া যাইবেন — বিলম্ব হইবার কোন কারণই নাই।” 

কেদারবাবু আমার প্রতি লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, “চল ভাই, স্ত্রীলোকটি কি বিপদে পড়িয়াছে, একবার যাইয়া দেখিয়া আসি; কিন্তু কোন ক্রমেই দুই মিনিটের অধিক বিলম্ব করিব না।” আমি প্রথমে যাইতে অস্বীকার করিলাম; পরে কেদারবাবুর অনুরোধ কোন প্রকারে লঙ্ঘন করিতে না পারিয়া আমার সম্পূর্ণ অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাটির ভিতর প্রবেশ করিতে স্বীকৃত হইলাম; কিন্তু ভাবিতে লাগিলাম, ‘বাটির ভিতর প্রবেশ করিলেই যেন কিরূপ ঘোর বিপদে পতিত হইতে হইবে।’ এক পা দুই পা করিয়া কেদারবাবুর সহিত বাটির ভিতর প্রবেশ করিলাম। বাল্যকাল হইতে আমার যেরূপ বিশ্বাস ছিল, সে প্রকার কোনরূপ বিপদ দেখিতে পাইলাম না। 

আমি যে কি কুলগ্নে এই বাটির ভিতর প্রবেশ করিলাম, তাহা তখন বুঝিতে পারিলাম না, পরে কিন্তু বুঝিয়াছিলাম। কেদারের উপর আমার অটল বিশ্বাস ও ভালবাসার ফল ক্রমে ফলিয়াছিল। তিন বৎসর পূর্ব্বের রোপিত বীজের অঙ্কুরের লক্ষণ অদ্য হইতে প্রকাশিত হইতে আরম্ভ হইল। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

কেদারবাবুর পশ্চাৎ পশ্চাৎ আমি বাটীর ভিতর প্রবেশ করিয়া বিনা কষ্টে উপরে উঠিলাম। ঐ বাটীর ভিতরের সমস্ত অবস্থা কেদারবাবুর ভালরূপ জানা ছিল বলিয়া বোধ হইল; নতুবা যে প্রকার সোপান-শ্রেণী দিয়া উঠিতে হইল, কোনও নূতন লোক হইলে সেই বাড়ীর লোকের সাহায্য ব্যতিরেকে কখনই উহা খুঁজিয়া লইতে সমর্থ হইত না। কিন্তু কেদারের তাহা করিতে হইল না। 

উপরে উঠিয়া দেখিলাম, একটি কক্ষের দ্বারে সেই স্ত্রীলোকটি দাঁড়াইয়া আছে। সে আমাদিগকে দেখিবামাত্র অতিশয় ব্যস্ত হইয়া যত্নের সহিত অভ্যর্থনা করিল ও অগ্রে অগ্রে ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল। কেদার ও আমি তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ঘরের ভিতর গমন করিলাম। সে আমাদিগকে বসিতে বলিল। 

এই ঘরটি উত্তর দক্ষিণ লম্বা, ছোটও নহে, অথচ অতিশয় বড়ও নহে; কিন্তু পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন ও উত্তমরূপ সজ্জিত। সাদা ধপধপে দেওয়ালের ধারে ধারে সবুজ বর্ণের লতা পাতা ও ফুল দেখা যাইতেছে। আটখানি বড় বড় বিলাতী ছবি ঘরের পূর্ব্ব ও পশ্চিম পার্শ্বে দেওয়ালের গায় সাজান রহিয়াছে, ঘরের মধ্যস্থলে লম্বমান প্রজ্বলিত ঝাড়ের আলো উহার উপর পড়িতেছে; বোধ হইতেছে, ছবিগুলি চিত্রকরের হস্তে চিত্রিত নহে, ঈশ্বরের সৃষ্ট চেতন পদার্থ। ঝাড়টি দেখিতে অতি পরিপাটী, ৩২টি ডাল আছে ৩২ রঙ্গের — তাহার মধ্যে ৪টি মাত্র জ্বলিতেছে। উত্তর দিকের দেওয়ালের গায়ে একখানি বৃহৎ আয়না, দেওয়াল ব্যাপিয়া মাথা হেলানভাবে রহিয়াছে; ইহার ভিতর ঐ ঘরের সমস্ত দ্রব্য দেখা যাইতেছে। দক্ষিণ দিকে একটি দরজার মধ্য দিয়া, অন্য আর একটি ঘরের ভিতরস্থিত একখানি খাট দেখা যাইতেছে। উহা একটি পরিষ্কার মশারির দ্বারা আচ্ছাদিত। ঐ দরজার একপার্শ্বে একটি মেহগ্নি কাষ্ঠের আলমারি ঝক্ ঝক্ করিতেছে— তাহার উপর কতকগুলি কাচের বাসন সাজান রহিয়াছে। লম্বা ঘরের মেজেতে একখানি সতরঞ্চ বিস্তৃত ও উহা একখানি পরিষ্কার সাদা চাদরে আবৃত রহিয়াছে। উহার উপর বড় বড় বালিস সারি সারি সাজান রহিয়াছে, এবং একপার্শ্বে কয়েকটি রূপার বাঁধা হুঁকা পিত্তল-নির্ম্মিত মনুষ্য-প্রতিকৃতির হস্তে বৈঠকের উপর শোভা পাইতেছে। কেদারবাবু সেইস্থানে ঐ সতরঞ্চের উপর একটি বালিসে বাম কনুই ভর দিয়া অৰ্দ্ধশায়িতাবস্থায় বসিলেন; আমিও তাঁহার নিকট নিশ্চিন্তভাবে বসিয়া রহিলাম। “রামদাস পান নিয়ে এস” বলিয়া একবার ডাকিয়া স্ত্রীলোকটি আমাদের উভয়েরই গা ঘেঁসিয়া বসিল। 

ঐ স্ত্রীলোকটির নাম গোলাপ। গোলাপের রূপ বর্ণন করিবার আমার ইচ্ছা নাই, কারণ পাঠক মহাশয়গণ যে মুখে শত শত প্রাতঃস্মরণীয় রমণীর রূপ-বর্ণন পড়িয়াছেন— সহস্ৰ সহস্ৰ পতিপ্রাণা সাধ্বী স্ত্রীলোকের রূপের মাধুরী কীৰ্ত্তন করিয়াছেন, সেই মুখে চিৎপুর রাস্তার একটি বারবনিতার রূপবর্ণন পড়াইয়া তাঁহার রসনাকে কলুষিত করিতে ইচ্ছা করি না। তবে এইমাত্র বলিতে পারি যে, কেদার ইহার রূপের অতিশয় পক্ষপাতী ছিল। পরে আমিও সকলের নিকট বলিয়াছি, গোলাপের মত সুন্দরী স্ত্রীলোক কলিকাতায় আর দেখিতে পাওয়া যায় না। তখন আমি আমার চক্ষে তাহাকে যদিও অতিশয় সুন্দরী দেখিতাম সত্য; কিন্তু আমার বন্ধুগণ মধ্যে মধ্যে আমাকে বলিতেন, “গোলাপকে সুন্দরী বলা যায় না, সে সুন্দরী নহে। তাহার বর্ণ ব্যতীত অন্য অঙ্গসৌষ্ঠব কিছুমাত্র নাই। যৌবনের প্রারম্ভে সাধারণতঃ স্ত্রীলোকমাত্রেই যেরূপ দেখায়, এও তাই।” এ সকল কথা আমার ভাল লাগিত না, আমি তাহাদিগের উপর অসন্তুষ্ট হইতাম। যাহা হউক, দেখিতে দেখিতে গোলাপের ‘সখের খানসামা’ রামদাস পানের বাটা আনিয়া গোলাপের সম্মুখে রাখিয়া দিল, এবং পার্শ্বস্থিত হুঁকার উপর হইতে একটি কলিকা উঠাইয়া লইয়া তামাক সাজিবার নিমিত্ত বাহিরে গমন করিল। গোলাপ পান তৈয়ার করিয়া প্রথমেই আমাকে দিল। উহার হস্ত হইতে পান লইতে আমার লজ্জা ও ঘৃণাবোধ হইতে লাগিল। আমি সঙ্কুচিত হইলাম, কিন্তু কেদারবাবুর অনুরোধে আমি উহা গ্রহণ করিলাম। কেদারবাবু একটি লইলেন, পরিশেষে গোলাপও আপনাকে ফাঁকি দিল না। রামদাস তামাক সাজিয়া আনিয়া একটি হুঁকা কেদারবাবুর হস্তে দিয়া প্রস্থান করিল। পান চিবাইতে চিবাইতে তিনি অল্পে অল্পে ধূমপান করিতে লাগিলেন। গোলাপ নানাপ্রকার মিষ্ট বাক্যে আস্তে আস্তে কেদারবাবুর সহিত গল্প করিতে আরম্ভ করিল; মধ্যে মধ্যে আমাকেও দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করিল। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

‘গোলাপের স্বর এরূপ মৃদু ও মধুর, এবং কথাবার্তা এরূপ সরল, বোধ হইতে লাগিল যে, কেহই তাহাকে অবিশ্বাসিনী বা কপটাচারিণী মনে করিতে পারে না। আমি তাহার মুখ-নিঃসৃত মিষ্ট মিষ্ট কথাগুলি শ্রবণ করিয়া, মনে মনে অতিশয় সন্তুষ্ট হইলাম। এইরূপে প্রায় অৰ্দ্ধঘণ্টা অতিবাহিত হইল, কিন্তু কি নিমিত্ত গোলাপ কেদারবাবুকে ডাকিয়াছে, এ পর্যন্ত তাহার বিন্দুবিসর্গও জানিতে পারিলাম না। দেখিতে দেখিতে কেদারবাবু উঠিয়া বাহিরের বারান্দায় গমন করিলেন, কিন্তু তাঁহার হস্তস্থিত হুঁকা পরিত্যাগ করিলেন না; গোলাপও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ প্রস্থান করিল। আমি সেই স্থানেই বসিয়া রহিলাম, এবং মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম, ‘বাল্যকাল হইতে আমার দৃঢ় বিশ্বাসের উপর নির্ভর করিয়া রাত্রিদিন আমি যে সকল স্ত্রীলোককে অতিশয় ঘৃণার চক্ষে দেখিতাম — যাহাদিগের ছায়া পর্যন্ত স্পর্শ করিলে মহাপাপ সংঘটিত হইবে, ভাবিতাম— যাহাদিগের বাটীর ভিতর এক পদ অগ্রসর হইলে ভয়ানক বিপদজালে জড়ীভূত হইব বলিয়া বিশ্বাস করিতাম— এখন দেখিতেছি, সেই ভাবনা ও বিশ্বাস সম্পূর্ণ অমূলকমাত্র। যে স্ত্রীলোক এরূপ সরল ও সাধু ভাবে আমাদিগের সহিত আলাপ পরিচয় করিতেছে— যাহার হৃদয়ের মধ্যস্থিত স্তর পর্য্যন্ত দৃষ্টিগোচর হইতেছে—তাহার নিকট কোন প্রকারেই অনিষ্ট আশঙ্কার সম্ভাবনা নাই।’ আমি এইরূপ চিন্তা করিতেছি ও তাহার ঘরের সৌন্দর্য্য অনিমেষ-লোচনে দর্শন করিতেছি, এমন সময়ে বারান্দা হইতে উভয়েই প্রত্যাগমন করিলেন। কেদার হুঁকাটি রামদাসের হস্তে অর্পণ করিয়া আমাকে কহিলেন, “চল ভাই, অনেক বিলম্ব হইয়াছে।” 

গোলাপ কেদারবাবুকে সম্বোধন করিয়া বলিল, “কেদারবাবু! আমিও মহাশয়দিগকে আর অধিক কষ্ট দিতে ইচ্ছা করি না। যাহা হউক, অনেকক্ষণ হইতে আপনাদিগকে কষ্ট দিতেছি বলিয়া অসন্তুষ্ট হইবেন না, ক্ষমা করিবেন। স্ত্রীলোক সহস্র দোষ করিলেও পুরুষের নিকট ক্ষমার্হা বলিয়াই এতদূর সাহসী হইয়াছি, এবং সেই সাহসের উপর নির্ভর করিয়াই পুনরায় বলিতেছি, যদি অনুগ্রহ করিয়া কল্য আর একবার এখানে পদার্পণ করেন, তাহা হইলে বড়ই উপকৃত ও বাধিত হইব, এবং মনে ভাবিব যে, আমার উপর আপনার সাতিশয় অনুগ্রহ আছে।” গোলাপ পরিশেষে আমাকে লক্ষ্য করিয়া বলিল, “মহাশয়! আপনার সহিত আমার বিশেষ পরিচয় নাই। বিশেষতঃ আমরা যেরূপ নিন্দনীয় পথ অবলম্বন করিয়াছি, তাহাতে মহাশয়দিগের ন্যায় সদাশয় ব্যক্তিগণকে কোন বিষয়ে বিশেষ অনুরোধ করিতে সাহস হয় না; তবে কেদার বাবু মহাশয়ের বন্ধু বলিয়াই এইমাত্র বলিতে সাহসী হইতেছি। অনুগ্রহ করিয়া কেদার বাবুর সহিত কল্য এখানে একবার আসিলে আমি আমাকে নিতান্ত শ্লাঘ্য মনে করিব, এবং আপনাকেও কেদার বাবুর সদৃশ আমার একজন পরম বন্ধু বলিয়া হৃদয়ে স্থান দিব।” এই বলিয়া আমাদিগকে ৪টি করিয়া পান প্রদান করিলে আমি ও কেদার বাবু সেই স্থান পরিত্যাগ করিলাম। গোলাপ নীচের দরজা পর্য্যন্ত আমাদিগের সঙ্গে সঙ্গে আসিল। সেই দিবস আমরা উভয়েই আপন আপন বাটীতে গমন করিলাম। বাল্যকাল হইতে যে বিশ্বাস আমার হৃদয় অধিকার করিয়াছিল, অদ্য হইতে তাহা তিরোহিত হইতে আরম্ভ হইল। 

পরদিন সন্ধ্যার পর কেদারের সহিত পুনরায় গোলাপের বাটীতে গেলাম। অদ্য কেদারকে আর কিছুই বলিতে হইল না, দ্বিরুক্তিমাত্র না করিয়া কেদারের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গোলাপের বাড়ীতে প্রবেশ করিলাম। সেদিন গোলাপের মিষ্ট বচনে, সাধু ব্যবহারে ও যত্নে, আরও সন্তুষ্ট হইলাম। প্রায় দুই ঘণ্টাকাল সেইস্থানে অতিবাহিত করিয়া চলিয়া আসিবার কালে, গোলাপ পুনরায় পরদিবস আসিবার জন্য অনুরোধ করিল। 

তৃতীয় দিবস সেইস্থানে গমন করিয়া আরও প্রীত হইলাম। এইরূপে প্রত্যহ গোলাপের বাড়ী যাই, দুই একঘণ্টা সেই স্থানে থাকিয়া নানাপ্রকার গল্প, হাস্য ও কৌতুক করি, এবং প্রত্যহ নানাপ্রকার সুখাদ্য দ্রব্যাদি ভক্ষণ করি। এখন ঘৃণা ও লজ্জা আর নাই, তবে বাটীর ভিতরে যাইবার বা বাহিরে আসিবার সময় বস্ত্র দ্বারা মুখ আচ্ছাদিত করি মাত্র; ভয়—- পাছে কেহ দেখিতে পায়। যাহা হউক, গোলাপের বাটী হইতে আসিবার সময় যে দিবস বৃষ্টি হয়, সেই দিবস গোলাপ তাহার নিজ ব্যয়ে গাড়ি করিয়া আমাদিগকে আপন আপন বাটীতে পাঠাইয়া দেয়। 

এইরূপে প্রায় একমাস অতীত হইল, দিন দিন ক্রমে ক্রমে গোলাপের সহিত ভালবাসা বাড়িতে লাগিল, সঙ্গে সঙ্গে আমার বাল্যকালের বিশ্বাস সুদূরে পলায়ন করিল। ক্রমে আরও ছয়মাস কাটিয়া গেল। এক দিবস সন্ধ্যার পর আমি, কেদার ও গোলাপ বসিয়া গল্প করিতেছি, এমন সময় কামিনী নাম্নী আর একটি স্ত্রীলোক অন্য ঘর হইতে আসিয়া আমাদিগের নিকট বসিল এবং কেদার বাবুকে বলিল, “বাবু! আজ আমাদিগকে কিছু খাওয়াইতে হইবে।” কেদার সম্মত হইল, এবং রামদাসকে চুপে চুপে কি বলিয়া দিল। রামদাস প্রস্থান করিল ও দশ মিনিট অতীত হইতে না হইতেই দুইটি বোতল এবং কিছু খাদ্যসামগ্রী লইয়া পুনরায় উপস্থিত হইল। কেদার ঐ সকল দ্রব্য গ্রহণ করিয়া গোলাপ ও কামিনীর সহিত একত্রে মদ্য পান করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। ঐ বাটীর অপর দুই একটি স্ত্রীলোকও আসিয়া উহাতে যোগ দিল। 

আমি এ পর্যন্ত উহার আস্বাদন পাই নাই; কারণ বাল্যকাল হইতে সুরার উপর আমার অত্যন্ত ঘৃণা ছিল। যে স্থানে কেহ সুরাপান করিত, আমি সেইস্থান ঘৃণার সহিত পরিত্যাগ করিতাম। এমন কি, সুরাপায়ী ব্যক্তির ছায়া পর্যন্ত স্পর্শ করিতাম না। অদ্য কিন্তু আমার আর সেরূপ মনের ভাব রহিল না। ঐ স্থান ঘৃণার সহিত পরিত্যাগ করা দূরে থাকুক, আমিও তাহাদের সহিত একত্র বসিয়া নিজ হস্তে সকলকে বোতল হইতে সুরা ঢালিয়া দিতে লাগিলাম, সকলে পান করিতে লাগিল; আমি কিন্তু সে দিবস পান করিলাম না। 

দ্বিতীয় দিবস আবার সুরাপানের উদ্যোগ হইল, সুরা আসিল, সকলে পান করিতে লাগিল। আমি সকলের—- বিশেষতঃ গোলাপের অনুরোধ লঙ্ঘন করিতে না পারিয়া জিহ্বা দ্বারা স্পর্শ করিলাম মাত্র, কিন্তু পান করিলাম না। তৃতীয় দিবস মুখে লইয়া ফেলিয়া দিলাম, চতুর্থ দিবস অল্প মাত্র কণ্ঠদেশ পর্যন্ত নামিল, পঞ্চম দিবস উদরস্থ হইল। ক্রমে এক মাসের মধ্যে আমি অন্য সকলের ন্যায় একজন সমান অংশীদার হইয়া উঠিলাম। উহার আনুষঙ্গিক যে যে দোষ হইতে পারে, তাহার সকলগুলিতেই আমার অধিকার জন্মিল। গোলাপকে এত দিবস পর্যন্ত যেরূপ ভাবে দেখিতাম, এখন হইতে তাহাকে আরও সহস্রগুণে সুন্দরী দেখিতে লাগিলাম- তাহাকে আরও ভালবাসিতে লাগিলাম। ক্রমে আমার কপাল পুড়িল, লজ্জা, ভয় ও ধর্ম্মের মস্তকে পদাঘাত করিয়া গোলাপ আমার সর্ব্বনাশ করিল। তখন হৃদয় হইতে সমস্ত ভাবনা দূরীভূত করিয়া কেবলমাত্র গোলাপের ভাবনাতেই রাত্রিদিন অতিবাহিত করিতে লাগিলাম। এই সময়ে এক দিবস প্রাতঃকালে সোণাগাছিতে অতিশয় গোলমাল শুনিতে পাইলাম। দেখিলাম, পুলিসের কর্ম্মচারীগণ সেইদিকে যাইতেছে, সুতরাং আমিও তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিলাম। দেখিলাম, একটি দ্বিতল বাটীর প্রাঙ্গণে এক ব্যক্তি মৃত অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে, তাহার হস্ত, পদ ও মস্তক চূর্ণ হইয়া গিয়াছে। আমি তাহার নিকটে গিয়া দেখিলাম, দেখিয়া চিনিলাম যে, আমার সেই পরম বন্ধু, — কেদারবাবুরই এই দশা হইয়াছে। যাঁহাকে এক দণ্ড না দেখিয়া থাকিতে পারিতাম না, তাঁহার এই দশা দেখিয়া আমার মনে যেরূপ দুঃখ হইল, তাহা বলিতে পারি না। সেই দিন হইতে এক বৎসরের মধ্যে এমন একদিনও যায় নাই, যে দিন কেদারের নিমিত্ত আমার চক্ষু দিয়া অন্ততঃ এক বিন্দু জলও না পড়িয়াছে! যাহা হউক, উক্ত মৃতদেহ মেডিকেল কলেজে পরীক্ষার্থ প্রেরিত হইলে, পুলিস কর্তৃক তাঁহার মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান হইতে লাগিল। পরে শুনিয়াছিলাম, ঐ দ্বিতল বাটীতে কতকগুলি বার-বনিতা বাস করে, কেদারবাবু তাহাদিগের একজনের ঘরে বসিয়া আমোদ প্রমোদ ও সুরাপান করিয়া অতিশয় উন্মত্ত হইয়াছিলেন, এবং কাহারও কথা না শুনিয়া, পক্ষীগণ যেরূপ শূন্যমার্গে উড্ডীয়মান হইয়া থাকে, সেইরূপ উড়িতে চেষ্টা করিয়াছিলেন ও সেইস্থান হইতে পড়িয়া তাহার এইরূপ দশা হইয়াছিল। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ

“এখন সন্ধ্যার পর দুই এক ঘণ্টা গোলাপের বাটীতে থাকিয়া আর তৃপ্তি হয় না, ক্রমে দিনমানে যাইতে আরম্ভ করিলাম। স্কুলে যাওয়া বন্ধ হইল; প্রত্যহ স্কুলে যাইবার নিয়মিত সময়ে বাটী হইতে বহির্গত হইয়া, স্কুলে যাওয়ার পরিবর্তে গোলাপের বাটীতে উপস্থিত হই। সমস্ত দিবস সেইস্থানে থাকিয়া, আমোদ আহ্লাদ করিয়া, বৈকালে বাটীতে ফিরিয়া আসি। পিতা মাতা মনে করিতে লাগিলেন, আমি পূৰ্ব্বমত স্কুলে যাইতেছি, এবং পূৰ্ব্বমত পাঠে মনঃসংযোগ করিতেছি। কিন্তু আমার যে গুণ বাড়িয়াছে, ইংরাজী শিক্ষকের পরিবর্তে গোলাপ যে আমাকে শিক্ষা দিতেছে, তাহা তাঁহারা মুহূর্তের জন্যও বুঝিতে পারিলেন না। এইরূপে বৎসর অতীত হইয়া গেল, প্রবেশিকা পরীক্ষার দিন আসিয়া উপস্থিত হইল। পরীক্ষা দিতে হইবে, কিন্তু ছয়মাস কাল পুস্তক হস্তে করি নাই, স্কুলের পথে পদার্পণও করি নাই। কিরূপে পরীক্ষা দিয়া উত্তীর্ণ হইব? এই সকল বিষয় একবার ভাবিলাম। মনে মনে একটু আক্ষেপ হইল, অনুশোচনা আসিয়াও উপস্থিত হইল। ভাবিতে ভাবিতে গোলাপের বাটীতে গেলাম। গোলাপ আমার মনের ভাব বুঝিল— আমাকে সুস্থ করিবার চেষ্টা করিল। এক গ্লাস সুরা আনিয়া আমার সম্মুখে ধরিল, আমি পান করিলাম, সকল দুঃখ ও ভাবনা ভুলিলাম। আমার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির প্রভাবে পরিশেষে পাস হইবার একটি অতি সহজ উপায়ও বাহির করিয়া রাখিলাম। 

স্কুলের সকলে পরীক্ষা দিল। পরীক্ষার ফল বাহির হইল। আমি সেই সময়ে যে উপায় ভাবিয়া রাখিয়াছিলাম, সেই উপায় অবলম্বন করিয়া দুষ্কর্ম্মের অন্য আর এক সোপানে পদার্পণ করিলাম। পিতাকে বলিলাম, “আমি পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হইয়াছি।” তিনি আমার কথায় বিশ্বাস করিলেন, মনে মনে সন্তুষ্ট হইলেন। সেই সময় পিতা আমার বিবাহের বন্দোবস্ত করিলেন,—আমিও শুনিলাম, আমার বিবাহ হইবে। শুনিয়াছি, বিবাহের কথা শুনিলে সকলে আহ্লাদিত হন, কিন্তু আমার মনে যে কি ভয়ানক দুঃখ আসিয়া উপস্থিত হইল, তাহা আমিই জানিলাম— আর যদি কেহ আমার মত অবস্থায় কখন পড়িয়া থাকেন, তাহা হইলে তিনিও বুঝিবেন। কিন্তু কি করি, কিছুই করিতে পারিলাম না; আমার অনভিমতেই বিবাহ হইয়া গেল। প্রতিবেশীগণের নিকট শুনিলাম যে, আমার স্ত্রী পরমা সুন্দরী; কিন্তু গোলাপ অপেক্ষা তাহাকে সুন্দরী বলিয়া আমি বিশ্বাস করিতে পারিলাম না। 

এই বৎসর হইল, গোলাপের সহিত আমার আলাপ হইয়াছে; ইহার মধ্যে গোলাপ আমার নিকট হইতে একটি পয়সাও লয় নাই, অথচ এমন দিন ছিল না যে, সে আমার জন্য একটি টাকাও খরচ না করিয়াছে। সে এক দিবসের জন্য আমার নিকট কিছু প্রার্থনা না করিলেও আমি এখন হইতে তাহাকে কিছু কিছু দিতে আরম্ভ করিলাম। 

পিতা আমাকে এল, এ (এফ্, এ) পড়িতে বলিলেন। আমিও সম্মত হইলাম। আমার উপর তাঁহার এতদূর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, তিনি এক দিবসের নিমিত্ত স্বপ্নেও মনে করিতেন না—- আমি তাঁহাকে প্রতারণা করিতেছি। পুস্তকের মূল্য, স্কুলের বেতন, পরীক্ষার ফি, প্রভৃতি আবশ্যকীয় খরচের টাকা যাহা তিনি দিতেন, আমি তাহা লইয়াই গোলাপের নিকট উপস্থিত হইতাম। এইরূপে আরও দুই বৎসর অতীত হইয়া গেল। এক দিবসের নিমিত্ত স্কুলের পথেও পদার্পণ করিলাম না; কিন্তু ক্রমে পরীক্ষার দিন আসিয়া উপস্থিত হইল। দেখিলাম, সকলে পরীক্ষা দিল। ক্রমে পরীক্ষার ফলও বাহির হইল; আমিও দুষ্কর্ম্মের আর এক পদ ঊর্দ্ধে উত্থিত হইলাম। পূৰ্ব্বমত পিতাকে বুঝাইলাম, আমি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছি। তিনি আমার কথায় সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিলেন, এবং ডাক্তারি শিখিবার নিমিত্ত আমাকে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হইতে বলিলেন। আমি তাঁহার উদ্দেশ্য বুঝিতে পারিলাম — বুঝিলাম যে, তিনি খরচের টাকা বন্ধ করিবার উদ্যোগ করিতেছেন। কারণ সেই সময়ে মেডিকেল কলেজের নিয়ম ছিল, যে ব্যক্তি এল, এ, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া, মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি শিখিবার নিমিত্ত প্রবেশ করিবে, সে কলেজ হইতে নিয়মিত বৃত্তি পাইবে, এবং বিনাবেতনে অধ্যয়ন করিতে পারিবে। আমি মহাবিপদে পড়িলাম; কারণ আমার খরচের টাকা বন্ধ হইলে আমি গোলাপের আর কিছুমাত্র সাহায্য করিতে পারিব না। অধিকন্তু মেডিকেল কলেজে ভর্তি হইবার সময় এল, এ, পরীক্ষার প্রশংসাপত্র দেখাইতে না পারিলে, আমার সকল জুয়াচুরি প্রকাশ হইয়া পড়িবে। এই সকল ভাবিয়া আমি অতিশয় অস্থির হইলাম। 

এই সময়ে আমার অন্তঃকরণে পুনরায় অনুশোচনার ছায়া পড়িল। উহাকে শীঘ্র অন্তঃকরণ হইতে বাহির করিয়া দিবার জন্য কোন প্রকার উপায় উদ্ভাবন নিযুক্ত হইলাম। তখন আমার মন একটু বিকৃত হইল, কিয়ৎক্ষণের নিমিত্ত একটু ভাবনা আসিয়া হৃদয় অধিকার করিল; কিন্তু আমার তীক্ষ্ণবুদ্ধির সাহায্যে তখনই তাহার এক উপায় বাহির করিলাম। জুয়াচুরির জন্য আর এক সোপান ঊর্দ্ধে উঠিলাম। 

অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম- ভবানীপুর হইতে এক ব্যক্তি ঐ বৎসর এল, এ, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছে, তাহার নাম ও আমার নাম একই। মনে মনে স্থির করিলাম, আমি ভবানীপুরে যাইয়া তাহার সহিত দুই এক দিবসের মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপন করিব; ও কৌশলে তাহার প্রশংসাপত্র চুরি করিয়া আনিব। এই পরামর্শ স্থির করিয়া পরদিন ভবানীপুরে গেলাম। সন্ধান করিয়া তাহার বাটীও পাইলাম, দেখিলাম, আমার অভীষ্ট-সিদ্ধির পথ আরও পরিষ্কার হইয়াছে। কারণ দুই তিন দিবস হইল, সেই ব্যক্তির মৃত্যু হইয়াছে। তাহার একমাত্র বৃদ্ধা মাতা পুত্রশোকে অধীরা হইয়া রোদন করিতেছে। 

আমি ধীরে ধীরে বাটীর ভিতর প্রবেশ করিয়া বৃদ্ধার নিকট যাইয়া কুটুম্ব বলিয়া পরিচয় দিলাম— তাঁহার দুঃখে কপট দুঃখ প্রকাশ করিয়া তাঁহাকে সান্ত্বনা করিতেও চেষ্টিত হইলাম। এইরূপে নিত্য নিত্য তাঁহার বাটীতে যাইয়া তাঁহাকে সান্ত্বনা, এবং তাঁহার আবশ্যকীয় খরচের নিমিত্ত দুই এক টাকার সাহায্যও করিতে লাগিলাম। ক্রমে পাঁচ সাত দিবসের মধ্যে বৃদ্ধা আমাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিলেন। এক দিবস তাঁহার ঘরে যত কাগজপত্র ছিল, সমস্ত আনিয়া আমাকে দেখাইলেন ও বলিলেন, “ইহার ভিতর কোন আবশ্যকীয় কাগজপত্র আছে কি না বাছিয়া দাও।” আমার মনোভীষ্ট সিদ্ধ হইল। প্রশংসা পত্রখানি প্রথমেই আপনার পকেটে রাখিলাম। অন্য কাগজপত্র অন্বেষণ করিতে করিতে একখানি ১০ দশ টাকার ও একখানি ১০০ টাকার নোট পাইলাম। দশ টাকার নোটখানি বৃদ্ধাকে দিলাম, সে আমাকে আশীর্ব্বাদ করিল। অপর খানির বিষয় তাহাকে কিছুমাত্র বলিলাম না, সেইখানি লুকাইয়া আনিয়া গোলাপের হস্তে অর্পণ করিলাম। গোলাপ সন্তুষ্ট হইল; সে দিবস আরও অধিক যত্ন করিল। বৃদ্ধার সহিত সেই দিবস হইতে সম্বন্ধ মিটিল, আর ভবানীপুরের দিকে পদার্পণ করিলাম না। 

পরদিন মেডিকেল কলেজে গমন করিয়া ঐ প্ৰশংসাপত্র দেখাইয়া কলেজে ভর্তি হইলাম। নিয়মিত বৃত্তি পাইবার আদেশ হইল। এতদিবস পর্য্যন্ত কেবল পিতাকেই ফাকী দিয়াছি, অদ্য বিলাতী চক্ষে ধুলিমুষ্টি নিক্ষেপ করিলাম। পিতা খরচের টাকা বন্ধ করিলেন সত্য, কিন্তু মাসিক বৃত্তির টাকা যে কি করিতেছি, তাহা এক দিবসের নিমিত্তও জিজ্ঞাসা করিলেন না। বলা বাহুল্য, তাহা মাসে মাসে গোলাপের হস্তে অর্পিত হইতে লাগিল। এই সময় আমার আমোদের কিছু ব্যাঘাত জন্মিল; কারণ সমস্ত দিবস গোলাপের বাটীতে থাকিতে পারিতাম না, নিয়মিত সময়ে একবার কলেজে যাইতেই হইত। কোন দিবস কলেজে গমন করিতে না পারিলে সে দিবসের বৃত্তির টাকা পাওয়া যায় না, ইহাই কলেজের নিয়ম; সুতরাং কলেজে গমন না করিলে গোলাপের টাকা কম পড়িত। এই নিমিত্ত প্রত্যহই একবার কলেজে যাইতে হইত; কিন্তু সময় পাইলেই সেইস্থান হইতে অন্তর্হিত হইয়া গোলাপের বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইতাম। এইরূপে তিন বৎসর অতীত হইল, কিন্তু পুস্তকের তিন পাতাও উল্টাইতে হইল না, অথচ ডাক্তারি বিদ্যায় পারদর্শী হইলাম। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ

পরীক্ষার দিন নিকট হইল, মনে মনে কত ভাবনা হইল। যদি পরীক্ষা না দিতে পারি, তাহা হইলে বৃত্তির টাকা বন্ধ হইবে, গোলাপকে আর কিছুই দিতে পারিব না। পরীক্ষার কেবলমাত্র দুইদিন বাকী আছে, তখন আর কোনও উপায় না দেখিয়া দুষ্কর্ম্মের আর এক সোপানে পদার্পণ করিলাম। সেইদিন অলক্ষিতভাবে কলেজের পুস্তকাগারে প্রবেশ করিলাম। সেই সময় কেহই সেইস্থানে ছিল না, সেইস্থান হইতে দুইখানি পুস্তক (যাহা অন্য স্থানে হঠাৎ পাওয়া সুকঠিন ও যাহা হইতে প্রশ্ন করিবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা ছিল,) চুরি করিয়া গোলাপের বাটীতে লইয়া আসিলাম পুস্তক দুইখানি আগাগোড়া একবার পড়িলাম ও বাছিয়া বাছিয়া তাহার ভিতর হইতে কতকগুলি পাতা কাটিয়া লইলাম। পরদিন কলেজে যাইয়া শুনিতে পাইলাম, পুস্তকালয় হইতে দুইখানি পুস্তক চুরি হওয়ায় অতিশয় গোলযোগ হইতেছে। পুস্তকাগারাধ্যক্ষ, পেয়াদা, দপ্তরি, প্রভৃতি পুস্তকাগারের সমস্ত কর্ম্মচারীগণ অতিশয় লাঞ্ছনা ভোগ করিতেছে। কলেজের সর্ব্বপ্রধান কর্মচারী সাহেব নিজে ঐ পুস্তকের অনুসন্ধান করিতেছেন। 

যাহা হউক, পরদিবস পরীক্ষা হইল। সকলে যেরূপ নিয়মিত সময়ে পরীক্ষার স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল, আমিও সেইরূপ আসিলাম। অপহৃত পুস্তকের পাতাগুলি আপনার পিরাণের পকেটে করিয়া আনিলাম। পরীক্ষা আরম্ভ হইল, প্রশ্নের কাগজ দেওয়া হইলে দেখিলাম, তাহার অধিকাংশের উত্তর আমার পকেটের ভিতর আছে। মনে অতিশয় আশা হইল, সাহস হইল। আস্তে আস্তে অন্যের অলক্ষিতভাবে পকেট হইতে কাগজগুলি বাহির করিলাম এবং দেখিয়া দেখিয়া প্রশ্নের উত্তর লিখিতে আরম্ভ করিলাম। কিন্তু পাপের রেখা কতক্ষণ অঙ্কিত থাকে? দুষ্কৰ্ম্ম কত দিবস লুক্কায়িত থাকে? অদ্য আমার সকল গুপ্ত পাপ প্রকাশ হইয়া গেল, আমি ধরা পড়িলাম। একজন শিক্ষক, যিনি সেইস্থানে ছাত্রগণের উপর পাহারায় নিযুক্ত ছিলেন, তিনি আমাকে সেই সময় সমস্ত কাগজপত্র সহিত ধরিয়া কলেজের প্রধান কর্তার নিকট লইয়া গেলেন। আমি তাঁহার মেজাজ জানিতাম, তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করায় আমি তাঁহার নিকট এই ঘটনার সমস্ত ব্যাপার স্বীকার করিলাম এবং তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া আনিয়া গোলাপের বাটী হইতে পুস্তক দুইখানি বাহির করিয়া দিয়া তাঁহার নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করিলাম। উক্ত সাহেব মহোদয় অতিশয় দয়ালু ছিলেন; তিনি আমাকে পুলিসের হস্তে অর্পণ না করিয়া কেবলমাত্র কলেজ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিলেন। আমি সে যাত্রা দণ্ডবিধি আইনের কঠিন দণ্ড হইতে পরিত্রাণ পাইলাম। 

পুস্তকাগারের অধ্যক্ষ প্রভৃতি যাহারা দুই দিবসের নিমিত্ত বিশেষরূপ লাঞ্ছনাভোগ করিয়াছিল, তাহারা এ সুযোগ পরিত্যাগ করিল না; আমার বিপক্ষে অনুসন্ধান করিয়া সমস্ত দোষ বাহির করিল ও আমার পিতাকে বলিয়া দিল। 

বৃদ্ধ পিতা মর্মান্তিক দুঃখিত হইয়া আমাকে কেবলমাত্র এই বলিলেন, “আমি তোমাকে যে প্রকার বিশ্বাস করিতাম, তাহার উপযুক্ত ফলই পাইয়াছি। কিন্তু ইহাও তুমি নিশ্চয় মনে রাখিও, ইহজীবনে তুমি কখনও সুখী হইতে সমর্থ হইবে না।” পিতা সেই দিবস হইতে আর আমার সহিত বাক্যালাপ পর্য্যন্ত করিলেন না। আমি পূর্ব্বে দিবাভাগে ও সন্ধ্যার সময় গোলাপের বাটীতে যাইতাম; কিন্তু এখন আমার আরও সুযোগ বাড়িল, রাত্রিদিন তাহার বাটীতেই থাকিতে লাগিলাম। কিন্তু এখন আর এক পয়সাও দিয়া তাহার সাহায্য করিতে পারিলাম না। 

গোলাপের উপর আমার মন এত আকৃষ্ট হইয়াছে যে, তাহাকে তিলার্দ্ধ দেখিতে না পাইলে চতুর্দিক অন্ধকার দেখি। গোলাপও তাহা বুঝিল। সে এত দিবস হইতে যে মায়াজাল বিস্তার করিয়া আমাকে প্রলোভিত করিতেছিল, এখন যে তাহার ফল ফলিয়াছে, তাহা সে বুঝিতে পারিল। সে এখন জানিল যে, তাহাকে ছাড়িয়া আর আমি মুহূর্ত্তও থাকিতে পারিব না। তখন সে নিজের স্বভাব ক্রমে ক্রমে প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিল। “খরচের টাকা নাই” “একটিমাত্র পয়সা নাই,” “হরিবাবু তারাকে যেরূপ একটি হীরার আংটি দিয়াছে, আমি সেইরূপ একটি আংটি লইব,” “কামিনীর মতন বারাণসী শাটী একখানিও আমার নাই,” “বসন্ত তাহার কাশ্মিরী শাল ঘোড়াটি বিক্রয় করিবে, উহা আমাকে খরিদ করিয়া দেও”, প্রভৃতি একটি একটি নূতন কথা নিত্য নিত্য আমার কাণে তুলিতে লাগিল। আমিও যাহাতে তাহার এই সকল মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে পারি, তাহার উপায় মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলাম। একদিবস সে আমার উপর অতিশয় বিরক্তি ভাব দেখাইয়া বলিল, “ডাক্তার! যদি তুমি কলা আমাকে এক সেট সোণার গহনা আনিয়া দেও, ভালই, নচেৎ তুমি আমার বাটীতে আসিও না।” এই কথায় আমার অতিশয় ক্রোধ ও দুঃখ হইল। তাহাকে বলিলাম, “যদি আমি তোমার নিমিত্ত সোণার গহনা আনিতে পারি ভালই, নচেৎ তোমার বাটীতে আর আসিব না।” এই বলিয়া ক্রোধভরে গোলাপের বাটী হইতে বহির্গত হইলাম। গোলাপ পশ্চাৎ হইতে বার বার ডাকিল, আমি শুনিয়াও শুনিলাম না, চলিয়া আসিলাম। অতঃপর দুষ্কর্ম্মের আর এক সোপান ঊর্দ্ধে উত্থিত হইলাম। 

নবম পরিচ্ছেদ

পূর্ব্বে প্রত্যহ সন্ধ্যার পর একবার আহারার্থে বাটীতে যাইতাম, আজ ক্রমিক সাত দিবসের পর বাটীতে যাইলাম। পিতা আমাকে দেখিয়া ঘাড় হেঁট করিয়া বাহির হইয়া গেলেন। বাটীর ভিতর যাইয়া দেখি, আমার স্ত্রী অন্য দিবসের অপেক্ষা অতিশয় ম্রিয়মাণ। সে দিবস আমার সহিত কথা কহিল না, বা আমার নিকটেও আসিল না। মাতা আমাকে ডাকাইয়া আহার করাইলেন ও অতিশয় দুঃখ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। আমার ছোট ছোট দুইটি পুত্র একটি কন্যা আসিয়া গলা ধরিয়া বলিল, “বাবা! তুই কোথায় ছিলি?” 

আমার সে সকল কিছুই ভাল লাগিল না; হৃদয়ের মধ্যে সেই গোলাপের রূপ চিন্তা করিতে লাগিলাম, তাহার কথাগুলি স্মরণ করিতে লাগিলাম। আহার সমাপ্ত হইল, আমার ঘরে গিয়া শয়ন করিলাম; ঘড়িতে নয়টা বাজিয়াছে। ক্রমে একটা বাজিয়া গেল, তথাপি আমার স্ত্রীকে সে রাত্রে আর দেখিতে পাইলাম না, বা অন্য কাহারও আর কোন প্রকার সাড়া শব্দ পাইলাম না। রাত্রি ২টা বাজিলে আস্তে আস্তে উঠিয়া, যে আলমারির ভিতর আমার স্ত্রীর গহনা থাকিত, তাহা খুলিলাম। খুলিতে কোন কষ্ট হইল না, সে স্থানে চাবি থাকিত, তাহা আমি জানিতাম। বাক্স খুলিয়া তাহার মধ্য হইতে তিনখানি সোণার অলঙ্কার বাহির করিয়া লইয়া সকলের অলক্ষিতভাবে বাটী হইতে বহির্গত হইলাম, এবং সেই রাত্রিতেই গোলাপের বাটীতে গিয়া তাহাকে সেই সকল অলঙ্কার প্রদান করিলাম। সে অবশ্যই অতিশয় সন্তুষ্ট হইল। 

পরদিন সন্ধ্যার সময় আমার জননী গোলাপের বাটীতে আমার নিকট লোক দ্বারা বলিয়া পাঠাইলেন,—“তুমি যে গহনা তিনখানি চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছ, তাহা আর পুনরায় পাইবার প্রত্যাশা করি না; কিন্তু তুমি একবার বাটীতে আসিয়া তোমার পিতাকে বলিয়া যাইবে। নতুবা শুনিলাম, তিনি তোমাকে পুলিসের হস্তে দিবার বন্দোবস্ত করিতেছেন।” আমি সেই লোককে বলিয়া দিলাম, “আমি যাইয়া পিতার সহিত সাক্ষাৎ করিব,” কিন্তু আর গেলাম না। গোলাপকে ছাড়িয়া যাইতে ইচ্ছা হইল না। 

পরদিন সন্ধ্যার সময় দেখিলাম, একজন ইংরাজ পুলিসকর্ম্মচারী আমার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত গোলাপের বাটীতে আসিতেছেন। তাঁহাকে দেখিয়া, মাতা যে সংবাদ পাঠাইয়া দিয়াছিলেন, তাহা মনে পড়িল, ভয়ও হইল। কিন্তু বুদ্ধিমতী গোলাপের পরামর্শে অন্য একটি ঘরের ভিতর যাইয়া লুকাইলাম। যে বাহির হইতে ঐ ঘরের তালা বদ্ধ করিল। ইংরাজ, পুলিস-কর্মচারী বাটীর ভিতর প্রবেশ করিলে, গোলাপ অতিশয় যত্নের সহিত তাঁহাকে বসাইল, আপনিও তাহার নিকট বসিয়া রামদাসকে পাখার বাতাস দিতে বলিল। রামদাস বাতাস দিতে লাগিল। গোলাপ নিজহস্তে একটি বোতল খুলিয়া তাহা হইতে এক গ্লাস সুরা ঢালিয়া সাহেবের হস্তে অর্পণ করিলে, সাহেব বিনা- আপত্তিতে তাহা পান করিলেন। গোলাপ তখন দেশলাই ও চুরুট আনাইয়া দিয়া তাঁহার সহিত বাক্যালাপে প্ৰবৃত্ত হইল। সাহেব ধীরে ধীরে ধূমপান করিতে করিতে, গোলাপকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ডাক্তারবাবু কোথায়?’ গোলাপ বলিল, “আমি কোন ডাক্তারবাবুকে জানি না। তবে নিত্য নিত্য নূতন নূতন লোক আসে বটে, কিন্তু আমি তাহাদিগের নাম বলিতে পারিব না।’ সাহেব গোলাপের কথায় বিশ্বাস করিয়া উঠিলেন, ও যাইবার সময় এদিক ওদিক চতুৰ্দ্দিকে লক্ষ্য করিতে করিতে, যে ঘরে আমি ছিলাম, সেই ঘরের নিকট আসিয়া বলিলেন, “এ ঘরে কে থাকে?” গোলাপ বলিল, “সুন্দরী নাম্নী অন্য আর একটি স্ত্রীলোক ঐ ঘরে থাকে। সে অদ্য প্রাতঃকালে দরজা বন্ধ করিয়া তাহার ভগিনীর বাটীতে গিয়াছে। যদি আপনার কোন প্রকার সন্দেহ হয়, আপনি তাহা ভাঙ্গিয়া দেখুন।” সাহেব মনে মনে কি ভাবিয়া বলিলেন, “না, ও ঘর আমার দেখিবার কোনও আবশ্যক নাই। তোমার কথায় অবিশ্বাস করার কোন কারণ দেখি না।” এই বলিয়া তিনি চলিয়া গেলেন। 

সাহেব চলিয়া গেলে ঐ ঘর হইতে গোলাপ আমায় বাহির করিয়া দিল, কিন্তু আমার মনে অতিশয় ভাবনা রহিল। গোলাপ বলিল, “তুমি আপাততঃ দিন কয়েকের নিমিত্ত অন্য কোনস্থানে গিয়া থাক, গোলমাল মিটিয়া 

গেলে পুনরায় আসিও।” আমিও সম্মত হইলাম এবং গোলাপের নিকট হইতে কিছু টাকা লইয়া সেইদিন রাত্রি নয়টার সময় এলাহাবাদ যাত্রা করিলাম। 

আমি যে সময়ের কথা বলিতেছি, সে সময়ে এলাহাবাদে বাঙ্গালীর সংখ্যা এখন অপেক্ষা অল্প ছিল। আমি এলাহাবাদে গমন করিয়া একজন বাঙ্গালী ডাক্তারের বাসায় উপস্থিত হইলাম। “শরীরের অসুস্থতা বশতঃ বায়ু পরিবর্তন করিতে আসিয়াছি” তাঁহাকে এই বলিয়া পরিচয় দিলাম, তিনি আমাকে অতিশয় যত্ন করিলেন। তাঁহার বাসায় প্রায় এক মাসকাল থাকিলাম। সেইস্থানে আমি এম, বি, ডাক্তার বলিয়া সকলের নিকট পরিচয় দিয়াছিলাম, সুতরাং সকলে আমাকে “এম, বি,” ডাক্তার বলিয়া অতিশয় মান্য করিতে লাগিলেন। ডাক্তারবাবুও মধ্যে মধ্যে আমার পরামর্শ লইয়া চিকিৎসা করিতে লাগিলেন। 

এই সময় আমি দুষ্কর্ম্মের আরও এক সোপান ঊর্দ্ধে উত্থিত হইলাম। সেইস্থানের সমস্ত বাঙ্গালীর নিকট হইতে হাওলাত বলিয়া কাহারও নিকট ১০০ টাকা, কাহারও নিকট ২০০ টাকা লইলাম। সকলেই আমাকে বিশ্বাস করিয়া হাওলাত দিলেন, কিন্তু কেহ কাহাকে কিছু বলিলেন না। সকলেই বুঝিলেন, আমার টাকা যাইলে আমি সকলের ঋণ পরিশোধ করিয়া দিব। এইরূপে প্রায় দুই সহস্র টাকা সংগ্রহ করিলাম। 

এই সময় আমাদিগের বাসায় হঠাৎ একজন কলিকাতার লোককে দেখিতে পাইলাম। তিনি আমাকে চিনিতেন, তিনি আমার সমস্ত গুণ ডাক্তারবাবুর নিকট প্রকাশ করিয়া দিলেন। “এম, বি,” উপাধি সকলে জানিতে পারিল, হাওয়া পরিবর্তনের কারণ সকলে অবগত হইল; ডাক্তার বাবু অতিশয় অসন্তুষ্ট হইলেন। অনন্যোপায় হইয়া আমি সেই রাত্রিতেই এলাহাবাদ হইতে পলায়ন করিয়া পুনরায় কলিকাতায় আসিলাম। পরে শুনিয়াছিলাম, আমাকে পুলিসের হস্তে সমর্পণ করিবার নিমিত্ত সকলেই আমার অনুসন্ধান করিয়াছিলেন, কিন্তু কেহই আমার কোনরূপ সন্ধান করিতে সমর্থ হয়েন নাই। 

বাটীতে আসিয়া এক সহস্র টাকা পিতাকে দিলাম, তাঁহার সমস্ত ক্রোধ অন্তর্হিত হইল, তিনি ঐ টাকা দিয়া আমার স্ত্রীকে পূর্ব্বের মত তিনখানি গহনা গড়াইয়া দিলেন। বক্রী টাকা লইয়া গোলাপের নিকট উপস্থিত হইলাম। পাঁচ সাত দিন সে আর কিছু বলিল না; অষ্টম দিবস হইতে আবার পূর্ব্ব ব্যবহার আরম্ভ করিল। তখন ভাবিলাম, এরূপ করিলে আর অধিক দিন চলিবে না; কোন প্রকার কাজকর্ম্মের বন্দোবস্ত করিতে হইবে। সেই সময় বঙ্গদেশীয় একজন প্রধান জমীদার এখানে ছিলেন, ক্রমে যাইয়া তাঁহার সহিত মিলিলাম। তাঁহার নিকট “এম্, বি” ডাক্তার বলিয়া পরিচয় দিলাম। তিনি আমাকে বিশ্বাস করিলেন, আমার ব্যবহারে সন্তুষ্ট হইয়া ক্রমে তিনি আমাকে তাঁহার বাটীর ডাক্তার নিযুক্ত করিলেন। মাসে মাসে ২০০ টাকা বেতন দিতে লাগিলেন, তাহা ব্যতীত মধ্যে মধ্যে পারিতোষিক প্রভৃতিও পাইতে লাগিলাম। ঐ টাকা হইতে ১০০ টাকা মাসে মাসে গোলাপকে দিতে লাগিলাম, বক্রী ১০০ টাকার মধ্যে আমার নিজের আবশ্যকীয় খরচপত্র বাদে যাহা অবশিষ্ট থাকিত, তাহা মাতার হস্তে দিতে লাগিলাম। ক্রমে পিতা মাতা ভাবিতে লাগিলেন যে, আমার মতিগতি এখন একটু ভাল হইতেছে। তখন মধ্যে মধ্যে বাটীতে যাইতে আরম্ভ করিলাম। প্রথম ৭/৮ দিবস আমার স্ত্রী আমার ছায়া পর্যন্ত স্পর্শ করিল না, কিন্তু সে হিন্দুরমণী হইয়া আর কত দিবস স্বামীর সেবা শুশ্রূষা না করিয়া থাকিতে পারিবে? পরে আপনিই আমার নিকট আসিল, আসিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। তাহার কান্না দেখিয়া আমার হৃদয়ে একটু দয়ার উদ্রেক হইল। একবার ভাবিলাম, যাহা করিবার করিয়াছি, আর এরূপ দুষ্কর্ম্ম করিব না; কিন্তু পর মুহূর্তেই তাহা ভুলিয়া গেলাম, গোলাপের বাড়ীতে যাইয়া উপস্থিত হইলাম। এখন আর আমার লজ্জা সরম নাই, হৃদয় কঠিন হইয়া গিয়াছে। এখন যখন ইচ্ছা, তখনই গোলাপের বাড়ীতে যাই, যখন ইচ্ছা, তখনই সে স্থান হইতে চলিয়া আসি। কাহাকেও ভয় বা লজ্জা করিতে ইচ্ছা হয় না, ইহা যেন কোন প্রকার দুষ্কৰ্ম্ম বলিয়া বিবেচনা হয় না। 

দশম পরিচ্ছেদ

এই সময় জমীদার মহাশয় দেশে যাইবার উদ্যোগ করিতেছেন দেখিয়া অতিশয় চিন্তিত হইলাম। ভাবিলাম, আমাকেও তাঁহার সহিত যাইতে হইবে। কি প্রকারে গোলাপকে না দেখিয়া থাকিব? না গেলেও গোলাপের খরচের সংস্থান করিতে পারিব না। ইত্যাকার নানাপ্রকার চিন্তা মনে উদয় হইল। সমস্ত কথা গোলাপকে বলিলাম। গোলাপ শুনিবামাত্র অতিশয় দুঃখ প্রকাশ করিল, কিন্তু পরিশেষে সেই আমার মত লওয়াইল। আমার অনিচ্ছাস্বত্ত্বেও জিদ করিয়া জমীদার মহাশয়ের সহিত আমাকে পাঠাইয়া দিল। যে আমাকে একদণ্ড কাল না দেখিলে থাকিতে পারিত না বলিত, তবে সে কেন এরূপ জিদ করিয়া আমাকে পাঠাইয়া দিল, তাহা বুঝিতে পারিলাম না;— বুঝিয়াছি কিন্তু পরে। পাঠক মহাশয়দিগের মধ্যে যদি কেহ এরূপ অবস্থায় কখনও পড়িয়া থাকেন, তবে তিনি বুঝিতে পারিবেন। যাহা হউক, পিতা মাতার মত লইয়া, স্ত্রীকে একবার জিজ্ঞাসা করিয়া, ভ্রাতাদ্বয়কে সম্ভাষণ করিয়া, অল্পদিন মধ্যেই বঙ্গদেশ যাত্রা করিলাম। 

কিছু দিবসের মধ্যেই সেখানে সকলে আমাকে ভালবাসিতে ও বিশ্বাস করিতে লাগিল। পনর দিবস অতীত হইতে না হইতেই গোলাপকে দেখিবার নিমিত্ত আমার মন অতিশয় ব্যস্ত হইল; সুতরাং জমীদার মহাশয়ের নিকট হইতে পনর দিবসের বিদায় লইয়া কলিকাতায় আসিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইলাম। সে সময় আমার নিকট একশত টাকার অধিক ছিল না, কিন্তু ঈশ্বরের কৃপায় আমার ভাগ্য প্রসন্ন হইল। 

আমি কলিকাতায় গমন করিতেছি, জানিতে পারিয়া সেই সময় সেইস্থানের অন্য একটি বড় লোক আমাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। আমি তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তিনি একটি ঘড়ী ও একছড়া সোণার চেন খরিদ করিয়া আনিবার নিমিত্ত আমাকে এক সহস্র টাকা প্রদান করিলেন। আমি সমস্ত টাকা লইয়া কলিকাতায় আসিলাম। তাহার মধ্য হইতে ২০০ টাকামাত্র আমার স্ত্রীকে দিলাম, সে অতিশয় সন্তুষ্ট হইল। অবশিষ্ট টাকা গোলাপের পাদপদ্মে অৰ্পণ করিলাম। পনর দিন অনবরত সুরাপান ও আমোদ-প্রমোদে কাটাইলাম। দেখিতে দেখিতে আরও পনর দিন অতীত হইয়া গেল, সুতরাং পুনরায় বঙ্গদেশে যাইতে হইল। চেন বা ঘড়ী কিছুই খরিদ করিলাম না; সে কথা আমার একবার মনেও হয় নাই। মনে থাকিলেই বা কি করিতাম? যাইবার সময় গোলাপের নিকট হইতে অনেক কষ্টে ২৫টি টাকা ঋণ করিয়া লইয়া গেলাম। কাৰ্য্যস্থানে প্রত্যাবৃত্ত হইতে অতিরিক্ত বিলম্ব হইবার জন্য জমীদার মহাশয় প্রথমে আমার প্রতি কিছু অসন্তোষভাব প্রকাশ করিলেন সত্য; কিন্তু মিষ্ট কথায় তাঁহাকে সন্তুষ্ট করিলাম। 

বড়লোক বাবুটি চেন ঘড়ীর কথা জিজ্ঞাসা করিলে তাঁহাকে বলিলাম, “মহাশয়! উৎকৃষ্ট চেন ও ঘড়ী, যাহার মূল্য প্রায় ১৫০০ টাকা হইবেক, তাহা আমি কেবলমাত্র ১১০০ শত টাকায় খরিদ করিয়াছি; কিন্তু নানাপ্রকার সাংসারিক গোলযোগে বিলম্ব হওয়া প্রযুক্ত তাড়াতাড়ি আসিবার কালে উহা বাটীতে ভুলিয়া আসিয়াছি। পরে এখানে আসিয়া চেন ঘড়ী ডাকে পাঠাইয়া দিবার নিমিত্ত পত্র লিখিয়াছি, চারি পাঁচদিবসের মধ্যেই বোধ হয়, উহা পাইতে পারিবেন।” বাবু অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন, সেই দিবসেই বক্রী ১০০ শত টাকা আমাকে পাঠাইয়া দিলেন। বলা বাহুল্য, যে ঐ টাকা আমি সেই দিবসেই গোলাপের ২৫ টাকা ঋণের পরিবর্তে পাঠাইয়া দিলাম। 

আমি দুষ্কর্ম্মের আরও একপদ ঊর্দ্ধে উত্থিত হইয়া যে কার্য্য করিলাম, তাহা শ্রবণ করিলে মনুষ্যমাত্রেরই ঘৃণার উদ্রেক হয়। সেই সময় যে বাবু আমাকে চেন ঘড়ী খরিদ করিতে দিয়াছিলেন, তাঁহার শরীর একটু অসুস্থ বোধ { হওয়ায়, আমাকে ডাকাইয়া একটি ঔষধ দিতে বলিলেন। আমি ভাবিলাম, ‘এখন আমি যে সুযোগ পাইয়াছি, তদনুসারে কার্য্য করিলে আর আমাকে ঐ ১১০০ শত টাকা দিতে হইবেক না।’ এই ভাবিয়া তাঁহাকে একটি ঔষধ দিলাম। বলিয়া দিলাম, “আপনাকে এই ঔষধ ভিন্ন অন্য কোন ঔষধ আর সেবন করিতে হইবেক না, এই ঔষধেই আপনার নিদ্রা আসিবে ও সমস্ত অসুখ দূর হইবেক।” এই বলিয়া রাত্রি ১০টার সময় চলিয়া আসিলাম। রাত্রি ১২টার সময় আমার ঔষধের ফল ফলিল; বাবুর হঠাৎ মৃত্যু হইল। ঐ টাকার বিষয় আর কেহই জানিত না, সুতরাং সে কথা আর কাহারও নিকট শুনিতে পাইলাম না। আমি অতিশয় কপট দুঃখ প্রকাশ করিয়া যাহাতে তাঁহার শীঘ্র সৎকার-কার্য্য সমাধা হয়, তাহার বন্দোবস্ত করিয়া দিলাম। 

এই সময়ে আমার মনে অতিশয় অনুতাপ হইয়াছিল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম, এরূপ দুষ্কর্ম্ম আর কখনও করিব না; কিন্তু সে প্রতিজ্ঞা অনেকদিবস রাখিতে পারি নাই। 

ইহার এক মাস পরেই বঙ্গদেশীয় জমীদার মহাশয় অতিশয় পীড়িত হইয়া কলিকাতায় আসিলেন; আমি তাঁহার সহিত আসিয়া তাঁহার চিকিৎসা করিতে লাগিলাম। কিন্তু তাহাতে পীড়ার কিছুমাত্র হ্রাস না হইয়া দিন দিন আরও বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। তখন আমি অন্য কোন উপায় না দেখিয়া জমীদার মহাশয়ের মত লইয়া এইস্থানের একজন প্রধান ইংরেজ-ডাক্তারকে চিকিৎসার্থ নিযুক্ত করিলাম। তিনি চিকিৎসা করিতে লাগিলেন। আমি জমীদার মহাশয়ের নিকট হইতে নিত্য নিত্য ইংরাজ-ডাক্তারকে দিবার নিমিত্ত দ্বিগুণ পরিমাণ টাকা লইতে লাগিলাম। কিন্তু বলা বাহুল্য যে, ডাক্তারকে ন্যায্য প্রাপ্য টাকা দেওয়া বাদে বক্রী আমার নিজ ব্যয়ে খরচ হইতে লাগিল। ক্রমে জমীদার মহাশয় সুস্থ হইতে লাগিলেন। তাঁহার পীড়া দিন দিন কমিতে লাগিল, কিন্তু একেবারে আরোগ্যলাভ করিলেন না। 

সেই সময়ে তাঁহার জমীদারির মধ্যে অনেক দেওয়ানী মোকদ্দমা উপস্থিত হওয়ায় বিপক্ষগণ তাঁহাকে প্রত্যেক মোকদ্দমায় সাক্ষী মান্য করিতে লাগিল। সেই অসুস্থ শরীরে তাঁহাকে পুনঃপুনঃ মফঃস্বল যাইতে হওয়ায়, তিনি পুনরায় অসুস্থ হইলেন। 

একাদশ পরিচ্ছেদ

জমীদার মহাশয় আমাকে একদিন বলিলেন, “ডাক্তার! কলিকাতায় অনেক বড়লোকের সহিত তোমার আলাপ আছে, শুনিয়াছি। যদি তুমি কোন বড়লোকের সাহায্যে আমার একটি উপকার করিতে পার, তাহা হইলে আমি নিতান্ত উপকৃত হই।’ 

আমি তাঁহার কথা শুনিয়া একটু ব্যস্ত হইলাম, এবং তিনি কিরূপ উপকার-প্রার্থী, তাহা জিজ্ঞাসা করিলে জমীদার মহাশয় বলিলেন, “দেখ ডাক্তার! ইংরাজ-রাজত্বে বড়লোকের জন্য একটি আইন আছে, গবর্ণমেণ্ট ইচ্ছা করিলে তাঁহাদিগকে দেওয়ানী আদালতে উপস্থিত হইয়া সাক্ষ্য দেওয়ার যন্ত্রণা হইতে নিষ্কৃতি দিতে পারেন। অনেক বড়লোক, এ যন্ত্রণায় নিষ্কৃতি পাইয়াছেন। কিছুদিবস হইল, আমিও বেঙ্গল গবর্ণমেণ্টে এই মৰ্ম্মে এক আবেদন করিয়াছিলাম; কিন্তু আমার সেই আবেদন সেই সময়ে গ্রাহ্য হয় নাই বলিয়া আমায় এইরূপ কষ্টভোগ করিতে হইতেছে। যদি কলিকাতার ভিতর এমত কোন লোকের সহিত তোমার বিশেষ জানা শুনা থাকে, যে, তিনি লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর বাহাদুরকে বলিয়া আমার এই কার্য্যটি সমাধা করিয়া দিতে পারেন, তাহা হইলে আমি যে কিরূপ উপকৃত হই, তাহা বলিতে পারি না। তুমি এই কার্য্য সমাপন করিয়া দিতে পারিলে ন্যায্য খরচ ব্যতিরেকে তোমায় উপযুক্ত পুরস্কার দিতেও আমিও প্রস্তুত আছি।” 

এই সুযোগে বিলক্ষণ দশ টাকা উপার্জ্জন করিতে পারিব ভাবিয়া দুষ্কর্ম্মের আর এক সোপান ঊর্দ্ধে উত্থিত হইলাম। আমি সগর্ব্বে জমীদার মহাশয়কে বলিলাম, “আমাকে এতদিন জানাইলে অনেক পূৰ্ব্বেই এ কাৰ্য্য সম্পন্ন হইতে পারিত। আপনি বিশেষরূপ জানেন যে, যে ইংরাজ ডাক্তার, মহাশয়কে রোগ মুক্ত করিয়াছিলেন, তিনি আমার একজন পরম বন্ধু। লেপ্টে নেণ্ট গবর্ণর বাহাদুরের সহিতও তাঁহার বিশেষ বন্ধুতা আছে। ইতিপূর্ব্বে আমাকে বলিলে ডাক্তার সাহেবের সাহায্যে এতদিনে সকল কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়া যাইত, আপনাকেও দেওয়ানী আদালতে উপস্থিত হইয়া এতদিন কষ্ট পাইতে হইত না। যাহা হউক, কল্যই আমি তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া সকল কথা স্থির করিব, এবং আপনার এ কার্য্য নিশ্চয়ই সম্পন্ন করিয়া দিব। তবে একটি কথা মহাশয়কে প্রথমেই বলা উচিত যে, ডাক্তারগণ অর্থপিশাচ; বিনা স্বার্থে যে তিনি কিছু করিবেন, তাহা আমার বিশ্বাস হয় না। তবে তিনি যখন আমার একজন বিশেষ বন্ধু, তখন আমি নিশ্চয়ই বলিতে পারি যে, অতি সামান্য ব্যয়ে এ কার্য্য তাঁহার দ্বারা আমি সম্পন্ন করাইয়া লইতে পারিব।’ 

জমীদার মহাশয় আমার এই কথা শুনিয়া অতিশয় আশ্বস্তও আহ্লাদিত হইলেন, এবং আমাকে বলিলেন, “তুমি যে প্রকারে পার, এই কার্য্য সমাধা কর, খরচ পত্রের জন্য তোমার কোন ভাবনা নাই। সমস্ত ঠিক করিয়া কল্য আসিয়া মহাশয়কে বলিব’ বলিয়া আমি সেই দিবসের মত বিদায় হইয়া গোলাপের বাটীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। তথায় সমস্ত রাত্রি আমোদ-আহ্লাদ ও সুরাপান প্রভৃতিতে কাটাইলাম। 

পরদিবস জমীদার মহাশয়ের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইয়া বলিলাম, “মহাশয়! ডাক্তার সাহেবের সহিত সমস্ত ঠিক হইয়াছে, কাৰ্য্য শীঘ্র সম্পন্ন হইবে। কিন্তু তাঁহাকে দশ সহস্র টাকা দিতে হইবেক। এখন পাঁচ সহস্ৰ দিলেই চলিবে, কাৰ্য্য সমাপ্ত হইলে অবশিষ্ট পাঁচ সহস্র দিবেন। তিনি আমার নিতান্ত বন্ধু বলিয়া এইরূপ অল্প টাকায় সম্মত হইয়াছেন, নতুবা ৫০ সহস্র মুদ্রার কম এরূপ কার্য্য কখনই সম্পন্ন হইতে পারে না। 

জমীদার মহাশয় আমার কথায় বিশ্বাস করিয়া সমস্ত টাকা দিতে সম্মত হইলেন। সেই দিবস ডাক্তার সাহেবকে দিবার নিমিত্ত আমাকে দুই সহস্র টাকা দিলেন। টাকাগুলি হস্তে পাইয়া আমি জমীদার মহাশয়ের বাড়ী পরিত্যাগ করিলাম। কিন্তু তাহার এক কপর্দকও ডাক্তার সাহেবকে না দিয়া তাহার পরিবর্ত্তে সহস্র মুদ্রা গোলাপকে দিলাম, বক্ৰী পিতা মাতাকে দিলাম। জমীদার মহাশয়কে বুঝাইবার নিমিত্ত ঐ টাকার একখানি রসিদ লিখিলাম ও তাহাতে উক্ত ইংরাজ-ডাক্তারের সহি জাল করিলাম। পরে ঐ জাল রসিদ জমীদার মহাশয়কে দিয়া কহিলাম, “ডাক্তার সাহেব টাকা পাইয়া এই রসিদ দিয়াছেন ও বক্রী তিন সহস্র টাকা চাহিয়াছেন।” রসিদ দেখিয়া তাঁহার আরও বিশ্বাস হইল, তিনি বলিলেন,—“বক্রী টাকার কতক কল্য দিব। তুমি ডাক্তার সাহেবকে বলিও, যাহাতে কাৰ্য্য শীঘ্র সম্পন্ন করিতে পারেন, তাহার যেন বিশেষ চেষ্টা করেন।” 

[ ফাল্গুন, ১৩০৮] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *