কৃপণের ধন ১

কৃপণের ধন (প্রথম অংশ)

(অর্থাৎ কৃপণের ধন ও জীবনের পরিণাম!) 

প্রথম পরিচ্ছেদ

দুই চারিটি রোগীর চক্ষুর পীড়া আরোগ্য করিবার সঙ্গে সঙ্গে আমার ক্রমে পসার হইতে আরম্ভ হইল। সুতরাং আমার উপার্জ্জনও ক্রমে বৰ্দ্ধিত হইতে লাগিল, কিন্তু উপার্জ্জন অধিক করিয়া কি হইবে? আমি যাহা উপার্জ্জন করিতাম, উহার অধিকাংশই রাসবিহারীবাবুকে প্রদান করিতে হইত। প্রত্যহ সন্ধ্যার সময় রাসবিহারীবাবু দস্তুরমত হিসাব করিয়া আমার নিকট হইতে তাঁহার প্রাপ্য টাকা গ্রহণ করিতেন। এইরূপে বেশ কিছুদিবস বাহিত হইয়া গেল, রাসবিহারীবাবু নিজ হইতে যে অর্থ প্রদান করিয়া ডিসপেনসারী খুলিয়া দিয়াছিলেন, তাহার সমস্ত অর্থই তিনি পুনরায় প্রাপ্ত হইলেন। তদ্ব্যতীত তাঁহার বেশ দশ টাকা উপার্জ্জন হইতেও আরম্ভ হইল। 

এইরূপে দুই বৎসর অতীত হইয়া গেল, এই সময় আমি অপর আর একস্থানে গমন করিয়া নিজের ডিপেনসারী স্থাপিত করিতে মনস্থ করিলাম, কিন্তু কার্য্যে তাহা করিয়া উঠিতে পারিলাম না। এককালীন পাঁচ সহস্র টাকা প্রদান করিতে না পারিলে রাসবিহারীবাবুর হস্ত হইতে উদ্ধার পাওয়ার উপায় ছিল না। অত টাকা একবারে প্রদান করিতেও পারিলাম না। সুতরাং আমার মনোবাঞ্ছাও পূর্ণ হইল না। 

অর্থ সম্বন্ধে কাহারও উপর রাসবিহারীবাবুর কিছুমাত্র বিশ্বাস ছিল না। এইরূপ উপায়ে তিনি নিত্য নিত্য যে অর্থ প্রাপ্ত হইতেন, বিশ্বাস করিয়া তাহা তিনি কাহারও নিকট রাখিতে সাহসী হইতেন না। এমন কি, ব্যাঙ্ক প্রভৃতির উপরও তাঁহার বিশ্বাস ছিল না। গবর্ণমেন্ট পেপার তিনি বুঝিতেন না। তিনি বুঝিতেন, নিজের অর্থ নিজের নিকট গচ্ছিত রাখা। যে ঘরে তিনি বাস করিতেন, সেই ঘরে তাঁহার একটি লোহার সিন্ধুক ছিল। তাঁহার সঞ্চিত অর্থ সেই সিন্ধুকের ভিতর তিনি বদ্ধ করিয়া রাখিতেন। তাহার চাবি তাঁহার নিজের নিকটেই রাখিয়া দিতেন। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

ডিপেনসারি-গৃহে বসিয়া আমার রোগী দেখিবার নিয়ম ছিল, 

প্রাতঃকালে সাতটা হইতে নয়টা ও বৈকালে চারিটা হইতে ছয়টা। সুতরাং ওই সময় ব্যতীত কোন রোগী আমার ডিসপেনসারিতে আগমন করিত না। ওই দুই সময় ব্যতীত আমাকে রোগী দেখাইবার যাঁহার প্রয়োজন হইত, তিনি আমাকে তাঁহার বাড়ীতেই ডাকিয়া লইয়া যাইতেন, সেই স্থানে গমন করিয়া আমি রোগী দেখিয়া আসিতাম। 

রোগী দেখিবার নিমিত্ত সন্ধ্যা ছয়টার পর আমাকে প্রায়ই বাহিরে গমন করিতে হইত, সেই সময় রাসবিহারীবাবুও তাঁহার বাড়ীতে উপস্থিত থাকিতেন না, কোথায় যে গমন করিতেন, তাহা আমরা কেহই জানিতাম না, কিন্তু রাত্রি দশটার পূর্ব্বে তিনি প্রায়ই প্রত্যাবর্তন করিতেন না। তাঁহার স্ত্রীর মৃত্যুর পর হইতেই তিনি ঐরূপ বাহিরে গমন করিতেন বলিয়া, তাঁহার চরিত্র সম্বন্ধে অনেকে অনেক কথা কহিলেন আমি নিজে এ পর্যন্ত কোন বিষয় স্বচক্ষে দর্শন করি নাই, কিন্তু সন্ধ্যার পর একদিবসও তাঁহাকে তাঁহার বাড়ীতে দেখিতে পাওয়া যাইত না। 

অদ্য সন্ধ্যা পাঁচটার সময় আমি আমার ডিসপেনসারিতে বসিয়া আছি, এরূপ সময়ে একজন ডাকপিয়ন আসিয়া আমার হস্তে একখানি পত্র প্রদান করিয়া চলিয়া গেল। পত্রখানি খুলিলাম, তাহা যে কাহার লেখা, তাহা আমি জানিতে পারিলাম না। কারণ সেই পত্রে কাহারও নাম স্বাক্ষর ছিল না। মনে করিলাম, লেখক পত্রখানি লিখিবার সময় তাঁহার নাম লিখিতে ভুলিয়া গিয়াছেন। পত্রখানি পাঠ করিলাম, উহাতে লেখা ছিল, “মহাশয়, অনেকদিবস হইতে কোন রোগে আক্রান্ত হইয়া আমি বিশেষরূপ কষ্ট পাইতেছি। চিকিৎসা অনেক করিয়াছি ও ঔষধ-পত্র অনেক সেবন করিয়াছি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় নাই। চিকিৎসা সম্বন্ধে লোক পরম্পরায় আপনার কথা শুনিয়া ইচ্ছা করিয়াছি, আপনার চিকিৎসাধীন হই। কিন্তু অনেক কারণবশতঃ আমি আপনাকে আমার বাড়ীতে আনিতে ইচ্ছা করি না। ইচ্ছা, আপনার নিকট গমন করিয়া, আমার সমস্ত অবস্থা আমি বিস্তারিতরূপে আপনার নিকট বর্ণনা করি, এবং উত্তমরূপে পরীক্ষা করাইয়া দেখি যে, আমার পীড়া সম্বন্ধে আপনি কিরূপ পরামর্শ প্রদান করেন। যে সময় আপনি আপনার ডিসপেনসারিতে বসিয়া রোগী দেখিয়া থাকেন, সেই সময় আমার পক্ষে সুবিধাজনক নহে, অদ্য সন্ধ্যা ছয়টার পর ও সাতটার মধ্যে আমি আপনার নিকট গমন করিব, সেই সময় আপনি অনুগ্রহপূর্বক আপনার ডিপেনসারিতে থাকিবেন, আর নিতান্তই যদি আপনি কোন গতিকে অদ্য উপস্থিত থাকিতে না পারেন, তাহা হইলে কলা যেন নিশ্চয়ই থাকিবেন। আমি অদ্য গমন করিয়া যদি আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে না পারি, তাহা হইলে পুনরায় কল্য সেই সময়ে আপনার নিকট গমন করিব। বলা বাহুল্য, আমি আপনাকে আপনার উপযুক্তরূপ ভিজিট বা দর্শনী প্রদান করিয়া আসিব।” 

পত্রখানি প্রাপ্ত হইয়া অদ্য সন্ধ্যার পর আর আমি বহির্গত হইলাম না, অদ্য বাহিরে গমন করিবার বিশেষ কোন প্রয়োজনও ছিল না। সুতরাং আমি সেই পত্র-লেখক-রোগীর প্রত্যাশায় ডিসপেনসারিতেই উপস্থিত রহিলাম। 

রাসবিহারীবাবু ছয়টার পরই নিয়মিতরূপে বহির্গত হইয়াছিলেন। আমি সেইদিবস আর বাহিরে গমন করিব না জানিতে পারিয়া রাসবিহারীবাবুর চাকরটিও বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া কোথায় চলিয়া গেল। সন্ধ্যার পর আমি বাহিরে গমন করিতাম, এবং রাসবিহারীবাবুও গমন করিতেন। সুতরাং তাঁহার চাকরকে বাড়ীতে উপস্থিত থাকিতে হইত, যেদিবস সে জানিতে পারিত যে, আমি বাহিরে গমন করিব না, সেই দিবস সেও বাহির হইয়া যাইত। ইহা সেই পরিচারকের একরূপ নিয়মের মধ্যে পরিগণিত ছিল। 

আমি আমার ডিসপেনসাঝিতে বসিয়া আছি, সাতটা বাজিতে অতি অল্পই বাকী আছে, এইরূপ সময়ে একখানি দ্বিতীয় শ্রেণী গাড়ি আসিয়া আমার ডিপেন্‌সারির সম্মুখে দণ্ডায়মান হইল। তাহার মধ্য হইতে একজন আরোহী বহির্গত হইয়া আমার সংবাদ গ্রহণ করিল, অর্থাৎ আমি ডিসপেনসারিতে উপস্থিত আছি কি না, তাহা জানিয়া গাড়ির মধ্য হইতে আর একজনকে লইয়া আমার ডিসপেনসারির মধ্যে প্রবেশ করিল। 

যে ব্যক্তি প্রথমে গাড়ি হইতে বহির্গত হয়, তাহার বয়ঃক্রম বোধ হয়, পঁচিশ বৎসরের অধিক হইবে না, কিন্তু দ্বিতীয় ব্যক্তির বয়ঃক্রম পঞ্চাশ বৎসরেরও অধিক বলিয়া অনুমান হয়। 

উভয়েই আমার ডিসপেনসারির ভিতর প্রবেশ করিল। অল্প বয়স্ক ব্যক্তি আমার দিকে লক্ষ্য করিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, “আপনিই কি ডাক্তারবাবু?” 

আমি। হাঁ, এই ডিসপেনসারিতে আমিই থাকি, আমিই এই স্থানের ডাক্তার। আপনারা কাহার অনুসন্ধান করিতেছেন? 

আগন্তুক। আপনারই অনুসন্ধান করিতেছি। আমাদিগের লিখিত একখানি পত্র আপনি প্রাপ্ত হইয়াছেন কি?

আমি। একখানি পত্র আমি অদ্য প্রাপ্ত হইয়াছি, কিন্তু উহা যে কাহার লিখিত, তাহা আমি অবগত নহি। কারণ, সেই পত্রে কাহারও নাম স্বাক্ষর নাই। 

আগন্তুক। উহাতে এরূপ লেখা ছিল কি যে, কোন রোগী আপনার নিকট আসিয়া আপনার দ্বারা তাহার রোগের চিকিৎসা করাইতে ইচ্ছা করেন। 

আমি। হাঁ, আমি ঐরূপ মর্ম্মেরই একখানি পত্র প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, আপনারাই কি সেই রোগী? 

আগন্তুক। হাঁ মহাশয়! আমার পিতাই সেই রোগী, তিনিই আপনাকে পত্র লিখিয়াছেন। 

এই বলিয়া তিনি তাঁহার সমভিব্যাহারী সেই বৃদ্ধকে তাঁহার পিতা পরিচয়ে আমার সম্মুখে উপস্থিত করিলেন। আমি তাঁহাদিগকে বসিতে বলিলে, তাঁহারা সেই স্থানে উপবেশন করিলেন। তখন আমি সেই বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি কিরূপ রোগে কতদিবস পর্য্যন্ত কষ্ট পাইতেছেন?” 

আমার কথা শুনিয়া বৃদ্ধ তাঁহার পুত্রের দিকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “যাও বাবা, তুমি এখন একটু বাহিরে গিয়া অপেক্ষা কর।” 

বৃদ্ধের কথা শুনিয়া অপর ব্যক্তি সেই স্থান হইতে উঠিয়া রাস্তার দিকে গমন করিলেন। আমি বিবেচনা করিলাম, রোগের সমস্ত কথা বর্ণন করিতে হইলে যে সকল বিষয় বলিবার প্রয়োজন হইবে, তাহা পুত্রের সম্মুখে বর্ণনীয় নহে। এই বলিয়া তিনি তাঁহার পুত্রকে বাহিরে গমন করিতে কহিলেন। 

তাঁহার পুত্র সেই স্থান হইতে স্থানান্তরে গমন করিবার পর, তিনি তাঁহার নিজের রোগের পরিচয় দিতে আরম্ভ করিলেন, তাঁহার কথাগুলি এরূপ অসংবদ্ধ যে, সেই কথা শুনিয়া কেহই অনুমান করিতে পারেন না যে, তিনি কিরূপ রোগে আক্রান্ত হইয়াছেন। তাঁহার শরীরাভ্যন্তরে যে সকল রোগ আছে বলিয়া তিনি পরিচয় প্রদান করিলেন, বাহির হইতে সেই সকল রোগের কোনরূপ চিহ্নই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। অধিকন্তু তাঁহাকে আমি যে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম, তিনি তাহার উত্তরে “হাঁ” ও মধ্যে মধ্যে “না” বলিতে আরম্ভ করিলেন। সেই সঙ্গে সঙ্গে এক একজন ডাক্তারের নাম উল্লেখ করিয়া তাঁহার উদ্দেশে সহস্র গালি বর্ষণ করিতে লাগিলেন। সেই গালির উদ্দেশ্য এই যে, তিনি সেই সকল ডাক্তারের নিকট তাঁহার রোগের চিকিৎসা করাইয়াছেন, কিন্তু কিছুমাত্র ফল প্রাপ্ত হন নাই; নিরর্থক, অর্থ ব্যয় হইয়াছে মাত্র। 

বৃদ্ধের সহিত এইরূপ কথা বলিতে বলিতে প্রায় একঘণ্টা অতিবাহির হইয়া গেল, কিন্তু তিনি যে কি রোগে আক্রান্ত, তাহার কিছুই আমি বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। আমার অনুমান হইল, বৃদ্ধ কোনরূপ রোগেই আক্রান্ত নহেন, সমস্তই তাঁহার মনের রোগ। 

এইরূপে একঘণ্টা অতীত হইবামাত্রই দ্বিতীয় ব্যক্তি পুনরায় আমাদিগের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন, এবং তাঁহার পিতার দিকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “আপনি অপর যেস্থানে গমন করিতে চাহিয়াছিলেন, তাহার সময় প্রায় উত্তীর্ণ হইতে চলিয়াছে, আপনি যদি ভুলিয়া গিয়া থাকেন, তাই আপনাকে স্মরণ করাইয়া দিলাম।” 

এই বলিয়া দ্বিতীয় ব্যক্তি পুনরায় বাহিরে গমন করিবার উদ্যোগ করিলে, বৃদ্ধ তাঁহাকে কহিলেন, “তোমাকে আর এখন বাহিরে গমন করিতে হইবে না। যেস্থানে আমাদিগের যাওয়ার কথা আছে, সেই স্থানে গমন করিতেই হইবে, এইস্থানে আর বিলম্ব করিব না। আমার পীড়ার অনেক কথা ডাক্তারবাবুকে বলিয়াছি, উনি একটু ভাবিয়া চিন্তিয়া দেখুন, আমরা কল্য না হয় পরশ্ব পুনরায় এই সময়ে আগমন করিয়া ঔষধাদির ব্যবস্থা করিয়া লইব, চল এখন আমরা গমন করি।” 

এই বলিয়া সেই দিবস তাঁহারা আমার নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিলেন। যাইবার সময় আমাকে দ্বিগুণ ভিজিট দিয়া গেলেন। 

তাঁহারা গমন করিবার পর আমি অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া দেখিলাম, অনেক পুস্তকাদির সহিত পরামর্শ করিলাম; কিন্তু বৃদ্ধের যে কি রোগ হইয়াছে, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

যে ঘরে রাসবিহারীবাবু বাস করিতেন বা তাঁহার অর্থাদি যে গৃহে থাকিত, বাহিরে গমন করিবার কালীন সেই গৃহের দরজা তিনি নিজে বন্ধ করিয়া যাইতেন, চাবি তিনি তাঁহার সঙ্গেই লইয়া যাইতেন। অদ্য রাত্রি দশটার সময় রাসবিহারীবাবু তাঁহার বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিলেন। বাহির হইতে আসিয়াই প্রথমই ডিস্পেন্‌সারিতে গমন পূৰ্ব্বক, নিয়মিত রূপে আমাকে সংবাদ প্রদান করিলেন। আমি তাঁহার নিকট গমন করিয়া সমস্ত দিবস যাহা কিছু উপার্জ্জন করিয়াছিলাম, তাহার একটি হিসাব এবং তাঁহার প্রাপ্য টাকা তাঁহাকে প্রদান করিলাম। তিনি সেই সমস্ত গ্রহণ পূৰ্ব্বক উপরে গমন করিলেন। 

উপরে গমন করিবার একটু পরেই তিনি পুনরায় আমাকে ডাকিলেন, আমি তাঁহার নিকট গমন করিলে তিনি আমার উপর একটু ক্রুদ্ধভাব প্রকাশ করিয়া কহিলেন, “আমার অবর্তমানে আমার গৃহের চাবি খুলিয়া উপরে আগমন করা আপনার কর্তব্য কি?” 

তাঁহার কথা শুনিয়া আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না, কহিলাম, “আপনি কি বলিতেছেন তাহা তো আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না।” 

রাসবিহারী। আমার অনুপস্থিতে আপনি আমার ঘরে আসিয়াছিলেন কেন? 

আমি। আমি আপনার ঘরে যাইব কেন? আপনার ঘর তালাবদ্ধ ছিল না কি? 

রাস। তালা তো বদ্ধ ছিল। 

আমি। যখন প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন, তখন তো তালা বদ্ধ পাইয়াছেন? 

রাস। হাঁ তখনও তালা বদ্ধ ছিল। 

আমি। তাহা হইলে আপনার ঘরে অপরে প্রবেশ করিবে কিরূপে? 

রাস। কেন, তালা খুলিয়া ঘরের ভিতর কি প্রবেশ করা যায় না? এবং বাহির হইয়া যাইবার সময় পুনরায় সেই তালা বদ্ধ করিয়া অনায়াসেই গমন করিতে পারা যায় না কি? 

আমি। চাবি তো আপনার কাছে ছিল। 

রাস। চাবি থাকিলে কি হয়, অপর চাবি দিয়া কি তালা খোলা যায় না? 

আমি। আপনার কোন দ্রব্যাদি অপহৃত হয় নাই তো? 

রাস। এখনও তাহা বুঝিতে পারি নাই। 

আমি। তাহা হইলে আপনার ঘরে যে কোন ব্যক্তি প্রবেশ করিয়াছে, তাহা আপনি কিরূপে অনুমান করিতেছেন?

রাস। অনুমান করিব কেন? আপনি কি দেখিতে পাইতেছেন না যে, সমস্ত ঘরের মধ্যেই প্ৰায় কৰ্দ্দম সহিত জুতার দাগ আছে। বিশেষ আমার লোহার সিন্ধুকের নিকটেই সেই দাগ অধিক। 

আমি। তাহাতো এখন দেখিতে পাইতেছি। কিন্তু আপনার ঘরে প্রবেশ করিল কে? 

রাস। চোরে প্রবেশ করে নাই; কারণ তাহা হইলে কোন না কোন দ্রব্য আমার ঘর হইতে অপহৃত হইত। আমার ভৃত্যও জুতা পায় দিয়া আমার ঘরের ভিতর আগমন করিবে না। কেবল মাত্র আপনিই বাড়ীতে উপস্থিত ছিলেন, এরূপ অবস্থায় আপনি ব্যতীত আর কোন ব্যক্তি আমার ঘরের ভিতর প্রবেশ করিতে সমর্থ? 

রাসবিহারীবাবুর কথা শুনিয়া আমার আপাদ মস্তক জ্বলিয়া গেল, নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া আমি তাঁহার ঘর হইতে বহির্গত হইলাম; এবং আপনার বন্ধুর নিকট গমন করিলাম, তিনিই আমাকে পত্রখানি লিখিয়া দিয়া আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে পরামর্শ প্রদান করিলেন, ও বলিয়া দিলেন; আপনি যদি অনুগ্রহ পূর্ব্বক একবার সেই স্থানে গমন করেন, তাহা হইলে এই ঘটনার প্রকৃত অবস্থা কি তাহা অনায়াসেই অবগত হইতে পারিবেন। তাহা হইলে আমিও এই মিথ্যা অপবাদ হইতে মুক্তি লাভ করিতে সমর্থ হইব। 

সুশীলবাবুর কথা শুনিয়া আমার মনে একটু কষ্ট হইল সত্য, কিন্তু সেই স্থানে গমন করিয়া আমি যে তাঁহার কি উপকার করিতে সমর্থ হইব, ভাবিয়া চিন্তিয়া তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। 

রাসবিহারীবাবুর ঘরে যে কেহ প্রবেশ করিয়া থাকিবে, সে বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই; কিন্তু যখন তাঁহার কোন দ্রব্য অপহৃত হয় নাই, তখন সেই স্থানে আমার গমনে বিশেষ কোন উপকারের সম্ভাবনা ছিল না। তথাপি কোনরূপেই আমি সুশীলবাবুর অনুরোধ এড়াইতে পারিলাম না। আমার নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই রাত্রিকালে সুশীলবাবুর সহিত আমাকে তাঁহার সহিত অনুগমন করিতে হইল। 

আমরা যখন সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম, সেই সময় রাসবিহারীবাবু তাঁহার ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া নিদ্রা যাইতেছিলেন। তাঁহার ঘরের অবস্থা আমাকে দেখাইবার নিমিত্ত সুশীলবাবু তাঁহাকে বার বার ডাকিলেন। অনেক ডাকাডাকির পর, তিনি তাঁহার ঘরের দরজা খুলিয়া নিতান্ত ক্রুদ্ধভাবে বাহিরে আসিলেন এবং কহিলেন “তোমার জ্বালায় একটু নিদ্রা যাইবারও যো নাই। কি হইয়াছে যে এত রাত্রিতে আমাকে ডাকাডাকি করিতেছ?” 

সুশীল। কি আর হইবে! আমরা একবার আপনার ঘরের ভিতর গমন করিতে ইচ্ছা করি। 

রাস। কেন? 

সুশীল। ঘরের মধ্যে যে সকল পায়ের দাগ হইয়াছে, তাহা একবার ইঁহাকে দেখাইব। 

রাস। ইনি কে? 

সু। ইনি একজন ডিটেকটিভ-পুলিশের-কর্মচারী, ইঁহার নাম : 

এই বলিয়া সুশীলবাবু রাসবিহারীবাবুর নিকট আমার পরিচয় প্রদান করিলেন। তিনি আমার পরিচয় পাইলেন সত্য, কিন্তু আমার সহিত বাক্যালাপ না করিয়া কহিলেন, “এত রাত্রিতে আমার বাড়ীতে পুলিশের গোলমাল চাহি না। আপনি কর্ম্মচারী মহাশয়কে বলুন, এত রাত্রিতে তাঁহার, আমার ঘরে প্রবেশ করিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই, তাঁহার আবশ্যক থাকে, কল্য দিবাভাগে যেন তিনি আগমন করেন, সেই সময় তাঁহাকে সমস্ত অবস্থা কহিব; এবং আমার ঘরের অবস্থা তাঁহাকে দেখিতে দিব। এখন আমি আপনাদিগের অনুরোধ রক্ষা করিতে পারিতেছি না।” 

এই বলিয়া রাসবিহারীবাবু তাঁহার ঘরের দরজা বদ্ধ করিলেন। 

রাসবিহারীবাবুর ব্যবহার দেখিয়া আমি অতিশয় আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। সুশীলবাবুও বিশেষ দুঃখিত হইলেন, কিন্তু তাঁহাকে আর কোন কথা বলিবার সুযোগ না পাইয়া, নিতান্ত লজ্জিত অন্তঃকরণে আমাকে কহিলেন, “দেখিলেন মহাশয়! ইঁহার কি ভদ্রোচিত ব্যবহার! ইঁহারই আয়ত্বাধীন হইয়া আমাকে সৰ্ব্বদা থাকিতে হয়। কোনরূপে যদি আমি পাঁচ সহস্ৰ মুদ্রা সংগ্রহ করিতে পারি, তাহা হইলে এখনই আমি ইঁহার সংস্রব পরিত্যাগ করি। সে যাহা হউক, আমি আপনাকে নিরর্থক যে কষ্ট প্রদান করিলাম, তাহার নিমিত্ত আমি বিশেষ লজ্জিত হইলাম। চলুন এখন আমি আপনাকে আপনার বাড়ীতে রাখিয়া আসি। এক দিবস সময় মত আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, আমার দুঃখের কথা আপনাকে কহিব।” 

সুশীলবাবুর কথা শুনিয়া আমি তাঁহাকে কহিলাম, “আপনি আমাকে এখানে আনিয়াছেন বলিয়া, আপনার লজ্জিত হইবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই, আমি এখন আপন স্থানে প্রস্থান করিলাম। আপনার যখন কোন বিষয়ে কিছুমাত্র প্রয়োজন হইবে, আপনি আমার নিকট আগমন করিবেন, বা আমাকে সংবাদ পাঠাইয়া দিবেন। আমি আপনার নিকট আগমন করিয়া, আমার সাধ্য মত আপনার কার্য্য করিব। পুনরায় আমার নিকট গমন করিতে বা আমার নিকট সংবাদ প্রদান করিতে আপনি কোন প্রকারে লজ্জিত হইবেন না।” 

এই বলিয়া আমি সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। এবং সময় মত নিজের বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। আসিবার সময় সুশীলবাবু আমার সহিত আগমন করিতে চাহিয়াছিলেন; কিন্তু আমি তাঁহাকে অনেক কথা বুঝাইয়া বলায়, তিনি পরিশেষে আমার কথায় সম্মত হইলেন। কিন্তু তাঁহার নিজ গাড়িতে করিয়া আমার বাড়ীতে পাঠাইয়া দিলেন। 

রাসবিহারীবাবুর সহিত আমার পূর্ব্ব হইতে আলাপ পরিচয় বা জানাশুনা ছিল না; কিন্তু তাঁহার ব্যবহারে আমি অতিশয় দুঃখিত হইলাম, কেন যে তিনি আমাদিগকে তাঁহার ঘরের ভিতর প্রবেশ করিতে দিলেন না, ভাবিয়া চিন্তিয়া তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। কিন্তু আমার মনে মনে ইচ্ছা থাকিল, কেন না, কোন দিবস একবার তাঁহার নিকট গমন করিব; এবং কোনরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া তাঁহার সহিত বাক্যালাপ করিয়া জানিয়া লইব, তিনি কি চরিত্রের লোক, ও রাত্রি দশটা পর্যন্ত তিনি থাকেনই বা কোথায়। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

পূর্ব্ব-বর্ণিত ঘটনার পর দুই তিনদিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। সুশীলবাবুও আমার নিকট আর কোনরূপ সংবাদ পাঠাইলেন না, আমিও আর সেই স্থানে গমন করিবার সময় পাইলাম না। 

চতুর্থ দিবস প্রাতঃকালে আটটার সময় আমি আমার জনৈক উপরিতন কর্মচারীর নিকট হইতে টেলিফোঁ দ্বারা সংবাদ পাইলাম, *** লেনস্থ সুশীলবাবুর ডিসপেনসারিতে একটি অনুসন্ধানের নিমিত্ত -সেই স্থানে গমন করিয়াই দেখিলাম, সুশীলবাবু তাঁহার ডিপেনসেরিতে বসিয়া আছেন, তাঁহাকে বেষ্টন করিয়া আরও দুই তিনজন পুলিস- কৰ্ম্মচারী সেইস্থানে উপবিষ্ট আছেন, এবং সুশীলবাবুকে নানাপ্রকার কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন। 

আমি সেই স্থানে গমন করিবামাত্র একজন প্রধান কর্মচারী আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনিও কি এই অনুসন্ধানে এখানে আগমন করিয়াছেন? 

আমি। অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত এখানে আসিয়াছি সত্য; কিন্তু কিসের অনুসন্ধান করিতে আসিয়াছি, তাহা আমি এখন পৰ্য্যন্তও অবগত নহি। 

কর্ম্মচারী। কিসের অনুসন্ধানে আসিয়াছেন, তাহা আপনি অবগত নহেন? আপনার কথা শুনিয়া বিস্মিত হইলাম। সত্যই কি আপনি কিছু অবগত নহেন? 

আমি। না। 

কর্ম্মচারী। এ কিরূপ কথা? 

আমি। যেরূপ কথাই হউক, আমি কিন্তু এখনও কিছুমাত্র অবগত নহি। 

কর্ম্মচারী। তবে আপনি এখানে আসিলেন কি প্রকারে? 

আমি। যেমন আদেশ পাইলাম, অমনি এই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। মনে করিয়াছিলাম, ঘটনার স্থানে উপস্থিত হইলেই সকল কথা অবগত হইতে পারিব; সুতরাং পূর্ব্বে বিশেষ করিয়া জানিয়া আসিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন না দেখিয়া, আমি এই স্থানে আকস্মিকভাবেই আসিলাম। 

কর্ম্মচারী। রাসবিহারীবাবু আত্মহত্যা করিয়াছেন। 

আমি। রাসবিহারীবাবু? কোন্ রাসবিহারীবাবু? এই ডিপেনসেরি যে রাসবিহারীবাবুর বাড়ীতে স্থাপিত, সেই রাসবিহারীবাবু কি? 

কর্ম্মচারী। হাঁ সেই রাসবিহারীবাবু, আপনি তাঁহাকে চিনিতেন কি? 

আমি। চিনিতাম বৈকি, খুব চিনিতাম। তিনি কিরূপে আত্মহত্যা করিয়াছেন? 

কর্ম্মচারী। গলায় দড়ি দিয়া মরিয়াছেন। 

আমি। কোথায়? 

কর্ম্মচারী। তাঁহারই ঘরের মধ্যে। 

আমি। কেন তিনি আত্মহত্যা করিলেন, তাহার কারণ কিছু অবগত হইতে পারিয়াছেন কি? 

কর্ম্মচারী। না, আত্মহত্যার কারণ স্থির হইয়া গেলে আপনাকে এই অনুসন্ধানের নিমিত্ত আর আসিতে হইবে কেন? 

আমি। রাসবিহারীবাবুর মৃতদেহ এখন কোথায়? 

কর্ম্মচারী। মৃতদেহ এখনও আমরা স্থানান্তরিত করি নাই, যে স্থানে তিনি গলায় দড়ি দিয়াছেন, সেই স্থানে তাঁহার মৃতদেহ এখনও ঝুলিতেছে। 

আমি। কিরূপে তিনি আত্মহত্যা করিয়াছেন, চলুন দেখি, একবার গিয়া দেখিয়া আসি। 

এই বলিয়া, রাসবিহারীবাবু যে ঘরে বাস করিতেন, সেই ঘরের দিকে আমি অগ্রবর্তী হইলাম। যে কৰ্ম্মচারী আমার সহিত কথা কহিতেছিলেন, তিনি ও ডাক্তার সুশীলবাবু আমার সঙ্গে সঙ্গে গমন করিতে লাগিলেন, আমাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ আরও অনেক লোক আসিতে লাগিলেন। 

রাসবিহারীবাবুর ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়াই দেখিলাম, রাসবিহারীবাবু তাঁহার যে খাটের উপর শয়ন করিতেন, সেই খাটের অতি সন্নিকটে তাঁহার মৃতদেহ ঝুলিতেছে। ঘরের মধ্যস্থিত একটি আড়াতে একটি হুক পূৰ্ব্ব হইতেই লাগান ছিল, সেই হুকের মধ্য হইতে দড়ি টাঙ্গান রহিয়াছে, সেই দড়ির অপর প্রান্ত রাসবিহারীবাবুর গলার সহিত আবদ্ধ আছে। দড়ির গ্রন্থি ঘাড়ের পশ্চাদভাগে পড়িয়াছে। মৃত্তিকা হইতে তাহার পদদ্বয় প্রায় নয়ইঞ্চি ঊর্দ্ধে রহিয়াছে। মৃতদেহের অবস্থা দেখিয়া আমি সেই কৰ্ম্মচারীকে জিজ্ঞাসা করিলাম, আমাদিগের অপেক্ষা অপর কোন প্রধান কৰ্ম্মচারী এই মৃতদেহ দেখিয়া গিয়াছেন কি? 

কর্ম্মচারী। একজন আসিয়াছিলেন, তিনি ইহা দেখিয়া গিয়াছেন। 

আমি। তিনি কি ইহা আত্মহত্যা স্থির করিয়া গিয়াছেন? 

কর্ম্মচারী। তিনি তাঁহার নিজের কোনরূপ মতামত প্রকাশ করিয়া যান নাই, আমরা যাহা যাহা বলিয়াছি, কেবলমাত্র তিনি তাহাই শুনিয়া এই স্থান হইতে প্রস্থান করিয়াছেন। 

আমি। আপনারা কি ইহা আত্মহত্যা বলিয়া স্থির করিয়া লইয়াছেন? 

কর্ম্মচারী। আত্মহত্যা ব্যতীত ইহা আর কি হইতে পারে? 

আমি। ইহা কি হত্যা হইতে পারে না? 

কর্ম্মচারী। হত্যা বলিয়া অনুমান হয় না। 

আমি। কি বলিয়া অনুমান হয়? 

কর্ম্মচারী। আত্মহত্যা। আমরা যতদূর জানি, এবং অবস্থা দেখিয়া যতদূর অনুমান করা যাইতে পারে, তাহাতে আত্মহত্যা বই আর কিছুই অনুমান হয় না। 

আমি। ইহা আত্মহত্যা নহে। 

কৰ্ম্মচারী। তবে কি? 

আমি। হত্যা বা খুন। 

কর্ম্মচারী। কেমন করিয়া ইহা হত্যায় পরিণত করিতে চাহেন? 

আমি। ইতিপূর্ব্বে আপনি অনেক গলায় দড়ি দেখিয়াছেন? 

কৰ্ম্মচারী। হাঁ, অনেক গলায় দড়ি মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিয়াছি। 

আমি। গলায় দড়ি দিয়া মৃত্যু হইবার পর তাহার নিম্নলিখিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অবস্থা সর্ব্বদা কিরূপ দেখিতে পান, তাহা বলুন দেখি। পায়ের বৃদ্ধ অঙ্গুলির অবস্থা প্রায়ই কিরূপ দেখিতে পাওয়া যায়? 

কর্ম্মচারী। যেন মাটীর দিকে ঝুলিয়া পড়ে, পায়ের অগ্রভাগ দেখিয়া অনুমান হয় যে, সে যেন মৃত্তিকা স্পর্শ করিবার নিমিত্ত নিম্নদেশে পা বাড়াইবার চেষ্টা করিতেছে। 

আমি। ইহার পায়ের অবস্থা কিরূপ দেখিতেছেন? 

কর্ম্মচারী। পায়ের অগ্রভাগ যেন ততটা নিম্নগমমুখী নহে। 

আমি। ইহার হস্তের অঙ্গুলিগুলি কেমন বোধ হইতেছে? 

কর্ম্মচারী। যেন স্বাভাবিক। 

আমি। যাহারা গলায় দড়ি দিয়া মরে, তাহাদিগের হস্তের বৃদ্ধ অঙ্গুলি প্রায়ই কিরূপ অবস্থায় থাকে, তাহা আপনি কখনও বিশেষ মনোযোগ করিয়া দেখিয়াছেন কি? 

কর্ম্মচারী। কিরূপ অবস্থায় থাকে? 

আমি। উভয় বৃদ্ধ অঙ্গুলি ভিতরের দিকে একটু বক্রভাব ধারণ করে, দেখিয়া বোধ হয়, উহারা যেন, হাতের তেলোর মধ্যভাগে, কষ্টে গমন করিবার নিমিত্ত চেষ্টা করিয়াছে; কিন্তু কৃতকাৰ্য্য হইতে না পারিয়া যেন ঈষৎ বক্রভাবে নিম্নমুখে ঝুলিতেছে। কেমন, প্রায়ই এইরূপ হয় কি না? 

কর্ম্মচারী। ঐরূপই প্রায় দেখিতে পাওয়া যায়। 

আমি। এই ব্যক্তি মৃত্যুর পূর্ব্বে মল কি মূত্র পরিত্যাগ করিয়াছে বলিয়া অনুমান হয় কি? 

কর্ম্মচারী। যে স্থানে ঐ ব্যক্তির মৃতদেহ ঝুলিতেছে, তাহার নিম্নে কোনরূপ মলমূত্রের চিহ্ন দেখিতে পাই নাই।

আমি। গলায় দড়ি দিয়া যে ব্যক্তি মরিয়া যায়, মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্ব্বে প্রায়ই সে মল মূত্র পরিত্যাগ করে; কখন কখন বা তাহার বীর্য স্খলিত হইয়া পড়ে, কোন কোন সময়ে ঐরূপ ঘটে না সত্য; কিন্তু তাহা নিতান্ত সামান্য। আমার বোধ হয়, শতকরা বা দুইজন মাত্র। 

কর্ম্মচারী। সেরূপ অবস্থা ত আমি ইহার কিছুই দেখিতে পাইতেছি না। 

আমি। ইহার জিহ্বাও সম্পূর্ণরূপ বাহির হয় নাই। 

কর্ম্মচারী। অনেক সময়ে অতি সামান্য মাত্র জিহ্বাও বাহির হইয়া থাকে। 

আমি। তাহাও হয় বটে, কিন্তু তাহারও পরিমাণ খুব সামান্য। 

কর্ম্মচারী। ইহার চক্ষুদ্বয় দেখিয়া বোধ হইতেছে, উহা যেন শরীর হইতে বাহির হইয়া পড়িবার চেষ্টা করিয়াছে।

আমি। গলায় দড়ি দিয়া মরিবার ইহাও একটি প্রধান চিহ্ন, উহাদিগের চক্ষু প্রায়ই যেন বাহির হইয়া পড়ে।

কর্ম্মচারী। তবে আপনি কিরূপে বলিতেছেন যে, ইহা গলায় দড়ি নহে? 

আমি। তাহার কারণ আছে, যদি আমার অনুমান প্ৰকৃত হয়, তখন তাহা আপনাকে বিশেষ করিয়া বুঝাইয়া দিব। বর্তমান অবস্থায় একটি কারণ এরূপ দেখিতে পাওয়া যাইতেছে, যাহাতে আমি বেশ বলিতে পারি যে, উহা আত্মহত্যা নহে। 

কর্ম্মচারী। সে কারণটি কি? 

আমি। গলায় দড়ি দিয়া যাহাদের মৃত্যু হয়, সেই দড়ি প্রায়ই কর্ণের পার্শ্ব দিয়া উঠে কি না? 

কর্ম্মচারী। হাঁ, তাহা প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায়, এবং দড়ির ফাঁস বা গিঁটও প্রায়ই কোন না কোন কর্ণের নিকটেই থাকে। 

আমি। আমি এরূপও দুই একটি দেখিয়াছি যে, দড়ি কর্ণের পার্শ্ব দিয়া উঠে নাই, উহা গলার মধ্যস্থল দিয়া অথবা নাকের সম্মুখ দিয়া উঠিয়াছে। 

কর্ম্মচারী। আমি কিন্তু ওরূপ কখনও দেখি নাই। 

আমি। আমি এরূপ অতি অল্পই দেখিয়াছি, কিন্তু বর্তমান দড়ি ঘাড়ের পশ্চাদভাগ দিয়া উঠিয়াছে; এরূপ কিন্তু আমি কখনও দেখি নাই, কখনও শুনিও নাই। ইহাতেই আমার বেশ অনুমান হইতেছে ইহা আত্মহত্যা নহে, ইহা নিশ্চয়ই খুন। 

কৰ্ম্মচারী। খুন করিল কে? 

আমি। তাহা বাহির করা আমাদিগের কার্য্য। 

কর্ম্মচারী। আর খুন করিবার উদ্দেশ্য? 

আমি। তাহাও বাহির করিতে হইবে, উদ্দেশ্য ব্যতীত হত্যা হয় না এবং হত্যা হইলে তাহার উদ্দেশ্যও ক্রমে বাহির হইয়া পড়ে। আপনারা ইহা আত্মহত্যা বলিয়াই স্থির করিতেছেন কিরূপে? আত্মহত্যার উদ্দেশ্য থাকে, সে উদ্দেশ্যও আপনারা এখনও বাহির করিয়া উঠিতে পারেন নাই। এখন অনুসন্ধান করিতে করিতে যে উদ্দেশ্য পাওয়া যাইবে, তাহাতে অনায়াসেই বুঝিতে পারা যাইবে, সেই উদ্দেশ্য আত্মহত্যার বা সেই উদ্দেশ্য হত্যার! 

কর্ম্মচারী। যদি কোনরূপ উদ্দেশ্য বাহির করিতে পারা যায়, তখন দেখা যাইবে; এখন আসুন উদ্দেশ্য অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হই। 

আমি। আত্মহত্যা করিবার দুই একটি উদ্দেশ্য আছে, তাহা আপনারা কিছু জানিতে পারিয়াছেন কি?

কর্ম্মচারী। না, এখনও পর্যন্ত কিছুই জানিতে পারি নাই। 

আমি। ইহার স্ত্রী বিয়োগ হইয়াছে, তাহা আপনারা শুনিয়াছেন কি? 

কর্ম্মচারী। শুনিয়াছি। 

আমি। আত্মহত্যার সে কি একটি কারণ হইতে পারে না? 

কর্ম্মচারী। পারে, স্ত্রীবিয়োগ অনেকদিবস হইল ঘটিয়াছে, যদি সেই কারণেই আত্মহত্যা করিবেন, তাহা হইলে এতদিবস পরে করিবেন কেন, সেই সময়েই উহা করিতেন। 

আমি। আর একটি কথা আপনারা অবগত আছেন কি? 

কৰ্ম্মচারী। কি কথা। 

আমি। ইহার স্ত্রীবিয়োগের পর হইতে এক দিবসও ইনি সন্ধ্যার পর বাড়ীতে থাকেন না। একথা আপনারা অবগত হইতে পারিয়াছেন কি? 

কর্ম্মচারী। একথা ইহার পরিচারকের মুখে আমরা এখনই শুনিয়াছি। 

আমি। কোথায় গমন করিতেন, তাহা কিছু জানিতে পারিয়াছেন কি? 

কর্ম্মচারী। না। বোধহয়, কোন স্ত্রীলোকের বাড়ীতে গমন করিতেন। আমার অনুমান যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে সেই স্থানে এমন কোন ঘটনা ঘটিয়াছে যে, যাহাতে তিনি মনে মনে বিশেষরূপ অবমানিত হইয়াছেন, ও পরিশেষে আত্মহত্যা করিয়া সেই অবমাননা হইতে মুক্তিলাভ করিয়াছেন। 

আমি। ইহা হইতে পারে। আমার ইহাও হইতে পারে যে, সেই স্থানের কোন ব্যক্তি কোন কারণে তাহাকে এই স্থানে আনিয়া হত্যা করিয়াছে, ও পরিশেষে তাহাকে এইরূপে টাঙ্গাইয়া রাখিয়া গিয়াছে। 

কর্ম্মচারী। তাহা এখন কিরূপে বলা যাইতে পারে? 

আমি। আর দুই একটি কথা আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করি। 

কৰ্ম্মচারী। কি? 

আমি। রাসবিহারীবাবু মরিয়া গিয়াছেন, একথা সৰ্ব্বাগ্রে কে জানিতে পারে?

কর্ম্মচারী। তাঁহার পরিচারক। 

আমি। সে কিরূপে উহা জানিতে পারিল? 

কর্ম্মচারী। সেই পরিচারকের নিকট হইতে আমরা যতদূর জানিতে পারিয়াছি, তাহাতে এই বুঝিয়াছি যে, যে সময় রাসবিহারীবাবু শয্যা হইতে নিয়মিতরূপ গাত্রোত্থান করেন, আজ সেই সময়ে উঠেন না; ক্রমে অধিক বেলা হইয়া পড়ে, ইহাতে তাঁহার পরিচারক তাঁহার দ্বারদেশে ধাক্কা দিয়া ডাকিতে গিয়া দেখে যে, সেই দরজা ভিতর হইতে বন্ধ নাই, ভেজান আছে মাত্র। সুতরাং ধাক্কা লাগিবামাত্রই সেই দরজা খুলিয়া যায়। সে তখন ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখে, তাহার মনিব সেই ঘরের ভিতর লম্বামান রজ্জুতে ঝুলিতেছে। 

আমি। রাত্রিকালে চাকর কোথায় ছিল? 

কৰ্ম্মচারী। বাড়ীতেই ছিল। 

আমি। বাড়ীর সদর দরজা সে কিরূপ অবস্থায় রাখিয়াছিল, এবং অদ্য প্রাতঃকালেই বা সেই দরজা কিরূপ অবস্থায় ছিল? 

কর্ম্মচারী। একথাও আমি সেই পরিচারককে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, সে করে, “রাত্রিকালে সে যখন শয়ন করে, তখন পর্যন্ত তাহার মনিব প্রত্যাবর্তন করিয়াছিলেন না, তখন বাড়ীর সদর দরজা খোলাই ছিল। তাহার মনিব যে কখন আগমন করেন, তাহা সে জানিতে পারে না, তিনি বাড়ীতে প্রত্যাবর্তন করিয়া আর তাহাকে ডাকেন না। অদ্য প্রাতঃকালে সে দেখিতে পায় যে, বাড়ীর সদর দরজা উন্মুক্ত অবস্থাতেই রহিয়াছে। 

আমি। আপনি পরিচারককে জিজ্ঞাসা করিয়াছেন কি যে, রাসবিহারীবাবুর কোন দ্রব্যাদি অপহৃত হইয়াছে কি না? 

কর্ম্মচারী। জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, সে কহে কোন দ্রব্য স্থানান্তরিত বা অপহৃত হইয়াছে বলিয়া বোধ হইতেছে না। কারণ, যে স্থানের যে সকল দ্রব্য, তাহা সেই স্থানে সেইরূপই আছে। 

আমি। শুনিতে পাওয়া যায় যে, রাসবিহারীবাবুর অনেক নগদ অর্থ আছে। 

কৰ্ম্মচারী। অনেকেই ইহা বলিয়া থাকেন ও ডাক্তারবাবু এখনই তাহা বলিতেছিলেন। 

আমি। তাঁহার অর্থাদি কিছু অপহৃত হয় নাই ত? 

কর্ম্মচারী। তাহা কি করিয়া বলিব। 

আমি। তাঁহার অর্থাদি থাকিত কোথায়? 

কর্ম্মচারী। ঘরের ভিতর একটি লোহার সিন্ধুক আছে দেখিতেছি, সুতরাং অর্থাদি যদি থাকে, তাহা হইলে উহার ভিতরেই থাকার সম্ভাবনা। লোহার সিন্ধুকের চাবি বন্ধ অবস্থায় রহিয়াছে দেখিয়াছি; সুতরাং উহার ভিতর হইতে কিছু অপহৃত হইয়াছে বলিয়া অনুমান হয় না। 

আমি। লোহার সিন্ধুকের চাবি কোথায়? 

কর্ম্মচারী। তাহা ত বলিতে পারি না। 

আমি। অনুসন্ধান করিয়া দেখিয়াছেন? 

কর্ম্মচারী। দেখিয়াছি, কিন্তু কোন স্থানে দেখিতে পাই নাই। 

আমি। চাকরটিকে একথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন কি? 

কর্ম্মচারী। করিয়াছিলাম, লোহার সিন্ধুকের চাবি যে রাসবিহারীবাবু কোথায় রাখিতেন, তাহা সে বলিতে পারে না। কিন্তু অপরাপর বাক্স প্রভৃতির চাবি তিনি সর্ব্বদা তাঁহার নিকটেই রাখিতেন। যখন স্ত্রীবিয়োগ হইয়াছিল, তাহার পর হইতে চাবি নিজের নিকট রাখাই সম্ভব। 

আমি। তাঁহার পরিধেয় পিরাণ কোথায়? 

কর্ম্মচারী। অনুসন্ধান করি নাই, বোধ হয় ঐ। 

এই বলিয়া রাসবিহারীবাবু যে বিছানায় শয়ন করিতেন, তাহার নিকটস্থিত একটি পিরাণ উঠাইয়া লইয়া কহিলেন, “বোধ হয় এই।” 

আমি উহার পকেটের ভিতর অনুসন্ধান করিয়া দেখিলাম, কিন্তু তাহার ভিতর কোন দ্রব্য প্রাপ্ত হইলাম না। বিছানা সকল উত্তম রূপে উল্টাইয়া দেখিলাম, তাহার ভিতরও চাবির কোন রূপ সন্ধান পাইলাম না। মনে করিলাম, তিনি নিশ্চয়ই তাহার চাবি সকল কোন স্থানে লুকাইয়া রাখিয়া থাকেন। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সেই ঘরের ভিতর উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিতে করিতে একটি আলমারির উপর একখানি পুস্তকের নিম্নে কয়েকটি চাবি পাইলাম। দেখিলাম কেবলমাত্র লোহার সিন্ধুক ব্যতীত সেই ঘরে অপর যে সকল সিন্ধুক বাক্স প্রভৃতি ছিল, তাহার সকল গুলির চাবিই উহাতে আছে। 

সেই সকল চাবি দিয়া, সেই ঘরের সিন্ধুক বাক্স সকল খুলিতে খুলিতে একটি সিন্ধুকের ভিতর লোহার সিন্ধুকের চাবি দেখিতে পাইলাম। সেই চাবি দ্বারা লোহার সিন্ধুকও খুলিয়া ফেলিলাম, দেখিলাম উহার ভিতর কিছুই নাই, এমন কি বিশেষ রূপ অনুসন্ধান করিয়াও সেই লোহার সিন্ধুকের ভিতর হইতে একটিমাত্র পয়সাও বাহির করিতে সমর্থ হইলাম না। তখন আমি সেই কৰ্ম্মচারীকে কহিলাম, “কেমন মহাশয়! হত্যার কারণ কি এখন তাহা বুঝিতে পারিলেন তো?” 

কর্ম্মচারী। কাজেই পারিতেছি, সিন্ধুকের মধ্যে হইতে যদি কোন অর্থ অপহৃত হইয়া থাকে, তাহা হইলে হত্যার উদ্দেশ্য যে অপহরণ, তৎবিষয়ে আর কিছু মাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু এই সিন্ধুকের ভিতর যে তাঁহার অর্থ ছিল, তাহার প্রমাণ এখন পাই কোথায়? হয় তো ইহার ভিতর তাঁহার কোন অর্থ না থাকিলেও থাকিতে পারে। 

আমি। তাহা সত্য, যখন জানিতে পারা যাইতেছে যে, রাসবিহারিবাবুর যথেষ্ট অর্থ ছিল; এবং গত কল্য ও ডাক্তারবাবুর নিকট হইতে নিয়মিতরূপ অর্থ গ্রহণ করিয়াছেন, তখন সে অর্থ যায় কোথা? তাঁহার যে যে স্থানে অর্থ রাখিবার স্থান আছে, তাহার সমস্তই দেখা হইল; কিন্তু কোন স্থানে একটি মাত্র পয়সাও দেখিতে পাওয়া গেল না। বিশেষ যাহার ঘরে লোহার সিন্ধুক থাকে, তাহার ঘরে বা সেই সিন্ধুকের মধ্যে যে একটি মাত্রও পয়সা থাকে না, ইহাই নিতান্ত আশ্চর্য্য। সে যাহা হউক, এখন আপনাদিগের যেরূপ বিবেচনা হইতেছে, তাহা করিতে পারেন। কিন্তু আমার বিবেচনায় ইহা আত্মহত্যা নহে, ইহা হত্যা বা খুন এবং এই হত্যার উদ্দেশ্য চুরি। 

কর্ম্মচারী। এরূপ অবস্থায় আমাকেও এখন বলিতে হইতেছে যে, ইহা হত্যা, সে যাহা হউক এই হত্যাকারী কে, তাহা এখন কিরূপে জানিতে পারা যাইবে। 

আমি। সে কাৰ্য্য আমাদিগের অর্থাৎ পুলিস কর্মচারীগণের। এখন সকলের বিশেষ রূপ চেষ্টা করিয়া দেখা কৰ্ত্তব্য যে, এই ভদ্রলোকটির হত্যাকারী কে? লোহার সিন্ধুকই বা সে খুলিল কি প্রকারে? এবং অর্থাদি অপহরণান্তে পুনরায় সিন্ধুক বন্ধ করিয়া রাখিবার কারণই বা কি? রাসবিহারীবাবুকে হত্যা করিয়া পুনরায় তাহার গলায় দড়ি বান্ধিয়া ঝুলাইয়া রাখিবার উদ্দেশ্যই বা কি? 

কর্ম্মচারী। ইহা বড়ই আশ্চর্য্য। 

আমি। এই ঘরের ভিতর আমি যে সকল দ্রব্যাদি দেখিতে পাইতেছি, তদ্ব্যতীত আর কোন দ্রব্য আমি আসিবার পূর্ব্বে এখানে ছিল কিনা? 

কর্ম্মচারী। আরও কয়েকটি দ্রব্য এই স্থানে পড়িয়া ছিল। 

আমি। কি কি দ্রব্য? 

কৰ্ম্মচারী। এক গাছি দড়ি, একটি হুক্ ও একটি হাতুড়ি। 

আমি। আর কোন দ্রব্য? 

কর্ম্মচারী। আর কোন দ্রব্য আমি দেখি নাই। 

আমি। সেই কয়েকটি দ্রব্য কোথায়? 

কর্ম্মচারী। আনাইতেছি। 

এই বলিয়া তিনি বাহিরে গমন করিলেন এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে সেই কয়েকটি দ্রব্যের সহিত তিনি পুনরায় ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলেন। 

আমি। দড়ি গাছাটি, দেখিতেছি, নূতন? 

কৰ্ম্মচারী। নূতন বলিয়াই বোধ হইতেছে 

আমি। যে দড়িতে রাসবিহারীবাবু লম্বিত আছেন, সেই দড়ি এবং এই দড়ি, দেখিতেছি, একই। কেমন মহাশয়, আপনার কি অনুমান হয়? 

কর্ম্মচারী। আমারও তাহাই বোধ হয়। 

আমি। হুক্‌টিও দেখিতেছি নূতন? 

কৰ্ম্মচারী। হাঁ, ইহাও নূতন বলিয়া বোধ হইতেছে। 

আমি। যে হুকের সহিত রাসবিহারীর গলায় দড়ি আবদ্ধ আছে, সেই হুক্ এবং এই হুক্ এক নহে? দেখিয়া বোধ হইতেছে, তাহার সহিত ইহার কোন প্রভেদ নাই। 

কর্ম্মচারী। না, ইহা এক প্রকারের হুক নহে এবং যে হুকে দড়ি ঝুলিতেছে, তাহা আড়ার সহিত অনেক দিবস হইতে আবদ্ধ আছে বলিয়া অনুমান হয়। 

আমি। ইহা যে পুরাতন হুক্, বহুদিবস হইতে কাঠের সহিত আবদ্ধ, সে সম্বন্ধে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।

কর্ম্মচারী। হাতুড়িটাও পুরাতন! 

আমি। কেবল মাত্র যে পুরাতন তাহা নহে, ইহা অনেক দিবস পর্য্যন্ত কোনরূপে ব্যবহৃত হয় নাই। 

কৰ্ম্মচারী। এই সকল দ্রব্য এই স্থানে কেন আনীত হইল, তাহার কিছু অনুমান করিয়া উঠিতে পারিতেছি না।

আমি। এই সকল দ্রব্য কাহার, তাহা কিছু জানিতে পারিয়াছেন কি? 

কর্ম্মচারী। না! পরিচারককে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, সে বলে এই সকল দ্রব্য, এই বাড়ীতে, সে কখন দেখে নাই। 

আমি। তাহা হইলে হত্যাকারীগণ ইহা আনিয়াছে? 

কর্ম্মচারী। হত্যাকারীগণ! আপনি কিরূপে জানিলেন যে হত্যাকারীর সংখ্যা একজন অপেক্ষা অধিক? 

আমি। এ কার্য্য একজনের দ্বারা কোনরূপেই হইতে পারে না! অভাব পক্ষে, দুইজন না হইলে মৃতদেহ উঠাইয়া কখনই আড়ার সঙ্গে দড়ি দিয়া টাঙ্গাইয়া দেওয়া যাইতে পারে না। 

কর্ম্মচারী। সেই সকল দ্রব্য হত্যাকারীগণের এখানে আনিবার উদ্দেশ্য? 

আমি। উদ্দেশ্য আছে, রাসবিহারীবাবুকে হত্যা করিয়া গলায় দড়ি বাধিয়া ঘরের আড়ার সহিত টাঙ্গাইয়া রাখিবে, ইহা পূর্ব্ব হইতে স্থির করিয়াই তাহারা সেই সকল দ্রব্য সঙ্গে লইয়া এখানে আসিয়াছিল। দড়ি আনিবার যে উদ্দেশ্য, তাহা ত স্বচক্ষে দেখিতে পাইতেছেন। যে পরিমাণ দড়ি তাহাদিগের কার্য্যে লাগিয়াছে, তাহা তাহারা কাটিয়া লইয়াছে, অবশিষ্ট এই স্থানে ফেলিয়া দিয়াছে। হুক্ আনিবার উদ্দেশ্য— যদি ঘরের ভিতর দড়ি টাঙ্গাইবার উপযোগী সুবিধা মত হুক্ বা অপর কোন দ্রব্য না থাকে, তাহা হইলে ঘরের আড়া বা বরগার সহিত এই হুক্ মারিয়া আপনাদিগের উদ্দেশ্য সফল করিয়া লইবে। কিন্তু আড়ার সহিত পুরাতন হুক্ সংলগ্ন ছিল বলিয়া নূতন হুকের আর প্রয়োজন হয় নাই। সুতরাং উহা এই স্থানে পড়িয়া রহিয়াছে। নূতন হুক্ মারিতে হইলে হাতুড়ির প্রয়োজন হয়। তাহারই নিমিত্ত এই হাতুড়ি এই স্থানে আনা হইয়াছিল বলিয়া অনুমান হয়। 

কর্ম্মচারী। যে সকল ব্যক্তি কেবল চুরি করিবে, তাহাদিগের হত্যা করিবার প্রয়োজন কি? যদি বলেন, প্রয়োজন অনুযায়ী চুরির নিমিত্ত তাহাদিগকে হত্যা কাৰ্য্যও সম্পন্ন করিতে হইয়াছে, তাহা হইলে উহাকে হত্যা করিয়া মৃতদেহ সেই স্থানে রাখিয়া প্রস্থান করিলেই পারিত। হত্যা করিয়া উহার গলায় দড়ি বাঁধিয়া টাঙ্গাইয়া রাখিতে হইলে এইরূপ বন্দোবস্ত করিয়া, এবং আবশ্যকীয় দ্রব্য সকল সংগ্রহ করিয়া, কার্য্য উদ্ধার করিবার কারণ যে কি, তাহা ভাবিয়া চিন্তিয়া আমি কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। 

আমি। হত্যাকারী যদি ধৃত হয়, তাহা হইলে তখন ইহার কারণ যে কি, তাহা অবগত হইতে পারিবেন, আমার বোধ হয়, যে সকল ব্যক্তিদ্বারা এইরূপ কার্য্য হইয়াছে, তাহারা নিতান্ত ক্ষুদ্র বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি নহে; বিশেষ রূপ বিবেচনা করিয়াই তাহারা এই রূপ কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছে। এই রূপ উপায়ে যদি তাহারা পুলিসের চক্ষে ধূলি মুষ্টি প্রদান করিতে পারে, তাহা হইলে তাহাদিগের আর ভাবনা কি? যে অবস্থায় তাহারা মৃতদেহ রাখিয়া গিয়াছে, সেই অবস্থা দেখিয়া যদি আমরা স্থির করিয়া লই যে, মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা, তাহা হইলে আর কোনরূপ অনুসন্ধানের প্রয়োজন হয় না। সুতরাং হত্যাকারী বা অপহরণকারীগণের ধৃত হইবার কোনরূপ ভয়ই তাকে না। সে যাহা হউক, এ সকল বিষয় লইয়া আমাদিগের এখন ভাবিবার কোন প্রয়োজন নাই। এখন আমাদিগের কার্য্য,–যে সকল ব্যক্তির দ্বারা এই হত্যা হইয়াছে, এখন অনুসন্ধান করিয়া তাহাদিগের সন্ধান এবং তাহাদিগকে ধৃত করা। 

কর্ম্মচারী মহাশয়কে এই কথা বলিয়া আমি সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম। সুশীলবাবু এতক্ষণ পর্যন্ত তাঁহার ডিপেনসারী গৃহেই বসিয়াছিলেন। আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার পূর্ব্বে তাঁহার সহিত গোপনে অনেকক্ষণ পর্যন্ত কথা কহিলাম। সেই সময় সুশীলবাবুর সহিত আমার গোপনে যে সকল কথা হইল, তাহা পাঠকগণের এইস্থানে জানিবার বিশেষ প্রয়োজন নাই। 

সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার সময় আমি অপরাপর কর্ম্মচারীগণকে বলিয়া গেলাম, “সন্ধ্যার সময় আমি পুনরায় এই স্থানে আগমন করিব।” 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

সেই দিবস সন্ধ্যার পরেই আমি পুনরায় সেই ডিপেনসেরীতে আসিয়া উপস্থিত হইলাম; ডিপেনসেরীর মধ্যে প্রবেশ করিয়াই দেখিলাম, কৰ্ম্মচারীগণের দ্বারা উহা পরিপূর্ণ। আমাকে পদব্রজে সেইস্থানে উপস্থিত হইতে দেখিয়া পূৰ্ব্ববর্ণিত সেই কৰ্ম্মচারী মহাশয় আমাকে কহিলেন, “আপনি কতক্ষণ এখানে আসিয়াছেন?” 

আমি। সন্ধ্যার সময় আসিব, ইহাই আপনাদিগকে বলিয়া গিয়াছিলাম, ঠিক সেই সময়েই আসিয়াছি, তবে তাহার দুই দশ মিনিটের বিলম্ব হইয়া থাকিবে মাত্র। 

কৰ্ম্ম। আমি তাহা বলিতেছি না, আমার বোধ হয়, আপনি অনেক পূর্ব্বে এইস্থানে আগমন করিয়াছেন, কিন্তু সেই সময়ে এই ডিস্পেসেরীর ভিতর প্রবেশ না করিয়া নিকটবর্তী অপর কোন স্থানে ছিলেন। 

আমি। সে যাহা হউক, এই মোকদ্দমা সম্বন্ধে আর কোন কথা বাহির হইয়াছে কি? 

কর্ম্ম। না, আর কোন নূতন কথা শুনি নাই। 

আমি। কাহার দ্বারা এই কার্য্য হইয়াছে তাহার কোনরূপ সন্ধান পাওয়া গিয়াছে কি? 

কৰ্ম্ম। না। 

আমাদিগের উভয়ের মধ্যে এইরূপ কথা বার্তা হইতেছে, এরূপ সময়, একজন উচ্চতন কৰ্ম্মচারী, যিনি সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন, তিনি আমাকে কহিলেন, “আপনার কথা আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না! আপনি কি বলিতেছেন?” 

আমি। কেন মহাশয়, কি হইয়াছে? 

উঃ ক। আপনি এখনি কহিলেন না, “কাহার দ্বারা এই কার্য্য হইয়াছে, তাহার কোনরূপ সন্ধান পাওয়া গিয়াছে কি?” 

আমি। এ কথা বলিয়াছি। 

উঃ কৰ্ম্ম। “এই কাৰ্য্য” কি কাৰ্য্য? 

আমি। হত্যা। 

উঃ কৰ্ম্ম। হত্যা? কাহাকে? 

আমি। রাসবিহারীবাবুকে 

উঃ কৰ্ম্ম। রাসবিহারীবাবুকে কেহ হত্যা করে নাই, তিনি আত্মহত্যা করিয়াছেন। 

আমি। তিনি আত্মহত্যা করিয়াছেন একথা আপনাকে কে বলিল? 

উঃ কর্ম্ম। বলিবে আর কে, আমি যে সকল অবস্থা দেখিয়াছি ও অপরাপর কর্মচারিগণের মুখে যে সকল কথা শুনিয়াছি, তাহাতে আমার নিশ্চয় প্রতীতি জন্মিয়াছে যে, ইহা আত্মহত্যা ভিন্ন আর কিছুই হইতে পারে না। 

আমি। হইতে পারে আপনার অনুমান সত্য, কিন্তু আমি কোনরূপেই আপনার অনুমানের অনুমোদন করিতে পারি না। আমার বিশ্বাস, রাসবিহারীবাবু হত হইয়াছেন। 

উঃ কর্ম্ম। রাসবিহারীর লাস পরীক্ষার্থ পাঠাইয়া দেওয়া হইয়াছিল, তাহা আপনি অবগত আছেন কি? 

আমি। আমার সম্মুখে ঐ মৃতদেহ প্রেরিত না হইলেও উহা যে পাঠাইয়া দেওয়া হইয়া থাকিবে, সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নাই, কারণ কলিকাতার ভিতর ঐরূপ মৃতদেহ ডাক্তারের পরীক্ষা ভিন্ন কখনই জ্বালাইতে দেওয়া হয় না। 

উঃ কৰ্ম্ম। ডাক্তার সাহেব, ঐ শব উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া কি অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা আপনি অবগত আছেন কি? 

আমি। না, তাহা আমি অবগত নহি। 

উঃ কর্ম্ম। ডাক্তার সাহেবের মতে শ্বাস প্রশ্বাস বদ্ধ হওয়াই রাসবিহারীবাবুর মৃত্যুর কারণ। অর্থাৎ গলায় দড়ি দিয়াই তিনি মরিয়াছেন। 

আমি। এ উত্তম কথা, প্রকৃত পক্ষে হইয়াছেও তাহাই। 

উঃ কৰ্ম্ম। তাহা হইলে আপনার মতে আত্মহত্যা না হইয়া হত্যা হইল কি প্রকারে? 

আমি। কেন হইবে না? 

উঃ কৰ্ম্ম। আপনি এই কথা বলিয়াছেন, যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণ ইহাকে হত্যা করিয়াছে, সে বা তাহারা উহার মৃত্যুর পর উহার গলায় দড়ি বাঁধিয়া ঝুলাইয়া রাখিয়াছে। 

আমি। আমার অনুমান এইরূপই। 

উঃ কর্ম্ম। ডাক্তার সাহেব পরীক্ষা করিয়া আরও বলিয়াছেন উহার শরীরের কোন স্থানে কোনরূপ আঘাতের চিহ্ন নাই। 

আমি। একথা আর ডাক্তার সাহেব বলিবেন কি, ইহা ত আমরা স্বচক্ষেই দেখিয়াছি। 

উঃ কৰ্ম্ম। তাহা হইলে শ্বাস প্রশ্বাস বদ্ধ হইয়া উহার মৃত্যু হইল কি প্রকারে? এখন বোধ হয়, আপনাকে স্বীকার করিতে হইবে যে, ঐ ব্যক্তি গলায় দড়ি দিয়া আত্মহত্যা করিয়াছে? 

আমি। একথা স্বীকার করিতে পারি না। শ্বাস প্রশ্বাস বদ্ধ হইয়া যে উহার মৃত্যু হইয়াছে, সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই; কিন্তু সে আত্মহত্যা করে নাই, তাহাকে হত্যা করা হইয়াছে। 

উঃ কৰ্ম্ম। তাহা হইলে আপনার মতেও উহার মৃত্যুর কারণ গলায় দড়ি। 

আমি। হাঁ! কিন্তু সেই দড়ি রাসবিহারীবাবু নিজে তাঁহার গলায় বাঁধিয়া আত্মহত্যা করেন নাই, গলায় দড়ি বাঁধিয়া তাঁহাকে মারিয়া ফেলা হইয়াছে। 

উঃ কৰ্ম্ম। তাহা হইলে আপনি বলিতে চাহেন যে, উহার গলায় দড়ি বাঁধিয়া, প্রথম উহাকে মারিয়া ফেলা হইয়াছে, তাহার পরে ঐ মৃতদেহ টাঙ্গাইয়া দেওয়া হইয়াছে? 

আমি। আমার সেইরূপ অনুমান হয়। 

উঃ কৰ্ম্ম। এরূপ অনুমান একেবারে অসম্ভব। 

আমি। অসম্ভব নহে, সম্পূর্ণরূপে সম্ভব। যখন আমি ইহার সত্যাসত্য প্রমাণ করিয়া দিব, তখন আপনি বুঝিতে পারিবেন যে, আমার কথা কতদূর প্রকৃত। ইহা যদি আত্মহত্যা হয় তাহা হইলে লোহার সিন্ধুকের অর্থাদি কোথায় গেল? 

উঃ কর্ম্ম। লোহার সিন্ধুকের ভিতর তাঁহার যে কোনরূপ অর্থাদি ছিল তাহার প্রমাণ কি? 

আমি। প্রমাণ যথেষ্ট আছে, সকলেই বলিতেছে তাঁহার প্রচুর অর্থ ছিল, তাহা হইলে সে সমস্ত অর্থ কোথায় গেল? 

উঃ কৰ্ম্ম। তাঁহার হয়ত কিছু অর্থ ছিল, কিন্তু সেই সকল অর্থ যে তিনি কি করিলেন, তাহা তিনি ব্যতীত আর কে বলিতে পারে? তিনি সেই অর্থ কোথায় রাখিয়া গিয়াছেন, কি তিনি উহা ব্যয় করিয়া ফেলিয়াছেন, তাহা আমাদিগের অনুমান করিয়া কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সহজ নহে। 

আমি। অনুমান করা সহজ নহে সত্য, কিন্তু অনুমানের উপর নির্ভর করিয়াই আমাদিগের সমস্ত কার্য্য নির্ব্বাহ করিতে হয়। অনুমানের উপর যদি আমরা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর না করিতাম, তাহা হইলে আমার বোধ হয়, এ পৰ্য্যন্ত একটি মকদ্দমারও কিনারা আমাদিগের দ্বারা হইত না। 

উঃ কৰ্ম্ম। আমি জানিনা, কেবলমাত্র অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া আপনারা কিরূপে এই প্রকার গুরুতর কার্য্য নির্ব্বাহ করিয়া থাকেন, বিশেষ ইংরাজী আইনের-মর্ম্মও তাহা নহে; অনুমানের উপর কখনই নির্ভর করিবে না, প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়াই এই সকল গুরুতর কার্য্য নির্ব্বাহ করা কর্ত্তব্য। 

আমি। আপনি যাহা বলিতেছেন তাহা প্রকৃত, কিন্তু অনুমানের উপর নির্ভর না করিলে কোন প্রকারেই চলিতে পারে না। প্রথমতঃ অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া কার্যক্ষেত্রে প্রবেশ করিতে হয়, ও পরিশেষে সেই অনুমান যদি কার্য্যে পরিণত হয়, তাহা হইলে আপনা আপনি তাহার প্রমাণও সংগৃহীত হইয়া পড়ে, তখন সেই সকল প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া কার্য্য উদ্ধার করিয়া লওয়াই কর্তব্য বলিয়া আমরা মনে করি; নতুবা অন্য উপায়ে কোন কাৰ্য্যই আমাদিগের দ্বারা কোনরূপেই সম্পন্ন হইতে পারে না। 

উঃ কৰ্ম্ম। যদি অনুমানের উপরই নির্ভর করিতে হয়, তাহা হইলে ইহা অনুমিত হইতে পারেনা কি?

আমি। কি? 

উঃ কৰ্ম্ম। রাসবিহারীবাবুর অর্থ ছিল, একথা যখন সকলেই বলিতেছে, তখন আমিও তাহা স্বীকার করিলাম। তাঁহার স্ত্রীর মৃত্যুর পর হইতে তাহার চরিত্র কলুষিত হইয়া ছিল, এ কথা সকলে অনুমান করিয়া থাকেন, ও তিনি প্রত্যহ সন্ধ্যার পরে যে বাড়ীতে থাকিতেন না, ইহা সকলেই অবগত আছে; এরূপ অবস্থায় অনায়াসেই অনুমান করা যাইতে পারে যে, তিনি কোন না কোন স্ত্রীলোকের প্রণয়াশক্ত হইয়াছেন। অবৈধ প্রণয়ে আশক্ত হইলে মনুষ্যগণ যে সহজেই মনুষ্যত্ব হারাইয়া থাকেন, তাহা কে না অবগত আছেন, ও পরিণামে তিনি সে অবস্থায় পরিণত হন তাহাই বা কে না জানেন। এরূপ অবস্থায় রাসবিহারীবাবুও ইদানিং যে কিরূপ অবস্থায় পরিণত হইয়াছিলেন তাহাই বা এখন কিরূপে বলিতে পারা যায়। এই কলিকাতার মধ্যে এখনও অনেক লোককে দেখিতে পাওয়া যায় যে, এক সময়ে তাঁহার যথেষ্ট মান্য ছিল, ও অপরিসীম অর্থে তাঁহার ধনভাণ্ডার পূর্ণ ছিল, কিন্তু পিশাচিনীগণের মায়ায় মুগ্ধ হইয়া ক্ৰমে তাঁহাদিগকে সেই অগাধ অর্থ হারাইতে হইয়াছে; বাড়ী, ঘর, দরজা, তৈজসপত্র ও পরিশেষে বিশাল জমিদারী পর্য্যন্ত বিক্রয় করিয়া দিয়াও পিশাচিনীগণকে পরিতুষ্ট করিতে পারেন নাই। পরিশেষে সেই সকল পাপীয়সিগণ কর্তৃক তাড়িত হইয়া তাহাদিগকে পথের ভিখারিরূপে পরিগণিত হইতে হইয়াছে। কেহ বা অর্থাভাবে অন্নকষ্ট সহ্য করিতে না পারিয়া অসময়ে কালগ্রাসে পতিত হইয়াছেন, কেহ বা তাঁহার পূর্ব্বাবস্থা স্মরণ করিয়া আপন অবমাননা আর সহ্য করিতে না পারিয়া আত্মহত্যা পূর্ব্বক আপনার ভয়ানক কষ্ট নিবারণ করিয়াছেন। নিত্য নিত্য এইরূপ অবস্থা যখন এইস্থানে দেখিতে পাওয়া যাইতেছে, তখন রাসবিহারী বাবুও যে সেইরূপ অবস্থায় পরিণত হন নাই, তাহাই বা কিরূপে অনুমান করা যাইতে পারে! তাহার যে সকল অর্থ ছিল, সেই সকল অর্থ হয়তো তিনি ঐরূপে পিশাচিনী মায়ায় মুগ্ধ হইয়া ব্যয় করিয়া ফেলিয়াছেন, ও পরিশেষে তাহাদিগের কর্তৃক তাড়িত হইয়া মনের কষ্টে আত্মজীবন নষ্ট করিয়া ইহজগত হইতে অশান্তিকে দূর করিয়া দিয়াছেন। এই নিমিত্তই তাঁহার সিন্ধুকে কোনরূপ অর্থাদি দেখিতে পাইতেছি না। 

আমি। আপনি যেরূপ কহিলেন, তাহা যে একেবারে হইতে পারে না, তাহা নহে; অনেক ধনশালী ব্যক্তি নিত্য নিত্য যে কপর্দকশূন্য হইয়া পড়িতেছেন, সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই, কিন্তু রাসবিহারীবাবুর যে সেইরূপ দশা ঘটিয়াছে তাহা আমি বলিতে পারি না। কারণ যে রাত্রিতে তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে, সেই রাত্রিতে বাহির হইতে ফিরিয়া আসিয়া সুশীলবাবুর নিকট হইতে তিনি যে কিছু অর্থ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, তাহা কোথায় গেল? 

উঃ কৰ্ম্ম। তাহা ছিল, সর্ব্বপ্রথমে তাহার পরিচারক যখন সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করে, সেই সময়ে সে ঐ অর্থ অনায়াসেই অপহরণ করিতে পারে! 

কর্ম্ম। রাসবিহারীবাবুর হত্যা সম্বন্ধে আপনি যাহা কিছু বলুন না কেন, তাহা কোনরূপেই আমি বিশ্বাস করিতে পারি না, বা আপনি যেরূপ ভাবেই আমাকে বুঝাইতে চেষ্টা করুন না কেন, আমাকে কিন্তু কোনরূপেই বুঝাইয়া উঠিতে পারিবেন না, কারণ আমি কিছুতেই বুঝিব না। আমি পূর্ব্বে যেরূপ অনুমান করিয়াছিলাম, কাৰ্য্যেও সেইরূপ প্রমাণ পাইয়াছি। যাহারা রাসবিহারীবাবুকে হত্যা করিয়াছে, তাহাদিগের নাম আমি জানিতে পারিয়াছি, ও তাহারা আমাকর্তৃক ধৃতও হইয়াছে, অপহৃত অনেক দ্রব্য আমি তাহাদিগের নিকট হইতে প্রাপ্তও হইয়াছি, সুতরাং আপনার অনুমানের উপর আমি নির্ভর করিব কেন? 

উঃ কৰ্ম্ম। আপনি আসামীগণকে ধৃত করিয়াছেন বলিতেছেন, তাহারা কোথায়?

আমি। তাহারা আমার গাড়ীতে আছে। 

[পৌষ, ১৩০৬] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *