বিষম ভ্রম ১

বিষম ভ্ৰম! (প্রথম অংশ)

(অর্থাৎ লাস সনাক্তে বিষম ভ্রম!)  

প্রথম পরিচ্ছেদ

বহুদিবস গত হইল, একবার কোন কার্য্যোপলক্ষে আমাকে ব্রহ্মদেশে গমন করিতে হয়। সেই প্রদেশের রাজধানী রেঙ্গুন নগরে উপস্থিত হইয়া, তত্রত্য সৰ্ব্বপ্রধান পুলিস কর্ম্মচারীর সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। আমরা উভয়ে বসিয়া কথাবার্তায় নিযুক্ত আছি, এমন সময় জনৈক পরিচারক একখানি সংবাদপত্র হস্তে সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল ও পূর্ব্বোক্ত কর্ম্মচারীর হস্তে উহা প্রদান করিয়া বহির্গত হইয়া গেল। তিনিও উহা পাঠ করিতে আরম্ভ করিলেন। এইরূপে কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হইবার পর, সহসা তাঁহার মুখ শুষ্ক ও বিবর্ণ হইয়া গেল। তাঁহার এইরূপ ভাবান্তর দেখিয়া আমি উহার কারণ জিজ্ঞাসা করায়, তিনি কোনও কথা না বলিয়া, সেই সংবাদপত্রখানি আমার হস্তে প্রদান করিলেন। আমিও বিনা বাক্যে যে স্থানটা তিনি পড়িতেছিলেন, তাহা বিশেষ মনোযোগের সহিত পাঠ করিতে লাগিলাম। উহাতে লেখা ছিল;— 

“ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ড!!! 

গত কল্য অপরাহ্ণে দুইটি বালক নৌকারোহণে নিকট নদীতে ভ্রমণ করিতে করিতে একটি পর্ব্বতের পাদদেশে গিয়া উপস্থিত হয়। নৌকাখানি সেইস্থানে রাখিয়া তাহারা যখন পর্ব্বতের উপর উঠিতেছিল, সেই সময় সহসা তাহাদিগের দৃষ্টি একটি কৃষ্ণবর্ণ ভাসমান পদার্থের উপর পতিত হইল। বিশেষ করিয়া লক্ষ্য করায়, স্পষ্ট বুঝা গেল, উহা একটি মনুষ্য মস্তক। এই ভয়ঙ্কর দৃশ্যে বালকদ্বয় সাতিশয় ভীত হইয়া পড়ে ও নিকটবর্ত্তী ময়দানে কয়েকজন লোককে দেখিতে পাইয়া তাহাদিগের নিকট গমন করতঃ সমস্ত বিষয় প্রকাশ করে। উহারাও এই সংবাদপ্রাপ্তে অনতিবিলম্বে নদীতীরে গমন করিয়া জানিতে পারে যে, বালকদ্বয় যাহা বলিয়াছে তাহার সমস্তই সত্য। উহা সত্য সত্যই একটি মনুষ্য মস্তক। উহাদিগের মধ্যে একব্যক্তি হস্তপ্রসারণ পূর্ব্বক মস্তকটিকে তীরে উত্তোলন করে। তখন সকলেই বুঝিতে পারে যে, উহা একটি পরমাসুন্দরী যুবতী স্ত্রীলোকের দেহান্তরিত মস্তক। কেশাবলী স্বর্ণের ন্যায় উজ্জ্বল ও প্রায় ত্রিশ ইঞ্চি লম্বা। চক্ষুদ্বয় উৎপাটিত হইয়া গিয়াছে। মুখে দুই তিনটি আঘাতের চিহ্ন। 

এরূপ ভয়ঙ্কর ঘটনা এই প্রদেশে মধ্যে মধ্যে ঘটিতেছে; কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, স্থানীয় পুলিস-কর্ম্মচারীগণের কার্য্যপটুতায় কোনটিরও কিনারা হইতেছে না।” 

কাগজখানি দুই তিনবার উত্তমরূপে পাঠ করিয়া, উহা তাঁহার হস্তে পুনরায় প্রদান পূর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলাম, “এ সংবাদ কি আপনি পূর্ব্বে প্রাপ্ত হন নাই?” 

কৰ্ম্মচারী। পাইয়াছি সত্য, কিন্তু কি করিব, কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। 

আমি। তাহার কারণ? 

কর্ম্মচারী। কারণ আর কিছুই নহে; আমার অধস্তন কর্মচারীগণ একবারে অকর্ম্মণ্য না হইলেও, তাঁহাদিগের দ্বারা এরূপ হত্যাকাণ্ডের অনুসন্ধান হওয়া অসম্ভব হইয়া পড়িতেছে। 

এই বলিয়া তিনি কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, পাঁচ সাত মিনিট পরে বলিলেন, “আচ্ছা, আপনি এই স্থানে কয় দিবস অবস্থিতি করিবেন?” 

আমি। বোধ হয় আট দশ দিবস আমাকে এই স্থানে অবস্থিতি করিতে হইবে। 

কৰ্ম্ম। তাহা হইলে আপনি অনুগ্রহপূর্ব্বক এই হত্যাকাণ্ডের অনুসন্ধান-ভার নিজহস্তে গ্রহণ করুন। আর আপনি যে কার্য্যের নিমিত্ত এই স্থানে আগমন করিয়াছেন, তাহা আমি যত শীঘ্র পারি, অপর কোন কর্মচারীর দ্বারা সম্পন্ন করিয়া লইতেছি। ইহাতে আপনি আর কোনও আপত্তি করিবেন না। যদি বলেন, আপনার প্রধান কর্ম্মচারীকেও আমি পত্র লিখিতে পারি। 

আমাকে অগত্যা তাঁহার প্রস্তাবে স্বীকৃত হইতে হইল। তিনিও যারপরনাই সন্তুষ্ট হইয়া আমার হস্তে একখানি পত্র ও পাঁচশত টাকার নোট প্রদান করিয়া কহিলেন “আপনার আবশ্যকীয় খরচ পত্র এই পাঁচ শত টাকার দ্বারা নির্ব্বাহ করিবেন। আর কোন পুলিস-কৰ্ম্মচারীর সাহায্য আবশ্যক হইলে তাঁহাকে এই পত্রখানি প্রদান করিলে তিনি সাধ্যমত আপনাকে সাহায্য করিতে কিছুমাত্র ত্রুটি করিবে না।” আমিও তথাস্তু বলিয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

বাসায় প্রত্যাগমনপূর্ব্বক আহারাদি শীঘ্র শীঘ্র সমাপন করিয়া বেলা এগারটার সময় যে স্থলে মস্তকটি রক্ষিত হইয়াছে সেইস্থানে গিয়া উপনীত হইলাম। দেখিলাম সেইস্থান একবারে লোকে লোকারণ্য হইয়া পড়িয়াছে। এরূপ জনতার ভিতর প্রবেশ করা নিতান্ত সহজ নহে। 

এরূপ অবস্থায় সেইস্থানে দণ্ডায়মান হইয়া কিরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া ভিতরে প্রবেশ করিতে সমর্থ হইব, তাহাই ভাবিতেছি, এমন সময় একজন পুলিস-কৰ্ম্মচারীকে সম্মুখে দেখিতে পাইয়া তাঁহাকে সেই পত্রখানি দেখাইলাম। তিনি উহা পাঠ করিবামাত্রই আমাকে সঙ্গে করিয়া একটি ঘরের ভিতর লইয়া গেলেন। এবং আমার ইচ্ছানুসারে সংবাদপত্রের জনৈক সংবাদদাতা বলিয়া সকলের নিকট আমার পরিচয় দিলেন। ঘরের ভিতরে প্রবেশ করিয়া মধ্যস্থলে একটা টেবিলের উপর সাদা কাপড়ের দ্বারা আচ্ছাদিত একটি পদার্থ রহিয়াছে দেখিলাম। তিনি সেই বস্ত্রখানি উঠাইয়া ফেলিবামাত্র সেই মস্তকটি বাহির হইয়া পড়িল। আমি উহা উত্তমরূপে পরীক্ষা করিতে লাগিলাম। পরীক্ষা শেষ হইলে উহা পূর্ব্বের ন্যায় সেই বস্ত্রের দ্বারা আচ্ছাদিত করিয়া পূর্ব্বোক্ত কর্ম্মচারীকে জিজ্ঞাসা করিলাম, — 

‘যে বালকেরা এই মস্তকটি সর্ব্বপ্রথম দেখিতে পায়, তাহারা কোথায়?” 

কর্ম্মচারী। এখানেই আছে। 

এই বলিয়া তিনি বালকদ্বয়কে আমার সম্মুখে আনয়ন করিলেন। 

আমি তাহাদিগকে একান্তে লইয়া গিয়া তাহাদিগের নিকট সমস্ত বিষয় আনুপূর্ব্বিক শ্রবণ করিলাম। পরিশেষে তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলাম- “যখন তোমরা মস্তকটি সর্ব্বপ্রথম দেখিতে পাও, তখন নদীর অবস্থা কিরূপ ছিল? জোয়ার না ভাঁটা?” 

বালকদ্বয়। ভাঁটা। 

আমি। তোমরা মস্তকটি পর্ব্বতের পাদদেশে দেখিতে পাও? 

বালকদ্বয়। হাঁ মহাশয় 

আমি। মস্তক ব্যতীত আর কিছু দেখিতে পাইয়াছিলে? 

বালকদ্বয়। না। 

আমি। যে স্থানটিতে মস্তকটি দেখিতে পাও, আমাকে সেই স্থানটি দেখাইয়া দিতে পারিবে? 

বালকদ্বয়। হাঁ মহাশয়। 

আমি। ভাল, তোমরা এখন আপনাপন বাড়ীতে গমন পূর্ব্বক আহারাদি শেষ করিয়া সেই স্থানে গমন কর। কিন্তু সাবধান কেহ যেন কিছু জানিতে না পারে। আমিও সেই স্থানে থাকিব। 

বালকদ্বয় তথাস্তু বলিয়া গমন করিল। এদিকে এক এক করিয়া প্রায় আট দশ জন লোক সেই মস্তকটি দেখিবার নিমিত্ত ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল ও বহির্গত হইয়া গেলন। আমি সেই টেবিলের পার্শ্বে দণ্ডায়মান থাকিয়া সমস্তই দেখিতে লাগিলাম। এইরূপে দ্বিপ্রহর অতীত হইয়া গেল। দিবা পাঁচটার সময় একটি স্ত্রীলোক বস্ত্রের দ্বারা আপাদমস্তক আচ্ছাদিত করিয়া সেই ঘরে প্রবেশ করিল। তাহার বয়স চল্লিশ বৎসর। আমিও বস্ত্রখানি উঠাইয়া লইলাম। স্ত্রীলোকটি অনিমেষ নয়নে মস্তকটির প্রতি চাহিয়া রহিল। অতি অল্পক্ষণ পরেই সীলোকটি কাঁদিয়া ফেলিল ও দেখিতে দেখিতে মূৰ্চ্ছিত হইয়া ভূতলে পতিত হইল। এরূপ অবস্থায় আমি আর স্থির থাকিতে পারিলাম না। তাহাকে ভূমি হইতে উঠাইয়া অন্য একটি ঘরে লইয়া গেলাম, ও মুখে চক্ষে জল প্রদান করিতে লাগিলাম। কিয়ৎক্ষণ পরে স্ত্রীলোকটির চৈতন্য হইল। আস্তে আস্তে উঠিয়া বসিল। এই স্থানে বলা আবশ্যক যে, যখন স্ত্রীলোকটি মূৰ্চ্ছিতা হইয়া পতিত হয়, সেই সময় তাহার মস্তকের কাপড় সরিয়া যাওয়ায় তাহার কেশাবলী আমার নয়নপথে পতিত হয়। আমিও উহা দেখিয়া একবারে স্তম্ভিত হইয়া পড়ি। কারণ, দেহশূন্য মস্তকটিতে যে চুল দেখিয়াছিলাম, তাহার সহিত এই স্ত্রীলোকটির চুলের কিছুমাত্র বিভিন্নতা নাই। উভয় মস্তকেরই কেশদাম একই রং-এর এবং একই ধরণের। 

স্ত্রীলোকটি সংজ্ঞালাভ করিবার পর আমি ধীরে ধীরে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম –”আপনি কি মস্তকটি চিনিতে পারিয়াছেন?” 

স্ত্রীলোক। নিশ্চয়ই! উহা আমার কন্যার মস্তক। 

আমি। তাহা আপনি কিরূপে জানিলেন? 

স্ত্রী। তাহার চুলে। 

আমি। আপনি কি মনে করেন যে, আপনার কন্যাকে হত্যা করিলে কাহারও অভীষ্ট সিদ্ধ হইবার সম্ভাবনা? স্ত্রী। কখনই না। 

আমি। আপনার কন্যাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছে না? 

স্ত্রী। হাঁ, গত আট দশ সপ্তাহ হইতে। 

আমি। আপনার কন্যা কি বিবাহিতা? 

স্ত্রী। না। 

আমি। তাহার চরিত্র কিরূপ ছিল? 

স্ত্রী। আমাকে মাপ করিবেন। পারিবারিক কলঙ্ক কিরূপে সর্ব্বসমক্ষে প্রকাশ করিব? 

আমি। এরূপ অবস্থায় না করিলে চলিবে না। 

স্ত্রী। আমার কন্যার চরিত্র ভাল ছিল না। কোন একটি লোক তাহার চরিত্র নষ্ট করে। 

আমি। আচ্ছা, চুল ব্যতীত অপর কোনও অঙ্গের সহিত আপনার কন্যার অঙ্গের সাদৃশ্য আছে কি? 

স্ত্রী। হাঁ, এ মস্তকটি যে আমার কন্যার, সে সম্বন্ধে আর কোন সন্দেহ নাই। চুল না থাকিলেও মস্তকটি আমি চিনিতে পারিতাম। 

আমি। আপনার কন্যার বয়স কত? 

স্ত্রী। কুড়ি বৎসর। 

আমি। বোধ হয়, আপনার ভুল হইতেছে। কারণ, এ মস্তকটি দেখিয়া বোধ হইতেছে, উহার বয়স চৌদ্দ পনের বৎসরের অধিক নহে। 

এইরূপ কথাবার্তার পর স্ত্রীলোকটি ঘরের বাহিরে আসিয়া একস্থানে উপবেশন করিল। 

স্ত্রীলোকটি বহির্গত হইয়া গেলে, পূর্ব্বোক্ত কর্ম্মচারী আমাকে বলিলেন, – “রহস্য ত উদ্ঘাটিত হইয়া গেল।”

আমি। না, প্রকৃতপক্ষে উহা আরও গভীর হইয়া আসিল। ঐ স্ত্রীলোকটির ভ্রমপ্রমাদ ঘটিয়াছে। 

কৰ্ম্ম। কেন? স্ত্রীলোকটি ত স্পষ্টাক্ষরে বলিয়া গেল যে উহা তাহার কন্যার মস্তক। 

আমি। হাঁ। কিন্তু চেষ্টা করিলে ঐরূপ আরও অনেকে আসিয়া বলিতে পারে। 

কৰ্ম্ম। তবে কি স্ত্রীলোকটি আমাদিগের সহিত প্রবঞ্চনা করিল? 

আমি। তাহা বলিতে পারা যায় না; পরে দেখিতে পাইবেন। 

কৰ্ম্ম। এক্ষণে কি করা কর্তব্য? 

আমি। কোন গতিকে দেহটিকে খুঁজিয়া বাহির করাই আমাদিগের প্রধান কার্যা। 

এই বলিয়া আমি সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

বাসায় প্রত্যাগমন করিয়া আপনার বেশ পরিবর্ত্তন করিলাম। সেই দেশীয় মাঝিদিগের ন্যায়— কাপড় পরিধানপূর্ব্বক বহির্গত হইলাম। রাত্রি প্রায় দ্বিপ্রহর। পূর্ব্বোক্ত নদীর পার্শ্ব অবলম্বন করিয়া যে স্থানে মস্তকটি পাওয়া গিয়াছিল, সেই দিকে গমন করিতে লাগিলাম। সেই সময় আমার মনে নিম্নলিখিত চিন্তাটি আসিয়া উপস্থিত হইল। “খুব সম্ভবতঃ স্ত্রীলোকটির ভ্রম হইয়াছে। যাহা হউক, দেহ কিম্বা পরিধেয় বস্ত্র প্রাপ্ত হইলেই কতকটা রহস্যভেদ করিতে সমর্থ হইব।” 

পূর্ব্বকথিত পাহাড়ের পাদদেশে গমন করিয়া দেখিলাম, একখানি নৌকা সেইস্থানে বাঁধা রহিয়াছে। আমিই ইতিপূর্ব্বে লোক দ্বারা এই নৌকাখানি এইস্থানে রাখাইয়াছিলাম। পাহাড়ের নিম্নদেশে একটি বৃহৎ জলাময় গহ্বর দেখা গেল, আমি নৌকাখানিতে উঠিয়া সেই গহ্বরের মধ্যে প্রবিষ্ট হইলাম। এইরূপে কিছুদূর গমন করিবার পর জল অল্প হইয়া আসিতে লাগিল। অবশেষে নৌকাখানি শুষ্ক জমিতে এরূপ ভাবে বদ্ধ হইয়া গেল যে, কিছুতেই উহাকে সেইস্থান হইতে স্থানান্তরিত করিতে সমর্থ হইলাম না। তখন অনন্যোপায় হইয়া আমার লণ্ঠনটি জ্বালিলাম। এবং কিয়ৎক্ষণ পরে নৌকা হইতে অবতরণ করিয়া ক্রমেই অগ্রসর হইতে লাগিলাম। এইরূপে কিছুদূর গমন করিতে না করিতেই সম্মুখে একখানি সোণার চিরুণী আমার নয়নপথে পতিত হইল। উহা উঠাইয়া লইয়া আরও অগ্রসর হইতেছি, এরূপ সময় পশ্চাদবর্ত্তী নদীতে দাঁড়নিক্ষেপের শব্দ শুনিতে পাইলাম। “একি! আমাকে কি কেহ অনুসরণ করিতেছে?” এই ভাবিয়া লণ্ঠনটিতে ঢাকা দিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইলাম। কিছুক্ষণ পরে বোধ হইল যে, দুইজন মনুষ্য আস্তে আস্তে কথা কহিতেছে। এ অবস্থায় সেখানে আর স্থিরভাবে থাকিতে পারিলাম না। আপন নৌকার নিকট গমন করিবার চেষ্টা দেখিতে প্রবৃত্ত হইলাম। আবার সেই দাঁড়ের শব্দ। আরও কিছুক্ষণ পরে শেষোক্ত নৌকার উপর একটি ক্ষীণ আলোক দৃষ্টিগোচর হইতে লাগিল। নৌকাস্থিত ব্যক্তিদিগের কথাবার্তা শুনিয়া বোধ হইল, উহারা ইতর লোক। 

আমি চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া তাহাদিগের কথাবার্তা শুনিতেছি, এমন সময় হঠাৎ একটি পিস্তলের আওয়াজ হইল। সঙ্গে সঙ্গে একটি গুলি শোঁ শোঁ করিয়া আমার মস্তকের উপর দিয়া চলিয়া গেল। আমি কালবিলম্ব না করিয়া বসিয়া পড়িলাম। দেখিতে দেখিতে আরও কয়েকটি গুলি একত্র আমার মস্তকের উপর দিয়া চলিয়া গেল। এই সময় নিম্নলিখিত কথোপকথন আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল। 

“আমার বেশ বোধ হইতেছে যে, যদি কোন হিংস্র জন্তু থাকে, তাহা হইলে সে এতক্ষণ শমন-সদনে গমন করিয়াছে।” এই কথা শুনিয়া আমার হৃৎকম্প উপস্থিত হইল! আমি কি করিব। কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। “আমি তো তোমাদের পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, পাহাড়ের পাদদেশে কি যেন একটি আছে বলিয়া আমার বোধ হইয়াছিল।” 

“এখন কি করা কর্তব্য?” 

“আচ্ছা, কোনও শব্দ শুনা গেল না, ইহার কারণ কি? পলাইয়া যায় নাই ত?” 

“পলাইতে যে পারে নাই, তাহাতে কোনও সন্দেহ নাই। তবুও সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া উচিত।” 

“ভাল, আমাদের একজন একখানি ছুরি লইয়া অগ্রসর হউক।” 

“কেযাইতে প্রস্তুত আছে?” 

“তুমি যাও না।” 

বলা বাহুল্য, আমি চুপ করিয়া পূর্ব্বোক্ত কথোপকথন শুনিলাম। ইহার পরক্ষণেই দেখিলাম, এক ব্যক্তি শাণিত ছুরিকা হস্তে আমার দিকে অগ্রসর হইতেছে। কিয়দ্দূর আগমন করিয়া এই ব্যক্তি বলিয়া উঠিল। – 

“এখানে কোন জন্তুরই মৃতদেহ নাই। ব্যাপার গুরুতর। সকলে সাবধান।” তাহার উত্তর আসিল।- 

“আচ্ছা, তুমি অগ্রসর হও।” 

লোকটিও আমার দিকে আবার অগ্রসর হইতে লাগিল। এরূপ অবস্থায় আর চুপ করিয়া থাকা অনুচিত বিবেচনায় আমি উঠিয়া বসিলাম। যখন বুঝিতে পারিলাম, লোকটি অতি নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে, তখন সহসা হস্ত দ্বারা তাহার গলদেশ এরূপ সজোরে চাপিয়া ধরিলাম যে, তাহার আর কথা কহিবার উপায় রহিল না। আমি তখন আস্তে আস্তে তাহার কাণের নিকট মুখ লইয়া গিয়া কহিলাম—“কোনও শব্দ করিও না। যদি কর তাহা হইলে এই ছুরিকা তোমার হৃদয়ে সজোরে বিদ্ধ করিয়া দিব।” 

আমার কথা শুনিয়া লোকটি চুপ করিয়া রহিল। আমি আমার পরিধেয় বস্ত্রের মধ্য হইতে হাতকড়ি বাহির করিয়া তাহার হস্তে পরাইয়া দিলাম। মুখে কাপড় জড়াইয়া বাঁধিলাম তাহার পর তাহার স্বর অনুকরণ করিয়া কহিলাম “তোমাদের একজন শীঘ্র আমার নিকট আইস। মৃতদেহটি প্রাপ্ত হইয়াছি।” 

আমার কথা শুনিয়া অপর এক ব্যক্তি আমার দিকে আসিতে লাগিল। পূর্ব্বের ন্যায় তাহাকেও আয়ত্তাধীন করিলাম তাহাদিগকে সেই স্থানে রাখিয়া আমি নৌকার দিকে গমন করিতে লাগিলাম। হামাগুড়ি দিয়া নৌকা পৰ্য্যন্ত গমন করিলাম দেখিলাম, একটি লোক বসিয়া আছে। আমি আস্তে আস্তে উঠিয়া তাহার মস্তকে সজোরে একটি আঘাত করিলাম। সে ইতস্ততঃ করিতে লাগিল। আমিও সেই অবকাশে তাহাকে লৌহ শৃঙ্খলের দ্বারা উত্তমরূপে আয়ত্তাধীন করিয়া ফেলিলাম। তখন দেখিলাম, যে পুলিস-কৰ্ম্মচারী পূর্ব্ব হইতে এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত ছিলেন, ইনি তিনিই। তাঁহার ও তাঁহার সমভিব্যাহারী লোকদিগের উপর আমি যেরূপ ব্যবহার করিয়াছিলাম, তাহাতে বিশেষরূপ লজ্জিত হইলাম; কিন্তু যা হইয়া গিয়াছে, তাহার আর উপায়ান্তর না থাকায় পূর্ব্বোক্ত লোক দুটিকেও নৌকার উপর আনয়ন করিয়া, এবার সকলে মিলিয়া পুনরায় আপন কার্য্যে যাত্রা করিলাম। 

এইরূপে সেই গভীর অন্ধকারে ক্রমেই অগ্রসর হইতে লাগিলাম। পূর্ব্বোক্ত স্থান হইতে প্রায় কুড়ি ফিট গমন করিয়াছি, এমন সময় হঠাৎ আমার দক্ষিণ পদ একটি ঠাণ্ডা পদার্থের উপর পতিত হইল। আমি তাড়াতাড়ি পা সরাইয়া লইলাম। লণ্ঠনের উপর হইতে আবরণ উন্মুক্ত করিয়া ফেলিলাম। যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমার হৃৎকম্প উপস্থিত হইল। আমি মাথায় হাত দিয়া কিছুক্ষণ সেই স্থানে বসিয়া রহিলাম। পরে কিঞ্চিৎ প্রকৃতিস্থ হইয়া বিশেষরূপে লক্ষ্য করিয়া দেখিলাম, যে, একখানি বস্ত্রের দ্বারা আচ্ছাদিত একটি মস্তকহীন দেহ কৰ্দ্দমাক্ত অবস্থায় সেই স্থানে পড়িয়া রহিয়াছে। দেহটিকে সেই স্থানে রাখিয়া আমি ইতস্ততঃ উহার পরিধেয় বস্ত্রাদির নিমিত্ত উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। কিন্তু অপর কিছু পাওয়া গেল না। 

এরূপ অবস্থায় আর সে স্থানে অধিকক্ষণ থাকা উচিত নয়। বিবেচনায়, আমি মৃতদেহটিকে উঠাইয়া লইয়া নৌকার উপর স্থাপিত করিলাম। দেখিতে দেখিতে নৌকাখানি নক্ষত্রবেগে ছুটিতে লাগিল। নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হইয়া নৌকাখানি সেইখানে রাখিলাম। 

থানায় গমন করিয়া সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারীর সহিত সাক্ষাৎ হইল। তিনি আমাকে দেখিবামাত্রই জিজ্ঞাসা করিলেন, “মৃতদেহটি প্রাপ্ত হইয়াছেন কি!” 

“আমার সহিত আগমন করুন।” 

এই বলিয়া আমরা উভয়ে যে স্থানে নৌকাখানি রাখিয়া আসিয়াছিলাম, সেই দিকে গমন করিতে লাগিলাম। ক্রমে আমরা সেই নৌকার নিকট উপস্থিত হইলাম। কৰ্ম্মচারী মৃতদেহটির উত্তমরূপে দেখিলেন। তখন মৃতদেহটি স্থানান্তরিত করা হইল। এই স্থানে বলা আবশ্যক, সে মৃতদেহটি কোন স্থানে কোনরূপ আঘাতের চিহ্ন দেখিতে পাইলাম না। 

মৃতদেহটি যে স্থানে পাওয়া গিয়াছিল, পরদিন প্রাতঃকালে পুনরায় সেইস্থানে গমন করিলাম; কিন্তু নূতন কোন সূত্র দেখিতে পাইলাম না। এদিকে যে স্ত্রীলোকটি মস্তক দেখিয়া তাহার কন্যার মস্তক বলিয়া চিনিতে পারিয়াছিল, তাহাকেও সংবাদ প্রেরণ করা হইল। সে আসিয়া কহিল, “এই আমার কন্যার মৃতদেহ।” আবশ্যকমত ডাক্তারের পরীক্ষা হইবার পর, মৃতদেহ ও মস্তক সৎকারের নিমিত্ত তাহাকে প্রদত্ত হইল। সেও উহা লইয়া প্রস্থান করিল। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

এই স্থানে বলা আবশ্যক যে, যখন ঐ মৃতদেহটি থানায় আনীত হইতেছিল, সেই সময় “বিয়ান” নামক একটি লোক আসিয়া উহা দেখিয়া যান। তিনি কেন যে ঐ মৃতদেহ বিশেষ আগ্রহের সহিত দেখিতেছিলেন, তাহা জিজ্ঞাসা করায়, তিনি তাহার বিশেষ কোনরূপ সন্তোষজনক উত্তর প্রদান করিতে পারেন না। কিন্তু তাঁহাকে তাঁহার ঠিকানা জিজ্ঞাসা করায়, তিনি উহার উত্তর প্রদান পূর্ব্বকথানা হইতে প্রস্থান করেন। 

এই ঘটনার পর এক দিবস পূর্ব্বোক্ত ঠিকানায় একটি সামান্য লোক একখানি পত্ৰহস্তে গিয়া উপস্থিত হয়। যে ঘরে “বিয়াম” বসিয়াছিলেন, তথায় গিয়া আগন্তুক তাঁহার হস্তে পত্রখানি প্রদান করে। তিনিও বিনা বাক্যব্যয়ে পত্রখানি পাঠ করিতে লাগিলেন। এই সময় আগন্তুকের দৃষ্টি একখানি সুবর্ণের চিরুণির উপর পতিত হইল। উহাতে লেখা ছিল— 

“আয়েষা! 

প্রণয়োপহার স্বরূপ তোমায় এই চিরুণীখানি দিলাম। 

তোমারই, হোসেন।” 

পত্রপাঠ শেষ হইলে তিনি বলিয়া উঠিলেন, “আমি আয়েষাকে কোনও রূপে সাহায্য করিতে প্রস্তুত নহি। সে আমার অনেকগুলি টাকা কড়ি প্রভৃতি চুরি করিয়া পলায়ন করিয়াছে। আমার ইচ্ছা আছে, তাহাকে পাইলে পুলিসে দিব।” 

আগন্তুক। তবে কি আপনি তাহাকে সাহায্য করিতে একবারেই অসম্মত? 

বিয়াম। তবে কি তুমি চিঠিখানি পড়িয়াছ? 

আগ। হাঁ মহাশয়! 

বিয়াম। তথাপি আমি তোমাকে পড়িয়া শুনাইতেছি। 

এই বলিয়া তিনি পত্রখানি আগন্তুককে শুনাইয়া শুনাইয়া পাঠ করিতে লাগিলেন। “প্রিয়তম! 

আমি তোমার নিকট হইতে পলাইয়া আসিয়া নিতান্ত অন্যায় কাৰ্য্য করিয়াছি। তদ্ব্যতীত নানারূপ বিপদগ্রস্ত হইয়া পড়িয়াছি। এখন অভাগিনীর ভিক্ষা এই যে, পত্রপাঠ লোক মারফত কিছু টাকা পাঠাইয়া দিবেন, অথবা আমাকে আপনার নিকট গমন করিতে অনুমতি করিবেন। 

তোমার, আয়েষা।” 

পত্রপাঠ শেষ হইলে “বিয়াম” জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই স্ত্রীলোকটি এখন কোথায়? তাহাকে চিঠি পত্র লিখিতে হইলে কোন্ ঠিকানায় লিখিতে হইবে?” 

আগ। তাহার ঠিকানা বলিতে আমাকে নিষেধ করিয়াছে ও বলিয়া দিয়াছে, আপনি তাহার ঠিকানা জানেন। বিয়াম। তুমি কে? থাক কোথায়? তোমাকে পত্র লিখিতে হইলে কোন্ ঠিকানায় লিখিব? 

আগ। আমার নাম মহম্মদ আলি। বড় ডাকঘরে আমার নামে চিঠি পাঠাইলে আমি তাহা প্রাপ্ত হইব। 

এই সময় বিয়াম হঠাৎ সাতিশয় রাগান্বিত হইয়া বলিয়া উঠিল, “তুমি কে বুঝিতে পারিয়াছি।” 

আগ। আমিও তোমার সমস্ত ব্যাপার অবগত হইয়াছি। 

বিয়াম। জাল চিঠির সহিত এরূপ ভাবে আমার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করার কারণ আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। যাহা হউক, তোমাকে এই নিমিত্ত শাস্তি গ্রহণ করিতে হইবে। আমার টাকা কড়ির অভাব নাই। 

আগ। দেখ হোসেন! ইহাতে তুমি যে বিশেষ কৃতকার্য্য হইবে, আমার এরূপ বোধ হয় না। 

আগন্তুকের কথা শুনিয়া হঠাৎ বিয়ামের মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। কিন্তু নিমেষ মধ্যে উহা গোপন করিয়া বলিয়া উঠিল, “আমার নাম হোসেন নয়। অথবা এরূপ নাম-বিশিষ্ট কোন ব্যক্তিকেও আমি জানি না।’ 

আগ। আচ্ছা পরে দেখা যাইবে। 

হোসেন। যদি ভাল চাও, তাহা হইলে সাবধান। আমার নিকট আগমন করিও না। তুমি যে এই স্থান হইতে জীবিতাবস্থায় প্রস্থান করিতে সমর্থ হইতেছ, ইহাই যথেষ্ট মনে করিবে। 

আগ। হত্যাকারী! তোমাকে একদিন ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিতে হইবে। 

হো। দূর হও। 

আগ। কাৰ্য্য শেষ হইয়াছে বলিয়া আমি প্রস্থান করিতেছি। আবশ্যক হইলে এই স্থানে অবস্থিতি করিতে আমার কিছুমাত্র আপত্তি ছিল না। 

হো। শীঘ্র দূর হও। নতুবা তোমাকে পুলিসে দিব। 

আগ। আমাকে অনায়াসে পুলিসে দিতে পার। কিন্তু যদি তাহা কর, তাহা হইলে নিশ্চয় জানিও, আমি তাহাদিগের সহিত মিলিত হইয়া ভাসমান মস্তকের রহস্য উদ্ঘাটন করিয়া দিব। 

শেষোক্ত কথা শুনিয়া হোসেন একবারে হাসিয়া উঠিল। পরে কহিল, “তা বেশ। সাধ্যমত চেষ্টা করিতে আপত্তি কি?” 

আগন্তুক আর সেইস্থানে থাকা উচিত নয় ভাবিয়া উঠিয়া প্রস্থান করিলেন। 

পাঠকগণের মধ্যে অনেকেই হয় ত জিজ্ঞাসা করিবেন, “আগন্তুকটি কে?” আগন্তুক আর কেহই নহেন। স্বয়ং

আমি। বিয়াম বা হোসেন যে কে? কেন যে আমি তাহার নিকট ঐরূপ ভাবে গমন করিয়াছিলাম? ও কিরূপে বা তাহার ঠিকানা অবগত হইতে পারিয়াছিলাম? তাহার বিবরণ পাঠকগণ পরে জানিতে পারিবেন। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইবার দুই এক দিবস পরে অন্য স্থানে গমন উপলক্ষে রাত্রি বারটার সময় রেলওয়ে ষ্টেসনের নিকট উপস্থিত হইয়াছি, এমন সময় একটি স্ত্রীলোকের উপর হঠাৎ আমার নয়নদ্বয় পতিত হইল। আমি তাহার মুখ দেখিবামাত্রই একবারে স্তম্ভিত হইয়া পড়িলাম। পরক্ষণেই প্রকৃতিস্থ হইয়া, যে দিকে ঐ স্ত্রীলোকটি দণ্ডায়মান ছিল, সেই দিকে ছুটিলাম। ইহার কারণ, যে স্ত্রীলোকটির মৃতদেহ আমরা পূর্ব্বে প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, তাহার সহিত এই জীবিতা স্ত্রীলোকটির কিছুমাত্র বিভিন্নতা নাই। কিছুক্ষণ এইরূপে দৌড়িয়া গিয়া কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না। এদিকে একখানি গাড়ি রেল ষ্টেসন হইতে ছাড়িয়া দিল, আমি তাড়াতাড়ি স্টেসন মাষ্টারকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “ষ্টেসনে একটি স্ত্রীলোককে দেখিয়াছেন কি?” 

ষ্টেসন-মাষ্টার। কই না। 

আমাদিগের মধ্যে এইরূপ কথোপকথন হইতেছে, এমন সময় একটি স্ত্রীলোক সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিবামাত্রই চিনিতে পারিলাম। বলা বাহুল্য, ইনিই বলিয়াছিলেন, মৃতদেহ তাঁহার কন্যার। আমাকে দেখিয়াই তিনি বলিয়া উঠিলেন, “আমার অত্যন্ত ভয় হইয়াছিল।” 

আমি। আমিও ভয় পাইয়াছিলাম। 

স্ত্রী। আপনি কি দেখিয়া ভীত হইয়াছিলেন? 

আমি। কিছু পূর্ব্বে অন্ধকারে তোমায় ও তোমার মস্তকের চুল দেখিয়া মনে ভয়ের সঞ্চার হইতেছিল। বোধ হইতেছিল, যেন মৃতদেহ কবর হইতে উত্থিত হইয়া বিচরণ করিতেছে। 

স্ত্রী। আপনি কি তাহাকে দেখিয়াছেন? 

আমি। তবে কি তুমি ইহার পূর্ব্বে এই স্থানে উপস্থিত ছিলে না? 

স্ত্রী। আমি এই মাত্র আসিতেছি। 

আমি। গাড়ি ছাড়িবার পূর্ব্বে তুমি কি এখানে ছিলে না? 

স্ত্রী। না মহাশয়। 

আমি। তবেই ত গোলের কথা। 

স্ত্রী। আপনি শুনিয়া আশ্চর্য্যান্বিত হইবেন যে, আমি অদ্য রাত্রিতে আমার মৃতা কন্যাকে দেখিতে পাইয়াছি। 

আমি। কি! ভূত দেখিয়াছেন? 

স্ত্রী। হাঁ মহাশয়। 

আমি। কতক্ষণ পূর্ব্বে? 

স্ত্রী। দশ মিনিটও গত হয় নাই। 

আমি। কোথায়? 

স্ত্রী। যখন আমি ষ্টেসনের দরজার নিকট উপস্থিত হই। 

আমি। ও কিছু নয়। তোমার মনের আতঙ্ক মাত্ৰ। 

স্ত্রী। কখনই নয়। 

আমি। আচ্ছা, আমাকে সঙ্গে লইয়া সেইস্থানে চল। 

স্ত্রীলোকটি তথাস্তু বলিয়া আমাকে সঙ্গে লইয়া চলিতে লাগিল। অতি অল্পদূর গমন করিতে না করিতেই, বোধ হইল, যেন একটি মনুষ্য আমাদিগের অগ্রে অগ্রে গমন করিতেছে। ইহা দেখিয়া স্ত্রীলোকটি আমার নিকট সরিয়া আসিয়া আস্তে আস্তে বলিল, “ওই সেই।” 

আমি। কি? স্ত্রী। ভূত। 

আমি। তুমি এইস্থানে দণ্ডায়মান থাক। আমি দেখিয়া আসিতেছি— উহা কি! 

এই বলিয়া আমি দ্রুতপদে অগ্রসর হইতে লাগিলাম। সঙ্গে সঙ্গে সেই মনুষ্য-আকৃতিও সজোরে চলিতে লাগিল। আমি যতদূর পারিলাম, তাহাকে অনুসরণ করিতে লাগিলাম। এইরূপে কিছুদূর গমন করিবার পর, আমরা উভয়ে একটি সমাধিক্ষেত্রের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলাম। আর স্থির থাকিতে না পারিয়া আমি দৌড়াইতে আরম্ভ করিলাম। আকৃতিও তাহাই করিল। তখন আমি উচ্চৈঃস্বরে বলিয়া উঠিলাম, “দাঁড়াও”। সে আমার কথায় কর্ণপাতও না করিয়া ক্রমে পলাইতে লাগিল। আমিও পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিলাম। এইরূপে কিছুদূর গমন করিবার পর, হঠাৎ তাহা অদৃশ্য হইয়া পড়িল। অনেক চেষ্টা করিয়াও তাহাকে দেখিতে পাইলাম না। তখন আমার পকেট হইতে ক্ষুদ্র আলোকটি বাহির করিয়া জ্বালিলাম এবং উহার সাহায্যে উত্তমরূপে ইতস্ততঃ অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। কিয়ৎক্ষণ পরে একটি সমাধি মন্দিরের নিকট আগমন করিয়া বোধ হইল, যেন উহার পশ্চাতে কে লুকাইয়া রহিয়াছে। আমিও একবারে উহার নিকট গিয়া উপস্থিত হইলাম। তখন একটি স্ত্রীকণ্ঠে নিম্নলিখিত কথা কয়টি মৃদুভাবে উচ্চারিত হইল। 

“মহাশয়! আপনি কেন আমার অনুসরণ করিতেছেন?” 

আমি। আপনিই বা এত রাত্রিতে এখানে কি করিতেছেন? 

স্বর। আমি ত কাহারও অনিষ্ট করিতেছি না। 

ইহার উত্তরে আমি আরও অগ্রসর হইয়া আলোকটি উহার মুখের উপরে ধরিলাম। যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হইয়া গেলাম। আমার মস্তক ঘুরিতে লাগিল। চতুর্দিক অন্ধকার দেখিতে লাগিলাম। কিয়ৎক্ষণ পরে প্রকৃতিস্থ হইয়া দেখিলাম, এই স্ত্রীলোকটির সহিত মৃতদেহের কিছুমাত্র প্রভেদ নাই। 

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমার নাম কি? আয়েষা!” 

উত্তর আসিল- “আমার নাম যাহাই হউক, তাহাতে আপনার কি?” 

আমি। তোমাকে আমার সহিত গমন করিতে হইবে। 

স্ত্রী। আপনার সহিত আমি কেন যাইব? আমি কোনও দোষ করি নাই। 

আমি। তোমার মাতার নিকট লইয়া যাইব। 

স্ত্রী। আমি মাতার নিকট যাইতে ইচ্ছা করি না।

আমি। তোমাকে অবশ্য যাইতে হইবে। 

স্ত্রী। কখনই না। 

আমি। তুমি এখানে আসিয়াছ কেন? 

স্ত্রী। বলিতে পারি না। 

আমি। অবশ্য কোন কারণ আছে। 

স্ত্রী। আপনি চলিয়া যান। আমি এই স্থানে থাকিব 

আমি। তোমাকে আমার সহিত অবশ্য যাইতে হইবে। 

আমার কথা শুনিয়া স্ত্রীলোকটি সহসা উত্থিত হইল। আমার বোধ হইল, পলাইবার চেষ্টা করিবে। অতএব তাহাকে ধরিবার নিমিত্ত হাত বাড়াইলাম। কিন্তু কি সৰ্ব্বনাশ! বালিকা একখানি ছুরি বাহির করিয়া আমাকে দেখাইল। আমিও বিশেষ কৌশলের সহিত তাহার হস্ত হইতে ছুরিকাখানি কাড়িয়া লইলাম ও বিলম্ব না করিয়া তাহাকে ধৃত করিলাম। সহসা এই সময় একটি বিকট চীৎকার আমাদিগের কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল। সঙ্গে সঙ্গে বালিকাও চুপ করিল। পরক্ষণেই বলিয়া উঠিল, “উহা কিসের শব্দ?” 

এই কথাটি শেষ হইতে না হইতেই আমার সঙ্গিনী পূর্ব্বকথিত স্ত্রীলোকটি সেই স্থানে আসিয়া উপনীত হইল। বালিকাটিকে দেখিতে পাইয়াই জিজ্ঞাসা করিল, “জীবিতা আছে ত?” 

আমি। আছে। 

স্ত্রী। এ আমার কন্যা। 

আমি। আমারও তাহাই বোধ হয়। 

কিয়ৎক্ষণ পরে আমি বলিলাম, “মৃতদেহটির রহস্য ত দেখিতেছি উদ্ঘাটিত হইল না!” 

আমার কথা শুনিয়া বালিকা কহিল, “আমি সমস্ত অবগত আছি।” 

আমি। ভাল, নিকটবর্ত্তী ঐ বৃক্ষতলে চল। সেই স্থানে তোমাদিগের নিকট সমস্ত শ্রবণ করিব। 

তখন আমরা সকলে সেই বৃক্ষতলে গমন করিলাম। বলা বাহুল্য, তথায় উপস্থিত হইয়া কিয়ৎক্ষণ বিশ্রাম করিবার পর প্রবীণা স্ত্রীলোকটি বলিতে লাগিলেন, “আমার নাম হামিদা। প্রায় ২০ বৎসর অতীত হইল, কোন ভয়ঙ্কর শত্রুর হস্ত হইতে আমার একমাত্র কন্যা আয়েষাকে রক্ষা করিবার অভিপ্রায়ে সাধারণে প্রকাশ করি যে, সে মরিয়া গিয়াছে। এদিকে তাহাকে দূরবর্তী একটি স্থানে কোন আত্মীয়ের নিকট প্রেরণ করা হয়। তাহার এক বৎসর পরে আমার আর একটি কন্যা হয়। তাহাকেও ঐরূপ উপায়ে রক্ষা করিবার সঙ্কল্প করিতেছি, এমন সময় হঠাৎ এক দিবস শত্রুগণ তাহাকে চুরি করিয়া লইয়া প্রস্থান করে। অনেক চেষ্টা করিয়াও তাহাকে প্রাপ্ত হওয়া যায় না। এই অবস্থায় বহু দিবস গত হইয়া যায়। তাহার পর আমি আমার বড় কন্যাকে আনয়ন করিয়া তাহার সহিত এ পর্য্যন্ত নিরাপদে বসবাস করিয়া আসিতেছিলাম। এমন সময় হঠাৎ একদিন সে নিরুদ্দেশ হইয়া পড়িল। অনেক চেষ্টা করিয়াও তাহাকে প্রাপ্ত হইলাম না। অবশেষে মৃতদেহটি দেখিয়া বুঝিতে পারি যে, সে আর ইহজগতে নাই। আর যে বালিকাটিকে আজ আপনি প্রাপ্ত হইয়াছেন, ও আমার দ্বিতীয়া কন্যা মেহেরউন্নিসা।” এই বলিয়া স্ত্রীলোকটি চুপ করিল। 

তাহার পর মেহেরউন্নিসা বলিতে লাগিল, “শৈশবাবস্থার কথা আমার অতি সামান্যই মনে হয়। এইমাত্র মনে আছে যে, এক দিবস বাগানে একাকী বেড়াইতেছি, এমন সময় দুই জন লোক আসিয়া আমার মুখের উপর একখানি রুমাল ফেলিয়া দেয়। আমি অজ্ঞান হইয়া পড়ি। তাহার পর আমার অদৃষ্টে যে কি ঘটে, তাহা আমার মনে হয় না। বহু দিবস পরে আমি কোনও একটি থিয়েটারের দলে অভিনয় করিতেছিলাম। সেই সময় একটি লোক আমাকে তাহার কন্যা বলিয়া পরিচয় দিল।” 

আমি। সে লোকটি কে? 

বালিকা। যে দুইজন আমাকে চুরি করিয়া লইয়া আসে, এ ব্যক্তি তাহাদিগের একজন। সেও পূর্ব্বোক্ত থিয়েটারে অভিনয় করিয়া থাকে। তাহার নাম ইস্মাইল। 

আমি। যখন তোমার চৈতন্য হয়, তখন তুমি কেবল তাহাকেই দেখিতে পাও? 

বালিকা। হাঁ মহাশয়। 

আমি। তুমি যাহা যাহা অবগত আছ, বলিয়া যাও। 

বা। এক দিবস অভিনয় শেষ হইবার পর আমি বিশ্রাম করিতেছি, এমন সময় “বিয়াম” নামক এক ব্যক্তি আসিয়া আমার প্রতিপালকের সহিত সাক্ষাৎ করে। 

আমি। কি! “বিয়াম?” 

বা। হাঁ, তাহার নাম “বিয়াম।” 

আমি। সে সৰ্ব্বপ্রথম কাহার সহিত কথা কহিতে আরম্ভ করে? তুমি না তোমার প্রতিপালক? 

বা। আমার প্রতিপালকের সহিত তাহার কথাবার্তা হয়। 

আমি। তখন তোমার বয়স কত? 

বা। দশ বৎসর। 

আমি। তোমার প্রতিপালকের সহিত তাহার যে সকল কথাবার্তা হয়, তাহা তোমার মনে আছে? 

বা। সমস্তই মনে আছে। 

আমি। বলিয়া যাও। 

বালিকা বলিতে লাগিল। “বিয়াম আমার প্রতিপালককে দেখিতে পাইয়াই বলিয়া উঠিল, “পাপিষ্ঠ! এতদিনে তোমাকে প্রাপ্ত হইয়াছি।” তাহার পর আমার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ পূৰ্ব্বক কহিল, “আমি বালিকাটিকে চিনিতে পারিয়াছি। আমার সঙ্গে পুলিস-কৰ্ম্মচারীগণ আসিয়াছেন। এখনই তোমাকে তাহাদিগের হস্তে অর্পণ করিব। 

আমি। ইহার উত্তরে তোমার প্রতিপালক কি বলিলেন? 

বা। সে নিতান্ত ভীত হইয়া বলিল, “আমি চুরির বিষয় কিছুই অবগত নহি।” 

ইহা শুনিয়া বিয়াম বলিল, “তুমি মেয়েটিকে আমার হস্তে প্রদান করিবে, কি না?’ 

“উত্তরে আমার প্রতিপালক বলিল, “ইহাতে আমি স্বীকৃত আছি। কিন্তু আপনি আমাকে পুলিসে দিতে পারিবেন না।” 

বিয়াম সম্মত হইল। কিন্তু বলিল, “কাপড়গুলিও প্রদান করিতে হইবে।” 

আমি। কিসের কাপড়? 

বা। তাহা বলিতে পারি না। বোধ হয়, যখন আমাকে চুরি করে, সেই সময় আমার পরিধানে যে সকল কাপড় ছিল, তাহাই। 

আমি। তাহার পর? 

বা। তাহার পর বিয়াম, আমার নিকট আগমন করিয়া কহিল যে, সে আমার মাতুল। আরও কহিল যে, সে আমাকে তাহার সহিত লইয়া যাইবে, এবং আমাকে নিজের কন্যার ন্যায় প্রতিপালন করিবে। 

আমি। কাৰ্য্যেও কি উহা পরিণত হয়? 

বা। হাঁ মহাশয়।— আমাকে লইয়া গিয়া তাহার বাড়ীতেই রাখিয়া দেয়। 

আমি। তাহার পর 

বা। এইরূপে আট বৎসর অতীত হইয়া যায়। আট বৎসর পরে অর্থাৎ গত বৎসর বিয়াম এক দিবস আমার নিকট আগমন করিয়া আমাকে বিবাহ করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করে। বলা বাহুল্য, আমি কিছুতেই তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইলাম না দেখিয়া সে আমাকে যৎপরোনাস্তি তিরস্কার ও ভয় প্রদর্শন করে। এইরূপে কয়েক দিবস গত হইবার পর, আমি তাহার গৃহ পরিত্যাগ করিবার সঙ্কল্প করি ও সুযোগ পাইয়া এক দিবস সেইস্থান হইতে পলায়ন করিয়া তাহার হস্ত হইতে নিষ্কৃতিলাভ করি। এক ব্যক্তি আমাকে আশ্রয় প্রদান করে, এ পর্যন্ত তাহার আশ্রয়েই বাস করিতেছিলাম। ইহার পর কয়েক মাস নির্বিঘ্নে অতীত হইয়া যায়। অদ্য সন্ধ্যার সময় হঠাৎ বিয়ামের সহিত সাক্ষাৎ হইল। আমাকে দেখিবামাত্রই সে পুনরায় তাহার গৃহে লইয়া যাইবার নিমিত্ত অনুরোধ করিল। বলা বাহুল্য, আমি সম্মত হইলাম না দেখিয়া সে নানারূপ ভয় প্রদর্শন করিতে লাগিল। আমিও বেগতিক দেখিয়া সেইস্থান হইতে পলায়ন পূৰ্ব্বক এক সমাধিক্ষেত্রে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি।” 

এই বলিয়া মেহেরউন্নিসা চুপ করিল। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

পর দিবস প্রত্যূষে স্ত্রীলোকটিকে তাহার কন্যার সহিত বাড়ীতে রাখিয়া আমি বাসায় প্রত্যাগমন করিলাম। সেই দিবস বেলা তিনটার সময় বিয়ামের বাড়ীর নিকট একটা মুসলমান অনবরত ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। বেলা চারিটা বাজিয়া গেল, তথাপি সেই মুসলমান সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল না। অবশেষে বেলা সাড়ে চারিটার সময় বিয়াম আপন বাড়ী হইতে বহির্গত হইল। পূর্ব্বোক্ত মুসলমানটি তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ অলক্ষিতভাবে গমন করিতে লাগিল। এইরূপে কিয়দ্দূরে গমন করিবার পর বিয়াম একটি সরাই খানার মধ্যে প্রবেশ করিল। কিয়ৎক্ষণ পরে মুসলমানটিও তথায় গিয়া উপস্থিত হইল। যাইয়া দেখিল যে, বিয়াম অপর একটি ইতরলোকের সহিত কথোপকথনে নিযুক্ত আছে। মুসলমানটি ঘরে প্রবেশ করিবামাত্রই সেই ইতর লোকটি তাহার হস্তস্থিত এক তাড়া নোট পকেটে রাখিয়া দিল। বলা বাহুল্য, ইহা মুসলমানটি চক্ষু এড়াইতে পারিল না। তিনি ভিতরে গিয়া একটি চূরুট ধরাইয়া লইয়া, পুনরায় বহির্গত হইয়া গেলেন। এদিকে কিয়ৎক্ষণ পরে বিয়ামও বহির্গত হইয়া গেল। তাহার গমন করিবার অতি অল্পক্ষণ পরেই সেই ইতর লোকটি বাহিরে আগমন পূৰ্ব্বক যে দিকে বিয়াম গমন করিয়াছিল, তাহার বিপরীত দিকে গমন করিতে লাগিল। মুসলমানটিও তাহার অনুসরণ করিতে ত্রুটি করিলেন না। এইরূপে গমন করিতে করিতে সন্ধ্যার সময় সেই ইতর ব্যক্তি একটি কাষ্ঠনির্ম্মিত বাড়ীতে প্রবেশ করিল। মুসলমানটিও নিকটে আগমনপূর্ব্বক 

দেখিলেন, উহা একটি কাফিখানা। বিনা বাক্যব্যয়ে তিনিও তথায় প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন, ঘরখানি নিতান্ত অপরিষ্কার। সম্মুখে একখানি টেবিল ও চারি পাঁচখানি চেয়ার। চারি জন নীচবংশসম্ভূত মুসলমান সেইস্থানে বসিয়া তাস খেলা করিতেছে। সেই ইতর ব্যক্তিকে সেই সময় আর দেখিতে পাইলেন না। উহার অনতিদূরে একটি ক্ষুদ্রতর টেবিল, উহার উপর কতকগুলি কাগজপত্র পড়িয়া রহিয়াছে। পার্শ্বে একখানি আয়না। মুসলমানটি আয়নাখানির নিকট গমন পূৰ্ব্বক সেই সকল কাগজের উপর একখানি স্ত্রীলোকের প্রতিমূর্ত্তি রাখিয়া আসিয়া পূৰ্ব্বকথিত নীচবংশসম্ভূত মুসলমানদিগের সহিত খেলায় নিযুক্ত হইলেন। এইরূপে কিছু ক্ষণ অতিবাহিত হইবার পর, আমাদিগের পরিচিত মুসলমানটি যে ইতর লোকটিকে অনুসরণ করিয়া আসিতেছিলেন, সেও তথায় আসিয়া উপস্থিত হইল। কিছুক্ষণ ক্রীড়া দর্শন করিবার পর সে পূর্ব্বকথিত আয়নার নিকট গমন করিল ও সেই প্রতিমূর্তিখানির উপর দৃষ্টি পড়াতে উহা উঠাইয়া লইয়া দেখিতে লাগিল। আমাদিগের পরিচিত মুসলমানটি খেলায় নিযুক্ত ছিলেন সত্য, কিন্তু তাহার দৃষ্টি ছিল সেই লোকটির উপর। কিয়ৎক্ষণ পরে তিনি আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। উঠিয়া আসিয়া সেই লোকটির পশ্চাতে দণ্ডায়মান হইয়া কহিলেন, “এই স্ত্রীলোকটি তোমার কে?” 

ইতর ব্যক্তি। তোমার সে কথায় আবশ্যক নাই। 

মুসলমান! তুমি প্রতিমূর্তিখানি আপন পকেটের ভিতর রাখিতেছ কেন? 

ই-ব্য। উহা আমার। 

মুসল। তুমি উহা এইমাত্র আয়নার পার্শ্ব হইতে উঠাইয়া লইলে। 

ই-ব্য। তবে কী উহা তোমার? 

মুসল। হইতে পারে। ভাল, প্রতিমূর্তিখানি আমাকে দাও না কেন? 

ই-ব্য। তাহা পারিব না। 

মুসল। পারিবে না? 

ই-ব্য। না। 

মুসল। না দেওয়ার কারণ? 

ই-ব্য। কিছুই নয়। 

এই বলিয়া সেই ইতর ব্যক্তি বহির্গত হইয়া যাইবার উপক্রম করিতে লাগিল। মুসলমানটি ছাড়িবার পাত্র নহেন। তাহাকে সজোরে ধরিয়া বলিয়া উঠিলেন, “দাঁড়াও। আমার জিনিস চুরি করিয়া কোথায় যাইতেছ?” 

ই-ব্য। আমি উহা টেবিলের উপর পাইয়াছি। 

মুসল। তাহা হইলে কী হয়! উহা আমার, আমি টেবিলের উপর রাখিয়াছিলাম। 

ই-ব্য। এটি যাহার প্রতিমূর্তি, তাহাকে কি তুমি জান? 

মুসল। তাহা না হইলে তাহার প্রতিমূর্ত্তি আমার নিকট থাকিবে কেন? 

মুসলমানটির কথা শুনিয়া সে সাতিশয় আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া কহিল, “ভাল, আমার ঘরে এস। আমি তোমার সহিত কথাবার্তা কহিব।” 

মুসলমান সম্মত হইয়া, সেই অপরিচিত ব্যক্তির পশ্চাৎ পশ্চাৎ তাহার ঘরে গমন করিলেন। ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া দরজা বন্ধ করা হইল। 

সেই ইতর ব্যক্তি আপন পকেট হইতে প্রতিমূর্তিখানি বাহির করিয়া কহিল, “তুমি কি ইহা টেবিলের উপর রাখিয়াছিলে?” 

মুসল। হাঁ। 

ই-ব্য। এই স্ত্রীলোকটি এখনও কি জীবিত আছে? 

মুসল। হাঁ। 

ই-ব্য। সে এখন কোথায়? 

মুসল। তাহা জানিয়া তোমার লাভ কি? 

ই-ব্য। দেখ, যদি আমায় তাহাকে দেখাইয়া দাও, তাহা হইলে তোমাকে যথেষ্ট পুরস্কার দিব। 

মুসল। আমি বলিব না। 

ইহা শুনিয়া সেই ইতর ব্যক্তি ক্রোধে একবারে অধৈর্য্য হইয়া পড়িল, ও দেখিতে দেখিতে একখানি ছুরি বাহির করিয়া কহিল, “যদি ভাল চাও ত প্রকাশ কর।” 

মুসল। আমাকে খুন করিলে তোমায় ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিতে হইবে। 

ই-ব্য। তাহা আমি উত্তমরূপে অবগত আছি। 

মুসল। স্ত্রীলোকটি কোথায় থাকিত, তাহা আমি জানি। কিন্তু এখন কোথায় আছে, তাহা অবগত নহি। আচ্ছা, তোমার তাহা জানিয়া কি লাভ? 

ই-ব্য। সে আমার কন্যা। 

মুসল। দেখিয়া বোধ হয় না। 

ই-ব্য। বাস্তবিক সে আমার কন্যা। যখন তাহার বয়স দশ বৎসর, সেই সময় কে তাহাকে চুরি করিয়া লইয়া যায়।

মুসল। আমার ইহা বিশ্বাস হয় না। 

ই-ব্য। সাবধান! আমি তোমায় খুন করিব। 

এই কথা শুনিয়া মুসলমানটি রাগান্বিত হইয়া কহিলেন, “দেখ সাবধান!”

ই-ব্য। তুমি কে? 

মুসল। তাহা কি তুমি জান না? 

ই-ব্য! না। 

মুসল। আমি তোমাকে জানি। 

ই-ব্য। আমাকে? 

মুসল। হাঁ। 

এই সময় সেই লোকটির হস্ত হইতে সেই ছুরিকাখানি মুসলমানটি সজোরে কাড়িয়া লইয়া কহিলেন, “ইস্মাইল! সাবধান!” 

মুসলমানটির কথা শুনিয়া তাহার মুখ একবারে বিবর্ণ হইয়া গেল। জিজ্ঞাসা করিল, “কি সৰ্ব্বনাশ! তুমি কে?” মুসল। আমি যে হই, তাহাতে তোমার কোন লাভ নাই। এখন বল দেখি, অদ্য বিয়ামের নিকট তোমার কি কাৰ্য্য ছিল? 

ই-ব্য। “বিয়াম” নামক কোন ব্যক্তিকে আমি চিনি না। 

মুসল। আমার নিকট মিথ্যা বলিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। বিয়াম যে অদ্য তোমাকে টাকা প্রদান করিয়াছে, তাহা আমি বিলক্ষণ রূপে অবগত আছি। 

 ই-ব্য। না মহাশয়, ধর্ম্মের দোহাই! টাকা কড়ি দেয় নাই। 

মুসল। সে যাহা হউক, বালিকাটি এখন কোথায়, তাহা তুমি জান? ই-ব্য। না মহাশয় আমি শপথ করিয়া বলিতেছি, আমি জানি না। মুসল। যে ব্যক্তি মনুষ্য চুরি করে, তাহার শপথ আমি গ্রাহ্য করি না। ই-ব্য। সৰ্ব্বনাশ! আপনি তবে সমস্তই অবগত হইতে পারিয়াছেন! 

মুসল। দেখ ইস্মাইল! যদি ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিবার ইচ্ছা না থাকে, তাহা হইলে সমস্ত কথা আমার নিকট প্রকাশ কর।

ই-ব্য। মেয়ে চুরি করিলে ফাঁসি হয় না। 

মুসল। তাহা সত্য; কিন্তু এরূপ গুরুতর অপরাধ আছে, যাহাতে ফাঁসি হইয়া থাকে। 

ই-ব্য। তাহা কি? 

মুসল। খুন। 

এই কথা শুনিয়া সে ব্যক্তি একবারে ভূতলে পতিত হইল এবং বলিতে লাগিল, “মহাশয় আমি যথার্থ বলিতেছি, আমার দ্বারা কোন হত্যাকাণ্ড সাধিত হয় নাই।” 

মুসল। বালিকা এখন কোথায়, যদি তুমি উহা না বল, তাহা হইলে তোমাকে নিশ্চয়ই ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিতে হইবে। 

ই-ব্য। মহাশয়! বলিতে কি, তাহা যদি আমি জানিতাম, তাহা হইলে বিয়ামের নিকট হইতে বিস্তর অর্থ সংগ্রহ করিতে সহজেই সমর্থ হইতাম। 

মুসল। তুমি না এই মাত্র বলিলে যে বিয়ামকে জান না? 

লোকটি চুপ করিয়া রহিল। 

মুসল। বিয়াম তোমাকে কিসের নিমিত্ত টাকা প্রদান করে? 

ই-ব্য। অগ্রে আপনি কে, তাহা বলুন! 

মুসল। তাহা জানিয়া তোমার কিছুমাত্র লাভ নাই। এখন যদি ভাল চাও, তাহা হইলে আমার কথার উত্তর প্রদান কর। 

ই-ব্য। আপনি আমায় কোনও কথা জিজ্ঞাসা করেন নাই। 

মুসল। আচ্ছা, আমি বলিতেছি, তুমি শ্রবণ কর। বহুদিবস পূর্ব্বে একটি মেয়ে চুরি করিবার ভার তোমার উপর অর্পিত হয়। 

ই-ব্য। উহা মিথ্যা কথা। 

মুসল। এবং তুমিও উহা সম্পন্ন করিতে কিছুমাত্র ত্রুটি কর না। তাহার পর নিজের অপরাধ গোপন করিবার মানসে অপর একটি বালিকাকে হত্যা করিয়া নদীতীরে ভাসাইয়া দাও। 

ই-ব্য। এ সমস্তই মিথ্যা। 

মুসল। তুমি থিয়েটারে অভিনয় করিতে। বালিকাকে লইয়া গিয়া তথায় অভিনয় করিতে শিক্ষা প্রদান করিতে আরম্ভ কর। 

ই-ব্য। মিথ্যা। 

মুসল। তাহার পর বিয়াম আসিয়া উহাকে লইয়া যায়। ইহার পর হইতেই তুমি উহার নিকট হইতে দস্তুরমত উৎকোচ গ্রহণ করিতে আরম্ভ কর। 

ই-ব্য। শেষোক্ত কথাগুলি সত্য হইতে পারে, কিন্তু চুরির সম্বন্ধে আমি সম্পূর্ণরূপে নির্দোষ। 

মুসলমান। ভাল, বিয়াম তোমাকে কত টাকা প্রদান করিয়া থাকে? 

ই-ব্য। সামান্য! বালিকাটিকে গ্রহণ করিয়া অবধি সৰ্ব্বশুদ্ধ আমাকে ১০০০ সহস্র মুদ্রার অধিক দেয় নাই। কিন্তু বালিকাটিকে যদি থিয়েটারে রাখিতে পারিতাম, তাহা হইলে আমি উহার দ্বারা অত্যল্পপক্ষে ৩০০০ সহস্র টাকা উপার্জ্জন করিতে সমর্থ হইতাম। 

মুসল। দেখ, বালিকার অনুসন্ধানে যদি তুমি আমার সহায়তা কর, তাহা হইলে আমি তোমাকে ৫০০ শত টাকা প্রদান করিব। 

ই-ব্য। আমি এই প্রস্তাবে সম্মত আছি। 

মুসল। আর বালিকাটি তোমার নিকট কিরূপে আগমন করে, তাহা যদি যথাযথ আমার নিকট বল, তাহা হইলে আর ৫০ টাকা প্রদান করিব। 

ই-ব্য। আচ্ছা, আমি এখনই বলিতেছি। 

সুবল। কিন্তু সাবধান! আমি প্রায় সমস্তই অবগত হইতে পারিয়াছি; সুতরাং আমার নিকট মিথ্যা কথা বলিলে তৎক্ষণাৎ আমি বুঝিতে পারিব। 

ই-ব্য। নুর মহম্মদ নামক এক ব্যক্তি ঐ বালিকাটিকে আমার নিকট আনয়ন করে। 

মুসল। সে উহাকে কিরূপে প্রাপ্ত হয়? 

ই-ব্য। তাহা আমি বলিতে পারি না। 

মুসল। নুর মহম্মদকে দেখিলে চিনিতে পারিবে? 

ই-ব্য। হাঁ মহাশয়। 

মুসল। তাহার বয়স কত? 

ই-ব্য। সে সময় তাহার বয়স ৩০ বৎসরের কম ছিল না। 

মুসল। যখন সে বালিকাটিকে তোমার নিকট আনয়ন করে, তখন উহার অঙ্গে কিরূপ বস্ত্র ছিল? নুতন না পুরাতন? 

ই-ব্য। পুরাতন। 

মুসল। আর কিছু উহার সঙ্গে ছিল? 

ই-ব্য। একটি সুবর্ণের মাদুলি। 

মুসল। উহা তুমি কিরূপে প্রাপ্ত হইলে? 

ই-ব্য। আমি ইহা নুর মহম্মদের নিকট হইতে ক্রয় করি। 

মুসল। এখনও উহা তোমার নিকট আছে? 

ই-ব্য। হাঁ। 

মুসল। কোথায়? 

ই-ব্য। আমার অঙ্গেই আছে। 

এই বলিয়া সে আপন অঙ্গ হইতে মাদুলীটি খুলিয়া মুসলমানটির হস্তে প্রদান করিল। তিনি উহা দেখিয়া বিশেষরূপে সন্তুষ্ট হইয়া কহিলেন, “দেখ, এখন তোমাকে একটি কার্য্য করিতে হইবে। বিয়ামের সহিত আর একবার সাক্ষাৎ করিয়া তাহার সহিত এ সম্বন্ধে কথোপকথন করিবে! বলা বাহুল্য, আমিও সেইস্থানে গোপনে উপস্থিত থাকিব।” 

তখন সে এই প্রস্তাবে স্বীকৃত হইল। আমিও আপন বাসায় গমন করিলাম। পর দিবস অতি প্রত্যূষে শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিয়াই দেখিলাম, হামিদা বিবি আমার অপেক্ষায় বসিয়া আছে। আমার নিকট আগমন করিবার কারণ জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিলেন, “গতকল্য বৈকালে আমি ও আমার কন্যা একটি আত্মীয়ের বাড়ীতে গমন করিতেছিলাম, এমন সময় আমার সহিত একটি পরিচিত লোকের সাক্ষাৎ হইল। ২।৩ মিনিট কাল তাহার সহিত কথোপকথনে অতিবাহিত হইবার পর দেখিলাম, আমার কন্যা সে স্থানে উপস্থিত নাই। মনে ভয়ের সঞ্চার হইল। বাড়ীতে গিয়া ও তাহাকে দেখিতে পাইলাম না। এই নিমিত্তই আপনার নিকট পুনরায় আগমন করিয়াছি। 

বলা বাহুল্য, আমি তাহার কথা শ্রবণ করিয়া বিশেষরূপ চিন্তিত হইলাম। কিন্তু মনের ভাব গোপন করিয়া তাহাকে অনেকরূপ আশ্বাস বাক্য প্রদানপূর্ব্বক সান্ত্বনা করিয়া নিজ গৃহে পাঠাইয়া দিলাম। বলা বাহুল্য, তাহার মনে দৃঢ় বিশ্বাস হইল, আমি তাহার কন্যাকে পুনরায় উদ্ধার করিতে সমর্থ হইব। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ

সেই দিবস রাত্রি দশটার সময় আমি একটি কাফিখানায় গমনপূর্ব্বক একটি ঘরে বসিয়া অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। প্রায় অৰ্দ্ধ ঘণ্টা অতীত হইতে না হইতেই বোধ হইল, দুইজন লোক আসিয়া পার্শ্ববর্তী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া কথোপকথনে নিযুক্ত হইল। বলা বাহুল্য, প্রথম ব্যক্তি বিয়াম এবং দ্বিতীয়টি ইসমাইল। আমিও একটি ছিদ্রের মধ্য দিয়া তাহাদিগের কথাগুলি শ্রবণ করিতে লাগিলাম। 

বি। দেখ, ইসমাইল! আমি তোমার জ্বালায় একেবারে জ্বালাতন হইয়াছি। আর আমি কিছুমাত্র সহ্য করিব না।

ইস। তাহার উপায় আমিও অবগত আছি। 

বি। কি? 

ইস। বালিকার মাতা এখনও জীবিতা। আর তিনি কোথায় থাকেন, তাহাও আমি অবগত আছি। 

বি। ইহা আমিও পূর্ব্বে জানিতাম। 

ইস। এখন আমি তাহার নিকট গমন করিয়া অনায়াসে সমস্ত বিষয় প্রকাশ করিয়া দিতে পারি। 

বি। তোমার যাহা ইচ্ছা, করিতে পার। আমি তোমায় আর এক পয়সাও প্রদান করিব না। 

ইস। মৃতদেহটি যে তাহার কন্যার, তাহা সে অবগত নহে। 

বি। তাহা সে উত্তমরূপে অবগত আছে। 

ইস। সে ইহাও অবগত নহে যে, তাহার কন্যা জীবিতা আছে। 

বি। তাহা তুমি জান না? 

ইস। নিশ্চয়ই জানি। 

বি। তবে তুমি আমার সহিত কোনরূপ সম্পর্ক রাখিতে ইচ্ছা কর না? 

ইস। না। আমি বোধ হয় 

নুর মহম্মদের সহিত মিলিত হইব। 

বি। দেখ, ইসমাইল! আমাদিগের মধ্যে বিবাদ হওয়া কি উচিত? বিশেষতঃ ইহাতে তোমার কিছুমাত্র লাভ নাই।

ইস। বিবাদ যদি হয়, তাহা হইলে উহা তোমার দোষ। 

বি। আচ্ছা। শীঘ্রই আমি তোমাকে ২৫০ টাকা প্রদান করিব। 

ইস। ভাল। 

বি। আচ্ছা হামিদা ও নুর মহম্মদের বিষয় তুমি কিরূপে অবগত হইতে পারিলে? 

ইস। তাহা আমি বলিব না। 

বি। দেখ, আমি হামিদার সহিত একবার সাক্ষাৎ করিতে ইচ্ছা করি। অতএব তোমায় অনুরোধ করিতেছি, সে কোথায় থাকে, তাহা আমায় বলিয়া দাও। আমি ইহার নিমিত্ত তোমায় ৫০ পঞ্চাশ টাকা প্রদান করিতে প্রস্তুত আছি। 

ইস। আচ্ছা, অদ্য নয়। 

বি। তা না হয়, নুর মহম্মদ কোথায় থাকে বলিয়া দাও। 

ইস। যখন ৫০ পঞ্চাশ টাকা প্রদান করিবে, তখন আমি বলিব। অগ্রে বলিব না। 

বি। আচ্ছা, এই লও ৫০ টাকা। 

তখন ইসমাইল টাকাগুলি পকেটে রাখিয়া বলিল, “বেশ”। 

বি। এখন নুর মহম্মদের ঠিকানা আমায় বলিয়া দাও। 

ইস। আচ্ছা, বলা যাইবে। 

বি। এখনই বল। 

ইস। এখন না! ২।৪ দিবস পরে। 

বি। আর তামাসা করিতে হইবে না। বলিয়া দাও। 

ইস। আমি তামাসা করিতেছি না। 

ইহা শুনিয়া বিয়াম ক্রোধে একেবারে অধৈর্য্য হইয়া পড়িল। দেখিতে দেখিতে একখানি বৃহৎ ছুরিকা বাহির করিয়া ইসমাইলের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল। ইসমাইলও ছাড়িবার পাত্র নহেন। সেও একখানি ছুরি বাহির করিয়া কহিল, “সাবধান, আর অগ্রসর হইও না।” 

বিয়াম বেগতিক দেখিয়া বসিয়া বলিল, “দেখ, ভাই! কেন অনর্থক আমার সহিত বিবাদ করিতেছ? যাহা হইবার হইয়াছে, এখন এস, একটু কাফি পান করা যাউক।” 

এই বলিয়া কাফি ওয়ালাকে ২ পেয়ালা কাফি আনিতে আদেশ করিল। বলা বাহুল্য, অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আদেশ প্রতিপালিত হইল। একটি বালক আসিয়া টেবিলের উপর দুই পেয়ালা কাফি স্থাপনপূর্ব্বক প্রস্থান করিল। এই সময় বিয়াম নিকটস্থ দেওয়ালের উপর ইসমাইলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া কহিল, “দেখ, কেমন সুন্দর ছবিখানি।” ইহা শুনিয়া ইসমাইল যেমন সেই দিকে ফিরিয়া দেখিতে লাগিল, অমনি বিয়াম একটি ছোট শিশির মধ্য হইতে ৪।৫ ফোঁটা জলীয় পদার্থ ইসমাইলের কাফিতে ঢালিয়া দিল। কিয়ৎক্ষণ পরে ইসমাইল কাফি-পেয়ালাটি হস্তে লইয়া পান করিতে যাইতেছে, এমন সময় সহসা একটি ভয়ঙ্কর শব্দ হওয়াতে, ইসমাইলের হস্তস্থিত কাপির পেয়ালাটি ভূমে পতিত হইল। এদিকে বিয়াম সেস্থান হইতে দৌড়িয়া প্রস্থান করিল। পরক্ষণেই আমি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। আমাকে দেখিবামাত্র ইসমাইল বলিয়া উঠিল, “পিস্তল কি আপনি ছুড়িয়াছেন?” 

আমি! হাঁ। 

ইস। কেন? 

আমি। তোমার জীবন রক্ষা করিবার নিমিত্ত। 

ইস। সে কি? 

আমি। কাফিতে বিষ মিশ্রিত করা হইয়াছিল। 

ইস। কাহার দ্বারা। 

আমি। বিয়াম যখন দেওয়ালের দিকে তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তাহা মনে আছে। 

ইস। আছে। 

আমি। সেই সাবকাশে সে কাফিতে বিষ মিশ্রিত করিয়া দেয়। 

ইস। কি ভয়ানক! 

অষ্টম পরিচ্ছেদ

পর দিবস আমি নুর মহম্মদের অনুসন্ধানে বহির্গত হইলাম। প্রায় অর্দ্ধ ঘণ্টা পরে সহরের প্রান্তস্থিত একটি ভয়ঙ্কর ও বিপদসঙ্কুল স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। বলা বাহুল্য, এই স্থানটি চোর ও হত্যাকারীদিগের দ্বারা একেবারে পরিপূর্ণ। একটি সঙ্কীর্ণ গলির মধ্যে প্রবেশ করিয়া সম্মুখে একখানি জীর্ণ ও অপরিষ্কার কাষ্ঠের বাড়ী দেখিতে পাইলাম। এই সময় আমার বেশভূষা দেখিয়া সকলেই মনে করিতে পারেন, আমি একজন সম্ভ্রান্ত বংশীয় মুসলমান। আমি ঐ বাড়ীর দরজায় উপস্থিত হইয়া কড়া নাড়িতে লাগিলাম। ভিতর হইতে উত্তর আসিল, “ভিতরে এস।” 

আস্তে আস্তে দরজা খুলিয়া বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, একটি যুবতী স্ত্রীলোক প্রাঙ্গণে দণ্ডায়মান আছে। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “এই স্থানে কোন দাই থাকে?” 

স্ত্রী। হাঁ থাকে! 

আমি। আমার একটি ভাল দাইর আবশ্যক। 

স্ত্রী। বেশ, আমি আপনার কার্য্য করিব। ঘরের মধ্যে আসুন। 

বলা বাহুল্য, আমি তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া একখানি তক্তাপোষের উপর উপবিষ্ট হইলাম। স্ত্রীলোকটি আমার পার্শ্বে আসিয়া উপবেশন করিল। ঠিক এই সময় একটি যণ্ডাকৃতি লোক একখানি বৃহৎ ছুরিকা হস্তে ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া কহিল, “কি তোমার এত বড় আস্পদ্ধা! আমার স্ত্রীর সহিত একত্র বসিয়া আছ।” 

আমি। না, না। আমি এই স্থান হইতে প্রস্থান করিতেছি। 

আগ। তাহা হইবে না। আমি তোমাকে হত্যা করিব। 

এই বলিয়া সে আমাকে সজোরে ধরিয়া ছোরা দেখাইতে লাগিল। 

আমি। আমাকে মাপ করুন। 

আগ। না, তাহা হইবে না। আমি তোমাকে নিশ্চয়ই হত্যা করিব।

আমি। দোহাই তোমার। আমাকে হত্যা করিও না। 

এই সময় স্ত্রীলোকটি বলিয়া উঠিল, “মহম্মদ, উহাকে খুন করিও না।” আগ। ইহাকে হত্যা করিবই। সঙ্গে সঙ্গে তোমাকেও খুন করিব। 

স্ত্রী। আচ্ছা, তাহা হইলে আমাকে উহার সহিত একটি কথা কহিতে দাও। 

আগ। শীঘ্র কহিয়া লও। তাহার পর আমি তোমাদিগের উভয়কেই হত্যা করিব। 

স্ত্রীলোকটি আমার নিকট আসিয়া বলিল, “দেখুন, আমার স্বামী নিতান্ত অসভ্য। উহাকে আপনি টাকা দিতে 

স্বীকার করুন। তাহা হইলে আপনাকে ছাড়িয়া দিবে।” 

আমি। আমার নিকট ত টাকা নাই! 

আমার কথা শুনিতে পাইয়া আগন্তুক বলিয়া উঠিল, “যদি ২০০ টাকা দাও, তবেই ছাড়িয়া দিব। নতুবা তোমার নিস্তার নাই।” 

আমি। আমার নিকট টাকা নাই। 

আগন্তুক। তাহা হইলে প্রস্তুত হও। এখনই তোমাকে খুন করিব। 

আমি। কী? খুন করিবে? 

আমার কথা শুনিয়া লোকটি ছুরিকা হস্তে অগ্রসর হইতে লাগিল। আমিও একেবারে নিরস্ত ছিলাম না। পকেট হইতে পিস্তল বাহির করিয়া কহিলাম, “নুর মহম্মদ, সাবধান।” আমার কথা শুনিয়া আগন্তুকের মুখ শুষ্ক হইয়া গেল। তাহার হস্ত হইতে ছুরিকা ভূতলে পতিত হইল। সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীলোকটিও চীৎকার করিয়া উঠিল। 

আমি কহিলাম, “যদি তোমরা কোনরূপ গোলমাল কর, তাহা হইলে উভয়কেই এই পিস্তলের সাহায্যে শমন- সদনে প্রেরণ করিব।” এই বলিয়া আমি পকেট হইতে লৌহ শৃঙ্খল বাহির করিয়া উহা মহম্মদের হস্তে পরাইয়া দিলাম। স্ত্রীলোকটি বসিয়া ক্রন্দন করিতে লাগিল। আমি মহম্মদকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আচ্ছা, বালিকাটিকে চুরি করিবার পর কোথায় লইয়া গিয়াছিলে? মিথ্যা কথা বলিও না। ইসমাইল সমস্তই স্বীকার করিয়াছে।” 

মহ। কি, ইস্মাইল সমস্ত প্রকাশ করিয়া ফেলিয়াছে? 

আমি। হাঁ। এক্ষণে তুমি সমস্ত কহিতে বাধ্য হইবে। 

মহ। আচ্ছা, যদি আমি সমস্ত প্রকাশ করি, তাহা হইলে আপনি আমাকে ছাড়িয়া দিবেন? 

আমি। তাহা আমি বলিতে পারি না, তবে চেষ্টা করিয়া দেখিব। 

মহ। বালিকাটিকে লইয়া আমরা বিয়ামের গৃহে গমন করি। 

এই বলিয়া মহম্মদ চুপ করিল। আমি তাহাকে লইয়া থানায় আসিয়া তাহাকে ফাটকে আবদ্ধ করিয়া বাসায় প্রত্যাগমন করিলাম। 

নবম পরিচ্ছেদ

পর দিবস পুনরায় বাসা হইতে বহির্গত হইয়া বিয়ামের বাড়ীর নিকট একটি দোকানে গিয়া উপবিষ্ট হইলাম। প্রায় অৰ্দ্ধ ঘণ্টাকাল অপেক্ষা করিতে না করিতেই পূর্ব্বোক্ত গৃহ হইতে একটি বৃদ্ধবহির্গত হইল। বলা বাহুল্য, ইহাকে দেখিয়া কিছুতেই বিয়াম বলিয়া বোধ হয় না। কিন্তু আমি তাহাকে অনুসরণ না করিয়া স্থির থাকিতে পারিলাম না। প্রায় ১ ঘণ্টা পরে সেই বৃদ্ধ সহরতলীর একটি বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিল। আমি তাহার একটু দূরে একটি বৃক্ষতলে বসিয়া অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। প্রায় ১৫ মিনিট পরে বৃদ্ধ বহির্গত হইয়া গেল। আমি কিন্তু এবার আর তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন না করিয়া সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। দরজার নিকটেই গৃহ-স্বামীর সহিত সাক্ষাৎ হইল। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কে?” 

আমি। আপনার জনৈক বন্ধু। 

গৃহস্বামী। আমার বন্ধু! এখানে তোমাকে কে লইয়া আসিল? 

আমি। আপনি আসিয়াছি। 

গৃ-স্বা। আমাকে না বলিয়া এরূপভাবে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার কারণ কী? 

আমি। কারণ আর কিছুই নহে। বালিকাটিকে দেখিতে আসিয়াছি। 

গৃ-স্বা। কোন্ বালিকা? 

আমি। যাহাকে বিয়াম এই স্থানে রাখিয়া গিয়াছে। 

গৃ-স্বা। এই বাড়ীতে কোনও বালিকা নাই। 

আমি। দেখ, আবদুল, যদি ভাল চাও, তাহা হইলে মিথ্যা কথা কহিও না। কারণ আমি বিশেষরূপ না জানিয়া তোমার এখানে আসি নাই। 

আবদুল। আপনি কে? 

আমি। আমি যেই হই না কেন, তুমি ভাল চাহ প্রকৃত কথা কহ। 

আবদুল। তাহা হইলে, কি আমাকে প্রকৃতই সমস্ত কথা কহিতে হইবে? 

আমি। তোমার ইচ্ছা। 

আবদুল। আমার এই স্থানে যে বালিকাটি আছে তাহাকে আপনাকে দেখাইয়া দিতেছি চলুন। 

এই বলিয়া আবদুল আমাকে তাহার বাড়ীর ভিতর লইয়া গেল। দেখিলাম যেরূপ অবয়বের মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, ঠিক সেইরূপ অবয়বের একটি বালিকা সেইস্থানে বসিয়া রহিয়াছে। কিন্তু সে মেহেরুন্নেসা নহে। 

[আষাঢ়, ১৩০৮] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *