1 of 2

অধ্যায় ৯ : কার হাতের পুতুল আমরা? – অগাস্টিন

অধ্যায় ৯ : কার হাতের পুতুল আমরা? – অগাস্টিন

সত্য কী, সেটি প্রায় মরিয়া হয়ে জানতে চেয়েছিলেন অগাস্টিন (৩৫৪-৪৩০ খ্রিস্টাব্দ)। একজন খ্রিস্টান হিসাবে, তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তাঁর বিশ্বাস বহু প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেনি। ঈশ্বর তাকে কী দিয়ে করাতে চাইছেন? কীভাবে তাঁর জীবন কাটানো উচিত? তাঁর কী বিশ্বাস করা উচিত? মোটামুটি তাঁর সবটুকু সচেতন সময় তিনি ব্যয় করেছিলেন এই প্রশ্নগুলোর উত্তর অনুসন্ধান এবং লেখালেখি করে। এসব কিছুই ছিল তাঁর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন, কারণ যে মানুষগুলো মৃত্যুর পর অনন্তকাল ধরে নরকের বিভীষিকা আর যন্ত্রণা সহ্য করার সম্ভাবনায় বিশ্বাস করেন, সেই বিষয়ে কোনো দার্শনিক ভ্রান্তি অবশ্যই ভয়ানক পরিণতির কারণ হতে পারে। অগাস্টিন বিষয়টি যেভাবে দেখেছিলেন, রনরকের আগুনে অনন্তকাল ধরেই পোড়ার সম্ভাবনা আছে যদি তিনি তাঁর চিন্তায় ভুল করে থাকেন। তবে একটি সমস্যা তাঁকে ভীষণ যন্ত্রণা দিয়েছে সেটি হলো, ঈশ্বরের মতো একজন দয়ালু সত্তা কেন এই পৃথিবীতে এত অশুভ আর নির্মম কর্মকাণ্ড ঘটার অনুমতি দিয়েছেন? এর উত্তর হিসাবে যা তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন তা বহু বিশ্বাসীর কাছেই এখনও জনপ্ৰিয়।

মধ্যযুগে, মোটামুটি পঞ্চম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী অবধি, ধর্ম আর দর্শন পরস্পর সংযুক্ত বিষয় ছিল। মধ্যযুগীয় দার্শনিকরা প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো এবং অ্যারিস্টোটলের কাছ থেকে শিখেছিলেন, কিন্তু তারা তাদের ধারণাগুলোকে সময়ের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছিলেন, সেই ধারণাগুলোকে তারা প্রয়োগ করেছিলেন তাদের নিজস্ব ধর্মতত্ত্বে। এইসব দার্শনিকদের অধিকাংশ‍ই ছিলেন খ্রিস্টীয় ধর্মানুসারী। কিন্তু বেশকিছু বিখ্যাত দার্শনিক ছিলেন যারা ইহুদী কিংবা আরব, যেমন মাইমোনাইডেস এবং ইবনে সিনা। অগাস্টিনও সেই সময়ের সেরা একজন দার্শনিক ছিলেন, এর বহু পরে তাকে সেইন্ট হিসাবে চিহ্নিত করেছিল ক্যাথলিক চার্চ। উত্তর আফ্রিকায় এখন যে দেশটি আলজেরিয়া, সেখানকার একটি শহর, টাগাস্টে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তখন সেটি ছিল রোম সাম্রাজ্যের অন্ত র্ভুক্ত একটি এলাকা। যদিও তাঁর আসল নাম ছিল অরেলিয়াস অগাস্টিনাস, কিন্তু বর্তমানে প্রায় সবসময়ই তিনি পরিচিত সেইন্ট অগাস্টিন অথবা অগাস্টিন অব হিপো নামে (হিপো রেজিয়াস, যে শহরে তিনি পরবর্তীতে বাস করতেন, এটি বর্তমান আলজেরিয়ার আনাবা শহরের প্রাচীন নাম)। অগাস্টিনের মা ছিলেন খ্রিস্টান তবে তার বাবা স্থানীয় একটি ধর্মের অনুসারী ছিলেন। বেপরোয়া তারুণ্যের কিছু সময়, যখন তিনি এক রক্ষিতার মাধ্যমে সন্তানের বাবাও হয়েছিলেন, পার করে অগাস্টিনের বয়স যখন তিরিশের ঘরে, তখন তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, পরবর্তীতে হিপোর বিশপও হয়েছিলেন। তিনি ঈশ্বরকে অনুরোধ করেছিলেন তার যৌনতাড়না হ্রাস করে দিতে, ‘কিন্তু এখনও না’, কারণ তিনি বেশিমাত্রায় পৃথিবীর আনন্দানুভূতি উপভোগ করছেন। পরবর্তী জীবনে তিনি বহু বই লিখেছিলেন, যেমন Confessions, The City of God ছাড়াও আরো প্রায় শতখানেক বই। মূলত তিনি তাঁর দর্শনে তীব্রভাবে ঋণী প্লেটোর কাছে, তবে তিনি প্লেটোর সেই ধারণাগুলোর একটি খ্রিস্টীয় সংস্করণ করে নিয়েছিলেন।

বেশিরভাগ খ্রিস্টধর্মানুসারীরা বিশ্বাস করেন যে ঈশ্বরের বিশেষ ক্ষমতা আছে : তিনি চূড়ান্তভাবে শ্রেষ্ঠ এবং দয়ালু, সবকিছু জানেন এবং যে-কোনো কিছু করার ক্ষমতা রাখেন। এই সবই ‘ঈশ্বর’ সংজ্ঞাটির সর্বদিক। এই গুণাবলি যদি না থাকে তাহলে ঈশ্বর অবশ্যই ঈশ্বর হতে পারেন না। বহু ধর্মেই ঈশ্বরকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে একইভাবে। কিন্তু অগাস্টিনের মনোযোগ ছিল খ্রিস্টীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি। ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন এমন যে-কোনো কারোরই অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে এই পৃথিবীতে দুঃখ-কষ্ট আর যন্ত্রণার কোনো শেষ নেই। খুবই কঠিন হবে বিষয়টি অস্বীকার করা। এর কিছু কারণ হচ্ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যেমন ভূমিকম্প কিংবা কোনো রোগব্যাধি। কিছু যন্ত্রণার কারণ নৈতিকতার স্তরের কোনো অশুভ শক্তি, যার কারণ মানুষ নিজেই। হত্যা এবং নিপীড়ন, অনৈতিক অশুভ শক্তির সুস্পষ্ট দুটি উদাহরণ। অগাস্টিনের লেখা শুরু করার বহু আগেই এপিকিউরাস বিষয়টিকে একটি সমস্যা হিসাবে শনাক্ত করেছিলেন। কীভাবে একজন দয়ালু, কল্যাণময় সর্বশক্তিমান ঈশ্বর পৃথিবীর এইসব অশুভ বিষয়গুলো সহ্য করেন? যদি ঈশ্বর এসব কিছু বন্ধ করতে না পারেন, তাহলে সত্যিকারভাবে তিনি তো সর্বশক্তিমান হতে পারেন না। তিনি কী করতে পারেন তাহলে তার অবশ্যই একটি সীমা আছে। কিন্তু ঈশ্বর যদি সর্বশক্তিমানই হন, এবং এইসব অশুভ জিনিসগুলো তিনি থামানোর কোনো তাগিদ অনুভব না করেন, তাহলে কীভাবে তিনি সর্বোত্তম দয়ালু আর কল্যাণময় হতে পারেন? এর কোনো অর্থই হতে পারে না। আজও বহু মানুষকে প্রশ্নটি ভাবায়। অগাস্টিন মূলত মনোযোগ দিয়েছিলেন মোরাল ইভিল বা নৈতিকতার স্তরে অশুভ বিষয়গুলোর দিকে। তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে কোনো একজন ভালো ঈশ্বরের ধারণা, যিনি এই ধরনের অশুভ বিষয়গুলো ঘটছে জেনেও সেগুলো থামাবার জন্য কিছুই করছেন না, মেনে নেয়া কিংবা কোনো সমঝোতায় আসা খুব কঠিন।

ঈশ্বর তার কাজ করেন এমন রহস্যময় উপায়ে, মানুষের পক্ষে যা বোঝা সম্ভব না, এমন কোনো অজুহাত অগাস্টিনকে মোটেও সন্তুষ্ট করেনি। অগাস্টিন এর উত্তর চেয়েছিলেন। কল্পনা করুন একজন খুনি, তার শিকারকে খুন করতে উদ্যত, ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করতে যাচ্ছে সে। ভয়ংকর একটি অশুভ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা জানি ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, তিনি চাইলে এই দুর্ঘটনাটি থামাতে পারেন, এর জন্য দরকার খুনির মগজের নিউরোনে কিছু রদবদল অথবা তিনি চাইলে ধারালো ছুরিটাকে নরম রবারের মতো কিছুতে রূপান্তরিত করতে পারেন যখনই কেউ অশুভ উদ্দেশ্যে অস্ত্র হিসাবে সেটি ব্যবহার করতে উদ্যত হয়। তাহলে শরীরে ক্ষতি করার বদলে বরং এটি চামড়ায় প্রবেশ করবে না, কারোরই কোনো ক্ষতি হবে না। ঈশ্বর অবশ্যই জানেন কী ঘটছে, কারণ কোনোকিছুই তার অজানা নয়। কোনোকিছুই তার জানার ক্ষেত্রের বাইরে নয়। তিনি যদি অবশ্যই চান অশুভ অকল্যাণকর কিছু ঘটবে না, কারণ এটাই চূড়ান্তভাবে ভালো বলতে যা বোঝায় তারই অংশ, কিন্তু তারপরও খুনি হত্যা করে। ইস্পাতের ছুরি রবারের মতো নরমও হয়ে যায় না। কোনো বিদ্যুৎ চমক কিংবা বজ্ৰপাত ঘটেনা, অলৌকিকভাবে খুনির হাত থেকে অস্ত্রও পড়ে যায় না। কিংবা খুনিও শেষ মুহূর্তে তার মন পরিবর্তন করে না। তাহলে কী ঘটছে এখানে? এটাই ইভিল বা অশুভ বিষয়-সংক্রান্তসেই প্রাচীন সমস্যা, ঈশ্বর কেন এসব ঘটার অনুমতি দিচ্ছেন সেটি ব্যাখ্যা করা সেই বহু প্রাচীন সমস্যা। যদি সবকিছুই ঈশ্বরের সৃষ্টি হয়ে থাকে, তাহলে অশুভ সবকিছুও আসছে ঈশ্বর থেকে। কোনো একটি অর্থে ঈশ্বরই নিশ্চয়ই চাইছেন এই খারাপ জিনিসগুলো ঘটুক।

তরুণ বয়সে অগাস্টিনের কাছে অবশ্যই একটি উপায় ছিল ‘ঈশ্বর অশুভ কিছু ঘটতে দিতে চান’ এই বিশ্বাসটিকে এড়িয়ে যাবার। কারণ তখন তিনি ছিলেন মানিকিয়াজম মতবাদে বিশ্বাসী। মানিকিয়াজম পারস্যে (বর্তমান ইরান) উদ্ভূত হওয়া একটি ধর্মীয় মতবাদ। এই মতবাদে বিশ্বাসীরা মনে করতেন ঈশ্বর চূড়ান্ত ভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী নন, বরং ভালো আর খারাপ শক্তির মধ্যে চিরন্তন একটি লড়াই অব্যহত আছে। সুতরাং এই দৃষ্টিভঙ্গিতে ঈশ্বর এবং শয়তান ক্ষমতার জন্য সংগ্রামরত। তারা দুজনেই অসীম শক্তিশালী, তবে তারা কেউই অন্যজনকে পরাজিত করার মতো ক্ষমতাবান নয়। কোনো একটি নির্দিষ্ট জায়গায়, কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে অশুভ শক্তি এই যুদ্ধে সুবিধা পায়, কিন্তু কখনোই সেটি দীর্ঘ সময়ের জন্য নয়। ভালোর শক্তি আবার ফিরে আসে, অশুভের উপর আবার সে জয়ী হয়। এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করে কেন এইসব ভয়ানক অশুভ ঘটনাগুলো ঘটে। অশুভ আসে অন্ধকার অকল্যাণের শক্তি থেকে এবং শুভশক্তি আসে আলো থেকে। কোনো একটি মানুষের মধ্যে, মানিকিয়ানরা বিশ্বাস করতেন শুভশক্তির সূচনা হয় আত্মা থেকে, আর অশুভ শক্তির উৎস হচ্ছে শরীর, শরীরের দুর্বলতা আর কামনাগুলোই আমাদের ভুলপথে পরিচালিত করার সম্ভাবনা রাখে। এটাই ব্যাখ্যা করে কেন মানুষের খারাপ কাজ করার প্রতি প্রবণতা আছে। মানিকিয়ানদের জন্য তেমন কোনো সমস্যা ছিল না অশুভ বিষয়গুলোর উপস্থিতি ব্যাখ্যা করা। কারণ মানিকিয়ানরা ঈশ্বর সর্বশক্তিমান এবং বাস্তবতার সব ক্ষেত্রে তার নিয়ন্ত্রণ আছে এমন কোনো ধারণায় বিশ্বাস করতেন না। যদি ঈশ্বরের সবকিছুর উপর ক্ষমতা না থাকে, তাহলে তিনি অশুভ শক্তির অস্তিত্বের জন্যও দায়ী নন, তেমনি আমরা কেউই ঈশ্বরকে দায়ী করতে পারব না অশুভ শক্তিকে দমন করতে ব্যর্থ হবার জন্য। মানিকিয়ানরা হয়তো ব্যাখ্যা করতেন যে খুনির কর্মের কারণ তার ভিতরের অন্ধকারের শক্তি তাকে বাধ্য করছে অশুভ কাজ করার জন্য। এবং কোনো-কোনো ব্যক্তির মধ্যে এই শক্তি এতবেশি ক্ষমতাবান যে আলোর শক্তি তাদের পরাজিত করতে পারে না।

তবে পরবর্তী জীবনে অগাস্টিন মানিকিয়ানদের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে বর্জন করেছিলেন। তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না কেন শুভ আর অশুভ শক্তির এই লড়াইকে চিরস্থায়ী হতে হবে। কেন ঈশ্বর পারছেন না এই যুদ্ধে জয়লাভ করার জন্য? নিশ্চয়ই যখন শুভশক্তি অশুভ শক্তির চেয়েও ক্ষমতাবান, যদিও খ্রিস্টানরা মেনে নিয়েছেন যে অশুভ শক্তির অস্তিত্ব থাকতে পারে, তবে ঈশ্বরের শক্তির চেয়ে তাদের শক্তি অবশ্যই বেশি নয়। কিন্তু যদি ঈশ্বর সত্যিকারভাবে সর্বশক্তিমান হয়ে থাকেন, যেমন অগাস্টিন বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন, তাহলেও এই অশুভ শক্তির উপস্থিতি ব্যাখ্যা করা সমস্যা অবশিষ্ট থেকে যায়। কেন ঈশ্বর অশুভ শক্তিগুলোকে টিকে থাকার অনুমতি দিচ্ছেন? কেনই বা এত ব্যাপকভাবে এই অশুভ শক্তির উপস্থিতি? কোনো সহজ সমাধান অবশ্যই নেই। অগাস্টিন গভীরভাবে ভেবেছেন এইসব সমস্যাগুলো নিয়ে। এবং তিনি যে সমাধান খুঁজে বের করেছিলেন তার ভিত্তি ছিল ফ্রি উইল বা স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির উপস্থিতি : মানুষ পরবর্তীতে কী করবে সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা। এটাই পরিচিত ‘ফ্রি উইল ডিফেন্স’ (Free Will Defence) নামে, যার মাধ্যমে অজুহাত দেখানো যেতে পারে কিছু করার জন্যে কোনো ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এবং এটি একই সাথে পরিচিত থিওডিসি বা theodicy নামে, বা কল্যাণময় আর দয়ালু ঈশ্বর কেন এত দুঃখ, কষ্ট টিকে থাকার অনুমতি দিচ্ছেন সেই বিষয়টি সমর্থন আর ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা।

ঈশ্বর আমাদের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন, এবং আপনি অবশ্যই পারেন, যেমন সিদ্ধান্ত নিতে যে পরের বাক্যটি আপনি পড়বেন কিনা। এটা আপনার ইচ্ছার ব্যাপার। কেউ যদি আপনাকে পড়া চালিয়ে যেতে বাধ্য না করে থাকে, তাহলে সেই কাজটি বন্ধ করে দেবার মতো স্বাধীনতা আপনার আছে। অগাস্টিন মনে করতেন এই স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিটি থাকা ভালো। এটি আমাদের নৈতিকভাবে কোনো কাজ করতে সাহায্য করে। আমরা ভালো হবার জন্যে সিদ্ধান্ত নিতে পারি, অগাস্টিনের কাছে এই ভালো হওয়া মানে বিশেষ করে ঈশ্বরের সেই দশটি নির্দেশনা বা টেন কম্যান্ডমেন্ট মেনে চলা ও এছাড়া যীশুর ‘তোমার প্রতিবেশীকে ভালোবাসো’ নির্দেশটিও মেনে চলা। কিন্তু স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি থাকার একটি পরিণতি হচ্ছে আমরা অশুভ কিছু করার সিদ্ধান্তও নিতে পারি। আমরা পথভ্রষ্ট হয়ে নানা খারাপ কাজও করতে পারি, যেমন মিথ্যা বলা, কারো ক্ষতি করা, এমনকি কাউকে হত্যা করা ইত্যাদি। এটি প্রায়শই ঘটে যখন আবেগ আমাদের যুক্তি প্রক্রিয়াকে দখল করে নেয়। কোনো কিছু বা অর্থের জন্যে তীব্র কামনা আমরা অনুভব করি। শারীরিক কামনার কাছে আমরা পরাজয় স্বীকার করি এবং ঈশ্বরের পথ থেকে দূরে সরে যাই, ঈশ্বরের নির্দেশ অবজ্ঞা করি। অগাস্টিন বিশ্বাস করতেন যে যৌক্তিক অংশটির আবেগকে সবসময় নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত, যে দৃষ্টিভঙ্গিটি তিনি প্লেটোর কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। মানুষের, পশুর ব্যতিক্রম, যুক্তি ব্যবহার করার ক্ষমতা আছে এবং তার সেটি করা উচিত। যদি ঈশ্বর আমাদের এমন করে তৈরি করতেন যে আমরা সবসময়ই খারাপ আর ভালোর মধ্যে ভালোটাকেই বেছে নেব, আমরা তাহলে খারাপ কোনোকিছুই করতাম না। কিন্তু আমরা আসলে সেক্ষেত্রে আসলেই স্বাধীন হতাম না, কারণ আমরা আমাদের যৌক্তিক বিশ্লেষণী ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারতাম না আমাদের কী করা উচিত সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে। ঈশ্বর চাইলেই আমাদের সেভাবে বানাতে পারতেন, কিন্তু অগাস্টিন মনে করতেন অনেক বেশি উত্তম কারণ তিনি আমাদের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন, ভালো মন্দ বাছাই করার একটি শক্তি দিয়েছেন। নতুবা আমরা ঈশ্বরের হাতে সুতোয় বাঁধা পুতুলের মতোই হতাম, আমাদের নিয়ন্ত্রণ করার সুতোগুলো থাকত ঈশ্বরের হাতে, তিনি নিশ্চিত করতেন যেন আমরা সবসময় সঠিক আচরণ করি। কীভাবে আমরা আচরণ করব সেই বিষয়ে কোনো চিন্তা করাই তখন অর্থহীন হতো, কারণ আমরা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সবসময় ভালো বিকল্পটাকে বেছে নিতাম।

সুতরাং ঈশ্বর সব অশুভ শক্তিকে প্রতিরোধ করার মতো শক্তিশালী, কিন্তু বাস্ত বতা হলো যে অশুভ শক্তির অস্তিত্ব আছে সেটির কারণ সরাসরিভাবে ঈশ্বর নন। মোরাল ইভিল বা নৈতিক অশুভ বিষয়গুলো হচ্ছে আমাদের বাছবিচার করার ক্ষমতার ফলাফল। অগাস্টিন বিশ্বাস করতেন আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ছাড়াও আংশিকভাবে এর জন্য দায়ী অ্যাডাম এবং ইভের ইচ্ছা-অনিচ্ছাগুলোও। তার সময়ের বহু খ্রিস্টানদের মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন বাইবেলের প্রথম বই জেনেসিসে বর্ণিত গার্ডেন অব ইডেনে যা ঘটেছে তা আসলেই ভয়ানক। যখন ইভ এবং তারপর অ্যাডাম জ্ঞানবৃক্ষ থেকে ফল খেয়েছিলেন এবং যার মাধ্যমে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন ঈশ্বরের সাথে, তারাই এভাবে প্রথম পাপকে নিয়ে এসেছিলেন এই পৃথিবীতে। এই পাপ বা সিন যাকে বলা হয় Original Sin কিংবা আদি পাপ, শুধু তাদের জীবনকেই প্রভাবিত করেনি, প্রতিটি মানুষকেই তাদের সেই পাপের মূল্য দিতে হয়েছে। অগাস্টিন বিশ্বাস করতেন এই আদি পাপ প্রজন্মান্তরে হস্তান্তরিত হয় যৌন প্রজননের মাধ্যমে। এমনকি জন্মের সূচনালগ্ন থেকেই একটি শিশু পাপের চিহ্ন বহন করছে। আর এই আদি পাপের অভিশাপ আমাদের আরো প্ররোচিত করে পাপ করার জন্য।

আধুনিক সময়ের বহু পাঠকদের জন্য, অগাস্টিনের এই ধারণাটি, আমরা নিজেরা কোনো-না-কোনোভাবে অপরাধী, এবং অন্য কারো করা পাপের জন্য শাস্তি পাচ্ছি, মেনে নেয়া খুবই কঠিন। মনে হতে পারে এটি একটি অবিচার। কিন্তু আমাদের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির ফলাফল হিসাবে অশুভ শক্তির উৎপত্তি এবং সরাসরিভাবে এটি ঈশ্বরের সাথে সংশ্লিষ্ট না, তার এই ধারণাটি বহু বিশ্বাসীকে আকৃষ্ট করেছিল। কারণ এটি তাদের সুযোগ করে দিয়েছিল একটি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান, সবচেয়ে দয়ালু আর কল্যাণময় শ্রেষ্ঠতম ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস রাখার জন্য। মধ্যযুগের অন্যতম জনপ্রিয় দার্শনিক লেখক বোয়েথিয়াস যেমন এমন ঈশ্বরকে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তিনি ফ্রি উইল বা স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অন্য সমস্যাগুলো সমাধান করার চেষ্টা করেছেন: বিশেষ করে সেই প্রশ্নটি, আমরা কীভাবে কোনোকিছু করার জন্য বাছাই করতে পারি, যদি ঈশ্বর আগে থেকেই জানেন আমরা কী করার জন্য ঠিক করেছি। অগাস্টিন মূলত সক্রিয় ছিলেন পঞ্চম শতাব্দীর শুরুর দিকে। যখন তিনি বাস করতেন ক্রমশ দুর্বল হতে থাকা রোমান সাম্রাজ্যের প্রান্তসীমায় উত্তর-আফ্রিকার একটি শহর হিপোতে, সেখানে ত্রিশ বছর ধরে তিনি বিশপের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি জনপ্রিয় ছিলেন স্থানীয় প্ৰায়- অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর আধ্যাত্মিক গুরু হিসাবে। তার জীবনের শেষাংশে হিপো শহরটিকে আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিল ভ্যানডালস বলে পরিচিত জার্মানিক একটি গোত্র। তবে তারা এই বৃদ্ধ দার্শনিককে শ্রদ্ধা দেখিয়ে তার ক্যাথিড্রাল এবং লাইব্রেরির কোনো ক্ষতি করেনি।

খ্রিস্টীয় দার্শনিক হওয়া সত্ত্বেও আমরা যারা খ্রিস্টধর্মানুসারী নই তাদের জন্যও তিনি গুরুত্বপূর্ণ। এর একটি কারণ যেভাবে তিনি তৎকালীন রোমের সমালোচনা করেছিলেন। বিশেষ করে রোমের বিদ্যমান মূল্যবোধ আর দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকে। কারণ অনেকেই মনে করেন আধুনিক পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বহু সাদৃশ্য আছে প্রাচীন সেই রোমের। যুক্তরাষ্ট্রের আদিপিতাদের কাছেও এই প্রাচীন সাম্রাজ্য এত বেশি প্রিয় ছিল যে তারা তাদের রাজধানী গড়েছিলেন পোটোমাক নদীর পাশেই রোমের আদলে, যেন দেখলে মনে হতে পারে আপনি সেই টাইবারের তীরে দাঁড়িয়ে আছেন।

রোমানরা দুটি নির্দিষ্ট বিষয়ে বিশ্বাস করতেন বলে অগাস্টিন প্রস্তাব করেছিলেন :

এক. পার্থিব সুখ : রোমানরা মোটামুটিভাবে খুব আশাবাদী জনগোষ্ঠী ছিল। পন্ট দ্যু গার্দ আর কলোসিয়ামের নির্মাতারা প্রযুক্তিতে বিশ্বাস করতেন; নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এমন মানবিক শক্তির উপর ভরসা ছিল তাদের, এবং তারা বিশ্বাস করতেন নিজেদের সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য তারা প্রকৃতিকেও নিয়ন্ত্রণ করার সব শক্তি রাখেন। সিসেরো, পুটার্কের মতো লেখকের লেখায় ভবিষ্যৎ নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষা, আত্মবিশ্বাস আমরা দেখতে পাই; খানিকটা সম্পাদনা করলে যে ভাবনাগুলোর সাথে আমরা খানিকটা মিল পাব বর্তমানে বহু লেখার সাথে। আজকের যুগে জনপ্রিয় self-help বিষয়টির প্রতিও আগ্রহী অনুশীলন জনপ্রিয় ছিল রোমের নাগরিকদের মধ্যে। তারা মনে করতেন মানুষ হচ্ছে এমন একটি প্রাণী যা নিখুঁত হবার জন্য বিশেষভাবে উপযুক্ত।

দুই. একটি ন্যায়বিচার নির্ভর সামাজিক ব্যবস্থা : দীর্ঘ সময় ধরেই রোমানরা বিশ্বাস করতেন তাদের সমাজব্যবস্থার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সুবিচার, বা justitia; যদিও উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সুবিধা সবচেয়ে প্রধান নিয়ামক ছিল সেই সমাজে, তারপরও তারা বিশ্বাস করত, উচ্চাশা এবং বুদ্ধিমত্তাসহ যে-কেউই রোমে সফল হতে পারবেন। এর সেনাবাহিনী ছিল মেরিটোক্রেটিক বা মেধানির্ভর, যেখানে টাকা বানাবার ক্ষমতাকে মনে করা হতো প্রায়োগিক দক্ষতা এবং আভ্যন্তরীণ সদগুণের প্রতিফলন হিসাবে। সুতরাং কারো সম্পদ সবাইকে প্রদর্শন করাকে মনে করা হতো সম্মানজনক একটি কাজ যা কিনা গর্বের বিষয়। ভোগবাদিতা ছিল সুস্পষ্ট এবং খ্যাতি ছিল পুরোপুরিভাবে সম্মানজনক একটি আদর্শ।

এই দুটো দৃষ্টিভঙ্গিকে লক্ষ্য করে অগাস্টিন রোমের সমালোচনা করেছিলেন। তাঁর বিখ্যাত দ্য সিটি অব গড বইটিতে তিনি এই দুটি দৃষ্টিভঙ্গিকে ব্যবচ্ছেদ করেন, যা এখনও প্রাসঙ্গিক এমন কারো কাছে যারা এই বিষয়দুটি নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন। এমনকি যখন সমস্যাগুলোর জন্য অগাস্টিনের প্রস্তাবিত সমাধানগুলোর খ্রিস্টধর্মীয় বোধে পূর্ণ-বিশ্বাসীদের কাছে শুধুমাত্র বিশেষ আবেদন রাখতে পারে। অগাস্টিনের বিপরীত যুক্তিগুলো ছিল খানিকটা এরকম, প্রথমত, আমরা সবাই লালসাপূর্ণ, উন্মত্ত, খামখেয়ালি, বিভ্রান্ত অস্বাভাবিকতা বহন করছি, যাদের কোনো সম্ভাবনা নেই পার্থিব সুখ অর্জন করা। আমরা দেখেছি যে অগাস্টিনই ছিলেন প্রথম দার্শনিক যিনি খ্রিস্টধর্মের একটি কেন্দ্রীয় ধারণা, ‘অরিজিনাল সিন’ প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন সব মানুষই, শুধুমাত্র কিছু দুর্ভাগ্যজনক উদাহরণ নয়, সবাই অপরাধী, কারণ আমরা সবাই আমাদের অজান্তেই আদম এবং হাওয়ার আদিপাপের উত্তরাধিকারী। আমাদের পাপপূর্ণ প্রকৃতি সৃষ্টি করে সেই অবস্থা, অগাস্টিন যাকে বলেছিলেন libido dominandi বা নিয়ন্ত্রণ করার বাসনা, যা খুবই স্পষ্ট এই পৃথিবীতে আমাদের চারপাশের মানুষের সাথে আমাদের নিষ্ঠুর, সংকীর্ণ আর স্বার্থপর আচরণে। আমরা সঠিকভাবে ভালোবাসতে পারিনা, সারাক্ষণই আমাদের আত্মাভিমান, অহংকার এবং গর্ব আমাদের সীমাবদ্ধ করে রাখে, ক্ষতিগ্রস্থ করে। যুক্তি ব্যবহারে আমাদের ক্ষমতা ও কোনোকিছু বোঝার ক্ষমতা চূড়ান্তভাবে ভঙ্গুর। লালসা ছিল অগাস্টিনের একটি বিশেষ চিন্তার বিষয়, কারণ অগাস্টিন নিজেই তার তারুণ্যে চার্চের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছিলেন নারীসঙ্গ কল্পনা করে; তিনি মনে করতেন লালসা আমাদের দিন ও রাতকে আচ্ছন্ন করে রাখে। আমরা আমাদের নিজেদের বুঝতে পারিনা, আমরা অস্তিত্বহীন কোনোকিছুকে পাবার চেষ্টা করি, আমাদের চিন্তা আমাদের নিপীড়ন করে। অগাস্টিন তার তীব্র সমালোচনার ইতি টানেন সেইসব দার্শনিকদের ভর্ৎসনা করে যারা বিস্ময়কর নির্বুদ্ধিতার সাথে আশা করেন, এই পৃথিবী সুখি হবার জন্যে, কিংবা আশা করেন কেবল প্রচেষ্টার মাধ্যমেই সুখ অর্জন করা যেতে পারে। হয়তো হতাশাজনক মনে হয় শুনতে, কিন্তু অদ্ভুতভাবে এটি হয়তো সান্ত্বনা দিতে পারে যে, যখন আমরা শুনি যে আমাদের জীবন যে সরল নয় সেটি ঘটনাচক্রে ঘটে না, কারণ সংজ্ঞানুযায়ী জীবন এরকমই। কারণ আমরা মানুষ, মানুষ এমন কিছু বানাতে পারেনা যা পুরোপুরিভাবে সরলরৈখিক (নিখুঁত কোনোকিছু সৃষ্টি করার অধিকার আছে শুধু স্বর্গীয় সত্তার)। আমরা খুব অদ্ভুত একটি প্রাণী যারা নিয়তি দ্বারা নির্দেশিত সদগুণ এবং ভালোবাসা অনুভব করতে পারার জন্য, কিন্তু কখনোই আমরা আমাদের নিজেদের জন্য এ সবকিছু নিরাপদ করতে পারব না। আমাদের সম্পর্ক, পেশা, দেশ এর কোনোকিছুই আমরা যেমনটা চাই আবশ্যিকভাবে তেমন নয়। এর কারণ আমরা কিছু করেছি সেটিও না, আমাদের প্রত্যেকেরই সফল হবার ক্ষেত্রে শুরুর থেকেই বাধার পরিমাণ অনেক বেশি। অগাস্টিনের নৈরাশ্যবাদিতা অনেকেই হয়তো যে চাপ অনুভব করেন সেটি হ্রাস করতে পারে (বিশেষ করে গভীর রাতে, রোববার সন্ধ্যায়, বয়স চল্লিশ পার হবার পর যে-কোনো সময়েই), যখন ধীরে ধীরে প্রায় সবকিছু যা আমরা করি কিংবা আমরা যেমন তার ত্রুটিপূর্ণ প্রকৃতিটি মেনে নিই। আমাদের ক্ষুব্ধ হওয়া উচিত না অথবা নিজেকে সব দুর্ঘটনার জন্য পূর্বনির্ধারিত শিকারও মনে করা উচিত না, যেন আমাদের প্রাপ্য নয় এমন শাস্তি দেয়া হচ্ছে। এটাই খুব স্বাভাবিক মানবিক পরিস্থিতি, এমনকি যদিও আমরা অগাস্টিনের ধর্মতত্ত্ব হয়তো বিশ্বাস করি না,যা হতে পারে আদিপাপের পরিণতি।

দ্বিতীয়ত, সবধরনের সামাজিক প্রাধান্যপরম্পরা পক্ষপাতদুষ্ট অবিচার। সামাজিক সুবিচার বলে কিছু নেই। যারা সমাজের উপরের স্তরে থাকে খুব স্বাভাবিকভাবে তারা সবাই ভালো হবে এমন কোনো কথা নেই যেমন, তেমনি যারা সমাজের নিচের স্তরে থাকে তারাও সবাই খারাপ নয়। এবং এর বিপরীতটাও সত্যি। রোমের নাগরিকরা তাদের সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী মুহূর্তে মনে করত যে তারা মেধাভিত্তিক কোনো একটি সমাজকে চালাচ্ছে। অবশ্যই বংশপরিচয় সুযোগ প্রভাবিত করে ঠিকই, কিন্তু কিছুতেই আপনি তার উপর ভিত্তি করে চূড়ায় পৌঁছাতে পারবেন না, আপনাকে ভরসা করতে হবে আপনার নিজের সত্যিকারের মেধা ও যোগ্যতার উপর। সর্বোপরি তারা রোমের মাহাত্ম্যকে অনুভব করত রোমের জনগোষ্ঠীর মেধার সম্মিলিত সফলতার চিহ্ন হিসাবে। তারা পৃথিবীর বিশাল অংশ রাজত্ব করত, কারণ তারাই এই কাজটি করার উপযুক্ত। এই সাম্রাজ্যই তাদের সদগুণের পুরস্কার। এটি অনেক বেশিমাত্রায় প্রলোভন-জাগানো দৃষ্টিভঙ্গি সেইসব মানুষগুলোর জন্য যারা সফল রাষ্ট্র কিংবা কোনো করপোরেশন ভিতরের মানুষ, তারা মনে করেন সমৃদ্ধি ও ক্ষমতা তাদের সম্মিলিত মেধার ন্যায্য পুরস্কার

অগাস্টিন এর প্রতুত্তর করেছিলেন, কী পরিমাণ উদ্ধত, অহংকারী এবং নিষ্ঠুর এই দাবিগুলো: এর আগে কখনো ছিলনা এবং রোম ছাড়া ভবিষ্যতে আর কখনোই জাস্টিটিয়াকে (justitia) দেখব না। ঈশ্বর ভালোমানুষদের সম্পদ আর ক্ষমতা দেননি, এবং অবশ্যই তিনি যাদের সম্পদ নেই তাদের দরিদ্রতার শাস্তিও দেননি। সামাজিক এই ব্যবস্থা পুরোপুরিভাবে যোগ্য আর অযোগ্যদের মিশ্রণ এবং উপরন্তু, কোন্ মানুষটি ভালো আর কোন্ মানুষটি খারাপ এমন বিচার করার কোনো মানবিক প্রচেষ্টা খুব বড় পাপ; এটি সেই কাজকে আত্মসাৎ করা, যে কাজটি করতে একমাত্র ঈশ্বরই পারেন। এবং সেই কাজটি তিনি করবেন শেষবিচারের দিনে, সময়ের শেষে, ফেরেস্তাদের বাহিনী পাশে নিয়ে, ট্রাম্পেটে শব্দ তুলে। অগাস্টিন পার্থক্য করেছিলেন দুটি শহরের মধ্যে, যাদের তিনি নাম দিয়েছিলেন, City of Men এবং City of God; পরের শহরটি তাঁর মতে আদর্শ, স্বর্গসদৃশ, যেখানে সব ভালোই পরিশেষে প্রাধান্য বিস্তার করবে, যেখানে ক্ষমতার সঠিকভাবে পক্ষ নেবে ন্যায়বিচার এবং সদৃগুণাবলিরা তাদের রাজত্ব করবে। কিন্তু মানুষ কখনোই এমন কোনো শহর তৈরি করতে পারবেনা, এবং কখনোই তাদের বিশ্বাস করা উচিত না এমন কিছু তারা করতে পারে। তারা, City of Men এ বসবাস করার জন্য দণ্ডপ্রাপ্ত, যে সমাজ ব্যাপকভাবে ত্রুটিপূর্ণ। অগাস্টিনের মন্তব্য ছিল : ‘সত্যিকারের ন্যায়বিচারের কোনো অস্তিত্ব থাকতে পারে না, শুধুমাত্র এমন কোনো প্রজাতন্ত্র ছাড়া, যার প্রতিষ্ঠাতা এবং শাসক স্বয়ং খ্রিস্ট, এর মানে হচ্ছে সৌভাগ্যের সত্যিকারের ন্যায়সঙ্গত বিতরণ এমন কোনো অবস্থা নয়, যা কিনা আমরা এই পৃথিবীতে আশা করতে পারব।আবারো, শুনলে মনে হতে পারে খুবই নৈরাশ্যবাদী, তবে এটাই অগাস্টিনের দর্শন, অতিমাত্রায় সেটি দয়া প্রদর্শন করেছে আমাদের নিজেদের এবং অন্যদের ব্যর্থতা, দরিদ্রতা এবং পরাজয়ের প্রতি। রোমের নাগরিকরা যেমন দাবি করতেন তার ব্যতিক্রম অগাস্টিন বলতেন পৃথিবীতে ব্যর্থ হওয়া কোনোভাবেই কাউকে সত্যিকারভাবে খারাপ মানুষ হিসাবে চিহ্নিত করেনা, ঠিক যেমন করে সফলতারও এমন কোনো গভীর অর্থ হতে পারেনা। সফলতার বাহ্যিক চিহ্নগুলো দিয়ে পরস্পরকে বিচার করা মানুষের কাজ নয়। এই ধরনের বিশ্লেষণ থেকেই আসে নৈতিকতার অবক্ষয় এবং ঔদ্ধত্য। একারণে আমাদের কর্তব্য হওয়া উচিত ক্ষমতার প্রতি সন্দিহান হওয়া এবং ব্যর্থতার প্রতি উদার হওয়া। আর এই উপসংহারগুলো থেকে স্বস্তি পাওয়ার জন্য আমাদের খ্রিস্টান হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। রাজনৈতিক দর্শন এবং মানব মনোবিজ্ঞানের প্রতি এগুলো ধর্মের বিশ্বজনীন উপহার। তারা আমাদের স্থায়ীভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়, জীবনকে ত্রুটিমুক্ত করা অথবা দরিদ্রতা কিংবা অখ্যাতিকে খারাপ গুণের নির্ভরযোগ্য মানদণ্ড হিসাবে বিশ্বাস করার কিছু বিপদ এবং নিষ্ঠুরতাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *