অধ্যায় ৫ : তাৎক্ষণিক সুখ – আরিস্টিপপাস ও সাইরেনাইক দর্শন
খ্রিস্টজন্মের প্রায় ২০০ বছর আগে, হিপপোবোটাস নামে একজন ইতিহাসবিদ তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় এমন নয়টি দার্শনিক চিন্তাধারা বা স্কুলের একটি তালিকা করেছিলেন। সেখানে পরিচিত দার্শনিক চিন্তার ধারাগুলো, যেমন প্লেটোনিস্ট, অ্যারিস্টোটেলিয়ান, স্টয়িক, এপিকিউরিয়ান ছাড়াও খানিকটা অপরিচিত, সাইরেনাইকস, আনিসেরিয়ানস এবং থিওডোরান নামের তিনটি দর্শনের স্কুলের নামও ছিল। তবে চিন্তা করার কোনো কারণ নেই, কোনো অপরিচিত গ্রুপ নিয়ে তিনটি অধ্যায় আমি যুক্ত করছি না। কারণ, দেখা গেছে আনিসেরিয়ান, থিওডোরান ধারাটি মূলত গড়ে উঠেছিল সাইরেনাইক নামের বড় দার্শনিক ধারণাটির মধ্যে। এমন নয় যে সাইরেনায়িক দর্শনের স্কুলটি খুব বড় ছিল; হিপপোবোটাস যখন লিখেছিলেন, ততদিনে সাইরেনাইকরা হারিয়ে গেছেন। কোনো বড় প্রভাবশালী দর্শনের স্কুলের তালিকায় তারা আর ছিলেন না। দর্শনের কেন্দ্রীয় বিতর্কের প্রশ্নটিতে সিনিকদের মতো তারাও একটি চূড়ান্ত অবস্থান বেছে নিয়েছিলেন। তবে খুব সহজ নয় তাদের ধারণাগুলো ব্যাখ্যা করা। সিনিকদের মতোই তাদের সম্বন্ধে আমাদের ধারণাগুলো পরোক্ষ, লিখিত তেমন কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। আসলেই সিনিকদের সাথে তাদের তুলনা বেশ যুক্তিযুক্ত মনে হতে পারে। সাইরেনাইকরা ছিলেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ভোগবাদী, যখন সিনিকরা পরিকল্পিতভাবে কঠোর একটি জীবন বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য ছিল অভিন্ন, পূর্ণ স্বাধীনতা, এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে তারা একই রাস্তা ব্যবহার করেছিল, আর সেটি হচ্ছে প্রকৃতিকে অনুসরণ। ঐতিহাসিকভাবেও তাদের আরো একটি সাধারণ মিল ছিল। প্রাচীন উৎসগুলো বলছে যে সাইরেনাইক এবং সিনিকরা তাদের দর্শনের ধারাটির সূচনাপর্বটি চিহ্নিত করতে পারবেন সক্রেটিসের দুজন সহযোগীদের ধারণায়। সিনিকরা তাদের শুরু খুঁজে পাবেন অ্যান্টিসথেনিসের ধারণায়, আর সাইরেনিয়াকরা সেই দাবি করবেন সক্রেটিসের আরেক অনুসারী আরিস্টিপপাসকে নিয়ে। সাইরেনাইক দর্শনের সেরা সময়টি যার হাত ধরে এসেছিল তারও নাম ছিল আরিস্টিপপাস (মূল সেই আরিস্টিপপাসের নাতি)। বয়স্ক আরিস্টিপপাসের জন্ম হয়েছিল বর্তমান লিবিয়ার একটি জায়গা সাইরেনেতে। জেনোফোনেরসক্রেটিসকে নিয়ে লেখা তাঁর স্মৃতিকথায় তিনি বয়স্ক আরিস্টিপপাসের ভোগবাদী জীবনাচরণের বিবরণ দিয়েছিলেন, যাকে সক্রেটিস অনুরোধ করেছিলেন আরো সংযমী জীবন যাপন করতে।
একটি সময় ভোগবাদী দর্শনের জন্যে খ্যাতি (মূলত কুখ্যাতি) অর্জন করেছিলেন বয়স্ক আরিস্টিপপাস। ডায়োজেনিস দ্য সিনিক যেমন সুপরিচিত তার দরিদ্রতা আর বুদ্ধিমত্তার নানা গল্পের জন্যে, বৃদ্ধ আরিস্টিপপাসও একবাক্যে সমাপ্ত এমন নানা গল্পের নায়ক ছিলেন, যার প্রত্যেকটির শিরোনাম হতে পারে: আনন্দই একমাত্র উদ্দেশ্য। এই গল্পগুলোতে সাধারণত আমরা বৃদ্ধ আরিস্টিপপাসকে দেখি কোনো ভোজসভায় অথবা বেশ্যালয়ে। যেমন এক ছাত্রকে তিনি বলেছিলেন, ‘বেশ্যালয়ে যাওয়া নয়, সমস্যা হচ্ছে বের হয়ে আসাটা।’ আরেকটি গল্পে সন্দেহজনক এক মহিলা যখন তাকে অভিযুক্ত করেছিল তাকে গর্ভবতী করার জন্যে, তিনি তাকে বলেছিলেন, ‘তুমি হচ্ছ সেই লোকটার মতো, যে কাঁটার ঝোপের মধ্যে হেঁটে এসে একটি মাত্র কাঁটাকে দায়ী করে তার গায়ে আঁচড় দেবার জন্যে।’ আরেকটি গল্পে আমরা তাঁকে তার ছাত্রদের কাছ থেকে অর্থ দাবি করতে দেখি, যা পুরোপুরিভাবে তাঁর গুরু সক্রেটিসের আচরণবিরোধী, যিনি বন্ধুত্ব ছাড়া আর কিছুই প্রত্যাশা করতেন না তাঁর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। যেমন একবার এক পিতা তার ছেলেকে আরিস্টিপপাসের কাছে নিয়ে এসেছিলেন তাকে শিক্ষা দেবার জন্যে, তিনি বলেছিলেন, তার ছেলেকে শিক্ষা দেবার জন্যে তাকে ৫০০ ড্রাকমা পারিশ্রমিক দিতে হবে। সেই পিতা বলেছিলেন, ‘এত বেশি টাকায় আমি তো একটি ক্রীতদাসই কিনতে পারি।’ এবং তিনি উত্তর দেন, ‘বেশ তাই করুন, তাহলে আপনার দুটি ক্রীতদাস হবে।’
প্রথমে শুনলে মনে হতে পারে বৃদ্ধ আরিস্টিপপাস দার্শনিক নয় বরং চরিত্রহীন লম্পট কেউ, যিনি আরো পরিচিত ডায়োজেনিসের নানা কাহিনিগুলো নিজের প্রয়োজনে পুনর্ব্যবহার করতেন, আর অবশ্যই প্রাচীন উৎসগুলো আমাদের তেমনই একটি ধারণা দেয়। কিন্তু খুব ভালো করে লক্ষ করলে দেখব বৃদ্ধ আরিস্টিপপাস তাঁর ভোগবাদী দর্শনে বেশ চিন্তাও যুক্ত করেছিলেন। তিনি আত্মসংযমের অনুশীলনও করতেন। তিনি যে-কোনো আনন্দ পাবার অনুভূতি হাতছাড়া হতে দিতেন না, কিন্তু সেই একই কারণে যে-কোনো পরিস্থিতিতে তিনি আনন্দ খুঁজে পেতে সক্ষম ছিলেন। বেশ্যালয় নিয়ে তার সেই গল্পটি যেখানে তিনি ছাত্রকে বলছেন, সেখান থেকে বের হয়ে আসার জন্যে সক্ষম হবার প্রয়োজন আছে, এটি খানিকটা সীমিত আকারের সংযমের ইঙ্গিত দেয়। কারো পক্ষে সম্ভব এমন, ঠিক এখনই, এই মুহূর্তে সুখানুভূতির আনন্দ উপভোগ করার প্রয়োজনীয়তার উপর তিনি জোর দিয়েছিলেন, এবং দাবি করেন যে এর মাধ্যমে জীবন সহজতর, আনন্দময় হবে এবং অবশ্যই সেটি হবে স্বাধীন। এখানেই বৃদ্ধ আরিস্টিপপাসের বেশকিছু মিল আছে সিনিক ডায়োজেনিসের সাথে। স্পষ্টতই তিনি সিনিকদের ব্যতিক্রম বিলাসিতা, আনন্দ আর সম্পদ চেয়েছিলেন; তিনি আনন্দ পাওয়াটাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন একটি ভালো জীবনের ভিত্তি হিসাবে; কিন্তু তাদের মতোই তিনি স্বাধীনভাবে সামাজিক কোনো বিধিনিষেধের গণ্ডীর বাইরে বাঁচতে চেয়েছিলেন। তবে বৃদ্ধ আরিস্টিপপাসকে নিয়ে এই অধ্যায়ে আর বেশিকিছু বলার নেই। তবে তাঁর নাতি তরুণ আরিস্টিপপাস সাইরেনাইসিজম (Cyrenaicism)-এর মূল দার্শনিক ভিত্তিটি রচনা করেছিলেন, এবং তার দর্শনের কেন্দ্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি তখনও ছিল হেডোনিজম বা ভোগবাদ: সেই দাবিটি হচ্ছে, আনন্দ সবচেয়ে ভালো। তিনি তার পিতামহের কাছে উত্তরাধিকারসূত্রে সেই ধারণাটাও পেয়েছিলেন যে, আমাদের শুধু বর্তমানের সুখগুলো নিয়ে ভাবা উচিত। এখানে তিনি ভিন্ন ছিলেন এপিকিউরাসের অনুসারীদের চেয়ে, তারা ভোগবাদী তবে তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছিল। তাদের জন্যে আনন্দ-খোঁজা স্বতঃস্ফূর্ত, অপরিকল্পিত মুহূর্তের কোনো ভাবনা নয়, বরং জীবন যাপনের একটি কৌশল, যার সাথে যুক্ত সতর্ক পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ, বর্তমান সুখকে বর্জন করা ভবিষ্যতের সুখ পাওয়া এবং ভবিষ্যতের দুঃখ এড়ানো নিশ্চিত করতে। তরুণ আরিস্টিপপাসের কাছে আপনার জীবন বর্তমান মুহূর্তে আপনি যেমন উপভোগ করছেন ঠিক ততটুকুই ভালো। বিষয়টি তরুণ আরিস্টিপপাসের দর্শনের অনন্যতা আর বিস্ময়কর একটি দিক প্রকাশ করে। প্রায় সব প্রাচীন দার্শনিকই প্লেটো আর অ্যারিস্টোটলের উদাহরণ অনুসরণ করে চেষ্টা করেছিলেন শ্রেষ্ঠ জীবনকে সুখী জীবন হিসাবে শনাক্ত করতে। আমরা দেখেছি তাদের দর্শনের কেন্দ্রে ছিল ইউডাইমোনিয়া; তারা মোটামুটি একমত ছিলেন যে, যখন আমরা নৈতিকতা অনুসরণ করি, আমরা চেষ্টা করি খুঁজে বের করতে কোন্ বিষয়টি আমাদের সুখী করে। অবশ্যই, একজন ভোগবাদীও সেটি করতে পারে। সাইরেনাইকরা এর ব্যতিক্রম ছিলেন, তারা বিশেষভাবে কোনো সুখী জীবন নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না। তারা তাৎক্ষণিক সুখের কথা ভাবতেন, ভবিষ্যতে কী ভালো হবে সেটি নয়। কিন্তু তরুণ আরিস্টিপপাস কেন এমন ভাবতেন, সম্ভবত তিনি অনুভব করেছিলেন কোনো ভোগবাদীকে কী পরিমাণ চাপের মুখে পড়তে হয় যদি তাকে ভবিষ্যতের জন্যে পরিকল্পনা আর হিসাব-নিকাশ করতে হয়। প্লেটো তার একটি সংলাপে, সক্রেটিসকে দিয়ে বলিয়েছেন যে, একজন সফল ভোগবাদীর দরকার আছে একটি art of measurement বা মাত্রা মাপার শিল্প, কারণ তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোটি তাকে সবচেয়ে বেশি সুখ দেবে। স্পষ্টতই এটি পিচ্ছিল ঢালে পা দেবার মতো যেখানে ভালোকে শনাক্ত করার জন্যে দরকার প্রজ্ঞা, যুক্তি, এবং পরিশেষে যা যুক্তি আমাদের করতে নির্দেশ দেয়, ভার্চু বা সদ্গুণ। তরুণ আরিস্টিপপাসের কাছে ভালো হচ্ছে সেইসব কিছু যা ভালো লাগে অনুভব করতে।
বিকল্পভাবে হয়তো তরুণ আরিস্টিপপাস চিন্তা করেছিলেন যে সারাজীবন ধরে সর্ব্বোচ্চ সুখ অর্জন করা অসম্ভব। এর কারণ হতে পারে জীবনের উদ্দেশ্য খুবই অনির্দিষ্ট, অথবা মানবজীবনের প্রকৃতিটাই এমন যে আনন্দের চেয়ে সারাজীবন ধরে তারা বেশি দুঃখই ভোগ করেন (এই জোরালো দাবিটি করেছিলেন আরেকজন সাইরেনাইক দার্শনিক হেজেসিয়াস)। সুতরাং আমাদের মনোযোগ দিতে হবে যা আমরা আসলেই অর্জন করতে পারব, সেটি হচ্ছে এখন এবং এই মুহূর্তে পাওয়া সম্ভব এমন সুখ। অতীত সুখের স্মৃতি আর ভবিষ্যৎ সুখের কামনা তার দর্শনের উদ্দেশ্য নয় বোঝাতে তিনি প্রস্তাব করেছিলেন যে, এগুলো এমন সুখ যা কিনা ঠিক এই মুহূর্তে আমাদের জন্যে অস্তিত্বশীল নয়। আমাদের জন্যে যা অস্তিত্বশীল সেটি হচ্ছে যা-কিছু আমাদের বর্তমান মুহূর্তটিকে প্রভাবিত করছে। তিনি বিষয়টিকে একধরনের গতির সাথে তুলনা করেছিলেন: আনন্দকে তিনি সংজ্ঞায়িত করেছেন ‘মসৃণ’ গতি এবং কষ্টকে ‘অমসৃণ’ গতি হিসাবে; তিনি কষ্টকে সমুদ্রের ঝড়ের সাথে, আনন্দকে সুবাতাস হিসাবে, এবং দুটির অনুপস্থিতিকে শান্ত সমুদ্রের সাথে তুলনা করেছিলেন।
কিন্তু কেন তিনি আনন্দকে ‘ভালোর’ সাথে সংশ্লিষ্ট করেছিলেন? যেন তিনি প্রথম থেকেই দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ ছিলেন বর্তমান মুহূর্তের সুখের ভোগবাদিতাকে তিনি সমর্থন করবেনই, এবং যা-কিছু তার এই প্রস্তাবনায় বাধা সৃষ্টি করবে তা তিনি দূরে সরিয়ে দেবেন, প্রজ্ঞা, স্মৃতি, আশা। আর দর্শনে কোনো একটি অবস্থান যে- কোনো মূল্যে আঁকড়ে ধরে থাকাটাকে খুব একটা সুনজরে দেখা হয়না। তাহলে কি এটি শুধু তার পিতামহের প্রতি ভালোবাসার ছদ্মপ্রকাশ? অথবা তরুণ আরিস্টিপপাসের কাছে কী যুক্তি ছিল তার বৃদ্ধ পিতামহের দর্শনের স্বপক্ষে? আসলেই ছিল, এই যুক্তিটি অনেকেই ব্যবহার করেছেন, এটিকে cradle argument বলা হয়। যুক্তিটা মূলত শুরু হয় এমন একটি দাবি করে যে একেবারে শৈশব থেকে সব মানুষই আনন্দ বা সুখ খুঁজে। ইউডোক্সাস, বিখ্যাত গণিতজ্ঞ জ্যোতির্বিদ এবং প্লেটোর অ্যাকাডেমির সদস্য, ভোগবাদী দর্শনকে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। তিনি এই যুক্তির একটি সংস্করণ প্রস্তাব করেছিলেন সেই সত্যটাকে প্রস্তবানা করার মাধ্যমে যে সব প্রাণী সারাক্ষণই সুখের সন্ধানে ব্যস্ত। সুখের সমর্থনে আমরা যুক্তিটি এপিকিউরাসের দর্শনেও পাই, আর স্টয়িকরা দাবি করেছিলেন শিশুদের সহজাত প্রবৃত্তিগত আর প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়ায় ভিত্তি হতে পারে তাদের নৈতিকতার।
আপনি হয়তো ভাবতে পারেন এই ক্রেডল আর্গুমেন্ট এমনকি কোনো শিশুও খণ্ডন করতে পারবে। শুধুমাত্র প্রাণী এবং মানবশিশুরা যে-কোনো মূল্যে আনন্দ খুঁজে, তার মানে এইনা যে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদেরও সেটি করা উচিত হবে। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন যে, আরো কোনো মহত্তর উদ্দেশ্যে সুখ বিসর্জন দেওয়া হয়তো প্রাপ্তবয়স্কতার চিহ্ন হতে পারে। কিন্তু এই যুক্তিটির আরো শক্তি আছে, যদি আপনি স্বীকার করেন, যেমন করে বহু প্রাচীন দার্শনিক স্বীকার করেছিলেন যে প্রকৃতিই মানুষের জন্যে সবচেয়ে ভালোটি নির্ধারণ করতে পারে। অ্যারিস্টোটলের সেই ফাংশন-যুক্তিটির কথা ভাবুন, এমনকি আজও বহু মানুষই মনে করেন যে যদি কোনোকিছু অপ্রাকৃতিক হয়, তাহলে সেটি অবশ্যই গ্রহণযোগ্য নয়। প্ৰকৃতি আর নৈতিকতার মধ্যে যোগসূত্রটি স্পষ্টতই সহজাত এবং মনের গভীরে প্রোথিত। এছাড়াও সাইরেনাইকদের বর্তমান মুহূর্তের সুখ অর্জন করার উপর গুরুত্বটি তাদের একটি লক্ষ্য অর্জন করতে সহায়তা করে, যা শুধু সিনিক নয়, গ্রিক দর্শনের আরো একটি চিন্তার সাথে যার সংযোগ আছে: ataraxia, যে-কোনো ধরনের উদ্বেগের অনুপস্থিতি, যা দাবি করে, সবচেয়ে সহজতম জীবন শুধুমাত্র বর্তমান মুহূর্তের সুখ অনুসন্ধান করে এবং এর দ্বারা সন্তুষ্টি লাভ করে, ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো চিন্তা যেমন এর থাকেনা, তেমনি অতীত নিয়ে কোনো আক্ষেপও থাকেনা।
তরুণ আরিস্টিপপাস বর্তমান মুহূর্তে অর্জন করা সুখের সর্ব্বোচ্চ গুরুত্ব দাবি করা বৈপ্লবিক প্রস্তাবটি সমর্থন করেছিলেন, মানবজ্ঞান নিয়ে আরো একটি বৈপ্লবিক প্রস্তাবনা করার মাধ্যমে। তিনি শুরু করেছিলেন আপাতদৃষ্টিতে খুব সাধারণ পর্যবেক্ষণ দিয়ে, আমরা শুধু সেই অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারি চারপাশের সবকিছু যেমনভাবে আমাদের প্রভাবিত করছে। সুতরাং, যেমন, আমি যদি কোনোকিছু সাদা দেখি, সেই জিনিসটা আমাকে প্রভাবিত করছে আমাদের অনুভব করিয়ে যে আমি সাদা দেখছি, আমি সাদায় আবিষ্ট হচ্ছি। আমাদের অভিজ্ঞতার আধেয় হচ্ছে নানা উপায়ে যেভাবে আমরা প্রভাবিত হচ্ছি, এবং অবশ্যই কোনোকিছু আমাকে যেভাবে প্রভাবিত করতে পারে, আপনাকে হয়তো অন্যভাবে প্রভাবিত করতে পারে। যেমন যদি আপনি অসুস্থ হন, হয়তো সবকিছু আপনার তিক্ত অনুভব হতে পারে, যেক্ষেত্রে মধুও আপনার কাছে তিক্ত স্বাদের মনে হবে; কিন্তু যেহেতু আমি সুস্থ, আমার কাছে সেটি মিষ্টি অনুভূত হবে। অবশ্যই সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান দাবি করবে যে, যদি মধু আমার কাছে মিষ্টি মনে হয় আর আপনার কাছে তিক্ত তার কারণ নিশ্চয়ই আমার স্বাদ নেবার ক্ষমতা সঠিকভাবে কাজ করছে, আপনারটা করছে না। আর যাইহোক না কেন, মধু তো আসলেই মিষ্টি, যদি আপনি ভাবেন এটি তিতা, সেটি আপনার দোষ, মধুর দোষ নয়। কিন্তু সাইরেনাইকরা মনে করতেন, সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের বেশকিছু সংশোধন প্রয়োজন। তরুণ আরিস্টিপপাস আমাদের মনে করিয়ে দেন যে আমরা মধুকে ভিন্ন ভিন্নভাবে অনুভব করছি, কারণ এভাবে মধু আমাদের প্রত্যেককে প্রভাবিত করছে। সেই অভিজ্ঞতাগুলো এমন কিছু নয় যা আমরা ভাগাভাগি করে নিতে পারি। আমি কখনোই মধু নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতায় অংশ নিতে পারব না, ঠিক একইভাবে আমি সেই ব্যথাও একইভাবে অনুভব করব না যখন কেউ আপনার মুখে একটি ঘুসি মারবে।
এই সবকিছু আমাদের প্লেটো সেই বক্তব্যটিকে মনে করিয়ে দিতে বাধ্য, যা তিনি দাবি করেছিলেন সোফিস্ট প্রোটাগোরাসের বলে; প্রোটাগোরাস বলেছিলেন, কোনো চরম বা চূড়ান্ত সত্য নেই, যেমন কোনো বাতাস ঠাণ্ডা না গরম সেই সম্বন্ধে যদি ভাবেন। যদি আপনার কাছে এটি ঠাণ্ডা লাগে, এটি আপনার জন্যে ঠাণ্ডা, যদি আমার কাছে গরম অনুভূত হয়, তাহলে আমার কাছে গরম। সাধারণভাবে সব সত্যই সত্য শুধুমাত্র আপেক্ষিকভাবে, বিষয়গুলো যার কাছে যেমন মনে হয়। হয়তো সাইরেনাইকদের দর্শন আর প্রোটাগোরাসের আপেক্ষিকতাবাদের মিলটি উপরিপৃষ্ঠে শুধু। সাইরেনাইকরা বিশেষভাবে নজর দিয়েছিলেন মৌলিক ইন্দ্রিয়ানুভূতিতে, যেমন কোনোকিছু সাদা নাকি মিষ্টি। এটাই, অবশ্যই, ভোগবাদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যদি জীবন সম্বন্ধে সচেতনতা, মহাবিশ্ব এবং সবকিছুই নির্ভর করে ঠিক এখনই সবকিছু কেমন আছে তার উপরে, তাহলে যুক্তিসঙ্গত হতে পারে বর্তমান সুখ আর কষ্ট অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হবে কারো জীবনে। এখন হয়তো আপনি তর্ক করতে পারেন যে, ঠিক এই বর্তমানটা মনে হতে পারে অন্যায্য, পক্ষপাতদুষ্ট অথবা আমাদের জন্যে সুন্দরও হতে পারে, আর সেই বিষয়টি তাৎক্ষণিক আনন্দ ছাড়াও আরো অনেক কিছু বিষয়ে ভাবারও অবকাশ দেয়। কিন্তু আরিস্টিপপাস এই ধাঁধায় আরো একটি অংশ যোগ করেছিলেন, তিনি বলেছিলেন আমাদের সব অভিজ্ঞতাই বাস্তবিকভাবে আনন্দ অথবা দুঃখের। সুতরাং যদি কোনোকিছু মিষ্টি হয়, সেটি সুখ, আর তিতা হয় তাহলে একধরনের কষ্ট। যদি সেটি সামান্য খানিকটা সুখকর বা খানিকটা কষ্টকর না হয়, আমাদের কোনো অভিজ্ঞতাই থাকবে না, এটি হবে এমন কিছু যা স্বাদহীন। এটাই ব্যাখ্যা করে যেখানে না-সুখ না-দুঃখ এমন কোনো পরিস্থিতিগুলোকে সাইরেনাইকরা তুলনা করেছিলেন শান্ত সমুদ্রের সাথে, যেখানে কোনো বাতাস নেই।
আমরা এতক্ষণ তরুণ আরিস্টিপপাসের দৃষ্টিভঙ্গিটি পড়লাম। আমরা দেখেছি, তিনি ভাবতেন যে আমার জন্যে যা-কিছুর অস্তিত্ব আছে সেটি আমি এখন অভিজ্ঞতালব্ধ হচ্ছি, যা নানা ধরনের সুখ আর কষ্ট ছাড়া আর কিছুই না। সে- কারণে জীবনের শুধুমাত্র ভালো যা-কিছু আমি পেতে পারি সেটি হচ্ছে এই মুহূর্তের আনন্দ, অন্যদিকে সবচেয়ে খারাপ জিনিসটি হচ্ছে যে কষ্ট আমি এখন পাচ্ছি। এই দৃশ্যটি অপরিবর্তিত এবং অনমনীয়। তবে তাদের দর্শন তেমন সফল হয়নি। এপিকিউরাসের দর্শন সাইরেনাইকদের ভোগবাদীদের প্রভাবশালী দর্শনের তালিকায় বেশখানিকটা নিচে নামিয়ে দিয়েছিল। তবে তারপরও তার অনুসারীরা ছিল। পরে তার ধারণাগুলো তিনটি ভিন্নদিকে বিকশিত হয়। স্পষ্টতই সাইরেনাইকদের তত্ত্বকে সমর্থন করতে হলে খুব সীমিত আকারের ছাড় দিতে হয়, যেন বিষয়টিকে ব্যাখ্যাযোগ্য করে। এটাই সম্ভবত কৌশল ছিল আনিসেরিসের, যিনি দাবি করেছিলেন সুখ ভালো, কিন্তু আরো বিস্তৃত একটি দৃষ্টিভঙ্গি তিনি ধারণ করেছিলেন সুখ নিয়ে।যখন দুই আরিস্টিপপাসই মনোযোগ দিয়েছিলেন মৌলিক শারীরিক সুখের উপর, আনিসেরিসরা ইঙ্গিত করেন যে সম্মান আর বন্ধুত্বও সুখকর। এই আরো বেশি ব্যবহার-উপযোগী সংস্করণটি খুবই ভিন্ন এই ধারার আরেক দার্শনিক থিওডোরাসের দর্শন থেকে। আরিস্টিপপাসের দৃষ্টিভঙ্গির গৃহপালিত সংস্করণ যা আনিসেরিস প্রস্তাব করেছিলেন তার সাথে তিনি পুরোপুরি একমত ছিলেন না, তবে তিনি শারীরিক সুখের উপর কম মূল্য দিয়েছেন। বিস্ময়কর এটি, বিশেষ করে এমন কেউ যারা কিনা সাইরেনাইক স্কুলের সাথে সংশ্লিষ্ট, কিন্তু তিনি আরো একটি কেন্দ্রীয় মূলনীতির সমর্থন করেছিলেন, সেটি হচ্ছে আত্মনির্ভরশীলতা এবং স্বয়ংসম্পূর্ণতা। আর এভাবে তিনি বন্ধুত্ব আর সামাজিক বন্ধনের ধারণাটিকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। স্পষ্টতই হতাশাপূর্ণ দিকে দর্শনটি মোড় নিয়েছিল, দর্শনটির তৃতীয় শাখাও তার প্রমাণ। হেজেসিয়াস নামের এক দার্শনিক তরুণ আরিস্টিপপাসের ভোগবাদিতা আর সংশয়বাদী জ্ঞানতত্ত্বকে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। কিন্তু শোপেনহাউয়ারের অচেনা এক গ্রিক সংস্করণের মতো, হেজেসিয়াস শিখিয়েছিলেন যে আমরা জীবনকে খুব একটা সুখকর কোনো বিষয় হিসাবে আশা করতে পারিনা। আমাদের জন্যে সবচেয়ে ভালো হবে যতটা সম্ভব ততটা দুঃখ এড়িয়ে চলা। এই চূড়ান্ত হতাশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্যে হেজেসিয়াসের একটি স্মরণীয় খেতাব জুটেছিল, মৃত্যুর অনুপ্রেরণাদানকারী। তিনি ছিলেন সেই দার্শনিক যিনি কিনা আক্ষরিকার্থে আপনাকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করতে পারতেন। এর সাথে সাইরেনাইক দর্শন ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়, যে তত্ত্বটি সুখকে ভালো জীবনের কেন্দ্রে রেখেছে, সেটি এত বেশি অপ্রিয় হবার কথা নয়। কিন্তু তারপরও সাইরেনাইকরা দর্শনের ইতিহাসে বেশ কৌতূহলোদ্দীপক একটি পাদটীকা হিসাবে রয়ে গেছেন, বিশেষ করে মানব-অভিজ্ঞতা নিয়ে তাদের উদ্ভাবনী ধারণাগুলো, এবং তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী এপিকিউরানদের ব্যতিক্রম তারা যা-কিছু আমাদের নিবেদন করেছিলেন তার জন্যে।