1 of 2

অধ্যায় ৪৫ : যেমন মানুষটি কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি – হানা আরেন্ট

অধ্যায় ৪৫ : যেমন মানুষটি কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি – হানা আরেন্ট

নাৎসি কর্মকর্তা অ্যাডলফ আইখমান খুবই কর্মঠ এবং দক্ষ একজন প্রশাসক ছিলেন। ১৯৪২ সাল থেকে তার উপর দায়িত্ব ছিল ইউরোপের সব ইহুদিকে পোল্যান্ডে অবস্থিত কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোয় পরিবহন করে আনা, যাদের একটি ছিল অসউইচ। এটাই ছিল হিটলারের সেই ‘ফাইনাল সল্যুশনের’ একটি অংশ : জার্মান সেনাবাহিনী দ্বারা অধিকৃত এলাকায় সব ইহুদিকে হত্যা করার মহাপরিকল্পনা। আইখমান ব্যক্তিগতভাবে দায়ী ছিলেন না এই ধরনের পদ্ধতিগত ভাবে ইহুদি-হত্যার নীতিমালা প্রণয়ন করার জন্যে, এটা তার নিজস্ব ধারণও ছিল না। কিন্তু তিনি গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন পরিবহনের জন্যে ব্যবহৃত রেলওয়ে সিস্টেমটির সাথে যা এমন একটি নীতি বাস্তবায়ন করার কাজটি সম্ভব করেছিল।

১৯৩০-এর দশক থেকেই জার্মানিতে নাৎসিরা নানা ধরনের আইন প্রণয়ন করতে শুরু করেছিল, যেগুলো কার্যত ইহুদি জনগোষ্ঠীর সদস্যদের সব অধিকারই হরণ করেছিল। জার্মানির সাথে খারাপ যা-কিছু হয়েছে সবকিছুর জন্য হিটলার ইহুদিদের দায়ী করেছিলেন, এবং তার উন্মত্ত একটি ইচ্ছা ছিল তিনি তাদের উপর চূড়ান্ত প্রতিশোধ নেবেন। এই আইনগুলো সরকারি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইহুদিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছিল, সব সম্পদ হস্তান্তর করতে ও সবসময় ইহুদি হিসাবে শনাক্তকারী চিহ্ন ‘হলুদ তারা’ পরার জন্য তাদের বাধ্য করা হয়েছিল। গেটো বা শহরের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় তাদের একসাথে বসবাস করতেও বাধ্য করা হয়েছিল, যা মূলত ছিল একধরনের কারাগার, যেখানে খাদ্য ছিল দুষ্প্রাপ্য, জীবন ছিল কঠোর। কিন্তু হিটলারের ফাইনাল সল্যুশন এই দুর্দশায় আরো নতুন একটি অশুভ মাত্রা যোগ করেছিল। জাতিগত বিশোধনের লক্ষ্যে মিলিয়ন সংখ্যক ইহুদি হত্যা করার জন্য হিটলারের সিদ্ধান্তটির অর্থ ছিল যে, নাৎসিদের কোনো- না-কোনো একটি উপায়ে তাদের অধিকৃত সব শহর থেকে ইহুদিদের এমন জায়গায় নিয়ে আসতে হবে, যেখানে তাদের গণহত্যা করা যায়। বিদ্যমান সব কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোকে রূপান্তরিত করা হয়েছিল গ্যাস ব্যবহার করে গণহত্যা আর শবদেহ পোড়ানোর কারখানা হিসাবে, যেন সেগুলো প্রতিদিন শত শত মানুষকে হত্যা ও দাহ করতে পারে। আর যেহেতু এইসব ক্যাম্পগুলো ছিল পোল্যান্ডে, কারো উপর দায়িত্ব দেবার দরকার ছিল ইহুদিদের তাদের মৃত্যু অভিমুখে ট্রেনে বহন করে আনার জন্যে। যখন আইখমান তার অফিসে বসে কাগজপত্র নাড়াচাড়া করেছেন আর গুরুত্বপূর্ণ ফোন করেছেন, মিলিয়ন সংখ্যক মানুষ তখন মারা গেছে তার সেই কাজের জন্য। কেউ মারা গেছে না-খেয়ে, কেউ টাইফয়েডে, অন্যদের কাজ করিয়ে মারা হয়েছে, তবে বেশিরভাগকে হত্যা করা হয়েছিল গ্যাস দিয়ে। নাৎসি জার্মানিতে ট্রেন সবসময়ই সময়মতো চলেছে। আইখমান ও তার অধীনস্থরা সেই বিষয়টি নিশ্চিত করেছিল। তাদের দক্ষতার কারণে সবসময় ট্রেন ভর্তি ছিল, নারী পুরুষ আর শিশুদের দিয়ে মৃত্যু-অভিমুখে যন্ত্রণাময় তাদের সেই যাত্রায়, তাদের সাধারণত কোনো খাওয়া ও পানি দেয়া হতো না, কখনো তীব্র গরম বা তীব্র শীতে। যাত্রাপথেই মারা গিয়েছিলেন বহু মানুষ, বিশেষ করে বৃদ্ধ আর অসুস্থরা।

যারা বেঁচে থাকতেন তারা দুর্বল ও ক্লান্ত শরীরে আতঙ্ক নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতেন, শাওয়ারের ছদ্মবেশে বানানো গ্যাসচেম্বারগুলোয় তাদের জোর করে ঢুকিয়ে দিত জার্মান সৈন্যরা, যেখানে তাদের সব কাপড় খুলে ফেলতে বলা হতো। দরজা বন্ধ করে দেয়া হতো, আর এখানেই নাৎসিরা জিকলন গ্যাস ব্যবহার করে গণহত্যার কাজটি সম্পন্ন করত। এরপর তাদের মৃতদেহগুলোকে পোড়ানো হতো ও তাদের সাথে বহন করে আনা জিনিসগুলো লুট করা হতো। যদি তাদের সাথে সাথে এভাবে হত্যা না করা হতো, তাদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত সুস্থদের হয়তো কাজ করতে বাধ্য করা হতো সামান্য খাদ্যের বিনিময়ে। নাৎসি প্রহরীরা মজা করার জন্যেও তাদের নির্যাতন কিংবা কখনো গুলি করে হত্যা করত। আইখমান এইসব অপরাধ ঘটানোর প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি মিত্রবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়া এড়াতে পেরেছিলেন, একপর্যায়ে তিনি আর্জেন্টিনায় পালিয়ে আসেন, যেখানে ১৯৬০ সাল অবধি বাস করেছিলেন কোনো সমস্যা ছাড়াই। তবে ১৯৬০ সালে ইসরায়েলি সিক্রেট পুলিশ, মোসাদ, বুয়েনোস আয়ার্সে তাকে খুঁজে বের করে এবং গ্রেফতার করে। এরপর তাকে বিচারের জন্য ইসরায়েলে নিয়ে আসা হয়।

আইখমান কি কোনো ধরনের অশুভ দানব ছিলেন, ধর্ষকামী কেউ, যে-কিনা অন্যদের দুর্দশা আর কষ্টে সুখ অনুভব করত? এটাই বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করতেন এই বিচার শুরু হবার আগে। নতুবা কীভাবে তিনি এই হলোকস্টে বা গণহত্যায় অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলেন? বেশকয়েক বছর ধরে তার কাজ ছিল সারা ইউরোপ থেকে কীভাবে ইহুদিদের মৃত্যুশিবিরে পাঠানো যেতে পারে তার কার্যকরী উপায় খুঁজে বের করা। নিশ্চয়ই এমন কাজ শুধু কোনো অশুভ দানবের পক্ষেই সম্ভব, যে-কিনা এই কাজ করে রাতে ঘুমাতে পারে। দার্শনিক হানা আরেন্ট (১৯০৬-৭৫), একজন জার্মান ইহুদি, যিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে এসেছিলেন ইউরোপে যুদ্ধচলাকালে। তিনি নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনের জন্য আইখমানের বিচারটি রিপোর্ট করতে ইসরায়েলের জেরুজালেমে এসেছিলেন, তিনি আগ্রহী ছিলেন নাৎসি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রকাঠামোর দ্বারা উৎপাদিত এই চরিত্রটির মুখোমুখি হবেন, যে রাষ্ট্রের সমাজে স্বাধীনভাবে চিন্তা করা খুবই দুরূহ একটি কাজ ছিল। তিনি এই মানুষটিকে বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন, একটা ধারণা পেতে চেয়েছিলেন, তিনি আসলে কেমন দেখতে, এবং কীভাবে তিনি এই ভয়ঙ্কর কাণ্ড করতে পেরেছিলেন। আরেন্টের দেখা প্রথম নাৎসি আইখমান নয়, তিনি নিজেও নাৎসির হাত থেকে পালিয়ে বেঁচেছিলেন, জার্মানি থেকে ফ্রান্স হয়ে, পরে একসময় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করেন। মারবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণী আরেন্টের শিক্ষক ছিলেন বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক মার্টিন হেইডেগার। খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কও ছিল, যখন তার বয়স মাত্র ১৮ আর হেইডেগার ছিলেন বিবাহিত। হেইডেগার তখন ব্যস্ত ছিলেন তাঁর Being and Time লেখা নিয়ে (১৯৬২ সালে যেটি প্রকাশিত হয়), ভয়ংকর কঠিন একটি বই, যা কেউ কেউ মনে করেন এটি দর্শনে একটি বিশাল অবদান, আবার অনেকেই এটিকে অস্পষ্ট ভাবনাপ্রসূত একটি লেখা মনে করেছিলেন। পরবর্তীতে হেইডেগার নিজেই নাৎসি পার্টির একজন একনিষ্ঠ সদস্য হবার মতো ভুল কাজটি করেছিলেন, যখন তিনি ইহুদিবিরোধী নীতিকে সমর্থন ও তার বন্ধু দার্শনিক এডমন্ড হুসেরল- এর নাম Being and Time-এর উৎসর্গ পৃষ্ঠা থেকে বাদ দিয়েছিলেন, কারণ তিনি ছিলেন ইহুদি।

কিন্তু জেরুজালেমে বিচারপ্রক্রিয়া দেখতে এসে আরেন্ট খুব ভিন্ন ধরনের এক নাৎসির দেখা পেয়েছিলেন, যে কিনা খুবই সাধারণ মানুষ, যে কিনা সে কী কাজ করছে, তা নিয়ে খুব গভীর ভাবে না-ভাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আর নিজের কাজ সম্বন্ধে তার চিন্তা করার অক্ষমতাটির পরিণতি ছিল ভয়াবহ। কিন্তু অবশ্যই তিনি অশুভ ধর্ষকামী কেউ ছিলেন না, যা আরেন্ট হয়তো আশা করেছিলেন তার মধ্যে দেখবেন বলে। বরং আইখমান ছিলেন এমন কেউ যে অন্য যে-কোনো সাধারণ মানুষের মতোই, কিন্তু সমানভাবেই বিপজ্জনক: আরেন্ট যাকে বলেছিলেন একজন unthinking man, যে মানুষ চিন্তা করে না। জার্মানিতে যেখানে বর্ণবাদের সব কুৎসিতরূপগুলো আইন হিসাবে সূত্রবদ্ধ করা হয়েছিল, তার জন্যে খুব সহজ ছিল নিজেকে রাজি করানো যে তিনি যা করছেন ঠিক কাজই করছেন। পরিস্থিতি তাকে সুযোগ করে দিয়েছিল তার পেশায় সফল হবার জন্যে এবং সেই সুযোগটি তিনি নিয়েছিলেন। হিটলারের ইহুদিগণহত্যার নীলনকশার ফাইনাল সল্যুশন ছিল আইখমানের জন্য একটি সুযোগ, তার কাজে যোগ্যতা দেখানো এবং তিনি কাজটি কত ভালোভাবে করতে পারেন সেই দক্ষতার প্রমাণ দেবার জন্যে। বিষয়টি কল্পনা করা খুব কঠিন, কিন্তু আরেন্ট-এর বহু সমালোচকই মনে করতেন তিনি ঠিক বলছেন না, কিন্তু তিনি অনুভব করেছিলেন যে, আইখমান আন্তরিক ও সত্যকথাই বলছে যখন সে দাবি করেছিল সে শুধুমাত্র তার কর্তব্য পালন করেছিল। কিছু নাৎসির ব্যতিক্রম, আইখানকে দেখে তার মনে হয়নি যে ইহুদিদের প্রতি তীব্র কোনো ঘৃণা তাকে পরিচালিত করেছিল। তার মধ্যে হিটলারের কোনো বিষই ছিল না। কারণ বহু নাৎসি ছিল তখন জার্মানিতে যারা আনন্দের সাথে কোনো ইহুদিকে পিটিয়ে হত্যা করতে পারত রাস্তায়, যদি তারা হাইল হিটলার বলে সম্ভাষণ না করত, কিন্তু তিনি তাদের মধ্যেও একজন ছিলেন না। কিন্তু তারপরও নাৎসিদের আনুষ্ঠানিক অবস্থানটি অনুসরণ ও গ্রহণ করে নিয়েছিলেন, কিন্তু তার পরিণতি ছিল আরো অনেক ভয়ানক, তিনি বহু মিলিয়ন ইহুদিকে তাদের মৃত্যু অভিমুখে প্রেরণ করেছিলেন। এমনকি যখন তিনি তার বিরুদ্ধে আনা সাক্ষ্যপ্রমাণগুলো দেখছিলেন বা শুনছিলেন, তার অপরাধটি কী ছিল সেটি বোঝা তার জন্যে বেশ কষ্টকর প্রমাণিত হয়েছিল। তিনি যতটুকু জানেন, যেহেতু তিনি কোনো আইন ভঙ্গ করেননি, বা নিজে কাউকে সরাসরি হত্যা করেননি বা অন্য কাউকে সেটি করতেও বলেননি তার হয়ে, তিনি যুক্তিসঙ্গতভাবে কাজ করেছিলেন। তাকে প্রতিপালন করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় আইন মেনে চলতে এবং প্রশিক্ষিত করা হয়েছে নির্দেশ অনুসরণ করার জন্য, আর তার চারপাশে সব মানুষই যখন একই কাজ করেছে তার মতোই। অন্যদের নির্দেশ গ্রহণ করার মাধ্যমে তিনি তার দৈনন্দিন কাজের ভয়াবহ সেই পরিণতির জন্যে দায়বদ্ধ হবার অনুভূতি এড়াতে পেরেছিলেন।

গবাদিপশু বহনকারী ট্রাক আর ট্রেনবগিতে মানুষকে গাদাগাদি করে ওঠানো বা মৃত্যুক্যাম্পে ভ্রমণ করার কোনো প্রয়োজন ছিল না আইখমানের, সুতরাং তেমন কিছু তিনি করেননি। আইখমান আদালতে বলেছিলেন তিনি ডাক্তার হতে পারেননি কারণ তিনি রক্ত ভয় পান। কিন্তু তার হাতেই রক্তের দাগ এখনও। তিনি এমন একটি পদ্ধতির উৎপাদন বা সমাজের সৃষ্টি, যা কোনো-না-কোনোভাবে তাকে তার নিজের কাজ ও সত্যিকার মানুষের উপর সেই কাজের পরিণতিগুলো সমালোচনামূলক বা ক্রিটিকাল উপায়ে কোনো চিন্তা করা থেকে প্রতিহত করেছিল। যেন তিনি অন্য কোনো মানুষের অনুভূতি আদৌ অনুভব করতে পারেন না। তার বিচারের পুরো সময় জুড়েই আইখমান তার নিজের নিরপরাধতা-সংক্রান্ত বিভ্রান্তিকর ধারণাটি থেকে সরে আসেননি একবারো। আর এটা যদি না হয়ে থাকে, তাহলে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এমন কিছু বলতে যে তিনি শুধু নির্দেশ মান্য করছেন, এটাই তার নিজেকে বাঁচানোর শ্রেষ্ঠ উপায় হতে পারে; আর যদি তাই হয়, তিনি আরেন্টকে বোকা বানিয়েছিলেন। আরেন্ট এখানে তার বিখ্যাত শব্দ, banality of evil ব্যবহার করেছিলেন ব্যাখ্যা করতে, তিনি যা আইখমানের মধ্যে দেখেছিলেন। যদি কিছু banal হয়, সেটি খুব সাধারণ, বিরক্তিকর, আর মৌলিকতাশূন্য। আইখমানের অশুভ রূপটি ছিল, তিনি দাবি করেছিলেন, খুব সাধারণ, সেই অর্থে যে এটি একটি আমলার অশুভ কর্ম, একজন অফিস ম্যানেজারের কাজ, এটি কোনো দানবীয় ধর্ষকামী শয়তানের কাজ নয়। তিনি হচ্ছেন খুব সাধারণ একধরনের মানুষ, যিনি নাৎসিদের দৃষ্টিভঙ্গিকে সুযোগ দিয়েছিলেন তিনি যা-কিছু করবেন সেটি প্রভাবিত করার জন্যে। আরেন্ট-এর দর্শনকে অনুপ্রাণিত করেছিল তাঁর চারপাশে ঘটা নানা ঘটনা। তিনি সেই ধরনের দার্শনিক ছিলেন না যিনি কিনা তার জীবন আর্মচেয়ারে বসে কাটাতে পারেন বিশুদ্ধ বিমূর্ত ভাবনা অথবা কোনো একটি শব্দের নিখুঁত অর্থ কী হতে পারে সেটি নিয়ে অশেষ বিতর্কে সময় কাটানোর মাধ্যমে। তাঁর দর্শনের সংযোগ ছিল বর্তমান ইতিহাস আর যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার সাথে।

তিনি যা লিখেছিলেন তাঁর বই Eichmann in Jerusalem-এ, তার ভিত্তি ছিল একটি মানুষকে নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ, এবং তার কাজের যথার্থতা দাবি করে প্রস্ত াবিত আইখম্যানের ভাষা আর যুক্তিগুলো বিশ্লেষণ। সেখান থেকে তিনি যা দেখেছিলেন, তিনি আরো বেশি সাধারণ প্রত্যাশা করেছিলেন, যা আমরা কোনো একদলীয় নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রকাঠামোয় দেখতে পারি, এবং সেইসব মানুষের উপর এর ভয়ংকর প্রভাব কী হতে পারে, যারা এর আরোপিত চিন্তার প্রক্রিয়া ও কাঠামোকে প্রতিহত করতে পারেননা। আইখমান সেই সময়ের বহু নাৎসির মতো, ব্যর্থ হয়েছিলেন বিষয়গুলো অন্য কারোর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে। তিনি যথেষ্ট সাহসী ছিলেন না যে আইনগুলো তাকে দেয়া হয়েছে সেগুলোকে প্রশ্ন করার মতো সাহস দেখাতে পারতেন: তিনি শুধু সেরা উপায়গুলোর অনুসন্ধান করেছিলেন কীভাবে সেটি অনুসরণ করা যায়। তার কল্পনাশক্তির ঘাটতি ছিল। আরেন্ট তাকে ব্যাখ্যা করেছেন ‘অগভীর আর মেধাশূন্য’ হিসাবে, যদিও সেটি তার একটি নাটকও হতে পারে। সে যদি সত্যি একটি দানব হতো, তাকে দেখে আতঙ্কিত হতে হতো আমাদের।

কিন্তু দানবরা অন্তত সংখ্যায় বেশি নয় এবং সাধারণত খুব সহজেই তাদের চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু যা আরো বেশি আতঙ্কের সেটি হচ্ছে সেই বাস্তবতা যে তারা দেখতে আসলেই আর যে-কোনো একটি সাধারণ মানুষের মতোই। আইখমান খুব সাধারণ এক মানুষ যে-কিনা তিনি কী করছেন সেই বিষয়ে প্রশ্ন না- করার মাধ্যমে, মানবতার ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্য অশুভ কাজটিতে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি যদি নাৎসি জার্মানিতে বাস না করতেন, তাহলে সম্ভাবনা খুব কম ছিল আদৌ কোনো অশুভ মানুষ হয়ে ওঠার। পরিস্থিতি তার বিপক্ষে ছিল। কিন্তু সেটি তার অপরাধ আর দায়বদ্ধতাকে মুছে দেয় না। তিনি অনৈতিক নির্দেশের প্রতি অনুগত ছিল। আর নাৎসি আদেশ মানা, যতটুকু আরেন্ট মনে করেন তাহলো ফাইনাল সল্যুশনকে সমর্থন করার সমতুল্য। তাকে যা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সেটি সম্বন্ধে প্রশ্ন না করে, আর সেই আদেশ মান্য করার মাধ্যমে, তিনি গণহত্যায় অংশ নিয়েছিলেন, এমনকি যখন তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও, যেখানে তিনি দাবি করেছিলেন তিনি শুধুমাত্র ট্রেনের সময়সূচী তৈরি করেছেন। বিচারের একটি পর্যায়ে তিনি এমনকি দাবি করেছিলেন যে তিনি ইমানুয়েল কান্টের theory of moral duty অনুযায়ী কাজ করেছেন, যেন আদেশ মান্য করে সঠিক কাজ করেছিলেন। তিনি পুরোপুরি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন যে কান্ট বিশ্বাস করতেন, মানুষের সাথে শ্রদ্ধা আর সম্মানের সাথে আচরণ করাটাই নৈতিকতার মৌলিক ভিত্তি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *