1 of 2

অধ্যায় ২৪ : রঙিন চশমায় দেখা বাস্তবতা – ইমানুয়েল কান্ট

অধ্যায় ২৪ : রঙিন চশমায় দেখা বাস্তবতা – ইমানুয়েল কান্ট

যদি আপনি গোলাপি রঙের চশমা পরে থাকেন সেটি আপনার দেখার প্রতিটি অভিজ্ঞতাও একই রঙে রঙিন করবে। হয়তো ভুলেও যেতে পারেন যে আপনি এমন কোনো চশমা পরে আছেন, কিন্তু সেটি তখনও আপনি যা-কিছু দেখছেন সে সবকিছুকেই প্রভাবিত করছে। ইমানুয়েল কান্ট (১৭২৪-১৮০৪) বিশ্বাস করতেন যে, আমরা সবাই পৃথিবীকে এরকম একটি ফিল্টার বা ছাঁকনির মধ্যে দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে জীবন কাটাচ্ছি। এই ফিল্টারটি হচ্ছে মানুষের মন। এটি নির্ধারণ করে কীভাবে আমরা সবকিছুর অভিজ্ঞতা অনুভব করব এবং সেই অভিজ্ঞতার উপরও এটি সুনির্দিষ্ট একটি রূপ চাপিয়ে দেয়। যা-কিছু আমরা উপলব্ধি করি, সেটি একটি স্থান ও সময়ে ঘটে আর প্রতিটি পরিবর্তনের একটি কারণ আছে, কিন্তু কান্টের মতে এর কারণ বাস্তবতা আসলেই যা সেটি নয়: এটি আমাদের মনের সৃষ্টি। পৃথিবী কেমন সেটি বোঝার জন্যে আমাদের সরাসরি কোনো উপায় নেই। এছাড়া আমরা কখনো চোখ থেকে সেই চশমাও খুলে ফেলতে পারিনা কোনোকিছুর সত্যিকারের স্বরূপ দেখার জন্য। সুতরাং আমরা বাঁধা পড়ে আছি এই ছাঁকনিসহ, আর এটি ছাড়া আমরাও কোনোকিছুর অভিজ্ঞতা অর্জনে পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হতাম। আমরা যা করতে পারি সেটি হলো, এই ছাঁকনিটার উপস্থিতি শনাক্ত করা এবং বোঝার চেষ্টা করা কীভাবে এটি আমাদের অভিজ্ঞতাকে প্রভাবিত আর রঞ্জিত করে। কান্টের নিজের মন ছিল খুবই যৌক্তিক আর শৃঙ্খলাপূর্ণ। তেমনই ছিল তার জীবনও। চিরকুমার ছিলেন এবং প্রতিটি দিনই কঠোরভাবে অনুসৃত কিছু নিয়ম মেনে কাটাতেন। কোনো সময় নষ্ট না- করার লক্ষ্যে, তিনি তার গৃহভৃত্যকে বলতেন তাকে ঠিক ভোর পাঁচটায় ঘুম ভাঙিয়ে দিতে, এর পর তিনি চা ও ধূমপান শেষে লিখতে বসতেন। খুবই উৎপাদনশীল ছিলেন তিনি লেখার ব্যপারে, প্রচুর প্রবন্ধ লিখেছেন। এরপর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেবার জন্য বের হতেন। বিকালে, ঠিক সাড়ে চারটায় তিনি হাঁটতে বের হতেন, প্রতিদিন ঠিক একই সময়, তাঁর নিজের রাস্তায়, শুরু থেকে শেষ অবধি মোট আটবার। বাস্তবিকভাবে তাঁর জন্মশহর কনিগসবার্গ (বর্তমানে যার নাম কালিনিনগ্রাদ)-এর অধিবাসীরা তাঁর হাঁটতে বের হওয়া দেখে তাদের ঘড়ি ঠিক করতে পারতেন।

বেশিরভাগ দার্শনিকদের মত, তিনি তাঁর সময় ব্যয় করেছিলেন বাস্তবতার সাথে আমাদের সম্পর্ক বোঝার চেষ্টা করে, সটি, মূলত, মেটাফিজিক্স বা অধিবিদ্যা বলতে যা বোঝায়। এবং কান্ট সর্বকালের মেটাফিজিয়ানদের মধ্যে অন্যতম সেরা একজন। তার বিশেষ আগ্রহের ক্ষেত্র ছিল আমাদের চিন্তার সীমানা, আমরা কী জানতে ও বুঝতে পারি তার সীমানা। তার মধ্যে একধরনের উন্মত্ত আচ্ছন্নতা ছিল এই বিষয়টি অনুসন্ধান করার জন্যে। তাঁর বিখ্যাত The Critique of Pure Reason (১৭৮১) বইটিতে তিনি এই সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করেছেন বোধগম্যতার শেষ সীমা অবধি। খুব কঠিন তার এই বইটি, কান্ট নিজেই এটি বর্ণনা করেছেন শুল্ক আর অস্পষ্ট বলে, এবং তিনি সঠিক ছিলেন। খুব কম মানুষই দাবি করতে পারবে তারা বইটি বুঝেছেন। এবং বেশিরভাগ যুক্তিপ্রক্রিয়াও ছিল জটিল এবং নানা বিশেষায়িত শব্দ দ্বারা ভারাক্রান্ত। পড়লে মনে হতে পারে শব্দের ঘন গভীর কোনো জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাবার মতো, যখন গন্তব্য কোথায় সেই বিষয়ে কোনো ধারণা থাকে না, মাঝে মাঝে সূর্যের আলোর দেখা পাওয়া ছাড়া। কিন্তু মূল যুক্তিটি ছিল যথেষ্ট স্পষ্ট। বাস্ততা আসলে কিসের মতো? কান্ট ভাবতেন আমাদের পক্ষে প্রকৃত অবস্থার সত্যিকারের সম্পূর্ণ পরিচয়টি জানা কখনোই সম্ভব না। আমরা কখনোই সেই জগৎ সম্বন্ধে সরাসরি কিছু জানতে পারিনা, যা-কিছু আমাদের আপাতদৃষ্টিতে দেখা কিছুর পেছনে লুকোনো থাকে, কান্ট যাকে নাম দিয়েছিলেন noumenal জগৎ। যদি তিনি মাঝে মাঝে একবাচক noumenon ব্যবহার করেছেন, কখনবা বহুবাচক noumena (অনেকেই মনে করেন যা তার করা উচিত ছিল না, যেমন হেগেল): আমরা জানতে পারব না বাস্তবতা কি একটি জিনিস অথবা অনেক। খুব কঠোরভাবে বললে এই noumenal জগৎ সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানতে পারিনা। নিদেনপক্ষে এই বিষয়ে আমরা কোনো সরাসরি তথ্য সংগ্রহ করতে পারব না। যদিও আমরা phenomenal এই জগৎ সম্বন্ধে জানতে পারি, আমাদের চারপাশে পৃথিবী, যে জগৎটিকে আমরা ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখুন, আপনি যা দেখছেন তা ফেনোমেনাল জগৎ, ঘাস, গাড়ি আকাশ কিংবা দালান ইত্যাদি যে-কোনো, কিন্তু noumenal জগৎ লুকিয়ে আছে আমাদের সব অভিজ্ঞতার পেছনে, এটি হচ্ছে তা যা গভীরতর স্তরে থাকে।

যা-কিছুর অস্তিত্ব আছে তার কিছু বিষয়, তাহলে, সবসময়ে আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে। গভীরভাবে চিন্তার মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত বিস্তারিত একটি ধারণা তারপরও আমরা পেতে পারি, যা কিনা আমরা শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক উপায়ে পেতে পারি। The Critique of Pure Reason-এর কান্ট যে প্রধান প্রশ্নটির উত্তর অনুসন্ধান করেছিলেন তা হলো এরকম: কীভাবে synthetic a priori জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব? প্রশ্নটি সম্ভবত আমাদের মতো সাধারণ পাঠকের কাছে আদৌ অর্থবহ কিছু না। বিষয়টি খানিকটা ব্যাখ্যা করতে হবে। কিন্তু মূল ধারণাটি প্রথমে যতটা কঠিন মনে হয় ততটা কঠিন নয়। আগের প্রশ্নটি প্রথম যে- শব্দটিকে ব্যাখ্যা করতে হবে সেটি হচ্ছে synthetic, এটি analytic-এর বিপরীত, analytic-এর মানে এখানে true by definition বা সংজ্ঞা দ্বারাই যা সত্য। সুতরাং যেমন, all men are male হচ্ছে true by definition-এর উদাহরণ। এর মানে হচ্ছে আপনি এই বাক্যটি দিয়েই জানতে পারবেন যে এটি সত্য, এর জন্য আপনাকে সত্যিকারের men পর্যবেক্ষণ করার দরকার নেই। আপনার পরীক্ষা করে দেখার দরকার নেই তারা সবাই male কিনা; মাঠপর্যায়ের কোনো গবেষণার দরকার নেই এই উপসংহারে পৌঁছানোর জন্য। আপনি চেয়ারে বসেই এটি সমাধান করতে পারবেন। কারণসহ শব্দটির মধ্যে male ধারণাটি যুক্ত হয়ে আছে। এটা সেই বাক্যের মতো: সব স্তন্যপায়ী তাদের সন্তানদের স্তন্য পান করায়। আবারো সব স্তন্যপায়ী প্রাণীকে পরীক্ষা করে দেখার প্রয়োজন নেই, তারা সবাই তাদের শিশুদের স্তন্যপান করায় কিনা জানার জন্য, কারণ mammal বা স্তন্যপায়ী শব্দটিতেই এই ধারণা যুক্ত হয়ে আছে। আপনি যদি এমন কিছু খুঁজে পান যাকে দেখে স্তন্যপায়ী মনে হয় ও সে তার সন্তানদের স্তন্যপান করায় না, আপনি জানবেন যে এটা স্তন্যপায়ী হতে পারে না। Analytic প্রস্তাবনাগুলো আসলে সংজ্ঞাসূচক, সুতরাং তারা আমাদের নতুন কোনো জ্ঞান দেয়না, তারা মূলত যা বোঝায় সেটি হচ্ছে শব্দটি সংজ্ঞায়িত করার প্রক্রিয়ায় আমরা আগেই কী ধরে নিয়েছি।

এর ব্যতিক্রম Synthetic জ্ঞানের জন্য দরকার অভিজ্ঞতা অথবা পর্যবেক্ষণ এবং এটি আমাদের নতুন তথ্য দেয়, এমন কিছু যা কোনোভাবেই আমাদের ব্যবহার-করা কোনো শব্দ অথবা প্রতীক ধারণ করতে পারেনা। যেমন, আমরা জানি, লেবুর স্বাদ টক, কিন্তু এটা জানা সম্ভব লেবুর স্বাদ নিয়ে (অথবা কারণ এমন হতে পারে যে কেউ হয়তো বলেছে এর স্বাদ কেমন তাদের নিজের অভিজ্ঞতা থেকে); সুতরাং সংজ্ঞায় এটি সত্য না যে লেবুর স্বাদ টক, এটি এমন কিছু যা আমরা শিখেছি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। আরেকটি Synthetic বাক্য হবে ‘সব বিড়ালের লেজ আছে’, এটি এমন কিছু যা আপনাকে অনুসন্ধান করে দেখতে হবে এটি সত্য কিনা। না অনুসন্ধান করে আপনি বলতে পারবেন না। বাস্ত বিকভাবে কিছু বিড়াল যেমন Manx বিড়ালরা, তাদের লেজ নেই। এবং কিছু বিড়াল তাদের লেজ হারিয়ে ফেলে, কিন্তু তারা ঠিকই বিড়াল থাকে। প্রশ্নটি হচ্ছে সব বিড়ালের লেজ থাকে কিনা, তাহলে, এটি অনুসন্ধানের বিষয়, বিড়ালের’ সংজ্ঞার প্রশ্ন না। এটি খু ভিন্ন ‘সব বিড়াল স্তন্যপায়ী’ বাক্যটি থেকে। এটি শুধুমাত্র সংজ্ঞার ব্যাপার, সেকারণে এটি analytic প্রস্তাবনা। তাহলে synthetic a priori জ্ঞানে কী বাকি থাকে? a priori জ্ঞান, যেমনটি আমরা দেখেছি, হচ্ছে এমন জ্ঞান, যা অভিজ্ঞতা থেকে স্বাধীন। আমরা এটি অভিজ্ঞতার আগেই জানি, তার মানে, আমাদের এই বিষয়ে অভিজ্ঞতা লাভের আগেই। সপ্তদশ আর অষ্টাদশ শতাব্দীতে একটি বিতর্ক ছিল আমরা কি কোনোকিছু a priori জানতে পারি কিনা। মোটামুটিভাবে বললে এমপেরিসিস্টরা (যেমন লক) ভাবতেন, না, আমরা সেটি পারিনা, র‍্যাশনালিস্ট (যেমন দেকার্ত) ভেবেছিলেন, হ্যাঁ আমরা পারি। যখন লক প্রস্তাব করেছিলেন কোনো জন্মগত ধারণা বা জ্ঞান নেই, একটি শিশুর মন শূন্য, একটি ফাঁকা স্লেটের মতো, তিনি তখন দাবি করেছিলেন কোনো a prioriজ্ঞান থাকার কথা না। এটি শুনে মনে হতে পারে যেন a priori অর্থ analytic-এর মতো একই রকম কিছু (এবং কিছু দার্শনিকদের জন্য এই শব্দগুলো পরস্পর প্রতিস্থাপনযোগ্য)। কিন্তু কান্টের জন্যে সেটি ছিলনা। তিনি ভাবতেন যে জ্ঞান পৃথিবীর সম্বন্ধে সত্য উন্মোচন করে, এবং যা আমরা অর্জন করতে পারি অভিজ্ঞতা ছাড়াই স্বতন্ত্রভাবে, সেটি সম্ভব। সেকারণে তিনি একটি বিশেষ শ্রেণীর synthetic a priori জ্ঞানের প্রস্তাবনা করেন এটি ব্যাখ্যা করার জন্য। synthetic a priori জ্ঞানের একটি উদাহরণ যেমন, যা কান্ট নিজেই ব্যবহার করেছিলেন, সেটি ছিল গাণিতিক একটি সমীকরণ ৭+৫=১২; যদিও বহু দার্শনিক এই ধরনের সত্যকে বলবেন analytic, গাণিতিক সংকেতের সংজ্ঞার একটি বিষয়। কান্ট বিশ্বাস করতেন আমরা apriori জানতে পারি যে ৭+৫=১২ (আমাদের এটিকে কোনো কিছু বা পর্যবেক্ষণের সাথে পরীক্ষা করে দেখার প্রয়োজনীয়তা নেই), তারপরও একই সাথে এটি আমাদের নতুন জ্ঞান দিচ্ছে, এটি একটি synthetic প্রস্তাবনা।

যদি কান্ট সঠিক হয়ে থাকেন, এটি একটি নতুন আবিষ্কার। তাঁর আগের দার্শনিকরা বাস্তবতার প্রকৃতিকে যারা নিরীক্ষা করেছেন, তারা শুধুমাত্র এটিকে দেখেছেন আমাদের বাইরের কিছু যা আমাদের অভিজ্ঞতার জন্য দায়ী। সেক্ষেত্রে কঠিন বিষয়টি হচ্ছে কীভাবে আমরা সেই বাস্তবতার স্বরূপ জানতে পারি যেন এর সম্বন্ধে অর্থবহ কিছু আমরা বলতে পারি যা শুধুমাত্র অনুমান থেকে বেশি। কান্টের অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টিটি ছিল, হ্যাঁ আমরা পারি, যুক্তির শক্তি ব্যবহার করে, আমরা আমাদের মনের নানা বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করতে পারি, যা আমাদের সব অভিজ্ঞতাকে রঞ্জিত করে। আর্মচেয়ারে বসে গভীরভাবে চিন্তা করে আমরা বাস্তবতা সম্বন্ধে কিছু আবিষ্কার করতে পারি, যা সত্য হতে বাধ্য, কিন্তু যা শুধুমাত্র সংজ্ঞার দ্বারা সত্য নয়:তারা তথ্যবহুল হতে পারে। তিনি বিশ্বাস করতেন যৌক্তিক যুক্তিতর্ক প্রস্তাব করে তিনি প্রমাণের সমতূল্য এমন কিছু কাজ করেছেন যে পৃথিবী আমাদের কাছে আবশ্যিকভাবে গোলাপি রঙে রঞ্জিত হয়ে আবির্ভূত হয়। তিনি শুধু প্রমাণই করেননি যে আমরা সবাই গোলাপি রঙের চশমা পরে আছি। এছাড়াও তিনি সেই গোলাপি রঙের নানা শেড বা মাত্রা সংক্রান্ত নতুন আবিষ্কারও করেছিলেন, যা এই চশমাগুলো আমাদের সব অভিজ্ঞতার সাথে যুক্ত করে।

বাস্তবতার সাথে আমাদের সম্পর্কের মৌলিক বিষয়গুলো তার সন্তুষ্টি মোতাবেক ব্যাখ্যা করার পর কান্ট তার মনোযোগ দিয়েছিলেন নৈতিক দর্শনের উপর। ধরুন আপনার দরজায় কেউ কড়া নাড়ছে। দরজা খুলে দেখলেন আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি তরুণ, যাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে সে বিপদে পড়েছে, এবং তার সাহায্য দরকার। সে আহত এবং তার রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আপনি তাকে ভিতরে নিয়ে গেলেন এবং তাকে সাহায্য করলেন, তাকে নিরাপদে বিশ্রাম নেবার সুযোগ দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ফোন করলেন। অবশ্যই এই পরিস্থিতিতে এটাই সঠিক কাজ। কিন্তু যদি আপনি তাকে সাহায্য করে থাকেন, কারণ তার জন্য আপনার করুণা হচ্ছে, তাহলে কান্টের মতো সেটি আসলেই আদৌ কোনো ‘নৈতিক’ কাজ হবে না। কাজের নৈতিকতার প্রশ্নে আপনার সহমর্মিতা অপ্রাসঙ্গিক। আপনার চরিত্রের সেটি অংশ ঠিকই, কিন্তু সঠিক আর ভুল কাজের সাথে এর কোনো যোগসূত্রতা নেই। নৈতিকতা কান্টের মতে শুধুমাত্র আপনি ‘কী’ করছেন সেটি না, আপনি ‘কেন’ করছেন কাজটি সেটিও। যারা সঠিক কাজ করেন তারা কেমন অনুভব করছেন শুধুমাত্র সেজন্যই কাজটি করেন না; সেই কাজটি করার সিদ্ধান্তের ভিত্তি হতে হবে যৌক্তিকতায়, সেই যুক্তি যা বলবে আপনার কর্তব্য কী, সে-বিষয়ে আপনি যা-কিছুই অনুভব করুন-না কেন। কান্ট ভেবেছিলেন নৈতিকতার প্রশ্নে আবেগ আসা উচিত না। কারোর মধ্যে সহমর্মিতার আবেগ থাকার ব্যপারটি মূলত ভাগ্যের ব্যাপার। কিছু মানুষ সমবেদনা ও সহমর্মিতা অনুভব করেন, অন্যরা করেন না। কেউ কেউ খুব নিষ্ঠুর, দয়াশীল হতে যাদের বেশ পরিশ্রম করতে হয়; আর কেউ তাদের টাকাপয়সা কিংবা সম্পত্তি মানুষের মধ্যে বিলিয়ে ও অন্যদের সাহায্য করে আনন্দ পান। কিন্তু যে-কোনো যুক্তিসম্পন্ন মানুষের জন্য ভালো হওয়ার বিষয়টি তাদের নিজস্ব বাছবিচারের উপর ভিত্তি করে অর্জন করতে পারা উচিত। কান্টের মতে, আপনি যদি তরুণকে সাহায্য করে থাকেন, কারণ আপনি জানেন এটা আপনার কর্তব্য, তাহলে এটি একটি নৈতিক কর্ম। এই কাজটি করা সঠিক, কারণ একই পরিস্থিতিতে এই কাজটাই সবার করা উচিত। আপনার কাছে বেশ অদ্ভুত মনে হতে পারে ব্যাপারটা। আপনি সম্ভবত ভাবছেন কেউ, যে-কিনা তরুণটির জন্য সমবেদনা অনুভব করেছিল এবং তাকে সাহায্য করেছিল সেই নৈতিকতার সাথেই কাজটি করেছে এবং সমবেদনার মতো সেই অনুভূতি অনুভব করার জন্যে সেই মানুষটি একটি উত্তম মানুষ। অ্যারিস্টোটলও তাই ভেবেছিলেন। কিন্তু কান্টের প্রস্তাবনা ছিল সুনির্দিষ্ট। যদি আপনি এমনকিছু করেন শুধুমাত্র আপনি কী অনুভব করছেন সেই কারণে, তা আসলেই উত্তম কোনো কাজ নয়। কল্পনা করুন এমন কাউকে যে-কিনা এই তরুণটিকে দেখে তীব্র বিরক্ত আর ঘৃণা অনুভব করেছিল, কিন্তু তারপরও সেই লোকটি তরুণটির জন্য যা-কিছু করার সেটি কর্তব্যের খাতিরে করলেন। সমবেদনায় বশবর্তী হয়ে কাজটি করেছে এমন কারো চেয়ে কান্টের দৃষ্টিভঙ্গিতে এই মানুষটি অবশ্যই অনেক বেশি নৈতিকতাপূর্ণ। এর কারণ সেই অতিশয় বিরক্তি-উৎপাদনকারী মানুষটি স্পষ্টতই তার কর্তব্যজ্ঞান থেকে কাজটি করেছে, কারণ তার ভিতরে কর্মরত আবেগটি তাকে সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে টেনেছে, সে যাতে সাহায্য না করে তা করতে প্ররোচিত করেছে।

বাইবেলের গুড সামারিটান-এর সেই প্রবাদকাহিনিটির কথা ভাবুন। গুড সামারিটান পথের পাশে শুয়ে থাকা এক বিপদগ্রস্ত সাহায্যপ্রার্থী মানুষকে সহায়তা করেছিলেন যখন কিনা বাকিরা সবাই তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু গুড সামারিটানকে ভালো করল কোন্ বিষয়টি? যদি সামারিটান সেই বিপদগ্রস্থ মানুষটিকে সহায়তা করেন, কারণ যদি তিনি ভাবেন এটি করলে তিনি স্বর্গে যেতে পারবেন, কান্টের দৃষ্টিভঙ্গিতে সেটি আদৌ নৈতিকতাপূর্ণ কোনো কাজ হবে না। সেটি হবে কোনোকিছু পাবার জন্য মানুষটিকে ব্যবহার করা, লক্ষ্যে পৌঁছানোর একটি উপায়। যদি তিনি তাকে শুধুমাত্র সমবেদনা বা করুণা থেকে সাহায্য করে থাকেন, যেমনটি আমরা দেখেছি আগে, সেটিও কান্টের চোখে ভালো কাজ হবে না। কিন্তু যদি তিনি তাকে সাহায্য করেন, কারণ তিনি শনাক্ত করতে পেরেছেন যে এটি তার কর্তব্য, এবং এধরনের পরিস্থিতিতে যে-কারোর জন্য সেই কাজটি করা সঠিক, তাহলে কান্ট একমত হবেন গুড সামারিটান আসলেই নৈতিকভাবেই উত্তম। ইনটেনশন বা উদ্দেশ্য-সংক্রান্ত কান্টের দৃষ্টিভঙ্গি তার আবেগ-সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সহজেই গ্রহণযোগ্য। আমরা বেশিরভাগ মানুষই পরস্পরকে বিচার করি আমরা কী করতে সফল হয়েছি সেটি নয় বরং আমরা কী করতে চেষ্টা করছি তার দ্বারা। ভাবুন, আপনি কি অনুভব করবেন যদি কোনো বাবা অথবা মা তার শিশুকে রাস্তার মধ্যে যাওয়া থেকে ঠেকাতে দুর্ঘটনাবশত আপনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। এবার এর সাথে তুলনা করুন আপনি কি অনুভব করবেন যদি কেউ সেই কাজটি ইচ্ছা করে শুধুমাত্র মজা করার জন্য। শিশুটির বাবা কিংবা মা রঙিন চশমায় দেখা বাস্তবতা আপনাকে ইচ্ছা করে আঘাত করেনি, কিন্তু যে আপনাকে ইচ্ছা করে ধাক্কা মেরেছে সে কাজটি করছে। কিন্তু আমরা যদি আরেকটি উদাহরণ দেখি, ভালো উদ্দেশ্যই যথেষ্ট নয় আপনার কাজটিকে নৈতিকতাপূর্ণ করার জন্য।

আরো একটি টোকা পড়ল দরজায়। আপনি দরজা খুললেন, দেখলেন আপনার প্রিয় বন্ধু দাঁড়িয়ে, চিন্তিত, স্পষ্টতই অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্থ, হাঁপাচ্ছে। সে আপনাকে বলে কেউ তাকে খুন করতে চায় এবং ছুরি হাতে তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আপনি তাকে ভিতরে নিয়ে আসলেন, এবং সে দৌড়ে উপরতলায় উঠে যায় লুকাতে। এর কিছুক্ষণ পর আরো একবার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। এবার সেই সম্ভাব্য খুনি, তার চোখে উন্মত্ত দৃষ্টি নিয়ে। সে জানতে চায় আপনার বন্ধু কোথায়? সে কি বাসায় আছে? সে কি কোথাও লুকিয়ে আছে? কোথায় সে? বাস্ত বিকভাবে সে তখন উপরতলায়। কিন্তু আপনি মিথ্যা বললেন, বললেন সে পার্কের দিকে চলে গেছে। নিশ্চয়ই আপনি সঠিক কাজটি করছেন একটি সম্ভাব্য খুনিকে ভুলদিকে নির্দেশনা দিয়ে। আপনি সম্ভবত আপনার বন্ধুর জীবন বাঁচালেন। এটি নিশ্চয়ই একটি নৈতিক কাজ হয়েছে, তাই না? না, কান্টের মতে কাজটি নৈতিকতাপূর্ণ নয়। কান্টের মতে আপনার কখনোই মিথ্যা বলা উচিত না, পরিস্থিতি যাই হোক না কেন। কোনো ব্যতিক্রম নেই। কোনো অজুহাত নেই। এর কারণ আপনি এমন কোনো সাধারণ নীতিমালা তৈরি করতে পারবেন না, যেখানে সবাই তাদের সুবিধামতো মিথ্যা বলতে পারবে। এই ক্ষেত্রে যদি আপনি না-জেনেই মিথ্যা বলেন এবং আপনার বন্ধু দরজায় তার আক্রমণকারীর উপস্থিতি টের পেয়ে পেছনের দরজা দিয়ে পার্কের দিকে পালিয়ে যেয়ে থাকে, আপনি তাহলে একজন খুনিকে হত্যাকাণ্ডে সহায়তা করলেন। আপনার বন্ধু যদি তখন খুন হয় তার জন্য আপনিও খানিকটা দায়ী। এই উদাহরণ হচ্ছে একটি যা কান্ট নিজেই ব্যবহার করেছিলেন, এটি প্রদর্শন করে তার দৃষ্টিভঙ্গি কত চূড়ান্ত ছিল। সত্য বলা আর নৈতিক কর্তব্য পালন করার ক্ষেত্রে কোনো ব্যতিক্রম নেই। আমাদের একটি চূড়ান্ত বা চরম কর্তব্য হচ্ছে সত্যিকথা বলা, কান্টের ভাষায় এমনকিছু করা হচ্ছে Categorical Imperative; Imperative মানে হচ্ছে নির্দেশ। Categorical Imperative-এর সাথে hypothetical imperative-এর কিছু পার্থক্য আছে। hypothetical imperative, যেমন ‘আপনি যদি ‘ক’ চান, তাহলে ‘খ’ করুন’। আপনি যদি জেলখানায় না-যেতে চান, তাহলে চুরি করা থেকে বিরত থাকুন, এগুলো hypothetical imperative-এর উদাহরণ। Categorical Imperative-এর থেকে ভিন্ন। এটি আপনাকে শিক্ষা দেয়। এই ক্ষেত্রে Categorical Imperative হবে, চুরি কোরো না। এটি একটি নির্দেশ যা আপনাকে বলছে আপনার কর্তব্য কী। কান্ট ভাবতেন নৈতিকতা হচ্ছে Categorical Imperative-এর একটি প্রক্রিয়া। আপনার নৈতিক কর্তব্য হচ্ছে আপনার নৈতিক কর্তব্য, এর পরিণতি আর পরিস্থিতি যাই হোক-না কেন।

কান্ট বিশ্বাস করতেন যা আমাদের অন্য সব প্রাণী থেকে আলাদা করে মানুষ হিসাবে, সেটি হলো আমরা আমাদের নির্বাচনগুলো নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে পারি। আমরা যন্ত্রের মতো হতাম যদি কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই কাজ করতে পারতাম। প্রায় কখনোই কোনো মানুষকে জিজ্ঞাসা করা ভুল হবে না, ‘কেন এই কাজটা আপনি করেছেন?’ আমরা শুধুমাত্র আমাদের প্রবৃত্তি থেকে কাজ করিনা, বরং যুক্তির ভিত্তিতেও কাজ করি। এই বক্তব্যগুলো প্রকাশ করার ক্ষেত্রে কান্টের উপায় হচ্ছে প্রবচন বা ম্যাক্সিম হিসাবে উপস্থাপন করা, যা অনুসরণ করে আমরা কাজ করতে পারি। ম্যাক্সিম হচ্ছে ভিত্তিস্বরূপ মূলনীতি, কেন আপনি এই কাজটি করেছেন? এই প্রশ্নটির উত্তর। আপনার কাজের মূল ভিত্তিস্বরূপ মূলনীতিটি বা ম্যাক্সিমটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি যুক্তি দেন আপনি সেই মূলনীতি বা ম্যাক্সিম মেনেই কাজ করবেন যে মূলনীতিগুলো সর্বজনীনযোগ্য বা যা সবার জন্য প্রযোজ্য হতে পারে। কোনোকিছু সর্বজনীনযোগ্য হতে হলে এটি সবার জন্য একইভাবে প্রযোজ্য হতে হবে। এর মানে হচ্ছে আমাদের সেই কাজগুলো করা উচিত, আপনার মতো পরিস্থিতিতে যে কাজটি করা যে-কোনো কারো জন্যই একইভাবে যুক্তিসঙ্গত কাজ হতে হবে। সবসময় কান্ট আমাদের যে প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করতে বলেছিলেন সেটি হচ্ছে, কী হবে যদি বাকিরা সবাই একই কাজ করে? নিজের জন্যে বিষয়টি কোনো বিশেষ ব্যতিক্রম করে ভাবা যাবে না। কান্ট মনে করতেন আসলেই এটির যা অর্থতা হচ্ছে, অন্য মানুষদের ব্যবহার করা নিজের স্বার্থে আপনার কখনোই উচিত হবে না বরং শ্রদ্ধার সাথেই সবার আচরণ করা উচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ যে প্রতিটি মানুষেরই অটোনমি বা নিজস্ব মতামত বা নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়া, তাদের সেই ক্ষমতার উপর ভরসা করা যে তারাও নিজে থেকে যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। মানুষের প্রতি এই সম্মান ও একক ব্যক্তি হিসাবে তার মূল্য আধুনিক মানবাধিকার তত্ত্বের কেন্দ্রে অবস্থিত। নীতিদর্শনে বা মোরাল ফিলোসফিতে এটি কান্টের সবচেয়ে বড় অবদান।

কোনো উদাহরণের মাধ্যমেই এটি বোঝা সহজ। কল্পনা করুন আপনি একটি দোকানের মালিক, এবং আপনি ফল বিক্রি করেন। যখন মানুষ আপনার দোকানে এসে ফল কেনে, আপনি সবসময় তাদের সাথে ভদ্র ব্যবহার করেন ও তাদের সঠিক মূল্য ফেরত দেন। হয়তো আপনি এটি করেন কারণ আপনি ভাবছেন এটি করলে আপনার ব্যবসার জন্য ভালো হবে, এবং আপনার দোকানে আবার সেই ক্রেতার ফিরে আসার সম্ভাবনাও বাড়বে। তাদের ন্যায্য প্রাপ্যমূল্য ফেরত দেবার যদি সেটি একমাত্র কারণ হয়ে থাকে, তাহলে সেটি হবে আপনি যা চান সেটি পাবার জন্য ক্রেতাদের ব্যবহার করা। কান্ট বিশ্বাস করতেন, যেহেতু আপনি যুক্তিসঙ্গতভাবে কখনোই দাবি করতে পারবেন না যে, সবাই সবার সাথে এমনভাবে (অন্যকে ব্যবহার করবে নিজের স্বার্থে) ব্যবহার করবে, এটি কোনো নৈতিক আচরণ হবে না। কিন্তু যদি আপনি সঠিকভাবে তাদের পয়সা ফেরত দেন কারণ আপনি মনে করেন যে কাউকে প্রতারণা করা আপনার কর্তব্য নয়, তাহলে সেটি হবে নৈতিক একটি কাজ। এর কারণ এটির ভিত্তি হচ্ছে একটি ম্যাক্সিম, Don’t deceive others, এই ম্যাক্সিম তিনি মনে করতেন আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করতে পারব। মানুষকে প্রতারণা করা হচ্ছে একটি উপায়, আপনি যা চান তার জন্য অন্যদের ব্যবহার করা। এটি কোনো নৈতিক মূলনীতি হতে পারেনা। যদি সবাই সবার সাথে প্রতারণা করে সব বিশ্বাসই ভেঙে পড়বে। কেউ তাহলে অন্যজন যা-কিছু বলছে তা কখনোই বিশ্বাস করবে না।

কান্টের ব্যবহৃত আরেকটি উদাহরণের কথা ধরুন: কল্পনা করুন যে আপনি পুরোপুরিভাবে সবকিছু হারিয়েছেন। ব্যাংক আপনাকে কোনো টাকা ধার দেবেনা, আপনার এমন কিছু নেই যে আপনি বিক্রি করতে পারবেন। আপনি যদি বাসার ভাড়া না দিতে পারেন তাহলে আপনাকে রাস্তায় নামতে হবে। আপনি এই সমস্যার একটি সমাধান ভেবে বের করলেন। আপনি একটি বন্ধুর কাছে যাবেন, এবং তার কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করবেন। আপনি তাকে প্রতিজ্ঞা করলেন যে, তার টাকা আপনি সময়মতো ফেরত দেবেন, এমনকি যখন আপনি জানেন আপনি সেটি করতে পারবেন না। এটাই আপনার শেষ ভরসা। বাড়ি ভাড়া দেবার জন্য এছাড়া আর কোনো উপায় আপনার হাতে নেই। এটা কি গ্রহণযোগ্য কাজ হবে নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে? কান্ট প্রস্তাব করেন, টাকা ফেরত না-দেবার উদ্দেশ্য আগে থেকেই ভেবে কোনো বন্ধুর কাছ থেকে ধার করা অবশ্যই অনৈতিক একটি কাজ। যুক্তি আমাদের সেটি প্রদর্শন করতে পারে। সবার জন্য বিষয়টি খুবই অদ্ভুত হবে যদি তারা টাকা ফেরত দেবে বলে প্রতিজ্ঞা করে টাকা ধার করে, এমনকি যখন তারা জানে সেটি তারা পারবেনা। এটা, আবার সেই সর্বজনীনভাবে প্রযোজ্য একটি ম্যাক্সিম। সেই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করুন, ‘কী হবে যদি সবাই সেটি করে? যদি সবাই মিথ্যা প্রতিজ্ঞা করে এমনভাবে, যে প্রতিজ্ঞাগুলো পুরোপুরিভাবে মূল্যহীন।’ যদি এটা সবার জন্য সঠিক না হয়ে থাকে, এটি আপনার জন্যও সঠিক না। আপনার এমন কিছু করা উচিত হবে না। এটি মিথ্যা হবে।

কোটা সঠিক আর কোন্‌টা ভুল এভাবে চিন্তা করার উপায়ের মূল ভিত্তি সরল যুক্তিপ্রক্রিয়া আবেগ নয়, এবং সেকারণে কান্ট অ্যারিস্টোটল থেকে খুবই ভিন্ন। অ্যারিস্টোটলের জন্যে, সত্যিকারের সদগুণসম্পন্ন কোনো মানুষের সবসময়ই সঠিক অনুভূতি থাকে এবং যার ফলে সঠিক কাজটি করেন। কান্টের মতে আবেগ আর অনুভূতি বিষয়টিকে সংশয়াচ্ছন্ন করে তোলে, বিষয়টি আরো কঠিন করে ফেলে বোঝার জন্য কেউ কি সত্যিকারভাবে সঠিক কাজটি করছে, নাকি মনে হচ্ছে সে সঠিক কাজ করছে। অথবা আরেকটি ইতিবাচকভাবে যদি বলা হয়, কান্ট যুক্তিসম্পন্ন প্রতিটি মানুষের কাছে নৈতিকতাকে প্রাপ্তিসাধ্য একটি বিষয় হিসাবে প্রস্তাব করেছেন, তারা যথেষ্ট সৌভাগ্যপূর্ণ হোক বা না হোক সেই অনুভূতিগুলো (সহমর্মিতা) ধারণ করার জন্য যা তাদের উত্তম কাজ করতে প্ররোচিত করে। প্রথাগত ধর্মীয় অনুরোধ বা উপদেশ আর খোশামোদ ছাড়াই মানুষ কীভাবে ভালো এবং দয়ালু হতে পারে সেই উপায়গুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলেন দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট।

যখন বাল্টিক সাগরের তীরে কনিগসবার্গ (Königsberg) শহরে ১৭২৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তখন কনিগসবার্গ ছিল প্রাশা (Prussia) সাম্রাজ্যের অংশ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই এটি রুশদের দখলে (বর্তমানে যার নাম কালিনিনগ্রাদ – Kaliningrad)। খুব সীমিত আয়ের পরিবার ছিল কান্টের, তাঁর বাবা ছিলেন ঘোড়ার স্যাডল বা জিন-নির্মাতা। কখনোই তাদের পরিবারে বাহুল্য ছিল না, বিষয়টি নিয়ে কোনো আক্ষেপও ছিল না কান্টের, বরং পরিমিত জীবনকে আনন্দের সাথে মেনে নিয়েছিলেন। কান্টের বয়স যখন মধ্য-পঞ্চাশ, কেবল তখনই তিনি পূর্ণ বেতনসহ অধ্যাপক হবার সুযোগ পেয়েছিলেন, আর এই সময়টিতে কিছুটা আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য তাঁর জীবনে এসেছিল। তাঁর পরিবারের সবাই ছিলেন গভীরভাবে ধার্মিক এবং ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর। পরবর্তী জীবনে কান্ট যদিও কোনো ধরনের প্রথাগত ধর্মে বিশ্বাস ধরে রাখেননি, তবে তিনি খুবই সচেতন ছিলেন, ধর্ম কীভাবে তাঁর পিতামাতাকে সহায়তা করেছিল আর্থিক দৈন্যদশা ও তাদের অস্তিত্বের দুঃখকষ্টগুলো মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে, এবং কীভাবে ধর্ম উপযোগী হতে পারে সমাজ এবং সামাজিক সংসক্তি প্রতিপালন করার ক্ষেত্রে।

কান্ট শারীরিকভাবে দুর্বল, ছোটখাটো গড়নের মানুষ ছিলেন, যাকে সুদর্শন বলা যাবেনা কোনোভাবেই। কিন্তু খুবই সামাজিক ছিলেন, এবং অতিরিক্ত মাত্রায় মানুষের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করার জন্যে তার সহকর্মীরা প্রায়শই তাঁর সমালোচনা করতেন। যখন, অবশেষে, তার নিজের ক্ষমতা হয়েছিল অন্যদের নিমন্ত্রণ করার জন্যে, তিনি কথোপকথনের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম বেঁধে দিয়েছিলেন। রাতের খাবারের শুরুতে আমন্ত্রিতরা তাদের নিজেদের মধ্যে সম্প্রতি কী ঘটেছে সে- বিষয়ে তথ্য আদানপ্রদান করবেন, এরপর একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব থাকবে ভাবনাচিন্তা করার,যখন আমন্ত্রিতরা চেষ্টা করবেন এইসব বিষয়গুলো থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাছাই করতে, এবং পরিশেষে একটি পর্ব থাকবে আনন্দ-ফুর্তি করার জন্যে, যেন সবাই খোশমেজাজে বাড়ি ফিরতে পারে। আশি বছর বয়সে ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে, কনিগসবার্গে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর দীর্ঘ জীবনে এই শহরটির বাইরে সময় কাটানোর কোনো তাগিদ তিনি প্রায় কখনোই অনুভব করেননি।

কান্ট লেখালেখি করেছিলেন ইতিহাসের একটি কৌতূহলোদ্দীপক পর্বে, যাকে আমরা এখন চিহ্নিত করি এনলাইটেনমেন্ট পর্ব হিসাবে। ১৭৮৪ সালে প্রকাশিত What is Enlightenment শীর্ষক একটি প্রবন্ধে কান্ট প্রস্তাব করেছিলেন তাঁর যুগের শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ক্রমবর্ধিষ্ণু ধর্মনিরপেক্ষতা। বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরে, কান্ট খ্রিস্টধর্মের উপর ক্রমশ কমতে থাকা বিশ্বাসকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যবহারিক স্তরে, তিনি বিশ্বাসের এই অপসৃয়মান তায় শঙ্কিতও হয়েছিলেন। মানুষের চরিত্রের ব্যাপারে তিনি ছিলেন নৈরাশ্যবাদী, তিনি বিশ্বাস করতেন প্রকৃতিগতভাবেই মানুষের দুর্নীতি করার সম্ভাবনাই অনেকবেশি। এই সচেতনতাবোধটি তাকে পরিচালিত করেছিল তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যে বরাবর : যুক্তির কর্তৃত্ব, বা মানববুদ্ধিমত্তা দিয়ে ধর্মীয় কর্তৃত্বকে প্রতিস্থাপন করার ইচ্ছা। তার এই সুবিশাল লক্ষ্য পূরণে তিনি প্রচেষ্টা করেছিলেন সমীহ-জাগানো শিরোনামে ধারাবাহিক কিছু বিখ্যাত বই প্রকাশ করার মাধ্যমে: The Critique of Pure Reason (১৭৮১), Prolegomena to Any Future Metaphysics (১৭৮৩), The Groundwork of the Metaphysics of Morals (১৭৮৫), The Critique of Practical Reason (১৭৮৮), The Critique of Judgment (১৭৯৩)।

ধর্ম প্রসঙ্গে লেখা Religion within the Bounds of Reason Alone (১৭৯৩) বইটিতে কান্ট যুক্তি প্রদর্শন করেন, যদিও ঐতিহাসিক ধর্মগুলো তাদের বিশ্বাসের বিষয়বস্তুতে ভ্রান্ত, তবে তারা নৈতিক আচরণ নিশ্চিত করার গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তার সাথে নিজেদের যুক্ত করেছিলেন, যা এখনও চলমান। এবং এই প্রসঙ্গেই প্রথম কান্ট তাঁর কিছু দার্শনিক ধারণায় পৌঁছেছিলেন, যার জন্য হয়তো তিনি এখনও সবচেয়ে বিখ্যাত। তিনি যার নাম দিয়েছিলেন Categorical Imperative (জার্মান ভাষায় kategorischer Imperativ), শুনতে অদ্ভুত এই শব্দটি প্রথম আবির্ভূত হয়েছিল তার Groundwork ofthe Metaphysics of Morals: Act only according to that maxim by which you can at the same time will that it should become a universal law—অর্থাৎ শুধুমাত্র সেই নীতি মেনে আচরণ করুন, এবং যে নীতি আপনি আশা করবেন সবাই মেনে চলবে বিশ্বজনীন নীতি হিসাবে। এই বাক্যটি দিয়ে কান্ট আসলে কী বোঝাতে চাইছেন? এটি আসলে বহুদিন ধরে প্রচলিত একটি ধারণারই পোশাকি আনুষ্ঠানিক রূপে প্রকাশ, এমন কিছু যা আমরা পাই প্রায় সব প্রধান ধর্মগুলোয়। কান্ট এখানে কোনো একটি কাজের বা আচরণের নৈতিকতা নিরীক্ষা করার জন্য একটি সুবিধাজনক উপায় উপস্থাপন করেছিলেন: অর্থাৎ আপনি যে কাজ বা আচরণ করছেন, কী হবে যদি কাজটি সবাই করে সাধারণভাবে এবং আপনি যদি সেই কাজ বা আচরণের শিকার হন। হয়তো অফিসের আলমারি থেকে কাগজের প্যাড চুরি করতে প্রলোভিত হতে পারেন, মনে হতে পারে খুব সামান্যই তো কাজ। কিন্তু যদি সবাই যদি এই কাজই করে, তাহলে অফিসের আলমারি তো বটেই সমাজেও অনেক পাহারাদারের প্রয়োজন পড়বে। যেমন, যদি আপনি আপনার সঙ্গিনী/সঙ্গীর অজান্তে অন্য কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন, আপনি হয়তো ভাবতে পারেন অসুবিধা কী। কিন্তু কান্টের ক্যাটেগরিকাল ইমপেরাটিভ এর বিরুদ্ধে এসে দাঁড়াবে, কারণ আপনি এমন কিছু করার মাধ্যমে সেই ধারণাটাকে মেনে নিচ্ছেন যে, আপনার সঙ্গিনী বা সঙ্গী যদি আপনাকে না বলে একইভাবে অন্য কারো সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে সেটাও ঠিক আছে। একইভাবে যদি আপনি কারো কাছ থেকে কিছু চুরি করেন বা কাউকে প্রতারণা করছেন এবং মনে করেন ‘বেশ তো আমি বেশ চালাক মানুষ’ আর কেউ তো জানছে না আমি চুরি করছি, আপনার কাছে হয়তো ব্যাপারটা ঠিকই মনে হচ্ছে, কিন্তু কান্টের ক্যাটেগরিকাল ইমপেরাটিভ এখানে যা বলছে তাহলো, আপনি মেনে নিচ্ছেন যে কেউ যদি আপনার সাথে একই কাজ করে তাহলে সেটাও ঠিক আছে।

কান্টের নৈতিক দর্শনের কেন্দ্রে আছে এই ক্যাটেগরিকাল ইমপেরাটিভ, বেশকিছু ব্যাখ্যা বা নির্দেশিকা তিনি প্রস্তাব করেছিলেন তার এই তত্ত্বটিকে বোঝাতে, তিনি মনে করেন, এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করা তার সব প্রস্তাবই আসলে একই কথা বলছে। দুটো গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব আমাদের জানা উচিত: যাকে আমরা বলতে পারি সর্বজনীন আইনের সূত্র। কান্টের ব্যাখ্যায় যে-কোনো একটি কাজ কতটা নৈতিক সেটি আমরা কীভাবে বুঝব, তার জন্য এই বাক্যটি হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। ধরুন আপনি কোনো একটি কাজ করবেন কি করবেন না সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার চেষ্টা করছেন, ধরুন সেই কাজটি হচ্ছে ‘ক’, সেক্ষেত্রে আমাকে নিচের ধাপগুলো অতিক্রম করতে হবে:

১. কাজটির একটি মূলনীতি নির্ণয় করুনঃ এর মানে আপনি যদি কাজটি করেন তাহলে কোন্ সাধারণ নীতি আপনি অনুসরণ করবেন। যেমন আমি যদি ‘খ’ ধরনের কোনো পরিস্থিতিতে পড়ি তাহলে আমি ‘ক’ কাজটি করব, যেমন, যখন আমার পানি পিপাসা লাগবে, এবং যদি পানি পাওয়া যায় আমি পানি পান করব অথবা এমন কোনো পরিস্থিতি যখন আমার টাকার প্রয়োজন এবং আমি জানি যে টাকাটা ফেরত দিতে পারব না, আমি মিথ্যা প্রতিজ্ঞা করব যে আমি টাকা পরিশোধ করে দেব।

২. এই মূলনীতিটিকে সর্বজনীন মূলনীতি হিসাবে ভাবুন : এর মানে মূলনীতিটি এমনভাবে নির্ণয় করতে হবে, এটি শুধুমাত্র আপনার ব্যক্তিগত মূলনীতি না বরং সেটি হবে এমন একটি নীতি যা সবার জন্য প্রযোজ্য। যেমন, সবাই যখন ‘খ’ধরনের কোনো পরিস্থিতিতে পড়ে, তারা ‘ক’ কাজটি করবে, যেমন, যখন কারো পানি পিপাসা লাগবে, এবং যদি পানি পাওয়া যায় সে পানি পান করবে অথবা এমন কোনো পরিস্থিতিতে যখন কারো টাকার প্রয়োজন এবং সে জানে যে টাকাটা সে ফেরত দিতে পারবে না, সে মিথ্যা প্রতিজ্ঞা করবে টাকাটি পরিশোধ করে দেবে বলে।

৩. এবার নির্ধারণ করুন সর্বজনীন মূলনীতিটি কী একটি সর্বজনীন সূত্র হতে পারে কিনা: এর মানে এটা কি সম্ভব যে সবাই এই মূলনীতির নির্দেশমতো কাজ করবে। আমাদের প্রথম উদাহরণ, পানি খাওয়ার ব্যাপারটি, যেখানে কোনো ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নেই, কিন্তু কান্ট দাবি করেন, দ্বিতীয় যে-পরিস্থিতিটির কথা আমরা উল্লেখ করেছি, সেটি সর্বজনীন কোনো সূত্র হতে পারে না, যদি সবাই মিথ্যা প্রতিজ্ঞা করতে শুরু করে, তাহলে প্রতিজ্ঞা বিষয় বলে কিছুই থাকবে না। আর যদি সর্বজনীন মূলনীতিটি আপনি সর্বজনীন সূত্রে রূপান্তরিত না করতে পারেন, তাহলে আপনার ‘নিখুঁত একটি দায়িত্ব এবং কর্তব্য’ বা ‘পারফেক্ট ডিউটি’ হচ্ছে সেই ধরনের কোনো কাজ করা থেকে বিরত থাকা।

৪. ধরুন এই মূলনীতিটিকে সর্বজনীন সূত্রে রূপান্তরিত করা যেতে পারে, তাহলে আমাদের বাড়তি একটি প্রশ্ন করতে হবে : আমরা কি এমন কোনো মূলনীতিকে সূত্রে রূপান্তরিত করার ইচ্ছা করতে পারি, যেমন, কান্ট মনে করেন, এমন হতে পারে যে আমরা সবাই বিপদে আছ এমন কাউকে সাহায্য করতে অস্বীকার করতে পারি, কিন্তু আমরা আসলে সেটা ইচ্ছা করতে পারি না, কারণ কেউই আমাদের সাহায্য করবে না, যখন আমরা বিপদে পড়ব, যদি এই মূলনীতিটি সর্বজনীন সূত্রে রূপান্তরিত হতে পারে, কিন্তু আপনি কিছুতেই প্ৰত্যাশা করবেন না যে এটি সর্বজনীন সূত্রে পরিণত হোক, তাহলে আপনার একটি ত্রুটিপূর্ণ কর্তব্য বা “ইমপারফেক্ট ডিউটি’ হচ্ছে এমন কোনো কাজ না-করা

কান্ট তার ক্যাটেগরিকাল ইমপেরাটিভকে এমনভাবে প্রস্তাব করেছিলেন যেন সেটি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনে। এটি সুযোগ করে দেয় আমাদের নিজেদের আচরণকে নৈর্ব্যক্তিক এবং অপেক্ষাকৃত কম ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে নিরীক্ষা করার জন্য এবং সেইসাথে এর কিছু সীমাবদ্ধতাকে চিহ্নিত করতে পারি। কান্ট ক্যাটেগরিকাল ইমপেরাটিভ কেন্দ্রীয় ধারণাটিকে আরো বিস্তারিত করেন বাড়তি একটি যুক্তি দিয়ে; তার মতে ক্যাটেগরিকাল ইমপেরাটিভকে অন্য আরেকটি উপায়ে প্রকাশ করা যেতে পারে: Act so as to treat people always as ends in themselves, never as mere means বা সবসময় মানুষের সাথে এমনভাবে আচরণ করুন যেন তারা শুধুমাত্র আপনার উদ্দেশ্য পূরণের কোনো উপায় না হয়। এই বাক্যটি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে কান্টের উদ্দেশ্য ছিল সর্বজনীন ভালোবাসার ব্যাপারে খ্রিস্টীয় নির্দেশটিকে প্রতিস্থাপিত করা; সেই নির্দেশটি হচ্ছে love one’s neighbour বা আপনার প্রতিবেশীকে ভালোবাসুন। ক্যাটেগরিকাল ইমপেরাটিভের এই দ্বিতীয় সূত্রটি যা বলছে তাহলো সবাই, যারা কিনা চিন্তা করতে পারে, যৌক্তিক কোনো সত্তা তারা সবাই আবশ্যিকভাবেই মূল্যবান, শুধুমাত্র আমাদের নিজেদের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য পূরণের কোনো মাধ্যম বা কৌশল না-ভেবে আমাদের সেকারণে উচিত হবে মানুষ হিসাবে মর্যাদা দিয়েই তাদের সাথে আচরণ করা। অন্যভাবে যদি বলা যায়, অন্য মানুষরা গুরুত্বপূর্ণ শুধুমাত্র এই কারণে না তাদের আমরা আমাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ব্যবহার করতে পারি তারা নিজেরাও মানুষ হিসাবে তাদের নিজেদের কারণেই গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল্যবান। কোনো একটি মানুষ end হিসাবে গণ্য করার মানে, তাদেরও নিজেদের জীবন আছে যেখানে তারা সুখি ও পরিপূর্ণতা অর্জন করতে চায়, তারা সুবিচার ও পক্ষপাতিত্বমুক্ত আচরণ পাবার যোগ্য, এমন দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করা।

কান্ট যুক্তি দিয়েছিলেন Categorical Imperative হচ্ছে আমাদের যৌক্তিক সত্তারই কণ্ঠস্বর, এটাই আমরা সবাই সত্যিকারভাবে বিশ্বাস করি যখন আমরা যৌক্তিকভাবে চিন্তা করি। এটি আমাদের নিজেদের বুদ্ধিমত্তা প্রদত্ত নিয়ম। কান্ট তার Categorical Imperative নিয়ে ভাবনাগুলো সম্প্রসারিত করেন রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও। তিনি বিশ্বাস করতেন যে-কোনো সরকারের মূল কর্তব্য হচ্ছে নাগরিকদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। কিন্তু তিনি অনুভব করেছিলেন, স্বাধীনতার প্রচলিত সংজ্ঞার মধ্যে কিছু সমস্যা আছে। স্বাধীনতা অবশ্যই libertarian বা উদারবাদী অর্থে ভাবা উচিত না, অর্থাৎ আমাদের যা ইচ্ছা তাই করার অধিকার অর্থে শব্দটিকে ভাবা যাবেনা। আমরা শুধুমাত্র স্বাধীন যখন আমরা এমনভাবে আচরণ করি যেখানে আমাদের চরিত্রের শ্রেষ্ঠতম বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশিত হয়। যেমনটি তিনি বলেছিলেন, a free will and a will under moral laws are one and the same বা স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি এবং নৈতিক বিধিমালার অধীনে কোনো ইচ্ছাশক্তি একই। সুতরাং স্বাধীনতা মানে এমন নয় যে সমাজে কোনো নিয়ন্ত্ৰণ থাকবে না বা সরকার বলে কিছু থাকবে না। একটি স্বাধীন সমাজ মানে সেই সমাজ না, যা মানুষকে যা মন চায় সেটাই বেশি করে করার সুযোগ করে দেয়। একটি স্বাধীন সমাজ হচ্ছে সেই সমাজ, যা সবাইকে আরো বেশি যৌক্তিক হয়ে ওঠার জন্য সাহায্য করে। একটি ভালো রাষ্ট্র সবার মধ্যে যৌক্তিক অংশগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে, এটি শাসন করে একটি সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য ইচ্ছাশক্তি দ্বারা যার অধীনে সবাই স্বাধীন হবার সুযোগ পায় বা a universally valid will under which everyone can be free, সুতরাং আদর্শগতভাবে সরকার, আমাদের প্রত্যেকের শ্রেষ্ঠতম অংশের বাহ্যিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ মাত্র।

১৭৯৩ সালে কান্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছিলেন সৌন্দর্য এবং শিল্পকলা নিয়ে: The Critique of Judgment; মনে হতে পারে মূলত নীতিশাস্ত্ৰ আর রাজনীতি নিয়ে ভাবনারত এই দার্শনিক খানিকটা ভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু কান্ট বিশ্বাস করতেন শিল্পকলা ও সৌন্দর্য সম্বন্ধে তাঁর ধারণাগুলোও তাঁর পুরো দর্শনেরই ভিত্তি। কান্ট ভাবতেন জীবন মূলত আমাদের তীব্রতম আবেগ আর আমাদের চরিত্রের শ্রেষ্ঠতম অংশের মল্লযুদ্ধ, কর্তব্য আর ভোগাসক্তির টানাপড়েন। কান্ট বিশেষভাবে গোলাপ, আঙুরলতা, আপেল গাছ এবং পাখি পছন্দ করতেন। সৌন্দর্য আমাদের তুষ্ট করে বিশেষ এবং গুরুত্বপূর্ণ উপায়ে। এটি আমাদের চরিত্রের সেরা অংশটির দিকে পরিচালনা করে, তাগিদ দেয় আমাদের বিশুদ্ধতম অংশটিকে লালন করার জন্য। আমাদের জীবনের বহু কিছুর ব্যতিক্রম সৌন্দর্যের প্রতি ভালোবাসা আসলে স্বার্থশূন্য। এটি আমাদের সংকীর্ণ স্বার্থভাবনা থেকে মুক্তি দেয়, কিন্তু মধুর এবং তৃপ্তিদায়ক কোনো উপায়ে, যা কঠোর এবং চাহিদাপূর্ণ নয়। প্রকৃতির সৌন্দর্য চলমান, নীরব তবে নিরন্তরভাবে আমাদের সাধারণ সর্বজনীন সত্তার কথা মনে করিয়ে দেয়। একটি সুন্দর ফুল কোনো ক্লান্ত কৃষক এবং কোনো রাজকুমারের কাছে একইভাবেই আকর্ষণীয়। কোনো পাখির মাধুর্যমণ্ডিত আকাশে ওড়া একজন শিশুর কাছে যেমন সুন্দর তেমনই সুন্দর কোন বিদ্বান পণ্ডিতের কাছেও। কান্টের মতে শিল্পকলা আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক ধারণাগুলোর মূর্ত প্রতীক। এটি দর্শনেরই সম্প্রসারিত রূপ। তিনি মনে করতেন সারাক্ষণই আমাদের সামনে শিল্পকলার উপস্থিতি প্রয়োজন, যেন আমরা এর জীবন্ত উদাহরণ এবং সুআচরণ মনে রাখার মতো প্রতীকের ব্যবহার থেকে উপকৃত হই এবং এভাবেই আমাদের স্বেচ্ছাচারী অংশকে সংযত রাখতে পারি। কান্টের বইগুলো সহজপাঠ্য নয়, কঠিন বিমূর্ত এবং উচ্চমাত্রায় বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু ধারণা উপস্থাপন করেছিলেন, যা আজো প্রয়োজনীয়। তিনি বুঝতে চেয়েছিলেন কীভাবে আমাদের প্রকৃতির আরো উত্তম, আরো যৌক্তিক অংশগুলোকে আরো শক্তিশালী করা যেতে পারে, যেন আমরা আমাদের অন্তর্গত দুর্বলতাগুলো আর স্বার্থপরতাকে নির্ভরযোগ্য কোনো উপায়ে জয় করতে পারি। তিনি যেভাবে বিষয়টি দেখেছিলেন, তিনি চেষ্টা করেছিলেন ধর্ম যা (খুবই ত্রুটিপূর্ণ উপায়ে) সবসময় করার চেষ্টা করে এসেছে তারই একটি সেক্যুলার আর যৌক্তিক সংস্করণ তৈরি করতে; আমাদের ভালো হবার জন্য সাহায্য করতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *