1 of 2

অধ্যায় ১১ : ত্রুটিহীন একটি দ্বীপ – আনসেল্ম ও অ্যাকোয়াইনাস

অধ্যায় ১১ : ত্রুটিহীন একটি দ্বীপ – আনসেল্ম ও অ্যাকোয়াইনাস

ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তার ব্যাপারে আমাদের সবারই একটি ধারণা আছে। আমরা বুঝতে পারি, ঈশ্বর বা God বা এর নানা প্রতিশব্দ আসলে কী বোঝাচ্ছে, এর জন্য আমাদের আবশ্যিকভাবে ঈশ্বরের অহিমত্বে বিশ্বাস করতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কোনো সন্দেহ নেই আপনি ঈশ্বর ধারণা নিয়ে মনে মনে এখন ভাবছেন। ঈশ্বরের আসলে অস্তিত্ব আছে এমন কিছু বলার চেয়ে ঈশ্বরের ধারণা নিয়ে ভাবা মনে হতে পারে খুবই ভিন্ন। আনসেল্ম (১০৩৩- ১১০৯), একজন ইতালীয় যাজক এবং খ্রিস্টধর্মের একজন ধর্মতাত্ত্বিক, পরে যিনি ক্যান্টারবুরির আর্চ বিশপ হয়েছিলেন, তার প্রস্তাবনাটি কিছুটা অপ্রচলিত ধারার ছিল। তার সত্তাতত্ত্বীয় বা অন্টোলজিকাল যুক্তিসহ তিনি দাবি করেছিলেন, যুক্তিযুক্ত ব্যাপারটি হচ্ছে আমাদের যে ঈশ্বর সম্বন্ধে ধারণা আছে এই বাস্তব সত্যটি প্ৰমাণ করছে ঈশ্বরের আসলেই অস্তিত্ব আছে। অন্টোলজিকাল (সত্তাতত্ত্বীয়) যুক্তিগুলো হচ্ছে ঈশ্বরের অস্তিত্বের স্বপক্ষে একটি দার্শনিক আর্গুমেন্ট বা যুক্তি যা দাবি করে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে, আর প্রমাণগুলো এসেছে সেইসব প্রস্তাবনাগুলো থেকে যা বাস্তব পর্যবেক্ষণ থেকে আলাদা কোনো উৎস থেকে এসেছে, যেমন শুধুমাত্র যুক্তি ব্যবহার করার মাধ্যমে। অন্যভাবে বললে, এই যুক্তিগুলোর ভিত্তি হচ্ছে a priori (A priori জ্ঞান হচ্ছে অভিজ্ঞতা থেকে স্বাধীন) ও আবশ্যিক প্রস্তাবনা, যা আগে থেকেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে এমন একটি উপসংহার দিয়ে শুরু করে। আনসেল্ম- এর যুক্তি, যা আমরা তাঁর বই Proslogion এ দেখতে পাই, শুরু হয়েছিল তার প্রস্তাবিত অবিতর্কিত দাবি যে, ঈশ্বর হচ্ছে সেই সত্তা ‘যার চেয়ে আরো বৃহত্তর কোনোকিছুই কল্পনা করা সম্ভব না।’ এটি হচ্ছে অন্যভাবে বলা যে, ঈশ্বর হচ্ছে কল্পনা করা সম্ভব এমন সবচেয়ে শ্রেষ্ঠতম সত্তা, ক্ষমতায়, মহত্ত্বে এবং জ্ঞানে। এর চেয়ে সেরা কিছু কল্পনা করা সম্ভব নয়, যদি সম্ভবও হয় তবে সেই অন্য সত্তাটি হবে ঈশ্বর। ঈশ্বর হচ্ছে সবকিছুর উপরে শ্রেষ্ঠতম সত্তা।

ঈশ্বরের এই সংজ্ঞা বিতর্কিত মনে নাও হতে পারে: যেমন বোয়েথিয়াসও ঈশ্বরকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন একইভাবে। আমাদের মনে, আমরা স্পষ্টভাবেই ঈশ্বরের একটি ধারণা করতে পারি। সেটাও অবিতর্কিত একটি বিষয়। কিন্তু তারপর আনসেল্ম প্রস্তাব করেন আমাদের মনেই শুধু যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব, কিন্তু বাস্তবে যার অস্তিত্ব নেই সে কোনোভাবেই কল্পনা করা সম্ভব এমন কোনো শ্রেষ্ঠতম সত্তা হতে পারেনা। যে ঈশ্বরের সত্যিকারভাবে অস্তিত্ব আছে নিশ্চয়ই সেই ঈশ্বর শ্রেষ্ঠতর সত্তা। এমন ঈশ্বরের অস্তিত্বের সম্ভাবনা থাকতে পারে— এমনকি নিরশ্বরবাদীরাও বিষয়টি সাধারণত মেনে নিয়েছেন। কিন্তু একজন কাল্পনিক ঈশ্বর, অস্তিত্ব আছে এমন কোনো ঈশ্বরের চেয়ে বড় হতে পারেনা। সুতরাং, আনসেল্ম উপসংহার টানেন, ঈশ্বরের ‘অবশ্যই’ অস্তিত্ব আছে, কারণ ঈশ্বরের যে সংজ্ঞা দিয়ে প্রস্তাবনাটি শুরু হয়েছে সেখান থেকে যৌক্তিকভাবে এমন একটি উপসংহারে আসতে পারি। যদি আনসেল্ম সঠিক হয়ে থাকেন, আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে শুধুমাত্র সেই বাস্তব সত্য বা ফ্যাক্ট থেকে যে, ঈশ্বর সম্বন্ধে আমাদের একটি ধারণা আছে। এটা একটি আ প্রাইওরি (A priori) আর্গুমেন্ট (যুক্তি), যে যুক্তি কোনো একটি উপসংহারে পৌঁছাতে পৃথিবীতে কোনো পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভর করে না। এটি একটি লজিকাল আর্গুমেন্ট, যা অবিতর্কিত একটি সূচনাবিন্দু থেকে মনে হয় যেন ঈশ্বরে অস্তিত্ব প্রমাণ করছে।

আনসেল্ম একটি চিত্রশিল্পীর উদাহরণ ব্যবহার করেছিলেন। শিল্পী আঁকার আগে একটি দৃশ্য কল্পনা করেন। একটি পর্যায়ে তিনি যা কল্পনা করেছিলেন সেটি আঁকেন। তাহলে এই চিত্রকর্মটির কল্পনা আর বাস্তবে দুটি ক্ষেত্রেই অস্তিত্ব আছে। কিন্তু এই ধরনের উদাহরণের চেয়ে ঈশ্বরের বিষয়টি ভিন্ন। আনসেল্ম বিশ্বাস করতেন যে, যৌক্তিকভাবেই ঈশ্বরের ধারণা ধারণ করা অসম্ভব যদি ঈশ্বরের আসলেই অস্তিত্ব না থাকে। যদিও আমরা সহজেই কল্পনা করতে পারব যে শিল্পী আসলে কোনো ছবি আঁকেননি, যা তিনি কল্পনা করেছিলেন, সুতরাং সেই চিত্রকর্মটির অস্তিত্ব আছে শুধু তার মনে, বাস্তব পৃথিবীতে না। একমাত্র ঈশ্বরই হচ্ছে এমন কোনো সত্তা: স্ববিরোধিতা করা ছাড়াঅস্তিত্ব নেই এমন আর কিছুর কল্পনা আমরা করতে পারিনা। যদি আমরা সত্যিকারভাবে বুঝতে পারি ঈশ্বর আসলে কী, আমরা অনুধাবন করতে পারব যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব না-থাকাই অসম্ভব।

বেশিরভাগ মানুষ যারা আনসেল্ম-এর ঈশ্বরের অস্তিত্ব ‘প্রমাণ’ করার ধারণাটি অনুধাবণ করতে পেরেছিলেন, তারা সন্দেহ করেছিলেন তিনি যেভাবে উপসংহারে পৌঁছেছেন সেখানে কিছু সন্দেহজনক বিষয় আছে। কোনো-না-কোনোভাবে তার এই যুক্তিটিকে সঠিক বলে অনুভূত হয় না। খুব বেশি মানুষ শুধুমাত্র বিশুদ্ধভাবে এই কারণে ঈশ্বরের অস্তিত্বের উপর বিশ্বাস স্থাপন করেন না। আনসেল্ম প্রত্যুত্তরে খ্রিস্টীয় Psalms বা সামস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দাবি করেন শুধুমাত্র একজন নির্বোধই নাকি পারে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে। তার নিজের জীবদ্দশায় আরেকজন যাজক, গাউনিলো অব মারমোতিয়ের, যদিও আনসেল্ম-এর এই যুক্তি প্রক্রিয়াটির সমালোচনা করেছিলেন। তিনি একটি চিন্তার পরীক্ষা বা থট এক্সপেরিমেন্ট প্রস্তাব করেছিলেন যা আনসেল্ম-এর প্রস্তাবিত ‘বোকার’ অবস্থানটি সমর্থন করে। কল্পনা করুন, মহাসমুদ্রে কোনো জায়গায় একটি দ্বীপ আছে যেখানে কেউ যেতে পারবে না। এই দ্বীপটি অবিশ্বাস্যরকম সমৃদ্ধশালী, নানা বৃক্ষ আর ফুল ও ফলে পরিপূর্ণ এবং এখানকার উদ্ভিদ এবং প্রাণীরাও অকল্পনীয়। এছাড়া এই দ্বীপে কোনো মানুষও বসবাস করেনা, যা এটিকে আরো বেশি নিখুঁত একটি জায়গায় পরিণত করেছে। বাস্তবিকভাবে এটি হচ্ছে কারো পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব এমন সবচেয়ে ত্রুটিহীন একটি দ্বীপ। যদি কেউ বলেন, এই দ্বীপের কোনো অস্তিত্ব নেই, তাহলে তারা সেই পস্তাবটি দ্বারা কী বোঝাতে চাইছেন সেটি বোঝা কিন্তু খুব কঠিন না, আর তাদের এমন ভাবনা অর্থহীনও নয়। কিন্তু ধরুন, তারপর তারা আপনার কাছে দাবি করবে যে এই দ্বীপটির আসলেই অস্তিত্ব আছে কারণ এটি যে-কোনো দ্বীপের চেয়ে বেশি নিখুঁত বা ত্রুটিহীন যা কিনা আপনারা ধারণা করতে পারেন। কিন্তু এটি সবচেয়ে নিখুঁত কোনো দ্বীপ হবে না যদি এটার শুধু অস্তিত্ব থাকে আপনার মনে, সুতরাং অবশ্যই এর অস্তিত্ব আছে বাস্তবতায়। গাউনিলো দেখিয়েছিলেন যে যদি কেউ এই যুক্তি ব্যবহার করে আপনাকে প্ররোচিত করতে চেষ্টা করে এই বলে যে সবচেয়ে নিখুঁত কোনো দ্বীপ আসলেই আছে, আপনি হয়তো ভাববেন এটি হয়তো কোনো তামাশা। আপনি কোনো নিখুঁত দ্বীপকে বাস্ত বে জাদুবলে অস্তিত্বশীল করতে পারবেন না এই পৃথিবীতে শুধুমাত্র সেটি কেমন দেখতে হবে তা কল্পনা করার মাধ্যমে। সেটা আসলেই খুব অদ্ভুত হবে। গাউনিলোর প্রস্তাবনাটি ছিল, আনসেল্ম-এর ঈশ্বরের অস্তিত্বের স্বপক্ষে যুক্তিটি, আদর্শতম নিখুঁত দ্বীপের অস্তিত্ব সংক্রান্ত প্রস্তাবনাটির মতো। আপনি যদি বিশ্বাস না করেন যে, কল্পনা করা সম্ভব এমন কোনো নিখুঁত দ্বীপের অবশ্যই অস্তিত্ব আছে, তাহলে আপনি কেন বিশ্বাস করবেন যে কল্পনা করা সম্ভব সবচেয়ে নিখুঁত কোনো সত্তারও অস্তিত্ব আছে? একই ধরনের যুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে প্রায় সবধরনের জিনিসের অস্তিত্বের ব্যপারে: শুধুমাত্র কোনো নিখুঁত দ্বীপ না, বরং সবচেয়ে নিখুঁত পর্বত, সবেচেয়ে নিখুঁত অট্টালিকা, সবচেয়ে নিখুঁত কোনো বনভূমি। গাউনিলো ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিলেন কিন্তু তিনি ঈশ্বরসংক্রান্ত আনসেল্ম-এর এই যুক্তিগুলোকে অত্যন্ত দুর্বল ভেবেছিলেন। এর উত্তরে আনসেল্ম দাবি করেছিলেন তার এই যুক্তি শুধুমাত্র খাটবে ঈশ্বরের ক্ষেত্রে, কোনো দ্বীপের ক্ষেত্রে না, কারণ ঈশ্বর ছাড়া আমরা আর যা-কিছু কল্পনা করিনা কেন সেগুলো শুধুমাত্র তাদের ধরনের ক্ষেত্রে নিখুঁত হতে পারে, অন্যদিকে ঈশ্বর সবকিছু থেকেই শ্রেষ্ঠতম ত্রুটিহীন সত্তা। আর সে-কারণেই ঈশ্বর হচ্ছে একমাত্র সত্তা যার আবশ্যিকভাবেই অস্তিত্ব থাকতে হবে, একমাত্র যে সত্তা যা অস্তিত্বহীন হতে পারেনা।

এর প্রায় ২০০ বছর পর সুমা থিওলজিকা ( Summa Theologica) নামের একটি দীর্ঘ বইয়ের ছোট একটি অনুচ্ছেদ লিখেছিলেন আরেকজন ইতালীয় ধর্মযাজক, পরে ক্যাথলিক চার্চের সেইন্ট থমাস আকোয়াইনাস (১২২৫-১২৭৪)। সেখানে তিনি মোট পাঁচটি যুক্তির একটি রূপরেখা প্রস্তাব করেছিলেন। এই পাঁচটি প্রস্তাবনার উদ্দেশ্য ছিল ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে সেই বিষয়টি প্রদর্শন করা। বইটির বাকি অংশের তুলনায় এই পাঁচটি উপায় বর্তমানে তাঁর সেই বইটির সবচেয়ে পরিচিত অংশ। এই পাঁচটি প্রস্তাবনার দ্বিতীয়টি ছিল First Cause Argument, একটি যুক্তি,আনসেল্ম-এর বাকি দর্শনের মতোই, নির্ভরশীল ছিল সেই যুক্তিগুলোর উপর যা অ্যারিস্টোটল ব্যবহার করেছিলেন বহুদিন আগে। আনসেল্ম-এর মতোই আকোয়াইনাসও চেয়েছিলেন বিশুদ্ধ যুক্তি ব্যবহার করে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য। First Cause Argument বা প্রথম কারণ যুক্তিটিতে প্রথমেই তার সূচনা বিন্দু হিসাবে কসমস, এই মহাবিশ্বে, অর্থাৎ যা-কিছু আছে সবকিছুরই অস্তি ত্ব আছে এমন একটি প্রস্তাবনা গ্রহণ করে নিয়েছে। আপনার চারপাশে তাকান, কোথা থেকে এই সবকিছু এসেছে? এর সরল উত্তর হচ্ছে প্রতিটি বিষয় যার অস্তি ত্ব আছে, সেটির সেই অস্তিত্বশীল হবার পেছনে এবং এটি যেমন করে গঠন করা হয়েছে, এর জন্যে কোনো-না-কোনো ধরনের কিছু কারণ আছে। একটি ফুটবলের কথা ধরুন। এটি বহু কারণের দ্বারা সৃষ্ট একটি দ্রব্য; এর পরিকল্পনাকারী মানুষ, এটিকে বানানোর জন্যে সেই সব উপাদানগুলো, যা-কিছু এটি তৈরির জন্যে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সরবরাহ করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সেইসব কাঁচামালগুলোর অস্তিত্বশীল হবার কারণটা কী? এবং সেইসব কারণের পিছনের কারণ কী? আপনি পশ্চাৎ অভিমুখে কারণ অনুসন্ধান করতে পারেন, যত খুশি অতীতে। কিন্তু এই একটার-পর-একটা কারণে ও তার পরিণতির ধারাবাহিক শৃঙ্খল কি অনন্তকাল পশ্চাৎ অভিমুখে আমাদের নিয়ে যাবে? আকোয়াইনাস বিশ্বাস করতেন প্রভাব আর পূর্বকারণের এই ধারাবাহিকতা অনন্তকাল চলতে পারেনা, সেই অসীম ক্রমান্বয়ে পূর্ববর্তী মতে ফিরে যাওয়া বা ইনফিনিট রিগ্রেস সম্ভব না। যদি কোনো ইনফিনিট রিগ্রেস সম্ভব হতে পারে তার অর্থ হচ্ছে কখনোই এর একটি প্রথম কারণ ছিল না: যা-কিছু আপনি ভাবছেন প্রথম কারণ হিসাবে, কোনো-না-কোনোকিছু সেটিরও কারণ ছিল এবং সেটিরও কারণ কোনো-না- কোনোকিছু, সুতরাং এটি চলবে অনন্ত অবধি।

কিন্তু আকোয়াইনাস ভাবতেন যৌক্তিকভাবে অবশ্যই এমন কোনো বিন্দু থাকবে যা এই কারণ ও পরিণতির ধারাবাহিক শৃঙ্খলের সবকিছুর সূচনা করবে। তিনি যদি এই বিষয়ে সঠিক হয়ে থাকেন, তাহলে অবশ্যই এমন কিছু থাকবে যা নিজে সেই কারণ আর পরিণতির শৃঙ্খল সূচনা করলেও তার নিজের কোনো পূর্ববর্তী কারণ নেইan uncaused cause, যে কারণের পূর্ববর্তী কোনো কারণ নেই। এই প্রথম কারণটি, তিনি ঘোষণা করেন, অবশ্যই ঈশ্বরই হবেন। ঈশ্বরই হচ্ছে যা- -কিছু আছে সবকিছুরই প্রথম কারণহীন কারণ। এই যুক্তির বিরুদ্ধে পরবর্তীতে বহু দার্শনিকই মতামত ব্যক্ত করেছেন। কেউ কেউ প্রস্তাব করেছেন যে আপনি যদি আকোয়াইনাসের সাথে একমতও হন যে অবশ্যই কোনো পূর্বকারণহীন কারণের অস্তিত্ব আছে, সবকিছু যা শুরু করেছিল, তবে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই বিশ্বাস করার যে এই কারণহীন কারণ বা তার uncaused cause হবেন, ঈশ্বর। কারণহীন প্রথম কারণ হবে চূড়ান্তভাবে শক্তিশালী, কিন্তু তার যুক্তিতে এমন কোনোকিছু নেই যা কিনা প্রস্তাব করছে ধর্ম ঈশ্বরের যে গুণাবলি আছে বলে ধরে নেয়, এই কারণহীণ কারণেরও সেইসব গুণাবলি বিদ্যমান থাকতে হবে। যেমন এধরনের কোনো কারণহীন কারণের চূড়ান্তভাবে ভালো হতে হবেই এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই; এছাড়া তাকে সর্বজ্ঞ হবারও কোনো দরকার নেই। কোনো একটি ব্যক্তিগত ঈশ্বরের বদলে এটি কোনো শক্তির তরঙ্গ হতে পারে। 

আকোয়াইনাসের যুক্তির আরেকটি সম্ভাব্য প্রত্যাখ্যান হচ্ছে যে, এমন কিছু প্রাক-ধারণা গ্রহণ করতে বাধ্যবাধকতা নেই যে পরিণতি ও তার পূর্ববর্তী কারণে ফিরে যাবার এই ইনফিনিট রিগ্রেস অনন্তকালের জন্য চলতে পারেনা। কীভাবে আমরা তা জানব? মহাবিশ্বের প্রতিটি প্রথম কারণের ব্যাপারে আমরা সবসময়ই জিজ্ঞাসা করতে পারি, আর সেটার কারণটাই বা কী? আকোয়াইনাস শুধু ধরে নিয়েছিলেন আমরা এই প্রশ্ন অব্যাহত রাখলে এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছাব যে যখন উত্তর হবে, কিছু না। এটাই তার কারণহীন কারণ। কিন্তু সুস্পষ্ট না এটা কি উত্তম উত্তর কিনা, কোনো কারণ ও পরিণতির সেই ইনফিনিট রিগ্রেসের তুলনায়। 

প্রথমে হয়তো বেশ অদ্ভুত মনে হতে পারে যে আমরা তার কাছ থেকে কিছু শিখতে পারব। আকোয়াইনাস একই সাথে দার্শনিক আর খ্রিস্টীয় সেইন্ট, বলা হয়ে থাকে কোনো একটি তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনায় তিনি শূন্যে ভেসেছিলেন ও কুমারী মাতার দৈবদৃষ্টি লাভ করেছিলেন। কীভাবে স্বর্গীয় দূত বা এঞ্জেলরা কথা বলে বা নড়াচড়া করে সেই বিষয়েও তিনি বেশ গভীরভাবে ভেবেছিলেন। কিন্তু তারপরও এই সময়ে তার সম্বন্ধে আমাদের কিছু জানার দরকার, তিনি হয়তো একটি বিষয়ে নিয়ে আমাদের সাহায্য করতে পারেন যা এখনও আমাদের জন্য বড় একটি সমস্যা : কীভাবে আমরা ধর্ম আর বিজ্ঞানকে সমন্বয় করতে পারি, ধর্মবিশ্বাস আর যুক্তির সমন্বয় করতে পারি। নিজের ধর্মবিশ্বাসকে হারাতে অথবা অন্ধের মতো কোনোকিছু বিশ্বাস করতে অস্বীকার করে মানবজীবনে যুক্তির অবস্থানটি সম্বন্ধে একটি নতুন ভাবনা তিনি প্রস্তাব করেছিলেন। পশ্চিম ইউরোপীয় সভ্যতার আকোয়াইনাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানটি হচ্ছে, শুধু খ্রিস্টান নয়, যে-কোনো মানুষকে তিনি শিখিয়েছিলেন, গভীর সত্যকে অনুধাবন করা সম্ভব যদি মানুষ তাকে দেয়া ঈশ্বরের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উপহারটি ব্যবহার করে, রিজন বা যুক্তি। তিনি খ্রিস্টীয় চিন্তার সেই আবদ্ধ ভাবনাটিকে মুক্ত করেছিলেন : কীভাবে কোনো অখ্রিস্টীয় মানুষ জ্ঞান অর্জন করতে পারে এবং একই সাথে যিশুখ্রিস্টকে নিয়ে যার জানার কোনো আগ্রহ থাকেনা। তিনি বুদ্ধিমত্তাকে বিশ্বজনীন একটি রূপ দিয়েছিলেন, বহু যুগ আর নানা মহাদেশের মানবতার অন্তর্দৃষ্টি আর জ্ঞানের জগৎটি উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন খ্রিস্টীয় জগতে। 

আধুনিক পৃথিবী, যা দাবি করে ভালো ধারণা ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে যে-কোনো জায়গা থেকেই আসতে পারে, তাঁর কাছে গভীরভাবে ঋণী। ইতালিতে ১২২৪ খ্রিস্টাব্দে একটি অভিজাত পরিবারে তাঁর জন্ম হয়েছিল। তিনি নেপলস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছিলেন, সেখানেই তিনি জ্ঞানের একটি উৎসের সংস্পর্শে আসেন যা কেবলই তখন আবিষ্কৃত হয়েছে: প্রাচীন গ্রিক ও রোমান লেখকদের লেখা, যা ইতিপূর্বে খ্রিস্টীয় পণ্ডিতরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। এখানে আকোয়াইনাস একই সাথে ডমিনিকান সন্ন্যাসীদের সংস্পর্শে এসেছিলেন, যারা কোনো মঠে আবদ্ধ না থেকে উন্মুক্ত পৃথিবীতে বাস করা শ্রেয়তর মনে করতেন। পরিবারের অমতে তিনি ডমিনিকান সন্ন্যাসীদের সাথে যুক্ত হোন। তাঁর পরিবারও জোর করে তাকে বন্দি করে রেখেছিল। তিনি পোপকে মরিয়া হয়ে চিঠি লিখেছিলেন তার পরিবারের হাত থেকে মুক্ত করতে সাহায্যের জন্যে। কিন্তু পোপ ব্যস্ত ছিলেন নানা রাজনৈতিক ব্যাপারে, সুতরাং তাকে বেশ কিছুদিন বন্দী থাকতে হয়েছিল, তার পরিবার সন্ন্যাসব্রত ভাঙার নানা চেষ্টা করেও পারেনি। অবশেষে তার পরিবার তাকে মুক্তি দিয়েছিল, তিনি ডমিনিকান সন্ন্যাসীদের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। এরপর তাকে আমরা দেখি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে। খুবই শান্ত শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি ঠিকই, তবে তিনি অত্যন্ত ব্যস্ত লেখক ছিলেন; তিন দশকে প্রায় ২০০টি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ আর বই লিখেছিলেন খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্ব নিয়ে। তার বইয়ের নামগুলোও ছিল সুন্দর, যেমন Summa Theologica বা Summa contra Gentiles; ক্রমেই তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় লেখক ও শিক্ষকে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। নেপলসের কাছে তিনি তার নিজের স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। উনপঞ্চাশ বছর বয়সে ছাত্রদের পড়ানোর সময়ই তিনি মারা যান। ক্যাথলিক চার্চ তাকে সেইন্ট হিসাবে চিহ্নিত করেছিল এবং তিনি এখন সব শিক্ষকদের পৃষ্ঠপোষক সেইন্ট। 

আকোয়াইনাসের একটি বুদ্ধিবৃত্তিক উচ্চাশা ছিল বোঝা যে কীভাবে মানুষ ভালো আর মন্দের পার্থক্যসম্বন্ধে জানে। জ্ঞানের খাতিরে নয়, বরং খ্রিস্টান হিসাবে তিনি জানতে চেয়েছিলেন কীভাবে কেউ নিশ্চিত হতে পারে যে তার কাজ তাকে স্বর্গে নিয়ে যাবে। তিনি জানতেন, বহু গুরুত্বপূর্ণ ধারণা এসেছে খ্রিস্টান নয় এমন মানুষদের লেখা থেকে। যেমন তিনি বিশেষভাবে অ্যারিস্টোটলের ভক্ত ছিলেন, যে মানুষটি গসপেল সম্বন্ধে পুরোপুরি অজ্ঞ ছিলেন। এই সংকটের মোকাবেলা করতে তিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা করেছিলেন ধর্মীয় বিশ্বাস ও যৌক্তিক চিন্তার সামঞ্জস্যপূর্ণতা নিয়ে। বহু মহান দার্শনিকরা ছিলেন প্যাগান (যারা খ্রিস্টান ছিলেন না), তিনি সেটি জানতেন, কিন্তু তাদের প্রজ্ঞা অর্জনের ক্ষেত্রে বিষয়টি কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি, কারণ তিনি প্রস্তাব করেছিলেন এককভাবে যুক্তি পৃথিবী নানা বিষয়ের রহস্যকে উন্মোচন করতে পারে। এটি ব্যাখ্যা করার জন্য তিনি প্রস্তাব করেছিলেন যে মহাবিশ্ব দুই ধরনের আইন মেনে চলে: প্রাকৃতিক আইন এবং স্বর্গীয় আইন। যে আইনগুলো আমরা পৃথিবীতে আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে আবিষ্কার করতে পারি, সেগুলো প্রাকৃতিক আইন, যেমন আমরা জানি কীভাবে আকরিক থেকে লোহা সংগ্রহ করতে হয়, পানি সরবরাহের নালিকা তৈরি করতে হয় বা কোনো ন্যায়ভিত্তিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হয় ইত্যাদি। কিন্তু ধর্মীয় সূত্রে পাওয়া আইনও আছে, চিরন্তন আইন, যা যুক্তির পক্ষে এককভাবে সমাধান করা সম্ভব না। যেমন (তিনি মনে করতেন) আমাদের মৃত্যুর পর দয়াশীল ঈশ্বর আমাদের বিচার করবেন অথবা যিশু একই সাথে মানুষ ও স্বর্গীয়, এই বিষয়গুলো বোঝার জন্য আমাদের পবিত্র বইয়ের ঐশী নির্দেশাবলির উপর ভরসা করতে হবে। কারণ আমরা সেটি পাই আরো উচ্চতর কর্তৃত্ব থেকে, যাকে আমরা বিশ্বাস করি। রোমের দার্শনিক বোয়েথিয়াসকে নিয়ে তার একটি লেখায় তিনি সেই সময়ের প্রধান একটি ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন: তখন বিশ্বাস করা হতো যে খ্রিস্টীয় ঈশ্বরের আলোয় আলোকিত না হলে মানবমন কোনোকিছুই জানতে পারেনা। এই দৃষ্টিভঙ্গিটি দাবি করেছিল যে আমাদের বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সবকিছু এসেছে একটিমাত্র বৈধ সূত্র থেকে: ঈশ্বর। তিনি এর বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়েছিলেন যে, প্রাকৃতিক ক্ষেত্রের কোনো জ্ঞান অর্জন করার জন্য মানবমনকে অবশ্যই ঈশ্বরের আলোয় আলোকিত হতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এই বৈপ্লবিক প্রস্তাবনা প্রাকৃতিক আইনগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা প্ৰদান করেছিল। 

অভিজ্ঞতা আর ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণকে গুরুত্ব দেবার ক্ষেত্রটি তিনি প্রসারিত করেছিলেন। তার চিন্তা ছিল যে বাইবেল এতবেশি গুরুত্বপূর্ণযে এটি যে-কোনো পর্যবেক্ষণকে ঢেকে দিতে পারে। এবং মানুষ এতই মুগ্ধ হবে ঐশী প্রত্যাদেশে যে, তারা পর্যবেক্ষণ শক্তিকে অথবা যা তারা নিজেরাই আবিষ্কার করে, সেটি উপেক্ষা করবে। আকোয়াইনাস যা বলতে চাইছিলেন সেটি হচ্ছে এই দুটি আইনই গুরুত্বপূর্ণ, তারা আবশ্যিকভাবে দ্বন্দ্বে নেই। সমস্যা আসে যখন আমরা যে-কোনো একটিকেই শুধুমাত্র সত্য বলে দাবি করি। আর কোটির উপর গুরুত্ব দিতে হবে সেটি সেই মুহূর্তে বিদ্যমান ভারসাম্যই নির্দেশ করবে। আজও উচ্চতর কর্তৃপক্ষ আর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্যে টানাপড়েন বিদ্যমান। যদিও আজকাল উচ্চতর কোনো কর্তৃপক্ষের ঐশী প্রত্যাদেশ মানে বাইবেল ঘাঁটা নয়, এর মানে সংঘবদ্ধ বিজ্ঞান। এর আধুনিক সংস্করণটি হচ্ছে কোনো ধরনের জ্ঞানকে স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানানো যার স্বপক্ষে পরীক্ষালব্ধ কোনো প্রমাণ, উপাত্ত, গাণিতিক মডেলিং, এবং পিয়ার রিভিউ জার্নাল থেকে আসা তথ্যসূত্র নেই। আজকের সময়ে শিল্পকলা, সাহিত্য আর দর্শন সেই অবস্থানে আছে যা আকোয়াইনাস সংজ্ঞায়িত করেছিল প্রাকৃতিক আইন হিসাবে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে, পর্যবেক্ষণ এবং ব্যক্তিগত চিন্তার মাধ্যমে তারা পৃথিবীকে বোঝার চেষ্টা করেন, তারা কোনো উচ্চতর কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের চিহ্ন বহন করে না (এখন যার অর্থ বিজ্ঞান, বাইবেল নয়)। যেমন যখন বদলেয়ার ঘোষণা করেছিলেন, ‘প্রতিভা হচ্ছে ইচ্ছামতো শৈশবকে মনে করার ক্ষমতা’ তখন কিন্তু তার বিরুদ্ধে অনায়াসে বুদ্ধিবৃত্তিক অসততার অভিযোগ আরোপ করা যেত। এমন কোনো কথা বলার জন্যে তিনি কি গবেষণা করেছেন? তিনি কোনো বিদ্যমান প্রমাণ যাচাই করে দেখেছিলেন (ডায়রি কিংবা জীবনীগ্রন্থ)? গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামকগুলো শনাক্ত করার জন্য তিনি কি জমজদের নিয়ে কোনো গবেষণা করেছেন যাদের একজন প্রতিভাবান আর অন্যজন নয়? 

আকোয়াইনাসের সমসাময়িকরা মোটাদাগে জানতেন প্রাচীন গ্রিক আর রোমানদের কথা, কিন্তু তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এই প্যাগানদের আসলেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলার কিছু নেই, যা কিনা তারা তাদের জন্য প্রয়োজনীয় মনে করতে পারেন। এটা অবশ্যই সেই প্রাচীনদের দোষ নয়, কারণ দুর্ভাগ্যক্রমে তারা যিশুর জন্মের আগেই জন্মেছিলেন। এবং তাদের একটাই গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি, সেটি হচ্ছে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস। এবং একটি সময় এটি এতবড় ত্রুটি ছিল যে-কোনো প্যাগান দার্শনিকের কোনো ধারণাই তারা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেননি। কিন্তু আকোয়াইনাস যুক্তি দিয়েছিলেন যারা কিছু মৌলিক বিষয়ে দিকভ্রান্ত তাদের থেকেও আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। তিনি সেই সময়ের একটি বুদ্ধিবৃত্তিক অহংকারী দৃষ্টিভঙ্গিকে শনাক্ত করেছিলেন। আমাদের প্রবণতা আছে অনেক ধারণাকে বাতিল করে দেয়া এর উৎস বিচার করে। আমরা অনুভব করি প্রায়ই যে ধারণাগুলো আমরা শুনব যদি-না এটি সঠিক জায়গা থেকে আসে। আমরা হয়তো এই সঠিক জায়গাকে এখন বাইবেল হিসাবে ভাবিনা, কিন্তু সেই তাড়নাটি ঠিক একই রকম। সুতরাং আজ লন্ডনের কোনো আধুনিক নিরীশ্বরবাদী হয়তো বিশ্বাস করতে পারবেন না যে সেইন্ট জনের গসপেল থেকে তার কিছু শিক্ষা নেবার আছে; তার মনে বাইবেল, অবশ্যই বহু ভ্রান্তিতে পূর্ণ, পৃথিবীর উৎপত্তি সম্বন্ধে এটি আদিম সেই ভুলগুলো ধারণ করছে, তথাকথিত নানা অলৌকিক কাহিনীতে যা পূর্ণ। মজার ব্যাপার হচ্ছে মধ্যযুগীয় খ্রিস্টানরাও প্রাচীন প্যাগান লেখকদের নিয়ে তেমনই ভাবতেন। 

আকোয়াইনাসের জন্যে মূল বিষয়টি হলো প্রাকৃতিক আইন হচ্ছে স্বৰ্গীয় আইনের অধীনস্থ একটি আইন, এবং স্বাধীন যুক্তি প্রক্রিয়ার দ্বারা এটি সমাধান করা যেতে পারে। তিনি যিশুর একটি নির্দেশের কথা উল্লেখ করেছিলেন, ‘অন্যদের সাথে ঠিক তেমনভাবে আচরণ করুন, যেমন আচরণ আপনি অন্যদের কাছে প্রত্যাশা করেন।’ যিশু হয়তো এই স্মরণীয় ধারণাটিকে বাক্যে বন্দি করেছিলেন, কিন্তু বাস্তবিকভাবে অধিকাংশ সমাজে এটাই নৈতিকতার মূলনীতি। কীভাবে তা সম্ভব হতে পারে? তাঁর মতে এর কারণ প্রাকৃতিক নিয়মগুলো মানুষের কাছে পৌঁছানো বা উন্মোচিত হবার জন্য ঈশ্বরের সরাসরি হস্তক্ষেপ লাগেনা। সতর্কভাবে যুক্তি ব্যবহার করলে আমরা সহজাত অন্তর্দৃষ্টি ব্যবহার করে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য অনুসরণ করতে পারব। তিনি মেনে নিয়েছিলেন কিছু ক্ষেত্রে ঈশ্বর কাজ করে শুধুমাত্র স্বর্গীয় আইনের মাধ্যমে, যা মানুষের যুক্তির সীমানার বাইরে। এবং তাদের ঐশী প্রত্যাদেশ দেন নবী কিংবা ফেরেশতাদের মাধ্যমে। তবে, বেশিরভাগ উপযোগী জ্ঞান আমরা পেতে পারি প্রাকৃতিক নিয়মের জগতে। 

আকোয়াইনাস যখন এমন করে ভাবছিলেন, ইসলামি জগতেও তখন ঠিক একই ধরনের দ্বন্দ্ব চলমান ছিল, বিশ্বাস আর যুক্তির সমন্বয়করণের যুদ্ধ। দীর্ঘ সময় ধরেই স্পেন, মরোক্কো আর মিশরে ইসলামি খিলাফত বিশেষভাবে সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল, কিন্তু ধর্মীয় নেতার ক্রমবর্ধিষ্ণু প্রভাবের কারণে তারা ক্রমশ মতবাদনির্ভর আর নিপীড়নমূলক সমাজে রূপান্তরিত হয়েছিল আকোয়াইনাসের জন্মের সময়। যেমন তারা খুবই হিংস্রতার সাথে আক্রমণ করেছিল ইসলামি দার্শনিক আভেরোয়েসকে (ইবন রুশদ) আকোয়াইনাসের মতো, অ্যারিস্টোটলও গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন আভেরোয়েসকে, এবং তিনিও যুক্তি দিয়েছিলেন ধর্ম আর যুক্তি সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে ঈশ্বরের আক্ষরিক শব্দ থেকে কখনো বিচ্যুত না-হওয়ার দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত খিলাফত নিশ্চিত করেছিল ইবন রুশদের ধারণাগুলো যেন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় ও তাঁর বইগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়। আকোয়াইনাস আভেরোয়েস পড়েছিলেন, দেখেছিলেন তিনিও এই মুসলিম দার্শনিকের মতো একই প্রকল্পে কাজ করছেন। তিনি জানতেন যে মুসলিম জগতে যুক্তি প্রক্রিয়ার প্রতি এই ক্রমশ বাড়তে থাকা চূড়ান্ত অস্বীকৃতি তাদের একসময়ের প্রাণবন্ত বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতিকে ধ্বংস করবে। খ্রিস্টীয় বিশ্বকে একই পরিণতির মুখোমুখি হতে হয়নি, তার আংশিক কারণ আকোয়াইনাসের লেখা। যদিও তিনি গভীরভাবে ধর্মবিশ্বাসী ছিলেন, তারপরও তিনি একটি দার্শনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন যা সংশয় আর উন্মুক্ত অনুসন্ধানের সুযোগ দেয়। তিনি আমাদের মনে করিয়ে দেন, প্রজ্ঞা আসতে পারে নানা উৎস থেকে ৷ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *