1 of 2

অধ্যায় ১৩ : সাধারণের দর্শন – মিশেল দো মনতাইন

অধ্যায় ১৩ : সাধারণের দর্শন – মিশেল দো মনতাইন 

আমরা সাধারণত ভাবি উর্বর মস্তিষ্ক নিয়ে দার্শনিকদের সঙ্গত কারণেই গর্বিত এবং চিন্তা, আত্মবীক্ষণ আর যৌক্তিক বিশ্লেষণের একনিষ্ঠ অনুরাগী হওয়া উচিত। কিন্তু ১৫৩৩ সালে ফ্রান্সে একজন দার্শনিকের জন্ম হয়েছিল যিনি আশাব্যঞ্জকভাবে খানিকটা ভিন্ন ধারণা পোষণ করতেন। মিশেল দো মনতাইন ছিলেন এমন একজন বুদ্ধিজীবী, যিনি তার লেখালেখির জীবন ব্যয় করেছিলেন বুদ্ধিজীবীদের ঔদ্ধত্য আর অহংকারকে আক্রমণ করে। তার শ্রেষ্ঠতম কাজ বা মাস্টারপিস, ‘দি এসেস’ (The Essays) বইটিতে আমরা তাকে সুস্পষ্টভাবে বিজ্ঞ এবং বুদ্ধিদীপ্ত একজন দার্শনিক হিসাবে আবির্ভূত হতে দেখি, কিন্তু সারাক্ষণই যিনি নিরহংকার, নম্র এবং শিক্ষার আত্মাভিমান আর দুরহস্কারের স্বরূপ উদ্ঘাটনে সদা সচেষ্ট। এবং একই সাথে তিনি কৌতুকময়, যেমন, ‘আমরা নির্বোধের মতো কিছু বলেছি বা করেছি সেটা জানা আসলে তেমন কিছু নয়। আমাদের অবশ্যই শিখতে হবে আরো সুবিশাল এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষা: সেটি হচ্ছে আমরা নিরেট বোকা ছাড়া আর কিছু না… পৃথিবীর উচ্চতম সিংহাসনে বসে আছি আমরা ঠিকই, কিন্তু তারপরও আমাদের নিতম্বের উপরে।’ কিংবা, আমরা যেন ভুলে না যাই: ‘রাজা এবং দার্শনিকরাও মল ত্যাগ করেন, এবং হ্যাঁ অবশ্যই নারীরাও তা করেন।’ 

মনতাইন ছিলেন রেনেসাঁর উত্তরসূরি এবং তার সময়ে জনপ্রিয় ও প্রাচীন দার্শনিকরা (গ্রিক ও রোমান) বিশ্বাস করতেন যুক্তি অনুশীলন করার ক্ষমতা আমাদের সুখ এবং মহত্ত্ব নিশ্চিত করতে পারে, অন্য প্রাণীরা যে ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত। যেমন, সিসেরোর মতো দার্শনিকরা দাবি করেছিলেন, যুক্তি এককভাবেই আমাদের সুযোগ করে দেয়, আমাদের তীব্রতম আবেগ, মেজাজ এবং আমাদের শরীরের অদম্য বন্য-কামনাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। যুক্তি অবশ্যই পরিশীলিত ও বাস্তবধর্মী, প্রায় স্বর্গীয়, এই পৃথিবী এবং নিজেদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার জন্যে আমাদেরকে দেয়া হয়েছে এমন একটি বিশেষ উপযোগী কৌশল। কিন্তু মানবযুক্তিকে এইভাবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করার প্রক্রিয়াটি মনতাইনকে ক্ষুব্ধ করেছিল। বহু বিশিষ্ট বিজ্ঞজন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও দার্শনিকদের সাথে সময় কাটানোর অভিজ্ঞতায় তিনি লিখেছিলেন, ‘বাস্তব ও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে, বহু সাধারণ রমণীরা (সিসেরোর চেয়েও) আরো বেশি শান্ত, আরো বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ, নিরূপদ্রব ও স্থির অপরিবর্তনীয় জীবন কাটাচ্ছেন তাদের গ্রামে।’ 

তাঁর বক্তব্য কিন্তু মানুষ আদৌ যুক্তির ব্যবহার করতে পারে না এমন ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে চায়নি। তিনি শুধুমাত্র প্রদর্শন করতে চেয়েছিলেন যে তারা তাদের নিজেদের মস্তিষ্কের ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি অহংকারী আর উদ্ধত। ‘আমাদের জীবন মূলত আংশিক উন্মত্ততা আর আংশিক প্রজ্ঞা দিয়ে তৈরি।’ তিনি লিখেছিলেন, ‘যারা এই বিষয়ে লিখছেন তারা শুধুমাত্র শ্রদ্ধার সাথে নিয়মানুযায়ী অর্ধেকেরও বেশি বিষয় নিয়ে কোনো আলোচনা করেননি।’ আমাদের পাগলামির হয়তো সবচেয়ে সুস্পষ্ট উদাহরণ হলো মানব শরীরের সাথে বাঁচার সংগ্রাম। আমাদের শরীরে দুর্গন্ধ আছে, যন্ত্রণা আছে, চামড়া শিথিল ঝুলে পড়ে, জরায় আক্রান্ত হয়। মনতাইন হয়তো প্রথম এবং সম্ভবত একমাত্র দার্শনিক যিনি যৌন দুর্বলতা ও অক্ষমতা নিয়ে বিস্তারিতভাবে লিখেছিলেন, তার কাছে যা মনে হয়েছিল আমাদের মন কত বেশি উন্মত্ত আর ভঙ্গুর হতে পারে এটি তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। 

মনতাইনের একজন বন্ধু তার প্রিয় রমণীর সাথে যৌনমিলনে অক্ষম হয়ে পড়েছিলেন। মনতাইন তার পুরুষাঙ্গকে দোষ দেননি: ‘সত্যিকারের অক্ষমতা ছাড়া, আপনি আর কখনো অক্ষম হবেন না যদি আপনি কাজটি একবার করতে সক্ষম হয়ে থাকেন।’ সমস্যাটি মনে, সেই পীড়াদায়ক ধারণা যে শরীরের উপর আমাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে, এবং এই সাধারণ চিত্র থেকে বিচ্যুতি সেই মানুষটিকে অক্ষম করে ফেলেছিল। সমাধান হচ্ছে সেই চিত্রটাকে আবার নতুন করে আঁকা। যৌনমিলনের সময় পুরুষাঙ্গের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানোকে একটি নির্দোষ সম্ভাবনা হিসাবে গ্রহণ করার মাধ্যমে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটা এড়ানো সম্ভব হতে পারে, যা আক্রান্ত পুরুষরা পরবর্তীতে আবিষ্কার করেন। কোনো রমণীর সাথে বিছানায়, তিনি প্রস্তাব করেছিলেন, সবার বলতে শেখা উচিত যে, আগে থেকেই স্বীকার করে নেয়া ভালো, এমন কোনো একটি অসুখে সে আক্রান্ত, এবং বিষয়টি নিয়ে উন্মুক্তভাবে কথা বলে সে তার মনে জমে থাকা নানা ধরনের চাপকে মুক্ত করতে পারে। এই সমস্যাটিকে প্রত্যাশিত হিসাবে মেনে নেবার মাধ্যমে, এই সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে তার অনুভূতি হ্রাস পায়, যা তার উপর অপেক্ষাকৃত কম চাপ প্রয়োগ করে। মনতাইনের সরল স্বীকারোক্তি পাঠকদের নিজেদের আত্মাকে নিপীড়ন করা মানসিক চাপটিকে মোকাবেলা করতে সাহায্য করে। যে পুরুষ তার সঙ্গিনীর সাথে ব্যর্থ হয় এবং অস্ফুট কিছু ক্ষমা প্রার্থনা ছাড়া যার আর কিছুই বলার ছিলনা, সে তার শক্তিকে পুনরুদ্ধার করতে পারে, তার দুশ্চিন্তাকে প্রশমিত করতে পারে মেনে নিয়ে যে তার এই অক্ষমতা আরো বিস্তৃত নানা ধরনের যৌন-ব্যর্থতার বহু উদাহরণের সমতূল্য, যেমন সেটি দুর্লভ কোনো ঘটনা না তেমনি খুব বেশি অদ্ভুতও কিছু না। মনতাইন যেমন জানতেন এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির কথা, এক রমণীর সাথে মিলনের সময় যিনি তার লিঙ্গের দৃঢ়তা রক্ষা করতে পারেননি দেখে, বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন, তার পুরুষাঙ্গটি কেটে তিনি সেই রমণীকে পাঠিয়েছিলেন তার ‘অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত’ করার জন্য। মনতাইন এই ধরনের কোনো আচরণের বিপরীতে প্রস্তাব করেন যে: ‘যদি (যুগল) তারা প্রস্তুত না থাকেন, তাদের তাড়াহুড়া করার চেষ্টাও করা উচিত না, প্রথম প্রত্যাখ্যানের হতাশায় নিরন্তর দুর্দশাগ্রস্থ হবার চেয়ে বরং উত্তম, উপযুক্ত মুহূর্তের জন্যে অপেক্ষা করা। কোনো পুরুষ যে-কিনা প্রত্যাখ্যানের শিকার হয়েছেন, তার উচিত হবে সুস্থিরভাবে পরিস্থিতি যাচাই করা এবং নানা কৌতুককর আর সরস মন্তব্যের একটি মুখবন্ধ রচনা করা; তার উচিত হবে না একগুঁয়ে হয়ে চিরকালের জন্য নিজেকে অক্ষম প্রমাণ করার চেষ্টা অব্যাহত রাখা।’ 

তাঁর নানা কাজেই মনতাইন বায়ুত্যাগ, পুরুষাঙ্গ, মলত্যাগ ইত্যাদি নানা বিষয়কে গ্রহণ করেছেন চিন্তাভাবনা করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে। যেমন তিনি তার পাঠকদের বলেছিলেন, তিনি শৌচাগারে বসে থাকার সময় নীরবতা পছন্দ করেন। সব ‘প্রাকৃতিক কর্মকাণ্ডগুলোর মধ্যে, এই কাজটি হচ্ছে একটি, যখন আমি কোনো ধরনের বিরক্তি সহ্য করতে প্রস্তুত নই।’ প্রাচীন দার্শনিকরা প্রস্তাব করেছিলেন যে, কোনো শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির জীবনকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে আমাদের নিজেদের জীবন গড়ে তোলা উচিত। সাধারণত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি বলতে তারা দার্শনিকদের বোঝাতেন। খ্রিস্টীয় চিন্তাধারায় এই জীবনের আদর্শ হবার জায়গাটি প্রতিস্থাপিত করেন যিশুখ্রিস্ট। কারো জীবনের মতো করে জীবন গড়ে তোলার বিষয়টি আকর্ষণীয়, এটি প্রস্তাব করছে যে আমাকে কাউকে খুঁজে বের করতে হবে আমাদের পথ দেখানো ও সেই পথ আলোকিত করার জন্যে। কিন্তু চারপাশে কী ধরনের প্রতিকৃতি আছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা অন্য কারো জীবনে সুন্দর জীবনের যে প্রমাণগুলো খুঁজি, আমরা আমাদের জীবনের ভিতরে শুধু সেই বিষয়গুলোর দিকেই নজর দিই। কিন্তু অন্যরা যে বিষয়ে নীরব বা যে অভিজ্ঞতাগুলো শুধুমাত্র লজ্জার, সেই বিষয়গুলো আমাদের চিরকালই অজানা থেকে যায়। মনতাইন এখানেই আমাদের জন্যে উৎসাহব্যঞ্জক ছিলেন, কারণ তিনি আমাদের যে জীবনের কথা বলেন, তা শনাক্তযোগ্যভাবেই আমাদের জীবনের মতো এবং তারপরও আমাদের অনুপ্রাণিত করে, খুবই নিবিড় একটি মানবিক আদর্শ। 

মনতাইনের দিনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুবই মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ছিল, আমাদের এই যুগের মতোই। মনতাইন অসাধারণ পণ্ডিত ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি পুঁথিগতবিদ্যার আচার রীতি নির্ভর গোঁড়ামি ঘৃণা করতেন। তিনি শুধু কাজে আসবে এমন কিছু শিখতে চাইতেন এবং অবিশ্রান্তভাবেই আক্রমণ করে গেছেন অ্যাকাডেমিয়াকে তাদের বাস্তব-বিবর্জিত অবস্থানের জন্য: ‘যদি মানুষ বিজ্ঞ হতো, সে তাহলে জীবনে এর উপযোগিতা ও উপযুক্ততা বিচার করত কোনোকিছুর সত্যিকার মূল্য পরিমাপ করার লক্ষ্যে।’ তিনি বলতেন, ‘শুধুমাত্র যা-কিছু আমাদের ভিতরে উত্তম অনুভূতির জন্ম দেয়, সেগুলো বোঝার হয়তো মূল্য আছে’। মনতাইন বহুক্ষেত্রেই সামাজিক মর্যাদাহীনদের প্রতি অবজ্ঞা এবং দাম্ভিকতা লক্ষ করেছিলেন এবং নিরন্তরভাবেই তিনি চেষ্টা করেছিলেন তাদের পৃথিবীর বাস্তবতায় নামিয়ে আনতে। তিনি মনে করিয়ে দেন যে ‘যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের প্রতিরক্ষাব্যূহের কোনো শূন্যস্থান খুঁজে ঝটিকা আক্রমণ, কোনো দূতাবাসের কর্মকাণ্ড পরিচালনা, কোনো জাতি শাসন করা সবকিছুই অতি উজ্জ্বল মাহাত্ম্যপূর্ণ কাজ। কিন্তু গালি দেয়া, হাসা, ক্রয়বিক্রয়করা, ভালোবাসা, ঘৃণা করা, নিজের ঘরে সবার এবং আপনার নিজের সাথে শান্তিপূর্ণ আর সঠিকভাবে বসবাস করা, কখনোই অলসতা না করা, নিজের কাছে মিথ্যা না বলা, এই কাজগুলো এমন কিছু যা আরো আসাধারণ, আরো বেশি দুর্লভ, আরো বেশি দুরূহ। মানুষ যা-কিছু বলুক-নাকেন এইসব বিচ্ছিন্ন অগোচরে থাকা জীবনগুলো যারা টিকে থাকে সেভাবে, সেখানে কর্তব্যগুলোও নিদেনপক্ষে ঐসব অন্য জীবনের কর্তব্যগুলোর মতোই কঠিন আর দৃঢ় হবে।’ 

একই সুরে মনতাইন সেইসব বইগুলোকে ব্যঙ্গ করেছিলেন যেগুলো দুর্বোধ্য। তিনি তার পাঠকদের কাছে স্বীকার করেছিলেন যে প্লেটো পড়তে তিনি ক্লান্তবোধ করেন এবং তিনি বই পড়ে শুধুমাত্র আনন্দ লাভ করতে চান। ‘আমি যে কোনো কিছুর জন্য আমার মস্তিস্ককে নিপীড়ন করতে প্রস্তুত না, এমনকি শেখার খাতিরেও না, সেটি যত মূল্যবান হোক না কেন। বই থেকে আমি নিজেকে আনন্দ দিতে চাই সম্মানজনকভাবে সময় কাটানোর মাধ্যমে…যদি কোনো কঠিন অনুচ্ছেদের মুখোমুখি হই পড়ার সময় আমি কখনোই দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে সময় অপচয় করিনা, একবার অথবা দুবার চেষ্টা করার পর, আমি বোঝার চেষ্টা পরিত্যাগ করি, যদি কোনো বই আমাকে ক্লান্ত করে ফেলে, আমি আরেকটা বই পড়ার চেষ্টা করি।’ অবোধ্য দার্শনিকদের সমালোচনায় তিনি বেশ ক্ষুরধার মন্তব্য ব্যবহার করেছিলেন : ‘দুর্বোধ্যতা হচ্ছে সেই পয়সা যা বিজ্ঞজনরা জাদুর মাধ্যমে শূন্য থেকে পাঠকদের সামনে হাজির করেন, যেন তাদের জ্ঞানের দাম্ভিকতা সেখানে প্রকাশ না পায় এবং মানুষের নির্বুদ্ধিতা যা মূল্য পরিশোধ হিসাবে গ্রহণ করতে উদগ্রীব।’ মনতাইন লক্ষ করেছিলেন কীভাবে পাণ্ডিত্যপূর্ণ সংস্কৃতি আমাদের সবাইকে বাধ্য করেছে ‘আমাদের নিজের মন সম্বন্ধে অধ্যয়ন না করে অন্যদের বই পড়ার জন্য’। অথচ, তিনি বলেছিলেন, “আমরা প্রত্যেকেই, নিজেদের যতটা ভাবি তারচেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধ।’ আমাদের সবার পক্ষেই প্রজ্ঞাপূর্ণ কোনো ধারণায় পৌঁছানো সম্ভব হবে, যদি আমরা নিজেদের সেই কাজে উপযুক্ত না, কারণ আমাদের বয়স দুই হাজার বছর হয়নি, প্লেটো সংলাপের বিষয়ে আগ্রহী নই এবং তথাকথিত সাধারণ জীবন যাপন করছি, এমন ভাবনা মন থেকে দূর করতে পারি। ‘আপনি খুব সাধারণ ব্যক্তিগত জীবনে পুরো নৈতিক দর্শন যুক্ত করতে পারবেন, ঠিক যেভাবে আরো সমৃদ্ধশালী কোনো জীবনের সাথে যুক্ত করা যায় ৷ 

এসবকিছুই জানান দেয় যে মনতাইন প্রচুর তথ্য সরবরাহ করেছিলেন যে কত সাধারণ হতে পারে নিজের জীবন, যেমন তিনি আমাদের বলতে চেয়েছিলেন যে, তিনি আপেল পছন্দ করেন না, ‘একমাত্র তরমুজ ছাড়া আর কোনো ফল আমার তেমন প্রিয় না।’ আর মূলার সাথে তার সম্পর্ক বেশ জটিল, ‘আমি প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম মূলা খেলে আমার কোনো সমস্যা হয়না, তারপর সমস্যা হলো, এখন আবার সমস্যা হচ্ছে না।’ সেই সময়ে তুলনায় অনেক অগ্রসরভাবেই দাঁতের যত্ন নিতেন, ‘আমার দাঁতগুলো… সবসময়ই অতিমাত্রায় ভালো; শৈশব থেকেই আমার রুমাল দিয়ে দাঁত মাজতে শিখেছি, ঘুম থেকে ওঠার পর, খাওয়ার আগে ও পরে।’ তিনি খুব দ্রুত খেতেন, ‘দ্রুত খাবার জন্য আমি প্রায়শই আমার জিহ্বায় কামড় দিই এবং কখনো আমার আঙুলেও’। এবং মুখ মুছতে পছন্দ করতেন, ‘কোনো টেবিলক্লথ ছাড়া আমি অনায়াসে খেতে বসতে পারি, কিন্তু পরিষ্কার ন্যাপকিন ছাড়া খেতে আমি খুব অস্বস্তি বোধ করি। আমার মনে একটা খেদ আছে, আমাদের রাজাদের শুরু করা খাবারের প্রতিটি কোর্সের সাথে যেমন প্লেট বদলানো হয় তেমনি ন্যাপকিন বদলানোর প্রথাটা আমরা অব্যাহত রাখতে পারিনি।’ ছোটখাটো ঘটনা হয়তো, কিন্তু প্রতীকীভাবে আমাদের মনে করিয়ে দেয় এই বইটির পিছনের একজন চিন্তাশীল ‘আমি’ আছেন, এবং নৈতিক দর্শন অতীতে এসেছে, এবং আবারো আসতে পারে, খুব সাধারণ ফল খেতে ভালোবাসে এমন আত্মার কাছ থেকে। 

হতাশ হবার কোনো প্রয়োজন নেই, যদি বাইরে থেকে আমরা দেখতে কোনোভাবে তাদের মতো না হই যারা অতীতের চিন্তাশীল দার্শনিক ছিলেন। মনতাইনের নতুন করে আঁকা, যথেষ্টভাবে পূর্ণ, প্রায়-যৌক্তিক মানবের প্রতিকৃতিতে, কোনো গ্রিক ভাষা না-জানা, বায়ু ত্যাগ করা, খাবার পরপরই মতপরিবর্তন করা, বই পড়তে গিয়ে অধৈর্য হওয়া, মাঝে মাঝে যৌন-অক্ষমতায় আক্রান্ত হওয়া আর প্রাচীন দার্শনিকদের নাম না-জানা অবশ্যই সম্ভব। একটি সৎ, শুদ্ধ সাধারণ জীবন যা জ্ঞানান্বেষণ করে তা কখনো পাগলামি হতে পারেনা, এটাই যথেষ্ট বড় অর্জন। 

মনতাইন এখনও সেরা, সহজে পাঠযোগ্য দার্শনিকদের একজন, যার সাথে আমরাও বুদ্ধিজীবী ও বহুধরনের দাম্ভিকতা নিয়ে হাসতে পারি। আবদ্ধ, অপার্থিব, সামাজিক মর্যাদার তোষণকারী ষোড়শ শতাব্দীর বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরে তিনি তাজা হাওয়ার শ্বাস নিয়ে এসেছিলেন। এবং যেহেতু দুঃখজনকভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো আগের মতোই আছে, তিনি তাই এখনও অনুপ্রেরণা আর সান্ত্বনা জোগাচ্ছেন আমাদের সবাইকে, যারা নিয়মিতভাবে নিপীড়িত হই তথাকথিত বুদ্ধিমান মানুষদের আচারসর্বস্বতা আর ঔদ্ধত্য দ্বারা। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *