1 of 2

অধ্যায় ৩০ : জীবনের বিসর্জন – সোরেন কিয়ের্কেগার্ড

অধ্যায় ৩০ : জীবনের বিসর্জন – সোরেন কিয়ের্কেগার্ড

ঈশ্বরের কাছ থেকে আব্রাহাম একটি বার্তা পেয়েছিলেন। সত্যিকারভাবেই ভয়ংকর ছিল সেই বার্তাটি: একমাত্র পুত্র আইজাককে তার অবশ্যই বিসর্জন দিতে হবে। স্বাভাবিক কারণেই বার্তাটি তার তীব্র মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়েছিল। তিনি তার ছেলেকে ভালোবাসতেন, কিন্তু আবার তিনি খুবই ঈশ্বর-অনুগত মানুষও ছিলেন এবং জানতেন অবশ্যই ঈশ্বরকে মান্য করতে হবে। ওল্ড টেস্টামেন্টে জেনেসিস থেকে এই কাহিনীটিতে আমরা দেখি যে আব্রাহাম তার ছেলেকে একটি পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যান, মাউন্ট মরিয়াহ, তাকে একটি পাথরের বেদির সাথে শক্ত করে বাঁধেন, এবং যখনই তার গলায় ছুরি বসিয়ে জবাই করতে যাবেন ঈশ্বরের সেই নির্দেশ অনুসরণ করে, ঠিক তখনই, একেবারে শেষমুহূর্তে এক ফেরেস্তা এসে হাজির, জবাই বন্ধ করার জন্য যাকে ঈশ্বর পাঠিয়েছেন। অতএব এর পরিবর্তে তিনি একটি বড় ভেড়া কোরবানি করেন, যাকে আশেপাশের কোনো ঝোপ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। ঈশ্বর অবশেষে আব্রাহামের আনুগত্যকে পুরস্কৃত করেন তার ছেলেকে বাঁচার সুযোগ দিয়ে। এই গল্পটিতে একটি বার্তা আছে, এর নৈতিক বাণীটি সাধারণভাবে মনে করা হয় এমন কিছু, “বিশ্বাস হারিও না, ঈশ্বর তোমাকে যা করতে বলছেন, সেটি করো, যা হবে ভালোই হবে।’ মূল বক্তব্যটি হচ্ছে ঈশ্বরের নির্দেশে কোনো সন্দেহ প্রকাশ না-করা। কিন্তু ডেনমার্কে জন্মগ্রহণকারী একজন দার্শনিক, সোরেন কিয়ের্কেগার্ড (১৮১৩-১৮৫৫) প্রস্তাব করেছিলেন: না, বার্তাটি আসলে এত সহজ-সরল না। তাঁর বিখ্যাত Fear and Trembling (১৮৪২) বইয়ে তিনি আব্রাহামের মানসিক অবস্থাটি কল্পনা করার চেষ্টা করেছিলেন, আব্রাহামের মনে সেই সময় কী চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল সেটি কল্পনা করেছিলেন। সেই প্রশ্নগুলো, ভয়, উদ্বেগ, যন্ত্রণা নিয়ে তিনি বাড়ি থেকে তিনদিনের যাত্রা শেষে উপস্থিত হয়েছিলেন সেই পর্বতচূড়ায়, যেখানে তিনি আসলেই বিশ্বাস করেছিলেন তার প্রিয় পুত্র আইজাককে বিসর্জন দিতে যাচ্ছেন।

কিয়ের্কেগার্ড বেশ বিষণ্ন, গভীর নৈরাশ্যবাদী চিন্তায় আচ্ছন্ন, তবে অসাধারণ একজন দার্শনিক ছিলেন ঊনবিংশ শতকের ডেনমার্কে। প্রায় ২২টি বই লিখেছিলেন, তার মধ্যে তিনটি এখনও তাঁকে প্রাসঙ্গিক করে রেখেছে চিন্তার জগতে: Fear and Trembling (১৮৪২), Either / Or (১৮৪৩) এবং The Sickness unto death (১৮৪৯)। কোপেনহেগেনের একটি সচ্ছল পরিবারে তার জন্ম, তিনি ছিলেন এই পরিবারের সাতটি সন্তানের মধ্যে একজন। ছোটবেলা থেকে তিনি মৃত্যুকে দেখেছেন, এবং মৃত্যু বিষয় হিসাবে তার চিন্তা জুড়ে ছিল সারাজীবন। শারীরিকভাবে তিনি বেশ দুর্বল ছিলেন, তাঁর বয়স যখন ২২, তিনি ও তাঁর একজন ভাই ছাড়া বাকি সব ভাইবোনই তখন মৃত। এই বিষয়টি তাকে প্ররোচিত করেছিল পরবর্তী ১৫ বছরে অনেকগুলো বই লিখে শেষ করার উন্মত্ততায়। যেমন ১৮৪৩ সালে একদিনেই তিনি তিনটি বই প্রকাশ করেছিলেন। তিনি কখনোই টাকার জন্য লেখেননি, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল নিজেকে রক্ষা করা, এবং ভাবতেন এর মাধ্যমে মানবতাকেও তিনি রক্ষা করবেন। ৪২ বছর অবধি বেঁচে ছিলেন তিনি। খুব ছোটবেলায় গাছ থেকে পড়ে গিয়ে তিনি তার মেরুদণ্ডে বেশ ব্যাথ্যা পেয়েছিলেন, তারই জটিলতায় তীব্র যন্ত্রণায় তাঁর মৃত্যু হয় (এছাড়াও সাধারণত মনে করা হয় তাঁর যক্ষ্মাও হয়েছিল)। কিয়ের্কেগার্ড অবশ্যই বেশ অদ্ভুত একজন মানুষ ছিলেন, যেখানে তিনি বাস করতেন, সেই কোপেনহেগেনের সমাজে খুব একটা মানানসই ছিলেন না তিনি। প্রতিদিন সকালে এই ক্ষীণকায় ছোটখাটো গড়নের মানুষটিকে দেখা যেত শহরের বিভিন্ন এলাকায় হাঁটছেন এবং তাঁর কোনো সঙ্গীর সাথে তিনি গভীর কথোপকথনে নিমগ্ন। তিনি নিজেকে ডেনিশ সক্রেটিস হিসাবে ভাবতে পছন্দ করতেন। সন্ধ্যাবেলায় তিনি লিখতেন, মোমবাতি দিয়ে ঘেরা একটি টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে। তাঁর একটি স্বভাব ছিল নাটক কিংবা অপেরার মধ্যবিরতিতে গিয়ে হাজির হওয়া, যেন সবাই মনে করেন তিনি বেশ উপভোগ করছেন নাটকটি, অথচ তিনি তখন তার বাসায় ব্যস্ত ছিলেন লেখালেখিতে। লেখক হিসাবে তাঁকে বেশ পরিশ্রমও করতে হয়েছে, কিন্তু ব্যক্তিজীবনে তাঁকে একটি কষ্টকর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল।

তিনি এক তরুণীকে ভালোবেসেছিলেন, রেজিন ওলসেন, এবং তাকে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন এবং রেজিন রাজিও হয়েছিল। কিন্তু পরে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন, কারণ তিনি খুবই বিষণ্নতায় ভোগা একজন মানুষ, এবং খুব বেশিমাত্রায় ধর্মপরায়ণ, তাঁর পক্ষে কাউকে বিয়ে করে মানিয়ে চলা কি সম্ভব হতে পারে? এছাড়াও আরো একটি কারণ ছিল, তিনি মনে করেছিলেন এভাবে তিনি তার ভালোবাসাকে রক্ষা করতে পারবেন আমৃত্যু। হয়তোবা তিনি চেয়েছিলেন তাঁর পারিবারিক নামের মর্যাদা তিনি রাখবেন, কিয়ের্কেগার্ড, তাঁর মাতৃভাষায় (ডেনিশ বা dansk) যার অর্থ সমাধিক্ষেত্র। তিনি রেজিনকে চিঠি লিখেছিলেন যে তিনি তাকে বিয়ে করতে পারবেন না, এবং তার বাগদানের আঙটিও ফেরত পাঠান কিন্তু এমন সিদ্ধান্ত তাকে আদৌ কোনো সুখ দেয়নি, বিষণ্ন সোরেনের বাকি জীবনের বহু রাতই বিনিদ্র কেটেছে, এবং তাঁর নানা লেখালেখি ও প্রত্যক্ষদর্শীদের মারফত আমরা জানি বহু রাত তিনি কেঁদেছেন রেজিনের জন্য। রেজিন, যেহেতু সোরেনকে ইতিমধ্যে কিছুটা চিনতে পেরেছিলেন, ভেঙে পড়লেও তাঁকে ফিরে আসার জন্যে অনেক অনুরোধও করেছিলেন। কিন্তু কিয়ের্কেগার্ড সেই আহ্বানও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সুতরাং আদৌ কিন্তু ঘটনাচক্রে ঘটেনি যে তাঁর সব লেখার মূল বিষয় ছিল কীভাবে বাঁচবেন সেটি নির্বাচন করা এবং আপনার সেই সিদ্ধান্তটি সঠিক কিনা সেটি জানার দুঃসাধ্যতা।

সিদ্ধান্ত নেবার কঠিন বিষয়টি নিয়ে ভাবনা আমরা তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত বইয়ের শিরোনামেই দেখতে পাই: Either/Or; এই বইটি পাঠকদের দুটি বিকল্পের মধ্যে কেবল একটি জীবন বাছাই করার সুযোগ দেয়, হয় আনন্দসন্ধানী এবং সৌন্দর্যপিপাসু জীবন, অথবা প্রথাগত নৈতিকতায় নিয়মসিদ্ধ কোনো জীবন, নান্দনিক আর নৈতিকতার মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়ার সুযোগ। কিন্তু যে মূল বিষয়টিতে তিনি বারবার ফিরে এসেছেন তার লেখায় তাহলো ঈশ্বরে বিশ্বাস। আব্রাহামের গল্পটি ছিল যার কেন্দ্রে। কিয়ের্কেগার্ডের জন্য ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস করা কখনোই খুব সহজ-সরল সিদ্ধান্ত নয়, বরং এটি এমন একটি সিদ্ধান্তযা অনেকটাই অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো, অন্ধবিশ্বাসের মাধ্যমে নেয়া কোনো সিদ্ধান্ত অনেক সময়ই আপনার কী করা উচিত সেই সংক্রান্ত প্রথাগত নৈতিক ধারণা বিরোধী হতে পারে। যদি আব্রাহাম সত্যি তার পুত্রকে হত্যা করতেন, তিনি অবশ্যই নৈতিকভাবে ভুল কাজটি করতেন। প্রতিটি পিতার মৌলিক দায়িত্ব তার নাবালক সন্তানদের সুরক্ষা করা। এবং অবশ্যই সেই সুরক্ষা করার মধ্যে এমন কিছু পড়ে না যে তাকে পাথরের বেদিতে বেঁধে জবাই করতে হবে ধর্মীয় আচার রক্ষায়। ঈশ্বর আব্রাহামকে যা বলেছিলেন তা হলো সেই নৈতিকতাটিকে উপেক্ষা করতে এবং বিশ্বাসের সাথে কাজটি চোখ বন্ধ করে অনুসরণ করতে। বাইবেলে আব্রাহামকে উপস্থাপন করা হয়েছে প্রশংসনীয় অনুকরণযোগ্য একটি চরিত্র হিসাবে, ভালোমন্দের এই সাধারণ বোধটিকে উপেক্ষা করে আইজাককে ঈশ্বরের নির্দেশে বিনা প্রশ্নে হত্যা করতে উদ্যত হবার জন্যে। কিন্তু তিনি কি ভয়ংকর একটি ভুল করতে যাচ্ছিলেন না? কী হতো যদি সেই বার্তাটি আসলে ঈশ্বরের কাছ থেকে না আসত? এটি তার একটি বিভ্রমও হতে পারত, হ্যালুসিনেশন, হয়তো আব্রাহাম মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন এবং তিনি গায়েবি কথা শুনতে পেতেন। কীভাবে তিনি নিশ্চিত হয়েছিলেন বার্তাটির প্রেরক সম্বন্ধে? যদি তিনি আগে থেকেই জানতেন যে ঈশ্বর শেষমুহূর্তে নিশ্চয়ই তার মত বদলাবেন, তার জন্য কাজটি বেশ সহজ হতো। কিন্তু যখন তিনি ছুরি তুলেছেন এবং প্রস্তুত তার সন্তানের রক্তপাত করার জন্য, তিনি তখন আসলেই বিশ্বাস করছিলেন যে তিনি তার সন্তানকে হত্যা করতে যাচ্ছেন। আর সেটাই, ঠিক যেমন করে বাইবেল এই দৃশ্যটি বর্ণনা করেছে, এর মূল বক্তব্য। তার ধর্মবিশ্বাস এত দৃঢ়, কারণ তিনি ঈশ্বরের উপর তার পুরো বিশ্বাস সমর্পণ করেছেন, প্রথাগত কিংবা প্রচলিত নৈতিকতানির্ভর কোনো নীতিমালার তোয়াক্কা না করে, যে সমর্পণ ছাড়া এটি ফেইথ বা ধর্মবিশ্বাসও হতো না। ফেইথ-এর সাথে ঝুঁকি সংশ্লিষ্ট। কিন্তু এছাড়াও এটি অযৌক্তিক, কোনো যুক্তি এর ভিত্তিতে নেই। আব্রাহামের কাহিনীটি দিয়ে কিয়ের্কেগার্ড বোঝাতে চেয়েছিলেন যে কখনো সাধারণ সামাজিক দায়িত্বগুলো, যেমন কোনো বাবার উচিত সবসময় তার সন্তানের সুরক্ষা করা, সবচেয়ে সেরা মূল্যবোধ নয়, ঈশ্বরের আজ্ঞানুবর্তী হবার কর্তব্যটি একজন ভালো পিতা হবার কর্তব্য থেকে বড়, এবং যে-কোনো কর্তব্যের চেয়ে এটি সবচেয়ে বড় কর্তব্য। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে শুধুমাত্র তার পুত্রকে বিসর্জন দেবার কথা বিবেচনা করার জন্যে আমাদের কাছে আব্রাহামকে মনে হতে পারে কঠোর হৃদয় আর অনৈতিক কিন্তু ঈশ্বরের নির্দেশ যেন তাসের টেক্কা, যা সবকিছুকেই হারিয়ে দেয়, ঈশ্বর যা নির্দেশ করে তার অগ্রাধিকার সবচেয়ে বেশি। এরচেয়ে বড় কোনো তাসের দান নেই প্যাকেটে, সুতরাং সেখানে মানবিক নৈতিকতাবোধ আর প্রাসঙ্গিক নয়। কিন্তু তারপরও যে, মানুষটি নৈতিকতাকে পরিত্যাগ করে তার ধর্মবিশ্বাসের জন্য, সে একটি যন্ত্রণাদায়ক সিদ্ধান্ত নেয়, সবকিছু হারাবার ঝুঁকি নেয়, তার সেই কাজ করার মাধ্যমে তার কী উপকার পাবার সম্ভাবনা আছে বা কী ঘটতে পারে সেটি না-জেনেই, বার্তাটি সত্যি ঈশ্বরের কাছ থেকে আসছে কিনা সেটি না-জেনেই তিনি দাবি করেন যে এই পথটি যারা বেছে নেয় তারা পুরোপুরি একা।

কিয়ের্কেগার্ড ধার্মিক খ্রিস্টান ছিলেন, যদিও ডেনিশ চার্চকে তিনি ঘৃণা করতেন এবং তাঁর চারপাশে সব আত্মতুষ্ট খ্রিস্টানদের আচরণ তিনি মেনে নিতে পারেননি। তাঁর মতে, ধর্ম হবে হৃদয়-নিংড়ানো একটি আত্মত্যাগের পথ, চার্চে গান গাওয়ার মতো কোনো সুবিধাবাদী অজুহাত নয়। তিনি মনে করতেন ডেনিশ চার্চ খ্রিস্টধর্মকে বিকৃত করেছে, এবং তারা পুরোপুরিভাবে খ্রিস্টান না। এবং অবাক হবার কারণ নেই, তাঁর এই অবস্থান তাকে বেশি জনপ্রিয় করেনি। সক্রেটিসের মতোই তিনিও বহু মানুষকে রাগিয়ে দিয়েছিলেন যারা তার সমালোচনা কিংবা তির্যক মন্তব্য সহ্য করতে পারেননি। এই অধ্যায়ে যদিও বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে দাবি করা হয়েছে কিয়ের্কেগার্ড কী বিশ্বাস করতেন, কিন্তু তাঁর যে-কোনো একটি বইয়ে তিনি কী বলতে চেয়েছিলেন সেটি ব্যাখ্যা করা খুব সহজ নয়। আর এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়। কারণ তিনি সেই ধরনের লেখক ছিলেন, যিনি আপনাকে আমন্ত্রণ জানাবেন একান্ত নিজস্বভাবে চিন্তা করার জন্যে। কদাচিৎ তিনি তাঁর নিজের নামে লিখেছিলেন, বরং বেশকিছু ছদ্মনাম ব্যবহার করেছিলেন, যেমন তিনি Fear and Trembling লিখেছিলেন Johannes de Silentio বা John of Silence নামে। এর কারণ কিন্তু শুধুমাত্র সেই সত্যটা আড়াল করা না যে কিয়ের্কেগার্ড এই বইগুলো লিখেছিলেন, কারণ বহু মানুষই খুব সহজেই অনুমান করতে পেরেছিলেন এর লেখক কে, সেটি সম্ভবত তিনি চেয়েছিলেন। তাঁর বইয়ের উদ্ভাবিত লেখকরা, বরং, চরিত্রের মতো যারা তাদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পৃথিবীটাকে দেখেছেন। এটি তাঁর কৌশলগুলোর মধ্যে একটি ছিল, যা তিনি ব্যবহার করেছিলেন তাঁর আলোচনার বিষয়গুলো পাঠকদের বোঝাতে এবং পাঠকদের তিনি উৎসাহ দিয়েছিলেন পড়ার সময় সেই লেখার সাথে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট হবার জন্যে। আপনি পৃথিবীটাকে দেখবেন সেই চরিত্রটির চোখে, এবং আপনাকে একা ছেড়ে দেয়া হবে মনস্থির করার জন্য জীবনের নানা দৃষ্টিভঙ্গিগুলোর মূল্য কী তা যাচাই করার জন্যে।

কিয়ের্কেগার্ডের লেখাপড়া অনেকটাই কোনো উপন্যাস পড়ার মতো, কারণ প্রায়শই তিনি কাল্পনিক কাহিনি ব্যবহার করেছেন তাঁর ধারণাগুলোকে একটি রূপ দেবার জন্য। তাঁর Either/Or (১৮৪৩) বইটিতে একজন কাল্পনিক পুস্তকসম্পাদক, ভিক্টর এরেমিতা, পুরোনো ডেস্কের ড্রয়ারে একটি পাণ্ডুলিপি খুঁজে পাবার ঘটনা বর্ণনা করেছিলেন। সেই পাণ্ডুলিপিটি ছিল বইয়ের মূল বিষয়। যেন পাঠকের মনে হয় এটি লিখেছেন দুজন ভিন্ন মানুষ, তিনি তাদের বর্ণনা দিয়েছেন A এবং B হিসাবে। প্রথমজন হচ্ছেন সুখসন্ধানী, যার জীবন আবর্তিত হচ্ছে কীভাবে একঘেয়েমিকে এড়ানো যায় নতুন উত্তেজনাপূর্ণ অভিযান খোঁজার মাধ্যমে। তিনি একটি তরুণীকে প্রেমের ভান করে জয় করার কাহিনি বর্ণনা করেন একটি ডায়রি হিসাবে, যা ছোটগল্পের মতোই পড়তে, এবং কিছুটা অংশে এটি রেজিনের সাথে কিয়ের্কেগার্ডের নিজের কাহিনীর সাথেও মিল আছে। আনন্দসন্ধানী সেই ব্যক্তি যদিও তার ব্যতিক্রম, কেবল নিজের অনুভূতিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। Either/Or-এর দ্বিতীয় পর্বে লেখা হয়েছে যেন একজন বিচারক সেটি লিখেছেন, যিনি জীবনে নৈতিকভাবে বাঁচার উপায়কে সমর্থন করেছেন। প্রথমপর্বের শৈলীতে আমরা A-এর পছন্দ আর আগ্রহের প্রতিফলন দেখতে পাই। শিল্পকলা, অপেরা আর কোনো নারীকে জয় করা নিয়ে ছোট একটি অংশ। মনে হতে পারে যেন লেখক কোনো একটি বিষয়ের উপর তার মনোযোগ বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেননি। দ্বিতীয় অংশে লেখা হয়েছে আরো গম্ভীর আর খানিকটা জটিল ভাব প্রকাশের শৈলীতে যেখানে বিচারকের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন আমরা দেখি।

প্রত্যাখ্যাত রেজিন ওলসেনের জন্য যদি আপনার মন খারাপ হয় তাহলে প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, কিয়ের্কেগার্ডের সাথে তার কঠিন সম্পর্কটি শেষ হবার পর তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তাকে বিয়ে করেছিলেন, বাকি জীবন তিনি বেশ সুখেই ছিলেন। তবে, কিয়ের্কেগার্ড, কখনোই বিয়ে করেননি, এই সম্পর্ক ভাঙার পর তাকে কোনো রমণীর সান্নিধ্যেও দেখা যায়নি। রেজিন আসলেই তার সত্যিকার ভালোবাসা ছিল, এবং তাদের ব্যর্থ সম্পর্কই ছিল তার সংক্ষিপ্ত আর যন্ত্রণাময় জীবনে যা-কিছু তিনি লিখেছিলেন তার প্রায় সবকিছুর মূল। বহু দার্শনিকের মতো কিয়ের্কেগার্ডও তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনে পুরোপুরিভাবে স্বীকৃতি পাননি। মাত্র ৪২ বছর বয়সে তিনি মারা যান। বিংশ শতাব্দীতে তাঁর বই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল অস্তি ত্ববাদী দার্শনিকদের কাছে, যেমন জ্যাঁ-পল সার্ত্র, তিনি বিশেষ করে পূর্বে নির্ধারিত কোনো নীতিমালার অনুপস্থিতিতে কোনোকিছু বাছাই করার উদ্বেগ আর মানসিক যন্ত্রণার বিষয়টিকে নিয়ে ভেবেছিলেন। কিয়ের্কেগার্ডের জন্যে, আত্মগত কোনো দৃষ্টিভঙ্গি, কোনো নির্বাচন করার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

কিয়ের্কেগার্ড তাঁর Either / Or আর Fear and Trembling বইদুটিতে আমাদের যা করতে বলেছিলেন তা হলো সবার আগে আমাদের ঘুম থেকে জেগে উঠতে হবে, সব সান্ত্বনাদায়ক ভাবালুতা ঝেড়ে ফেলে। তিনি পদ্ধতিগতভাবে আধুনিক জীবনের মূল ভিত্তিগুলোকে আক্রমণ করেছিলেন, পরিবারের প্রতি আমাদের বিশ্বাস, আমাদের কাজের উপর আমাদের ভরসা, ভালোবাসার প্রতি আমাদের দুর্বলতা, জীবনের অর্থ আর উদ্দেশ্য আছে আমাদের সেই সাধারণ বোধটি। তার শত্রু ছিল নানারূপের দৃষ্টিকটুভাবে আত্মতৃপ্ত মানুষগুলো, বিশেষ করে ডেনমার্কের নব্য বুর্জোয়া আর প্রতিষ্ঠিত চার্চের সদস্যরা। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যখনই বড় হয়ে উঠেছি, আমি আমার চোখও খুলেছি, সত্যিকারের এই পৃথিবীটাকে দেখেছি, আমি হাসতে শুরু করেছি, আর এখনও সেই হাসি থামেনি। আমি দেখেছি, জীবনের অর্থ মানে কোনো জীবিকা খুঁজে পাওয়া, জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে হাইকোর্টের বিচারপতি হওয়া, ভালোবাসার সবচেয়ে আনন্দ হচ্ছে সচ্ছল কোনো পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করা, আর জ্ঞান হচ্ছে সেটাই যা সংখ্যাগরিষ্ঠরা বলে জ্ঞান, আর তীব্র তাড়না হচ্ছে উঁচুগলায় ভাষণ দেয়া, আর সাহস হচ্ছে দশ ডলারের জরিমানা হবার মতো কোনো কাজ করার জন্য ঝুঁকি নেয়া, আর আন্তরিকতা হচ্ছে রাতের খাবারের পর ‘আপনি স্বাগতম’ বলা। আর ঈশ্বরকে ভয় মানে বছরে একবার কমিনিউন করা। সেটাই আমি দেখেছি আর হেসেছি।’

কিয়ের্কেগার্ড বিশেষভাবে সমালোচনা করেছিলেন ভালোবাসা সম্বন্ধে ঊনবিংশ শতাব্দীর ধারণাটিকে, আবেগময় ভালোবাসার বিয়ের সেই নতুন ধারণাটি, যা কামনার সাথে দূরদর্শিতাকেও যোগ করেছিল, প্রস্তাব করেছিল প্রেমের সব আনন্দই যে-কেউ উপভোগ করতে পারবে এবং একই সাথে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের স্থিতিশীলতাও থাকবে। কিন্তু কিয়ের্কেগার্ড ঠাট্টা করেছিলেন বিয়ের সাথে রোমান্টিক ভালোবাসাকে মিশ্রণ করার ধারণাটি নিয়ে, তিনি মনে করতেন কারো পক্ষেই, আবেগময় ভালোবাসা ও যৌনতাও থাকবে, আবার সন্তান ও স্থিতিশীলতা এবং আটপৌরতাও থাকবে, এমন সম্পর্ক অর্জন করা আসলে সম্ভব নয়। যদিও তিনি দুটোকেই সমীহ করতেন কিন্তু বিশ্বাস করতে পারেননি কেউ একই সাথে দুটোই পেতে পারে কোনো সুবিধাজনক বিয়েতে যা নির্দিষ্ট করে দেয় কোনো রাষ্ট্র ও সমাজ। তাঁর এই বিশ্বাসটির উৎস তার নিজের যন্ত্রণাময় প্রেমকাহিনি। তিনি নিজেই রেজিন ওলসেনের সাথে সম্পর্ক ভেঙে দেন যখন তিনি অনুধাবন করেছিলেন রেজিনের সাথে চিরকাল বসবাস করা বা তার চেষ্টা করার আরেকটি অর্থ হচ্ছে নিজের ভালোবাসাকে হত্যা করা, যে ভালোবাসাই তাকে একদিন রেজিনের কাছে নিয়ে এসেছিল।

কিয়ের্কেগার্ড যেদিকে তাকিয়েছেন তিনি শুধু অসহনীয় অসঙ্গতি আর অসম্ভব সব সিদ্ধান্ত দেখেছেন। এটাই ছিল তার অসাধারণ বই Either/Or বই-এর মূল বিষয়। তিনি লিখেছিলেন, ‘বিয়ে করুন, আপনাকে অনুশোচনা করতে হবে, বিয়ে না করুন তাও আপনাকে অনুশোচনা করতে হবে। বিয়ে করুন বা না করুন, যে- কোনো সিদ্ধান্তেই আপনাকে অনুশোচনা করতে হবে। পৃথিবীর নির্বুদ্ধিতার প্রতি হাসুন, আপনাকে অনুশোচনা করতে হবে;আপনি যদি সেই নির্বুদ্ধিতা নিয়ে বিলাপ করুন, তাও আপনাকে অনুশোচনা করতে হবে। গলায় দড়ি দেন, আপনাকে অনুশোচনা করতে হবে; যদি গলায় দড়ি না দেন তাও আপনাকে অনুশোচনা করতে হবে। আর এটাই, ভদ্রমহোদয়গণ, হলো সব দর্শনের সারকথা।’ হাসবার বিষয়টির উল্লেখ কিন্তু কাকতলীয় কোনো ঘটনা নয়, কিয়ের্কেগার্ড-এর দর্শনের মূল বক্তব্য জীবনের ভয়াবহতার বিরুদ্ধে একমাত্র বুদ্ধিমান প্রতিরোধ কৌশল হচ্ছে, স্পর্ধার সাথে এর দিকে তাকিয়ে হাসা। খুব কম দার্শনিকই হাস্যরসকে এতটা গুরুত্ব দিয়েছেন।

কিয়ের্কেগার্ডকে প্রায়শই বলা হয় দর্শনের একটি বিশেষ আন্দোলনের জনক, Existentialism বা অস্তিত্ববাদ। কারণ তাঁর মধ্যে আমরা সেই ধারণাগুলোকে খুঁজে পাই যা পরবর্তী সময়ের দার্শনিকদের, যেমন সার্ত্র, কামু কিংবা হাইডেগারকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তাঁর যে-বইটি অস্তিত্ববাদী দার্শনিকদের মুগ্ধ করেছিল, সেটি হচ্ছে The Concept of Anxiety, ১৮৪৪ সালে এটি প্রকাশিত হয়েছিল, এখানেই তিনি প্রথমবারের মতো Angest শব্দটি ব্যবহার করেন, যার ইংরেজি প্রতিশব্দ Angest-এর সাথে আমরা এখন পরিচিত। শব্দটি দিয়ে তিনি এমন একটি পরিস্থিতি বোঝাতে চেয়েছিলেন: কোনো একটি সিদ্ধান্ত নেবার জন্যে যখন আমরা বুঝতে পারি আমাদের বেশকিছু বিকল্প আছে আর যেগুলোর মধ্য থেকে যে-কোনো একটি আমরা বাছাই করতে পারি, কিন্তু সেই বাছাই করা স্বাধীনতাটি প্রজ্ঞার সাথে প্রয়োগ করার জন্যে যখন আমাদের বিচারক্ষমতা বা জ্ঞান সবসময়ই অপ্রতুল। যেমন কিয়ের্কেগার্ড বলেছিলেন ‘জীবনকে আমরা বুঝতে পারি পিছন দিক বরাবর তাকিয়ে, সবকিছু ঘটে যাবার পর, অথচ অবশ্যই আমাদের জীবনযাপন করতে হবে সামনের দিকে তাকিয়ে।’ আমাদের অস্তিত্বের এই চিরন্তন টানাপড়েন, মানেদুঃখ সবার জীবনের চিত্রনাট্যেই কমবেশি লেখা আছে। যেমন তিনি লিখেছেন, ‘যে কেউই, যে কিনা বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছেন, তারা বুঝতে পারবেন, আমি সঠিক কথাই বলছি, যখন আমি বলছি, কারো পক্ষেই কখনো সম্ভব নয় চূড়ান্তভাবে, কোনো বোধগম্য উপায়ে পুরোপুরিভাবে সন্তুষ্ট হওয়া, এমনকি তার জীবনে মাত্র আধাঘণ্টার জন্যেও। এই পৃথিবীতে না-কেঁদে কেউই প্রবেশ করেনি, কেউই জিজ্ঞাসা করেনি, কখন আপনি পৃথিবীতে প্রবেশ করতে চান, কেউই জিজ্ঞাসা করবে না কখন আপনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চান, কতটা শূন্য আর অর্থহীন এই জীবন, কাউকে সমাহিত করে, তার উপর তিন কোদাল ভর্তি মাটি ফেলে দিন, এরপর যে ঘোড়াগাড়ি করে এসেছিলেন আবার সেই ঘোড়াগাড়ি করে ফিরে যান, এবং আমরা নিজেদের সান্ত্বনাদিই, এখনও বেঁচে থাকার মতো অনেকটা জীবন বাকি আছে। কিন্তু আসলেই এই সত্তর বছর কতটা দীর্ঘ সময়, কেন আমরা এখনই সেটি শেষ করেদিই না?’

কিন্তু কিয়ের্কেগার্ডের অবশ্য একটি উত্তর ছিল, যা তিনি তার জীবনের শেষদিকের লেখায় বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন, যিশুখ্রিস্ট। যদিও তিনি প্রতিষ্ঠিত ডেনিশ চার্চের খ্রিস্টধর্মকে অপছন্দ করতেন, কিন্তু তিনি গসপেলের সরল সত্যগুলোকে ভালোবাসতেন, যার গল্প শৈশবে তার বাবা তাকে শিখিয়েছিলেন। তার কাছে খ্রিস্টধর্ম হচ্ছে ধর্মের কাছে চূড়ান্ত আত্মসমর্পণ, কৃষকসুলভ সরলতায়। খ্রিস্টের জন্যে এর অনুসারীদের সবসময় মৃত্যুকে বরণ করে নিতে প্রস্তুত থাকতে হবে, পার্থিব সবকিছুর প্রতি মোহ ত্যাগ করতে হবে, পৃথিবীর সব মানুষকে ভালোবাসতে হবে আপন ভাই-বোনদের জন্য। কোনো যুক্তি দিয়ে কিয়ের্কেগার্ড ধর্মের প্রতি তার এই আত্মনিবেদন ব্যাখ্যা করেননি। বরং তিনি প্রস্তাবনা করেছিলেন, একটি নাটকীয় এবং এখন বিখ্যাত, leap of faith (বিশ্বাসের সাথে চোখ বুজে ঝাঁপিয়ে পড়া) পদ্ধতি, যেখানে কোনো অপ্রতুল মনের উচিত হবে না ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার কোনো চেষ্টা করা। যেখানে উচিত হবে ত্রুটিযুক্ত যৌক্তিক চিন্তা করার ক্ষমতাকে নিশ্চুপ করে একটি সম্পূর্ণ সমাধান হিসাবে ঈশ্বরের ধারণাটিকে মেনে নেয়া। তিনি যেমন বলেছিলেন, ‘ধর্মবিশ্বাস মানে নিজেকে হারিয়ে ফেলা আর ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়া।’ মার্ক্সবাদী কমিউনিজমের মতো, মানবজীবনের সমস্যাগুলোর জন্যে কিয়ের্কেগার্ডের সমাধান অনেক কম নির্ভরযোগ্য, যা আমাদের সামগ্রিক অসুস্থতাকে শনাক্ত করা ছাড়া তেমন কৌতূহল বা ভরসার উদ্রেক করেনা। কিন্তু কিয়ের্কেগার্ড আমাদের মনোযোগ দাবি করার যোগ্যতা রাখেন মানবিক পরিস্থিতিটিকে তার সৌন্দর্যময় তিক্ততা আর বিদ্রূপাত্মক দৃষ্টি দিয়ে উপস্থাপন করার কারণে। তিনি হচ্ছেন সেই অল্পকিছু দার্শনিকদের মধ্যে একজন, আমরা যার কাজে বন্ধুর মতো সান্ত্বনা খুঁজে পেতে পারি যদি জীবন আমাদের হতাশ করে। যিনি পুরোপুরিভাবে বুঝতে পেরেছিলেন, ঠিক কোন্ অন্ধকার জায়গায় আমাদের বসবাস, একবার যখন ভাবালুতার বিভ্রমগুলো ঝরে পড়ে, যা এতদিন আমাদের পরিচালিত করেছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *