1 of 2

অধ্যায় ১৪ : নোংরা, পাশবিক এবং সংক্ষিপ্ত – থমাস হবস

অধ্যায় ১৪ : নোংরা, পাশবিক এবং সংক্ষিপ্ত  – থমাস হবস 

ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা একজন রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ছিলেন থমাস হবস (১৫৮৮-১৭৬৯)। তবে তার সম্বন্ধে যা আমরা জানিনা সেটি হচ্ছে তিনি শুরুর দিককার একজন ফিটনেস ফ্যানাটিক ছিলেন, নিজেদের সুস্থ ও শারীরিকভাবে কর্মক্ষম রাখার জন্য যারা সদাব্যস্ত। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনি বহুদূর পথ হাঁটতেন, দ্রুত খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠতেন যতক্ষণ তিনি সহজে শ্বাস নিতে পারেন। আর বাইরে থাকার সময় যদি তাঁর কোনো ভালো ধারণা মাথায় আসত, সেটি সংরক্ষণ করার জন্য হাতলে কলমের কালি রাখার ব্যবস্থাসহ বিশেষ ধরনের একটি লাঠি সাথে রাখতেন। এই লম্বা, লালচে মুখের, হালকা দাড়ি এবং গোঁফসহ উচ্ছল মানুষটি শৈশবে নানা অসুখে ভুগেছিলেন। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় হবসকে আমরা দেখি খুবই স্বাস্থ্যসচেতন ও স্বাস্থ্যবান, যিনি সত্যিকারের টেনিস খেলা অব্যাহত রেখেছিলেন তার বৃদ্ধবয়স অবধি। প্রচুর মাছ খেতেন, সামান্য পান করতেন এবং তার ফুসফুসের অনুশীলন করার জন্য কেউ যেন শুনতে না পায় এমনভাবে বন্ধঘরে গলা ছেড়ে গান গাইতেন এবং অবশ্যই বেশিরভাগ দার্শনিকদের মতো, খুবই সক্রিয় একটি মন ছিল তার। এর ফলাফল হচ্ছে তিনি প্রায় ৯১ বছর বেঁচে ছিলেন, সপ্তদশ শতাব্দীর জন্যে বিষয়টি খুবই বিস্ময়কর, যখন কিনা গড়পড়তা আয়ু ছিল মাত্র পঁয়ত্রিশ। 

বন্ধুভাবাপূর্ণ মানসিকতা সত্ত্বেও হবস, মাকিয়াভেলির মতোই, মানুষ সম্পর্কে বেশ নিচু ধারণা পোষণ করতেন। মৌলিকভাবে আমরা সবাই স্বার্থপর, মৃত্যুভয় আর ব্যক্তিগত লাভের আশায় তাড়িত, এমনটাই তার বিশ্বাস ছিল। আমরা সবাই অন্যদের উপর ক্ষমতা আরোপ বা কর্তৃত্ব স্থাপন করতে চাই, সেটা আমরা বুঝি কিংবা না বুঝি। আপনি যদি হবসের মানবতা সম্বন্ধে ধারণার সাথে একমত না হন তাহলে কেন বাসা থেকে বের হবার সময় আপনি দরজায় তালা লাগান? নিশ্চয়ই আপনি জানেন এর কারণ বহু মানুষ আছে যারা অন্যের জিনিস খুব খুশি মনেই চুরি করতে পারে? কিন্তু আপনি হয়তো যুক্তি দিতে পারেন, শুধুমাত্র কিছু মানুষ স্বার্থপর, হবস তা মনে করতেন না; তিনি বিশ্বাস করতেন হৃদয়ের অন্তস্থলে আমরা সবাই স্বার্থপর এবং শুধুমাত্র আইনের শাসন এবং শাস্তির ভয়ই এধরনের কোনো কাজ করা থেকে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে রাখে। 

তিনি যুক্তি দেন, এর পরিণতিতে, সামাজিক কাঠামো যদি ভেঙে পড়ে কখনো তাহলে আপনাকে সেই পরিস্থিতিতে জীবন কাটাতে হবে, যাকে তিনি বলেছেন state of nature (প্রাকৃতিক অবস্থা), কোনো আইন এবং সেই আইন প্রয়োগ করার মতো কোনো ক্ষমতা ছাড়া একটি অরাজকতার পরিস্থিতি, যেখানে আপনিও, আর সবার মতোই চুরি এবং হত্যা করতে বাধ্য হবেন প্রয়োজন পড়লে। নিদেনপক্ষে আপনাকে সেটা করতেই হবে যদি আপনি বেঁচে থাকতে চান। এমন কোনো পৃথিবীতে যেখানে ব্যবহারযোগ্য সম্পদের দুষ্প্রাপ্যতা আছে, বিশেষ করে যদি বেঁচে থাকার খাদ্য ও পানি অনুসন্ধান করতে যদি আপনাকে সংগ্রাম করতে হয়, তখন অন্যরা আপনাকে হত্যা করে ফেলার বদলে তাদেরকে আগে হত্যা করা আসলেই যুক্তিযুক্ত হবে। হবসের স্মরণীয় বর্ণনায়, ‘সমাজের বাইরে জীবন হবে নিঃসঙ্গ, দরিদ্র, নোংরা, পাশবিক এবং সংক্ষিপ্ত। 

অন্য কারো জমি দখল ও যাকে খুশি তাকে হত্যা প্রতিহত করার রাষ্ট্রের ক্ষমতা যদি কেড়ে নেওয়া হয় তার ফলাফল হবে নিরন্তর যুদ্ধ, যেখানে সবাই সবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। এর চেয়ে খারাপ কোনো পরিস্থিতি কল্পনা করা কঠিন। এই ধরনের আইনহীন পৃথিবীতে, এমনকি সবচেয়ে শক্তিশালীও বেশিদিন নিরাপদে থাকতে পারবে না। আমাদের সবারই ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করতে হবে এবং যখন আমরা ঘুমাই, আমাদের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা প্রবল। এমনকি সবচেয়ে দুর্বলতম কেউ, যদি যথেষ্ট ধূর্ত হয়, সেও সবচেয়ে শক্তিশালীকে ধ্বংস করতে পারবে ৷ 

আপনি হয়তো কল্পনা করতে পারবেন এইভাবে প্রাণ-হারানো এড়ানোর একটি উপায় হচ্ছে বন্ধুদের সাথে জোট বাঁধা। সমস্যা হচ্ছে আপনি নিশ্চিত হতে পারবেন না যে কেউ এমন নির্ভরযোগ্য আছে কিনা। যদি অন্য মানুষ আপনাকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেয়, তাহলে হয়তো কখনো কখনো তাদের নিজেদের স্বার্থ থাকবে সেই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করায়। যে-কোনো ক্রিয়াকর্ম যেখানে সহযোগিতার প্রয়োজন আছে, যেমন বাণিজ্যিকভাবে খাদ্যশস্য উৎপাদন, অথবা নিৰ্মাণ, কোনোকিছুই সম্ভব হবে না ন্যূনতম পর্যায়ের পারস্পরিক কোনো বিশ্বাস ছাড়া। আপনি জানতেও পারবেন না আপনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন, আর যখন জানবেন ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। হয়তো ইতিমধ্যেই আক্ষরিকার্থে আপনার পিঠে কেউ ছুরি বসিয়ে দিয়েছে এবং কেউই থাকবে না আপনার পিঠে যে ছুরি বসিয়েছে তার বিচার করার জন্যে। আপনার শত্রুরা থাকতে পারে সর্বত্র। আপনি আক্রান্ত হবার ভয়েই আপনার সারাজীবন কাটাবেন। খুব আকর্ষণীয় কোনো জীবন সেটি নয়। এর সমাধান হিসাবে হবস যুক্তি দেন, শক্তিশালী ব্যক্তি বা কোনো পার্লামেন্ট বা সংসদকে ক্ষমতায় বসাতে হবে। এবং সেই প্রাকৃতিক পরিস্থিতি বা state of nature-এর মানুষগুলো একটি social contract বা সামাজিক চুক্তিতে আসবে নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের কিছু ভয়ংকর স্বাধীনতা বিসর্জন দেবার জন্যে। তিনি যাকে বলেছিলেন sovereign বা সর্ব্বোচ্চ শাসক, এমন কোনো শাসকছাড়া জীবন মূলত একধরনের নরক। এই শাসককে সেই অধিকার দিতে হবে যেন তিনি আইন-অমান্যকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারেন। 

হবস বিশ্বাস করতেন কিছু সুনির্দিষ্ট প্রাকৃতিক আইন আছে যা আমরা গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করতে পারি, যেমন, আমরা এমন কোনো আচরণ করব না কারো সাথে, যে আচরণ আমরাও চাইব না কেউ আমাদের সাথে করুক। আইনের কোনো মূল্য নেই যদি যথেষ্ট শক্তিশালী কেউ বা কিছু না থাকে, যা-কিনা সবাইকে সেই আইনটি মানতে বাধ্য করে। আইন ছাড়া ও শক্তিশালী আইনের শাসক ছাড়া, প্রাকৃতিক সেই পরিবেশে হিংস্রাবে মৃত্যু হওয়াটাই প্রত্যাশা করতে পারে। শুধুমাত্র একটি সান্ত্বনা থাকবে যে এমন কোনো জীবন হবে খুব সংক্ষিপ্ত। 

‘লেভিয়াথান’ (Leviathan) [১৬৫১ সালে প্রকাশিত], হবসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইটি বিস্তারিতভাবে সেই প্রয়োজনীয় ধাপগুলোকে ব্যাখ্যা করেছিল, যার মাধ্যমে আমরা state of nature-এর সেই দুঃস্বপ্নময় পরিস্থিতি থেকে কীভাবে একটি নিরাপদ সমাজ গড়তে পারি, যেখানে বেঁচে থাকার মতো সহনীয় একটি পরিস্থিতি থাকবে। লেভিয়াথান হচ্ছে বাইবেলে বর্ণিত সুবিশাল এক সামুদ্রিক প্রাণী। হবস এটি ব্যবহার করেছিলেন রাষ্ট্রের বিশাল ক্ষমতার প্রতিভূ হিসাবে। লেভিয়াথান বইটির শুরুতেই একটি ছবিতে হাতে তলোয়ার আর রাজদণ্ড নিয়ে এক পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকা একটি দানবকে আমরা দেখি। এখানে অনেক ছোট ছোট চরিত্রও দেখি, যাদের সবাইকে এককভাবে মানুষ হিসাবে চিহ্নিত করা সম্ভব। শক্তিশালী শাসক ছাড়া হবস বিশ্বাস করতেন সবকিছুই ভেঙে পড়বে এবং সমাজ পঁচে যাবে নৈরাজ্যে, যেখানে মানুষ টিকে থাকার জন্য পারস্পরিক হিংস্র দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়বে। 

সেকারণে state of nature এ থাকা মানুষগুলোর একসাথে কাজ করা ও শান্তিপূর্ণ সমঝোতা খোঁজার খুব ভালো কারণ আছে। এটাই একমাত্র উপায় যার মাধ্যমে তারা নিজেদের সুরক্ষিত করতে পারে। এটি ছাড়া তাদের জীবন হবে অসহনীয়ভাবে ভয়ংকর। হবস মনে করতেন স্বাধীনতার চেয়ে নিরাপত্তা অনেক বেশি জরুরি। মৃত্যুভয় মানুষকে তাড়না করবে সমাজগঠনে। তিনি মনে করতেন তারা একমত হবে বড় ধরনের স্বাধীনতা ত্যাগ করার জন্য যেন তারা পরস্পরের সাথে একটি সামাজিক চুক্তিতে আসতে পারে, যা একটি প্রতিশ্রুতি যে তারা একজন শাসক বা ব্যবস্থাকে অনুমতি দেবেন তাদের উপর আইনের শাসন প্রয়োগ করার জন্য। পারস্পরিক যুদ্ধ করার চেয়ে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে কোনো শক্তিশালী কর্তৃত্ব থাকলে তাদের জন্য তা হবে মঙ্গলকর। 

থমাস হবস আমাদের রাজনীতির সবচেয়ে কণ্টকময় একটি বিষয় নিয়ে উপদেশ দিয়েছিলেন: কোন্ পর্যায় অবধি আমাদের উচিত হবে কোনো শাসকের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা, বিশেষ করে যে শাসকরা আদৌ সুশাসক নয়; কোন্ পর্যায়ে আমাদের উচিত হবে আরো উত্তম কোনো পৃথিবীর জন্য বিপ্লবের সূচনা করা ও সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা। হবসের চিন্তাকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব না একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাথে, যা ঘটেছিল যখন তার বয়স ৬৪, আর ঘটনাটি তাঁকে ও তাঁর পরবর্তী সব চিন্তাগুলোকে প্রভাবিত করেছিল গভীরভাবে (হবস বেঁচে ছিলেন প্রায় ৯১ বছর আর তিনি যা-কিছুর জন্যে আজও স্মরণীয় সেই সবকিছুই তিনি লিখেছিলেন তার বয়স ষাট অতিক্রম করার পরে)। সেই ঘটনাটি ছিল ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধ, একটি ভয়ংকর বিভাজনমূলক, রক্তাক্ত সংঘর্ষ যা এক দশকব্যাপী সারা ইংল্যান্ড জুড়ে অরাজকতার কারণ হয়েছিল। রাজা আর পার্লামেন্টের মধ্যে এই যুদ্ধে উভয়পক্ষে প্রায় দুই লক্ষ প্রাণহানি হয়েছিল। চারিত্রিকভাবে হবস খুবই শান্তি প্রিয় আর সতর্ক মানুষ ছিলেন। তিনি সবধরনের সহিংসতাকে ঘৃণা করতেন। যে কাজের জন্যে মূলত তিনি পরিচিত, লেভিয়াথান, সেটি তার সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট, প্ররোচনামূলক আর সংগঠিত বার্তা ছিল সরকারি কর্তৃত্বকে কেন আমাদের মেনে নেয়া উচিত সেই বিষয়ে, এমনকি যখন সেই সরকার ত্রুটিপূর্ণ, তার যুক্তি ছিল এর মাধ্যমে আমরা বিশৃঙ্খলা আর রক্তপাতের ভয়াবহতা এড়াতে পারি। 

হবসের এই রক্ষণশীলতা বুঝতে আমাদের অনুধাবন করতে হবে যে সপ্তদশ শতকে পশ্চিম-ইউরোপ জুড়ে রাজনৈতিক তাত্ত্বিকরা জিজ্ঞাসা করতে শুরু করেছিলেন, নতুন ধরনের সুস্পষ্ট প্রত্যক্ষতার সাথে, কিসের ভিত্তিতে প্রজাদের উচিত তাদের শাসকের প্রতি অনুগত থাকা। বহু শতাব্দী ধরে, মধ্যযুগে, একটি সাধারণ উত্তর ছিল এই প্রশ্নটির, যা ধারণ করেছিল একটি তত্ত্ব, রাজাদের স্বর্গীয় কর্তৃত্ব বা অধিকার ( দ্য ডিভাইন রাইটস অব কিংস)। এটি খুবই সুস্পষ্ট আর কার্যকরী তত্ত্ব ছিল: যা দাবি করে আর কেউ না, কেবল ঈশ্বরই সব রাজাদের নিয়োগ দিয়ে থাকেন, এবং আমাদের সবার উচিত সেই রাজাদের মান্য করা একটি সুস্পষ্ট কারণে: ঈশ্বর সেটি করতে বলেছেন, আর আপনি যদি একমত না হন, তাহলে তিনি আপনাকে নরকে পাঠাবেন। কিন্তু যুক্তিটি বহু চিন্তাশীল মানুষকে আর আগের মতো প্ররোচিত করতে ব্যর্থ হয়েছিল। যারা যুক্তি দিয়েছিলেন, শাসন করার অধিকার আসলে রাজাদের হাতে নেই, সেটি আছে সাধারণ মানুষদের হাতে, যারা রাজাকে ক্ষমতা দেয়, সেকারণে কেউ রাজার নির্দেশ শুনবে এমন প্রত্যাশা করা উচিত সেই অবধি যতক্ষণ তাদের অবস্থাও ভালো থাকে। এটাই পরিচিত রাষ্ট্রনীতির ‘সোস্যাল কনট্র্যাক্ট তত্ত্ব’ নামে। হবস দেখতে পেরেছিলেন রাজাদের শাসন করার স্বর্গীয় অধিকারের তত্ত্বটি অর্থহীন এবং ক্রমশ এটি মানুষের উপর প্রভাব হারাবে যখন ধর্মীয় আচারের পরিমাণও হ্রাস পাবে। তিনি নিজেই ঈশ্বর অবিশ্বাসী ছিলেন, যদিও ব্যক্তিগত পর্যায়ে। একই সময়ে হবস গভীরভাবে ভীত ছিলেন সোস্যাল কনট্র্যাক্ট তত্ত্বের সম্ভাব্য পরিণতিগুলো নিয়ে, যা মানুষদের অনুপ্রাণিত করতে পারে শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করানোর জন্য যখনই তারা তাদের ভাগ্য নিয়ে অসুখী হবেন। ১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে হোয়াইট হল প্যালেসের সামনে রাজা প্রথম চার্লসের শিরশ্চেদের ঘটনার সাক্ষী ছিলেন হবস আর পরবর্তীতে তার বুদ্ধিবৃত্তিক সব পরিশ্রমের লক্ষ্য ছিল, নিশ্চিত করা এমন আদিম ভয়ানক দৃশ্য যেন আর কখনোই পুনরাবৃত্তি না হয়। 

লেভিয়াথান বইটিতে তিনি বেশকিছু উদ্ভাবনী যুক্তি প্রস্তাবনা করেছিলেন, যা সংযোগ করেছিল সোস্যাল কনট্র্যাক্ট তত্ত্ব আর প্রথাগত কর্তৃত্বে পূর্ণ আনুগত্যের প্রতি সমর্থনের বিষয়টিকে। আর এই যোগসূত্রটা করে তিনি তার পাঠকদের অতীতে নিয়ে গিয়েছিলেন, এমন একটি সময়ে যাকে তিনি বলেছিলেন এ স্টেট অব নেচার (প্রাকৃতিক অবস্থা), যখন কোনো ধরনের রাজা ছিলনা, এবং এখান থেকে তিনি তার পাঠকদের ভাবার সুযোগ দেন কেমন করে সরকার পদ্ধতিগুলোর সূচনা হয়েছিল একেবারে শুরুতে। হবসের যুক্তি ছিল প্রাকৃতিক সেই অবস্থা কখনোই ভালো পরিস্থিতি হতে পারে না, কারণ কোনো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ছাড়া মানুষদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণের উপর ছেড়ে দিলে খুব শীঘ্রই নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ভয়ানক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে, যেখানে জীবন, প্ৰকৃতি যেমন, nasty, brutish and short বা নোংরা, পাশবিক আর সংক্ষিপ্ত। এর পরিণতিতে, ভয়ে আর বিশৃঙ্খলার কারণে মানুষ বাধ্য হয়েছিল সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য। তারা স্বেচ্ছায় সেটি করেছিল, যেমন করে সোস্যাল কনট্র্যাক্ট তত্ত্বের তাত্ত্বিকরা দাবি করেন, কিন্তু সেটি তারা করেছিলেন যথেষ্ট পরিমাণ বাধ্য হয়ে, তারা বাধ্য হয়েছিল শক্তিশালী কর্তৃত্বের কাছে আশ্রয় নিতে, সেকারণে তাদের উচিত, হবস যুক্তি দিয়েছিলেন, পরবর্তীতে সেই কর্তৃত্বের প্রতি অনুগত থাকার বিষয়টি কর্তব্য হিসাবে মনে করা, খুব সামান্য তাদের অভিযোগ করার অধিকার আছে যদি তারা সেটি পছন্দ না করেন। চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী কোনো শাসকের বিরুদ্ধে বা যাকে তিনি লেভিয়াথান বলেছিলেন, প্রতিবাদ করার শুধুমাত্র অধিকার আছে যদি তিনি সরাসরি তাদের হত্যা করার জন্য হুমকি দিয়ে থাকেন। তবে যদি শাসক শুধুমাত্র বিরোধীদের দমন করেন, কড়া কর আরোপ করেন, অর্থনীতিকে পঙ্গু করেন, ভিন্নমতাবলম্বীদের বন্দি করে রাখেন, চূড়ান্তভাবে কোনো কারণই নেই সরকার পরিবর্তন করার দাবি নিয়ে রাস্তায় নামার। যদিও এত অসীম ক্ষমতার অধিকারী কাউকে নিয়ে মানুষ হয়তো অশুভ পরিণতির কথা ভাববে, কিন্তু তার বিপরীতটা, প্রতিটি মানুষের বিরুদ্ধে প্রতিটি মানুষের যুদ্ধ, আরো বেশি ভয়াবহ। তিনি স্বীকার করেছিলেন যে-কোনো একটি শাসক হয়তো আসতে পারেন যার প্রবণতা আছে ক্ষতিকর কিছু করার জন্যে। কিন্তু তিনি মনে করেন জনগণের তারপরও দায়িত্ব আছে তাকে মান্য করা, কারণ মানবীয় কর্মকাণ্ড কখনোই ঝামেলামুক্ত না। কিন্তু এই সমস্যার জন্য দায়ী মানুষরাই, রাজা নয়; কারণ যদি মানুষরা তাদের নিজেদের রাজা ছাড়াই শাসন করতে পারত, তাদের এই শোষকশক্তির কোনো দরকার হতো না। তিনি লিখেছিলেন, ‘যে রাজার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে অভিযোগ করে, সে তার নিজের বিরুদ্ধে আসলে অভিযোগ করে, সেকারণে তার নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই অভিযুক্ত করা উচিত নয়।’ 

হবসের তত্ত্বটি খুব নৈরাশ্যবাদী, সতর্ক এবং বিশেষভাবে সরকারব্যবস্থা নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী নয়। আমাদের আশাবাদী মুহূর্তে, আমরা চাই তিনি ভুল প্রমাণিত হোন। কিন্তু স্পষ্টতই হবসের নাম সবসময়ই প্রাসঙ্গিক থাকবে, আরো নতুন মনে হবে যখনই স্বাধীনতার লক্ষ্যে কোনো বিপ্লব ভয়ংকরভাবে তাদের লক্ষ্যচ্যুত হয়। কোনো অশুভ উদ্দেশ্যে, হবস বিপ্লবের বিরুদ্ধে ছিলেন না, তিনি শুধু বলেছিলেন, যেমন করে তার লেভিয়াথানে তিনি লিখেছিলেন, তিনি তাগিদ অনুভব করেছিলেন: ‘মানুষের চোখের সামনে উপস্থাপন করতে যে সুরক্ষা আর আনুগত্যের মধ্যে একটি পারস্পরিক সম্পর্ক আছে।’ 

স্পষ্টতই হবস খুব বিপজ্জনক সময়ের মধ্যে দিয়ে তার জীবন কাটিয়েছিলেন, এমনকি মাতৃগর্ভেও। তাঁর জন্ম সময়ের আগেই হয়েছিল, কারণ স্পেনীয়রা তাদের যুদ্ধজাহাজ আর্মাদা নিয়ে সম্ভবত ইংল্যান্ড দখল করতে আসছে সেই খবর শোনার পর তাঁর মায়ের প্রসববেদনা উঠেছিল ভয়ে। সৌভাগ্যজনকভাবে তেমন কিছু ঘটেনি। পরবর্তীতে তিনি প্যারিসে পালিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধ এড়াতে, কিন্তু ইংল্যান্ড যে সহজে নৈরাজ্যে পতিত হতে পারে এই শঙ্কা পরবর্তীতে তার সব লেখাকেই প্রভাবিত করেছিল। প্যারিসে বসেই তিনি তার সেরা বই লেভিয়াথান লিখেছিলেন। এটি প্রকাশ হবার কিছুদিন পরই তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। তার সময়ে বহু চিন্তাবিদের মতোই, হবস শুধুমাত্র একজন দার্শনিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন সেই মানুষ যাকে আমরা এখন বলতে পারি রেনেসাঁ-মানব। তার তীব্র আগ্রহ ছিল জ্যামিতি ও বিজ্ঞানেও। তারুণ্যে তিনি সাহিত্য ভালোবাসতেন এবং লিখেছেন, অনুবাদও করেছেন। মধ্যবয়সেই তিনি দর্শনে আগ্রহী হয়েছিলেন। 

তিনি ছিলেন ম্যাটেরিয়ালিস্ট, বিশ্বাস করতেন মানুষ শুধুমাত্র একটি শরীরনির্ভর সত্তা, আত্মা বলে কিছু নেই, আমরা শুধুমাত্র শরীর, আমরা মূলত জটিল যন্ত্র। ঘড়ির যন্ত্রকৌশল ছিল সপ্তদশ শতাব্দীর সবচেয়ে অগ্রসর প্রযুক্তি। হবস বিশ্বাস করতেন যে মাংসপেশি, শরীরের অঙ্গ আসলে ঘড়ির যন্ত্রের সমতুল্য। তিনি প্রায়শই ঘড়ি থেকে রূপক বর্ণনা করেছেন যেমন কর্মের springs এবং wheels যা আমাদের সামনের দিকে নিয়ে যায়। তিনি বিশ্বাস করতেন যে মানব-অস্তিত্বের-সব অংশই, চিন্তাসহ, সবই শারীরিক ভৌত একটি প্রক্রিয়া। তার দর্শনে আত্মার কোনো জায়গা নেই। এটি আধুনিক একটি ধারণা যা বহু বিজ্ঞানীরাও অনুসরণ করেন, কিন্তু তার সময়ে এটি ছিল বৈপ্লবিক। তিনি এমনকি দাবি করেছিলেন ঈশ্বরও এমন কোনো বিশাল ভৌত বস্তু, যদিও কেউ কেউ মনে করেন নিজেকে নিরীশ্বরবাদী হিসাবে ঘোষণা করার এটাই ছিল তাঁর ছদ্মবেশী একটি উপায়। 

হবসের সমালোচকরা মনে করেন, সমাজের সদস্যদের উপর শাসককে তিনি বেশি ক্ষমতা দিয়ে ফেলেছেন, সেই শাসক, রাজা অথবা রানি অথবা সংসদ যাই হোক না কেন। তিনি যে রাষ্ট্রের বর্ণনা দিয়েছিলেন, সেখানে তাদের প্রায় অসীম ক্ষমতা ছিল নাগরিকদের উপর। শান্তি অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত হতে পারে, কারণ হিংস্রভাবে মৃত্যুর ভয় শান্তিরক্ষাকারী ক্ষমতার কাছে নতি স্বীকার করার একটি শক্তিশালী তাড়না। কিন্তু কোনো ব্যক্তি বা এক দল ব্যক্তির উপর এতবেশি ক্ষমতা দেয়া বিপজ্জনক হতে পারে। তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন না, তিনি বিশ্বাস করতেন না যে সাধারণ মানুষদের সেই যোগ্যতা আছে যে তারা তাদের জন্য সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু যদি তিনি জানতেন বিংশ শতাব্দীর একনায়ক শাসকরা কী পরিমাণ হিংস্র ছিলেন, তিনি সম্ভবত তার মতপরিবর্তন করতেন। আত্মার অস্তি ত্ব অস্বীকার করা নিয়ে হবস কুখ্যাত ছিলেন। রেনে দেকার্ত, তার সমসাময়িক, এর বিপরীতটাই বিশ্বাস করতেন, তিনি মনে করতেন মন এবং শরীর, পুরোপুরি আলাদা পরস্পর থেকে। সেকারণেই হবস হয়তো ভাবতেন, দেকার্ত দর্শনের চেয়ে জ্যামিতিতে অনেক ভালো, তার শুধু জ্যামিতি চর্চা করাই উচিত ছিল (পরবর্তী একটি অধ্যায়ে আমরা দেকার্ত সম্বন্ধে জানবো)। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *