1 of 2

অধ্যায় ৪০ : ভাষার সম্মোহন – লুদভিগ ভিটগেনস্টাইন

অধ্যায় ৪০ : ভাষার সম্মোহন – লুদভিগ ভিটগেনস্টাইন

আপনি যদি ১৯৪০-এর দশকে কেমব্রিজে লুদভিগ ভিটগেনস্টাইনের কোনো একটি সেমিনারে নিজেকে আবিষ্কার করতে পারতেন, খুব সহজেই অনুভব করতে পারতেন খুব অদ্ভুত একটি মানুষের উপস্থিতিতে আপনি আছেন। তাঁর সাথে দেখা হয়েছে এমন বেশিরভাগ মানুষই ভাবতেন তিনি প্রতিভাবান। বার্ট্রান্ড রাসেল তাকে বর্ণনা করেছিলেন, ‘আবেগপ্রবণ, জ্ঞানগর্ভ, তীব্র ভাবাবেগপূর্ণ ও প্রাধান্য বিস্তারকারী ব্যক্তিত্ব হিসাবে। এই উজ্জ্বল নীল চোখের ছোটখাটো ভিয়েনিজ (অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহরে তাঁর জন্ম) মানুষটির গাম্ভীর্য সহজেই চোখে পড়ত, দ্রুত পায়চারি করতেন ক্লাসেই, ছাত্রদের প্রশ্ন করতেন, অথবা লক্ষ্য করার মতো দীর্ঘবিরতি নিয়ে নিশ্চুপ থাকতেন আপন মনের ভাবনায়। কেউই সেই সময় তাঁকে বিরক্ত করার সাহস পেত না, তিনি গোছানো কোনো নোট ব্যবহার করতেন না লেকচার দেবার সময় বরং ক্লাসেই সবার সামনে সমস্যাগুলো নিয়ে ভাবতেন, ধারাবাহিক কিছু উদাহরণ ব্যবহার করে মূল বক্তব্যটিকে বের করে আনার চেষ্টা করতেন। তিনি তাঁর ছাত্রদের বলতেন দর্শনের বই পড়ে তারা যেন কোনো সময় নষ্ট না করে। যদি তারা এমন কোনো বই গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে থাকে, তাদের উচিত সেই বইগুলো ছুড়ে ফেলে দিয়ে বরং যে অমীমাংসিত বিষয়গুলো সেই বইগুলো উত্থাপন করেছে সেগুলো নিয়ে আরো গভীরভাবে ভাবতে। অনেক সমস্যারই সৃষ্টি হয় যখন আমরা ঠিকমতো কমিউনিকেট বা সংযোগ করতে পারিনা, কারণ আমরা অন্য মানুষদের খুব স্পষ্টভাবে বোঝাতে পারি না আমরা আসলে কী বলতে চাচ্ছি। আমাদের এই সমস্যাটি নিয়ে ভেবেছিলেন লুদভিগ ভিটগেনস্টাইন ভাষার সমস্যাগুলো নিয়ে তিনি গভীরভাবে ভেবেছিলেন, যিনি চেষ্টা করেছিলেন শব্দ দিয়ে আমাদের সৃষ্ট সমস্যাগুলোর একটি সমাধানের পথ বাতলে দেবার জন্য। সঙ্গবিমুখ নিঃসঙ্গতাপ্রিয় এই মানুষটি কথাবলার সময় তোতলাতেন, বাক্যের মাঝখানে লক্ষ্য করার মতো দীর্ঘবিরতি নিতেন, এবং লোকজনের কথা পছন্দ না করলে, কোনোকিছু না বলে সেখান থেকে দ্রুত বের হয়ে যেতেন। স্পষ্টতই খুব অদ্ভুত এক আদর্শ প্রেক্ষাপট এমন কোনো ব্যক্তির জন্যে, যিনি কিনা তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন কীভাবে মানুষের মধ্যে কমিউনেশন বা যোগাযোগ বা ভাবের আদানপ্রদানে কত সহজে গোলমাল পাকিয়ে যেতে পারে সেই ভাবনায়।

ভিটগেনস্টাইনের জন্ম ১৮৮৯ সালে ভিয়েনায়। ইস্পাত ধনকুবের খুবই বিত্তশালী সংস্কৃতিবান পরিবারের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সন্তান ছিলেন তিনি। তবে তার বাবার ব্যক্তিত্ব ছিল কঠোর এবং একনায়ক সূলভ। লুদভিগের চার ভাইয়ের মধ্যে তিন ভাই আত্মহত্যা করেছিলেন, আর লুদভিগের প্রায়শই সেই আত্মহত্যা করার ভাবনা মনে আসত। তারুণ্যে তাঁর আগ্রহ ছিল প্রকৌশলে, কেমব্রিজে তিনি তাঁর পড়াশুনাও শেষ করেন সে-বিষয়ে। বাবা মারা যাবার পর, তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে বিশাল ধনসম্পত্তির মালিক হন, কিন্তু সব তিনি দান করে দিয়েছিলেন, মূলত তাঁর ইতিমধ্যেই বিত্তশালী আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে। আর সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে সাদামাটা নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করতে তিনি নরওয়ে চলে যান। এরপর ১৯২১ সালে তিনি tractus logico-philosophicus বইটি লিখেছিলেন, ছোটখাটো তবে গভীর চিন্তা- উদ্রেককারী একটি বই। ট্রাকটাস লজিকো-ফিলোসফিকাস বইটি তিনি লিখেছিলেন ক্রমিক নম্বরসহ ধারাবাহিক সংক্ষিপ্ত অনুচ্ছেদ আকারে, পড়লে দর্শন নয় বরং কবিতার মতো মনে হবে। এর মূল বক্তব্য ছিল, নৈতিকতা আর ধর্মসংক্রান্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো আমাদের বোঝার সীমানার বাইরে অবস্থিত, এবং আমরা যদি অর্থবহভাবে এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে না পারি তাহলে আমাদের নীরব থাকা উচিত। বইটিতে যে বড় প্রশ্নটি নিয়ে তিনি ভেবেছিলেন সেটি হচ্ছে : কীভাবে মানুষ পরস্পরের সাথে যোগাযোগ বা ভাবের আদানপ্রদান করতে সক্ষম হয়? আর তার উত্তরটা সেই সময়ে বৈপ্লবিক বলেই অনুভূত হয়েছিল। তিনি দাবি করেছিলেন যে ভাষা কাজ করে আমাদের মধ্যে পৃথিবীতে কোনোকিছু বাস্তবে ঠিক যেমন, তেমন একটি ছবির উদ্রেক করে। তিনি বিষয়টি ভেবেছিলেন প্যারিসের আদালতে একটি মামলা নিয়ে খবরের কাগজে একটি নিবন্ধ পড়ার সময়। সেখানে সফলভাবে কী আসলে ঘটেছিল সেটি বোঝাতে সড়ক দুর্ঘটনার বিস্তারিত খুঁটিনাটি বিষয়গুলো মডেল গাড়ি ও পথচারীদের দিয়ে উপস্থাপন করার ব্যবস্থা করেছিল আদালত, যেন পুরো দৃশ্যটিকে সেখানে প্রতিনিধিত্ব করা যেতে পারে। এটি ভিটগেনস্টাইনের জন্য ছিল একটি ইউরেকা-মুহূর্ত, তার দৃষ্টিতে শব্দ আমাদের বাস্তব কোনো তথ্য বা ফ্যাক্টকে ছবি হিসাবে দেখতে সাহায্য করে। ধরুন বলা হলো, সমুদ্রতীরের নারিকেল গাছ, এটি দ্রুত সেই দৃশ্যের একটি রেখাচিত্র উপস্থাপন করে মডেলের মতো, যা অন্য কোনো ব্যক্তিকে সেই পরিস্থিতি তাদের মনে দেখতে ও বুঝতে সাহায্য করে। আমরা সারাক্ষণই এভাবে নিজেদের মধ্যে ছবি আদানপ্রদান করছি, প্যারিসের সেই আদালত আসলেই সত্যিকারের মডেলের সাহায্য নিয়েছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণে, সেটি হচ্ছে সার্বিকভাবে আমরা খুবই খারাপ অন্যদের মনে খুব ভালো মানের ছবি তৈরি করতে।

যোগাযোগ খুব সহজেই ভুলপথে চলে যেতে পারে, কারণ অন্য মানুষদের মনে, যেমন করে আমরা সাধারণত বলি, আমরা বোঝাতে চাইছি সেটির ভুল একটি ছবি আছে। দুটি মানুষের জন্যে বহু সময় লাগতে পারে খুব মৌলিক বিষয়গুলোর পার্থক্য অনুধাবন করতে। যোগাযোগের সমস্যা সাধারণত শুরু হয়, কারণ আমাদের মনে যথেষ্ট পরিমাণ সুস্পষ্ট আর সঠিক ছবি থাকে না যা আমরা বোঝাতে চাইছি সেটির। আমরা প্রায় অর্থহীন, জট পাকানো, অস্পষ্ট বিষয় উচ্চারণ করি, যা সঙ্গত কারণেই অন্যদের মনে কোথাও প্রবেশ করতে পারেনা। আরো একটি বিপদ আছে, অন্যরা যে শব্দ ব্যবহার করছে, তারা যতটুকু উদ্দেশ্য নিয়ে শব্দগুলো বলছে, বা যতটুকু প্রয়োজন তারচেয়ে বেশি আমরা সেই শব্দগুলোর অর্থ নিয়ে বাড়তি কিছু বা ভুল বুঝি। হয়তো আপনি আপনার সঙ্গীকে বললেন যে হোটেলের রিসেপশনে আপনার সাথে একটা ইন্টারেস্টিং বা মজার মানুষের সাথে দেখা হয়েছে। আপনার মনে যে চিত্রটি আছে, সেটি নিষ্পাপ, কিন্তু আপনার সঙ্গীর মনে খুব ভিন্ন একটি চিত্র তৈরি হতে পারে দ্রুত। ট্রাকটাস বইটি মূলত খুব স্বল্পবাক, সুনির্দিষ্ট ভাবনা মনে এমন এক দার্শনিকের আবেদন যেন আমরা সতর্কভাবে ও কম আবেগতাড়িত হয়ে কথা বলি। তিনি যেমন বলেছিলেন … wovon man nicht sprechen kahn, daruber muss man schweigen মানে হচ্ছে, যখন কেউ কোনো কথা বলতে পারবে না (বা বলার থাকেনা) সেখানে তাকে অবশ্যই নীরব থাকা উচিত। তার পরের কাজগুলোর কেন্দ্রীয় ভাবনা ছিল, ভাষার সম্মোহনী জাদু নিয়ে। তিনি বিশ্বাস করতেন ভাষা দার্শনিকদের নানা সংশয়ে ফেলে দিতে পারে। তারা এর জাদুকরি সম্মোহনের জালে আটকে যেতে পারেন। ভিটগেনস্টাইন তার নিজের ভূমিকাটিকে দেখেছিলেন একজন থেরাপিস্টের মতো, যিনি কিনা এই সংশয়ের একটি বড় অংশ দূর করার দায়িত্ব নিয়েছেন। উদ্দেশ্যটি ছিল আপনি তাঁর সতর্কভাবে বাছাই করা উদাহরণগুলো যুক্তি অনুসরণ করবেন এবং আপনি যখন সেটি করবেন আপনার দার্শনিক সমস্যাগুলোও অদৃশ্য হয়ে যাবে। যা ভয়ানক সমস্যা হিসাবে একসময় অনুভূত হয়েছিল তা আর সমস্যা মনে হবে না। দার্শনিক সংশয়ের একটি কারণ হচ্ছে, তিনি প্রস্তাব করেছিলেন, সেই পূর্বধারণাটি যা দাবি করে সব ভাষাই একইভাবে কাজ করে, সেই ধারণাটি যে, শব্দ শুধুমাত্র বিভিন্ন জিনিসের নামকরণ করে। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন তার পাঠকদের জন্য, অনেক ল্যাঙ্গুয়েজ গেম, বা ভাষার খেলা আছে, নানাধরনের ক্রিয়াকাণ্ড আমরা সম্পাদন করি শব্দ ব্যবহার করে। ভাষার কোনো ‘এসেন্স’ বা মূল সার নেই, কোনো একক বৈশিষ্ট্য নেই যা এর ব্যবহারের সব ক্ষেত্রগুলোকে ব্যাখ্যা করতে পারে।

যখন বইটি প্রকাশ করেছিলেন, তিনি ভেবেছিলেন, খানিকটা অতিমাত্রায় যদিও, দর্শনে ট্রাকটাসের পরে আর কোনো বই লেখার দরকার নেই, তা বইটি হবে দর্শনের শেষ বই। সুতরাং তিনি দর্শন বাদ দিয়ে খুঁজতে লাগলেন জীবনের বাকি অংশ কীভাবে কাটাবেন। তাঁর দৃষ্টি গিয়েছিল স্থাপত্যে, তাঁর বোনের জন্যে ভিয়েনায় একটি বাড়ি বানানোর জন্য তিনি বেশকয়েক বছর ব্যয় করেছিলেন, স্পষ্টতই তিনি সবকিছু ঠিকমতো, যেমন দরজার হাতল, বা তাপ বের হবার রেডিয়েটর কোথায় বসবে এসব নিয়ে প্রয়োজনের চেয়ে বহু সময় ব্যয় করেছিলেন। এবং শেষের দিকে একটি ঘরের ছাদ নিয়ে তিনি খুব চিন্তিত হয়েছিলেন, তিনি উপসংহারে পৌঁছান যে, ছাদটি নিচু হয়ে গেছে, সবার অসুবিধা করে তিনি জোর করে সেটি ঠিক করলেন, হ্যাঁ, মাত্র তিন সেন্টি মিটার উঁচু করে। তাঁর ভাবনায় এটাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। ১৯২৯ সালে তিনি হঠাৎ করে আবার কেমব্রিজে ফিরে আসেন ও দর্শনেও। কারণ তিনি অনুধাবন করেছিলেন তার আরো কিছু জিনিস বলা বাকি রয়েছে, ভাষা আর কমিউনিকেশন নিয়ে। সুতরাং তিনি তাঁর দ্বিতীয় বইটি লেখা শুরু করে করেন, যে বইটি তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছিল, Philosophical investigations। আপনি যদি একদল মানুষ দেখেন যারা পরস্পরের আত্মীয়, যেমন কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে, আপনি হয়তো কোনো পরিবারের সদস্যদের চিহ্নিত করতে পারবেন তাদের মধ্যে শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলোর সদৃশতা দেখে। এটাই পারিবারিক সাদৃশ্য বলে বোঝাতে চেয়েছিলেন ভিটগেনস্টাইন। কোনো-না-কোনো উপায়ে আপনি কিছুটা আপনার মায়ের মতো দেখতে হতে পারেন। হয়তো আপনাদের চুলের আর চোখের রঙ একই এবং খানিকটা আপনার দাদার মতো যেমন আপনাদের দুজনের গড়ন হালকা পাতলা, এবং লম্বা। হয়তো আপনার একই চুলের আর চোখের আকার হতে পারে আপনার বোনের মতো, কিন্তু তার চোখের রঙ হয়তো আপনার কিংবা আপনার মা থেকে ভিন্ন হতে পারে। একক কোনো বৈশিষ্ট্য নেই যা পরিবারের সব সদস্যের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে, যা কিনা সরাসরিভাবে আমাদের দেখার সুযোগ করে দিতে পারে যে তারা সবাই একই জিনগত সম্পর্কযুক্ত পরিবারের সদস্য। বরং তাদের মধ্যে অধিক্রমণ করা সদৃশতার একটি প্যাটার্ন আছে, মানে, আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ কিছু বৈশিষ্ট্য ধারণ করবেন আর অন্যরা হয়তো অন্য কোনো বৈশিষ্ট্য। এই অধিক্রমিত সদৃশতাই ভিটগেনস্টাইনের কৌতূহলকে প্ররোচিত করেছিল। পারিবারিক সদৃশতার এই রূপকটি তিনি ব্যবহার করেছিলেন কীভাবে ভাষা কাজ করে সেটি ব্যাখ্যা করার জন্য।

গেম বা খেলা শব্দটির কথা চিন্তা করুন। বহু জিনিসই আছে যা ভিন্ন, কিন্তু তাদের আমরা খেলা বলি: বোর্ড গেম, দাবা, তাশ খেলা যেমন ব্রিজ বা পেশেন্স, দলগত খেলা যেমন ফুটবল ইত্যাদি। অন্য আরো কিছু জিনিস আছে যেগুলোকেও আমরা খেলা বলি, যেমন লুকোচুরির খেলা, কোনো মিথ্যাকে সত্য বলে বিশ্বাস করানোর খেলা। বেশিরভাগ মানুষই মনে করে নেয় যে, যেহেতু আমরা একই শব্দ গেম বা খেলা ব্যবহার করছি, এই সবকিছুকে বোঝানোর জন্য, নিশ্চয়ই কিছু একক বৈশিষ্ট্য আছে যা তাদের সবার মধ্যে সাধারণ, যাকে বলা যেতে পারে গেম ধারণাটির মূল সার বা এসেন্স। কিন্তু এমন কোনো সাধারণ বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতির কথা আগে থেকে ধারণা করে নেবার বদলে, ভিটগেনস্টাইন তার পাঠকদের তাগাদা দেন তাকাতে আর দেখতে। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন যে, সব খেলায় একজন বিজয়ী আর একজন বিজিত থাকে, কিন্তু সলিটায়ার খেলায়? অথবা দেয়ালের দিকে বল ছুড়ে সেটি আবার ধরার খেলায় কী হয়? দুটোই খেলা, আর স্পষ্টতই কেউ পরাজিত নয় এখানে। অথবা সেই ধারণাটি যে প্রতিটি খেলায় সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একগুচ্ছ নিয়ম? কিন্তু কিছু মিথ্যা সত্য বলে বিশ্বাস করানোর খেলায় আপাতদৃষ্টিতে কোনো নিয়ম নেই। সব খেলার একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্যে সব দাবিগুলোর বিপরীতে তিনি একটি বিপরীত উদাহরণ উপস্থাপন করেন, কোনো একটি কেস যা একটি খেলা কিন্তু সেই প্রস্তাবিত মূল সার বা এসেন্সটি সব খেলায় সাধারণ নয়। সব খেলার একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে এমন না-ভেবে আমরা গেম-এর শব্দগুলোকে দেখতে পারি, সদৃশ্য শব্দের পরিবার হিসাবে। যখন ভিটগেনস্টাইন ভাষাকে বর্ণনা করেছিলেন একটি ধারাবাহিক ল্যাঙ্গুয়েজ গেম বা ভাষার খেলা হিসাবে, তিনি সেই বাস্তব সত্যটার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছিলেন, আমরা বহুবিধ কারণে ভাষার ব্যবহার করি এবং দার্শনিকদের যা সংশয়ে ফেলে দিয়েছে সেটি হচ্ছে তারা অধিকাংশই ভাবেন যে, সব ভাষাই একই ধরনের কাজ করছে। দার্শনিক হিসাবে তার লক্ষ্য সম্বন্ধে তার নিজস্ব বিখ্যাত বিবরণটি ছিল এমন : তিনি বলেছিলেন যে তিনি মাছি রাখার বোতল থেকে মাছিকে বাইরে বের হয়ে আসার পথটা দেখাতে চেয়েছিলেন। একজন সাধারণ দার্শনিক বোতলের মধ্যে আটকে থাকা মাছির মতো ভনভন করবে, কাচের দেয়ালে সে বারবার ধাক্কা খাবে। কোনো একটি দার্শনিক-সমস্যা সমাধান করার উপায় হচ্ছে বোতলটির ছিপি খুলে দেয়া ও মাছিটিকে উড়ে বের হয়ে আসতে সুযোগ দেয়া। আর তিনি এটি বলতে যা বোঝাতে চেয়েছিলেন সেটি হচ্ছে দার্শনিকদের দেখানো যে তিনি ভুল প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করছেন ও ভাষার সম্মোহনী জাদুতে ভ্রান্ত নির্দেশনা পাচ্ছেন। ভাষাকে শুধুমাত্র ছবি-সংক্রান্ত ভাবনায় আবদ্ধ না-রেখে তিনি আরো একটি ধারণা প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন যে ভাষা হচ্ছে একধরনের যন্ত্র-উপকরণ বা টুল যা আমরা ব্যবহার করি বিভিন্ন খেলা খেলতে। অবশ্যই এই খেলা মানে আক্ষরিকভাবে খেলা না, মূলত আমাদের উদ্দেশ্য বা ইনটেনশনের প্যাটার্ন। সুতরাং যদি কোনো পিতামাতা আতঙ্কিত কোনো শিশুকে বলে, “চিন্তা কোরো না, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে’, তারা কিন্তু জানেন না আসলেই সবকিছুই ঠিক হয়ে যাবে কিনা। এখানে যুক্তিসঙ্গত কোনো ভবিষ্যদ্বাণীর খেলা খেলছে না বাস্তব তথ্যের উপর ভিত্তি করা খেলা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। তারা অন্য একটি খেলা খেলছেন। শব্দ এখানে উপকরণ, যা সান্ত্বনা ও নিরাপত্তা খেলার। ভিটগেনস্টাইন আমাদের জানান যে সবধরনের ভুল- বোঝাবুঝির সূচনা হয় যখন আমরা বুঝতে পারিনা অন্যজন কোনো খেলাটি খেলছে তার ভাষা দিয়ে। যদি কোনো সঙ্গী বলে, ‘তুমি কখনো আমাকে কোন্ কাজে সাহায্য কোরো না, তুমি একদম নির্ভরযোগ্য না’, অপরজনের স্বাভাবিক প্রবণতা হবে এটি বাস্তব সত্য প্রকাশের খেলার অংশ হিসাবে মনে করার। যেমন, ওয়ারটারলুর যুদ্ধ হয়েছিল ১৮১৫ সালে। সুতরাং কেউ হয়তো এর প্রত্যুত্তর দেবেন বাস্তব তথ্য উত্থাপন করে, যেমন আপনি কীভাবে গতকাল আসলেই গাড়ির ইনসুরেন্সের কাগজ করেছেন, কিংবা সেদিন কাজের পরে বাজারে গিয়ে সব্জি কিনেছেন। কিন্তু আসলে সেই মানুষটি ভিন্ন একটি ভাষার খেলা খেলছে, তারা শব্দ ব্যবহার করছে ফ্যাক্ট হিসাবনিকাশ করার জন্য না, তারা সাহায্য আর আশ্বস্ততার খেলা খেলছে। ‘তুমি কখনো সাহায্য কোরো না’, এর মানে হচ্ছে আমি চাই তুমি আরো বেশি আমার খেয়াল রাখো। আর কোন্ খেলাটি খেলা হচ্ছে সেটি বের করাই তিনি অনুধাবন করেছিলেন কমিউনিকেশনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

তার philosophical invetgation বইটিতে এছাড়াও তিনি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন দেখাতে আমাদের নিজেদের সম্বন্ধে বোঝাপড়ার অনেকটুকুই নির্ভর করে অন্যদের শব্দের উপর। সেই ভাষার উপর যা বহু শতাব্দী ধরে মানুষের ব্যবহার আর সামাজিকভাবে গড়ে তুলেছে, আমাদের জন্মের বহুদিন আগে। যেমন রোববার দুপরে কেউ হয়তো আক্রান্ত হতে পারেন চিন্তা আর সংশয়পূর্ণ মেজাজে, যখন তিনি আগামী সপ্তাহ ও আর যা-কিছু করতে হবে সেই বিষয়টি মনে পড়ে, কিন্তু আমাদের এই অবোধ পরিস্থিতিটি বোঝা সহজবোধ্য হবে যদি বেশ কিছুদিন ধরে ব্যবহৃত শব্দ, Angst, আমাদের প্রদান করা হয়, একটি শব্দ ঊনবিংশ শতাব্দীতে যা উদ্ভাবন করেছিলেন সোরেন কিয়ের্কেগার্দ, angst কিংবা nostalgia, melancholy বা ambivalent-এর মতো শব্দগুলো আমাদের সাহায্য করতে পারে আমাদের অভিজ্ঞতার খুব অস্পষ্ট বিষয়গুলো বুঝতে। ভাষা হচ্ছে ব্যক্তিগত জীবনকে ব্যাখ্যা করার জন্য উন্মুক্ত সাধারণ একটি উপকরণ। সুতরাং নিজেকে জানার বিষয়টি সমৃদ্ধ করতে খুব দরকার ভাষার সমৃদ্ধতার সুযোগ নেয়া। তিনি যেমন বলেছিলেন, ‘আমার ভাষার সীমাবদ্ধতা আমার জীবনের সীমাবদ্ধতা নির্দেশ করে।’ অনেক বই পড়লে আমরা অস্ত্র পেতে পারি নিজেকে জানার জন্য। যদিও তার দর্শন বেশ জটিল, কিন্তু এর মূল ভিত্তিতেই ছিল বিষয়টি উপযোগী করে তোলা। দর্শনের কাজ হচ্ছে তিনি বলতেন, মাছিকে মাছির বোতল থেকে বের হয়ে আসার পথটি দেখানো। আর যে মাছির বোতলের বিষয়ে তিনি বিশেষ মনোযোগ দিয়েছিলেন সেটি হচ্ছে ভাষা, এবং ১৯৫১ সালে তিনি ক্যানসারে মারা যাবার আগে অনেকগুলো শব্দ মাছিকে মুক্ত করেছিলেন আমাদের জন্য।

কীভাবে তিনি কথা বলতে শিখেছিলেন সেই বিষয়ে সেইন্ট অগাস্টিনের বিবরণটির কথা ধরুন। অগাস্টিন তাঁর Confessions বইটিতে প্রস্তাব করেছিলেন তার চারপাশে মানুষরা নানা জিনিসের প্রতি নির্দেশ করে তাদের নাম বলতেন। তিনি একটি ‘আপেল’ দেখলেন, কেউ সেটির দিকে নির্দেশ করে বলে ‘আপেল’। ধীরে ধীরে অগাস্টিন বুঝতে পেরেছিলেন যে শব্দ আসলে কী বোঝাতে চায়, এবং সেগুলো তিনি ব্যবহার করতে শুরু করেন অন্যদের জানাতে তিনি কী চান সেটি বোঝাতে। ভিটগেনস্টাইন এই ব্যাখ্যাটি নিয়েছিলেন একটি কেসস্টাডি হিসাবে যেখানে কেউ মনে করেন সব ভাষার একটি এসেন্স আছে, একটি একক কাজ আছে। এই একক কাজটি হচ্ছে নানা জিনিসের নাম দেয়া। অগাস্টিনের জন্যে, প্রতিটি শব্দের একটি অর্থ আছে, যার জন্য সেটি ব্যবহৃত হয়। ভাষার এই দৃশ্যের পরিবর্তে, ভিটগেনস্টাইন আমাদের উৎসাহিত করেন ভাষাকে ধারাবাহিক ক্রিয়া হিসাবে দেখার জন্য যা বক্তার বাস্তব জীবনের সাথে সংযুক্ত হয়ে আছে। ভাষাকে, সবসময় একই কাজ করে যেমন কোনো একটি স্ক্রু-ড্রাইভার যেমন করে, তেমনভাবে দেখার বদলে ভাষাকে বরং আমাদের দেখা উচিত বরং নানা যন্ত্রে ভরা কোনো থলে হিসাবে, যেখানে নানাধরনের যন্ত্র ও উপকরণ আছে বিভিন্ন কাজ করার জন্যে। বিষয়টি আপনার কাছে খুব স্পষ্টই মনে হতে পারে, যখন আপনার কোনো যন্ত্রণা হচ্ছে আর আপনি সেই বিষয়ে কথা বলছেন। আপনি যা করছেন সেটি হচ্ছে, আপনি শব্দ ব্যবহার করছেন, যা আপনার অভিজ্ঞতার কোনো সুনির্দিষ্ট অনুভূতিকে নামকরণ করছে। কিন্তু ভিটগেনস্টাইন অনুভূতির ভাষার সেই দৃশ্যটিকে নাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। অবশ্যই মিথ্যা নয় যে আপনি কোনো অনুভূতি টের পাচ্ছেন না, শুধুমাত্র, যৌক্তিকভাবে, আপনার শব্দগুলো সেই অনুভূতিগুলোর নাম হতে পারেনা। এখানে তিনি ‘বিটল ইন দ্য বক্স’ অ্যানালজি ব্যবহার করেন। যদি সবার কাছে একট বাক্স থাকে, যেখানে একটি বিটল বা গুবরেপোকা থাকে, যা তারা কখনোই অন্যকে দেখায়নি, তাহলে সেই বাক্সে কী আছে সেটি নিয়ে আসলে কিছুই যায় আসে না, যখন তারা পরস্পরের সাথে কথা বলবে তাদের ‘বিটল’ নিয়ে। ভাষা হচ্ছে সর্বসাধারণের জন্য, এর প্রয়োজন উন্মুক্ত কোনো পরীক্ষা করে দেখার উপায় যে আমরা যা বলছি সেটি অর্থবহ। যখন কোনো শিশু তার ব্যথাকে বর্ণনা করতে শেখে, ভিটগেনস্টাইন বলেন, যা ঘটে তা হলো, পিতামাতা শিশুটিকে উৎসাহিত করেন নানা কিছু করতে, যেমন বলতে আমার ব্যথা লাগছে, এবং অনেকভাবে সমরূপ একটি অভিব্যক্তি হচ্ছে খুব স্বাভাবিক একটি প্রকাশ যেমন, উফফ! এখানে তার বার্তার অংশবিশেষ হচ্ছে যে আমাদের ভাবা উচিত হবে না ‘আমার ব্যথা লাগছে’ শব্দগুলো কোনো ব্যক্তিগত অনুভূতিকে নামকরণ করার একটি উপায়। যদি ব্যথা আর অন্য অনুভূতিগুলো সত্যিকারভাবে ব্যক্তিগত হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের বিশেষ ব্যক্তিগত ভাষার প্রয়োজন সেগুলো ব্যাখ্যা করার জন্য। কিন্তু তিনি ভেবেছিলেন, সেই ধারণাটির কোনো অর্থ হয় না। তার আরেকটি উদাহরণ হয়তো আমাদের সাহায্য করবে বোঝাতে তিনি কী বলতে চেয়েছিলেন।

এক ব্যক্তি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তার একটি নির্দিষ্ট ধরনের অনুভূতি, যার কোনো নাম নেই, হয়তো নির্দিষ্ট ধরনের কোনো সুড়সুড়ির অনুভূতি, সেটি তিনি রেকর্ড করে রাখবেন যখনই তিনি সেই বিশেষ ধরনের সুড়সুড়ি অনুভব করবেন। তিনি তার ডায়রিতে s হিসাবে তিনি সেটি লিখে রাখতেন। S হচ্ছে তার ব্যক্তিগত ভাষার একটি শব্দ, কেউ জানে না শব্দটি দিয়ে তিনি আসলে কী বোঝাতে চাইছেন। মনে হতে পারে যেন এমন কিছু ঘটা সম্ভব, খুব কঠিন না এমন কোনো মানুষ কল্পনা করা যিনি ঠিক এমনটাই করছেন। কিন্তু, বিষয়টি নিয়ে আরো একটু গভীরভাবে ভাবুন। তিনি কীভাবে জানবেন যখনই তার কোনো একটি সুড়সুড়ির অনুভূতি হচ্ছে সেটি আসলে সেই S ধরনের সুড়সুড়িরই আরেকটি উদাহরণ, যা তিনি রেকর্ড করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কেনই বা সেটি অন্য কোনো ধরনের সুড়সুড়ি হতে পারবে না? তিনি অতীতে ফিরে যেতে পারবেন না এবং তার নিজের স্মৃতি ছাড়া আর কিছুর সাথে তুলনা করে দেখতে পারবেন না। নিজের স্মৃতির সাথে তাকে তুলনা করে দেখতে হবে তার এই সুড়সুড়িটি আগের সেই S ধরনের সুড়সুড়ির মতো কিনা। কিন্তু বিষয়টি যথেষ্ট শক্তিশালী হবে না, তিনি পুরোপুরি ভুল হতে পারেন। এটি অবশ্যই নির্ভরযোগ্য কোনো উপায় না বলার যে আপনি একইভাবে শব্দটি ব্যবহার করছেন। তিনি তাঁর এই ডায়রির উদাহরণ ব্যবহার করে যা বোঝাতে চেয়েছেন তাহলো, যেভাবে আমরা শব্দ ব্যবহার করি আমাদের অভিজ্ঞতাকে ব্যাখ্যা করার জন্য, শব্দটির সাথে আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সম্পর্কের ভিত্তি অবশ্যই হতে পারবেনা। সেখানে কিছু থাকা উচিত যেটি সাধারণ, সবার জন্যে উন্মুক্ত। আমাদের সবার নিজস্ব ভাষা থাকতে পারে না। আর যদি সেটি সত্য হয়, মন যে একটি বন্ধ থিয়েটারের মতো যেখানে আর কেউ ঢুকতে পারে না, এমন ধারণাটি বিভ্রান্তিকর। ভিটগেনস্টাইনের জন্য, তাহলে, কোনো অনুভূতির একটি ব্যক্তিগত ভাষার ধারণা কোনো অর্থ হয়না। এটি গুরুত্বপূর্ণ, এবং বেশ কঠিন বিষয়টি বোঝা, কারণ তার আগে বহু দার্শনিক ভেবেছেন প্রতিটি মানুষের মন পুরোপুরিভাবে তার একান্ত ব্যক্তিগত। যদিও তিনি খ্রিস্টধর্মীয়, তার পরিবারকে বিবেচনা করা হয়েছিল ইহুদি হিসাবে, যখন নাৎসিরা অস্ট্রিয়াকে জার্মানির সাথে যুক্ত করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বেশকিছুটা সময় তিনি লন্ডনের একটি হাসপাতালে আর্দালি হিসাবে কাজ করেছিলেন, কিন্তু তার পুরো পরিবার সৌভাগ্যক্রমে ভিয়েনা থেকে পালাতে পেরেছিল। যদি না হতো আইখমান তাদের কনসেনট্রশন ক্যাম্পে মৃত্যুর জন্য পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার বহু লেখা হারিয়ে গিয়েছিল। সম্প্রতি সেগুলো খুঁজেও পাওয়া গেছে, সেই প্রায় দুই লক্ষ শব্দের আর্কাইভ ও গাণিতিক সমীকরণের পাণ্ডুলিপি তার সম্বন্ধে আমাদের আরো নতুন কিছু জানার সুযোগ করে দিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *